ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান5%

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান লেখক:
: এ.কে.এম. আনোয়ারুল কবীর
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইতিহাস

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 47 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 112196 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

ইসলাম ও ইরানের পারস্পরিক অবদান

লেখক:
প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে যখন ইসলাম আমাদের এ দেশে আসে তখন তা কিরূপ পরিবর্তন সাধন করে ? এ পরিবর্তনের ধারা কোন্ দিকে ছিল ? ইসলাম ইরান হতে কি গ্রহণ করেছে ও ইরানকে কি দিয়েছে ? ইরানে ইসলামের আগমন অনুগ্রহ ছিল নাকি বিপর্যয় ? বিশ্বের অনেক জাতিই ইসলামকে গ্রহণ করেছিল ও ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। তারা ইসলামের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছিল এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে‘ ইসলামী সভ্যতা’ নামে এক বৃহৎ ও আড়ম্বরপূর্ণ সভ্যতার সৃষ্টি হয়। এ সভ্যতার সৃষ্টিতে ইরানীদের অবদান কতটুকু ? এ ক্ষেত্রে ইরানীদের অবস্থান কোন্ পর্যায়ে ? তারা কি এ ক্ষেত্রে প্রথম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল ? ইসলামের প্রতি তাদের এ অবদান ও ভূমিকার পেছনে কোন্ উদ্দীপনা কাজ করেছিল ? অত্র গ্রন্থের আলোচনাসমূহ এ প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর পেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।


1

2

শিয়া মাযহাব

প্রথম যখন ইরানীরা ইসলাম গ্রহণ করে তখন হতেই তারা নবী (সা.)-এর পরিবার ও বংশের প্রতি বিশেষ ভালবাসা ও ভক্তি প্রদর্শন করেছে।

কোন কোন প্রাচ্যবিদ তাদের এ ভক্তি-ভালবাসাকে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কারণে বলে মনে করেন নি ;বরং একে ইসলাম অথবা আরব জাতীয়তার বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রাচীন ধর্ম ও রীতিকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস হিসেবে দেখেছেন এবং একে ইরানীদের কৌশল ও প্রতিক্রিয়ার ফল বলে মনে করেছেন।

প্রাচ্যবিদদের এ বক্তব্য দু শ্রেণীর মানুষের জন্য বাহানা উপস্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছে :

প্রথম শ্রেণী হলো গোঁড়া সুন্নীরা যারা এর মাধ্যমে শিয়াদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত একদল কৃত্রিম মুসলমান বলে প্রচারের প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং এর ওপর ভিত্তি করে শিয়াদের ওপর হামলা করেছে। যেমন মিশরীয় লেখক আহমাদ আমিন তাঁর ফাজরে ইসলাম গ্রন্থে এরূপ করেছেন। বিশিষ্ট শিয়া আলেম মুহাম্মদ হুসাইন কাশেফুল গেতা এ মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে আসলুশ্ শিয়া ওয়া উসূলুহা নামক এক যুক্তিনির্ভর ও বলিষ্ঠ গ্রন্থ রচনা করেছেন।

দ্বিতীয় শ্রেণী হলো তথাকথিত ইরানী জাতীয়তাবাদীরা। প্রথম দলের বিপরীতে এরা ইরানীদের এ জন্য প্রশংসা করে থাকে যে ,তারা শিয়া মতাদর্শের আবরণে তাদের প্রাচীন ধর্মকে সংরক্ষণ করতে পেরেছে। যেমন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা হতে প্রকাশিত ডক্টর পারভেজ সানেয়ী রচিত কানুন ওয়া শাখসিয়াত গ্রন্থের ১৫৭ পৃষ্ঠায় আমাদের স্কুলগুলোর ইতিহাস গ্রন্থসমূহ অগভীর চিন্তাপ্রসূত ও বেশ শুষ্ক হয়ে পড়ার সমালোচনা করে একে সজীব ও বিশ্লোষণধর্মী গভীরতা দানের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে :

যেমন ইসলামে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যে পার্থক্যের বিষয়ে ইতিহাসে আমাদের শিখানো হয়েছে ইরানীরা হযরত আলী (আ.)-এর পন্থাবলম্বন করেছে শিয়া ও সুন্নীদের মধ্যকার বিভেদের সূত্র ধরে। আর তা হলো আমরা হযরত আলীকে প্রথম খলীফা মনে করি। আর সুন্নীরা তাঁকে চতুর্থ খলীফা বলে বিশ্বাস করে। শিয়া-সুন্নী পার্থক্যের বিষয়ের মূলকে বিশ্লেষণ না করে এভাবে উপস্থাপন করে অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে প্রধান্য দান করা হয়েছে ,অথচ পার্থ্যক্যের এ ভিত্তি অযৌক্তিক বলে মনে হয়। স্কুল ত্যাগের অনেক বছর পর আমি নিজে অধ্যয়ন করে বুঝতে পারলাম শিয়া মাযহাব ইরানীদের আবিষ্কার। ইরানীরা তাদের স্বাধীনতা ও প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে এর জন্ম দেয়। যেহেতু ইমাম হুসাইন (আ.) ইরানের সর্বশেষ বাদশার কন্যাকে বিয়ে করেন সেহেতু তাঁর সন্তানরা বংশ পরম্পরায় শাহজাদা হিসেবে ইরানী শাসনেরই গৌরবময় ধারাবাহিকতা। ইমাম হুসাইনের সন্তানদের যে সাইয়্যেদ ৩৪ বলা হয় তা ফার্সী ভাষার শাহজাদা শব্দের সমার্থক।

ইরানীদের এ আবিষ্কার তাদের জাতীয়তাকে সংরক্ষণের লক্ষ্যেই ছিল। ইরানের প্রাচীন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানই শিয়া মাযহাবে অনুপ্রবেশ করেছে। শিয়া মাযহাবের সঙ্গে প্রাচীন ইরানী ধর্মীয় ঐতিহ্যের তুলনার মাধ্যমে আমরা এটি বুঝতে পারব। অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা জানতে পারব প্রাচীন ইরানী ধর্ম (যারথুষ্ট্রবাদ) কিভাবে শিয়া মাযহাবের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে।

প্রায় একশ বছর পূর্বে কান্ট গোবিনু মধ্য এশিয়ার ধর্ম ও দর্শন নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র ইমামদের নিস্পাপ হওয়ার বিশ্বাসকে সামানী সম্রাটদের ঐশী হওয়ার বিশ্বাস হতে উৎসারিত বলে উল্লেখ করেছেন এবং ইমাম হুসাইনের সঙ্গে ইরানী শাহজাদী শাহের বানুর বিবাহের কারণে তাঁর বংশধারা এ পবিত্রতা লাভ করেছে বলে প্রচার করেছেন।

