ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর শাহাদাত
কুতুবুদ্দীন রাওয়ানদি তার‘
দাওয়াত’
-এ বর্ণনা করেছেন ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন (আ.) থেকে যে ,“
দশই মহররম আমার বাবা আমাকে তার বুকের সাথে চেপে ধরেন তখন তার শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিলো এবং তিনি বললেন ,“
হে প্রিয় সন্তান , এ দোআ মনে রাখো যা সাইয়্যেদা ফাতিমা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে এবং তিনি জিবরাঈল থেকে পেয়েছেন এবং যা আমার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কারণ এটি সব আশা পূর্ণ হওয়ার জন্য , গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে , দুশ্চিন্তায় , কঠিন পরিস্থিতিতে এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে উপকারী। দোআটি এমন:
بِحَقِّ يس وَالْقُرْآنِ الْحَكيمِ وَ بِحَقِّ طه وَ الْقُرْآنِ الْعَظيمِ يا مَنْ يَقْدِرُ عَلى حَوآئِجِ السّآئِلينَ يا مَنْ يَعْلَمُ ما فِى الضَّميرِ يا مُنَفِّساً عَنِ الْمَكْرُوبينَ يا مُفَرِّجاً عَنِ الْمَغْمُومينَ يا راحِمَ الشَّيْخِ الْكَبيرِ يا رازِقَ الطِّفْلِ الصَّغيرِ يا مَنْ لايَحْتاجُ اِلَى التَّفْسيرِ صَلِّ عَلى مُحَمَّدٍ وَ آلِ مُحَمَّدٍ وَافْعَلْ بى...
অর্থ:“
ইয়াসিন এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ কোরআনের উসিলায় , এবং ত্বোহা ও উচ্চতর মর্যাদাপূর্ণ কোরআনের উসিলায় হে যিনি প্রার্থনাকারীদের প্রয়োজন পূরণ করেন , হে যিনি জানেন হৃদয়ের ভিতরে কি আছে , হে যিনি দুঃখ - কষ্ট দূরকারী , হে শোকার্তদের স্বস্তিদানকারী , হে অতি বৃদ্ধদের ওপর দয়ালু , হে ছোট্ট শিশুদের রিয্ক্ব দানকারী , হে যার কাছে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই , কল্যাণ বর্ষণ করুন মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবারের ওপর এবং আমার বিষয়ে ।”
[তারপর প্রয়োজনগুলো বলতে হবে ]
সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) তার যুবকদের ও বন্ধুদের লাশ দেখতে পেলেন তিনি শহীদ হওয়ার জন্য দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন ,“
কেউ কি আছে আল্লাহর রাসূলের পরিবারকে রক্ষা করবে ? তাওহীদবাদী কেউ কি আছে যে আল্লাহকে ভয় করবে আমাদের বিষয়ে ? কোন সাহায্যকারী কি আছে যে আল্লাহর জন্য আমাদেরকে সাহায্য করতে আসবে ? কেউ কি আছে যে আমাদের সাহায্যে দ্রুত আসবে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কারের বিনিময়ে ?”
নারীদের কান্নার আওয়াজ উঁচু হলো এবং ইমাম তাঁবুর দরজায় এলেন এবং যায়নাব (আ.)-কে ডাকলেন ,“
আমাকে আমার দুধের শিশুটিকে দাও যেন বিদায় নিতে পারি।”
এরপর তিনি তাকে দুহাতে নিলেন এবং উপুড় হলেন তার ঠোঁটে চুমু দেয়ার জন্য। হুরমালা বিন কাহিল আসাদি শিশুটির দিকে একটি তীর ছুঁড়লো , যা তার গলা ভেদ করে তার মাথা আলাদা করে ফেললো (আল্লাহর রহমত ও রবকত শিশুর উপর বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তার হত্যাকারীর উপর)।
সিবতে ইবনে জওযি তার‘
তাযকিরাহ’
-তে বর্ণনা করেছেন হিশাম বিন মুহাম্মাদ ক্বালবি থেকে যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.) দেখলেন তারা তাকে হত্যা করবেই , তিনি কোরআন আনলেন এবং তা খুলে মাথার ওপর রাখলেন এবং উচ্চ কণ্ঠে বললেন ,“
আল-কোরআন এবং আমার নানা , আল্লাহর রাসূল (সা.) হলেন আমার ও তোমাদের মধ্যে বিচারক। হে জনতা , কিভাবে তোমরা আমার রক্ত ঝরানোকে বৈধ মনে করছো ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি নই ? আমার নানা থেকে কি হাদীস পৌঁছায় নি তোমাদের কাছে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে যে , আমরা জান্নাতের যুবকদের সদারর্ ? তাহলে জিজ্ঞেস করো জাবির (বিন আব্দুল্লাহ আনসারি)-কে , যায়েদ বিন আরক্বামকে এবং আবু সাঈদ খুদরীকে , জাফর তাইয়ার কি আমার চাচা নন ?”
