আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন11%

আশুরা সংকলন প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা সংকলন
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 51 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 78918 / ডাউনলোড: 7838
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা সংকলন

আশুরা সংকলন

প্রকাশক: কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দুতাবাস -
বাংলা

এ বইটি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের বিশ্লেষণ এবং আশুরার ঘটনাবলী ও শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংকলন যা ঢাকাস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সকল আহলে বাইত প্রেমীর উদ্দেশ্যে নিবেদেন করা হলো যাতে তা তাদের মহান আল্লাহ অভিমুখে পূর্ণতার যাত্রা পথে আলোকবর্তিকা হয় ইনশাল্লাহ।


1

হুর ইবনে ইয়াযীদ

বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে : শেষ ভালো যার সব ভালো তার । আমরা মা সুমগণের নিকট থেকে বর্ণিত দোয়ায় পাঠ করি , হে আল্লাহ! আমাদের কাজের পরিণাম শুভ করুন। কিন্তু সে সৌভাগ্য হয় ক জনের ? হলফ করে বলা যায় ,এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এদের কারো কথা ইতিহাস মনে রাখে ,আর কেউ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। যাদের কথা ইতিহাস কখনোই বিস্মৃত হতে পারে না নিঃসন্দেহে তাদের সাথে জড়িয়ে আছে কোনো অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কারবালার বীরত্ব গাথায় আমরা যে ক জন ত্যাগী বীরের কথা জানতে পারি তাদের মধ্যে হুর ইবনে ইয়াযীদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

হুর ইবনে ইয়াযীদ এক সম্ভান্ত্র গোত্রে গ্রহণ করেন। তার বীরত্ব ও উদারতা তার পূর্বপুরুষেরই উত্তরাধিকার। ইসলামপূর্ব ও পরবর্তীকালে তারা উদারতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন । হুর ইবনে ইয়াযীদ অত্যাচারীকে সাহায্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে এক সুন্দর-সৌভাগ্যময় পরিণতির মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন কাল্যাণ লাভ করেছিলেন ।

হুর ছিলেন কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম। আর এ কারণে ইবনে যিয়াদ তাকে সহস্রাধিক অশ্বারোহী সৈন্যের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করেছিল । সে কুফার উদ্দেশ্যে গমনরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পথরোধ করার জন্য হুর ইবনে ইয়াযীদ কে আদেশ দিয়েছিল ।

হুর ইবনে ইয়াযীদ বলেন : দারুল ইমারা থেকে যখন বাইরে আসছিলাম তখন তিনবার এ শব্দ শুনতে পেলাম যে ,কেউ যেন বলছেন :‘‘ হে হুর! তোমাকে শাহাদাতের সংবাদ!’’ যতই এদিক ওদিক তাকালাম ,কাউকে দেখতে পলাম না। আপন মনে বলতে লাগলাম :‘‘ তোমার মাতা শোকার্ত হোক ;হোসাইনের বিরুদ্ধে ,আর বেহেশতের সুসংবাদ শুনছো’’ !

কিন্তু আশুরার দিনে হুর যখন ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলেন তখন সেই গায়েবী আওয়াজের অর্থ বুঝতে পারলেন।

হুর যু হুসাম নামক স্থানে হযরত ইমাম হোসাইনের সাথে সাক্ষাৎ করেন যখন তিনি ও তার সঙ্গীরা তৃষ্ণার্ত ছিলো। ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের ও তাদেরকে বহনকারী পশুগুলোকে তৃপ্তিসহকারে পানি পান করানোর আদেশ দেন। অতঃপর হুর ইমাম হোসাইনকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করলেন। ইমাম হুরকে বললেন যে ,তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে কুফায় যাচ্ছেন। কিন্তু হুর তাকে কুফায় যেতে দিল না। অতঃপর ইমাম সেখানেই তাবু ফেললেন।

বর্ণিত আছে যে ,হুর আশুরার রাতে দেখেন যে ,তার পিতা তাকে বলছেন : আজ তুমি কোথায় আছ ? হুর জবাব দিলেন : ইমাম হোসাইনের সম্মুখে ,তাকে বাধা দেবো এবং ইবনে যিয়াদের বাহিনী আসা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখব। তার পিতা তার ওপর রাগান্বিত হলেন এবং বললেন : ধিক তোমাকে ! রাসূল (সা.) -এর সন্তানদের সাথে কী করছো ? যদি নিজেকে অনন্তকাল দোযখের আগুনে দেখতে চাও তবেই ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তুমি কি কিয়ামত দিবসে মহানবী (সা.) ,আমীরুল মু মিনীন (আ.) ও ফাতেমা যাহরার ক্রোধে পতিত হতে চাও এবং তাদের শাফা আত থেকে বঞ্চিত হতে চাও ?

আশুরার দিন হুর ওমর ইবনে সা দের সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে জানতে চাইলেন : তুমি কি হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফলেছো ? ওমর ইবনে সা দ জবাবে বললো : হ্যাঁ । এমনভাবে যুদ্ধ করবো যাতে কমসংখ্যকের মাথা ও হাত কাটতে হয়। হুর বললেন : এটা কি ভালো ছিলোনা যে ,তাকে তার ওপর ছেড়ে দেবে ,আর তিনি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে দূরে যেখানে ইচ্ছা চলে যাবেন ? ওমর ইবনে সাদ বললো : যদি ব্যাপারটা আমার হাতে থাকতো তাহলে এমনটিই করতাম । কিন্তু আমীর ওবায়দুল্লাহ এমনটি করার অনুমতি দেননি।

হুর ওমর ইবনে সা দ থেকে দূরে সরে গিয়ে একাকী চিন্তায় মগ্ন হলেন। এমন সময় কোররাত ইবনে কাইস রিয়াহী কাছে এলে তাকে উদ্দেশ্য করে হুর বললেন : নিজের ঘোড়াকে পানি পান করিয়েছো ?

কোররাত বলে :বুঝতে পারলাম যে ,তিনি চাচ্ছিলেন যে ,আমি তার নিকটে অবস্থান করি। আর তাই বললাম : না ,আমার ঘোড়াকে পানি দেইনি। আমি তাকে রেখে অন্যত্র চলে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম হুর ধীরে ধীরে হোসাইনের দিকে যাচ্ছেন। মুহাজির ইবনে আউস তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল : আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছো ? হুর নীরব থাকলেন এবং কোনো জবাব দিলেন না। কিন্তু ভীষণ কাপছিলেন । হাজির ইবনে আউস হুরকে বলল : তোমার আচরণ তো সন্দেহ জনক ;আমি তোমাকে কখনোই এমন দেখিনি। যদি আমাকে পূর্বে জিজ্ঞাসা করা হতো কুফার শ্রেষ্ঠ বীর কে ? তবে আমি তোমার নামটিই বলতাম। তাহলে তোমার মধ্যে যে উদ্বেগ আমি দেখতে পাচ্ছি তা কি জন্য ?

