শাফাআত

শাফাআত37%

শাফাআত লেখক:
: মোঃ সামিউল হক
প্রকাশক: খেদমতে ইসলামী সংস্থা, কোম, ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শাফাআত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15731 / ডাউনলোড: 4345
সাইজ সাইজ সাইজ
শাফাআত

শাফাআত

লেখক:
প্রকাশক: খেদমতে ইসলামী সংস্থা, কোম, ইরান
বাংলা

যে বইটি বর্তমানে আপনাদের হাতে আছে তা একজন তাকওয়া সম্পন্ন বিশিষ্ট লেখকের সুদীর্ঘ কষ্টের ফসল। যা তিনি বিবেক সম্মত দলিল ও যুক্তি দিয়ে লিখেছেন। এই বইটি ব্যবহারের মাধ্যমে সত্যের পথ খুজে পাওয়ার অধিকার আপনাদের রয়েছে। তবে এই বইতে যে সকল দলিল ব্যবহার করা হয়েছে তা অতি উচ্চমানের এবং অধিক গ্রহণযোগ্য। সর্বোপরি এই বইতে উল্লেখিত প্রতিটি দলিলই হচ্ছে বিবেক সম্মত এবং যা কিছু তার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে তাতে আল্লাহ রাব্বুল আ লামিনেরও সহানুভতি থাকে।

বিবেকের বিচারে শাফাআত

বিবেকের মাধ্যমে শাফাআত প্রমাণ করার জন্য চারটি ধাপ উল্লেখযোগ্য ।

১. আল্লাহ তালা তার বান্দার প্রতি দয়াশীল এবং তার রহমত আযাবের চেয়ে অগ্রবর্তী ।

২. যেহেতু মানুষ আল্লাহর ক্ষমা (করার ক্ষমতা) কে মেনে নিয়েছে , অতএব বিবেক বলে শাফাআত ও ক্ষমা ঘটমান বিষয় ।

৩. সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর রহমত তার বান্দাদের কাছে পৌছতে হলে উসিলা থাকা আবশ্যকীয় যা উভয়ের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি করে । কারণ স্রষ্ট্রা ও সৃষ্টির মাঝে কোন বন্ধন বা শিকল নেই , তাই আল্লাহ তারা বলেন ,لیس کمثله شئ তার (আল্লাহর) মত অনুরূপ কোন কিছুই নেই ।

৪. আর এ দুয়ের সৃষ্ট উসিলা উভয়ের সাথে এক প্রকার সামনঞ্জস্য থাকতে হবে , কারন যদি আল্লাহর সাতে তার কোন সম্পর্ক না থাকে তাহলে তার আবেদন কবুল হওয়ার নয় অপর দিকে যদি বান্দার (শাফাআত প্রার্থীর) সাথে তার সম্পর্ক না থাকে তাহলে তাকে শাফাআত করতে পারবে না ।

আল্লাহ সৃষ্ট বিশ্ব চরাচরের নিয়ম অনুযায়ী বস্তুবাদী ও আধ্যাত্মিক সকল ক্রিয়াকর্মের জন্য এক বা একাধিক উসিলার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রেরিত হয়।

অতএব আল্লাহর ক্ষমা ও মাগফেরাত পাওযার জন্য উসিলা থাকা বাঞ্ছনীয় ।

একটি প্রশ্ন: বিবেক কি শাফাআতকে স্বীকৃতি দেয় ? এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজীর মত হল , প্রশিক্ষণ বিষয়াদীর ক্ষেত্রে বিবেকের বিচার হল , শাফাআত একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় এবং মানুষকে সফল হতে হলে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে গঠন করতে হবে এবং এ জন্য একজন শাফাআতকারী অত্যাবশ্যকীয় ।অতএব বিবেক শাফাআতকে স্বীকৃতি দেয় ।

আমাদের মতে ; বিবেক আধ্যাত্মিক ও বাস্তব জীবনে শাফাআতের স্বীকৃতি দেয় কারণ যদি এই সম্বন্ধ ও উসিলা না থাকতো তাহলে উর্ধআকাশ থেকে রহমতের ধারা পৃথিবীতে আসতোনা । তবে বিবেক শাফাআতের পারিভাষিক অর্থকে স্বীকৃতি দেয়না ,শুধুমাত্র শাফাআতের সম্ভাবনাকে স্বীকৃতি দেয় । এ ব্যাপারে কাজী আইয়াজ বলেন ; আহলে সুন্নাতের অনুসারীগণ বিবেকের বিচারে শাফাআতকে জায়েয মনে করেনএবং কোরআন হাদীসের দৃষ্টিতে শাফআতকে ওয়াজিব মনে করে থাকেন ।৪৪

ফলাফল: বিবেক সরাসরি শাফাআতকে স্বীকৃতি দেয়না তবে শাফাআতকারীদের উসিলায় গুনাহগার ব্যক্তিদের গুনাহ মাফের ঘটনা কুরআন ও হাদীসে ও শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহনযোগ্য বিষয় । শাফাআতের ব্যাপারে কোরআন ও হাদীস নিখুত তথ্য প্রদান করে । কিন্তু বিবেক শাফাআতকে জায়েয বরে স্বীকৃতি প্রদান করে ।

