ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান2%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 112227 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

প্রথম স্তরের দার্শনিক

ইসলামী দর্শন ফিলসুফুল আরাব নামে প্রখ্যাত দার্শনিক আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইসহাক কিন্দীর মাধ্যমে শুরু হয়েছে। আল কিন্দী খাঁটি আরব এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুন ও মুতাসিম বিল্লাহর সমসাময়িক। তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব হলেন হুনাইন ইবনে ইসহাক ও আবদুল মাসিহ ইবনে নায়েমা হামাছী। তাঁরা উভয়েই প্রসিদ্ধ অনুবাদক। উসূলুজিয়া গ্রন্থের ভূমিকায় বলা হয়েছে ,এ গ্রন্থটি আবদুল মাসিহ অনুবাদ করেছেন এবং আবু ইয়াকুব কিন্দী তা সংস্কার ও সংশোধন করেছেন। স্বয়ং আবু ইয়াকুব অনুবাদক ছিলেন কিনা এ বিষয়ে মতান্তর রয়েছে। অবশ্য কিন্দীর ছাত্র আবু মাশার বালখী বর্ণনা করেছেন ,কিন্দী ইসলামী শাসনামলের প্রথম শ্রেণীর চারজন অনুবাদকের অন্যতম। কিন্দীর সময়কাল ইসলামী সভ্যতার অনুবাদের যুগ হলেও কিন্দী দর্শনের ক্ষেত্রে উচ্চতর অবস্থানে ছিলেন ও স্বতন্ত্র মতের অধিকারী ছিলেন। বলা হয়ে থাকে তাঁর প্রায় দু সত্তরটি গ্রন্থ ও পুস্তিকা ছিল। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে যুক্তিবিদ্যা ,দর্শন ,জ্যোতির্বিদ্যা ,গণিতশাস্ত্র ,জ্যামিতি ,চিকিৎসাশাস্ত্র ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর রচিত তাঁর গ্রন্থের একটি তালিকা দিয়েছেন। কিন্দীর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থ সম্প্রতি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থগুলো হতে এই দার্শনিকের মূল্য তাঁর সম্পর্কে পূর্ব ধারণা হতে অনেক বেশি তা বোঝা গিয়েছে। কিন্দী নিঃসন্দেহে বিশ্বের এক বিরল প্রতিভা ও ইসলামী সভ্যতার উজ্জ্বল নক্ষত্র। কোন কোন ইউরোপীয় চিন্তাবিদ তাঁকে বিশ্ব ইতিহাসের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের শ্রেষ্ঠ বারোজন ব্যক্তির অন্যতম বলে উল্লেখ করেছেন।২৯৬

কিন্দী আত্মপরিশোধিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পূর্বের ও পরের মুসলমান ও অমুসলমান দার্শনিকদের মধ্যে তাঁর ন্যায় উত্তম ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া যায় না।

কিন্দী বসরা ও বাগদাদে শিক্ষাজীবন কাটালেও সে সময় এ দু স্থানে কোন দার্শনিকই ছিলেন না। তাই কিন্দী তাঁর পূর্বের কোন দার্শনিকের সঙ্গে সম্পর্কহীন হিসেবে ইসলামী দর্শনের প্রথম বিন্দুতে অবস্থান করছেন।

জনাব তাকী যাদেহ্ তাঁর তারিখে উলুম দার ইসলাম গ্রন্থে এবং অধ্যাপক হেনরী কেরবেন তাঁর ইসলামী দর্শনের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ,কিন্দী তাঁর এক গ্রন্থে (পুস্তিকায়) ইসলামী খেলাফতের সময়কাল কতদিন স্থায়ী হবে তা নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা প্রায় সঠিক হয়েছিল। আমরা এখানে অধ্যাপক কারবানের বক্তব্যটি তুলে ধরছি :

এই দার্শনিক (কিন্দী) তাঁর এক পুস্তিকায় গ্রীক জ্যোতির্বিদ্যা ও কোরআনের তাফসীরের সহায়তায় ইসলামী খেলাফতের স্থায়িত্ব ৬৯৩ বলেছিলেন।

