আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর8%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48474 / ডাউনলোড: 5357
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে

আশুরা ও কারবালা

বিষয়ক

প্রশ্নোত্তর

এই বইটি আল হাসানাইন (আ.) ওয়েব সাইট কর্তৃক আপলোড করা হয়েছে ।

http://alhassanain.org/bengali

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

মূল ফারসি : লেখকবৃন্দ

অনুবাদ : আবদুল্লাহ

মোঃ আনিসুর রহমান

মোঃ মোজাফ্ফর হোসেন

মোঃ রফিকুল ইসলাম

মোঃ ফয়সল বারী

আবুল কাসেম

সম্পাদনাঃ কে এম আনোয়ারুল কবীর

প্রকাশনায় :

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা ,ইরান ও বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ ,ইরান ।

প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০১৬

Ashura O Karbala bishayak Prosnottor, Writer: A Group Of Writers, Translated into Bengali from Persian by Abdullah, Md. Anisur Rahman, Md. Mozaffor Hossain, Md. Rofiqul Islam, Md. Faysal Bary and Abul Kasem, Editor: A. K. M. Anwarul Kabir;publisher: World Assembly of Ahl-ul-Bayt & Bangladesh Islamic Cultural Association, Iran;Printed on January ২০১৬.

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থার মুখবন্ধ

মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের (আ.) রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারটি তাঁদেরই প্রবর্তিত মতাদর্শে সংগৃহীত ও সঞ্চিত হয়েছিল এবং তাঁদের অনুসারীরা সেটিকে বিনাশ হতে রক্ষা করেছিলেন । এ মতাদর্শে ইসলামের সকল শাখা ও বিভাগের সমন্বয় ঘটেছে । তাই এটি ইসলামের একটি সামগ্রিক রূপ । এ মতাদর্শ ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ও সত্য গ্রহণে প্রস্তুত অগণিত হৃদয়কে প্রশিক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিল যারা এর প্রবহমান জ্ঞানের সুপেয় পানির ধারা হতে দু হাত ভরে গ্রহণ করেছে । এটি সেই ধারা যা ইসলামী উম্মাহকে আহলে বাইত (আ.)-এর পদাঙ্কানুসারী অনেক মহান মনীষী উপহার দিয়েছে । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যখনই ইসলামী ভূখণ্ডের অভ্যন্তর ও তার বাইরের বিভিন্ন ধর্মমত ও চিন্তাধারার পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন ও নবচিন্তার উদ্ভব ঘটেছে তাঁরা তার বলিষ্ঠ জবাব ও সমাধান দিয়েছেন ।

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা ,কোম ,ইরান তার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই নবুওয়াতী মিশনের পবিত্র সত্য-সঠিক রূপ ও সীমার প্রতিরক্ষাকে তার অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে যা সবসময়ই ইসলামের অমঙ্গলকামী বিভিন্ন দল ,মত ও চিন্তাধারার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল । বিশেষভাবে এক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল আহলে বাইতের পবিত্র আদর্শিক পথ ও তাঁদের মতাদর্শের অনুসারীরা যারা এ শত্রুদের আক্রমণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার আকাঙ্ক্ষায় সবসময়ই সামনের সারিতে থেকেছে এবং সবযুগেই কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা রেখেছে ।

এ বিশেষ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের (আ.) মতাদর্শে প্রশিক্ষিত আলেমদের অর্জিত অভিজ্ঞতামালায় পূর্ণ গ্রন্থসমূহ সত্যিই অদ্বিতীয় । কারণ ,এগুলোর শক্তিশালী জ্ঞানগত ভিত্তি রয়েছে যা বুদ্ধি ও যুক্তিভিত্তিক প্রমাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং সকল প্রকার অন্যায় গোঁড়ামি ও প্রবৃত্তির অনুসরণ হতে দূরে । এ চিন্তাধারা সকল বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদের প্রতি এমন আহ্বান রেখেছে যা যে কোন বুদ্ধিবৃত্তি ও সুস্থ বিবেকই মেনে নেয় ।

