আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর16%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48488 / ডাউনলোড: 5357
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে


1

2

3

4

5

6

7

8

9

৩০ নং প্রশ্ন : শোকানুষ্ঠানের দর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করা যুক্তিসঙ্গত কি ?

উত্তর : প্রকৃতপক্ষে বাহির থেকে কোন বিষয়ের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা বর্তমান সময়ের মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য । নতুন এ দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে যদি কোন ব্যক্তি বাহির থেকে শোকানুষ্ঠানের বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত করে ও একে বিশ্লেষণ করে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত এর সপক্ষে তার বুদ্ধিবৃত্তির কাছে গ্রহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা না পায় অথবা অন্তত এটি তার বুদ্ধিবৃত্তির সাথে সাংঘর্ষিক নয় তা অনুধাবন করে ততক্ষণ শোক পালনের বিষয়টি গ্রহণ এবং এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না ।

বিষয়সমূহের প্রতি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ভালো । কেননা ,তা ইসলামী ও শিয়া সংস্কৃতি গঠনকারী শিক্ষার উপাদানসমূহের ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞানের ভিত্তিসমূহকে শক্তিশালী করে । আর এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে ,এ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপস্থাপিত প্রমাণসমূহ মানুষের ঈমানকেও আরো দৃঢ় ও উন্নত করবে । কেননা ,ঈমান জ্ঞান ও জ্ঞানের অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত হয় । এ কারণেই যদি শোক পালন করার বিষয়ের গ্রহণযোগ্য বর্ণনা ও যুক্তিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে এ সম্পর্কে যুবক ও নতুন প্রজন্মের বিশ্বাসের ভিত্তি শক্তিশালী হবে ।

আহলে বাইত (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালনের দর্শন ও উপকারিতা

৩১ নং প্রশ্ন : আহলে বাইত (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালনের দর্শন কী ও এর কী উপকারিতা রয়েছে ?

উত্তর : শোক পালন করার দর্শন নিম্নলিখিত বিষয়সমূহে খুঁজে পাওয়া সম্ভব :

ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে শোক প্রকাশ : কোরআন ও রেওয়ায়াত রাসূল (সা.)-এর পরিবারের প্রতি ভালোবাসাকে আবশ্যক করেছে ।৩২০ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট যে ,ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের কিছু প্রয়োজনীয় শর্ত রয়েছে । নিষ্ঠার সাথে ভালোবাসাকারী ব্যক্তি তিনিই হবেন যিনি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার শর্ত যথাযথ পূরণ করেন । বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো ,তাদের সুখ ও দুঃখের সময় সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করা ।৩২১ এ কারণেই হাদীসে আহলে বাইতের সুখে ও আনন্দে আনন্দ অনুষ্ঠান পালন এবং দুঃখের সময় সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশের ওপর অনেক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে ।

হযরত আলী (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত হয়েছে :

یفرحون لفرحنا و يحزنون لحزننا

(আমাদের শিয়ারা) আমাদের সুখে সুখী ও আমাদের দুঃখে দুঃখী হয় । ৩২২

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন :

شیعتنا جزء منا خلقوا من فضل طینتنا یس و ؤهم ما یس ؤنا و یس رّهم ما یس رّنا

আমাদের শিয়ারা আমাদেরই অংশ ,আমাদের মাটির অতিরিক্ত অংশ থেকে সৃষ্টি হয়েছে ;যা আমাদেরকে ব্যথিত ও আনন্দিত করে ,তা তাদেরকেও ব্যথিত ও আনন্দিত করে । ৩২৩

এছাড়াও ,আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিগত ও ধর্মীয় দায়িত্ব যে ,আহলে বাইতের জন্য শোক প্রকাশের দিনগুলোতে অশ্রু বিসর্জন ও আহাজারির মাধ্যমে নিজেদের শোক ও দুঃখকে প্রকাশ করা এবং দুঃখিত ও ব্যথিত ব্যক্তির মতো কম খাওয়া ও কম পান করা ।৩২৪

পোশাকের দিক থেকে প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যে সকল পোশাক রং এবং পরিধানের ধরনের দিক থেকে শোক ও দুঃখের প্রকাশ ঘটায় সেগুলো পরিধান করাই বাঞ্ছনীয় ।

মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধ তৈরির দৃষ্টিতে শোক প্রকাশ : যেহেতু শিয়া সংস্কৃতিতে শোক প্রকাশ অবশ্যই জ্ঞান ও পরিচিতির ভিত্তিতে হওয়া অপরিহার্য ,সেহেতু শোকানুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হলো সম্মানিত ইমামদের সাথে একাত্মতা ও সমবেদনা প্রকাশ করা ,তাঁদের মর্যাদা ,গুণ এবং আদর্শের স্মরণ করা । প্রকৃতপক্ষে এ কাজটি মানুষকে তাঁদের নিকট থেকে আদর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে ।

যে ব্যক্তি জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সহকারে শোকের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে তার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি ও আবেগ-উদ্দীপনা এবং জ্ঞান ও হৃদয়ের অনুভূতির মধ্যে সমন্বয় ঘটে । এর ফলে তার ইচ্ছাশক্তি দৃঢ় ও শক্তিশালী হয় । আর যখন সে শোকের অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে আসে তখন একজন কর্মতৎপর অগ্রগামী প্রেমিকে পরিণত হয় ,যে নিজের মধ্যে প্রেমাস্পদের পূর্ণতার গুণাবলি সৃষ্টির জন্য সংকল্পবদ্ধ ।

সমাজ গঠনের দৃষ্টিতে শোক প্রকাশ : যেহেতু শোকানুষ্ঠান পালন প্রকৃত মানুষ গড়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি করে সেহেতু এর ফলে মানুষের অন্তরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় যার প্রভাব সমাজে পড়ে এবং মানুষ সচেষ্ট হয় আহলে বাইতের আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ।

অন্য ভাষায় ,আহলে বাইতের প্রতি শোক প্রকাশ প্রকৃতপক্ষে একটি মাধ্যম যা আমাদেরকে তাঁদের আদর্শ রক্ষা ও বাস্তবায়নে উদ্বুদ্ধ করে । এ কারণেই বলা যায় যে ,শোক প্রকাশের একটি দর্শন হলো ইসলামের আদর্শ অনুসারে সমাজ গঠন করা ।

শিয়া সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর : কেউ এ চরম সত্যটিকে অস্বীকার করতে পারবে না যে ,নতুন প্রজন্ম শিশুকাল থেকেই শোক প্রকাশের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আহলে বাইতের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয় । প্রকৃতপক্ষে শোকানুষ্ঠান পালন ইমামদের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক শিক্ষা ও আদর্শকে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট স্থানান্তরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম । শোকানুষ্ঠান পালন ,এর ধরন ও বিষয়বস্তুর কারণে এটি আহলে বাইতের বাণী এবং কর্মের সাথে পরিচিত হওয়া এবং নতুন প্রজন্মকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করা ও গড়ে তোলার সবচেয়ে উত্তম পথ ।

৩২ নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের দর্শন কী ?