এডওয়ার্ড ব্রাউনও গোবিনুর এ মতকে সমর্থন করে বলেছেন ,

আমি বিশ্বাস করি গোবিনু সঠিক বলেছেন। যেহেতু ইরানীরা রাজকীয় ক্ষমতা স্রষ্টার ঐশী দান ও অধিকার বলে মনে করত যা সাসানীদের হাতে তিনি গচ্ছিত রেখেছিলেন ,এ বিশ্বাস পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইরানের ইতিহাসে ব্যাপক প্রভাব রেখেছিল। বিশেষত শিয়া মাযহাবের প্রতি ইরানীদের ঝুঁকে পড়ার পেছনে এ বিশ্বাসের প্রভাব খুবই বেশি ছিল। রাসূলের ঐশী স্থলাভিষিক্ত বা খলীফা নির্বাচিত হওয়াটাই গণতান্ত্রিক আরবদের নিকট স্বাভাবিক ছিল। এর বিপরীতে শিয়াদের নিকট এটি অস্বাভাবিক ও নিদারুণ বিরক্তির কারণ ছিল। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর কর্তৃক ইরান সাম্রাজ্য ধ্বংসের কারণে শিয়াদের নিকট অপছন্দীয় ছিলেন। তাঁর প্রতি ইরানীদের অসন্তুষ্টিই যে একটি মাযহাবরূপে আবির্ভূত হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইরানীদের বিশ্বাস নবীর কন্যা হযরত ফাতিমার কনিষ্ট সন্তান হুসাইন ইবনে আলী সর্বশেষ সাসানী শাসক ইয়ায্দ গারদের কন্যাকে বিয়ে করেন। তাই শিয়াদের বড় দু টি দলই (বার ইমামী ও ইসমাঈলী) শুধু নবুওয়াতের সম্মান ও মর্যাদার অধিকারীই নয় ,সে সাথে রাজকীয় মর্যাদারও প্রতিনিধিত্ব করে। কারণ এতে দু বংশধারার সমন্বয় ঘটেছে: নবুওয়াত ও সাসানী অভিজাত।

কিছু সংখ্যক প্রাচ্যবিদ এবং ইরানীও এ ধরনের বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং শিয়া মাযহাবের উৎপত্তির উৎস সম্পর্কে এরূপ মন্তব্য করেছেন। এটা স্পষ্ট যে ,এ বিষয়ে আলোচনার জন্য পৃথক গ্রন্থ রচনার প্রয়োজন। তবে আমরা এখানে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু বিষয় তুলে ধরছি।

ইমাম হুসাইনের সঙ্গে ইয়ায্দ গারদের কন্যার বিবাহের ঘটনা এবং এ দম্পতি হতে ইমাম সাজ্জাদের (জয়নুল আবেদীনের) জন্মের মাধ্যমে আহলে বাইতের ইমামদের ধারার উৎপত্তি তথা নবুওয়াতের পরিবারের সঙ্গে সাসানী রাজবংশের আত্মীয়তার বানোয়াট ঘটনা স্বার্থন্বেষী কিছু ব্যক্তির হাতে এমন এক হাতিয়ার তুলে দিয়েছে যা ইমামদের প্রতি শিয়াদের বিশ্বাসকে সাসানী সম্রাট ফাররাহে ইয়াযাদীর প্রতি বিশ্বাসের ফলশ্রুতি বানিয়ে ছেড়েছে। কারণ সাসানী সম্রাটগণ নিজেদেরকে স্বর্গীয় বংশধারার এবং মানুষের ঊর্ধ্বে প্রায় খোদায়ী মর্যাদার সমতুল্য মনে করত। যারথুষ্ট্র ধর্মও তাদের এ চিন্তাকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা করত।

জানা গেছে ,সাসানী শাসক আরদ্শিরের পুত্র শাপুরের আমলের পাহলভী ভাষায় লিখিত একটি পাণ্ডুলিপি হাজীআবাদে পাওয়া গিয়েছে যাতে লেখা রয়েছে :

“‘ ইরান ও অ-ইরানের সম্রাট শাপুর মিনুসেরেশত ইয়ায্দানের পক্ষ হতে মনোনীত ,তাঁর স্বর্গীয় পুত্র মাসদার উপাসক আরদ্শির মিনুসেরেশত ইয়ায্দানের পক্ষ হতে মনোনীত ,তাঁর স্বর্গীয় প্রপৌত্র ববাকও ইয়ায্দানের পক্ষ হতে মনোনীত। ৩৫

যেহেতু সাসানী সম্রাটগণ নিজেদের স্বর্গীয় অবস্থান ও মর্যাদায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং পবিত্র ইমামগণের বংশধারাও তাঁদের সঙ্গে মিশে যায় সেহেতু তাঁরা ও তাঁদের অনুসারীরা সকলেই ইরানী বংশোদ্ভূত হিসেবে স্বর্গীয় হতে বাধ্য। এ দু প্রতিজ্ঞা পাশাপাশি রাখলে সহজেই বোঝা যায় ,পবিত্র ইমামদের নেতৃত্বের বিষয়ে বিশ্বাস ইরানীদের প্রাচীন বিশ্বাসেরই ধারাবাহিকতা।

আমরা এখানে সংক্ষেপে এ দাবির অসাড়তা ও ভিত্তিহীনতা প্রমাণ করব। প্রথমে বলে রাখি এখানে দু টি বিষয় রয়েছে যে দু টিকে পার্থক্য করা উচিত। প্রথমত এটি প্রকৃতিগত ও স্বাভাবিক। কোন জাতি যদি পূর্বে বিশেষ কোন চিন্তাধারা ও ধর্মের অনুসরণ করে পরে তা পরিবর্তন করে তবে তাদের অজান্তেই পূর্ববর্তী আকীদা-বিশ্বাসের কিছু বিষয় চলে আসে। হয়তো নতুন গৃহীত ধর্ম ও বিশ্বাসের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা রয়েছে এবং আন্তরিকভাবেই তা গ্রহণ করেছে ,পূর্ববর্তী বিশ্বাসের প্রতি তার কোন গোঁড়ামি ও এর ধারবাহিকতার চিন্তাও সে করে না ,কিন্তু তদুপরি তার চিন্তাশক্তি হতে প্রাচীন বিশ্বাসের কিছু বিষয় মুছে যায়নি এবং অসচেতনভাবেই সেগুলোকে সে নতুন ধর্ম ও বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে।

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই ,যে সকল জাতি ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের কেউ পূর্বে মূর্তিপূজক ,কেউ দ্বিত্ববাদী ,কেউ খ্রিষ্টান ,ইহুদী বা মাজুসী ছিল। তাই সম্ভাবনা রয়েছে কোন কোন ক্ষেত্রে তদপূর্ববর্তী চিন্তা ও বিশ্বাসসমূহ ইসলাম গ্রহণের পরও তাদের মধ্যে বর্তমান থাকার।

নিশ্চিত বলা যায় ইরানিগণও কোন কোন বিশ্বাসকে ইসলাম গ্রহণের পরও তাদের অজান্তেই সংরক্ষণ করেছে। দুঃখজনকভাবে কিছু সংখ্যক ইরানীর মধ্যে পূর্ববর্তী সময়ের কুসংস্কার এখনও বর্তমান রয়েছে ,যেমন বছরের শেষ বুধবার আগুনের ওপর দিয়ে লাফ দেয়া অথবা আগুনের দিকে তাকিয়ে প্রতিজ্ঞা করা ইত্যাদি। এটি আমাদের দীনী দায়িত্ব ,নিখাঁদ ইসলামের মূল মানদণ্ডের ভিত্তিতে জাহেলী যুগের সকল চিন্তাধারাকে দূর করার।

নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের ইমামত (নেতৃত্ব) ও বেলায়েতের (অভিভাবকত্ব) বিষয়টি যদি আমরা অধ্যয়ন করতে চাই তাহলে আমাদের অবশ্যই কোরআন ও রাসূলুল্লাহর অকাট্য সুন্নাতের প্রতি প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তবেই আমাদের নিকট স্পষ্ট হবে অন্যান্য জাতি ও গোষ্ঠীর ইসলাম আনয়নের পূর্বেও ইসলামে এ বিষয়টি ছিল কি না ?

