সত্য কাহিনী সম্ভার

সত্য কাহিনী সম্ভার0%

সত্য কাহিনী সম্ভার লেখক:
: মাওলানা আলী আক্কাস
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

সত্য কাহিনী সম্ভার

লেখক: শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহহারী
: মাওলানা আলী আক্কাস
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 45876
ডাউনলোড: 5690

সত্য কাহিনী সম্ভার
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 79 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 45876 / ডাউনলোড: 5690
সাইজ সাইজ সাইজ
সত্য কাহিনী সম্ভার

সত্য কাহিনী সম্ভার

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি তার বিষয়ের সর্বপ্রথম ও অনন্য অবতারণা হোক অথবা না হোক , এর জন্য প্রাপ্য ফুলের মামলার যোগ্য পাত্র আমি নই , অর্থাৎ যদি এ বইটি কাহিনী রচনার জগতে কোন গুরুত্বপূর্ণ নতুন অবতারণার দাবিদার হয় তাহলে তার গোড়াপত্তনকারী আমি নই। বরং প্রকাশনা ও প্রচারণার একটি প্রতিষ্ঠানে দেশের বিজ্ঞ বিজ্ঞ বিজ্ঞানী-গুণী কতিপয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি সম্পাদনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ অধমও সে বোর্ডের একজন সদস্য। দেশের খ্যাতনামা লেখক ও বিজ্ঞতম ব্যক্তিত্ব সমৃদ্ধ সে বোর্ডের এক বৈঠকে প্রস্তাব রাখা হলো যে , এমন একটি গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত যার মধ্যে চারিত্রিক সুন্দর ও গুণাবলী কাহিনী আকারে উপস্থাপিত থাকবে। আর সে কাহিনীগুলো লেখকের নিজের মস্তিষ্ক থেকে আবিস্কৃত বা নিজের খেয়াল মোতাবেক তৈরি হবে না। বরং তার ভিত্তিমূল ও উৎস হবে হাদীস , বাস্তব জীবন ও ইতিহাসের গ্রন্থরাজি। এর সংকলনের উদ্দেশ্য থাকবে মুসলিম সমাজকে শিক্ষা দান এবং যুব সমাজকে হেদায়েতের পথ প্রদর্শন ও পরিচালনা করা।

44

স্বাধীন নাকি দাস ?

একটি বাড়ী থেকে নাচগানের আওয়াজ আসছিল। ঘরের পাশ দিয়ে চলাচলকারী কারো জন্যে বুঝতে দেরী হচ্ছিল না যে , বাড়ীর ভেতর কি হচ্ছে ? শরাব-কাবাব ও আনন্দ-উলাসে অনুষ্ঠান সরগরম। শরাবের পেয়ালা পরস্পরের সাথে টক্কর খাচ্ছিল। এ বাড়ীর এক চাকরানী ময়লা ইত্যাদি ফেলার জন্য বাইরে এসেছিল। এমন সময় এক ব্যক্তি যার চেহারায় ইবাদত-বন্দেগীর নিদর্শন প্রতিভাত হচ্ছিল এবং তার ললাট এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে , নিশ্চয়ই লোকটি রাত জেগে ইবাদতকারী। তিনি এ বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। চাকরানীটিকে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। চাকরানীটি যখন তার কাছে এলো তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন , এ বাড়ির মালিক স্বাধীন নাকি দাস ?

চাকরানী বললো , স্বাধীন।

পথিক বললেন , জানি সে স্বাধীন। যদি সে দাস হতো তাহলে নিশ্চয়ই সে তার প্রভু মহান আল্লাহর নাফরমানী করে এ ধরনের অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করতো না।

এভাবে চাকরানী ও পরহেযগার লোকটির মধ্যে কথাবার্তা হতে হতে চাকরানীটির বাড়ী ফিরতে খানিকটা দেরী হলো। চাকরানীটি ফিরে আসার সাথে সাথে তার মালিক তাকে জিজ্ঞাসা করলো , এত দেরী করলে কেন ? চাকরানীটি সমস্তঘটনা খুলে বললো , একজন লোক এসেছিলেন , যার চেহারা ছুরতে মনে হচ্ছিল খুবই মোত্তাকী পরহেযগার। আমাদের বাড়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে এ প্রশ্ন করেছেন। আমি তাকে এ জবাব দিয়েছি। অতঃপর তিনি এ কথা বলে চলে গেলেন। আর আমি ঘরে ফিরে এলাম।

