ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান0%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক: শহীদ অধ্যাপক মুর্তাজা মুতাহ্হারী
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 104583
ডাউনলোড: 5187

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 104583 / ডাউনলোড: 5187
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।

শিল্প ও সাহিত্য

এতক্ষণ জ্ঞান ও সংস্কৃতির বিষয়ে আমরা যা আলোচনা করলাম তাতে ইসলামে ইরানীদের চিন্তাগত অবদান ফুটে উঠেছে। ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতার বিকাশে ইরানীরা যে অবদান রেখেছিল তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এখন আমরা ইসলামের শিল্পকলা ও সাহিত্যে ইরানীদের অবদানের বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরব। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবদান অন্য সকল ক্ষেত্র হতে তাদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাকে উত্তমরূপে তুলে ধরতে সক্ষম। কারণ এ ক্ষেত্রটির সঙ্গে মানুষের বিশ্বাস ও ভালবাসার সম্পর্ক অধিকতর। অর্থাৎ বলা যেতে পারে ,শৈল্পিক সৃষ্টিসমূহ মানুষের গভীর বিশ্বাস ও ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কারো নিকট থেকে মহাসৃষ্টি আদায় করা সম্ভব নয়। তাই ভালবাসা ও ঈমানই পারে শুধু মহাসৃষ্টি করতে। চিন্তাগত মহাসৃষ্টির ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি সত্য। তবে শিল্পকলা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটি আরো স্পষ্ট। ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতিতে যেমন ইরানীদের মহাসৃষ্টি রয়েছে তেমনি সাহিত্য ও শিল্পকলাতেও রয়েছে।

ইসলামী যুগে স্থাপত্য শিল্প ,চিত্র শিল্প ,ক্যালিগ্রাফি ,স্বর্ণ-কারুকার্য শিল্প ,অঙ্গুরি শিল্প ,মোজাইক শিল্প ,লৌহ শিল্প প্রভৃতিতে ইরানীরা যে সৃষ্টিশীল অবদান রেখেছে তার অধিকাংশই ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ বিষয়টি আলোচনার জন্য স্বতন্ত্র একটি গ্রন্থের দাবি রাখে।

এ মহাসৃষ্টিসমূহ ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন মসজিদ ,পবিত্র স্থান ,মাদ্রাসা ,কোরআন ,দোয়াগ্রন্থসমূহে প্রতিফলিত হয়েছে। বিষয়টি যেমন মসজিদ ,মাদ্রাসা ও অন্যান্য পবিত্র স্থানের স্থাপত্যকর্মে ফুটে উঠেছে তেমনি বিভিন্ন গ্রন্থসমূহে স্বর্ণলিপি ,অঙ্গুরি ও মোজাইকেও তা পরিদৃষ্ট হয়। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে (এমনকি ইসলামী বিশ্বের বাইরেও অমুসলিম দেশসমূহের জাদুঘরেও) কোরআনের যেসব অনুলিপি রয়েছে তা এ ক্ষেত্রে ইরানীদের শিল্পমনস্কতা ও তাদের অন্তরে বিদ্যমান ইসলামের প্রতি ভালবাসাকে তুলে ধরেছে।

ইরানীরা ইরানের বাইরে ও অন্যান্য স্থানে ইসলামী শিল্পকলাতে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। বিশ্বের অমুসলিম বিভিন্ন দেশ যেখানে মুসলমানগণ সংখ্যলঘু ,যেমন ভারত ও চীনেও ইরানীরা এমন অনেক মহাকীর্তি সৃষ্টি করেছে যা ইরানীদের ইসলামপ্রেম ও নিষ্ঠাকেই প্রমাণ করে। এ বিষয়ে গবেষণার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি।

