এরফান ও ইসলাম
তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই এরফানের সঙ্গে ইসলামের অনেক দিক হতে সম্পর্ক ও মিল এবং অনেক দিক হতে অমিল ও সংঘর্ষ রয়েছে। অন্যান্য ধর্ম ও মতের মত (বাস্তবে অন্যান্য ধর্ম ও মত হতে অধিকতর) এরফান মানুষের সঙ্গে স্রষ্টা ,বিশ্বজগৎ ও নিজ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছে এবং অস্তিত্বজগৎকে ব্যাখ্যা দিয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন দেখা দেবে ,এরফান এ বিষয়গুলো সম্পর্কে কি বলেছে ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এ বিষয়সমূহে কিরূপ এবং এ দু’
দৃষ্টিভঙ্গির মিল বা অমিল কতটুকু ?
অবশ্য মুসলিম সুফী ও আরেফগণ কখনই দাবি করেন না যে ,তাঁরা ইসলাম বহির্র্ভূত কিছু বলছেন ,বরং তাঁরা দাবি করেন অন্যদের হতে তাঁরা উত্তমরূপে ইসলামের বাস্তবতাকে অনুভব ও অনুধাবন করতে পেরেছেন ও তাঁরাই প্রকৃত মুসলমান। তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক উভয় ক্ষেত্রেই তাঁরা কোরআন ,সুন্নাত ,নবী (সা.)-এর জীবনপদ্ধতি ,আহলে বাইতের পবিত্র ইমামদের বাণী ও বিশিষ্ট সাহাবীদের কর্মপদ্ধতি হতে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন।
কিন্তু অন্যরা তাঁদের সম্পর্কে ভিন্নদৃষ্টি পোষণ করেন । আমরা এ মতসমূহ ক্রমানুসারে তুলে ধরছি :
১. কোন কোন ফকীহ্ ও মুহাদ্দিসের মত হলো সুফী ও আরেফগণ আমলের ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসারী নয়। তাঁদের কোরআন ও হাদীস হতে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনের বিষয়টি মানুষকে প্রতারণার উদ্দেশ্য বলা হয়ে থাকে। তাঁদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।
২. বর্তমান সময়ের কিছু নব্য চিন্তার অনুসারীদের মত: এ দলের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ইসলামের তেমন ভাল সম্পর্ক নেই বিধায় তারা তাদের দৃষ্টিতে যাদের মধ্যে নিরপেক্ষতার গন্ধ পাওয়া যায় তাদের মতকে উষ্ণভাবে গ্রহণ করে আর সেই মতকে ইসলাম ও ইসলামী বিধিবিধানের প্রতি এক প্রকার অনীহা ও প্রতিবাদ বলে প্রচার করে থাকেন। তাই তারাও প্রথম দলের ন্যায় আরেফদের মধ্যে কোন ইসলামী আচরণ ও বিশ্বাস নেই বলে মনে করে ও দাবি করে যে ,এরফান ও সুফীবাদ ইসলাম ও আরবদের বিরুদ্ধে অনারবদের প্রতিবাদের রূপ। অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতার ছত্রচ্ছায়ায় তারা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এ ব্যক্তিবর্গও প্রথম দলের ন্যায় এরফান ও সুফীবাদকে ইসলামের বিরুদ্ধবাদী একটি মত বলে মনে করে। তবে প্রথম দল ইসলামের পবিত্রতার ধারণা ও সাধারণ মুসলমানদের অনুভূতির ওপর নির্ভর করে আরেফ ও সুফীবাদের তীব্র সমালোচনা করে তাঁদের মতকে ইসলামী জ্ঞানের বহির্ভূত বলার প্রয়াস চালান ,আর দ্বিতীয় দল কোন কোন আরেফ ও সুফীর বিশ্বজনীন মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও ইসলামকে ছোট করার চেষ্টা চালায়। তারা বলে ,এরফানের সূক্ষ্ম ও উচ্চ মর্যাদার চিন্তা ইসলাম ও এর সংস্কৃতি বহির্ভূত। অর্থাৎ ইসলামী সংস্কৃতির বাইরে থেকে তা ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং ইসলাম ও ইসলামী চিন্তা এরফানী চিন্তা হতে অনেক নিম্নমানের। তারা দাবি করে যে ,আরেফগণ জনসাধারণের ভয়ে ও তাকিয়াগত কারণে কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে তাঁদের বিশ্বাসের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করতেন এবং এভাবে তাঁরা চেয়েছেন নিজেদের জীবন রক্ষা করতে।
৩. নিরপেক্ষ দলের মতামত: এ দলের মতে তাসউফ ও এরফানে বিশেষত এরফানের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক স্থানে কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী বিদআত ও বিচ্যুত কর্ম লক্ষ্য করা যায় যা অনেক সময় স্বতন্ত্র ফির্কার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আরেফগণ ইসলামী সংস্কৃতির অন্যান্য দলের (ইসলামের বিভিন্ন মতের অনুসারী) ন্যায় খাঁটি নিয়্যতে ইসলামের সেবায় রত হয়েছিলেন এবং কখনো তাঁরা ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেননি। হয়তো আরেফ ও সুফিগণের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার পণ্ডিতগণ ,যেমন কালামশাস্ত্রবিদ ,দার্শনিক ,মুফাসসির এবং ফকীহ্দের মধ্যকার অনেকের ন্যায় ভুলভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু তাঁদের ভুল-ভ্রান্তির পেছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না।
আরেফদের সঙ্গে ইসলামের দ্বন্দ্ব রয়েছে এ ধারণা এক বিশেষ শ্রেণীর পক্ষ হতে বিশেষ উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। তাঁরা বলেন ,হয় ইসলামকে গ্রহণ কর অথবা এরফান ও সুফীবাদকে। যদি কেউ নিরপেক্ষভাবে আরেফদের গ্রন্থসমূহ অধ্যয়ন করেন এ শর্তে যে ,তিনি এরফানশাস্ত্রের বিশেষ পরিভাষার সঙ্গে পরিচিত তাহলে হয়তো লক্ষ্য করবেন ,তাঁদের বেশ কিছু ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে ,কিন্তু এটি বুঝতে পারবেন যে ,আরেফ ও সুফিগণ ইসলামের প্রতি পূর্ণ আন্তরিক ছিলেন।
আমরা তৃতীয় মতটিকে প্রাধান্য দিই এবং বিশ্বাস করি ,আরেফগণ কখনই অসৎ উদ্দেশ্যে কাজ করেন নি। তাই প্রয়োজন রয়েছে ইসলামের গভীর জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত এবং এরফানশাস্ত্রের ওপর বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ নিরপেক্ষভাবে ইসলামের সঙ্গে এরফানের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবেন।
একটি বিষয় এখানে উপস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন ,আর তা হলো ইসলামী এরফান কি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,তাফসীর ও হাদীসের ন্যায় জ্ঞান যা মুসলমানগণ ইসলামের মৌলিক নীতিমালা ও উৎস হতে গ্রহণ করেছে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় আইন-কানুন ও বিধিমালা উদ্ঘাটন করেছে নাকি গণিতশাস্ত্র ও চিকিৎসাবিদ্যার মতো বিষয় যা ইসলামী বিশ্বের বাইরে থেকে ইসলামী বিশ্বে প্রবেশ করেছে এবং মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রোড়ে বিকশিত হয়ে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়েছে নাকি তৃতীয় কোন মত এ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য হবে ?
আরেফ ও সুফিগণ প্রথম মতটিকে গ্রহণ করেছেন এবং অন্য মতগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোন কোন প্রাচ্যবিদ প্রমাণ করতে চান এরফানশাস্ত্র এবং এর সূক্ষ্ম ও যথার্থ চিন্তাধারা ইসলামী বিশ্বের বাইরে থেকে ইসলামী বিশ্বে প্রবেশ করেছে। কখনো কখনো তাঁরা বলেন ,ইসলামী এরফানের মূল খ্রিষ্টধর্ম হতে এসেছে এবং মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিষ্টান দুনিয়াবিমুখ পাদ্রীদের পরিচয় লাভের ফলশ্রুতিতে তা ঘটেছে। কখনো তাঁরা এরফানী মতের উৎপত্তিকে ইসলাম ও আরবদের প্রতি ইরানীদের প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি বলে উল্লেখ করে থাকেন। কখনো তাঁরা এরফানশাস্ত্রকে নব্য প্লেটোনিক (ঘবড় চষধঃড়হরপ) দর্শনের (যাকে অ্যারিস্টটল ,প্লেটো ,পিথাগোরাস ,আলেকজান্দ্রীয় সুফী এবং খ্রিষ্ট-ইহুদী মতবাদের সংমিশ্রণ বলা হয়ে থাকে) হুবহু অনুকরণ বলে থাকেন। কেউ কেউ আবার এরফান বা সুফীবাদকে বৌদ্ধ বা হিন্দু চিন্তা হতে উৎসারিত মনে করেন ;যেমনটি ইসলামী বিশ্বে সুফীবাদের বিরোধী ব্যক্তিবর্গও বলে থাকেন। অর্থাৎ এরফান ও তাসাউফকে তাঁরা অনৈসলামী ও ইসলাম বহির্ভূত বলে বিশ্বাস করেন।
এ বিষয়ে তৃতীয় মত হলো এরফানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকই (মূল উপাদানসমূহ) ইসলাম হতে গ্রহণ করা হয়েছে এবং তার ওপর ভিত্তি করেই মৌল নীতি ও বিধান তৈরি করা হয়েছে। তবে তা ইসলাম বহির্ভূত দর্শন ও চিন্তাধারা বিশেষত এশরাকী চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
কিন্তু আরেফগণ ইসলামের মৌল উপাদানের ভিত্তিতে সঠিক কোন নীতিমালা ও বিধি প্রণয়ন করতে কতটুকু সক্ষম হয়েছেন বা এ ক্ষেত্রে তাঁদের সফলতা ফকীহ্গণের সমপর্যায়ের কিনা বা এ ক্ষেত্রে তাঁরা ইসলামের প্রকৃত মৌল নীতি হতে বিচ্যুত না হওয়ার বিষয়ে কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন ? তা ছাড়া ইসলাম বহির্ভূত চিন্তাধারা এরফানশাস্ত্রে কতটা প্রভাব ফেলেছে বা ইসলামী এরফান তাঁদের (অন্যান্য চিন্তাধারার ব্যক্তিবর্গ) কতটা আকৃষ্ট করেছে ও তাঁদের স্বীয় রঙে রঞ্জিত করেছে বা নিজ পথ পরিক্রমায় তাঁদের হতে কতটা গ্রহণ করেছে তা যেরূপ বিবেচ্য তেমনি ইসলামী এরফান তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিন্ন পথ অনুসরণ করেছিল কিনা তাও বিবেচ্য। উপরোক্ত বিষয়সমূহ স্বতন্ত্রভাবে যথার্থরূপে আলোচিত হওয়া আবশ্যক। এটি নিশ্চিত যে ,ইসলামী এরফান তার মূল পুঁজি ইসলাম হতেই গ্রহণ করেছে।
এরফান সম্পর্কিত তিনটি মতের (এরফান কোরআন ও সুন্নাতের প্রতি অনুগত কিনা) মধ্যে প্রথম মতটি পূর্ণরূপে এবং দ্বিতীয় মতটি প্রায় তার অনুরূপ দৃষ্টিতে মনে করে ইসলাম ধর্ম একটি সহজ ,সাধারণের বোধগম্য ,অস্পষ্টতামুক্ত ও গভীর চিন্তামুক্ত ধর্ম। তাঁদের ধারণা মতে ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহীদ হলো গৃহ নির্মাতা ও গৃহের ন্যায় পরস্পর বিচ্ছিন্ন দু’