হুর জবাবে বললেন : আল্লাহর শপথ ,আমি নিজেকে বেহেশত ও দোযখের মাঝে পরীক্ষা করছি। আল্লাহর শপথ ,বেহেশত ব্যতীত অন্য কোনো পথ বেছে নেবো না ,এমনকি টুকরা টুকরা হয়ে গেলেও । অতঃপর তিনি নিজের ঘোড়াকে দ্রূত ইমাম হোসাইনের দিকে পরিচালনা করলেন। ইমামের নিকটবর্তী হলে নিজের ঢালকে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত হিসাবে উাল্টো করে ধরলেন এবং ইমাম হোসাইনের সামনে উপস্থিত হয়ে মুখমণ্ডল মাটিতে স্থাপন করলেন।

ইমাম হোসাইন (আ.) তাকে বললেন : মাথা ওপরে তোলো ,তুমি কে ? হুর বললেন : হে রাসূলের সন্তান! আমি সেই ব্যক্তি যে আপনার পথে বাধ সেধেছিল । আমি আপনাকে নিরাপদ স্থানে যেতে দেই নি। কিন্তু আল্লাহর কসম ,আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে ,আপনার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে । আমার ধারণা ছিলো আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা হবে । এখন অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আপনার দিকে ফিরে এসেছি ;আমার তাওবা কি কবুল হয়েছে ? ইমাম জবাব দিলেন : হে ,মহান আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করেছেন। হুর তৃপ্ত হৃদয়ে ইমাম হোসাইনের নিকট প্রার্থনা করলেন : আমাকে অনুমতি দিন যাতে আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রথম ব্যক্তি হতে পারি।

ইমাম হোসাইন (আ.) তার কাল্যাণার্থে দোয়া করলেন। অতঃপর হুর ইবনে যিয়াদের সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে উপদেশ দিলেন। কিন্তু তাতে তারা কর্ণপাত না করে তার দিকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। হুর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) হুরের রক্তাক্ত নিথর দেহের পাশে গিয়ে বললেন : তুমি সত্যিই হুর (মুক্ত) যেমনটি তোমার মাতা তোমার নামকরণ করেছেন। তুমি দুনিয়াতে ,আর আখেরাতে সৌভাগ্যবান।

এ মহান ত্যাগী বীরের সমাধিস্থল বর্তমান কারবালা থেকে পশ্চিমে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তার সমাধির ওপর একটি স্থাপনা আছে যা সুন্দর কারুকার্য খচিত। কথিত আছে ,হুরের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তামিম গোত্রের একদল ব্যক্তি আশুরার ঘটনার পর তার দেহ এ স্থানে এনে দাফন করেন।

শাহ ইসমাইল (আয়াতুল্লাহ হায়েরীর বর্ণনামতে শাহ আব্বাস) ইরাক দখল করার পর কারবালায় এসে ছিলেন । তিনি হুরের মর্যাদা ও মাযার সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন । সত্য উদঘাটনের জন্য তিনি হুরের কবর খননের নির্দেশ দেন। কবর খননের পর তিনি হুরের দেহকে রক্তাক্ত পোশাকসহ দেখতে পান । তারা তার জখমগুলোকে তাজা দেখতে পান । তার মাথায় তরবারির আঘাতে সৃষ্ট জখম দেখতে পান যা এক টুকরা কাপর দিয়ে বাধা ছিল । শাহ এ কাপড় খুলে অন্য কাপড দিয়ে জখমটি বাধার নির্দেশ দিলে তা খোলা মাত্র ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে । ফলে পুনরায় তা বেধে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাবাররুক হিসাবে শাহ সে কাপড়ের টুকরা থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ কেটে নেন। অতঃপর শাহ হুরের সমাধিকে পুনরায় আকর্ষণীয় রূপে তৈরী করার নির্দেশ দেন।[ সূত্র : দায়েরাতুল মা য়ারেফে তাশাইয়্যূ , ৬ষ্ঠ খণ্ড ]

সংকলনে : মোঃ মাঈন উদ্দিন

দ্বিতীয় অধ্যায়

শীয়াদের ধর্মীয় চিন্তাধারা

ধর্মীয় চিন্তাধারার সংজ্ঞা

ধর্মীয় চিন্তাধারা বলতে এখানে সেসব বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা , আলোচনা ও অনুসন্ধিসাকে বোঝায় , যা ধর্ম সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রদান করে । যেমনি ভাবে গণিত সংক্রান্ত চিন্তাধারা বলতে সেই চিন্তা ধারাকেই বোঝায় , যা গণিত সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করে , অথবা গণিত সংক্রান্ত কোন সমস্যার সমাধান করে ।

ইসলামের ধর্মীয় চিন্তাধারার মূল উৎস

অন্য যে কোন বিষয়ক চিন্তা ধারার মত ধর্মীয় চিন্তা ধারারও উৎস থাকা প্রয়োজন , যা থেকে চিন্তাধারা উৎসারিত হবে এবং যার উপর তা হবে নির্ভরশীল । যেমন : গণিত সংক্রান্ত কোন একটি সমস্যা সমাধানের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে গণিত সংক্রান্ত কিছু সূত্র ও জ্ঞান কাজে লাগাতে হয় , যা শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোন কারিগরি বিষয়ে গিয়ে সমাপ্ত হয় । ধর্মীয় চিন্তাধারার ব্যাপারে ঐশী ধর্ম ইসলাম একমাত্র যে জিনিসটিকে নির্ভরযোগ্য ও মূল উৎস হিসেবে ঘোষণা করেছে , তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন । পবিত্র কুরআনই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন নবুয়তের অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ । ইসলামের প্রতি আহবানই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু । অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কুরআনকে একমাত্র মূল উৎস বলার অর্থ এটা নয় যে , এ সংক্রান্ত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ্য উৎসগুলোকে অস্বীকার করা । এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব ।