অন্য যে ক্ষেত্রটিতে ইরানীরা তাদের রুচি ও অনুভূতির স্বাক্ষর রেখেছে তা হলো ফার্সী ভাষার মাধ্যমে ইসলামের উপস্থাপন। ইরানী কবি ,সাহিত্যিক ,আরেফ ও বাগ্মী আলেমগণ ইসলামের প্রকৃত বর্ণনাকে ফার্সীর অলংকৃত পোশাক পরিয়ে সর্বোত্তম রূপে উপস্থাপন করেছেন ;ইসলামের অভ্যন্তরীণ রূপকে রূপকভাবে প্রতিমূর্ত করেছেন। তাঁরা কোরআনের বিভিন্ন সূক্ষ্ম বিষয়কে বোধগম্য ও আকর্ষণীয় রূপে কাব্য আকারে উপস্থাপন করেছেন। মাওলানা রুমীর মাসনভী এর সর্বোত্তম উদাহরণ।

দারী ফার্সী (ইসলাম পরবর্তী ইরানী ফার্সী) ইসলামে যে আবদান রেখেছে তা স্বতন্ত্রভাবে গবেষণার বিষয়। এ বিষয়ে কেউ অধ্যয়ন করলে দেখতে পাবেন ,এ ভাষাটি ইসলামের আবির্ভাবের পরে বারোশ বছরের অধিক সময় ধরে ইসলামের সেবাতেই যেন নিয়োজিত ছিল।

কেউ যদি শুধু ইসলামের তাওহীদ ,কোরআন ,নবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রশংসায় রচিত ফার্সী ভাষায় বিদ্যমান উচ্চমানের কবিতাসমূহ নিয়েই গবেষণা করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে ,এর পরিমাণ কয়েক খণ্ড পুরু গ্রন্থের সমান। ফার্সী ভাষায় বিদ্যমান ইসলামের রূপ বর্ণনাকারী বিভিন্ন গজল ,কাহিনী ,উপদেশমূলক গল্পসমূহ সামনে রাখলে এর পরিমাণ হবে তার কয়েকগুণ।

গত বারোশ শতাব্দী ধরে ফার্সী সাহিত্য ,কোরআন ও হাদীসের বাণী ও ভাবধারা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ফার্সী ভাষায় বর্ণিত বিভিন্ন উপদেশ বাণী ও এরফানী গভীর তত্ত্বসমূহ কোরআন ও হাদীস হতেই গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ কোরআন ও সুন্নাহর দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েই তা বিকশিত হয়েছে।

দারী ফার্সীর সঙ্গে কোন কোন ব্যক্তির শত্রুতা এ কারণেই যে ,এ ভাষাটি ইসলামী ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং ইসলামী সংস্কৃতির শক্তিশালী উপস্থাপকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাই তাঁরা জানেন এ ভাষার সঙ্গে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া ব্যতীত ইসলামকে পরাভূত করা যাবে না। ফার্সী সাহিত্যের ক্ষেত্রেও আলোচনার গুরুদায়িত্বটি বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে চাই। কারণ এ বিষয়ে তাঁরাই অধিক যোগ্য।

দু শতাব্দীর নীরবতা

সম্মানিত পাঠকগণ! এ গ্রন্থের তৃতীয় আলোচনায় যে বিষয়টি স্পষ্টরূপে ফুটে উঠেছে তা হলো ইরানীরা উদারতা ,মহত্ত্ব ও কৃতজ্ঞচিত্ত নিয়ে ইসলামের প্রতি অনুগত হয়েছিল এবং ইসলামের মধ্যে তাদের প্রকৃতি ও আত্মিক চাহিদারই প্রতিফলন লক্ষ্য করেছি। ইরানীদের নিকট ইসলাম যেন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির নিকট সুস্বাদু খাদ্যের মতো ছিল। ইরানীরা তৃষ্ণার্ত ছিল এবং ইসলাম যেন তাদের জন্য সুপেয় পানি এনে দিয়েছিল। ইসলামপূর্ব ইরানী ভৌগোলিক ও সময়গত সামাজিক অবস্থান ও ইরানীদের প্রকৃতি ইসলামের প্রতি ইরানীদের আকৃষ্ট করেছিল এবং তা তাদের জীবনসঞ্চারে শক্তি দিয়েছিল । পরবর্তীতে ইরানীরা নিজেদের জীবন ও শক্তিকে ইসলামের সেবায় নিবেদিত করেছিল।

