আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন11%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 78922 / ডাউনলোড: 7838
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।


1

2

3

4

5

6

7

কারবালার বীর নারী হযরত যায়নাব (আ.)

নূর হোসেন মজিদী

ইসলামের ইতিহাসে যেসব মহীয়সী নারী জ্ঞান ,মনীষা ,প্রজ্ঞা ও সাহসী ভূমিকার জন্য চিরভাস্বর হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে হযরত যায়নাব (আ.) অন্যতম। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষদর্শী হযরত যায়নাব শুধু যে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পরে তার পরিবারের নারী ও শিশুদের এবং অসুস্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) -এর অভিভাবিকার দায়িত্ব পালন করেন তা নয় ,বরং কুফা ও দামেস্কে অসাধারণ সাহসিকতার সাথে ইমাম হোসাইন ও তার পরিবার-পরিজনের প্রতি ইয়াযীদের জুলুম-অত্যাচারের কথা সর্বসমক্ষে তুলে ধরেন। এর ফলে ইয়াযীদ ও তার তবেদারদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের জাল ছিন্ন হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের কাছে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে।

ইয়াযীদ ও তার সুবিধাভোগীরা এ মর্মে মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছিল যে ,ইয়াযীদ মুসলিম উম্মাহর বৈধ খলিফা এবং ইমাম হোসাইন ছিলেন একজন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি যিনি ক্ষমতার লোভে খলিফাতুল মুসলিমীন ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন । কিন্তু হযরত যায়নাব এ মিথ্যাচারের স্বরূপ প্রকাশ করে দেন এবং ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মিশন ও তাকে যে অন্যায়ভাবে শহীদ করা হয় তা তুলে ধরেন। ফলে কারবালার ঘটনার স্বরূপ মিথ্যাচারের জঞ্জালের নিচে চাপা পড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। হযরত যায়নাব (আ.) -এর ভূমিকার ফলে মুসলিম উম্মাহ অচেতনতার নিদ্রা থেকে জগে ওঠে। এর ফলে অচিরেই বিভিন্ন স্থানে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ,উমাইয়্যা নর ঘাতকদের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইনকে হত্যার প্রতিশোধ নেয়া হয় এবং উমাইয়্যা শাসনের ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

হযরত যায়নাব (আ.) নারীকুল শিরোমণি হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) ও জ্ঞান নগরীর দরজা হযরত আলী (আ.) -এর সন্তান। তার জন্মের তারিখ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। তবে অধিকতর সঠিক বলে পরিগণিত মত অনুযায়ী তার জন্ম হিজরী পঞ্চম সালের পাঁচ জমাদিউল উলা। তিনি ৬২ হিজরীর ১৫ রজব ৫৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার মাযার দামেস্কে অবস্থিত ;তার নামানুসারে ঐ জায়গা যায়নাবিয়া নামে সুপরিচিত।

স্বয়ং হযরত রাসুলে আকরাম (আ.) তার নাম রাখেন যায়নাব । তার ডাকনাম ছিল উম্মে কুলসুম। উল্লেখ্য যে ,তার কনিষ্ঠতম বোনের নামও যায়নাব ও ডাকনাম উম্মে কুলসুম ছিল । হযরত যায়নাব (আ.) যায়নাবে কুবরা (বড় যায়নাব ) ও তার ছোট বান যায়নাবে ছোগরা (ছোট যায়নাব ) নামে পরিচিত ছিলেন । যায়নাবে ছোগরা হযরত ফাতেমা (আ.) -এর সন্তান ছিলেন না ;হযরত ফাতেমার ইন্তেকালের পর হযরত আলী ছাহ্বায়ে ছা লাবিয়া নামে একজন মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন ;তারই সন্তান যায়নাবে ছোগরা। অনেকে এই দুই যায়নাবকে এক করে ফেলেন।

হযরত যায়নাবে কুবরা ছিলেন মানব জাতির ইতিহাসে সর্বাধিক মহিমান্বিত পরিবারের সন্তান। বেহেশতে নারীদের নেত্রী হযরত ফাতেমা যাহরা ছিলেন তার মাতা ,শেরে খোদা হযরত আলী ছিলেন তার পিতা ,বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন ছিলেন তার ভ্রাতা এবং সর্বোপরি সৃষ্টি লোকের সৃষ্টির কারণ রাহমাতুল্লিল আলামীন রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন তার নানা। এমন অনন্যসাধারণ প্রিয়জনদের নয়নমনি ছিলেন হযরত যায়নাবে কোবরা। তিনি এমন এক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন যেখানে হযরত জিবরাঈল (আ.) অবতরণ করতেন। খোদায়ী ওহীর ধারক-বাহক ও ব্যাখ্যাকারকদের সহচর্যে তিনি বড় হন।

হযরত যায়নাব ছিলেন অনন্যসাধারণ মেধা ও স্মরণশক্তির অধিকারী। এই অন্যতম প্রমাণ এই যে ,হযরত ফাতেমা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) -এর ইন্তেকালের কিছুদিন পরে মসজিদে নববীতে যে ভাষণ দেন হযরত যায়নাব তা হুবহু মনে রাখেন ও পরবর্তীকালে বর্ণনা করেন ,অথচ ঐ সময় তার বয়স ছিল মাত্র ছয় বছর । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস তার নিকট থেকে শুনে হযরত ফাতেমা (আ.) -এর ভাষণ বর্ণনা করেন।

পরবর্তীকালে অর্থাৎ কৈশোরকাল থেকেই তিনি মনীষার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। এ কারণে তিনি বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হন । লোকমুখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসব উপাধি প্রচলিত হয়ে পড়ে। এসব উপাধির মধ্যে সর্বাধিক বিশিষ্ট উপাধি হচ্ছে আকীলাতু বানী হাশেম (হাশেম বংশের বুদ্ধিমতী মহিলা) । তার অন্যান্য উপাধির মধ্যে রয়েছে : মুআচ্ছাকাহ (নির্ভরযোগ্য ;নির্ভরযোগ্য হাদীস-বর্ণনাকারিণী) , আলেমাতু গায়রা মু তাআল্লামা (কারো কাছে শিক্ষাগ্রহণ ব্যতিরেকেই যিনি আলেমাহ) , আরেফাহ ,ফাযেলাহ ,কামেলাহ ও আবেদাতু আলে আলী (আলী-বংশের আবেদাহ) ।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর প্রতি ভালোবাসা

হযরত যায়নাব মাত্র ছয় বছর বয়সে নানা ও মাকে হারান। এর পর তিনি পিতা ও ভ্রাতাদের সহচর্যে বড় হন। তবে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর প্রতি তার ভালোবাসা ছিল এতই বেশী যে ,তিনি ইমাম হোসাইনকে না দেখে একদিনও থাকতে পারতেন না। তার এ ভালোবাসা আজীবন আটুট থাকে। কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন শহীদ হওয়া পর্যন্ত কখনোই হযরত যায়নাব তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি।

হযরত যায়নাব ১৬ হিজরীতে বয়ঃপ্রাপ্তা হলে হযরত আলী (আ.) তাকে স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জা ফর তাইয়ারের সাথে বিবাহ দেন। ইমাম হোসাইন -এর প্রতি হযরত যায়নাব -এর অপরিসীম মুহাব্বাতের কারণে হযরত আলী ববিবাহের ক্ষেত্রে দু টি বিশেষ শর্ত আরোপ করেন। প্রথম শর্ত এই যে ,আবদুল্লাহর সাথে বিবাহের পর (যেহেতু তার বাড়িতে গিয়ে বসবাস করবেন) হযরত যাযনাব প্রতি দিনে-রাত অন্তত একবার তার ভাই হযরত ইমাম হোসাইনের সাথে সাক্ষাৎ করতে যেতে পারবেন। দ্বিতীয় শর্ত এই যে ,যখনই ইমাম হোসাইন কোথাও সফরে যাবেন তখন হযরত যায়নাবকে সাথে নিয়ে যেতে পারবেন ;আবদুল্লাহ এতে কোনো রূপ আপত্তি করতে পারবেন না। আবদুল্লাহ এ উভয় শর্তই মেনে নিলে হযরত আলী উভয়ের মধ্যে বিবাহকার্য সম্পাদন করেন।

৩৫ হিজরীর ১৮ জিলহজ্ব হযরত আলী (আ.) খেলাফতের দায়িত্ব লাভ করেন । এর পরপরই তাকে বিদ্রোহ দমনে পদক্ষেপ নিতে হয়। ৩৬ হিজরীর জঙ্গে জামাল-এর পর তিনি সিরিয়ার বিদ্রোহ দমনের সুবিধার্থে ইসলামী খেলাফতের কেন্দ্র মদীনা মুনাওয়ারা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত করেন । হযরত আলীর সাথে হযরত ইমাম হাসান ,হযরত ইমাম হোসাইন এবং হযরত যায়নাবও কুফায় চলে যান।

মুসলিম উম্মাহর খলিফার কন্যা হিসাবে কুফায় হযরত যায়নাব অত্যন্ত মর্যাদার জীবনের অধিকারী ছিলেন । তা ছাড়া তারা জ্ঞান-গরিমার খবর আগেই কুফাবাসীর নিকট পৌছে ছিল। তাই হযরত যায়নাব কুফায় এসেছেন জানতে পেরে সেখানকার মহিলারা দীনী জ্ঞানার্জনের জন্য তার নিকট ভিড় জমাতে থাকেন। বিশেষ করে হযরত যায়নাব তাদের সামনে নিয়মিত কুরআন মজীদের তাফসীর করতেন এবং তারা তার নিকটে এসে খোদায়ী কালামের গভীর জ্ঞানের সাথে পরিচিত হতেন।

হযরত আলীর শাহাদাতের পর হযরত ইমাম হাসান মুসলিম জাহানের খলিফার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছয় মাস এ দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর মুসলিম উম্মাহকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ণ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষে ৪১ হিজরীর ২৫ রবিউল আউয়াল এক শান্তি চুক্তির মাধ্যমে তিনি আমীর মু আবিয়ার অনুকূলে খেলাফত ত্যাগ করেন। অতঃপর হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনী স্বীয় পরিবার-পরিজনসহ মদীনায় ফিরে আসেন।

হযরত যায়নাব ও তাদের সাথে মদীনায় ফিরে আসেন। এর পর দীর্ঘ বিশ বছর তিনি মদীনায় অবস্থান করেন। হিজরী ৬০ সালের রজব মাসে আমীর মু আবিয়ার মৃত্যু হলে ইয়াযীদ নিজেকে মুসলিম জাহানের খলিফা হিসাবে ঘোষণা করে । আমীর মু আবিয়া মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বেই ইয়াযীদের অনুকূলে প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বাই আত গ্রহণ করে তার ক্ষমতারোহণের পথ নিষ্কন্টক করে যান। হযরত ইমাম হোসাইনসহ কেবল চার ব্যক্তি এ বাই আতের বাইরে ছিলেন । আমীর মু আবিয়া তার দীর্ঘকালীন রাজনেতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ইয়াযীদকে অসিয়ত করে যান যাতে সে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর নিকট থেকে বাই আত আদায়ের চেষ্টা না করে ;বরং তকে স্বাধীনভাবে নিজের মতো চলতে দেয়। কিন্তু উদ্ধত অহঙ্কারী ইয়াযীদ সে উপদেশকে গুরুত্ব না দিয়ে তার অনুকূলে হযরত ইমাম হোসাইনের নিকট থেকে বাই আত আদায়ের জন্য মদীনার উমাইয়্যা আমীরকে নির্দেশ দেয়। মদীনার আমীর ওয়ালিদ বিন উতবাহ ইয়াযীদের নির্দেশ অনুযায়ী তার নিকট বাইআত দাবি করে । কিন্তু ইমাম এ দাবি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ ,ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পক্ষে ইয়াযীদের মতো চরিত্রহীন ব্যক্তিকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নেয়ার প্রশ্নই ওঠেনা।

এমতাবস্থায় ইমাম হোসাইন মদীনা থেকে বেরিযে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি জানতেন যে ,ইয়াযীদ তার নিকট থেকে বাই আত আদায়ের জন্য শক্তি প্রয়োগ করবে যার পরিণাম যুদ্ধ ও ব্যাপক রক্তপাত । কিন্তু তিনি সর্বান্তঃকরণে রক্তপাত এড়াতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি স্বীয় পরিবার - পরিজন নিয়ে ২৮ রজব রাতে মদীনা ত্যাগ করে মাক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। বনী হাশেমের যুবকগণও তার সঙ্গী হন। সর্বাবস্থায় ইমাম হাসানের সাথী প্রিয় বোন হযরত যায়নাবও তার সাথে রাওয়ানা হন ;সাথে নেন তার দুই পুত্র আওন ও মুহাম্মাদকে। স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে জা ফর তাইয়ার ,দুই পুত্র আকবার ও আব্বাস এবং কন্যা কুলসুমকে মদীনায় রেখে যান।

কারবালায় বীর নারী

হযরত ইমাম হোসাইন ৩ শা বান মক্কা মু আয্যামায় এসে পৌছেন এবং মসজিদুল হারামে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু মদীনার উমাইয়্যা আমীর ওয়ালিদ বিন উতবাহ ইয়াযীদকে খুশি করার লক্ষ্যে মক্কায় ঘাতকদল প্রেরণ করে । তারা ইমামকে হত্যার জন্য সুযোগ খুজতে থাকে। ইমাম তা জানতে পারেন। কিন্তু তিনি চাচ্ছিলেন না যে ,মসজিদুল হারামে তার রক্তপাত ঘটুক। ঘাতকরা হজ্বের সময় তাকওয়াফকারীদের ভিড়ের মধ্যে ইমামকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্য দিকে কুফার লোকদের পক্ষ থেকে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দান ও খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তার নিকট একের পর এক পত্র আসছিল ;তাদের ডাকে সাড়া দেয়ারও প্রয়োজন ছিল । এমতাবস্থায় ইমাম ৮ জিলহজ্ব মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।

কুফার পথে কারবালায় উপনীত হবার পর হযরত ইমাম হোসাইন ইয়াযীদের অনুগত বাহিনী দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হন। তারা ইমামের কুফায় গমনের পথ বন্ধ করার সাথে সাথে তাদের জন্য ফোরাত নদীর পানিও বন্ধ করে দেয়। তারা ইমামকে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই আত হবার জন্য চাপ দেয়। তখন ইমাম হোসাইন তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেন ,তা হচ্ছে : তিনি মক্কায় প্রত্যাবর্তন করবেন ,অথবা দামেশকে গিয়ে সরাসরি ইয়াযীদের মুখোমুখি হবেন অথবা ইয়াযীদের শাসনাধীন এলাকার বাইরে চলে যাবেন। কিন্তু ইয়াযীদী বাহিনীর অধিনায়করা তা মানতে রাযী হয়নি। তারা বাই আত ,স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করে কুফা হয়ে দামেশকে নীত হওয়া অথবা যুদ্ধ এ তিনটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করে । বলা বাহুল্য যে ,ইমামের পক্ষে প্রথম দুই প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না ,তাই বাধ্য হয়ে তাকে যুদ্ধ ও শাহাদাতের পথ বছে নিতে হয়।

