আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন11%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 78928 / ডাউনলোড: 7838
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী প্রদত্ত ভাষণ

১৪১৫ হিজরীর মুহররম মাসে কোহ্কিলূয়েহ ও বোয়ের আহমদ প্রদেশের আলেমদের সাথে সাক্ষাতকালে ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী প্রদত্ত ভাষণ

পরম করুণাময় দাতা ও দয়ালু মহান আল্লাহর নামে।

সমস্ত প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর এবং দরুদ ও সালাম আমাদের নেতা মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র বংশধরদের ওপর বর্ষিত হোক । সৌভাগ্যবশত আজ আলেমগণ ও মুবাল্লিগদের সাথে সাক্ষাৎ - যা প্রতি বছর মুহররম মাসের পূর্বে প্রচলিত একটি প্রথা ,এ বছর তা এই শহর ও এই প্রদেশে অনুষ্ঠিত হলো । আমরা এ সুযোগটি কাজে লাগাতে এবং পবিত্র মুহররম মাস ও আশুরার অবিস্মরণীয় স্মৃতি সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় প্রিয় আলেম ভাইদের খেদমতে উপস্থাপন করতে চাই। কিন্তু ঐ সব বিষয় আলোচনা করার পূর্বে সম্মানিত আলেমদের ,বিশেষ করে এ প্রদেশের মহান আলেমদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যারা আলহামদুলিল্লাহ অধ্যয়ন-অধ্যাপনা ,আলোচনা ,জ্ঞানচর্চা ,তাফসীর ,বাস্তব পরিস্থিতি বর্ণনা এবং জুমআ ও পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েম করার গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাধে তুলে নিয়েছেন। এ প্রদেশ ঈমানী শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশসমূহের অন্তর্ভুক্ত। যদিও গোটা দেশেই আমাদের জনগণ ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি অনুরক্ত ,তবে সব কিছুরই কম-বেশি আছে। এ প্রদেশ ঐ সব কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর অধিবাসীরা প্রমাণ করেছেন যে ,তারা বিশ্বাসী ,নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক। যেখানকার অধিবাসীরা এরকম হবেন সেখানে আলেমগণের ঐশী দায়িত্ব -কর্তব্য পালন করার উপযুক্ত ও সহায়ক ক্ষেত্র বিদ্যমান।

আমি এ সব মহান ব্যক্তি ,বিশেষ করে মহান আলেমদের পরিশ্রম ও সাধনার কারণে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ,যারা অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখে চলেছেন। আমি সে সাথে তাদের প্রতি এ আবেদেনও রাখতে চাই যে ,বঞ্চিত কোহ্কিলূয়েহ ও বোয়ের আহমদ প্রদেশের সাংস্কৃতিক পাশ্চাদপদতার অবসান ঘটানোর জন্য আপনাদের অদম্য প্রচেষ্টা ও একাগ্রতা যেন আরো বৃদ্ধি পায়।

পবিত্র মুহররমের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সংক্রান্ত দু ধরনের আলোচ্য বিষয় আছে। একটি হচ্ছে আশুরার আন্দোলন সংক্রান্ত কথা । যদিও মহান আলেমগণ ইমাম হোসাইনের বিপ্লবের দর্শন সম্পর্কে অনেক আলোচনা করেছেন ,লিখেছেন এবং এ প্রসঙ্গে অনেক মূল্যবান কথাও বলা হয়েছে ;কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ দেদীপ্যমান বাস্তব ঘটনা সম্পর্কে জীবনভর কথা বলা যায়। আশুরা ও ইমাম হোসাইনের বিপ্লব সম্পর্কে আমরা যতই চিন্তা করি না কেনো ,তারপরও এ সুমহান বিপ্লব তত বেশি ভিন্ন ভিন্ন পরিমাত্রায় চিন্তা-ভাবনা ও ব্যাখ্যার দাবী রাখে। এ মহান বিপ্লবের ব্যাপারে আমরা যত বেশি চিন্তা করবো ততই নতুন নতুন সারসত্যের সন্ধান পেতে থাকবো।

এটা গেলো প্রথম কথা ,যদিও সারাবছর ধরে তা বলা হয় এবং বলা উচিতও বটে ;কিন্তু মুহররমের এমন এক বিশেষত্ব রয়েছে যা এ মাসের দিনগুলোতে বেশি বেশি আলোচনা করা উচিত। যেমনটা সবসময় এ ব্যাপারে বলা হয় ,ইনশাআল্লাহ আরো বলা হবে ।

আরেকটি কথা যা মুহররম উপলক্ষে আলোচিত হওয়ার দাবি রাখে এবং খুব কমই আলোচিত হয়ে থাকে ,আর আমিও এ রাতে যে ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই ,তা হচ্ছে ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (আ.) -এর স্মরণে শোকানুষ্ঠান (আযাদারী) পালন এবং আশুরার পূণ্যস্মৃতিকে পুনজাগরুক করার কল্যাণসমূহ সম্পর্কে ।

নিঃসন্দেহে অন্যান্য মুসলিম ভাইয়ের ওপর শিয়া সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে ,শিয়া সমাজ আশুরার পূণ্যস্মৃতি লালনকারী। যেদিন থেকে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মুসিবত স্মরণের বিষয়টি প্রবর্তিত হয়েছে সেদিন থেকেই আহলে বাইতের ভক্ত ও প্রমিকদের অন্তরে এক আধ্যাত্মিক ও ঐশ্বরিক কৃপার উচ্ছ্বল ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়েছে যা আজ অবধি প্রবহমান রয়েছে এবং ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতেও অব্যাহতভাবে প্রবহমান থাকবে। আর এর উৎসও হচ্ছে আশুরার পূণ্যস্মৃতির স্মরণ।

আশুরার পুণ্যস্মৃতি নিছক একটি স্মৃতির বর্ণনা ও রোমন্থন নয় ;বরং তা হচ্ছে এমন এক ঘটনার বর্ণনা যা অগণিত দিক ও মাত্রার অধিকারী। তাই এ পুণ্যস্মৃতির স্মরণ প্রকৃত প্রস্তাবে এমন এক আলোচ্য বিষয় যা অপরিসীম আধ্যাত্মিক আশীষ ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। এ কারনেই আপনারা লক্ষ্য করবেন যে ,ইমামদের যুগে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর জন্য কাদা ও কাদানোর এক বিশেষ স্থান ও মর্যাদা ছিল । পাছে কেউ ধারণা না করে যে ,চিন্তা ও যুক্তি প্রমাণ থাকতে আবার কান্নাকাটি ও পুরাতন সব আলোচনার প্রয়োজন কি ? না জনাব ,এটা ভুল । এ সব কিছুরই স্ব স্ব গুরুত্ব আছে। মানুষের ব্যক্তিত্ব বিনির্মাণে এগুলোর প্রতিটিরই ভূমিকা রয়েছে ;আবেগ- অনুভূতির যেমন নিজস্ব গুরুত্ব রয়েছে । এমন অনেক সমাস্যা আছে যেগুলো ভক্তি ও ভালোবাসা দ্বারা সমাধান করতে হয়। সেখানে যুক্তি ও প্রমাণ যথেষ্ট নয়। আপনারা যদি পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে দেখতে পাবেন ,মহান নবীদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে যখনই তারা (নবুওয়াত সহকারে) উত্থিত হতেন তখন প্রথমে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি তাদের চারপাশে জড়ো হতো । কিন্তু তাদের এই ঝুকে পড়ার পেছনে যুক্তি ও প্রমাণ মূল কারণ ছিল না। আপনারা মহানবী (সা.) -এর ইতিহাস-যা একটি লিখিত ও স্পষ্ট জীবনেতিহাস- জানেন যে ,উদাহরণস্বরূপ ,তিনি কি কোনো যোগ্যতাবান ও প্রতিভাসম্পন্ন কুরাইশদলকে ডেকে বসিয়েছেন এবং যুক্তি -প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন কিংবা বলেছেন যে ,এ যুক্তিতে আল্লাহ অস্তিত্বশীল অথবা এ যুক্তিতে আল্লাহ এক- অদ্বিতীয় কিংবা এই যুক্তিতে মুর্তিসমূহ বাতিল। মহানবী (সা.) -এর যুক্তি হলো পরবর্তী সময় সম্পর্কিত। বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি -প্রমাণ সেই সময়ের ব্যাপার যখন আন্দোলন এগিয়ে গিয়েছে। শুরুতে আন্দোলন হল একটি আবেগ ও অনুভূতিগত আচরণ। শুরুতেই মহানবী (সা.) উচৈঃস্বরে ঘোষণা করেন , তোমরা তাকিয়ে দেখ এসব মুর্তির দিকে ;দেখ ,যে এগুলো নিষ্কর্মা। এ পর্যায়েই তিনি বলেছিলেন , তোমরা ভালো করে দেখ যে ,মহান আল্লাহ এক-অদ্বিতীয়। (قولوا لا اله الا الله تفلحون ) তোমরা যদি আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই বল ,তাহলে সফলকাম হবে । কোন যুক্তিতেلا اله الا الله (তিনি ব্যতীত আর উপাস্য নেই) সফলকাম হওয়ার কারণ ? কোন বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক যুক্তি -প্রমাণ এখানে রয়েছে ? অবশ্য ,প্রত্যেক সত্য আবেগ-অনুভূতির মধ্যেই একটি দার্শনিক প্রমাণও নিহিত থাকে। কিন্তু কথা হলো ,নবী যখন তার ধর্ম প্রচার কার্যক্রম করতে চান তখন দার্শনিক যুক্তি উত্থাপন করেন না ,সত্য আবেগ ও অনুভূতিই উপস্থাপন করেন। অবশ্য ঐ সত্য আবেগ কোনো যুক্তিবর্জিত ভুল আবেগ নয়। এর নিজের মধ্যে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি লুক্কায়িত থাকে। এই অনুভুতি প্রথমে জনগণকে সমাজে বিরাজমান অন্যায় ও শ্রেণীবৈষম্যের প্রতি আর আল্লাহর শত্রু মনুষ্য শয়তানরা জনগণের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করে তার প্রতি সচেতন করে তোলে। অতঃপর যখন বুদ্ধিবৃত্তিক গতিপ্রবাহ লাভ করে এবং স্বাভাবিক গতিপথে প্রবেশ করে তখন বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি-প্রামাণের পালা আসে। যাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সহনীয়তা ও চিন্তার প্রশস্ততা রয়েছে তারাই স্বাভাবিক যুক্তি প্রমাণ অনুধাবন করতে সক্ষম। কেউ কেউ আবার ঐ সাধারণ স্তরেই আটকে যায়। অবশ্য একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে ,যারা যুক্তি প্রমাণের দিক দিয়ে উচ্চস্তরে রয়েছে ,তারা অনিবার্যভাবে আধ্যাত্মিকতারও উচ্চতর পর্যাযে থাকবে। কখনো কখনো যাদের অবস্থান বুদ্ধিবৃত্তির নিম্ন পর্যাযে ,তাদের আত্মিক আবেগ-অনুভূতির জোয়ার আর গায়েবী উৎসমূল ও মহানবী (সা.) -এর সাথে তাদের আত্মিক সম্পর্ক ও বন্ধন অপেক্ষাকৃত বেশি এবং তাদের প্রেম-ভক্তিও অত্যধিক প্রবল। আর এরাই আবার আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর পর্যায়সমূহ অর্জন করে । ঘটনা এরকমই। আবেগ-অনুভুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এবং এর নিজস্ব স্থান রয়েছে । আবেগ-অনুভুতি যেমন যুক্তির স্থান দখল করতে পারেনা ,তেমনি যুক্তিও আবেগ-অনুভুতির স্থান দখল করতে পারেনা। আশুরার মহাঘটনা এর নিজস্ব সত্ত্বা ও প্রকৃতির মধ্যে এক সত্য আবেগ-অনুভূতির উত্তাল গর্জনশীল ঝাঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের ধারক। একজন মহান পবিত্র জ্যোতির্ময় মানুষ ,যার সুমহান স্বর্গীয় ব্যক্তিত্বের মাঝে বিন্দুমাত্র সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই ,যে সুমহান লক্ষ্যের সত্যতার ব্যাপারে বিশ্বের সকল ন্যায়বান ব্যক্তিই একমত অর্থাৎ ,যুদ্ধ অন্যায় ,অত্যাচার ও সীমালঙ্ঘনের হাত থেকে মানব সমাজকে উদ্ধার করা ও মুক্তি দেয়া ,সেই লক্ষ্যের জন্য তিনি দৃঢ়ভাবে অভ্যুত্থান করেন।

