আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন7%
আশুরা সংকলন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 78927 / ডাউনলোড: 7838
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।


1

2

3

4

5

আহলে বাইতের ভালোবাসায় ইমাম শাফেয়ী (রহ.)

মুর্তাযা জাকাঈ সাভেজী

আবু আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদরীস বিন আব্বাস বিন ওসমান বিন শাফে হাশেমী কারশী মোত্তালেবী-যিনি ইমাম শাফেয়ী নামে সমধিক খ্যাত- আহলে সুন্নাতের ইমাম চেয়ের অন্যতম। এ মহান ব্যক্তি ১৫০ হিজরীতে ফিলিস্তিনের গাজায় জন্ম গ্রহণ করেন। অবশ্য কেউ কেউ তার জান্মস্থান আসকালান ,মিনা বা ইয়েমেন বলেও উল্লেখ করেছেন। শাফেয়ী অনেক দিন মাক্কা শরীফে থেকে ফিকাহশাস্ত্র শিক্ষা করে ছিলেন । এরপর তিনি মদীনায় চলে যান এবং আহলে সুন্নাতের ইমাম চতুষ্টয়ের অন্যতম মালেক বিন আনাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৭৯ হিজরীতে ইমাম মালেকের ওফাতের পরে তিনি ইয়েমেনে চলে যান এবং সেখানে কিছু দিন থাকার পর বাগদাদে চলে যান। তিনি ১৮৮ হিজরীতে বাগদাদ ত্যাগ করেন এবং হারান (ইরাকে অবস্থিত) ও শাম (সিরিয়া) হয়ে মিশরে যান। কিন্তু ১৯৫ হিজরীতে তিনি পুনরায় বাগদাদে ফিরে আসেন এবং ১৯৮ হিজরী পর্যন্ত সেখানে শিক্ষা দানের কাজে নিয়োজিত থাকেন। এর পর তিনি পুনরায় মিশরে গমন করেন। ২০০ হিজরীতে তিনি বাইতুল্লাহ শরীফেরে উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন এবং হজ্ব সমাপনের পরে মিশরে ফিরে যান। ২০৪ হিজরীতে তিনি মিশরের ফুস্তাতে ইন্তেকাল করেন।

ইমাম শাফেয়ী অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী তার রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ১১৩ থেকে ১৪০টি। ইবনে নাদীম তার বিখ্যাত গ্রন্থ আল ফিহরিস্ত -এ-তার লিখিত ১০৯টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। তার লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থাবলীর অন্যতম হচ্ছে কিতাবুল উম্ম যা তার অনুসারী ইউসুফ বিন ইয়াহইয়া বুয়েতী (জন্ম ২৭০ হিজরী) কর্তৃক সংকলিত ও রাবি বিন সোলায়মান কর্তৃক বিভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়েছে। কিতাবুল উম্ম -এর বিষয় বস্তু হচ্ছে ফিকাহ। গ্রন্থটি ১৯৬১-১৯৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কায়রো থেকে ৮খণ্ড- এবং ১৩২১-১৩২৬ হিজরীতে বুলা থেকে একবার চার খণ্ড- ও আরেকবার ১৩২৪-১৩২৫ হিজরীতে সাত খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

শাফেয়ী রচিত অপরাপর বিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : আল মুসনাদ (হাদীস গ্রন্থ) , আহকামুল কুরআন , আসসুনান , আর রিসালাতু ফি উসূলিল ফিকহ , ইখতিলাফুল হাদীস , আসা সাবাকু ওয়ার রামী , ফাযায়েলু কুরাইশ , আদাবুল কাজী , আল মাওয়ারিস ইত্যাদি।

প্রাচীন কালের গবেষক ইবনে আবি হাতেম রাযী (জন্ম ৩২৭ হিজরী) ,আবি বাকর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন মানজার (জন্ম ৩১৮ হিজরী) ,আবি জা ’ফার বিন মুহাম্মাদ খুলদী (জন্ম ৩৪৮ হিজরী) ,মুহাম্মদ বিন হোসাইন বিন ইবরাহীম ‘আছেম আবেরী (জন্ম ৩৬৩ হিজরী) ,ফখরুদ্দীন আবি আবদিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ওমর রাযী (জন্ম ৬০৬ হিজরী) প্রমুখ শাফেয়ী সম্বন্ধে গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং তাতে তার সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আধুনিক কালের গবেষক ওয়াস্তেন ফেল্ড ( Wusten Feld) ইমাম শাফেয়ী এবং ৩০০ হিজরী পর্যন্ত তার শিষ্য -অনুসারীদের সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। তেমনি মুস্তাফা মুনীর আদহাম ,আবু মুহাম্মাদ যোহরাহ প্রমুখ ইমাম শাফেয়ী সম্বন্ধে গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

স্বাধীন চিন্তাধারা পোষণকারী এ মহান মনীষী সব রকমের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত থেকে নিষ্পাপ ও পবিত্র আহলে বাইত সম্বন্ধে স্বীয় মনোভাবকে বারবার সুস্পষ্টভাবে বয়ান করেছেন। তিনি মীনায় অবস্থানরত হাজীদের সম্বোধন করে যে সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধান যোগ্য। তিনি লিখেছেন :

ان ﮐﺎ ن ر ﻓﻀﺎ ﺣﺐ ﺁ ل ﻣﺤﻤﺪ

ﻓﻠﻴﺸﻬﺪ ا ﻟﺜﻘﻼ ن ا ﻧﯽ را ﻓﻀﯽ

আলে মুহাম্মাদের প্রতি ভালোবাসা যদি রাফযী হয় তাহলে জিন ও ইনসান সাক্ষী থাকুক যে ,নিশ্চয়ই আমি রাফেযী।

