ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান8%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 112223 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

আহলে সুন্নাতের তাফসীর গ্রন্থসমূহ :

১. জামেউল বায়ান ফি তাফসীরিল কোরআন: এই তাফসীর গ্রন্থটি তাফসীরে তাবারী নামে প্রসিদ্ধ এবং এর রচয়িতা হলেন প্রসিদ্ধ ফকীহ্ ,মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ইবনে জারীর তাবারী। তাবারী আহলে সুন্নাতের প্রথম সারির আলেমগণের একজন। তিনি তাঁর সময়ের অধিকাংশ ইসলামী জ্ঞানের পণ্ডিত ছিলেন ও এ ক্ষেত্রে অন্যদের পুরোধা হিসেবে পরিগণিত হতেন। তাবারী প্রথম জীবনে শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হলেও পরবর্তী জীবনে স্বতন্ত্র ফিকাহর প্রবর্তন করেন এবং চার মাযহাবের কোন ইমামেরই অনুসরণ হতে বিরত হন। তাঁর মাযহাব কিছুদিন পর বিলুপ্ত হয়। ইনবুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বেশ কিছু ফকীহর নাম বলেছেন যাঁরা তাবারী ফিকাহর অনুসরণ করতেন।

তিনি ইরানের মাযেনদারানের আমুলের অধিবাসী ছিলেন । তিনি ২২৪ হিজরীতে জন্মগ্রহণ ও ৩১০ হিজরীতে বাগদাদে মৃত্যুবরণ করেন। তাফসীরে তাবারী প্রথম মিশরে মুদ্রিত হয়। তাফসীরটি সামানী শাসক নূহ ইবনে মনসুরের নির্দেশে তাঁর আরব বংশোদ্ভূত মন্ত্রী বালাআমী কর্তৃক ফার্সী ভাষায় অনূদিত হয়। তাবারীর ফার্সী অনূদিত তাফসীরটি সম্প্রতি তেহরান হতে মুদ্রিত হয়েছে।

২. কাশশাফ: আহলে সুন্নাতের তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ তাফসীর। সাহিত্যিক দৃষ্টিতে বিশেষত অলংকারশাস্ত্রের দিক দিয়ে তাফসীরটি অনন্য। এ তাফসীরের রচয়িতা হলেন আবুল কাসেম মাহমুদ ইবনে উমর যামাখশারী খাওয়ারেজমী যিনি জারুল্লাহ্ উপাধি লাভ করেছিলেন । যামাখশারী ইসলামের প্রথম সারির আলেমদের একজন। তিনি সাহিত্য ,হাদীস ও উপদেশমূলক অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। যদিও তিনি ইরানের উত্তরাঞ্চলের তীব্র শীত প্রধান অঞ্চল খাওয়ারেজমের অধিবাসী তদুপরি দীর্ঘদিন মক্কায় বসবাস করেন ও মক্কার তীব্র উষ্ণতা সহ্য করেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন আল্লাহর গৃহের সান্নিধ্য নৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন কাবাগৃহের নিকট ছিলেন সেহেতু আল্লাহর প্রতিবেশী বা জারুল্লাহ্ উপাধি প্রাপ্ত হন। সম্ভবত তিনি সেখানে অবস্থানকালেই তাফসীরে কাশশাফ রচনা করেন। যামাখশারী তাঁর তাফসীর গ্রন্থ কাশশাফের ৩য় খণ্ডে সূরা আনকাবুতের ৫৬ নং আয়াতيا عبادي الّذين آمنوا إنّ أرضي واسعة فإيّي فاعبدون - হে আমার ঈমানদার বান্দাগণ! আমার পৃথিবী প্রশস্ত। অতএব ,তোমরা আমারই ইবাদত কর -এর ব্যাখ্যা দান করে বলেছেন ,মুমিনদের অবশ্যই ইবাদত ও দীনকে রক্ষার স্বার্থে সবচেয়ে উপযোগী ভূমি নির্বাচন করা উচিত। অতঃপর তিনি বলেছেন ,

আমার প্রাণের শপথ! স্থানসমূহের মধ্যে দৃষ্টিতে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমরা যেমন পরীক্ষা করে দেখেছি আমাদের পূর্ববর্তিগণও পরীক্ষা করে দেখেছেন যে ,আল্লাহর হারাম (কাবা ঘর) ও এর নিকটবর্তী থাকার প্রভাব খুবই বেশি । বিশেষত প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ ,চিন্তার স্থিরতা ও মনোযোগ এবং আত্মিক পরিতৃপ্তিতে...।

যামাখশারী এরপর শীতকালে জ্ঞানসংশ্লিষ্ট কোন এক কাজের উদ্দেশ্যে খাওয়ারেজমে প্রত্যাবর্তন করেন ও দুর্ভাগ্যক্রমে এক পা হারান। কিন্তু এ অবস্থায়ই ক্রাচে ভর করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মক্কায় পৌঁছান ও কয়েক বছর কাবার নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান করেন। যামাখশারী ৪৬৭ হিজরীতে জন্মগ্রহণ এবং ৫৩৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৩. তাফসীরে কাবীর বা মাফাতিহুল গাইব: এ তাফসীর গ্রন্থটি মুহাম্মদ ইবনে উমর ইবনে হুসাইন ইবনে হাসান ইবনে আলী কর্তৃক রচিত। তিনি ফাখরে রাযী নামে প্রসিদ্ধ।

ফাখরে রাযী ইসলামের প্রসিদ্ধ আলেমদের অন্যতম। তাঁর তাফসীর ,কালামশাস্ত্র ও দর্শন বিষয়ে বিভিন্ন মত শিয়া-সুন্নী সকলের মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি মাযেনদারানে জন্মগ্রহণ এবং পরবর্তীতে রেই শহরে বসতি স্থাপন করেন। তিনি হেরাত ও খাওয়ারেজমেও গিয়েছিলেন। জীবদ্দশায়ই তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। রাযী ৫৪৩ হিজরীতে জন্মগ্রহণ এবং ৬০ হিজরীতে হেরাতে ইন্তেকাল করেন।

৪. গারাইবুল কোরআন: এই তাফসীরটি তাফসীরে নিশাবুরী নামে প্রসিদ্ধ এবং আহলে সুন্নাতের প্রথম সারির তাফসীরসমূহের অন্যতম। হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হুসাইন নিযামে নিশাবুরী তাফসীরটি রচনা করেন। নিযাম কোমের অধিবাসী হলেও নিশাবুরে বাস করতেন। তিনি পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি সাহিত্য ও গণিতশাস্ত্রেও গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি ৭৩০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৫. কাশফুল আসরার: দশ খণ্ডের এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় লিখিত। কয়েক বছর পূর্বে তেহরানে এটি মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি আবুল ফাযল রশীদ উদ্দিন মাইবাদী ইয়াযদী কর্তৃক রচিত। তিনি পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ হতে ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। বিশেষজ্ঞদের নিকট তাফসীরটি সমাদৃত হচ্ছে।

৬. আনওয়ারুত তানযীল ওয়া আসরারুত তাভীল: এ তাফসীরটি তাফসীরে বাইদাভী নামে প্রসিদ্ধ। এটি আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর ইবনে আহমাদ কর্তৃক রচিত যিনি ইরানের বাইদার (বাইযা) অধিবাসী ও সেখানকার কাজী (বিচারক) ছিলেন। তাঁর তাফসীরটি তাফসীরে কাবীর ও কাশশাফের সমন্বিত ও সংক্ষিপ্ত উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে রচিত। মরহুম ফাইয কাশানী তাঁর তাফসীরে সাফীতে এ তাফসীর গ্রন্থ হতে সাহায্য নিয়েছেন। মরহুম শেখ বাহায়ীও এই তাফসীরটির ওপর টীকা লিখেছেন। বাইদ্বাভী আল্লামা হিল্লী ও বিশিষ্ট গবেষক নাসিরুদ্দীন তুসীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সপ্তম হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন।

৭. তাফসীরে ইবনে কাসির: এটি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনে কাসির কর্তৃক প্রণীত যিনি তাঁর আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া নামক ইতিহাস গ্রন্থের জন্য প্রসিদ্ধ। তাঁর উপনাম হলো আবুল ফিদা। তিনি কোরেশ বংশোদ্ভূত ,ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ও সিরিয়ার অধিবাসী। তিনি ৭৭৪ হিজরীতে মারা যান। তাঁর তাফসীর গ্রন্থটি কায়রো হতে প্রকাশিত হয়েছে।

