22
খলিফার দরবারে
মুতাওয়াককিল একজন স্বৈরাচারী আব্বাসীয় শাসক। সে হযরত ইমাম হাদী (আঃ)-এর প্রতি জনগণের আধ্যাত্মিক টান প্রত্যক্ষ করে সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো। তার মনঃকষ্টের শেষ ছিল না যখন দেখতো লোকেরা আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সাথে ইমামের হুকুম ও নির্দেশবালীর আনুগত্য করার জন্য প্রস্তুত। শাসকের পরামর্শদাতারা তাকে আগেই বলে রেখেছিল যে , আলী ইবনে মুহাম্মদ আন নাকী (আঃ) অথার্ৎ ইমাম হাদী (আঃ) আপনার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গোপনে বিদ্রোহ ও বিপ্লব করার ইচ্ছা রাখে। কাজেই এটা অসম্ভব কিছু নয় যে , তার বাড়ী থেকে এমন সব কাগজপত্র ও সাজ সরঞ্জাম বেরিয়ে পড়বে যা এ কথাকে প্রমাণ করবে। তাই মুতাওয়াককিল এক রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়লো , মধ্য রাতের নীরব নিশীথে তার একদল জলাদ প্রকৃতির নির্দয় লোককে হুকুম দিল যে , ইমাম হাদী (আঃ)-এর ঘর তলাশি করো । তারপর তাকে আমার দরবারে হাজির করো। মুতাওয়াককিল এ সিদ্ধান্তটি তখন নিয়েছিল যখন সে তার শরাবখোর বন্ধুদের সাথে মদ্যপানে লিপ্ত ছিল।
যা হোক , মুতাওয়াককিলের নির্দেশ পাওয়া মাত্র তার লোকেরা আনন্দ-উলাস করে ইমামের বাড়িতে হানা দিল। তারা সর্বপ্রথম ইমাম (আঃ)-কেই খুঁজে বের করলো। দেখতে পেলো ইমাম (আঃ) একটি কক্ষ নির্জন করা এবং কার্পেটটি একপাশে গোটানো। আর তিনি বালু ও নুড়ির উপর বসে বসে আল্লাহর যিকির ও তার সাথে মনের গোপন ভেদ প্রকাশের কথাবার্তায় মশগুল আছেন। তারপর শাসক সেবাদাসরা ইমামের ঘর তলাশি শুরু করলো। তারা ঘরের আনাচে-কানাচে তলাশি করছিল। তারা যা চাচ্ছিল তেমন কিছুই হস্তগত হলো না বাধ্য হয়ে তারা কেবল ইমাম (আঃ)-কে ধরে এনে মুতাওয়াককিলের সামনে হাজির করলো।
হযরত ইমাম হাদী (আঃ) যখন উপস্থিত হলেন তখন দেখতে পেলেন মদ্যপানের আসর জমজমাট। আর মুতাওয়াককিল তার মাঝে বসে মদ পানে লিপ্ত। ইমামকে দেখে সে বললো ,‘
তাকে আমার পাশেই বসার আসন দাও। ইমাম বসলেন। মুতাওয়াককিল ইমামের দিকে মদের পেয়ালা এগিয়ে দিল। তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন , খোদার কসম। আমার রক্ত-মাংসে কোন দিন মদ প্রবেশ করেনি। সুতরাং এ বিষয়ে তুমি আমাকে ক্ষমা করো।
মুতাওয়াককিল ইমামের আপত্তি মেনে নিল এবং বললো , তাহলে কিছু কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। গযলের মন-মাতানো ছন্দের সূরে আমাদের এ আসরকে আরো সৌন্দর্য-মন্ডিত ও আনন্দদায়ক করে তুলুন।
ইমাম (আঃ) বললেন , আমি কোন কবি নই। পূর্বতন কবিদের কবিতা সামান্যই আমার স্মরণে আছে। মুতাওয়াককিল বললো , উপায় নেই। কবিতা আপনাকে পড়তেই হবে।
