আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর15%
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25551 / ডাউনলোড: 4777
সাইজ সাইজ সাইজ
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( আ .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

গাদীরের হাদীসের অন্তর্নিহিত অর্থ

গাদীরের হাদীসে যে বাক্যটি দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে থাকে ও গাদীরের ঘটনার বাস্তব তাৎপর্য যার ভিতর নিহিত সেটা হচ্ছে- রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه

অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা , এই আলীও তাদের মাওলা

যারা এই হাদীসটিকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন তারা মাওলা শব্দটি আওলা বা অধিকারের ক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভকারী অর্থে ব্যবহার করেছেন অর্থাৎ এমন এক ব্যক্তি যিনি সহজ ভাষায় বলা যায় অভিভাবকত্ব , নেতৃত্ব দান ও কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে উপযুক্ত। উক্তধারায় এই হাদীসের অর্থ দাড়ায় আমি যাদের অভিভাবক ও নেতা বা প্রধান এই আলীও তাদের অভিভাবক ও নেতা বা প্রধান । সুতরাং যারা রাসূল (সা.)-এর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের অনুগত , শুধুমাত্র তারাই আলীর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বকে স্বীকার ও তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।

এ পর্যায়ে অবশ্যই জানা দরকার যে , আরবী ভাষাতে মাওলা শব্দের অর্থ কি ঠিক এভাবে ব্যবহৃত হয়েছে না কি অন্যভাবে ? আবার যদি মেনেও নিই যে , এই একই অর্থেই আরবী ভাষাতেও মাওলা শব্দের ব্যবহার হয়েছে , তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে- এই খুতবাতেও (বক্তব্যেও) কি সেই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে ? না-কি ভিন্ন অর্থে।

মরহুম আল্লামা আমিনী ৪২ জন প্রসিদ্ধ মুফাসসীর ও আভিধানিক আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন , যাদের মধ্যে ২৭ জনই বলেছেন যে , মাওলা এর অর্থ আওলা বা প্রধান। বাকী ১৫ জন বলেছেন- আওলা হচ্ছে- মাওলা শব্দের বিভিন্ন অর্থের মধ্যে একটি অর্থ।৬২

কিন্তু উক্ত হাদীসে কি মাওলা শব্দ ঐ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা বুঝতে আমাদেরকে দেখতে হবে যে , কোন্ প্রেক্ষাপটে ও কোন্ স্থানে এই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। খুতবাটিকে স্থান , কাল ও পাত্রভেদে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে , ঐ বাক্যটিতে ব্যবহৃত মাওলা শব্দের অর্থটি নিঃসন্দেহে আওলা অর্থাৎ প্রধান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

কেননা রাসূল (সা.)-এর মত ব্যক্তি যিনি পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী পূর্ণাঙ্গ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং আসমানী দূত ,ঐ রকম একটি দিনে , যে দিনের তাপ্রমাত্রা এত বেশী ছিল যে , সেখানকার মাটিগুলো যেন উত্তপ্ত গলিত লৌহের মত উপস্থিত শ্রোতাদের পদযুগলকে পোড়াচ্ছিল এবং সূর্যের উত্তপ্ত কিরণ যেন তাদের মাথার মগজকে টগবগ করে ফুটাচ্ছিল , উত্তপ্ত মরুভূমির চরম প্রতিকূল সেই পরিবেশে৬৩ এমন অবস্থা ছিল যেন , মাটিতে মাংস ফেললে তা কাবাবে পরিণত হবে।৬৪ ঐ স্থানটি ছিল এমনি এক এলাকায় যেখানে কোন কাফেলা বা পথযাত্রীই যাত্রা বিরতি দেয় না , কিন্তু রাসূল (সা.) সেখানে হাজার হাজার হাজীকে দাড়ঁ করিয়ে রেখেছেন , অগ্রগামীদের প্রত্যাবর্তন করিয়েছেন ও অপেক্ষায় ছিলেন যাতে পশ্চাৎগামীরা উপস্থিত হয় এবং দিনের সর্বাধিক তাপমাত্রার সময় চাচ্ছেন ভাষণ দিতে। তাছাড়াও তিনি কয়েকবার জনগণের নিকট প্রশ্ন করলেন যাতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন হয় যে , তারা তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কি না এবং সর্বশেষে আলীকে (আ.) তাদের সামনে তুলে ধরলেন ও নাম এবং বংশ পরিচয়সহ তাকে পরিচয় করালেন এবং বললেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা । অতঃপর সকলকে দায়িত্ব দিয়ে বললেন যেন , তারা এই বার্তাটি অনুপস্থিতদের কর্ণগোচর করে। তারপর সবাইকে নির্দেশ দিলেন যে , তার নিকট যেন বাইয়াত (শপথ গ্রহণ) করে ও তাকে স্বাদর-সম্ভাষণ জানায় এবং স্বীয় পাগড়ী মোবারকটি তার মাথায় পরালেন ও বললেনঃ পাগড়ী হচ্ছে আরবের তাজ বা মকুট আর সাহাবীদের বললেনঃ বদর যুদ্ধের দিন যে সকল ফেরেশতা আমার সাহায্যার্থে এসেছিল তারা ঠিক এরূপ পাগড়ীই পরে এসেছিল।

এখন যদি আমরা ধরেও নিই যে , হাদীসটি কোন প্রকার ইশারা-ইঙ্গিত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাড়াই কারো নিকট পৌছানো হয় এবং সে নিরপেক্ষভাবে হাদীসটিকে পর্যালোচনা করে , তাহলেও এই হাদীসের অর্থ স্পষ্ট হয়ে যাবে যে , হাদীসটির অর্থ এ সম্পর্কে অনবগতদের কথার বিপরীত অর্থই প্রকাশ করে অর্থাৎ হাদীসটির অর্থ এটা নয় যে রাসূল (সা.) বলতে চেয়েছেনঃ আমি যাদের বন্ধু এই আলীও তাদের বন্ধু অথবা আমি যাদের সাথী এই আলীও তাদের সাথী! কেননা , বন্ধু ও সাথীর ক্ষেত্রে বাইয়াত বা শপথের প্রয়োজন পড়ে না , পাগড়ী বা মুকুট পরানোর দরকার হয় না , মোটকথা এত গুরুত্ব দেওয়ার কোন কারণই নেই যে , ঐরূপ পরিস্থিতিতে ও ঐরূপ ভূমিকাসহ ঘোষণা দিতে হবে।

এসব দলিলের উপর ভিত্তি করেই মরহুম সেবতে ইবনে জাওজী যিনি আহলে সুন্নাতের একজন আলেম , এ সম্পর্কে একটি বিশাল আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে , উক্ত হাদীসে মাওলা শব্দের অর্থ আওলা বা প্রধান।৬৫

