ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান5%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 112207 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

কেরাআত ও তাফসীর

ইসলামী জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জ্ঞানটি উৎপত্তি লাভ করে তা হলো কেরাআত ,অতঃপর তাফসীর। কেরাআত কোরআনের শব্দমালার উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তাফসীর পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান।

কেরাআতশাস্ত্রে কোরআন পঠনে ওয়াক্ফ ,ওয়াস্ল ,মাদ ,তাশদীদ ,ইদগাম প্রভৃতির নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা করা হয়। এ শাস্ত্রে কোরআনের কোন কোন শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

সাহাবীরা নবী (সা.)-এর নিকট হতে কোরআন শিক্ষা করতেন ,কোন কোন সাহাবীকে রাসূল সরাসরি কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং অন্যদের শিক্ষা দানের জন্য তাঁদের প্রেরণ করতেন। তাবেয়ীরা (যাঁরা রাসূলের সময়ে ছিলেন না ও তাঁর সাহচর্য লাভ করেননি) সাহাবীদের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এ যুগেই কেরাআতশাস্ত্রের একদল বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয় যাঁরা সঠিকভাবে কোরআন পাঠ শিক্ষা দান শুরু করেন। সাধারণ মুসলমান যাদের সংখ্যা সে সময় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা পরম আগ্রহ নিয়ে কোরআন শিক্ষা করত এবং এই সকল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতো। এ বিশেষজ্ঞগণ কোন ইমাম বা সাহাবীর সূত্রে কোরআন পাঠ প্রক্রিয়া বর্ণনা করতেন। তাঁরাও নিজ পদ্ধতিতে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করতেন। তাঁদের ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণ কি ? রাসূল (সা.)-এর সময়েও কি এ বিষয়ে ভিন্নতা ছিল ? স্বয়ং নবী কি কোরআনের কিছু কিছু শব্দকে কয়েকভাবে পঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন বা কোরআনের কিছু শব্দ কি বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির মাধ্যমে নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ? নাকি অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় যে বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণে পঠনে ভিন্নতার সৃষ্টি হয় কোরআনেও তেমনটি হয়েছে ? এ বিষয়গুলো অন্যত্র আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত ,নবী (সা.) যেরূপে কোরআন পাঠ ও তেলাওয়াত করতেন মুসলমানরা সেরূপেই তা পাঠ ও তেলাওয়াত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। যে সকল ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাসূলের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাই তারা তাঁদের নিকট হতে কোরআন পাঠ শিক্ষাগ্রহণ করতেন।

প্রথমদিকে কারিগণ মৌলিকভাবে শুনে ও মুখস্থ করে শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখতেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ বিষয়ে গ্রন্থ সংকলিত ও লিখিত হয়।

কেউ কেউ দাবি করেছেন ,এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আবু উবাইদা কাসেম ইবনে সালাম (মৃত্যু ২২৪ হিজরী) একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন এজন্য যে ,এর একশ বছর পূর্বেই সাতজন প্রসিদ্ধ কারীর (কোররায়ে সাবআ) একজন হামযা ইবনে হাবিব- যিনি শিয়া ছিলেন ,কোরআন পাঠ পদ্ধতির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তদুপরি এ সম্পর্কিত গবেষণায় আয়াতুল্লাহ্ হাসান সাদর ইবনুন্ নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও নাজ্জাশীর ফেহেরেস্ত গ্রন্থ হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শিষ্য ও সাহাবী আবান ইবনে তাগলিব এরও পূর্বে এ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি আরো প্রমাণ করেছেন ,সর্বপ্রথম আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কোরআন সংকলন করেন এবং তাঁরই শিষ্য ও সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালী কোরআনে প্রথম নুকতাহ সংযোজন করেন।২৫৭ সর্বপ্রথম কোরআন পঠন পদ্ধতির ওপর আবান ইবনে তাগলিব গ্রন্থ লিখেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনের অর্থ ও কঠিন শব্দসূমহের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বপ্রথম কোরআনের ফযিলত বর্ণনা করে গ্রন্থ রচনা করেন প্রসিদ্ধ সাহাবী ও হযরত আলীর অনুসারী উবাই ইবনে কা ব (রা.)। কোরআনের রূপক শব্দসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন তিনি হলেন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ ফাররা যিনি একজন ইরানী শিয়া ছিলেন। সর্বপ্রথম কোরআনের বিধিবিধান নিয়ে যিনি গ্রন্থ লিখেন তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী। সর্বপ্রথম তাফসীর গ্রন্থ লিখেন সাঈদ ইবনে যুবাইর।২৫৮

যা হোক প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর তাবেয়িগণ ও তাদের ছাত্রদের মধ্য হতে দশ ব্যক্তি কোরআন পঠন পদ্ধতিতে (কেরাআতশাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে কোররায়ে সাবআ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন নাফে ইবনে আবদুর রহমান ,আবদুল্লাহ্ ইবনে কাসির ,আবু আমর ইবনুল আলা ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ,আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ ,হামযা ইবনে হাবিব এবং আলী কিসায়ী।

এই সাতজনের চারজনই হলেন ইরানী এবং তাঁদের দু জন হলেন শিয়া। অ-ইরানী তিনজন কারীর দু জনও শিয়া অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর মধ্যে চারজন শিয়া। আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থের ৩৪৬ পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল জলিল রাযী-এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন কেরাআতশাস্ত্রের পুরোধাদের সকলেই আদলীয়াদের (শিয়া ও মুতাযিলা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ,হোক তিনি কুফা ,বসরা ,মক্কা ,মদীনা বা অন্য কোন স্থানের অধিবাসী।

চার প্রসিদ্ধ ইরানী কারী হলেন :

১. আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ একজন ইরানী। তিনি আবু আবদুর রহমান সালামীর নিকট কেরাআত শিক্ষা করেছেন। আবু আবদুর রহমান হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন। আছেমের কেরাআতকে প্রসিদ্ধতম কেরাআত মনে করা হয়। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে বলা হয়েছে , কোরআনের মূল লিখন ও পঠন পদ্ধতিটি সাধারণত আছেমের অনুকরণে লিখা হতো এবং অন্যান্য কারীদের কেরাআতের ধরন নিম্নে লাল কালি দ্বারা কারীর নাম উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করা হতো।২৫৯ আসেম কুফায় থাকতেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাজালিসুল মুমিনীন গ্রন্থের লেখকসহ আরো কিছু গবেষক ,যেমন আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর শিয়া হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বলেছেন। তিনি ১৩০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

২. নাফে ইবনে আবদুর রহমান সম্পর্কে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বলেছেন , তিনি ইরানের ইসফাহানের লোক হলেও মদীনায় বাস করতেন। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,নাফে কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন। তিনি মদীনায় কেরাআতশাস্ত্রের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মদীনার লোকেরা কেরাআতের ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করত। তিনি প্রসিদ্ধ দশজন কারীর একজন ইয়াযীদ ইবনে কা কা হতে কেরাআত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি ১৫৯ বা ১৬৯ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৩. ইবনে কাসির সম্পর্কে ইবনুন নাদিম বলেছেন , কথিত আছে ইরান সম্রাট আনুশিরওয়ান ইরানীদের যে দলটিকে ইয়েমেনে হাবাশীদের নিকট হতে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ইবনে কাসির তাদেরই বংশধর।

আমরা ইতোপূর্বে ইয়েমেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইরানীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে , ইবনে কাসির কেরাআতশাস্ত্রের মৌলনীতি মুজাহিদ-এর নিকট হতে ,তিনি ইবনে আব্বাস-এর নিকট হতে এবং ইবনে আব্বাস হরযত আলী (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইবনে কাসির ১২০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৪. ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে কিসায়ীর নাম আলী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা হলেন হামযা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে বাহমান ইবনে ফিরুয। কিসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি আব্বাসীয় খলীফা হারুন উর রশীদের দু পুত্রের শিক্ষক ছিলেন। খোরাসানে আগমনের সময় তিনি হারুনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি ইরানের রেই শহরে ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যক্রমে হারুনের অন্যতম সফরসঙ্গী ও প্রধান কাযী মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীও ঐ দিন রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাধিস্থ হন। হারুন উর রশিদ এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বলেন , আজকে ইসলামী ফিকাহ্ ও সাহিত্যকে রেইয়ে সমাহিত করেছি। কিসায়ী দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন। কিসায়ীও শিয়া ছিলেন।