হে জনগণ ! মহানবী (সা.) বলেছেন , যে ব্যক্তি একজন অত্যাচারী শাসন কর্তাকে দেখবে ... কথা এ ব্যাপারেই। ইমাম হোসাইন (আ.) অন্যায়ের মোকাবিলা করাটাকে তার আন্দোলনের দর্শন হিসাবে দাঁড় করেছিলেন । যে আল্লাহর বান্দাদের মাঝে অন্যায় ও সীমালঙ্ঘন করে অথবা পাপাচার ও শত্রুতা মূলক কার্যকলাপ করে বেড়ায় - আলোচনা এ বিষয়কে নিয়েই। ঐ ধরনের একজন মানুষ একটি পবিত্রতম মহান লক্ষ্যের পথে যা বিশ্বের সকলা ন্যায়বান স্বীকার করে থাকেন ,সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামের কষ্ট সহ্য করেন। সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম হচ্ছে নিঃসঙ্গ ও প্রবাসী অবস্থায় সংগ্রাম । বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীদের হৈ হুল্লোড়ও আর সর্ব সাধারণের প্রশংসা ,করতালির মাঝে নিহত হওয়া তো তেমন কঠিন কিছু নয়। যখন সত্য ও মিথ্যার দুই পক্ষ মুখোমুখি হয় আর মহানবী (সা.) ও আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) -এর মতো কোনো ব্যক্তি সত্যপন্থী দলের নেতৃত্বে থাকেন এবং বলেন : কে ময়দানে যেতে প্রস্তুত ,তখন তো সবাই যাবে।

মহানবী (সা.) যারা যুদ্ধের ময়দানে যাচ্ছে তাদের জন্য দোয়া করেন। তাদের মাথায় (আশীর্বাদের) হাত বুলিয়ে দেন এবং বিদায় জানান। মুসলমানরাও তাদের জন্য দোয়া করে । এরপর তারা ময়দানে যায় ,জিহাদ করে এবং শহীদ হয়। এটা হচ্ছে একধরনের নিহত হওয়া ও একধরনের জিহাদ । আরও একধরনের জিহাদ আছে যখন মানুষ যুদ্ধের ময়দানে গমন করে ,অথচ পুরো সমাজই তাকে অস্বীকার করে অথবা তার ব্যাপারে উদাসীন (গাফেল) ও অমনোযোগী অথবা তার থেকে দূরে থাকে অথবা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। যারা তাকে অন্তরে অন্তরে প্রশংসা ও স্তুতি জানায় তাদের সংখ্যা ও কম ,তারা এমনকি মুখেও তাদের প্রশংসা জানানোর সাহস পায়না। অর্থাৎ ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কারবালায় শাহাদাত বরণের ঘটনায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে জাফরের মতো যারা বনী হাশেম বংশীয় এবং এ পবিত্র বৃক্ষেরই শাখা- তারাও মক্কা অথবা মদীনায় দাড়িয়ে ফরিয়াদ করতে ও ইমাম হোসাইনের নামে স্লোগান দেয়ার সাহস পান না।

এটাই হল নিঃসঙ্গ ও প্রবাসী অবস্থায় সংগ্রাম । সবচেয়ে কঠিন সংগ্রামই হচ্ছে এ ধরণের সংগ্রাম । সবাই শত্রু ,সবাই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ,এমনকি বন্ধুরাও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নয় এমনভাবে যে ,যখন ইমাম হোসাইন (আ.) একজনকে বলেন , এসো আমাকে সাহায্য কর! তখন সে সাহায্যের বদলে নিজের ঘোড়াটি সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে : ধরুন ,আমার এ ঘোড়া ব্যবহার করুন । এর চেয়ে বড় নিঃসঙ্গতা এবং এর চেয়ে পরবাসী অবস্থায় সংগ্রাম আর আছে কি ? এমতাবস্থায় এই নিঃসঙ্গ অবস্থার সংগ্রামে তার সবচেয়ে প্রিয়জনরা তার চোখের সামনের কুরবানি হচ্ছে । তার পুত্রগণ ,ভ্রাতুষ্পুত্রগণ ,ভ্রাতৃবৃন্দ ,চাচাত ভাইরা। বনী হাশেমের ফুলগুলো তার সামনে ছিড়ে ছিড়ে ঝরে পড়ছে ,এমনকি তার ছয় মাসের শিশু পুত্রও নিহত হচ্ছে। অধিকিন্তু তিনি জানেন যে ,তার পবিত্র দেহ থেকে প্রাণ বের হওয়া মাত্রই তার নিরাশ্রয় নিরস্ত্র পরিবার-পরিজন আক্রমণের শিকার হবে ।

এ সব ক্ষুধার্ত নেকড়ে কিশোরী ও তরুণীদের চারপাশে হানা দেবে ,তাদের অন্তরকে ভীতসন্ত্রস্ত করবে ,তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করবে ,তাদেরকে বন্দি করবে ,তাদের প্রতি অবমাননা করবে ,আর হযরত আমীরুল মুমিনীনের মহীয়ষী কন্যা হযরত যায়নাবে কুবরা যিনি ইসলামী বিশ্বের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তার সামনে চরম স্পর্ধা প্রদর্শন করবে। আবু আবদিল্লাহ (আ.) এসব কিছুই জানেন। ভেবে দেখুন যে ,এ সংগ্রাম কতটা কঠিন! এসব কিছু ছাড়াও তিনি নিজে এবং তার পরিবার-পরিজন সকলেই তৃষ্ণার্ত ;ছোট ছোট শিশু ,ছোট ছোট মেয়ে ,বয়স্ক ,দুগ্ধপোষ্য শিশু সকলেই তৃষ্ণার্ত। এখন সঠিকভাবে কল্পনা করুন যে ,এ সংগ্রাম কতখানি কঠিন! এরকম সুমহান ,পবিত্র এবং জ্যোতির্ময় ব্যক্তি ,যার উজ্জ্বল প্রতিভাস এক ঝলক দেখার জন্য আকাশের ফেরেশতাগণ পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন যে ,হোসাইন ইবনে আলী (আ.) কে দেখবেন এবং তার কাছ থেকে আশীষ গ্রহণ করবেন ,মহান নবী ও ওয়ালিগণ তার মাকাম লাভের আকাঙ্ক্ষা করেন ,এ ধরণের এত কঠিন ও কষ্টকর সংগ্রামে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। কোন মানুষ রয়েছে যার আবেগ-অনুভূতি এ ঘটনায় দুঃখভারাক্রান্ত না হয় ? কোন মানুষ রয়েছে যে এ ঘটনা অনুধাবন করে অথচ এ ঘটনার প্রতি তার হৃদয় আপ্লুত হয় না ? এ হল প্রবলবেগী প্রবহমান ঝরনাধারা যা আশুরার দিন থেকে উৎসারিত হয়েছে। সেই সময় থেকে যখন যায়নাবে কুবরা (আ.) একটি রেওয়ায়েত অনুসারে ,কারবালাস্থ যায়নাবীয়াহ টিলার চূড়ায় উঠে মহানবী (সা.) -কে সম্বোধন করে বলে ছিলেন :

ﻳﺎ رﺳﻮل اﷲ! صلی علیک ملائکته السماء. هذا حسینک مرمل بالدماء مقطع الاعضاء مصلوب العمامة و الرداء

হে রাসূলুল্লাহ (সা.) ! আপনার ওপর আকাশের ফেরেশতাগণের দরুদ ,এ হলো আপনার হোসাইন ,রক্তরঞ্জিত-কর্তিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ,লুণ্ঠিত পাগড়ি ও বস্ত্র তখন থেকেই তিনি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকগাথা পড়তে এবং এ ঘটনা উঃচৈস্বরে বলতে শুরু করেন। যে ঘটনাকে গোপন রাখতে চাওয়া হয়েছিল ।

তিনি উঃচৈস্বরে ফরিয়াদ করে বলেন ,কারবালায় বলেন ,কুফায় বলেন ,শামে বলেন ,মদীনায় বলেন। (তখন থেকেই) এই ঝরনাধারার উদগীরণ হতে শুরু করেছে যা আজও উদগীরণ হচ্ছে। এ হলো আশুরার ঘটনা । যে ব্যক্তি কোনো নেয়ামত পায়নি তাকে উক্ত নেয়ামতের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হয়না ;কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি একটি নেয়ামত প্রাপ্ত হয় তখন তাকে ঐ নেয়ামতের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে । এরকম একটি মহান নেয়ামত হলো হোসাইন ইবনে আলী (আ.) -এর পুন্যস্মৃতি স্মরণের নেয়ামত অর্থাৎ শোকানুষ্ঠানের নেয়ামত ,মুহররমের নেয়ামত ও আশুরার নেয়ামত যা আমাদের শিয়া সমাজ পেয়েছে। দুঃখজনক হলে ও সত্য যে ,আমাদের অ-শিয়া মুসলিম ভাইরা এ নেয়ামত থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত রেখেছেন। তারাও নিজেদেরকে এ মহান নেয়ামতের দ্বারা সমৃদ্ধ করতে পারেন। অবশ্য তাদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের আনাচে-কানাচে হযরত আবা আবদিল্লাহ (আ.) -এর জন্য শোক পালন করে থাকেন। তবে প্রচলিত নয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে প্রচলিত। এসব অনুষ্ঠান ও পুণ্যস্মৃতির কিভাবে সদ্ব্যবহার করা উচিত ? কীভাবে এ নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো যায় ? এটা এমন এক বিষয় যা আমি প্রশ্নাকারে উত্থাপন করতে চাচ্ছি এবং আপনারা এর জবাব দেবেন। এ সুমহান নেয়ামতসমূহকে ইসলামী বিশ্বাসের প্রবল জোশ ও উদ্যমের উৎসধারার সাথে সংযুক্ত করে দেয়। এ নেয়ামত এমন একটি কাজ করেছে যার ফলে ইতিহাসকাল জুড়ে কর্তৃত্বকারী অত্যাচারীরা আশুরা ও ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মাযারকে ভয় পেয়ে এসেছে। এ ভয় উমাইয়্যা বংশীয় খলীফাদের সময় থেকে শুরু হয়েছে এবং তা আজও অব্যাহত রয়েছে । আর আপনারা এর একটি নমুনা স্বয়ং আমাদের বিপ্লবের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছেন । যখন মুহররম মাস এসেছে তখনই প্রতিক্রিয়াশীল কাফির ,ফাসিক ও ফাসেদ পাহলভী সরকার দেখতে পেয়েছে যে ,তাদের হাত-পা বাধা পড়ে গেছে ,কিছুই করতে সক্ষম নয়। তারা বুঝতে পারত যে ,মুহররম এসে গেছে। ঐ অশুভ সরকারের থেকে উদ্ধারকৃত রীপোর্ট ও নথিপত্র সমূহে এমন বেশ কিছু ইঙ্গিত বরং স্পষ্ট ভাষ্য পাওয়া যায় যা প্রতিপন্ন করে যে ,মুহররম আসার সাথে সাথে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ত। আর আমাদের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) যিনি ছিলেন সুক্ষ্ণদর্শী ,চলমান বিশ্ব-পরিস্থিতি এবং মানব বিশারদ ,তিনি খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) -এর লক্ষ্যও উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কীভাবে এ ঘটনার সদ্ব্যবহার করতে হবে ,আর সেটাই তিনি করেছেন । তিনি পবিত্র মুহররমকে তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের মাস হিসাবে ঘোষণা করেন এবং এই বিশ্লেষণ ও যুক্তি এবং মুহররমের কল্যাণের দ্বারাই তিনি রক্তকে তরবারির ওপর বিজয়ী করেন। এটা হচ্ছে একটি বাস্তব উদাহরণ যা আপনারা দেখেছেন।

এ নেয়ামতের অবশ্যই সদ্ব্যবহার করা উচিত। যেমন জনগণের উচিত এ নেয়ামতের সদ্ব্যবহার করা ঠিক তেমনি আলেমদেরও উচিত এর সদ্ব্যবহার করা। জনগণ এর সদ্ব্যবহার করবে শোক মজলিসসমূহের সাথে মনে-প্রাণে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আর শোকানুষ্ঠান আয়োজন করার মাধ্যমে । জনগণ সমাজের বিভিন্ন স্তরে যত বেশি সম্ভব শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারে। এ সব শোকসভা ও অনুষ্ঠানে নিষ্ঠাসহকারে তারা অংশ গ্রহণ করবে। তবে তারা এ সব শোকানুষ্ঠান থেকে সঠিক আধ্যাত্মিক উপকার নেয়ার উদ্দেশ্যেই অংশগ্রহণ করবে। যেন নিছক সময় কাটানো বা সাদামাটাভাবে পারলৌকিক সওয়াব অর্জনের জন্য না হয় যে জানেও না এই পারলৌকিক পুণ্য কোথা থেকে আসবে ? নিঃসন্দেহে এ সব শোকানুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার পারলৌকিক সওয়াব রয়েছে। কিন্তু এসব মজলিসের সওয়াব কোন কারণে ,সে দিকটি কি ? এই সওয়াব অবশ্যই এমন এক দিকের কারণে যে ,যদি শোকানুষ্ঠানে ঐ দিকটা না থাকে তাহলে সওয়াবও থাকবে না। কেউ কেউ এ দিকটার প্রতি মনোযোগী নয়। জনগণের উচিত এসব মজলিসে অংশ গ্রহণ করা ,এর গুরুত্ব অনুধাবন এবং এ থেকে যথাযথ উপকার লাভ করা। জনগণের উচিত এ শোকানুষ্ঠানের মজলিসগুলোকে হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ,মহানবীর পবিত্র আহলে বাইত ,ইসলামের মূল সারবত্তা ও পবিত্র কুরআনের সাথে তাদের নিজেদের আত্মিক ও আন্তরিক সম্পর্ক ও বন্ধনকে যত দৃঢ় ও মজবুত করা সম্ভব ততখানি দৃঢ় করার মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা। পক্ষান্তরে ,যে বিষয়টা শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের সাথে সংশ্লিষ্ট তা আরো কঠিন। কারণ ,শোকসভাগুলো এভাবে রূপ লাভ করে যে ,একদল লোক সমবেত হবে । আর একজন আলেম উক্ত মজলিসে উপস্থিত হয়ে মূল শোকানুষ্ঠান বা আযাদারী উপস্থাপন করবেন যাতে অন্যরা তা থেকে উপকৃত হয়। আপনারা কীভাবে আযাদারী অনুষ্ঠান করবেন ? আমার এ প্রশ্ন তাদের সকলের কাছে যারা এ ব্যাপারে কর্তব্য অনুভব করে থাকেন। আমি বিশ্বাস করি ,এসব শোকানুষ্ঠানে তিনটি বিষয় থাকা বাঞ্ছনীয় :

