চিরঞ্জীব শহীদ মোতাহারী
অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহারীর শাহাদাতের পর ষোল বছর অতিক্রান্ত হলো। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রায় তিন মাস অতীত হবার পর 1979 সালের 1 মে এই মহান সাধকের শাহাদাতের মর্মন্তুদ ঘটনাটি সংঘটিত হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চরেরা বিপক্ক-পূর্বকালের এ মহান চিন্তাবিদ ও দার্শনিককে শহীদ করার মাধ্যমে বিপ্লবের মনীষাকে নস্যাৎ করার জন্য এক গণ্য ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করেছিল। তাদের সে পরিকল্পনা সার্থক হয়নি। কারণ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহারীর যে মনীষা ও বুদ্ধিমত্তা তার জীবদ্দশার চেয়ে শাহাদাতের পরে আরো প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আর এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসের যে কোন গ্রন্থকারের তুলনায় তার গ্রন্থগুলো আজ সর্বত্র বিপুলভাবে পঠিত হচ্ছে।
ইসলামী চিন্তাধারা ও দর্শনের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যেই মোতাহারী তার কলম ধরেছিলেন এবং তিনি ইরানের নতুন বংশধরদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন অস্ত্রে সুসজ্জিত করেছিলেন যে , তাতে করে তারা বিপথগামী আদর্শ ও মতাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন দেশের যুব শক্তিগুলো যাতে ইসলামের মহান শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অকাট্য যুক্তিগুলো আত্মস্থ করতে পারে সে জন্য তিনি বিরামহীন চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
শহীদ মোতাহারী ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তবে তিনি তার সে প্রতিভাকে শুধু তত্ত্বগত ও শিক্ষায়তনগত পরিমণ্ডলেই নিয়োজিত রাখেন নি-যা জনগণের ওপর কোন প্রকার প্রভাব ব্যতিরেকে শুধু কোন মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। তিনি ছিলেন সরল- সহজ প্রকাশভঙ্গির অধিকারী। তবে তাতে তার চিন্তার গাম্ভীর্য আদৌ ক্ষুণ্ণ হতো না , এমন কি যুক্তির যথার্থতা বিসর্জন না দিয়ে এবং কোন প্রকার কূটযুক্তি তথা অর্তহীন বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি ও কাব্যিক সুর সংযোজন ব্যতীতই তিনি তার সরল-সহজ বক্তব্যকে পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন। মোটকথা , ইসলামের মহান ব্যক্তিগণ দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে যে সব গুণের অধিকারী হয়েছেন তিনিও সে সব গুণের অধিকারী ছিলেন। শহীদ মোতাহারী তার যুগের যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন পূরণ করার মতোই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
তাঁর গ্রন্থগুলো আজ সর্বস্তরের লোকেরাই পাঠ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে বিদগ্ধ পন্ডিত সমাজ আজ তার গ্রন্থের সমঝদার পাঠক। আর তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী সে সব গ্রন্থ থেকে অফুরন্ত ফায়দা গ্রহণ করছেন। তার গ্রন্থগুলো পাঠ করা মাত্র যে কোন চিন্তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন-আর এটাই হচ্ছে তার লেখার বিশেষত্ব। আমরা মনে করি তার সমুদয় লেখা বিদেশী ভাষাসমূহে অনূদিত হওয়া প্রয়োজন- যাতে ফাসীর্ভাষা ভাষী নন এমন সব মুসলিম ভাইয়েরাও তার জ্ঞান ও চিন্তাধারার সারবত্তা , মৌলিকতা এবং ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন।
