64
সাধারণের খ্যাতি
বহু দিন থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ব্যক্তি খুব জনপ্রিয়। সকলের মুখে মুখে তার নাম আলোচিত। চারদিকে তার তাকওয়া , পরহেযগারী ও ঈমানদারীর চর্চা হতো। সর্বত্র লোকেরা তার উন্নত চরিত্র ও শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা গেয়ে বেড়াতো। অনেক সময় হযরত ইমাম জা’
ফর সাদিক (আঃ)- এর সামনেও লোকেরা তার তাকওয়া-পরহেযগারী ও সৎ চরিত্রের কথা আলোচনা করেছে। তাই ইমাম (আঃ)-এর চিন্তা হলো এমন একজন খোদাভক্ত লোককে সবার অলক্ষ্যে নিজের চোখে দেখা দরকার। যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এতো বিরাট জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে। প্রত্যেক মানুষই তাকে অত্যন্তসম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
একদিন হযরত ইমাম জা’
ফর সাদিক (আঃ) একজন অপরিচিত লোকের মতো সে ব্যক্তির কাছে গেলেন। দেখতে পেলেন তার আশপাশে তার ভক্তবৃন্দ ভিড় জমিয়ে বসে আছে। তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ-জাহেল। ইমাম (আঃ) নিজের পরিচয় না দিয়ে চুপচাপ বসে বসে সব কিছু অবলোকন করতে লাগলেন। প্রথম দর্শনেই ইমামের বুঝতে দেরী হলো না যে , সে লোকদের সাথে ধোঁকার নীতি অবলম্বন করে লোকদেরকে আকৃষ্ট করে রেখেছে। একবার সে লোকদের ভিড় থেকে বেরিয়ে পড়লো এবং এক সড়ক পথে এগিয়ে যেতে লাগলো। ইমামও তার পিছে পিছে যাচ্ছিলেন যাতে করে দেখতে পারেন যে , সে কোথায় যায় এবং কি করে ? এমন কোন্ কাজটি করে , যার কারণে লোকেরা তার প্রতি এত আসক্ত হয়ে গেছে ?
কিছু দূর চলার পর সে একটি রুটির দোকানের সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেল। একটি দৃশ্য দেখে ইমাম অবাক হয়ে গেলেন যে , লোকটি দোকানদারের অগোচরে দুটি রুটি নিয়ে নিজের কাপড়ের নিচে গোপন করে ফেললো। এরপর সে আরো সামনে এগুতে লাগলো। ইমাম ভাবলেন হতে পারে এ রুটিগুলো সে খরিদ করার উদ্দেশ্যেই নিয়েছে। এর দাম হয়তো আগেই পরিশোধ করে দিয়েছে অথবা পরে পরিশোধ করবে। কিন্তু এমনটিই যদি হবে তাহলে দোকানদারের দৃষ্টির আড়ালে রুটিগুলো তুলে নেবে কেন ? আর দোকানিকে কিছু না বলেই সামনে চলে যাবে কেন ?
সে যাই হোক , ইমাম (আঃ) তার পিছে পিছে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি রুটির দোকানের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। ঠিক এমনি সময় সে লোকটি একটি ফলের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানদারের চোখ একটু আড়াল হতেই সে খপ করে দুটি ডালিম নিজের কাপড়ের নিচে লুকিয়ে ফেললো। এরপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এটা দেখে ইমাম আরো অবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু ইমামের আশ্চর্য হওয়ার সীমানা তখন ছাড়িয়ে গেল যখন তিনি দেখলেন যে , লোকটি সে রুটিগুলো ও ডালিমগুলো একজন রুগীকে দান করে দিল। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর ইমাম তার সামনে এসে তাকে বললেন , আজ আমি তোমাকে আশ্চর্য ধরনের কিছু কাজ করতে দেখলাম। এরপর ইমাম প্রথম থেকে শেষ পর্যন্তঘটনাগুলো বর্ণনা করলেন। অতঃপর তার কাছে এ অবৈধ কর্ম-কাণ্ডগুলোর ব্যাখ্যা চাইলেন। সে ইমামকে নিরীক্ষণ করলো এবং বললো , আমার মনে হয় আপনি জা’
ফর ইবনে মুহাম্মাদ (আঃ)।
জবাবে ইমাম বললেন , হ্যাঁ , তোমার ধারণা সত্য। আমি জা’
ফর ইবনে মুহাম্মাদ।
লোকটি বললো , নিঃসন্দেহে আপনি রাসূলে পাক (সাঃ)-এর সন্তান এবং খান্দানী মর্যাদার দিক থেকে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু আমার আফসোস হয় যে , আপনি একজন অজ্ঞ জাহেল।
ইমাম (আঃ) বললেন , তুমি আমার মধ্যে কি অজ্ঞতা-মূর্খতা দেখতে পেলে ?
