শাফাআত

শাফাআত37%

শাফাআত লেখক:
: মোঃ সামিউল হক
প্রকাশক: খেদমতে ইসলামী সংস্থা, কোম, ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শাফাআত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15181 / ডাউনলোড: 4138
সাইজ সাইজ সাইজ
শাফাআত

শাফাআত

লেখক:
প্রকাশক: খেদমতে ইসলামী সংস্থা, কোম, ইরান
বাংলা

যে বইটি বর্তমানে আপনাদের হাতে আছে তা একজন তাকওয়া সম্পন্ন বিশিষ্ট লেখকের সুদীর্ঘ কষ্টের ফসল। যা তিনি বিবেক সম্মত দলিল ও যুক্তি দিয়ে লিখেছেন। এই বইটি ব্যবহারের মাধ্যমে সত্যের পথ খুজে পাওয়ার অধিকার আপনাদের রয়েছে। তবে এই বইতে যে সকল দলিল ব্যবহার করা হয়েছে তা অতি উচ্চমানের এবং অধিক গ্রহণযোগ্য। সর্বোপরি এই বইতে উল্লেখিত প্রতিটি দলিলই হচ্ছে বিবেক সম্মত এবং যা কিছু তার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে তাতে আল্লাহ রাব্বুল আ লামিনেরও সহানুভতি থাকে।

শাফাআত

লেখক:

উস্তাদ সাইয়েদ মোহাম্মদ কাজাভী

অনুবাদ:

মোঃ সামিউল হক

পরম করুনাময় ও দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি

শাফাআত

লেখক : উস্তাদ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ কাজাভী

অনুবাদ : মোঃ সামিউল হক

সম্পাদনা : মির আশরাফ-উল-আলম

প্রথম প্রকাশ

তারিখ: ২০০৫

প্রকাশক : খেদমতে ইসলামী সংস্থা , কোম , ইরান

প্রকাশক কর্তৃক সর্ব সত্ত সংরক্ষিত

ভূমিকা

আল্লাহ রাব্বুল আ লামিনের প্রতি অশেষ শুকরিয়া যে , তিনি মানুষকে বিবেক দানের মাধ্যমে অন্যান্য পশু থেকে আলাদা করেছেন। বিবেক হচ্ছে এমন এক ঐশী সম্পদ যার গুরুত্ব পরিমাপ করা সম্ভব নয়। আর মানুষ এই বিবেকের মাধ্যমেই সত্য অনুসন্ধান করতে পেরেছে এবং অসত্য বা ভুল পথকে নির্দিষ্ট করতে।

প্রকৃত পক্ষে কাল কেয়ামতের দিনেও এই বিবেক দিয়েই হিসাব-নিকাশ করা হবে। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আ লামিন ভাল থেকে মন্দ আর নেকি থেকে ত্রুটিকে আলাদা করার জন্যেই মানুষের মাঝে তা দিয়েছেন। আর এই বিবেকই হচ্ছে সে দিনের ঐ সমস্ত কিছুর ব্যাপারে দায়িত্বশীল।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে , দ্বীন ইসলাম অন্যান্য দ্বীনের বিপরীতে পরিপূর্ণ একটি দ্বীন ও ধর্ম হওয়া সত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি তা অন্যান্য দ্বীনের মতই দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই মুসলমানগণ দুর্বল হয়ে পড়ছেন। এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে একটাই আর তা হল , হাদীসে সাকালাইনের প্রতি দৃষ্টি না দেয়া। যে হাদীসটি অতি প্রসিদ্ধ ও মুতাওয়াতির সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে আমাদের কাছে এসে পৌছেছে। তাই যে কেউ এই হাদীসটির মাধ্যমে সত্য পথের ঠিকানা খুজবে , আল্লাহ রাব্বুল আ লামিন তাকে গোমরাহী থেকে রক্ষা করবেন। আর এর বিপরীতে যে কেউ এই হাদীসটির সাথে বিরোধিতা করবে বা ইজতিহাদ করবে অথবা নফসকে তার বিপরীতে স্থান দিবে তারা গোমরাহ্ হয়ে যাবে।

যে বইটি বর্তমানে আপনাদের হাতে আছে তা একজন তাকওয়া সম্পন্ন বিশিষ্ট লেখকের সুদীর্ঘ কষ্টের ফসল। যা তিনি বিবেক সম্মত দলিল ও যুক্তি দিয়ে লিখেছেন। এই বইটি ব্যবহারের মাধ্যমে সত্যের পথ খুজে পাওয়ার অধিকার আপনাদের রয়েছে। তবে এই বইতে যে সকল দলিল ব্যবহার করা হয়েছে তা অতি উচ্চমানের এবং অধিক গ্রহণযোগ্য। সর্বোপরি এই বইতে উল্লেখিত প্রতিটি দলিলই হচ্ছে বিবেক সম্মত এবং যা কিছু তার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে তাতে আল্লাহ রাব্বুল আ লামিনেরও সহানুভতি থাকে।

মুখবন্ধ

ইসলাম ধর্মের আকিদা বিশ্বাসের মধ্যে যে বিষয়টি সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মতামত পেশ করা হয়েছে এবং যার ফলে ইসলামের মূল ভাব ধারা থেকে তার অর্থ বিচ্যুত হয়েছে তা হল শাফাআত। অথচ যদি এই বিষয়টি ইসলাম ধর্মের মূল উৎস সমূহ হতে গ্রহণ করা যায় এবং সত্যিকার অর্থ অনুধাবন করা হয় তাহলে এটা একটা উজ্জল ও স্পষ্ট বিষয়ে পরিনত হবে যা সকলের জন্যই গ্রহন যোগ্য বিষয়ে বিবেচিত হবে। স্পষ্ট ধারনা না থাকার কারণে শাফাআত আমাদের মাঝে বিকৃত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আর তাই শাফাআতের বিষয়টিকে কুফর , গুনাহ ও ইত্যাদি বলেও অভিহিত করা হয়।

বিশ্বের অন্যান্য ভাষাভাষী ভাই বোনদের মত বাংলা ভাষাভাষী ভাই বোনদের মাঝেও এ বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনার অভাব পরিলক্ষ্যিত করেছি। এ বইটি বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী ভাই বোনদের উক্ত অভাব পূরণ করবে বলে আমার বিশ্বাস। শুধু তাই নয় এই বইটি মনযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে দুনিয়া ও আখেরাতের অসংখ্য মুসিবত থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব হবে। মূলতঃ শাফাআতের মূল বিষয়ে কোন দ্বিধা দন্দ নেই। ইসলামের সকল মাযহাবের অনুশারিগণই শাফাআতের মূল বিষয়ে একমত। যে বিষয় নিয়ে অনৈক্য পরিলক্ষিত হয় তা শুধুমাত্র শাফাআতকারীগণদের দৃষ্টান্ত , উপমা এবং খুটিনাটি ও আনুসাঙ্গিক বিষয় সমূহ।

বইটি মূলতঃ একটি ফারসী বই থেকে অনূদিত ; অন্যক ব্যস্ততার মাঝে এই গুরুদায়িত্বটি পালন করতে সক্ষম হয়েছি , ভুল ভ্রান্তি থাকাই স্বাভাবিক , আর এজন্য অধম বান্দার প্রতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি রাখার জন্য পাঠকবৃন্দের প্রতি অনুরোধ রাখছি। অধিকন্তু যদি কেহ সংশোধনিতে মতামত জানিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে থাকেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো এবং পরবর্তী সংষ্করণে তা সংশোধন করার ওয়াদা দিচ্ছি।

বইটি প্রকাশে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন , ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সলেশন এণ্ড রিসার্চ সেন্টার ইমাম আলী (আঃ) ফাউণ্ডেশন। আশা করছি ভবিষ্যতেও বাংলাভাষা ভাষী ভাইবোনদের প্রয়োজনীয়তা পূরণে নতুন নতুন বই প্রকাশে সহযোগিতা করবে। কেয়ামতের সেই মহা মুসীবতের সময় আল্লাহ তালা আমাদের জন্য তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লাম) কে সেই মাকামে মাহমুদে অধিষ্টিত করুক এবং আমাদেরকে তার শাফাআত নসীব করুক , আমিন।

মোহাম্মদ সামিউল হক

প্রথম অধ্যায়

শাফাআতের আভিধানিক অর্থ ও পারিভাষিক অর্থ

শাফাআতের প্রভাব ও কারণ সমূহ

আমলের প্রতিচ্ছবি ও শাফাআত

পাপ মোচনের জন্য শাফাআত

শাফাআতের আভিধানিক অর্থ

শাফাআত আরবী শব্দشفع থেকে নেয়া হয়েছে এর অর্থ হল একই প্রকার কোন বস্তুর সাথে অনুরূপ বস্তুর সংযোজন। এবং এই সংযোজনের উদ্দেশ্য হল সাহায্য করা। আর এজন্য অবশ্যই দ্বিতীয় বস্তুটির আবেদন থাকা বাঞ্চনীয়। আর তাই সাধারনত ঊর্দ্ধতন মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তি নিম্নস্তরের ব্যক্তির জন্য শাফাআত করে থাকে।

