আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর0%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক: লেখকবৃন্দ
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ:

ভিজিট: 43876
ডাউনলোড: 3950

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 43876 / ডাউনলোড: 3950
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে

কারবালার প্রান্তরে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন

প্রশ্ন 21 : কারবালার প্রান্তরে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন ও হুজ্জাত সম্পূর্ণ করা হয়েছে-এ কথার অর্থ কী ?

উত্তর : 10 মুহররমের উত্থানে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক প্রচারপদ্ধতি ও কৌশল ব্যবহার করেছিলেন যাতে এর মাধ্যমে জনগণকে প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে অবগত করতে পারেন । প্রচারের এই পদ্ধতি একদিকে যেমন এ আন্দোলনকে চির স্মরণীয় করে রেখেছে ও সবধরনের বিচ্যুতি এবং বক্রতা থেকে মুক্ত রেখে এর প্রকৃত রূপকে তুলে ধরেছে তেমনি অন্যদিকে সঙ্গী-সাথিদের চেতনাকে জাগ্রত ও কুফার সেনাবাহিনীর চিন্তা ও দৃঢ়তায় ফাটল সৃষ্টির কারণও হয়েছে । আবার তা শত্রুদের চক্রান্ত ধ্বংসের বা তাদের অপমানের কারণও হয়েছিল । এই পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি পদ্ধতি ছিল চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করা । ইমাম হোসাইন (আ.) এই পদ্ধতির মাধ্যমে যে কোন ধরনের ওজর-আপত্তি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের রাস্তাকে শত্রুদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছেন ,সত্যের সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন এবং তাঁর সাথে উমাইয়াদের শত্রুতার বিষয়টি যেসকল লোকের নিকট অজানা ছিল তাদের নিকট স্পষ্ট করে দিয়েছেন ।

চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করা কথোপকথনের সংস্কৃতিকে সজীব ও প্রচার করার একটি কার্যকর পদ্ধতি ;এ পদ্ধতিটি ইমাম হোসাইন (আ.) মহানবীর সুন্নাত ও হযরত আলীর কর্মপন্থা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন । তিনি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন যে ,দাওয়াত প্রচার ও সুপথপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে সংলাপের সংস্কৃতি সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আর দমন-নিপীড়ন ,সহিংসতা ও ক্ষমতার দাপট হয়েছে যুক্তি ,পরামর্শ ও তর্ক-বিতর্কের স্থলাভিষিক্ত । এ জন্যই তিনি সবসময় চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করা র পদ্ধতিটিকে যে কোন আলোচনার মূল ভিত্তি হিসেবে গুরুত্ব দান করতেন যাতে এটি জনগণের মধ্যে উত্তম সুন্নাত (সুন্নাতে হাসানা) বলে বিবেচিত হয় এবং সর্বদা বিরাজমান থাকে ।

তিনি তাঁর চূড়ান্ত যুক্তি-প্রমাণগুলোর মধ্যে একটিতে উল্লেখ করেছেন :

আমি কি তোমাদের রাসূলের (সা.) কন্যার সন্তান ,তাঁর চাচাতো ভাই-যিনি প্রথম মুসলমান ছিলেন ,তাঁর সন্তান নই ? শহীদদের নেতা হামযা ও জাফর তাইয়্যার কি আমার চাচা নন ? যদি তোমরা আমাকে মিথ্যাবাদী মনে কর তাহলে জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী ,আবু সাঈদ খুদরী ,সাহ্ল ইবনে সা দ সায়েদী ,যাইদ ইবনে আরকাম ,আনাস ইবনে মালিক তাঁদের মতো বিশেষ ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসা কর!

আমি কি তোমাদের কাউকে হত্যা করেছি যে ,তোমরা রক্তের বদলা নিতে উঠে পড়ে লেগেছ ? অথবা তোমাদের কোন ধন-সম্পদ কি আমি ধ্বংস করেছি যে তোমরা সেটার প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছ অথবা আমি কি কাউকে কখনো আঘাত দিয়েছি যে তার কিসাস বা বদলা নিচ্ছ ?

যখন তারা কিছুই বলল না তখন ইমাম উচ্চৈঃস্বরে বললেন : হে শাবাস ইবনে রা বী! হে হাজার ইবনে আবজার! হে কাইস ইবনে আশআস! হে ইয়াযীদ ইবনে হারেস! তোমরা কি আমাকে চিঠি লেখনি যে ,এখানকার ফলগুলে পেকে গেছে ,বাগানগুলো সবুজ-শ্যামল হয়ে গেছে আর আমরা সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছি ? না ,আল্লাহর শপথ আমি কখনোই নীচ ও হীন লোকের মতো বাইআতের জন্য হাত বাড়াব না ও ক্রীতদাসের মতো পলায়ন করব না । 245

ইমাম হোসাইন (আ.) এই ধরনের বাক্যের মাধ্যমে একদিকে ইসলামের আপেষহীন মৌলনীতির ওপর অটল থেকেছেন ও কোনরূপ অপমানকে সহ্য করেননি অন্যদিকে অকাট্য যুক্তি উপস্থাপনের বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন । অবশ্য এই বিষয়টি তাঁর অনুসারীদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয় ,যেমন আব্বাস ইবনে আলী ,জুহাইর ইবনে কাইন ও হাবীব ইবনে মাজাহির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘোর শত্রুর সাথে সংলাপ করেছেন এবং চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন ।246

স্বীয় শাহাদাত সম্পর্কে পূর্বজ্ঞান

প্রশ্ন 22 : ইমাম হোসাইন (আ.) কি জানতেন তিনি শহীদ হবেন ? যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে কেন তিনি নিজের পায়ে হেঁটে মৃত্যুস্থলে গেলেন ?

উত্তর : শিয়াদের হাদীস ও বর্ণনা অনুযায়ী ইমামদের (আ.) অদৃশ্যের জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক প্রকার অনুগ্রহ যা তাঁরা কাজে লাগিয়ে থাকেন । আল্লাহ তা আলা বলেছেন :

) عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا (26) إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ(

তিনি গুপ্ত জ্ঞানের অধিকারী আর কাউকে স্বীয় জ্ঞান দান করেন না শুধু তাঁর প্রেরিত ব্যক্তি ব্যতীত যাঁর ওপর তিনি সন্তুষ্ট... 247

উক্ত আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় যে ,গোপন জ্ঞান সত্তাগতভাবে শুধু আল্লাহর জন্য নির্ধারিত ও তিনি ব্যতীত সেটা কেউ জানে না । কিন্তু আল্লাহর রাসূলগণ তাঁর অনুমতিক্রমে সে সম্পর্কে অবগত হতে পারেন আর অন্য ব্যক্তিরাও আল্লাহর পক্ষ থেকে অথবা তাঁর রাসূলের শিক্ষার মাধ্যমে সে সম্পর্কে অবগত হবেন ।