শিমর উত্তর দিলো ,“
খুব শীঘ্রই তুমি জ্বলন্ত আগুনের [জাহান্নামের] দিকে দ্রুত যাবে।”
(আউযুবিল্লাহ)। ইমাম বললেন ,“
আল্লাহু আকবার , আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাকে জানিয়েছেন যে , তিনি দেখেছেন একটি কুকুর তার গলা পূর্ণ করছে তার আহলুল বাইত (আ.)-এর রক্ত দিয়ে এবং আমি বুঝতে পারছি সেটি তুমি ছাড়া কেউ নয়।”
শিমর বললো ,“
আমি শুধু জিহ্বা দিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবো , যদি আমি বুঝি তুমি কী বলছো।”
ইমাম হোসেইন (আ.) ফিরে দেখলেন তার শিশুপুত্র পিপাসায় কাঁদছে। তিনি তাকে কোলে নিলেন এবং বললেন ,“
হে জনতা , যদি তোমরা আমার প্রতি দয়া না দেখাও , কমপক্ষে এ বাচ্চার ওপর দয়া করো।”
এক ব্যক্তি একটি তীর ছুঁড়লো যা তার গলা বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। ইমাম কেঁদে বললেন ,“
হে আল্লাহ , আপনি বিচারক হোন আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে , যারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং এর বদলে আমাদের হত্যা করেছে।”
একটি কণ্ঠ আকাশ থেকে ভেসে এলো ,“
তাকে ছেড়ে দাও হে হোসেইন , কারণ এক সেবিকা তাকে শুশ্রুষা করার জন্য বেহেশতে অপেক্ষা করছে।”
এরপর হাসীন বিন তামীম একটি তীর ছোঁড়ে তার ঠোঁটের দিকে এবং তা থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে।
ইমাম কাঁদলেন এবং বললেন ,“
হে আল্লাহ , আমি তোমার কাছে অভিযোগ করি , তারা যেভাবে আমার সাথে , আমার ভাই , আমার সন্তানদের এবং আমার পরিবারের সাথে আচরণ করেছে।”
‘
আল-ইহতিজায’
গ্রন্থে উল্লেখ আছে , এরপর ইমাম (আ.) তার তরবারির খাপ দিয়ে একটি কবর খুঁড়লেন এবং রক্তে ভেজা বাচ্চাকে বালির নিচে দাফন করলেন। তিনি তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং শোকগাঁথা আবৃত্তি করলেন। শাহাদাতের লেখকরা এবং ইহতিজাজের লেখকও বলেন যে , ইমাম এরপর তার ঘোড়ায় চড়লেন এবং যুদ্ধের জন্য এগিয়ে গেলেন এই বলে ,“
এ জাতি অবিশ্বাস করেছে এবং তারা রাব্বুল আলামীনের পুরস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে , এ জাতি হত্যা করেছে আলীকে এবং তার সন্তান হাসানকে যিনি ছিলেন উত্তম এবং সম্মানিত পিতা-মাতার সন্তান। তারা ঘৃণা ও বিদ্বেষে পূর্ণ ছিলো এবং তারা জনতাকে ডাক দিয়েছে এবং জমা হয়েছে হোসেইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। অভিশাপ এ নীচ জাতির ওপর যারা বিভিন্ন দলকে একত্র করেছে‘
দুই পবিত্র আশ্রয়স্থলের’
লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। এভাবে মুশরিকদের বংশধর উবায়দুল্লাহর জন্য তারা যাত্রা করেছে এবং মুরতাদদের আনুগত্য করার জন্য অন্যদেরকে আহ্বান করেছে আল্লাহর বিরোধিতা করে আমার রক্ত ঝরানোর জন্য , এবং সা’
আদের সন্তান আমাকে হত্যা করেছে আক্রমণাত্মকভাবে এক সেনাবাহিনীর সাহায্যে যা প্রবল বন্যার মতো এবং এসব আমার কোন অপরাধের প্রতিশোধের জন্য নয় , শুধু এ কারণে যে , আমার গর্ব হচ্ছে দুই নক্ষত্র , আলী যিনি ছিলেন নবীর পরে শ্রেষ্ঠ এবং নবী ছিলেন কুরাইশ পিতা-মাতার সন্তান , আমার বাবা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আমরা দুজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান , রূপার মতো যা বেরিয়ে এসেছে স্বর্ণ থেকে। আমি হচ্ছি রূপা , দুই