৮. দুররুল মানসুর: তাফসীরটি ইসলামের সবচেয়ে জ্ঞানী আলেমদের অন্যতম ও সর্বাধিক গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ুতী কর্তৃক রচিত। তাঁর কিছু গ্রন্থ খুবই মুল্যবান যেমন , আল ইতিকান ফি উলুমিল কোরআন । দুররুল মনসুর একটি হাদীসনির্ভর তাফসীর অর্থাৎ আয়াতসমূহকে হাদীস দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ দৃষ্টিতে তাফসীরটি আহলে সুন্নাতের অনন্য একটি তাফসীর। দুররুল মানসুর হাদীসনির্ভর তাফসীরের দৃষ্টিকোণ হতে শিয়াদের তাফসীরে বুরহানের অনুরূপ।

সুয়ূতী মিশরের অধিবাসী। রাইহানুতুল আদাব গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের ১৪৮ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে যে ,তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে কোরআন হেফয করেছিলেন। একই গ্রন্থে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা উনআশি বলে উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর মৃত্যু ৯১০ অথবা ৯১১ হিজরীতে।

৯. তাফসীরে জালালাইন: এ তাফসীরটি দু ব্যক্তির দ্বারা লিখিত। সূরা ফাতেহা হতে সূরা কাহাফ পর্যন্ত (কোরআনের প্রায় অর্ধাংশ) ইয়েমেনের বিশিষ্ট শাফেয়ী আলেম জালালউদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে ইবরাহীম মাহাল্লী কর্তৃক রচিত। তিনি ৮৬৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করলে কোরআনের পূর্ণ তাফসীর করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর আল্লামা জালালউদ্দীন সুয়ূতী আল্লামা মাহাল্লাীর অনুসৃত পথেই কোরআনের বাকী অংশ অর্থাৎ সূরা কাহাফ হতে সূরা নাস পর্যন্ত তাফসীর রচনা পূর্ণ করেন। এ কারণেই তাফসীরটি তাফসীরে জালালাইন নামে পরিচিত হয়।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের রচয়িতার বর্ণনা মতে এ তাফসীরটি ভারত ,ইরান ও মিশরে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে।

১০. তাফসীরে কুরতুবী: এ গ্রন্থটি আবু বকর সায়েনউদ্দীন ইয়াহিয়া ইবনে সা দুন আন্দালুসী কর্তৃক রচিত। তিনি তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ,মুহাদ্দিস ,ব্যাকরণবিদ ও ভাষাবিদ হিসেবে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন । কুরতুবী স্পেনের (আন্দালুস) অধিবাসী ছিলেন ও ৫৬৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

১১. এরশাদুল আকলিস সালিম ইলা মাযাইয়াযল কোরআনুল কারিম (তাফসীরে আবুস সাউদ নামে প্রসিদ্ধ): এটি আবুস সাউদ কর্তৃক রচিত যিনি দশম হিজরী শতাব্দীর উসমানী আলেমদের একজন। সুলতান দ্বিতীয় বাইজিদ এ তাফসীরের কারণে তাঁকে সম্মানিত করেন।

তিনি ৯৬২ হিজরীতে উসমানী খেলাফতের প্রধান বিচারক ও মুফতী হিসেবে শাইখুল ইসলাম খেতাবে ভূষিত হন। তাঁর তাফসীরটি কায়রো হতে পুনঃপুন মুদ্রিত হয়েছে। আমি এ তাফসীরটি দেখিনি তবে আমাদের সমকালীন প্রথম সারির অনেক শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ এ তাফসীরটির মূল্য দেন। আবুস সাউদ ৯৮২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

১২. রূহুল বায়ান: এ তাফসীরটি আরবী-ফারসী মিশ্রিত। প্রচুর ফার্সী এরফানী কবিতা এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। উসমানী আলেমদের অন্যতম শেখ ইসমাঈল হাককী তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি ইস্তাম্বুলে দীনী শিক্ষা ও ওয়াজ মাহফিল চালাতেন। অতঃপর তুরস্কের অপর শহর বুরুসায় যান। তিনি সুফী ধারার একজন আলেম ছিলেন এবং তাঁর তাফসীরেও এর প্রভাব রয়েছে। সুফী বিশ্বাসের কারণে তিনি তাঁর সমকালীন অনেকের দ্বারাই মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি ১১২৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

১৩. রূহুল মায়ানী: সাইয়্যেদ মাহমুদ ইবনে আবদুল্লাহ্ বাগদাদী হাসানী হুসেইনী এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি আলুসী নামে প্রসিদ্ধ। আলুসী শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী হলেও অনেক বিষয়েই হানাফী ফিকাহর অনুসরণ করতেন। তিনি হযরত আলী (আ.)-এর প্রশংসায় আবদুল বাকী মৌসেলী রচিত কাসীদায়ে আইনিয়ার ব্যাখ্যা লিখেন। এই কাসীদাটি প্রসিদ্ধ আলেম সাইয়্যেদ কাযিম রাশতীও ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কাসীদাগ্রন্থটি শারহুল কাসীদা নামে পরিচিত। আলুসী ইরাকের অধিবাসী ছিলেন। আলুস ইরাকের একটি স্থান যা ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর তীরে অবস্থিত। আলুসী ১২৭০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

১৪. ফাতহুল কাদীর: এ তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ শাওকানী ইয়ামানী রচিত। শাওকানী ইয়েমেনের সানআ শহরে বড় হয়েছেন এবং সেখানেই শিক্ষা ও ফতোয়া দান শুরু করেন। তাঁর প্রসিদ্ধ একটি গ্রন্থের নাম নাইলুল আওতার মিন আসরারে মুনতাকাল আখবার । তাঁর প্রসিদ্ধি এ গ্রন্থের কারণেই। শাওকানী ১২৫০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

ওপরে যে চৌদ্দটি তাফসীরের নাম উল্লেখ করেছি সম্ভবত এগুলো তেরশ শতাব্দী পর্যন্ত আহলে সুন্নাতের সবচেয়ে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ। চৌদ্দশ শতাব্দীতেও তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অনেক তাফসীর রচিত হয়েছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। উপরোক্ত চৌদ্দটি তাফসীরের মধ্যে ছয়টির রচয়িতা হলেন ইরানী। ইরানীদের রচিত তাফসীরগুলোর কয়েকটি প্রথম সারির এবং এর অধিকাংশই সপ্তম হিজরী শতাব্দীর পূর্বে রচিত। এ চৌদ্দজনের দু জন ইয়েমেনের ,দু জন উসমানী সাম্রাজ্যভুক্ত অংশের ,একজন স্পেনের ,একজন সিরীয় ,একজন মিসরীয় ও একজন ইরাকী।

সুতরং দেখা যাচ্ছে তাফসীর ও কেরাআতশাস্ত্রে ইরানীদের প্রাধান্য ও মূল্যবান অবদান রয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ইরানী মুসলমানগণ অন্যদের চেয়ে অধিক ঈমান ,ইখলাস ,একাগ্রতা ও আগ্রহ পোষণ করেছে।

কেরাআত ও তাফসীর

ইসলামী জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জ্ঞানটি উৎপত্তি লাভ করে তা হলো কেরাআত ,অতঃপর তাফসীর। কেরাআত কোরআনের শব্দমালার উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তাফসীর পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান।

কেরাআতশাস্ত্রে কোরআন পঠনে ওয়াক্ফ ,ওয়াস্ল ,মাদ ,তাশদীদ ,ইদগাম প্রভৃতির নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা করা হয়। এ শাস্ত্রে কোরআনের কোন কোন শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

