আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন0%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 73120
ডাউনলোড: 6657

আশুরা সংকলন
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 73120 / ডাউনলোড: 6657
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।

কাঁদে ফোরাতের নীর

সিরাজুল হক

এখনো শোকে মুহ্যমান নিশ্চল সেই ফোরাতের নীর ,

এখনো তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ে

কোটি মানুষের সেই ফোরাতের তীরে।

ওই মোনা যায় আমার ইমামের আহাজারি!

এখনো ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত ফোরাতের কূলে কূলে ,

আর বিলোড়িত কারবালার উষ্ণ বালুকণা

পবিত্র খুনে হয়েছে রঞ্জিত

কোন এক আশুরার দিনে।

বর্ষে বর্ষে আসে সেই দশই মুহররম ,আসে

শোণিত-সিক্ত পতাকার বেশে ,

আর হিংস্র ভয়াল থাবা শিমরের সহসা

আমার ব্যথাতুর পাজরে এসে বিধে।

গিয়েছে শিমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে ,

নিপাত গিয়েছে তার গুরু ইবনে জিয়াদ

আর ওমর বিন সাদ

ইয়াজিদের অনুসৃত পথে ,

সেতো প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড নরকের।

আমার ইমামের স্মৃতি লেখা আছে

স্বর্গের রাজতোরণে সোনালী-রক্তিম আখরে

চিরদিন :‘‘ শহীদকুল শিরমনি-বেহেশতে

শহীদানের সরদার’’ তিনি ।

ওগো ,ফোরাতের নীর আজো কাঁপে

বিষাদের ছাপ লেগে আছে তার নীলাভ অবয়বে-

বিষাক্ত তীরের আঘাতে যেন জরর্জরিত

বনের শোকার্ত পক্ষীকূল!

আজও শোকার্ত কারবালার লু-হাওয়া বয়

হেথা চারদিকে-তপ্ত নিঃশ্বাসের মতো ,

আমার ইমামের শোকে বিহবল অবিরত-

কুফা নগরী ,আর

দামেস্কে ইয়াজিদের স্বপ্নপুরী-

দ্বিখণ্ডিত শির তার স্থাপিত হয়েছিল যেখানে ।

ইয়াজিদের রঙিন স্বপ্ন সে দিন

হয়েছিল বিচুর্ণ-বিলীন ,

অভিশপ্ত আজ সে বিশ্ব লোকে ,

জালিমের পরিণাম কত যে করুণ

দেখে নিল এ বিশ্ববাসী আরেকবার

দামেস্কের রাজপুরীতে!

মজলুমের প্রতীক ,সত্য ন্যায় আর সংগ্রামের প্রতীক

আবু আবদুল্লাহ আল হোসাইন-মহাবীর ,

কারবালার মাটি গুমরে কাঁদে ,কাঁদে ফোরাতের নীর

কাঁদে শহীদের ঝাণ্ডাবাহী লক্ষ মানুষ

আজও দিকে দিকে এই পৃথিবীর।

সে চেতনায় অবগাহন

আবদুল মুকীত চৌধুরী

এক.

বলে ,এ যে রাহর দশা :ষোলকলার রাত!

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে ,মিথ্যা বাজীমাত!

গলাধাক্কা অর্ধচন্দ্রে দিন যাপনের গ্লানি-

বলে , দুষ্টগ্রহের ফেরে গোলক-জাড়া ঘানি!

কনুই-গুতো লাথি খেয়ে বুদ্ধুগুলো ভাবে ,

কী আনন্দ! সরাসরি বেহেশতেই যাবে !

আগ্রাসীদের আস্ফালনে পৃথিবী গোটা টলে

কালো রাতের যাত্রী সময় কুকড়ে হেটে চলে।

কাঠের পুতুল ,কুড়ের বাদশা কড়ায়-গণ্ডায়

দেখো ,কেমন আক্কেল-এর সেলামী দি যায়!

আত্মঘাতী গুতোগুতির এ মেষকুলে কবে

ভিটেয় ঘুঘু চরার আগে সুবুদ্ধিটা হবে !

আকাট মুর্খগুলো যেন আমড়া কাঠের ঢেকি

কলুর বলদ ,চিনির বলদ-গোড়ায় গলদ ,সে কী ?

দুই.