তাফসীর আল-মীযান এর লেখক আল্লামা তাবাতাবাঈ এ সম্পর্কে বলেছেন : সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইন (আ.)-শিয়া 12 ইমামীদের বিশ্বাস অনুযায়ী-রাসূল (সা.)-এর বারজন স্থলাভিষিক্তের মধ্যে তৃতীয় এবং সকল ক্ষেত্রে সর্বজনীন কর্তৃত্বের অধিকারী । ইমামদের জ্ঞান বাস্তবে সংঘটিত ও ঘটিতব্য সকল বিষয়ে পূর্ণ অবগতির অধিকারী । বাইরের জগতের বিবেচনায় এ জ্ঞান-কোরআন ও হাদীস এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ অনুযায়ী-দু প্রকার : প্রথম প্রকার : ইমাম যে কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহর অনুমতিক্রমে বিশ্ব জগতের প্রকৃত অবস্থা ও বাস্তবতা সম্পর্কে অবগত-সেটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন বিষয় হোক বা তার ঊর্ধ্বের কিছু ;যেমন: মহাশূন্যের অস্তিত্বসমূহ ,অতীতে সংঘটিত ঘটনাসমূহ ও ভবিষ্যতের ঘটনাসমূহ ।

দ্বিতীয় প্রকার : রাসূল (সা.) এবং ইমামগণও সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী অর্থাৎ তাদের মতো তাঁরাও স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ঘটনার পারিপার্শ্বিক দিক সম্পর্কে জানতে জ্ঞান লাভের প্রচলিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন এবং এরূপ জ্ঞানের ভিত্তিতে যা কিছু উপযুক্ত মনে করেন সে অনুযায়ী সবকিছুর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেন । 248

অবশ্য এটা লক্ষ্য রাখা দরকার যে ,অপরিবর্তনশীল কোন ঘটনার ক্ষেত্রে ইমামদের অকাট্য জ্ঞান থাকার অর্থ এ নয় যে ,তা সংঘটিত হওয়া জাব্র বা বাধ্যতামূলক হয়ে যায় ;এটা অনেকটা ঐ রকম যেমন মানুষের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তা আলার জ্ঞান থাকা ;কিন্তু এই জ্ঞান থাকার অর্থ এটা নয় যে ,সেটা সংঘটিত হওয়া বান্দার জন্য বাধ্যতামূলক কোন বিষয় হয়ে যাবে এবং সে তার স্বাধীনতা হারাবে ;কেননা ,মানুষের স্বাধীন কর্মের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা আলার ইচ্ছাটি তাদের স্বাধীনতা ও ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত ;অর্থাৎ আল্লাহ তা আলা জানেন যে ,মানুষ স্বীয় ইচ্ছায় কোন্ কোন্ কাজ সম্পাদন করে বা করবে । [তিনি জানেন ,অমুক ব্যক্তি তার স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে কোন্ ভালো কাজ করবে এবং অমুক ব্যক্তি তার স্বাধীনতার অপব্যবহার করে কোন্ মন্দ কাজ করবে । ]

ইমাম হোসাইন (আ.) সম্পর্কেও আমরা জানি ও বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত যে ,রাসূল (সা.) ও ইমাম আলী (আ.) ,ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের সংবাদ দিয়েছিলেন এবং এই সংবাদটি বিশুদ্ধতম ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে ।

রাসূলের সাহাবিগণ ,স্ত্রীরা ,আত্মীয়-স্বজন ও নিকটতম ব্যক্তিরা এই সংবাদটি সরাসরি তাঁর থেকে অথবা কোন না কোন নির্ভুল মাধ্যমে শুনেছিলেন ।

অনুরূপ ইমাম হোসাইন (আ.) যখন ইরাকে সফর করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং এ উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে মক্কায় গমন করলেন সকলেই তখন শঙ্কিত হলেন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন ।

তারা রাসূলের দেয়া সংবাদ অনুযায়ী স্পষ্টভাবে জানত যে ,শাহাদাত ইমাম হোসাইনের অপেক্ষায় আছে । আর তৎকালে বিরাজমান পরিস্থিতিও এ কথা বলছিল । কারণ ,মুসলিম বিশ্বের ওপর বনি উমাইয়ার শাসনকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল । তাদের চরম অত্যাচারের ফলে জনমনে তীব্র ভীতি ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছিল এবং এরূপ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় তারা অত্যাচারী বনি উমাইয়া শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল । আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সময়কালে কুফা শহরের জনগণের অবস্থা সম্পর্কে তাদের অভিজ্ঞতা ছিল ,তাতে তারা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) মৃত্যু ও শাহাদাতের দিকে ছুটে যাচ্ছেন এবং এর বিপরীত কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ ।

ইমাম হোসাইন (আ.) প্রায়ই স্বীয় প্রাণনাশের খবর দিতেন ;কিন্তু কখনই ইয়াযীদের উৎখাত ও তাঁর দ্বারা ইসলামী হুকুমত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার খবর দিতেন না ;যদিও তিনি মনে করতেন সবারই এটা দায়িত্ব ও কর্তব্য যে ,ইয়াযীদের হাতে বাইআত ও তার অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকা এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা । তিনি আহ্বান জানাতেন যেন সবাই তাঁকে সহযোগিতা করুক ,যদিও তিনি জানতেন যে ,এ ধরনের সর্বব্যাপী আন্দোলন কখনো গড়ে উঠবে না আর অবশেষে তাঁকে কিছু সংখ্যক সাথি নিয়েই প্রতিবাদ করতে হবে এবং আল্লাহর রাস্তায় প্রাণ দিতে হবে । আর এ জন্য তিনি স্বীয় শাহাদাতের কথা জনগণের সামনে ঘোষণা দিতেন । কখনো কখনো যেসব ব্যক্তি তাঁকে ইরাকে যেতে বারণ করছিল তাদের প্রশ্নের জবাবে বলতেন : আমি আল্লাহর রাসূলকে স্বপ্নে দেখেছি ও ঐ স্বপ্নের মাধ্যমেই আমি একটি গুরুদায়িত্ব পেয়েছি যেটা আমার দ্বারা সম্পাদিত হওয়াই উপযুক্ত । 249

কাশফুল গুম্মাহ গ্রন্থে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,তিনি বলেছেন : সফরের সময় যে স্থানেই আমরা থামতাম ও বোঝা বাঁধতাম ,আমার পিতা আল্লাহর নবী ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়ার শাহাদাতের কথা বলতেন । আর একদিন তিনি এভাবে বললেন : আল্লাহ তা আলার নিকট দুনিয়া সবচেয়ে হীন ও নিকৃষ্ট বলে গণ্য হওয়ার একটা কারণ হলো যে ,(দুনিয়া পাওয়ার জন্য) ইয়াহিয়ার পবিত্র মস্তক শরীর থেকে আলাদা করা হয় আর সেই মস্তককে ইসরাইলী একজন ব্যভিচারী নারীর নিকট উপহারস্বরূপ নিয়ে যাওয়া হয় । 250

সুতরাং এসকল নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক দলিল এটাই প্রমাণ করে যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় শাহাদাত ও সামরিক পরাজয়ের বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ব থেকেই জানতেন এবং তাঁর উত্থান ছিল ইয়াযীদী শাসনকে বাতিল ঘোষণা করা ,দ্বীনের পুনঃজাগরণ ঘটানো ,সত্যের বিষয়ে সন্দেহ ও চিন্তাগত বিচ্যুতি দূরীকরণ এবং ইয়াযীদী শাসনের মরণাঘাত থেকে দ্বীন ইসলামকে মুক্তি দান । ইমাম হোসাইনের সফলতা এখানেই ছিল যে ,স্বীয় দাবির সঠিকতাকে তুলে ধরা । এ লক্ষ্যেই তিনি কুফাবাসীদের দাওয়াতে সাড়া দিয়েছিলেন এবং সুকৌশলে ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তাঁর পরিকল্পনাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন । আর এভাবেই সবার সামনে চূড়ান্ত প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন । তিনি তাঁর সংগ্রামকে স্বীয় আহলে বাইতের মাযলুমিয়াতের (নির্যাতিত হওয়া) সাথে এমনভাবে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন যাতে নির্যাতনকারীদের চেহারা অত্যন্ত নিকৃষ্ট আকারে ইতিহাসের পাতায় অবশিষ্ট থাকে এবং তাঁদের আত্মত্যাগ ,অবদান ও মহান উদ্দেশ্য নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার বা অনুজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে । তাই এই ঐশী আবীর শাহাদত ও বন্দিদশা ব্যতীত চিরস্থায়ী করে রাখা সম্ভব ছিল না ।