কুরআন নির্দেশিত ধর্মীয় চিন্তা ধারার নিয়ম-নীতি

ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছা এবং ইসলামী জ্ঞান উপলদ্ধির ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা তার অনুসারীদেরকে তিনটি পদ্ধতি উপহার দেয় । সেগুলো হচ্ছে: নিষ্ঠা , দাসত্ব বা আনুগত্যের মাধ্যমে ধর্মের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিমত্তাগত দলিল , ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি । ব্যাখ্যা : আমরা যদি পবিত্র কুরআনের দিকে লক্ষ্য করি , তাহলে দেখতে পাব যে , কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয় যেমনঃ তৌহীদ (একত্ববাদ) ,নবুয়ত , মা আদ (কেয়ামত) এবং ব্যবহারিক আইন কানুন সংক্রান্ত বিষয় , যেমনঃ নামায , রোযা..... ইত্যাদি নিয়ম নীতিগুলো মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছে । একইভাবে কিছু কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে । কিন্তু সেখানে মহান আল্লাহ স্বীয় বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেনি । বরং স্বীয় প্রভুত্বের ক্ষমতা সেখানে খাটানো হয়েছে । মহান আল্লাহ যদি পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত তার শাব্দিক বক্তব্যগুলোকে নির্ভরযোগ্যতা (প্রামাণ্য) ও গুরুত্ব প্রদান না করতেন , তাহলে অবশ্যই তিনি মানুষের কাছ থেকে ঐ ব্যাপারে আনুগত্য কামনা করতেন না । তখন বাধ্য হয়ে তিনি বলতেন যে , কুরআনের এ ধরণের সাধারণ বক্তব্যসমূহ ধর্মীয় লক্ষ্যসমুহ এবং ইসলামী জ্ঞান অনুধাবন করার একটি পদ্ধতি মাত্র । আমরা পবিত্র কুরআনের এ ধরণের শাব্দিক বর্ণনা গুলোকে (ঈমান আনো আল্লাহর এবং তার রাসূলের প্রতি) ও (নামায প্রতিষ্ঠা কর) ইসলামের বাহ্যিক দিক বলে গণ্য করি । অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই যে , পবিত্র কুরআনে তার প্রচুর আয়াত বুদ্ধিমত্তাগত প্রমাণের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে । পবিত্র কুরআন মানুষকে আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ এ বিশ্বে ও তাতে বসবাসরত জাতিসমুহ সম্পর্কে সুগভীর চিন্তা ভাবনা করার আহবান্ জানায় । এ ছাড়া স্বয়ং আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে সত্য প্রমাণের জন্য বুদ্ধিমত্তাগত দলিল প্রমাণের মাধ্যমে মুক্ত আলোচনার আশ্রয় নিয়েছেন । সত্যি বলতে কি , বিশ্বের কোন ঐশী পুস্তকই পবিত্র কুরআনের মত যুক্তি প্রমাণ ভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষা দেয় না । পবিত্র কুরআন এসব বর্ণনার মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তাগত দলিল ও স্বাধীন যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণের বিষয়কে নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত বলে গণ্য করে । কুরআন কখনও প্রথমে ইসলামী জ্ঞানের সত্যতা গ্রহণ করে অতঃপর বুদ্ধিমত্তা প্রসূত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করার আহবান জানায় না । বরঞ্চ , বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ আস্থা সহ কুরআন বলেঃ বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে যাচাই-বাছাইর মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানমালা অর্জন ও গ্রহণ কর । যখন ইসলামের আহবান্ শুনতে পাবে , তখন তা যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নেবে । অর্থাৎ যুক্তিভিত্তিক দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানাবলী অর্জন ও গ্রহণ বা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে । প্রথমে তার প্রতি ঈমান এনে তারপর স্বপক্ষে যুক্তি -প্রমাণ আনার চেষ্টা করবে না । এরপর দার্শনিক চিন্তাধারারও পথ আছে , যা পবিত্র কুরআনও সমর্থন করে । অন্য দিকে পবিত্র কুরআন তার চমৎকার বর্ণনার মাধ্যমে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে যে , সকল সত্য ভিত্তিক জ্ঞানই তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয়গত জ্ঞান থেকেই উৎসারিত । পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতি লাভ একমাত্র তাদের জন্যেই সম্ভব , যাদেরকে মহান প্রভু নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি নিজেই ঐ সকল বিশেষ বিশ্বাস নিজের জন্যে বেছে নিয়েছেন । আর তারা হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি , যারা সবার থেকে নিজেকে পৃথক করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভুলে গেছেন । অতঃপর হৃদয়ের সততা ও আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের সকল শক্তিকে একমাত্র সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি বিনিয়োগ করেছেন । মহাপ্রভু আল্লাহর পবিত্র জ্যোতিচ্ছটায় তারা তাদের দৃষ্টিকে জ্যোতির্ময় করেছেন । তারা তাদের বাস্তব দৃষ্টিতে বস্তু নির্ণয়ের নিগুঢ়তত্ব এবং আকাশ ও পৃথিবীর ঐশী রহস্য আবলোকন করেছেন । কারণঃ আত্মিক নিষ্ঠা ও উপাসনার মাধ্যমে তারা দৃঢ় বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়েছেন । আ র দৃঢ় বিশ্বাসের (ইয়াকীন) স্তরে উন্নতি হওয়ার কারণে এ আকাশ , পৃথিবী ও অনন্ত জীবনের গোপন রহস্য তাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে । নিম্নলিখিত কুরআনের আয়াতগুলো এ বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে ।

(ক) আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি , তাকে এ আদেশ দিয়েছি যে , আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই । সুতরাং আমারই ইবাদত কর ।102 (সূরা আল্ আম্বিয়া 25 নং আয়াত ।)

(খ) তারা যা বলে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র । তবে কেবল মাত্র সত্যনিষ্ঠ বান্দারা ব্যতীত ।103 (সূরা আল্ সাফাত 159 নং আয়াত থেকে 160 নং আয়াত পর্যন্ত ।)

(গ) বলুনঃ আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ , আমার প্রতি পত্যাদেশ হয় যে , তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য । অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে , সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে ।104 (সূরা আল্ কাহাফ 110 নং আয়াত ।) ( ঘ) এবং পালনকর্তার ইবাদত কর যে পর্যন্ত তোমার নিকট নিশ্চিত জ্ঞান না আসে । (সূরা আল্ হিজর 99 নং আয়াত ।)

(ঙ) আমি এ রূপেই ইব্রাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়ে ছিলাম,য াতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায় ।105 (সূরা আল্ আনয়াম 75 নং আয়াত ।)

(চ) কখনও না , নিশ্চয় সৎ লোকদের আমলনামা আছে ইল্লিয়্যীনে আপনি জানেন ইল্লিয়্যীন কি ? এটা লিপিবদ্ধ খাতা , আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একে প্রত্যক্ষ করে ।106 (সূরা আল্ মুতাফফিফিন 18 নং আয়াত থেকে 21 নং আয়াত পর্যন্ত )

(ছ) কখনও নয় ; যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের অধীকারী হতে তবে অবশ্যই জাহান্নামকে (এই পৃথিবীতেই) দেখতে পেতে ।107 (সূরা আত তাকাসুর 5 ও 6 নং আয়াত ।)