شفع বিপরীত শব্দ হলوتر অর্থাৎ একক। আর একটি বস্তুর সাথে অনুরূপ আরেকটি বস্তুর সংযোজন কে সহপাটি , জোড়া শাফা বলা হয়।

ইবনে ফারেস বলেন: যে ব্যক্তি শাফাআতের জন্য উদ্দোগী হয় , তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিজস্ব শক্তি সামর্থ যথেষ্ট নয় ; আর তাই অন্য এক ঊর্দ্ধতম শক্তির সাথে নিজের বন্ধন সৃষ্টি করে এবং নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিল করে।

المشفَّع শব্দের অর্থ হল ; যে ব্যক্তি শাফাআত করলে আল্লাহর দরবারে কবুল হয় , যেমন নবী , রাসূল ও ইমাম (আঃ) গণ।

المشفِّع শব্দের অর্থ হল ; যিনি শাফাআত কবুল করেন এবং তিনি হলেন একমাত্র উপাস্য আল্লাহ তালা।شفیع শব্দের অর্থ হল ; যে ব্যক্তি শাফাআত করে থাকে (এটা সেফাতে মোশাব্বেহা যার অর্থ হবে এসমে ফায়েল)।

شفعاء শব্দটিشفیع শব্দের বহুবচন।

শাফাআতের পারিভাষিক সংজ্ঞা

ইবনে আসির বলেন: শাফাআত হল অতীতের গুনাহ খাতা ও ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করার জন্য আবেদন।

ভূতপূর্ব আলেমগণ শাফাআতের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করেছেন , এ ব্যাপারে কোন রকম গবেষণা চালাননি। আর পরবর্তী আলেমগনের বিশ্বাস হল: শাফাআত এক প্রকার দোয়া যা আল্লাহ তালা কবুল করে থাকেন।

আমাদের মতে , শাফাআত হল কোন বস্তু বা ব্যক্তি অন্য কোন গুনাহগার ব্যক্তির গুনাহ খাতা মাফ করানোর জন্য কিয়ামতের দিনে ওসিলা হওয়া।

আর এর ব্যাখ্যা হল: কোন ব্যক্তি যখন তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিজেকে দুর্বল মনে করে। তখন নিজের প্রচেষ্টার সাথে সাথে অন্য এমন এক ব্যক্তির সহযোগিতা কামনা করে যার সেরূপ যোগ্যতা রয়েছে। আর তাই এমন এক ব্যক্তির শাফাআত কামনা করে যিনি আল্লাহ তালার কাছে অতি সম্মানিত এবং যার শাফাআত আল্লাহ তালা কবুল করে থাকেন।

শাফাআতের প্রকারভেদ

প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই শাফাআত সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন প্রকার শাফাআতের ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে তাই এ বিষয় স্পষ্ট করার জন্য আমরা পথেমে নানাবিধ শাফাআতের ব্যাখ্যা তুলে ধরবো , অতঃপর শাফাআতের সঠিক ধারণাটি পরিষ্কার করে তুলব।

১। বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় শাফাআত

বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় শাফাআতের প্রভাব রয়েছে।

আল্লামা তাবাতাবাই (রহঃ) এর মতে , শাফাআত নিজেই একটি কারণ এবং শাফাআত প্রার্থী ব্যক্তি ক্ষমা পাওয়ার জন্য নিকটতম উসিলা হিসেবে শাফাআতকারীর আশ্রয় নিয়ে থাকে ; এবং অন্যান্য উসিলা সমূহের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেটিই গ্রহন করে। এ বিষয়টিই শাফাআতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

তবে আমরা শাফাআত সম্পর্কে এমন ধারণা পোষন করি যে , আল্লাহ তালা দুই ভাবে শাফাআত কবুল করে থাকেন প্রথমত বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিষয় ও দ্বিতীয়ত শরিয়তি বিষয়।

প্রথম মতে , আল্লাহ তালা সর্ব প্রকার কার্য কারণ সমূহের উৎস এবং অন্য সব কারণ সমূহ অবশেষে তার কাছেই সমাস্থি লাভ করে। পবিত্র কোরআন শরিফও এ বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করেছে উদাহরণস্বরূপ:

) إ ِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ(

তোমাদের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ তা লা আসমান ও জমিনকে সাতদিনে সৃষ্টি করেছেন । অতঃপর আরশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং সৃষ্টির ধারাবাহিকতা আনয়ন করলেন । তার অনুমতি ছাড়া কেহই উসিলা হতে পারবেনা (শাফাআত করতে পারে না)।

যদিও এ আয়াতটি আসমান ও জমিনের সৃষ্টির প্রতি নির্দেশ করে তবে আমাদের লক্ষ্যনীয় বিষয়টি হলيُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ এবং তা শাফাআতের মাধ্যমে বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে এবং এটাই সত্যিকার কারণ ও উসিলা হিসেবে গন্য হবে ।

আমাদের মতে , বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় শাফাআতের আভিধানিক অর্থ হল ক্ষমা প্রাস্থির কারণ সমূহের উসিলা ।

২ । শরিয়তি শাফাআত

এর অর্থ হল যা বাস্তব জীবনের দায়িত্ব কর্তব্যের ক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য । আল্লামা তাবাতাবাই এ বিষয় সম্পর্কে বলেন: শাফায়াত কিছু সংখ্যক মানুষ ও ফেরেশতার জন্য নির্ধারিত তবে এজন্য আল্লাহর অনুমতি অত্যাবশ্যকীয় এবং আল্লাহর অনুমতিই শাফাআতের পরিপূর্ণতা দেয় । অর্থাৎ আল্লাহ তালঅ তার অনুমতি দিয়ে তার কিছু সংখ্যক বান্দাকে কবুল করে নেন , কারণ সমস্ত রাজত্ব ও কর্তৃত্ব তারই জন্য ।

অতএব আল্লাহ তালা তার সেসব বান্দাগণকে এই পদমর্যাদা দান করেছেন তারা আল্লাহ তালার রহমত , ক্ষমা , মাগফেরাত ও অন্যান্য গুনাহবলীর উসিলা ধরে কিছু সংখ্যক গুনাহগার ব্যক্তিকে তার সাথে সংযুক্ত করে এবং যে সকল আযাব ঐ সকল ব্যক্তির প্রাপ্য ছিল তা থেকে ফিরিয়ে আনে । এভাবে যে সকল ব্যক্তি আযাব থেকে মুক্তি পায় ও আযাব ভোগ করতে হয়না । তাই শাফাআতের বিষয়টি আল্লাহর রাজত্ব ও কর্তৃত্বের শামিল এটা আল্লাহর রাজত্বের বিপরীত কোন বিষয় নয় । আর এ বিষয়টি আল্লাহর বানী দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় ।

) ف َأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ(

আল্লাহ তালা উক্ত ব্যক্তিদের গুনাহ খাতাকে সওয়াবে পরিবর্তন করেন।

মূলত আল্লাহ তালা যা ইচ্ছা করেন তাই করে থাকেন ও যেকোন আদেশ বলবত করে থাকেন।

শাফাআত সম্পর্কে আল্লামা তাবাতাবাঈর উক্ত ব্যাখ্যা শাফাআত ও দোয়া করা একই শ্রেনীভূক্ত আমাদের কাছে গ্রহন যোগ্য।

শর্ত সাপেক্ষে দোয়া করলে ক্ষতির সম্ভাবনা ব্যহত করে আল্লাহ তালা তার বান্দার প্রতি কল্যান বর্ষণ করেন। এ রকম ভাবে দোয়া করাই শাফাআতের আভিধানিক অর্থ। আর শাফাআতকারী পাপী বান্দার ক্ষমার কারণ হয়ে থাকে।

৩। আমলের শাফাআত

এই প্রকার শাফাআতের ব্যাখ্যায় বলতে হয়:

মানুষ ও তার আমলের মাঝে এ দুনিয়ায় এক ধরনের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং এই সম্পর্ক কেয়ামতের দিনও বলবৎ থাকবে অর্থাৎ সেদিন এই আমল ভাষ্কর্য (প্রতিকৃতি) হয়ে উঠবে।

এ প্রসঙ্গে কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে তার কিছু সংখ্যকের প্রতি দৃষ্টিপাত করা শ্রেয় মনে করছি।

) ي َوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ(

মোফাসসেররগণ এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন: কেয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে তার নেতার সাথে পুনরুত্থান করা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে , কেয়ামতের দিন ফেরাউন তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে কারণ সে দুনিয়াতেও তাদের নেতা ছিল। নিম্নলিখিত আয়াত এ বিষয়ের সাক্ষ প্রদান করে।১০

) ي َقْدُمُ قَوْمَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَوْرَدَهُمُ النَّارَ(

ফেরাউন কেয়ামতের দিন তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামের আগুন নিক্ষেপ করবে।১১