ইমাম (আঃ) কবিতা আবৃত্তি আরম্ভ করলেন।
যার বিষয়বস্তু এই :
*অনেক লোকেরাই এ পৃথিবীতে নিরাপদ-নিশ্চিন্তে ও আরাম-আয়েশে বসবাস করার জন্য উঁচু উঁচু বিরাট বিশাল দালান-কোঠা ও মজবুত দুর্গ গড়ে তুলেছে। তাদের নিরাপত্তা ও হেফাযতের জন্য তারা সব সময় সশস্ত্র সান্ত্রী পাহারাদার নিয়োগ করে রেখেছে। কিন্তু সশস্ত্র এ সিপাহী-লশকররা কেউই তাদের মৃত্যুর সাথে মোকাবিলা করতে পারেনি। আর না তাদের বিপদের সময় তাদেরকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সফলতা লাভ করতে পেরেছে।
*অবশেষে একদিন তাদেরকে এসব উঁচু উঁচু অট্টালিকা , সুরম্য মহল ও সুদৃঢ়-মজবুত কিলাথেকে টেনে-হেঁচড়ে কবর বাড়ির ছোট্ট অন্ধকার কবরের গর্তের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অতীব দুর্ভাগ্যজনকভাবে ও অত্যন্ত অসহায় অবস্থার মতো ছোট্ট একটি সংকীর্ণ পরিসরে নিস্প্রদীপ আঁধার গোরে , চিরদিনের জন্য বসবাসের ঠিকানা বানাতে বাধ্য হয়েছে।
*এমতাবস্থায় অদৃশ্য আহবানকারী ডেকে জিজ্ঞেস করে তাদের তোমাদের সে শান-শওকত আর তখত ও তাজ কোথায় চলে গেছে আজ ?
কোথায় রেখে এসেছো তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অহংবোধ ?
*কোথায় তোমাদের সে চেহারাটি , যা তোমরা নাজ-নেয়ামত খেয়ে খেয়ে নাদুশ-নুদুশ করে লালন করেছিল ?
চকচকে ঝলমল রেশমী মিহি পর্দার আড়ালের গর্ব-অহংকারে ভরপুর সে মুখটি কোথায় , যা তোমরা গণমানষ থেকে অনেক দূরে লুকিয়ে রেখেছিলে ?
*ভাগ্য বিপর্যয় কবর দিয়েছে তাদেরকে পরিণতি লাঞ্ছনা আর অবমাননার। ভোগ-বিলাসে লালিত দেহটিকে সঁপে দিয়েছে লোকেরা সে মাটির দয়ার কাছে , যে মাটিকে পদতলে পিষে চলতো দম্ভ অহংকার ভরে।
*দীর্ঘকাল ধরে এরা পৃথিবীতে স্বাদ-আস্বাদের রকমারি খাদ্য খাবার ভক্ষণ করে চলে এসেছিল। কিন্তু আজ তারাই পরিণত হয়েছে মাটির খাদ্যরূপে। আর তারা মাটির গর্ভেই তাদের পরিণতি ভুগতে থাকবে চিরকাল-চিরদিন।
হযরত ইমাম (আঃ) নিজস্ব বিশেষ ভঙ্গিতে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলেন এমনভাবে যে , উপস্থিত সকলের এমন কি স্বয়ং মুতাওয়াককিলের অন্তরের গভীরে গিয়ে দাগ কেটেছে। কবিতা আবৃত্তি শেষ হবার সাথে সাথে মদ্যপানের এ আসরে অংশগ্রহণকারী সকলের মদের নেশা কেটে গেল। মুতাওয়াককিল মদের পেয়ালাটি ছুঁড়ে মারলো। আর তার চোখ দিয়ে অশ্রুপ্রবাহিত হতে লাগলো।
এভাবে মদ্যপানের এ আসরটির পরিসমাপ্তি ঘটলো। প্রকৃত সত্যের আলো একজন জালিম প্রকৃতির শাসকের অন্তরে বিরাজিত গর্ব-অহংকারের কালিমাকে পরিষ্কার করে দিল , যদিও তার প্রতিক্রিয়া অল্প কিছুক্ষণই অবশিষ্ট ছিল।