ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান0%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 104602
ডাউনলোড: 5191

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 104602 / ডাউনলোড: 5191
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

ইরানে ইসলামের কর্মতালিকা

পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহ অধ্যয়নে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে পবিত্র ও সম্মানিত ইসলাম ধর্ম আমাদের এ প্রিয় দেশে আগমনের প্রাক্কালে এই দেশ কিরূপ অবস্থায় ছিল এবং ইসলাম আমাদের কি দিয়েছে এবং আমাদের নিকট থেকে কি নিয়েছে ?

যা কিছু ইতোপূর্বে অধ্যয়ন করেছেন সেগুলো স্মরণে রাখুন। ইসলাম ইরানকে ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিন্তার দিক থেকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পেয়েছিল এবং এ দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তা ও বিশ্বাসের একতা দান করেছিল। এ ভূখণ্ডে ইসলামের মাধ্যমেই প্রথম বারের মত এই ঐক্য সাধিত হয়েছিল। ইরানের উত্তর-দক্ষিণ ,পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত সেমিটিক ও আর্য বংশের বিভিন্ন মানুষ ভাষা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভিন্নতা নিয়ে শক্তি ও ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বাস করছিল। ইসলামই তাদের এ অবস্থা হতে বের করে এনে একক দর্শনের ছায়ায় আশ্রয় দেয়। প্রথম বারের মত তারা একক

চিন্তা ,মূল্যবোধ ও আদর্শ লাভ করে এবং তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। যদিও এ প্রক্রিয়া চার শতাব্দী ধরে পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত হয় তদুপরি তা সফল হয়। তখন হতে এখন পর্যন্ত এ দেশের আটানব্বই ভাগ মানুষ এমনই রয়েছে। যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণও প্রায় চার শতাব্দী এ দেশে শাসন পরিচালনা করেছিলেন এবং প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যারথুষ্ট্র চিন্তার ছায়ায় বিশ্বাসের ঐক্য সাধনের কিন্তু সফল হন নি। কিন্তু ইরানে দু বছরের প্রবর্তিত ইসলামী শাসনের অবসান ঘটলেও ইসলামের আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ও প্রশান্তিদায়ক অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে যুগ যুগ ধরে তা টিকে রয়েছে।

ইসলাম ইরান ও প্রাচ্যে খ্রিষ্টবাদের প্রভাব ও বিস্তারকে প্রতিহত করে। ইরান ও প্রাচ্য খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে কিরূপ পরিণতি লাভ করত আমরা অকাট্যভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে না পারলেও এতটুকু নিশ্চিত বলতে পারি ,তৎকালীন খ্রিষ্ট বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় ইরানে অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ নেমে আসত। কিন্তু সে সময়ের খ্রিষ্টান দেশসমূহ যখন অন্ধকার মধ্যযুগ অতিক্রম করছিল তখন ইরান ইসলামের ছায়ায় অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের অগ্রভাগে উজ্জ্বল ও প্রস্ফুটিত ইসলামী সভ্যতার মশাল বহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল।

এখন প্রশ্ন হতে পারে যদি খ্রিষ্টধর্মের বৈশিষ্ট্য ঐরূপ হয়ে থাকে এবং ইসলামের এরূপ তবে কেন বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন কথা বলে ? উত্তরটি পরিষ্কার যে ,তারা আট শতাব্দী পূর্বে খ্রিষ্টবাদ ত্যাগ করে মুক্তি পেয়েছে আর আমরা এখনই ইসলামকে ত্যাগ করে পতনের সম্মুখীন হয়েছি।

ইসলাম ইরানের চারিদিক হতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বেড়াজাল (যা এ জাতিকে আবদ্ধ করে রেখেছিল তা) উপড়ে ফেলে এবং অন্যান্য জাতির মধ্যে ইরানীদের প্রতিভা বিকাশের যে পথ দীর্ঘ দিন রুদ্ধ ছিল এবং এ জাতি নিকট ও দূরবর্তী অন্যান্য জাতির জ্ঞান হতে বঞ্চিত হয়েছিল তা হতে মুক্তি দেয়। ইসলাম ইরানের দ্বারকে অন্যান্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য যেমন উন্মুক্ত করে তেমনি ইরানীদের জন্যও অন্যান্য দেশগুলোর দ্বারসমূহ উন্মোচিত করে। এর মাধ্যমে ইরানীরা এমনভাবে নিজেদের যোগ্যতা ও প্রতিভা অন্যদের সামনে তুলে ধরেছিল যে ,অন্যদের নেতা ও আদর্শে পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে অন্যান্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতার পূর্ণতা ও বিকাশের মাধ্যমে বিশ্বে এক নতুন সভ্যতা উপহার দিতে পেরেছিল।

এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করি ইরানী জাতির ইতিহাসে প্রথম বারের মত ইরানীরা ধর্মীয় বিষয়ে অন্য জাতির জন্যও ইমাম ও নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। যেমন লাইস ইবনে সাদ একজন ইরানী হিসেবে মিশরের জনগণের ফিকাহর ইমাম হন ,আবু হানিফা যদিও ইরানের মধ্যে আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণের প্রভাবের কারণে ইরানী অনুসারী লাভ করেন নি তদুপরি যে জাতিসমূহ আহলে বাইত সম্পর্কে অবগত নন তাদের মাঝে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফকীহ্ ও ইমাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আবু উবাইদা মুয়াম্মার ইবনুল মুসান্না ,ওয়াসিল ইবনে আতা প্রমুখ কালামশাস্ত্রের অন্যতম পুরোধা হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন। কিসায়ী ও সিবাভেই আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রের পণ্ডিত ও অভিধান রচয়িতা হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। হিশাম ইবনে আবদুল মালিক কুফার একজন আলেমকে জিজ্ঞেস করেন :

যে সকল আলেম ও ফকীহ্ ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন শহরে মুফতী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের চেন কি ? তিনি বলেন , হ্যাঁ।

হিশাম প্রশ্ন করেন , বর্তমানে মদীনার মুফতী কে ?

উত্তরে বলেন , নাফে।

হিশাম প্রশ্ন করেন , সে কি আরব না মাওলা ? 179

-সে ইরানী মুক্ত দাস।

-মক্কার ফকীহ্ ও মুফতী কে ?

-আতা ইবনে রিবাহ্।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-ইয়েমেনের ফকীহ্ ও মুফতী কে ?

-তাউস ইবনে কিসান।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-ইয়ামামার ফকীহ্ কে ?

-ইয়াহিয়া ইবনে কাসির।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-সিরিয়ার (শাম) ফকীহ্ কে ?

-মাকহুল।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-জাজিরার ফকীহ্ কে ?

-মাইমুন ইবনে মাহান।

-মাওলা না আরব ?

-মাওলা।

-খোরাসানের ফকীহ্ কে ?

-যাহ্হাক ইবনে মুযাহেম।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-বসরার ফকীহ্ কে ?

-হাসান ও ইবনে সিরীন।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-কুফার ফকীহ্ কে ?

-ইবরাহীম নাখয়ী।

-আরব না মাওলা ?

-আরব।

হিশাম বললেন: আমার শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যার বিষয়েই প্রশ্ন করছিলাম তুমি বলছিলে মাওলা ,অন্তত একজন আরব খুঁজে পাওয়া গেল। 180

ইরানীদের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান যথা হিজায ,ইরাক ,ইয়েমেন ,সিরিয়া ,মিশর ও আরব উপদ্বীপের মানুষদের ধর্মীয় ইমাম হওয়ার এরূপ সুবর্ণ সৌভাগ্য ইতোপূর্বে কখনও লাভ করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তী সময়ে তাদের এই ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রভাব আরো বিস্তৃত হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে ইরানীদের এই জ্ঞানগত ও নৈতিক পুনর্জাগরণে ও প্রতিভা বিকাশের সময়কে স্যার জন ম্যালকম ইরানীদের স্থবিরতার কাল বলে অভিহিত করেছেন। স্যার জন ম্যালকম উনবিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদের প্রচারক হিসেবে জাতিগত গোঁড়ামীর চশমা পড়ে তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এ বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। ম্যালকমের দৃষ্টিতে একমাত্র লক্ষণীয় বিষয় হলো কোন্ ব্যক্তি ও কোন্ গোত্র-বর্ণের মানুষ ঐ জাতির ওপর শাসনকার্য চালাচ্ছে। তাঁর দৃষ্টিতে সাধারণ মানুষ দাস ও শোষিত বা অন্য কোন্ অবস্থায় রয়েছে তা দেখার প্রয়োজন নেই। ম্যালকমের মত ব্যক্তিদের এ জন্য কোন আফসোস নেই ,হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মত লোকেরা কেন মানুষ হত্যা ও মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে: বরং তাঁর আফসোস হলো হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পরিবর্তে কেন এক ইরানী এরূপ কাজ করল না।