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা নতুন পর্যায়ে অর্জিত এ অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধ ভাণ্ডার হতে সত্যানুসন্ধানীদের জন্য বিভিন্ন আলোচনা ও লেখা প্রকাশের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিয়েছে । এ সংস্থা এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ ও এ সম্পর্কিত গবেষণা প্রকাশ ও প্রচারের মাধ্যমে আহলে বাইতের অনুসারী বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মূল্যবান লেখা হতে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়াও তা যেন সত্যানুসন্ধানীদের জন্য সুপেয় পানির উৎস হয় সে ব্রতও নিয়েছে । এতে রাসূলের আহলে বাইতের মহান মতাদর্শ কর্তৃক বিশ্ববাসীর জন্য যে মহাসত্য উপস্থাপিত হয়েছে তা সত্যাকাঙ্ক্ষীদের কাছে প্রকাশিত হবে । বুদ্ধিবৃত্তির অনুপম পূর্ণমুখিতার ও হৃদয়সমূহের দ্রুত পরস্পর সংযুক্তির এ যুগে তা আরও ত্বরান্বিত হবে নিঃসন্দেহে ।

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা এ গ্রন্থের অনুবাদদেরসহ এটি প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে যাঁরা ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে ।

আশা করছি এ গ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে মহান প্রতিপালকের-যিনি তাঁর রাসূল (সা.)কে হেদায়াত ও সত্যদ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন যাতে সকল দ্বীনের ওপর ইসলামকে বিজয়ী করেন এবং সাক্ষী হিসেবে তিনিই যথেষ্ট-পক্ষ হতে আমাদের ওপর অর্পিত মিশনের গুরুদায়িত্বের কিছু অংশ পালনে সক্ষম হয়ে থাকব ।

সাংস্কৃতিক বিভাগ

আহলে বাইত (আ.) বিশ্ব সংস্থা

প্রথম অধ্যায় : ইতিহাস ও জীবনী

এক নজরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন1

মদীনার শাসক ওয়ালীদের পক্ষ থেকে এজীদের জন্য বাইআতের আহবানঃ

শুক্রবার , 27 রজব , 60 হিজরি।

ওয়ালীদের সাথে ইমাম হোসাইন (আ:)-এর দ্বিতীয় সাক্ষাতঃ

শনিবার 28 রজব , 60 হিজরী।

মদীনা থেকে ইমাম হোসাইন (আ:)-এর বহির্গমনঃ

শনিবার 28 রজব , 60 হিজরী (রাতে)।

ইমামের মক্কায় প্রবেশঃ

বৃহস্পতিবার (রাতে) , 3শাবন , 60 হিজরী।

মক্কায় অবস্থান :

4 মাস , 5 দিন।

মুসলিমের মক্কা থেকে যাত্রা:

সোমবার , 15 রমজান , 60 হিজরী।

মুসলিমের শাহাদাত :

মঙ্গলবার , 8 জিলহজ্ব , 60 হিজরী।

মক্কা থেকে ইমামের বহির্গমন :

মঙ্গলবার , 8 জিলহজ্ব , 60 হিজরী।

কারবালায় ইমামের প্রবেশ :

শুক্রবার , 3 মুহাররাম , 61 হিজরী।

করবালায় উমর-বিন-সাদের প্রবেশ

শুক্রবার , 3 মুহাররাম , 61 হিজরী।

উমর-বিন-সাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও ইমামের সাথে কথোপকথন:

3-6 মুহাররাম , 61 হিজরী।

ইমামের সঙ্গীদের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ :

মঙ্গলবার 7 মুহাররাম , 61 হিজরী।

ইমামের বাহিনীর উপর প্রথম হামলা :

বৃহস্পতিবার , 9 মুহাররাম , 61 হিজরী।

কারবালার ঘটনা :

শুক্রবার , 10 মুহাররাম , 61 হিজরী।

কারবালা থেকে আহরে বাইতের (আ.) বন্দীদের বহির্গমন :

শনিবার , 11 মুহাররাম , 61 হিজরী , জোহর নামাজের পর।

মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন না করার কারণ

1 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি ?