অতএব এখান থেকে প্রমাণিত হল যে , ঐশী জ্ঞান উপলদ্ধির একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও উপাসনায় আত্মিক নিষ্ঠা রক্ষা করা ।

পূর্বে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতির পারস্পরিক পার্থক্য পূর্বোক্ত বর্ণনা অনুসারে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ,পবিত্র কুরআন ইসলামী শিক্ষা উপলদ্ধির জন্যে তিনটি পদ্ধতি (ইসলামের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিবৃত্তি ও উপাসনা) উপস্থাপন করেছে । তবে এটাও জানা প্রয়োজন যে , বিভিন্ন দিক থেকে এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান ।

প্রথমত : ইসলামের বাহ্যিক দিক অর্থাৎ শরীয়তি বিধান , যা অত্যন্ত সহজ ভাষায় শাব্দিকভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং যা সর্ব সাধারণের নাগালে রয়েছে । প্রত্যেক ব্যক্তি তার বোধশক্তির মাত্রা অনুযায়ী তা থেকে উপকৃত হয় ।108 এই প্রথম পদ্ধতিটি অন্য দুটি পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক । কারণ অন্য দুটি পদ্ধতি সব সাধারণের জন্যে নয় । বরং তা বিশেষ একটি গোষ্ঠিরজন্য ।

দ্বিতীয়ত : প্রথম পদ্ধতিটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও গৌণ বা শাখা-প্রশাখাগত অংশের জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় । আর এর মাধ্যমে ইসলামের বিশ্বাসগত ও ব্যবহারিক (জ্ঞান ও চরিত্র গঠনের মূলনীতি) জ্ঞান অর্জন করা যায় । তবে অন্য পদ্ধতি দুটি (বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মশুদ্ধি) এমন নয় । অবশ্য যদিও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচারগত এবং ব্যবহারিক বিষয় (শরীয়তের বিধান) সম্পর্কে সামষ্টিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব । তবে ঐসবের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ও খুঁটি-নাটি ব্যাপারগুলো বুদ্ধিবৃত্তির নাগালের বাইরে । একইভাবে আত্মশুদ্ধির পথ , যার মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্যের উম্নোচন ঘটে , তা হচ্ছে খোদাপ্রদত্ত একটি কাজ । খোদাপ্রদত্ত ঐ বিষয়ের পরিণতিতে বিশ্বের সকল গুস্তরহস্য মানুষের কাছে উদঘাটিত ও দৃশ্যমান হয় , যার কোন সীমা বা পরিসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । কেননা এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য সবকিছুকেই সে ভুলে যায় । ঐ অবস্থায় সে সরাসরি এবং স্বয়ং আল্লাহর বিশেষ বিলায়াত (কর্তৃত্ব ) ও তত্বাবধানে থাকে । তখন আল্লাহ যা কিছু চান (ব্যক্তি ইচ্ছায় নয়) , তাই তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ।

প্রথম পদ্ধতি

ইসলামের বাহ্যিক অংশ ও তার প্রকারভেদ

যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে , মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের শাব্দিক অংশকে এর অধ্যয়ন ও শ্রবণকারীদের জন্যে অনুসরণযোগ্য হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন । আর পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর বাণীকেও মাননীয় দলিল ও প্রমাণ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন । তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : তোমার কাছে কুরআন অবতির্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে , যা তাদের প্রতি অবতির্ণ করা হয়েছিল । (সূরা আন্ নাহল , 44 নং আয়াত ।)

পবিত্র কুরআনে তিনি আরও বলেছেন : তিনি তাদের মধ্য থেকেই (গোত্রীয়) একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল হিসেবে । যে তাদের কাছে তার আয়াত আবৃতি করে , তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় । (সূরা আল্ জুমআ , 2 নং আয়াত ।)

আল্লাহ আরও বলেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম আদর্শ । (সূরা আল্ আহজাব , 21 নং আয়াত ।)

এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ব্যাপার যে , মহানবী (সা.)-এর বাণী , আচরণ , অনুমোদন এবং নিরবতা যদি পবিত্র কুরআনের মতই আমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ না হত , তাহলে পবিত্র কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াত গুলোর অর্থ আদৌ সঠিক হত না । সুতরাং যে কেউ সরাসরি মহানবী (সা.)-এর কোন বানী শ্রবণ করবে , অথবা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র থেকে তার কাছে বর্ণিত হবে , তখন তার জন্যে অবশ্য অনুকরণীয় বলে গণ্য হবে । একইভাবে মহানবী (সা.)-এর মুতাওয়াতের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূল (সা.) -এর আহলে- বাইতের বাণীও রাসূল (সা.)-এর বাণীর মতই নির্ভরযোগ্য ও অবশ্য অনুকরণীয় । এভাবে বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.)-এর হাদীস দ্বারা আহলে-বাইতের হাদীসের আনুগত্যের অপরিহার্যতা প্রমাণিত । রাসূল (সা.)-এর আহলে-বাইতগণ ইসলামী জ্ঞান জগতের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন রয়েছেন । ইসলামী জ্ঞান ও বিধান শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল । তাদের যে কোন মৌখিক বক্তব্যই আমাদের জন্যে নির্ভরযোগ্য দলিল ও প্রমাণ স্বরূপ । উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , ইসলামী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইসলামের বাহ্যিক অংশ , যা একটি মৌলিক সূত্র বা উৎস হিসেবে গণ্য তা দু ধরণের : (1) পবিত্র কুরআন ও (2) সুন্নাত ।

এখানে পবিত্র কুরআন বলতে , কুরআনের সুস্পষ্ট ও বাহ্যিক অর্থ সম্পন্ন আয়াতগুলোকে বোঝান হচ্ছে । আর সুন্নাত বলতে , মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীসকেই বোঝান হচ্ছে ।

সাহাবীদের হাদীস

সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসও যদি মহানবী (সা.)-এর বাণী ও কাজের অনুরূপ এবং পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর হাদীসের বিরোধী না হয় , তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে । কিন্তু সাহাবীদের ঐসব হাদীস যদি তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না । ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে সাহাবীরাও অন্য সকল সাধারণ মুসলমানদের মতই । এমনকি স্বয়ং সাহাবীরাও তাদের নিজেদের মধ্যে সাধারণ মুসলমানদের মতই আচরণ করেছেন ।