চাকরানীর এ কথা শুনে লোকটি কিছুক্ষণ চিন্তায় ডুবে গেল। বিশেষ করে তার এ বাক্যটি সম্পর্কে যে , যদি দাস হতো তাহলে তার প্রভুকে পরোয়া করে চলতো। কথাটি তার অন্তরে তীরের মতো বিঁধলো। তৎক্ষণাত উঠে দাড়ালো। আর জুতো জোড়া পায়ে দেবার অবকাশটুকু না দিয়ে সে মোত্তাকী ব্যক্তির পিছনে দৌঁড়াতে লাগলো। অবশেষে সে ব্যক্তির নিকট পৌঁছলো। পৌঁছে দেখলো তিনি আর কেউ নন , বরং সপ্তম ইমাম হযরত মূসা ইবনে জা ফর (আঃ)। সে ইমামের সামনে তওবা করলো। যেহেতু তওবা করার সময় সে খালি পায়ে ছিল তাই সে আর কোনদিন জুতা পরেনি। সারা জীবন খালি পায়ে চলাফেরা করতো । তওবা করার পূর্বে সে বশীর ইবনে হারেছ বিন আবদুর রহমান মারুযী নামে খ্যাত ছিল , কিন্তু এরপর থেকে সারা জীবন আল-হাফী অর্থাৎ খালি পা-ওয়ালা উপাধিতে ডাকা হতো। পরে সে বুশর হাফী নামে খ্যাত হয়ে গেল। এরপর সে যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন তার কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির উপর দৃঢ় ছিল। অত্যন্ত আনুগত্য পরায়ণতার প্রমাণ দিয়ে কখনোও গুনাহের কাজের কাছেও যায়নি। আগে সে এলাকার ধনী ও নামযাদা লোকদের মধ্যে পরিগণিত হতো , কিন্তু শেষ জীবনে খোদাভীরু-মোত্তাকী-পরহেযগার লোকদের অন্তর্ভুক্ত হলো।55

45

মীকাতে

মালেক ইবনে আনাস মদীনার বিখ্যাত ফকীহ ইসলামী আইনজ্ঞ ছিলেন। এক বছর হজ্বের সময় তিনি ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-এর সঙ্গী হন। তারা মীকাতে পৌঁছলেন। এহরামের পোশাক পরিধান করা ও তালবিয়াহ অর্থাৎ লাব্বাইকা আলাহুম্মা লাব্বাইক যিকির পাঠ করার সময় যখন এলো তখন অন্য হাজীগণ সাধারণ নিয়ম মোতাবেক এ যিকিরটি নিজের নিজের মুখে পাঠ করছিল। এদিকে মালেক ইবনে আনাস ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-এর দিকে লক্ষ্য করে দেখলেন যে , ইমামের অবস্থা একেবারে বেহাল দশা। তিনি যখনই সে যিকিরটি নিজের মুখে উচ্চারণ করতে যান তখনই তিনি উৎকণ্ঠা গ্রস্ত হয়ে পড়েন। আর তাতে তার স্বর কণ্ঠনালীতে আটকে যাচ্ছিল। স্বীয় স্নায়ু শক্তিকে এমনভাবে হারিয়ে ফেলেন যে , নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতো না। এমন কি নিজেকে বাহনের উপর ধরে রাখাটাই ছিল তাঁর জন্য দুস্কর। তাঁর শরীরে এমন একটা কম্পন সৃষ্টি হতো , মনে হয় তিনি বাহনের পৃষ্ঠ থেকে পড়ে যাবেন। এ অবস্থা দেখে মালেক ইবনে আনাস ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর সামনে আসলেন এবং বললেন , হে রাসূলের (সাঃ) সন্তান! যেভাবেই সম্ভব হোক সে যিকিরটি উচ্চারণ করার চেষ্টা করুন। এ ছাড়াতো আর কোন উপায় নেই।

ইমাম (আঃ) বললেন , হে আবী আমেরের ছেলে! এ দুঃসাহস আমি কিভাবে করবো ? লাব্বাইক বলার হিম্মত আমি কোথায় পাবো ? লাব্বাইক বলার অর্থ হচ্ছে , হে আমার পরোয়ারদিগার! তুমি যে উদ্দেশ্যে আমাকে ডেকেছো , আমি তা পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে নেবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সর্বদা তোমার আনুগত্য করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি! আমি কি করে আমার প্রভুর সামনে এমন ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করবো ? নিজেকে একজন সদা প্রস্তুত গোলাম হিসাবে পেশ করবো কিরূপে ? যদি আমার ডাকে তিনি উত্তর দেন যে , লা-লাব্বাইক অর্থাৎ তোমার আমি গ্রহণ করলাম না। তখন আমি কি করবো ?56

