আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন11%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 78926 / ডাউনলোড: 7838
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

ইসলামের পুনরুজ্জীবনে আশুরা আন্দোলনের ভূমিকা

ড.মনজুর আলম*

মানবজাতির জন্য আল্লাহর একমাত্র মনোনীত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহ তা আলা আদম (আ.) - কে সৃষ্টি করে দুনিয়াতে সুন্দরভাবে চলার জন্য যে জীবন ব্যাবস্থা দিয়ে পাঠিয়েছেন তার নাম ইসলাম। অল্পদিন পরেই দেখা গেল আদমের এক সন্তান কাবিল আল্লাহর পাঠানো জীবন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এক খোদাদ্রোহী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ফেললো। সেই থেকে পৃথিবীর ইতিহাসের অধিকাংশ সময়ব্যাপী দেখা যায় কাবিলের সন্তানদেরই (অর্থাৎ কাবিলের আদর্শ অনুসারীদের) জয়জয়কার। মানুষকে বিভ্রান্ত মত ও পথের অনুসরণ থেকে দূরে সরিয়ে এনে প্রকৃত কল্যাণের পথে পরিচালনা করার জন্য আল্লাহ তা আলা যুগে যুগে পাঠিয়েছেন ঐশী দূত ,যাদের আরবি ভাষায় বলা হয় নবী ও রাসূল । এসব নবী -রাসূল যে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তা হলো মূলত পুনরুজ্জীবনের দায়িত্ব । মানুষ তার আজন্ম শত্রু ইবলিসের প্ররোচনায় আর তার আপন পশু-প্রবৃত্তির তাড়নায় বার বার খোদাকে ভুলে গিয়েছে ,আর আল্লাহ তা আলা যুগে যুগে মানব জাতির পুনরুজ্জীবনের জন্য পাঠিয়েছেন নবী ,রাসূল ও ইমাম ।

নবী -রাসূল ও ইমামদের দায়িত্ব ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানব জাতিকে বিভ্রান্তি ও গোমরাহীর ঘুম থেকে পুনরায় জাগ্রত করা। তাদের ভালো করে বুঝিয়ে দেয়া যে ,পশু প্রবৃত্তির দাসত্ব করার জন্য তার সৃষ্টি নয় ,পশুর মতোই পেটের পুজা আর বংশ বিস্তার করে যাওয়াটাই তার একমাত্র কাজ নয়। মানুষের পরিচয় হলো সে আল্লাহর খলিফা হিসাবে এক মহান মর্যাদার অধিকারী। তার সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে নিজের মধ্যে খোদায়ী গুণসমূহ পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করার মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে । এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ,পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন এ সব কিছুরই দিক -নির্দেশনা যুগে যুগে বয়ে এনেছেন নবী -রাসূল গণ। তাদের ভূমিকা ছিলো শিক্ষক ,সমাজ সংস্কারক ও বিপ্লবী নেতার-এক কথায় তারা ছিলেন খোদা সম্পর্কে গাফিল মানব সমাজের জন্য ইসলামী পুনরুজ্জীবনের মশালবাহী।

ইসলামী পুনরুজ্জীবন সম্পর্কে আমার উপলদ্ধি আলোচনার পর আশুরা আন্দোলন সম্পর্কে আমার সামান্য উপলদ্ধি বর্ণনা করছি।

আশুরা বিপ্লবের তাৎপর্য এক ব্যাপক ও বিস্তৃত যে ,আমার আলোচনায় এ মহান বিষয়ের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব নয়। তবুও আমার চোখে আশুরার যে দিক গুলো তুলনামূলক ভাবে বেশি স্পষ্ট তা ই সমকালীন প্রেক্ষাপটে আলোচনা করবো।

আমার দৃষ্টিতে আশুরা বিপ্লবের সবচেয়ে বড় দিক হলো এ বিপ্লব আমাদের চোখে তরবারির ওপর রক্তের বিজয়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্ব তাগুতী শক্তি মনে করে মারণাস্ত্রই হচ্ছে শক্তির একমাত্র উৎস। যখন বিশ্বে ছিলো দুই পরাশক্তি (আমেরিকা ও রাশিয়া) ,তখন তারা মেতে উঠেছিলো শক্তিশালী থেকে আরো শক্তিশালী মারণাস্ত্র উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতায়। আজ বিশ্বে একটি মাত্র পরাশক্তি রয়েছে ,যে পরাশক্তি আজও কেবল একের পর এক শক্তিশালী মারণাস্ত্র উদ্ভাবন ও সংগ্রহে ব্যস্ত । বিশ্বের ছোট ছোট দেশ এসব ভয়াবহ মারণাস্ত্রের কথা শুনে ভাবে পরাশক্তির অধীনতা স্বীকার করা ছাড়া তাদের অন্য উপায় নেই। তাই আমেরিকা যখন নির্লজ্জভাবে ইসরাইলের প্রতিটি অপকর্মের সমর্থন দিয়ে যায় ,তখন ছোট ছোট দেশ কোনো রকমে মুখ রক্ষার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে মৌখিক একটা দায়সারা গোছের নিন্দা জানিয়ে পরক্ষণেই আমেরিকার পায়ে সিজদাবনত হয়ে জানিয়ে আসে , আমরা আসলে আপনারই গোলাম । আমাদের মৌখিক নিন্দা-বিবৃতি ইত্যাদিকে আমল দেবেন না। বিশ্বের দুর্বল দেশগুলোর এ রকম হতাশাজনক অবস্থায় আশুরার বিপ্লব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বেহেশতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইনের রক্তের কাছে তাগুতের পরাজয় বরণের কথা ।

অনেকে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করবেন ,কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) তো সঙ্গী-সাথীসহ নিহত হয়েছিলেন ,তাকে বিজয়ী বলা যায় কীভাবে ? এ প্রশ্নের উত্তরে হয়তো বলা যায় যে ,আজকের ইতিহাসে ইয়াযীদ একটি ঘৃণিত চরিত্র ,তার কবরের কোনো চিহ্ন আজ আর নেই ,কোনো লোক আজ তার সন্তানের নাম ইয়াযীদ রাখে না। অন্যদিকে ইমাম হোসাইনের মাযার ও কারবালা আজ বিশ্ব মুসলিমের কাছে অতি শ্রদ্ধেয় এক তীর্থস্থান ,ইমাম হোসাইনের মাযারের মতো সুশোভিত ও অলংকৃত মাযার পৃথিবীতে বিরল ,তার জন্য পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ অশ্রু বর্ষণ করে । এ বক্তব্যে সাথে আমি একমত নই। আমি মনে করি ইমাম হোসাইনের বিজয় ইতিহাসে এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়নি। এ বিজয় অর্জিত হয়েছে ব্যাপক মারণাস্ত্রসজ্জিত ইয়াযীদের বিশাল বাহিনীর সামনে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাবার মাধ্যমে। ইয়াযীদের আশা ছিলো ইমাম হোসাইন তার বিশাল বাহিনী দেখে ভয়ে নতি স্বীকার করবেন ,এমনকি আজও গুটিকয় ঐতিহাসিক মন্তব্য করেন যে ,ঐ সময় ইয়াযীদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়াটাই ছিলো বুদ্ধিমানের কাজ । অনেকের পক্ষে আজও বিশ্বাস করা সম্ভব হয় না যে ,ইমাম হোসাইন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও কারবালার ময়দানে এগিয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু আজ আমরা ইমাম হোসাইনের বিভিন্ন উক্তি ও ঘটনাপরস্পরা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে ,ইমাম হোসাইন চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন হয়েই কারবালায় মাত্র বাহাত্তর জন সঙ্গী নিয়ে ইয়াযীদের সত্তর হাজারেরও বেশি জনবল সম্বলিত বাহিনীর মোকাবিলা করেছিলেন ।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর এত বিশাল দুনিয়াবী শক্তির বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র জনবল নিয়ে সম্পূর্ণ নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে যাবার মাধ্যমেই আশুরা আন্দোলনের এক মহান লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। যে আন্দোলনে ঘোষিত হলো : তাগুতের এই জনবল ,এই দুনিয়াবী শক্তি ,এই মারণাস্ত্র ,ঈমানের শক্তির কাছে তুচ্ছ। এ প্রতিরোধের ঘোষণাই গুড়িয়ে দিল ইয়াযীদের সমস্ত দুনিয়াবী শক্তির দম্ভ। সে দিনের ইয়াযীদের তরবারির ঝলকানি আর আজকের সাম্রাজ্যবাদের ক্রুজ মিসাইল ও প্যাট্টিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের ভিডিও প্রদর্শনের উদ্দেশ্য একটাই ,তা হলো এগুলোর ভয় দেখিয়ে মানুষকে দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করা। যে ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী এরূপ দুনিয়াবী শক্তি দেখে ভয় পেলো ,তাগুতের দাসত্ব স্বীকার করে নিলো তারাই দুর্বল ঈমানের অধিকারী। এতো বেশি লোক এত সহজে তাগুতের অস্ত্রের ঝলকানিতে ভয় পায় যে ,তাগুতী শক্তি নিজেকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মনে করে বসে। সে মুহূর্তে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠি ঘোষণা করে সে তাগুতের দাসত্ব স্বীকার করতে রাজি নয় ,তাগুতের হাজারো মারণাস্ত্রের কাছে এতটুকু ভীত না হয়ে সে তার মোকাবিলা করতে রাজি ,তখনই তাগুতের সমস্তত দম্ভ চূর্ণ হয়ে যায়। ক্রোধে অন্ধ হয়ে তাগুত হয়তো এ বিদ্রোহীকে হত্যা করতে পারে ,কিন্তু অন্তরে সে পরাজয় ও হতাশারা গ্লানি ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারে না। আশুরার দিন ইয়াযীদ বাহিনী ইমাম হোসাইন (আ.) -এর রক্তপাত করেছিল এবং তার পবিত্র দেহের ওপর ঘোড়া ছুটিয়ে তার শারীরিক অস্তিত্বের অবমাননা করতে চেষ্টা করেছে সত্য ,কিন্তু তারা স্বাধীন আত্মার মর্যাদাকে এতটুকু খাটো করতে পারেনি ,বরং গৌরবান্বিত করেছে। এখানেই ইমাম হোসাইনের বিজয়। এ থেকেই পরবর্তীকালে মানুষ উদ্দীপনা পেয়েছে ,শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে তাগুতী শক্তির হাজারো লোকবল ও হাজারো মারণাস্ত্রের চেয়ে ঈমান-যে ঈমান হোসাইনের মতো নির্দ্বিধায় রক্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত-বেশি শক্তিশালী।

ঠিক যেমনিভাবে ইয়াযীদ তার শক্তির দাপট দেখিয়ে ইমাম হোসাইনকে নতিস্বীকার করাতে চেয়েছিল তেমনিভাবে আজকের যুগের আমেরিকা ও অন্যান্য পরাশক্তি হাইড্রোজেন বোমা ,ক্রজ মিসাইল আর প্রেসিশন বম্বিং-এর ভিডিও দেখিয়ে বিশ্বের মযলুম জনগোষ্ঠীকে দাস বানিয়ে রাখতে চায়। বিশ্বের ক্ষুদ্র দেশগুলো এসব দেখে ভয়ে নতি স্বীকারও করে নেয় পরাশক্তিগুলোর। যখন বিশ্বে দুই পরাশক্তির রাজত্ব (Bipolar World ) ছিলো তখন এটা ধরেই নেয়া হতো যে ,কোনো দেশ যদি আমেরিকার দাসত্ব ছেড়ে আসতে চায় তাহলে তাকে রাশিয়ার দাসত্ব কবুল করতেই হবে ,আর রাশিয়ার বলয়মুক্ত হতে হলে আমেরিকার খপ্পরে ধরা দিতেই হবে । ফলে ১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবী জনতা যখন হযরত আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (রহ.) -এর নেতৃত্বে ঘোষণা করলো , লা শারকীয়া লা গারবিয়া (প্রাচ্য নয় ,পাশ্চাত্য নয়) তখন বিশ্বের তাবৎ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছিল । শাহের পাশ্চাত্য প্রভুরা যখন দেখলো জনগণ ভীষণদর্শন ট্যাংক ,কামান আর রিকয়েললেস রাইফেলকে উপেক্ষা করে বুকের রক্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত তখন তারা বুঝলো তাদের সকল মারণাস্ত্র ,সকল সামরিক গবেষণা ,সিআইএ র সকল গোয়েন্দাবৃত্তি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। হেনরী কিসিঞ্জারের মতো খ্যাতিমান কূটনীতিক ঘোষণা করলেন , দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইরানের বিপ্লব আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড়-রাজনৈতিক বিপর্যয় (Greatest Geopolitical Disaster ) ।