ইবনে তালহা তার মাতালিবুস সুউল গ্রন্থে লিখেছেনঃ

হযরত রাসূল (সা.) মাওলা শব্দের যে অর্থই নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন , আলীর জন্যেও ঠিক একই অর্থই প্রয়াগ করেছেন। আর এটা একটা উচ্চ মর্যাদা যা রাসূল (সা.) বিশেষ করে আলীর জন্য ব্যবহার করেছেন।৬৬

উল্লিখিত ফলাফলটি ঐ একই ফলাফল যা রাসূল (সা.)-এর খুতবার প্রতিটি বাক্যে তার প্রমাণ বহন করে ও ঐ একই জিনিস যা , একলক্ষ বিশ হাজার প্রকৃত আরবীভাষী দ্বিধা-দ্বন্দহীনভাবে রাসূল (সা.)-এর বাণী থেকে তা অনুধাবন করেছিলেন। আর তাই হাসসান্ উঠে দাড়িয়ে আলী (আ.)-এর শানে কবিতা আবৃতি করেছিলেন এবং রাসূলও (সা.) তাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এরপর থেকে যারাই এ ঘটনা শুনেছে তারা সবাই একই রকম বিষয় অনুধাবন করেছে যে , রাসূল (সা.) স্বীয় প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আভিধানিকগণ এবং আলেমগণও ঠিক ঐ একই রকম বিষয়বস্তু অনুধাবন করেছেন। আর শত শত আরবী কবি ও অন্যান্য কবিগণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করেছেন এবং তাতে উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.) স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে আলীকে নির্ধারণ করেছেন। আর সে কারণেই গাদীর দিবসকে সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়।

হযরত আলী (আ.) তার প্রকাশ্য খেলাফতকালে কুফা শহরে অনেকবার এই হাদীসটি উল্লেখ করে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদেরকে কসম দিতেন যাতে যা কিছু এ সম্পর্কে তাদের স্মরণে আছে যেন তার সাক্ষ্য প্রদান করে তাও আবার ঐ ঘটনার চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর যখন রাসূল (সা.)-এর অনেক সাহাবী ইন্তেকাল করেছিল আর যারা জীবিত ছিল তারাও ছিল বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং কুফাও ছিল সে সময়ে সাহাবীদের প্রাণকেন্দ্র মদীনা হতে অনেক দূরে এবং তিনিও কোন পূর্ব পরিকল্পনা ব্যতীতই বা কোন ভূমিকা ছাড়াই তাদের নিকট সাক্ষ্য চেয়েছিলেন। তারাও কোন ধরনের অজুহাত দেখানো ছাড়াই আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর কথার সত্যতা স্বীকার করেছিলেন। বর্ণনাকারীগণ সাক্ষীদের যে সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন তা একেক জনের বর্ণনা একেক রকম , কোন কোন বর্ণনা মতে ৫ অথবা ৬ জন৬৭ অন্য এক বর্ণনায় ৯ জন৬৮ আর এক বর্ণনায় ১২ জন৬৯ অপর এক বর্ণনায় ১২ জন বদরী সাহাবী৭০ অন্য এক বর্ণনায় ১৩ জন৭১ অপর এক বর্ণনায় ১৬ জন৭২ এক বর্ণনায় ১৮ জন৭৩ এক বর্ণনায় ৩০ জন৭৪ এক বর্ণনায় একদল লোক৭৫ এক বর্ণনায় ১০ জনেরও বেশী৭৬ এক বর্ণনায় কিছু সংখ্যক৭৭ এক বর্ণনায় কয়েক দল লোক৭৮ এবং এক বর্ণনায় ১৭ জন৭৯ ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করেছেন যে , গাদীর দিবসে রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه

অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা বা নেতা এই আলীও তাদের মাওলা বা নেতা

অনুরূপভাবে আহলে বাইত (নবীর পরিবার) ও তাদের সাথীগণ এবং অনুসারীগণও বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। মরহুম আল্লামা আমিনী এ ধরনের ২২টি প্রমাণ উপস্থাপনের ঘটনা তুলে ধরেছেন , সেগুলি থেকে এখানে আমরা কয়েকটির উল্লেখ করছি।

১. উম্মুল আয়েম্মা (ইমামগণের মাতা) , ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

আপনারা কি ভুলে গেছেন যে , রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক৮০

২. ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করেছেন

যখন হাসান মুজতবা (আ.) মোয়াবিয়া র সাথে সন্ধি করার সিদ্ধান্ত নিলেন , তখন একটি বক্তব্য রেখে ছিলেন। উক্ত বক্তব্যের কিছু অংশ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছঃ

এই উম্মত আমার পিতামহ রাসূল (সা.) হতে শুনেছে যে , তিনি বলেছেনঃ প্রত্যেক জাতিই যেন তাদের নিজেদের মধ্য হতে সেই ব্যক্তিকেই তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচন করে , যে হবে তাদের মাঝে সবচেয়ে জ্ঞানী ও সর্বোত্তম। তারা ক্রমাগত অধপতিত হবে যদি না তারা তাদের মাঝে যে উপযুক্ত ও যোগ্য ব্যক্তি , তাকে প্রাধান্য দেয়। তারা আরো শুনেছে যে , তিনি (সা.) আমার পিতাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক ঐরূপ যেমন মূসার (আ.) সাথে হারুনের (আ.) সম্পর্ক ছিল ; পার্থক্য শুধু এতটুকু যে , (মুসা ও হারুন উভয় নবী ছিল কিন্ত) আমার পরে আর কোন নবী নাই। আরো শুনেছে যে , গাদীরে খুমে আমার পিতার হাত ধরে তিনি (সা.) বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক , এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে এবং তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। সে সময় উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন যেন তারা অনুপস্থিতদের কাছে এই খবরটি পৌছে দেয়।৮১

৩. হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

সিফফিনের যুদ্ধে আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) যখন আমর ইবনে আস-এর মুখোমুখি হলেন , তখন তিনি বলেছিলেনঃ

আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে , আমি যেন নাকিসীন দের (চুক্তি ভঙ্গকারীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি , আর আমি তার নির্দেশানুযায়ী তা করেছি। তিনি আরো বলেছেনঃ তুমি কাসিতীন দের (বিদ্রোহীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে , আর তোমরাই হলে রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত সেই বিদ্রোহী তাই তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব এবং জানিনা মারিকীন দের (দ্বীন ত্যাগীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধেও সফল হব কি-না। এই নির্বংশ! তুমি কি জাননা রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেনঃ

من کنت مولاه فعلی مولاه اللهم وال من والاه و عاد من عاداه ؟

অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! আলীকে যারা ভালবাসে তুমি তাদেরকে ভালবাস আর আলীর সাথে যারা শত্রুতা করে তুমিও তাদের সাথে শত্রুতা কর। আমার অভিভাবক আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) অতঃপর আলী। কিন্ত তোমার তো কোন মাওলা বা অভিভাবকই নেই।

আমর ইবনে আস উত্তরে বললঃ এই আবা ইয়াকজান! কেন আমাকে ভৎসনা করছো আমি তো তোমাকে ভৎসনা করিনি।৮২

৪. আসবাগ ইবনে নাবাতা গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

সিফফিনের যুদ্ধে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) একটি পত্র লিখেছিলেন এবং আসবাগ ইবনে নাবাতা কে দায়িত্বভার দিয়ে বলেছিলেন যেন পত্রটি মোয়াবিয়ার নিকট পৌছে দেয়। আসবাগ যখন মোয়াবিয়ার দরবারে উপস্থিত হল দেখল সৈনিকের এক বিশাল দল বিশেষ করে রাসূল (সা.)-এর দুইজন সাহাবী আবু হোরায়রা ও আবু দারদা সেখানে উপস্থিত আছে। আসবাগ বর্ণনা করেছেন যে , মোয়াবিয়া পত্রটি পাঠ করার পর বললঃ আলী কেন উসমানের হত্যাকারীদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে না । আমি বললামঃ এই মোয়াবিয়া! উসমানের রক্তের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ো না ; তুমি আসলে ক্ষমতার ও শক্তির প্রত্যাশী। তুমি যদি উসমানকে সাহায্যই করতে চাইতে তাহলে তার জীবদ্দশায়ই তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু তুমি যেহেতু তার রক্তকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলে তাই এতটাই বিলম্ব করেছিলে যাতে সে নিহত হয় । এই কথা শুনার পর মোয়াবিয়ার যেন টনক নড়ে গেল। আর আমিও যেহেতু চাচ্ছিলাম যে একটু বেশী উত্তেজিত হউক , সে কারণেই আবু হোরায়রাকেও আবার জিজ্ঞেস করলামঃ এই রাসূল (সা.)-এর সাহাবী! তোমাকে এক আল্লাহর , যিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জ্ঞানের অধিকারী এবং তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদের (সা.) কসম দিচ্ছি- তুমি কি গাদীর দিবসে সেখানে উপস্থিত ছিলে না ?

সে বললঃ হা , আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম

বললামঃ ঐ দিন আলী সম্পর্কে রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে কি শুনেছিলে ? বললঃ আমি শুনেছিলাম তিনি বলেছিলেন যে আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ! তুমি তাকে ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে , তুমি তার সাথে শত্রুতা কর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে , তাকে তুমি ত্যাগ কর যে আলীকে ত্যাগ করে

বললামঃ এই আবু হোরায়রা! তাহলে কেন তুমি তার শত্রুদের সাথে বন্ধুত্ব আর তার বন্ধু্দের সাথে শত্রুতা করছো ?

আবু হোরায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললঃ উন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন৮৩ অর্থাৎ আমরা আল্লাহর নিকট থেকে এসেছি এবং তার নিকট প্রত্যাবর্তনন করবো।

এ ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে , বিখ্যাত ব্যক্তিগণ , যারা এই হাদীসের সাথে যথার্থ আমল না করে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর বিরোধিতা করতো , তাদের নিকট সাধারণ জনগন গাদীরের এই হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে উত্থাপন করতেন ; তার মধ্যে একটি হচ্ছেঃ

৫. দারামী র এক মহিলার প্রমাণ স্বরূপ উত্থাপিত গাদীরের হাদীস

সে ছিল দারামের অধিবাসী আলী (আ.)-এর অনুসারীদের মধ্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা যে মদীনার হুজুন এলাকায় বসবাস করতো। আর সে কারণেই তাকে দারামীয়া হুজনীয়া বলা হত। তার এই উপনামের প্রসিদ্ধতার কারণে তার প্রকৃত নাম ইতিহাসে উল্লেখ হয়নি। হজ্জের সময় মোয়াবিয়া তাকে ডেকে বললঃ তুমি কি জান কেন তোমাকে ডেকেছি ?

বললঃ সুবহানাল্লাহ! (আল্লাহ মহা পবিত্র) আমি অদৃশ্যের জ্ঞানের অধিকারী নই (অদৃশ্যের বিষয়ে কিছু জানিনা)

বললঃ আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম যে , তুমি কেন আলীকে ভালবাস আর আমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ কর ? তার শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছ অথচ আমার সাথে শত্রুতা কর ?

বললঃ যদি সম্ভব হয় আমাকে এরূপ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষমা কর (বাধ্য কর না)

বললঃ না , তোমাকে ক্ষমা করবো না। (তোমাকে বলতেই হবে)

বললঃ এ রকমই যখন তাহলে শোন! আলীকে ভালবাসি কারণ , তিনি দেশের নাগরিকদের সাথে ন্যায় সঙ্গত আচরণ করতেন ও বাইতুল মাল (সরকারী সম্পদ) সবার মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করতেন। তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করি কারণ , যে ব্যক্তি খেলাফতের ক্ষেত্রে তোমার চেয়ে অনেক বেশী উপযুক্ত ছিল তুমি তার সাথে যুদ্ধ করেছ ও যেটা তোমার অধিকার নয় , সেটা দাবী করেছ। আলীর শাসন-কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছি কারণ , আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে শাসন কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন এবং তিনি ছিলেন গরীব-দুঃখীদের বন্ধু ও দ্বীনদার ব্যক্তির সম্মানকারী। আর তোমার সাথে শত্রুতা করি কারণ , তুমি মানুষের রক্ত ঝরিয়েছ ও বিবাদ সৃষ্টি করেছ , বিচারকার্যে অন্যায় করেছ এবং নাফসের চাহিদা মোতাবেক হুকুম প্রদান করেছ।৮৪

৬. এক অজ্ঞাত যুবক গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন

আবু হোরায়রা কুফার মসজিদে প্রবেশ করল। আর প্রবেশ করার সাথে সাথে জনগণ তার চারিপাশে ঘিরে বসলো এবং সবাই তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো। এমন সময় এক যুবক দাড়িয়ে বললঃ তোমাকে আল্লাহর কসম দিচ্ছি! তুমি কি আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে শুনেছ যে , তিনি বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা বা অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা বা অভিভাবক। হে আল্লাহ তাকে তুমি ভালবাস যে তাকে ভালবাসে ও তার সাথে শত্রুতা কর যে তার সাথে শত্রুতা করে ?

