আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন11%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 78923 / ডাউনলোড: 7838
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

ভারতীয় উপমহাদেশে মার্সিয়ার উৎপত্তি ক্রমবিকাশ ও সাহিত্য অবদান

এ্যাডভোকেট মোঃ জাকির হোসেন*

মার্সিয়া সাহিত্য

শোক ,দুঃখ ,কান্না ও অশ্রু বিসর্জন মানুষের সহজাত স্বভাব। মানব শিশু কান্নার মধ্য দিয়েই পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে । মানব জীবনে সুখ-দুঃখ নিত্য দিনের সহচর।

দুঃখ ,শোক ,মাতম মানব জীবনকে গতিময় করে । বেচে থাকার শক্তি ,উৎসাহ ও প্রেরণা যোগায়। মানুষের প্রতি ,মানবতার প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত করে । কোনো লোক যখন তার পরম পাওয়ার বা ভালোবাসার কোনো বস্তুকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে কিংবা কোনো প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটে তখন মানুষ কেবল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েনা ,সে বুক-মাথা চাপাড়ায় এবং শোকগাথা গাইতে থাকে। কেননা ,প্রিয়জনের বিয়োগ জ্বালা ,প্রিয়জনকে হারানোর বেদনার কারণে সৃষ্ট অদৃশ্য শোককান্নাকে সে রুখতে পারে না। এমনকি ইচ্ছে না থাকলেও অনুভূতির ভাবাবেগে মানুষ নিজের অজান্তেই কেদে ফেলে। মানুষের শোক প্রকাশের এরূপ ধারাকে মাতম বলা হয়ে থাকে। মাতমের সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশে রচিত সাহিত্যকর্মকে মার্সিয়া বলা হয়।

মার্সিয়ার সংজ্ঞা ,উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ

কোনো ট্র্যাজিক বা শোকময় ঘটনা সম্পর্কে প্রশংসাসূচক গান ,স্মৃতিচারণমূলক গাথা অথবা কাব্য রচনা হলো মার্সিয়া সাহিত্য। মার্সিয়া আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ শোক করা ,মাতম করা ,ক্রন্দন করা-বিলাপ করা। মানব সভ্যতার আদি থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ বিলাপের মাধ্যমে শোক প্রকাশের রীতি প্রচলিত ছিল । কারবালা ট্র্যাজেডিকে ঘিরে পূর্ব যুগে গৌরবময় স্মৃতিচারণমূলক পনের হতে বিশটি শেস্নাক বা শোকগাথা লিখিত হলে তা মার্সিয়ার অন্তর্ভুক্ত হতো। কিন্তু পরে মার্সিয়ার অর্থের পরিবর্তন ঘটে।

৬১ হিজরীতে কারবালার মরু প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এবং অন্যান্য বীর শহীদদের উদ্দেশ্যে লিখিত প্রশংসাসূচক কবিতাই বিশেষভাবে মার্সিয়া নামে অভিহিত হয়।

হযরত ইমাম হাসান ,ইমাম হোসাইন এবং অন্যান্য শহীদানের আত্মত্যাগের বীরত্ব গাথা প্রসঙ্গে শোকগীতিই মার্সিয়ার রূপ পরিগ্রহ করে । প্রখ্যাত কবি নিযামী মার্সিয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন যে ,কোনো মৃত ব্যক্তির জীবনের গুণ বর্ণনার ক্ষেত্রে ছন্দে রচিত বিলাপ অথবা দুঃখ প্রকাশের নাম মার্সিয়া । পাশ্চাত্য মনীষীHughes বলেছেন ,মার্সিয়া কারও শুভযাত্রা উপলক্ষে বিষাদগীতি। বিশেষ করে মুহররম মাসে ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের আত্মবিসর্জন সম্পর্কে কবিত্ব ছন্দে যে শোকগাথা গীত হয় তা-ই মার্সিয়া । কারবালার শহীদদের স্মরণে মুহররম মাসে মজলিস অনুষ্ঠানে মার্সিয়া পঠিত হয়।

তাজিয়াসহ আহলে বাইতের অনুসারীরা শোক মিছিলের সময় পথ চলতে চলতে মার্সিয়া আবৃত্তি করে থাকে। মার্সিয়ার ইংরেজি প্রতিশব্দElegy বা Mournful poem বা Funeral Song । এই শোকগাথা বিশ্ব সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

যুদ্ধের বর্ণনাকে আশ্রয় করে আরবে প্রথম মার্সিয়া সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। আরবে মার্সিয়া রচনার মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের বিষাদময়ভাব প্রকাশ করে পরস্পরের মনের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করা হতো। তামসিক যুগে মার্সিয়া সাহিত্যের চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল বটে কিন্তু ইসলামী যুগে তা পূর্বাপেক্ষা ব্যাপকতর পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং বিকাশ লাভ করে । আত্মীয়ের মৃত্যুতে মানুষের মনে যে গভীর বেদনা ও ক্ষতের সৃষ্টি হয় ,তা কাব্য ও কবিতা রচনার মূলভিত্তি। আর এই ভিত্তিমূলেই প্রতিষ্ঠা পায় মার্সিয়া । পৃথিবীর সব দেশেই বেদনাবোধ হতে কাব্যসাহিত্য রূপ লাভ ঘটেছে। ইসলাম পরবর্তী যুগে যারা মার্সিয়া লিখতেন তাদের অন্যতম হলেন খানস এবং মোতামিন বিন নূব্যয়রা।

তবে কিছু কিছু আরব দেশীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকায় এ সময়ে কোনো কোনো মার্সিয়ায় গভীর বিষাদের ভাব স্পষ্ট । অন্তরে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে এ মার্সিয়া কবিতাগুলো সাহিত্যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। হযরত উসমানের মৃত্যু উপলক্ষে কাফ বিন মালিক নামক একজন আরব কবি আরবি ভাষায় মার্সিয়া কবিতা রচনা করেছিলেন । এরপর ইমাম আলী শহীদ হওয়ার পর আবি আসওয়াদ দুওয়ালী নামক অপর একজন কবি আরবি ভাষায় একখানি মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। এর মাত্র বিশ বছরের মধ্যে কারবালার ট্র্যাজেডি ঘটে। কারবালার ভয়াবহ কলংকজনক ট্র্যাজেডির সময় যদি আরব জাতির পূর্বের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকত তাহলে সবিজ্ঞ কবিগণ এমন করুণ ভাষায় আরবি মার্সিয়া রচনা করতেন যে ,এর প্রভাবে সমগ্র বিশ্বে শোকের অনলশিখা প্রজ্বলিত হতো। কিন্তু ইতোমধ্যে আরব জাতির মধ্যে পূর্বের বৈশিষ্ট্য যথেষ্ট পরিমাণে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ।

বনী উমাইয়্যা রাজবংশের পতনের পর আব্বাসী রাজবংশীয় শাসকগণ কাব্য সাহিত্যের ব্যাপক উৎকর্ষ সাধন করেন। কিন্তু এ সময়ে রাজ পুরুষদের প্রশংসাসূচক কাসিদা লিখে কবিগণ পুরস্কার লাভ করতেন। ফলে মার্সিয়া সাহিত্যের অচলাবস্থার পরিবর্তন হলো না। তবে মা আন ও জাফর বার্মাকীর বদান্যতার ফলে তাদের মৃত্যুর পর যে মার্সিয়া কাব্য লিখিত হয়েছিল তাতে গভীর শোকের আভাস পাওয়া যায়।

পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসী তার শাহনামায় সোহরাবের মৃত্যুর পর তার মাতার জবানীতে যে শোকগাথা বর্ণনা করেছেনে তা বিশেষভাবে মার্সিয়া সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য। কবি খররুখী ,কবি শেখ সা দী ,ভারতের আমীর খসরু ফার্সি ভাষায় মার্সিয়া রচনা করে মার্সিয়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ।

বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ তুসী কারবালার যুদ্ধে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনা অবলম্বনে মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। কবি সানায়ী একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ,কবি নজিরী ও উরফী ১৬ শতাব্দীতে নতুন ধরনের মার্সিয়া রচনায় ব্রতী হন। কবি মোল্লা মুহতাশিম কাশানী সাফাবী বংশের প্রশংসা করে কাসীদা রচনা করেন।

সাফাবী বংশের সূচনালগ্নে মার্সিয়া সাহিত্য পুনরায় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং এ সময় কবি মুকবিল এককভাবে কয়েকখানা মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। তিনি কারবালার লোমহর্ষক বর্ণনা তার মার্সিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরেন। বিংশ শতাব্দীর পারস্য কবি কানী হৃদয়স্পর্শী ভাষায় কারবালার কাহিনী অবলম্বনে মার্সিয়া রচনা করেন। তার মার্সিয়াগুলো অতিব করুণ ও শ্রুতিমধুর। কানীর ও মার্সিয়া সম্বন্ধে একথা স্বীকৃত যে ,তিনি তার সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। তার মার্সিয়ার গঠন প্রণালী ও ভাষা শৈলী প্রয়োগ স্বতন্ত্র। তার রচনায় ইমাম হোসাইনের শাহাদাত বৃত্তান্ত অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাবে ফুটে উঠেছে।

পারস্য হতে অনেক কবি ও সাহিত্যিকের ভারত আগমনের ফলে ভারতেও মার্সিয়া সাহিত্য ও কাব্য রচনার নতুন দিগন্ত সম্প্রসারিত হয়।

উপমহাদেশে ফার্সি মার্সিয়া সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

উপমহাদেশে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর দিল্লী রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং রাজদরবারের ভাষা হিসাবে ফার্সি মর্যাদা লাভ করে । ফার্সী ভাষা রাজদরবারের ভাষা হিসাবে স্থান লাভ করায় ভারতীয় সাহিত্যে ফার্সি এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

এ প্রসঙ্গে ড. হাবিবুল্লাহ বলেন ,রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণবশত ইরানের সাভাবী রাজবংশের রাজাদের সাথে তৈমুর বংশীয় সুন্নী মুঘলদের চিরন্তন শত্রুতা থাকায় এ অঞ্চলের কবিগণ অনুকূল পরিবেশের অভাবে মার্সিয়া রচনায় উৎসাহী হননি।

এর ফলে উত্তর ভারতে ফার্সি সাহিত্যে সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্বে মার্সিয়া রচিত হয়নি। পাক্ষান্তরে ,দিল্লীর মুঘল শাসকগণের শত্রু দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর শিয়া নরপতিগণের সহানুভূতি ও উৎসাহে শিয়া মাযহাবের প্রচারক ও কবি-সাহিত্যিকগণ দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে শিয়া চিন্তাধারাপুষ্ট সাহিত্য রচনার সম্প্রসারণ ঘটে।

সম্রাট বাবর লোদী বংশের শেষ সম্রাটকে পরাজিত করে ১৫২৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তার পুত্র হুমামান ভারত হতে শের শাহ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে ১৫৪৪ সালে সাময়িকভাবে পারস্য সম্রাট তাহমাসপের আশ্রয় গ্রহণ করেন । পারস্য বা ইরান হতে তার সামরিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা লাভ ইরান ও ভারতের মধ্যে শিল্প -সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের এক নব যুগের সূচনা করে ।

সম্রাট হুমায়নের ভারত প্রত্যাবর্তনের সময় বহু ইরানী কবি-সাহিত্যিকের সংশ্রবের ফলে ফার্সি ভাষা শরীফদের ভাষায় স্থান লাভ করে । মুঘল আমলে ভারতের সর্বত্র ফার্সি সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হতে থাকে। মুঘল যুগের পূর্বেও ভারতে ফার্সি ভাষা প্রচলিত ছিল । এর আগমন ঘটে আফগানিস্তান ও তুর্কিস্তান হতে । কিন্তু মুঘল আমলে ফার্সি ভাষার মূল উৎসস্থল ইরান থেকে এ ভাষা ও সাহিত্যের প্রবাহ শুরু হয়। এ সময় দিল্লী ও দিল্লীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের কবি-সাহিত্যিকগণ ব্যাপকভাবে সাহিত্য চর্চা করেন। প্রথম তারা ফার্সি ও পরে উর্দু ভাষার কাব্য চর্চা করেন। সে সময় দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাষ্ট্রগুলোতে মার্সিয়া কাব্য চর্চা পুরা দমে শুরু হলেও উত্তর ভারতের শিয়া কবি ও সাহিত্যিকগণ সাম্রাটের ভয়ে ধর্ম সম্বন্ধীয় কোনো কাব্য রচনা করতে সাহসী হননি। বরং মুঘল রাজদরবারের কবিগণ কাসীদা রচনা করে সম্রাট ও শাসকবর্গের সন্তোষ বিধান করতেন। এর কারণ মূলত অর্থনৈতিক। কেননা ,মৃত ব্যক্তির গুণকীর্তন অপেক্ষা জীবিত ব্যক্তির প্রশংসা কীর্তনের প্রতি তাদের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল । সম্রাট শাহজাহানের রাজদরবারের কবি হাজী মুহাম্মদ জান কুদসী স্বীয় যুবক পুত্রের অকাল মৃত্যুতে এক মার্সিয়া রচনা করেছিলেন । দাক্ষিণাত্যের শাসক দ্বিতীয় আদিল শাহ এই শাসনকালে (১৫৮০-১৬২৬.খ্রি.) তার দরবারের কবি মোল্লাহ যুহুরী আদিল শাহের নির্দেশে মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন।

মুঘল যুগের সূচনালগ্নে কিছুসংখ্যক লেখক ও কবির রচনার নমুনা ঐতিহাসিক রদাযুন কর্তৃক সংরক্ষিত হয়। আমীর খসরু (১২৩৫-১৩২৫.খ্রি.) এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বলে জানা যায়। বুগরা খান যখন বাংলাদেশের শাসন কর্তা নিযুক্ত হয়ে আসেন তখন আমীর খসরু তার সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। এরপর খসরু বাংলাদেশ হতে দিল্লী যান। রাজধানী দিল্লীতে গিয়ে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে প্রতিষ্ঠা পান এবং সুখ্যাতি অর্জন করেন।

ফার্সি ভাষায় তিনি অসংখ্য কাসীদা ,গজল ও মসনবী রচনা করেন। তবে ফার্সি ভাষায় তিনি কোনো মার্সিয়া রচনা করেছিলেন কিনা জানা যায়নি।

জামালী নামে সুলতান সিকান্দার লোদীর অতিপ্রিয় একজন কবি ছিলেন । সুলতান সিকান্দার লোদী ১৪৮৮ থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিলেন । সুলতানের মৃত্যু ঘটলে কবি জামালী মর্মস্পর্শী ভাষায় একটি মার্সিয়া রচনা করেন।

উপমহাদেশে উর্দু মার্সিয়া সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

উপমহাদেশের উর্দু সাহিত্যের সূতিকাগার হিসাবে ঐতিহাসিকগণ দাক্ষিনাত্যকে অভিহিত করেছেন । উর্দু সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে এখান থেকেই। উর্দু ভাষায় মার্সিয়া কাব্যের উৎপত্তির মূলে দাক্ষিণাত্যের উর্দু কবিগণের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পারস্যে যেমন শীয়া সাফাবী রাজবংশের সূচনা হয় তেমনি ভারতের দাক্ষিণাত্যে শীয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সম্রাট বাবর কর্তৃক ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অর্ধশত বছর পূর্বেই দাক্ষিণাত্যে মার্সিয়া কাব্য রচনার প্রচলন হয়। উপমহাদেশে ফার্সি ,উর্দু এবং বাংলা ভাষায় মার্সিয়া সাহিত্য ধারার প্রবর্তন যে ইরানি বণিক ,দরবেশ ও পণ্ডিত মহলের অনুপ্রেরণায়ই হয়েছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই।

