দ্বিতীয় স্তরের দার্শনিকগণ
এ স্তরে দু’
দল দার্শনিক রয়েছেন যাঁদের একদল কিন্দীর ছাত্র ও অন্যদল কিন্দীর ছাত্র নন। প্রথম দলের ব্যক্তিবর্গ হলেন :
১. আহমাদ ইবনুন তাইয়্যেব সারাখশী (আবুল আব্বাস): তিনি কিন্দীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও প্রসিদ্ধ ছাত্র। তিনি ২১৮ হিজরীতে জন্ম ও ২৮৬ হিজরীতে কাসেম ইবনে উবাইদুল্লাহর হাতে নিহত হন। ইবনে আবি আছিবায়াহ্ সারখশীর চুয়ান্নটি গ্রন্থ ছিল বলে উল্লেখ করেছেন যার কোনটি এখন বিদ্যমান নেই। তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো‘
আল মাসালিক ওয়াল মামালিক’
যা সম্ভবত ভূগোলশাস্ত্রে লিখিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। তিনি আরবী ব্যাকরণশাস্ত্র ,যুক্তিবিদ্যা ,দর্শনের মৌলনীতি ও বিতর্কের কৌশল বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন।
হেনরী কারবান বলেছেন ,‘
তিনি আরবী ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের উদ্ভাবক এবং হামযা ইসফাহানীর মাধ্যমে এর পূর্ণতা ঘটে।’
তিনি আরো বলেছেন ,‘
দার্শনিক জেনোর ব্যবহৃত বিভিন্ন পরিভাষা তিনি আরবীতে ব্যাখ্যা করেন ও তা হতে মূল্যবান তথ্য হস্তগত করেন। যদি তিনি তা না করতেন তবে জেনোর দর্শন সম্পর্কে মুসলিম বর্ণনাসমূহে বিষয়টি অস্পষ্ট থাকত।’
তিনিও নাস্তিকতার অপবাদ হতে বাঁচতে পারেননি।‘
রাইহানাতুল আদাব’
গ্রন্থে‘
লিসানুল মিযান’
ও‘
আইয়ানুশ শিয়া’
গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁকে শিয়া বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২. আবু যাইদ আহমাদ ইবনে সাহল বালখী: তিনি সাহিত্যিক ও দার্শনিক ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর জীবনী আলোচনায় তাঁকে সাহিত্যিক ও লেখকদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন ;দার্শনিক হিসেবেও তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন।
তিনি মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযীর জীবনী আলোচনায় মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযী ইবনে বালখীর নিকট দর্শন শিক্ষা করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন এবং ইবনে বালখী সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন। যদিও তিনি এ বিষয়টি পরিষ্কার করেননি যে ,এই ব্যক্তি আবু যাইদ বালখী নাকি অন্য কোন ইবনে বালখী। তিনি বলেছেন ,‘
আমি বিভিন্ন বিষয়ে ইবনে বালখী কর্তৃক লিখিত অনেক গ্রন্থ দেখেছি যেগুলো অসম্পূর্ণ ও খসড়া অবস্থায় ছিল।’
বালখী দর্শনশাস্ত্র ছাড়াও ইসলামী সাহিত্যের প্রথম সারির একজন সাহিত্যিক ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে সাহিত্যে জাহেযের সমকক্ষ ,আবার কেউ কেউ জাহেযের চেয়েও শ্রেষ্ঠ বলেছেন।
ইবনুন নাদিম তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহের তালিকায় শারায়িউল আদইয়ান ,নাজমুল কোরআন ,কাওয়ারিউল কোরআন ,গারিবুল কোরআন ও ফাযায়িলু মাক্কা নামক গ্রন্থও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইবনে বালখী ৩২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
ইবনুন নাদিমের‘
আল ফেহেরেস্ত’
ও ইবনে কাফতীর‘
তারিখুল হুকামা’
গ্রন্থে বালখী যে কিন্দীর ছাত্র ছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের ঐতিহাসিকগণ সকলেই তাঁকে কিন্দীর ছাত্র বলেছেন। সম্ভবত এ বর্ণনাটি তাঁরা ইয়াকুব হামাভীর‘
মুজামুল উদাবা’
গ্রন্থ হতে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যদি বালখী প্রকৃতই ৩২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করে থাকেন তবে তাঁর পক্ষে কিন্দীর ছাত্র হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কিন্দী ২৫৮ হিজরীতে মারা যান ,বালখীর মৃত্যুর ৬৪ বছর পূর্বে তিনি পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছেন। অবশ্য যদি ধরা হয় যে ,বালখী একশ’