আমরা জানি ,41 হিজরী হতে 123 হিজরী পর্যন্ত প্রায় একশ বছর উমাইয়্যারা মুসলিম বিশ্বে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। ইসলাম জাতি ও বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের যে জাহেলী রীতির অবসান ঘটিয়েছিল উমাইয়্যারা তা পুনর্জীবিত করেছিল। তাদের রাজনীতি ছিল জাতিগত বৈষম্যকেন্দ্রিক। তারা আরবদের মধ্যে পার্থক্য করত। বিশেষত ইরানীদের সাথে উমাইয়্যাদের আচার অন্যান্য জাতি হতে নিকৃষ্টতর ছিল। এর প্রকৃত করণ হলো হযরত আলী (আ.)-এর প্রতি ইরানীদের বিশেষ ভালবাসা। যেহেতু হযরত আলীর রাজনীতি ইসলামের জাতি-বর্ণ ও শ্রেণীহীন নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং উমাইয়্যা বা আরব ও কুরাইশ হিসেবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ দেখিয়ে ক্ষমতার ক্ষেত্রে লাভবান হতো সেহেতু তারা আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি ক্ষিপ্ত ছিল। এ কারণেই আলী (অ.)-এর অনুসারী আরব ,ইরানী ,আফ্রিকীয় সকলেই তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যদের হতে ইরানীরাই বেশি নির্যাতিত হয়েছে।

132 হিজরীতে যখন আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসেন তখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হয়ে যায়। খলীফা মুতাসিম বিল্লাহর ক্ষমতা হারানোর পূর্ব পর্যন্ত আব্বাসীয়দের নীতি ছিল আরবদের পরিবর্তে ইরানীদের পৃষ্টপোষকতা ও শক্তিশালী করা। খলীফা মুতাসিমের সময়কালে তুর্কীরা ইরানীদের স্থলাভিষিক্ত হয়। আব্বাসীয় শাসনের প্রথম একশ বছর ইরানীদের স্বর্ণযুগ ছিল। আব্বাসীয় শাসকদের বেশ কিছু উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ,যেমন বার্মাকী (বালখের সম্ভ্রান্ত বৌদ্ধ পরিবারের সন্তান ;পরবর্তীতে তাঁরা মুসলমান হন) এবং ফাযল ইবনে সাহল সারখসী (যুররিয়াসাতাইন) খলীফার পর সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত হতেন।

আব্বাসীয় শাসনের প্রথম শতাব্দীতে ইরানীরা স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ছিল না ;বরং রাজনৈতিকভাবে ইসলামী খেলাফতের অধীন হিসেবে স্বাচ্ছন্দে কাজ করত। কিন্তু এক শতাব্দী পর হতে যখন তাহেরিয়ান বংশ খোরাসানের ক্ষমতা লাভ করে ,তখন থেকে ইরানীরা মোটামুটি স্বাধীন হয়ে পড়ে এবং বিশেষভাবে সাফারিয়ানদের শাসনামলে ইরানীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন শাসন ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়।