ভারতের দাক্ষিনাত্যে বর্তমান হায়দারাবাদে প্রথম উর্দু ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়। সেখানে উর্দু ছিল শিক্ষিত জনসাধারণের ব্যবহৃত ভাষা । ১৩৬৪ সালে দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে দাক্ষিনাত্যের বাহমানী রাজবংশের শাসকের বিদ্রোহের ফলে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। ফলে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো প্রাচীন উর্দু বা দাকিনীকে রাজভাষারূপে গ্রহণ করে । এর বিশ বছর পূর্বে মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের সৈন্যবাহিনী দাক্ষিনাত্যে উর্দুর প্রবর্তন করে । তার দাক্ষিণাত্যের রাজভাষা রূপে তা গৃহীত হয়। উর্দু সাহিত্যের সূচনা দাক্ষিণাত্যের কবি ওয়ালী (১৬৬৮-১৭৪৪ খ্রি.) হতে ;তবে তখনকার ভাষা ছিল দাকিনী। কবি ওয়ালী কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা অবলম্বনে মসনবী রচনা করেন ;কিন্তু কোনো মার্সিয়া লিখেননি। উপমহাদেশে মার্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি কে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও খাজা মীর দার্দ-এর (১১৩৩-১১৯৯.খ্রি.) পূর্বেই মার্সিয়া কাব্য রচনার প্রচলন ছিল । এর পূর্বে মার্সিয়া ছিল চার পংক্তি বিশিষ্ট কবিতা ,কিন্তু মীর্যা সওদা সর্বপ্রথম ১৭৫০ সালে ছয় পংক্তির মার্সিয়া রচনা রীতির প্রচলন করেন। তার সাহিত্য প্রতিভা ও কবিত্ব শক্তির প্রভাবে পরবর্তীকালে মীর আনিস ও মীর্যা দবীরের যুগে মার্সিয়া সাহিত্য উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করে । মীর্যা সওদা দীওয়ান ও মসনবী ব্যতীত সালাম ও রচনা করেন। মীর ত্বকীও (১৭১২-১৮১০.খ্রি.) মার্সিয়া লিখে ছিলেন ।

উর্দু কবিগণের জীবন চরিত সংগ্রহকার মীর ত্বকী ও মীর হাসান সে যুগের অনেক মার্সিয়া লেখকের নাম উল্লেখ করেছেন । তাদের মধ্যে মীর আমানী ,মীর আল আলী দারাখশান সিকান্দার ,কাদির ,গোমান ,আসেমী ,নদীম ,সবর প্রমুখ অন্যতম। বর্তমান কালের এক গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে যে ,দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডা রাজ্যের শাসনকর্তা মুহাম্মাদ কুলী কুতুব শাহ (১৫৮০-১৬১১:খ্রি.) উর্দু ভাষার প্রথম বিশিষ্ট কবি। তিনি মার্সিয়া শ্রেণীর বহু কবিতা লিখেছেন। বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্যের রাজন্যবর্গ মার্সিয়া কাব্য সাহিত্যের কবিদের শুধু পৃষ্ঠপোষকতা করেই ক্ষান্ত হননি ;তারা শিয়া মাযহাবভুক্ত হওয়ায় নিজেরাও মার্সিয়া সাহিত্য ও কাব্যাদি রচনা করতে আত্মনিয়োগ করাকে ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতেন। বিজাপুরের আদিল শাহী শাসকগণের দান ও পৃষ্ঠপোষকতায় এ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুহররমের মজলিস অনুষ্ঠান চালু হয়। সেই সাথে এ শাহী ও নিযামশাহী শাসকগণের রাজত্বের সময় মার্সিয়া কাব্য রচনাধারা যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়। প্রথম প্রথম এ সকল মজলিস অনুষ্ঠানে ইরানী কবি মুহতাশিম কাশানীর ফার্সি ভাষায় লিখিত মার্সিয়া পাঠ করা হতো । কিন্তু পরে উর্দু ভাষায় তা রচিত হয়। পরবর্তীতে মার্সিয়া কবিতা আবৃত্তির জন্য এক বিশেষ গোষ্ঠি গড়ে ওঠে এবং বহু মার্সিয়া কাব্য রচিত হতে থাকে। এ সময় রওজাতুস শুহাদা নামক বিখ্যাত মার্সিয়া খানি ফজলে আলী কর্তৃক উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়। অনুদিত এ গ্রন্থের নাম কারবালার কথা । এ গ্রন্থে ইমাম হোসাইনের শাহাদাত এবং কারবালার অপরাপর ঘটনা মার্সিয়া কাব্যাকারে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

সম্রাট আকবরের সময় দাক্ষিণাত্যের শিয়া রাজা আদিল শাহ ও কুতব শাহ নিজ নিজ রাজ্যে মুহররমের মিছিল এবং মাতম অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন।

মজলিসের সময় ঐ সকল স্থানে চৌদ্দটি (আহলে বাইতের চৌদ্দ জন নিষ্পাপ ব্যক্তির সাম্মানে) স্তম্ভ প্রোথিত হতো। গোলাকুণ্ডা শহরকে আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হতো। মার্সিয়া পাঠকগণ রাজধানীতে শহীদগণের প্রশংসাসূচক কবিতা ,মার্সিয়া এবং নওহা পাঠ করত। দশ মুহররম সুলতান স্বয়ং কালো রঙের পাশোক পরে খালি পায়ে পতাকা ,পাঞ্জাসহ মিছিলে যোগদান করতেন। বীজাপুরে শাহী আম্বরখানার নাম ছিল হাসেইনী মহল। দাক্ষিণাত্যের কবি নসরতী তার কাসীদায় হোসেইনী মহলের সৌন্দর্যের বর্ণনা প্রদান করেছেন । ভারতীয় দাকিনী ভাষায় কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনামূলকা প্রাচীন একখানা গ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে। এটির নিযাম শাহী রাজ্যের কবি আশরাফ কর্তৃক লিখিত হয়েছিল । অতঃপর যে মার্সিয়া কাব্য বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে ,তা গোলকুণ্ডার প্রসিদ্ধ কবি ওয়াজহী রচিত। তৎপর অন্যান্য কবি মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন। তাদের মধ্যে গোলকুণ্ডের কবি গাওয়াসী ,লতীফ কাযেম ,আফজল ,শাহ কুলী খান ,শাহী নুরী এবং বীজাপুরের মির্যা ও হাশিমীর নাম উল্লেখযোগ্য। মির্যা সারাজীবন মার্সিয়া কবিতা রচনা করে গেছেন বলে জানা যায়।

১৬৫০ সালে গোলকুণ্ডার কবি আহম্মাদ কারবালা ঘটনা নিয়ে মুসিবাত-ই-আহলে বাইত নামক একখানি মসনবী কাব্য রচনা করেন। মুহাম্মাদ হানিফার উপাখ্যান নিয়েও দু খানা মহাকাব্য রচিত হয়।

মীর জমীরের সময় উর্দু ভাষায় মার্সিয়া সাহিত্য পূর্ণাঙ্গ রূপলাভ করে । মীর জমীর সর্বপ্রথম মিম্বরে বসে মার্সিয়া পাঠ করার রীতি প্রচলন করেন। তার পূর্ববর্তী কবিগণ যে পদ্ধতিতে মার্সিয়া রচনা করতেন তা চল্লিশ পাঞ্চাশ বন্দের বেশি দীর্ঘ হতো না।

উল্লেখ্য যে , রওজাতুস শুহাদা গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির তিনটি কপির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এর দুই কপি লণ্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে এবং এক কপি রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আছে। মির্যা ও হাশিমীর রচিত মার্সিয়া কাব্যের পাণ্ডুলিপি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আছে।

এরপর মীর খালিকের (১৭৭৪-১৮০৪:খ্রি.) সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। মীর খালীকের চার ভাইয়ের তিন ভাইই কবি ছিলেন । খালক ,খালীক এবং মহসীন এ তিন ভাই মার্সিয়া কবিতা লিখে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন । মীর খালীকের পুত্র মীর বাবর আলী (১৮০২-১৮৭৪:খ্রি.) মার্সিয়া কাব্যের সর্বাধিক উন্নতি বিধান করেন। দাক্ষিণাত্য অপেক্ষা দিল্লী ও লক্ষৌতে এসে মার্সিয়া সাহিত্যের প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয়েছে। লক্ষৌতে শহরের অধিকাংশ আমীর ও ওমরাহ শিয়া মাযহাবভুক্ত ছিলেন । এ কারনে তারা কারবালার বীর শহীদদের দুঃখ-কষ্টের কথা অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে আলোচনা করতেন এবং ক্রন্দন ও শোক প্রকাশ করাকে ধর্মীয় কার্যের অংশ হিসাবে গণ্য করতেন। শুধু তা-ই নয় ,অন্যান্য কবিদেরও তারা মার্সিয়া সাহিত্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। লক্ষৌর নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ (১৮৪৭-৫৬ :খ্রি.) নিজেও কবি ছিলেন । তিনি জিলদে মিরাসী ,দফতর -ই-গম ও বহর-ই-আলম এবং সরমায়া-ই-ঈমান নামক তিন খানা মার্সিয়া কাব্য রচনা করেন।

১৮৫৬ সালে তিনি কলকাতা আসেন এবং ১৮৮৭ সালে তার মৃত্যু ঘটে। মার্সিয়া সাহিত্যের যথার্থ উন্নতি ও বিকাশের সময় লক্ষৌ শহরে মুহররমের শোক প্রকাশের সময়কাল ১০ দিনের পরিবর্তে ৪০ দিন নির্দিষ্ট হয়। নবাব ওয়াজেদ আলী স্বয়ং মার্সিয়া কাব্য রচনা করতেন এবং তা মজলিস অনুষ্ঠানে পঠিত হতো। এ সময় কালের মার্সিয়া সাহিত্যে দু জন বিশিষ্ট কবির সন্ধান পাওয়া যায়। তারা হলেন মীর আনীস এবং মীর্যা দবীর। তারা উভয়ই মার্সিয়া সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কবি ছিলেন । বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের যেমন দুই কবি চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতি ,তেমনি উর্দু ভাষায় মার্সিয়া কাব্য সাহিত্যের দুই শ্রেষ্ঠ কবি মীর্যা দবীর ও মীর আনিস। এই দুই প্রতিভাদীপ্ত কবির কাব্য সাধনার ফলে উর্দু মার্সিয়া কাব্যের চরম উন্নতি সাধিত হয় এবং মার্সিয়া সাহিত্য বিশেষভাবে লাভবান হয়।

বাংলায় মার্সিয়া সাহিত্যের ক্রমবিকাশ

বাঙালি সংস্কৃতিতে মার্সিয়া সাহিত্য অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী সাহিত্য হিসাবে পরিগণিত হয়ে আছে। বাঙালি মুসলমানদের জীবনের সাথে কারবালার কাহিনী ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

কারবালার মরু প্রান্তরে মহানবী রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর প্রিয়তম দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সপরিবারে এই আত্মদানের ঘটনা এমন করুণ ও হৃদয়বিদারক যে ,তা যুগে যুগে সাহিত্যিকদের কাব্য ও সাহিত্য রচনায় প্রেরণা যুগিয়েছে। কারবালার যুদ্ধের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর আত্মদান চিরদিন মানুষকে ত্যাগের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করবে। বাংলা সাহিত্যে কারবালার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সে কাল থেকেই এ দেশের মুসলমান তথা জনসাধারণের মধ্যে প্রতি বছর মুহররম মাসে শোক পালন করার রীতি চলে আসছে এবং এ বিষয়ে পুথি-কস্তক লেখার রেওয়াজ চালু হয়েছে। কারবালার ঘটনা বা মুহররমের ঘটনা নিয়ে মধ্যযুগে এবং পরবর্তীকালে যে সব পুথি ও বই লেখা হয়েছে. সেগুলোর নাম জঙ্গনামা । মকতুল হুসায়ন ,শহীদ-ই-কারবালা ,সংগ্রাম হুসন ,এমাম এনের কেচ্ছা ,শাহাদাৎ নামা ,হানিফার লড়াই ,বড় জঙ্গনামা ,গুলজার-ই-শাহদাৎ ,দাস্তান শহীদে ইকবরালী ,জঙ্গে কারবালা ইত্যাদি।

ইংরেজ আমলে কারবালার করুণ কাহিনী নিয়ে বিস্তর কাব্য ও সাহিত্য রচিত হয়েছে। এ বিষয়ে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্দুর সাহিত্যমান অতুলনীয়। যদিও এতে প্রচুর ইতিহাস বিকৃতি রয়েছে । তাছাড়া বাংলা কাব্যে কতিপয় কবি এ বিষয়ে নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আবুল মা আলী ,মুহম্মদ হামিদ আলী ,কায়কোবাদ ,ইসমাইল হোসেন সিরাজী ,মীর রহমাত আলী ,কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে কারবালার ঘটনা নিয়ে মুহররম মাসে মুসলমানের একাংশ যে বিষাদময় গীতিকা গেয়ে থাকে তার নাম জারি গান। প্রকৃতপক্ষে মুহররমের মর্মস্পর্শী ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফার্সিও উর্দু ভাষার মতো বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য করুণভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ,জারিগান তারই এক বিশিষ্ট রূপ।

এই উপমহাদেশে কারবালার ঘটনা নিয়ে সাহিত্য নির্মাণের সূচনা হয় পনের শতকের শেষার্ধ্বে তখন কারবালার ঘটনা নিয়ে লেখা মার্সিয়া পড়া হতো। হিন্দু- মুসলমান সবাই মুহররমের মিছিল করত। মাতম করতো এবং এ মাতম উপলক্ষে ইরানী কবি কাশানীর ফার্সি হফতবন্ধ পড়া হতো। কিন্তু অনতিকাল পরে দাকিনী ভাষায় (প্রাচীন উর্দু ভাষায় ) কারবালার করুণ ঘটনা নিয়ে এক প্রকার মার্সিয়া কবিতা রচিত হতে লাগল। আহমদে নগরের কবি আশরাফ প্রথম বারের মতো মার্সিয়া লিখতে শুরু করেন। দক্ষিণ ভারত থেকে উত্তর ভারত ও অন্যান্য স্থানে কারবালা ঘটনা অবলম্বনে বিষাদময় কবিতা লেখার প্রচলন হয় এবং ধীরে ধীরে তার বিস্তৃতি ঘটে। বাংলা ভাষায় কারবালার ঘটনা নিয়ে সর্বপ্রথম কে সাহিত্য রচনার সূচনা করেন সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে এ পর্যন্ত যতদূর তথ্য প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে তাতে শায়খ ফয়জুল্লাহ কারবালা সম্বন্ধে জয়নবের চৌতিশা রচনা করেন যা এ সম্পর্কিত প্রথম বাংলা কবিতা বলে গণ্য করা হয়। সমসাময়িক কালে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা ও অর্থমন্ত্রী বাহরাম খান মাকতাল হোসেন রচনা করেন। মাকতাল হোসেন-এ ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনার বর্ণনা স্থান পায়। চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামের অধিবাসী মুহম্মদ খান এ সম্পর্কিত কয়েকখানি কবিতা রচনা করেন। রংপুরের ঘোড়াঘাট সরকারের অধীন ঝাড় বিশিলা গ্রামের কবি হায়াৎ মামুদ কাশেমের লড়াই নিয়ে জঙ্গনামা নামে কাব্য রচনা করে মার্সিয়া সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবি হামিদ কারবালা ঘটনা নিয়ে সংগ্রাম রচনা করেন। ব্রিটিশ আমলে ফকীর গরীবুল্লাহ জঙ্গনামা রচনা করেন। গরীবুল্লাহর জঙ্গনামা অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য হিসাবে পরিচিতি লাভ করে । আঠার শতকে রাঢ় অঞ্চলে কারবালার ঘটনা হিন্দু- মুসলমান লেখক ও পাঠকদের মধ্য প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করে । কবি রাধাচরণ এ এমাম এনের কেচ্ছা রচনা করেন।

