69
তায়েফ সফরের ফল
রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর চাচা জনাব আবু তালিব (আঃ) ও স্ত্রী হযরত খাদিজা বিনতে খোয়াইলেদ অল্প দিনের ব্যবধানে দুইজনই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। এভাবে আল্লাহর নবী (সাঃ) এমন একজন চাচার স্নেহ-মায়া থেকে বঞ্চিত হলেন যিনি বাইরের সমস্তবিপদ প্রতিহত করতেন এবং তাকে রক্ষা করতেন। এর অল্প কিছুদিন পরেই তার জীবন সঙ্গিনী হযরত খাদিজা (আঃ)-কে হারালেন। যিনি ঘরের অভ্যন্তরে তার আত্মার প্রশান্তি যোগাতেন।
হযরত আবু তালিবের মৃত্যুতে রাসূল (সাঃ) খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত হলেন। তার মৃত্যুর কারণে কোরাইশ কাফেররা আল্লাহর নবীকে নানাভাবে কষ্ট দেবার এবং উত্যক্ত করার সুযোগ পেয়ে যায়। তাই তারা ইসলাম প্রচারের পথে সম্ভাব্য সব রকমের বাধা সৃষ্টি করতে লাগলো। জনাব আবু তালিবের মৃত্যু হয়েছে বেশী দিন হয়নি , এমন সময় একদিন মহানবী (সাঃ) রাস্তা দিয়ে পথ চলছিলেন , তখন লোকেরা রাসূলের মাথার উপর নোংরা-ময়লা নিক্ষেপ করলো। এতে তাঁর সমস্ত দেহ ধুলা-বালি-ময়লায় ভরে গেল। এ অবস্থায় তিনি বাড়ি ফিরে আসলেন। এ সময় তার প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা যাহরা (রাঃ) দৌঁড়ে কাছে এলেন এবং পিতার মাথা ও দেহ থেকে ময়লাগুলো সাফ করতে লাগলেন। রাসূল (সাঃ) লক্ষ্য করে দেখলেন যে , প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতিমার দুইচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। তিনি বললেন , মা আমার! কেঁদো না! আর খুব বেশী দুঃখও করো না। তোমার আব্বা একা নন। বরং মহান আল্লাহ তার সহায় আছেন।
এ ঘটনার পর একদিন আল্লাহর নবী (সাঃ) ইসলাম প্রচারের কাজে মক্কা নগরী থেকে একা একা বের হলেন। ছাকীফ কাবিলার মাঝে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য তিনি তায়েফের দিকে চললেন। তায়েফ ভালো আবহাওয়া ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের স্থান হিসেবে পরিচিত। মক্কার ধনী লোকেরা এখানে ভ্রমণের জন্য আসা-যাওয়া করে থাকে।
তায়েফের লোকদের ব্যাপারে তেমন কোনো আশাপ্রদ অবস্থা ছিল না। তাদের ধ্যান-ধারণাও ঠিক তেমনি ছিল যেমনটি ছিল কা’
বা ঘরের আশপাশে বসবাসকারী মক্কার অন্যান্য অধিবাসীদের। এখানকার লোকেরাও মূর্তিপূজার ছায়াতলে থেকে আরাম-আয়েশের জীবন যাপনে বিশ্বাসী ছিল।
কিন্তু রাসূলে আকরাম (সাঃ) নিঃরাশ ও হতাশ হবার পাত্র ছিলেন না। তিনি এ সমস্তকষ্ট-ক্লেশের ব্যাপারে বরাবর চিন্তা-ভাবনা করতেন। শুধু তাই নয় বরং তিনি লোকদের অন্তর জয় করার জন্য বড়ো থেকে বড়ো কঠোর বিপদাপদের মোকাবিলা করতেও সব সময় প্রস্তুত থাকতেন।
তিনি তায়েফ নগরীতে গেলেন। তায়েফবাসীদের কাছ থেকেও সে সব কথাবার্তাই শুনলেন যা অধিকাংশ সময় মক্কাবাসীদের কাছ থেকে শুনতে পেতেন। একজন বললো , জগতে কি আর কোনো লোক ছিল না যে , মহান আল্লাহ তোমাকেই নবী বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। আরেকজন বললো , কা’
