শাফাআত

শাফাআত37%

শাফাআত লেখক:
: মোঃ সামিউল হক
প্রকাশক: খেদমতে ইসলামী সংস্থা, কোম, ইরান
বিভাগ: ধর্ম এবং মাযহাব

শাফাআত
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 37 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 15187 / ডাউনলোড: 4138
সাইজ সাইজ সাইজ
শাফাআত

শাফাআত

লেখক:
প্রকাশক: খেদমতে ইসলামী সংস্থা, কোম, ইরান
বাংলা

যে বইটি বর্তমানে আপনাদের হাতে আছে তা একজন তাকওয়া সম্পন্ন বিশিষ্ট লেখকের সুদীর্ঘ কষ্টের ফসল। যা তিনি বিবেক সম্মত দলিল ও যুক্তি দিয়ে লিখেছেন। এই বইটি ব্যবহারের মাধ্যমে সত্যের পথ খুজে পাওয়ার অধিকার আপনাদের রয়েছে। তবে এই বইতে যে সকল দলিল ব্যবহার করা হয়েছে তা অতি উচ্চমানের এবং অধিক গ্রহণযোগ্য। সর্বোপরি এই বইতে উল্লেখিত প্রতিটি দলিলই হচ্ছে বিবেক সম্মত এবং যা কিছু তার সাথে সামঞ্জস্যতা রাখে তাতে আল্লাহ রাব্বুল আ লামিনেরও সহানুভতি থাকে।

শাফাআত সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের মতামত

ওহাবী সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য সব মুসলিম সম্প্রদায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারত গমন ও তাঁর কাছে শাফাআতের আবেদনকে (তার জীবদ্দশায় অথবা ওফাতের পর) জায়েয মনে করেন উদাহরণস্বরূপ কাসতালায়ী আহলে সুন্নাতের এক আলেম বলেন ,

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর কবর যিয়ারত করা যুক্তি সম্মত , (তার কবরের পাশে) অধিক কান্নাকাটি ও দোয়া করা , সাহায্য চাওয়া , শাফাআতের আবেদন করা , তাকে উসিলা করা সবই সঠিক ও যুক্তিযুক্ত কাজ।১৫০

তার মতে ঠিক যেমন তাহকিক উল বাছিরাহ এবং মেসবাহ উল কালাম গন্থে উল্লেখিত আছে , নিম্নলিখিত যে কোন স্থান ও সময়ে শাফাআতের আবেদন করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের পূর্বে ও পরে , তার জীবদ্দশায় , মৃত্যুর পর , বারজাখে , কেয়ামতের দিবসে অতঃপর অন্যান্য স্থানে।

আল্লামা আমিনি , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শাফাআতের আবেদন সম্পর্কিত আহলে সুন্নাতের মতামতকে নিম্নলিখিত ভাবে উল্লেখ করেন।

১। আল্লাহর কাছে প্রয়াজনীয় জিনিসের আবেদন নবী উসিলায় সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর বরকত ও উসিলা ।

২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে দোয়ার আবেদন।

তিনি বলেন: উপরোক্ত দু ভাবে আবেদন করা যে কোন অবস্থাতেই জায়েয।

৩। আবেদন করা হবে নবীর কাছে , এই অর্থে যে , আল্লাহর কাছে আবেদন করার ফলে তিনি শাফাআতের অনুমতি পাবেন এবং একারণে তিনি শাফাআত করতে পারবেন। অবশ্য এ বিষয়টিও দ্বিতীয় বিষয়টির অনুরূপ , কারণ দুই ও তিন নম্বর বিষয়টি বাহ্যিক ভাবে দু রকম মনে হয় তবে সত্যিকার ভাবে দুটি একই বিষয় ।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে আহলে সুন্নাতের মতেও হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর উভয় স্থানেই জায়েয।

শাফাআতের সম্পর্কে ওহাবী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস পর্যালোচনা ও গবেষণা করার ফলাফল:

অন্যান্য মসলিম সম্প্রদায়ের মত ওহাবীরাও শাফাআতের ঘটনাকে স্বীকার করেছেন , ঠিক যেমন মুহাম্মদ ইবনে আব্দু ল ওহাব বলেন , যদি বলা হয় , তুমি কি নবীকে অস্বীকারী কর এবং তার শাফাআত সম্পর্কে নারাজ ? বলে দাও , আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম কে ও তাঁর শাফাআতকে অস্বীকার করিনা , বরং আমি বিশ্বাস করি যে , তিনি শাফাআত করবেন এবং আমার নসীবে তার শাফাআত হবে বলে মনে করি।

তবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে তাদের পার্থক্য হল যে , তারা বলে থাকে একমাত্র আল্লাহর কাছে শাফাআতের আবেদন করতে হবে কারণ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে আবেদন করা শিরক।

একইভাবে আলেম সম্প্রদায়ের মতামত পর্যালোচনা করার পর স্পষ্ট পতীয়মান হয় যে , শাফাআতের আবেদন ও দোয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শাফাআতের আবেদন করলে কোন অসুবিধা নেই যেমন যদি কেহ এভাবে বলে:

হে আল্লাহর রাসূল শাফাআত করুন।

অথবাاللهم ارزقنیی شفعته হে আল্লাহ তার শাফাআত আমার জন্য নসীব কর ।

একইভাবে কোন পার্থক্য নেই যে সে নিজে আবেদন করে অথবা কারোও উসিলা ধরে আবেদন করে , তার জীবদ্দশায় , অথবা মৃত্যুর পর। তবে ইতিহাসের ৭ম শতাব্দীতে ইবনে তাইমিয়া চিরারিত এ বিষয়কে অস্বীকার করেছেন এবং ৮ম শতাব্দীতে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব তার সাথে একাত্বতা প্রকাশ করেছেন।

আমরা আশা পোষন করছি যে , আমাদের উপস্থাপিত যুক্তি ও প্রমানাদী অধ্যয়ন করার পর শাফাআতের সত্যিকার বিষয়টি নীতিবান লোকদের জন্য বোধগম্য হবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শাফাআতের আবেদন করা কোন রকম শিরক নয়। তবে কিছু কিছু ব্যক্তি আছে যারা বলে থাকে যে , যে ব্যক্তি শাফাআতের আবেদন করবে তার রক্তপাত করা হালাল।

অষ্টম অধ্যায়

শাফাআত সম্পর্কিত আপত্তি মূলক প্রশ্নাদী ও জবাব সমূহ

শাফাআত সম্পর্কিত আপত্তিমূলক প্রশ্নাদী ও জবাব সমূহ

প্রথম প্রশ্ন:

শাফাআতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে , মানুষের মনে অহংকার ও গুনাহ করার প্রবণতা পায় এবং ফরজ কাজ সমূহ পালনে নিষ্ক্রিয়তা প্রকাশ করে। কারণ শাফাআতের সুবিধা ভোগ করার প্রতি বিশ্বাসের ফলে মনে করে থাকে যে , তাকে আর শাস্তি দেয়া হবে না।

জবাব:

কোরআনের আয়াত সমূহ শাফাআতের বিষয়কে সার্বিকভাবে নির্দেশনা প্রকাশ করে কিন্তু এমন কোন দলিল নেই যে , কোন ব্যক্তি বলতে পারবে যে , তাকে অবশ্যই শাফাআত করা হবে। অতএব কেউ নিশ্চিত ভাবে বলতে পারবেনা যে , তাকে শাফাআত করা হবে এবং সে অবশ্যই দোজখের আযাব থেকে মুক্তি পাবে। অন্যদিকে শাফাআতের স্থানও কারো জন্য নির্দিষ্ট নয় যে , কেয়ামতে অথবা জাহান্নামের কোন পর্যায়ে তাকে শাফাআত করা হবে ? উদাহরণ স্বরূপ একটি হাদীসে হাসানা যেখানে ইমাম (আঃ) বলেন , দোযখে প্রবেশ করে কিছু কাল শাস্তি ভোগ করার পর (কিছু লোক) শাফাআতের মাধ্যমে মুক্তি পাবে।

ওসমান ইবনে ঈসা , ইবনে মাকান এর কাছ থেকে , সে আবি বাছিরের কাছ থেকে বর্ণনা করেন যে , আমি ইমাম বাকের (আঃ) এর কাছ থেকে শুনেছি যে , তিনি বলেছেন , একদল লোক জাহান্নামে জ্বলবে ও একটি পর্যায় আতিক্রম হওয়ার পর শাফাআতের সুবিধা ভোগ করবে।১৫১

ইমাম বাকের (আঃ) বলেন , দোযখে অবস্থানকারী কাফের ও মুশরিকরা তাদের পার্শবর্তী একত্ববাদীদেরর দিকে লক্ষ্যে করে বলবে যে তোমাদের একত্ববাদীতা তোমাদের জন্য কোন মঙ্গল বয়ে আনেনি , তোমাদের ও আমাদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই আমরা উভয়েই সমান (সম আজাবের অধিকারী)।

তখন আল্লাহ তালা সেই একত্ববাদীদের প্রতি দৃষ্টিপাত করবেন এবং ফেরেশতাদের বলবেন , শাফাআত কর। অতএব আল্লাহ যাকে চাইবেন তার জন্য ফেরেশতারা শাফাআত করবে।১৫২

সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় যে , এমন অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চিত শাফাআতের সুবিধা মানুষের উদ্ধত করতে পারেনা কারণ , মানুষের ক্ষমতা নেই এক মুহুর্ত জাহান্নমের আগুন ও আজাবকে সহ্য করবে। অতএব সে গুনাহ থেকে দূরে থেকে আল্লাহর এবাদতে মগ্ন থাকতে বাধ্য।

অন্য দিকে সে সকল মহান ব্যক্তিবর্গ যারা দ্বীন ও ধর্মকে দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এসেছিলেন তাদের পক্ষ থেকে তাদের অনুসারীদের জন্য এমন একটি আশার বানী থাকা প্রয়োজন যে তারা সুপারিশ করে তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন এবং মুমিনরা তাদের শাফাআতের আশা পোষন করবে এবং আশার দরজা তাদের জন্য সর্বদাই উন্মুক্ত থাকবে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন

গুনাহগার ব্যক্তি তওবার মাধ্যমে আজাব থেকে মুক্তি পেতে পারে , তাহলে শাফাআতের আর কী প্রয়াজন থাকতে পারে ?

জবাব

আল্লাহ তালা তওবা ও শাফাআত যা গুনাহ ক্ষমা করার দুটি পন্থা উভয়ের প্রত্যোকটি বিষয়কে বিশেষ এক উদ্দেশ্যে স্থাপন করেছেন , তওবা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে ,

অনুতাপ , আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে ফিরে আসা ও শয়তানের নাকে মুখে মাটি দেয়ার কারণে তওবা কবুল করা হয়। অন্যদিকে শাফাআত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে , অলি ও আউলিয়াদের শাফাআত কবুল করার কারণ হল আল্লাহ তালা তাদেরকে ভালবাসেন এবং তাদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করে থাকেন ।

তৃতীয় প্রশ্ন

আল্লাহ তালা ওয়াদা দিয়েছেন যে , গুনাহগারদের শাস্তি দিবেন না যদি শাফাআতের মাধ্যমে গুনাহগার মুক্তি পায় তাহলে তা আল্লাহর ওয়াদার সাথে সামঞ্জস্যহীন।

) ف َلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّـهِ تَبْدِيلًا ۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ اللَّـهِ تَحْوِيلًا(

আল্লাহর সুন্নত ওপদ্ধতিতে কোন রকম পরিবর্তন ও পরিশোধন দেখতে পাবেনা ।১৫৩

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে ,আল্লাহর সুন্নত ও পদ্ধতিতে কোনরকম পরিবর্তন হবেনা।জবাব

আপত্তিকারীগণ ধারণা করেছেন যে , আল্লাহর সুন্নত ও পদ্ধতি শুধুমাত্র গুনাহগারদের আজাব দেয়ার মধ্যেইে নিহিত এবং শাফাআতের মাধ্যমে যদি তা ক্ষমা করা হয় তাহলে তা আল্লাহর আইনের ব্যতিক্রম। কিন্তু আল্লাহর সুন্নত ওপদ্ধতি শুধুমাত্র তার বান্দাদের শান্তি ও হুমকির মাধ্যমেই সীমিত নয় বরং শাফাআতের মাধ্যমে গুনাহখাতা ক্ষমা করা তাঁরই নিশ্চিত এক সুন্নত ও পদ্ধতি যা সময় ও ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আল্লাহ তালার রহমত ও মাগফেরাতের মত অনেক গুণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো শাফাআতের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়।

চতুর্থ প্রশ্ন

শাফাআত কারীদের শাফাআত আল্লাহর ইচ্ছার উপর এক ধরনের প্রভাব বা ক্ষমতা প্রদর্শন স্বরূপ কারণ শাফাআতকারীরা চায় তাদেরকে (গুনাহগারদেরকে) আজাব থেকে মুক্তি দিতে যাদেরকে আল্লাহ তালা চান শাস্তি দিতে ।

জবাব:

শাফাআত কারীদের শাফাআত তখনই গ্রহনযোগ্য হবে যখন আল্লাহ তালা তাতে অনুমতি দিবেন। কিন্তু যদি শাফাআতকারী আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রভাব ফেলতো তাহলে আল্লাহর অনুমতির প্রয়োজন হতো না , বরং তা অনুসরণ করতে আল্লাহ তালা বাধ্য থাকতেন। মূলত বাস্তবে তার বিপরীত। উদাহরণ স্বরূপ , যদি এমন হতো যে শাফাআতকারী তার অধিনস্ত কারো কাছে সুপারিশ করবে যার উপর তার কতৃত্ব রয়েছে। কিন্তু শাফাআত এমন নয় কারণ শাফাআত শুধুমাত্র আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে গ্রহনযোগ্য। অতএব তা আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রভাব বিস্তুার করতে পারেনা।

পঞ্চম প্রশ্ন

আল্লাহর ভালবাসা অফুরন্তু , আর যদি শাফাআত থেকেই থাকে তবে কেন , সব মানুষ শাফাআতের সুবিধা ভোগ করবেনা ?

জবাব

সব মানুষ শাফাআতের সুবিধা পাবেনা এর অর্থ এই নয় যে , আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানী সীমিত। মূলতঃ এর অর্থ হল অন্য লোকজন তাদের নিজেদের দূর্বলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণেই শাফাআত পাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে , একজন বিশেষ ডাক্তার পারেনা কোন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে , কারণ ঐ লোক বেচে থাকার যোগ্যতা ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে এতে ডাক্তারের অপারগতা প্রকাশ পায়না।

মূলতঃ প্রত্যেক মানুষই পারে শাফাআত পাওয়ার যোগ্যতা ও শত সমূহ অর্জন করতে এবং যার ফলে সে খোদায়ী রহমত ভোগ করতে পারবে।

ষষ্ঠ প্রশ্ন

শাফাআতকারীদের ভালবাসা ও মহব্বত কী আল্লাহর মহব্বত ও ভালবাসার চেয়ে বেশি ? যদি তাই না হয় তাহলে কেন শাফাআত কারীদের উসিলায় আল্লাহর রহমতের প্রয়োজন হবে ?