উনিশশ তাকে চট্টগ্রামের কবি মোহাম্মদ হামিদ উল্লাহ খানে রচিত গুলজার-ই-শাহাদাৎ বা শাহাদা স্থান কাব্য খানি আগাগোড়া সাধু ভাষায় রচিত হয়। সুনামগঞ্জের লক্ষণ শ্রী পরগনা অধিবাসী ওয়াহিদ আলী পাচশ পৃষ্ঠার এক কাব্য বড় জঙ্গনামা রচনা করেন । অতঃপর বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং কবি -সাহিত্যিকগণ কারবালার ঘটনা নিয়ে সাহিত্য সৃজনে পাশ্চাত্য ভাবের আমদানি ঘটান। এ কবিদের মধ্যে মুহাম্মদ হামিদ আলী ,মতীয়ুর রহমান খান ,কায়কোবাদ ,আব্দুল বারী ,আব্দুল মুনায়েম ,ইসমাইল হোসেন সিরাজী ,আজিজুল হাকিম ,মুহম্মদ ইব্রাহিম প্রমুখের নাম উল্লেখ যোগ্য।

মুহাম্মাদ হামিদ আলীর পুরো নাম আবুল মা আলী মুহাম্মদ হামেদ আলী। তার বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের রাউজান থানার অধীন সুলতানপুর গ্রামে। তার জন্ম ১৮৬৫ সালে। তিনি জয়নলোদ্ধার এবং কাসেম বধ কাব্য রচনা করেন। কাব্য দু খানি মুসলমান পাঠকদের কাছে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে । কাসেম বধ কাব্যের বিষয় কারবালার ভীষণ যুদ্ধ ,নবী পরিজনের শোচনীয় দুর্গতি ও সখিনার মর্মভেদী বিলাপ। কবি নবীন চন্দ্র সনের মহাকাব্য প্রকাশের সময়কাল ১৮৯৬ সাল। এ মহাকাব্য রচনার যুগে কবি হামিদ আলী ক্লাসিক্যাল রীতিতে এ কাব্য লিখেন।

মতীযূর রহমান খান এবং কবি কায়কোবাদের আবির্ভাব একই সময়ে। মানিকগঞ্জ জেলার পারিল গ্রামে মতীয়ূর রহমানের জন্ম হয়। তিনি শক্তিকতা করতেন। তিনি এজিদ বধ মাসলেম বধ নামক দু খানি কাব্য রচনা করেন। এজিদ বধ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি মাত্র উপসর্গে রচিত একটি প্রকাণ্ড খণ্ড কবিতা । কবিতার প্রথমাংশে হোসাইন পরিবারের প্রতি ইয়াযীদের রূঢ় আচরণ এবং ইয়াযীদের রাজসভার বর্ণনা স্থান পেয়েছে।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কারবালার ঘটনা নিয়ে কাব্য রচনার ক্ষেত্রে কবি কায়কোবাদ অনন্য স্থান দখল করে আছেন। তার পূর্ব নাম মুহাম্মদ কাযেম আল কুরায়শী। ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৩৩ সালে তিনি মহরম শহীদ নামে তিন খণ্ডে সমাপ্ত কাব্য রচনা করেন।

কবি আব্দুল বারী ১৮৭৭ সালে নোয়াখালী জেলার মাইজদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কারবালা কাব্য রচনা করেন। ২১০ পৃষ্ঠার কাব্যে তিনি হোসাইন শিবির সন্নিবেশ ,যুদ্ধ ও আত্মত্যাগের বিবরণ তুলে ধরেন। ইসমাইল হোসেন সিরাজী শক্তিশালী লেখক ,কবি ও বক্তা ছিলেন । কারবালা ট্র্যাজেডি নিয়ে তিনি রচনা করেন মহাশিখা কাব্য।

আব্দুলল মুনায়েম ১৮৮৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার ফতেপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইমাম হাসান ,আলী আসগর ,আব্দুল ওহাব ,মহাবীর কাসেম ও ইমাম হোসাইন এই পাচ শহীদকে নিয়ে পঞ্চ শহীদ কাব্য রচনা করেন।

পাবনা শহরের কৃষ্ণপুরের অধিবাসী ছিলেন কবি মোহাম্মদ ইব্রাহিম । ১৮৮২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কারবালার ঘটনা অবলম্বনে তিনি শহীদের খুন রচনা করেন।

কবি আজিজুল হাকিম ঢাকা জেলার রায়পুর থানার হাসনাবাদ গ্রামে ১৯০৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। কারবালা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি মরু সেনা রচনা করেন।

মীর রহমত আলী নরসিংদী জেলার রসূলপুর গ্রামের অধিবাসী ছিলেন । তার লেখা মহরম কাব্য বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আজীবন দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতের জগতে এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছেন । কারবালাকে কেন্দ্র করে তিনি যে ক টি কবিতা ও গান লিখেছেন তা অসাধারণ ।

আধুনিক বাংলা সাহিত্য ছাড়া কারবালা ট্র্যাজেডি পল্লীর অগণিত মানুষের কাছে প্রতিভাত হয় বেদনার অথৈ সমুদ্র হিসাবে । মুহররমকে উপলক্ষ করে বাংলার প্রত্যন্ত জনপদে রচিত হয়েছে অসংখ্য জারীগান ও কবিয়ালদের কবিত্ব গাথা।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ,সম্রাট হুমায়ুনের সাথে ইরানী সৈনিক শিল্পী ও সাহিত্যিকগণের সংস্পর্শ বাংলাদেশের সাহিত্য ,সাংস্কৃতিক সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। এ ছাড়া এ সময়ে ইরানের রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে বহু শীয়া মতাবলম্বী নর-নারী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ এবং মুঘল সম্রাটগণ কর্তৃক বহু শীয়া আমির- এবং সুবাদার সুবে বাংলার শাসক নির্বাচিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গের সুন্নি নর-নারী শিয়া ধর্মীয়ভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । এ প্রভাবের কারণে মার্সিয়া সাহিত্যের বিস্তার ঘটে।

১৮৫৭ সালে দিল্লীর সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহী বিদ্রোহের সাথে জড়িত আছেন- এ অভিযোগে ইংরেজরা তাকে বন্দি করে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে । বাহাদুর শাহ শিয়া ছিলেন । (Religious Quest of India,Oxford University Press- ১৯৩০ ,Page No- ৬১ ) বাহাদুর শাহ কাব্য ও কবিতার সমঝদার ছিলেন এবং তিনি কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। সে সময় মার্সিয়া সাহিত্যের যথেষ্ট অনুশীলন হতো। কিন্তু বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসন দেওয়ার পরেই দিল্লী হতে শিয়া কবিগণ কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ গমন করেন এবং আস্তে আস্তে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েন। শিয়া কবিদের সংস্পর্শে এ দেশীয় কবি-সাহিত্যিকগণ মার্সিয়া রচনায় উৎসাহী হয়ে পড়েন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হতে যে সব কবি-সাহিত্যিক কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ আগমন করেছিলেন তাদের মধ্যে মার্সিয়া কাব্যের অধিকাংশ কবি শিয়া ছিলেন । কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে মুহররম উপলক্ষে তারা কাব্য রচনা করতেন। এভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই লক্ষৌ ও দিল্লীর পরিবর্তে কলকাতা মার্সিয়া সাহিত্যের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়।

মুঘল আমলে ঢাকা শহরে শিয়াগণের বসতি স্থাপিত হয়। ফলে ঢাকাতেও বেশ কয়েকখানি মার্সিয়া কাব্য রচিত হয়েছিল । পারস্যের জগদ্বিখ্যাত কবি ফেরদৌসীর শাহনামার অনুকরণে ঢাকার কবি সৈয়দ গোলাম আলী আল মুসাড় ১৮৪৬ সালে কারবালার মর্মবিদারক কাহিনী অবলম্বনে একখানি ফার্সি কাব্য রচনা করেন।

১৭৬৩ সালে বাংলার সর্বশেষ নবাব মীর কাশিমের সাথে ইংরেজদের বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মীর কাশিম পরাজিত হয়ে অযোধ্যার শাসনকর্তার আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাতে ইংরেজরা ভীষণ ক্ষুদ্ধ হয়। অযোধ্যার তৎকালীন শাসক নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের আশ্রয়ে বহু কবির জীবিকা নির্বাহ হতো। তিনি অত্যন্ত বিলাসী ছিলেন বলে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করেন নি। ফলে ইংরেজ সেনাপতি বিনা যুদ্ধে জয়লাভ করে নবাবকে বন্দি করে । পরে তাকে কলকাতায় আনা হয়। এ সময় অযোধ্যার অন্তর্গত লক্ষৌ শহর হতে মার্সিয়া সাহিত্যের কবিগণ চতুর্দিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়েন। এ সকল কবির কেউ কেউ নবাবের সঙ্গে মাটিয়াবুরুজ অঞ্চল ,কতক মুর্শিদাবাদ এবং কতক রামপুরের নবাব দরবারে আসেন ও তারা পুণরায় মার্সিয়া সাহিত্য চর্চা করতে থাকেন । যে সকল কবি মাটিয়াবুরুজে এসে নবাবের সাথে মিলিত হয়েছেন নবাব তাদের সম্মানজনক খেতাব ও উপঢৌকন দিয়েছেন। সপ্তগ্রহ নামে নবাবের একটি কবি পরিষদ ছিলো। এ পরিষদের সাতজন বিশিষ্ট কবিকে সপ্তগ্রহ বলা হতো। তারা হলেন : ফতেহ উদ দৌলা বকসীউল মুলক বাকি ,মাহতাব-উদ-দৌলা কাউকাব উল-মুলক সিতারা জঙ্গে দারাখশান ,নওয়াব মুহম্মদ তাকি খান লক্ষৌবি ,মীর্যা আলী ,মীর্যা মসীতা ,মীর্যা মুজাফফর আলী লক্ষৌবি ,বলায়েত আলী কাশ্মীরি।

এ সময় মার্সিয়া ধারার কবিতা রচনার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী অবস্থার সূচনা ঘটে। নবাব সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় আরো অনেকে মার্সিয়া কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ আগা হুসেন ,খাজা আরশাদ আলী খান ,মীর্যা আলী জান ,আমীর আলী খান ,সৈয়দ ইনশাআল্লাহ খান প্রমুখ।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় কবিগণের অধিকাংশ নবাব আলীবর্দী খান ও তদীয় দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার আমলে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদে আগমন করে কাব্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন । এ সকল কবি প্রধানত ফার্সিও উর্দু ভাষায় মার্সিয়া রচনা করতেন। বিখ্যাত ফার্সি কাব্য মকতুল হুসেন কাব্যের অনুভাবেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবিগণ বাংলা ভাষায় মার্সিয়া কাব্য রচনায় যত্নবান হন। তাদের মধ্যে মুহম্মদ খান ,হায়াৎ মামুদ ,ফকীর গরীবুল্লাহ ,রাধাচরণ গোপ ,হামিদ অন্যতম ।

কলকাতর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু উর্দু কাব্য কারবালার করুণ ঘটনা অবলম্বনে লিখিত হয়। উর্দু ভাষাতেও মার্সিয়া কাব্য রচনার রেওয়াজ বহুকাল যাবত চলেছিল । আনাসেরে শাহাদাতায়েন ,লতায়েফ আশরাফি এবং আবুল কাসিম মীর্যার জঙ্গনামা উর্দু ভাষায় লিখিত হয়েছিল । ফার্সীও উর্দু ভাষার ধর্মীয় বোধ ও প্রেরণা হতেই বাংলাদেশের বহু মুসলমান কবি-সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় মার্সিয়া রচনা করেন। এ সাহিত্যধারা সম্পর্কে সাহিত্যিক আব্দুল কাদির বলেন : ধর্মীয় পুস্তকাদি ছাড়া আর এক ধরনের পুথিতে উর্দু ,ফার্সির আধিক্য দেখা যায়। সে সমস্ত পুথি সাহিত্যের অধিকাংশই রচিত হয়েছে মুহররমের মর্মান্তিক ঘটনাকে উপলক্ষ করে । ইমাম হোসাইনের নিদারুণ হত্যা কাহিনীর ভিত্তিতে বাঙ্গালায় যে বিরাট পুথি সাহিত্য গড়ে উঠেছে ,আমি তার নামকরণ করেছি মার্সিয়া সাহিত্য । মহাজন পদাবলী ,নাথ গীতিকা ,মঙ্গলকাব্য চৈতন্য সাহিত্য প্রভৃতি যেমন উপাদান ও প্রকাশ রূপের দিকে দিয়ে পরস্পর হতে পৃথক ,তেমনি বাঙালার এই মার্সিয়া সাহিত্য বিষয়বস্তু ও বাকভঙ্গিতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

মার্সিয়া কাব্য রচনার ক্ষেত্রে কবিগণ চট্টগ্রাম ,ঢাকা ,মুর্শিদাবাদ ,হুগলী প্রভৃতি অঞ্চলে সুবাদার অথবা শাসন কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ সাহায্য ও উৎসাহ লাভ করতেন বলে মনে হয়। অন্যান্য অঞ্চল মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থানরূপে পরিগণিত হবার বহু পূর্বেই চট্টগ্রামে মুসলমানদের উপনিবেশ স্থাপিত হয়। তখন হতেই এখানে সমুমদ্রগামী বণিক ও ধর্মপ্রচারকগণ ঘাটি নির্মাণ করেছিলেন । ফলে পূর্ব ও উত্তরবঙ্গে যে মুসলিম শাসকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে তার মূলে চট্টগ্রামের অবদান অনেক খানি।

চট্টগ্রামের ন্যায় অন্যান্য কেন্দ্রস্থলে এবং তৎসন্নিহিত অঞ্চলসমূহে ফার্সিও উর্দু ভাষায় কাব্য চর্চাও যথেষ্ট হতো। মুহররমের সময় কবিগণের রচিত মার্সিয়া কাব্য ও কবিতা পাঠ হতো। বাংলাদেশের শিয়া শাসক বা নবাবের পৃষ্ঠপোষকতায় ইমামবাড়াগুলোতে মজলিস অনুষ্ঠান জাকজমকের সাথে পালিত হতো। এ কারণে কারবালা কাহিনী রাজধানীসহ তৎসন্নিহিত অঞ্চলের মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং জনমনে বিরাট প্রভাব বিস্তার করে । কোনো কারণে রাজ্যের শাসক ও কর্তৃপক্ষ রদবদল হলেও দেশের মুসলিম জনসাধারণ বংশ পরস্পরায় কারবালার করুণ ও মর্মস্পর্শী কাহিনীর প্রতি চিরদিনই হৃদয়ের টান অনুভব করে এসেছে। শুধু তা-ই নয় ধর্মীয় কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর আত্মত্যাগ সম্পর্কিত কাহিনী মুসলিম নর-নারীর নিকট চিরদিন গভীর শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছে। দীর্ঘকাল যাবত মুসলমানরা হিন্দুগণের পুরান পচালী শুনে সাহিত্য রস পিপাসা মিটিয়েছেন।

