ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান11%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 112224 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

শিল্প ও সাহিত্য

এতক্ষণ জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিষয়ে আমরা যা আলোচনা করলাম তাতে ইসলামে ইরানীদের চিন্তাগত অবদান ফুটে উঠেছে। ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতার বিকাশে ইরানীরা যে অবদান রেখেছিল তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এখন আমরা ইসলামের শিল্পকলা ও সাহিত্যে ইরানীদের অবদানের বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরব। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবদান অন্য সকল ক্ষেত্র হতে তাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাকে উত্তমরূপে তুলে ধরতে সক্ষম। কারণ এ ক্ষেত্রটির সঙ্গে মানুষের বিশ্বাস ও ভালবাসার সম্পর্ক অধিকতর। অর্থাৎ বলা যেতে পারে ,শৈল্পিক সৃষ্টিসমূহ মানুষের গভীর বিশ্বাস ও ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কারো নিকট থেকে মহাসৃষ্টি আদায় করা সম্ভব নয়। তাই ভালবাসা ও ঈমানই পারে শুধু মহাসৃষ্টি করতে। চিন্তাগত মহাসৃষ্টির ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি সত্য। তবে শিল্পকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি আরো স্পষ্ট। ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে যেমন ইরানীদের মহাসৃষ্টি রয়েছে তেমনি সাহিত্য ও শিল্পকলাতেও রয়েছে।

ইসলামী যুগে স্থাপত্য শিল্প ,চিত্র শিল্প ,ক্যালিগ্রাফি ,স্বর্ণ-কারুকার্য শিল্প ,অঙ্গুরি শিল্প ,মোজাইক শিল্প ,লৌহ শিল্প প্রভৃতিতে ইরানীরা যে সৃষ্টিশীল অবদান রেখেছে তার অধিকাংশই ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ বিষয়টি আলোচনার জন্য স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থের দাবি রাখে।

এ মহাসৃষ্টিসমূহ ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন মসজিদ ,পবিত্র স্থান ,মাদ্রাসা ,কোরআন ,দোয়াগ্রন্থসমূহে প্রতিফলিত হয়েছে। বিষয়টি যেমন মসজিদ ,মাদ্রাসা ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের স্থাপত্যকর্মে ফুটে উঠেছে তেমনি বিভিন্ন গ্রন্থসমূহে স্বর্ণলিপি ,অঙ্গুরি ও মোজাইকেও তা পরিদৃষ্ট হয়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে (এমনকি ইসলামী বিশ্বের বাইরেও অমুসলিম দেশসমূহের জাদুঘরেও) কোরআনের যেসব অনুলিপি রয়েছে তা এ ক্ষেত্রে ইরানীদের শিল্পমনস্কতা ও তাদের অন্তরে বিদ্যমান ইসলামের প্রতি ভালবাসাকে তুলে ধরেছে।

ইরানীরা ইরানের বাইরে ও অন্যান্য স্থানে ইসলামী শিল্পকলাতে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। বিশ্বের অমুসলিম বিভিন্ন দেশ যেখানে মুসলমানগণ সংখ্যলঘু ,যেমন ভারত ও চীনেও ইরানীরা এমন অনেক মহাকীর্তি সৃষ্টি করেছে যা ইরানীদের ইসলামপ্রেম ও নিষ্ঠাকেই প্রমাণ করে। এ বিষয়ে গবেষণার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি।

অন্য যে ক্ষেত্রটিতে ইরানীরা তাদের রুচি ও অনুভূতির স্বাক্ষর রেখেছে তা হলো ফার্সী ভাষার মাধ্যমে ইসলামের উপস্থাপন। ইরানী কবি ,সাহিত্যিক ,আরেফ ও বাগ্মী আলেমগণ ইসলামের প্রকৃত বর্ণনাকে ফার্সীর অলংকৃত পোশাক পরিয়ে সর্বোত্তম রূপে উপস্থাপন করেছেন ;ইসলামের অভ্যন্তরীণ রূপকে রূপকভাবে প্রতিমূর্ত করেছেন। তাঁরা কোরআনের বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয়কে বোধগম্য ও আকর্ষণীয় রূপে কাব্য আকারে উপস্থাপন করেছেন। মাওলানা রুমীর মাসনভী এর সর্বোত্তম উদাহরণ।

দারী ফার্সী (ইসলাম পরবর্তী ইরানী ফার্সী) ইসলামে যে আবদান রেখেছে তা স্বতন্ত্রভাবে গবেষণার বিষয়। এ বিষয়ে কেউ অধ্যয়ন করলে দেখতে পাবেন ,এ ভাষাটি ইসলামের আবির্ভাবের পরে বারোশ বছরের অধিক সময় ধরে ইসলামের সেবাতেই যেন নিয়োজিত ছিল।

কেউ যদি শুধু ইসলামের তাওহীদ ,কোরআন ,নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রশংসায় রচিত ফার্সী ভাষায় বিদ্যমান উচ্চমানের কবিতাসমূহ নিয়েই গবেষণা করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে ,এর পরিমাণ কয়েক খণ্ড পুরু গ্রন্থের সমান। ফার্সী ভাষায় বিদ্যমান ইসলামের রূপ বর্ণনাকারী বিভিন্ন গজল ,কাহিনী ,উপদেশমূলক গল্পসমূহ সামনে রাখলে এর পরিমাণ হবে তার কয়েকগুণ।

গত বারোশ শতাব্দী ধরে ফার্সী সাহিত্য ,কোরআন ও হাদীসের বাণী ও ভাবধারা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ফার্সী ভাষায় বর্ণিত বিভিন্ন উপদেশ বাণী ও এরফানী গভীর তত্ত্বসমূহ কোরআন ও হাদীস হতেই গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহর দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েই তা বিকশিত হয়েছে।

দারী ফার্সীর সঙ্গে কোন কোন ব্যক্তির শত্রুতা এ কারণেই যে ,এ ভাষাটি ইসলামী ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং ইসলামী সংস্কৃতির শক্তিশালী উপস্থাপকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাই তাঁরা জানেন এ ভাষার সঙ্গে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া ব্যতীত ইসলামকে পরাভূত করা যাবে না। ফার্সী সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আলোচনার গুরুদায়িত্বটি বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে চাই। কারণ এ বিষয়ে তাঁরাই অধিক যোগ্য।

দু শতাব্দীর নীরবতা

সম্মানিত পাঠকগণ! এ গ্রন্থের তৃতীয় আলোচনায় যে বিষয়টি স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে তা হলো ইরানীরা উদারতা ,মহত্ত্ব ও কৃতজ্ঞচিত্ত নিয়ে ইসলামের প্রতি অনুগত হয়েছিল এবং ইসলামের মধ্যে তাদের প্রকৃতি ও আত্মিক চাহিদারই প্রতিফলন লক্ষ্য করেছি। ইরানীদের নিকট ইসলাম যেন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির নিকট সুস্বাদু খাদ্যের মতো ছিল। ইরানীরা তৃষ্ণার্ত ছিল এবং ইসলাম যেন তাদের জন্য সুপেয় পানি এনে দিয়েছিল। ইসলামপূর্ব ইরানী ভৌগোলিক ও সময়গত সামাজিক অবস্থান ও ইরানীদের প্রকৃতি ইসলামের প্রতি ইরানীদের আকৃষ্ট করেছিল এবং তা তাদের জীবনসঞ্চারে শক্তি দিয়েছিল । পরবর্তীতে ইরানীরা নিজেদের জীবন ও শক্তিকে ইসলামের সেবায় নিবেদিত করেছিল।

আমরা জানি ,৪১ হিজরী হতে ১২৩ হিজরী পর্যন্ত প্রায় একশ বছর উমাইয়্যারা মুসলিম বিশ্বে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। ইসলাম জাতি ও বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের যে জাহেলী রীতির অবসান ঘটিয়েছিল উমাইয়্যারা তা পুনর্জীবিত করেছিল। তাদের রাজনীতি ছিল জাতিগত বৈষম্যকেন্দ্রিক। তারা আরবদের মধ্যে পার্থক্য করত। বিশেষত ইরানীদের সাথে উমাইয়্যাদের আচার অন্যান্য জাতি হতে নিকৃষ্টতর ছিল। এর প্রকৃত করণ হলো হযরত আলী (আ.)-এর প্রতি ইরানীদের বিশেষ ভালবাসা। যেহেতু হযরত আলীর রাজনীতি ইসলামের জাতি-বর্ণ ও শ্রেণীহীন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং উমাইয়্যা বা আরব ও কুরাইশ হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দেখিয়ে ক্ষমতার ক্ষেত্রে লাভবান হতো সেহেতু তারা আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিল। এ কারণেই আলী (অ.)-এর অনুসারী আরব ,ইরানী ,আফ্রিকীয় সকলেই তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যদের হতে ইরানীরাই বেশি নির্যাতিত হয়েছে।

১৩২ হিজরীতে যখন আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসেন তখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হয়ে যায়। খলীফা মুতাসিম বিল্লাহর ক্ষমতা হারানোর পূর্ব পর্যন্ত আব্বাসীয়দের নীতি ছিল আরবদের পরিবর্তে ইরানীদের পৃষ্টপোষকতা ও শক্তিশালী করা। খলীফা মুতাসিমের সময়কালে তুর্কীরা ইরানীদের স্থলাভিষিক্ত হয়। আব্বাসীয় শাসনের প্রথম একশ বছর ইরানীদের স্বর্ণযুগ ছিল। আব্বাসীয় শাসকদের বেশ কিছু উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ,যেমন বার্মাকী (বালখের সম্ভ্রান্ত বৌদ্ধ পরিবারের সন্তান ;পরবর্তীতে তাঁরা মুসলমান হন) এবং ফাযল ইবনে সাহল সারখসী (যুররিয়াসাতাইন) খলীফার পর সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতেন।

আব্বাসীয় শাসনের প্রথম শতাব্দীতে ইরানীরা স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিল না ;বরং রাজনৈতিকভাবে ইসলামী খেলাফতের অধীন হিসেবে স্বাচ্ছন্দে কাজ করত। কিন্তু এক শতাব্দী পর হতে যখন তাহেরিয়ান বংশ খোরাসানের ক্ষমতা লাভ করে ,তখন থেকে ইরানীরা মোটামুটি স্বাধীন হয়ে পড়ে এবং বিশেষভাবে সাফারিয়ানদের শাসনামলে ইরানীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন শাসন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়।

অবশ্য এ শাসকবর্গের স্বাধীন ক্ষমতা থাকলেও আব্বাসীয় শাসনামলের শেষ সময় পর্যন্ত নৈতিকভাবে তাঁরা আব্বাসীয় খলীফাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ইরানের জনসাধারণ মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে খলীফাদের বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ইরানী শাসক খলীফার পক্ষ হতে অভিষিক্ত না হতেন ততক্ষণ তারা তা শরীয়তসম্মত মনে করত না। সপ্তম হিজরী শতাব্দীতে যখন আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটে তখন অভিষিক্ত হওয়ার এ ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। আব্বাসীয় শাসনের পতনের পর উসমানী শাসকরা ইরানের বাইরে অন্যান্য স্থানে নৈতিক প্রভাব রাখলেও ইরানে তাদের কোন প্রভাব ছিল না। এর কারণ হলো ইরানী জনসাধারণের শিয়া প্রবণতা এবং উসমানী খিলাফতকে সঙ্গত মনে না করা। কোন কোন প্রাচ্যবিদ ,যেমন ব্রিটিশ লেখক সার্জন ম্যালকম ইরানে ইসলামের আবির্ভাবের সময়কাল হতে ইরানের স্বাধীন ক্ষমতা লাভের সময়কাল পর্যন্ত (প্রথম হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধ হতে তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত) ইরানীদের নীরবতা ও দাসত্বের যুগ বলে উল্লেখ করেছেন। এ মত অনেক ইরানীকে প্রভাবিত করেছে।

যদি আমরা বিষয়টিকে সার্জন ম্যালকমের দৃষ্টিতে দেখি অর্থাৎ এ দু শতাব্দীতে ইরানের সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বিষয়ে নজীরবিহীন যে পরিবর্তন হয়েছিল এবং তাদের জন্য এটি কতটা কল্যাণকর হয়েছিল সে বিষটিকে উপেক্ষা করে ইরানের পূর্ববর্তী শাসকবর্গের দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখি তাহলে এ সময়কালকে নীরবতার যুগ বলতে পারি।

যদি আমরা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ও আবু মুসলিম খোরাসানীদের আদর্শ হিসেবে ধরি ,যাঁদের একজন ১ লক্ষ ২০ হাজার লোক হত্যা করেছিলেন এবং অপরজন ৬ লক্ষ লোক ,সে ক্ষেত্রে কোন গোঁড়া আরবের ন্যায় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হাজ্জাজের হাতে কেন এই ৬ লক্ষ লোক নিহত হলো না সেজন্য আফসোস করতে পারি । সেরূপ আমাদেরও আফসোস হতে পারে ,আবু মুসলিম খোরাসানী কেন ইরানী হিসেবে আরো ১ লক্ষ ২০ হাজার লোক হত্যা করতে পারলেন না। যদি তা করতে পারতেন তবে তিনিও আরব হাজ্জাজের ন্যায় প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারতেন ,কিন্তু তা যখন হয়নি তাহলে নিশ্চয় এ দু শতাব্দী ইরানীদের নীরবতার যুগ ।

কিন্তু ইরানের সাধারণ মানুষের অর্থাৎ কর্মকার ,চর্মকার ,শ্রমিক যাদের মধ্য হতে সীবাভেই ,আবু হানিফা ,আবু ওবায়দা ,বনী শাকের ,বনী নৌবাখত এরূপ অনেক ব্যক্তিত্ব ও বংশের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের দৃষ্টিতে দেখি তবে দেখব এ দু শতাব্দী ইরানীদের জোশ ,উদ্দীপনা ,সুর ও ছন্দের যুগ ছিল। কারণ তারা এ সময়েই পেরেছিল নিজেদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে ও স্বাধীনভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা করতে। যেন ইরানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত তারা জ্ঞান ,সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার মাধ্যমে অন্যান্য জাতির ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছিল। তারা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে স্বভূমি ও ব্যক্তিসত্তার সম্মানকে চির উন্নত ও স্থায়ী করতে পেরেছিল।

এই দু শতাব্দীতেই ইরানীরা জাতি-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানবিক ও বিশ্বজনীন এক আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। এ আদর্শের সত্তাকে তারা স্থান ,কালের ঊর্ধ্বে এক ঐশী সত্য হিসেবে বুঝতে পেরেছিল। কোরআন ও ইসলামের বিশ্বজনীন ভাষা যা কোন বিশেষ জাতির জন্য নয় বরং একটি ধর্মের ভাষা ,তাকে নিজ জাতীয় ভাষার ওপর প্রধান্য দিয়েছিল।

আশ্চর্যের বিষয় হলো এরা বলে থাকে দু শতাব্দীতে ইরানীরা বাকরুদ্ধ হয়েছিল ,শুধু তরবারীই তাদের কথা বলাতো।

প্রকৃতপক্ষে এ বক্তব্যের অর্থ আমার বোধগম্য নয়। তবে কি জ্ঞান ও সাহিত্যের ভাষা কোন ভাষা নয় ? সীবাভেইয়ের সাহিত্যে ও ব্যাকরণ শাস্ত্রের মহাগ্রন্থটি (যেটি টলেমারী ম্যাজেস্টি এবং অ্যারিস্টটলের যু্িক্তবিদ্যা গ্রন্থের সমমানের বলা যেতে পারে) কি এ সময়েই রচিত হয়নি ? ইবনে কুতাইবার আদাবুল কাতিব নামক মহাসৃষ্টিটি কি এ সময়েই রচিত হয়নি ? ব্যাকরণ সম্পর্কিত সৃষ্টি কি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় ?

