27
ভার উত্তোলন প্রতিযোগিতা
একদল মুসলমান যুবক শক্তি পরীক্ষা ও ভার উত্তোলন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। সেখানে খুব ভারী একটা পাথর পড়ে ছিল। যুবক দল সে ভারী পাথরটি উত্তোলন করার ক্ষেত্রে নিজেদের শক্তি ও বাহাদুরী প্রদর্শন করছিল। প্রত্যেকেই নিজের শক্তি অনুযায়ী সে পাথরটি উত্তোলনের চেষ্টা করছিল। এমন সময় রাসূলে আকরাম (সাঃ) সেখানে পৌঁছলেন এবং যুবকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন , তোমরা কি করছো ?
যুবকরা বললো , আমরা শক্তি পরীক্ষা করছি। আমরা দেখতে চাই যে , আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী কে ?
রাসূল (সাঃ) বললেন , তোমরা যদি বলো তাহলে আমি বলে দিতে পারি তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী কে ? তারা বললো , জী হ্যাঁ! অবশ্যই! এর চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে যে , আপনার মতো ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি আমাদের প্রতিযোগিতার বিচারক হবেন ?
সকলেই আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছিল যে , রাসূলে আকরাম (সাঃ) কাকে সব চাইতে শক্তিশালী বলে ঘোষণা করেন। কেউ কেউ ভাবছিল যে , এখনই রাসল (সাঃ) তার হাত ধরে সকলের সামনে ঘোষণা দেবেন যে , তোমাদের মধ্য থেকে এ ছেলেটি সবচেয়ে শক্তিশালী।
আল্লাহর নবী (সাঃ) বললেন , সবচাইতে শক্তিশালী সে ব্যক্তি , যার কোন জিনিস খুব পছন্দ হয় আর সে ঐ জিনিসের প্রতি আসক্তও হয়ে পড়ে। কিন্তু সে জিনিসের আসক্তি তাকে সত্য পথ ও মানবতা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। আর মন্দের দ্বারা কলুষিত করে না। আর যদি সে ব্যক্তি কোন বিষয়ে অসন্তুষ্ট হয় এবং রাগ ও ক্ষোভের কারণে অগ্নিশর্মা হয়ে যায় তাহলে সে অবস্থাতেও সে নিজেকে সংযত রাখে , সত্য ছাড়া মিথ্যা বলে না। সে যদি প্রতাপশালী হয় এবং বাধাসমূহ তার সামনে থেকে সরে যায় তাহলেও তার অধিকারের বাইরে সে হাত বাড়ায় না।
28
নওমুসলিম
দুই প্রতিবেশী! একজন মুসলমান ও অন্যজন খ্রিস্টান। তারা মাঝে মাঝে ইসলাম ধর্ম নিয়ে পরস্পরে আলাপ-আলোচনা করতো। মুসলমান লোকটি ছিল খুবই দ্বীনদার-ইবাদতকারী। আলাপ-আলোচনার সময় সে ইসলাম ধর্মের এতো প্রশংসা ও শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতো যে , তার খ্রিস্টান বন্ধুটি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেলো। অবশেষে কিছুদিন পর সে খ্রিস্টান লোকটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নিলো।
রাতের বেশীর ভাগ সময় পার হয়ে সেহরীর সময় হয়েছিল। নও মুসলিম সে খ্রিস্টান লোকটি বুঝতে পারলো যে , কেউ তার ঘরের দরজায় টোকা দিচ্ছে। সে ত্রস্ত-ব্যস্তহয়ে দরজার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলো , কে ?
দরজার বাহির থেকে জবাব এলো , আমি অমুক অর্থাৎ দরজায় আওয়াজ দেয়া লোকটি নিজের পরিচয় দিল। এ সেই মুসলমান প্রতিবেশী লোকটি যার হাতে খ্রিস্টান লোকটি কয়েকদিন পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিল। সে নও মুসলিম খ্রিস্টান লোকটি প্রতিবেশী বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলো , এতো রাতে কি দরকারে এসেছো ?
মুসলমান বন্ধুটি বললো , তাড়াতাড়ি অযু করে নাও। তারপর কাপড়-চোপড় পরে বেরিয়ে এসো। ফজরের নামায পড়ার জন্য মসজিদে যেতে হবে। সে নতুন মুসলমানটি জীবনে প্রথমবারের মতো অযু করলো। তারপর মুসলমান বন্ধুটির সাথে মসজিদে চলে গেল। এখনও সকাল হতে অনেক দেরী। রাতের নফল নামাযের সময় আছে। দইু বন্ধু বেশ কিছুক্ষণ ধরে নফল নামায আদায় করলো। এমন সময় সেহরীর সময় পার হয়ে সাদা আভা দেখা দিল অর্থাৎ ফজরের নামাযের সময় হলো। তারা ফজরের নামায আদায় করলো। এরপর দোয়া-দরুদ ইত্যাদিতে লিপ্ত হলো। এভাবে পূর্ণ সকাল হয়ে গেল। তাই নও মুসলমানটি মসজিদ থেকে বাড়ি যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালো। তার মুসলমান বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করলো , কোথায় যাচ্ছো ?