স্বর্ণালীর সন্তান। আর কারো নানা কি আমার নানার মতো , অথবা তাদের পিতা আমার পিতার মতো , এরপর আমি দুজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র-সন্তান , আমার মা ফাতিমাতুয্ যাহরা এবং বাবা যিনি মুশরিকদের পিঠ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন বদর ও হুনাইনের যুদ্ধে এবং যিনি শৈশবকাল থেকেই রবের ইবাদত করেছেন যখন কুরাইশরা ইবাদত করতো একসাথে দুই মূর্তির লাত ও উযযার , তখন আমার বাবা নামায পড়েছেন দুই ক্বিবলার দিকে ফিরে। আর আমার বাবা হলেন সূর্য এবং আমার মা চাঁদ , আর আমি এক নক্ষত্র , দুই চাঁদের সন্তান এবং তিনি [আলী (আ.)] উহুদের দিনে এমন মোজেযা দেখিয়েছেন সেনাবাহিনীকে দুভাগ করে দেওয়ার মাধ্যমে , যা হিংসা দূর করেছিলো এবং আহযাবে [এর যুদ্ধে] ও মক্কা বিজয়ে। যেদিন দুই সেনাবাহিনীতে একটি কথাই ছিলো মৃত্যু এবং এ সবই আল্লাহর রাস্তায় করা হয়েছিল , কিন্তু কিভাবে এ নীচ জাতি এ দুই সন্তানের সাথে আচরণ করেছে যারা সৎকর্মশীল নবী ও আলীর সন্তান , দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের দিনে যারা লাল গোলাপের মতো।”
এরপর তিনি সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে দাঁড়ালেন তার তরবারিকে খাপমুক্ত করে , জীবনকে পরিত্যাগ করে এবং হৃদয়ে মৃত্যুর দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে। তিনি বলছিলেন ,“
আমি আলীর সন্তান , যিনি ছিলেন পবিত্র ও হাশিমের বংশধর এবং এ মর্যাদা আমার জন্য যথেষ্ট যখন আমি গর্ব করি , আমার নানা আল্লাহর রাসূল সবার চেয়ে সম্মানিত। আমরা সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর বাতি এবং আমার মা ফাতিমা যাহরা (আ.) , যিনি আহমাদ (সা.)-এর কন্যা এবং আমার চাচা যিনি দুপাখার অধিকারী বলে পরিচিত এবং আমাদের মাঝে আছে আল্লাহর কিতাব এবং তা সত্যসহ নাযিল হয়েছে এবং আমাদের মধ্যেই আছে বৈধতা এবং কল্যাণপূর্ণ ওহী এবং আমরা হলাম সব মানুষের মধ্যে আল্লাহর আমানত এবং আমরা গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘোষণা করি যে , কাউসারের ওপর আমরা কর্তৃত্ব রাখি এবং আমরা আমাদের অনুসারীদের পান করাবো নবীর পেয়ালা দিয়ে , যা অস্বীকার করা যায় না এবং আমাদের অনুসারীরা হলো অনুসারীদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং যারা আমাদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে , কিয়ামতের দিন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন:“
মৃত্যু অপমানিত হওয়ার চেয়ে উত্তম এবং অপমান জাহান্নামের আগুনে প্রবেশের চাইতে উত্তম।”
“
আমি হোসেইন , আলীর সন্তান , আমি শপথ করেছি যে শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে যাবো না এবং আমার বাবার পরিবারকে রক্ষা করবো , যতক্ষণ না আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ধর্মের উপর নিহত হই।”
মুহাম্মাদ বিন আবি তালিব , ইবনে শাহর আশোব এবং সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তখন বললেন ,“
দুর্ভোগ তোমাদের ওপর হে আবু সুফিয়ানের পরিবারের অনুসারীরা , যদি তোমরা অধার্মিক লোক হও এবং কিয়ামতের দিনটিকে ভয় না পাও , তাহলে কমপক্ষে স্বাধীন চিন্তার লোক হও এবং বুঝতে চেষ্টা করো যদি তোমরা আরবদের বংশধর হও।”
শিমর বললো ,“
হে ফাতিমার সন্তান , তুমি কী বুঝাতে চাও ?”
