সত্য কাহিনী সম্ভার

সত্য কাহিনী সম্ভার16%

সত্য কাহিনী সম্ভার লেখক:
: মাওলানা আলী আক্কাস
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

সত্য কাহিনী সম্ভার
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 79 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46790 / ডাউনলোড: 5945
সাইজ সাইজ সাইজ
সত্য কাহিনী সম্ভার

সত্য কাহিনী সম্ভার

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি তার বিষয়ের সর্বপ্রথম ও অনন্য অবতারণা হোক অথবা না হোক , এর জন্য প্রাপ্য ফুলের মামলার যোগ্য পাত্র আমি নই , অর্থাৎ যদি এ বইটি কাহিনী রচনার জগতে কোন গুরুত্বপূর্ণ নতুন অবতারণার দাবিদার হয় তাহলে তার গোড়াপত্তনকারী আমি নই। বরং প্রকাশনা ও প্রচারণার একটি প্রতিষ্ঠানে দেশের বিজ্ঞ বিজ্ঞ বিজ্ঞানী-গুণী কতিপয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি সম্পাদনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ অধমও সে বোর্ডের একজন সদস্য। দেশের খ্যাতনামা লেখক ও বিজ্ঞতম ব্যক্তিত্ব সমৃদ্ধ সে বোর্ডের এক বৈঠকে প্রস্তাব রাখা হলো যে , এমন একটি গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত যার মধ্যে চারিত্রিক সুন্দর ও গুণাবলী কাহিনী আকারে উপস্থাপিত থাকবে। আর সে কাহিনীগুলো লেখকের নিজের মস্তিষ্ক থেকে আবিস্কৃত বা নিজের খেয়াল মোতাবেক তৈরি হবে না। বরং তার ভিত্তিমূল ও উৎস হবে হাদীস , বাস্তব জীবন ও ইতিহাসের গ্রন্থরাজি। এর সংকলনের উদ্দেশ্য থাকবে মুসলিম সমাজকে শিক্ষা দান এবং যুব সমাজকে হেদায়েতের পথ প্রদর্শন ও পরিচালনা করা।


1

চিরঞ্জীব শহীদ মোতাহারী

অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহারীর শাহাদাতের পর ষোল বছর অতিক্রান্ত হলো। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রায় তিন মাস অতীত হবার পর ১৯৭৯ সালের ১ মে এই মহান সাধকের শাহাদাতের মর্মন্তুদ ঘটনাটি সংঘটিত হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চরেরা বিপক্ক-পূর্বকালের এ মহান চিন্তাবিদ ও দার্শনিককে শহীদ করার মাধ্যমে বিপ্লবের মনীষাকে নস্যাৎ করার জন্য এক গণ্য ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করেছিল। তাদের সে পরিকল্পনা সার্থক হয়নি। কারণ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহারীর যে মনীষা ও বুদ্ধিমত্তা তার জীবদ্দশার চেয়ে শাহাদাতের পরে আরো প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আর এ কারণেই ইসলামের ইতিহাসের যে কোন গ্রন্থকারের তুলনায় তার গ্রন্থগুলো আজ সর্বত্র বিপুলভাবে পঠিত হচ্ছে।

ইসলামী চিন্তাধারা ও দর্শনের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যেই মোতাহারী তার কলম ধরেছিলেন এবং তিনি ইরানের নতুন বংশধরদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন অস্ত্রে সুসজ্জিত করেছিলেন যে , তাতে করে তারা বিপথগামী আদর্শ ও মতাদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন দেশের যুব শক্তিগুলো যাতে ইসলামের মহান শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের অকাট্য যুক্তিগুলো আত্মস্থ করতে পারে সে জন্য তিনি বিরামহীন চেষ্টা চালিয়েছিলেন।

শহীদ মোতাহারী ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। তবে তিনি তার সে প্রতিভাকে শুধু তত্ত্বগত ও শিক্ষায়তনগত পরিমণ্ডলেই নিয়োজিত রাখেন নি-যা জনগণের ওপর কোন প্রকার প্রভাব ব্যতিরেকে শুধু কোন মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে। তিনি ছিলেন সরল- সহজ প্রকাশভঙ্গির অধিকারী। তবে তাতে তার চিন্তার গাম্ভীর্য আদৌ ক্ষুণ্ণ হতো না , এমন কি যুক্তির যথার্থতা বিসর্জন না দিয়ে এবং কোন প্রকার কূটযুক্তি তথা অর্তহীন বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তি ও কাব্যিক সুর সংযোজন ব্যতীতই তিনি তার সরল-সহজ বক্তব্যকে পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করিয়ে দিতে সক্ষম ছিলেন। মোটকথা , ইসলামের মহান ব্যক্তিগণ দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে যে সব গুণের অধিকারী হয়েছেন তিনিও সে সব গুণের অধিকারী ছিলেন। শহীদ মোতাহারী তার যুগের যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজন পূরণ করার মতোই এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

তাঁর গ্রন্থগুলো আজ সর্বস্তরের লোকেরাই পাঠ করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে বিদগ্ধ পন্ডিত সমাজ আজ তার গ্রন্থের সমঝদার পাঠক। আর তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী সে সব গ্রন্থ থেকে অফুরন্ত ফায়দা গ্রহণ করছেন। তার গ্রন্থগুলো পাঠ করা মাত্র যে কোন চিন্তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন-আর এটাই হচ্ছে তার লেখার বিশেষত্ব। আমরা মনে করি তার সমুদয় লেখা বিদেশী ভাষাসমূহে অনূদিত হওয়া প্রয়োজন- যাতে ফাসীর্ভাষা ভাষী নন এমন সব মুসলিম ভাইয়েরাও তার জ্ঞান ও চিন্তাধারার সারবত্তা , মৌলিকতা এবং ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্বন্ধে সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন।

