সত্য কাহিনী সম্ভার

সত্য কাহিনী সম্ভার16%

সত্য কাহিনী সম্ভার লেখক:
: মাওলানা আলী আক্কাস
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: চরিত্র গঠনমূলক বই

সত্য কাহিনী সম্ভার
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 79 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 46792 / ডাউনলোড: 5945
সাইজ সাইজ সাইজ
সত্য কাহিনী সম্ভার

সত্য কাহিনী সম্ভার

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি তার বিষয়ের সর্বপ্রথম ও অনন্য অবতারণা হোক অথবা না হোক , এর জন্য প্রাপ্য ফুলের মামলার যোগ্য পাত্র আমি নই , অর্থাৎ যদি এ বইটি কাহিনী রচনার জগতে কোন গুরুত্বপূর্ণ নতুন অবতারণার দাবিদার হয় তাহলে তার গোড়াপত্তনকারী আমি নই। বরং প্রকাশনা ও প্রচারণার একটি প্রতিষ্ঠানে দেশের বিজ্ঞ বিজ্ঞ বিজ্ঞানী-গুণী কতিপয় ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে একটি সম্পাদনা বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এ অধমও সে বোর্ডের একজন সদস্য। দেশের খ্যাতনামা লেখক ও বিজ্ঞতম ব্যক্তিত্ব সমৃদ্ধ সে বোর্ডের এক বৈঠকে প্রস্তাব রাখা হলো যে , এমন একটি গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিত যার মধ্যে চারিত্রিক সুন্দর ও গুণাবলী কাহিনী আকারে উপস্থাপিত থাকবে। আর সে কাহিনীগুলো লেখকের নিজের মস্তিষ্ক থেকে আবিস্কৃত বা নিজের খেয়াল মোতাবেক তৈরি হবে না। বরং তার ভিত্তিমূল ও উৎস হবে হাদীস , বাস্তব জীবন ও ইতিহাসের গ্রন্থরাজি। এর সংকলনের উদ্দেশ্য থাকবে মুসলিম সমাজকে শিক্ষা দান এবং যুব সমাজকে হেদায়েতের পথ প্রদর্শন ও পরিচালনা করা।


1

2

উটের কোমর বাঁধা

কাফেলাটি বহুক্ষণ পথ চলেছিল। সকলের চেহারাতেই ক্লান্তির ছাপ। বহনকারী পশুগুলোও। ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমন একটি স্থানে উপস্থিত হলো যেখানে কিছু পানি ছিল। কাফেলা থেমে গেল। রসুলুলাহ (সাঃ) ও এ কাফেলার সাথে ছিলেন। তিনিও উটের পিঠ থেকে নেমে এলেন। সকলেই চেষ্টা করছিল যে , তাড়াতাড়ি পানির কাছে গিয়ে অযু ইত্যাদি সেরে নামাযের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।

মহানবী (সাঃ)ও নামার পর পানির দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কয়েক ধাপ চলার পর কাউকে কিছু না বলে আবার নিজের উটের দিকে ফিরে এলেন। রাসূলের সাহাবী ও সাথীগণ আশ্চর্য হয়ে পরস্পরে বলাবলি করতে লাগলেন যে , মনে হয় যাত্রা বিরতির জন্য এ স্থানটি আল্লাহর নবীর পছন্দ হয়নি। এখনই হয়তো রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেবেন। সকলেই রাসূলের দিকে তাকিয়ে থাকলেন এবং নতুন হুকুমের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লোকেরা আরো অধিক আশ্চর্য হলেন তখন , যখন তারা দেখলেন যে , মহানবী (সাঃ) নিজের উটের কোমরবন্ধনী (উটের কোমর বাঁধার রশি বিশেষ) হাতে নিলেন এবং নিজের উটের কোমর বাঁধতে শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে তিনি আবার পানির দিকে গেলেন ।

চারদিক থেকে লোকেরা এসে বললেন , হে আল্লাহর রাসূল! আপনি এ কাজের জন্য আমাদেরকে কেন হুকুম দিলেন না ? আপনি কেন এ কাজটি করতে গেলেন ? এ কাজটির জন্য আপনি আবার ফিরে গেলেন। আমরা তো অত্যন্তগর্বের সাথে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম

প্রিয় নবী (সাঃ) তাদের কথার জবাবে বললেন , নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়। সেটা একটি মেসওয়াকের ব্যাপারই হোক না কেন অর্থাৎ কাজটি ছোট হোক অথবা বিরাট ,অপরের ভরসায় বসে থাকার চেয়ে নিজেই করা উচিত

হজ্বের সফর সঙ্গী

হজ্ব থেকে ফিরে এসে এক ব্যক্তি তার নিজের ও তার সঙ্গীদের হজ্বের সফরের কাহিনী ইমাম জা ফর সাদিক (আঃ)-কে বর্ণনা করছিল। সে তার সাথীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তির বিশেষ প্রশংসা করছিল। সে বলতে লাগলো যে , প্রকৃতপক্ষেই সে ব্যক্তিটি খুবই মোত্তাকী-পরহেযগার ও অত্যন্ত ইবাদতকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময়ই মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়েছেন। আমরা যখনই কোথাও রাত্রি যাপন করার উদ্দেশ্যে যাত্রা বিরতি করতাম তখনই তিনি এক কিনারে চলে যেতেন এবং সাথে সাথেই জায়নামায বিছিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন হয়ে যেতেন।

ইমাম সাদিক (আঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তার কাজ-কর্মগুলো আঞ্জাম দিত কে ? কে তার জন্তুটির দেখাশোনা করতো ?