পরবর্তীকালে তাদের সমাজ মানসে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়। তারা নিজেদের ঐতিহ্য নির্ভর কাব্য কাহিনী পাঠ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো এবং এ প্রয়োজনের তাগিদেই ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিভিত্তিক সাহিত্যের সূত্রপাত। এ সাহিত্যের অন্যতম শাখা হিসাবেই বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। কবিগণ মুসলিম ঐতিহ্য নির্ভর কাহিনী গ্রহণ করলেন বটে কিন্তু কাব্যের কাঠামোর কোনো পরিবর্তন করলেন না। কাব্য কাঠামো বাঙালি হিন্দু কবি রচিত পুরান পচালীর ন্যায় রয়ে গেল। মুসলমান কবিগণ পুরান এর প্রভাব অতিক্রম করতে পারেনি।

যা হোক এ সকল সাহিত্যের মধ্যে দু টি ধারা লক্ষ্য করা যায়। প্রথম ধারা : সপ্তদশ-অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে হরি বংশ প্রভৃতির অনুসরণে নবী বংশ এবং শ্রীকৃষ্ণ বিজয় , পাণ্ডব বিজয় প্রভৃতির অনুসরণে রসূল বিজয় , মুহাম্মদ বিজয় ,কাসাসুল আম্বিয়া প্রভৃতি পয়গম্বরদের কাহিনী মূলক কাব্যাদি রচনা । দ্বিতীয় ধারা : হযরত রাসূলুল্লাহর পরবর্তী খলিফাগণের বিজয় অভিযানের বীরত্ব ব্যঞ্জক কথা ও ইমাম হোসাইনের কারবালার যুদ্ধের করুণ কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য রচনা ।

দ্বিতীয় ধারার কাব্যগুলোর সাধারণ নাম জঙ্গনামা জঙ্গনামা র বিষয়ব অত্যন্ত করুণ ও মর্মস্পর্শী। বাঙালি মুসলমানদের নিকট এ কাব্যের কদর হয়েছিল অত্যন্ত বেশি । প্রকৃতপক্ষে এ জঙ্গনামা বা বাংলা মার্সিয়ার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা তাদের প্রাণের কথা প্রতিধ্বনিত হতে শুনলেন এবং এর মাধ্যমে তাদের অতীত ঐতিহের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শিখলেন। বাংলা মার্সিয়া কাব্যগুলো প্রধানত অনুবাদ সাহিত্য হিসাবেই গড়ে ওঠে। বাঙালি কবিগণ যদিও মূলত ফার্সি ও উর্দু কাব্যের ভাব-কল্পনা ও ছায়া আশ্রয় করে তাদের কাব্যাদি রচনা করেছিলেন তথাপি এগুলোর মধ্যে যথেষ্ট মৌলিকতা ছিল । ফলে এ কাব্যগুলো এক প্রকার অভিনব সৃষ্টি হয়ে দাড়িয়ে ছিল । সুদূর আরব ও পারস্যের মানুষের কাহিনী কাব্যাকারে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে কবিগণ যে শিল্পরস ও পরিকল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তা অনকক্ষেত্রে অবাস্তব ও উদ্ভট হয়েছে। এতে মনে হয় বাঙালি কবিগণ মাটির প্রভাব অতিক্রম করতে পারেনি।

বাংলা ভাষায় জয়নবের চৌতিশা নামীয় একখানা মার্সিয়া কাব্য পাওয়া গিয়েছে। এটি ষোড়শ শতাব্দীর কবি শেখ ফয়জুল্লাহ রচিত। আপাতত অন্য কোন পুথি আবিস্কৃত না হওয়ায় এ কাব্যখানিকে মার্সিয়া সাহিত্যে প্রাচীনতম রচনা হিসাবে গ্রহণ করো যায়। এতে কারবালার করুণ কাহিনীর সাথে ইমাম হোসাইনের বোন বিবি যায়নাবের বিলাপ বর্ণিত হয়েছে। সম্প্রতি অধ্যাপক আলী আহম্মদ কর্তৃক আবিষ্কৃত ষোড়শ শতাব্দীর কবি দৌলত উজির বাহরাম খানের রচিত জঙ্গনামা র সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। পুথিখানির মাত্র কয়েক পাতা পাওয়া গিয়েছে। এটি শেখ ফয়জুল্লাহর সমসাময়িক বলে ধারণা করছেন ঐতিহাসিকগণ।

এরপরে চট্টগ্রামের লোকপ্রিয় কবি মুহাম্মদ খান মাকতাল হোসেন কাব্য রচনা করেন ১৬৪৫ সনে ,যা অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য। মুহম্মাদ খানের এ কাব্য বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে পঠিত হতো। রংপুরের কবি হায়াৎ মামুদের জঙ্গনামা ১৭২৩ সালে রচিত হয় এবং পূর্ববঙ্গের সিলেটের কবি হামিদের সংগ্রাম হুসন কাব্যের অনুলিপি হয় ১৭৪১ সালে। হয়তো কবি মূল কাব্য এর অনেক পূর্বেই রচনা করেছিলেন । হায়াত মামুদ উত্তরবঙ্গের একজন শ্রেষ্ঠ কবি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের বাংলা ভাষায় কাব্য রচনায় যে ধারার সূত্রপাত হয় তাতে বহু কবি মার্সিয়া কাব্য রচনায় যত্নবান হয়েছিলেন । এ ধারার প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবি গরীবুল্লাহ। তিনি জঙ্গনামা কাব্য প্রণয়ন করেন। ফকির গরীবুল্লাহ ফার্সি-উর্দু-হিন্দি শব্দ মিশ্রিত বাংলা ভাষার এক নতুন ধরনের সাহিত্য সৃষ্টির সূচনা করেন। তৎপর রাঢ়ের হিন্দু কবি রাধাচরণ গোপের ওফাৎনামা এবং ইমাম গণের বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাব্য দু খানি পশ্চিমবঙ্গের এমাম এনের কেচ্ছা বোলপুর নিকেতনের লোহাগুড়ি গ্রাম হতে আবিস্কৃত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গের ভূরশুই কানপুর পরগনা হতে মুন্সী জোনাব আলীর শহীদে কারবালা প্রকাশিত হয়। সাদ আলী ও আব্দুল ওহাব শহীদে কারবালা র কাব্যধারা সংযোজন করেন। মুসলমানী বাঙলায় রচিত পুথির আদি কবি ফকীর হাবিবুল্লাহ ফার্সি-উর্দু-হিন্দী মিশ্রিত বাংলা ভাষায় কাব্য রচনার যে রীতি চালু করেছিলেন তা বর্তমান সময়েও হয়ে আসছে। অতি আধুনিককালের কবিদের মধ্যে রংপুরের মুহাম্মদ ইসহাক দাস্তান শহীদ কারবালা এবং চট্টগ্রামের কাজী আমিনুল হকের জঙ্গে কারবালার নাম উল্লেখযোগ্য।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সিলেটের অশিক্ষিত ,অর্ধশিক্ষিত মুসলমানগণের মধ্যে এক প্রকার নাগরীলিপিতে বাঙলা সাহিত্য চর্চা হতো। দেবনাগরী ভাষা হতে এটি ভিন্ন প্রকৃতির। এটি প্রধানত সিলেটের মুসলমানদের মধ্যে চালু ছিল বলে এর নাম সিলেটি নাগরী । এ লিপিতে বাংলা কাব্য রচনার রীতি শুধু সিলেট অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল । স্থানীয় মুসল মানরাই ছিলেন এ কাব্যের পৃষ্ঠপোষক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হতে এ লিপিতে কাব্যাদি রচনা যথারীতি চালু হয়। নানা বিষয়ক কাব্যের মধ্যে মার্সিয়া ধারার কাব্য অন্যতম। সিলেটি নাগরী লিপিতে বাংলা ভাষায় একখানি জঙ্গনামা কাব্য লেখেন ওয়াহিদ আলী নামক এক কবি। ওয়াহিদ আলীর বাড়ি ছিল সুনামগঞ্জ জেলার ষোলঘর মৌজায়। তার রচিত জঙ্গনামা পাঁচশ পৃষ্ঠার এক সুবৃহৎ কাব্য।

আধুনিক কালের কবি-সাহিত্যিকগণ বহু কবিতা ও কাব্য রচনা করে বাংলা মার্সিয়া সাহিত্য ভাণ্ডারকে বিকশিত করে গেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি নজরুল ইসলাম মুহররম ও কারবালা কাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশের ওপর ভিত্তি করে অনেক কবিতা ও ইসলামী গান রচনা করেছেন । বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলসমূহে বহু লোককবি কারবালার কাহিনীর বিষাদ অংশ অবলম্বনে অসংখ্য পল্লীগান রচনা করেছেন যা এ দেশের বিস্তৃত জনপদে আপামর জনসাধারণের অন্তরে বেদনার করুণ ভাব সৃষ্টি করেছে। কারবালা কাহিনীর বিশেষ বিশেষ অংশ অবলম্বনে রচিত পল্লীগানগুলোর অধিকাংশ জারী হিসাবে রচিত ও পঠিত হয়েছে । জারীগান ছাড়াও বাংলা মার্সিয়া বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। মার্সিয়ার তাল ও সুর বিষাদে পরিপূর্ণ । বাংলা মার্সিয়া সাহিত্য এবং সংগীত মুসলমানদের ধর্মীয় পটভূমিকে উপলক্ষ করেই গড়ে ওঠে এবং ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে অগ্ রণী ভূমিকা রেখেছে।

*প্রবন্ধটি ভারতের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকের এম ফিল গবেষণায় থিসিস অবলম্বনে রচিত।

পবিত্র আহলে বাইতের মুহাব্বাত ঈমানের অংশবিশেষ। আর তাদের প্রতি কৃত পাশবিক অত্যাচারের কাহিনী ভুলে যাওয়ার মতো নয়। হযরত হোসাইন (রা.) এবং তার সাথীদের ওপর নিপীড়নমূলক ঘটনা এবং হৃদয়বিদারক শাহাদাত যার অন্তরে শোক এবং বেদনা সৃষ্টি করে না ,সে মুসলমান তো নয়ই ,মানুষ নামেরও অযোগ্য।

মুফতী শফী (রহ.)

মানদণ্ডসমূহ

রাসূল (সা.) গাদীর দিবস ও বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করে আলীকে (আ.) তার খলিফা ও প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করানো ছাড়াও আরো অনেক হাদীস বলেছেন যা আলী (আ.)-এর খেলাফতকেই প্রমাণ করে। আমরা এ অধ্যায়ে যে সমস্ত হাদীস মানদণ্ড শিরোনামে তুলে ধরব তাতে রাসূল (সা.) এমন এক মানদণ্ড ও পরিমাপক নির্ধারণের প্রচেষ্টায় আছেন যে , যখন ইসলামী রাষ্ট্রে ভুল-ভ্রান্তি ও যে সব ক্ষেত্রে সত-অসত্য মিশ্রিত হয়ে যায় এবং সত্যকে অসত্য হতে আলাদা করা সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যাপূর্ণ হয় , তখন যেন তারা ঐ মানদণ্ড বা পরিমাপকের সহায়তায় সত্যকে গ্রহণ করে অসত্যকে পরিহার করে। এ সমস্ত হাদীসে তিনি হযরত আলীকে (আ.) হেদায়াতের প্রদীপ , ঈমানের মাপকাঠি এবং সত্যের মানদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল হাদীসানুসারে হযরত আলী (আ.) একজন সাধারণ রাহবার (পথনির্দেশক) নন , বরং এমন ঐশী পথনির্দেশক যে , তার সকল কথাবার্তা ও কাজ-কর্মই হচ্ছে মানদণ্ড , সৎকর্ম হচ্ছে সেটাই যা তিনি সম্পাদন করেন , সত্যবাণী তাই যা তিনি বলেন , সত্য-মিথ্যার দ্বন্দে তিনি যে পক্ষে আছেন সে পক্ষই সত্য। যে ব্যক্তি তার সাথে নেই সে নিশ্চয় বাতিল ও ভ্রান্ত।

1. ভালবাসা

যে বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর পর তার উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তা হচ্ছে যে , তিনি কাকে বেশী ভালবাসতেন। হাদীস গ্রন্থ সমূহ ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , আলী (আ.)-এর সম্পর্কে এত পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে ততখানি বর্ণিত হয়নি। রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) যতটা পছন্দ করতেন ও ভালবাসতেন অন্য কোন সাহাবীকে তিনি ততটা ভালবাসতেন না।114 যেমনভাবে ইবনে হাজার তার সাওয়ায়েক’’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীই ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়পাত্র।115

রাসূল (সা.) যে নিজেই শুধু আলীকে (আ.) ভালবেসে ক্ষান্ত ছিলেন তা নয় , বরং মুসলমানদেরকেও বলতেন তাকে (আলীকে) ভালবাসার জন্যে এবং এটাও বলতেন যে , আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।116

কখনো কখনো বলতেনঃ আমি আলীকে যতটা ভালবাসি মহান আল্লাহ তাকে তার চেয়েও বেশী ভালবাসেন।117

অথবা- আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়পাত্র হচ্ছে আলী।118

হযরত আয়েশা বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহ এমন কাউকেই সৃষ্টি করেননি যে রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীর চেয়ে প্রিয় বা পছন্দের হবে।119

তিনি তার সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- সাহাবীদের মধ্যে চারজনকে যেন আমি বেশী বেশী ভালবাসি এবং আরো বলেছেন- তিনি নিজেই তাদেরকে বেশী বেশী ভালবাসেন।

সাহাবাগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা ? আমরাও কামনা করি যেন তাদেরই একজন হতে পারি।

তিনি বললেন জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। অতঃপর নীরব রইলেন। আবারও মুখ খুললেন এবং বললেন- তোমরা জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। এই কথা বলে পূর্বের ন্যায় নীরব হয়ে গেলেন।120

অতঃপর আবার বললেনঃ

یحب اللّه و رسوله و یحبه اللّه و رسوله

অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রাসূল তাকে (আলীকে) ভালবাসেন এবং সেও (আলীও) আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালবাসে।121

আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূল (সা.)-এর জন্য কিছু ভাজা মুরগী আনা হলে তিনি হাত তুলে দোয়া করলেন- হে প্রভূ !তুমি এমন কাউকে পাঠিয়ে দাও যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালবাসে। ঐ মুহূর্তে আলী দরজায় করাঘাত করলেন। যেহেতু আমি চেয়েছিলাম সেই ব্যক্তি আনসারদের মধ্যে কেউ হোক , তাই তাকে বললাম রাসুল (সা.) এখন ব্যস্ত আছেন।

আলী ফিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবারও করাঘাত করলেন। আমি একই কথা তাকে বললাম। তিনি ফিরে গেলেন। যখন তিনি তৃতীয়বার করাঘাত করলেন , তখন রাসূল (সা.) বললেনঃ হে আনাস! তাকে আসতে দাও , আমি তারই জন্য অপেক্ষা করছি।122