মোল্লা সদরের ইন্তেকালের পর (১০৫০ হিজরী) দীর্ঘদিন পর্যন্তইসলামী দর্শন কম-বেশী জড়তাগ্রস্ত থাকার পর শহীদ মোতাহারীর লেখনি শক্তির মাধ্যমেই ইসলামী দর্শন ও চিন্তাধারা আধুনিক ধারায় প্রবেশ করে এবং একটি সতেজ ও গুরুত্বপূর্ণ রূপ লাভ করে। তিনি ইরানের এবং শহীদ আয়াতুল্লাহ বাকের আল সদর ইরাকের মার্কসবাদের ও পুঁজিবাদের অসার যুক্তিগুলোকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেন। শুধু তাই নয় , তারা সাধারণভাবে ইউরোপের আধুনিক দর্শনের গোলমেলে অগ্রগতি , বিশেষ করে মার্কসবাদের মোকাবিলায় ইসলামী দর্শনের অকাট্য ও অপ্রতিহত প্রাধান্য এবং এর আবশ্যিক পবিত্রতা ও সংহতিকে প্রতিষ্ঠিত করেন-যা প্রকৃতপক্ষে একটি অতি প্রাকৃতিক ও জগাখিচুড়িপূর্ণ ঘোলাটে দর্শন এবং যাকে প্রতারণাপূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক এই লেবেল দ্বারা বাজারজাত করানো হয়েছে।

শহীদ মোতাহারীর সংক্ষিপ্ত জীবনী শহীদ মুর্তাজা মোতাহারী ১৯১৯ সালের (হিজরী ১৩৩৮) ২ ফেব্রয়ারী খোরাসান প্রদেশের ফারিমান নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ হোসাইন মোতাহারী ছিলেন সে যুগের একজন মস্তবড় সাধক ব্যক্তি ও আলেম। ফারিমানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপণান্তে ১২ বছর বয়সে তিনি মির্জা মেহেদী শহীদী রেজাভীর অধীনে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে মাশহাদের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে গমন করেন। অতঃপর আয়াতুল্লাহ বুরুজারদী , ইমাম খোমেনী ও অন্যান্য মহান শিক্ষক ও চিন্তাবিদদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি কোমে গমন করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। হাজী মির্জা আলী আগা শিরাজীর সাথে পরিচিতি তার চিন্তাধারার বিপুল পরিবর্তন ও প্রভাব ঘটায়। এই সময় শহীদ মোতাহারী ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে বিশেষভাবে আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি ইসলামী আইনের মূলনীতিসমূহ তথা ইলমে উসুল ও ইসলামী আইন বা ফিকাহ এই উভয়বিধ শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে ইসলামী দর্শনশাস্ত্রে আত্মনিয়োগ করেন। ঠিক এই সময়ই তিনি কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে একজন অন্যতম মেধাবী ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। শুধু তাই নয় , তিনি ইমাম খোমেনীর একজন অতিশয় প্রিয় ও স্নেহভাজন ছাত্র হিসেবে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন।

অধ্যাপক মোতাহারী আয়াতুল্লাহ মুহাক্কিক , আগা মেহেদী মির্জা আশতিয়ানী , আল্লামা তাবাতাবায়ী ও আয়াতুলাহজ বুরুজারদীর মতো মহান শিক্ষকদের অধীনে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। আর এভাবেই তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনে ব্রতী হন। তাঁর সুযোগ্য শিক্ষকদের মধ্যে আর যাদের নাম উল্লেখ করা যায় , তারা হলেন আয়াতুল্লাহ ইয়াসবেরী কাশানী , আয়াতুল্লাহ খোনছারী ও আয়াতুল্লাহ সদর।

উপরে উল্লিখিত তার এ বিদ্যা অভ্যাস থেকে এটাই অনুমান করা যায় যে , মাশহাদে থাকাকালীন তথা যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি ইসলামী দর্শনশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে অতীতের সে দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন , মাশহাদে আমি যখন আরবী ভাষা শিক্ষা শুরু করেছিলাম তখন থেকেই আমি আমার অতীতের কথাটা স্মরণ করতে পারি। আমি যদিও মহান দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের দর্শন সম্পর্কে খুব একটা পরিচিত ছিলাম না , তথাপি আমি তখন থেকেই তাদের পান্ডিত্য ও দর্শনের বিশেষ মূল্য দিতে শুরু করি। সুতরাং আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে , আবিষ্কারক , উদ্ভাবক , অনুসন্ধানী ও বিজ্ঞানীদের তুলনায় আমি তাদের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠি। আর এ কারণেই আমি তাদেরকে পৃথিবীর চিন্তা রাজ্যের নায়ক বলে মনে করতে লাগলাম

আমরা অনায়াসে জানতে পারি যে , কোমে ইমাম খোমেনী এবং পরবর্তী পর্যায়ে ইমাম তাবাতাবায়ীর মতো সুযোগ্য উস্তাদদের অধীনে দীর্ঘ ১৫ বছরকাল অধ্যয়নের পূর্বেই অধ্যাপক মোতাহারী দর্শন শাস্ত্রের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। ইমাম খোমেনীর নিকট দর্শনশাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ করা ছাড়াও তিনি ইমামের আখলাক শীর্ষক ক্লাসগুলোতে নিয়মিত যোগদান করতেন। এতে মনে হচ্ছে যে , বক্তৃতামালা তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি নিজেই ইমাম খোমেনীর সে সব বক্তৃতার কথা এভাবে স্মরণ করেছেন : নীতিজ্ঞান তথা আখলাক সম্পর্কে প্রতি বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক (ইমাম খোমেনী) যে সব বক্তৃতা দিতেন আধ্যাত্মিক পথে পরিচালিত করার লক্ষ্যে তা বিশেষ প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের কাজ করতো। তিনি কোন নির্জীব নীতিশাস্ত্রের শুষ্ক আকৃষ্ট করতো যে , আমি অলক্ষ্যেই যেন তার প্রভাবাধীন হয়ে পড়তাম এবং পরবর্তী সোম ও মঙ্গলবার পর্যন্তত আমার হৃদয়পটে স্থায়ী হয়ে থাকতো। আমি এই আধ্যাত্মিক শিক্ষকের নিকট দীর্ঘ ১২ বছর পর্যন্ত যে সব বক্তৃতার ক্লাসে অংশগ্রহণ করেছিলাম আমার আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের অধিকাংশ ফসলগুলো তারই ফলশ্রুতি। আমি সব সময়ই আমাকে তার নিকট ঋণী বলে মনে করতাম