প্রথমত এসব শোকানুষ্ঠান যেন মহান আহলে বাইত (আ.) -এর প্রতি ভক্তি -ভালোবাসা বৃদ্ধি করে । কারণ ,আবেগগত সম্পর্ক এক অতি মূল্যবান সম্পর্ক। তাই আপনাদের এমন কাজ করা উচিত যাতে এ সব শোক মজলিসে অংশ গ্রহণকারীদের ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসা এবং ঐশ্বরিক মারেফাত দিন দিন বৃদ্ধি পায় । আপনারা যদি ,খোদা না করুন ,এ সব শোক মজলিসে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেন যার ফলে এ মজলিসের শ্রোতা অথবা এ মজলিসের বাইরে যে রয়েছে সে আবেগের দিক থেকে আহলে বাইতের নিকটবর্তী না হয় এবং খোদা না করুন ,সে তাদের থেকে দূরে সরে যায় এবং সে যদি দুরত্ব ও বিরক্তি অনুভব করে তাহলে তখন শোক পালনের মজলিস শুধু যে এর সবচেয়ে বড় উপকারিতাকে তো হারাবে তা নয় ;বরং তা অন্য অর্থে অপকারী ও ক্ষতিকারকও হয়ে দাঁড়াবে।

এখন আপনারা যারা শোক মজলিসের আয়োজক ও বক্তা ,আপনাদের ভেবে দেখতে হবে যে ,কী করা উচিত যাতে ইমাম হোসাইন (আ.) ও মহানবী (সা.) -এর আহলে বাইতের প্রতি জনগণের আবেগ-অনুভূতি এ সব শোক মজলিসে উপস্থিত হওয়ার কারণে দিন দিন বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে এই যে ,এ সব শোক মজলিসে আশুরার মূল ঘটনার ব্যাপারে অবশ্যই যেন জনগণের জন্য একটি স্বচ্ছ ও স্পষ্টতর পরিচিতি জন্মায়। এমন যেন না হয় যে ,আমরা (আলেমগণ) ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শোকানুষ্ঠানে এসে একটি বক্তৃতা দেব অথবা মিম্বরে উঠব এমনভাবে যে এ শোক মজলিসে যদি একজন চিন্তাশীল ও ধীসম্পন্ন ব্যক্তি উপস্থিত থাকেন - আর আমাদের সমাজে বর্তমানে এরূপ চিন্তাশীল ব্যক্তি অনেক রয়েছেন ইসলামী বিপ্লবেরই কল্যাণে ,তিনি নিজে নিজে চিন্তা করবেন যে ,আমরা কিসের জন্য এখানে এসেছি এবং আসল ঘটনাটি বা কী ? কেন ইমাম হোসাইন (আ.) -এর জন্য ক্রন্দন করা উচিত! আসলে কেনই বা ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালায় আগমন করলেন এবং আশুরার শোকাবহ ঘটনার সৃষ্টি করলেন ? এমনভাবে হতে হবে যে ,কোনো ব্যক্তির মনে যদি এ ধরণের প্রশ্নের উদয় হয় তাহলে আপনারা এর জবাব দিতে থাকেন। অতএব ,আপনারা যে শোকগাথা বর্ণনা করে থাকেন অথবা যে বক্তৃতা প্রদান করেন এবং যে সব বিষয় বয়ান করেন সেগুলোতে যদি এই অর্থে কোনো নির্দেশনা ,এমনকি কোনো ইঙ্গিত না থাকে তাহলে শোকানুষ্ঠানের যে তিন মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর একটির ঘাটতি দেখা দেবে এবং তা হয়তো কাঙ্ক্ষিত উপকারিতা আর দিতে পারবে না। এমনকি খোদা না করুন কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা দ্বারা অপকারও সাধিত হতে পারে।

তৃতীয় যে বিষয়টি এসব শোক মজলিসের জন্য অত্যাবশ্যক তাহলো এগুলো যেন জনগণের ধর্মীয় জ্ঞান ও বিশ্বাসের বৃদ্ধি ঘটায়। আপনারা এ শোক মজলিসে ধর্মসংক্রান্ত এমন একটা কিছু বলবেন যা ঈমান ও জ্ঞান বৃদ্ধির কারণ হয়। একটি সদুপদেশ ,একটি বিশুদ্ধ হাদীস ,একটি সঠিক ইতিহাসের শিক্ষণীয় অংশ ,পবিত্র কুরআনের কোনো একটি আয়াতের ব্যাখ্যা ,ইসলামের কোনো বুযুর্গ আলেম ও পণ্ডিতের থেকে একটি বিষয়ের বর্ণনা এগুলো হচ্ছে এমন সব বিষয় যা বর্ণিত হতে পারে। এমন যেন না হয় যে ,আমরা মিম্বরে শুধু বকবক করলাম অথবা যদি কোন বিষয়ে আলোচনা করলামও বটে কিন্তু সেটা একটা দুর্বল বিষয় ,যা ঈমানকে তো বৃদ্ধি করেই না বরং দুর্বল করে দেয়।

আমাকে অবশ্যই আপনাদের কাছে বলতে হবে যে ,দুঃখজনক ভাবে কখনো কখনো দেখা যায় এ ধরনের ব্যাপার রয়েছে । কখনো কখনো দেখা যায় যে ,শোক মজলিসে বক্তা এমন বিষয় বর্ণনা করেন যা যুক্তির দিক থেকে এবং বুদ্ধিগত ও বর্ণনাগত সনদ-প্রমাণের আলোকে দুর্বল। আবার একজন বিচক্ষণ শ্রোতা ও যুক্তিবাদীর চিন্তা-চেতনায় ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিস্তার করে । কিছু কিছু জিনিস কোনো একটি পুস্তকে লেখা হয়েছে এবং এগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন হওয়ার কোনো প্রমাণও আমাদের কাছে নেই। হতে পারে তা সত্য ,আবার হতে পারে মিথ্যা। এগুলোর মিথ্যা হওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু আপনারা যখন ঐ বিষয় বর্ণনা করবেন আর আপনাদেরা শ্রোতা-যে হতে পারে একজন যুবক ,একজন শিক্ষার্থী ,ধর্মতত্ত্বের একজন ছাত্র ,একজন যোদ্ধা ও একজন বিপ্লবী-আল হামদুল্লিাহ ,অবশ্য বিপ্লব জনগণের মন ও মানসিকতাকে উন্মুক্ত ও প্রশস্ত করেছে ,সে যখন তা আপনাদের কাছ থেকে শুনবে তখন ধর্মের ব্যাপারে তার প্রশ্ন ,সংশয় ও ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। তার এ ধরণের কথা বলা উচিত নয়। এমন কি যদি এ বিষয়ের সঠিক সনদ-প্রমাণও বিদ্যমান থাকতো ,কিন্তু যেহেতু তা পথভ্রষ্টতা ও বিচ্যুতির কারণ ,কাজেই তা বলা উচিত নয়। আর যখন এগুলোর বেশিরভাগেই সঠিক সনদই নেই তখন তো আর কথাই নেই। এ ব্যক্তি কারও কাছ থেকে কিছু একটা শুনেছে। একজন বর্ণনা করেছে যে , আমি অমুক স্থানে ছিলাম এবং অমুক সফরে অমুক ঘটনা ঘটে ছিল । বা প্রমাণ সহকারে অথবা বিনা প্রমাণে একটি বিষয় বলল আর শ্রোতাও তা বিশ্বাস করে নিল। ঘটনাচক্রে ঐ শ্রোতা উক্ত ঘটনার কথা পুস্তকে লিখেও ফেলল যা কোনো এক কোণায় পড়ে আছে। কেন আপনাকে বা আমাকে তা বলতে হবে যেগুলো কোন বৃহত্তর সমাবেশে এবং সূক্ষ্ণবিচারী ও সচেতন মানুষের সামনে ব্যাখ্যা করা যায় না ? যেখানেই যা কিছু লেখা রয়েছে সেটাই কি বলতে হবে ? আজ আমাদের সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক বাস্তবতা হচ্ছে এই যে ,আমরা বিপ্লবের আগে বলতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকরা ,কিন্তু আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুবকদের জন্য বিশেষভাবে নয় বরং তারা ছাড়া ও আমাদের সমাজে নারী -পুরুষ ,ছেলে-মেয়ে সকলেরই মন-মানসিকতা উন্মুক্ত ;তারা ব্যাপারগুলোকে বিচক্ষণতার দৃষ্টিতে দেখে ,বুঝতে চায়। এরা সংশয়ের মধ্যে পড়বে। এটা হচ্ছে আমাদের যুগে একটি সাংস্কৃতিক বাস্তবতা । শত্রুরা নয় ,বরং আমার ও আপনার চিন্তাকে অস্বীকারকারীরা সংশয় ছড়ায়।

কেন ,এটা কি বলা যায় না কি যে ,যে ব্যক্তি আমাদের চিন্তাকে মেনে নেয় না ,সে বোবা হয়ে যাক ,কথা না বলুক ,কোন সংশয়ের সৃষ্টি না করুক ? তারা সংশয়ের জন্ম দেয় ,কথা বলে ,(বিভিন্ন ) বিষয় ছড়ায় এবং দোদুল্যমানতা ও দ্বিধার সৃষ্টি করে। এ কারনে আপনারা যা বলবেন তা যেন সংশয়ের অবসান ঘটায়-সংশয়কে বৃদ্ধি না করে । অনেকে এ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের দিকে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ না করেই মিম্বরে বসে এমন বক্তব্য প্রদান করে যা শ্রোতার মন-মগজ থেকে জঠিলতা তো দূর করেই না ,বরং শ্রোতার মনে তা আরো জট পাকিয়ে দেয়। আসুন দেখা যাক ,যদি আমরা মিম্বরে বসে এমন কোন একটি কথা বললাম যে দশ-পাঁচ জন ,এমনকি একজন যুবকও দীনের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়লো তারপর চলে গেল ,আর আমরা তাকে চিনলামও না ;এমতাবস্থায় কীভাবে এ ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব ? আসলে কি এ ক্ষতি পূরণ করা যায় ? আল্লাহ কি আমাদেরকে ক্ষমা করবেন ? ব্যাপারটা খুবই কঠিন।

অতএব ,বক্তৃতায় অবশ্যই উপরিউক্ত তিনটি বিষয় থাকতে হবে । প্রথমত ইমাম হোসাইন (আ.) ,মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতের প্রতি ভক্তিপূর্ণ আবেগকে বৃদ্ধি করবে এবং আত্মিক-আবেগপূর্ণ সম্পর্ক ও বন্ধনকে দৃঢ়তর করবে। দ্বিতীয়ত শ্রোতাকে আশুরার এ সুমহান ঘটনা সম্পর্কে উজ্জ্বলতর ও স্পষ্টতর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করবে এবং তৃতীয়ত ধর্ম বিষয়ে জ্ঞানও বৃদ্ধি করবে আর ঈমানও সৃষ্টি করবে।