অবশ্য এ শাসকবর্গের স্বাধীন ক্ষমতা থাকলেও আব্বাসীয় শাসনামলের শেষ সময় পর্যন্ত নৈতিকভাবে তাঁরা আব্বাসীয় খলীফাদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ইরানের জনসাধারণ মহানবী (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে খলীফাদের বিশেষ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখত এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ইরানী শাসক খলীফার পক্ষ হতে অভিষিক্ত না হতেন ততক্ষণ তারা তা শরীয়তসম্মত মনে করত না। সপ্তম হিজরী শতাব্দীতে যখন আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটে তখন অভিষিক্ত হওয়ার এ ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। আব্বাসীয় শাসনের পতনের পর উসমানী শাসকরা ইরানের বাইরে অন্যান্য স্থানে নৈতিক প্রভাব রাখলেও ইরানে তাদের কোন প্রভাব ছিল না। এর কারণ হলো ইরানী জনসাধারণের শিয়া প্রবণতা এবং উসমানী খিলাফতকে সঙ্গত মনে না করা। কোন কোন প্রাচ্যবিদ ,যেমন ব্রিটিশ লেখক সার্জন ম্যালকম ইরানে ইসলামের আবির্ভাবের সময়কাল হতে ইরানের স্বাধীন ক্ষমতা লাভের সময়কাল পর্যন্ত (প্রথম হিজরী শতাব্দীর প্রথমার্ধ হতে তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত) ইরানীদের নীরবতা ও দাসত্বের যুগ বলে উল্লেখ করেছেন। এ মত অনেক ইরানীকে প্রভাবিত করেছে।

যদি আমরা বিষয়টিকে সার্জন ম্যালকমের দৃষ্টিতে দেখি অর্থাৎ এ দু শতাব্দীতে ইরানের সাধারণ মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বিষয়ে নজীরবিহীন যে পরিবর্তন হয়েছিল এবং তাদের জন্য এটি কতটা কল্যাণকর হয়েছিল সে বিষটিকে উপেক্ষা করে ইরানের পূর্ববর্তী শাসকবর্গের দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখি তাহলে এ সময়কালকে নীরবতার যুগ বলতে পারি।

যদি আমরা হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ও আবু মুসলিম খোরাসানীদের আদর্শ হিসেবে ধরি ,যাঁদের একজন 1 লক্ষ 20 হাজার লোক হত্যা করেছিলেন এবং অপরজন 6 লক্ষ লোক ,সে ক্ষেত্রে কোন গোঁড়া আরবের ন্যায় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হাজ্জাজের হাতে কেন এই 6 লক্ষ লোক নিহত হলো না সেজন্য আফসোস করতে পারি । সেরূপ আমাদেরও আফসোস হতে পারে ,আবু মুসলিম খোরাসানী কেন ইরানী হিসেবে আরো 1 লক্ষ 20 হাজার লোক হত্যা করতে পারলেন না। যদি তা করতে পারতেন তবে তিনিও আরব হাজ্জাজের ন্যায় প্রসিদ্ধি লাভ করতে পারতেন ,কিন্তু তা যখন হয়নি তাহলে নিশ্চয় এ দু শতাব্দী ইরানীদের নীরবতার যুগ ।

কিন্তু ইরানের সাধারণ মানুষের অর্থাৎ কর্মকার ,চর্মকার ,শ্রমিক যাদের মধ্য হতে সীবাভেই ,আবু হানিফা ,আবু ওবায়দা ,বনী শাকের ,বনী নৌবাখত এরূপ অনেক ব্যক্তিত্ব ও বংশের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের দৃষ্টিতে দেখি তবে দেখব এ দু শতাব্দী ইরানীদের জোশ ,উদ্দীপনা ,সুর ও ছন্দের যুগ ছিল। কারণ তারা এ সময়েই পেরেছিল নিজেদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে ও স্বাধীনভাবে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা করতে। যেন ইরানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত তারা জ্ঞান ,সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার মাধ্যমে অন্যান্য জাতির ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার সুযোগ পেয়েছিল। তারা তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে স্বভূমি ও ব্যক্তিসত্তার সম্মানকে চির উন্নত ও স্থায়ী করতে পেরেছিল।

এই দু শতাব্দীতেই ইরানীরা জাতি-বর্ণের ঊর্ধ্বে মানবিক ও বিশ্বজনীন এক আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। এ আদর্শের সত্তাকে তারা স্থান ,কালের ঊর্ধ্বে এক ঐশী সত্য হিসেবে বুঝতে পেরেছিল। কোরআন ও ইসলামের বিশ্বজনীন ভাষা যা কোন বিশেষ জাতির জন্য নয় বরং একটি ধর্মের ভাষা ,তাকে নিজ জাতীয় ভাষার ওপর প্রধান্য দিয়েছিল।