পবিত্র কোরআন ও রাসূলুল্লাহর অকাট্য সুন্নাহ্ হতে হয় স্পষ্ট যে ,প্রথমত কোরআন কোন কোন সত্যপন্থী সৎ কর্মশীল বান্দাকে ঐশীভাবে নেতৃত্বের জন্য মনোনীত করেছেন। দ্বিতীয়ত কোরআন কোথাও কোথাও সুস্পষ্টভাবে আবার কোথাও ইশারা-ইঙ্গিতে ইমামত ও বেলায়েতের বিষয় দু টিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে। সে সাথে রাসূলও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের এরূপ মর্যাদার ঘোষণা দিয়েছেন।

আরব মুসলমানগণ অন্যান্য জাতির ওপর শাসন কর্তৃত্ব লাভ করার অনেক পূর্বেই ইসলামে এ বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন কোরআনের সূরা আলে ইমরানের ৩৩-৩৪ নং আয়াতে এসেছে:

) إنّ الله اصطفى آدم و نوحاً و آل إبراهيم و آل عمران على العالمين ذرّيّة بعضها من بعض و الله سميع العليم(

নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ আদম ,নূহ ,ইবরাহীম ও ইমরানের বংশধরকে নির্বাচিত করেছেন। যাঁরা বংশধর ছিলেন পরস্পরের। আল্লাহ্ শ্রবণকারী ও মহাজ্ঞানী। (তাই তিনি মুহাম্মদ (সা.)-এর বংশধর হতেও নির্বাচন করবেন। এটিই স্বাভাবিক ,নয় কি ? কারণ তিনি পূর্ববর্তীদের হতে শ্রেষ্ঠ)।

সুতরাং শিয়া মাযহাবের মূল ভিত্তি কোরআন ও নির্ভরযোগ্য হাদীস এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ থাকলেও যেহেতু আমাদের মূল আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় সেহেতু এতে প্রবেশ করতে চাই না। আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় হলো শিয়া মাযহাবের সঙ্গে ইরানীদের সম্পর্ক। কোন কোন প্রাচ্যবিদ ও তাদের এ দেশীয় অনুচররা শিয়া মাযহাব ইরানীরা উদ্ভাবন করেছে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাতে করে এ মাযহাবের ছত্রছায়ার তার প্রাচীন আচার ও ধর্মনীতিকে সংরক্ষণ করা যায় বলে যে দাবি করেছেন এখানে আমরা তার জবাব দেব।

আরেক দল প্রাচ্যবিদ যাঁরা বলেন ইরানীরা শিয়া মাযহাব তৈরি করেনি ;বরং সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হওয়ার ফলশ্রুতিতে প্রতিরোধ হিসেবে এ মতাদর্শ গ্রহণ করেছে যাতে করে প্রাচীন বিশ্বাসকে এর ছায়ায় টিকিয়ে রাখা যায়-এ দৃষ্টিকোণ হতেও আমরা বিষয়টি আলোচনা করব।

এ বিষয় দু টি আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনার ওপর নির্ভরশীল যেখানে আমরা ইরানীদের ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি জবরদস্তিমূলক নাকি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত তা বিশ্লেষণ করেছি। যদি এটি সত্য হতো ,ইরানীরা বাধ্য হয়ে পূর্ববর্তী ধর্ম পরিত্যাগ করেছে ও ইসলাম গ্রহণ করেছে তবে এরূপ ধারণা স্বাভাবিক ছিল যে ,তারা পূর্ববর্তী বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার জন্য এরূপ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু যখন প্রমাণিত হয়েছে আরব মুসলমানগণ কখনই ইরানীদের পূর্ববর্তী ধর্ম পরিত্যাগে বাধ্য করেনি ;বরং অনুমতি দিয়েছিল তাদের অগ্নিমন্দিরগুলো সংরক্ষণের ;এ জন্য যে ,আহলে কিতাবগণ (ইহুদী ,খ্রিষ্টান ,সাবেয়ী ,মাজুসী) জিম্মি হিসেবে মুসলমানদের অধীনে থাকায় আরবগণ তাদের উপাসনালয়ের সংরক্ষণকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করত। তা ছাড়াও ইরানে বসবাসকারী কিছু সংখ্যক আরবের পক্ষে সম্ভব ছিল না কয়েক মিলিয়ন মানুষকে তাদের দীন পরিত্যাগে বাধ্য করা। কারণ সংখ্যায় যেমন তারা স্বল্প ছিল তেমনি যুদ্ধ সরঞ্জাম ও অন্যান্য দিক হতেও তারা ইরানীদের থেকে দুর্বল ছিল (আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি ১৭০ হিজরীতে আব্বাসী খলীফা মামুনের শাসনামলে মুসলিম সেনা বাহিনীর বৃহদাংশ ইরানীদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল)। তাই আরবদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাদের পূর্ববর্তী দীন পরিত্যাগে বাধ্য করা। তাহলে ইরানীদের কি প্রয়োজন ছিল পূর্ববর্তী ধর্মকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বাহ্যিকভাবে ইসলাম প্রকাশ করার বা শিয়া মাযহাবের আশ্রয় নেয়ার ?

তদুপরি আমরা পূর্বে প্রমাণ করেছি ইরানীদের ইসলাম গ্রহণ মন্থর প্রক্রিয়ায় হয়েছিল। ইরানীদের অন্তরে পবিত্র ইসলামের গভীর প্রভাব এবং যারথুষ্ট্র ধর্মের ওপর ইসলামের বিজয় ইরানীদের স্বাধীনতা অর্জনের পর ঘটেছিল। তাই এ অনর্থক কথার কোন মূল্য নেই।

স্বয়ং এডয়ার্ড ব্রাউন তাঁর গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন ,ইরানীরা ইসলাম ধর্মকে সাগ্রহে ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করেছে। যেমন তাঁর সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের ২৯৭ পৃষ্ঠায় বলেছেন ,

যারথুষ্ট্র ধর্মের ওপর ইসলামের বিজয়ের বিষয়ে গবেষণা চালানো সাসানীদের ভূখণ্ডের ওপর আরবদের বিজয় নিয়ে গবেষণা অপেক্ষা কঠিন। অনেকে ভেবে থাকেন মুসলিম যোদ্ধারা তাদের বিজিত ভূমিগুলোর অধিবাসীদের কোরআন ও তরবারীর মাঝে যে কোন একটি বেছে নেয়ার নির্দেশ দিত। কিন্তু এটি সঠিক নয়। কারণ ইহুদী ,গোবার৩৬ ও তারসাগণ৩৭ স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করত। তারা শুধু জিজিয়া দিতে বাধ্য ছিল। এটি করা ন্যায়সঙ্গতই ছিল। কারণ অমুসলিমগণ মুসলমানদের ন্যায় যুদ্ধে অংশ গ্রহণ ,যাকাত ও খুম্স দেয়া হতে মুক্ত ছিল।