কেনো কিসিঞ্জার ইরানের বিপ্লবকে আমেরিকার জন্য এক মহাবিপর্যয় বলে অভিহিত করলেন ? ইরানের বিপ্লবীরা কি আমেরিকার এক ইঞ্চি পরিমাণ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছিল ? এর উত্তর মিলবে কিসিঞ্জারের অন্য আরেকটি উক্তি থেকে । ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে ফরাসী প্রধানমন্ত্রী দ্যগল কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করেছিলেন : ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালিয়ে তোমাদের লোকসান ছাড়া লাভ তো হচ্ছে না ,এর পরেও তোমরা ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য সরিয়ে আনছো না কেন ? কিসিঞ্জার জবাবে বললেন , এতে আমাদের বিশ্বাস যোগ্যতা (Credibility ) ক্ষতিগ্রস্ত হবে । দ্যগল বললেন , কোথায় তোমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবার ভয় পাচ্ছ ? কিসিঞ্জার বললেন , মধ্যপ্রাচ্যে । কূটনৈতিক পরিভাষায় কিসিঞ্জার যা বলতে চাইলেন তা হচ্ছে ভিয়েতনাম থেকে আমরা যদি সৈন্য সরিয়ে আনি তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানরা আমাদের আর ভয় পাবে না অর্থাৎ মুসলমানদেরকে যে শক্তি দেখিয়ে আমরা পদানত রাখতে চাই ,সে শক্তি প্রদর্শনের জন্য আমাদের ভিয়েতনামে যথেচ্ছ বোমাবর্ষণ করা দরকার। লক্ষ্য করলে দেখবেন ,এ মানসিকতাই ইয়াযিদী মানসিকতা । দ্যগলের সাথে কিসিঞ্জারের এ কথোপকথনের এক দশক পরেই যখন সাম্রাজ্যবাদের সমস্ত কূটচাল আর ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে ইমাম হোসাইনের পথ ধরে ইমাম খোমেইনীর কণ্ঠে উচ্চারিত হলো , আল্লাহ আকবার এবং জনতা ও কাফন পরে রাজপথে নেমে এলো ,তখন আমেরিকার সিআইএ ,পররাষ্ট্র দফতর ,প্রেসিডেন্টের দফতর ইত্যাদির মধ্যেই পারস্পরিক দ্বন্দ শুরু হয়ে গিয়েছিল । তারা একে অপরকে দায়ী করছিল পরাজয়ের জন্য। কেউ বলছিল সিআইএ র গোযেন্দা তথ্যাবলী ভুল ছিল ,কেউ বলছিল পররাষ্ট্র দফতরের নীতিতে ভুল ছিল ইত্যাদি। এর কারণ ,তারা আজও ইমাম হোসাইনের শিক্ষা উপলদ্ধি করতে পারেনি।

ইমাম হোসাইন শিখিয়েছেন বাহ্যিক অর্জন বড় কথা নয় ,সত্যের সাক্ষ্যদিতে পারাটাই আসল বিজয়। তাই অনেকে যদিও মনে করেন ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও ইরানের বিপ্লবীরা ১৯৭৯ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারিতে একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছিলেন ,সেটা আসলে ভুল ধারণা। বিজয় অর্জিত হয়েছিল তখনই যখন শাহের সর্বাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণ খালি হাতে এগিয়ে গিয়েছিল নির্দ্বিধায়। ইরানের বিরুদ্ধে ইরাক কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় ইমাম খোমেইনী বলেছিলেন , আমরা যদি যুদ্ধক্ষেত্রে এগুতে এগুতে বাগদাদ পর্যন্ত অগ্রসর হই তবু তাকে বিজয় বলা যাবে না। আর আমরা যদি পিছু হটতে হটতে একেবারে তেহরানেও এসে ঠেকি তবুও তাকে পরাজয় বলা যাবে না। আমাদের বিজয় আমাদের ওপর ন্যস্ত খোদায়ী দায়িত্ব পালন করার মধ্যেই নিহিত। এ শিক্ষা আশুরা বিপ্লবেরই শিক্ষা।

আশুরা বিপ্লবের আরেকটি বড় দিক হলো সঠিক ধর্মকে মেকী ধর্মাচরণ থেকে পৃথকীকরণ। বর্ণিত আছে যে ,ইয়াযীদের সৈন্যরা আশুরার দিন একে অপরকে বলছিল : তাড়াতাড়ি হোসাইনের শির কেটে নাও ,আসরের নামাযের সময় পার হয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ তারা ধর্মের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো কিন্তু ধর্মের লক্ষ্য আদর্শকে কতল করতে এতটুকু দ্বিধাগ্রস্ত ছিল না। আজকের যুগের ইয়াযীদরাও মাঝে মাঝে ধর্মের পাশোক ধারণ করে ধর্মের শিক্ষাকে ধ্বংস করতে এতটুকু পিছপা নয়। আমেরিকান ইসলাম , সউদী ইসলাম ইত্যাদি নানান রূপ ধরে ইসলামের নামে ইসলামী আদর্শকে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে। হজ্বের মতো সমাবেশে আমেরিকা ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া নিষিদ্ধ করা হচ্ছে ইসলামেরই নামে। নির্ভেজাল তাওহীদ প্রতিষ্ঠার নামে সৃষ্টি করা হয়েছে বিষাক্ত ওয়াহাবী মতবাদ ,যে মতবাদ অনুযায়ী লম্পট রাজাদের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র জায়েয ,ইয়াহুদী-নাসারা শাসিত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিটি আদেশ-নির্দেশ মেনে চলা জায়েয ,কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) -এর জন্য শোক প্রকাশ করা বিদআত ,হে মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকারকল্পে ইয়াহুদী-নাসারাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া নাজায়েয। আশুরার বিপ্লব আমাদের শিক্ষা দেয় যে ,বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পালনকারীরাও ইয়াযীদের দলভুক্ত হতে পারে এবং তাদেরই হাতে ঝরতে পারে আজকের হোসাইনীদের রক্ত।

আজ বড় শয়তানের দেশ আমেরিকার প্রেসিডেন্টও উদ্ধৃত করেন পবিত্র কুরআনের আয়াত ,ঠিক যেমনিভাবে ইয়াযীদ কারবালার বন্দিনী হযরত যায়নাবের সামনে উচ্চারণ করেছিল । ইয়াযীদ সেদিন কুরআনের আয়াত , আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন ,যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন উচ্চারণ করে বোঝাতে চেয়েছিল যে ,আল্লাহর ইচ্ছাতেই যায়নাবের (সালামুল্লাহ আলাইহা) সঙ্গী-সাথী দের এ বন্দি দশা এবং আল্লাহর ইচ্ছাতেই ইমাম হোসাইনের পবিত্র দেহ পদদলিত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টও আজ কুরআনের আয়াত উচ্চারণ করে ফিলিস্তিনিদের দাসখত লেখার অনুষ্ঠানে। যে চুক্তি দিয়ে ইয়াহুদীবাদীদের সমস্ত অপকর্মকে বৈধতা দেয়া হলো ,যে চুক্তি দিয়ে ঘোষণা করা হলো লক্ষ্য কোটি ফিলিস্তিনির হত্যা ,সন্ত্রাস ,ধর্ষণ ও জুলুমের মাধ্যমে দেশছাড়া করা সম্পূর্ণ বৈধ ,যে চুক্তি দিয়ে মুসলমানদের তৃতীয় কেবলা সান্ত্রাসবাদী জালিম ইয়াহুদী শাসকদের হাতে তুলে দেয়া হলো ,যে চুক্তি দিয়ে ফিলিস্তিনিদের দিয়ে ইয়াহুদীদের আনুগত্য করতে বাধ্য করা হলো ,সে দাসখতের নাম দেয়া হলো শান্তি চুক্তি । আর দাসখত লেখার অনুষ্ঠানে ওরা কুরআনের আয়াত , যদি তারা শান্তির আহবান নিয়ে আসে তোমরাও তাতে রাজি হও উদ্ধৃত করার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করে যে ,কুরআনই তোমাদের এ দাসখত লেখাকে সমর্থন করে ।

আশুরার আর ও অনেক দিক ও গভীর তাৎপর্য রয়েছে । সকল দিকের উপলদ্ধি আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধারণ অসন্তুষ্ট । আমি এ এটুকু বলে শেষ করবো যে ,যুগে যুগে যখনই মানুষ ইসলাম বিস্মৃত হয়েছে তখনই আল্লাহ মানুষকে সংশোধন করার জন্য নবী ,রাসূল ও ইমাম পাঠিয়েছেন। ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক সময়ে আশুরার বিপ্লব সাধন করেছিলেন যখন ইসলামের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান বিদ্যমান থাকলেও মানুষ ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে সরে গিয়েছিল । এ বিপ্লব করতে গিয়ে তিনি রক্ত দিয়ে সত্যের সাক্ষ্য দান করে প্রমাণ করলেন যে ,রক্ত সকল মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারে। আশুরার এ শিক্ষার আজ ইরানের বিপ্লবে ,লেবাননের হিযবুল্লাহ কর্তৃক শক্তিশালী ইসরাইলী বাহিনীর মোকাবিলায় এবং কাশ্মীর ,আলজেরিয়া ,মিশর-সুদানসহ বিশ্বে ইসলামের মুজাহিদদের প্রেরণার উৎস।

*অধ্যাপক ,অর্থনীতি বিভাগ ,সাউথইষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ,ঢাকা

কবিতা

মোহররমের চাঁদ এল ঐ

কাজী নজরুল ইসলাম

মোহররমের চাঁদ এল ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়

ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায়।।

কাঁদিয়া জয়নাল আবেদীন বেহোশ হ 'ল কারবালায়

বেহেশতে লুটিয়া কাঁদে আলি ও মা-ফাতেমায়।।

আজও শুনি কাঁদে যেন কুল মুলুক্ আসমান জমীন

ঝরে মেঘে খুন লালে-লাল শোক-মরু সাহারায়।।

কাশেমের লাশ লয়ে কাঁদে বিবি সকিনা

আসগারের ঐ কচি বুকে তীর দেখে কাঁদে খোদায়।।

কাঁদে বিশ্বের মুসলিম আজি ,গাহে তারি মর্সিয়া

ঝরে হাজার বছর ধ 'রে অশ্রু তারি শোকে হায়।।

[জুলফিকার]

শহীদে কারবালা

ফররুখ আহমদ

'সকলে শহীদ হৈল দস্তকারবালাতে '

ফোরাতের তীরে তীরে কাঁদে আজও সংখ্যাহীণ প্রাণ ;

উদভ্রান্ত ঘূর্ণিরর মত শান্তি চায় মাতমে - কান্নায় ,

যেখানে মৃত্যুর মুখে তৃষ্ণাতপ্ত মরুর হাওয়ায়

জিগরের খুন দিল কারবালার বীর শহীদান।

স্মৃতির পাথর পটে সে কাহিনী রয়েছে অম্লান

উজ্জ্বল রক্তের রঙে ,মোছেনি তা মরু সাহারায় ,

লোভের পঙ্কিল পথে অথবা রাত্রির তমসায়

যেখানে জ্বালালো দীপ সত্যাশ্রয়ী আদম সন্তান।

নির্ভীক মুসার পণ ,খলিলের সুদৃঢ় ঈমান

যেখানে দেখেছি দীপ্ত ,মসীকৃষ্ণ রাত্রির ছায়ায়

কুতুব তারার মত প্রোজ্জ্বল আপন মহিমায়

যেখানে দেখেছি চেয়ে সর্বত্যাগী হুসেনের দান ,

যেখানে শুনেছে প্রাণ মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদের গান

পুঁথির পাতায় নয় জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়।।

শহীদে কারবালা

শাহাদাৎ হোসেন

দামামার দমদম তুৰ্য্যের বাজনা

থেমে গেছে ,স্তব্ধ সে মৃত্যুর সাহানা ।

ছায়াময়ী সন্ধ্যা সে নামে ধীরে বিশ্বে

নিভে যায় আলো-রেখা আঁধারের দৃশ্যে ।

রক্তে নহর বয় কারবালা-বক্ষে

অশ্রুর ধারা ঝরে প্রকৃতির চক্ষে ।

সন্ধ্যার আসমান উঠিয়াছে রাঙিয়া

শহীদের খুন যেন দিয়েছে কে ঢালিয়া ।

ওকে বীর ধেয়ে যায় ফোরাতের কুলেতে

উন্মাদ পিপাসায় কর চাপি বুকেতে ?

মণি-দীপ ও যে গো হজরৎ বংশের

দুষমনে খেদায়ে করে ধরি শমশের

ফোরাতের বারি পানে শীতলিতে পরাণী

চলে দ্রুত ,ঘর্ম্মেতে সিক্ত সে পেশানী।

ও কি পুন! স্বাদুনীরে অঞ্জলি ভরিয়া

মুখে তুলি পান বিনা দিল যে ও ফেলিয়া ।

কূলে উঠি ওই অঙ্গের বসনে

উন্মোচি একে একে ভূতলের শয়নে

ঢালে দেহ বীরবর বীরসাজ ত্যজিয়া

শ্রান্ত কি কেশরী ও পড়িয়াছে ঢলিয়া

জম্বুক সংগ্রামে ? হুঙ্কারি নিমেষে

কে রে তুই নির্ম্মম ধেয়ে এলি কি বেশে ?

কি করিস! কি করিস! রে ঘাতক কেমনে

বসিলি রে নির্ভয়ে ও ছাতির আসনে!

কোনা প্রাণে নির্ম্মম নূরাণী ও অঙ্গে

বসিলি রে উল্লাসে দানবের ভঙ্গে ?

ও কি পুন খঞ্জরে রক্তের ফিনকি!

মনে নাই রে-ঘাতক হাসরের দিন কি ?

ওই শোন্ ক্রন্দনে বেজে ওঠে দুনিয়া-

হায়! হায়! হা হোসেন! আসমান চুনিয়া-

খুন ঝরে প্রান্তরে জান্নাত নিঙাড়ি ,

কল্লোলে কাঁদে নদী সৈকতে আছাড়ি।

নূরনবী হজরৎ নিশিদিন যাহারে

চুমিতেন বুকে ধরি ,সস্নেহে আদরে ,

সেই আজি প্রান্তরে রক্তের শয়নে

আছে শুয়ে পাণ্ডুর জ্যোতি-লেখা নয়নে।

করিলি কি নির্দয়! ফুৎকারে নিভালি

প্রোজ্জ্বল দীপখানি ,ইসলামে ডুবালি!