জবাব:

এটা স্পষ্ট যে , আল্লাহর রহমত অন্য সকলের চাইতে বেশি কিন্তু তিনিই চেয়েছেন যে , তার মহব্বত তাদের উসিলায় আসবে যাতে খোদায়ী রহমতের পাশাপাশি আল্লাহর কাছে শাফাআত কারীদের অবস্থান ও মর্যাদা মানুষ কাছে স্পষ্ট হয় এবং এই উসিলায় মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করবে এবং সফলতার চাবি অর্জন করবে।

উপসংহার:

আমরা সবাই অবশেষে জীবন চলার পথে তাকওয়া (খোদাভীতি) অর্জন ও গুনাহ খাতা থেকে বিরত থাকবো। কারণ তখনই শাফাআত পাওয়া সম্ভব যদি ঈমানদার অবস্থায় (যে অবস্থায় আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকবেন) মৃত্যু বরন করে আল্লাহর সাক্ষাতে মিলিত হব। লক্ষ্যে রাখতে হবে যে , যদি অধিক গুনাহ করা হয় অথবা কবিরা গুনাহ করা হয় তাহলে তা ঈমানের পথে অন্তুরায় হয়ে দাড়াবে এবং যদি সে অবস্থায় তওবা না করেই কেহ মৃত্যু বরণ করে তাহলে তার জন্য পরকাল অত্যন্ত কঠিন হবে। অতএব মানুষ মাত্রই সর্বদা ভয় ও আশা নিয়ে বেচে থাকতে হবে (ভয় এ কারণে যে , হয়তো শাফাআত নসীবে হবেনা , আশা এজন্য যে , যদি শাফাআত পাওয়া যায় তাহলে পরকালে ধন্য হওয়া যাবে)।

কোরআন হাদীসের উল্লেখিত আলোচনা থেকে বলা যেতে পারে যে , শাফাআত অবশ্যই গুনাহগারদের জন্য কিন্তু কেহই নির্দিষ্ট করে বলতে পারবেনা যে , তার কপালে শাফাআত থাকবে এবং জাহান্নামের সব রকম আজাব থেকে সে শাফাআতের মাধ্যমে মুক্তি পাবে। অতএব , আমরা সবাই সর্বদা তাকওয়া (খোদাভীতি) অর্জন করার চেষ্টা করব এবং অপকর্ম ও গুনাহ থেকে বিরত থাকবো । কারণ গুনাহের কারণে ঈমান দর্বল হয় এবং অন্তুর মলিন হয়ে যায় , অধিকন্তু কিছু কিছু গুনাহ শিরক করারও কারণ হয়ে দাড়ায়।

الحمدلله الذیی علی ما هدانا لهذا و ما کنا لنهتدیی لو لا ان هدانا الله

তথ্যসূত্র :

১. মুফরাদাতে রাগেব , পৃ. ২৬৩।

২. আল মঞ্জিদ অভিধান , পৃ. ৩৯৫।

৩. শারহে তাজরিদ , পৃ. ২৬২।

৪. আল নেহায়াতু ফি গারিবুল হাদিস ওয়াল আসার পৃ. ৪৮৫।

৫. আল নেহায়াতু ফি গারিবুল হাদিস ওয়াল আসার পৃ. ৪৮৫।

৬. তাফসীরে আল মিজান , খণ্ড-১ , পৃ:১৫৯ , ১৬২ ।

৭. সূরা ইউনুস , আয়াত-৩ ।

৮. সূরা ফুরকান , আয়াত-৭০।

৯. তাফসীর আল মিজান , প্রথম খণ্ড , পৃ: ১৬০।

১০. সূরা এসরা , আয়াত- ৭১।

১১. সূরা হুদ , আয়াত- ৯৮।

১২. মুসনাদে আহমাদ , খণ্ড-২ , পৃ: ১৭৪।

১৩. তাফসীর আল জাওয়াহের , খণ্ড-১ , পৃ: ৬৫।

১৪. সূরা গাফের , আয়াত-৭।

১৫. সূরা বাকারা , আয়াত-৪৭ ,৪৮ ।

১৬. সূরা বাকারা , আয়াত-১২২ ,১২৩ । পূর্ববর্তী আয়াতের অনুরূপ অর্থ শুধু দুই একটি স্থান পরিবর্তন হবে ।

১৭. সূরা আনআম , আয়াত- ৯৪।

১৮. সূরা বাকারা- ২৪৫।

১৯. সূরা বাকারা , আয়াত- ২৫৫।

২০. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড- ৮ , পৃ. ৩৮।

২১. সূরা মুদাসসের , আয়াত- ৪৮।

২২. তাফসীর আল মিজান , খণ্ড-১ , পৃ: ১৬৭।

২৩. দালায়েলুল এ জাযুল মিজান , খণ্ড- ১ , পৃ: ১৬৭।

২৪. সূরা আনবিয়া , আয়াত- ২৮।

২৫. সূরা নাজম , আয়াত-২৬।

২৬. সূরা তাহা , আয়াত-১০৯।

২৭. তাফসীরে যায়ামেউল জামে , পৃ:২৮৬।

২৮. মানসুরে জাভিদ , খণ্ড-৮ , পৃ:৪৯।

২৯. সূরা সাবা , আয়াত- ২৩।

৩০. সূরা মারিয়াম , আয়াত- ৮৬ , ৮৭।

৩১. সূরা যুখরুফ , আয়াত- ৮৬।

৩২. সূরা আদ দুহা , আয়াত- ৫।

৩৩. আমালী সাদুক , আল মিজান , খণ্ড-১ , পৃ:১৭৭ ।

৩৪. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড-৮ , পৃ:৫৭ ।

৩৫. সূরা বনি ইসরাঈল , আয়াত- ৭৯ , সূরা এসরা আয়াত- ৭৯। ।

৩৬. মুসনাদে আহমাদ , খণ্ড- ২ , পৃ. ৫২৮। সুনানে তিরমিজি ৪/ ৩৬৫।

৩৭. তাফসীরে ফাখরে রাযী , খণ্ড- ২১ , পৃ: ৩১।

৩৮. তাফসীরে বেইজাভী , খণ্ড- ৩ , পৃ: ২০৯।

৩৯. তাফসীর আল মিজান , খণ্ড-১ , পৃ: ১৮ , ২ , ১৮৩।

৪০. তাফসীর ফখরুদ্দীন রাযী , খণ্ড- ৩ , পৃ. ৬৪ , ৬৫।

৪১. কাশফুল মুরাদ , পৃ:৪১৬।

৪২. কাশফুল মুরাদ , পৃ:৪১৬।

৪৩. মাজমাউল বায়ান , খণ্ড ২ , পৃ: ৪৩৫ ।

৪৪. সহীহ মুসলিম এর ব্যাখ্যা , খণ্ড-৩ , পৃ:৫৭ ।

৪৫. শারহুল মাকাসিদ , খণ্ড-৫ , পৃ:১৫৭।

৪৬. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড-৮ , পৃ:৪২ ।

৪৭. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড-৮ , পৃ:৩৮।

৪৮. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড-৮ , পৃ:৫৯ ।

৪৯.খেসাল ,বিহারুল আনোয়ার ,খণ্ড-৮ ,পৃ:৩৯ ,বইরুত

প্রিন্ট ।

৫০.কানজ কারাচিক ,৩৯৫৪৯ ।বিহারুল আনোয়ার ,খণ্ড-৮ ,পৃ:৪০ ।

৫১.কানজ কারচিক ,৩৯০৫৫ ।

৫২.তাফসীরে ফখরুদ্দীন রাযী ,খণ্ড-৩ ,পৃ:৬৫ ।

৫৩.তাফসীরে জাত্তাহেরী ,খণ্ড-১ ,পৃ:৬৩

৫৪.সহীহ মুসলিম এর ব্যখ্যা , খণ্ড-৩ ,পৃ:৫৭

৫৫.আত্তায়েলুল মাকালাত ,পৃ-১৪-১৫

৫৬. তাফসীরে ফখরুদ্দীন রাযী , খণ্ড- ৩ , পৃ: ৫৯।

৫৭. সূরা বাকারা , আয়াত - ৪৮।

৫৮. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড- ৮ , পৃ: ৩৯। ২ ৩

৫৯. বাকারা , আয়াত ২৫৬ ।

৬০. মুসনাদে আহমাদ , খণ্ড- ৫ , পৃ: ৪৩ ।

৬১. এমালিয়ে সাদুক ,পৃ:৫।

৬২. আকায়েদ সাদুক।

৬৩. সূরা ইনফিতার ,১৪ ,১৫ ,১৬।

৬৪.আল খাওয়ারেজ ফিল ইসলাম , পৃ: ১০২।

৬৫. সূরা নিসা-৪৮ ।

৬৬.সূরা যিলযাল ,৭ ।

৬৭.কাশফূল মুরাদ ,পৃ:৩২৮ ,৩২৯

৬৮.সূরা দোহা আয়াত- ৫ ।

৬৯. সূরা আসরা আয়াত- ৭৯।

৭০. সূরা শুয়ারা ,আয়াত ১০০।

৭১. সূরা মুদ্দাস্যের ,আয়াত -৪৮।

৭২. আল কাফী ,খণ্ড- ৩ পৃ: ২৪২ , হাদীস- ৩।

৭৩. তাফসীর আল মিজান , খণ্ড- ১ , পৃ: ১৭৪।

৭৪. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড-২ ,পৃ: ১৯৪ ।

৭৫. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড- ৬ , পৃ: ২১৭ , হাদীস- ১০।

৭৬. সূরা ইউনস-৩।

৭৭ সূরা বাকারা- ২৫৫ ।

৭৮. সূরা যুখরুফ-৮৬ ।

৭৯. সূরা তহা-১০৯ ।

৮০. আল মিজান , খণ্ড-১৪ ,পৃ:২১২ ।

৮১. সূরা মারিয়াম ,৮৭ ।

৮২. খেসালু সাদক , পৃ.- ১৫৬ ।

৮৩. সূরা আম্বিয়া ,২৬।

৮৪.. আদ দুররুল মানসর , খণ্ড- ৪ ,পৃ: ৯৭।

৮৫. তাফসীর আল বোরহান , খণ্ড- ২ , ৪৩৮- ৪৪০।

৮৬ সুনানে তিরমিজি , খণ্ড- ৫ , পৃ: ২৪৭।.সুনানে ইবনে মাজাহ ২/১৪৪৩।

৮৭. বিহারুল আনোয়ার খণ্ড- ৮ , পৃ: ৪৮।

৮৮. বিহারুল আনোয়ার খণ্ড- ৮ , পৃ:৪৭ ,৪৮।

৮৯. সুনানে আবি মাজিদ , খণ্ড- ২ , পৃ: ১৪৪০।

৯০. আমালি সাদুক , হাক্কুল ইয়াকিন , শাবর , পৃ: ১৩৭।

৯১. মানাকেব ইবনে শাহরে আশুব , খণ্ড-২ , পৃ:১৫ । মাজমাউল বায়ান , খণ্ড-১ পৃ:১০৪ ।

৯২. মানাকেব ইবনে শাহরে আশুব , খণ্ড-২ , পৃ:১৪ । বিহারুল আনোয়ার খণ্ড- ৮ , ‍পৃ:৪৩ , হাদীস-৩৯ ।

৯৩. মানাকেব ইবনে শাহরে আশুব , খণ্ড-২ , পৃ:১৫ ।

৯৪. খেসালে সাদুক , পৃ: ৬২৪ ।

৯৫. বিহারুল আনোয়ার খণ্ড- ৮ , ‍পৃ:৪৩ ।

৯৬. বিহারুল আনোয়ার খণ্ড-৪৩ ,পৃ: ৬৫ ।

৯৭. বিহারুল আনোয়ার খণ্ড-৮ ,পৃ:৫১ ।

৯৮. আমালি সাদুক ,২৯১ ।

৯৯. সূরা শুরা- ৫।

১০০. সূরা নাজম ,২৬।

১০১. সহীহ বুখারী , খণ্ড- ৯ , পৃ. ১৬০।

১০২. সুনানে নেসায়ী , খণ্ড- ২ , পৃ: ১৮১।

১০৩. মুসনাদে আহমদ , খণ্ড- ২ , পৃ: ১৭৪।

১০৪. মুসনাদে আহমদ , খণ্ড-৫ ,পৃ: ২৪৯- ২৫১।

১০৫. মুসনাদে আহমদ , খণ্ড-২ ,পৃ: ৯৯।

১০৬. মানাকেব , খণ্ড-২ , পৃ: ১৪।

১০৭. নাহাজলু বালাগা , খোতবা- ১৭১।

১০৮. সুনানে ইবনে মাজাহ ,

১০৯. সুনানে ইবনে দাউদ , খণ্ড-২ , পৃ: ১৫।

১১০. বিহার , খণ্ড-৮ , পৃ: ৫৬।

১১১. মোহাসেন বারকী , পৃ: ১৮৪।

১১২. নাহাজলু বালাগা , খণ্ড- ৩ , পৃ: ২৪২।

১১৩. মানাকেব ইবনে অশুব , খণ্ড- ২ , পৃ: ১৪।

১১৪. মুসনাদে আহমদ , খণ্ড- ২ , পৃ: ১৭৪।

১১৫. মুসনাদে আহমদ , খণ্ড- ৬ , পৃ :৪৪৮।

১১৬. সহিফায়ে সাজ্জাদিয়ে ,পৃ: ১৬৫ ।

১১৭. সূরা নাজম-৩৯ ।

১১৮. সূরা যিলযাল-৭-৮ ।

১১৯. সূরা তূর-২১ ।

১২০. সুনানে ইবনে মাজাহ , খণ্ড-২ , পৃ:১৪৪০ , মুসনাদে আহমদ , ১/২৮১ ।

১২১. সূরা মুদ্দাসসের ,৪০-৪৮ ।

১২২. সূরা শোয়ারা ,আয়াত-৯৫-১০১ ।

১২৩. মাহাসীন বারকী ,পৃ:১৮৪ ।

১২৪. আমালী , শেখ সাদুক ,পৃ:১৭৭ ।

১২৫. বিহারুল আনোয়ার ,খণ্ড-৪৪ ,পৃ:৩২৮ ।

১২৬. উসূলে কাফি ,খণ্ড-৬ ,পৃ:৪০০ ।

১২৭. আমালী , শেখ সাদুক ,পৃ:৫-৭ ।

১২৮. বিহারুল আনোয়ার ,খণ্ড-৮ পৃ:৩৪ ,হাদীস নং-৪ ।

১২৯. মুসনাদে আহমদ ,১/৭২ ।

১৩০. মুসনাদে আহমদ ,১ ,পৃ:৭২ ।

১৩১. উসুলে কাফি ,খণ্ড-৬ ,পৃ:৪০০০ ।

১৩২.উসুলে কাফি ,খণ্ড-৫ ,পৃ:৪৬৯ ।

১৩৩. মুসনাদে আহমদ ,খণ্ড-৩ ,পৃ:৩৪৫ ।

১৩৪. উয়ুনু আখরারে রেজা ,খণ্ড-২ ,পৃ:১২৫ ।

১৩৫. মুসনাদে আহমদ ,খণ্ড-৩ ,পৃ:৩৩৫ ।

১৩৬. উয়ুনু আখরারে রেজা ,খণ্ড-২ ,পৃ:২৪ । বিহারুল আনোয়ার ,খণ্ড-৮ ,পৃ:৪৯ ১৩৭. মুসনাদে আহমাদ খণ্ড-৪ ,পৃ:১০৮