সাহাবীরা নবী (সা.)-এর নিকট হতে কোরআন শিক্ষা করতেন ,কোন কোন সাহাবীকে রাসূল সরাসরি কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং অন্যদের শিক্ষা দানের জন্য তাঁদের প্রেরণ করতেন। তাবেয়ীরা (যাঁরা রাসূলের সময়ে ছিলেন না ও তাঁর সাহচর্য লাভ করেননি) সাহাবীদের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এ যুগেই কেরাআতশাস্ত্রের একদল বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয় যাঁরা সঠিকভাবে কোরআন পাঠ শিক্ষা দান শুরু করেন। সাধারণ মুসলমান যাদের সংখ্যা সে সময় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা পরম আগ্রহ নিয়ে কোরআন শিক্ষা করত এবং এই সকল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতো। এ বিশেষজ্ঞগণ কোন ইমাম বা সাহাবীর সূত্রে কোরআন পাঠ প্রক্রিয়া বর্ণনা করতেন। তাঁরাও নিজ পদ্ধতিতে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করতেন। তাঁদের ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণ কি ? রাসূল (সা.)-এর সময়েও কি এ বিষয়ে ভিন্নতা ছিল ? স্বয়ং নবী কি কোরআনের কিছু কিছু শব্দকে কয়েকভাবে পঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন বা কোরআনের কিছু শব্দ কি বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির মাধ্যমে নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ? নাকি অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় যে বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণে পঠনে ভিন্নতার সৃষ্টি হয় কোরআনেও তেমনটি হয়েছে ? এ বিষয়গুলো অন্যত্র আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত ,নবী (সা.) যেরূপে কোরআন পাঠ ও তেলাওয়াত করতেন মুসলমানরা সেরূপেই তা পাঠ ও তেলাওয়াত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। যে সকল ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাসূলের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাই তারা তাঁদের নিকট হতে কোরআন পাঠ শিক্ষাগ্রহণ করতেন।

প্রথমদিকে কারিগণ মৌলিকভাবে শুনে ও মুখস্থ করে শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখতেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ বিষয়ে গ্রন্থ সংকলিত ও লিখিত হয়।

কেউ কেউ দাবি করেছেন ,এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আবু উবাইদা কাসেম ইবনে সালাম (মৃত্যু 224 হিজরী) একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন এজন্য যে ,এর একশ বছর পূর্বেই সাতজন প্রসিদ্ধ কারীর (কোররায়ে সাবআ) একজন হামযা ইবনে হাবিব- যিনি শিয়া ছিলেন ,কোরআন পাঠ পদ্ধতির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তদুপরি এ সম্পর্কিত গবেষণায় আয়াতুল্লাহ্ হাসান সাদর ইবনুন্ নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও নাজ্জাশীর ফেহেরেস্ত গ্রন্থ হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শিষ্য ও সাহাবী আবান ইবনে তাগলিব এরও পূর্বে এ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি আরো প্রমাণ করেছেন ,সর্বপ্রথম আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কোরআন সংকলন করেন এবং তাঁরই শিষ্য ও সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালী কোরআনে প্রথম নুকতাহ সংযোজন করেন।257 সর্বপ্রথম কোরআন পঠন পদ্ধতির ওপর আবান ইবনে তাগলিব গ্রন্থ লিখেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনের অর্থ ও কঠিন শব্দসূমহের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বপ্রথম কোরআনের ফযিলত বর্ণনা করে গ্রন্থ রচনা করেন প্রসিদ্ধ সাহাবী ও হযরত আলীর অনুসারী উবাই ইবনে কা ব (রা.)। কোরআনের রূপক শব্দসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন তিনি হলেন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ ফাররা যিনি একজন ইরানী শিয়া ছিলেন। সর্বপ্রথম কোরআনের বিধিবিধান নিয়ে যিনি গ্রন্থ লিখেন তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী। সর্বপ্রথম তাফসীর গ্রন্থ লিখেন সাঈদ ইবনে যুবাইর।258

যা হোক প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর তাবেয়িগণ ও তাদের ছাত্রদের মধ্য হতে দশ ব্যক্তি কোরআন পঠন পদ্ধতিতে (কেরাআতশাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে কোররায়ে সাবআ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন নাফে ইবনে আবদুর রহমান ,আবদুল্লাহ্ ইবনে কাসির ,আবু আমর ইবনুল আলা ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ,আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ ,হামযা ইবনে হাবিব এবং আলী কিসায়ী।

এই সাতজনের চারজনই হলেন ইরানী এবং তাঁদের দু জন হলেন শিয়া। অ-ইরানী তিনজন কারীর দু জনও শিয়া অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর মধ্যে চারজন শিয়া। আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থের 346 পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল জলিল রাযী-এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন কেরাআতশাস্ত্রের পুরোধাদের সকলেই আদলীয়াদের (শিয়া ও মুতাযিলা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ,হোক তিনি কুফা ,বসরা ,মক্কা ,মদীনা বা অন্য কোন স্থানের অধিবাসী।

চার প্রসিদ্ধ ইরানী কারী হলেন :

1. আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ একজন ইরানী। তিনি আবু আবদুর রহমান সালামীর নিকট কেরাআত শিক্ষা করেছেন। আবু আবদুর রহমান হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন। আছেমের কেরাআতকে প্রসিদ্ধতম কেরাআত মনে করা হয়। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে বলা হয়েছে , কোরআনের মূল লিখন ও পঠন পদ্ধতিটি সাধারণত আছেমের অনুকরণে লিখা হতো এবং অন্যান্য কারীদের কেরাআতের ধরন নিম্নে লাল কালি দ্বারা কারীর নাম উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করা হতো।259 আসেম কুফায় থাকতেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাজালিসুল মুমিনীন গ্রন্থের লেখকসহ আরো কিছু গবেষক ,যেমন আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর শিয়া হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বলেছেন। তিনি 130 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

2. নাফে ইবনে আবদুর রহমান সম্পর্কে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বলেছেন , তিনি ইরানের ইসফাহানের লোক হলেও মদীনায় বাস করতেন। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,নাফে কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন। তিনি মদীনায় কেরাআতশাস্ত্রের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মদীনার লোকেরা কেরাআতের ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করত। তিনি প্রসিদ্ধ দশজন কারীর একজন ইয়াযীদ ইবনে কা কা হতে কেরাআত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি 159 বা 169 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

3. ইবনে কাসির সম্পর্কে ইবনুন নাদিম বলেছেন , কথিত আছে ইরান সম্রাট আনুশিরওয়ান ইরানীদের যে দলটিকে ইয়েমেনে হাবাশীদের নিকট হতে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ইবনে কাসির তাদেরই বংশধর।

আমরা ইতোপূর্বে ইয়েমেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইরানীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে , ইবনে কাসির কেরাআতশাস্ত্রের মৌলনীতি মুজাহিদ-এর নিকট হতে ,তিনি ইবনে আব্বাস-এর নিকট হতে এবং ইবনে আব্বাস হরযত আলী (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইবনে কাসির 120 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

4. ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে কিসায়ীর নাম আলী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা হলেন হামযা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে বাহমান ইবনে ফিরুয। কিসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি আব্বাসীয় খলীফা হারুন উর রশীদের দু পুত্রের শিক্ষক ছিলেন। খোরাসানে আগমনের সময় তিনি হারুনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি ইরানের রেই শহরে ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যক্রমে হারুনের অন্যতম সফরসঙ্গী ও প্রধান কাযী মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীও ঐ দিন রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাধিস্থ হন। হারুন উর রশিদ এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বলেন , আজকে ইসলামী ফিকাহ্ ও সাহিত্যকে রেইয়ে সমাহিত করেছি। কিসায়ী দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন। কিসায়ীও শিয়া ছিলেন।

তাফসীরের বিষয়ে বলা যায় ,রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় স্বাভাবিকভাবেই সাহাবিগণ কোরআনের আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য রাসূলেরই শরণাপন্ন হতেন। কোন কোন সাহাবী অন্যদের নিকট হতে কোরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিকতর অগ্রসর ছিলেন ,এজন্য প্রথম হতেই আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন ,যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ। অবশ্য ইবনে আব্বাসের এ ক্ষেত্রে পরিচিতি অধিক ছিল এবং তাঁর মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিক বর্ণিত হয়ে থাকে। ইবনে আব্বাস260 হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদও হযরত আলীর ছাত্র ও শিয়া ছিলেন। গ্রন্থসূচী সম্পর্কিত আল ফেহেরস্ত গ্রন্থগুলোতে ইবনে আব্বাস সংকলিত একটি তাফসীরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন এই গ্রন্থটি এখনও মিশরের রাজকীয় জাদুঘরে রাখা আছে। তাফসীরে ইবনে আব্বাসের স্বতন্ত্র মত থাকলেও হযরত আলীর এ সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন , হযরত আলীর জ্ঞানের নিকট আমি মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির ন্যায়।