নিজেকে ধ্বংসের সম্মুখীন করা

প্রশ্ন 23 : যদি মানুষের উদ্দেশ্য মৃত্যুবরণ করা ও নির্যাতিত হওয়া এবং পরিবার-পরিজনের বন্দিদশা হয়ে থাকে ,তাহলে তা নিজেকে মৃত্যুর সম্মুখীন করা বা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার শামিল যেটা বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিতে ভুল ও শরীয়তগতভাবে কোরআনের আয়াত-

) وَلَا تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ(

(তোমরা স্বহস্তে নিজেদের ধ্বংসে নিপতিত কর না) অনুযায়ী জায়েয নয় ;তাহলে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) শাহাদাত ও মৃত্যুর জন্য বের হলেন ও তার পটভূমিকে নিজ ইচ্ছায় প্রস্তুত করলেন ?

উত্তর : 1. নিজেকে বিপদের মুখে ফেলা অথবা নিজেকে ধ্বংসের সম্মুখীন করার বিধান উদ্দেশ্য ,বিষয় ও অবস্থার ভিন্নতায় বিভিন্ন হয়ে থাকে ,কখনো কখনো তা হারাম বা নিষিদ্ধ আবার কখনো কখনো তা জরুরি ও অপরিহার্য হয় । এরকম নয় যে ,নিজেকে ধ্বংসের সম্মুখীন করা সকল অবস্থায় হারাম ;বরং কখনো কখনো তা ওয়াজিব বা আবশ্যক হয়ে পড়ে ,যদি ধরেও নিই যে ,এই আয়াত সর্বজনীনভাবে বর্ণিত হয়েছে ,কিন্তু অন্যান্য দলিলের ভিত্তিতে ক্ষেত্রবিশেষে তা নির্দিষ্ট বা সীমিত হয়ে যায় ।

যদি ইসলাম ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়ে আর তাকে উদ্ধার করার জন্য যদি নিজেকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয়া ছাড়া উপায় না থাকে ,তারপরও কি ধ্বংসের সম্মুখীন হওয়া জায়েয নয় ?

যদি কেউ স্বীয় জীবন বাঁচানোর জন্য ইসলামকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দেয় ,বুদ্ধিবিবেক ও শরীয়তের দৃষ্টিতে কি তাহলে সে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না ? এ বিষয়টি কি ইসলামের প্রতিরক্ষা ও জিহাদের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র নয় এবং এক্ষত্রে আত্মত্যাগ কি সবচেয়ে জরুরি বলে গণ্য নয় ?

তাওহীদের প্রতি দাওয়াত করা ,আল্লাহ ভিন্ন অন্য কিছুর ইবাদত করা থেকে মানুষকে মুক্তি দান করা ,ইসলাম ও দ্বীনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদীদের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখাই হলো জিহাদের দর্শন । ইসলামী বিধান অনুযায়ী জিহাদ ও ধর্মের প্রতিরক্ষার কাজটি-নিহত ও ধ্বংসের সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত জেনেও-ওয়াজিব বা অপরিহার্য ।

যদি ইসলামী রাষ্ট্র রক্ষার জন্য শত্রুকে প্রতিরোধ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে এবং এর সীমান্ত ও ভূখণ্ড রক্ষা করা কিছু সংখ্যক সৈন্যের মৃত্যুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাহলে অবশ্যই বড় ধরনের ক্ষতিকে মেনে নিয়েও তার প্রতিরক্ষা করতে হবে । আর এ ক্ষেত্রে যদি নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে হয় তাহলে অবশ্যই তা করা জায়েয ;বরং ওয়াজিব ।

2. নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হারাম -এই নির্দেশটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক নির্দেশ যা শরীয়তও সমর্থন করেছে । কিন্তু নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা -বুদ্ধিবৃত্তিক এই বিধানকে সকল অবস্থায় প্রযোজ্য একটি বিধান বলে মনে করে না । বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতেও এ বিধানটি তখনই প্রযোজ্য হবে যখন তার বিপরীতে তার থেকে অধিক

গুরুত্বপূর্ণ ও বেশি কল্যাণকর কিছু থাকবে না ;কিন্তু যদি তার (জীবন রক্ষা) থেকে মূল্যবান ও বড় কোন কল্যাণকে পেতে হলে তাকে বিসর্জন দিতে হয় তখন বুদ্ধিবৃত্তি তাকে জায়েয ও কখনো কখনো জরুরি এবং সেটাকে ভালো বলে নির্দেশ দিয়ে থাকে ।

3. ক্ষতি বা ধ্বংসের ব্যাপারটি কয়েকভাবে ধারণা করা যেতে পারে ,যেমন ধ্বংস ,নিঃশেষ ,অনর্থক । বর্ণিত আয়াতে ধ্বংস বা ক্ষতির বিষয়টি দ্বারা হয়তো এই ধরনের অনর্থক বিনাশ ও ধ্বংসকেই বুঝানো হয়েছে । কারণ ,এ ধরনের উদ্দেশ্যে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া শরীয়তগতভাবে ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কখনই সঠিক নয় ;কিন্তু যদি তার উদ্দেশ্য ঐরূপ না হয়ে কর্তব্য পালন এবং বিধি-বিধানের প্রতিরক্ষায় হয়ে থাকে তাহলে আত্মত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ করার অর্থ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া ও ধ্বংস হয়ে যাওয়া নয় ।

যারা আল্লাহর রাস্তায় ও দ্বীন রক্ষার জন্য নিহত হয় তারা নিঃশেষ ও ধ্বংস হয় না ;বরং আরো দৃঢ় ও চিরস্থায়ী হয় । সুতরাং শরীয়তগতভাবে নিজের জীবন রক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোন কল্যাণ অর্জন করা অথবা এমন অকল্যাণকর কিছুকে দমন করা যেটার ক্ষতি রোধ করা জীবন রক্ষার চেয়েও মূল্যবান ,এরূপ ক্ষেত্রে জীবন দান করা ও শাহাদাতবরণ করার অর্থ নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করা নয় ;তাই এধরনের মহান উদ্দেশ্যে নিজেকে বিসর্জন দেয়া কখনই আয়াতটির নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয় । আয়াতটির অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো আর্থিক ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত আচরণ । যেমন কেউ যদি বিলাসিতার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করে নিজেকে অভাবগ্রস্ত করে তাহলে তা নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে ;কিন্তু যদি মান-সম্মান রক্ষার জন্য অথবা অন্য কোন ভালো কাজে (কারো সম্মান রক্ষার জন্য) খরচ করে বা দান করে ,তাহলে সেটা অপচয় নয় ;বরং সেটা সঠিক কাজ ও শরীয়তসিদ্ধ কাজ ।