১৩৮. ইবনে তাই মিয়ার জীবনীতে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে ।

১৩৯. আল হাদিয়াতুস সুন্নিয়্যাহ ,পৃ:৪২ ।

১৪০. কাশফুল এরতিয়াব ।

১৪১. মাজমাউল বায়ান , খণ্ড- ৪ , পৃ: ৫০১।

১৪২. সূরা যুমার , ৪৩ , ৪৪।

১৪৩. কাশফুল এরতিয়ব ।

১৪৪. মাকাতেল।

১৪৫. কাশফুল এরতিয়ব , পৃ: ২৬৩।

১৪৬. কামুসুর রেজাল , খণ্ড- ৫ , পৃ: ২১।

১৪৭. কাশফুল এরতিয়ব।

১৪৮. কাশফুল এরতিয়ব।

১৪৯. আল গাদীর , খণ্ড- ৫ , পৃ: ১৩৯।

১৫০. আল মাওয়াহেব আদ দানিয়্যাহ , খণ্ড- ৮ , পৃ: ৩১৭ , আল গাদীর , খণ্ড- ৫ , পৃ: ১৪৪।

১৫১. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড- ৮ , পৃ: ৩৬১।

১৫২. বিহারুল আনোয়ার , খণ্ড- ৮ , পৃ: ২৭৯।

১৫৩. সূরা ফাতির ,৪৩ ।

গ্রন্থ পরিচিতি

১। পবিত্র কোরআন মজিদ ।

২। আল মোসনাদ , আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃত্যু-২৪১ হি:)।

৩। আস সাহীহ্ , মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বুখারী ,(মৃ-২৫৬ হি:)।

৪। আস সাহীহ , মোসলেম ইবনে হেজাজ কাশিরী (মৃ-২৬১ হি:)।

৫। সাহিফাতু সাজ্জাদিয়্যাহ ইমাম আলী ইবনে হুসাইন জয়নুল আবেদীন (আঃ)।

৬। সুনানে তিরমিযি ,আবু ঈসা মোহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিযি (২০৯- ২৭৯ হিঃ)।

৭। সুনানে ইবনে মাজাহ মোহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ কাজভিনি (২০৭- ২৭৫ হিঃ)।

৮। উয়ূনে আখবারে রেজা , শেখ সাদূক (মৃ: ৩৮১ হিঃ)।

৯। নাহজ উল বালাগাহ শারিফ রাযী (মৃ:৪০৬)।

১০। আওয়ায়েল উল মাকালাত , শেখ মুফিদ , মোহাম্মদ ইবনে নো মান (৩৩৬- ৪১৩ হিঃ) ১১। আমালি ,শেখতুসী ,মোহাম্মদ ইবনে হাসান , (৩৫৮- ৪৬০হিঃ)।

১২। তাফসীরে মাজমাউল বায়ান ও জামেউল জাওয়ামে , শেখ তাবারসী আল ফাজল ইবনে হাসান ইবনে ফাজল তাবারসী (৪৭০- ৫৩৮ হিঃ)।

১৩। আল বাবউল হাদী আশার , আল্লামা হিল্লি , হাসান ইবনে ইউসুফ মোতাহহার (৬৪৮- ৭২৬ হিঃ)।

১৪। বিহারুল আনোয়ার , আল্লামা মোহাম্মদ বাকের মাজলিসি (মৃ: ১১১১ হিঃ)।

১৫। হাক্কুল ইয়াকিন সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহ শাব্বির (মৃ: ১২৪২ হিঃ)।

১৬। কাশফুশ শাহাব , মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব (১মৃ: ২০৬ হিঃ)।

১৭। তাফসীর উল মিনার , মুহাম্মদ রাশিদ রেজা , (মৃ-১৩৫৪ হিঃ)।

১৮। তাফসীরে জাওয়াহের , তানতাভী।

১৯। আল গাদীর আব্দুল হোসাইন আহমাদ নাজাফী আল আমিনী (১৩২০- ১৩৯০ হিঃ)।

২০। আল মিজান ফি তাফসীরুল কোরআন ,তাবা তাবায়ী সাইয়্যেদ মোহাম্মদ হোসাইন (মৃ: ১৪০২ হিঃ)।

২১। মাফাহিমূল কোরআন , উস্তাদ জাফর সোবাহানী।

২২। উসূলে কাফী , শেখ কুলাইনি মোহাম্মদ ইবনে ইয়াকুব (মৃ:৩২৯ হিঃ)।

২৩। তাফসীরে ফখরে রাযী , মোহাম্মদ ইবনে আতিব (৫৪৪- ৬০৬ হিঃ)।

২৪। কাশফুল এরতিয়াব , সাইয়্যেদ মোহসেন আমিন।

و آخر دعوانا ان الحمدلله ربّ العالمین

দ্বীনী শাসক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিতব্য হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত

এবার আমরা বিষয়টিকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থাৎ বাস্তবতার আলোকে দেখতে চাই। তা হচ্ছে , কারো জন্য আল্লাহ্ ও রাসূলের ( আঃ) ফয়ছালাহ্ বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার জন্য হুজ্জাত্ পূর্ণ (ইতমামে হুজ্জাত্) হওয়া অর্থাৎ সেটি আল্লাহ্ ও রাসূলের ( আঃ) ফয়ছালাহ্ হওয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে ইয়াক্বীন্ সৃষ্টি হওয়া ; ইখ্লাছ সত্ত্বেও ইয়াক্বীনের অধিকারী হতে অক্ষম হলে ঐ ফয়ছালাহ্ না মানার সপক্ষে তার ওযর আল্লাহ্ তা আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

এ অবস্থায় আমরা যদি ধরে নেই যে , ইখ্লাছ্ সত্ত্বেও উম্মাহর সংখ্যাগুরু সদস্যদের মধ্যে এ ব্যাপারে ইয়াক্বীন্ সৃষ্টি হয় নি যে , নবুওয়াত্ ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা সমাপ্তির পরে মুসলমানদের নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের জন্য আল্লাহ্ তা আলা কাউকে মনোনীত করে দিয়েছেন , বরং তাঁরা ইখ্লাছের সাথেই মনে করেছেন যে , আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিসিক্ততার বিষয়টিকে মুসলিম উম্মাহর নির্বাচনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন ; সে ক্ষেত্রে উম্মাহর জন্য কী ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অপরিহার্য ?

যেহেতু বিষয়টি কোনো আদর্শনিরপেক্ষ নিরেট পার্থিব বিষয়ের (যেমন : রাস্তাঘাট নির্মাণ , বাজার বা কারখানা পরিচালনা , গৃহের ডিজাইন করা ইত্যাদির) সাথে জড়িত নয় , বরং দ্বীন ও শরী আহর বাস্তবায়নের সাথে জড়িত সেহেতু ইখ্লাছের দাবী হচ্ছে এই যে , দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির ওপরে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয় নি।

দ্বীনী নেতৃত্বের জন্য সাধারণভাবে যে গুণাবলী অপরিহার্য এবং যে গুণাবলীর ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে : ইলম্ , আমল্ ও দূরদৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে ইলম্-এর অবস্থান সর্বাগ্রে , কারণ , যথাযথ ইলম্-এর অধিকারী নন এমন ব্যক্তি ইখলাছ ও তাক্বওয়া -র অধিকারী হলেও তাঁর ইখ্লাছ তাঁকে দ্বীনী ও শর ঈ বিষয়াদিতে সঠিক ফয়ছালাহ্ প্রদানের যোগ্যতার অধিকারী করবে না। অন্যদিকে যথাযথ ইলম্ ব্যতিরেকে কারো পক্ষে প্রকৃত অর্থে তাক্বওয়া -র অধিকারী হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কারণ , যথাযথ ইলম্-এর অধিকারী নন এমন ব্যক্তি ফরযকে মুস্তাহাব , মুস্তাহাবকে ফরয , মোবাহকে হারাম ও হারামকে মোবাহ্ গণ্য করে বসতে পারেন এবং দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে বসতে পারেন। যেহেতু তাক্ব্ওয়া ’ -র মানে বিশেষ ধরনের দাড়ি , বিশেষ কাটিং-এর পোশাক , নফল ইবাদত ও তাসবীহ্-তাহলীল নয় , বরং তাক্বওয়া -র মানে আল্লাহ্ তা আলার আদেশ-নিষেধকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা এবং কোনো ক্ষেত্রে কমতি-বাড়তি বা বাড়াবাড়ি না করা-যে জন্য যথাযথ ইলম্ থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ(

“ নিঃসন্দেহে আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে। ” (সূরাহ্ আল্-ফাত্বির্ : ২৮)

আর ইলমের অধিকারী ব্যক্তির সাথে অন্যদের তুলনা হতে পারে না। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ(

“ (হে রাসূল!) আপনি বলুন : যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে ? (সূরাহ্ আয্-যুমার্ : ৯)

আর যিনি ইলমের ক্ষেত্রে শেষ্ঠত্বের অধিকারী তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের বিষয়টি কোনো মুস্তাহাব পর্যায়ের বিষয় নয় , বরং আনুগত্য লাভ ও অনুসৃত হওয়া হচ্ছে তাঁর অধিকার। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) أَفَمَنْ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ أَحَقُّ أَنْ يُتَّبَعَ أَمْ مَنْ لا يَهِدِّي إِلا أَنْ يُهْدَى(

“ তাহলে অনুসৃত হওয়ার জন্য সে-ই কি অধিকতর হক্ব্দার যে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করে , নাকি সে যে পথপ্রদর্শিত না হলে পথলাভ করে না ? (সূরাহ্ ইউনুস্ : ৩৫)

যদিও এ আয়াতটিতে আল্লাহ্ তা আলার হেদায়াতের কথা বলা হয়েছে , কিন্তু নবীর ও যার কাছে নবীর ইলম্ পুরোপুরি রয়েছে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর হেদায়াত্ লাভ করা সম্ভব নয়।

দ্বীনী নেতৃত্বের তিনটি গুণ-বৈশিষ্ট্য

অবশ্য কেবল প্রকৃত অর্থে ও যথাযথ জ্ঞানের অধিকারী হলেই কারো পক্ষে আল্লাহকে ভয় করা সম্ভব এবং এ আয়াতে জ্ঞানী ’ ( আলেম) বলতে এ ধরনের লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে , আলেম হিসেবে পরিচিত যে কোনো লোককে নয়। অতএব , সত্যিকারের আলেম হলে তিনি অবশ্যই যথাযথ আমলের তথা তাক্ব্ওয়ার অধিকারী হবেন এবং ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , তাক্ব্ওয়ার অধিকারী ব্যক্তি দ্বীন ও শারী আহর ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার নির্ধারণের চেয়ে কমতি-বাড়তি করতে পারেন না তথা এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে পারেন না। সুতরাং তিনি হবেন চরম পন্থা (ইফরাত্ব্) ও শিথিল পন্থা (তাফরীত্ব্) থেকে মুক্ত তথা ভারসাম্যের ( আদ্ল্-এর) অধিকারী মধ্যম পন্থার অনুসারী (উম্মাতে ওয়াসাত্ব) । যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা ঈমানদারদেরকে সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন :

) لا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ(

“ তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অগ্রে পদক্ষেপ করো না। ” (সূরাহ্ আল্-হুজুরাত্ : ১) সেহেতু তিনি নিজস্ব বিবেচনায় ইসলামের স্বার্থচিন্তা থেকেও আল্লাহ্ ও রাসূলের (ছ্বাঃ) নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবেন না।

তৃতীয়তঃ দ্বীনী নেতৃত্বের জন্য এমন ব্যক্তিকে বেছে নেয়া অপরিহার্য যার মধ্যে উপরোক্ত দু টি গুণ ছাড়াও দূরদৃষ্টি (بصيرت ) রয়েছে যাতে তিনি পরিস্থিতি বিবেচনা করে উম্মাহকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারেন। আমরা নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জীবনেও-যাদের সকলেই ছিলেন গুনাহ্ ও ভুলের উর্ধে-এর দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। তাঁরা পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মনীতি গ্রহণ করেন।

তার চেয়েও বড় কথা , এককভাবে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে পরিস্থিতি বিবেচনায় যথোপযুক্ত বিভিন্ন কর্মনীতি অনুসরণের অনেকগুলো দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন : তিনি নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ লাভের পর প্রথম তিন বছর অত্যন্ত গোপনে বেছে বেছে সুনির্দিষ্ট ও স্বল্পসংখ্যক লোকের কাছে তাঁর দাও ’ আত পেশ করেন। এরপর তিনি মক্কায় আরো দশ বছর অহিংস ও প্রতিরোধবিহীন কর্মনীতি অনুসরণ করে প্রচারতৎপরতা চালান ; এ সময়ের মধ্যে তিনি মুসলমানদের কতককে হিজরতে পাঠান এবং কিছুদিন অবরুদ্ধ জীবনও কাটান। এরপর তিনি হিজরত করেন , উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে মদীনায় হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন এবং সে হুকুমতে ইয়াহূদীদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সুযোগ দিয়ে ঘোষণাপত্র জারী করেন। মদীনার জীবনে তিনি যুদ্ধ করেন , সন্ধি করেন ও পত্রযোগাযোগ করেন তথা কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। তিনি এমন সব শর্তাবলী সহকারে হুদায়বীয়্যাহর সন্ধি সম্পাদন করেন যা দৃশ্যতঃ তাঁর ও ইসলামের জন্য অপমানজনক ছিলো যে কারণে কতক ছাহাবী এতে আপত্তি করেছিলেন , কিন্তু এ সন্ধি ইসলামের জন্য বিরাট কল্যাণ বয়ে এনেছিলো-সন্ধি সম্পাদিত হবার পর পরই আল্লাহ্ তা আলা আয়াত নাযিল করে এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় ’ বলে আখ্যায়িত করে যে কল্যাণ সম্বন্ধে অগ্রিম সুসংবাদ প্রদান করেন।

বস্তুতঃ পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা নেই এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষে এতো বিচিত্র ক্ষেত্রে ও পরিস্থিতিতে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথ কর্মনীতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