[কলকাতা ,১৩২৭]

ইমামের শাহাদাত

হোসেন মাহমুদ

ধু ধু মরুভূমি ,আকাশে জ্বলন্ত সূর্য সারাদিন ঢালে অসহ্য উত্তাপ

নেই কোন সবুজের আভাস ডাকে না পাখি শুধু বৈরী বালির বিস্তার

অনাহার তৃষ্ণায় ধুকে মরছে অবরুদ্ধ একদল নিরীহ মানুষ

তাদের অপরাধ-তারা সাথী এক সত্যনিষ্ঠ ন্যায়বান মানুষের ।

ইমাম হোসেন সিজদা থেকে তোলেন মাথা ,এবার তার শেষ প্রস্তুতি

নিষ্ঠুর অত্যাচারী এজিদ হয়েছে এখন মুসলিম সাম্রাজ্যের খলিফা

হায়! দুর্ভাগ্য এই কওমের যে ,এক স্বৈরাচারী আজ তাদের শাসক

যে কি না কবর রচনা করেছে ইসলামী সাম্যের মহান ধারার।

তার অশুভ শক্তির প্রবল দাপটে সবাই থরথর কম্পমান

সম্পূর্ণ ভূলুণ্ঠিত আজ পবিত্র স্থান মক্কা ও মদীনার মর্যাদা

ভয় ত্রাসের সেই অন্ধকারে সত্যের মত দীপ্ত শুধু হোসেন

কে না জানে তিনি রাসূলের প্রিয় দৌহিত্র ,পুত্র আলী ও ফাতেমার

এ চরম দুর্দিনে তিনিই একমাত্র আশা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর।

দশ মুহররম । শিশুদের আহাজারি-পানি! পানি! বুকে যন্ত্রণা বাড়ে

সত্যের বাধ ভাঙ্গে ,ইমাম অশ্বরূঢ় ,আজই হবে শেষ ফয়সালা ।

দুলদুল দুলকি চালে পৌছে যায় ফোরাতের তীরে ,শত্রুরা অপেক্ষায়

তাকে দেখেই শুরু করে তীর বর্ষণ ,কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার

হাতের খোলা তলোয়ার শুধু ঝলসায় ,যেন বিদ্যুতের চকিত চমক

শত্রুরা ঘিরে ফেলে তাকে ,কিন্তু সত্যের সামনে কি করে টিকবে মিথ্যা ?

রণহুঙ্কার ,অস্ত্রের ঝনঝন ,আঘাত ও প্রত্যাঘাত ,এক শত্রু মরে

পরক্ষণেই আসে আরেকজন ,তবু তিনি পৌছে যান ফোরাতের তীরে।

হায় পানি ,তোমার অন্য নাম জীবন! তিনি আজলায় তুলে নেন পানি

মুখে দিতে গিয়েই মনে পড়ে যায় কাতার কচি শিশুদের মুখ

আঙ্গলের ফাক গলে পড়ে যায় পানি ,কিছুতেই হয়না পান করা।

হোসেন উঠে দাড়াতেই শত্রুসৈন্যের দল পুনরায় ঘিরে ধরে তাকে

আবার লড়াই। কিন্তু আর কত ? সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে তার

আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত দেহ ,অবসন্ন তিনি লুটিয়ে পড়েন ভূমিতে

তার চোখের সামনে ভুলুণ্ঠিত খিলাফত । দূরে শিবিরে ওঠে কান্নার রোল

সব আশাই শেষ ,সত্য ও ন্যায়ের শ্রেষ্ঠ পতাকাবাহী চলে যাচ্ছেন

আজ আশুরায় শাহাদাতের পিয়ালা ঠোটে ,খোলে জান্নাতের দরোজা।

এই তো সময়! পশুর অধর্ম সীমার তৎপর হয়ে ওঠে মুহূর্তেই

আর নিষ্কম্প হাতে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইমামের পবিত্র মস্তক

একদিকে মর্মভেদী বিলাপ ও আহাজারিতে বিদীর্ণ আকাশ বাতাস

অন্যদিকে রক্তের নদীতে নেয়ে নাচে হাসে শত্রুরা উন্মত্ত উল্লাসে

পৃথিবী নীরবে চেয়ে দেখে মানব ইতিহাসের এই করুণ ট্টাজেডি। [অংশ বিশেষ]

কারবালার পর পবিত্র মক্কা ও মদীনায় ইয়াযিদী তাণ্ডবলীলা

মাওলানা শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)

[ইয়াযীদ মুসলিম জাহানের ক্ষমতারোহণ করে মাত্র সাড়ে তিন বছর রাজত্ব করে । তার দ্বারা মুসলমানদের কোনো উপকার হয়নি ;বরং যা হয়েছে তা হলো চরম দুঃখ ,লাঞ্ছনা ও লোমহর্ষক গঞ্জনা। তার সৈন্যরা প্রথম বছর কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) -কে বাহাত্তর জন সঙ্গী- সাথীসহ হত্যা করে ,দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা শরীফে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং তৃতীয় বছর পবিত্র মক্কা নগরীকে দু মাস ধরে অবরুদ্ধ রেখে পবিত্র কাবা গৃহে অগ্নি সংযোজন করে । এখানে আমরা কারবালার পর ইয়াযীদ বাহিনী কর্তৃক মদীনা ও মক্কায় যে হত্যালীলা ও লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তার কিয়দংশ বর্ণনার আশা রাখি।]

কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পরে মদীনায় ইয়াযীদ কর্তৃক যে লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় এটাই হাররা র ঘটনা নামে অভিহিত। এ স্থানটি মদীনা নগরী থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত। মদীনা তৈয়বাতে যে সব হত্যাকাণ্ড ,সংঘর্ষ ও এ পবিত্র স্থানের অবমাননার ঘটনা ঘটেছে সে সব ঘটনা বর্ণনার দ্বারা যদিওবা পবিত্র অন্তর বিশিষ্ট লোকদের অন্তর দুঃখভারাক্রান্ত হয় ,কিন্তু হুজুর আকরাম (সা.) এ সমুদয় অঘটনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন ,তাই এ সম্পর্কে এখানে কিঞ্চিত আভাস দেয়া দরকার । যেমন তিনি এরশাদ করেছেন -যে ব্যক্তি মদিনাবাসীকে কষ্ট দেবে এবং ভীতসন্ত্রস্ত করবে ,সে দুনিয়া ও আখিরাতের আযাবে গ্রেপ্তার হবে । হাররা এলাকায় যে অঘটন ঘটেছে হাদিস দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

কোনো কোনো আলেম বলেছেন যে , হাররা ঘটনা এ হাদিসের দ্বারাও সত্যায়িত করা হয়। তিনি এরশাদ করেছেন-মদীনা শরীফ আবাদ হওয়ার পর আবার বিরান হয়ে যাবে ,মানুষও এ স্থান ছেড়ে চলে যাবে এবং মরু এলাকার পশুপক্ষী এখানে এসে বসবাস করবে। কিন্তু বাস্তব এই যে ,মদীনার এ অবস্থা কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দেখা দেবে ,ইমাম নববী কথা বলেছেন। কেননা ,কোনো কোনো হাদিসে যে সমুদয় বর্ণনা পাওয়া যায় ,এতে বুঝা যায় যে , হাররা র ঘটনায় এটা পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন- ইবনে আবি শাইবা উল্লেখ করেছেন ,এ পবিত্র নগরী চল্লিশ বছর যাবৎ বিরান হয়ে পড়ে থাকবে। তথায় হিংস্র জন্তু এবং পশু-পাখি বসবাস করবে। অতঃপর মুজনিয়া গোত্রের দু জন রাখাল এখানে এসে অবাক হয়ে পরস্পরকে বলবে ,এখানকার জনপদ কোথায় গেল ? তারা সেখানে বন্য জীবজন্তু ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না । এতে বুঝা যায় যে ,এটা কিয়ামত পূর্বকালীন সময়ের ঘটনা হবে ।

হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে-মদীনার ওপর এমন এক সময় উপস্থিত হবে যে ,মদীনার বাসিদেরকে এ খান থেকে বের করে দেয়া হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : কে তাদেরকে বের করে দেবে ? এরশাদ করলেন : আমীরগণ । বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে যে ,নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন : কুরাইশ গোত্রীয় লোকের হাতে আমার উম্মত ধ্বংস হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! তখন আমাদের জন্য কী নির্দেশ ? এরশাদ করলেন : তখন তোমাদের একাকীভাবে জীবন যাপন করা উচিত। অপর এক হাদিসেও হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে ,হযরত (সা.) এরশাদ করেছেন : যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন ,তার শপথ করে বলছি ,মদীনায় এমন এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে ,যার ফলে‘‘ দ্বীন’’ এখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে ,যেমন মাথা মুণ্ডনের ফলে চুল মাথা থেকে খসে পড়ে যায়। সেদিন তোমরা মদীনার বাইরে চলে যেও ,এক মনজিলের ব্যবধান হলেও । হযরত আবু হুরাইরাহ থেকে আরো বর্ণিত আছে যে ,তিনি এভাবে দোয়া করতেন : হে আল্লাহ ! আমাকে ষাট হিজরীর অঘটন এবং ছেলেদের রাজত্ব থেকে রক্ষা করুন। সে আসার পূর্বেই আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিন। এতে ইয়াযীদের হুকুমতের প্রতিই ইঙ্গিত রয়েছে । কেননা ,সে ষাট হিজরীতে সিংহাসনে আরোহণ করেছে এবং হাররা র ঘটনা তারই রাজত্বকালে সংঘটিত হয়েছে।

ওয়াকেদী হাররা নামক কিতাবে আইয়ুব ইবনে বশর থেকে বর্ণনা করেছেন-রাসূল (সা.) একদা সফর করে হাররা নামক স্থানে পৌছেন ,তখন দাড়িয়ে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েন । এতে সাহাবাগণ মনে করলেন যে ,হয়ত সফরের পরিণতি শুভ হবে না। তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলো । হযরত ওমর (রা.) আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! আপনি কী ভেবে ইন্নালিল্লাহ পড়লেন ? তিনি বললেন : হাররার এ মরু প্রান্তরে আমার সাহাবাদের পরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে ,তিনি তার হস্ত মুবারকের দ্বারা ইশারা করে বললেন : এ হাররার মরু প্রান্তরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত কা বে আহবার থেকে বর্ণনা করেন যে ,হযরত কাব বলতেন , তাওরাত কিতাবে বর্ণিত আছে যে ,মদীনা মুনাওয়ারার পূর্বদিকের মরু প্রান্তরে উম্মতে মুহাম্মাদীয়া (সা.) -এর এমন কতক লোক শাহাদাত বরণ করবেন ,যাদের চেহারা চৌদ্দ তারিখের চাদের আলো থেকে উজ্জ্বল । ইবনে যুবলা থেকে বর্ণিত আছে- একদা আমিরুল মু মিনীন হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতের আমলে খুব বৃষ্টিপাত হয়। তখন তিনি তার বন্ধু বান্ধবসহ মদীনার বাইরে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন । যখন হাররা নামক স্থানে পৌছেন এবং দেখতে পান যে ,চতুর্দিকে পানির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে ,তখন তার সাথী হযরত কাবে আহবার (রা.) শপথ গ্রহণ করে বললেন : এখানে যেভাবে পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে ,ঠিক এমনিভাবেই এখানে রক্ত প্রবাহিত হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , এটা কোন সময়ে হবে ? তিনি উত্তর দিলেন : হে যুবাইরের পুত্র ! তুমি এর থেকে সতর্ক থেক যেন তোমার হস্ত-পদের দ্বারা এটা সংঘটিত না হয়।

সীরাত লেখক এবং ঐতিহাসিকরা সংক্ষেপ এবং বিস্তারিতভাবে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের উদ্ধৃতিসমূহ নিম্নে পেশ করা হলো যাতে আসল ঘটনা অস্পষ্ট না থাকে।

কুরতবী বলেন : মদীনাবাসীর মদীনা থেকে বাইরে চলে যাওয়ার কারণ এ হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা । যেমন কোনো কোনো হাদিসে বর্ণিত আছে-যে সময় মদীনা শরীফ অবশিষ্ট সাহাবা এবং তাবেয়ী দ্বারা পরিপূর্ণ এবং লোক বসতিতে ভরপুর এবং তার চিত্তাকর্ষক সাদৃশ্য বিদ্যমান তখন মদীনাবাসীর ওপর একের পর এক বিপর্যয় এবং অঘটন নেমে আসে ফলে তারা মদীনা ছেড়ে বাইরে চলে যান। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে শাম দেশীয় এক বিশাল সৈন্য বাহিনী যুদ্ধ করার জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । সৈন্য বাহিনীর বদবখত লোকেরা তিন দিন পর্যন্ত মসজিদে নববীর সম্মান হানিকর কাজে লিপ্ত থাকে। এ কারনেই একে হাররা র ঘটনা বলা হয়। এটা শহর থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত।

এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদের কুচক্রী দল শিশু এবং নারী ব্যতীত মদীনার বিশিষ্ট ও সম্মানিত বার হাজার চারশ সাতানব্বই জন লোককে হত্যা করে ।