পবিত্র কুরআন ও সুন্নতে মুজাদ্দিদ সংক্রান্ত আলোচনা

পবিত্র কুরআনই ইসলামী চিন্তাধারার একমাত্র মূলভিত্তি ও উৎসস্বরূপ । আর একমাত্র কুরআনই ইসলামের অন্যান্য মূল ভিত্তিগুলোকে নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী । এছাড়া পবিত্র কুরআন নিজেকে জ্যোতি ও অন্যদের জ্যোতির্ময় হিসেবে বর্ণনা করেছে । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , তারা যদি সুগভীর ভাবে কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে তারা ঐ কুরআনের মধ্যে পরস্পর বিরোধী কোন বিষয় খুজে পাবে না । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , যদি তারা সক্ষম হয় তাহলে কুরআনের মুকাবেলায় কুরআনের মতই আরেকটি গ্রন্থ রচনা করে নিয়ে আসুক । পবিত্র কুরআন যদি সর্ব সাধারণের জন্যে বোধগম্যই না হত , তাহলে মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের এধরণের বক্তব্য প্রদানই বৃথা বলে গণ্য হত । অবশ্য এটা কারও ভাবাও উচিত নয় যে , কুরআনের এ বিষয়টি (কুরআন নিজেই সকলের জন্যে বোধগম্য) এর পূর্ববর্তী বিষয়ের [মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ কুরআনে বর্ণিত ইসলামী জ্ঞান ও তার নিগূঢ়তত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আরোহনের মূল উৎস] সাথে অসংগতিপূর্ণ । কারণঃ ইসলামী বিধানের শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলোই সংক্ষিপ্ত আকারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে । আর তার বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ব্যাখার জন্যে আমাদেরকে সুন্নাত তথা মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতগণের হাদীসের মুখাপেক্ষী হতে হয় । যেমন : নামায , রোযা , ক্রয়-বিক্রয় , বিচার সহ ইবাদত সংক্রান্ত সকল বিষয়েই আমাদেরকে সুন্নাত বা রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইতদের হাদীসের প্রতি নির্ভর করতে হয় । আর মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অর্থ ও ব্যাখা যদিও মোটামুটিভাবে সর্ব সাধারণের বোধগম্য , তথাপি এ ব্যাপারে একমাত্র আহলে বাইতগণের (আ.) গৃহীত পদ্ধতিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে । কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াতের দ্বারা ব্যাখা করতে হবে । নিজেদের মনমত তাফসীর বা ব্যাখা করা যাবে না । পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অভ্যস্ত মনের ইচ্ছেমত ব্যাখা করা যাবে না । হযরত ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের ব্যাখা স্বরূপ । কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ ।109 আর মহানবী (সা.) বলেছেন : কুরআনের কিছু অংশ অন্য কিছু অংশের জন্যে ব্যাখা বা বাস্তব নমুনা স্বরূপ ।110

মহানবী (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের ব্যাখা করবে , এর মধ্যে সে , নিজেই নিজের জন্যে জাহান্নামে বসবাসের স্থান নির্ধারণ করবে ।111 কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে তাফসীরের একটি সহজ উদাহরণ হল : মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একস্থানে পাপিষ্ট লুত জাতির প্রতি অবতির্ণ ঐশী শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন যে , আমি তাদের উপর খারাপ বৃষ্টি বর্ষণ করেছি ।112 একই বিষয়ে কুরআনের অন্যত্র তিনি এ ব্যাপারটি শব্দ পরিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন : আমি তাদের প্রতি প্রস্তর বর্ষণ করেছি ।113 এখানে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটিকে দ্বিতীয় আয়াতের সাথে মিলিয়ে নিলেই অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । প্রথম আয়াতে উল্লেখিত খারাপ বৃষ্টি বলতে এখানে ঐশী প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণই বোঝানো হয়েছে । কেউ যদি সুক্ষ্ণভাবে গবেষণার দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবং সাহাবী ও তাবেঈন মুফাসসিরদের (তাফসীর কারক) হাদীস ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সমূহ পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে , কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে ব্যাখার নীতি একমাত্র পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত নীতি ছিল ।

দ্বিতীয় অধ্যায়

শীয়াদের ধর্মীয় চিন্তাধারা

ধর্মীয় চিন্তাধারার সংজ্ঞা

ধর্মীয় চিন্তাধারা বলতে এখানে সেসব বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা , আলোচনা ও অনুসন্ধিসাকে বোঝায় , যা ধর্ম সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত বা ফলাফল প্রদান করে । যেমনি ভাবে গণিত সংক্রান্ত চিন্তাধারা বলতে সেই চিন্তা ধারাকেই বোঝায় , যা গণিত সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্ত প্রদান করে , অথবা গণিত সংক্রান্ত কোন সমস্যার সমাধান করে ।

ইসলামের ধর্মীয় চিন্তাধারার মূল উৎস

অন্য যে কোন বিষয়ক চিন্তা ধারার মত ধর্মীয় চিন্তা ধারারও উৎস থাকা প্রয়োজন , যা থেকে চিন্তাধারা উৎসারিত হবে এবং যার উপর তা হবে নির্ভরশীল । যেমন : গণিত সংক্রান্ত কোন একটি সমস্যা সমাধানের চিন্তাধারার ক্ষেত্রে গণিত সংক্রান্ত কিছু সূত্র ও জ্ঞান কাজে লাগাতে হয় , যা শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কোন কারিগরি বিষয়ে গিয়ে সমাপ্ত হয় । ধর্মীয় চিন্তাধারার ব্যাপারে ঐশী ধর্ম ইসলাম একমাত্র যে জিনিসটিকে নির্ভরযোগ্য ও মূল উৎস হিসেবে ঘোষণা করেছে , তা হচ্ছে পবিত্র কুরআন । পবিত্র কুরআনই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর চিরন্তন নবুয়তের অকাট্য প্রমাণ স্বরূপ । ইসলামের প্রতি আহবানই কুরআনের মূল বিষয়বস্তু । অবশ্য এখানে বলে রাখা দরকার যে ধর্মীয় চিন্তাধারার ক্ষেত্রে কুরআনকে একমাত্র মূল উৎস বলার অর্থ এটা নয় যে , এ সংক্রান্ত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য ও প্রমাণ্য উৎসগুলোকে অস্বীকার করা । এ বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব ।