শাফাআতের উপকারিতা সম্পর্কে মতামত

মুসলমানদের বিভিন্ন সম্প্রদায় শাফাআতের ফলাফল সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন । তার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করবো :

১. শাফাআত শুধুমাত্র মুমিন মুসলমানদের সওয়াব ও পুরষ্কার বৃদ্ধিতে কার্যকর হয় ।

২. যে সকল ব্যক্তি আজাব প্রাস্থির উপযুক্ত শাফাআত শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় ।

৩. শাফাআত উপরোক্ত দুটি মতের উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ।

শাফাআতের উপকারিতা সম্পর্কিত হাদীস

১. সাইদ উদ্দীন তাফতাজানী বলেন ,

মোতাজিলাদের মতে , শাফাআত শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য , যারা সওয়াবের অধিকারী , এবং শাফাআতের কারণে তাদের সওয়াব বৃদ্ধি পায় যা তাদের প্রাপ্য ছিলনা ।৪৫

২. ইমাম সাদিক (আ.) বলেন ,

আদি যুগ তেকে মেষ যুগ পর্যন্ত মানুষের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই যার জন্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর শাফাআতের প্রয়োজন হবে না । ৪৬

৩. আবু আইমান ইমাম কাজেম (আ.) এর বাড়িতে প্রবেশ করে বললেন , ওহে আবু জাফর! আপনি মানুষকে অহঙ্কারী করে তুলছেন (কারণ মানুষকে শাফাআতের ওয়াদা দিচ্ছেন) তাদেরকে বলে থাকেন মুহাম্মদের শাফাআত , মুহাম্মদের শাফাআত!

ইমাম কাজেম (আ.) এতই রাগান্বিত হলেন যে , চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন ,

তোমার জন্য দুঃখ হয়,৪৭ ওহে আবু আইমান ; তুমি যে হারাম খাওয়া তেকে তোমার পেটকে বিরত রেখেছ কামভাব থেকে নিজেকে বিরত রেখেছ তাই বলে অহঙ্কারী হয়েছো ? যদি তুমি কেয়ামতের কঠিন মুসিবতের বিষয় অনুধাবনকরতে পারতে তাহলে মুহাম্মদের শাফাআতের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে । আফসোস তোমার জন্য , তুমি কি মনে কর ও সেদিন যে ব্যক্তি আযাবের উপযোগী তাকে ছাঢ়া তিনি অন্য কাউকে শাফাআত করবেন ?

অতঃপর বলেন: আদী যুগ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত এমন কোন ব্যক্তি থাকবেনা , যার জন্য মুহাম্মদের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম শাফাআত , প্রযোজন হবেনা ।

ইমাম রেজা (আ.) বলেন , যখনই আল্লাহর কাছে কোন আবেদন করবে ,৪৮ বল: আমি তোমাকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এবং আলী (আ.) এর কসম দিয়ে ডাকছি নিশ্চয় এই দু ব্যক্তি তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ পদ ও সম্মানের অধিকারী ।

কেয়ামতের দিন এমন কোন বাদশা , আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত ব্যক্তি. নবী রাসূল ও মুমিন ব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবেনা যাদের জন্য এ দু ব্যক্তির শাফাআত তাদের প্রয়োজন হবে না।

উপরে বর্ণিত চারটি হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে , যে সকল ব্যক্তি কোন গুনাহ করেনি যেমন , ফেরেশতাগণ , নবী রাসূল , মুমিন ও সালেহ ব্যক্তিবর্গ তাদেরও শাফাআতের প্রয়োজন হবে । যদিও এদের শাফাআতের বিষয় অকল্পনীয় তবে তাদের পদ ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য শাফাআত করা হলে অকল্পনীয় নয় । কারণ , তারাতো কোন গুনাহ করেনি যে , সে কারণে শাফাআত করা প্রয়োজন হবে ।

অতএব এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে , তাদের ব্যাপারে যে শাফাআত করা হবে তা শাফআতের পারিভাষিক অর্থে নয় বরং তার অর্থ হল আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উসিলা ধরা ।

তৃতীয় অধ্যায়

শাফাআতের উপকারীতা

গুনাহগারদের আজাব অপনোদন

মোতাজিলাদের যুক্তি পদ ও মর্যাদা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে

মোতাজিলাদের যুক্তি খণ্ডনে হাদীস ও বিবেকের যুক্তি ।

সত্যপন্থীদের মতামত ।

শাফাআত গুনাহগারদের আজাব অপনোদের কারন

শিয়া ও মাযহাবের বিভিন্ন সম্প্রদায় (শুধুমাত্র মোতাজিলা সম্প্রদায় ব্যতীত)এর বিশ্বাস হল শাফাআত গুনাহগার ব্যক্তিদের দোযখের আযাব থেকে মুক্তির কারন হবে । তবে কিছু কিছু রেওয়ায়েত থেকে বুঝা যায় যে ,শাফাআতের কারনে গুনাহ গুনাহ ও মাফ হয়ে থাকে উদাহরন স্বরূপ নিম্নোক্ত হাদীস প্রনিধান যোগ্য ।