জর্জি যাইদান দাবি করেছেন ,প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত কোরআনের তাফসীর মুখে মুখে স্থানান্তরিত হতো এবং কোরআনের সর্বপ্রথম তাফসীর সংকলন করেন মুজাহিদ (মৃত্যু 104 হিজরী)। অতঃপর ওয়াকেদী ও ইবনে জারীর তাবারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে তাফসীর লিখেন।261

অবশ্য এ মতটি সঠিক নয়। ইবনে আব্বাস ছাড়াও সাঈদ ইবনে জুবাইর তাঁর পূর্বে তাফসীর সংকলন করেছেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানগণ কোন গ্রন্থই রচনা করেনি। এ মতের অনুবর্তী হয়েই জর্জি যাইদান উপরোক্ত মত দিয়েছেন। তাঁর এ মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তাই এ মতটি প্রত্যাখ্যাত। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেরাআতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন ইরানীরা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাফসীরের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের মূল হিসেবে তাফসীর ,ফিকাহ্ ও হাদীসশাস্ত্রের প্রতি ইরানীরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য বিষয়ের প্রতি ততটা নয়। এখানে ইসলামের প্রথম যুগ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইরানী মুফাসসিরের নাম উল্লেখ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতি শতাব্দীতেই শত শত মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থ ছিল। তাই তাঁদের মধ্য হতে বিভিন্ন জাতির মুফাসসিরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। তবে তাফসীরশাস্ত্রে ইরানীদের অবদান তুলে ধরার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু নমুনা প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকা হতে উল্লেখ করছি। লক্ষ্য করবেন ,এদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

প্রথম পর্যায়ের মুফাসসিরগণ হলেন যাঁদের নাম ও মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর উল্লেখ করা হয় অথবা তাঁদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এখনো বিদ্যমান। এখানে আমরা তাঁদের মধ্য হতেই মনোনীত করব ।

প্রথম শ্রেণীর মুফাসসির যাঁদের নাম তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর স্মরণ করা হয় তাঁদের কেউ সাহাবী ,কেউ তাবেয়ী ,কেউ তাবে তাবেয়ী আবার কেউ তাঁদের ছাত্র বা শিষ্য। এ ধরনের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে আব্বাস ,ইবনে মাসউদ ,উবাই ইবনে কাব ,সা দী ,মুজাহিদ ,কাতাদা ,মুকাতিল ,কালবী ,সাবিয়ী ,আ মাশ ,সুফিযান সাওরী ,জুহরী ,আতা ,আকরাম ,ফাররা প্রমুখ।

এদের কেউ শিয়া ,কেউ সুন্নী ,কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশই অ-ইরানী। শুধু মুকাতিল ,আ মাশ ও ফাররা ইরানী বংশোদ্ভূত।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইরানের খোরাসান অথবা রেইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর একজন ব্যক্তিত্ব এবং 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মুকাতিল শাফেয়ী মাযহাবের লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং শাফেয়ী অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে বলেছেন , অন্যরা তাফসীরের ক্ষেত্রে মুকাতিলের পরিবারস্বরূপ অর্থাৎ তাঁর অনুসারী।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের 1ম খণ্ডের 150 পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে সুলাইমান ইবনে মেহরান আ মাশের পিতা ইরানের দামাভান্দের অধিবাসী হলেও আ মাশ কুফায় জন্মগ্রহণ করেন ও জীবন কাটান। আ মাশ শিয়া হলেও আহলে সুন্নাতের আলেমগণও তাঁর প্রশংসা করেছেন। আ মাশ রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফাররা ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ আকতা একজন আরবী ব্যাকরণবিদ ও অভিধান রচয়িতা। আরবী সাহিত্যের গ্রন্থে তাঁর নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। তিনি কেসায়ীর ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুনের সন্তানদের শিক্ষক ছিলেন।

রিয়াজুল উলামা তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে শিয়া বলেছেন। তাঁর পিতা যিয়াদ আকতা ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনায় হুসাইন ইবনে আলী ইবনে হাসানের262 সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় আব্বাসীয় খলীফার নির্দেশে হস্ত কর্তিত হন। এজন্যই তাঁকে আকতা বা কর্তিত হস্ত বলা হয়। ফাররা 207 বা 208 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর মুফাসসিরগণ হলেন তাঁরা যাঁরা তাফসীর বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে এত অধিক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ,তা গণনা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করব। আমাদের আলোচনা শিয়া মুফাসসিরগণের তাফসীর দিয়ে শুরু করছি। শিয়া মুফাসসিরগণ দু অংশে বিভক্ত। একদল হলেন সে সকল মুফাসসির যাঁরা ইমামগণের উপস্থিতিতে ও বর্তমান অবস্থায় তাফসীর লিখেছেন ও অন্যদল হলেন যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ে তাফসীর লিখেছেন। ইমামগণের সমকালীন সময়ে যাঁরা তাফসীর রচনা করেছেন তাঁদের কেউ ইরানী ,কেউ অ-ইরানী। ইমামদের সাহাবী এরূপ কয়েকজন মুফাসসির হলেন আবু হামযা সুমালী ,আবু বাছির আসাদী ,ইউনুস ইবনে আবদুর রহমান ,হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ,আলী ইবনে মেহযিয়ার আহওয়াযী ,মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী কুমী এবং ফাজল ইবনে শাজান নিশাবুরী।

ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ের মুফাসসিরের সংখ্যা অসংখ্য। এখানে আমরা শুধু শিয়াদের প্রসিদ্ধ কিছু তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। এ হতেই বোঝা যাবে শিয়া মুফাসসিরগণের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

1. তাফসীরে আলী ইবনে ইবরাহীম কুমী: এ তাফসীর গ্রন্থটি শিয়াদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ যা এখনও বর্তমান রয়েছে। আলী ইবনে ইবরাহীমের পিতা কুফা হতে কোমে আসেন। অসম্ভব নয় ,আলী ইবনে ইবরাহীম একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। তিনি শেখ কুলাইনীর শিক্ষক ও মাশয়িখ (যাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন)। তিনি 307 হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

2. তাফসীরে আয়াশী: এই তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ সামারকান্দী লিখেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সুন্নী ছিলেন এবং পরবর্তীতে শিয়া হন। তিনি শেখ কুলাইনীর সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি তাঁর পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিন লক্ষ দিনারের পুরোটাই গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লিখন ,সংকলন ,নকল ও ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। যে সকল ব্যক্তি এরূপ কর্ম করতেন তাঁদের জীবিকা র্নিবাহের খরচ তিনি দিতেন। আয়াশী তাফসীর ,হাদীস ,ফিকাহ্শাস্ত্র ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন ও দাবি করেছেন আয়াশীর রচিত গ্রন্থসমূহ খোরাসানে বেশ প্রচলিত ছিল। আয়াশী ইরানী হলেও আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,কথিত আছে তিনি তামীম গোত্রের উত্তর পুরুষ। তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব।

3. তাফসীরে নোমানী: এ তাফসীরটির রচয়িতা হলেন আবদুুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইবনে আবি যাইনাব নামেও সুপরিচিত। তিনি শেখ কুলাইনীর ছাত্র। তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন ,তাফসীরে নোমানীর অনুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রয়েছে। নোমানী ইরাকের না মিশরের অধিবাসী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম।

নোমানীর এক দৌহিত্রের নাম আবুল কাসেম হুসাইন ,যিনি ইবনুল মারযবান নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পিতার দিকে হতে তিনি সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদের বংশধর। তিনি কয়েকবার তৎকালীন শাসনকর্তার মন্ত্রী হওয়ায় ওয়াযিরে মাগরেবী নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইবনুল মারযবান চৌদ্দ বছর বয়সে কোরাআনের হাফেজ হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ,হিসাবশাস্ত্র ,অংক ও জ্যামিতি ,যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চ মাপের সাহিত্যিক ও শক্তিমান লেখকও ছিলেন।

তিনি খাসায়িসুল কোরআন নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি 418 অথবা 428 সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা বাগদাদ হতে নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয় ও তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর কবরের নিকটবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।

