সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা75%

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা লেখক:
: এ.কে.এম. রশিদুজ্জামান
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

  • শুরু
  • পূর্বের
  • 20 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 8462 / ডাউনলোড: 3769
সাইজ সাইজ সাইজ
সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ইমাম হোসেইন (আ.) ও কারবালা

লেখক:
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
বাংলা

ইমাম হোসেইন (আ.) ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার , বিনয়ী , জ্ঞানী , সাহসী এবং স্বাধীনতাকামী একজন নেতা। তিনি তার নানা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর উম্মতের সংশোধনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে উদ্দ্যোগ নেন। কিন্তু সে সময়ের খলিফা (শাসক) ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়া তা অপছন্দ করে এবং তার সব ধরনের অন্যায় ও অপকর্মকে সম্মতি দিয়ে তার প্রতি আনুগত্য করার জন্য ইমাম হোসেইন (আ.)-কে আদেশ দেয়। আর তা করা না হলে তাকে হত্যা করা হবে বলে জানিয়ে দেয়। ইমাম হোসেইন (আ.) তার সব অপকর্মের প্রতিবাদ করেন এবং আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন।

হযরত আব্বাস ইবনে আলী (আ.)-এর শাহাদাত

ইবনে শাহর আশোব তার মানাক্বিব -এ বলেছেন যে , সাক্কা [পানি বহনকারী] , হাশেমীদের চাঁদ , হোসেইনের পতাকাবাহক এবং তার ভাইদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আব্বাস পানির খোঁজে গেলেন। তারা তাকে আক্রমণ করলো এবং তিনিও জবাব দিলেন এবং বললেন , আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না যখন সে আমাকে উচ্চকণ্ঠে ডাকে , অথবা যতক্ষণ না আমি পরীক্ষিত যোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করি এবং মাটিতে পড়ে যাই , আমার জীবন কোরবান হোক তার ওপর যিনি হলেন মুস্তাফার জীবন , নিশ্চয়ই আমি আব্বাস , যে পানি আনে , আর আমি যুদ্ধের দিনে ভয় পাই না।

তিনি শত্রুসৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেন , কিন্তু যায়েদ বিন ওয়ারক্বা জাহনি যে একটি গাছের পিছনে ওঁৎ পেতে ছিলো , সে তার ডান হাতকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো হাকীম বিন তুফাইল সুমবোসির সহযোগিতায়। এরপর তিনি তরবারি বাম হাতে নিলেন এবং যুদ্ধের কবিতা আবৃত্তি করছিলেন , আল্লাহর শপথ , তোমরা আমার ডান হাত কেটে ফেলেছো , আমি আমার ধর্মের প্রতিরক্ষা করতেই থাকবো যেমন করবে আমার সত্যবাদী ইমাম পবিত্র ও বিশ্বনবীর সন্তান।

তিনি যুদ্ধ করতে লাগলেন এবং ক্লান্তহয়ে পড়লেন এবং হাকীম বিন তুফাইল তাঈ একটি গাছের পিছনে লুকিয়ে ছিলো , সে তার বাম হাতে আঘাত করলো ও তা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। আব্বাস বললেন , হে আমার সত্তা , কাফেরদের ভয় পেয়ো না , সর্বক্ষমতাবান আল্লাহর রহমতের ও ক্ষমতাপ্রাপ্তদের অভিভাবক রাসূলের সুসংবাদ তোমার কাছে আসুক , তারা আমার বাম হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে অন্যায়ভাবে , হে আল্লাহ তাদেরকে [জাহান্নামের] আগুনে পোড়ান।

অভিশপ্ত ব্যক্তি তাকে হত্যা করলো লোহার বর্শা দিয়ে। যখন ইমাম হোসেইন (আ.) তাকে ফোরাত নদীর তীরের কাছে দেখতে পেলেন , তিনি কাঁদলেন এবং বললেন , তোমরা তোমাদের কাজের মাধ্যমে অবিচার করেছো হে অভিশপ্ত জাতি , এবং রাসূল (সা.)-এর কথার বিরোধিতা করেছো , শ্রেষ্ঠ নবী কি আমাদেরকে তোমাদের কাছে আমানত রেখে যান নি , আমরা কি সৎকর্মশীল নবীর বংশধর নই , তোমাদের মধ্য থেকে যাহরা (আ.) কি আমার মা নন , আহমাদ (সা.) সৃষ্টির মধ্যে কি শ্রেষ্ঠ নন , অভিশাপ তোমাদের ওপর পড়েছে এবং তোমরা যা করেছো তার জন্য অপমানিত হবে এবং খুব শীঘ্রই তোমরা চরম আগুনের মুখোমুখি হবে [জাহান্নামে]

ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর শাহাদাত

কুতুবুদ্দীন রাওয়ানদি তার দাওয়াত -এ বর্ণনা করেছেন ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) থেকে যে , দশই মহররম আমার বাবা আমাকে তার বুকের সাথে চেপে ধরেন তখন তার শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিলো এবং তিনি বললেন , হে প্রিয় সন্তান , এ দোআ মনে রাখো যা সাইয়্যেদা ফাতিমা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে এবং তিনি জিবরাঈল থেকে পেয়েছেন এবং যা আমার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কারণ এটি সব আশা পূর্ণ হওয়ার জন্য , গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে , দুশ্চিন্তায় , কঠিন পরিস্থিতিতে এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে উপকারী। দোআটি এমন:

بِحَقِّ يس وَالْقُرْآنِ الْحَكيمِ وَ بِحَقِّ طه وَ الْقُرْآنِ الْعَظيمِ يا مَنْ يَقْدِرُ عَلى حَوآئِجِ السّآئِلينَ يا مَنْ يَعْلَمُ ما فِى الضَّميرِ يا مُنَفِّساً عَنِ الْمَكْرُوبينَ يا مُفَرِّجاً عَنِ الْمَغْمُومينَ يا راحِمَ الشَّيْخِ الْكَبيرِ يا رازِقَ الطِّفْلِ الصَّغيرِ يا مَنْ لايَحْتاجُ اِلَى التَّفْسيرِ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَ آلِ مُحَمَّدٍ وَافْعَلْ بى...

অর্থ: ইয়াসিন এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ কোরআনের উসিলায় , এবং ত্বোহা ও উচ্চতর মর্যাদাপূর্ণ কোরআনের উসিলায় হে যিনি প্রার্থনাকারীদের প্রয়োজন পূরণ করেন , হে যিনি জানেন হৃদয়ের ভিতরে কি আছে , হে যিনি দুঃখ - কষ্ট দূরকারী , হে শোকার্তদের স্বস্তিদানকারী , হে অতি বৃদ্ধদের ওপর দয়ালু , হে ছোট্ট শিশুদের রিয্ক্ব দানকারী , হে যার কাছে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই , কল্যাণ বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের ওপর এবং আমার বিষয়ে । [তারপর প্রয়োজনগুলো বলতে হবে ]

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) তার যুবকদের ও বন্ধুদের লাশ দেখতে পেলেন তিনি শহীদ হওয়ার জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন , কেউ কি আছে আল্লাহর রাসূলের পরিবারকে রক্ষা করবে ? তাওহীদবাদী কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ভয় করবে আমাদের বিষয়ে ? কোন সাহায্যকারী কি আছে যে আল্লাহর জন্য আমাদেরকে সাহায্য করতে আসবে ? কেউ কি আছে যে আমাদের সাহায্যে দ্রুত আসবে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের বিনিময়ে ?