46

খেজুর গাছের বোঝা

হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্যান্য দিনের মতো মরুর মধ্যে সে সব বাগানের দিকে চললেন যে সব জায়গায় তিনি কাজ করে অভ্যস্ত। তাঁর সাথে একটি বোঝাও ছিল। পথে এক লোক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো , হে আলী! আপনার সাথে কি ? জবাবে আলী (আঃ) বললেন , ইনশাআল্লাহ! খুরমা গাছ।

লোকটি আশ্চর্য হয়ে বললো , খুরমা গাছ ? তার কথার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছিল যে , সে হযরত আলীর কথার অর্থ বুঝতে পারেনি। (অর্থাৎ খুরমা গাছ তো বেশ বড়। সে তো আর একটা ছোটখাটো বোঝা হতে পারে না।)

সে লোকটির আশ্চর্য বোধ তখন বিদূরিত হলো , যখন কিছুদিন পর সে ও তার বন্ধুরা দেখতে পেলো যে , সেদিন হযরত আলী খুরমার যে বীচিগুলো সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন আর তিনি আশা পোষণ করেছিলেন যে , খুব শীঘ্রই এগুলো প্রকাণ্ড বৃক্ষে পরিণত হবে , সত্যিই সেগুলো আজ এক সবুজ- শ্যামল খুরমার বাগানের রূপ ধারণ করেছে। হযরত আলী (আঃ) সেদিন যে খুরমার বীচিগুলো রোপণ করেছিলেন সেগুলো আজ বেশ মোটা তাজা ও সুন্দর বৃক্ষের আকার ধারণ করেছে।57

47

মেহনতের ঘাম

ইমাম মূসা কাজেম (আঃ) নিজের ক্ষেতে কাজ করছিলেন। অত্যাধিক পরিশ্রমের কারণে তাঁর সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। এমন সময় আলী ইবনে আবী হামযা নামক এক ব্যক্তি ইমামের কাছে এসে বললো , আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত হোক! আপনি এ কাজটি অন্য লোকের ওপর ন্যস্তকরেন না কেন ?

ইমাম (আঃ) বললেন , আমি আমার এ কাজ অন্যকে দিয়ে করাবো কেন ? আমার চেয়ে উত্তম লোকেরা সব সময় এ জাতীয় কাজ নিজেরাই আঞ্জাম দিয়েছেন।

ইবনে হামযা বললো , সে সকল লোক কারা ?

ইমাম (আঃ) বললেন , রাসূলে আকরাম (সাঃ) , আমীরুল মু মিনীন হযরত আলী (আঃ) এবং আমাদের বাপ-দাদা পূর্ব-পুরুষদের সকলেই এ জাতীয় কাজকর্ম নিজেরাই আঞ্জাম দিয়েছেন। মূলত ক্ষেতে খামারে কাজ করা আল্লাহর নবী-রাসূল , তাদের প্রতিনিধি , উত্তরসূরী ও আল্লাহর সুযোগ্য বান্দাদের সুন্নত।58

48

বন্ধুত্বের চির অবসান

কেউ কোনদিন চিন্তাও করতে পারেনি যে , এ বন্ধুত্বের বিচ্ছেদ ঘটবে। তারা দু জন এমন বন্ধু ছিলেন যে , পরস্পর একে অপরের ছায়াসঙ্গী ছিলেন। তারাই আজ একে অপর থেকে আলাদা হয়ে গেছেন। কখনও তারা একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না। অবস্থা এমন ছিল যে , লোকেরা তাদের আসল নাম না জেনে বরং তার বন্ধু বলে জানতো। লোকেরা যখন তাদের কথা বলতো তখন প্রায়ই তাদের আসল নামের পরিবর্তে বলতো , রফিক অর্থাৎ বন্ধু।

জ্বী হ্যাঁ! লোকটি হযরত ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-এর বন্ধু হিসাবে খ্যাত ও পরিচিত ছিল। কিন্তু সেদিনও তারা অন্যান্য দিনের মতো একে-অপরের সাথেই ছিলেন। তারা উভয়ে এক সাথে একটি জুতা তৈরির দোকানে গেলেন। কেউ কি একথা বিশ্বাস করতে পারে যে ,এমন গভীর বন্ধুত্বঘন সমপর্কের লোকেরা বাজার থেকে বের হবার পর পরস্পর থেকে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ হয়ে যাবেন ?