4. তাফসীরে তিবইয়ান: এ তাফসীরের রচয়িতা শেইখুত তায়িফা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আলী আত তুসী। তিনি তাফসীর ,ফিকাহ্ ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ও আরবী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি 385 হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁর জন্ম হতে এখন এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর মাশহাদে তাঁর সহস্র বছর পূর্তি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। শিয়া-সুন্নী ,মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে প্রচুর মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র 460 হিজরীতে অস্তমিত হয়। তিনি 23 বছর বয়সে খোরাসান হতে ইরাকে আসেন এবং শেখ মুফিদ ও সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর সময়ের শিয়া মতাবলম্বীদের ফকীহ্ ও নেতা হন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও তিনি শিয়া আলেমদের শিরোমণি ছিলেন। মৃত্যুর বারো বছর পূর্বে বাগদাদের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার (মোগলদের আক্রমণ) ফলে নাজাফে চলে আসেন এবং নাজাফের ধর্মীয় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন যা তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরও বিদ্যমান রয়েছে।

5. মাজমাউল বায়ান: এ তাফসীর গ্রন্থটি ফাযল ইবনে হাসান তাবরেসী রচনা করেছেন। তিনি ইরানে তাফরেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি 536 হিজরীতে তাঁর এই তাফসীর লেখা সমাপ্ত করেন। রচনা ও সাহিত্যিক মানের দিক দিয়ে এ তাফসীরটি সর্বোত্তম। আহলে সুন্নাত ও শিয়া উভয়েই এই তাফসীরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই মিসর ,বৈরুত ও ইরানে পুনঃপুন ছাপা হয়েছে। আল্লামা তাবরেসী জাওয়ামেউল জামে নামে অপর একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীরটি তিনি তাঁর সমকালীন প্রসিদ্ধ মুফাসসির জারুল্লাহ্ যামাখশারী রচিত তাফসীরে কাশশাফ হতে আকর্ষণীয় সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে সংযোজন করেছেন।

অবশ্য তাফসীর বিশেষজ্ঞরা জানেন তাফসীরে কাশশাফে এমন অনেক সাহিত্যিক ও অলংকারিক বিষয় রয়েছে যা মাজমাউল রায়ানে নেই। আবার মাজমাউল বায়ানেও এমন অনেক সাহিত্যিক ও তাফসীরগত বিষয় রয়েছে যা কাশশাফে নেই।

6. রাউযুল জিনান: আবুল ফুতুহ রাযী তাফসীরটি রচনা করেছেন। এ তাফসীর ফার্সী ভাষায় রচিত। শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সমৃদ্ধতম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে ফখরুদ্দীন রাযী ও তাবরেসী উভয়েই এ তাফসীর গ্রন্থ হতে পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়েছেন। গত চল্লিশ বছরে তাফসীরটি ইরানে ব্যাপকভাবে ছাপা হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাযী নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করলেও রেই শহরে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি আরব বংশোদ্ভূ ইরানী। তিনি হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও সিফফিন যুদ্ধে তাঁর পক্ষে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ্ ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার বংশধর।

আবুল ফুতুহ তাবরেসী ও যামাখশারীর সমসাময়িক ব্যক্তি এবং শেখ তুসীর পরোক্ষ ছাত্র। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত ,তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর রেই শহরে বিদ্যমান।

7. তাফসীরে সাফী: বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ,মুফাসসির ,দার্শনিক ও আরেফ মোল্লা মুহাম্মদ ফাইয কাশানী এ তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি প্রসিদ্ধ শিয়া আলেমদের অন্যতম। তিনি একাদশ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। মরহুম ফাইয প্রথম জীবনে কোমে ছিলেন। তাঁর নামেই কোমের ধর্মীয় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মাদ্রাসায়ে ফাইযিয়া । পরে তিনি কোম হতে সিরাজ যান ও সাইয়্যেদ মাজিদ বাহরানীর নিকট হাদীসশাস্ত্র এবং মহান দার্শনিক ও আরেফ সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরা নামে প্রসিদ্ধ) নিকট দর্শন ও এরফান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সাদরুল মুতাআল্লিহীনের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি 1091 হিজরীতে কাশানে মৃত্যুবরণ করেন।

8. তাফসীরে মোল্লা সাদরা: যদিও মোল্লা সাদরা দর্শন ও অধিবিদ্যাশাস্ত্রে অধিকতর পরিচিত ও স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা তদুপরি তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি উসূলে কাফী নামক হাদীস গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি সূরা বাকারার 65 আয়াত পর্যন্ত ,সূরা সিজদাহ্ ,ইয়াসীন ,ওয়াকেয়া ,হাদীদ ,জুমআ ,ত্বারিক ,আলা ,যিলযাল ,আয়াতুল কুরসী ,সূরা নূরের কিছু আয়াত ও সূরা নামলেরوترى الجبال تحسبها جامدة আয়াতটি তাফসীর করেছেন। যদিও মোল্লা সাদরার তাফসীর পূর্ণ তাফসীর নয় ,তদুপরি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এবং আয়তনে তাফসীরে সাফীর সমান।

গ্রন্থটি ইরানে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। তিনি 1050 হিজরীতে পদব্রজে হজ্বে গমনের সময় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সপ্তমবারের মত হজ্বে যাওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। কাবার আকর্ষণ তাঁকে এমনভাবে টানত যে ,কণ্টকময় পথ তাঁর নিকট রেশমী কাপড় বিছানো পথের ন্যায় মনে হতো।

9. মিনহাজুস সাদেকীন: এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় রচিত। এটি তাবরীজ হতে তিন খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি মোল্লা ফাতহুল্লাহ্ ইবনে শুকরুল্লাহ্ কাশানী কর্তৃক দশম হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। এই লেখকের অধিকাংশ লেখা ফার্সীতে ছিল। যেমন নাহজুল বালাগার ফার্সী অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

10. তাফসীরে শাব্বার: সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ শাব্বার এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি কাশেফুল গেতা ও মির্যা কুমীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন চিন্তাশীল ,জ্ঞানী ও আবেদ ছিলেন। তিনি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,কালাম ,হাদীসশাস্ত্র ,তাফসীর ও রিজালশাস্ত্রে প্রচুর গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি 1242 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ও ইমাম কাযিম (আ)-এর সমাধিস্থলের নিকটে সমাধিস্থ হন।

11. তাফসীরে বুরহান: এই তাফসীরটি সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী কর্তৃক রচিত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস ও গবেষক। তাফসীরটি আখবারী ধারায় লিখিত অর্থাৎ কোরআন শুধু হাদীসের সাহায্যেই তাফসীর করতে হবে-এই মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসীদের ধারায় এটি লিখা হয়েছে। তাই শুধু আয়াতসংশ্লিষ্ট হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদীসটির বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি। সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী 1107 অথবা 1109 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

12. নুরুস সাকালাইন: এ তাফসীরটি হুয়াইযের একজন আলেম কর্তৃক লিখিত যিনি সিরাজে বাস করতেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল আলী ইবনে জুমাআ। তিনি মরহুম আল্লামা মাজলিসী ও শেখ হুররে আমেলীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়। তাঁর তাফসীরটিও হাদীসনির্ভর তাফসীর।

ওপরে আমরা যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি সেগুলো দ্বাদশ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত শিয়াদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এবং শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতের নিকটেই রয়েছে। তাই শিয়া ভিন্ন অন্যরাও চাইলে সহজেই তা পেতে পারেন। চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীতেও অনেক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। যদি কেউ শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান পেতে চান তাহলে আল্লামা শেইখ আগা বুযুরগে তেহরানী রচিত আয যারবিয়া ইলা তাসানিফুশ শিয়া নামক গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ওপরে আমরা নমুনাস্বরূপ যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি তা হতে স্পষ্ট ,প্রসিদ্ধ সকল শিয়া তাফসীর গ্রন্থই হয় ইরানীদের দ্বারা রচিত হয়েছে নতুবা আরব বংশোদ্ভূত কোন ইরানী বা শিয়া যাঁরা ইরানে বসবাস করতেন তাঁরা লিখেছেন।

কেরাআত ও তাফসীর

ইসলামী জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জ্ঞানটি উৎপত্তি লাভ করে তা হলো কেরাআত ,অতঃপর তাফসীর। কেরাআত কোরআনের শব্দমালার উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তাফসীর পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান।

কেরাআতশাস্ত্রে কোরআন পঠনে ওয়াক্ফ ,ওয়াস্ল ,মাদ ,তাশদীদ ,ইদগাম প্রভৃতির নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা করা হয়। এ শাস্ত্রে কোরআনের কোন কোন শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