নারীদের কান্নার আওয়াজ উঁচু হলো এবং ইমাম তাঁবুর দরজায় এলেন এবং যায়নাব (আ.)-কে ডাকলেন , আমাকে আমার দুধের শিশুটিকে দাও যেন বিদায় নিতে পারি। এরপর তিনি তাকে দুহাতে নিলেন এবং উপুড় হলেন তার ঠোঁটে চুমু দেয়ার জন্য। হুরমালা বিন কাহিল আসাদি শিশুটির দিকে একটি তীর ছুঁড়লো , যা তার গলা ভেদ করে তার মাথা আলাদা করে ফেললো (আল্লাহর রহমত ও রবকত শিশুর উপর বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তার হত্যাকারীর উপর)।

সিবতে ইবনে জওযি তার তাযকিরাহ -তে বর্ণনা করেছেন হিশাম বিন মুহাম্মাদ ক্বালবি থেকে যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) দেখলেন তারা তাকে হত্যা করবেই , তিনি কোরআন আনলেন এবং তা খুলে মাথার ওপর রাখলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন , আল-কোরআন এবং আমার নানা , আল্লাহর রাসূল (সা.) হলেন আমার ও তোমাদের মধ্যে বিচারক। হে জনতা , কিভাবে তোমরা আমার রক্ত ঝরানোকে বৈধ মনে করছো ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি নই ? আমার নানা থেকে কি হাদীস পৌঁছায় নি তোমাদের কাছে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে যে , আমরা জান্নাতের যুবকদের সদারর্ ? তাহলে জিজ্ঞেস করো জাবির (বিন আব্দুল্লাহ আনসারি)-কে , যায়েদ বিন আরক্বামকে এবং আবু সাঈদ খুদরীকে , জাফর তাইয়ার কি আমার চাচা নন ?

শিমর উত্তর দিলো , খুব শীঘ্রই তুমি জ্বলন্ত আগুনের [জাহান্নামের] দিকে দ্রুত যাবে। (আউযুবিল্লাহ)। ইমাম বললেন , আল্লাহু আকবার , আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে জানিয়েছেন যে , তিনি দেখেছেন একটি কুকুর তার গলা পূর্ণ করছে তার আহলুল বাইত (আ.)-এর রক্ত দিয়ে এবং আমি বুঝতে পারছি সেটি তুমি ছাড়া কেউ নয়।

শিমর বললো , আমি শুধু জিহ্বা দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবো , যদি আমি বুঝি তুমি কী বলছো। ইমাম হোসেইন (আ.) ফিরে দেখলেন তার শিশুপুত্র পিপাসায় কাঁদছে। তিনি তাকে কোলে নিলেন এবং বললেন , হে জনতা , যদি তোমরা আমার প্রতি দয়া না দেখাও , কমপক্ষে এ বাচ্চার ওপর দয়া করো। এক ব্যক্তি একটি তীর ছুঁড়লো যা তার গলা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। ইমাম কেঁদে বললেন , হে আল্লাহ , আপনি বিচারক হোন আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে , যারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং এর বদলে আমাদের হত্যা করেছে। একটি কণ্ঠ আকাশ থেকে ভেসে এলো , তাকে ছেড়ে দাও হে হোসেইন , কারণ এক সেবিকা তাকে শুশ্রুষা করার জন্য বেহেশতে অপেক্ষা করছে। এরপর হাসীন বিন তামীম একটি তীর ছোঁড়ে তার ঠোঁটের দিকে এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে।

ইমাম কাঁদলেন এবং বললেন , হে আল্লাহ , আমি তোমার কাছে অভিযোগ করি , তারা যেভাবে আমার সাথে , আমার ভাই , আমার সন্তানদের এবং আমার পরিবারের সাথে আচরণ করেছে।

আল-ইহতিজায গ্রন্থে উল্লেখ আছে , এরপর ইমাম (আ.) তার তরবারির খাপ দিয়ে একটি কবর খুঁড়লেন এবং রক্তে ভেজা বাচ্চাকে বালির নিচে দাফন করলেন। তিনি তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং শোকগাঁথা আবৃত্তি করলেন। শাহাদাতের লেখকরা এবং ইহতিজাজের লেখকও বলেন যে , ইমাম এরপর তার ঘোড়ায় চড়লেন এবং যুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন এই বলে , এ জাতি অবিশ্বাস করেছে এবং তারা রাব্বুল আলামীনের পুরস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে , এ জাতি হত্যা করেছে আলীকে এবং তার সন্তান হাসানকে যিনি ছিলেন উত্তম এবং সম্মানিত পিতা-মাতার সন্তান। তারা ঘৃণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ ছিলো এবং তারা জনতাকে ডাক দিয়েছে এবং জমা হয়েছে হোসেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। অভিশাপ এ নীচ জাতির ওপর যারা বিভিন্ন দলকে একত্র করেছে দুই পবিত্র আশ্রয়স্থলের লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এভাবে মুশরিকদের বংশধর উবায়দুল্লাহর জন্য তারা যাত্রা করেছে এবং মুরতাদদের আনুগত্য করার জন্য অন্যদেরকে আহ্বান করেছে আল্লাহর বিরোধিতা করে আমার রক্ত ঝরানোর জন্য , এবং সা আদের সন্তান আমাকে হত্যা করেছে আক্রমণাত্মকভাবে এক সেনাবাহিনীর সাহায্যে যা প্রবল বন্যার মতো এবং এসব আমার কোন অপরাধের প্রতিশোধের জন্য নয় , শুধু এ কারণে যে , আমার গর্ব হচ্ছে দুই নক্ষত্র , আলী যিনি ছিলেন নবীর পরে শ্রেষ্ঠ এবং নবী ছিলেন কুরাইশ পিতা-মাতার সন্তান , আমার বাবা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আমরা দুজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান , রূপার মতো যা বেরিয়ে এসেছে স্বর্ণ থেকে। আমি হচ্ছি রূপা , দুই স্বর্ণালীর সন্তান। আর কারো নানা কি আমার নানার মতো , অথবা তাদের পিতা আমার পিতার মতো , এরপর আমি দুজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র-সন্তান , আমার মা ফাতিমাতুয্ যাহরা এবং বাবা যিনি মুশরিকদের পিঠ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বদর ও হুনাইনের যুদ্ধে এবং যিনি শৈশবকাল থেকেই রবের ইবাদত করেছেন যখন কুরাইশরা ইবাদত করতো একসাথে দুই মূর্তির লাত ও উযযার , তখন আমার বাবা নামায পড়েছেন দুই ক্বিবলার দিকে ফিরে। আর আমার বাবা হলেন সূর্য এবং আমার মা চাঁদ , আর আমি এক নক্ষত্র , দুই চাঁদের সন্তান এবং তিনি [আলী (আ.)] উহুদের দিনে এমন মোজেযা দেখিয়েছেন সেনাবাহিনীকে দুভাগ করে দেওয়ার মাধ্যমে , যা হিংসা দূর করেছিলো এবং আহযাবে [এর যুদ্ধে] ও মক্কা বিজয়ে। যেদিন দুই সেনাবাহিনীতে একটি কথাই ছিলো মৃত্যু এবং এ সবই আল্লাহর রাস্তায় করা হয়েছিল , কিন্তু কিভাবে এ নীচ জাতি এ দুই সন্তানের সাথে আচরণ করেছে যারা সৎকর্মশীল নবী ও আলীর সন্তান , দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের দিনে যারা লাল গোলাপের মতো।

এরপর তিনি সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে দাঁড়ালেন তার তরবারিকে খাপমুক্ত করে , জীবনকে পরিত্যাগ করে এবং হৃদয়ে মৃত্যুর দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে। তিনি বলছিলেন , আমি আলীর সন্তান , যিনি ছিলেন পবিত্র ও হাশিমের বংশধর এবং এ মর্যাদা আমার জন্য যথেষ্ট যখন আমি গর্ব করি , আমার নানা আল্লাহর রাসূল সবার চেয়ে সম্মানিত। আমরা সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর বাতি এবং আমার মা ফাতিমা যাহরা (আ.) , যিনি আহমাদ (সা.)-এর কন্যা এবং আমার চাচা যিনি দুপাখার অধিকারী বলে পরিচিত এবং আমাদের মাঝে আছে আল্লাহর কিতাব এবং তা সত্যসহ নাযিল হয়েছে এবং আমাদের মধ্যেই আছে বৈধতা এবং কল্যাণপূর্ণ ওহী এবং আমরা হলাম সব মানুষের মধ্যে আল্লাহর আমানত এবং আমরা গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘোষণা করি যে , কাউসারের ওপর আমরা কর্তৃত্ব রাখি এবং আমরা আমাদের অনুসারীদের পান করাবো নবীর পেয়ালা দিয়ে , যা অস্বীকার করা যায় না এবং আমাদের অনুসারীরা হলো অনুসারীদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং যারা আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে , কিয়ামতের দিন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

তিনি বলেন: মৃত্যু অপমানিত হওয়ার চেয়ে উত্তম এবং অপমান জাহান্নামের আগুনে প্রবেশের চাইতে উত্তম। আমি হোসেইন , আলীর সন্তান , আমি শপথ করেছি যে শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবো না এবং আমার বাবার পরিবারকে রক্ষা করবো , যতক্ষণ না আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ধর্মের উপর নিহত হই।

মুহাম্মাদ বিন আবি তালিব , ইবনে শাহর আশোব এবং সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তখন বললেন , দুর্ভোগ তোমাদের ওপর হে আবু সুফিয়ানের পরিবারের অনুসারীরা , যদি তোমরা অধার্মিক লোক হও এবং কিয়ামতের দিনটিকে ভয় না পাও , তাহলে কমপক্ষে স্বাধীন চিন্তার লোক হও এবং বুঝতে চেষ্টা করো যদি তোমরা আরবদের বংশধর হও।

শিমর বললো , হে ফাতিমার সন্তান , তুমি কী বুঝাতে চাও ?

