আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর15%

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর লেখক:
: মুহাদ্দিস এম, এ, রহমান
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বিভাগ: ইতিহাস

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 28 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 25554 / ডাউনলোড: 4777
সাইজ সাইজ সাইজ
আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে গাদীর

লেখক:
প্রকাশক: আল মুস্তাফা (সা.) আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, কোম-ইরান
বাংলা

মুসলিম বিশ্ব আজ পরাশক্তির চক্রান্তের শিকার। তাদের ফাদে পরে মুসলমানদের অবস্থা এখন অতি নাজুক। মুসলমানরা আজ বহু দলে বিভক্ত , মিথ্যা ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দী , তারা নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ - সংঘাত , মারামারি , আর হানাহানিতে লিপ্ত। ফতোয়া দিয়ে একে অপরকে কাফির ঘোষণা এখন একদল অজ্ঞ ও পাশ্চাত্যের হাতের পুতুল ব্যক্তির নিত্য দিনের কর্মে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য সম্মানিত বিজ্ঞ লেখক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুন্নীদের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সমূহের উপর ভিত্তি করে Ghadir az didgahe ahle sunnatনামে একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে লেখক গাদীরের ঐতিহাসিক ঘটনাকে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি হযরত আলী ( আ .)- এর মর্যাদা যে শিয়া - সুন্নী নির্বিশেষে সকলের কাছে অনস্বীকার্য একটি বিষয় তা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন এবং প্রকৃত ও সত্য বিষয়কে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

স্থলাভিষিক্ত ও উত্তরাধিকারী

সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত খলিফা বা প্রতিনিধি

শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস অনুযায়ী , রাসূল (সা.)-এর খলিফা বা প্রতিনিধির দু ধরনের দায়িত্ব বা কর্তব্য রয়েছে ; যথা- ক. বাহ্যিক শাসন ও খ. আধ্যাত্মিক শাসন।

ক. বাহ্যিক শাসন

অর্থাৎ শাসন পরিচালনা , আইনের বাস্তবায়ন , অধিকার সংরক্ষণ , ইসলামী রাষ্ট্রের সংরক্ষণ ইতাদি।

এক্ষেত্রে খলিফা বা প্রতিনিধি অন্যান্য শাসকদের মতই , শুধু এতটুকু পার্থক্য যে , সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য ও আবশ্যক কাজ।

খ. আধ্যাত্মিক শাসন

আধ্যাত্মিক শাসন এই অর্থে যে , খলিফা বা প্রতিনিধির কর্তব্য হচ্ছে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়গুলি (যা কোন কারণে বলা হয়নি) মুসলমানদের নিকট তুলে ধরা।

খলিফা বা প্রতিনিধি একজন শাসকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অবশ্যই ইসলামী বিধি-বিধান ও কোরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যাও জনগণের সামনে বর্ণনা করবে যাতে ইসলামের চিন্তাধারাকে যে কোন ধরনের বিচ্যুতি থেকে রক্ষা এবং বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ-সংশয় হতে মুক্ত রাখতে পারে।

সুতরাং খলিফাকে অবশ্যই রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে ইসলামের ভিত্তি , মানদণ্ড ও শরীয়তের বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিজ্ঞ হতে হবে। অর্থাৎ সবার চেয়ে বেশি মহানবীর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ঝর্ণা ধারা হতে পানি পান ও মহান রাসূল (সা.)-এর বিদ্যমান থাকাকালীন সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ তার থেকে জ্ঞান ও নৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হবে। সুতরাং ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরূপ ব্যক্তিত্ব বিদ্যমান থাকা অপরিহার্য যিনি রাসূল (সা.)-এর পবিত্র অস্তিত্ব থেকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করেছেন। সেই সাথে ইসলামের অগ্রবর্তী অবদানের অধিকারী তেমন ব্যক্তির মধ্যে সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে , নিজের স্বার্থের উপর মুসলমানদের ও ইসলামের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনকে রক্ষার জন্য আত্মোৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত থাকতে হবে।

খলিফার শাসনকার্যের ক্ষেত্রে মুসলমানের সমস্ত সম্পদের উপর তার শাসন কর্তৃত্বের অধিকার থাকবে বিশেষ করে খুমস , যাকাত , টাক্স বা রাজস্ব , যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা গণিমত , খনিজ ও অন্যান্য সাধারণ সম্পদ ইতাদি যা খলিফার অধীনে থাকবে এবং খলিফার দায়িত্ব হচ্ছে এগু্লোকে কোন প্রকার অনিয়ম ও অনাচার ছাড়াই জনগণের মাঝে বিতরণ করা ; অথবা ইসলামী রাষ্ট্রের কল্যাণকর কোন কাজে লাগানো। সুতরাং তাকে অবশ্যই দুনিয়ার প্রতি নিরাসক্ত হতে হবে যাতে সংবেদনশীল বিশেষ মুহূর্তে ও ভুল না করে। ঠিক এই দলিলের ভিত্তিতেই খেলাফত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত যা তার পক্ষ হতে উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকই প্রদান করা হয়। তাই ঐ পবিত্র পদ মানুষের নির্বাচনের নাগালের বাইরে।

অন্যভাবে বলা যায় , খেলাফত আল্লাহর মনোনীত একটি পদ যাতে মানুষের ভোটের কোন প্রভাব নেই। এ চিন্তার ভিত্তিতে আমরা রাসূল (সা.)- এর স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই বর্ণিত দলিল ও ঐশী নির্দেশের উপর নির্ভর করবো এবং রাসূল (সা.)-এর বাণীসমূহ যা এই সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো নিরপেক্ষভাবে পর্যালোচনা করে তার ফলাফলের উপর সিদ্ধান্ত নিব।

ইতিপূর্বেই জেনেছি যে , গাদীরের ঘটনা একটি প্রামাণিক ঘটনা যা ইসলামের ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) হাদীসও একটি তর্কাতীত বাণী যা রাসূল (সা.) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। আর অর্থ ও ভাবধারার ক্ষেত্রেও কোন প্রকার অস্পষ্টতার চিহ্ন তাতে নেই ; যারাই একটু আরবি ব্যকরণ সম্পর্কে জ্ঞাত ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রচলিত সর্বগ্রাহ্য মাপকাঠি সম্পর্কে পরিচিত তারা যদি ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিতে পক্ষপাতহীনভাবে এই হাদীসটির প্রতি দৃষ্টিপাত করে তাহলে অবশ্যই স্বীকার করবে যে এই হাদীসটি আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) ইমামত , নেতৃত্ব ও প্রাধান্যতার কথাই প্রমাণ করে।

এমন কি এই হাদীসটিকে যদি না দেখার ভান করি তারপরেও আলীর (আ.) ইমামত ও নেতৃত্ব সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নীদের গ্রন্থসসমূহে যথেষ্ট পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা আমাদের নিকট বিদ্যমান।

রাসূল (সা.) হতে এই সম্পর্কে যে সমস্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার কিছু নমুনা এখানে দু টি ভিন্ন অধ্যায়ে তুলে ধরবোঃ