তাফসীরের বিষয়ে বলা যায় ,রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় স্বাভাবিকভাবেই সাহাবিগণ কোরআনের আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য রাসূলেরই শরণাপন্ন হতেন। কোন কোন সাহাবী অন্যদের নিকট হতে কোরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিকতর অগ্রসর ছিলেন ,এজন্য প্রথম হতেই আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন ,যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ। অবশ্য ইবনে আব্বাসের এ ক্ষেত্রে পরিচিতি অধিক ছিল এবং তাঁর মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিক বর্ণিত হয়ে থাকে। ইবনে আব্বাস২৬০ হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদও হযরত আলীর ছাত্র ও শিয়া ছিলেন। গ্রন্থসূচী সম্পর্কিত আল ফেহেরস্ত গ্রন্থগুলোতে ইবনে আব্বাস সংকলিত একটি তাফসীরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন এই গ্রন্থটি এখনও মিশরের রাজকীয় জাদুঘরে রাখা আছে। তাফসীরে ইবনে আব্বাসের স্বতন্ত্র মত থাকলেও হযরত আলীর এ সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন , হযরত আলীর জ্ঞানের নিকট আমি মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির ন্যায়।

জর্জি যাইদান দাবি করেছেন ,প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত কোরআনের তাফসীর মুখে মুখে স্থানান্তরিত হতো এবং কোরআনের সর্বপ্রথম তাফসীর সংকলন করেন মুজাহিদ (মৃত্যু ১০৪ হিজরী)। অতঃপর ওয়াকেদী ও ইবনে জারীর তাবারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে তাফসীর লিখেন।২৬১

অবশ্য এ মতটি সঠিক নয়। ইবনে আব্বাস ছাড়াও সাঈদ ইবনে জুবাইর তাঁর পূর্বে তাফসীর সংকলন করেছেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানগণ কোন গ্রন্থই রচনা করেনি। এ মতের অনুবর্তী হয়েই জর্জি যাইদান উপরোক্ত মত দিয়েছেন। তাঁর এ মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তাই এ মতটি প্রত্যাখ্যাত। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেরাআতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন ইরানীরা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাফসীরের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের মূল হিসেবে তাফসীর ,ফিকাহ্ ও হাদীসশাস্ত্রের প্রতি ইরানীরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য বিষয়ের প্রতি ততটা নয়। এখানে ইসলামের প্রথম যুগ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইরানী মুফাসসিরের নাম উল্লেখ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতি শতাব্দীতেই শত শত মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থ ছিল। তাই তাঁদের মধ্য হতে বিভিন্ন জাতির মুফাসসিরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। তবে তাফসীরশাস্ত্রে ইরানীদের অবদান তুলে ধরার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু নমুনা প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকা হতে উল্লেখ করছি। লক্ষ্য করবেন ,এদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

প্রথম পর্যায়ের মুফাসসিরগণ হলেন যাঁদের নাম ও মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর উল্লেখ করা হয় অথবা তাঁদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এখনো বিদ্যমান। এখানে আমরা তাঁদের মধ্য হতেই মনোনীত করব ।

প্রথম শ্রেণীর মুফাসসির যাঁদের নাম তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর স্মরণ করা হয় তাঁদের কেউ সাহাবী ,কেউ তাবেয়ী ,কেউ তাবে তাবেয়ী আবার কেউ তাঁদের ছাত্র বা শিষ্য। এ ধরনের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে আব্বাস ,ইবনে মাসউদ ,উবাই ইবনে কাব ,সা দী ,মুজাহিদ ,কাতাদা ,মুকাতিল ,কালবী ,সাবিয়ী ,আ মাশ ,সুফিযান সাওরী ,জুহরী ,আতা ,আকরাম ,ফাররা প্রমুখ।

এদের কেউ শিয়া ,কেউ সুন্নী ,কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশই অ-ইরানী। শুধু মুকাতিল ,আ মাশ ও ফাররা ইরানী বংশোদ্ভূত।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইরানের খোরাসান অথবা রেইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর একজন ব্যক্তিত্ব এবং ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মুকাতিল শাফেয়ী মাযহাবের লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং শাফেয়ী অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে বলেছেন , অন্যরা তাফসীরের ক্ষেত্রে মুকাতিলের পরিবারস্বরূপ অর্থাৎ তাঁর অনুসারী।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ১৫০ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে সুলাইমান ইবনে মেহরান আ মাশের পিতা ইরানের দামাভান্দের অধিবাসী হলেও আ মাশ কুফায় জন্মগ্রহণ করেন ও জীবন কাটান। আ মাশ শিয়া হলেও আহলে সুন্নাতের আলেমগণও তাঁর প্রশংসা করেছেন। আ মাশ রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি ১৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফাররা ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ আকতা একজন আরবী ব্যাকরণবিদ ও অভিধান রচয়িতা। আরবী সাহিত্যের গ্রন্থে তাঁর নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। তিনি কেসায়ীর ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুনের সন্তানদের শিক্ষক ছিলেন।

রিয়াজুল উলামা তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে শিয়া বলেছেন। তাঁর পিতা যিয়াদ আকতা ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনায় হুসাইন ইবনে আলী ইবনে হাসানের২৬২ সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় আব্বাসীয় খলীফার নির্দেশে হস্ত কর্তিত হন। এজন্যই তাঁকে আকতা বা কর্তিত হস্ত বলা হয়। ফাররা ২০৭ বা ২০৮ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর মুফাসসিরগণ হলেন তাঁরা যাঁরা তাফসীর বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে এত অধিক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ,তা গণনা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করব। আমাদের আলোচনা শিয়া মুফাসসিরগণের তাফসীর দিয়ে শুরু করছি। শিয়া মুফাসসিরগণ দু অংশে বিভক্ত। একদল হলেন সে সকল মুফাসসির যাঁরা ইমামগণের উপস্থিতিতে ও বর্তমান অবস্থায় তাফসীর লিখেছেন ও অন্যদল হলেন যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ে তাফসীর লিখেছেন। ইমামগণের সমকালীন সময়ে যাঁরা তাফসীর রচনা করেছেন তাঁদের কেউ ইরানী ,কেউ অ-ইরানী। ইমামদের সাহাবী এরূপ কয়েকজন মুফাসসির হলেন আবু হামযা সুমালী ,আবু বাছির আসাদী ,ইউনুস ইবনে আবদুর রহমান ,হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ,আলী ইবনে মেহযিয়ার আহওয়াযী ,মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী কুমী এবং ফাজল ইবনে শাজান নিশাবুরী।

ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ের মুফাসসিরের সংখ্যা অসংখ্য। এখানে আমরা শুধু শিয়াদের প্রসিদ্ধ কিছু তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। এ হতেই বোঝা যাবে শিয়া মুফাসসিরগণের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

১. তাফসীরে আলী ইবনে ইবরাহীম কুমী: এ তাফসীর গ্রন্থটি শিয়াদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ যা এখনও বর্তমান রয়েছে। আলী ইবনে ইবরাহীমের পিতা কুফা হতে কোমে আসেন। অসম্ভব নয় ,আলী ইবনে ইবরাহীম একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। তিনি শেখ কুলাইনীর শিক্ষক ও মাশয়িখ (যাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন)। তিনি ৩০৭ হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