জবাবে লোকটি বললো : তার সমস্তকাজগুলো করে দেবার সৌভাগ্য আমাদেরই হয়েছিল। তিনি তো শুধু তাঁর নেক আমলের কাজগুলোতে ব্যস্ত থাকতেন। এসব কাজের প্রতি তার কোন মনোযোগ ছিল না।

ইমাম (আঃ) বললেন , এ কারণেই তোমরা সকলে উক্ত মোত্তাকী পরহেযগার ও ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক উত্তম

বনভোজন

হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গী দল নিজ নিজ বাহনের পিঠ থেকে নিচে নামলেন। মাল সামানগুলোকে খুলে মাটিতে রাখলেন। তারপর সকলে মিলে ঠিক করলেন যে , একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরী করা হবে।

একজন সাহাবী বললেন , দুম্বা জবাই করা আমার দায়িত্বে রইলো

আরেকজন বললেন দুম্বার চামড়া ছাড়ানো এবং গোশত কাটার দায়িত্ব আমার।

তৃতীয় জন বললেন , গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার।

চতুর্থ জন বললেন ,

রসুলুলাহ (সাঃ) বললেন , কাঠ কুড়িয়ে আনার দায়িত্ব আমার।

সকল সাহাবী এক সাথে বলে উঠলেন , হে আল্লাহর রাসূল! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন ? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা গর্বের সাথে সমস্ত কাজ ঠিকঠাক সেটে নিব।। রাসূল (সাঃ) বললেন , আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ সে বান্দাকে কখনো ভালোবাসেন না যে নিজের বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে এবং নিজেকে অপরের চেয়ে বিশেষ ব্যক্তিত্ব জ্ঞান করে এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানী কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।

হজ্বযাত্রী এক কাফেলা

মুসলমানদের একটি কাফেলা মক্কা যাচ্ছিল। মদীনা পৌঁছেই কাফেলার লোকেরা কয়েক দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। কয়েক দিন বিশ্রাম গ্রহণের পর তারা আবার মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওয়ানা হলো।

মক্কা ও মদীনার মাঝে এক স্থানে এসে কাফেলা আবার বিশ্রাম গ্রহণের জন্য যাত্রা বিরতি করলো। এ সময় কাফেলার লোকদের সাথে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাত ঘটলো যিনি কাফেলার সকল লোককে চিনতেন ও জানতেন। লোকটি যখন কাফেলার লোকদের সাথে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত তখন তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি অত্যন্তহাসি মুখে কাফেলার লোকদের খেদমতে ব্যস্তছিলেন। লোকটি প্রথম দৃষ্টিতেই সে ব্যক্তিকে চিনতে পারলেন , যিনি খুব আনন্দমনে লোকদের খেদমত করে চলছিলেন। তাই অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে কাফেলার লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা কি এ ব্যক্তিকে চেনো যিনি তোমাদের খেদমতে লেগে আছেন ? জবাবে তারা বললো , না ,আমরা এ লোকটিকে মোটেই চিনি না। এ লোকটি তো মদীনা থেকে আমাদের কাফেলার সাথে শামিল হয়েছে। তবে এ কয়েক দিনের সফরের সাথী হিসেবে এতোখানি বলতে পারি যে , এ লোকটি একজন সৎ লোক এবং অত্যন্ত মোত্তাকী-পরহেযগার। আমরা তাকে বলিনি ,আমাদের কাজ করে দাও। কিন্তু সে নিজেই অপরের খেদমতে লেগে আছে এবং সকলেরই সাহায্য-সহযোগিতা করে চলছে

কাফেলার লোকদের বন্ধুটি বললেন , আমি জানি তোমরা তাকে মোটেও চেনো না। যদি তোমরা তাকে চিনতেই পারতে তাহলে কখনও এমন অপরাধজনক কাজ করতে পারতে না যে , একজন সাধারণ খাদেমের ন্যায় তোমাদের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যেতে থাকবেন তিনি । এ কথা শুনে সকলে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলো , তিনি কে ?

লোকটি বললেন , তিনি হলেন আলী ইবনুল হোসাইন (আঃ) অর্থাৎ ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ)

এ কথা শুনেই কাফেলার সমস্তলোক হতবাক হয়ে গেল এবং ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য অত্যন্ত আদবের সাথে ইমামের হাতে চুমু খাওয়ার আশায় তাঁর দিকে এগিয়ে গেল। সমস্তলোক ইমামের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে অনুযোগের সুরে বলতে লাগলো , হে ইমাম! আপনি আমাদের সাথে এমনটি কেন করলেন ? সম্ভাবনা ছিল যে , আমরা অজ্ঞতাবশত আপনার সাথে মারাত্মক কোন অপরাধ করে বসতাম তাতে আমরা বড় গুণাহগার-পাপী হতাম

ইমাম বললেন , যেহেতু তোমরা কেউ আমাকে চিনতে না ,এ জন্যই আমি তোমাদের সফর সঙ্গী হয়েছি । কেননা আমি যখন চেনা-জানা লোকদের সাথে সফর করি তখন লোকেরা রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর খাতিরে আমাকে অত্যন্ত ভালোবেসে আমার সাথে সদয় আচরণ করে। আর তারা আমাকে ছোটখাটো কোন কাজও করতে দেয় না। এ জন্যই আমি সফরের জন্য এমন একটি কাফেলা বেছে নিয়েছি যাদের কেউ আমাকে চেনে না যাতে করে আমি নিজের কাজ নিজেই আঞ্জাম দিতে পারি। আর আমি লোকদের কাছে আমার পরিচয় এজন্য গোপন রেখেছি যাতে করে আমি আমার সাথীদের খেদমত করার সুযোগ লাভ করতে পারি

এক মুসলমান ও এক আহলে কিতাব

সে সময় কুফা নগরী ছিল ইসলামী শাসনেরা প্রাণকেন্দ্র। সিরিয়া ছাড়াও ইসলামী সাম্রাজ্যের অন্য সকল স্থানের সকল লোকের নজর তখন সে নগরীর দিকেই নিবন্ধ থাকতো এ জন্য যে , সেখান থেকে কখন কোন নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ হুকুম জারী করা হয়।

এ শহর থেকে অনেক দূরে দুই ব্যক্তির সাথে রাস্তায় দেখা হলো। একজন মুসলমান আর অপরজন আহলে কিতাব (আহলে কিতাব মানে ইয়াহুদী বা খ্রিস্টান কিংবা যারথুস্ত্রীয়)। দুই জনেই একে অপরের গন্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো। জানা গেল যে ,মুসলমান লোকটি কুফা শহরে যাবে। আর আহলে কিতাব লোকটি কুফার নিকটেই অন্য এক স্থানে যাবে। দুইজনে মিলে স্থির করলে যে , তারা এক সাথে সফর করবে। কেননা ,অনেক দূর পর্যন্ত দুইজনের রাস্তা একই। এক সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে পথ চলা যাবে।