বছরের মতো বেঁচে ছিলেন ,কিন্তু‘
মুজামুল উদাবা’
য় উল্লিখিত হয়েছে বালখী ৮৭ বছর বেঁচে ছিলেন। সে ক্ষেত্রে কিন্দীর মৃত্যুর সময় বালখীর বয়স ছিল ২৩ বছর। তাই বালখী হয় কিছু সময়ের জন্য কিন্দীর ছাত্র ছিলেন নতুবা তাঁর ছাত্রের ছাত্র হিসেবে পরোক্ষভাবে তাঁর ছাত্র ছিলেন। সম্ভবত বালখীও শিয়া ছিলেন। যে কারণে তাঁকেও নাস্তিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। কথিত আছে প্রসিদ্ধ দার্শনিক আবুল হাসান আমেরী বালখীর ছাত্র ছিলেন ,কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তা সঠিক নয় বলে মনে হয়।
৩. আবু মাশার জাফর ইবনে মুহাম্মদ বালখী: তিনি একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। প্রথম জীবনে কিন্দীর সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করতেন। কিন্দী বিভিন্ন কৌশলে তাঁকে গণিতশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আসক্ত করে তাঁর শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতার অপনোদন করেন।‘
আল ফেহেরেস্ত’
গ্রন্থে তাঁকে কিন্দীর ছাত্রদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আবু মাশার একশ’
র অধিক বছর জীবিত ছিলেন ও ২৭২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দার্শনিক অপেক্ষা ঐতিহাসিক ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে অধিকতর প্রসিদ্ধ ।
ইবনুন নাদিম হাসনাভীয়া ,নাফতাভীয়া ,সালামাভীয়া ও এরূপ কাছাকাছি নামের আরেক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে তাঁদের কিন্দীর ছাত্র বলেছেন। এদের সম্পর্কে আমরা ইবনুন নাদিমের বর্ণনার অতিরিক্ত কিছু জানি না। তবে এটুকু জানি ,সালামাভীয়া নামের একজন চিকিৎসক কিন্দীর সমসাময়িক ছিলেন যিনি আব্বাসীয় খলীফা মুতাসিমের বিশেষ চিকিৎসক ছিলেন। ইবনুন নাদিম ও ইবনে আবি আছিবায়াহ্ তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ ব্যক্তি সুরিয়ানী ও খ্রিষ্টান ছিলেন। কিন্তু এই সালামাভীয়াকেই ইবনুন নাদিম কিন্দীর ছাত্র বলেছেন কিনা তা আমরা জানি না।
দাবিস মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযীদ নামে কিন্দীর অপর এক ছাত্র ছিলেন যাঁর সম্পর্কে ইবনুন নাদিম আলোচনা করেছেন। ইবনে আবি আছিবায়াহ্ কিন্দীর লিখিত পত্রসমূহের আলোচনায় যারনাব নামের অপর এক ব্যক্তির উল্লেখ করে বলেছেন ,‘
এ পত্রটি জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নকারী ছাত্র যারনাবের প্রতি লিখিত।’
দ্বিতীয় স্তরের দার্শনিকদের মধ্যে যাঁরা কিন্দীর ছাত্র ছিলেন না তাঁরা হলেন :
১. আবু ইসহাক ইবরাহীম কুয়াইরী: ইবনুন নাদিম তাঁর‘
আল ফেহেরেস্ত’
গ্রন্থে আবুল আব্বাস সারাখশীর নামের পর ইবরাহীম কুয়াইরী নাম উল্লেখ করে বলেছেন ,‘
তাঁর নিকট অনেকেই যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা করতেন। তিনি পূর্ববর্তী ব্যক্তিবর্গের গ্রন্থাবলীর ব্যাখ্যাদাতা ও বিশ্লেষক ছিলেন।’
ইবনে আবি আছিবায়াহ্ তাঁর‘
উউনুল আম্বা’
গ্রন্থে ফারাবীর জীবনী আলোচনায় ফারাবীর বর্ণনা হতে গ্রীসে দর্শনের জন্ম ও সেখান হতে আলেকজান্দ্রিয়ায় স্থানান্তরের ইতিহাসের আলোচনার পর কুয়াইরীর সম্পর্কে ফারাবীর নিম্নোক্ত বক্তব্য এনেছেন :
‘
ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান ইনতাকীয়ায় (সিরিয়া) স্থানান্তরিত হয়। ফলে দর্শনজ্ঞানের এমন এক মন্দা অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যে ,ইনতাকীয়ায় একজন মাত্র শিক্ষক ছিলেন। তাঁর নিকট মারভের এক ব্যক্তি ও হারানের অধিবাসী অপর এক ব্যক্তিই শুধু দর্শন শিক্ষা করেছিলেন । এ দু’