কেউ কেউ বলেছেন , মুসলমানগণ গ্রীক দর্শনের সঙ্গে গ্রীস ও আলেকজান্দ্রিয়ার বিভিন্ন দার্শনিকের গ্রন্থের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা গ্রন্থের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিল এবং বিভিন্ন ইহুদী ও খ্রিষ্টান মনীষী ,যেমন কুয়াইরী ,ইউহান্না ইবনে হাইলান ,আবু ইয়াহিয়া আল মারওয়াজী (মারূরুদী সুরইয়ানী) ,আবু বাশার মাত্তা ইবনে ইউনুস ও আবু যাকারিয়া ইয়াহিয়া ইবনে আদীর মাধ্যমে তা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ বক্তব্যটি সঠিক নয় ;বরং মুসলমানদের দর্শনের পরিচিতি এমনকি তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র চিন্তার দার্শনিকের উদ্ভবও উপরোল্লিখিত ব্যক্তিবর্গের যুগের পূর্বে ঘটেছিল। কারণ ইসলামী দর্শন আবু ইউসুফ ইয়াকুব কিন্দীর মাধ্যমে শুরু হয় এবং তাঁর ছাত্রদের মাধ্যমে তা অব্যাহত থাকে।

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ ,যেমন ইবরাহীম কুয়াইরী ,ইউহান্না ইবনে হাইলান ,ইবরাহীম মুরুজী ,ইবনে কারনিব আল কিন্দীর ছাত্রদের সমসাময়িক। আবার কেউ কেউ ,যেমন আবু বাশার ইবনে মাত্তা ও ইয়াহিয়া ইবনে আদী প্রমুখ তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তীতে বিস্তারিত আলোচনা করব এবং ইসলামী দর্শনে তাঁদের প্রভাব কতটুকু ছিল তাও বিশ্লেষণ করব।

কিন্দী যেমন একদিকে উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক ছিলেন তেমনি পবিত্র চিন্তার অধিকারী ও ধর্মীয় বিশ্বাসের একজন রক্ষক ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মের সপক্ষে যুক্তিনির্ভর অনেক গ্রন্থ লিখেছেন। কেউ কেউ তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যকে নির্ভর করে তাঁকে শিয়া বলেছেন। কিন্দী সেই সকল ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত যাঁরা ইসলাম ও দর্শনের মৌলনীতির মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ইসলামের পক্ষাবলম্বন করতেন। যেমন বিশ্বজগতের সৃষ্ট হওয়া ও কিয়ামতে দৈহিক পুনরুত্থানের বিষয়ে তিনি ইসলামের মতকে সমর্থন করেছেন।

কিন্দী সব সময় চেষ্টা করতেন ইসলামী জ্ঞান ও দর্শনের মৌলনীতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের। সমন্বয়ের এ বিষয়টি কিন্দীর মাধ্যমে শুরু হয় ও অব্যাহত থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো কেউ কেউ তাঁর নাম ইয়াকুব ,তাঁর পিতার নাম ইসহাক ও উপনাম আবু ইউসুফ হওয়ায় তাঁকে ইহুদী মনে করেছেন এবং বর্ণনা করেছেন তিনি কোরআনের বিরুদ্ধে গ্রন্থ রচনার চিন্তা করেছিলেন। নিঃসন্দেহে এ বর্ণনা ভিত্তিহীন ও মিথ্যা।

বর্তমানে গবেষণার মাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে এ বিষয়গুলো প্রমাণিত হয়েছে যে ,প্রথমত পূর্বে তাঁর কর্মের মূল্য সম্পর্কে যে ধারণা করা হতো তাঁর অবদান তা হতে অনেক বেশি ;দ্বিতীয়ত তিনি একজন পবিত্র হৃদয়ের মুসলমান হিসেবে ইসলামী বিশ্বাসের প্রতিরক্ষক ছিলেন ;তৃতীয়ত তাঁর সামাজিক ও জ্ঞানগত অবস্থানের কারণে তাঁর প্রতি অন্যরা হিংসা করত ও তাঁর নামে অপপ্রচার চালাত।

পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে ,তিনি তাঁর স্তরের অর্থাৎ প্রথম পর্যায়ের একমাত্র দার্শনিক। তাঁর যুগে তিনি ব্যতীত অন্য কোন দার্শনিক ছিলেন না। কিন্দী ২৫৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

দ্বিতীয় স্তরের দার্শনিকগণ

এ স্তরে দু দল দার্শনিক রয়েছেন যাঁদের একদল কিন্দীর ছাত্র ও অন্যদল কিন্দীর ছাত্র নন। প্রথম দলের ব্যক্তিবর্গ হলেন :