টি সত্তা সম্পর্কে ধারণা। তাই মানুষের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য বস্তুসমূহের সম্পর্ক তাওহীদের ধারণায় যুহদের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তাঁদের মতে যুহদ অর্থ বিশ্বের ধ্বংসশীল ও অস্থায়ী বস্তুসমূহকে ত্যাগ করে আখেরাতের চিরস্থায়ী নেয়ামতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়া। এর পাশাপাশি ইসলামের কিছু দৈনন্দিন পালনীয় কর্তব্য রয়েছে যা বর্ণনার দায়িত্ব হলো ফিকাহ্শাস্ত্রের ওপর। এ দলের মতে আরেফগণ তাওহীদ বলতে যা বলেন তা ইসলামের তাওহীদী ধারণার বহির্ভূত বিষয়। কারণ এরফানের পরিভাষায় তাওহীদ হলো ওয়াহ্দাতে উজুদ (অস্তিত্বের একতা) এবং আল্লাহর পবিত্র নামসমূহ ,গুণাবলী এবং শ্রেষ্ঠত্ব ছাড়া অন্য কিছুর কোন অস্তিত্ত্ব নেই। তা ছাড়া এরফানের পথ পরিক্রমা ইসলামী যুহদ বহির্ভূত পথ পরিক্রমা। কারণ এরফানের পথ পরিক্রমায় এমন কিছু কথা রয়েছে যা ইসলামী যুহদের ধারণায় অনুপস্থিত। যেমন আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ,আল্লাহর মধ্যে বিলীন হওয়া (ফানাফিল্লাহ্) ,আরেফের হৃদয়ে আল্লাহর জ্যোতির প্রতিফলন ও প্রকাশ প্রভৃতি। এরফানের তরীকতও ইসলামী শরীয়ত বর্হিভূত একটি বিষয়। কারণ তরীকতে এমন কিছু বিষয় উপস্থাপনা করা হয় যা ইসলামী ফিকাহ্ ও শরীয়ত বহির্ভূত।
এ সকল ব্যক্তির মতে আরেফ ও সুফীরা তাঁদের মত ও পথকে রাসূল (সা.)-এর যে সকল সাহাবী হতে গৃহীত বলে দাবি করেন তাঁরা সাধারণ দুনিয়াবিরাগী (যাহেদ) বৈ কিছু ছিলেন না ,তাঁরা এরফানের তাওহীদ ও পথ পরিক্রমা পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তাঁরা দুনিয়ার বস্তুসমূহ হতে বিমুখ এবং আখেরাতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁরা আল্লাহর আযাবের ভয় এবং বেহেশতের আশাতেই এমনটি করতেন।
এ ব্যক্তিবর্গের মত কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়। কারণ ইসলামের মৌল উপাদান তাঁদের ধারণা (অজ্ঞতাপ্রসূত হোক বা উদ্দেশ্যমূলক) হতে অনেক বেশি গভীর। ইসলামের তাওহীদী ধারণা যতটা সহজ ও অন্তঃসারশূন্য বলে তাঁরা মনে করেছেন তা যেমন সঠিক নয় ,তেমনি ইসলামের নৈতিকতা ও আত্মিক দিক তাঁদের ধারণার শুষ্ক দুনিয়াবিমুখতাও নয়। তেমনি রাসূল (সা.)-এর ঐ সকল সাহাবীও জানতেন ইসলামের বিভিন্ন আচার দৈহিক কর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
আমরা এখানে ইসলামের যে সকল মৌল শিক্ষা এরফানের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক গভীর জ্ঞানের উৎপত্তিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তা হতে একটি অংশের উল্লেখ করছি যাতে করে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। পবিত্র কোরআন তাওহীদের বিষয়ে আল্লাহ্ ও তাঁর সৃষ্টিকে কখনোই গৃহ নির্মাতা ও গৃহের ন্যায় মনে করেনি। কোরআন মহান আল্লাহ্কে বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসেবে পরিচয় দানের পাশাপাশি তাঁর পবিত্র সত্তা সবকিছুর সঙ্গেই বিদ্যমান রয়েছে বলেছে। যেমন বলেছে ,
)
فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّـهِ(
‘
তোমরা যেদিকে মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহ্ বিরাজমান।’
অন্যত্র বলা হয়েছে :
)
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ(
‘
আমরা তার (মানুষের) ঘাড়ের রগ হতেও তার নিকটবর্তী।’
সূরা হাদীদের ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে :
)
هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ(
‘
তিনিই প্রথম এবং সর্বশেষ (তাঁর থেকেই শুরু হয়েছে এবং তাতেই পরিসমাপ্ত ঘটবে) এবং তিনিই প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত।’
এবং এরূপ অন্যান্য আয়াত।
সুতরাং স্পষ্ট যে ,এ সকল আয়াত বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাসমূহকে তাওহীদের গভীরতর ও ব্যাপক এক অর্থের প্রতি আহ্বান জানায় যা সাধারণের ধারণার তাওহীদ হতে অনেক ঊর্ধ্বের বিষয়। উসূলে কাফীর এক হাদীসে এসেছে যে ,যেহেতু শেষ যামানায় এমন এক দল গভীর চিন্তার ব্যক্তিবর্গের আবির্ভাব ঘটবে সে কারণেই মহান আল্লাহ্ সূরা হাদীদের প্রথম কয়েকটি আয়াত এবং সূরা ইখলাস অবতীর্ণ করেন (যাতে তাওহীদের গভীর ও ব্যাপকতর অর্থ নিহিত রয়েছে)।
এরফানের পথ পরিক্রমায় আল্লাহর নৈকট্য হতে শেষ স্তর (ফানাফিল্লাহ্) পর্যন্ত পৌঁছার বিষয়টি কোরআনের বিভিন্ন আয়াত যেখানে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভ (لقاء الله
) ,আল্লাহর সন্তুষ্টি (رضوان الله
) ,নবী ব্যতীত অন্যদের সঙ্গে ফেরেশতাদের কথোপকথন ,যেমন হযরত মরিয়ম (আ.) এবং রাসূল (সা.)-এর মিরাজ সম্পর্কিত আয়াতসমূহ হতে প্রমাণ করা যায়। কোরআনে নাফসে আম্মারা ,নাফসে লাওয়ামা ,নাফসে মুতমাইন্না প্রভৃতি যেমন এসেছে তেমনি বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত জ্ঞান ,স্রষ্টা হতে প্রাপ্ত জ্ঞান (وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا
‘
যারা আমাদের পথে কঠোর প্রচেষ্টা ও সাধনা করবে ,অবশ্যই আমরা তাদেরকে আমাদের পথ দেখিয়ে দেব’
)-এ বিষয়গুলোও এসেছে যে সম্পর্কে এরফানেও আলোচিত হয়ে থাকে অর্থাৎ বিষয়টি কোরআন হতেই নেয়া।
কোরআন আত্মশুদ্ধির বিষয়টিকে মানুষের সফলতার একমাত্র পথ বলে মনে করেছে। তাই বলা হয়েছে :
)
قَدْ أَفْلَحَ مَن زَكَّاهَا وَقَدْ خَابَ مَن دَسَّاهَا(
‘
নিশ্চয়ই সে-ই সফল হয়েছে যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করেছে এবং যে আত্মাকে প্রোথিত অর্থাৎ কুলষিত করেছে সে-ই ব্যর্থ মনোরথ হয়েছে।’
কোরআনে আল্লাহর ভালবাসাকে সকল ভালবাসা ও মানবিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনে বিশ্বের সকল বস্তুরই (তা যত ক্ষুদ্র বা বৃহৎ হোক) আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসায় রত থাকার কথা উল্লিখিত হয়েছে। বিষয়টি এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যে ,তা হতে বুঝা যায় মানুষ যদি তার অন্তরকে পূর্ণতায় পৌঁছায় তাহলে বস্তুসমূহের এ প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা শুনতে পাবে। তদুপরি কোরআন মানুষের মধ্যে ঐশী সত্তার উপস্থিতির কথা বলেছে।
উপরোক্ত প্রমাণসমূহ আল্লাহ্ ,বিশ্ব ,মানুষ এবং বিশেষভাবে মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক বিষয়ক ইসলামী নৈতিকতার গভীর ও ব্যাপক ধারণার উপস্থিতিকে প্রমাণ করে। পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি ,মুসলিম আরেফগণ ইসলামের এই মূলধন হতে সঠিক ধারণাকে গ্রহণ করতে পেরেছেন কি পারেননি তা এখানে আমাদের বিবেচ্য নয়। আমরা শুধু ইসলামী নৈতিকতার
অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণের (পাশ্চাত্যপ্রেমী কিছু লোকের) প্রচেষ্টাকে ভিত্তিহীন হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছি। মূল কথা হলো ইসলামের অভ্যন্তরে এক বিশাল সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে যা হতে মুসলিম বিশ্ব উত্তমরূপে উপকৃত হতে পারে। যদি ধরেও নিই আরেফগণ সঠিকভাবে তা ব্যবহার করতে সক্ষম হননি কিন্তু নিশ্চয়ই অন্য কেউ যাঁরা আরেফ নামে প্রসিদ্ধ নন তাঁরা এ উৎসের সদ্ব্যবহার করেছেন।
তদুপরি বিভিন্ন হাদীস ,ইসলামের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গের জীবনী ,বিভিন্ন দোয়া ,মনীষীদের বক্তব্যসহ ইসলামের বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায় ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের ইবাদাত ও যুহদ শুষ্ক দুনিয়াবিমুখতা এবং সওয়াব বা পুরস্কারের আশায় ছিল না। বিভিন্ন হাদীস ,খুতবা বা দোয়াসমূহে উচ্চমার্গের অর্থপূর্ণ প্রচুর বিষয় রয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগের অনেক ব্যক্তিত্বের জীবনী তাঁদের উচ্চ ও আলোকিত প্রাণের পরিচয় বহন করে ,তাঁদের জীবনী আত্মিক প্রেমের পরিপূর্ণতার স্বাক্ষর বহন করে।
উসূলে কাফীতে বর্ণিত হয়েছে ,একদিন রাসূল (সা.) ফজরের নামাজের পর এক যুবক সাহাবীর প্রতি তাকিয়ে রইলেন। যুবকটির চক্ষু ছিল কোটরাগত ,দেহ শীর্ণ এবং রং ছিল বিবর্ণ। সে ছিল আত্মমগ্ন ও কিছুটা ভারসাম্যহীন। রাসূল (সা.) তাকে প্রশ্ন করলেন ,‘
কিরূপে রাত কাটিয়েছ ?’
সে বলল ,‘
ইয়াকীন (দৃঢ় বিশ্বাস) অর্জন করে।’
রাসূল বললেন ,‘
তোমার ইয়াকীনের চিহ্ন কি ?’
সে বলল ,‘
আমার ইয়াকীন আমাকে গভীর চিন্তায় মগ্ন করেছে ,আমি বিনিদ্র অবস্থায় (আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন হয়ে) রাত্রি কাটাচ্ছি ,দিনগুলো কাটাচ্ছি অভুক্ত- পিপাসার্ত অবস্থায় (রোযা রেখে)। আমার ইয়াকীন আমাকে পৃথিবী ও পৃর্থিবীর মধ্যকার সবকিছু হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আমি যেন আল্লাহর আরশ দেখতে পাচ্ছি। সেখানে সকল মানুষ হিসাবের জন্য সমবেত হয়েছে। পুনরুত্থিত সকল মানুষের মধ্যে আমিও যেন রয়েছি। আমি যেন বেহেশতীদের বেহেশতের নেয়ামতের মধ্যে এবং জাহান্নামীদের আযাবে নিপতিত দেখতে পাচ্ছি। যেন আমি এই কান দিয়েই জাহান্নামের বিকট শব্দ শুনতে পাচ্ছি।’
রাসূল (সা.) তাঁর দিক হতে মুখ ফিরিয়ে সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন ,‘
এই যুবকের হৃদয় আল্লাহ্ ঈমানের নূর দ্বারা আলোকিত করেছেন।’
অতঃপর যুবকটির উদ্দেশে বললেন ,‘
তোমার এ অবস্থাকে সংরক্ষণ কর ,যাতে তা পরিবর্তিত না হয়।’
যুককটি বলল ,‘
আমার জন্য দোয়া করুন যেন শহীদ হতে পারি।’
এর কিছুদিন পরেই এক যুদ্ধে এ যুবক শহীদ হয়।
স্বয়ং রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন বাণী ,দোয়াসমূহ ,আত্মিক অবস্থা ,সর্বোপরি সমগ্র জীবন ঐশী চরিত্র ,উদ্দীপনা ও এরফানী চেতনায় পরিপূর্ণ ছিল। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)ও এরূপ ছিলেন। অধিকাংশ সুফী ও এরফানী ধারার (সিলসিলা) হযরত আলীতে পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তাঁর বিভিন্ন বাণী মারেফাত ও নৈতিকতায় পূর্ণ। আমি দুঃখিত যে ,এরূপ দু’
একটি উদাহরণও এখানে উপস্থাপনের সুযোগ আমার নেই। ইসলামের দোয়াসমূহ বিশেষত শিয়াদের নিকট বিদ্যমান দোয়াসমূহ যেমন ,দোয়ায়ে কুমাইল ,দোয়ায়ে আবু হামযা সুমালি ,শাবান মাসের দোয়া ,সহীফায়ে সাজ্জাদিয়ায় বর্ণিত দোয়াসমূহ নৈতিকতা ও আত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিন্তা ও বিশ্বাসকে ধারণ করে আছে। আমরা কি ইসলামের মধ্যে বিদ্যমান এই গভীর উৎসসমূহকে বাদ দিয়ে এর বহির্ভূত কোন উৎসের সন্ধান করব ?