উত্তর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে মানুষ ও সমাজ গড়া এবং পরবর্তী প্রজন্মের নিকট আশুরা সংস্কৃতির উপাদানগুলো পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি শক্তিশালীভাবে বিদ্যমান । কেননা ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ও প্রশিক্ষণমূলক রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক ও সামাজিক শিক্ষা মানুষ এবং সমাজের নৈতিক উৎকর্ষ সাধনে মৌলিক অবদান রেখেছে । কারবালার ঘটনার মূল উপাদান আশুরা ও শিয়া সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে যা শোকানুষ্ঠানের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট স্থানান্তরিত হয় ।

আশুরার ঘটনা বর্ণনা ও এ সম্পর্কিত আলোচনা ও স্লোগানগুলোর মধ্যে মানুষ ও সমাজ এবং বিপ্লবী সংস্কৃতি তৈরির মূল উপাদান খুঁজে পাওয়া যায় । এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইবাদত ,ত্যাগ ,বীরত্ব ,আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ,ধৈর্য ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ,ইয়াযীদী শাসনের অধীনে ইসলামের ধ্বংস ,ইয়াযীদীদের মতো ব্যক্তির হাতে বাইআত গ্রহণ নিষিদ্ধ ,অপমানের চেয়ে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ ,পরীক্ষার ময়দানে সত্যপথ অবলম্বনকারীদের স্বল্পতা ,অবৈধ ও বাতিল শাসকের সময়ে শাহাদাত কামনার প্রয়োজনীয়তা ,শাহাদাত মানুষের জন্য সৌন্দর্য বলে গণ্য হওয়া ,অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়িত্ব ,সত্য ও সঠিক ইমামের বৈশিষ্ট্য ,আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর সন্তুষ্ট থাকা ,সত্য সংগ্রামে শাহাদাতকামীদের সহযোগিতা করা ,ঈমানদার ,জ্ঞানী ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের জন্য অপমান সহ্য করা নিষিদ্ধ হওয়া ,মৃত্যুকে চিরস্থায়ী বেহেশতে প্রবেশের সাঁকো হিসেবে গণ্য করা ,সত্য প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সবসময় সকল মানুষের কাছে সহযোগিতা কামনা করা এবং এ ক্ষেত্রে স্বাধীন ও সাহসী হওয়া ।৩২৫

হোসাইনের আচরণ দুনিয়াকে স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছে

হোসাইনের চিন্তা-চেতনা মানুষের অন্তরে সাহসের বীজ বপণ করেছে ।

যদি তুমি পৃথিবীর কোন ধর্মে বিশ্বাসী না হও ,কমপক্ষে স্বাধীনচেতা মানুষ হও

এটি হোসাইন এর বিস্ময়কর বক্তব্য ।

অপমানের জীবন থেকে সম্মানের মৃত্যু উত্তম

এটি হোসাইন এর কণ্ঠ থেকে উত্থিত সুমিষ্ট সংগীত ।

এ ছাড়া নিচের বিষয়গুলো ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক প্রকাশের দর্শনের অন্তর্ভুক্ত :

১. সকল যুগের অন্যায়-অত্যাচারীদের প্রতি এক ধরনের প্রতিবাদ৩২৬ ও বিশ্বের মযলুমদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা ।

২. মানুষের মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠার অনুভূতিকে প্রবল ও অত্যাচারীদের অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণ করার প্রবণতাকে শক্তিশালী করা ।

৩. মুসলিম সমাজকে সত্যের প্রতিরক্ষায় উদ্বুদ্ধ ও বিজয়ী করার জন্য প্রস্তুত করা ।

রেওয়ায়াতে শোক প্রকাশ৩২৭

৩৩ নং প্রশ্ন : আহলে বাইত (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালন করার ক্ষেত্রে কোন রেওয়ায়াত রয়েছে কি ?

উত্তর : এ সম্পর্কে অনেক রেওয়ায়াত রয়েছে । আহলে বাইতের জন্য শোক প্রকাশ করার বিষয়ে তিনটি রেওয়ায়াত বর্ণনা করাকে যথেষ্ট বলে মনে করছি ।

১. ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন :

رحم الله شیعتنا، شیعتنا والله هم الم ؤمنون فقد والله شرکونا فی المصیبة بطول الحزن و الحسرة

আল্লাহ আমাদের শিয়া ও অনুসারীদেরকে রহমত ও দয়া করুন । আল্লাহর শপথ ,আমাদের অনুসারীরাই হলো ঈমানদার যারা তাদের দীর্ঘ দুঃখণ্ডশোক প্রকাশ ও অনুশোচনা দ্বারা আমাদের ওপর আপতিত মুসিবতে অংশীদার হয় । ৩২৮

২. ইমাম রেযা (আ.) বলেন :

من تذکر مصابنا و بکی لما ارتکب مناکان معنا فی درجتنا یوم القیامه ومن ذکر بمصابنا فبکی وابکی لم تبك عینه یوم تبکی العیون ومن جلس مجلسا يحیی فیه امرنا لم یمت قلبه یوم تموت القلوب

যে আমাদের মুসিবতকে স্মরণ করে ও আমাদের ওপর যে যুলুম ও অত্যাচার হয়েছে তার জন্য ক্রন্দন করে কিয়ামতের দিন সে আমাদের সাথে থাকবে ;আমাদের যে সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে তা লাভ করবে । যে ব্যক্তি আমাদের মুসিবতসমূহকে বর্ণনা করবে অতঃপর নিজে ক্রন্দন করবে এবং অন্যকে কাঁদাবে ,কিয়ামতের দিনে তার (ইমামদের শোকে ক্রন্দনকারী) চোখ ব্যতীত সকল চোখ ক্রন্দনরত অবস্থায় থাকবে । যে আমাদের নির্দেশের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে ,তার অন্তর সেদিন জীবিত থাকবে যেদিন সকল অন্তর মরে যাবে । ৩২৯

৩. ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ফুদাইলকে বলেছেন :

تجلسون و تَدثون؟ قال: نعم جعلت فدا ك، قال: ان تلك المجالس احبها فاحیوا امرنا یا فضیل، فرحم الله من احیی امرنا یا فضیل من ذکرنا اوذکرنا عنده فخرج من عینه مثل جناح الذباب غفرالله له ذنوبه لو کانت اکثر من زبدالبحر

তোমরা কি (আমাদের কথা স্মরণ করে শোকানুষ্ঠান পালন করার উদ্দেশ্যে) একসঙ্গে বস এবং (আমাদের ওপর যা বিপদ-মুসিবত আপতিত হয়েছে তা নিয়ে) আলোচনা কর ? ফুদাইল বললেন : জী ,অবশ্যই ,আপনার জন্য আমি উৎসর্গিত! ইমাম (আ.) বললেন : এ ধরনের শোকানুষ্ঠানকে আমরা পছন্দ করি । অতঃপর হে ফুদাইল! আমাদের নির্দেশকে বাস্তবায়ন কর । যারা আমাদের নির্দেশের বাস্তবায়ন করে তারা আল্লাহর দয়া ও রহমতের অন্তর্ভুক্ত হয় । হে ফুদাইল! যে কেউ আমাদেরকে স্মরণ করবে ও যার নিকট আমাদের স্মরণ করানো হবে এবং তাতে কারো চোখ থেকে মাছির পাখার সমপরিমাণেও অশ্রু ঝরবে ,আল্লাহ তার সকল গুনাহকে ক্ষমা করে দেবেন ,যদিও তার গুনাহের পরিমাণ সাগরের ফেনার থেকেও অধিক হয় । ৩৩০

শোক প্রকাশের ইতিহাস

৩৪ নং প্রশ্ন : ইমাম (আ.)-দের জীবদ্দশায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক পালনের কোন নজির আছে কি ?

