সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা75%

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা লেখক:
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 20 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 8461 / ডাউনলোড: 3769
সাইজ সাইজ সাইজ
সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার , বিনয়ী , জ্ঞানী , সাহসী এবং স্বাধীনতাকামী একজন নেতা। তিনি তার নানা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর উম্মতের সংশোধনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে উদ্দ্যোগ নেন। কিন্তু সে সময়ের খলিফা (শাসক) ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া তা অপছন্দ করে এবং তার সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্মকে সম্মতি দিয়ে তার প্রতি আনুগত্য করার জন্য ইমাম হোসেইন (আ.)-কে আদেশ দেয়। আর তা করা না হলে তাকে হত্যা করা হবে বলে জানিয়ে দেয়। ইমাম হোসেইন (আ.) তার সব অপকর্মের প্রতিবাদ করেন এবং আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন।

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

শিরোনাম : সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

সংকলনে : মুহাম্মাদ ইরফানুল হক

এ.কে.এম. রাশিদুজ্জামান

প্রকাশক : ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস

২৭৯/৫ , মাসকান্দা , ময়মনসিংহ

গ্রন্থস্বত্ব : প্রকাশক কর্তৃক সংরক্ষিত।

প্রকাশকাল : ১লা মর্হরম , ১৪৩৪ হি. ,

২রা অগ্রহায়ণ , ১৪১৯ বাং. ,

১৬ই নভেম্বর , ২০১২ খ্রি.।

মূদ্রণ :

কম্পোজ ও প্রচ্ছদ : আলতাফ হোসাইন

قال رسول الله (ص) إنّ الحسین مصباح الهدی و سفینة النچاة

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: নিশ্চয়ই হোসেইন হেদায়াতের বাতি ও নাজাতের নৌকা।

[মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩৩ , সাফিনাতুল বিহার , খণ্ড-১ , মদিনাতুল মায়াজিয , খণ্ড-৪ , পৃষ্ঠা-৫২ , খাসায়িসুল হোসেইনিয়া , পৃষ্ঠা-৪৫ , নাসিখুত্ তাওয়ারিখ , পৃষ্ঠা-৫৭]

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন ( আ .) ও কারবালা

মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য শাহাদাত বরণকারী এক মহান ব্যক্তি। তার পিতা হলেন হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ.) এবং মা হলেন জান্নাতে নারীদের প্রধান ফাতিমা যাহরা (সা. আ.)। ইমাম হোসেইন (আ.) সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন , নিশ্চয়ই হাসান ও হোসেইন জান্নাতে যুবকদের সর্দার। [ জামে আত তিরমিযী , হাদীস - ৩৭২০ ]

জন্ম

হিজরী চতুর্থ সনের শা বান মাসের তৃতীয় দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। শেইখ সাদুক্ব তার বর্ণনাকারীদের ক্রমধারা উল্লেখ করে সাফিয়াহ বিনতে আব্দুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেন যে , তিনি বলেছেন: যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্ম হলো আমি তখন তার মায়ের সেবা করছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে এলেন এবং বললেন , হে ফুপু , আমার ছেলেকে আমার কাছে আনো। আমি বললাম আমি তাকে এখনো পবিত্র করিনি। তিনি বললেন , তাকে তুমি পবিত্র করবে ? বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাকে পরিষ্কার ও পবিত্র করেছেন।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন , যখন হোসেইন (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখন মহান আল্লাহ জিবরাঈল (আ.)-কে ওহী করলেন যে মুহাম্মাদের একটি ছেলে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তাকে তার কাছে অবতরণ করতে বললেন , অভিনন্দন জানাতে বললেন এবং তাকে বলতে বললেন যে , নিশ্চয়ই আলীর অবস্থান তোমার কাছে ঠিক তেমনই যেমন মূসার কাছে হারুনের। তাই তার নাম রাখো হারুনের সন্তানের নামে। অতএব জিবরাঈল (আ.) অবতরণ করলেন , আল্লাহর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানালেন এবং এরপর বললেন , নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে আদেশ করেছেন তাকে হারুনের সন্তানের নামে নাম রাখতে। তিনি (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন , তার নাম কি ছিল ? তিনি জবাব দিলেন , শুবাইর । তিনি (সা.) বললেন , কিন্তু আমার ভাষাতো আরবী! তিনি বললেন , তাই তার নাম রাখুন হোসেইন [যা হলো এর আরবী অর্থ] । [ মীযান আল - হিকমাহ , হাদীস - ৪২৫ ]

অন্য একটি হাদীসে বর্ণিত আছে যে , তখন তিনি শিশু হোসেইনকে রাসূল (সা.)-এর কাছে দিলেন যিনি তার জিভকে তার মুখের ভিতর দিলেন এবং ইমাম হোসেইন (আ.) তা চাটতে লাগলেন। সাফিয়াহ বলেন যে , আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে দুধ ও মধু ছাড়া অন্য কিছু দেন নি। তিনি বলেন যে , এরপর শিশু পেশাব করলো এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) তার দুচোখের মাঝখানে একটি চুমু দিলেন এবং কাঁদলেন , এরপর আমার কাছে তাকে তুলে দিয়ে বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , আল্লাহ যেন তাকে অভিশাপ দেন যে তোমাকে হত্যা করবে। তিনি তা তিন বার বললেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম , আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক , কে তাকে হত্যা করবে ? তিনি বললেন , বনি উমাইয়ার মধ্য থেকে যে অত্যাচারী দলটি আবির্ভূত হবে।

বর্ণিত আছে , রাসূলুল্লাহ (সা.) তার ডান কানে আযান ও বাম কানে ইক্বামাহ দিলেন। ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) বর্ণনা করেছেন যে , রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কানে আযান দিয়েছিলেন যেদিন তার জন্ম হয়েছিল। এছাড়া বর্ণিত আছে যে , সপ্তম দিনে তার আকিকা দেওয়া হয়েছিল এবং সাদা রঙের মন কাড়া দুটো ভেড়া কোরবানী করা হয়েছিল , এর একটি উরুসহ পা এবং সাথে একটি স্বর্ণমুদ্রা ধাত্রীকে দেওয়া হয়েছিল। বাচ্চার চুল চেঁছে ফেলা হয়েছিল এবং এর সমান ওজনের রুপা দান করা হয়েছিল। এরপর বাচ্চার মাথায় সুগন্ধি মেখে দেওয়া হয়েছিল।

ইসলামের বিশ্বস্ত কর্তৃপক্ষ শেইখ কুলাইনি বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার মা হযরত ফাতিমা (আ.) অথবা অন্য কোন মহিলা থেকে দুধ পান করেন নি। তাকে সবসময় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আনা হতো এবং তিনি তাকে তার হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি চুষতে দিতেন। ইমাম হোসেইন (আ.) তার বুড়ো আঙ্গুল চুষতেন এবং এরপর দুই অথবা তিন দিন তৃপ্ত থাকতেন। এভাবেই ইমাম হোসেইন (আ.)-এর রক্ত ও মাংস তৈরী হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রক্ত ও মাংস থেকে।

মালহুফ -এ সাইয়েদ ইবনে তাউস বলেন যে , আকাশগুলোতে কোন ফেরেশতা বাকী ছিলো না যে রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্মদিনে অভিনন্দন জানাতে ও তার শাহাদাত সম্পর্কে শোক-বার্তা জানাতে আসে নি এবং তারা জানিয়েছিলো ইমামের জন্য কী পুরস্কার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তারা তাকে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কবর দেখালেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) দোআ করলেন , হে আল্লাহ , তাকে পরিত্যাগ করো যে হোসেইনকে পরিত্যাগ করে এবং তাকে হত্যা করো যে হোসেইনকে হত্যা করে এবং তাকে কোন প্রাচুর্য দান করো না যে তার মৃত্যু থেকে সুবিধা নেওয়ার ইচ্ছা করে। (ইবনে শাহর আশোব মানাক্বিব -এ লিখেছেন যে , একদিন জিবরাঈল অবতরণ করলেন এবং দেখলেন যে , হযরত ফাতিমা (আ.) ঘুমাচ্ছেন এবং ইমাম হোসেইন (আ.) অস্থিরতা অনুভব করছেন এবং কাঁদছেন। জিবরাঈল বসে পড়লেন এবং সান্ত্বনা দিলেন এবং শিশুর সাথে খেলা করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না হযরত ফাতিমা (আ.) জেগে উঠলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে এ কথা জানালেন। )

সাইয়্যেদ হাশিম হোসেইন বাহরানি তার মাদিনাতুল মা আজিয -এ শারহাবীল বিন আবি আউফ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) জন্ম নিয়েছিলেন উচ্চতম বেহেশতের ফেরেশতাদের একজন অবতরণ করলেন এবং বড় সমুদ্রে গেলেন এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর বান্দাহ , শোক ও দুঃখের পোষাক পরো এবং শোক পালন করো , কারণ মুহাম্মাদ (সা.)-এর সন্তান পড়ে আছে মাথাবিহীন , নির্যাতিত এবং পরাভূত অবস্থায়।