গলদটা সেই শুরুতেই এজিদী উত্থান ,

মিশিয়ে দিলো ধুলোয় সেদিন খোদার দীনের মান।

খুন ঝরালো ,ঘূণ ধরালো নবীর পতাকায়

আঘাত হানে সেই বিধানে শোকের কারবালায় !

ইমাম বিহীন সে মিম্বরে জাগে রোদন তার

আকুল আর্তি জাগে খোদা : বাচাও অধিকার।

রাষ্ট্র বিদায় ,সাম্য বিদায় -মানুষ প্রভু হয় ,

ইসলাম কি মানতে পারে এমন বিপর্যয় ?

তিন.

সে জিজ্ঞাসার খুজতে জবাব শতক শতক পার:

সে চেতনায় অবগাহন চাই যে পুনর্বার।

শাহাদাতের উজ্জীবনী ছড়ায় আলোর বান

জেগে ওঠার এই তো সময় ,রেঙেছে আসমান!

আশুরার দ্বি-প্রহর

মো.মোবারক আলী মোল্লা

দ্বি-প্রহর গড়াইয়া বিকাল হইল রক্তরাঙা রোজ আশুর

আকবর ,আজগার ,কাশেমও শহীদ ,শহীদ বাহাত্তুর।

অবশেষে যখন রহিল না কেহ অসুস্থ জয়নুল ছাড়া ,

চাপি দুল দুলে যুদ্ধ সাজ পরি ছুটালেন তিনি ঘোড়া।

শত-সহস্র কাফের কমবখত হারাইল তাদেরা প্রাণ ,

ছেড়ে নদী তীর অবশিষ্ট যারা ত্বরিৎ করে পলায়ন।

মুক্ত হইলো ফোরাতের কূল ,দেখিলেন স্বচ্ছ নীর ,

বাড়িল পিপাসা নামিলেন তিনি ঘোড়া হতে নদী তীর।

দু হাতে উঠালেন পিয়াসের বারি তুলিবেন যখন মুখে ,

একে একে বুঝি হইলো স্মরণ ব্যথা তাই বাজে বুকে।

ক্ষণকাল তিনি দড়াইয়া সেথা ফিরে এলেন নীর ছেড়ে ,

শোকে মুহ্যমান পিপাসায় কাতর চলিলেন ধীরে ধীরে।

নিদারুণ শোকে শোকাতুর তিনি চলার শক্তি নাই ,

পড়িলেন ঢলি তপ্ত মরুতে দুলদুল দেখিয়া তাই ;

হ্রেষারব তুলি ছুটিল শিবিরে অশ্রু ভরা দু-নয়ন ,

শূন্য পৃষ্ঠ হেরিয়া বুঝিল আশার বাতি নিভিল যে এখন।

অসহায় যত পরিগণ কাঁদে লুটায়ে ধুলাতে হায় ,

রওজা মোবারক কাপে থরথর সুদূর মদীনায় ।

কাঁদে আজও তাই বিশ্ব মুসলিম ঢালিয়া হৃদয়ের প্রীতি ,

দুনিয়া জাহান বুকে লয়ে কাঁদে আজও কারবালার স্মৃতি।

আজ এ আশুরায়

আ. শ. ম. বাবর আলী

মিথ্যের সাথে সন্ধি নয় কখনো ,

সত্যের সাথে সখ্য।

সত্যকে শক্তি করে

যে করে জীবনের ভিত রচনা ,

সে জীবনের মূল্য অনেক ।

যে মূল্য অতিক্রম করে যায়

মৃত্যুকে পৌছে দিয়ে

মহত্বের শীর্ষ তোরণে।

কারবালা !

তেমনি এক মহান সত্যের পিরামিড

যেখানে উড়লো

সত্যের আবাদী পতাকা

অসত্য আর অন্যায়

প্রতিরোধ সংগ্রামের

মানব আর মানবতার

বিশ্ব নযীর।

সে পতাকার শ্রেষ্ঠ ধারক

হাসান-হোসেন

বুকের মানিক আহা

মোর নবীজীর!