দুজনের আন্তরিক আলাপ-আলোচনা ও বিভিন্ন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে পথ শেষ হয়ে এলো। অবশেষে তারা একটি দুই রাস্তার মোড়ে এসে উপস্থিত হলো যেখান থেকে দু জনের রাস্তা দু দিকে চলে গেছে। আহলে কিতাব লোকটি তার নিজের পথ ধরে চলতে লাগলো। কিছু দূর পথ চলার পর পিছনে ফিরে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো তার মুসলমান বন্ধুটি কুফার দিকে না গিয়ে তারই পিছে পিছে চলে আসছে। এ অবস্থা দেখে সে দাড়িয়ে গেল এবং তার মুসলমান বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলো : কি ভাই! তুমি না বলেছিলে যে , তুমি কুফা যাবে ?

জবাবে মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি তো এখনো বলছি যে ,আমি কুফা যাবো

আহলে কিতাব লোকটি বললো , তাহলে তুমি এদিকে আসছো কেন ? এটা তো কুফার রাস্তা নয়। কুফা যাবার রাস্তা তো ঐটা।

মুসলমান বন্ধুটি বললো , আমি জানি। কিন্তু আমার মন চাইলো যে , কিছু দূর পর্যন্তআমি তোমার সঙ্গ দেবো। কেননা আমাদের নবী বলেছেন যখন দু ব্যক্তি এক সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে পথ চলে তখন একে অপরের প্রতি অধিকার লাভ করে। এখন তোমারও আমার ওপর। সতরাং আমি অধিকার রয়েছে। আমি সে অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্য কিছু দূর পর্যন্ততোমার সাথে চলতে চাই। এরপর তো আমি আমার পথেই ফিরে যাবো

আহলে কিতাব বললো , ওহ্! তোমাদের নবী যে মানুষের উপর এতোই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন এতো দ্রুত বিশ্বে প্রসার লাভ করেছি ,এটা নিশ্চয় তাঁর এই উত্তম চরিত্রেরই গুণে ছিল।

আহলে কিতাব লোকটি আরো বেশী অবাক হলো তখন যখন সে জানতে পারলো যে , তার সফর সঙ্গী মুসলমান বন্ধুটি আর কেউ নন ,বরং মুসলিম মিলাতের বর্তমান খলিফা হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ)। তৎক্ষণাত সে আহলে কিতাব লোকটি ইসলাম গ্রহণ করে মসলমান হয়ে গেল এবং হযরত আলীর একজন বিশ্বস্তও অনুগত সাহাবীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো।

খলিফার সান্নিধ্যে

হযরত আলী (আঃ) কুফার দিকে আসছিলেন। পথে আম্বার নামক এক শহরে উপস্থিত হলেন। যেখানকার বেশীর ভাগ অধিবাসী ছিল ইরানী। ইরানী কৃষক ও মাতব্বররা যখন জানতে পারলো যে , তাদের প্রিয় খলিফা তাদেরই শহর দিয়ে অতিক্রম করবেন তখন তাদের আর আনন্দের সীমা রইলো না। সকলে তাদের খলিফাকে স্বাগতম ও খোশ আমদেদ জানাবার জন্য দৌঁড়ে এলো। হযরত আলী (আঃ)-এর বাহন যখন এগিয়ে চললো তখন লোকেরাও বাহনের আগে আগে দৌঁড়াতে লাগলো। হযরত আলী (আঃ) নিজের বাহন থামিয়ে দিয়ে লোকদেরকে ডেকে পাঠালেন। লোকেরা যখন তার কাছে এলো তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা এভাবে দৌঁড়াদৌড়ি করছো কেন ? এভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ির পেছনে তোমাদের উদ্দেশ্য কি ?

লোকেরা বললো , আসলে এটা শাসকবর্গ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটা রীতি। বহুকাল আগ থেকে প্রচলিত আমাদের একটি প্রথা

হযরত আলী (আঃ) তাদেরকে বললেন , তোমাদের এ কাজ দুনিয়াতে তোমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে আর পরকালেও এর কারণে অনেক শাস্তিভোগ করতে হবে। এমন কাজ কখনো করবে না ,যা তোমাদের অপমান ও লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আর তোমরাই দেখো যে ,তোমাদের এ কাজের দ্বারা তোমাদের ১ নেতা ও অমীরেরই বা কি লাভ হয় ?১০

১০

ইমাম বাক্বের ( আঃ ) ও এক খ্রিস্টান

ইমাম বাক্বের (আঃ)। নাম মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনিল হোসাইন (আঃ) । যার উপাধি ছিল বাক্বের । বাক্বের শব্দের আভিধানিক অর্থ ভাগ-বিশেষণকারী। তাকে বলা হতো বাক্বেরুল উলুম যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাগ-বিশেষণ ও ব্যাখ্যাকারী।

এক খ্রিস্টান বাক্বের শব্দের বিকৃত উচ্চারণ করে ইমামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে চাইলো। সে ইমামকে উদ্দেশ্যে করে বললো , [আনতা বাক্বার] অর্থাৎ তুমি গাভী

ইমাম কোন প্রকার অসন্তুষ্টি বা রাগান্বিত না হয়ে অত্যন্তসরল ও সহজ ভাষায় বললেন , না ভাই! আমি বাক্বার (গাভী) নই। আমি বাক্বের (বিশেষণকারী)

অতঃপর খ্রিস্টান লোকটি বললো , তুমি একটা রাঁধুনির ছেলে। ইমাম বললেন ,এটা তার পেশা ছিল । এতে কোনো লজ্জা বা ঘৃণার কিছু নেই।

খ্রিস্টান লোকটি আরো বললো , তোমার মা ছিল কালো কুৎসিত। তার লজ্জা-শরম কিছুই ছিল না। আর তার ভাষাও ছিল বিশ্রী