4. দ্বীনের জন্য জিহাদ ও প্রতিরক্ষার ময়দানে ধৈর্যধারণ করা বিশেষ করে যে ক্ষেত্রে রণাঙ্গন থেকে পলায়ন করা মুসলিম বাহিনীর পরাজয় ও কাফেরদের বিজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে আর আত্মোৎসর্গ করা জিহাদকারীদের জন্য উৎসাহের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সেক্ষেত্রে শাহাদাতের চেতনাকে প্রশংসার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বরং সেটাকে ওয়াজিব করা হয়েছে আর কেউ কখনো এ ধরনের সাহসিকতা ও দৃঢ় মনোবলপ্রসূত কাজকে নিজেকে ধ্বংসের মুখে সঁপে দেওয়া বলে গণ্য করে নি ;বরং সর্বদা ,বিশেষ করে ইসলামের প্রাথমিক যুগে ,মহা গৌরবের মধ্যে একটি গৌরব ও সৈন্যদের মধ্যে পতাকাধারী ও সেনাপতিদের জন্য উচ্চ মর্যাদা বলে গণ্য করা হয়েছে । যেমন মুতার যুদ্ধে জাফর তাইয়্যার (রা.)-এর ঐতিহাসিক আত্মত্যাগ । এরূপ আত্মোৎসর্গ ও শাহাদাতের উদ্দেশ্য হলো প্রকৃত সৌভাগ্য লাভ এবং আল্লাহ তা আলার নৈকট্য অর্জন ;এটা আত্মহত্যা ও নিজেকে ধ্বংসের মুখে সঁপে দেওয়া নয় ।

5. আয়াতটি যদিও নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করা হারাম হওয়ার অর্থ নির্দেশ করছে ,কিন্তু যেহেতু নিষিদ্ধতার বিধানটি ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করার ওপর আরোপিত হয়েছে সেহেতু এ বিষয়টি বাইরে বিদ্যমান যে সকল বস্তুর (যেমন-মদ ,জুয়া ইত্যাদির) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে সেগুলোর মতো নয় ,এ কারণে যে ,সেটার বাস্তব নমুনা (নিষেধাজ্ঞা) উক্ত শিরোনামের অর্থাৎ ধ্বংসে পতিত হওয়ার সাপেক্ষে নির্ধারিত হবে । তাই দেখা যাবে হয়তো একটি উদ্যোগ ও কোন একটি কাজ বর্তমান প্রেক্ষাপটে অথবা কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিপতিত করা বলে গণ্য হবে ,কিন্তু এ সম্ভাবনাও আছে যে ,হয়তো অন্য কোন প্রেক্ষাপটে বা অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটা ঐরকম নয় । এ আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে ,

এক. ইমাম হোসাইন (আ.) উম্মতের মধ্যে আল্লাহর বিধি-বিধানের বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন আর তিনি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে ভুল-ত্রুটিমুক্ত হয়ে কাজ করতেন । তাই তিনি যা কিছু করেছেন সবকিছুই আল্লাহর নির্দেশে ও শরীয়তের দায়িত্ব হিসেবে পালন করেছেন ।

দুই. উমাইয়ারা যে কোনভাবেই হোক ইমাম হোসাইনকে শহীদ করত-তিনি ইরাকের দিকে যান বা মক্কাতেই অবস্থান করুন । তিনি এই বিষয়টি সকল দিক থেকে ভেবে দেখেছেন এবং যে কেউ তাঁর আন্দোলন ও কর্মসূচির প্রতি লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেন ,তাঁর শাহাদাত ও নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি ইসলামকে টিকিয়ে রাখা ও দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফল দান করবে । আর সে দিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি প্রতিটি বিষয়ে ও প্রতিটি মুহূর্তকে নিঁখুতভাবে কাজে লাগিয়েছেন ।

তিন. ইমাম হোসাইনের উত্থান ,বাইআত করা থেকে বিরত থাকা ,ঐ মহাবিপদকে সহ্য করা ইত্যাদির একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল দ্বীনকে রক্ষা করা আর এই উদ্দেশ্যটি ছিল ইমামের জন্য মহা মূল্যবান একটি বিষয় যেটা অর্জন করার জন্য তিনি স্বীয় জীবন ও সন্তানবর্গ এবং সঙ্গী-সাথিদেরকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন । এই কারণেই তিনি শাহাদাতকে বেছে নিয়েছিলেন এবং ঐ মহা বিপদকে স্বাগত জানিয়েছিলেন ।

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মূল উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিল আল্লাহর নির্দেশ পালন করা ও দ্বীন রক্ষা ,অধিকার আদায়ে সহযোগিতা করা ,বনি উমাইয়ার শাসনব্যবস্থার ওপর বাতিলের সীলমোহর মেরে দেওয়া ইত্যাদি । আর এ সকল উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর জন্য নত না হওয়া ও শহীদ হওয়া পর্যন্ত অটল থাকা এবং অন্যান্য ঘটনা ছিল এক প্রকার ভূমিকাস্বরূপ । যেহেতু স্বীয় সত্য বিশ্বাস ও দ্বীন রক্ষার ওপর অবিচল থাকাটা হচ্ছে গৌরব ও উচ্চ মর্যাদার কারণ ,সেহেতু এ বিষয়টি নিজেকে ধ্বংসে নিপতিত করার শামিল নয় ।

নারীদের অবস্থান

প্রশ্ন 24 : ইমাম হোসাইন (আ.) যদি জানতেনই যে ,তিনি শহীদ হবেন তারপরেও কেন স্বীয় পরিবারকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন ? ইমাম হোসাইনের এই আশুরা বিপ্লবে নারীদের ভূমিকা ও অবস্থানই বা কী ছিল ?

উত্তর : ইমাম হোসাইনের অভ্যুত্থানের দু টি রূপ ছিল এবং ঐ দু টি রূপের প্রত্যেকটির ওপর এক একটি কর্ম উৎপত্তি লাভ করেছে ;তার মধ্যে একটি আত্মত্যাগ ,সংগ্রাম এবং শাহাদাত । আর অপরটি হচ্ছে বাণী প্রচার । অবশ্য এই বাণী প্রচারটি আত্মত্যাগ ও অক্লান্ত পরিশ্রম ব্যতীত সম্ভব ছিল না । এ ক্ষেত্রে নারীদের মূল ভূমিকা ছিল দ্বিতীয় বিষয়টিতে । যদিও নারীরা সংগ্রাম ীদেরকে প্রস্তুত করা ,তাঁদেরকে উদ্বুদ্ধ করা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন ;কিন্তু তাঁদের মূল ভূমিকা ছিল বাণী প্রচার করা

ইসলামী ও হোসাইনী বিপ্লবের ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে প্রথমে দু টি পটভূমি সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। প্রথমটি হচ্ছে হাদীস অনুসারে। সাইয়্যেদুশ শুহাদা ইমাম হোসাইনের সমস্ত কাজই অত্যন্ত নিপুণ ছিল এবং বিপদের আশঙ্কা থাকার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও যে তিনি তাঁর পরিবার - পরিজনকে সাথে নিয়ে কুফা শহরের দিকে যাত্রা করেছিলেন তার কারণ হলো রাসূল ( সা .)- কে তিনি স্ব প্নে দেখেছিলেন যে ,তিনি ( রাসূল ) তাঁকে বলছেন :251