পবিত্র হলো ফোরাতের পানি

তোমাদের শহীদী রক্তের ছোয়ায়।

অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামে

তোমরাই প্রেরণা হলে

আজ এ আশুরায়।

মুহররমের চাঁদ

আমিন আল আসাদ

আকাশে ঐ উঠলো দেখো

মুহররমের চাঁদ

ইমাম হোসেনের শোকে

কাঁদ রে তোরা কাদ।

এই চাঁদেরই দশ তারিখে

ফোরাত নদীর তীরে

কারবালা মাঠ লাল হয়েছে

রক্তেরই আবীরে।

এজিদ সীমার পাষণ্ডরা

ছুড়লো যখন তীর

সেই তীরেতে জীবন দিলেন

আল্লাহ প্রেমিক বীর।

ইমাম এবং তার সাথীরা

শহীদ হলেন হেসে

সত্য পথে লড়াই করে

দ্বীনকে ভালোবেসে।

এজিদ সীমার পাষণ্ডরা

আজো লেগেই আছে ;

বীর মুজাহিদ ইমাম হোসেন

অনুসারীদের নাশে।

নবীর নাতি হোসেন সাথী

আছে বিশ্ব মাঝে

করছে লড়াই ঢালছে লহ

সকাল দুপুর সাঝে।

জানার ইচ্ছে

বুলবুল সরওয়ার

ফোরাতে এখন কার পদধ্বনি ? কে জাগে দজলা-তীরে ?

আজলায় কার সুপেয় জলের ধারা ?

নাম কি তাহার ? জন্ম কাহার ঘরে ?

জানতে ইচ্ছে করে রে বন্ধু ,জানতে ইচ্ছে করে ।

যাদের স্মৃতিতে হোসেন ,তারা সব ঘুমায় কেমন করে !

শত্রু ভাবছো মাতমকারীকে ,বলছো সংযোজন

মানি হে বন্ধু ,মানি ;

অর্থই আজ মন্দিরে দেবী -মহাজগতের রাণী!

তার ঘুম নিঝ্বুম

কবর কবিতা এই থেকে উঠে বুকেতে পাচ্ছে উম ।

হায় রে দুনিয়া! কবিরা ঘুমায় ,স্বদেশ ঘুমায় ,ঘুমায় স্বপ্ন ঘোরে

কাবা কি জাগবে ? কবে থেকে খুব জানতে ইচ্ছে করে !

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মাযারের ইতিহাস

কারবালা অন্য যে কোন শহর থেকে স্বতন্ত্র। এর নাম সকল মুসলমানের স্মৃতিতে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বিশ্ববাসী এ নাম স্মরণ করে নিদারুণ দুঃখ ও ব্যাথা নিয়ে। কারণ ,তারা শহীদদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.) -এর ইতিহাস ও ইসলামের জন্য তার আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ।

কারবালায় দর্শনার্থীদের স্রোত কখনও বন্ধ হয়নি। উমাইয়্যা ও আব্বাসী খলিফারা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মাযার নির্মাণে বার বার বাধা দেয়া সত্বেও এক সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা ইমামের মাযার নির্মাণে সফল হয়।

বর্তমানে কারবালা প্রত্যক্ষ করছে এক নতুন বিপদ। ইমাম হোসাইন (আ.) ও তার সাথীদের মাযার আজ ধ্বংস ও অবহেলার শিকার। দর্শনার্থীদের সেখানে পৌছতে বাধা দেওয়া হচ্ছে।

দু টি প্রধান রাস্তা দর্শনার্থীদের কারবালা নিয়ে যায়। একটি হচ্ছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে মসুল-এর ভেতর দিয়ে এবং আরেকটি হচ্ছে ধর্মীয় নগরী নাজাফ থেকে ।

কারবালা পৌছার পর দর্শনার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করবে মাযারের মহিমান্বিত মিনার ও গম্বুজগুলো।

দর্শনার্থীরা শহরের প্রবেশ মুখে এসে দাড়াতেই দেখতে পাবে একটি সীমানা প্রাচীর যা কাচের কারুকাজ সম্বলিত কাঠের দরজাগুলোকে ঘিরে আছে। কেউ যখন এর কোনো একদরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সে নিজেকে একটি প্রাঙ্গণে দেখতে পাবে যার চারদিকে রয়েছে ছোটছোট কক্ষ।

পবিত্র কবরস্থানটি প্রাঙ্গণের মাঝখানে অবস্থিত ;যার চতুর্দিকে রয়েছে স্বর্ণের তৈরী অত্যন্ত সুন্দর আলোকোজ্জ্বল জানালাসমূহ যা সত্যিই দেখার মতো।