এ ছাড়াও তার প্রতি ভালবাসার কথা এত বেশী বলা হয়েছে যা অন্য কারো সম্পর্কে বলা হয়নি। যেমন-

(1-ক) আলীর সাথে বন্ধুত্ব মানেই আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে বন্ধুত্ব ও আলীর সাথে বিদ্বেষই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে বিদ্বেষের শামিল

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- একদিন রাসূল (সা.) ও আলী পরস্পর হাত ধরে ঘর থেকে বের হলেন ও বললেনঃ তোমরা জেনে রাখ! যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তরে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসলো সে আল্লাহ ও তার রাসূলকেই ভালবাসলো।123

রাসুল (সা:) আলীকে বলেছেনঃ

یا علی ! انت سید فی الدنیا و سید فی الاخره حبیبک حبیبی و حبیبی حبیب اللّه و عدوک عدوی و عدوی عدو اللّه والویل لمن ابغضک بعدی

অর্থাৎ হে আলী! তুমি ইহকাল ও পরকালের নেতা। তোমার বন্ধু আমার বন্ধু আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু ও আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। অভিশাপ তার উপর যে আমার পরে তোমার সাথে শত্রুতা করবে।124

আরো বলেছেনঃ

یا علی محبک محبی و مبغضک مبغضی

অর্থাৎ হে আলী! যে তোমাকে ভালবাসলো সে আমাকে ভালবেসেছে আর যে তোমার প্রতি ক্রোধান্বিত সে আমার প্রতি ক্রোধ পুষে রেখেছে তার অন্তরে ।125

(1-খ) আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণকারী সৌভাগ্যশালী

তিনি বলেছেনঃ যারা আমাকে এবং এই দু জনকে (হাসান ও হোসাঈন) ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসবে কিয়ামতের দিন তারা আমার স্তরে স্থান লাভ করবে বা আমার সাথে থাকবে।126

এবং আরো বলেছেনঃ যারা চায় আমার মত করে বেচে থাকতে ও আমার মত মৃত্যু বরণ করতে এবং ঐ বেহেশতে বাস করতে যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন , তারা যেন আলী ইবনে আবী তালিবকে ভালবাসে।127

তিনি আরো বলেছেনঃ এ হচ্ছে জিব্রাইল যে আমাকে সংবাদ প্রদান করেছে: প্রকৃত সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি সে , যে আলীকে যেমন জীবিতাবস্থায় ভালবাসবে তেমনি তার (আলীর) মৃত্যুর পর , আর প্রকৃত হতভাগ্য সে ব্যক্তি , যে আলীর প্রতি যেমন জীবিতাবস্থায় ঘৃণা পোষণ করবে তেমনি তার মৃত্যুর পরও।128

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আগুন হতে মুক্তিলাভের কোন উপায় আছে কি ?

তিনি বললেন- হ্যাঁ ,

আমি বললাম- সেটা কি ?

তিনি বললেন- আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করা।129

(1-গ) আলীকে ভালবাসা সৎকর্ম

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حب علی بن ابیطالب یاکل السیئات کما تاکل النار الحطب

অর্থাৎ আলীকে ভালবাসলে কুলষতা ঐরূপে ধ্বংস হয়ে যায় যেরূপে শুকনা কাঠ আগু্নে পোড়ালে ধ্বংস হয়।130

তিনি আরো বলেছেনঃ

عنوان صحیفه المؤمن علی بن ابی طالب

অর্থাৎ আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করাই হবে মু মিনদের আমলনামার শিরোনাম ।131

(1-ঘ) আলীর প্রতি ভালবাসা ব্যতীত কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন-

لو ان عبدا عبد اللّه الف عام و الف عام و الف عام بین الرکن و المقام ثم لقی اللّه عز و جل مبغضا لعلی بن ابیطالب و عترتی اکبه اللّه علی منخریه فی النار

অর্থাৎ যদি কোন বান্দা লক্ষ কোটি বছর মাকামে ইব্রাহীম এবং হাজরে আসওয়াদের (রোকন ও মাকামের) মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহর ইবাদত করে , কিন্তু আলীর প্রতি ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী হিসেবে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয় , তারপরেও আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবে।132

তিনি আরো বলেছেনঃ

یا علی لو ان امتی صاموا حتی یکونوا کالحنایا و صلوا حتی یکونوا کالاوتار ثم ابغضوک لاکبهم اللّه علی وجوههم فی النار

অর্থাৎ হে আলী! যদি আমার উম্মত এমনভাবে রোজা রাখে যে , তার দেহ (পিষ্ঠদেশ) ধনুকের রূপলাভ করে এবং যদি এমনভাবে নামাজও পড়ে যে , তার দেহ (ধনুকের) তন্ত্রীর ন্যায় শীর্ণ হয়ে যায় অথচ তার অন্তরে যদি তোমার প্রতি ঘৃণা থাকে , তাহলেই আল্লাহ তাকে নিম্নমুখী করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।133

(1-ঙ) আলীর প্রতি ঘৃণা এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসা এ দু টি কখনোই একতিতে হতে পারে না

তিনি বলেছেনঃ

یا علی من زعم انه یحبنی و هو یبغضک فهو کذاب

অর্থাৎ হে আমার প্রাণপ্রিয় আলী! সেই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী যে চিন্তা করে আমাকে ভালবাসে অথচ তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।134

(1-চ) আলীর প্রতি ঘৃণা করা ও ঈমানদার বলে দাবী করা একেবারেই অসম্ভব

রাসূল (সা.) বলেন-

من زعم انه آمن بی و ما جئت به و هو یبغض علیا فهو کاذب لیس بمؤمن

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধারণাপোষণ করে যে , আমার প্রতি ও আমার দ্বীনের প্রতি ঈমান এনেছে অথচ আলীর প্রতি ঘৃণাপোষণ করে , সে মিথ্যাবাদী , সে মু মিন নয়।135

(1-ছ) আলীর প্রতি বিদ্বেষপোষণ কুফরের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যদি কেউ তোমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ করে মৃত্যু বরণ করে , তাহলে সে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল। কিন্তু তার আমলের হিসাব মুসলমানদের মতই হবে।136

উপরোক্ত হাদীসের গভীরতা খুজে বের করার জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

কিয়ামতের দিন কাফেরদের হিসাব সম্বন্ধে দু টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছেঃ

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি: এমন কাফের যাদেরকে তাদের কুফরীর জন্য জবাবদিহি করতে হবে ও তাদের জন্য কঠিন শাস্থির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত আমলাদি যা ইসলাম ওয়াজিব (ফরজ) করেছিল তার জন্য তার নিকট জবাবদিহি চাওয়া হবে না। যেমনভাবে ঐ পাপকর্ম যা ইসলামে হারাম তা তার কাছ থেকে হিসাব চাওয়া হবে না। কেননা এই হিসাব-কিতাব ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি কুফরীর সাথে সংযুক্ত নয়। কারণ যেহেতু কুফরীর তুলনায় সমস্ত পাপকর্ম অতিক্ষুদ্র তাই কাফেরদের ক্ষেত্রে অন্যান্য হারামকৃত বিষয়ে হিসাব চাওয়া হবে না।

দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি: কাফের যেমনভাবে তার কুফরী ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তেমনি তার আমলের কারণেও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ সে ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণের কারণ ছাড়াও স্বীয় পাপকর্মের এবং ওয়াজিব (ফরজ) কর্মসমূহ সম্পাদন না করার কারণেও শাস্তিভোগ করবে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ একটি সূত্র তৈরী করে বলেছেনঃ

الکفارمعاقبون علی الفروع کما انهم معاقبون علی الاصول

অর্থাৎ কাফের যেমন তার বিশ্বাসগত বিচ্যুতির কারণে শাস্তি পাবে তেমনি শাস্তি পাবে তার কৃতকর্মের জন্য।

উপরোক্ত হাদীসে যে সকল কাফেরের কথা বলা হয়েছে তারা সবাই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির দলিলে।

(1-জ) আলীর প্রতি ভালবাসা ঈমানের চিহ্ন ও তার প্রতি বিদ্বেষ মোনাফিক বা কপটতার চিহ্ন

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ

لا یحبک الا مؤمن و لا یبغضک الا منافق

অর্থাৎ মু মিন ব্যতীত তোমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত তোমার প্রতি কেউ বিদ্বেষী হবে না।137

তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন যে , মু মিন ব্যতীত আমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত আমাকে কেউ ঘৃণা করবে না।138

উক্ত কারণে সাহাবীগণ বলতেনঃ আমরা আলী ইবনে আবী তালিবের প্রতি শত্রুতা করা দেখে মোনাফিককে চিনতাম।139

2. আলীকে কষ্ট প্রদান অর্থাৎ রাসূলকেই কষ্ট প্রদান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من آذی علیا فقد آذانی

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিল সে যেন প্রকৃতার্থে আমাকেই কষ্ট দিল।140

তিনি আরো বলেনঃ হে আলী! যে তোমাকে আঘাত দিল সে যেন আমাকেই আঘাত দিল আর যে আমাকে আঘাত দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল।141 .

3. আলীকে গালমন্দ করা রাসূলকে (সা.) গালমন্দ করার শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আলীকে গালমন্দ করল সে আমাকেই গালমন্দ করল আর যে আমাকে গালমন্দ করল সে আল্লাহকেই গালমন্দ করল আর যে আল্লাহকে গালমন্দ করল আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।142

4.আলীকে পরিত্যাগ করা রাসূলকে পরিত্যাগের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من فارق علیا فارقنی و من فارقنی فارق اللّه عزوجل

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে পরিত্যাগ করল সে আমাকেই পরিত্যাগ করল আর যে আমাকে পরিত্যাগ করল সে আল্লাহকে পরিত্যাগ করল।143

5. আলীর সাথে যুদ্ধ করার অর্থ রাসূলের সাথে যুদ্ধ করা

আবু হোরায়রা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আলী , ফাতিমা , হাসান ও হোসাঈনকে (আ.) দেখে রাসূল (সা.) বললেন-

انا حرب لمن حاربکم و سلم لمن سالمکم

অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব।144

6. হিদায়াতের প্রতীক

রাসূলে আকরাম (সা.) আবু বারযাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা আলী ইবনে আবী তালিব সম্পর্কে আমাকে বলেছেন- সে হচ্ছে হিদায়াতের প্রতীক , ঈমানের চিহ্ন , খোদাপ্রেমীদের ইমাম ও আল্লাহর সকল আনুগত্যকারীদের জন্য আলোক বর্তিকা।

7. আলী এবং হক বা সত্য

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و الحق معه حیثما دار

অর্থাৎ আলী হক বা সত্যের সাথে আর হক বা সত্য আলীর সাথে যা পরস্পরকে ঘিরে আছে।145

8. হক বা সত্য এবং আলী

তিনি আরো বলেনঃ

الحق مع علی حیث دار

অর্থাৎ আলী যে দিকেই যাবে হক বা সত্যও সে দিকেই তার সাথে গমন করবে।146

9. আলী , সত্য এবং কোরআন

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و القرآن و الحق و القرآن مع علی لن یتفرقا حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী , কোরআন এবং সত্যের সাথে আছে ; সত্য এবং কোরআনও আলীর সাথে আছে। তারা আমার সাথে হাউজে কাউসারে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।147

10. আলী ও কোরআন

নবী কারিম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع القرآن والقرآن مع علی لا یفترقان حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী কোরআনের সাথে আর কোরআন আলীর সাথে তারা ঐ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না যে পর্যন্ত না হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হবে।148

11. আলীর মর্যাদা কাবা ঘরের মর্যাদার সমান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انت بمنزله الکعبه تؤتی و لا تاتی

অর্থাৎ হে আলী! তোমার মর্যাদা কাবা ঘরের তুল্য যার পানে সবাই ছুটে আসে। কিন্তু সে কারো দিকে যায় না।149

তিনি আরো বলেন-

مثل علی فیکم کمثل الکعبه المتسوره النظر الیها عباده والحج الیها فریضه

অর্থাৎ আলী তোমাদের মাঝে ঠিক কাবা ঘরের মত , যার প্রতি তাকানো ইবাদত ও হজ্জ করা ওয়াজিব (ফরজ)।150

12. আলী শিক্ষার তোরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی باب حطه فمن دخل منه کان مؤمنا و من خرج منه کان کافرا

অর্থাৎ আলীই হচ্ছে শিক্ষার দ্বার , যে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সেই মু মিন আর যে এ দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে সে কাফির।151

13. আলী ঈমানের মানদণ্ড

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

لولاک یا علی ما عرف المؤمنون من بعدی

অর্থাৎ হে আলী! যদি তুমি না থাক তাহলে আমার পরে মু মিনদেরকে আর চেনা যাবে না।152

14. হক (সত) ও বাতিলের (মিথ্যার) পৃথককারী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

نت الفاروق بین الحق والباطل

অর্থাৎ হে আলী! তুমিই সত্য ও মিথ্যার পৃথককারী।153

15. ঈমানের প্রতীক

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

جعلتک علما فیما بینی و بین امتی فمن لم یتبعک فقد کفر

অর্থাৎ হে আলী! আমি তোমাকে আমার ও আমার উম্মতের মাঝে ঈমানের প্রতীক হিসেবে রেখেছি , যে তোমার অনুসরণ করবে না সে কাফের।154

16. স্বর্গ ও নরকের বন্টনকারী

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেন-

انت قسیم النار

অর্থাৎ তুমি হচ্ছ জাহান্নাম বন্টনকারী।155

আর তিনি (আলী) নিজেই বলেছেনঃ

انا قسیم النار

আমি হচ্ছি জাহান্নাম বন্টনকারী।156

তিনি আরো বলেন- আমি (আলী) হলাম জাহান্নামের বন্টনকারী। কিয়ামতের দিন আমি জাহান্নামকে বলবো- এটা তোমার জন্য আর ঐটা আমার জন্য অথবা একে তুমি নাও আর তাকে ছেড়ে দাও।157

এখানে বন্টনকারী বলতে যিনি ভাগাভাগি করে দেন তাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যিনি দুইটি জিনিসকে দু দলের মাঝে ভাগ করে দেন। সুতরাং যখন বলা হবে যে , আলী জাহান্নামের বন্টনকারী অর্থাৎ তিনি নিজের ও জাহান্নামের মাঝে জনগণকে ভাগ করে দিবেন। অতএব উক্ত হাদীসের উদ্দেশ্য হল যে , আলীর সত্ত্বা হচ্ছে জাহান্নামের বিপরীত অর্থাৎ কিছু লোক জাহান্নামবাসী হবে আর কিছু লোক আলী (আ.)-এর দল হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে , আলীই হচ্ছে বেহেশতের প্রতিকৃতি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি তৃতীয় হাদীস হতে স্পষ্ট হয় তা হচ্ছে এই ভাগ- বাটোয়ারা আলী (আ.)-এর ইচ্ছাধীন , কেননা তিনিই তো জাহান্নামকে বলবেন যে কাকে গ্রহণ করবে কাকে বর্জন করবে। যেমনভাবে রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ তুমিই হচ্ছ জান্নাত ও জাহান্নামের বন্টনকারী।158