তিনি তার আরে কবিতায় আহলে বাইত এর প্রতি তার ভালোবাসা এভাবে প্রকাশ করেছেন :

اذا ﻓﯽ ﻣﺠﻠﺲ ذ ﮐﺮ وا ﻋﻠﻴﺎ

و ﺷﺒﻠﻴﻪ و ﻓﺎﻃﻤﺔ ا ﻟﺰ کیة

ﻳﻘﺎ ل : ﺗﺠﺎ وزوا ﻳﺎ ﻗﻮ م ﻋﻦ ذا

ﻓﻬﺬ ا ﻣﻦ ﺣﺪﻳﺚ ا ﻟﺮ ا ﻓﻀﻴﻪ

هر ﺑﺖ ا ﻟﻲ ا ﻟﻤﻬﻴﻤﻦ ﻣﻦ ا ﻧﺎ س

ﻳﺮ ون ا ﻟﺮﻓﺾ ﺣﺐ ا ﻟﻔﺎﻃﻤﻴﻪ

ﻋﻠﻲ ﺁ ل ا ﻟﺮﺳﻮ ل ﺻﻠﻮ ة ر ﺑﻲ

و ﻟﻌﻨﺔ ﻟﺘﻠﻚ ا ﻟﺠﺎ هلیة

- যখন কোনো মজলিসে লোকেরা আলীকে স্মরণ করলো ,আর তার দুই সিংহ শাবককে (তার দু পুত্রকে) ও পবিত্র ফাতেমাকে ,বলা হলো : হে লোকেরা! (সাবধান!) ওরা সঙ্গীমালঙ্ঘন করেছে এ (ইসলামের সীমারেখা) থেকে ,আর এ মত দেয়া হয় হাদীসে রাফেযিয়াহর ভিত্তিতে ,(কিন্তু) আমি ঐসব লোক থেকে মুহাইমেনের (আল্লাহ তা আলার) দিকে পালিয়ে গেলাম ,ফলে (আমার মধ্যে) মুহাববাতে ফাতেমিয়াহ সুদৃঢ় হলো ,আমার রবের সালাওয়া আলে রাসূলের ওপর ,আর লা নত ঐ জাহেলীয়াতের ওপর ।

ইবনে হাজ্র মাক্কীও ইমাম শাফেয়ী থেকে নিম্নোক্ত পংক্তি উদ্ধৃত করেছেন :

ﻳﺎ اهل ﺑﻴﺖ ر ﺳﻮ ل ا ﷲ ﺣﺒﻜﻢ

ﻓﺮ ض ﻣﻦ ا ﷲ ﻓﻲ ا ﻟﻘﺮﺁ ن ا ﻧﺰﻟﻪ

کفاکم ﻣﻦ ﻋﻈﻴﻢ ا ﻟﻘﺪ ر ا ﻧﻜﻢ

ﻣﻦ ﻟﻢ ﻳﺼﻠﻲ ﻋﻠﻴﻜﻢ ﻻﺻﻠﻮ ة ﻟﻪ

হে রাসূলুল্লাহর আহলে বাইত ! তোমাদের (প্রতি) মুহাববাত ,আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরয করা হয়েছে তার নাযিলকৃত কুরআনে ,এটাই যথেষ্ট যে ,(তোমাদের মধ্যে) মহান মর্যাদা পুঞ্জীভূত হয়েছে ,অতএব ,নিঃসন্দেহে তোমরা হচ্ছে সেই ব্যক্তিগণ ,যে ব্যক্তি তোমাদের ওপর সালাত (দরুদ) প্রেরণ করেনি তার জন্য কোনো সালাত (নামায ) নেই।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শোকে ইমাম শাফেয়ীর কাসিদা (কবিতা)

মুওয়াফফাক বিন আহমদ খাওয়ারিমী তার মাকতালুল হোসাইন -এ স্বীয় ধারাবাহিক সনদসূত্রে মুহাম্মাদ বিন ইদরীস শাফেয়ী থেকে একটি কাসিদাহ উদ্ধৃত করেছেন। কাসিদাটি হচ্ছে :

