ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান0%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 104881
ডাউনলোড: 5231

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 104881 / ডাউনলোড: 5231
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

তৃতীয় স্তরের দার্শনিকগণ

এ স্তরে পাঁচ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁরা হলেন :

1. আবু বাকর মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া রাযী: তিনি আরবের গ্যালেন 305 নামে প্রসিদ্ধ । তাঁর প্রসিদ্ধি মূলত চিকিৎসাশাস্ত্রে। এ শাস্ত্রে তিনি ইতিহাসে প্রখ্যাত। চিকিৎসাশাস্ত্রের ব্যবহারিক ও পর্যবেক্ষণ বিষয়ে অনেকে তাঁকে ইবনে সিনার ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি 251 হিজরীতে জন্মগ্রহণ এবং 313 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। পূর্বে আমরা বলেছি ,ইবনুন নাদিম তাঁকে বালখীর শিষ্য বলেছেন। সম্ভবত এই বালখীই কিন্দীর ছাত্র ছিলেন। তাই রাযী কিন্দীর পরোক্ষ ছাত্র।

আবু যাইদ বালখী 243 অথবা 244 হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর ছাত্র যাকারিয়ার চেয়ে 7 বা 8 বছরের বড় ছিলেন। রাযী কিছুটা বেশি বয়সে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। আবু যাইদ তাঁর ছাত্রের মৃত্যুর পরও নয় বছর জীবিত ছিলেন। রাযীর অপর শিক্ষক ছিলেন আবুল আব্বাস ইরানশাহরী। রাযী দর্শনের ক্ষেত্রে বিশেষ মত পোষণ করতেন। তিনি তাঁর সময়ে প্রচলিত অ্যারিস্টটলের দর্শনের অনুসারী ছিলেন না। তিনি পদার্থের সৃষ্টিতে অণুর সমন্বয়ের ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি পাঁচ চিরন্তন অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন যা বিভিন্ন দর্শন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। পরবর্তীতে ফারাবী ,আবুল হাসান শহীদ বালখী ,আলী ইবনে রিদওয়ান মিশরী ও ইবনুল হাইসাম বাসরী তাঁর এই তত্ত্বকে খণ্ডন ও প্রত্যাখ্যান করেছেন।

যাকারিয়া রাযীর গ্রন্থের তালিকায় কিতাবুন ফিন নবুওয়াত নামক একটি গ্রন্থ রয়েছে যাকে অন্যরা তিরস্কারের মনোবৃত্তি নিয়ে নাকজুল আদইয়ান বা ধর্মকে প্রত্যাখ্যান নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর অপর একটি গ্রন্থ ফি হাইলিল মুতানাব্বিয়ীন ও অন্যদের দ্বারা মুখারিকুল আম্বিয়া নামে অভিহিত ও সমালোচিত হয়েছে। এ গ্রন্থ দু টি বর্তমানে বিদ্যমান নেই। কিন্তু ইসমাঈলী কালামশাস্ত্রবিদ আবু হাতেম রাযীও সম্ভবত তাঁরই সূত্রে নাসের খসরু যাকারিয়ার উপরোক্ত গ্রন্থ দু টি হতে কিছু বর্ণনার ভিত্তিতে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে ,তিনি নবুওয়াতের অধিকারী ছিলেন। যদিও আবু হাতেম রাযী যাকারিয়ার নাম উল্লেখ না করে বলেছেন এক নাস্তিক এ কথা বলেছে তদুপরি স্পষ্ট ,তাঁর লক্ষ্য হলো যাকারিয়া রাযী।