একই গ্রন্থের ৩০৬ ও ৩০৭ পৃষ্ঠায় যারথুষ্ট্র ধর্মের বিলুপ্তির পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছেন ,

প্রথম দিকে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত কম ছিল। কারণ ইসলামের বিজয়ের পর সাড়ে তিনশ বছর পর্যন্ত ইরানীরা বিজয়ী শাসকদের মহানুভবতা ও সহনশীলতার অনুগ্রহ লাভ করেছিল যা এ সত্যকে প্রমাণ করে যে ,ইরানিগণ শান্ত পরিবেশে পর্যায়ক্রমে তাদের পূর্ববর্তী ধর্ম ত্যাগ করেছে।

এডওয়ার্ড ব্রাউন হল্যান্ডের প্রাচ্যবিদ দুজীর ইসলাম গ্রন্থ হতে উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জাতি ধর্মান্তরিত হয় তা হলো ইরানী। কারণ আরব নয় ,ইরানীরাই ইসলামকে দৃঢ় ও মুজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে ,তাদের মধ্য হতেই আকর্ষণীয় এক মাযহাবের সৃষ্টি হয়েছে।

ইরানীরা ইসলামের প্রতি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা এতটা ভালবাসায় পূর্ণ ছিল যে ,এটি বলার কোন সুযোগ নেই ,তারা শিয়া মাযহাবের আবরণে তাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তা করেছে।

আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি ইরানীদের পরাজয়ের অন্যতম বড় কারণ ছিল শাসক ও প্রচলিত ধর্মের প্রতি তাদের অসন্তুষ্টি ও অনাস্থা। সাধারণ মানুষ তাদের শাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ,তারা শান্তির আশ্রয় খুঁজছিল এবং সত্য ও ন্যায়ের ধ্বনি শ্রবণের অপেক্ষায় ছিল। ইতোপূর্বে মাযদাকী ধর্মের প্রতি তাদের ঝুঁকে পড়ার কারণও এটিই ছিল। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি ,বিচ্যুত ও অনাচারক্লিষ্ট যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রতি তারা এতটা অসন্তষ্ট ছিল যে ,যদি ইরানে ইসলাম না আসত তবে খ্রিষ্টধর্ম ইরান দখল করত।

দুজির উদ্ধৃতি দিয়ে ব্রাউন আরো বলেছেন ,

সপ্তম শতাব্দীর প্রথমাংশে (৬০০-৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ) পূর্ব রোম ও পারস্যে রাজকীয় শাসক স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। এ দু সাম্রাজ্য পশ্চিম এশিয়ার ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো দখলের লক্ষ্যে সব সময় যুদ্ধরত থাকত। বাহ্যিকভাবে এ দু সাম্রাজ্যের উন্নয়ন ঘটেছিল। তাদের রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর ও মুনাফা আহরিত হতো ,দু সাম্রাজ্যের রাজধানীর জাঁকজমক ও সৌন্দর্য প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছিল। স্বৈরাচার উভয় সাম্রাজ্যের মেরুদণ্ডকে ন্যুব্জ করে ফেলেছিল। এতদু ভয়ের ইতিহাসই মানব শোষণের মর্মান্তিকতায় পূর্ণ। জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় বিভেদ ও দ্বৈততার ফলশ্রুতিতে এ জুলুম তুঙ্গে উঠেছিল। এমন সময় আকস্মিকভাবে মরুভূমির মধ্য হতে এক অপরিচিত জাতি বিশ্বের বুকে জাগরিত হলো। ঐ সময় পর্যন্ত যে জাতি বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ও পরস্পর বিরোধ ও যুদ্ধে রত ছিল প্রথম বারের মত পরস্পর একত্র হয়ে অভিন্ন এক জাতির আকারে আবির্ভূত হলো।

স্বাধীনতা পিয়াসী এ জাতিটি সাধারণ পোশাক পরিধান করত , সাধারণ খাদ্য গ্রহণ করত , খোলা মনের , অতিথিবৎসল , ফুর্তিবাজ ও রসিক , অথচ আত্মগর্বী ও রগচটা প্রকৃতির এবং যখন তার ক্রোধ বৃদ্ধি পায় তখন চরম অত্যাচারী ও শান্তি বিরোধীতে পরিণত হয়। এরূপ একটি জাতিই কিছু দিনের মধ্যে প্রাচীন ও ক্ষমতাধর কিন্তু অন্তঃক্ষয়প্রাপ্ত ইরানকে পদানত করে , কনস্টানটাইনের ( constantine)উত্তরাধিকারীদের ( রোমীয়দের ) হতে সবচেয়ে সুন্দর প্রদেশ

হস্তগত করে। স্পেন দখল করে ইউরোপীয় অন্যান্য দেশ ,যেমন নতুন প্রতিষ্ঠিত জার্মানদের প্রতি হুমকির সৃষ্টি করল ,পূর্ব দিকেও হিমালয় পর্বত পর্যন্ত অঞ্চল তাদের পদানত হলো। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যজয়ী জাতির সঙ্গে এদের কোন সাদৃশ্য ছিল না। কারণ তারা নতুন ধর্ম সঙ্গে নিয়ে এসেছিল এবং অন্যান্য জাতিকে তা গ্রহণের আহ্বান জানাত। ইরানের প্রচলিত দ্বিত্ববাদ ও পতনশীল খ্রিষ্ট মতবাদের বিপরীতে এরা নিখাঁদ একত্ববাদের দিকে আহ্বান জানাত। বর্তমান সময়েও ইসলাম পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ধর্ম যার অসংখ্য অনুসারী রয়েছে ;পৃথিবীর এক দশমাংশ মানুষ এ ধর্মের অনুসারী।

এডওয়ার্ড ব্রাউন তাঁর প্রাগুক্ত গ্রন্থের ১৫৫ পৃষ্ঠায় পারসিকদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ আভেস্তা সম্পর্কে বলেছেন , আভেস্তা যারথুষ্ট্রের (যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তা) ধর্মীয় বিশ্বাস ও চিন্তাধারা এবং প্রাচীন ধর্মের বিধিবিধান সম্বলিত গ্রন্থ। এ গ্রন্থ বিশ্ব ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যদিও বর্তমানে এ ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ইরানে দশ হাজার এবং ভারতবর্ষে নব্বই হাজারের অধিক নয়। কিন্তু এ ধর্ম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল ও গভীর প্রভাব রেখেছে। আভেস্তাকে কোন আনন্দদায়ক গ্রন্থ বলা যায় না এবং এর বিভিন্ন অংশ সন্দেহযুক্ত বিবরণে পূর্ণ তদুপরি হয়তো গভীর অধ্যয়নে এর মূল্য ও মর্যাদা অনুধাবন করা যাবে। কিন্তু কোরআনের ক্ষেত্রে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় ,এ গ্রন্থ অত্যন্ত সাবলীল ও যত অধিক অধ্যয়ন করা যায় এর গূঢ় অর্থও তত অনুধাবন করা যায় ,ততই এর মর্যাদা স্পষ্ট হয়। এর বিপরীতে আভেস্তা দ্রুত অনুধাবনযোগ্য নয় ;বরং এর অধ্যয়ন ক্লান্তিকর ,তবে যদি কেউ ভাষাবিদ হিসেবে পৌরাণিক বিষয়াবলী অধ্যয়ন করতে চান তাঁর কথা ভিন্ন।