জবাবে নও মুসলিমটি বললো , বাড়ি যাচ্ছি। সকালের নামায তো পড়ে নিলাম। এখন আর এখানে কি কাজ ?
মুসলমান বন্ধুটি বললো , আর একটু দেরী করো। নামাযের পরের দোয়া-দরুদ ইত্যাদিও পড়ে নাও। এরই মধ্যে সূর্যও উদয় হয়ে যাবে।
নও মুসলিম বন্ধুটি বললো , বেশ ভালো।
এ কথা বলে সে মসজিদে বসে গেল এবং খোদার যিকির-আযকারে লিপ্ত হলো। সূর্য উঠে গেল। সে আবার বাড়ি যাবার জন্য উঠছিল। এমন সময় তার মুসলমান বন্ধুটি কোরআন মজীদ তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , আপাতত কিছুক্ষণ কোরআন তিলাওয়াত করো। এতে করে সূর্যটা ও ভালোভাবে উঠে যাবে। আর আমি তোমাকে উপদেশ দেবো যে , আজ তুমি রোযার নিয়ত করে নাও। তুমি কি জানো না রোযা কত সওয়াব ও ফজিলতের কাজ ?
এভাবে ধীরে ধীরে যোহরের নামাযের সময় হয়ে এসেছে। সে মুসলমান বন্ধুটি বললো , আর একটু দেরী করো। যোহরের নামাযের সময় প্রায় হয়ে গেছে। যোহরের নামাযও মসজিদে পড়ে নাও। যোহরের নামাযও পড়া হলো। তারপর মুসলমান বন্ধুটি বললো , আর অল্প কিছুক্ষণ দেরী করো। আসরের নামাযের ফজিলতের সময় খুবই নিকটবর্তী। এ নামাযটাও ফজিলতের সময়ে আদায় করে নেয়া যাক। আসরের নামায শেষ হবার পর তার নও মুসলিম বন্ধুটিকে বললো , সূর্যাস্ত খুব নিকটে। আর অল্প পরেই মাগরিব নামাযের সময় হয়ে যাবে। নও মুসলিম লোকটি মাগরিব নামাযের পর বাড়ি যাবার ইচ্ছা করলো। সারা দিন রোযা রাখার পর এখন ইফতার করবে। তার মুসলমান বন্ধুটি বললো , এখন একমাত্র এশার নামাযই বাকি আছে। আর খানিক সময় অপেক্ষা করো। ঘণ্টা খানিকের মধ্যে এশার নামাযের ফজিলতের সময়। এভাবে এশার নামাযও সে নওমুসলিম লোকটি মসজিদে আদায় করলো। এরপর বাড়ি ফিরে গেলো।
দ্বিতীয় রাতে সেহরীর সময় সে নও মুসলিমের কানে দরজা টোকানোর শব্দ এলো। সে জিজ্ঞাসা করলো , কে ?
জবাব এলো , আমি তোমার প্রতিবেশী অমুক। অযু করে কাপড়-চোপড় পরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসো। এক সাথে মসজিদে গিয়ে ফজরের নামায আদায় করবো।
নও মুসলিম বললো , আমি গতকাল মসজিদ থেকে ফিরে এসে তখনই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছি। তুমি চলে যাও। আমার থেকে বেকার কোন লোক খুঁজে নাও যার কাছে নামায , রোযা ও আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত দুনিয়ার আর কোন কাজ নেই। সে তার সমস্ত সময় মসজিদে কাটিয়ে দেবে। আমি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তলোক। তা ছাড়া আমার উপর আমার পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে। সুতরাং আমার নামায-রোযা ও খোদার ইবাদত ছাড়া আরো কাজ-কর্ম রয়েছে। আমাকে আমার পরিবারের লোকদের জন্য খাওয়া পরার ব্যবস্থাও করতে হবে।
হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) তাঁর সাহাবীদের নিকট এ ঘটনাটি বর্ণনা করার পর বলেন , এভাবে এ কঠোর ও চরম ইবাদতকারী পরহযেগার লোকটি একজন অমুসলিমকে মুসলমান তো বানালো , কিন্তু নিজের কট্টর মনোভাব অবলম্বনের কারণে সে তার নিজেরই হাতে করা নওমুসলিম বন্ধুটিকে ইসলামের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। অতএব তোমাদেরকে সর্বদা এ সত্যটি সামনে রাখতে হবে যে , লোকেরা তোমাদের কঠোর মনোভাব ও চরম পন্থা অবলম্বনের কারণে যেনো বিরক্ত না হয়ে যায়। তাদের সামর্থ্য ও সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রেখে কাজ হবে যাতে করে তারা দ্বীন ইসলাম ও এর সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজে নিজেই ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। ইসলাম থেকে যেন সরে না পড়বে। তোমাদের কি এ কথা জানা নেই যে , কঠোরতা ও বলপ্রয়োগ উমাইয়া শাসকদের নীতি ছিল ? কিন্তু আমাদের নীতি হচ্ছে। মধুর চরিত্র , নম্র আচরণ , ভালোবাসা ও পরস্পর আন্তরিকতা ভিত্তিক। নির্ভেজাল ইসলামী চরিত্র ও উত্তম আচরণের দ্বারা লোকদের অন্তর জয় করে নেয়াই আমাদের পন্থা।