ইসলামের আবির্ভাবের পরবর্তী ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় ,সেসময় ইরানীদের মধ্যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির এক নব উদ্দীপনা জেগে উঠেছিল যাকে পানিবঞ্চিত তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির সন্ধানী তৎপরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েই তারা স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে প্রথম বারের মত অন্যান্য জাতির ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম হতে সপ্তম হিজরী শতাব্দীর ঐ সকল ইরানী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অভাবনীয় গ্রহণযোগ্যতা এখনও বিদ্যমান।

অন্যদিকে এই দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার ফলেই ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাইরেও গ্রীক ,ভারতীয ,মিশরীয় ও অন্যান্য জাতির জ্ঞান ও সংস্কৃতি এখানে আসার সুযোগ পায় এবং এর ওপর ভিত্তি করেই বৃহৎ ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার সৃষ্টি সম্ভব হয। এর ফলেই আবু আলী ,ফারাবী ,আবু রাইহান বিরুনী ,খাইয়াম (গণিতজ্ঞ) ,খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী ,মোল্লা সাদরাসহ এরূপ শত শত আরেফ (আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব) ,দার্শনিক ,সাহিত্যিক ,চিকিৎসক ,ভূগোলবিদ ,ঐতিহাসিক ,গণিতবিদ ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীর প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

হাস্যকর বিষয় হলো পুর দাউদ বলেছেন ,যদি আরবদের আক্রমণ ও সেমিটিকদের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা না পেত তাহলে ইবনে সিনা ও খাইয়ামদের মত মনীষীরা নওরুজ নামে দানেশ নামে গ্রন্থদ্বয়ের ন্যায় গ্রন্থ রচনা করতেন এবং বর্তমানের ফার্সী ভাষা আরো সমৃদ্ধ হতো।

আমার প্রশ্ন হলো যদি আরবরা আক্রমণ না করত তবে যারথুষ্ট্র পুরোহিতরা যে দেয়াল তৈরি করে রেখেছিলেন তাতে ইরানীদের প্রতিভা বিকাশের কোন সুযোগই হতো না এবং কোন ইবনে সিনা ও খাইয়ামেরও জন্ম হতো না। ফলে দানেশ নামে , নওরুজ নামে এবং ফার্সী ভাষায় এরূপ সহস্র গ্রন্থও সৃষ্টি হতো না। ইরানী মনীষিগণ আরবী ও ফার্সী ভাষায় সহস্র গ্রন্থ বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন তা ঐ আরবদের হামলারই ফল। কারণ তারাই প্রতিটি মুসলমানের ওপর জ্ঞানার্জন অপরিহার্য ঘোষণার মাধ্যমে পূর্বের রচিত দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে ভিন্ন এক ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিল।

পুর দাউদের কথাটি এরূপ ,যদি দিনে সূর্য না উঠত তবে আমাদের মস্তিষ্কও উত্তপ্ত হতো না এবং আমরা সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবে সূর্য না উঠলে দিনেরও অস্তিত্ব থাকত না।

এ দু ধারা (অন্যান্য জাতির ওপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব লাভ ও সহস্র মনীষীর জন্ম) শুধু বাহ্যিক এ দেয়াল ধ্বংসের ফলে দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার কারণেই নয় ;বরং অন্য একটি কারণও এর পাশে বিদ্যমান ছিল। আর তা হলো ইরানের সাধারণ ও বঞ্চিত শ্রেণীর ওপর হতে শিক্ষা গ্রহণের যে নিষেধাজ্ঞা যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণ আরোপ করেছিলেন তা উপড়িয়ে ফেলা। ইসলাম সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শ্রেণী বলে কিছু মানে না এবং জ্ঞানকে পুরোহিত বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে চর্মকার ও কর্মকার শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়কের পুত্রের সমান অধিকার রাখে এবং এই শ্রেণী হতেই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়। এই অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও ঐ বাহ্যিক দেয়াল ভাঙ্গার কারণেই ইরানীরা অন্য জাতিসমূহেরও অগ্রদূত হওয়ার যোগ্যতা ও বিশাল ইসলামী সভ্যতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার সুযোগ লাভ করে।

ইসলাম ইরানীদের আপন সত্তাকে চিনতে যেমন সাহায্য করে তেমনি বিশ্বকে তাদের নিকট পরিচিত করায়। পূর্বে বলা হতো ইরানীদের প্রতিভা ও যোগ্যতা শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই সীমিত ,অন্যান্য বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই ,এ কথাটি সঠিক নয়। বিভিন্ন সময়ে ইরানীরা যে পিছিয়ে ছিল তা তাদের যোগ্যতার অভাবে নয় ;বরং তা প্রাচীন পুরোহিত শাসিত সমাজের শৃংখলে আবদ্ধতার কারণে ঘটেছিল। এ কারণেই ইসলামী আমলে ইরানীরা তাদের জ্ঞান-প্রতিভার উচ্চ অবস্থানকে প্রমাণে সক্ষম হয়েছিল।

