আরবী ব্যাকরণশাস্ত্র ও ভাষাতত্ত্ব
আরবী ভাষা বলতে আমরা আরবী ব্যাকরণ (সারফ ও নাহু) ,অভিধানশাস্ত্র ,অলংকার ,বাগ্মিতা ,কবিতা ও ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করছি। এ ক্ষেত্রে ইরানীরা প্রচুর অবদান রেখেছে।
ইরানীদের আরবী ভাষায় অবদান স্বয়ং আরবদের চেয়ে অনেক বেশি ,এমনকি ইরানীরা ফার্সী ভাষা অপেক্ষা আরবী ভাষায় অধিক অবদান রেখেছে। ইরানীরা এক পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতির উদ্দীপনায় আরবী ভাষায় অবদান রাখতে প্রয়াসী হয়েছিল। অন্যান্য মুসলমানদের ন্যায় ইরানীরাও আরবী ভাষাকে আরবদের ভাষা মনে করত না ;বরং একে কোরআনের ও মুসলিম বিশ্বের ভাষা মনে করত। এ কারণেই তারা মুক্ত মনে বিপুল উদ্দীপনা সহকারে এ ভাষা শিক্ষা করেছিল ও গবেষণায় রত হয়েছিল।
আরবী ব্যাকরণশাস্ত্র আরবী ভাষার বিধিবিধান (নাহু) দিয়ে শুরু হয়। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ এ বিষয়ে একমত ,এ শাস্ত্রের উদ্ভাবক আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)। বিশিষ্ট আলেম আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর‘
তাসিসুশ শিয়া’
গ্রন্থে এ দাবির সপক্ষে কিছু অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। হযরত আলী তাঁর প্রতিভাধর সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালীকে এ (নাহু) শাস্ত্রের মৌলনীতি শিক্ষাদান করে এর ভিত্তিতে অন্যান্য বিধান তৈরির পরামর্শ দান করেন। আবুল আসওয়াদ এ পরামর্শের ভিত্তিতে অন্যান্য বিধান তৈরি করেন ও তাঁর দু’
পুত্র আতা ইবনে আবিল আসওয়াদ ,আবা হারব ইবনে আবিল আসওয়াদ এবং তাঁর ছাত্র ইয়াহিয়া ইবনে ইয়ামুর ,মাইমুন আকরান ,ইয়াহিয়া ইবনে নোমান এবং আনবাসাতুল ফিল প্রমুখকে তা শিক্ষাদান করেন। কথিত আছে ইসলামের প্রসিদ্ধ দু’
জন সাহিত্যিক আবু উবাইদা ইরানী ও আসমায়ী আরব ,আতা ইবনে আবিল আসওয়াদের ছাত্র ছিলেন।
দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাষাবিদদের মধ্যে আবু ইসহাক হাদারামী ,ঈসা সাকাফী এবং প্রসিদ্ধ ও শ্রেষ্ঠ সাত ক্বারীর অন্যতম বিশিষ্ট শিয়া ব্যক্তিত্ব আবু আমর ইবনুল আলা রয়েছেন।
আবু আমর ইবনুল আলা আরবী অভিধান ,ভাষা ও ব্যাকরণবিদ এবং সাহিত্যিক ছিলেন। বিশেষত কবিতায় তাঁর পারদর্শিতা ছিল। একবার হজ্ব যাত্রার সময় তিনি তাঁর হস্তলিখিত কবিতার মধ্যে আরব জাহেলিয়াতের যে কবিতাসমূহ ছিল সেগুলো ধ্বংস করেন। তিনি একজন পরহেজগার ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পবিত্র রমজান মাসে কখনও কবিতা পড়তেন না। আসমায়ী ,ইউনুস ইবনে হাবিব নাহভী ,আবু উবাইদা এবং সা’
দান ইবনে মুবারাক তাঁর ছাত্র ছিলেন।
তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম শ্রেণীর ব্যাকরণশাস্ত্রবিদদের অন্যতম হলেন খলিল ইবনে আহমাদ আরুজী। তিনি একজন শিয়া ও বিরল প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তি। বিশিষ্ট ব্যাকরণবিদ‘
আল কিতাব’
গ্রন্থের রচয়িতা সিবাভেই খলিলের ছাত্র। অন্যতম প্রসিদ্ধ আরবী ভাষাবিদ আখফাশ ,খলিল ও সিবাভেই-এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন।
