আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন0%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ:

ভিজিট: 73714
ডাউনলোড: 6760

আশুরা সংকলন
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 73714 / ডাউনলোড: 6760
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।

অত্যুজ্জ্বল শাহাদাত

আলী আকবর (আ.)-এর বীরত্ব

[সাইয়্যেদ ইবনে তাউস প্রণীত লোহুফ থেকে সংকলিত]

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সঙ্গীরা ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত অবস্থায় একে একে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন। আহলে বাইত ছাড়া আর কেউ বেচে নেই।

এসময় সবচেয়ে সুন্দর অবয়ব ,সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী আলী বিন হোসাইন তার পিতার কাছে এসে যুদ্ধের অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইমাম হোসাইন তৎক্ষণাৎ অনুমতি দেন। এর পর তার দিকে উদ্বেগের দৃষ্টি ফেলেন আর ইমামের দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল । অশ্রুশিক্ত অবস্থায় বললেন :

اﻟﻠــﻬﻢ اﺷﻬﺪ ﻓﻘﺪ ﺑﺮز اﻟﻴﻬـﻢ ﻏﻼم اﺷﺒﻪ اﻟﻨـﺎس ﺧﻠﻘﺎ و ﺧﻠﻘﺎ وﻣﻨْﻄﻘﺎ ﺑﺮﺳـــﻮﻟـﻚ وکﻨّـﺎ اذا اﺷﺘﻘﻨـﺎ اﻟـﻲ ﻧﺒﻴﻚ ﻧﻈﺮﻧـﺎ اﻟﻴـﻪ

হে আল্লাহ ! তুমি সাক্ষী থাক। তাদের দিকে এমন এক এক এক যুবক অগ্রসর হয়েছে যে শরীরের গঠন ,সৌন্দর্য ,চরিত্র ও বাক্যালাপে তোমার রাসূল (সা.) এর সাদৃশ্যপূর্ণ । আমরা যখন তোমার নবী (সা.) -এর দিকে তাকানোর আকাঙ্ক্ষা করতাম তখন এ যুবকের দিকেই তাকাতাম। এর পর ওমর বিন সা দের প্রতি লক্ষ করে উচ্চকণ্ঠে বললেন :

ﻳـﺎ ﺑـﻦ ﺳﻌـﺪ ﻗﻄـﻊ اﷲ رﺣـﻤـﻚ کما ﻗﻄﻌﺖ رﺣـﻤﻲ

হে সা দের ছেলে! আল্লাহ তোমার বংশধরকে বিচ্ছিন্ন করুন যেভাবে তুমি আমার বংশধরকে বিচ্ছিন্ন করেছ।

আলী বিন হোসাইন দুশমনের মোকাবিলায় প্রচণ্ড লড়াই শুরু করেন। বহু সংখ্যক শত্রু সেনা হত্যা করে শ্রান্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পিতা ইমাম হোসাইনের কাছে এসে বললেন :

ﻳـﺎ اﺑـﺔ اﻟﻌﻄﺶ ﻗـﺪ ﻗﺘﻠﻨـﻲ وﺛﻘﻞ اﻟﺤﺪﻳـﺪ ﻗـﺪ اﺟـﻬـﺪﻧـﻲ ﻓـﻬﻞ اﻟـﻲ ﺷـــﺮﺑـﺔ ﻣﻦ اﻟﻤﺎء ﺳﺒﻴﻞ

হে মহান পিতা ! পিপাসায় আমার জীবন ওষ্ঠাগত ,যুদ্ধের প্রচণ্ডতায় আমি ক্লান্ত ,আমাকে একটু পানি দিয়ে জীবন বাচাতে দিন। ইমাম হোসাইন কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন : হায়! কে সাহায্য করবে ? প্রিয় ছেলে! ফিরে যাও ,যুদ্ধ চালাও ,সময় ঘনিয়ে এসেছে। একটু পরেই আমার নানা মুহাম্মাদ (সা.) -এর সাথে সাক্ষাৎ করবে। তার হাতের পেয়ালা এমনভাবে পান করবে যে ,এরপর আর কখনও পিপাসার্ত হবে না।