সাহাবীরা নবী (সা.)-এর নিকট হতে কোরআন শিক্ষা করতেন ,কোন কোন সাহাবীকে রাসূল সরাসরি কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং অন্যদের শিক্ষা দানের জন্য তাঁদের প্রেরণ করতেন। তাবেয়ীরা (যাঁরা রাসূলের সময়ে ছিলেন না ও তাঁর সাহচর্য লাভ করেননি) সাহাবীদের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এ যুগেই কেরাআতশাস্ত্রের একদল বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয় যাঁরা সঠিকভাবে কোরআন পাঠ শিক্ষা দান শুরু করেন। সাধারণ মুসলমান যাদের সংখ্যা সে সময় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা পরম আগ্রহ নিয়ে কোরআন শিক্ষা করত এবং এই সকল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতো। এ বিশেষজ্ঞগণ কোন ইমাম বা সাহাবীর সূত্রে কোরআন পাঠ প্রক্রিয়া বর্ণনা করতেন। তাঁরাও নিজ পদ্ধতিতে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করতেন। তাঁদের ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণ কি ? রাসূল (সা.)-এর সময়েও কি এ বিষয়ে ভিন্নতা ছিল ? স্বয়ং নবী কি কোরআনের কিছু কিছু শব্দকে কয়েকভাবে পঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন বা কোরআনের কিছু শব্দ কি বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির মাধ্যমে নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ? নাকি অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় যে বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণে পঠনে ভিন্নতার সৃষ্টি হয় কোরআনেও তেমনটি হয়েছে ? এ বিষয়গুলো অন্যত্র আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত ,নবী (সা.) যেরূপে কোরআন পাঠ ও তেলাওয়াত করতেন মুসলমানরা সেরূপেই তা পাঠ ও তেলাওয়াত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। যে সকল ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাসূলের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাই তারা তাঁদের নিকট হতে কোরআন পাঠ শিক্ষাগ্রহণ করতেন।

প্রথমদিকে কারিগণ মৌলিকভাবে শুনে ও মুখস্থ করে শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখতেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ বিষয়ে গ্রন্থ সংকলিত ও লিখিত হয়।

কেউ কেউ দাবি করেছেন ,এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আবু উবাইদা কাসেম ইবনে সালাম (মৃত্যু 224 হিজরী) একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন এজন্য যে ,এর একশ বছর পূর্বেই সাতজন প্রসিদ্ধ কারীর (কোররায়ে সাবআ) একজন হামযা ইবনে হাবিব- যিনি শিয়া ছিলেন ,কোরআন পাঠ পদ্ধতির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তদুপরি এ সম্পর্কিত গবেষণায় আয়াতুল্লাহ্ হাসান সাদর ইবনুন্ নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও নাজ্জাশীর ফেহেরেস্ত গ্রন্থ হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শিষ্য ও সাহাবী আবান ইবনে তাগলিব এরও পূর্বে এ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি আরো প্রমাণ করেছেন ,সর্বপ্রথম আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কোরআন সংকলন করেন এবং তাঁরই শিষ্য ও সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালী কোরআনে প্রথম নুকতাহ সংযোজন করেন।257 সর্বপ্রথম কোরআন পঠন পদ্ধতির ওপর আবান ইবনে তাগলিব গ্রন্থ লিখেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনের অর্থ ও কঠিন শব্দসূমহের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বপ্রথম কোরআনের ফযিলত বর্ণনা করে গ্রন্থ রচনা করেন প্রসিদ্ধ সাহাবী ও হযরত আলীর অনুসারী উবাই ইবনে কা ব (রা.)। কোরআনের রূপক শব্দসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন তিনি হলেন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ ফাররা যিনি একজন ইরানী শিয়া ছিলেন। সর্বপ্রথম কোরআনের বিধিবিধান নিয়ে যিনি গ্রন্থ লিখেন তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী। সর্বপ্রথম তাফসীর গ্রন্থ লিখেন সাঈদ ইবনে যুবাইর।258

যা হোক প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর তাবেয়িগণ ও তাদের ছাত্রদের মধ্য হতে দশ ব্যক্তি কোরআন পঠন পদ্ধতিতে (কেরাআতশাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে কোররায়ে সাবআ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন নাফে ইবনে আবদুর রহমান ,আবদুল্লাহ্ ইবনে কাসির ,আবু আমর ইবনুল আলা ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ,আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ ,হামযা ইবনে হাবিব এবং আলী কিসায়ী।

এই সাতজনের চারজনই হলেন ইরানী এবং তাঁদের দু জন হলেন শিয়া। অ-ইরানী তিনজন কারীর দু জনও শিয়া অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর মধ্যে চারজন শিয়া। আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থের 346 পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল জলিল রাযী-এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন কেরাআতশাস্ত্রের পুরোধাদের সকলেই আদলীয়াদের (শিয়া ও মুতাযিলা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ,হোক তিনি কুফা ,বসরা ,মক্কা ,মদীনা বা অন্য কোন স্থানের অধিবাসী।

চার প্রসিদ্ধ ইরানী কারী হলেন :

1. আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ একজন ইরানী। তিনি আবু আবদুর রহমান সালামীর নিকট কেরাআত শিক্ষা করেছেন। আবু আবদুর রহমান হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন। আছেমের কেরাআতকে প্রসিদ্ধতম কেরাআত মনে করা হয়। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে বলা হয়েছে , কোরআনের মূল লিখন ও পঠন পদ্ধতিটি সাধারণত আছেমের অনুকরণে লিখা হতো এবং অন্যান্য কারীদের কেরাআতের ধরন নিম্নে লাল কালি দ্বারা কারীর নাম উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করা হতো।259 আসেম কুফায় থাকতেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাজালিসুল মুমিনীন গ্রন্থের লেখকসহ আরো কিছু গবেষক ,যেমন আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর শিয়া হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বলেছেন। তিনি 130 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

2. নাফে ইবনে আবদুর রহমান সম্পর্কে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বলেছেন , তিনি ইরানের ইসফাহানের লোক হলেও মদীনায় বাস করতেন। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,নাফে কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন। তিনি মদীনায় কেরাআতশাস্ত্রের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মদীনার লোকেরা কেরাআতের ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করত। তিনি প্রসিদ্ধ দশজন কারীর একজন ইয়াযীদ ইবনে কা কা হতে কেরাআত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি 159 বা 169 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

3. ইবনে কাসির সম্পর্কে ইবনুন নাদিম বলেছেন , কথিত আছে ইরান সম্রাট আনুশিরওয়ান ইরানীদের যে দলটিকে ইয়েমেনে হাবাশীদের নিকট হতে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ইবনে কাসির তাদেরই বংশধর।

আমরা ইতোপূর্বে ইয়েমেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইরানীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে , ইবনে কাসির কেরাআতশাস্ত্রের মৌলনীতি মুজাহিদ-এর নিকট হতে ,তিনি ইবনে আব্বাস-এর নিকট হতে এবং ইবনে আব্বাস হরযত আলী (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইবনে কাসির 120 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

4. ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে কিসায়ীর নাম আলী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা হলেন হামযা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে বাহমান ইবনে ফিরুয। কিসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি আব্বাসীয় খলীফা হারুন উর রশীদের দু পুত্রের শিক্ষক ছিলেন। খোরাসানে আগমনের সময় তিনি হারুনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি ইরানের রেই শহরে ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যক্রমে হারুনের অন্যতম সফরসঙ্গী ও প্রধান কাযী মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীও ঐ দিন রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাধিস্থ হন। হারুন উর রশিদ এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বলেন , আজকে ইসলামী ফিকাহ্ ও সাহিত্যকে রেইয়ে সমাহিত করেছি। কিসায়ী দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন। কিসায়ীও শিয়া ছিলেন।

তাফসীরের বিষয়ে বলা যায় ,রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় স্বাভাবিকভাবেই সাহাবিগণ কোরআনের আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য রাসূলেরই শরণাপন্ন হতেন। কোন কোন সাহাবী অন্যদের নিকট হতে কোরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিকতর অগ্রসর ছিলেন ,এজন্য প্রথম হতেই আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন ,যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ। অবশ্য ইবনে আব্বাসের এ ক্ষেত্রে পরিচিতি অধিক ছিল এবং তাঁর মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিক বর্ণিত হয়ে থাকে। ইবনে আব্বাস260 হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদও হযরত আলীর ছাত্র ও শিয়া ছিলেন। গ্রন্থসূচী সম্পর্কিত আল ফেহেরস্ত গ্রন্থগুলোতে ইবনে আব্বাস সংকলিত একটি তাফসীরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন এই গ্রন্থটি এখনও মিশরের রাজকীয় জাদুঘরে রাখা আছে। তাফসীরে ইবনে আব্বাসের স্বতন্ত্র মত থাকলেও হযরত আলীর এ সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন , হযরত আলীর জ্ঞানের নিকট আমি মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির ন্যায়।