এর পরবর্তী সময়ের ব্যাকরণবিদগণ‘
কুফী’
ও‘
বাসরী’
এ দু’
ভাগে বিভক্ত ছিলেন। প্রসিদ্ধ ব্যাকরণবিদ কিসায়ী ,তাঁর ছাত্র ফাররা ,তাঁর ছাত্র আবুল আব্বাস সা’
লাব এবং তদীয় ছাত্র ইবনুল আম্বারী কুফী ব্যাকরণবিদদের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে সিবাভেই ,আখফাশ ,মাযানী ,মুবাররেদ ,জুজায ,আবু আলী ফারেসী ,ইবনে জুনা এবং আবদুল কাদের জুরজানী পর্যায়ক্রমে শিক্ষক ও ছাত্র এবং বাসরী ব্যাকরণবিদদের অন্তর্ভুক্ত।
উপরিউক্ত ব্যক্তিদের অনেকেই ইরানী। ইরানী বংশোদ্ভূত আরবী ভাষাবিদগণের তালিকা ও পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হলো।
১. ইউনুস ইবনে হাবিব (মৃত্যু ১৮৩ হিজরী): ইবনুন নাদিম বলেছেন ,তিনি অনারব (ইরানী)।
তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম‘
মায়ানিউল কোরআনুল কারিম’
। তিনি সারা জীবন অবিবাহিত ছিলেন। তিনি তাঁর সাতাশি বছরের জীবনকে জ্ঞানের সেবায় নিবেদন করেছিলেন।
২. আবু উবাইদা মুয়াম্মার ইবনুল মুসান্না (মৃত্যু ২১০ হিজরী): ইবনুন নাদিম বলেছেন ,আবু উবাইদাও ইরানী ছিলেন।
৩. সা’
দান ইবনে মুবারাক: তাঁর মৃত্যুর তারিখ জানা যায়নি।‘
রাইহানাতুল আদাব’
গ্রন্থের বর্ণনা মতে তিনি ইরানের তাখারিস্তানের অধিবাসী ও অন্ধ ছিলেন।
৪. আবু বাশার আমর ইবনে উসমান ইবনে কাম্বার (সিবাভেই নামে প্রসিদ্ধ): তিনি ১৮০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বাইদায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন বসরায় কাটান ও এ সময়ে একবার বাগদাদ সফর করেন। তাঁর বাগদাদ সফরে বিশিষ্ট ক্বারী ও ব্যাকরণবিদ কিসায়ীর সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি‘
যাম্বরিয়ার ঘটনা’
নামে প্রসিদ্ধ । তিনি বাগদাদ সফরের পর নিজ ভূমি ইরানের ফার্সে ফিরে আসেন এবং মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে সেখানে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাহিত হন। ব্যাকরণশাস্ত্রে (নাহু) তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটির নাম‘
আল কিতাব’
যা আরবী ব্যাকরণ ও ভাষাশাস্ত্রে অ্যারিস্টটলের যুক্তিবিদ্যা গ্রন্থ ও জ্যোতির্বিদ্যায় টলেমীর ম্যাজেস্টি গ্রন্থের মর্যাদাসম্পন্ন। তাঁর এ গ্রন্থ মিশর ,কলকাতা ,প্যারিস ও বার্লিনে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। সাইয়্যেদ বাহরুল উলুম ও অনেকের মতে‘
নাহুশাস্ত্রে সকল ব্যাকরণবিদ সিবাভেই-এর পরিবারভুক্ত ও অনুসারী। তাঁর এ গ্রন্থে পবিত্র কোরআনের তিন শতাধিক আয়াত উদাহরণ হিসেবে এসেছে। বিশিষ্ট আরব ব্যাকরণবিদ অনেক মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়েও গ্রন্থটি একজন আহলে কিতাবকে শিক্ষাদানে রাজী হননি। এ কারণে যে ,এতে করে ঐ অমুসলমানের হাত পবিত্র কোরআনের আয়াতের ওপর পড়বে যা কোরআনের অবমাননার শামিল।
৫. সাঈদ ইবনে মাসয়াদ আখফাশ (আখফাশ অথবা আখফাশে আওসাত নামে প্রসিদ্ধ): তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর আরবী ভাষা ও ব্যাকরণবিদ। তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি খলিল ইবনে আহমাদ লিখিত গ্রন্থে কবিতা ও ছন্দ সংযোজন করেন। ইবনুন নাদিমের বর্ণনা মতে এ ব্যক্তি ইরানের খাওয়ারেজমের অধিবাসী। তাঁকে‘