দৃশ্যতঃ উক্ত হাদীস হচ্ছে যে , আলী (আ.) মানুষের মাঝে জান্নাত ও জাহান্নাম বন্টন করে দিবেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এইভাবে বন্টন করার প্রয়োজনই পড়ে না বরং তার উপস্থিতিই বন্টনের মানদণ্ড। অর্থাৎ আলী (আ.) মানুষের বেহেশতবাসী হওয়ার মাপকাঠি ও মানদণ্ড। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতবাসী বলে গণ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আলী (আ.) হতে বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে বিচ্যুত হবে না । কিন্তু যখনই সে পথচ্যুত হবে এবং ঐ পবিত্র সত্তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল হবে তখন এমনই শুকনা কাঠ হবে যা জাহান্নামের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অতঃপর উক্ত হাদীসের সারকথাও বাকী তিনটি হাদীসের সারকথার মতই। সবগুলির সারকথা হচ্ছে- আলী (আ.) নিজেই বেহেশতের প্রতিকৃতি ও বেহেশতবাসী হওয়ার মানদণ্ড।

17. পুল সিরাতের অনুমতিদাতা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যতক্ষণ পর্যন্ত আলী অনুমতিপত্র লিখবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পুল সিরাত পার হতে পারবে না।159

18. আলীর আনুগত্যেই সৌভাগ্য নিহিত

রাসূলে আকরাম (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেছেন-

والذی نفسی بیده ان هذا و شیعته هم الفائزون یوم القیامه

অর্থাৎ শপথ ঐ সত্ত্বার , যার হাতে আমার প্রাণ- আলী ও তার শিয়াগণ (প্রকৃত অনুসারীগণ) কিয়ামতের দিনে সৌভাগ্যবান হিসেবে পরিগণিত হবে।160

19. আলীর প্রকৃত অনুসারীরাই বেহেশতবাসী

রাসূল (সা.) তাকে (আলীকে) বলেছেনঃ

انت و شیعتک فی الجنه

অর্থাৎ তুমি ও তোমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) সকলেরই জান্নাতবাসী।161

20. সফলকামী দল

রাসূলে করিম (সা.) তাকে (আলীকে) ইশারা করে বলেন-

هذا و حزبه المفلحون

অর্থাৎ সে এবং তার দল সফলকাম।162

21. আলীর অনুসারীগণ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং তার সন্তুষ্টভাজন

রাসূলে খোদা (সা.) আমাকে (আলীকে) বলেছেন যে , আমি ও আমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) এমন অবস্থায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হব যে , আমরা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবো এবং আল্লাহও আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকবেন।163 অনুরূপ তুলনা কোরআন শরীফেও এসেছে , সূরা বাইয়্যেনা তে বলা হয়েছেঃ

) ر َضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ(

অর্থাৎ আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট ও তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট।

উক্ত আয়াতের পরে রাসূলের হাদীসও বর্ণিত হয়েছে যে , উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আলী এবং তার শিয়াগণ (অনুসারীগণ)। এই মর্যাদাটি অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট আর আল্লাহও তার উপর সন্তুষ্ট হবে এটা মানুষের পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায়। কারণ , কোরআন শরীফ এরূপ মানুষের সত্তাকে নাফসে মোতমাইন্না অর্থাৎ পরিতৃপ্ত আত্মা বলে অভিহিত করেছে অর্থাৎ যে আত্মা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মশগুল এবং তার স্মরণে এমন প্রশান্তি লাভ করেছে যে , বস্তু জগতের কোন শঙ্কা , অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা তাকে বিচলিত করে না , বলা হয়েছে-

) ي َا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ () ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً(

অর্থাৎ হে পরিতৃপ্ত আত্মা! আল্লাহর দিকে এসো , তুমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।

22. আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত

রাসূলে আকরাম বলেছেনঃ

ذکر علی عباده

অর্থাৎ আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত।164

23. আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত

হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমার পিতাকে দেখেছি যে , তিনি বেশী বেশী আলীর চেহারার প্রতি তাকিয়ে থাকতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে , হে আমার পিতা! আপনি আলীর প্রতি এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন ?

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- হে আমার কন্যা! আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে , তিনি বলেছেন- আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত।165

24. আলী (আ.) জান্নাতের দরজা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا مدینه الجنه و علی بابها یا علی کذب من زعم انه یدخلها من غیر بابها

অর্থাৎ আমি হলাম বেহেশতের নগর আর আলী তার দ্বার , ঐ ব্যক্তি ভুল করবে যে ব্যক্তি দরজা ব্যতীত প্রবেশ করতে চাইবে।166

25. আলী (আ.) বেহেশতের দীপ্তিময় প্রদীপ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی یزهر لا هل الجنه کما یزهر کوکب الصبح لا هل الدنیا

অর্থাৎ ধ্রুবতারা যেমনভাবে পৃথিবীকে আলোকিত করে , আলী ঠিক তেমনিভাবে বেহেশতবাসীদেরকে আলোকিত করবে।167

26. মুসলমানদের পিতা আলী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حق علی علی کل مسلم حق الوالد علی ولده

অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমানদের উপর আলীর অধিকার তেমনি , যেমন প্রত্যেক পিতার অধিকার তার সন্তানের উপর।168

27. আলীর অনুসরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من اطاعنی فقد اطاع اللّه و من اطاعک اطاعنی , و من عصانی فقد عصی اللّه و من عصاک فقدعصانی

অর্থাৎ যারা আমার অনুসরণ করে তারা আল্লাহর অনুসরণকারী , আর যারা আলীর অনুসরণ করে তারা আমার অনুসরণকারী যারা আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আল্লাহর অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে যারা আলীকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আমার অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে।169

28. রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

صاحب سری علی بن ابیطالب

অর্থাৎ আলী হচ্ছে আমার গোপনীয়তা রক্ষাকারী।170

হযরত আয়েশা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে , আলী ছিল রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী।171

29. আলী , রাসূল (সা.)-এর মাথা স্বরূপ

علی منی مثل راسی من بدنی

অর্থাৎ আলীর অস্তিত্ব আমার নিকট ঐরূপ (প্রয়োজনীয়) যেরূপ শরীরের নিকট মাথার অস্তিত্ব ।172

30. আলীর উপাধিসমূহ

রাসূল (সা.)-এর খলিফা (প্রতিনিধি) নির্ধারণের মাপকাঠিগুলোর মধ্যে একটি মাপকাঠি হচ্ছে- এমন কিছু উপাধি যা রাসূল (সা.) তার জীবদ্দশায় কোন ব্যক্তিকে দিয়েছেন। যেমন- হাদীসের গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে , আলীর মত মর্যাদাকর উপাধিধারী ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে দ্বিতীয় কেউ নাই। হাদীসবেত্তারা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.)-এর কোন সাহাবাই হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় মহামূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনি।

আলীকে রাসূল (সা.) যে সকল উপাধিতে ভূষিত করেছেন সেগুলো আমরা নিম্নে তুলে ধরছি: (30-ক) সিদ্দীক ,173

(30-খ) সিদ্দীকে আকবর,174

(30-গ) সাইয়্যেদুল আরাব ,

একদিন রাসূল (সা.) আয়েশাকে বললেনঃ যদি তুমি আরবের সর্দার (সাইয়্যেদ) ও নেতাকে দেখতে চাও , তাহলে আলী ইবনে আবী তালিবের দিকে তাকাও। আয়েশা বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আরবের সর্দার নন ? তিনি বললেনঃ আমি গোটা মানবজাতির সর্দার আর আলী হচ্ছে আরবের সর্দার।175

(30 - ঘ ) সাইয়্যেদুল মুসলিমীন ( মুসলমানদের সর্দার ) ও ইমামুল মুত্তাকিন ( পরহেযগারদের ইমাম) । 176

(30-ঙ) সাইয়্যেদুল মু মিনীন (মু মিনগণের সর্দার) ও ইমামুল মুত্তাকিন (পরহেযগারদের ইমাম) এবং ক্বায়্যেদুল গাররিল মোহাজ্জালীন (কিয়ামতের দিন মুখোজ্জল চেহারাধারীদের নেতা ও অগৃদূত)।

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে রাত্রে আমি মেরাজে গিয়েছিলাম , সে রাত্রে আলীর তিনটি উপাধি আমার উপর ওহী হয়েছিল। সে তিনটি উপাধি হচ্ছে- (1) সে মু মিনদের সরদার , (2) পরহেযগারদের নেতা এবং (3) কিয়ামতের দিনে শুভ্রচেহারাধারীদের মধ্যে প্রধান।177

(30-চ) ইযা সুবুল মু মিনীন (মু মিনদের আবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু) , রাঈসুল মু মিনীন [(অনুসরণের ক্ষেত্রে) মু মিনদের পুরোধা]। 178

(30-ছ) আমিরুল মু মিনীন (মু মিনদের নেতা)। 179

(30-জ) সাইয়্যেদু শাবাবি আহলিল জান্নাত।180

বাখ্যাঃ যেমনভাবে হাদীসসমূহে এসেছে যে , বেহেশতের অধিবাসী সকলেই যুবক হবে। অর্থাৎ বৃদ্ধগণও বেহেশতে প্রবেশের প্রাক্কালে যুবক হয়ে প্রবেশ করবে। অতএব যিনি বেহেশতের যুবকদের সর্দার হবেন তিনি সমস্ত বেহেশতবাসীদের সর্দার ও নেতা হবেন।

(30-ঝ) খাইরুল বারিয়্যাহ অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টি।181

এই উপাধিটি এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে , যখনই সাহাবীগণ তাকে দেখতেন তখনই বলতেনঃ

قد جاء خیر البریة

অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টির আগমন ঘটেছে182

(30-ঞ) আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا و علی حجه اللّه علی عباده

অর্থাৎ আমি ও আলী আল্লাহর বান্দাদের উপর হুজ্জাত বা প্রমাণ।183

(30-ট) রাসূলের সহযোগি

আনাস বিন মালিক বলেন- যখন সূরা নাসর অবতীর্ণ হল তখন আমরা সকলেরই বুঝলাম যে , এই সূরা রাসূলের ইন্তেকালের বার্তা নিয়ে এসেছে। তখন সালমান ফারসীকে বললাম- রাসূলকে যেন জিজ্ঞাসা করে যে , তার পরে কে আমাদের নেতা ও আশ্রয়স্থল হবে এবং কাকে আমরা প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসবো। সালমান রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর প্রদানে বিরত থাকলেন। সালমান আবার জিজ্ঞেস করলেন- তারপরেও তিনি উত্তর দিলেন না। সালমানের মনে ভীতি সঞ্চার হল যে , হয়তো রাসূলকে (সা.) তিনি দুঃখ বা কষ্ট দিয়েছেন। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিছুক্ষণ পরে রাসূল (সা.) বললেন- তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর আশা করছো ? সালমান বলল- হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভয় পেয়েছি যে , হয়তো আমি আপনাকে রাগান্বিত করেছি। তিনি বললেনঃ না এমনটি নয় , জেনে রাখ যে ব্যক্তি আমার ভাই , আমার সহযোগি , আমার খলিফা ও প্রতিনিধি , আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার পরে অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোত্তম , আমার ঋণ পরিশোধ করবে এবং আমার ওয়াদাসমূহ পালন করবে সে ব্যক্তি হচ্ছে আলী ইবনে আবী তালিব।184

আলী (আ.) নিজেও বিভিন্ন উপলক্ষে উক্ত ফজিলতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ আমি রাসূল (সা.)-এর ভাই ও উজীর (সহযোগি)। কেউ এটা আমার পূর্বে বলে নাই (দাবী করে নাই) এবং কেউ আমার পরেও তা বলবে না , যদি না মিথ্যাবাদী হয়। 185

মানদণ্ডসমূহ

রাসূল (সা.) গাদীর দিবস ও বিভিন্নস্থানে বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করে আলীকে (আ.) তার খলিফা ও প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করানো ছাড়াও আরো অনেক হাদীস বলেছেন যা আলী (আ.)-এর খেলাফতকেই প্রমাণ করে। আমরা এ অধ্যায়ে যে সমস্ত হাদীস মানদণ্ড শিরোনামে তুলে ধরব তাতে রাসূল (সা.) এমন এক মানদণ্ড ও পরিমাপক নির্ধারণের প্রচেষ্টায় আছেন যে , যখন ইসলামী রাষ্ট্রে ভুল-ভ্রান্তি ও যে সব ক্ষেত্রে সত-অসত্য মিশ্রিত হয়ে যায় এবং সত্যকে অসত্য হতে আলাদা করা সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যাপূর্ণ হয় , তখন যেন তারা ঐ মানদণ্ড বা পরিমাপকের সহায়তায় সত্যকে গ্রহণ করে অসত্যকে পরিহার করে। এ সমস্ত হাদীসে তিনি হযরত আলীকে (আ.) হেদায়াতের প্রদীপ , ঈমানের মাপকাঠি এবং সত্যের মানদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ সকল হাদীসানুসারে হযরত আলী (আ.) একজন সাধারণ রাহবার (পথনির্দেশক) নন , বরং এমন ঐশী পথনির্দেশক যে , তার সকল কথাবার্তা ও কাজ-কর্মই হচ্ছে মানদণ্ড , সৎকর্ম হচ্ছে সেটাই যা তিনি সম্পাদন করেন , সত্যবাণী তাই যা তিনি বলেন , সত্য-মিথ্যার দ্বন্দে তিনি যে পক্ষে আছেন সে পক্ষই সত্য। যে ব্যক্তি তার সাথে নেই সে নিশ্চয় বাতিল ও ভ্রান্ত।

1. ভালবাসা

যে বিষয়টি রাসূল (সা.)-এর পর তার উত্তরাধিকারী নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হতে পারে তা হচ্ছে যে , তিনি কাকে বেশী ভালবাসতেন। হাদীস গ্রন্থ সমূহ ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে , আলী (আ.)-এর সম্পর্কে এত পরিমাণ হাদীস বর্ণিত হয়েছে যা অন্য কোন সাহাবী সম্পর্কে ততখানি বর্ণিত হয়নি। রাসূল (সা.) আলীকে (আ.) যতটা পছন্দ করতেন ও ভালবাসতেন অন্য কোন সাহাবীকে তিনি ততটা ভালবাসতেন না।114 যেমনভাবে ইবনে হাজার তার সাওয়ায়েক’’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীই ছিলেন সর্বাধিক প্রিয়পাত্র।115

রাসূল (সা.) যে নিজেই শুধু আলীকে (আ.) ভালবেসে ক্ষান্ত ছিলেন তা নয় , বরং মুসলমানদেরকেও বলতেন তাকে (আলীকে) ভালবাসার জন্যে এবং এটাও বলতেন যে , আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করার জন্য মহান আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।116

কখনো কখনো বলতেনঃ আমি আলীকে যতটা ভালবাসি মহান আল্লাহ তাকে তার চেয়েও বেশী ভালবাসেন।117

অথবা- আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়পাত্র হচ্ছে আলী।118

হযরত আয়েশা বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহ এমন কাউকেই সৃষ্টি করেননি যে রাসূল (সা.)-এর নিকট আলীর চেয়ে প্রিয় বা পছন্দের হবে।119

তিনি তার সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলতেনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- সাহাবীদের মধ্যে চারজনকে যেন আমি বেশী বেশী ভালবাসি এবং আরো বলেছেন- তিনি নিজেই তাদেরকে বেশী বেশী ভালবাসেন।

সাহাবাগণ বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা ? আমরাও কামনা করি যেন তাদেরই একজন হতে পারি।