মোদ্দা কথা , আমরা যদি ধরে নেই যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অবর্তমানে মুসলমানদের পরিচালনা , নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কাউকে মনোনীত করে দেয়া হয় নি , তথাপি ইখলাছের দাবী অনুযায়ী মু মিনাদের কর্তব্য হচ্ছে এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তির ওপরে এ দায়িত্ব অর্পণ করা। অতএব , এ থেকে সুস্পষ্ট যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পরে মুসলমানদের জন্য হযরত আলী ( আঃ)-এর ওপর নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা অপরিহার্য ছিলো। কিন্তু তা হয় নি এবং না হওয়ার ফলে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে যে বিভেদ-অনৈক্য , দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিভ্রান্তির ধারাবাহিকতার সূচনা হয় তা কারোই অজানা নয়।

ছাহাবীদের মর্যাদা প্রসঙ্গে

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা যরূরী বলে মনে করি।

আমাদের অনেকের মধ্যে মুসলমানদের ইতিহাস , বিশেষ করে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের ব্যাপারে এমন একটি প্রবণতা আছে যা বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদ সমর্থন করে না। তা হচ্ছে , ঢালাওভাবে তাঁদের প্রতি অন্ধ ভক্তি পোষণ করা-যার ফলে তাঁদের অনেকের ভুলত্রুটি আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে ও অব্যাহত থেকে যাচ্ছে।

মুসলমানদের অকাট্য ঐতিহাসিক বর্ণনা ও ছহীহ্ হিসেবে চিহ্নিত বহু হাদীছ থেকে যেখানে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের অনেকের বহু ভুল-ত্রুটির কথা এবং তাঁদের কতকের দ্বারা যেনা , নরহত্যা ও মদপানের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হবার কথা জানা যায় , এমনকি জানা যায় যে , স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও প্রথম চার খলীফাহ্ তাঁদের কতককে বিভিন্ন ধরনের কঠিন অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছেন , এছাড়া হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে তাঁরা পরস্পর যুদ্ধ করেছেন ও রণাঙ্গনে পরস্পরকে হত্যা করেছেন , তা সত্ত্বেও ঢালাওভাবে তাঁদের সকলকে নক্ষত্রতুল্য , অনুসরণীয় ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করা হচ্ছে এবং সারা দুনিয়া যে বিষয়গুলো জানে তা থেকে স্বয়ং মুসলমানদের না-ওয়াক্বিফ্ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

যারা বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের এ সব অপরাধকে ইজতিহাদী ভুল হিসেবে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন তাঁদেরকে চারটি বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রথমতঃ যথাযথ যোগ্যতা ব্যতিরেকে কারো জন্য ইজতিহাদের নামে কিছু করা জায়েয হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ইজতিহাদী ভুল যদি এমন ধরনের হয় যে , এর ফলে অন্যায় ও অবৈধভাবে মানুষের জান-মাল বিনষ্ট হয় তো আল্লাহ্ তা আলার কাছে তা ক্ষমাযোগ্য হবার সম্ভাবনা কম। এমনকি তা যদি আল্লাহ্ তা আলার কাছে ক্ষমাযোগ্য হয়ও তথাপি পার্থিব জীবনে শর ঈ বিচারে তা শাস্তিযোগ্য , ঠিক যেভাবে যে কারো যেনার মতো অপরাধের পরকালীন শাস্তি খালেছ্ তাওবাহর কারণে আল্লাহর কাছে ক্ষমাযোগ্য , কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামী হুকূমাত্ পার্থিব জীবনে তাকে তার অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই দেবে না। তৃতীয়তঃ এ ব্যাপারে ছাহাবীগণের ক্ষেত্রে যদি আল্লাহ্ তা আলার বিধানে কোনো ব্যতিক্রম থাকতো তাহলে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও প্রথম চার খলীফাহ্ কোনো ছাহাবীকে কোনো অপরাধের জন্যই শাস্তি দিতেন না , অথচ তাঁরা এ সব অপরাধের জন্য বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণকে শাস্তি দিয়েছেন। চতুর্থতঃ তাঁদেরকে নক্ষত্রতুল্য ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করা হলে যে কেউ তাঁদের যে কাউকে অনুসরণ করতে পারে এবং এভাবে দ্বীন ও শরী আতের লঙ্ঘনমূলক কাজে লিপ্ত হবার জন্য তাঁদের এ ধরনের মত ও আমলকে দলীল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ; আর কার্যতঃও তাঁদের অনুসরণে কতক ভ্রান্ত ফত্ওয়া প্রদান ও অনুসরণ করা হচ্ছে।

এখানে পরিহাসের ব্যাপার হলো এই যে , যারা ঢালাওভাবে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের সকলকে নক্ষত্রতুল্য , অনুসরণীয় ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করছেন আক্বাএদের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যকার অনেকেই স্বয়ং নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জন্য নিষ্পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিকে অপরিহার্য গণ্য করেন না।

যারা ঢালাওভাবে তাঁদের সকলকে নক্ষত্রতুল্য , অনুসরণীয় ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করছেন তাঁরা ভেবে দেখতে প্রস্তুত নন যে , ছাহাবীদের সকলের নক্ষত্রতুল্য হওয়া সংক্রান্ত হাদীছটি হাদীছ-বর্ণনার সুদীর্ঘ পরম্পরার মধ্যে কোনো এক পর্যায়ে মিথ্যা রচিত হয়ে থাকতে পারে অথবা হয়তো হাদীছ সঠিক কিন্তু ছাহাবী ’ র যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা ঠিক নয় , অর্থাৎ কেবল ঈমানের ঘোষণা ’ সহকারে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে দেখাই ছাহাবী ’ হওয়া প্রমাণ করে না , বরং শারীরিক ও আত্মিক উভয় দিক থেকে তাঁর সাহচর্যই (معيت جسمانی و روحانی ) কারো ছাহাবী ’ হওয়া প্রমাণ করে।

এ অন্ধ ভক্তির কারণেই অনেককে ছাহাবীগণের শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে চার খলীফাহকে তাঁদের পর্যায়ক্রম অনুযায়ী সকলের উর্ধে স্থান দিতে দেখা যায়। এটা কতোই না ভুল নীতি যে , যেহেতু তাঁরা চারজন পর্যায়ক্রমে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেহেতু তাঁদেরকে পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে! ঘটনাক্রমে যদি তাঁদের পরিবর্তে অন্য ছাহাবীদের মধ্য থেকে কয়েক জন ছাহাবী খলীফাহ্ হতেন তাহলে এরা তাঁদেরকেই পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিতেন। উদাহরণস্বরূপ , ছয় সদস্যের নির্বাচনী কমিটির মধ্য থেকে যদি অন্য কেউ তৃতীয় খলীফাহ্ হতেন তাহলে তাঁরা তাঁকেই তৃতীয় শ্রেষ্ঠ ছাহাবীর মর্যাদা দিতেন। (!!)

[প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের অবস্থা সম্বন্ধে পরিশিষ্টে সংযোজিত কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব্ প্রবন্ধে অধিকতর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।]

আহলে বাইত (আঃ)ই ছিলেন শাসনকর্তৃত্বের হক্ব্দার

বস্তুতঃ গুণাবলীর বিচারে অনস্বীকার্য সত্য হলো এই যে , ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে তিনি সাবালেগ হওয়ার তথা শিরক ও গুনাহ্ প্রযোজ্য হওয়ার বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই ইসলামের ছায়াতলে স্থানলাভ করেন এবং মুহূর্তের তরেও শিরকী যিন্দেগী যাপন করেন নি।

সন্দেহ নেই যে , ইসলাম গ্রহণ অতীতের শিরক ও গুনাহকে মুছে দেয় এবং ব্যক্তি আর সে জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও এরূপ ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তি জীবনে কখনো শিরকে বা অন্য কোনো গুনাহে লিপ্ত হন নি এ দুই ব্যক্তি কখনো এক হতে পারেন না , ঠিক যেভাবে একটি নতুন কাগজে ছবি আঁকা হলে এবং একই ছবি একটি ছবিযুক্ত কাগজের ছবি মুছে তার ওপরে আঁকা হলে দু টি ছবি গুণের দিক থেকে অভিন্ন হতে পারে না।

এমনকি এ প্রশ্নটি বাদ দিলেও এবং তাক্ব্ওয়া ও বাছীরাতের দৃষ্টিতে কে অগ্রগণ্য সে প্রশ্নও পাশে সরিয়ে রাখলে যেহেতু সর্বসম্মত মত অনুযায়ী ইলমের ক্ষেত্রে ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে আলেমের যে মর্যাদা বর্ণনা করেছেন তার ভিত্তিতে তিনি যে ছাহাবীগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তা অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অতঃপর , কেবল এর ভিত্তিতে অর্থাৎ ইলমী যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্রমবিন্যাস করা হলে[ এবং আহলে বাইতের ( আঃ ) অপর ব্যক্তিত্ববর্গের - যারা ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন , তাঁদের বিষয়টি বিবেচনায় না নিলেও ] শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে হযরত আলী ( আঃ)-এর মর্যাদা সবার ওপরে , অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মর্যাদা ; (তর্কের খাতিরে মেনে নিলে) অপর তিন খলীফাহর মর্যাদা বড় জোর তৃতীয় থেকে পঞ্চম হতে পারে।

অনুরূপভাবে , অর্থাৎ আমরা যদি ধরে নেই যে , আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে কাউকে নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের জন্য মনোনীত করেন নি , তাহলেও সকল বিচারে যে হযরত আলী ( আঃ)কে এবং তাঁর পরে যথাক্রমে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)কে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করা অপরিহার্য ছিলো সে ব্যাপারে দ্বিমতের কোনোই অবকাশ নেই। এমনকি যারা চার খলীফাহর খেলাফতকেই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে গণ্য করেন তাঁরাও হযরত আলী ( আঃ)-এর পরে যথাক্রমে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর খেলাফতের অধিকারকে স্বীকার করেন।

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর

প্রশ্ন করা হয় যে , আহলে বাইতের ( আঃ) ধারাবাহিকতার ইমামগণের , বিশেষতঃ হযরত আলী ( আঃ)-এর নামোল্লেখ করে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ইমাম নিয়োগের কথা কোরআন মজীদে উল্লেখ নেই কেন ? এটা উল্লেখ থাকলে তো আর কোনো বিতর্ক ও বিভ্রান্তির সুযোগ থাকতো না। বলা হয় , যেহেতু তা উল্লেখ নেই সেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইমামতের ধারাবাহিকতা ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ইমাম নিয়োগের দাবী ভিত্তিহীন।

যারা এ ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করেন তাঁরা কতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমরা জানি যে , তাওরাত্ ও ইনজীলে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমন সম্বন্ধে তাঁর নামোল্লেখ সহ ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো। এমনকি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর যুগেও তাওরাত্ ও ইনজীলে তা উল্লেখ ছিলো বলে মনে করার কারণ রয়েছে। কিন্তু যে সব ইয়াহূদী ও খৃস্টান আলেম ও ধর্মনেতা তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেয়াকে নিজেদের পার্থিব স্বার্থের পরিপন্থী বলে গণ্য করে তারা তাওরাত্ ও ইনজীল থেকে সে সব আয়াত্ তুলে দেয়।

সে যুগে মানব সভ্যতার বিকাশ , লিখন-পঠন ও গ্রন্থসমূহের কপিকরণের অবস্থা যে স্তরে ছিলো তাতে এটা খুব সহজেই করা সম্ভবপর হয়েছিলো। তাই প্রাচীন ঐশী গ্রন্থসমূহের মধ্যে কেবল বারনাবাসের ইনজীলেই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর নাম সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে তাঁর নাম থেকে যাওয়ার কারণ এই যে , সেন্ট্ পল্ খৃস্ট জগতের ধর্মীয় নেতৃত্ব একচ্ছত্রভাবে করায়ত্ত করার পর বারনাবাস ও তাঁর লিখিত ইনজীল্ খৃস্ট জগত থেকে বর্জিত হয়ে যায়। ফলে ঐ গ্রন্থের বিরল কপি কোথায় আছে তা লোকেরা জানতোই না ; কেবল সাম্প্রতিক কালে তা আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু খৃস্ট ধর্মীয় নেতারা সেটিকে প্রকৃতই বারনাবাসের ইনজীল বলে স্বীকার করেন না বিধায় তা প্রকাশ হওয়ায় খৃস্ট জগতের ওপরে তা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় নি।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যখন ইন্তেকাল করেন তখন কোরআন মজীদের তাঁর নির্দেশে লিপিবদ্ধ কপিটি ছাড়া মাত্র স্বল্প সংখ্যক ছাহাবী ব্যক্তিগতভাবে পূর্ণ কোরআনের কপি করে সংরক্ষণ করেছিলেন এবং স্বল্পসংখ্যক ছাহাবী পুরো কোরআন মুখস্ত করেছিলেন। ফলে[ হযরত রাসূলে আকরাম ( ছ্বাঃ ) কর্তৃক লিপিবদ্ধ করানো কপি থাকা সত্ত্বেও ] পরবর্তীকালে , প্রথম খলীফাহর উদ্যোগে কোরআন লিপিবদ্ধ করানো হয়েছিলো মর্মে কল্পকাহিনী এবং কোরআনে কম-বেশী হওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন মিথ্যা হাদীছ তৈরী করা সম্ভব হয়।

তবে এতদসত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে সমগ্র উম্মাহর মাঝে কোরআন মজীদের একটিমাত্র পাঠ (text -متن ) রয়েছে। কিন্তু কোরআন মজীদে আহলে বাইতের ইমামগণের , বা ন্যূনকল্পে হযরত আলী ( আঃ)-এর নামোল্লেখ করে তাঁকে ইমাম নিয়োগের কথা থাকলে এতদসংক্রান্ত আয়াত নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো। ফলে অসম্ভব নয় যে , এ ধরনের আয়াত সহ ও এ ধরনের আয়াত বাদ দিয়ে কোরআন মজীদের একাধিক পাঠ (text -متن ) অস্তিত্বলাভ করতো। বিশেষ করে , মুনাফিক্বরা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতো না।

যেহেতু পুরো কোরআনের কপির অধিকারী বা পুরো কোরআন মুখস্তকারী ছাহাবীর সংখ্যা ছিলো অল্প সেহেতু মুনাফিক্বদের পক্ষে এটা খুব সহজেই প্রচার করা সম্ভব হতো যে , এ ধরনের আয়াত কোরআনে ছিলো না , বরং ঐ স্বল্পসংখ্যক ছাহাবী নিজেরা তা যোগ করেছেন। তেমনি তাদের পক্ষে এ-ও প্রচার করা সম্ভবপর হতো যে , এ ধরনের আয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয় নি , বরং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁর জামাতা ও কন্যার বংশধরদেরকে স্থায়ীভাবে মুসলিম উম্মাহর শাসনকর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগুলো নিজের পক্ষ থেকে যোগ করেছেন। আর সে ক্ষেত্রে সরলমনা ও নবুওয়াত্ সম্পর্কে মযবূত ধারণার অধিকারী ছিলেন না এমন ছাহাবীদের পক্ষে তা বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হওয়া অসম্ভব ছিলো না।