উত্তর : ইমামদের জীবদ্দশায় শোক পালনের নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে যার কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনা তুলে ধরা হলো :

ঐতিহাসিক ইয়াকুবি তাঁর তারীখ গ্রন্থে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার অঝরে ক্রন্দনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন । উম্মুল মুমিনীন বলেন : যেদিন হোসাইন শহীদ হন আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে ধূলি ধুসরিত ও শোকে মূহ্যমান অবস্থায় দেখলাম । আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম : হে আল্লাহর রাসূল! আপনার এ অবস্থা কেন ? তিনি বললেন : আমার সন্তান হোসাইন ও তার আহলে বাইতকে আজ শহীদ করা হয়েছে । আমি এইমাত্র তাদের দাফন সম্পন্ন করে আসলাম । ৩৩১

১. শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য বনি হাশেমের শোক প্রকাশ : ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বনি হাশেমের কোন নারী সুরমা ও মেহেদী ব্যবহার করে নি এবং বনি হাশেমের কোন ঘর থেকে খাবার রান্না করার চিহ্ন হিসেবে উনুন থেকে কোন ধোঁয়া বের হতে দেখা যায় নি ,যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে যিয়াদ নিহত ও ধ্বংস হয় । কারবালার মর্মান্তিক ও রক্তাক্ত ঘটনার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে আমাদের চোখে অশ্রু ছিল । ৩৩২

২. ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শোক প্রকাশ : তীব্র শোক ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে ,তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ক্রন্দনময় । তিনি তাঁর পিতা শহীদদের নেতার মুসিবতের জন্য সবচেয়ে বেশি অশ্রু ঝরিয়েছেন । তাঁর ভাই ,চাচা ,চাচাতো ভাই ,ফুফু ও তাঁর বোনদের ভাগ্যে যা ঘটেছিল তা স্মরণ করে তিনি অজ ¯ ধারায় ক্রন্দন করতেন । এমনকি যখন তাঁর সামনে পান করার জন্য পানি নিয়ে আসা হতো তখন তিনি পানি দেখে ক্রন্দন শুরু করে দিতেন এবং বলতেন : কিভাবে পান করব যখন রাসূল (সা.)-এর সন্তানদের পিপাসার্ত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে । ৩৩৩

আর তিনি বলতেন : যখনই আমার দাদী ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সন্তানের শাহাদাতের কথা স্মরণ হয় তখনই আমার কান্না পায় । ৩৩৪

ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর অন্যতম সাহাবী যুরারাকে বলেছেন : আমার দাদা আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) যখনই হোসাইন ইবনে আলী (আ.)-কে স্মরণ করতেন তখন এত বেশি ক্রন্দন করতেন যে ,তাঁর দাড়ি ভিজে যেত ও তার ক্রন্দন দেখে উপস্থিত ব্যক্তিরাও ক্রন্দন করত । ৩৩৫

৩. ইমাম বাকির (আ.)-এর শোক প্রকাশ : ইমাম বাকির (আ.) আশুরার দিন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন ও তাঁর ওপর মুসিবতের কথা স্মরণ করে ক্রন্দন করতেন । এ রকম কোন একটি শোকানুষ্ঠানে ইমাম বাকিরের উপস্থিতিতে কুমাইত নামক একজন কবি কবিতা পাঠ করেন । যখন কবিতা পাঠ করার এক পর্যায়ে এ অংশে এসে পৌঁছেন-قتیل بالطف অর্থাৎ তাফের ভূমিতে নিহত ,ইমাম (আ.) এ অংশ শোনামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন : হে কুমাইত! এই কবিতার পুরস্কার হিসেবে আমার কাছে কোন সম্পদ থাকলে তোমাকে পুরস্কৃত করতাম । কিন্তু তোমার পুরস্কার হিসেবে ঐ দোয়াটি করব যা রাসূল (সা.) হাস্সান ইবনে ছাবিত সম্পর্কে করেছেন । আর দোয়াটি হলো : আমাদের আহলে বাইতের পক্ষ সমর্থন ও তাদের প্রতিরক্ষা করার জন্য যখনই পদক্ষেপ নেবে তখনই রুহুল কুদ্সের (পবিত্র আত্মার) সমর্থন ও সহায়তা লাভ করবে । ৩৩৬

৪. ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শোক প্রকাশ : ইমাম মূসা কাযিম (আ.) বলেন : যখনই পবিত্র মুহররম মাস আসত ,আমার পিতা ইমাম বাকির (আ.) আর হাসতেন না ;বরং দুঃখ ও শোক তাঁর চেহারাতে স্পষ্ট হয়ে উঠত । তাঁর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত । এভাবেই আশুরার দিন উপনীত হতো ,এই মুসিবতের দিনে ইমামের দুঃখ ও শোক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছত । তিনি বিরামহীনভাবে ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন : আজকে এমন একটি দিন যে দিন আমার দাদা হোসাইন ইবনে আলী শাহাদাত বরণ করেছেন ৩৩৭

৫. ইমাম মূসা কাযিম (আ.)-এর শোক প্রকাশ : ইমাম রেযা (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে ,তিনি বলেছেন : যখন পবিত্র মুহররম মাস আসত তখন আমার পিতা মূসা কাযিম (আ.)-কে কেউ হাসতে দেখত না ;এভাবে চলতে থাকত আশুরার দিন পর্যন্ত ;এ দিনে দুঃখণ্ডশোক ,মর্মপীড়া-মুসিবত আমার পিতাকে ঘিরে ধরত ;তিনি ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন : এ দিনে হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করা হয়েছে । ৩৩৮

৬. ইমাম রেযা (আ.)-এর শোক প্রকাশ : ইমাম রেযা (আ.)-এর ক্রন্দন এত বেশি পরিমাণ ছিল যে ,তিনি বলতেন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুসিবতের দিন আমাদের চোখের পাতাকে আহত করেছে ,আমাদের অশ্রুধারা প্রবাহিত করেছে । ৩৩৯

বিশিষ্ট শিয়া কবি দেবেল খুজায়ী ইমাম রেযার নিকট আসলেন । ইমাম রেযা ইমাম হোসাইনের জন্য ক্রন্দন ও শোকের কবিতার গুরুত্ব তুলে ধরে বললেন : হে দেবেল! যে ব্যক্তি আমার দাদার মুসিবতে ক্রন্দন করে আল্লাহ তা আলা তার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেন । অতঃপর তাঁর পরিবার ও উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে পর্দা টেনে দিলেন যাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুসিবতে তাঁরা ক্রন্দন করতে পারেন ।

অতঃপর ইমাম রেযা (আ.) দেবেল খুজায়ীকে বললেন : যতদিন জীবিত থাকবে ইমাম হোসাইনের জন্য শোকগাথা পাঠ কর । যতক্ষণ তোমার শারীরিক শক্তি থাকবে ততক্ষণ আমাদেরকে সহযোগিতা করতে কার্পণ্য কর না । এ কথা শুনে দেবেল খুজায়ী ক্রন্দনরত অবস্থায় একটি কবিতাটি পাঠ করেছিলেন যার বিষয়টি ছিল এমন:

হে ফাতিমা! যদি হোসাইনকে কারবালার যমিনে পড়ে থাকতে দেখতেন ;যিনি ফুরাত নদীর তীরে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন । তখন অত্যধিক দুঃখ ও কষ্টের কারণে নিজের হাত দিয়ে মুখ চাপড়াতেন এবং আপনার গাল দিয়ে চোখের পানি প্রবাহিত হতো ।

এ কবিতা শুনে ইমাম রেযা (আ.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন শুরু করলেন ।৩৪০

৭. ইমাম মাহদী (আ.)-এর শোক প্রকাশ : রেওয়ায়াত অনুসারে ইমাম মাহদী (আ.) (আল্লাহ তাঁর আগমনকে ত্বরান্বিত করুন) আত্মগোপনকালীন এবং আত্মপ্রকাশের পর উভয় অবস্থায় তাঁর দাদার শাহাদাতের জন্য ক্রন্দন করছেন এবং করবেন । তিনি তাঁর সম্মানিত পিতামহ শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন :

فلئن اخرتنی الدهور و عاقنی عن نصرك المقدور ولم اکن لمن حاربك محارباً و لمن نصب لك العداوة مناصبا فلاندبنك صباحاً و مساء ولابکین لك بدل الدموع دما، حسرة علیك و تأسفاً علی ما دهاك

যদিও সময় আমাকে পশ্চাদ্বর্তী করেছে এবং আপনাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভাগ্য আমাকে দূরে রেখেছে যে কারণে আপনার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করতে পারি নি ,কিন্তু এখন প্রত্যেক সকাল-সন্ধ্যা আপনার জন্য ক্রন্দন করি এবং আপনার মুসিবতে আমার দু চোখ থেকে অশ্রুপাতের বদলে রক্ত বর্ষিত হয় । আপনার ওপর ঘটে যাওয়া মুসিবত আমার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করেছে । ৩৪১

৩৫ নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান সাফাভীদের সময় থেকে চালু হয়েছিল কি ?