৬১ হিজরীর দশ মুহররম মানব জাতির ইতিহাসের সর্বাধিক বিয়োগান্তক ঘটনার দিন। প্রথমে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর ৫০ জন সহচর ইয়াযিদী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। এর পর হুর বিন ইয়াযীদ ও তার সঙ্গীরা যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। অতঃপর ইমামের পরিবারের যুবকদের ও স্বজনদের যুদ্ধের পালা। এ সময় হযরত যায়নাব তার দুই পুত্র আওন ও মুহাম্মাদকে ইমামের পুত্রদের আগে যুদ্ধে পাঠান এবং উভয়ই শাহাদাত বরণ করেন।

আওন ও মুহাম্মাদ শহীদ হলে ইমাম হোসাইন উভয়ের লাশ মোবারক এনে তার সামনে রাখেন। কিন্তু হযরত যায়নাব পুত্রদের শাহাদাতে সামান্যতমও ক্রন্দন বা মনোবেদনা প্রকাশ করেননি। এমনকি শহীদদ্বয়ের লাশ দেখার জন্য তাবুর বাইরেও যাননি। কিন্তু এরপর যখন ইমাম হোসাইন (আ.) -এর জৈষ্ঠপুত্র আলী আকবার রণাঙ্গনে গিয়ে শহীদ হলেন এবং ইমাম তার লাশ নিয়ে এসে তার শাহাদাতের কথা ঘোষণা করলেন তখন হযরত যায়নাব অস্থিতার সাথে তাবু থেকে বেরিযে এলেন এবং আলী আকবারের লাশ জড়িয়ে ধরে এমনই বিলাপ করলেন যা কেবল কোনো মায়ের পক্ষে স্বীয় নিহত সন্তানের জন্য করা সম্ভব।

নিজ সন্তানের শাহাদাতের কারণে হযরত যায়নাবের মোটেই ব্যথিত না হওয়া ও আলী আকবারের শাহাদাতে বিলাপ করার মধ্যে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এবং অত্যন্ত উচুমানের আধ্যাত্মিক শিক্ষা নিহিত রয়েছে । তা হচ্ছে ,মানুষ যখন খালেসভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারই রাস্তায় কোনো কিছু দান করে ,তখন ঐ বস্তুর ওপরে তার মালিকানার বিন্দুমাত্র অনুভূতি থাকে না। অতঃপর ঐ বস্তুর কী হলো তা তার অন্তরে কোনোরূপ ভাবান্তর সৃষ্টি করেনা । দানকৃত বস্তুর প্রতি সামান্যতম আকর্ষণ ও বজায় থাকার মানে হচ্ছে তার দান পুরোপুরি খালেস নয়। মোখলেস দাতা দানকৃত বস্তুর প্রতি কখনো ফিরে তাকায়না। এমনকি অনিচ্ছা সত্বেও চোখে পড়ে গেলে লজ্জিতভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। কারণ ,এভাবে দৃষ্টি পড়ার কারণে দানগ্রহীতার মনে হতে পারে যে ,দাতা বোধ হয় দানকৃত বস্তুর মায়া পুরোপুরি কাটাতে পারেনি। দাতা আরো এক কারণে লজ্জিত হতে পারে ,তা হচ্ছে ,দানকৃত বস্তুকে দাতার প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট মনে না হওয়া ,অথচ ঐ মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি কিছু দিতে সক্ষম না হওয়া।

দ্বিতীয়ত হযরত যায়নাব হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -কে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাই ইমামের সন্তান তার নিকট নিজের ও নিজের সন্তানের চেয়েও প্রিয়তর ছিল । এ কারনেই আলী আকবারের শাহাদাতে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি ,বরং বিলাপে ভেঙ্গে পড়েন।

হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পর তার পরিবারের নারী ও শিশুদের এবং অসুস্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) -এর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন হযরত যায়নাব । অসাধারণ ধৈর্যের সাথে তিনি কারবালার বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আতঙ্কে ছড়িয়ে পড়া ইমাম -পরিবারের সদস্যদের একত্র করেন এবং অসুস্থ ও আহতদের সেবাশুশ্রূষা করেন।

কুফাবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ

ইয়াযীদের অনুগত বাহিনী হযরত যায়নাব ও হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) সহ আহলে বাইতের নারী ও শিশুদেরকে বন্দি করে কুফায় নিয়ে যায়। কুফাবাসী বন্দিদের নিয়ে আসার দৃশ্য দেখার জন্য কুফার রাস্তায় জমা হয় । বন্দিদেরকে দেখার পর তাদের অনেকের চোখ অশ্রু সিক্ত হয়। তখন হযরত যায়নাব তাদের মধ্যে বিবেকের দংশন সৃষ্টির জন্য তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে বক্তব্য রাখেন। কারণ ,তারা ইমাম হোসাইনকে কুফায় এসে ইয়াযীদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব প্রদান ও খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেছিল । কিন্তু পরে তারা অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং ইমামের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে ।

হযরত যায়নাব কুফাবাসীকে সম্বোধন করে প্রাঞ্জল ভাষায় যে জ্বালাময়ী ভাষণ দেন তা মানব জাতির ইতিহাসে সর্বাধিক স্মরণীয় ভাষণসমূহের অন্যতম। তিনি বলেন : হে কুফার জনগণ! হে বাহানার আশ্রয়গ্রহণকারিগণ! হে প্রতারণার আশ্রয়গ্রহণকারিগণ! তোমরা আমাদের জন্য ক্রন্দন করছো ;তোমাদের চোখের অশ্রুপ্রবাহ যেন বন্ধ না হয় ,তোমাদের বিলাপ যেন নীরব হয়ে না যায়। তোমরা হচ্ছ সেই নারীর সমতুল্য যে তার সুতাকে মজবুত বুননে গেথে দেবার পর আবার তা খুলে ফেলছিলো ,তারপর তার প্রতিটি তন্তুকে আলাদা করে ফেলছিলো। তোমরা তোমাদের ঈমানের সুত্রকে ছিন্ন করে ফেলেছো এবং তোমাদের মূল কুফরে ফিরে গিয়েছো। তোমরা কি তোমাদের শপথের ব্যাপারে প্রতারণা ও বিশ্বাস ঘাতকতা করতে চাও ? তোমাদের কাছ থেকে মিথ্যা দাবি ,রিয়াকারী কলুষতা ,চাটুকারিতা ,হীনতা-নীচতা আর কথার ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছুই আশা করা যায় না। হে লোকেরা! তোমরা আবর্জনার স্তুপে জন্মগ্রহণকারী উদ্ভিদের ন্যায় অথবা এমন রৌপ্য ও চক-পাথর সমতুল্য যার ওপরে আলকাতরা লেপন করা হয়েছে। তোমরা তোমাদের পরকালের জন্য এই খারাপ পাথেয় প্রেরণ করেছো। তোমাদের ওপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিপতিত হোক । তোমাদের জন্য আল্লাহর আযাব প্রস্তুত হয়ে আছে যেখানে তোমরা চিরদিন থাকবে। হে কুফাবাসী! তোমরা কি আমাদের জন্য ক্রন্দন ও বিলাপ করছো ? আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি তোমরা অনেক বেশি কাঁদো এবং খুব কম হাসো। কারণ ,তোমরা নিজেদের জন্য চিরন্তন অপরাধ ও লাজ্জা রেখে এসেছো এবং চিরন্তন লাঞ্ছনা খরিদ করছো। তোমরা কোনোদিনই নিজেদের থেকে এ লাঞ্ছনা দূর করতে সক্ষম হবে না। আর কোনো পানি দ্বারাই তা ধুয়ে ফেলতে পারবেনা। তোমরা কীদিয়ে (এ লাঞ্ছনা ও লজ্জাকে) ধুয়ে ফেলবে ? কোন কাজের দ্বারা এর ক্ষতিপূরণ করবে ? হোসাইন হচ্ছেন খাতামুন্নাবিয়্যিনের কলিজার টুকরা ,বেহেশতে যুবকদের নেতা ;তোমরা তাকেই হত্যা করেছো। তিনি ছিলেন তোমাদের সেরা মানুষদের আশ্রয়স্থল। যে কোন অবস্থায় ,যে কোন ঘটনায় তোমরা তার নিকট আশ্রয় নিতে ;তিনি তোমাদের ঐতিহ্যকে বাস্তবায়ন করতেন। তোমরা তার নিকট থেকে ধর্ম ও শরীয়তের শিক্ষা গ্রহণ করতে । হে লোকেরা! তোমরা অত্যন্ত খারাপ ধরনের পাপাচারে জড়িয়ে পড়েছো। আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে গিয়েছো। তোমাদের চেষ্টা-সাধনায় আর কী ফায়দা! তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতিতে নিমজ্জিত হয়েছো। তোমরা আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত হয়ে গেছো এবং তোমাদের নিজেদের জন্য নিকৃষ্ট আবাসস্থল ক্রয় করেছো। তোমাদের জন্য আফসোস ,হে কুফার জনগণ! কারণ ,তোমরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কলিজার টুকরাকে ছিন্নভিন্ন করেছো এবং তার পরিবারের পর্দানসীনা নারীদেরকে পর্দার বাইরে নিয়ে এসেছো। আল্লাহ তা আলার মনোনীত ব্যক্তির [রাসূল (সা.)-এর ] সন্তানদের থেকে কতই না রক্ত প্রবাহিত করেছো! হে জনগণ! তোমরা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও জঘন্য কাজ করেছো-যার কদর্যতা আসমান ও যমিনকে আবৃত করে ফেলেছে । তোমরা কি এতে বিস্মিত হয়েছো যে ,আসমান থেকে রক্ত বৃষ্টি হয়েছে! অবশ্য আখেরাতের শাস্তি তোমাদেরকে অধিকতর লাঞ্ছিত করবে এবং তখন কেউ তোমাদেরকে সাহায্য করতে আসবেনা। আল্লাহ তা আলা তোমাদেরকে যে অবকাশ দিয়েছেন ,সে কারণে তোমাদের আরামের নিঃশ্বাস ফেলার কোনো কারণ নেই। কারণ ,আল্লাহ তা আলা পাপাচারীদের শাস্তি দানের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করেন না এবং কালের প্রবাহে প্রতিশোধ গ্রহণের বিষয়টি পিছিয়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হননা। তোমাদের রব পাপাচারীদের প্রতি দৃষ্টি রাখছেন।

হযরত যায়নাব (আ.)-এর এ ভাষণ কুফার জনগণের অন্তরে তীব্র দংশন সৃষ্টি করে। তারা বুঝতে পারে যে ,তারা এমন এক পৈশাচিক অপরাধ করেছে মানব জাতির ইতিহাসে যার দৃষ্টান্ত নেই। এ ভাষণ তাদের অচেতন অবস্থা থেকে চেতনায় ফিরিয়ে আনে। ফলে অচিরেই ইয়াযিদী জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। পরবর্তীকালে মুখতারের অভ্যুত্থান নামে খ্যাত অভ্যুত্থানের প্রচণ্ড আঘাতে জালিমদের প্রাসাদ ধসে পড়ে।

ইবনে যিয়াদের সাথে বিতর্ক

হযরত যায়নাব (আ.) -সহ আহলে বাইতের বন্দিদেরকে কুফায় ইয়াযীদের নিয়োজিত আমীর ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হযরত যায়নাব ও ইবনে যিয়াদের মধ্যে যে বাকযুদ্ধ সংঘটিত হয় কার্যত তাতেই ইবনে যিয়াদের পতন নিশ্চিত হয়ে যায়। কারণ ,হযরত যায়নাব তাকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করেন এবং তার স্বরূপ সর্বসমক্ষে উম্মুক্ত করে দেন। ফলে মনের দিক থেকে সকলেই তার বিরুদ্ধে চলে যায়।

ইবনে যিয়াদ হযরত যায়নাব কে চিনতে পেরে তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে । ইবনে যিয়াদ বলে : সকল প্রশংসা আল্লাহর ,যিনি তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন এবং তোমাদের পুরুষদেরকে হত্যা করেছেন ,আর তোমাদের বাগাড়ম্বরকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। সাথে সাথে হযরত যায়নাব জবাব দিলেন : সকল প্রশংসা আল্লাহর ,যিনি তার নবী মুহাম্মাদ (সা.) -এর বদৌলতে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন এবং আমাদেরকে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করেছেন।( হযরত যায়ন াব এখানে আয়াতে তাতহীর নামে খ্যাত আল - আহযাবের ৩৩নং আয়াতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যাতে আহলে বাইতের সদস্যদের পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে। এ আয়াতে আল্লাহ তা আলা এরশাদ করেনঃ হে আহলে বাইত ! অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভূত করতে এবং তোমাদেরকে যথাযথভাব ে পবিত্র করতে চান। ) অবশ্যই ফাসেক লাঞ্ছিত হবে এবং ফাজের (পাপাচারী) মিথ্যা বলছে ;আর সে ব্যক্তি আমরা ছাড়া অন্য কেউ। তাই সকল প্রশংসা আল্লাহর ।

ইবনে যিয়াদ এ ধরণের জবাবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। তাই এভাবে লাঞ্ছিত হয়ে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং হযরত যায়নাবকে যে কোনভাবে লাঞ্ছিত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এবার ইবনে যিয়াদ নতুন করে বিদ্রূপবাণ ছুড়ে দিল : আল্লাহ তোমার ভাইয়ের সাথে যে আচরণ করলেন তা কেমন দখলে ? সে খলীফা ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ছিল ও প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছিল ,তাই আল্লাহ তাকে হতাশ করলেন এবং ইয়াযীদকে সাহায্য করলেন। জবাবে হযরত যায়নাব বললেন : আমরা এতে উত্তম বৈ কিছু দেখিনি। আল্লাহ তা আলা আমার ভাইকে শাহাদাতের মর্যাদায় পৌছিয়ে সম্মানিত করেছেন। আমার ভাই সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছেন ,আর তা হচ্ছে তার রাস্তায় নিহত হওয়া। আল্লাহর পক্ষ থেকে এর চেয়ে উত্তম আচরণ আর উত্তম বেচা-কেনা কী হতে পারে ? আল্লাহ তাদের জন্য শাহাদাত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন । তোমাকে এবং তুমি যাদেরকে হত্যা করেছ তাদেরকে খুব শীঘ্রই আল্লাহ তা আলা বিচারার্থে তার আদালতে হাজির করবেন। অতএব ,জবাব দেয়ার জন্য প্রস্তুত হও । কী জবাব দেবে সেদিন ? সেদিনর জন্য উদ্বিগ্ন হও । কে সেদিন বিজয়ী ও সফল হবে ,হে যেনাকারিণীর পুত্র ? ( ঐতিহাসিক গণ এ ব্যাপারে একমত যে , ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ ছিল তার মায়ের জারজ সন্তান )