আলী ময়দানে ফিরে যান ,জীবনের মায়া ত্যাগ করে শাহাদাতের জন্য প্রস্তুতি নেন। প্রচণ্ড হামলা শুরু করেন। হঠাৎ মুনকিজ বিন মুররা আবদী (আল্লাহর লানত তার উপর বর্ষিত হোক) আলী বিন হোসাইনের দিকে তীর নিক্ষেপ করেন। এ তীরের আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হয়ে পড়েন। তিনি চিৎকার দিয়ে বলেন :

ﻳﺎ اﺑﺘــﺎﻩ ﻋﻠﻴﻚ ﻣﻨـﻲ اﻟﺴﻼم هذا جدّی یقرئک اﻟﺴــﻼم و یقول لک عجّل اﻟﻘـﺪوم اﻟﻴﻨـﺎ

বাবা! খোদা হাফেজ ,আপনার প্রতি সালাম। আমার সামনেই নানা মুহাম্মাদ (সা.) আপনাকে সালাম জানাচ্ছেন আর বলছেন :‘‘ হে হোসাইন ! তাড়াতাড়ি আমাদের সাথে মিলিত হও’’ । এরপরই একটি চিৎকার দিয়ে তিনি শাহাদাতের শরবত পান করেন।

ইমাম হোসাইন নিহত সন্তানের মাথার কাছে দাঁড়ালেন।

و و ﺿﻊ خدّه ﻋَ ـ ﻠﻲ خدّه

তার গালে গাল লাগিয়ে চুমু খেলেন আর বললেন :

ﻗﺘﻞ ا ﷲ ﻗﻮﻣًﺎ ﻗﺘﻠﻮ ك ﻋﻠﻲ ا ﻟﺪﻧﻴ ــ ﺎ ﺑﻌﺪ ك ا ﻟﻌﻔﺎ

হে বৎস! আল্লাহ সে সম্প্রদায়কে হত্যা করবে য তোমাকে হত্যা করেছে। এরা আল্লাহর কাছে কতই না অপরাধ করেছে ,আল্লাহর রাসূলের সাম্মানে কতই না আঘাত হেনেছে!

বর্ণিত হয়েছে ,যায়নাব তাবু থেকে বের হয়ে ময়দানের দিকে ছুটে চললেন এবং ভয়ানক চিৎকার দিয়ে বললেন :

ﻳﺎ ﺣﺒ ـ ﻴ ـ ﺒ ــ ﺎﻩ ﻳ ـ ﺎ ﺑ ـ ﻦ ا ﺧ ـ ﺎﻩ

হে আদরের ধন! হে ভাতিজা!

আপন ভাতিজার লাশের কাছে এসে তিনি গড়িয়ে গড়িয়ে কেঁদেছিলেন ছিলেন । ইমাম হোসাইন এসে তাকে নারীদের তাবুতে ফিরিয়ে নেন। এরপরই আহলে বাইতের যুবকরা একে একে ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং অনেকেই ইবনে যিয়াদের বাহিনীর হাতে শহীদ হন। এ সময় ইমাম হোসাইন ফরিয়াদ করে বললেন : হে আমার চাচাতো ভাইয়েরা! হে আমার বংশধরগণ! ধৈর্য ধারণ করো। আল্লাহর শপথ ,আজকের দিনের পর কোনো দিন অপমানিত ও লাঞ্চিত হবে না।

কবি বলেন :