এখানে আরবী শব্দأَوْرَد - এর প্রতি মনোযোগ দিলে বুঝা যাবে যে , যে ফেরাউন তার গোত্রের জন্য গোমরাহির কারণ হয়ে ছিল সেই আবার কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। ফলাফল এই দাড়ায় যে , যেভাবে সে দুনিয়াতে তাদের অপকর্মের কারণ হয়েছিল কেয়ামতের দিনও সেভাবে জাহান্নামের কারণ হবে।

আমলের প্রতিকৃতি (ভাষ্কর্য) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক হাদীসও বর্ণিত আছে। উদাহরণ স্বরূপ সে সব হাদীস নামাজ পড়া , রোজা রাখা ও কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য ভাষ্কর্য হয়ে দাড়াবে ও তার জন্য শাফাআত করবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন , কেয়ামতের দিন কোরআন ও রোজা মানুষের জন্য শাফাআত করবে। রোজা বলবে , হে পরওয়ারদেগার! তার জন্য শাফাআত করার অনুমতি দাও , কারণ আমি ওকে সারাদিনভর খাওয়া ও পানাহার থেকে বিরত রেখেছি এবং কামভাব ও আকাংখ্যা থেকে বিরত রেখেছি। কোরআন বলবে , হে আল্লাহ! তার জন্য শাফাআত করার তৌফিক দাও , কারণ আমি তাকে রাতে ঘুমাতে দেইনি । তখন রোজা ও কোরআন শাফাআত করবে এবং আল্লাহ তালা তাদের শাফাআত কবুল করবেন।১২

আহলে সুন্নাতের বড় এক আলেম শেখ তানতাভি শাফাআত সম্পর্কে বলেন , জেনে নাও , (উদাহরণস্বরূপ) , শাফাআতের বীজ , গাছ ও ফল রয়েছে। আর এগুলো হল কেয়ামতের দিনের নাযাত (আযাব থেকে মুক্তি) পাওয়ার উসিলা। আল্লাহর নবী রাসূল (আঃ) গণ মানুষকে শরিয়তের আহকাম শিক্ষা দিয়ে বীজ বপন করেন। আর মানুষ যদি সে অনুপাতে আমল করে তাহলে ফল লাভের যোগ্যতা অর্জন করে এবং কেয়ামতের দিন সেই ফল (আযাব থেকে মুক্তি) লাভ করে থাকবে। অতএব শাফাআতের শুরু হল শাফাআত সম্পর্কিত জ্ঞান , অতঃপর আমল ও সবশেষে সফলতা ও বেহেশতের উর্ধ্বতম মর্যাদা হল তার ফলাফল।১৩

আমাদের মতে , আমলের শাফাআত শাফাআতের এক রকম আভিধানিক অর্থ। আর শাফাআতের পারিভাষিক অর্থ অন্য রকম।

শাফাআত: পাপ মোচন অথবা অনুগ্রহ

এ ধরনের শাফাআতে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যস্থতায় গুনাহের ক্ষমা এবং সে ক্ষেত্রে না দেখার ভাব করার শামিল। একে পাপ মোচন অথবা অনুগ্রহ মূলক শাফাআতও বলা হয়ে থাকে। এর কারণ হল , আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যস্থতায় গুনাহগার বান্দাদের জন্য ক্ষমা অথবা অনুগ্রহ হয়ে থাকে। অর্থাৎ আল্লাহ তালা তার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের উসিলায় তার অনুগ্রহ ও রহমত পাপী বান্দাদের (যারা আযাবের উপযোগী ছিল) উপর বর্ষণ করে থাকেন।

এর ব্যাখ্যায় বলতে হয় , আল্লাহ তালা অকল্পনীয় রহমতের মালিক। পবিত্র কোরআনের আয়াত সমূহও এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে কোরআনে এভাবে বলা হয়েছে , হে পরওয়ার দেগার তোমার অসীম জ্ঞান ও রহমত বিশ্ব জাহানকে ছেয়ে ফেলেছে।১৪

আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের উসিলায় পাপী বান্দাদের জন্য শাফাআত করা এক রকমের খোদায়ী রহমত বর্ষনের উপায়। তবে এর পেছনে সুক্ষ কারণ ও কারক নিহিত রয়েছে। আর আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাগণ সে সব পাপী ব্যক্তিদের শাফাআত করতে পারেন যারা শাফাআত পাওয়ার উপযোগী। এর অন্যমত একটা কারণ হল আল্লাহর রহমত।

উল্লেখিত তিন প্রকার শাফাআতের মধ্যে কোনটি পারিভাষিক শাফাআত বলে গন্য ?

উপরোক্ত আলোচনার পর বলা যেতে পারে যে , ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং কোরআন নাযিলের সময়ে আরব জাতি শাফাআত সম্পর্কে যে ধারনা রাখতো তা হল , অনুগ্রহ মূলকঃ শাফাআত ও পাপমোচন যা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের মধ্যস্থতায় হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনের শাফাআত সম্পর্কিত আয়াত সমূহ (যেগুলো কেয়ামত দিবসের ইঙ্গিত বহন করে) ঠিক একই প্রকার শাফাআত আর এই আলোচনা থেকে বুঝা যায় যে ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেও মানুষের মাঝে শাফাআত সম্পর্কিত ধারণা ছিল। এবং পবিত্র কোরআনের শাফাআত সম্পর্কিত আয়াত সমূহও যেগুলো হয় শাফাআত কে সত্যায়িত করেছে অথবা পত্যাক্ষান করেছে) ঠিক একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যে ধারনা পূর্ববর্তী মানুষের মাঝে বলবত ছিল এবং কিছু কিছু আয়াত সমুহ শাফাআতের শর্ত ও সীমানা নির্ধারণ করেছে।

মূলতঃ সংক্ষিপ্তভাবে বলা যেতে পারে যে , শাফাআতের অর্থ হল সুপারিশকারীর উসিলায় পাপমোচন। ভূতপূর্ব মোফাসসের ফখরুদ্দীন রাযী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লাম এর মাকামে মাহমুদ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন , আহলে সুন্নতের মতে: পাপ মোচনের জন্য শাফাআত করা হয়ে থাকে। তিনি তার আলোচনায় বলেন যে , আজাব থেকে মুক্তির জন্য মানুষের প্রচেষ্টা উচ্চ মর্যাদা লাভের চেষ্টা ও ভাল কাজের প্রচেষ্টা চেয়ে শ্রেয়তর। কারণ মানুষ যদি পাপ মোচনের চেষ্টা না করে সফলতা ও কল্যাণ লাভের চেষ্টা করে থাকে তাহলে তাতে তার কোন লাভ হবে না সেই পাপের কারণে তাকেতো জাহান্নামে যেতে হবে।

عسی أن یبعثک ربّک مقاما محمودا

অর্থ: অতি শীঘ্রই আপনাকে মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করবেন। এই আয়াতের উদ্দেশ্য হল শাস্তি থেকে পরিত্রাণ।

আমাদের মতে শাফাআতের পারিভাষিক অর্থ হল ,কেয়ামতের দিন (আল্লাহ নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের উসিলায়) পাপমোচন। পবিত্র মাসুমিন (আঃ) দের থেকে বর্ণিত হাদীস সমূহেও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায় : শাফাআতের দলিল প্রমাণ

১। কোরআনের আয়াত সমূহ

২। হাদীস সমূহ

৩। এজমা

৪। আক্বল (বিবেক)

কার্যকারণ

নিঃসন্দেহে বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তুই অপর কোন সত্তার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কথায় প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ রয়েছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ ,আমরা যদি আমাদের বাড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে প্রত্যক্ষ করবো সুপরিকল্পিত সুন্দর একটি গৃহ। তখন যদি বলি এত সুন্দর একটি গৃহ নির্মাণের পেছনে কেউ কাজ করেনি ,এমনিতেই আপন সত্তার বলে নির্মিত হয়েছে তা হলে আমাদের বিবেক-বুদ্ধির ব্যাপারে কেউ সন্দেহ করলে কি অমুলক কিছু হবে ? আমাদের গৃহের যে কোন আসবাপত্রের কথাই ধরুন। গৃহাভ্যন্তরে সজ্জিত সুন্দর একখানা দেয়াল ঘড়ি ,আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরী সোফা ইত্যাদির ব্যাপারে যদি কেউ বলে এত সব সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র স্বীয় সত্তা বলে ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত হয়েছে তাহলে আপনি তাকে নির্বোধ ,বোকা ও বুদ্ধিহীন বললে কি কোন অন্যায় করবেন ? সব বুদ্ধিমান ব্যক্তিই স্বীকার করবেন যে এ সব প্রতিটি বস্তুর জন্যে নিশ্চয়ই একজন প্রস্তুতকারক রয়েছেন। কেননা কোন কিছুই স্বীয় সত্তায় সৃষ্টি হয়নি। এ সৃষ্টিজগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে নিঃসন্দেহে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হবো যে ,এতসব সুন্দর ,মনোরম ,নিখুত ও শৈল্পিক সৃষ্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়ে যায় নি বরং এ সকল সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ রয়েছে। এ জগতের পরমাণু থেকে বৃহৎ সৃষ্টি পর্যন্ত প্রতিটি সৃষ্টিই নিখুত এবং চমকপ্রদ। যদি কোথাও আমরা একটা সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর ছবি প্রত্যক্ষ করি তা হলে আমাদের বিবেক ,জ্ঞান ও অবচেতন মন নিঃসন্দেহে একজন ছবি অংকনকারীর কথা ব্যক্ত করতে বাধ্য হবে। আর সে ছবি ও চিত্র যদি আপনার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় ও মনোহরিণী আকার ধারণ করে তা হলে নিশ্চয়ই আপনি বলবেন এর স্রষ্টাও একজন সূরুচিসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শিল্পী না হয়ে পারেন না। আপনি যখন একটা সুন্দর গ্রন্থ অবলোকন করেন তখন কি এ পুস্তকের কোন গ্রন্থকার নেই কথাটি ব্যক্ত করেন ? নিশ্চয়ই না। কেননা কোন অস্তিত্বশীল সত্তার জন্যে প্রস্তুতকারকের অস্তিত্বহীনতার ধারণা পাগলের প্রলাপ মাত্র।