ﺗﺄ وب همی و ا ﻟﻔﺆ اد کتیب

وارق ﻧﻮﻣﻲ ﻓﺎﻟﺴﺤﺎ ر ﻏﺮﻳﺐ

و ﻣﻤﺎ ﻧﻔﻲ ﻧﻮﻣﻲ و ﺷﻴﺐ ﻟﻤﺘﻲ

ﺗﺼﺎ ر ﻳﻒ ا ﻳﺎ م ﻟﻬﻦ ﺧﻄﻮ ب

ﻓﻤﻦ ﻣﺒﻠﻎ ﻋﻨﻲ ا ﻟﺤﺴﻴﻦ ر ﺳﺎﻟﺔ

و ان کرهتها انفس و قلوب

ﻗﺘﻴﻼ ﺑﻼﺟﺮ م کأن ﻗﻤﻴﺼﺔ

ﺻﺒﺢ ﺑ ـ ﻤﺎ ء ا ﻻ ر ﺟﻮ ان ﺧﻀﻴﺐ

ﻓﻠﻠﺴﻴﻒ ا ﻋﻮ ال و ﻟﻠﺮﻣﺢ ر ﻧﺔ

و ﻟﻠﺨﻴﻞ ﻣﻦ ﺑﻌﺪ ا ﻟﺼﻬﻴﻞ ﻧﺤﻴﺐ

ﺗﺰﻟﺰﻟﺖ ا ﻟﺪﻧﻴﺎ ﻵ ل ﻣﺤﻤﺪ

وکاذت ﻟﻬﻢ ﺻﻢ ا ﻟﺠﺒﺎ ل ﺗﺬ وب

و ﻏﺎ رت ﻧﺠﻮ م وا ﻗﺸﻌﺮ ت کواکب

وهتک ا ﺳﺘﺎ ر و ﺷﻖ ﺟﻴﻮ ب

ﻳﺼﻠﻲ ﻋﻠﻲ ا ﻟﻤﻬﺪ ي ﻣﻦ ال ها ﺷﻢ

و ﻳﻐﺰ ي ﻧﺒﻮﻩ ان ذا ﻟﻌﺠﻴﺐ

ﻟﺌﻦ کان ذ ﻧﺒﻲ ﺣﺐ ﺁ ل ﻣﺤﻤﺪ

ﻓﺬ ا ﻟﻚ ذ ﻧﺒﻲ ﻟﺴﺖ ﻋﻨﻪ ا ﺗﻮ ب

هم ﺷﻔﻌﺎﺋﻲ ﻳﻮ م ﺣﺸﺮ ي و ﻣﻮﻗﻔﻲ

اذا کثر ﺗﻨﻲ ﻳﻮ م ذاك ذ ﻧﻮ ب

আমার বেদনার প্রতিক্রিয়য় হৃদয় বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো এবং আমার নিদ্রা হরণ করে নিলো ,এরপর নিদ্রা যে কত দূরে। আর যা আমার নিদ্রা কড়ে নিয়েছে এবং আমাকে করে দিয়েছে তা হচ্ছে কালের সেই বিবর্তন যা তাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক ছিলো। অতঃপর কে আমার বাণীকে হোসাইনের কাছে পৌছে দবে ? যদিও এ বাণী সকল ব্যক্তি ও হৃদয় অপছন্দ করবে ,তা হচ্ছে নিরপরাধ শহীদ যেন এই যে ,তার জামাকে রক্তিম রং মেশানো পানিতে ডুবিয়ে রাঙ্গানো হয়েছে। অতএব ,তলোয়ারের জন্যই বিলাপ ও আর্তনাদ এবং বর্শার জন্যই বেদনার দীর্ঘশ্বাস ,আর হ্রেষা ও দাবড়ানোর পরে অম্বের জন্য রয়েছে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন।

আলে মুহাম্মাদের জন্য দুনিয়া প্রকম্পিত হবে ,যেহেতু অচিরেই তাদের (বেদনার) কারণে পাহাড়গুলো বিগলিত হয়ে যাবে। তারকারাজি ছিটকে পড়েছে ধ্বংস হয়ে গেছে ,পোশোকসমূহ ছিন্ন হয়েছে ,জামার গলাবন্ধ ফেটে গেছে। হাশেম বংশের লোকেরা যারা স্বীয় সন্তানদেরকে মুহাববাতের শিক্ষা দান করেন তাদের পক্ষ থেকে মাহদীর প্রতি দরুদ ;আলে মুহাম্মাদের প্রতি মুহাববাত যদি গুনাহ হয়ে থাকে তাহলে এ হচ্ছে সেই গুনাহ যা থেকে আমি কখনোই তওবাহ করবো না। কিয়ামতের দিন তারাই আমার শাফায়াতকারী যেদিন আমার গুনাহ পরিমাণ হবে অনেক বেশি ;সেদিন তারাই আমার সাহায্যকারী।

অনুবাদ :নূর হোসেন মজিদী ,

সূত্র: কেইহানে ফারাঙ্গী ,সংখ্যা -১০২৩-০২৮৯

হে মানব জাতি! আমি তোমাদের মাঝে অতি ভারী মহান দু টি জিনিস রেখে যাচ্ছি ;যদি তোমরা তা ধরে রাখো তবে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না- একটি হলো আল্লাহর কিতাব যার মধ্যে রয়েছে হেদায়াতের নুর ,অপরটি আমার আহলে বাইত । অতঃপর হাউজে কাওসারে যাওয়া পর্যন্ত এই দুই জিনিস কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না।

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) (তিরমিযী ,মুসলিম)

আশুরা পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ

ইয়াযীদের দরবারে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)

এম. তোরাবী

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পুত্র ইমাম আলী ইবনে হোসাইন ওরফে যায়নুল আবেদীন (আ.) কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তার আল্লাহ -ভক্তি ,ইবাদাত ও দো আ প্রবাদতুল্য এবং তার অভিধাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সাইয়্যেদুশ সাজেদীন ইমাম সাজ্জাদ । কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনা বিশ্বের সবচেয়ে যুগান্তকারী ঘটনা। এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে দামেস্কে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) -এর ঐতিহাসিক উক্তি। এ সুযোগটি তিনি পান বন্দি অবস্থায়। একদিন যখন ইয়াযীদের সরকারি প্রচারক মিম্বরে উঠে ইমাম আলী (আ.) ও তার সন্তানদের নিন্দা এবং মু আবিয়া ও তার বংশধরদের গুণকীর্তন করতে থাকে তখন ইমাম সাজ্জাদ জনগণকে উদ্দেশ্য করে সেই সত্য উম্মোচন করেন যা তাদের নিকট অবগুণ্ঠিত ছিল।

বলাবাগুল্য যে ,ইমাম সাজ্জাদ (আ.) জনগণকে একথা বলার সুযোগ সহজে পান নি ;বহু সমস্যা ও প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই তিনি তা অর্জন করেন। তাই এটি ছিল একটি মহামূল্যবান সুযোগ। ইমাম সাজ্জাদের জন্য এর চেয়ে আর কী উৎকৃষ্টতর হতে পারতো যে ,তিনি সেই মিম্বরেই আরোহণ করেন যেখান থেকে তার মহান পূর্বপুরুষগণকে গালমন্দন্দ করা হতো। তিনি সখান থেকেই বনি উমাইয়্যার অপপ্রচারণাকে ধূলিসাৎ করে নিজ বক্তব্যে জনগণকে আলোকিত করেন- যারা বহু বছর ধরে সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল ।