১৯৪২ সালের গ্রীষ্মকাল। মোতাহারীর জীবনে একটি ঘটনা ঘটে গেল। পরবর্তী পর্যায়ে এই ঘটনাই তাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বে রূপায়িত করে। আর এই ঘটনাটি হচ্ছে মরহুম হাজী মির্জা আলী শিরাজী ইস্পাহানীর সঙ্গে তার সাক্ষাতকার। এই সাক্ষাতকারের মাধ্যমেই তিনি নাহজুল বালাগা র প্রকৃত মূল্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। নাহজুল বালাগা হচ্ছে হযরত আলী (আঃ)-এর বক্তৃতা , পত্রাবলী ও বাণীসমূহের একটি সংকলন। নাহজুল বালাগা র প্রতি তার এই পরিচিতি তার জন্য বিশেষ উপকারী হয়েছিল। এই সময় তিনি এই গ্রন্থ ও এর বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। নাহজুল বালাগার মধ্যে ভ্রমণ নামক গ্রন্থটি হচ্ছে তার কাজের একটি অংশ বিশেষ যা তিনি আরো বর্ধিত কলেবরে বের করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে সক্ষম হননি।

১৯৪৭ সালের কথা। বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। যেহেতু দর্শনশাস্ত্রে এমনিতেই তার আগ্রহ ছিল , তাই তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে এই বস্তুবাদী দর্শনের উপর অধ্যয়ন শুরু করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার এ পড়াশোনা অব্যাহত রাখেন। তবে তিনি সিয়ামের আধ্যাত্মিক দর্শনের উপর যে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন তা ছিল তুলনাহীন , বিশেষ করে মোলাসদরের দর্শনের ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল অপরিসীম। একদিকে ইসলামী দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে তার প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি অর্জন তাকে একটি তুলনামূলক দর্শনশাস্ত্র সৃষ্টির ব্যাপারে সক্ষম করেছিল- যে সম্পর্কে পূর্ব থেকে তার নিকট কোন নজীর বা দৃষ্টান্ত ছিল না। অবশ্য তার পূর্বেই আল্লামা তাবাতাবায়ী পাশ্চাত্য দর্শন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে সমালোচনা শুরু করে দিয়েছিলেন। আর তার এ কাজটাই পরবর্তী সময়ে তার বিজ্ঞ ছাত্রগণ একটি নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্তপৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন।

১৯৫১ সালের কথা। আল্লামা তাবাতাবায়ী তুলনামূলক দর্শনশাস্ত্রের পাঠ দান শুরু করেছিলেন। তার প্রদত্ত এসব ক্লাসে উস্তাদ মোতাহারী , শহীদ ড. আয়াতুল্লাহ বেহেশতী , শহীদ ড. বাহোনার এবং আরো অসংখ্য ছাত্র অংশগ্রহণ করেছিলেন। উস্তাদ মোতাহারী এসব বক্তৃতা একটি সংকলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন , যার নাম দেয়া হয়েছিল প্রকৃত দর্শনের মূলনীতি ও পদ্ধতি । তিনি এই সংকলনটিতে অনেক পাদটীকাও সংযোজিত করেছিলেন- যা আল্লামা তাবাতাবায়ীর গ্রন্থের কলেবর থেকে পাঁচ গুণ বড়।

কোমে অধ্যয়নকালে ইরানী সমাজের কতিপয় সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের প্রতি তার দৃষ্টি নিবন্ধ হয়। আর এটাই স্বাভাবিক যে , তার মতো একজন ব্যক্তিত্বের পক্ষে ইরান তথা মুসলিম বিশ্বের এ দূরবস্থা অবলোকন করে উদাসীন ও চুপ থাকা সহজ নয়। ইরানসহ মসলিম জাহানের এই করুণ অবস্থা্ তাকে বাধ্য করেছিল মুসলমানদের সামাজিক , ধর্মীয় , ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর কতিপয় গ্রন্থ রচনা করতে। গ্রন্থ রচনার কথা বাদ দিলেও তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ শিক্ষক এবং অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন বক্তা ও বাগ্মী। একাধারে তার লেখা ও বক্তৃতা ইরানের নতুন প্রজন্মের চিন্তার ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে এবং পাহলভী বংশের নতুন ঔপনিবেশিক গোষ্ঠী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ধ্বংসাত্মক ও বিশৃঙ্খল সামাজিক পদ্ধতির অসারত্বগুলো খণ্ডন করে-যা মূলত দেশ থেকে ইসলাম , ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বিতাড়নের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছিল।

১৯৫৩ সালের দিকে অধ্যাপক মোতাহারী তেহরান গমন করেন এবং খোরাসানের একজন প্রসিদ্ধ আলেমের কন্যাকে বিয়ে করেন। এর এক বছর পরে তথা ১৯৫৪ সালে তিনি আল্লামা তাবাতাবায়ীর বক্তৃতামালা প্রকৃত দর্শনের মূলনীতি ও পদ্ধতি নাম দিয়ে প্রকাশ করেন। ১৯৫৬ সালে তাকে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত ও ইসলামী বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘ ২২ বছর যাবত সেখানে শিক্ষা দানে ব্যাপৃত ছিলেন। এই সময় তিনি ইরানী সমাজের নতুন প্রজন্মের নিকট সুযোগ্য ও মহান শিক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ধর্মীয় ও বদ্ধিজীবীবৃন্দ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সাথে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ ও বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং আদর্শ ও চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েছিলেন , যোগাযোগের নিমিত্তে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি সমরক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৯৫৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ে এমন কি তার পরেও মুসলিম ডাক্তারদের সমিতি কর্তৃক বক্তৃতা দানের জন্য তিনি আমন্ত্রিত হন। এই সময়ে রচিত তার গ্রন্থগুলো মূলত সে সব বক্তৃতাকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান ও উপস্থিতি তাকে কোমের ধর্মকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম করেছিল। কোমের এই বিশ্ববিশ্রুত ধর্মকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ ও যোগসূত্র রচনায় মোতাহারী কঠোর পরিশ্রম করেন। এই ধর্মীয় শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিচালিত ইসলামী বিজ্ঞান সম্বন্ধে অধ্যয়ন করার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও গ্রাজুয়েটকে উদ্বুদ্ধ করেন।

এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু সংখ্যক মার্কসবাদীর উপস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি মার্কসবাদের অজ্ঞৈানিকতা ও ভ্রম সম্বন্ধে কলম ধরতে বাধ্য হন। ধর্মীয় ও দার্শনিক মতামত এবং যুক্তিতর্ক শোনা ও বোঝার ব্যাপারে তার অপরিসীম দক্ষতা ছিল। তাই তিনি তার গ্রন্থাবলীতে প্রতিপক্ষের যুক্তিতর্কগুলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা করার পূর্বে সেগুলোকে যথার্থ ও সুন্দররূপে বর্ণনা ও মূল্যায়ন করার প্রয়াস পান।

শাহের নব্য ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ১৯৬৩ সালের ৫ জুন যে রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় , ঠিক তখন থেকেই উস্তাদ মোতাহারীর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার গুরুত্বপূর্ণ উন্মেষ ঘটে। সেই সময়কার সকল ইসলামী চিন্তাবিদগণ ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সময় তাদের অধিকাংশই গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। উস্তাদ মোতাহারীও গ্রেফতার হন এবং ৫ জুনের মধ্যরাতে তাকে জেলে পাঠানো হয়। এরপর জনগণের অব্যাহত চাপ ও আলেম সমাজের প্রচেষ্টায় তিনি কারামুক্ত হন।

ইমাম খোমেনী তখন জেলে। জনগণ তাদের প্রিয় নেতার সান্নিধ্য ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত হলো , ঠিক এই সময় অধ্যাপক মোতাহারী ব্যক্তিগতভাবে বিপ্লবের সুকঠিন দায়িত্ব তার স্কন্ধে তুলে নেন।

১৯৬৪ সালের কথা। ইমাম খোমেনীকে তুরস্কে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইরানের আলেম সমাজ তখন তাদেরকে সুসংগঠিত করার কাজে ব্যস্ত। পরিশেষে তারা ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেমদের সমন্বয়ে একটি বিপবী ও জেহাদী মোর্চা গঠন করেন। আর ইমামের প্রতিনিধি হিসেবে মোতাহারী এই বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হন। অতঃপর ১৯৬৪-১৯৭৭ পর্যন্তইসলামী বিপবী বাহিনীকে একনায়ক পাহলভী প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে মরণ সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয় উস্তাদ মোতাহারী সে বিপবী বাহিনীকে পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আসলে ইমাম খোমেনীই তাকে এ দায়িত্ব অর্পণ করেন।

১৯৭৮ সাল। বিপ্লবের অগ্নিশিখা তখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। এই সময় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোতাহারীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দৃঢ়তার সাথে নেতৃত্ব দেন। আর এই সময়ই তিনি ইমাম খোমেনীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্যারিস গমন করেন। প্যারিসে অবস্থানকালে ইমাম খোমেনী তাকে বিপবী কাউন্সিল গঠনের পরামর্শ দেন। ইমামের তেহরান প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তার সান্নিধ্যেই অবস্থান করেন এবং তার একজন উপদেষ্টা হিসেবে সার্বিক সহযোগিতা করেন।

১ মে ১৯৭৯। গভীর রাতে উস্তাদ মোতাহারী তার এক বন্ধুর বাসা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক শেষে ঘরে ফিরছিলেন। ফেরার পথে ফোরকান নামক একটি খোদাদ্রোহী তথা নাস্তিক গ্রুপের জনৈক সদস্য তার উপর অতর্কিত হামলা চালায় এবং তাকে হত্যা করে।

উস্তাদ মোতাহারী শাহাদত বরণ করলেন। কিন্তু ইসলামের পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে যে নিরলস কর্মপ্রবাহ রেখে গেছেন তা তাকে যুগ যুগ ধরে চিরঞ্জীব করে রাখবে। সবচেয়ে বড় কথা ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য তার যে স্বপ্ন তা তার জীবদ্দশায়ই সাফল্য অর্জন করে এবং তিনি তা দেখে যেতে সক্ষম হন। তার শহীদী আত্ম চির শান্তিতে থাকুক এবং সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করুক।

রাসূলে আকরাম ( সাঃ ) ও দু দল মুসলমান

রাসূলে আকরাম (সাঃ) মসজিদে নববীতে গেলেন। দেখলেন দু দল লোক গোল হয়ে বসে কোন কাজে লিপ্ত আছে। একদল আল্লাহর যিকির-আযকার ও ইবাদত-বন্দেগী করছিল। আরেক দল লোক (ইসলামী) শিক্ষা-দীক্ষার কাজে মশগুল ছিল। রাসূল (সাঃ) দু দলকেই দেখে খুশি হলেন এবং তাঁর সাথের লোকদেরকে বললেন , এ দু দল লোকই ভালো কাজে লিপ্ত আছে এবং দু দলের অন্তর্ভুক্ত সকল লোকই উত্তম ও পূণ্যবান। তারপর তিনি আরো বললেন , কিন্তু আমাকে পাঠানো হয়েছে লোকদেরকে শিক্ষা দিয়ে জ্ঞানী করে গড়ে তোলার জন্য । এ কথা বলেই তিনি সে দলের দিকে এগিয়ে গেলেন যারা শিক্ষা দান ও গ্রহণের কাজে ব্যস্তছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনিও তাদের সাথে বসলেন এবং শিক্ষা দানের কাজে লেগে গেলেন।

সাহায্যপ্রার্থী এক ব্যক্তি

তিনি তার পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালেন। তার মনে পড়ছিল কতই না কষ্ট-ক্লেশের মধ্য দিয়ে তার দিনগুলো কাটিয়েছেন। সে দিনগুলো তার এমন মন্দ কেটেছে যে , সারাদিন চেষ্টা করেও তিনি তার স্ত্রী ও নিষ্পাপ শিশুদের পেট ভরে খাবার যোগাড় করতে পারতেন না। মনে মনে তিনি একটি কথা চিন্তা-ভাবনা করতেন। যে কথাটি তার মনের মধ্যে জাগরণ এনে দিয়েছিল সে একটি মাত্র কথাই তার অন্তরে এক অসাধারণ শক্তি যুগিয়েছিল। সে কথাটিই তার জীবনে এনে দিয়েছিল এক বিপ্লব। বদলে দিয়েছিল তার দুর্দিনকে সুদিনে। কাল যে পরিবারটি সীমাহীন অভাব-অনটন আর সহায়-সম্বলহীন থাকার কারণে লজ্জা ও লাঞ্ছনার জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল , সে পরিবারটিই আজ একটি মাত্র কথার বরকতে সুখ স্বাছন্দের জীবন যাপন করতে লাগলো।

