ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান5%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 112219 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

চীনে ইসলামের প্রবেশ ও বিস্তার

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান মতে চীনে বর্তমানে পাঁচ কোটি মুসলমান বাস করেন। চীনে ইসলামের দাওয়াত ও প্রচার একদল মুসলমান-যাঁরা সেখানে হিজরত ও বসতি স্থাপন করেছিলেন ,তাঁদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল। চীনে ইসলামের প্রচারে ইরানী মুসলমানদের ভূমিকা বেশ ব্যাপক ছিল।

সিরাতে মুস্তাকিম নামক গ্রন্থে চীনে ইসলামী সংস্কৃতি ২২৭ শিরোনামের এক প্রবন্ধে চীনে ইসলামের প্রবেশ ,উন্নয়ন ও ক্রমাবনতির যুগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। চীনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ইরানীদের ভূমিকা এ প্রবন্ধে লক্ষণীয়।

তিনি চীনে ইসলামের প্রবেশের এক নাতিদীর্ঘ ইতিহাস চীনের বিভিন্ন গ্রন্থসূত্র ও উৎস হতে উল্লেখ করেছেন। কোন ইসলামী উৎসে তা উল্লিখিত হয়নি বলে তিনি বলেছেন। তিনি বলেন ,

তাং বংশের প্রাচীন ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে সম্রাট ইয়াংভির শাসনামলের দ্বিতীয় বর্ষে (৩১ হিজরীতে) মদীনা হতে দূত তাঁর দরবারে কিছু উপঢৌকন ও উপহার নিয়ে আসেন। দূত বর্ণনা করেন যে ,একত্রিশ বছর হলো তাঁদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে... সম্রাট দূতকে কিছু প্রশ্ন করার পর ইসলাম সম্পর্কে যা শুনতে পান তাতে একে কনফুসিয়াসের শিক্ষার অনুরূপ বলে বুঝতে পারেন। তিনি ইসলামকে সত্যায়ন করেন ,কিন্তু প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও বছরে এক মাস রোযার বিষয়টি পালন কষ্টকর মনে করেন। তাই তা পালনে নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি মদীনা হতে আগত দূত সা২২৮ ও তাঁর সঙ্গীদের চীনে ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন এবং চানগান শহর -এ সর্বপ্রথম মসজিদ স্থাপনে নিজ সম্মতি ঘোষণা করেন । এভাবে তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর ভালবাসা প্রদর্শন করেন। এই মসজিদটি ইসলামী ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকর্ম যা এখনও পুনঃপুন সংস্কারের মাধ্যমে বিদ্যমান রয়েছে। ২২৯

যদি উপরোক্ত ঘটনা সত্য হয় তবে ইসলাম আরব মুসলমানদের মাধ্যমে সর্বপ্রথম চীনে প্রবেশ করে । এ ঘটনা ছাড়াও চীনে মুসলমান বণিকগণ যাঁদের অনেকেই ইরানী বংশোদ্ভূত ছিলেন তাঁরা ইসলাম প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

একই গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,

বনি উমাইয়্যা ও আব্বাসীয়দের শাসনামলে মুসলিম বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বনি উমাইয়্যার শাসনামলে অনেক আরব বণিকই চীনে গিয়েছিলেন যাঁদের আরব শুভ্র পোশাকধারী বলা হতো। আব্বাসীয়দের খেলাফতকালে মুসলিম ও চীন সম্রাজ্যের মধ্যে অধিকতর বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে উঠলে প্রচুর আরব বণিক সেখানে যান। তাঁরা কৃষ্ণ পোশাকধারী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

...একশত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে (৩১ হতে ১৮৪ হিজরী পর্যন্ত) প্রচুর সংখ্যক আরব ও ইরানী বণিক চীনে পৌঁছে এবং চীনের কুয়াংচু বন্দরে বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে তারা তীরবর্তী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরে যায় ও ধীরে ধীরে উত্তর চীনের হাংচু শহর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে... ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীনে মুসলিম বণিকদের সংখ্যা বেশ বেড়ে যায়। তাদের অনেকেই চীনাদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় ও স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এই মুসলামানদের ভিন্ন সমাজ ছিল। তারা অন্য ধর্মাবলম্বী চীনাদের হতে স্বতন্ত্রভাবে ইসলামের প্রাত্যহিক ও অন্যান্য ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন শুরু করে ,এমনকি বিবাহ ,তালাক ,উত্তরাধিকার ও অন্যান্য ইসলামী বিধিবিধানের ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র বিচার বিভাগ ছিল। এটি তৎকালীন সময়ে মুসলিম সমাজের প্রভাব ও আধিপত্যের একটি প্রমাণ।

তিনি আরো বলেন ,

ইরানী ও আরব ব্যবসায়ীরা চীন হতে রেশমী বস্ত্র ,চীনামাটির পাত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়ে যেত। আবার ঐ সকল অঞ্চল হতে মশলাদ্রব্য ,উদ্ভিজ্জ চিকিৎসা উপকরণ ,মুক্তা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ও সামগ্রী চীনে নিয়ে আসত। এ বণিকরা এই লাভজনক ব্যবসায়ের মাধ্যমে অন্যান্য মুসলিম বণিকদেরও চীনে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করত। ফলে মুসলিম বণিকদের নতুন নতুন দল চীনে প্রবেশ করে উত্তর পশ্চিম ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে ও ধর্মীয় প্রচারও বৃদ্ধি পায়। ২৩০

ঐ গ্রন্থে আরো উল্লিখিত হয়েছে :

চীনের উত্তরাঞ্চলে অধিকাংশ ভারবাহী পশু (বাণিজ্য কাফেলার জন্য ব্যবহৃত) ,যেমন উট ,ঘোড়া ও গাধা মুসলমানদের অধিকারেই ছিল। এ ছাড়াও ইয়াংতিসি ও হাওয়াইহু২৩১ নদী ও এদের শাখা-প্রশাখার তীরবর্তী অঞ্চলে যে ধান উৎপন্ন হতো তা বেচাকেনা ও বহন ,মেষ ও অন্যান্য প্রাণীর ক্রয়-বিক্রয় সবই মুসলমানদের দ্বারা সম্পন্ন হতো। এখনও বিভিন্ন প্রাণীর বেচাকেনায় ফার্সী পরিভাষার ব্যবহার তৎকালীন সময়ে এতদঞ্চলে মুসলমানদের প্রভাবের বিষয়টিকে প্রমাণ করে। ২৩২

তিনি অন্যত্র বলেছেন ,

চীনের মুসলমানগণ দু ভাগে বিভক্ত ছিল। একদল হলো সিকিয়াং-এর মুসলমানগণ যাদের পাগড়ীধারী মুসলমান বলা হয় এবং অন্যদল হলো হান গণ... হান মুসলমানগণ সাধারণত দীনী বিষয়ে আরবী ও ফার্সী পরিভাষা বিশেষত ফার্সী পরিভাষা বিশেষ গঠনরূপে ব্যবহার করে থাকে। ২৩৩

এ গ্রন্থে আরো উল্লিখিত হয়েছে ,

মসজিদের আলেমদের প্রধানকে আখুন্দ অথবা অখুনাক বলা হতো যার অর্থ ইসলামী বিধান শিক্ষাদাতা। জামায়াতের নামাজের ইমাম প্রধান আলেমের সহযোগী বলে বিবেচিত হতেন... চীনের তৎকালীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইরান ও আরবের অনুকরণে ছিল।

হেযারেয়ে শেখ তুসী গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর সাইয়্যেদ জাফর শাহিদী বিশ্বে ইসলামের প্রসারে ইরান জাতির অবদান শীর্ষক প্রবন্ধে (যা তিনি গত বছরে অনুষ্ঠিত শেখ তুসীর সহস্রতম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানে পাঠ করেন) চীনে ইসলামের প্রবেশের বিষয়ে আতা মূলক জুয়াইনীর জাহান গুশাই গ্রন্থ হতে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন ,

এ বিষয়টি (নবুওয়াতের সত্যতা) বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব এবং কল্পনা হতেও দূরে নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিতে দু টি বিষয় রয়েছে: প্রথমত নবুওয়াতের প্রকাশ ,দ্বিতীয়ত নবুওয়াতের বাণী। এটি একটি শক্তিশালী অলৌকিক নিদর্শন যে ,ছয়শ বছরের কিছু পর নবী (সা.)-এর বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি বলেছিলেন: আমার জন্য পৃথিবী প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। সুতরাং আমি দেখতে পাচ্ছি পূর্ব-পশ্চিমের সেই প্রস্তুত হয়ে থাকা দেশগুলোকে যেখানে আমার উম্মতের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

এটি বহিঃশত্রুর পতনের মাধ্যমে সম্ভবপর হবে... এবং এর ফলে ইসলামের পতাকা সমুন্নত ,ইসলাম ধর্মের প্রদীপ প্রজ্বলিত এবং মুহাম্মদী দীনের আলো সকল ভূমিকে আলোকিত করবে ,অথচ এমন ভূমিতে ইসলামের আগমন ঘটেছিল যেখানে পূর্বে ইসলামের সুগন্ধ কখনও পৌঁছেনি ,তাদের অধিবাসীরা আজান ও তাকবীরের ধ্বনি শুনেনি ,নাপাক লাত ও উজ্জার উপাসনা ছাড়া সেখানে কিছু ছিল না। আর এই ভূমিতেই কিছু মুমিনের সৃষ্টি হয় যাঁরা নিজ ভূমির সীমা অতিক্রম করে দূরবর্তী স্থানে পৌঁছেন ও সেখানে বসতি স্থাপন করে ইসলামের বাণী প্রচার করেন ।

অনারবদের কেউ কেউ খোরাসান ও উজবেকিস্তান (সামারকান্দ ও বোখারা) হতে মোগলদের মাধ্যমে কারিগর ও পশুপালক হিসেবে তাদের বিজিত ভূমিতে (চীনে) কাজের জন্য গৃহীত হয় এবং কেউ কেউ সিরিয়া ,ইরাক ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন ইসলামী অঞ্চল হতে ব্যবসায় অথবা পর্যটনের উদ্দেশ্যে ঐ অঞ্চলে যায়। তারা যেখানেই গিয়েছে সেখানেই পরিচিতি লাভ করেছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপসনালয়ের পাশাপাশি মসজিদ ,মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আলেমগণ ধর্মীয় শিক্ষা ,জ্ঞান ও নিজ চিন্তা-মতকে সবার মধ্যে প্রচার করেন ও একে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। সম্ভবত এ সময়ের প্রতি ইঙ্গিত করেই রাসূল (সা.) বলেছিলেন , চীনে গিয়ে হলেও জ্ঞান শিক্ষা কর।

ছয়শ বছর পর ইরানী ও অ-ইরানী ইসলাম ধর্ম প্রচারকগণ চীনে যাবেন ও তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত করবেন এ সম্পর্কিত নবীর ভবিষ্যদ্বাণীকে আতা মূলক জুয়াইনী তাঁর অন্যতম মুজিযা মনে করেছেন।

ইসলামের পথে আত্মোৎসর্গীকৃত সামরিক সেবা

ইসলামের পথে ইরানীদের সামরিক সেবা ইসলাম ও ইরানের সম্পর্কের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই সামরিক সেবা তারা আন্তরিকভাবেই দিয়েছিল।

আমরা ইয়েমেনের অধিবাসী ইরানী মুসলমানদের আত্মত্যাগী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছি। উমাইয়্যা শাসকদের বিরুদ্ধে ইরানীদের আন্দোলন আব্বাসীয়দেরকে ক্ষমতায় বসায় তাও এরূপ ভূমিকার সাক্ষ্য। তাদের এই সামরিক অভ্যুত্থান শুধু আরবদের ইসলামের সঠিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করানো ও প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ছিল। যদিও এই সামরিক অভ্যুত্থানের বিজয়ে উমাইয়্যাদের পতন ঘটেছিল ,কিন্তু তার পরিবর্তে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল তাদের হতে উত্তম ছিল না। ফলে উত্তম কোন ফল হয়নি।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে ইরানের অভ্যন্তরেই কিছু আন্দোলন শুরু হয় যা ইসলামবিরোধী ছিল বিধায় দমন করা হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ,এ ইসলামবিরোধী আন্দোলনগুলোকে আরবরা নয় ,ইরানীরাই দমন করে।

তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে আজারবাইজানে ববাক খুররাম দীনের নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয় যদি ইরানী সেনাপতি ও সাধারণ সৈনিকরা না থাকত তাহলে আড়াই লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে তা দমন করা সম্ভব হতো না। আল মুকাননাহ্ ,সিনবাদ অথবা উসতাদাসিসের নেতৃত্বে যে আন্দোলনগুলো হয়েছিল তাও অনুরূপ। সুলতান মাহমুদ গজনভী ভারতবর্ষে যে সকল সেনা অভিযান চালান তাতে ইসলামী জিহাদের রং দিয়েছিলেন বলেই ইরানীরা জিহাদের উদ্দীপনা নিয়ে ভারতের বিজয়ে অংশ নিয়েছিল। তেমনিভাবে ইরানের বিভিন্ন সম্রাট পাশ্চাত্যের পক্ষ হতে পরিচালিত ক্রুসেডের যুদ্ধগুলোতে ইরানী মুসলমানদের ইসলামী অনুভূতি ও চেতনাকে ব্যবহার করেছিলেন বলেই ভাল ফল পেয়েছিলেন।

ইরানী সৈন্যরাই এশিয়া মাইনরে ইসলামের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল ,আরবরা নয়। এখানে হাজারেয়ে শেখ তুসী গ্রন্থের ডক্টর সাইয়্যেদ জাফর শাহিদীর প্রবন্ধ হতে কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তিনি বলেছেন ,

মুসলমানগণ পূর্ব রোমকে রোমসাম্রাজ্য এবং ভূমধ্যসাগরকে রোম সাগর বলে থাকে। এ কারণেই এশিয়া মাইনরকে (তুরস্ক ,লেবানন ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য দেশও এর অন্তর্ভুক্ত) তারা রোম বলত।... মুসলমানরা যখন সমগ্র সিরিয়া দখল করে তখন এশিয়া মাইনরও হস্তগত করা তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়ে। খলীফা হযরত উমরের শাসনামলে মুয়াবিয়া চেয়েছিলেন ঐ অঞ্চলে আক্রমণ করতে ,কিন্তু খলীফা অনুমতি দেননি। খলীফা হযরত উসমানের শাসনামলে তাঁর অনুমতি নিয়ে তিনি আমুবিয়া পর্যন্ত জয় করেন। কিন্তু তখন হতেই এই ভূমি নিয়ে মুসলমান ও রোমীয়দের মধ্যে দীর্ঘ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এতদঞ্চলের ভূমি ,শহর ও দুর্গগুলো কখনও উমাইয়্যা বা আব্বাসীয় খলীফাদের আওতায় কখনও রোমীয়দের আওতায় হস্তান্তরিত হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য মতে উমাইয়্যা বা আব্বাসীয় খলীফা কারো পক্ষেই সমগ্র অঞ্চলে ইসলামের স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি।... দীর্ঘ সময় পর একমাত্র সালজুকীদের শাসনামলে এই অঞ্চলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং সমগ্র এশিয়া মাইনর তাদের অধীনে আসে। এ সময়েই ইসলামের বাণী ও শিক্ষা সেখানে ফার্সী ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচারিত হয় এবং এতটা বিকাশ লাভ করে যে ,ইসলামী অধ্যাত্মবাদের প্রবাদ পুরুষ জালালুদ্দীন রুমীর ন্যায় ব্যক্তিত্বের জন্ম হয় ও এই জ্যোতি সকল ফার্সী ভাষী ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

এ অংশটি অকসারায়ী প্রণীত মুসামেরাতুল আখবার নামক এশিয়া মাইনরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস গ্রন্থ হতে বর্ণনা করছি। কারণ এ গ্রন্থে এতদঞ্চলের ইরানী শাসক ও মুসলমান জনসাধারণের চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। যদি ইরাক ও পশ্চিমাঞ্চলের দেশগুলোতে মুসলিম খলীফাদের আক্রমণ এ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়ে থাকে যে ,জিযিয়া লাভের মাধ্যমে বায়তুল মালের পরিমাণ বৃদ্ধি ;পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোতে ইরানী মুসলিম বিজেতাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু ইসলামের প্রচার ও প্রসার। অকসারায়ী বর্ণনা করেছেন , রোম সম্রাট আরমিয়ানুস এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে ইসলামী ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হলেন। প্রথমে তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের

সীমান্তবর্তী নাকিসারুসিওয়াম ,তুকাত ,আবলিস্তান ও অন্যান্য অংশে আক্রমণের চিন্তা করেন। এতদঞ্চলের শাসক দানেশমান্দ মুসলিম শাসক কাল্জ আরসালানের নিকট দূত পাঠিয়ে কাফেরদের মোকাবিলায় উৎসাহিত করলেন ও প্রতিশ্রুতি দিলেন যদি মুসলমানরা জয়ী হয় তাহলে তাদের এক লক্ষ দিনার ও আবলিস্তান উপহার দেবেন। কাল্জ আরসালান ইসলামী দৃষ্টিতে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে অন্যান্য মুসলিম শাসকদের সহযোগিতা নিয়ে বড় এক সেনাবাহিনী নিয়ে কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরা বিজয় লাভ করেন এবং আরমিয়ানুস যুদ্ধ হতে পলায়নে বাধ্য হন ও তাঁর সৈন্যবাহিনীর খুব কমই প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়। সম্রাট দানেশমান্দ কাল্জ আরসালানের নিকট এক লক্ষ দিরহাম পাঠিয়ে আবলিস্তান হস্তান্তরে সম্মত হলেন। মুসলিম শাসক কাল্জ আরসালান এ কথা শুনে ঐ এক লক্ষ দিরহাম ফেরত পাঠিয়ে দিলেন এবং বললেন , আমি ইসলামের জন্য এ যুদ্ধ করেছি। দিনার ও দিরহামের আমার কোন প্রয়োজন নেই।

একই গ্রন্থে ভারতবর্ষে মুসলমানদের সামরিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত আলোচনায় বর্ণিত হয়েছে :

৪৩ হিজরীতে প্রথমবারের মতো আবদুল্লাহ্ ইবনে সাওয়ার আবদী ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ইবনে কুরাইযের পক্ষ হতে সিন্ধু প্রদেশে আক্রমণ চালান ও ব্যর্থ হন। ৪৪ হিজরীতে মুহাল্লাব ইবনে আবি সুফরাহ্ সেখানে আক্রমণ চালান ,কিন্তু সফল হননি। ৮৯ হিজরীতে মুহাম্মদ বিন কাসিম এক যুদ্ধে সিন্ধুর রাজাকে পরাস্ত করেন ও তাঁকে হত্যার মাধ্যমে এ অঞ্চল মুসলমানদের হস্তগত হয়। কিন্তু ভারতবর্ষে ইসলামের প্রচারকার্য ইরানীদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল।

এখানেও আমরা ঐতিহাসিক সূত্র লক্ষ্য করলে দেখতে পাই ঐতিহাসিক জারফাদকানী বাদশাহ নাসিরুদ্দীন সাবক্তাকীন সম্পর্কে বলেছেন , তিনি কাফেরদের সঙ্গে জিহাদ ও ইসলামের শত্রুদের দমনের কাজ শুরু করেন এবং মূর্তিসমূহের উপাসনালয় ও ইসলামের শত্রুদের আবাসস্থলকে ধর্মীয় যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেন।

সুলতান মাহমুদ গজনভীর জীবনী আলোচনায় তিনি লিখেছেন , সুলতান ইয়ামিনুদ্দৌলা ও আমিনুল মিল্লাহ্ যখন ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহ দখল করতে শুরু করেন তখন এমন দূরবর্তী স্থানসমূহেও পৌঁছান যেখানে কখনও ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়নি ও কোন সময়েই মুহাম্মদী ধর্মের দাওয়াত ,কেরাআনের আয়াত ও মুজিযার কথা পৌঁছেনি। তাঁরা সেখান হতে র্শিক ও কুফরের অন্ধকার দূর করেন ,ইসলামের শরীয়তের মশালকে সেখানকার শহর ও গ্রামগুলোতে নিয়ে যান ,মসজিদসমূহ তৈরি করেন ,কোরআন পাঠ ও শিক্ষাদান শুরু করেন ,ইসলামের আজান ও ঈমানের আহ্বানকে প্রকাশ করেন...।

সুলতান মাহমুদ গজনভীর প্রাচ্যে বিজয় অভিযান ও শাসন পদ্ধতির সঙ্গে স্পেনে প্রথম মুসলিম শাসক আবদুর রহমানের আচরণের তেমন অমিল না থাকলেও প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে ইসলামের বিজয় অভিযানের মধ্যে লক্ষণীয় পার্থক্য ছিল। আরব মুসলমানরা পাশ্চাত্যে তাদের বিজয় অভিযান ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র পর্যন্ত চালাতে সক্ষম হলেও ইতিহাসের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে তা মুসলমানদের আধিপত্যের বাইরে চলে যায় এবং ঐ অঞ্চলের নবীন মুসলমানরাও ইসলাম ত্যাগ করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু ইরানী জাতিভুক্তদের মাধ্যমে প্রাচ্যে ইসলামী সভ্যতার যে ভিত্তি স্থাপিত হয় তা এতটা দৃঢ় ও মজবুত ছিল যে শত শত বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও এতদঞ্চলের মানুষ মুসলমান হিসেবে কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে ও পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো ,যে বছর২৩৪ আরব উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের একটি অংশ ইসলামের শত্রুদের দ্বারা অধিকৃত হয়২৩৫ সে বছরই ইরানের পূর্ব দিকে ৯ কোটি মানুষ স্বতন্ত্র ইসলামী ভূমি ও দেশ হিসেবে পাকিস্তান নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিজ সম্পৃক্ততার ঘোষণা দেয়।২৩৬

যদিও যে সকল মুসলিম বিজেতার নাম এখানে এসেছে ,যেমন কাল্জ আরসালান ,নাসিরুদ্দীন সাবক্তাকীন ,সুলতান মাহমুদ গজনভী ও অন্যান্য সকলেই ইরানী তুর্কী বংশোদ্ভূত ছিলেন ,কিন্তু যেমনটি ডক্টর শাহিদী বলেছেন যে ,তাঁরা ছিলেন তৎকালীন ইরানের প্রতিনিধি ও এ ভূখণ্ডের শক্তির প্রতীক ও এতদঞ্চলের মুসলমানদের শাসক এবং তাদের পক্ষে ইসলামের নামে ইরানীরাই জিহাদ করত ;অন্যরা নয়।