যেহেতু ঐ গ্রন্থ দু টি আমাদের হাতে নেই তাই সে বিষয়ে নিশ্চিত কোন মতামত দান সম্ভব নয়। তবে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন বিবরণের ভিত্তিতে বলা যায় ,যাকারিয়া নবুওয়াত অস্বীকারকারী ছিলেন না ;বরং মুতানাব্বিয়ীন বা মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। রেই শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির গৃহে শহরের নামকরা ও সুপরিচিত ব্যক্তিদের সামনে যাকারিয়া রাযী ও আবু হাতেম ইসমাঈলী যে বিতর্ক করেন তাতে যদি রাযী প্রকাশ্যে সকল নবুওয়াতকেই অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতেন তবে তাঁর পক্ষে পরবর্তীতে সেখানে সম্মানের সঙ্গে বাস করা সম্ভব হতো না। কেউ কেউ যে দাবি করেছেন আবু রাইহান বিরুনী নাকজুল আদইয়ান মুখারিকুল আম্বিয়া নামের দু টি গ্রন্থ রাযীর রচিত বলেছেন এ বিষয়টি সঠিক নয়। কারণ স্বয়ং আবু রাইহান এ দু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করে বলেছেন ,এরূপ দাবি করা হয়েছে ;বরং তিনি কিতাবুন ফিন নবুওয়াত ফি হাইলিল মুতানাব্বিয়ীন নামেই বই দু টির উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা যায় অন্যরা এরূপ নাম দিয়েছিল। ইবনে আবি আছিবায়াহ্ এরূপ নামের গ্রন্থ যাকারিয়ার ছিল না বলে মন্তব্য করে বলেছেন , সম্ভবত কোন মন্দ ব্যক্তি মুখারিকুল আম্বিয়া নামের গ্রন্থ রচনা করে যাকারিয়ার সম্মানহানি করতে প্রয়াস পেয়েছিল। রাযীর শত্রুদের মধ্যে কেউ ,যেমন আলী ইবনে রিদওয়ান মিশরীও তাঁর গ্রন্থের এরূপ নামকরণ করে থাকতে পারেন। ইবনে আবি আছিবায়ার বক্তব্য হতে বুঝা যায় যাকারিয়ার কিতাবুন ফিন নবুওয়াত ফি হাইলিল মুতানাব্বিয়ীন নামক গ্রন্থ থাকলেও মুখারিকুল আম্বিয়া নামের কোন গ্রন্থ ছিল না ;বরং অন্যরা তাঁর প্রতি এরূপ গ্রন্থ রচনার অপবাদ আরোপ করেছিল।

তদুপরি যাকরিয়া রাযী খোদা ,পরকাল ও আত্মার মৌলিকত্ব ও চিরন্তনতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি স্রষ্টা সম্পর্কে ফি ইন্না লিল ইনসানে খালেকান মুত্তাকেনান হাকিমান নামে এবং মনী ধর্মের দ্বিত্ববাদকে খণ্ডন করে সিসান সানাভী নামে অপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি পরকালের অস্তিত্ব প্রমাণ করে আলী ইবনে শাহীদ বালখীর নিকট একটি পুস্তিকা পাঠান যাতে তিনি পরকালের অস্তিত্ব অস্বীকারকারীদের মতকে খণ্ডন করেছেন। তিনি ফি ইন্নান নাফসা লাইসা বিজিসমিন নামে অপর এক গ্রন্থে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। তাই প্রশ্ন হলো- যে ব্যক্তি স্রষ্টা ,পরকাল ও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন তিনি কিভাবে নবুওয়াত ও শরীয়তকে অস্বীকার করতে পারেন ? তদুপরি তিনি ফি আছারিল ইমামিল ফাযিলিল মাসুম নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। সম্ভবত এ গ্রন্থটি তিনি শিয়া দৃষ্টিতে ইমামতের ধারণা হতে লিখেছেন। ইমামত সম্পর্কে আন নাকজ আলাল কায়াল ফিল ইমামত কিতাবুল ইমাম ওয়াল মামুমুল মুহিক্কীন নামের তাঁর আরো দু টি গ্রন্থ রয়েছে। এ বিষয়গুলো প্রমাণ করে ইমামতের ধারণা তাঁর চিন্তাকে মশগুল রাখত। স্পষ্ট যে ,নবুওয়াত অস্বীকারকারী কোন ব্যক্তি ইমামতের বিষয়ে এতটা সংবেদনশীল হতে পারে না ।

সম্ভবত তাঁর মধ্যে শিয়া ইমামতের চিন্তা বিদ্যমান থাকায় শিয়াদের শত্রুরা তাঁর প্রতি এরূপ অপবাদ আরোপ করেছিল যেমনটি তারা অন্যান্য শিয়া চিন্তাবিদদের ওপরও আরোপ করত।

তা ছাড়া নবুওয়াত অস্বীকারের দলিল হিসেবে রাযী থেকে যে সকল বর্ণনা আনা হয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় তাঁর মতো ব্যক্তিদের নিকট থেকে তা উপস্থাপিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। যেমন বলা হয়েছে যে ,রাযী বলেছেন ,যদি সকল মানুষের হেদায়েত পাওয়াই আল্লাহর লক্ষ্য তবে সকল মানুষ কেন নবী হলো না ?