কুরআন নির্দেশিত ধর্মীয় চিন্তা ধারার নিয়ম-নীতি

ধর্মীয় লক্ষ্যে পৌছা এবং ইসলামী জ্ঞান উপলদ্ধির ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা তার অনুসারীদেরকে তিনটি পদ্ধতি উপহার দেয় । সেগুলো হচ্ছে: নিষ্ঠা , দাসত্ব বা আনুগত্যের মাধ্যমে ধর্মের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিমত্তাগত দলিল , ও আধ্যাত্মিক উপলদ্ধি । ব্যাখ্যা : আমরা যদি পবিত্র কুরআনের দিকে লক্ষ্য করি , তাহলে দেখতে পাব যে , কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানব জাতিকে উদ্দেশ্য করে মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত বিষয় যেমনঃ তৌহীদ (একত্ববাদ) ,নবুয়ত , মা আদ (কেয়ামত) এবং ব্যবহারিক আইন কানুন সংক্রান্ত বিষয় , যেমনঃ নামায , রোযা..... ইত্যাদি নিয়ম নীতিগুলো মেনে চলার আহবান জানানো হয়েছে । একইভাবে কিছু কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে । কিন্তু সেখানে মহান আল্লাহ স্বীয় বক্তব্যের স্বপক্ষে কোন দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেনি । বরং স্বীয় প্রভুত্বের ক্ষমতা সেখানে খাটানো হয়েছে । মহান আল্লাহ যদি পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত তার শাব্দিক বক্তব্যগুলোকে নির্ভরযোগ্যতা (প্রামাণ্য) ও গুরুত্ব প্রদান না করতেন , তাহলে অবশ্যই তিনি মানুষের কাছ থেকে ঐ ব্যাপারে আনুগত্য কামনা করতেন না । তখন বাধ্য হয়ে তিনি বলতেন যে , কুরআনের এ ধরণের সাধারণ বক্তব্যসমূহ ধর্মীয় লক্ষ্যসমুহ এবং ইসলামী জ্ঞান অনুধাবন করার একটি পদ্ধতি মাত্র । আমরা পবিত্র কুরআনের এ ধরণের শাব্দিক বর্ণনা গুলোকে (ঈমান আনো আল্লাহর এবং তার রাসূলের প্রতি) ও (নামায প্রতিষ্ঠা কর) ইসলামের বাহ্যিক দিক বলে গণ্য করি । অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই যে , পবিত্র কুরআনে তার প্রচুর আয়াত বুদ্ধিমত্তাগত প্রমাণের ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছে । পবিত্র কুরআন মানুষকে আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ এ বিশ্বে ও তাতে বসবাসরত জাতিসমুহ সম্পর্কে সুগভীর চিন্তা ভাবনা করার আহবান্ জানায় । এ ছাড়া স্বয়ং আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে সত্য প্রমাণের জন্য বুদ্ধিমত্তাগত দলিল প্রমাণের মাধ্যমে মুক্ত আলোচনার আশ্রয় নিয়েছেন । সত্যি বলতে কি , বিশ্বের কোন ঐশী পুস্তকই পবিত্র কুরআনের মত যুক্তি প্রমাণ ভিত্তিক জ্ঞানের শিক্ষা দেয় না । পবিত্র কুরআন এসব বর্ণনার মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তাগত দলিল ও স্বাধীন যুক্তি ভিত্তিক প্রমাণের বিষয়কে নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত বলে গণ্য করে । কুরআন কখনও প্রথমে ইসলামী জ্ঞানের সত্যতা গ্রহণ করে অতঃপর বুদ্ধিমত্তা প্রসূত যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে সেগুলো যাচাই করার আহবান জানায় না । বরঞ্চ , বাস্তবতার প্রতি পূর্ণ আস্থা সহ কুরআন বলেঃ বুদ্ধিবৃত্তিগত যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে যাচাই-বাছাইর মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানমালা অর্জন ও গ্রহণ কর । যখন ইসলামের আহবান্ শুনতে পাবে , তখন তা যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নেবে । অর্থাৎ যুক্তিভিত্তিক দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামী জ্ঞানাবলী অর্জন ও গ্রহণ বা তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে । প্রথমে তার প্রতি ঈমান এনে তারপর স্বপক্ষে যুক্তি -প্রমাণ আনার চেষ্টা করবে না । এরপর দার্শনিক চিন্তাধারারও পথ আছে , যা পবিত্র কুরআনও সমর্থন করে । অন্য দিকে পবিত্র কুরআন তার চমৎকার বর্ণনার মাধ্যমে এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করেছে যে , সকল সত্য ভিত্তিক জ্ঞানই তাওহীদ (একত্ববাদ) এবং সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রকৃত পরিচয়গত জ্ঞান থেকেই উৎসারিত । পরিপূর্ণ খোদা পরিচিতি লাভ একমাত্র তাদের জন্যেই সম্ভব , যাদেরকে মহান প্রভু নির্ধারণ করেছেন এবং তিনি নিজেই ঐ সকল বিশেষ বিশ্বাস নিজের জন্যে বেছে নিয়েছেন । আর তারা হচ্ছেন সেসব ব্যক্তি , যারা সবার থেকে নিজেকে পৃথক করেছেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুকে ভুলে গেছেন । অতঃপর হৃদয়ের সততা ও আনুগত্যের মাধ্যমে নিজের সকল শক্তিকে একমাত্র সর্বস্রষ্টা আল্লাহর প্রতি বিনিয়োগ করেছেন । মহাপ্রভু আল্লাহর পবিত্র জ্যোতিচ্ছটায় তারা তাদের দৃষ্টিকে জ্যোতির্ময় করেছেন । তারা তাদের বাস্তব দৃষ্টিতে বস্তু নির্ণয়ের নিগুঢ়তত্ব এবং আকাশ ও পৃথিবীর ঐশী রহস্য আবলোকন করেছেন । কারণঃ আত্মিক নিষ্ঠা ও উপাসনার মাধ্যমে তারা দৃঢ় বিশ্বাসের স্তরে উন্নীত হয়েছেন । আ র দৃঢ় বিশ্বাসের (ইয়াকীন) স্তরে উন্নতি হওয়ার কারণে এ আকাশ , পৃথিবী ও অনন্ত জীবনের গোপন রহস্য তাদের কাছে উন্মোচিত হয়েছে । নিম্নলিখিত কুরআনের আয়াতগুলো এ বক্তব্যের প্রমাণ বহন করে ।

(ক) আপনার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি , তাকে এ আদেশ দিয়েছি যে , আমি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই । সুতরাং আমারই ইবাদত কর ।102 (সূরা আল্ আম্বিয়া 25 নং আয়াত ।)

(খ) তারা যা বলে আল্লাহ তা থেকে পবিত্র । তবে কেবল মাত্র সত্যনিষ্ঠ বান্দারা ব্যতীত ।103 (সূরা আল্ সাফাত 159 নং আয়াত থেকে 160 নং আয়াত পর্যন্ত ।)

(গ) বলুনঃ আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ , আমার প্রতি পত্যাদেশ হয় যে , তোমাদের উপাস্যই একমাত্র উপাস্য । অতএব যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে , সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরীক না করে ।104 (সূরা আল্ কাহাফ 110 নং আয়াত ।) ( ঘ) এবং পালনকর্তার ইবাদত কর যে পর্যন্ত তোমার নিকট নিশ্চিত জ্ঞান না আসে । (সূরা আল্ হিজর 99 নং আয়াত ।)