প্রতিভা দমনকারী প্রাচীন পুরোহিত শাসনের কারণে কোন কোন বিদেশী ভুল করে গোঁড়া হতেই ইরানীদের প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রতি তিরস্কার করেছেন। যেমন গুসতাভ লুবুন বলেন ,

বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইরানীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকলেও সভ্যতার ইতিহাসে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। প্রাচীন ইরানীরা দু শত বছর পর্যন্ত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের অধিপতি হিসেবে জাঁকজমকপূর্ণ এক রাজকীয় সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করে কিন্তু জ্ঞান ,সাহিত্য ,শিল্পকলা ও স্থাপত্যে তেমন কিছু দিতে পারেনি এবং পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহের অবশিষ্ট যে সকল জ্ঞান ও শিল্প বিদ্যমান ছিল তার কোন উত্তরণও ঘটায় নি।... ইরানীরা সভ্যতার স্রষ্টা ছিল না ;বরং সভ্যতার বিস্তারক ছিল। এ দৃষ্টিতে সভ্যতার সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। 181

ফরাসী ঐতিহাসিক কিলম্যান হাওয়ার তাঁর ইরানে বাসতানী ও তামাদ্দুনে ইরান গ্রন্থে বলেছেন ,

ইরান একটি সামরিক দেশ ছিল। তই সেখানে জ্ঞান ,শিল্প ও স্থাপত্যকলা বিকাশের কোন সুযোগ ছিল না। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে প্রশিক্ষিত গ্রীক চিকিৎসকগণ ইরানের একমাত্র জ্ঞানের ধারক ছিলেন। স্থাপত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রেও গ্রীক ,লিডীয় ও মিশরীয় স্থাপকগণই ছিলেন তাদের প্রতিনিধি । তাদের রাজকীয় হিসাবরক্ষকগণও ছিলেন সেমিটিক বংশোদ্ভূত ব্যাবিলনীয় বা আর্মেনীয়রা। 182

জে. রাও লিনসন তাঁর প্রাচ্যের পাঁচ বৃহৎ সাম্রাজ্য নামক গ্রন্থে বলেছেন ,

প্রাচীন ইরানীরা জ্ঞানের উন্নয়নে কোন ভূমিকাই রাখে নি। এ জাতির মন-মানসিকতা কখনই গবেষণার ন্যায় কর্মের জন্য ধৈর্য ধারণের উপযোগী ছিল না। জ্ঞানের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য যে চিন্তা ,গবেষণা ও অনুসন্ধান প্রয়োজন তাদের নিকট তা পছন্দনীয় বিষয় ছিল না।...

ইরানীরা তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজত্বের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কখনই জ্ঞানের বিষয়ে মনোযোগী ছিল না এবং ভাবত তাদের নৈতিক শক্তিকে প্রদর্শনের জন্য শুশের প্রাসাদ ,তাখতে জামশিদ (জামশিদ সিংহাসন) ,বৃহৎ রাজকীয় পরিচালনা পরিষদ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতাই যথেষ্ট। 183

সন্দেহ নেই এরূপ মন্তব্য তাঁদের অযৌক্তিক মন্দ ধারণার ফল। ইসলামপূর্ববর্তী প্রাচীন ইরানকে এরূপে উপস্থাপিত করা একরকম বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জিত বিষয় (এ বিষয়ে পরবর্তীতে আমরা পারস্য সভ্যতার মৌলিকতা শিরোনামে আলোচনা করব)। কারণ পুরোহিত শাসকদের গুনাহের বোঝা সাধারণ মানুসের কাঁধে চাপান ঠিক হবে না এবং তাঁদের কর্মের ত্রুটিকে ইরানীদের প্রতিভাহীনতা বলে চালানোও অযৌক্তিক। এর পক্ষে সর্বোত্তম প্রমাণ হলো ঐ জাতিই ইসলামী শাসনামলে তাদের প্রতিভা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটিয়ে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে।

কিলম্যান184 ,গুসতাভ লুবুন ও রাও লিনসন ভুলবশত ইসলামী সভ্যতা কে আরব সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন ,অথচ ইসলামী সভ্যতা পারস্য বা ভারত সভ্যতার মত নয় (বরং এতে আরবদের ভূমিকা অন্যদের হতে কম এবং ইসলাম নতুন এক সভ্যতা নিয়ে এসেছিল যার সঙ্গে আরবদের তেমন কোন পরিচয়ই ছিল না)।