২. তাফসীরে আয়াশী: এই তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ সামারকান্দী লিখেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সুন্নী ছিলেন এবং পরবর্তীতে শিয়া হন। তিনি শেখ কুলাইনীর সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি তাঁর পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিন লক্ষ দিনারের পুরোটাই গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লিখন ,সংকলন ,নকল ও ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। যে সকল ব্যক্তি এরূপ কর্ম করতেন তাঁদের জীবিকা র্নিবাহের খরচ তিনি দিতেন। আয়াশী তাফসীর ,হাদীস ,ফিকাহ্শাস্ত্র ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন ও দাবি করেছেন আয়াশীর রচিত গ্রন্থসমূহ খোরাসানে বেশ প্রচলিত ছিল। আয়াশী ইরানী হলেও আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,কথিত আছে তিনি তামীম গোত্রের উত্তর পুরুষ। তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব।

৩. তাফসীরে নোমানী: এ তাফসীরটির রচয়িতা হলেন আবদুুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইবনে আবি যাইনাব নামেও সুপরিচিত। তিনি শেখ কুলাইনীর ছাত্র। তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন ,তাফসীরে নোমানীর অনুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রয়েছে। নোমানী ইরাকের না মিশরের অধিবাসী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম।

নোমানীর এক দৌহিত্রের নাম আবুল কাসেম হুসাইন ,যিনি ইবনুল মারযবান নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পিতার দিকে হতে তিনি সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদের বংশধর। তিনি কয়েকবার তৎকালীন শাসনকর্তার মন্ত্রী হওয়ায় ওয়াযিরে মাগরেবী নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইবনুল মারযবান চৌদ্দ বছর বয়সে কোরাআনের হাফেজ হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ,হিসাবশাস্ত্র ,অংক ও জ্যামিতি ,যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চ মাপের সাহিত্যিক ও শক্তিমান লেখকও ছিলেন।

তিনি খাসায়িসুল কোরআন নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ৪১৮ অথবা ৪২৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা বাগদাদ হতে নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয় ও তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর কবরের নিকটবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।

৪. তাফসীরে তিবইয়ান: এ তাফসীরের রচয়িতা শেইখুত তায়িফা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আলী আত তুসী। তিনি তাফসীর ,ফিকাহ্ ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ও আরবী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি ৩৮৫ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁর জন্ম হতে এখন এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর মাশহাদে তাঁর সহস্র বছর পূর্তি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। শিয়া-সুন্নী ,মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে প্রচুর মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র ৪৬০ হিজরীতে অস্তমিত হয়। তিনি ২৩ বছর বয়সে খোরাসান হতে ইরাকে আসেন এবং শেখ মুফিদ ও সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর সময়ের শিয়া মতাবলম্বীদের ফকীহ্ ও নেতা হন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও তিনি শিয়া আলেমদের শিরোমণি ছিলেন। মৃত্যুর বারো বছর পূর্বে বাগদাদের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার (মোগলদের আক্রমণ) ফলে নাজাফে চলে আসেন এবং নাজাফের ধর্মীয় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন যা তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরও বিদ্যমান রয়েছে।

৫. মাজমাউল বায়ান: এ তাফসীর গ্রন্থটি ফাযল ইবনে হাসান তাবরেসী রচনা করেছেন। তিনি ইরানে তাফরেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৫৩৬ হিজরীতে তাঁর এই তাফসীর লেখা সমাপ্ত করেন। রচনা ও সাহিত্যিক মানের দিক দিয়ে এ তাফসীরটি সর্বোত্তম। আহলে সুন্নাত ও শিয়া উভয়েই এই তাফসীরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই মিসর ,বৈরুত ও ইরানে পুনঃপুন ছাপা হয়েছে। আল্লামা তাবরেসী জাওয়ামেউল জামে নামে অপর একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীরটি তিনি তাঁর সমকালীন প্রসিদ্ধ মুফাসসির জারুল্লাহ্ যামাখশারী রচিত তাফসীরে কাশশাফ হতে আকর্ষণীয় সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে সংযোজন করেছেন।

অবশ্য তাফসীর বিশেষজ্ঞরা জানেন তাফসীরে কাশশাফে এমন অনেক সাহিত্যিক ও অলংকারিক বিষয় রয়েছে যা মাজমাউল রায়ানে নেই। আবার মাজমাউল বায়ানেও এমন অনেক সাহিত্যিক ও তাফসীরগত বিষয় রয়েছে যা কাশশাফে নেই।

৬. রাউযুল জিনান: আবুল ফুতুহ রাযী তাফসীরটি রচনা করেছেন। এ তাফসীর ফার্সী ভাষায় রচিত। শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সমৃদ্ধতম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে ফখরুদ্দীন রাযী ও তাবরেসী উভয়েই এ তাফসীর গ্রন্থ হতে পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়েছেন। গত চল্লিশ বছরে তাফসীরটি ইরানে ব্যাপকভাবে ছাপা হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাযী নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করলেও রেই শহরে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি আরব বংশোদ্ভূ ইরানী। তিনি হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও সিফফিন যুদ্ধে তাঁর পক্ষে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ্ ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার বংশধর।

আবুল ফুতুহ তাবরেসী ও যামাখশারীর সমসাময়িক ব্যক্তি এবং শেখ তুসীর পরোক্ষ ছাত্র। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত ,তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর রেই শহরে বিদ্যমান।

৭. তাফসীরে সাফী: বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ,মুফাসসির ,দার্শনিক ও আরেফ মোল্লা মুহাম্মদ ফাইয কাশানী এ তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি প্রসিদ্ধ শিয়া আলেমদের অন্যতম। তিনি একাদশ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। মরহুম ফাইয প্রথম জীবনে কোমে ছিলেন। তাঁর নামেই কোমের ধর্মীয় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মাদ্রাসায়ে ফাইযিয়া । পরে তিনি কোম হতে সিরাজ যান ও সাইয়্যেদ মাজিদ বাহরানীর নিকট হাদীসশাস্ত্র এবং মহান দার্শনিক ও আরেফ সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরা নামে প্রসিদ্ধ) নিকট দর্শন ও এরফান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সাদরুল মুতাআল্লিহীনের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি ১০৯১ হিজরীতে কাশানে মৃত্যুবরণ করেন।

৮. তাফসীরে মোল্লা সাদরা: যদিও মোল্লা সাদরা দর্শন ও অধিবিদ্যাশাস্ত্রে অধিকতর পরিচিত ও স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা তদুপরি তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি উসূলে কাফী নামক হাদীস গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি সূরা বাকারার ৬৫ আয়াত পর্যন্ত ,সূরা সিজদাহ্ ,ইয়াসীন ,ওয়াকেয়া ,হাদীদ ,জুমআ ,ত্বারিক ,আলা ,যিলযাল ,আয়াতুল কুরসী ,সূরা নূরের কিছু আয়াত ও সূরা নামলেরوترى الجبال تحسبها جامدة আয়াতটি তাফসীর করেছেন। যদিও মোল্লা সাদরার তাফসীর পূর্ণ তাফসীর নয় ,তদুপরি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এবং আয়তনে তাফসীরে সাফীর সমান।

গ্রন্থটি ইরানে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। তিনি ১০৫০ হিজরীতে পদব্রজে হজ্বে গমনের সময় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সপ্তমবারের মত হজ্বে যাওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। কাবার আকর্ষণ তাঁকে এমনভাবে টানত যে ,কণ্টকময় পথ তাঁর নিকট রেশমী কাপড় বিছানো পথের ন্যায় মনে হতো।

৯. মিনহাজুস সাদেকীন: এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় রচিত। এটি তাবরীজ হতে তিন খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি মোল্লা ফাতহুল্লাহ্ ইবনে শুকরুল্লাহ্ কাশানী কর্তৃক দশম হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। এই লেখকের অধিকাংশ লেখা ফার্সীতে ছিল। যেমন নাহজুল বালাগার ফার্সী অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