সম্ভবত তাঁরা বলবেন ,এসব গ্রন্থ তো আরবী ভাষায় রচিত হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হলো ,কেউ কি ইরানীদের বাধ্য করেছিল আরবী ভাষায় মহাসৃষ্টি করতে ? আদৌ জোরপূর্বক মহাসৃষ্টি করান সম্ভব কি ? যদি ইরানীরা কোন ভাষাতে ঐশী মুজিযার সন্ধান পেয়ে থাকে এবং জানতে পারে ,তা কোন জাতির জন্য শুধু নয় ;বরং এটি এক গ্রন্থের ভাষা। অতঃপর তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে তাকে শক্তিশালী করার কাজে ব্রত হয়ে থাকে তবে একে কি ত্রুটি বলা যায় ? যদি ইরানীরা তাদের প্রাচীন ভাষার সঙ্গে এ নতুন ভাষার শব্দ ও ভাবার্থের মিশ্রণ ঘটিয়ে আকর্ষণীয় ও মিষ্টি নবীন ফার্সী ভাষার সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তাকে অপরাধ বলা যাবে কি ?

তাঁরা বলে থাকেন যে ,ইসলামপূর্ব ইরানী ভাষা এমন এক জাতির ভাষা ছিল যা সাহিত্য ,সংস্কৃতি ও জ্ঞানে পূর্ণ ছিল ,অথচ এ জাতিটি আরবদের মুখোমুখি হওয়ার পর কি শুনে নীরব হয়ে গেল ?

ড. যেররিন কুব উপরিউক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করে নিজেই এর জবাব দিয়েছেন ,

বলা হয়ে থাকে আরবী ভাষা অন্ধকার জাতির ভাষা হিসেবে এর কোন মধুরতা ,স্নিগ্ধতা ছিল না। তদুপরি যখন ইরান সাম্রাজ্যের আকাশে এ ভাষার আযান প্রতিধ্বনিত হলো তখন প্রাচীন পাহলভী ভাষা এর বিপরীতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কথা হলো ,যদি এমনটি হয়ে থাকে তবে যে ঘটনাটি ইরানীদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল তা হলো কোরআনের বাণী। সাধারণের বোধগম্য অথচ অলৌকিক এ বাণী আরবদের যেমন বিস্মিত করেছিল তেমনি তা ইরানীদের চিন্তাশক্তিকে বিস্মিত এবং হতবিহ্বল করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ইরানীরা নতুন এ ধর্মের মধ্যে এমন কিছুর সন্ধান পেয়েছিল যা তাদের হৃদয়কে উদ্দীপিত করেছিল এবং তারা আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে একে গ্রহণ করেছিল। তারা এতটা আত্মহারা হয়ে পড়েছিল যে ,কোন কবি বা বক্তাই তা ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি।

মুসলিম খলীফাগণ এমন কি উমাইয়্যা খলীফাদের ব্যাপারেও এরূপ কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি যে ,তাঁরা ইরানীদের তাদের প্রকৃত ভাষার ক্ষেত্রে-ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত থাকলেও প্রচলিত মূল ভাষার ব্যাপারে-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। তাই এ বিষয়ে যেরূপ দাবি করা হয়েছে তার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই ;বরং বুঝা যায় তাঁরা বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কল্পনাপ্রসূত এরূপ কথা বলেছেন। কোরআনের অর্থ ,শব্দ বিন্যাস এবং এর বিশ্বজনীন শিক্ষার আকর্ষণ বিশ্বের সকল মুসলমানকে এ ঐশী গ্রন্থের প্রতি অনুরাগী করেছে। ফলে তারা তাদের নিজ ভাষার ওপর কোরআনের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই বিষয়টি শুধু ইরানীদের ক্ষেত্রেই নয় ;বরং সকল মুসলমানের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল এবং তারা তাদের নিজ ভাষাকে কোরআনের ভাষার বিপরীতে বিসর্জন দিয়েছিল। আমরা বারবার উল্লেখ করেছি যে ,যদি আব্বাসীয় খলীফাগণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরববিরোধী নীতি গ্রহণ না করতেন তবে বর্তমানে প্রচলিত ফার্সী ভাষার (যার সাথে ইসলামপূর্ব ফার্সীর পার্থক্য রয়েছে) উৎপত্তি হতো না। আব্বাসীয় খলীফাগণ ফার্সী ভাষার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরা কখনোই চাননি ,আরবী ভাষা ইরানের সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলন লাভ করুক। বনি আব্বাস আরববিরোধী শুয়ূবীয়া আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শুয়ূবী নেতা আলান আরবদের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে ব্যাঙ্গাত্মক গ্রন্থ রচনা করেন ,অথচ তিনি খলীফা হারুন ও মামুনের দরবারের কর্মচারী ও তাঁদের স্থাপিত জ্ঞানকেন্দ্রের অনুবাদকের দায়িত্বে ছিলেন এবং নিয়মিত মজুরি পেতেন। শুয়ূবী চরমভাবে আরববিদ্বেষী ছিলেন এবং আরবদের কটুক্তি করে গ্রন্থ রচনা করতেন। অথচ তিনি হারুন ও মামুনের স্থাপিত জ্ঞানকেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতেন।৩৫৬ পূর্বে ফার্সী ভাষা সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি ,খলীফা মামুন প্রথম মুসলিম শাসক যিনি ফার্সী ভাষায় কবিতা রচনাকে উৎসাহিত করেছেন।

সুতরাং ইরানীদের প্রাচীন ফার্সীকে বাদ দিয়ে নতুন ফার্সী গ্রহণের বিষয়টি যাকে কোন কোন প্রাচ্যবিদ ইরানীদের বাকরুদ্ধ হওয়া বলে অভিহিত করেছেন- তা এ জাতির জন্য অনুশোচনার বিষয় নয় ;বরং খুশী হওয়ার মত বিষয়। প্রত্যেক ভাষারই নিজম্ব কিছু সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য রয়েছে ,ফার্সী ভাষাও এরূপ সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি ভাষা। এ ভাষার সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে ইরানীরা ঈমানের বলে ইসলামে মূল্যবান অবদান রেখেছে।

এ বিষয়টি মূল্যায়নে এডওয়ার্ড ব্রাউন ইনসাফ রক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন ,

ইরানের ইতিহাস বিষয়ে রচিত দু টি গ্রন্থ সম্পর্কে ব্রিটিশরা অধিক পরিচিত। যার একটি স্যার জন ম্যালকমের এবং অপরটি ক্রিমেনটেজ মার্কহাম রচিত। এ দু টি গ্রন্থে ১ম হিজরী শতাব্দীতে (সপ্তম খ্রিষ্টীয় শতাব্দী) আরবগণ কর্তৃক ইরান বিজয়ের সময়কাল হতে ৩য় হিজরী শতাব্দীতে

(৯ম খ্রিষ্ট শতাব্দী) ইরানীদের স্বাধীন ক্ষমতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের ইরানের ইতিহাস সম্পর্কে যা আলোচনা করা হয়েছে তা অসম্পূর্ণ এবং বিষয়টিকে স্থূল দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে... অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এ সময়কালটি পূর্ববর্তী যে কোন সময়ের চেয়ে ইরানীদের জন্য উদ্দীপনাময় সময় ছিল এবং ইরানের ইতিহাসে জ্ঞান ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে এ সময়টিতে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।

অন্যত্র তিনি সালমান ফার্সী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন ,

সালমান ফার্সীই যিনি ইরানীদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে রাসূলের সম্মানিত ও বিশেষ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের অনেক উচ্চ পর্যায়ের আলেম ইরানী বংশোদ্ভূত ছিলেন। আরবদের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দী কিছু ব্যক্তি ,যেমন জালুলা যুদ্ধে বন্দী ইবনে শিরীন ও তাঁর তিন ভ্রাতা ইসলামী বিশ্বে আলেম হিসেবে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তাই যে সকল ব্যক্তি বলে থাকেন আরবগণ কর্তৃক ইরান জয়ের পর দু শতাব্দী ধরে ইরানীরা জ্ঞান ও নৈতিকতা হতে বঞ্চিত ছিল সেটি কখনোই সত্য নয় ;বরং এর বিপরীতে ইসলামের অবির্ভাবের পরবর্তী দু তিন শতাব্দী ইরানীরা এ ক্ষেত্রে এতটা আকৃষ্ট হয়েছিল যা ইতিহাসে নজীরবিহীন। এ সময়কালটিকে নবীন ও প্রবীণ সভ্যতার মধ্যে সংমিশ্রণের যুগ বলা যায়। এ যুগটি প্রাচীন আচার ,বিশ্বাস ও চিন্তার পরিবর্তনের যুগ এবং কোন অবস্থায়ই একে মৃত্যু ,পতন বা নীরবতার যুগ বলা যায় না।

এ দু শতাব্দীর অন্যতম বিশেষত্ব হলো ইরানী মুসলমান ব্যক্তিত্বগণ তাঁদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আশ্বর্যজনক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি দীনী দৃষ্টিতেও উচ্চ সম্মান ও মর্যাদায় পৌঁছেছিলেন। তাঁদের অনেকেই অন্যান্য জাতির নিকটও অতীব সম্মানার্হ ছিলেন। এখনও ইরানের বাইরের আহলে সুন্নাতের গ্রন্থসমূহে এ সকল ব্যক্তির নাম অতি সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয়ে থাকে। ইসলামী বিশ্বের দূরবর্তী দেশসমূহেও তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। এ যুগটি জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ের হলেও ধর্মীয় সম্মান লাভের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায় ইরানীরা এ সময়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হতে পেরেছিল।

যদি আমরা এ দু শতাব্দীর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের ইরানে ইসলামের বিজয়ের সময়কাল হতে খোরাসানে ইরানীদের (তাহরিয়ান বংশ) স্বাধীন ক্ষমতা লাভ পর্যন্ত সময়কালের ইরানের সমাজকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

অবশ্য যে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের অসচেতন হওয়া যাবে না তা হলো ইরানে সাফারিয়ান ও সামানিয়ান শাসনামলে যে সকল ইরানী মনীষী তাঁদের প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁদের সকলেই ইরানে বাস করতেন না। তাঁদের অনেকেই ইরাকে অথবা হেজাযে বসবাস করতেন।

ইরানীদের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর নৈকট্য ও সাহচর্যের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি বিরল সম্মান লাভ করেছিলেন তিনি হলেন সালমান ফার্সী৩৫৭ । তিনি শিয়া মুসলমানদের দৃষ্টিতে রাসূল ও হযরত আলীর শ্রেষ্ঠ সাহাবী এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে রাসূলের প্রথম সারির সাহাবীদের একজন । মসজিদে নববীর দেয়ালে প্রথম সারির অন্যান্য সাহাবীদের সাথে তাঁর নাম খচিত রয়েছে।

রাসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবী ছাড়াও ইরানের অন্যান্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ এ দু শতাব্দীতে ইরান ও ইরানী জাতির জন্য যে সম্মান-মর্যাদা ও সম্ভাবনা বহন করে এনেছেন তা আলোচনা করলে দেখব প্রকৃতপক্ষেই ইরানের ইতিহাসে তা ছিল অভূতপূর্ব।

এ দু শতাব্দীতে একদল ইরানী কেরাআত ,তাফসীর ,হাদীস এবং ফিকাহ্শাস্ত্রে ধর্মীয়ভাবে এতটা উচ্চ স্থানে পৌঁছেছিলেন যে ,অন্যান্য জাতির মুসলমানরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করত। বিশ্বের ৫৫ কোটি সুন্নী মুসলমান তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে অনুসরণ করে। নাফে ,আসেম ,ইবনে কাসীর ,মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী ,মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ নিশাবুরী ,তাউস ইবনে কাইসান ,রাবীতুর রাঈ ,আমাশ ,আবু হানিফা ,লাইস ইবনে সা দ প্রমুখ এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত। লাইস ইবনে সা দ একজন ইরানী ছিলেন যিনি মিশরের প্রধান মুফতির পদে অধিষ্ঠিত হন। একবার তিনি হজ্বব্রত পালন করতে এলে আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট ফকীহ্ সুফিয়ান সাওরী (যিনি একজন আদনানী আরব) তাঁকে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে স্বহস্তে তাঁর উষ্ট্রের দড়ি টেনে এনে বাঁধেন।