এ বিশ্বজগতে প্রতিটি সৃষ্টিই সুন্দর ও আকর্ষণীয়। বিস্তীর্ণ মহাকাশ সুপ্রশস্ত ভূ-পৃষ্ঠ ,সুবিশাল নদ-নদী ,পাহাড়-পর্বত ,বিশাল গ্রহরাজী ও নক্ষত্র মন্ডলী ,বিষ্ময়কর জীব-জন্তু ,মনোরম বৃক্ষরাজী-বনভূমী ও সুন্দর তরুলতা সব কিছুই একটা নির্দিষ্ট কার্যকারণের মাধ্যমে সত্তাশীল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শহীদ ডঃ জাভেদ বাহোনারের বক্তব্য প্রানিধান যোগ্য। তিনি বলেছেন ,কার্যকারণ সন্বন্ধীয় বিধি-বিধান আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে ,প্রত্যেক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পিছনে একটা কারণ থাকে এবং কারণ ছাড়া কোন ঘটনাই ঘটতে পারে না। ...এবং বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার বিশাল অংশ এই দার্শনিক নীতির উপর ভিত্তিশীল। অধিকন্তু কারণ অনুসন্ধান মানুষের সহজাত প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। সে কারণে কোন চিত্রকর্ম ,ভবন অথবা কারো পদচিহ্ন দেখেন কিংবা কোন আওয়াজ শুনতে পেলেই মানুষ তার বোধগম্যতার স্তর যাই হোক না কেন ,ঐ সব ঘটনা সংঘঠনকারী কারণ বা মাধ্যমের অনুসন্ধান করে ,যেন প্রতিটি ঘটনা সংঘটনের কারণ অনুসন্ধান তার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য লিপি। এ জন্যেই মানুষ এই বিশ্ব জগতে সৃষ্টি ও এর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে যায়।2

আল্লাহ্ পাক আল্ কোরআনে বলছেন :

( سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ)

অর্থাৎ : আমি (আল্লাহ্) অচিরেই তাদেরকে প্রান্ত স্থানসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করাবো যেন তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে সেটা সুনিশ্চিত সত্য। (সূরা ফুসসিলাত ,আঃ 53 )

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

সৃষ্টিজগতের সকল ক্ষেত্রে একটি সুষম বিন্যাস ,শৃঙ্খলা ,সমন্বয় ,সামঞ্জস্যতা এবং ভারসাম্য বিদ্যমান। দিন-রাতের পালাবদল ,সপ্তাহ মাস ,ও বৎসরের সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্থ ব্যবস্থা ,ঋতুসমুহের সঠিক নিয়ম ও পরিচালনা ,সবকিছুই একটি নিশ্চিত ব্যপারে বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করে যে ,এ বিশ্বজগত শৃঙ্খলাবব্ধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্রিয়াশীল।

সিসিল বাইক হাইম্যান (Cecil Boyce Hamann ) নামক একজন বিজ্ঞানী তারকারাজীর ব্যপারে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে : যদি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে তারকারজীর শৃঙ্খলার বিস্ময়কর কার্যাদি পরিদর্শনে অবাক কণ্ঠে চিৎকার ধ্বনি বেরিয়ে আসবে । দিবা -রাত্রি ,ঋতুর পালাবদল ,শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে অস্তিত্বমান আসমানের রশ্মিগুলোসহ সবকিছু এক নির্দিষ্ট পথে ঘূর্ণায়মান। এরা এতই সুশৃঙ্খলাবদ্ধভাবে তাদের নিজ নিজ কক্ষে আবর্তিত হচ্ছে যে কয়েক শতাব্দি পূর্বে বর্তমান সময়ের সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় নির্ধারণ করা সম্ভব।

এর পরও কি কেউ বলতে পারে যে ,গ্রহ-নক্ষত্র কোন একটি দূর্ঘটনার ফলাফল ,আর তারা নিজ কক্ষপথ ভুলে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে ? যদি নক্ষত্ররাজীর কক্ষপথ অনির্দিষ্ট এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা বহির্ভূত হতো তা হলে কিভাবে মানুষ মহাসমুদ্র ,শুস্কমরুভূমি ও নাম-নিশান বিহীন পথঘাটগুলোতে তারকার ঘূর্ণাবর্তের মাধ্যমে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হতো ? যারা মহাপরাক্রমশালী বিধাতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন তারাও এ ব্যপারে একমত যে ,মহাকাশের রশ্মিসমূহের আবর্তন এক নির্দিষ্ট শক্তির অনুসরণ করে চলছে । তাই নক্ষত্রমণ্ডলী কখনও দূর্ঘটনাক্রমে আপন কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে শ ূন্যাকাশে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘূর্ণন করতে পারে না। এতসব শৃঙ্খলা ও বিন্যাস ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগ্রত হয় ,কে এ সব কিছুর পরিচালক ,নির্মাতা ও শৃঙ্খলাদানকারী ? আমরা যদি কোন স্কুলের ব্যাপারে শুনি যে ,ঐ স্কুলের ছেলে-মেয়েরা একটি নির্দিষ্ট রংয়ের পোশাক পরিধান করে স্কুলে আগমন করে এবং সঠিক নিয়ম-নীতি মেনে চলে আর সকলে খুব সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ ,তারা সবাই শিক্ষকের নির্দেশ মোতাবেক স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকে তা হলে এটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হবে না যে ঐ স্কুলে নিশ্চয়ই একজন নীতিবান ও বিজ্ঞ শিক্ষক ও পরিচালক রয়েছেন।

বিশ্বব্যবস্থার সকল দিকগুলো বিবেচনা করলে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবো যে ,এ বিশ্বের সকল কিছু শৃঙ্খলাধীন সুনিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি প্রত্যক্ষ করবে না কেউ। সবাই আপন দায়িত্ব পালনে ক্রটিহীন। স্বভাবতঃ-ই মনে প্রশ্ন জাগ্রত হয় ,এতসব কিছুর একজন ব্যবস্থাপক ছাড়াই কি পরিচালিত হচ্ছে ?

সৌরজগতের সর্ববৃহৎ গ্রহ হচ্ছে সূর্য। সূর্যের আয়তন পৃথিবীর চেয়ে 3 ,30 ,000 গুণ বড়। সৌরজগত হচ্ছে ছায়া পথের একটি অংশ। এতে অন্তঃত এক বিলিয়ন সূর্য আছে যার অধিকাংশই আমাদের সূর্যের ওজনের চেয়ে অনেক বেশী। জ্যোর্তিষবিদগণ বলেন ,আমাদের ছায়াপথের ন্যায় একলক্ষ ছায়াপথ বিশ্বজগতে বিদ্যমান।

আবার ভূ-মণ্ডল বিশ্বজগতের এমন একটি গ্রহ যেখানে সর্বত্র ভারসাম্য বিরাজমান এবং এর নিজের চতূর্দিকে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়নমান। যার ফলে দিবা-রাত্রির উদ্ভব হয়েছে। তারপরও সূর্যের চতূদির্কে বাৎসরিক অবস্থান পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই ভারসাম্য ও ভূমণ্ডলের কেন্দ্রীয় অবস্থান সর্বদা সংরক্ষিত রয়েছে। এ ধরনের সুবৃহৎ ও সুশৃঙ্খল সৃষ্টি ব্যবস্থা কি কোন মহাক্ষমতাবান প্রস্তুতকারকের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে না ? হ্যাঁ তিনিই সর্বশক্তিমান মহাপরিচালক। তার সার্বভৌমতা ও শাসন ক্ষমতার পরিধির কোন সীমারেখা অংকন করা সম্ভব নয়। ইসলাম ধর্মে তিনিই আল্লাহ নামে অভিহিত।

