শাফাআত পাওয়ার শর্তাবলী
ধর্মের আলোকে শাফাআত প্রার্থীদের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক যার ফলে তাদের প্রতি শাফাআত প্রযোজ্য হবে । এ পর্যায়ে আমরা যে সব শর্তাবলীর প্রতি ইশারা করব ।
প্রথমত:শাফাআত প্রার্থীগনকে ইমানদার হতে হবে
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,“
আমার শাফাআত যে ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য যারা তাদের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কোন শিরক করেনি ।
এই হাদীস মোতাবেক মুশরিক ও কাফেরদের জন্য শাফাআত প্রযোজ্য হবেনা । কোরআনের আয়াত এই বিষয়কে সত্যায়ন করে ।
)
ف
ِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ ﴿٤٠﴾ عَنِ الْمُجْرِمِينَ ﴿٤١﴾ مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ ﴿٤٢﴾ قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ ﴿٤٣﴾ وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ ﴿٤٤﴾ وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ ﴿٤٥﴾ وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ ﴿٤٦﴾ حَتَّىٰ أَتَانَا الْيَقِينُ ﴿٤٧﴾ فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ ﴾
“
বেহেশত বাসীরা দোজখ বাসীদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বলবে তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে নিপতিত করেছে ?
তারা বলবে আমরা নামাজ পড়তামনা , অভাব গ্রস্থকে আহার্য দিতামনা , আমরা ভ্রান্ত লোকদের সাথে সমালোচনা করতাম। আমরা সেই দিনকে (কেয়ামতের দিনকে) অস্বীকার করতাম। আর এহেন পরিস্থিতিতে আমাদের মৃত্যু হয়। অতএব শাফাআত কারীদের শাফাআত তাদের জন্য কোন উপকারে আসবেনা।
﴿
وَجُنُودُ إِبْلِيسَ أَجْمَعُونَ ﴿٩٥﴾ قَالُوا وَهُمْ فِيهَا يَخْتَصِمُونَ ﴿٩٦﴾ تَاللَّـهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ ﴿٩٧﴾ إِذْ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿٩٨﴾ وَمَا أَضَلَّنَا إِلَّا الْمُجْرِمُونَ ﴿٩٩﴾ فَمَا لَنَا مِن شَافِعِينَ ﴿١٠٠﴾ وَلَا صَدِيقٍ حَمِيمٍ﴾
ইবলিশের দলভূক্ত সকলেই যখন কথা কাটাকাটি করতে থাকবে তখন বলবে ,আল্লাহর কসম আমরা স্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত ছিলাম , কারন আমরা তোমাদেরকে বিশ্ব পালনকর্তার সমতূল্য মনে করতাম । আমাদের দুস্কৃদকারীরাই গোমরাহ করেছিল ,অতএব আমাদের কোন শাফাআতকারী নেই এবং কোন সহৃদয় বন্ধু ও নেই ।
দ্বিতীয়ত: রাসূলের খান্দানের দুশমন ছিলনা
অন্য একটি বৈশিষ্ট যা শাফাআত প্রার্থীদের জন্য থাকা প্রয়োজন তা হল শাফাআতকারীরা তাদের জীবনে রাসূলের আহলে বাইতের সাথে কোন রকম দুশমনি করেনি ।এ সম্পর্কে বেশ কিছু হাদীস বর্ণিত হয়েছে ।
এরূপ একটি হাদীস লক্ষ্যে করুন :
মুমিনগন তাদের বন্ধুদের জন্য শাফাআত করবেন তবে তারা আহলে বাইতের দুশমন ছিলনা (কারন আহলে বাইতের দুশমন শাফাআত পাবেনা)এবং যদি তারা নাসেবী (যারা পবিতও ইমামদের দুশমন) হয় তাহলে যদি সকল নবী রাসূল ও ফেরেশতাগন ও তাদের জন্য শাফাআত করে তবুও কবুল হবেনা ।
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন ,
“
যদি সমস্ত ও আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসূলগন নাসেবী(
যারা পবিত্র ইমামের দুশমন)দের জন্য শাফাআত করে তবুও তা কবুল করা হবেনা ।