উত্তর : ইমাম হোসাইন (আ.) 50 হিজরি থেকে 61 হিজরি পর্যন্ত 11 বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এর মধ্যে 10 বছর মুয়াবিয়ার শাসনামলে অতিবাহিত হয় । ঐ সময় ধরে তার সঙ্গে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল । এ দ্বন্দ্বের কতগুলো নমুনা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিভিন্ন চিঠিতে লক্ষ্য করা যায় । ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর চিঠিতে মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো (যেমন আল্লাহর রাসূলের সাহাবী আমর ইবনে হামেক ও হুজর ইবনে আদীকে হত্যা) তুলে ধরে মুসলমানদের ওপর মুয়াবিয়ার শাসনকে বড় ফিতনা হিসেবে উল্লেখ করেন ।2 আর এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.) ,মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেন । ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে জিহাদ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন । এছাড়া তিনি মনে করতেন ,যদি কেউ তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই ইস্তিগফার করতে (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে) হবে ।3 কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন (আ.) কেন মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি তার কতগুলো কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে পাওয়া যায় । যদি আমরা ঐ কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই ,তাহলে আমাদেরকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে হবে ।

এক : মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তি

ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল ,ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে দেয়া চিঠিতে সেই সন্ধিচুক্তির প্রতি তাঁর নিবেদিত থাকার কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘন করার যে অভিযোগ মুয়াবিয়া তুলেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ।4 কিন্তু প্রশ্ন হলো ,মুয়াবিয়া যেখানে কুফায় প্রবেশ করার পর সন্ধিচুক্তির কালি শুকানোর আগেই তা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার প্রতি নিবেদিত থাকা তার জন্য আবশ্যক নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল5 সেখানে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি মেনে চললেন ?

এ প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া যেতে পারে :

. যদি আমরা মুয়াবিয়ার বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে ,সে সুস্পষ্টভাবে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলেনি । কারণ ,সে বলেছিল : আমি হাসানকে কতগুলো বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছি । আর হতে পারে সে যে ওয়াদার কথা বলেছে তা সন্ধিচুক্তির বহির্ভূত কোন বিষয় ছিল যার প্রতি নিবেদিত থাকা মুয়াবিয়ার মতে আবশ্যক ছিল না । আর অন্তত এর ভিত্তিতে সে অজুহাত দেখাত যে ,তার পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি ।

. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল ,ঠিক যে রকম তফাৎ ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার ছিল ।

আসলে মুয়াবিয়া এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিল ,যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে কোন অন্যায়-অবিচার ,6 প্রতারণা ও ছল-চাতুরির

আশ্রয় নিত । এসব প্রতারণার কতক নমুনা ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়েও দেখা যায় । যেমন উসমানের রক্তকে বাহানা হিসেবে তুলে ধরা ,তালহা এবং যুবায়েরকে ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা ,সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরা এবং ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ।

অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন ,যিনি স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সত্যের পরিপন্থী কোন পথে অগ্রসর হতেন না । যেভাবে ইমাম আলী (আ.) বলেছিলেন : আমি জোর-জবরদস্তি করে বিজয়ী হতে চাই না । 7

অতএব ,এটা স্বাভাবিক যে ,ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) কোনক্রমেই তা লঙ্ঘন করতে পারেন না । এমনকি মুয়াবিয়া তা লঙ্ঘন করলেও ইমামের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় ।

. অবশ্যই আমাদেরকে ঐ সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে । আর এটাও দেখতে হবে যে ,ইমাম যদি সন্ধির খেলাফ কাজ করতেন তাহলে কী ঘটত ? কারণ ,ঐ সময় মুয়াবিয়া মুসলমানদের একচ্ছত্র খলীফা ছিল । আর তার শাসনব্যবস্থা সিরিয়া থেকে শুরু করে মিশর ,ইরাক ,আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেন তথা গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল । প্রতিটি এলাকাতে তার অনুচর ও দালালরা তার খেলাফতের বৈধতার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতো । এহেন পরিস্থিতিতে ইমামের পক্ষে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না ।

মুয়াবিয়া ,হযরত আলী (আ.)-এর সাথে দ্বন্দ্বের সময় সিরিয়াবাসীদের কাছে নিজেকে উসমান দরদী এবং তাঁর খুনের একমাত্র দাবিদার (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) হিসেবে তুলে ধরেছিল । যদিও উসমান হত্যার ঘটনায় সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কোন সাহায্যই করেনি ।8 অতএব ,এটা সুস্পষ্ট যে ,ঐ সময় কেউ তার সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস করত না । এ পরিস্থিতিতে যদি ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করতেন ,তাহলে মুয়াবিয়া তাঁকে মুসলিম সমাজে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করাতো এবং উম্মাহর চিন্তাধারাকে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাতো । আর ঐ পরিস্থিতিতে ইমামের আহ্বান মুসলিম জাতির কাছে পৌঁছত না । ইমাম এবং তাঁর সাথিরা এ সময় মুয়াবিয়াকে প্রথম সন্ধি লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিলেন ,কিন্তু তাঁরা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ।