মোল্লা সদরের ইন্তেকালের পর (1050 হিজরী) দীর্ঘদিন পর্যন্তইসলামী দর্শন কম-বেশী জড়তাগ্রস্ত থাকার পর শহীদ মোতাহারীর লেখনি শক্তির মাধ্যমেই ইসলামী দর্শন ও চিন্তাধারা আধুনিক ধারায় প্রবেশ করে এবং একটি সতেজ ও গুরুত্বপূর্ণ রূপ লাভ করে। তিনি ইরানের এবং শহীদ আয়াতুল্লাহ বাকের আল সদর ইরাকের মার্কসবাদের ও পুঁজিবাদের অসার যুক্তিগুলোকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেন। শুধু তাই নয় , তারা সাধারণভাবে ইউরোপের আধুনিক দর্শনের গোলমেলে অগ্রগতি , বিশেষ করে মার্কসবাদের মোকাবিলায় ইসলামী দর্শনের অকাট্য ও অপ্রতিহত প্রাধান্য এবং এর আবশ্যিক পবিত্রতা ও সংহতিকে প্রতিষ্ঠিত করেন-যা প্রকৃতপক্ষে একটি অতি প্রাকৃতিক ও জগাখিচুড়িপূর্ণ ঘোলাটে দর্শন এবং যাকে প্রতারণাপূর্ণভাবে‘
বৈজ্ঞানিক’
এই লেবেল দ্বারা বাজারজাত করানো হয়েছে।
শহীদ মোতাহারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী শহীদ মুর্তাজা মোতাহারী 1919 সালের (হিজরী 1338) 2 ফেব্রয়ারী খোরাসান প্রদেশের ফারিমান নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ হোসাইন মোতাহারী ছিলেন সে যুগের একজন মস্তবড় সাধক ব্যক্তি ও আলেম। ফারিমানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণান্তে 12 বছর বয়সে তিনি মির্জা মেহেদী শহীদী রেজাভীর অধীনে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মাশহাদের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে গমন করেন। অতঃপর আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী , ইমাম খোমেনী ও অন্যান্য মহান শিক্ষক ও চিন্তাবিদদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি কোমে গমন করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র 18 বছর। হাজী মির্জা আলী আগা শিরাজীর সাথে পরিচিতি তার চিন্তাধারার বিপুল পরিবর্তন ও প্রভাব ঘটায়। এই সময় শহীদ মোতাহারী ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি ইসলামী আইনের মূলনীতিসমূহ তথা‘
ইলমে উসুল’
ও ইসলামী আইন বা ফিকাহ এই উভয়বিধ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন। ঠিক এই সময়ই তিনি কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে একজন অন্যতম মেধাবী ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। শুধু তাই নয় , তিনি ইমাম খোমেনীর একজন অতিশয় প্রিয় ও স্নেহভাজন ছাত্র হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন।
অধ্যাপক মোতাহারী আয়াতুল্লাহ মুহাক্কিক , আগা মেহেদী মির্জা আশতিয়ানী , আল্লামা তাবাতাবায়ী ও আয়াতুলাহজ বুরুজারদীর মতো মহান শিক্ষকদের অধীনে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। আর এভাবেই তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনে ব্রতী হন। তাঁর সুযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে আর যাদের নাম উল্লেখ করা যায় , তারা হলেন আয়াতুল্লাহ ইয়াসবেরী কাশানী , আয়াতুল্লাহ খোনছারী ও আয়াতুল্লাহ সদর।
উপরে উল্লিখিত তার এ বিদ্যা অভ্যাস থেকে এটাই অনুমান করা যায় যে , মাশহাদে থাকাকালীন তথা যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি ইসলামী দর্শনশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে অতীতের সে দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন ,‘
মাশহাদে আমি যখন আরবী ভাষা শিক্ষা শুরু করেছিলাম তখন থেকেই আমি আমার অতীতের কথাটা স্মরণ করতে পারি। আমি যদিও মহান দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের দর্শন সম্পর্কে খুব একটা পরিচিত ছিলাম না , তথাপি আমি তখন থেকেই তাদের পান্ডিত্য ও দর্শনের বিশেষ মূল্য দিতে শুরু করি। সুতরাং আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে , আবিষ্কারক , উদ্ভাবক , অনুসন্ধানী ও বিজ্ঞানীদের তুলনায় আমি তাদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠি। আর এ কারণেই আমি তাদেরকে পৃথিবীর চিন্তা রাজ্যের নায়ক বলে মনে করতে লাগলাম’
।