এটি সত্য হলে শুধু এটুকু বলা যায় ,রাযীর চিন্তায় কিছু বিকৃতি ও ভুল ছিল কিন্তু তা নবুওয়াত ও শরীয়ত অস্বীকারের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু তাঁর শত্রুরা তাঁর এরূপ চিত্র অংকন করেছে। বর্তমান সময়েও আমরা লক্ষ্য করি এমন কিছু গ্রন্থ রয়েছে যেগুলো ভুলত্রুটি মুক্ত নয় ,কিন্তু ঐ গ্রন্থগুলোর বিরোধীরা এমনভাবে সেগুলোকে চিত্রায়িত করে উত্তর প্রদান করেন যে ,কেউ মূল গ্রন্থটি দেখলে সন্দেহে পড়বে যে ,জবাব গ্রন্থটি এ গ্রন্থের নাকি অন্য কোন গ্রন্থের।

যাকারিয়া রাযীর দু ধরনের শত্রু ছিল। একদল তাঁর দর্শনের মত খণ্ডন করে গ্রন্থ লিখেছেন ,যেমন ফারাবী ,শাহীদ বালখী ,ইবনে হাইসাম প্রমুখ এবং আরেক দল তাঁর মাযহাবী মতকে খণ্ডন করে গ্রন্থ লিখেছেন ,যেমন ইসমাঈলী মতাবলম্বীরা। একমাত্র তারাই রাযীকে ইতিহাসে নাস্তিক বলে প্রচার চালিয়েছে ও অন্যদেরও এ দৃষ্টিভঙ্গী পোষণে প্রভাবিত করেছে। অবশ্য ইতিহাস ইসমাঈলীদেরও নাস্তিক বলেছে। আমাদের সমকালীন নাস্তিকগণ ইসমাঈলীদের অনুকরণে যাকারিয়া রাযীকে নাস্তিক বলে প্রচার করছে এ উদ্দেশ্যে যে ,তাদের কর্ম অন্যদের কাছে বৈধতা পাবে। অন্য আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য ,চিকিৎসাশাস্ত্রে যাকারিয়া রাযী বিরল প্রতিভা হলেও দর্শনে তিনি তেমন যোগ্য ছিলেন না। এ কারণেই আবু রাইহান আল বিরুনীর প্রশ্নের জবাবে ইবনে সিনা যাকারিয়া রাযী সম্পর্কে বলেছেন , অনধিকার সত্ত্বেও তিনি নিজেকে কালামশাস্ত্রবিদ সাজিয়েছেন অর্থাৎ তিনি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও অনধিকার চর্চা করেছেন। এ কথাটি কিছুটা হলেও সত্য।

2. আবুল হুসাইন শাহীদ ইবনিল হুসাইন বালখী: তিনি যেমন দার্শনিক ছিলেন তেমনি কবি। তিনি আরবী ও ফার্সী উভয় ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তিনি ইরানের প্রাচীন কবিদের অন্যতম। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,তিনি শাহীদ বালখীকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারেননি। এ কারণেই তিনি তাঁকে যে ব্যক্তি শাহীদ ইবনিল হুসাইন নামে পরিচিত ও তাঁর উপনাম আবুল হুসাইন এ শিরোনামে আলোচনা করেছেন। অতঃপর ইবনুন নাদিম বলতে চেয়েছেন ,তিনি আবু যাইদ বালখীর ছাত্র ছিলেন। যদিও এ বিষয়টি অন্য কেউ বলেছেন বলে আমি দেখিনি। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,শাহীদ বালখী বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন ও দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে যাকারিয়া রাযীর বিতর্ক হয়েছে।

শাহীদ বালখী রাযীর চিরন্তন পাঁচ সত্তা ও অস্তিত্ব এবং আনন্দ উপভোগ সম্পর্কিত দার্শনিক তত্ত্বের খণ্ডন করেছেন। তিনি 325 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