এসেছে নিশি ,পূর্ণশশী তুমি তো আসোনি

জীবন ওষ্ঠাগত ,আমার জীবন হে আলী আসোনি

খচার পাখি মরুর দিকে উড়ে গেলো

কিন্তু হে হোমা পাখি! তার কাছেও আসোনি

আমার শরৎ অন্তর তোমার দিদারে হতো বসন্ত

হে গোলাপ পুষ্প! কেনো তুমি আসোনি

ছড়ালাম অশ্রু ,গেলাম সবার আগে তোমার গমন পথে

তোমার প্রতীক্ষায় হলাম পেরেশান তুমি তো আসোনি

অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় ছিলাম তুমি যদি আসো।

তোমার পায়ে জান করবো কুরবান ,তুমি তো আসোনি।

হযরত আবুল ফযল আব্বাস (আ.)-এর শাহাদাত

[সাইয়্যেদ ইবনে তাউস প্রণীত লোহুফ থেকে সংকলিত]

বর্ণনাকারী বলেন ,ইমাম হোসাইন পিপাসায় কাতার হয়ে ফোরাতের তীরে উপস্থিত হলেন। সাথে রয়েছেন তার ভাই আব্বাস। ইবনে সা দের বাহিনী ঝপিয়ে পড়ল দু জনের ওপর । তাদের পথ বন্ধ করল। বনী দারাম গোত্রের এক দুরাচার আবুল ফযল আব্বাস-এর দিকে তীর নিক্ষেপ করলে তার পবিত্র মুখে বিদ্ধ হয়। ইমাম হোসাইনই তা টেনে বের করে নেন ,তার হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। তিনি সেই রক্ত ছুড়ে ফেলে বললেন : হে আল্লাহ ! এ জনগোষ্ঠী তোমার নবী নন্দিনীর সন্তানের ওপর এ যুলুম চালাচ্ছে ,এদের বিরুদ্ধে তোমার দরবারে বিচার দিচ্ছি। ইবনে সা দের বাহিনী মুহূর্তের মধ্যে ইমাম হোসাইনের নিকট থেকে হযরত আব্বাসকে ছিনিয়ে নেয়। চতুর্মুখী আক্রমণ ও তারবারির সম্মিলিত আঘাতে হযরত আব্বাস শহীদ হন। তার শাহাদাতে ইমাম হোসাইন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবি তাই তো বলেছেন :

احق الناس ان یبکی علیه

فتی ابکی الحسین بکربلاء

اخوه و ابن والده علی

ابو الفضل المضرج بالدماء

و من واساه لا یثنیه شیء

و جادله عل عطش بماء

‘‘ কতই না উত্তম ব্যক্তি যার জন্য ইমাম হোসাইন কারবালার এ কঠিন মুসিবতের সময়ও কেঁদেছেন। তিনি ছিলেন ইমাম হোসাইনের ভাই ,তার বাবা ছিলেন আলী ,তিনি তা আর কেউ নন রক্তাক্ত বদন আবুল ফযল আব্বাস। তিনি ছিলেন ইমাম হোসাইনের সহমর্মী ,কোনো কিছুই তাকে এপথ থেকে সরাতে পারেনি। প্রচণ্ড পিপাসা নিয়ে ফোরাতের তীরে পৗছেন ,কিন্তু ইমাম হোসাইন যেহেতু পান করেননি তিনিও তাই পানি মুখে নেননি।

অন্য কবি বলেন : মুষ্ঠির মাঝে পানি নিলেন ,মনভরে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করবেন কিন্তু যখনই ইমাম হোসাইনের পিপাসার কথা মনে পড়লো ,হাতের মুঠোর পানিতে অশ্রু ফলে ফিরে আসলেন।

হযরত আবুল ফযল আব্বাস-এর এ মহান আত্মত্যাগ সকল লখক ,চিন্তাশীলের দৃষ্টিতেই গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লামা মাজলিশী তার বিখ্যাত গ্রন্থ বিহারুল আনওয়ার -এই মধ্যে লিখেছেন , হযরত আব্বাস ফোরাতের তীরে গেলেন। যখনই অঞ্জলী ভরে পানি পান করতে চাইলেন তখন হঠাৎ ইমাম হোসাইন ও তার আহলে বাইতের পানির পিপাসার যন্ত্রণার কথা মনে পড়ল। তাই তিনি পানি ফোরাতেই ফলে দিলেন ,পান করলেন না।