এবারও ইমাম অত্যন্তসহজ-সরল ভাষায় বললেন , আমার মাতা সম্পর্কে তুমি যে সব অপবাদ দিচ্ছো তা যদি সত্য হয় তাহলে মহান আল্লাহ যেন তার গুণাহ খাতা মাফ করে দেন। আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে যেনো তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেন। কেননা কারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দেয়া বড়ই গুণাহের কাজ

একজন মানুষ যার জন্যে ইসলামের বহির্ভূত একজন লোককে শাস্তি দেয়ার সব ধরনের সামর্থ্য তার ছিল ,অথচ এতটা ধৈর্য্য ধরলেন। এটুকুই ঐ খ্রিস্টান লোকটির মনের ভেতরে বিপ্লব সংঘটনের জন্য এবং তাকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল।

পরবর্তীতে খ্রিস্টান লোকটি মসলমানু হয়।

১১

এক আরব বেদুঈন ও রাসূলে আকরাম ( সাঃ )

এক আরব বেঈদুন মদীনা শহরে এসে সোজা মসজিদে নববীতে চলে গেল। তার উদ্দেশ্য ছিল মহানবী (সাঃ)-এর কাছ থেকে সোনা-দানা টাকা-পয়সা নিবে। সে সময় প্রিয় নবী (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। বেদুঈন লোকটি রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সামনে এসে তার আরজ পেশ করলো এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আবেদন জানালো। আল্লাহর নবী (সাঃ) তাকে কিছু দান করলেন। কিন্তু তাতে সে সন্তুষ্ট হলো না। সে রাসূলের (সাঃ) দানকে সামান্য গণ্য করলো। তাছাড়া সে কিছু বিশ্রী শব্দ ব্যবহার করে রাসল (সাঃ) এর প্রতি বেয়াদবি করলো। এ অবস্থা দেখে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীরা প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং ঐ লোকটিকে কঠিন শাস্তিদেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সাঃ) তাদেরকে থামিয়ে দিলেন।

এরপর রাসূলে খোদা (সাঃ) লোকটিকে সাথে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলেন এবং তাকে আরো কিছু সাহায্য দান করলেন। এ সময় বেদুঈন লোকটি নিজের চোখে দেখতে পেলো যে ,রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর জীবন ও অন্যান্য নেতা ও শাসকদের জীবনের অবস্থার মধ্যে কোন মিল নেই। আর সে রাসূলের কাছে যে সোনা দানা আশা করেছিলো আসলেই তা তারঁ কাছে নেই।

বেদুঈন আরব সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো এবং মুখে কতৃজ্ঞতার ভাষা উচ্চারণ করলো। তখন মহানবী (সাঃ) আরব বেদঈনকে বললেন , গতকাল তুমি আমার সম্পর্কে বিশ্রী কথাবার্তা বলেছ যা আমার সাহাবীদেরকে উত্তেজিত করে দেয়। তারা তোমার উপর খুবই অসন্তুষ্ট। এখন আমার ভয় হচ্ছে যে ,তারা তোমার কোন ক্ষতি করে বসতে পারে। এখন তুমি আমার সামনে কৃতজ্ঞতার কথা বলেছ। অতএব এটা কি সম্ভব যে ,তুমি তোমার এ কথাটি তাদের সামনেও প্রকাশ করবে যাতে তাদের রাগ দূর হয়ে যায় ? জবাবে সে বললো , এতে আমার কোন আপত্তি নেই

পরদিন বেদুঈন লোকটি মসজিদে নববীতে গেল। যখন সবাই সেখানে সমবেত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , লোকসকল! এ লোকটি বলছে যে আমার প্রতি সে সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। কি ? এ কথা কি সঠিক ?

বেদুঈন লোকটি বললো , জ্বি ,এটাই সঠিক। অতঃপর সে ঐ কথাটাই বিড়বিড় করে বললো যা ইতোপূর্বে বলেছিল। রসূলে খোদা (সাঃ) এর সাহাবীরা তখন হেসে ফেললেন।

এ সময় আল্লাহর নবী (সাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বললেন , এ লোকটি আর আমার ঘটনাটির উদাহরণ হলো সে ব্যক্তির মতো ,যার উট স্বীয় মালিকের প্রতি আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আর লোকেরা উটের মালিককে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়ে শোরগোল শুরুকরে দিল এবং সে পলায়নকারী উটটির পিছে পিছে দৌঁড়াতে লাগলো। উটটি আরো আতঙ্কিত হয়ে দ্রুত পালাতে লাগলো। এ অবস্থা দেখে উটের মালিক সকল লোককে উদ্দেশ্য করে চিৎকার দিয়ে বললো , ভাইসব! অনুরোধ করছি আমার উটের পিছনে কাউকে দৌঁড়াতে হবে না। আমার উটকে কিভাবে শান্তকরতে হয় সেটা আমি ভালো জানি।

তার এ আহ্বান শুনে উটের পিছে দৌঁড়ানো লোকজন থেমে গেল। তারপর উটের মালিক এক মুষ্টি ঘাস নিজের হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে উটের কাছে পৌঁছে গেল। আর খুব সহজে উটের বলা (লাগাম বিশেষ) নিজের হাতে নিয়ে নিল। উটটি তখন মালিকের সাথে ফিরে এলো।

গতকাল যদি আমি তোমাদেরকে বারণ না করতাম তাহলে এ আরব বেদুঈনকে তার জীবন হারাতে হতো। তোমরা তাকে জীবিত ছেড়ে দিতে না। তাতে লোকটি কুফরী ও মূর্তি পূজারীর অবস্থায় মারা যেতো। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমি তোমাদেরকে কোন পদক্ষেপ নিতে দেইনি। আর এখন তোমরা নিজেরাই দেখতে পেলে যে ,আমি আমার ভালোবাসা ও নম্র ব্যহার দ্বারা লোকটিকে একেবারেই মুগ্ধ করে ফেলেছি১১

১২

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি ও ইমাম হোসাইন ( আঃ )