তার ইমামতের প্রমাণ

হযরত ফাতিমা (আ.) বলেছেন , আমি হোসেইনকে জন্ম দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে এসেছিলেন। তাই আমি তাকে [হোসেইনকে] তাঁর (সা.) কাছে দিলাম একটি হলদে কাপড়ে জড়িয়ে যা তিনি সরিয়ে দেখলেন এবং তাকে একটি সাদা কাপড়ে জড়িয়ে দিলেন। এরপর বললেন , ফাতিমা , তাকে নাও , নিশ্চয়ই সে একজন ইমাম এবং ইমামের সন্তান। সে নয় জন ইমামের পিতা ; তার পিঠের নিম্নাংশ থেকে আসবে নৈতিক গুণসম্পন্ন ইমামবৃন্দ , যাদের নবম জন হবে আল-ক্বায়েম [যিনি প্রতীক্ষিত আল-মাহদী-আ.]। [মীযান আল- হিকমাহ , হাদীস-৪২৬]

হযরত ফাতিমা (আ.) বলেছেন , আমি হোসেইনকে জন্ম দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার কাছে এসেছিলেন। তাই আমি তাকে [হোসেইনকে] তাঁর (সা.) কাছে দিলাম একটি হলদে কাপড়ে জড়িয়ে যা তিনি সরিয়ে দেখলেন এবং তাকে একটি সাদা কাপড়ে জড়িয়ে দিলেন। এরপর বললেন , ফাতিমা , তাকে নাও , নিশ্চয়ই সে একজন ইমাম এবং ইমামের সন্তান। সে নয় জন ইমামের পিতা ; তার পিঠের নিম্নাংশ থেকে আসবে নৈতিক গুণসম্পন্ন ইমামবৃন্দ , যাদের নবম জন হবে আল-ক্বায়েম [যিনি প্রতীক্ষিত আল-মাহদী-আ.]। [মীযান আল- হিকমাহ , হাদীস-৪২৬]

ইমাম হাসান (আ.) বলেছেন , নিঃসন্দেহে হোসেইন বিন আলী (আ.) আমার্য রতমপর এবং আমার দেহ থে কে আমার আত্মা চলে যাওয়ার পর ইমাম হবে এবং আল্লাহ যার নাম প্রশংসিত তাঁর কিতাবে নবীর উত্তারাধিকার আছে যা আল্লাহ তার পিতা ও মাতার উত্তারাধিকারের সাথে যুক্ত করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ জানতেন যে তোমরা তাঁর সৃষ্টিকূলের ভেতর শ্রেষ্ঠ , তাই তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই মুহাম্মাদ (সা.)-কে বেছে নিয়েছেন এবং মুহাম্মাদ (সা.) তোমাদের মধ্য থেকে বেছে নিয়েছেন আলীকে (আ.) এবং আলী (আ.) আমাকে বেছে নিয়েছেন ইমামতের জন্য , আর আমি বেছে নিয়েছি হোসেইনকে (আ.)। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪২৭]

হোসেইন (আ.) আমার থেকে

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , আর হোসেইনের (আ.) বিষয়ে সে আমার থেকে , সে আমার সন্তান , আমার বংশ , মানবজাতির মধ্যে তার ভাইয়ের পরে শ্রেষ্ঠ। সে মুসলমানদের ইমাম , মুমিনদের অভিভাবক , জগতসমূহের রবের প্রতিনিধি , তাদের সাহায্যকারী যারা সাহায্য চায় , তাদের আশ্রয় যারা আশ্রয় খোঁজে , [সে] আল্লাহর প্রমাণ তাঁর পুরো সৃষ্টির ওপরে , সে বেহেশতের যুবকদের সর্দার , উম্মতের নাজাতের দরজা। তার আদেশই হলো আমার আদেশ। তার আনুগত্য করা হলো আমারই আনুগত্য করা। যে-ই তাকে অনুসরণ করে সে আমার সাথে যুক্ত হয় এবং যে তার অবাধ্য হয় সে আমার সাথে যুক্ত হতে পারে না। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪২৮]

বারাআ ইবনে আযিব বর্ণনা করেছেন , আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছি ইমাম হোসেইন (আ.)-কে বহন করছেন এবং বলছেন , হে আল্লাহ , নিশ্চয়ই আমি তাকে ভালোবাসি , তাই আপনিও তাকে ভালোবাসুন। [মীযান আল- হিকমাহ , হাদীস-৪২৯ ; বুখারী , হাদীস-২১৫০ ; মুসলিম , হাদীস-৬০৭৭]

হাকিমের আমালি -এর সূত্রে নাক্কাশের তাফসীর থেকে ইবনে আব্বাসের বর্ণনা এসেছে যে , তিনি বলেছেন , একদিন আমি রাসূল (সা.)-এর সামনে বসা ছিলাম। এ সময় তার ছেলে ইবরাহীম তার বাম উরুর ওপরে এবং ইমাম হোসেইন (আ.) তার ডান উরুর ওপরে বসা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের একজনের পর আরেকজনকে চুমু দিলেন। হঠাৎ জিবরাঈল অবতরণ করলেন ওহী নিয়ে। যখন ওহী প্রকাশ শেষ হলো রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন , আমার রবের কাছ থেকে জিবরাঈল এসেছিল এবং আমাকে জানালো যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে তিনি এ দুই শিশুকে একত্রে থাকতে দিবেন না এবং একজনকে অপরজনের মুক্তিপণ (বিনিময়) করবেন।

রাসূল (সা.) ইবরাহীমের দিকে তাকালেন এবং কাঁদতে শুরুকরলেন এবং বললেন , তার মা একজন দাসী [ মারইয়াম মিশরীয় কিবতি ] , যদি সে মারা যায় আমি ছাড়া কেউ বেদনা অনুভব করবে না , কিন্তু হোসেইন হলো ফাতিমা এবং আমার চাচাতো ভাই আলীর সন্তান এবং আমার রক্ত-মাংস , যদি সে মারা যায় শুধু আলী এবং ফাতিমা নয় আমিও ভীষণ ব্যথা অনুভব করবো। তাই আলী ও ফাতিমার শোকের চাইতে আমি আমার শোককে বেছে নিচ্ছি। তাই হে জিবরাঈল , ইবরাহীমকে মৃত্যুবরণ করতে দাও , কারণ আমি হোসেইনের জন্য তাকে মুক্তিপণ করছি।

ইবনে আব্বাস বলেছেন যে , তিন দিন পর ইবরাহীম মৃত্যুবরণ করলেন। এরপর থেকে যখনই রাসূল (সা.) হোসেইনকে দেখতেন , তিনি তাকে চুমু দিতেন এবং তাকে নিজের দিকে টেনে নিতেন এবং তার ঠোঁটগুলোতে নিজের জিভ বুলাতেন। এরপর তিনি বলতেন , আমার জীবন তার জন্য কোরবান হোক যার মুক্তিপণ হিসাবে আমার ছেলে ইবরাহীমকে দিয়েছি। আমার পিতা-মাতা তোমার জন্য কোরবান হোক , হে আবা আবদিল্লাহ ।

তাঁর নৈতিক গুণাবলী

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , যে-ই চায় আকাশগুলোর বাসিন্দা ও পৃথিবীর বাসিন্দাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে দেখতে , তাহলে তার উচিৎ হোসেইনের দিকে তাকানো। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩২]

ইমাম হোসেইন (আ.) বলেছেনে , আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাক্ষাতে গিয়েছিলাম যেখানে উবাই বিন কা ব তার সাথে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন , স্বাগতম! হে আবা আবদিল্লাহ , হে আকাশগুলো ও পৃথিবীগুলোর সৌন্দর্য। এতে উবাই বললো , হে রাসূলুল্লাহ (সা.) , আপনি ছাড়া অন্য কারো জন্য এটি কি করে সম্ভব যে সে আকাশগুলো ও পৃথিবীগুলোর সৌন্দর্য হবে ? তিনি বললেন , হে উবাই , আমি তার শপথ করে বলছি যিনি আমাকে তাঁর অধিকার বলে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন , নিশ্চিতভাবেই হোসেইন বিন আলী[-র মূল্য] আকাশগুলো ও পৃথিবীগুলোর চেয়ে বেশী এবং নিশ্চয়ই [তার বিষয়ে] আল্লাহর আরশের ডান দিকে লেখা আছে: হেদায়েতের আলো , নাজাতের নৌকা , একজন ইমাম , দুর্বল না , মর্যাদা ও গৌরবের [উৎস] , এক সুউচ্চ বাতিঘর এবং মহামূল্যবান সম্পদ। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩৩]