জ্ঞান ও সংস্কৃতি

ইরানীদের ইসলামের পেছনে অবদানের ক্ষেত্র হিসেবে সবচেয়ে ব্যাপক ও উদ্দীপনার স্বাক্ষরসম্পন্ন ক্ষেত্রটি হলো জ্ঞান ও সংস্কৃতি।

সভ্যতার উন্নয়ন ও বিকাশ ,সামগ্রিকতা ও সর্বজনীনতা ,সমাজের সকল স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ,সামষ্টিক ও সুন্দর উদ্যোগসমূহের বিচিত্রতা প্রভৃতি দিকগুলো ইসলামী সভ্যতার তীব্র আকর্ষণীয় বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত।

জর্জি যাইদান বলেছেন ,

আরবগণ (মুসলমানগণ) এক শতাব্দীর কিছু বেশি সময়ের মধ্যে অন্য ভাষা হতে বিভিন্ন জ্ঞানের যে বিপুল সংখ্যক অনুবাদ করে রোমীয়গণ কয়েক শতাব্দীতেও তা পারেনি। হ্যাঁ ,মুসলমানগণ সভ্যতা সৃষ্টির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এরূপ দ্রুতগতিতেই অগ্রসর হয়েছিল। ২৩৭

মুসলমানগণ কোরআন ও সুন্নাতকে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানসমূহ ,যেমন কেরাআত ,তাফসীর ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ,ফিকাহ্ ,সারফ ,নাহু (ব্যাকরণশাস্ত্র) ,মায়ানী ,বাদীই ও বায়ান (বর্ণনাভঙ্গী ও অলংকারশাস্ত্র) ,সীরাতুন্নবী (নবীর জীবন ও ইতিহাস) প্রভৃতি নিজেরাই উদ্ভাবন করেছে। এ সকল বিষয়ে যদি কিছু অন্যদের হতে নিয়েও থাকে তা অনুল্লেখ্য। যে সকল জ্ঞান তৎকালীন অন্যান্য জাতির নিকট ছিল ও ভিন্ন জাতির প্রচেষ্টার ফল বলে বিবেচিত হতো ,যেমন অংকশাস্ত্র ,প্রকৃতিবিজ্ঞান ,জ্যোতির্বিজ্ঞান ,চিকিৎসাশাস্ত্র ,দর্শন ও অন্যান্য জ্ঞান তা আরবীতে ভাষান্তরিত ও অনূদিত হয়েছিল। জর্জি যাইদান বলেছেন ,

ইসলামী সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠত্ব হলো গ্রীক ,পারসিক ,ভারতীয় ও ব্যাবিলনীয় ভাষার গ্রন্থগুলোকে আরবীতে অনুবাদ করে সেগুলোর পরিবর্ধন সাধনের মাধ্যমে পূর্ণতা দান।

মুসলমানগণ বিভিন্ন ভাষায় বিদ্যমান দর্শন ,অংকশাস্ত্র ,জ্যামিতি ,জ্যোতির্বিজ্ঞান ,সাহিত্য ,চিকিৎসাশাস্ত্রের গ্রন্থসমূহকে আরবীতে অনুবাদ করে। তৎকালীন প্রসিদ্ধ ভাষাসমূহ যথা গ্রীক ,ভারতীয় (হিন্দী) ,ফার্সী ভাষা হতে গ্রন্থসমূহ অনুবাদ করা হয়। বলা যায় প্রতিটি জাতিরই শ্রেষ্ঠ জ্ঞানগুলোকে তারা গ্রহণ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ গ্রীকদের নিকট থেকে দর্শন ,চিকিৎসাশাস্ত্র ,জ্যামিতিবিজ্ঞান ,যুক্তিশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যা ;ইরানীদের নিকট থেকে ইতিহাস ,সাহিত্য ,সংগীত ,উপদেশবাণী ও জ্যোতিষ্কবিদ্যা ;ভারতীয়দের নিকট থেকে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা ,উদ্ভিদবিজ্ঞান ,তারকাবিজ্ঞান ,হিসাবশাস্ত্র ,গল্পকাহিনী রচনা ও সংগীত শিল্প। ব্যাবিলনীয় ও নাবতীদের নিকট থেকে কৃষিকাজ ,উদ্ভিদের পরিচর্যা ,জ্যোতির্বিদ্যা ,যাদু ও হিপনোটিসম ;মিসরীয়দের নিকট থেকে রসায়ন ও বিশ্লেষণবিদ্যা। প্রকৃতপক্ষে আরবগণ (মুসলমানগণ) অ্যাসিরীয় ,ব্যাবিলনীয় ,মিশরীয় ,ইরানী ,ভারতীয় ও গ্রীক জ্ঞানসম্ভারকে (সাহিত্য ,স্থাপত্য ও অন্যান্য জ্ঞান) সমন্বিত করে ও উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেয়।২৩৮

প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র

ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি (সার্বিকভাবে ইসলামী সভ্যতা) ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ করে গৌরবময় স্থানে পৌঁছায়। যেমনভাবে সজীব প্রাণীসমূহ প্রথমদিকে এককোষী হিসেবে উৎপত্তি লাভ করে ও ধীরে ধীরে তার অভ্যন্তরীণ প্রাণসত্তা ও ক্ষমতার বিকাশের মাধ্যমে শাখা-প্রশাখা বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গঠিত হয় ও সবশেষে পূর্ণাঙ্গ সত্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তেমনিভাবে ইসলামী সভ্যতাও বিকশিত হয়ে পূর্ণতায় পৌঁছায়।

মুসলমানদের জ্ঞান অন্বেষণের ধারা ও উদ্দীপনা একটি নির্দিষ্ট স্থান হতে বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিশেষ ব্যক্তির মাধ্যমে শুরু হয়। এখন আমরা দেখব কোন্ স্থানে এ আন্দোলনের ধারাটি শুরু হয় অর্থাৎ মুসলমানদের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্রটি কোথায় চালু হয় ?

মুসলমানদের জ্ঞানার্জন ও বিকাশের ধারা মদীনা হতে শুরু হয়েছিল। প্রথম যে গ্রন্থটি মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও মুসলমানগণ তার অন্বেষায় আত্মনিয়োগ করে তা হলো কোরআন। কোরআনের পর তাদের অধ্যয়নের বিষয় ছিল হাদীসসমূহ। হেজাযের আরবরা প্রথমবারের ন্যায় শিক্ষক-ছাত্রের মুখস্থকরণ ,সংকলন প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়। মুসলমানগণ আগ্রহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পর্যায়ক্রমে অবতীর্ণ কোরআনের আয়াতসমূহ মুখস্থ করত। যে সকল আয়াত তারা সরাসরি রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে না শুনত তা রাসূলের নির্দেশে কোরআন সংকলনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের২৩৯ নিকট থেকে শুনত ও মুখস্থ করত। তদুপরি তারা রাসূলের পুনঃপুন নির্দেশের কারণে তাঁর পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীসমূহকে পরস্পরের নিকট থেকে শ্রবণ করে মুখস্থ করত অথবা লিখে রাখত।

মদীনার মসজিদে নিয়মিত শিক্ষার আসর বসত এবং সেখানে বিভিন্ন শিক্ষণীয় ইসলামী বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা হতো। একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মসজিদে প্রবেশ করে দেখলেন দু দল লোক ভিন্ন দু ধরনের কর্মে মশগুল রয়েছে। একদল ইবাদাত ও যিকর-আযকারে মশগুল অপর দল জ্ঞানের আলোচনায়। রাসূল দু দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন ,

كلاهما على خير و لكن بالتّعليم أُرسلت

দু দলই কল্যাণময় কর্মে লিপ্ত রয়েছে ,তবে আমি শিক্ষাদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি। অতঃপর রাসূল জ্ঞানের আলোচনায় লিপ্তদের সঙ্গে গিয়ে বসলেন।২৪০

মদীনার পর ইরাক জ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত হয়। সর্বপ্রথম ইরাকের বসরা ও কুফা এই দু শহর জ্ঞানকেন্দ্র ছিল। পরে বাগদাদ শহর নির্মিত হলে তা জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয় এবং এখান হতেই জ্ঞান-বিজ্ঞান ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে খোরাসান ,রেই ,বুখারা ,সামারকান্দ (বর্তমানের উজবেকিস্তানের দু শহর) ,মিশর ,সিরিয়া ,আন্দালুস ও অন্যান্য স্থান জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়। জর্জি যাইদান মুসলিম শাসকদের উদ্যোগকে এ বিষয়ে সবচেয়ে কার্যকর প্রভাবশীল বলে মনে করেন। তিনি বলেন ,

ইসলামী ব্যক্তিত্বসমূহ ও উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিবর্গের জ্ঞানের অনুরাগ ও জ্ঞান চর্চার মনোবৃত্তির ফলে ইসলামী দেশসমূহে গ্রন্থ ও গ্রন্থ রচয়িতার পরিমাণ প্রতিদিন বৃদ্ধি পেতে থাকে ও গবেষণার পরিধির উত্তরোত্তর বিস্তৃতি ঘটে। সম্রাট ,উজীর ,প্রাদেশিক শাসনকর্তা ,ধনী ,দরিদ্র ,আরব ,ইরানী ,রোমীয় ,ভারতীয় ,তুর্কী ,মিশরীয় ,ইহুদী ,খ্রিষ্টান ,দাইলামী ,সুরিয়ানী সকলেই ইসলামী ভূখণ্ডের সকল স্থানে যথা সিরিয়া ,মিশর ,ইরাক ,ইরান ,খোরাসান ,উজবেকিস্তান ,সিন্ধু ,আফ্রিকা ,স্পেন প্রভৃতিতে দিবা-রাত্র গ্রন্থ রচনা ও সংকলনে মনোনিবেশ করলেন। অর্থাৎ যেখানেই ইসলামী শাসন ছিল সেখানেই জ্ঞানের দ্রুত বিস্তার ঘটতে লাগল। এ সকল মূল্যবান রচনাসমগ্র ও সংকলনে পূর্ববর্তী যুগসমূহের সকল গবেষণার সারসংক্ষেপ সংকলিত হয়েছিল। ফলে প্রকৃতিবিজ্ঞান ,ঐশী জ্ঞান ,ইতিহাস ,অংকশাস্ত্র ,সাহিত্য ,দর্শন ,প্রজ্ঞা প্রভৃতি বিষয় এ গ্রন্থসমূহে সমন্বিতভাবে বিদ্যমান ছিল। মুসলিম মনীষীদের গবেষণার ফল হিসেবে উপরোক্ত জ্ঞানসমূহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভক্ত হয়। ২৪১

যখন অন্য ভাষার জ্ঞানসমূহ আরবীতে অনূদিত হওয়া শুরু হয় তখন খ্রিষ্টান মনীষীরা বিশেষত সিরীয় খ্রিষ্টানরা এ বিষয়ে অন্যদের হতে অগ্রগামী ছিলেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে মুসলমানগণ সে স্থান অধিকার করে।

জর্জি যাইদান বলেন ,

আব্বাসীয় খলীফাগণ জ্ঞান ও সাহিত্যের বীজ বাগদাদের মাটিতে রোপন করেন এবং এর ফল পর্যায়ক্রমে খোরাসান ,রেই ,আজারবাইজান ,উজবেকিস্তান ,মিশর ,সিরিয়া ,আফ্রিকা ,স্পেন প্রভৃতি স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বাগদাদে খেলাফত ও ইসলামী ভূখণ্ডের সম্পদের কেন্দ্র হিসেবে পূর্বের ন্যায় মনীষীদের সম্মিলন কেন্দ্ররূপে এরপরও বিদ্যমান থাকে। আব্বাসীয় খলীফাদের সেবায় নিয়োজিত খ্রিষ্টান চিকিৎসকগণই প্রথমদিকে চিকিৎসা ও অনুবাদের কাজ করতেন। পরবর্তীতে বাগদাদ হতে কিছু মুসলিম পণ্ডিত এ কর্মে নিয়োজিত হন। কিন্তু সার্বিকভাবে বাগদাদের প্রতিষ্ঠিত ও উচ্চ পর্যায়ের মনীষীদের অধিকাংশই খ্রিষ্টান ছিলেন যাঁরা খলীফাদের দরবারে কর্মের জন্য ইরাক ও অন্যান্য স্থান হতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। মুসলিম মনীষীদের অধিকাংশই বাগদাদের বাইরে আত্মপ্রকাশ করেছেন। বিশেষত যখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তখন ঐ ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের শাসকগণ খলীফাদের অনুসরণে জ্ঞান ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া শুরু করেন ও তাঁদের অধীন বিভিন্ন অঞ্চল ,যেমন কায়রো ,গাজনীন ,দামেস্ক ,নিশাবুর ,ইসতাখর ও অন্যান্য স্থান হতে পণ্ডিত ও গবেষকদের আহ্বান জানান। ফলে রেই হতে জাকারিয়া রাযী ;তুর্কিস্তানের২৪২ বোখারা হতে ইবনে সিনা ;সিন্ধের বিরুন হতে আল বিরুনী ,উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইবনে জালিল ,দার্শনিক ইবনে বাজা ,চিকিৎসক ইবনে জাহরা ,দার্শনিক ইবনে রুশদ ;স্পেন হতে উদ্ভিদবিদ ইবনে রুমীয়া ও অন্যান্যদের সৃষ্টি হয়। ২৪৩

সুতরাং প্রথম জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল মদীনা এবং সেখানেই জ্ঞানের প্রথম বীজ রোপিত হয়।

জ্ঞানের প্রথম বিষয়বস্তু

প্রথম কোন্ বিষয়টি মুসলমানদের আকর্ষণ করে ও তাদের মধ্যে জ্ঞানের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে ? মুসলমানদের জ্ঞানের শুরু কোরআন দিয়ে। তারা প্রথম কোরআনের আয়াতের অর্থ ও বিষয়বস্তু অনুধাবন ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করে। অতঃপর হাদীস গবেষণা শুরু করে। তাই যে শহরটিতে সর্বপ্রথম জ্ঞানের জাগরণ শুরু হয় তা হলো মদীনা। মুসলমানদের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র ছিল মসজিদ। তাদের শিক্ষার বিষয়বস্তু ছিল কোরআন ও সুন্নাহ্ এবং তাদের প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাসূল (সা.)। ইসলামের প্রথম শিক্ষণীয় বিষয় ছিল পঠন ,তাফসীর ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ,রিজালশাস্ত্র ,ভাষাজ্ঞান ,অভিধান ,সারফ ও নাহু (ব্যাকরণশাস্ত্র) ,বাচনভঙ্গী ও অলংকারশাস্ত্র ,ইতিহাস ইত্যাদি। এ সকল জ্ঞান কোরআন ও সুন্নাতের স্বার্থে সৃষ্টি হয়েছিল। এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন ,

বিশিষ্ট আরবী ভাষাবিদ প্রফেসর দাখভিয়া এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকার বাইশতম খণ্ডে তাবারী ও অন্যান্য আরব ঐতিহাসিকদের সম্পর্কে যে প্রবন্ধ লিখেছেন তাতে প্রশংসনীয়ভাবে ইসলামী সমাজে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার বিকাশকে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত কোরআনের আলোকে ইতিহাসের জ্ঞানের উৎপত্তি ও বিকাশের বিষয়টি সেখানে আলোচিত হয়েছে। তিনি এ জ্ঞানসমূহ কিরূপে ঐশী প্রজ্ঞার ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে তা উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কিত জ্ঞান প্রথমত শব্দ ও ভাষা শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হয়। যখন অন্যান্য ভাষাভাষীরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ শুরু করে তখন আরবী শব্দ ও বাক্যগঠন এবং ব্যাকরণশাস্ত্রের আশু প্রয়োজন অনুভূত হলো। কারণ পবিত্র কোরআন আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল। কোরআনে বর্ণিত অপ্রচলিত শব্দসমূহের অর্থ বিশ্লেষণের জন্য আরবী প্রাচীন কবিতাসমূহ যথাসম্ভব সংকলনের প্রয়োজন পড়ল... এই কবিতাসমূহের অর্থ অনুধাবনের জন্য আরবদের বংশ পরিচিতিবিদ্যা ও তৎকালীন আরবদের ইতিহাস ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিল। কোরআনে অবতীর্ণ বিধিবিধানের পূর্ণতার জন্য জীবনের বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবী ও তাবেয়ীদের নিকট হতে নবীর বাণী ও কর্ম সম্পর্কিত প্রশ্নের ফলশ্রুতিতে হাদীসশাস্ত্রের জন্ম হলো। হাদীসসমূহের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা যাচাইয়ের জন্য হাদীসের সনদ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি অপরিহার্য বিষয় বলে পরিগণিত হলো।... গবেষণার স্বার্থে সনদের বাস্তবতা ,ইতিহাসের জ্ঞান ,বর্ণনাকারীদের বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো। এর ফলে হাদীসশাস্ত্রবিদগণের জীবনী ,বিভিন্ন সময়ের জ্ঞান ,প্রশিক্ষণ ও ঘটনাসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞান উদ্ভূত হলো। এ ক্ষেত্রে আরবের ইতিহাস যথেষ্ট ছিল না। তাই প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষত ইরানী ,গ্রীক ,হামিরী ,হাবাশী ও অন্যান্য দেশের ইতিহাস জানাও কোরআনে সন্নিবেশিত জ্ঞান ও প্রাচীন কবিতা বোঝার জন্য অপরিহার্য হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ভূগোলবিদ্যাও এ উদ্দেশ্যে উদ্ভূত হয়েছিল। এরূপ অন্যান্য বিদ্যাও ইসলামী সাম্রাজ্যে দ্রুত বিস্তারের সাথে সাথে অপরিহার্য হিসেবে উদ্ভূত হয়। ২৪৪

জর্জি যাইদানের মত এটিই যে ,অন্যান্য জ্ঞানের প্রতি মুসলমানদের আকর্ষণ কোরআনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। মুসলমানগণ কোরআনের প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং এর সঠিক তেলাওয়াত ও উচ্চারণের বিষয়ে গুরুত্ব দিত। কোরআন তাদের দীন ও দুনিয়ার সমস্যার সমাধান দিত এবং তারা কোরআনের বিধান বোঝার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাত। কোরআনের শব্দ ও অর্থ অনুধাবনের প্রচেষ্টা বিভিন্ন জ্ঞানের উদ্ভব ঘটায়। ইসলামী সমাজে যে সজীব কোষটি জন্মের পর বিকাশ ও পূর্ণতার মাধ্যমে বৃহৎ ইসলামী সভ্যতার জন্ম দেয় সে কোষটি হলো কোরআনের প্রতি মুসলমানদের সীমাহীন ভালবাসা ও প্রেম। কোরআনের প্রতি মুসলমানদের অকুণ্ঠ ভালবাসাই যে জ্ঞানের সকল দ্বার উন্মোচনে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে জর্জি যাইদান মনে করেন। তিনি বলেন ,

মুসলমানগণ কোরআন লিখন ও সংরক্ষণে যথার্থ দৃষ্টি রাখত ও এ বিষয়কে এতটা গুরুত্ব দিত যে ,ইতোপূর্বে অন্য কারো ক্ষেত্রে তা লক্ষ্য করা যায়নি। তারা এমনকি স্বর্ণ ,রৌপ্য ও হাতির দাঁতের পত্রের ওপরও কোরআন লিখত। কখনও রেশমী কাপড় বা দামী কোন কাপড়ের ওপর স্বর্ণ ও রৌপ্যের কালি দ্বারা কোরআনের আয়াত লিখা হতো। গৃহ ,মসজিদ ,গ্রন্থাগার ,সভাকক্ষের দেয়াল ও দরবারসমূহ এরূপ কাপড় ও কোরআনের আয়াতের দ্বারা অলংকৃত করত। লেখার জন্য সুন্দর হাতের লেখা ব্যবহার করত। বিভিন্ন ধরনের চামড়া ও কাগজ কোরআন লিখনে ব্যবহৃত হতো এবং বিভিন্ন রংয়ের কালির মাধ্যমে লিখে তার চারিপাশের রেখাগুলো স্বর্ণ দিয়ে অলংকৃত করা হতো।... মুসলমানগণ কোরআনের শব্দ ও আয়াত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করত ,এমনকি কোরআনের বর্ণসংখ্যা স্বতন্ত্রভাবে তারা গণনা করেছিল। ২৪৫

তিনি বলেছেন ,

...তাদের সকল বক্তব্য ও লেখনীতে কোরআনের পথকে তাদের কর্মপদ্ধতির আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। তারা তাদের লেখনীতে কোরআনের আয়াতসমূহ হতে উদাহরণ নিয়ে আসত। কোরআনের শিক্ষা ও আদব তাদের দৈনন্দিন জীবনের চরিত্রে ও আচরণে ব্যাপক প্রভাব রাখত। অথচ অধিকাংশ মুসলিম জাতির ভাষা কোরআনের ভাষা ছিল না এবং তারা এমন দেশে বাস করত যেখান হতে কোরআন অনেক দূরে অবতীর্ণ হয়েছিল। পূর্ববর্তী মুসলমানগণ শরীয়তের জ্ঞান ছাড়াও আরবী ব্যাকরণের বিষয়েও কোরআনের আয়াত ও অর্থ হতে উদাহরণ উপস্থাপন করত ,যেমন আরবী ভাষা ও ব্যাকরণবিদ সিবাভেই তাঁর গ্রন্থে কোরআন হতে তিনশ আয়াত উদাহরণ হিসেবে এনেছেন। যে সকল সাহিত্যিক ও লেখক তাঁদের বক্তব্য ও লেখনীকে সুন্দর ও অলংকৃত করতে চাইতেন অবশ্যই কোরআনের আয়াতের সহযোগিতা নিতেন। ২৪৬

জর্জি যাইদান আরো উল্লেখ করেছেন ,

সালাউদ্দীন আইউবী মিশর অধিকারের পর দ্বিতীয় ফাতেমী খলীফা আল আযিয বিল্লাহ্ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থাগারে স্বর্ণ দ্বারা লিখিত ও অলংকৃত তিন হাজার চারশ কোরআন পান। আল আযিয বিল্লার মন্ত্রী ইয়াকুব ইবনে কালাস তাঁকে এরূপ কোরআন লিপিবদ্ধ করার কাজে পৃষ্ঠপোষকতা করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ২৪৭

ইরানের মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর যাদুঘরে যে প্রাচীন কোরআন সংরক্ষিত আছে সেগুলোর আকর্ষণীয় ও আশ্চর্যজনক সুন্দর লিখনপদ্ধতি ও অলংকৃত পৃষ্ঠাসমূহ এ দেশের মানুষের কোরআনের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসার প্রমাণ।

ইসলামের জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বর্ণিত পর্যায়ক্রমিক ধারাতেই বিকশিত হয়েছিল। এখন আমরা এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে আলোচনা করব।