১। শাফাআত যে সব গুনাহগারদের জন্য প্রযোজ্য হবে যারা শিরক ও জুলুম করেনি ।৪৯

২। কেয়ামতের দিন (সব নারীরাই শাফাআত করতে পারবেন)আমার গর্বের বিষয় হল সেদিন আমি আমার গুনাহগার উম্মতের জন্য শাফাআত করব ।৫০

৩।আমার শাফাআত আমার গুনাহগার উম্মতের জন্য ।৫১

এ ধরনের প্রচুর রেওয়ায়েত রয়েছে যেগুলো গুনাহগার ব্যক্তিদের দোযখের আগুন থেকে মুক্তির বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে । আর সে কারনে কিছু কিছু আলেমগন দাবী করেছেন যে এই রেওয়ায়েত তাওয়াতোরের পর্যায়ে পৌঁছেছে । এ প্রসঙ্গে মহান মোফাসসেরে কোরআন ফখরুদ্দীন রাবী লিখেছেন ,যদি ও এ ধরনের প্রত্যেকটি রেওয়ায়েত এককভাবে একক খবর হিসেবে এসেছে তথাপি এত অধিক এবং তাদের সবগুলোর অর্থ প্রায় একইরূপ । ফরে বলা যায় যে এই হাদীস তাত্তাতোরের পর্যায়ে পৌঁছেছে (শাফাআত গুনাহ মাফের কারন ) । অতএব শাফাআত সম্পর্কিত হাদীস একটি হুজ্জাত ও দলীল ।৫২

শেখ তানভীর ( আহলে সুন্নাতের এক বড় আলেম ) বলেন , জেনে নাও! শাফাআত সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস হল যে , তাদের ভাষায়: শাফাআতের কারনে গুনাহগারদের প্রাপ্য আজাব ক্ষমা করা হয় । এটা এভাবে হবে যে ,মহা মুসিবতের সেই কেয়ামতের দিনে যখন গুনাহগারদের জাহান্নামে পাঠানোর পরিকল্পনা করা হবে তখন শাফাআতের কারনে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে এবং জাহান্নমের পরিবর্তে বেহেশতে পাঠানো হবে ।৫৩

এ প্রসঙ্গে সুন্নী ও শিয়াদের আলেমগন এজমা করেছেন যে , তাদের কিছু কিছু মতামত নিম্নরূপ :

১ । শেখ মুফিদ: ইমামিয়াগন একমত প্রকাশ করেছেন যে ,কেয়ামতের দিন গুনাহগারদেরকে শাফাআত করা হবে ।৫৪

২ ।কাজী আইয়াজ: আহলে সুন্নাতের ভূতপূর্ব ও সাম্প্রতিক কালের সকল আলেমগন ,মুমিনদের গুনাহ মাফের জন্য কেয়ামতের দিন শাফাআত করা হবে বলে মনে করেন ।৫৫

৩ ।ফখরুদ্দীন রাযী: উম্মতে ইসলামীর এজমা হল যে , হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম কেয়ামতের দিন শাফাআত করবেন এবং অত:পর বলেন , শাফাআতের ফলে আজাব ভোগের উপযোগী ব্যক্তিদের আজাব মাফ করা হবে ।৫৬

মোতাজিলা সম্প্রদায় এ ব্যপারে দ্বিমত প্রকাশ করে থাকে এবং নিম্নোক্ত আয়াত সমূহের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে ।

) و َاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ(

অর্থ: সেদিনকে ভয় কর , যখন কেউ কারও সামান্যতম উপকারেও আসবেনা এবং তার পক্ষে কোন শাফাআত ও কবুল করা হবেনা , কারও কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণও নেয়া হবেনা এবং তারা কোন প্রকার সাহা্য্য ও পাবেনা ।৫৭

আমাদের মতে এই আয়াত বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় এর জন্য নাযিল হয়েছে , তবে অন্য যে কোন লোকই বাতিল ও ভ্রান্ত ধারনায় বিশাসী তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে অর্থাৎ তাদের জন্য শাফাআত প্রযোজ্য হবে না এবং এই আয়াত তাদেরকে নিরাশ করেছে। অতএব গুনাহগার ব্যক্তিদের গুনাহ মাফের বিষয়কে এই আয়াত পত্যাখ্যান করেনা।

আল্লামা হিল্লি এ সকল আয়াত সমূহ -প্রসঙ্গে বলেন ,

وَلَا تَنفَعُ الشَّفَاعَةُ - يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا- فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

এ সকল আয়াত বিশেষ করে কাফের ও মুশরিদের জন্য প্রযোজ্য ,৫৮ কারণ তারা শাফাআতের মাধ্যমে কোনরূপ উপকৃত হবেনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেন ,

আমার শাফাআত সে সব গুনাহগার ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য ,যারা মুশরিক ও কাফের নয় ।৫৯ .

( وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ)

এই আয়াতেরهم অর্থাৎ সে সব কাফেরগণ ।

মোতাজিলা সম্প্রদায়ও এ আয়াত সম্পর্কে ধারণা করে থাকেন যে , আল্লাহ তালা এ আয়াতের মাধ্যমে খবর দেন যে , ফেরেশতারা সেদিন কোন ব্যক্তিকে শাফাআত করবেনা কিন্তু যদি আল্লাহ তালা কারও উপর সন্তুষ্ট থাকে তাহলে সে ব্যক্তি শাফাআত করতে পারবে। এবং এটা স্পষ্ট যে , ফাসেক ও গুনাহগার ব্যক্তিদের উপর আল্লাহ তালা সন্তুষ্ট নন , অতএব ফেরেশতারা তাদের জন্য এবং শাফাআত করবেনা নবী রাসূলগণও তাদের জন্য শাফাআত করবেনা , কারণ শাফাআত কারীদের মধ্যে কোন বিভেদ নেই ।

তাদের আপত্তির জবাব

প্রথম জবাব : আল্লাহ তালা কোন দিক দিয়েই ফাসেক ব্যক্তিদের উপর সন্তুষ্ট নন। কিন্তু যদি আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাসী থাকে এবং ঈমান এনে থাকে তাহলে তার ব্যাপারে শাফাআত প্রযোজ্য হবে কারণ তার ব্যাপারে আল্লাহ সম্মত থাকবেন , যদিও সে ব্যক্তি গুনাহগার হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,

ফেরেশতাগণ,নব ী রাসূল ও শহিদদেরকে শাফাআত করার অনুমতি দেয়া হবে , তারা শাফাআত করবেন এবং যাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান থাকবে তারা শাফাআতের মাধ্যমে দোযেখের আগুন থেকে মুক্তি পাবে।৬০

এই হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন , যদিও মানুষ পরিপূর্ণ ঈমানের অধিকারী না হয় তবও আল্লাহ তালা তাকে শাফাআত করার জন্য সন্তুষ্ট থাকবে এবং শাফাআতের মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।

দ্বিতীয় জবাব : وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَىٰ .এই আয়াত প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে ইমাম রেজা বলেন ,.শাফাআত কারীগণ সে সব ব্যক্তিদের জন্য শাফাআত করবেন আল্লাহ তালা যাদের দীন ও ধর্ম সম্পর্কে সন্তুষ্ট থাকবেন।৬১

অতএব , ফাসেক ও গুনাহগার ব্যক্তির দীন ও ধর্ম যদি খোদা সম্মত থাকে তবে তাদেরকে শাফাআত করা হবে।

শাফাআত সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস হল কোন ব্যক্তি ছোট বড় যত গুনাহই করে থাকুক যদি আল্লাহ তার ধর্মের উপর সন্তুষ্ট থাকে তাহলে সে শাফাআত পাবে।৬২

فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

উল্লেখিত আয়াত সম্পর্কে মোতাজিলা সম্প্রদায় বলে থাকেন ,যদি শাফাআতের ফলে আজাব থেকে উদ্ধার পাওয়া যায় এবং তারা এর মাধ্যমে উপকৃত হয় তাহলে তা উক্ত আয়াতের পরিপন্থি ।

জবাব: ফখরুদ্দীন রাযী এ যুক্তির মোকাবেলায় বলেন , তার মতে এ আয়াতটি শাফাআতের বিরুদ্ধে নয় বরং তা শাফাআতের পক্ষেরই একটি দলিল স্বরূপ। কারণ কাফের মুশরিকরা শাফাআত থেকে কোন সুবিধা ভোগ করবেনা আর এর কারণ হল তাদের কফরী কাজ সমূহ। নতুবা উক্ত আয়াতের মাধ্যমে শাফাআত প্রমাণিত হয় কারণ উক্ত আয়াতে শাফাআত শব্দটি শাফিয়িণ এর সাথে যুক্ত হয়েছে আরবী ভাষামতে তা শাফাআতের প্রমাণ বহন করে। কারণ যুক্ত শব্দটি বহুবচন আর আল্লাহর সম্বোধন হল কাফেরদের প্রতি কিন্তু মুসলমানরা কাফের নয়। অতএব শাফাআত মুসলমানদের জন্য যুক্তিযুক্তভাবে প্রমানিত হয়।

) و َإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ يَصْلَوْنَهَا يَوْمَ الدِّينِ وَمَا هُمْ عَنْهَا بِغَائِبِينَ( .