একজন আর বীকবিবলেন :

ذبلت یا عباس نفسا نفیسة

لِنَصر حسین عز بالجد عن مثل

ابیت التذاذ الماء قبل التذاذ

فحسن فعال المرء فرع من الاصل

فانت اخوه السبطین فی یوم مفخر

وفی یوم بذل الماء انت ابو الفضل

আবুল ফযল আব্বাস তার সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণ ইমাম হোসাইন -এর জন্যই উৎসর্গ করেছেন। ইমাম হোসাইন পান করার পূর্বে তিনি নিজে পান করলেন না। মানুষের কর্মের সর্বোত্তম কর্ম ও মূল কাজই তিনি করলেন। আপনি তো গৗরবের দিবসে রাসূলের দুই নাতির ভাই ,আর আপনিই তো পানি পানের দিবসে করেছেন আত্মত্যাগ ,হে আবুল ফযল!

পানি টলটলায়মান ,বাদশাহ তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত ,

উদ্দম তার অন্তরে হাতে রয়েছে পানির মশক ,

মুর্তাযার সিংহ শাবককে হামলা করলো এমনভাবে

এ যেন অগণিত নেকড়ের মাঝে এক বাঘ।

এমন একটি বদন কেউ দেখেনি যাতে কয়েক হাজার তীর ,

এমন একটি ফুল কেউ দেখেনি যাতে রয়েছে কয়েক হাজার কাটা।

হযরত কাসেম বিন হাসান (আ.) -এর শাহাদাত

[আয়াতুল্লাহ মুর্তাযা মোতাহহারী প্রণীত হামাসায়ে হোসাইন থেকে সংকলিত]

হযরত আলী আকবরের শাহাদাতের পর এই তেরো বছরের কিশোর হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর নিকট এগিয়ে এলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন নাবালেগ কিশোর ,তার শরীরের বৃদ্ধি তখনো সম্পূর্ণ হয়নি ,তাই তার শরীরে অস্ত্র ঠিকভাবে খাপ খাচ্ছিলো না ;কামরে ঝুলানো তলোয়ার ভূমি স্পর্শ করে কাত হয়ে ছিলো। আর বর্মও ছিলো বড় ,কারণ বর্ম পূর্ণ বয়স্কদের জন্য তৈরী করা হয়ে ছিলো ,কিশোরদের জন্য নয়। লৗহ টুপি বড়দের মাথার উপযোগী ,ছোট বাচ্চাদের উপযোগী নয়। কাসেম বললেন : চাচাজান! এবার আমার পালা। অনুমতি দিন আমি রণাঙ্গনে যাই।

উল্লেখ্য যে ,আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সঙ্গী-সাথীদের কেউই তার কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে রণাঙ্গনে যাননি। প্রত্যেকেই তার নিকট এসে তাকে সালাম করেন এবং এরপর অনুমতি চান ;বলেন : আসসালামু আলাইকা ইয়া আবা আবদিল্লাহ। আমাকে অনুমতি দিন।

ইমাম হোসাইন (আ.) সাথে সাথেই কাসেমকে অনুমতি দিলেন না। তিনি কাদতে শুরু করলেন। কাসেম ও তার চাচা পরস্পরকে বুকে চপে ধরে কাদতে লাগেলেন। ইতিহাসে লখা হয়েছে : অতঃপর কাসেম ইমাম হোসাইনের হাত ও পা চুম্বন করতে শুরু করলেন। মাক্বাতিল গ্রন্থে এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে :

فلم یزل الغلام یقبل یدیه و رجلیه حتی اذن له

তাকে যতক্ষণ না অনুমতি দেয়া হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কিশোর তার (ইমাম হোসাইনের) হাত ও পা চুম্বন অব্যাহত রাখেন। ( বিহারুল আনওয়ার , 45তম খণ্ড , পৃ 34 এবং মাকতা লু খাওয়ারেযমী , 2য় খণ্ড , পৃ 27 )

