লেখকের কথা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আমরা ইরানের আটানব্বই ভাগ মানুষ মুসলমান। একদিকে নিজেদের ধর্ম হিসেবে ইসলামের প্রতি যেমন আমাদের গভীর ঈমান রয়েছে তেমনি নিজেদের দেশ হিসেবে ইরানের প্রতি রয়েছে অকৃত্রিম ভালবাসা। তাই আমাদের বিশ্বাস ও ভালবাসার বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিকভাবে জানার জন্য আমরা দায়িত্ববোধ করি। এ দু’
টি বিষয় ও এদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনাকে তিনটি প্রশ্নে উত্থাপন করা যায় :
1. আমাদের মধ্যে যেমন ধর্মীয় অনুভূতি ও চেতনা রয়েছে তেমনি রয়েছে জাতীয় অনুভূতি ও চেতনা। আমরা কি এ দু’
ধরনের অনুভূতি ও চেতনাকে বিপরীতমুখী মনে করব নাকি বলব আমাদের ধর্মীয় চেতনা ও অনুভূতির সঙ্গে জাতীয় চেতনা ও অনুভূতির কোন বৈপরীত্য ও সংঘাত নেই ?
2. চৌদ্দশ’
বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ?
3. বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘
ইসলামী সভ্যতা’
নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ?
আমার মতে ইরান ও ইসলামের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত প্রশ্ন তিনটিই প্রধান।
এ গ্রন্থটি তিনটি বিষয় ও আলোচনাকে ধারণ করেছে :
ক. ইসলাম ও জাতীয়তা।
খ. ইরানে ইসলামের অবদান।
গ. ইসলামে ইরানের অবদান।
এ তিনটি আলোচনা পূর্বোক্ত তিনটি প্রশ্নের উত্তর দান করবে।
এ গ্রন্থে উপস্থাপিত আলোচনাটি তিন বছর পূর্বে আমার দেয়া বক্তব্যের পরিবর্ধন এবং পূর্ণাঙ্গরূপ।
আলোচনার প্রথমাংশ 1388 হিজরীর মুহররম মাসে দেয়া আমার বক্তব্যের পরিবর্ধিত পূর্ণরূপ।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় আলোচনাটিও একই বছর সফর মাসে আমার উপস্থাপিত‘
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান’
শীর্ষক আলোচনার পূর্ণরূপ।
আমার তেহরান অবস্থানকালীন দীর্ঘ সময়ে যত বক্তব্য দিয়েছি তার কোনটিই এ বিষয়ক আলোচনার ন্যায় এত অধিক আলোড়ন ও সাড়া জাগায়নি। বিশেষত সফর মাসে আমি‘
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান’
শিরোনামে যে ছয়টি বক্তব্য রাখি তেহরান ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অধিবাসীরা সেটিকে ব্যাপকভাবে স্বাগত জানায় ও প্রচুর সংখ্যক ক্যাসেট কপি হিসেবে নিয়ে যায়। বিশেষভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিষয়টিতে অধিকতর আগ্রহ ব্যক্ত করে। তাদের এ আগ্রহ আমার ঐ বক্তব্যের বিশিষ্টতার কারণে নয় ;বরং ইসলাম ও ইরানের সম্পর্কের আলোচনার বিশিষ্টতার কারণেই ছিল।
যদিও এ বিষয়টি যথার্থ ও স্পষ্ট পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে সর্বসাধারণের বিশেষত যুবকদের জন্য উপস্থাপন অপরিহার্য তদুপরি আমার জানা মতে দুঃখজনকভাবে এখন পর্যন্ত এরূপ কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাই আলোচ্য গ্রন্থ এ সম্পর্কিত আলোচনার প্রথম গ্রন্থ। এ বিষয়ে গবেষণার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। যদি ইসলাম ও ইরানের অভিন্ন বিষয়সমূহে পর্যাপ্ত গবেষণা করা হয় তবে তা কয়েক খণ্ডের গ্রন্থ হবে। আমি আশা করি অত্র গ্রন্থটি উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গকে এ বিষয়ে গবেষণায় অধিকতর উৎসাহিত করবে ও তাঁদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
সাধারণত ইসলাম ও ইরানের সম্পর্কের বিষয়ে যে সকল ব্যক্তি কলম চালিয়েছেন হয় তাঁরা এ বিষয়ে তেমন জানতেন না ,নতুবা গবেষণার স্বার্থে নয় ;বরং নিজস্ব বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা তা করেছেন। ফলে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। আমরা ইসলাম ও ইরানের সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে যতই অধ্যয়ন করেছি এ বিষয়টি আমাদের নিকট ততই স্পষ্ট হয়েছে যে ,আলোচনাটি ইরান ও ইসলাম উভয়ের জন্যই গর্বের বিষয়। একদিকে ইসলাম এর সমৃদ্ধ বিষয়বস্তুর দ্বারা সংস্কৃতিবান ,বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন ও সভ্যতার অধিকারী এক জাতিকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার গর্বে গৌরবান্বিত হয়েছে ;অপরদিকে সত্যাকাঙ্ক্ষী ,কুসংস্কারমুক্ত ও সংস্কৃতিপ্রেমী এ জাতি অন্যদের থেকে ইসলামের প্রতি অধিকতর অবনত ও নিষ্ঠাপূর্ণ নিবেদিত ভূমিকা রাখার গৌরব লাভ করেছে।
ইসলাম ও ইরানের সম্পর্কের বিষয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে অন্য যে বিষয়টি আমাকে হতবাক করেছে তা হলো এ সম্পর্কে বাস্তবের বিপরীত বিকৃত উপস্থাপনার পরিমাণ ধারণাতীত।
ইসলামী দেশ ইরানে বিভিন্ন সময় বেশ কিছু ধারার সৃষ্টি হয়েছিল যাকে কোন কোন প্রাচ্যবিদ ও তাঁদের অনুসারীরা ইসলামের বিরুদ্ধে ইরানী মানসিকতার প্রতিক্রিয়া ও বিদ্রোহ বলে অভিহিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। যেমন শুয়ূবী বা আরববিরোধী আন্দোলন ,ফার্সী ভাষার জাগরণ ,তাসাউফ ও শিয়া প্রবণতা। আবার কোন কোন ব্যক্তিত্ব ইসলাম বিরোধিতার প্রতীক বলে আখ্যায়িত হয়েছেন ,যেমন বিপ্লবী কাব্য রচয়িতা কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসী এবং‘
শেখ ইশরাক’
নামে পরিচিত প্রসিদ্ধ দার্শনিক শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী।
অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস। আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেরদৌসী ও শেখ ইশরাকের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাকর্ম সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণের ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম ,কিন্তু এ গ্রন্থে তা সম্ভব হয়নি। কারণ এজন্য পর্যাপ্ত সময় ও বিশেষ পরিকল্পনা প্রয়োজন। ফার্সী ভাষার জাগরণ ও শিয়া প্রবণতা নিয়ে এ গ্রন্থের প্রথমাংশে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ এ বিষয়সমূহ ছাড়াও অন্য কয়েকটি বিষয়ে গবেষণালব্ধ আলোচনা এখানে লক্ষ্য করবেন।
এ গ্রন্থটি অধ্যয়নের পর কোন নিরপেক্ষ গবেষক এ বিষয়ে অভিমত ও পরামর্শ দিলে ইনশাল্লাহ্ আমি তা সাদরে গ্রহণ করব।
মুর্তাজা মুতাহ্হারী
ফার্সী 1349 সাল
(খ্রিষ্টীয় 1970 সাল)