এ দু শতাব্দীতে আরবী সাহিত্য ও ব্যাকরণশাস্ত্রে যে সকল ইরানী বিশেষ ভূমিকা রাখেন তাঁদের কয়েকজন হলেন সিবাভেই কেসায়ী ,ফাররা ,আবু ওবায়দা মুয়াম্মার ইবনে মুসান্না ,ইউনুস ,আখফাস ,হাম্মাদ রাভীয়া ,ইবনে কুতাইবা দীনওয়ারী। ঐতিহাসিকদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ,আবু হানিফা দীনওয়ারী এবং ফুতুহুল বুলদান গ্রন্থের লেখক বালাযুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। কালামশাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আলে নাওবাখত ,আবুল হাজিল আলাফ ,নিযাম ,ওয়াসিল ইবনে আতা ,হাসান বসরী ,আমর ইবনে ওবায়িদ প্রমুখ। দর্শন ,গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় শাকের খাওয়ারেজমীর পুত্রগণ ,নাওবাখতিগণ ,আবু মা শার বালখী ,আবুত তায়্যিব সারাখসী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ইরানী মুসলিম সেনা নায়কদের মধ্যে তাহের যুল ইয়ামিনাইন এবং স্পেন বিজয়ী সেনাপতি মূসা ইবনে নাসিরের নাম উল্লেখযোগ্য। উপরোক্ত উদাহরণসমূহ এ দু শতাব্দীতে ইরানীদের নীরবতার তথাকথিত দাবিকেই খণ্ডন করছে।

সমাপ্ত

কেরাআত ও তাফসীর

ইসলামী জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জ্ঞানটি উৎপত্তি লাভ করে তা হলো কেরাআত ,অতঃপর তাফসীর। কেরাআত কোরআনের শব্দমালার উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তাফসীর পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান।

কেরাআতশাস্ত্রে কোরআন পঠনে ওয়াক্ফ ,ওয়াস্ল ,মাদ ,তাশদীদ ,ইদগাম প্রভৃতির নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা করা হয়। এ শাস্ত্রে কোরআনের কোন কোন শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

সাহাবীরা নবী (সা.)-এর নিকট হতে কোরআন শিক্ষা করতেন ,কোন কোন সাহাবীকে রাসূল সরাসরি কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং অন্যদের শিক্ষা দানের জন্য তাঁদের প্রেরণ করতেন। তাবেয়ীরা (যাঁরা রাসূলের সময়ে ছিলেন না ও তাঁর সাহচর্য লাভ করেননি) সাহাবীদের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এ যুগেই কেরাআতশাস্ত্রের একদল বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয় যাঁরা সঠিকভাবে কোরআন পাঠ শিক্ষা দান শুরু করেন। সাধারণ মুসলমান যাদের সংখ্যা সে সময় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা পরম আগ্রহ নিয়ে কোরআন শিক্ষা করত এবং এই সকল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতো। এ বিশেষজ্ঞগণ কোন ইমাম বা সাহাবীর সূত্রে কোরআন পাঠ প্রক্রিয়া বর্ণনা করতেন। তাঁরাও নিজ পদ্ধতিতে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করতেন। তাঁদের ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণ কি ? রাসূল (সা.)-এর সময়েও কি এ বিষয়ে ভিন্নতা ছিল ? স্বয়ং নবী কি কোরআনের কিছু কিছু শব্দকে কয়েকভাবে পঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন বা কোরআনের কিছু শব্দ কি বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির মাধ্যমে নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ? নাকি অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় যে বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণে পঠনে ভিন্নতার সৃষ্টি হয় কোরআনেও তেমনটি হয়েছে ? এ বিষয়গুলো অন্যত্র আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত ,নবী (সা.) যেরূপে কোরআন পাঠ ও তেলাওয়াত করতেন মুসলমানরা সেরূপেই তা পাঠ ও তেলাওয়াত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। যে সকল ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাসূলের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাই তারা তাঁদের নিকট হতে কোরআন পাঠ শিক্ষাগ্রহণ করতেন।

প্রথমদিকে কারিগণ মৌলিকভাবে শুনে ও মুখস্থ করে শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখতেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ বিষয়ে গ্রন্থ সংকলিত ও লিখিত হয়।

কেউ কেউ দাবি করেছেন ,এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আবু উবাইদা কাসেম ইবনে সালাম (মৃত্যু 224 হিজরী) একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন এজন্য যে ,এর একশ বছর পূর্বেই সাতজন প্রসিদ্ধ কারীর (কোররায়ে সাবআ) একজন হামযা ইবনে হাবিব- যিনি শিয়া ছিলেন ,কোরআন পাঠ পদ্ধতির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তদুপরি এ সম্পর্কিত গবেষণায় আয়াতুল্লাহ্ হাসান সাদর ইবনুন্ নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও নাজ্জাশীর ফেহেরেস্ত গ্রন্থ হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শিষ্য ও সাহাবী আবান ইবনে তাগলিব এরও পূর্বে এ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি আরো প্রমাণ করেছেন ,সর্বপ্রথম আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কোরআন সংকলন করেন এবং তাঁরই শিষ্য ও সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালী কোরআনে প্রথম নুকতাহ সংযোজন করেন।257 সর্বপ্রথম কোরআন পঠন পদ্ধতির ওপর আবান ইবনে তাগলিব গ্রন্থ লিখেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনের অর্থ ও কঠিন শব্দসূমহের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বপ্রথম কোরআনের ফযিলত বর্ণনা করে গ্রন্থ রচনা করেন প্রসিদ্ধ সাহাবী ও হযরত আলীর অনুসারী উবাই ইবনে কা ব (রা.)। কোরআনের রূপক শব্দসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন তিনি হলেন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ ফাররা যিনি একজন ইরানী শিয়া ছিলেন। সর্বপ্রথম কোরআনের বিধিবিধান নিয়ে যিনি গ্রন্থ লিখেন তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী। সর্বপ্রথম তাফসীর গ্রন্থ লিখেন সাঈদ ইবনে যুবাইর।258

যা হোক প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর তাবেয়িগণ ও তাদের ছাত্রদের মধ্য হতে দশ ব্যক্তি কোরআন পঠন পদ্ধতিতে (কেরাআতশাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে কোররায়ে সাবআ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন নাফে ইবনে আবদুর রহমান ,আবদুল্লাহ্ ইবনে কাসির ,আবু আমর ইবনুল আলা ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ,আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ ,হামযা ইবনে হাবিব এবং আলী কিসায়ী।

এই সাতজনের চারজনই হলেন ইরানী এবং তাঁদের দু জন হলেন শিয়া। অ-ইরানী তিনজন কারীর দু জনও শিয়া অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর মধ্যে চারজন শিয়া। আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থের 346 পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল জলিল রাযী-এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন কেরাআতশাস্ত্রের পুরোধাদের সকলেই আদলীয়াদের (শিয়া ও মুতাযিলা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ,হোক তিনি কুফা ,বসরা ,মক্কা ,মদীনা বা অন্য কোন স্থানের অধিবাসী।

চার প্রসিদ্ধ ইরানী কারী হলেন :

1. আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ একজন ইরানী। তিনি আবু আবদুর রহমান সালামীর নিকট কেরাআত শিক্ষা করেছেন। আবু আবদুর রহমান হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন। আছেমের কেরাআতকে প্রসিদ্ধতম কেরাআত মনে করা হয়। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে বলা হয়েছে , কোরআনের মূল লিখন ও পঠন পদ্ধতিটি সাধারণত আছেমের অনুকরণে লিখা হতো এবং অন্যান্য কারীদের কেরাআতের ধরন নিম্নে লাল কালি দ্বারা কারীর নাম উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করা হতো।259 আসেম কুফায় থাকতেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাজালিসুল মুমিনীন গ্রন্থের লেখকসহ আরো কিছু গবেষক ,যেমন আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর শিয়া হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বলেছেন। তিনি 130 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

2. নাফে ইবনে আবদুর রহমান সম্পর্কে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বলেছেন , তিনি ইরানের ইসফাহানের লোক হলেও মদীনায় বাস করতেন। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,নাফে কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন। তিনি মদীনায় কেরাআতশাস্ত্রের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মদীনার লোকেরা কেরাআতের ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করত। তিনি প্রসিদ্ধ দশজন কারীর একজন ইয়াযীদ ইবনে কা কা হতে কেরাআত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি 159 বা 169 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

3. ইবনে কাসির সম্পর্কে ইবনুন নাদিম বলেছেন , কথিত আছে ইরান সম্রাট আনুশিরওয়ান ইরানীদের যে দলটিকে ইয়েমেনে হাবাশীদের নিকট হতে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ইবনে কাসির তাদেরই বংশধর।

আমরা ইতোপূর্বে ইয়েমেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইরানীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে , ইবনে কাসির কেরাআতশাস্ত্রের মৌলনীতি মুজাহিদ-এর নিকট হতে ,তিনি ইবনে আব্বাস-এর নিকট হতে এবং ইবনে আব্বাস হরযত আলী (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইবনে কাসির 120 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

4. ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে কিসায়ীর নাম আলী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা হলেন হামযা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে বাহমান ইবনে ফিরুয। কিসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি আব্বাসীয় খলীফা হারুন উর রশীদের দু পুত্রের শিক্ষক ছিলেন। খোরাসানে আগমনের সময় তিনি হারুনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি ইরানের রেই শহরে ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যক্রমে হারুনের অন্যতম সফরসঙ্গী ও প্রধান কাযী মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীও ঐ দিন রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাধিস্থ হন। হারুন উর রশিদ এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বলেন , আজকে ইসলামী ফিকাহ্ ও সাহিত্যকে রেইয়ে সমাহিত করেছি। কিসায়ী দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন। কিসায়ীও শিয়া ছিলেন।

তাফসীরের বিষয়ে বলা যায় ,রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় স্বাভাবিকভাবেই সাহাবিগণ কোরআনের আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য রাসূলেরই শরণাপন্ন হতেন। কোন কোন সাহাবী অন্যদের নিকট হতে কোরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিকতর অগ্রসর ছিলেন ,এজন্য প্রথম হতেই আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন ,যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ। অবশ্য ইবনে আব্বাসের এ ক্ষেত্রে পরিচিতি অধিক ছিল এবং তাঁর মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিক বর্ণিত হয়ে থাকে। ইবনে আব্বাস260 হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদও হযরত আলীর ছাত্র ও শিয়া ছিলেন। গ্রন্থসূচী সম্পর্কিত আল ফেহেরস্ত গ্রন্থগুলোতে ইবনে আব্বাস সংকলিত একটি তাফসীরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন এই গ্রন্থটি এখনও মিশরের রাজকীয় জাদুঘরে রাখা আছে। তাফসীরে ইবনে আব্বাসের স্বতন্ত্র মত থাকলেও হযরত আলীর এ সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন , হযরত আলীর জ্ঞানের নিকট আমি মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির ন্যায়।

জর্জি যাইদান দাবি করেছেন ,প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত কোরআনের তাফসীর মুখে মুখে স্থানান্তরিত হতো এবং কোরআনের সর্বপ্রথম তাফসীর সংকলন করেন মুজাহিদ (মৃত্যু 104 হিজরী)। অতঃপর ওয়াকেদী ও ইবনে জারীর তাবারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে তাফসীর লিখেন।261

অবশ্য এ মতটি সঠিক নয়। ইবনে আব্বাস ছাড়াও সাঈদ ইবনে জুবাইর তাঁর পূর্বে তাফসীর সংকলন করেছেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানগণ কোন গ্রন্থই রচনা করেনি। এ মতের অনুবর্তী হয়েই জর্জি যাইদান উপরোক্ত মত দিয়েছেন। তাঁর এ মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তাই এ মতটি প্রত্যাখ্যাত। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেরাআতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন ইরানীরা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাফসীরের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের মূল হিসেবে তাফসীর ,ফিকাহ্ ও হাদীসশাস্ত্রের প্রতি ইরানীরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য বিষয়ের প্রতি ততটা নয়। এখানে ইসলামের প্রথম যুগ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইরানী মুফাসসিরের নাম উল্লেখ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতি শতাব্দীতেই শত শত মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থ ছিল। তাই তাঁদের মধ্য হতে বিভিন্ন জাতির মুফাসসিরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। তবে তাফসীরশাস্ত্রে ইরানীদের অবদান তুলে ধরার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু নমুনা প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকা হতে উল্লেখ করছি। লক্ষ্য করবেন ,এদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

প্রথম পর্যায়ের মুফাসসিরগণ হলেন যাঁদের নাম ও মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর উল্লেখ করা হয় অথবা তাঁদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এখনো বিদ্যমান। এখানে আমরা তাঁদের মধ্য হতেই মনোনীত করব ।

প্রথম শ্রেণীর মুফাসসির যাঁদের নাম তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর স্মরণ করা হয় তাঁদের কেউ সাহাবী ,কেউ তাবেয়ী ,কেউ তাবে তাবেয়ী আবার কেউ তাঁদের ছাত্র বা শিষ্য। এ ধরনের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে আব্বাস ,ইবনে মাসউদ ,উবাই ইবনে কাব ,সা দী ,মুজাহিদ ,কাতাদা ,মুকাতিল ,কালবী ,সাবিয়ী ,আ মাশ ,সুফিযান সাওরী ,জুহরী ,আতা ,আকরাম ,ফাররা প্রমুখ।

এদের কেউ শিয়া ,কেউ সুন্নী ,কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশই অ-ইরানী। শুধু মুকাতিল ,আ মাশ ও ফাররা ইরানী বংশোদ্ভূত।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইরানের খোরাসান অথবা রেইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর একজন ব্যক্তিত্ব এবং 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মুকাতিল শাফেয়ী মাযহাবের লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং শাফেয়ী অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে বলেছেন , অন্যরা তাফসীরের ক্ষেত্রে মুকাতিলের পরিবারস্বরূপ অর্থাৎ তাঁর অনুসারী।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের 1ম খণ্ডের 150 পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে সুলাইমান ইবনে মেহরান আ মাশের পিতা ইরানের দামাভান্দের অধিবাসী হলেও আ মাশ কুফায় জন্মগ্রহণ করেন ও জীবন কাটান। আ মাশ শিয়া হলেও আহলে সুন্নাতের আলেমগণও তাঁর প্রশংসা করেছেন। আ মাশ রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফাররা ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ আকতা একজন আরবী ব্যাকরণবিদ ও অভিধান রচয়িতা। আরবী সাহিত্যের গ্রন্থে তাঁর নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। তিনি কেসায়ীর ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুনের সন্তানদের শিক্ষক ছিলেন।

