38
আলীর মেহমান আকীল
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর খেলাফতকাল। তার ভাই জনাব আকীল একবার কুফায় তার বাড়িতে মেহমান হলেন। হযরত আলী (আঃ) তার বড় ছেলে ইমাম হাসানকে ইঙ্গিত করলেন যে , স্বীয় চাচা আকীলকে একটি জামা উপহার দাও। ইমাম হাসান একটি জামা ও নিজের পক্ষ থেকে একটি রিদা (চাদর) চাচার খেদমতে উপহার হিসেবে পেশ করলেন। দিন শেষে রাত এলো। গ্রীষ্মকাল। হযরত আলী ও তাঁর ভাই আকীল দারুল খেলাফতের ছাদে বসে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রাতের খাবার সময় হয়েছে। জনাব আকীল নিজেকে খলিফার মেহমান হিসাবে ভাবছিলেন । তাই তার আশা ছিল যে , আজ দস্তরখানে রকমারী ও রং বেরংয়ের মজাদার খাবার সাজানো থাকবে। কিন্তু তার আশার বিপরীত অত্যন্তসাধারণ খাবার দস্তরখানে দেখতে পেলেন। অবাক হয়ে দস্তরখানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , খাবার জন্যে তোমাদের যা প্রস্তুতি তা কি শুধু এই ?
আলী (আঃ) বললেন , এগুলো কি খোদার নেয়ামত নয় ? আমি তো খোদার এ নেয়ামতগুলোর জন্যই লাখ লাখ শুকুর আদায় করি।
জনাব আকীল বললেন , তাহলে আমার প্রয়োজনের কথাটা তোমাকে বলে তাড়াতাড়ি এখান থেকে বিদায় নেবো। আসল কথা হলো , আমি ঋণের দায়ে জর্জরিত আছি। এখন তুমি হুকুম দাও খুব তাড়াতাড়ি যেন বাইতুলমাল থেকে আমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়াও ভাই হিসাবে যতদূর তোমার পক্ষে সম্ভব আমাকে সাহায্য করো যেন প্রশান্তির মন নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি।
হযরত আলী (আঃ) জিজ্ঞাসা করলেন , আপনার ঋণ কত টাকা ?
জনাব আকীল বললেন , এক লাখ দিরহাম।
হযরত আলী (আঃ) বললেন , উহ্! এক লাখ দিরহাম ? এতো বিরাট অংকের টাকা ? অত্যন্ত আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে যে , আমার কাছে এতো টাকা নেই যে , আপনার ঋণ পরিশোধ করতে পারি। কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করুন। আমার মাসিক ভাতা পাওয়ার সময় নিকটবর্তী। আমার ভাতার টাকা থেকে আমি আমার নিজের অংশটা আপনাকে দিয়ে দেবো। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের যে অধিকার রয়েছে সে ব্যাপারে আমি বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করবো না। যদি পরিবার-পরিজনের দায়-দায়িত্ব আমার উপর না থাকতো তাহলে আমি আমার সমস্ত পয়সাই আপনাকে দিয়ে দিতাম। আমার নিজের জন্য কিছুই রাখতাম না।
জনাব আকীল বললেন , তুমি এসব কি বলছো ? আমি তোমার বেতন পাওয়া অবধি অপেক্ষা করবো ? তুমি এ ধরনের কথাবার্তা কেন বলছো ? দেশের সমস্ত টাকা পয়সা ও বাইতুলমাল তোমার হস্তগত। আর তুমি নাকি আমাকে বলছো বেতনের সময় নিকটবর্তী। কাজেই বেতন হওয়া অবধি আমি অপেক্ষা করতে থাকবো। তারপর তুমি তোমার বেতনের কিছু অংশ আমাকে দেবে। অথচ বাইতুলমাল তোমার হাতেই। তুমি যত ইচ্ছা বাইতুলমাল থেকে নিতে পারো। তাহলে কেন আমাকে বেতনের হাওয়ালা দিচ্ছো ? আর কতো টাকাই বা তুমি বাইতুলমাল থেকে বেতন পাও ? ধরে নাও তুমি তোমার সমস্ত বেতনটাই আমাকে দিয়ে দিলে , তাতেও তো আমার ব্যথার উপশম হবে না।
হযরত আলী (আঃ) বললেন , আপনার চিন্তা-ভাবনার উপর আমি অবাক হচ্ছি। রাষ্ট্রের বাইতুলমালে টাকা পয়সা আছে কি নেই তাতে আমার আর আপনার কি আসে যায় ? আমার ও আপনার তো ততটুকু অধিকার যতোটুকু আর সব মুসলমান ভাইয়ের রয়েছে। এ কথা সত্য যে , আপনি আমার ভাই। অতএব আমার কর্তব্য রয়েছে যে , যথাসাধ্য আপনার সাহায্য করা। কিন্তু সে সাহায্য বাইতুলমাল থেকে নয় , বরং ব্যক্তিগত অর্থ থেকে।
এভাবে দুই ভাইয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। জনাব আকীল স্বীয় ভ্রাতা আলীকে বার বার বলতে থাকলেন যে , বাইতুলমালের দ্বার খুলে দিয়ে সেখান থেকে তার প্রয়োজনীয় অর্থ তাকে দিয়ে দিতে যাতে করে তিনি লোকদের পাওনা পরিশোধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারেন।
তারা যেখানে বসে কথাবার্তা বলছিলেন সেখান থেকে কুফার বাজার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ব্যবসায়ী-বণিকদের নিজেদের টাকা পয়সা রাখার সিন্দুকগুলোও দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। জনাব আকীল বার বার তার ভাই আলীর কাছে খোশামোদের ভাষায় জিদ করছিলেন , আমাকে বাইতুলমাল থেকে প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা দিয়ে দাও , যাতে করে আমি ঋণমুক্ত হতে পারি।
হযরত আলী (আঃ) বললেন , আপনি খালি খালি জিদ করছেন আর আমার কথা বুঝতে চাচ্ছেন না। আপনি যদি আমার কথা বুঝতে চান তাহলে আসুন আমি আপনাকে একটা পন্থা বলে দিচ্ছি। যদি সে পন্থা অবলম্বন করতে পারেন তাহলে আপনার সমস্তঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় , আপনার নিজের খরচাদির জন্যও অনেক টাকা বেঁচে যাবে।
জনাব আকীল বললেন , কি সে পন্থা ?
হযরত আলী (আঃ) বললেন , দেখুন। এ বাজারে অনেক টাকার সিন্দুক পড়ে আছে। এখন রাত্রি বেলা। সমস্ত বাজার নীরব নিস্তব্ধ। আপনি নিচে চলে যান। বাজারে গিয়ে সিন্দুকগুলোর তালা ভেঙ্গে আপনার যত টাকা প্রয়োজন নিয়ে নিন।
জনাব আকীল বললেন , এ সিন্দুকগুলো কার ? আলী বললেন , এগুলো ব্যসায়ীদের নিজস্ব সিন্দুক। তারা সারাদিন পরিশ্রম করে কেনা-বেচা করে যা টাকা আয় করেছে তা এ সিন্দুকগুলোতে রেখে তারা বাড়ি চলে গেছে।
আকীল বললেন , বড় আশ্চর্যের কথা। তমি আমাকে পরামর্শ দিচ্ছ যে , লোকদের সিন্দুকের তালা ভেঙ্গে সে সমস্ত লোকের টাকা-পয়সা নিয়ে নিতে যারা সারাদিন খেটে অনেক কষ্ট-ক্লেশ করে টাকা- পয়সা উপার্জন করে নিজেদের সমস্ত কামাই-পুঁজি আল্লাহর উপর ভরসা করে এ সিন্দুকগুলোতে রেখে ঘরে চলে গেছে। তুমি কি আমাকে এ কথা বলতে চাও যে , তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের জমাকৃত টাকা-পয়সা চুরি করে নিয়ে যাবো ?
আলী (আঃ) বললেন , তাহলে আপনি আমাকে এ পরামর্শ কেন দিচ্ছেন আর তার উপর জিদ করছেন যে , আমি সমস্ত মুসলমানের বাইতুলমালের তালা খুলে আপনার প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা আপনাকে দিয়ে দিতে ? আপনি নিজেই বলুন। এ বাইতুলমাল কার ? বস্তুত এ সম্পদ তো তাদের যারা নিজেদের ঘর-বাড়িতে নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে। আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন যে , বাইতুলমাল আমার ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। যেভাবে রাতের অন্ধকারে ব্যবসায়ীদের সিন্দুকের তালা ভাঙ্গা একটা অবৈধ কাজ , তেমনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বাইতুলমালের দরজা খোলাও অপরাধ। আচ্ছা আসুন। আমি আপনাকে আরেকটি পন্থাও বলছি। যদি আপনার পছন্দ হয় তাহলে এ প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারেন।
জনাব আকীল , তোমার দ্বিতীয় প্রস্তাব কি ?
আলী (আঃ) বললেন , আপনি যদি ভালো মনে করেন তাহলে আপনার তলোয়ার হাতে নিন। আমিও আমার তলোয়ার তুলে নেবো। কুফার নিকটেই একটি পুরাতন শহরে নাম হাইরাহ। সেখানে বড় বড় বণিক-সওদাগরদের বাড়িঘর। রাতের অন্ধকারে আমরা দুই ভাই মিলে সেখানে যাবো। আর সে সওদাগরদের কোন একজনের বাড়িতে ডাকাতি করে পর্যাপ্ত টাকা পয়সা নিয়ে ফিরে আসব। আকীল বললেন , হে আমার প্রিয় ভাই। আমি এখানে চুরি-ডাকাতি করার জন্য আসি নাই। আর তুমি আমাকে এ সবের প্রস্তাব দিচ্ছো। আমি তো কেবল তোমাকে এ কথা বলছি যে , আমাকে রাষ্ট্রীয় বাইতুলমাল থেকে সে কয়টা টাকা দান করো যা দ্বারা আমার ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হতে পারি।
আলী (আঃ) বললেন , আমরা দুই ভাই মিলে এক ব্যক্তির মাল চুরি করা উত্তম নাকি হাজার হাজার মুসলমানদের তথা সমস্ত মুসলমানদের অধিকার চুরি করা ? এটা আপনার কোন ধরনের চিন্তা-ভাবনা ও কি রকম যুক্তি যে , তলোয়ারের সাহায্যে এক ব্যক্তির মাল নিয়ে নেয়া চুরি আর বাইতুলমাল থেকে সাধারণ মুসলমানদের মাল তুলে নেয়া চুরি নয় ? আমার মনে হয় আপনার নিকট চুরি-ডাকাতির অর্থ হচ্ছে কোন লোক নিজের শক্তি প্রয়োগ করে কারো কাছ থেকে তার মাল ছিনিয়ে নেয়া। ভাইজান।
আপনি বাইতুলমালের দরজা খুলে টাকা পয়সা বের করার কথা বলছেন। কিন্তু আপনার জানা থাকা উচিত যে , সব চেয়ে নিকৃষ্ট চুরি হচ্ছে এটাই , যা আপনি এখন আমাকে করার জন্য বলছেন।