এর পাশাপাশি ইসলামের সামাজিক দিকটিও রাসূলের বিভিন্ন সাহাবী ,যেমন আবু যার গিফারীর মধ্যে তীব্রভাবে লক্ষণীয়। তিনি তাঁর সময়ের অত্যাচারী শাসকের বৈষম্য ,অবিচার ,আত্মপূজা ও অনাচারমূলক বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে এতটা প্রতিবাদী ছিলেন যে ,তাঁকে নির্বাসিত হতে হয় এবং তিনি নির্বাসনেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুকে বরণ করেন।
কোন কোন প্রাচ্যবিদ আবু যারের এরূপ ভূমিকার উৎস ও কারণ খুঁজতে ইসলামী চিন্তার বাইরে হাতিয়ে বেড়িয়েছেন। যেমন জর্জ জুরদাক তাঁর‘
আল ইমাম আলী সওতাল আদালাতুল ইনসানিয়াহ্’
গ্রন্থে বলেছেন ,‘
আমি এ সকল ব্যক্তির ব্যাপারে আশ্চর্য বোধ করি ,তারা এক ব্যক্তিকে কোন বৃহৎ নদী বা সমুদ্রের পাশে পানি ভর্তি পাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিন্তায় পতিত হয় এ পাত্রটি সে কোথা হতে পানি দিয়ে পূর্ণ করল। অথচ তারা ঐ নদী বা সমুদ্রের প্রতি কোন দৃষ্টি দেয় না। আবু যার ইসলাম ছাড়া অন্য কোন্ উৎস থেকে এ উদ্দীপনা পেতে পারেন ? ইসলাম ভিন্ন কোন্ উৎসটি আবু যারকে এতটা উদ্দীপ্ত করতে পারে ?’
এরফানের ক্ষেত্রেও আমরা একই অবস্থা লক্ষ্য করি। এখানেও প্রাচ্যবিদরা এরফানে ইসলামের উচ্চতর নৈতিকতা ভিন্ন অন্য উৎসের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত। তাঁরা ইসলামী নৈতিকতার মহাসমুদ্রকে উপেক্ষা করে থাকে। আমরা কি কোরআন ,হাদীস ,খুতবা ,দোয়া ,মুনাজাত ,জীবনেতিহাস ও অন্যান্য প্রমাণসমূহকে উপেক্ষা করে এ সব প্রাচ্যবিদ ও তাঁদের অনুসারীদের অনুকরণে এরফানের ইসলাম ভিন্ন উৎসের অনুসন্ধান করব ?
আনন্দের বিষয় হলো যে ,সম্প্রতি কিছু প্রাচ্যবিদ ,যেমন ব্রিটিশ লেখক নিকলসন এবং ফরাসী লেখক মসিও নিওন ইসলামী এরফানশাস্ত্রের ওপর ব্যাপক পড়াশোনার পর স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন ,ইসলামী এরফানশাস্ত্রের মূল উৎস হলো কোরআন ও সুন্নাহ্। এ সম্পর্কে নিকলসনের বক্তব্য হতে কিছু অংশ তুলে ধরে এ আলোচনা শেষ করব। তিনি বলেছেন ,
‘
কোরআনে আমরা এমন কিছু আয়াত লক্ষ্য করি ,যেমন‘
মহান আল্লাহ্ আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের জ্যোতি’
,‘
তিনি প্রথম ও সর্বশেষ’
,‘
তিনি ভিন্ন ইলাহ্ নেই’
,‘
তিনি ব্যতীত সকল কিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে’
,‘
আমি মানুষের মধ্যে নিজ হতে রূহ ফুঁকে দিয়েছি’
,‘
নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং কি তার সত্তাকে দ্বিধান্বিত করে তা আমরা অবগত এবং আমরা তার ঘাড়ের রগ অপেক্ষা তার নিকটবর্তী’
,‘
তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন’
,‘
তোমরা যেদিকেই মুখ ফিরাও সেদিকেই আল্লাহ্ বিরাজমান’
,‘
যাকে আল্লাহ্ আলো হতে বঞ্চিত করেন তার জন্য কোন আলোই অবশিষ্ট থাকে না’
প্রভৃতি নিশ্চিতভাবে এরফানশাস্ত্রের বীজ রোপন করেছিল। প্রাথমিক যুগের সুফীদের নিকট এ আয়াতসমূহ আল্লাহর বাণী হিসেবেই শুধু নয় ,সে সাথে তাঁর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হয়েছিল। ইবাদাত ও কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে গভীর চিন্তার (বিশেষত যে সকল মিরাজ সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে) মাধ্যমে সুফিগণ রাসূল (সা.)-এর আত্মিক অবস্থা উদ্ঘাটনের চেষ্টায় রত হয়েছেন এবং নিজেদের মধ্যে সে অবস্থা আনয়নে সচেষ্ট হয়েছেন।’
তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ,
‘
সুফীবাদের ঐক্যের মৌল নীতিটি কোরআনে যেমনভাবে এসেছে তেমনি নবীর হাদীসেও এসেছে । নবী (সা.) বলেছেন: (হাদীসে কুদসী) আল্লাহ্ বলেছেন যে বান্দা ইবাদাত ও সৎ কর্মের মাধ্যমে আমার এতটা নিকটবর্তী হয় যে আমি তাকে ভালবাসতে শুরু করি। ফলে আমি তার কর্ণে পরিণত হই এরূপে যে ,আমার মাধ্যমেই সে শোনে ,আমি তার চক্ষুতে পরিণত হই এরূপে যে ,আমার মাধ্যমেই সে দেখে ,আমি তার জিহ্বা ও হস্তে পরিণত হই এরূপে যে ,আমার মাধ্যমেই কথা বলে এবং ধারণ করে।’
এ বিষয়টি নিশ্চিত যে ,প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানদের মধ্যে সুফী বা আরেফ বলে কোন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। এ নামটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে উদ্ভাবিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে ,সর্বপ্রথম যে ব্যক্তিটিকে সুফী হিসেবে অভিহিত করা হয় তিনি হলেন দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর কুফার অধিবাসী আবু হাশেম সুফী। তিনি প্রথমবারের মত ফিলিস্তিনের রামাল্লায় মুসলিম আবেদ ও যাহেদদের জন্য খানকা তৈরি করেন।
আবু হাশেমের মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা যায়নি। আবু হাশেম সুফিয়ান সাওরীর (মৃত্যু ১৬১ হিজরী) শিক্ষক ছিলেন। ড. কাশেম গনী তাঁর‘
তারিখে তাসাউফ দার ইসলাম’
গ্রন্থের ১৯ পৃষ্ঠায় ইবনে তাইমিয়ার‘
সুফীয়া ওয়া ফুকারা’
গ্রন্থের উদ্ধতি দিয়ে বলেছেন ,
‘
সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি সুফীদের জন্য খানকা তৈরি করেন তিনি হাসান বসরীর শিষ্য আবদুল ওয়াহেদ ইবনে যায়িদের একজন শিষ্য।’
যদি আবু হাশেম সুফী আবদুল ওয়াহেদের শিষ্য হয়ে থাকেন তবে এই দু’
বর্ণনার মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই।
প্রসিদ্ধ সুফী ও আরেফ আবুল কাসেম কুশাইরী বলেছেন ,‘
সুফী’
পরিভাষাটি ২০০ হিজরী শতাব্দীর পূর্বেই উৎপত্তি লাভ করেছে। নিকলসনের বর্ণনা মতেও পরিভাষাটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষ দিকে উৎপত্তি লাভ করেছে। উসূলে কাফীর ৫ম খণ্ডের‘
কিতাবুল মায়িশাত’
অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীস হতে জানা যায় ,এ পরিভাষাটি ইমাম সাদিক (আ.)-এর সময় হতেই অর্থাৎ ২য় হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধেই উৎপত্তি লাভ করেছিল এবং এ সময়েই সুফিয়ান সাওরীসহ অনেককেই এ নামে ডাকা হতো। যদি আবু হাশেম কুফী সুফী নামে অভিহিত প্রথম ব্যক্তি হয়ে থাকেন তবে তিনি সুফিয়ান সাওরীর শিক্ষক হওয়ার সম্ভবনাটি প্রবল। তাই নিকলসন ও অন্যান্যের মতে এ মতটি সঠিক যে ,সুফী নামটি ২য় হিজরী শতাব্দীর প্রথম হতেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। সুফীয়া বা সুফী পরিভাষাটি‘
সাওফ’
صوف
শব্দ হতে উৎপত্তি লাভ করেছে যার অর্থ পুরু পশম। যেহেতু এ ব্যক্তিবর্গ মসৃণ কাপড় পরিধান করা থেকে বিরত থাকতেন এবং বিশেষভাবে তৈরি পুরু পশমের কাপড় পরতেন সেহেতু তাঁদের‘
সুফী’
বলে অভিহিত করা হতো। এ বিষয়টি তাঁদের যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতার নিদর্শন ছিল।
তবে এরূপ ব্যক্তিবর্গকে কখন হতে‘
আরেফ’
নামে অভিহিত করা হয় সে বিষয়ে সঠিক তথ্য আমাদের হাতে নেই। সেররী সাকতির (মৃত্যু ২৪৩ হিজরী) বর্ণনা হতে জানা যায় ,তৃতীয় হিজরী শতাব্দী হতেই এ পরিভাষাটি প্রচলন লাভ করে। কিন্তু আবু নাসর শিরাজের‘
আল্লাময়ু’
গ্রন্থ (যা এরফান ও তাসাউফ সম্পর্কিত একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ) হতে জানা যায় ,দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধেই এ পরিভাষাটি উৎপত্তি লাভ করেছিল।
যা হোক প্রথম হিজরী শতাব্দীতে সুফী নামে কোন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল না। এ পরিভাষাটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে উৎপত্তি লাভ করেছিল। সম্ভবত এ সময়েই স্বতন্ত্র একটি দল হিসেবে সুফিগণ পরিচিতি লাভ করেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে সুফী বা আরেফ নামে কোন বিশেষ দলের অস্তিত্ব না থাকলেও এর অর্থ এটি নয় যে ,রাসূল (সা.)-এর সাহাবিগণ সাধারণ অর্থে যাহেদ বা আবেদ ছিলেন এবং ঈমানের মানদণ্ডে তাঁরা সকলে সাধারণ পর্যায়ে ছিলেন বা তাঁরা আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার উচ্চতর পর্যায় সম্পর্কে অনবহিত ছিলেন যেমনটি পাশ্চাত্যের কোন কোন পণ্ডিত ব্যক্তি বলে থাকেন। যদিও সাহাবীদের কেউ কেউ ইবাদাত ও যুহদের ক্ষেত্রে সাধারণ পর্যায়ে অবস্থান করতেন তদুপরি তাঁদের অনেকেই উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে যাঁরা আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন তাঁরাও সকলে এক পর্যায়ের ছিলেন না ,এমনকি হযরত সালমান ফার্সী (রা.) এবং হযরত আবু যার গিফারী (রা.)ও এক পর্যায়ের ছিলেন না। সালমানের আধ্যাত্মিকতার ধারণ ক্ষমতা যে পর্যায়ে ছিল আবু যার তা ধারণে সক্ষম ছিলেন না। এ সম্পর্কিত বেশ কিছু হাদীস রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো :
لو علم أبو ذر ما في قلب سلمان لَقتله
‘
সালমানের হৃদয়ে যা রয়েছে যদি তা আবু যার জানত ,তাহলে তাকে (সালমানকে) সে হত্যা করত।’
এখন দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দী হতে দশম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত সুফী ও আরেফগণের একটি ধারাবাহিক তালিকা প্রদান করবো।
দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. হাসান বসরী: পারিভাষিক অর্থে এরফানশাস্ত্রের ইতিহাস হাসান বসরীর মাধ্যমে শুরু হয়েছে যেমনটি আহলে সুন্নাতের কালামশাস্ত্রের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। হাসান বসরী ২২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ এবং ১১০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জীবনের নয়-দশমাংশ সময় প্রথম হিজরী শতাব্দীতেই অতিক্রান্ত হয়েছিল এবং তিনি সুফী নামে অভিহিত ছিলেন না। তবে তিনি তাসাউফের বিষয়ে‘
রেয়াইতু হুকুকুল্লাহ্’
(আল্লাহর হক আদায়) নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন তা তাসাউফ সস্পর্কিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। বর্তমানে এ গ্রন্থটির একটি মাত্র খণ্ডই বিদ্যমান রয়েছে যা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। নিকলসন দাবি করেছেন ,
‘
সুফী জীবন পদ্ধতির সর্বপ্রথম ব্যক্তি হলেন হাসান বসরী অর্থাৎ মুসলমানদের মধ্যে তিনিই এ পদ্ধতির প্রবক্তা। সাম্প্রতিক লেখকগণ তাসাউফের উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছার জন্য যে পথের বর্ণনা দিয়ে থাকেন তার প্রথম পর্যায় হলো তওবা। অতঃপর ধারাবাহিক কিছু আমল রয়েছে... যার প্রতিটি পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরণের জন্য ধারাবাহিকভাবে অতিক্রম করতে হয়।’
কোন কোন আরেফ ও সুফী তাঁদের সিলসিলাকে হাসান বসরীর মাধ্যমে হযরত আলী (আ.) পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন। যেমন আবু সাঈদ আবুল খায়েরের সিলসিলা। ইবনুন নাদিম তাঁর‘
আল ফেহেরেস্ত’
গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়ের ৫ম প্রবন্ধে আবু মুহাম্মদ এবং জাফার খুলদীর সিলসিলাকেও হাসান বসরী পর্যন্ত পৌঁছিয়ে বলেছেন ,হাসান বসরী ৭০ জন বদরী সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন।
কোন কোন বর্ণনা মতে ,হাসান বসরী ও তাঁর অনুসারীরা পরবর্তীতে সুফী নামে অভিহিত হয়েছিলেন। এরূপ কয়েকটি বর্ণনা আমরা পরবর্তীতে উল্লেখ করব। হাসান বসরী একজন ইরানী বংশোদ্ভূত ব্যক্তি।
২. মালেক ইবনে দীনার: তিনি বসরার অধিবাসী। এ ব্যক্তি দুনিয়াবিমুখতার ক্ষেত্রে খুবই কড়াকড়ি করতেন। বৈধ উপভোগ্য অনেক বিষয়কেই তিনি চরমভাবে বর্জন করতেন। তিনি ১৩১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. ইবরাহীম আদহাম: তিনি বাল্খের অধিবাসী। তাঁর ঘটনাটি বেশ প্রসিদ্ধ এবং তাঁর জীবনী অনেকটা গৌতম বুদ্ধের মতো। তিনি বাল্খের বাদশাহ ছিলেন। এক রাতের এক ঘটনায় তিনি পরিবর্তিত হন এবং সুফী হয়ে যান। সুফীরা তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। মাওলানা রুমী‘
মাসনভী’
গ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইবরাহীম আদহাম ১৬১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. রাবেয়া আদভীয়া: এই নারী বংশগতভাবে বসরার অথবা মিশরের। তিনি তাঁর সময়ের বিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পিতামাতার চতুর্থ কন্যা হিসেবে তাঁকে রাবেয়া বলা হতো। রাবেয়া আদভীয়া ও রাবেয়া শামিয়া এক নারী নন। রাবেয়া শামিয়া একজন সুফী ও আরেফ ছিলেন যিনি নবম হিজরী শতাব্দীর জামীর সমসাময়িক। রাবেয়া আদাভীয়া এরফান ও আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের পরিচয় বহনকারী বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। তাঁর কিছু বাণী হতেও তাঁর উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সঙ্গে হাসান বসরী ও মালেক ইবনে দীনারের সাক্ষাতের আকর্ষণীয় ঘটনা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ১৩৫ বা ১৩৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। কারো কারো মতে তিনি ১৮০ বা ১৮৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. আবুল হাশেম সুফী কুফী: তিনি সিরিয়ার অধিবাসী। সিরিয়াতেই তিনি জন্মগ্রহণ এবং জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে জানা যায়নি। তিনি সুফিয়ান সাওরীর শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত তিনি সুফী হিসেবে অভিহিত সর্বপ্রথম ব্যক্তি। সুফিয়ান সাওরী বলেছেন ,‘
আবুল হাশেম না থাকলে রিয়া সম্পর্কে যথার্থভাবে আমি জানতে পারতাম না।’
৬. শাকীক বালখী: তিনি ইবরাহীম আদহামের শিষ্য ছিলেন।‘
রাইহানাতুল আদাব’
গ্রন্থে আলী ইবনে ঈসা আরবিলীর‘
কাশফুল গুম্মাহ’
এবং শাবলানজীর‘
নুরুল আবসার’
গ্রন্থের সূত্রে বলা হয়েছে ,এ ব্যক্তির সঙ্গে মক্কায় হযরত মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি ইমাম মূসার উচ্চ মর্যাদার পরিচয় বহনকারী কিছু ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। শাকীক বালখী ১৫৩ হিজরীতে (কোন কোন বর্ণনায় ১৭৪ বা ১৮৪ হিজরীতে) মৃত্যুবরণ করেন।
৭. মারুফ কুর্খী: তিনি বাগদাদের কুর্খের অধিবাসী। যেহেতু এ ব্যক্তির পিতার নাম ফিরুজ সেহেতু মনে হয় তিনি ইরানী বংশোদ্ভূত। তিনি প্রসিদ্ধ আরেফদের মধ্যে পরিগণিত। কথিত আছে যে ,তাঁর পিতামাতা খ্রিষ্টান ছিলেন এবং তিনি ইমাম রেজা (আ.)-এর মাধ্যমে মুসলমান হন। তিনি ইমাম রেযার সান্নিধ্যে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। আরেফদের দাবি অনুযায়ী কোন কোন এরফানী সিলসিলা মারুফ কুর্খীর মাধ্যমে ইমাম রেযাতে এবং ইমাম রেযার মাধ্যমে স্বয়ং রাসূল (সা.) পর্যন্ত পৌঁছায়। এ কারণেই এরফানের এই সিলসিলাটিকে‘
সিলসিলাতু যাহাব’
অর্থাৎ‘
স্বর্ণের শিকল’
বলা হয়ে থাকে। যাহাবী সিলসিলার আরেফগণ সাধারণত এ দাবি করে থাকেন। মারুফ কুর্খী ২০০ হতে ২০৬ হিজরীর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।
৮. ফাজেল ইবনে আয়াজ: তিনি খোরাসানের মার্ভের অধিবাসী। তবে আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। কথিত আছে ,তিনি প্রথম জীবনে মরুদস্যু ছিলেন। এক রাতে ডাকাতির উদ্দেশ্যে একটি ঘরে প্রবেশ করতে গেলে ঐ গৃহের এক ব্যক্তির কণ্ঠে কোরআনের একটি আয়াত শুনে তিনি পরিবর্তিত হয়ে যান।‘
মিসবাহুশ শারীয়াত’
গ্রন্থটি তাঁর রচিত । কথিক আছে যে ,এ গ্রন্থটি তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করে রচনা করেছিলেন। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হাজী মির্জা হুসাইন নূরী তাঁর‘
মুসতাদরাক’
গ্রন্থে উপরোক্ত গ্রন্থের নির্ভরযোগ্যতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। ফাজেল ইবনে আয়াজ ১৮৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. বায়েজীদ বাস্তামী: প্রকৃত নাম তাইফুর ইবনে ঈসা। তিনি একজন প্রসিদ্ধ আরেফ এবং ইরানের বাস্তামের অধিবাসী। কথিত আছে তিনি সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ফানাফিল্লাহ্ ও বাকাবিল্লাহ্ সম্পর্কে স্পষ্ট কথা বলেন। বায়েজীদ বাস্তামী আল্লাহ্ সম্পর্কে অসংলগ্ন কিছু বলার কারণে অন্যেরা তাঁকে কাফের বলেছে। কোন কোন আরেফ তাঁকে মাতাল ও চিন্তাশক্তি লোপপ্রাপ্ত বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ তাঁদের মতে বায়েজীদ যখন বুদ্ধিশক্তি হারাতেন তখনই এরূপ কথা বলতেন। কথিত আছে ,বায়েজীদ ইমাম সাদিক (আ.)-এর গৃহে পানি আনার কাজ করতেন ,কিন্তু এ বর্ণনাটি সঠিক নয়। কারণ বায়েজীদ ইমাম সাদিকের মৃত্যুর ১১৩ বছর পর অর্থাৎ ২৬১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তাঁর পক্ষে ইমাম সাদিকের গৃহে কাজ করার বিষয়টি অমূলক।
২. বাশার হাফী: তিনি বাগদাদের অধিবাসী। তবে তাঁর পিতৃপুরুষ খোরাসানের মার্ভের অধিবাসী ছিলেন। তিনিও প্রসিদ্ধ আরেফদের একজন। কথিত আছে ,প্রথম জীবনে তিনি একজন অসৎ লোক ছিলেন ;পরবর্তীতে তওবা করেন। আল্লামা হিল্লী তাঁর‘
মিনহাজুল কারামাহ্’
গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ,বাশার হাফী ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর নিকট তওবা করেন এবং যেহেতু তওবা করার মুহূর্তে তাঁর পা ছিল নগ্ন যাকে আরবীতে‘
হাফী’
বল হয় সেহেতু তিনি বাশার হাফী নামে পরিচিতি লাভ করেন। বাশার হাফী ২২৬ অথবা ২২৭ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. সেররী সাকতী: তিনি বাগদাদের অধিবাসী। তিনি বাশার হাফীর অন্যতম সঙ্গী ছিলেন। সেররী সাকতী একজন ত্যাগী ,দয়ালু ও মানব সেবক ছিলেন। ইবনে খাল্লেকান তাঁর‘
ওফাইয়াতুল আইয়ান’
গ্রন্থে সেররীর নিকট থেকে বর্ণনা করেছেন ,তিনি বলেছেন ,‘
এক আলহামদুলিল্লাহ্ বলার কারণে আমি ত্রিশ বছর ধরে অনুশোচনা ও জন্য তওবা করছি ।’
তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন ,‘
এক রাত্রে বাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে আমি গৃহ হতে এ উদ্দেশ্যে বের হলাম যে ,আমার দোকানে আগুন লেগেছে কিনা। যখন দেখলাম আমার দোকানে আগুন লাগেনি তখন সন্তুষ্ট হয়ে বললাম: আলহামদুলিল্লাহ্। তখনই আমার মনে হলো আমি অন্য মুসলমানদের চিন্তা না করে নিজের দোকান ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় কেন্ খুশি হলাম ?’
কবি সাদী এই ঘটনাটিকে সামান্য পার্থক্য সহকারে নিম্নোক্ত কবিতায় বর্ণনা করেছেন :
‘
এক রাত্রে অগ্নিকাণ্ডের এক ঘটনা ঘটল
শুনলাম তাতে বাগদাদ হয়েছে প্রজ্বলিত
ধূলিভস্মের মাঝে এক ব্যক্তি আল্লাহর শোকর করল
এ আনন্দে যে ,তার দোকান হয়নি ভস্মীভূত
অন্তর হতে বিবেক বলল ,হে প্রবৃত্তি পূজারী! হে নষ্ট!
আপন মু্ক্তিতেই হলি তুই সন্তুষ্ট ?
পুরো শহর হলো ধ্বংস ,তুই কেন হলি না রুষ্ট ?
যদি নিজেও হতি আক্রান্ত তবেই কি পেতি কষ্ট ?’