আবু হোরায়রা বললঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , আমি স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর কাছ থেকে ঠিক এভাবেই শুনেছি। ৮৫

অনুরূপভাবে ইসলামের ইতিহাসেও দেখা যায় যে , যারা আলী (আ.)- এর বিপরীতে রণাঙ্গণে যুদ্ধ করেছিল তারা আলী (আ.)-এর সাথে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও গাদীরের হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতেন। যেমনঃ

৭. আমর ইবনে আস গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

সকলেরই জানে যে , আমর ইবনে আস , আলীর একজন ঘোর শত্রু ছিল , সে- ই মোয়াবিয়াকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বুদ্ধি দিয়েছিল এবং আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য ইন্ধন যুগিয়েছিল । স্বীয় চক্রান্তের মাধ্যমে তাকে নির্ঘাত পতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল ও বিচারের বিষয়টি উত্থাপন করে শামের (সিরিয়ার) সৈন্যদেরকে শক্তি যুগিয়েছিল এবং কুফার সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। আর সেখানেই খারিজীদের (দ্বীন ত্যাগীদের) বীজ বপিত হয়েছিল আর তার এসব সহযোগিতার কারণেই সে মোয়াবিয়ার নিকট থেকে পুরস্কার স্বরূপ মিশরের শাসনভার পেয়েছিল।

মোয়াবিয়া তার হাতে শাসন ক্ষমতা ন্যস্ত করার পূর্বে তার নিকট সাহায্য কামনা করে একটি পত্র লিখেছিল। তাতে লিখেছিলঃ আলী ছিল উসমান হত্যার কারণ , আর আমি হলাম উসমানের খলিফা

আমর তার প্রত্যুত্তরে লিখেছিলঃ

তোমার পত্রটি পাঠ করলাম ও বুঝলাম। তবে তুমি চাচ্ছ যে , আমি দ্বীন ত্যাগ করে তোমার সাথে পথভ্রষ্টতার উপত্যকায় প্রবেশ করি ও তোমাকে তোমার ঐ ভ্রান্ত পথে সাহায্য করি এবং আমিরুল মু মিনীন আলীর বিরুদ্ধে তরবারী ধারণ করি। কিন্তু তিনি হচ্ছেন রাসূল (সা.)-এর ভ্রাতা , অভিভাবক , প্রতিনিধি ও ওয়ারিশ। তিনি রাসূল (সা.)-এর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আর তার অঙ্গীকারগুলো রক্ষা করেছেন। তিনি তার জামাতা , বিশ্বের নারীদের নেত্রীর স্বামী , বেহেশতেরর যুবকদের সরদার হাসান ও হোসাইনের পিতা। এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারলাম না।

কিন্তু তুমি যে দাবি করেছ উসমানের প্রতিনিধি আর উসমানের মৃত্যুর সাথে সাথে তুমি হয়েছ পদচ্যুত আর তোমার খেলাফত হয়েছে নিশ্চিহ্ন ও আরো বলেছঃ আমিরুল মু মিনীন আলী , উসমানকে হত্যার জন্য সাহাবীদেরকে উস্কানি দিয়েছে , এটা মিথ্যা ও অপবাদ। তোমার জন্য দুঃখ হয় এই মোয়াবিয়া! তুমি কি জান না আবুল হাসান (আলী) আল্লাহর পথে নিজেকে আত্মোৎসর্গ করে দিয়েছিল ও রাসূল (সা.)-এর বিছানায় ঘুমিয়েছিল এবং রাসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা।৮৬

৮. উমর ইবনে আব্দল আজিজ গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করেছেন

ইয়াজিদ ইবনে উমর নামক একজন বলেছেনঃ আমি শামে (সিরিয়াতে) ছিলাম , উমর ইবনে আব্দুল আজিজ কিছু সম্পদ বন্টন করছিল , আমিও আমার অংশ নেওয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম , যখন আমার পালা আসল , বললঃ তুমি কোন্ বংশের ? আমি বললামঃ কোরাঈশ বংশের। বললঃ কোন্ গোষ্ঠীর ? বললামঃ বনী-হাশিম গোষ্ঠীর। বললঃ কোন্ পরিবারের ? বললামঃ আলীর আত্মীয়দের মধ্য হতে। বললঃ কোন্ আলীর ? আমি উত্তর দিই নি। তখন উমর ইবনে আব্দুল আজিজ তার বুকে হাত রেখে বললঃ আল্লাহর কসম! আমিও আলীর আত্মীয়দের মধ্য হতে। একদল লোক আমাকে বলেছে যে , রাসূল (সা.) তার সম্পর্কে বলেছেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা।

তখন সে তার সহকারীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললঃ এ রকম লোককে তুমি কি পরিমাণ দিয়ে থাক ? বললঃ একশ থেকে দুইশ দিরহাম। বললেনঃ তাকে তুমি ৫০ দিনার দাও।৮৭ কারণ , সে হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াতে বিশ্বাসী তথা তার অনুসারী। আমাকে বললঃ তুমি তোমার শহরে ফিরে যাও , তোমার প্রাপ্য তুমি সেখানেই পাবে।৮৮

৯. আব্বাসীয় খলিফা মামুনও গাদীরের হাদীসকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন

প্রসঙ্গক্রমে মামুন ও বিচারপতি ইসহাক ইবনে ইব্রাহিমের মাঝে রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মর্যাদা নিয়ে সে যুগে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল , তখন মামুন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলঃ তুমি কি শাসন কর্তৃত্বের (বেলায়াতের) হাদীসটি বর্ণনা কর ? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ করি। মামুন বললঃ হাদীসটা পাঠ কর। ইয়াহহিয়া হাদীসটি পাঠ করল।

মামুন জিজ্ঞেস করলঃ তোমার দৃষ্টিতে এই হাদীসটি কি আবু বকর ও উমরের উপর আলীর প্রতি কোন দায়িত্ব অর্পন করে ? না-কি করে না ?

ইসহাক বললঃ বলা হয় যে , রাসূল (সা.) এই হাদীসটি ঐ সময় বলেছিলেন যখন আলী ও যাইদ ইবনে হারিসের মধ্যে এক মতপার্থক্যকে দেখা দিয়েছিল। রাসূল (সা.)-এর সাথে আলীর আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা যাইদ অস্বীকার করেছিল ; আর এই কারণেই রাসূল (সা.) বলেছিলেনঃ আমি যাদের মাওলা এই আলীও তাদের মাওলা...। মামুন বললঃ এই হাদীসটি কি রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় বলেন নি ?

ইসহাক বললঃ হ্যাঁ ।

মামুন বললঃ যাইদ ইবনে হারিসা গাদীরের পূর্বেই শহীদ হয়েছিলেন। তুমি কিভাবে এটা মেনে নিলে যে , রাসূল (সা.) এই হাদীসটি তার কারণেই বলেছেন ? আমাকে বল যদি তোমার পনের বছরের ছেলে মানুষকে বলে যে , হে জনগণ! আপনারা জেনে নিন যে , যাদের সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে , আমার চাচাতো ভাই-এর সাথেও তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। তুমি কি তাকে বলবে না যে , যে বিষয়টা সবার জানা ও কারো কাছে যেটা অস্পষ্ট নয় , কেন তুমি সেই বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করছো ?