এডওয়ার্ড ব্রাউন যা বলেছেন সকল ইরানীও তা বলেন এবং এটিই সত্য ,ইরানিগণ শতাব্দী ক্রমে দলে দলে আভেস্তাকে পরিত্যাগ করে কোরআনকে ধারণ করেছে। আভেস্তা থেকে কোরআনের দিকে ঝুঁকে পড়া ইরানীদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সাধারণ ছিল। তাই প্রাক্তন সম্রাটদের রীতিনীতি ও আভেস্তার শিক্ষাকে সংরক্ষণের জন্য নিজেদের শিয়া মাযহাবের আড়ালে লুকিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন ছিল না।

দ্বিতীয়ত সাসানী সম্রাট ইয়ায্দ গারদ রাজধানীতে প্রতিরোধে সক্ষম নয় বুঝতে পেরে তাঁর পরিবার ও সভাসদদের নিয়ে প্রদেশ হতে প্রদেশ ও শহর হতে অন্য শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন (যদিও তাঁর রাজধানীতে ও প্রাসাদে সহস্র প্রহরী ,শিকারী কুকুর ,সহস্র গায়ক ,পাচক ,খেদমতগার ,দাস-দাসী ছিল তবুও সেখানে নিরাপত্তা বোধ করেননি)। অবশ্যই রাজধানী ও এর নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরা চাইলে আক্রমণকারী আরব মুসলমানদের প্রতিরোধ করতে পারত। কিন্তু এর বিপরীতে তারা সম্রাটকে সহযোগিতা ও আশ্রয় দেয়নি। ফলে তিনি খোরাসানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানেও তাঁকে কেউ সহায়তা না করায় একটি ঘানি কলে আশ্রয় নেন এবং সেখানে ইরানীরাই (সীমান্ত রক্ষীরা) তাঁকে হত্যা করে।

কিরূপে সম্ভব ,যে ইরানীরা ইয়ায্দ গারদকে আশ্রয় দেয়নি ,তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে নবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে তাদের মনের মণিকোঠায় আশ্রয় দেবে ? কিরূপে সম্ভব এ কারণে নবীর বংশধরদের জন্য নিজেদের উৎসর্গের প্রস্তুতি নেবে ?

তৃতীয়ত যদি ধরেও নেই ইরানীরা প্রথম হিজরী শতাব্দীতে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়েছিল তাই শিয়া বিশ্বাসের অন্তরালে নিজ বিশ্বাসকে গোপন করেছিল । তবে কেন তারা দ্বিতীয় শতাব্দীর পরে স্বাধীনতা লাভ করার পর স্বীয় বিশ্বাসকে প্রকাশ করে নি ? বরং পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে নিজেদের ইসলামের মধ্যে অধিকতর নিমজ্জিত করেছে এবং পূর্ববর্তী ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদকে আরো ত্বরান্বিত করেছে।

চতুর্থত ইরানের প্রতিটি মুসলমান জানে শাহর বানু (ইমাম সাজ্জাদের মাতা)-এর মর্যাদা কোন ক্রমেই অন্যান্য ইমামদের মাতাদের চেয়ে যাঁরা কেউ আরব ,কেউ আফ্রিকান ছিলেন ,অধিক নয়। কোন্ ইরানী ও অ-ইরানী শিয়া ইমাম সাজ্জাদের মাতার প্রতি অন্য ইমামদের মাতাদের চেয়ে অধিকতর সম্মান দেখায় ? ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর মাতা হযরত নারজেস খাতুন যিনি একজন রোমীয় দাসী ছিলেন তাঁর মর্যাদা শিয়াদের নিকট শাহর বানু অপেক্ষা অনেক বেশি।

পঞ্চমত ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ হতে ইমাম হুসাইনের সঙ্গে শাহর বানুর বিবাহ এবং ইরানী শাহজাদা হিসেবে ইমাম সাজ্জাদের জন্মের ঘটনা অপ্রমাণিত। আহলে বাইতের ইমামদের সঙ্গে সাসানী রাজবংশের সম্পর্কের ঘটনাটি নিম্নোক্ত কাহিনীর মতো: এক ব্যক্তি বলল , ইমাম পুত্র ইয়াকুবকে মসজিদের মিনারের ওপর নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলে। অন্য একজন বলল , না ,না। ইমামপুত্র নয় ,নবীর পুত্র ,ইয়াকুব নয় ,ইউসুফ ছিলেন ,মিনারের ওপর নয় কেনানের গর্তে। মূল কথা ঘটনাটিই মিথ্যা। আসলে ইউসুফকে কোন নেকড়েই খায়নি।

এখানে প্রকৃতপক্ষে ইয়ায্দ গারদের শাহর বানু অথবা ভিন্ন নামে কোন কন্যা ছিল কিনা বা ইমাম হুসাইনের সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমেই তিনি ইমাম সাজ্জাদের মাতৃত্ব অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন কিনা সম্পূর্ণ ঘটনাটি ঐতিহাসিক দলিলের ভিত্তিতে সন্দেহযুক্ত একটি বিষয়। বলা হয়ে থাকে ,সকল ঐতিহাসিকের মধ্যে একমাত্র ইয়াকুবী এ সম্পর্কে একটি বাক্য বলেছেন। আর তা হলো: আলী ইবনুল হুসাইনের মাতার নাম ছিল হাররার যিনি ইয়ায্দ গারদের কন্যা এবং ইমাম হুসাইন তাঁর নাম পরিবর্তিত করে গাযালাহ্ রাখেন।

স্বয়ং এডওয়ার্ড ব্রাউন এ ঘটনাকে বানোয়াট বলে মনে করেন। ক্রিস্টেন সেনও বিষয়টি অপ্রমাণিত মনে করেন। সাঈদ নাফিসী তাঁর ইরানের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে একে কল্পকাহিনী ছাড়া কিছু মনে করেন নি। এখন যদি ধরে নিই ইরানীরাই এ কাহিনী তৈরি করেছে তবে অবশ্যই তা দু শ বছর পর তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ ইরানীদের স্বাধীন শাসন কর্তৃত্ব লাভের সময়কালে এবং শিয়া মাযহাবের উৎপত্তিরও দু বছর পর।

এখন আমরা কি করে বলতে পারি আহলে বাইতের ইমামগণ শাহজাদা হওয়ার কারণেই ইরানীরা শিয়া মাযহাবের প্রতি ঝুঁকেছিল ?