সেররী সাকতী মারুফ কুর্খীর শিষ্য ছিলেন। বিশিষ্ট আরেফ জুনায়েদ বাগদাদী তাঁর ভাগ্নে ও শিষ্য ছিলেন। তিনি ঐশী প্রেম এবং তাওহীদ সম্পর্কে অনেক কথা বলেছেন। তিনি আরেফকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন ,আরেফ হলেন সূর্যের ন্যায় পৃথিবীতে আলো বিতরণকারী। আরেফ পৃথিবীর ন্যায় ভাল-মন্দের বোঝা পৃষ্ঠে বহন করেন ,আরেফ পানির ন্যায় অন্তরসমূহের জীবনের মাধ্যম এবং অগ্নির ন্যায় শিখা বিতরণকারী। সেররী ২৪৫ অথবা ২৫০ হিজরীতে ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. হারেস মুহাসেবী: তিনি বসরার অধিবাসী এবং জুনায়েদ বাগদাদীর সহপাঠী ছিলেন। তিনি মুরাকাবা (ধ্যান) এবং মুহাসাবা (আত্মসমালোচনা) এ উভয় বিষয়েই অধিকতর গুরুত্ব দিতেন বিধায় তাঁকে মুহসেবী বলা হতো। তিনি আহমাদ ইবনে হাম্বলের সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। আহমাদ ইবনে হাম্বল যেহেতু কালামশাস্ত্রের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতেন সেহেতু কালামশাস্ত্রবিদ হিসেবে হারেস মুহাসেবীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। এ কারণেই জনসাধারণকে তাঁর থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিতেন। হারেস ২৪৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. জুনায়েদ বাগদাদী: তিনি নাহাভান্দের অধিবাসী ছিলেন। সুফী ও আরেফগণ তাঁকে‘
সাইয়্যেদুত তায়েফা’
নামে অভিহিত করেছেন যেমনিভাবে শিয়া ফকীহ্গণ ফিকাহ্শাস্ত্রের পুরোধা হিসেবে শেখ তুসীকে‘
শাইখুত তায়েফা’
বলে থাকেন। জুনায়েদ বাগদাদী একজন ভারসাম্যপূর্ণ আরেফ। অনেক আরেফ হতে যেরূপ অসংলগ্ন কথা শোনা যায় তাঁর থেকে তা কখনই শোনা যায়নি। তিনি কখনই সুফীদের পোশাক পরিধান করেননি ;বরং আলেম ও ফকীহ্দের পোশাক পরিধান করতেন। তাঁকে বলা হয়েছিল অন্তত শিষ্যদের কারণে খিরকা (সুফীদের বিশেষ পোষাক) পরিধান করুন। তখন তিনি বলেছিলেন ,‘
যদি পোশাক মানুষকে তৈরি করতে পারে এটি নিশ্চিত হতাম ,তবে প্রয়োজনে লোহার পোশাক পরিধান করতাম।’
অতঃপর বলেন ,
ليس الإعتبار بالْخرقة إنّما الإعتبار بالْحرقة
‘
খিরকা দ্বারা কার্যসিদ্ধি সম্ভব নয় ,কার্যসাধণের জন্য হিরকা (অন্তরের) অগ্নিশিখার প্রয়োজন।’
জুনায়েদ বাগদাদী ২৯৭ হিজরীতে ৯০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
৬. যুন্নুন মিসরী: তিনি মিশরের অধিবাসী। তিনি একজন প্রসিদ্ধ ফকীহ্ এবং ফিকাহ্শাস্ত্রে মালেক ইবনে আনাসের ছাত্র ছিলেন। জামী তাঁকে সুুফীদের নেতা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম এরফানশাস্ত্রে রহস্যময় প্রতীকসমূহ ব্যবহার শুরু করেন যাতে করে এ পরিভাষাগুলো কেবল আরেফগণই বুঝতে পারেন। তাঁর প্রবর্তিত পদ্ধতিটি পরবর্তীতে আরেফদের মধ্যে প্রচলন লাভ করে এবং প্রতীকী অর্থে বিভিন্ন গজলে ও কবিতায় ব্যবহৃত হতে থাকে। কারো কারো মতে নব্য প্লেটোনিক দর্শনের চিন্তাধারা যুন্নন মিসরীর মাধ্যমে এরফান ও তাসাউফে প্রবেশ করছে। যুন্নুন মিসরী ২৪০ হতে ২৫০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন।
৭. সাহাল ইবনে আবদুল্লাহ্ তস্তুরী: তিনি অন্যতম প্রসিদ্ধ সুফী। তিনি শুস্তারের অধিবাসী ছিলেন।
আরেফদের মধ্যে যে দলটি নাফসের সঙ্গে সংগ্রামকে মূল বলে ধরেছেন তাঁরা সাহলীল (তাঁর নাম অনুসারে) নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। যুন্নুন মিসরীর সঙ্গে মক্কায় একবার তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ২৮৩ অথবা ২৯৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৮. হুসাইন ইবনে মনসুর হাল্লাজ: তিনি ইরানের শিরাজ প্রদেশের বাইদার অধিবাসী ছিলেন। তবে ইরাকেই জীবন অতিবাহিত করেন । আরেফগণের মধ্যে তাঁকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি হৈ চৈ হয়েছে। আল্লাহ্ সম্পর্কে অসংলগ্ন ও অবোধগম্য কথা বলার কারণে তাঁকে মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) বলে অভিযুক্ত করা হয় এবং আব্বাসীয় খলীফা মুকতাদিরের শাসনামলে এ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অনেক আরেফই তাঁকে গোপন রহস্য ফাঁস করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। কবি হাফেয শিরাজী এ সম্পর্কে বলেছেন ,
‘
বললেন পীর ,বন্ধুকে
আমার ঝুলানো হয়েছে ফাঁসির কাষ্ঠে
অপরাধ তাঁর ছিল এটাই ,বলেছিল সে গোপন কথা প্রকাশ্যে।’
কেউ কেউ তাঁকে যাদুকর বলে অভিহিত করেছেন। অনেক আরফেই তাঁর ও বায়েজীদ
বাস্তামীর সমালোচনা করে বলেছেন ,তাঁরা বোধশক্তিহীন অবস্থায় এরূপ কুফরী কথা বলেছেন। আরেফগণ তাঁকে শহীদ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তিনি ৩০৬ অথবা ৩০৯ হিজরীতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. আবু বাকর শিবলী: তিনি জুনায়েদ বাগদাদীর মুরীদ ও শিষ্য ছিলেন। তিনি খোরাসানের অধিবাসী এবং একজন প্রসিদ্ধ আরেফ।‘
রাওজাতুল জান্নাত’
এবং অন্যান্য জীবনী গ্রন্থে তাঁর নিকট হতে অনেক এরফানী কবিতা ও বাণী উদ্ধৃত হয়েছে। খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারী বলেছেন ,‘
এরফানে প্রতীকী পরিভাষার ব্যবহার যুন্নুন মিসরীর মাধ্যমে শুরু হয় এবং জুনায়েদ বাগদাদী এর সুবিন্যস্ত রূপ দেন। পরবর্তীতে শিবলী এ জ্ঞানটির উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটান।’
শিবলী ২৩৪ হতে ২৪৪ হিজরীর মধ্যবর্তী সময়ে ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
২. আবু আলী রুদবারী: তিনি সাসানী বংশোদ্ভূত এবং তাঁর বংশধারা সম্রাট আনুশিরওয়ানে পৌঁছায়। তিনি তাসাউফের ক্ষেত্রে জুনায়েদ বাগদাদীর শিষ্য। তবে আবুল আব্বাস ইবনে শারীহর নিকট ফিকাহ্শাস্ত্র এবং সা’
য়ালাবের নিকট আরবী ব্যাকরণশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। তিনি শরীয়ত ,তরীকত এবং হাকীকতের সমন্বয় সাধনকারী ছিলেন। তিনি ৩২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. আবু নাসর শিরাজ তুসী: তিনি এরফান ও তাসাউফশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গ্রন্থ‘
আল্লুমা’
র রচয়িতা। তরীকতে প্রসিদ্ধ অনেক ব্যক্তিত্বই তাঁর প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ছাত্র। তিনি ৩৭৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ দাবি করেছেন তাঁর সমাধি মাশহাদ স্ট্রীটে অবস্থিত যা পালয়ান্দুজ পীরের কবর বলে প্রসিদ্ধ।
৪. আবুল ফাযল সারখসী: তিনি খোরাসানের অধিবাসী এবং আবু নাসর সিরাজের শিষ্য। তাঁর শিষ্য আবু সাঈদ আবুল খায়ের একজন খুব প্রসিদ্ধ আরেফ। আবুল ফাযল সারাখসী ৪০০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. আবু আবদুল্লাহ্ রুদবারী: তিনি আবু আলী রুদবারীর ভাগ্নেয়। পৈত্রিকসূত্রে তিনি সিরীয় এবং সে অঞ্চলের একজন প্রসিদ্ধ আরেফ। তিনি ৩৬৯ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৬. আবু তালেব মাক্কী: তাঁর পরিচিতি মূলত এরফানশাস্ত্রে রচিত তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ‘
কুওয়াতুল কুলুব’
-এর মাধ্যমে। এ গ্রন্থটি এরফান ও তাসাউফশাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থগুলোর অন্যতম। আবু তালেব মূলত ইরানের জাবাল এলাকার অধিবাসী। তবে যেহেতু দীর্ঘদিন মক্কায় বসবাস করেছেন সেহেতু মাক্কী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ৩৮৫ অথবা ৩৮৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
পঞ্চম হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. শেখ আবুল হাসান খারকানী: তিনি প্রসিদ্ধতম আরেফদের একজন। তাঁর সম্পর্কে অনেক আশ্চর্যজনক কাহিনী বর্ণিত আছে। কথিত আছে যে ,তিনি বায়েজীদ বোস্তামীর কবরের নিকটে গিয়ে তাঁর রূহের সঙ্গে কথা বলতেন এবং তাঁর সমস্যা সমাধান করতেন। মাওলানা রুমী বলেছেন ,
‘
অনেকদিন হলো বায়েজীদের হয়েছে ওফাত
আবুল হাসান পেতে চাইল তাঁর সাক্ষাৎ
কখনো কখনো সতেজ এক মন
নিয়ে
গিয়ে বসতেন বায়েজীদের কবরের’
পরে
যখনই পড়তেন তিনি কোন সমস্যায়
গুরুর সমীপে
পেতেন সমাধান সেথায়।’
মাওলানা রুমী‘
মাসনভী’
গ্রন্থে তাঁর কথা অনেক বার উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। বলা হয়ে থাকে যে ,প্রসিদ্ধ দার্শনিক ইবনে সিনা এবং বিশিষ্ট আরেফ আবু সাঈদ আবুল খায়েরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ৪২৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
২. আবু সাঈদ আবুল খায়ের নিশাবুরী: তিনি আরেফদের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। তিনি অনেক চতুষ্পদী কবিতা রচনা করেছেন। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হলো:‘
তাসাউফ কি ?’
