71
সত্যের সন্ধানে
ওনওয়ান বসরী সত্যের সন্ধানে সব সময় লেগে থাকতো। তার যথাসাধ্য চেষ্টা-প্রচেষ্টা এটাই যে , ইয়াক্বীনের সর্বশেষ প্রান্তসীমায় পৌঁছে যাবে। (ইয়াক্বীনের অবস্থা হচ্ছে আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণ করে ঈমানের চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়া)।
একবার সে সফরের কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে মদীনায় গিয়ে উপস্থিত হলো। সে সময় মদীনা ছিল ইসলাম প্রচারের প্রাণকেন্দ্র। সব সময় ফকীহ ও মুহাদ্দেসগণের ভীড় লেগে থাকতো। মদীনায় পৌঁছে সে তৎকালীন বিখ্যাত ফকীহ ও মুহাদ্দিস মালিক ইবনে আনাসের শিষ্যদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
প্রচলিত নিয়ম মাফিক মালিক ইবনে আনাসের এখানে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও জমা করার ধারা অব্যাহত ছিল। অন্যদের মতো ওনওয়ান বসরীও রাসূলের হাদীস লেখা পড়ার কাজ শুরুকরে দিল। এখানে সমস্ত শিক্ষার্থীকেই হাদীসের শিক্ষা দান করা হতো। সাথে সাথে তাদেরকে এটাও শিক্ষা দেয়া হতো যে , হাদীসের সনদ কিভাবে নির্ণয় করা যায়।
ওনওয়ান বসরীর অন্তরে পূর্ব থেকেই সত্য সন্ধানের আগ্রহ বর্তমান ছিল। সুতরাং এ কাজে সে আত্মতৃপ্তি লাভ করলো এবং অত্যন্ত তুষ্টচিত্তে অনুসন্ধান কর্মের দ্বারা আত্মার খোরাক সংগ্রহ করতে থাকলো। সে সময় হযরত ইমাম জা’
ফর সাদিক (আঃ) মদীনায় উপস্থিত ছিলেন না। কিছুদিন পর তিনি মদীনায় ফিরে এলেন। ওনওয়ানের অন্তরে এ চিন্তা জাগলো যে , সে কিছুদিন ইমাম জা’
ফর সাদিক (আঃ)-এর শিষ্যত্বও গ্রহণ করবে। তাই সে মালিক ইবনে আনাসের দরবার ত্যাগ করে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে চলে গেল।
কিন্তু ইমাম (আঃ) তার আগ্রহের মধ্যে আরো তীব্রতা আনয়নের জন্য কিছুদিন পর্যন্ত তার থেকে এড়িয়ে চললেন। একদিন ইমাম (আঃ) তার আবেদনের জবাবে বললেন , আমি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। আমার একেবারেই অবসর নেই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিক্ষা-দীক্ষার ধারা অব্যাহত রাখতে হয়। আমার কাছে এতটুকুন সময় নেই যে , আমি তোমার আশা পূরণ করবো। অতএব তুমি আগের মতোই মালিক ইবনে আনাসের শিক্ষাঙ্গনেই ফিরে যাও। আমি এখন তোমাকে শিক্ষা দানে অপারগ । আমার কাছে সময় থাকলে আমি অবশ্যই তোমার মনোবাঞ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করতাম।
ইমামের জবাব শুনে সে খুবই দুঃখিত হলো। আর নিজেকে তিরস্কার করতে লাগলো। সে বললো , যদি আমার মধ্যে যোগ্যতা ও সামর্থ্য থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই ইমাম আমার আবেদন গ্রহণ করে নিতেন। তাই সে ভারাক্রান্তমনে মসজিদে নববীতে চলে গেল। নবীর রওজায় সালাম নিবেদন করে বাড়ীর দিকে চলে গেল। তার চোখে-মুখে ছিল বেদনা-ব্যথা ও দুঃখের ছাপ।
দ্বিতীয় দিন সে বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেল রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর রওজা শরীফে। সেখানে গিয়ে সে দুই রাকাত নামায আদায় করে মহান আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে কান্নাকাটি করে ফরিয়াদ জানাতে লাগলো :
হে আমার পালনকর্তা আল্লাহ! তুমি সকলের অন্তর্যামী। তোমার দরবারে আমার আরাধনা কেবল এটাই যে , হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর অন্তর আমার প্রতি সদয় করে দাও যেনো আমার প্রতি তাঁর সুদৃষ্টি পতিত হয়। আমি যেনো তারঁ শিষ্য হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারি। তাঁর কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করে যেনো তোমার সরল সঠিক পথের সন্ধানে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন না হই।