দুই. মুয়াবিয়ার শক্তিশালী অবস্থান

ঐ সময় মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাকে কঠিন করে তুলেছিল । কারণ ,সিরিয়াবাসী তাকে নবীর সাহাবা ,ওহী লেখক এবং মুসলমানদের মামা মনে করত । তাদের দৃষ্টিতে ,সিরিয়া ও দামেশকে ইসলাম প্রচারে মুয়াবিয়ার ভূমিকাই ছিল মূখ্য ।

এছাড়া মুয়াবিয়া একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিল । আর তার বয়সও ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) থেকে বেশি ছিল । এজন্য সে সবসময় ইমামদের কাছে দেয়া চিঠিতে এ দুটি বিষয় উল্লেখ করত এবং নিজেকে খেলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করত ।9 অতএব ,এটা স্বাভাবিক যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধি লঙ্ঘন করলে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগত ।

তিন. মুয়বিয়ার রাজনৈতিক কূটচাল ও ধূর্ততা

সন্ধির পর যদিও মুয়াবিয়া বনি হাশেম ,বিশেষ করে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিবারকে কোণঠাসা করার জন্য সকল প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল ,এমনকি বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করেছিল ,10 কিন্তু সে বাহ্যত মানুষদের দেখাত যে ,নবী-বংশের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ,মুয়াবিয়া প্রতি বছর এবং প্রতি মাসে ইমাম হাসান (আ.) ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ বিন জাফরের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন পাঠাত । আর তারাও যেহেতু নিজেদেরকে বায়তুল মালের হকদার মনে করতেন তাই ঐসব উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত জায়গায় সেগুলো খরচ করতেন ।11

মুয়াবিয়া নিজেকে নবীর পরিবারের ভক্ত হিসেবে দেখানোর জন্য মৃত্যুর সময়ে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে অসিয়ত করেছিল যে ,যদি ইমাম আন্দোলন করেন তাহলে যেন তাঁকে হত্যা করা না হয় ।12

মুয়াবিয়ার এ রকম রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট । কারণ ,সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধি করে নিজের খেলাফতকে বৈধতা না থাকার সংকট থেকে মুক্তি দান করে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বৈধ খলীফা হিসেবে পরিচিত করায় । আর সে চাইত না যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করার মাধ্যমে সে মুসলিম সমাজে ঘৃণিত হোক । এর বিপরীতে সে চেষ্টা করত যে ,নবীপরিবারের প্রতি লোকদেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে নিজের সুনাম বজায় রাখা ।

আর সে ভাবত যে ,এভাবে সে নবীর বংশধরদের নিজের প্রতি ঋণী করছে । ফলে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তার অনুগত হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে । একবার সে ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে বিপুল পরিমাণে উপঢৌকন পাঠিয়ে খোঁটা দিয়ে বলেছিল , এ উপহারগুলো গ্রহণ কর ,আর জেনে রাখ যে ,আমি হিন্দার ছেলে । খোদার শপথ ,এর আগে কেউ তোমাদেরকে এ রকমভাবে দান করেনি । আর আমার পরেও কেউ তোমাদেরকে এভাবে দান করবে না ।

ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়াকে দেয়া চিঠিতে তার উপঢৌকনগুলো যে করুণা প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখে না তা উল্লেখ করে বলেছেন : খোদার শপথ ,তোমার আগের এবং পরের কোন লোকের পক্ষে আমাদের থেকে

শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছে উপহার পাঠানো সম্ভব নয় (কেননা ,নবুওয়াতের গৃহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন গৃহ নেই) । 13

মুয়াবিয়া জানত যে ,সে যদি কঠোর নীতি গ্রহণ করে ,তাহলে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাবে । পরিশেষে মানুষ মুয়াবিয়ার শাসনের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠবে । আর স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম সমাজ আহলে বাইতের পাশে একত্র হবে ।