কারবালার আদি ইতিহাস ও এর অর্থ

কারবালা শব্দটির উৎস নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। কেউ বলছেন কারবালা শব্দটি কারবালাতো ভাষার সাথে সম্পর্কিত। আবার কেউ কারবালা শব্দের অর্থ এর বানান ও ভাষা পর্যালোচনা করে উপস্থাপন করেছেন । তারা উপসংহারে পৌছেছেন যে ,আরবি কার্বাবেল থেকে এর উৎপত্তি যা প্রাচীন ব্যবিলনীয় কয়েকটি গ্রামের সমষ্টি-যার মধ্যে ছিলো নিনেভা ,আল-গাদীরিয়া ,কারবেলা ,আল-নাওয়াউইস এবং আল হীর ;শেষোক্ত গ্রামটি বর্তমানে আল-হাইর নামে পরিচিত যেখানে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মাযার অবস্থিত।

গবেষক ইয়াকুত আল-হামাভী বলেছেন যে , কারবালা শব্দটির বেশ কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এর একটি হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে ইমাম হোসাইন (আ.) কে শহীদ করা হয় যা নরম মাটি আল-কারবালাত দিয়ে তৈরী।

অন্যান্য লেখকগণ এ নামকে মরুভূমিকে রক্তাক্তকারী ভয়াবহ ঘটনার সাথে যুক্ত দেখেছেন। আর তাই বলা হচ্ছে , কারবালা শব্দটি দু টি আরবি শব্দের সমষ্টি ,একটি হচ্ছে কারব যার অর্থ হচ্ছে শোক দুঃখ এবং বালা যার অর্থ দুর্দশা। এ সম্পর্কের কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। কারণ ,ইমাম হোসাইন (আ.) সেখানে আসার অনেক আগ থেকেই জায়গাটি কারবালা হিসাবে পরিচিত ছিলো।

শাহাদাত ও জনপ্রিয়তা

কারবালা প্রথমে একটি বসতিহীন জায়গা ছিলো এবং সেখানে নির্মিত কোনো কিছু ছিলো না যদিও যথেষ্ট পানি ও উর্বর জমি ছিল ।

61 হিজরীর 10 মুহররম ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের পর এর নিকটে বসবাসকারী গোত্রগুলো এবং দূরের মানুষ ইমামের পবিত্র কবর যিয়ারতের জন্য এখানে আসতে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই এখানে থেকে যায় এবং অনেকে আত্মীয়-স্বজনদের অনুরোধ করে যেন তারা তাদের মৃত্যুর পর তাদেরকে কারবালায় দাফন করে ।

আব্বাসী শাসক হারুনুর রশীদ ও মুতাওয়াক্কিল প্রমুখ একের পর এক এ এলাকার উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে । তারপরও জায়গাটি শহরে পরিণত হয়েছে।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কবর যিয়ারতের পুরস্কার

হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কবর যিয়ারতে বিরাট আত্মিক কল্যাণ রয়েছে । নবী করীম (সা.) তার নাতি ইমাম হোসাইন (আ.) সম্পর্কে বলেছেন , হোসাইন আমা থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে । বেশ কিছু বর্ণনায় বলা হয়েছে যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কবর যিয়ারত করলে পৃথিবীর এবং মৃত্যুর পরের দুঃখ কষ্ট থেকে মানুষ মুক্তি লাভ করে । তাই পৃথিবীর সব জায়গা থেকে মুসলমানরা সারা বছর ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মাযার যিয়ারতের জন্য কারবালা আগমন করে ,বিশেষ করে মুহররমের প্রথম দশ দিন এবং 20 সফর তার শাহাদাতের চল্লিশতম দিনে।

ইরাকীদের একটি সাধারণ ঐতিহ্য হচ্ছে মুহররমে নাজাফ থেকে কারবালায় হেটে আসা যা তাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে মজবুত বন্ধনেরই প্রতিফলন - যার জন্য ইমাম হোসাইন (আ.) সংগ্রাম এবং শাহাদাত বরণ করেছেন ।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর রওযা

ঐতিহাসিক ইবনে কুলুওয়াইহ উল্লেখ করেছেন ,যারা ইমাম হোসাইনকে কবর দিয়েছিল তারা তার কবরের ওপর চিহ্নসহ একটি আকর্ষণীয় ও মজবুত ভবন তৈরী করেছিলো। আরো উচু ও বড় ভবন তৈরী শুরু হয় প্রথম আব্বাসী খলীফা আবুল আব্বাস আস-সাফফার শাসনামলে। কিন্তু হারুনুর রশীদ ইমামের কবর যিযারতের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