আশ্চর্যের বিষয় হলো এরা বলে থাকে দু শতাব্দীতে ইরানীরা বাকরুদ্ধ হয়েছিল ,শুধু তরবারীই তাদের কথা বলাতো।

প্রকৃতপক্ষে এ বক্তব্যের অর্থ আমার বোধগম্য নয়। তবে কি জ্ঞান ও সাহিত্যের ভাষা কোন ভাষা নয় ? সীবাভেইয়ের সাহিত্যে ও ব্যাকরণ শাস্ত্রের মহাগ্রন্থটি (যেটি টলেমারী ম্যাজেস্টি এবং অ্যারিস্টটলের যু্িক্তবিদ্যা গ্রন্থের সমমানের বলা যেতে পারে) কি এ সময়েই রচিত হয়নি ? ইবনে কুতাইবার আদাবুল কাতিব নামক মহাসৃষ্টিটি কি এ সময়েই রচিত হয়নি ? ব্যাকরণ সম্পর্কিত সৃষ্টি কি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় ?

সম্ভবত তাঁরা বলবেন ,এসব গ্রন্থ তো আরবী ভাষায় রচিত হয়েছে। আমাদের প্রশ্ন হলো ,কেউ কি ইরানীদের বাধ্য করেছিল আরবী ভাষায় মহাসৃষ্টি করতে ? আদৌ জোরপূর্বক মহাসৃষ্টি করান সম্ভব কি ? যদি ইরানীরা কোন ভাষাতে ঐশী মুজিযার সন্ধান পেয়ে থাকে এবং জানতে পারে ,তা কোন জাতির জন্য শুধু নয় ;বরং এটি এক গ্রন্থের ভাষা। অতঃপর তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে তাকে শক্তিশালী করার কাজে ব্রত হয়ে থাকে তবে একে কি ত্রুটি বলা যায় ? যদি ইরানীরা তাদের প্রাচীন ভাষার সঙ্গে এ নতুন ভাষার শব্দ ও ভাবার্থের মিশ্রণ ঘটিয়ে আকর্ষণীয় ও মিষ্টি নবীন ফার্সী ভাষার সৃষ্টি করে থাকে তাহলে তাকে অপরাধ বলা যাবে কি ?

তাঁরা বলে থাকেন যে ,ইসলামপূর্ব ইরানী ভাষা এমন এক জাতির ভাষা ছিল যা সাহিত্য ,সংস্কৃতি ও জ্ঞানে পূর্ণ ছিল ,অথচ এ জাতিটি আরবদের মুখোমুখি হওয়ার পর কি শুনে নীরব হয়ে গেল ?

ড. যেররিন কুব উপরিউক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করে নিজেই এর জবাব দিয়েছেন ,

বলা হয়ে থাকে আরবী ভাষা অন্ধকার জাতির ভাষা হিসেবে এর কোন মধুরতা ,স্নিগ্ধতা ছিল না। তদুপরি যখন ইরান সাম্রাজ্যের আকাশে এ ভাষার আযান প্রতিধ্বনিত হলো তখন প্রাচীন পাহলভী ভাষা এর বিপরীতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কথা হলো ,যদি এমনটি হয়ে থাকে তবে যে ঘটনাটি ইরানীদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল তা হলো কোরআনের বাণী। সাধারণের বোধগম্য অথচ অলৌকিক এ বাণী আরবদের যেমন বিস্মিত করেছিল তেমনি তা ইরানীদের চিন্তাশক্তিকে বিস্মিত এবং হতবিহ্বল করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ইরানীরা নতুন এ ধর্মের মধ্যে এমন কিছুর সন্ধান পেয়েছিল যা তাদের হৃদয়কে উদ্দীপিত করেছিল এবং তারা আগ্রহ ও আন্তরিকতার সাথে একে গ্রহণ করেছিল। তারা এতটা আত্মহারা হয়ে পড়েছিল যে ,কোন কবি বা বক্তাই তা ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি।