মহান আল্লাহর ইচ্ছা না হলে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ও তার ফুফু হযরত যায়নাব (আ.) -এর পক্ষে আহলে বাইতের মহত্ব এবং ইসলামে তাদের সুমহান অবস্থান সম্পর্কে বলার সুযোগ হতো না।

মূলত মহানবী (সা.) -এর প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু যার গিফারী (রা.) ইতঃপূর্বেই এ বক্তব্যের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন ;তিনি মু আবিয়ার বিপথগামিতার প্রকাশ্য ও তীব্র বিরোধী ছিলেন । তিনি যখন বুঝতে পারলেন যে ,খেলাফত প্রকৃত পথ থেকে কক্ষচ্যুত হয়েছে তখন তিনি খলিফার উপস্থিতিতে এবং মাঠ-ঘাট ও বাজার-বন্দরেও তার বিরোধিতা ও সমালোচনা করতে শুরু করেন। তাকে ইসলামের পুনরুজ্জীবন দানকারী ও বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। কারণ ,তিনি ছিলেন মহানবী (সা.) -এর একজন সঙ্গী এবং সাহাবীদের তালিকায় তিনি অন্যদের থেকে অগ্রগণ্য ছিলেন । আবু যার নির্বাসিত হন ও সমাহীন দুর্দশা ভোগ করেন ,তথাপি তিনি কখনো চুপ করে বসে থাকেন নি। তিনি রাবযা নামক স্থানে অসহায় অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।

মু আবিয়ার ক্ষমতায় আরোহণের পর আরো কিছু সংখ্যক লোক হযরত আবু যার গিফারীর অনুসারী হয়ে কাজ করেন। আবু যার দুনিয়া থেকে বিদায় নন। কিন্তু হযরত হুযর বিন আদী কিন্দি তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে তা -ই বলতে থাকেন যা ন্যায়সঙ্গত ছিল । তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাঙ্গে মু আবিয়ার বিরোধিতা করেন। এজন্য তাকে জীবন দিতে হয়। আবু যার (রা.) এবং হুযর বিন আদী ও তার বন্ধুগণ উমাইয়্যাদের অন্যায় প্রচারণার বিরুদ্ধে যে জবাব দিয়েছিলেন তা যথেষ্ট ছিল না। তার আহলে বাইতের সদস্যদের কারো পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব পালন জরুরি হয়ে পড়ে। এ কারণে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) মিম্বরে আরোহণ ও জনসমক্ষে দাড়ানোর সুযোগকে মূল্যবান বিবেচনা করলেন।

সরকার নিযুক্ত এক ফতোয়াবাজ মিম্বরে আরোহণ করে আল্লাহর প্রশংসা করলো ,অতঃপর ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.) -এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর পর উচ্চকণ্ঠে মুআবিয়া ও ইয়াযীদের গুণকীর্তন করলো। সমস্ত পূর্ণ কর্মের সাথে মু আবিয়া ও ইয়াযীদকে যুক্ত করলো এ বলে যে ,পুণ্যাত্মা পিতা ও পুত্র সমস্ত উত্তম কর্মও নীতি প্রস্রবণধারা এবং জনগণ যা কিছু অর্জন করেছে তার মূলে রয়েছে আবু সুফিয়ানের বংশধর। পৃথিবীতে ও মৃত্যুর পরের জীবনে সফলকাম হওয়ার জন্য জনগণকে তাদের ওপর নির্ভর করতে হবে এবং তাদেরকে মান্য ও অনুসরণ করাই হচ্ছে স্বর্গীয় সুখ প্রাপ্তির একমাত্র উপায়।

তখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.) কোনো শঙ্কা না করে উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে বক্তা! তোমার জন্য দুঃখ হয়। মানুষকে তোষণের জন্য কেনো তুমি আল্লাহর ক্রোধকে নিজের দিকে ডেকে আনছো ? তোমার জানা উচিত যে ,তোমার গন্তব্য হচ্ছে নরক।

তার এ মন্তব্য ছিল দামেস্কের সেই প্রচারকের বিরুদ্ধে যে ইয়াযীদকে তুষ্ট করতে গিয়ে আল্লাহকে অসুন্তুষ্ট করেছিল ,আর এভাবে সে তার জাহান্নাম-যাত্রাকেই নিশ্চিত করেছিল । কিন্তু ইমামের এ বাণী ছিল এমন সকল প্রচারকেরই উদ্দেশ্যে ,যারা সৃষ্টিকে খুশি করার উদ্দেশ্যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে । ইমাম এভাবে সমস্ত মুসলমান বক্তাকেই শিক্ষা দিলেন যে ,স্বর্গীয় সুখ প্রাপ্তির উপায় হচেছ আল্লাহর বাণীকে কোনো সংযুক্তি বা পরিবর্তন ব্যতীত মানুষের কাছে পৌছানো । মানুষকে তুষ্ট করার জন্য তাদের এমন কিছু বলা উচিত নয় যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এবং আল্লাহ কুরআন মজীদে যা বলেছেন তার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে :

নিশ্চিতভাবেই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে এবং আমরা অবগত তাদের নাফস তাদেরকে যে কুমন্ত্রণা দেয় সে সম্পর্কে । আমরা তাদের ঘাড়ের শাহ রগের চেয়ে তাদের নিকটবর্তী । যখন দু জন ফেরেশতা তার ডানে ও বামে সংলগ্ন হয়ে বসে তখন সে এমন একটি শব্দও উচ্চারণ করে না যা পর্যবেক্ষক লেখকদ্বয় দ্বারা সাথে সাথেই লিপিবদ্ধ হয় না। (সূরা ক্বাফ : ১৬-১৮)

