কালামশাস্ত্র
কালামশাস্ত্র ইসলামের একটি নিজস্ব জ্ঞান। কালামশাস্ত্র ইসলামের মৌলবিশ্বাস ও এর প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত গবেষণামূলক জ্ঞান। কালামশাস্ত্রে আল্লাহর একত্ববাদ ও গুণাবলীকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক (আকলী) জ্ঞান যেমন রয়েছে তেমনি ওহী ও হাদীসনির্ভর বর্ণনামূলক (নাকলী) জ্ঞানও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ শিয়াদের দৃষ্টিতে ইমামত। সুতরাং কালামশাস্ত্র আকলী ও নাকলী জ্ঞানের সমন্বয়ে সৃষ্ট।
ইসলামের মতো ধর্মে যা স্রষ্টা ,সৃষ্টি ,পুনরুত্থান ও বিশ্বজগৎ সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ও এ বিষয়ে বিভিন্ন বক্তব্য রেখেছে এরূপ একটি জ্ঞান বিদ্যমান থাকা আবশ্যকীয়। বিশেষত প্রথম শতাব্দীগুলোতে মুসলিম সমাজে জ্ঞানের প্রতি যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল তাতে কালামশাস্ত্রের ন্যায় জ্ঞানের উদ্ভব ঘটা স্বাভাবিক ছিল।
পবিত্র কোরআন তাওহীদ ,নবুওয়াত ও আখেরাতের মতো আকীদা সংক্রান্ত বিষয়ে অনেক স্থানে দলিল উপস্থাপন করেছে এবং এর বিরোধীদেরকে যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপনের আহ্বান জানিয়েছে। যেমন বলেছে ,قل هاتوا برهانكم إن كنتم صادقين
‘
যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক তবে প্রমাণ উপস্থাপন কর।’
নিঃসন্দেহে ইসলামী আকীদা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ,যেমন সসীম ও অসীম ,স্রষ্টা ও সৃষ্ট ,স্থান-কালের ঊর্ধ্বে ও স্থান-কালের অধীন ,বাধ্যবাধকতা ,স্বাধীনতা (জাবর ও ইখতিয়ার) ,মৌলিকত্ব ও যৌগিকতা ও এরূপ অন্যান্য আলোচনা সর্বপ্রথম হযরত আলী (আ.) উপস্থাপন করেছেন। এ কারণেই শিয়াগণ বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী ছিল।
ইসলামে ইরানীদের অবদানের আলোচনায় কালামশাস্ত্রে ইরানীদের ভূমিকার বিষয়টি শিয়া কালামশাস্ত্রবিদদের দিয়ে শুরু করছি।
১. প্রথম শিয়া কালামশাস্ত্রবিদ যিনি এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি হলেন আলী ইবনে ইসমাঈল ইবনে মাইসাম তাম্মার। তাঁর পিতামহ মাইসাম হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও প্রসিদ্ধ বক্তা ছিলেন। তিনি বাহরাইনের হিজরের অধিবাসী হলেও বংশগতভাবে ইরানী ছিলেন। তাঁর পৌত্র আলী ইবনে ইসমাঈল ইবনে মাইসাম ,দারার ইবনে আমর ,আবুল হাযিল আলাফ ও আমর ইবনে উবাইদের সমকালীন ব্যক্তি ছিলেন। এরা সকলেই দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর কালামশাস্ত্রবিদ। তিনি এদের সঙ্গে কালামশাস্ত্রীয় আলোচনা করতেন।
২. হিশাম ইবনে সালেম জাওযাজানী: এই ব্যক্তি ইমাম সাদিক (আ.)-এর বিশিষ্ট ও প্রসিদ্ধ সাহাবী। ইমাম সাদিকের কিছু সাহাবীকে ইমাম নিজে‘
কালামশাস্ত্রবিদ’
বলে অভিহিত করেছিলেন ,যেমন হামরান ইবনে আইয়ান ,মুমিন আলতাক ,কাইস ইবনিল মাসের ,হিশাম ইবনে হাকাম প্রমুখ।
কাইস ইবনিল মাসের ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর নিকট কালাম শিক্ষা লাভ করেছিলেন বলে কথিত আছে।
৩. ফাযল ইবনে আবু সাহল ইবনে নওবাখত: তিনি নওবাখত বংশের। ইবনুন নাদিমের বর্ণনা মতে এ বংশটি শিয়া হিসেবে প্রসিদ্ধ ও তিন শতাব্দী ধরে তাঁদের মধ্য থেকে প্রসিদ্ধ আলেমের আগমন ঘটেছিল। ফাযলের পিতামহ নওবাখত একজন জ্যোতির্বিদ ও আব্বাসীয় খলীফা মনসুরের দরবারে কর্মরত ছিলেন।
একদিন নওবাখত তাঁর পুত্র আবু সাহলকে মনসুরের দরবারে নিয়ে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। মনসুর তাঁর নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন ,‘
খুরশীদ মাহ তিমাযাহ মা বজারাদ বাদ খসরু না শাহ।’
মনসুর বলেন ,‘
এর পুরোটাই তোমার নাম ?’