সেদিনও সে বরাবরের ন্যায় ইমাম সাদিক (অঃ)-এর সাথে ছিল। তারা উভয়ে বাজারে প্রবেশ করলেন। তার সাথে তার কৃষাঙ্গ গোলামও ছিল। গোলাম তার মালিকের পিছে পিছে চলছিল । কিছু দূর চলার পর পেছনে ফিরে সে তাকিয়ে দেখে তার গোলাম নেই। আরও একটু সামনে চলার পর পিছনে ফিরে দেখলো গোলামকে দেখা যায় না। কিছুক্ষণ পর আবার মুখ ঘুরিয়ে দেখলো কিন্তু গোলামের হদীস নেই। মনে হচ্ছিল সে বাজারের খেল-তামাশা দেখার মধ্যে লিপ্ত হয়ে গেছে। আর তার মালিক ও মালিকের সাথীগণ অনেক আগে চলে গেছে। চতুর্থবার পিছনে ফিরে দেখে যে তার গোলাম হাজির। গোলামকে দেখেই সে ক্রোধে আক্রোশে বলে উঠলো :

হারামযাদা! এতক্ষণ কোথায় চলে গিয়েছিলি ?

বন্ধুর মুখ থেকে এমন অশ্রাব্য কথাটি শুনে ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ) আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন। ইমাম নিজের ললাটে হাত মেরে বললেন , সুবহানালাহ! তুমি তার মাকে গালি দিলে ? তুমি তার মাকে অবৈধ কর্মের সাথে সম্পৃক্ত করলে ? আমি তো এতদিন ভেবেছিলাম যে , তুমি একজন মোত্তাকী- পরহেযগার লোক। কিন্তু আজ তোমার প্রকৃত রূপ সামনে এসে গেছে। দেখা যাচ্ছে তোমার মধ্যে তাকওয়া পরহেযগারীর নাম-নিশানাও নেই।

বন্ধু বললো , হে রাসূলের (সাঃ) সন্তান! এ গোলামটি আসলে সিন্ধী। তার মাতাও সিন্ধী। আপনি তো জানেন যে , তারা মুসলমান নয়। আর গোলামের মা কোন মুসলমান নারী নয় যে , আমি তার উপর অবৈধ কাজের অপবাদ লাগিয়ে দিয়েছি।

ইমাম (আঃ) বললেন , তার মাতা কাফের ছিল একশ বার থাকুক। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই বিয়ে শাদীর একটা নিয়ম-কানুন ও বিশেষ প্রথা বর্তমান থাকে। যদি কোন জাতির লোক তার জাতীয় নিয়ম-নীত ও পন্থা অনুসরণ করে বিয়ে-শাদী করে , তাহলে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কোনদিন অবৈধ সম্পর্ক হবে না। আর তাদের সন্তানদেরকে হারামযাদা বা অবৈধ সন্তান হিসাবে গণ্য করা যাবে না।

ইমাম (আঃ) তাকে আরো বললেন , তুমি এ মুহূর্তে আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাও। আর কোনদিন আমার কাছেও আসবে না।

সেদিন থেকে কেউ হযরত ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-কে আর কোনদিন ঐ লোকটির সাথে চলতে দেখেনি। আজীবন তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘরে গেল।59

49

একটি গালি

ইরানের প্রখ্যাত লেখক ও পন্ডিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুকান্না। তার গোলাম নিজের মালিকের ঘোড়ার লাগাম ধরে বসরার গভর্ণর সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়া মাহলাবীর দরবারের সামনে বসেছিল। সে অপেক্ষায় ছিল তার মালিক কাজ সেরে দরবার থেকে বেরিয়ে আসবে ও ঘোড়ায় চড়ে নিজের বাড়ি ফিরবে।

সে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু ইবনে মুকান্নার বেরিয়ে আসার নাম নেই। অন্য লোকেরা যারা ইবনে মুকান্নার পরে গভর্ণরের দরবারে ঢুকেছে তারা সকলেই বেরিয়ে আসলো। কিন্তু ইবনে মুকান্নার কোন খবরও নেই। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর সে লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো । সকলেই না জানার কথা বলে নিজ নিজ পথে এগিয়ে যেতে থাকলো। গোলামের অস্থিরতা বেড়েই চললো। তাই সে গভর্ণরে দরবার থেকে বের হয়ে আসা সকল লোকদের কাছে স্বীয় মালিকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা শুরুকরলো। কেউ কেউ এ কথা বলে চলে যাচ্ছিল যে , আমি জানি না। অনেকে আবার গোলামের প্রশ্ন শুনে বিরক্তি ও বিরাগ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল।

এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো। অবশেষে গোলাম অধৈর্য ও নিরাশ হয়ে ঈসা ও সুলাইমানের নিকট গিয়ে হাজির হলো। ঈসা ও সুলাইমান ছিল আলী ইবনে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের পুত্রদ্বয় এবং খলিফা মুকতাদির মনসুর দেওয়ানিকীর চাচাদ্বয়। ইবনে মুকান্না তাদের মুন্সী ও লেখক ছিল। গোলাম তাদের কাছে সমস্তঘটনা খুলে বললো।

ঈসা ওলসা ইমান , আব্দুল্লাহ ইবনে মকান্নার মতো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিজ্ঞ লেখক ও দক্ষ অনুবাদকের প্রতি ছিল খুব শ্রদ্ধাশীল। তারা তার পৃষ্ঠপোষকও ছিল। এদিকে ইবনে মুকান্নাও তাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে দাপটের সাথে চলতো। প্রকৃতিগতভাবেই সে ছিল একজন কর্কশভাষী ও বেপরোয়া লোক। অন্যকে কথার তীর দ্বারা ঘায়েল করার ব্যাপারে সে কুণ্ঠিত হতো না। ক্ষমতাসীন খলিফার চাচা ঈসা ও সুলাইমানের পৃষ্ঠপোষকতা তাকে আরো অধিক কর্কশ ও খরখরে বানিয়ে তুলেছিল । যা হোক ঈসা ও সুলাইমান বসরার গভর্ণর সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়ার কাছে ইবনে মুকান্নাকে তলব করলো। জবাবে গভর্ণর বললো , ইবনে মুকান্নার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। সে আমার বাড়িতে আসেওনি। কিন্তু অনেক লোকই তাকে গভর্ণরে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেছে। সুতরাং প্রত্যক্ষদর্শীদের নিজের চোখে দেখা সাক্ষ্য প্রদানের পর গভর্ণরের আর এ অবকাশ রইলো না যে , সে এ সত্যটিকে অস্বীকার করতে পারে।

এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল না , বরং এটা ছিল একটা হত্যাকাণ্ড। তাও ইবনে মকান্নার মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের হত্যাকাণ্ড। নিঃসন্দেহে এটি একটি মারাত্মক ও গুরুতর ব্যাপার ছিল। শুধু তাই নয় , বরং এ ব্যাপারে একদিকে ছিল বসরার গভর্ণর। আর অপর দিকে ছিল ক্ষমতাসীন খলিফার চাচা। অবশেষে বাধ্য হয়ে ঘটনাটি বাগদাদে খলিফার দরবারে নিতে হলো। খলিফা উভয়পক্ষের সাক্ষ্য ও সাফাই পেশ করার জন্য লোকদেরকে তার দরবারে ডেকে পাঠালো। মামলাটি খলিফার দরবারে দায়ের করা হলো। অতঃপর সাক্ষীরা সব একে একে এসে খলিফার সামনে নিজেদের জবানবন্দী দিল। এরপর খলিফা মনসুর নিজের চাচাকে লক্ষ্য করে বললো , আমার জন্য এতে কোনো বাধা নেই যে , সুফিয়ানকে ইবনে মুকান্নার হত্যার অপরাধে কতল করবো। কিন্তু আপনাদের দুইজনের মধ্যে থেকে কে প্রস্তুত আছেন যে , এর দায়-দায়িত্ব নিবেন ? অর্থাৎ সুফিয়ানের কতল করে দেয়ার পরে যদি ইবনে মুকান্না জীবিত ও সুস্থভাবে দরবারে এসে হাজির হয় তাহলে তাকে সুফিয়ানের হত্যার বদলে কিসাস করব ? এমনও হতে পারে যে , ইবনে মুকান্না জীবিত রয়েছে এবং আমার পিছনের দরজা দিয়ে দরবারে এসে হাজির হবে।

ঈসা ও সুলাইমান খলিফার এ প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলতে পারলো না। অবাক হয়ে নিজেদের স্থানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারা মনে করলো যে , খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে , ইবনে মুকান্না জীবিত আছে। সুফিয়ান তাকে জীবিত অবস্থায়ই খলিফার দরবারে পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নিল এবং নিজের বাড়িতে চলে গেল। অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু ইবনে মুকান্নার কোনই সংবাদ পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে তার কথা ভুলে যেতে লাগলো।