যদিও ইসলামী বিশ্বের বাইরে হতে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্বলিত যে সকল গ্রন্থ অনূদিত হয়েছিল তা ইরানী ছিল না ,কিন্তু ইসলামী বিশ্বের ধর্মীয় ও অন্যান্য জ্ঞান বিষয়ক অধিকাংশ গ্রন্থ ইরানী মুসলিম মনীষীদের মাধ্যমেই রচিত ও সংকলিত হয়েছিল। এটিই ইসলামী শাসনামলে ইরানীদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন ,

তাফসীর ,হাদীস ,কালামশাস্ত্র ,দর্শন ,চিকিৎসাশাস্ত্র ,অভিধান ,জীবনী ,ইতিহাস ,এমনকি আরবী ব্যাকরণ ও অলংকারশাস্ত্রের বিষয়ে যে সকল গ্রন্থ আরবদের নামে প্রসিদ্ধি ও পরিচিতি লাভ করেছে তার অধিকাংশই ইরানীদের রচনা এবং ইরানীদের অংশ বাদ দিলে এ সকল জ্ঞানের উল্লেখযোগ্য ও উত্তম অংশ আর অবশিষ্ট থাকবে না।

আমরা এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে অ-ইরানী মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করতে চাই না। কারণ ইসলামী সভ্যতা বিশেষ কোন জাতির নয় ;বরং সকল মুসলমানের। তাই আরব ,ইরানী বা অন্য কোন জাতি তাঁকে নিজস্ব বলে দাবি করতে পারে না। তবে প্রতি জাতিই তার অবদানের অংশটুকু বর্ণনা ও নির্দিষ্ট করার অধিকার রাখে।

রচনা ও সংকলনের প্রারম্ভ

সাধারণত প্রাচ্যবিদগণ ও তাঁদের অনুসারীরা দাবি করে থাকেন ,ইসলামের প্রাথমিক যুগে অর্থাৎ রাসূল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় গ্রন্থ রচনা ও সংকলনের প্রচলন ছিল না ;বরং তা নিষিদ্ধ ছিল। তাঁরা এ ক্ষেত্রে রচনা ও সংকলনের বিষয়ে রাসূলের নিষেধাজ্ঞার একটি হাদীস বর্ণনা করে থাকেন। তাঁদের মতে পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে ইসলামের প্রসার ঘটলে রচনা ও সংকলন শুরু হয় এবং তখনই মুসলমানগণ রচনা ও সংকলনের সুফল বর্ণনা করে রাসূল (সা.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হাদীস উপস্থাপন শুরু করে ।

জর্জি যাইদান বলেছেন ,

খোলাফায়ে রাশেদীন আরবদের বেদুইন অবস্থা হতে শহুরে জীবনে প্রবেশের বিষয়টিকে ভয় পেতেন। তাঁরা মনে করতেন শহুরে জীবন লাভ করলে তারা সরল সাধারণ জীবন ও উদ্দীপনাপূর্ণ জীবন হতে দূরে সরে যাবে। এ কারণেই আরবদেরকে গ্রন্থ রচনা ও সংকলন হতে তাঁরা বিরত রাখতেন।... কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলামের প্রসার ঘটলে ইসলামী রাষ্ট্রের পরিধি বিস্তৃত হয়। ফলে সাহাবীরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং চিন্তা-বিশ্বাসের মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত ও সে সবের উত্তর আহ্বান করা হলো। মুসলমানগণ বাধ্য হয়ে হাদীস ,ফিকাহ্ ও কোরআন সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা ও সংকলন শুরু করল। তারা দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন ও ইজতিহাদ শুরু করল।... ফলে তখন থেকে রচনা ও সংকলনকে মাকরুহ বা অপছন্দনীয় কর্ম মনে না করে মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় কর্ম বলা শুরু করল এবং এ বিষয়ে নবী (সা.)-এর নিকট হতে আনাস ইবনে মালেক বর্ণিত হাদীসটি উপস্থাপন করল। ২৪৮

জর্জি যাইদান খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রতি যে বিষয়টি আরোপ করেছেন তা সর্বৈব মিথ্যা। জর্জি যাইদান শহুরে জীবনের প্রতি অনীহা এবং রচনা ও সংকলন নিষিদ্ধ থাকার বিষয়টি নিয়ে যা বলেছেন তার কোনটিই ঠিক নয়। নবী (সা.)-এর সাহাবীদের মদীনা হতে বহির্গত হওয়া ও অন্য স্থানে বসতি স্থাপনের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং হাদীসসমূহ লিপিবদ্ধকরণে নিষেধ ও বাধা প্রদানের বিষয়টি খোলাফায়ে রাশেদীনের সকল খলীফার প্রতি আরোপ করা কখনই সঠিক নয়। কারণ এ বিষয়টি শুধু দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পূর্বে আমরা হাদীস সংকলনের বিষয়ে একদিকে হযরত আলী ও একদল সাহাবীর অবস্থান গ্রহণ ও অন্যদিকে হযরত উমর ও আরেকদল সাহাবীর তার বিপরীতে অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছি। আমরা পরে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। মদীনা হতে অন্যত্র হিজরত ও বসতি স্থাপনের বিষয়েও হযরত আলী ও অন্যান্য সাহাবীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। এ কারণেই রাজধানী কুফায় স্থানান্তরের পর হযরত আলী তাঁর বিপরীত নির্দেশ দেন। তাই জর্জি যাইদানের বক্তব্য ভিত্তিহীন।

এডওয়ার্ড ব্রাউনের মতেও প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও উদ্দীপনা থাকলেও কোন গ্রন্থ সংকলিত হয়নি। তাই জ্ঞান ও তথ্যসমূহ মুখস্থের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং বলতে গেলে একমাত্র কোরআনই লিখিতরূপে গ্রন্থ হিসেবে বিদ্যমান ছিল। তিনি বলেছেন ,

প্রথম হিজরী শতাব্দীতে জ্ঞান অর্জন একমাত্র ভ্রমণ ও হিজরতের মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। তারা জ্ঞানান্বেষণে দীর্ঘ সফর করত। প্রথমদিকে পরিস্থিতির কারণেই সফরের বিষয়টি অপরিহার্য ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সফর নিয়মে পরিণত হয় ও এক রকম উন্মাদনা সৃষ্টি করে। নিম্নোক্ত হাদীসের ন্যায় জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে সফরের মর্যাদা ও গুরুত্ব বর্ণনাকারী হাদীসসমূহ এর সমর্থনে উপস্থাপিত হলো। যেমন নবী (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে সফর করে আল্লাহ্ তাকে বেহেশতের পথে পরিচালিত করেন। মিশরের অধিবাসী মাকহুল নামের একজন দাস তার মনিব কর্তৃক মুক্ত ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও ততক্ষণ মিশর ত্যাগ করেনি যতক্ষণ মিশরের প্রচলিত জ্ঞানসমূহ অর্জন সমাপ্ত হয়নি। অতঃপর যখন তার লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল তখন সে হেজায ,সিরিয়া ও ইরাকে যায় ও গনীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহ সংকলন করে। ২৪৯

কিন্তু এ মতটি ভিত্তিহীন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের নিদর্শনসমূহ হতে বোঝা যায় নবী (সা.)-এর সময় হতেই লিখন ও সংকলন শুরু হয় ও অব্যাহত থাকে। এর সপক্ষে অনেক প্রমাণ উপস্থিত। ব্রাউনের হিস্ট্রি অব লিটারেচার গ্রন্থের ফার্সী অনুবাদের প্রথম খণ্ডের টীকা অংশে ব্রাউনের মতো ব্যক্তিদের মতকে খণ্ডন করে আল্লামা শাইখুল ইসলাম যানজানীর মুসন্নাফাতুশ শিয়াতিল ইমামিয়া ফিল উলুমিল ইসলামিয়া গ্রন্থ হতে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি এর বিপরীত মতকেই প্রমাণ করেছেন।২৫০

মরহুম আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর (আল্লাহ্ তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করুন) তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম নামক মূল্যবান গ্রন্থেও এ মতটির ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করেছেন। আমরা পরবর্তী আলোচনায় সেখান হতে কিছু অংশ উপস্থাপন করব। আলোচনা দীর্ঘায়িত হওয়ার ভয়ে এখানে তা উল্লেখ হতে বিরত থাকছি।

দ্রুততার ভিত্তি ও কারণ

জ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানদের দ্রুত উন্নয়নের অন্যতম কারণ হলো তারা জ্ঞান ,শিল্প ও স্থাপত্যবিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন গোঁড়ামি পোষণ করত না। তারা যেখানেই বা যার কাছেই জ্ঞানের সন্ধান পেত তা আহরণ করত। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে তারা উদার মনোভাব পোষণ করত।

আমরা জানি যে ,নবী (সা.)-এর হাদীসেও জ্ঞান যেখানেই ও যার কাছেই পাওয়া যাক না কেন তা লাভ করতে বলা হয়েছে। যেমন রাসূল (সা.) বলেছেন ,

كلمة الحكمة ضالّة المؤمن فحيث وجدها فهو أحقّ بها

সঠিক প্রজ্ঞা মুমিনের হারানো সম্পদ। তাই যেখানেই তা পায় তা অর্জনে তার অধিকার সর্বাধিক। ২৫১

নাহজুল বালাগায় এসেছে :

الحكمة ضالّة المؤمن فخذ الحكمة و لو من أهل النّفاق

সঠিক জ্ঞান মুমিনের হারানো সম্পদ। তাই তা গ্রহণ কর যদিও মুনাফিকের নিকট হতে হয়। ২৫২

হযরত আলী (আ.) অন্যত্র বলেছেন ,

خذوا الحكمة و لو من المشركين

জ্ঞান শিক্ষা কর যদিও মুশরিকদের নিকট হতে হয়। ২৫৩

পবিত্র ইমামগণের নিকট হতে বর্ণিত হয়েছে ,হযরত ঈসা (আ.) বলেছেন ,

خذوا الحقّ من أهل الباطل و لا تأخذوا الباطل من أهل الحقّ و كونوا نقّاد الكلام

সত্য জ্ঞানকে ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের নিকট হতে হলেও গ্রহণ কর ,কিন্তু ভ্রান্ত ধারণাকে সত্যপন্থীর নিকট হতে হলেও গ্রহণ কর না এবং যে কোন কথা পর্যালোচনা কর। ২৫৪

সমুন্নত চিন্তা ,গোঁড়ামিমুক্ত ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির এ সকল হাদীস অমুসলমানদের হতেও জ্ঞান অর্জনে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করেছে। এ হাদীসসমূহ জ্ঞানার্জনে মুসলমানদের মধ্যে সংস্কারহীন ও মুক্ত মনের সৃষ্টি করেছে।

এ কারণেই মুসলমানরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত না যে ,কার নিকট হতে জ্ঞান লাভ করছে বা কার মাধ্যমে গ্রন্থসমূহ অনূদিত হয়ে তাদের নিকট পৌঁছেছে ;বরং তাদের ইমামদের শিক্ষানুযায়ী মুমিন ও জ্ঞানের প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেদের মনে করত এবং অন্যদের নিকট তা গচ্ছিত রয়েছে বলে বিশ্বাস করত। মাওলানা রুমীর ভাষায় :

জ্ঞান অন্যের নিকট তোমার ঋণ যেন

দাস বিক্রেতার নিকট ক্রীতদাসী সম।

মুসলমানরা বিশ্বাস করত ইলম ও ঈমান পরস্পর বিচ্ছিন্ন হতে পারে না এবং ঈমানহীন পরিবেশে জ্ঞান অপরিচিত হিসেবে মূল্যহীন হয়ে রয়েছে। তাই তার প্রকৃত ও পরিচিত ভূমি মুমিনের অন্তরে ফিরে আসা প্রয়োজন।

তাই রাসূলেরكلمة الحكمة ضالّة المؤمن فحيث وجدها فهو أحقّ بها এ কথা উপরোক্ত সকল কিছুকেই ধারণ করে। আর এজন্যই মুসলমানদের সকল প্রচেষ্টা এ চিন্তাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো যে ,কিরূপে বিশ্বের সকল জ্ঞানভাণ্ডার হস্তগত করা যায়।

জর্জি যাইদান ইসলামী সভ্যতার দ্রুত প্রসার ও বিস্তারের কারণ সম্পর্কে বলেন ,

ইসলামী সভ্যতার দ্রুত প্রসার এবং জ্ঞান ও সাহিত্যের দ্রুত বিকাশ ও উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারণ আব্বাসীয় খলীফাগণ অন্য ভাষার জ্ঞান অনুবাদের বিষয়ে ব্যয় করতে কোন দ্বিধা করতেন না এবং জাতি ,ধর্ম ও বংশের বিষয়টি লক্ষ্য করা ব্যতীতই সকল অনুবাদক ও জ্ঞানী ব্যক্তির প্রতি অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শন করতেন। তাঁদের সকল ধরনের সহযোগিতা দিতেন। এ কারণেই ইহুদী ,খ্রিষ্টান ,যারথুষ্ট্র ,সাবেয়ী ও সামেরী সকল ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিই খলীফাদের নিকট আসত। এ ক্ষেত্রে আব্বাসীয় খলীফাদের আচরণ সকল জাতি ও ধর্মের সেই সকল নেতা যাঁরা স্বাধীন ও ন্যায়পরায়ণ চিন্তা করেন তাঁদের আদর্শ হওয়ার উপযুক্ত। ২৫৫

জর্জি যাইদান সাইয়্যেদ শরীফ রাযী কর্তৃক সাবেয়ী ধর্মানুসারী আবু ইসহাক নামের এক ব্যক্তির প্রতি মর্সিয়া পাঠের প্রসিদ্ধ ঘটনা বর্ণনা করে বলেছেন ,চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা ও মনীষীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি এতটা প্রচলিত যে ,একজন আলেম সম্পূর্ণ মুক্ত মনে একজন সাবেয়ী মনীষীর প্রশংসায় মর্সিয়া পাঠ করেছেন ।

জর্জি যাইদানের মতে খলীফা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের উদারতা ও তাঁদের সংস্কারমুক্ত হওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষও তাঁদের অনুসরণে এরূপ করত। যদি নির্দেশদাতা ও সম্ভ্রান্তগণ স্বাধীন নীতি গ্রহণ করেন তাহলে অন্যরাও তাঁদের অনুসরণে তা-ই করে। কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়। কারণ সাইয়্যেদ শরীফ রাযীর ন্যায় ব্যক্তিবর্গ খলীফাদের অনুসরণ করতেন না এবং এ উদারতা ও সমুন্নত চিন্তা তাঁরা খলীফাদের নিকট হতে শিক্ষাগ্রহণ করেননি। তাঁরা এটি পবিত্র ইসলাম ধর্মের নীতি হতে শিক্ষা লাভ করেছিলেন যা মনে করে যে ,জ্ঞান সকল অবস্থায়ই সম্মানিত। তাই যখন মর্সিয়া পাঠের কারণে সাইয়্যেদের সমালোচনা করা হয় তখন তিনি উত্তরে বলেন , আমি জ্ঞানের প্রশংসায় মর্সিয়া পাঠ করেছি ;ব্যক্তির প্রশংসায় নয়।

ডক্টর যেররিন কুবও তাঁর করনামেহ ইসলাম গ্রন্থে মুসলমানদের দ্রুত অগ্রগতির পেছনে গোঁড়ামিমুক্ত উদার নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে উল্লেখ করেছেন।

মুসলমানদের জ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ হলো জ্ঞানার্জনের জন্য ইসলামের পুনঃপুন অনুপ্রেরণা দান ও তাকিদ। জর্জি যাইদান খ্রিষ্টধর্মের প্রতি গোঁড়ামি পোষণ সত্ত্বেও (যা তাঁর কোন কোন লেখায় স্পষ্ট ,যেমন তিনি বলেছেন , প্রথম যুগের মুসলমানগণ কোরআন ব্যতীত অন্য সকল গ্রন্থের বিরোধী ছিল ) এটি স্বীকার করেছেন ,জ্ঞানের প্রতি ইসলামের অনুপ্রেরণা দানের বিষয়টি মুসলমানদের অগ্রগতিতে বিশেষ প্রভাব রেখেছিল। তিনি বলেন ,

যখন ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটল এবং মুসলমানগণ ইসলামী শিক্ষার প্রসার সম্পন্ন করল তখন ধীরে ধীরে শিল্প ও অন্যান্য জ্ঞান অন্বেষণে লিপ্ত হলো। তারা নিজ সভ্যতার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ শুরু করল। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই শিল্প ও অন্যান্য জ্ঞান অর্জনের পথে পা বাড়াল। যেহেতু তারা খ্রিষ্টান পাদ্রীদের হতে দর্শন সম্পর্কে শুনেছিল সেহেতু অন্যান্য জ্ঞান অপেক্ষা দর্শনের প্রতি অধিকতর ঝুঁকে পড়ল। বিশেষত রাসূলের নিকট হতে জ্ঞান অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে যে সকল হাদীস বর্ণিত হয়েছিল ,যেমন জ্ঞান অর্জন কর যদিও তা চীনে গিয়ে অর্জন করতে হয় , প্রজ্ঞা মুমিনের হারান সম্পদ ,যার কাছেই পাও তা গ্রহণ কর যদিও সে ব্যক্তি মুশরিকও হয় , প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর ওপর জ্ঞান অর্জন ফরয এবং দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর তা তাদের এ পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। ২৫৬

ডক্টর যেররিন কুব বলেছেন ,

ইসলাম ইলম (জ্ঞান) ও আলেমের (জ্ঞানীর) প্রতি গুরুত্ব ও মনোযোগ দানের বিষয়ে এতটা উদ্বুদ্ধ করেছিল যে ,তা মানবিক জ্ঞান ও সংস্কৃতি শিক্ষায় মুসলমানদের অগ্রগতির কারণ হয়েছিল। কোরআন মানব জাতিকে পুনঃপুন বিশ্বজগৎ ও কোরআনের আয়াতের রহস্য অনুসন্ধানে চিন্তা করতে বলেছে ,অনেক স্থানেই অন্যান্যদের ওপর জ্ঞানীদের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছে ,একস্থানে আল্লাহ্ ও ফেরেশতামণ্ডলীর সাক্ষ্যের সমপর্যায়ে জ্ঞানীর সাক্ষ্যের মূল্য দিয়েছে ,এ বিষয়গুলো জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যথেষ্ট বলে ইমাম গাজ্জালী মনে করেন। তদুপরি বিভিন্ন সূত্রে রাসূল (সা.)-এর নিকট হতে বর্ণিত হাদীসসমূহও ইলম ও আলেমের মর্যাদার সাক্ষ্য। হাদীসসমূহ ও তাতে নির্দেশিত জ্ঞানের বিষয়ে মতানৈক্যও জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রতি মুসলমানদের আসক্তির কারণ হয়েছিল। এ বিষয়টি বিশ্বের রহস্য উদ্ঘাটনে ও এ সম্পর্কে চিন্তা ও পর্যালোচনায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। রাসূল স্বয়ং জ্ঞানার্জনে অনুপ্রেরণা দিতেন। বদরের যুদ্ধে যে সকল বন্দী মুক্তিপণ হিসেবে অর্থ প্রদানে সক্ষম ছিল না তারা যদি মদীনার দশটি শিশুকে অক্ষরজ্ঞান দান করত তবে মুক্তি পেত। রাসূলের অনুপ্রেরণাতেই যাইদ ইবনে সাবেত সুরিয়ানী ও হিব্র ভাষা শিক্ষা লাভ করেন এবং অন্য সাহাবীরাও জ্ঞানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। যেমন প্রসিদ্ধ সূত্রমতে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) তাওরাত ও ইঞ্জিলে পণ্ডিত ছিলেন ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনে আসও তাওরাতের জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষা জানতেন বলেও কথিত আছে। নবীর তাকিদ ও অনুপ্রেরণা যেমন মুসলমানদের জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছিল তেমনি জ্ঞানী ও আলেমের সম্মানকে বর্ধিত করেছিল।

এখন আমরা ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে ইরানীদের প্রভাব ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান নিয়ে আলোচনা করব। আমাদের এ গ্রন্থের উদ্দেশ্যও এটিই ,ইসলামী সংস্কৃতি ও জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ইরানীদের কার্যকর ভূমিকাসমূহ নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণ। ইতোপূর্বে যা বলেছি তা এ আলোচনারই ভূমিকাস্বরূপ এনেছি।

ইতোপূর্বে কয়েকবার বলেছি এবং এখানেও বলছি ইসলামী সভ্যতা বিশেষ কোন জাতির নয় ;বরং ইসলাম ও সকল মুসলমানের। তাই কোন জাতিরই অধিকার নেই তা নিজস্ব বলে দাবি করার। হোক সে আরব বা ইরানী অথবা অন্য কোন জাতির। তবে প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব অবদান নিয়ে কথা বলার অধিকার রয়েছে।

ইরান ও মিশরের গ্রন্থাগারসমূহে অগ্নি সংযোগ

ইরান ও ইসলামের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মুসলিম বিজেতাদের মাধ্যমে ইরানের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংসের তথাকথিত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যে সকল বিষয় সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত ও স্বতঃসিদ্ধ কেবল সেগুলোই স্কুল ,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত এবং যে সকল বিষয় সন্দেহজনক ও অপ্রমাণিত এবং শিক্ষার্থীদের কাঁচা মনে প্রভাব ফেলতে পারে তা বর্ণনা হতে বিরত থাকা উচিত। অথচ এরূপ একটি বিষয়ে অনবরত প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

যদি মুসলমানগণ কর্তৃক ইরান বা মিশরের গ্রন্থাগারসমূহে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়ে থাকে তবেই আমরা তা আলোচনা করতে পারি ইসলামের প্রকৃতি গঠনমূলক না ধ্বংসাত্মক এবং মতামত দিতে পারি ইসলাম সভ্যতা ও সংস্কৃতি তৈরি করে থাকলেও অনেক সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসও করেছে। এ ক্ষেত্রে ইসলাম ইরানে বিভিন্ন অবদান রাখলেও এর পাশাপাশি নেতিবাচক কর্মও করেছে । অর্থাৎ একদিকে সৌভাগ্য আনলেও অপরদিকে বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

ইরানে গ্রন্থাগারসমূহ ও বিভিন্ন শিক্ষালয় ,যেমন স্কুল ,কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিদ্যমান ছিল এবং সেগুলো বিজয়ী মুসলিমদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে বলে এত বেশি প্রচারণা চালানো হয়েছে যে ,অনভিজ্ঞদের নিকট নিশ্চিত ঘটনা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

কয়েক বছর পূর্বে একটি চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকার (তানদুরুসত নামে) একটি সংখ্যায় বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এক ইরানী চিকিৎসকের বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে। ঐ বক্তব্যে কবি শেখ সা দীর প্রসিদ্ধ কবিতার ,যাতে তিনি সকল আদম সন্তানকে এক দেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন ,উল্লেখ করে বলা হয়েছে প্রথম বারের মত একজন ইরানী কবি বিশ্বসমাজের ধারণার জন্ম দিয়েছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন :

প্রাচীন গ্রীস সভ্যতার লালনকেন্দ্র যেখানে দার্শনিক ও বিশিষ্ট মনীষিগণ ,যেমন সক্রেটিস ও অন্যান্যদের জন্ম হয়েছিল ;কিন্তু বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় এরূপ শিক্ষাঙ্গন সর্ব প্রথম ইরানে সাসানী সম্রাট খসরু পারভিজের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানের তৎকালীন রাজধানী শুশে জান্দী শাপুর নামের এক বৃহৎ শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল...। এই বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ দিন কার্যকর ছিল তবে আবরদের ইরান আক্রমণের সময় ইরানের অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনের মত এটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যদিও ইসলাম ধর্ম জ্ঞানার্জনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে চীন পর্যন্ত যেতে বলেছে ,তদুপরি আরবরা ইসলামের নবীর নির্দেশের বিপরীতে ইরানের জাতীয় গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগ করে ও আমাদের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে। এরপর দু শতাব্দী ইরানীরা আরবদের অধীনে ছিল।

এ রকম সনদ ও সূত্রবিহীন লেখার সংখ্যা অসংখ্য। এ বিষয়ে ঐতিহাসিক গবেষণাভিত্তিক আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে এরূপ দাবিদারদের উপস্থাপিত দলিলসমূহের পর্যালোচনাভিত্তিক জবাব দান করব। এই সম্মানিত চিকিৎসক যিনি এক বিদেশী সেমিনারে ইরানের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞাত একদল শ্রোতার সম্মুখে দ্বিধাহীন ও অকাট্যভাবে এ বিষয়ে তাঁর মত দিয়েছেন ,তাঁর উদ্দেশ্যে বলতে চাই:

প্রথমত গ্রীস ও ইরানের জান্দি শাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় অনেক বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যার সঙ্গে জান্দি শাপুরের ঐ ক্ষুদ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন তুলনা হয় না। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকদের মতে মুসলমানগণ প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ দিকে বিদেশী ভাষার গ্রন্থসমূহ আরবীতে অনুবাদ শুরু করে এবং এ ক্ষেত্রে তারা আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থসমূহ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রন্থসমূহ দেখতে পারেন।

দ্বিতীয়ত জান্দি শাপুরের বিশ্ববিদ্যালয় যা একটি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় বৈ অন্য কিছু ছিল না আরবদের দ্বারা কোনরূপ আক্রমণের শিকারই হয় নি এবং চতুর্থ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত তা চালু ছিল। এ সময় বাগদাদে একটি বৃহৎ শিক্ষাঙ্গন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে ধীরে ধীরে জান্দি শাপুরের চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়টি স্তিমিত হয়ে পড়ে। আব্বাসীয় খলীফারা বাগদাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত এ চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের চিকিৎসকগণকেই তাঁদের দরবারে ডাকতেন। প্রসিদ্ধ চিকিৎসক বাখতিশু এবং মসাভীয়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে এ মহাবিদ্যালয় হতেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। সুতরাং জান্দি শাপুরের চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় আরব বিজেতাদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বলা এ বিষয়ে অজ্ঞতার পরিচায়ক।

তৃতীয়ত জান্দি শাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়টি ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে রোমের খ্রিষ্টান আলেমদের দ্বারা পরিচালিত হতো। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ইরানী যারথুষ্ট্রীয় মনোবৃত্তির নয় ;বরং রোমীয় খ্রিষ্ট মনোবৃত্তির ছিল। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে ইরানে অবস্থিত ছিল ,কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তা ও জ্ঞানের খোরাক ইরানী যারথুষ্ট্র চিন্তার বাইরের অর্থাৎ ইরানের বাইরে এর অভিভাবক গোষ্ঠী রোমানদের নিকট থেকে সকল পৃষ্ঠপোষকতা পেত। এরূপ আরো কিছু শিক্ষা কেন্দ্র বৌদ্ধদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অবশ্য ইরানীদের মানসিকতা জ্ঞানপিপাসু মনোবৃত্তির পরিচয় বহন করলেও সাসানী আমলে প্রতিষ্ঠিত যারথুষ্ট্র পুরোহিত নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থা জ্ঞানবিরোধী হওয়ায় তাঁদের অধীনস্থ অঞ্চলে জ্ঞানের বিকাশকে প্রতিরোধ করতেন। এ কারণেই ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল যা যারথুষ্ট্র পুরোহিত প্রভাবাধীন ছিল না সেখানে বিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল ;কিন্তু তাঁদের প্রভাবাধীন এলাকায় তা হয়নি।

সাধারণত ইতিহাস ,ভূগোল ও সাহিত্যের পাঠ্য পুস্তকগুলোতে কম-বেশি আলোচ্য প্রচারণাটির পুনরাবৃত্তি ঘটছে। রেজা যাদেহ শাফাক যিনি একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব তিনি তাঁর গ্রন্থে এ বিষয়ে কিছুটা ইনসাফ রক্ষা করেছেন। তিনি দশম শ্রেণীর সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখেছেন , সাসানী আমলে ধর্ম ,সাহিত্য ,বিজ্ঞান ,ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ ব্যাপকভাবে লিখিত ও অনূদিত হতো। তা ছাড়া রাজকীয় কবি ও গায়কদের সম্পর্কে যে সকল কথা বর্ণিত হয়েছে তা হতে বোঝা যায় ,সে সময়ে সাহিত্যের প্রচলন অধিক বিস্তৃত ছিল না এবং বিশেষত পুরোহিত ও রাজ দরবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সাসানী আমলের শেষ দিকে পুরোহিত ও রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ব্যাপক চরিত্রিক স্খলন ও বিচ্যুতি দেখা দেয় এবং এ ধর্মের বিভিন্ন বিচ্যুত দলের সৃষ্টি হয়। তাই ইসলামের আবির্ভাবের সময় ইরানের সাহিত্যও এ দু শ্রেণীর বিচ্যুতির ফলে অধঃপতিত অবস্থায় পৌঁছেছিল।

চতুর্থত এ মহামান্য চিকিৎসক অন্যান্যদের অনুকরণে তোতা পাখির মত বলেছেন ,আরব বিজেতাগণ ইরানের জাতীয় গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগ করেছিল ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছিল। যদি তিনি বলতেন ঐ জাতীয় গ্রন্থাগার কোথায় ছিল তাহলে ভাল হতো। তা কি হামেদানে নাকি ইসফাহানে ,শিরাজে নাকি আজারবাইজানে ,তিসফুনে নাকি নিশাবুরে ,আকাশে না পৃথিবীতে ? কোথায় ছিল তা বললে বাধিত হতাম। তাঁর মতো যাঁরা জাতীয় গ্রন্থাগার ধ্বংসের ধূয়া তোলেন তাঁরা এই গ্রন্থাগার কোথায় অবস্থিত ছিল তার উল্লেখ করেন না কেনো ? নাকি এ বিষয়ে তাঁদের নিকট কোন তথ্য নেই ?

কোন তথ্যসূত্রেই এ বিষয় উল্লিখিত হয়নি। যদিও আরবদের ইরান বিজয়ের ইতিহাস সকল ঐতিহাসিক গ্রন্থেই এসেছে তদুপরি তাতে ইরানের কোন গ্রন্থাগারের নাম দিয়ে তাতে অগ্নি সংযোগ হয়েছে কি হয় নি তাও আলোচিত হয়নি ;বরং ঐতিহাসিক দলিলসমূহে এর বিপরীতে বলা হয়েছে যারথুষ্ট্র পরিমণ্ডলে জ্ঞানের প্রতি কোন অনুরাগ ছিল না। আরব লেখক জাহেয যিনি আরবীয় গোঁড়ামিমুক্ত ও আরবদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট লিখেছেন তাঁর নিকট থেকে এ বিষয়ে বর্ণনা করব। তিনি তাঁর আল মুহাসিন ওয়াল আযদাদ গ্রন্থে বলেছেন , ইরানীরা গ্রন্থ প্রণয়নে তেমন আগ্রহী ছিল না ,তারা স্থাপত্য শিল্পে অধিকতর আগ্রহী ছিল। কয়েকজন মধ্যপ্রাচ্যবিদের দৃষ্টিতে পারস্য সভ্যতা গ্রন্থে বলা হয়েছে ,সাসানী আমলে যারথুষ্ট্র ধর্মে লেখার প্রচলন ছিল না ,এমনকি গবেষকগণের মতে যারথুষ্ট্রদের ধর্মীয় গ্রন্থ আভেস্তার পাণ্ডুলিপির অনুলিপিও নিষিদ্ধ ছিল। সম্ভবত আলেকজান্ডারের ইরান আক্রমণের সময় আভেস্তার দু টি মাত্র পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান ছিল যার একটি ইসতাখরে ছিল ও আলেকজান্ডার কর্তৃক তা ভস্মীভূত হয়।

যেহেতু তৎকালীন সময়ে জ্ঞান ,শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের বিষয়টি রাজকীয় ব্যক্তিবর্গ ও পুরোহিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল সেহেতু অন্যান্য শ্রেণীর লোক শিক্ষা হতে বঞ্চিত ছিল। সাধারণত বঞ্চিত শ্রেণী হতেই মনীষীদের জন্ম হয় ;অভিজাত শ্রেণী হতে নয়। কামার-কুমার ,চর্মকার প্রভৃতি শ্রেণী হতেই ইবনে সিনা ,আল বিরুনী ,ফারাবী ,জাকারিয়া রাযীদের জন্ম হয়েছে ;অভিজাত শ্রেণী হতে নয়। তদুপরি মরহুম ডক্টর শাফাকের উদ্ধৃতিতে আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি ,সাসানী আমলে এ উভয় শ্রেণী এতটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ,তাদের নিকট হতে কোন সংস্কৃতি ও জ্ঞানগত বিষয় আশা করা সম্ভব ছিল না।

অবশ্য সাসানী আমলে নিঃসন্দেহে কিছু সাহিত্যিক কর্ম বিদ্যমান ছিল। এগুলোর অধিকাংশই মুসলিম শাসনামলে আরবী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল ও বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে। তবে অনেক সাহিত্যকর্মই বিলুপ্ত হয়ে গেছে সংরক্ষণের অভাবে ;গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগের মত কারণে নয়। তা ছাড়া স্বাভাবিকভাবেই যখন মানুষের চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন আসে এবং এক সংস্কৃতি অপর সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে তখন অমনোযোগ ও বাড়াবাড়ির কারণে প্রাচীন সংস্কৃতি উপেক্ষিত ও এর সাহিত্য ,সংস্কৃতি মানুষের মাঝে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে ও ধীরে ধীরে বিনাশের কবলে পড়ে। বর্তমানে এর নমুনা আমরা ইসলামী সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে লক্ষ্য করেছি। ইরানের জনসাধারণের মধ্যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ফ্যাশান বলে পরিগণিত হচ্ছে এবং ইসলামী সংস্কৃতি সেকেলে বলে উপেক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। ইসলামী সংস্কৃতির সংরক্ষণে তাই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। গণিত ,দর্শন ,সাহিত্য ,প্রকৃতিবিজ্ঞান ও ধর্মীয় মূল্যবান গ্রন্থসমূহ যা কয়েক বছর পূর্বেও বিদ্যমান ছিল বর্তমানে কোথায় রয়েছে তা অজ্ঞাত। সম্ভবত মুদির দোকানে কাজে লাগছে অথবা লুটপাট হয়ে গেছে। অধ্যাপক জালালুদ্দীন হুমায়ীর বর্ণনা মতে মরহুম আল্লামাহ্ মাজলিসীর ব্যক্তিগত সংগহের মূল্যবান কিছু হস্তলিখিত গ্রন্থ যা তিনি ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্বীয় প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করেছিলেন তা কয়েক বছর পূর্বে সের দরে বিক্রি হয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই ইরান বিজয়ের সমকালীন সময়ে কিছু মূল্যবান গ্রন্থ বিভিন্ন ব্যক্তির নিজস্ব সংগ্রহশালায় ছিল এবং দু বা তিন শতাব্দী তাঁদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে আরবী লিখন পদ্ধতি প্রচলনের ফলে পাহলভী ভাষায় লিখিত গ্রন্থগুলো সাধারণের ব্যবহার বর্জিত হয়ে পড়ে এবং পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার ফলে নষ্ট হয়ে যায়। তাই ইরানে গ্রন্থাগারসমূহ ও শিক্ষাঙ্গন ছিল এবং আরবরা তা ধ্বংস করে এমন কথা কল্পকাহিনী বৈ অন্য কিছু নয়।

ইবরাহীম পুর দাউদের মত লোক যাঁর সৎ উদ্দেশ্যের প্রতি যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে-মরহুম কাযভিনীর ভাষায় যা কিছু আরবদের থেকে এসেছে সবই খারাপ এমন ধারণা পোষণকারী-ইতিহাস হতে হস্ত-পদ কর্তিত কোন আলামত এ বিষয়ে পেলে কিংবা যদি নাও পাওয়া যায় তবু বর্ণনাতে পরিবর্তন ও বিকৃতি সাধন করে হলেও আরব কর্তৃক ইরানের গ্রন্থাগার ও শিক্ষাঙ্গনসমূহ ধ্বংসের বিবরণ দান অস্বাভাবিক কিছু নয়। তদুপরি কিছু লোক যাঁদের নিকট থেকে এরূপ আশা করা যায় না তাঁরাও পুর দাউদের অনুকরণে এমন কথা বলেছেন ও তাঁর অনুসরণ করেছেন। ডক্টর মুঈনও তাঁদের অন্যতম। তিনি তাঁর মাযদা ইয়াসনা ও আদাবে পার্সী গ্রন্থে আরবদের ইরান আক্রমণের পরিণাম শীর্ষক আলোচনায় এ বিষয়ে যা বলেছেন তার অধিকাংশই পুর দাউদের বর্ণনা হতে নেয়া হয়েছে। তিনি প্রমাণ হিসেবে যাঁদের নিকট থেকে বর্ণনা দিয়েছেন ও যে সকল দলিল উপস্থাপন করেছেন তা নিম্নরূপ :

1. ইংরেজ স্যার জন ম্যালকমের ইতিহাস হতে।

2. এরূপ বর্ণনা ,ইসলামের আবির্ভাবের সমকালীন সময়ে আরবরা অশিক্ষিত ও নিরক্ষর ছিল। ওয়াকেদীর বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আবির্ভাবের সময়ে কুরাইশদের মধ্যে মাত্র সতের জন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিল। আরব বেদুইনদের সর্বশেষ কবি যুররামা সাক্ষর হলেও তা গোপন করে বলতেন সাক্ষরতা আমাদের নিকট অভদ্রতা বলে পরিগণিত।

3. জাহেযের আল বাইয়ান ওয়াত তানবীহ্ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে ,এক কুরাইশ গোত্রপতি এক বালককে সিবাভেই -এর গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে দেখে চীৎকার করে বলে , হে বালক! তোমার লজ্জা হওয়া উচিত এ জন্য যে ,এই কাজ শিক্ষক ও ভিক্ষুকদের অর্থাৎ সে সময়ে শিক্ষা দান বা শিশুদের অক্ষরজ্ঞান শিখানো আরবদের নিকট অপমানের বিষয় ছিল। কারণ শিক্ষকদের বেতন ছিল ষাট দিরহাম এবং তাদের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত নগণ্য।

4. ইবনে খালদুন ইতিহাস গ্রন্থের ভূমিকায় আল উলুমুল আকলিয়া ওয়া আছনাফুহা অধ্যায়ে বলেছেন: ইরান বিজয়ের সময় এ ভূখণ্ডের অধিকাংশ স্থান আরবদের হাতে আসে। সা দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস হযরত উমরের নিকট পত্র লিখে বিদ্যমান গ্রন্থসমূহ আরবী ভাষায় অনুবাদের অনুমতি চেয়েছিলেন। হযরত উমর ঐ গ্রন্থগুলো পানিতে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন: আল্লাহ্ হেদায়েতের জন্য আমাদের ঐ সব গ্রন্থ হতে উত্তম কিছু দান করেছেন এবং যদি তাতে কোন পথভ্রষ্টতা থাকে তবে মন্দ হতে তিনি আমাদের রক্ষা করুন। ফলে ঐ গ্রন্থসমূহতে অগ্নি সংযোগ করা হয় অথবা পানিতে নিক্ষেপ করা হয়। এ কারণেই ইরানীদের লিখিত জ্ঞান এর সাথে বিলুপ্ত হয়। আবুল ফারাজ ইবনুল ইবরী তাঁর তুখতাছারুদ্দৌলা ,আবদুল লতিফ বাগদাদী তাঁর কিতাবুল ইফাদাহ্ ওয়াল ই তিবার ,কাফতী তাঁর তারিখুল হুকামা গ্রন্থে ইয়াহিয়া নাহওয়ার জীবনী আলোচনায় ,হাজী খলীফা তাঁর কাশফুয যুনুন গ্রন্থে ,ডক্টর সাফা তাঁর তারিখে উলুমে আকলী গ্রন্থে আরবদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ভস্মীকরণের বর্ণনা দিয়েছেন। তাই যদি প্রতিষ্ঠিত হয় ,আরবরা মিশরের এই গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগ করেছিল তবে অন্যান্য স্থানের গ্রন্থাগারসমূহও তারা ধ্বংস করেছিল বলে প্রমাণিত হয়। তাই অসম্ভব নয় ,ইরানেও তারা এ কাজ করেছে। কিন্তু শিবলী নোমানী তাঁর আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার শিরোনামের লেখায় (নিবন্ধে) এবং মুজতবা মিনুয়ী সুখান পত্রিকার এক প্রবন্ধে এরূপ অগ্নি সংযোগের বিষয়কে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

5. আবু রাইহান বিরুনী তাঁর আসারুল বাকীয়াহ্ গ্রন্থে খাওয়ারেজম অঞ্চলের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন , খাওয়ারেজমের জনসাধারণ মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হওয়ার পর কুতাইবা ইবনে মুসলিম কর্তৃক তা দ্বিতীয় বারের ন্যায় বিজিত হয়। তিনি আসাক জামুক কে ঐ অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন এবং যারা খাওয়ারেজম লিখন পদ্ধতি জানত ও পূর্ববর্তী জ্ঞান সম্পর্কে অবগত ছিল তাদের ছিন্নভিন্ন করেন এবং অতীত নিদর্শনসমূহ ধ্বংস করেন। ফলে তাদের অবস্থা এতটা সংকটময় হয়ে পড়েছিল যে ,ইসলামের আবির্ভাবের পর এ অঞ্চলের সঠিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার কোন উপায়ই ছিল না। আবু রাইহান ঐ গ্রন্থেই লিখেছেন , যেহেতু কুতাইবা ইবনে মুসলিম খাওয়ারেজমী লেখকদের হত্যা করেন ,তাদের পুরোহিতদের নির্বংশ ও লেখা ধ্বংস ও ভস্মীভূত করেন সেহেতু খাওয়ারেজমের অধিবাসীরা অজ্ঞ থেকে যায়। তারা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে শুধু তাদের মুখস্থ শক্তির ওপর নির্ভর করত। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তারা এ বিষয়গুলোর ক্ষুদ্র ক্ষদ্র পার্থক্যের ক্ষেত্রসমূহ ভুলে যায় এবং শুধু সার্বিক বিষয়গুলো তাদের মস্তিষ্কে বিদ্যমান ছিল।

6. দৌলত শাহ সামারকান্দীর তাযকিরাতুশ শুয়ারা গ্রন্থে আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহির কর্তৃক গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিবরণ।

উপরিউক্ত দলিলসমূহ ডক্টর মুঈন ইরানের গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগের প্রমাণস্বরূপ এনেছেন। দলিলসমূহের মধ্যে চতুর্থটি যা ইবনে খালদুন কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে এবং ইবনুল ইবরী ,বাগদাদী ও কাফতী কর্তৃক আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত হয়েছে তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। হাজী খলীফা তাঁর কাশফুয যুনুন গ্রন্থেও বিষয়টিকে সমর্থন করেছেন।

এ ছাড়াও সপ্তম দলিল হিসেবে অপর যে বিষয়টির উল্লেখ ডক্টর মুঈন করেন নি কিন্তু জর্জি যাইদান ও কিছু ইরানী লেখক করেছেন তা হলো আরবদের জ্ঞান ও গ্রন্থ প্রণয়নের প্রতি অনীহা ও বিদ্বেষ। যেমন দ্বিতীয় খলীফা হাদীসসমূহ লেখার বিরোধী ছিলেন ও সব সময বলতেন ,

حسبنا كتاب الله আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট। এরূপে তিনি সকল ধরনের লেখা ও সংকলনকে নিষিদ্ধ করেছিলেন। যে কেউ এ কাজ করত সে অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হতো। এই নিষেধাজ্ঞা দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত বহাল ছিল ও সময়ের চাপে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

এটি স্পষ্ট ,যে জাতি কমপক্ষে একশ বছর লেখা ও সংকলনের অনুমতি দেয়নি সে জাতি বিজিত জাতির বিদ্যমান পুস্তক ও লেখালেখিকে অব্যাহত থাকতে দিতে পারে না।

আমরা প্রথমে ডক্টর মুঈনের উপস্থাপিত প্রথম দলিলের পর্যালোচনা করব। অতঃপর যথাক্রমে সপ্তম ও চতুর্থ দলিলের উত্তর দান করব।

প্রথম দলিলটি স্যার জন ম্যালকমের। বিভিন্ন মত এবং মাযদা ইয়াসনা ওয়া আদাবে পার্সী (মাযদা ইয়াসনা ও ফার্সী সাহিত্য) শীর্ষক আলোচনায় আমরা তাঁর লক্ষ্য ,উদ্দেশ্য ও দলিলসমূহের ভিত্তিহীনতা নিয়ে আলোচনা করেছি। স্যার জন ম্যালকম সম্ভবত ত্রয়োদশ হিজরী শতাব্দীর মানুষ। তাঁর সঙ্গে বর্ণিত ঘটনার তেরশ বছর সময়ের ব্যবধান ছিল। তাই এ বিষয়ে তাঁর বর্ণনা ঐতিহাসিক তথ্যনির্ভর হওয়া উচিত ছিল। তদুপরি তাঁর লেখায় যেরূপ ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে ঐ বর্ণনার কোন ভিত্তিই থাকে না।

তিনি দাবি করেছেন ,আরব নবীর অনুসারীরা ইরানের শহরগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। এরূপ মিথ্যা কোন পণ্য বিক্রেতার কৌটার মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আশ্চর্যের বিষয় হলো ডক্টর মুঈন স্যার জন ম্যালকমের অসংলগ্ন কথাগুলোকে তাঁর গ্রন্থে দলিল হিসেবে এনেছেন।

জাহেলী (অজ্ঞ) আরবদের নিরক্ষরতার বিষয়টিকে পবিত্র কোরআনও বর্ণনা করেছে। কিন্তু এটি কেমন যুক্তি যে ,জাহেলিয়াত যুগের আরবগণ যেহেতু মূর্খ ছিল তাই তারা ইসলামী শাসনামলে গ্রন্থসমূহে অগ্নি সংযোগ করেছে ? তা ছাড়া জাহেলী যুগ হতে ইসলামের বিজয়ের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান ছিল পঁচিশ বছর। সে সময়কালে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মাধ্যমে আরবে বিশেষত মদীনায় সাক্ষরতার এক আশ্চর্য বিপ্লব সম্পাদিত হয়েছিল।

অন্ধকার যুগের আরবরা এমন এক ধর্মে ঈমান এনেছিল যে ধর্মের নবী মুসলমান শিশুদের লিখন-পঠন শিক্ষাদানকে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তিপণ হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। ঐ ধর্মের নবী তাঁর কিছু সঙ্গীকে অনারব বিভিন্ন ভাষা ,যেমন সুরিয়ানী ,হিব্র ও ফার্সী শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে বিশ ব্যক্তির একদল সহযোগী ছিলেন। তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে বা কয়েকজন মিলে একেকটি বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন। এই অজ্ঞ আরবরা এমন ধর্ম গ্রহণ করেছিল যার ঐশী গ্রন্থে কলম ও লেখার শপথ করা হয়েছেن و القلم و ما يسطرون নুন-শপথ কলমের এবং সেই বিষযের যা তারা লিপিবদ্ধ করে এবং যার প্রথম প্রত্যাদেশ পড়ালেখার আহ্বান দিয়ে শুরু হয়েছে :

) إقرأ باسم ربّك الّذي خلق,خلق الإنسان من علق,إقرأ و ربّك الأكرم,الذي علّم بالقلم,علّم الإنسان ما لم يعلم(

পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন ,সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন ,আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু ,যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন ,শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না। -(সূরা আলাক: 1-5)

প্রশ্ন হলো এই নবীর গৃহীত পন্থা ,তাঁর ওপর অবতীর্ণ কোরআনের লিপিবদ্ধকরণ ,পঠন ও শিক্ষণের আহ্বানের বিষয়টি তাঁর অনুসারী ব্যক্তিবর্গ যাঁরা কোরআন ও তাঁর প্রতি অগাধ ভালবাসা পোষণ করতেন তাঁদের অনুভূতিতে জ্ঞান ,সংস্কৃতি ,লিখন ও পঠনের প্রতি কি আগ্রহ ও সুদৃষ্টি সৃষ্টি করতে পারেনি ?