তিনি বলেন ,‘
হ্যাঁ।’
মনসুর হেসে বলেন ,‘
তোমার বাবা তোমার কি অবস্থা করেছে! তোমার নামকে সংক্ষিপ্ত কর ,তিমাযা রাখ নতুবা আমার দেয়া‘
আবু সাহল’
নামটি গ্রহণ কর।’
আবু সাহল এ নাম গ্রহণে রাজী হলেন।
এর পরবর্তীতে নওবাখতীদের অধিকাংশের নাম‘
আবু সাহল’
রাখার প্রচলন ছিল।
শিয়া কালামশাস্ত্রবিদদের অনেকেই নওবাখতী বংশের ,যেমন ফাযল ইবনে আবি সাহল ইবনে নওবাখত যিনি খলীফা হারুনের‘
বায়তুল হিকমাহ্’
নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারের দায়িত্বশীল ও ফার্সী হতে আরবীতে গ্রন্থসমূহ অনুবাদের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তেমনি ইসহাক ইবনে আবি সাহল ইবনে নওবাখত ,তাঁর দু’
পুত্র ইসমাঈল ইবনে ইসহাক ইবনে আবি সাহল ও আলী ইবনে ইসহাক নওবাখত এবং পৌত্র আবু সাহল ইসমাঈল ইবনে আলী ইবনে ইসহাক সকলেই শিয়া কালামশাস্ত্রবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বিশেষত আবু সাহল ইসমাঈল ইবনে আলী শিয়াদের মধ্যে‘
শাইখুল মুতাকাল্লিমীন’
(কালামশাস্ত্রবিদগণের নেতা) উপাধি পান। তাঁর ভাগ্নেয় হাসান ইবনে মূসা নওবাখতীসহ ইরানী এ বংশটির আরো কিছু ব্যক্তি প্রসিদ্ধ শিয়া মুতাকাল্লিমদের
অন্তর্ভুক্ত।
৪. ফাযল ইবনে শাজান নিশাবুরী: তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষাংশ ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধের ব্যক্তিত্ব। তাঁর সম্পর্কে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। ফাযল ইবনে শাজান ইমাম রেযা (আ.) ,ইমাম জাওয়াদ এবং ইমাম হাদী (আ.)-এর শিষ্য হিসেবে পরিগণিত। তিনি কালামশাস্ত্রে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
৫. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে মামলাক জুরজানী ইসফাহানী: তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আবু আলী জাবায়ীর সমসাময়িক।
৬. আবু জাফর ইবনে কুব্বা রাযী: তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর কালামশাস্ত্রবিদদের অন্যতম। তিনি ইমামতের বিষযে আবুল কাসেম কা’
ব বালখীর সঙ্গে পত্র বিনিময় ও বিতর্ক করেছেন।
৭. আবুল হাসান সুসানগারদী: তিনি ইবনে কুব্বা রাযীর সমসাময়িক। কথিত আছে তিনি আবু সাহল ইসমাঈল ইবনে আলী নওবাখতীর দাস ছিলেন। তিনি পঞ্চাশ বার হেঁটে হজ্বব্রত পালন করেন।
৮. আবু আলী ইবনে মাসকাভীয়ে রাযী ইসফাহানী: তিনি ইসলামের বিশিষ্ট কালামশাস্ত্রবিদ ,দার্শনিক ও চিকিৎসকদের অন্যতম। এ শাস্ত্রে তাঁর প্রসিদ্ধ দু’
টি গ্রন্থ হলো‘
আল ফাউযুল আকবার’
ও আল ফাউযুল আসগার’
যা বর্তমানে মুদ্রিত ও ছাপা হয়েছে। তাঁর লিখিত‘
তাহারাতুল আরাক’
ইসলামী নৈতিকতার বিষয়ে লিখিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তিনি প্রসিদ্ধ দার্শনিক ও চিকিৎসক ইবনে সিনার সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব এবং ৪৩১ হিজরীতে মারা যান।
শিয়া কালামশাস্ত্রবিদগণ ইরানী অ-ইরানী সব মিলিয়ে অনেক। আমরা শুধু উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় হতে চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর কিছু সংখ্যক কালামশাস্ত্রবিদের নাম উল্লেখ করলাম। অবশ্য সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে মুসলিম কালামশাস্ত্রবিদদের মূল ভিত্তি হিসেবে শিয়া কালামশাস্ত্রবিদরাই মুখ্য।
বিশিষ্ট দার্শনিক ,কালামশাস্ত্রবিদ ,গণিতবিদ ও রাজনীতিক খাজা নাসিরুদ্দীন তুসীর আবির্ভাব ও‘
আত তাজরীদ’
গ্রন্থ রচনার ফলে শিয়া কালামশাস্ত্র বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে এবং এর পরবর্তীতে শিয়া ও সুন্নী উভয় কালামশাস্ত্রই এই গ্রন্থকে কেন্দ্র করে আলোচনা উপস্থাপন শুরু করে।