ইসলাম ইরানীদের বিষয়ে উপরোক্ত মন্তব্যগুলোকে ভুল প্রমাণিত করে। ইসলাম ইরানীদেরকে তাদের আপন সত্তাগত প্রতিভা ও যোগ্যতার সঙ্গে পরিচিত করায় ও বিশ্ববাসীকেও তা জানায়। অন্যভাবে বলা যায় ইরানীরা ইসলামের মাধ্যমে নিজেদের চিনতে পারে ও ইসলামকে অন্যদের নিকট পরিচিত করায়।

কেন ইসলামপূর্ব যুগে লাইস ইবনে সা দ ,নাফে ,আতা ,তাউস ,ইয়াহিয়া ও মাকহুলের ন্যায় অন্যান্য ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হলো না যাঁরা মিশর ,ইরাক ,তিউনিসিয়া ,মরক্কো ,হিজায ,ইয়েমেন ,সিরিয়া ,আলজিরিয়া ,ভারত ,পাকিস্তান ,ইন্দোনেশিয়া ,স্পেনসহ ইউরোপের একাংশের মানুষদের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতা হতে পারেন। কেন সেসময় মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযী ,ফারাবী ও ইবনে সীনার আবির্ভাব হয় নি ?

তৎকালীন ইরানী শাসক ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে ইসলাম তাদের ওপর এক আক্রমণ হিসেবে পরিগণিত হলেও ইরানের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এটি সর্বাঙ্গীনভাবে এক বিপ্লব ছিল। ইসলাম ইরানীদের বিশ্বদৃষ্টির পরিবর্তন ঘটায়। ইরানীদের অন্তর হতে দ্বিত্ববাদ এবং তা হতে উৎসারিত সকল মন্দ চিন্তাকে দূরীভূত করে। কয়েক হাজার বছরের সেই দ্বিত্ববাদ যার সঙ্গে যারদুশত যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন ও তাঁর ধর্ম এর দ্বারা কলুষিত ও বিকৃত হয়ে পড়েছিল ইসলাম তাকে ইরানীদের অন্তর হতে দূরে ছুঁড়ে ফেলে ও ইরানীদের মস্তিষ্ককে পরিশোধিত করে।

একটি বিপ্লব কি করে ? অবশ্যই মানুষের বিশ্বদৃষ্টির পরিবর্তন ঘটায় ,তাকে নতুন লক্ষ্য ,পরিকল্পনা ও আদর্শের সঙ্গে পরিচিত করায় ,তার পূর্ববর্তী বিশ্বাসের পরিবর্তন সাধন করে ,সামাজিক অবকাঠামোর এমন পরিবর্তন ঘটায় যে ,পূর্বের কোন চিহ্নই না থাকে ,শোষকদের ওপর হতে টেনে নীচে নামায় ও শোষিতদের টেনে ওপরে ওঠায় ,মানুষের আচার-আচরণ ও চরিত্রের পরিবর্তন করে জীবন্ত করে তোলে ,বলপ্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষুব্ধ মনোভাবের জন্ম দেয় ,ঈমান ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে ,ধমনীতে নতুন রক্ত সঞ্চারিত হয়। ইসলামের আবির্ভাবের ফলে ইরানে কি তাই ঘটেনি ?

তাঁরা বলেন তরবারী দিয়ে তা করা হয়েছে। হ্যাঁ ,তরবারীর সাহায্য নিয়েই তা করা হয়েছে ,কিন্তু ইসলামের তরবারী কি করেছে ? ইসলামের তরবারী শয়তানের শক্তিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে ,পুরোহিতদের অনিষ্টকারী ছায়াকে কর্তিত করেছে ,চৌদ্দ কোটি মানুষের গর্দান হতে শিকল ছিন্ন করেছে ,বঞ্চিত ও মানুষেদের মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলামের তরবারী সব সময় বলদর্পীদের হাতকে কর্তন করেছে ও অত্যাচারীদের মস্তকের ওপর নিপীড়িতের সাহায্যে আপতিত হয়েছে। ইসলামের তরবারী সব সময় শোষিত ও বঞ্চিতদের পক্ষে কাজ করেছে। কোরআন বলেছে ,

) و ما لكم لا تقاتلون في سبيل الله و المستضعفين من الرّجال و النساء و الولدان(

তোমাদের কি হয়েছে যে ,তোমরা সংগ্রাম করছ না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য ? (সূরা নিসা: 75)