মানব-প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের বিভিন্ন পথ রয়েছ। দার্শনিকগণ তাদের দর্শনের প্রমাণ করে থাকেন। আরেফ ও আধ্যাত্মি ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ প্রমাণাদিও আমাদের সমক্ষে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু এ সকল পথের মধ্যে সবচেয়ে সহজ ও সরল পথ-যা অতিক্রম করলে সহজে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব ,তা হলো আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ। আমাদের প্রকৃতগত স্বভাব এমন একটি বিষয় যা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। আরাবীতে এই স্বভাবজাত শব্দটি ফিত্রাত (فطرة ) নামে পরিচিত এবং এর ইংরাজী প্রতিশব্দ হচ্ছেNature যা সর্বকালে ,সর্বস্থানে ও সব মানুষের মাঝে সমানভাবে বিরাজমান। মা তার সন্তানকে ভালবাসেন। নবজাত শিশুকে শিখিয়ে দিতে হয় না যে ,এটি তোমার মা। তাই মায়ের প্রতি সন্তানের আকর্ষণ মানবীয় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। তদ্রূপ স্রষ্টা অন্বেষণের মনোভাব প্রতিটি মানুষের একটি প্রকৃতিগত ব্যাপার। প্রতিটি মানুষের অন্তঃকরন খোদা অন্বেষী। মানুষ কৌতুহলী মনোভাব নিয়ে ছুটে চলে এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে। এ কাজটি কাউকে শিখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। মানুষ স্বতঃষ্ফুর্তভাবে নিজেকে যে কোন এক মহাশক্তির অধীনে অবনত রাখতে ইচ্ছুক। আর স্বভাবতঃই এ ধরনেরই এক খোদা অন্বেষণী ঝংকার মনের একান্ত নিবিড়ে প্রতিটি স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষের অন্তকরণ থেকে বেজে উঠে।

সত্যান্বেষী আকাঙ্খা মানুষের সহজাত প্রকৃতিরই অন্তর্ভূক্ত। সাধারণভাবে কোন মানব হৃদয়ই এ অনুভূতি শূন্য নয়। প্রতিটি মানব মনই সর্বদা সকল বিষয়ের মূল উৎস উদঘাটন করতে বদ্ধপরিকর। জ্ঞান অন্বেষনের ব্যাপারে সে স্বভাবতঃই কৌতুহলী। প্রয়োজনে জ্ঞান পিপাসা মিটানোর জন্যে মানুষ যে কোন কষ্ট স্বীকার করে নিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। আর এ কারনেই মানুষ তার আত্মপরিচিতির ব্যাপারে স্বীয় বিবেক প্রসূত যে সকল প্রশ্ন থাকে তাহলো ,আমরা কোথা থেকে এসেছি ? কি আমাদের দায়িত্ব ? মানুষের মৌলিক ও স্বভাবজাত প্রসূত জিজ্ঞাসা। কেননা উপরোক্ত প্রশ্নগুলো তার স্বভাবজাত কৌতুহলী মনোভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। মনীষীগণ বলেন : বর্ণ ,গোত্র ,ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে যদি তার স্বীয় অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া হয় আর যদি বিশেষ কোন মতবাদের শিক্ষা-দীক্ষা না পায় এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অভিপ্রায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে তাহলে সে আভ্যন্তরীন তাড়না থেকেই নিঃসন্দেহে কোন মহাশক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন অনুভব করবে। এ ধরনের ব্যক্তি তার বিবেকের গভীরে এমন এক ধরনের সুপ্ত আওয়াজ অনুভব করে ,যা তাকে এ বিশ্বজগতের সূচনাকারী মহান স্রষ্টার প্রতি অণুরাগী করে তোলে। ইসলামে এ ধরনের মহাশক্তির নাম হচ্ছে আল্লাহ্ । মনোবিজ্ঞানীরা বিশ ্বাস করেন যে ,প্রধানতঃ আল্লাহর উপাসনা স্বাধীনভাবে মানুষের সহজাত প্রকৃতি থেকেই উদ্ভব হয়েছে। এটা মানব প্রকৃতিরই দাবী। তাই ,মানব সভ্যতার ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা দেখতে পাই মানুষ সর্বদা কোন না কোন শক্তির প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছে এবং তাকে সৃষ্টিকর্তা বলে পূজা-অর্চনা করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় ,আল্লাহর উপাসনা-ইবাদত সর্বকালে ,সর্বস্থানে বিভিন্ন রূপে মানুষের মাঝে বিরাজমান ছিল। আর মানুষের মাঝে এ একই ধরনের অনুভূতি ও মনোভাব যা তাকে সর্বদা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী করে রাখে তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে এ বিষয়টা মানুষের স্বভাবপ্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত। এ জন্যে অন্য কোন দার্শনিক প্রমানের প্রয়োজন হয় না মোটেও। প্রশ্ন হতে পারে খোদা অন্বেষণ মানব প্রকৃতির অংশ হলে পৃথিবীতে নাস্তিকতার অবস্থান বিদ্যমান কেন ? হ্যাঁ ,খোদা অন্বেষী মনোভাব মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। যদিও তা সবার মধ্যে সমপরিমাণ বিরাজমান নয়। কেননা ,যারা বিভিন্ন রকমের শিক্ষা ,প্রচার ও পরিবেশের শিকার তারা এ শিক্ষা ,অপপ্রচার ও দূষিত পরিবেশের মাঝে বৃদ্ধিলাভ করেছে। তাই তাদের ফিত্রাত সে সব শিক্ষা ও প্রচারের মোটা কালো আবরণে ঢেকে গেছে। তাদের অন্তরচক্ষু থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে এমন একটি বাল্বের তুলনা করা যায় যা একটি মোটা কালো কাপড় দিয়ে পেচিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর সুইচ অন্ থাকার পরও সে বাল্ব আলো বিতরণ করতে পারছে না। কিন্তু যখনই এই অপপ্রচার ও অপসংস্কৃতির কালো পর্দা তাদের মন ও হৃদয় থেকে সরিয়ে নেয়া হবে তখনই তা একটি শক্তিশালী বাল্বের ন্যায় আলো বিকিরণ করতে সক্ষম হবে। তাদের বিবেকই তখন ব্যক্ত করবে -নিশ্চয়ই এ বিশ্ব জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি সর্বশক্তিমান ,সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ

বুদ্ধিভিত্তিক দৃষ্টিকোন থেকে আমরা অস্তিত্বসমূহকে তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। কেননা আমরা যখনই অস্তিত্বের প্রকারভেদ নিয়ে চিন্তা করি তখন সেটা হয় তার জাত সত্তার সাথে সম্পৃক্ত হবে নতুবা অসম্পৃক্ত।

সুতরাং : যদি কোন অস্তিত্বের ধারণা করে তাকে তার জাতসত্তার সাথে সংযোগ করানো না যায় তাহলে এ ধরণের কোন সত্তা কখনো সত্তাশীল হতে পারে না। দর্শনের পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় :

1. অসম্ভাব্য অস্তিত্ব (মুমতানেউল উজুদ) অপরদিকে যে অস্তিত্বকে তার জাতসত্তার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় সেটা আবার দু ভাগে বিভক্ত।

যে অস্তিত্ব কখনো তার জাতসত্তা থেকে পৃথক হয়ে অনস্তিত্বে পরিণত হয়ে যেতে পারে সে সত্তার নাম দর্শনের পরিভাষায় বলা হয় :

2. নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা (মুমকিনুল উজুদ) এবং যে সত্তা কখনো তার জাত থেকে পৃথক হতে পারে না দর্শনের ভাষায় বলা হয় :

3. স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল উজুদ) অতএব সত্তাশীল সকল অস্তিত্বকে দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

(1) নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা

(2) স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী সত্তা

বস্তজগতের সকল সত্তাই বস্তুগত নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা। নিম্নে বস্তুগত নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা গেল :

(ক) পরিবর্তন ,পরিবর্ধন ,সংযোগ ,বিয়োগ ইত্যাদি।

(খ) অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব আসা আবার অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে ফিরে যাওয়া।

(গ) এ ধরনের অস্তিত্বের জন্যে অস্তিত্বশীলতা ও অস্তিত্বহীনতা উভয়ই সমান। একটি অপরটির উপর কোন প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বরং এ দু টির সম্ভাবনা সর্বদা সমানভাবে বিরাজমান।

(ঘ) অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব ,অবশ্যই কোন নির্দিষ্ট কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল। কোন কারণ ছাড়া এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে না। আর স্বাধীন অবশ্যাম্ভাবী সত্তার বৈশিষ্ট্যাবলী যেমন : আদি অন্তহীনতা ,সর্বদা বিরাজমান ,সকল কারণের মূল কারণ ,আদিসত্তা ইত্যাদি।