ইমাম হোসেইন (আ.) আশুরার দিন [কারবালাতে] তার বক্তৃতায় বলেছিলেন , সাবধান! ভণ্ডের সন্তান ভণ্ড[উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ এবং যিয়াদ ইবনে আবিহ] আমাকে কোনঠাসা করেছে দুটো জিনিসের মাঝখানে খাপ থেকে তরবারি খোলা অথবা অপমান সহ্য করা। আর তা বহু দূরে যে আমরা অপমান বেছে নেবো। নিশ্চয়ই আল্লাহ , তাঁর রাসূল , বিশ্বাসীরা এবং যে ঐশী ও পবিত্র কোল আমাদের সেবা করেছে এবং যা অপমানকে ঘৃণা করে , তারা সবাই এটি প্রত্যাখ্যান করেছেন যে , সম্মানের মৃত্যুর ওপরে জঘন্য ব্যক্তিদের আনুগত্যকে বেছে নেওয়া হবে। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩৪]

ইমাম হোসেইন (আ.) আশুরার দিন [কারবালাতে] তার বক্তৃতায় বলেছিলেন , আল্লাহর শপথ , আমি তোমাদের হাতে আমার হাত দিবো না কোন অপমানিত ব্যক্তির মতো , আর না আমি পালিয়ে যাবো একজন ক্রীতদাসের মতো। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩৫]

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেছেন , আমি হোসেইন (আ.)-কে বলতে শুনেছি , যদি কোন ব্যক্তি আমাকে এই কানে অপমান করে ডান কানের দিকে ইঙ্গিত করে এবং ক্ষমা চায় অন্যটিতে , আমি তার কাছ থেকে তা গ্রহণ করবো ; আর তা এ কারণে যে , আমিরুল মু মিনিন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে তিনি আমার নানা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছেন , যে ব্যক্তি কোন ব্যক্তির ক্ষমা প্রার্থনা শুনতে চায় না হোক সে সঠিক অবস্থানে অথবা ভুল অবস্থানে , সে হাউজে কাউসারে উপস্থিত হবে না। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩৬]

হুযাইফা বিন আল-ইয়ামান বর্ণনা করেছেন , আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছি হোসেইন (আ.)-এর হাত ধরে থাকা অবস্থায় বলতে , হে জনগণ , এ হলো হোসেইন ইবনে আলী , অতএব তাকে স্বীকার করে নাও। তাঁর শপথ যাঁর হাতে আমার জীবন , নিশ্চয়ই সে জান্নাতে থাকবে , যারা তাকে ভালোবাসে তারা জান্নাতে থাকবে এবং যারা তার প্রেমিকদের ভালোবাসে তারাও জান্নাতে থাকবে। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৪৩৭]

শুয়াইব বিন আব্দুর রহমান আল-খযাঈ বলেছেন , তাফ [আশুরা]-এর দিনে হোসেইন (আ.)-এর পিঠে একটি দাগ দেখা গিয়েছিল , তাই তারা যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলো [এ বিষয়ে] এবং তিনি উত্তর দিলেন , এগুলো [খাদ্যের] বস্তাগুলোর দাগ যা তিনি পিঠে বহন করে বিধবাদের , ইয়াতিমদের ও সহায় সম্বলহীন ব্যক্তিদের বাড়ীগুলোতে নিতেন। [মীযান আল- হিকমাহ , হাদীস-৪৩৮]

বর্ণিত হয়েছে যে , একদিন ফাতিমা যাহরা (আ.) তার দুই ছেলে ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসেইন (আ.)-কে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলেন যিনি খুব অসুস্থ ছিলেন (এবং পরে তিনি এ কারণেই ইন্তেকাল করেন)। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে অনুরোধ করলেন তার দুই ছেলেকে [তার গুণাবলী থেকে] কিছু উত্তরাধিকার হিসেবে দিতে। এতে রাসূল (সা.) বললেন , হাসানের জন্য সে আমার খোদাভীতি ও শ্রেষ্ঠত্ব উত্তরাধিকার হিসেবে লাভ করবে এবং হোসেইন সে আমার উদারতা ও বীরত্ব উত্তরাধিকার হিসাবে লাভ করবে।

এটি সুপরিচিত যে , ইমাম হোসেইন (আ.) অতিথিদের আপ্যায়ন ও সেবা করতে ভালোবাসতেন এবং অন্যের আশা পূরণ করতেন এবং আত্মীয়দের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি দরিদ্র প্রতিবন্ধীদের ও দরিদ্রদের উপহার দিতেন , অভাবীদের দান করতেন , বস্ত্রহীনকে পোষাক দিতেন , ক্ষুধার্তকে খাওয়াতেন , ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্ত করতেন , ইয়াতিমদের স্নেহের সাথে হাত বুলিয়ে দিতেন এবং সাহায্যপ্রার্থীদের সাহায্য করতেন , যখনই তিনি কোন সম্পদ লাভ করতেন তিনি তা অন্যদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন।

হত্যা করা সম্পর্কে কুরআনের আয়াত ও হাদীস

মহান আল্লাহ বলেন :

) م ِنْ أَجْلِ ذَٰلِكَ كَتَبْنَا عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ أَنَّهُ مَن قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا(

জন্যই আমরা ইসরাইলের সন্তানদের জন্য সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাম যে ,যে কেউ কোন সত্তাকে হত্যা করবে ,মানুষ হত্যা [ অপরাধে অপরাধীকে ]ছাড়া ,অথবা পৃথিবীতে দুষ্কর্মকারী [ছাড়া ] ,তা হলো এমন যেন সে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করলো। আর যে - একটি জীবন বাঁচায় তা হলো এমন যেন সে পুরো মানবজাতিকে রক্ষা করলো। [সূরা মায়েদা :৩২ ]

মানুষ হত্যা করা সম্পর্কে সুবিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ মিজান আল-হিকমাহ থেকে কিছু হাদীস নিচে উল্লেখ করা হলো:-

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , মানুষের মধ্যে সবচেয়ে আগ্রাসী হলো সে যে নিজের হত্যাকারীকে ছাড়া কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে অথবা নিজের আঘাতকারীকে ছাড়া কোন ব্যক্তিকে আঘাত করে। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস- ৫১৪০]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , কিয়ামতের দিন [সমবেত] জনতার মাঝে প্রথম যে বিষয়ে বিচার করা হবে তা হলো [তাদের মধ্যে] রক্তপাত। [মীযান আল- হিকমাহ , হাদীস-৫১৪১]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , আল্লাহর কাছে পুরো পৃথিবীকে উপড়ে ফেলা খুবই গুরুত্বহীন ঐ রক্তপাতের চেয়ে যা অন্যায়ভাবে ঘটানো হয়েছে। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৫১৪২]

বিশ্বাসীকে হত্যা করা

মহান আল্লাহ বলেন :

) و َمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّـهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا(

যদি কেউ ইচ্ছে করে কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করে , তার প্রতিফল হলো জাহান্নাম , সেখানেই থাকার জন্য চিরকাল ; আল্লাহ তার প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন ও তাকে অভিশাপ দিবেন এবং তিনি তার জন্য এক বিরাট শাস্তিপ্রস্তুত করবেন। [সূরা নিসা: ৯৩]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , হে জনগণ , কোন মানুষকে কি হত্যা করা হবে যখন আমি তোমাদের মাঝে আছি এবং হত্যাকারী কে তা অজ্ঞাত ? যদি আকাশগুলোর ও পৃথিবীর পুরো জনগণ একত্র হতো একজন মুসলমানকে হত্যা করার জন্য , তাহলে আল্লাহ তাদের সবাইকে শাস্তি দিবেন কোন সংখ্যা ও হিসাব ছাড়া। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৫১৪৪]

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন , যে একজন বিশ্বাসীকে হত্যা করতে সাহায্য করে , এমনকি একটি কথার একটি অংশ দিয়েও , সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে কপালে এ কথাটি লেখা অবস্থায়-“ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত। [মীযান আল-হিকমাহ , হাদীস-৫১৪৫]

কারবালার ঘটনার প্রেক্ষাপট

ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার , বিনয়ী , জ্ঞানী , সাহসী এবং স্বাধীনতাকামী একজন নেতা। তিনি তার নানা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর উম্মতের সংশোধনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে উদ্দ্যোগ নেন। কিন্তু সে সময়ের খলিফা (শাসক) ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া তা অপছন্দ করে এবং তার সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্মকে সম্মতি দিয়ে তার প্রতি আনুগত্য করার জন্য ইমাম হোসেইন (আ.)-কে আদেশ দেয়। আর তা করা না হলে তাকে হত্যা করা হবে বলে জানিয়ে দেয়। ইমাম হোসেইন (আ.) তার সব অপকর্মের প্রতিবাদ করেন এবং আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন।