যারা প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের সকলকে ঢালাওভাবে ঈমান , ইলম্ ও তাক্ব্ওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ বলে ও সমালোচনার উর্ধে বলে মনে করেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করতে হয় যে , মানব সভ্যতার বিকাশ , বিশেষ করে শিক্ষা ও তথ্যবিস্তারের ক্ষেত্রে বিশ্ব , বিশেষতঃ আরব ভূখণ্ড তৎকালে যে স্তরে বিরাজ করছিলো সে কারণে প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের মধ্যকার খুব কম সংখ্যকের পক্ষেই পুরো কোরআনের জ্ঞানের অধিকারী হওয়া ও নবুওয়াতের পূর্ণ পরিচিত লাভ করা সম্ভবপর ছিলো। (বস্তুতঃ যাদের কাছে পুরো কোরআনের কপি ছিলো না বা যাদের পুরো কোরআন মুখস্ত ছিলো না তাদের পক্ষে পুরো কোরআনের ইলমের অধিকারী হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।)

আল্লাহ্ তা আলা যেখানে সুস্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেছেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁর প্রবৃত্তি থেকে কিছু বলেন না অর্থাৎ দ্বীন , আদর্শ ও পথনির্দেশ হিসেবে তিনি যা কিছু বলেন তা ওয়াহীয়ে মাত্লূ (কোরআন মজীদ) বা গায়রে মাত্লূ তা সত্ত্বেও হুদায়বীয়ায় কোনো কোনো ছাহাবী তাঁর সন্ধির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তেমনি তিনি মৃত্যুশয্যায় একটি ওয়াছীয়াত্ লিখে রেখে যেতে চাইলে কতক ছাহাবী তার বিরোধিতা করেন , এমনকি কেউ কেউ বলেন যে , তিনি অসুস্থতার ঘোরে প্রলাপ বকছেন। অর্থাৎ তাঁর ওয়াছীয়াত্ লেখার বিরোধিতাকারী ছাহাবীগণের যদি কোনো অসদুদ্দেশ্য না থেকে থাকে তো সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিষয়টি ছিলো এই যে , তাঁদের জানা ছিলো না যে , আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মুখ থেকে কোনো অবস্থায়ই , এমনকি অসুস্থ অবস্থায়ও , কোনো ভুল কথা বের হতে দেবেন না।

কতক ছাহাবী যখন মন্তব্য করলেন যে , নবী করীম (ছ্বাঃ) প্রলাপ বকছেন তখন তিনি ওয়াছীয়াত্ লিপিবদ্ধ করানো থেকে বিরত থাকেন। কারণ , এরপরও তিনি তা লিপিবদ্ধ করালে পরবর্তীকালে তার গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে গুরুতর রকমের বিতর্ক সৃষ্টি হতো এবং বিষয়টি ঈমান ও কুফর্ পর্যন্ত গড়াতো।

অনুরূপভাবে কোরআন মজীদে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের ইমামগণের , নিদেন পক্ষে হযরত আলী ( আঃ)-এর নামোল্লেখ সহ ইমাম নিয়োগের কথা উল্লেখ থাকলে সে আয়াতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতো এবং সে আয়াত সহ ও তা বাদে কোরআন মজীদের কম পক্ষে দু টি পাঠ তৈরী হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা তা চান নি। বরং বিষয়টি কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে পরোক্ষভাবে থাকায় এবং এতদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মুতাওয়াতির তথ্যাদি বিদ্যমান থাকায় পরবর্তীকালে চিন্তাশীল লোকদের পক্ষে সেগুলো নিয়ে গবেষণা (তাদাব্বুর্) করে সঠিক উপসংহারে উপনীত হওয়া সম্ভবপর হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর বান্দাহদের দুর্বলতা , সত্যে উপনীত হবার পথে তাদের সামনে বিরাজমান বাধা-বিঘ্ন ও তাদের মেধা-প্রতিভার সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে ওয়াক্বিফহাল বিধায় বিষয়টি এ অবস্থায় রাখা তাঁর পক্ষ থেকে বান্দাহদের প্রতি অনুগ্রহও বটে। কারণ , এ বিষয়টি কোরআন মজীদের আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলে যারা তাতে সন্দেহ পোষণ করতো তাদের ঈমান বিনষ্ট হয়ে যেতো। তার পরিবর্তে বিষয়টি কোরআনে সরাসরি উল্লেখ না থাকায় যারা ইখ্লাছ্ সত্ত্বেও এতে উপনীত হতে পারে নি তথা এ ব্যাপারে যাদের জন্য ইতমামে হুজ্জাত্ হয় নি তারা আহলে বাইতের ( আঃ) ইমামতকে গ্রহণ না করার কারণে আল্লাহ্ তা আলার কাছে পাকড়াও হবে না ; কেবল তারাই পাকড়াও হবে যারা এ বিষয়ে ইতমামে হুজ্জাত্ হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করে নি , অথবা এ বিষয়ে বিতর্ক আছে জানা সত্ত্বেও প্রকৃত সত্যকে জানার জন্য চেষ্টা করে নি।

আরো দু ‘ টি প্রশ্নের উত্তর

আহলে বাইতের , বিশেষ করে হযরত আলী ( আঃ)-এর বিশেষ মর্যাদা এবং কোরআন মজীদ ও বিচারবুদ্ধির আলোকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অব্যবহিত স্থলাভিষিক্ততা তাঁরই প্রমাণিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে যে , এমতাবস্থায় প্রথম তিন খলীফাহর খেলাফত বৈধ ছিলো কিনা এবং যে সব ছাহাবী হযরত আলী ( আঃ)কে খেলাফতের অধিকার প্রদানে বিরত থাকেন তাঁদের অবস্থা কী ?

এ প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করতে হয় যে , এ বিষয়ে আমরা যদি প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের সম্ভাব্য অবস্থাসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করি তাহলে তাঁদের মধ্যে সম্ভাব্য পাঁচটি অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি :

(১) তাঁদের মধ্যকার একদল জানতেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত আলী ( আঃ)কে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করেছিলেন এবং এ কারণে তাঁরা খেলাফতকে তাঁরই হক্ব্ মনে করতেন ও সব সময় তাঁর পক্ষে ছিলেন। তাঁরা প্রথম খলীফাহ্ নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন না অর্থাৎ তাঁরা এতদসংক্রান্ত বৈঠকের খবর জানতেন না বলে তাতে অনুপস্থিত থাকেন। তাঁরা মনে করতেন যে , হযরত আলী ( আঃ) ও বানী হাশেমকে না জানিয়ে খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠক অনুষ্ঠান ও খলীফাহ্ নির্বাচন করা ঠিক হয় নি। এ কারণে তাঁরা প্রথম খলীফাহর অনুকূলে বাইআত করা থেকে বিরত থাকার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেন এবং কেবল চাপের মুখে অনন্যোপায় হয়ে বাইআত করেন।

(২) তাঁদের মধ্যকার সম্ভাব্য আরেক দল মনে করতেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে যান নি , বরং বিষয়টি উম্মাতের ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন। এ কারণে তাঁরা খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠকে ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন।

এদের মধ্যে যারা খলীফাহ্ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন না তাঁরা খলীফাহ্ নির্বাচনের ফলাফল জানার পরে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সন্তুষ্ট চিত্তে খলীফাহ্ নির্বাচনকে মেনে নেন ও নির্বাচিত খলীফাহর অনুকূলে বাইআত করেন।

(৩) সম্ভাব্য আরেক দল-এদের সংখ্যাই ছিলো সবচেয়ে বেশী-ছিলেন অগভীর চিন্তার লোক ; তাঁদের মধ্যকার কতক লোক খেলাফত্ নির্ধারণ প্রশ্নে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে জেনে তাতে ও খেলাফত নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং সে ক্ষেত্রে হযরত আলী ( আঃ)-এর বিষয়টি তাঁদের চিন্তায়ই আসে নি। এ ধরনের লোকদের বেশীর ভাগই-যারা খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না-খলীফাহ্ নির্বাচনের খবর জানার সাথে সাথে কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেন এবং ঘটে যাওয়া পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে নির্বাচিত খলীফাহর অনুকূলে বাইআত হয়ে করেন।

(৪) তাঁদের মধ্যকার সম্ভাব্য আরেক দল-যারা খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না-মনে করতেন যে , হযরত আলী ( আঃ)ই খেলাফতের হক্ব্দার , কিন্তু তা সত্ত্বেও-অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও-একটি ঘটে যাওয়া বিষয় হিসেবে খলীফাহ্ নির্বাচনকে মেনে নেন এবং খলীফাহর অনুকূলে বাইআত করেন। পরে তাঁরা তাঁদের বাইআত করার বিষয়টি একটি ভুল কাজ ছিলো বলে মনে করলেও একবার বাইআত করার পরে আর তা থেকে সরে আসা উচিত হবে না বলে মনে করেন।

(৫) সম্ভাব্য আরেক দল জানতো যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত আলী ( আঃ)কে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন , কিন্তু তা সত্ত্বেও হিংসা-বিদ্বেষ ও ঈর্ষাবশতঃ তারা হযরত আলী ( আঃ)-এর খেলাফত লাভের অধিকার স্বীকার করা থেকে বিরত থাকে ; এরা ছিলো মুনাফিক্ব্।

এখানে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে , হযরত আলী ( আঃ)-এর খেলাফতের হক্ব্ সম্পর্কে উপরোল্লিখিত সম্ভাব্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলের জন্য হুজ্জাত্ পূর্ণ হয় নি এবং চতুর্থ দল স্বীয় করণীয় সম্পর্কে দোদুল্যমানতার শিকার হয়েছিলেন। এ তিনটি দল ইখলাছের অধিকারী হওয়ার কারণে আল্লাহ্ তা আলার কাছে তাঁদের কাজের সপক্ষে ওযর আছে। কিন্তু পঞ্চম দলটি খেলাফতের জন্য আল্লাহ্ ও রাসূলের (ছ্বাঃ) পক্ষ থেকে হযরত আলী ( আঃ)-এর মনোনয়ন সম্পর্কে জানা থাকা সত্ত্বেও তার বরখেলাফ ও বিরোধিতা করেছিলো-যা ছিলো সুস্পষ্ট নেফাক্ব। সুতরাং তাদের কাছে আল্লাহ্ তা আলার সামনে পেশ করার জন্য কোনো ওযর থাকবে না।

তবে আমরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারি না যে , প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের মধ্যে কে মুখ্লিছ , আর কে মুনাফিক্ব্ , বরং বিষয়টি মানুষের অন্তরের সাথে সম্পর্কিত বিধায় আল্লাহ্ তা আলার ওপরে সোপর্দ করে দেয়াই উত্তম। অবশ্য ব্যক্তিদের অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেকে তাঁদের ইখ্লাছ্ বা নেফাক্ব্ সম্বন্ধে ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব হতে পারে , তবে তা প্রাপ্ত তথ্যাদির অকাট্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ওপরে নির্ভরশীল।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এই যে , হযরত আলী ( আঃ) যদি জানতেন যে , আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশ অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করেছিলেন এবং তিনিই খেলাফতের হক্ব্দার , তাহলে কেন তিনি নির্বাচিত খলীফাহর বিপরীতে নিজেকে খলীফাহ্ হিসেবে ঘোষণা করেন নি এবং স্বীয় হক্ব্ উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করেন নি , বরং প্রথম তিন খলীফাহকেই মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন ?

এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে , যদিও নবী-রাসূলগণ ( আঃ) ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত মা ছূম্ ইমামগণ ( আঃ) তাঁদের ঐশী মনোনয়নের অপরিহার্য দাবী অনুযায়ীই মানুষের ওপর নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের হক্ব্দার , কিন্তু তাঁদের যে কারো ক্ষেত্রেই এ অধিকার কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত হয় কেবল তখনই যখন সংশ্লিষ্ট জনগণ তাঁকে ঐশী মনোনয়নের অধিকারী নেতা ও শাসক হিসেবে চিনতে পারে। তার আগে তিনি নিজের জন্য নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব দাবী করেন নি ; নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জীবনাচরণ থেকে এ মূলনীতি নিষ্পন্ন হয়।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কেবল তখনি একটি জনপদের (মদীনাহর) জনগোষ্ঠীর ওপর আল্লাহ্ প্রদত্ত তাঁর শাসনাধিকার কার্যকর করেন যখন সেখানকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরু জনগণ তাঁর রিসালাত্ এবং তাঁর নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু মক্কায় থাকাকালে তিনি তাঁর এ অধিকার কার্যকর করার উদ্যোগ নেন নি। তেমনি হযরত আলী (আঃ) নিজেকে খেলাফতের হক্ব্দার জানা সত্ত্বেও তা লাভের জন্য যুদ্ধ করেন নি , বরং জনগণ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে খলীফাহ্ নির্বাচন করে কেবল তখনই তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

একই কারণে অতীতের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) মধ্যে খুব কম সংখ্যকই শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয় , বানী ইসরাঈলের অনেক নবীর ( আঃ) ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে , স্বয়ং নবীর উপস্থিতিতে অন্য কোনো ব্যক্তি রাজা হিসেবে শাসনকর্তৃত্ব পরিচালনা করেছে এবং নবী তা মেনে নিয়ে তার সাথে সহযোগিতা করেছেন। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে নবী রাজার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বও দিয়েছেন।

এ বিষয়টি কার্যতঃ দ্বীনের সাথে রাজার সম্পর্কের ওপরে নির্ভর করতো। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে রাজার বাহ্যিক দ্বীনদারী এবং তার পক্ষ থেকে সমাজে দ্বীনী বিধিবিধান কার্যকর রাখার পরিপ্রেক্ষিতে নবী রাজাকে মেনে নিয়ে তার সাথে সহযোগিতা করতেন। যদিও নবী জানতেন যে , শাসনক্ষমতার হক্বদার তিনি নিজেই , কিন্তু তা সত্ত্বেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সে অধিকার কার্যকর করার চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে শান্তি বজায় রাখাকেই দ্বীনের স্বার্থের জন্য অধিকতর সহায়ক বলে মনে করতেন। তবে যে ক্ষেত্রে নবী লক্ষ্য করতেন যে , দ্বীন থেকে রাজার বিচ্যুতি এমন এক পর্যায়ের যে , তাকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া ও সহযোগিতা করা উচিত হবে না তখন নবী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছেন বা তাতে সহায়তা দিয়েছেন।