১. আহমাদ ইবনুন তাইয়্যেব সারাখশী (আবুল আব্বাস): তিনি কিন্দীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ ছাত্র। তিনি ২১৮ হিজরীতে জন্ম ও ২৮৬ হিজরীতে কাসেম ইবনে উবাইদুল্লাহর হাতে নিহত হন। ইবনে আবি আছিবায়াহ্ সারখশীর চুয়ান্নটি গ্রন্থ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন যার কোনটি এখন বিদ্যমান নেই। তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো আল মাসালিক ওয়াল মামালিক যা সম্ভবত ভূগোলশাস্ত্রে লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। তিনি আরবী ব্যাকরণশাস্ত্র ,যুক্তিবিদ্যা ,দর্শনের মৌলনীতি ও বিতর্কের কৌশল বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন।

হেনরী কারবান বলেছেন , তিনি আরবী ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের উদ্ভাবক এবং হামযা ইসফাহানীর মাধ্যমে এর পূর্ণতা ঘটে। তিনি আরো বলেছেন , দার্শনিক জেনোর ব্যবহৃত বিভিন্ন পরিভাষা তিনি আরবীতে ব্যাখ্যা করেন ও তা হতে মূল্যবান তথ্য হস্তগত করেন। যদি তিনি তা না করতেন তবে জেনোর দর্শন সম্পর্কে মুসলিম বর্ণনাসমূহে বিষয়টি অস্পষ্ট থাকত।

তিনিও নাস্তিকতার অপবাদ হতে বাঁচতে পারেননি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে লিসানুল মিযান আইয়ানুশ শিয়া গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁকে শিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

২. আবু যাইদ আহমাদ ইবনে সাহল বালখী: তিনি সাহিত্যিক ও দার্শনিক ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর জীবনী আলোচনায় তাঁকে সাহিত্যিক ও লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন ;দার্শনিক হিসেবেও তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন।২৯৭ তিনি মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযীর জীবনী আলোচনায় মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযী ইবনে বালখীর নিকট দর্শন শিক্ষা করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন এবং ইবনে বালখী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। যদিও তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করেননি যে ,এই ব্যক্তি আবু যাইদ বালখী নাকি অন্য কোন ইবনে বালখী। তিনি বলেছেন , আমি বিভিন্ন বিষয়ে ইবনে বালখী কর্তৃক লিখিত অনেক গ্রন্থ দেখেছি যেগুলো অসম্পূর্ণ ও খসড়া অবস্থায় ছিল।

বালখী দর্শনশাস্ত্র ছাড়াও ইসলামী সাহিত্যের প্রথম সারির একজন সাহিত্যিক ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে সাহিত্যে জাহেযের সমকক্ষ ,আবার কেউ কেউ জাহেযের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলেছেন।

ইবনুন নাদিম তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহের তালিকায় শারায়িউল আদইয়ান ,নাজমুল কোরআন ,কাওয়ারিউল কোরআন ,গারিবুল কোরআন ও ফাযায়িলু মাক্কা নামক গ্রন্থও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইবনে বালখী ৩২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

ইবনুন নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও ইবনে কাফতীর তারিখুল হুকামা গ্রন্থে বালখী যে কিন্দীর ছাত্র ছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের ঐতিহাসিকগণ সকলেই তাঁকে কিন্দীর ছাত্র বলেছেন। সম্ভবত এ বর্ণনাটি তাঁরা ইয়াকুব হামাভীর মুজামুল উদাবা গ্রন্থ হতে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যদি বালখী প্রকৃতই ৩২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করে থাকেন তবে তাঁর পক্ষে কিন্দীর ছাত্র হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কিন্দী ২৫৮ হিজরীতে মারা যান ,বালখীর মৃত্যুর ৬৪ বছর পূর্বে তিনি পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছেন। অবশ্য যদি ধরা হয় যে ,বালখী একশ বছরের মতো বেঁচে ছিলেন ,কিন্তু মুজামুল উদাবা য় উল্লিখিত হয়েছে বালখী ৮৭ বছর বেঁচে ছিলেন। সে ক্ষেত্রে কিন্দীর মৃত্যুর সময় বালখীর বয়স ছিল ২৩ বছর। তাই বালখী হয় কিছু সময়ের জন্য কিন্দীর ছাত্র ছিলেন নতুবা তাঁর ছাত্রের ছাত্র হিসেবে পরোক্ষভাবে তাঁর ছাত্র ছিলেন। সম্ভবত বালখীও শিয়া ছিলেন। যে কারণে তাঁকেও নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কথিত আছে প্রসিদ্ধ দার্শনিক আবুল হাসান আমেরী বালখীর ছাত্র ছিলেন ,কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তা সঠিক নয় বলে মনে হয়।