রিয়াজুল উলামা তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে শিয়া বলেছেন। তাঁর পিতা যিয়াদ আকতা ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনায় হুসাইন ইবনে আলী ইবনে হাসানের262 সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় আব্বাসীয় খলীফার নির্দেশে হস্ত কর্তিত হন। এজন্যই তাঁকে আকতা বা কর্তিত হস্ত বলা হয়। ফাররা 207 বা 208 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর মুফাসসিরগণ হলেন তাঁরা যাঁরা তাফসীর বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে এত অধিক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ,তা গণনা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করব। আমাদের আলোচনা শিয়া মুফাসসিরগণের তাফসীর দিয়ে শুরু করছি। শিয়া মুফাসসিরগণ দু অংশে বিভক্ত। একদল হলেন সে সকল মুফাসসির যাঁরা ইমামগণের উপস্থিতিতে ও বর্তমান অবস্থায় তাফসীর লিখেছেন ও অন্যদল হলেন যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ে তাফসীর লিখেছেন। ইমামগণের সমকালীন সময়ে যাঁরা তাফসীর রচনা করেছেন তাঁদের কেউ ইরানী ,কেউ অ-ইরানী। ইমামদের সাহাবী এরূপ কয়েকজন মুফাসসির হলেন আবু হামযা সুমালী ,আবু বাছির আসাদী ,ইউনুস ইবনে আবদুর রহমান ,হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ,আলী ইবনে মেহযিয়ার আহওয়াযী ,মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী কুমী এবং ফাজল ইবনে শাজান নিশাবুরী।

ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ের মুফাসসিরের সংখ্যা অসংখ্য। এখানে আমরা শুধু শিয়াদের প্রসিদ্ধ কিছু তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। এ হতেই বোঝা যাবে শিয়া মুফাসসিরগণের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

1. তাফসীরে আলী ইবনে ইবরাহীম কুমী: এ তাফসীর গ্রন্থটি শিয়াদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ যা এখনও বর্তমান রয়েছে। আলী ইবনে ইবরাহীমের পিতা কুফা হতে কোমে আসেন। অসম্ভব নয় ,আলী ইবনে ইবরাহীম একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। তিনি শেখ কুলাইনীর শিক্ষক ও মাশয়িখ (যাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন)। তিনি 307 হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

2. তাফসীরে আয়াশী: এই তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ সামারকান্দী লিখেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সুন্নী ছিলেন এবং পরবর্তীতে শিয়া হন। তিনি শেখ কুলাইনীর সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি তাঁর পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিন লক্ষ দিনারের পুরোটাই গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লিখন ,সংকলন ,নকল ও ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। যে সকল ব্যক্তি এরূপ কর্ম করতেন তাঁদের জীবিকা র্নিবাহের খরচ তিনি দিতেন। আয়াশী তাফসীর ,হাদীস ,ফিকাহ্শাস্ত্র ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন ও দাবি করেছেন আয়াশীর রচিত গ্রন্থসমূহ খোরাসানে বেশ প্রচলিত ছিল। আয়াশী ইরানী হলেও আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,কথিত আছে তিনি তামীম গোত্রের উত্তর পুরুষ। তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব।

3. তাফসীরে নোমানী: এ তাফসীরটির রচয়িতা হলেন আবদুুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইবনে আবি যাইনাব নামেও সুপরিচিত। তিনি শেখ কুলাইনীর ছাত্র। তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন ,তাফসীরে নোমানীর অনুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রয়েছে। নোমানী ইরাকের না মিশরের অধিবাসী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম।

নোমানীর এক দৌহিত্রের নাম আবুল কাসেম হুসাইন ,যিনি ইবনুল মারযবান নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পিতার দিকে হতে তিনি সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদের বংশধর। তিনি কয়েকবার তৎকালীন শাসনকর্তার মন্ত্রী হওয়ায় ওয়াযিরে মাগরেবী নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইবনুল মারযবান চৌদ্দ বছর বয়সে কোরাআনের হাফেজ হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ,হিসাবশাস্ত্র ,অংক ও জ্যামিতি ,যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চ মাপের সাহিত্যিক ও শক্তিমান লেখকও ছিলেন।

তিনি খাসায়িসুল কোরআন নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি 418 অথবা 428 সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা বাগদাদ হতে নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয় ও তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর কবরের নিকটবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।

4. তাফসীরে তিবইয়ান: এ তাফসীরের রচয়িতা শেইখুত তায়িফা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আলী আত তুসী। তিনি তাফসীর ,ফিকাহ্ ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ও আরবী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি 385 হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁর জন্ম হতে এখন এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর মাশহাদে তাঁর সহস্র বছর পূর্তি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। শিয়া-সুন্নী ,মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে প্রচুর মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র 460 হিজরীতে অস্তমিত হয়। তিনি 23 বছর বয়সে খোরাসান হতে ইরাকে আসেন এবং শেখ মুফিদ ও সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর সময়ের শিয়া মতাবলম্বীদের ফকীহ্ ও নেতা হন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও তিনি শিয়া আলেমদের শিরোমণি ছিলেন। মৃত্যুর বারো বছর পূর্বে বাগদাদের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার (মোগলদের আক্রমণ) ফলে নাজাফে চলে আসেন এবং নাজাফের ধর্মীয় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন যা তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরও বিদ্যমান রয়েছে।

5. মাজমাউল বায়ান: এ তাফসীর গ্রন্থটি ফাযল ইবনে হাসান তাবরেসী রচনা করেছেন। তিনি ইরানে তাফরেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি 536 হিজরীতে তাঁর এই তাফসীর লেখা সমাপ্ত করেন। রচনা ও সাহিত্যিক মানের দিক দিয়ে এ তাফসীরটি সর্বোত্তম। আহলে সুন্নাত ও শিয়া উভয়েই এই তাফসীরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই মিসর ,বৈরুত ও ইরানে পুনঃপুন ছাপা হয়েছে। আল্লামা তাবরেসী জাওয়ামেউল জামে নামে অপর একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীরটি তিনি তাঁর সমকালীন প্রসিদ্ধ মুফাসসির জারুল্লাহ্ যামাখশারী রচিত তাফসীরে কাশশাফ হতে আকর্ষণীয় সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে সংযোজন করেছেন।

অবশ্য তাফসীর বিশেষজ্ঞরা জানেন তাফসীরে কাশশাফে এমন অনেক সাহিত্যিক ও অলংকারিক বিষয় রয়েছে যা মাজমাউল রায়ানে নেই। আবার মাজমাউল বায়ানেও এমন অনেক সাহিত্যিক ও তাফসীরগত বিষয় রয়েছে যা কাশশাফে নেই।

6. রাউযুল জিনান: আবুল ফুতুহ রাযী তাফসীরটি রচনা করেছেন। এ তাফসীর ফার্সী ভাষায় রচিত। শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সমৃদ্ধতম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে ফখরুদ্দীন রাযী ও তাবরেসী উভয়েই এ তাফসীর গ্রন্থ হতে পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়েছেন। গত চল্লিশ বছরে তাফসীরটি ইরানে ব্যাপকভাবে ছাপা হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাযী নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করলেও রেই শহরে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি আরব বংশোদ্ভূ ইরানী। তিনি হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও সিফফিন যুদ্ধে তাঁর পক্ষে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ্ ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার বংশধর।

আবুল ফুতুহ তাবরেসী ও যামাখশারীর সমসাময়িক ব্যক্তি এবং শেখ তুসীর পরোক্ষ ছাত্র। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত ,তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর রেই শহরে বিদ্যমান।

7. তাফসীরে সাফী: বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ,মুফাসসির ,দার্শনিক ও আরেফ মোল্লা মুহাম্মদ ফাইয কাশানী এ তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি প্রসিদ্ধ শিয়া আলেমদের অন্যতম। তিনি একাদশ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। মরহুম ফাইয প্রথম জীবনে কোমে ছিলেন। তাঁর নামেই কোমের ধর্মীয় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মাদ্রাসায়ে ফাইযিয়া । পরে তিনি কোম হতে সিরাজ যান ও সাইয়্যেদ মাজিদ বাহরানীর নিকট হাদীসশাস্ত্র এবং মহান দার্শনিক ও আরেফ সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরা নামে প্রসিদ্ধ) নিকট দর্শন ও এরফান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সাদরুল মুতাআল্লিহীনের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি 1091 হিজরীতে কাশানে মৃত্যুবরণ করেন।

8. তাফসীরে মোল্লা সাদরা: যদিও মোল্লা সাদরা দর্শন ও অধিবিদ্যাশাস্ত্রে অধিকতর পরিচিত ও স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা তদুপরি তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি উসূলে কাফী নামক হাদীস গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি সূরা বাকারার 65 আয়াত পর্যন্ত ,সূরা সিজদাহ্ ,ইয়াসীন ,ওয়াকেয়া ,হাদীদ ,জুমআ ,ত্বারিক ,আলা ,যিলযাল ,আয়াতুল কুরসী ,সূরা নূরের কিছু আয়াত ও সূরা নামলেরوترى الجبال تحسبها جامدة আয়াতটি তাফসীর করেছেন। যদিও মোল্লা সাদরার তাফসীর পূর্ণ তাফসীর নয় ,তদুপরি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এবং আয়তনে তাফসীরে সাফীর সমান।

গ্রন্থটি ইরানে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। তিনি 1050 হিজরীতে পদব্রজে হজ্বে গমনের সময় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সপ্তমবারের মত হজ্বে যাওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। কাবার আকর্ষণ তাঁকে এমনভাবে টানত যে ,কণ্টকময় পথ তাঁর নিকট রেশমী কাপড় বিছানো পথের ন্যায় মনে হতো।

9. মিনহাজুস সাদেকীন: এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় রচিত। এটি তাবরীজ হতে তিন খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি মোল্লা ফাতহুল্লাহ্ ইবনে শুকরুল্লাহ্ কাশানী কর্তৃক দশম হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। এই লেখকের অধিকাংশ লেখা ফার্সীতে ছিল। যেমন নাহজুল বালাগার ফার্সী অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

10. তাফসীরে শাব্বার: সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ শাব্বার এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি কাশেফুল গেতা ও মির্যা কুমীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন চিন্তাশীল ,জ্ঞানী ও আবেদ ছিলেন। তিনি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,কালাম ,হাদীসশাস্ত্র ,তাফসীর ও রিজালশাস্ত্রে প্রচুর গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি 1242 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ও ইমাম কাযিম (আ)-এর সমাধিস্থলের নিকটে সমাধিস্থ হন।

11. তাফসীরে বুরহান: এই তাফসীরটি সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী কর্তৃক রচিত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস ও গবেষক। তাফসীরটি আখবারী ধারায় লিখিত অর্থাৎ কোরআন শুধু হাদীসের সাহায্যেই তাফসীর করতে হবে-এই মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসীদের ধারায় এটি লিখা হয়েছে। তাই শুধু আয়াতসংশ্লিষ্ট হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদীসটির বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি। সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী 1107 অথবা 1109 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

12. নুরুস সাকালাইন: এ তাফসীরটি হুয়াইযের একজন আলেম কর্তৃক লিখিত যিনি সিরাজে বাস করতেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল আলী ইবনে জুমাআ। তিনি মরহুম আল্লামা মাজলিসী ও শেখ হুররে আমেলীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়। তাঁর তাফসীরটিও হাদীসনির্ভর তাফসীর।

ওপরে আমরা যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি সেগুলো দ্বাদশ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত শিয়াদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এবং শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতের নিকটেই রয়েছে। তাই শিয়া ভিন্ন অন্যরাও চাইলে সহজেই তা পেতে পারেন। চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীতেও অনেক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। যদি কেউ শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান পেতে চান তাহলে আল্লামা শেইখ আগা বুযুরগে তেহরানী রচিত আয যারবিয়া ইলা তাসানিফুশ শিয়া নামক গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ওপরে আমরা নমুনাস্বরূপ যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি তা হতে স্পষ্ট ,প্রসিদ্ধ সকল শিয়া তাফসীর গ্রন্থই হয় ইরানীদের দ্বারা রচিত হয়েছে নতুবা আরব বংশোদ্ভূত কোন ইরানী বা শিয়া যাঁরা ইরানে বসবাস করতেন তাঁরা লিখেছেন।

কেরাআত ও তাফসীর

ইসলামী জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জ্ঞানটি উৎপত্তি লাভ করে তা হলো কেরাআত ,অতঃপর তাফসীর। কেরাআত কোরআনের শব্দমালার উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তাফসীর পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান।

কেরাআতশাস্ত্রে কোরআন পঠনে ওয়াক্ফ ,ওয়াস্ল ,মাদ ,তাশদীদ ,ইদগাম প্রভৃতির নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা করা হয়। এ শাস্ত্রে কোরআনের কোন কোন শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

সাহাবীরা নবী (সা.)-এর নিকট হতে কোরআন শিক্ষা করতেন ,কোন কোন সাহাবীকে রাসূল সরাসরি কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং অন্যদের শিক্ষা দানের জন্য তাঁদের প্রেরণ করতেন। তাবেয়ীরা (যাঁরা রাসূলের সময়ে ছিলেন না ও তাঁর সাহচর্য লাভ করেননি) সাহাবীদের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এ যুগেই কেরাআতশাস্ত্রের একদল বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয় যাঁরা সঠিকভাবে কোরআন পাঠ শিক্ষা দান শুরু করেন। সাধারণ মুসলমান যাদের সংখ্যা সে সময় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা পরম আগ্রহ নিয়ে কোরআন শিক্ষা করত এবং এই সকল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতো। এ বিশেষজ্ঞগণ কোন ইমাম বা সাহাবীর সূত্রে কোরআন পাঠ প্রক্রিয়া বর্ণনা করতেন। তাঁরাও নিজ পদ্ধতিতে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করতেন। তাঁদের ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণ কি ? রাসূল (সা.)-এর সময়েও কি এ বিষয়ে ভিন্নতা ছিল ? স্বয়ং নবী কি কোরআনের কিছু কিছু শব্দকে কয়েকভাবে পঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন বা কোরআনের কিছু শব্দ কি বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির মাধ্যমে নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ? নাকি অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় যে বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণে পঠনে ভিন্নতার সৃষ্টি হয় কোরআনেও তেমনটি হয়েছে ? এ বিষয়গুলো অন্যত্র আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত ,নবী (সা.) যেরূপে কোরআন পাঠ ও তেলাওয়াত করতেন মুসলমানরা সেরূপেই তা পাঠ ও তেলাওয়াত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। যে সকল ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাসূলের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাই তারা তাঁদের নিকট হতে কোরআন পাঠ শিক্ষাগ্রহণ করতেন।