এখন আমরা এ কথা বলছি না যে ,সকল বক্তৃতায় অবশ্যই সবকিছু থাকতে হবে । আপনারা যদি একটি সহীহ হাদীস কোনো একটি নির্ভর যোগ্য গ্রন্থ থেকে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেন তাহলে তা কার্যকর প্রভাব রাখতে পারে। কখনো কখনো একটি হাদীসকে এতটা অতিরঞ্জিত আকারে বর্ণনা করা হয় যে ,এর আসল অর্থ আর বজায় থাকে না। আপনারা যদি এই একটি হাদীসকেই সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেন তাহলেই হয়তো বা আমরা যা চাচ্ছি তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ ব্যাখ্যার মধ্যে এসে যেতে পারে। আপনারা যদি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত কোন নির্ভরযোগ্য তাফসীরের ভিত্তিতে এবং গভীর চিন্তা ও অধ্যয়ন সহকারে বর্ণনা করেন তাহলেই লক্ষ্য অর্জিত হয়ে যাবে । কারবালার বিপদ ও শোককথা স্মরণ করার জন্য মরহুম মুহাদ্দিস কোমীর‘‘ নাফাসুল মাহমূম’’ গ্রন্থটি খুলে দেখে দেখে পড়বেন। দেখতে পাবেন যে ,শ্রোতার জন্য ক্রন্দনের উদ্রেককারী এবং প্রবল হৃদয়াবেগ ও অনুভূতি সৃষ্টি করবে । কি প্রয়োজন রয়েছে যে ,আমরা আমাদের খেয়াল ও কল্পনায় শোক মজলিসকে সজ্জিত করার মানসে এমন কোনো কাজ করবো যার ফলে শোক-মজলিস তার প্রকৃত দর্শন থেকে দূরে সরে যাবে ? আমি আসলেই আশংকা করছি যে ,পাছে খোদা না করুন ,বর্তমান যুগ সন্ধিক্ষণটি- যা হচ্ছে ইসলাম ধর্মের এবং আহলে বাইতের চিন্তা ও মতাদর্শের রেনেসা ,আবির্ভাব ,বিকাশ ও প্রসারের যুগ ,এ যুগে আমাদের সঠিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে না পারি। এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো মানুষকে আল্লাহ ও দীনের নিকটবর্তী করে । এই ট্টাডিশনাল (বা ঐতিহ্যবাহী) শোক পালন জনগণকে দীনের নিকটবর্তী করে । ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেছেন , আপনারা সবার ঐতিহ্যগত শোকানুষ্ঠান পালন করবেন। শোক মজলিসে বসা ,শোককথা বর্ণনা করা ,ক্রন্দন করা ,মাথা ও বুক চাপড়ানো ,শোক মিছিল বের করা ইত্যাদি হচ্ছে সেসব বিষয় যেগুলো মহানবী (সা.) -এর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি আবেগ উথলে দেয় ,যা অত্যন্ত ভালো। আবার এমন কিছু কাজ আছে যেগুলো বিপরীতক্রমে কোন কোন মানুষকে দীনবিমুখ করে দেয়। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে ,একথা বলতে হচ্ছে ,সাম্প্রতিক এ তিন চার বছরে বেশ কিছু কাজ যা আমার দৃষ্টিতে কোন অশুভ মহল আমাদের সমাজে প্রচলন ঘটাচ্ছে ,সেগুলো এমনভাবে তুলে ধরা হচ্ছে যে ,যে কেউ সেগুলো দেখবে তার মনে প্রশ্ন দেখা দেবে।

আগেকার দিনে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচলন ছিল যে শোকের দিনগুলোতে নিজেদের দেহে তালা লাগাতো। বিজ্ঞ আলেমগণ একাজের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন পুনরায় এ কাজ শুরু হয়েছে এবং আমি শুনেছি যে ,দেশের (ইরান) আনাচে-কানাচে কেউ কেউ দেহে তালা লাগাচ্ছে। এটা কোন ধরনের কাজ যা কেউ কেউ করছে ? কামা মারাও ঠিক এমনই। কামা মারাও শরীয়তবিরোধী কাজগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আমি জানি যে ,এখন একদল বলবে , অমুকে যদি কামা মারার কথা না তুলতেন তাহলে ঠিক হতো। আপনার এতে কাজ কী ? মারতে দিন। না জনাব! তা হয় না। এভাবে যে সম্প্রতি এই চার-পাঁচ বছরে এবং (ইরান-ইরাক) যুদ্ধের পর কামা মারার বিষয়টির প্রচলন করে ফেলছে ,যদি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জীবদ্দশায়ও এমনটা হতো তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি ও এ কাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন (উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের তাকবীর ধ্বনি) ।

এটা একটা গর্হিত কাজ যে ,একদল কামা নিয়ে নিজেদের মাথায় আঘাত করবে এবং রক্ত ঝরাবে। এ কাজের অর্থ কী ? কোথায় এ কাজ শোক ও আযাদারীর তাৎপর্য বহন করে ? মাথায় কামা মারা কি আযাদারী পালন ? যদি আপনারা লক্ষ্য করেন তাহলে দেখতে পাবেন যে ,যাদের ওপর কোন শোক নেমে আসে তারা নিজেদের মাথা ও বুক চাপড়ায়। এটাই (হলো ) আযাদারী। এটা হলো প্রচলিত শোক পালন। আপনারা কোথায় দেখেছেন যে ,কোনো ব্যক্তি তার প্রিয় থেকে ও প্রিয়জনের মৃত্যুতে তরবারি দিয়ে নিজ মস্তিষ্কে আঘাত করবে এবং নিজের মাথা থেকে রক্ত ঝরাবে ? এ কাজ কীভাবে আযাদারী হয় ? এটা আসলে বানোয়াট। এগুলো হচ্ছে এমন বিষয় যেগুলো ধর্ম-বহির্ভূত। নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ এ সব কাজে সন্তুষ্ট নন। অগ্রবর্তী আলেমবর্গ নিরুপায় ছিলেন বিধায় তারা এসব কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু আজ ইসলামের সার্বভৌমত্ব ও প্রকাশ্য বিজয়ের দিন। আমাদের এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যার ফলে শ্রেষ্ঠ ইসলামী সমাজ যামানার নেতা ইমাম মাহদী (আ.) [আমাদের প্রাণ তার জন্য উৎসর্গীকৃত হোক ]-এর নামে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামে এবং হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর পবিত্র নামের বরকতে গৌরবান্বিত ,তারা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ এবং অমুসলমানদের দৃষ্টিতে একদল কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিবেক-বুদ্ধিবর্জিত জনগোষ্ঠী বলে গণ্য হন। আমি সত্যিকারে যতই ভেবে দেখেছি ততই উপলদ্ধি করেছি যে ,এ বিষয়টি ,যা নির্ঘাত একটি শরীয়তবিরোধী কাজ ও বিদআত তা আমাদের প্রিয়জনগণের গোচরীভূত না করে পারি না। এ কাজ করবেন না। আমি অবশ্যই এসব কাজে সন্তুষ্ট নই।

কেউ যদি প্রকাশ্যে কামা মারে তাহলে আমি আন্তরিকভাবে তার প্রতি অসন্তুষ্ট (হব) । এটা আমি নিবেদেন করছি এজন্য যে ,একসময় দেশের আনাচে-কানাচে কিছু লোক জড়ো হতো ,এ সব কাজ করত। আনাচে কানাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল ;কারো চোখের সামনে ছিল না। অর্থাৎ এতদার্থে তা প্রকাশ্যে করা হতো না। এ কারনে ,তাদের সাথে কারো কাজ ও ছিল না। এখন সেটা ভালো হোক আর মন্দ হোক । মোটকথা একটি ক্ষুদ্র গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু যখন ঠিক করা হয় যে ,কয়েক হাজার লোক হঠাৎ করে তেহরান ,কোম ,আযারবাইজান বা খোরাসানের মতো শহরগুলোর রাজপথে বের হয়ো প্রকাশ্যে মাথায় কামা দিয়ে আঘাত করবে ,তখন এটা অবশ্যই শরীয়ত বিরোধী কাজ হবে । ইমাম হোসাইন (আ.) এ ধরণের শোক পালনে সন্তুষ্ট নন। আমি জানি না যে ,কোথা থেকে এ কাজগুলোর উৎপত্তি। আর কোন কোন অভিরুচি এ সব কাজকে আমাদের ইসলামী ও বিপ্লবী সমাজে আমদানি করছে।

সাম্প্রতিককালে যিয়ারত করার ক্ষেত্রেও এক অদ্ভুত ও অভূতপূর্ব এবং বিদঘুটে ধরনের বিদআতের প্রচলন করা হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য করুন যে ,মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও নিষ্পাপ ইমামদের পবিত্র কবর সকলে যিয়ারত করতেন। মহানবী ও ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পবিত্র কবর আমাদের ইমামগণ অর্থাৎ ইমাম সাদেক (আ.) ,ইমাম মূসা ইবনে জাফর (আ.) এবং অন্য সকল ইমাম যিয়ারত করতেন। ইরান ও ইরাকে অবস্থিত আহলে বাইতের পবিত্র কবর সহ আমাদের বড় বড় আলেম ও ফকীহবৃন্দ যিয়ারত করতেন। আপনারা কি কখনও শুনেছেন যে ,কোনো আলেম ও ইমাম (আ.) যখন যিয়ারত করতে চাইতেন তখন তারা মাযার প্রাঙ্গণের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে বুক ঘষে ঘষে ইমামদের হারামে পৌছতেন ? যদি এ কাজ মুস্তাহাব ,প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হতো তাহলে আমাদের মহান সম্মানিত আলেমগণ একাজ করতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। এমনকি বর্ণিত আছে যে ,মরহুম আয়াতুল্লাহ আল উযমা বুরুজারদী (রহ.) এত বড় একজন শক্তিমান আলেম ,জ্ঞান গভীর ও বুদ্ধিদীপ্ত মুজতাহিদ হয়েও মাযারের চৌকাঠ (মাযারের দরজার চৌকাঠের মাঝের অংশ) চুম্বন করতে নিষেধ করতেন ,অথচ এ কাজ হয়তো মুস্তাহাবও হতে পারে। সম্ভবত রেওয়ায়েতে চৌকাঠ চুম্বন করার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। দোয়ার বই-পুস্তকে রয়েছে । আর আমার মনে পড়ছে যে ,রেওয়ায়েতেও রয়েছে চৌকাঠকে চুম্বন করবে। যদিও এটি একটি মুস্তাহাব কাজ ,তবু তিনি বলতেন , এ কাজ করো না। পাছে অন্যেরা হয়তো ধারণা করবে যে ,আমরা ইমামদের পবিত্র কবর সমূহের ওপর সিজদা করি ,এভাবে আবার শিয়া মাযহাবের শত্রুরা কোন সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি না করে । এখন আবার একদল যখন ইমাম আলী ইবনে মূসা আর রেযা (আ.) -এর পবিত্র মাযার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে তখন উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে এবং ২০০ মিটার পথ বুকে ঘষে অতিক্রম করে । এ কাজটা কি ঠিক ? না ,এ কাজ ভুল এবং ধর্ম ও যিয়ারতের জন্য অবমাননাকর। কে এ সব কাজ জনগণের মধ্যে প্রচলন করছে ? এ সব কাজ না আবার শত্রুদের কারসাজি (হয়) ? অবশ্যই জনগণকে এসব কথা বলবেন এবং তাদের মন-মানসিকতাকে আলোকিত করবেন।

ধর্ম ও ইসলাম হলো যুক্তিপূর্ণ। আর ইসলামের সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ অংশ হলো ঐ ব্যাখ্যা যা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে শিয়া মাযহাবের রয়েছে । শিয়া কালামশাস্ত্রবিদগণের প্রত্যেকেই স্ব স্ব্ যুগে কিরণময় সূর্যসম ছিলেন । কেউ বলতে পারত না যে ,আপনাদে যুক্তি দুর্বল। কি ইমামদের যুগে যেমন মুমিন-ই তাক হিশাম ইবনে হাকামে র মতো ব্যক্তিবর্গ ,আর কি ইমামদের পরে যেমন বনী নওবখত শেখ মুফীদ এর মতো ব্যক্তিবর্গ ,আর কি তদপরবর্তী যুগগুলোতে যেমন আল্লামা হিল্লী প্রমুখের মতো ব্যক্তিবর্গ ছিলেন যারা সকলেই ছিলেন বিচার -বুদ্ধি ও যুক্তিবাদী। আমরা যুক্তি ও প্রমাণের অনুসারী । আপনারা দেখুন শিয়া মাযহাবের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কত যুক্তি ও প্রমাণসমৃদ্ধ গ্রন্থ লিখিত হয়েছে! আমাদের বর্তমান যুগে মরহুম আল্লামা শরফুদ্দীনের গ্রন্থাবলী এবং মরহুম আল্লামা আমীনীর আল গাদীর গ্রন্থটি আপাদমস্তক যুক্তি -প্রমাণে সমৃদ্ধ এবং কংক্রিট ঢালাইয়ের মতো মজবুত । শীয়ায়ীত্ব হচ্ছে এটা ;না ঐ সব ,যেগুলোর কোনো যুক্তি প্রমাণ নেই ,শুধু তাই-নয় ,বরং কতকটা কুসংস্কার সদৃশ্য। কেনো এগুলো সমাজে আমদানি করা হচ্ছে ? এটা ধর্মীয় পরিমণ্ডল ও দীনী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বড় হুমকি। আকীদা-বিশ্বাসের সীমানা প্রহরীদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে । আমি বলেছি যে ,একদল লোক নিশ্চিত ভাবে যখন এ কথা শুনবে তখন সহানুভূতি সহকারেই বলবে ,ভালো হতো অমুক এখন এ কথা না বলতেন।