মুসলিম খলীফাগণ এমন কি উমাইয়্যা খলীফাদের ব্যাপারেও এরূপ কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি যে ,তাঁরা ইরানীদের তাদের প্রকৃত ভাষার ক্ষেত্রে-ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত থাকলেও প্রচলিত মূল ভাষার ব্যাপারে-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন। তাই এ বিষয়ে যেরূপ দাবি করা হয়েছে তার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই ;বরং বুঝা যায় তাঁরা বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কল্পনাপ্রসূত এরূপ কথা বলেছেন। কোরআনের অর্থ ,শব্দ বিন্যাস এবং এর বিশ্বজনীন শিক্ষার আকর্ষণ বিশ্বের সকল মুসলমানকে এ ঐশী গ্রন্থের প্রতি অনুরাগী করেছে। ফলে তারা তাদের নিজ ভাষার ওপর কোরআনের ভাষাকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই বিষয়টি শুধু ইরানীদের ক্ষেত্রেই নয় ;বরং সকল মুসলমানের ক্ষেত্রেই ঘটেছিল এবং তারা তাদের নিজ ভাষাকে কোরআনের ভাষার বিপরীতে বিসর্জন দিয়েছিল। আমরা বারবার উল্লেখ করেছি যে ,যদি আব্বাসীয় খলীফাগণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরববিরোধী নীতি গ্রহণ না করতেন তবে বর্তমানে প্রচলিত ফার্সী ভাষার (যার সাথে ইসলামপূর্ব ফার্সীর পার্থক্য রয়েছে) উৎপত্তি হতো না। আব্বাসীয় খলীফাগণ ফার্সী ভাষার সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁরা কখনোই চাননি ,আরবী ভাষা ইরানের সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলন লাভ করুক। বনি আব্বাস আরববিরোধী শুয়ূবীয়া আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শুয়ূবী নেতা আলান আরবদের বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরে ব্যাঙ্গাত্মক গ্রন্থ রচনা করেন ,অথচ তিনি খলীফা হারুন ও মামুনের দরবারের কর্মচারী ও তাঁদের স্থাপিত জ্ঞানকেন্দ্রের অনুবাদকের দায়িত্বে ছিলেন এবং নিয়মিত মজুরি পেতেন। শুয়ূবী চরমভাবে আরববিদ্বেষী ছিলেন এবং আরবদের কটুক্তি করে গ্রন্থ রচনা করতেন। অথচ তিনি হারুন ও মামুনের স্থাপিত জ্ঞানকেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করতেন।356 পূর্বে ফার্সী ভাষা সম্পর্কিত আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি ,খলীফা মামুন প্রথম মুসলিম শাসক যিনি ফার্সী ভাষায় কবিতা রচনাকে উৎসাহিত করেছেন।

সুতরাং ইরানীদের প্রাচীন ফার্সীকে বাদ দিয়ে নতুন ফার্সী গ্রহণের বিষয়টি যাকে কোন কোন প্রাচ্যবিদ ইরানীদের বাকরুদ্ধ হওয়া বলে অভিহিত করেছেন- তা এ জাতির জন্য অনুশোচনার বিষয় নয় ;বরং খুশী হওয়ার মত বিষয়। প্রত্যেক ভাষারই নিজম্ব কিছু সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য রয়েছে ,ফার্সী ভাষাও এরূপ সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি ভাষা। এ ভাষার সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে ইরানীরা ঈমানের বলে ইসলামে মূল্যবান অবদান রেখেছে।

এ বিষয়টি মূল্যায়নে এডওয়ার্ড ব্রাউন ইনসাফ রক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন ,