যে সব হাদীস গাদীরের হাদীসের মত সরাসরি আমিরুল মু মিনীন আলীর (আ.) খেলাফতের দিকে ইঙ্গিত করে , সে সকল হাদীস প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করবো।

আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঐ সমস্ত হাদীস তুলে ধরা হবে যেগুলোতে আমিরুল মু মিনীন আলীর (আ.) ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং যা গাদীরের হাদীসের সঠিকতার প্রমাণ বহন করে ও খেলাফতের ক্ষেত্রে তার অগ্রাধিকারকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করে।

অতঃপর বিদ্যমান হাদীসসমূহ এবং বর্ণনাগত দলিল (শাব্দিকভাবে তার শ্রেষ্ঠতার ইঙ্গিত বহনকারী প্রমাণ) ব্যতীত হযরত আলী (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব থেকে যে সকল সত্তাগত যোগ্যতা ও মর্যাদার পরিচয় পাওয়া যায় তার পর্যালোচনা করবো। সর্বশেষে গাদীরের ঈদ ও এই ঈদের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোকপাত করবো।

হযরত আলীর (আ.) খেলাফতের অকাট্য প্রমাণসসমূহ

গাদীরের হাদীস ছাড়াও অন্য যে সকল প্রমাণাদি সরাসরি সুস্পষ্টভাবে আলীর (আ.) খেলাফত ও নেতৃত্বকে প্রমাণ করে তার সংখ্যা এত বেশী যে যদি আমরা তা উল্লেখ করতে চাই তাহলে শুধু সেগুলিই একটা বড় গ্রন্থের রূপলাভ করবে। তাই এখানে সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকব।

প্রথমেই বলা দরকার যে , যদিও মুসলিম সমাজ রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর নেতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত পথে গিয়েছিল ও রাসূল (সা.)-এর প্রকৃত খলিফাকে ২৫ বছর (পচিশঁ বছর) ধরে শাসনকার্য হতে দূরে রেখেছিল , কিন্তু এতে তার সত্ত্বাগত মর্যাদার মূল্য বিন্দু পরিমাণও কমে নি ; বরং তারা নিজেরাই একজন নিষ্পাপ বা মাসুম নেতা হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং উম্মতকেও বঞ্চিত করেছে। কারণ , তার মান-মর্যাদা বাহ্যিক খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না , বরং খেলাফতের পদটি স্বয়ং আলীর (আ.) দায়িত্বভারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অর্থাৎ যখনই তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এই পদে আসীন হয়েছেন তখনই এই পদ বা আসনটির অধঃপতন ঘটেছে। আর শুধুমাত্র তখনই তা প্রকৃত মর্যাদায় পৌছেছে যখন আলী (আ.) তার উপর সমাসীন হয়েছেন। বর্ণিত হয়েছেঃ

যখন আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) কুফা শহরে প্রবেশ করলেন , তখন এক ব্যক্তি সামনে এসে বললঃ আল্লাহর কসম হে আমিরুল মু মিনীন! খেলাফতই আপনার মাধ্যমে সুশোভিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত হয়েছে , এমন নয় যে আপনি ঐ খেলাফতের মাধ্যমে। আপনার কারণেই এই পদটি মর্যাদার উচ্চ স্তরে পৌছেছে , এমন নয় যে আপনি ঐ পদের কারণে উচ্চস্তরে পৌছেছেন। খেলাফতই আপনার মুখাপেক্ষী হয়েছিল না আপনি তার পতি।৯০

আহমাদ ইবনে হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেছেনঃ একদিন আমার পিতার নিকট বসেছিলাম। কুফার অধিবাসী একদল লোক প্রবেশ করলো ও খলিফাদের খেলাফত সম্পর্কে আলোচনা করলো ; কিন্তু আলীর খেলাফত সম্পর্কে কথা-বার্তা একটু দীর্ঘায়িত হল। আমার পিতা মাথা উচু করে বললেনঃ তোমরা আর কত আলী ও তার খেলাফত (শাসনকর্তৃত্ব) সম্পর্কে আলোচনা করতে চাও! খেলাফত আলীকে সুশোভিত করেনি বরং আলীই খেলাফতকে সৌন্দ্রর্য্য দান করেছেন।৯১

১. ইয়াওমদুদার র হাদীস (প্রথম দাওয়াতের হাদীস)

রাসূল (সা.)-এর খেলাফত ও ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্বের বিষয়টি এমন কোন বিষয় ছিল না যে , রাসূল (সা.) তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটাকে (খেলাফত) অব্যক্ত রাখবেন আর ইসলামী সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্যকে ঐ ক্ষেত্রে স্পষ্ট করবেন না। রাসূল (সা.) যেদিন তার রেসালাতের দায়িত্বকে প্রকাশ্যে ঘোষণার নির্দেশ পেয়েছেন , সেদিনই তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন স্বীয় স্থলাভিষিক্তকেও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার।

পবিত্র কোরআনের এই আয়াত-

) و َأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ(

অর্থাৎ তোমার নিকটাত্মীয়গণকে সতর্ক করে দাও (সূরা আশ শুয়ারা)

যখন তিনি নবূয়্যতী দায়িত্ব গ্রহণের তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করলেন , আলীকে ডাকলেন ও বললেনঃ আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি আমার নিকটাত্মীয়দেরকে ইসলামের দাওয়াত দিই। তুমি কিছু খাবার তৈরী কর ও কিছু দুধ সংগ্রহ কর এবং আব্দুল মোত্তালিবের সন্তান্তানদেরকে দাওয়াত দাও যাতে আমি আমার দায়িত্বটি পালন করতে পারি। হযরত আলী (আ.) বলেছেনঃ আমি আব্দুল মোত্তালিব বংশের প্রায় চল্লিশজন গণ্য-মান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত করলাম ও যে খাবার তৈরী করেছিলাম সেটা সামনে রাখলাম। তারা সে খাবার খেল এবং দুধ পান করল ; কিন্তু খাবার ও দুধ ঠিক পূর্বের পরিমাণেই অবশিষ্ট রয়ে গেল। যখন রাসূল (সা.) তাদের সাথে কথা বলতে চাইলেন , আবু লাহাব বললঃ মুহাম্মদ তোমাদেরকে যাদু করেছে , একথা বলে অনুষ্ঠান ভেঙ্গে দিল। পরের দিন তিনি আবার নির্দেশ দিলেন তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার জন্যে এবং খাবার ও দুধ প্রস্তুত করার জন্যে। তাদের খাদ্য গ্রহণ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রাসূল (সা.) মুখ খুললেন ও বললেনঃ হে আব্দুল মোত্তালিবের সন্তানগন! আল্লাহর কসম ; এই আরবে আমি এমন কোন যুবককে দেখি নি যে , স্বীয় গোত্রের জন্য আমি যা এনেছি তার চেয়ে উত্তম কিছু নিয়ে এসেছে। আমি তোমাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নিয়ে এসেছি এবং আমার আল্লাহ বলেছেন যেন আমি তোমাদেরকে সেই পথে আহবান করি। তোমাদের মাঝে কে আছে যে , এই কাজের জন্য আমাকে সাহায্য করবে। আমি (আলী) সে সময় উপস্থিতদের মধ্যে সবার চেয়ে কম বয়সী (তরুন) ছিলাম বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে সাহায্য করব। তিনি আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেনঃ তোমাদের মধ্যে এ আমার ভাই , ওসী (দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি) ও খলিফা বা স্থলাভিষিক্ত তার কথা শোন ও তার আনুগত কর। তখন অনুষ্ঠানের সকলেরই উঠে দাড়ালো ও হাসতে হাসতে আবু তালিবকে বললঃ তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছে যে , তুমি তোমার ছেলে আলীর আনুগত কর। ৯২