৩. আবু মাশার জাফর ইবনে মুহাম্মদ বালখী: তিনি একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। প্রথম জীবনে কিন্দীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করতেন। কিন্দী বিভিন্ন কৌশলে তাঁকে গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আসক্ত করে তাঁর শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতার অপনোদন করেন। আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁকে কিন্দীর ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।২৯৮ আবু মাশার একশ র অধিক বছর জীবিত ছিলেন ও ২৭২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দার্শনিক অপেক্ষা ঐতিহাসিক ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে অধিকতর প্রসিদ্ধ ।

ইবনুন নাদিম হাসনাভীয়া ,নাফতাভীয়া ,সালামাভীয়া ও এরূপ কাছাকাছি নামের আরেক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাঁদের কিন্দীর ছাত্র বলেছেন। এদের সম্পর্কে আমরা ইবনুন নাদিমের বর্ণনার অতিরিক্ত কিছু জানি না। তবে এটুকু জানি ,সালামাভীয়া নামের একজন চিকিৎসক কিন্দীর সমসাময়িক ছিলেন যিনি আব্বাসীয় খলীফা মুতাসিমের বিশেষ চিকিৎসক ছিলেন। ইবনুন নাদিম ও ইবনে আবি আছিবায়াহ্ তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ ব্যক্তি সুরিয়ানী ও খ্রিষ্টান ছিলেন। কিন্তু এই সালামাভীয়াকেই ইবনুন নাদিম কিন্দীর ছাত্র বলেছেন কিনা তা আমরা জানি না।

দাবিস মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযীদ নামে কিন্দীর অপর এক ছাত্র ছিলেন যাঁর সম্পর্কে ইবনুন নাদিম আলোচনা করেছেন। ইবনে আবি আছিবায়াহ্ কিন্দীর লিখিত পত্রসমূহের আলোচনায় যারনাব নামের অপর এক ব্যক্তির উল্লেখ করে বলেছেন , এ পত্রটি জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নকারী ছাত্র যারনাবের প্রতি লিখিত।

দ্বিতীয় স্তরের দার্শনিকদের মধ্যে যাঁরা কিন্দীর ছাত্র ছিলেন না তাঁরা হলেন :

১. আবু ইসহাক ইবরাহীম কুয়াইরী: ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে আবুল আব্বাস সারাখশীর নামের পর ইবরাহীম কুয়াইরী নাম উল্লেখ করে বলেছেন , তাঁর নিকট অনেকেই যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা করতেন। তিনি পূর্ববর্তী ব্যক্তিবর্গের গ্রন্থাবলীর ব্যাখ্যাদাতা ও বিশ্লেষক ছিলেন।

ইবনে আবি আছিবায়াহ্ তাঁর উউনুল আম্বা গ্রন্থে ফারাবীর জীবনী আলোচনায় ফারাবীর বর্ণনা হতে গ্রীসে দর্শনের জন্ম ও সেখান হতে আলেকজান্দ্রিয়ায় স্থানান্তরের ইতিহাসের আলোচনার পর কুয়াইরীর সম্পর্কে ফারাবীর নিম্নোক্ত বক্তব্য এনেছেন :

ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান ইনতাকীয়ায় (সিরিয়া) স্থানান্তরিত হয়। ফলে দর্শনজ্ঞানের এমন এক মন্দা অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যে ,ইনতাকীয়ায় একজন মাত্র শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নিকট মারভের এক ব্যক্তি ও হারানের অধিবাসী অপর এক ব্যক্তিই শুধু দর্শন শিক্ষা করেছিলেন । এ দু ব্যক্তি ইনতাকীয়া হতে বেশ কিছু গ্রন্থ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইবরাহীম মুরুজী ও ইউহান্না ইবনে হাইলান মারভের ঐ ব্যক্তির নিকট এবং ইসরাঈল আসকাফ ও ইবরাহীম কুয়াইরী হারানের অধিবাসীর নিকট দর্শন শিক্ষা করেন। ইসরাইল ও কুয়াইরী উভয়েই বাগদাদে যান। ইসরাইল ধর্মীয় জ্ঞানে ব্যাপৃত হলেও কুয়াইরী শিক্ষা দান শুরু করেন। ইউহান্না ইবনে হাইলানও ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ,কিন্তু ইবরাহীম মুরুজী শিক্ষা দানকে অগ্রাধিকার দেন। আবু বাশার মাতী তাঁর নিকট দর্শন শিক্ষা লাভ করেন।২৯৯