سبایا ان الله شاء ان یراهنّ

1 (নিশ্চয় আল্লাহ তাঁদের বন্দি অবস্থায় দেখতে চান)-এ থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ,তাঁদের বন্দি হওয়ার বিষয়টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত আছে । অর্থাৎ তিনি দেখলেন যে ,পরিবারকে সাথে নিয়ে যাওয়াটাই কল্যাণকর । প্রকৃত অর্থে ইমাম হোসাইন (আ.) এই কাজের মাধ্যমে স্বীয় প্রচারকগণকে বিভিন্ন শহরে ,এমনকি শত্রুর শাসনব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্রে পাঠিয়েছেন এবং স্বীয় বাণীকে সবার কর্ণকুহরে পৌঁছে দিয়েছেন ।

নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে দ্বিতীয় আলোচনাটি হচ্ছে ইতিহাসে । কেননা ,কারবালায় নারীদের ভূমিকার কথা কোন ঐতিহাসিকই অস্বীকার করেননি । সরাসরিভাবে না হলেও বিভিন্নভাবে নারীদের বিশেষ ভূমিকা পালনের বিষয়ে তাঁরা সকলেই একমত পোষণ করেছেন ;আর সেটা এভাবে যে ,নারীরা পুরুষদেরকে প্রস্তুত করে আর পুরুষরা ইতিহাস রচনা করে । আর পুরুষদেরকে তৈরির ক্ষেত্রে নারীরা যে ভূমিকা পালন করে থাকে সেটা পুরুষরা যে ইতিহাস রচনা করে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি । সর্বোপরি ,নারিগণের ভূমিকা পালন করা অথবা ভূমিকা পালন না করার ক্ষেত্রকে ইতিহাসে তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় :

ক. কোন কোন সমাজে নারী মূল্যবান রত্ন বলে গণ্য হত । কিন্তু সামাজিকভাবে তারা কোন দায়িত্ব পালন করত না । এক্ষেত্রে নারী ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হত না ,মূল্যবান সম্পদ বলে তাদের অন্দর মহলে আবদ্ধ থাকত এবং পুরুষের ওপর তার প্রভাব মূল্যবান এক রত্নের পর্যায়ে ছিল ;এর বেশি কিছু নয় । এধরনের সমাজের রচনাকারী কেবল পুরুষ ।

খ. কোন কোন সমাজে নারীরা বস্তু বলে গণ্য হওয়ার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের সকল অঙ্গনে প্রবেশ করে ;কিন্তু এক পর্যায়ে তারা তাদের মর্যাদার সীমানাকে হারিয়ে ফেলে । কারণ তারা তাদের সৌন্দর্য ও রূপের প্রকাশসহ সকল ক্ষেত্রে বিচরণ করা শুরু করে । যেহেতু এক্ষেত্রে তাদের পদচারণার সাথে নিজেকে প্রদর্শনের প্রবণতাও থাকে তাই তাদের মর্যাদাকে হারিয়ে ফেলে মূল্যহীন হয়ে পড়ে! এ ধরনের সমাজে নারীরা একপ্রকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী বটে ,কিন্তু মূল্যহীন এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী । যদিও এরূপ সমাজ মানবিক উৎকর্ষের কিছু কিছু দিক -যেমন জ্ঞান ,ইচ্ছাশক্তি ,সামাজিক ব্যক্তিত্ব ,বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন ,কর্মচঞ্চল উপস্থিতি ইত্যাদি-থেকে তাকে মর্যাদা দিয়ে থাকে ও নিছক বস্তুর পর্যায়ে থাকার অবস্থা থেকে বের করে এনে ব্যক্তিত্ব দান করে ,কিন্তু অপর দিকে পুরুষদের কাছে তাদের মর্যাদা আর থাকে না । কেননা ,যেখানে নারীদের প্রকৃতি হচ্ছে পুরুষদের কাছে পণ্যের দৃষ্টিতে মূল্যবান হওয়া নয় বরং মানুষের মূল্যে মহামূল্যবান হিসেবে গণ্য হওয়া ,কিন্তু বাস্তবে নারীকে সে মর্যাদা দেওয়া হয় না ;বরং তাদের থেকে ঐ মর্যাদাকে কেড়ে নেওয়া হয় ও তাদেরকে নিজেদের প্রবৃত্তি ও বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করে । ফলে তাদের মানসিক বিপর্যয় ঘটে ।

এ ধরনের সমাজের স্রষ্টা যদিও নারী-পুরুষ উভয়ই ,কিন্তু নারীকে সস্তা এক পণ্য বলে মনে করা হয় ;ফলে পুরুষরা তাদেরকে উপযুক্ত সম্মান দেয় না ।

গ. ইসলামের দৃষ্টিতে ,নারীকে অবশ্যই তার পূর্ণ মর্যাদা দিতে হবে । অর্থাৎ একদিকে সে যেমন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একজন আধ্যাত্মিক ও পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের ,যেমন জ্ঞান ,শৈল্পিকতা ,শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তি ,সাহসিকতা ,সৃজনশীলতা ,এমনকি নৈতিকতার দিক থেকে মর্যাদা ও সর্বোচ্চ মানের অধিকারী হবে ,অপর দিকে সে অশ্লীল হবে না । পবিত্র কোরআনও নারীদেরকে এ ধরনের মর্যাদা দান করেছে । উদাহরণস্বরূপ ,(মহান আল্লাহ) হযরত হাওয়া (আ.)-কে হযরত আদম (আ.)-এর পাশাপাশি সম্বোধন করে কথা বলেছেন । দু জনকেই বলা হয়েছে যেন ঐ বৃক্ষের নিকটবর্তী না হন ।252 হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর স্ত্রী সারা ও হযরত ইবরাহীমের মতো ফেরেশ্তাদেরকে দেখতে পেতেন এবং তাঁদের সাথে কথা বলতেন । হযরত মারইয়াম (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন রিযিক বা খাদ্য পেতেন যা দেখে আল্লাহর নবি হযরত যাকারিয়া (আ.)ও অবাক হয়ে যেতেন এবং হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-কে কাউসার তথা মহা কল্যাণ বলা হয়েছে ।

ইসলামী ইতিহাসে সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) । যিনি আনন্দিত হতেন শুধু এ কারণেই যে ,রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে ঘরের কাজকর্মের দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করা হয়েছে ,তিনিই মসজিদে আল্লাহর তাওহীদের ওপর এমন এক বক্তব্য দিয়েছিলেন যেরূপ বক্তব্য ইবনে সীনার মতো দার্শনিকও দিতে সক্ষম হননি । কিন্তু তারপরেও তিনি পর্দার আড়াল থেকে বের হননি ,বরং সেখান থেকেই বক্তব্য দিয়েছেন । অর্থাৎ পুরুষদের সাথে স্বীয় ব্যক্তিত্ব ও গণ্ডি রক্ষার পাশাপাশি দেখিয়ে দিয়েছেন যে ,একজন নারী সমাজে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে!