ঐ সময়ে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করত না । কিন্তু ভবিষ্যতে যেহেতু নবী-পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বিপদ না আসতে পারে এজন্য এ রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করে চলত যাতে অঙ্কুরেই বিপদের বীজ বিনাশ হয়ে যায় ।

অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খেলাফতকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন । এর সুস্পষ্ট নমুনা হলো মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠিতে মুয়াবিয়ার সৃষ্ট বেদআত ও তার কৃত অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা14 এবং যুবরাজ হিসেবে ইয়াযীদের মনোনয়নের বিরোধিতা করা ।15 অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) ভালো করেই জানতেন যে ,যদি তিনি মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন ,তাহলে সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কলা-কৌশলের কারণে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিবে না । উপরন্তু সরকারি অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুয়াবিয়াকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবে ।

চার. তৎকালীন সময়ের মুসলমানদের চিন্তাগত ও সামাজিক অবস্থা

যদিও একদল কুফাবাসী ইমাম হাসান (আ.) শহীদ হওয়ার পর সমবেদনা জ্ঞাপন করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি লিখেছিল এবং নিজেদেরকে ইমামের নির্দেশের অপেক্ষাকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল16 ,কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে ,সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কুফা শহরও উমাইয়া গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে । এছাড়া কুফাবাসী ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে অনেকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । যখন সমগ্র ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর মুয়াবিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল হয়েছে তখন যদি তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাহলে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না । আর যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে তারাও অযথা নিহত হবে এবং তিনি বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হবেন । পরিশেষে তিনি কোন ফলাফল ছাড়াই শহীদ হবেন এবং তাঁর রক্ত বৃথা যাবে । কিন্তু ইয়াযীদের শাসনামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এর বিপরীত ছিল ।

মদীনায় বিদ্রোহ না করার কারণ

2 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনায় তাঁর আন্দোলন শুরু করেননি ?

উত্তর : এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদেরকে ঐ সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে । কারণ ,ইমাম হোসাইন (আ.) যখন মদীনায় ছিলেন ,তখনও মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর চারিদিকে ছড়ায়নি । এছাড়া মানুষ তখন পর্যন্ত মুয়াবিয়া এবং ইয়াযীদের খেলাফতের মধ্যে খুব একটা তফাৎ বুঝতে পারেনি । কারণ ,যদিও বিশেষ কিছু ব্যক্তি ,যেমন ইমাম হোসাইন (আ.) ,আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের ,আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবদুর রহমান বিন আবু বকর ইয়াযীদকে শরাবখোর এবং কুকুর ও বানর নিয়ে খেলাকারী হিসেবে জানতেন17 ,তথাপি অধিকাংশ মানুষ মুয়াবিয়ার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অথবা উমাইয়া গোষ্ঠীর প্রলোভন ও হুমকির মুখে মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায়ই তার ছেলে ইয়াযীদের হাতে বাইআত করেছিল ।18

এছাড়া সমর্থকের দৃষ্টিতেও স্থান হিসেবে মদীনা আন্দোলন করার জন্য খুব একটা উপযুক্ত ছিল না । কারণ :

এক যদিও মদীনায় অধিকাংশ মানুষ আহলে বাইতকে ভালোবাসত ,তথাপি তাদের ভালোবাসা এ পর্যায়ে ছিল না যে ,আহলে বাইতের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে কিংবা কোন ক্ষতি স্বীকার করবে । আর তারা এর নমুনা খুব ভালোভাবে সকীফা এবং পরবর্তী ঘটনায় দেখিয়েছিল । আশ্চর্যের বিষয় হলো হযরত আলী (আ.) যখন বাইআত ভঙ্গকারীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মদীনাবাসীদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন ,তখন তাদের অধিকাংশই হযরত আলী (আ.)-এর ডাকে সাড়া দেয়নি । ফলে হযরত আলী (আ.) চারশ 19 অথবা সাতশ 20 সৈন্য নিয়ে বিরোধী দলের কয়েক হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