খলিফা মামুনের সময় ইমামের কবরের ওপর রওযা নির্মাণ হয় এবং 236 হিজরী পর্যন্ত চলে। এরপর মুতাওয়াক্কিলের নির্দেশে ইমামের কবর ধ্বংস করা হয় এবং কবর খুড়ে এর গর্তকে পানি দিয়ে ভরে দেওয়া হয়। তারপর মুতাওয়াক্কিলের পুত্র তার উত্তরাধিকারী হিসাবে ক্ষমতা লাভ করে জনগণকে কবর যিয়ারতের অনুমতি দিলে তখন থেকেই কবর এলাকায় নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে ঐতিহাসিক ইবনে আছীর বলেছেন যে ,371 হিজরীতে আযদুদ দাওলা আলে বুইয়া বিশাল আকারের নির্মাণ কাজের জন্য প্রথম এর ভিত্তি স্থাপন করেন এবং স্থানটিকে উদারভাবে সজ্জিত করেন। তিনি মাযার প্রাঙ্গণকে ঘিরে বাড়িঘর ও মার্কেট নির্মাণ করেন এবং কারবালোকে দেয়াল উচু দিয়ে ঘিরে দেন যা এটিকে একটি দুর্গে পরিণত করে ।

407 হিজরীতে অলঙ্করণের কাঠের ওপরে দু টি জ্বলন্ত মোমবাতি পড়ে যাবার কারণে মাযারা প্রাঙ্গণে আগুন ধরে যায়। মন্ত্রী হাসান ইবনে ফযল এ ক্ষতিগ্রস্থ অংশটি পুনঃনির্মাণ করেন।

ইতিহাসে বেশ কয়েকজন শাসকের নাম উল্লেখ রয়েছে যারা মাযার প্রাঙ্গণটি প্রশস্তকরণ ,সৌন্দর্যবর্ধন এবং প্রাঙ্গণটিকে ভালো অবস্থায় রাখার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইরানের কাজার বংশীয় বাদশাহ ফাতহ আলী শাহ যিনি 1250 হিজরীতে দু টি গম্বুজ নির্মাণের আদেশ দেন ;একটি ইমাম হোসাইন (আ.) ও অপরটি তার ভাই আবুল ফযল আব্বাসের কবরের ওপর । প্রথম গম্বুজটি 27 মিটার উচু এবং পুরোপুরি স্বর্ণ দিয়ে ঢাকা। নিচে 12টি জানালা এটাকে ঘিরে আছে ,ভেতরের দিকে যার একটি অপরটি থেকে 1.25 মিটার দূরে এবং বাইরে 1.3 মিটার দূরে।

মাযারটির দৈর্ঘ্য 75 মিটার এবং প্রস্থে 59 মিটার। এর রয়েছে 10টি দরজা ও 65 কক্ষ (আইভান) ,যা ভেতর ও বাইরে চমৎকারভাবে সজ্জিত। এগুলো শ্রেণীকক্ষ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

ইমামের পবিত্র কবরের ওপর সৌধে রয়েছে বেশ কয়েকটি দরজা। সবচেয়ে বিখ্যাতটির নাম হচ্ছে আল-ক্বিবলা ,অপর নাম বাবুয যাহাব (স্বর্ণদ্বার) । এর ভেতরে ডান দিকে হাবীব ইবনে মাযাহের আল-আসাদীর কবর রয়েছে । হাবীব শিশুকাল থেকেই ইমাম হোসাইন (আ.) -এর একজন সাথী ছিলেন । তিনি কারবালায় শাহাদাতের উচ্চ মর্যাদা লাভকারীদের একজন ।

হযরত আব্বাস (আ.) -এর কবর

আবুল ফযল আব্বাস (আ.) ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সৎ ভাই। তিনি কারবালার রণাঙ্গনে ইমামের পতাকাবাহী ছিলেন । তিনি তার সাহসিকতা ও আনুগত্যের জন্য বিখ্যাত ,যেমন ছিলেন তার পিতা শেরে খোদা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ।