প্রথমদিকে কারিগণ মৌলিকভাবে শুনে ও মুখস্থ করে শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখতেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ বিষয়ে গ্রন্থ সংকলিত ও লিখিত হয়।

কেউ কেউ দাবি করেছেন ,এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আবু উবাইদা কাসেম ইবনে সালাম (মৃত্যু 224 হিজরী) একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন এজন্য যে ,এর একশ বছর পূর্বেই সাতজন প্রসিদ্ধ কারীর (কোররায়ে সাবআ) একজন হামযা ইবনে হাবিব- যিনি শিয়া ছিলেন ,কোরআন পাঠ পদ্ধতির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তদুপরি এ সম্পর্কিত গবেষণায় আয়াতুল্লাহ্ হাসান সাদর ইবনুন্ নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও নাজ্জাশীর ফেহেরেস্ত গ্রন্থ হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শিষ্য ও সাহাবী আবান ইবনে তাগলিব এরও পূর্বে এ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি আরো প্রমাণ করেছেন ,সর্বপ্রথম আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কোরআন সংকলন করেন এবং তাঁরই শিষ্য ও সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালী কোরআনে প্রথম নুকতাহ সংযোজন করেন।257 সর্বপ্রথম কোরআন পঠন পদ্ধতির ওপর আবান ইবনে তাগলিব গ্রন্থ লিখেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনের অর্থ ও কঠিন শব্দসূমহের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বপ্রথম কোরআনের ফযিলত বর্ণনা করে গ্রন্থ রচনা করেন প্রসিদ্ধ সাহাবী ও হযরত আলীর অনুসারী উবাই ইবনে কা ব (রা.)। কোরআনের রূপক শব্দসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন তিনি হলেন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ ফাররা যিনি একজন ইরানী শিয়া ছিলেন। সর্বপ্রথম কোরআনের বিধিবিধান নিয়ে যিনি গ্রন্থ লিখেন তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী। সর্বপ্রথম তাফসীর গ্রন্থ লিখেন সাঈদ ইবনে যুবাইর।258

যা হোক প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর তাবেয়িগণ ও তাদের ছাত্রদের মধ্য হতে দশ ব্যক্তি কোরআন পঠন পদ্ধতিতে (কেরাআতশাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে কোররায়ে সাবআ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন নাফে ইবনে আবদুর রহমান ,আবদুল্লাহ্ ইবনে কাসির ,আবু আমর ইবনুল আলা ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ,আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ ,হামযা ইবনে হাবিব এবং আলী কিসায়ী।

এই সাতজনের চারজনই হলেন ইরানী এবং তাঁদের দু জন হলেন শিয়া। অ-ইরানী তিনজন কারীর দু জনও শিয়া অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর মধ্যে চারজন শিয়া। আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থের 346 পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল জলিল রাযী-এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন কেরাআতশাস্ত্রের পুরোধাদের সকলেই আদলীয়াদের (শিয়া ও মুতাযিলা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ,হোক তিনি কুফা ,বসরা ,মক্কা ,মদীনা বা অন্য কোন স্থানের অধিবাসী।

চার প্রসিদ্ধ ইরানী কারী হলেন :

1. আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ একজন ইরানী। তিনি আবু আবদুর রহমান সালামীর নিকট কেরাআত শিক্ষা করেছেন। আবু আবদুর রহমান হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন। আছেমের কেরাআতকে প্রসিদ্ধতম কেরাআত মনে করা হয়। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে বলা হয়েছে , কোরআনের মূল লিখন ও পঠন পদ্ধতিটি সাধারণত আছেমের অনুকরণে লিখা হতো এবং অন্যান্য কারীদের কেরাআতের ধরন নিম্নে লাল কালি দ্বারা কারীর নাম উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করা হতো।259 আসেম কুফায় থাকতেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাজালিসুল মুমিনীন গ্রন্থের লেখকসহ আরো কিছু গবেষক ,যেমন আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর শিয়া হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বলেছেন। তিনি 130 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

2. নাফে ইবনে আবদুর রহমান সম্পর্কে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বলেছেন , তিনি ইরানের ইসফাহানের লোক হলেও মদীনায় বাস করতেন। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,নাফে কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন। তিনি মদীনায় কেরাআতশাস্ত্রের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মদীনার লোকেরা কেরাআতের ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করত। তিনি প্রসিদ্ধ দশজন কারীর একজন ইয়াযীদ ইবনে কা কা হতে কেরাআত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি 159 বা 169 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

3. ইবনে কাসির সম্পর্কে ইবনুন নাদিম বলেছেন , কথিত আছে ইরান সম্রাট আনুশিরওয়ান ইরানীদের যে দলটিকে ইয়েমেনে হাবাশীদের নিকট হতে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ইবনে কাসির তাদেরই বংশধর।

আমরা ইতোপূর্বে ইয়েমেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইরানীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে , ইবনে কাসির কেরাআতশাস্ত্রের মৌলনীতি মুজাহিদ-এর নিকট হতে ,তিনি ইবনে আব্বাস-এর নিকট হতে এবং ইবনে আব্বাস হরযত আলী (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইবনে কাসির 120 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

4. ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে কিসায়ীর নাম আলী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা হলেন হামযা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে বাহমান ইবনে ফিরুয। কিসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি আব্বাসীয় খলীফা হারুন উর রশীদের দু পুত্রের শিক্ষক ছিলেন। খোরাসানে আগমনের সময় তিনি হারুনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি ইরানের রেই শহরে ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যক্রমে হারুনের অন্যতম সফরসঙ্গী ও প্রধান কাযী মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীও ঐ দিন রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাধিস্থ হন। হারুন উর রশিদ এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বলেন , আজকে ইসলামী ফিকাহ্ ও সাহিত্যকে রেইয়ে সমাহিত করেছি। কিসায়ী দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন। কিসায়ীও শিয়া ছিলেন।

তাফসীরের বিষয়ে বলা যায় ,রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় স্বাভাবিকভাবেই সাহাবিগণ কোরআনের আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য রাসূলেরই শরণাপন্ন হতেন। কোন কোন সাহাবী অন্যদের নিকট হতে কোরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিকতর অগ্রসর ছিলেন ,এজন্য প্রথম হতেই আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন ,যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ। অবশ্য ইবনে আব্বাসের এ ক্ষেত্রে পরিচিতি অধিক ছিল এবং তাঁর মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিক বর্ণিত হয়ে থাকে। ইবনে আব্বাস260 হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদও হযরত আলীর ছাত্র ও শিয়া ছিলেন। গ্রন্থসূচী সম্পর্কিত আল ফেহেরস্ত গ্রন্থগুলোতে ইবনে আব্বাস সংকলিত একটি তাফসীরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন এই গ্রন্থটি এখনও মিশরের রাজকীয় জাদুঘরে রাখা আছে। তাফসীরে ইবনে আব্বাসের স্বতন্ত্র মত থাকলেও হযরত আলীর এ সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন , হযরত আলীর জ্ঞানের নিকট আমি মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির ন্যায়।

জর্জি যাইদান দাবি করেছেন ,প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত কোরআনের তাফসীর মুখে মুখে স্থানান্তরিত হতো এবং কোরআনের সর্বপ্রথম তাফসীর সংকলন করেন মুজাহিদ (মৃত্যু 104 হিজরী)। অতঃপর ওয়াকেদী ও ইবনে জারীর তাবারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে তাফসীর লিখেন।261

অবশ্য এ মতটি সঠিক নয়। ইবনে আব্বাস ছাড়াও সাঈদ ইবনে জুবাইর তাঁর পূর্বে তাফসীর সংকলন করেছেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানগণ কোন গ্রন্থই রচনা করেনি। এ মতের অনুবর্তী হয়েই জর্জি যাইদান উপরোক্ত মত দিয়েছেন। তাঁর এ মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তাই এ মতটি প্রত্যাখ্যাত। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেরাআতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন ইরানীরা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাফসীরের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের মূল হিসেবে তাফসীর ,ফিকাহ্ ও হাদীসশাস্ত্রের প্রতি ইরানীরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য বিষয়ের প্রতি ততটা নয়। এখানে ইসলামের প্রথম যুগ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইরানী মুফাসসিরের নাম উল্লেখ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতি শতাব্দীতেই শত শত মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থ ছিল। তাই তাঁদের মধ্য হতে বিভিন্ন জাতির মুফাসসিরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। তবে তাফসীরশাস্ত্রে ইরানীদের অবদান তুলে ধরার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু নমুনা প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকা হতে উল্লেখ করছি। লক্ষ্য করবেন ,এদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

প্রথম পর্যায়ের মুফাসসিরগণ হলেন যাঁদের নাম ও মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর উল্লেখ করা হয় অথবা তাঁদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এখনো বিদ্যমান। এখানে আমরা তাঁদের মধ্য হতেই মনোনীত করব ।

প্রথম শ্রেণীর মুফাসসির যাঁদের নাম তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর স্মরণ করা হয় তাঁদের কেউ সাহাবী ,কেউ তাবেয়ী ,কেউ তাবে তাবেয়ী আবার কেউ তাঁদের ছাত্র বা শিষ্য। এ ধরনের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে আব্বাস ,ইবনে মাসউদ ,উবাই ইবনে কাব ,সা দী ,মুজাহিদ ,কাতাদা ,মুকাতিল ,কালবী ,সাবিয়ী ,আ মাশ ,সুফিযান সাওরী ,জুহরী ,আতা ,আকরাম ,ফাররা প্রমুখ।

এদের কেউ শিয়া ,কেউ সুন্নী ,কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশই অ-ইরানী। শুধু মুকাতিল ,আ মাশ ও ফাররা ইরানী বংশোদ্ভূত।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইরানের খোরাসান অথবা রেইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর একজন ব্যক্তিত্ব এবং 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মুকাতিল শাফেয়ী মাযহাবের লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং শাফেয়ী অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে বলেছেন , অন্যরা তাফসীরের ক্ষেত্রে মুকাতিলের পরিবারস্বরূপ অর্থাৎ তাঁর অনুসারী।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের 1ম খণ্ডের 150 পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে সুলাইমান ইবনে মেহরান আ মাশের পিতা ইরানের দামাভান্দের অধিবাসী হলেও আ মাশ কুফায় জন্মগ্রহণ করেন ও জীবন কাটান। আ মাশ শিয়া হলেও আহলে সুন্নাতের আলেমগণও তাঁর প্রশংসা করেছেন। আ মাশ রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফাররা ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ আকতা একজন আরবী ব্যাকরণবিদ ও অভিধান রচয়িতা। আরবী সাহিত্যের গ্রন্থে তাঁর নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। তিনি কেসায়ীর ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুনের সন্তানদের শিক্ষক ছিলেন।

রিয়াজুল উলামা তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে শিয়া বলেছেন। তাঁর পিতা যিয়াদ আকতা ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনায় হুসাইন ইবনে আলী ইবনে হাসানের262 সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় আব্বাসীয় খলীফার নির্দেশে হস্ত কর্তিত হন। এজন্যই তাঁকে আকতা বা কর্তিত হস্ত বলা হয়। ফাররা 207 বা 208 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর মুফাসসিরগণ হলেন তাঁরা যাঁরা তাফসীর বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে এত অধিক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ,তা গণনা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করব। আমাদের আলোচনা শিয়া মুফাসসিরগণের তাফসীর দিয়ে শুরু করছি। শিয়া মুফাসসিরগণ দু অংশে বিভক্ত। একদল হলেন সে সকল মুফাসসির যাঁরা ইমামগণের উপস্থিতিতে ও বর্তমান অবস্থায় তাফসীর লিখেছেন ও অন্যদল হলেন যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ে তাফসীর লিখেছেন। ইমামগণের সমকালীন সময়ে যাঁরা তাফসীর রচনা করেছেন তাঁদের কেউ ইরানী ,কেউ অ-ইরানী। ইমামদের সাহাবী এরূপ কয়েকজন মুফাসসির হলেন আবু হামযা সুমালী ,আবু বাছির আসাদী ,ইউনুস ইবনে আবদুর রহমান ,হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ,আলী ইবনে মেহযিয়ার আহওয়াযী ,মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী কুমী এবং ফাজল ইবনে শাজান নিশাবুরী।

ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ের মুফাসসিরের সংখ্যা অসংখ্য। এখানে আমরা শুধু শিয়াদের প্রসিদ্ধ কিছু তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। এ হতেই বোঝা যাবে শিয়া মুফাসসিরগণের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

1. তাফসীরে আলী ইবনে ইবরাহীম কুমী: এ তাফসীর গ্রন্থটি শিয়াদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ যা এখনও বর্তমান রয়েছে। আলী ইবনে ইবরাহীমের পিতা কুফা হতে কোমে আসেন। অসম্ভব নয় ,আলী ইবনে ইবরাহীম একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। তিনি শেখ কুলাইনীর শিক্ষক ও মাশয়িখ (যাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন)। তিনি 307 হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