উত্তর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান তাঁর শাহাদাতের সময় থেকে চালু হয়েছিল ,তবে আলে-বুইয়া বংশ ক্ষমতায় আসার (৩৫২ হিজরি) পূর্ব পর্যন্ত এই শোকানুষ্ঠান গোপনে অনুষ্ঠিত হতো ।৩৪২ চতুর্থ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান প্রকাশ্য ছিল না ;বরং গৃহসমূহে গোপনে পালিত হতো । কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শোকানুষ্ঠান অলিতে-গলিতে সর্বত্র প্রকাশ্যে পালিত হতো । সাধারণতভাবে মুসলিম ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে যাঁরা সারা বছরের বিভিন্ন ঘটনাকে ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁরা ৩৫২ হিজরি ও তার পরবর্তী বছরগুলোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আশুরার দিনে শিয়াদের শোকানুষ্ঠান পালন সম্পর্কে লিখেছেন । এদের মধ্যে ইবনে জাওযির মুনতাজেম ,ইবনে আসিরের কামিল ,ইবনে কাসিরের আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ,ইয়াফেয়ীর মিরআতুল জিনান গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য ,এছাড়াও যাহাবী ও আরো অনেকে এ সম্পর্কে লিখেছেন ।

ইবনে জাওযি বর্ণনা করেছেন : ৩৫২ হিজরিতে মুইয্যুদ্দৌলা দায়লামী জনগণকে আশুরার দিনে একত্র হয়ে শোক প্রকাশের নির্দেশ দেন । এ দিনে বাজারগুলো বন্ধ থাকত ,কেনা-বেচা হতো না ;কসাইরা ভেড়া ,দুম্বা জবাই করত না ,হালিম রান্না করত না । জনসাধারণ পানি পান করত না ,বাজারগুলোতে তাঁবু টাঙ্গানো হতো ও শোক প্রকাশের নিয়ম অনুসারে তাঁবুগুলোতে চট ঝুলানো হতো ,নারীরা তাদের মাথা ও মুখ চাপড়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ করতেন ।৩৪৩

হামাদানীর বর্ণনা অনুসারে : এদিনে নারীরা অগোছালো চুলে শোক প্রকাশের প্রথা অনুযায়ী নিজেদের চেহারাকে কালো করত ও গলিতে পথ চলত এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে নিজেদের চেহারায় আঘাত করত ।৩৪৪

শাফেয়ীর বর্ণনা অনুসারে : প্রথম বারের মতো কারবালার শহীদদের জন্য প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের ঘটনা ছিল এটা ।৩৪৫ ইবনে কাসির ৩৫২ হিজরির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে ,সুন্নিরা শিয়াদের এ কাজে বাধা দিত না । কেননা ,শিয়ারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল এবং সরকারও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করত ।

৩৫২ হিজরি থেকে পঞ্চম হিজরি শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত আলে বুইয়া শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল । এ সময়ে বেশির ভাগ বছরগুলোতে উল্লিখিত রীতি অনুসারে সামান্য পরিসরে হলেও শোকানুষ্ঠান পালন করা হতো । যদি আশুরার দিন ও ইরানী নববর্ষ বা ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসীদের শরৎকালীন ফসলী নববর্ষের প্রাচীন উৎসব একই সময়ে পড়ত ,সেক্ষেত্রে আশুরার সম্মানে প্রাচীন নববর্ষের আনন্দ উৎসবকে দেরিতে উদ্যাপন করত ।৩৪৬

এই বছরগুলোতে ফাতিমী ও ইসমাইলী সম্প্রদায় সবেমাত্র মিশরে ক্ষমতা দখল করে কায়রো শহরকে নির্মাণ করেছিল এবং তারাই আশুরার শোকানুষ্ঠানকে মিশরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল । মাকরিজীর লিখিত দলিল অনুসারে : ৩৬৩ হিজরির আশুরার দিনে শিয়াদের একটি দল প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ইমাম হাসান (আ.)-এর এর দুই কন্যাসন্তান সাইয়্যেদা কুলছুম ও সাইয়্যেদা নাফিছার দাফনস্থলে যেতেন এবং এই দু টি পবিত্র স্থানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকগাথা পাঠ ও ক্রন্দন করতেন (এই বাক্য থেকে স্পষ্ট হয় যে ,উল্লিখিত অনুষ্ঠান এর পূর্বের বছরগুলোতেও যথারীতি প্রচলিত ছিল) । ফাতিমীদের শাসনকালে আশুরার অনুষ্ঠান যথারীতি প্রতি বছর পালিত হতো । এ কারণে বাজারগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হতো ;জনসাধারণ সমবেত হয়ে কারবালার শোকাবহ কথা স্মরণ করে শোকগাথা পাঠরত অবস্থায় কায়রোর জামে মসজিদে যেত ।৩৪৭

এর পরে মিশরে শিয়াদের বিচ্ছিন্নতা ও সমাজের সাথে সংশ্রবহীনতার কারণে শোকানুষ্ঠান অতটা প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হতো না । যদিও শোকানুষ্ঠান আলে বুইয়ার শাসকদের পূর্বের অবস্থার চেয়ে উত্তম ছিল । কিছু সূত্র থেকে প্রমাণিত হয় ইরানের সাফাভী শাসনের প্রতিষ্ঠার পূর্বেও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালন করা হতো ।৩৩৮ বিশেষ ভাবে কাশেফীর গ্রন্থ রওজাতুশ শুহাদা র বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় । ইরানের সাফাভীদের আমলে শিয়া মাযহাবের প্রসারের কারণে শোকানুষ্ঠান সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও প্রকাশ লাভ করে ।

শিকল মারা ও বুক চাপড়ানো এবং তাজিয়ার উৎপত্তি

৩৬ নং প্রশ্ন : শিকল মারা ও বুক চাপড়ানো৩৪৯ এবং তাজিয়া কোন্ জাতি এবং কোন্ সংস্কৃতি থেকে উৎপত্তি ঘটেছে ?

উত্তর : শিকল মারার সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তান থেকে ইরানে এসেছে । সেখানে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এমনভাবে শিকল দিয়ে নিজেকে আঘাত করে শোক প্রকাশ করে যে ,তাদের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি ও রক্ত বের হয় । এ কারণে কিছুসংখ্যক আলেম এ বিষয়টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন । যদি এ বিষয়টি এমনভাবে পালন করা হয় যেখানে শরীরে কোন ক্ষত সৃষ্টি হবে না ও বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে তা অপছন্দনীয় নয় অথবা তা আশুরার শিক্ষার অবমাননার কারণ না হয় তাহলে এ ধরনের শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই । যেহেতু ইরানের জনগণ বিশেষভাবে শিকল মারার ক্ষেত্রে শোক প্রকাশের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা রক্ষা করে চলে সেহেতু এ ধরনের শোক প্রকাশ প্রচলিত রয়েছে ।৩৫০

বুক চাপড়ানো শোক প্রকাশের একটি প্রথা হিসেবে পূর্ব থেকে আরবদের মাঝে প্রচলিত ছিল এবং পরে এই বিষয়টি সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে । গুরুগম্ভীর শোক-গাথা পাঠের সাথে বিশেষ ছন্দে বুক চাপড়িয়ে শোকপ্রকাশ প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে প্রচলিত ছিল ,কিন্তু পরে যখন সাফাভীদের সময় প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের প্রসার ঘটেছিল তখন শোকানুষ্ঠান ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিক ও সামাজিক রূপ লাভ করেছিল ।৩৫১