ইমাম বললেন ,“
আমি বলছি যে আমরা পরস্পর যুদ্ধ করবো , কিন্তু নারীরা তো কোন দোষ করে নি । আমার পরিবারের তাঁবু লুট করা থেকে বিরত থাকো যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি।”
ইমাম (আ.) বলেন:“
তোমরা একত্রে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছো ? আল্লাহর শপথ , আমার পরে তোমরা আর কাউকে হত্যা করবে না যার হত্যাতে আল্লাহ তোমাদের ওপর এর চাইতে বেশী ক্রোধান্বিত হবেন। আল্লাহর শপথ , আমি চাই যে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসুন তোমাদের ঘৃণার পরিবর্তে এবং তিনি আমার প্রতিশোধ নিন তোমাদের ওপর এমন এক মাধ্যমে যে সম্পর্কে তোমরা সচেতন নও। সাবধান , যদি তোমরা আমাকে হত্যা করো , আল্লাহও তোমাদেরকে হত্যা করবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরাবেন। এরপর তিনি তোমাদের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিবেন না , যতক্ষণ না তিনি ভয়ানক শাস্তি কে দ্বিগুণ করবেন।”
আবুল আব্বাস আহমেদ বিন ইউসুফ দামিশকি ক্বিরমানি , যিনি 1019 হিজরিতে মারা যান , তার‘
আখবারুল দাওল’
গ্রন্থে বলেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর পিপাসা তীব্র হয়ে উঠলো , কিন্তু তারা তাকে পানি পান করার জন্য পানি দেয় নি। এক পেয়ালা পানি তার হাতে এলো এবং তিনি উপুড় হলেন তা পান করার জন্য। হাসীন বিন নামীর তার দিকে একটি তীর ছুঁড়লো , যা তার থুতনি ভেদ করলো এবং পেয়ালাটি রক্তে ভরে গেলো। তখন তিনি তার দুহাত আকাশের দিকে তুলে বললেন ,“
হে আল্লাহ , তাদের সংখ্যা কমিয়ে দাও , তাদের প্রত্যেককে হত্যা করো এবং তাদের মধ্য থেকে একজনকেও পৃথিবীর ওপর ছেড়ে দিও না।”
তখন তারা তাকে সব দিক থেকে আক্রমণ করলো এবং তিনি তাদেরকে বাম ও ডান দিকে তাড়িয়ে দিলেন , যতক্ষণ পর্যন্তনা যারাহ বিন শারীক তার বাম কাঁধে আঘাত করে এবং আরেকটি আঘাত কাঁধে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। শিমর তখন তার ঘোড়া থেকে নেমে এসে তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তা খাওলি আসবাহির হাতে হস্তান্তর করে। এরপর তারা তার জামা-কাপড় লুট করে।
মুহাদ্দিস শেইখ আব্বাস কুম্মি বলেন যে , সাইয়্যেদ ইবনে তাউস , ইবনে নিমা , শেইখ সাদুক্ব , তাবারি , ইবনে আসীর জাযারি , ইবনে আব্দুল বির বির , মাসউদী এবং আবুল ফারাজ বলেছেন যে , শিমারের নির্দেশে অভিশপ্ত সিনান [বিন আনাস] তার মাথা বিচ্ছিন্ন করেছিল।
সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বলেন যে , সিনান এগিয়ে এলো এবং বললো ,“
যদিও আমি জানি যে সে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি এবং তার মা-বাবা মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , তবুও আমি তার মাথা কাটবো।”
এরপর সে তার পবিত্র ঘাড়ে আঘাত করে তার তরবারি দিয়ে এবং তার পবিত্র ও সম্মানিত মাথা আলাদা করে ফেলে।
আবু তাহির মুহাম্মাদ বিন হাসান [অথবা হোসেইন] বারাসি [অথবা নারাসি]‘
মা’
আলিমুদ দ্বীন’
গ্রন্থে বলেন যে , ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেছেন , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বিষয়টি এ পর্যায়ে পৌঁছে যায় , তখন ফেরেশতারা আল্লাহর সামনে কাঁদতে থাকে এবং বলে ,“