কেউ কেউ কুরাইশ ও অন্যান্য আরবদের শিক্ষকতার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের যুক্তি এনে বলেছেন ,কুরাইশ ও আরবরা শিশুদের লিখন-পঠন শিক্ষাদান ও শিক্ষকতার পেশাকে অপমানজনক মনে করত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে শিক্ষা ও অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হওয়াকে অপমান ও ঘৃণার চোখে দেখত।

প্রথমত তাঁরা স্বীকার করেছেন আরবরা স্বল্প আয়ের অজুহাতে শিক্ষকতার পেশাকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করত ও একে খারাপভাবে দেখত। এ বিষয়টি আমরা বর্তমান ইরানেও লক্ষ্য করছি। আলেম সমাজ ,শিক্ষকগণ এবং কেরানী শ্রেণী সমাজের নিম্ন বেতনভুক্তদের অন্তর্গত এবং এ কারণেই অনেকে এরূপ পেশা পরিবর্তন করে অন্য দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন।

যদি কোন যুবক শিক্ষক ,আলেম বা কেরানী পদের কোন মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তাহলে ঐ মেয়ের অভিভাবক যদি ঠিকাদার ,কাঠ মিস্ত্রী ,ঝুড়ি বিক্রেতা বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও হয়ে থাকে আর তাদের মেয়ে অশিক্ষিতও হয় তবুও বিয়ে দিতে রাজী হয় না। তারা কোন শিক্ষক ,আলেম বা কেরানীর চেয়ে কোন ঠিকাদার বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। কিন্তু কেন ? এ কারণে কি যে ,তারা শিক্ষা ও নৈতিকতাকে হীন ও মন্দ মনে করে ? অবশ্যই না। এ বিষয়টি শিক্ষার সঙ্গে আদৌ সম্পর্কিত নয় ;বরং এরূপ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বিবাহ দিতে হলে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয় ,কিন্তু সকলের এমন মানসিকতা নেই।

আজব যুক্তি এই যে ,কুরাইশদের কোন এক ব্যক্তি গ্রন্থ পাঠের কারণে এক বালককে তিরস্কার করেছে তাই আরবরা জ্ঞান ও লিখন-পঠনের শত্রু এবং যেখানেই তারা গ্রন্থ পেয়েছে পুড়িয়ে দিয়েছে। আরবদের এরূপ কথা ইরানী কবি ও সাহিত্যিক ওবায়েদ যাকানীর কবিতার মত যিনি বলেছেন ,

হে মহৎ জন জ্ঞান অন্বেষণের পথ কর না অবলম্বন

এতে এক দিনের রুজী যোগাতেই তুমি হবে অক্ষম।

গান ও কৌতুক শেখার পথ ধর

আপন বাক প্রাঞ্জলতায় সকলকে খুশী কর।

এখন ইরানী এ কবির কথার সূত্র ধরে কি আমরা বলব ইরানীরা জ্ঞান ও শিক্ষার বিরোধী ও শত্রু। তাই যেখানেই তারা গ্রন্থ বা গ্রন্থাগার পায় তাতে অগ্নি সংযোগ করে। শুধু তাই নয় তারা গান ও কৌতুক করে জীবিকার্জনের পক্ষপাতী। কিংবা আবু হাইয়ান তাওহীদী অর্থাভাব ও দারিদ্র্যের কারণে তাঁর সকল গ্রন্থ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন-এ যুক্তিকে ভর করে কি আমরা বলব তাঁর দেশীয়রাও (ইরানীরা) জ্ঞানবিরোধী ও গ্রন্থ ভস্মীভূত করে।

আবু রাইহান আল বিরুনী খাওয়ারেজম সম্পর্কে যা বর্ণনা করেছেন তার কোন সূত্র উল্লেখ করেননি। তদুপরি তিনি অন্যান্য জ্ঞানের বাইরেও একজন বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক হিসেবে ভিত্তিহীন কথা বলতে পারেন না। যেহেতু তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ হতে পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর প্রথম ভাগের একজন ব্যক্তিত্ব এবং এ ঘটনার সময়কাল হতে তাঁর ব্যবধান খুব বেশি নয় সেহেতু সম্ভাবনা রয়েছে ঘটনাটি সত্য হওয়ার। তা ছাড়া তিনি স্বয়ং খাওয়ারেজমের অধিবাসী ছিলেন। খাওয়ারেজম ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের সময় অর্থাৎ 93 হিজরীতে বিজিত হয়।

কিন্তু আবু রাইহান যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তা শুধু খাওয়ারেজম ও খাওয়ারেজমী ভাষা সম্পর্কিত। এর সঙ্গে পারস্যের পাহলভী ভাষা ও আভেস্তার মত ধর্মীয় গ্রন্থ ধ্বংসের কোন সম্পর্ক নেই।

দ্বিতীয়ত স্বয়ং আবু রাইহান তাঁর সাইদানা বা সাইদালাহ্ নামক গ্রন্থে জ্ঞানগত বিভিন্ন বিষয় বর্ণনায় ভাষাসমূহের দক্ষতার তুলনা করতে গিয়ে আরবী ভাষাকে খাওয়ারেজমী বা ফার্সীর ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশেষত খাওয়ারেজমী ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেছেন , এই ভাষা কখনই জ্ঞানগত বিষয় বর্ণনার উপযোগী ছিল না। যদি কোন ব্যক্তি এ ভাষায় এরূপ বিষয় বর্ণনা করতে চায় তবে তা ছাদের পার্শ্বস্থ পানির পাইপ হতে উট বের হওয়ার মত বিষয়। 154

সুতরাং খাওয়ারেজমী ভাষায় যদি মূল্যবান কোন গ্রন্থ থাকত তবে আবু রাইহান এ ভাষাকে এতটা অক্ষম বলে পরিচয় দিতেন না। তাই তিনি খাওয়ারেজমের যে গ্রন্থসমূহ ধ্বংস হয়েছে বলেছেন তা ইতিহাসের কিছু গ্রন্থ বৈ অন্য কিছু ছিল না। তদুপরি খাওয়াজেমের অধিবাসীদের সঙ্গে এরূপ আচরণ ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের সময় ঘটেছিল ,খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় নয়। যদি প্রকৃতই ঘটনাটি সত্য হয়ে থাকে তবে তা অমানবিক ও অনৈসলামী ছিল।155 যে সকল মুসলিম বিজয়ী পারস্য ও রোম জয় করেন সাধারণত তাঁরা রাসূল (সা.)-এর সাহাবী ও তাঁর (রাসূলের শিক্ষা) দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন বিধায় পরবর্তী শাসকদের সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য ছিল।

তাই বনী উমাইয়্যার শাসনামল যা ইসলামী খেলাফতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সময় বলে পরিগণিত সে সময়ে সংঘটিত কোন ঘটনাকে ইসলামের প্রাথমিক যুগের ব্যক্তিদের দ্বারা ইরান বিজিত হওয়ার ঘটনার তুলনা হতে পারে না।

যা হোক ,এখানে উল্লেখ্য যে ,ইরানে যদি কোন গ্রন্থাগার সে সময়ে বিদ্যমান থেকে থাকে তা খাওয়ারেজমে ছিল না ;বরং তিসফুন (মাদায়েন) ,হামেদান ,নাহভান্দ ,ইসফাহান ,ইসতাখর ,রেই ,নিশাবুর বা আজারবাইজানে ছিল এবং পাহলভী ভাষায় ছিল। ইসলামী শাসনামলে ইরানের যে সকল গ্রন্থ আরবী ভাষায় অনূদিত হয় তন্মধ্যে কালিলা ও দিমনা গ্রন্থটি ইবনে মুকাফফাহ্ কর্তৃক এবং তাঁর পুত্র কর্তৃক অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা বইয়ের কিয়দংশ পাহলভী ভাষা হতে আরবীতে অনূদিত হয়েছিল ;খাওয়ারেজমী বা অন্য ভাষা হতে নয়।

ক্রিস্টেন সেন বলেছেন , আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান পাহলভী ভাষার গ্রন্থসমূহ আরবীতে অনুবাদের নির্দেশ দেন।

কোন হামলা বা আক্রমণের কারণে যদি বিশেষ কোন ভাষা বিলুপ্ত হয় ও সে অঞ্চলের অধিবাসীরা সকলে মূর্খে পরিণত হয় এবং এ নিরক্ষরতার কারণে পূর্ববর্তী ইতিহাস ভুলে যায় তবে বুঝতে হবে সে ভাষা সীমিত ও আঞ্চলিক কোন ভাষা। এটি স্বাভাবিক ,কোন ক্ষুদ্র অঞ্চলের ভাষা সীমাবদ্ধতার কারণে জ্ঞানধারক হতে পারে না এবং সম্ভব নয় এ ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞান ,অংকশাস্ত্র ,প্রকৃতিবিজ্ঞান ,জ্যোতির্বিজ্ঞান ,সাহিত্য ও ধর্মীয় সকল বিষয়ে পুস্তক রচনার।

যদি কোন ভাষা এতটা ব্যাপক হয় যে ,তা বিভিন্ন জ্ঞানসম্বলিত পুস্তক রচনা ও অনূদিত হওয়ার উপযোগী তাহলে কোন এক আক্রমণের শিকার হয়ে বিলুপ্ত হতে পারে না এবং জনগণ এতে মূর্খে পরিণত হওয়া সম্ভব নয় । আমরা জানি মোগলদের আক্রমণের চেয়ে ভয়াবহ কোন আক্রমণ কখনও হয়নি। গণহত্যা প্রকৃত অর্থেই তাদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল ,গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারসমূহ তারাই সর্বাধিক হারে ধ্বংস ও ভস্মীভূত করেছিল। কিন্তু এ ভয়ঙ্কর আক্রমণও আরবী ও ফার্সীর জ্ঞানগত নিদর্শন ও স্মৃতিচিহ্নকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করতে পারে নি ;বরং পূর্ববর্তী মোগল ও পরবর্তী প্রজন্মের (মোগলদের) মধ্যে সংস্কৃতির ভেদরেখা টেনে দিয়েছিল। কারণ আরবী ও ফার্সীর জ্ঞানগত ভিত্তি এতটা দৃঢ় ও ব্যাপক ছিল যে ,মোগলদের কয়েক দফা গণহত্যাতেও তা নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং বোঝা যায় খাওয়ারেজমে যা বিলুপ্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তা যারথুষ্ট্র ধর্মীয় ও সাহিত্যের কিছু গ্রন্থ বৈ অন্য কিছু ছিল না। আবু রাইহান আল বিরুনীও এর অতিরিক্ত কিছু বলেননি। তাঁর লেখনীর প্রতি দৃষ্টি দিলে এটিই বোঝা যায়।

আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহের কর্তৃক গ্রন্থাগার ধ্বংসের যে বিবরণ ডক্টর মুঈন দিয়েছেন তা আরো হাস্যকর। তিনি এ ঘটনাকে বিজয়ী আরবগণ কর্তৃক ইরানের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংসের দলিল বলে উল্লেখ করেছেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহের যুল ইয়ামিনাইন আব্বাসীয় খলীফা আমিন ও মামুনের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে খোরাসানের সেনাদলের প্রধান ছিলেন। তিনি হারুনুর রশীদের পক্ষ হতে তাঁর পুত্র মামুনের সহযোগী ছিলেন এবং হারুনের অপর পুত্র আমিনের নিযুক্ত আরব সেনাপতি আলী ইবনে ঈসার ওপর ঐ যুদ্ধে জয়ী হন ও বাগদাদকে মামুনের অধীনে আনেন। তিনিই আমিনকে হত্যা করেন এবং মামুনের খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করেন।

আবদুল্লাহর পিতা তাহের একজন আরববিরোধী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি হারুনুর রশীদের জ্ঞানকেন্দ্রে (বাইতুল হিকমাহ্) কাজ করতেন এবং আরবদের ত্রুটি ও অসৎ দিক তুলে ধরে মাসালিবে আরব নামক গ্রন্থ রচনা করে হারুন কর্তৃক ত্রিশ হাজার দিনার বা দিরহাম পুরস্কৃত হন।156

অগ্নি সংযোগের দায়ে অভিযুক্ত আবদুল্লাহ্ তাহেরীয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা অর্থাৎ প্রথম বারের মত তিনি খোরাসানে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন ইরানী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

স্বাভাবিকভাবেই আবদুল্লাহ্ও তাঁর পিতার ন্যায় আরববিরোধী ছিলেন। তথাপি ইসলামের ঐতিহাসিক আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করুন এই আরববিরোধী ইরানী বংশোদ্ভূত আবদুল্লাহ্ বাগদাদের খলীফাকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা ঘোষণার মত শক্তি অর্জন করলেও ইসলামপূর্ববর্তী ইরানী গ্রন্থসমূহকে কোরআনের উপস্থিতিতে অনর্থক ও অপ্রয়োজনীয় মনে করে পুড়িয়ে দিয়েছেন। মিস্টার ব্রাউন তাঁর সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন :

এক দিন এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহেরের দরবারে (নিশাবুরে) আসে এবং একটি প্রাচীন ফার্সী গ্রন্থ উপহার দেয়। তিনি প্রশ্ন করেন: এটি কি গ্রন্থ ? সে জবাব দেয়: ওয়ামেক ও আজরার সেই কাহিনী যা সাহিত্যিকরা রচনা করে সাসানী সম্রাট আনুশিরওয়ানকে উপহার দিয়েছিল। তিনি বললেন: আমরা কোরআন অধ্যয়ন করি ,আমাদের এ গ্রন্থের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের হাদীস আমাদের জন্য যথেষ্ট। তা ছাড়া যে গ্রন্থ তুমি এনেছ তা মাজুসীরা (অগ্নিপূজক) রচনা করেছে বিধায় আমাদের নিকট অগ্রহণযোগ্য। অতঃপর গ্রন্থটি পানিতে নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন এবং ফার্সী ভাষায় মাজুসী চিন্তার যে গ্রন্থই পাওয়া যাবে তা ধ্বংস করার হুকুম জারি করেন।

কেন তিনি এমনটি করেছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে সম্ভবত ইরানী যারথুষ্ট্রদের প্রতি ঘৃণা হতেই তিনি এমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। যা হোক এ কর্ম আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহের নামের এক ইরানী করেছিল ;আরবরা নয়। এখন আমরা আবদুল্লাহর এ কর্মকে সকল ইরানীর মনোবৃত্তির পরিচায়ক বলতে পারি কি ? আমরা কি বলব ইরানীরা কোরআন ব্যতীত যা পায় তা ভস্মীভূত করে দেয় ? অবশ্যই না।

আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহেরের কাজটি সঠিক ছিল না। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যখন এক সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তখন নতুন সংস্কৃতির প্রেমিক ও অনুসারীরা কখনও কখনও বাড়াবাড়ি করে পুরাতন সংস্কৃতির নিদর্শন ও স্মৃতিচিহ্নকে উপেক্ষা করে থাকে। ইরানীরাও ইসলামের নতুন সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হয়ে পুরাতন ও নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়েছিল।

আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহেরের ন্যায় অনেক ইরানীই ছিলেন যাঁরা আরববিরোধী (আত্মগর্বী সেই সব আরব যারা অন্যদের এক রক্তবংশের অধীনে আনতে চেয়েছিল) হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের প্রতি অনুরক্ত ও গোঁড়ামি ভাব প্রকাশ করতেন এবং মাজুসীদের স্মৃতিচিহ্নের ওপর ঐ গোঁড়ামির প্রকাশ ঘটাতেন।

আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহেরের ন্যায় গ্রন্থসমূহ ধ্বংসের নজীর ইতিহাসে যদি আরো থেকে থাকে তবে এ বিষয়টি দলিল হিসেবে উপস্থাপন অপ্রয়োজনীয়। বিশ্ব এর চেয়েও ব্যাপক আকারে গ্রন্থ ধ্বংসের সাক্ষী। আমাদের সময়ে আহমাদ কাসরাভী গ্রন্থ ভস্মীকরণ উৎসব পালন করেছেন। খ্রিষ্টানরা স্পেনের বিপর্যয়ে মুসলমানদের গণহত্যা ও তাদের আশি হাজার গ্রন্থ অগ্নিতে ভস্মীভূত করে।157 জর্জি যাইদান (খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক) স্বীকার করেছেন ,ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিষ্টানরা সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে কয়েক লক্ষ গ্রন্থ পুড়িয়ে দিয়েছিল।158 তুর্কীরা মিশরে গ্রন্থাগার ধ্বংস করে।159 সুলতান মাহমুদ গজনভী রেই শহরে গ্রন্থসমূহ জ্বালিয়ে দেন।160 মোগলরা বাগদাদ ও খোরাসানের গ্রন্থাগারসমূহ ভস্মীভূত করে।161 যারথুষ্ট্ররা সাসানী আমলে মাযদাকীদের গ্রন্থসমূহ পুড়িয়ে দেয়।162 আলেকজান্ডার ইরানে গ্রন্থাগারসমূহে অগ্নি সংযোগ করেন।163 রোমানরা প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ আরশমিদাদের গ্রন্থগুলো অগ্নিদগ্ধ করে।164 আমরা পরবর্তীতে খ্রিষ্টানগণ কর্তৃক মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিষয়ে আলোচনা করব।

জর্জ সার্টন তাঁর বিজ্ঞানের ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন ,

ভাববাদী গ্রীক দার্শনিক প্রোটোগোরাস তাঁর একটি গ্রন্থে বলেছিলেন: খোদাগণ আছেন আমরা তা যেমন বলতে পারি না ,তেমনি তাঁরা নেই এমনও বলতে পারি না। কারণ এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা আমাদের সামনে তা প্রমাণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রধান যে বিষয় তা হলো: খোদ এ বিষয়টির অস্পষ্টতা এবং মানুষের স্বল্পায়ু। 165

সার্টন বলেছেন , এ কারণেই খ্রিষ্টপূর্ব 411 সালে তাঁর গ্রন্থসমূহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে এনে অগ্নি সংযোগে ভস্মীভূত করা হয়। ইতিহাসে গ্রন্থ ভস্মীভূতকরণের প্রথম ঘটনা হিসেবে এটি বিধৃত হয়েছে। 166

ইসলামী বিশ্বে গ্রন্থ প্রণয়ন ও সংকলন নিষিদ্ধ হওয়া এবং একশ বছর তা অব্যাহত থাকার ঘটনাটি জনশ্রুতি মাত্র। যদিও আমরা এই গ্রন্থের তৃতীয়াংশ ইসলামে ইরানীদের অবদান শীর্ষক আলোচনার সাংস্কৃতিক অংশে গ্রন্থ প্রণয়ন ও সংকলন কখন শুরু হয়েছিল শিরোনামে এ বিষয়ে আলোচনা করব তদুপরি এখানেও কিছুটা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি বিশেষত দ্বিতীয় খলীফা গ্রন্থ প্রণয়ন ও সংকলন নিষিদ্ধ করেননি ;বরং হাদীস লিপিবদ্ধকরণ অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন।

ইসলামের প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ওফাতের পর হাদীস সংকলনের বিষয়ে হযরত উমর ও কিছু সাহাবী একদিকে এবং হযরত আলী (আ.) ও কিছু সাহাবী অন্যদিকে অবস্থান নেন। তাঁদের মধ্যে এ বিষয়ে মতদ্বৈততা দেখা দেয়।