এতে ইবনে যিয়াদ তীরবিদ্ধ নেকড়ের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু দেয়ার মতো উপযুক্ত জবাব তার কাছে ছিল না। তাই চরম নির্লজ্জতার সাথে বলল : আমার অন্তর শীতল হয়েছে ,আমি খুশি হয়েছি। কারণ ,আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি।

জবাবে হযরত যায়নাব বললেন : তুমি দুনিয়ার দ্বারা নেশাগ্রস্ত ,প্রতারিত ও ফিতনাগ্রস্ত। কিন্তু তোমার এ আধিপত্য টিকে থাকবেনা ,বরং খুব শীঘ্রই বিলুপ্ত হবে । তুমি কি মনে করেছো যে ,হোসাইনের পরে তুমি আনন্দের সাথে পৃথিবীতে চিরদিন টিকে থাকবে ? তুমি কি মনে করছো যে ,স্বস্তিতে থাকবে ? কখনো নয় ;তুমি স্বস্তির মুখ দেখবে না। তুমি তোমার অভীষ্ট লক্ষে উপনীত হতে পারবে না। হে ইবনে যিয়াদ ! তুমি নিজ হাতে নিজের ওপর যে কলঙ্ক লেপন করেছ তা অনন্তকাল পর্যন্ত থেকে যাবে।

এতে দিশেহারা ,অস্তির ও ক্ষিপ্ত হয়ে ইবনে যিয়াদ চিৎকার করে উঠল : আমাকে এ নারীর হাত থেকে মুক্তি দাও ;ওদেরকে কারাগারে নিয়ে যাও ।

ইবনে যিয়াদের নির্দেশমতো হযরত যায়নাব সহ বন্দিদেরকে কুফার প্রাসাদের কাছে কারাগারে আটক রাখা হলো এবং হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কর্তিত শির কুফার রাস্তায় রাস্তায় ও বাজারে ঘুরিয়ে লোকদের দেখানো হলো ।

বন্দিদেরকে কিছুদিন কুফার কারাগারে আটক রাখা হলো । এর পর হযরত ইমামের শির মোবারকসহ তাদেরকে দামেশকে ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলো ।

ইয়াযীদের দরবারে

হযরত যায়নাবসহ বন্দিদেরকে ইয়াযীদের দরবারে হাজির করার আগেই ইয়াযীদের সামনে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কর্তিত মস্তক পেশ করা হয়। বন্দিরা যখন দরবারে প্রবেশ করেন তখন ইয়াযীদ ও তার পরিষদবর্গ হাসিঠাট্টায় মশগুল ছিল । হযরত ইমামের শিরের প্রতি দৃষ্টি পড়তেই নিজের অজান্তেই হযরত যায়নাব ফরিয়াদ করে ওঠেন : হায় আমার প্রিয়! হায় মক্কা তনয়ের (অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) -এর । কা বাগৃহে তার জন্ম হয়েছিল বলে বর্ণিত আছে) হৃদয়ের ফসল! হায়া মুস্তাফা-তনয়ার (অর্থাৎ হযরত ফাতেমা (আ.) -এর ) পুত্র!...

হযরত যায়নাবের হৃদয়বিদারক ফরিয়াদে মূহুর্তের মধ্যে মজলিসের হাসি-আনন্দ নিভে যায়। অতঃপর হযরত যায়নাব ও ইয়াযীদের মধ্যে কিছুক্ষণ বাকযুদ্ধ চলে এবং এ বাকযুদ্ধে হযরত যায়নাবের কথায় ইয়াযীদ চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়।

হযরত যায়নাবের ফরিয়াদে মজলিসে নীরবতা নেমে এলে কিচুক্ষণ পর সিরীয় এক ব্যক্তি নীরবতা ভঙ্গ করে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কন্যা ফাতেমাকে দাসী হিসাবে দেয়ার জন্য ইয়াযীদের কাছে অনুরোধ জানায়। এতে ফাতেমা ভয় পেয়ে তার ফুফুকে জড়িয়ে ধরলে হযরত যায়নাব তাকে সান্তনা দিয়ে বলেন : শান্ত হও ;এ হওয়ার নয় ;কেউ ,এমনকি ইয়াযীদও তোমাকে দাসী বানাতে পারবেনা।

হযরত যায়নাবের এ উক্তিতে ইয়াযীদের অহংবোধে দারুণ আঘাত লাগে । তাই সে বলে : আমি চাইলে হোসাইনের কন্যাকেও দাসী বানাতে পারি ;এতে কোনো সমস্যা নেই। হযরত যায়নাব দৃঢ়তার সাথে বললেন : তা পারবে না ,যদি না আমাদের দীন ও আমাদের মিল্লাত থেকে বেরিযে যাও ।

ইয়াযীদ তার অহংবোধ চরিতার্থ করতে গিয়ে এভাবে অপমানিত হবে তা ভাবতেও পারেনি। তাই হযরত যায়নাবকে পাল্টা অপমান করার জন্য বলল : নিঃসন্দেহে তোমার বাবা ও তোমার ভাই-ই আল্লাহর দ্বীন থেকে বেরিযে গেছে। সাথে সাথে হযরত যায়নাব দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিলেন : আমার পিতা ও আমার ভ্রাতার দ্বীনের দ্বারাই তুমি পথ পেয়েছো যদি তুমি মুসলিম হয়ে থাকো।

হযরত যায়নাব সুস্পষ্ট ভাষায় ইয়াযীদের মুসলমান হওয়ার বিষয়টিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেন। এর কোনো জবাব না থাকায় ইয়াযীদ ক্ষিপ্ত হয়ে (চিৎকার করে) বলে : মিথ্যা বলছ ,হে আল্লাহর দুশমন!

এ ধরনের গালির জন্য হযরত যায়নাব প্রস্তুত ছিলেন না ,তাই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।কিন্তু শীঘ্রই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন : যেহেতু ক্ষমতা তোমার হাতে তাই গালি দিচ্ছো ,মন্দ বলছো ,জুলুম করছো।

এ কথার কোনো জবাব খুজে না পেয়ে ইয়াযীদ নীরব হলো । কিন্তু এ সময় সেই সিরীয় ব্যক্তি ফাতেমা বিনতে হোসাইনকে দাসী হিসাবে দেয়ার জন্য ইয়াযীদের কাছে পুনরায় অনুরোধ জানায়। এতে যায়নাব তেজোদীপ্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। নাসেখুত তাওয়ারীখ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ,হযরত যায়নাব লোকটিকে দৃঢ়কণ্ঠে ধমক দিয়ে বললেন : চুপকরো ,আল্লাহ তোমার কণ্ঠরোধ করে দিন ,তোমাকে অন্ধকরে দিন ,তোমার হাতকে অবশ করে দিন এবং তোমাকে দোযখের আগুনে জায়গা দিন ;রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সন্তানগণ (বংশধরগণ) যেনাকারিণীর সন্তানের খেদমতে নিয়োজিত হবে না কখনোই। সাথে সাথেই অভিশপ্ত সিরীয় লোকটির দু হাত অবশ হয়ে যায় এবং সে সেখানেই মারা যায়।

এভাবে হযরত যায়নাব (আ.) -এর নিকট থেকে কারামত প্রকাশিত হওয়ায় ইয়াযীদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং পরিবেশ পরিবর্তনের লক্ষে মদপান ও কবিতা আবৃতি শুরু করে । তখন হযরত যায়নাব (আ.) বলেন : হে ইয়াযীদ ! হোসাইনকে হত্যা করাই কি তোমার জন্য যথেষ্ট হয়নি ? তুমি তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে ;হত্যা করেছো। তোমার জন্য এটাইকি যথেষ্ট নয় যে ,তার পরিবার-পরিজনকে বন্দি করেছো শহরে শহরে ঘুরিয়েছো এবং এই অবস্থায় তোমার দরবারে নিয়ে এসেছো ? আর এখন তার কর্তিত মস্তকের সাথে এ আচরণ করছো!

জবাবে ইয়াযীদ বলল : তোমার ভাই হোসাইন কি বলতনা :‘‘ আমি ইয়াযীদের চেয়ে উত্তম ।’’ ? হোসাইন কি বলতনা :‘‘ আমার পিতা ইয়াযীদের পিতার তুলনায় উত্তম’’ ? সে কি বলতনা :‘‘ আমার মাতা ইয়াযীদের মাতার চেয়ে উত্তম’’ ? জবাবে হযরত যায়নাব শুধু এতটুকু বললেন : তোমার কি বিশ্বাস হয় না যে ,হোসাইন তোমার চেয়ে উত্তম ,তার পিতা তোমার পিতার চেয়ে উত্তম ,তার মাতা তোমার মাতার চেয়ে উত্তম ?

এবার ইয়াযীদ এক নতুন কুটকৌশলের আশ্রয় নিল। বলল : তোমার ভাই কি এ আয়াত পড়েনি যে ,আল্লাহর হাতেই রাজত্ব এবং তিনি যাকে চান রাজত্ব দেন ,যার কাছ থেকে চান রাজত্ব ফিরিয়ে নন ,যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন ,যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন ;তার হাতেই কল্যাণ নিহিত ? কুরআন মজীদের সূরা আলে ইমরানের ২৬ নং আয়াত উদ্ধৃত করে ইয়াযীদ বলল : তোমার ভাই কি এ আয়াত পড়েনি ? যদি পড়ে থাকে তাহলে তার জানা উচিত ছিল যে ,সত্য আমার অনুকূলে ;আল্লাহ তোমার পিতার কাছ থেকে রাজত্ব নিয়ে আমার পিতাকে দিয়েছেন এবং হোসাইনকে লাঞ্ছিত করেছেন ও আমাকে সম্মানিত করেছেন।

ইয়াযীদ এভাবে কুরআন মজীদের অপব্যাখ্যা করায় হযরত যায়নাব এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দান করেন যা মানব জাতির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ হিসাবে পরিগণিত।

হযরত যায়নাব -এর ভাষণ

হযরত যায়নাব (আ.) ইয়াযীদের দরবারে নিম্নোক্ত ভাষণ দেন : আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা রাসূলিহি ওয়া আলিহি আজমা ঈন। পরম প্রমুক্ত আল্লাহ তা আলা সত্য বলেছেন। যারা খারাপ কাজ করেছে তাদের পরিণতি এই হয়েছে যে ,তারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করেছে এবং তা নিয়ে উপহাস করেছে। হে ইয়াযীদ ! তুমি কি মনে করছ যে ,তুমি এমনভাবে আমাদের জন্য ভূ-পৃষ্ঠের সকল জায়গাকে ও আকাশের দিগন্তসমূহকে রুদ্ধ করে দিয়েছো যে ,অতঃপর আমরা ক্রীতদাস-দাসীদের মতো অসহায় হয়ে পড়েছি এবং এজন্যই যেদিকে খুশি টেনে নিচ্ছ ? তুমি কি মনে করেছো যে ,আমরা আল্লাহর নিকট তুচ্ছ ,আর তুমি সম্মানিত এবং আমাদের ওপরে তোমার বিজয়ের কারণে তুমি তার নিকট মর্যাদার অধিকারী ? এ কারণেই কি তুমি তোমার নাসিকা উচু করেছো ও অহঙ্কার করেছো এবং আনন্দে আত্মগৌরব করছো যেন গাটা পৃথিবী তোমার ধনুকের আওতার মধ্যে এবং তোমার সকল কাজ কর্মকে সুন্দর ও চমৎকার মনে করছো ? আমাদের শাসন -কর্তৃত্ব (তোমার হাতে গিয়ে) তোমাকে সুখে নিমজ্জিত করেছে ;ধীরে ধীরে তুমি মহিমান্বিত মহা প্রতাপশীল আল্লাহর সেই বাণী ভুলে গিয়েছো : কাফেররা যেন মনে না করে যে ,আমরা যে তাদেরকে অবকাশ দিয়েছি তা তাদের নিজেদের জন্য কাল্যাণকর। বরং আমরা তাদেরকে এজন্যই অবকাশ দিচ্ছি যাতে তাদের পাপসমূহ বৃদ্ধি পায় এবং তাদের জন্য অপমানজনক শাস্তি অবধারিত হয়ে যায়।(সূরা আলে ইমরান : ১৭৮।)

হে সেই ব্যক্তির পুত্র যাকে বন্দি হবার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল( উল্লেখ্য , আমীর মু আবিয়া হযরত রাসূলুল্লাহ ( সা .) কর্তৃক মক্কা বিজয়ের সময় বন্দি হয়েছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিলে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ) ! এটা কি ন্যায়সঙ্গত কাজ যে ,তুমি তোমার পরিবারের নারী ও কন্যাদেরকে সসম্মানে পর্দার অন্তরালে রেখেছো ,আর রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কন্যাদেরকে (তার বংশধর নারী ও কন্যাদেরকে) বন্দি করে যেদিকে খুশি নিয়ে যাচ্ছ ? তুমি তাদের পর্দাকে ছিন্ন করেছো ,তাদের চেহারাকে উম্মুক্ত করেছো ;শত্রুরা তাদেরকে এক শহর থেকে আরেক শহরে টনে নিয়ে গেছে এবং বেগানা ও আদিবাসী লোকেরা তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছে ;কাছের লোক ও দূরের লোকেরা এবং ইতর লোকেরা ও শরীফ লোকেরা তাদেরকে দেখেছে। না তাদের পুরুষদের মধ্য থেকে তাদের কোনো অভিভাবক (বেচে) আছেন ,না তাদের সহায়কদের মধ্য থেকে কোনো সহায়ক (বেচে) আছেন। এমতাবস্থায় কীভাবে তারা এমন এক বন্ধুর আশা করতে পারেন যিনি তার কথার দ্বারা তাদেরকে সান্তনা দেবেন-যার দেহের মাংস শহীদগণের খুন থেকে গঠিত হয়েছে ? এমতাবস্থায় এটা কী করে সম্ভব যে ,যে ব্যক্তি আমাদের আহলে বাইতের প্রতি হিংসা ও ঈর্ষার দৃষ্টি পোষণ করে সে দুশমনী চরিতার্থ করবেনা ? তাই এটাই স্বাভাবিক যে ,তুমি কোনো পপাপবোধ ছাড়াই এবং একাজকে গুরুতর মনে না করেই (কবিতার ভাষায়) বলছ : আহা! তারা (গোত্রের গত হয়ে যাওয়া লোকেরা) যদি থাকতেন এবং আনন্দের সাথে এ প্রতিশোধ গ্রহণ দেখতেন ,তাহলে বলতেন : হে ইয়াযীদ ! তোমার হস্ত প্রকম্পিত না হোক ।’’ আর (এ কথা বলে) বেহেশতে যুবকদের নেতা আবু আবদুল্লাহ হোসাইনের দাতে আঘাত করছো। আর কেনোই বা তুমি তা বলবেনা যখন তুমি মুহাম্মাদ (সা.) এর বংশধরের যখমকে বৃদ্ধি করেছো ,তার দাড়ি (হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর ) উৎপাটিত করেছো ও পুড়িয়েছো এবং তার খুনকে প্রবাহিত করেছো ? অথচ আবদুল মুত্তালিবের এ বংশধর ছিলেন ধরণীর অধিবাসীদের মধ্যে নক্ষত্রতুল্য।

তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের স্মরণ করছো এবং তাদেরকে আহবান করছো। অবশ্য খুব শীঘ্রই তুমি তাদের কাছে প্রেরিত হবে এবং (সেখানে) এরূপ কামনা করবে যে ,(দুনিয়ার বুকে) যদি তোমার হস্তদ্বয় অবশ হয়ে যতো এবং তুমি বোবা হতে ,আর যা বলেছো তা না বলতে ও যা করেছো তা না করতে !