প্রাকৃতিক জগতের সবকিছুই কোন এক সময় সৃষ্টি হয় পরিশেষ আবার তা ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ সকল বস্তুগত সত্তা-ই কোন এক সময়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে তা অনস্তিত্বে প্রত্যাবর্তীত হয়ে যায়। মোট কথা সর্বদা পরিবর্তন ও রূপান্তরের আবরণে আবৃত থাকে বস্তুগত সত্তা। তাই এ সকল অস্তিত্ব হচ্ছে সম্ভাব্য নির্ভরশীল মুখাপেক্ষী সত্তা। সবটুকুই কোন নির্দিষ্ট কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল ,স্ব-প্রচেষ্টায় বস্তুসত্তা অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না কখনো।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তাহলে সৃষ্টিজগতের মূল কারণ কে ? এর উত্তরে যদি বলা হয় এ সকল সৃষ্টির পেছনে কোন কার্যকারণ ছিল না তা হলে উত্তরদাতা দর্শনশাস্ত্রের সে সুপ্রমাণিত নীতিরই বিরুদ্ধাচারণ করলেন ,যেখানে বলা হয়েছে সব ফলাফলের পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ বিদ্যমান। আবার যদি বলা হয় বস্তুনিচয়ের সৃষ্টির কারণ তারা নিজেরাই অর্থাৎ প্রকৃতি নিজেই তার সৃষ্টিকারক ,তাহলে নিদারুণ সত্যেরই অবমাননা করা হবে। কেননা ,বস্তু নিজের সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টার রূপ ধারণ করতে পারে না কিছুতেই। এ ধরনের উত্তর আমাদের নিরেট বুদ্ধিবৃত্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না মোটেও । কি করে অনস্তিত্ব ,অস্তিত্বের প্রবর্তক হতে পারে ? আবার যদি বলা হয় সৃষ্টি বস্তুর স্রষ্টা অপর কোন বস্তুগত সত্তা তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় ,তার সৃষ্টিকর্তা কে ? কেননা সকল বস্তুগত সত্তাই অন্য কোন সত্তার বলে সৃষ্টি হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যদি অপর কোন সম্ভাব্য নির্ভরশীল বস্তুগতসত্তার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করা হয় তাহলে এ ধরনের প্রশ্ন অবিরাম চলতেই থাকেব। আর কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ অসমাপ্ত চেইনটির এরূপ অবস্থান মেনে নিতে পারেন না। কারণ ,যদি কোথাও গিয়ে এর প্রশ্ন শেষ না হয় তা হলে বস্তুজগতের অস্তিত্ব ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।

অতএব ,নিঃসংকোচে আমাদের এমন এক সত্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যিনি সকল সৃষ্টির পূবেই অস্তিত্বমান ,যার মাধ্যমে কার্যকারণের অসমাপ্ত চেইনের হবে পূর্ণতা লাভ। যিনি সর্বপ্রথম ,আদিসত্তা ,শাশ্বত। তিনি হলেন অপরিহার্য সত্তা । তিনি আপন থেকেই অস্তিত্বমান ও আবির্ভূত যার কোন সূচনা নেই ,সূচনা তারই সৃষ্টি।

9

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়

বিজ্ঞান ঈমানের অগ্রদুত।

মানুষের জ্ঞান স্বল্প ও সীমিত।

আল্লাহর অস্তিত্ব বিজ্ঞানের পথধারার ঊর্দ্ধে।

বিশ্ব-প্রকৃতির সূচনাকাল বিদ্যমান।

প্রাকৃতিক বিশ্বে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত।

উদ্ভিদ জগতে শৃঙ্খলা।

এটোমের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা।

অতি ক্ষুদ্রতম অণু কোষের ভিতর শৃঙ্খলা।

মৌলিক পদার্থের ছকে যথার্থ হিসেব ও শৃঙ্খলা।

নভোপুঞ্জ এবং পৃথিবীর কল্পনাতীত বিশালতা।

কয়েকটি আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

দুর্ঘটনা নাকি কোন মহাশক্তির পরিচালনা ?

কার্যকারণ

নিঃসন্দেহে বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তুই অপর কোন সত্তার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কথায় প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ রয়েছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ ,আমরা যদি আমাদের বাড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে প্রত্যক্ষ করবো সুপরিকল্পিত সুন্দর একটি গৃহ। তখন যদি বলি এত সুন্দর একটি গৃহ নির্মাণের পেছনে কেউ কাজ করেনি ,এমনিতেই আপন সত্তার বলে নির্মিত হয়েছে তা হলে আমাদের বিবেক-বুদ্ধির ব্যাপারে কেউ সন্দেহ করলে কি অমুলক কিছু হবে ? আমাদের গৃহের যে কোন আসবাপত্রের কথাই ধরুন। গৃহাভ্যন্তরে সজ্জিত সুন্দর একখানা দেয়াল ঘড়ি ,আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরী সোফা ইত্যাদির ব্যাপারে যদি কেউ বলে এত সব সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র স্বীয় সত্তা বলে ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত হয়েছে তাহলে আপনি তাকে নির্বোধ ,বোকা ও বুদ্ধিহীন বললে কি কোন অন্যায় করবেন ? সব বুদ্ধিমান ব্যক্তিই স্বীকার করবেন যে এ সব প্রতিটি বস্তুর জন্যে নিশ্চয়ই একজন প্রস্তুতকারক রয়েছেন। কেননা কোন কিছুই স্বীয় সত্তায় সৃষ্টি হয়নি। এ সৃষ্টিজগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে নিঃসন্দেহে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হবো যে ,এতসব সুন্দর ,মনোরম ,নিখুত ও শৈল্পিক সৃষ্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়ে যায় নি বরং এ সকল সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ রয়েছে। এ জগতের পরমাণু থেকে বৃহৎ সৃষ্টি পর্যন্ত প্রতিটি সৃষ্টিই নিখুত এবং চমকপ্রদ। যদি কোথাও আমরা একটা সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর ছবি প্রত্যক্ষ করি তা হলে আমাদের বিবেক ,জ্ঞান ও অবচেতন মন নিঃসন্দেহে একজন ছবি অংকনকারীর কথা ব্যক্ত করতে বাধ্য হবে। আর সে ছবি ও চিত্র যদি আপনার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় ও মনোহরিণী আকার ধারণ করে তা হলে নিশ্চয়ই আপনি বলবেন এর স্রষ্টাও একজন সূরুচিসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শিল্পী না হয়ে পারেন না। আপনি যখন একটা সুন্দর গ্রন্থ অবলোকন করেন তখন কি এ পুস্তকের কোন গ্রন্থকার নেই কথাটি ব্যক্ত করেন ? নিশ্চয়ই না। কেননা কোন অস্তিত্বশীল সত্তার জন্যে প্রস্তুতকারকের অস্তিত্বহীনতার ধারণা পাগলের প্রলাপ মাত্র।

এ বিশ্বজগতে প্রতিটি সৃষ্টিই সুন্দর ও আকর্ষণীয়। বিস্তীর্ণ মহাকাশ সুপ্রশস্ত ভূ-পৃষ্ঠ ,সুবিশাল নদ-নদী ,পাহাড়-পর্বত ,বিশাল গ্রহরাজী ও নক্ষত্র মন্ডলী ,বিষ্ময়কর জীব-জন্তু ,মনোরম বৃক্ষরাজী-বনভূমী ও সুন্দর তরুলতা সব কিছুই একটা নির্দিষ্ট কার্যকারণের মাধ্যমে সত্তাশীল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শহীদ ডঃ জাভেদ বাহোনারের বক্তব্য প্রানিধান যোগ্য। তিনি বলেছেন ,কার্যকারণ সন্বন্ধীয় বিধি-বিধান আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে ,প্রত্যেক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পিছনে একটা কারণ থাকে এবং কারণ ছাড়া কোন ঘটনাই ঘটতে পারে না। ...এবং বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার বিশাল অংশ এই দার্শনিক নীতির উপর ভিত্তিশীল। অধিকন্তু কারণ অনুসন্ধান মানুষের সহজাত প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। সে কারণে কোন চিত্রকর্ম ,ভবন অথবা কারো পদচিহ্ন দেখেন কিংবা কোন আওয়াজ শুনতে পেলেই মানুষ তার বোধগম্যতার স্তর যাই হোক না কেন ,ঐ সব ঘটনা সংঘঠনকারী কারণ বা মাধ্যমের অনুসন্ধান করে ,যেন প্রতিটি ঘটনা সংঘটনের কারণ অনুসন্ধান তার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য লিপি। এ জন্যেই মানুষ এই বিশ্ব জগতে সৃষ্টি ও এর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে যায়।2

আল্লাহ্ পাক আল্ কোরআনে বলছেন :

( سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ)

অর্থাৎ : আমি (আল্লাহ্) অচিরেই তাদেরকে প্রান্ত স্থানসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করাবো যেন তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে সেটা সুনিশ্চিত সত্য। (সূরা ফুসসিলাত ,আঃ 53 )

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

সৃষ্টিজগতের সকল ক্ষেত্রে একটি সুষম বিন্যাস ,শৃঙ্খলা ,সমন্বয় ,সামঞ্জস্যতা এবং ভারসাম্য বিদ্যমান। দিন-রাতের পালাবদল ,সপ্তাহ মাস ,ও বৎসরের সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্থ ব্যবস্থা ,ঋতুসমুহের সঠিক নিয়ম ও পরিচালনা ,সবকিছুই একটি নিশ্চিত ব্যপারে বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করে যে ,এ বিশ্বজগত শৃঙ্খলাবব্ধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্রিয়াশীল।