হে আল্লাহ এ হোসেইন আপনার মেহমান , সে আপনার রাসূলের নাতি”
, তখন আল্লাহ ইমাম আল- ক্বায়েম [আল-মাহদী]-এর একটি ছবি দেখালেন এবং বললেন ,“
আমি তাদের ওপর প্রতিশোধ নিবো এর মাধ্যমে।”
বর্ণনাকারী বলেন , যে মুহূর্তে তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা কেটে ফেললো তখন এক প্রচণ্ডঘুর্ণিঝড় আবির্ভূত হলো এবং পুরো দিগন্তকে অন্ধকারে ছেয়ে ফেললো। এরপর এক লাল ঝড় বইলো যার কারণে কিছু দেখা যাচ্ছিলো না এবং সেনাবাহিনী ভাবলো আল্লাহর অভিশাপ বোধ হয় নামলো। এরকম অবস্থা এক ঘণ্টা চললো এবং তারপর থামলো।
হিলাল বিন নাফে’
বলেন যে , আমি উমর বিন সা’
আদের সাথীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং কেউ একজন চিৎকার করে বললো ,“
অধিনায়ক , সুসংবাদ নিন , শিমর হোসেইনকে হত্যা করেছে।”
তখন আমি তার শাহাদাতের স্থানে গেলাম এবং তার পাশে দাঁড়ালাম এবং তিনি মারা যাচ্ছিলেন। আল্লাহর শপথ , আমি এর চেয়ে ভালো কোন লাশ দেখি নি যা রক্তে ভেজা ছিলো এবং তার চেহারার চাইতে আলোকিত কোন চেহারা দেখি নি। তার চেহারার আলো এবং অসাধারণ সৌন্দর্য আমাকে তার মৃত্যু ভুলিয়ে দিলো।
এ অবস্থায় তিনি পানি চাইলেন এবং এক ব্যক্তি তাকে বললো ,“
আল্লাহর শপথ , তুমি তা পাবে না যতক্ষণ না জ্বলন্ত আগুনে [জাহান্নামে] প্রবেশ কর।’’
(আউযুবিল্লাহ)। আমি ইমামকে বলতে শুনলাম ,“
দুর্ভোগ হোক তোমার , আমি জ্বলন্তআগুনের দিকে যাচ্ছি না , না আমি সেখানে ফুটন্ত পানির স্বাদ নিবো , বরং আমি যাচ্ছি আমার নানা আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কাছে এবং আমি বাস করবো তার সত্যপূর্ণ বাসস্থানে আল্লাহর আশ্রয়ে , যিনি সর্বশক্তিমান এবং আমি পবিত্র পানি পান করবো এবং এরপর আমি তার কাছে অভিযোগ করবো তোমরা আমার সাথে কী করেছো”
। তা শুনে তাদের সবাই ক্রুদ্ধ হলো। যেন তাদের বুকের ভেতর কোন দয়া-মায়া ছিলো না এবং এ পরিস্থিতিতে যখন তিনি তাদের সাথে কথা বলছিলেন তারা তার মাথা কেটে নিলো। আমি তাদের নৃশংসতায় আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম এবং বললাম ,“
আমি আর কোন দিন কোন কাজে এখন থেকে তোমাদের সাথে থাকবো না।”
ইমাম জাফর আস-সাদিক্ব (আ.) বলেছেন , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)- এর ওপর একটি আঘাত করা হলো , তিনি তার ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন এবং তারা দৌড়ে আসলো তার মাথা কেটে ফেলতে। একটি কণ্ঠ আকাশ থেকে শোনা গেলো ,“
হে , যে জাতি তাদের নবীর ইন্তেকালের পর উদ্ধত হয়ে গেছে এবং পথভ্রষ্ট হয়েছে , আল্লাহ যেন তাদের রোযা ও ঈদুল ফিতরের অনুগ্রহ দান না করেন।”
তখন তিনি (ইমাম-আ.) বললেন , অতএব আল্লাহর শপথ , তারা সমৃদ্ধি লাভ করে নি এবং তারা বৃদ্ধি পেতে থাকবে যতক্ষণ না প্রতিশোধ গ্রহণকারী [ইমাম মাহদী] উঠে দাঁড়াবেন ইমাম হোসেইনের (আ.) জন্য।
মাশহাদির বর্ণনায় আছে যে , উম্মে সালামা (আ.)-এর কাছে সালামা গেলেন , তখন তিনি কাঁদছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন ,“
আপনি কাঁদছেন কেন ?”
