শাফাআতের পারিভাষিক সংজ্ঞা
ইবনে আসির বলেন: শাফাআত হল অতীতের গুনাহ খাতা ও ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করার জন্য আবেদন।
ভূতপূর্ব আলেমগণ শাফাআতের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করেছেন ,
এ ব্যাপারে কোন রকম গবেষণা চালাননি। আর পরবর্তী আলেমগনের বিশ্বাস হল: শাফাআত এক প্রকার দোয়া যা আল্লাহ তালা কবুল করে থাকেন।
আমাদের মতে , শাফাআত হল কোন বস্তু বা ব্যক্তি অন্য কোন গুনাহগার ব্যক্তির গুনাহ খাতা মাফ করানোর জন্য কিয়ামতের দিনে ওসিলা হওয়া।
আর এর ব্যাখ্যা হল: কোন ব্যক্তি যখন তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নিজেকে দুর্বল মনে করে। তখন নিজের প্রচেষ্টার সাথে সাথে অন্য এমন এক ব্যক্তির সহযোগিতা কামনা করে যার সেরূপ যোগ্যতা রয়েছে। আর তাই এমন এক ব্যক্তির শাফাআত কামনা করে যিনি আল্লাহ তালার কাছে অতি সম্মানিত এবং যার শাফাআত আল্লাহ তালা কবুল করে থাকেন।
শাফাআতের প্রকারভেদ
প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই শাফাআত সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন প্রকার শাফাআতের ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে তাই এ বিষয় স্পষ্ট করার জন্য আমরা পথেমে নানাবিধ শাফাআতের ব্যাখ্যা তুলে ধরবো , অতঃপর শাফাআতের সঠিক ধারণাটি পরিষ্কার করে তুলব।
1। বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় শাফাআত
বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় শাফাআতের প্রভাব রয়েছে।
আল্লামা তাবাতাবাই (রহঃ) এর মতে , শাফাআত নিজেই একটি কারণ এবং শাফাআত প্রার্থী ব্যক্তি ক্ষমা পাওয়ার জন্য নিকটতম উসিলা হিসেবে শাফাআতকারীর আশ্রয় নিয়ে থাকে ; এবং অন্যান্য উসিলা সমূহের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেটিই গ্রহন করে। এ বিষয়টিই শাফাআতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
তবে আমরা শাফাআত সম্পর্কে এমন ধারণা পোষন করি যে , আল্লাহ তালা দুই ভাবে শাফাআত কবুল করে থাকেন প্রথমত বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ার বিষয় ও দ্বিতীয়ত শরিয়তি বিষয়।
প্রথম মতে , আল্লাহ তালা সর্ব প্রকার কার্য কারণ সমূহের উৎস এবং অন্য সব কারণ সমূহ অবশেষে তার কাছেই সমাস্থি লাভ করে। পবিত্র কোরআন শরিফও এ বিষয়টির সত্যতা প্রমাণ করেছে উদাহরণস্বরূপ:
)
إ
ِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ(
তোমাদের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ তা’
লা আসমান ও জমিনকে সাতদিনে সৃষ্টি করেছেন । অতঃপর আরশের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন এবং সৃষ্টির ধারাবাহিকতা আনয়ন করলেন । তার অনুমতি ছাড়া কেহই উসিলা হতে পারবেনা (শাফাআত করতে পারে না)।
যদিও এ আয়াতটি আসমান ও জমিনের সৃষ্টির প্রতি নির্দেশ করে তবে আমাদের লক্ষ্যনীয় বিষয়টি হলيُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ
এবং তা শাফাআতের মাধ্যমে বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত প্রদান করে এবং এটাই সত্যিকার কারণ ও উসিলা হিসেবে গন্য হবে ।
আমাদের মতে , বিশ্ব জগতের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় শাফাআতের আভিধানিক অর্থ হল ক্ষমা প্রাস্থির কারণ সমূহের উসিলা ।
2 । শরিয়তি শাফাআত
এর অর্থ হল যা বাস্তব জীবনের দায়িত্ব কর্তব্যের ক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য । আল্লামা তাবাতাবাই এ বিষয় সম্পর্কে বলেন: শাফায়াত কিছু সংখ্যক মানুষ ও ফেরেশতার জন্য নির্ধারিত তবে এজন্য আল্লাহর অনুমতি অত্যাবশ্যকীয় এবং আল্লাহর অনুমতিই শাফাআতের পরিপূর্ণতা দেয় । অর্থাৎ আল্লাহ তালঅ তার অনুমতি দিয়ে তার কিছু সংখ্যক বান্দাকে কবুল করে নেন , কারণ সমস্ত রাজত্ব ও কর্তৃত্ব তারই জন্য ।