দুই . মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মদীনাবাসীরা তৎকালীন খলীফার অনুগত ছিল । তারা খলীফা আবু বকর ও উমরের এতই ভক্ত ছিল যে ,নবীর সুন্নাতের পাশাপাশি উক্ত দুই খলীফার সুন্নাতের প্রতি খুবই স্পর্শকাতরতা দেখাতো । যেমন এ দলের প্রতিনিধি আবদুর রহমান বিন আউফ ,উমরের গঠিত শুরা য় (খলিফা মনোনয়ন পরিষদ) উক্ত দুই খলিফার সুন্নাত অনুসরণ করাকে হযরত আলী (আ.)-এর খলীফা হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু আলী (আ.) এ শর্ত মেনে নেননি ।21 হযরত আলী (আ.) যখন খলীফা হন তখন তাঁর খলীফা হওয়ার পেছনেও মদীনাবাসীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না ;বরং বিভিন্ন শহর থেকে আগত মুসলমানরাই প্রথম হযরত আলী (আ.)-কে খলীফা করার জন্য চাপ দিয়েছিল ।

তিন . ঐ সময়ে মদীনায় কুরাইশ বংশের বিভিন্ন শাখার বিশেষ করে উমাইয়া শাখার মারওয়ান ও তার অনুগতদের প্রভাব ছিল খুব বেশি । আর এটা সুস্পষ্ট ছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) যদি আন্দোলন শুরু করতেন ,তাহলে তারা দ্রুত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত ।

চার . ঐ সময়ে মদীনার জনসংখ্যা খুব কম ছিল । অপর দিকে কুফা ,বসরা ও সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল খুবই বেশি । এজন্য মদীনায় অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে একটা বড় আন্দোলন শুরু করা সহজ ছিল না ।

পাঁচ . ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ,কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য মদীনা খুব একটা উপযুক্ত জায়গা ছিল না । কারণ যেসব বিদ্রোহ এ শহরে সংঘটিত হয়েছে তার প্রত্যেকটি পরাজয়ের শিকার হয়েছে । যেমন-63 হিজরিতে মদীনাবাসী ইয়াযীদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল ,তা কঠোর হস্তে দমন করা হয় ।22 একই রকম ভাবে 145 হিজরিতে23 মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর (নাফ্সে যাকিয়া) আন্দোলন ও 169 হিজরিতে24 হোসাইন বিন আলী (ইবনে হাসান মুসাল্লাস ইবনে হাসান মুসান্না ইবনে হাসান ইবনে আলী-যিনি শহীদে ফাখ বা ফাখের শহীদ নামে প্রসিদ্ধ) আন্দোলনে মদীনার অল্পসংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করার কারণে দুটি আন্দোলনই পরাজয়ের শিকার হয় ।

ছয় . উমাইয়া শাসনামলে মদীনাবাসী দেখিয়েছিল যে ,তারা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে এবং আহলে বাইতের পক্ষে অবস্থান নিতে রাজী নয় । এর প্রমাণ হলো মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে হযরত আলী (আ.)-কে গালি-গালাজ করার যে রীতি চালু হয়েছিল মদীনাবাসী তার কোন প্রতিবাদ করেনি ;বরং এ শহরের প্রত্যেকটা মসজিদে মিম্বারের ওপর বসে হযরত আলী (আ.)-কে গালি-গালাজ করা হতো । আর মদীনাবাসী মুয়াবিয়ার এ অন্যায় কর্মকে চোখ বুঁজে সহ্য করত । শুধু ইমাম হোসাইন (আ.) এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন ,কিন্তু কেউ তাঁকে সহযোগিতা করত না ।25

সাত . মদীনা শহরে উমাইয়া গভর্নর ওয়ালীদ বিন উতবার খুব প্রভাব ছিল । এজন্য একটা ছোট-খাট আন্দোলনের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা তার হাত থেকে কেড়ে নেয়া সম্ভব ছিল না ।

মক্কায় গমন

3 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) আন্দোলনের শুরুতেই মদীনা থেকে মক্কা গেলেন ?