হযরত আব্বাসের কবর ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কবরের মতোই বিশেষ যত্ন লাভ করেছে। 1032 হিজরীতে শাহ তাহমাসেব তার কবরের গম্বুজটির সৌন্দর্য বর্ধনের আদেশ দেন। তিনি কবরের সমাধিগাত্রে একটি জানালা নির্মাণ করেন এবং প্রাঙ্গণটিকে সুবিন্যস্ত করেন। এ ধরনের আরো কিছু কাজ অন্যান্য শাসকরাও করেছেন ।

কারবালা ইমাম হোসাইন (আ.) ও তার ভাইয়ের কবরই শুধু বক্ষে ধারণ করেনি ,ধারণ করেছে কারবালার 72 শহীদের সকলেরই কবর । তাদের একটি গণকবরে দাফন করা হয় যা মাটি দিয়ে পূর্ণ করে সমতল পর্যায়ে আনা হয়। এ গণকবরটি ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পায়ের কাছে অবস্থিত। ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পাশেই রয়েছে তার দুই ছেলে আলী আকবর ও ছ মাসের শিশু আলী আসগারের কবর ।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর মাযার উন্নয়নের ধারাবাহিক ইতিহাস

61 হিজরী 01 আগস্ট 680 খ্রিস্টাব্দে : ইমাম হোসাইন (আ.) -কে এ পবিত্র স্থানে সমাহিত করা হয়।

65 হিজরীর 18 আগস্ট 684 খ্রিস্টাব্দে : মুখতার ইবনে আবু উবাইদা সাকাফী ইমামের কবরের চারদিকে একটি দেয়াল নির্মাণ করেন। তা দেখতে ছিল মসজিদের মতো এবং কবরের ওপরে একটি গম্বুজ তৈরী করা হয়। এতে প্রবেশের দু টি পথ ছিলো।

132 হিজরী 12 আগস্ট 749 খ্রিস্টাব্দে : এ মসজিদের আংশিক ছাদ তৈরী করা হয় এবং প্রথম আব্বাসী খলীফা আল আব্বাস আস-সাফফার শাসনামলে আরো দু টি প্রবেশপথ তৈরী করা হয়।

140 হিজরী 31 মার্চ 763 খ্রিস্টাব্দে : খলিফা মানসুরের শাসনামলে এর ছাদ ধ্বংস করা হয়।

158 হিজরী 11 নভেম্বর 774 খ্রিস্টাব্দে : খলিফা মাহদীর শাসনামলে ছাদ পুনরায় নির্মাণ করা হয় ।

171 হিজরী 22 জুন 787 খ্রিস্টাব্দে : হারুনুর রশীদের শাসনামলে গম্বুজ ও ছাদটি ধ্বংস করা হয়।

193 হিজরী 25 অক্টেবর 808 খ্রিস্টাব্দে : আমিনের শাসনামলে ভবনটি পুনঃনির্মাণ করা হয়।

236 হিজরী 15 জুলাই 850 খ্রিস্টাব্দে : মুতাওয়াক্কিলের আদেশে ভবনটি ধ্বংস করে ফেলা হয় এবং সেখানকার জমিতে চাষাবাদের আদেশ দেয়া হয়।

247 হিজরী 17 মার্চ 861 খ্রিস্টাব্দে : মুনতাসির কবরের ওপর একটি ছাদ নির্মাণ করেন এবং যিয়ারতকারীদের জন্য চিহ্ন হিসাবে এর কাছে একটি লোহার স্তম্ভ নির্মাণ করেন।

273 হিজরী 8 জুন 886 খ্রিস্টাব্দে : ছাদটি আবার ধ্বংস করে ফেলা হয়।

280 হিজরী 23 মার্চ 893 খ্রিস্টাব্দে : আলাভীদের প্রতিনিধি এর মাঝখানে একটি গম্বুজ নির্মাণ করেন এবং দু পাশে দু টি ছাদসহ আরো দু টি প্রবেশপথসমেত একটি দেয়াল তৈরী করেন।

307 হিজরী 19 আগষ্ট 977 খ্রিস্টাব্দে : আযদ ইবনে বুইয়া গম্বুজটি ও সীমানা প্রাচীর পুনঃনির্মাণ করেন এবং সমাধির চারদিকে একটি সেগুন কাঠের ঘর তৈরী করে দেন। তিনি মাযারের চারদিকে ঘর তৈরী করেন এবং শহরের সীমানা প্রাচীর তৈরী করেন। একই সময়ে ইমরান ইবনে শাহীন রওযার পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