হযরত উমরসহ প্রথম দল হাদীস শ্রবণ ও বর্ণনা জায়েয মনে করলেও তা লিপিবদ্ধকরণ ও সংকলন মাকরুহ মনে করতেন। তাঁদের যুক্তি ছিল এতে করে কোরআনের গুরুত্ব কমে যাওয়া ও হাদীসের সঙ্গে মিশ্রিত হওয়ার ভয় ও সম্ভাবনা রয়েছে। হযরত আলীসহ দ্বিতীয় দল প্রথম হতেই হাদীস সংকলনকে উৎসাহিত করতেন। আহলে সুন্নাত দ্বিতীয় খলীফার অনুকরণে একশ বছর হাদীস সংকলন হতে বিরত থাকে। কিন্তু একশ হিজরী হতে তারাও হযরত আলী (আ.)-এর মতের অনুসরণ শুরু করলে প্রথম মতটি পরিত্যক্ত হয়। এ কারণেই হাদীস সংকলনে শিয়ারা সুন্নীদের চেয়ে এক শতাব্দী অগ্রগামী। সুতরাং এ বিষয়টি সঠিক নয় যে ,আরবদের মধ্যে যে কোন প্রকার গ্রন্থ প্রণয়ন ও সংকলন নিষিদ্ধ ছিল। তাই এ যুক্তিও সঠিক নয় যে ,যেহেতু তারা সংকলনের বিরোধী ছিল সেহেতু অন্যদের লিখিত গ্রন্থসমূহ ধ্বংস করেছে। প্রথমত এই নিষিদ্ধের বিধান শুধু হাদীসের বিষয়ে ছিল ,অন্য বিষয়ে নয়। দ্বিতীয়ত আহলে সুন্নাতের মধ্যে এটি বিদ্যমান থাকলেও শিয়াদের মধ্যে ছিল না এবং এ বিষয়টির সঙ্গে গ্রন্থ প্রণয়ন ও সংকলনের কোন সম্পর্ক নেই।

জর্জি যাইদান তাঁর তারিখে তামাদ্দুনে ইসলাম এবং ডক্টর যাবিউল্লাহ্ সাফা তাঁর তারিখে উলুমে আকলী গ্রন্থে এ বিষয়ে যে বর্ণনা দিয়েছেন এখানে তার উল্লেখ করা সমীচীন মনে করছি। ডক্টর সাফা বলেছেন :

অন্যান্য মুসলমানদের মতো আরবদেরও বিশ্বাস ছিলإنّ الإسلام يهدم ما قبله অর্থাৎ ইসলাম পূর্ববর্তী সকল কিছুকে ধ্বংস করে। এ কারণেই মুসলমানদের মনে ধারণা জন্মেছিল কোরআন ব্যতীত অন্য কিছুর প্রতি দৃষ্টি দেয়া যাবে না। কারণ কোরআন অন্যান্য সকল ঐশীগ্রন্থের রহিতকারী এবং অন্যান্য ধর্মসমূহের বিলোপ সাধনকারী। শরীয়তের ইমামরাও তাই কোরআন ব্যতীত অন্য সকল ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন।

বর্ণিত হয়েছে রাসূল (সা.) একদিন হযরত উমরের হাতে তাওরাতের কিছু পাতা দেখে অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং ক্রোধে তাঁর চেহারা রক্তিম হয়ে ওঠে। তিনি বলেন :

ألم اتكم بِها بيضاء نقيّة و الله لو كان موسى حيّا ما وسعه إلّا أتّباعي

আমি কি তোমাদের জন্য পবিত্র ও উজ্জ্বল এক ধর্ম আনি নি ? আল্লাহর শপথ! যদি হযরত মূসাও এখন জীবিত থাকতেন তাহলে আমার শরীয়তের অনুসরণ ব্যতীত তাঁর পথ ছিল না।

অতঃপর বলেন :

) لا تصدّقوا أهل الكتاب و لا تكذّبوهم و قولوا آمنّا بالّذي أنْزل علينا و أنزل إليكم و إلهنا و إلهكم واحد(

আহলে কিতাবরা ধর্মের নামে যা বলে তা সত্যায়নও কর না আবার মিথ্যাও বল না ;বরং বল আমাদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে ও তোমাদের নিকট যা এসেছে (অর্থাৎ প্রকৃতই যা আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন) আমরা তার প্রতি বিশ্বাসী এবং আমাদের ও তোমাদের উপাস্য একই।

সে সময়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত একটি হাদীস হলো :

كتاب الله فيه خبر ما قبلكم و نبأ ما بعدكم و حكم ما بينكم

আল্লাহর কিতাবে (কোরআনে) তোমাদের পূর্ববর্তীদের খবর যেমন রয়েছে তেমনি তোমাদের ভবিষ্যতের খবরও রয়েছে এবং সে সাথে তোমাদের মধ্যকার মীমাংসাকারী বিষয়সমূহ।

পবিত্র কোরআন এ সত্যকে এভাবে বর্ণনা করেছে :و لا رطت و لا يابس إلّا في كتاب مبين কোন আর্দ্র ও শুষ্ক বস্তু নেই যা প্রকাশ্য গ্রন্থে বর্ণিত হয় নি। এ সকল বর্ণনা মুসলমানদের মধ্যে এক দৃঢ় বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। তাই তারা কোরআন ও হাদীসের ওপর নির্ভর করাকে যথেষ্ট মনে করত ও অন্যান্য গ্রন্থ ও নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করত...।

আমি এই মনীষীদের কথায় আশ্চর্য বোধ করছি। তাঁরা কি জানেন নাالإسلام يهدم ما قبله হাদীসটির অর্থ হলো ইসলামের আগমনের ফলে সকল অতীত ধর্মীয় আচার ও নিয়ম-রীতি অচল ঘোষিত হয়েছে। মানুষ ইসলামের প্রথম যুগ থেকে এখন পর্যন্ত এই বাক্য হতে এরূপ অর্থই বুঝেছেন। এ হাদীস জাহেলী যুগের সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বিশেষত মুশরিক ও আহলে কিতাবের অধর্মীয় আচারসমূহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অর্থাৎ ধর্মের নামে যে সকল অধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল তা অবৈধ ঘোষণা করেছে। এর সঙ্গে ধর্মীয় নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান বহির্ভূত বিষয়ের কোন সম্পর্ক নেই। অন্য একটি হাদীসالإسلام يجبّ ما قبله ইসলাম পূর্ববর্তী বিষয়সমূহকে বিলুপ্ত করে এর অর্থ পূর্ববর্তী বিষয়ের ওপর আবরণ টেনে দেয় ও বর্তমানের সঙ্গে তাকে সংযুক্ত করে না। যেমন ইসলামী আইনে কাউকে আহত বা নিহত করার মত অন্যায় সাধিত হলে দিয়াত বা কিসাস -এর ন্যায় বিশেষ বিধান রয়েছে। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুশরিক অবস্থায় যদি কেউ এরূপ অন্যায় করে থাকে তাহলে ইসলাম গ্রহণের পর তার পূর্ববর্তী অপরাধকে ধরা হয় না। সকল মুসলমানই এ বাক্য হতে এমন অর্থ বোঝে। কিন্তু এই মনীষীরা এ সব বাক্যের যে অর্থ বোঝেন প্রকৃত অর্থ হতে তার ব্যবধান অনেক বেশি।

তা ছাড়া হযরত উমরের হাদীসটিতে রাসূল (সা.) বলেছেন ,কোরআন ও সর্বশেষ শরীয়তের আগমনের ফলে তাওরাত ও হযরত মূসার শরীয়ত রহিত হয়ে গেছে। তাই নবী কোন গ্রন্থই ,এমনকি ধর্মীয় হলেও তা অধ্যয়ন করতে নিষেধ করেন নি। তিনি কেবল রহিত ধর্মীয় গ্রন্থ অধ্যয়নে নিষেধ করেছেন। মুসলমানরা যেন রহিত কোন শরীয়তের সঙ্গে ইসলামী শরীয়তের মিশ্রণ না ঘটায় এজন্যই তাওরাত অধ্যয়নে নিষেধ করেছিলেন। অতঃপর নবী (সা.) বলেছিলেন আহলে কিতাবের হতে তা শ্রবণ কর কিন্তু তা সত্যায়ন বা মিথ্যা প্রতিপন্ন কোনটিই কর না। তার মধ্যে ধর্মীয় কাহিনী ও শরীয়তের বিধান উভয়টিই বিদ্যমান এবং উভয়ের ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি সত্য। নবী (সা.) তাঁর এ বাক্যের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছেন ,আহলে কিতাবদের নিকট যা রয়েছে তা সত্য ও মিথ্যা মিশ্রিত এবং তোমরা যেহেতু পার্থক্য করতে সক্ষম নও সেহেতু সত্যায়ন কর না কারণ তা মিথ্যা হতে পারে আবার মিথ্যা প্রতিপন্ন কর না হয়তো তা সত্য। এ বিষয়টি নাহজুল বালাগাতেও এসেছে যে ,কোরআনে অতীতের ঘটনা ,ভবিষ্যতে যা ঘটবে এবং মানুষের মধ্যে মীমাংসাকারী বিধানসমূহ রয়েছে। এ বাণীটি ধর্মীয় বিধান ,পরকালীন জীবন ও ধর্ম সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছে কোরআনের আগমনের ফলে অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে (প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে)।

সবচেয়ে হাসির বিষয় হলো সূরা আনআমের 59 নং আয়াতের মাধ্যমে দলিল উপস্থাপন- যেখানে বলা হয়েছে ,কোন আদ্র ও শুষ্ক বস্তু নেই যা প্রকাশ্য গ্রন্থে বর্ণিত হয় নি। আমার জানা মতে কোন তাফসীরকারই এ আয়াতটিতে প্রকাশ্য গ্রন্থ বলতে কোরআন বোঝানো হয়েছে বলেন নি ;বরং প্রকাশ্য গ্রন্থ বলতে লাওহে মাহফুয -কে বোঝানো হয়েছে বলেছেন।

এই আয়াত ও ঐ হাদীসগুলোর অর্থ মুসলমানগণ কখনই এই ব্যক্তিদের অনুরূপ বোঝেননি ,অথচ তাঁরা ভেবেছেন এই আয়াত ও বাণীসমূহই মুসলমানদের এ ধরনের চিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল যে ,কোরআন ব্যতীত যে কোন জ্ঞান ও শিল্পকলার বই-ই ধ্বংস করতে হবে।

এখন আমরা ডক্টর মুঈনের চতুর্থ যুক্তিটির পর্যালোচনা করব। তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন ,ইবনে খালদুন স্পষ্টভাবে ইরানের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংসের ব্যাপারে মত দিয়েছেন এবং আবুল ফারাজ ইবনুল ইবরী ,আবদুল লতিফ বাগদাদী ,কুফতী এবং হাজী খলীফা প্রমুখের বর্ণনায় কোন ভুলই নেই ,অথচ তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞগণ সম্প্রতি মুসলমানদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের ইতিহাসকে ভিত্তিহীন ও অসত্য বলে প্রমাণ করেছেন। ডক্টর মুঈন শিবলী নোমানী এবং ডক্টর মিনুয়ীও যে এ বিষয়টিকে অস্বীকার করেছেন তার উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন ,অথচ তাঁদের উপস্থাপিত অকাট্য দলিলসমূহের প্রতি কোন মনোযোগই দেননি।

আমরা এখানে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারসমূহে অগ্নি সংযোগের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ গবেষকদের মতের পাশাপাশি যে বিষয়গুলো আমাদের চিন্তায়ও এসেছে তার উল্লেখ করব। অতঃপর ইরানের গ্রন্থাগারসমূহ ভস্মীভূত হওয়ার বিষয়ে ইবনে খালদুন ও হাজী খলীফার নামে যা বলা হয়েছে তার জবাব দেব।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ,মুসলমানদের হাতে ইরানের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংসের দাবিদাররা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে অগ্নি সংযোগের যুক্তি নিয়ে আসেন। যখন জাহেলী যুগের আরবদের মূর্খতা ,কুরাইশদের কোন এক ব্যক্তির কোন এক বালককে গ্রন্থ পাঠের কারণে তিরস্কার ,ইরানী আবদুল্লাহ্ ইবনে তাহের কর্তৃক গ্রন্থসমূহ ধ্বংস ,ইসলামী শাসকদের প্রথম দেশ জয়ের শত বর্ষ পরে খাওয়ারেজমে কুতাইবা ইবনে মুসলিম কর্তৃক গ্রন্থ ভস্মীভূতকরণের মতো বিষয়সমূহ ইরানে গ্রন্থাগার ধ্বংসের প্রমাণ হিসেবে এসেছে তখন স্বাভাবিকভাবেই আমর ইবনে আস-এর মত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি কিনা আলেকজান্দ্রিয়ার প্রসিদ্ধ দার্শনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ও দর্শন শিক্ষা করতেন তাঁর দ্বারা গ্রন্থাগার ধ্বংসের (তাও আবার ইসলামী শাসনের কেন্দ্র মদীনার খলীফার সরাসরি নির্দেশে ,খাওয়ারেজমের ন্যায় কুতাইবা ইবনে মুসলিমের নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত সিদ্ধান্তে নয়) বিষয়টিও দলিল হিসেবে আসবে। এ বিষয়টি মুসলমাদের ইরানে গ্রন্থাগার ধ্বংসের দলিল হিসেবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়ে থাকে।

ভূমিকা হিসেবে বলতে চাই ইসলাম ও ইসলামের বিজয় সম্পর্কিত ইতিহাস সামগ্রিকভাবে (বিশেষ স্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত ইতিহাস) দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষার্ধে রচিত হয়েছে এবং এই ইতিহাসগ্রন্থগুলো এখনও আমাদের হাতে রয়েছে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ছাড়াও কয়েকজন খ্র্রিষ্টান ঐতিহাসিকও আরব মুসলমানদের দ্বারা মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের ইতিহাস ব্যাপক ও বিস্তারিত আকারে বর্ণনা করেছেন। প্রথম ক্রসেড যুদ্ধের পূর্ববর্তী কোন মুসলিম ,খ্রিষ্টান ও ইহুদী ইতিহাস গ্রন্থেই আলেকজান্দ্রিয়া বা ইরানের গ্রন্থাগারসমূহে অগ্নি সংযোগের বিবরণ পাওয়া যায় না। প্রথম বারের মত ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ ও সপ্তম হিজরী শতাব্দীর প্রারম্ভে ইরাকী খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক আবদুল লতিফ বাগদাদী তাঁর আল ইফাদাহ্ ওয়াল ই তিবার ফিল উমুরিল মুশাহাদা ওয়াল হাওয়াদিসিল মায়াইনাহ্ বি আরদে মিস্র নামক গ্রন্থে (যা তাঁর প্রত্যক্ষ দর্শন ও এক কথায় সফরনামার ওপর ভিত্তি করে রচিত) আমুদুস্ সাওয়াদি স্তম্ভের আলোচনায় আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের বিবরণ দিয়ে বলেছেন ,

এবং বলা হয়ে থাকে এই স্তম্ভ ঐ সকল স্তম্ভের একটি যার ওপর ঝুলন্ত বারান্দা ছিল এবং অ্যারিস্টটল এই বারান্দায় বসে শিক্ষা দান করতেন ও এটি একটি শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এখানে একটি বৃহৎ গ্রন্থাগার ছিল যা মদীনার খলীফার নির্দেশে আমর ইবনে আস ভস্মীভূত করেন।

আবদুল লতিফ বলতে চান নি তাঁর স্বধর্মী খ্রিস্টানগণ এরূপ বলে থাকেন বা সাধারণ মানুষের মধ্যে এরূপ গুজব ছড়িয়েছে তাই বক্তব্য শুরু করেছেন বলা হয়ে থাকে দিয়ে। আমরা সকলেই জানি হাদীস বা ঐতিহাসিক বিষয় বর্ণনা করতে হলে অবশ্যই তথ্যসূত্র ও সনদ উল্লেখ করতে হয়। যেমনটি হাদীসবেত্তা ও ঐতিহাসিকগণ করে থাকেন। তাবারী ও অন্যান্য ঐতিহাসিকগণ এমনটিই করেছেন। এর মাধ্যমে পাঠককে বিষয়টি গবেষণা ও যাচাই করার সুযোগ দেয়া হয় যাতে করে তথ্যসূত্র সঠিক হলে সে তা গ্রহণ করতে পারে। যদি কোন হাদীস বা ঐতিহাসিক তথ্যের সনদ বা তথ্যসূত্র জানা না থাকে তাহলে তা দু ভাবে বলা যায়: প্রথম পদ্ধতিতে উল্লিখিত আছে বলে উল্লেখ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ উল্লিখিত আছে অমুক বছর অমুক ঘটনা ঘটেছিল ;দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বলা হয়ে থাকে বলে বিষয়টির উল্লেখ করা হয়। প্রথমভাবে বর্ণিত বিষয়ের ক্ষেত্রে বোঝা যায় বক্তা সেটি বিশ্বাস করেন যদিও অন্যরা তথ্যসূত্র ও সনদবিহীন এরূপ হাদীসকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণও তথ্যসূত্রহীন বর্ণনাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। এ বিষয়ের উল্লেখ করলে বলে থাকেন অমুক ব্যক্তি তাঁর গ্রন্থে এরূপ বর্ণনা করেছেন কিন্তু তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি অর্থাৎ ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্যতা নেই।

কিন্তু যদি দ্বিতীয়ভাবে বর্ণনা করা হয় এবং বক্তা বা বর্ণনাকারী কথিত আছে বা বলা হয়ে থাকে বলে বিষয়টির উল্লেখ করেন তাহলে বোঝা যায় স্বয়ং বর্ণনাকারী বিষয়টি নির্ভরযোগ্য মনে করেন না।

আবদুল লতিফ ঘটনাটিকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন তাতে বোঝা যায় তিনি বিষয়টিকে বিশ্বাস করেন না। তদুপরি ,আবদুল লতিফ অন্তত নিশ্চিতভাবে জানতেন অ্যারিস্টটল গ্রীসে ছিলেন এবং কখনও মিশরে আসেননি। তাই ঐ বারান্দায় বসে তাঁর পক্ষে শিক্ষাদানও সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি আলেকজান্ডারের মিশর আক্রমণের পর নির্মিত হয় অর্থাৎ অ্যারিস্টটল আলেকজান্ডারের সমসাময়িক হলেও তাঁর পরে এই শহর গড়ে ওঠে ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সুতরাং আবদুল লতিফ বর্ণনাটি বিশ্বাস করলেও তা অনির্ভরযোগ্য ও দুর্বল বলে প্রতিপন্ন। অর্থাৎ ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে নিশ্চিতভাবে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কোন বর্ণনায় যদি কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ থাকে যার কোন কোনটি মিথ্যা বলে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে বাকী অংশটিও অসত্য ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণিত হয়। তাই অ্যারিস্টটলের ঐ বারান্দায় বসে শিক্ষাদানের মতো মুসলমানগণ কর্তৃক ঐ গ্রন্থাগার ভস্মীভূতকরণও অসত্য ও ভিত্তিহীন।

সুতরাং আবদুল লতিফের বর্ণনা তথ্যগতভাবে দুর্বল যেহেতু তিনি কোন তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি এবং বিষয়বস্তুও দুর্বল যেহেতু তাতে স্পষ্ট একটি মিথ্যা রয়েছে। তাছাড়া বর্ণনার দিক হতেও দুর্বল যেহেতু বলা হয়ে থাকে বলে শুরু করে তিনি বিষয়টির প্রতি নিজের অবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

যদি আবদুল লতিফ প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানদের আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের সময়কার কোন ব্যক্তি হতেন অথবা যারা ঐ সময়ের নিকটবর্তী তাদের হতে সরাসরি বা তাদের সূত্রে অন্য কারো হতে বর্ণনা করতেন তবে বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য ছিল। কিন্তু এরূপ কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ আবদুল লতিফ ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর শেষার্ধ হতে সপ্তম হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। অর্থাৎ আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের (17 হিজরী) সময় হতে তাঁর সময়ের ব্যবধান ছিল ছয়শ বছরের মত। এই ছয়শ বছরে কোন অমুসলিম বা মুসলিম ঐতিহাসিকের নিকট হতে এরূপ বর্ণনা দেখা বা শোনা যায় নি। হঠাৎ করে ছয়শ বছর পর আবদুল লতিফের গ্রন্থে তা খুঁজে পাওয়া গেছে। তাঁর বক্তব্য সনদবিহীন বর্ণনা হতেও নিম্নমানের এবং বাহ্যিক বর্ণনার দিক হতেও অসত্য হিসেবে প্রমাণিত।

উপরন্তু ঐতিহাসিক সাক্ষ্য মতে মুসলমানদের হাতে আলেকজান্দ্রিয়া পতনের পূর্বে আলেকজান্দ্রিয়া কয়েকবার বিভিন্ন শক্তির হামলার শিকার হয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল। মুসলমানরা যখন আলেকজান্দ্রিয়া জয় করে তখন সেখানে পূর্বের ন্যায় কোন গ্রন্থাগারই ছিল না। শুধু কিছু ব্যক্তির হাতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গ্রন্থ বিদ্যমান ছিল এবং চতুর্থ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানরা তা থেকে উপকৃত হতো।

এ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উইল ডুরান্টের তারিখে তামাদ্দুন 167 গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত করব। তিনি বলেছেন , আবদুল লতিফের যুক্তি ও বর্ণনার দুর্বলতাসমূহ নিম্নরূপ :

1. আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ 392 খ্রিষ্টাব্দে আর্চ বিশপ তুফিনসের সময় গোঁড়া খ্রিষ্টানরা পুড়িয়ে দেয় অর্থাৎ মুসলমানগণ আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের 250 বছর পূর্বে এই গ্রন্থাগারের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ গ্রন্থ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল।

2. ধারণাকৃত ঘটনাটির সঙ্গে আবদুল লতিফ রচিত গ্রন্থের পাঁচ শতাব্দীর অধিক সময়ের ব্যবধান ছিল এবং ইতোপূর্বে কোন ঐতিহাসিকই এ বিষয়টি উল্লেখ করেন নি ,অথচ 322 হিজরীতে (933 খ্রিষ্টাব্দ) আলেকজান্দ্রিয়ার দায়িত্বশীল খ্রিষ্টান আর্চ বিশপ উতকিউস আরবদের হাতে এ শহর বিজিত হওয়ার ইতিহাস বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তাই অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে সত্য বলে মনে করেন নি এবং বানোয়াট বলেছেন। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি দীর্ঘ সময়ে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছিল যা ইতিহাসের অন্যতম দুঃখজনক ঘটনা।168

উইল ডুরান্ট তাঁর উক্ত গ্রন্থে খ্রিষ্টানদের হাতে গ্রন্থাগারটি ধ্বংসের বিবরণ দিয়েছেন। আগ্রহীরা ফার্সীতে অনূদিত তাঁর গ্রন্থের ষষ্ঠ ,নবম ও একাদশ খণ্ডটি দেখতে পারেন।