2. তাফসীরে আয়াশী: এই তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ সামারকান্দী লিখেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সুন্নী ছিলেন এবং পরবর্তীতে শিয়া হন। তিনি শেখ কুলাইনীর সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি তাঁর পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিন লক্ষ দিনারের পুরোটাই গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লিখন ,সংকলন ,নকল ও ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। যে সকল ব্যক্তি এরূপ কর্ম করতেন তাঁদের জীবিকা র্নিবাহের খরচ তিনি দিতেন। আয়াশী তাফসীর ,হাদীস ,ফিকাহ্শাস্ত্র ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন ও দাবি করেছেন আয়াশীর রচিত গ্রন্থসমূহ খোরাসানে বেশ প্রচলিত ছিল। আয়াশী ইরানী হলেও আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,কথিত আছে তিনি তামীম গোত্রের উত্তর পুরুষ। তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব।

3. তাফসীরে নোমানী: এ তাফসীরটির রচয়িতা হলেন আবদুুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইবনে আবি যাইনাব নামেও সুপরিচিত। তিনি শেখ কুলাইনীর ছাত্র। তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন ,তাফসীরে নোমানীর অনুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রয়েছে। নোমানী ইরাকের না মিশরের অধিবাসী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম।

নোমানীর এক দৌহিত্রের নাম আবুল কাসেম হুসাইন ,যিনি ইবনুল মারযবান নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পিতার দিকে হতে তিনি সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদের বংশধর। তিনি কয়েকবার তৎকালীন শাসনকর্তার মন্ত্রী হওয়ায় ওয়াযিরে মাগরেবী নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইবনুল মারযবান চৌদ্দ বছর বয়সে কোরাআনের হাফেজ হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ,হিসাবশাস্ত্র ,অংক ও জ্যামিতি ,যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চ মাপের সাহিত্যিক ও শক্তিমান লেখকও ছিলেন।

তিনি খাসায়িসুল কোরআন নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি 418 অথবা 428 সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা বাগদাদ হতে নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয় ও তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর কবরের নিকটবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।

4. তাফসীরে তিবইয়ান: এ তাফসীরের রচয়িতা শেইখুত তায়িফা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আলী আত তুসী। তিনি তাফসীর ,ফিকাহ্ ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ও আরবী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি 385 হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁর জন্ম হতে এখন এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর মাশহাদে তাঁর সহস্র বছর পূর্তি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। শিয়া-সুন্নী ,মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে প্রচুর মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র 460 হিজরীতে অস্তমিত হয়। তিনি 23 বছর বয়সে খোরাসান হতে ইরাকে আসেন এবং শেখ মুফিদ ও সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর সময়ের শিয়া মতাবলম্বীদের ফকীহ্ ও নেতা হন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও তিনি শিয়া আলেমদের শিরোমণি ছিলেন। মৃত্যুর বারো বছর পূর্বে বাগদাদের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার (মোগলদের আক্রমণ) ফলে নাজাফে চলে আসেন এবং নাজাফের ধর্মীয় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন যা তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরও বিদ্যমান রয়েছে।

5. মাজমাউল বায়ান: এ তাফসীর গ্রন্থটি ফাযল ইবনে হাসান তাবরেসী রচনা করেছেন। তিনি ইরানে তাফরেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি 536 হিজরীতে তাঁর এই তাফসীর লেখা সমাপ্ত করেন। রচনা ও সাহিত্যিক মানের দিক দিয়ে এ তাফসীরটি সর্বোত্তম। আহলে সুন্নাত ও শিয়া উভয়েই এই তাফসীরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই মিসর ,বৈরুত ও ইরানে পুনঃপুন ছাপা হয়েছে। আল্লামা তাবরেসী জাওয়ামেউল জামে নামে অপর একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীরটি তিনি তাঁর সমকালীন প্রসিদ্ধ মুফাসসির জারুল্লাহ্ যামাখশারী রচিত তাফসীরে কাশশাফ হতে আকর্ষণীয় সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে সংযোজন করেছেন।

অবশ্য তাফসীর বিশেষজ্ঞরা জানেন তাফসীরে কাশশাফে এমন অনেক সাহিত্যিক ও অলংকারিক বিষয় রয়েছে যা মাজমাউল রায়ানে নেই। আবার মাজমাউল বায়ানেও এমন অনেক সাহিত্যিক ও তাফসীরগত বিষয় রয়েছে যা কাশশাফে নেই।

6. রাউযুল জিনান: আবুল ফুতুহ রাযী তাফসীরটি রচনা করেছেন। এ তাফসীর ফার্সী ভাষায় রচিত। শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সমৃদ্ধতম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে ফখরুদ্দীন রাযী ও তাবরেসী উভয়েই এ তাফসীর গ্রন্থ হতে পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়েছেন। গত চল্লিশ বছরে তাফসীরটি ইরানে ব্যাপকভাবে ছাপা হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাযী নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করলেও রেই শহরে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি আরব বংশোদ্ভূ ইরানী। তিনি হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও সিফফিন যুদ্ধে তাঁর পক্ষে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ্ ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার বংশধর।

আবুল ফুতুহ তাবরেসী ও যামাখশারীর সমসাময়িক ব্যক্তি এবং শেখ তুসীর পরোক্ষ ছাত্র। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত ,তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর রেই শহরে বিদ্যমান।

7. তাফসীরে সাফী: বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ,মুফাসসির ,দার্শনিক ও আরেফ মোল্লা মুহাম্মদ ফাইয কাশানী এ তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি প্রসিদ্ধ শিয়া আলেমদের অন্যতম। তিনি একাদশ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। মরহুম ফাইয প্রথম জীবনে কোমে ছিলেন। তাঁর নামেই কোমের ধর্মীয় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মাদ্রাসায়ে ফাইযিয়া । পরে তিনি কোম হতে সিরাজ যান ও সাইয়্যেদ মাজিদ বাহরানীর নিকট হাদীসশাস্ত্র এবং মহান দার্শনিক ও আরেফ সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরা নামে প্রসিদ্ধ) নিকট দর্শন ও এরফান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সাদরুল মুতাআল্লিহীনের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি 1091 হিজরীতে কাশানে মৃত্যুবরণ করেন।

8. তাফসীরে মোল্লা সাদরা: যদিও মোল্লা সাদরা দর্শন ও অধিবিদ্যাশাস্ত্রে অধিকতর পরিচিত ও স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা তদুপরি তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি উসূলে কাফী নামক হাদীস গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি সূরা বাকারার 65 আয়াত পর্যন্ত ,সূরা সিজদাহ্ ,ইয়াসীন ,ওয়াকেয়া ,হাদীদ ,জুমআ ,ত্বারিক ,আলা ,যিলযাল ,আয়াতুল কুরসী ,সূরা নূরের কিছু আয়াত ও সূরা নামলেরوترى الجبال تحسبها جامدة আয়াতটি তাফসীর করেছেন। যদিও মোল্লা সাদরার তাফসীর পূর্ণ তাফসীর নয় ,তদুপরি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এবং আয়তনে তাফসীরে সাফীর সমান।

গ্রন্থটি ইরানে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। তিনি 1050 হিজরীতে পদব্রজে হজ্বে গমনের সময় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সপ্তমবারের মত হজ্বে যাওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। কাবার আকর্ষণ তাঁকে এমনভাবে টানত যে ,কণ্টকময় পথ তাঁর নিকট রেশমী কাপড় বিছানো পথের ন্যায় মনে হতো।

9. মিনহাজুস সাদেকীন: এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় রচিত। এটি তাবরীজ হতে তিন খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি মোল্লা ফাতহুল্লাহ্ ইবনে শুকরুল্লাহ্ কাশানী কর্তৃক দশম হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। এই লেখকের অধিকাংশ লেখা ফার্সীতে ছিল। যেমন নাহজুল বালাগার ফার্সী অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

10. তাফসীরে শাব্বার: সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ শাব্বার এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি কাশেফুল গেতা ও মির্যা কুমীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন চিন্তাশীল ,জ্ঞানী ও আবেদ ছিলেন। তিনি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,কালাম ,হাদীসশাস্ত্র ,তাফসীর ও রিজালশাস্ত্রে প্রচুর গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি 1242 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ও ইমাম কাযিম (আ)-এর সমাধিস্থলের নিকটে সমাধিস্থ হন।

11. তাফসীরে বুরহান: এই তাফসীরটি সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী কর্তৃক রচিত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস ও গবেষক। তাফসীরটি আখবারী ধারায় লিখিত অর্থাৎ কোরআন শুধু হাদীসের সাহায্যেই তাফসীর করতে হবে-এই মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসীদের ধারায় এটি লিখা হয়েছে। তাই শুধু আয়াতসংশ্লিষ্ট হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদীসটির বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি। সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী 1107 অথবা 1109 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

12. নুরুস সাকালাইন: এ তাফসীরটি হুয়াইযের একজন আলেম কর্তৃক লিখিত যিনি সিরাজে বাস করতেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল আলী ইবনে জুমাআ। তিনি মরহুম আল্লামা মাজলিসী ও শেখ হুররে আমেলীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়। তাঁর তাফসীরটিও হাদীসনির্ভর তাফসীর।

ওপরে আমরা যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি সেগুলো দ্বাদশ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত শিয়াদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এবং শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতের নিকটেই রয়েছে। তাই শিয়া ভিন্ন অন্যরাও চাইলে সহজেই তা পেতে পারেন। চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীতেও অনেক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। যদি কেউ শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান পেতে চান তাহলে আল্লামা শেইখ আগা বুযুরগে তেহরানী রচিত আয যারবিয়া ইলা তাসানিফুশ শিয়া নামক গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ওপরে আমরা নমুনাস্বরূপ যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি তা হতে স্পষ্ট ,প্রসিদ্ধ সকল শিয়া তাফসীর গ্রন্থই হয় ইরানীদের দ্বারা রচিত হয়েছে নতুবা আরব বংশোদ্ভূত কোন ইরানী বা শিয়া যাঁরা ইরানে বসবাস করতেন তাঁরা লিখেছেন।

কেরাআত ও তাফসীর

ইসলামী জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জ্ঞানটি উৎপত্তি লাভ করে তা হলো কেরাআত ,অতঃপর তাফসীর। কেরাআত কোরআনের শব্দমালার উচ্চারণের সঙ্গে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তাফসীর পবিত্র কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান।

কেরাআতশাস্ত্রে কোরআন পঠনে ওয়াক্ফ ,ওয়াস্ল ,মাদ ,তাশদীদ ,ইদগাম প্রভৃতির নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক আলোচনা করা হয়। এ শাস্ত্রে কোরআনের কোন কোন শব্দ উচ্চারণের বিভিন্ন ধরন ও প্রকার নিয়েও আলোচনা হয়ে থাকে।

সাহাবীরা নবী (সা.)-এর নিকট হতে কোরআন শিক্ষা করতেন ,কোন কোন সাহাবীকে রাসূল সরাসরি কোরআন শিক্ষা দিতেন এবং অন্যদের শিক্ষা দানের জন্য তাঁদের প্রেরণ করতেন। তাবেয়ীরা (যাঁরা রাসূলের সময়ে ছিলেন না ও তাঁর সাহচর্য লাভ করেননি) সাহাবীদের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেন। এ যুগেই কেরাআতশাস্ত্রের একদল বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয় যাঁরা সঠিকভাবে কোরআন পাঠ শিক্ষা দান শুরু করেন। সাধারণ মুসলমান যাদের সংখ্যা সে সময় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল তারা পরম আগ্রহ নিয়ে কোরআন শিক্ষা করত এবং এই সকল বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতো। এ বিশেষজ্ঞগণ কোন ইমাম বা সাহাবীর সূত্রে কোরআন পাঠ প্রক্রিয়া বর্ণনা করতেন। তাঁরাও নিজ পদ্ধতিতে ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করতেন। তাঁদের ইতিহাস ও কর্মপদ্ধতি ইতিহাস ও অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।

কোরআন পাঠ পদ্ধতির বিভিন্নতার কারণ কি ? রাসূল (সা.)-এর সময়েও কি এ বিষয়ে ভিন্নতা ছিল ? স্বয়ং নবী কি কোরআনের কিছু কিছু শব্দকে কয়েকভাবে পঠনের অনুমতি দিয়েছিলেন বা কোরআনের কিছু শব্দ কি বিভিন্ন পঠন পদ্ধতির মাধ্যমে নবীর ওপর অবতীর্ণ হয়েছিল ? নাকি অন্যান্য গ্রন্থের ক্ষেত্রে যেমনটি দেখা যায় যে বর্ণনাকারীদের বর্ণনার বিভিন্নতার কারণে পঠনে ভিন্নতার সৃষ্টি হয় কোরআনেও তেমনটি হয়েছে ? এ বিষয়গুলো অন্যত্র আলোচনা হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়টি নিশ্চিত ,নবী (সা.) যেরূপে কোরআন পাঠ ও তেলাওয়াত করতেন মুসলমানরা সেরূপেই তা পাঠ ও তেলাওয়াত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করত। যে সকল ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাসূলের নিকট হতে কোরআন শিক্ষা লাভ করেছেন তাই তারা তাঁদের নিকট হতে কোরআন পাঠ শিক্ষাগ্রহণ করতেন।

প্রথমদিকে কারিগণ মৌলিকভাবে শুনে ও মুখস্থ করে শিক্ষকদের নিকট থেকে শিখতেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ বিষয়ে গ্রন্থ সংকলিত ও লিখিত হয়।