তিনি আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর একজন সাহাবী। অভাব-অনটন আর দারিদ্র্য তার উপর ছেয়েছিল। একদিন তিনি যখন দুঃখ-কষ্টে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। তখন তার স্ত্রী তাকে পরামর্শ দিলেন , আপনি আপনার এ দুঃখ-কষ্টের কথা আল্লাহর নবী (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে বলুন । স্ত্রীর পরামর্শে রাজী হয়ে স্থির করলেন যে , তিনি রাসূলের খেদমতে হাজির হয়ে নিজের অভাব-অনটনের কথা বলবেন এবং তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা সাহায্য চাইবেন।

সুতরাং তিনি তার মনের সংকল্প নিয়ে মহানবী (সাঃ)-এর দরবারে হাজির হলেন। কিন্তু তিনি তার সাহায্য চাওয়ার আগেই রাসূলের মুখ থেকে একটি কথা শুনতে পেলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন , যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করবো। কিন্তু যদি কোন লোক আল্লাহর সৃষ্টি কোন মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকে তাহলে আল্লাহ তার অভাব মোচন করে দিবেন। এ কথা শুনে তিনি রাসূলের কাছে আর কিছু চাইতে পারলেন না এবং বাড়িতে ফিরে এলেন। ঘরে এসে দেখলেন যে , আগের মতোই দারিদ্র্য ও অভাবের পরিবেশ ছেয়ে আছে। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় দিন আবার সে সংকল্প নিয়েই রাসূলের খেদমতে উপস্থিত হলেন। এ দিনও তিনি রাসূলের মুখে একই কথা শুনতে পেলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন , যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করবো। কিন্তু যদি কোন লোক আল্লাহর বান্দার সামনে হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকে তাহলে সত্য সত্যই আল্লাহ তাকে অপরের মুখাপেক্ষী করে রাখবেন না । এবারও তিনি তার মনের কথা না বলে বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে বিরাজমান সে অভাব-অভিযোগ ও দারিদ্র্য লেগেই আছে। সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও অসহায় অবস্থা তাকে আবারও রাসূলের কাছে যেতে বাধ্য করলো। তাই সাহায্য প্রার্থনার প্রবল ইচ্ছা নিয়েই তিনি আবার মহানবীর নিকট গেলেন। এবারও তিনি রাসূলের কাছ থেকে একই কথা শুনতে পেলেন। আল্লাহর নবী (সাঃ) পূর্বের মতোই সে কথাটি আবার তাকে শোনালেন।

এবার রাসূল (সাঃ)-এর মুখ থেকে সে কথাটি শোনার পর তিনি তার অন্তরে পরম প্রশান্তিবোধ করলেন। তিনি উপলব্ধি করতে লাগলেন যেন এই একটি মাত্র কথাই তার জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর করার চাবিকাঠি। এবারে তিনি যখন রাসূলের (সাঃ) দরবার থেকে উঠে যেতে লাগলেন তখন তার মনের মধ্যে অসীম প্রশান্তি অনুভব করছিলেন। তার অন্তরে অত্যন্ত শান্তিও স্বস্তিনিয়ে তিনি নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন। আর মনে মনে ভাবতে লাগলেন , আগামীতে আর কোনদিন কারো সামনে হাত পাতবেন না। যদি কারো কাছে কিছু চাইতেই হয় তাহলে নিজের প্রভু আল্লাহর কাছে চাইবেন। আর তাঁরই উপর ভরসা রেখে নিজের বাহুবলে কাজ করবেন। তিনিই আমাকে সফলতা দান করবেন এবং আমাকে সকল প্রকারের হাত পাতা থেকে রক্ষা করবেন

মনে মনে ভাবতে লাগলেন , আমার দ্বারা কোন কাজ সম্ভব ? তার মনে হলো , আপাততঃ তিনি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রি করবেন। এ কথা ভেবে-চিন্তে তিনি তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা কুঠার ধার নিলেন এবং জঙ্গলে চলে গেলেন । কিছুক্ষণ পরিশ্রম করে তিনি অনেক লাকড়ি জমা করলেন আর তা এনে বাজারে বিক্রি করলেন। এভাবে তিনি দেখতে পেলেন তার পরিশ্রমের ফল খুবই ভালো। তাই তিনি তার এ কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তিনি তার আয় দ্বারা একটি কুঠার কিনলেন। এরপর আরো কিছু দিনের আয় জমা করে কয়েকটি পশু ও ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলেন। কিন্তু তিনি বনে গিয়ে কাঠ কেটে আনা ও বিক্রি করা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন। তখন গোলাম (চাকর) ইত্যাদি মালিক হলেন।

একদিন রাসূলে আকরাম (সাঃ) তাঁর কাছে গেলেন এবং মুচকি হেসে বললেন , কি ? আমি বলি নি ? যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করবো। কিন্তু যদি কোন লোক অপরের সামনে হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকে তাহলে মহান আল্লাহ তাকে অপরের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।

দোয়ার আবেদন

এক ব্যক্তি খুবই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সাথে ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললো , আমি খুব দরিদ্র ও অভাবী মানুষ। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ আমার রিযিক বাড়িয়ে দেন। আর আমি যেন সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করতে পারি

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন :

আমি তোমার জন্য কখনো এমন দোয়া করবো না

লোকটি একটা চাপা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো :

হে ইমাম! কি কারণে আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন না ?

জবাবে ইমাম (আঃ) বললেন :

তুমি খুব ভালভাবেই জানো যে , মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে একটা পন্থা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তিনি হুকুম দিয়েছেন যে , জীবিকা অর্জনের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ো এবং পরিশ্রম করো। কিন্তু তুমি চাচ্ছো যে , ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে জীবিকা অর্জনের পরিবর্তে দোয়ার দ্বারা রিযিক ঘরে ডেকে আনবে

মদীনা হতে ইমাম হোসাইনের (আ.) হিজরত

ওয়ালিদ ও মারওয়ানের সাথে সাক্ষাতের পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ লিখেছেন- ঐদিন ভোরে অর্থাৎ ৬০ হিজরীর ৩রা শাবান ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কার দিকে রওয়ানা হন । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তার খেদমতে উপস্থিত হন । তারা বলেন যে , আপনি মক্কাতেই অবস্থান করুন । তিনি বললেন- রাসূলে খোদার (সা.) তরফ থেকে আমার উপর যে নির্দেশ আছে তা আমাকে পালন করতেই হবে । ইবনে আব্বাস ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন । পথে তিনি বলছিলেন-واحسینا হায় হোসাইন ! এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আসেন এবং বললেন- এখানকার পথহারা লোকদের সংশোধন করাই উত্তম হবে । যুদ্ধের পদক্ষেপ নিবেন না । তিনি বললেন-