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) অজ্ঞ প্রচারকদের এ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তাদেরকে সাবধান করেন এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যে ,মানুষের ভালো-মন্দ সমস্ত কর্মই লিপিবদ্ধ হচ্ছে এবং কোনো মানুষের উচিত নয় আল্লাহর সৃষ্ট জীবের তু্ষ্টির জন্য তারা ক্রোধকে । অগ্রাহ্য করা। কারণ ,এমন একদিন আসবে ,যেদিন সে যাদের ক্ষমতাবান বিবেচনা করতো ,তারা তার জন্য কিছুই করতে পারবে না।

খলিফার প্রচারককে ভর্ৎসনা করে ও তার ধর্মবিরোধী নিন্দা জ্ঞাপন করে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) ইয়াযীদের দিকে ফিরলেন ও বললেন , তুমি কি আমাকেও এ কাষ্ঠখণ্ডসমূহের ওপর আরোহণের অনুমতি দেবে যাতে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ও শ্রোতাদের আতিমক পুরুস্কারের জন্য কিছু বলতে পারি ?

এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এর প্রজ্ঞার ইঙ্গিত রয়েছে । কারণ ,তিনি মিম্বরে আরোহণের অনুমতি চাননি ,বরং কাষ্ঠখণ্ড আরোহণের অনুমতি চান। তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন যে ,কোনো কিছুকে মিম্বরের আকৃতি দিয়ে যে কেউ তাতে বসে কিছু বললেই তাকে মিম্বর বলা যায়না ,বরং এরূপ কাষ্ঠখণ্ডসমূহ মিম্বরের জন্য ধ্বংসাত্মক। যে কেউ ধর্ম প্রচারকের ছদ্মবেশ ধারণ করলেই তাকে ধর্মের প্রচারক বলা চলে না। তিনি আরো বুঝাচ্ছিলেন যে ,যে প্রচারক নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে পার্থিব স্বার্থের আশায় বক্তব্য প্রদান করে এবং মানুষকে খুশি করতে আল্লাহর বিরাগ ভাজন হয় ,তার পরিণতি দোযখ। অন্যদিকে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কিছু বলতে চান।

তিনি যা বোঝাতে চাচ্ছিলেন তা হচ্ছে ,প্রচারক যা বলছিল তা আল্লাহর ক্রোধকে ডেকে আনবে এবং ইমাম আলী (আ.) -এর মতো মানুষকে গালমন্দ করে ও ইয়াযীদের মতো লোকের প্রশংসা করে কখনো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব নয়। তিনি আরো বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে ,শ্রোতারা এসব বক্তব্য শ্রবণে কোনো আত্মিক পুরুস্কার তো পাবেই না ,বরং তা তাদের পাপের বোঝা ভারী করবে এবং তাদেরকে সুপথ থেকে বিপথগামী করবে।

জনগণ ইমাম সাজ্জাদকে বক্তব্য প্রদানের অনুমতি দেয়ার জন্য ইয়াযীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে প্রথমে সে প্রবলভাবে তা অগ্রাহ্য করে এবং বলে , এসব লোক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার আবহে প্রতিপালিত হয়েছে ;আমি যদি তাকে কথা বলতে দেই তাহলে সে আমাকে লাজ্জায় ফেলবে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত জনগণের আকাঙ্ক্ষারই জয় হলো ,ইমাম সাজ্জাদ (আ.) মিম্বরে দাড়ালেন। তিনি যেভাবে কথা বললেন তাতে লোকজন আন্দোলিত হলো ,তারা কেদে ফেললো। ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পুত্র ইসলামী সমাজে আহলে বাইতের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করলেন ,তাদের মেধা ও মহত্ত্বের বিষয়ও জনগণকে অবহিত করলেন। তিনি সে সাথে একটি মাপকাঠি উপস্থাপন করলেন ,যা সকল জ্ঞানীর কাছে গৃহীত। তিনি বললেন , যারা জনগণকে নেতৃত্ব ও পথ দেখাতে চান ,তারা অবশ্যই জনগণের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর হবেন এবং শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখেই তাদের নির্বাচিত করা হবে ।

পবিত্র কোরআন এ যৌক্তিক মাপকাঠি সম্পর্কে বলছে , সেই ব্যক্তি কি সত্যের দিকে অন্যকে পরিচালিত করতে পারে অন্য কেউ তাকে সুপথ না দেখালে যে নিজেই সত্যপথের সন্ধান পায় না ? তোমাদের কী হলো ?তোমরা কেমন ফায়সালা করছো ? (সূরা ইউনুস : ৩৫)

এ আয়াত তার্কের খাতিরে ব্যবহৃত হয়নি ,বরং লোকজনের মনোযোগকে এ যৌক্তিক মাপকাঠির দিকে আহবান করতে ব্যবহৃত হয়েছে যে ,যিনি অধিক জ্ঞানী তিনিই অন্যদের পরিচালিত করতে পারেন ,অন্যরা নয়। যদিও মক্কার বহু দেব-দেবীর উপাসকরা মহানবী (সা.)-বেদুইন নবুওয়াতের ওপর বিশ্বাস করে নি ,তথাপি তারা এ যৌক্তিক মাপকাঠির ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতো যে ,যদি তাদের জাতির জন্য আল্লাহকে একজন নবী নিযুক্ত করতে হয় ,তাহলে তিনি একজন মহামানবই হবেন ,যদিও তারা মহত্বের উপায় ও শ্রেষ্ঠত্বের উৎস সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করছিল । তারা ভাবতো যে ,মহত্ব বিপুল পরিমাণ সম্পদ অথবা অনেক পুত্র ও আত্মীয়-স্বজন বা ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা বলতো ,আল্লাহ যদি আমাদের অর্থাৎ হেজাযবাসীর জন্য একজন নবী নিযুক্ত করতেন তাহলে কেনো তিনি তা মক্কার কোনো মহান ব্যক্তি ,যেমন: ওয়ালিদ বিন মুগিরা মাম্জুসী বা তায়েফের মহান ব্যক্তি উরওয়া ইবনে মা সদ সাকাফীকে নিয়োগ দিলেন না ?