3. আবু আহমাদ হুসাইন ইবনে আবুল হুসাইন ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ইবনে যাইদ ইবনে কাতেব (ইবনে কারনিব নামে প্রসিদ্ধ): তিনি প্রসিদ্ধ মুসলিম কালামশাস্ত্রবিদ ,প্রকৃতিবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। অন্যদিকে তাঁর ভ্রাতা আবুল হুসাইন ইবনে কারনিব এবং ভ্রাতুষ্পুত্র আবুল আলা ইবনে আবিল হুসাইন ছিলেন গণিতজ্ঞ। ইবনুন নাদিম তাঁদের নাম গণিতজ্ঞদের তালিকায় এনেছেন। আবু আহমাদ ইবনে কারনিব একাধারে কালামশাস্ত্রবিদ ,দার্শনিক ও চিকিৎসক ছিলেন। নামে দানেশওয়ারান গ্রন্থ মতে তিনি কালামশাস্ত্র ও দর্শন উভয় বিষয়ই শিক্ষা দান করতেন। তাঁর স্বনামধন্য কিছু ছাত্রও ছিল। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,তিনি তৎকালের প্রচলিত প্রকৃতিবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিমের বর্ণনাটিই ইবনে কাফতী তাঁর তারিখুল হুকামা ও ইবনে আবি আছিবায়াহ্ তাঁর উউনুল আম্বা গ্রন্থে হুবহু এনেছেন। ঐতিহাসিক মাসউদী তাঁর নাম কুয়াইরী ও মুরুজীর পরবর্তী স্তরে এবং আবু বাশার মাতীর স্তরে এনেছেন। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না যে ,তিনি কুয়াইরী ও মুরুজীর ছাত্র ছিলেন যদিও বলা হয়ে থাকে আবু বাশার মাতী ইবনে কারনিবের নিকট শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইবনে কারনিবের জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ এবং শিক্ষক ও ছাত্রদের নাম জানা যায়নি। তবে সম্ভাবনা রয়েছে তিনি এই স্তরের দার্শনিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। দর্শনে বিপরীতমুখী দু গতির মাঝে স্থিতির অবশ্যম্ভাবিতা অথবা অসম্ভাব্য বিষয়ে সাবিত ইবনে কোররার মতকে খণ্ডন করে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ইবনে কাফতীর তারিখুল হুকামা এবং ইবনে আবি আছিবায়ার উউনুল আম্বা গ্রন্থের অনুকরণে নামে দানেশওয়ারান গ্রন্থে এ দার্শনিক মতকে সমমুখী দু গতি নামে অভিহিত করা হয়েছে ,কিন্তু এটি সঠিক নয় ;বরং আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে উল্লিখিত মতটিই সঠিক ;সেখানে এ মতকে বিপরীতমুখী দু গতি বলা হয়েছে।

4. আবু বাশার মাত্তা ইবনে ইউনুস: তিনি একজন গ্রীক ও খ্রিষ্টান যুক্তিবিদ। তিনি বাগদাদে বাস করতেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁকে গ্রীক বংশোদ্ভূত ও দিরকানীর অধিবাসী বলেছেন। নামে দানেশওয়ারান গ্রন্থের বর্ণনা মতে দিরকানী হলো বাগদাদের নিকটবর্তী দিরমারমারী যা মারমারী স্কুল নামেও পরিচিত। ইবনুন নাদিম বলেছেন , তিনি তাঁর সময়ে যুক্তিবিদ্যা ধারার সর্বশেষ নেতা। তিনি ইবরাহীম কুয়াইরী ,আবি আহমাদ ইবনে কারনিব ,দুফিল (রুবিলও বলা হয়ে থাকে) এবং বিন ইয়ামীনের নিকট শিক্ষা লাভ করেছেন।

ইবনে আবি আছিবায়াহ্ ফারাবীর জীবনী আলোচনায় বলেছেন , আবু বাশার মাত্তা ইসাগুযী (যুক্তিবিদ্যায় অ্যারিস্টটলের ধারা) বিষয়ে একজন খ্রিষ্টান মনীষীর (সম্ভবত বিন ইয়ামীন) নিকট শিক্ষা লাভ করেন। তিনি যুক্তিবিদ্যার ক্যাথাগোরাস (বিধেয় সম্পর্কিত আলোচনা) অধ্যায় রুবিলের নিকট এবং অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত -এর বিষয়টি আবু ইয়াহিয়া মুরুজীর নিকট শিক্ষা লাভ করেন।

আবু বাশার অনুবাদক ছিলেন ,আবার দার্শনিকও। তবে বর্তমানে দার্শনিক বলতে যা বুঝায় তা ছিলেন না ;বরং বর্তমানের দৃষ্টিতে তাঁকে যুক্তিবাদী বললে যথার্থ হবে। ইবনে কাফতীর বর্ণনা মতে তাঁর রচিত যুক্তিবিদ্যা গ্রন্থ ও অ্যারিস্টটলের এ সম্পর্কিত গ্রন্থের ব্যাখ্যা সম্বলিত পুস্তক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা দান করা হতো।306 তিনি 320 অথবা 330 হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে ইবনে কাফতী উল্লেখ করেছেন। ইবনে আবি আছিবায়ার মতে আবু বাশার মাত্তা 328 হিজরীতে মারা যান।