তিনি বললেন জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। অতঃপর নীরব রইলেন। আবারও মুখ খুললেন এবং বললেন- তোমরা জেনে রাখ! আলী তাদের অন্যতম। এই কথা বলে পূর্বের ন্যায় নীরব হয়ে গেলেন।120

অতঃপর আবার বললেনঃ

یحب اللّه و رسوله و یحبه اللّه و رسوله

অর্থাৎ আল্লাহ ও তার রাসূল তাকে (আলীকে) ভালবাসেন এবং সেও (আলীও) আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালবাসে।121

আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- রাসূল (সা.)-এর জন্য কিছু ভাজা মুরগী আনা হলে তিনি হাত তুলে দোয়া করলেন- হে প্রভূ !তুমি এমন কাউকে পাঠিয়ে দাও যাকে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালবাসে। ঐ মুহূর্তে আলী দরজায় করাঘাত করলেন। যেহেতু আমি চেয়েছিলাম সেই ব্যক্তি আনসারদের মধ্যে কেউ হোক , তাই তাকে বললাম রাসুল (সা.) এখন ব্যস্ত আছেন।

আলী ফিরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবারও করাঘাত করলেন। আমি একই কথা তাকে বললাম। তিনি ফিরে গেলেন। যখন তিনি তৃতীয়বার করাঘাত করলেন , তখন রাসূল (সা.) বললেনঃ হে আনাস! তাকে আসতে দাও , আমি তারই জন্য অপেক্ষা করছি।122

এ ছাড়াও তার প্রতি ভালবাসার কথা এত বেশী বলা হয়েছে যা অন্য কারো সম্পর্কে বলা হয়নি। যেমন-

(1-ক) আলীর সাথে বন্ধুত্ব মানেই আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে বন্ধুত্ব ও আলীর সাথে বিদ্বেষই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে বিদ্বেষের শামিল

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- একদিন রাসূল (সা.) ও আলী পরস্পর হাত ধরে ঘর থেকে বের হলেন ও বললেনঃ তোমরা জেনে রাখ! যে ব্যক্তি স্বীয় অন্তরে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে সে নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। আর যে ব্যক্তি আলীকে ভালবাসলো সে আল্লাহ ও তার রাসূলকেই ভালবাসলো।123

রাসুল (সা:) আলীকে বলেছেনঃ

یا علی ! انت سید فی الدنیا و سید فی الاخره حبیبک حبیبی و حبیبی حبیب اللّه و عدوک عدوی و عدوی عدو اللّه والویل لمن ابغضک بعدی

অর্থাৎ হে আলী! তুমি ইহকাল ও পরকালের নেতা। তোমার বন্ধু আমার বন্ধু আমার বন্ধু আল্লাহর বন্ধু। তোমার শত্রু আমার শত্রু ও আমার শত্রু আল্লাহর শত্রু। অভিশাপ তার উপর যে আমার পরে তোমার সাথে শত্রুতা করবে।124

আরো বলেছেনঃ

یا علی محبک محبی و مبغضک مبغضی

অর্থাৎ হে আলী! যে তোমাকে ভালবাসলো সে আমাকে ভালবেসেছে আর যে তোমার প্রতি ক্রোধান্বিত সে আমার প্রতি ক্রোধ পুষে রেখেছে তার অন্তরে ।125

(1-খ) আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণকারী সৌভাগ্যশালী

তিনি বলেছেনঃ যারা আমাকে এবং এই দু জনকে (হাসান ও হোসাঈন) ও তাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসবে কিয়ামতের দিন তারা আমার স্তরে স্থান লাভ করবে বা আমার সাথে থাকবে।126

এবং আরো বলেছেনঃ যারা চায় আমার মত করে বেচে থাকতে ও আমার মত মৃত্যু বরণ করতে এবং ঐ বেহেশতে বাস করতে যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন , তারা যেন আলী ইবনে আবী তালিবকে ভালবাসে।127

তিনি আরো বলেছেনঃ এ হচ্ছে জিব্রাইল যে আমাকে সংবাদ প্রদান করেছে: প্রকৃত সৌভাগ্যশালী ব্যক্তি সে , যে আলীকে যেমন জীবিতাবস্থায় ভালবাসবে তেমনি তার (আলীর) মৃত্যুর পর , আর প্রকৃত হতভাগ্য সে ব্যক্তি , যে আলীর প্রতি যেমন জীবিতাবস্থায় ঘৃণা পোষণ করবে তেমনি তার মৃত্যুর পরও।128

ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে নিবেদন করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! আগুন হতে মুক্তিলাভের কোন উপায় আছে কি ?

তিনি বললেন- হ্যাঁ ,

আমি বললাম- সেটা কি ?

তিনি বললেন- আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করা।129

(1-গ) আলীকে ভালবাসা সৎকর্ম

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حب علی بن ابیطالب یاکل السیئات کما تاکل النار الحطب

অর্থাৎ আলীকে ভালবাসলে কুলষতা ঐরূপে ধ্বংস হয়ে যায় যেরূপে শুকনা কাঠ আগু্নে পোড়ালে ধ্বংস হয়।130

তিনি আরো বলেছেনঃ

عنوان صحیفه المؤمن علی بن ابی طالب

অর্থাৎ আলীর প্রতি ভালবাসা পোষণ করাই হবে মু মিনদের আমলনামার শিরোনাম ।131

(1-ঘ) আলীর প্রতি ভালবাসা ব্যতীত কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন-

لو ان عبدا عبد اللّه الف عام و الف عام و الف عام بین الرکن و المقام ثم لقی اللّه عز و جل مبغضا لعلی بن ابیطالب و عترتی اکبه اللّه علی منخریه فی النار

অর্থাৎ যদি কোন বান্দা লক্ষ কোটি বছর মাকামে ইব্রাহীম এবং হাজরে আসওয়াদের (রোকন ও মাকামের) মধ্যবর্তী স্থানে আল্লাহর ইবাদত করে , কিন্তু আলীর প্রতি ও আমার রক্ত সম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়দের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী হিসেবে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হয় , তারপরেও আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবে।132

তিনি আরো বলেছেনঃ

یا علی لو ان امتی صاموا حتی یکونوا کالحنایا و صلوا حتی یکونوا کالاوتار ثم ابغضوک لاکبهم اللّه علی وجوههم فی النار

অর্থাৎ হে আলী! যদি আমার উম্মত এমনভাবে রোজা রাখে যে , তার দেহ (পিষ্ঠদেশ) ধনুকের রূপলাভ করে এবং যদি এমনভাবে নামাজও পড়ে যে , তার দেহ (ধনুকের) তন্ত্রীর ন্যায় শীর্ণ হয়ে যায় অথচ তার অন্তরে যদি তোমার প্রতি ঘৃণা থাকে , তাহলেই আল্লাহ তাকে নিম্নমুখী করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।133

(1-ঙ) আলীর প্রতি ঘৃণা এবং রাসূলের প্রতি ভালবাসা এ দু টি কখনোই একতিতে হতে পারে না

তিনি বলেছেনঃ

یا علی من زعم انه یحبنی و هو یبغضک فهو کذاب

অর্থাৎ হে আমার প্রাণপ্রিয় আলী! সেই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী যে চিন্তা করে আমাকে ভালবাসে অথচ তোমার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে।134

(1-চ) আলীর প্রতি ঘৃণা করা ও ঈমানদার বলে দাবী করা একেবারেই অসম্ভব

রাসূল (সা.) বলেন-

من زعم انه آمن بی و ما جئت به و هو یبغض علیا فهو کاذب لیس بمؤمن

অর্থাৎ যে ব্যক্তি ধারণাপোষণ করে যে , আমার প্রতি ও আমার দ্বীনের প্রতি ঈমান এনেছে অথচ আলীর প্রতি ঘৃণাপোষণ করে , সে মিথ্যাবাদী , সে মু মিন নয়।135

(1-ছ) আলীর প্রতি বিদ্বেষপোষণ কুফরের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যদি কেউ তোমার প্রতি বিদ্বেষপোষণ করে মৃত্যু বরণ করে , তাহলে সে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল। কিন্তু তার আমলের হিসাব মুসলমানদের মতই হবে।136

উপরোক্ত হাদীসের গভীরতা খুজে বের করার জন্য ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

কিয়ামতের দিন কাফেরদের হিসাব সম্বন্ধে দু টি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছেঃ

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি: এমন কাফের যাদেরকে তাদের কুফরীর জন্য জবাবদিহি করতে হবে ও তাদের জন্য কঠিন শাস্থির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ঐ সমস্ত আমলাদি যা ইসলাম ওয়াজিব (ফরজ) করেছিল তার জন্য তার নিকট জবাবদিহি চাওয়া হবে না। যেমনভাবে ঐ পাপকর্ম যা ইসলামে হারাম তা তার কাছ থেকে হিসাব চাওয়া হবে না। কেননা এই হিসাব-কিতাব ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি কুফরীর সাথে সংযুক্ত নয়। কারণ যেহেতু কুফরীর তুলনায় সমস্ত পাপকর্ম অতিক্ষুদ্র তাই কাফেরদের ক্ষেত্রে অন্যান্য হারামকৃত বিষয়ে হিসাব চাওয়া হবে না।

দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি: কাফের যেমনভাবে তার কুফরী ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের কারণে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তেমনি তার আমলের কারণেও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ সে ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণের কারণ ছাড়াও স্বীয় পাপকর্মের এবং ওয়াজিব (ফরজ) কর্মসমূহ সম্পাদন না করার কারণেও শাস্তিভোগ করবে।

এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থকগণ একটি সূত্র তৈরী করে বলেছেনঃ

الکفارمعاقبون علی الفروع کما انهم معاقبون علی الاصول

অর্থাৎ কাফের যেমন তার বিশ্বাসগত বিচ্যুতির কারণে শাস্তি পাবে তেমনি শাস্তি পাবে তার কৃতকর্মের জন্য।

উপরোক্ত হাদীসে যে সকল কাফেরের কথা বলা হয়েছে তারা সবাই দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গির দলিলে।

(1-জ) আলীর প্রতি ভালবাসা ঈমানের চিহ্ন ও তার প্রতি বিদ্বেষ মোনাফিক বা কপটতার চিহ্ন

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ

لا یحبک الا مؤمن و لا یبغضک الا منافق

অর্থাৎ মু মিন ব্যতীত তোমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত তোমার প্রতি কেউ বিদ্বেষী হবে না।137

তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেনঃ আল্লাহর কসম! রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন যে , মু মিন ব্যতীত আমাকে কেউ ভালবাসবে না আর মোনাফিক ব্যতীত আমাকে কেউ ঘৃণা করবে না।138

উক্ত কারণে সাহাবীগণ বলতেনঃ আমরা আলী ইবনে আবী তালিবের প্রতি শত্রুতা করা দেখে মোনাফিককে চিনতাম।139

2. আলীকে কষ্ট প্রদান অর্থাৎ রাসূলকেই কষ্ট প্রদান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من آذی علیا فقد آذانی

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে কষ্ট দিল সে যেন প্রকৃতার্থে আমাকেই কষ্ট দিল।140

তিনি আরো বলেনঃ হে আলী! যে তোমাকে আঘাত দিল সে যেন আমাকেই আঘাত দিল আর যে আমাকে আঘাত দিল সে আল্লাহকেই কষ্ট দিল।141 .

3. আলীকে গালমন্দ করা রাসূলকে (সা.) গালমন্দ করার শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আলীকে গালমন্দ করল সে আমাকেই গালমন্দ করল আর যে আমাকে গালমন্দ করল সে আল্লাহকেই গালমন্দ করল আর যে আল্লাহকে গালমন্দ করল আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।142

4.আলীকে পরিত্যাগ করা রাসূলকে পরিত্যাগের শামিল

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من فارق علیا فارقنی و من فارقنی فارق اللّه عزوجل

অর্থাৎ যে ব্যক্তি আলীকে পরিত্যাগ করল সে আমাকেই পরিত্যাগ করল আর যে আমাকে পরিত্যাগ করল সে আল্লাহকে পরিত্যাগ করল।143

5. আলীর সাথে যুদ্ধ করার অর্থ রাসূলের সাথে যুদ্ধ করা

আবু হোরায়রা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন- আলী , ফাতিমা , হাসান ও হোসাঈনকে (আ.) দেখে রাসূল (সা.) বললেন-

انا حرب لمن حاربکم و سلم لمن سالمکم

অর্থাৎ যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করবে আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করব এবং যারা তোমাদের সাথে সন্ধি করবে আমিও তাদের সাথে সন্ধি করব।144

6. হিদায়াতের প্রতীক

রাসূলে আকরাম (সা.) আবু বারযাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আল্লাহ তায়ালা আলী ইবনে আবী তালিব সম্পর্কে আমাকে বলেছেন- সে হচ্ছে হিদায়াতের প্রতীক , ঈমানের চিহ্ন , খোদাপ্রেমীদের ইমাম ও আল্লাহর সকল আনুগত্যকারীদের জন্য আলোক বর্তিকা।

7. আলী এবং হক বা সত্য

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و الحق معه حیثما دار

অর্থাৎ আলী হক বা সত্যের সাথে আর হক বা সত্য আলীর সাথে যা পরস্পরকে ঘিরে আছে।145

8. হক বা সত্য এবং আলী

তিনি আরো বলেনঃ

الحق مع علی حیث دار

অর্থাৎ আলী যে দিকেই যাবে হক বা সত্যও সে দিকেই তার সাথে গমন করবে।146

9. আলী , সত্য এবং কোরআন

রাসূলে আকরাম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع الحق و القرآن و الحق و القرآن مع علی لن یتفرقا حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী , কোরআন এবং সত্যের সাথে আছে ; সত্য এবং কোরআনও আলীর সাথে আছে। তারা আমার সাথে হাউজে কাউসারে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।147

10. আলী ও কোরআন

নবী কারিম (সা.) বলেছেনঃ

علی مع القرآن والقرآن مع علی لا یفترقان حتی یردا علی الحوض

অর্থাৎ আলী কোরআনের সাথে আর কোরআন আলীর সাথে তারা ঐ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হবে না যে পর্যন্ত না হাউজে কাউসারে আমার সাথে মিলিত হবে।148

11. আলীর মর্যাদা কাবা ঘরের মর্যাদার সমান

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انت بمنزله الکعبه تؤتی و لا تاتی

অর্থাৎ হে আলী! তোমার মর্যাদা কাবা ঘরের তুল্য যার পানে সবাই ছুটে আসে। কিন্তু সে কারো দিকে যায় না।149

তিনি আরো বলেন-

مثل علی فیکم کمثل الکعبه المتسوره النظر الیها عباده والحج الیها فریضه

অর্থাৎ আলী তোমাদের মাঝে ঠিক কাবা ঘরের মত , যার প্রতি তাকানো ইবাদত ও হজ্জ করা ওয়াজিব (ফরজ)।150

12. আলী শিক্ষার তোরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی باب حطه فمن دخل منه کان مؤمنا و من خرج منه کان کافرا

অর্থাৎ আলীই হচ্ছে শিক্ষার দ্বার , যে এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে সেই মু মিন আর যে এ দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবে সে কাফির।151

13. আলী ঈমানের মানদণ্ড

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

لولاک یا علی ما عرف المؤمنون من بعدی

অর্থাৎ হে আলী! যদি তুমি না থাক তাহলে আমার পরে মু মিনদেরকে আর চেনা যাবে না।152

14. হক (সত) ও বাতিলের (মিথ্যার) পৃথককারী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