اما علمت ان من هوان الدنیا علی الله ان راس یحیی بن زکریا اهدی الی بغی من بغایا بنی اسرائیل

“ আপনি কি জানেন না , দুনিয়া এতখানি নিকৃষ্ট যে , ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এর মাথা বানি ইসরাইলের এক অবাধ্যের কাছে হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । আপনার কি জানা নেই যে বনি ইসরাইল সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ৭০ জন নবীকে হত্যা করে । এরপর বাজারে এসে তারা কেনা কাটায় মশগুল হয় । অর্থাৎ যেন কোন ঘটনাই ঘটেনি । তবুও মহান আল্লাহ তাআলা তাদের আযাব ত্বরান্বিত করেননি । তাদেরকে অবকাশ দেন । আর অবকাশ দানের পরই চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন । হে আব্দুল্লাহ ! মহান আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবকে ভয় করুন এবং আমার সাহায্য থেকে পিছপা হবেন না । ”

হোসাইন (আ.) এর প্রতি কুফাবাসীর দাওয়াত

কুফাবাসীরা হযরত হোসাইন (আ.) এর মক্কা আগমন এবং ইয়াজিদের হাতে বাইআত গ্রহণে তার অস্বীকৃতির খবর জানত । এ খবর পেয়েই তারা সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ীর ঘরে সমবেত হয় । সমাবেশে সুলাইমান ইবনে সা দ দাড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন । বক্তব্য শেষে তিনি বলেন ওহে আলীর অনুসারীরা! তোমরা সবাই শুনেছ যে , মুআবিয়া মরে গেছে এবং নিজের হিসাব কিতাবের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে । তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে । তার ছেলে ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেছে । আপনারা আরো জানেন যে , হোসাইন ইবনে আলী (আ.) তার সাথে বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি উমাইয়ার জালিম ও খোদাদ্রোহীদের দূরাচার থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তোমরা তার পিতার অনুসারী । হোসাইন (আ.) আজ তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী । যদি এ ব্যপারে নিশ্চিত হও যে , তাকে সাহায্য করবে এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে , তাহলে লিখিত আকারে নিজের প্রস্তুতির কথা তাকে জানিয়ে দাও । যদি ভয় পাও এবং আশংকা কর যে , তোমাদের মধ্যে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে , তাহলেও তাকে জানিয়ে দাও , তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও । তাকে ধোকা দিও না । এরপর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়বস্তুর উপর একটি পত্র লেখেন-

بسم الله الرحمن الرحیم

এ পত্র হোসাইন ইবনে আলী (আ.) সমীপে সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ী , মুসাইয়্যেব ইবনে নাজরা , রেফাআ ইবনে শাদ্দাদ , হাবিব ইবনে মাজাহের আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ায়েলসহ একদল মুমিন ও অনুসারীর পক্ষ হতে প্রেরিত হল ।

সালামের পর আল্লাহর তা ’ রিফ ও প্রশংসা যে , তিনি আপনার ও আপনার পিতার দুশমনদের ধ্বংস করেছেন । সেই জালিম ও রক্তপিপাসু , যে উম্মতের শাসন ক্ষমতা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অন্যায়ভাবে চেপে বসেছে এবং মুসলমানদের বাইতুল মাল আত্মসাৎ করেছে , মন্দ লোকদের বাচিয়ে রেখেছে , আল্লাহর সম্পদকে অবাধ্য দুরাচারীদের হাতে তুলে দিয়েছে , সামুদ সম্প্রদায় যেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছে তারাও সেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হোক । আপনি ছাড়া আমাদের আজ কোন নেতা নেই । কজেই আপনি যদি কষ্ট করে আমাদের শহরে তাশরীফ আনেন তাহলে বড়ই অনুগ্রহ হবে । আশা করি , আপনার মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত করবেন ।

কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশির দারুল এমারাত ’ প্রাসাদে রয়েছে । কিন্তু আমরা তার পেছেনে জামাত ও জুমার নামাজে শরীক হইনি । ঈদের দিন তার সাথে ঈদগাহে যাইনি । যদি শুনতে পাই যে , আপনি কুফায় আসছেন তাহলে তাকে কুফা থেকে বিতাড়িত করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেব । হে পয়গাম্বরের সন্তান আপনার প্রতি সালাম , আপনার পিতার পবিত্র রুহের প্রতি সালাম ।

و السلام علیک و رحمة الله و برکته

و لا حول ولا قوة الا بالله العلی العظیم

চিঠিখানা লেখার পর পাঠিয়ে দিল । দুইদিন অপেক্ষার পর আর একদল লোককে প্রায় ১৫টি চিঠি নিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে দিল । ঐ সব চিঠির প্রত্যেকটিতে দুই কি তিন বা চার জনের স্বাক্ষর ছিল । কিন্তু হোসাইন (আ.) এত সব চিঠিপত্র পাওয়ার পরও নীরব রইলেন তাদের কোন পত্রের উত্তর দিলেন না । এমন কি মাত্র এক দিনেই ৩০০ টি চিঠি এসে তার হাতে পৌছে । এরপরও পর্যায়ক্রমে একের পর এক চিঠি আসছিল । তার চিঠি ১২হাজার ছাড়িয়ে যায় । সর্বশেষ যে চিঠিখানা তার হাতে এসে পৌছে তা ছিল হানি ইবনে হানি ছবিয়ী এবং সায়ীদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফীর । তারা উভয়ে ছিল কুফার অধিবাসী । ঐ পত্রে তারা লিখেন-

بسم الله الرحمن الرحسم

ইবনে হোসাইন আলী (আ.) এর খেদমতে তার ও তার পিতার অনুসারীদের পক্ষ হতে প্রেরিত হলো । সালাম বাদ জনগন আপনার আগমনের অপেক্ষায়। আপনি ছাড়া কাউকে তারা চায় না । হে নবীর সন্তান ! অতি শীঘ্র আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন । কেননা , বাগ-বাগিচাগুলোতে সবুজের সমারোহ এসেছে , ফলগুলো পেকেছে , লতাগুল্ম জেগে উঠেছে এবং সবুজ পত্রে গাছের সৌন্দর্য শোভায় মাতিয়ে তুলেছে । আসুন আপনি আমাদের মাঝে আসুন । কেননা আপনার সৈন্যদলের মাঝেই তো আপনি আসবেন ।