(ঙ) আমি এ রূপেই ইব্রাহীমকে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পরিচালন ব্যবস্থা দেখিয়ে ছিলাম,য াতে সে দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে যায় ।105 (সূরা আল্ আনয়াম 75 নং আয়াত ।)

(চ) কখনও না , নিশ্চয় সৎ লোকদের আমলনামা আছে ইল্লিয়্যীনে আপনি জানেন ইল্লিয়্যীন কি ? এটা লিপিবদ্ধ খাতা , আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ একে প্রত্যক্ষ করে ।106 (সূরা আল্ মুতাফফিফিন 18 নং আয়াত থেকে 21 নং আয়াত পর্যন্ত )

(ছ) কখনও নয় ; যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞানের অধীকারী হতে তবে অবশ্যই জাহান্নামকে (এই পৃথিবীতেই) দেখতে পেতে ।107 (সূরা আত তাকাসুর 5 ও 6 নং আয়াত ।)

অতএব এখান থেকে প্রমাণিত হল যে , ঐশী জ্ঞান উপলদ্ধির একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আত্মশুদ্ধি ও উপাসনায় আত্মিক নিষ্ঠা রক্ষা করা ।

পূর্বে উল্লিখিত তিনটি পদ্ধতির পারস্পরিক পার্থক্য পূর্বোক্ত বর্ণনা অনুসারে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ,পবিত্র কুরআন ইসলামী শিক্ষা উপলদ্ধির জন্যে তিনটি পদ্ধতি (ইসলামের বাহ্যিকরূপ , বুদ্ধিবৃত্তি ও উপাসনা) উপস্থাপন করেছে । তবে এটাও জানা প্রয়োজন যে , বিভিন্ন দিক থেকে এ তিনটি পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান ।

প্রথমত : ইসলামের বাহ্যিক দিক অর্থাৎ শরীয়তি বিধান , যা অত্যন্ত সহজ ভাষায় শাব্দিকভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং যা সর্ব সাধারণের নাগালে রয়েছে । প্রত্যেক ব্যক্তি তার বোধশক্তির মাত্রা অনুযায়ী তা থেকে উপকৃত হয় ।108 এই প্রথম পদ্ধতিটি অন্য দুটি পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক । কারণ অন্য দুটি পদ্ধতি সব সাধারণের জন্যে নয় । বরং তা বিশেষ একটি গোষ্ঠিরজন্য ।

দ্বিতীয়ত : প্রথম পদ্ধতিটি এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক ও গৌণ বা শাখা-প্রশাখাগত অংশের জ্ঞান সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় । আর এর মাধ্যমে ইসলামের বিশ্বাসগত ও ব্যবহারিক (জ্ঞান ও চরিত্র গঠনের মূলনীতি) জ্ঞান অর্জন করা যায় । তবে অন্য পদ্ধতি দুটি (বুদ্ধিবৃত্তি ও আত্মশুদ্ধি) এমন নয় । অবশ্য যদিও বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচারগত এবং ব্যবহারিক বিষয় (শরীয়তের বিধান) সম্পর্কে সামষ্টিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব । তবে ঐসবের সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ও খুঁটি-নাটি ব্যাপারগুলো বুদ্ধিবৃত্তির নাগালের বাইরে । একইভাবে আত্মশুদ্ধির পথ , যার মাধ্যমে সৃষ্টি রহস্যের উম্নোচন ঘটে , তা হচ্ছে খোদাপ্রদত্ত একটি কাজ । খোদাপ্রদত্ত ঐ বিষয়ের পরিণতিতে বিশ্বের সকল গুস্তরহস্য মানুষের কাছে উদঘাটিত ও দৃশ্যমান হয় , যার কোন সীমা বা পরিসীমা নির্ধারণ করা সম্ভব নয় । কেননা এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ নিজেকে বিশ্বের সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর অন্য সবকিছুকেই সে ভুলে যায় । ঐ অবস্থায় সে সরাসরি এবং স্বয়ং আল্লাহর বিশেষ বিলায়াত (কর্তৃত্ব ) ও তত্বাবধানে থাকে । তখন আল্লাহ যা কিছু চান (ব্যক্তি ইচ্ছায় নয়) , তাই তার কাছে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ।

প্রথম পদ্ধতি

ইসলামের বাহ্যিক অংশ ও তার প্রকারভেদ

যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে , মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের শাব্দিক অংশকে এর অধ্যয়ন ও শ্রবণকারীদের জন্যে অনুসরণযোগ্য হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন । আর পবিত্র কুরআন মহানবী (সা.)-এর বাণীকেও মাননীয় দলিল ও প্রমাণ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন । তাই মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন : তোমার কাছে কুরআন অবতির্ণ করেছি মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে , যা তাদের প্রতি অবতির্ণ করা হয়েছিল । (সূরা আন্ নাহল , 44 নং আয়াত ।)

পবিত্র কুরআনে তিনি আরও বলেছেন : তিনি তাদের মধ্য থেকেই (গোত্রীয়) একজনকে পাঠিয়েছেন রাসূল হিসেবে । যে তাদের কাছে তার আয়াত আবৃতি করে , তাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয় । (সূরা আল্ জুমআ , 2 নং আয়াত ।)

আল্লাহ আরও বলেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যেই রয়েছে তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম আদর্শ । (সূরা আল্ আহজাব , 21 নং আয়াত ।)

এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট ব্যাপার যে , মহানবী (সা.)-এর বাণী , আচরণ , অনুমোদন এবং নিরবতা যদি পবিত্র কুরআনের মতই আমাদের জন্যে অনুকরণীয় আদর্শ না হত , তাহলে পবিত্র কুরআনের উপরোল্লিখিত আয়াত গুলোর অর্থ আদৌ সঠিক হত না । সুতরাং যে কেউ সরাসরি মহানবী (সা.)-এর কোন বানী শ্রবণ করবে , অথবা নির্ভরযোগ্য কোন সূত্র থেকে তার কাছে বর্ণিত হবে , তখন তার জন্যে অবশ্য অনুকরণীয় বলে গণ্য হবে । একইভাবে মহানবী (সা.)-এর মুতাওয়াতের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে , রাসূল (সা.) -এর আহলে- বাইতের বাণীও রাসূল (সা.)-এর বাণীর মতই নির্ভরযোগ্য ও অবশ্য অনুকরণীয় । এভাবে বিশ্বস্ত সূত্রে বর্ণিত মহানবী (সা.)-এর হাদীস দ্বারা আহলে-বাইতের হাদীসের আনুগত্যের অপরিহার্যতা প্রমাণিত । রাসূল (সা.)-এর আহলে-বাইতগণ ইসলামী জ্ঞান জগতের নেতৃত্বের আসনে সমাসীন রয়েছেন । ইসলামী জ্ঞান ও বিধান শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল । তাদের যে কোন মৌখিক বক্তব্যই আমাদের জন্যে নির্ভরযোগ্য দলিল ও প্রমাণ স্বরূপ । উপরোল্লিখিত বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে , ইসলামী চিন্তাধারার ক্ষেত্রে ইসলামের বাহ্যিক অংশ , যা একটি মৌলিক সূত্র বা উৎস হিসেবে গণ্য তা দু ধরণের : (1) পবিত্র কুরআন ও (2) সুন্নাত ।