হে আল্লাহ! আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের অধিকার আদায় করো ,যারা আমাদের ওপর জুলুম করেছে তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করো ,আর যারা আমাদের রক্ত প্রবাহিত করেছে তাদের জন্য তোমার গযব অবধারিত করো। সে আমাদের সহায়কদেরকে হত্যা করেছে।

আল্লাহর কসম! তুমি তা কেবল নিজের চামড়াকেই (কেটে) ফাক করেছো ,কেবল নিজের মাংসকেই টুকরা টুকরা করেছো। তুমি অচিরেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহ) -এর বংশধরদের রক্তপাতের এবং তার স্বজনদের ও যারা তার শরীরের অংশস্বরূপ তাদের সম্ভ্রমহানির দায় বহনরত অবস্থায় তার নিকট প্রেরিত হবে । অন্যদিকে আল্লাহ তাদের (আহলে বাইতের বেচে থাকা সদস্যদের । ) পরেশানী ও দুশ্চিন্তা -উদ্বেগকে দূর করে দেবেন এবং তাদের বিক্ষিপ্ততার অবসান ঘটাবেন ,আর তাদের অধিকার আদায় করবেন (তাদেরকে হত্যা ও তাদের প্রতি জুলুমের প্রতিশোধ নেবেন) । আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়েছে তোমরা তাদেরকে মৃত মনে করোনা ,বরং তারা তাদের রবের নিকট জীবিত-রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছে। (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯) আর বিচারক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং প্রতিপক্ষ (অভিযোগকারী) হিসাবে মুহাম্মাদ (সা.) ও পৃষ্ঠপোষক হিসাবে জিবরাঈলই যথেষ্ট ।

যে ব্যক্তি (আমীর মু আবিয়ার প্রতি ইঙ্গিত) তোমার জন্য এসবের ব্যাবস্থা করেছে এবং তোমাকে মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে সে অচিরেই জানতে পারবে যে ,জালিমদের জন্য কতই না মন্দ প্রতিদান রয়েছে এবং (এ-ও জানতে পারবে যে) তোমাদের মধ্যে কার অবস্থান নিকৃষ্টতর ,আর কার বাহিনী দুর্বলতর !

যদিও ঘটনাচক্র আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে বাধ্য করেছে ,কিন্তু আমি তোমাকে খুবই তুচ্ছ ও নীচ মনে করি এবং তোমাকে কঠোরভাবে তিরস্কার করছি ও অনেক বেশি নিন্দা করছি ,কিন্তু (আমার ভাইয়ের হত্যার কারণে মুসলমানদের) দৃষ্টিসমূহ অশ্রুসজল আর হৃদয়সমূহ কাবাবসম দগ্ধীভূত।

বড়ই বিস্ময়কর ব্যাপারে যে ,শয়তানের দলের হাতে আল্লাহর দলের সদস্যরা নিহত হয়েছেন এবং তোমাদের মুখ থেকে আমাদের মাংস চর্বিত হয়ে পড়েছে ,আর ঐ পবিত্র লাশগুলোকে নেকড়েরা ঘিরে রেখেছে ও চিতারা তাদেরকে টানাহেচড়া করছে।( তোমাদের মুখ থেকে ...টানাহেচড়া করছে। রূপক অর্থে জুলুম-নির্যাতন ও অবমাননা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে।)

আজকে যদি তুমি আমাদেরকে গনিমত হিসাবে গণ্য করে থাক ও লাভজনক মনে করে থাকো ,তাহলে খুব শীঘ্রই আমাদেরকে তোমার লোকসান ও ক্ষতির কারণ হিসাবে দেখতে পাবে-যখন তোমার হস্তদ্বয় যা পাঠিয়েছে তা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না। আর তোমার রব বান্দার ওপর জুলুমকারী নন। (সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ: ৪৬। ) অতএব ,তুমি যে ষড়যন্ত্রই করতে চাও করো যে চেষ্টাই করতে চাও কারো ,সমস্ত সাধনাকে কাজে লাগাও । কিন্তু আল্লাহর কসম ,আমাদের স্মরণ বিলুপ্ত করতে পারবে না এবং আমাদের (নিকট আগত) ওহীকে দূর করে দিতে পারবে না ,আমাদের অবস্থানে কখনোই তুমি পৌছতেঁ পারবে না এবং এই (আমাদের ওপর জুলুম-অত্যাচারের) কলঙ্ক ঘুচাতে পারবে না। তোমার অভিমত একেবাই মূল্যহীন ,তোমার (রাজত্বের) দিনসমূহ কয়েক দিন বৈ নয় ;আর যেদিন ঘোষণাকারীরা ঘোষণা প্রদান করবে সেদিন তোমার লোকজনরা পেরেশানীর কবলে নিক্ষিপ্ত হবে।

মনে রেখো ,জালেমদের ওপর আল্লাহর লা নত। অতএব ,সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের রব আল্লাহর জনন্য যিনি আমাদের অগ্রবর্তীদের জন্য সৌভাগ্য ও ক্ষমার পরিণতি দিয়েছেন এবং আমাদের মধ্যকার অনুবর্তীদেরকে শাহাদাত ও রহমতের পরিণতি দিয়েছেন। আমরা আল্লাহর নিকট দো আ করি ,তিনি তাদের শুভ প্রতিদান পূর্ণ করে দিন এবং তাদেরকে (স্বীয় অনুগ্রহ) বৃদ্ধি করে দিন এবং আমাদেরকে তাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী করুন। অবশ্যই তিনি দয়াবান ,প্রেমময়। আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং কতই না উত্তম অভিভাবক তিনি ! (সূরা আলে ইমরান : ১৭৩ )

হযরত যায়নাব (আ.) -এর এ ভাষণ ইয়াযীদের পরিষদবর্গের অনেকের মধ্যেই ভাবান্তর সৃষ্টি করে । পরে এ ভাষণ তাদের মাধ্যমে দামেশকের জনগণের মধ্যে এবং অচিরেই তৎকালীন মুসলিম জাহানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ও বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি কিরে। কারবালার ঘটনার দশ বছরের মধ্যে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের লক্ষে উমাইয়্যা শাসনের বিরুদ্ধে মুখতারের অভ্যুত্থানসহ বহু বিদ্রোহ ও অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। শুধু আরব উপদ্বীপেরই চার লক্ষ লোক ইমাম হোসাইনের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য অভ্যুত্থান করে । বস্তুত হযরত যায়নাবের ভাষণই উমাইয়্যা শাসন উৎখাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ।

মদীনায় প্রত্যাবর্তন

হযরত যায়নাবের ভাষণের পর আর ইয়াযীদের পক্ষে আহলে বাইতের সদস্যদের ওপর জুলুম-অত্যাচার অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না। তাই সে তাদেরকে মুক্তি দেয় এবং মদীনায় ফিরে যাবার অনুমতি দেয়। সে সাথে তাদের নিরাপত্তার জন্য একদল সশস্ত্র প্রহরী প্রদান করে । হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে আহলে বাইতের কাফেলা কারবালা যিয়ারতসহ বিভিন্ন শহর হয়ে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে । পথে প্রতিটি শহর-জনপদে হাজার হাজার মানুষ তাদের কাছে এসে ভিড় জমায় এবং হযরত যায়নুল আবেদীন ও হযরত যায়নাব লোকদের নিকট কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাবলী বর্ণনা করেন। এর ফলে জনমনে উমাইয়্যা শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

সিরিয়া প্রত্যাবর্তন ও ইন্তেকাল

আহলে বাইতের কাফেলা মদীনায় পৌছার পর হযরত যায়নাব সেখানে বেশি দিন থাকেননি। এ সময় মদীনায় খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তাই তিনি সিরিয়ায় তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে জা ফর তাইয়ারের খামারবাড়িতে চলে আসেন। এখানে আগমনের অল্প দিনের মধ্যেই ৬২ হিজরীর ১৫ রজব তিনি ইন্তেকাল করেন। সেখানের তাকে দাফন করা হয়। এ জায়গা পরবর্তীকালে যায়নাবিয়া নামে পরিচিত হয় যা বর্তমানে দামেশক শহরেরই অংশ ।

মানদণ্ডসমূহ

রাসূল (সা.) গাদীর দিবস ও বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করে আলীকে (আ.) তার খলিফা ও প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করানো ছাড়াও আরো অনেক হাদীস বলেছেন যা আলী (আ.)-এর খেলাফতকেই প্রমাণ করে। আমরা এ অধ্যায়ে যে সমস্ত হাদীস মানদণ্ড শিরোনামে তুলে ধরব তাতে রাসূল (সা.) এমন এক মানদণ্ড ও পরিমাপক নির্ধারণের প্রচেষ্টায় আছেন যে , যখন ইসলামী রাষ্ট্রে ভুল-ভ্রান্তি ও যে সব ক্ষেত্রে সত-অসত্য মিশ্রিত হয়ে যায় এবং সত্যকে অসত্য হতে আলাদা করা সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যাপূর্ণ হয় , তখন যেন তারা ঐ মানদণ্ড বা পরিমাপকের সহায়তায় সত্যকে গ্রহণ করে অসত্যকে পরিহার করে। এ সমস্ত হাদীসে তিনি হযরত আলীকে (আ.) হেদায়াতের প্রদীপ , ঈমানের মাপকাঠি এবং সত্যের মানদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল হাদীসানুসারে হযরত আলী (আ.) একজন সাধারণ রাহবার (পথনির্দেশক) নন , বরং এমন ঐশী পথনির্দেশক যে , তার সকল কথাবার্তা ও কাজ-কর্মই হচ্ছে মানদণ্ড , সৎকর্ম হচ্ছে সেটাই যা তিনি সম্পাদন করেন , সত্যবাণী তাই যা তিনি বলেন , সত্য-মিথ্যার দ্বন্দে তিনি যে পক্ষে আছেন সে পক্ষই সত্য। যে ব্যক্তি তার সাথে নেই সে নিশ্চয় বাতিল ও ভ্রান্ত।

1. ভালবাসা

যে বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর পর তার উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তা হচ্ছে যে , তিনি কাকে বেশী ভালবাসতেন। হাদীস গ্রন্থ সমূহ ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , আলী (আ.)-এর সম্পর্কে এত পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে ততখানি বর্ণিত হয়নি। রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) যতটা পছন্দ করতেন ও ভালবাসতেন অন্য কোন সাহাবীকে তিনি ততটা ভালবাসতেন না।114 যেমনভাবে ইবনে হাজার তার সাওয়ায়েক’’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীই ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়পাত্র।115

রাসূল (সা.) যে নিজেই শুধু আলীকে (আ.) ভালবেসে ক্ষান্ত ছিলেন তা নয় , বরং মুসলমানদেরকেও বলতেন তাকে (আলীকে) ভালবাসার জন্যে এবং এটাও বলতেন যে , আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।116

কখনো কখনো বলতেনঃ আমি আলীকে যতটা ভালবাসি মহান আল্লাহ তাকে তার চেয়েও বেশী ভালবাসেন।117

অথবা- আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়পাত্র হচ্ছে আলী।118

হযরত আয়েশা বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহ এমন কাউকেই সৃষ্টি করেননি যে রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীর চেয়ে প্রিয় বা পছন্দের হবে।119

তিনি তার সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- সাহাবীদের মধ্যে চারজনকে যেন আমি বেশী বেশী ভালবাসি এবং আরো বলেছেন- তিনি নিজেই তাদেরকে বেশী বেশী ভালবাসেন।

সাহাবাগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা ? আমরাও কামনা করি যেন তাদেরই একজন হতে পারি।

তিনি বললেন জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। অতঃপর নীরব রইলেন। আবারও মুখ খুললেন এবং বললেন- তোমরা জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। এই কথা বলে পূর্বের ন্যায় নীরব হয়ে গেলেন।120

অতঃপর আবার বললেনঃ

یحب اللّه و رسوله و یحبه اللّه و رسوله

অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রাসূল তাকে (আলীকে) ভালবাসেন এবং সেও (আলীও) আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালবাসে।121

আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূল (সা.)-এর জন্য কিছু ভাজা মুরগী আনা হলে তিনি হাত তুলে দোয়া করলেন- হে প্রভূ !তুমি এমন কাউকে পাঠিয়ে দাও যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালবাসে। ঐ মুহূর্তে আলী দরজায় করাঘাত করলেন। যেহেতু আমি চেয়েছিলাম সেই ব্যক্তি আনসারদের মধ্যে কেউ হোক , তাই তাকে বললাম রাসুল (সা.) এখন ব্যস্ত আছেন।

আলী ফিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবারও করাঘাত করলেন। আমি একই কথা তাকে বললাম। তিনি ফিরে গেলেন। যখন তিনি তৃতীয়বার করাঘাত করলেন , তখন রাসূল (সা.) বললেনঃ হে আনাস! তাকে আসতে দাও , আমি তারই জন্য অপেক্ষা করছি।122