এ প্রসঙ্গে কুরআন মজীদ বলছে , তারা প্রশ্ন করে কেনো কুরআন এ দুই শহরের দুই মহান ব্যক্তির কোনো একজনের ওপর নাযিল হলো না ? (সূরা যুখরুফ : ৩১)

তাদের এ ভুলের কারণ হচ্ছে তারা সম্পদ ও বাহ্যিক ক্ষমতা এবং খ্যাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠিরূপে বিবেচনা করতো ,জ্ঞান ,নৈতিক ও অন্যান্য মানবিক গুণকে নয়। তাই তাদের বিশ্বাস ছিলো না যে ,শুধু হেজাযে নয় ,বরং সমগ্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তার ঘোষণায় সেসব গুণের কথা উল্লেখ করে ছিলেন যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যায় বা এক জাতি ছাড়িয়ে যেতে পারে অপর জাতিকে। তিনি এ বিষয়েও সুস্পষ্টরূপে বলেন যে ,নবী (সা.) -এর পবিত্র আহলে বাইত অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন ,অন্যরা তাদের সমর্মযাদার নয়। কারণ ,মহান আল্লাহই তাদের শ্রেষ্ঠরূপে প্রেরণ করেছেন এবং তাদের মানবতার দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করেছেন।

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) সাথে বললেন , হে লোকসকল! আল্লাহ আমাদের ছয়টি জিনিস দিয়েছেন এবং আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব অন্যদের ওপর সাতটি স্তরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে যা একজন ব্যক্তির অপর একজনের ওপর বা এক জাতির অপর এক জাতির ওপর শ্রেষ্ঠত্বের মৌলিক ভিত্তি। আমাদের ধৈর্য দেয়া হয়েছে যা জনগণকে পুনর্গঠন করতে বা হেদায়াত প্রদান করতে জরুরি। উদারতা-যা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য ,তা আমাদের স্বভাবগত। বাগ্মিতাও যা লোকজনকে পথ দেখাতে এবং তাদের সৎ পথে আনতে ও অসৎ পথ থেকে বিরত রেখে আলোকিত করতে ও জিহাদে উজ্জীবিত করতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আত্মোৎসর্গ আমাদের পরিবারের বিশেষ । সাহসিকতা - যার ওপর নেতৃত্ব নির্ভরশীল ,তা আমাদের দেয়া হয়েছে। ঈমানদারদের বন্ধুত্ব ও স্নেহশীলতা হচ্ছে পরিচালনা ও প্রজ্ঞার রহস্য ,তা আমাদের প্রদান করা হয়েছে ;আর বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য লোকজনের কাছ থেকে জবরদস্তি করে আদায় করা সম্ভব নয়।

এসব বক্তব্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চান ,হে ইয়াযীদ ! এটি আল্লাহর ইচ্ছা যে ,ঈমানদার লোকদের উচিত আমাদের ভালোবাসা এবং তাদের এ থেকে বিরত রাখাও সম্ভব নয় ;এও করা সম্ভব নয় যে ,তারা অন্যদের প্রতি বন্ধুবৎসল হবে ,আর আমাদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করবে।

অতঃপর ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বললেন , অন্যদের ওপর সে যে-ই হোক না কেনো ,আমাদের এসব বিশেষত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত যে ,মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল ,তার উত্তরসূরি আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ,হামযা ইবনে আবদুল মুত্তালিব বেহেশতের পথযাত্রী ,জা ফর ইবনে আবি তালিব (আ.) ,যারা এই কওমের নবীর দৌহিত্র ;মাহদী (যিনি নির্যাতিতদের উদ্ধারকর্তা) -দ্বাদশ ইমাম ,হাসান ও হোসাইন (আ.) এবং এরা সবাই আমাদের অন্তর্ভুক্ত । সম্ভব হলে ইয়াযীদ এই মুহূর্তে এসব বিশেষত্ব নিজের ওপর আরোপ করুক । অন্যকথায় ,কেবল ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করেই সম্ভব হবে যা আমাদের আছে তা তার পক্ষে অর্জন করা ,সেই সাথে তার লজ্জাকর ও অসৎকর্মগুলোকে উপেক্ষা করে তার অবস্থা পুননির্ধারিত করা । অন্যথায় যতদিন ইসলামের বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের বনী হাশেমের মাঝে বর্তমান ,যেমন আবু তালিব ,তার ভাই হামযা এবং তার পুত্ররা অর্থাৎ আলী ও জা ফর এবং ইমাম আলীর পুত্র হাসান ও হোসাইন (আ.) ,আর এ ইতিহাস যতদিন সংরক্ষিত আছে যে ,তারা আল্লাহর সবচেয়ে অনুগত বান্দা ,বিশেষত যখন আল্লাহর নবী ও বনী হাশিমের সাথে সংযুক্ত ,ততদিন কীভাবে সম্ভব আমাদেরকে অন্ধকারে রেখে বা আমাদের অমর্যাদা করে বা আমাদের অধিকার অন্য কাউকে দিয়ে বা অন্য কারো দিকে ঘুরে গিয়ে আমাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ?