না ,জনাব! আমাকে অবশ্যই এ কথা বলতে হতো। আমাকে অবশ্যই এ কথা বলতে হবে । আমার দায়িত্ব অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি । সম্মানিত উলামা ও মুবাল্লিগবৃন্দেরও এ কথা বলা উচিত। আপনারাও অবশ্যই বলবেন। আমাদের শ্রদ্ধেয় ইমাম খোমেইনী (রহ.) সেই সংস্কারক যিনি যেখানেই বিচ্যুতির কোনো ছাপ দেখতে পেতেন সেখানেই পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করে এবং কোনো ছাড় না দিয়েই তার মোকাবিলায় দাড়াতেন। আর যদি এসব জিনিস তার সময়ে থাকত অথবা এ পর্যাযে প্রচলিত থাকত তাহলে নিঃসন্দেহে তিনিও এ সব কথাই বলতেন। একদল লোক যারা আবার এসব জিনিসের প্রতি ভীষণ ভাবে আসক্ত হয়ে পড়েছে ,তারা এসব কথায় ব্যথিত হবে যে ,কেন অমুক এসব জিনিস যেগুলোকে আমরা পছন্দ করি ,সেগুলোর প্রতি এমন নির্দয় হলেন এবং এভাবে তীব্র ভাষায় কথা বললেন। তাদের অধিকাংশই অবশ্য মুমিন ,সত্যবাদী ও কোনো অভিসন্ধি পোষণ করে না। কিন্তু তারা ভুল করছে। এটা হচ্ছে এক মহান দায়িত্ব যা আপনারা সম্মানিত আলেমবর্গ যেখানেই থাকুন না কেন ,কাধে তুলে নিতে হবে । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক মজলিস এমন এক অনুষ্ঠান যা অবশ্যই খাঁটি ইসলামী জ্ঞান এবং যে তিনটি বিষয় আমি উল্লেখ করেছি সেগুলোর উৎস হতে হবে ।

আশা করি ,মহান আল্লাহ আপনাদেরকে যা কিছু তার সন্তুষ্টির কারণ তা শক্তি ,সাহস ও শ্রম-সাধনাসহকারে নিরবচ্ছিন্নভাবে বর্ণনা করার তৌফিক দিন এবং (ইনশাআল্লাহ) আপনাদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে সফল করুন।

ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

সূত্র : ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এবং শ্রদ্ধেয় আয়াতুল্লাহদের কাছে আশুরার শোক পালন সংক্রান্ত ইস্তিফতাসমূহ ,পৃ ৫ - ১৯ ,দাফতারে তাবলীগাতে ইসলামী হাওযা - ই ইলমীয়া - ই কোম ,ইরান কর্তৃক প্রকাশিত। প্রকাশকাল মুহররম ১৪১৫ হি ( খোরদাদ ১৩৭৩ ফার্সী সাল ) ।

শয়তানের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গ

অনেক মানুষই মনে করে যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য কেবল শয়তানই দায়ী। তাদের ধারণা , শয়তানকে সৃষ্টি করা না হলে হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ) বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হতেন না এবং আমরা (মানব প্রজাতি) বেহেশতেই থাকতাম। কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ এতদূর পর্যন্ত বলে যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে গোমরাহ্ করার উদ্দেশ্যেই আগেই শয়তানকে (অর্থাৎ আযাযীল বা ইবলীসকে) সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য যে , এটা মহান আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কে অত্যন্ত হীন ধারণা।

যেহেতু বিষয়টি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত ধারণারই অংশবিশেষ এবং বিশেষ করে এ ধারণায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা আলাকেই দায়ী করা হয় সেহেতু এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা জরুরী বলে মনে হয়।

প্রথম কথা হচ্ছে এই যে , শয়তানের গোমরাহ্ করার ক্ষমতা অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না , বরং অদৃষ্টবাদকে খণ্ডন করে। কারণ , এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে মানুষ সহ প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির ভবিষ্যতের ছোটবড় সবকিছু নির্ধারণ করে রাখেন নি। কেননা , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে সব কিছু নির্ধারণ করে রেখে থাকলে শয়তানের কোনো ক্ষমতা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। তেমনি শয়তানের ক্ষমতা এ-ও প্রমাণ করে যে , প্রতি মুহূর্তে মানুষ সহ সকল সৃষ্টির প্রতিটি কাজ স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা করেন বা করিয়ে নেন-এ ধারণাও পুরোপুরি ভ্রান্ত।

এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি আনুষঙ্গিক ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা যরূরী বলে মনে হয়। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে , আযাযীল (শয়তান) ফেরেশতা ছিলো এবং ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। অবশ্য যারা জানে যে , কোরআন মজীদে আযাযীলের জিন্ প্রজাতির সদস্য হওয়ার কথা উল্লেখ আছে , তাদের অনেকে মনে করে যে , সে জিন্ হলেও ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। আর এদের সকলেই মনে করে যে , সে অত্যন্ত উঁচু স্তরের আাবেদ (আল্লাহ্ তা আলার ইবাদতকারী) ছিলো ; অতঃপর আল্লাহ্ তা আলার একটিমাত্র হুকুম অমান্য করে [হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে] আল্লাহর অভিসম্পাতের শিকার হয়। এজন্য অনেকে বিস্ময়করভাবে দাবী করে যে , আযাযীল ছিলো সবচেয়ে বড় তাওহীদবাদী , এ কারণে সে আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে সিজদাহ্ করতে রাযী হয় নি। (!!!)

এসব দাবী অকাট্য দলীল বিহীন ভিত্তিহীন কাল্পনিক দাবী মাত্র। কারণ , আযাযীল বা ইবলীস ফেরেশতা ছিলো না। ফেরেশতারা আল্লাহ্ তা আলার নাফরমানী করতে পারে না ; নাফরমানীর মূল চালিকাশক্তি স্বাধীনতা ভোগের প্রবণতা , বিশেষতঃ কুপ্রবৃত্তি থেকে তারা মুক্ত। বরং আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৫০) ।

আর যারা স্বীকার করেন যে , আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো , কিন্তু অত্যন্ত উঁচু দরের আলেম ও আাবেদ ছিলো বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাকে ফেরেশতাদের শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। এ দাবীরও কোনো ভিত্তি নেই। বিশেষ করে ফেরেশেতাদের সম্পর্কে ইসলামের অকাট্য সূত্রসমূহ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হচ্ছে তাদের মধ্যে অজ্ঞতা , সুপ্ত প্রতিভা ও প্রতিভার বিকাশ ও জ্ঞানার্জন বলতে কোনো কিছু নেই। বরং সৃষ্টিগতভাবেই তারা আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কিত , স্বীয় নিয়মিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সৃষ্টি সম্পর্কে প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং সেই সাথে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যখনই যে হুকুম দেয়া হয় তা পালনের প্রবণতার অধিকারী। এমতাবস্থায় তাদের জন্য শিক্ষক নিয়োগের ধারণা একটি একান্তই অবান্তর ধারণা।

অন্যদিকে জিন্ প্রজাতির সদস্য আযাযীল আদৌ কোনো আাবেদ ছিলো না। বরং হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সে নাফরমান ছিলো। হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে আযাযীল ইবলীসের অস্বীকৃতি প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ)

সে (আল্লাহর হুকুম পালনে) অস্বীকৃতি জানালো ও বড়ত্ব দাবী করলো (অহঙ্কার করলো) ; আর সে ছিলো কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩৪)

অনেকে এ আয়াতের শেষ বাক্যের অর্থ করেন: আর সে কাফের হয়ে গেলো। বা আর সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয়। সে মুসলমান (আল্লাহর অনুগত) ছিলো , কিন্তু কাফের হয়ে গেলো-এটা বুঝাতে চাওয়া হলে বলা হতো:فاصبح کافراً (ফলে সে কাফের হয়ে গেলো)। কিন্তু আয়াতে যা বলা হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্ট যে , সে পূর্ব থেকেই কাফের ছিলো। শুধু তা-ই নয় , আয়াত থেকে এ-ও বুঝা যায় যে , হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যখন হুকুম দেয়া হয় তখন সে একাই কাফের ছিলো না , বরং পূর্ব থেকেই একটি গোষ্ঠী (একদল জিন্) কাফের ছিলো ; ইবলীস ছিলো তাদের নেতা।

এমনকি আল্লাহ্ তা আলা হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য ইবলীসকে হুকুম না দিলে সে হযরত আদম (আঃ) ও মানব প্রজাতির ক্ষতি করার (তাদেরকে গোমরাহ্ করার) চেষ্টা করতো না-এরূপ মনে করাও ঠিক নয়। কারণ , কুফর্ বা খোদাদ্রোহিতার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মু মিনদেরকে কুফরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।

অন্যদিকে ঐ সময় ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলেও তথা ইবলীসকে আদৌ সৃষ্টি করা না হলেও মানব প্রজাতিকে বেহেশতে রাখা হতো না। কারণ , মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছিলো ধরণীর বুকে আল্লাহ্ তা আলার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)।

অবশ্য বেহেশতে থাকাকালে ইবলীসের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঘটনা না ঘটলে কোনোরূপ তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ)কে বেহেশত ছেড়ে যমীনে আসতে হতো।

ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলে কোনো মানুষই নাফরমান হতো না তা নয়। কারণ , স্বাধীনতার মানেই হচ্ছে নাফরমানী ও ফরমানবরদারী উভয়েরই সম্ভাবনা। আল্লাহ্ তা আলা যখন ধরণীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি (খলীফাহ্) পাঠাবার কথা ঘোষণা করেন (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০) তখনই ফেরেশতারা ধারণা করে নেয় যে , আল্লাহর প্রতিনিধিগণ (অন্ততঃ তাদের একাংশ) নাফরমানী করবে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)। কারণ , খলীফাহ্ (স্থলাভিষিক্ত) শব্দ থেকেই তারা বুঝতে পেরেছিলো যে , আল্লাহ্ তা আলার ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলীর অনুরূপ ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলী এ নতুন সৃষ্টিকে (সীমিত পরিমাণে হলেও) দেয়া হবে , কিন্তু সৃষ্টি হওয়া জনিত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের দ্বারা স্বীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারের অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। অসম্ভব নয় যে , ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টি জিন্ প্রজাতির সদস্যদের একাংশের নাফরমানী দেখেই তাদের এ ধারণা হয়ে থাকবে। বিশেষ করে জিন্ প্রজাতি আল্লাহ্ তা আলার খলীফাহ্ ছিলো না বিধায় তাদের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা ছিলো অপেক্ষাকৃত সীমিত , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার খলীফাহ্ হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা হবে তাদের চেয়ে অনেক বেশী। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যকার অন্ততঃ একাংশের পক্ষ থেকে নাফরমানী হওয়াই স্বাভাবিক।

মোদ্দা কথা , নাফরমান ইবলীস না থাকলেও কতক মানুষ নাফরমান হতো।

বস্তুতঃ শয়তান কোনো ব্যক্তিবাচক নাম নয় , বরং গুণবাচক নাম। তাই আল্লাহ্ তা আলার এ সৃষ্টিলোকে ইবলীস বা আযাযীল একাই শয়তান নয়। কোরআন মজীদে শাইত্বান শব্দের বহু বচন শায়াত্বীন্ শব্দটি ১৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। জিন্ ও মানুষ উভয় প্রজাতির মধ্যেই শয়তান রয়েছে (সূরাহ্ আল্-আন্ আম্: ১১২)। শুধু মানুষ শয়তানদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৪)। প্রায় অভিন্ন অর্থে খান্নাস্ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে , যে মানুষের অন্তরে ওয়াস্ওয়াসাহ্ (কুমন্ত্রণা ও সন্দেহ-সংশয়) সৃষ্টি করে এবং এ ধরনের খান্নাস্ মানুষ ও জিন্ উভয় প্রজাতির মধ্যেই রয়েছে (সূরাহ্ আন্-নাস্: ৫-৬)।

প্রকৃত পক্ষে মানুষকে গোমরাহ্ করার ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ভূমিকা ইবলীসের চেয়ে বেশী। তাই যে ব্যক্তি গোমরাহ্ হতে চায় না তাকে গোমরাহ্ করার কোনো ক্ষমতাই ইবলীসের নেই (সূরাহ্ ইবরাহীম: ২২ ; আল্-হিজর্: ৪২ ; আন্-নাহল্: ৯৯ ; ইসরা / বানী ইসরাঈল: ৬৫)। অন্যদিকে কতক লোক স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে প্রবৃত্তিপূজায় লিপ্ত হয় , কোরআন মজীদের ভাষায় , স্বীয় প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ্ রূপে গ্রহণ করে (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩ ; আল্-জাছিয়াহ্: ২৩)। এ ধরনের লোককে হেদায়াত করা স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জন্যও সম্ভব ছিলো না (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩)।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য সে নিজেই মুখ্য কারণ ; ইবলীস সহ অন্যান্য শয়তান গৌণ কারণ মাত্র।

একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত

আমরা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি , ভবিষ্যতের একটি অংশ সুনিশ্চিতরূপে এবং একটি অংশ দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত রয়েছে। আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত বিষয়ক জ্ঞানে এ উভয় ধরনের বিষয়াদিই শামিল রয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতের আরো একটি অংশ রয়েছে যা শূন্য তথা পুরোপুরি অনিশ্চিত।

যে সব বিষয় সংঘটিত হওয়ার পূর্ণ কারণ বিদ্যমান তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই পূর্ণ কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহ্ তা আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা , প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া , প্রাণীজ ও মানবিক কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ্ তা আলার প্রাজ্ঞ হস্তক্ষেপের ফল। এর কোনো একটি বা একাধিক বা সবগুলো কারণ যা অনিবার্য করে তোলে তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তবে প্রথম ও শেষ কারণ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা এবং তাঁর হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া ব্যতীত অন্যান্য কারণের প্রতিক্রিয়াকে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা চাইলে পরিবর্তিত করে দেন। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ ব্যতিক্রম , সেহেতু ভবিষ্যতের এ অংশটিকে অর্থাৎ পূর্ণ কারণ যা অনিবার্য করে ফেলেছে তাকে আমরা অনিবার্য বলে গণ্য করতে পারি।