সিরিয়াবাসী এক ব্যক্তি হজ্ব অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্য মদীনায় আসলো। মসজিদে নববীতে একদিন হঠাৎ তার নজর গিয়ে পড়লো এমন এক ব্যক্তির উপর যিনি মসজিদের এক কোণে বসেছিলেন। সে ভাবতে লাগলো যে ,এ লোকটি কে ? নিকটেই দাঁড়ানো অপর এক লোককে জিজ্ঞাসা করলো , এ লোকটি কে ভাই ? সে বললো , তিনি হোসাইন ইবনে আলী ইবনে আবী তালিব (আঃ) । পূর্ব থেকেই ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার-প্রপাগাণ্ডা১২ তার মন-মগজকে (ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে) বিগড়ে রেখেছিল।

সুতরাং এ নামটি শোনার সাথে সাথেই ক্রোধ ও ক্ষোভে তার চেহারা লাল হয়ে গেল। আর সে খোদার সন্তুষ্টি লাভের নিয়তে ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে গালি-গালাজের বৃষ্টি বর্ষণ করতে লাগলো। অশ্রাব্য ,বিশ্রী ও কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করে সে ইমামকে গালি দিয়ে তার অন্তরের জ্বালা মিটালো এবং তার মনের ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশ করলো। ইমাম হোসাইন (আঃ) তার গালাগালিতে মোটেও রাগ করলেন না , বরং অত্যন্ত ভালোবেসে ও সদ্ব্যবহারের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আল-কোরআনের সে আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন ,যে আয়াতগুলোতে ভালো ব্যবহার , ক্ষমা প্রদর্শন ও মার্জনা করার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কোরআনের আয়াতগুলো পাঠ করার পর ইমাম হোসাইন (আঃ) সিরিয়ার অধিবাসী সে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন , আমি তোমার যে কোন খেদমত ও সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত আছি । তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করলেন , তুমি কি সিরিয়ার অধিবাসী ? জবাবে সে বললো , হ্যা! আমি একজন সিরিয়ার অধিবাসী । তখন ইমাম তাকে বললেন , সিরিয়াবাসীদের এরূপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার আছে। আর আমি খব ভালোভাবে জানি ,এ দুর্ব্যবহার ও শত্রুতার কারণ কি ?

অতঃপর ইমাম লোকটিকে বললেন , তুমি এ শহরে একজন মুসাফির । বিদেশের বাড়িতে যদি তোমার কোন কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে তুমি আমাকে বলো। আমি তোমার যে কোন খেদমত করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি তোমাকে আমার মেহমান করতে চাই এবং তোমাকে পোশাক-পরিচ্ছদ ও টাকা-পয়সা ইত্যাদিও দিতে চাই । সিরিয়াবাসী লোকটি তার দুর্ব্যবহার ও গালিগালাজের জন্য একটা কঠোর পরিণতির অপেক্ষা করছিল। সে এমনটি কখনোই আশা করছিল না যে , তার এ অপরাধ ও ধৃষ্টতা একেবারেই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হবে। ইমামের এ সুন্দর ব্যবহার তার মধ্যে এক আত্মিক বিপ্লব এনে দিয়েছে। সে নিজে নিজে বলতে লাগলো , আমার মন চায় যে , মাটি ফেটে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাক আর আমি তাতে ঢুকে পড়ি। হায় আফসোস! নিজের অজ্ঞতার কারণে আমি যদি এ অপরাধ না করতাম! এর আগ পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চেয়ে বড় দুশমন আর কেউ ছিল না। আর এখন আমার দৃষ্টিতে ইমাম হোসাইন (আঃ) ও তাঁর পিতার চাইতে অধিক প্রিয় আর কেউ নেই১৩

১৩

উপদেশ প্রার্থী এক ব্যক্তি

এক আরব বেদুঈন মদীনা শহরে এসে রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে আবেদন করলো , হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমাকে কিছু উপদেশ দান করুন । মহানবী (সাঃ) তাকে বললেন , ক্রোধান্বিত হয়ো না । এর বেশি তাকে আর কিছুই বললেন না।

অতঃপর লোকটি তার গোত্রের মাঝে ফিরে গেল। বাড়ি ফিরেই সে জানতে পারলো যে , তার অনুপস্থিতিতে এক মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে। তারই গোত্রের যুবকরা অপর এক গোত্রের কিছু মালামাল জোরপূর্বক লুটপাট করে নিয়ে এসেছে। এর জবাবে সে গোত্রের লোকেরাও এদের অনেক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এভাবে লুটপাটের এ ধারা উভয় গোত্রের মাঝে এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে ,এখন দুই গোত্রের লোকেরাই এক মারাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও খুনাখুনির পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এ খবর শোনা মাত্রই সে লোকটি ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল। তৎক্ষণাত সে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলো এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটলো নিজের গোত্রের সঙ্গ দেবার জন্য।

ঠিক এমন সময় তার মনে পড়লো যে , সে মদীনায় গিয়েছিল এবং রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কাছে উপদেশ প্রার্থনা করেছিল , তখন মহানবী (সাঃ) বলেছিলেন , নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখো

অতঃপর সে মনে মনে ভাবতে লাগলো , কেন আমি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হলাম কোন কারণে আমি এভাবে যুদ্ধ করতে এবং খুনাখুনি করতে তৈরি হয়ে গেলাম ? কেনই বা আমি এরূপ ক্রোধান্বিত হয়ে গেলাম ? এসব প্রশ্ন তার মনে জেগে ওঠার পর সে ভাবলো : এখনই উপযুক্ত সময় , রসুলুলাহ (সাঃ) ছোট্ট উপদেশটি পালন করার।

এরপর সে এগিয়ে গেল এবং বিরোধী গোত্রের সরদারকে ডেকে বললো , এ সংঘাত কি জন্যে ? যদি এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হয় সে সমস্ত মালামাল ফিরে পাওয়া যা আমাদের গোত্রের যুবকরা বোকামি করে তোমাদের থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে , তাহলে এসো আমি আমার নিজস্ব সম্পদ থেকে তোমাদের ক্ষতিপূর ণ করে দেই। এটা একটা ভালো কথা নয় যে , এর কারণে আমরা একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে যাবো