এসব বলে ইমাম সাজ্জাদ (আ.) নিজের পরিচয় উম্মোচন করলেন ,আর পরিস্থিতি এমন দাড়ালো যে ,ইয়াযীদ বাধা দান করতে বাধ্য হলো ,হীন উদ্দেশ্যে সে মুয়াজ্জিনকে নামাযের জন্য আযান দিতে বললো। মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক ইমামও সে সময় নিশ্চুপ রইলেন। অতঃপর তিনি যখন আরো একটি সুযোগ পলেন তার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন। মুয়াজ্জিন বললো : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল । তখন ইমাম সাজ্জাদ (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাম্মানার্থে তার পাগড়ি খুলে ফেললেন এবং বললেন : হে মুয়াজ্জিন ! তুমি এই মাত্র নবীর নাম উচ্চারণ করলে তার নামে তোমাকে চুপ করতে বলছি।

সূত্র:মাহজুবা :সেপ্টেম্বর ২০০৫

অনুবাদ : এন.জেড.আলী হোসাইন

হুর ইবনে ইয়াযীদ

বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে : শেষ ভালো যার সব ভালো তার । আমরা মা সুমগণের নিকট থেকে বর্ণিত দোয়ায় পাঠ করি , হে আল্লাহ! আমাদের কাজের পরিণাম শুভ করুন। কিন্তু সে সৌভাগ্য হয় ক জনের ? হলফ করে বলা যায় ,এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এদের কারো কথা ইতিহাস মনে রাখে ,আর কেউ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। যাদের কথা ইতিহাস কখনোই বিস্মৃত হতে পারে না নিঃসন্দেহে তাদের সাথে জড়িয়ে আছে কোনো অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কারবালার বীরত্ব গাথায় আমরা যে ক জন ত্যাগী বীরের কথা জানতে পারি তাদের মধ্যে হুর ইবনে ইয়াযীদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

হুর ইবনে ইয়াযীদ এক সম্ভান্ত্র গোত্রে গ্রহণ করেন। তার বীরত্ব ও উদারতা তার পূর্বপুরুষেরই উত্তরাধিকার। ইসলামপূর্ব ও পরবর্তীকালে তারা উদারতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন । হুর ইবনে ইয়াযীদ অত্যাচারীকে সাহায্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে এক সুন্দর-সৌভাগ্যময় পরিণতির মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন কাল্যাণ লাভ করেছিলেন ।

হুর ছিলেন কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম। আর এ কারণে ইবনে যিয়াদ তাকে সহস্রাধিক অশ্বারোহী সৈন্যের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করেছিল । সে কুফার উদ্দেশ্যে গমনরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পথরোধ করার জন্য হুর ইবনে ইয়াযীদ কে আদেশ দিয়েছিল ।

হুর ইবনে ইয়াযীদ বলেন : দারুল ইমারা থেকে যখন বাইরে আসছিলাম তখন তিনবার এ শব্দ শুনতে পেলাম যে ,কেউ যেন বলছেন :‘‘ হে হুর! তোমাকে শাহাদাতের সংবাদ!’’ যতই এদিক ওদিক তাকালাম ,কাউকে দেখতে পলাম না। আপন মনে বলতে লাগলাম :‘‘ তোমার মাতা শোকার্ত হোক ;হোসাইনের বিরুদ্ধে ,আর বেহেশতের সুসংবাদ শুনছো’’ !

কিন্তু আশুরার দিনে হুর যখন ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলেন তখন সেই গায়েবী আওয়াজের অর্থ বুঝতে পারলেন।

হুর যু হুসাম নামক স্থানে হযরত ইমাম হোসাইনের সাথে সাক্ষাৎ করেন যখন তিনি ও তার সঙ্গীরা তৃষ্ণার্ত ছিলো। ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের ও তাদেরকে বহনকারী পশুগুলোকে তৃপ্তিসহকারে পানি পান করানোর আদেশ দেন। অতঃপর হুর ইমাম হোসাইনকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করলেন। ইমাম হুরকে বললেন যে ,তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে কুফায় যাচ্ছেন। কিন্তু হুর তাকে কুফায় যেতে দিল না। অতঃপর ইমাম সেখানেই তাবু ফেললেন।

বর্ণিত আছে যে ,হুর আশুরার রাতে দেখেন যে ,তার পিতা তাকে বলছেন : আজ তুমি কোথায় আছ ? হুর জবাব দিলেন : ইমাম হোসাইনের সম্মুখে ,তাকে বাধা দেবো এবং ইবনে যিয়াদের বাহিনী আসা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখব। তার পিতা তার ওপর রাগান্বিত হলেন এবং বললেন : ধিক তোমাকে ! রাসূল (সা.) -এর সন্তানদের সাথে কী করছো ? যদি নিজেকে অনন্তকাল দোযখের আগুনে দেখতে চাও তবেই ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তুমি কি কিয়ামত দিবসে মহানবী (সা.) ,আমীরুল মু মিনীন (আ.) ও ফাতেমা যাহরার ক্রোধে পতিত হতে চাও এবং তাদের শাফা আত থেকে বঞ্চিত হতে চাও ?