নিশ্চয় পাপাচারীরা থাকবে দোযখের আগুনে। তারা বিচার দিবসে তথায় প্রবেশ করবে। তারা সেখান থেকে পৃথক হবেনা।৬৩

মোতাজিলা সম্প্রদায় বিশ্বাস করে থাকে , উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে , পাপাচারীরা দোযখে অনন্তুকাল ধরে থাকবে ও সেখান থেকে কোন দিন বের হতে পারবেনা। অতএব গুনাহগারা যদি জাহান্নামে প্রবেশ করে থাকে তাহলে আর বের হওয়ার উপায় থাকবেনা। অতএব এ অবস্থায় শাফাআতের কারণে কবিরা গুনাহ সমূহ ক্ষমা হতে পারেনা।

আমাদের মতে তাদের এ ধারনার কারণ হল যে তারা কবিরা গুনাহকারী ব্যক্তিদের কাফের মনে করে থাকে যদিও তারা আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছে।

ওমর আবু নাসের এ ব্যাপারে বলেন , মোতাজিলা সম্প্রদায় বিশ্বাস করেন যে , যারা কবিরা গুনাহ করে তারা নবী রাসুলদের প্রতি ঈমান আনলেও কাফের বলে পর্যবসিত হবে কিন্তু আমাদের মতে (আক্কল ও কোরআন হাদীসের যুক্তি মোতাবেক) কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ ও তার রাসুলকে স্বীকার করে নেয় কিন্তু গুনাহ করে থাকে তাহলে সে কাফের নয়।৬৪ এবং চির দিনের জন্য জাহান্নামে থাকবেনা ।

বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল

যদি কোন মুসলমান অধিক পরিমাণ ভাল কাজ করে থাকে এবং সারা জীবনে কিছু পরিমাণ পাপ করে ; সে অবস্থায় যদি তাকে চিরদিন দোযখের আগুনে জ্বলতে হয়। তাহলে তার প্রতি অবিচার করা হবে। আর আল্লাহ তালা কারো প্রতিই অবিচার করেন না , অতএব শাফাআতের কারণে সে ব্যক্তি দোযখের আগুন থেকে ক্ষমা পেয়ে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে।

কোরআন হাদীসের যুক্তি

ক-কোরআনের আয়াত:

শাফাআত সম্পর্কিত প্রচুর আয়াত আছে তবে শর্ত হল শাফাআত প্রার্থী কাফের অথবা মুশরিক নয়।

উদাহরণস্বরূপ:

) إ ِنَّ اللَّـهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ( .

যে ব্যক্তি শিরক করে আল্লাহ তালা তার গুনাহ খাতা সমূহ ক্ষমা করেন না ।কিন্তু শিরক ব্যতীত অন্য যে কোন গুনাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন ।৬৫

মোতাজিলাদের যুক্তিগত আয়াত ছাড়া ও এমন কিছু আয়াত আছে যেগুলো দ্বারা মোতাজিলাদের যুক্তি খণ্ডন করে শাফাআত কে প্রমান করা যায় । কারন উক্ত আয়াত সমূহে আল্লাহ তা আলা গুনাহ খাতা মাফ করার ওয়াদা দিয়েছেন । আল্লামা হিল্লি এ প্রসঙ্গে অসংখ্য যুক্তি পেশ করেছেন । তিনি বলেছেন ,যে ব্যক্তি ,ঈমান এনেছে ও সৎ কাজ করেছে সর্বদাই সওয়াব পাওয়ার উপযোগী । আল্লাহ তা আলা এ প্রসঙ্গে বলেন ,

) ف َمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ(

যে ব্যক্তি বিন্দু পরিমান সৎ কাজ করেছে তার প্রতিদান ও সেদিন দেখতেপাবে ।৬৬ আর ইমান হল সর্বোচ্চ সওয়াবের কাজ এবং ঈমানের ফলে চিরকালই সওয়াবের অধিকারী হয় । যদি বলে থাকি যে ঈমানদার ব্যক্তির জন্য পাপকর্মের আজাব সৎ কাজের প্রতিদানে অগ্রাধিকার প্রাপ্য তবে তা যুক্তিযুক্ত নয় । আর এ ব্যপারে আলেমগন এজমাতে একমত হয়েছেন ।৬৭

খ- হাদীস:

মাসুম ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে অসংখ্য হাদীস আছে যেগুলো থেকে বুঝা যায় যে , শাফাআতের উসিলায় গুনাহগারদের গুনাহ ক্ষমা করা হবে । উদাহরনস্বরূপ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর এ হাদিসটি ;شفاعتی لاصحاب الکبائر

আমার শাফাআত কারীরা গুনাহকারীদের জন্য । অতএব বুদ্ধিবৃত্তিক ও কোরআন হাদীসের যুক্তি দ্বারা মুতাজিলাদের আপত্তি খন্ডিত হয়েছে এবং এরূপ বলা যেতে পারে যে যদি কেহ কোন গুনাহ করার পর তওবা না করেই মৃত্যু বরন করে তাহলে ও সে শাফাআতের কারনে মুক্তি পেতে পারে এবং চিরদিন তাকে জাহান্নামে থাকতে হবেনা ।

ফলাফল:

উপরোক্ত আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রমানিত হয় যে ,শিয়া ও সুন্নী সব আলেমরাই বিশ্বাস করেন যে ,শরিয়তের ভিক্তিতেই শাফাআত কারীগন ক্ষমার উপযুক্ত পাপী ব্যক্তিদের জন্য সুপারিশ করে তাদেরকে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন ।

চতুর্থ অধ্যায়

কখন ও কোথায় শাফাআত করা হবে ?