দীর্ঘকাল পরে একদিন এ ঘটনার জট খুললো। জানা গেল যে , ইবনে মুকান্না সব সময় তার কথা দ্বারা সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়াকে নানা রকম আঘাত দিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং একদিন ইবনে মুকান্না অনেক অনেক লোকের সামনে সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়াকে তার মা তুলে গালি দিয়েছে। তারপর থেকে সে সব সময় এ সুযোগের অপেক্ষা করছিল যে , সে ইবনে মুকান্নার গালির কথার প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু সে খলিফার চাচা ঈসা ও সুলাইমানের ভয়ে তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছিল না। এ অবস্থায় ঘটনাটির অবতারণা ঘটলো :

ঘটনাটি ছিল এই , সিদ্ধান্তহলো যে , খলিফা মনসুরের অপর এক চাচা আব্দুল্লাহ ইবনে আলীর নামে নিরাপত্তা পত্র লেখা হবে এবং তা খলিফা মনসুরের কাছে পেশ করে এ নিরাপত্তা নামায় দস্তখত করার জন্য দাবি করা হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আলী তার ভাই ঈসা ও সুলাইমানের লেখক ইবনে মুকান্নার কাছে নিবেদন করলো যে , একটি নিরাপত্তানামা তৈরি করে দিতে হবে। ইবনে মুকান্না তার আবেদন গ্রহণ করলো এবং নিরাপত্তানামা তৈরি করলো। এ নিরাপত্তানামায় সে মনসুরের প্রতি নানা অশীল ও উদ্ধৃত ভাষা উল্লেখ করে। মনসুর এ নিরাপত্তা পত্রটি পাঠ করে সাংঘাতিকভাবে অসন্তুষ্ট হলো। সে জিজ্ঞাসা করলো , এ নিরাপত্তানামার মুসাবিদা কে তৈরি করেছে ? লোকেরা বললো , এ মুসাবিদা ইবনে মুকান্নার তৈরি। এরপর খলিফা মনসুরের অন্তরেও ইবনে মুকান্নার বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হলো। যেমনটি ছিল বসরার গভর্ণর সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়ার অন্তরে।

খলিফা মনসুর গভর্ণর সুফিয়ানকে গোপনে চিঠি লিখে পাঠালো ইবনে মুকান্নার খবর নিতে। সুতরাং সুফিয়ান সুযোগের সন্ধান করতে লাগলো। এভাবে একদিন ইবনে মুকান্না কোন এক প্রয়োজনে সুফিয়ানের বাড়ি পৌঁছলো। সে তার ঘোড়া ও গোলামকে গভর্নরের বাড়ির সামনেই রেখে এসে ছিল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখলো সুফিয়ান তার এক জল্লাদ প্রকৃতির গোলামকে নিয়ে এক কামরায় বসে আছে। আর তাদের সামনেই প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডলী। ইবনে মুকান্নাকে দেখেই সুফিয়ানের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সে ইবনে মুকান্নাকে জিজ্ঞাসা করলো , তোমার মনে আছে যে , তুমি অমুক দিন আমার মাকে তুলে গালি দিয়েছিলে ? এখন তার প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে। ইবনে মুকান্না ক্ষমা চাইলো। কিন্তু কোন ফল হলো না , বরং অত্যন্ত নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হলো।60

50

বাক্যবাণ

আলী ইবনে আব্বাস পরিচিত ছিলেন ইবনে রুমী নামে। তিনি ছিলেন তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর মাঝামাঝি আব্বাসীয় খেলাফতকালে একজন বিখ্যাত প্রশংসা ও ব্যঙ্গ ভাষী কবি। একদিন তিনি কাসেম ইবনে আব্দুল্লাহ আল মু তাজিদ আব্বাসী নামক মন্ত্রীর দরবারে বসে ছিলেন। তিনি তার বাক্যবাণ ও যুক্তিপূর্ণ বিশেষ বর্ণনা শক্তির ওপর সব সময় অহংকার বোধ করতেন। মু তাজিদ আব্বাসী তার বাক্যবাণ থেকে ভীতসন্ত্রস্তও অতিষ্ঠ ছিল। কিন্তু নিজের অসন্তুষ্টি ও তিক্ততা প্রকাশ করতো না বরং এর বিপরীতে অত্যন্ত সদ্ব্যবহার করতো। তার বাক্যবাণে আঘাত প্রাপ্ত হয়েও সে তার ভালো ব্যবহার ও খোশ আখলাক প্রদর্শনে কমতি করতো না বরং তার সাথে ওঠাবসা ও আলাপ- আলোচনা পরিত্যাগ করতো না। একবার কাসেম আল-মু তাজিদ আব্বাসী তার লোকদেরকে হুকুম দিল যে , ইবনে রুমীর খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দেয়া হোক। খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই ইবনে রুমী ব্যাপারটি টের পেয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি নিজের স্থান থেকে উঠে চলে যাচ্ছিলেন। কাসেম জিজ্ঞাসা করলো , কোথায় যাচ্ছো ?