লোকটি বললো , আপনার এ প্রশ্নটিই মুর্খতা বৈ কিছু নয়। মনে হচ্ছে আপনি দ্বীনের সহজ-সরল হিসাবটাও জানেন না। আপনি কি জানেন না যে , মহান আল্লাহ বলেছেন ,
অর্থাৎ যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করলো , তাকে তার প্রতিদান দেয়া হবে দশ গুণ।
আল-কোরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে :
অর্থাৎ আর যে ব্যক্তি একটি মন্দ কাজ করবে , তাকে তার পরিণতিতে সে পরিমাণ শাস্তি ব্যতীত আর কিছু দেয়া হবে না। সুতরাং একটি গুনাহের কাজের জন্য একটি সাজা আর একটি নেক কাজের জন্য দশ গুণ ছওয়াব। তাহলে সে হিসাবে আমি দুটি রুটি চুরি করেছি তাতে দুটি গুনাহের কাজ করেছি। আবার আমি দুটি ডালিম চুরি করেছি এ জন্য আরো দুটি গুনাহ আমার হিসাবে যোগ হয়েছে। অপর দিকে সে রুটি দুটি ও ডালিম দুটি আল্লাহর পথে একজন রুগীকে দান করে দিয়েছি যার প্রতিটির বিনিময়ে দশ নেকী করে আমার হিসাবে লেখা হয়েছে। এভাবে প্রতিটিতে দশ নেকী হিসাবে আমি চল্লিশটি নেকী লাভ করেছি। এখন খুব সহজে এ হিসাব করা যেতে পারে যে , আমার আমলনামায় চলিশটি সওয়াব লেখা হয়েছে। আর মোকাবিলায় গুনাহের সংখ্যা মাত্র চারটি। তাহলে এখন যদি আমার চলিশটি নেকী থেকে চারটি গুনাহ বিয়োগ করা হয় তাতেও আমার আমলনামায় ছত্রিশটি নেকী অবশিষ্ট থাকে। এ হলো সে সহজ-সরল হিসাব যা আপনি বুঝতে পারেননি এবং আমাকে অজ্ঞের মতো প্রশ্ন করে বসেছেন।
ইমাম জা’
ফর সাদিক (আঃ) বললেন , তোমার মৃত্যু হোক। আসলে তুমি হলে বড় জাহেল যে নিজের ইচ্ছা মতো মনগড়া হিসাব-কিতাব করছো। তুমি কোরআনের এ আয়াত পড়োনি ? মহান আল্লাহ বলেন , ----------------
অর্থাৎ মহান আল্লাহ কেবল মোত্তাকী পরহেযগার লোকদের আমলই গ্রহণ করে থাকেন।
তাহলে এ সহজ-সরল আয়াতটি তোমার ভুল-ভ্রান্তি ধরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। তুমি তো নিজেই তোমার চারটি গুনাহের কথা স্বীকার করে নিয়েছো। অন্যের মাল সদকা-খয়রাতের নাম দিয়ে অপরকে দিয়ে দিয়েছো। এতে কোন সওয়াব হবে না। শুধু তাই নয় , বরং এ কাজের দ্বারা তুমি আরো চারটি গুনাহের পাত্র হয়েছো। অনুরূপভাবে তোমার পূর্বের চার গুনাহের সাথে আরও চার গুনাহ যোগ কর। এ হিসাবে তোমার আমল নামায় আটটি গুনাহ লেখা হয়েছে। এদিকে সওয়াবের নামে তুমি কিছুই হাসিল করোনি।
ইমামের এ কথাগুলো লোকটির চেহারায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে দিল। সে কিছক্ষণ ইমামের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এরপর ইমাম (আঃ) তাকে সেখানে রেখে বাড়ি চলে গেলেন।
ইমাম (আঃ) তার সাথীদের সামনে এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন , দ্বীনের ব্যাপারে এ ধরনের ব্যাখ্যা- বিশেষণ লোকদেরকে গোমরাহ বানিয়ে দেয় এবং অপর লোকদেরকেও সে পথভ্রষ্ট করে।