সে সময় ও স্থান হর কেয়ামত ও জাহান্নাম

আয়াত

হাদীস

বারজাখে ও দুনিয়াতেও শাফাআত করা হবে ।

ফলাফল

চতুর্থ ইমাম

হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.)

তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.) হলেন চতুর্থ ইমাম । তার প্রসিদ্ধ উপাধি হল সাজ্জাদ ও জয়নুল আবেদীন । আর এ দুটো নামেই (উপাধি) তিনি অধিক পরিচিত । তার মা হলেন ইরানের ইয়াযদগের্দের রাজকন্যা । হযরত ইমাম সাজ্জাদই (আ.) ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র । কারণ , ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অন্য তিন ভাই কারবালায় শাহাদৎ বরণ করেন ।৩৪

অবশ্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-ও পিতার সাথে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তিনি সেখানে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন । যার ফলে অস্ত্র বহন বা যুদ্ধ করার মত দৈহিক সামর্থ তখন তার মোটেই ছিল না । তাই তিনি জিহাদে অংশ গ্রহণ বা শাহাদত বরণ করতে পারেননি । যুদ্ধশেষে ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদের সাথে বন্দী অবস্থায় তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় । তারপর সেখানে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটানোর পর গণসন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইয়াযিদের নির্দেশে সসম্মানে তাকে মদীনায় পা ঠানো হয় । পরবর্তীতে আব্দুল মালেক নামক জনৈক উমাইয়া খলিফার নির্দেশে চতুর্থ ইমামকে পুনরায় বন্দী করে শিকল দিয়ে হাত পা বেধে দামেস্কে পাঠানো হয় । অবশ্য দামেস্ক থেকে আবার তাকে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয় ।৩৫

চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.) মদীনায় ফেরার পর ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । অপরিচিতদেরকে সাক্ষাত প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন । তখন থেকেই সর্বক্ষণ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন । হযরত আবু হামজা সামালী (রা.) ও হযরত আবু খালেদ কাবুলীর (রা.) মত বিশিষ্ট শীয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সাথেই তিনি যোগাযোগ করতেন না । ইমামের ঐ বিশিষ্ট সাহাবীরা তার কাছ থেকে যেসব জ্ঞান আরহণ করতেন , তা তারা শীয়াদের মধ্যেই বিতরণ করতেন । এভাবে শীয়া মতাদর্শের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে । আর এর প্রভাব পরবর্তীতে পঞ্চম ইমামের যুগে প্রকাশিত হয় । সাহিফাতুস সাজ্জাদিয়াহ নামক চতুর্থ ইমামের দোয়ার সংকলন তার অবদান সমূহের অন্যতম । এই ঐতিহাসিক দোয়ার গ্রন্থটিতে ৫৭টি দোয়া রয়েছে । যার মধ্যে ইসলামের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে । এই গ্রন্থ কে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের যাবুর (হযরত দাউদের (আ.) কাছে অবতির্ণ ঐশী গন্থ) বলে অভিহিত করা হয় । বেশকিছু শীয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৫ বছর যাবৎ ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর উমাইয়া খলিফা হিশামের প্ররোচণায় ওয়লিদ। ইবনে আব্দুল মালেক নামক জনৈক ব্যক্তি বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-কে হত্যা করে ।৩৬ এভাবে হিজরী ৯৫ সনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শাহাদত বরণ করেন ।

পঞ্চম ইমাম

ইমাম বাকের (আ.)

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী ওরফে বাকের (আ.) হলেন পঞ্চম ইমাম । বাকের অর্থ পরিস্ফুটনকারী । মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন ।৩৭ তিনি ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র । তিনি হিজরী ৫৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর । কারবালায় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ব পুরুষদের ওসিয়তের মাধ্যমে তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন ।

হিজরী ১১৪ অথবা ১১৭ সনে (কিছু শীয় বর্ণনা অনুযায়ী) উমাইয়া খলিফা হিশামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহীম বিন ওয়লিদ বিন আব্দুল মালেকের দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৩৮