আহলে বাইতের মা ছূম্ ইমামগণের ( আঃ) জীবনাচরণেও একই ধরনের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। তাঁরা কেবল দু টি কারণ বা দু টি কারণের মধ্য থেকে যে কোনো একটি কারণ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ক্ষমতাসীন শাসকদেরকে মেনে নিয়েছিলেন। প্রথমতঃ শাসক কর্তৃক বাহ্যতঃ দ্বীনী জীবন যাপন ও সমাজে দ্বীনী বিধিবিধান কার্যকর রাখা-যার বিপরীতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশ্রয় নেয়া হলে উভয় পক্ষের ব্যাপক রক্তক্ষয়ের পরিণামে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত দ্বীনী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা দ্বীন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিলো। দ্বিতীয়তঃ শাসক কর্তৃক বাহ্যিক আচরণে দ্বীন থেকে বিচ্যুতি বা সমাজে দ্বীনী বিধি-বিধান কার্যকর না রাখা সত্ত্বেও তার মোকাবিলায় দ্বীনী শক্তি খুবই দুর্বল থাকায় সংঘাতের ফলে দ্বীনের পুরোপুরি বিলুপ্তির আশঙ্কা ছিলো।

অন্যদিকে শাসকের মধ্যে দ্বীন থেকে গুরুতর ধরনের বিচ্যুতির অবস্থায় শাসককে মেনে নিলে বা তার সাথে সহযোগিতা করলে দ্বীনের মূল চেতনাই বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকায় ইমাম ( আঃ) শাসককে মেনে নিতে ও তার সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) ইয়াযীদের ক্ষমতারোহণের পরে এ ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে মেনে নিতে ও তার সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান।

দ্বীনী শাসক জনগণ কর্তৃক নির্বাচিতব্য হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত

এবার আমরা বিষয়টিকে ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থাৎ বাস্তবতার আলোকে দেখতে চাই। তা হচ্ছে , কারো জন্য আল্লাহ্ ও রাসূলের ( আঃ) ফয়ছালাহ্ বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়ার জন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার জন্য হুজ্জাত্ পূর্ণ (ইতমামে হুজ্জাত্) হওয়া অর্থাৎ সেটি আল্লাহ্ ও রাসূলের ( আঃ) ফয়ছালাহ্ হওয়ার ব্যাপারে তার মধ্যে ইয়াক্বীন্ সৃষ্টি হওয়া ; ইখ্লাছ সত্ত্বেও ইয়াক্বীনের অধিকারী হতে অক্ষম হলে ঐ ফয়ছালাহ্ না মানার সপক্ষে তার ওযর আল্লাহ্ তা আলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

এ অবস্থায় আমরা যদি ধরে নেই যে , ইখ্লাছ্ সত্ত্বেও উম্মাহর সংখ্যাগুরু সদস্যদের মধ্যে এ ব্যাপারে ইয়াক্বীন্ সৃষ্টি হয় নি যে , নবুওয়াত্ ও রিসালাতের ধারাবাহিকতা সমাপ্তির পরে মুসলমানদের নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের জন্য আল্লাহ্ তা আলা কাউকে মনোনীত করে দিয়েছেন , বরং তাঁরা ইখ্লাছের সাথেই মনে করেছেন যে , আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিসিক্ততার বিষয়টিকে মুসলিম উম্মাহর নির্বাচনের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন ; সে ক্ষেত্রে উম্মাহর জন্য কী ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অপরিহার্য ?

যেহেতু বিষয়টি কোনো আদর্শনিরপেক্ষ নিরেট পার্থিব বিষয়ের (যেমন : রাস্তাঘাট নির্মাণ , বাজার বা কারখানা পরিচালনা , গৃহের ডিজাইন করা ইত্যাদির) সাথে জড়িত নয় , বরং দ্বীন ও শরী আহর বাস্তবায়নের সাথে জড়িত সেহেতু ইখ্লাছের দাবী হচ্ছে এই যে , দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাধিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির ওপরে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা হয় নি।

দ্বীনী নেতৃত্বের জন্য সাধারণভাবে যে গুণাবলী অপরিহার্য এবং যে গুণাবলীর ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে : ইলম্ , আমল্ ও দূরদৃষ্টি। এ ক্ষেত্রে ইলম্-এর অবস্থান সর্বাগ্রে , কারণ , যথাযথ ইলম্-এর অধিকারী নন এমন ব্যক্তি ইখলাছ ও তাক্বওয়া -র অধিকারী হলেও তাঁর ইখ্লাছ তাঁকে দ্বীনী ও শর ঈ বিষয়াদিতে সঠিক ফয়ছালাহ্ প্রদানের যোগ্যতার অধিকারী করবে না। অন্যদিকে যথাযথ ইলম্ ব্যতিরেকে কারো পক্ষে প্রকৃত অর্থে তাক্বওয়া -র অধিকারী হওয়া আদৌ সম্ভব নয়। কারণ , যথাযথ ইলম্-এর অধিকারী নন এমন ব্যক্তি ফরযকে মুস্তাহাব , মুস্তাহাবকে ফরয , মোবাহকে হারাম ও হারামকে মোবাহ্ গণ্য করে বসতে পারেন এবং দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে বসতে পারেন। যেহেতু তাক্ব্ওয়া ’ -র মানে বিশেষ ধরনের দাড়ি , বিশেষ কাটিং-এর পোশাক , নফল ইবাদত ও তাসবীহ্-তাহলীল নয় , বরং তাক্বওয়া -র মানে আল্লাহ্ তা আলার আদেশ-নিষেধকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা এবং কোনো ক্ষেত্রে কমতি-বাড়তি বা বাড়াবাড়ি না করা-যে জন্য যথাযথ ইলম্ থাকা অপরিহার্য। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ(

“ নিঃসন্দেহে আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে। ” (সূরাহ্ আল্-ফাত্বির্ : ২৮)

আর ইলমের অধিকারী ব্যক্তির সাথে অন্যদের তুলনা হতে পারে না। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يَعْلَمُونَ(

“ (হে রাসূল!) আপনি বলুন : যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে ? (সূরাহ্ আয্-যুমার্ : ৯)

আর যিনি ইলমের ক্ষেত্রে শেষ্ঠত্বের অধিকারী তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণের বিষয়টি কোনো মুস্তাহাব পর্যায়ের বিষয় নয় , বরং আনুগত্য লাভ ও অনুসৃত হওয়া হচ্ছে তাঁর অধিকার। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন :

) أَفَمَنْ يَهْدِي إِلَى الْحَقِّ أَحَقُّ أَنْ يُتَّبَعَ أَمْ مَنْ لا يَهِدِّي إِلا أَنْ يُهْدَى(

“ তাহলে অনুসৃত হওয়ার জন্য সে-ই কি অধিকতর হক্ব্দার যে সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করে , নাকি সে যে পথপ্রদর্শিত না হলে পথলাভ করে না ? (সূরাহ্ ইউনুস্ : ৩৫)

যদিও এ আয়াতটিতে আল্লাহ্ তা আলার হেদায়াতের কথা বলা হয়েছে , কিন্তু নবীর ও যার কাছে নবীর ইলম্ পুরোপুরি রয়েছে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ ব্যতীত আল্লাহর হেদায়াত্ লাভ করা সম্ভব নয়।

দ্বীনী নেতৃত্বের তিনটি গুণ-বৈশিষ্ট্য

অবশ্য কেবল প্রকৃত অর্থে ও যথাযথ জ্ঞানের অধিকারী হলেই কারো পক্ষে আল্লাহকে ভয় করা সম্ভব এবং এ আয়াতে জ্ঞানী ’ ( আলেম) বলতে এ ধরনের লোকদেরকেই বুঝানো হয়েছে , আলেম হিসেবে পরিচিত যে কোনো লোককে নয়। অতএব , সত্যিকারের আলেম হলে তিনি অবশ্যই যথাযথ আমলের তথা তাক্ব্ওয়ার অধিকারী হবেন এবং ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , তাক্ব্ওয়ার অধিকারী ব্যক্তি দ্বীন ও শারী আহর ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার নির্ধারণের চেয়ে কমতি-বাড়তি করতে পারেন না তথা এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে পারেন না। সুতরাং তিনি হবেন চরম পন্থা (ইফরাত্ব্) ও শিথিল পন্থা (তাফরীত্ব্) থেকে মুক্ত তথা ভারসাম্যের ( আদ্ল্-এর) অধিকারী মধ্যম পন্থার অনুসারী (উম্মাতে ওয়াসাত্ব) । যেহেতু আল্লাহ্ তা আলা ঈমানদারদেরকে সম্বোধন করে এরশাদ করেছেন :

) لا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ(

“ তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের অগ্রে পদক্ষেপ করো না। ” (সূরাহ্ আল্-হুজুরাত্ : ১) সেহেতু তিনি নিজস্ব বিবেচনায় ইসলামের স্বার্থচিন্তা থেকেও আল্লাহ্ ও রাসূলের (ছ্বাঃ) নির্ধারিত সীমারেখা অতিক্রম করবেন না।

তৃতীয়তঃ দ্বীনী নেতৃত্বের জন্য এমন ব্যক্তিকে বেছে নেয়া অপরিহার্য যার মধ্যে উপরোক্ত দু টি গুণ ছাড়াও দূরদৃষ্টি (بصيرت ) রয়েছে যাতে তিনি পরিস্থিতি বিবেচনা করে উম্মাহকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিতে পারেন। আমরা নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জীবনেও-যাদের সকলেই ছিলেন গুনাহ্ ও ভুলের উর্ধে-এর দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। তাঁরা পরিস্থিতি অনুযায়ী কর্মনীতি গ্রহণ করেন।

তার চেয়েও বড় কথা , এককভাবে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জীবনে পরিস্থিতি বিবেচনায় যথোপযুক্ত বিভিন্ন কর্মনীতি অনুসরণের অনেকগুলো দৃষ্টান্ত রয়েছে। যেমন : তিনি নবুওয়াত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ লাভের পর প্রথম তিন বছর অত্যন্ত গোপনে বেছে বেছে সুনির্দিষ্ট ও স্বল্পসংখ্যক লোকের কাছে তাঁর দাও ’ আত পেশ করেন। এরপর তিনি মক্কায় আরো দশ বছর অহিংস ও প্রতিরোধবিহীন কর্মনীতি অনুসরণ করে প্রচারতৎপরতা চালান ; এ সময়ের মধ্যে তিনি মুসলমানদের কতককে হিজরতে পাঠান এবং কিছুদিন অবরুদ্ধ জীবনও কাটান। এরপর তিনি হিজরত করেন , উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে মদীনায় হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন এবং সে হুকুমতে ইয়াহূদীদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের সুযোগ দিয়ে ঘোষণাপত্র জারী করেন। মদীনার জীবনে তিনি যুদ্ধ করেন , সন্ধি করেন ও পত্রযোগাযোগ করেন তথা কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। তিনি এমন সব শর্তাবলী সহকারে হুদায়বীয়্যাহর সন্ধি সম্পাদন করেন যা দৃশ্যতঃ তাঁর ও ইসলামের জন্য অপমানজনক ছিলো যে কারণে কতক ছাহাবী এতে আপত্তি করেছিলেন , কিন্তু এ সন্ধি ইসলামের জন্য বিরাট কল্যাণ বয়ে এনেছিলো-সন্ধি সম্পাদিত হবার পর পরই আল্লাহ্ তা আলা আয়াত নাযিল করে এ সন্ধিকে সুস্পষ্ট বিজয় ’ বলে আখ্যায়িত করে যে কল্যাণ সম্বন্ধে অগ্রিম সুসংবাদ প্রদান করেন।

বস্তুতঃ পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার নিশ্চয়তা নেই এমন কোনো ব্যক্তির পক্ষে এতো বিচিত্র ক্ষেত্রে ও পরিস্থিতিতে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথ কর্মনীতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।

মোদ্দা কথা , আমরা যদি ধরে নেই যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অবর্তমানে মুসলমানদের পরিচালনা , নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে কাউকে মনোনীত করে দেয়া হয় নি , তথাপি ইখলাছের দাবী অনুযায়ী মু মিনাদের কর্তব্য হচ্ছে এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তির ওপরে এ দায়িত্ব অর্পণ করা। অতএব , এ থেকে সুস্পষ্ট যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের পরে মুসলমানদের জন্য হযরত আলী ( আঃ)-এর ওপর নেতৃত্ব ও শাসন-কর্তৃত্বের দায়িত্ব অর্পণ করা অপরিহার্য ছিলো। কিন্তু তা হয় নি এবং না হওয়ার ফলে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে যে বিভেদ-অনৈক্য , দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিভ্রান্তির ধারাবাহিকতার সূচনা হয় তা কারোই অজানা নয়।

ছাহাবীদের মর্যাদা প্রসঙ্গে

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা যরূরী বলে মনে করি।

আমাদের অনেকের মধ্যে মুসলমানদের ইতিহাস , বিশেষ করে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের ব্যাপারে এমন একটি প্রবণতা আছে যা বিচারবুদ্ধি ( আক্বল্) ও কোরআন মজীদ সমর্থন করে না। তা হচ্ছে , ঢালাওভাবে তাঁদের প্রতি অন্ধ ভক্তি পোষণ করা-যার ফলে তাঁদের অনেকের ভুলত্রুটি আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে ও অব্যাহত থেকে যাচ্ছে।

মুসলমানদের অকাট্য ঐতিহাসিক বর্ণনা ও ছহীহ্ হিসেবে চিহ্নিত বহু হাদীছ থেকে যেখানে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের অনেকের বহু ভুল-ত্রুটির কথা এবং তাঁদের কতকের দ্বারা যেনা , নরহত্যা ও মদপানের মতো অপরাধমূলক কার্যকলাপ সংঘটিত হবার কথা জানা যায় , এমনকি জানা যায় যে , স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও প্রথম চার খলীফাহ্ তাঁদের কতককে বিভিন্ন ধরনের কঠিন অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছেন , এছাড়া হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে তাঁরা পরস্পর যুদ্ধ করেছেন ও রণাঙ্গনে পরস্পরকে হত্যা করেছেন , তা সত্ত্বেও ঢালাওভাবে তাঁদের সকলকে নক্ষত্রতুল্য , অনুসরণীয় ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করা হচ্ছে এবং সারা দুনিয়া যে বিষয়গুলো জানে তা থেকে স্বয়ং মুসলমানদের না-ওয়াক্বিফ্ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