নামায ও দোয়া প্রার্থনার পর সে বাড়ি ফিরে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনুভব করতে লাগলো যে , তার অন্তরে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর ভালোবাসা বেড়েই চলেছে। ভালোবাসা বৃদ্ধির সাথে সাথে তার দুঃখ-বেদনাও বাড়তে থাকে। আর বলে , আফসোস! ইমাম সাদিক (আঃ)-এর শিষ্য হবার সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারলাম না। এ দুঃখ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই সে নিজের ঘর ছেড়ে আর কোথাও যেতো না। কেবল ফরয নামায আদায় করার জন্য মসজিদে যেতো। বাকী সময় ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দিতো। আর তার মনের মধ্যে নানা রকম চিন্তা-ভাবনা আলোড়িত হতে থাকতো। একদিকে ইমামের অপারগতা প্রকাশ , অপর দিকে ইমামের শিষ্যত্ব গ্রহণের আগ্রহের আধিক্য তার হৃদয়ে বেড়েই চলছিল। তাই মাঝে মাঝে বলতো , হায় যদি এমন কোন পথ খুলে যেতো যে , ইমাম আমাকে তার শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। মোটকথা তার মধ্যে একটা অত্যাগ্রহের অবস্থা বিরাজিত করছিল। তার ব্যথা-বেদনা বেড়েই চলেছে। সীমাহীন দুঃখ-বেদনার কারণে দিনের পর দিন সে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অবশেষে একদিন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। সে পুনরায় ইমামের দরবারে গিয়ে হাজির হলো।
দরবারের খাদেম জিজ্ঞাসা করলো , বলুন , কি কাজ।
সে বললো , তেমন কোন কাজ নেই। আমি তো কেবলমাত্র ইমামের খেদমতে সালাম নিবেদন করতে এসেছি।
খাদেম বললো , ইমাম এখন নামায আদায় করছেন।
কিছুক্ষণ পরে খাদেম এসে বললো , আসুন।
ওনওয়ান বসরী ঘরে প্রবেশ করলো। ইমামকে দেখেই সালাম নিবেদন করলো। ইমাম তার সালামের জবাব দিলেন এবং তার জন্য দোয়াও করলেন। তারপর ইমাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমার ডাক নাম কি ? সে বললো , আবু আব্দুল্লাহ।
ইমাম তার জন্য দোয়া করে বললেন , মহান আল্লাহ তোমার এ নামের হেফাজত করুন। তোমার তওফিক আরো বাড়িয়ে দিন।
ইমামের এ দোয়ার বাণী শুনে সে মনে মনে ভাবতে লাগলো যে , যদি আর কিছ নাও হাসিল হয় , তাহলে এ দোয়াই আমার জন্য যথেষ্ট। তারপর ইমাম জিজ্ঞাসা করলেন , বলো! তোমার কাজ কি ? কোন উদ্দশ্যে তুমি আমার এখানে এসেছো ?
সে বললো , আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যে , আপনার অন্তরে আমার জন্য একটু স্থান করে দিতে যাতে করে আমি আপনার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে উপকৃত হতে পারি। আমার বিশ্বাস যে , আমার দোয়া মঞ্জুর হয়েছে।
ইমাম বললেন , হে আবু আবদুল্লাহ! আল্লাহর মা’
রেফাত ও ইয়াক্কীনের আলো এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে এবং দ্বারে দ্বারে তালাশ করে হাসিল হয় না। অন্য কেউ তোমাকে ইয়াক্কীনের নূর দিতে পারে না। এটা শিক্ষা করার বিষয় নয় , বরং এটা হচ্ছে সে নূর যা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্জিত হয়। আল্লাহ যখন তাঁর কোন বান্দাকে হেদায়েত করার ইচ্ছা করেন , তখন তার অন্তরে এ নূরে-ইয়াক্কীন সৃষ্টি করে দেন। যদি তুমি খোদার মা’
রেফাত ও নূরে ইয়াক্কীনের সন্ধানী হও , তাহলে আল্লাহর গোলামী ও বন্দেগীর গভীরে নিজের অন্তর আত্মায় সন্ধান করো। আমলের পথেই ইলম খুঁজ। আর তাঁর কাছে দোয়া প্রার্থনা করো। তিনিই তোমার অন্তর নূরে ইয়াক্কীন দিয়ে ভরপুর করে দেবেন।