বললঃ কেন , অবশ্যই তাকে বলবো।

মামুন বললঃ এই ইসহাক! যে বিষয়টি তুমি তোমার পনের বছরের ছেলের ক্ষেত্রে মেনে নিচ্ছ না , তাহলে কিভাবে ঐ একই বিষয় রাসূল (সা.)- এর ক্ষেত্রে মেনে নিলে ? আক্ষেপ হয় তোমাদের উপর , কেন তোমরা তোমাদের ফকীহদের (ফিকাহবিদদের) পূজারী বা ইবাদত কর ?৮৯

যেমনভাবে পরিলক্ষিত হল তাতে সকল আলোচনাই ছিল হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত সম্পর্কে কথোপকথোনের কেন্দ্র বিন্দু। প্রমাণ উপস্থাপনকারীগণ এই হাদীস দ্বারা , আলী (আ.)-এর খেলাফতকে প্রমাণ করেছেন। আর বক্তাগণও কখনো বলেননি যে , এই হাদীসে মাওলা শব্দটি নেতা বা অভিভাবক ব্যতীত অন্যকিছু। যদি উক্ত হাদীসে আলী (আ.)-এর নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য কোন অর্থ থাকতো , তাহলে আবু হোরায়রা এভাবে বিনীত হয়ে জনাব আসবাগ ইবনে নাবাতার সামনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো না ও লজ্জিত হত না এবং আমর ইবনে আস , আম্মারের কাছে নিরুপায় হয়ে আত্ম সমর্পন করতো না।

সুতরাং যদি কেউ যে কোন অভিসন্ধির কারণে গাদীরের হাদীসের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে তাহলে সে শুধু সত্যকেই গোপন করেনি বরং রাসূল (সা.)-এর হাদীসকেও বিকৃত করেছে এবং আব্বাসীয় খলিফা মামুনের ভাষায় অর্থ বিকৃতকারীরা রাসূল (সা.)-এর উপর এমন কিছু আরোপ করেছে যা এক পনের বছরের ছেলের উপরও আরোপ করা যায় না।

দ্বিতীয় অধ্যায়

বিদায় হজ্জের একটি বিবরণ

হিজরী দশম বছর সমস্ত আরব উপদ্বীপে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে। আরবের সকল গোত্রই মুসলিম আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল , রাসূল (সা.)-এর রেসালাতকে স্বীকার করে নিয়েছেন। মূর্তি ও মূর্তি পূজার কোন চিহ্নই তাদের কোন গোত্রের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না। রেসালাতের কর্ণধারের পরিশ্রম আজ ফলদায়ক হয়েছে এবং তার সুস্বাদু ফলকে উৎপাদনশীল করেছে। উপাস্যের সিংহাসন থেকে মূর্তি গুলোর পতন ঘটেছে ও পবিত্র বাণী লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বিস্তৃত আরব উপদ্বীপে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

মানুষের মধ্যে এখন পার্থক্যকে শুধুমাত্র তাদের আন্তরিক ঈমানের পর্যায় ও ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতার ভিত্তিতে। মহান রাসূল (সা.) -যিনি প্রায় 23টি (তেইশটি) বছর ধরে প্রচহু জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন ও এই দীর্ঘ সময়ে তিনি এক মূহুর্তের জন্যেও তার কর্তব্য ও রেসালাতের প্রচার কার্যে অবহেলা করেন নি- তিনি কখনোই দূর্বলতা অনুভব করেন নি , এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে , অতিশীঘ্রই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে এবং মহান প্রভূর সাথে সাক্ষাত করতে হবে। তাই পূর্বের মতই নিরলশ চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মত দীস্থিমান হয় ও ইসলামী আইন-কানুন শিক্ষা লাভ করে। অতি সামান্যই ইসলামী বিধি-বিধান অবশিষ্ট আছে যা এখনও প্রচারের ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত সময় আসেনি। ফরজ হজ্জ হচ্ছে তার একটি। তিনি তখনও সুযোগ পান নি যে , মুসলমানদেরকে নামাজের ন্যায় হজ্জের শিক্ষা দিবেন। তাই এখনই একমাত্র ও শেষ সময়।

সাধারণ ঘোষণা করা হল যে , রাসূল (সা.) হজ্জ করতে যাবেন। বিভিন্ন গোত্রের মানুষেরা মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং তিনি (সা.) জিলক্বদ মাসের 6 দিন (ছয় দিন) অবশিষ্ট থাকতে বৃহস্পতিবার4 অথবা চার দিন অবশিষ্ট থাকতে শনিবারে , আবু দুজানাকে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত করে5 তাঁর সমস্ত স্ত্রীগণ ও পরিবারবর্গসহ সঙ্গীদের নিয়ে যাত্রা করলেন6 তিনি একশ টি উট7 কোরবানীর জন্য সাথে নিয়ে মদীনা হতে যাত্রা করেছিলেন।

ঐ সময় মদীনায় রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। যারফলে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই এই বরকতময় সফর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।8 তারপরেও হাজার হাজার লোক রাসূল (সা.)-এর সহযাত্রী হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তার সহযাত্রীর সংখ্যা চল্লিশ হাজার , সত্তর হাজার , নব্বই হাজার , একলক্ষ চৌদ্দ হাজার , একলক্ষ বিশ হাজার , একলক্ষ চব্বিশ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন।9 কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি আরো বলা যেতে পারে যে , আসলে এত পরিমাণ জনগণ তার সহযাত্রী হয়েছিলেন যে , তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কারো সাধ্য ছিল না।10 তাও আবার তারা শুধু ঐ সকল ব্যক্তিই ছিলেন যারা মদীনা হতে এসেছিলেন। তবে হাজীদের সংখ্যা এর মধ্যেই সীমিত ছিল না। কেননা , মক্কার ও তার আশেপাশের অধিবাসীগণ এবং যারা ইয়েমেন থেকে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর সাথে এসেছেন তারাও উক্ত হজ্জে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

রাসূল (সা.) গোসল করলেন ও পবিত্র দেহ মোবারকে তেল মালিশ করলেন , সুগন্ধি লাগালেন এবং চুলগেুলোকে চিরুণী দিয়ে আচড়ে পরিপাটি করলেন।11 অতঃপর মদীনা হতে বের হলেন। মদীনা হতে বের হওয়ার সময় তার শরীরে মাত্র দু টি কাপড় ছিল যার একটি ছিল কাধের উপর রাখা আর অপরটি ছিল কোমরে বাধা। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন , যখন জিল হুলাইফা তে পৌছালেন তখন ইহরাম বাধলেন।12 অতঃপর আবারও পূর্বের ন্যায় পথ চলতে শুরু করলেন এবং জিলহজ্জ মাসের চার তারিখ মঙ্গলবারে মক্কায় প্রবেশ করলেন। বনী শাইবা র ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে (কাবা ঘরে) প্রবেশ করলেন ,13 তাওয়াফ করলেন , তাওয়াফের নামাজ পড়লেন , সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করলেন এবং নিয়মানুযায়ী ওমরার কর্মাদি সম্পাদন করলেন।14 যারা নিজেদের সাথে কোরবানীর পশু নিয়ে আসেননি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন- তারা যেন চুল কেটে ইহরাম খুলে ফেলে।15 তিনি (সা.) যেহেতু কোরবানীর পশু নিয়ে এসেছিলেন তাই ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন যতক্ষন পর্যন্ত না মীনা তে কোরবানী করেন।16 আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) যেহেতু রাসূল (সা.)-এর হজ্জে যাওয়ার কথা ইতিপূর্বেই অবগত হয়েছিলেন তাই তিনিও ইয়েমেন থেকে 37টি (সাইত্রিশটি) কোরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছিলেন ও ইয়েমেনের অধিবাসীদের মিকাতে ঐ একই নিয়্যতেই , যে নিয়্যতে রাসূল (সা.) ইহরাম বেধেছিলেন , ইহরাম বাধলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ন্যায় সাফা ও মারওয়া সাঈ করার পর ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন।17

রাসূল (সা.) জিলহজ্জ মাসের 8ম (অষ্টম) দিনে মীনা হয়ে আরাফা র ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন যাতে হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শুরু করতে পারেন। 9ম (নবম) দিনের সূর্য়যাদয় পর্যন্ত মীনা তেই ছিলেন। অতঃপর আরাফায় পৌছে স্বীয় তাবুতে অবস্থান নিলেন।

আরাফায় মুসলমানদের আড়ম্বরপূর্ণ জন সমাবেশে প্রাঞ্জল ভাষায় খুতবা পাঠ করলেন। তার এই খুতবাতে মুসলমানদেরকে ভ্রাতৃত্বের প্রতি ও পরস্পরের প্রতি সম্মানের কথা তুলে ধরলেন ; ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগের সমস্ত আইন-কানুনকে বাতিল ঘোষণা করলেন এবং স্বীয় রেসালাতের সমাপ্তির কথাও ব্যক্ত করলেন।18 9ম (নবম) দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন। যখন সূর্য অস্তমিত হল ও অন্ধকার নেমে আসল তখন মুজদালাফা র উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।19 তিনি সেখানেই রাত্রি যাপন করার পর দশম দিনের প্রত্যুশে মীনা র দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মীনা র নিয়ম কানুন পালনের মাধ্যমে হজ্জ শেষ করলেন এবং এভাবেই হজ্জের বিধি-নিষেধগুলি মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিলেন।

এই হজ্জকে হাজ্জাতুল বিদা , হাজ্জাতুল ইসলাম , হাজ্জাতুল বালাগ , হাজ্জাতুল কামাল ও হাজ্জাতুত তামাম বলা হয়ে থাকে ।20 হজ্জের অনুষ্ঠান সমাপনীর পর তিনি মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন। যখন রাগেব নামক স্থানে পৌছালেন , (যে স্থানটিকে গাদীরে খুম বলা হত) হযরত জিব্রাইল (আ.) অবতীর্ণ হলেন এবং তার নিকট ঐশীবাণী এভাবে পাঠ করলেন-21

) ي َا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ(

হে রাসূল! প্রচার করুন আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন , তাহলে আপনি তার রেসালাতের কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে (একদল) মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।22

আল্লাহর এই বাণী এমন এক নির্দেশ যা রাসূল (সা.)-এর উপর গুরুদায়িত্ব হিসেবে অর্পন করা হয়েছে ; এমনই এক ঘোষণা যে , কেউ যেন এ সম্পর্কে অনবগত না থাকে , আর যদি তিনি এমনটা না করেন তাহলে যেন এমন যে , তিনি দ্বীনের কোন কাজই সম্পাদন করেননি। সুতরাং এই বাণী প্রচারের জন্য উক্ত স্থানই ও উক্ত সময়ই সর্বোত্তম ; যেখানে মিশর , ইরাক , মদীনা ও অন্যান্য সকল স্থানের অধিবাসীদের পরস্পরের পথ আলাদা হওয়ার স্থান। আর সকল হাজীগণ অনন্যোপায় হয়ে এই পথই পাড়ি দিয়ে থাকেন। গাদীরের খুম নামক স্থানটিই একমাত্র স্থান ছিল যেখানে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণীটি সমস্ত হাজীদের কর্ণ কুহরে পৌছানো সম্ভবপর।

তাই সকলকে সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হল। তিনি বললেন অগ্রগামীদের ফিরে আসতে বল আর পশ্চাৎপদদের জন্য প্রতীক্ষা কর।23 হেজাজের উত্তপ্ত মরুতে জনগণের ঘটেছিল এক মহা সমাবেশ। দিনটিতে ছিল প্রচহু গরম ও এলাকাটির তাপ্রমাত্রাও ছিল অত্যন্ত বেশী ; এত গরম ছিল যে , সেখানকার পুরুষরা তাদের স্বীয় বস্ত্রের অর্ধাংশ দিয়েছিলেন মাথায় আর অর্ধাশ দিয়েছিলেন প্রায়র নীচে।24 সকলের মনে একই প্রশ্ন ছিল যে , কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে যে , এরকম প্রচহু গরমের মধ্যে বা বাহ্যিক দিক থেকে অনুপোযুক্ত জায়গায় রাসূল (সা.) আমাদেরকে স্বস্থানে অবস্থানের নির্দেশ দিলেন ? তাপামাত্রা এত উচ্চ মাত্রায় পৌছেছিল যে , হাজীদেরকে অস্থির করে ফেলছিল।

তিনি নির্দেশ দিলেন- যেন বয়োবৃদ্ধদেরকে বৃক্ষতলে নিয়ে যাওয়া হয় আর উটের জিনগু্লোকে যেন একটার উপর অপরটা রেখ মঞ্চ বানানো হয়। সুউচ্চ মঞ্চ তৈরী করা হল। প্রায় দুপুরের সময় যখন হাজীগণ ঐ মরুভূমিতে একত্রিত হয়েছিল , তিনি মঞ্চে আরোহন করলেন এবং এভাবে একটি বক্তব্য প্রদান করলেনঃ

সকল প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য । আমরা তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি , তার প্রতি ঈমান আনয়ন করি , তার প্রতিই ভরসা করি এবং নাফসের তাড়না ও অসৎ আচরণের জন্য চাই তাঁর নিকট আশ্রয় ; তিনি এমনই প্রভূ যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নেই আর যাকে তিনি পথ প্রদর্শন করেন তার কোন পথভ্রষ্টকারী নেই । আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , এক আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রভূ নেই ও মুহাম্মদ তারই প্রেরিত বান্দা অতঃপরঃ

হে উপস্থিত জনতা ; সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা আমাকে অবগত করেছেন যে , কোন নবীই তার পূর্ববর্তী নবীর বয়সের অর্ধেকের বেশী বয়স ধরে জীবন যাপন করে নি এবং অচিরেই আমাকেও চিরস্থায়ী আবাসের দিকে আহবান করা হবে , আর আমিও তার আহবানে সাড়া দিব। এটা বাস্তব যে , আমাকে ও তোমাদের সবাইকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। তখন তোমরা কি জবাব দিবে ?

সকলেই বললেনঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , আপনি আল্লাহর বাণী আমাদের নিকট পৌছিয়েছেন ও উপদেশ দান করেছেন এবং চেষ্টা- প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি করেননি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন।

তিনি বললেনঃ তোমরা কি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছ যে , এক আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত বান্দা , তার প্রতিশ্রুত বেহেশত , দোযখ ও মৃত্যু সত্য এবং নিঃসন্দেহে পুনরুত্থান সংঘটিত হবে ও আল্লাহ তায়ালা সকল মৃত বক্তিদেরকে জীবিত করবেন ?

সকলেই বললেনঃ হ্যা , আমরা এ সকল বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি।

তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। 25

অতঃপর বললেনঃ হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ?

তারা বললেনঃ হ্যা।

তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের পূর্বেই হাউজে কাউসারে উপস্থিত হব আর তোমরা হাউজের পার্শ্বে আমার নিকট উপস্থিত হবে ; ঐ হাউজটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে সানআ হতে বুসরা র দৈর্ঘ্যের সমান এবং সেখানে রয়েছে রৌপ্য পানপাত্র ও এর সংখ্যা নক্ষত্রের সমান। এখন দেখতে চাই যে , আমার পরে তোমরা আমার এই দু টি মহামূল্যবান বস্তুর সাথে কেমন আচরণ কর।

উপস্থিত জনগণের মধ্য হতে একজন বলে উঠলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! ঐ দু টি মহা মূল্যবান বস্তু কি ?

তিনি বললেনঃ ঐ দু টি বস্তু হচ্ছে- একটি সবচেয়ে বড় যা আল্লাহর কিতাব (কোরআন)। যার এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্তটি তোমাদের হাতে ; তাই এটাকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে যাতে পথভ্রষ্ট না হও। আর অপরটি হচ্ছে- ইতরাত বা আমার নিকটাত্মীয়। মহান প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তায়ালা আমাকে জানিয়েছেন যে , এ দু টি বস্তু কিয়ামতের দিনে হাউজে কাউসারে আমার নিকট না পৌছা পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। আর আমিও আল্লাহর নিকট এটাই কামনা করেছিলাম। সুতরাং তোমরা তাদের অগ্রবর্তী হবে না , হলে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পশ্চাতে পড়ে থাকবে না , তাহলেও ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর আলীর হাত ধরে উচু করলেন। আর এমনভাবে উচু করলেন যে , তাদের দু জনেরই শুভ্র বগল দেখা যাচ্ছিলো এবং সেখানকার সকলেই আলীকে চিনতে পারলো।

তখন তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! মু মিনদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম এবং তাদের উপর প্রাধান্য রাখে ?

সকলেই বললোঃ আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।

তিনি বললেনঃ আল্লাহ আমার মাওলা ও অভিভাবক , আমি মু মিনদের মাওলা ও অভিভাবক। আর আমি মু মিনদের উপর তাদের চেয়ে প্রধান্য রাখি। সুতরাং আমি যাদের মাওলা ও অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা ও অভিভাবক। 26

এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন।

অতঃপর বললেনঃ হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে ;27 তুমি সহযোগিতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগিতা করে , তুমি তাকে নিঃসঙ্গ কর যে আলীকে নিঃসঙ্গ করে28 এবং সত্যকে সর্বদা আলীর সাথে রাখ সে (আলী) যে দিকেই থাক না কেন। 29

হে লোকসকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা এই বাণীটি অবশ্যই অনুপস্থিতদের নিকট পৌছিয়ে দিবে।30

রাসূল (সা.)-এর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর জিব্রাইল (আ.) দ্বিতীয়বার অবতীর্ণ হলেন এবং তাকে এই বাণীটি পৌছে দিলেনঃ

) ال ْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও নেয়ামত বা অনুগ্রহকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা-3)31

রাসূল (সা.) এই আনন্দদায়ক বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর আনন্দিত হলেন এবং বললেন- আল্লাহ মহান! কেননা দ্বীন পরিপূর্ণ ও নেয়ামত বা অনুগ্রহ সম্পূর্ণ এবং মহান প্রভূ আমার রেসালাতের বা নবুয়্যতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন।32

অভিনন্দন অনুষ্ঠান

রাসূল (সা.) তার বক্তব্য শেষ করার পর মঞ্চ থেকে নেমে আসলেন ও একটি তাবুতে বসলেন এবং বললেনঃ আলীও যেন অপর এক তাবুতে বসে। অতঃপর নির্দেশ দিলেন , সকল সাহাবীগণ যেন আমিরুল মু মিনীনের সাক্ষাতে যায় এবং বেলায়াতের মর্যাদার জন্য তাকে অভিনন্দন জানায়।

ইতিহাস গ্রন্থ রওজাতুস সাফা এর লেখক গাদীরের ঘটনা উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ রাসূল (সা.) এর নির্দেশ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট তাবুতে বসলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন যেন পর্যায়ক্রমে সকলেই আলীর তাবুতে যায় ও তাকে অভিনন্দন জানায়। যখন সবাই এই কাজটি সম্পন্ন করলেন , উম্মাহাত (এর উদ্দেশ্য রাসূলের (সা.) স্ত্রীগণ অর্থাৎ উম্মাহাতুল মু মিনীন অর্থাৎ উম্মতের জননী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।) আলীর নিকট গেলেন এবং তাকে অভিনন্দন জানালেন।33

হাবিবুস সীয়ার নামক ইতিহাস গ্রন্থে গাদীরের হাদীস বর্ণনার পর এরূপে এসেছে যে , অতঃপর আমিরুল মু মিনীন আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহু অর্থাৎ মূর্তির সমীপে তার শির কখনো নত হয়নি) রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের ভিত্তিতে এক তাবুতে বসলেন যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাকে অভিবাদন জানাতে পারে , বিশেষ করে উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের কণর্ধারকে বললেন-

بخ بخ یا بنابی طالب اصبحت مولای و مولی کل مؤمن و مؤمنة

অর্থাৎ অভিনন্দন , অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মু মিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হলেন।34

তারপর উম্মাহাতুল মু মিনীন রাসূল (সা.)-এর ইঙ্গিতে আমিরুল মু মিনীনের তাবুতে গেলেন এবং তাকে অভিবাদন জানালেন। বিশিষ্ট শিয়া মুফাসসীর ও মুহাদ্দিস মরহুম তাবারসী তার ইলামুল ওয়ারা নামক গ্রন্থে ও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।35

সকল সাহাবীগণ আবার রাসূল (সা.)-এর হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করলেন এবং সেই সাথে আলী (আ.)-এর সাথেও বাইয়াত বা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। সর্ব প্রথম যে ব্যক্তিবর্গ রাসূল (সা.)-এর ও আলী (আ.)-এর হাতে হাত রেখেছিলেন তারা ছিলেন আবু বকর , উমর , উসমান , তালহা ও জোবায়ের।36 ইতিপূর্বেও তুলে ধরেছি যে , অভিনন্দনের জন্য হযরত উমর যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন , তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেনঃ অভিনন্দন , অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মু মিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হলেন।37 আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ মুহাদ্দিস বা হাদীসবেত্তাগণ এই ঘটনাটি ঐ সকল সাহাবীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং উমরের কন্ঠে এই বাক্যটি শুনেছিলেন। যেমন- যারা এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে- ইবনে আব্বাস , আবু হোরায়রা , বুরাআ ইবনে আযিব , যায়েদ ইবনে আরকাম , সা আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস , আবু সাঈদ খুদরী এবং আনাস ইবনে মালিকের নাম উল্লেখযোগ্য ।

আল্লামা আমিনী তার আল-গাদীর নামক গ্রন্থে 60 জন (ষাটজন) আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন যারা স্বীয় গ্রন্থে উক্ত ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন।38 আবার অনেকেই এটাকে আবু বকরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।

যখন অভিনন্দন অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘটল তখন হাসসান্ বিন সাবিত নামক একজন কবি , যিনি স্বীয় যুগে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন , তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমতি প্রার্থনা করছি যে , আপনার উপস্থিতিতে আলীর উদ্দেশ্যে কবিতার ক টি লাইন পাঠ করবো।

তিনি (রাসূল)বললেনঃ আল্লাহর নামে শুরু কর।

অতঃপর হাসসান্ উচু স্থানে উঠে পাঠ করতে লাগলেনঃ মুসলমানদের রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে উচ্চস্বরে তাদেরকে ডাকলেন , কতটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে , আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এভাবে আহবান করছেন।

তিনি বললেনঃ তোমাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক এবং রাসূল কে ?

সেখানকার সকলেই নির্দ্বিধায় বললেনঃ আপনার আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং আপনি আমাদের রাসূল ও আমাদের মধ্যে এমন একজনকেও পাবেন না , যে বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) নির্দেশের ক্ষেত্রে আপনার অবাধ্য হবে ও বিরোধিতা করবে।

তখন আলীকে বললেনঃ হে আলী উঠে দাড়াও! কারণ , আমি তোমাকে আমার পরে ইমামত ও নেতৃত্বের জন্য নির্বাচন করেছি।

অতএব আমি যাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক , এই আলীও অনুরূপ তাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং তোমরা তার সঠিক অনুসারী হও এবং তাকে ভালবাস।

এবং সেখানে দোয়া করলেনঃ হে আল্লাহ! আলীর বন্ধু্কে তোমার বন্ধু মনে কর এবং যে আলীর সাথে শত্রুতা করবে তুমিও তার সাথে শত্রুতা কর।39

গাদীর দিবসে বেলায়াতের মুকুট পরানো

বাইয়াত বা অঙ্গীকার অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় তিন দিন সময় লেগেছিল।40 যেহেতু সবাই মহান খেলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে জেনে গেছেন ও রাসূল (সা.)-এর খলিফা বা প্রতিনিধিও নির্বাচন হয়ে গেছে এবং জনগণও তার সাথে পরিচিতি লাভ করেছেন ও তার হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করেছেন , তাই এখনই উপযুক্ত সময় হচ্ছে রাজ মুকুট পড়ানোর মত অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। রাসূল (সা.) আমিরুল মু মিনীন আলীকে (আ.) ডাকলেন ও স্বীয় পাগড়ীটি , যার নাম ছিল সাহাব তার মাথায় পরালেন এবং প্রান্তটি তার গ্রীবা পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে বললেনঃ

یا علی العمائم تیجان العرب

অর্থাৎ হে আলী! পাগড়ী হচ্ছে আরবদের মুকুট।41

অতঃপর তিনি তার সুন্নাতানুসারে পাগড়ী পড়ানো হয়েছে কি-না তা নিরীক্ষণ করার জন্য বললেনঃ আমার দিকে মুখ ফিরে দাড়াও। তিনি দাড়ালেন। তিনি বললেনঃ এবার ঘুরে দাড়াও। তিনি ঘুরে দাড়ালেন।42

এমতাবস্থায় সাহাবীদের দিকে মুখ ফিরে বললেনঃ যে সকল ফেরেশতা বদর ও হুনায়নের যুদ্ধের দিন আমাকে সাহায্য করতে এসেছিল তারা ঠিক এইভাবেই পাগড়ী পরেছিল।43

তিনি আরো বলেনঃ পাগড়ী হচ্ছে ইসলামের নিদর্শন।44 পাগড়ী এমনই চিহ্ন যা মুসলমানদেরকে মুশরিক হতে পৃথক করে।45 তিনি বলেছেনঃ ফেরেশতা ঠিক এরূপে আমার নিকট আসে।46

এভাবেই গাদীরের ঘটনার সমাপ্তি ঘটলো এবং হাজীগণ প্রত্যেকেই স্বীয় অঞ্চলের বা দেশের পথ ধরে সেখান থেকে জাজিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। তারা বেলায়াত বা শাসন কর্তৃত্বের হাদীসটি সমস্ত মুসলমানের কানে পৌছে দিয়েছেন।

এখন যেহেতু সংক্ষিপ্তাকারে গাদীরের বীরত্বগাথা ঘটনাটি সম্পর্কে আমরা জানলাম তারপরেও দু টি কথা উল্লেখ করা দরকারঃ

ক. ইতিহাসের দৃষ্টিতে গাদীরের ঘটনার সত্যতা ;

খ. গাদীর দিবসে প্রদত্ত রাসূল (সা.)-এর ভাষণের তাৎপর্য।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13