ইমাম বললেন , আমি বলছি যে আমরা পরস্পর যুদ্ধ করবো , কিন্তু নারীরা তো কোন দোষ করে নি । আমার পরিবারের তাঁবু লুট করা থেকে বিরত থাকো যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি।

ইমাম (আ.) বলেন: তোমরা একত্রে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো ? আল্লাহর শপথ , আমার পরে তোমরা আর কাউকে হত্যা করবে না যার হত্যাতে আল্লাহ তোমাদের ওপর এর চাইতে বেশী ক্রোধান্বিত হবেন। আল্লাহর শপথ , আমি চাই যে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসুন তোমাদের ঘৃণার পরিবর্তে এবং তিনি আমার প্রতিশোধ নিন তোমাদের ওপর এমন এক মাধ্যমে যে সম্পর্কে তোমরা সচেতন নও। সাবধান , যদি তোমরা আমাকে হত্যা করো , আল্লাহও তোমাদেরকে হত্যা করবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরাবেন। এরপর তিনি তোমাদের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিবেন না , যতক্ষণ না তিনি ভয়ানক শাস্তি কে দ্বিগুণ করবেন।

আবুল আব্বাস আহমেদ বিন ইউসুফ দামিশকি ক্বিরমানি , যিনি ১০১৯ হিজরিতে মারা যান , তার আখবারুল দাওল গ্রন্থে বলেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর পিপাসা তীব্র হয়ে উঠলো , কিন্তু তারা তাকে পানি পান করার জন্য পানি দেয় নি। এক পেয়ালা পানি তার হাতে এলো এবং তিনি উপুড় হলেন তা পান করার জন্য। হাসীন বিন নামীর তার দিকে একটি তীর ছুঁড়লো , যা তার থুতনি ভেদ করলো এবং পেয়ালাটি রক্তে ভরে গেলো। তখন তিনি তার দুহাত আকাশের দিকে তুলে বললেন , হে আল্লাহ , তাদের সংখ্যা কমিয়ে দাও , তাদের প্রত্যেককে হত্যা করো এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকেও পৃথিবীর ওপর ছেড়ে দিও না। তখন তারা তাকে সব দিক থেকে আক্রমণ করলো এবং তিনি তাদেরকে বাম ও ডান দিকে তাড়িয়ে দিলেন , যতক্ষণ পর্যন্তনা যারাহ বিন শারীক তার বাম কাঁধে আঘাত করে এবং আরেকটি আঘাত কাঁধে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। শিমর তখন তার ঘোড়া থেকে নেমে এসে তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তা খাওলি আসবাহির হাতে হস্তান্তর করে। এরপর তারা তার জামা-কাপড় লুট করে।

মুহাদ্দিস শেইখ আব্বাস কুম্মি বলেন যে , সাইয়্যেদ ইবনে তাউস , ইবনে নিমা , শেইখ সাদুক্ব , তাবারি , ইবনে আসীর জাযারি , ইবনে আব্দুল বির বির , মাসউদী এবং আবুল ফারাজ বলেছেন যে , শিমারের নির্দেশে অভিশপ্ত সিনান [বিন আনাস] তার মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিল।

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন যে , সিনান এগিয়ে এলো এবং বললো , যদিও আমি জানি যে সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি এবং তার মা-বাবা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , তবুও আমি তার মাথা কাটবো। এরপর সে তার পবিত্র ঘাড়ে আঘাত করে তার তরবারি দিয়ে এবং তার পবিত্র ও সম্মানিত মাথা আলাদা করে ফেলে।

আবু তাহির মুহাম্মাদ বিন হাসান [অথবা হোসেইন] বারাসি [অথবা নারাসি] মা আলিমুদ দ্বীন গ্রন্থে বলেন যে , ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেছেন , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বিষয়টি এ পর্যায়ে পৌঁছে যায় , তখন ফেরেশতারা আল্লাহর সামনে কাঁদতে থাকে এবং বলে , হে আল্লাহ এ হোসেইন আপনার মেহমান , সে আপনার রাসূলের নাতি , তখন আল্লাহ ইমাম আল- ক্বায়েম [আল-মাহদী]-এর একটি ছবি দেখালেন এবং বললেন , আমি তাদের ওপর প্রতিশোধ নিবো এর মাধ্যমে।

বর্ণনাকারী বলেন , যে মুহূর্তে তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা কেটে ফেললো তখন এক প্রচণ্ডঘুর্ণিঝড় আবির্ভূত হলো এবং পুরো দিগন্তকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেললো। এরপর এক লাল ঝড় বইলো যার কারণে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না এবং সেনাবাহিনী ভাবলো আল্লাহর অভিশাপ বোধ হয় নামলো। এরকম অবস্থা এক ঘণ্টা চললো এবং তারপর থামলো।

হিলাল বিন নাফে বলেন যে , আমি উমর বিন সা আদের সাথীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং কেউ একজন চিৎকার করে বললো , অধিনায়ক , সুসংবাদ নিন , শিমর হোসেইনকে হত্যা করেছে। তখন আমি তার শাহাদাতের স্থানে গেলাম এবং তার পাশে দাঁড়ালাম এবং তিনি মারা যাচ্ছিলেন। আল্লাহর শপথ , আমি এর চেয়ে ভালো কোন লাশ দেখি নি যা রক্তে ভেজা ছিলো এবং তার চেহারার চাইতে আলোকিত কোন চেহারা দেখি নি। তার চেহারার আলো এবং অসাধারণ সৌন্দর্য আমাকে তার মৃত্যু ভুলিয়ে দিলো।

এ অবস্থায় তিনি পানি চাইলেন এবং এক ব্যক্তি তাকে বললো , আল্লাহর শপথ , তুমি তা পাবে না যতক্ষণ না জ্বলন্ত আগুনে [জাহান্নামে] প্রবেশ কর।’’ (আউযুবিল্লাহ)। আমি ইমামকে বলতে শুনলাম , দুর্ভোগ হোক তোমার , আমি জ্বলন্তআগুনের দিকে যাচ্ছি না , না আমি সেখানে ফুটন্ত পানির স্বাদ নিবো , বরং আমি যাচ্ছি আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কাছে এবং আমি বাস করবো তার সত্যপূর্ণ বাসস্থানে আল্লাহর আশ্রয়ে , যিনি সর্বশক্তিমান এবং আমি পবিত্র পানি পান করবো এবং এরপর আমি তার কাছে অভিযোগ করবো তোমরা আমার সাথে কী করেছো । তা শুনে তাদের সবাই ক্রুদ্ধ হলো। যেন তাদের বুকের ভেতর কোন দয়া-মায়া ছিলো না এবং এ পরিস্থিতিতে যখন তিনি তাদের সাথে কথা বলছিলেন তারা তার মাথা কেটে নিলো। আমি তাদের নৃশংসতায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম এবং বললাম , আমি আর কোন দিন কোন কাজে এখন থেকে তোমাদের সাথে থাকবো না।

ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেছেন , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)- এর ওপর একটি আঘাত করা হলো , তিনি তার ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন এবং তারা দৌড়ে আসলো তার মাথা কেটে ফেলতে। একটি কণ্ঠ আকাশ থেকে শোনা গেলো , হে , যে জাতি তাদের নবীর ইন্তেকালের পর উদ্ধত হয়ে গেছে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে , আল্লাহ যেন তাদের রোযা ও ঈদুল ফিতরের অনুগ্রহ দান না করেন। তখন তিনি (ইমাম-আ.) বললেন , অতএব আল্লাহর শপথ , তারা সমৃদ্ধি লাভ করে নি এবং তারা বৃদ্ধি পেতে থাকবে যতক্ষণ না প্রতিশোধ গ্রহণকারী [ইমাম মাহদী] উঠে দাঁড়াবেন ইমাম হোসেইনের (আ.) জন্য।

মাশহাদির বর্ণনায় আছে যে , উম্মে সালামা (আ.)-এর কাছে সালামা গেলেন , তখন তিনি কাঁদছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন , আপনি কাঁদছেন কেন ? তিনি বললেন , আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলাম তার মাথা ও দাড়ি ধুলায় মাখা। আমি জিজ্ঞেস করলাম , হে রাসলূ ুলাহ (সা.) , আপনার কী হয়েছে যে আপনি ধুলায় মাখা ? তিনি বললেন , এইমাত্র আমি আমার হোসেইনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।

ইবনে হাজারের সাওয়ায়েক্বে মুহরিক্বা -এ বর্ণিত আছে যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের দিন যে চিহ্নগুলি দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিলো আকাশ এতো কালো হয়ে গিয়েছিল যে , দিনের বেলা তারা দেখা গিয়েছিলো। যে কোন পাথর তুললে তার নিচে তাজা রক্ত দেখা গিয়েছিলো এবং আরো বলা হয় যে , আকাশ লাল হয়ে গিয়েছিলো তার শাহাদাতে এবং সূর্য পীচের মতো কালো। তারাগুলো দিনের বেলা দেখা যাচ্ছিলো এবং মানুষ মনে করেছিলো কিয়ামতের দিন [পুনরুত্থানের দিন] চলে এসেছে। সেদিন সিরিয়াতে যে কোন পাথর উঠানো হয়েছিলো তার নিচে তাজা রক্ত দেখা গিয়েছিলো।

ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-কে হত্যার পর তারা শহীদদের লাশের মাথাগুলো কেটে বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে এবং দেহগুলোকে শত শত ঘোড়ার পায়ের আঘাতে পিষ্ট করে। তারা তাবুগুলো লুট করে ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করার সময় পরিবারের সদস্যদের চাবুক মারে। ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মেয়ে পাঁচ বছরের শিশু সাকিনার কানের দুল কান থেকে ছিঁড়ে নেয় এবং তা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। শিশুরা ভয়ে ও ব্যাথায় কাঁদতে থাকলে তাদের গালে চড় মারে। নারীদের মাথার চাদরও [বোরখা] কেড়ে নেয়। নবী পরিবারের নির্যাতিত অসহায় এসব সম্মানিত ব্যক্তিরা মরুভূমিতে আশ্রয়হীনভাবে খোলা আকাশের নীচে চলে আসেন।

শাহাদাতের সময় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বয়স হয়েছিলো ৫৭ বছর। নির্মম , নির্বিচার ও জঘন্যতম এসব অন্যায় অত্যাচার ও হত্যার এ দিনটিই ছিলো ১০ই মহররম যা আশুরা দিন হিসেবে সুপরিচিত। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের এ দিনে ইমাম হোসেইন (আ.)-সহ মোট ৭২ জন শহীদ হন। মহান আল্লাহ ইমাম হোসেইন (আ.) , তার সন্তানদের , শহীদ সাথীদের ও নির্যাতন সহ্যকারী পরিবারের সদস্যদের সবার ওপর তার শান্তিও সম্মান আরো বাড়িয়ে দিন।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: নিশ্চয়ই প্রত্যেক মু মিনের হৃদয়ে হোসেইনের শাহাদাতের ব্যাপারে এমন ভালোবাসা আছে যে , তার উত্তাপ কখনো প্রশমিত হয় না। [মুস্তাদরাক আল-ওয়াসাইল , খণ্ড-১০ , পৃষ্ঠা-৩১৮]

রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন: সমস্তচোখ কিয়ামতের দিন কাঁদতে থাকবে , নিশ্চয়ই কেবল সেই চোখ ছাড়া যা হোসেইনের বিয়োগান্ত ঘটনায় কাঁদবে ; ঐ চোখ সেদিন হাসতে থাকবে এবং তাকে জান্নাতের সুসংবাদ ও বিপুল নেয়ামত প্রদান করা হবে। [বিহারুল আনওয়ার , খণ্ড-৪৪ , পৃষ্ঠা-১৯৩]

ইমাম আলী ইবনে হোসেইন (আ.) প্রায়ই বলতেন: প্রত্যেক মু মিন যার চোখ হোসেইন ইবনে আলী (আ.) ও তাঁর সহযোগীদের হত্যার কারণে অশ্রুপাত করে এবং সেই চোখের পানি তার গাল গড়িয়ে পড়ে , আল্লাহ অবশ্যই তাকে জান্নাতে একটি সম্মানিত গৃহ দান করবেন। [ইনাবিউল মাওয়াদ্দাহ , পৃষ্ঠা- ৪১৯]

ইমাম বাকির (আ.) বলেন: যে ব্যক্তি আমাদের স্মরণ করে অথবা যার সামনে আমাদের স্মরণ করা হয় এবং [এর ফলে] তার চোখ দিয়ে অশ্রুপ্রবাহিত হয় , যদিও তা মশার একটি ডানার পরিমাণ হয় , আল্লাহ জান্নাতে তার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করবেন এবং অশ্রুকে তার ও [জাহান্নামের ] আগুনের মাঝে প্রতিবন্ধক করে দেবেন। [আল-গাদীর , খণ্ড-২ , পৃষ্ঠা-২০২]

ইমাম আলী (আ.) বলেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের জন্য অনুসারী নির্বাচন করেছেন যারা আমাদের সাহায্য করে , আমাদের আনন্দে আনন্দিত হয় ও আমাদের দুঃখে দুঃখিত হয়। [গুরারুল হিকাম , খণ্ড-১ , পৃষ্ঠা-১৩৫]

ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেন: এমন কোন ব্যক্তি নেই , যে হোসেইন (আ.)-কে নিয়ে কবিতা পাঠ করে , নিজে কাঁদে ও এর মাধ্যমে অন্যদের কাঁদায় , অথচ আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে অপরিহার্য এবং তার পাপসমূহকে ক্ষমা করে দেন না। [রিজাল , আল-শেখ আল-তুসী , পৃষ্ঠা-১৮৯]

ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেন: আমাদের ওপর যে জুলুম করা হয়েছে তার কারণে যে শোকার্ত , তার দীর্ঘশ্বাস হলো তাসবীহ এবং আমাদের বিষয়ে তার দুশ্চিন্তা হলো ইবাদত এবং আমাদের রহস্যগুলো গোপন রাখা আল্লাহর পথে জিহাদের পুরস্কার বহন করে। এরপর তিনি বললেন , নিশ্চয়ই এ হাদীসটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা উচিত। [শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস , খণ্ড-১ , পৃষ্ঠা-২২]

তথ্যসূত্র:

১ শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস [নাফাসুল মাহমুম] , মুহাদ্দিস শেইখ আব্বাস কুম্মী , ঢাকা , ২০১০।

২. মীযান আল-হিকমাহ , আল্লামা মুহাম্মদ মুহাম্মাদি রেইশাহরি , দার আল-হাদীস ইনস্টিটিউট , কোম , ইরান , ২০০৯।

৩. সহীহ বুখারী , মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী , ঢাকা-২০০৫।