তৃতীয়ত : নবীর সন্তানদের কোন রকম কষ্ট দেয়নি ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন , যখন আমি এই মাকামে মাহমুদে অধিষ্টিত হব তখন আমার উম্মতের জন্য শাফাআত করব এবং তা কবুল করা হবে । আল্লাহর কসম যারা আমার বংশের লোকজনদেরকে কষ্ট দিয়েছে তাদের জন্য শাফাআত করবনা ।
আল্লাহর রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,“
ওহে হুসাইন , অতি শিঘ্রই তোমাকে এমন অবস্থায় দেখব যে তোমার রক্ত টগবগিয়ে গড়াতে থাকবে , আমার জালিম উম্মতগন তোমার শিরচ্ছেদ করবে তুমি তৃষ্ণার্ত থাকবে কিন্তু তোমাকে তারা পানি দিবেনা । এত কিছুর পরে ও আমার শাফাআতের আশা পোষন করবে! আল্লাহ তালা তাদের কপালে আমার শাফাআত রাখেনি ।
চতুর্থ : নামাজের প্রতি অবহেলা করেনি
ইমাম সাদিক (আ.) মৃত্যুর সময় সংক্ষিপ্ত ভাবে বলেন ,“
যে নামাজের প্রতি অবহেলা করবে তারা আমাদের শাফাআত পাবেনা ।
পঞ্চমত: নবী রাসূলদের শাফাআতকে অস্বীকার করেনি ।
ইমাম আলী (আ.)বলেন ,
“
যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর শাফাআত কে অস্বীকার করবে সে তার শাফাআত পাবেনা ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,“
যে কেউ আমার শাফাআতের প্রতি অবিশ্বাস করবে তার ভাগ্যে আমার শাফাআত জুটবেনা ।
ষষ্ঠত : প্রতারক ও ধোকাবাজ নয় ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,
“
যে কেউ আমার সাথে খেয়ানত করবে সে আমার শাফাআত থেকে কোনরূপ ফলভোগ করবেনা ।
বিশেষ পয়েন্ট : এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে , দ্বীনি ভাইদের সাথে খেয়ানত করলে তা শাফাআতের জন্য বাঁধা হয়ে দাড়ায় , এবং উল্লেখিত হাদীসে ব্যবহৃত আরব শব্দটি তারই উদাহরন হিসেবে পেশ করা হয়েছে ।
সপ্তমত : মদখোর নয় ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,“
আল্লাহর কসম যারা মদখোর তাদের জন্য আমার শাফাআত থাকবেনা এবং তারা আমার হাউজের ( হাউজে কাউসার) কাছে আসতে পারবেনা ।”
অষ্টমত : জেনাকারী নয় ।
ইবনে শাবল হতে বর্ণিত হয়েছে যে , ইমাম সাদিক (আ.) এর কাছে প্রশ্ন করেছিলাম এক মুসলমান ব্যক্তি তার চাকরানীর সাথে খেয়ানত করেছে , কিভাবে সেই পাপের শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে পারে ?
ইমাম বললেন , অবশ্যই সেই চাকরানীর মালিকের কাছ থেকে অনুমোদন চাইতে হবে এবং ভবিষ্যতে সে অপকর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে । জিজ্ঞেস করলাম , যদি সে সম্মতি না দেয় , কি হবে ? ইমাম বললেন ,“
নিরুপায় হয়ে জেনাকারী অবস্থায় আল্লাহর সামনে সাক্ষাত করবে ।”
বললাম তাহলে অবশেষে জাহান্নামে যাবে!”
বললাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামও আমাদের শাফাআতের মাধ্যমে তোমরা মুক্তি পাবে তবে কি তোমরা পূনরায় পাপে লিপ্ত হবে ?
আল্লাহর কসম , আমাদের এরূপ গুনাহগার ব্যক্তির জন্য পৌঁছাবেনা যতক্ষন সে আজাব ভোগ না করবে এবং দোযখের ভয়াবহতা না দেখবে ।
একটি প্রশ্ন :
এমন কিছু হাদীস আছে যে ,স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যারা বিন্দু পরিমান ঈমানের অধিকারী হবে তারা ও শাফাআতের অধিকারী হবে ,যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লামবলেন ,
“
শাফাআতকারীগন শাফাআত করবে যারা অন্তত পক্ষে তাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান পোষন করবে ।”
এখন প্রশ্ন হল : এই হাদীসটি পূর্বোক্ত হাদীসের সাথে কিভাবে সামনজস্য রাখে ?