আমরা অনায়াসে জানতে পারি যে , কোমে ইমাম খোমেনী এবং পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম তাবাতাবায়ীর মতো সুযোগ্য উস্তাদদের অধীনে দীর্ঘ 15 বছরকাল অধ্যয়নের পূর্বেই অধ্যাপক মোতাহারী দর্শন শাস্ত্রের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ইমাম খোমেনীর নিকট দর্শনশাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করা ছাড়াও তিনি‘
ইমামের আখলাক’
শীর্ষক ক্লাসগুলোতে নিয়মিত যোগদান করতেন। এতে মনে হচ্ছে যে , বক্তৃতামালা তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি নিজেই ইমাম খোমেনীর সে সব বক্তৃতার কথা এভাবে স্মরণ করেছেন :‘
নীতিজ্ঞান তথা আখলাক সম্পর্কে প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক (ইমাম খোমেনী) যে সব বক্তৃতা দিতেন আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে তা বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের কাজ করতো। তিনি কোন নির্জীব নীতিশাস্ত্রের শুষ্ক আকৃষ্ট করতো যে , আমি অলক্ষ্যেই যেন তার প্রভাবাধীন হয়ে পড়তাম এবং পরবর্তী সোম ও মঙ্গলবার পর্যন্তত আমার হৃদয়পটে স্থায়ী হয়ে থাকতো। আমি এই আধ্যাত্মিক শিক্ষকের নিকট দীর্ঘ 12 বছর পর্যন্ত যে সব বক্তৃতার ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছিলাম আমার আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের অধিকাংশ ফসলগুলো তারই ফলশ্রুতি। আমি সব সময়ই আমাকে তার নিকট ঋণী বলে মনে করতাম’
।
1942 সালের গ্রীষ্মকাল। মোতাহারীর জীবনে একটি ঘটনা ঘটে গেল। পরবর্তী পর্যায়ে এই ঘটনাই তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বে রূপায়িত করে। আর এই ঘটনাটি হচ্ছে মরহুম হাজী মির্জা আলী শিরাজী ইস্পাহানীর সঙ্গে তার সাক্ষাতকার। এই সাক্ষাতকারের মাধ্যমেই তিনি‘
নাহজুল বালাগা’
র প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।‘
নাহজুল বালাগা’
হচ্ছে হযরত আলী (আঃ)-এর বক্তৃতা , পত্রাবলী ও বাণীসমূহের একটি সংকলন।‘
নাহজুল বালাগা’
র প্রতি তার এই পরিচিতি তার জন্য বিশেষ উপকারী হয়েছিল। এই সময় তিনি এই গ্রন্থ ও এর বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। নাহজুল বালাগার মধ্যে‘
ভ্রমণ’
নামক গ্রন্থটি হচ্ছে তার কাজের একটি অংশ বিশেষ যা তিনি আরো বর্ধিত কলেবরে বের করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে সক্ষম হননি।
1947 সালের কথা। বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। যেহেতু দর্শনশাস্ত্রে এমনিতেই তার আগ্রহ ছিল , তাই তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে এই বস্তুবাদী দর্শনের উপর অধ্যয়ন শুরু করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার এ পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন। তবে তিনি সিয়ামের আধ্যাত্মিক দর্শনের উপর যে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন তা ছিল তুলনাহীন , বিশেষ করে মোলাসদরের দর্শনের ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল অপরিসীম। একদিকে ইসলামী দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে তার প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি অর্জন তাকে একটি তুলনামূলক দর্শনশাস্ত্র সৃষ্টির ব্যাপারে সক্ষম করেছিল- যে সম্পর্কে পূর্ব থেকে তার নিকট কোন নজীর বা দৃষ্টান্ত ছিল না। অবশ্য তার পূর্বেই আল্লামা তাবাতাবায়ী পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন। আর তার এ কাজটাই পরবর্তী সময়ে তার বিজ্ঞ ছাত্রগণ একটি নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্তপৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন।