407 হিজরী 10 জুন 1016 খ্রিস্টাব্দে : স্থাপনাগুলো আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রধানমন্ত্রী হাসান ইবনে ফযল সেগুলো পুনঃনির্মাণ করেন।

620 হিজরী 4 ফেব্রুয়ারী 1223 খ্রিস্টাব্দে : নাসির লেদীনিল্লাহ রওযার আবরণসমূহ পুনঃনির্মাণ করেন।

757 হিজরী 18 সেপ্টেম্বর 1365 খ্রিস্টাব্দে : সুলতান ওয়াইস ইবনে হাসান জালাইবী গম্বুজটিকে নতুন আকার দান করেন এবং সীমানা প্রাচীরকে আরো উচু করেন।

780 হিজরী 24 ফেব্রুয়ারী 1384 খ্রিস্টাব্দে : আহমাদ ইবনে ওয়াইস দু টি স্বর্ণে ঢাকা মিনার নির্মাণ করেন এবং প্রাঙ্গণকে আরো বড় করেন।

1032 হিজরী 5 নভেম্বর 1622 খ্রিস্টাব্দে : শাহ আব্বাস সাফাভী কবরের চারদিকে তামা ও ব্রোঞ্জের রেলিং তৈরী করেন এবং গম্বুজকে টাইল্স দিয়ে সজ্জিত করেন।

1048 হিজরী 15 মে 1638 খ্রিস্টাব্দে : সুলতান চতুর্থ মুরাদ রওযা মোবারক যিয়ারত করেন এবং গম্বুজকে সাদা রং করেন।

1155 হিজরী 8 মার্চ 1742 খ্রিস্টাব্দে : নাদির শাহ রওযা মোবারক যিয়ারতে যান এবং এই ভবনের সৌন্দর্য বর্ধন করেন। তিনি মাযারের কোষাগারে মূল্যবান উপহার জমা দেন।

1211 হিজরী 7 জুলাই 1796 খ্রিস্টাব্দে : শাহ অগা মোহাম্মদ খান কাজার মাযারের গম্বুজটি সোনা দিয়ে ঢেকে দেন।

1216 হিজরী 14 মে 1801 খ্রিস্টাব্দে : ওয়াহাবীরা কারবালা আক্রমণ করে মাযারের রেলিং ও হলকক্ষ নষ্ট করে দেয় এবং মাযার লুট করে ।

1232 হিজরী 21 নভেম্বর 1817 খ্রিস্টাব্দে : ফাতহ আলী শাহ কাজার মাযারের রেলিং মেরামত করেন এবং তা রূপা দিয়ে ঢেকে দেন। তিনি হলকক্ষের কেন্দ্রও সোনা দিয়ে ঢেকে দেন এবং ওয়াহাবী লুটেরাদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলো মেরামত করেন।

1283 হিজরী 16 মে 1866 খ্রিস্টাব্দে : নাসিরুদ্দীন শাহ কাজার মাযারের প্রাঙ্গণে বড় করেন।

1358 হিজরী 21 ফেব্রুয়ারী 1939 খ্রিস্টাব্দে : ড. সাইয়্যেদ তাহের সাইফুদ্দীন দাউদী বোহরা সম্প্রদায়ের 51তম দা ঈউল-মুতলাক এক সেট রূপার রেলিং উপহার দেন যা রওযায় স্থাপন করা হয়।

1360 হিজরী 29 জানুয়ারী 1941 খ্রিস্টাব্দে : ডা. সাইয়্যেদ তাহের সাইফুদ্দীন পশ্চিমের মিনারটি পুনঃনির্মাণ করেন।

1367 হিজরী 20 ডিসেম্বর 1948 খ্রিস্টাব্দে : কারবালার প্রশাসক সাইয়্যেদ আবদুর রাসূল খালাসী মাযারকে ঘিরে একটি রাস্তা নির্মাণ এবং মাযার প্রাঙ্গণকে আরো প্রশস্ত করার জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যে মাযারের নিকটবর্তী বাড়িগুলো কিনে নেন।

আল্লাহ তা আলার নিকট আমাদে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের সৎ প্রচেষ্টাগুলো দীর্ঘস্থায়ী করেন এবং আমাদের তার দয়া ও হেফাজত লাভের তাওফীক দান করেন। তিনি তো শানেন এবং জবাবও দেন।

(সূত্র: ইন্টারনেট)

অনুবাদ :মুহাম্মদ ইরফানুল হক