উক্ত দু টি ভূমিকার পর অবশ্যই বলতে পারি যে ,কারবালার ইতিহাস নারী-পুরুষ উভয়ের ইতিহাস । অর্থাৎ নারী -পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা তাতে বিদ্যমান ,কিন্তু প্রত্যেকটি তার স্বীয় সীমারেখা ও মান-মর্যাদার মধ্যে সীমিত ।

কারবালাতে পুরুষদের ভূমিকা সুস্পষ্ট ,কিন্তু নারীদের ভূমিকা বিশেষ করে হযরত যায়নাব (আ.)-এর ভূমিকা আশুরার (10 মুহররম) বিকাল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছিল এবং এরপর থেকে শুরু করে সমস্ত দায়িত্ব (বন্দি কাফেলার নেতৃত্ব ও পরিচালনা এবং ইমাম হোসাইন ও আহলে বাইতের মুখপাত্র হিসাবে বক্তব্য তুলে ধরা) তাঁর ওপর অর্পণ করা হয়েছিল । তিনি ইমাম হোসাইনের পবিত্র দেহ মোবারকের সামনে এমন কিছু কাজ করেছিলেন যা দেখে বন্ধু ও শত্রু সকলেই অঝরে ক্রন্দন করেছিল । প্রকৃত অর্থে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রথম শোকানুষ্ঠান তিনি সেখানেই পালন করেছিলেন । ইমাম হোসাইনের পুত্র ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এবং অন্যান্য নারী-শিশুর সেবা-শুশ্রুষা করেছিলেন এবং কুফা শহরের প্রধান ফটকের সামনে স্বীয় বক্তব্যের মাধ্যমে হযরত আলী (আ.)-এর বীরত্ব ও হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর আত্মসম্মানবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন । আর হযরত আলীর উচ্চমানের বক্তব্যগুলোর কথা জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এবং কুফা শহরের অধিবাসীদের অন্যায় কর্মকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে তাদেরকে জাগ্রত করছিলেন । এটাই হল ইসলামের কাঙ্ক্ষিত নারী । যে স্বীয় সম্মান ও লজ্জা এবং ধর্মীয় সীমারেখা বজায় রেখে একজন সামাজিক পরিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে আবিভ ত হয় ।253 এই মহিয়সী নারী তার উত্তম দৃষ্টান্ত ।।

উপরিউক্ত বর্ণনা অনুসারে ,আশুরা বিপ্লবে ইমাম হোসাইনের পরিবারকে সাথে নেওয়ার বিষয়কে কয়েকটি দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী বলে মনে করি :

1. নারী ও শিশুরা প্রচার ও বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী ।

2. প্রচারক্ষমতা ছাড়াও শত্রুরাও নারীদের সামনে অনেক ক্ষেত্রে অক্ষম হয়ে যায় । কেননা ,অবশ্যই তাদের (নারীদের) যে সীমারেখা আছে সেটা মেনে চলতে হয় । আর নারী ও শিশুদেরকে আঘাত করলে প্রত্যেকের সহানুভূতিতে আঘাত হানে ও যারা এই জঘন্য কাজটি করে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা তাদেরকে অপরাধী হিসেবে গণ্য করে থাকে । যেমনভাবে কারবালার ঘটনায় এমনকি শত্রুরাও স্বীয় পরিবারের নিকট লাঞ্ছিত হয়েছে ।

অপরদিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর সর্বস্ব ও তাঁর সঙ্গী-সাথিসহ কোন প্রকার ঘাটতি ছাড়াই ঐকান্তিকতার সাথে সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে আল্লাহর সমীপে হাজির হয়েছিলেন । আর এ ধরনের ঐকান্তিকতার ফসলই হচ্ছে এই যে ,আশুরা বিপ্লবের বিষয়টি মুসলমান ও অমুসলিম সকলকেই প্রভাবিত করেছে । আর কিয়ামতের দিনেও তাঁরা (শহীদগণ) এমন এক মর্যাদায় উন্নীত হবেন যে ,সকলেই ঐ মর্যাদা লাভ করার আশা পোষণ করবে । এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা আবশ্যক :

এক. বাণী পৌঁছানো

ইসলামী শাস্ত্রে সামাজিক দায়িত্ব শুধু পুরুষদের জন্যই নির্দিষ্ট নয় ;বরং ধার্মিক মুসলিম নারীরাও সত্য-মিথ্যার মোকাবিলায় ঐশী বেলায়াত বা নেতৃত্বের প্রতি দায়িত্বশীল আর তারাও অবশ্যই সঠিক নেতার অনুসরণ করবে এবং দুর্নীতিবাজ শাসক ও অনুপোযুক্ত শাসকদের কর্ম ও আচরণের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করবে এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরব উপস্থিতি দেখাবে ।

আর ঐ পথের ওপর অবিচল থাকবে যে পথের ওপর হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) ছিলেন যিনি আল্লাহর মনোনীত ইমামের সহযোগিতায় তৎকালীন শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভুমিকায় নেমেছিলেন এবং তার অন্যায় কর্মকাণ্ডগুলোকে তুলে ধরার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করেছিলেন । নারীরা বিশেষ করে হযরত যায়নাবও কারবালা বিপ্লবে ইমাম হোসাইনের সহযোগী ছিলেন ।

প্রতিটি বিপ্লব ও সংগ্রামই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দু টি অংশ রক্ত বাণী দ্বারা গঠিত । রক্ত শিরোনামের অংশটির উদ্দেশ্য হচ্ছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সশস্ত্র সংগ্রাম-যেটা আল্লাহর রাস্তায় হত্যা করা ও নিহত হওয়া এবং আহত হওয়াকে বুঝায় । বাণী শিরোনামের অপর অংশটির উদ্দেশ্য হচ্ছে বাণী পৌঁছানো ও বিপ্লবের উদ্দেশ্যকে প্রচার করা ।

ইমাম হোসাইনের এই বিপ্লবকে পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে ,উল্লিখিত দুটি অংশই তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল ;কেননা ,আশুরার বিকাল পর্যন্ত ইমাম হোসাইনের বিপ্লব ছিল প্রথম অংশ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় হত্যা করা ,নিহত হওয়া ও আহত হওয়া ইত্যাদি । এসময় পর্যন্ত ইসলামের পতাকা বহন ও নেতৃত্বের সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল তাঁরই ওপর ন্যস্ত । অতঃপর দ্বিতীয় অংশটি ইমাম হোসাইনের পুত্র ইমাম সাজ্জাদ (যায়নুল আবেদীন) ও হযরত যায়নাব (আ.)-এর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল । তাঁরা তাঁদের জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাথিদের দ শাহাদাত ও বিপ্লবের বাণীকে সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার মধ্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন ও কুখ্যাত উমাইয়া শাসকগোষ্ঠীকে জনগণের সামনে নিকৃষ্ট হিসেবে পরিচয় করিয়েছিলেন ।

উমাইয়া শাসকরা মুয়াবিয়ার সময় থেকে ,আহলে বাইতের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক অপপ্রচার ইসলামী ভ খণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ করে শাম বা সিরিয়ায় চালিয়ে আসছিল তাতে এটা নিশ্চিত যে ,ইমাম হোসাইনের বংশের যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁরা যদি তাদের মুখোশ উন্মোচন ও সাধারণ মানুষের চেতনা জাগ্রত করার কাজটি না করতেন তাহলে ইসলামের শত্রুরা ও ক্ষমতাশালীদের কর্মচারীরা তাঁর চিরজীবি মহান বিপ্লবকে ভবিষ্যতে মূল্যহীন করে দিত ও তার (বিপ্লবের) রূপকে পাল্টে অন্যভাবে তুলে ধরত ;