অপর এক বর্ণনা মতে রাসূল (সা.) তিনবার এই প্রস্তাব পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকবার আলী (আ.) ব্যতীত অন্য কেউ তার প্রস্তাবে সম্মতি জানায় নি।৯৩

২. মানযিলাত র হাদীস (পদ মর্যাদার হাদীস)

অপর একটি হাদীস যেটা আলীর (আ.) খেলাফতের পক্ষে প্রমাণ বহন করে তা হচ্ছে মানযিলাতের হাদীস (পদ মর্যাদার হাদীস)। রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত হাদীসসমূহের মধ্যে মানযিলাতের হাদীস হচ্ছে রাসূল (সা.)-এর থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধতম হাদীসসমূহের অন্যতম এবং অনেক সাহাবীই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।৯৪ ইবনে আসাকির তার তারিখে দামেশক শীর্ষক গ্রন্থে ৩২ জন সাহাবী থেকে এ হাদীসটি সূত্র সহকারে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাধারা এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণসমূহ থেকে বোঝা যায় এই পবিত্র বাণীটি রাসূল (সা.) বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কয়েকবার ব্যক্ত করেছেন , কিন্তু প্রসিদ্ধতম স্থান হল তাবুকের যুদ্ধের সময়।

তাবুকের যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) স্বয়ং সৈন্যদের নেতৃত্বের দায়িত্বভার কাধে নিয়ে মদীনা হতে বের হলেন ও আলীকে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রাখলেন। এটিই একমাত্র যুদ্ধ ছিল যে যুদ্ধে আলী (আ.) রাসূলের (সা.) সাথে ছিলেন না , আর সে কারণেই তার জন্য মদীনায় থাকাটা একটু কঠিন হচ্ছিল। রাসূল (সা.) রণাঙ্গনের পথে যাত্রা শুরু করলেন। সৈন্যদল যখন যাত্রা শুরু করেছে ঠিক তখনই তিনি (আলী) রাসূল (সা.)-এর নিকট গিয়ে বললেনঃ আমাকে আপনি এই শিশু আর নারীদের সাথে মদীনায় রেখে যাচ্ছেন ?

তখন রাসূল (সা.) তার উত্তরে বললেনঃ

اما ترضی أن تکون منی بمنزلة هارون من موسی الا انه لا نبی بعدی

আমা তারজা আন তাকুনা মিন্নি বি মানযিলাতি হারুনা মিন মুসা ইল্লা আন্নাহু লা নাবীয়্যা বা দী। ৯৫

অর্থাৎ তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে , আমার সাথে তোমার সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমনটি মুসার সাথে হারুনের ছিল ? শুধু এতটুকু পার্থক্য যে আমার পরে আর নবী আসবে না। পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত মুসার (আ.) সাথে হযরত হারুনের (আ.) সম্পর্ক ছিল পাচঁ দিক থেকেঃ ১. ভাই , ২. নবুয়্যতের অংশীদার , ৩. উজীর ও সাথী , ৪. সাহায্যকারী ,৯৬ ৫. খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত।৯৭

সুতরাং হযরত আলীও (আ.) রাসূল (সা.)-এর সাথে এই পাচটি সম্পর্কের অধিকারী: কারণ তাকে ভাই হিসেবে নির্ধারণ করার পর বলেছেনঃ ইহকাল ও পরকালে তুমিই আমার ভাই ,৯৮ আল্লাহর বাণী পৌছানোর ক্ষেত্রে তার অংশীদার , যেমন বলেছেনঃ আমি এবং আলী ব্যতীত কেউ যেন আমার বাণী প্রচার না করে৯৯ তার উজীর কারণ , তিনি নিজে বলেছেনঃ আলী আমার উজীর।১০০ তার সাহায্যকারী যেমনঃ আল্লাহ তাকে আলীর (আ.) দ্বারা সাহায্য করেছেন ,১০১ ও তার খলিফাঃ কারণ , তিনি স্বয়ং তাকে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচন করেছেন।১০২

৩. উত্তরাধিকারের ও প্রতিনিধিত্বের হাদীস

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

لکل نبی وصیّ و وارث و إنّ علیا وصیی و وارثی

অর্থাৎ প্রত্যেক নবীরই ওসী বা প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী আছে আমার প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী হল আলী।১০৩

আরো বলেনঃ

أنّا نبی هذه الامة و علی وصیی فی عترتی و اهل بیتی و أمتی من بعدی

অর্থাৎ আমি এই উম্মতের (জাতির) নবী আর আলী হচ্ছে আমার পরে আমার পরিবারের ও উম্মতের মধ্যে আমার ওসী বা প্রতিনিধি।১০৪

তিনি বলেনঃ

علی أخی و وزیری و وارثی و وصیی و خلیفتی فی أمتی

অর্থাৎ আমার উম্মতের মধ্যে আলীই আমার ভাই , আমার সহযোগি উজীর , উত্তরাধিকারী , প্রতিনিধি ও আমার খলিফা।১০৫

এই হাদীসসমূহে ওসী (প্রতিনিধি) ও উত্তরাধিকারী এ দু টি শিরোনামকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ঐ দু টির প্রতকেটিই আমিরুল মু মিনীন আলীর (আ.) খেলাফতকেই প্রমাণ করে।

ওসী বা প্রতিনিধি

ওসী বা প্রতিনিধি তাকেই বলা হয় যিনি সমস্ত দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রে অসিয়তকারীর অনুরূপ অর্থাৎ যা কিছুর উপর অসিয়তকারীর অধিকার ও ক্ষমতা ছিল ওসীর বা প্রতিনিধিরও তার সবকিছুর উপর অধিকার ও ক্ষমতা রয়েছে এবং তা ব্যবহার করতে পারবেন ; শুধুমাত্র ঐ ক্ষেত্র ছাড়া যে ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্টভাবে তাকে অসিয়ত করবেন যে , এই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত তার ব্যবহারের অধিকার আছে।

এই হাদীসে রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) অসিয়তের ক্ষেত্রে দায়িত্বকে সীমিত করেন নি বরং তাকে নিঃশর্তভাবে ওসী বা প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন ; অর্থাৎ তিনি রাসূল (সা.)-এর সকল কাজের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন। অন্যভাবে বলা যায় , রাসূল (সা.)-এর অধীনে যা কিছু আছে তার সবকিছুতে আলীর (আ.) অধিকার আছে আর এটাই হচ্ছে খেলাফতের প্রকৃত অর্থ।

উত্তরাধিকারী

উত্তরাধিকারী শব্দটি শুনে প্রথম যে চিত্রটি মাথায় আসে তা হচ্ছে- উত্তরাধিকারী ব্যক্তি , উত্তরাধিকারী মনোনীতকারীর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয় ; কিন্তু আলী (আ.) শরীয়তের দৃষ্টিতে রাসূল (সা.)-এর সম্পদের উত্তরাধিকারী ছিলেন না। কেননা , ইমামিয়া ফিকাহ্ শাস্ত্রের আইন অনুযায়ী মৃতের যখন কোন সন্তান থাকে , তখন অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন সম্পদের উত্তরাধিকারী হয় না (সন্তানগণ সম্পদের প্রথম পর্যায়ের উত্তরাধিকারী , তারপর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন) আর আমরা জানি যে , রাসূল (সা.) তার জীবদ্দশায় সন্তান রেখে গিয়েছিলেন। ফাতিমা জাহরা (সালাঃ) তার (রাসূলের) ইন্তেকালের পরেও কমপক্ষে ৭৫ দিন জীবিত ছিলেন , তাছাড়াও রাসূল (সা.)-এর সহধর্মিনীগণ , যারা সম্পদের এক অষ্টাংশের অধিকারীনি ছিলেন , তারা সকলেরই জীবিত ছিলেন। যদি এ বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করি তবুও আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর চাচাতো ভাই আর চাচাতো ভাই তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে উত্তরাধিকার পায় এবং আমরা জানি রাসূল (সা.)-এর চাচা আব্বাস তার (সা.) মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন আর চাচা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্যায়ের উত্তরাধিকারী বা ওয়ারিশ।

কিন্তু আহলে সুন্নাতের ফিকাহশাস্ত্র অনুযায়ী , স্ত্রীগণকে তাদের অংশ (১/৮) দেওয়ার পর সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকেঃ সে অনুযায়ী তার এক অংশ পাবে হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.) যিনি রাসূল (সা.)-এর একমাত্র কন্যা ছিলেন। অপর অংশটি যেটা তার অংশের বাইরে , সেটা তার (সা.) চাচা আব্বাসের দিকে বর্তায়। সুতরাং , আমিরুল মু মিনীন হযরত আলী (আ.) কোনভাবেই রাসূল (সা.)-এর সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পারেন না। অপরদিকে যেহেতু রাসূল (সা.) সরাসরি তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন , তাই অবশ্যই এই হাদীসে এরস বা উত্তরাধিকারের বিষয়টি সম্পদ ভিন্ন অন্যকিছুকে বুঝায়। স্বাভাবিকভাবেই এই হাদীসে উত্তরাধিকারের বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর আধ্যাত্মিক ও সামাজিক মর্যাদার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং আলী (আ.) রাসূল (সা.)-এর জ্ঞান ও সুন্নাতের উত্তরাধিকারী আর সেই দলিলের ভিত্তিতেই তিনি তার (সা.) খলিফা বা প্রতিনিধি।

রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) বলেছেনঃ তুমি আমার ভাই ও উত্তরাধিকারী । আলী (আ.) বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার কাছ থেকে উত্তরাধিকারী হিসেবে কি পাব ? রাসূল (সা.) বললেনঃ ঐ সকল জিনিস যা আমার পূর্ববর্তী নবীগণ উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন। জিজ্ঞেস করলেনঃ তারাঁ কি জিনিস উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে গেছেন ? তিনি বললেনঃ আল্লাহর কিতাব ও নবীদের সুন্নাত। ১০৬ আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) নিজেও বলেছেনঃ আমি রাসূল (সা.)-এর জ্ঞানের উত্তরাধিকারী।১০৭

৪. মু মিনদের পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে আলী

রাসূল (সা.) যখনই এমন কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত করতেন যে , আলীর (আ.) সাথে যে কারণেই হোক দ্বন্দ সৃষ্টি করেছে বা যদি কেউ মূর্খতার বশে আলী (আ.) সম্পর্কে কেউ রাসূল (সা.)-এর নিকট অভিযোগ করতো , তিনি তাদেরকে বলতেনঃ

ما تریدون من علی إنّ علیا منّی و أنا منه و هو ولیّ کل مؤمن بعدی

অর্থাৎ আলীর সম্পর্কে তোমরা কি বলতে চাও সে আমা হতে আর আমি তার থেকে। আমার পরে আলীই প্রত্যেক মু মিনের ওয়ালী বা পৃষ্ঠপোষক (অভিভাবক)।১০৮

যদিও বাক্যে ব্যবহৃত ওয়ালী শব্দটির অনেকগুলো আভিধানিক অর্থ রয়েছে , তারপরেও এই হাদীসে নেতা , পৃষ্ঠপোষক বা অভিভাবক ব্যতীত অন্য কোন অর্থে ব্যবহার হয়নি ; এই হাদীসে আমার পরে শব্দটিই উক্ত মতকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কারণ , যদি ওয়ালী শব্দের উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব , বন্ধু , সাথী , প্রতিবেশী , একই শপথ গ্রহণকারী , এ ধরনের অর্থই হত তাহলে রাসূল (সা.)-এর পরে যে সময়ের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত করা হয়েছে তার দরকার ছিল না , কারণ তার (সা.) জীবদ্দশায়ই তিনি (আলী) ঐরূপ ছিলেন।

৫. রাসূল (সা.)-এর বাণীতে আলীর (আ.) পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্বকে মেনে নেওয়ার সুফলের কথা

যখনই সাহাবীগণ রাসূল (সা.)-এর পরে তার খলিফা বা প্রতিনিধি ও ইসলামী রাষ্ট্র নেতা সম্পর্কে তার (সা.) সাথে কথা বলতেন , তখনই তিনি (কোন কোন হাদীস অনুযায়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন) আলীর (আ.) পৃষ্ঠপোষকতা বা অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়ার সুফল সম্পর্কে বক্তব্য দিতেন।

তিনি বলতেনঃ

ان و لیتموها علیا وجدتموه هادیا مهدیا یسلک بکم علی الطریق المستقیم

অর্থাৎ যদি খেলাফতকে আলীর হাতে তুলে দাও , তাহলে দেখবে যে , হেদায়াত প্রাপ্ত ও হেদায়াতকারী হিসাবে সে তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করছে।১০৯

اما والذی نفسی بیده لئن اطاعوه لیدخلن الجنه اجمعین اکتعین

অর্থাৎ তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ আছে! যারা আলীর আনুগত্য করবে তারা সকলেই বেহেশতে প্রবেশ করবে।১১০

ان تستخلفوا علیا و لا اراکم فاعلین تجدوه هادیا مهدیا یحملکم علی المحجه البیضا

অর্থাৎ যদি তোমরা আলীকে খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নাও , তাহলে (আমার মনে হয় না তোমরা এমনটি করবে) দেখবে যে , সে সঠিক পথপ্রাপ্ত ও পথপ্রদর্শক , যে তোমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে।১১১

৬. আলী (আ.)-এর নির্ধারিত খেলাফত

ইতিপূর্বেও গাদীরের হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছি যে , আলীকে পরিচয় করানোর বিষয়টি আল্লাহর নির্দেশেই হয়েছিল ; এখন এমন একটি হাদীস তুলে ধরব যা ঐ বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করবে।

রাসূল (সা.) হতে বর্ণিত আছে যে , শবে মেরাজে (ঊর্ধ্বগমনের রাতে) যখন আমি নৈকট্যের প্রান্ত সীমাতে পৌছালাম ও আল্লাহর সম্মুখে দণ্ডায়মান হলাম , তিনি বললেনঃ হে মুহাম্মদ! আমি জবাব দিলামঃ লাব্বাইক (আমি হাজির)। তিনি বললেনঃ আপনি কি আমার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে , তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশী আমার অনুগত ?

আমি বললামঃ হে আল্লাহ তাদের মধ্যে আলীই সবচেয়ে বেশী অনুগত।

তিনি বললেনঃ আপনি সত্যই বলেছেন হে মুহাম্মদ! আপনি কি স্বীয় খলিফা বা প্রতিনিধি নির্ধারণ করেছেন যে আপনার পরে আপনার দায়িত্বগুলি পালন করবে ও আমার বান্দাদেরকে যারা কোরআন সম্পর্কে জানে না তাদেরকে শিক্ষা দিবে ?

আমি বললামঃ হে আল্লাহ! আপনি নিজেই আমার জন্য প্রতিনিধি নির্ধারণ করে দিন ।

বললেনঃ আমি আলীকে আপনার প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করলাম ; তাকে আপনি স্বীয় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করুন।১১২

একইভাবে তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য নবী নির্বাচন করেছেন ও প্রত্যেক নবীর জন্য নির্ধারণ করেছেন তার প্রতিনিধি। আমি হলাম এই জাতির নবী আর আলী হচ্ছে আমার ভারপ্রাপ্ত বা ওসী।১১৩

তৃতীয় অধ্যায়

বিদায় হজ্জের একটি বিবরণ

হিজরী দশম বছর সমস্ত আরব উপদ্বীপে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে। আরবের সকল গোত্রই মুসলিম আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল , রাসূল (সা.)-এর রেসালাতকে স্বীকার করে নিয়েছেন। মূর্তি ও মূর্তি পূজার কোন চিহ্নই তাদের কোন গোত্রের মাঝে দেখতে পাওয়া যায় না। রেসালাতের কর্ণধারের পরিশ্রম আজ ফলদায়ক হয়েছে এবং তার সুস্বাদু ফলকে উৎপাদনশীল করেছে। উপাস্যের সিংহাসন থেকে মূর্তি গুলোর পতন ঘটেছে ও পবিত্র বাণী লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বিস্তৃত আরব উপদ্বীপে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

মানুষের মধ্যে এখন পার্থক্যকে শুধুমাত্র তাদের আন্তরিক ঈমানের পর্যায় ও ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রবর্তিতার ভিত্তিতে। মহান রাসূল (সা.) -যিনি প্রায় 23টি (তেইশটি) বছর ধরে প্রচহু জুলুম-নির্যাতন সহ্য করেছেন ও এই দীর্ঘ সময়ে তিনি এক মূহুর্তের জন্যেও তার কর্তব্য ও রেসালাতের প্রচার কার্যে অবহেলা করেন নি- তিনি কখনোই দূর্বলতা অনুভব করেন নি , এখন তিনি বুঝতে পেরেছেন যে , অতিশীঘ্রই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে এবং মহান প্রভূর সাথে সাক্ষাত করতে হবে। তাই পূর্বের মতই নিরলশ চেষ্টা করতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মত দীস্থিমান হয় ও ইসলামী আইন-কানুন শিক্ষা লাভ করে। অতি সামান্যই ইসলামী বিধি-বিধান অবশিষ্ট আছে যা এখনও প্রচারের ও শিক্ষাদানের উপযুক্ত সময় আসেনি। ফরজ হজ্জ হচ্ছে তার একটি। তিনি তখনও সুযোগ পান নি যে , মুসলমানদেরকে নামাজের ন্যায় হজ্জের শিক্ষা দিবেন। তাই এখনই একমাত্র ও শেষ সময়।

সাধারণ ঘোষণা করা হল যে , রাসূল (সা.) হজ্জ করতে যাবেন। বিভিন্ন গোত্রের মানুষেরা মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন এবং তিনি (সা.) জিলক্বদ মাসের 6 দিন (ছয় দিন) অবশিষ্ট থাকতে বৃহস্পতিবার4 অথবা চার দিন অবশিষ্ট থাকতে শনিবারে , আবু দুজানাকে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত করে5 তাঁর সমস্ত স্ত্রীগণ ও পরিবারবর্গসহ সঙ্গীদের নিয়ে যাত্রা করলেন6 তিনি একশ টি উট7 কোরবানীর জন্য সাথে নিয়ে মদীনা হতে যাত্রা করেছিলেন।

ঐ সময় মদীনায় রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। যারফলে মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই এই বরকতময় সফর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।8 তারপরেও হাজার হাজার লোক রাসূল (সা.)-এর সহযাত্রী হয়েছিলেন। ঐতিহাসিকগণ তার সহযাত্রীর সংখ্যা চল্লিশ হাজার , সত্তর হাজার , নব্বই হাজার , একলক্ষ চৌদ্দ হাজার , একলক্ষ বিশ হাজার , একলক্ষ চব্বিশ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করেছেন।9 কিন্তু এগুলোর পাশাপাশি আরো বলা যেতে পারে যে , আসলে এত পরিমাণ জনগণ তার সহযাত্রী হয়েছিলেন যে , তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কারো সাধ্য ছিল না।10 তাও আবার তারা শুধু ঐ সকল ব্যক্তিই ছিলেন যারা মদীনা হতে এসেছিলেন। তবে হাজীদের সংখ্যা এর মধ্যেই সীমিত ছিল না। কেননা , মক্কার ও তার আশেপাশের অধিবাসীগণ এবং যারা ইয়েমেন থেকে আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.)-এর সাথে এসেছেন তারাও উক্ত হজ্জে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

রাসূল (সা.) গোসল করলেন ও পবিত্র দেহ মোবারকে তেল মালিশ করলেন , সুগন্ধি লাগালেন এবং চুলগেুলোকে চিরুণী দিয়ে আচড়ে পরিপাটি করলেন।11 অতঃপর মদীনা হতে বের হলেন। মদীনা হতে বের হওয়ার সময় তার শরীরে মাত্র দু টি কাপড় ছিল যার একটি ছিল কাধের উপর রাখা আর অপরটি ছিল কোমরে বাধা। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন , যখন জিল হুলাইফা তে পৌছালেন তখন ইহরাম বাধলেন।12 অতঃপর আবারও পূর্বের ন্যায় পথ চলতে শুরু করলেন এবং জিলহজ্জ মাসের চার তারিখ মঙ্গলবারে মক্কায় প্রবেশ করলেন। বনী শাইবা র ফটক দিয়ে মসজিদুল হারামে (কাবা ঘরে) প্রবেশ করলেন ,13 তাওয়াফ করলেন , তাওয়াফের নামাজ পড়লেন , সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করলেন এবং নিয়মানুযায়ী ওমরার কর্মাদি সম্পাদন করলেন।14 যারা নিজেদের সাথে কোরবানীর পশু নিয়ে আসেননি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন- তারা যেন চুল কেটে ইহরাম খুলে ফেলে।15 তিনি (সা.) যেহেতু কোরবানীর পশু নিয়ে এসেছিলেন তাই ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন যতক্ষন পর্যন্ত না মীনা তে কোরবানী করেন।16 আমিরুল মু মিনীন আলী (আ.) যেহেতু রাসূল (সা.)-এর হজ্জে যাওয়ার কথা ইতিপূর্বেই অবগত হয়েছিলেন তাই তিনিও ইয়েমেন থেকে 37টি (সাইত্রিশটি) কোরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছিলেন ও ইয়েমেনের অধিবাসীদের মিকাতে ঐ একই নিয়্যতেই , যে নিয়্যতে রাসূল (সা.) ইহরাম বেধেছিলেন , ইহরাম বাধলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ন্যায় সাফা ও মারওয়া সাঈ করার পর ইহরাম অবস্থায় রয়ে গেলেন।17

রাসূল (সা.) জিলহজ্জ মাসের 8ম (অষ্টম) দিনে মীনা হয়ে আরাফা র ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন যাতে হজ্জের অনুষ্ঠানাদি শুরু করতে পারেন। 9ম (নবম) দিনের সূর্য়যাদয় পর্যন্ত মীনা তেই ছিলেন। অতঃপর আরাফায় পৌছে স্বীয় তাবুতে অবস্থান নিলেন।

আরাফায় মুসলমানদের আড়ম্বরপূর্ণ জন সমাবেশে প্রাঞ্জল ভাষায় খুতবা পাঠ করলেন। তার এই খুতবাতে মুসলমানদেরকে ভ্রাতৃত্বের প্রতি ও পরস্পরের প্রতি সম্মানের কথা তুলে ধরলেন ; ইসলাম পূর্ব অন্ধকার যুগের সমস্ত আইন-কানুনকে বাতিল ঘোষণা করলেন এবং স্বীয় রেসালাতের সমাপ্তির কথাও ব্যক্ত করলেন।18 9ম (নবম) দিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করলেন। যখন সূর্য অস্তমিত হল ও অন্ধকার নেমে আসল তখন মুজদালাফা র উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।19 তিনি সেখানেই রাত্রি যাপন করার পর দশম দিনের প্রত্যুশে মীনা র দিকে যাত্রা শুরু করলেন। মীনা র নিয়ম কানুন পালনের মাধ্যমে হজ্জ শেষ করলেন এবং এভাবেই হজ্জের বিধি-নিষেধগুলি মুসলমানদেরকে শিক্ষা দিলেন।

এই হজ্জকে হাজ্জাতুল বিদা , হাজ্জাতুল ইসলাম , হাজ্জাতুল বালাগ , হাজ্জাতুল কামাল ও হাজ্জাতুত তামাম বলা হয়ে থাকে ।20 হজ্জের অনুষ্ঠান সমাপনীর পর তিনি মদীনার অভিমুখে যাত্রা করলেন। যখন রাগেব নামক স্থানে পৌছালেন , (যে স্থানটিকে গাদীরে খুম বলা হত) হযরত জিব্রাইল (আ.) অবতীর্ণ হলেন এবং তার নিকট ঐশীবাণী এভাবে পাঠ করলেন-21

) ي َا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ(

হে রাসূল! প্রচার করুন আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন , তাহলে আপনি তার রেসালাতের কিছুই পৌছালেন না। আল্লাহ আপনাকে (একদল) মানুষের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কাফিরদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।22

আল্লাহর এই বাণী এমন এক নির্দেশ যা রাসূল (সা.)-এর উপর গুরুদায়িত্ব হিসেবে অর্পন করা হয়েছে ; এমনই এক ঘোষণা যে , কেউ যেন এ সম্পর্কে অনবগত না থাকে , আর যদি তিনি এমনটা না করেন তাহলে যেন এমন যে , তিনি দ্বীনের কোন কাজই সম্পাদন করেননি। সুতরাং এই বাণী প্রচারের জন্য উক্ত স্থানই ও উক্ত সময়ই সর্বোত্তম ; যেখানে মিশর , ইরাক , মদীনা ও অন্যান্য সকল স্থানের অধিবাসীদের পরস্পরের পথ আলাদা হওয়ার স্থান। আর সকল হাজীগণ অনন্যোপায় হয়ে এই পথই পাড়ি দিয়ে থাকেন। গাদীরের খুম নামক স্থানটিই একমাত্র স্থান ছিল যেখানে এই গুরুত্বপূর্ণ বাণীটি সমস্ত হাজীদের কর্ণ কুহরে পৌছানো সম্ভবপর।

তাই সকলকে সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দেওয়া হল। তিনি বললেন অগ্রগামীদের ফিরে আসতে বল আর পশ্চাৎপদদের জন্য প্রতীক্ষা কর।23 হেজাজের উত্তপ্ত মরুতে জনগণের ঘটেছিল এক মহা সমাবেশ। দিনটিতে ছিল প্রচহু গরম ও এলাকাটির তাপ্রমাত্রাও ছিল অত্যন্ত বেশী ; এত গরম ছিল যে , সেখানকার পুরুষরা তাদের স্বীয় বস্ত্রের অর্ধাংশ দিয়েছিলেন মাথায় আর অর্ধাশ দিয়েছিলেন প্রায়র নীচে।24 সকলের মনে একই প্রশ্ন ছিল যে , কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ হয়ে দাড়িয়েছে যে , এরকম প্রচহু গরমের মধ্যে বা বাহ্যিক দিক থেকে অনুপোযুক্ত জায়গায় রাসূল (সা.) আমাদেরকে স্বস্থানে অবস্থানের নির্দেশ দিলেন ? তাপামাত্রা এত উচ্চ মাত্রায় পৌছেছিল যে , হাজীদেরকে অস্থির করে ফেলছিল।

তিনি নির্দেশ দিলেন- যেন বয়োবৃদ্ধদেরকে বৃক্ষতলে নিয়ে যাওয়া হয় আর উটের জিনগু্লোকে যেন একটার উপর অপরটা রেখ মঞ্চ বানানো হয়। সুউচ্চ মঞ্চ তৈরী করা হল। প্রায় দুপুরের সময় যখন হাজীগণ ঐ মরুভূমিতে একত্রিত হয়েছিল , তিনি মঞ্চে আরোহন করলেন এবং এভাবে একটি বক্তব্য প্রদান করলেনঃ

সকল প্রশংসা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য । আমরা তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি , তার প্রতি ঈমান আনয়ন করি , তার প্রতিই ভরসা করি এবং নাফসের তাড়না ও অসৎ আচরণের জন্য চাই তাঁর নিকট আশ্রয় ; তিনি এমনই প্রভূ যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন তার কোন পথপ্রদর্শক নেই আর যাকে তিনি পথ প্রদর্শন করেন তার কোন পথভ্রষ্টকারী নেই । আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , এক আল্লাহ ব্যতীত কোন প্রভূ নেই ও মুহাম্মদ তারই প্রেরিত বান্দা অতঃপরঃ

হে উপস্থিত জনতা ; সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা আমাকে অবগত করেছেন যে , কোন নবীই তার পূর্ববর্তী নবীর বয়সের অর্ধেকের বেশী বয়স ধরে জীবন যাপন করে নি এবং অচিরেই আমাকেও চিরস্থায়ী আবাসের দিকে আহবান করা হবে , আর আমিও তার আহবানে সাড়া দিব। এটা বাস্তব যে , আমাকে ও তোমাদের সবাইকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে। তখন তোমরা কি জবাব দিবে ?

সকলেই বললেনঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে , আপনি আল্লাহর বাণী আমাদের নিকট পৌছিয়েছেন ও উপদেশ দান করেছেন এবং চেষ্টা- প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি করেননি। আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরস্কার দান করবেন।

তিনি বললেনঃ তোমরা কি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছ যে , এক আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত বান্দা , তার প্রতিশ্রুত বেহেশত , দোযখ ও মৃত্যু সত্য এবং নিঃসন্দেহে পুনরুত্থান সংঘটিত হবে ও আল্লাহ তায়ালা সকল মৃত বক্তিদেরকে জীবিত করবেন ?

সকলেই বললেনঃ হ্যা , আমরা এ সকল বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছি।

তিনি বললেনঃ হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক। 25

অতঃপর বললেনঃ হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শুনতে পাচ্ছ ?

তারা বললেনঃ হ্যা।

তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের পূর্বেই হাউজে কাউসারে উপস্থিত হব আর তোমরা হাউজের পার্শ্বে আমার নিকট উপস্থিত হবে ; ঐ হাউজটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে সানআ হতে বুসরা র দৈর্ঘ্যের সমান এবং সেখানে রয়েছে রৌপ্য পানপাত্র ও এর সংখ্যা নক্ষত্রের সমান। এখন দেখতে চাই যে , আমার পরে তোমরা আমার এই দু টি মহামূল্যবান বস্তুর সাথে কেমন আচরণ কর।

উপস্থিত জনগণের মধ্য হতে একজন বলে উঠলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! ঐ দু টি মহা মূল্যবান বস্তু কি ?

তিনি বললেনঃ ঐ দু টি বস্তু হচ্ছে- একটি সবচেয়ে বড় যা আল্লাহর কিতাব (কোরআন)। যার এক প্রান্ত আল্লাহর হাতে এবং অপর প্রান্তটি তোমাদের হাতে ; তাই এটাকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরবে যাতে পথভ্রষ্ট না হও। আর অপরটি হচ্ছে- ইতরাত বা আমার নিকটাত্মীয়। মহান প্রজ্ঞাবান আল্লাহ তায়ালা আমাকে জানিয়েছেন যে , এ দু টি বস্তু কিয়ামতের দিনে হাউজে কাউসারে আমার নিকট না পৌছা পর্যন্ত একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না। আর আমিও আল্লাহর নিকট এটাই কামনা করেছিলাম। সুতরাং তোমরা তাদের অগ্রবর্তী হবে না , হলে ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পশ্চাতে পড়ে থাকবে না , তাহলেও ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর আলীর হাত ধরে উচু করলেন। আর এমনভাবে উচু করলেন যে , তাদের দু জনেরই শুভ্র বগল দেখা যাচ্ছিলো এবং সেখানকার সকলেই আলীকে চিনতে পারলো।

তখন তিনি বললেনঃ হে লোক সকল! মু মিনদের মধ্যে কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম এবং তাদের উপর প্রাধান্য রাখে ?

সকলেই বললোঃ আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।

তিনি বললেনঃ আল্লাহ আমার মাওলা ও অভিভাবক , আমি মু মিনদের মাওলা ও অভিভাবক। আর আমি মু মিনদের উপর তাদের চেয়ে প্রধান্য রাখি। সুতরাং আমি যাদের মাওলা ও অভিভাবক এই আলীও তাদের মাওলা ও অভিভাবক। 26

এই বাক্যটি তিনি তিনবার পুনরাবৃত্তি করলেন।

অতঃপর বললেনঃ হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাস যে আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে ;27 তুমি সহযোগিতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগিতা করে , তুমি তাকে নিঃসঙ্গ কর যে আলীকে নিঃসঙ্গ করে28 এবং সত্যকে সর্বদা আলীর সাথে রাখ সে (আলী) যে দিকেই থাক না কেন। 29

হে লোকসকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ তারা এই বাণীটি অবশ্যই অনুপস্থিতদের নিকট পৌছিয়ে দিবে।30

রাসূল (সা.)-এর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর জিব্রাইল (আ.) দ্বিতীয়বার অবতীর্ণ হলেন এবং তাকে এই বাণীটি পৌছে দিলেনঃ

) ال ْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا(

অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও নেয়ামত বা অনুগ্রহকে তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়িদা-3)31

রাসূল (সা.) এই আনন্দদায়ক বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর আনন্দিত হলেন এবং বললেন- আল্লাহ মহান! কেননা দ্বীন পরিপূর্ণ ও নেয়ামত বা অনুগ্রহ সম্পূর্ণ এবং মহান প্রভূ আমার রেসালাতের বা নবুয়্যতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন।32

অভিনন্দন অনুষ্ঠান

রাসূল (সা.) তার বক্তব্য শেষ করার পর মঞ্চ থেকে নেমে আসলেন ও একটি তাবুতে বসলেন এবং বললেনঃ আলীও যেন অপর এক তাবুতে বসে। অতঃপর নির্দেশ দিলেন , সকল সাহাবীগণ যেন আমিরুল মু মিনীনের সাক্ষাতে যায় এবং বেলায়াতের মর্যাদার জন্য তাকে অভিনন্দন জানায়।

ইতিহাস গ্রন্থ রওজাতুস সাফা এর লেখক গাদীরের ঘটনা উল্লেখ করার পর লিখেছেনঃ রাসূল (সা.) এর নির্দেশ অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট তাবুতে বসলেন। তারপর নির্দেশ দিলেন যেন পর্যায়ক্রমে সকলেই আলীর তাবুতে যায় ও তাকে অভিনন্দন জানায়। যখন সবাই এই কাজটি সম্পন্ন করলেন , উম্মাহাত (এর উদ্দেশ্য রাসূলের (সা.) স্ত্রীগণ অর্থাৎ উম্মাহাতুল মু মিনীন অর্থাৎ উম্মতের জননী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।) আলীর নিকট গেলেন এবং তাকে অভিনন্দন জানালেন।33

হাবিবুস সীয়ার নামক ইতিহাস গ্রন্থে গাদীরের হাদীস বর্ণনার পর এরূপে এসেছে যে , অতঃপর আমিরুল মু মিনীন আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহু অর্থাৎ মূর্তির সমীপে তার শির কখনো নত হয়নি) রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের ভিত্তিতে এক তাবুতে বসলেন যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাকে অভিবাদন জানাতে পারে , বিশেষ করে উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বেলায়াতের বা অভিভাবকত্বের কণর্ধারকে বললেন-