তিনি বললেন ,‘
তাসাউফ হলো যা কিছু তোমার মাথায় রয়েছে তা অস্বীকার কর এবং যা কিছু তোমার হাতে রয়েছে তা বিলিয়ে দাও এবং যা কিছু তোমার ওপর আপতিত হয় তা থেকে পলায়ন কর।’
তাঁর সঙ্গে ইবনে সিনার সাক্ষাৎ হয়েছিল। একদিন ইবনে সিনা আবু সাঈদের বক্তব্য শোনার জন্য তাঁর মজলিসে যান। আবু সাঈদ আমলের গুরুত্ব ,আল্লাহর আনুগত্য এবং গুনাহের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমরা নিজের কর্মের ওপর নয় ;বরং আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভর করি-ইবনে সিনা এটি বুঝানোর জন্য নিম্নোক্ত চতুষ্পদী কবিতাটি পাঠ করেন :
‘
আমরা আপনার ক্ষমার প্রতি আকৃষ্ট
তদুপরি করছি আনুগত্য ,হয়েছি গুনাহের প্রতি রুষ্ট
যাকে আপনি করবেন অনুগ্রহ সে-ই পাবে মুক্তি
আপনার ইচ্ছাই সকল কিছুর নির্ধারক শক্তি।’
আবু সাঈদ ত্বরিত বললেন ,
‘
ওহে! যে সওয়াব অর্জন না করে গুনাহই করেছে অর্জন
অথচ তাঁর অনুগ্রহে মুক্তির আশায় গণিছ ক্ষণ
শুধু আল্লাহর অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করে থেকো না বসে
যদিও তাঁর ইচ্ছাই সকল কিছুর নির্ধারক পরিশেষে।’
আবু সাঈদ রচিত অপর একটি চতুষ্পদী কবিতা হলো :
‘
আগামীকাল যখন পৃথিবী ধ্বংস হবে
তোমার মর্যাদা তোমার মারেফাত অনুযায়ী হবে
সৎ গুণাবলী অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা চালাও সবে
তোমার অর্জিত গুণাবলীর রূপেই তুমি পুনরুত্থিত হবে।’
আবু সাঈদ ৪৪০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. আবু আলী দাকাক নিশাবুরী: তিনিও শরীয়ত ও তরীকতের একজন সমন্বয়কারী। তিনি একজন মুফাসসির ও ওয়ায়েজ ছিলেন। তিনি মুনাজাতের সময় এত অধিক ক্রন্দন করতেন যে তাঁকে‘
ক্রন্দনকারী শেখ’
উপাধি দেয়া হয়েছিল। তিনি ৪০৫ অথবা ৪১২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. আবুল হাসান আলী ইবনে উসমান হিজভিরী গজনভী: তাঁর রচিত‘
কাশফুল মাহযুব’
গ্রন্থটি তাসাউফশাস্ত্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। তিনি ৪৭০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারী: তিনি আরব বংশোদ্ভূত এবং বিশিষ্ট সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারীর বংশধর। খাজা আবদুল্লাহ্ প্রসিদ্ধ আরেফদের অন্যতম। ইবাদাতের ক্ষেত্রে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর হতে বিভিন্ন চতুষ্পদী কবিতা ,মুনাজাত এবং জ্ঞানগর্ভ বাণীসমূহ বর্ণিত হয়েছে। তিনি অনেক বাণী ,কবিতা ও মুনাজাত রেখে গেছেন। যেমন ,
‘
শিশুকালে ছিলে হীন ,যুবাবস্থায় মাতাল ,
বৃদ্ধাবস্থায় হয়েছ অক্ষম ,তাই এখন হয়েছ খোদা উপাসক।’
‘
মন্দের জবাব দান মন্দের দ্বারা কুকুরের কাজ
ভালোর জবাবে ভালো করা গাধার কাজ ,
আর মন্দের জবাব দান ভালোর দ্বারা খাজা আবদুল্লাহ্ আনসারীর কাজ।’
‘
নিজেকে বড় মনে করা ত্রুটি জেনো
নিজেকে উত্তম ভেবে অন্যদের কর হীন
চোখের মণির মতো হও তুমি উদার
তবেই সকলকে দেখবে তুমি নিজেকে না দেখে।’
খাজা আবদুল্লাহ্ হেরাতে জন্মগ্রহণ করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন। তিনি‘
হেরাতের পীর’
নামে প্রসিদ্ধ। ৪৮১ হিজরীতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। খাজা আবদুল্লাহ্ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এরফানশাস্ত্রে তাঁর প্রসিদ্ধতম গ্রন্থ হলো‘
মানাজিলুস সায়েরীন’
যা এরফানশাস্ত্রের উত্তম গ্রন্থসমূহের একটি এবং এ শাস্ত্রের ছাত্রদের পাঠ্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থটির অসংখ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে।
৬. ইমাম আবু হামেদ গাজ্জালী তুসী: তিনি ফিকাহ্শাস্ত্রের অন্যতম প্রসিদ্ধ আলেম। তিনি বাগদাদের ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ আলেমের পদ লাভ করেছিলেন ,কিন্তু এতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের উদ্দেশ্যে জনসাধারণ থেকে দূরে আত্মগোপন করেন। ১০ বছর তিনি পরিচিত পরিবেশের বাইরে বায়তুল মোকাদ্দেসের নিকটবর্তী এক স্থানে আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টায় রত থাকেন। এ সময়েই এরফান ও তাসাউফের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং শেষ জীবন পর্যন্ত কোন সামাজিক পদ গ্রহণে রাজী হন নি। দীর্ঘ দিন তাসাউফ সাধনার পর তিনি‘
এহইয়াউ উলুমুদ্দীন’
নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনি ৫০৫ হিজরীতে তাঁর জন্মস্থান তুসে মৃত্যুবরণ করেন।
ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. আইনুল কুযযাত হামেদানী: তিনি আরেফদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ ছিলেন বলে পরিচিত। তিনি মুহাম্মদ গাজ্জালীর ভ্রাতা বিশিষ্ট আরেফ আহমদ গাজ্জালীর শিষ্য ছিলেন। তিনি এরফানশাস্ত্রে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর আকর্ষণীয় কবিতাগুলো ভ্রমাত্মক ও অসংলগ্ন কথামুক্ত নয়। ফলে তাঁকে কাফের হিসেবে অভিযুক্ত করে হত্যা করা হয় এবং তাঁর দেহ ভস্মীভূত করা হয়। তিনি ৫২৫ অথবা ৫৩৩ হিজরীতে নিহত হন।
২. সানায়ী গজনভী: তিনি একজন প্রসিদ্ধ এরফানী কবি। তাঁর কবিতাগুলো তাসাউফের গভীর অর্থ বহন করে। মাওলানা রুমী তাঁর‘
মাসনভী’
গ্রন্থে তাঁর অনেক কবিতা বর্ণনা করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. আহমদ জামী: তিনি‘
জেন্দে পিল’
নামে প্রসিদ্ধ। তিনি প্রসিদ্ধ আরেফ ও সুফীদের একজন। তাঁর সামাধি ইরানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের জামে অবস্থিত।
আল্লাহর ভয় ও রহমতের আশা সম্পর্কিত তাঁর একটি কবিতা হলো :
‘
গর্বিত হয়ো না ,
অনেক প্রসিদ্ধ মানুষের বাহন হয়েছে ভূপাতিত এ কংকরময় ভূমিতে
নিরাশও হয়ো না ,
অনেক সুফী এক রাতে তসবীহ জপে পৌঁছেছেন গন্তব্যে।’
তিনি অকাতরে দান ও কৃপণতার মধ্যে ভারসাম্যের বিষয়ে তাঁর এক কবিতায় বলেছেন ,
‘
কুঠারের ন্যায় নিজের জন্য পুরোটাই রেখে দিও না
আবার বান্দার ন্যায় সবকিছুই বিলিয়ে দিও না
নিজের জীবনে করাতের মতো হও
নিজের জন্য কিছু রেখে বাকিটা বিলিয়ে দাও।’
তিনি ৫৩৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. আবদুল কাদের জিলানী: তিনি ইরানের উত্তরাঞ্চলের গিলানে জন্মগ্রহণ করেন। তবে বাগদাদে জীবন অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই তাঁর জীবনাবসান হয়। কেউ কেউ তাঁকে বাগদাদের নিকটবর্তী জিল শহরের অধিবাসী বলেছেন। তিনি ইসলামী বিশ্বের অন্যতম পরিচিত ব্যক্তি। কাদেরিয়া সিলসিলার সুফী ধারাটি তাঁর নামেই প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। তাঁর কারামত সম্পর্কে অনেক কথা প্রচলিত আছে। তিনি ইমাম হাসান (আ.)-এর বংশধারার একজন সাইয়্যেদ। ৫৬০ অথবা ৫৬১ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
৫. শেখ রুয বাহান বাকলী শিরাজী: তিনি শেখ শাত্তাহ্ নামে প্রসিদ্ধ। কারণ খুব বেশি ভ্রমাত্মক (শাত্তাহ্) কথা বলতেন। সম্প্রতি তাঁর কিছু কিছু গ্রন্থ প্রাচ্যবিশারদগণ প্রকাশ করেছেন। তিনি ৬০৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
সপ্তম হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
এ শতাব্দীতে অনেক উচ্চ পর্যায়ের আরেফের আবির্ভাব ঘটেছিল। আমরা এখানে তাঁদের মৃত্যু সনের ধারাবাহিকতা অনুসারে কয়েক জনের নাম উল্লেখ করছি :
১. শেখ নাজমুদ্দিন কোবরা খাওয়ারেজমী: তিনি আরেফদের মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। সুফী ধারার কয়েকটি সিলসিলা তাঁর মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করেছে। তিনি শেখ রুয বাহান বাকলী শিরাজীর শিষ্য ও জামাতা। তাঁর অসংখ্য মুরীদ ছিল। তাঁর বিশিষ্ট মুরীদদের একজন হলেন মাওলানা জালালউদ্দীন রুমীর পিতা বাহাউদ্দীন। শেখ নাজমুদ্দীন খাওয়ারেজমের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর সময়কালেই মোগলরা হামলা চালায়। মোগলরা এতদঞ্চলে আক্রমণের পূর্বে তাঁর নিকট এ মর্মে পত্র পাঠায় ,‘
আপনি আপনার নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যান। তারপর আমরা আক্রমণ চালাব।’
তিনি জবাবে বলেন ,‘
আমি এ জনসাধারণের সুখের দিনে তাদের সাথে আনন্দে জীবন অতিবাহিত করেছি। এখন আমি কঠিন সময়ে তাদের ত্যাগ করতে পারব না।’
অতঃপর তিনি যুদ্ধের পোশাক পরিধান করে শহরের অধিবাসীদের সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। অতঃপর সাহসিকতার সহিত যুদ্ধ করে শহীদ হন। এটি ৬১৬ হিজরী শতাব্দীর ঘটনা।
২. শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তার নিশাবুরী: তিনি প্রথম শ্রেণীর আরেফদের একজন। তাঁর বেশ কিছু কাব্য ও গদ্যগ্রন্থ রয়েছে। আরেফ ও সুফীদের জীবনীর ভিত্তিতে রচিত‘
তাযকিরাতুল আউলিয়া’
নামক তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি এ বিষয়ে একটি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থ তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর জীবনী দিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন এবং ইমাম বাকির (আ.)-এর জীবনী দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। প্রাচ্যবিদগণ গ্রন্থটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাঁর রচিত‘
মানতেকুত তায়ির’
গ্রন্থটি এরফানশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার।
মাওলানা রুমী ফরিদউদ্দীন আত্তার এবং সানায়ী সম্পর্কে বলেছেন ,
‘
আত্তার ছিলেন তাঁর প্রাণ আর সানায়ী ছিলেন চোখের মনি
আমারা সানায়ী আর আত্তারের অনুসারী পথযাত্রী।’
অন্যত্র তিনি বলেছেন ,
‘
আত্তার প্রেমের সাত শহর বেড়িয়েছে ঘুরে
আমরা এখনও এক শহরের গলিতে রয়েছি পড়ে।’
এখানে মাওলানা রুমী সাত শহর বলতে এরফানের সাতটি গন্থব্য ও পর্যায় বুঝিয়েছেন যে সম্পর্কে ফরিদউদ্দীন আত্তার তাঁর‘
মানতেকুত তায়ির’
গ্রন্থে বর্ণনা দিয়েছেন।
মাহমুদ শাবেস্তারী তাঁর‘
গুলশানে রায’
গ্রন্থে বলেছেন ,
‘
আমার নগণ্য কাব্য প্রতিভায় আমি লজ্জাবোধ করি না
কারণ আত্তারের ন্যায় কবি তো শত শতাব্দীতেও আসে না।’
ফরিদউদ্দীন আত্তার শেখ নাজমুদ্দীন কোবরার মুরীদ শেখ মাযদুদ্দীন বাগদাদীর শিষ্য। তিনি তাঁর সমসাময়িক আরেফ কুতুবউদ্দীন হায়দারের নামে প্রসিদ্ধ হায়দারীয়া শহরে সমাহিত হয়ে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। ফরিদউদ্দীন আত্তারও মোগলদের আক্রমণের সময় নিহত হন।
৩. শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী জানজানী: তাসাউফ ও এরফানশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ‘
আওয়ারিফুল মাআরিফা’