১০. তাফসীরে শাব্বার: সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ শাব্বার এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি কাশেফুল গেতা ও মির্যা কুমীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন চিন্তাশীল ,জ্ঞানী ও আবেদ ছিলেন। তিনি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,কালাম ,হাদীসশাস্ত্র ,তাফসীর ও রিজালশাস্ত্রে প্রচুর গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি ১২৪২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ও ইমাম কাযিম (আ)-এর সমাধিস্থলের নিকটে সমাধিস্থ হন।

১১. তাফসীরে বুরহান: এই তাফসীরটি সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী কর্তৃক রচিত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস ও গবেষক। তাফসীরটি আখবারী ধারায় লিখিত অর্থাৎ কোরআন শুধু হাদীসের সাহায্যেই তাফসীর করতে হবে-এই মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসীদের ধারায় এটি লিখা হয়েছে। তাই শুধু আয়াতসংশ্লিষ্ট হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদীসটির বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি। সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী ১১০৭ অথবা ১১০৯ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

১২. নুরুস সাকালাইন: এ তাফসীরটি হুয়াইযের একজন আলেম কর্তৃক লিখিত যিনি সিরাজে বাস করতেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল আলী ইবনে জুমাআ। তিনি মরহুম আল্লামা মাজলিসী ও শেখ হুররে আমেলীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়। তাঁর তাফসীরটিও হাদীসনির্ভর তাফসীর।

ওপরে আমরা যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি সেগুলো দ্বাদশ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত শিয়াদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এবং শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতের নিকটেই রয়েছে। তাই শিয়া ভিন্ন অন্যরাও চাইলে সহজেই তা পেতে পারেন। চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীতেও অনেক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। যদি কেউ শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান পেতে চান তাহলে আল্লামা শেইখ আগা বুযুরগে তেহরানী রচিত আয যারবিয়া ইলা তাসানিফুশ শিয়া নামক গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ওপরে আমরা নমুনাস্বরূপ যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি তা হতে স্পষ্ট ,প্রসিদ্ধ সকল শিয়া তাফসীর গ্রন্থই হয় ইরানীদের দ্বারা রচিত হয়েছে নতুবা আরব বংশোদ্ভূত কোন ইরানী বা শিয়া যাঁরা ইরানে বসবাস করতেন তাঁরা লিখেছেন।

ইরানে ইসলামের কর্মতালিকা

পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাসমূহ অধ্যয়নে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে পবিত্র ও সম্মানিত ইসলাম ধর্ম আমাদের এ প্রিয় দেশে আগমনের প্রাক্কালে এই দেশ কিরূপ অবস্থায় ছিল এবং ইসলাম আমাদের কি দিয়েছে এবং আমাদের নিকট থেকে কি নিয়েছে ?

যা কিছু ইতোপূর্বে অধ্যয়ন করেছেন সেগুলো স্মরণে রাখুন। ইসলাম ইরানকে ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিন্তার দিক থেকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পেয়েছিল এবং এ দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তা ও বিশ্বাসের একতা দান করেছিল। এ ভূখণ্ডে ইসলামের মাধ্যমেই প্রথম বারের মত এই ঐক্য সাধিত হয়েছিল। ইরানের উত্তর-দক্ষিণ ,পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত সেমিটিক ও আর্য বংশের বিভিন্ন মানুষ ভাষা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভিন্নতা নিয়ে শক্তি ও ক্ষমতার ছত্রছায়ায় বাস করছিল। ইসলামই তাদের এ অবস্থা হতে বের করে এনে একক দর্শনের ছায়ায় আশ্রয় দেয়। প্রথম বারের মত তারা একক

চিন্তা ,মূল্যবোধ ও আদর্শ লাভ করে এবং তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতি সৃষ্টি হয়। যদিও এ প্রক্রিয়া চার শতাব্দী ধরে পর্যায়ক্রমে সম্পাদিত হয় তদুপরি তা সফল হয়। তখন হতে এখন পর্যন্ত এ দেশের আটানব্বই ভাগ মানুষ এমনই রয়েছে। যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণও প্রায় চার শতাব্দী এ দেশে শাসন পরিচালনা করেছিলেন এবং প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন যারথুষ্ট্র চিন্তার ছায়ায় বিশ্বাসের ঐক্য সাধনের কিন্তু সফল হন নি। কিন্তু ইরানে দু বছরের প্রবর্তিত ইসলামী শাসনের অবসান ঘটলেও ইসলামের আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ও প্রশান্তিদায়ক অভ্যন্তরীণ শক্তির কারণে যুগ যুগ ধরে তা টিকে রয়েছে।

ইসলাম ইরান ও প্রাচ্যে খ্রিষ্টবাদের প্রভাব ও বিস্তারকে প্রতিহত করে। ইরান ও প্রাচ্য খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করলে কিরূপ পরিণতি লাভ করত আমরা অকাট্যভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে না পারলেও এতটুকু নিশ্চিত বলতে পারি ,তৎকালীন খ্রিষ্ট বিশ্বের দেশগুলোর ন্যায় ইরানে অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ নেমে আসত। কিন্তু সে সময়ের খ্রিষ্টান দেশসমূহ যখন অন্ধকার মধ্যযুগ অতিক্রম করছিল তখন ইরান ইসলামের ছায়ায় অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের অগ্রভাগে উজ্জ্বল ও প্রস্ফুটিত ইসলামী সভ্যতার মশাল বহন করে এগিয়ে যাচ্ছিল।

এখন প্রশ্ন হতে পারে যদি খ্রিষ্টধর্মের বৈশিষ্ট্য ঐরূপ হয়ে থাকে এবং ইসলামের এরূপ তবে কেন বর্তমানের পরিস্থিতি ভিন্ন কথা বলে ? উত্তরটি পরিষ্কার যে ,তারা আট শতাব্দী পূর্বে খ্রিষ্টবাদ ত্যাগ করে মুক্তি পেয়েছে আর আমরা এখনই ইসলামকে ত্যাগ করে পতনের সম্মুখীন হয়েছি।

ইসলাম ইরানের চারিদিক হতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বেড়াজাল (যা এ জাতিকে আবদ্ধ করে রেখেছিল তা) উপড়ে ফেলে এবং অন্যান্য জাতির মধ্যে ইরানীদের প্রতিভা বিকাশের যে পথ দীর্ঘ দিন রুদ্ধ ছিল এবং এ জাতি নিকট ও দূরবর্তী অন্যান্য জাতির জ্ঞান হতে বঞ্চিত হয়েছিল তা হতে মুক্তি দেয়। ইসলাম ইরানের দ্বারকে অন্যান্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য যেমন উন্মুক্ত করে তেমনি ইরানীদের জন্যও অন্যান্য দেশগুলোর দ্বারসমূহ উন্মোচিত করে। এর মাধ্যমে ইরানীরা এমনভাবে নিজেদের যোগ্যতা ও প্রতিভা অন্যদের সামনে তুলে ধরেছিল যে ,অন্যদের নেতা ও আদর্শে পরিণত হয়েছিল। অন্যদিকে অন্যান্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতার পূর্ণতা ও বিকাশের মাধ্যমে বিশ্বে এক নতুন সভ্যতা উপহার দিতে পেরেছিল।

এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করি ইরানী জাতির ইতিহাসে প্রথম বারের মত ইরানীরা ধর্মীয় বিষয়ে অন্য জাতির জন্যও ইমাম ও নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। যেমন লাইস ইবনে সাদ একজন ইরানী হিসেবে মিশরের জনগণের ফিকাহর ইমাম হন ,আবু হানিফা যদিও ইরানের মধ্যে আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণের প্রভাবের কারণে ইরানী অনুসারী লাভ করেন নি তদুপরি যে জাতিসমূহ আহলে বাইত সম্পর্কে অবগত নন তাদের মাঝে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফকীহ্ ও ইমাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আবু উবাইদা মুয়াম্মার ইবনুল মুসান্না ,ওয়াসিল ইবনে আতা প্রমুখ কালামশাস্ত্রের অন্যতম পুরোধা হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন। কিসায়ী ও সিবাভেই আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রের পণ্ডিত ও অভিধান রচয়িতা হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। হিশাম ইবনে আবদুল মালিক কুফার একজন আলেমকে জিজ্ঞেস করেন :

যে সকল আলেম ও ফকীহ্ ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন শহরে মুফতী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের চেন কি ? তিনি বলেন , হ্যাঁ।

হিশাম প্রশ্ন করেন , বর্তমানে মদীনার মুফতী কে ?

উত্তরে বলেন , নাফে।

হিশাম প্রশ্ন করেন , সে কি আরব না মাওলা ? 179

-সে ইরানী মুক্ত দাস।

-মক্কার ফকীহ্ ও মুফতী কে ?

-আতা ইবনে রিবাহ্।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-ইয়েমেনের ফকীহ্ ও মুফতী কে ?

-তাউস ইবনে কিসান।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-ইয়ামামার ফকীহ্ কে ?

-ইয়াহিয়া ইবনে কাসির।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-সিরিয়ার (শাম) ফকীহ্ কে ?

-মাকহুল।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-জাজিরার ফকীহ্ কে ?

-মাইমুন ইবনে মাহান।

-মাওলা না আরব ?

-মাওলা।

-খোরাসানের ফকীহ্ কে ?

-যাহ্হাক ইবনে মুযাহেম।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-বসরার ফকীহ্ কে ?

-হাসান ও ইবনে সিরীন।

-আরব না মাওলা ?

-মাওলা।

-কুফার ফকীহ্ কে ?

-ইবরাহীম নাখয়ী।

-আরব না মাওলা ?

-আরব।

হিশাম বললেন: আমার শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যার বিষয়েই প্রশ্ন করছিলাম তুমি বলছিলে মাওলা ,অন্তত একজন আরব খুঁজে পাওয়া গেল। 180

ইরানীদের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান যথা হিজায ,ইরাক ,ইয়েমেন ,সিরিয়া ,মিশর ও আরব উপদ্বীপের মানুষদের ধর্মীয় ইমাম হওয়ার এরূপ সুবর্ণ সৌভাগ্য ইতোপূর্বে কখনও লাভ করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তী সময়ে তাদের এই ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রভাব আরো বিস্তৃত হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে ইরানীদের এই জ্ঞানগত ও নৈতিক পুনর্জাগরণে ও প্রতিভা বিকাশের সময়কে স্যার জন ম্যালকম ইরানীদের স্থবিরতার কাল বলে অভিহিত করেছেন। স্যার জন ম্যালকম উনবিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদের প্রচারক হিসেবে জাতিগত গোঁড়ামীর চশমা পড়ে তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এ বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। ম্যালকমের দৃষ্টিতে একমাত্র লক্ষণীয় বিষয় হলো কোন্ ব্যক্তি ও কোন্ গোত্র-বর্ণের মানুষ ঐ জাতির ওপর শাসনকার্য চালাচ্ছে। তাঁর দৃষ্টিতে সাধারণ মানুষ দাস ও শোষিত বা অন্য কোন্ অবস্থায় রয়েছে তা দেখার প্রয়োজন নেই। ম্যালকমের মত ব্যক্তিদের এ জন্য কোন আফসোস নেই ,হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মত লোকেরা কেন মানুষ হত্যা ও মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে: বরং তাঁর আফসোস হলো হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পরিবর্তে কেন এক ইরানী এরূপ কাজ করল না।

ইসলামের আবির্ভাবের পরবর্তী ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় ,সেসময় ইরানীদের মধ্যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির এক নব উদ্দীপনা জেগে উঠেছিল যাকে পানিবঞ্চিত তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির সন্ধানী তৎপরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েই তারা স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে প্রথম বারের মত অন্যান্য জাতির ধর্মীয় নেতৃত্ব অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম হতে সপ্তম হিজরী শতাব্দীর ঐ সকল ইরানী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের অভাবনীয় গ্রহণযোগ্যতা এখনও বিদ্যমান।

অন্যদিকে এই দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার ফলেই ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির বাইরেও গ্রীক ,ভারতীয ,মিশরীয় ও অন্যান্য জাতির জ্ঞান ও সংস্কৃতি এখানে আসার সুযোগ পায় এবং এর ওপর ভিত্তি করেই বৃহৎ ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার সৃষ্টি সম্ভব হয। এর ফলেই আবু আলী ,ফারাবী ,আবু রাইহান বিরুনী ,খাইয়াম (গণিতজ্ঞ) ,খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী ,মোল্লা সাদরাসহ এরূপ শত শত আরেফ (আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব) ,দার্শনিক ,সাহিত্যিক ,চিকিৎসক ,ভূগোলবিদ ,ঐতিহাসিক ,গণিতবিদ ও প্রকৃতি বিজ্ঞানীর প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

হাস্যকর বিষয় হলো পুর দাউদ বলেছেন ,যদি আরবদের আক্রমণ ও সেমিটিকদের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা না পেত তাহলে ইবনে সিনা ও খাইয়ামদের মত মনীষীরা নওরুজ নামে দানেশ নামে গ্রন্থদ্বয়ের ন্যায় গ্রন্থ রচনা করতেন এবং বর্তমানের ফার্সী ভাষা আরো সমৃদ্ধ হতো।

আমার প্রশ্ন হলো যদি আরবরা আক্রমণ না করত তবে যারথুষ্ট্র পুরোহিতরা যে দেয়াল তৈরি করে রেখেছিলেন তাতে ইরানীদের প্রতিভা বিকাশের কোন সুযোগই হতো না এবং কোন ইবনে সিনা ও খাইয়ামেরও জন্ম হতো না। ফলে দানেশ নামে , নওরুজ নামে এবং ফার্সী ভাষায় এরূপ সহস্র গ্রন্থও সৃষ্টি হতো না। ইরানী মনীষিগণ আরবী ও ফার্সী ভাষায় সহস্র গ্রন্থ বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন তা ঐ আরবদের হামলারই ফল। কারণ তারাই প্রতিটি মুসলমানের ওপর জ্ঞানার্জন অপরিহার্য ঘোষণার মাধ্যমে পূর্বের রচিত দেয়াল ভেঙ্গে দিয়ে ভিন্ন এক ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করিয়েছিল।

পুর দাউদের কথাটি এরূপ ,যদি দিনে সূর্য না উঠত তবে আমাদের মস্তিষ্কও উত্তপ্ত হতো না এবং আমরা সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবে সূর্য না উঠলে দিনেরও অস্তিত্ব থাকত না।

এ দু ধারা (অন্যান্য জাতির ওপর ধর্মীয় কর্তৃত্ব লাভ ও সহস্র মনীষীর জন্ম) শুধু বাহ্যিক এ দেয়াল ধ্বংসের ফলে দ্বার উন্মুক্ত হওয়ার কারণেই নয় ;বরং অন্য একটি কারণও এর পাশে বিদ্যমান ছিল। আর তা হলো ইরানের সাধারণ ও বঞ্চিত শ্রেণীর ওপর হতে শিক্ষা গ্রহণের যে নিষেধাজ্ঞা যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণ আরোপ করেছিলেন তা উপড়িয়ে ফেলা। ইসলাম সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ শ্রেণী বলে কিছু মানে না এবং জ্ঞানকে পুরোহিত বা সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে চর্মকার ও কর্মকার শিক্ষা লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়কের পুত্রের সমান অধিকার রাখে এবং এই শ্রেণী হতেই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়। এই অভ্যন্তরীণ প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও ঐ বাহ্যিক দেয়াল ভাঙ্গার কারণেই ইরানীরা অন্য জাতিসমূহেরও অগ্রদূত হওয়ার যোগ্যতা ও বিশাল ইসলামী সভ্যতা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার সুযোগ লাভ করে।

ইসলাম ইরানীদের আপন সত্তাকে চিনতে যেমন সাহায্য করে তেমনি বিশ্বকে তাদের নিকট পরিচিত করায়। পূর্বে বলা হতো ইরানীদের প্রতিভা ও যোগ্যতা শুধু সামরিক ক্ষেত্রেই সীমিত ,অন্যান্য বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই ,এ কথাটি সঠিক নয়। বিভিন্ন সময়ে ইরানীরা যে পিছিয়ে ছিল তা তাদের যোগ্যতার অভাবে নয় ;বরং তা প্রাচীন পুরোহিত শাসিত সমাজের শৃংখলে আবদ্ধতার কারণে ঘটেছিল। এ কারণেই ইসলামী আমলে ইরানীরা তাদের জ্ঞান-প্রতিভার উচ্চ অবস্থানকে প্রমাণে সক্ষম হয়েছিল।

প্রতিভা দমনকারী প্রাচীন পুরোহিত শাসনের কারণে কোন কোন বিদেশী ভুল করে গোঁড়া হতেই ইরানীদের প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রতি তিরস্কার করেছেন। যেমন গুসতাভ লুবুন বলেন ,

বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইরানীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকলেও সভ্যতার ইতিহাসে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নগণ্য। প্রাচীন ইরানীরা দু শত বছর পর্যন্ত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের অধিপতি হিসেবে জাঁকজমকপূর্ণ এক রাজকীয় সাম্রাজ্যের সৃষ্টি করে কিন্তু জ্ঞান ,সাহিত্য ,শিল্পকলা ও স্থাপত্যে তেমন কিছু দিতে পারেনি এবং পার্শ্ববর্তী জাতিসমূহের অবশিষ্ট যে সকল জ্ঞান ও শিল্প বিদ্যমান ছিল তার কোন উত্তরণও ঘটায় নি।... ইরানীরা সভ্যতার স্রষ্টা ছিল না ;বরং সভ্যতার বিস্তারক ছিল। এ দৃষ্টিতে সভ্যতার সৃষ্টিতে তাদের ভূমিকা ছিল নগণ্য। 181

ফরাসী ঐতিহাসিক কিলম্যান হাওয়ার তাঁর ইরানে বাসতানী ও তামাদ্দুনে ইরান গ্রন্থে বলেছেন ,

ইরান একটি সামরিক দেশ ছিল। তই সেখানে জ্ঞান ,শিল্প ও স্থাপত্যকলা বিকাশের কোন সুযোগ ছিল না। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের শিক্ষাঙ্গনে প্রশিক্ষিত গ্রীক চিকিৎসকগণ ইরানের একমাত্র জ্ঞানের ধারক ছিলেন। স্থাপত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রেও গ্রীক ,লিডীয় ও মিশরীয় স্থাপকগণই ছিলেন তাদের প্রতিনিধি । তাদের রাজকীয় হিসাবরক্ষকগণও ছিলেন সেমিটিক বংশোদ্ভূত ব্যাবিলনীয় বা আর্মেনীয়রা। 182

জে. রাও লিনসন তাঁর প্রাচ্যের পাঁচ বৃহৎ সাম্রাজ্য নামক গ্রন্থে বলেছেন ,

প্রাচীন ইরানীরা জ্ঞানের উন্নয়নে কোন ভূমিকাই রাখে নি। এ জাতির মন-মানসিকতা কখনই গবেষণার ন্যায় কর্মের জন্য ধৈর্য ধারণের উপযোগী ছিল না। জ্ঞানের বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য যে চিন্তা ,গবেষণা ও অনুসন্ধান প্রয়োজন তাদের নিকট তা পছন্দনীয় বিষয় ছিল না।...

ইরানীরা তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজত্বের প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কখনই জ্ঞানের বিষয়ে মনোযোগী ছিল না এবং ভাবত তাদের নৈতিক শক্তিকে প্রদর্শনের জন্য শুশের প্রাসাদ ,তাখতে জামশিদ (জামশিদ সিংহাসন) ,বৃহৎ রাজকীয় পরিচালনা পরিষদ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতাই যথেষ্ট। 183

সন্দেহ নেই এরূপ মন্তব্য তাঁদের অযৌক্তিক মন্দ ধারণার ফল। ইসলামপূর্ববর্তী প্রাচীন ইরানকে এরূপে উপস্থাপিত করা একরকম বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জিত বিষয় (এ বিষয়ে পরবর্তীতে আমরা পারস্য সভ্যতার মৌলিকতা শিরোনামে আলোচনা করব)। কারণ পুরোহিত শাসকদের গুনাহের বোঝা সাধারণ মানুসের কাঁধে চাপান ঠিক হবে না এবং তাঁদের কর্মের ত্রুটিকে ইরানীদের প্রতিভাহীনতা বলে চালানোও অযৌক্তিক। এর পক্ষে সর্বোত্তম প্রমাণ হলো ঐ জাতিই ইসলামী শাসনামলে তাদের প্রতিভা ও যোগ্যতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটিয়ে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে।

কিলম্যান184 ,গুসতাভ লুবুন ও রাও লিনসন ভুলবশত ইসলামী সভ্যতা কে আরব সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন ,অথচ ইসলামী সভ্যতা পারস্য বা ভারত সভ্যতার মত নয় (বরং এতে আরবদের ভূমিকা অন্যদের হতে কম এবং ইসলাম নতুন এক সভ্যতা নিয়ে এসেছিল যার সঙ্গে আরবদের তেমন কোন পরিচয়ই ছিল না)।

ইসলাম ইরানীদের বিষয়ে উপরোক্ত মন্তব্যগুলোকে ভুল প্রমাণিত করে। ইসলাম ইরানীদেরকে তাদের আপন সত্তাগত প্রতিভা ও যোগ্যতার সঙ্গে পরিচিত করায় ও বিশ্ববাসীকেও তা জানায়। অন্যভাবে বলা যায় ইরানীরা ইসলামের মাধ্যমে নিজেদের চিনতে পারে ও ইসলামকে অন্যদের নিকট পরিচিত করায়।

কেন ইসলামপূর্ব যুগে লাইস ইবনে সা দ ,নাফে ,আতা ,তাউস ,ইয়াহিয়া ও মাকহুলের ন্যায় অন্যান্য ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হলো না যাঁরা মিশর ,ইরাক ,তিউনিসিয়া ,মরক্কো ,হিজায ,ইয়েমেন ,সিরিয়া ,আলজিরিয়া ,ভারত ,পাকিস্তান ,ইন্দোনেশিয়া ,স্পেনসহ ইউরোপের একাংশের মানুষদের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতা হতে পারেন। কেন সেসময় মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযী ,ফারাবী ও ইবনে সীনার আবির্ভাব হয় নি ?

তৎকালীন ইরানী শাসক ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে ইসলাম তাদের ওপর এক আক্রমণ হিসেবে পরিগণিত হলেও ইরানের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে এটি সর্বাঙ্গীনভাবে এক বিপ্লব ছিল। ইসলাম ইরানীদের বিশ্বদৃষ্টির পরিবর্তন ঘটায়। ইরানীদের অন্তর হতে দ্বিত্ববাদ এবং তা হতে উৎসারিত সকল মন্দ চিন্তাকে দূরীভূত করে। কয়েক হাজার বছরের সেই দ্বিত্ববাদ যার সঙ্গে যারদুশত যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন ও তাঁর ধর্ম এর দ্বারা কলুষিত ও বিকৃত হয়ে পড়েছিল ইসলাম তাকে ইরানীদের অন্তর হতে দূরে ছুঁড়ে ফেলে ও ইরানীদের মস্তিষ্ককে পরিশোধিত করে।

একটি বিপ্লব কি করে ? অবশ্যই মানুষের বিশ্বদৃষ্টির পরিবর্তন ঘটায় ,তাকে নতুন লক্ষ্য ,পরিকল্পনা ও আদর্শের সঙ্গে পরিচিত করায় ,তার পূর্ববর্তী বিশ্বাসের পরিবর্তন সাধন করে ,সামাজিক অবকাঠামোর এমন পরিবর্তন ঘটায় যে ,পূর্বের কোন চিহ্নই না থাকে ,শোষকদের ওপর হতে টেনে নীচে নামায় ও শোষিতদের টেনে ওপরে ওঠায় ,মানুষের আচার-আচরণ ও চরিত্রের পরিবর্তন করে জীবন্ত করে তোলে ,বলপ্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষুব্ধ মনোভাবের জন্ম দেয় ,ঈমান ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে ,ধমনীতে নতুন রক্ত সঞ্চারিত হয়। ইসলামের আবির্ভাবের ফলে ইরানে কি তাই ঘটেনি ?