মদীনায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে শহীদানের তালিকা

1. মুহাজির,আনসার ,তাবেয়ীন ,উলামা- 1700 জন

2. সাধারণ লোক 10 ,000 জন

3. কুরআনের হাফিজ 700 জন

4. কুরাইশ 97 জন

সর্বমোট = 12 ,497 জন

হাররাহ এ লোমহর্ষক ঘটনা ছাড়া ও ইয়াযীদের সৈন্যরা নানা প্রকার অত্যাচার ,অনাচার ও ধৃষ্টতাপূর্ণ অপকর্মে লিপ্ত হয় এবং জেনার মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত আছে যে ,এ ঘটনার পর এক হাজার অবৈধ সন্তান প্রসব করে । এ সব পাপিষ্ঠ লোক মসজিদে নববীর অমার্জনীয় অবমাননা করে । এ পবিত্র স্থানকে তারা ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে । হুযুর আকরাম (সা.) -এর রওজায়ে পাক এবং মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান (যার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে ,এখানে বেহেশতের বাগান সমূহের একটি বাগান আছে) ঘোড়ার মলমূত্র দ্বারা কলুষিত করে । আর লোকদের থেকে ইয়াযীদের জন্য এভাবে বাইআত নেয়া হয় যে ,ইয়াযীদ যদি ইচ্ছা করে ,তাদেরকে বিক্রয় করতে পারবে অথবা স্বাধীনভাবেও রাখতে পারবে। সে যদি ইচ্ছে করে আল্লাহর বন্দেগীতেও রাখতে পারবে অথবা তার নাফরমানি করারও নির্দেশ দিতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যমা (রা.) যখন ইয়াযীদকে বললেন যে ,বাইআততো অন্ততঃপক্ষে কুরআন ও সুন্নাতের ওপর গ্রহণ করা চাই। তখনই ইয়াযীদ তাকে হত্যা করে ফেলে।

ইমাম কুরতবী বলেন-ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে ,মদীনা মুনাওয়ারা তখন জন শূন্য হয়ে যায়। তখন মরুর পশুপাখিরা তথায় মলমুত্র ত্যাগ করত। মসজিদে নববী কুকুরের বাসস্থানে পরিণত হয়। এ সকল ঘটনা দ্বারা হুজুর (সা.) -এর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়।

তাবরানী হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে রেওয়ায়েত করেন যে ,হযরত মু আবিয়া (রা.) -এর ইন্তিকালের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) ইয়াযীদের বাইআত এবং আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং তার নিন্দাবাদ করতে থাকেন। ইয়াযীদ এ কথা শ্রবণে শপথ নিয়ে বলল : খোদার কসম ,আমি আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর গলায় বেড়ী পরাব। অতঃপর সে একজন দূত মারফত তাকে ডেকে পাঠায়। দূত এসে তাকে বলল : আপনি রৌপ্যের একটি ফাদ তৈরী করুন এবং ইয়াযীদের শপথ পূরণকল্পে গলার মধ্যে তা ঝুলিয়ে দিন ,আর এই ওপর স্বীয় কাপড় পরিধান করুন ,তবে আশা করি আপনি রক্ষা পাবেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বললেন : আল্লাহ তাআল কখনও তার শপথকে বাস্তবায়িত করবেন না। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও আত্মসমর্পণ করবো না। যতক্ষণ শক্ত পাথর দাতের নিচে নরম হবে না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) জনগণকে তার বাইআত গ্রহণ ও আনুগত্য স্বীকারের দাওয়াত দিতে লাগলেন।

এ দিকে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী শাম (সিরিয়া) থেকে মদীনা অভিমুখে প্রেরণ করে । তাদেরকে সে এ নির্দেশ দিয়েছিল যে ,মদীনাকে ধ্বংস করে দেয়ার পর মক্কায় চলে যাবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে হত্যা করবে। মুসলিম ইবনে উকবা যখন মদীনায় পৌছে তখন সকল সাহাবায়ে কেরাম মদীনা শরীফের বাইরে চলে গেলেন। মুসলিম ইবনে উকবা অবশিষ্ট লোকদের হত্যা করার পর মক্কা শরীফ অভিমুখে যাত্রা করল। পথিমধ্যে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এ সময় সে হোসাইন ইবনে নুমাইর কিন্দিকে স্বীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -কে অবরোধ করার জন্য পবিত্র মক্কায় কামানের গোলা নিক্ষেপ এবং অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দেয়। হোসাইন পথিমধ্যে থাকাকালেই ইয়াযীদের মৃত্যু সংবাদ পৌছে । হোসাইন পালিয়ে গেল এবং সে তার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে পারল না।

ইবনে জওযী বলেন ,বাষট্টি হজরীতে ইয়াযীদ তার চাচাত ভাই উসমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু সুফিয়ান তার বাইআত গ্রহণের জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । উসমান মদীনাবাসীর একটি দলকে ইয়াযীদের নিকটে পাঠিয়ে দেন। যখন তারা ইয়াযীদের কাছ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন ,তখন তারা ইয়াযীদকে গালিগালাজ করতে লাগলেন ও বললেন যে ,সে ধর্মদ্রোহী ,মদখোর ,ফাসিক । সে কুকুর পালন করে । এ কথা বলে তারা তার বাইআত বর্জন করলেন। ইয়াযীদের নিকট গমনকারী লোকদের মধ্যে হযরত মুনযের (রা.)ও ছিলেন । তিনি বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে। সে আমাকে একলক্ষ দিরহাম অনুদান দিয়েছে। কিন্তু এজন্য আমি সত্যকে পরিত্যাগ করতে পারিনি। সে মদ্যপায়ী ও বেনামাযী। তার মুখ থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথেই লোকজন তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার হাতে বাইআত গ্রহণ করল আর উসমানকে মদীনা থেকে বের করে দিল। আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) বলতেন : যদি আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণের আশংকা না করতাম ,তবে ইয়াযীদের বাইআত প্রত্যাখ্যান করতাম না এবং তার মোকাবিলা করার ঝুকি গ্রহণ করতাম না। ইবনে জওযী আবদুল হাসান মাদাহেনী থেকে বর্ণনা করেন যে ,ইয়াযীদের পাপাচার এবং কর্মসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর মদীনাবাসী মিম্বরের ওপর আরোহণ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হাফস মাখযুমী মাথা থেকে পাগড়ি নিক্ষেপ করে বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে এবং আমাকে বিশেষ অনুদানে সম্মানিত করেছে কিন্তু সে আল্লাহর শত্রু এবং মদপানে আসক্ত ব্যক্তি ;আমি তার বাইআত এভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম যেভাবে এ পাগড়িকে নিক্ষেপ করেছি । এক ব্যক্তি দাড়িয়ে জুতা নিক্ষেপ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করল। এভাবে পাগড়ি এবং জুতাতে মজলিস ভরে গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) কে কুরাইশের এবং আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) কে আনসারের প্রশাসক নিযুক্ত করা হলো ।

উমাইয়্যা বংশীয় লোকদেরকে মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ করা হলো । উমাইয়্যাগণ তাদের এ দুরবস্থার সংবাদ ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে সৈন্য দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানায়। ইয়াযীদ তাদের সাহায্যার্থে মুসলিম ইবনে উকবাকে মদীনায় প্রেরণ করে । এ হতভাগা যদিও বৃদ্ধ ,কিন্তু মদীনাবাসীকে রক্ত স্রোত প্রবাহিত করার ঝুকি গ্রহণ করে । অতঃপর ইয়াযীদ এ কথাও ঘোষণা করে যে ,যে ব্যক্তি হেজাযে গমন করবে তাকে যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সফরের যাবতীয় আসবাবপত্র ছাড়াও একশ দিনার করে বখশিস দেয়া হবে । এ ঘোষণা শুনে বার হাজার লোক হেজায গমনে রাজি হয়ে গল। এ সব লোককে সেখানে প্রেরণ করে ইবনে ফারজানাকে নির্দেশ দিল যে ,তুমি তথায় গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সাথে যুদ্ধ কর। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এবং বললেন , আল্লাহর শপথ ,একজন ফাসেকের সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমি পয়গম্বর আলাইহিস সালামের একজন আওলাদের হত্যা এবং হেরেম শরীফে আল্লাহর ঘরের মধ্যে লড়াইয়ের ঝুকি নিতে পারি না। এরপর সে মুসলিম ইবনে উকবাকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। সে তাকে নির্দেশ দেয় যে ,যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে হোসাইন ইবনে নুমাইরকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবে। সে আরও নির্দেশ দিল যে ,যার বিরুদ্ধে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে তাকে তিনবার দাওয়াত দেবে ,যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তবে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি দাওয়াত কবুল না করে ,তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বিজয় লাভ করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

সেখানে সম্পদ ,অস্ত্র এবং খাদ্য ইত্যাদি যা কিছু পাও তা সৈন্যদের জন্য হালাল করে দাও । তিনদিন পর যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। হযরত হোসাইনের পুত্র হযরত আলী ওরফে যায়নুল আবেদীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। কেননা ,তিনি ঐ দলকে সমর্থন করেন না। যখন মদীনাবাসীর নিকট এ খবর পৌছে তখন মদীনাবাসী সমবেতভাবে ইয়াযীদের সৈন্যদের মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন । বনী উমাইয়্যার যে দলটি মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ ছিল ,তারা তাদের নিকট গিয়ে বললেন : তোমরা এ কথার প্রতিশ্রুতি দাও যে ,তোমরা ধোকাবাজি ,প্রতারণা এবং গোয়োন্দাগিরি করবে না এবং আমাদের শত্রুদের কোনো প্রকার সাহায্য -সহযোগিতা করবে না। তাহলেই আমরা তোমাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি ;অন্যথায় আমরা তোমাদেরকে হত্যা করব। বনী উমাইয়্যার ঐসব লোক মুনাফিকী করে মদীনাবাসীর সাথে শামিল হয়ে মুসলিম ইবনে উকবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেরিয়ে আসে। মারওয়ান ইবনে হাকাম গোপনে স্বীয় পুত্রকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট প্রেরণ করে এ কথা বলে যে ,মদীনায় পৌছে তিনদিন যেন যুদ্ধ স্থগিত রাখে। তিনদিন পর মারওয়ান মদীনাবাসীর সাথে পরামর্শ করে তাদেরকে বলল : তোমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ ? তারা বললেন : যুদ্ধ ব্যতীত গতি নেই।

মারওয়ান বলল : যুদ্ধ করা উচিত হবে না। এতে ফাসাদ বড়ে যাবে। ইয়াযীদের হাতে বাইআত করাই আমি সমীচীন বলে মনে করি। কিন্তু মদীনাবাসী তা পছন্দ করলো না এবং ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মদীনার বাইরে চলে গেলেন ।

এক দিকে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ,অপর দিকে মুসলিম ইবনে উকবা বার্ধক্য জনিত কারণে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে স্বীয় সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) তার সাত পুত্র সহকারে শত্রুর মোকাবিলা করে শাহাদাত বরণ করেন। মুসলিম ইবনে উকবা তার মস্তক মুবারক দ্বিখণ্ডিত করে ইয়াযীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে ইয়াযীদ বাহিনী বিজয় লাভ করে । ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনী তার নির্দেশ মোতাবেক মদীনা মুনাওয়ারায় তিনদিন পর্যন্ত অত্যাচার ,অবিচার ও ব্যভিচার চালায় ,সম্পদ লুটপাট করে এবং জেনার মতো জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়।

ওয়াকেদী বলেন : যখন ইয়াযীদের সেনাবাহিনী মদীনার নিকট পৌছে তখন মদীনাবাসী পরস্পরের পরামর্শক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মতো মদীনার চতুর্দিকে দীর্ঘ পনের দিন অত্যন্ত দুঃখ কষ্ট সহকরে পরিখা খনন করেন। মদীনার চতুর্দিকে তারকটার বেড়া লাগিয়ে দেন এবং দুশমনের পথ অবরোধ করে চতুর্দিক থেকে তাদের ওপর তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে শাম বাহিনী মদীনায় প্রবেশ করতে বাধার সম্মুখীন হয়। অবস্থা বেগতিক দখে মুসলিম ইবনে উকবা ভীত হয়ে হাররা র এক কোণায় অবস্থান করে এবং মারওয়ানের নিকট এ মর্মে লোক প্রেরণ করে যে ,যুদ্ধে জয়লাভ করার কোনো একটা পথ বের করতে ,যাতে সফলকাম হওয়া যায়। মারওয়ান বনী হারেসার নিকট গমন করে তাদেরকে লোভ-লালসায় আকৃষ্ট করে মদীনার একদিকের রাস্তা খুলে দিল। ইয়াযীদের সেনাবাহিনী সে পথ দিয়ে মদীনায় প্রবেশ করে এবং মদিনাবাসী অপর দিক থেকে গুটিয়ে এসে শুধু সে দিকে এসেই যুদ্ধে লিপ্ত হন।

ইবনে আবি খাইসামা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে ,মদীনার লোকজন বর্ণনা করেন যে ,হযরত মু আবিয়া তার মৃত্যুকালে ইয়াযীদকে ডেকে বলে ছিলেন : আমার মনে হয় মদীনাবাসীর সাথে একদিন তোমাকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে । সে সময় তুমি মুসলিম ইবনে উকবার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে নিও ! কেননা ,এ ব্যাপারে তার চেয়ে অধিক বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। পিতার মৃত্যুর পর যখন ইয়াযীদ সিংহাসনে আরোহণ করে তখন মদিনাবাসীর সাথে তার দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। সে পিতার নির্দেশ মতো এ সমস্যার সমাধান করে।

কথিত আছে যে ,এক বৃদ্ধা মুসলিম ইবনে উকবার নিকট এসে কেদে কেদে ফরিয়াদ করলেন : আমার পুত্র বন্দি হয়েছে ,আপনি তাকে মুক্তি দিন। সে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিল যে ,তার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার গর্দান দু টুকরা করে যেন মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। নির্দেশমত কাজ করা হলো এবং বৃদ্ধার হাতে তার পুত্রের মস্তক সোপর্দকরে তাকে বলে দেয়া হলো , তুমি নিজের জীবনের মঙ্গল না চেয়ে পুত্রকে রেহাই দানের সুপারিশ করাতেই এ পরিণতি হয়েছে।

হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যেব যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন তাকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট হাজির করা হয়। সে তাকে বলল : ইয়াযীদের বাইআত গ্রহণ কর। তিনি বললেন : আমি আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.) এর নীতি মোতাবেক বাইআত করেছি। এ সময় একজন লোক দাড়িয়ে বলল : এ একজন পাগল। এ কথা বলার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। মুসলিম ইবনে উকবা হত্যাকাণ্ডে এবং ফিতনা-ফাসাদে অতিশয় সীমালঙ্ঘনকারী ছিল বিধায় স মাসরিফ (সীমালঙ্ঘনকারী) নামে অভিহিত ছিল ।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ওয়াকেদী তার কিতাবুল হাররা নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ,একদা ইয়াযীদ মুসলিমের নিকট এসে দেখতে পায় যে ,সে অর্ধাঙ্গ রোগে আক্রান্ত। ইয়াযীদ তাকে লক্ষ করে বলল : যদি তুমি দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত না হতে তবে আমি তোমাকে মদীনা অভিযানে প্রেরণ করতাম । কেননা ,আমি তোমার চেয়ে আর কাউকে আমার একনিষ্ঠ ভক্ত বলে মনে করিনা । আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মু আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান আমাকে তার মুমূর্ষ অবস্থায় অসিয়ত করেছেন : যদি হেজাযবাসীর সাথে তোমার কোনো অঘটন ঘটে তবে তুমি মুসলিম ইবনে উকবার নিকট তোমার সমস্যার সমাধান চেয়ে নেবে’’ এ কথা শোনামাত্র মুসলিম ইবনে উকবা উঠে দাড়ায় এবং বলে : হে আমীরুল মু মিনীন! আপনাকে শপথ দিয়ে বলছি- একাজ আমি ব্যতীত আর কারও ওপর ন্যস্ত করবেন না। কেননা ,আমার থেকে মদীনাবাসীর আর কোনো বড় শত্রু নেই। এ সম্পর্কে আমি একটি স্বপ্নও দখেছি যে ,জান্নাতুল বাকীর একটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাসহ হযরত উসমান (রা.) এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার ফরিয়াদ করছেন। আমি যখন বৃক্ষটির নিকটে যাই তখন বলতে শুনলাম ,এ কাজ মুসলিম ইবনে উকবার দ্বারাই সম্পন্ন হবে । সে দিন থেকে আমার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে ,আমিই মদিনাবাসীকে হত্যা করব এবং এ আশায় মনকে সান্তনা দিয়েছি এই বলে- আমিই হযরত উসমান (রা.) -এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করব। যখন ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার মধ্যে এরূপ প্রেরণা ও আগ্রহ দেখতে পেল- তখন তাকে নির্দেশ দিল : সত্বর প্রতিশোধ গ্রহণ কর এবং আল্লাহর নাম নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা কর। যদি মদীনায় প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হও এবং বাইআত গ্রহণে মদিনাবাসী রাজি না হয় ,তবে তুমি ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করবে। তিনদিন পর্যন্ত একাজ চালিয়ে যাবে। কাউকে বাদ দেবে না। আর তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করে নেবে। অবশ্য যদি তারা বাইআত স্বীকার করে তবে তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। সেখান থেকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাছে চলে যাবে এবং তার কাজ সম্পন্ন করবে।

বর্ণিত আছে যে ,মদীনার হেরেমের শহীদগণকে দর্শন করে সে বলত : আমি এ সব লোককে হত্যা করার পরও যদি দোযখে যাই তবে আমার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই।

মারওয়ানের গোলাম যাকওয়ান বলে : একদা মুসলিম ইবনে উকবা রোগের ঔষধ সেবন করার পর খাবার তলব করল। অথচ ডাক্তার তাকে নিষেধ করে ছিল যে ,ঔষধ সেবনের পর খাদ্য গ্রহণ করলে ঔষধ ক্রিয়াশীল হবে না। সে বলল : এখন আমি জীবিত থাকার আর কোনো আশা করবনা। কারণ ,আমি তো হযরত উসমান (রা.) এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে এখন স্বস্তিবোধ করছি । আমার অন্তরের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যু ব্যতীত এখন আমার কাছে আর কোনো কিছু প্রিয় নেই। এখন মৃত্যুই আমার কাছে সবেচেয়ে প্রিয়। আমার বিশ্বাস এ সব নাপাককে হত্যা করার ফলে আল্লাহ তা আলা আমার সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’’ সৈয়দ আলাহির রহমত বলেন : তার গুনাহ মার্জনার ধারণা নিতান্ত মুর্খতা ,অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক ;কেননা ,আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত এমন একদল বিশিষ্ট সাহাবায়ে করামকে হত্যা করা এমন এক অপরাধ ও পাপের কাজ ,যা ক্ষমা করা দূরের কথা এই অশুভ পরিণতি থেকে তার রেহাই পাওয়াও অসম্ভব ;এ তার দুঃস্বপ্ন মাত্র।

যে সব সাহাবায়ে কেরামকে মদীনায় জোরপূর্বক অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ফেরেশতা কর্তৃক গোসলপ্রাপ্ত হযরত হানযালা (রা.) -এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা.) । তিনি তার সাত পুত্রসহ শহীদ হন। আর রয়েছেন রাসূল (সা.) -এর অজুর বর্ণনা প্রদানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ (রা.) ও হযরত মাকল ইবনে সিনান (রা.) ,যিনি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বীয় গোত্রের পতাকা বহন করেন।

ইবনে জওযী সনদের সূত্র ধরে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব থেকে বর্ণনা করেন ,তিনি বলেছেন : হাররার অঘটনের সময়ে রাত্রিতে আমি ব্যতীত আর কেউ মসজিদে নববীতে উপস্থিত হতো না। শাম দেশীয় লোকজন আমাকে মসজিদে দেখে বলত ,এ পাগল বুড়ো! এখানে কী করছো ? প্রত্যেক নামাযের সময় রাসূলে পাক (সা.) -এর হুজরা শরীফ থেকে আযান ,ইকামাতের আওয়াজ শুনে আমি নামায পড়তাম।

হাররা র এ হৃদয় বিদারক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদ বাহিনীর হাতে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) সর্বশেষ লাঞ্চিত হন। বর্ণিত আছে যে ,এ গুণ্ডাবাহিনী তার দাড়ি মোবারক গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে। লোকেরা তার দাড়ির এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করতো : আপনি কি দাড়ি নিয়ে খেলেছেন এবং দাড়ি উচ্ছেদ করে ফলেছেন ? তিনি উত্তর দিতেন : না। বরং শাম দেশের লোকজন আমার ওপর এ অত্যাচার করেছে। শাম দেশীয় একদল লোক আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরের সমস্ত আসবাব পত্র নিয়ে যায়। তারপর আরেক দল প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে কোনো আসবাবপত্র না পেয়ে আমার দাড়ি নির্মম ভাবে উপড়ে ফেলে ,যা তোমরা প্রত্যক্ষ করছো। এ সব দুষ্ট লোক এভাবে আরো কত যে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।

এ সব জালিম অশুভ ও ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে মুক্তি পায়নি। বর্ণিত আছে যে ,যখন পাপিষ্ঠ মুসলিম ইবনে উকবা মদীনাবাসী থেকে জোরপূর্বক ইয়াযীদের জন্য বাইআত নিচ্ছিল ,তখন অধিকাংশ লোক ভয়ে বাইআত গ্রহণ করে আনুগত্যের স্বীকৃতি দেয়। এ সময় কুরাইশ বংশীয় একজন লোক বলে : আমি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর বাইআত করেছি গুনাহের ওপর নয়। এ কথা বলায় মুসলিম তার বাইআত কবুল না করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। তিনি যখন শহীদ হয়ে যান তখন তার মাতা আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করেন ,যদি আল্লাহ তা আলা আমাকে শক্তি দান করেন ,তবে আমি এ পাপিষ্ঠ মুসলিমকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় জ্বালিয়ে ফেলব।

উল্লেখ্য যে ,হতভাগা মুসলিম মদীনা মুনাওয়ারায় লুটপাট এবং হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত করার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য মক্কাভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। তখন পূর্ব থেকে সে যে রোগে আক্রান্ত ছিলো তিনদিন পর সে রোগেই মৃত্যু বরণ করে জাহান্নামে পৌছে যায়। এ সময় ঐ স্ত্রীলোক তার শপথ মোতাবেক তিনজন গোলামকে সাথে নিয়ে মুসলিমের কবরে উপস্থিত হয়। যখন কবর খনন করা হয় তখন দেখা গেল যে ,একটি বিরাট সাপ তার গর্দান বেষ্টন করে নাকের হাড় চুষে খাচ্ছে। লোকেরা এ অবস্থা দর্শনে ভীত হয়ে পড়ে। তারা সকলে ঐ স্ত্রীলোককে বলল : আল্লাহ তা আলা তার অপকর্মের শাস্তি প্রদান করেছেন এবং তোমার তরফ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তাই এ শাস্তিই যথেষ্ট । ঐ স্ত্রীলোক বলল : না ,এটা হবে না। খোদার শপথ গ্রহণ করে আমি যে পণ করেছি তা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পূর্ণ করব না ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করব না। অতঃপর স্ত্রীলোকটি বলল : তাকে তার পায়ের দিক থেকে বের কর। কিন্তু দেখা গেল- তার পায়েও অপর একটি সাপ বেষ্টন করে আছে। এরপর স্ত্রীলোকটি অজু করে দু রাকাআত নামায পড়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করল : খোদাওন্দ করীম! আপনি জানেন ,মুসলিম ইবনে উকবার ওপর আমার রাগ একমাত্র আপনারই সন্তুষ্টির জন্য। সুতরাং আপনি আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমি তাকে কবর থেকে বের করো জ্বালিয়ে দিতে পারি। এরপর একখণ্ড গাছের টুকরা নিয়ে সাপের লেজে আঘাত করায় সাপ চলে যায়। অতঃপর সে লাশটি কবর থেকে বের করে জ্বালিয়ে দেয়।

ওয়াকেদী বলেন : আমর যাচাই মতে উক্ত স্ত্রীলোক ছিল ইয়াযীদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে যমআ র মাতা । যখন মুসলিম ইবনে উকবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কায় যাচ্ছিল তখন এ স্ত্রীলোকও তার পিছনে ধাওয়া করে । যখন মুসলিমের সংবাদ তার কাছে পৌছে তখন সত্বর সে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং মুসলিম ইবনে উকবাকে কবর থেকে বের করে শূল বিদ্ধ করে ।

জাহহাক বলেন : যে সব লোক মুসলিম ইবনে উকবাকে শূল বিদ্ধ অবস্থায় দেখেছে তারাই আমার কাছে এসে বর্ণনা করেছে যে ,লোকেরা তার ওপর পাথরও নিক্ষেপ করেছে। এ রেওয়ায়েতের মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়ার কথা নেই ,হতে পারে শূল বিদ্ধ করার দু তিন দিন পরে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং যে ব্যক্তি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন সম্ভবত তিনি জ্বালিয়ে দেয়ার আগে তাকে শূলিতে দেখেছেন।

আল্লামা কুরতবী বলেন : মুসলিম ইবনে উকবা হাররার তিন দিন পর মারা যায়। মদীনা মুনাওয়ারার পথে রক্ত এবং পুজে তার পেট পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নিতান্ত খারাপ অবস্থায় সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। মৃত্যুকালে সে অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার সাথে বলে : হে আল্লাহ ! কালেমায়ে শাহাদাতের পরে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় নেক আমল ,যা আপনার দরবারে গ্রহণযোগ্য বলে আমার ধারণা ,তা মদীনাবাসীকে হত্যা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন যদি আমার এমন নেক আমল সত্বেও আপনি আমাকে দোযখে নিয়ে যান তবে আমার মতো হতভাগা আর কেউ হতে পারেনা

এর পর মুসলিম ইবনে উকবা হোসাইন ইবনে নুমাইরকে ডেকে এনে বলল : আমীরুল মু মিনীন (ইয়াযীদ ) আমার পরে তোমাকেই প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছে। তুমি অতি সত্বর মক্কায় পৌছে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাজ সম্পন্ন কর। তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে কোনোরূপ দ্বিধা করবে না। কামানের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করবে। যদি সে কাবা গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে এতেও কোনো পরোয়া করো না ,কামান দাগিয়ে যাও । এ বদবখতের নির্দেশমতো হোসাইন ইবনে নুমাইর চল্লিশ দিন (অপর এক রেওয়ায়েত মতে চৌষট্টি দিন) যাবৎ মক্কা শরীফকে ঘেরাও করে রাখে এবং ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয় ,আর কা বা শরীফের দিকে কামানের গোলা ছোড়ে ।

বর্ণিত আছে যে ,এক ব্যক্তি বর্শার মাথায় আগুন লাগিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে এবং হঠাৎ দম্কাকা হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় কা বাগৃহে আগুন ধরে যায়। ইতোমধ্যে ইয়াযীদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ,সে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এ সংবাদ শ্রবণের পর শামদেশীয় এবং বনী উমাইয়্যার লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ে। অতঃপর সবাই অপমানের বোঝা নিয়ে পরাজয় বরণ করে পলায়ন করে ।

উল্লেখ্য যে , হাররা র ঘটনা তেষট্টি হিজরীর জিলহজ্ব মাসের সাতাশ অথবা আটাশ তারিখ বুধবারে সংঘটিত হয়। মুসলিম ইবনে উকবা চৌষট্টি হিজরীর মুহররম মাসের প্রথম তারিখে মারা যায়। মক্কার সংঘর্ষও কামানের দ্বারা বাইতুল্লাহ শরীফে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে চৌষট্টি হিজরীর তেসরা রবিউসসানী শনিবারে। হাররা র ঘটনার পর রবিউসসানীর প্রথম তারিখে ইয়াযীদের মৃত্যু হয়। সাদী কিতাবুল ওয়াফা নামক গ্রন্থে এভাবই উল্লেখ করেছেন।

অনুবাদ :মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জববার

পীরসাহেব বায়তুশ শরফ

সৌজন্যে : জয়ুল কুলুব ইলা দিয়ারিল

মাহবুব- হযরত মাওলানা শাহ আবদুল হক দেহলভী (রহ.)