তাজিয়া (تعزیه )-পারিভাষিক অর্থে আশুরার হৃদয়বিদারক ঘটনাকে অভিনয়ের মাধ্যমে চিত্রায়ন করাকে বোঝায় । প্রথম করিম খাঁন যান্দ এবং সাফাভীদের শাসনকালে বাহ্যত ইরানে এ ধরনের শোক প্রকাশের প্রচলন ঘটে এবং তা নাসির উদ্দিন শাহের সময় ব্যাপক প্রসার লাভ করে । ইউরোপ সফরে গিয়ে নাসির উদ্দিন শাহ থিয়েটার বা মঞ্চ নাটক দেখেছিলেন । তিনিই পরবর্তীকালে অন্যদেরকে আশুরার ঘটনাকে বাস্তব রূপ দানের উদ্দেশ্যে নাট্যরূপে উপস্থাপনে উৎসাহিত করেছিলেন । স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,তাজিয়া (অভিনয়ের মাধ্যমে কারবালার ঘটনাকে চিত্রায়িত করা) শুধু ইরানের সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত ছিল না ,অন্যান্য মুসলিম দেশ ও শিয়া অঞ্চলেও এ সংস্কৃতির প্রচলন ছিল । বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস ও বিভিন্ন উপকরণ ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা করা হতো । বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে এ ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ছিল ।

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক প্রকাশের উপকরণ হিসেবে এক বা কয়েক ব্যক্তি কর্তৃক ভারী লৌহদণ্ডের ওপর লৌহ নির্মিত ময়ূর বহনের আচারটি বিভিন্ন আশুরা উদ্যাপন কমিটি পালন করে থাকে । এ ধরনের উপকরণ কাজার বংশের শাসনামলে ইরান ও ইউরোপের সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার পর খ্রিস্টানদের ধর্মীয় আচার থেকে গ্রহণ করা হয়েছে । এ উপকরণে এমন কিছু বিষয়ের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোক প্রকাশকারীকে শোক প্রকাশের মূল লক্ষ্য ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের মর্ম থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ।৩৫২

৩৭ নং প্রশ্ন : ইসলামের শুরুতে শোক প্রকাশের যে পদ্ধতিগুলোর প্রচলন ছিল না সেগুলোকে ইসলামে প্রচলন করা এক ধরনের বেদআত সমতুল্য নয় কি ?

উত্তর : প্রথমত ,স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের ধরন স্বয়ং শোক প্রকাশ করা থেকে ভিন্ন এক বিষয় । প্রকৃতপক্ষে শোক প্রকাশের বিষয়টি ভিন্নভাবে ও পদ্ধতিতে প্রকাশ লাভ করতে পারে । তাই শোক প্রকাশের পদ্ধতি এক্ষেত্রে একটি উপকরণ বা মাধ্যম ছাড়া অন্য কিছু নয় ।

দ্বিতীয়ত ,শোক প্রকাশের উপকরণ বা মাধ্যম ও পদ্ধতি অবশ্যই শোক প্রকাশের মূল লক্ষ্য ও এর বার্তার সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে অর্থাৎ তার প্রকাশ এমনভাবে হতে হবে যে ,সাবলীল ,কার্যকর ও উত্তম রূপে আশুরার বার্তাকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে পারে । অন্যভাবে বলা যায় যে ,যদি আশুরার শিক্ষাকে একজন ব্যক্তির গায়ের জামার সাথে তুলনা করা হয় তাহলে এমন একটি জামা হতে হবে যা কোন ব্যক্তির গায়ের সাথে মানানসই হয়-যেন ছোট বা বড় না হয় । যদি ছোট হয় তাহলে সমস্ত শরীরকে ঢেকে রাখবে না অর্থাৎ আশুরার সকল বার্তাকে পৌঁছাবে না । আর যদি জামাটি বড় হয় তাহলেও বার্তাগ্রহণকারীদের বিচ্যুত করবে ও বাস্তবতা অনুধাবন থেকে দূরে সরিয়ে দেবে ।

তৃতীয়ত ,আশুরার প্রকৃত বার্তা প্রচার ও প্রসারের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি ও সভ্যতার পছন্দনীয় উপকরণ৩৫৩ ও উপাদান থেকে উপকৃত হতে হবে ও এগুলো ব্যবহার করতে হবে । যেমন ভারতে ইসলাম ধর্মকে প্রচারের জন্য উর্দু ভাষাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কিংবা দর্শনশাস্ত্রকে গ্রীক সভ্যতা থেকে গ্রহণ করে ওহীর শিক্ষার প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে...

চতুর্থত ,ইসলাম ইসলামের মৌলিক বিষয়বস্তুর সাথে সংঘর্ষিক না হওয়া শর্তে সকল জাতির মধ্যে প্রচলিত রীতি ও প্রথাকে সম্মান দেখায় । এ ক্ষেত্রে কোন ধরনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করে না । উদাহরণস্বরূপ ,ইসলাম সকল জাতির ভাষা ,পোশাক-আশাক ,খাদ্যাভ্যাস ,বিজ্ঞান ,শিল্পকলা ইত্যাদিকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছে ,যদি না এর মৌলিক বিশ্বাস ও সারসত্তার পরিপন্থী হয় ।

ওপরে উল্লিখিত বিষয় অনুসারে ,ইসলামের দৃষ্টিতে আহলে বাইতের জন্য শোক প্রকাশ বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতিতে প্রচলিত থাকতে ও বাস্তবায়িত হতে পারে যতক্ষণ না তা আশুরার সত্যিকার বার্তাকে পৌঁছানোর পথে বাধা সৃষ্টি করে ;বরং তা ভালোমত শ্রোতার মন-মগজে পৌঁছাতে সাহায্য করে । এ কারণেই শোক প্রকাশের এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার-যেগুলো ইসলামের প্রাথমিক যুগে প্রচলিত ছিল না (যেমন শিকল মারা ,বুক চাপড়ানো ,তাজিয়া) সেগুলো বেদআত তো নয়ই বরং ইসলামের প্রচার-প্রসারে সাহায্যকারী হিসেবে গণ্য হবে ;এগুলো নিজের গণ্ডির মধ্যে আশুরার বাণীকে বর্তমান সময়ের মানুষের নিকট পৌঁছে দিয়েছে এবং তাদের অন্তরকে বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করেছে ।

আবারো গুরুত্ব আরোপ করছি যে ,এগুলো উপকরণ ছাড়া অন্য কিছুই নয় । অবশ্যই সবসময় এ বিষয়গুলোকে উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে সীমানা রক্ষা করে চলতে হবে । আল্লাহ না করুন ,কেউ যেন কোন বিষয়ের

উপকরণ বা মাধ্যমকে আসল বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দান না করে । উপকরণ ও মাধ্যম কেবল একটি ব্রিজের মতো যা দিয়ে আসল বিষয়ে পৌঁছানো সম্ভব এবং এগুলো কখনই প্রকৃত উদ্দেশ্য হতে পারে না । দুঃখের বিষয় যে ,এ ক্ষেত্রে অনেকে অজ্ঞতাবশত বাহ্যিক রূপ ও আচারকে অভ্যন্তরীণ সারসত্তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রকৃত বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে যায় ।

৩৮ নং প্রশ্ন : কেন অন্য ইমামদের জন্য শোক প্রকাশ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোক প্রকাশের মতো নয় ?