মাজাশায়ী’
ও বলা হয়েছে। তাই স্পষ্ট নয় ,তিনি আরব বংশোদ্ভূত ইরানী নাকি এ উপনামটি তৎকালীন সময়ের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এক আরব গোত্রের সঙ্গে (চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে) সংযুক্ত হয়েছে। তিনি ২১৫ অথবা ২২১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৬. আলী ইবনে হামযা কিসায়ী: তাঁর সম্পর্কে কারীদের আলোচনায় আমরা বর্ণনা দিয়েছি। কিসায়ী নিঃসন্দেহে ইরানী। তাঁর প্রপিতার নাম ফিরুয। তিনি প্রায় দু’
শ’
হিজরীতে খলীফা হারুনুর রশীদের সঙ্গে খোরাসান যাত্রাকালে রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন।
৭. ফাররা: তিনিও একজন ইরানী। কারী ও কোরআনের মুফাসসিরদের আলোচনায় তাঁর নাম আমরা উল্লেখ করেছি।
৮. মুহাম্মদ ইবনে কাসেম আনবারী (ইবনুল আনবারী বা আম্বারী নামে প্রসিদ্ধ): তিনি আম্বারের অধিবাসী। এ স্থানটি সাসানী আমলে ইরানের শস্যভাণ্ডার ছিল। তিনি আবুল আব্বাস সা’
লাবের ছাত্র এবং ৩২৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৯. আবু ইসহাক ,ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সারি ইবনে সাহল (জুজায নামে প্রসিদ্ধ): তিনি মুবাররেদ ও সা’
লাবের ছাত্র ছিলেন। তিনি তাঁর জীবিকা নির্বাহের জন্য কাঁচ ও স্ফটিকের পাত্র ও ছাঁচ তৈরি করতেন। এ কারণেই তাঁকে‘
জুজায’
বলা হয়। কথিত আছে প্রতিদিন তিনি তাঁর অর্জিত অর্থ হতে এক দিরহাম তাঁর শিক্ষক মুবাররেদকে শিক্ষার পারিশ্রমিক হিসেবে দিতেন। তিনি ৩১০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
১০. আবু আলী ফারেসী: তিনি ফার্সের ফাসার অধিবাসী ও দাইয়ালামার (দাইলামী শাসকদের) সমসাময়িক। কেউ কেউ তাঁকে সর্বশেষ আরবী ব্যাকরণবিদ বলেছেন।‘
তাসিসুশ শিয়া’
গ্রন্থের ৫১ পৃষ্ঠায় সালামাত ইবনে আয়ায শামীর‘
আল মিসবাহ্’
গ্রন্থের সূত্রে বলা হয়েছে ,নাহুশাস্ত্র (আরবী ব্যাকরণের বাক্য গঠনের নিয়মাবলী সম্পর্কিত শাস্ত্র) ফার্সে উৎপত্তি লাভ করে ফার্সেই সমাপ্তি ঘটেছে। এ কথার উদ্দেশ্য হলো নাহু ফার্সের সিবাভেইয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর বিকাশ আবু আলী ফারেসীর মৃত্যুর মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে। নিঃসন্দেহে উপরোক্ত কথায় অতিরঞ্জন রয়েছে।
১১. আবদুল কাহের জুরজানী: তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ,ব্যাকরণবিদ ,অভিধান রচয়িতা ও অলংকারশাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। অবশ্য আবদুল কাহেরের প্রসিদ্ধি বিশেষত অলংকারশাস্ত্র (বালাগাত) ও বাগ্মিতায়। তদুপরি তিনি বৈয়াকরণ হিসেবেও পরিচিত।
বালাগাত বা অলংকারশাস্ত্রে তাঁর কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে ,যেমন আসরারুল বালাগাহ্ ,দালায়িলুল ইজায ,ইজাযুল কোরআন প্রভৃতি। তিনি ৪৭১ অথবা ৪৭৪ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।
উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রসিদ্ধ আরো কিছু ব্যাকরণবিদ ইরানী ছিলেন। এখানে আমরা শুধু তাঁদের নাম উল্লেখ করছি: খালফ আহমার (দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর) ,আবু হাতেম সাজেসতানী ,ইবনে সিককীত আহওয়াযী (শিয়া ছিলেন) ,‘
আদাবুল কাতিব’
গ্রন্থের লেখক ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী। ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী এ গ্রন্থ ছাড়াও উয়ুনুল আখবার ,আল মা’
আরিফ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেছেন। আবু হানিফা দিনওয়ারী ভাষাবিদ ছাড়াও ঐতিহাসিক ,গণিতবিদ ও দার্শনিক ছিলেন। আবু বাকর ইবনিল খাইয়াত সামারকান্দীসহ পূর্বোক্তগণ তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ইরানী ব্যাকরণবিদগণের অন্তর্ভুক্ত। চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন হাসান ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে মারযবান সিরাফী সিরাজী (পূর্বে তাঁর পরিবার মাজুসী ছিল ও পরবর্তীতে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ্ ইসলাম গ্রহণ করেন) ,ইউসুফ ইবনে হাসান ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে মারযবান সিরাফী ,আবু বাকর খাওয়ারেজমী তাবারিস্তানী এবং ইবনে খলাভেই হামেদানী। এ ছাড়া পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর আবু মুসলিম ইসফাহানী এবং সপ্তম হিজরী শতাব্দীর নাজমুল আইম্মা রাযী আসতারাবাদী প্রসিদ্ধ ইরানী ব্যাকরণবিদগণের অন্তর্ভুক্ত।
আরবী ভাষার অলংকারশাস্ত্রেও অনেক ইরানী অবদান রেখেছেন ,যেমন আবদুল কাহের জুরজানী ,মুহাম্মদ ইবনে ইমরান মারযবানী খোরাসানী (তিনি একজন শিয়া এবং বলা হয়ে থাকে আরবী ভাষার বর্ণনাশাস্ত্রে তিনি পুরোধা ছিলেন। তিনি ৩৭১ হিজরীতে মারা যান) ,যামাখশারী ,সাহেব ইবনে ইবাদ তালেকানী (৩৮৫ হিজরীতে মৃত্যু) ,সাক্কাকী খাওয়ারেজমী (মৃত্যু সপ্তম হিজরী শতাব্দী) ,সাক্কাকীর‘
মিফতাহ্’
গ্রন্থের ব্যাখ্যা রচয়িতা কুতুব উদ্দীন সিরাজী (মৃত্যু ৭১০ হিজরী) ,তাফতাযানী নাসয়ী অথবা সারাখসী (মৃত্যু ৭৯১ হিজরী) এবং মীর সাইয়্যেদ শারিফ জুরজানী (মৃত্যু ৮১৬ হিজরী) ।
আরবী অভিধানশাস্ত্রবিদগণের মধ্যেও অনেক ইরানী রয়েছেন। যেমন‘
সেহহাহুল লুগাত’
গ্রন্থের রচয়িতা জাওহারী নিশাবুরী (মৃত্যু চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে) ,রাগেব ইসফাহানী (তিনি‘
মুফরাদাতুর রাগেব’
নামক অভিধান গ্রন্থ রচনা করেন ও ৫৬৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন) ,‘
কামুসুল লুগাত’
গ্রন্থের রচয়িতা মাজদুদ্দীন ফিরুযাবাদী (মৃত্যু ৮১৬ হিজরী) ,‘
আস্ সামী ফিল আসামী’
গ্রন্থের রচয়িতা মাইদানী নিশাবুরী (তিনি‘
মাজমাউল আমছাল’
নামেও একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং ৫১৮ হিজরীতে মারা যান) এবং অন্যান্য অনেকেই।
মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যেও অনেকে ইরানী। যেমন আবু হানিফা দিনওয়ারী ,ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারী ,তাবারী ,বালাজুরী (মৃত্যু ২৭৯ হিজরী) ,আবুল ফারাজ ইসফাহানী (তিনি উমাইয়্যা বংশোদ্ভূত ও ৩৫৬ হিজরীতে মারা যান) ,হামযা ইসফাহানী (মৃত্যু ৩৫০ হিজরী) প্রমুখ।