অন্যদিকে পূর্ণ কারণ ভবিষ্যতের একটি অংশকে দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে রেখেছে-ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কারণ যার একটি বাদে অপর সম্ভাবনাটিকে বা সম্ভাবনাগুলোকে বিলুপ্ত করে দেবে এবং যে সম্ভাবনাটি অবশিষ্ট থাকবে তা অনিবার্য হয়ে উঠবে।

এছাড়া ভবিষ্যতের রয়েছে এক সীমাহীন শূন্য দিগন্ত যেখানে কোনো কারণ কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোথিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তোলে নি। অন্য কথায় , ভবিষ্যতের একটি অংশে কোনই কারণ বিদ্যমান নেই অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলা ভবিষ্যতের একটি অংশকে সকল প্রকার কারণ থেকে মুক্ত রেখেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত ইচ্ছাই কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তুলতে পারে।

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ)

আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং (যা ইচ্ছা করেন) স্থির করে দেন। আর তাঁর সামনে রয়েছে গ্রন্থজননী (উম্মুল কিতাব)। (সূরাহ্ আর্-রা দ্: ৩৯) অর্থাৎ উম্মুল কিতাবে কতগুলো ভবিষ্যত বিষয় একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত রূপে নিহিত রয়েছে।

তিনি আরো এরশাদ করেন:

( الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلً)

[তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ্) পরম বরকতময়] যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে , তোমাদের মধ্যে কর্মের বিচারে কে অধিকতর উত্তম। (সূরাহ্ আল্-মুলক্: ২)

এর মানে আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির শুরুতেই নির্ধারণ করে রাখেন নি যে , কর্মের বিচারে কে ভালো হবে ও কে মন্দ হবে। অর্থাৎ তিনি মানুষকে ভালো-মন্দের উভয় সম্ভাবনাযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য সেহেতু তিনি ব্যক্তি-মানুষের ভবিষ্যতকে ভালো ও মন্দের সমান সম্ভাবনাযুক্ত করে দিয়েছেন , অতঃপর বিভিন্ন কারণ তাকে প্রভাবিত করে , তবে ভালো-মন্দ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী কারণ যা অন্য সমস্ত কারণ ও তজ্জনিত সম্ভাবনা সমূহকে পরাভূত করতে সক্ষম।

এছাড়া কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিষয়কে শর্তযুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে যা একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যতেরই প্রমাণ বহন করে। এখানে আমরা মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

( وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ)

আর জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীন থেকে বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। (সূরাহ্ আল্-আ রাফ্: ৯৬)

এ আয়াতে বরকত প্রাপ্তির জন্য ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে , বলা হয় নি যে , তাদের ভাগ্যে বরকত লিপিবদ্ধ ছিলো না বিধায় তাদেরকে বরকত প্রদান করা হয় নি। আর এ আয়াত থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে , ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বন করা তাদের এখতিয়ারাধীন বিষয় , নইলে আল্লাহ্ তা আলা বলতেন না যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

( يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُم)

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদম সমূহকে সুদৃঢ় করে দেবেন। (সূরাহ্ মুহাম্মাদ: ৭)

এখানে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তিকে তাঁকে সাহায্য করার (তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য চেষ্টা-সাধনার) সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে সাহায্য না করলে তথা তাঁর রাস্তায় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম না করলে তিনি মু মিনদেরকে সাহায্য করবেন না ।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

( إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا)

তোমাদের মধ্য থেকে যদি ধৈর্য ও দৃঢ়তার অধিকারী বিশ জন হয় তাহলে কাফেরদের দুইশ জনকে পরাজিত করবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে (এরূপ) একশ জন হলে তাদের এক হাজার জনকে পরাজিত করবে। (সূরাহ্ আল্-আনফাল্: ৬৫)

এখানে ধৈর্য ও দৃঢ়তাকে বিজয়ের শর্ত করা হয়েছে , ভাগ্যলিপিকে নয়।

অন্যদিকে শূন্য বা পুরোপুরি অনিশ্চিত ভবিষ্যত হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে না কিছু নিশ্চিত হয়ে আছে , না সুনির্দিষ্ট একাধিক সম্ভাবনা আছে , বরং তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত ইচ্ছার সীমাহীন দিগন্ত। এরূপ একটি সীমাহীন দিগন্ত আল্লাহ্ তা আলার চিরন্তন সৃষ্টিশীলতা গুণের জন্য অপরিহার্য। শুধু বর্তমান সৃষ্টিনিচয়ের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিশীলতাকে (তা যতই না দৃশ্যতঃ সীমাহীন হোক) সীমাবদ্ধ গণ্য করা মানে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকে সীমিত গণ্য করা-যা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।

আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিশীলতার ওপরে সীমাবদ্ধতা কল্পনাকারী চিন্তাধারা বর্তমানে প্রাপ্ত বিকৃত তাওরাতে লক্ষ্য করা যায় । তাওরাত নামে দাবীকৃত বাইবেলের প্রথম পুস্তকে (আদি/ সৃষ্টি পুস্তক) বলা হয়েছে: পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃত কার্য হতে নিবৃত্ত হলেন ; সেই সপ্তম দিবসে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হতে বিশ্রাম করলেন। (২:২)

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

( وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ)

আর ইয়াহূদীরা বলে: আল্লাহর হাত সংবদ্ধ। তাদেরই হাত সংবদ্ধ হোক এবং তারা যা বলেছে সে কারণে তারা অভিশপ্ত হোক। বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় (কুদরাতী) হাতই সম্প্রসারিত। (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্: ৬৪)

অবশ্য উক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এরশাদ হয়েছে:ينفق کيف يشاء - তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন। এ থেকে বাহ্যতঃ আল্লাহ্ তা আলার কুদরাতী হাতের প্রসারতা তাঁর নে আমত প্রদান সংক্রান্ত বলে মনে হলেও এ আয়াতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে আল্লাহ্ তা আলার সীমাহীন সৃষ্টিশীলতাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা অন্যত্র এরশাদ করেছেন:

( إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيم)

নিঃসন্দেহে (হে রাসূল!) আপনার রব অনবরত সৃষ্টিকারী সদাজ্ঞানী। (সূরাহ্ আল্-হিজর্: ৮৬)

অন্য এক আয়াত থেকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( يَاأَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (১৫) إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ (১৬) وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ)

হে মানব মণ্ডলী! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ্ ; তিনি হচ্ছেন অ-মুখাপেক্ষী সদাপ্রশংসনীয়। তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) কোনো নতুন সৃষ্টিকে নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর আল্লাহর জন্য এটা মোটেই কঠিন নয়। (সূরাহ্ আল্-ফাতের: ১৫-১৭)

সূরাহ্ ইবরাহীমের ১৯ ও ২০তম আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এখানে নতুন সৃষ্টি (خلق جديد ) বলতে এমন সৃষ্টিকে বুঝানো হয়েছে যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা তিনি এখনো করেন নি।

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

( إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِآخَرِينَ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَلِكَ قَدِيرًا)

হে মানবমণ্ডলী! তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) অন্য কাউকে (কোনো নতুন সৃষ্টিকে) নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর এটা করতে আল্লাহ্ পুরোপুরি সক্ষম। (সূরাহ্ আন্-নিসা : ১৩৩)

অনেকে উপরোক্ত আয়াত সমূহের তাৎপর্য করেছেন এই যে , আল্লাহ্ তা আলা এক জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দিয়ে অন্য জনগোষ্ঠীকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করার কথা বলেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কারণ , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেايها الناس (হে মানবমণ্ডলী!) সম্বোধন থেকে সুস্পষ্ট যে , তিনি সমগ্র মানব প্রজাতিকে সরিয়ে দেয়ার ও তাদের পরিবর্তে অন্য কোনো নতুন প্রজাতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। তবে তা করা বা না-করার ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন নি।

বস্তুতঃ ভবিষ্যতের একাধিক সম্ভাবনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত থেকে আশা এরী ও মু তাযিলী উভয় চিন্তাধারাই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।

আল্লাহর হস্তক্ষেপ

মানুষ আল্লাহ্ তা আলার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। কিন্তু শ্রেষ্ঠতম হলেও সে সৃষ্টি বৈ নয়। তাই সৃষ্টি হিসেবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে বহু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা তাকে ধরণীর বুকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত (খলীফাহ্) নিযুক্ত করেছেন। এ কারণে তার পক্ষে আল্লাহ্ তা আলার দেয়া গুণাবলীর ভুল প্রয়োগ অসম্ভব ব্যাপার নয়। তাই তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পথনির্দেশ , পর্যবেক্ষণ ও হস্তক্ষেপ অপরিহার্য । সে যদি পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যলিপি অনুযায়ী পরিচালিত হতো তাহলে তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হেদায়াত ও ওয়াহীর প্রয়োজন হতো না এবং আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপেরও প্রয়োজন হতো না , বরং সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্বনির্ধারিত কাজ সমূহ সম্পাদন করতো। তা নয় বলেই তার জন্য হেদায়াত ও ওয়াহীর আগমন ঘটে এবং তার কাজে কখনো কখনো আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়।

বস্তুতঃ নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণ ও ওয়াহী নাযিলই একটি বিরাট ইতিবাচক হস্তক্ষেপ। এমনকি যে সব হস্তক্ষেপ দৃশ্যতঃ নেতিবাচক , যেমন: আযাব নাযিল করণ , সে সবেরও উদ্দেশ্য ইতিবাচক । কারণ , এর মাধ্যমে অন্যদেরকে ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনন্ত দুর্ভাগ্যের পথ থেকে অবিনশ্বর সাফল্যের পথের দিকে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুধু তা-ই নয় , যাদেরকে আযাবের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয় তাদের জন্যও তা ইতিবাচক। কারণ , পরকালীন জীবনে তথা অনন্ত সৌভাগ্য ও অনন্ত দুর্ভাগ্যের জীবনে ব্যক্তির কর্ম অনুযায়ী তার নে আমত ও শাস্তির পরিমাণ ও মাত্রায় পার্থক্য হবে। তাই পাপীর ধ্বংস সাধনের ফলে তার পাপের বোঝা আর বেশী ভারী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তা তার নিজের জন্যও কমবেশী কল্যাণকর।

আল্লাহ্ তা আলা তাঁর রাসূল (ছ্বাঃ)কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন:

( مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ)

আপনার জন্য যে কল্যাণের আগমন ঘটে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আপনার ওপর যে অকল্যাণ আপতিত হয় তা আপনার নিজের কারণে। (সূরাহ্ আন্-নিসা : ৭৯)

মানুষের কাজে আল্লাহ্ তা আলার ইতিবাচক হস্তক্ষেপের অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বদর যুদ্ধে মু মিনদেরকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে সাহায্যকরণ (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ১২৩) যার ফলে মুসলমানরা সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তিতে দুর্বল হয়েও বিজয়ী হয়েছিলেন।

আল্লাহ্ তা আলা মানুষের দো আ কবুল করেন ; এ-ও মানবিক জগতে আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

( أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ)

কোনো আহবানকারী (দো আ-কারী/ প্রার্থনাকারী) যখন আমাকে আহবান করে (দো আ করে) তখন আমি তার আহবানে সাড়া দেই (তার দো আ কবুল করি)। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৮৬)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

( أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ)

কে অসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং তার কষ্ট দূর করে দেন ? (সূরাহ্ আন্-নামল্: ৬২)

বস্তুতঃ সৃষ্টিলোকের চলমান প্রক্রিয়ায় , বিশেষ করে মানবিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ জাবারীয়াহ্ ও মু তাযিলী উভয় ধরনের প্রান্তিক চিন্তাধারাকেই ভ্রান্ত প্রমাণ করে।

শয়তানের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গ

অনেক মানুষই মনে করে যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য কেবল শয়তানই দায়ী। তাদের ধারণা , শয়তানকে সৃষ্টি করা না হলে হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ) বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত হতেন না এবং আমরা (মানব প্রজাতি) বেহেশতেই থাকতাম। কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ এতদূর পর্যন্ত বলে যে , আল্লাহ্ তা আলা মানুষকে গোমরাহ্ করার উদ্দেশ্যেই আগেই শয়তানকে (অর্থাৎ আযাযীল বা ইবলীসকে) সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। বলা বাহুল্য যে , এটা মহান আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কে অত্যন্ত হীন ধারণা।

যেহেতু বিষয়টি মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ সংক্রান্ত ধারণারই অংশবিশেষ এবং বিশেষ করে এ ধারণায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত হওয়া ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্ তা আলাকেই দায়ী করা হয় সেহেতু এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা জরুরী বলে মনে হয়।

প্রথম কথা হচ্ছে এই যে , শয়তানের গোমরাহ্ করার ক্ষমতা অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না , বরং অদৃষ্টবাদকে খণ্ডন করে। কারণ , এ থেকে প্রমাণিত হয় যে , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে মানুষ সহ প্রতিটি প্রাণশীল সৃষ্টির ভবিষ্যতের ছোটবড় সবকিছু নির্ধারণ করে রাখেন নি। কেননা , আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে সব কিছু নির্ধারণ করে রেখে থাকলে শয়তানের কোনো ক্ষমতা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। তেমনি শয়তানের ক্ষমতা এ-ও প্রমাণ করে যে , প্রতি মুহূর্তে মানুষ সহ সকল সৃষ্টির প্রতিটি কাজ স্বয়ং আল্লাহ্ তা আলা করেন বা করিয়ে নেন-এ ধারণাও পুরোপুরি ভ্রান্ত।

এ প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি আনুষঙ্গিক ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা যরূরী বলে মনে হয়। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে , আযাযীল (শয়তান) ফেরেশতা ছিলো এবং ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। অবশ্য যারা জানে যে , কোরআন মজীদে আযাযীলের জিন্ প্রজাতির সদস্য হওয়ার কথা উল্লেখ আছে , তাদের অনেকে মনে করে যে , সে জিন্ হলেও ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিলো। আর এদের সকলেই মনে করে যে , সে অত্যন্ত উঁচু স্তরের আাবেদ (আল্লাহ্ তা আলার ইবাদতকারী) ছিলো ; অতঃপর আল্লাহ্ তা আলার একটিমাত্র হুকুম অমান্য করে [হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে] আল্লাহর অভিসম্পাতের শিকার হয়। এজন্য অনেকে বিস্ময়করভাবে দাবী করে যে , আযাযীল ছিলো সবচেয়ে বড় তাওহীদবাদী , এ কারণে সে আল্লাহ্ ছাড়া আর কাউকে সিজদাহ্ করতে রাযী হয় নি। (!!!)