ইয়ায্দ গারদের কন্যার সঙ্গে ইমাম হুসাইনের বিবাহের ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে সত্য প্রমাণিত না হলেও কিছু কিছু হাদীসে এ ঘটনাকে সত্য বলা হয়েছে। তন্মধ্য উসূলে কাফী র এ হাদীসটি যেখানে বলা হয়েছে: খলীফা উমরের শাসনামলে ইয়ায্দ গারদের কন্যাকে মদীনায় আনা হলে খলীফা উমর হযরত আলী (আ.)-এর পরামর্শে তাঁকে মুক্ত ঘোষণা করেন এবং যে কোন যুবককে বেছে নেয়ার পরামর্শ দিলে তিনি ইমাম হুসাইনকে বেছে নেন।

কিন্তু ইতিহাসের সঙ্গে এ হাদীসের বক্তব্যের সাদৃশ্য নেই এবং এর সনদে এমন দু জন রাবী রয়েছে যারা নির্ভরযোগ্য নয়। তাদের একজন ইবরাহীম ইবনে ইসহাক আহ্মারীকে রেজালশাস্ত্রবিদগণ ধর্মীয় বিষয়ে অভিযুক্ত মনে করেন ও তার হাদীসকে অনির্ভরযোগ্য বলেছেন। অপরজন হলেন আম্মার ইবনে শিমার যাকে হাদীসশাস্ত্রবিদগণ মিথ্যুক ও হাদীস জালকারী বলেছেন।

আমার জানা নেই এ সম্পর্কিত অন্যান্য হাদীসও অনুরূপ কি না ? তবে এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীসসমূহের যথার্থ পর্যালোচনা ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

ষষ্ঠত যদি সাসানী বংশধারার সঙ্গে রক্ত সম্পর্কের কারণেই ইরানীরা আহলে বাইতের ইমামদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে তবে উমাইয়্যা বংশীয়দের প্রতিও তাদের সম্মান দেখান উচিত। কারণ এমনকি যে সকল ঐতিহাসিক ইয়ায্দ গারদের কন্যা শাহর বানুর সঙ্গে ইমাম হুসাইনের বিবাহকে অস্বীকার করেন তাঁরাও এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন ,উমাইয়্যা শাসক ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের সময় সংঘটিত এক যুদ্ধে ইয়ায্দ গারদের এক নাতনী শাহ আফরিদ কুতাইবা ইবনে মুসলিমের হাতে বন্দী হন। তখন ওয়ালিদ তাঁকে বিবাহ করে এবং উমাইয়্যা খলীফা ইয়াযীদ ইবনে ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিকের জন্ম হয়। এই উমাইয়্যা খলীফাকে অপূর্ণ ইয়াযীদ বলা হয়ে থাকে। উমাইয়্যা শাসকরাও এ ক্ষেত্রে ইরানী শাহজাদা হওয়ার কারণে ইরানীদের উচিত উমাইয়্যা শাসকদেরও সম্মান করা।

তবে কেন ইরানীরা ইয়ায্দ গারদের জামাতা হিসেবে ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ও ইরানী শাহজাদা হিসেবে ইয়াযীদ ইবনে ওয়ালিদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে না ,অথচ তারা ইয়ায্দ গারদের ষষ্ঠ বংশধর (যদি ধরেও নিই তা সত্য) ইমাম রেযার প্রতি কেন এত অধিক ভালবাসা প্রদর্শন করে ?

ইরানীদের জাতীয় অনুভূতি যদি এতটা তীব্রই হয়ে থাকে তবে উবাইদুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদের প্রতি ইরানীদের সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। কারণ বলতে গেলে সে অর্ধেক ইরানী ছিল। কারণ তার মাতা মারজানা ইরানের সিরাজের মেয়ে এবং তার পিতা যিয়াদ ফার্স প্রদেশের শাসনকর্তা থাকাকালে তাকে বিয়ে করে।

ইরানীরা যদি জাতীয় অনুভূতির কারণে সাসানীদের সঙ্গে রক্ত সম্পর্কের যুক্তিতে নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণের প্রতি এতটা সম্মান দেখিয়ে থাকে তবে ইরানী মারজানা ও তার পুত্রের প্রতি তারা কেন এত অসন্তুষ্ট ও তাকে অভিশপ্ত মনে করে (ইমাম হুসাইনকে হত্যার নির্দেশ দেয়ায়) ?

সপ্তমত ইরানীদের শিয়া হওয়ার যুক্তি হিসেবে এ কথা তখনই সত্য হতো যদি শিয়া মাযহাব ইরানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত অথবা অন্ততপক্ষে প্রথম পর্যায় ও সময়ের শিয়াগণ যদি ইরানী হতো অথবা এমন হতো যে ,প্রথম সময়ের অধিকাংশ ইরানী শিয়া মাযহাব গ্রহণ করেছে। অথচ সালমান ফারসী ব্যতীত প্রথম পর্যায় ও সময়ের অন্য কোন শিয়া ইরানী ছিল না এবং প্রথম সময়ের অধিকাংশ ইরানীও শিয়া ছিল না ;বরং এর বিপরীতে প্রথম সময়ের অধিকাংশ ইরানী আলেম ও মুসলমান যাঁরা তাফসীর ,হাদীস ,কালামশাস্ত্র অথবা আরবী সাহিত্যে ভূমিকা রেখেছেন তাঁরা সকলেই সুন্নী ছিলেন ও শিয়া মাযহাবের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করতেন। ইরানীদের মধ্যে এ অবস্থা সাফাভী শাসনামল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সাফাভী শাসনামল পর্যন্ত ইরানের অধিকাংশ প্রদেশে সুন্নী ছিল ,এমনকি উমাইয়্যা শাসনামলে ইরানের সকল স্থানে মসজিদের মিম্বারে হযরত আলী (আ.)-এর প্রতি লানত (অভিশাপ) পড়া হতো। ইরানীরা উমাইয়্যাদের অপপ্রচারে প্রচণ্ড রকম প্রভাবিত ছিল এবং অজ্ঞাতবশত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত। এমনকি বলা হয়ে থাকে উমর ইবনে আবদুল আজিজ এটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর ইরানের সকল স্থানে প্রতিবাদ হয়।

সাফাভী শাসনামলের পূর্ব পর্যন্ত আহলে সুন্নাতের অধিকাংশ বড় মুফাসসির ,ফকীহ্ ,মুহাদ্দিস ,কালামশাস্ত্রবিদ ,দার্শনিক ,আরবী ভাষা ও ব্যাকরণশাস্ত্রবিদ ইরানী ছিলেন ,এমনকি আহলে সুন্নাতের সবচেয়ে বড় ফকীহ্ আবু হানিফা যাঁকে ইমামে আযম বলা হয় তিনিও একজন ইরানী। মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী যিনি আহলে সুন্নাতের সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিস ও প্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থ প্রণেতা তিনিও একজন ইরানী। বিশিষ্ট ব্যাকরণ ও আরবী ভাষাশাস্ত্রবিদ সিবাভেই ,অভিধান রচয়িতা জওহারী ও ফিরুযাবাদী ,মুফাসসির যামাখশারী এবং কালামশাস্ত্রবিদ আবু উবাইদা এবং ওয়াসিল ইবনে আতাও ইরানী ছিলেন। সুতরাং প্রমাণিত হয় সাফাভী আমলের পূর্বে প্রায় সকল ইরানী আলেম ও অধিকাংশ জনগণ সুন্নী ছিল।