-ইবনে রুমী বললেন , সেখানেই যাচ্ছি যেখানে তুমি আমাকে পাঠিয়েছো।

-তাহলে আমার বাবা মার কাছে আমার সালাম পৌঁছে দিও।

-জেনে রেখো! আমি জাহান্নামের পথে যাবো না।

এ কথাগুলো বলতে বলতে ইবনে রুমী নিজের বাড়ির দিকে চলে গেলেন। বাড়ি গিয়ে বিষক্রিয়া নিরসনের জন্য চিকিৎসা শুরু করলেন। কিন্তু কোন ফল হলো না। অবশেষে তিনি বাক্যবাণের গুণ-বৈশিষ্ট্য সাথে নিয়েই এ দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিলেন।61

51

দুই সহযোগী

হিশাম ইবনে হাকাম ও আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ আবাযীর আন্তরিকতাপূর্ণ বন্ধুত্ব ও নজিরবিহীন সহযোগিতা প্রত্যক্ষ করে কুফাবাসীরা অবাক হতো। লোকেরা এ দই জনের বন্ধুত্বকে দৃষ্টান্তহিসাবে পেশ করতো। তারা দুইজনে মিলে সেলাই সামগ্রীর একটি দোকান খুলেছিলেন। দু জনে মিলে মিশেই দোকান পরিচালনা করতেন। যতদিন তারা জীবিত ছিলেন কোনদিন তাদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ বা ঝগড়া-বিবাদ হয়নি।

তাদের এ গভীর বন্ধুত্বের কথা লোক সমাজে ছড়িয়ে পড়ার ও সমাদৃত হওয়ার সাথে সাথে এ ব্যাপারটা সকলের আশ্চর্য দৃষ্টি আকর্ষণ করার আসল যে কারণ ছিল সেটা হলো-ধর্মীয় আকিদা- বিশ্বাসের দিক থেকে এরা দুজনেই ছিলেন একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা দু জনেই নিজ নিজ মাযহাবের উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে পরিগণিত হতেন। তাদের মধ্যে হিশাম ছিলেন ইমামীয়া শিয়া মাযহাবের উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন একজন বিজ্ঞ আলেম। তিনি ছিলেন হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর একজন বিশেষ ঘনিষ্ঠ সাহাবী। পবিত্র আহলে বাইতের ইমামতে তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস ছিল। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াযীদ আবাযীয়া মতবাদের ওলামাদের অন্যতম বলে পরিগণিত। যেখানেই মাযহাবী আকীদা বিশ্বাসের প্রশ্ন দেখা দিত সেখানেই তারা একে অপরে বিপরীত মেরুতে দণ্ডায়মান হতেন। কিন্তু তারা তাদের মাযহাবী পক্ষপাতিত্বকে জীবনের অন্যান্য বিষয় থেকে পৃথক রাখতেন। আর অত্যন্ত ন্যায়-নীতিভিত্তিক সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ-কর্মগুলো আঞ্জাম দিতেন। একটা আশ্চর্য ব্যাপার এ ছিল যে , জনাব হিশামের অধিকাংশ শিয়া বন্ধু-বান্ধব সে দোকানে আসা- যাওয়া করতো আর তিনি তাদেরকে শিয়া মাযহাবের মৌলিক আকীদাও মাসআলা-মাসায়েল শিক্ষা দিতেন। আব্দুল্লাহ স্বীয় মাযহাব বিরোধী আকীদা-বিশ্বাসের কথাবার্তা শুনেও অসন্তুষ্ট হতেন না। অনুরূপভাবে হিশামের চোখের সামনে আব্দুল্লাহ তার বন্ধুদেরকে আবাযী মতবাদের শিক্ষা দিতেন যা শিয়া আকীদা মতের পরিপন্থী , কিন্তু হিশামের চেহারায় কখনও অসন্তুষ্টির ছাপ পরিলক্ষিত হয়নি।