ইসলাম ইরান হতে দ্বিত্ববাদ ,অগ্নি ,সূর্য ও হুমের উপাসনাকে উচ্ছেদ করে তাওহীদ ও খোদা উপাসনা উপহার দিয়েছে। এ দৃষ্টিতে আরবের চেয়ে ইরানে ইসলামের অবদান অধিকতর মূল্যবান। কারণ ইসলাম আরবদের উপাসনার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের জাহেলিয়াত হতে মুক্তি দেয় ,কিন্তু ইরানীদের সৃষ্টিকর্তার চিন্তার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব হতে মুক্তি দিয়েছিল।

ইসলাম শৃঙ্গ ও ডানাযুক্ত ,গোঁফ ও শ্মশ্রুমণ্ডিত ,হাতে ছড়ি বা দণ্ডধারী ,জোব্বা পরিহিত ,কুঞ্চিত কেশ ও খাঁজকাটা মুকুট পরিহিত খোদার অস্তিত্বের চিন্তাকে চিরস্থায়ী185 ,নিরাকার ,সকল ধারণা ,কল্পনা ও তুলনার ঊর্ধ্বে এক মহান ও সম্মানিত অস্তিত্বের চিন্তায় রূপান্তরিত করে। ইসলাম তাদের এমন খোদার সঙ্গে পরিচিত করায় যিনি বর্ণনার ঊর্ধ্বে186 ,তিনি সকল কিছুর সঙ্গে আছেন187 ,কিন্তু সকল কিছু তাঁর সঙ্গে নেই ,তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ ,তিনিই গুপ্ত ও প্রকাশ্য188 ,তিনি সকল কিছুকে দেখেন কিন্তু কেউ তাঁকে দেখে না189

ইসলাম সত্তাগত ,কর্মগত ও গুণগত একত্ববাদের সর্বোত্তম রূপকে ইরানী অ-ইরানী সকল মুসলমানকে শিখিয়েছে। ইসলাম একত্ববাদকে তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর যেমন দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে তেমনি এটি চিন্তার সবচেয়ে গতিশীল উদ্দীপক হিসেবে পরিগণিত।

ইসলাম যারথুষ্ট্র ধর্মের সকল কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণা যেমন আহুরামাযদা ও আহ্রিমানের নয় হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধ ,সন্তান ধারণের লক্ষ্যে যারওয়ানের এক হাজার বছর ধরে কুরবানী করা ,দিভদের (দৈত্যদের) প্রার্থনা কবুল হওয়া ,অগ্নি উপাসনার আশ্চর্যজনক আচার-অনুষ্ঠান ,মৃতদের জন্য ছাদের ওপর মদ্যপান ,অগ্নির মধ্যে বন্য প্রাণী ও পাখি নিক্ষেপ ,মাসে চার বার সূর্য ও চন্দ্রের উপাসনা ,অগ্নির ওপর আলোর পতন প্রতিরোধ ,মৃতদের দাফন না করা ,মৃত ব্যক্তি ও নারীদের অপবিত্র দেহে হাত দেয়ার কঠিন আচার ,গরম পানিতে গোসল নিষিদ্ধকরণ ,গরুর প্রস্রাব দ্বারা পবিত্রকরণ এবং এরূপ হাজারো বিষয়কে ইরানীদের চিন্তা ও কর্মজীবন হতে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।

ইসলাম অগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে অনর্থক বুলি আওড়ানো ,মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে অগ্নিকে নাড়াচাড়া করা ,অগ্নির সম্মুখে মুখ বেঁধে অবনত হওয়ার মতো অর্থহীন ইবাদাতসমূহের স্থলে যুক্তিপূর্ণ ,নৈতিকতা ও পূর্ণতার পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরতম রূপের ইবাদাতকে প্রতিস্থাপন করে। ইসলামের নামায ,রোযা ,হজ্ব ,জুমআ ,জামায়াত ,মসজিদ ,ধর্মীয় সমাবেশ ,জিক্র ও দোয়াসমূহ প্রজ্ঞা ও জ্ঞানপূর্ণ হিসেবে তার উচ্চ মর্যাদার সাক্ষী।

ইসলাম মাযদাকী ,মনী ,যারথুষ্ট্র ও খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা অর্থাৎ দেহ ও আত্মার সৌভাগ্যের ভিন্ন পথ ,দুনিয়া ও আখেরাতের কর্মের বিপরীত অবস্থান ,কঠোর সাধনার দর্শন ,কঠিন আচার-অনুষ্ঠান ,বৈবাহিক জীবনের প্রতি অনীহা ,মনাভী ও মাযদাকী ধর্মের পুরোহিত এবং খ্রিষ্টধর্মের ধর্মযাজকদের (পোপ ও কার্ডিনালদের) অবিবাহিত থাকা ইত্যাদিকে সভ্যতার শত্রু হিসেবে গণ্য করে। ইসলাম ইরানে প্রসারমান এরূপ শিক্ষাকে ইরানের ভূমি হতে বিতাড়িত করে আত্মিক পরিশুদ্ধির190 সঙ্গে পৃথিবীর পবিত্র নিয়ামত হতে উপভোগের শিক্ষার191 প্রচলন ঘটায়।

ইসলাম তৎকালীন সময়ে প্রচলিত রক্ত ও মালিকানার ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রাচীন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং ঐ দু য়ের আবর্তে কেন্দ্রীভূত আইন ,সামাজিক রীতি ও আচার-অনুষ্ঠানকে বিলুপ্ত করে শ্রেণীহীন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে যার কেন্দ্র ছিল জ্ঞান ,কর্মপ্রচেষ্টা ,তাকওয়া ,আত্মসম্মানবোধ ও মর্যাদা।

ইসলাম বংশগত উত্তরাধিকারভিত্তিক বিশেষ শ্রেণীর পেশাদার পুরোহিত ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। ফলে সকল শ্রেণী হতেই ধর্মীয় আলেম হওয়ার সুযোগ ঘটে এবং জ্ঞান ও তাকওয়ার মৌল ভিত্তিতে তাদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়।

ইসলাম ঐশী বংশধারার বাদশাগণের রাজত্বের ধারণাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে। ক্রিস্টেন সেন বলেছেন:

সাসানী সম্রাটগণ তাঁদের শিলালিপিগুলোতে নিজেদের মাযদার উপাসক বলে উল্লেখ করলেও নিজেদেরকে ঐশী বলে দাবি করে স্রষ্টা ইয়াসদান বংশোদ্ভূত পরিচয় দান করতেন। 192

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ,

দ্বিতীয় খসরু (পারভেজ) নিজেকে তাই মনে করতেন ও নিজেকে খোদাগণের মাঝে আদমরূপী অবিনাশী এবং মানুষের মাঝে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এক খোদা বলে পরিচয় দিতেন। 193

এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন ,

সম্ভবত সাসানী আমলের ইরানের ন্যায় কোন রাজত্বেই সম্রাটগণের ঐশী বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়ে দৃঢ়তর বিশ্বাসসম্পন্ন প্রজাকুল বিদ্যমান ছিল না। নাওলাদকা বলেছেন: বাহরাম চুবিনের ন্যায় যাঁরাই সম্রাটের বংশধারার না হয়ে অভিজাত অন্য কোন বংশীয় হিসেবে রাজত্ব দাবি করেছেন এ দেশের মানুষ তাঁর অবাধ্য হয়ে বিদ্রোহ করেছে। শাহর বারাজের রাজত্ব লাভের বিষয়টি তাই অনেকটা অবিশ্বাস্য ও তাঁর লজ্জাহীনতার পরিচায়ক।

ইরানীরা এরূপ চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে ,শুধু এক বংশধারাই এ দেশে রাজত্বের যোগ্যতা রাখে। এডওয়ার্ড ব্রাউন বাহরাম চুবিনের পলায়নের প্রসিদ্ধ কাহিনীতে তাঁর সঙ্গে পথিমধ্যে এক বৃদ্ধা রমনীর কথোপকথনের ঘটনায় স্বর্গীয় বংশধারার না হওয়া সত্ত্বেও রাজত্ব দাবির কারণে তিরস্কৃত হওয়ার বিষয়টি এনেছেন। ডক্টর মাহমুদ সাজারী অযাদীয়ে ফারদ ওয়া কুদরাতে দৌলাত নামক গ্রন্থে ইউরোপীয় কিছু দার্শনিক যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজকীয় পাদমর্যাদা ঐশী বলে মনে করেন সে সম্পর্কে বলেছেন , এ মতটি নতুন নয় ;বরং এর মূলকে আমাদের (ইরানের) ইতিহাসেই খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন ইরানীরা এরূপ মতেই বিশ্বাসী ছিল। 194

ইসলাম এই ইতিহাসকেও ব্যাপকভাবে পাল্টিয়ে দেয়। ইসলামে রাজকীয় বংশোদ্ভূত বলে কিছু নেই। ইসলাম কাঁসা শিল্পী ,জেলে ,দাস ,দরবেশ195 ও ফকির সকলের মধ্যেই এরূপ প্রতিভা ও যোগ্যতা রয়েছে বলে মনে করে। যদি কারো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাহস থাকে সে তাতে পৌঁছতে পারে। তাই ইসলামী শাসনামলে যাঁরা আত্মনির্ভরভাবে রাজত্ব লাভ করেছেন তা তাঁদের যোগ্যতার বলেই অর্জন করেছেন ,বংশের কারণে নয়।

ইসলাম ইরানীদের মধ্য হতে এ চিন্তার অপনোদন ঘটায় যে ,ধর্মীয় পুরোহিত ও আলেমগণ এক বংশীয় হতে হবে। ইসলাম অভিজাত শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থার চিন্তা ইরানীদের মস্তিষ্ক হতে মুছে দিয়ে সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটায়।

ইসলাম নারীদের আইনগত অধিকার দান করে। শর্ত ও বিধিহীনভাবে অসংখ্য স্ত্রী রাখার বিষয়টির বিলোপ সাধন করে তদস্থলে নারী ও স্ত্রীদের সম অধিকারের ভিত্তিতে পুরুষের সক্ষমতার আলোকে সীমিত পরিসরে সামাজিক প্রয়োজনীয়তার খাতিরে একাধিক বিবাহের অনুমোদন দেয়।

ইসলাম স্ত্রীকে ভাড়া বা বন্ধক দেয়া ,প্রতিস্থাপন বিবাহ ,অন্যের ঔরসে নিজ স্ত্রীর গর্ভের

সন্তানকে নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত করা ,মাহ্রাম বিবাহ ,স্ত্রীর ওপর স্বামীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রভৃতি রীতিকে অবৈধ ও হারাম ঘোষণা করে।

যে সকল ইরানী মুসলমান হয়েছিল তাদের জন্যই শুধু নয় ,ইসলাম যারথুষ্ট্র ধর্মের জন্য অশেষ বরকত বয়ে আনে। পরোক্ষভাবে ইসলাম যারথুষ্ট্র ধর্মের গভীরে সংস্কার সাধন করে। এ বিষয়ে আমরা ক্রিস্টেন সেন থেকে বর্ণনা করেছি যে ,ইসলাম যখন যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণের পৃষ্ঠপোষক সাসানী সাম্রাজ্যের পতন ঘটায় তখন যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণ উপলব্ধি করলেন এ ধর্মকে ধ্বংস ও পতন হতে রক্ষা করতে হলে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। তাই যারওয়ানী ধারণাসহ অন্যান্য শিশুসুলভ কাল্পনিক বিশ্বাসসমূহকে বাদ দিলেন ,সূর্য উপাসনা পরিত্যাজ্য ঘোষণা করলেন। ধর্মীয় অসংখ্য বিবরণ হয় পরিবর্তন করা হলো নতুবা পুরোটাই বাদ দেয়া হলো। সাসানী আভেস্তা ও এর ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহের যে অংশ যারওয়ানী ধারণামিশ্রিত ছিল তা গ্রন্থাগারের তাকেই পরিত্যাগ অথবা ধ্বংস করা হলো...।

ইরানে ইসলামের অবদান প্রথম দিকের (হিজরী) শতাব্দীগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না ;বরং এ দেশে যে দিন হতে ইসলামের ছায়া পড়েছে সে দিন হতে এ দেশের জন্য যত বিপদই এসেছে ইসলামের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়েছে। ইসলামই মোগলদেরকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে মানব হত্যাকারী হতে জ্ঞানপ্রেমিকে পরিণত করেছে। ইসলামই চেঙ্গিস খাঁনের বংশধর হতে মুহাম্মদ খোদাবান্দের ন্যায় ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং তৈমুর লং-এর বংশধর হতে বৈসংকর ও আমির হোসেন বৈকরার মত শাসকদের সৃষ্টি করেছিল।

আজও বিদেশীদের ধ্বংসাত্মক দার্শনিক চিন্তার বিপরীতে ইসলাম আমাদের টিকিয়ে রেখেছে এবং আমাদের মধ্যে আত্মসম্মান ,মর্যাদাবোধ ও স্বাধীনতার অনুভূতিকে জিইয়ে রেখেছে। ইরান জাতি আজ যা নিয়ে গর্ব করতে পারে তা হলো কোরআন ও নাহজুল বালাগাহ্ ;আভেস্তা ও যান্দ নয়।

আমরা ইরানে ইসলামের অবদান শীর্ষক আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এর পরবর্তী অংশে আমরা ইসলামে ইরানের অবদান নিয়ে আলোচনা করব।