এসব দাবী অকাট্য দলীল বিহীন ভিত্তিহীন কাল্পনিক দাবী মাত্র। কারণ , আযাযীল বা ইবলীস ফেরেশতা ছিলো না। ফেরেশতারা আল্লাহ্ তা আলার নাফরমানী করতে পারে না ; নাফরমানীর মূল চালিকাশক্তি স্বাধীনতা ভোগের প্রবণতা , বিশেষতঃ কুপ্রবৃত্তি থেকে তারা মুক্ত। বরং আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্: ৫০) ।

আর যারা স্বীকার করেন যে , আযাযীল জিন্ প্রজাতির সদস্য ছিলো , কিন্তু অত্যন্ত উঁচু দরের আলেম ও আাবেদ ছিলো বিধায় আল্লাহ্ তা আলা তাকে ফেরেশতাদের শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। এ দাবীরও কোনো ভিত্তি নেই। বিশেষ করে ফেরেশেতাদের সম্পর্কে ইসলামের অকাট্য সূত্রসমূহ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হচ্ছে তাদের মধ্যে অজ্ঞতা , সুপ্ত প্রতিভা ও প্রতিভার বিকাশ ও জ্ঞানার্জন বলতে কোনো কিছু নেই। বরং সৃষ্টিগতভাবেই তারা আল্লাহ্ তা আলা সম্পর্কিত , স্বীয় নিয়মিত দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত ও আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে সৃষ্টি সম্পর্কে প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং সেই সাথে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যখনই যে হুকুম দেয়া হয় তা পালনের প্রবণতার অধিকারী। এমতাবস্থায় তাদের জন্য শিক্ষক নিয়োগের ধারণা একটি একান্তই অবান্তর ধারণা।

অন্যদিকে জিন্ প্রজাতির সদস্য আযাযীল আদৌ কোনো আাবেদ ছিলো না। বরং হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পূর্ব থেকেই সে নাফরমান ছিলো। হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করতে আযাযীল ইবলীসের অস্বীকৃতি প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( أَبَى وَاسْتَكْبَرَ وَكَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ)

সে (আল্লাহর হুকুম পালনে) অস্বীকৃতি জানালো ও বড়ত্ব দাবী করলো (অহঙ্কার করলো) ; আর সে ছিলো কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩৪)

অনেকে এ আয়াতের শেষ বাক্যের অর্থ করেন: আর সে কাফের হয়ে গেলো। বা আর সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয়। সে মুসলমান (আল্লাহর অনুগত) ছিলো , কিন্তু কাফের হয়ে গেলো-এটা বুঝাতে চাওয়া হলে বলা হতো:فاصبح کافراً (ফলে সে কাফের হয়ে গেলো)। কিন্তু আয়াতে যা বলা হয়েছে তা থেকে সুস্পষ্ট যে , সে পূর্ব থেকেই কাফের ছিলো। শুধু তা-ই নয় , আয়াত থেকে এ-ও বুঝা যায় যে , হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে যখন হুকুম দেয়া হয় তখন সে একাই কাফের ছিলো না , বরং পূর্ব থেকেই একটি গোষ্ঠী (একদল জিন্) কাফের ছিলো ; ইবলীস ছিলো তাদের নেতা।

এমনকি আল্লাহ্ তা আলা হযরত আদম (আঃ)কে সিজদাহ্ করার জন্য ইবলীসকে হুকুম না দিলে সে হযরত আদম (আঃ) ও মানব প্রজাতির ক্ষতি করার (তাদেরকে গোমরাহ্ করার) চেষ্টা করতো না-এরূপ মনে করাও ঠিক নয়। কারণ , কুফর্ বা খোদাদ্রোহিতার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মু মিনদেরকে কুফরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা।

অন্যদিকে ঐ সময় ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলেও তথা ইবলীসকে আদৌ সৃষ্টি করা না হলেও মানব প্রজাতিকে বেহেশতে রাখা হতো না। কারণ , মানুষকে সৃষ্টি করাই হয়েছিলো ধরণীর বুকে আল্লাহ্ তা আলার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)।

অবশ্য বেহেশতে থাকাকালে ইবলীসের দ্বারা প্রতারিত হওয়ার ঘটনা না ঘটলে কোনোরূপ তিক্ত অভিজ্ঞতা ছাড়াই হযরত আদম ও হযরত হাওয়া (আঃ)কে বেহেশত ছেড়ে যমীনে আসতে হতো।

ইবলীসের অস্তিত্ব না থাকলে কোনো মানুষই নাফরমান হতো না তা নয়। কারণ , স্বাধীনতার মানেই হচ্ছে নাফরমানী ও ফরমানবরদারী উভয়েরই সম্ভাবনা। আল্লাহ্ তা আলা যখন ধরণীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি (খলীফাহ্) পাঠাবার কথা ঘোষণা করেন (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০) তখনই ফেরেশতারা ধারণা করে নেয় যে , আল্লাহর প্রতিনিধিগণ (অন্ততঃ তাদের একাংশ) নাফরমানী করবে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ৩০)। কারণ , খলীফাহ্ (স্থলাভিষিক্ত) শব্দ থেকেই তারা বুঝতে পেরেছিলো যে , আল্লাহ্ তা আলার ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলীর অনুরূপ ক্ষমতা , এখতিয়ার ও গুণাবলী এ নতুন সৃষ্টিকে (সীমিত পরিমাণে হলেও) দেয়া হবে , কিন্তু সৃষ্টি হওয়া জনিত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার কারণে তাদের দ্বারা স্বীয় ক্ষমতা ও এখতিয়ারের অপব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। অসম্ভব নয় যে , ইতিপূর্বে বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন ও স্বাধীনতার অধিকারী সৃষ্টি জিন্ প্রজাতির সদস্যদের একাংশের নাফরমানী দেখেই তাদের এ ধারণা হয়ে থাকবে। বিশেষ করে জিন্ প্রজাতি আল্লাহ্ তা আলার খলীফাহ্ ছিলো না বিধায় তাদের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা ছিলো অপেক্ষাকৃত সীমিত , কিন্তু আল্লাহ্ তা আলার খলীফাহ্ হওয়ার কারণে মানুষের ক্ষমতা , এখতিয়ার ও স্বাধীনতা হবে তাদের চেয়ে অনেক বেশী। এমতাবস্থায় তাদের মধ্যকার অন্ততঃ একাংশের পক্ষ থেকে নাফরমানী হওয়াই স্বাভাবিক।

মোদ্দা কথা , নাফরমান ইবলীস না থাকলেও কতক মানুষ নাফরমান হতো।

বস্তুতঃ শয়তান কোনো ব্যক্তিবাচক নাম নয় , বরং গুণবাচক নাম। তাই আল্লাহ্ তা আলার এ সৃষ্টিলোকে ইবলীস বা আযাযীল একাই শয়তান নয়। কোরআন মজীদে শাইত্বান শব্দের বহু বচন শায়াত্বীন্ শব্দটি ১৮ বার ব্যবহৃত হয়েছে। জিন্ ও মানুষ উভয় প্রজাতির মধ্যেই শয়তান রয়েছে (সূরাহ্ আল্-আন্ আম্: ১১২)। শুধু মানুষ শয়তানদের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৪)। প্রায় অভিন্ন অর্থে খান্নাস্ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে , যে মানুষের অন্তরে ওয়াস্ওয়াসাহ্ (কুমন্ত্রণা ও সন্দেহ-সংশয়) সৃষ্টি করে এবং এ ধরনের খান্নাস্ মানুষ ও জিন্ উভয় প্রজাতির মধ্যেই রয়েছে (সূরাহ্ আন্-নাস্: ৫-৬)।

প্রকৃত পক্ষে মানুষকে গোমরাহ্ করার ক্ষেত্রে মানুষের নিজের ভূমিকা ইবলীসের চেয়ে বেশী। তাই যে ব্যক্তি গোমরাহ্ হতে চায় না তাকে গোমরাহ্ করার কোনো ক্ষমতাই ইবলীসের নেই (সূরাহ্ ইবরাহীম: ২২ ; আল্-হিজর্: ৪২ ; আন্-নাহল্: ৯৯ ; ইসরা / বানী ইসরাঈল: ৬৫)। অন্যদিকে কতক লোক স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে প্রবৃত্তিপূজায় লিপ্ত হয় , কোরআন মজীদের ভাষায় , স্বীয় প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ্ রূপে গ্রহণ করে (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩ ; আল্-জাছিয়াহ্: ২৩)। এ ধরনের লোককে হেদায়াত করা স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর জন্যও সম্ভব ছিলো না (সূরাহ্ আল্-ফুরক্বান্: ৪৩)।

অতএব , সুস্পষ্ট যে , মানুষের গোমরাহীর জন্য সে নিজেই মুখ্য কারণ ; ইবলীস সহ অন্যান্য শয়তান গৌণ কারণ মাত্র।

একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত

আমরা ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি , ভবিষ্যতের একটি অংশ সুনিশ্চিতরূপে এবং একটি অংশ দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত রয়েছে। আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত বিষয়ক জ্ঞানে এ উভয় ধরনের বিষয়াদিই শামিল রয়েছে। অবশ্য ভবিষ্যতের আরো একটি অংশ রয়েছে যা শূন্য তথা পুরোপুরি অনিশ্চিত।

যে সব বিষয় সংঘটিত হওয়ার পূর্ণ কারণ বিদ্যমান তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। এই পূর্ণ কারণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহ্ তা আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা , প্রাকৃতিক বিধিবিধানের প্রতিক্রিয়া , প্রাণীজ ও মানবিক কার্যক্রমের প্রতিক্রিয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে আল্লাহ্ তা আলার প্রাজ্ঞ হস্তক্ষেপের ফল। এর কোনো একটি বা একাধিক বা সবগুলো কারণ যা অনিবার্য করে তোলে তা সংঘটিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী। তবে প্রথম ও শেষ কারণ অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলার মূল সৃষ্টিলক্ষ্য ও সৃষ্টি পরিকল্পনা এবং তাঁর হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া ব্যতীত অন্যান্য কারণের প্রতিক্রিয়াকে ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলা চাইলে পরিবর্তিত করে দেন। কিন্তু যেহেতু আল্লাহ্ তা আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ ব্যতিক্রম , সেহেতু ভবিষ্যতের এ অংশটিকে অর্থাৎ পূর্ণ কারণ যা অনিবার্য করে ফেলেছে তাকে আমরা অনিবার্য বলে গণ্য করতে পারি।

অন্যদিকে পূর্ণ কারণ ভবিষ্যতের একটি অংশকে দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে রেখেছে-ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কারণ যার একটি বাদে অপর সম্ভাবনাটিকে বা সম্ভাবনাগুলোকে বিলুপ্ত করে দেবে এবং যে সম্ভাবনাটি অবশিষ্ট থাকবে তা অনিবার্য হয়ে উঠবে।

এছাড়া ভবিষ্যতের রয়েছে এক সীমাহীন শূন্য দিগন্ত যেখানে কোনো কারণ কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোথিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তোলে নি। অন্য কথায় , ভবিষ্যতের একটি অংশে কোনই কারণ বিদ্যমান নেই অর্থাৎ আল্লাহ্ তা আলা ভবিষ্যতের একটি অংশকে সকল প্রকার কারণ থেকে মুক্ত রেখেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত ইচ্ছাই কোনো কিছুকে অনিবার্য অথবা দুই বা ততোধিক সম্ভাবনাযুক্ত করে তুলতে পারে।

আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ)

আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং (যা ইচ্ছা করেন) স্থির করে দেন। আর তাঁর সামনে রয়েছে গ্রন্থজননী (উম্মুল কিতাব)। (সূরাহ্ আর্-রা দ্: ৩৯) অর্থাৎ উম্মুল কিতাবে কতগুলো ভবিষ্যত বিষয় একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত রূপে নিহিত রয়েছে।

তিনি আরো এরশাদ করেন:

( الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلً)

[তিনি (অর্থাৎ আল্লাহ্) পরম বরকতময়] যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে , তোমাদের মধ্যে কর্মের বিচারে কে অধিকতর উত্তম। (সূরাহ্ আল্-মুলক্: ২)

এর মানে আল্লাহ্ তা আলা সৃষ্টির শুরুতেই নির্ধারণ করে রাখেন নি যে , কর্মের বিচারে কে ভালো হবে ও কে মন্দ হবে। অর্থাৎ তিনি মানুষকে ভালো-মন্দের উভয় সম্ভাবনাযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যেহেতু পরীক্ষা করাই উদ্দেশ্য সেহেতু তিনি ব্যক্তি-মানুষের ভবিষ্যতকে ভালো ও মন্দের সমান সম্ভাবনাযুক্ত করে দিয়েছেন , অতঃপর বিভিন্ন কারণ তাকে প্রভাবিত করে , তবে ভালো-মন্দ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী কারণ যা অন্য সমস্ত কারণ ও তজ্জনিত সম্ভাবনা সমূহকে পরাভূত করতে সক্ষম।

এছাড়া কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার বিষয়কে শর্তযুক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে যা একাধিক সম্ভাবনাযুক্ত ভবিষ্যতেরই প্রমাণ বহন করে। এখানে আমরা মাত্র কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকবো। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

( وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ)

আর জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও যমীন থেকে বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। (সূরাহ্ আল্-আ রাফ্: ৯৬)

এ আয়াতে বরকত প্রাপ্তির জন্য ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বনের শর্ত আরোপ করা হয়েছে , বলা হয় নি যে , তাদের ভাগ্যে বরকত লিপিবদ্ধ ছিলো না বিধায় তাদেরকে বরকত প্রদান করা হয় নি। আর এ আয়াত থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে , ঈমান আনয়ন ও তাক্বওয়া অবলম্বন করা তাদের এখতিয়ারাধীন বিষয় , নইলে আল্লাহ্ তা আলা বলতেন না যদি ঈমান আনতো ও তাক্বওয়া অবলম্বন করতো

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

( يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُم)

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদম সমূহকে সুদৃঢ় করে দেবেন। (সূরাহ্ মুহাম্মাদ: ৭)

এখানে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তিকে তাঁকে সাহায্য করার (তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য চেষ্টা-সাধনার) সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে সাহায্য না করলে তথা তাঁর রাস্তায় চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম না করলে তিনি মু মিনদেরকে সাহায্য করবেন না ।

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে:

( إِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ عِشْرُونَ صَابِرُونَ يَغْلِبُوا مِائَتَيْنِ وَإِنْ يَكُنْ مِنْكُمْ مِائَةٌ يَغْلِبُوا أَلْفًا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا)

তোমাদের মধ্য থেকে যদি ধৈর্য ও দৃঢ়তার অধিকারী বিশ জন হয় তাহলে কাফেরদের দুইশ জনকে পরাজিত করবে এবং তোমাদের মধ্য থেকে (এরূপ) একশ জন হলে তাদের এক হাজার জনকে পরাজিত করবে। (সূরাহ্ আল্-আনফাল্: ৬৫)

এখানে ধৈর্য ও দৃঢ়তাকে বিজয়ের শর্ত করা হয়েছে , ভাগ্যলিপিকে নয়।

অন্যদিকে শূন্য বা পুরোপুরি অনিশ্চিত ভবিষ্যত হচ্ছে এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে না কিছু নিশ্চিত হয়ে আছে , না সুনির্দিষ্ট একাধিক সম্ভাবনা আছে , বরং তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা আলার ভবিষ্যত ইচ্ছার সীমাহীন দিগন্ত। এরূপ একটি সীমাহীন দিগন্ত আল্লাহ্ তা আলার চিরন্তন সৃষ্টিশীলতা গুণের জন্য অপরিহার্য। শুধু বর্তমান সৃষ্টিনিচয়ের অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিশীলতাকে (তা যতই না দৃশ্যতঃ সীমাহীন হোক) সীমাবদ্ধ গণ্য করা মানে তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকে সীমিত গণ্য করা-যা থেকে তিনি পরম প্রমুক্ত।

আল্লাহ্ তা আলার সৃষ্টিশীলতার ওপরে সীমাবদ্ধতা কল্পনাকারী চিন্তাধারা বর্তমানে প্রাপ্ত বিকৃত তাওরাতে লক্ষ্য করা যায় । তাওরাত নামে দাবীকৃত বাইবেলের প্রথম পুস্তকে (আদি/ সৃষ্টি পুস্তক) বলা হয়েছে: পরে ঈশ্বর সপ্তম দিনে আপনার কৃত কার্য হতে নিবৃত্ত হলেন ; সেই সপ্তম দিবসে আপনার কৃত সমস্ত কার্য হতে বিশ্রাম করলেন। (২:২)

কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে:

( وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ)

আর ইয়াহূদীরা বলে: আল্লাহর হাত সংবদ্ধ। তাদেরই হাত সংবদ্ধ হোক এবং তারা যা বলেছে সে কারণে তারা অভিশপ্ত হোক। বরং তাঁর (আল্লাহর) উভয় (কুদরাতী) হাতই সম্প্রসারিত। (সূরাহ্ আল্-মাএদাহ্: ৬৪)

অবশ্য উক্ত আয়াতের ধারাবাহিকতায় এরশাদ হয়েছে:ينفق کيف يشاء - তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন। এ থেকে বাহ্যতঃ আল্লাহ্ তা আলার কুদরাতী হাতের প্রসারতা তাঁর নে আমত প্রদান সংক্রান্ত বলে মনে হলেও এ আয়াতের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যে আল্লাহ্ তা আলার সীমাহীন সৃষ্টিশীলতাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কারণ , আল্লাহ্ তা আলা অন্যত্র এরশাদ করেছেন:

( إِنَّ رَبَّكَ هُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيم)

নিঃসন্দেহে (হে রাসূল!) আপনার রব অনবরত সৃষ্টিকারী সদাজ্ঞানী। (সূরাহ্ আল্-হিজর্: ৮৬)

অন্য এক আয়াত থেকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রমাণিত হয়। আল্লাহ্ তা আলা এরশাদ করেন:

( يَاأَيُّهَا النَّاسُ أَنْتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ (১৫) إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ وَيَأْتِ بِخَلْقٍ جَدِيدٍ (১৬) وَمَا ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ بِعَزِيزٍ)

হে মানব মণ্ডলী! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ্ ; তিনি হচ্ছেন অ-মুখাপেক্ষী সদাপ্রশংসনীয়। তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) কোনো নতুন সৃষ্টিকে নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর আল্লাহর জন্য এটা মোটেই কঠিন নয়। (সূরাহ্ আল্-ফাতের: ১৫-১৭)

সূরাহ্ ইবরাহীমের ১৯ ও ২০তম আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এখানে নতুন সৃষ্টি (خلق جديد ) বলতে এমন সৃষ্টিকে বুঝানো হয়েছে যা সৃষ্টি করার ইচ্ছা তিনি এখনো করেন নি।

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

( إِنْ يَشَأْ يُذْهِبْكُمْ أَيُّهَا النَّاسُ وَيَأْتِ بِآخَرِينَ وَكَانَ اللَّهُ عَلَى ذَلِكَ قَدِيرًا)

হে মানবমণ্ডলী! তিনি যদি চান তাহলে তোমাদেরকে অপসারিত (বিলুপ্ত) করে দেবেন এবং (তোমাদের স্থলে) অন্য কাউকে (কোনো নতুন সৃষ্টিকে) নিয়ে আসবেন (ও তাদেরকে ধরণীর বুকে স্বীয় খেলাফত প্রদান করবেন)। আর এটা করতে আল্লাহ্ পুরোপুরি সক্ষম। (সূরাহ্ আন্-নিসা : ১৩৩)

অনেকে উপরোক্ত আয়াত সমূহের তাৎপর্য করেছেন এই যে , আল্লাহ্ তা আলা এক জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দিয়ে অন্য জনগোষ্ঠীকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করার কথা বলেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। কারণ , আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকেايها الناس (হে মানবমণ্ডলী!) সম্বোধন থেকে সুস্পষ্ট যে , তিনি সমগ্র মানব প্রজাতিকে সরিয়ে দেয়ার ও তাদের পরিবর্তে অন্য কোনো নতুন প্রজাতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। তবে তা করা বা না-করার ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেন নি।

বস্তুতঃ ভবিষ্যতের একাধিক সম্ভাবনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত থেকে আশা এরী ও মু তাযিলী উভয় চিন্তাধারাই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়।

আল্লাহর হস্তক্ষেপ

মানুষ আল্লাহ্ তা আলার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। কিন্তু শ্রেষ্ঠতম হলেও সে সৃষ্টি বৈ নয়। তাই সৃষ্টি হিসেবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে বহু দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও আল্লাহ্ তা আলা তাকে ধরণীর বুকে স্বীয় স্থলাভিষিক্ত (খলীফাহ্) নিযুক্ত করেছেন। এ কারণে তার পক্ষে আল্লাহ্ তা আলার দেয়া গুণাবলীর ভুল প্রয়োগ অসম্ভব ব্যাপার নয়। তাই তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পথনির্দেশ , পর্যবেক্ষণ ও হস্তক্ষেপ অপরিহার্য । সে যদি পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যলিপি অনুযায়ী পরিচালিত হতো তাহলে তার জন্য আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হেদায়াত ও ওয়াহীর প্রয়োজন হতো না এবং আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপেরও প্রয়োজন হতো না , বরং সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূর্বনির্ধারিত কাজ সমূহ সম্পাদন করতো। তা নয় বলেই তার জন্য হেদায়াত ও ওয়াহীর আগমন ঘটে এবং তার কাজে কখনো কখনো আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে হস্তক্ষেপ করা হয়।

বস্তুতঃ নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণ ও ওয়াহী নাযিলই একটি বিরাট ইতিবাচক হস্তক্ষেপ। এমনকি যে সব হস্তক্ষেপ দৃশ্যতঃ নেতিবাচক , যেমন: আযাব নাযিল করণ , সে সবেরও উদ্দেশ্য ইতিবাচক । কারণ , এর মাধ্যমে অন্যদেরকে ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনন্ত দুর্ভাগ্যের পথ থেকে অবিনশ্বর সাফল্যের পথের দিকে প্রত্যাবর্তনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শুধু তা-ই নয় , যাদেরকে আযাবের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয় তাদের জন্যও তা ইতিবাচক। কারণ , পরকালীন জীবনে তথা অনন্ত সৌভাগ্য ও অনন্ত দুর্ভাগ্যের জীবনে ব্যক্তির কর্ম অনুযায়ী তার নে আমত ও শাস্তির পরিমাণ ও মাত্রায় পার্থক্য হবে। তাই পাপীর ধ্বংস সাধনের ফলে তার পাপের বোঝা আর বেশী ভারী হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তা তার নিজের জন্যও কমবেশী কল্যাণকর।

আল্লাহ্ তা আলা তাঁর রাসূল (ছ্বাঃ)কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন:

( مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ)

আপনার জন্য যে কল্যাণের আগমন ঘটে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এবং আপনার ওপর যে অকল্যাণ আপতিত হয় তা আপনার নিজের কারণে। (সূরাহ্ আন্-নিসা : ৭৯)

মানুষের কাজে আল্লাহ্ তা আলার ইতিবাচক হস্তক্ষেপের অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে বদর যুদ্ধে মু মিনদেরকে আল্লাহ্ তা আলার পক্ষ থেকে বিশেষভাবে সাহায্যকরণ (সূরাহ্ আালে ইমরান্: ১২৩) যার ফলে মুসলমানরা সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তিতে দুর্বল হয়েও বিজয়ী হয়েছিলেন।

আল্লাহ্ তা আলা মানুষের দো আ কবুল করেন ; এ-ও মানবিক জগতে আল্লাহ্ তা আলার হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত। যেমন , এরশাদ হয়েছে:

( أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ)

কোনো আহবানকারী (দো আ-কারী/ প্রার্থনাকারী) যখন আমাকে আহবান করে (দো আ করে) তখন আমি তার আহবানে সাড়া দেই (তার দো আ কবুল করি)। (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ১৮৬)

অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে:

( أَمَّنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ)

কে অসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং তার কষ্ট দূর করে দেন ? (সূরাহ্ আন্-নামল্: ৬২)

বস্তুতঃ সৃষ্টিলোকের চলমান প্রক্রিয়ায় , বিশেষ করে মানবিক ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা আলার তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ জাবারীয়াহ্ ও মু তাযিলী উভয় ধরনের প্রান্তিক চিন্তাধারাকেই ভ্রান্ত প্রমাণ করে।


13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26