و السلام علیک و رحمة الله وبرکته و علی ابیک من قبلک

চিঠি পাওয়ার পর পত্র বাহক দু জনের কাছে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) জিজ্ঞেস করেন এ চিঠিগুলো কে কে লিখেছে । তারা বলল , হে আল্লাহর রাসুলের সন্তান! পত্রের লেখকরা হলেন-শাব্স ইবনে রাবায়ী , হাজার ইবনে আবজার , ইয়াজিদ ইবনে হারেছ , ইয়াজিদ ইবনে রোয়াম , উরওয়া ইবনে কাইছ , আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে আতারেদ ।

মুসলিম ইবনে আকিলের কুফা গমন

এরুপ পরিস্থিতিতে হোসাইন ইবনে আলী (আ.)একদিন কাবাঘরের পাশে গিয়ে রুকন ও মাকামে ইব্রাহীমের মাঝখানে দাড়িয়ে দু রাকত নামায আদায় এবং মহান আল্লাহর দরবারে পরিস্থিতির কল্যাণকর পরিণতির জন্য দোয়া করেন । অতঃপর মুসলিম ইবনে আকিলকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন ।

এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীর চিঠির জবাব লিখে মুসলিম ইবনে আকিলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। জবাবী পত্রে তাদের আমন্ত্রণ কবুলের ওয়াদা দিয়ে লেখা ছিল- আমি আমার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে তোমাদের কাছে পাঠালাম যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে ।

মুসলিম ইমামের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও মুসলিম ইবনে আকিলকে পেয়ে আনন্দিত হল । তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দিলেন । অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল । প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমামের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন । আনন্দে দর্শনার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে ।

মদীনা হতে ইমাম হোসাইনের (আ.) হিজরত

ওয়ালিদ ও মারওয়ানের সাথে সাক্ষাতের পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ লিখেছেন- ঐদিন ভোরে অর্থাৎ ৬০ হিজরীর ৩রা শাবান ইমাম হোসাইন (আ.) মক্কার দিকে রওয়ানা হন । আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তার খেদমতে উপস্থিত হন । তারা বলেন যে , আপনি মক্কাতেই অবস্থান করুন । তিনি বললেন- রাসূলে খোদার (সা.) তরফ থেকে আমার উপর যে নির্দেশ আছে তা আমাকে পালন করতেই হবে । ইবনে আব্বাস ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন । পথে তিনি বলছিলেন-واحسینا হায় হোসাইন ! এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আসেন এবং বললেন- এখানকার পথহারা লোকদের সংশোধন করাই উত্তম হবে । যুদ্ধের পদক্ষেপ নিবেন না । তিনি বললেন-

اما علمت ان من هوان الدنیا علی الله ان راس یحیی بن زکریا اهدی الی بغی من بغایا بنی اسرائیل

“ আপনি কি জানেন না , দুনিয়া এতখানি নিকৃষ্ট যে , ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়া (আ.) এর মাথা বানি ইসরাইলের এক অবাধ্যের কাছে হাদিয়া হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল । আপনার কি জানা নেই যে বনি ইসরাইল সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত ৭০ জন নবীকে হত্যা করে । এরপর বাজারে এসে তারা কেনা কাটায় মশগুল হয় । অর্থাৎ যেন কোন ঘটনাই ঘটেনি । তবুও মহান আল্লাহ তাআলা তাদের আযাব ত্বরান্বিত করেননি । তাদেরকে অবকাশ দেন । আর অবকাশ দানের পরই চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করেন । হে আব্দুল্লাহ ! মহান আল্লাহর ক্রোধ ও আযাবকে ভয় করুন এবং আমার সাহায্য থেকে পিছপা হবেন না । ”

হোসাইন (আ.) এর প্রতি কুফাবাসীর দাওয়াত

কুফাবাসীরা হযরত হোসাইন (আ.) এর মক্কা আগমন এবং ইয়াজিদের হাতে বাইআত গ্রহণে তার অস্বীকৃতির খবর জানত । এ খবর পেয়েই তারা সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ীর ঘরে সমবেত হয় । সমাবেশে সুলাইমান ইবনে সা দ দাড়িয়ে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন । বক্তব্য শেষে তিনি বলেন ওহে আলীর অনুসারীরা! তোমরা সবাই শুনেছ যে , মুআবিয়া মরে গেছে এবং নিজের হিসাব কিতাবের জন্য আল্লাহর দরবারে পৌছে গেছে । তার কৃতকর্মের ফল সে পাবে । তার ছেলে ইয়াজিদ ক্ষমতায় বসেছে । আপনারা আরো জানেন যে , হোসাইন ইবনে আলী (আ.) তার সাথে বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি উমাইয়ার জালিম ও খোদাদ্রোহীদের দূরাচার থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহর ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন । তোমরা তার পিতার অনুসারী । হোসাইন (আ.) আজ তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী । যদি এ ব্যপারে নিশ্চিত হও যে , তাকে সাহায্য করবে এবং তার দুশমনদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে , তাহলে লিখিত আকারে নিজের প্রস্তুতির কথা তাকে জানিয়ে দাও । যদি ভয় পাও এবং আশংকা কর যে , তোমাদের মধ্যে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রকাশ পাবে , তাহলেও তাকে জানিয়ে দাও , তাকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও । তাকে ধোকা দিও না । এরপর তিনি নিম্নোক্ত বিষয়বস্তুর উপর একটি পত্র লেখেন-

بسم الله الرحمن الرحیم

এ পত্র হোসাইন ইবনে আলী (আ.) সমীপে সুলাইমান ইবনে সা দ খাজায়ী , মুসাইয়্যেব ইবনে নাজরা , রেফাআ ইবনে শাদ্দাদ , হাবিব ইবনে মাজাহের আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়ায়েলসহ একদল মুমিন ও অনুসারীর পক্ষ হতে প্রেরিত হল ।