1951 সালের কথা। আল্লামা তাবাতাবায়ী তুলনামূলক দর্শনশাস্ত্রের পাঠ দান শুরু করেছিলেন। তার প্রদত্ত এসব ক্লাসে উস্তাদ মোতাহারী , শহীদ ড. আয়াতুল্লাহ বেহেশতী , শহীদ ড. বাহোনার এবং আরো অসংখ্য ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। উস্তাদ মোতাহারী এসব বক্তৃতা একটি সংকলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন , যার নাম দেয়া হয়েছিল‘
প্রকৃত দর্শনের মূলনীতি ও পদ্ধতি’
। তিনি এই সংকলনটিতে অনেক পাদটীকাও সংযোজিত করেছিলেন- যা আল্লামা তাবাতাবায়ীর গ্রন্থের কলেবর থেকে পাঁচ গুণ বড়।
কোমে অধ্যয়নকালে ইরানী সমাজের কতিপয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রতি তার দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। আর এটাই স্বাভাবিক যে , তার মতো একজন ব্যক্তিত্বের পক্ষে ইরান তথা মুসলিম বিশ্বের এ দূরবস্থা অবলোকন করে উদাসীন ও চুপ থাকা সহজ নয়। ইরানসহ মসলিম জাহানের এই করুণ অবস্থা্’
তাকে বাধ্য করেছিল মুসলমানদের সামাজিক , ধর্মীয় , ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর কতিপয় গ্রন্থ রচনা করতে। গ্রন্থ রচনার কথা বাদ দিলেও তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ শিক্ষক এবং অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন বক্তা ও বাগ্মী। একাধারে তার লেখা ও বক্তৃতা ইরানের নতুন প্রজন্মের চিন্তার ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এবং পাহলভী বংশের নতুন ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ধ্বংসাত্মক ও বিশৃঙ্খল সামাজিক পদ্ধতির অসারত্বগুলো খণ্ডন করে-যা মূলত দেশ থেকে ইসলাম , ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বিতাড়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছিল।
1953 সালের দিকে অধ্যাপক মোতাহারী তেহরান গমন করেন এবং খোরাসানের একজন প্রসিদ্ধ আলেমের কন্যাকে বিয়ে করেন। এর এক বছর পরে তথা 1954 সালে তিনি আল্লামা তাবাতাবায়ীর বক্তৃতামালা‘
প্রকৃত দর্শনের মূলনীতি ও পদ্ধতি’
নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। 1956 সালে তাকে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত ও ইসলামী বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ 22 বছর যাবত সেখানে শিক্ষা দানে ব্যাপৃত ছিলেন। এই সময় তিনি ইরানী সমাজের নতুন প্রজন্মের নিকট সুযোগ্য ও মহান শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ধর্মীয় ও বদ্ধিজীবীবৃন্দ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সাথে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ ও বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং আদর্শ ও চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েছিলেন , যোগাযোগের নিমিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সমরক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
1958-1971 সাল পর্যন্ত সময়ে এমন কি তার পরেও মুসলিম ডাক্তারদের সমিতি কর্তৃক বক্তৃতা দানের জন্য তিনি আমন্ত্রিত হন। এই সময়ে রচিত তার গ্রন্থগুলো মূলত সে সব বক্তৃতাকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান ও উপস্থিতি তাকে কোমের ধর্মকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম করেছিল। কোমের এই বিশ্ববিশ্রুত ধর্মকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ ও যোগসূত্র রচনায় মোতাহারী কঠোর পরিশ্রম করেন। এই ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালিত ইসলামী বিজ্ঞান সম্বন্ধে অধ্যয়ন করার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও গ্রাজুয়েটকে উদ্বুদ্ধ করেন।
এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু সংখ্যক মার্কসবাদীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি মার্কসবাদের অজ্ঞৈানিকতা ও ভ্রম সম্বন্ধে কলম ধরতে বাধ্য হন। ধর্মীয় ও দার্শনিক মতামত এবং যুক্তিতর্ক শোনা ও বোঝার ব্যাপারে তার অপরিসীম দক্ষতা ছিল। তাই তিনি তার গ্রন্থাবলীতে প্রতিপক্ষের যুক্তিতর্কগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা করার পূর্বে সেগুলোকে যথার্থ ও সুন্দররূপে বর্ণনা ও মূল্যায়ন করার প্রয়াস পান।
শাহের নব্য ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে 1963 সালের 5 জুন যে রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় , ঠিক তখন থেকেই উস্তাদ মোতাহারীর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার গুরুত্বপূর্ণ উন্মেষ ঘটে। সেই সময়কার সকল ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময় তাদের অধিকাংশই গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। উস্তাদ মোতাহারীও গ্রেফতার হন এবং 5 জুনের মধ্যরাতে তাকে জেলে পাঠানো হয়। এরপর জনগণের অব্যাহত চাপ ও আলেম সমাজের প্রচেষ্টায় তিনি কারামুক্ত হন।
ইমাম খোমেনী তখন জেলে। জনগণ তাদের প্রিয় নেতার সান্নিধ্য ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হলো , ঠিক এই সময় অধ্যাপক মোতাহারী ব্যক্তিগতভাবে বিপ্লবের সুকঠিন দায়িত্ব তার স্কন্ধে তুলে নেন।
1964 সালের কথা। ইমাম খোমেনীকে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইরানের আলেম সমাজ তখন তাদেরকে সুসংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত। পরিশেষে তারা ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমদের সমন্বয়ে একটি বিপবী ও জেহাদী মোর্চা গঠন করেন। আর ইমামের প্রতিনিধি হিসেবে মোতাহারী এই বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হন। অতঃপর 1964-1977 পর্যন্তইসলামী বিপবী বাহিনীকে একনায়ক পাহলভী প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে মরণ সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় উস্তাদ মোতাহারী সে বিপবী বাহিনীকে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আসলে ইমাম খোমেনীই তাকে এ দায়িত্ব অর্পণ করেন।
1978 সাল। বিপ্লবের অগ্নিশিখা তখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। এই সময় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোতাহারীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দৃঢ়তার সাথে নেতৃত্ব দেন। আর এই সময়ই তিনি ইমাম খোমেনীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্যারিস গমন করেন। প্যারিসে অবস্থানকালে ইমাম খোমেনী তাকে বিপবী কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ দেন। ইমামের তেহরান প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তার সান্নিধ্যেই অবস্থান করেন এবং তার একজন উপদেষ্টা হিসেবে সার্বিক সহযোগিতা করেন।
1 মে 1979। গভীর রাতে উস্তাদ মোতাহারী তার এক বন্ধুর বাসা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক শেষে ঘরে ফিরছিলেন। ফেরার পথে‘
ফোরকান’
নামক একটি খোদাদ্রোহী তথা নাস্তিক গ্রুপের জনৈক সদস্য তার উপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং তাকে হত্যা করে।
উস্তাদ মোতাহারী শাহাদত বরণ করলেন। কিন্তু ইসলামের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে যে নিরলস কর্মপ্রবাহ রেখে গেছেন তা তাকে যুগ যুগ ধরে চিরঞ্জীব করে রাখবে। সবচেয়ে বড় কথা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য তার যে স্বপ্ন তা তার জীবদ্দশায়ই সাফল্য অর্জন করে এবং তিনি তা দেখে যেতে সক্ষম হন। তার শহীদী আত্ম চির শান্তিতে থাকুক এবং সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করুক।