অবশ্য ফারাবীর বিস্তারিত বর্ণনা হতে বোঝা যায় ইনতাকীয়ার খ্রিষ্টীয় শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা যুক্তিবিদ্যার মধ্যেই সীমিত ছিল। ফারাবীর নিজের বর্ণনা মতে তিনি ইউহান্না ইবনে হাইলানের নিকট যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা করেন। তিনি বলেন ,যুক্তিবিদ্যা জ্ঞান মুসলমানদের নিকট আসার পরই গীর্জা কর্তৃক যুক্তিবিদ্যা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি রহিত হয়।

মাসউদী তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ আত তানবীহ্ ওয়াল আশরাফ গ্রন্থে বলেছেন , আমি ফুনুনুল মা আরিফ ওয়া মা জারা ফিদ দুহুরিস সাওয়ালিফ গ্রন্থে উমর ইবনে আবদুল আজিজের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রটি ইনতাকীয়ায় স্থানান্তরের কারণ নিয়ে আলোচনা করেছি। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খলীফা মুতাওয়াক্কিলের সময়ে তা আন্টাকিয়া হতে হারানে স্থানান্তরিত হয়। মু তাদিদের শাসনামলে৩০০ এ শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষকতার দায়িত্ব ইবরাহীম কুয়াইরী ,ইউহান্না ইবনে হাইলান (মুক্তাদিরের সময় বাগদাদে মারা যান) ও ইবরাহীম মুরুজীর হাতে অর্পিত ছিল। অতঃপর আবু আহমাদ ইবনে কারনিব ও আবু বাশার মাত্তা এ দায়িত্ব লাভ করেন। ইবনুন নাদিমের বর্ণনা মতে কুয়াইরী আবু বাশার মাত্তার শিক্ষক ছিলেন।

২. আবু ইয়াহিয়া: তিনিই পূর্বোল্লিখিত ইবরাহীম মুরুজী। তিনিও আবু বাশার মাত্তার শিক্ষক ছিলেন । ইবনুন নাদিম বলেছেন , তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী এবং যুক্তিবিদ্যার সকল গ্রন্থ সুরিয়ানী ভাষায় লিখেছেন। ৩০১

৩. ইউহান্না ইবনে হাইলান: পূর্বে ইবরাহীম কুয়াইরীর সঙ্গে তাঁর নাম আমরা উল্লেখ করেছি। বলা হয়ে থাকে তিনি ফারাবীর যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু ফারাবী কোথায় তাঁর নিকট যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেছেন তা জানা যায়নি। অবশ্য কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন ফারাবী যুক্তিবিদ্যা শিক্ষার জন্য হারানে ইউহান্নার নিকট যান।৩০২

কাফতী বলেছেন ,বাগদাদে তিনি তাঁর নিকট শিক্ষাগ্রহণ করেন।৩০৩ কিন্তু উয়ুনুল আম্বা য় ফারাবীর বর্ণনা মতে মনে হয় ইউহান্না বাগদাদে আসেননি।

৪. আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইরানশাহরী নিশাবুরী: এই ব্যক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। আবু রাইহান বিরুনী তাঁর আল আছারুল বাকীয়াহ্ এবং নাসির খসরু তাঁর যাদাল মুসাফিরিন গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযীর কিছু দার্শনিক চিন্তা ,যেমন স্থানের চিরন্তনতা ,অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের মাঝে একটি বিষয় (هيولا ) তাঁর নিকট থেকে নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। কথিত আছে তিনি অনারবদের নবী হিসেবে নিজেকে দাবি করেছিলেন।৩০৪ ইরানশাহরী কিন্দীর ছাত্র ছিলেন নাকি কুয়াইরী ,ইবনে হাইলান ও মুরুজীর স্তরের তা স্পষ্ট নয়।

উপরোক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট যে ,চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত দর্শন শিক্ষায় দু টি ধারা বিদ্যমান ছিল। প্রথম ধারা কিন্দীর মাধ্যমে শুরু হয় এবং তিনি দর্শনের সঙ্গে যুক্তিবিদ্যা ,চিকিৎসাশাস্ত্র ,জ্যোতির্বিদ্যা ,সংগীতকলা প্রভৃতি বিষয়ও শিক্ষা দিতেন। অন্য ধারাতে যুক্তিবিদ্যার অধিক কিছু শিক্ষা দেয়া হতো না।


22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35