উত্তর : এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে আশুরার ঘটনার পরিমাণ ও গুণগত বিস্তৃতির (গভীর প্রভাবের) কারণে ঘটেছে । একদিকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সময় মুসলমান ও ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরাজমান বিশেষ অবস্থা ,তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অবস্থা ও তাদের অত্যধিক যুলুম এবং সার্বিকভাবে মানবতা ও স্বাধীনতা হরণ ও ইসলাম সংকটাপন্ন হওয়া ,মুসলিম উম্মাহর অবমাননা ,সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতা ,শিয়াদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি ,সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের শিক্ষাকে ভুলে যাওয়া ,ধর্মে বেদআতের প্রবেশ ও প্রচার করা ,মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী ঐক্য বিনষ্ট করা ,ইসলামী ও মানবীয় মূল্যবোধ থেকে দূরে সরে যাওয়া ইত্যাদি কারণ (যা ইসলামের লক্ষ্য ও গতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে দিয়েছিল । তাই এ অবস্থাকে পূর্বের পথে ফিরিয়ে আনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল) ,অপর দিকে কারবালায় আবু আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর মাযলুমিয়াত (অন্যায় ও নিপীড়নের শিকার হওয়া) ও একাকিত্ব ,ইমামের সাথে বন্ধু বেশধারী মুসলমানদের আচরণ ,যুদ্ধের ধরন (অসম যুদ্ধ ও সীমাহীন অনাচার ও চরম নৃশংসতার পরিচয় দান) ,ইমাম ও তাঁর পরিবার এবং অনুসারীদের সাথে শারীরিকভাবে অবমাননাকর আচরণ এবং সেসাথে কারবালার ঘটনায় বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মধ্যে বিদ্যমান সামাজিক ,রাজনৈতিক ,সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণমূলক যে অফুরন্ত শিক্ষা রয়েছে সে দিক থেকে এ শোক প্রকাশ স্বাতন্ত্র্য ও ভিন্নতার দাবি রাখে ।৩৫৪

এই ঘটনার বিশেষ ধরন ও ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন জটিলতা উন্মোচনকারী ভূমিকা ও গভীর তাৎপর্যের কারণে গবেষকদের অনেক প্রশ্নের উদ্রেক ও সমাধান দান করেছে । ফলে এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে ।

হযরত রাসূল (সা.) ,ইমাম আলী (আ.) ,হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) ,ইমাম হাসান (আ.) ও অন্য ইমামগণ (আ.) ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত ও কারবালার ঘটনার অনুপম ও অতুলনীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে একে শোকানুষ্ঠানের ছাঁচে উজ্জীবিত রাখার ওপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।৩৫৫

আশুরার ঘটনার ভিন্ন দিক একে ঐতিহাসিক নজিরবিহীন ঘটনায় পরিণত করেছে । একারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন :

لا یوم کیومك یا ابا عبد الله

হে আবা আবদিল্লাহ (হে হোসাইন)! আপনার (শোকের) দিনের মতো কোন (দুঃখজনক) দিন নেই । ৩৫৬

এ বিষয়টি স্পষ্ট যে ,কোন ঘটনার প্রভাবের ব্যাপকতা ও গভীরতার ওপর ঐ ঘটনার সম্মান-মর্যাদা ও স্থায়িত্ব নির্ভর করে । এ দিক থেকে আশুরার ঘটনাটি এমন একটি ঘটনা যা পরিমাণ ,ব্যাপকতা ও গুণগত দিক থেকে অন্য কোন ঘটনার সাথে তুলনীয় নয় । তাই এর স্মরণও অনন্য ও অসাধারণভাবে হয়ে থাকে ।

ثار الله এর অর্থ

প্রশ্ন নং 58 :ثار الله শব্দের অর্থ কী ? ইমাম হোসাইন (আ.)-কে এ নামে অভিহিত করার সপক্ষে কোরআন ও হাদীসের কোন দলিল আছে কি ?

উত্তর :ثار শব্দটিثأر অথবাثؤرة শব্দ মূল থেকে এসেছে । এর অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ ,রক্তের বদলা ,রক্তপণ ;রক্ত অর্থেও তা ব্যবহৃত হয় ।488

1ثارالله শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যার প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে ,যেগুলোর সামগ্রিক অর্থ হলো যে ,আল্লাহ্ তা আলা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তের অভিভাবক এবং তিনি নিজেই শত্রুদের থেকে এই মহান ব্যক্তির রক্তের বদলা নিতে চান । কেননা ,কারবালায় সাইয়্যেদুশ শুহাদার রক্ত ঝরানো মহান আল্লাহর নিষিদ্ধের সীমা লঙ্ঘন ,তাঁর সম্মান বিনষ্ট করা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল । সর্বোপরি আহলে বাইত (আ.) হচ্ছেন আলুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত ও বিশেষজন ;এই ইমামদের রক্ত ঝরানোর অর্থ আল্লাহ তা আলার কাছে সম্মানিত ও তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিদের রক্ত ঝরানো ।489

যদিও এ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়নি ,কিন্তু কোরআনের আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে ,আল্লাহ্ বলেছেন

) وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا(

অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় নিশ্চয় আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি । (সূরা বনি ইসরাঈল : 33)

যদি কেউ (যে কোন ধর্মের অনুসারী হোক) অন্যায় ও মযলুমভাবে নিহত হয় তাহলে তার অভিভাবকরা তার রক্তপণ আদায়ের অধিকার রাখে । যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণ বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.) সত্য ,ন্যায় এবং আল্লাহর পথে অসহায় ও মযলুমভাবে শহীদ হয়েছেন ,সেহেতু আল্লাহ নিজেই তাঁর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী । কেননা ,স্বয়ং আল্লাহ্ই ইমাম হোসাইনের রক্তের উত্তরাধিকারী ।

এই কারণেثأرالله এই অর্থে ব্যবহৃত হয় যে ,ইমাম হোসাইনের রক্ত আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং তিনি নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন । এই শব্দটা আল্লাহর সাথে সাইয়্যেদুশ শুহাদার সুদৃঢ় বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করে যে ,তাঁকে হত্যার মাধ্যমে যেন আল্লাহ তা আলার সাথে সম্পৃক্ত ও তাঁর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত এক ব্যক্তির রক্ত ঝরানো হয়েছে । ফলে তাঁর রক্তের প্রতিশোধ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গ্রহণ করলে হবে না ।490

2. যদিثار শব্দটির অর্থ রক্ত হয় ,তাহলে অবশ্যইثار الله শব্দটি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি ;বরং তা উপমা হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । কেননা ,এ বিষয়টি সুনিশ্চিত যে ,আল্লাহ কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নন যে ,তাঁর শরীর অথবা রক্ত থাকবে । অতএব ,এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপমা দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে বুঝানো হয়েছে ,যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের ভূমিকা অর্থাৎ জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা । আল্লাহর দ্বীনের সাথে ইমাম হোসাইনের সম্পর্কও ঠিক সেরকম । আশুরা বিপ্লবই ইসলামকে পুনরায় জীবনদান করেছে ।

3. সম্ভবত এই ব্যাপারটিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা বিভিন্ন রেওয়ায়াতের দলিলের ভিত্তিতে একটি ভালো ফলাফলে পৌঁছতে পারি । আলী (আ.)-কেও আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) বা ইয়াদুল্লাহ (আল্লাহর হাত) বলা হয়েছে । হাদীসে কুরবে নাওয়াফেল (নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ সংক্রান্ত হাদীস)-এ মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,আল্লাহ্ তা আলা বলেছেন : আমার বান্দা ওয়াজিবসমূহের থেকে অধিক পছন্দনীয় কিছু দ্বারা আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না ,তদ্রূপ নফল দ্বারাও আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে । তখন আমিও তাকে ভালোবাসি আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং আমি তার চোখ হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে দেখে ,আমি তার জিহ্বা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে কথা বলে ,আমি তার হাত হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে ধরে ,আমি তার পা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে পথ চলে ;যদি সে আমার দরবারে দোয়া করে আমি তা পছন্দ করি এবং যদি আমার কাছে কিছু চায় তবে তাকে তা দান করি । 491

এই রেওয়ায়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে ,আল্লাহর ওলীরা হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর স্পষ্ট দলিল হিসেবে তাঁর কর্মের প্রকাশকারী । যেহেতু আল্লাহ নিরাকার সেহেতু তাঁর দেহ নেই ,কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন । তাঁর ওলীদের মাধ্যমেই নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটান এবং যখন তাঁর কোন বান্দাকে সাহায্য করতে চান তখন তাঁদের মাধ্যমেই তা করেন এবং ধর্মকে বাঁচানোর জন্য যে রক্ত তিনি ঝরাতে চান তা তাঁর ওলীদের শাহাদাতের মাধ্যমেই ঝরান । ঠিক যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় তাঁর হাতকে সবার হাতের ওপর আল্লাহর কুদরাতী হাতের (ইয়াদুল্লাহ) নমুনাস্বরূপ রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তখন এ আয়াতيَدُ اللَّـهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ অবতীর্ণ করেন ,তেমনি ইমাম হোসাইনের রক্তও আল্লাহর রক্ত (ثارالله ) হিসেবে গণ্য হয়েছে । যিয়ারতে আশুরায় আমরা পড়ি :