এখানে পবিত্র কুরআন বলতে , কুরআনের সুস্পষ্ট ও বাহ্যিক অর্থ সম্পন্ন আয়াতগুলোকে বোঝান হচ্ছে । আর সুন্নাত বলতে , মহানবী (সা.) এবং তার পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীসকেই বোঝান হচ্ছে ।

সাহাবীদের হাদীস

সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসও যদি মহানবী (সা.)-এর বাণী ও কাজের অনুরূপ এবং পবিত্র আহলে বাইত (আ.)-এর হাদীসের বিরোধী না হয় , তাহলে তাও গ্রহণযোগ্য হবে । কিন্তু সাহাবীদের ঐসব হাদীস যদি তাদের নিজস্ব মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর ভিত্তি করে রচিত হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না । ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে সাহাবীরাও অন্য সকল সাধারণ মুসলমানদের মতই । এমনকি স্বয়ং সাহাবীরাও তাদের নিজেদের মধ্যে সাধারণ মুসলমানদের মতই আচরণ করেছেন ।

পবিত্র কুরআন ও সুন্নতে মুজাদ্দিদ সংক্রান্ত আলোচনা

পবিত্র কুরআনই ইসলামী চিন্তাধারার একমাত্র মূলভিত্তি ও উৎসস্বরূপ । আর একমাত্র কুরআনই ইসলামের অন্যান্য মূল ভিত্তিগুলোকে নির্ভরযোগ্যতার স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী । এছাড়া পবিত্র কুরআন নিজেকে জ্যোতি ও অন্যদের জ্যোতির্ময় হিসেবে বর্ণনা করেছে । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , তারা যদি সুগভীর ভাবে কুরআনকে পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে তারা ঐ কুরআনের মধ্যে পরস্পর বিরোধী কোন বিষয় খুজে পাবে না । কুরআন মানব জাতিকে চালেঞ্জ করে আরও বলেছে যে , যদি তারা সক্ষম হয় তাহলে কুরআনের মুকাবেলায় কুরআনের মতই আরেকটি গ্রন্থ রচনা করে নিয়ে আসুক । পবিত্র কুরআন যদি সর্ব সাধারণের জন্যে বোধগম্যই না হত , তাহলে মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআনের এধরণের বক্তব্য প্রদানই বৃথা বলে গণ্য হত । অবশ্য এটা কারও ভাবাও উচিত নয় যে , কুরআনের এ বিষয়টি (কুরআন নিজেই সকলের জন্যে বোধগম্য) এর পূর্ববর্তী বিষয়ের [মহানবী (সা.) ও তার পবিত্র আহলে বাইতগণ কুরআনে বর্ণিত ইসলামী জ্ঞান ও তার নিগূঢ়তত্ব সম্পর্কে জ্ঞান আরোহনের মূল উৎস] সাথে অসংগতিপূর্ণ । কারণঃ ইসলামী বিধানের শুধুমাত্র মূল বিষয়গুলোই সংক্ষিপ্ত আকারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে । আর তার বিস্তারিত ও সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ ব্যাখার জন্যে আমাদেরকে সুন্নাত তথা মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতগণের হাদীসের মুখাপেক্ষী হতে হয় । যেমন : নামায , রোযা , ক্রয়-বিক্রয় , বিচার সহ ইবাদত সংক্রান্ত সকল বিষয়েই আমাদেরকে সুন্নাত বা রাসূল (সা.) ও তার আহলে বাইতদের হাদীসের প্রতি নির্ভর করতে হয় । আর মৌলিক বিশ্বাস ও শিষ্টাচার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অর্থ ও ব্যাখা যদিও মোটামুটিভাবে সর্ব সাধারণের বোধগম্য , তথাপি এ ব্যাপারে একমাত্র আহলে বাইতগণের (আ.) গৃহীত পদ্ধতিই আমাদের গ্রহণ করতে হবে । কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতকে অন্য একটি আয়াতের দ্বারা ব্যাখা করতে হবে । নিজেদের মনমত তাফসীর বা ব্যাখা করা যাবে না । পারিপার্শ্বিক পরিবেশে অভ্যস্ত মনের ইচ্ছেমত ব্যাখা করা যাবে না । হযরত ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের ব্যাখা স্বরূপ । কিছু আয়াত অন্য কিছু আয়াতের জন্যে সাক্ষী স্বরূপ ।109 আর মহানবী (সা.) বলেছেন : কুরআনের কিছু অংশ অন্য কিছু অংশের জন্যে ব্যাখা বা বাস্তব নমুনা স্বরূপ ।110

মহানবী (সা.) বলেছেন : যে ব্যক্তি তার নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে পবিত্র কুরআনের ব্যাখা করবে , এর মধ্যে সে , নিজেই নিজের জন্যে জাহান্নামে বসবাসের স্থান নির্ধারণ করবে ।111 কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে তাফসীরের একটি সহজ উদাহরণ হল : মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের একস্থানে পাপিষ্ট লুত জাতির প্রতি অবতির্ণ ঐশী শাস্তির ব্যাপারে বলেছেন যে , আমি তাদের উপর খারাপ বৃষ্টি বর্ষণ করেছি ।112 একই বিষয়ে কুরআনের অন্যত্র তিনি এ ব্যাপারটি শব্দ পরিবর্তনের মাধ্যমে এভাবে বর্ণনা করেছেন : আমি তাদের প্রতি প্রস্তর বর্ষণ করেছি ।113 এখানে উল্লেখিত প্রথম আয়াতটিকে দ্বিতীয় আয়াতের সাথে মিলিয়ে নিলেই অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে । প্রথম আয়াতে উল্লেখিত খারাপ বৃষ্টি বলতে এখানে ঐশী প্রস্তর বৃষ্টি বর্ষণই বোঝানো হয়েছে । কেউ যদি সুক্ষ্ণভাবে গবেষণার দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে এবং সাহাবী ও তাবেঈন মুফাসসিরদের (তাফসীর কারক) হাদীস ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) হাদীস সমূহ পর্যবেক্ষণ করে , তাহলে নিঃসন্দেহে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে , কুরআনকে কুরআনের মাধ্যমে ব্যাখার নীতি একমাত্র পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) অনুসৃত নীতি ছিল ।


5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26