তাঁরা বলেন তরবারী দিয়ে তা করা হয়েছে। হ্যাঁ ,তরবারীর সাহায্য নিয়েই তা করা হয়েছে ,কিন্তু ইসলামের তরবারী কি করেছে ? ইসলামের তরবারী শয়তানের শক্তিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে ,পুরোহিতদের অনিষ্টকারী ছায়াকে কর্তিত করেছে ,চৌদ্দ কোটি মানুষের গর্দান হতে শিকল ছিন্ন করেছে ,বঞ্চিত ও মানুষেদের মুক্তি ও স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলামের তরবারী সব সময় বলদর্পীদের হাতকে কর্তন করেছে ও অত্যাচারীদের মস্তকের ওপর নিপীড়িতের সাহায্যে আপতিত হয়েছে। ইসলামের তরবারী সব সময় শোষিত ও বঞ্চিতদের পক্ষে কাজ করেছে। কোরআন বলেছে ,

) و ما لكم لا تقاتلون في سبيل الله و المستضعفين من الرّجال و النساء و الولدان(

তোমাদের কি হয়েছে যে ,তোমরা সংগ্রাম করছ না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য ? (সূরা নিসা: 75)

ইসলাম ইরান হতে দ্বিত্ববাদ ,অগ্নি ,সূর্য ও হুমের উপাসনাকে উচ্ছেদ করে তাওহীদ ও খোদা উপাসনা উপহার দিয়েছে। এ দৃষ্টিতে আরবের চেয়ে ইরানে ইসলামের অবদান অধিকতর মূল্যবান। কারণ ইসলাম আরবদের উপাসনার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের জাহেলিয়াত হতে মুক্তি দেয় ,কিন্তু ইরানীদের সৃষ্টিকর্তার চিন্তার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব হতে মুক্তি দিয়েছিল।

ইসলাম শৃঙ্গ ও ডানাযুক্ত ,গোঁফ ও শ্মশ্রুমণ্ডিত ,হাতে ছড়ি বা দণ্ডধারী ,জোব্বা পরিহিত ,কুঞ্চিত কেশ ও খাঁজকাটা মুকুট পরিহিত খোদার অস্তিত্বের চিন্তাকে চিরস্থায়ী185 ,নিরাকার ,সকল ধারণা ,কল্পনা ও তুলনার ঊর্ধ্বে এক মহান ও সম্মানিত অস্তিত্বের চিন্তায় রূপান্তরিত করে। ইসলাম তাদের এমন খোদার সঙ্গে পরিচিত করায় যিনি বর্ণনার ঊর্ধ্বে186 ,তিনি সকল কিছুর সঙ্গে আছেন187 ,কিন্তু সকল কিছু তাঁর সঙ্গে নেই ,তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ ,তিনিই গুপ্ত ও প্রকাশ্য188 ,তিনি সকল কিছুকে দেখেন কিন্তু কেউ তাঁকে দেখে না189

ইসলাম সত্তাগত ,কর্মগত ও গুণগত একত্ববাদের সর্বোত্তম রূপকে ইরানী অ-ইরানী সকল মুসলমানকে শিখিয়েছে। ইসলাম একত্ববাদকে তার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। এর যেমন দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে তেমনি এটি চিন্তার সবচেয়ে গতিশীল উদ্দীপক হিসেবে পরিগণিত।

ইসলাম যারথুষ্ট্র ধর্মের সকল কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণা যেমন আহুরামাযদা ও আহ্রিমানের নয় হাজার বছরব্যাপী যুদ্ধ ,সন্তান ধারণের লক্ষ্যে যারওয়ানের এক হাজার বছর ধরে কুরবানী করা ,দিভদের (দৈত্যদের) প্রার্থনা কবুল হওয়া ,অগ্নি উপাসনার আশ্চর্যজনক আচার-অনুষ্ঠান ,মৃতদের জন্য ছাদের ওপর মদ্যপান ,অগ্নির মধ্যে বন্য প্রাণী ও পাখি নিক্ষেপ ,মাসে চার বার সূর্য ও চন্দ্রের উপাসনা ,অগ্নির ওপর আলোর পতন প্রতিরোধ ,মৃতদের দাফন না করা ,মৃত ব্যক্তি ও নারীদের অপবিত্র দেহে হাত দেয়ার কঠিন আচার ,গরম পানিতে গোসল নিষিদ্ধকরণ ,গরুর প্রস্রাব দ্বারা পবিত্রকরণ এবং এরূপ হাজারো বিষয়কে ইরানীদের চিন্তা ও কর্মজীবন হতে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।

ইসলাম অগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে অনর্থক বুলি আওড়ানো ,মন্ত্র পড়ার সাথে সাথে অগ্নিকে নাড়াচাড়া করা ,অগ্নির সম্মুখে মুখ বেঁধে অবনত হওয়ার মতো অর্থহীন ইবাদাতসমূহের স্থলে যুক্তিপূর্ণ ,নৈতিকতা ও পূর্ণতার পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরতম রূপের ইবাদাতকে প্রতিস্থাপন করে। ইসলামের নামায ,রোযা ,হজ্ব ,জুমআ ,জামায়াত ,মসজিদ ,ধর্মীয় সমাবেশ ,জিক্র ও দোয়াসমূহ প্রজ্ঞা ও জ্ঞানপূর্ণ হিসেবে তার উচ্চ মর্যাদার সাক্ষী।

ইসলাম মাযদাকী ,মনী ,যারথুষ্ট্র ও খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা অর্থাৎ দেহ ও আত্মার সৌভাগ্যের ভিন্ন পথ ,দুনিয়া ও আখেরাতের কর্মের বিপরীত অবস্থান ,কঠোর সাধনার দর্শন ,কঠিন আচার-অনুষ্ঠান ,বৈবাহিক জীবনের প্রতি অনীহা ,মনাভী ও মাযদাকী ধর্মের পুরোহিত এবং খ্রিষ্টধর্মের ধর্মযাজকদের (পোপ ও কার্ডিনালদের) অবিবাহিত থাকা ইত্যাদিকে সভ্যতার শত্রু হিসেবে গণ্য করে। ইসলাম ইরানে প্রসারমান এরূপ শিক্ষাকে ইরানের ভূমি হতে বিতাড়িত করে আত্মিক পরিশুদ্ধির190 সঙ্গে পৃথিবীর পবিত্র নিয়ামত হতে উপভোগের শিক্ষার191 প্রচলন ঘটায়।

ইসলাম তৎকালীন সময়ে প্রচলিত রক্ত ও মালিকানার ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রাচীন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং ঐ দু য়ের আবর্তে কেন্দ্রীভূত আইন ,সামাজিক রীতি ও আচার-অনুষ্ঠানকে বিলুপ্ত করে শ্রেণীহীন এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে যার কেন্দ্র ছিল জ্ঞান ,কর্মপ্রচেষ্টা ,তাকওয়া ,আত্মসম্মানবোধ ও মর্যাদা।

ইসলাম বংশগত উত্তরাধিকারভিত্তিক বিশেষ শ্রেণীর পেশাদার পুরোহিত ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে। ফলে সকল শ্রেণী হতেই ধর্মীয় আলেম হওয়ার সুযোগ ঘটে এবং জ্ঞান ও তাকওয়ার মৌল ভিত্তিতে তাদের সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়।