এ ছাড়াও তার প্রতি ভালবাসার কথা এত বেশী বলা হয়েছে যা অন্য কারো সম্পর্কে বলা হয়নি। যেমন-

(1-ক) আলীর সাথে বন্ধুত্ব মানেই আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে বন্ধুত্ব ও আলীর সাথে বিদ্বেষই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে বিদ্বেষের শামিল

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- একদিন রাসূল (সা.) ও আলী পরস্পর হাত ধরে ঘর থেকে বের হলেন ও বললেনঃ তোমরা জেনে রাখ! যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তরে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসলো সে আল্লাহ ও তার রাসূলকেই ভালবাসলো।123

রাসুল (সা:) আলীকে বলেছেনঃ

یا علی ! انت سید فی الدنیا و سید فی الاخره حبیبک حبیبی و حبیبی حبیب اللّه و عدوک عدوی و عدوی عدو اللّه والویل لمن ابغضک بعدی

অর্থাৎ হে আলী! তুমি ইহকাল ও পরকালের নেতা। তোমার বন্ধু আমার বন্ধু আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু ও আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। অভিশাপ তার উপর যে আমার পরে তোমার সাথে শত্রুতা করবে।124

আরো বলেছেনঃ

یا علی محبک محبی و مبغضک مبغضی

অর্থাৎ হে আলী! যে তোমাকে ভালবাসলো সে আমাকে ভালবেসেছে আর যে তোমার প্রতি ক্রোধান্বিত সে আমার প্রতি ক্রোধ পুষে রেখেছে তার অন্তরে ।125

(1-খ) আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণকারী সৌভাগ্যশালী

তিনি বলেছেনঃ যারা আমাকে এবং এই দু জনকে (হাসান ও হোসাঈন) ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসবে কিয়ামতের দিন তারা আমার স্তরে স্থান লাভ করবে বা আমার সাথে থাকবে।126

এবং আরো বলেছেনঃ যারা চায় আমার মত করে বেচে থাকতে ও আমার মত মৃত্যু বরণ করতে এবং ঐ বেহেশতে বাস করতে যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন , তারা যেন আলী ইবনে আবী তালিবকে ভালবাসে।127

তিনি আরো বলেছেনঃ এ হচ্ছে জিব্রাইল যে আমাকে সংবাদ প্রদান করেছে: প্রকৃত সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি সে , যে আলীকে যেমন জীবিতাবস্থায় ভালবাসবে তেমনি তার (আলীর) মৃত্যুর পর , আর প্রকৃত হতভাগ্য সে ব্যক্তি , যে আলীর প্রতি যেমন জীবিতাবস্থায় ঘৃণা পোষণ করবে তেমনি তার মৃত্যুর পরও।128

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আগুন হতে মুক্তিলাভের কোন উপায় আছে কি ?

তিনি বললেন- হ্যাঁ ,

আমি বললাম- সেটা কি ?

তিনি বললেন- আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করা।129

(1-গ) আলীকে ভালবাসা সৎকর্ম

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حب علی بن ابیطالب یاکل السیئات کما تاکل النار الحطب

অর্থাৎ আলীকে ভালবাসলে কুলষতা ঐরূপে ধ্বংস হয়ে যায় যেরূপে শুকনা কাঠ আগু্নে পোড়ালে ধ্বংস হয়।130

তিনি আরো বলেছেনঃ

عنوان صحیفه المؤمن علی بن ابی طالب

অর্থাৎ আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করাই হবে মু মিনদের আমলনামার শিরোনাম ।131

(1-ঘ) আলীর প্রতি ভালবাসা ব্যতীত কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন-

لو ان عبدا عبد اللّه الف عام و الف عام و الف عام بین الرکن و المقام ثم لقی اللّه عز و جل مبغضا لعلی بن ابیطالب و عترتی اکبه اللّه علی منخریه فی النار

অর্থাৎ যদি কোন বান্দা লক্ষ কোটি বছর মাকামে ইব্রাহীম এবং হাজরে আসওয়াদের (রোকন ও মাকামের) মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহর ইবাদত করে , কিন্তু আলীর প্রতি ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী হিসেবে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয় , তারপরেও আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবে।132

তিনি আরো বলেছেনঃ

یا علی لو ان امتی صاموا حتی یکونوا کالحنایا و صلوا حتی یکونوا کالاوتار ثم ابغضوک لاکبهم اللّه علی وجوههم فی النار

অর্থাৎ হে আলী! যদি আমার উম্মত এমনভাবে রোজা রাখে যে , তার দেহ (পিষ্ঠদেশ) ধনুকের রূপলাভ করে এবং যদি এমনভাবে নামাজও পড়ে যে , তার দেহ (ধনুকের) তন্ত্রীর ন্যায় শীর্ণ হয়ে যায় অথচ তার অন্তরে যদি তোমার প্রতি ঘৃণা থাকে , তাহলেই আল্লাহ তাকে নিম্নমুখী করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।133

(1-ঙ) আলীর প্রতি ঘৃণা এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসা এ দু টি কখনোই একতিতে হতে পারে না

তিনি বলেছেনঃ

یا علی من زعم انه یحبنی و هو یبغضک فهو کذاب

অর্থাৎ হে আমার প্রাণপ্রিয় আলী! সেই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী যে চিন্তা করে আমাকে ভালবাসে অথচ তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।134

(1-চ) আলীর প্রতি ঘৃণা করা ও ঈমানদার বলে দাবী করা একেবারেই অসম্ভব

রাসূল (সা.) বলেন-

من زعم انه آمن بی و ما جئت به و هو یبغض علیا فهو کاذب لیس بمؤمن

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধারণাপোষণ করে যে , আমার প্রতি ও আমার দ্বীনের প্রতি ঈমান এনেছে অথচ আলীর প্রতি ঘৃণাপোষণ করে , সে মিথ্যাবাদী , সে মু মিন নয়।135

(1-ছ) আলীর প্রতি বিদ্বেষপোষণ কুফরের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যদি কেউ তোমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ করে মৃত্যু বরণ করে , তাহলে সে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল। কিন্তু তার আমলের হিসাব মুসলমানদের মতই হবে।136

উপরোক্ত হাদীসের গভীরতা খুজে বের করার জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

কিয়ামতের দিন কাফেরদের হিসাব সম্বন্ধে দু টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছেঃ

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি: এমন কাফের যাদেরকে তাদের কুফরীর জন্য জবাবদিহি করতে হবে ও তাদের জন্য কঠিন শাস্থির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত আমলাদি যা ইসলাম ওয়াজিব (ফরজ) করেছিল তার জন্য তার নিকট জবাবদিহি চাওয়া হবে না। যেমনভাবে ঐ পাপকর্ম যা ইসলামে হারাম তা তার কাছ থেকে হিসাব চাওয়া হবে না। কেননা এই হিসাব-কিতাব ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি কুফরীর সাথে সংযুক্ত নয়। কারণ যেহেতু কুফরীর তুলনায় সমস্ত পাপকর্ম অতিক্ষুদ্র তাই কাফেরদের ক্ষেত্রে অন্যান্য হারামকৃত বিষয়ে হিসাব চাওয়া হবে না।

দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি: কাফের যেমনভাবে তার কুফরী ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তেমনি তার আমলের কারণেও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ সে ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণের কারণ ছাড়াও স্বীয় পাপকর্মের এবং ওয়াজিব (ফরজ) কর্মসমূহ সম্পাদন না করার কারণেও শাস্তিভোগ করবে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ একটি সূত্র তৈরী করে বলেছেনঃ

الکفارمعاقبون علی الفروع کما انهم معاقبون علی الاصول

অর্থাৎ কাফের যেমন তার বিশ্বাসগত বিচ্যুতির কারণে শাস্তি পাবে তেমনি শাস্তি পাবে তার কৃতকর্মের জন্য।

উপরোক্ত হাদীসে যে সকল কাফেরের কথা বলা হয়েছে তারা সবাই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির দলিলে।

(1-জ) আলীর প্রতি ভালবাসা ঈমানের চিহ্ন ও তার প্রতি বিদ্বেষ মোনাফিক বা কপটতার চিহ্ন

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ

لا یحبک الا مؤمن و لا یبغضک الا منافق

অর্থাৎ মু মিন ব্যতীত তোমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত তোমার প্রতি কেউ বিদ্বেষী হবে না।137

তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন যে , মু মিন ব্যতীত আমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত আমাকে কেউ ঘৃণা করবে না।138

উক্ত কারণে সাহাবীগণ বলতেনঃ আমরা আলী ইবনে আবী তালিবের প্রতি শত্রুতা করা দেখে মোনাফিককে চিনতাম।139

2. আলীকে কষ্ট প্রদান অর্থাৎ রাসূলকেই কষ্ট প্রদান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من آذی علیا فقد آذانی

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিল সে যেন প্রকৃতার্থে আমাকেই কষ্ট দিল।140

তিনি আরো বলেনঃ হে আলী! যে তোমাকে আঘাত দিল সে যেন আমাকেই আঘাত দিল আর যে আমাকে আঘাত দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল।141 .

3. আলীকে গালমন্দ করা রাসূলকে (সা.) গালমন্দ করার শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আলীকে গালমন্দ করল সে আমাকেই গালমন্দ করল আর যে আমাকে গালমন্দ করল সে আল্লাহকেই গালমন্দ করল আর যে আল্লাহকে গালমন্দ করল আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।142

4.আলীকে পরিত্যাগ করা রাসূলকে পরিত্যাগের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من فارق علیا فارقنی و من فارقنی فارق اللّه عزوجل

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে পরিত্যাগ করল সে আমাকেই পরিত্যাগ করল আর যে আমাকে পরিত্যাগ করল সে আল্লাহকে পরিত্যাগ করল।143

5. আলীর সাথে যুদ্ধ করার অর্থ রাসূলের সাথে যুদ্ধ করা

আবু হোরায়রা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আলী , ফাতিমা , হাসান ও হোসাঈনকে (আ.) দেখে রাসূল (সা.) বললেন-

انا حرب لمن حاربکم و سلم لمن سالمکم

অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব।144

6. হিদায়াতের প্রতীক

রাসূলে আকরাম (সা.) আবু বারযাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা আলী ইবনে আবী তালিব সম্পর্কে আমাকে বলেছেন- সে হচ্ছে হিদায়াতের প্রতীক , ঈমানের চিহ্ন , খোদাপ্রেমীদের ইমাম ও আল্লাহর সকল আনুগত্যকারীদের জন্য আলোক বর্তিকা।

7. আলী এবং হক বা সত্য

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و الحق معه حیثما دار

অর্থাৎ আলী হক বা সত্যের সাথে আর হক বা সত্য আলীর সাথে যা পরস্পরকে ঘিরে আছে।145

8. হক বা সত্য এবং আলী

তিনি আরো বলেনঃ

الحق مع علی حیث دار

অর্থাৎ আলী যে দিকেই যাবে হক বা সত্যও সে দিকেই তার সাথে গমন করবে।146

9. আলী , সত্য এবং কোরআন

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و القرآن و الحق و القرآن مع علی لن یتفرقا حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী , কোরআন এবং সত্যের সাথে আছে ; সত্য এবং কোরআনও আলীর সাথে আছে। তারা আমার সাথে হাউজে কাউসারে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।147

10. আলী ও কোরআন

নবী কারিম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع القرآن والقرآن مع علی لا یفترقان حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী কোরআনের সাথে আর কোরআন আলীর সাথে তারা ঐ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না যে পর্যন্ত না হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হবে।148

11. আলীর মর্যাদা কাবা ঘরের মর্যাদার সমান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انت بمنزله الکعبه تؤتی و لا تاتی

অর্থাৎ হে আলী! তোমার মর্যাদা কাবা ঘরের তুল্য যার পানে সবাই ছুটে আসে। কিন্তু সে কারো দিকে যায় না।149

তিনি আরো বলেন-

مثل علی فیکم کمثل الکعبه المتسوره النظر الیها عباده والحج الیها فریضه

অর্থাৎ আলী তোমাদের মাঝে ঠিক কাবা ঘরের মত , যার প্রতি তাকানো ইবাদত ও হজ্জ করা ওয়াজিব (ফরজ)।150

12. আলী শিক্ষার তোরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی باب حطه فمن دخل منه کان مؤمنا و من خرج منه کان کافرا

অর্থাৎ আলীই হচ্ছে শিক্ষার দ্বার , যে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সেই মু মিন আর যে এ দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে সে কাফির।151

13. আলী ঈমানের মানদণ্ড

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

لولاک یا علی ما عرف المؤمنون من بعدی

অর্থাৎ হে আলী! যদি তুমি না থাক তাহলে আমার পরে মু মিনদেরকে আর চেনা যাবে না।152

14. হক (সত) ও বাতিলের (মিথ্যার) পৃথককারী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

نت الفاروق بین الحق والباطل

অর্থাৎ হে আলী! তুমিই সত্য ও মিথ্যার পৃথককারী।153

15. ঈমানের প্রতীক

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

جعلتک علما فیما بینی و بین امتی فمن لم یتبعک فقد کفر

অর্থাৎ হে আলী! আমি তোমাকে আমার ও আমার উম্মতের মাঝে ঈমানের প্রতীক হিসেবে রেখেছি , যে তোমার অনুসরণ করবে না সে কাফের।154

16. স্বর্গ ও নরকের বন্টনকারী

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেন-

انت قسیم النار

অর্থাৎ তুমি হচ্ছ জাহান্নাম বন্টনকারী।155

আর তিনি (আলী) নিজেই বলেছেনঃ

انا قسیم النار

আমি হচ্ছি জাহান্নাম বন্টনকারী।156

তিনি আরো বলেন- আমি (আলী) হলাম জাহান্নামের বন্টনকারী। কিয়ামতের দিন আমি জাহান্নামকে বলবো- এটা তোমার জন্য আর ঐটা আমার জন্য অথবা একে তুমি নাও আর তাকে ছেড়ে দাও।157

এখানে বন্টনকারী বলতে যিনি ভাগাভাগি করে দেন তাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যিনি দুইটি জিনিসকে দু দলের মাঝে ভাগ করে দেন। সুতরাং যখন বলা হবে যে , আলী জাহান্নামের বন্টনকারী অর্থাৎ তিনি নিজের ও জাহান্নামের মাঝে জনগণকে ভাগ করে দিবেন। অতএব উক্ত হাদীসের উদ্দেশ্য হল যে , আলীর সত্ত্বা হচ্ছে জাহান্নামের বিপরীত অর্থাৎ কিছু লোক জাহান্নামবাসী হবে আর কিছু লোক আলী (আ.)-এর দল হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে , আলীই হচ্ছে বেহেশতের প্রতিকৃতি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি তৃতীয় হাদীস হতে স্পষ্ট হয় তা হচ্ছে এই ভাগ- বাটোয়ারা আলী (আ.)-এর ইচ্ছাধীন , কেননা তিনিই তো জাহান্নামকে বলবেন যে কাকে গ্রহণ করবে কাকে বর্জন করবে। যেমনভাবে রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ তুমিই হচ্ছ জান্নাত ও জাহান্নামের বন্টনকারী।158