উত্তর : ইয়াযীদ মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ বিন উতবার কাছে চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়েছিল যে ,বিরোধীদের কাছ থেকে যেন বাইআত নেয়া হয় । আর বাইআত ব্যতিরেকে তাদেরকে যেন ছাড়া না হয় ।26

ওয়ালীদ চেয়েছিল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে নরম ব্যবহার করতে এবং তাঁর রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত না করতে ।27 কিন্তু মদীনায় বসবাসকারী উমাইয়া গোষ্ঠী বিশেষ করে মারওয়ান বিন হাকাম ,যে ছিল ওয়ালীদের প্রধান উপদেষ্টা সে ওয়ালীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলো যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে যেন হত্যা করা হয় । প্রথম ওয়ালীদ যখন ইয়াযীদের চিঠি পেল ,তখন সে মারওয়ানের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করলো । মারওয়ান বলল : আমার মত হলো ,এ মুহূর্তে আলোচ্য ব্যক্তিদেরকে যেন হাজির করা হয় এবং ইয়াযীদের পক্ষে আনুগত্যের শপথ নেয়ার জন্য বাধ্য করা হয় । আর যদি তারা বিরোধিতা করে তাহলে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর জানার আগেই যেন তাদেরকে হত্যা করা হয় । কারণ ,তারা যদি মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর জানতে পারে ,তাহলে তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের বিরোধিতার কথা প্রকাশ করবে এবং মানুষকে নিজেদের চারপাশে একত্র করবে । 28

অতএব ,ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনার পরিস্থিতি ভালো না থাকায় নিজের বিরোধিতার কথা প্রকাশ এবং আন্দোলন শুরু করার জন্য মদীনা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন । আর মদীনায় বিপদের আশঙ্কা থাকায় সেখানে কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন । আর মদীনা ত্যাগের সময় ইমাম হোসাইন (আ.) যে আয়াত তেলাওয়াত করেছিলেন তা থেকে বোঝা যায় ,তাঁর মদীনা ত্যাগের গুরুত্বপূর্ণ করণ ছিল নিরাপত্তার অভাব ।

আবু মিখনাফের মতে ,ইমাম হোসাইন (আ.) 27 রজব অথবা 28 রজব স্বীয় আত্মীয় স্বজনকে সাথে নিয়ে মদীনা ত্যাগের সময় সেই আয়াতটি তেলাওয়াত করছিলেন যা মূসা (আ.) নিরাপত্তার অভাবে মিশর ত্যাগের সময় তেলাওয়াত করেছিলেন29 :

) فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِين (

তাকে পশ্চাদ্ধাবন করা হবে এ ভীতি ও আশঙ্কা নিয়ে তিনি শহর থেকে বের হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এ অত্যাচারী জাতির হাত থেকে রক্ষা করুন । 30

ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক অবস্থায় মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যখন অধিকাংশ মানুষ মুয়াবিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে ছিল অনবহিত (কেননা ,মুয়াবিয়া 15 অথবা 22 রজব মারা যায় আর ইমাম হোসাইন 27 রজব মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন) । আর তাই ইয়াযীদের বিরুদ্ধে তখনও প্রকাশ্যে বিরোধিতা শুরু হয়নি এবং কোন শহর থেকে ,এমনকি কুফা থেকেও (পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাপেক্ষে) কোন চিঠি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছেনি । এজন্য ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হিজরতের জন্য এমন একটি জায়গা বাছাই করতে হতো যেখানে তিনি প্রথমত কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে এবং নিরাপত্তার মধ্যে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন । আর দ্বিতীয়ত ইসলামী ভূখণ্ডের প্রতিটি অঞ্চলে নিজের চিন্তাধারা পৌঁছে দেয়ার জন্য ঐ জায়গাটি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন ।

উপরিউক্ত দুটি বৈশিষ্ট্যই মক্কা শহরের ছিল ।

কারণ ,তখনও পর্যন্ত মক্কা ছিল তাঁর জন্য আপাত নিরাপদ স্থান । এছাড়া এ শহরে কাবা শরীফ থাকায় এবং হজ ও উমরা পালন করার জন্য ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানদের আগমনের কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) খুব সহজে বিভিন্ন দলের সাথে দেখা করে তাদেরকে উমাইয়া শাসকদের সাথে নিজের বিরোধিতার কথা জানাতে পারতেন । আর এভাবে ইসলামী শহরসমূহ বিশেষ করে কুফা ও বসরার31 বিভিন্ন দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতেন ।

ইমাম হোসাইন (আ.) 60 হিজরির 3 শাবান শুক্রবার রাতে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং 8ই যিলহজ পর্যন্ত এ শহরে স্বীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন ।32


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25