কেউ কেউ দাবি করেছেন ,এ বিষয়ে সর্বপ্রথম আবু উবাইদা কাসেম ইবনে সালাম (মৃত্যু 224 হিজরী) একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এ দাবি ভিত্তিহীন এজন্য যে ,এর একশ বছর পূর্বেই সাতজন প্রসিদ্ধ কারীর (কোররায়ে সাবআ) একজন হামযা ইবনে হাবিব- যিনি শিয়া ছিলেন ,কোরআন পাঠ পদ্ধতির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তদুপরি এ সম্পর্কিত গবেষণায় আয়াতুল্লাহ্ হাসান সাদর ইবনুন্ নাদিমের আল ফেহেরেস্ত ও নাজ্জাশীর ফেহেরেস্ত গ্রন্থ হতে বিভিন্ন উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেছেন ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর শিষ্য ও সাহাবী আবান ইবনে তাগলিব এরও পূর্বে এ সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিনি আরো প্রমাণ করেছেন ,সর্বপ্রথম আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) কোরআন সংকলন করেন এবং তাঁরই শিষ্য ও সাহাবী আবুল আসওয়াদ দুয়ালী কোরআনে প্রথম নুকতাহ সংযোজন করেন।257 সর্বপ্রথম কোরআন পঠন পদ্ধতির ওপর আবান ইবনে তাগলিব গ্রন্থ লিখেন এবং তিনিই সর্বপ্রথম কোরআনের অর্থ ও কঠিন শব্দসূমহের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা করেন। সর্বপ্রথম কোরআনের ফযিলত বর্ণনা করে গ্রন্থ রচনা করেন প্রসিদ্ধ সাহাবী ও হযরত আলীর অনুসারী উবাই ইবনে কা ব (রা.)। কোরআনের রূপক শব্দসমূহ নিয়ে সর্বপ্রথম যিনি গ্রন্থ সংকলন করেন তিনি হলেন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ ফাররা যিনি একজন ইরানী শিয়া ছিলেন। সর্বপ্রথম কোরআনের বিধিবিধান নিয়ে যিনি গ্রন্থ লিখেন তিনি হলেন মুহাম্মদ ইবনে সায়েব কালবী। সর্বপ্রথম তাফসীর গ্রন্থ লিখেন সাঈদ ইবনে যুবাইর।258

যা হোক প্রথম ও দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর তাবেয়িগণ ও তাদের ছাত্রদের মধ্য হতে দশ ব্যক্তি কোরআন পঠন পদ্ধতিতে (কেরাআতশাস্ত্র) বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে সাতজন প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হিসেবে কোররায়ে সাবআ নামে অভিহিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন নাফে ইবনে আবদুর রহমান ,আবদুল্লাহ্ ইবনে কাসির ,আবু আমর ইবনুল আলা ,আবদুল্লাহ্ ইবনে আমের ,আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ ,হামযা ইবনে হাবিব এবং আলী কিসায়ী।

এই সাতজনের চারজনই হলেন ইরানী এবং তাঁদের দু জন হলেন শিয়া। অ-ইরানী তিনজন কারীর দু জনও শিয়া অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাতজন ক্বারীর মধ্যে চারজন শিয়া। আয়াতুল্লাহ্ সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর তাসিসুশ শিয়া লি উলুমিল ইসলাম গ্রন্থের 346 পৃষ্ঠায় শেখ আবদুল জলিল রাযী-এর নিকট হতে বর্ণনা করেছেন কেরাআতশাস্ত্রের পুরোধাদের সকলেই আদলীয়াদের (শিয়া ও মুতাযিলা) অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ,হোক তিনি কুফা ,বসরা ,মক্কা ,মদীনা বা অন্য কোন স্থানের অধিবাসী।

চার প্রসিদ্ধ ইরানী কারী হলেন :

1. আছেম ইবনে আবিন নাজওয়াদ একজন ইরানী। তিনি আবু আবদুর রহমান সালামীর নিকট কেরাআত শিক্ষা করেছেন। আবু আবদুর রহমান হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন। আছেমের কেরাআতকে প্রসিদ্ধতম কেরাআত মনে করা হয়। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে বলা হয়েছে , কোরআনের মূল লিখন ও পঠন পদ্ধতিটি সাধারণত আছেমের অনুকরণে লিখা হতো এবং অন্যান্য কারীদের কেরাআতের ধরন নিম্নে লাল কালি দ্বারা কারীর নাম উল্লেখ করে লিপিবদ্ধ করা হতো।259 আসেম কুফায় থাকতেন ও সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মাজালিসুল মুমিনীন গ্রন্থের লেখকসহ আরো কিছু গবেষক ,যেমন আল্লামা সাইয়্যেদ হাসান সাদর তাঁর শিয়া হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত বলেছেন। তিনি 130 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

2. নাফে ইবনে আবদুর রহমান সম্পর্কে ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে বলেছেন , তিনি ইরানের ইসফাহানের লোক হলেও মদীনায় বাস করতেন। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে ,নাফে কৃষ্ণবর্ণের ছিলেন। তিনি মদীনায় কেরাআতশাস্ত্রের ইমাম বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মদীনার লোকেরা কেরাআতের ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করত। তিনি প্রসিদ্ধ দশজন কারীর একজন ইয়াযীদ ইবনে কা কা হতে কেরাআত শিক্ষা করেছিলেন। তিনি 159 বা 169 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

3. ইবনে কাসির সম্পর্কে ইবনুন নাদিম বলেছেন , কথিত আছে ইরান সম্রাট আনুশিরওয়ান ইরানীদের যে দলটিকে ইয়েমেনে হাবাশীদের নিকট হতে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ইবনে কাসির তাদেরই বংশধর।

আমরা ইতোপূর্বে ইয়েমেনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে এই ইরানীদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছি। রাইহানাতুল আদাব গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে , ইবনে কাসির কেরাআতশাস্ত্রের মৌলনীতি মুজাহিদ-এর নিকট হতে ,তিনি ইবনে আব্বাস-এর নিকট হতে এবং ইবনে আব্বাস হরযত আলী (আ.)-এর নিকট হতে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইবনে কাসির 120 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

4. ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে কিসায়ীর নাম আলী বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর পিতা হলেন হামযা ইবনে আবদুল্লাহ্ ইবনে বাহমান ইবনে ফিরুয। কিসায়ী একজন প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ও সাহিত্যিক। তিনি আব্বাসীয় খলীফা হারুন উর রশীদের দু পুত্রের শিক্ষক ছিলেন। খোরাসানে আগমনের সময় তিনি হারুনের সফরসঙ্গী ছিলেন। তিনি ইরানের রেই শহরে ইন্তেকাল করেন। ভাগ্যক্রমে হারুনের অন্যতম সফরসঙ্গী ও প্রধান কাযী মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীও ঐ দিন রেই শহরে মৃত্যুবরণ করেন ও সমাধিস্থ হন। হারুন উর রশিদ এ ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বলেন , আজকে ইসলামী ফিকাহ্ ও সাহিত্যকে রেইয়ে সমাহিত করেছি। কিসায়ী দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন। কিসায়ীও শিয়া ছিলেন।

তাফসীরের বিষয়ে বলা যায় ,রাসূল (সা.)-এর জীবদ্দশায় স্বাভাবিকভাবেই সাহাবিগণ কোরআনের আয়াতের অর্থ ও ব্যাখ্যার জন্য রাসূলেরই শরণাপন্ন হতেন। কোন কোন সাহাবী অন্যদের নিকট হতে কোরআনের অর্থ অনুধাবনে অধিকতর অগ্রসর ছিলেন ,এজন্য প্রথম হতেই আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে অন্যদের অনুসরণীয় ছিলেন ,যেমন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ। অবশ্য ইবনে আব্বাসের এ ক্ষেত্রে পরিচিতি অধিক ছিল এবং তাঁর মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিক বর্ণিত হয়ে থাকে। ইবনে আব্বাস260 হযরত আলীর শিষ্য ছিলেন এবং এ বিষয়টি নিয়ে গর্ব করতেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদও হযরত আলীর ছাত্র ও শিয়া ছিলেন। গ্রন্থসূচী সম্পর্কিত আল ফেহেরস্ত গ্রন্থগুলোতে ইবনে আব্বাস সংকলিত একটি তাফসীরের কথা উল্লিখিত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেছেন এই গ্রন্থটি এখনও মিশরের রাজকীয় জাদুঘরে রাখা আছে। তাফসীরে ইবনে আব্বাসের স্বতন্ত্র মত থাকলেও হযরত আলীর এ সম্পর্কিত জ্ঞান সম্পর্কে তিনি বলেছেন , হযরত আলীর জ্ঞানের নিকট আমি মহাসমুদ্রের এক ফোঁটা পানির ন্যায়।

জর্জি যাইদান দাবি করেছেন ,প্রথম হিজরী শতাব্দীর শেষ লগ্ন পর্যন্ত কোরআনের তাফসীর মুখে মুখে স্থানান্তরিত হতো এবং কোরআনের সর্বপ্রথম তাফসীর সংকলন করেন মুজাহিদ (মৃত্যু 104 হিজরী)। অতঃপর ওয়াকেদী ও ইবনে জারীর তাবারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে তাফসীর লিখেন।261

অবশ্য এ মতটি সঠিক নয়। ইবনে আব্বাস ছাড়াও সাঈদ ইবনে জুবাইর তাঁর পূর্বে তাফসীর সংকলন করেছেন। প্রথম হিজরী শতাব্দীতে মুসলমানগণ কোন গ্রন্থই রচনা করেনি। এ মতের অনুবর্তী হয়েই জর্জি যাইদান উপরোক্ত মত দিয়েছেন। তাঁর এ মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। তাই এ মতটি প্রত্যাখ্যাত। আমরা পরবর্তীতে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

কেরাআতশাস্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন ইরানীরা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাফসীরের ক্ষেত্রেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের মূল হিসেবে তাফসীর ,ফিকাহ্ ও হাদীসশাস্ত্রের প্রতি ইরানীরা যতটা গুরুত্ব দিয়েছে অন্য বিষয়ের প্রতি ততটা নয়। এখানে ইসলামের প্রথম যুগ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সকল ইরানী মুফাসসিরের নাম উল্লেখ করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। কারণ প্রতি শতাব্দীতেই শত শত মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থ ছিল। তাই তাঁদের মধ্য হতে বিভিন্ন জাতির মুফাসসিরদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব। তবে তাফসীরশাস্ত্রে ইরানীদের অবদান তুলে ধরার জন্য এ সম্পর্কিত কিছু নমুনা প্রসিদ্ধ মুফাসসির ও তাফসীর গ্রন্থসমূহের তালিকা হতে উল্লেখ করছি। লক্ষ্য করবেন ,এদের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

প্রথম পর্যায়ের মুফাসসিরগণ হলেন যাঁদের নাম ও মত তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর উল্লেখ করা হয় অথবা তাঁদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এখনো বিদ্যমান। এখানে আমরা তাঁদের মধ্য হতেই মনোনীত করব ।

প্রথম শ্রেণীর মুফাসসির যাঁদের নাম তাফসীর গ্রন্থসমূহে অধিকতর স্মরণ করা হয় তাঁদের কেউ সাহাবী ,কেউ তাবেয়ী ,কেউ তাবে তাবেয়ী আবার কেউ তাঁদের ছাত্র বা শিষ্য। এ ধরনের প্রসিদ্ধ কিছু সংখ্যক ব্যক্তিত্ব হলেন ইবনে আব্বাস ,ইবনে মাসউদ ,উবাই ইবনে কাব ,সা দী ,মুজাহিদ ,কাতাদা ,মুকাতিল ,কালবী ,সাবিয়ী ,আ মাশ ,সুফিযান সাওরী ,জুহরী ,আতা ,আকরাম ,ফাররা প্রমুখ।

এদের কেউ শিয়া ,কেউ সুন্নী ,কেউ ইরানী আবার কেউ অ-ইরানী। স্বাভাবিকভাবেই এদের অধিকাংশই অ-ইরানী। শুধু মুকাতিল ,আ মাশ ও ফাররা ইরানী বংশোদ্ভূত।

মুকাতিল ইবনে সুলাইমান ইরানের খোরাসান অথবা রেইয়ের অধিবাসী ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর একজন ব্যক্তিত্ব এবং 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। মুকাতিল শাফেয়ী মাযহাবের লোক ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং শাফেয়ী অতিরঞ্জিত মন্তব্য করে বলেছেন , অন্যরা তাফসীরের ক্ষেত্রে মুকাতিলের পরিবারস্বরূপ অর্থাৎ তাঁর অনুসারী।

রাইহানুল আদাব গ্রন্থের 1ম খণ্ডের 150 পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হয়েছে সুলাইমান ইবনে মেহরান আ মাশের পিতা ইরানের দামাভান্দের অধিবাসী হলেও আ মাশ কুফায় জন্মগ্রহণ করেন ও জীবন কাটান। আ মাশ শিয়া হলেও আহলে সুন্নাতের আলেমগণও তাঁর প্রশংসা করেছেন। আ মাশ রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন । তিনি 150 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ফাররা ইয়াহিয়া ইবনে যিয়াদ আকতা একজন আরবী ব্যাকরণবিদ ও অভিধান রচয়িতা। আরবী সাহিত্যের গ্রন্থে তাঁর নাম প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। তিনি কেসায়ীর ছাত্র এবং আব্বাসীয় খলীফা মামুনের সন্তানদের শিক্ষক ছিলেন।

রিয়াজুল উলামা তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে শিয়া বলেছেন। তাঁর পিতা যিয়াদ আকতা ফাখের মর্মন্তুদ ঘটনায় হুসাইন ইবনে আলী ইবনে হাসানের262 সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেয়ায় আব্বাসীয় খলীফার নির্দেশে হস্ত কর্তিত হন। এজন্যই তাঁকে আকতা বা কর্তিত হস্ত বলা হয়। ফাররা 207 বা 208 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

দ্বিতীয় শ্রেণীর মুফাসসিরগণ হলেন তাঁরা যাঁরা তাফসীর বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে এত অধিক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে যে ,তা গণনা করা সম্ভব নয়। তাই শুধু এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থসমূহের নাম এখানে উল্লেখ করব। আমাদের আলোচনা শিয়া মুফাসসিরগণের তাফসীর দিয়ে শুরু করছি। শিয়া মুফাসসিরগণ দু অংশে বিভক্ত। একদল হলেন সে সকল মুফাসসির যাঁরা ইমামগণের উপস্থিতিতে ও বর্তমান অবস্থায় তাফসীর লিখেছেন ও অন্যদল হলেন যাঁরা ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ে তাফসীর লিখেছেন। ইমামগণের সমকালীন সময়ে যাঁরা তাফসীর রচনা করেছেন তাঁদের কেউ ইরানী ,কেউ অ-ইরানী। ইমামদের সাহাবী এরূপ কয়েকজন মুফাসসির হলেন আবু হামযা সুমালী ,আবু বাছির আসাদী ,ইউনুস ইবনে আবদুর রহমান ,হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ,আলী ইবনে মেহযিয়ার আহওয়াযী ,মুহাম্মদ ইবনে খালিদ বারকী কুমী এবং ফাজল ইবনে শাজান নিশাবুরী।