জাতিগত গোঁড়ামির ওপর ইসলামের বিজয়

আশ্চর্যের বিষয় হলো ইসলামী জাতিসমূহ পূর্বে দৃশ্যত এমন সব আলেমের ফতোয়ার অনুসরণ করত যারা জাতিগতভাবে তাদের হতে ভিন্ন ছিল। যেমন মিশরের অধিবাসীরা ইরানী আলেম লাইস ইবনে সা দের অনুসারী ছিল ,তার বিপরীতে সেসময় ইরানীরা আরব বংশোদ্ভূত শাফেয়ীর অনুসারী ছিল। ইরানের প্রসিদ্ধ কিছু আলেম ,যেমন ইমাম গাযযালী ,তুসী এবং ইমাদুল হারামাইন জুয়াইনী শাফেয়ীর ভক্ত এবং ইরানী জাতিভুক্ত আবু হানিফার চরম সমালোচক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইরানের জনসাধারণ যখন শিয়া মাযহাব গ্রহণ করে তখন হতে আহলে বাইতের পবিত্র ইমামগণ যাঁরা কুরাইশ ও হাশেমী বংশোদ্ভূত তাঁদের অনুসরণ শুরু করে।

ফিকাহ্শাস্ত্রের নিকাহ্ অধ্যায়ে কুফু বা কুফুওয়াত (সমকক্ষতা) অর্থাৎ সকল জাতি বিবাহের ক্ষেত্রে সমমর্যাদার কিনা এ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইরানী আবু হানিফার ফতোয়ার প্রতি অনেকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে (ভিন্নতার কারণে)। আবু হানিফা গোঁড়া আরবদের ন্যায় বলেছেন , অনারবরা আরবদের সমকক্ষ নয় ;তাই অনারব আরব নারী বিয়ে করতে পারবে না। কিন্তু আরব ফকীহ্ মালিক ইবনে আনাস ও অন্যরা বলেছেন ,এ ক্ষেত্রে আরব-অনারবের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুফিয়ান সাওরী আরব ফকীহ্ হওয়া সত্ত্বেও বলেছেন ,এ ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। আরবীয় শিয়া ফকীহ্ আল্লামাহ্ হিল্লীও তাই বলেছেন। তিনি তাঁর তাযকিরাতুল ফোকাহা গ্রন্থে আবু হানিফার ফতোয়া উল্লেখ করে বলেছেন , আবু হানিফার বক্তব্য সঠিক নয়। ইসলামে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ ও হাবাশী কৃতদাসী সমান মর্যাদার। তিনি আরো বলেছেন , এ বক্তব্যের সপক্ষে দলিল হলো নবী (সা.) তাঁর চাচাতো বোনকে কৃষ্ণবর্ণের মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ কিন্দীর সঙ্গে বিবাহ দেন। কেউ কেউ তাঁর এ কর্মের প্রতিবাদ করলে তিনি বলেন:لتتّضع المناكح সকলকে সমকক্ষ করার উদ্দেশ্যেই আমি এটি করেছি।

আবু হানিফার এ ফতোয়া আশ্চর্যজনক তা আহলে সুন্নাতের অনেকেই স্বীকার করেছেন। তবে এতে প্রমাণিত হয় সে সময়ে মুসলমান আলেমদের মধ্যে জাতিগত কোন গোঁড়ামি ছিল না।

ফিকাহর গ্রন্থসমূহে এমন কিছু কাহিনী বর্ণিত হয়েছে যাতে একদিকে অনারবদের প্রতি আরবদের তীব্র অনীহা ,অন্য দিকে এরূপ গোঁড়ামির ওপর ইসলামের আশ্চর্যজনক বিজয় ফুটে উঠেছে।

কথিত আছে ,সালমান ফার্সী খলীফা হযরত উমরের কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে যদিও তিনি (খলীফা) এরূপ (জাতিগত) গোঁড়ামি হতে পূর্ণ মুক্ত ছিলেন না তদুপরি ইসলামের নির্দেশের কারণে তা গ্রহণ করেন। খলীফার পুত্র আবদুল্লাহ্ এ সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে আমর ইবনে আসের শরণাপন্ন হলে আমর ইবনে আস বললেন ,এ কাজের দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দাও। আমর একদিন সালমান ফারসীর মুখোমুখি হলে তাঁকে বললেন , তোমার প্রতি অভিনন্দন ,শুনলাম খলীফার জামাতা হওয়ার সম্মান লাভ করছ ? সালমান বললেন , এ কাজ যদি আমার সম্মান বলে পরিগণিত হয় তবে আমি এ কাজ হতে বিরত হওয়ার ঘোষণা দিচ্ছি।

ইসলামের মানদণ্ড

ইসলাম যে সময় আবির্ভূত হয় সে সময় আরব জাতির মাঝে বংশ. গোত্র ও জাতিভক্তি চরম পর্যায়ে ছিল। তখন আরবদের মাঝে আরব জাতীয়তাবাদ তেমন প্রসার লাভ করে নি ,কারণ আরবরা অন্যান্য জাতির মোকাবিলায় তখনও একক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই আরবদের গোঁড়ামি গোত্রবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তারা নিজ গোত্র নিয়েই গর্ব করত। কিন্তু ইসলাম তাদের এ গোত্রভক্তির প্রতি কোন গুরুত্ব দেয় নি ;বরং এর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং কোরআন স্পষ্ট বলেছে ,

) يا أيّها النّاس إنّا خلقناكم من ذكر و أنثى و جعلناكم شعوبا و قبائل لتعارفوا إنّ أكرمكم عند الله أتقاكم(

হে মানব জাতি! আমরা এক পুরুষ ও নারী হতে তোমাদের সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্তি করেছি যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও (পরস্পরকে চিনতে পার) ,নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত সে যে সর্বাধিক তাকওয়াসম্পন্ন । 15

এ বিষয়ে কোরআনের আয়াত ,রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস এবং বিভিন্ন আনারব গোত্র ও জাতির সঙ্গে তাঁর আচরণ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিকে পূর্ণরূপে তুলে ধরে।

পরবর্তীতে উমাইয়্যা বংশের ক্ষমতায় আরোহণ এবং তাদের ইসলামবিরোধী নীতির কারণে একদল আরব আরব জাতীয়তার বিষয়টিকে ব্যবহার করে জাতি ও বংশগত গোঁড়ামির অগ্নি প্রজ্বলিত করে। অনারব অন্যান্য জাতি বিশেষত ইরানীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও পূর্বে বর্ণিত আয়াতসমূহকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদেরকে সমতাকামী ও সাম্যের পক্ষ শক্তি বলে প্রচার করে। তারা আয়াতে ব্যবহৃতشعوبا শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদেরشعوبي বলত। কোন কোন মুফাসসিরের মত এবং ইমাম সাদিক (আ.)-এর হাদীস হতে বোঝা যায় আরবী কাবায়িল শব্দ এমন একটি একক যা ঐ গোত্রসমূহের জন্য ব্যবহৃত হয় যারা বংশগতভাবে একত্রে বসবাস করে এবংشعوب গোত্র হতে বৃহত্তর একক যারা জাতি হিসেবে একত্রে বসবাস করে। সুতরাং শুয়ুবীরা নিজেদের এ নামে সম্বোধিত করার কারণ স্পষ্টত বোঝা যায় তাদের আন্দোলন আরব জাতীয়তার গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ইসলামের মৌলনীতিনির্ভর একটি আন্দোলন ছিল। অন্তত বলা যায় ,এ আন্দোলনের ভিত্তি এর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। যদিও এ আন্দোলনের কিছু সংখ্যক লোক এর গতিকে ইসলাম বিরোধিতার দিকে টানার চেষ্টা করে থাকে তদুপরি পুরো আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী বলা যায় না।16 সকল ঐতিহাসিকই রাসূল (সা.)-এর নিকট হতে এ বাক্যটি পুনঃপুন বর্ণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন ,