জবাব
:
কাফের , মুশরিক এবং যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম ও ইমামদের সাথে দুশমনি করে তারা চিরদিনই জাহান্নামে থাকবে ,কারন তারা শাফাআতের উপযোগী নয় । কিন্তু এসব ব্যক্তি ব্যতিত অন্যান্য পাপী ব্যক্তিরা কিছুকাল আজাব ভোগ করার পর সম্ভাবনা রয়েছে শাফাআত পাবে ঠিক যেমন ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন ,“
জেনাকারীরা দোযখের ভয়াবহতা অনুধাবন এবং শাস্তি ভোগ করার পর শাফাআত পাবে যদি তাদের অন্তরে ঈমান থাকে এবং তারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবেনা”
এ থেকে বোঝা যায় যে , উক্ত হাদীস দুটির মাঝে কোন বিরোধ নেই । উক্ত ব্যক্তিরা (ঈমানদার অথচ পাপী) কিছুকাল দোযখের শাস্তি ভোগ করলে ও অবশেষে শাফাআতের মাধ্যমে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পাবে । ঠিক যেমন ইমাম রেজা বলেছেন ,“
একত্ববাদী গুনাহগার ব্যক্তিরা অনন্ততাল জাহান্নামে থাকবেনা , সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে এবং শাফাআত পাবে ।
ঠিক একই ভাবে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ,“
যারা অন্ততপক্ষে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলবে এবং বিন্দুমাত্র ঈমান পোষন করবে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি পাবে ।
অতএব উপরোক্ত আলোচনা থেকে বলা যেতে পারে যে , পারিভার্ষিক অর্থে শাফাআত শুধুমাত্র সেসব ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে যারা শাফাআতের যোগ্য ।
একইভাবে শাফাআতের স্থান সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে ,কেয়ামতের দিন দোযখে প্রবেশের পর অর্থাৎ এমন সম্ভাবনা আছে যে ,শাফাআতের যোগ্য কিছু কিছু ব্যক্তি প্রথমে জাহান্নামের ভয়াবহতা অনুধাবন ও আজাব ভোগ করার পর (এমনকি তা দীর্ঘকাল ধরে ও হতে পারে) শাফাআত পেতে পারে ।
এখন এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করব ,যেগুলো শাফাআতকে ত্বরান্বিত করে ও ফলে কিছু কিছু লোকের ভাগ্যে বেহেশত নাছিব হয় ।
1 । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা ও সহযোগীতা
হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছেন“
আমি কেয়ামতের দিন চার প্রকার ব্যক্তিদেরকে শাফাআত করব ।
(1) যে ব্যক্তি.
আমাদের সন্তানদেরকে ভালবাসবে ।
(2) যে ব্যক্তি তাদের প্রয়োজনীয়তা পূরন করবে ।
(3) যে ব্যক্তি তাদের কোন কাজ করার সময় নিজের অসহায় অবস্থা সত্বেও চেষ্টা করে থাকে তা পালন করার জন্য ।
(4) যে ব্যক্তি তার ভাষা ও অন্তর দ্বারা তাদেরকে ভালবাসে ।
2 । যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দরুদ পড়ে ।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,“
যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি দরুদ পড়ে ও বলে যে হে আল্লাহ তাকে কেয়ামতের দিন তোমার সান্নিধ্য দান কর । তার জন্য আমার শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যায় ।
গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট : উপরোক্ত হাদীস দুটিতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম কিছু কিছু ব্যক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেন যে ,শাফাআত করা হবে । তবে এমন নয় যে , সে ব্যক্তি ছাড়া অন্য কাউকে তিনি শাফাআত করবেন না । বরং উপরোক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায় যে , সেদিন তিনি উল্লেখিত ব্যক্তিদের সবার আগে শাফাআত করবেন যাতে তারা দোযখের আযাব থেকে অতি শীঘ্র নাযাত পায় ।