একদিন আব্দুল্লাহ স্বীয় বন্ধু হিশামকে বললো , আমরা একজন আরেকজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী শরিকদার। আমি চাই যে , তুমি আমাকে তোমার জামাই বানিয়ে নাও। তোমার মেয়ে ফাতেমাকে আমার সাথে বিয়ে দাও।

জনাব হিশাম জবাবে শুধু একটি কথাই বললেন , ফাতিমা মু মিনাহ (ঈমানদার)।

আব্দুল্লাহ বন্ধুর এ জবাব শুনে চুপ হয়ে গেল। আর কোনদিন এ বিষয়ে কথাবাতা তোলেনি ।

এ ঘটনাও দুই বন্ধুর মধ্যে কোন ভাঙ্গন ধরাতে পারেনি। আগের মতোই তারা মিলে-মিশে ব্যবসা- বাণিজ্য চালিয়ে যেতে থাকেন। একমাত্র মৃত্যুই এমন একটি ব্যাপার ছিল যা এ বন্ধুদ্বয়কে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। তা না হলে মৃত্যুর পূর্ব মূহর্ত পর্যন্ত তারা একে অপরের থেকে অলাদা হননি এবং সারা জীবন এক সাথে কাজ-কর্ম করতে থাকেন।62

52

মদ্যপের হেদায়েত

আব্বাসীয় খলিফা মনসুরের নির্দেশে বাইতুলমালের দরজা খুলে দেয়া হলো। তা থেকে প্রত্যেককেই কিছু প্রদান করা হচ্ছিল। সাকরানী নামের এক লোকও বাইতুলমাল থেকে তার অংশ নেবার জন্যে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তাকে কেউ চিনতো না। এ জন্য সে বাইতুলমাল থেকে তার অংশ নিতে পারছিল না। সাকরানীর পূর্ব-পুরুষদের মধ্যে এক ব্যক্তি কৃতদাস ছিল যাকে মহানবী (সাঃ) আযাদ করে দিয়েছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে সেও আযাদ। লোকেরা তাকে মুওয়ালায়ে রাসূলাল্লাহ (সাঃ) অর্থাৎ রাসূলের আযাদকৃত হিসাবে জানতো। এটা সাকরানীর জন্য একটা গর্ব ও গৌরবের বিষয় ছিল , সে তার এ খ্যাতির কারণে নিজেকে রাসূলের (সাঃ) খানদানের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে প্রচার করতো।

যা হোক বাইতুলমাল থেকে নিজের অংশ পাওয়ার উদ্দেশ্যে সে এমন একজন লোকের সন্ধান করতে লাগলো-যে তাকে চিনে এবং এ কাজে তার সাহায্য এগিয়ে আসে। হঠাৎ সে দেখতে পেলো হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) কে। সে ইমামের নিকট গিয়ে নিজের আবেদন জানালো। ইমাম সাথে সাথেই তার অংশ এনে তাকে দিয়ে দিলেন। ইমাম (আঃ) তাকে তার প্রাপ্য দেবার সময় অত্যন্ত স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন , ভালো কাজ ভালোই। সেটা যে কেউ করুক না কেন! তোমাকে লোকেরা রাসূলের (সাঃ) বংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে জানে। এ জন্য তুমি যদি কোনো ভালো কাজ করো তাহলে তার সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি লাভ করে। অনরূপভাবে প্রতিটি মন্দ কাজই মন্দ। সেটা যে কেউ আঞ্জাম দিক না কেন। কিন্তু রাসূল বংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত থাকার কারণে তুমি যদি কোনো মন্দ কাজ করো তাহলে তার মন্দত্ব আরো বড় করে দেখা দেয়। এ কথাটা বলেই ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) সেখান থেকে চলে গেলেন।

ইমামের এ মায়াভরা কথাটি শুনে সাকরানীর বুঝতে দেরী হলো না যে , তার মদ পান করার গোপন ব্যাপারটি ইমাম অবগত হয়েছেন। ইমাম (আঃ) সব কিছু জেনেশুনেও তার সাথে এ অসাধারণ ভালোবাসা ও সুন্দর আচরণ এ জন্য করেছেন যে , সাকরানীকে তার দোষের বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করানো যেতে পারে। ইমামের কথায় সাকরানী খুবই লজ্জিত হলো এবং এ ভুলের জন্য নিজেকে অনেক ধিক্কার দিতে থাকলো।63