বা ঘরের গিলাফের কসম করে বলছি তুমি আল্লাহর নবী নও। অপর এক ব্যক্তি তাকে বললো , আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে আদৌ প্রস্তুত নই। মোটকথা তায়েফের লোকেরা এভাবে রাসূলের মন ভেঙ্গে দেয়ার মত জবাব দিতে আরম্ভ করলো।
এক কথায় বলা যায় যে , তায়েফের লোকেরা রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর দাওয়াতে মোটেও সাড়া দিল না। শুধু তাই নয় বরং তারা শহরের গুণ্ডা-পাণ্ডাদের লেলিয়ে দিয়ে বললো , একে শহর থেকে বের করে দাও। আবার এমনটি না হয়ে যায় যে , সহজ-সরল লোকেরা তার দাওয়াতের শিকারে পরিণত হয়ে যায়। সুতরাং তারা আল্লাহর নবীর উপর পাথর নিক্ষেপ করতে লাগলো। তার সাথে সাথে নানা রকম গালিও দিতে থাকলো। এভাবে মারাত্মকভাবে আহত করে রাসূল (সাঃ) কে শহর থেকে বের করে দিল। আহত ও যখমপ্রাপ্ত হয়ে মহানবী (সাঃ) শহরের বাইরে একটি বাগানে চলে গেলেন। এ বাগানটি ছিল কোরাইশের ওতবা ও শাইবা নামক দুইজন ধনী ব্যবসায়ীর। ঘটনাক্রমে বাগানের মালিক দুইজনও তখন বাগানে উপস্থিত ছিল। তারা দূর থেকে দাঁড়িয়ে রাসূলের সাথে কৃত এ দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করছিল। আল্লাহর নবীর এ অবস্থা দেখে তারা খুব খুশী হলো।
কিছুক্ষণ পর তায়েফের পাষণ্ডরা ফিরে চলে গেল। মহানবী (সাঃ) ওতবা ও শাইবার থেকে দূরে এক স্থানে গাছতলায় বসে গেলেন। তিনি ছিলেন একেবারে একা। কেবলমাত্র তার প্রভুই তাঁর সাথে ছিলেন। সুতরাং তিনি মহান আল্লাহর কাছে নিজের মনের সমস্তভেদ খুলে বলতে লাগলেন।
তিনি বললেন , হে আমার মালিক আল্লাহ! তোমার দরবারে আমার দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার ফরিয়াদ জানাই , এ জনপদের লোকদের দুর্ব্যবহার ও কষ্ট দেয়ার অভিযোগ জানাই। এরা আমার পথে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করেছে। হে পরম দয়ালু খোদা! তুমিই নিঃস্ব-অসহায় লোকদের প্রভু। তুমিই আমারি প্রতিপালক। তুমি আমাকে কোন সমাজে ছেড়ে দিয়েছো ? এরা আমাকে আহত করছে। আমার সাথে অচেনা-অজানা অনাত্মীয়দের মতো আচরণ করছে। তুমি কি দুশমনকে আমার উপর প্রাধান্য দান করছো ? হে বিশ্ব জাহানের মালিক! আমি খুব ভালোভাবে জানি যে , আমার উপর যে সব জুলুম-অত্যাচার চাপানো হচ্ছে , আমি তার যোগ্য পাত্র নই। তবুও সর্বাবস্থায় তোমার সন্তুষ্টি বিধানই আমার কাম্য। তুমি যদি আমার প্রতি রাজী থাকো , তাহলে এসব কিছুকে আমি মোটেও পরোয়া করবো না। আমি তোমার মহান নূরের সে ছায়াতলে আশ্রয় চাচ্ছি , যা সমগ্র বিশ্বের অন্ধকারকে বিদূরিত করেছে এবং অন্ধকার পৃথিবী উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। তোমারই নির্দেশে ইহকাল ও পরকালের সব কিছু সন্নিবেশিত হয়েছে। তুমি যদি তোমার পক্ষ থেকে আমার উপর আযাব নাযিল করো তাতেও আমি তোমার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সব কিছুকে নত শিরে গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত রয়েছি। প্রতিনিয়ত আমার চেষ্টা-সাধনা কেবল এটাই যে , তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকো। নিখিল জাহানে তোমার চেয়ে বড় শক্তিশালী আর কেউ নেই। তুমিই সমস্তসৃষ্টির উপর ক্ষমতাবান।