গুসতাভ লুবুন তাঁর ইসলাম ও আরব সভ্যতা গ্রন্থে বলেছেন ,

আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি ধ্বংসের জন্য মুসলমানদের অভিযুক্ত করা হয় এটি আশ্চর্যের বিষয় এজন্য যে ,কিভাবে এমন একটি বানোয়াট ও অসত্য বিষয় এতকাল ধরে প্রচারিত ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে! কিন্তু বর্তমানে বিষয়টির অসত্যতা প্রমাণিত হয়েছে ;বরং এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ,ইসলামের পূর্বে খ্রিষ্টানরাই আলেকজান্দ্রিয়ার সকল উপাসনালয় ও মূর্তিসমূহ ধ্বংস করেছিল সেই সাথে এই মূল্যবান গ্রন্থাগারটিও জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ইসলামী শাসনামলে আলেকজান্দ্রিয়া বিজিত হওয়ার সময় তেমন কিছুই সেখানে বিদ্যমান ছিল না যা মুসলমানরা পুড়িয়ে দিতে পারে।

খ্রিষ্টপূর্ব 332 সালে আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হতে মুসলিম যোদ্ধাদের হাতে এর পতন পর্যন্ত এক হাজার বছর ব্যাপী এ শহরটি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল একটি শহর হিসেবে পরিগণিত হতো।

সম্রাট আলেকজান্ডারের প্রতিনিধিগণ অর্থাৎ বাতালাসাদের সময় পৃথিবীর সকল দার্শনিক ও পণ্ডিত এ শহরে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরা সেখানে শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগারসমূহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কিন্তু এ উন্নয়ন বেশি দিন অব্যাহত থাকেনি। খ্রিষ্টপূর্ব 48 সালে সিজার-এর নেতৃত্বে আলেকজান্দ্রিয়া শহরে হামলা করা হয় ও এই জ্ঞানকেন্দ্রের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। অবশ্য রোমানদের রাজত্বে ও পরিচালনায় শহরটি পুনরায় উন্নত হয় ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করে। কিন্তু তাও বেশি দিন টিকে নি। কারণ সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব দেখা যায় এবং রোমের সম্রাটের পক্ষ হতে রক্তক্ষয়ী দমন অভিযান পরিচালনার পরও তা অব্যাহত ছিল। এমতাবস্থায় রোমে খ্রিষ্টবাদ রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গৃহীত হয়। রোম সম্রাট থিওডর মূর্তিপূজকদের169 সকল খোদা ,তাদের উপাসনালয় ও গ্রন্থাগারসমূহ জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।170

আলেকজান্দ্রিয়া শহর মিশরের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর যা রোম সম্রাট আলেকজান্ডারের নির্দেশে খ্রিষ্টপূর্ব চারশ অব্দে (চতুর্থ খ্রিষ্টপূর্ব শতাব্দীতে) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়া

আলেকজান্ডারের মিশরীয় প্রতিনিধি ও গভর্ণরদের বাতালাসাহ্ বলে অভিহিত করা হতো। তাঁরা ঐ শহরে যাদুঘর ও গ্রন্থাগার তৈরি করেন যা প্রকৃতপক্ষে একটি একাডেমী ছিল এবং পরবর্তীতে জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। আলেকজান্দ্রিয়ার অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব গ্রীকদের সমকক্ষ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানকেন্দ্রটি খ্রিষ্টপূর্ব তিনশ বা দু সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চতুর্থ খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। আলেকজান্ডার ও তাঁর পরবর্তীদের শাসনামলে মিশর গ্রীকদের রাজনৈতিক অধিকারে ছিল। কিন্তু গ্রীক সভ্যতা পতনের দিকে ধাবিত হলে রোম সাম্রাজ্য-যার রাজধানী বর্তমানের ইতালীর রোম ছিল-যুদ্ধে গ্রীসকে পরাজিত করে তখন মিশর ও আলেকাজান্দ্রিয়াও রোমের রাজনৈতিক অধিকারে চলে যায়। রোম সাম্রাজ্য চতুর্থ খিষ্ট শতাব্দীতে দু ভাগে বিভক্ত হয়। যথা: পূর্ব রোম-যার রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল (বর্তমানে তুরস্কের

ইস্তাম্বুল) এবং পশ্চিম রোম-যার রাজধানী বর্তমানে ইতালির রাজধানী রোম। পূর্ব রোম খ্রিষ্টবাদ গ্রহণ করে। খ্রিষ্টবাদ গ্রীস ও রোম উভয় সভ্যতার ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রোমের বিভক্তির সময় হতেই ইউরোপের মধ্যযুগ (অন্ধকার যুগ) শুরু হয়। পূর্ব রোম খ্রিষ্টবাদ গ্রহণের ফলে তৎকালীন খ্রিষ্টবাদী চিন্তার প্রভাবে-যারা বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চাকে খ্রিষ্টধর্মের মৌলনীতি বিরোধী মনে করত এবং দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের অধার্মিক ও বিচ্যুত বলে ফতোয়া দিত-আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষা কেন্দ্রটির ওপর খড়গহস্ত হলো। 48 খ্রিষ্টাব্দে সিজারের আক্রমণের পর রোমের শাসকবর্গ দ্বিতীয় বারের মত এই শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগারটি অগ্নি সংযোগ ও ধ্বংসের শিকার হলো। কনস্টানটাইন পূর্ব রোম সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট যিনি খ্রিষ্টবাদ গ্রহণ করেন। কনস্টানটাইনের প্রতিনিধিগণের অন্যতম জাস্টিনিয়ান ষষ্ঠ খ্রিষ্ট শতাব্দীতে এথেন্সের জ্ঞানকেন্দ্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন। ইতোপূর্বে চতুর্থ খ্রিষ্ট শতাব্দীতে আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রটি বন্ধ ঘোষিত হয়েছিল। এথেন্সের শিক্ষাকেন্দ্রটি 529 খ্রিষ্টাব্দে বন্ধ ঘোষিত হয় অর্থাৎ রাসূল (সা.)-এর জন্মের 41 বছর ,তাঁর নবুওয়াত ঘোষণার 81 বছর ,হিজরতের 94 বছর ,তাঁর ইন্তেকালের 105 বছর এবং মুসলমানদের হাতে আলেকজান্দ্রিয়া বিজিত হওয়ার 120 বছর পূর্বে এ ঘটনা ঘটেছিল।

এ আলোচনা হতে পরিষ্কার হলো যে ,আলেজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার মূর্তিপূজকরা প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং খ্রিষ্টানরা তা ধ্বংস করেছে। কিন্তু মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে সংঘটিত ক্রুসেড যুদ্ধের (যা পঞ্চম হতে ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত থাকে) পর খ্রিষ্টানরা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয় এবং এ সভ্যতা তাদের সচেতনতা দান করে। অন্যদিকে মুসলমানদের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ার পর তারা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে মুসলমানদের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারা কোরআন ,ইসলাম ,রাসূল (সা.) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এত বেশি অপপ্রচার ও গুজব রটাতে থাকে যাকে আধুনিক খ্রিষ্ট সভ্যতার লজ্জা বলা যেতে পারে। এই লজ্জার ক্ষতিকে পুষিয়ে নিতে অনেক খ্রিষ্টান লেখক গ্রন্থ রচনা করেছেন ,যেমন জন ডেভেন পোর্ট মুহাম্মদ ও কোরআনের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেছেন তাতে মুসলমানদের হাতে গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিষয়টি উপস্থাপন করে একে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলেছেন। মুসলমানদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের গুজবটি সপ্তম হিজরী শতাব্দীর পর হতে কোন কোন মুসলিম লেখকও অজ্ঞতাবশত কথিত আছে , বর্ণিত হয়েছে বা বলা হয়ে থাকে প্রভৃতি লিখে উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা জানেন না ক্রুসেডার খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বদনাম ও কুৎসা রটনার উদ্দেশ্যে এ গুজব ছড়িয়েছে। গত শতাব্দী (বিংশ) হতে সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলাম ও প্রথম যুগের মুসলমানদের প্রতি বর্তমান মুসলমানদের বিতৃষ্ণ করে তুলতে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে । তাই পুরদাউদের মত ব্যক্তিদের দ্বারা এরূপ কাল্পনিক ও বানোয়াট কাহিনী তৈরি করিয়ে ও আবদুল লতিফের ন্যায় ঐতিহাসিকদের বিবরণকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ইতিাহাসের রূপ দিয়ে শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করেছে যারা ইতিহাস সম্পর্কে তেমন অবগত নয় ।

এতক্ষণ আমরা আবদুল লতিফের বর্ণনা নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন আবুল ফারাজ ইবনুল ইবরীর বর্ণনা নিয়ে পর্যালোচনা করব।

আবুল ফারাজ ইবরী একজন ইহুদী চিকিৎসক যিনি 623 হিজরীতে এশিয়া মাইনরের মালাতিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ইহুদী ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টান হন। আবুল ফারাজও তাঁর জীবনের প্রথম ভাগে খ্রিষ্ট ধর্ম অধ্যয়নে সময় ব্যয় করেন। তিনি আরবী ও সুরিয়ানী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি সুরিয়ানী ভাষায় এক ইতিহাস গ্রন্থ লিখেন যার তথ্যসমূহ আরবী ,সুরিয়ানী ও গ্রীক ভাষার গ্রন্থসমূহ হতে নেয়া হয়েছে। ঐ গ্রন্থে মুসলমানদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের কোন বিবরণই নেই। গ্রন্থটি আরবী ভাষায় সংক্ষিপ্তাকারে মুখতাছারুদ দোয়াল নামে প্রকাশিত হয়। কথিত আছে এ গ্রন্থটি অসম্পূর্ণ। আশ্চর্যের বিষয় হলো এ গ্রন্থটি সুরিয়ানী ভাষায় লিখিত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ হলেও এতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা ঐ মূল গ্রন্থে নেই ,যেমন মুসলমানদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের কাহিনী।

মুখতাছারুদ দোয়াল গ্রন্থটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর পোকুক নামের এক অধ্যাপক কর্তৃক অনূদিত হয়েছে। এই ভদ্রলোক মুসলমানদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণায় বেশ কিছু বই লিখেছেন যেগুলো ল্যাটিন ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। এই ব্যক্তির মাধ্যমেই মুসলমানদের দ্বারা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের বানোয়াট কাহিনীটি ইউরোপে প্রচারিত হয়। অবশেষে গত শতাব্দীতে কিছু ইউরোপীয় গবেষক যেমন গীবন ,গুসতাব লুবন ,কুরিল ও অন্যান্যদের দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিবরণটি মুখতাছারুদ দোয়াল গ্রন্থে এভাবে এসেছে :

তৎকালীন সময়ে ইয়াহিয়া নাহভী যিনি আমাদের ভাষায় গারমাতিকুস অর্থাৎ ব্যাকরণবিদ উপাধিধারী ছিলেন তিনি আবরদের মাঝে বিশিষ্ট অবস্থান লাভ করেছিলেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার অধিবাসী ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি খ্রিষ্টান ধর্মের ইয়াকুবী ধারার আভেরী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করেন। ফলে মিশরের সকল খ্রিষ্টান ধর্মযাজক তাঁর নিকট এসে উপদেশ দানের মাধ্যমে তাঁকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন কিন্তু ব্যর্থ হন। ধর্মযাজকগণ তাঁর একগুঁয়েমীর কারণে তাঁর পদ হতে অপসারণ করেন। এরূপ নাস্তিক অবস্থায়ই তিনি বেশ কিছু দিন অতিবাহিত করেন। এ সময়ই মিশর বিজয়ী মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনে আস মিশরে আসেন।

একদিন ইয়াহিয়া আমর ইবনে আসের নিকট উপস্থিত হলে আমর তাঁর জ্ঞান সম্পর্কে অবহিত হন ও তাঁর প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখান। এই বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি সেখানে প্রজ্ঞাজনোচিত এমন এক বক্তব্য দান করেন যা আরবরা কখনও শুনে নি। তাঁর বক্তব্য আমর ইবনে আসের মনে এতটা প্রভাব বিস্তার করল যে ,তিনি তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লেন। যেহেতু আমর ইবনে আস একজন চিন্তাশীল ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন সেহেতু তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলেন এবং সব সময় তাঁকে নিজের কাছে রাখতেন।

একদিন ইয়াহিয়া আমর ইবনে আসকে বললেন: আলেকজান্দ্রিয়ার সকল কিছু আপনার অধিকারে রয়েছে। তন্মধ্যে আপনাদের প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহ আমরা চাই না কিন্তু যে বস্তুগুলো আপনাদের কোন প্রয়োজন নেই তা আমাদের অধিকারে দিন যাতে আমরা তা থেকে অধিক উপকৃত হতে পারি। আমর ইবনে আস প্রশ্ন করলেন: ঐ বস্তুসমূহ কি কি ? তিনি বললেন: দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ যা সরকারী গ্রন্থাগারে বিদ্যমান।

আমর বললেন: আমি নিজের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কিছু করার অধিকার রাখি না। তাই মদীনায় খলীফার (হযরত উমর) নিকট হতে এ বিষয়ে অনুমতি চাইব। আমর খলীফার নিকট অনুমতি চেয়ে পত্র লিখলে তিনি জবাবে লিখেন: যদি এই গ্রন্থসমূহ কোরআনের মতের অনুরূপ হয় সে ক্ষেত্রে এগুলোর কোন প্রয়োজন আমাদের নেই আর যদি কোরআনের মতের পরিপন্থী হয় সেগুলো ধ্বংস কর।

এ উত্তর পাওয়ার পর আমর ইবনে আস গ্রন্থাগার ধ্বংসের কাজে ব্রতী হলেন এবং আলেকজান্দ্রিয়ার গোসলখানাগুলোর কর্মচারীদের মধ্যে গ্রন্থসমূহ বণ্টনের নির্দেশ দিলেন। এভাবে ছয় মাসের মধ্যে সকল গ্রন্থ গোসলখানার পানি গরমের কাজে পুড়িয়ে ফেলা হলো। বিষয়টিকে আশ্চর্য না ভেবে তা গ্রহণ কর। 171

এ বিষয়টি স্বয়ং আবুল ফারাজ ইবনুল ইবরীই বর্ণনা করে থাকুন বা প্রফেসর পোকুক উভয় ক্ষেত্রেই দুঃখজনকভাবে তাঁর কথা মত আশ্চর্য বোধ না করে গ্রহণ করতে পারি না। আমরা আবদুল লতিফের বক্তব্যের পর্যালোচনায় বলেছি ঐতিহাসিক কোন বিবরণকে সনদ ,গ্রন্থ বা তথ্যসূত্র ব্যতিরেকে আমরা কখনই গ্রহণ করতে পারি না বিশেষত ছয়শ বছর পর যখন কেউ সনদবিহীনভাবে এরূপ বর্ণনা দান করে ,এমনকি পূর্বেও কেউ সনদহীন এ ঘটনার কোন বর্ণনা দেন নি। তদুপরি গবেষকগণ প্রমাণ করেছেন মুসলমানগণ আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের সময় সেখানে কোন গ্রন্থাগারই ছিল না অর্থাৎ যে বিষয়কে কেন্দ্র করে আলোচনা তা-ই বিদ্যমান ছিল না। এছাড়া অন্যান্য প্রমাণও রয়েছে।

প্রথমত এ ঘটনার অন্যতম মূল নায়ক প্রসিদ্ধ দার্শনিক ইয়াহিয়া নাহভী। সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্যানুযায়ী আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের একশ বছর পূর্বে পরলোক গমন করেছিলেন। তাই তাঁর সঙ্গে আমর ইবনে আসের সাক্ষাতের ঘটনা কাল্পনিক ।172 আশ্চর্যের বিষয় হলো শিবলী নোমানী যদিও লিখেছেন ইয়াহিয়া ঐ সাত জন দার্শনিকের একজন যাঁরা সম্রাট জাস্টিনিয়ানের রোষানলে পড়ে ইরানে আগমন করেন এবং ইরান সম্রাট খসরু আনুশিরওয়ান সাদরে তাঁদের গ্রহণ করেন ,অথচ তিনি তাঁর সঙ্গে আমর ইবনে আসের সাক্ষাৎকে অস্বীকার করেন নি। তিনি লক্ষ্য করেননি ঐ বিশিষ্ট মনীষীদের ইরানে আগমন হতে মুসলমানদের আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের সময়ের মধ্যে একশ বিশ বছরের অধিক সময়ের ব্যবধান ছিল। সম্ভব নয় যে ,যে ব্যক্তি আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের একশ বিশ বছর পূর্বে ছিলেন ব্যতিক্রমীভাবে জীবিত থেকে (এক অতিশয় বৃদ্ধ হিসেবে) আমর ইবনে আসের সঙ্গে দেখা করবেন। তাই যে সকল বর্ণনা গ্রন্থাগারের উল্লেখ করেও ঐ সাক্ষ্যকে স্বীকার করেছে তারা ভুল করেছে।

আবুল ফারাজ কর্তৃক বর্ণিত ইয়াহিয়া নাহভীর সঙ্গে আমর ইবনে আসের সাক্ষাতের ঘটনা আবদুল লতিফ কর্তৃক বর্ণিত অ্যারিস্টটলের আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষাদানের ঘটনার ন্যায়ই অবান্তর যাতে ঘটনার লেখকরা ঐতিহাসিক সময়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত কাহিনীতে বলা হয়েছে খলীফার নির্দেশ পৌঁছার পর আমর ইবনে আস গ্রন্থগুলোকে গণ-গোসলখানার কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন করেন এবং ছয় মাস ধরে সেগুলো গোসলখানাগুলোতে ব্যবহৃত হয়। আলেকজান্দ্রিয়া সে সময় মিশরের সবচেয়ে বড় শহর ছিল এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ শহর বলে পরিগণিত হতো। স্বয়ং আমর ইবনে আস এই শহরের আশ্চর্যের বর্ণনা দিয়ে খলীফাকে লিখেছিলেন , এ শহরে চার হাজার গোসলখানা ,চার হাজার ভবন ও ইমারত ,চল্লিশ হাজার জিযিয়া দানকারী ইহুদী ,চারশ টি সরকারী বিনোদন কেন্দ্র ,বারো হাজার সব্জি বিক্রেতা রয়েছে । তাই আমাদের ধরে নিতে হবে ছয় মাস এই গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে এই চার হাজার গোসলখানার পানি উত্তপ্ত হতো অর্থাৎ এত অধিক গ্রন্থ ছিল যে ,প্রতিদিন চার হাজার না হয়ে একটি গোসলখানার পানি উত্তপ্ত করলে ঐ গ্রন্থ দিয়ে (4 হাজারের সঙ্গে 6 মাস অর্থাৎ 180 দিন গুণ করলে দাঁড়ায় 720000 দিন বা দুই হাজার বছর) দুই হাজার বছর চলত। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো আবুল ফারাজের বর্ণনায় এসেছে ,ঐ গ্রন্থসমূহ বুদ্ধিবৃত্তিক ও দর্শন সম্পর্কিত ছিল ,অন্য কোন গ্রন্থ নয়। এখন চিন্তা করে দেখব সভ্যতার জন্ম হতে ছাপাখানার সৃষ্টি পর্যন্ত যদি অনবরত দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক বই বের করা হতো তাহলেও তা চার হাজার গোসলখানার ছয় মাসের পানি উত্তপ্ত করার জন্য যথেষ্ট হতো কি ?

আরো চিন্তা করে দেখব এই পরিমাণ গ্রন্থের জন্য কি পরিমাণ স্থানের প্রয়োজন ? গ্রন্থসমূহ তো খড়ের গাদার মত স্তুপীকৃত ছিল না ;বরং তাকসমূহে বা আলমারীতে সাজানো ছিল। কারণ মানুষ সেগুলো অধ্যয়ন করত। চতুর্থ খ্রিষ্ট শতাব্দীতে রোম সম্রাটের পক্ষ হতে গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংসের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক ধর্মযাজক আলেকান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পর্কে এরূপ বিবরণ দিয়েছেন , আমি ঐ গ্রন্থাগারের আলমারীগুলোতে কোন গ্রন্থই পাইনি। 173

আবদুল লতিফ আলেকজান্দ্রিয়ায় শুধু একটি ঝুলন্ত বারান্দা দেখেছেন। এরূপ ঝুলন্ত বারান্দা কেন ইবনুল ইবরীর পরিসংখ্যানের গ্রন্থের জন্য পুরো এক শহরও যথেষ্ট নয়।

বর্তমানে ছাপাশিল্পের ও অন্যান্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিশেষত আমেরিকা ও রাশিয়ায় বৃহৎ শহর ও গ্রন্থাগার তৈরির সর্বাধিক সুবিধা রয়েছে তদুপরি আমার জানা নেই ঐ শহরগুলোর গোসলখানাগুলোকে ছয় মাস ধরে গরম রাখার মত পর্যাপ্ত গ্রন্থ সেখানে আছে কিনা ?

এ যুক্তিগুলো বর্ণিত বিষয়টি বানোয়াট ও ভিত্তিহীন প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। সম্ভবত কল্পনায় এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কথিত আছে এক ব্যক্তি আফগানিস্তানের হেরাত শহর কতটা বড় ও এ শহরে কত অধিক সংখ্যক মানুষ আছে তা বুঝাতে বলেছিল। হেরাত শহরে শুধু আহমাদ নামের এক চক্ষুবিশিষ্ট পাচকের সংখ্যা ছিল একুশ হাজার ,তাহলে বুঝুন আরো আহমাদ ছিল যারা এক চক্ষুবিশিষ্ট ও পাচক ছিল না ,আবার সবার নাম আহমাদও ছিল না ,তবে কত লোক এ শহরে বাস করত ? এক আহমাদ নামে যদি এত লোক থাকে অন্যান্য প্রতিটি নামে কত লোক হতে পারে ? অবশ্যই সৃষ্টির প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত সকল লোককে গণনা করলেও এত হবে কিনা সন্দেহ।

স্পষ্ট যে ,আবুল ফারাজের এই বর্ণনা আহমাদ নামের এক চক্ষুবিশিষ্ট একুশ হাজার পাচকের কাহিনীর ন্যায়। এ কারণেই এনসাইক্লোপিডিয়ার লেখকগণ আবুল ফারাজের এই বর্ণনাকে শিবলী নোমানের বর্ণনা মতে কৌতুকময় মনে করেছেন।

তৃতীয়ত শিবলী নোমান এবং কিছু পাশ্চাত্য গবেষক বলেছেন ,তৎকালীন সময়ে গ্রন্থসমূহ চামড়ায় লিখিত হতো এবং কখনই তা পোড়ানোর কাজে লাগা সম্ভব নয়। তাই সেগুলোকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার অযৌক্তিক। শিবলী নোমান মসিয়ে দ্যাঁ পিয়ের নামক এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি পানি গরমের জন্য যখন অন্য জ্বালানী পর্যাপ্ত ছিল তখন গোসলখানার কর্মচারীরা চামড়া নির্মিত গ্রন্থসমূহ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না।

চতুর্থত যদি বাস্তবেই আলেকজান্দ্রিয়ায় এত বড় গ্রন্থাগার থাকত তাহলে আমর ইবনে আস তার বিবরণ খলীফার নিকট লিখিত পত্রে উল্লেখ করতেন। ইতিহাসে বিধৃত তাঁর পত্রে শহরের বিনোদন কেন্দ্র ও সব্জি বিক্রেতার বর্ণনা থাকলেও কোন গ্রন্থাগারের বিবরণ নেই কেন ?