ইরানের ইতিহাস বিষয়ে রচিত দু টি গ্রন্থ সম্পর্কে ব্রিটিশরা অধিক পরিচিত। যার একটি স্যার জন ম্যালকমের এবং অপরটি ক্রিমেনটেজ মার্কহাম রচিত। এ দু টি গ্রন্থে 1ম হিজরী শতাব্দীতে (সপ্তম খ্রিষ্টীয় শতাব্দী) আরবগণ কর্তৃক ইরান বিজয়ের সময়কাল হতে 3য় হিজরী শতাব্দীতে

(9ম খ্রিষ্ট শতাব্দী) ইরানীদের স্বাধীন ক্ষমতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালের ইরানের ইতিহাস সম্পর্কে যা আলোচনা করা হয়েছে তা অসম্পূর্ণ এবং বিষয়টিকে স্থূল দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে... অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এ সময়কালটি পূর্ববর্তী যে কোন সময়ের চেয়ে ইরানীদের জন্য উদ্দীপনাময় সময় ছিল এবং ইরানের ইতিহাসে জ্ঞান ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে এ সময়টিতে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল।

অন্যত্র তিনি সালমান ফার্সী সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন ,

সালমান ফার্সীই যিনি ইরানীদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে রাসূলের সম্মানিত ও বিশেষ সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের অনেক উচ্চ পর্যায়ের আলেম ইরানী বংশোদ্ভূত ছিলেন। আরবদের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে বন্দী কিছু ব্যক্তি ,যেমন জালুলা যুদ্ধে বন্দী ইবনে শিরীন ও তাঁর তিন ভ্রাতা ইসলামী বিশ্বে আলেম হিসেবে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তাই যে সকল ব্যক্তি বলে থাকেন আরবগণ কর্তৃক ইরান জয়ের পর দু শতাব্দী ধরে ইরানীরা জ্ঞান ও নৈতিকতা হতে বঞ্চিত ছিল সেটি কখনোই সত্য নয় ;বরং এর বিপরীতে ইসলামের অবির্ভাবের পরবর্তী দু তিন শতাব্দী ইরানীরা এ ক্ষেত্রে এতটা আকৃষ্ট হয়েছিল যা ইতিহাসে নজীরবিহীন। এ সময়কালটিকে নবীন ও প্রবীণ সভ্যতার মধ্যে সংমিশ্রণের যুগ বলা যায়। এ যুগটি প্রাচীন আচার ,বিশ্বাস ও চিন্তার পরিবর্তনের যুগ এবং কোন অবস্থায়ই একে মৃত্যু ,পতন বা নীরবতার যুগ বলা যায় না।

এ দু শতাব্দীর অন্যতম বিশেষত্ব হলো ইরানী মুসলমান ব্যক্তিত্বগণ তাঁদের জ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আশ্বর্যজনক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার পাশাপাশি দীনী দৃষ্টিতেও উচ্চ সম্মান ও মর্যাদায় পৌঁছেছিলেন। তাঁদের অনেকেই অন্যান্য জাতির নিকটও অতীব সম্মানার্হ ছিলেন। এখনও ইরানের বাইরের আহলে সুন্নাতের গ্রন্থসমূহে এ সকল ব্যক্তির নাম অতি সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয়ে থাকে। ইসলামী বিশ্বের দূরবর্তী দেশসমূহেও তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। এ যুগটি জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ের হলেও ধর্মীয় সম্মান লাভের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বলা যায় ইরানীরা এ সময়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হতে পেরেছিল।

যদি আমরা এ দু শতাব্দীর প্রকৃত মূল্যায়ন করতে চাই তবে অবশ্যই আমাদের ইরানে ইসলামের বিজয়ের সময়কাল হতে খোরাসানে ইরানীদের (তাহরিয়ান বংশ) স্বাধীন ক্ষমতা লাভ পর্যন্ত সময়কালের ইরানের সমাজকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

অবশ্য যে বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের অসচেতন হওয়া যাবে না তা হলো ইরানে সাফারিয়ান ও সামানিয়ান শাসনামলে যে সকল ইরানী মনীষী তাঁদের প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁদের সকলেই ইরানে বাস করতেন না। তাঁদের অনেকেই ইরাকে অথবা হেজাযে বসবাস করতেন।