আশুরার দিন হুর ওমর ইবনে সা দের সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে জানতে চাইলেন : তুমি কি হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফলেছো ? ওমর ইবনে সা দ জবাবে বললো : হ্যাঁ । এমনভাবে যুদ্ধ করবো যাতে কমসংখ্যকের মাথা ও হাত কাটতে হয়। হুর বললেন : এটা কি ভালো ছিলোনা যে ,তাকে তার ওপর ছেড়ে দেবে ,আর তিনি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে দূরে যেখানে ইচ্ছা চলে যাবেন ? ওমর ইবনে সাদ বললো : যদি ব্যাপারটা আমার হাতে থাকতো তাহলে এমনটিই করতাম । কিন্তু আমীর ওবায়দুল্লাহ এমনটি করার অনুমতি দেননি।

হুর ওমর ইবনে সা দ থেকে দূরে সরে গিয়ে একাকী চিন্তায় মগ্ন হলেন। এমন সময় কোররাত ইবনে কাইস রিয়াহী কাছে এলে তাকে উদ্দেশ্য করে হুর বললেন : নিজের ঘোড়াকে পানি পান করিয়েছো ?

কোররাত বলে :বুঝতে পারলাম যে ,তিনি চাচ্ছিলেন যে ,আমি তার নিকটে অবস্থান করি। আর তাই বললাম : না ,আমার ঘোড়াকে পানি দেইনি। আমি তাকে রেখে অন্যত্র চলে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম হুর ধীরে ধীরে হোসাইনের দিকে যাচ্ছেন। মুহাজির ইবনে আউস তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল : আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছো ? হুর নীরব থাকলেন এবং কোনো জবাব দিলেন না। কিন্তু ভীষণ কাপছিলেন । হাজির ইবনে আউস হুরকে বলল : তোমার আচরণ তো সন্দেহ জনক ;আমি তোমাকে কখনোই এমন দেখিনি। যদি আমাকে পূর্বে জিজ্ঞাসা করা হতো কুফার শ্রেষ্ঠ বীর কে ? তবে আমি তোমার নামটিই বলতাম। তাহলে তোমার মধ্যে যে উদ্বেগ আমি দেখতে পাচ্ছি তা কি জন্য ?

হুর জবাবে বললেন : আল্লাহর শপথ ,আমি নিজেকে বেহেশত ও দোযখের মাঝে পরীক্ষা করছি। আল্লাহর শপথ ,বেহেশত ব্যতীত অন্য কোনো পথ বেছে নেবো না ,এমনকি টুকরা টুকরা হয়ে গেলেও । অতঃপর তিনি নিজের ঘোড়াকে দ্রূত ইমাম হোসাইনের দিকে পরিচালনা করলেন। ইমামের নিকটবর্তী হলে নিজের ঢালকে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত হিসাবে উাল্টো করে ধরলেন এবং ইমাম হোসাইনের সামনে উপস্থিত হয়ে মুখমণ্ডল মাটিতে স্থাপন করলেন।

ইমাম হোসাইন (আ.) তাকে বললেন : মাথা ওপরে তোলো ,তুমি কে ? হুর বললেন : হে রাসূলের সন্তান! আমি সেই ব্যক্তি যে আপনার পথে বাধ সেধেছিল । আমি আপনাকে নিরাপদ স্থানে যেতে দেই নি। কিন্তু আল্লাহর কসম ,আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে ,আপনার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে । আমার ধারণা ছিলো আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা হবে । এখন অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আপনার দিকে ফিরে এসেছি ;আমার তাওবা কি কবুল হয়েছে ? ইমাম জবাব দিলেন : হে ,মহান আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করেছেন। হুর তৃপ্ত হৃদয়ে ইমাম হোসাইনের নিকট প্রার্থনা করলেন : আমাকে অনুমতি দিন যাতে আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রথম ব্যক্তি হতে পারি।

ইমাম হোসাইন (আ.) তার কাল্যাণার্থে দোয়া করলেন। অতঃপর হুর ইবনে যিয়াদের সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে উপদেশ দিলেন। কিন্তু তাতে তারা কর্ণপাত না করে তার দিকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। হুর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) হুরের রক্তাক্ত নিথর দেহের পাশে গিয়ে বললেন : তুমি সত্যিই হুর (মুক্ত) যেমনটি তোমার মাতা তোমার নামকরণ করেছেন। তুমি দুনিয়াতে ,আর আখেরাতে সৌভাগ্যবান।

এ মহান ত্যাগী বীরের সমাধিস্থল বর্তমান কারবালা থেকে পশ্চিমে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তার সমাধির ওপর একটি স্থাপনা আছে যা সুন্দর কারুকার্য খচিত। কথিত আছে ,হুরের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তামিম গোত্রের একদল ব্যক্তি আশুরার ঘটনার পর তার দেহ এ স্থানে এনে দাফন করেন।

শাহ ইসমাইল (আয়াতুল্লাহ হায়েরীর বর্ণনামতে শাহ আব্বাস) ইরাক দখল করার পর কারবালায় এসে ছিলেন । তিনি হুরের মর্যাদা ও মাযার সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন । সত্য উদঘাটনের জন্য তিনি হুরের কবর খননের নির্দেশ দেন। কবর খননের পর তিনি হুরের দেহকে রক্তাক্ত পোশাকসহ দেখতে পান । তারা তার জখমগুলোকে তাজা দেখতে পান । তার মাথায় তরবারির আঘাতে সৃষ্ট জখম দেখতে পান যা এক টুকরা কাপর দিয়ে বাধা ছিল । শাহ এ কাপড় খুলে অন্য কাপড দিয়ে জখমটি বাধার নির্দেশ দিলে তা খোলা মাত্র ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে । ফলে পুনরায় তা বেধে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাবাররুক হিসাবে শাহ সে কাপড়ের টুকরা থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কেটে নেন। অতঃপর শাহ হুরের সমাধিকে পুনরায় আকর্ষণীয় রূপে তৈরী করার নির্দেশ দেন।[ সূত্র : দায়েরাতুল মা য়ারেফে তাশাইয়্যূ , 6ষ্ঠ খণ্ড ]

সংকলনে : মোঃ মাঈন উদ্দিন


8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26