জর্জি যাইদান দাবি করেছেন ,প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত কোরআনের তাফসীর মুখে মুখে স্থানান্তরিত হতো এবং কোরআনের সর্বপ্রথম তাফসীর সংকলন করেন মুজাহিদ (মৃত্যু 104 হিজরী)। অতঃপর ওয়াকেদী ও ইবনে জারীর তাবারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে তাফসীর লিখেন।261

অবশ্য এ মতটি সঠিক নয়। ইবনে আব্বাস ছাড়াও সাঈদ ইবনে জুবাইর তাঁর পূর্বে তাফসীর সংকলন করেছেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানগণ কোন গ্রন্থই রচনা করেনি। এ মতের অনুবর্তী হয়েই জর্জি যাইদান উপরোক্ত মত দিয়েছেন। তাঁর এ মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তাই এ মতটি প্রত্যাখ্যাত। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেরাআতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন ইরানীরা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাফসীরের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের মূল হিসেবে তাফসীর ,ফিকাহ্ ও হাদীসশাস্ত্রের প্রতি ইরানীরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য বিষয়ের প্রতি ততটা নয়। এখানে ইসলামের প্রথম যুগ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইরানী মুফাসসিরের নাম উল্লেখ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতি শতাব্দীতেই শত শত মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থ ছিল। তাই তাঁদের মধ্য হতে বিভিন্ন জাতির মুফাসসিরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। তবে তাফসীরশাস্ত্রে ইরানীদের অবদান তুলে ধরার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু নমুনা প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকা হতে উল্লেখ করছি। লক্ষ্য করবেন ,এদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

প্রথম পর্যায়ের মুফাসসিরগণ হলেন যাঁদের নাম ও মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর উল্লেখ করা হয় অথবা তাঁদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এখনো বিদ্যমান। এখানে আমরা তাঁদের মধ্য হতেই মনোনীত করব ।

প্রথম শ্রেণীর মুফাসসির যাঁদের নাম তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর স্মরণ করা হয় তাঁদের কেউ সাহাবী ,কেউ তাবেয়ী ,কেউ তাবে তাবেয়ী আবার কেউ তাঁদের ছাত্র বা শিষ্য। এ ধরনের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে আব্বাস ,ইবনে মাসউদ ,উবাই ইবনে কাব ,সা দী ,মুজাহিদ ,কাতাদা ,মুকাতিল ,কালবী ,সাবিয়ী ,আ মাশ ,সুফিযান সাওরী ,জুহরী ,আতা ,আকরাম ,ফাররা প্রমুখ।

এদের কেউ শিয়া ,কেউ সুন্নী ,কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশই অ-ইরানী। শুধু মুকাতিল ,আ মাশ ও ফাররা ইরানী বংশোদ্ভূত।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইরানের খোরাসান অথবা রেইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর একজন ব্যক্তিত্ব এবং 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মুকাতিল শাফেয়ী মাযহাবের লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং শাফেয়ী অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে বলেছেন , অন্যরা তাফসীরের ক্ষেত্রে মুকাতিলের পরিবারস্বরূপ অর্থাৎ তাঁর অনুসারী।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের 1ম খণ্ডের 150 পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে সুলাইমান ইবনে মেহরান আ মাশের পিতা ইরানের দামাভান্দের অধিবাসী হলেও আ মাশ কুফায় জন্মগ্রহণ করেন ও জীবন কাটান। আ মাশ শিয়া হলেও আহলে সুন্নাতের আলেমগণও তাঁর প্রশংসা করেছেন। আ মাশ রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফাররা ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ আকতা একজন আরবী ব্যাকরণবিদ ও অভিধান রচয়িতা। আরবী সাহিত্যের গ্রন্থে তাঁর নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। তিনি কেসায়ীর ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুনের সন্তানদের শিক্ষক ছিলেন।

রিয়াজুল উলামা তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে শিয়া বলেছেন। তাঁর পিতা যিয়াদ আকতা ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনায় হুসাইন ইবনে আলী ইবনে হাসানের262 সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় আব্বাসীয় খলীফার নির্দেশে হস্ত কর্তিত হন। এজন্যই তাঁকে আকতা বা কর্তিত হস্ত বলা হয়। ফাররা 207 বা 208 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর মুফাসসিরগণ হলেন তাঁরা যাঁরা তাফসীর বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে এত অধিক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ,তা গণনা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করব। আমাদের আলোচনা শিয়া মুফাসসিরগণের তাফসীর দিয়ে শুরু করছি। শিয়া মুফাসসিরগণ দু অংশে বিভক্ত। একদল হলেন সে সকল মুফাসসির যাঁরা ইমামগণের উপস্থিতিতে ও বর্তমান অবস্থায় তাফসীর লিখেছেন ও অন্যদল হলেন যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ে তাফসীর লিখেছেন। ইমামগণের সমকালীন সময়ে যাঁরা তাফসীর রচনা করেছেন তাঁদের কেউ ইরানী ,কেউ অ-ইরানী। ইমামদের সাহাবী এরূপ কয়েকজন মুফাসসির হলেন আবু হামযা সুমালী ,আবু বাছির আসাদী ,ইউনুস ইবনে আবদুর রহমান ,হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ,আলী ইবনে মেহযিয়ার আহওয়াযী ,মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী কুমী এবং ফাজল ইবনে শাজান নিশাবুরী।

ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ের মুফাসসিরের সংখ্যা অসংখ্য। এখানে আমরা শুধু শিয়াদের প্রসিদ্ধ কিছু তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। এ হতেই বোঝা যাবে শিয়া মুফাসসিরগণের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

1. তাফসীরে আলী ইবনে ইবরাহীম কুমী: এ তাফসীর গ্রন্থটি শিয়াদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ যা এখনও বর্তমান রয়েছে। আলী ইবনে ইবরাহীমের পিতা কুফা হতে কোমে আসেন। অসম্ভব নয় ,আলী ইবনে ইবরাহীম একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। তিনি শেখ কুলাইনীর শিক্ষক ও মাশয়িখ (যাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন)। তিনি 307 হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

2. তাফসীরে আয়াশী: এই তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ সামারকান্দী লিখেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সুন্নী ছিলেন এবং পরবর্তীতে শিয়া হন। তিনি শেখ কুলাইনীর সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি তাঁর পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিন লক্ষ দিনারের পুরোটাই গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লিখন ,সংকলন ,নকল ও ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। যে সকল ব্যক্তি এরূপ কর্ম করতেন তাঁদের জীবিকা র্নিবাহের খরচ তিনি দিতেন। আয়াশী তাফসীর ,হাদীস ,ফিকাহ্শাস্ত্র ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন ও দাবি করেছেন আয়াশীর রচিত গ্রন্থসমূহ খোরাসানে বেশ প্রচলিত ছিল। আয়াশী ইরানী হলেও আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,কথিত আছে তিনি তামীম গোত্রের উত্তর পুরুষ। তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব।

3. তাফসীরে নোমানী: এ তাফসীরটির রচয়িতা হলেন আবদুুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইবনে আবি যাইনাব নামেও সুপরিচিত। তিনি শেখ কুলাইনীর ছাত্র। তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন ,তাফসীরে নোমানীর অনুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রয়েছে। নোমানী ইরাকের না মিশরের অধিবাসী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম।

নোমানীর এক দৌহিত্রের নাম আবুল কাসেম হুসাইন ,যিনি ইবনুল মারযবান নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পিতার দিকে হতে তিনি সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদের বংশধর। তিনি কয়েকবার তৎকালীন শাসনকর্তার মন্ত্রী হওয়ায় ওয়াযিরে মাগরেবী নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইবনুল মারযবান চৌদ্দ বছর বয়সে কোরাআনের হাফেজ হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ,হিসাবশাস্ত্র ,অংক ও জ্যামিতি ,যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চ মাপের সাহিত্যিক ও শক্তিমান লেখকও ছিলেন।