যারা বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের এ সব অপরাধকে ইজতিহাদী ভুল হিসেবে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন তাঁদেরকে চারটি বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রথমতঃ যথাযথ যোগ্যতা ব্যতিরেকে কারো জন্য ইজতিহাদের নামে কিছু করা জায়েয হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ইজতিহাদী ভুল যদি এমন ধরনের হয় যে , এর ফলে অন্যায় ও অবৈধভাবে মানুষের জান-মাল বিনষ্ট হয় তো আল্লাহ্ তা আলার কাছে তা ক্ষমাযোগ্য হবার সম্ভাবনা কম। এমনকি তা যদি আল্লাহ্ তা আলার কাছে ক্ষমাযোগ্য হয়ও তথাপি পার্থিব জীবনে শর ঈ বিচারে তা শাস্তিযোগ্য , ঠিক যেভাবে যে কারো যেনার মতো অপরাধের পরকালীন শাস্তি খালেছ্ তাওবাহর কারণে আল্লাহর কাছে ক্ষমাযোগ্য , কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামী হুকূমাত্ পার্থিব জীবনে তাকে তার অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই দেবে না। তৃতীয়তঃ এ ব্যাপারে ছাহাবীগণের ক্ষেত্রে যদি আল্লাহ্ তা আলার বিধানে কোনো ব্যতিক্রম থাকতো তাহলে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) ও প্রথম চার খলীফাহ্ কোনো ছাহাবীকে কোনো অপরাধের জন্যই শাস্তি দিতেন না , অথচ তাঁরা এ সব অপরাধের জন্য বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণকে শাস্তি দিয়েছেন। চতুর্থতঃ তাঁদেরকে নক্ষত্রতুল্য ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করা হলে যে কেউ তাঁদের যে কাউকে অনুসরণ করতে পারে এবং এভাবে দ্বীন ও শরী আতের লঙ্ঘনমূলক কাজে লিপ্ত হবার জন্য তাঁদের এ ধরনের মত ও আমলকে দলীল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ; আর কার্যতঃও তাঁদের অনুসরণে কতক ভ্রান্ত ফত্ওয়া প্রদান ও অনুসরণ করা হচ্ছে।

এখানে পরিহাসের ব্যাপার হলো এই যে , যারা ঢালাওভাবে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীগণের সকলকে নক্ষত্রতুল্য , অনুসরণীয় ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করছেন আক্বাএদের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যকার অনেকেই স্বয়ং নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জন্য নিষ্পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকার বিষয়টিকে অপরিহার্য গণ্য করেন না।

যারা ঢালাওভাবে তাঁদের সকলকে নক্ষত্রতুল্য , অনুসরণীয় ও সমালোচনার উর্ধে গণ্য করছেন তাঁরা ভেবে দেখতে প্রস্তুত নন যে , ছাহাবীদের সকলের নক্ষত্রতুল্য হওয়া সংক্রান্ত হাদীছটি হাদীছ-বর্ণনার সুদীর্ঘ পরম্পরার মধ্যে কোনো এক পর্যায়ে মিথ্যা রচিত হয়ে থাকতে পারে অথবা হয়তো হাদীছ সঠিক কিন্তু ছাহাবী ’ র যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা ঠিক নয় , অর্থাৎ কেবল ঈমানের ঘোষণা ’ সহকারে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)কে দেখাই ছাহাবী ’ হওয়া প্রমাণ করে না , বরং শারীরিক ও আত্মিক উভয় দিক থেকে তাঁর সাহচর্যই (معيت جسمانی و روحانی ) কারো ছাহাবী ’ হওয়া প্রমাণ করে।

এ অন্ধ ভক্তির কারণেই অনেককে ছাহাবীগণের শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে চার খলীফাহকে তাঁদের পর্যায়ক্রম অনুযায়ী সকলের উর্ধে স্থান দিতে দেখা যায়। এটা কতোই না ভুল নীতি যে , যেহেতু তাঁরা চারজন পর্যায়ক্রমে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেহেতু তাঁদেরকে পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেয়া হয়েছে! ঘটনাক্রমে যদি তাঁদের পরিবর্তে অন্য ছাহাবীদের মধ্য থেকে কয়েক জন ছাহাবী খলীফাহ্ হতেন তাহলে এরা তাঁদেরকেই পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিতেন। উদাহরণস্বরূপ , ছয় সদস্যের নির্বাচনী কমিটির মধ্য থেকে যদি অন্য কেউ তৃতীয় খলীফাহ্ হতেন তাহলে তাঁরা তাঁকেই তৃতীয় শ্রেষ্ঠ ছাহাবীর মর্যাদা দিতেন। (!!)

[প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের অবস্থা সম্বন্ধে পরিশিষ্টে সংযোজিত কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে ছ্বাহাবী ও রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগের মুনাফিক্ব্ প্রবন্ধে অধিকতর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।]

আহলে বাইত (আঃ)ই ছিলেন শাসনকর্তৃত্বের হক্ব্দার

বস্তুতঃ গুণাবলীর বিচারে অনস্বীকার্য সত্য হলো এই যে , ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশেষ করে তিনি সাবালেগ হওয়ার তথা শিরক ও গুনাহ্ প্রযোজ্য হওয়ার বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই ইসলামের ছায়াতলে স্থানলাভ করেন এবং মুহূর্তের তরেও শিরকী যিন্দেগী যাপন করেন নি।

সন্দেহ নেই যে , ইসলাম গ্রহণ অতীতের শিরক ও গুনাহকে মুছে দেয় এবং ব্যক্তি আর সে জন্য শাস্তিযোগ্য থাকে না। কিন্তু এ সত্ত্বেও এরূপ ব্যক্তি এবং যে ব্যক্তি জীবনে কখনো শিরকে বা অন্য কোনো গুনাহে লিপ্ত হন নি এ দুই ব্যক্তি কখনো এক হতে পারেন না , ঠিক যেভাবে একটি নতুন কাগজে ছবি আঁকা হলে এবং একই ছবি একটি ছবিযুক্ত কাগজের ছবি মুছে তার ওপরে আঁকা হলে দু টি ছবি গুণের দিক থেকে অভিন্ন হতে পারে না।

এমনকি এ প্রশ্নটি বাদ দিলেও এবং তাক্ব্ওয়া ও বাছীরাতের দৃষ্টিতে কে অগ্রগণ্য সে প্রশ্নও পাশে সরিয়ে রাখলে যেহেতু সর্বসম্মত মত অনুযায়ী ইলমের ক্ষেত্রে ছাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী ( আঃ) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহ্ তা আলা কোরআন মজীদে আলেমের যে মর্যাদা বর্ণনা করেছেন তার ভিত্তিতে তিনি যে ছাহাবীগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তা অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। অতঃপর , কেবল এর ভিত্তিতে অর্থাৎ ইলমী যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্রমবিন্যাস করা হলে[ এবং আহলে বাইতের ( আঃ ) অপর ব্যক্তিত্ববর্গের - যারা ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন , তাঁদের বিষয়টি বিবেচনায় না নিলেও ] শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে হযরত আলী ( আঃ)-এর মর্যাদা সবার ওপরে , অতঃপর হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মর্যাদা ; (তর্কের খাতিরে মেনে নিলে) অপর তিন খলীফাহর মর্যাদা বড় জোর তৃতীয় থেকে পঞ্চম হতে পারে।

অনুরূপভাবে , অর্থাৎ আমরা যদি ধরে নেই যে , আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর পরে কাউকে নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের জন্য মনোনীত করেন নি , তাহলেও সকল বিচারে যে হযরত আলী ( আঃ)কে এবং তাঁর পরে যথাক্রমে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)কে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করা অপরিহার্য ছিলো সে ব্যাপারে দ্বিমতের কোনোই অবকাশ নেই। এমনকি যারা চার খলীফাহর খেলাফতকেই সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে গণ্য করেন তাঁরাও হযরত আলী ( আঃ)-এর পরে যথাক্রমে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ)-এর খেলাফতের অধিকারকে স্বীকার করেন।

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর

প্রশ্ন করা হয় যে , আহলে বাইতের ( আঃ) ধারাবাহিকতার ইমামগণের , বিশেষতঃ হযরত আলী ( আঃ)-এর নামোল্লেখ করে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ইমাম নিয়োগের কথা কোরআন মজীদে উল্লেখ নেই কেন ? এটা উল্লেখ থাকলে তো আর কোনো বিতর্ক ও বিভ্রান্তির সুযোগ থাকতো না। বলা হয় , যেহেতু তা উল্লেখ নেই সেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইমামতের ধারাবাহিকতা ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে ইমাম নিয়োগের দাবী ভিত্তিহীন।

যারা এ ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করেন তাঁরা কতোগুলো গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমরা জানি যে , তাওরাত্ ও ইনজীলে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (ছ্বাঃ)-এর আগমন সম্বন্ধে তাঁর নামোল্লেখ সহ ভবিষ্যদ্বাণী ছিলো। এমনকি স্বয়ং নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর যুগেও তাওরাত্ ও ইনজীলে তা উল্লেখ ছিলো বলে মনে করার কারণ রয়েছে। কিন্তু যে সব ইয়াহূদী ও খৃস্টান আলেম ও ধর্মনেতা তাঁকে নবী হিসেবে মেনে নেয়াকে নিজেদের পার্থিব স্বার্থের পরিপন্থী বলে গণ্য করে তারা তাওরাত্ ও ইনজীল থেকে সে সব আয়াত্ তুলে দেয়।

সে যুগে মানব সভ্যতার বিকাশ , লিখন-পঠন ও গ্রন্থসমূহের কপিকরণের অবস্থা যে স্তরে ছিলো তাতে এটা খুব সহজেই করা সম্ভবপর হয়েছিলো। তাই প্রাচীন ঐশী গ্রন্থসমূহের মধ্যে কেবল বারনাবাসের ইনজীলেই নবী করীম (ছ্বাঃ)-এর নাম সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ পাওয়া যায়। এতে তাঁর নাম থেকে যাওয়ার কারণ এই যে , সেন্ট্ পল্ খৃস্ট জগতের ধর্মীয় নেতৃত্ব একচ্ছত্রভাবে করায়ত্ত করার পর বারনাবাস ও তাঁর লিখিত ইনজীল্ খৃস্ট জগত থেকে বর্জিত হয়ে যায়। ফলে ঐ গ্রন্থের বিরল কপি কোথায় আছে তা লোকেরা জানতোই না ; কেবল সাম্প্রতিক কালে তা আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু খৃস্ট ধর্মীয় নেতারা সেটিকে প্রকৃতই বারনাবাসের ইনজীল বলে স্বীকার করেন না বিধায় তা প্রকাশ হওয়ায় খৃস্ট জগতের ওপরে তা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় নি।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) যখন ইন্তেকাল করেন তখন কোরআন মজীদের তাঁর নির্দেশে লিপিবদ্ধ কপিটি ছাড়া মাত্র স্বল্প সংখ্যক ছাহাবী ব্যক্তিগতভাবে পূর্ণ কোরআনের কপি করে সংরক্ষণ করেছিলেন এবং স্বল্পসংখ্যক ছাহাবী পুরো কোরআন মুখস্ত করেছিলেন। ফলে[ হযরত রাসূলে আকরাম ( ছ্বাঃ ) কর্তৃক লিপিবদ্ধ করানো কপি থাকা সত্ত্বেও ] পরবর্তীকালে , প্রথম খলীফাহর উদ্যোগে কোরআন লিপিবদ্ধ করানো হয়েছিলো মর্মে কল্পকাহিনী এবং কোরআনে কম-বেশী হওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন মিথ্যা হাদীছ তৈরী করা সম্ভব হয়।

তবে এতদসত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলার অনুগ্রহে সমগ্র উম্মাহর মাঝে কোরআন মজীদের একটিমাত্র পাঠ (text -متن ) রয়েছে। কিন্তু কোরআন মজীদে আহলে বাইতের ইমামগণের , বা ন্যূনকল্পে হযরত আলী ( আঃ)-এর নামোল্লেখ করে তাঁকে ইমাম নিয়োগের কথা থাকলে এতদসংক্রান্ত আয়াত নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো। ফলে অসম্ভব নয় যে , এ ধরনের আয়াত সহ ও এ ধরনের আয়াত বাদ দিয়ে কোরআন মজীদের একাধিক পাঠ (text -متن ) অস্তিত্বলাভ করতো। বিশেষ করে , মুনাফিক্বরা এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতো না।

যেহেতু পুরো কোরআনের কপির অধিকারী বা পুরো কোরআন মুখস্তকারী ছাহাবীর সংখ্যা ছিলো অল্প সেহেতু মুনাফিক্বদের পক্ষে এটা খুব সহজেই প্রচার করা সম্ভব হতো যে , এ ধরনের আয়াত কোরআনে ছিলো না , বরং ঐ স্বল্পসংখ্যক ছাহাবী নিজেরা তা যোগ করেছেন। তেমনি তাদের পক্ষে এ-ও প্রচার করা সম্ভবপর হতো যে , এ ধরনের আয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয় নি , বরং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁর জামাতা ও কন্যার বংশধরদেরকে স্থায়ীভাবে মুসলিম উম্মাহর শাসনকর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগুলো নিজের পক্ষ থেকে যোগ করেছেন। আর সে ক্ষেত্রে সরলমনা ও নবুওয়াত্ সম্পর্কে মযবূত ধারণার অধিকারী ছিলেন না এমন ছাহাবীদের পক্ষে তা বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হওয়া অসম্ভব ছিলো না।

যারা প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের সকলকে ঢালাওভাবে ঈমান , ইলম্ ও তাক্ব্ওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ বলে ও সমালোচনার উর্ধে বলে মনে করেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে উল্লেখ করতে হয় যে , মানব সভ্যতার বিকাশ , বিশেষ করে শিক্ষা ও তথ্যবিস্তারের ক্ষেত্রে বিশ্ব , বিশেষতঃ আরব ভূখণ্ড তৎকালে যে স্তরে বিরাজ করছিলো সে কারণে প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের মধ্যকার খুব কম সংখ্যকের পক্ষেই পুরো কোরআনের জ্ঞানের অধিকারী হওয়া ও নবুওয়াতের পূর্ণ পরিচিত লাভ করা সম্ভবপর ছিলো। (বস্তুতঃ যাদের কাছে পুরো কোরআনের কপি ছিলো না বা যাদের পুরো কোরআন মুখস্ত ছিলো না তাদের পক্ষে পুরো কোরআনের ইলমের অধিকারী হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।)

আল্লাহ্ তা আলা যেখানে সুস্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেছেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁর প্রবৃত্তি থেকে কিছু বলেন না অর্থাৎ দ্বীন , আদর্শ ও পথনির্দেশ হিসেবে তিনি যা কিছু বলেন তা ওয়াহীয়ে মাত্লূ (কোরআন মজীদ) বা গায়রে মাত্লূ তা সত্ত্বেও হুদায়বীয়ায় কোনো কোনো ছাহাবী তাঁর সন্ধির সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তেমনি তিনি মৃত্যুশয্যায় একটি ওয়াছীয়াত্ লিখে রেখে যেতে চাইলে কতক ছাহাবী তার বিরোধিতা করেন , এমনকি কেউ কেউ বলেন যে , তিনি অসুস্থতার ঘোরে প্রলাপ বকছেন। অর্থাৎ তাঁর ওয়াছীয়াত্ লেখার বিরোধিতাকারী ছাহাবীগণের যদি কোনো অসদুদ্দেশ্য না থেকে থাকে তো সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিষয়টি ছিলো এই যে , তাঁদের জানা ছিলো না যে , আল্লাহ্ তা আলা হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর মুখ থেকে কোনো অবস্থায়ই , এমনকি অসুস্থ অবস্থায়ও , কোনো ভুল কথা বের হতে দেবেন না।