এ ঘটনার অবতারণা কি এ উদ্দেশ্যে হয়নি যাতে ইতিহাস পুরো ঘটনাকে অধিকতর উত্তমরূপে বিচার করতে পারে ? কাসেম অনুমতির জন্য পীড়াপীড়ি করেন আর ইমাম হোসাইন (আ.) অনুমতি দানে বিরত থাকেন। ইমাম মনে মনে চাচ্ছিলেন কাসেমকে অনুমতি দবেন এবং বলবেন ,যদি যেতে চাও তো যাও । কিন্তু মুখে সাথে সাথেই অনুমতি দিলেন না।বরং সহসাই তিনি তার বাহুদ্বয় প্রসারিত করে দিলেন এবং বললেন: এসো ভাতিজা! এসো ,তোমার সাথে খোদা হাফেযীকরি।

কাসেম ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কাধের ওপর তার হাত দু টি রাখলেন এবং ইমামও কাসেমের কাধের ওপর স্বীয় হস্তদ্বয় রাখলেন। এর পর উভয়ে ক্রন্দন করলেন। ইমামের সঙ্গী- সাথী ও তার আহলে বাইতের সদস্যগণ এ হৃদয়বিদারক বিদায়ের দৃশ্য অবলোকন করলেন। ইতিহাসে লখা হয়েছে ,উভয়ে এতই ক্রন্দন করলেন যে ,উভয়ই সম্বিতহারা হয়ে পড়লেন। এরপর এক সময় তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন এবং কিশোর কাসেম সহসাই তার ঘোড়ায় আরোহণ করলেন।

ইয়াযীদ পক্ষের সেনাপতি ওমর ইবনে সা দের সেনাবাহিনীর মধ্যে অবস্থানকারী বর্ণনাকারী বলে : সহসাই আমরা এক বালককে দেখলাম ঘোড়ায় চড়ে আমাদের দিকে আসছে যে তার মাথায় টুপির (ধাতব) পরিবর্তে এক পাগড়ি বেধেছে। আর তার পায়ে যোদ্ধার বুট জুতার পরিবর্তে সাধারণ জুতা এবং তার এক পায়ের জুতার ফিতা খোলা ছিলো ;আমার স্মৃতি থেকে এটা মুছে যাবে না যে ,এটা ছিলো তার বাম পা। তারপর বর্ণনাকারী বলে : সে যেন চাঁদের একটি টুকরা। ( মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব , 4র্থ খণ্ড , পৃ 106 , আলামুল ওয়ারা ,. পৃ 242 ; আল - লুহুফ , পৃ 48 , বিহারুল আনোয়ার , 45তম খণ্ড , পৃ 35 ; ইরশাদ - শেখ মুফিদ , পৃ 239 ;, মাকতালু মুকাররাম , পৃ 231 ; তারীখে তাবারী , 6ষ্ঠ খণ্ড , পৃ 256 )

একই বর্ণনাকারী আরো বলে , কাসেম যখন আসছিলেন তখনো তার গণ্ডদেশে অশ্রুর ফোটা দেখা যাচ্ছিলো।

সবাই অনুপম সুন্দর এ কিশোর যোদ্ধাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো এবং ভবে পাচ্ছিলনা যে ,এ ছেলেটি ক! তৎকালে রীতি ছিলো এই যে ,কোনো যোদ্ধা রণাঙ্গনে আসার পর প্রথমেই নিজের পরিচয় দিতো যে , আমি অমুক ব্যক্তি । উক্ত রীতি অনুযায়ী কাসেম প্রতিপক্ষের সামনে এসে পৌছার পর উচ্চৈঃস্বরে বললেন :

যদি না চেনো আমাকে ,জেনো ,আমি হাসান তনয়

সেই নবী মুস্তাফার নাতি যার ওপর ঈমান আনা হয়

ঋণে আবদ্ধ বন্দিসম এইযে হোসাইন

প্রিয়জনদের মাঝে ,পানি দেয়া হয়নি যাদের উত্তম রীতি মেনে।

(বিহারুল আনওয়ার : 45তম খণ্ড ,পৃ. 34)