কিন্তু তিনি জানতে পারেন ইয়াযীদ হজ্বের সময় তাকে হত্যার জন্য মক্কায় তার দূত পাঠিয়েছে। পবিত্র কাবা ঘরের কোন স্থানে তার রক্ত ঝরুক এটি তিনি পছন্দ করেন নি। তাই হজ্ব না করেই ৮ই জিলহজ্ব ইমাম হোসেইন (আ.) মক্কা থেকে মরুভূমির দিকে বেরিয়ে পড়েন। [বর্তমান ইরাকের] কুফা এলাকা থেকে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইমাম হোসেইন (আ.)-কে চিঠি পাঠিয়েছিলেন যেন তিনি কায়ফযান এবং সেখানে গিয়ে তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব দেন। এতে ইসলাম ধ্বংস ও বিকৃতি থেকে রক্ষা পাবে। এসব চিঠির কারণে ইমাম হোসেইন (আ.) মক্কা ত্যাগ করে কুফার দিকে যাত্রা শুরুকরেন। কিন্তু পথে ইয়াযীদের নিয়োগ করা গভর্নর উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের আদেশে হুর বিন ইয়াযীদ ইমামকে বাধা প্রদান করে এবং কারবালা প্রান্তরে নিয়ে যায়। এখানে শত্রুরা প্রায় ত্রিশ হাজার সসস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করে এবং ইমাম হোসেইন (আ.)-কে জোরপূর্বক বাইয়াত (আনুগত্য) করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। তারা জানায় যে , যদি তা না করা হয় তাহলে তাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথে ছিলো কেবল অল্প ক জন [প্রায় ১০০ জন] বন্ধু ও সাহায্যকারী এবং তার পরিবারের নারী ও শিশুরা।দ্ধযকরতে পারেন এমন পুরুষের সংখ্যা ছিলো ৭০ জনেরও কম। তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে সত্য ইসলামকে রক্ষার জন্য [আত্মরক্ষার] যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ইয়াযীদের দরবারে হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য

ইমাম আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) কন্যা যয়নব , ইয়াযীদের সভায় দণ্ডায়মান হয়ে বলেন :

“ বিশ্বের প্রতিপালকের জন্যে সমস্ত প্রশংসা ও স্তুতি এবং রাসূল ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর করুণা অবতীর্ণ হোক ! পরম পবিত্র আল্লাহ্ তায়ালা কতটা সত্য কথা বলেছেন ! তিনি বলেন : গোনাহ্গার ও মন্দ লোকদের পরিণতি এই হবে যে ,আমাদের নিদর্শনগুলিকে মিথ্যা মনে করবে এবং সেইগুলিকে উপহাসের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করবে। ’ ইয়াযীদ ! তুমি কি ধারণা করেছো ? তুমি কি ধারণা করছ যে , তুমি এখন আমাদের জন্য পৃথিবী ও আকাশকে সংকীর্ণ করে দিয়েছো এবং আমাদেরকে এই অবস্থায় উপনীত করেছো যে , বন্দিদের মত আমাদেরকে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । ভেবেছো এই কাজটি আমাদেরকে আল্লাহর নিকট হীন ও অযোগ্য করে দিবে এবং তোমাকে সম্মানিত ও মহত্বে পৌঁছাবে ; আর আল্লাহর নিকট তোমার উচ্চমর্যাদার কারণে এই বাহ্যিক বিজয় ঘটেছে ? এই কারণে তুমি চরম আনন্দিত এবং নিজের অতীতে ফিরে গেছ , পৃথিবীকে নিজের জন্যে প্রস্তুত , সুসজ্জিত ও সুস্বাদু দেখে তুমি খুশী ও আনন্দে বাগ বাগ হয়েছো ? আমাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন তোমার করতলগত হয়েছে এইরূপ করছ ? শান্ত হও , শান্ত হও ! মহান আল্লাহর বাণী কি ভুলে গেছ ( ?) তিনি বলেছেন : যারা কুফরী করে তারা যেন এইরূপ ধারণা না করে যে , পৃথিবীর যে সব সুযোগ সুবিধা আমরা তাদেরকে দান করি সেগুলি তাদের জন্যে কল্যাণকর। আমরা এই সুযোগ সুবিধাগুলি তাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করি যে , সেইগুলি যেন তাদের পাপসমূহকে বৃদ্ধি করে এবং আগামীতে তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি ।

হে আমাদের নানার মুক্তকৃত লোকদের সন্তান ! এইটি কি ন্যায়বিচার যে , তুমি নিজ নারী ও দাসীদেরকে পর্দায় রাখছ আর রাসূলুল্লাহর কন্যাগণকে বন্দী হিসেবে ইসলামী দেশের চতুর্দিকে ঘোরাচ্ছ ? তাঁদের পর্দা কেড়ে মুখমণ্ডলসমূহকে প্রকাশ করছ ? শত্রুদের দ্বারা তাঁদেরকে শহর হতে শহরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য করছ ? তাঁদেরকে শহরের লোকজনদের নিকট বিনোদনের উপাদান বানাচ্ছ , যাতে পরিচিত অপরিচিত এবং উত্তম অধম সবাই তাঁদের মুখমণ্ডলগুলিকে লক্ষ্য করে। আর এই অবস্থায় তাঁদের সাথে তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই এবং তাঁদের পুরুষগণের পক্ষ হতে তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে না ?!

না , হে আল্লাহ্ , কি বলব ! নিরাপত্তার ব্যাপারে কি করে তাদের প্রতি আশা করা যায় ( ?) যারা সায়্যিদুশ্ শুহাদা হযরত হামযা ’ র মত পবিত্রতম ব্যক্তিত্বের কলিজা চিবিয়েছে এবং ওহুদের শহীদগণের রক্তের দ্বারা যাদের রক্ত মাংসের বৃদ্ধি ঘটেছে ? আমাদের আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে নরম আচরণ করবে বলে তাদের উপর কি করে আশা করা যায় যারা আমাদেরকে অস্বীকার করে , শত্রুতা , ঈর্ষা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখে এবং তাদের মধ্যে গুনাহর কোন অনুভূতিই নেই , এই কাজটিকে বড় কোন অন্যায় বলে মনে করে না ? বরং বলছে : লোকেরা যেন আনন্দ করে , খুশীতে থাকে , উল্লাস করে ! আর বলে , এ কর্মের জন্যে হে ইয়াযীদ! তোমাকে ধন্যবাদ। ’ এই অবস্থায় , বেহেশ্তের যুবকদের সর্দার হযরত আবু আব্দিল্লাহর দাঁতগুলিকে তুমি তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত করছ ! কেনই বা তুমি এইরূপ কাজ করবে না ?! মুহাম্মদের (সা.) নাতি ও আলে আব্দিল মুত্তালিবের আকাশের তারকাগণের রক্তপাতের মাধ্যমে তুমি যে , তোমার হিংসা বিদ্বেষপূর্ণ নোংরা বস্তুগত চেহারার পর্দা উন্মুক্ত করেছো এবং তোমার মূলে ফিরে গেছ , তোমার পিতৃপুরুষদের স্মরণ করছ ও তাদেরকে আহ্বান করাকে কল্যাণকর ধারণা করছ , অথচ খুব শীঘ্রই তুমি তাদের প্রবেশের স্থানে প্রবেশ করবে ! সেইখানে তুমি চাইবে যে , যদি তুমি খোঁড়া , অক্ষম ও বোবা হতে এবং এই সব না বলতে ও এইরূপ কর্ম না করতে !

হে আল্লাহ্ ! আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ কর ! যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি অত্যাচার করেছে তার নিকট হতে প্রতিশোধ নাও ! যে ব্যক্তি আমাদের রক্তপাত করেছে ও আমাদের অভিভাবকগণকে হত্যা করেছে তুমি তাদের উপর তোমার ক্রোধ ও অভিসম্পাত প্রেরণ কর !

ইয়াযীদ ! আল্লাহর শপথ ! তুমি তোমার নিজের চামড়া ব্যতীত অন্য কিছু চিরনি এবং তোমার নিজেরই মাংস ব্যতিত অন্য কিছুই কাটনি ! আল্লাহর রাসূলের সন্তান সন্ততির রক্তপাত ,তাঁর ইতরাত (বংশধর) ও তাঁর শরীরের অংশসমূহের সম্মান বিনষ্ট করার ফলে যেসব অপরাধ তোমার কাঁধে চেপেছে সেসব সহকারে তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর (রাসূল) নিকট প্রবেশ করবে ! আল্লাহ্ তাঁদের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহকে সংযোজন করবেন , তাঁদের বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে সংযুক্ত করবেন এবং তাঁদের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন ! আর তোমরা এইরূপ ধারণা করো না যে , যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছেন তাঁরা মারা গেছেন , বরং তাঁরা জীবিত আছেন এবং তাঁদের প্রতিপালকের নিকট হতে রিয্ক গ্রহণ করেন।

তোমার জন্যে এই যথেষ্ট যে , মহান আল্লাহ্ তোমার নিকট হিসাব গ্রহণ করবেন , মুহাম্মদ (সা.) তোমার সাথে দুশমনি করবেন এবং জিব্রাঈল (আ.) আমাদের পৃষ্ঠপোষক হবেন। যে ব্যক্তি তোমার জন্যে এইরূপ অপরাধকে সুসজ্জিত করেছে এবং মুসলমানদের উপর তোমাকে কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী করেছে সে অচিরেই বুঝবে যে , অত্যাচারীর জন্যে জাহান্নামের মন্দ স্থান নির্ধারিত রয়েছে এবং তুমিও বুঝবে যে , তোমাদের ও আমাদের মাঝে কারা মন্দ স্থানে রয়েছে এবং কারা দুর্বলতর শক্তির অধিকারী।

ইয়াযীদ ! বর্তমান কঠিন অবস্থা ও সমস্যাদি আমাকে এমন স্থানে উপনীত করেছে , যার ফলে তোমার সাথে কথা বলছি ! তবে তুমি জেনে রেখ ! আমি তোমাকে এতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করি যে , তোমাকে ভর্ৎসনা করাটাও তোমার সত্তার চেয়ে বড় মনে করি এবং তোমার জন্যে তিরস্কার করাটাও বেশী মনে করি (অর্থাৎ তুমি ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের অযোগ্য) ! কিন্তু কি করি ! ? চক্ষুগুলি অশ্রুতে পূর্ণ এবং অন্তরসমূহ অগ্নিদগ্ধ ! জেনে রেখ ! বিস্ময়কর ! সবই বিস্ময়কর !! শয়তানের দলের মুক্তিপ্রাপ্ত লোকদের হাতে হিযবুল্লাহর মহানুভব ব্যক্তিগণ নিহত হচ্ছেন ! এই হাতগুলি হতে আমাদের রক্ত ঝরছে , এই মুখগুলি আমাদের মাংসকে চোষণ করছে এবং আমাদের পবিত্র ব্যক্তিগণের দেহসমূহকে নেকড়েরা ছিন্নভিন্ন করছে , হায়েনারা মাটির উপর টানাটানি করছে !

ইয়াযীদ ! তুমি যদি আমাদেরকে তোমার জন্য গনিমত মনে করে থাক তবে এইটি জেনে রেখ যে , খুব শীঘ্রই আমাদেরকে তোমার ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখবে ! পূর্বে প্রেরিত আমলগুলি ছাড়া সেইখানে আর অন্য কিছু পাবে না ! তোমার প্রতিপালক অত্যাচারী লোকদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না ! আমি আল্লাহর নিকট অভিযোগ করছি এবং তাঁর উপর আমার ভরসা আছে।

ইয়াযীদ ! তুমি তোমার প্রতারণাকে কাজে লাগাও , তোমার চেষ্টাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাও এবং তোমার প্রচেষ্টাকে বিস্তৃত কর ! আল্লাহর শপথ ! তুমি আমাদের স্মরণকে বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আমাদের ঐশী প্রেরণাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। এই অপরাধের লজ্জা ও অপমান তোমার থেকে কখনই মুছে যাবে না। দুর্বল (যুক্তি)ও মিথ্যা(ভাষ্য) ব্যতীত তোমার কি মত আছে ? মুষ্টিমেয় কয়েকটি দিন এবং বিক্ষিপ্ত জনতা ছাড়া তোমার আর কি আছে ? যে দিন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন : জেনে রাখ ! জালিমের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হোক ! বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা , যিনি আমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৌভাগ্য ও মাগফিরাতসহ গন্তব্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়েছেন এবং আমাদের উত্তরসুরিগণকে শাহাদত ও রহমত দ্বারা নৈকট্য দান করেছেন। মহান আল্লাহর নিকট কামনা করব , তিনি যেন তাঁদেরকে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেন এবং তাঁদের শাহাদতকে তাঁর নিয়ামত বৃদ্ধির উপকরণ বানিয়ে দেন ! আমাদেরকে তাঁদের উত্তম প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করেন ! তিনি হচ্ছেন করুণাময় ও দয়ালু। তিনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম ভরসাস্থল । ১৩৩

দামেশকের জামে মসজিদে হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর ভাষণ

ইয়াযীদ দামেশকের জামে মসজিদে স্বীয় খতীবকে আদেশ প্রদান করে যে , সে যেন মিম্বরে আরোহণ করে মুয়াবিযা ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে এবং ইমাম আলী ও ইমাম হুসাইনের (আ.) সমালোচনা করে। খতীব মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতির পর যথাসাধ্য আলী ও হুসাইনের (আ.) নিন্দা এবং মুয়াবিয়া ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে।

এ অবস্থায় হুসাইনের পুত্র আলী (আ.) তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন : হে বক্তা , তোমার অকল্যাণ হোক ! সৃষ্টির সন্তুষ্টিকে স্রষ্টার ক্রোধের সাথে বিনিময় করলে এবং জাহান্নামে তোমার জায়গা বেছে নিলে ?!

অতঃপর তিনি বলেন : ইয়াযীদ ! তুমি আমাকে অনুমতি দাও , আমি এই কাঠের (মিম্বারের দিকে নির্দেশ করে) উপর আরোহণ করে এমন কিছু কথা বলব যে , তা আল্লাহর সন্তুষ্টিরও কারণ হবে এবং উপস্থিত জনগণও ছাওয়াব ও কল্যাণ লাভ করবে । ইয়াযীদ গ্রহণ করল না। উপস্থিত জনতা বলল : হে আমীরুল মু মিনীন ! তাঁকে আরোহণ করার অনুমতি দিন , আমরা তাঁর নিকট হতে সম্ভবতঃ কিছু শুনতে পাব । ইয়াযীদ তাদেরকে বলল : যদি এই ব্যক্তিটি মিম্বরে আরোহণ করেন তবে আমার এবং আবু সুফিয়ানের বংশের মান সম্মান ধুলিস্যাত না করে নামবেন না ! লোকেরা বলল : কোন্ লোক তাঁর ও তাঁর বক্তব্যের পক্ষ নেবে ? ইয়াযীদ বলল : সে এমন এক পরিবারের সদস্য যারা জ্ঞানকে সর্বোত্তমরূপে আস্বাদন করেছে ! কিন্তু উপস্থিত লোকেরা এতবেশী পীড়াপীড়ি করতে লাগল যে , শেষে ইয়াযীদ অনুমতি দিতে বাধ্য হল। ইমাম (আ.) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা , স্তুতি ও গুণগান করে বললেন :

“ হে উপস্থিত জনতা ! রাসূলের বংশধর হিসেবে আমাদেরকে ছয়টি বিশেষত্ব দান করা হয়েছে এবং অন্যদের উপর আমাদের সাতটি বিষয়ে প্রাধান্য রয়েছে। আমাদের প্রতি দানকৃত জিনিসগুলি হচ্ছে : জ্ঞান প্রজ্ঞা , ধৈর্য , মহানুভবতা , বাকপটুতা , সাহসিকতা ও মু মিনদের অন্তরসমূহে আমাদের প্রতি ভালবাসা। আর অন্যদের চেয়ে আমাদের প্রাধান্যের বিষয়গুলো হচ্ছে :আমরা হচ্ছি আল্লাহর নির্বাচিত নবী মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) বংশভুক্ত , আর সিদ্দীক , আসাদুল্লাহ্ ,ও আসাদুর রাসূল আলী , বিশ্বের নারীদের নেত্রী ফাতিমা বাতুল ,এই বংশের দুই সন্তান জান্নাতের যুবকদের দুই সর্দার , জাফর তাইয়ার সকলেই আমাদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর বলেন: যারা আমাকে চিনেন তারা তো চিনেনই ; আর যারা আমাকে চিনেন না তাদেরকে এখন আমার বংশকৌলীন্য সম্পর্কে অবহিত করব ।

আমি মক্কা ও মিনার সন্তান। আমি জমজম ও সাফার সন্তান। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান যিনি চাদরের আঁচলে করে যাকাত নিয়ে চারদিকে ছুটে যেতেন। সর্বোত্তম লুঙ্গি ও চাদর পরিধানকারী লোকের আমি সন্তান। আমি সর্বোত্তম খড়ম পরিধানকারীর সন্তান। আমি সেই সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বের সন্তান যিনি তাওয়াফ ও সাঈ ’ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি হজ্জ করেছেন ও লাব্বাইক বলেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি বোরাকে আরোহণ করে আসমানে ভ্রমণ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁকে নৈশকালে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তিনি কত পবিত্র সত্ত্বা যিনি তাঁকে নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন।)১৩৪ আমি তাঁর সন্তান যাঁকে জিব্রাঈল (আ.) সিদ্রাতুল মুন্তাহায় ’ পৌঁছিয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি নিকটবর্তী হয়েছেন এবং দুই বিঘত পরিমাণ অথবা তদোপেক্ষা নিকটবর্তী হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি আসমানসমূহের ফেরেশ্তাদের সাথে নামায আদায় করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁর নিকটে মহান আল্লাহর যা কিছু ওহী করার ছিল তা ওহী করেছেন। আমি মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) সন্তান , তাঁর সন্তান যিনি মানুষের নাসিকা ধুলায় ধুসরিত করেছেন ফলে তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি দুইবার বাইআত করেছেন। দুই কিবলার দিকে নামায আদায় করেছেন। বদর ও হুনাইনে যুদ্ধ করেছেন। চোখের পলক পড়ার সমান পরিমাণ সময়ও আল্লাহকে অস্বীকার করেন নি। মুসলমানদের অগ্রপথিক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী , অত্যাচারী ও খারিজীদেরকে হত্যাকারী। মহানুভব ও দাতা , পবিত্রদের নেতা , হেজাজের সিংহ , ইরাকের ব্যাঘ্র , মক্কী , মাদানী , আবতাহী , তাহামী , খাইফী , আকাবী , বদরী , ওহুদী , শাজারী , মুহাজেরী , সিবতাইনের (হাসান ও হুসাইন) পিতা আলী ইবনে আবী তালিবের সন্তান। আমি ফাতিমা যাহরার সন্তান। আমি নারীদের নেত্রীর সন্তান। আমি রাসূলের দেহের অংশের সন্তান ।

বর্ণনাকারী বলেন : মানুষের কান্না ও চিৎকার ধ্বনি উত্থিত হওয়া পর্যন্ত ইমাম অব্যাহতভাবে আমি , আমি , বলে যাচ্ছিলেন। হট্টগোল সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে ইয়াযীদ মুয়াজ্জিনকে আযান দিতে আদেশ দেয় এবং ইমামের বক্তব্যের ছেদ ঘটায়। ইমামও নীরব হয়ে যান। মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার ’ বলল , ইমাম (আ.) বলেন : তিনি মহান , এমন মহান সত্তা যে , কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধারণযোগ্য নন। কোনো বস্তুই তাঁর চেয়ে মহান নয় । মুয়াজ্জিন আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলল ইমাম (আ.) বললেন : এই বাণীর প্রতি আমার সমস্ত অস্তিত্ব সাক্ষ্য দিচ্ছে ; আমার লোম , চামড়া , মাংস , রক্ত , মেধা , অস্থি সবই তার প্রতি সাক্ষ্য দিচ্ছে । মুয়াজ্জিন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলল , ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) মিম্বরের উপর হতে ইয়াযীদের দিকে মুখ করে বলেন : ইয়াযীদ ! এই মুহাম্মদ (সা.) আমার নানা , না তোমার নানা ? যদি তোমার নানা বলে দাবি কর তবে নিশ্চয় তুমি মিথ্যা বলছ , আর যদি আমার নানা বলে স্বীকার কর তবে তাঁর ইতরাতকে (বংশধর) কেন হত্যা করলে ?

বর্ণনাকারী বলেন : মুয়াজ্জিন আযান সমাপ্ত করলে , ইয়াযীদ সামনে যায় এবং যোহরের নামায আদায় করে। ’১৩৫

খিলাফতের রাজধানীতে শোকানুষ্ঠান পালন

দামেশকের মসজিদে ইমামের (আ.) বক্তব্যের পর , ইয়াযীদ নামায সম্পন্ন করে আদেশ দেয় যে , প্রস্তুতকৃত ঘরটিতে যেন ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) এবং তাঁর ভগ্নীগণ ও ফুফুদেরকে স্থান দেয়া হয়। তাঁরাও সেইখানে কয়েকদিন যাবৎ শোকানুষ্ঠান পালন করেন এবং হুসাইনের (আ.) জন্যে ক্রন্দন করেন ও শোকগাথাঁ পাঠ করেন।

এই অনুষ্ঠানের পরে , ইয়াযীদ রাসূলের (সা.) সন্তান সন্ততির সাথে আচরণ পরিবর্তন করতে এবং কতকগুলি সীমাবদ্ধতাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় ও তাঁদের শহীদগণের জন্যে শোকানুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ।

অতঃপর ইয়াযীদ দামেশক শহরের অবস্থা শোচনীয় দেখে বন্দী কাফেলাকে সম্মানের সাথে মদীনায় পাঠায়।

ইয়াযীদের দরবারে হযরত যয়নবের (আ.) বক্তব্য

ইমাম আলী ইবনে আবী তালিবের (আ.) কন্যা যয়নব , ইয়াযীদের সভায় দণ্ডায়মান হয়ে বলেন :

“ বিশ্বের প্রতিপালকের জন্যে সমস্ত প্রশংসা ও স্তুতি এবং রাসূল ও তাঁর বংশধরের উপর আল্লাহর করুণা অবতীর্ণ হোক ! পরম পবিত্র আল্লাহ্ তায়ালা কতটা সত্য কথা বলেছেন ! তিনি বলেন : গোনাহ্গার ও মন্দ লোকদের পরিণতি এই হবে যে ,আমাদের নিদর্শনগুলিকে মিথ্যা মনে করবে এবং সেইগুলিকে উপহাসের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করবে। ’ ইয়াযীদ ! তুমি কি ধারণা করেছো ? তুমি কি ধারণা করছ যে , তুমি এখন আমাদের জন্য পৃথিবী ও আকাশকে সংকীর্ণ করে দিয়েছো এবং আমাদেরকে এই অবস্থায় উপনীত করেছো যে , বন্দিদের মত আমাদেরকে এদিক সেদিক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । ভেবেছো এই কাজটি আমাদেরকে আল্লাহর নিকট হীন ও অযোগ্য করে দিবে এবং তোমাকে সম্মানিত ও মহত্বে পৌঁছাবে ; আর আল্লাহর নিকট তোমার উচ্চমর্যাদার কারণে এই বাহ্যিক বিজয় ঘটেছে ? এই কারণে তুমি চরম আনন্দিত এবং নিজের অতীতে ফিরে গেছ , পৃথিবীকে নিজের জন্যে প্রস্তুত , সুসজ্জিত ও সুস্বাদু দেখে তুমি খুশী ও আনন্দে বাগ বাগ হয়েছো ? আমাদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা যখন তোমার করতলগত হয়েছে এইরূপ করছ ? শান্ত হও , শান্ত হও ! মহান আল্লাহর বাণী কি ভুলে গেছ ( ?) তিনি বলেছেন : যারা কুফরী করে তারা যেন এইরূপ ধারণা না করে যে , পৃথিবীর যে সব সুযোগ সুবিধা আমরা তাদেরকে দান করি সেগুলি তাদের জন্যে কল্যাণকর। আমরা এই সুযোগ সুবিধাগুলি তাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করি যে , সেইগুলি যেন তাদের পাপসমূহকে বৃদ্ধি করে এবং আগামীতে তাদের জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি ।

হে আমাদের নানার মুক্তকৃত লোকদের সন্তান ! এইটি কি ন্যায়বিচার যে , তুমি নিজ নারী ও দাসীদেরকে পর্দায় রাখছ আর রাসূলুল্লাহর কন্যাগণকে বন্দী হিসেবে ইসলামী দেশের চতুর্দিকে ঘোরাচ্ছ ? তাঁদের পর্দা কেড়ে মুখমণ্ডলসমূহকে প্রকাশ করছ ? শত্রুদের দ্বারা তাঁদেরকে শহর হতে শহরে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে বাধ্য করছ ? তাঁদেরকে শহরের লোকজনদের নিকট বিনোদনের উপাদান বানাচ্ছ , যাতে পরিচিত অপরিচিত এবং উত্তম অধম সবাই তাঁদের মুখমণ্ডলগুলিকে লক্ষ্য করে। আর এই অবস্থায় তাঁদের সাথে তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই এবং তাঁদের পুরুষগণের পক্ষ হতে তত্ত্বাবধায়ন হচ্ছে না ?!