প্রতিপক্ষ গোত্রের লোকেরা যখন এ ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ ও উদারতাপূর্ণ কথাগুলো শুনলো তখন তাদের মধ্যেও বীরত্ববোধ জেগে উঠলো। বললো , আমরাও তোমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নই। যদি এমনটিই হয় তাহলে আমরা আমাদের দাবি প্রত্যাহার করলাম

তখন উভয় গোত্রের লোকেরা নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল।১৪

রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়

ইসলামের শিক্ষা থেকে শীয়ারা যে জ্ঞান লাভ করেছিল , তাতে শীয়ারা বিশ্বাস করত যে , যে বিষয়টি সমাজের জন্যে সর্বপ্রথম জরুরী তা হল , ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া ।20 আর পরবর্তী পর্যায়ে সেই ইসলামী শিক্ষা সমূহকে পূর্ণ ভাবে সমাজে প্রয়োগ করা । অন্য কথায় ,

প্রথমতঃ সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানব জাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত এবং তা পালনে বর্ত হওয়া উচিত । এমন কি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধীও হয় তবুও তা পালন করা উচিত ।

দ্বিতীয়তঃ একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধি বিধান সমূহকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে । যাতে করে ঐ সমাজের কেউই যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারে । আর এদু টি মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন , যে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিস্পাপ হওয়ার মত গুণের অধিকারী হবে । অন্যথায় হয়ত এমন কোন লোক সেই শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে , যে তার ঐ গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা থেকে মুক্ত নয় । এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যহত হবে ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একটি অত্যাচারী একনায়েক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে । তখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পণ্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবে । বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং যার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুরূপ ছিল , তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) ।21

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে , কুরাইশরা খেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির বিরোধী । তারপরও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করা । ঠিক যেমনটি যাকাত প্রদান অস্বীকারকারীদের সাথে করা হয়েছিল । এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধও করা হয়েছিল । তবুও যাকাত আদায় থেকে তারা বিরত হয়নি । তাই কুরাইশদের বিরোধীতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্যকে হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নি । নির্বাচিত খেলাফতর্ক সম্মতি প্রদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখে ছিল , তা হচ্ছে এ ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি , যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিত । বাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হতে থাকে । যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গানা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল , যা বৃহত্তর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল , তথাপি পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যান । অন্যদিকে এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তারা শ্বাসক গোষ্ঠির সাথে প্রকাশ্যে বিরোধীতা থেকে বিরত থাকেন । এমন কি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সকল জিহাদেরও অংশ গ্রহণ করতেন এবং গণ-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেন । স্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথ নির্দেশনা দিতেন ।22

নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও শীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে , ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত , যার উৎস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে ।23 ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেই । ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমস্যামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পুর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক কাগজ কলম আনার ঘটনা খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে । এ ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যায় যে , নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবগ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসী । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত না । বরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারে । তদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসূল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদ । ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন , পুরস্কৃত হবেন । আর যদি ভুল করেন , ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন) । এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়া লিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায় । কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়িতে আকস্মিকভাবে অতিথি হন । খালিদ বিন ওয়ালিদ তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন ।

অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন । কিন্তু , সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজন । এই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি , খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত খাকলেন ।24 একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়- স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্ বন্ধ করে দেন ।25 রাসূল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত ।26 হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে অব্যাহত ছিল । আর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ 99 - 102 হিঃ) পর্যন্ত বলবৎ থাকে ।27 দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ 13 - 25 হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । এ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধান করেন । যেমন : হজ্জে তামাত্তু মুতা বিবাহ্ এবং আযান হাইয়্যা আলা খায়রিল আমাল ব্যাক্যটির ব্যাবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।28 তিনিই একই বৈঠকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অন্য নীতির প্রচলন শুরু করেন ।29

দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্বপ্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যেরে সৃষ্টি করেন ।30 এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় । দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপ্রাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের কাসূরা (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্ বলে ডাকতেন । তিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি ।

দ্বিতীয় খলিফা ওমর হিজরী 23 সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন । মৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে 6 সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয় । এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেন । তৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়্যাদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেন । হিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পন করেন ।31 এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার , দূর্নীতি , ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার পচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায় ।32 তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চতুর্দিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌছতে লাগল । কিন্তু খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন । ফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না ।

শুধু তাই নয় , মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন ।33 অবশেষে হিজরী 35 সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে । খলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ ক দিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংঘর্ষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করে । সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয় । ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেন । প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে । যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনা । তবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।34

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন । দ্বিতীয় খলিফা , প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেন । আর তৃতীয় খলিফা , দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হন । ঐ কমিটির নির্বাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল । যাই হোক , ইসলামের প্রথম তিন খলিফা , যাদের শাসনকাল প্রায় পচিশঁ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে , তারা নিজস্ব ইজতিহাদু (গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগপোযাগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেন । ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে , পবিত্র কুরআন , তাফসীর (ব্যাখা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবে । আর রাসূল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল । আর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।35 হিজরী 12 সনে সংঘটিত ইয়ামামা র যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল । ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের কারী ও হাফেজ ছিলেন । তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর , প্রথম খলিফা আবুব বকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন , ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন , তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত্ব থাকবে না । সুতরাং কুরআনের সব আয়াতগুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন ।36

এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয় । অথচ রাসূল (সা.)-এর হাদীস , কুরআনের পরই যার অবস্থান , তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিল । কারণ , রাসূল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরিবর্তন , পরিবর্ধন সংকোচন , বিস্মৃতি , বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল না । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি । এমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত , সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হত । পরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছালো যে , খুব অল্প দিনের মধ্যেই নামায , রোযা.... ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হল । একইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি । অথচ , পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসূল (সা.)-এর হাদীসে , জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা , অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে , খেলাফতের যুগে এসে তা সম্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়ে । অধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিল । আর তখন তাদের যুদ্ধলদ্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিল । যার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি । ঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উৎসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তার ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে , হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি । এমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি । শুধু তাই নয় , এ ব্যাপারে তার নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিন । অথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে , রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন । আর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একর্তিতে ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন ।37 খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল । এর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে । ওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যান । এই দীর্ঘ 25 বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেন । যারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.) , হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরতুমিকদাদ কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) , ইয়ামান , ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসূলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হন । যার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চতুর্দিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয় । সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন ।