সিসিল বাইক হাইম্যান (Cecil Boyce Hamann ) নামক একজন বিজ্ঞানী তারকারাজীর ব্যপারে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে : যদি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে তারকারজীর শৃঙ্খলার বিস্ময়কর কার্যাদি পরিদর্শনে অবাক কণ্ঠে চিৎকার ধ্বনি বেরিয়ে আসবে । দিবা -রাত্রি ,ঋতুর পালাবদল ,শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে অস্তিত্বমান আসমানের রশ্মিগুলোসহ সবকিছু এক নির্দিষ্ট পথে ঘূর্ণায়মান। এরা এতই সুশৃঙ্খলাবদ্ধভাবে তাদের নিজ নিজ কক্ষে আবর্তিত হচ্ছে যে কয়েক শতাব্দি পূর্বে বর্তমান সময়ের সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় নির্ধারণ করা সম্ভব।

এর পরও কি কেউ বলতে পারে যে ,গ্রহ-নক্ষত্র কোন একটি দূর্ঘটনার ফলাফল ,আর তারা নিজ কক্ষপথ ভুলে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে ? যদি নক্ষত্ররাজীর কক্ষপথ অনির্দিষ্ট এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা বহির্ভূত হতো তা হলে কিভাবে মানুষ মহাসমুদ্র ,শুস্কমরুভূমি ও নাম-নিশান বিহীন পথঘাটগুলোতে তারকার ঘূর্ণাবর্তের মাধ্যমে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হতো ? যারা মহাপরাক্রমশালী বিধাতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন তারাও এ ব্যপারে একমত যে ,মহাকাশের রশ্মিসমূহের আবর্তন এক নির্দিষ্ট শক্তির অনুসরণ করে চলছে । তাই নক্ষত্রমণ্ডলী কখনও দূর্ঘটনাক্রমে আপন কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে শ ূন্যাকাশে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘূর্ণন করতে পারে না। এতসব শৃঙ্খলা ও বিন্যাস ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগ্রত হয় ,কে এ সব কিছুর পরিচালক ,নির্মাতা ও শৃঙ্খলাদানকারী ? আমরা যদি কোন স্কুলের ব্যাপারে শুনি যে ,ঐ স্কুলের ছেলে-মেয়েরা একটি নির্দিষ্ট রংয়ের পোশাক পরিধান করে স্কুলে আগমন করে এবং সঠিক নিয়ম-নীতি মেনে চলে আর সকলে খুব সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ ,তারা সবাই শিক্ষকের নির্দেশ মোতাবেক স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকে তা হলে এটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হবে না যে ঐ স্কুলে নিশ্চয়ই একজন নীতিবান ও বিজ্ঞ শিক্ষক ও পরিচালক রয়েছেন।

বিশ্বব্যবস্থার সকল দিকগুলো বিবেচনা করলে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবো যে ,এ বিশ্বের সকল কিছু শৃঙ্খলাধীন সুনিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি প্রত্যক্ষ করবে না কেউ। সবাই আপন দায়িত্ব পালনে ক্রটিহীন। স্বভাবতঃ-ই মনে প্রশ্ন জাগ্রত হয় ,এতসব কিছুর একজন ব্যবস্থাপক ছাড়াই কি পরিচালিত হচ্ছে ?

সৌরজগতের সর্ববৃহৎ গ্রহ হচ্ছে সূর্য। সূর্যের আয়তন পৃথিবীর চেয়ে 3 ,30 ,000 গুণ বড়। সৌরজগত হচ্ছে ছায়া পথের একটি অংশ। এতে অন্তঃত এক বিলিয়ন সূর্য আছে যার অধিকাংশই আমাদের সূর্যের ওজনের চেয়ে অনেক বেশী। জ্যোর্তিষবিদগণ বলেন ,আমাদের ছায়াপথের ন্যায় একলক্ষ ছায়াপথ বিশ্বজগতে বিদ্যমান।

আবার ভূ-মণ্ডল বিশ্বজগতের এমন একটি গ্রহ যেখানে সর্বত্র ভারসাম্য বিরাজমান এবং এর নিজের চতূর্দিকে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়নমান। যার ফলে দিবা-রাত্রির উদ্ভব হয়েছে। তারপরও সূর্যের চতূদির্কে বাৎসরিক অবস্থান পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই ভারসাম্য ও ভূমণ্ডলের কেন্দ্রীয় অবস্থান সর্বদা সংরক্ষিত রয়েছে। এ ধরনের সুবৃহৎ ও সুশৃঙ্খল সৃষ্টি ব্যবস্থা কি কোন মহাক্ষমতাবান প্রস্তুতকারকের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে না ? হ্যাঁ তিনিই সর্বশক্তিমান মহাপরিচালক। তার সার্বভৌমতা ও শাসন ক্ষমতার পরিধির কোন সীমারেখা অংকন করা সম্ভব নয়। ইসলাম ধর্মে তিনিই আল্লাহ নামে অভিহিত।

মানব-প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের বিভিন্ন পথ রয়েছ। দার্শনিকগণ তাদের দর্শনের প্রমাণ করে থাকেন। আরেফ ও আধ্যাত্মি ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ প্রমাণাদিও আমাদের সমক্ষে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু এ সকল পথের মধ্যে সবচেয়ে সহজ ও সরল পথ-যা অতিক্রম করলে সহজে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব ,তা হলো আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ। আমাদের প্রকৃতগত স্বভাব এমন একটি বিষয় যা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। আরাবীতে এই স্বভাবজাত শব্দটি ফিত্রাত (فطرة ) নামে পরিচিত এবং এর ইংরাজী প্রতিশব্দ হচ্ছেNature যা সর্বকালে ,সর্বস্থানে ও সব মানুষের মাঝে সমানভাবে বিরাজমান। মা তার সন্তানকে ভালবাসেন। নবজাত শিশুকে শিখিয়ে দিতে হয় না যে ,এটি তোমার মা। তাই মায়ের প্রতি সন্তানের আকর্ষণ মানবীয় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। তদ্রূপ স্রষ্টা অন্বেষণের মনোভাব প্রতিটি মানুষের একটি প্রকৃতিগত ব্যাপার। প্রতিটি মানুষের অন্তঃকরন খোদা অন্বেষী। মানুষ কৌতুহলী মনোভাব নিয়ে ছুটে চলে এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে। এ কাজটি কাউকে শিখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। মানুষ স্বতঃষ্ফুর্তভাবে নিজেকে যে কোন এক মহাশক্তির অধীনে অবনত রাখতে ইচ্ছুক। আর স্বভাবতঃই এ ধরনেরই এক খোদা অন্বেষণী ঝংকার মনের একান্ত নিবিড়ে প্রতিটি স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষের অন্তকরণ থেকে বেজে উঠে।