না , হে আল্লাহ্ , কি বলব ! নিরাপত্তার ব্যাপারে কি করে তাদের প্রতি আশা করা যায় ( ?) যারা সায়্যিদুশ্ শুহাদা হযরত হামযা ’ র মত পবিত্রতম ব্যক্তিত্বের কলিজা চিবিয়েছে এবং ওহুদের শহীদগণের রক্তের দ্বারা যাদের রক্ত মাংসের বৃদ্ধি ঘটেছে ? আমাদের আহলে বাইতের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে নরম আচরণ করবে বলে তাদের উপর কি করে আশা করা যায় যারা আমাদেরকে অস্বীকার করে , শত্রুতা , ঈর্ষা ও বিদ্বেষের দৃষ্টিতে আমাদেরকে দেখে এবং তাদের মধ্যে গুনাহর কোন অনুভূতিই নেই , এই কাজটিকে বড় কোন অন্যায় বলে মনে করে না ? বরং বলছে : লোকেরা যেন আনন্দ করে , খুশীতে থাকে , উল্লাস করে ! আর বলে , এ কর্মের জন্যে হে ইয়াযীদ! তোমাকে ধন্যবাদ। ’ এই অবস্থায় , বেহেশ্তের যুবকদের সর্দার হযরত আবু আব্দিল্লাহর দাঁতগুলিকে তুমি তোমার লাঠি দ্বারা আঘাত করছ ! কেনই বা তুমি এইরূপ কাজ করবে না ?! মুহাম্মদের (সা.) নাতি ও আলে আব্দিল মুত্তালিবের আকাশের তারকাগণের রক্তপাতের মাধ্যমে তুমি যে , তোমার হিংসা বিদ্বেষপূর্ণ নোংরা বস্তুগত চেহারার পর্দা উন্মুক্ত করেছো এবং তোমার মূলে ফিরে গেছ , তোমার পিতৃপুরুষদের স্মরণ করছ ও তাদেরকে আহ্বান করাকে কল্যাণকর ধারণা করছ , অথচ খুব শীঘ্রই তুমি তাদের প্রবেশের স্থানে প্রবেশ করবে ! সেইখানে তুমি চাইবে যে , যদি তুমি খোঁড়া , অক্ষম ও বোবা হতে এবং এই সব না বলতে ও এইরূপ কর্ম না করতে !

হে আল্লাহ্ ! আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ কর ! যে ব্যক্তি আমাদের প্রতি অত্যাচার করেছে তার নিকট হতে প্রতিশোধ নাও ! যে ব্যক্তি আমাদের রক্তপাত করেছে ও আমাদের অভিভাবকগণকে হত্যা করেছে তুমি তাদের উপর তোমার ক্রোধ ও অভিসম্পাত প্রেরণ কর !

ইয়াযীদ ! আল্লাহর শপথ ! তুমি তোমার নিজের চামড়া ব্যতীত অন্য কিছু চিরনি এবং তোমার নিজেরই মাংস ব্যতিত অন্য কিছুই কাটনি ! আল্লাহর রাসূলের সন্তান সন্ততির রক্তপাত ,তাঁর ইতরাত (বংশধর) ও তাঁর শরীরের অংশসমূহের সম্মান বিনষ্ট করার ফলে যেসব অপরাধ তোমার কাঁধে চেপেছে সেসব সহকারে তুমি নিঃসন্দেহে তাঁর (রাসূল) নিকট প্রবেশ করবে ! আল্লাহ্ তাঁদের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহকে সংযোজন করবেন , তাঁদের বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে সংযুক্ত করবেন এবং তাঁদের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন ! আর তোমরা এইরূপ ধারণা করো না যে , যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছেন তাঁরা মারা গেছেন , বরং তাঁরা জীবিত আছেন এবং তাঁদের প্রতিপালকের নিকট হতে রিয্ক গ্রহণ করেন।

তোমার জন্যে এই যথেষ্ট যে , মহান আল্লাহ্ তোমার নিকট হিসাব গ্রহণ করবেন , মুহাম্মদ (সা.) তোমার সাথে দুশমনি করবেন এবং জিব্রাঈল (আ.) আমাদের পৃষ্ঠপোষক হবেন। যে ব্যক্তি তোমার জন্যে এইরূপ অপরাধকে সুসজ্জিত করেছে এবং মুসলমানদের উপর তোমাকে কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের অধিকারী করেছে সে অচিরেই বুঝবে যে , অত্যাচারীর জন্যে জাহান্নামের মন্দ স্থান নির্ধারিত রয়েছে এবং তুমিও বুঝবে যে , তোমাদের ও আমাদের মাঝে কারা মন্দ স্থানে রয়েছে এবং কারা দুর্বলতর শক্তির অধিকারী।

ইয়াযীদ ! বর্তমান কঠিন অবস্থা ও সমস্যাদি আমাকে এমন স্থানে উপনীত করেছে , যার ফলে তোমার সাথে কথা বলছি ! তবে তুমি জেনে রেখ ! আমি তোমাকে এতটা নগণ্য ও ক্ষুদ্র জ্ঞান করি যে , তোমাকে ভর্ৎসনা করাটাও তোমার সত্তার চেয়ে বড় মনে করি এবং তোমার জন্যে তিরস্কার করাটাও বেশী মনে করি (অর্থাৎ তুমি ভর্ৎসনা ও তিরস্কারের অযোগ্য) ! কিন্তু কি করি ! ? চক্ষুগুলি অশ্রুতে পূর্ণ এবং অন্তরসমূহ অগ্নিদগ্ধ ! জেনে রেখ ! বিস্ময়কর ! সবই বিস্ময়কর !! শয়তানের দলের মুক্তিপ্রাপ্ত লোকদের হাতে হিযবুল্লাহর মহানুভব ব্যক্তিগণ নিহত হচ্ছেন ! এই হাতগুলি হতে আমাদের রক্ত ঝরছে , এই মুখগুলি আমাদের মাংসকে চোষণ করছে এবং আমাদের পবিত্র ব্যক্তিগণের দেহসমূহকে নেকড়েরা ছিন্নভিন্ন করছে , হায়েনারা মাটির উপর টানাটানি করছে !

ইয়াযীদ ! তুমি যদি আমাদেরকে তোমার জন্য গনিমত মনে করে থাক তবে এইটি জেনে রেখ যে , খুব শীঘ্রই আমাদেরকে তোমার ক্ষতির কারণ হিসেবে দেখবে ! পূর্বে প্রেরিত আমলগুলি ছাড়া সেইখানে আর অন্য কিছু পাবে না ! তোমার প্রতিপালক অত্যাচারী লোকদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেন না ! আমি আল্লাহর নিকট অভিযোগ করছি এবং তাঁর উপর আমার ভরসা আছে।

ইয়াযীদ ! তুমি তোমার প্রতারণাকে কাজে লাগাও , তোমার চেষ্টাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাও এবং তোমার প্রচেষ্টাকে বিস্তৃত কর ! আল্লাহর শপথ ! তুমি আমাদের স্মরণকে বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আমাদের ঐশী প্রেরণাকে নস্যাৎ করতে পারবে না। এই অপরাধের লজ্জা ও অপমান তোমার থেকে কখনই মুছে যাবে না। দুর্বল (যুক্তি)ও মিথ্যা(ভাষ্য) ব্যতীত তোমার কি মত আছে ? মুষ্টিমেয় কয়েকটি দিন এবং বিক্ষিপ্ত জনতা ছাড়া তোমার আর কি আছে ? যে দিন আহ্বানকারী আহ্বান করবেন : জেনে রাখ ! জালিমের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষিত হোক ! বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে সমস্ত প্রশংসা , যিনি আমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৌভাগ্য ও মাগফিরাতসহ গন্তব্যের শেষ প্রান্তে পৌঁছিয়েছেন এবং আমাদের উত্তরসুরিগণকে শাহাদত ও রহমত দ্বারা নৈকট্য দান করেছেন। মহান আল্লাহর নিকট কামনা করব , তিনি যেন তাঁদেরকে অফুরন্ত নিয়ামত দান করেন এবং তাঁদের শাহাদতকে তাঁর নিয়ামত বৃদ্ধির উপকরণ বানিয়ে দেন ! আমাদেরকে তাঁদের উত্তম প্রতিনিধি হিসেবে নির্ধারণ করেন ! তিনি হচ্ছেন করুণাময় ও দয়ালু। তিনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম ভরসাস্থল । ১৩৩

দামেশকের জামে মসজিদে হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর ভাষণ

ইয়াযীদ দামেশকের জামে মসজিদে স্বীয় খতীবকে আদেশ প্রদান করে যে , সে যেন মিম্বরে আরোহণ করে মুয়াবিযা ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে এবং ইমাম আলী ও ইমাম হুসাইনের (আ.) সমালোচনা করে। খতীব মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতির পর যথাসাধ্য আলী ও হুসাইনের (আ.) নিন্দা এবং মুয়াবিয়া ও ইয়াযীদের প্রশংসা করে।

এ অবস্থায় হুসাইনের পুত্র আলী (আ.) তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলেন : হে বক্তা , তোমার অকল্যাণ হোক ! সৃষ্টির সন্তুষ্টিকে স্রষ্টার ক্রোধের সাথে বিনিময় করলে এবং জাহান্নামে তোমার জায়গা বেছে নিলে ?!