৪. সহীহ মুসলিম , আবুল হুসাইন মুসলিম , ঢাকা-২০০৩।

৫. জামে আত-তিরমিযী , আবু ঈসা আত-তিরমিযী , ঢাকা-১৯৯৮।

বাঁদুড় পাখি

কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণীর আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা দেখতে পাই রাত্রের গভীর অন্ধকারের মধ্যেও এ পাখি সাহসিকতার সাথে খাবারের সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ঘুট ঘুটে অন্ধকার । রাত্রে যখন কোন কিছুই দৃষ্টিগোচন হয় না তখন এরই মাঝে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় একটি ছোট্ট পাখি। রাতেই তার বিচরণ সময়। খাবার যোগাড় করে সে রাত্রেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর শিকার এ গভীর ও ঘন অন্ধকারেই করে থাকে সে। এ ছোট্ট পাখিটির নাম বাঁদুড়। প্রকৃতিতে এটি একটি বিষ্ময়ক র প্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলো ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে এর বিচরণ।

এ দ্রুতগতি সম্পন্ন ক্ষুদ্র পাখি রাতের আঁধারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। এটা কতই না বিষ্ময়কর! এ ব্যাপারে যতই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন করা হয় ততই এর অন্তর্নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আমাদের সামনে আরো অধিক পরিমাণে উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে। দিবালোকে একটা দ্রুত উড্ডয়নশীল পাখি যে ভাবে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায় এ ক্ষুদ্র বাদুড় পাখিটাও সেভাবে অন্ধকার রাতে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে সক্ষম।

আমরা জানি এ পাখির কোন চোখ নেই। তবুও রাতের অন্ধকার তার জন্যে সমস্যাই নয়। যদি তার উড্ডয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম না থাকে তাহলে কিভাবে সে এত অকুতোভয় ? কোথাও তো আঘাত লেগে গতিরোধ হচ্ছে না ?

দেখা গেছে যদি এ পাখিটাকে কোন আঁকাবাঁকা ও অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে ছেড়ে দেয়া হয় আর সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালগুলোতে কালি মেখে রাখা হয় তারপরও এ বিষ্ময়কার প্রাণীটি খুব সুন্দরভাবে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। বাদুড় পাখির মধ্যকার এ বিষ্ময়কর অবস্থার সাথে আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কার রাডার1 নামক যন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। বাঁদুড় পাখি সৃষ্টিকর্তার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনার গভীরতা উপলব্ধির জন্যে রাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত: পদার্থ বিদ্যায় শব্দের অধ্যায়ে মহাশব্দ বা অতিশব্দ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ মহাশব্দের তরঙ্গমালা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন ও দীর্ঘ যে মানুষের দ্বারা কোন ক্রমে তা কর্ণগোচন সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ,যখন কোন দেয়ালে ছুড়ে মারা হয় তখন তা ঠিক নিক্ষেপের গতিতেই পূর্বস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য। যখন আমরা কোন পাহাড়ের নিকট গিয়ে চিৎকার করি তখন এর ধ্বনি একট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্বস্থানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তদ্রুপ কোন মহাশব্দের তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিক্ষেপ করা হলে তা নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখনই কোন কিছুতে বাধাগ্রস্থ হয় তখনই তা পূর্বের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে। সচরাচর যুদ্ধের সময় শত্রু বিমানকে চিহ্নিত করার জন্যে এ ধরণের রাডার থেকে একটা বিশেষ শব্দ বিমানের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর যখনই তা শত্রু বিমানে আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রত্যাবর্তন করে রাডার যন্ত্রে। এরই মাধ্যমে শত্রু বিমানের গতিবেগ ,দুরত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন ,বাদুড় পাখির দেহে রাডারের ন্যায় একটা যন্ত্র বিদ্যমান। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যদি বাদুড় পাখিকে একটা শুন্য কক্ষে ছেড়ে দেয়া হয় আর সেখানে মহাশব্দ ধারণ ও তা সাধারণ শব্দের তরঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন মাইক্রোফোন রাখা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবে রাডার থেকে নির্গত মহাশব্দ শ্রবণ সম্ভবপর হয়ে উঠবে। প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ থেকে ষাট বার মহাশব্দের তরঙ্গ বাদুড় পাখির নিকট থেকে শোনা যায় বলে তারা ধারনা করে থাকেন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে বাদুড় তার বাকযন্ত্র থেকে শব্দ নির্গত করে তা নাসিকার মাধ্যমে বাইরে ছেড়ে দেয়। আর তা কোন স্থানে বাধাগ্রস্থ হয়ে ফিরে আসে কর্ণে। বাদুড়ের কর্ণ নির্গত তরঙ্গরাজীর ধারক। এ পাখি তার কর্ণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে কতটুকু দুরত্বে বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কি অবাক সব ক্রিয়া-কান্ড! এতসব জটিল ব্যবস্থাপনা কি কোন একজন বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞানী ব্যবস্থাপক ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সম্ভব ? আর কোন বুদ্ধিহীন ব্যবস্থাপক তো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতে পারে না। সৃষ্টি জগতের এ বিশাল নৈপূণ্য ক্ষমতা ও জটিলতা দর্শনে এ অবধি অনেক বিজ্ঞানী এমন কোন একক মহাস্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ,যিনি সকল প্রকৃতির উর্দ্ধে।

পুষ্প ও কীট পতঙ্গ

প্রাকৃতিক জগতে আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুষ্প ও কীট পতঙ্গের মাঝে বন্ধুত্ব। বসন্তকালের শেষের দিক যখন ধীরে ধীরে বাতাস গরম হতে শুরু করে তখন ফলের বাগান গুলোতে বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের আনাগোনা দেখা যায়। ছোট-বড় পতঙ্গ ,প্রজাপতি ,মৌমাছি ইত্যাদি কত রকমের প্রাণী। এধরণের প্রাণীর কাজ হলো এরা কোন এক গাছের ফুলের উপর বসে রস আহরণ করে অন্য গাছের পাপড়ির উপর গিয়ে বসে। ওরা পুঃলিঙ্গের গাছের পাপড়ি থেকে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় স্ত্রী লিঙ্গের পুষ্পের উপর। এভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে সঙ্গম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিণতিতে বৃক্ষরাজী ফুলে -ফলে ভরপুর হয়ে উঠে।

এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গের আনাগোনা ,এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ,গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো ইত্যাদি দেখে মনে হয় কোন এক বিশেষ শক্তি তাদেরকে ঠিক একটি উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ন্যায় পরিচালনা করছে। ফলে সকলে নিজ কর্মে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করে আছে। কাজের কোন ফাঁকি নেই। পরিশ্রম করছে সবাই একযোগে। যথাযথভাবে সকলে স্ব -স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কতই না বিষ্ময়কর এ বিষয়টি !

কখনো কি ভেবে দেখেছি ,যেখানে বৃক্ষ ,তরুলতার নড়াচড়া ও স্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই সেখানে ওগুলো কি ভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কি পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হয় ? কিভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে পুরুষ পরাগরেণু ও স্ত্রী ডিম্বানুর মিলন ঘঠে ? অনেক ক্ষেত্রে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব কীট পতঙ্গের উপর ন্যস্ত। আবার কখনো বায়ু এ মিলন ক্রিয়াতে সাহায্য করে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষরাজীর মধ্যকার এ বিষ্ময়কর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে তখন স্বভাবতঃই তার মনে প্রশ্নের উদেয় হয় ,কে কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষদের মাঝে এ অপুরম ও মজবুত বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিয়েছে ?