সত্যান্বেষী আকাঙ্খা মানুষের সহজাত প্রকৃতিরই অন্তর্ভূক্ত। সাধারণভাবে কোন মানব হৃদয়ই এ অনুভূতি শূন্য নয়। প্রতিটি মানব মনই সর্বদা সকল বিষয়ের মূল উৎস উদঘাটন করতে বদ্ধপরিকর। জ্ঞান অন্বেষনের ব্যাপারে সে স্বভাবতঃই কৌতুহলী। প্রয়োজনে জ্ঞান পিপাসা মিটানোর জন্যে মানুষ যে কোন কষ্ট স্বীকার করে নিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। আর এ কারনেই মানুষ তার আত্মপরিচিতির ব্যাপারে স্বীয় বিবেক প্রসূত যে সকল প্রশ্ন থাকে তাহলো ,আমরা কোথা থেকে এসেছি ? কি আমাদের দায়িত্ব ? মানুষের মৌলিক ও স্বভাবজাত প্রসূত জিজ্ঞাসা। কেননা উপরোক্ত প্রশ্নগুলো তার স্বভাবজাত কৌতুহলী মনোভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। মনীষীগণ বলেন : বর্ণ ,গোত্র ,ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে যদি তার স্বীয় অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া হয় আর যদি বিশেষ কোন মতবাদের শিক্ষা-দীক্ষা না পায় এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অভিপ্রায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে তাহলে সে আভ্যন্তরীন তাড়না থেকেই নিঃসন্দেহে কোন মহাশক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন অনুভব করবে। এ ধরনের ব্যক্তি তার বিবেকের গভীরে এমন এক ধরনের সুপ্ত আওয়াজ অনুভব করে ,যা তাকে এ বিশ্বজগতের সূচনাকারী মহান স্রষ্টার প্রতি অণুরাগী করে তোলে। ইসলামে এ ধরনের মহাশক্তির নাম হচ্ছে আল্লাহ্ । মনোবিজ্ঞানীরা বিশ ্বাস করেন যে ,প্রধানতঃ আল্লাহর উপাসনা স্বাধীনভাবে মানুষের সহজাত প্রকৃতি থেকেই উদ্ভব হয়েছে। এটা মানব প্রকৃতিরই দাবী। তাই ,মানব সভ্যতার ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা দেখতে পাই মানুষ সর্বদা কোন না কোন শক্তির প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছে এবং তাকে সৃষ্টিকর্তা বলে পূজা-অর্চনা করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় ,আল্লাহর উপাসনা-ইবাদত সর্বকালে ,সর্বস্থানে বিভিন্ন রূপে মানুষের মাঝে বিরাজমান ছিল। আর মানুষের মাঝে এ একই ধরনের অনুভূতি ও মনোভাব যা তাকে সর্বদা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী করে রাখে তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে এ বিষয়টা মানুষের স্বভাবপ্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত। এ জন্যে অন্য কোন দার্শনিক প্রমানের প্রয়োজন হয় না মোটেও। প্রশ্ন হতে পারে খোদা অন্বেষণ মানব প্রকৃতির অংশ হলে পৃথিবীতে নাস্তিকতার অবস্থান বিদ্যমান কেন ? হ্যাঁ ,খোদা অন্বেষী মনোভাব মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। যদিও তা সবার মধ্যে সমপরিমাণ বিরাজমান নয়। কেননা ,যারা বিভিন্ন রকমের শিক্ষা ,প্রচার ও পরিবেশের শিকার তারা এ শিক্ষা ,অপপ্রচার ও দূষিত পরিবেশের মাঝে বৃদ্ধিলাভ করেছে। তাই তাদের ফিত্রাত সে সব শিক্ষা ও প্রচারের মোটা কালো আবরণে ঢেকে গেছে। তাদের অন্তরচক্ষু থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে এমন একটি বাল্বের তুলনা করা যায় যা একটি মোটা কালো কাপড় দিয়ে পেচিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর সুইচ অন্ থাকার পরও সে বাল্ব আলো বিতরণ করতে পারছে না। কিন্তু যখনই এই অপপ্রচার ও অপসংস্কৃতির কালো পর্দা তাদের মন ও হৃদয় থেকে সরিয়ে নেয়া হবে তখনই তা একটি শক্তিশালী বাল্বের ন্যায় আলো বিকিরণ করতে সক্ষম হবে। তাদের বিবেকই তখন ব্যক্ত করবে -নিশ্চয়ই এ বিশ্ব জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি সর্বশক্তিমান ,সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ

বুদ্ধিভিত্তিক দৃষ্টিকোন থেকে আমরা অস্তিত্বসমূহকে তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। কেননা আমরা যখনই অস্তিত্বের প্রকারভেদ নিয়ে চিন্তা করি তখন সেটা হয় তার জাত সত্তার সাথে সম্পৃক্ত হবে নতুবা অসম্পৃক্ত।

সুতরাং : যদি কোন অস্তিত্বের ধারণা করে তাকে তার জাতসত্তার সাথে সংযোগ করানো না যায় তাহলে এ ধরণের কোন সত্তা কখনো সত্তাশীল হতে পারে না। দর্শনের পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় :

1. অসম্ভাব্য অস্তিত্ব (মুমতানেউল উজুদ) অপরদিকে যে অস্তিত্বকে তার জাতসত্তার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় সেটা আবার দু ভাগে বিভক্ত।

যে অস্তিত্ব কখনো তার জাতসত্তা থেকে পৃথক হয়ে অনস্তিত্বে পরিণত হয়ে যেতে পারে সে সত্তার নাম দর্শনের পরিভাষায় বলা হয় :

2. নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা (মুমকিনুল উজুদ) এবং যে সত্তা কখনো তার জাত থেকে পৃথক হতে পারে না দর্শনের ভাষায় বলা হয় :

3. স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল উজুদ) অতএব সত্তাশীল সকল অস্তিত্বকে দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

(1) নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা

(2) স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী সত্তা

বস্তজগতের সকল সত্তাই বস্তুগত নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা। নিম্নে বস্তুগত নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা গেল :

(ক) পরিবর্তন ,পরিবর্ধন ,সংযোগ ,বিয়োগ ইত্যাদি।

(খ) অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব আসা আবার অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে ফিরে যাওয়া।

(গ) এ ধরনের অস্তিত্বের জন্যে অস্তিত্বশীলতা ও অস্তিত্বহীনতা উভয়ই সমান। একটি অপরটির উপর কোন প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বরং এ দু টির সম্ভাবনা সর্বদা সমানভাবে বিরাজমান।

(ঘ) অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব ,অবশ্যই কোন নির্দিষ্ট কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল। কোন কারণ ছাড়া এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে না। আর স্বাধীন অবশ্যাম্ভাবী সত্তার বৈশিষ্ট্যাবলী যেমন : আদি অন্তহীনতা ,সর্বদা বিরাজমান ,সকল কারণের মূল কারণ ,আদিসত্তা ইত্যাদি।

প্রাকৃতিক জগতের সবকিছুই কোন এক সময় সৃষ্টি হয় পরিশেষ আবার তা ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ সকল বস্তুগত সত্তা-ই কোন এক সময়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে তা অনস্তিত্বে প্রত্যাবর্তীত হয়ে যায়। মোট কথা সর্বদা পরিবর্তন ও রূপান্তরের আবরণে আবৃত থাকে বস্তুগত সত্তা। তাই এ সকল অস্তিত্ব হচ্ছে সম্ভাব্য নির্ভরশীল মুখাপেক্ষী সত্তা। সবটুকুই কোন নির্দিষ্ট কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল ,স্ব-প্রচেষ্টায় বস্তুসত্তা অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না কখনো।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তাহলে সৃষ্টিজগতের মূল কারণ কে ? এর উত্তরে যদি বলা হয় এ সকল সৃষ্টির পেছনে কোন কার্যকারণ ছিল না তা হলে উত্তরদাতা দর্শনশাস্ত্রের সে সুপ্রমাণিত নীতিরই বিরুদ্ধাচারণ করলেন ,যেখানে বলা হয়েছে সব ফলাফলের পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ বিদ্যমান। আবার যদি বলা হয় বস্তুনিচয়ের সৃষ্টির কারণ তারা নিজেরাই অর্থাৎ প্রকৃতি নিজেই তার সৃষ্টিকারক ,তাহলে নিদারুণ সত্যেরই অবমাননা করা হবে। কেননা ,বস্তু নিজের সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টার রূপ ধারণ করতে পারে না কিছুতেই। এ ধরনের উত্তর আমাদের নিরেট বুদ্ধিবৃত্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না মোটেও । কি করে অনস্তিত্ব ,অস্তিত্বের প্রবর্তক হতে পারে ? আবার যদি বলা হয় সৃষ্টি বস্তুর স্রষ্টা অপর কোন বস্তুগত সত্তা তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় ,তার সৃষ্টিকর্তা কে ? কেননা সকল বস্তুগত সত্তাই অন্য কোন সত্তার বলে সৃষ্টি হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যদি অপর কোন সম্ভাব্য নির্ভরশীল বস্তুগতসত্তার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করা হয় তাহলে এ ধরনের প্রশ্ন অবিরাম চলতেই থাকেব। আর কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ অসমাপ্ত চেইনটির এরূপ অবস্থান মেনে নিতে পারেন না। কারণ ,যদি কোথাও গিয়ে এর প্রশ্ন শেষ না হয় তা হলে বস্তুজগতের অস্তিত্ব ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।

অতএব ,নিঃসংকোচে আমাদের এমন এক সত্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যিনি সকল সৃষ্টির পূবেই অস্তিত্বমান ,যার মাধ্যমে কার্যকারণের অসমাপ্ত চেইনের হবে পূর্ণতা লাভ। যিনি সর্বপ্রথম ,আদিসত্তা ,শাশ্বত। তিনি হলেন অপরিহার্য সত্তা । তিনি আপন থেকেই অস্তিত্বমান ও আবির্ভূত যার কোন সূচনা নেই ,সূচনা তারই সৃষ্টি।

9

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়

বিজ্ঞান ঈমানের অগ্রদুত।

মানুষের জ্ঞান স্বল্প ও সীমিত।

আল্লাহর অস্তিত্ব বিজ্ঞানের পথধারার ঊর্দ্ধে।

বিশ্ব-প্রকৃতির সূচনাকাল বিদ্যমান।

প্রাকৃতিক বিশ্বে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত।

উদ্ভিদ জগতে শৃঙ্খলা।

এটোমের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা।

অতি ক্ষুদ্রতম অণু কোষের ভিতর শৃঙ্খলা।

মৌলিক পদার্থের ছকে যথার্থ হিসেব ও শৃঙ্খলা।

নভোপুঞ্জ এবং পৃথিবীর কল্পনাতীত বিশালতা।

কয়েকটি আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

দুর্ঘটনা নাকি কোন মহাশক্তির পরিচালনা ?


4

5

6

7

8