কাসেম রণাঙ্গনে চলে গেলেন ,আর হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) তার ঘোড়াকে প্রস্তুত করলেন এবং ঘোড়ার লাগাম হাতে নিলেন। মনে হচ্ছিলো যেন তিনি তার দায়িত্ব পালনের জন্য যথাসময়ের অপেক্ষা করছিলেন । জানি না তখন ইমামের মনের অবস্থা কেমন ছিলো! তিনি অপেক্ষমাণ ;তিনি কাসেমের কণ্ঠ শোনার জন্য অপেক্ষমাণ। সহসাই কাসেমের কণ্ঠে চাচাজান! ধ্বনি উচ্চকিত হলো । বর্ণনাকারী বলে : আমরা বুঝতে পারলাম না ইমাম হোসাইন কত দ্রুত গতিতে ঘোড়ায় আরোহণ করলেন এবং রণাঙ্গনের দিকে ছুটে এলেন। তার এ কথা বলার অর্থ এই যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) এক শিকারী বায পাখির ন্যায় রণাঙ্গনে পৌছে যান।

ইতিহাসে লিখিত আছে ,কাসেম যখন ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যান তখন শত্রুপক্ষের প্রায় দু যোদ্ধা তাকে ঘিরে ফেলে। তাদের একজন কাসেমের মাথা কেটে ফেলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু তারা যখন দেখলো যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) আসছেন তখন তাদের সকলেই সেখান থেকে পালিয়ে গেলো। আর যে ব্যক্তি কাসেমের মাথা কাটতে চাচ্ছিলো সে তাদের ঘোড়ার পায়ের নিচে পিষ্ট হলো । যহে তারা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সেহেতু তারা তাদের বন্ধুর ওপর দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে পালিয়ে যায়। অনেক লোক ঘোড়া চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো ;কেউ কারো দিকে তাকাবার অবকাশ পাচ্ছিলো না। মহাকবি ফেরদৌসীর ভাষায় :

ز ﺳﻢ ﺳﺘﻮ ران در ﺁ ن ﭘﻬﻦ د ﺷﺖ

ز ﻣﻴﻦ ﺷﺪ ﺷﺶ و ﺁﺳﻤﺎ ن ه ﺸﺖ

সেই বিশাল প্রান্তরে কঠিন ক্ষুরের ঘায়ে

ধরণী হলো ছয়ভাগ আর আসমান আট।

কেউ বুঝতে পারলো না যে ,কী ঘটে গেলো! ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে সৃষ্ট ধুলার কুণ্ডলী যখন বসে গেলো এবং হাওয়া কিছুটা স্বচ্ছ হলো তখন সবাই দেখতে পেলো যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কাসেমকে কোলে নিয়ে আছেন। আর কাসেম তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলো অতিক্রম করছিলেন এবং যন্ত্রণার তীব্রতার কারণে মাটিতে পা আছড়াচ্ছিলেন। এ সময় শোনা গেলো ,ইমাম হোসাইন (আ.) বলছেন :

یعزّ و الله علی عمّک أن تدعوه فلا ینفعک صوته

আল্লাহর শপথ ,এটা তোমার চাচার জন্য কতই না কষ্টকর যে ,তুমি তাকে ডাকলে কিন্তু তার জবাব তোমার কোনো কাজে এলো না। ( মানাকিবে ইবনে শাহরে আশুব , 4র্থ খণ্ড , পৃ 107 ; আলামুল ওয়ারা , পৃ 243 , আল - লুহুফ , পৃ 48 ; বিহারুল আনওয়ার , 45তম খণ্ড , পৃ 35 ; ইরশাদ - শেখ মুফিদ , পৃ 239 ; মাকতালু মুকাররাম , পৃ 232 ; তারীখে তাবারী , 6ষ্ঠ খণ্ড , পৃ 25 )