49
একটি গালি
ইরানের প্রখ্যাত লেখক ও পন্ডিত আব্দুল্লাহ ইবনে মুকান্না। তার গোলাম নিজের মালিকের ঘোড়ার লাগাম ধরে বসরার গভর্ণর সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়া মাহলাবীর দরবারের সামনে বসেছিল। সে অপেক্ষায় ছিল তার মালিক কাজ সেরে দরবার থেকে বেরিয়ে আসবে ও ঘোড়ায় চড়ে নিজের বাড়ি ফিরবে।
সে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু ইবনে মুকান্নার বেরিয়ে আসার নাম নেই। অন্য লোকেরা যারা ইবনে মুকান্নার পরে গভর্ণরের দরবারে ঢুকেছে তারা সকলেই বেরিয়ে আসলো। কিন্তু ইবনে মুকান্নার কোন খবরও নেই। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পর সে লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো । সকলেই না জানার কথা বলে নিজ নিজ পথে এগিয়ে যেতে থাকলো। গোলামের অস্থিরতা বেড়েই চললো। তাই সে গভর্ণরে দরবার থেকে বের হয়ে আসা সকল লোকদের কাছে স্বীয় মালিকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা শুরুকরলো। কেউ কেউ এ কথা বলে চলে যাচ্ছিল যে , আমি জানি না। অনেকে আবার গোলামের প্রশ্ন শুনে বিরক্তি ও বিরাগ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল।
এভাবে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলো। অবশেষে গোলাম অধৈর্য ও নিরাশ হয়ে ঈসা ও সুলাইমানের নিকট গিয়ে হাজির হলো। ঈসা ও সুলাইমান ছিল আলী ইবনে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের পুত্রদ্বয় এবং খলিফা মুকতাদির মনসুর দেওয়ানিকীর চাচাদ্বয়। ইবনে মুকান্না তাদের মুন্সী ও লেখক ছিল। গোলাম তাদের কাছে সমস্তঘটনা খুলে বললো।
ঈসা ওলসা ইমান , আব্দুল্লাহ ইবনে মকান্নার মতো উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন বিজ্ঞ লেখক ও দক্ষ অনুবাদকের প্রতি ছিল খুব শ্রদ্ধাশীল। তারা তার পৃষ্ঠপোষকও ছিল। এদিকে ইবনে মুকান্নাও তাদের সমর্থনপুষ্ট হয়ে দাপটের সাথে চলতো। প্রকৃতিগতভাবেই সে ছিল একজন কর্কশভাষী ও বেপরোয়া লোক। অন্যকে কথার তীর দ্বারা ঘায়েল করার ব্যাপারে সে কুণ্ঠিত হতো না। ক্ষমতাসীন খলিফার চাচা ঈসা ও সুলাইমানের পৃষ্ঠপোষকতা তাকে আরো অধিক কর্কশ ও খরখরে বানিয়ে তুলেছিল । যা হোক ঈসা ও সুলাইমান বসরার গভর্ণর সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়ার কাছে ইবনে মুকান্নাকে তলব করলো। জবাবে গভর্ণর বললো , ইবনে মুকান্নার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। সে আমার বাড়িতে আসেওনি। কিন্তু অনেক লোকই তাকে গভর্ণরে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখেছে। সুতরাং প্রত্যক্ষদর্শীদের নিজের চোখে দেখা সাক্ষ্য প্রদানের পর গভর্ণরের আর এ অবকাশ রইলো না যে , সে এ সত্যটিকে অস্বীকার করতে পারে।
এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল না , বরং এটা ছিল একটা হত্যাকাণ্ড। তাও ইবনে মকান্নার মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের হত্যাকাণ্ড। নিঃসন্দেহে এটি একটি মারাত্মক ও গুরুতর ব্যাপার ছিল। শুধু তাই নয় , বরং এ ব্যাপারে একদিকে ছিল বসরার গভর্ণর। আর অপর দিকে ছিল ক্ষমতাসীন খলিফার চাচা। অবশেষে বাধ্য হয়ে ঘটনাটি বাগদাদে খলিফার দরবারে নিতে হলো। খলিফা উভয়পক্ষের সাক্ষ্য ও সাফাই পেশ করার জন্য লোকদেরকে তার দরবারে ডেকে পাঠালো। মামলাটি খলিফার দরবারে দায়ের করা হলো। অতঃপর সাক্ষীরা সব একে একে এসে খলিফার সামনে নিজেদের জবানবন্দী দিল। এরপর খলিফা মনসুর নিজের চাচাকে লক্ষ্য করে বললো , আমার জন্য এতে কোনো বাধা নেই যে , সুফিয়ানকে ইবনে মুকান্নার হত্যার অপরাধে কতল করবো। কিন্তু আপনাদের দুইজনের মধ্যে থেকে কে প্রস্তুত আছেন যে , এর দায়-দায়িত্ব নিবেন ? অর্থাৎ সুফিয়ানের কতল করে দেয়ার পরে যদি ইবনে মুকান্না জীবিত ও সুস্থভাবে দরবারে এসে হাজির হয় তাহলে তাকে সুফিয়ানের হত্যার বদলে কিসাস করব ? এমনও হতে পারে যে , ইবনে মুকান্না জীবিত রয়েছে এবং আমার পিছনের দরজা দিয়ে দরবারে এসে হাজির হবে।
ঈসা ও সুলাইমান খলিফার এ প্রশ্নের জবাবে কিছুই বলতে পারলো না। অবাক হয়ে নিজেদের স্থানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারা মনে করলো যে , খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে , ইবনে মুকান্না জীবিত আছে। সুফিয়ান তাকে জীবিত অবস্থায়ই খলিফার দরবারে পাঠিয়ে দিয়েছে। অবশেষে তারা বাধ্য হয়ে তাদের মামলা প্রত্যাহার করে নিল এবং নিজের বাড়িতে চলে গেল। অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেল কিন্তু ইবনে মুকান্নার কোনই সংবাদ পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে তার কথা ভুলে যেতে লাগলো।
দীর্ঘকাল পরে একদিন এ ঘটনার জট খুললো। জানা গেল যে , ইবনে মুকান্না সব সময় তার কথা দ্বারা সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়াকে নানা রকম আঘাত দিয়েছে। শুধু তাই নয় বরং একদিন ইবনে মুকান্না অনেক অনেক লোকের সামনে সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়াকে তার মা তুলে গালি দিয়েছে। তারপর থেকে সে সব সময় এ সুযোগের অপেক্ষা করছিল যে , সে ইবনে মুকান্নার গালির কথার প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু সে খলিফার চাচা ঈসা ও সুলাইমানের ভয়ে তার বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছিল না। এ অবস্থায় ঘটনাটির অবতারণা ঘটলো :
ঘটনাটি ছিল এই , সিদ্ধান্তহলো যে , খলিফা মনসুরের অপর এক চাচা আব্দুল্লাহ ইবনে আলীর নামে নিরাপত্তা পত্র লেখা হবে এবং তা খলিফা মনসুরের কাছে পেশ করে এ নিরাপত্তা নামায় দস্তখত করার জন্য দাবি করা হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে আলী তার ভাই ঈসা ও সুলাইমানের লেখক ইবনে মুকান্নার কাছে নিবেদন করলো যে , একটি নিরাপত্তানামা তৈরি করে দিতে হবে। ইবনে মুকান্না তার আবেদন গ্রহণ করলো এবং নিরাপত্তানামা তৈরি করলো। এ নিরাপত্তানামায় সে মনসুরের প্রতি নানা অশীল ও উদ্ধৃত ভাষা উল্লেখ করে। মনসুর এ নিরাপত্তা পত্রটি পাঠ করে সাংঘাতিকভাবে অসন্তুষ্ট হলো। সে জিজ্ঞাসা করলো , এ নিরাপত্তানামার মুসাবিদা কে তৈরি করেছে ? লোকেরা বললো , এ মুসাবিদা ইবনে মুকান্নার তৈরি। এরপর খলিফা মনসুরের অন্তরেও ইবনে মুকান্নার বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হলো। যেমনটি ছিল বসরার গভর্ণর সুফিয়ান ইবনে মুআবিয়ার অন্তরে।
খলিফা মনসুর গভর্ণর সুফিয়ানকে গোপনে চিঠি লিখে পাঠালো ইবনে মুকান্নার খবর নিতে। সুতরাং সুফিয়ান সুযোগের সন্ধান করতে লাগলো। এভাবে একদিন ইবনে মুকান্না কোন এক প্রয়োজনে সুফিয়ানের বাড়ি পৌঁছলো। সে তার ঘোড়া ও গোলামকে গভর্নরের বাড়ির সামনেই রেখে এসে ছিল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দেখলো সুফিয়ান তার এক জল্লাদ প্রকৃতির গোলামকে নিয়ে এক কামরায় বসে আছে। আর তাদের সামনেই প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডলী। ইবনে মুকান্নাকে দেখেই সুফিয়ানের অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। সে ইবনে মুকান্নাকে জিজ্ঞাসা করলো , তোমার মনে আছে যে , তুমি অমুক দিন আমার মাকে তুলে গালি দিয়েছিলে ? এখন তার প্রতিশোধ নেবার সময় এসেছে। ইবনে মুকান্না ক্ষমা চাইলো। কিন্তু কোন ফল হলো না , বরং অত্যন্ত নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হলো।