ইরানীদের মধ্যে রাসূল (সা.)-এর নৈকট্য ও সাহচর্যের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি বিরল সম্মান লাভ করেছিলেন তিনি হলেন সালমান ফার্সী357 । তিনি শিয়া মুসলমানদের দৃষ্টিতে রাসূল ও হযরত আলীর শ্রেষ্ঠ সাহাবী এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে রাসূলের প্রথম সারির সাহাবীদের একজন । মসজিদে নববীর দেয়ালে প্রথম সারির অন্যান্য সাহাবীদের সাথে তাঁর নাম খচিত রয়েছে।

রাসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবী ছাড়াও ইরানের অন্যান্য প্রসিদ্ধ ব্যক্তিবর্গ এ দু শতাব্দীতে ইরান ও ইরানী জাতির জন্য যে সম্মান-মর্যাদা ও সম্ভাবনা বহন করে এনেছেন তা আলোচনা করলে দেখব প্রকৃতপক্ষেই ইরানের ইতিহাসে তা ছিল অভূতপূর্ব।

এ দু শতাব্দীতে একদল ইরানী কেরাআত ,তাফসীর ,হাদীস এবং ফিকাহ্শাস্ত্রে ধর্মীয়ভাবে এতটা উচ্চ স্থানে পৌঁছেছিলেন যে ,অন্যান্য জাতির মুসলমানরা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করত। বিশ্বের 55 কোটি সুন্নী মুসলমান তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে অনুসরণ করে। নাফে ,আসেম ,ইবনে কাসীর ,মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী ,মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ নিশাবুরী ,তাউস ইবনে কাইসান ,রাবীতুর রাঈ ,আমাশ ,আবু হানিফা ,লাইস ইবনে সা দ প্রমুখ এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের অন্তর্ভুক্ত। লাইস ইবনে সা দ একজন ইরানী ছিলেন যিনি মিশরের প্রধান মুফতির পদে অধিষ্ঠিত হন। একবার তিনি হজ্বব্রত পালন করতে এলে আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট ফকীহ্ সুফিয়ান সাওরী (যিনি একজন আদনানী আরব) তাঁকে সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে স্বহস্তে তাঁর উষ্ট্রের দড়ি টেনে এনে বাঁধেন।

এ দু শতাব্দীতে আরবী সাহিত্য ও ব্যাকরণশাস্ত্রে যে সকল ইরানী বিশেষ ভূমিকা রাখেন তাঁদের কয়েকজন হলেন সিবাভেই কেসায়ী ,ফাররা ,আবু ওবায়দা মুয়াম্মার ইবনে মুসান্না ,ইউনুস ,আখফাস ,হাম্মাদ রাভীয়া ,ইবনে কুতাইবা দীনওয়ারী। ঐতিহাসিকদের মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ,আবু হানিফা দীনওয়ারী এবং ফুতুহুল বুলদান গ্রন্থের লেখক বালাযুরীর নাম উল্লেখযোগ্য। কালামশাস্ত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আলে নাওবাখত ,আবুল হাজিল আলাফ ,নিযাম ,ওয়াসিল ইবনে আতা ,হাসান বসরী ,আমর ইবনে ওবায়িদ প্রমুখ। দর্শন ,গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যায় শাকের খাওয়ারেজমীর পুত্রগণ ,নাওবাখতিগণ ,আবু মা শার বালখী ,আবুত তায়্যিব সারাখসী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ইরানী মুসলিম সেনা নায়কদের মধ্যে তাহের যুল ইয়ামিনাইন এবং স্পেন বিজয়ী সেনাপতি মূসা ইবনে নাসিরের নাম উল্লেখযোগ্য। উপরোক্ত উদাহরণসমূহ এ দু শতাব্দীতে ইরানীদের নীরবতার তথাকথিত দাবিকেই খণ্ডন করছে।

সমাপ্ত