অতঃপর তিনি বলেন : ইয়াযীদ ! তুমি আমাকে অনুমতি দাও , আমি এই কাঠের (মিম্বারের দিকে নির্দেশ করে) উপর আরোহণ করে এমন কিছু কথা বলব যে , তা আল্লাহর সন্তুষ্টিরও কারণ হবে এবং উপস্থিত জনগণও ছাওয়াব ও কল্যাণ লাভ করবে । ইয়াযীদ গ্রহণ করল না। উপস্থিত জনতা বলল : হে আমীরুল মু মিনীন ! তাঁকে আরোহণ করার অনুমতি দিন , আমরা তাঁর নিকট হতে সম্ভবতঃ কিছু শুনতে পাব । ইয়াযীদ তাদেরকে বলল : যদি এই ব্যক্তিটি মিম্বরে আরোহণ করেন তবে আমার এবং আবু সুফিয়ানের বংশের মান সম্মান ধুলিস্যাত না করে নামবেন না ! লোকেরা বলল : কোন্ লোক তাঁর ও তাঁর বক্তব্যের পক্ষ নেবে ? ইয়াযীদ বলল : সে এমন এক পরিবারের সদস্য যারা জ্ঞানকে সর্বোত্তমরূপে আস্বাদন করেছে ! কিন্তু উপস্থিত লোকেরা এতবেশী পীড়াপীড়ি করতে লাগল যে , শেষে ইয়াযীদ অনুমতি দিতে বাধ্য হল। ইমাম (আ.) মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা , স্তুতি ও গুণগান করে বললেন :

“ হে উপস্থিত জনতা ! রাসূলের বংশধর হিসেবে আমাদেরকে ছয়টি বিশেষত্ব দান করা হয়েছে এবং অন্যদের উপর আমাদের সাতটি বিষয়ে প্রাধান্য রয়েছে। আমাদের প্রতি দানকৃত জিনিসগুলি হচ্ছে : জ্ঞান প্রজ্ঞা , ধৈর্য , মহানুভবতা , বাকপটুতা , সাহসিকতা ও মু মিনদের অন্তরসমূহে আমাদের প্রতি ভালবাসা। আর অন্যদের চেয়ে আমাদের প্রাধান্যের বিষয়গুলো হচ্ছে :আমরা হচ্ছি আল্লাহর নির্বাচিত নবী মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) বংশভুক্ত , আর সিদ্দীক , আসাদুল্লাহ্ ,ও আসাদুর রাসূল আলী , বিশ্বের নারীদের নেত্রী ফাতিমা বাতুল ,এই বংশের দুই সন্তান জান্নাতের যুবকদের দুই সর্দার , জাফর তাইয়ার সকলেই আমাদের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর বলেন: যারা আমাকে চিনেন তারা তো চিনেনই ; আর যারা আমাকে চিনেন না তাদেরকে এখন আমার বংশকৌলীন্য সম্পর্কে অবহিত করব ।

আমি মক্কা ও মিনার সন্তান। আমি জমজম ও সাফার সন্তান। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান যিনি চাদরের আঁচলে করে যাকাত নিয়ে চারদিকে ছুটে যেতেন। সর্বোত্তম লুঙ্গি ও চাদর পরিধানকারী লোকের আমি সন্তান। আমি সর্বোত্তম খড়ম পরিধানকারীর সন্তান। আমি সেই সর্বোত্তম ব্যক্তিত্বের সন্তান যিনি তাওয়াফ ও সাঈ ’ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি হজ্জ করেছেন ও লাব্বাইক বলেছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি বোরাকে আরোহণ করে আসমানে ভ্রমণ করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁকে নৈশকালে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর তিনি কত পবিত্র সত্ত্বা যিনি তাঁকে নৈশকালে ভ্রমণ করিয়েছেন।)১৩৪ আমি তাঁর সন্তান যাঁকে জিব্রাঈল (আ.) সিদ্রাতুল মুন্তাহায় ’ পৌঁছিয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি নিকটবর্তী হয়েছেন এবং দুই বিঘত পরিমাণ অথবা তদোপেক্ষা নিকটবর্তী হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি আসমানসমূহের ফেরেশ্তাদের সাথে নামায আদায় করেছেন। আমি তাঁর সন্তান যাঁর নিকটে মহান আল্লাহর যা কিছু ওহী করার ছিল তা ওহী করেছেন। আমি মুহাম্মদ মোস্তফার (সা.) সন্তান , তাঁর সন্তান যিনি মানুষের নাসিকা ধুলায় ধুসরিত করেছেন ফলে তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলতে বাধ্য হয়েছেন। আমি তাঁর সন্তান যিনি দুইবার বাইআত করেছেন। দুই কিবলার দিকে নামায আদায় করেছেন। বদর ও হুনাইনে যুদ্ধ করেছেন। চোখের পলক পড়ার সমান পরিমাণ সময়ও আল্লাহকে অস্বীকার করেন নি। মুসলমানদের অগ্রপথিক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী , অত্যাচারী ও খারিজীদেরকে হত্যাকারী। মহানুভব ও দাতা , পবিত্রদের নেতা , হেজাজের সিংহ , ইরাকের ব্যাঘ্র , মক্কী , মাদানী , আবতাহী , তাহামী , খাইফী , আকাবী , বদরী , ওহুদী , শাজারী , মুহাজেরী , সিবতাইনের (হাসান ও হুসাইন) পিতা আলী ইবনে আবী তালিবের সন্তান। আমি ফাতিমা যাহরার সন্তান। আমি নারীদের নেত্রীর সন্তান। আমি রাসূলের দেহের অংশের সন্তান ।

বর্ণনাকারী বলেন : মানুষের কান্না ও চিৎকার ধ্বনি উত্থিত হওয়া পর্যন্ত ইমাম অব্যাহতভাবে আমি , আমি , বলে যাচ্ছিলেন। হট্টগোল সৃষ্টি হওয়ার ভয়ে ইয়াযীদ মুয়াজ্জিনকে আযান দিতে আদেশ দেয় এবং ইমামের বক্তব্যের ছেদ ঘটায়। ইমামও নীরব হয়ে যান। মুয়াজ্জিন আল্লাহু আকবার ’ বলল , ইমাম (আ.) বলেন : তিনি মহান , এমন মহান সত্তা যে , কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ে ধারণযোগ্য নন। কোনো বস্তুই তাঁর চেয়ে মহান নয় । মুয়াজ্জিন আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ’ বলল ইমাম (আ.) বললেন : এই বাণীর প্রতি আমার সমস্ত অস্তিত্ব সাক্ষ্য দিচ্ছে ; আমার লোম , চামড়া , মাংস , রক্ত , মেধা , অস্থি সবই তার প্রতি সাক্ষ্য দিচ্ছে । মুয়াজ্জিন আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলল , ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) মিম্বরের উপর হতে ইয়াযীদের দিকে মুখ করে বলেন : ইয়াযীদ ! এই মুহাম্মদ (সা.) আমার নানা , না তোমার নানা ? যদি তোমার নানা বলে দাবি কর তবে নিশ্চয় তুমি মিথ্যা বলছ , আর যদি আমার নানা বলে স্বীকার কর তবে তাঁর ইতরাতকে (বংশধর) কেন হত্যা করলে ?

বর্ণনাকারী বলেন : মুয়াজ্জিন আযান সমাপ্ত করলে , ইয়াযীদ সামনে যায় এবং যোহরের নামায আদায় করে। ’১৩৫

খিলাফতের রাজধানীতে শোকানুষ্ঠান পালন

দামেশকের মসজিদে ইমামের (আ.) বক্তব্যের পর , ইয়াযীদ নামায সম্পন্ন করে আদেশ দেয় যে , প্রস্তুতকৃত ঘরটিতে যেন ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.) এবং তাঁর ভগ্নীগণ ও ফুফুদেরকে স্থান দেয়া হয়। তাঁরাও সেইখানে কয়েকদিন যাবৎ শোকানুষ্ঠান পালন করেন এবং হুসাইনের (আ.) জন্যে ক্রন্দন করেন ও শোকগাথাঁ পাঠ করেন।

এই অনুষ্ঠানের পরে , ইয়াযীদ রাসূলের (সা.) সন্তান সন্ততির সাথে আচরণ পরিবর্তন করতে এবং কতকগুলি সীমাবদ্ধতাকে উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় ও তাঁদের শহীদগণের জন্যে শোকানুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ।

অতঃপর ইয়াযীদ দামেশক শহরের অবস্থা শোচনীয় দেখে বন্দী কাফেলাকে সম্মানের সাথে মদীনায় পাঠায়।


4