أيّها النّاس كلّكم لآدم و آدم من تراب لا فضل لعربيّ على عجميّ إلّا بالتّقوى

হে মানবকূল! তোমরা সকলেই আদমের সন্তান ,আদম মাটি হতে সৃষ্ট হয়েছে। আরব অনারবের ওপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব রাখে না একমাত্র তাকওয়া ব্যতীত। 17

মহানবী (সা.) তাঁর এক হাদীসে স্বজাতির পূর্ববর্তীদের নিয়ে গর্ব করার বিষয়টিকে দুর্গন্ধময় বলে অভিহিত করেছেন এবং যে সকল ব্যক্তি এরূপ কাজ করে তাদেরجُعل অর্থাৎ তেলাপোকার (আরশোলা) সঙ্গে তুলনা করেছেন। হাদীসটি এরূপ :

ليدعن رجال فخرهم بأقوام إنّما هم فحم من فحم جهنّم أو ليكوننّ أهون على الله من الجعلان الّتي تدفع بأنفها النّتن

যারা নিজ জাতীয়তা নিয়ে গর্ব করে ,তারা জেনে রাখুক এই গর্ব জাহান্নামের ইন্ধন বৈ কিছু নয় ,(যদি তারা এ কর্ম পরিত্যাগ না করে) আল্লাহর নিকট নাসারন্ধ্রে দুর্গন্ধ বহনকারী তেলাপোকা অপেক্ষাও নিকৃষ্ট বলে পরিগণিত হবে। 18

রাসূল (সা.) আবুযার গিফারী ,মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ কিন্দী এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে যেভাবে গ্রহণ করতেন ঠিক তেমনিভাবে সালমান ফরসী ও বেলাল হাবাশীকে গ্রহণ করতেন। কারণ সালমান ফারসী (ইরানী) অন্যদের হতে এতটা অগ্রগামী হতে পেরেছিলেন ,নবী (সা.)-এর আহলে বাইত 19 বলে তাঁর নিকট হতে উপাধি লাভ করেছিলেন:سلمان منّا أهل البيت

রাসূল সব সময় লক্ষ্য রাখতেন অন্যদের মধ্যে জাতিভক্তির যে বাড়াবাড়ি রয়েছে তা যেন মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। উহুদের যুদ্ধে একজন ইরানী মুসলিম যুবক শত্রুপক্ষের এক ব্যক্তিকে তরবারী দ্বারা আঘাত করে বলল ,خذها و أنا الغلام الفارسيّ এই তরবারীর আঘাত গ্রহণ কর আমার মত এক ইরানী যুবকের নিকট হতে। নবী (সা.) এ বিষয়টি জাতিগত গোঁড়ামির সৃষ্টি করতে পারে বলে তৎক্ষণাৎ যুবককে বললেন , কেন তুমি বললে না ,এক আনসার যুবক হতে ? 20 অর্থাৎ ইসলাম যে বিষয়টিকে গর্বের উপকরণ মনে করে তা না করে কেন জাতীয় ও গোত্রীয় বিষয়কে টেনে আনলে ?

নবী (সা.) অন্য এক স্থানে বলেছেন ,

ألا إنّ العربيّة ليست بأب والد و لكنّها لسان ناطق فمن قصر به عمله لم يبلغ به حسبه

আরবীয়তা কারো পিতৃত্ব নয় ;বরং একটি ভাষা। তাই যার আমল ও কর্ম অপূর্ণ ,পিতৃত্ব ও বংশীয় পরিচয় তাকে কোথাও পৌঁছাবে না। 21

রাওজায়ে কাফীতে উল্লিখিত হয়েছে: একদিন সালমান ফারসী মদীনার মসজিদে বসেছিলেন। রাসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবীদের অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বংশ ও গোত্রীয় পরিচয় নিয়ে সকলে আলোচনা করছিলেন। সকলেই নিজ গোত্র ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলছিলেন ও এর মাধ্যমে নিজেকে সম্মানিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। হযরত সালমানের পালা আসলে তাঁকে সকলে নিজ বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলতে বললেন। ইসলামের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত এ মনীষী তখন নিজ গোত্র ,বংশ ও জাতীয় পরিচিতির কোন গর্ব না করে বললেন:

أنا سلمان بن عبد الله আমি সালমান ,আল্লাহর এক বান্দার সন্তান ,كنت ضالّا فهداني الله عزّ وجلّ بمحمّد আমি পথভ্রষ্ট ছিলাম ,আল্লাহ্ আমাকে মুহাম্মদের মাধ্যমে হেদায়েত করেছেন।

كنت عائلا فأغناني الله بمحمد আমি দরিদ্র ছিলাম ,তিনি মুহাম্মদের মাধ্যমে আমাকে ধনী করেছেন। كنت مملوكا فأعتقني الله بمحمد আমি দাস ছিলাম ,মুহাম্মদের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছেন। এটিই আমার বংশ পরিচয়

এমন সময় রাসূল (সা.) সেখানে প্রবেশ করলে হযরত সালমান তাঁকে ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূল সমবেত লোকদের (যাদের অধিকাংশই কুরাইশ ছিলেন) উদ্দেশে বললেন ,

يا معشر قريش إنّ حسب الرّجل دينه و مروئته خلقه و أصله عقله

হে কুরাইশ! ব্যক্তির গর্ব হলো তার ধর্ম (তার রক্ত ও বংশ নয়) ,তার পৌরুষত্ব হলো তার চরিত্র ও সুন্দর স্বভাব ,তার ভিত্তি হলো তার আক্ল (বুদ্ধিবৃত্তি) ও চিন্তাশক্তি। 22

মানুষের মূল তার বংশের ভিত্তিতে নয় ;বরং বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তির ভিত্তিতে। পচনশীল ও দুর্গন্ধযুক্ত অস্থিমাংস নিয়ে গর্ব করা অপেক্ষা দীন ,চরিত্র ,আক্ল ও অনুধাবন ক্ষমতা নিয়ে গর্ব কর চিন্তা করুন এ হতে উত্তম ও অধিকতর যুক্তিযুক্ত কথা কি হতে পারে ?

জাতি ও বংশগৌরবের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহর উপর্যুপরি তাগিদ মুসলমানদের মনে বিশেষত অনারব মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল। এ কারণেই আরব-অনারব সকল মুসলমানই ইসলামকে তাদের স্বকীয় ও নিজস্ব বলে মনে করত। এ জন্যই উমাইয়্যা শাসকদের জাতিগত গোঁড়ামি অনারব মুসলমানদেরকে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করতে পারে নি । তারা জানত খলীফাদের এ সকল কর্মের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এ সকল খলীফার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ছিল-কেন ইসলামী বিধান অনুযায়ী কাজ করা হয় না।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35