ব্যক্তি ইনতাকীয়া হতে বেশ কিছু গ্রন্থ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইবরাহীম মুরুজী ও ইউহান্না ইবনে হাইলান মারভের ঐ ব্যক্তির নিকট এবং ইসরাঈল আসকাফ ও ইবরাহীম কুয়াইরী হারানের অধিবাসীর নিকট দর্শন শিক্ষা করেন। ইসরাইল ও কুয়াইরী উভয়েই বাগদাদে যান। ইসরাইল ধর্মীয় জ্ঞানে ব্যাপৃত হলেও কুয়াইরী শিক্ষা দান শুরু করেন। ইউহান্না ইবনে হাইলানও ধর্মীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ,কিন্তু ইবরাহীম মুরুজী শিক্ষা দানকে অগ্রাধিকার দেন। আবু বাশার মাতী তাঁর নিকট দর্শন শিক্ষা লাভ করেন।
অবশ্য ফারাবীর বিস্তারিত বর্ণনা হতে বোঝা যায় ইনতাকীয়ার খ্রিষ্টীয় শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা যুক্তিবিদ্যার মধ্যেই সীমিত ছিল। ফারাবীর নিজের বর্ণনা মতে তিনি ইউহান্না ইবনে হাইলানের নিকট যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা করেন। তিনি বলেন ,যুক্তিবিদ্যা জ্ঞান মুসলমানদের নিকট আসার পরই গীর্জা কর্তৃক যুক্তিবিদ্যা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি রহিত হয়।
মাসউদী তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ‘
আত তানবীহ্ ওয়াল আশরাফ’
গ্রন্থে বলেছেন ,‘
আমি ফুনুনুল মা’
আরিফ ওয়া মা জারা ফিদ দুহুরিস সাওয়ালিফ গ্রন্থে উমর ইবনে আবদুল আজিজের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়ার শিক্ষাকেন্দ্রটি ইনতাকীয়ায় স্থানান্তরের কারণ নিয়ে আলোচনা করেছি। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় খলীফা মুতাওয়াক্কিলের সময়ে তা আন্টাকিয়া হতে হারানে স্থানান্তরিত হয়। মু’
তাদিদের শাসনামলে
এ শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষকতার দায়িত্ব ইবরাহীম কুয়াইরী ,ইউহান্না ইবনে হাইলান (মুক্তাদিরের সময় বাগদাদে মারা যান) ও ইবরাহীম মুরুজীর হাতে অর্পিত ছিল। অতঃপর আবু আহমাদ ইবনে কারনিব ও আবু বাশার মাত্তা এ দায়িত্ব লাভ করেন। ইবনুন নাদিমের বর্ণনা মতে কুয়াইরী আবু বাশার মাত্তার শিক্ষক ছিলেন।
২. আবু ইয়াহিয়া: তিনিই পূর্বোল্লিখিত ইবরাহীম মুরুজী। তিনিও আবু বাশার মাত্তার শিক্ষক ছিলেন । ইবনুন নাদিম বলেছেন ,‘
তিনি জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী এবং যুক্তিবিদ্যার সকল গ্রন্থ সুরিয়ানী ভাষায় লিখেছেন।’
৩. ইউহান্না ইবনে হাইলান: পূর্বে ইবরাহীম কুয়াইরীর সঙ্গে তাঁর নাম আমরা উল্লেখ করেছি। বলা হয়ে থাকে তিনি ফারাবীর যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু ফারাবী কোথায় তাঁর নিকট যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা লাভ করেছেন তা জানা যায়নি। অবশ্য কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন ফারাবী যুক্তিবিদ্যা শিক্ষার জন্য হারানে ইউহান্নার নিকট যান।
কাফতী বলেছেন ,বাগদাদে তিনি তাঁর নিকট শিক্ষাগ্রহণ করেন।
কিন্তু‘
উয়ুনুল আম্বা’
য় ফারাবীর বর্ণনা মতে মনে হয় ইউহান্না বাগদাদে আসেননি।
৪. আবুল আব্বাস মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইরানশাহরী নিশাবুরী: এই ব্যক্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। আবু রাইহান বিরুনী তাঁর‘
আল আছারুল বাকীয়াহ্’
এবং নাসির খসরু তাঁর‘
যাদাল মুসাফিরিন’
গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযীর কিছু দার্শনিক চিন্তা ,যেমন স্থানের চিরন্তনতা ,অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের মাঝে একটি বিষয় (هيولا
) তাঁর নিকট থেকে নেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। কথিত আছে তিনি অনারবদের নবী হিসেবে নিজেকে দাবি করেছিলেন।
ইরানশাহরী কিন্দীর ছাত্র ছিলেন নাকি কুয়াইরী ,ইবনে হাইলান ও মুরুজীর স্তরের তা স্পষ্ট নয়।
উপরোক্ত আলোচনা হতে স্পষ্ট যে ,চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত দর্শন শিক্ষায় দু’
টি ধারা বিদ্যমান ছিল। প্রথম ধারা কিন্দীর মাধ্যমে শুরু হয় এবং তিনি দর্শনের সঙ্গে যুক্তিবিদ্যা ,চিকিৎসাশাস্ত্র ,জ্যোতির্বিদ্যা ,সংগীতকলা প্রভৃতি বিষয়ও শিক্ষা দিতেন। অন্য ধারাতে যুক্তিবিদ্যার অধিক কিছু শিক্ষা দেয়া হতো না।