আমাদের চারপার্শ্বে রয়েছে এ ধরণের বহু আশ্চর্য ঘটনা যা বিশ্বকে দান করে এক সাবলীল সৌন্দর্য ও বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা। বিশ্বজগত চমৎকার ও বিষ্ময়কর সৃষ্টিতে ভরপুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন সৃষ্টিকে নিয়ে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ অধ্যয়ন ,গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব বহু অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া-কান্ড ,সুনিপুণ কলা-কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে কোরআন উল্লেখ করছে :

) يُنبِتُ لَكُم بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

অর্থাৎ : (আল্লাহ্) তোমাদের জন্যে ওটার (বৃষ্টির) মাধ্যমে কৃষিকার্য উৎপাদন এবং জলপাই ,খেজুর ও আঙ্গুর ইত্যাদি সব ধরণের ফলাদি বৃক্ষ সমুদগত করেন ,নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আন্ নাহল ,আঃ নং-11 )

আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন-

) إ ِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّـهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

অর্থাৎ : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন এবং দিবা-রাত্রির পালা বদল এবং মানুষের উপকারার্থে চলন্ত জাহাজসমূহ এবং আল্লাহ্ কর্তৃক আসমান থেকে বারিবর্ষন যার ফলে মৃত যমীন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় এবং যমীনের বুকে চতুষ্পদ জন্তুর উত্থান আর বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে সংরক্ষিত ও করতলগত মেঘ খণ্ড চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আল্ বাক্বারা ,আঃ নং-164। )

6

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে ,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু ,কে সৃষ্টি করলো ? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে ? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন ,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো ? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে ,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী ,যিনদিক ,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক ,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে যুক্তিবাদী বস্তুবাদ বা Dialectic Materialism । আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী ? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত ? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি ,যেমন ধরুন যদি বলি যে ,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

7

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন , আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে ,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন ? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে ?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,হ্যাঁ ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য ,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম ,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

চিন্তা করে দেখুন ,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা হলে ঘন্টার পর ঘন্টা ,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন ,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা ,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ ,মুর্খ ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন ? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য ,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ,প্রজ্ঞাবান ,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান ,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে ?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

কথায় বলে , নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা। আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় । তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা ,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

8

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

কার্যকারণ

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

মানব প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ

বাঁদুড় পাখি

কখনও কখনও অন্ধকার রাত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী প্রাণীর আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হয়। আমরা দেখতে পাই রাত্রের গভীর অন্ধকারের মধ্যেও এ পাখি সাহসিকতার সাথে খাবারের সন্ধানে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। ঘুট ঘুটে অন্ধকার । রাত্রে যখন কোন কিছুই দৃষ্টিগোচন হয় না তখন এরই মাঝে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় একটি ছোট্ট পাখি। রাতেই তার বিচরণ সময়। খাবার যোগাড় করে সে রাত্রেই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীর শিকার এ গভীর ও ঘন অন্ধকারেই করে থাকে সে। এ ছোট্ট পাখিটির নাম বাঁদুড়। প্রকৃতিতে এটি একটি বিষ্ময়ক র প্রাণী। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য হলো ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাত্রিতে এর বিচরণ।

এ দ্রুতগতি সম্পন্ন ক্ষুদ্র পাখি রাতের আঁধারে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। এটা কতই না বিষ্ময়কর! এ ব্যাপারে যতই পর্যবেক্ষণ ও অধ্যায়ন করা হয় ততই এর অন্তর্নিহিত ও গুপ্ত রহস্য আমাদের সামনে আরো অধিক পরিমাণে উদ্ঘাটন হয়ে পড়ে। দিবালোকে একটা দ্রুত উড্ডয়নশীল পাখি যে ভাবে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায় এ ক্ষুদ্র বাদুড় পাখিটাও সেভাবে অন্ধকার রাতে নির্ভয়ে আকাশে উড়ে বেড়াতে সক্ষম।

আমরা জানি এ পাখির কোন চোখ নেই। তবুও রাতের অন্ধকার তার জন্যে সমস্যাই নয়। যদি তার উড্ডয়নের পথে প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে কোন প্রকার তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম না থাকে তাহলে কিভাবে সে এত অকুতোভয় ? কোথাও তো আঘাত লেগে গতিরোধ হচ্ছে না ?

দেখা গেছে যদি এ পাখিটাকে কোন আঁকাবাঁকা ও অন্ধকার সুড়ঙ্গ পথে ছেড়ে দেয়া হয় আর সুড়ঙ্গ পথের দেয়ালগুলোতে কালি মেখে রাখা হয় তারপরও এ বিষ্ময়কার প্রাণীটি খুব সুন্দরভাবে কোন রকম প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় সুড়ঙ্গের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম। বাদুড় পাখির মধ্যকার এ বিষ্ময়কর অবস্থার সাথে আধুনিক বিশ্বের আবিষ্কার রাডার1 নামক যন্ত্রের তুলনা করা যেতে পারে। বাঁদুড় পাখি সৃষ্টিকর্তার এক আশ্চর্য সৃষ্টি। এর অন্তর্নিহিত ব্যবস্থাপনার গভীরতা উপলব্ধির জন্যে রাডার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকা প্রয়োজন। সাধারণত: পদার্থ বিদ্যায় শব্দের অধ্যায়ে মহাশব্দ বা অতিশব্দ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়ে থাকে। এ মহাশব্দের তরঙ্গমালা এত দ্রুতগতিসম্পন্ন ও দীর্ঘ যে মানুষের দ্বারা কোন ক্রমে তা কর্ণগোচন সম্ভব নয়। এটা পরীক্ষিত সত্য যে ,যখন কোন দেয়ালে ছুড়ে মারা হয় তখন তা ঠিক নিক্ষেপের গতিতেই পূর্বস্থানে ফিরে আসতে বাধ্য। যখন আমরা কোন পাহাড়ের নিকট গিয়ে চিৎকার করি তখন এর ধ্বনি একট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পূর্বস্থানের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। তদ্রুপ কোন মহাশব্দের তরঙ্গ একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে নিক্ষেপ করা হলে তা নির্দিষ্ট গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যখনই কোন কিছুতে বাধাগ্রস্থ হয় তখনই তা পূর্বের অবস্থানের দিকে ফিরে আসে। সচরাচর যুদ্ধের সময় শত্রু বিমানকে চিহ্নিত করার জন্যে এ ধরণের রাডার থেকে একটা বিশেষ শব্দ বিমানের উদ্দেশ্য প্রেরণ করা হয়ে থাকে। আর যখনই তা শত্রু বিমানে আঘাত প্রাপ্ত হয় তখনই একটা নির্দিষ্ট গতিতে প্রত্যাবর্তন করে রাডার যন্ত্রে। এরই মাধ্যমে শত্রু বিমানের গতিবেগ ,দুরত্ব ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়ে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলেন ,বাদুড় পাখির দেহে রাডারের ন্যায় একটা যন্ত্র বিদ্যমান। তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন যদি বাদুড় পাখিকে একটা শুন্য কক্ষে ছেড়ে দেয়া হয় আর সেখানে মহাশব্দ ধারণ ও তা সাধারণ শব্দের তরঙ্গে পরিণত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন মাইক্রোফোন রাখা হয় তাহলে পরিষ্কারভাবে রাডার থেকে নির্গত মহাশব্দ শ্রবণ সম্ভবপর হয়ে উঠবে। প্রতি সেকেন্ডে ত্রিশ থেকে ষাট বার মহাশব্দের তরঙ্গ বাদুড় পাখির নিকট থেকে শোনা যায় বলে তারা ধারনা করে থাকেন।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে বাদুড় তার বাকযন্ত্র থেকে শব্দ নির্গত করে তা নাসিকার মাধ্যমে বাইরে ছেড়ে দেয়। আর তা কোন স্থানে বাধাগ্রস্থ হয়ে ফিরে আসে কর্ণে। বাদুড়ের কর্ণ নির্গত তরঙ্গরাজীর ধারক। এ পাখি তার কর্ণের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে কতটুকু দুরত্বে বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণেই এ ক্ষুদ্র প্রাণী রাতের অন্ধকারে শিকারের খোঁজে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কি অবাক সব ক্রিয়া-কান্ড! এতসব জটিল ব্যবস্থাপনা কি কোন একজন বুদ্ধিমান ও সর্বজ্ঞানী ব্যবস্থাপক ব্যতীত অন্য কারো দ্বারা সম্ভব ? আর কোন বুদ্ধিহীন ব্যবস্থাপক তো এ ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতে পারে না। সৃষ্টি জগতের এ বিশাল নৈপূণ্য ক্ষমতা ও জটিলতা দর্শনে এ অবধি অনেক বিজ্ঞানী এমন কোন একক মহাস্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন ,যিনি সকল প্রকৃতির উর্দ্ধে।