মুসলিম ঐতিহাসিকদের সংখ্যা প্রচুর। সম্ভবত ইতিহাসের মতো খুব কম বিষয়েই এত গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
জর্জি যাইদান বলেছেন ,
‘
মুসলমানরা অন্যান্য সকল জাতি হতে ইতিহাসে অগ্রসর ছিল ও এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছিল।‘
কাশফুল জুনুন’
গ্রন্থে মুসলিম ঐতিহাসিকদের রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৩০০ বলা হয়েছে। অবশ্য এ সংখ্যা শুধু মূল গ্রন্থের ;ব্যাখ্যাগ্রন্থসহ নয় এবং সংক্ষিপ্ত ও বিলুপ্ত গ্রন্থসমূহের নামও সেখানে আনা হয়নি... ঐতিহাসিক মাসউদী তাঁর‘
মুরুজুয যাহাব’
গ্রন্থে তাঁর সময়ে বিদ্যমান প্রচুর ইতিহাস গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন... ।’
ইসলামের ইতিহাস গ্রন্থ রচনায় বিভিন্ন জাতি অংশগ্রহণ করেছে ,যেমন স্পেনের ইবনে আবদুল বার ,ইবনে বাশকাওয়াল ও ইবনে আবার ,মিশরের মাকরিযী ও জামাল উদ্দীন কাফতী ,সিরিয়ার ইবনে আসাকির ও সাফাদী ,ইরাকের খতিব বাগদাদী ,আবদুর রহমান ইবনিল জাওযী ও তাঁর দৌহিত্র শামসুদ্দীন আবুল মুজাফ্ফার ইবনিল জাওযী ,ইরানী বংশোদ্ভূত ইবনে খাল্লেকান আরবিলী এবং তিউনিসিয়ার ইবনে খালদুন।
ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস গ্রন্থ বিদ্যমান ছিল। যেমন জীবনী বা সিরাত গ্রন্থ (যেমন সীরায়ে নাবাভী) ,বিশেষ ব্যক্তি ,কোন সম্রাট বা বাদশার ইতিহাস ,শহরের ইতিহাস (যেমন তারিখে কোম) ,দেশের ইতিহাস (তারিখে মিশর ,তারিখে দামেস্ক প্রভৃতি) ,বিশেষ জ্ঞান বা শাস্ত্রের ইতিহাস (যেমন তাবাকাতুল হুকামা ,তাবাকাতুল আতেব্বা ,তাবাকাতুল হুফ্ফাজ প্রভৃতি) ,সাধারণ ইতিহাস গ্রন্থ (যেমন তারিখে ইয়াকুবী ,তারিখে তাবারী)। এ ছাড়া কিছু সংখ্যক ভূগোলবিদও ইতিহাস লিখেছেন ,যেমন‘
আহসানুত্ তাফাসীর’
গ্রন্থের লেখক আল মাকদেসী ,‘
সুয়ারুল আকালিম’
ও‘
মাসালিকুল মামালিক’
গ্রন্থের লেখক ইসতাখরী ফারেসী প্রমুখ। আল্লামা সুয়ূতীর অনুসরণে জর্জি যাইদান ইসলামী যুগের সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক হিসেবে দু’
ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন :
একজন হলেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক যিনি একজন শিয়া ও ইরানী এবং অপরজন হলেন উরওয়াহ্ ইবনে যুবাইর (বিশিষ্ট সাহাবী যুবাইর ইবনুল আওয়ামের পুত্র)। কিন্তু আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর প্রমাণ করেছেন ইসলামের সর্বপ্রথম ইতিহাস রচয়িতা হযরত আলীর বায়তুল মাল রক্ষক উবাইদুল্লাহ্ ইবনে আবি রাফে। তিনি একজন মিশরীয় ও কিবতী বংশের। তাঁর রচিত ইতিহাস গ্রন্থে হযরত আলীর খেলাফতকালের তাঁর সহযোগী ব্যক্তিবর্গের বিবরণ রয়েছে।
যদি‘
সীরায়ে নাবাভী’
ও‘
সীরায়ে ইবনে হিশাম’
গ্রন্থের রচয়িতা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক মাতলাবী ইরানী হয়ে থাকেন তবে বলা যায় ইবনে আবি রাফের পর ইসলামের ইতিহাসে যে দু’