গ্রন্থটি তাঁরই রচিত। তিনি প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের বংশধর। কথিত আছে ,তিনি প্রতি বছর মক্কা-মদীনায় যিয়ারতে যেতেন। তাঁর সঙ্গে আবদুল কাদের জিলানীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রসিদ্ধ কবি শেখ সাদী এবং কামালউদ্দীন ইসমাঈল ইসফাহানী তাঁর মুরীদ ছিলেন। সাদী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন ,
‘
আমার জ্ঞানী মুর্শিদ পীর শাহাব
দু’
টি উপদেশ দিয়েছেন আমার অন্তরের’
পর
নিজ প্রবৃত্তির প্রতি কভু কর না সুধারণা
অপরের প্রতি কভু কর না কুধারণা।’
বিশিষ্ট দার্শনিক শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী যিনি‘
শেখ এশরাক’
নামে প্রসিদ্ধ এবং ৫৮১ হতে ৫৯০ হিজরীর মধ্যবর্তী সময় হালাবে নিহত হন। তিনি এবং আরেফ শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী এক ব্যক্তি নন। আরেফ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী ৬৩২ হিজরীতে মৃত্যবরণ করেন।
৪. ইবনুল ফারেজ মিশরী: তিনিও প্রথম সারির আরেফদের একজন। আরবী ভাষায় লিখিত তাঁর এরফানী কবিতাসমূহ অতি উচ্চ মানের। তাঁর রচিত কবিতাসমূহ বিভিন্ন স্থানে বারবার ছাপা হয়েছে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কবিতাসমূহের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচয়িতাদের মধ্যে নবম হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আরেফ আবদুর রহমান জামীও রয়েছেন। ইবনুল ফারেজের আরবীতে রচিত এরফানী কবিতাসমূহ কবি হাফেযের ফার্সীতে রচিত এরফানী কবিতার সমতুল্য । বিশিষ্ট আরেফ মুহিউদ্দীন আরাবী তাঁকে তাঁর কবিতাসমূহ ব্যাখ্যা করে গ্রন্থ রচনার আহ্বান জানালে তিনি বলেন ,‘
আপনার‘
ফুতুহাতে মাক্কীয়া’
গ্রন্থটিই আমার ব্যাখ্যাগ্রন্থ’
। ইবনুল ফারেজ অধিকাংশ সময়ই এরফানী আবেগে আপ্লুত থাকতেন এবং এ অবস্থায়ই কবিতা রচনা করতেন। তিনি ৬৩২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. মুহিউদ্দীন আরাবী হাতেমী তায়ী আন্দালুসী: তিনি হাতেম তায়ীর বংশধর। তিনি আন্দালুসে (স্পেনে) জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের অধিকাংশ সময় মক্কায় এবং সিরিয়ায় অতিবাহিত করেন। তিনি ৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর আরেফ আবু মাদিন মাগরেবী আন্দালুসীর শিষ্য। তাঁর তরীকাটি শেখ আবদুল কাদের জিলানী হতে উৎসারিত।
মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবী এরফানশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ত্ব। তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আরেফদের কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়। এ কারণেই তাঁকে‘
শেখে আকবার’
উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। ইসলামী এরফান-এর উৎপত্তিকাল হতে শতাব্দীকাল ধরে তা ক্রমে ক্রমে বিকশিত হয়ে (প্রতি শতাব্দীর আরেফগণের মাধ্যমে ধারাবাহিক পূর্ণতা অর্জন করে) ৭ম হিজরী শতাব্দীতে মুহিউদ্দীন আরাবীর মাধ্যমে বৈপ্লবিকভাবে বিকশিত হয়ে পূর্ণতার শিখরে পৌঁছায়। মুহিউদ্দীন আরাবী এরফানশাস্ত্রকে নব্য পর্যায়ে উত্তরণ ঘটান। তিনি এরফানশাস্ত্রের অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটিয়ে এর তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ভিত্তি প্রদান করেন। তাঁর পরবর্তী যুগের এরফানশাস্ত্র তাঁরই রেখে যাওয়া ফসল। তিনি তাঁর সময়ের এক আশ্বর্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যের কারণেই তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে বিপরীতমুখী বক্তব্য এসেছে। কেউ কেউ তাঁকে‘
আরেফকুল শিরোমণি’
আবার কেউ কেউ তাঁকে কাফেরও বলেছে। কেউ কেউ তাঁকে দীনকে পুনর্জীবিতকারী ,আবার কেউ কেউ তাঁকে দীনের হত্যাকারী বলেছে। দর্শনের বিরল প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব মোল্লা সাদরা মুহিউদ্দীন আরাবীর প্রতি অকুণ্ঠ সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে মুহিউদ্দীন ইবনে সিনা এবং ফারাবী থেকে অনেক ঊর্ধ্বের ব্যক্তিত্ব। তিনি দু’
শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ত্রিশের অধিক গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে । তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো‘
ফুতুহাতে মাক্কীয়া’
যাকে এরফানশাস্ত্রের এনসাইক্লোপেডিয়া বা বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। তাঁর রচিত‘
ফুসুসুল হেকাম’
এরফানশাস্ত্রের গভীর অর্থবহ ,সূক্ষ্ম ও যথার্থ একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থের অনেক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। গ্রন্থটি এতটা গভীর অর্থবহ যে ,প্রতি শতাব্দীতে সম্ভবত দু’
তিন ব্যক্তির অধিক ব্যক্তিত্ব তা বুঝতে সক্ষম হন নি। মুহিউদ্দীন আরাবী ৬৩৮ হিজরীতে দামেশ্কে মৃত্যুবরণ করেন। সিরিয়ায় তাঁর মাজার একটি প্রসিদ্ধ স্থান।
৬. সাদরুদ্দীন মুহাম্মদ কৌনাভী: তিনি মুহিউদ্দীন আরাবীর স্ত্রীর পূর্ববর্তী স্বামীর সন্তান এবং তাঁর শিষ্য ও মুরীদ। তিনি মাওলানা রুমী এবং খাজা নাসিরুদ্দীন তুসীর সময়সাময়িক ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে খাজা নাসিরউদ্দীন তুসীর পত্রালাপ হতো এবং নাসিরুদ্দীন তাঁকে বিশেষ সম্মান করতেন।
মাওলানা রুমীর কৌনাভীতে অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মাওলানা রুমী তাঁর পেছনে নিয়মিত নামাজ পড়তেন। কোন কোন বর্ণনা মতে মাওলানা রুমী সাদরুদ্দীন কৌনাভীর শিষ্য ছিলেন এবং তাঁর নিকট হতেই মুহিউদ্দীন আরাবীর এরফানশাস্ত্রের শিক্ষাগ্রহণ করেন। কথিত আছে ,একদিন মাওলানা রুমী কৌনাভীর দরবারে উপস্থিত হলে তিনি তাঁর আসন ছেড়ে দিয়ে তাঁকে সেখানে বসতে বলেন। মাওলানা রুমী বসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন ,‘
আপনার আসনে আমি বসলে আল্লাহর নিকট কি জবাব দেব ?’
সাদরুদ্দীন কৌনাভী তখন আসনটিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন ,‘
যে আসন তোমার জন্য মানায় না সে আসন আমার জন্যও মানায় না।’
মুহিউদ্দীন আরাবীর চিন্তা ও কর্মধারার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারী হলেন সাদরুদ্দীন কৌনাভী। সম্ভবত তিনি না থাকলে মুহিউদ্দীন আরাবীর চিন্তাধারা বোধগম্য হতো না। তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ গত ছয় শতাব্দী ধরে ইসলামী এরফান ও দর্শনশাস্ত্রের পাঠ্যগ্রন্থ। সাদরুদ্দীন কৌনাভীর প্রসিদ্ধ তিনটি গ্রন্থ হলো যথাক্রমে মিফতাহুল গাইব ,নুসুস এবং ফুকুক। কৌনাভী ৬৭২ হিজরীতে (যে বছর মাওলানা রুমী এবং খাজা নাসিরুদ্দীন তুসী মৃত্যুবরণ করেন) অথবা ৬৭৩ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৭. মাওলানা জালালউদ্দীন মুহাম্মদ বালখী রুমী: তিনি মৌলাভী নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর‘
মাসনভী’
গ্রন্থটি বিশ্বে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তিনি আরেফদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তিনি হযরত আবু বকরের বংশধর। তাঁর রচিত‘
মাসনভী’
গ্রন্থটি জ্ঞান ,প্রজ্ঞা ,আত্মিক অবস্থার সূক্ষ্ম দিক নির্দেশক এবং এরফানের উচ্চতর ভাবধারা সম্বলিত। তদুপরি এর সামাজিক দিকটিও যথার্থ। তিনি ইরানের প্রথম সারির কবিদের একজন। তিনি মূলত
আফগানিস্তানের বালখের অধিবাসী। শৈশবেই তিনি পিতার সাথে বালখ হতে মক্কায় যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হন। নিশাবুরে তিনি শেখ ফরিদউদ্দীন আত্তারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মক্কায় যিয়ারত সম্পন্ন করে তিনি পিতার সঙ্গে কৌনিয়ায় যান এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। মাওলানা রুমী একজন প্রথম সারির আলেম ছিলেন এবং দীন শিক্ষাদান করতেন। সমাজে তাঁর বিশেষ অবস্থান ছিল। একদা যখন প্রসিদ্ধ আরেফ শামস তাবরিযীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয় তখন তিনি তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হন এবং সবকিছু ত্যাগ করেন। তাঁর রচিত গজল ও কবিতাগুলো‘
দিওয়ানে শামস’
নামে প্রসিদ্ধ। তিনি তাঁর‘
মাসনভী’
গ্রন্থে বারবার শামসের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর বিয়োগ ব্যথার শোককে কবিতায় তুলে ধরেছেন। মাওলানা রুমী ৬৭২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৮. ফাখরুদ্দীন ইরাকী হামেদানী: তিনি একজন প্রসিদ্ধ কবি ও গজল রচয়িতা এবং সাদরুদ্দীন কৌনাভী ও শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য ছিলেন। তিনি ৬৮৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
অষ্টম হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. আলাউদ্দৌলা সেমনানী: তিনি প্রথম জীবনে বিচার কার্যের সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তা ত্যাগ করেন এবং তাসাউফের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তিনি তাঁর সমস্ত ধনসম্পত্তি আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেন। তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এরফানশাস্ত্রের তাত্ত্বিক বিষয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু মত রয়েছে যা এরফানের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহে উল্লিখিত হয়েছে। তিনি ৭৩৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। প্রসিদ্ধ কবি খাজুয়ে কেরমানী তাঁর অন্যতম শিষ্য ছিলেন। তিনি তাঁর প্রসংশায় নিম্নোক্ত কবিতাটি রচনা করেছেন :
‘
যে কেউ আলীর পথে নিজেকে গড়বে
খিজিরের ন্যায় প্রাণের উৎসের সন্ধান লাভ করবে।
শয়তানী প্ররোচণা হতে যদি হতে পার মুক্ত
আলাউদ্দৌলা সেমানীর সঙ্গে হতে পারবে যুক্ত।’
২. আবদুর রাজ্জাক কাশানী: তিনি এ শতাব্দীর একজন বিশেষজ্ঞ আরেফ। তিনি মুহিউদ্দীন আরাবীর‘
ফুসুসুল হিকাম’
এবং খাজা আবদুল্লাহর‘
মানাজিলুস সায়েরীন’
গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন।‘
রাউযাতুল জান্নাত’
গ্রন্থের লেখক তাঁর গ্রন্থে শেখ আবদুর রাজ্জাক লাহিযীর জীবনী আলোচনায় আবদুর রাজ্জাক কাশানী সম্পর্কে শহীদে সানীর প্রশংসাবাণী উল্লেখ করেছেন। মুহিউদ্দীন আরাবী কর্তৃক উপস্থাপিত এরফানের তাত্ত্বিক বিষয়ে আবদুর রাজ্জাক কাশানীর সঙ্গে আলাউদ্দৌলা সেমনানীর আলোচনা ও বিতর্ক হতো। তিনি ৭৩৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. খাজা হাফেয শিরাজী: হাফিযের বিশ্বপরিচিতি থাকলেও তাঁর জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি। যতটুকু জানা যায় ,তিনি একজন আলেম ,আরেফ ,হাফেয এবং কোরআনের মুফাসসির ছিলেন। তিনি তাঁর কবিতাসমূহে পুনঃপুন এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
‘
হে হাফেয!