ইসলাম ঐশী বংশধারার বাদশাগণের রাজত্বের ধারণাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে। ক্রিস্টেন সেন বলেছেন:

সাসানী সম্রাটগণ তাঁদের শিলালিপিগুলোতে নিজেদের মাযদার উপাসক বলে উল্লেখ করলেও নিজেদেরকে ঐশী বলে দাবি করে স্রষ্টা ইয়াসদান বংশোদ্ভূত পরিচয় দান করতেন। 192

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ,

দ্বিতীয় খসরু (পারভেজ) নিজেকে তাই মনে করতেন ও নিজেকে খোদাগণের মাঝে আদমরূপী অবিনাশী এবং মানুষের মাঝে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এক খোদা বলে পরিচয় দিতেন। 193

এডওয়ার্ড ব্রাউন বলেছেন ,

সম্ভবত সাসানী আমলের ইরানের ন্যায় কোন রাজত্বেই সম্রাটগণের ঐশী বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়ে দৃঢ়তর বিশ্বাসসম্পন্ন প্রজাকুল বিদ্যমান ছিল না। নাওলাদকা বলেছেন: বাহরাম চুবিনের ন্যায় যাঁরাই সম্রাটের বংশধারার না হয়ে অভিজাত অন্য কোন বংশীয় হিসেবে রাজত্ব দাবি করেছেন এ দেশের মানুষ তাঁর অবাধ্য হয়ে বিদ্রোহ করেছে। শাহর বারাজের রাজত্ব লাভের বিষয়টি তাই অনেকটা অবিশ্বাস্য ও তাঁর লজ্জাহীনতার পরিচায়ক।

ইরানীরা এরূপ চিন্তায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে ,শুধু এক বংশধারাই এ দেশে রাজত্বের যোগ্যতা রাখে। এডওয়ার্ড ব্রাউন বাহরাম চুবিনের পলায়নের প্রসিদ্ধ কাহিনীতে তাঁর সঙ্গে পথিমধ্যে এক বৃদ্ধা রমনীর কথোপকথনের ঘটনায় স্বর্গীয় বংশধারার না হওয়া সত্ত্বেও রাজত্ব দাবির কারণে তিরস্কৃত হওয়ার বিষয়টি এনেছেন। ডক্টর মাহমুদ সাজারী অযাদীয়ে ফারদ ওয়া কুদরাতে দৌলাত নামক গ্রন্থে ইউরোপীয় কিছু দার্শনিক যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাজকীয় পাদমর্যাদা ঐশী বলে মনে করেন সে সম্পর্কে বলেছেন , এ মতটি নতুন নয় ;বরং এর মূলকে আমাদের (ইরানের) ইতিহাসেই খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীন ইরানীরা এরূপ মতেই বিশ্বাসী ছিল। 194

ইসলাম এই ইতিহাসকেও ব্যাপকভাবে পাল্টিয়ে দেয়। ইসলামে রাজকীয় বংশোদ্ভূত বলে কিছু নেই। ইসলাম কাঁসা শিল্পী ,জেলে ,দাস ,দরবেশ195 ও ফকির সকলের মধ্যেই এরূপ প্রতিভা ও যোগ্যতা রয়েছে বলে মনে করে। যদি কারো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও সাহস থাকে সে তাতে পৌঁছতে পারে। তাই ইসলামী শাসনামলে যাঁরা আত্মনির্ভরভাবে রাজত্ব লাভ করেছেন তা তাঁদের যোগ্যতার বলেই অর্জন করেছেন ,বংশের কারণে নয়।

ইসলাম ইরানীদের মধ্য হতে এ চিন্তার অপনোদন ঘটায় যে ,ধর্মীয় পুরোহিত ও আলেমগণ এক বংশীয় হতে হবে। ইসলাম অভিজাত শ্রেণীর শাসন ব্যবস্থার চিন্তা ইরানীদের মস্তিষ্ক হতে মুছে দিয়ে সর্বজনীন ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটায়।

ইসলাম নারীদের আইনগত অধিকার দান করে। শর্ত ও বিধিহীনভাবে অসংখ্য স্ত্রী রাখার বিষয়টির বিলোপ সাধন করে তদস্থলে নারী ও স্ত্রীদের সম অধিকারের ভিত্তিতে পুরুষের সক্ষমতার আলোকে সীমিত পরিসরে সামাজিক প্রয়োজনীয়তার খাতিরে একাধিক বিবাহের অনুমোদন দেয়।

ইসলাম স্ত্রীকে ভাড়া বা বন্ধক দেয়া ,প্রতিস্থাপন বিবাহ ,অন্যের ঔরসে নিজ স্ত্রীর গর্ভের

সন্তানকে নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত করা ,মাহ্রাম বিবাহ ,স্ত্রীর ওপর স্বামীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রভৃতি রীতিকে অবৈধ ও হারাম ঘোষণা করে।

যে সকল ইরানী মুসলমান হয়েছিল তাদের জন্যই শুধু নয় ,ইসলাম যারথুষ্ট্র ধর্মের জন্য অশেষ বরকত বয়ে আনে। পরোক্ষভাবে ইসলাম যারথুষ্ট্র ধর্মের গভীরে সংস্কার সাধন করে। এ বিষয়ে আমরা ক্রিস্টেন সেন থেকে বর্ণনা করেছি যে ,ইসলাম যখন যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণের পৃষ্ঠপোষক সাসানী সাম্রাজ্যের পতন ঘটায় তখন যারথুষ্ট্র পুরোহিতগণ উপলব্ধি করলেন এ ধর্মকে ধ্বংস ও পতন হতে রক্ষা করতে হলে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। তাই যারওয়ানী ধারণাসহ অন্যান্য শিশুসুলভ কাল্পনিক বিশ্বাসসমূহকে বাদ দিলেন ,সূর্য উপাসনা পরিত্যাজ্য ঘোষণা করলেন। ধর্মীয় অসংখ্য বিবরণ হয় পরিবর্তন করা হলো নতুবা পুরোটাই বাদ দেয়া হলো। সাসানী আভেস্তা ও এর ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহের যে অংশ যারওয়ানী ধারণামিশ্রিত ছিল তা গ্রন্থাগারের তাকেই পরিত্যাগ অথবা ধ্বংস করা হলো...।

ইরানে ইসলামের অবদান প্রথম দিকের (হিজরী) শতাব্দীগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না ;বরং এ দেশে যে দিন হতে ইসলামের ছায়া পড়েছে সে দিন হতে এ দেশের জন্য যত বিপদই এসেছে ইসলামের মাধ্যমে তা প্রতিহত হয়েছে। ইসলামই মোগলদেরকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে মানব হত্যাকারী হতে জ্ঞানপ্রেমিকে পরিণত করেছে। ইসলামই চেঙ্গিস খাঁনের বংশধর হতে মুহাম্মদ খোদাবান্দের ন্যায় ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং তৈমুর লং-এর বংশধর হতে বৈসংকর ও আমির হোসেন বৈকরার মত শাসকদের সৃষ্টি করেছিল।

আজও বিদেশীদের ধ্বংসাত্মক দার্শনিক চিন্তার বিপরীতে ইসলাম আমাদের টিকিয়ে রেখেছে এবং আমাদের মধ্যে আত্মসম্মান ,মর্যাদাবোধ ও স্বাধীনতার অনুভূতিকে জিইয়ে রেখেছে। ইরান জাতি আজ যা নিয়ে গর্ব করতে পারে তা হলো কোরআন ও নাহজুল বালাগাহ্ ;আভেস্তা ও যান্দ নয়।

আমরা ইরানে ইসলামের অবদান শীর্ষক আলোচনা এখানেই শেষ করছি। এর পরবর্তী অংশে আমরা ইসলামে ইরানের অবদান নিয়ে আলোচনা করব।


16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35