পুষ্প ও কীট পতঙ্গ

প্রাকৃতিক জগতে আরেকটি অত্যাশ্চর্য বিষয় হচ্ছে পুষ্প ও কীট পতঙ্গের মাঝে বন্ধুত্ব। বসন্তকালের শেষের দিক যখন ধীরে ধীরে বাতাস গরম হতে শুরু করে তখন ফলের বাগান গুলোতে বিভিন্ন প্রকার কীট পতঙ্গের আনাগোনা দেখা যায়। ছোট-বড় পতঙ্গ ,প্রজাপতি ,মৌমাছি ইত্যাদি কত রকমের প্রাণী। এধরণের প্রাণীর কাজ হলো এরা কোন এক গাছের ফুলের উপর বসে রস আহরণ করে অন্য গাছের পাপড়ির উপর গিয়ে বসে। ওরা পুঃলিঙ্গের গাছের পাপড়ি থেকে পরাগরেণু বহন করে নিয়ে যায় স্ত্রী লিঙ্গের পুষ্পের উপর। এভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে সঙ্গম ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। পরিণতিতে বৃক্ষরাজী ফুলে -ফলে ভরপুর হয়ে উঠে।

এ সময়ে বিভিন্ন প্রকার কীট-পতঙ্গের আনাগোনা ,এক ডাল থেকে অন্য ডালে বিচরণ ,গাছে গাছে উড়ে বেড়ানো ইত্যাদি দেখে মনে হয় কোন এক বিশেষ শক্তি তাদেরকে ঠিক একটি উৎপাদনশীল শিল্প কারখানার শ্রমিকদের ন্যায় পরিচালনা করছে। ফলে সকলে নিজ কর্মে পরিপূর্ণ আত্মনিয়োগ করে আছে। কাজের কোন ফাঁকি নেই। পরিশ্রম করছে সবাই একযোগে। যথাযথভাবে সকলে স্ব -স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কতই না বিষ্ময়কর এ বিষয়টি !

কখনো কি ভেবে দেখেছি ,যেখানে বৃক্ষ ,তরুলতার নড়াচড়া ও স্থান পরিবর্তন করার ক্ষমতা নেই সেখানে ওগুলো কি ভাবে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় আর কি পদ্ধতিতে তাদের সঙ্গমক্রিয়া সম্পন্ন হয় ? কিভাবে বৃক্ষরাজীর মাঝে পুরুষ পরাগরেণু ও স্ত্রী ডিম্বানুর মিলন ঘঠে ? অনেক ক্ষেত্রে এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজটির দায়িত্ব কীট পতঙ্গের উপর ন্যস্ত। আবার কখনো বায়ু এ মিলন ক্রিয়াতে সাহায্য করে থাকে। যখন কোন ব্যক্তি কীট-পতঙ্গ ও বৃক্ষরাজীর মধ্যকার এ বিষ্ময়কর ঘটনাবলী অধ্যয়ন করে তখন স্বভাবতঃই তার মনে প্রশ্নের উদেয় হয় ,কে কীটপতঙ্গ ও বৃক্ষদের মাঝে এ অপুরম ও মজবুত বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিয়েছে ?

আমাদের চারপার্শ্বে রয়েছে এ ধরণের বহু আশ্চর্য ঘটনা যা বিশ্বকে দান করে এক সাবলীল সৌন্দর্য ও বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা। বিশ্বজগত চমৎকার ও বিষ্ময়কর সৃষ্টিতে ভরপুর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোন সৃষ্টিকে নিয়ে যদি আমরা সামান্য পরিমাণ অধ্যয়ন ,গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখতে পাব বহু অত্যাশ্চর্য ক্রিয়া-কান্ড ,সুনিপুণ কলা-কৌশল ও ব্যবস্থাপনা। এ প্রসঙ্গে কোরআন উল্লেখ করছে :

) يُنبِتُ لَكُم بِهِ الزَّرْعَ وَالزَّيْتُونَ وَالنَّخِيلَ وَالْأَعْنَابَ وَمِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ ۗ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ(

অর্থাৎ : (আল্লাহ্) তোমাদের জন্যে ওটার (বৃষ্টির) মাধ্যমে কৃষিকার্য উৎপাদন এবং জলপাই ,খেজুর ও আঙ্গুর ইত্যাদি সব ধরণের ফলাদি বৃক্ষ সমুদগত করেন ,নিশ্চয়ই এগুলোর মধ্যে চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আন্ নাহল ,আঃ নং-11 )

আল্লাহ্ অন্যত্র বলেন-

) إ ِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنزَلَ اللَّـهُ مِنَ السَّمَاءِ مِن مَّاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِن كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَعْقِلُونَ(

অর্থাৎ : নিশ্চয়ই আসমানসমূহ ও যমীন এবং দিবা-রাত্রির পালা বদল এবং মানুষের উপকারার্থে চলন্ত জাহাজসমূহ এবং আল্লাহ্ কর্তৃক আসমান থেকে বারিবর্ষন যার ফলে মৃত যমীন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায় এবং যমীনের বুকে চতুষ্পদ জন্তুর উত্থান আর বায়ুরাশির গতি পরিবর্তন এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে সংরক্ষিত ও করতলগত মেঘ খণ্ড চিন্তাশীলদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। (আল্ বাক্বারা ,আঃ নং-164। )

6

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

শিশু জন্মলগ্ন থেকেই তার চার পাশে অনেককে দেখতে পায়। সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে তিনি হলেন নবজাত শিশুর মা। ধীরে ধীরে যখন শিশু বড় হতে থাকে তখন সে মা ছাড়াও আরো অনেকের সাখে পরিচয় লাভ করে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথেও পরিচিত হতে থাকে। এভাবে শুরু হয় একটি শিশুর জীবনযাত্রা।

মানুষ স্বভাবগত ভাবেই কৌতুহলী। তার চারপাশের বিভিন্ন বস্তু ও ব্যক্তি সন্বন্ধে জানার কৌতুহলী মনোভাব শৈশবেই প্রতিটি শিশুর মাঝে পরিলক্ষিত হয়। প্রথমে সে ক্ষুদ্র জিনিষ থেকেই শুরু করে ,পরে বয়স যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে ততই জীজ্ঞাসার মাত্রা ও পরিমাপও বেশী হতে থাকে।

একটি শিশু যখন পাঠশালায় গমন করে তখন সে তার চতুষ্পার্শ্বে অনেক ধরনের সৃষ্টির সাথে পরিচয় লাভ করে। আর প্রথম থেকেই তো এ আকাশ তার মাথার উপর ছেয়ে আছে। অক্সিজেন অনবরত গ্রহণ করছে। পানি পান করছে। এভাবে সে ধীরে ধীরে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী এবং অনেক ধরনের গৃহপালিত পশু-পাখির সাথে পরিচয় লাভ করতে থাকে। ঐ শিশুর কৌতুহলী মনে একটি মাত্র জিজ্ঞাসা এত সব কিছু ,কে সৃষ্টি করলো ? সৃষ্টির পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত আছে ? সূর্য প্রভাতে পূর্বাকাশে উদয় হয় আবার সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমাকাশে অস্ত যায় প্রতিদিন ,এ নিয়ম-শৃঙ্খলা কে তৈরী করলো ? রাত্রে যখন সে আকাশের তারকারাজীর দিকে তাকায় তখন আবারও তার মনে প্রশ্নের উদেয় ঘটে ,এত সুন্দর মনোরম নক্ষত্রমণ্ডলীকে কনো অভিজ্ঞ চিত্রকর আকাশের বুকে সাজিয়ে রেখেছে ? এসব প্রশ্নের উত্তরই হল বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্ব অস্তিত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিই হল অন্তরের এতসব প্রশ্নের উত্তর।

অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্বের সৃষ্টির পেছনে কোন পরিকল্পনা প্রণেতার প্রয়োজন নেই। এর পেছনে কোন উদ্দেশ্যও নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে উদ্ভব হয়েছে এ সৃষ্টিজগত। প্রকৃতিই স্বয়ং সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা। আর একেই বলে বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। প্রাক ইসলামী যুগে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অনুসারীদের বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হতো। তন্মোধ্যে প্রাকৃতিবাদী ,যিনদিক ,দাহরী ও নাস্তিক অন্যতম। কিন্তু বর্তমান আধুনিক ,শিল্পোন্নত ও ইলেকট্রোনিক্স যুগে তাদের মুখোশ পরিবর্তন হতে দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বে বস্তুবাদীদের বিভিন্নমুখী মতাদর্শের মধ্যে অতি পরিচিত নামটি হচ্ছে যুক্তিবাদী বস্তুবাদ বা Dialectic Materialism । আর মার্ক্সবাদী দর্শন এরই উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আবার অনেকে বিশ্বাস করেন এ বিশ্ব জগতের বালু কণা থেকে শুরু করে প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। কোন কিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়নি। বরং প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে কোন স্বাধীন সত্তার শক্তিমত্তা কাজ করছে। এ ধরনের চিন্তা ভাবনার নাম বিশ্ব সম্পর্কে আস্তিকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্ব পরিচিতি এক কথা নয়। এরা দুটি পৃথক পরিভাষা। দৃষ্টান্তস্বরূপ ,পৃথিবীতে পানির পরিমান মাটির চেয়ে কতগুণ বেশী ? অথবা সৌর জগতে বিরাজমান গ্রহের সংখ্যা কত ? ইত্যাদি সৃষ্টি জগতের পরিচয় নিয়ে আলোচনা মাত্র। এগুলোতে বিশ্ব সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যখন আমরা সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করি ,যেমন ধরুন যদি বলি যে ,সমগ্র বস্তুজগত কোন অবস্তুগত সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভরশীল -তাহলে এ বিষয়টি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্ত বলে পরিগণিত হবে।

7

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন , আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে ,তা তো আছেই। আমাদের বিভিন্ন প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এগুলোর তো কোন পরিবর্তন আসবে না। তাহলে এ বিষয়ে এত আলোচনার কি প্রয়োজন ? এর আলোচনা আমাদের জন্যে কি ফলাফল বয়ে আনতে পারে ?

উক্ত প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় ,হ্যাঁ ,আমাদের চারদিকে কোন সৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলবে না সত্য ,কিন্তু তাই বলে আমাদের কাজ-কর্ম ,আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হবে না এটা বলা মনে হয় সঠিক হবে না।

অধিকন্তু বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাবিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টির স্পষ্টতার জন্যে নিন্মে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা গেল।

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও বিজ্ঞানের উন্নতি

চিন্তা করে দেখুন ,আপনার বন্ধু সফর থেকে ফিরে এসেছে। সে আপনাকে একটি বই উপহার দিয়ে বললো এ চমৎকার বইটির লেখক একজন বড় চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ,বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞ এবং উচ্চজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অধিকারী। নিশ্চয়ই আপনি সে বইটা হালকাভাবে রিডিং পড়েই ক্ষান্ত হবেন না। বরং এর প্রতিটি শব্দ ,বাক্য ও তাদের গঠন বর্ণনা ও পরিবর্তন সবকিছুকে খুব সূক্ষ্মভাবে মনযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করবেন। যদি কোথাও না বুঝে থাকেন তা হলে ঘন্টার পর ঘন্টা ,দিনের পরদিন মোট কথা সুযোগ পেলেই এ বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবেন ,বোঝার চেষ্টা করবেন। সাধ্যমত পরিশ্রম করতেও আপনি কুন্ঠাবোধ করবেন না। কেননা ,এ বইয়ের গ্রন্থকার কোন সাধারণ লোক নন। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ,চিন্তাবিদ। তার কোন কথাই অযথা নয়। কোন বাক্যই তার অপরিকল্পিত নয়।

অপরদিকে যদি আপনাকে বলা হয় এ বইটা যদিও বাহ্যিকভাবে চমৎকার বলে মনে হবে কিন্তু এর পুস্তকার একজন অজ্ঞ ,মুর্খ ,নির্বোধ ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তি। আপনি নিখুত ভাবে এ বইটার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন নাকি শুধুমাত্র একটু চোখ বুলিয়ে রেখে দিবেন ? কেননা আপনি জানেন এ বইয়ের কোন মূল্য নেই। কোন জ্ঞান-গর্ভ আলোচনা এ বইতে নেই। মোট কথা এ গ্রন্থটি অধ্যয়ন করা অযথা সময় নষ্ট করারই নামান্তর বলে বিবেচনা করবেন। এ বিশ্বজগতও একটি বৃহৎ গ্রন্থের ন্যায়। এ জগতের প্রতিটি সৃষ্টি এক একটি বাক্য ,যার সমম্বয়ে গঠিত হয়েছে এ বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ।

যদি আমরা আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুগামী হই তাহলে এ বিশ্বের প্রতিটি বস্তু ,প্রতিটি সৃষ্টিকেই আমরা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবো আর খুব মনোযোগ সহকারে তাঁর প্রতিটি বিষয়ের অধ্যায়নে গুরুত্বারোপ করবো এবং কৌতুহলী অন্তঃকরণ নিয়ে প্রতিটি সৃষ্টির অন্তর্নিহিত রহস্যাবলী উদ্ঘাটনের জন্যে উদ্গ্রীব হবো। কেননা আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি সৃষ্টি বস্তুর পেছনে নিশ্চয়ই কোন শক্তিশালী ও বিশাল বুদ্ধিমান শক্তিমত্তা বা সৃষ্টিকর্তা ক্রিয়শীল রয়েছেন। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমান ,প্রজ্ঞাবান ,শিল্পী ও জ্ঞানী। তিনি মহাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। সুতরাং তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। আর এ দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।

আর যদি আমরা বস্তুবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হই তা হলে এ বিশ্বের রহস্যময় সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে সামান্যতম চিন্তা-ভাবণা করারও মনোভাব তৈরী হবে না। কেনান ,বস্তুবাদীরা এ বিশ্বজগতের সৃষ্টিকারক হিসেবে বুদ্ধি ও জ্ঞানহীন প্রকৃতিকেই মনে করেন। আর এতসব কিছুর স্রষ্টা যদি এক নির্বোধ ও জ্ঞানহীন প্রকৃতি হয়ে থাকে তা হলে তার সৃষ্টির-ই বা কি মূল্য হতে পারে ?

বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা

কথায় বলে , নদীর এপাড় ভাঙ্গে ওপাড় গড়ে -এই তো নদীর খেলা। আর এ খেলা মানুষের জীবনেও ঘটে থাকে অহরহ। সাধারণতঃ মানুষের এ ক্ষণকালীন জীবনও বহু চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় । তাই কখনো একজন মানুষের জীবনের দ্বারে কিছু অনাকঙ্খিত বিপদও কড়া নাড়তে পারে। অনেক সময় এমনও হয় যে এ অপ্রত্যাশিত সমস্যা থেকে তার পালানের কোন পথ থাকে না। তখন চতুর্দিকে পথরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায় সে। এমতাবস্থায় সে নিজেকে অতিশয় দুর্বল ও অসহায় অবস্থার মুখোমুখি দেখতে পায়। আর এরকম কঠিন বিপদের মুহুর্তে একমাত্র আস্তিকবাদী দৃষ্টি-ভঙ্গিই তাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। কেননা ,সে তখন তার চেয়ে বড় ও বিশাল কোন অস্তিত্বের আশ্রয়ের সন্ধান খুঁজে পায়। তিনি জানেন এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই একজন পরম পরাক্রমশালী ও বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অধীন। আর আমাদের পরিত্রানদাতাও তিনি। ফলে একজন আস্তিক ব্যক্তি এ ধরনের কঠিন ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবলা করার জন্যে যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিয়ে থাকেন।

অপর দিকে একজন বস্তুবাদী ব্যক্তি এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। হতাশা ও ভয় তাকে অক্টোপাসের মত ঘিরে ফেলে একটি ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায়। এমতাবস্থায় সে নিরাশ্রিত অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়ে। আর এ কারনেই বস্তুবাদীরা এহেন তহাশাগস্থ অবস্থায় আত্মহত্যার ঘৃন্য পথের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে আস্তিকবাদীরা সর্বাবস্থায় তাদের মহাপরাক্রমশালী পরিত্রানদাতার আশ্রয় কামনা করে থাকেন। আর এ কারনেই তারা কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন না।

আর এক ন্যায়সংগত কারণে ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ বলে পরিগণিত। কেননা আত্মহত্যা হতাশা ও পরাজয়ের মনোভাব থেকেই জন্ম লাভ করে থাকে।

8

আস্তিকবাদী বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ

কার্যকারণ

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

মানব প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ


4