ইমাম মাহ্দীর অন্তর্ধানের পরবর্তী সময়ের মুফাসসিরের সংখ্যা অসংখ্য। এখানে আমরা শুধু শিয়াদের প্রসিদ্ধ কিছু তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি। এ হতেই বোঝা যাবে শিয়া মুফাসসিরগণের অধিকাংশই ইরানী ছিলেন।

1. তাফসীরে আলী ইবনে ইবরাহীম কুমী: এ তাফসীর গ্রন্থটি শিয়াদের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ যা এখনও বর্তমান রয়েছে। আলী ইবনে ইবরাহীমের পিতা কুফা হতে কোমে আসেন। অসম্ভব নয় ,আলী ইবনে ইবরাহীম একজন আরব বংশোদ্ভূত ইরানী। তিনি শেখ কুলাইনীর শিক্ষক ও মাশয়িখ (যাঁর নিকট হতে হাদীস বর্ণনার অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন)। তিনি 307 হিজরী পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।

2. তাফসীরে আয়াশী: এই তাফসীরটি মুহাম্মদ ইবনে মাসউদ সামারকান্দী লিখেছেন। তিনি প্রথম জীবনে সুন্নী ছিলেন এবং পরবর্তীতে শিয়া হন। তিনি শেখ কুলাইনীর সমসাময়িক ব্যক্তি। তিনি তাঁর পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তিন লক্ষ দিনারের পুরোটাই গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি লিখন ,সংকলন ,নকল ও ক্রয়ের কাজে ব্যয় করেন। যে সকল ব্যক্তি এরূপ কর্ম করতেন তাঁদের জীবিকা র্নিবাহের খরচ তিনি দিতেন। আয়াশী তাফসীর ,হাদীস ,ফিকাহ্শাস্ত্র ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ইবনুন নাদিম তাঁর আল ফেহেরেস্ত গ্রন্থে তাঁর রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন ও দাবি করেছেন আয়াশীর রচিত গ্রন্থসমূহ খোরাসানে বেশ প্রচলিত ছিল। আয়াশী ইরানী হলেও আরব বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়। ইবনুন নাদিম বলেছেন ,কথিত আছে তিনি তামীম গোত্রের উত্তর পুরুষ। তিনি তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব।

3. তাফসীরে নোমানী: এ তাফসীরটির রচয়িতা হলেন আবদুুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইবনে আবি যাইনাব নামেও সুপরিচিত। তিনি শেখ কুলাইনীর ছাত্র। তাসিসুশ শিয়া গ্রন্থের লেখক বলেছেন ,তাফসীরে নোমানীর অনুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে রয়েছে। নোমানী ইরাকের না মিশরের অধিবাসী ছিলেন তা বলা মুশকিল। তিনি চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর একজন আলেম।

নোমানীর এক দৌহিত্রের নাম আবুল কাসেম হুসাইন ,যিনি ইবনুল মারযবান নামে প্রসিদ্ধ। তাঁর পিতার দিকে হতে তিনি সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদের বংশধর। তিনি কয়েকবার তৎকালীন শাসনকর্তার মন্ত্রী হওয়ায় ওয়াযিরে মাগরেবী নামেও প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ইবনুল মারযবান চৌদ্দ বছর বয়সে কোরাআনের হাফেজ হন। তিনি আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ,হিসাবশাস্ত্র ,অংক ও জ্যামিতি ,যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য জ্ঞানের ক্ষেত্রেও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি একজন উচ্চ মাপের সাহিত্যিক ও শক্তিমান লেখকও ছিলেন।

তিনি খাসায়িসুল কোরআন নামে এক গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি 418 অথবা 428 সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা বাগদাদ হতে নাজাফে স্থানান্তরিত করা হয় ও তাঁর অসিয়ত অনুযায়ী হযরত আলী (আ.)-এর কবরের নিকটবর্তী স্থানে দাফন করা হয়।

4. তাফসীরে তিবইয়ান: এ তাফসীরের রচয়িতা শেইখুত তায়িফা আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ইবনে আলী আত তুসী। তিনি তাফসীর ,ফিকাহ্ ,কালামশাস্ত্র ,হাদীস ও আরবী সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। তিনি 385 হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী তাঁর জন্ম হতে এখন এক হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে গত বছর মাশহাদে তাঁর সহস্র বছর পূর্তি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। শিয়া-সুন্নী ,মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে প্রচুর মনীষী ও বিশেষজ্ঞ ঐ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইসলামের এ উজ্জ্বল নক্ষত্র 460 হিজরীতে অস্তমিত হয়। তিনি 23 বছর বয়সে খোরাসান হতে ইরাকে আসেন এবং শেখ মুফিদ ও সাইয়্যেদ মুরতাজা আলামুল হুদার নিকট শিক্ষা লাভ করেন। পরবর্তীতে তাঁর সময়ের শিয়া মতাবলম্বীদের ফকীহ্ ও নেতা হন। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতেও তিনি শিয়া আলেমদের শিরোমণি ছিলেন। মৃত্যুর বারো বছর পূর্বে বাগদাদের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার (মোগলদের আক্রমণ) ফলে নাজাফে চলে আসেন এবং নাজাফের ধর্মীয় মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন করেন যা তাঁর মৃত্যুর এক হাজার বছর পরও বিদ্যমান রয়েছে।

5. মাজমাউল বায়ান: এ তাফসীর গ্রন্থটি ফাযল ইবনে হাসান তাবরেসী রচনা করেছেন। তিনি ইরানে তাফরেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি 536 হিজরীতে তাঁর এই তাফসীর লেখা সমাপ্ত করেন। রচনা ও সাহিত্যিক মানের দিক দিয়ে এ তাফসীরটি সর্বোত্তম। আহলে সুন্নাত ও শিয়া উভয়েই এই তাফসীরকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই মিসর ,বৈরুত ও ইরানে পুনঃপুন ছাপা হয়েছে। আল্লামা তাবরেসী জাওয়ামেউল জামে নামে অপর একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীর লিখেছেন। এ তাফসীরটি তিনি তাঁর সমকালীন প্রসিদ্ধ মুফাসসির জারুল্লাহ্ যামাখশারী রচিত তাফসীরে কাশশাফ হতে আকর্ষণীয় সাহিত্যিক বিষয়বস্তু নির্বাচন করে সংযোজন করেছেন।

অবশ্য তাফসীর বিশেষজ্ঞরা জানেন তাফসীরে কাশশাফে এমন অনেক সাহিত্যিক ও অলংকারিক বিষয় রয়েছে যা মাজমাউল রায়ানে নেই। আবার মাজমাউল বায়ানেও এমন অনেক সাহিত্যিক ও তাফসীরগত বিষয় রয়েছে যা কাশশাফে নেই।

6. রাউযুল জিনান: আবুল ফুতুহ রাযী তাফসীরটি রচনা করেছেন। এ তাফসীর ফার্সী ভাষায় রচিত। শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের মধ্যে এটি সমৃদ্ধতম ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। কারো কারো মতে ফখরুদ্দীন রাযী ও তাবরেসী উভয়েই এ তাফসীর গ্রন্থ হতে পর্যাপ্ত সাহায্য নিয়েছেন। গত চল্লিশ বছরে তাফসীরটি ইরানে ব্যাপকভাবে ছাপা হয়েছে। আবুল ফুতুহ রাযী নিশাবুরে জন্মগ্রহণ করলেও রেই শহরে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি আরব বংশোদ্ভূ ইরানী। তিনি হযরত আলীর বিশিষ্ট সাহাবী ও সিফফিন যুদ্ধে তাঁর পক্ষে অংশগ্রহণকারী স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ্ ইবনে বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার বংশধর।

আবুল ফুতুহ তাবরেসী ও যামাখশারীর সমসাময়িক ব্যক্তি এবং শেখ তুসীর পরোক্ষ ছাত্র। তাঁর মৃত্যুর সঠিক সাল জানা যায়নি। তবে এটি নিশ্চিত ,তিনি ষষ্ঠ হিজরী শতাব্দীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর রেই শহরে বিদ্যমান।

7. তাফসীরে সাফী: বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ,মুফাসসির ,দার্শনিক ও আরেফ মোল্লা মুহাম্মদ ফাইয কাশানী এ তাফসীরটি লিখেছেন। তিনি প্রসিদ্ধ শিয়া আলেমদের অন্যতম। তিনি একাদশ হিজরী শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব। এই বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বেশ কিছু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। মরহুম ফাইয প্রথম জীবনে কোমে ছিলেন। তাঁর নামেই কোমের ধর্মীয় মাদ্রাসার নামকরণ করা হয় মাদ্রাসায়ে ফাইযিয়া । পরে তিনি কোম হতে সিরাজ যান ও সাইয়্যেদ মাজিদ বাহরানীর নিকট হাদীসশাস্ত্র এবং মহান দার্শনিক ও আরেফ সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরা নামে প্রসিদ্ধ) নিকট দর্শন ও এরফান শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সাদরুল মুতাআল্লিহীনের কন্যাকে বিবাহ করেন। তিনি 1091 হিজরীতে কাশানে মৃত্যুবরণ করেন।

8. তাফসীরে মোল্লা সাদরা: যদিও মোল্লা সাদরা দর্শন ও অধিবিদ্যাশাস্ত্রে অধিকতর পরিচিত ও স্বতন্ত্র মতবাদের প্রবক্তা তদুপরি তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি উসূলে কাফী নামক হাদীস গ্রন্থের ব্যাখ্যা লিখেন। তিনি সূরা বাকারার 65 আয়াত পর্যন্ত ,সূরা সিজদাহ্ ,ইয়াসীন ,ওয়াকেয়া ,হাদীদ ,জুমআ ,ত্বারিক ,আলা ,যিলযাল ,আয়াতুল কুরসী ,সূরা নূরের কিছু আয়াত ও সূরা নামলেরوترى الجبال تحسبها جامدة আয়াতটি তাফসীর করেছেন। যদিও মোল্লা সাদরার তাফসীর পূর্ণ তাফসীর নয় ,তদুপরি বিস্তারিত ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ এবং আয়তনে তাফসীরে সাফীর সমান।

গ্রন্থটি ইরানে কয়েকবার মুদ্রিত হয়েছে। তিনি 1050 হিজরীতে পদব্রজে হজ্বে গমনের সময় বসরায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সপ্তমবারের মত হজ্বে যাওয়ার সময় ইন্তেকাল করেন। কাবার আকর্ষণ তাঁকে এমনভাবে টানত যে ,কণ্টকময় পথ তাঁর নিকট রেশমী কাপড় বিছানো পথের ন্যায় মনে হতো।

9. মিনহাজুস সাদেকীন: এ তাফসীরটি ফার্সী ভাষায় রচিত। এটি তাবরীজ হতে তিন খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাফসীরটি মোল্লা ফাতহুল্লাহ্ ইবনে শুকরুল্লাহ্ কাশানী কর্তৃক দশম হিজরী শতাব্দীতে রচিত হয়েছে। এই লেখকের অধিকাংশ লেখা ফার্সীতে ছিল। যেমন নাহজুল বালাগার ফার্সী অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ।

10. তাফসীরে শাব্বার: সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ্ শাব্বার এ তাফসীরটি লিখেন। তিনি কাশেফুল গেতা ও মির্যা কুমীর সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন চিন্তাশীল ,জ্ঞানী ও আবেদ ছিলেন। তিনি উসূল ,ফিকাহ্শাস্ত্র ,কালাম ,হাদীসশাস্ত্র ,তাফসীর ও রিজালশাস্ত্রে প্রচুর গ্রন্থ লিখেছেন। তিনি 1242 হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন ও ইমাম কাযিম (আ)-এর সমাধিস্থলের নিকটে সমাধিস্থ হন।

11. তাফসীরে বুরহান: এই তাফসীরটি সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী কর্তৃক রচিত। তিনি একজন প্রসিদ্ধ শিয়া মুহাদ্দিস ও গবেষক। তাফসীরটি আখবারী ধারায় লিখিত অর্থাৎ কোরআন শুধু হাদীসের সাহায্যেই তাফসীর করতে হবে-এই মনোবৃত্তিতে বিশ্বাসীদের ধারায় এটি লিখা হয়েছে। তাই শুধু আয়াতসংশ্লিষ্ট হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে এবং হাদীসটির বিষয়ে কোন ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়নি। সাইয়্যেদ হাশেম বাহরেইনী 1107 অথবা 1109 হিজরীতে ইন্তেকাল করেন।

12. নুরুস সাকালাইন: এ তাফসীরটি হুয়াইযের একজন আলেম কর্তৃক লিখিত যিনি সিরাজে বাস করতেন। তাঁর নাম শেখ আবদুল আলী ইবনে জুমাআ। তিনি মরহুম আল্লামা মাজলিসী ও শেখ হুররে আমেলীর সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ নিশ্চিত নয়। তাঁর তাফসীরটিও হাদীসনির্ভর তাফসীর।

ওপরে আমরা যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি সেগুলো দ্বাদশ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত লিখিত শিয়াদের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ এবং শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদের হাতের নিকটেই রয়েছে। তাই শিয়া ভিন্ন অন্যরাও চাইলে সহজেই তা পেতে পারেন। চতুর্দশ হিজরী শতাব্দীতেও অনেক তাফসীর গ্রন্থ রচিত হয়েছে ও হচ্ছে। আমরা এখানে তার উল্লেখ হতে বিরত থাকছি। যদি কেউ শিয়া তাফসীর গ্রন্থসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি একটা পরিসংখ্যান পেতে চান তাহলে আল্লামা শেইখ আগা বুযুরগে তেহরানী রচিত আয যারবিয়া ইলা তাসানিফুশ শিয়া নামক গ্রন্থটি দেখতে পারেন।

ওপরে আমরা নমুনাস্বরূপ যে সকল তাফসীর গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি তা হতে স্পষ্ট ,প্রসিদ্ধ সকল শিয়া তাফসীর গ্রন্থই হয় ইরানীদের দ্বারা রচিত হয়েছে নতুবা আরব বংশোদ্ভূত কোন ইরানী বা শিয়া যাঁরা ইরানে বসবাস করতেন তাঁরা লিখেছেন।


29

30

31

32

33

34

35