কারবালার পর পবিত্র মক্কা ও মদীনায় ইয়াযিদী তাণ্ডবলীলা

মাওলানা শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)

[ইয়াযীদ মুসলিম জাহানের ক্ষমতারোহণ করে মাত্র সাড়ে তিন বছর রাজত্ব করে । তার দ্বারা মুসলমানদের কোনো উপকার হয়নি ;বরং যা হয়েছে তা হলো চরম দুঃখ ,লাঞ্ছনা ও লোমহর্ষক গঞ্জনা। তার সৈন্যরা প্রথম বছর কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.) -কে বাহাত্তর জন সঙ্গী- সাথীসহ হত্যা করে ,দ্বিতীয় বছর পবিত্র মদীনা শরীফে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং তৃতীয় বছর পবিত্র মক্কা নগরীকে দু মাস ধরে অবরুদ্ধ রেখে পবিত্র কাবা গৃহে অগ্নি সংযোজন করে । এখানে আমরা কারবালার পর ইয়াযীদ বাহিনী কর্তৃক মদীনা ও মক্কায় যে হত্যালীলা ও লোমহর্ষক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তার কিয়দংশ বর্ণনার আশা রাখি।]

কারবালায় হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পরে মদীনায় ইয়াযীদ কর্তৃক যে লোমহর্ষক ও মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয় এটাই হাররা র ঘটনা নামে অভিহিত। এ স্থানটি মদীনা নগরী থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত। মদীনা তৈয়বাতে যে সব হত্যাকাণ্ড ,সংঘর্ষ ও এ পবিত্র স্থানের অবমাননার ঘটনা ঘটেছে সে সব ঘটনা বর্ণনার দ্বারা যদিওবা পবিত্র অন্তর বিশিষ্ট লোকদের অন্তর দুঃখভারাক্রান্ত হয় ,কিন্তু হুজুর আকরাম (সা.) এ সমুদয় অঘটনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন ,তাই এ সম্পর্কে এখানে কিঞ্চিত আভাস দেয়া দরকার । যেমন তিনি এরশাদ করেছেন -যে ব্যক্তি মদিনাবাসীকে কষ্ট দেবে এবং ভীতসন্ত্রস্ত করবে ,সে দুনিয়া ও আখিরাতের আযাবে গ্রেপ্তার হবে । হাররা এলাকায় যে অঘটন ঘটেছে হাদিস দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

কোনো কোনো আলেম বলেছেন যে , হাররা ঘটনা এ হাদিসের দ্বারাও সত্যায়িত করা হয়। তিনি এরশাদ করেছেন-মদীনা শরীফ আবাদ হওয়ার পর আবার বিরান হয়ে যাবে ,মানুষও এ স্থান ছেড়ে চলে যাবে এবং মরু এলাকার পশুপক্ষী এখানে এসে বসবাস করবে। কিন্তু বাস্তব এই যে ,মদীনার এ অবস্থা কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে দেখা দেবে ,ইমাম নববী কথা বলেছেন। কেননা ,কোনো কোনো হাদিসে যে সমুদয় বর্ণনা পাওয়া যায় ,এতে বুঝা যায় যে , হাররা র ঘটনায় এটা পরিলক্ষিত হয়নি। যেমন- ইবনে আবি শাইবা উল্লেখ করেছেন ,এ পবিত্র নগরী চল্লিশ বছর যাবৎ বিরান হয়ে পড়ে থাকবে। তথায় হিংস্র জন্তু এবং পশু-পাখি বসবাস করবে। অতঃপর মুজনিয়া গোত্রের দু জন রাখাল এখানে এসে অবাক হয়ে পরস্পরকে বলবে ,এখানকার জনপদ কোথায় গেল ? তারা সেখানে বন্য জীবজন্তু ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পাবে না । এতে বুঝা যায় যে ,এটা কিয়ামত পূর্বকালীন সময়ের ঘটনা হবে ।

হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে-মদীনার ওপর এমন এক সময় উপস্থিত হবে যে ,মদীনার বাসিদেরকে এ খান থেকে বের করে দেয়া হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : কে তাদেরকে বের করে দেবে ? এরশাদ করলেন : আমীরগণ । বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদিসে বর্ণিত আছে যে ,নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন : কুরাইশ গোত্রীয় লোকের হাতে আমার উম্মত ধ্বংস হবে । সাহাবাগণ আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! তখন আমাদের জন্য কী নির্দেশ ? এরশাদ করলেন : তখন তোমাদের একাকীভাবে জীবন যাপন করা উচিত। অপর এক হাদিসেও হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে যে ,হযরত (সা.) এরশাদ করেছেন : যে মহান সত্তার হাতে আমার জীবন ,তার শপথ করে বলছি ,মদীনায় এমন এক যুদ্ধ সংঘটিত হবে ,যার ফলে‘‘ দ্বীন’’ এখান থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে ,যেমন মাথা মুণ্ডনের ফলে চুল মাথা থেকে খসে পড়ে যায়। সেদিন তোমরা মদীনার বাইরে চলে যেও ,এক মনজিলের ব্যবধান হলেও । হযরত আবু হুরাইরাহ থেকে আরো বর্ণিত আছে যে ,তিনি এভাবে দোয়া করতেন : হে আল্লাহ ! আমাকে ষাট হিজরীর অঘটন এবং ছেলেদের রাজত্ব থেকে রক্ষা করুন। সে আসার পূর্বেই আমাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিন। এতে ইয়াযীদের হুকুমতের প্রতিই ইঙ্গিত রয়েছে । কেননা ,সে ষাট হিজরীতে সিংহাসনে আরোহণ করেছে এবং হাররা র ঘটনা তারই রাজত্বকালে সংঘটিত হয়েছে।

ওয়াকেদী হাররা নামক কিতাবে আইয়ুব ইবনে বশর থেকে বর্ণনা করেছেন-রাসূল (সা.) একদা সফর করে হাররা নামক স্থানে পৌছেন ,তখন দাড়িয়ে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়েন । এতে সাহাবাগণ মনে করলেন যে ,হয়ত সফরের পরিণতি শুভ হবে না। তাকে এ সম্পর্কে অবহিত করা হলো । হযরত ওমর (রা.) আরজ করলেন : হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ! আপনি কী ভেবে ইন্নালিল্লাহ পড়লেন ? তিনি বললেন : হাররার এ মরু প্রান্তরে আমার সাহাবাদের পরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । অপর এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে ,তিনি তার হস্ত মুবারকের দ্বারা ইশারা করে বললেন : এ হাররার মরু প্রান্তরে আমার উম্মতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হযরত কা বে আহবার থেকে বর্ণনা করেন যে ,হযরত কাব বলতেন , তাওরাত কিতাবে বর্ণিত আছে যে ,মদীনা মুনাওয়ারার পূর্বদিকের মরু প্রান্তরে উম্মতে মুহাম্মাদীয়া (সা.) -এর এমন কতক লোক শাহাদাত বরণ করবেন ,যাদের চেহারা চৌদ্দ তারিখের চাদের আলো থেকে উজ্জ্বল । ইবনে যুবলা থেকে বর্ণিত আছে- একদা আমিরুল মু মিনীন হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতের আমলে খুব বৃষ্টিপাত হয়। তখন তিনি তার বন্ধু বান্ধবসহ মদীনার বাইরে ভ্রমণে বের হয়েছিলেন । যখন হাররা নামক স্থানে পৌছেন এবং দেখতে পান যে ,চতুর্দিকে পানির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে ,তখন তার সাথী হযরত কাবে আহবার (রা.) শপথ গ্রহণ করে বললেন : এখানে যেভাবে পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে ,ঠিক এমনিভাবেই এখানে রক্ত প্রবাহিত হবে । হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন , এটা কোন সময়ে হবে ? তিনি উত্তর দিলেন : হে যুবাইরের পুত্র ! তুমি এর থেকে সতর্ক থেক যেন তোমার হস্ত-পদের দ্বারা এটা সংঘটিত না হয়।

সীরাত লেখক এবং ঐতিহাসিকরা সংক্ষেপ এবং বিস্তারিতভাবে এ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের উদ্ধৃতিসমূহ নিম্নে পেশ করা হলো যাতে আসল ঘটনা অস্পষ্ট না থাকে।

কুরতবী বলেন : মদীনাবাসীর মদীনা থেকে বাইরে চলে যাওয়ার কারণ এ হাররা র মর্মান্তিক ঘটনা । যেমন কোনো কোনো হাদিসে বর্ণিত আছে-যে সময় মদীনা শরীফ অবশিষ্ট সাহাবা এবং তাবেয়ী দ্বারা পরিপূর্ণ এবং লোক বসতিতে ভরপুর এবং তার চিত্তাকর্ষক সাদৃশ্য বিদ্যমান তখন মদীনাবাসীর ওপর একের পর এক বিপর্যয় এবং অঘটন নেমে আসে ফলে তারা মদীনা ছেড়ে বাইরে চলে যান। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে শাম দেশীয় এক বিশাল সৈন্য বাহিনী যুদ্ধ করার জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । সৈন্য বাহিনীর বদবখত লোকেরা তিন দিন পর্যন্ত মসজিদে নববীর সম্মান হানিকর কাজে লিপ্ত থাকে। এ কারনেই একে হাররা র ঘটনা বলা হয়। এটা শহর থেকে এক মাইল দূরে অবস্থিত।

এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদের কুচক্রী দল শিশু এবং নারী ব্যতীত মদীনার বিশিষ্ট ও সম্মানিত বার হাজার চারশ সাতানব্বই জন লোককে হত্যা করে ।

মদীনায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে শহীদানের তালিকা

1. মুহাজির,আনসার ,তাবেয়ীন ,উলামা- 1700 জন

2. সাধারণ লোক 10 ,000 জন

3. কুরআনের হাফিজ 700 জন

4. কুরাইশ 97 জন

সর্বমোট = 12 ,497 জন

হাররাহ এ লোমহর্ষক ঘটনা ছাড়া ও ইয়াযীদের সৈন্যরা নানা প্রকার অত্যাচার ,অনাচার ও ধৃষ্টতাপূর্ণ অপকর্মে লিপ্ত হয় এবং জেনার মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বর্ণিত আছে যে ,এ ঘটনার পর এক হাজার অবৈধ সন্তান প্রসব করে । এ সব পাপিষ্ঠ লোক মসজিদে নববীর অমার্জনীয় অবমাননা করে । এ পবিত্র স্থানকে তারা ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে । হুযুর আকরাম (সা.) -এর রওজায়ে পাক এবং মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান (যার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে ,এখানে বেহেশতের বাগান সমূহের একটি বাগান আছে) ঘোড়ার মলমূত্র দ্বারা কলুষিত করে । আর লোকদের থেকে ইয়াযীদের জন্য এভাবে বাইআত নেয়া হয় যে ,ইয়াযীদ যদি ইচ্ছা করে ,তাদেরকে বিক্রয় করতে পারবে অথবা স্বাধীনভাবেও রাখতে পারবে। সে যদি ইচ্ছে করে আল্লাহর বন্দেগীতেও রাখতে পারবে অথবা তার নাফরমানি করারও নির্দেশ দিতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যমা (রা.) যখন ইয়াযীদকে বললেন যে ,বাইআততো অন্ততঃপক্ষে কুরআন ও সুন্নাতের ওপর গ্রহণ করা চাই। তখনই ইয়াযীদ তাকে হত্যা করে ফেলে।

ইমাম কুরতবী বলেন-ঐতিহাসিকরা লিখেছেন যে ,মদীনা মুনাওয়ারা তখন জন শূন্য হয়ে যায়। তখন মরুর পশুপাখিরা তথায় মলমুত্র ত্যাগ করত। মসজিদে নববী কুকুরের বাসস্থানে পরিণত হয়। এ সকল ঘটনা দ্বারা হুজুর (সা.) -এর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়।

তাবরানী হযরত উরওয়া ইবনে যুবাইর থেকে রেওয়ায়েত করেন যে ,হযরত মু আবিয়া (রা.) -এর ইন্তিকালের পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) ইয়াযীদের বাইআত এবং আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং তার নিন্দাবাদ করতে থাকেন। ইয়াযীদ এ কথা শ্রবণে শপথ নিয়ে বলল : খোদার কসম ,আমি আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর গলায় বেড়ী পরাব। অতঃপর সে একজন দূত মারফত তাকে ডেকে পাঠায়। দূত এসে তাকে বলল : আপনি রৌপ্যের একটি ফাদ তৈরী করুন এবং ইয়াযীদের শপথ পূরণকল্পে গলার মধ্যে তা ঝুলিয়ে দিন ,আর এই ওপর স্বীয় কাপড় পরিধান করুন ,তবে আশা করি আপনি রক্ষা পাবেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) বললেন : আল্লাহ তাআল কখনও তার শপথকে বাস্তবায়িত করবেন না। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও আত্মসমর্পণ করবো না। যতক্ষণ শক্ত পাথর দাতের নিচে নরম হবে না। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) জনগণকে তার বাইআত গ্রহণ ও আনুগত্য স্বীকারের দাওয়াত দিতে লাগলেন।