হযরত আলী ( আ .)- এর খেলাফত ও তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

হিজরী 35 সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয় । প্রায় 4 বছর 5 মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিল । হযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসূল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন ।38 তার পূর্ববতী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল , তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন । খেলাফত প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন ।39 তার এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল , যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছে । হযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেন : হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়তের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লে । তোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে । যে সকল মহৎ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তারা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেন । একইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে । (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছে । তবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয় , সেটা এমন নতুন কিছু নয় । সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয় , হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকে । আর উন্নতির আশাও এতের রয়েছে । তবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে , যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পনুরায় তার কাছে ফিরে এসেছে ।40

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তার বৈপ্লবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেন । কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলন সমূহের স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে , এই আন্দোলনের ফলে যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় , তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠে । আমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপ্লবিক নীতি বহু স্বার্থন্বেষী মহলকে আঘাত করেছিল । তাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠে । বিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুয়া তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করে । এ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিল । শীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধ সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না ।

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার । এমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই ।41

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা জংগে জামাল নামে পরিচিত , তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল না । ঐ মতপার্থক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা বাইতুল মালের অর্থ বন্টনে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভুত হয়েছিল । হযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাইতুল মালের অর্থের সুষম বন্টন করেন ।42 আর এটাই ছিল হযরত রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ । কিন্তু হযরত আলী (আ.)- এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করেছিল । যার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেন । তারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেন । উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন । তারা এটা ভাল করেই জানতেন যে , ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়শার সম্পর্কের টানা পোড়ন চলছে । এ অবস্থাকে তারা আপন স্বার্থে কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজ পক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হন । অতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেন । অবশেষে জংগে জামাল নামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর সূচনা করেন ।43 অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তালহা ও যুবায়ের বিপ্লবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেন । কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি ।44 এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন ।45 ওদিকে নবীপত্নী আয়শাও স্বয়ং ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । তিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন ।46 নবীপত্নী আয়শা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন । তৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেন । তারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন ।

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল , তা হচ্ছে সিফফিনের যুদ্ধ । দীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে । এ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসল । তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেন । এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ্যেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হন । এ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারী । এটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল না । বরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধ । কারণ , প্রতিশোধ গ্রহণ মূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে না । এ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ । অথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহা্য্য চেয়ে পাঠান । মুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হন । কিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্য মূলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে , ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন । এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যান । এর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন ।47 সিফফিন যুদ্ধের পর নাহরাওয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয় । রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেন । একদল লোক যারা সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল , তারাই পরবর্তিতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । তারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে । তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করত । এমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত ।48

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেন । কিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব খাওয়ারেজদের হাতেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন ।

রাসূল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়

ইসলামের শিক্ষা থেকে শীয়ারা যে জ্ঞান লাভ করেছিল , তাতে শীয়ারা বিশ্বাস করত যে , যে বিষয়টি সমাজের জন্যে সর্বপ্রথম জরুরী তা হল , ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া ।20 আর পরবর্তী পর্যায়ে সেই ইসলামী শিক্ষা সমূহকে পূর্ণ ভাবে সমাজে প্রয়োগ করা । অন্য কথায় ,

প্রথমতঃ সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানব জাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত এবং তা পালনে বর্ত হওয়া উচিত । এমন কি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধীও হয় তবুও তা পালন করা উচিত ।

দ্বিতীয়তঃ একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধি বিধান সমূহকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে । যাতে করে ঐ সমাজের কেউই যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারে । আর এদু টি মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন , যে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিস্পাপ হওয়ার মত গুণের অধিকারী হবে । অন্যথায় হয়ত এমন কোন লোক সেই শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে , যে তার ঐ গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা থেকে মুক্ত নয় । এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যহত হবে ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একটি অত্যাচারী একনায়েক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে । তখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পণ্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবে । বিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং যার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পবিত্র কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুরূপ ছিল , তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (আ.) ।21

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে , কুরাইশরা খেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির বিরোধী । তারপরও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করা । ঠিক যেমনটি যাকাত প্রদান অস্বীকারকারীদের সাথে করা হয়েছিল । এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধও করা হয়েছিল । তবুও যাকাত আদায় থেকে তারা বিরত হয়নি । তাই কুরাইশদের বিরোধীতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্যকে হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নি । নির্বাচিত খেলাফতর্ক সম্মতি প্রদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখে ছিল , তা হচ্ছে এ ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি , যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিত । বাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হতে থাকে । যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গানা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল , যা বৃহত্তর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল , তথাপি পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যান । অন্যদিকে এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তারা শ্বাসক গোষ্ঠির সাথে প্রকাশ্যে বিরোধীতা থেকে বিরত থাকেন । এমন কি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সকল জিহাদেরও অংশ গ্রহণ করতেন এবং গণ-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেন । স্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথ নির্দেশনা দিতেন ।22

নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও শীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে , ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত , যার উৎস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে ।23 ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেই । ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমস্যামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর মৃত্যু পুর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক কাগজ কলম আনার ঘটনা খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলে । এ ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যায় যে , নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবগ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসী । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত না । বরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারে । তদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসূল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদ । ইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন , পুরস্কৃত হবেন । আর যদি ভুল করেন , ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন) । এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়া লিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায় । কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়িতে আকস্মিকভাবে অতিথি হন । খালিদ বিন ওয়ালিদ তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন ।

অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন । কিন্তু , সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজন । এই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি , খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত খাকলেন ।24 একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়- স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্ বন্ধ করে দেন ।25 রাসূল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত ।26 হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে অব্যাহত ছিল । আর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ 99 - 102 হিঃ) পর্যন্ত বলবৎ থাকে ।27 দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ 13 - 25 হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । এ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধান করেন । যেমন : হজ্জে তামাত্তু মুতা বিবাহ্ এবং আযান হাইয়্যা আলা খায়রিল আমাল ব্যাক্যটির ব্যাবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ।28 তিনিই একই বৈঠকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অন্য নীতির প্রচলন শুরু করেন ।29

দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্বপ্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যেরে সৃষ্টি করেন ।30 এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায় । দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপ্রাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের কাসূরা (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্ বলে ডাকতেন । তিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি ।

দ্বিতীয় খলিফা ওমর হিজরী 23 সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হন । মৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে 6 সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয় । এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেন । তৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়্যাদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেন । হিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পন করেন ।31 এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার , দূর্নীতি , ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার পচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায় ।32 তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের চতুর্দিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌছতে লাগল । কিন্তু খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেন । ফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না ।

শুধু তাই নয় , মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন ।33 অবশেষে হিজরী 35 সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে । খলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ ক দিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংঘর্ষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করে । সিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয় । ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেন । প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে । যদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনা । তবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না ।34

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন । দ্বিতীয় খলিফা , প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেন । আর তৃতীয় খলিফা , দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হন । ঐ কমিটির নির্বাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল । যাই হোক , ইসলামের প্রথম তিন খলিফা , যাদের শাসনকাল প্রায় পচিশঁ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে , তারা নিজস্ব ইজতিহাদু (গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগপোযাগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেন । ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে , পবিত্র কুরআন , তাফসীর (ব্যাখা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবে । আর রাসূল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে । পবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিল । আর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ।35 হিজরী 12 সনে সংঘটিত ইয়ামামা র যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল । ঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের কারী ও হাফেজ ছিলেন । তখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর , প্রথম খলিফা আবুব বকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেন । দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন , ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন , তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত্ব থাকবে না । সুতরাং কুরআনের সব আয়াতগুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন ।36

এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয় । অথচ রাসূল (সা.)-এর হাদীস , কুরআনের পরই যার অবস্থান , তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিল । কারণ , রাসূল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরিবর্তন , পরিবর্ধন সংকোচন , বিস্মৃতি , বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল না । কিন্তু রাসূল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি । এমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত , সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হত । পরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছালো যে , খুব অল্প দিনের মধ্যেই নামায , রোযা.... ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হল । একইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি । অথচ , পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসূল (সা.)-এর হাদীসে , জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা , অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে , খেলাফতের যুগে এসে তা সম্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়ে । অধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিল । আর তখন তাদের যুদ্ধলদ্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিল । যার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নি । ঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উৎসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তার ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে , হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি । এমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নি । শুধু তাই নয় , এ ব্যাপারে তার নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিন । অথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে , রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেন । আর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একর্তিতে ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন ।37 খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক হতে সাহায্য করেছিল । এর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে । ওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যান । এই দীর্ঘ 25 বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেন । যারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.) , হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরতুমিকদাদ কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) , ইয়ামান , ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসূলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হন । যার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চতুর্দিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয় । সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন ।

হযরত আলী ( আ .)- এর খেলাফত ও তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

হিজরী 35 সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয় । প্রায় 4 বছর 5 মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিল । হযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসূল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন ।38 তার পূর্ববতী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল , তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন । খেলাফত প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন ।39 তার এসব পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষে এক বৈপ্লবিক আন্দোলন ছিল , যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছে । হযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেন : হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়তের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লে । তোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন ঘটবে । যে সকল মহৎ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তারা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেন । একইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে । (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছে । তবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয় , সেটা এমন নতুন কিছু নয় । সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয় , হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকে । আর উন্নতির আশাও এতের রয়েছে । তবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে , যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পনুরায় তার কাছে ফিরে এসেছে ।40

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তার বৈপ্লবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেন । কিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলন সমূহের স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে , এই আন্দোলনের ফলে যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় , তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠে । আমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপ্লবিক নীতি বহু স্বার্থন্বেষী মহলকে আঘাত করেছিল । তাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠে । বিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুয়া তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করে । এ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিল । শীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধ সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না ।

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার । এমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই ।41

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা জংগে জামাল নামে পরিচিত , তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল না । ঐ মতপার্থক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা বাইতুল মালের অর্থ বন্টনে শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভুত হয়েছিল । হযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাইতুল মালের অর্থের সুষম বন্টন করেন ।42 আর এটাই ছিল হযরত রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ । কিন্তু হযরত আলী (আ.)- এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করেছিল । যার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেন । তারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেন । উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেন । তারা এটা ভাল করেই জানতেন যে , ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়শার সম্পর্কের টানা পোড়ন চলছে । এ অবস্থাকে তারা আপন স্বার্থে কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজ পক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হন । অতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেন । অবশেষে জংগে জামাল নামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধর সূচনা করেন ।43 অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তালহা ও যুবায়ের বিপ্লবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেন । কিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি ।44 এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন ।45 ওদিকে নবীপত্নী আয়শাও স্বয়ং ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন । তিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন ।46 নবীপত্নী আয়শা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেন । তৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেন । তারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন ।

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল , তা হচ্ছে সিফফিনের যুদ্ধ । দীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে । এ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসল । তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেন । এ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ্যেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হন । এ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারী । এটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল না । বরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধ । কারণ , প্রতিশোধ গ্রহণ মূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে না । এ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ । অথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহা্য্য চেয়ে পাঠান । মুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হন । কিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্য মূলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে , ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন । এ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যান । এর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন ।47 সিফফিন যুদ্ধের পর নাহরাওয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয় । রাসূল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেন । একদল লোক যারা সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল , তারাই পরবর্তিতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে । তারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টি করতে থাকে । তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করত । এমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত ।48

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররাচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেন । কিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব খাওয়ারেজদের হাতেই তিনি শাহাদৎ বরণ করেন ।


6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18