ব্যক্তি প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁদের একজন ইরানী ও অপরজন আরব কোরেশী (উরওয়াহ্ ইবনে যুবাইর)। তবে বর্তমানে এ তিন ব্যক্তির মধ্যে শুধু মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের লিখিত গ্রন্থ আমাদের হাতে রয়েছে ,অন্য দু’
টি বিলুপ্ত হয়েছে।
ইবনুন নাদিম তাঁর‘
আল ফেহেরেস্ত’
গ্রন্থে প্রথম যুগের মুসলিম ঐতিহাসিকদের মধ্যে যাঁরা‘
মাওয়ালী’
ছিলেন তাঁদের নাম উল্লেখ করেছেন।
‘
মাওয়ালী’
শব্দটির অর্থ সম্ভবত অনারব। আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই যে ,‘
মাওয়ালী’
বলতে ইরানীদের নাকি অনারবদের সকল জাতিকে ,নাকি আরবদের বিভিন্ন গোত্র যারা পরস্পর চুক্তিবদ্ধ তাদের বোঝান হয়। ইবনুন নাদিম ঐতিহাসিকদের অনেককেই মাওয়ালী বলে উল্লেখ করেছেন ও তাঁদের অনেকেই ইরানী ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তিনি যাঁদের নিশ্চিতভাবে ইরানী বলেছেন তাঁদের কয়েকজন হলেন প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ওয়াকেদী (মৃত্যু ২০৭ হিজরী) ,আবুল কাসেম হাম্মাদ ইবনে সাবুর দাইলামী (মৃত্যু ১৫৬ হিজরী) ,আবু জান্নাদ ইবনে ওয়াসেল আল কুফী ,আবুল ফাযল মুহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে আবদুল হামিদ আল কাতিব এবং আলান শুয়ূবী কুলাইনী রাযী।
আমাদের উপরোক্ত আলোচনা হতে কেউ যেন অসচেতনভাবে না ভাবেন যে ,আরবী ভাষা ,সাহিত্য ,ব্যাকরণ ,অভিধানশাস্ত্র ,অলংকারশাস্ত্র ,ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে কেবল ইরানীরাই ভূমিকা রেখেছেন ;বরং আরবী ভাষা ও ব্যাকরণে অন্যান্য জাতির মানুষ ,যেমন আরব ,মিশরীয় ,স্পেনীয় ,সিরীয় ,তুর্কী ,কুর্দী ও রোমীয় সকলেই অবদান রেখেছে যাঁদের অনেকেই বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আমরা এ গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় তাঁদের নাম উল্লেখ করা হতে বিরত থাকছি।
আরবী ভাষাজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রসিদ্ধ চারটি গ্রন্থ ও এগুলোর রচয়িতা: ইবনে কুতাইবা দিনওয়ারীর‘
আদাবুল কাতিব’
,মুবাররেদ রচিত‘
আল কামিল’
,জাহিয রচিত‘
আল বায়ান ওয়াত তাবয়ীন’
এবং আবু আলী কালীর‘
নাওয়াদের’
।
এ চার প্রসিদ্ধ লেখকের শুধু একজন ইরানী ,আর তিনি হলেন ইবনে কুতাইবা। তা ছাড়া মুবাররেদ হলেন আযদী আরব ,জাহিয হলেন কিনানী আরব এবং আবু আলী কালী হলেন এশিয়া মাইনর বা তুরস্কের দিয়ারবেকীরর অধিবাসী।
আহমাদ আমিন তাঁর‘
দোহাল ইসলাম’
গ্রন্থে‘
আল মুযহার’
গ্রন্থ হতে বর্ণনা করেছেন ,দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে আরবী ভাষা ,অভিধান ও কবিতার ক্ষেত্রে তিন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল ,যাঁদের পূর্বে ও পরবর্তীতে সমকক্ষ কেউ আসেনি। তাঁরা হলেন :
১. আবু যাইদ আনসারী খাজরাজী (মৃত্যু ২১৫ হিজরী)।
২. আসমায়ী (প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক ও ভাষাতাত্ত্বিক ,মৃত্যু ২১৫ হিজরী)।
৩. আবু উবাইদা মুয়াম্মার ইবনুল মুসান্না (মৃত্যু ২১০ হিজরী)।
উপরোক্ত তিনজনের মধ্যে একমাত্র আবু উবাইদা ইরানী বংশোদ্ভূত। আবু যাইদ মদীনার খাজারাজ গোত্রীয় আরব এবং আসমায়ী বাহেলী আরব।