এ দিকে পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার নেতৃত্বে এক বিশাল সেনাবাহিনী শাম (সিরিয়া) থেকে মদীনা অভিমুখে প্রেরণ করে । তাদেরকে সে এ নির্দেশ দিয়েছিল যে ,মদীনাকে ধ্বংস করে দেয়ার পর মক্কায় চলে যাবে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে হত্যা করবে। মুসলিম ইবনে উকবা যখন মদীনায় পৌছে তখন সকল সাহাবায়ে কেরাম মদীনা শরীফের বাইরে চলে গেলেন। মুসলিম ইবনে উকবা অবশিষ্ট লোকদের হত্যা করার পর মক্কা শরীফ অভিমুখে যাত্রা করল। পথিমধ্যে সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এ সময় সে হোসাইন ইবনে নুমাইর কিন্দিকে স্বীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -কে অবরোধ করার জন্য পবিত্র মক্কায় কামানের গোলা নিক্ষেপ এবং অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দেয়। হোসাইন পথিমধ্যে থাকাকালেই ইয়াযীদের মৃত্যু সংবাদ পৌছে । হোসাইন পালিয়ে গেল এবং সে তার প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে পারল না।

ইবনে জওযী বলেন ,বাষট্টি হজরীতে ইয়াযীদ তার চাচাত ভাই উসমান ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবু সুফিয়ান তার বাইআত গ্রহণের জন্য মদীনায় প্রেরণ করে । উসমান মদীনাবাসীর একটি দলকে ইয়াযীদের নিকটে পাঠিয়ে দেন। যখন তারা ইয়াযীদের কাছ থেকে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন ,তখন তারা ইয়াযীদকে গালিগালাজ করতে লাগলেন ও বললেন যে ,সে ধর্মদ্রোহী ,মদখোর ,ফাসিক । সে কুকুর পালন করে । এ কথা বলে তারা তার বাইআত বর্জন করলেন। ইয়াযীদের নিকট গমনকারী লোকদের মধ্যে হযরত মুনযের (রা.)ও ছিলেন । তিনি বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে। সে আমাকে একলক্ষ দিরহাম অনুদান দিয়েছে। কিন্তু এজন্য আমি সত্যকে পরিত্যাগ করতে পারিনি। সে মদ্যপায়ী ও বেনামাযী। তার মুখ থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথেই লোকজন তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালার হাতে বাইআত গ্রহণ করল আর উসমানকে মদীনা থেকে বের করে দিল। আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) বলতেন : যদি আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষণের আশংকা না করতাম ,তবে ইয়াযীদের বাইআত প্রত্যাখ্যান করতাম না এবং তার মোকাবিলা করার ঝুকি গ্রহণ করতাম না। ইবনে জওযী আবদুল হাসান মাদাহেনী থেকে বর্ণনা করেন যে ,ইয়াযীদের পাপাচার এবং কর্মসমূহ প্রকাশিত হওয়ার পর মদীনাবাসী মিম্বরের ওপর আরোহণ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হাফস মাখযুমী মাথা থেকে পাগড়ি নিক্ষেপ করে বললেন : ইয়াযীদ আমার বড় উপকার করেছে এবং আমাকে বিশেষ অনুদানে সম্মানিত করেছে কিন্তু সে আল্লাহর শত্রু এবং মদপানে আসক্ত ব্যক্তি ;আমি তার বাইআত এভাবে প্রত্যাখ্যান করলাম যেভাবে এ পাগড়িকে নিক্ষেপ করেছি । এক ব্যক্তি দাড়িয়ে জুতা নিক্ষেপ করে তার বাইআত প্রত্যাখ্যান করল। এভাবে পাগড়ি এবং জুতাতে মজলিস ভরে গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) কে কুরাইশের এবং আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) কে আনসারের প্রশাসক নিযুক্ত করা হলো ।

উমাইয়্যা বংশীয় লোকদেরকে মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ করা হলো । উমাইয়্যাগণ তাদের এ দুরবস্থার সংবাদ ইয়াযীদের কাছে পাঠিয়ে সৈন্য দিয়ে সাহায্যের আবেদন জানায়। ইয়াযীদ তাদের সাহায্যার্থে মুসলিম ইবনে উকবাকে মদীনায় প্রেরণ করে । এ হতভাগা যদিও বৃদ্ধ ,কিন্তু মদীনাবাসীকে রক্ত স্রোত প্রবাহিত করার ঝুকি গ্রহণ করে । অতঃপর ইয়াযীদ এ কথাও ঘোষণা করে যে ,যে ব্যক্তি হেজাযে গমন করবে তাকে যুদ্ধের অস্ত্র-শস্ত্র এবং সফরের যাবতীয় আসবাবপত্র ছাড়াও একশ দিনার করে বখশিস দেয়া হবে । এ ঘোষণা শুনে বার হাজার লোক হেজায গমনে রাজি হয়ে গল। এ সব লোককে সেখানে প্রেরণ করে ইবনে ফারজানাকে নির্দেশ দিল যে ,তুমি তথায় গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর সাথে যুদ্ধ কর। তিনি চিন্তা করতে লাগলেন এবং বললেন , আল্লাহর শপথ ,একজন ফাসেকের সন্তুষ্টির নিমিত্তে আমি পয়গম্বর আলাইহিস সালামের একজন আওলাদের হত্যা এবং হেরেম শরীফে আল্লাহর ঘরের মধ্যে লড়াইয়ের ঝুকি নিতে পারি না। এরপর সে মুসলিম ইবনে উকবাকে সেখানে পাঠিয়ে দেয়। সে তাকে নির্দেশ দেয় যে ,যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে হোসাইন ইবনে নুমাইরকে তোমার প্রতিনিধি নিযুক্ত করবে। সে আরও নির্দেশ দিল যে ,যার বিরুদ্ধে তোমাকে পাঠানো হচ্ছে তাকে তিনবার দাওয়াত দেবে ,যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তবে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি দাওয়াত কবুল না করে ,তবে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। বিজয় লাভ করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

সেখানে সম্পদ ,অস্ত্র এবং খাদ্য ইত্যাদি যা কিছু পাও তা সৈন্যদের জন্য হালাল করে দাও । তিনদিন পর যুদ্ধ থেকে বিরত থাকবে। হযরত হোসাইনের পুত্র হযরত আলী ওরফে যায়নুল আবেদীনের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। কেননা ,তিনি ঐ দলকে সমর্থন করেন না। যখন মদীনাবাসীর নিকট এ খবর পৌছে তখন মদীনাবাসী সমবেতভাবে ইয়াযীদের সৈন্যদের মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন । বনী উমাইয়্যার যে দলটি মারওয়ানের গৃহে অবরুদ্ধ ছিল ,তারা তাদের নিকট গিয়ে বললেন : তোমরা এ কথার প্রতিশ্রুতি দাও যে ,তোমরা ধোকাবাজি ,প্রতারণা এবং গোয়োন্দাগিরি করবে না এবং আমাদের শত্রুদের কোনো প্রকার সাহায্য -সহযোগিতা করবে না। তাহলেই আমরা তোমাদেরকে ছেড়ে দিতে পারি ;অন্যথায় আমরা তোমাদেরকে হত্যা করব। বনী উমাইয়্যার ঐসব লোক মুনাফিকী করে মদীনাবাসীর সাথে শামিল হয়ে মুসলিম ইবনে উকবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেরিয়ে আসে। মারওয়ান ইবনে হাকাম গোপনে স্বীয় পুত্রকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট প্রেরণ করে এ কথা বলে যে ,মদীনায় পৌছে তিনদিন যেন যুদ্ধ স্থগিত রাখে। তিনদিন পর মারওয়ান মদীনাবাসীর সাথে পরামর্শ করে তাদেরকে বলল : তোমরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ ? তারা বললেন : যুদ্ধ ব্যতীত গতি নেই।

মারওয়ান বলল : যুদ্ধ করা উচিত হবে না। এতে ফাসাদ বড়ে যাবে। ইয়াযীদের হাতে বাইআত করাই আমি সমীচীন বলে মনে করি। কিন্তু মদীনাবাসী তা পছন্দ করলো না এবং ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মদীনার বাইরে চলে গেলেন ।

এক দিকে আবদুল্লাহ ইবনে হানযালা (রা.) যুদ্ধের ময়দানে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন ,অপর দিকে মুসলিম ইবনে উকবা বার্ধক্য জনিত কারণে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে স্বীয় সেনাবাহিনীকে উৎসাহিত করছিলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুতী (রা.) তার সাত পুত্র সহকারে শত্রুর মোকাবিলা করে শাহাদাত বরণ করেন। মুসলিম ইবনে উকবা তার মস্তক মুবারক দ্বিখণ্ডিত করে ইয়াযীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়। অবশেষে ইয়াযীদ বাহিনী বিজয় লাভ করে । ইয়াযীদের সৈন্য বাহিনী তার নির্দেশ মোতাবেক মদীনা মুনাওয়ারায় তিনদিন পর্যন্ত অত্যাচার ,অবিচার ও ব্যভিচার চালায় ,সম্পদ লুটপাট করে এবং জেনার মতো জঘন্য কার্যে লিপ্ত হয়।

ওয়াকেদী বলেন : যখন ইয়াযীদের সেনাবাহিনী মদীনার নিকট পৌছে তখন মদীনাবাসী পরস্পরের পরামর্শক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মতো মদীনার চতুর্দিকে দীর্ঘ পনের দিন অত্যন্ত দুঃখ কষ্ট সহকরে পরিখা খনন করেন। মদীনার চতুর্দিকে তারকটার বেড়া লাগিয়ে দেন এবং দুশমনের পথ অবরোধ করে চতুর্দিক থেকে তাদের ওপর তীর ও পাথর নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে শাম বাহিনী মদীনায় প্রবেশ করতে বাধার সম্মুখীন হয়। অবস্থা বেগতিক দখে মুসলিম ইবনে উকবা ভীত হয়ে হাররা র এক কোণায় অবস্থান করে এবং মারওয়ানের নিকট এ মর্মে লোক প্রেরণ করে যে ,যুদ্ধে জয়লাভ করার কোনো একটা পথ বের করতে ,যাতে সফলকাম হওয়া যায়। মারওয়ান বনী হারেসার নিকট গমন করে তাদেরকে লোভ-লালসায় আকৃষ্ট করে মদীনার একদিকের রাস্তা খুলে দিল। ইয়াযীদের সেনাবাহিনী সে পথ দিয়ে মদীনায় প্রবেশ করে এবং মদিনাবাসী অপর দিক থেকে গুটিয়ে এসে শুধু সে দিকে এসেই যুদ্ধে লিপ্ত হন।

ইবনে আবি খাইসামা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে ,মদীনার লোকজন বর্ণনা করেন যে ,হযরত মু আবিয়া তার মৃত্যুকালে ইয়াযীদকে ডেকে বলে ছিলেন : আমার মনে হয় মদীনাবাসীর সাথে একদিন তোমাকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে । সে সময় তুমি মুসলিম ইবনে উকবার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে নিও ! কেননা ,এ ব্যাপারে তার চেয়ে অধিক বিশ্বস্ত আর কেউ নেই। পিতার মৃত্যুর পর যখন ইয়াযীদ সিংহাসনে আরোহণ করে তখন মদিনাবাসীর সাথে তার দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। সে পিতার নির্দেশ মতো এ সমস্যার সমাধান করে।

কথিত আছে যে ,এক বৃদ্ধা মুসলিম ইবনে উকবার নিকট এসে কেদে কেদে ফরিয়াদ করলেন : আমার পুত্র বন্দি হয়েছে ,আপনি তাকে মুক্তি দিন। সে তৎক্ষণাৎ নির্দেশ দিল যে ,তার ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার গর্দান দু টুকরা করে যেন মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। নির্দেশমত কাজ করা হলো এবং বৃদ্ধার হাতে তার পুত্রের মস্তক সোপর্দকরে তাকে বলে দেয়া হলো , তুমি নিজের জীবনের মঙ্গল না চেয়ে পুত্রকে রেহাই দানের সুপারিশ করাতেই এ পরিণতি হয়েছে।

হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যেব যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন তাকে মুসলিম ইবনে উকবার নিকট হাজির করা হয়। সে তাকে বলল : ইয়াযীদের বাইআত গ্রহণ কর। তিনি বললেন : আমি আবু বকর (রা.) এবং উমর (রা.) এর নীতি মোতাবেক বাইআত করেছি। এ সময় একজন লোক দাড়িয়ে বলল : এ একজন পাগল। এ কথা বলার পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। মুসলিম ইবনে উকবা হত্যাকাণ্ডে এবং ফিতনা-ফাসাদে অতিশয় সীমালঙ্ঘনকারী ছিল বিধায় স মাসরিফ (সীমালঙ্ঘনকারী) নামে অভিহিত ছিল ।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক ওয়াকেদী তার কিতাবুল হাররা নামক গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে ,একদা ইয়াযীদ মুসলিমের নিকট এসে দেখতে পায় যে ,সে অর্ধাঙ্গ রোগে আক্রান্ত। ইয়াযীদ তাকে লক্ষ করে বলল : যদি তুমি দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত না হতে তবে আমি তোমাকে মদীনা অভিযানে প্রেরণ করতাম । কেননা ,আমি তোমার চেয়ে আর কাউকে আমার একনিষ্ঠ ভক্ত বলে মনে করিনা । আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মু আবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান আমাকে তার মুমূর্ষ অবস্থায় অসিয়ত করেছেন : যদি হেজাযবাসীর সাথে তোমার কোনো অঘটন ঘটে তবে তুমি মুসলিম ইবনে উকবার নিকট তোমার সমস্যার সমাধান চেয়ে নেবে’’ এ কথা শোনামাত্র মুসলিম ইবনে উকবা উঠে দাড়ায় এবং বলে : হে আমীরুল মু মিনীন! আপনাকে শপথ দিয়ে বলছি- একাজ আমি ব্যতীত আর কারও ওপর ন্যস্ত করবেন না। কেননা ,আমার থেকে মদীনাবাসীর আর কোনো বড় শত্রু নেই। এ সম্পর্কে আমি একটি স্বপ্নও দখেছি যে ,জান্নাতুল বাকীর একটি বৃক্ষের শাখা-প্রশাখাসহ হযরত উসমান (রা.) এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার ফরিয়াদ করছেন। আমি যখন বৃক্ষটির নিকটে যাই তখন বলতে শুনলাম ,এ কাজ মুসলিম ইবনে উকবার দ্বারাই সম্পন্ন হবে । সে দিন থেকে আমার অন্তরে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে ,আমিই মদিনাবাসীকে হত্যা করব এবং এ আশায় মনকে সান্তনা দিয়েছি এই বলে- আমিই হযরত উসমান (রা.) -এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করব। যখন ইয়াযীদ মুসলিম ইবনে উকবার মধ্যে এরূপ প্রেরণা ও আগ্রহ দেখতে পেল- তখন তাকে নির্দেশ দিল : সত্বর প্রতিশোধ গ্রহণ কর এবং আল্লাহর নাম নিয়ে মদীনা অভিমুখে যাত্রা কর। যদি মদীনায় প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হও এবং বাইআত গ্রহণে মদিনাবাসী রাজি না হয় ,তবে তুমি ছোট-বড় নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করবে। তিনদিন পর্যন্ত একাজ চালিয়ে যাবে। কাউকে বাদ দেবে না। আর তাদের ধন-সম্পদ লুটপাট করে নেবে। অবশ্য যদি তারা বাইআত স্বীকার করে তবে তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না। সেখান থেকে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাছে চলে যাবে এবং তার কাজ সম্পন্ন করবে।