نت الفاروق بین الحق والباطل

অর্থাৎ হে আলী! তুমিই সত্য ও মিথ্যার পৃথককারী।153

15. ঈমানের প্রতীক

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

جعلتک علما فیما بینی و بین امتی فمن لم یتبعک فقد کفر

অর্থাৎ হে আলী! আমি তোমাকে আমার ও আমার উম্মতের মাঝে ঈমানের প্রতীক হিসেবে রেখেছি , যে তোমার অনুসরণ করবে না সে কাফের।154

16. স্বর্গ ও নরকের বন্টনকারী

রাসূল (সা.) তাকে বলেছেন-

انت قسیم النار

অর্থাৎ তুমি হচ্ছ জাহান্নাম বন্টনকারী।155

আর তিনি (আলী) নিজেই বলেছেনঃ

انا قسیم النار

আমি হচ্ছি জাহান্নাম বন্টনকারী।156

তিনি আরো বলেন- আমি (আলী) হলাম জাহান্নামের বন্টনকারী। কিয়ামতের দিন আমি জাহান্নামকে বলবো- এটা তোমার জন্য আর ঐটা আমার জন্য অথবা একে তুমি নাও আর তাকে ছেড়ে দাও।157

এখানে বন্টনকারী বলতে যিনি ভাগাভাগি করে দেন তাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যিনি দুইটি জিনিসকে দু দলের মাঝে ভাগ করে দেন। সুতরাং যখন বলা হবে যে , আলী জাহান্নামের বন্টনকারী অর্থাৎ তিনি নিজের ও জাহান্নামের মাঝে জনগণকে ভাগ করে দিবেন। অতএব উক্ত হাদীসের উদ্দেশ্য হল যে , আলীর সত্ত্বা হচ্ছে জাহান্নামের বিপরীত অর্থাৎ কিছু লোক জাহান্নামবাসী হবে আর কিছু লোক আলী (আ.)-এর দল হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে , আলীই হচ্ছে বেহেশতের প্রতিকৃতি।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি তৃতীয় হাদীস হতে স্পষ্ট হয় তা হচ্ছে এই ভাগ- বাটোয়ারা আলী (আ.)-এর ইচ্ছাধীন , কেননা তিনিই তো জাহান্নামকে বলবেন যে কাকে গ্রহণ করবে কাকে বর্জন করবে। যেমনভাবে রাসূল (সা.) তাকে বলেছেনঃ তুমিই হচ্ছ জান্নাত ও জাহান্নামের বন্টনকারী।158

দৃশ্যতঃ উক্ত হাদীস হচ্ছে যে , আলী (আ.) মানুষের মাঝে জান্নাত ও জাহান্নাম বন্টন করে দিবেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এইভাবে বন্টন করার প্রয়োজনই পড়ে না বরং তার উপস্থিতিই বন্টনের মানদণ্ড। অর্থাৎ আলী (আ.) মানুষের বেহেশতবাসী হওয়ার মাপকাঠি ও মানদণ্ড। কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতবাসী বলে গণ্য হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আলী (আ.) হতে বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে বিচ্যুত হবে না । কিন্তু যখনই সে পথচ্যুত হবে এবং ঐ পবিত্র সত্তার সাথে অসামঞ্জস্যশীল হবে তখন এমনই শুকনা কাঠ হবে যা জাহান্নামের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অতঃপর উক্ত হাদীসের সারকথাও বাকী তিনটি হাদীসের সারকথার মতই। সবগুলির সারকথা হচ্ছে- আলী (আ.) নিজেই বেহেশতের প্রতিকৃতি ও বেহেশতবাসী হওয়ার মানদণ্ড।

17. পুল সিরাতের অনুমতিদাতা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যতক্ষণ পর্যন্ত আলী অনুমতিপত্র লিখবে না ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ পুল সিরাত পার হতে পারবে না।159

18. আলীর আনুগত্যেই সৌভাগ্য নিহিত

রাসূলে আকরাম (সা.) আলীর প্রতি ইশারা করে বলেছেন-

والذی نفسی بیده ان هذا و شیعته هم الفائزون یوم القیامه

অর্থাৎ শপথ ঐ সত্ত্বার , যার হাতে আমার প্রাণ- আলী ও তার শিয়াগণ (প্রকৃত অনুসারীগণ) কিয়ামতের দিনে সৌভাগ্যবান হিসেবে পরিগণিত হবে।160

19. আলীর প্রকৃত অনুসারীরাই বেহেশতবাসী

রাসূল (সা.) তাকে (আলীকে) বলেছেনঃ

انت و شیعتک فی الجنه

অর্থাৎ তুমি ও তোমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) সকলেরই জান্নাতবাসী।161

20. সফলকামী দল

রাসূলে করিম (সা.) তাকে (আলীকে) ইশারা করে বলেন-

هذا و حزبه المفلحون

অর্থাৎ সে এবং তার দল সফলকাম।162

21. আলীর অনুসারীগণ আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় এবং তার সন্তুষ্টভাজন

রাসূলে খোদা (সা.) আমাকে (আলীকে) বলেছেন যে , আমি ও আমার শিয়াগণ (অনুসারীগণ) এমন অবস্থায় কিয়ামতের দিন উপস্থিত হব যে , আমরা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকবো এবং আল্লাহও আমাদের উপর সন্তুষ্ট থাকবেন।163 অনুরূপ তুলনা কোরআন শরীফেও এসেছে , সূরা বাইয়্যেনা তে বলা হয়েছেঃ

) ر َضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ(

অর্থাৎ আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট ও তারাও আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট।

উক্ত আয়াতের পরে রাসূলের হাদীসও বর্ণিত হয়েছে যে , উক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আলী এবং তার শিয়াগণ (অনুসারীগণ)। এই মর্যাদাটি অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট আর আল্লাহও তার উপর সন্তুষ্ট হবে এটা মানুষের পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায়। কারণ , কোরআন শরীফ এরূপ মানুষের সত্তাকে নাফসে মোতমাইন্না অর্থাৎ পরিতৃপ্ত আত্মা বলে অভিহিত করেছে অর্থাৎ যে আত্মা সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মশগুল এবং তার স্মরণে এমন প্রশান্তি লাভ করেছে যে , বস্তু জগতের কোন শঙ্কা , অস্থিরতা ও উদ্বিগ্নতা তাকে বিচলিত করে না , বলা হয়েছে-

) ي َا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ () ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً(

অর্থাৎ হে পরিতৃপ্ত আত্মা! আল্লাহর দিকে এসো , তুমি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।

22. আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত

রাসূলে আকরাম বলেছেনঃ

ذکر علی عباده

অর্থাৎ আলীকে স্মরণ করাও ইবাদত।164

23. আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত

হযরত আয়েশা হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন- আমার পিতাকে দেখেছি যে , তিনি বেশী বেশী আলীর চেহারার প্রতি তাকিয়ে থাকতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে , হে আমার পিতা! আপনি আলীর প্রতি এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন ?

তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- হে আমার কন্যা! আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি যে , তিনি বলেছেন- আলীর প্রতি তাকানোও ইবাদত।165

24. আলী (আ.) জান্নাতের দরজা

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا مدینه الجنه و علی بابها یا علی کذب من زعم انه یدخلها من غیر بابها

অর্থাৎ আমি হলাম বেহেশতের নগর আর আলী তার দ্বার , ঐ ব্যক্তি ভুল করবে যে ব্যক্তি দরজা ব্যতীত প্রবেশ করতে চাইবে।166

25. আলী (আ.) বেহেশতের দীপ্তিময় প্রদীপ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

علی یزهر لا هل الجنه کما یزهر کوکب الصبح لا هل الدنیا

অর্থাৎ ধ্রুবতারা যেমনভাবে পৃথিবীকে আলোকিত করে , আলী ঠিক তেমনিভাবে বেহেশতবাসীদেরকে আলোকিত করবে।167

26. মুসলমানদের পিতা আলী

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

حق علی علی کل مسلم حق الوالد علی ولده

অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমানদের উপর আলীর অধিকার তেমনি , যেমন প্রত্যেক পিতার অধিকার তার সন্তানের উপর।168

27. আলীর অনুসরণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

من اطاعنی فقد اطاع اللّه و من اطاعک اطاعنی , و من عصانی فقد عصی اللّه و من عصاک فقدعصانی

অর্থাৎ যারা আমার অনুসরণ করে তারা আল্লাহর অনুসরণকারী , আর যারা আলীর অনুসরণ করে তারা আমার অনুসরণকারী যারা আমাকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আল্লাহর অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে যারা আলীকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারা প্রকৃতার্থে আমার অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে।169

28. রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

صاحب سری علی بن ابیطالب

অর্থাৎ আলী হচ্ছে আমার গোপনীয়তা রক্ষাকারী।170

হযরত আয়েশা তার পিতা হতে বর্ণনা করেন যে , আলী ছিল রাসূলের গোপনীয়তা রক্ষাকারী।171

29. আলী , রাসূল (সা.)-এর মাথা স্বরূপ

علی منی مثل راسی من بدنی

অর্থাৎ আলীর অস্তিত্ব আমার নিকট ঐরূপ (প্রয়োজনীয়) যেরূপ শরীরের নিকট মাথার অস্তিত্ব ।172

30. আলীর উপাধিসমূহ

রাসূল (সা.)-এর খলিফা (প্রতিনিধি) নির্ধারণের মাপকাঠিগুলোর মধ্যে একটি মাপকাঠি হচ্ছে- এমন কিছু উপাধি যা রাসূল (সা.) তার জীবদ্দশায় কোন ব্যক্তিকে দিয়েছেন। যেমন- হাদীসের গ্রন্থাদিতে উল্লেখিত হয়েছে , আলীর মত মর্যাদাকর উপাধিধারী ব্যক্তি রাসূল (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্যে দ্বিতীয় কেউ নাই। হাদীসবেত্তারা সকলেই উল্লেখ করেছেন যে , রাসূল (সা.)-এর কোন সাহাবাই হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় মহামূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেনি।

আলীকে রাসূল (সা.) যে সকল উপাধিতে ভূষিত করেছেন সেগুলো আমরা নিম্নে তুলে ধরছি: (30-ক) সিদ্দীক ,173

(30-খ) সিদ্দীকে আকবর,174

(30-গ) সাইয়্যেদুল আরাব ,

একদিন রাসূল (সা.) আয়েশাকে বললেনঃ যদি তুমি আরবের সর্দার (সাইয়্যেদ) ও নেতাকে দেখতে চাও , তাহলে আলী ইবনে আবী তালিবের দিকে তাকাও। আয়েশা বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আরবের সর্দার নন ? তিনি বললেনঃ আমি গোটা মানবজাতির সর্দার আর আলী হচ্ছে আরবের সর্দার।175

(30 - ঘ ) সাইয়্যেদুল মুসলিমীন ( মুসলমানদের সর্দার ) ও ইমামুল মুত্তাকিন ( পরহেযগারদের ইমাম) । 176

(30-ঙ) সাইয়্যেদুল মু মিনীন (মু মিনগণের সর্দার) ও ইমামুল মুত্তাকিন (পরহেযগারদের ইমাম) এবং ক্বায়্যেদুল গাররিল মোহাজ্জালীন (কিয়ামতের দিন মুখোজ্জল চেহারাধারীদের নেতা ও অগৃদূত)।

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ যে রাত্রে আমি মেরাজে গিয়েছিলাম , সে রাত্রে আলীর তিনটি উপাধি আমার উপর ওহী হয়েছিল। সে তিনটি উপাধি হচ্ছে- (1) সে মু মিনদের সরদার , (2) পরহেযগারদের নেতা এবং (3) কিয়ামতের দিনে শুভ্রচেহারাধারীদের মধ্যে প্রধান।177

(30-চ) ইযা সুবুল মু মিনীন (মু মিনদের আবর্তনের কেন্দ্র বিন্দু) , রাঈসুল মু মিনীন [(অনুসরণের ক্ষেত্রে) মু মিনদের পুরোধা]। 178

(30-ছ) আমিরুল মু মিনীন (মু মিনদের নেতা)। 179

(30-জ) সাইয়্যেদু শাবাবি আহলিল জান্নাত।180

বাখ্যাঃ যেমনভাবে হাদীসসমূহে এসেছে যে , বেহেশতের অধিবাসী সকলেই যুবক হবে। অর্থাৎ বৃদ্ধগণও বেহেশতে প্রবেশের প্রাক্কালে যুবক হয়ে প্রবেশ করবে। অতএব যিনি বেহেশতের যুবকদের সর্দার হবেন তিনি সমস্ত বেহেশতবাসীদের সর্দার ও নেতা হবেন।

(30-ঝ) খাইরুল বারিয়্যাহ অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টি।181

এই উপাধিটি এত প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে , যখনই সাহাবীগণ তাকে দেখতেন তখনই বলতেনঃ

قد جاء خیر البریة

অর্থাৎ সর্বোত্তম সৃষ্টির আগমন ঘটেছে182

(30-ঞ) আল্লাহর হুজ্জাত বা প্রমাণ

রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

انا و علی حجه اللّه علی عباده

অর্থাৎ আমি ও আলী আল্লাহর বান্দাদের উপর হুজ্জাত বা প্রমাণ।183

(30-ট) রাসূলের সহযোগি

আনাস বিন মালিক বলেন- যখন সূরা নাসর অবতীর্ণ হল তখন আমরা সকলেরই বুঝলাম যে , এই সূরা রাসূলের ইন্তেকালের বার্তা নিয়ে এসেছে। তখন সালমান ফারসীকে বললাম- রাসূলকে যেন জিজ্ঞাসা করে যে , তার পরে কে আমাদের নেতা ও আশ্রয়স্থল হবে এবং কাকে আমরা প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসবো। সালমান রাসূলের সমীপে উপস্থিত হলেন এবং এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি উত্তর প্রদানে বিরত থাকলেন। সালমান আবার জিজ্ঞেস করলেন- তারপরেও তিনি উত্তর দিলেন না। সালমানের মনে ভীতি সঞ্চার হল যে , হয়তো রাসূলকে (সা.) তিনি দুঃখ বা কষ্ট দিয়েছেন। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কিছুক্ষণ পরে রাসূল (সা.) বললেন- তুমি কি তোমার প্রশ্নের উত্তর আশা করছো ? সালমান বলল- হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভয় পেয়েছি যে , হয়তো আমি আপনাকে রাগান্বিত করেছি। তিনি বললেনঃ না এমনটি নয় , জেনে রাখ যে ব্যক্তি আমার ভাই , আমার সহযোগি , আমার খলিফা ও প্রতিনিধি , আমার পরিবারের সদস্য এবং আমার পরে অবশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোত্তম , আমার ঋণ পরিশোধ করবে এবং আমার ওয়াদাসমূহ পালন করবে সে ব্যক্তি হচ্ছে আলী ইবনে আবী তালিব।184

আলী (আ.) নিজেও বিভিন্ন উপলক্ষে উক্ত ফজিলতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ আমি রাসূল (সা.)-এর ভাই ও উজীর (সহযোগি)। কেউ এটা আমার পূর্বে বলে নাই (দাবী করে নাই) এবং কেউ আমার পরেও তা বলবে না , যদি না মিথ্যাবাদী হয়। 185


15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26