بخ بخ یا بنابی طالب اصبحت مولای و مولی کل مؤمن و مؤمنة

অর্থাৎ অভিনন্দন , অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মু মিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হলেন।34

তারপর উম্মাহাতুল মু মিনীন রাসূল (সা.)-এর ইঙ্গিতে আমিরুল মু মিনীনের তাবুতে গেলেন এবং তাকে অভিবাদন জানালেন। বিশিষ্ট শিয়া মুফাসসীর ও মুহাদ্দিস মরহুম তাবারসী তার ইলামুল ওয়ারা নামক গ্রন্থে ও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।35

সকল সাহাবীগণ আবার রাসূল (সা.)-এর হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করলেন এবং সেই সাথে আলী (আ.)-এর সাথেও বাইয়াত বা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলেন। সর্ব প্রথম যে ব্যক্তিবর্গ রাসূল (সা.)-এর ও আলী (আ.)-এর হাতে হাত রেখেছিলেন তারা ছিলেন আবু বকর , উমর , উসমান , তালহা ও জোবায়ের।36 ইতিপূর্বেও তুলে ধরেছি যে , অভিনন্দনের জন্য হযরত উমর যে বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেন , তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেনঃ অভিনন্দন , অভিনন্দন হে আবু তালিব নন্দন! আজ হতে আপনি আমার এবং সকল মু মিন পুরুষ ও নারীর মাওলা হলেন।37 আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ মুহাদ্দিস বা হাদীসবেত্তাগণ এই ঘটনাটি ঐ সকল সাহাবীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং উমরের কন্ঠে এই বাক্যটি শুনেছিলেন। যেমন- যারা এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে- ইবনে আব্বাস , আবু হোরায়রা , বুরাআ ইবনে আযিব , যায়েদ ইবনে আরকাম , সা আদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস , আবু সাঈদ খুদরী এবং আনাস ইবনে মালিকের নাম উল্লেখযোগ্য ।

আল্লামা আমিনী তার আল-গাদীর নামক গ্রন্থে 60 জন (ষাটজন) আহলে সুন্নাতের পণ্ডিতের নাম উল্লেখ করেছেন যারা স্বীয় গ্রন্থে উক্ত ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন।38 আবার অনেকেই এটাকে আবু বকরের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন।

যখন অভিনন্দন অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘটল তখন হাসসান্ বিন সাবিত নামক একজন কবি , যিনি স্বীয় যুগে সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন , তিনি বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি অনুমতি প্রার্থনা করছি যে , আপনার উপস্থিতিতে আলীর উদ্দেশ্যে কবিতার ক টি লাইন পাঠ করবো।

তিনি (রাসূল)বললেনঃ আল্লাহর নামে শুরু কর।

অতঃপর হাসসান্ উচু স্থানে উঠে পাঠ করতে লাগলেনঃ মুসলমানদের রাসূল (সা.) গাদীর দিবসে উচ্চস্বরে তাদেরকে ডাকলেন , কতটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে , আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এভাবে আহবান করছেন।

তিনি বললেনঃ তোমাদের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক এবং রাসূল কে ?

সেখানকার সকলেই নির্দ্বিধায় বললেনঃ আপনার আল্লাহ আমাদের অভিভাবক এবং আপনি আমাদের রাসূল ও আমাদের মধ্যে এমন একজনকেও পাবেন না , যে বেলায়াতের (কর্তৃত্বের) নির্দেশের ক্ষেত্রে আপনার অবাধ্য হবে ও বিরোধিতা করবে।

তখন আলীকে বললেনঃ হে আলী উঠে দাড়াও! কারণ , আমি তোমাকে আমার পরে ইমামত ও নেতৃত্বের জন্য নির্বাচন করেছি।

অতএব আমি যাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক , এই আলীও অনুরূপ তাদের নেতা ও পৃষ্ঠপোষক। সুতরাং তোমরা তার সঠিক অনুসারী হও এবং তাকে ভালবাস।

এবং সেখানে দোয়া করলেনঃ হে আল্লাহ! আলীর বন্ধু্কে তোমার বন্ধু মনে কর এবং যে আলীর সাথে শত্রুতা করবে তুমিও তার সাথে শত্রুতা কর।39

গাদীর দিবসে বেলায়াতের মুকুট পরানো

বাইয়াত বা অঙ্গীকার অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় তিন দিন সময় লেগেছিল।40 যেহেতু সবাই মহান খেলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে জেনে গেছেন ও রাসূল (সা.)-এর খলিফা বা প্রতিনিধিও নির্বাচন হয়ে গেছে এবং জনগণও তার সাথে পরিচিতি লাভ করেছেন ও তার হাতে বাইয়াত বা শপথ গ্রহণ করেছেন , তাই এখনই উপযুক্ত সময় হচ্ছে রাজ মুকুট পড়ানোর মত অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। রাসূল (সা.) আমিরুল মু মিনীন আলীকে (আ.) ডাকলেন ও স্বীয় পাগড়ীটি , যার নাম ছিল সাহাব তার মাথায় পরালেন এবং প্রান্তটি তার গ্রীবা পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে বললেনঃ

یا علی العمائم تیجان العرب

অর্থাৎ হে আলী! পাগড়ী হচ্ছে আরবদের মুকুট।41

অতঃপর তিনি তার সুন্নাতানুসারে পাগড়ী পড়ানো হয়েছে কি-না তা নিরীক্ষণ করার জন্য বললেনঃ আমার দিকে মুখ ফিরে দাড়াও। তিনি দাড়ালেন। তিনি বললেনঃ এবার ঘুরে দাড়াও। তিনি ঘুরে দাড়ালেন।42

এমতাবস্থায় সাহাবীদের দিকে মুখ ফিরে বললেনঃ যে সকল ফেরেশতা বদর ও হুনায়নের যুদ্ধের দিন আমাকে সাহায্য করতে এসেছিল তারা ঠিক এইভাবেই পাগড়ী পরেছিল।43

তিনি আরো বলেনঃ পাগড়ী হচ্ছে ইসলামের নিদর্শন।44 পাগড়ী এমনই চিহ্ন যা মুসলমানদেরকে মুশরিক হতে পৃথক করে।45 তিনি বলেছেনঃ ফেরেশতা ঠিক এরূপে আমার নিকট আসে।46

এভাবেই গাদীরের ঘটনার সমাপ্তি ঘটলো এবং হাজীগণ প্রত্যেকেই স্বীয় অঞ্চলের বা দেশের পথ ধরে সেখান থেকে জাজিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। তারা বেলায়াত বা শাসন কর্তৃত্বের হাদীসটি সমস্ত মুসলমানের কানে পৌছে দিয়েছেন।

এখন যেহেতু সংক্ষিপ্তাকারে গাদীরের বীরত্বগাথা ঘটনাটি সম্পর্কে আমরা জানলাম তারপরেও দু টি কথা উল্লেখ করা দরকারঃ

ক. ইতিহাসের দৃষ্টিতে গাদীরের ঘটনার সত্যতা ;

খ. গাদীর দিবসে প্রদত্ত রাসূল (সা.)-এর ভাষণের তাৎপর্য।


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13