দৃশ্যতঃ উক্ত হাদীস হচ্ছে যে , আলী (আ.) মানুষের মাঝে জান্নাত ও জাহান্নাম বন্টন করে দিবেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এইভাবে বন্টন করার প্রয়োজনই পড়ে না বরং তার উপস্থিতিই বন্টনের মানদণ্ড। অর্থাৎ আলী (আ.) মানুষের বেহেশতবাসী হওয়ার মাপকাঠি ও মানদণ্ড। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতবাসী বলে গণ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আলী (আ.) হতে বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে বিচ্যুত হবে না । কিন্তু যখনই সে পথচ্যুত হবে এবং ঐ পবিত্র সত্তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল হবে তখন এমনই শুকনা কাঠ হবে যা জাহান্নামের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অতঃপর উক্ত হাদীসের সারকথাও বাকী তিনটি হাদীসের সারকথার মতই। সবগুলির সারকথা হচ্ছে- আলী (আ.) নিজেই বেহেশতের প্রতিকৃতি ও বেহেশতবাসী হওয়ার মানদণ্ড।

17. পুল সিরাতের অনুমতিদাতা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যতক্ষণ পর্যন্ত আলী অনুমতিপত্র লিখবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পুল সিরাত পার হতে পারবে না।159

18. আলীর আনুগত্যেই সৌভাগ্য নিহিত

রাসূলে আকরাম (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেছেন-

والذی نفسی بیده ان هذا و شیعته هم الفائزون یوم القیامه

অর্থাৎ শপথ ঐ সত্ত্বার , যার হাতে আমার প্রাণ- আলী ও তার শিয়াগণ (প্রকৃত অনুসারীগণ) কিয়ামতের দিনে সৌভাগ্যবান হিসেবে পরিগণিত হবে।160

19. আলীর প্রকৃত অনুসারীরাই বেহেশতবাসী

রাসূল (সা.) তাকে (আলীকে) বলেছেনঃ

انت و شیعتک فی الجنه

অর্থাৎ তুমি ও তোমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) সকলেরই জান্নাতবাসী।161

20. সফলকামী দল

রাসূলে করিম (সা.) তাকে (আলীকে) ইশারা করে বলেন-

هذا و حزبه المفلحون

অর্থাৎ সে এবং তার দল সফলকাম।162

21. আলীর অনুসারীগণ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং তার সন্তুষ্টভাজন

রাসূলে খোদা (সা.) আমাকে (আলীকে) বলেছেন যে , আমি ও আমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) এমন অবস্থায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হব যে , আমরা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবো এবং আল্লাহও আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকবেন।163 অনুরূপ তুলনা কোরআন শরীফেও এসেছে , সূরা বাইয়্যেনা তে বলা হয়েছেঃ

) ر َضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ(

অর্থাৎ আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট ও তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট।

উক্ত আয়াতের পরে রাসূলের হাদীসও বর্ণিত হয়েছে যে , উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আলী এবং তার শিয়াগণ (অনুসারীগণ)। এই মর্যাদাটি অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট আর আল্লাহও তার উপর সন্তুষ্ট হবে এটা মানুষের পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায়। কারণ , কোরআন শরীফ এরূপ মানুষের সত্তাকে নাফসে মোতমাইন্না অর্থাৎ পরিতৃপ্ত আত্মা বলে অভিহিত করেছে অর্থাৎ যে আত্মা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মশগুল এবং তার স্মরণে এমন প্রশান্তি লাভ করেছে যে , বস্তু জগতের কোন শঙ্কা , অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা তাকে বিচলিত করে না , বলা হয়েছে-

) ي َا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ () ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً(

অর্থাৎ হে পরিতৃপ্ত আত্মা! আল্লাহর দিকে এসো , তুমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।

22. আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত

রাসূলে আকরাম বলেছেনঃ

ذکر علی عباده

অর্থাৎ আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত।164

23. আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত

হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমার পিতাকে দেখেছি যে , তিনি বেশী বেশী আলীর চেহারার প্রতি তাকিয়ে থাকতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে , হে আমার পিতা! আপনি আলীর প্রতি এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন ?

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- হে আমার কন্যা! আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে , তিনি বলেছেন- আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত।165

24. আলী (আ.) জান্নাতের দরজা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا مدینه الجنه و علی بابها یا علی کذب من زعم انه یدخلها من غیر بابها

অর্থাৎ আমি হলাম বেহেশতের নগর আর আলী তার দ্বার , ঐ ব্যক্তি ভুল করবে যে ব্যক্তি দরজা ব্যতীত প্রবেশ করতে চাইবে।166

25. আলী (আ.) বেহেশতের দীপ্তিময় প্রদীপ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی یزهر لا هل الجنه کما یزهر کوکب الصبح لا هل الدنیا

অর্থাৎ ধ্রুবতারা যেমনভাবে পৃথিবীকে আলোকিত করে , আলী ঠিক তেমনিভাবে বেহেশতবাসীদেরকে আলোকিত করবে।167

26. মুসলমানদের পিতা আলী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حق علی علی کل مسلم حق الوالد علی ولده

অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমানদের উপর আলীর অধিকার তেমনি , যেমন প্রত্যেক পিতার অধিকার তার সন্তানের উপর।168

27. আলীর অনুসরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من اطاعنی فقد اطاع اللّه و من اطاعک اطاعنی , و من عصانی فقد عصی اللّه و من عصاک فقدعصانی

অর্থাৎ যারা আমার অনুসরণ করে তারা আল্লাহর অনুসরণকারী , আর যারা আলীর অনুসরণ করে তারা আমার অনুসরণকারী যারা আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আল্লাহর অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে যারা আলীকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আমার অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে।169

28. রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

صاحب سری علی بن ابیطالب

অর্থাৎ আলী হচ্ছে আমার গোপনীয়তা রক্ষাকারী।170

হযরত আয়েশা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে , আলী ছিল রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী।171

29. আলী , রাসূল (সা.)-এর মাথা স্বরূপ

علی منی مثل راسی من بدنی

অর্থাৎ আলীর অস্তিত্ব আমার নিকট ঐরূপ (প্রয়োজনীয়) যেরূপ শরীরের নিকট মাথার অস্তিত্ব ।172

30. আলীর উপাধিসমূহ

রাসূল (সা.)-এর খলিফা (প্রতিনিধি) নির্ধারণের মাপকাঠিগুলোর মধ্যে একটি মাপকাঠি হচ্ছে- এমন কিছু উপাধি যা রাসূল (সা.) তার জীবদ্দশায় কোন ব্যক্তিকে দিয়েছেন। যেমন- হাদীসের গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে , আলীর মত মর্যাদাকর উপাধিধারী ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে দ্বিতীয় কেউ নাই। হাদীসবেত্তারা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.)-এর কোন সাহাবাই হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় মহামূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনি।

আলীকে রাসূল (সা.) যে সকল উপাধিতে ভূষিত করেছেন সেগুলো আমরা নিম্নে তুলে ধরছি: (30-ক) সিদ্দীক ,173

(30-খ) সিদ্দীকে আকবর,174

(30-গ) সাইয়্যেদুল আরাব ,

একদিন রাসূল (সা.) আয়েশাকে বললেনঃ যদি তুমি আরবের সর্দার (সাইয়্যেদ) ও নেতাকে দেখতে চাও , তাহলে আলী ইবনে আবী তালিবের দিকে তাকাও। আয়েশা বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আরবের সর্দার নন ? তিনি বললেনঃ আমি গোটা মানবজাতির সর্দার আর আলী হচ্ছে আরবের সর্দার।175

(30 - ঘ ) সাইয়্যেদুল মুসলিমীন ( মুসলমানদের সর্দার ) ও ইমামুল মুত্তাকিন ( পরহেযগারদের ইমাম) । 176

(30-ঙ) সাইয়্যেদুল মু মিনীন (মু মিনগণের সর্দার) ও ইমামুল মুত্তাকিন (পরহেযগারদের ইমাম) এবং ক্বায়্যেদুল গাররিল মোহাজ্জালীন (কিয়ামতের দিন মুখোজ্জল চেহারাধারীদের নেতা ও অগৃদূত)।

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে রাত্রে আমি মেরাজে গিয়েছিলাম , সে রাত্রে আলীর তিনটি উপাধি আমার উপর ওহী হয়েছিল। সে তিনটি উপাধি হচ্ছে- (1) সে মু মিনদের সরদার , (2) পরহেযগারদের নেতা এবং (3) কিয়ামতের দিনে শুভ্রচেহারাধারীদের মধ্যে প্রধান।177

(30-চ) ইযা সুবুল মু মিনীন (মু মিনদের আবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু) , রাঈসুল মু মিনীন [(অনুসরণের ক্ষেত্রে) মু মিনদের পুরোধা]। 178

(30-ছ) আমিরুল মু মিনীন (মু মিনদের নেতা)। 179

(30-জ) সাইয়্যেদু শাবাবি আহলিল জান্নাত।180

বাখ্যাঃ যেমনভাবে হাদীসসমূহে এসেছে যে , বেহেশতের অধিবাসী সকলেই যুবক হবে। অর্থাৎ বৃদ্ধগণও বেহেশতে প্রবেশের প্রাক্কালে যুবক হয়ে প্রবেশ করবে। অতএব যিনি বেহেশতের যুবকদের সর্দার হবেন তিনি সমস্ত বেহেশতবাসীদের সর্দার ও নেতা হবেন।

(30-ঝ) খাইরুল বারিয়্যাহ অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টি।181

এই উপাধিটি এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে , যখনই সাহাবীগণ তাকে দেখতেন তখনই বলতেনঃ

قد جاء خیر البریة

অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টির আগমন ঘটেছে182

(30-ঞ) আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا و علی حجه اللّه علی عباده

অর্থাৎ আমি ও আলী আল্লাহর বান্দাদের উপর হুজ্জাত বা প্রমাণ।183

(30-ট) রাসূলের সহযোগি

আনাস বিন মালিক বলেন- যখন সূরা নাসর অবতীর্ণ হল তখন আমরা সকলেরই বুঝলাম যে , এই সূরা রাসূলের ইন্তেকালের বার্তা নিয়ে এসেছে। তখন সালমান ফারসীকে বললাম- রাসূলকে যেন জিজ্ঞাসা করে যে , তার পরে কে আমাদের নেতা ও আশ্রয়স্থল হবে এবং কাকে আমরা প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসবো। সালমান রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর প্রদানে বিরত থাকলেন। সালমান আবার জিজ্ঞেস করলেন- তারপরেও তিনি উত্তর দিলেন না। সালমানের মনে ভীতি সঞ্চার হল যে , হয়তো রাসূলকে (সা.) তিনি দুঃখ বা কষ্ট দিয়েছেন। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিছুক্ষণ পরে রাসূল (সা.) বললেন- তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর আশা করছো ? সালমান বলল- হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভয় পেয়েছি যে , হয়তো আমি আপনাকে রাগান্বিত করেছি। তিনি বললেনঃ না এমনটি নয় , জেনে রাখ যে ব্যক্তি আমার ভাই , আমার সহযোগি , আমার খলিফা ও প্রতিনিধি , আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার পরে অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোত্তম , আমার ঋণ পরিশোধ করবে এবং আমার ওয়াদাসমূহ পালন করবে সে ব্যক্তি হচ্ছে আলী ইবনে আবী তালিব।184

আলী (আ.) নিজেও বিভিন্ন উপলক্ষে উক্ত ফজিলতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ আমি রাসূল (সা.)-এর ভাই ও উজীর (সহযোগি)। কেউ এটা আমার পূর্বে বলে নাই (দাবী করে নাই) এবং কেউ আমার পরেও তা বলবে না , যদি না মিথ্যাবাদী হয়। 185

মানদণ্ডসমূহ

রাসূল (সা.) গাদীর দিবস ও বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করে আলীকে (আ.) তার খলিফা ও প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করানো ছাড়াও আরো অনেক হাদীস বলেছেন যা আলী (আ.)-এর খেলাফতকেই প্রমাণ করে। আমরা এ অধ্যায়ে যে সমস্ত হাদীস মানদণ্ড শিরোনামে তুলে ধরব তাতে রাসূল (সা.) এমন এক মানদণ্ড ও পরিমাপক নির্ধারণের প্রচেষ্টায় আছেন যে , যখন ইসলামী রাষ্ট্রে ভুল-ভ্রান্তি ও যে সব ক্ষেত্রে সত-অসত্য মিশ্রিত হয়ে যায় এবং সত্যকে অসত্য হতে আলাদা করা সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যাপূর্ণ হয় , তখন যেন তারা ঐ মানদণ্ড বা পরিমাপকের সহায়তায় সত্যকে গ্রহণ করে অসত্যকে পরিহার করে। এ সমস্ত হাদীসে তিনি হযরত আলীকে (আ.) হেদায়াতের প্রদীপ , ঈমানের মাপকাঠি এবং সত্যের মানদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল হাদীসানুসারে হযরত আলী (আ.) একজন সাধারণ রাহবার (পথনির্দেশক) নন , বরং এমন ঐশী পথনির্দেশক যে , তার সকল কথাবার্তা ও কাজ-কর্মই হচ্ছে মানদণ্ড , সৎকর্ম হচ্ছে সেটাই যা তিনি সম্পাদন করেন , সত্যবাণী তাই যা তিনি বলেন , সত্য-মিথ্যার দ্বন্দে তিনি যে পক্ষে আছেন সে পক্ষই সত্য। যে ব্যক্তি তার সাথে নেই সে নিশ্চয় বাতিল ও ভ্রান্ত।

1. ভালবাসা

যে বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর পর তার উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তা হচ্ছে যে , তিনি কাকে বেশী ভালবাসতেন। হাদীস গ্রন্থ সমূহ ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , আলী (আ.)-এর সম্পর্কে এত পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে ততখানি বর্ণিত হয়নি। রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) যতটা পছন্দ করতেন ও ভালবাসতেন অন্য কোন সাহাবীকে তিনি ততটা ভালবাসতেন না।114 যেমনভাবে ইবনে হাজার তার সাওয়ায়েক’’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীই ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়পাত্র।115