পঞ্চমত আমর ইবনে আস আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের পর নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে জিম্মি চুক্তি তে আবদ্ধ হয়েছিলেন এবং নিশ্চয়ই তিনি তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে আচরণ করতেন। অর্থাৎ তাদের প্রাণ ,সম্পদ ,পরিবার ,উপাসনালয়সমূহ প্রভৃতি রক্ষা ও সংরক্ষণ ইসলামী হুকুমতের কর্তব্য বলে বিবেচিত হতো। আমর ইবনে আস মিশরের জনগণের সাথে লিখিত চুক্তিতে উল্লেখ করেন: এই নিরাপত্তা চুক্তি আমরের পক্ষ হতে মিশরের জনসাধারণের রক্ত ,প্রাণ ,সম্পদ ,গৃহ ও অন্যান্য বিষয়ের নিরাপত্তা দান করছে। 174 মুজামুল বুলদান গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে চুক্তিতে বলা হয়েছে: মিশরের জনসাধারণের ভূমি ,সম্পদ ও পুঁজি তাদেরই মালিকানা ও অধিকারে থাকবে। কেউ তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। 175

আমরা জানি আহলে কিতাবের সঙ্গে মুসলমানদের আচরণ এরূপ ছিল যে ,তাদের ভূমি দখলে আসলে তাদের সঙ্গে জিম্মি চুক্তি করে তাদের নিকট হতে জিযিয়া গ্রহণ করত।

জিযিয়ার বিপরীতে তাদের জীবন ,সম্পদ ,সম্মান ও উপাসনালয়সমূহের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নিত। আলেকজান্দ্রিয়াতেও তাই করা হয়েছে। যদি আবুল ফারাজ তাঁর বর্ণনায় বলতেন ,মুসলমানরা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পূর্বেই এই কাজ করেছিল তবে হয়তো কেউ কেউ বিশ্বাস করত। কিন্তু তাঁর বর্ণনা মতে আলেকজান্দ্রিয়া জয়ের বেশ পরে ইয়াহিয়া নাহভীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খলীফার নির্দেশে তা করা হয়েছে। এটি বিশ্বাসযোগ্য নয় যে ,মুসলমানরা কারো সঙ্গে সন্ধি চুক্তি করার পর এমন কাজ করবে কারণ তা তাদের নীতির পরিপন্থী।

ষষ্ঠত আমর ইবনে আস সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি তা এ বিষয়টিকে সমর্থন করে না। কারণ আমর ইবনে আস একজন স্বাধীন চিন্তার বিচক্ষণ ও দক্ষ পরিচালক ছিলেন ,এমনকি নিজে যা মনে করতেন খলীফাকে যেভাবেই হোক তা বুঝিয়ে বাধ্য করতেন। ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে খলীফা হযরত উমর মিশর জয়ের তেমন আগ্রহ পোষণ করেননি ,কিন্তু আমর ইবনে আস তাঁকে উৎসাহিত ও প্ররোচিত করেন ,এমনকি বলা হয়েছে ,খলীফার অনুমতি পত্র আসার পূর্বেই তিনি মিশরে আক্রমণ চালান। ইবনুল ইবরীর বর্ণনা মতে ইয়াহিয়া নাহভী আমর ইবনে আসের প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর প্রজ্ঞাজনোচিত জ্ঞান হতে লাভবান হতেন। তাই আমর এমনভাবে খলীফাকে পত্র লিখতেন যাতে তাঁর বন্ধুর পছন্দের গ্রন্থাগারটি সংরক্ষিত হয়। যদি খলীফা এর বিপরীত কিছূ করতেন তাহলে দ্বিতীয়বার তাঁকে পত্র লিখে বুঝানোর চেষ্টা করতেন ও তাঁর বন্ধুর প্রাণ হতে প্রিয় গ্রন্থসমূহকে রক্ষার প্রচেষ্টা নিতেন। তাছাড়া আলেকজান্দ্রিয়ার বিজয়ী হিসেবে আমর ইবনে আসের নীতি একজন অত্যাচারী শাসক যেমন কুতাইবা ইবনে মুসলিমের ন্যায় ছিল না ;বরং তিনি সেখানে সংস্কার ,নির্মাণ ও পুনর্গঠনের ব্রত নিয়ে কাজ করতেন। উইল ডুরান্ট বলেছেন :

আমর ন্যায়ের সাথে শাসন করতেন। ভূমিকর ও রাজস্বের একটি বিরাট অংশ খাল খনন ,পুল সংস্কার এবং নীল নদ হতে লোহিত সাগর পর্যন্ত খালটির পুনর্খননে ব্যয় করতেন। এর ফলে জাহাজসমুহ ভূমধ্যসাগর হতে ভারত মহাসাগরে যাতায়াত করতে পারত। খালটি 114 হিজরীতে দ্বিতীয়বারের মত ভরাট ও পরিত্যক্ত হয়ে যায়। 176

যে ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ববোধ এত বেশি তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগার ধ্বংস করবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

খলীফা উমর যদিও রুক্ষ্ণ প্রকৃতির ছিলেন কিন্তু কোন ব্যক্তিই তাঁর দূরদর্শিতার বিষয়ে সন্দেহ করতে পারে না ,এমনকি তিনি সব দায়িত্ব যাতে নিজে পালন না করতে হয় এজন্য অন্যদের পরামর্শ নিতেন। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে বিশেষত হিজাযের বাইরের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শের জন্য পরিষদ গঠন করতেন যার নমুনা ইতিহাসে বিধৃত হয়েছে। হযরত আলী (আ.)ও নাহজুল বালাগা য় এরূপ দু টি বিষয়ের উদাহরণ দিয়েছেন। কোন ইতিহাস গ্রন্থেই পাওয়া যায় নি যে ,তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের বিষয়ে পরামর্শ পরিষদ গঠন করেছিলেন। এমন একটি বিষয়ে তিনি পরামর্শ ব্যতীত সিদ্ধান্ত নেবেন তা সম্ভব নয়। যদি খলীফ উমর এমন চিন্তা পোষণ করতেন ,কোরআনের উপস্থিতিতে অন্য কোন গ্রন্থের প্রয়োজন নেই তাহলে নিঃসন্দেহে এ চিন্তাও করতেন ,সমজিদ থাকতে গীর্জা ,ইহুদীদের উপাসনালয় ও অন্যান্য ধর্মের মন্দিরসমূহও থাকার কোন প্রয়োজন নেই। তবে কেন তিনি ইহুদী ,খ্রিষ্টান ,এমনকি যারথুষ্ট্রদের অগ্নিমন্দিরসমূহও সংরক্ষণ করতেন এবং ইসলামী হুকুমতের জন্য জিম্মি শর্তানুযায়ী তার সংরক্ষণ দায়িত্ব বলে মনে করতেন ?

সপ্তমত যদি ধরেও নিই আমর ইবনে আস এ রকম নির্দেশ দিয়েছিলেন তদুপরি কিভাবে আমরা বিশ্বাস করতে পারি আলেজান্দ্রিয়ার ইহুদী ও খ্রিস্টান অধিবাসী তাদের দীর্ঘদিনের অর্জন ঐ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদকে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই জ্বালানী হিসেবে গ্রহণ করল ও পুড়িয়ে দিল ? অথচ তারা ঐ গ্রন্থগুলো গোপনে লুকিয়ে ফেলতে পারত।

কাফতীর বর্ণনাও আবুল ফারাজের বর্ণনার অনুরূপ। তাই যে সকল ত্রুটি আবুল ফারাজের বর্ণনায় রয়েছে তাঁর বর্ণনাতেও তা রয়েছে। আবুল ফারাজ যেমন সুরিয়ানী ভাষায় লিখিত তাঁর বিস্তারিত ঐতিহাসিক গ্রন্থে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের ঘটনার উল্লেখ করেন নি ,কিন্তু আরবীতে তাঁর ঐ গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত অনুবাদে তা এনেছেন আশ্চর্যজনকভাবে কাফতীও তাঁর মিশরের ইতিহাস গ্রন্থে এই আশ্চর্যজনক ঘটনাটি বর্ণনা করেন নি।177 কিন্তু তাঁর দর্শনের ইতিহাস বিষয়ক আখবারুল উলামা বি আখবারিল হুকামা নামক গ্রন্থে ইয়াহিয়া নাহভীর জীবনী আলোচনায় কোন সূত্র ছাড়াই উপরোক্ত ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। সুতরাং ঐ ঘটনার অন্যতম নায়ক ইয়াহিয়া নাহভী সম্পর্কে কাফতীর বর্ণনাও পূর্বের ন্যায় এবং সেখানেও দর্শন গ্রন্থের পরিমাণ চার হাজার গোসলখানার ছয় মাসের জ্বালানীর সমপরিমাণ বলা হয়েছে।

তবে কাফতীর দাবি অনুযায়ী ইয়াহিয়া নাহভী প্রথম জীবনে নাবিক ছিলেন পরে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর জ্ঞানের পিপাসা জাগ্রত হলে দর্শন ,চিকিৎসা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জনের পাশাপাশি ধর্মীয়ভাবে আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চ বিশপের পদমর্যাদা লাভ করেন।

মোট কথা ,ইয়াহিয়া নাহিভীর জীবনী ইতিহাসের একটি অস্পষ্ট বিষয়। যতটুকু জানা যায় ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ইয়াহিয়া নাহভী নামে একজন ব্যক্তি ছিলেন যিনি একদিকে দার্শনিক ,অন্যদিকে আর্চ বিশপ ছিলেন। তিনি অ্যারিস্টটল ও আবারকিলুসের মতামত খণ্ডন করে গ্রন্থ রচনা করেছেন। খ্রিষ্টধর্মের মৌল বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে একটি গ্রন্থও লিখেছেন। ইবনে সিনা আবু রাইহান বিরুনীর প্রতি লেখা তাঁর প্রসিদ্ধ পত্রে এই দার্শনিকের তীব্র সমালোচনা করে তাঁর মতকে সাধারণ খ্রিষ্টানদের প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে রচিত বলেছেন। অন্যদিকে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেসত গ্রন্থে ইয়াহিয়া নাহভীর সঙ্গে আমর ইবনে আসের সাক্ষাতের কথা লিখেছেন ,কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার সম্পর্কে কিছুই বলেননি। আবু সুলাইমান মানতেকী তাঁর সাওয়াবুল হিকমাহ্ গ্রন্থে বলেছেন ,তাঁকে খলীফা উসমান ও মুয়াবিয়ার আমলে দেখা গেছে। তদুপরি বলা যায় ইবনুন নাদিম ও আবু সুলাইমানের বর্ণনা হয় ভিত্তিহীন নতুবা খলীফা উসমান ও মুয়াবিয়ার শাসনামলে যে ইয়াহিয়া ছিলেন তিনি ভিন্ন কোন ব্যক্তি ছিলেন ,যিনি আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চ বিশপ ছিলেন না এবং অ্যারিস্টটলের মত খণ্ডন করে গ্রন্থও লিখেননি। অসম্ভব নয় যে ,যাঁরা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের কাহিনী তৈরি করেছেন তাঁরা ইবনুন নাদিম ও আবু সুলাইমানের গ্রন্থ হতে ইয়াহিয়া নাহভীর নামটি ব্যবহার করেছেন। যা হোক এটি প্রমাণিত যে ,আলেকজান্দ্রিয়ার প্রসিদ্ধ দার্শনিক ,চিকিৎসক ,আর্চ বিশপ ও অ্যারিস্টটলের মতবিরোধী ইয়াহিয়া নাহভী মুয়াবিয়া ও আমর ইবনে আসের সাক্ষাৎ লাভ করেননি।

এখন আমরা ইবনে খালদুনের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করব। তিনি সরাসরি ইরানের গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিষয়ে কথা বলেননি। যদি আমরা ইবনে খালদুনের মূল ভাষ্যের প্রতি লক্ষ্য না করে পুর দাউদের ইয়াশতা যেখান হতে ডক্টর মুঈন বর্ণনা করেছেন তার ওপর নির্ভর করি তদুপরি বলতে হবে ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন আবদুল লতিফের মত এক চিকিৎসক যিনি ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন বা আবুল ফারাজ যিনিও এক চিকিৎসক তাঁদের মত নন ,এমনকি তারিখুল হুকামা র লেখক কাফতীর সঙ্গেও তিনি তুলনীয় নন। তিনি নিজে একজন ঐতিহাসিক ও সর্বজনীন ইতিহাস রচয়িতা। তাই তিনি যদি কোন বিষয়ে স্পষ্ট মত দেন তাহলে বুঝতে হবে নিশ্চয়ই কোন তথ্যসূত্র তাঁর হাতে ছিল।

কিন্তু দুঃখজনক হলো ইবনে খালদুনও এ বিষয়ে মতামত দেননি এবং কর্মবাচক ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। তিনিও তাঁর বক্তব্যকে এমনটি বলা হয়ে থাকে বলে শুরু করেছেন। তদুপরি ইবনে খালদুন তাঁর বক্তব্যের মাঝে এমন এক বাক্য যোগ করেছেন যা ঘটনাটির ভিত্তিকে দুর্বল করে ফেলে। তিনি প্রথমে একটি সামাজিক মৌলনীতির কথা বলেছেন। আর তা হলো যেখানেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ও নগর উন্নয়ন ঘটে স্বাভাবিকভাবেই সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানসমূহের বিস্তার ঘটে ;যদিও অধিকাংশ সমাজবিদ তাঁর এই মৌলনীতি অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। অতঃপর তিনি এই মৌলনীতির ভিত্তিতে বলেছেন যেহেতু ইরানে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ও নগর উন্নয়ন ঘটেছিল সেহেতু বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান প্রসার লাভ না করে পারে না। তিনি বলেন , বলা হয়ে থাকে আলেকজান্ডার ইরান আক্রমণের পর সম্রাট দারাকে হত্যা করেন এবং বৃহৎ এক রাষ্ট্রের ওপর তিনি প্রভুত্ব লাভে সক্ষম হন ও প্রচুর গ্রন্থ তাঁর হস্তগত হয়। সে সময়েই বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ইরান হতে গ্রীসে স্থানান্তরিত হয়। সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ইরান জয়ের পর খলীফা উমরকে পত্র লিখেন... ।

আলেকজান্ডার ইরান হতে গ্রীসে বিভিন্ন গ্রন্থ নিয়ে গেছেন ও তাঁর মাধ্যমে ইরান বিজিত হওয়ার ফলে গ্রীস নতুন এক জ্ঞানভাণ্ডারের অধিকারী হয়েছিল কোন ঐতিহাসিকই তা বলেন নি। এ বক্তব্যের কোন ভিত্তি নেই। পুর দাউদ ধূর্ততার সাথে ইবনে খালদুন যে তাঁর বক্তব্যে কর্তা উহ্য রেখেছেন ও বলা হয়ে থাকে বলে শুরু করেছেন তার যেমন উল্লেখ করেননি আবার ইরান হতে গ্রীসে আলেকজান্ডার কর্তৃক গ্রন্থ পাচারের ভিত্তিহীন কাহিনীও আনেননি ,অথচ ইবনে খালদুনের বক্তব্য হতে উপসংহার টেনেছেন।

যে গুজবটির কথা ইবনে খালদুন উল্লেখ করেছেন তার উৎস আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের উৎস হতে ভিন্ন। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের গুজবটি খ্রিস্টানরা তৈরি করেছে এজন্য যে ,যেহেতু ঐ গ্রন্থাগার তারাই ধ্বংস করেছে সেহেতু তা মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের রক্ষার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। অন্যদিকে ইবনে খালদুনের বর্ণিত গুজবটি সম্ভবত শুয়ূবীয়া রা178 ছড়িয়েছে। ইবনে খালদুনও যে আরববিরোধী ও শুয়ূবীয়া প্রভাবিত ছিলেন না তা বলা মুশকিল।

ইরানের শুয়ূবীয়াদের অন্যতম স্লোগান ছিল শিল্পজ্ঞান শুধু ইরানীদের রয়েছে । ইবনে খালদুনের বর্ণনা হতে বোঝা যায় হয়তো তিনি বলতে চেয়েছেন গ্রীকদের সকল জ্ঞান ইরানীদের নিকট থেকে নেয়া। কিন্তু আমরা জানি অ্যারিস্টটলের জীবদ্দশায় আলেকজান্ডার ইরান আক্রমণ করেন এবং গ্রীস তখন সভ্যতা ও সংস্কৃতির শিখরে অবস্থান করছিল।

অন্যদিকে ইবনে খালদুন হতে উপরোক্ত যে বিবরণটি দেয়া হয়েছে তা তাঁর সামাজিক দর্শন গ্রন্থের ভূমিকা হতে নেয়া হয়েছে। আজ পর্যন্ত কেউ তাঁর আল ইবর ওয়া দিওয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খাবার নামক ইতিহাস গ্রন্থ হতে এটি বর্ণনা করেন নি। যদি ইবনে খালদুন উক্ত বর্ণনাটিকে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন তাহলে অবশ্যই তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে তার উল্লেখ করতেন।

আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে যেমন বর্ণনাকারীদের কর্মবাচক ক্রিয়ার মাধ্যমে বিবরণ দান বিষয়টির অনির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ ছিল এবং এর পাশাপাশি বাহ্যিক কিছু কারণও বিদ্যমান ছিল যা হতে বোঝা যায় ইসলামের আবির্ভারের অনেক পূর্বেই ঐ গ্রন্থাগার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ইরানের গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রেও তদ্রূপ বাহ্যিক কিছু কারণ বিদ্যমান যা থেকে ঐ গুজবের ভিত্তিহীনতা প্রমাণিত হয়। তদুপরি ইতিহাস গ্রন্থসমূহ ইরানে এরূপ কোন গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব উল্লেখ করেনি। অন্যদিকে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতাব্দী হতে চতুর্থ খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল বলে ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে।

যদি ইরানে কোন গ্রন্থাগার থাকত তবে তাতে অগ্নি সংযোগের ঘটনার উল্লেখ না থাকলেও অন্তত এরূপ গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের বিষয়টি উল্লিখিত হতো। বিশেষত যখন বিশ্বের অন্যান্য স্থানের চেয়ে ইরানের ইতিহাস ইরানী ও আরব ঐতিহাসিকদের মাধ্যমে অধিক বিবৃত হয়েছে।

তাছাড়া ইরানীদের মাঝে আরব শাসনামলে এমন এক আন্দোলন শুরু হয়েছিল যারা ইরানে গ্রন্থাগার ধ্বংসের মত কোন ইস্যু পেলে অবশ্যম্ভাবীভাবে তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করত আর তা হলো শুয়ূবী আন্দোলন। যদিও প্রথম দিকে শুয়ূবী আন্দোলন ইসলামের সাম্য ও ন্যায়ের পবিত্র অনুভূতি নিয়ে শুরু হয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তা আরববিরোধী ইরানী জাতীয়তাবাদী এক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। এই আন্দোলনের ব্যক্তিরা আরবদের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে গ্রন্থ রচনা করত এবং যেখানেই আরবদের কোন দুর্বলতা পেত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করত ,এমনকি ইতিহাস হতে আরবদের খুঁটিনাটি সব বিষয় ঘাটিয়ে দেখত।

যদি আরবরা গ্রন্থাগার (বিশেষত ইরানের গ্রন্থাগার) ধ্বংসের মত কোন বড় অপরাধ করত নিঃসন্দেহে বলা যায় শুয়ুবীদের উত্তরণের সেই সময়ে অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে যখন বনি আব্বাস আরববিরোধী নীতি গ্রহণ করেছিল তখন তাদের পক্ষে নিশ্চুপ বসে থাকা অসম্ভব ছিল ;বরং তারা এ সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিলকে তাল বানাত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। অথচ শুয়ুবীরা এমন কোন প্রচারণা চালায় নি। এটি ইরানের গ্রন্থাগার ধ্বংসের কাহিনী বানোয়াট হওয়ার পক্ষে একটি অকাট্য দলিল।

শিবলী নোমানী আলেকাজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের বিবরণ প্রত্যাখ্যান করে প্রশ্ন করেছেন এরূপ মিথ্যা প্রচারণার পেছনে কি উদ্দেশ্য রয়েছে ? এটি কি ঐ গ্রন্থসমূহের প্রতি তাঁদের সহমর্মিতা নাকি অন্য কোন রাজনৈতিক স্বার্থ বিদ্যমান ? যদি ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রন্থগুলোর জন্য তাঁরা সমব্যথী হয়ে থাকেন তবে কেন প্রতিষ্ঠিত গ্রন্থ ধ্বংসের ইতিহাসের যেমন স্পেন জয় ও ক্রুসেডের যুদ্ধের সময় খ্রিষ্টানরা যে সকল গ্রন্থাগার ধ্বংস করেছে তার জন্য তাঁরা সমব্যথী হন না ?

শিবলী নোমানী এর উত্তর দিয়ে বলেছেন প্রকৃতপক্ষে খ্রিষ্টানরাই ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ঐ গ্রন্থাগার ধ্বংস করেছিল। তাদের অপরাধ ঢাকার উদ্দেশ্যেই তারা এমনটি করছে ।

শিবলী যে কারণ উল্লেখ করেছেন তর বাইরেও অন্যান্য কারণ বিদ্যমান এবং মূল কারণ হলো সাম্রাজ্যবাদ। কারণ তাঁরা জানেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ তখনই সফল হবে যখন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সাধারণ মানুষকে তাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি অবিশ্বাসী করতে পারলেই সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সফলতা লাভ করবে। সাম্রাজ্যবাদ যথার্থভাবে বুঝেছে মুসলমানরা যার প্রতি নির্ভর করে তা হলো তাদের মতাদর্শ ও সংস্কৃতি। তাই মুসলমানদের স্বীয় ঈমান ও আকীদার প্রতি সুধারণার অপনোদন ঘটিয়ে পাশ্চাত্য মাতদর্শ গ্রহণে প্রস্তুত করার লক্ষ্যে যুবকদের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে যেন তারা মানবতার মুক্তিদাতা হিসেবে যাদের মনে করে তাদের মতাদর্শ ও সংস্কৃতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়। এরই নমুনাস্বরূপ কল্পিত কাহিনী প্রস্তুত করে বলা হচ্ছে দেখ তারা কিরূপ হিংস্রভাবে অন্য সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে।


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35