বর্ণিত আছে যে ,মদীনার হেরেমের শহীদগণকে দর্শন করে সে বলত : আমি এ সব লোককে হত্যা করার পরও যদি দোযখে যাই তবে আমার থেকে হতভাগা আর কেউ নেই।

মারওয়ানের গোলাম যাকওয়ান বলে : একদা মুসলিম ইবনে উকবা রোগের ঔষধ সেবন করার পর খাবার তলব করল। অথচ ডাক্তার তাকে নিষেধ করে ছিল যে ,ঔষধ সেবনের পর খাদ্য গ্রহণ করলে ঔষধ ক্রিয়াশীল হবে না। সে বলল : এখন আমি জীবিত থাকার আর কোনো আশা করবনা। কারণ ,আমি তো হযরত উসমান (রা.) এর হত্যাকারীদের প্রতিশোধ গ্রহণ করে এখন স্বস্তিবোধ করছি । আমার অন্তরের বাসনা পূর্ণ হয়েছে। মৃত্যু ব্যতীত এখন আমার কাছে আর কোনো কিছু প্রিয় নেই। এখন মৃত্যুই আমার কাছে সবেচেয়ে প্রিয়। আমার বিশ্বাস এ সব নাপাককে হত্যা করার ফলে আল্লাহ তা আলা আমার সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন’’ সৈয়দ আলাহির রহমত বলেন : তার গুনাহ মার্জনার ধারণা নিতান্ত মুর্খতা ,অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক ;কেননা ,আল্লাহর রহমত প্রাপ্ত এমন একদল বিশিষ্ট সাহাবায়ে করামকে হত্যা করা এমন এক অপরাধ ও পাপের কাজ ,যা ক্ষমা করা দূরের কথা এই অশুভ পরিণতি থেকে তার রেহাই পাওয়াও অসম্ভব ;এ তার দুঃস্বপ্ন মাত্র।

যে সব সাহাবায়ে কেরামকে মদীনায় জোরপূর্বক অমানুষিকভাবে হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন ফেরেশতা কর্তৃক গোসলপ্রাপ্ত হযরত হানযালা (রা.) -এর পুত্র হযরত আবদুল্লাহ (রা.) । তিনি তার সাত পুত্রসহ শহীদ হন। আর রয়েছেন রাসূল (সা.) -এর অজুর বর্ণনা প্রদানকারী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যাইদ (রা.) ও হযরত মাকল ইবনে সিনান (রা.) ,যিনি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে উপস্থিত ছিলেন এবং স্বীয় গোত্রের পতাকা বহন করেন।

ইবনে জওযী সনদের সূত্র ধরে সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব থেকে বর্ণনা করেন ,তিনি বলেছেন : হাররার অঘটনের সময়ে রাত্রিতে আমি ব্যতীত আর কেউ মসজিদে নববীতে উপস্থিত হতো না। শাম দেশীয় লোকজন আমাকে মসজিদে দেখে বলত ,এ পাগল বুড়ো! এখানে কী করছো ? প্রত্যেক নামাযের সময় রাসূলে পাক (সা.) -এর হুজরা শরীফ থেকে আযান ,ইকামাতের আওয়াজ শুনে আমি নামায পড়তাম।

হাররা র এ হৃদয় বিদারক ঘটনার প্রাক্কালে ইয়াযীদ বাহিনীর হাতে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু সাইদ খুদরী (রা.) সর্বশেষ লাঞ্চিত হন। বর্ণিত আছে যে ,এ গুণ্ডাবাহিনী তার দাড়ি মোবারক গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে। লোকেরা তার দাড়ির এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করতো : আপনি কি দাড়ি নিয়ে খেলেছেন এবং দাড়ি উচ্ছেদ করে ফলেছেন ? তিনি উত্তর দিতেন : না। বরং শাম দেশের লোকজন আমার ওপর এ অত্যাচার করেছে। শাম দেশীয় একদল লোক আমার ঘরে প্রবেশ করে ঘরের সমস্ত আসবাব পত্র নিয়ে যায়। তারপর আরেক দল প্রবেশ করে ঘরের মধ্যে কোনো আসবাবপত্র না পেয়ে আমার দাড়ি নির্মম ভাবে উপড়ে ফেলে ,যা তোমরা প্রত্যক্ষ করছো। এ সব দুষ্ট লোক এভাবে আরো কত যে অবর্ণনীয় নিপীড়ন ও নির্যাতন চালিয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।

এ সব জালিম অশুভ ও ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে মুক্তি পায়নি। বর্ণিত আছে যে ,যখন পাপিষ্ঠ মুসলিম ইবনে উকবা মদীনাবাসী থেকে জোরপূর্বক ইয়াযীদের জন্য বাইআত নিচ্ছিল ,তখন অধিকাংশ লোক ভয়ে বাইআত গ্রহণ করে আনুগত্যের স্বীকৃতি দেয়। এ সময় কুরাইশ বংশীয় একজন লোক বলে : আমি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর বাইআত করেছি গুনাহের ওপর নয়। এ কথা বলায় মুসলিম তার বাইআত কবুল না করে তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয়। তিনি যখন শহীদ হয়ে যান তখন তার মাতা আল্লাহর নামে শপথ গ্রহণ করেন ,যদি আল্লাহ তা আলা আমাকে শক্তি দান করেন ,তবে আমি এ পাপিষ্ঠ মুসলিমকে মৃত অথবা জীবিত অবস্থায় জ্বালিয়ে ফেলব।

উল্লেখ্য যে ,হতভাগা মুসলিম মদীনা মুনাওয়ারায় লুটপাট এবং হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত করার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য মক্কাভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। তখন পূর্ব থেকে সে যে রোগে আক্রান্ত ছিলো তিনদিন পর সে রোগেই মৃত্যু বরণ করে জাহান্নামে পৌছে যায়। এ সময় ঐ স্ত্রীলোক তার শপথ মোতাবেক তিনজন গোলামকে সাথে নিয়ে মুসলিমের কবরে উপস্থিত হয়। যখন কবর খনন করা হয় তখন দেখা গেল যে ,একটি বিরাট সাপ তার গর্দান বেষ্টন করে নাকের হাড় চুষে খাচ্ছে। লোকেরা এ অবস্থা দর্শনে ভীত হয়ে পড়ে। তারা সকলে ঐ স্ত্রীলোককে বলল : আল্লাহ তা আলা তার অপকর্মের শাস্তি প্রদান করেছেন এবং তোমার তরফ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। তাই এ শাস্তিই যথেষ্ট । ঐ স্ত্রীলোক বলল : না ,এটা হবে না। খোদার শপথ গ্রহণ করে আমি যে পণ করেছি তা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি পূর্ণ করব না ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করব না। অতঃপর স্ত্রীলোকটি বলল : তাকে তার পায়ের দিক থেকে বের কর। কিন্তু দেখা গেল- তার পায়েও অপর একটি সাপ বেষ্টন করে আছে। এরপর স্ত্রীলোকটি অজু করে দু রাকাআত নামায পড়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করল : খোদাওন্দ করীম! আপনি জানেন ,মুসলিম ইবনে উকবার ওপর আমার রাগ একমাত্র আপনারই সন্তুষ্টির জন্য। সুতরাং আপনি আমাকে সুযোগ দিন যাতে আমি তাকে কবর থেকে বের করো জ্বালিয়ে দিতে পারি। এরপর একখণ্ড গাছের টুকরা নিয়ে সাপের লেজে আঘাত করায় সাপ চলে যায়। অতঃপর সে লাশটি কবর থেকে বের করে জ্বালিয়ে দেয়।

ওয়াকেদী বলেন : আমর যাচাই মতে উক্ত স্ত্রীলোক ছিল ইয়াযীদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে যমআ র মাতা । যখন মুসলিম ইবনে উকবা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.) -এর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কায় যাচ্ছিল তখন এ স্ত্রীলোকও তার পিছনে ধাওয়া করে । যখন মুসলিমের সংবাদ তার কাছে পৌছে তখন সত্বর সে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং মুসলিম ইবনে উকবাকে কবর থেকে বের করে শূল বিদ্ধ করে ।

জাহহাক বলেন : যে সব লোক মুসলিম ইবনে উকবাকে শূল বিদ্ধ অবস্থায় দেখেছে তারাই আমার কাছে এসে বর্ণনা করেছে যে ,লোকেরা তার ওপর পাথরও নিক্ষেপ করেছে। এ রেওয়ায়েতের মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়ার কথা নেই ,হতে পারে শূল বিদ্ধ করার দু তিন দিন পরে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং যে ব্যক্তি এ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন সম্ভবত তিনি জ্বালিয়ে দেয়ার আগে তাকে শূলিতে দেখেছেন।

আল্লামা কুরতবী বলেন : মুসলিম ইবনে উকবা হাররার তিন দিন পর মারা যায়। মদীনা মুনাওয়ারার পথে রক্ত এবং পুজে তার পেট পরিপূর্ণ হয়ে যায়। নিতান্ত খারাপ অবস্থায় সে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। মৃত্যুকালে সে অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার সাথে বলে : হে আল্লাহ ! কালেমায়ে শাহাদাতের পরে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় নেক আমল ,যা আপনার দরবারে গ্রহণযোগ্য বলে আমার ধারণা ,তা মদীনাবাসীকে হত্যা ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন যদি আমার এমন নেক আমল সত্বেও আপনি আমাকে দোযখে নিয়ে যান তবে আমার মতো হতভাগা আর কেউ হতে পারেনা

এর পর মুসলিম ইবনে উকবা হোসাইন ইবনে নুমাইরকে ডেকে এনে বলল : আমীরুল মু মিনীন (ইয়াযীদ ) আমার পরে তোমাকেই প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেছে। তুমি অতি সত্বর মক্কায় পৌছে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর-এর কাজ সম্পন্ন কর। তার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে কোনোরূপ দ্বিধা করবে না। কামানের সাহায্যে পাথর নিক্ষেপ করবে। যদি সে কাবা গৃহে আশ্রয় গ্রহণ করে তবে এতেও কোনো পরোয়া করো না ,কামান দাগিয়ে যাও । এ বদবখতের নির্দেশমতো হোসাইন ইবনে নুমাইর চল্লিশ দিন (অপর এক রেওয়ায়েত মতে চৌষট্টি দিন) যাবৎ মক্কা শরীফকে ঘেরাও করে রাখে এবং ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয় ,আর কা বা শরীফের দিকে কামানের গোলা ছোড়ে ।

বর্ণিত আছে যে ,এক ব্যক্তি বর্শার মাথায় আগুন লাগিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করে এবং হঠাৎ দম্কাকা হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় কা বাগৃহে আগুন ধরে যায়। ইতোমধ্যে ইয়াযীদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ,সে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। এ সংবাদ শ্রবণের পর শামদেশীয় এবং বনী উমাইয়্যার লোকজন চিন্তিত হয়ে পড়ে। অতঃপর সবাই অপমানের বোঝা নিয়ে পরাজয় বরণ করে পলায়ন করে ।

উল্লেখ্য যে , হাররা র ঘটনা তেষট্টি হিজরীর জিলহজ্ব মাসের সাতাশ অথবা আটাশ তারিখ বুধবারে সংঘটিত হয়। মুসলিম ইবনে উকবা চৌষট্টি হিজরীর মুহররম মাসের প্রথম তারিখে মারা যায়। মক্কার সংঘর্ষও কামানের দ্বারা বাইতুল্লাহ শরীফে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে চৌষট্টি হিজরীর তেসরা রবিউসসানী শনিবারে। হাররা র ঘটনার পর রবিউসসানীর প্রথম তারিখে ইয়াযীদের মৃত্যু হয়। সাদী কিতাবুল ওয়াফা নামক গ্রন্থে এভাবই উল্লেখ করেছেন।

অনুবাদ :মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জববার

পীরসাহেব বায়তুশ শরফ

সৌজন্যে : জয়ুল কুলুব ইলা দিয়ারিল

মাহবুব- হযরত মাওলানা শাহ আবদুল হক দেহলভী (রহ.)


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26