রাসূল (সা.) যে নিজেই শুধু আলীকে (আ.) ভালবেসে ক্ষান্ত ছিলেন তা নয় , বরং মুসলমানদেরকেও বলতেন তাকে (আলীকে) ভালবাসার জন্যে এবং এটাও বলতেন যে , আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।116

কখনো কখনো বলতেনঃ আমি আলীকে যতটা ভালবাসি মহান আল্লাহ তাকে তার চেয়েও বেশী ভালবাসেন।117

অথবা- আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়পাত্র হচ্ছে আলী।118

হযরত আয়েশা বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহ এমন কাউকেই সৃষ্টি করেননি যে রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীর চেয়ে প্রিয় বা পছন্দের হবে।119

তিনি তার সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- সাহাবীদের মধ্যে চারজনকে যেন আমি বেশী বেশী ভালবাসি এবং আরো বলেছেন- তিনি নিজেই তাদেরকে বেশী বেশী ভালবাসেন।

সাহাবাগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা ? আমরাও কামনা করি যেন তাদেরই একজন হতে পারি।

তিনি বললেন জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। অতঃপর নীরব রইলেন। আবারও মুখ খুললেন এবং বললেন- তোমরা জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। এই কথা বলে পূর্বের ন্যায় নীরব হয়ে গেলেন।120

অতঃপর আবার বললেনঃ

یحب اللّه و رسوله و یحبه اللّه و رسوله

অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রাসূল তাকে (আলীকে) ভালবাসেন এবং সেও (আলীও) আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালবাসে।121

আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূল (সা.)-এর জন্য কিছু ভাজা মুরগী আনা হলে তিনি হাত তুলে দোয়া করলেন- হে প্রভূ !তুমি এমন কাউকে পাঠিয়ে দাও যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালবাসে। ঐ মুহূর্তে আলী দরজায় করাঘাত করলেন। যেহেতু আমি চেয়েছিলাম সেই ব্যক্তি আনসারদের মধ্যে কেউ হোক , তাই তাকে বললাম রাসুল (সা.) এখন ব্যস্ত আছেন।

আলী ফিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবারও করাঘাত করলেন। আমি একই কথা তাকে বললাম। তিনি ফিরে গেলেন। যখন তিনি তৃতীয়বার করাঘাত করলেন , তখন রাসূল (সা.) বললেনঃ হে আনাস! তাকে আসতে দাও , আমি তারই জন্য অপেক্ষা করছি।122

এ ছাড়াও তার প্রতি ভালবাসার কথা এত বেশী বলা হয়েছে যা অন্য কারো সম্পর্কে বলা হয়নি। যেমন-

(1-ক) আলীর সাথে বন্ধুত্ব মানেই আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে বন্ধুত্ব ও আলীর সাথে বিদ্বেষই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে বিদ্বেষের শামিল

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- একদিন রাসূল (সা.) ও আলী পরস্পর হাত ধরে ঘর থেকে বের হলেন ও বললেনঃ তোমরা জেনে রাখ! যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তরে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসলো সে আল্লাহ ও তার রাসূলকেই ভালবাসলো।123

রাসুল (সা:) আলীকে বলেছেনঃ

یا علی ! انت سید فی الدنیا و سید فی الاخره حبیبک حبیبی و حبیبی حبیب اللّه و عدوک عدوی و عدوی عدو اللّه والویل لمن ابغضک بعدی

অর্থাৎ হে আলী! তুমি ইহকাল ও পরকালের নেতা। তোমার বন্ধু আমার বন্ধু আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু ও আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। অভিশাপ তার উপর যে আমার পরে তোমার সাথে শত্রুতা করবে।124

আরো বলেছেনঃ

یا علی محبک محبی و مبغضک مبغضی

অর্থাৎ হে আলী! যে তোমাকে ভালবাসলো সে আমাকে ভালবেসেছে আর যে তোমার প্রতি ক্রোধান্বিত সে আমার প্রতি ক্রোধ পুষে রেখেছে তার অন্তরে ।125

(1-খ) আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণকারী সৌভাগ্যশালী

তিনি বলেছেনঃ যারা আমাকে এবং এই দু জনকে (হাসান ও হোসাঈন) ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসবে কিয়ামতের দিন তারা আমার স্তরে স্থান লাভ করবে বা আমার সাথে থাকবে।126

এবং আরো বলেছেনঃ যারা চায় আমার মত করে বেচে থাকতে ও আমার মত মৃত্যু বরণ করতে এবং ঐ বেহেশতে বাস করতে যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন , তারা যেন আলী ইবনে আবী তালিবকে ভালবাসে।127

তিনি আরো বলেছেনঃ এ হচ্ছে জিব্রাইল যে আমাকে সংবাদ প্রদান করেছে: প্রকৃত সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি সে , যে আলীকে যেমন জীবিতাবস্থায় ভালবাসবে তেমনি তার (আলীর) মৃত্যুর পর , আর প্রকৃত হতভাগ্য সে ব্যক্তি , যে আলীর প্রতি যেমন জীবিতাবস্থায় ঘৃণা পোষণ করবে তেমনি তার মৃত্যুর পরও।128

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আগুন হতে মুক্তিলাভের কোন উপায় আছে কি ?

তিনি বললেন- হ্যাঁ ,

আমি বললাম- সেটা কি ?

তিনি বললেন- আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করা।129

(1-গ) আলীকে ভালবাসা সৎকর্ম

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حب علی بن ابیطالب یاکل السیئات کما تاکل النار الحطب

অর্থাৎ আলীকে ভালবাসলে কুলষতা ঐরূপে ধ্বংস হয়ে যায় যেরূপে শুকনা কাঠ আগু্নে পোড়ালে ধ্বংস হয়।130

তিনি আরো বলেছেনঃ

عنوان صحیفه المؤمن علی بن ابی طالب

অর্থাৎ আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করাই হবে মু মিনদের আমলনামার শিরোনাম ।131

(1-ঘ) আলীর প্রতি ভালবাসা ব্যতীত কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন-

لو ان عبدا عبد اللّه الف عام و الف عام و الف عام بین الرکن و المقام ثم لقی اللّه عز و جل مبغضا لعلی بن ابیطالب و عترتی اکبه اللّه علی منخریه فی النار

অর্থাৎ যদি কোন বান্দা লক্ষ কোটি বছর মাকামে ইব্রাহীম এবং হাজরে আসওয়াদের (রোকন ও মাকামের) মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহর ইবাদত করে , কিন্তু আলীর প্রতি ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী হিসেবে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয় , তারপরেও আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবে।132

তিনি আরো বলেছেনঃ

یا علی لو ان امتی صاموا حتی یکونوا کالحنایا و صلوا حتی یکونوا کالاوتار ثم ابغضوک لاکبهم اللّه علی وجوههم فی النار

অর্থাৎ হে আলী! যদি আমার উম্মত এমনভাবে রোজা রাখে যে , তার দেহ (পিষ্ঠদেশ) ধনুকের রূপলাভ করে এবং যদি এমনভাবে নামাজও পড়ে যে , তার দেহ (ধনুকের) তন্ত্রীর ন্যায় শীর্ণ হয়ে যায় অথচ তার অন্তরে যদি তোমার প্রতি ঘৃণা থাকে , তাহলেই আল্লাহ তাকে নিম্নমুখী করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।133

(1-ঙ) আলীর প্রতি ঘৃণা এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসা এ দু টি কখনোই একতিতে হতে পারে না

তিনি বলেছেনঃ

یا علی من زعم انه یحبنی و هو یبغضک فهو کذاب

অর্থাৎ হে আমার প্রাণপ্রিয় আলী! সেই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী যে চিন্তা করে আমাকে ভালবাসে অথচ তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।134

(1-চ) আলীর প্রতি ঘৃণা করা ও ঈমানদার বলে দাবী করা একেবারেই অসম্ভব

রাসূল (সা.) বলেন-

من زعم انه آمن بی و ما جئت به و هو یبغض علیا فهو کاذب لیس بمؤمن

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধারণাপোষণ করে যে , আমার প্রতি ও আমার দ্বীনের প্রতি ঈমান এনেছে অথচ আলীর প্রতি ঘৃণাপোষণ করে , সে মিথ্যাবাদী , সে মু মিন নয়।135

(1-ছ) আলীর প্রতি বিদ্বেষপোষণ কুফরের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যদি কেউ তোমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ করে মৃত্যু বরণ করে , তাহলে সে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল। কিন্তু তার আমলের হিসাব মুসলমানদের মতই হবে।136

উপরোক্ত হাদীসের গভীরতা খুজে বের করার জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

কিয়ামতের দিন কাফেরদের হিসাব সম্বন্ধে দু টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছেঃ

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি: এমন কাফের যাদেরকে তাদের কুফরীর জন্য জবাবদিহি করতে হবে ও তাদের জন্য কঠিন শাস্থির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত আমলাদি যা ইসলাম ওয়াজিব (ফরজ) করেছিল তার জন্য তার নিকট জবাবদিহি চাওয়া হবে না। যেমনভাবে ঐ পাপকর্ম যা ইসলামে হারাম তা তার কাছ থেকে হিসাব চাওয়া হবে না। কেননা এই হিসাব-কিতাব ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি কুফরীর সাথে সংযুক্ত নয়। কারণ যেহেতু কুফরীর তুলনায় সমস্ত পাপকর্ম অতিক্ষুদ্র তাই কাফেরদের ক্ষেত্রে অন্যান্য হারামকৃত বিষয়ে হিসাব চাওয়া হবে না।

দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি: কাফের যেমনভাবে তার কুফরী ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তেমনি তার আমলের কারণেও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ সে ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণের কারণ ছাড়াও স্বীয় পাপকর্মের এবং ওয়াজিব (ফরজ) কর্মসমূহ সম্পাদন না করার কারণেও শাস্তিভোগ করবে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ একটি সূত্র তৈরী করে বলেছেনঃ

الکفارمعاقبون علی الفروع کما انهم معاقبون علی الاصول

অর্থাৎ কাফের যেমন তার বিশ্বাসগত বিচ্যুতির কারণে শাস্তি পাবে তেমনি শাস্তি পাবে তার কৃতকর্মের জন্য।

উপরোক্ত হাদীসে যে সকল কাফেরের কথা বলা হয়েছে তারা সবাই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির দলিলে।

(1-জ) আলীর প্রতি ভালবাসা ঈমানের চিহ্ন ও তার প্রতি বিদ্বেষ মোনাফিক বা কপটতার চিহ্ন

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ

لا یحبک الا مؤمن و لا یبغضک الا منافق

অর্থাৎ মু মিন ব্যতীত তোমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত তোমার প্রতি কেউ বিদ্বেষী হবে না।137

তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন যে , মু মিন ব্যতীত আমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত আমাকে কেউ ঘৃণা করবে না।138

উক্ত কারণে সাহাবীগণ বলতেনঃ আমরা আলী ইবনে আবী তালিবের প্রতি শত্রুতা করা দেখে মোনাফিককে চিনতাম।139

2. আলীকে কষ্ট প্রদান অর্থাৎ রাসূলকেই কষ্ট প্রদান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من آذی علیا فقد آذانی

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিল সে যেন প্রকৃতার্থে আমাকেই কষ্ট দিল।140

তিনি আরো বলেনঃ হে আলী! যে তোমাকে আঘাত দিল সে যেন আমাকেই আঘাত দিল আর যে আমাকে আঘাত দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল।141 .

3. আলীকে গালমন্দ করা রাসূলকে (সা.) গালমন্দ করার শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আলীকে গালমন্দ করল সে আমাকেই গালমন্দ করল আর যে আমাকে গালমন্দ করল সে আল্লাহকেই গালমন্দ করল আর যে আল্লাহকে গালমন্দ করল আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।142

4.আলীকে পরিত্যাগ করা রাসূলকে পরিত্যাগের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من فارق علیا فارقنی و من فارقنی فارق اللّه عزوجل

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে পরিত্যাগ করল সে আমাকেই পরিত্যাগ করল আর যে আমাকে পরিত্যাগ করল সে আল্লাহকে পরিত্যাগ করল।143

5. আলীর সাথে যুদ্ধ করার অর্থ রাসূলের সাথে যুদ্ধ করা

আবু হোরায়রা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আলী , ফাতিমা , হাসান ও হোসাঈনকে (আ.) দেখে রাসূল (সা.) বললেন-

انا حرب لمن حاربکم و سلم لمن سالمکم

অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব।144

6. হিদায়াতের প্রতীক

রাসূলে আকরাম (সা.) আবু বারযাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা আলী ইবনে আবী তালিব সম্পর্কে আমাকে বলেছেন- সে হচ্ছে হিদায়াতের প্রতীক , ঈমানের চিহ্ন , খোদাপ্রেমীদের ইমাম ও আল্লাহর সকল আনুগত্যকারীদের জন্য আলোক বর্তিকা।

7. আলী এবং হক বা সত্য

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و الحق معه حیثما دار

অর্থাৎ আলী হক বা সত্যের সাথে আর হক বা সত্য আলীর সাথে যা পরস্পরকে ঘিরে আছে।145

8. হক বা সত্য এবং আলী

তিনি আরো বলেনঃ

الحق مع علی حیث دار

অর্থাৎ আলী যে দিকেই যাবে হক বা সত্যও সে দিকেই তার সাথে গমন করবে।146

9. আলী , সত্য এবং কোরআন

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و القرآن و الحق و القرآن مع علی لن یتفرقا حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী , কোরআন এবং সত্যের সাথে আছে ; সত্য এবং কোরআনও আলীর সাথে আছে। তারা আমার সাথে হাউজে কাউসারে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।147

10. আলী ও কোরআন

নবী কারিম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع القرآن والقرآن مع علی لا یفترقان حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী কোরআনের সাথে আর কোরআন আলীর সাথে তারা ঐ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না যে পর্যন্ত না হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হবে।148

11. আলীর মর্যাদা কাবা ঘরের মর্যাদার সমান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انت بمنزله الکعبه تؤتی و لا تاتی

অর্থাৎ হে আলী! তোমার মর্যাদা কাবা ঘরের তুল্য যার পানে সবাই ছুটে আসে। কিন্তু সে কারো দিকে যায় না।149

তিনি আরো বলেন-

مثل علی فیکم کمثل الکعبه المتسوره النظر الیها عباده والحج الیها فریضه

অর্থাৎ আলী তোমাদের মাঝে ঠিক কাবা ঘরের মত , যার প্রতি তাকানো ইবাদত ও হজ্জ করা ওয়াজিব (ফরজ)।150

12. আলী শিক্ষার তোরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی باب حطه فمن دخل منه کان مؤمنا و من خرج منه کان کافرا