অতএব আল্লাহ তালা তার সেসব বান্দাগণকে এই পদমর্যাদা দান করেছেন তারা আল্লাহ তালার রহমত , ক্ষমা , মাগফেরাত ও অন্যান্য গুনাহবলীর উসিলা ধরে কিছু সংখ্যক গুনাহগার ব্যক্তিকে তার সাথে সংযুক্ত করে এবং যে সকল আযাব ঐ সকল ব্যক্তির প্রাপ্য ছিল তা থেকে ফিরিয়ে আনে । এভাবে যে সকল ব্যক্তি আযাব থেকে মুক্তি পায় ও আযাব ভোগ করতে হয়না । তাই শাফাআতের বিষয়টি আল্লাহর রাজত্ব ও কর্তৃত্বের শামিল এটা আল্লাহর রাজত্বের বিপরীত কোন বিষয় নয় । আর এ বিষয়টি আল্লাহর বানী দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় ।
)
ف
َأُولَئِكَ يُبَدِّلُ اللَّهُ سَيِّئَاتِهِمْ حَسَنَاتٍ(
আল্লাহ তালা উক্ত ব্যক্তিদের গুনাহ খাতাকে সওয়াবে পরিবর্তন করেন।
মূলত আল্লাহ তালা যা ইচ্ছা করেন তাই করে থাকেন ও যেকোন আদেশ বলবত করে থাকেন।
শাফাআত সম্পর্কে আল্লামা তাবাতাবাঈর উক্ত ব্যাখ্যা“
শাফাআত ও দোয়া করা একই শ্রেনীভূক্ত”
আমাদের কাছে গ্রহন যোগ্য।
শর্ত সাপেক্ষে দোয়া করলে ক্ষতির সম্ভাবনা ব্যহত করে আল্লাহ তালা তার বান্দার প্রতি কল্যান বর্ষণ করেন। এ রকম ভাবে দোয়া করাই শাফাআতের আভিধানিক অর্থ। আর শাফাআতকারী পাপী বান্দার ক্ষমার কারণ হয়ে থাকে।
3। আমলের শাফাআত
এই প্রকার শাফাআতের ব্যাখ্যায় বলতে হয়:
মানুষ ও তার আমলের মাঝে এ দুনিয়ায় এক ধরনের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং এই সম্পর্ক কেয়ামতের দিনও বলবৎ থাকবে অর্থাৎ সেদিন এই আমল ভাষ্কর্য (প্রতিকৃতি) হয়ে উঠবে।
এ প্রসঙ্গে কোরআনে বহু আয়াত রয়েছে তার কিছু সংখ্যকের প্রতি দৃষ্টিপাত করা শ্রেয় মনে করছি।
)
ي
َوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ(
মোফাসসেররগণ এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন: কেয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে তার নেতার সাথে পুনরুত্থান করা হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে , কেয়ামতের দিন ফেরাউন তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে কারণ সে দুনিয়াতেও তাদের নেতা ছিল। নিম্নলিখিত আয়াত এ বিষয়ের সাক্ষ প্রদান করে।
)
ي
َقْدُمُ قَوْمَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَوْرَدَهُمُ النَّارَ(
ফেরাউন কেয়ামতের দিন তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামের আগুন নিক্ষেপ করবে।
এখানে আরবী শব্দأَوْرَد
- এর প্রতি মনোযোগ দিলে বুঝা যাবে যে , যে ফেরাউন তার গোত্রের জন্য গোমরাহির কারণ হয়ে ছিল সেই আবার কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। ফলাফল এই দাড়ায় যে , যেভাবে সে দুনিয়াতে তাদের অপকর্মের কারণ হয়েছিল কেয়ামতের দিনও সেভাবে জাহান্নামের কারণ হবে।
আমলের প্রতিকৃতি (ভাষ্কর্য) সম্পর্কে কিছু সংখ্যক হাদীসও বর্ণিত আছে। উদাহরণ স্বরূপ সে সব হাদীস নামাজ পড়া , রোজা রাখা ও কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি কেয়ামতের দিন মানুষের জন্য ভাষ্কর্য হয়ে দাড়াবে ও তার জন্য শাফাআত করবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ালিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন , কেয়ামতের দিন কোরআন ও রোজা মানুষের জন্য শাফাআত করবে। রোজা বলবে , হে পরওয়ারদেগার! তার জন্য শাফাআত করার অনুমতি দাও , কারণ আমি ওকে সারাদিনভর খাওয়া ও পানাহার থেকে বিরত রেখেছি এবং কামভাব ও আকাংখ্যা থেকে বিরত রেখেছি। কোরআন বলবে , হে আল্লাহ! তার জন্য শাফাআত করার তৌফিক দাও , কারণ আমি তাকে রাতে ঘুমাতে দেইনি । তখন রোজা ও কোরআন শাফাআত করবে এবং আল্লাহ তালা তাদের শাফাআত কবুল করবেন।
আহলে সুন্নাতের বড় এক আলেম“
শেখ তানতাভি”
শাফাআত সম্পর্কে বলেন , জেনে নাও , (উদাহরণস্বরূপ) , শাফাআতের বীজ , গাছ ও ফল রয়েছে। আর এগুলো হল কেয়ামতের দিনের নাযাত (আযাব থেকে মুক্তি) পাওয়ার উসিলা। আল্লাহর নবী রাসূল (আঃ) গণ মানুষকে শরিয়তের আহকাম শিক্ষা দিয়ে বীজ বপন করেন। আর মানুষ যদি সে অনুপাতে আমল করে তাহলে ফল লাভের যোগ্যতা অর্জন করে এবং কেয়ামতের দিন সেই ফল (আযাব থেকে মুক্তি) লাভ করে থাকবে। অতএব শাফাআতের শুরু হল শাফাআত সম্পর্কিত জ্ঞান , অতঃপর আমল ও সবশেষে সফলতা ও বেহেশতের উর্ধ্বতম মর্যাদা হল তার ফলাফল।
আমাদের মতে ,“
আমলের শাফাআত”
শাফাআতের এক রকম আভিধানিক অর্থ। আর শাফাআতের পারিভাষিক অর্থ অন্য রকম।