যেমনভাবে কিছু কিছু ব্যক্তি ইমাম হোসাইনের ইতিহাসকে বিকৃত করে বলে থাকে : তিনি যক্ষ্মা রোগের কারণে ফুসফুস নষ্ট হয়ে মারা গেছেন ।

কিন্তু ইমাম হোসাইনের বংশধরদের বন্দিদশার কারণে পরবর্তীতে যে বিশাল প্রচারণার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা এ ধরনের বিকৃতি ও পরিবর্তন ঘটানোর সুযোগ শত্রুদেরকে দেয়নি । আহলে বাইতের নারী ও শিশুদের উপস্থিতির আবশ্যিকতা ও আশুরায় তাদের বিশেষ ভূমিকার বিষয়টি সিরিয়ায় উমাইয়াদের শাসনক্ষমতা সম্পর্কে পর্যালোচনা ও গবেষণা করলেই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে ।

দুই. বনি উমাইয়ার প্রচারব্যবস্থাকে অকার্যকরকরণ

সিরিয়া যে দিন থেকে মুসলমানদের হাতে এসেছিল সে দিন থেকেই সেখানকার শাসনকর্তৃত্ব খালেদ বিন ওয়ালিদ ও মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের মতো জঘন্য ব্যক্তিদের ওপর ন্যস্ত ছিল । সেখানকার জনগণ রাসূল (সা.)-এর বাণী শোনার সৌভাগ্যও অর্জন করেনি আর তাঁর সাহাবীদের নিয়মনীতির সাথেও তারা খুব একটা পরিচিত ছিল না এবং ইসলাম ঠিক যেভাবে মদীনায় প্রচলিত ছিল সেভাবে ইসলামের সাথে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি । অবশ্য রাসূলের 113 জন সাহাবী এই এলাকা বিজয়ের সময় হয় অংশগ্রহণ করেছিলেন অথবা ধীরে ধীরে তাঁরা সেখানে বসতি গড়ে তুলেছিলেন । কিন্তু এ সকল ব্যক্তির জীবনী পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে ,গুটি কয়েক ব্যক্তি ব্যতীত অন্যরা খুব অল্প সময় রাসূলের সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন । ফলে তাঁদের নিকট থেকে কেবল অল্প কয়েকটি হাদীসই বর্ণিত হয়েছে ।

এ ছাড়াও তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তিই খলিফা হযরত উমর ও উসমানের খেলাফতকাল থেকে মুয়াবিয়ার শাসনামলের শুরুর সময়ের মধ্যে ইন্তেকাল করেছিলেন এবং ইমাম হোসাইনের বিপ্লবের সময় তাঁদের মধ্যে মাত্র 11 ব্যক্তি জীবিত ছিলেন যাঁরা সিরিয়াতে বাস করতেন । তাঁরা সকলেই প্রায় 70/80 বছর বয়সের ছিলেন । তাঁরা সর্বদা জনগণের মাঝে থাকার চেয়ে ঘরের কোণে বসে থাকাকেই বেশি পছন্দ করতেন আর সাধারণ জনগণের ওপরও তাঁদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না । যার ফলে সে সময়ের যুবকশ্রেণি প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না । তাদের দৃষ্টিতে ইসলাম ঠিক তেমনই একটি শাসনব্যবস্থা ছিল যেমনটি ইসলাম-পূর্ব সময়ে তাদের দেশে রোমানদের সময় ছিল । স্বেচ্ছাচরিতা ও স্বৈরাচার শাসকদের জন্য বৈধ এক কর্ম বলে পরিগণিত হত! আর মুয়াবিয়ার দরবারের ঐশ্বর্য ,বিশাল অট্টালিকা তৈরি ,বিরোধিতাকারীদেরকে হত্যা করা ,বন্দি করে রাখা ,নির্বাসন দেওয়া ,সাধারণ জনগণের সম্পদের (বায়তুল মালের) আত্মসাৎ এবং সকলের কাছে একটি স্বাভাবিক ও সহনীয় বিষয় ছিল । কেননা ,ইসলামের আগমনের অর্ধ শতাধিক বছর পূর্বেও তাদের এই ধরনের শাসনের অভিজ্ঞতা ছিল তাই মুয়াবিয়ার শাসনের ব্যাপারে তাদের কোন আপত্তি ছিল না । জনগণের এই বিশ্বাস ছিল যে ,রাসূল (সা.)-এর যুগে মদীনাতেও ঠিক এরকম শাসনব্যবস্থাই ছিল ।254

মুয়াবিয়া প্রায় 42 বছর ধরে সিরিয়াতে শাসন করেছিল আর এই সময়টি তুলনামূলকভাবে অনেক দীর্ঘ একটি সময় । সিরিয়ার জনগণকে সে এমনভাবে গড়ে তুলেছিল যাতে তারা সত্য সম্পর্কে অনবহিত ও দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং তার চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রশ্ন ছাড়াই সবকিছুকে মেনে নেয় ।255 মুয়াবিয়া এত দীর্ঘ সময় ধরে সিরিয়ার জনগণকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে স্বীয় আধিপত্যে রাখার কারণে ঐসব এলাকার মানুষ চিন্তা-চেতনা ও মাযহাবগত বিষয়ে অন্ধ ও বোবা এবং পথভ্রষ্ট ছিল আর সে কারণেই যা কিছু সে ইসলামের শিক্ষা নামে তাদের নিকট তুলে ধরত সেগুলোকে কোন প্রকার আপত্তি ছাড়াই জনগণ গ্রহণ করে নিত ।

উমাইয়া বংশের জঘন্য ও নোংরা শাসনব্যবস্থার বিষাক্ত ও হিংসাত্মক প্রচার-প্রপাগাণ্ডা রাসূলের পবিত্র বংশধরকে সিরিয়ার জনগণের সামনে অত্যন্ত ঘৃণিত হিসেবে তুলে ধরেছিল ,অপরদিকে উমাইয়া বংশকে রাসূলের আত্মীয় ও অতি নিকটতম হিসেবে পরিচয় করিয়েছিল । আব্বাসী খলিফা আবুল আব্বাস সাফ্ফাহ-এর শাসন প্রতিষ্ঠার পর সিরিয়ার 10 জন দায়িত্বশীল কর্মচারী তার নিকট যায় এবং সকলেই কসম খেয়ে বলে- আমরা দ্বিতীয় মারওয়ানের (উমাইয়া খলিফা) মৃত্যুকাল পর্যন্ত জানতাম না যে ,আল্লাহর রাসূলের বনি উমাইয়া ব্যতীত অন্য কোন আত্মীয় ছিল যারা তাঁর উত্তরাধিকারী । আপনি আমীর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমরা কিছুই জানতাম না । 256

সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই ,যখন মাকাতিল গ্রন্থে পড়ি : দামেশ্কে (সিরিয়ার রাজধানীতে) যখন কারবালার যুদ্ধবন্দিদেরকে (ইমাম হোসাইনের বংশধরদেরকে) নিয়ে আসা হয়েছিল তখন এক ব্যক্তি ইমাম হোসাইনের পুত্র যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল : সেই আল্লাহর প্রশংসা করি যে আল্লাহ তোমাদেরকে (তোমাদের আত্মীয়-স্বজনদেরকে) হত্যা ও ধ্বংস করেছেন এবং জনগণকে তোমাদের অকল্যাণ থেকে মুক্তি দিয়েছেন! ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) একটুখানি ধৈর্যধারণ করলেন যাতে ঐ লোকটির মনে যা কিছু আছে তা বলে শেষ করতে পারে । অতঃপর তিনি কোরআনের এই আয়াতটি-

) إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا(

অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ চান যে কোন ধরনের অপবিত্রতা হতে তোমরা আহলে বাইতকে দূরে রাখতে ও তোমাদের সর্বোতভাবে পবিত্র করতে 257 পাঠ করলেন ও বললেন : আয়াতটি আমাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে । তারপর ঐ ব্যক্তিটি বুঝতে পারল যে ,এতদিন যা কিছু এই যুদ্ধবন্দিদের সম্পর্কে শুনেছে তা সঠিক নয় । তাঁরা অপরিচিত বিদ্রোহী নন ;বরং রাসূল (সা.)-এর সন্তান । আর যা কিছু সে বলেছে তার জন্য অনুতপ্ত হলো এবং পরিশেষে তওবা করল ।258

সুতরাং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পরিবার-পরিজনের জ্বালাময়ী ভাষণসমূহ এবং হযরত যায়নাব ও ইমাম সাজ্জাদের অসত্যের পর্দা উন্মোচনকারী বক্তব্যগুলো বনি উমাইয়াদের কয়েক দশকের বিকৃত বিষয়গুলোকে ,এমনকি শত্রুদের খেলাফতের প্রাণকেন্দ্র সিরিয়াতেও অকার্যকর করে দিয়েছিল ।

তিন. অত্যাচারীদের মুখোশ উন্মোচন

ইমাম হোসাইনের পরিবার-পরিজনের উপস্থিতির কারণসমূহের অন্য একটি দিক হচ্ছে রক্তপিপাসু ,নিষ্ঠুর ও অমানুষ ইয়াযীদের এবং তার শাসনব্যবস্থার জঘন্য রূপকে জনগণের সামনে তুলে ধরা । যেসব কারণে জনগণ অধিক প্রভাবিত হয়েছিল তার অন্যতম হচ্ছে আহলে বাইতের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি ।

এ কারণেই কিছু কিছু রাজনৈতিক দল ও উপদল সাধারণ জনগণের চিন্তা-চেতনায় স্থান করে নেওয়ার জন্য প্রচারাভিযানের সময় নিজেদেরকে নিপীড়িত ও নির্যাতিত দেখানোর চেষ্টা করে । কেননা ,মানুষ সত্তাগতভাবেই যুলুম-নিপীড়ন ও অত্যাচারীদের প্রতি অসন্তষ্ট ,অপর দিকে নিপীড়িতদেরকে অত্যন্ত ভালোবাসে ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে থাকে ।

তবে কারবালার ঘটনার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন ছিল না ;সেখানে নির্যাতিত বা নিপীড়িত হিসেবে দেখানোর বিষয়টি ছিল না ;বরং প্রকৃত নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি আহলে বাইতের আত্মত্যাগের সাথে মিশ্রিত হয়ে গিয়েছিল এবং শহীদদের নেতা ও তাঁর সঙ্গী-সাথিদের উদ্দেশ্যকে সর্বোত্তমরূপে সবার নিকট পৌঁছে দিয়েছিল-এমনভাবে তা পৌঁছে দিয়েছিল যে ,আজও তাঁদের বাণী মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে দেয় ।

শিশু ও নারিগণ ,যাঁদের না ছিল যুদ্ধাস্ত্র আর না ছিল যুদ্ধ করার মতো শক্তি ,তারপরেও তাঁরা অত্যন্ত কঠিন অবস্থায় আঘাত ,নির্যাতন ,অপদস্থ ও মানসিক কষ্টের শিকার হয়েছেন । ছয় মাসের কচি শিশু তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শুষ্ক ঠোঁট নিয়ে জলে ভরা ফোরাত নদীর তীরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে ;ছোট্ট কন্যা পিতার রক্তাক্ত ,টুকরো টুকরো লাশের পাশে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ,তাঁদের তাঁবুগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে... এ সকল কারণ বাণী প্রচার ও ইয়াযীদের শাসনব্যবস্থার প্রকৃত রূপ প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ঐ সঙ্গী-সাথিদের শাহাদাত ও আহত হওয়ার চেয়ে কোন অংশেই কম ছিল না । ইমাম হোসাইনের কচি শিশুর ঐ তৃষ্ণার্ত আওয়াজ আর সাদা কাপড়ে মুড়ানো ছোট্ট শিশু আলী আসগারের মৃতদেহ-এগুলোই ঐ তরবারি চালানো ও ঐ নিপতিত রক্তগুলোকে আজও জীবন্ত করে রেখেছে ।

তাই ইমাম সাজ্জাদ (আ.) শামে বনি উমাইয়ার শাসকগোষ্ঠীর কুৎসিত রূপকে তুলে ধরতে গিয়ে বলেন : আমার শ্রদ্ধেয় পিতা ইমাম হোসাইনকে ঐভাবে টুকরো টুকরো করে শহীদ করা হয়েছে যেভাবে খাঁচায় বন্দি একটি পাখির ডানা ভেঙে দেওয়া হয় যাতে সে মারা যায় ।

এখানে যদি ইমাম সাজ্জাদ (আ.) এভাবে না বলে এভাবে বলতেন যে : আমার পিতাকে শহীদ করা হয়েছে ,তাহলে সিরিয়ার লোকজনের চোখে-যারা আহলে বাইত সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না ,তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হতো না ;কেননা ,তারা মনে করত যে ,যুদ্ধে তো অনেক লোক বা অনেকেরই পিতা মারা গেছে ,তার মধ্যে একজন হচ্ছেন ইমাম হোসাইন ।

কিন্তু ইমাম সাজ্জাদ (আ.) সেভাবে বলেননি । তাঁর এভাবে বলার উদ্দেশ্য হলো এই যে ,ধরে নিলাম তোমরা তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলে ,কিন্তু এভাবে কেন হত্যা করলে ? কেন পাখির মতো তার শরীরটাকে টুকরো টুকরো করলে ? কেন পানিভরা নদীর তীরে তাকে পানি না দিয়ে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় হত্যা করলে ? কেন তাঁর তাঁবুগুলোতে হামলা করলে ? কেন তাঁর শিশুদেরকে হত্যা করলে ? এই কথাগুলো জনগণের মনে এমনই আঁচড় কেটেছিল যে ,গোটা সিরিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং উমাইয়াদের বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ।

শেষকথা হলো ,ইয়াযীদ চেয়েছিল পুরুষদেরকে হত্যা ও আহলে বাইতের সদস্যদেরকে বন্দি করার মাধ্যমে সকল প্রকার বিপ্লবী উদ্যোগকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে-এমনভাবে বিনাশ করতে যেন সকলেই এ ধরনের পরিণতি দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে আর সে ক্ষমতার সিংহাসনে আরামে বসে থাকতে পারে । কিন্তু ইমাম হোসাইনের সম্মানজনক উত্থান ও তাঁর নির্যাতিত পরিবারের প্রচারাভিযান এবং বনি উমাইয়ার মুখোশ উন্মোচনের কাজ সেই ঘৃণ্য চক্রান্তকে সফল হতে দেয়নি । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ ,বনি উমাইয়ার অত্যাচারীদের শিকড় উৎপাটন এবং তাদেরকে নিঃশেষ করার জন্য ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন জায়গায় এ আন্দোলনের অনুসরণে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছিল ।