55
হাবাশার মোহাজিরগণ
মক্কা নগরীতে মুসলমানদের সংখ্যা প্রতি বছর প্রতি মাসে বেড়েই চলছিল। কাফের মুশরিকদের নানা রকম অত্যাচার-নিপীড়ন ইসলামে অনুপ্রাণিত লোকদেরকে ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হওয়া থেকে রুখতে পারছিল না। তারা সম্ভাব্য সব রকম চেষ্টা সাধনা করেছে লোকদেরকে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করার জন্য। কিন্তু তাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। বরং বন্যার পাবনের মতো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের লোক দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে চলছিল । চরম জুলুম- নির্যাতনও তাদেরকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। দিনের পর দিন ইসলামের এ ক্রমোন্নতি কোরাইশ কাফেরদের নিকট একেবারে অসহ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইসলামের এ অসাধারণ জনপ্রিয়তায় তাদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ ক্রমেই বেড়ে চলছিল। তাই তারা মুসলমানদের উপর তাদের নির্যাতন ও নিপীড়নের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
মুসলমানদের জীবন যাপন করা ছিল তখন এক কঠিন ব্যাপার। কিন্তু শত অত্যাচারের মুখে ধৈর্য ধারণ করে থাকা ব্যতীত আর কোন উপায় ছিল না তাদের সামনে। আল্লাহর নবী (সাঃ) কোরাইশ কাফেরদের নিপীড়ন থেকে মুসলমানদেরকে সাময়িকভাবে রক্ষা করার জন্য তাদের সামনে একটি প্রস্তাব রাখলেন। প্রস্তাবটি হলো এই যে , তারা আপাতত মক্কা থেকে হিজরত করে হাবাশা চলে যাবে। এ পর্যায়ে তিনি তাদেরকে বললেন , হাবাশার বাদশা একজন ন্যায়পরায়ণ লোক। কাজেই তোমরা তার রাজ্যে কিছুদিন পর্যন্তনিরাপদ ও নিশ্চিতভাবে বসবাস করতে পারো। আল্লাহ চাহেন তো খুব শীঘ্রই সমস্ত মুসলমানের জন্য পরিবেশ অনুকূলে চলে আসবে।
অবশেষে অনেক মুসলমানই মক্কা থেকে হিজরত করে হাবাশার দিকে চলে গেলেন। সেখানে তারা খুব আরামে নিশ্চিন্তভাবে দিন যাপন করতে লাগলেন। মক্কায় তারা ধর্মীয় কাজ-কর্মগুলো স্বাধীনভাবে আদায় করতে পারছিলেন না। কিন্তু হাবাশায় তাদের সব রকমের স্বাধীনতা ছিল। তাই তারা মুক্তভাবে ইসলামের করণীয় কাজগুলো আঞ্জাম দিতে থাকলেন।
কিছুদিন পরেই মক্কার কোরাইশ কাফেররা সংবাদ পেলো যে , মক্কা থেকে হিজরত করে গিয়ে মুসলমানরা হাবাশায় খুব আরামে জীবন যাপন করছেন। তারা চিন্তায় পড়ে গেল , আবার হাবাশায় ইসলামী বিপ্লব সাধিত না হয়ে যায়। তাই তারা সকলে মিলে পরামর্শ করলো যে , এমন একটি কৌশল বের করতে হবে যাতে করে সমস্ত মুসলমান মক্কায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তারপর তাদেরকে আবার জুলুম-নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হবে। এ উদ্দেশ্যে তারা দুইজন চালাক ও বুদ্ধিমান লোক মনোনীত করলো। তাদের সাথে হাবাশার বাদশা নাজ্জাশীর জন্য বহু মূল্যবান উপহার-উপঢৌকন পাঠিয়ে দিল। যাতে করে তারা বাদশাহ ও তার সভাসদদের সাথে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারে। যাবার সময় তাদের দুইজনকে বলে দেয়া হলো যে , হাবাশা পৌঁছে সর্বপ্রথম সে সমস্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করবে , যাদের কথায় বাদশাহ প্রভাবান্বিত হন। কর্মকর্তাদেরকে উপহার সামগ্রী প্রদানের পর তাদেরকে বলবে যে , আমাদের দেশের কিছু অজ্ঞ- মুর্খ ও অনভিজ্ঞ যুবক নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করেছে। আর তারা আপনাদের ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা নিজেদের দেশ ত্যাগ করে আপনাদের দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এখন আমাদের দেশের নেতা ও সরদারগণ আমাদেরকে আপনাদের খেদমতে পাঠিয়েছেন। আমাদের আবেদন হচ্ছে যে , আপনারা সে সব যুবককে আপনাদের দেশ থেকে বের করে দিন। তাদেরকে আমাদের হাতে তুলে দিন। অতএব আপনাদের নিকট বিনীত নিবেদন হচ্ছে যে , যখন আমরা এ ব্যাপারটি মহামান্য বাদশাহর নিকট উত্থাপন করবো তখন আপনারা আমাদের পক্ষে সুপারিশ।
অবশেষে কুরাইশদের দূতরা হাবাশায় পৌঁছে গেল এবং সর্বপ্রথম প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাত করলো। তাদের খেদমতে মূল্যবান উপঢৌকন পেশ করার পর নিজেদের আবেদন-নিবেদন তুলে ধরলো। তারা সকলে প্রতিশ্রুতি দিল যে , তারা বাদশাহর সামনে এদের বক্তব্যের সমর্থন করবে।
তারপর একদিন তারা বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে হাজির হলো। অতি উত্তম ও মূল্যবান উপঢৌকন পেশ করে তারা বাদশাহর কাছে নিজেদের আবেদন-নিবেদন তুলে ধরলো ।
কথাবার্তা যেহেতু পূর্বেই চূড়ান্ত হয়েছিল। তাই রাজ দরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সকলেই কোরাইশিদের প্রতিনিধিদের সহযোগিতা-সমর্থন দিতে লাগলো। তারা সকলেই সম্মিলিতভাবে বাদশাহকে পরামর্শ দিল যে , ঐ মুসলমানদেরকে বের করে দেয়ার নির্দেশ খুব তাড়াতাড়ি জারি করা উচিত এবং তাদেরকে কুরাইশ প্রতিনিধিবৃন্দের হাতে তুলে দেয়া উচিত।
কিন্তু বাদশাহ নাজ্জাশী সভাসদদের মতামতের সাথে মোটেও একমত হলেন না। তিনি বললেন , কিছু সংখ্যক লোক নিজের দেশ ত্যাগ করে আমাদের দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এটা কিছুতেই সমুচিত হবে না যে , আমি ব্যাপারটি তদন্ত না করে তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে হুকুম জারী করে পাঠাবো যে , তাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হোক। আমি অত্যন্ত জরুরী মনে করছি যে , তাদেরকে দরবারে ডাকা হোক। যাতে আমি তাদের বক্তব্য শুনতে পারি এবং তারপর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি যে , তাদেরকে কি করা উচিত।
বাদশাহ নাজ্জাশীর সর্বশেষ কথাটি শুনেই কোরাইশ প্রতিনিধিদের চেহারার রং বদলে গেল এবং তাদের অন্তরের স্পন্দনও বেড়ে গেল। তারা চাচ্ছিল না যে , মুসলমানদেরকে বাদশাহর দরবারে কথাবার্তা বলার সুযোগ দেয়া হোক। তাই তারা শ্রেয় মনে করলো , মসলমানদেরকে চাই ফেরত না দেয়া হোক , কিন্তু তাদেরকে দরবারে আসার সুযোগ যেন দেয়া না হয়। কেননা এ নতুন মতবাদের মধ্যে যে সৌন্দর্য নিহিত আছে সেটা হলো তাদের কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনার সৌন্দর্য। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর বক্তব্য হচ্ছে যে , মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর ওয়াহী বা প্রত্যাদেশ নাযিল হয়েছে। তারা যাদুমাখা কথাগুলোতে কি যে আকর্ষণ লুকায়িত রয়েছে ? কে জানে এখন কি হবে ? হতে পারে তারা এখন দরবারে এসে সে সমস্তবাণী বলতে আরম্ভ করবে যা তারা মুহাম্মদের কাছ থেকে শুনেছে। আর তাদের সে সমস্তকথা মুখস্থও আছে। তাদের বাণীগুলো শাহী দরবারে সে রকমই প্রভাব বিস্তার করে বসবে যেমন মক্কাবাসীদের উপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। কিন্তু এখন কি করা যেতে পারে ? পরিস্থিতি হাত ছাড়া হয়ে গেছে। যা হোক , বাদশাহ হুকমু জারী করে পাঠালেন যে , হাবাশায় আশ্রয় গ্রহণকারী সে সব যুবকদেরকে অমুক সময়ে দরবারে হাজির করা হোক।
এদিকে মুসলমানরা আগেই জানতে পেরেছেন যে , কোরাইশের প্রতিনিধিরা এসে বাদশাহর দরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করেছে। এ প্রতিনিধি দলের হাবাশা আগমনের আসল উদ্দেশ্যে তাদের জানা ছিল। মোদ্দা কথা তারাও এ ব্যাপারে অস্থির ছিলেন। বার বার এ চিন্তাই করছিলেন যে , যদি তারা তাদের উদ্দেশ্যে সফলকাম হয়ে যায় তাহলে আমাদেরকে হাবাশা থেকে বের করে দেয়া হবে। আর আমরা আবার মক্কায় ফিরে যেতে বাধ্য হবো।
একদিন বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারের এক সিপাহী তাদের কাছে এলো এবং বাদশাহর ফরমান তাদেরকে দিয়ে বললো , আপনাদেরকে অমুক তারিখে শাহী দরবারে উপস্থিত হতে হবে। বাদশাহর এ হুকুম তাদের জন্য একটা সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি করলো। তারা ভাবতে লাগলেন যে , আমাদেরকে আবার মক্কায় গিয়ে সে জুলুম-নির্যাতনেরই সম্মুখীন হতে হবে। তাই সকলে মিলে পরামর্শ করতে লাগলেন যে , বাদশাহর দরবারে গিয়ে কি বলা হবে ? সকলেই সম্মিলিতভাবে এ মত প্রকাশ করলেন যে , বাদশাহর দরবারে সত্য ঘটনা ব্যতীত অন্য কিছু বলা যাবে না। অর্থাৎ প্রথমে জাহেলি যুগের হাল অবস্থার উপর আলোকপাত করা হবে। তারপর ইসলামের সত্যতা , এর হুকুম-আহকাম ও ইসলামের উদাত্ত আহবানে নিহিত আধ্যাত্মিক আকর্ষণের কথা উল্লেখ করা হবে। অসত্য কোন কথাই বলা যাবে না। আর কোন সত্যকে গোপনও রাখা যাবে না।
তারা এ সিদ্ধান্তও মনোবল নিয়ে বাদশাহর দরবারে উপস্থিত হলেন। যেহেতু একটি নতুন ধর্মের অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণের ব্যাপার ছিল। তাই বাদশাহ নাজ্জাশী তার দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম খ্রিস্টবাদের প্রখ্যাত আলেমদেরকেও ডেকে দরবারে উপস্থিত রেখেছিলেন। খ্রিস্টধর্মের সে ওলামাদের সম্মুখে বড় বড় কিতাব রাখা ছিল। দরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট ছিল। শাহী শান- শওকতের মাঝে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন খ্রিস্টান ওলামাদের উপস্থিতি দরবারকে আরো জৌলুসময় করে তুলেছে। বাদশাহ স্বয়ং অনুষ্ঠানের সভাপতির আসন অলংকৃত করেছেন। অন্য সমস্তলোক নিজ নিজ আসনে বসে আছে।
ইসলামের অকৃত্রিম বিশ্বাস ও পরিপূর্ণ আস্থা মুসলমানদেরকে একটা বিশেষ দৃঢ়তা ও দুর্জয় মনোবল দান করে রেখেছিল। সুতরাং তারা কোন প্রকার হীন অনুভূতির শিকারে পরিণত হননি বরং অত্যন্ত নির্ভীক-নিশ্চিন্তমনে দীপ্ত মনোবল সহকারে এ বিশেষ জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে গিয়ে হাজির হলেন। জাফর ইবনে আবী তালিব সর্বাগ্রে দরবারে প্রবেশ করলেন। অন্য সকল মুসলমান তার পিছনে একের পর এক দরবারে প্রবেশ করতে থাকলেন। তারা যখন দরবারে প্রবেশ করছিলেন তখন তারা তাদের চাল-চলনে ও ভাব-ভঙ্গিমায় এমন একটি ভাবের অবতারণা করছিলেন যে , মনে হলো যেন দরবারের এ ঐতিহাসিক আড়ম্বর ও অসাধারণ সাজসজ্জা তাদের মধ্যে কোনই ভয়-ভীতির সঞ্চার করেনি। এর সাথে সাথে তারা শাহী দরবারে প্রবেশের প্রচলিত আদব-কায়দা অবলম্বন করেননি। সাধারণ লোকেরা রাজ-দরবারে প্রবেশ করার সময় নিজের হীনতা প্রকাশ করার জন্য দরবারের মেঝে চুম্বন করে থাকে। কিন্তু মুসলমানরা একেবারেই সহজ-সরলভাবে দরবারে প্রবেশ করে গেলেন এবং ইসলামী নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে বাদশাহকে সালাম জ্ঞাপন করলেন।
মুসলমানদের এহেন আচরণকে কেউ কেউ রাজ দরবারের প্রতি অবমাননাকর অভিহিত করে অভিযোগ উত্থাপন করলো। এর জবাবে তারা বললেন , যে দ্বীনের জন্য আমরা মাতৃভূমি ত্যাগ করে এ দেশে আশ্রয় গহণ করেছি , আমাদের সে দ্বীন কখনও আমাদেরকে অনুমতি দেয় না যে , লা-শারীক এক খোদা ব্যতীত আর কারো সামনে মাথানত করে হীনতা-নিচুতার প্রকাশ করতে।
মুসলমানদের এ জবাবে শাহী দরবারে সমাগত লোকদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করলো। আর মুসলমানদের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও অসামান্য শ্রেষ্ঠত্বের সামনে শাহী দরবারের বাহ্যিক জাঁকজমক ও যাবতীয় সাজসজ্জা ম্লান হয়ে গেল।
এবার স্বয়ং বাদশাহ নাজ্জাশী মুমলমানদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমাদের সে নতুন ধর্মটি কি যা আমাদের ধর্ম ও তোমাদের পুরাতন ধর্ম অপেক্ষা অধিক উত্তম এবং ভিন্নতর ?
হাবাশার বাদশাহ নাজ্জাশীর রাজ দরবারে মুসলমানদের এ দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমীরুল মু’
মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর ভাই জনাব জাফর ইবনে আবী তালিব। আগেই সিদ্ধান্তগৃহীত হয়েছিল যে , শাহী দরবারের প্রশ্নের জবাব তিনিই দেবেন।
জনাব জা’
ফর তাইয়্যার বাদশাহর প্রশ্নের জবাবে বললেন , আসলে আমরা অজ্ঞতা ও মুর্খতার জীবন যাপন করছিলাম। আমরা মূর্তি পূজা করতাম। মৃত প্রাণী খেতাম। অশ্লীল কর্মকাণ্ড ছিল আমাদের কর্মধারা। প্রতিবেশীর সাথে আমরা করতাম দুর্ব্যবহার। আমাদেরকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য মহান আল্লাহ আমাদের মাঝে একজন নবী পাঠিয়েছেন। যার পাক-পবিত্রতা ও বংশীয় মর্যাদা সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। খোদার সে রাসূল আমাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসের আহবান জানিয়েছেন এবং এক খোদারই ইবাদত-বন্দেগী করার শিক্ষা দিয়েছেন। মূর্তি , পাথর , গাছপালা ইত্যাদির পূজা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদেরকে সত্য কথা বলার হুকুম করেছেন। লোকদের আমানত পরিশোধ করার এবং প্রতিবেশীর সাথে ভালো ব্যবহার করার শিক্ষা দান করেছেন। তার কাছে আমরা শিক্ষা লাভ করেছি লোকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের পন্থা। আল্লাহর এ রাসূল আমাদেরকে মিথ্যা কথা বলতে , পাক-পবিত্র নারীদের অপবাদ দিতে এবং অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি আমাদেরকে হুকুম করেছেন যে , ইবাদত-বন্দেগীতে এক আল্লাহর সাথে আর কাউকে অংশীদার না বানাতে। আল্লাহর এ পয়গাম্বরই আমাদেরকে নামায , রোযা , হজ্ব , যাকাত ইত্যাদির শিক্ষা দিয়েছেন। সুতরাং আমরা তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং তার রেসালতের সাক্ষ্য প্রদান করেছি। আমরা ইসলামের এ মহান অনুশাসনগুলোর ও এর গুরুত্বপূর্ণ মহামূল্যবান শিক্ষাগুলোর অনুশীলন শুরুকরেছি। কিন্তু আমাদের জাতির একদল লোক আমাদের এ ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আপত্তি করেছে এবং আমাদের উপর নানা রকম বিপদ-মুছিবত ও জুলুম-অত্যাচার চাপিয়ে দিয়েছে। যা আগাগোড়া অন্যায়-অবিচার ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা পুনরায় মূর্তি পূজা ও অন্যান্য খারাপ কর্মকান্ডে প্রত্যাবর্তন করতে প্রকাশ্যে অস্বীকার করেছি। আমাদের প্রত্যাবর্তন অস্বীকার করার কারণে আমাদের জাতির লোকেরা আমাদের উপর অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের সীমাহীন জুলুম-নির্যাতনে অতীষ্ট হয়ে আমরা মাতৃভূমি ত্যাগ করে আপনাদের দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছি।
হযরত জা’
ফর ইবনে আবী তালিবের বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথেই বাদশাহ নাজ্জাশী বললেন , যে কথাগুলোকে তোমাদের নবী ঐশী বাণী বলে প্রচার করেন এবং বলেন যে , এ বাণীগুলো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে , তার কোনো কথা কি তোমাদের স্মরণ আছে ?
জনাব জা’
ফর বিন আবু তালিব বললেন , জ্বী হ্যাঁ!
বাদশাহ নাজ্জাশী বললেন , তাহলে কিছু অংশ পাঠ করে শোনাও।
জনাব জাফর তাইয়্যার দরবারের তাক লেগে থাকা পরিবেশের দিকে একবার তাকালেন। সমগ্র দরবার খ্রিস্ট ধর্মমতে বিশ্বাসীদের দ্বারা পরিপূর্ণ। বাদশাহ নিজেও খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী। অনুষ্ঠানের পুরোভাগে উপবিষ্ট বড় বড় পাদ্রীবৃন্দ। তাদের সামনে পবিত্র ইঞ্জিল কিতাব রাখা। সুতরাং পরিস্থিতি- পরিবেশের আলোকে তিনি সূরা মরিয়াম তিলাওয়াত শুরুকরলেন। পবিত্র সূরার সে সমস্তআয়াতই তিনি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে পাঠ করতে লাগলেন , যে আয়াতগুলো হযরত ঈসা , মারিয়াম , ইয়াহইয়া ও যাকারিয়া (আঃ)-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। হযরত জা’
ফর ক্বিরাআতের বিশেষ ভঙ্গিতে এ কোরআন তিলাওয়াত শাহী দরবারে সমবেত সকলের উপর একটা অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করে। তার উদ্দেশ্য ছিল কোরআনের এ আয়াতগুলো তিলাওয়াতের মাধ্যমে হযরত ঈসা ও মরিয়াম (আঃ) সম্পর্কে আল- কোরআনের বিশুদ্ধ ও মধ্যম নীতির বক্তব্যটি খ্রিস্টানদের সামনে তুলে ধরা। আর তিনি আরও বুঝাতে চাইলেন যে , পবিত্র কোরআন হযরত ঈসা ও মারিয়াম (আঃ) কে অত্যন্তপাক-পবিত্র বলে ঘোষণা করে। সাথে সাথে তাদেরকে আল্লাহর অংশীদারিত্ব থেকে অনেক দূরে বলে সাব্যস্তকরে। কোরআনের এ আয়াতগুলো পাঠ করার সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলে গেল এবং সকলের চোখ থেকে অশ্রুপ্রবাহিত হতে লাগলো।
বাদশাহ নাজ্জাশী বললেন , খোদার কসম! হযরত ঈসা (আঃ) যে সত্যের আলোচনা করেছিলেন তা এগুলোই। হযরত ঈসা (আঃ)-এর কথাবার্তা ও আল-কোরআনের বাণীসমূহের ভিত্তি একই।
অতঃপর বাদশাহ নাজ্জাশী কোরাইশের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বললেন , তোমরা সোজা নিজেদের দেশে ফিরে যাও। আর তোমরা যে উপঢৌকন সামগ্রী নিয়ে এসেছো সেগুলোও ফিরিয়ে নিয়ে যেয়ো।
এর অল্প কিছুদিন পরেই বাদশাহ নাজ্জাশী ইসলাম কবল করে মসলমান হয়ে গেলেন। তিনি নবম হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। রাসূল (সাঃ) সুদূর মদীনা থেকেই তার জানাযার নামাজ পড়েন।