বাগানের মালিক ওতবা ও শাইবা রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর এ অবস্থা দেখে খুশী হয়েছিল ঠিকই। কিছু আত্মীয়ের বিবেচনায় তারা তাদের গোলাম আদ্দাসকে হুকুম দিল , কিছু আঙ্গুর নিয়ে গিয়ে ঐ লোকটির সামনে রেখে দাও। তারা খৃস্টধর্মে বিশ্বাসী সে গোলামটিকে আরো বলে দিল , আঙ্গুর দিয়ে সাথে সাথেই সেখান থেকে চলে আসবে।
আদ্দাস আঙ্গুর নিয়ে বিশ্বনবীর কাছে এলো এবং আঙ্গুর সামনে রেখে দিয়ে বললো , এগুলো খেয়ে নিন। রাসূলে আকরাম (সাঃ) আঙ্গুর হাতে নিলেন এবং খাবার আগে বললেন , আল্লাহর নামে।
আদ্দাস এর আগে কখনোও এ কথা শুনেনি। জীবনে প্রথম বারের মতো সে এ ধরনের কথা শুনতে পেলো। সে রাসূলের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো , এ কথা তো এখানকার লোকদের প্রচলিত কথা নয়। আমি তো এ এলাকার লোকদের মুখে এ জাতীয় কথা কোনোদিন শুনতে পাইনি। আপনি এটা কি কথা বললেন ?
আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন , হে আদ্দাস! তুমি কোথাকার অধিবাসী ? তোমার ধর্ম কি ?
জবাবে সে বললো , মূলত আমি নাইনেওয়ার অধিবাসী। আর আমি খৃস্ট ধর্মে বিশ্বাসী।
রাসূল (সাঃ) বললেন , তুমি নাইনেওয়াবাসী অর্থাৎ ইউনুস বিন মাত্তা-এর মতো খোদার নেক বান্দার দেশ ?
সে বললো , আমি হতবাক হচ্ছি! আমি বুঝতে পারছি না যে , ইউনুস বিন মাত্তা-এর নাম আপনি কি করে জানালেন ? যে সময় আমি নাইনেওয়াতে বসবাস করতাম সেখানে তখন এমন দশজন লোকও ছিল না যারা ইউনূসের মা-বাবার নাম জানতো। আমার আশ্চর্য লাগছে যে , আপনি কি করে তার নাম জানলেন ?
মহানবী (সাঃ) বললেন , ইউনুস আমার ভাই! তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী। আমিও আল্লাহর নবী।
ওতবা ও শাইবা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল যে , আদ্দাস আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত। তারা অস্থির হয়ে গেল। বরাবরই তাদের চেষ্টা-তদবির এটাই থাকতো যে , কোনো লোক যেন নবীর সাথে দেখা- সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা বলতে না পারে। তারা খুব ভালোভাবে জানতো যে , অল্প কিছু সময় আলাপ- আলোচনা করার পরই লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে নেয়। যা হোক তারা যা ভেবেছিল তাই বাস্তবে রূপ নিয়েছে। হঠাৎ তারা দেখতে পেলো যে , আদ্দাস মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর হাত-পায়ে চুম্বন করতে লাগলো। তারা একজন আরেকজনকে উদ্দেশ্য করে বললো , দেখলে এ গোলামটিকেও সে পথভ্রষ্ট করেছে।