সালামের পর আল্লাহর তা ’ রিফ ও প্রশংসা যে , তিনি আপনার ও আপনার পিতার দুশমনদের ধ্বংস করেছেন । সেই জালিম ও রক্তপিপাসু , যে উম্মতের শাসন ক্ষমতা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে অন্যায়ভাবে চেপে বসেছে এবং মুসলমানদের বাইতুল মাল আত্মসাৎ করেছে , মন্দ লোকদের বাচিয়ে রেখেছে , আল্লাহর সম্পদকে অবাধ্য দুরাচারীদের হাতে তুলে দিয়েছে , সামুদ সম্প্রদায় যেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হয়েছে তারাও সেভাবে আল্লাহর রহমত হতে বঞ্চিত হোক । আপনি ছাড়া আমাদের আজ কোন নেতা নেই । কজেই আপনি যদি কষ্ট করে আমাদের শহরে তাশরীফ আনেন তাহলে বড়ই অনুগ্রহ হবে । আশা করি , আপনার মাধ্যমে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সঠিক পথে হেদায়েত করবেন ।

কুফার গভর্ণর নোমান ইবনে বশির দারুল এমারাত ’ প্রাসাদে রয়েছে । কিন্তু আমরা তার পেছেনে জামাত ও জুমার নামাজে শরীক হইনি । ঈদের দিন তার সাথে ঈদগাহে যাইনি । যদি শুনতে পাই যে , আপনি কুফায় আসছেন তাহলে তাকে কুফা থেকে বিতাড়িত করে সিরিয়া পাঠিয়ে দেব । হে পয়গাম্বরের সন্তান আপনার প্রতি সালাম , আপনার পিতার পবিত্র রুহের প্রতি সালাম ।

و السلام علیک و رحمة الله و برکته

و لا حول ولا قوة الا بالله العلی العظیم

চিঠিখানা লেখার পর পাঠিয়ে দিল । দুইদিন অপেক্ষার পর আর একদল লোককে প্রায় ১৫টি চিঠি নিয়ে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর কাছে পাঠিয়ে দিল । ঐ সব চিঠির প্রত্যেকটিতে দুই কি তিন বা চার জনের স্বাক্ষর ছিল । কিন্তু হোসাইন (আ.) এত সব চিঠিপত্র পাওয়ার পরও নীরব রইলেন তাদের কোন পত্রের উত্তর দিলেন না । এমন কি মাত্র এক দিনেই ৩০০ টি চিঠি এসে তার হাতে পৌছে । এরপরও পর্যায়ক্রমে একের পর এক চিঠি আসছিল । তার চিঠি ১২হাজার ছাড়িয়ে যায় । সর্বশেষ যে চিঠিখানা তার হাতে এসে পৌছে তা ছিল হানি ইবনে হানি ছবিয়ী এবং সায়ীদ ইবনে আব্দুল্লাহ হানাফীর । তারা উভয়ে ছিল কুফার অধিবাসী । ঐ পত্রে তারা লিখেন-

بسم الله الرحمن الرحسم

ইবনে হোসাইন আলী (আ.) এর খেদমতে তার ও তার পিতার অনুসারীদের পক্ষ হতে প্রেরিত হলো । সালাম বাদ জনগন আপনার আগমনের অপেক্ষায়। আপনি ছাড়া কাউকে তারা চায় না । হে নবীর সন্তান ! অতি শীঘ্র আপনি আমাদের কাছে চলে আসুন । কেননা , বাগ-বাগিচাগুলোতে সবুজের সমারোহ এসেছে , ফলগুলো পেকেছে , লতাগুল্ম জেগে উঠেছে এবং সবুজ পত্রে গাছের সৌন্দর্য শোভায় মাতিয়ে তুলেছে । আসুন আপনি আমাদের মাঝে আসুন । কেননা আপনার সৈন্যদলের মাঝেই তো আপনি আসবেন ।

و السلام علیک و رحمة الله وبرکته و علی ابیک من قبلک

চিঠি পাওয়ার পর পত্র বাহক দু জনের কাছে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) জিজ্ঞেস করেন এ চিঠিগুলো কে কে লিখেছে । তারা বলল , হে আল্লাহর রাসুলের সন্তান! পত্রের লেখকরা হলেন-শাব্স ইবনে রাবায়ী , হাজার ইবনে আবজার , ইয়াজিদ ইবনে হারেছ , ইয়াজিদ ইবনে রোয়াম , উরওয়া ইবনে কাইছ , আমর ইবনে হাজ্জাজ এবং মুহাম্মদ ইবনে ওমর ইবনে আতারেদ ।

মুসলিম ইবনে আকিলের কুফা গমন

এরুপ পরিস্থিতিতে হোসাইন ইবনে আলী (আ.)একদিন কাবাঘরের পাশে গিয়ে রুকন ও মাকামে ইব্রাহীমের মাঝখানে দাড়িয়ে দু রাকত নামায আদায় এবং মহান আল্লাহর দরবারে পরিস্থিতির কল্যাণকর পরিণতির জন্য দোয়া করেন । অতঃপর মুসলিম ইবনে আকিলকে ডেকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন ।

এরপর ইমাম হোসাইন (আ.) কুফাবাসীর চিঠির জবাব লিখে মুসলিম ইবনে আকিলের মাধ্যমে প্রেরণ করেন। জবাবী পত্রে তাদের আমন্ত্রণ কবুলের ওয়াদা দিয়ে লেখা ছিল- আমি আমার চাচাত ভাই মুসলিম বিন আকিলকে তোমাদের কাছে পাঠালাম যাতে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করে সে সম্পর্কে আমাকে অবহিত করে ।

মুসলিম ইমামের পত্র নিয়ে কুফায় আসেন । কুফাবাসী হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ও মুসলিম ইবনে আকিলকে পেয়ে আনন্দিত হল । তাকে মুখতার ইবনে আবী ওবায়দা সাকাফীর বাড়িতে থাকতে দিলেন । অনুসারীরা দলে দলে মুসলিম ইবনে আকিলের সাথে সাক্ষাত করতে আসতে লাগল । প্রত্যেক দল আসার সাথে সাথে মুসলিম ইমামের পত্র পড়ে শুনাতে থাকেন । আনন্দে দর্শনার্থীদের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং তার হাতে বাইআত গ্রহণ করছিল । দেখতে দেখতে আঠারশো লোক তার হাতে বাইআত গ্রহণ করে ।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18