তিনি বললেন , আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলাম তার মাথা ও দাড়ি ধুলায় মাখা। আমি জিজ্ঞেস করলাম ,“
হে রাসলূ ুলাহ (সা.) , আপনার কী হয়েছে যে আপনি ধুলায় মাখা ? তিনি বললেন ,“
এইমাত্র আমি আমার হোসেইনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি।”
ইবনে হাজারের‘
সাওয়ায়েক্বে মুহরিক্বা’
-এ বর্ণিত আছে যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদাতের দিন যে চিহ্নগুলি দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিলো আকাশ এতো কালো হয়ে গিয়েছিল যে , দিনের বেলা‘
তারা’
দেখা গিয়েছিলো। যে কোন পাথর তুললে তার নিচে তাজা রক্ত দেখা গিয়েছিলো এবং আরো বলা হয় যে , আকাশ লাল হয়ে গিয়েছিলো তার শাহাদাতে এবং সূর্য পীচের মতো কালো। তারাগুলো দিনের বেলা দেখা যাচ্ছিলো এবং মানুষ মনে করেছিলো কিয়ামতের দিন [পুনরুত্থানের দিন] চলে এসেছে। সেদিন সিরিয়াতে যে কোন পাথর উঠানো হয়েছিলো তার নিচে তাজা রক্ত দেখা গিয়েছিলো।
ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.)-কে হত্যার পর তারা শহীদদের লাশের মাথাগুলো কেটে বর্শার মাথায় বিদ্ধ করে এবং দেহগুলোকে শত শত ঘোড়ার পায়ের আঘাতে পিষ্ট করে। তারা তাবুগুলো লুট করে ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করার সময় পরিবারের সদস্যদের চাবুক মারে। ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মেয়ে পাঁচ বছরের শিশু সাকিনার কানের দুল কান থেকে ছিঁড়ে নেয় এবং তা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। শিশুরা ভয়ে ও ব্যাথায় কাঁদতে থাকলে তাদের গালে চড় মারে। নারীদের মাথার চাদরও [বোরখা] কেড়ে নেয়। নবী পরিবারের নির্যাতিত অসহায় এসব সম্মানিত ব্যক্তিরা মরুভূমিতে আশ্রয়হীনভাবে খোলা আকাশের নীচে চলে আসেন।
শাহাদাতের সময় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বয়স হয়েছিলো 57 বছর। নির্মম , নির্বিচার ও জঘন্যতম এসব অন্যায় অত্যাচার ও হত্যার এ দিনটিই ছিলো 10ই মহররম যা আশুরা দিন হিসেবে সুপরিচিত। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের এ দিনে ইমাম হোসেইন (আ.)-সহ মোট 72 জন শহীদ হন। মহান আল্লাহ ইমাম হোসেইন (আ.) , তার সন্তানদের , শহীদ সাথীদের ও নির্যাতন সহ্যকারী পরিবারের সদস্যদের সবার ওপর তার শান্তিও সম্মান আরো বাড়িয়ে দিন।