অর্থাৎ আলীই হচ্ছে শিক্ষার দ্বার , যে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সেই মু মিন আর যে এ দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে সে কাফির।151

13. আলী ঈমানের মানদণ্ড

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

لولاک یا علی ما عرف المؤمنون من بعدی

অর্থাৎ হে আলী! যদি তুমি না থাক তাহলে আমার পরে মু মিনদেরকে আর চেনা যাবে না।152

14. হক (সত) ও বাতিলের (মিথ্যার) পৃথককারী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

نت الفاروق بین الحق والباطل

অর্থাৎ হে আলী! তুমিই সত্য ও মিথ্যার পৃথককারী।153

15. ঈমানের প্রতীক

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

جعلتک علما فیما بینی و بین امتی فمن لم یتبعک فقد کفر

অর্থাৎ হে আলী! আমি তোমাকে আমার ও আমার উম্মতের মাঝে ঈমানের প্রতীক হিসেবে রেখেছি , যে তোমার অনুসরণ করবে না সে কাফের।154

16. স্বর্গ ও নরকের বন্টনকারী

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেন-

انت قسیم النار

অর্থাৎ তুমি হচ্ছ জাহান্নাম বন্টনকারী।155

আর তিনি (আলী) নিজেই বলেছেনঃ

انا قسیم النار

আমি হচ্ছি জাহান্নাম বন্টনকারী।156

তিনি আরো বলেন- আমি (আলী) হলাম জাহান্নামের বন্টনকারী। কিয়ামতের দিন আমি জাহান্নামকে বলবো- এটা তোমার জন্য আর ঐটা আমার জন্য অথবা একে তুমি নাও আর তাকে ছেড়ে দাও।157

এখানে বন্টনকারী বলতে যিনি ভাগাভাগি করে দেন তাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যিনি দুইটি জিনিসকে দু দলের মাঝে ভাগ করে দেন। সুতরাং যখন বলা হবে যে , আলী জাহান্নামের বন্টনকারী অর্থাৎ তিনি নিজের ও জাহান্নামের মাঝে জনগণকে ভাগ করে দিবেন। অতএব উক্ত হাদীসের উদ্দেশ্য হল যে , আলীর সত্ত্বা হচ্ছে জাহান্নামের বিপরীত অর্থাৎ কিছু লোক জাহান্নামবাসী হবে আর কিছু লোক আলী (আ.)-এর দল হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে , আলীই হচ্ছে বেহেশতের প্রতিকৃতি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি তৃতীয় হাদীস হতে স্পষ্ট হয় তা হচ্ছে এই ভাগ- বাটোয়ারা আলী (আ.)-এর ইচ্ছাধীন , কেননা তিনিই তো জাহান্নামকে বলবেন যে কাকে গ্রহণ করবে কাকে বর্জন করবে। যেমনভাবে রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ তুমিই হচ্ছ জান্নাত ও জাহান্নামের বন্টনকারী।158

দৃশ্যতঃ উক্ত হাদীস হচ্ছে যে , আলী (আ.) মানুষের মাঝে জান্নাত ও জাহান্নাম বন্টন করে দিবেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এইভাবে বন্টন করার প্রয়োজনই পড়ে না বরং তার উপস্থিতিই বন্টনের মানদণ্ড। অর্থাৎ আলী (আ.) মানুষের বেহেশতবাসী হওয়ার মাপকাঠি ও মানদণ্ড। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতবাসী বলে গণ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আলী (আ.) হতে বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে বিচ্যুত হবে না । কিন্তু যখনই সে পথচ্যুত হবে এবং ঐ পবিত্র সত্তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল হবে তখন এমনই শুকনা কাঠ হবে যা জাহান্নামের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অতঃপর উক্ত হাদীসের সারকথাও বাকী তিনটি হাদীসের সারকথার মতই। সবগুলির সারকথা হচ্ছে- আলী (আ.) নিজেই বেহেশতের প্রতিকৃতি ও বেহেশতবাসী হওয়ার মানদণ্ড।

17. পুল সিরাতের অনুমতিদাতা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যতক্ষণ পর্যন্ত আলী অনুমতিপত্র লিখবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পুল সিরাত পার হতে পারবে না।159

18. আলীর আনুগত্যেই সৌভাগ্য নিহিত

রাসূলে আকরাম (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেছেন-

والذی نفسی بیده ان هذا و شیعته هم الفائزون یوم القیامه

অর্থাৎ শপথ ঐ সত্ত্বার , যার হাতে আমার প্রাণ- আলী ও তার শিয়াগণ (প্রকৃত অনুসারীগণ) কিয়ামতের দিনে সৌভাগ্যবান হিসেবে পরিগণিত হবে।160

19. আলীর প্রকৃত অনুসারীরাই বেহেশতবাসী

রাসূল (সা.) তাকে (আলীকে) বলেছেনঃ

انت و شیعتک فی الجنه

অর্থাৎ তুমি ও তোমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) সকলেরই জান্নাতবাসী।161

20. সফলকামী দল

রাসূলে করিম (সা.) তাকে (আলীকে) ইশারা করে বলেন-

هذا و حزبه المفلحون

অর্থাৎ সে এবং তার দল সফলকাম।162

21. আলীর অনুসারীগণ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং তার সন্তুষ্টভাজন

রাসূলে খোদা (সা.) আমাকে (আলীকে) বলেছেন যে , আমি ও আমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) এমন অবস্থায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হব যে , আমরা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবো এবং আল্লাহও আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকবেন।163 অনুরূপ তুলনা কোরআন শরীফেও এসেছে , সূরা বাইয়্যেনা তে বলা হয়েছেঃ

) ر َضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ(

অর্থাৎ আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট ও তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট।

উক্ত আয়াতের পরে রাসূলের হাদীসও বর্ণিত হয়েছে যে , উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আলী এবং তার শিয়াগণ (অনুসারীগণ)। এই মর্যাদাটি অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট আর আল্লাহও তার উপর সন্তুষ্ট হবে এটা মানুষের পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায়। কারণ , কোরআন শরীফ এরূপ মানুষের সত্তাকে নাফসে মোতমাইন্না অর্থাৎ পরিতৃপ্ত আত্মা বলে অভিহিত করেছে অর্থাৎ যে আত্মা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মশগুল এবং তার স্মরণে এমন প্রশান্তি লাভ করেছে যে , বস্তু জগতের কোন শঙ্কা , অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা তাকে বিচলিত করে না , বলা হয়েছে-

) ي َا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ () ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً(

অর্থাৎ হে পরিতৃপ্ত আত্মা! আল্লাহর দিকে এসো , তুমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।

22. আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত

রাসূলে আকরাম বলেছেনঃ

ذکر علی عباده

অর্থাৎ আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত।164

23. আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত

হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমার পিতাকে দেখেছি যে , তিনি বেশী বেশী আলীর চেহারার প্রতি তাকিয়ে থাকতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে , হে আমার পিতা! আপনি আলীর প্রতি এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন ?

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- হে আমার কন্যা! আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে , তিনি বলেছেন- আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত।165

24. আলী (আ.) জান্নাতের দরজা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا مدینه الجنه و علی بابها یا علی کذب من زعم انه یدخلها من غیر بابها

অর্থাৎ আমি হলাম বেহেশতের নগর আর আলী তার দ্বার , ঐ ব্যক্তি ভুল করবে যে ব্যক্তি দরজা ব্যতীত প্রবেশ করতে চাইবে।166

25. আলী (আ.) বেহেশতের দীপ্তিময় প্রদীপ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی یزهر لا هل الجنه کما یزهر کوکب الصبح لا هل الدنیا

অর্থাৎ ধ্রুবতারা যেমনভাবে পৃথিবীকে আলোকিত করে , আলী ঠিক তেমনিভাবে বেহেশতবাসীদেরকে আলোকিত করবে।167

26. মুসলমানদের পিতা আলী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حق علی علی کل مسلم حق الوالد علی ولده

অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমানদের উপর আলীর অধিকার তেমনি , যেমন প্রত্যেক পিতার অধিকার তার সন্তানের উপর।168

27. আলীর অনুসরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من اطاعنی فقد اطاع اللّه و من اطاعک اطاعنی , و من عصانی فقد عصی اللّه و من عصاک فقدعصانی

অর্থাৎ যারা আমার অনুসরণ করে তারা আল্লাহর অনুসরণকারী , আর যারা আলীর অনুসরণ করে তারা আমার অনুসরণকারী যারা আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আল্লাহর অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে যারা আলীকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আমার অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে।169

28. রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

صاحب سری علی بن ابیطالب

অর্থাৎ আলী হচ্ছে আমার গোপনীয়তা রক্ষাকারী।170

হযরত আয়েশা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে , আলী ছিল রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী।171

29. আলী , রাসূল (সা.)-এর মাথা স্বরূপ

علی منی مثل راسی من بدنی

অর্থাৎ আলীর অস্তিত্ব আমার নিকট ঐরূপ (প্রয়োজনীয়) যেরূপ শরীরের নিকট মাথার অস্তিত্ব ।172

30. আলীর উপাধিসমূহ

রাসূল (সা.)-এর খলিফা (প্রতিনিধি) নির্ধারণের মাপকাঠিগুলোর মধ্যে একটি মাপকাঠি হচ্ছে- এমন কিছু উপাধি যা রাসূল (সা.) তার জীবদ্দশায় কোন ব্যক্তিকে দিয়েছেন। যেমন- হাদীসের গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে , আলীর মত মর্যাদাকর উপাধিধারী ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে দ্বিতীয় কেউ নাই। হাদীসবেত্তারা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.)-এর কোন সাহাবাই হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় মহামূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনি।

আলীকে রাসূল (সা.) যে সকল উপাধিতে ভূষিত করেছেন সেগুলো আমরা নিম্নে তুলে ধরছি: (30-ক) সিদ্দীক ,173

(30-খ) সিদ্দীকে আকবর,174

(30-গ) সাইয়্যেদুল আরাব ,

একদিন রাসূল (সা.) আয়েশাকে বললেনঃ যদি তুমি আরবের সর্দার (সাইয়্যেদ) ও নেতাকে দেখতে চাও , তাহলে আলী ইবনে আবী তালিবের দিকে তাকাও। আয়েশা বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আরবের সর্দার নন ? তিনি বললেনঃ আমি গোটা মানবজাতির সর্দার আর আলী হচ্ছে আরবের সর্দার।175

(30 - ঘ ) সাইয়্যেদুল মুসলিমীন ( মুসলমানদের সর্দার ) ও ইমামুল মুত্তাকিন ( পরহেযগারদের ইমাম) । 176

(30-ঙ) সাইয়্যেদুল মু মিনীন (মু মিনগণের সর্দার) ও ইমামুল মুত্তাকিন (পরহেযগারদের ইমাম) এবং ক্বায়্যেদুল গাররিল মোহাজ্জালীন (কিয়ামতের দিন মুখোজ্জল চেহারাধারীদের নেতা ও অগৃদূত)।

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে রাত্রে আমি মেরাজে গিয়েছিলাম , সে রাত্রে আলীর তিনটি উপাধি আমার উপর ওহী হয়েছিল। সে তিনটি উপাধি হচ্ছে- (1) সে মু মিনদের সরদার , (2) পরহেযগারদের নেতা এবং (3) কিয়ামতের দিনে শুভ্রচেহারাধারীদের মধ্যে প্রধান।177

(30-চ) ইযা সুবুল মু মিনীন (মু মিনদের আবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু) , রাঈসুল মু মিনীন [(অনুসরণের ক্ষেত্রে) মু মিনদের পুরোধা]। 178

(30-ছ) আমিরুল মু মিনীন (মু মিনদের নেতা)। 179

(30-জ) সাইয়্যেদু শাবাবি আহলিল জান্নাত।180

বাখ্যাঃ যেমনভাবে হাদীসসমূহে এসেছে যে , বেহেশতের অধিবাসী সকলেই যুবক হবে। অর্থাৎ বৃদ্ধগণও বেহেশতে প্রবেশের প্রাক্কালে যুবক হয়ে প্রবেশ করবে। অতএব যিনি বেহেশতের যুবকদের সর্দার হবেন তিনি সমস্ত বেহেশতবাসীদের সর্দার ও নেতা হবেন।

(30-ঝ) খাইরুল বারিয়্যাহ অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টি।181

এই উপাধিটি এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে , যখনই সাহাবীগণ তাকে দেখতেন তখনই বলতেনঃ

قد جاء خیر البریة

অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টির আগমন ঘটেছে182

(30-ঞ) আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا و علی حجه اللّه علی عباده

অর্থাৎ আমি ও আলী আল্লাহর বান্দাদের উপর হুজ্জাত বা প্রমাণ।183

(30-ট) রাসূলের সহযোগি

আনাস বিন মালিক বলেন- যখন সূরা নাসর অবতীর্ণ হল তখন আমরা সকলেরই বুঝলাম যে , এই সূরা রাসূলের ইন্তেকালের বার্তা নিয়ে এসেছে। তখন সালমান ফারসীকে বললাম- রাসূলকে যেন জিজ্ঞাসা করে যে , তার পরে কে আমাদের নেতা ও আশ্রয়স্থল হবে এবং কাকে আমরা প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসবো। সালমান রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর প্রদানে বিরত থাকলেন। সালমান আবার জিজ্ঞেস করলেন- তারপরেও তিনি উত্তর দিলেন না। সালমানের মনে ভীতি সঞ্চার হল যে , হয়তো রাসূলকে (সা.) তিনি দুঃখ বা কষ্ট দিয়েছেন। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিছুক্ষণ পরে রাসূল (সা.) বললেন- তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর আশা করছো ? সালমান বলল- হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভয় পেয়েছি যে , হয়তো আমি আপনাকে রাগান্বিত করেছি। তিনি বললেনঃ না এমনটি নয় , জেনে রাখ যে ব্যক্তি আমার ভাই , আমার সহযোগি , আমার খলিফা ও প্রতিনিধি , আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার পরে অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোত্তম , আমার ঋণ পরিশোধ করবে এবং আমার ওয়াদাসমূহ পালন করবে সে ব্যক্তি হচ্ছে আলী ইবনে আবী তালিব।184

আলী (আ.) নিজেও বিভিন্ন উপলক্ষে উক্ত ফজিলতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ আমি রাসূল (সা.)-এর ভাই ও উজীর (সহযোগি)। কেউ এটা আমার পূর্বে বলে নাই (দাবী করে নাই) এবং কেউ আমার পরেও তা বলবে না , যদি না মিথ্যাবাদী হয়। 185


11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26