পঞ্চম ইমামের যুগে ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন গণঅভ্যুত্থান ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এমনকি স্বয়ং উমাইয়া পরিবারের মধ্যেও মতভেদ শুরু হয় । এ সব সমস্যা উমাইয়া প্রশাসনকে এতই ব্যস্ত রাখে যে , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা হয়ে উঠতো না । যার ফলে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি তাদের অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা কমে যায় । এছাড়া কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এবং পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্যাতিত অবস্থা জনগণের হৃদয়ের আবেগ অনুভুতিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল । আর চতুর্থ ইমাম ছিলেন কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী । এর ফলে ক্রমেই মুসলমানরা পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন । এ সব কারণে , পঞ্চম ইমামের দর্শন লাভের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে মদীনায় জনগণ এবং বিশেষ করে শীয়াদের গণস্রোতের ঢল নামে । যার ফলে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপক সুযোগ ইমাম বাকের (আ.)-এর জন্যে সৃষ্টি হয় । এমনকি তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) জীবনেও এমন সুবর্ণ সুযোগ কখনও আসেনি । এ যাবৎ প্রাপ্ত অসংখ্য হাদীসই এ বক্তব্যের উত্তম সাক্ষী । শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী , পণ্ডিত ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ অসংখ্য বিখ্যাত আলেমই হযরত ইমাম বাকেরর (আ.) পবিত্র জ্ঞান নিকেতনে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হয়েছেন । ঐসব বিশ্ববিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিতগণের পূর্ণ পরিচিতি রিজাল (ইসলামী ঐতিহাসিক জ্ঞানী গুণীদের পরিচিতি শাস্ত্র) শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত আছে ।৩৯

ষষ্ঠ ইমাম

ইমাম জাফর আস্ সাদেক (আ.)

পঞ্চম ইমামের পুত্র হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক (আ.) ছিলেন ষষ্ঠ ইমাম । তিনি হিজরী ৮৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে (শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে) আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪০ ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল । ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে মুসাওয়াদাহু বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কেননা , ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয় । এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল । পঞ্চম ইমাম তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামতের যুগে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন । এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন । এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান । ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণপ প্রাপ্ত হয়েছেন । যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ , মুহাম্মদ বিন মুসলিম , মুমিন তাক , হিশাম বিন হাকাম , আবান বিন তাগলুব , হিশাম বিন সালিম , হারিয , হিশাম কালবী নাসাবাহ , জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী , কাযী সাকুনী , কাযী আব্দুল বাখতারী , প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য , যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য ।৪১ হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ , মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী ।

কিন্তু হযরত জাফর সাদেক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন । খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা , নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন । আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন । তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয় । খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত । অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত । তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে । তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত । তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত ।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে । অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন । এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল । খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন । খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল । সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল । অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । ইমাম মদীনায় ফিরে যান । ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন তাকীয়ার মাঝে অতিবাহিত করেন । তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয় ।৪২

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো । ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে , মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায় । অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা (উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে । ইমামের ওসিয়ত নামায় যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে , তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় । এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া । কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে । খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার ওসিয়ত নামা চেয়ে নেয় । কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । কারণ , ঐ ওসিয়ত নামায় ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন । ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর , মদীনার প্রশাসক , ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্ , ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ । এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল ।৪৩

চতুর্থ ইমাম

হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.)

তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.) হলেন চতুর্থ ইমাম । তার প্রসিদ্ধ উপাধি হল সাজ্জাদ ও জয়নুল আবেদীন । আর এ দুটো নামেই (উপাধি) তিনি অধিক পরিচিত । তার মা হলেন ইরানের ইয়াযদগের্দের রাজকন্যা । হযরত ইমাম সাজ্জাদই (আ.) ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র । কারণ , ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অন্য তিন ভাই কারবালায় শাহাদৎ বরণ করেন ।৩৪

অবশ্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-ও পিতার সাথে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তিনি সেখানে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন । যার ফলে অস্ত্র বহন বা যুদ্ধ করার মত দৈহিক সামর্থ তখন তার মোটেই ছিল না । তাই তিনি জিহাদে অংশ গ্রহণ বা শাহাদত বরণ করতে পারেননি । যুদ্ধশেষে ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদের সাথে বন্দী অবস্থায় তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় । তারপর সেখানে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটানোর পর গণসন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইয়াযিদের নির্দেশে সসম্মানে তাকে মদীনায় পা ঠানো হয় । পরবর্তীতে আব্দুল মালেক নামক জনৈক উমাইয়া খলিফার নির্দেশে চতুর্থ ইমামকে পুনরায় বন্দী করে শিকল দিয়ে হাত পা বেধে দামেস্কে পাঠানো হয় । অবশ্য দামেস্ক থেকে আবার তাকে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয় ।৩৫

চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.) মদীনায় ফেরার পর ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । অপরিচিতদেরকে সাক্ষাত প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন । তখন থেকেই সর্বক্ষণ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন । হযরত আবু হামজা সামালী (রা.) ও হযরত আবু খালেদ কাবুলীর (রা.) মত বিশিষ্ট শীয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সাথেই তিনি যোগাযোগ করতেন না । ইমামের ঐ বিশিষ্ট সাহাবীরা তার কাছ থেকে যেসব জ্ঞান আরহণ করতেন , তা তারা শীয়াদের মধ্যেই বিতরণ করতেন । এভাবে শীয়া মতাদর্শের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে । আর এর প্রভাব পরবর্তীতে পঞ্চম ইমামের যুগে প্রকাশিত হয় । সাহিফাতুস সাজ্জাদিয়াহ নামক চতুর্থ ইমামের দোয়ার সংকলন তার অবদান সমূহের অন্যতম । এই ঐতিহাসিক দোয়ার গ্রন্থটিতে ৫৭টি দোয়া রয়েছে । যার মধ্যে ইসলামের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে । এই গ্রন্থ কে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের যাবুর (হযরত দাউদের (আ.) কাছে অবতির্ণ ঐশী গন্থ) বলে অভিহিত করা হয় । বেশকিছু শীয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৫ বছর যাবৎ ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর উমাইয়া খলিফা হিশামের প্ররোচণায় ওয়লিদ। ইবনে আব্দুল মালেক নামক জনৈক ব্যক্তি বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-কে হত্যা করে ।৩৬ এভাবে হিজরী ৯৫ সনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শাহাদত বরণ করেন ।

পঞ্চম ইমাম

ইমাম বাকের (আ.)

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী ওরফে বাকের (আ.) হলেন পঞ্চম ইমাম । বাকের অর্থ পরিস্ফুটনকারী । মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন ।৩৭ তিনি ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র । তিনি হিজরী ৫৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর । কারবালায় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ব পুরুষদের ওসিয়তের মাধ্যমে তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন ।

হিজরী ১১৪ অথবা ১১৭ সনে (কিছু শীয় বর্ণনা অনুযায়ী) উমাইয়া খলিফা হিশামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহীম বিন ওয়লিদ বিন আব্দুল মালেকের দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৩৮

পঞ্চম ইমামের যুগে ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন গণঅভ্যুত্থান ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এমনকি স্বয়ং উমাইয়া পরিবারের মধ্যেও মতভেদ শুরু হয় । এ সব সমস্যা উমাইয়া প্রশাসনকে এতই ব্যস্ত রাখে যে , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা হয়ে উঠতো না । যার ফলে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি তাদের অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা কমে যায় । এছাড়া কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এবং পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্যাতিত অবস্থা জনগণের হৃদয়ের আবেগ অনুভুতিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল । আর চতুর্থ ইমাম ছিলেন কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী । এর ফলে ক্রমেই মুসলমানরা পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন । এ সব কারণে , পঞ্চম ইমামের দর্শন লাভের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে মদীনায় জনগণ এবং বিশেষ করে শীয়াদের গণস্রোতের ঢল নামে । যার ফলে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপক সুযোগ ইমাম বাকের (আ.)-এর জন্যে সৃষ্টি হয় । এমনকি তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) জীবনেও এমন সুবর্ণ সুযোগ কখনও আসেনি । এ যাবৎ প্রাপ্ত অসংখ্য হাদীসই এ বক্তব্যের উত্তম সাক্ষী । শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী , পণ্ডিত ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ অসংখ্য বিখ্যাত আলেমই হযরত ইমাম বাকেরর (আ.) পবিত্র জ্ঞান নিকেতনে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হয়েছেন । ঐসব বিশ্ববিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিতগণের পূর্ণ পরিচিতি রিজাল (ইসলামী ঐতিহাসিক জ্ঞানী গুণীদের পরিচিতি শাস্ত্র) শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত আছে ।৩৯

ষষ্ঠ ইমাম

ইমাম জাফর আস্ সাদেক (আ.)

পঞ্চম ইমামের পুত্র হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক (আ.) ছিলেন ষষ্ঠ ইমাম । তিনি হিজরী ৮৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে (শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে) আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪০ ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল । ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে মুসাওয়াদাহু বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কেননা , ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয় । এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল । পঞ্চম ইমাম তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামতের যুগে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন । এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন । এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান । ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণপ প্রাপ্ত হয়েছেন । যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ , মুহাম্মদ বিন মুসলিম , মুমিন তাক , হিশাম বিন হাকাম , আবান বিন তাগলুব , হিশাম বিন সালিম , হারিয , হিশাম কালবী নাসাবাহ , জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী , কাযী সাকুনী , কাযী আব্দুল বাখতারী , প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য , যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য ।৪১ হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ , মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী ।

কিন্তু হযরত জাফর সাদেক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন । খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা , নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন । আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন । তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয় । খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত । অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত । তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে । তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত । তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত ।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে । অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন । এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল । খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন । খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল । সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল । অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । ইমাম মদীনায় ফিরে যান । ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন তাকীয়ার মাঝে অতিবাহিত করেন । তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয় ।৪২

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো । ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে , মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায় । অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা (উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে । ইমামের ওসিয়ত নামায় যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে , তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় । এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া । কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে । খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার ওসিয়ত নামা চেয়ে নেয় । কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । কারণ , ঐ ওসিয়ত নামায় ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন । ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর , মদীনার প্রশাসক , ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্ , ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ । এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল ।৪৩


4

5

6

7

8