তিনি খাসায়িসুল কোরআন নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি 418 অথবা 428 সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা বাগদাদ হতে নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয় ও তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর কবরের নিকটবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।

4. তাফসীরে তিবইয়ান: এ তাফসীরের রচয়িতা শেইখুত তায়িফা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আলী আত তুসী। তিনি তাফসীর ,ফিকাহ্ ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ও আরবী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি 385 হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁর জন্ম হতে এখন এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর মাশহাদে তাঁর সহস্র বছর পূর্তি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। শিয়া-সুন্নী ,মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে প্রচুর মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র 460 হিজরীতে অস্তমিত হয়। তিনি 23 বছর বয়সে খোরাসান হতে ইরাকে আসেন এবং শেখ মুফিদ ও সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর সময়ের শিয়া মতাবলম্বীদের ফকীহ্ ও নেতা হন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও তিনি শিয়া আলেমদের শিরোমণি ছিলেন। মৃত্যুর বারো বছর পূর্বে বাগদাদের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার (মোগলদের আক্রমণ) ফলে নাজাফে চলে আসেন এবং নাজাফের ধর্মীয় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন যা তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরও বিদ্যমান রয়েছে।

5. মাজমাউল বায়ান: এ তাফসীর গ্রন্থটি ফাযল ইবনে হাসান তাবরেসী রচনা করেছেন। তিনি ইরানে তাফরেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি 536 হিজরীতে তাঁর এই তাফসীর লেখা সমাপ্ত করেন। রচনা ও সাহিত্যিক মানের দিক দিয়ে এ তাফসীরটি সর্বোত্তম। আহলে সুন্নাত ও শিয়া উভয়েই এই তাফসীরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই মিসর ,বৈরুত ও ইরানে পুনঃপুন ছাপা হয়েছে। আল্লামা তাবরেসী জাওয়ামেউল জামে নামে অপর একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীরটি তিনি তাঁর সমকালীন প্রসিদ্ধ মুফাসসির জারুল্লাহ্ যামাখশারী রচিত তাফসীরে কাশশাফ হতে আকর্ষণীয় সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে সংযোজন করেছেন।

অবশ্য তাফসীর বিশেষজ্ঞরা জানেন তাফসীরে কাশশাফে এমন অনেক সাহিত্যিক ও অলংকারিক বিষয় রয়েছে যা মাজমাউল রায়ানে নেই। আবার মাজমাউল বায়ানেও এমন অনেক সাহিত্যিক ও তাফসীরগত বিষয় রয়েছে যা কাশশাফে নেই।

6. রাউযুল জিনান: আবুল ফুতুহ রাযী তাফসীরটি রচনা করেছেন। এ তাফসীর ফার্সী ভাষায় রচিত। শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সমৃদ্ধতম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে ফখরুদ্দীন রাযী ও তাবরেসী উভয়েই এ তাফসীর গ্রন্থ হতে পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়েছেন। গত চল্লিশ বছরে তাফসীরটি ইরানে ব্যাপকভাবে ছাপা হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাযী নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করলেও রেই শহরে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি আরব বংশোদ্ভূ ইরানী। তিনি হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও সিফফিন যুদ্ধে তাঁর পক্ষে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ্ ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার বংশধর।

আবুল ফুতুহ তাবরেসী ও যামাখশারীর সমসাময়িক ব্যক্তি এবং শেখ তুসীর পরোক্ষ ছাত্র। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত ,তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর রেই শহরে বিদ্যমান।

7. তাফসীরে সাফী: বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ,মুফাসসির ,দার্শনিক ও আরেফ মোল্লা মুহাম্মদ ফাইয কাশানী এ তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি প্রসিদ্ধ শিয়া আলেমদের অন্যতম। তিনি একাদশ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। মরহুম ফাইয প্রথম জীবনে কোমে ছিলেন। তাঁর নামেই কোমের ধর্মীয় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মাদ্রাসায়ে ফাইযিয়া । পরে তিনি কোম হতে সিরাজ যান ও সাইয়্যেদ মাজিদ বাহরানীর নিকট হাদীসশাস্ত্র এবং মহান দার্শনিক ও আরেফ সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরা নামে প্রসিদ্ধ) নিকট দর্শন ও এরফান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সাদরুল মুতাআল্লিহীনের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি 1091 হিজরীতে কাশানে মৃত্যুবরণ করেন।

8. তাফসীরে মোল্লা সাদরা: যদিও মোল্লা সাদরা দর্শন ও অধিবিদ্যাশাস্ত্রে অধিকতর পরিচিত ও স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা তদুপরি তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি উসূলে কাফী নামক হাদীস গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি সূরা বাকারার 65 আয়াত পর্যন্ত ,সূরা সিজদাহ্ ,ইয়াসীন ,ওয়াকেয়া ,হাদীদ ,জুমআ ,ত্বারিক ,আলা ,যিলযাল ,আয়াতুল কুরসী ,সূরা নূরের কিছু আয়াত ও সূরা নামলেরوترى الجبال تحسبها جامدة আয়াতটি তাফসীর করেছেন। যদিও মোল্লা সাদরার তাফসীর পূর্ণ তাফসীর নয় ,তদুপরি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এবং আয়তনে তাফসীরে সাফীর সমান।

গ্রন্থটি ইরানে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। তিনি 1050 হিজরীতে পদব্রজে হজ্বে গমনের সময় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সপ্তমবারের মত হজ্বে যাওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। কাবার আকর্ষণ তাঁকে এমনভাবে টানত যে ,কণ্টকময় পথ তাঁর নিকট রেশমী কাপড় বিছানো পথের ন্যায় মনে হতো।

9. মিনহাজুস সাদেকীন: এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় রচিত। এটি তাবরীজ হতে তিন খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি মোল্লা ফাতহুল্লাহ্ ইবনে শুকরুল্লাহ্ কাশানী কর্তৃক দশম হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। এই লেখকের অধিকাংশ লেখা ফার্সীতে ছিল। যেমন নাহজুল বালাগার ফার্সী অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

10. তাফসীরে শাব্বার: সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ শাব্বার এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি কাশেফুল গেতা ও মির্যা কুমীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন চিন্তাশীল ,জ্ঞানী ও আবেদ ছিলেন। তিনি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,কালাম ,হাদীসশাস্ত্র ,তাফসীর ও রিজালশাস্ত্রে প্রচুর গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি 1242 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ও ইমাম কাযিম (আ)-এর সমাধিস্থলের নিকটে সমাধিস্থ হন।

11. তাফসীরে বুরহান: এই তাফসীরটি সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী কর্তৃক রচিত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস ও গবেষক। তাফসীরটি আখবারী ধারায় লিখিত অর্থাৎ কোরআন শুধু হাদীসের সাহায্যেই তাফসীর করতে হবে-এই মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসীদের ধারায় এটি লিখা হয়েছে। তাই শুধু আয়াতসংশ্লিষ্ট হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদীসটির বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি। সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী 1107 অথবা 1109 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

12. নুরুস সাকালাইন: এ তাফসীরটি হুয়াইযের একজন আলেম কর্তৃক লিখিত যিনি সিরাজে বাস করতেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল আলী ইবনে জুমাআ। তিনি মরহুম আল্লামা মাজলিসী ও শেখ হুররে আমেলীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়। তাঁর তাফসীরটিও হাদীসনির্ভর তাফসীর।

ওপরে আমরা যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি সেগুলো দ্বাদশ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত শিয়াদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এবং শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতের নিকটেই রয়েছে। তাই শিয়া ভিন্ন অন্যরাও চাইলে সহজেই তা পেতে পারেন। চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীতেও অনেক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। যদি কেউ শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান পেতে চান তাহলে আল্লামা শেইখ আগা বুযুরগে তেহরানী রচিত আয যারবিয়া ইলা তাসানিফুশ শিয়া নামক গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ওপরে আমরা নমুনাস্বরূপ যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি তা হতে স্পষ্ট ,প্রসিদ্ধ সকল শিয়া তাফসীর গ্রন্থই হয় ইরানীদের দ্বারা রচিত হয়েছে নতুবা আরব বংশোদ্ভূত কোন ইরানী বা শিয়া যাঁরা ইরানে বসবাস করতেন তাঁরা লিখেছেন।


18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35