5. আবু নাসর মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তুরখান ফারাবী: এ স্বনামধন্য দার্শনিকের পরিচয় দেয়ার তেমন কোন প্রয়োজন নেই। তাঁকে দর্শনের দ্বিতীয় শিক্ষক মুসলমানদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিক উপাধি দানের বিষয়টি যথার্থ। তিনি তুর্কিস্তানের অধিবাসী। তিনি তুর্কী না ইরানী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তবে তিনি তুর্কী ও ফার্সী উভয় ভাষা জানতেন। তিনি অত্যন্ত আত্মতুষ্ট ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাধারণত ঝরনা বা নদীর তীরে অথবা ফুল বাগান ও উদ্যানের নিকট বাসস্থান নির্ধারণ করতেন এবং ছাত্ররা সেখানেই তাঁর নিকট শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসতেন। তিনি যুক্তিবিদ্যায় কিন্দীর অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করেন। কথিত আছে ,তাঁর পূর্বে যুক্তিবিদ্যার বিশ্লেষণকলা ও গাণিতিকরূপ সম্পর্কিত কোন গ্রন্থ অনূদিত হয়নি বা আরবদের নিকট ছিল না। ফারাবী স্বয়ং তা উদ্ভাবন করেন। তিনি যুক্তির পাঁচ ক্ষেত্রের (প্রামাণ্য দলিল ,বক্তব্য ,কবিতা ,তর্কশাস্ত্র ও ভ্রমাত্মক যুক্তি) প্রয়োগক্ষেত্র চিহ্নিত করেন। ফারাবী ঐ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত যাঁদের সম্পর্কে অন্যরা অতিরঞ্জিত কথা বলে থাকে। যেমন বলা হয়েছে ,তিনি সত্তরটি ভাষা জানতেন। তবে এটি সঠিক যে ,ফারাবী আত্মপ্রশিক্ষিত এক বিরল প্রতিভা ছিলেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কোন শিক্ষক ছিল না। শুধু যুক্তিবিদ্যায় তাঁর শিক্ষক ছিলেন ইউহান্না ইবনে হাইলান। সাম্প্রতিক কিছু লেখক উল্লেখ করেছেন ,তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে বাগদাদে আবু বাশার মাত্তার নিকট পড়াশোনা করেন। অতঃপর হারানে যান ও ইউহান্না ইবনে হাইলানের নিকট যুক্তিবিদ্যা শিক্ষা করেন। সম্ভবত তাঁদের এ বক্তব্যের উৎস ইবনে খাল্লেকানের বক্তব্য। তিনিও কোন গ্রন্থ উৎসের উল্লেখ না করে এ মতটি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইবনুল কাফতী ও ইবনে আবি আছিবায়ার বর্ণনানুযায়ী ফারাবী ,আবু বাশার মাত্তার সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন এবং তাঁর সময়ে আবু বাশার হতে তাঁর ব্যক্তিত্ব অনেক ঊর্ধ্বে ছিল।

ইবনুল কাফতী বলেছেন ,ফারাবী আবু বাশার মাত্তা ইবনে ইউনুসের সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। বয়সে তিনি আবু বাশারের কনিষ্ঠ হলেও জ্ঞানে তাঁর অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। ইবনে আবি আছিবায়াহ্ও এরূপ মন্তব্য করেছেন। তদুপরি এটি অসম্ভব যে ,ফারাবী বাগদাদে আবু বাশার মাত্তার নিকট শিক্ষাগ্রহণের পর হারানে ইউহান্না ইবনে হাইলানের নিকট যুক্তিবিদ্যা শিক্ষার জন্য যাবেন। স্বয়ং ফারাবীও তাঁর গ্রন্থে একমাত্র ইউহান্না ইবনে হাইলানকে শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য ইবনুল কাফতী দাবি করেছেন ,ফারাবী বাগদাদে ইউহান্না ইবনে হাইলানের নিকট শিক্ষাগ্রহণ করেছেন।

ফারাবী 257 হিজরীতে (যাকারিয়া রাযীর জন্মের ছয় বছর পর ও কিন্দীর মৃত্যুর এক বছর পূর্বে) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি 339 হিজরীতে 82 বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

ফারাবী মাশশায়ী ধারার (অ্যারিস্টটলের ধারার) দার্শনিক হলেও ইশরাকী ধারা (প্লেটোনিক ধারা) হতেও পর্যাপ্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।307 তিনি একজন প্রথম সারির গণিতজ্ঞ ও সংগীতজ্ঞও বটে। রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর বিশেষ মত ,বিশেষত আদর্শ নগরী র ধারণাটি প্রসিদ্ধ। ফারাবী তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক ধারণার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটান এবং অ্যারিস্টটলের উত্তরাধিকারী হিসেবে দর্শনের দ্বিতীয় শিক্ষক উপাধি পান।