কতক ছাহাবী যখন মন্তব্য করলেন যে , নবী করীম (ছ্বাঃ) প্রলাপ বকছেন তখন তিনি ওয়াছীয়াত্ লিপিবদ্ধ করানো থেকে বিরত থাকেন। কারণ , এরপরও তিনি তা লিপিবদ্ধ করালে পরবর্তীকালে তার গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে গুরুতর রকমের বিতর্ক সৃষ্টি হতো এবং বিষয়টি ঈমান ও কুফর্ পর্যন্ত গড়াতো।

অনুরূপভাবে কোরআন মজীদে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর আহলে বাইতের ইমামগণের , নিদেন পক্ষে হযরত আলী ( আঃ)-এর নামোল্লেখ সহ ইমাম নিয়োগের কথা উল্লেখ থাকলে সে আয়াতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতো এবং সে আয়াত সহ ও তা বাদে কোরআন মজীদের কম পক্ষে দু টি পাঠ তৈরী হয়ে যেতো। কিন্তু আল্লাহ্ তা আলা তা চান নি। বরং বিষয়টি কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে পরোক্ষভাবে থাকায় এবং এতদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মুতাওয়াতির তথ্যাদি বিদ্যমান থাকায় পরবর্তীকালে চিন্তাশীল লোকদের পক্ষে সেগুলো নিয়ে গবেষণা (তাদাব্বুর্) করে সঠিক উপসংহারে উপনীত হওয়া সম্ভবপর হচ্ছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে এই যে , আল্লাহ্ তা আলা তাঁর বান্দাহদের দুর্বলতা , সত্যে উপনীত হবার পথে তাদের সামনে বিরাজমান বাধা-বিঘ্ন ও তাদের মেধা-প্রতিভার সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে ওয়াক্বিফহাল বিধায় বিষয়টি এ অবস্থায় রাখা তাঁর পক্ষ থেকে বান্দাহদের প্রতি অনুগ্রহও বটে। কারণ , এ বিষয়টি কোরআন মজীদের আয়াতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলে যারা তাতে সন্দেহ পোষণ করতো তাদের ঈমান বিনষ্ট হয়ে যেতো। তার পরিবর্তে বিষয়টি কোরআনে সরাসরি উল্লেখ না থাকায় যারা ইখ্লাছ্ সত্ত্বেও এতে উপনীত হতে পারে নি তথা এ ব্যাপারে যাদের জন্য ইতমামে হুজ্জাত্ হয় নি তারা আহলে বাইতের ( আঃ) ইমামতকে গ্রহণ না করার কারণে আল্লাহ্ তা আলার কাছে পাকড়াও হবে না ; কেবল তারাই পাকড়াও হবে যারা এ বিষয়ে ইতমামে হুজ্জাত্ হওয়া সত্ত্বেও গ্রহণ করে নি , অথবা এ বিষয়ে বিতর্ক আছে জানা সত্ত্বেও প্রকৃত সত্যকে জানার জন্য চেষ্টা করে নি।

আরো দু ‘ টি প্রশ্নের উত্তর

আহলে বাইতের , বিশেষ করে হযরত আলী ( আঃ)-এর বিশেষ মর্যাদা এবং কোরআন মজীদ ও বিচারবুদ্ধির আলোকে হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর অব্যবহিত স্থলাভিষিক্ততা তাঁরই প্রমাণিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে যে , এমতাবস্থায় প্রথম তিন খলীফাহর খেলাফত বৈধ ছিলো কিনা এবং যে সব ছাহাবী হযরত আলী ( আঃ)কে খেলাফতের অধিকার প্রদানে বিরত থাকেন তাঁদের অবস্থা কী ?

এ প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করতে হয় যে , এ বিষয়ে আমরা যদি প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের সম্ভাব্য অবস্থাসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করি তাহলে তাঁদের মধ্যে সম্ভাব্য পাঁচটি অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি :

(১) তাঁদের মধ্যকার একদল জানতেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত আলী ( আঃ)কে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করেছিলেন এবং এ কারণে তাঁরা খেলাফতকে তাঁরই হক্ব্ মনে করতেন ও সব সময় তাঁর পক্ষে ছিলেন। তাঁরা প্রথম খলীফাহ্ নির্বাচনের প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন না অর্থাৎ তাঁরা এতদসংক্রান্ত বৈঠকের খবর জানতেন না বলে তাতে অনুপস্থিত থাকেন। তাঁরা মনে করতেন যে , হযরত আলী ( আঃ) ও বানী হাশেমকে না জানিয়ে খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠক অনুষ্ঠান ও খলীফাহ্ নির্বাচন করা ঠিক হয় নি। এ কারণে তাঁরা প্রথম খলীফাহর অনুকূলে বাইআত করা থেকে বিরত থাকার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেন এবং কেবল চাপের মুখে অনন্যোপায় হয়ে বাইআত করেন।

(২) তাঁদের মধ্যকার সম্ভাব্য আরেক দল মনে করতেন যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কাউকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে যান নি , বরং বিষয়টি উম্মাতের ওপরে ছেড়ে দিয়েছেন। এ কারণে তাঁরা খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠকে ও নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন।

এদের মধ্যে যারা খলীফাহ্ নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন না তাঁরা খলীফাহ্ নির্বাচনের ফলাফল জানার পরে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সন্তুষ্ট চিত্তে খলীফাহ্ নির্বাচনকে মেনে নেন ও নির্বাচিত খলীফাহর অনুকূলে বাইআত করেন।

(৩) সম্ভাব্য আরেক দল-এদের সংখ্যাই ছিলো সবচেয়ে বেশী-ছিলেন অগভীর চিন্তার লোক ; তাঁদের মধ্যকার কতক লোক খেলাফত্ নির্ধারণ প্রশ্নে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে জেনে তাতে ও খেলাফত নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং সে ক্ষেত্রে হযরত আলী ( আঃ)-এর বিষয়টি তাঁদের চিন্তায়ই আসে নি। এ ধরনের লোকদের বেশীর ভাগই-যারা খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না-খলীফাহ্ নির্বাচনের খবর জানার সাথে সাথে কোনোরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেন এবং ঘটে যাওয়া পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে নির্বাচিত খলীফাহর অনুকূলে বাইআত হয়ে করেন।

(৪) তাঁদের মধ্যকার সম্ভাব্য আরেক দল-যারা খলীফাহ্ নির্বাচনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না-মনে করতেন যে , হযরত আলী ( আঃ)ই খেলাফতের হক্ব্দার , কিন্তু তা সত্ত্বেও-অসন্তুষ্টি সত্ত্বেও-একটি ঘটে যাওয়া বিষয় হিসেবে খলীফাহ্ নির্বাচনকে মেনে নেন এবং খলীফাহর অনুকূলে বাইআত করেন। পরে তাঁরা তাঁদের বাইআত করার বিষয়টি একটি ভুল কাজ ছিলো বলে মনে করলেও একবার বাইআত করার পরে আর তা থেকে সরে আসা উচিত হবে না বলে মনে করেন।

(৫) সম্ভাব্য আরেক দল জানতো যে , হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশে হযরত আলী ( আঃ)কে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন , কিন্তু তা সত্ত্বেও হিংসা-বিদ্বেষ ও ঈর্ষাবশতঃ তারা হযরত আলী ( আঃ)-এর খেলাফত লাভের অধিকার স্বীকার করা থেকে বিরত থাকে ; এরা ছিলো মুনাফিক্ব্।

এখানে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে , হযরত আলী ( আঃ)-এর খেলাফতের হক্ব্ সম্পর্কে উপরোল্লিখিত সম্ভাব্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলের জন্য হুজ্জাত্ পূর্ণ হয় নি এবং চতুর্থ দল স্বীয় করণীয় সম্পর্কে দোদুল্যমানতার শিকার হয়েছিলেন। এ তিনটি দল ইখলাছের অধিকারী হওয়ার কারণে আল্লাহ্ তা আলার কাছে তাঁদের কাজের সপক্ষে ওযর আছে। কিন্তু পঞ্চম দলটি খেলাফতের জন্য আল্লাহ্ ও রাসূলের (ছ্বাঃ) পক্ষ থেকে হযরত আলী ( আঃ)-এর মনোনয়ন সম্পর্কে জানা থাকা সত্ত্বেও তার বরখেলাফ ও বিরোধিতা করেছিলো-যা ছিলো সুস্পষ্ট নেফাক্ব। সুতরাং তাদের কাছে আল্লাহ্ তা আলার সামনে পেশ করার জন্য কোনো ওযর থাকবে না।

তবে আমরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারি না যে , প্রচলিত সংজ্ঞার ছাহাবীদের মধ্যে কে মুখ্লিছ , আর কে মুনাফিক্ব্ , বরং বিষয়টি মানুষের অন্তরের সাথে সম্পর্কিত বিধায় আল্লাহ্ তা আলার ওপরে সোপর্দ করে দেয়াই উত্তম। অবশ্য ব্যক্তিদের অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেকে তাঁদের ইখ্লাছ্ বা নেফাক্ব্ সম্বন্ধে ধারণায় উপনীত হওয়া সম্ভব হতে পারে , তবে তা প্রাপ্ত তথ্যাদির অকাট্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ওপরে নির্ভরশীল।

দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে এই যে , হযরত আলী ( আঃ) যদি জানতেন যে , আল্লাহ্ তা আলার নির্দেশ অনুযায়ী হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) তাঁকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করেছিলেন এবং তিনিই খেলাফতের হক্ব্দার , তাহলে কেন তিনি নির্বাচিত খলীফাহর বিপরীতে নিজেকে খলীফাহ্ হিসেবে ঘোষণা করেন নি এবং স্বীয় হক্ব্ উদ্ধারের জন্য যুদ্ধ করেন নি , বরং প্রথম তিন খলীফাহকেই মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন ?

এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে , যদিও নবী-রাসূলগণ ( আঃ) ও আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত মা ছূম্ ইমামগণ ( আঃ) তাঁদের ঐশী মনোনয়নের অপরিহার্য দাবী অনুযায়ীই মানুষের ওপর নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্বের হক্ব্দার , কিন্তু তাঁদের যে কারো ক্ষেত্রেই এ অধিকার কার্যতঃ প্রতিষ্ঠিত হয় কেবল তখনই যখন সংশ্লিষ্ট জনগণ তাঁকে ঐশী মনোনয়নের অধিকারী নেতা ও শাসক হিসেবে চিনতে পারে। তার আগে তিনি নিজের জন্য নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব দাবী করেন নি ; নবী-রাসূলগণের ( আঃ) জীবনাচরণ থেকে এ মূলনীতি নিষ্পন্ন হয়।

হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) কেবল তখনি একটি জনপদের (মদীনাহর) জনগোষ্ঠীর ওপর আল্লাহ্ প্রদত্ত তাঁর শাসনাধিকার কার্যকর করেন যখন সেখানকার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগুরু জনগণ তাঁর রিসালাত্ এবং তাঁর নেতৃত্ব ও শাসনকর্তৃত্ব মেনে নেয়। কিন্তু মক্কায় থাকাকালে তিনি তাঁর এ অধিকার কার্যকর করার উদ্যোগ নেন নি। তেমনি হযরত আলী (আঃ) নিজেকে খেলাফতের হক্ব্দার জানা সত্ত্বেও তা লাভের জন্য যুদ্ধ করেন নি , বরং জনগণ যখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে খলীফাহ্ নির্বাচন করে কেবল তখনই তিনি খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

একই কারণে অতীতের নবী-রাসূলগণের ( আঃ) মধ্যে খুব কম সংখ্যকই শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয় , বানী ইসরাঈলের অনেক নবীর ( আঃ) ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে , স্বয়ং নবীর উপস্থিতিতে অন্য কোনো ব্যক্তি রাজা হিসেবে শাসনকর্তৃত্ব পরিচালনা করেছে এবং নবী তা মেনে নিয়ে তার সাথে সহযোগিতা করেছেন। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে নবী রাজার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বও দিয়েছেন।

এ বিষয়টি কার্যতঃ দ্বীনের সাথে রাজার সম্পর্কের ওপরে নির্ভর করতো। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে রাজার বাহ্যিক দ্বীনদারী এবং তার পক্ষ থেকে সমাজে দ্বীনী বিধিবিধান কার্যকর রাখার পরিপ্রেক্ষিতে নবী রাজাকে মেনে নিয়ে তার সাথে সহযোগিতা করতেন। যদিও নবী জানতেন যে , শাসনক্ষমতার হক্বদার তিনি নিজেই , কিন্তু তা সত্ত্বেও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সে অধিকার কার্যকর করার চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে শান্তি বজায় রাখাকেই দ্বীনের স্বার্থের জন্য অধিকতর সহায়ক বলে মনে করতেন। তবে যে ক্ষেত্রে নবী লক্ষ্য করতেন যে , দ্বীন থেকে রাজার বিচ্যুতি এমন এক পর্যায়ের যে , তাকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া ও সহযোগিতা করা উচিত হবে না তখন নবী রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান সৃষ্টি করেছেন বা তাতে সহায়তা দিয়েছেন।

আহলে বাইতের মা ছূম্ ইমামগণের ( আঃ) জীবনাচরণেও একই ধরনের দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। তাঁরা কেবল দু টি কারণ বা দু টি কারণের মধ্য থেকে যে কোনো একটি কারণ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় ক্ষমতাসীন শাসকদেরকে মেনে নিয়েছিলেন। প্রথমতঃ শাসক কর্তৃক বাহ্যতঃ দ্বীনী জীবন যাপন ও সমাজে দ্বীনী বিধিবিধান কার্যকর রাখা-যার বিপরীতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আশ্রয় নেয়া হলে উভয় পক্ষের ব্যাপক রক্তক্ষয়ের পরিণামে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত দ্বীনী শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে ইসলামের দুশমনদের দ্বারা দ্বীন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিলো। দ্বিতীয়তঃ শাসক কর্তৃক বাহ্যিক আচরণে দ্বীন থেকে বিচ্যুতি বা সমাজে দ্বীনী বিধি-বিধান কার্যকর না রাখা সত্ত্বেও তার মোকাবিলায় দ্বীনী শক্তি খুবই দুর্বল থাকায় সংঘাতের ফলে দ্বীনের পুরোপুরি বিলুপ্তির আশঙ্কা ছিলো।

অন্যদিকে শাসকের মধ্যে দ্বীন থেকে গুরুতর ধরনের বিচ্যুতির অবস্থায় শাসককে মেনে নিলে বা তার সাথে সহযোগিতা করলে দ্বীনের মূল চেতনাই বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকায় ইমাম ( আঃ) শাসককে মেনে নিতে ও তার সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। হযরত ইমাম হোসেন ( আঃ) ইয়াযীদের ক্ষমতারোহণের পরে এ ধরনের পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে মেনে নিতে ও তার সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান।


4

5

6

7

8