তোমার কবিতা হতে আকর্ষণীয় কোন কবিতা আমি দেখিনি
শপথ ঐ কোরআনের যা রেখেছি এ সিনায়
তোমার প্রেমের সুর বাজে সকল হাফেযের বীণায়
তোমার ন্যায় চৌদ্দ নিয়মে কোরআন পাঠ কেউ শিখেনি
বিশ্বের কোন হাফেযই আমার ন্যায় একত্র করেনি
সূক্ষ্ম প্রজ্ঞার কথাসমূহ থেকে কোরআনের বাণী।’
তিনি তাঁর কবিতাসমূহে তরীকতের পীর ও মুর্শিদ সম্পর্কে অসংখ্য কথা বললেও তাঁর মুর্শিদ কে ছিলেন সে সম্পর্কে জানা যায় না। তাঁর এরফানী কবিতাসমূহ এতটা উচ্চ পর্যায়ের যে ,খুব কম ব্যক্তিই এর গভীর অর্থ অনুধাবনে সক্ষম। তাঁর পরবর্তী যুগের সকল আরেফই স্বীকার করেছেন ,তিনি এরফানের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন। অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্ব হাফেযের কবিতাসমূহের ব্যাখ্যা লিখেছেন। যেমন নবম হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ দার্শনিক মুহাক্কেক জালালউদ্দীন দাওয়ানী হাফেযের একটি কবিতার নিম্নোক্ত চরণ দু’
টিকে ব্যাখ্যা করে পুস্তিকা রচনা করেছেন :
‘
সৃষ্টির কলম কোন ভুলই করেনি জগৎ সৃষ্টিতে
ধন্যবাদ ঐ ত্রুটি আবৃতকারী পবিত্র দৃষ্টিকে।’
হাফেয ৭৯১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. শেখ মাহমুদ শাবেস্তারী: তিনি এরফানের অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের একটি কাব্যগ্রন্থ‘
গুলশানে রায’
-এর রচয়িতা। বলা যেতে পারে ,এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। গ্রন্থটির অনেক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচিত হয়েছে। এ সব ব্যাখ্যাগ্রন্থের মধ্যে সম্ভবত শেখ মুহাম্মদ লাহিযীর রচিত ব্যাখ্যাগ্রন্থটি সর্বোত্তম। তিনি ৭২০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
৫. সাইয়্যেদ হায়দার আমোলী: তিনি বিশিষ্ট দার্শনিকদের একজন ,তাঁর রচিত‘
জামেউল আসরার’
গ্রন্থটি এরফানশাস্ত্রের তাত্ত্বিক বিষয়ের একটি মূল্যবান গ্রন্থ যা সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হলো মুহিউদ্দীন আরাবীর‘
ফুসুস’
গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ‘
নাসসুন নুসুস’
। তিনি প্রসিদ্ধ ফকীহ্ আল্লামা হিল্লীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সময় জানা যায়নি।
৬. আবদুল করিম যিলী: তিনি‘
আল ইনসানুল কামিল’
নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের রচয়িতা। ইনসানে কামিল বা পূর্ণ মানবের বিষয়টি সর্বপ্রথম মুহিউদ্দীন আরাবী উপস্থাপন করেন। পরবর্তীতে এই বিষয়টি ইসলামী এরফানশাস্ত্রে বিশেষ স্থান লাভ করে। মুহিউদ্দীন আরাবীর শিষ্য সাদরুদ্দীন কৌনাভীর‘
মিফতাহুল গাইব’
গ্রন্থে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আমার জানা মতে দু’
জন আরেফ এ নামে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁদের একজন হলেন আবদুল করিম যিলী এবং অপর জন হলেন আজিজউদ্দীন নাসাফী যিনি সপ্তম হিজরী শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের একজন আরেফ। তিনি মাত্র ৩৮ বছর বয়সে ৮০৫ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ।
নবম হিজরী শতাব্দীর সুফী ও আরেফগণ
১. শাহ নেয়ামতউল্লাহ্ ওয়ালী: তিনি হযরত আলী (আ.)-এর বংশধর এবং প্রসিদ্ধ আরেফদের একজন। বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধতম তাসাউফের সিলসিলা হলো নেয়ামতউল্লাহী । তাঁর মাজারটি কেরমানের মাহান শহরে অবস্থিত। তিনি ৯৫ বছর বয়সে ৮২৭ অথবা ৮৩৪ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সঙ্গে কবি হাফেয শিরাজীর সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর প্রচুর এরফানী কবিতা রয়েছে।
২. সায়েনউদ্দীন আলী তারাকেহ ইসফাহানী: তিনি বিশিষ্ট আরেফদের অন্যতম। মুহিউদ্দীন আরাবীর এরফানী ধারার ওপর তাঁর বিশেষ দখল ছিল। তাঁর রচিত‘
তামহিদুল কাওয়ায়েদ’
গ্রন্থটি এরফানশাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে।
৩. মুহাম্মদ ইবনে হামযা ফানারী রুমী: তিনি তুরস্কের আলেমদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পণ্ডিত ছিলেন এবং অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি তাঁর‘
মিসবাহুল উনস’
গ্রন্থের কারণে এরফানশাস্ত্রে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর এ গ্রন্থটি সাদরুদ্দীন কৌনাভী রচিত‘
মিফতাহুল গাইব’
গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
মুহিউদ্দীন আরাবী এবং সাদরুদ্দীন কৌনাভীর গ্রন্থসমূহ ব্যাখ্যা করা সহজ কাজ নয়। তাঁর পরবর্তী যুগের আরেফগণ তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের যথার্থ মূল্য দিয়েছেন।
৪. শামসুদ্দীন মুহাম্মদ লাহিযী নূরবাখশী: তিনি বিশিষ্ট দার্শনিক মীর সাদরুদ্দীন দাশতকী এবং আল্লামা দাওয়ানীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি মাহমুদ শাবেস্তারীর‘
গুলশানে রায’
গ্রন্থটির ব্যাখ্যা রচনা করেছেন। তিনি শিরাজের অধিবাসী ছিলেন। কাজী নুরুল্লাহ্ তাঁর‘
মাজালিসুল মুমিনীন’
গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ,সাদরুদ্দীন দাশতকী এবং আল্লামা দাওয়ানী তাঁকে অত্যন্ত সম্মান করতেন। তিনি বিশিষ্ট ফকীহ্ ইবনে ফাহাদ হিল্লীর ছাত্র সাইয়্যেদ মুহাম্মদ নূরবাখশের শিষ্য ছিলেন। লাহিযী‘
গুলশানে রায’
গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থের ৬৮৯ পৃষ্ঠায় তাঁর তাসাউফের সিলসিলাটি তাঁর শিক্ষক সাইয়্যেদ মুহাম্মদ নূরবাখশের মাধ্যমে মারুফ কুর্খী পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন এবং যেহেতু মারুফ কুর্খী ইমাম রেযার মাধ্যমে ইসলামে দীক্ষা লাভ করেছিলেন সেহেতু এ সিলসিলাটি রাসূল (সা.)-এ পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে তিনি দাবি করেছেন। তাই তিনি এ সিলসিলাকে‘
স্বর্ণ নির্মিত সিলসিলা’
(সিলসিলাতুয যাহাব) বলে অভিহিত করেছেন।
‘
গুলশানে রায’
গ্রন্থটির যে ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনার মাধ্যমে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন তা এরফানের উচ্চ পর্যায়ের একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি এর রচনাকাল ৮৭৭ হিজরী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সময় আমাদের জানা নেই।
৫। নূরুদ্দীন আবদুর রহমান জামী: তিনি আরব বংশোদ্ভূত এবং দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর বিশিষ্ট ফকীহ্ হাসান শাইবানীর বংশধর। জামী একজন শক্তিমান কবি ছিলেন। তাঁকে ফার্সী সাহিত্যের সর্বশেষ বড় এরফানী কবি বলা হয়। প্রথম জীবনে তাঁর ছদ্ম নাম ছিল দাশতী ,কিন্তু পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে তাঁর জন্মস্থান জামের (মাশহাদের নিকটবর্তী একটি শহর) নামানুসারে জামী নাম রাখেন। নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছেন ,
‘
জন্ম যেহেতু জামে আমার ,অধিবাসী জামের
মুরীদ আমি জামের অধিবাসী শাইখুল ইসলামের।
এ কথাই তুলে ধরেছি আমার কবিতায়
হয়েছি আমি জামী দু’
অর্থে তাই।’
জামী আরবী ব্যাকরণ (সারফ ও নাহু) ,উসূল ও ফিকাহ্শাস্ত্র ,যুক্তিবিদ্যা ,দর্শন এবং এরফানসহ জ্ঞানের বিভিন্নি শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তন্মধ্যে মুহিউদ্দীন আরাবীর‘
ফুসুসুল হিকাম’
,ফাখরুদ্দীন ইরাকীর‘
লোমাআত’
,ইবনে ফারেযের‘
তাইয়্যা’
গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ,শেখ সাদীর‘
গুলিস্তান’
গ্রন্থের ধাঁচে‘
বাহরেস্তান’
এবং‘
লাওয়াইহ’
নামে দু’
টি গ্রন্থ ,রাসূল (সা.)-এর প্রশংসায় রচিত‘
শারহে কাসীদায়ে বুরদাহ্’
,ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর প্রশংসায় রচিত কবি ফারাযদাকের কাসীদায়ে মহিমিয়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ এবং আরেফদের জীবনী অবলম্বনে‘
নাফাহাতুল উনস’
উল্লেখযোগ্য। তিনি নকশাবন্দীয়া তরীকার প্রতিষ্ঠাতা বাহাউদ্দীন নকশবন্দের মুরীদ ছিলেন। কিন্তু তিনি বাহাউদ্দীন নকশবন্দের তরীকার অনুসারী হলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব ঐতিহাসিকভাবে বাহাউদ্দীন নকশবন্দ হতে অধিক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। যেহেতু আমরা এরফানের সাংস্কৃতিক ধারার ইতিহাস নিয়ে এখানে আলোচনা করেছি-তরীকতী ধারা নিয়ে নয়-তাই আবদুর রহমান জামীর নাম এখানে আসলেও তাঁর পীরের নাম এখানে আসেনি। তিনি ৮৯৮ হিজরীতে ৮১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
এতক্ষণ আমরা এরফানশাস্ত্রের উৎপত্তিকাল হতে নবম হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত ইতিহাস আলোচনা করলাম। নবম হিজরী শতাব্দীর পর থেকে এরফানশাস্ত্র ভিন্নরূপ লাভ করেছে বলে আমরা মনে করি। এরফানশাস্ত্রের জ্ঞান ও সংস্কৃতির ধারক প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ এবং তাসাউফ বিষয়ক ধারার বিভিন্ন সিলসিলার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বগণের প্রায় সকলেই নবম হিজরী শতাব্দীর পূর্বের। এখানে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য :
প্রথমত এর পরবর্তী সময়ের সুফী ও আরেফগণ পূর্ববতীদের ন্যায় ততটা উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের নন। সম্ভবত এর কারণ হলো এর পরবতী সময়ে তাসাউফ আচারসর্বস্ব ও বাহ্যিকতার দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বিদআত প্রচলিত হয়।
দ্বিতীয়ত এর পরবর্তী সময়ের আরেফদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তিবর্গের সন্ধান পাওয়া যায় মুহিউদ্দীন আরাবীর এরফান তত্ত্বের ওপর অভূতপূর্ব পাণ্ডিত্যের অধিকারী হলেও তাসাউফের বিভিন্ন সিলসিলা ও ধারার কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। যেমন সাদরুল মুতাআল্লেহীন শিরাজী (মৃত্যু ১০৯১ হিজরী) ,তাঁর ছাত্র ফায়েয কাশানী (মৃত্যু ১৩৯১) এবং তাঁর ছাত্রের ছাত্র কাজী সায়ীদ কুমী তাঁদের সমকালীন প্রসিদ্ধ সুফী ব্যক্তিবর্গ থেকে মুহিউদ্দীন আরাবীর এরফান তত্ত্বের ওপর অধিকতর জ্ঞান রাখতেন ,অথচ এই ব্যক্তিবর্গ তাসাউফের কোন ধারারই অন্তুর্ভুক্ত নন। বর্তমান সময়েও প্রসিদ্ধ অনেক আরেফ তাসাউফের কোন ধারার অনুসারী না হয়েও এরফানশাস্ত্রের ওপর গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ,যেমন গত শতাব্দীর প্রসিদ্ধ আলেম আগা মুহাম্মদ রেযা হাকিম কামশেহী এবং আগা মির্জা হাশেম রাশতী।
মোটামুটিভাবে বলা যায় ,মুহিউদ্দীন আরাবী এবং সাদরুদ্দীন কৌনাভীর মাধ্যমে এরফান দার্শনিক ভিত্তি লাভ করে এবং এর তাত্ত্বিকতার বীজ বপিত হয়। সম্ভবত মুহাম্মদ ইবনে হামযা ফানারী এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু দশম হিজরী শতাব্দীর পর থেকে যে সকল ব্যক্তি এরফানশাস্ত্রের ওপর বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন তাঁরা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এরফানী পথের পরিব্রাজক ছিলেন না নতুবা পরিব্রাজক হলেও প্রচলিত সুফী তরীকার কোন সিলসিলারই অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। বিষয়টি স্পষ্ট।
তৃতীয়ত দশম হিজরী শতাব্দীর পর থেকে শিয়া বিশ্বে বেশ কিছু ব্যক্তিত্ব ও দলের আবির্ভাব ঘটেছিল যাঁরা এরফানের ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পরিব্রাজক হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন এবং এরফানের পথ সর্বোত্তম উপায়ে পরিক্রমণ করেছিলন। যদিও তাঁরা এ ক্ষেত্রে তাসাউফ সংক্রান্ত ধারার কোন সিলসিলারই অন্তুর্ভুক্ত ছিলেন না ,এমনকি তাসাউফের পূর্ববর্তী তরীকাসমূহের ত্রুটিবিচ্যুতির সমালোচক ছিলেন।
এ দলটির একটি বিশেষত্ব হলো তাঁরা সকলে যেহেতু ফিকাহ্শাস্ত্রের ওপর অভিজ্ঞ ছিলেন তাই তাঁদের এরফানী পথ পরিক্রমও এর সাথে সঙ্গতিশীল ছিল। এই ধারার ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ এখানে না থাকায় তা থেকে বিরত থাকছি।
পরিশেষে বল যায় ,ইসলামী সংস্কৃতির এরফানী ধারাটি এর অন্যান্য ধারার মতই সারা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপৃত ছিল। স্পেন ,মিশর ,সিরিয়া ও রোম হতে খাওয়ারেজম পর্যন্ত এর শাখা বিস্তৃত ছিল এবং এ শাস্ত্রে ইরানীদের অবদান অন্যান্যদের থেকে নিশ্চিতভাবেই অধিক ছিল। আরেফ ও সুফীদের প্রথম সারির ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই যেমন ছিলেন ইরানী তেমনি আবার অনেকেই অ-ইরানী।