السلام علیك یا ثار الله و ابن ثاره و الوتر الموتور

অর্থাৎ হে আল্লাহর রক্ত ,তাঁর রক্তের সন্তান ,তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক । তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে নিঃসঙ্গ একাকী! তেমনিভাবে মরহুম ইবনে কুলাভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর 17 এবং 23 নং যিয়ারতে এভাবে বর্ণনা করেছেন :

انک ثارالله فی الارض والدم الذی لا یدرک ترته احد من اهل الارض ولا یدرکه الا الله وحده

যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের জীবনসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে এবং রক্ত থাকা বা না থাকার ওপর তার জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে ,ইমাম আলী ও ইমাম হোসাইনের উপস্থিতি আল্লাহর নিকট তাঁর ধর্মের জন্য তেমন ভূমিকা রাখে । যদি হযরত আলী (আ.) না থাকতেন তাহলে বদর ,উহুদ ,খায়বার ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হতো এবং ইসলাম টিকে থাকত না ;আর যদি ইমাম হোসাইন (আ.) না থাকতেন তাহলে ইসলামের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । কেননা ,আল্লাহ তাঁর মনোনীত বান্দাদের-যখন তাঁরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গী ভূমিকা রাখেন-প্রতি তাঁর ঐশী সাহায্য প্রেরণ করার মাধ্যমেই সকল যুগে তাঁর ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন ।

হ্যাঁ ,যতদিন ইমাম হোসাইনের স্মৃতি জগরুক থাকবে ,তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে ,হোসাইনপ্রীতি মানুষের অন্তরে অন্তরে স্পন্দিত হবে ,তাঁর বেলায়াত ও প্রেমের শিখা মানুষের হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবে , ইয়া হোসাইন আহাজারি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে ততদিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর নাম টিকে থাকবে । কেননা ,তিনি তাঁর সর্বস্ব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন ,উৎসর্গ করেছেন । সত্যকে বিচ্যুতকারী মুনাফিকদের কুৎসিত চেহারা থেকে মুখোশ খুলে দিয়েছেন এবং মহানবীর খাঁটি ও প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন । আর তাই তাঁর রক্ত আল্লাহর রক্তের মর্যাদা পেয়েছে ।

আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ক্রন্দনের ভূমিকা

প্রশ্ন নং 59 : এরফান ও অধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম হোসাইনের জন্য শোক প্রকাশ ও ক্রন্দন-আহাজারিকে কিভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণের (আল্লাহর দিকে যাত্রা) সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে ?

উত্তর : মনের দহন এবং ক্রন্দন : একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে ঐকান্তিকতার সাথে ক্রন্দন ও অন্তর্জ্বালা প্রকাশ অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ এবং তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এরূপ অনুভূতি সৃষ্টিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করেন এবং সবসময় তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন । যদি তিনি প্রকৃতই সেটা অর্জনে ব্যর্থ হন অর্থাৎ শোকে মুহ্যমান হয়ে অশ্রু না ঝরাতে পারেন ,তবে অন্ততপক্ষে ঐকান্তিকতার সাথে কান্নার ভাব অর্জনের জন্য একাগ্রচিত্ত হন ।

সর্বোপরি ইবাদতের পথপরিক্রমায় ইস্তিগ্ফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) সময়ই হোক অথবা যে কোন অবস্থায় ,ক্রন্দন ও দগ্ধ হৃদয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে । কখনই এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় এবং এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় । হৃদয়ের দহন এবং ক্রন্দন ভালোবাসার কারণে হোক অথবা ভয়ে ,ইস্তিগফারের অবস্থায় হোক অথবা কোরআন পড়া অথবা শোনার সময় ,সিজদায় অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক ,অবশ্যই তা গভীর অনুধাবন ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপত্তি লাভ করে । যে উপলব্ধি করতে পারে সেই দগ্ধ হয় ও অশ্রু ঝরায় আর যে উপলব্ধি করতে পারে না সে দগ্ধও হয় না এবং অশ্রুও ঝরায় না ।

সূরা বনি ইসরাঈলের 107-109 নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব ,এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ,যারা অনুধাবন করতে পারে তারা পবিত্র কোরআনের আয়াতের সামনে বিনয়ী ও নম্র হয় এবং ক্রন্দন করে :

) قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا (107) وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا (108) وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا(

(হে নবী) তুমি বল ,তোমরা একে (কোরআনকে) বিশ্বাস কর আর না-ই কর ,নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে (আসমানি কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে যখনই তাদের সামনে এটি পড়া হয় তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে । তখন তারা বলে : আমাদের প্রভু পূত-পবিত্র মহান ,অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ হবে । আর তারা ক্রন্দন করতে করতে নত মস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে ;(মূলত এ কোরআন) তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি করে ।

একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মিক সাধককে এই আয়াতগুলোর তাৎপর্য গভীরভাবে বোঝার উপদেশ দিচ্ছি ;কারণ ,এটা আল্লাহর মহা সত্যবাণী ।

যে কোন সুগভীর জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত এবং শোনার সাথে সাথে এর সত্যতা ও যথার্থতা বুঝতে পারবে ও অন্তরে তা বিশ্বাস করবে । প্রভুর অঙ্গীকারসমূহকে সুনিশ্চিতভাবে দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে । ফলশ্রুতিতে তার বিনয় ,নম্রতা ও ঈমান অনেক গুণে বৃদ্ধি পাবে । ঐশী উৎসাহ ,উদ্দীপনা ,আকুলতা এবং আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা তার সমগ্র অস্তিত্বকে ছেয়ে ফেলবে । তখন তার চেষ্টা ও সাধনা আরো গতিশীল ও পূর্ণতা লাভ করবে । দারিদ্র ও দুনিয়াবিমুখতার পথ বেছে নেবে ,আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে ও দগ্ধ হৃদয়ে অশ্রু ঝরাবে । তার অন্তরের দহন ও নয়নের অশ্রু যেন আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের আশায় রয়েছে ।

যে মহাসত্য ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারেনি সে যে নিজের জাহান্নাম নিজেই তৈরি করেছে-এবং তার মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে-তা অনুভব করতে পারেনি । সে তার অন্তরের ওপর যে পর্দা পড়েছে এবং যা পড়ার কারণে সে বিভিন্ন রূপ বিপদে পতিত হচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি ।

বলে রাখা দরকার যে ,উল্লিখিত আয়াতে যে জ্ঞান এবং সূক্ষ্ণ দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে-এবং ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ক্রন্দনকারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে-তা শাস্ত্রীয় বা তাত্ত্বিক জ্ঞান নয় ;বরং অন্য এক জ্ঞান ও দর্শন । তা না হলে কত বিদ্বান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানী আছেন যাঁরা শাস্ত্রীয় এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ,কিন্তু তাঁদের মধ্যে এই বিশেষত্ব নেই ।

সর্বাবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়ের জ্বালা প্রকাশ এবং ক্রন্দন করা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী এবং আল্লাহর জ্ঞানে ধন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদের বিশেষত্ব । পবিত্র কোরআন এটাকে নবিগণের-যাঁরা সকল আধ্যাত্মিক সাধক এবং ঐশী জ্ঞানের অধিকারীর শিক্ষক-বিভিন্ন গুণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে । সূরা মারইয়ামে আল্লাহর মনোনীত কিছুসংখ্যক বান্দা ও নবীকে তাঁদের বৈশিষ্ট্যসহকারে স্মরণ করা হয়েছে । তাঁদের ব্যাপারে বলা হয়েছে :

) أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا(

এরা হচ্ছে আদমের বংশধর সেসব নবী যাদের প্রতি আল্লাহ তা আলা অনুগ্রহ করেছেন এবং যাদের তিনি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছেন এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর ,যাদেরকে আমি পথপ্রদর্শন করেছি এবং মনোনীত করেছি ,যখনই তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহ তা আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তখন এরা ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়ত । (সূরা মারইয়াম : 58)

) إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(

অর্থাৎ যখন তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহর তা আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় আল্লাহকে সিজদা করার জন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ত ।

এই অংশটি (আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াতের সময়) তাঁদের বিনয় ও নম্রতার সাথে সিজদা করা এবং ক্রন্দনের সংবাদ দেয় । তাঁদের এই কান্না আল্লাহর ভালোবাসায় হোক আর তাঁর ভয়েই হোক ।

এই আয়াতে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে রহস্যময় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত । আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহর নির্বাচিত একদল নবীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ব্যাপারে বলা হয়েছে । আল্লাহ বলেছেন ,এরাই হলো তাঁরা যাঁদের সম্পর্কে পূর্বে (এ সূরায় উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে) বলা হয়েছে । এরাই তাঁরা আল্লাহ যাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন-

أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ অতঃপর আয়াতের শেষে

) إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(

এই বাক্যটি দ্বারা তাঁদের বিনয়ের সাথে মাথা নত করে অশ্রু ঝরানোকে আল্লাহর অনুগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এটি এ সূক্ষ্ম ও গূঢ় রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে যে ,মহান আল্লাহ যাঁকেই বিনয় ও নম্রতার সাথে তাঁর সামনে মাথা নত করা এবং মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেন তা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ ,রহমত ও ফযিলত ।

হে ভাই! মনের হাসি ,দুঃখ ও কান্নার

প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা উৎসমূল ,

জেনে রাখ তায়

এও জেনে রাখ ,রয়েছে প্রতিটির স্বতন্ত্র ভাণ্ডার ও চাবি

রয়েছে যা এক মহা উন্মোচকের হাতের মুঠোয়492

হাফেজ বলেন :

ভোর রাতের এত বেদনা ও ক্রন্দন

সবই জানি তোমার থেকে হে পরমজন!

কোরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে-

) وَمَن يُؤْمِن بِاللَّـهِ يَهْدِ قَلْبَهُ(

যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে পথ দেখিয়ে দেন ।

রাসূল (সা.)ও বলেছেন493 :

قلب المؤمن بین اصبعین من اصابع الرحمن

মুমিনের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে অবস্থান করছে ।

ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন494 :

ان القلوب بین اصبعین من اصابع الله,یقلبها كیف یشاء,ساعة كذا,وساعة كذا

নিশ্চয় অন্তরসমূহ আল্লাহর আঙ্গুলগুলোর দু টির মাঝে রয়েছে ;তিনি যেমনভাবে চান তা পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।

এই দুই রেওয়ায়াত থেকে প্রত্যেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী এ বিষয়টি বুঝতে পারে ।

প্রথম রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,ঐ ব্যক্তির অন্তর প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তা তাঁর রহমান নামের পূর্ণ অধীনে রয়েছে এবং এই নামের কিরণ ও তাজাল্লীর ছায়ায় প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত হয়ে থাকে । অর্থাৎ ঈমান আনয়নকারীদের অন্তরসমূহ তাদের যোগ্যতা এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর রহমান নামের বিভিন্ন স্তরের প্রকাশের নিয়ন্ত্রণাধীন ।

দ্বিতীয় রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,অন্তরসমূহ-বিশ্বাসীদের অন্তর হোক বা যে কোন অন্তর- আল্লাহ নামের নিয়ন্ত্রণাধীন । আর এই পবিত্র ও বরকতময় নামের বিভিন্নরূপ প্রকাশ রয়েছে । তিনি তাঁর ইচ্ছামত প্রত্যেক হৃদয়কে এ নামের বিশেষ তাজাল্লি দ্বারা পরিচালিত করেন এবং ব্যক্তির প্রবণতা ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তার অবস্থার পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।

সালেক (আধ্যাত্মিক যাত্রী)-কে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে ক্রন্দন করাটাকে তার বন্দেগির পথে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে নিজের জন্য সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে হবে । বিশেষ করে এই মাকামে (মাকামে ইস্তিগফারে) যা কিছু মনের দহন দ্বারা অর্জিত হয় তার কদর তারা ভালোভাবেই জানে । যখনই এমন তাওফিক লাভ হয় তখন ইস্তিগফারের সাথে আকুতি মিনতি এবং অনুনয় প্রার্থনাকে অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে হাতছাড়া করে না । সে সতর্ক থাকে যে ,শত্রু যেন তাকে ধোঁকা দিতে না পারে এবং তার সম্মুখে যে রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে শয়তান সূক্ষ্ম চক্রান্ত দ্বারা সে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে । সুতরাং অনুনয়-বিনয় ,প্রার্থনা ও ইস্তিগফার কখনই বন্ধ করে না ,নিজের এ অবস্থাকে বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং অন্য সময়ে তা হবে এমন মনে করে অমনোযোগী হয় না । কারণ ,সে জানে যে ,এই সৌভাগ্য এত সহজে অর্জন করা যায় না এবং এই সুযোগ সবসময় আসে না । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :

اذا اقشعر جلدک و دمعت عیناک، فدونک دونک، فقد قصدقصدک

যখন তোমার দেহ আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং তোমার চোখ থেকে অশ্রু বর্ষিত হয় ,তখন জেনো ,তিনি তোমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন বলেই তুমি এমন অনুভূতির অধিকারী হয়েছ । 495

শোক ও কান্নার অন্য দিক : আরেফদের হৃদয়ের শোক এবং প্রেমাসক্ত ও ভীতদের কান্নার পর্দার একদিকে যেমন রয়েছে হৃদয়ের দগ্ধতা অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বস্তি ,আনন্দ ,উপভোগ এবং মর্যাদার অনুভূতি ।

এখন রাসূল (সা.) এবং ইমামদের বাণী থেকে এর অর্থ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব ।

দগ্ধ হৃদয় ,কান্না এবং মানসিক প্রশান্তি

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : কিয়ামতের দিন প্রতিটি চক্ষু থেকেই অশ্রু ঝরবে ,কিন্তু ঐসব চক্ষু ছাড়া যেসব চক্ষু আল্লাহর নিষেধসমূহকে পরিহার করে চলেছে এবং ঐ চক্ষু যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য জাগ্রত থেকেছে এবং ঐ চক্ষু যে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে । 496

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,পর্দার এ পাশে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী মুখটিই পর্দার ওপাশে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন প্রশান্ত এবং নিশ্চিন্ত রূপে প্রকাশিত হবে । কেননা ,কিয়ামতের দিন পর্দার অন্তরালের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ হওয়ার দিন ।497 ঐ দিন পর্দার আড়ালে থাকা সত্যই সামনে হাজির হবে ।

দুঃখ ,কান্না ও আনন্দ উপভোগ

রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ্ তা আলা শোকাহত ও ব্যথিত হৃদয়কে ভালোবাসেন ।498

আল্লাহর ভালোবাসার অর্থ বান্দাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা । যার ফলে হাদীসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে ,বান্দার হৃদয় যখন পর্দার এ পাশে শোক ও কান্নায় বিহ্বল তখন পর্দার অপর দিকে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।

আর এই আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ উপভোগ করা যায় । ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন : আল্লাহর নিকট রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনায় যে অশ্রুবিন্দু ঝরে তার চেয়ে অধিক প্রিয় কোন কিছু নেই । 499

এটা এই অর্থে যে ,বান্দা রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রু ঝরায় ও আকুতি প্রকাশ করে তা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় অর্থাৎ এ দুঃখ ও কান্নার আড়ালে তার হৃদয় তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং সে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের আনন্দ উপভোগ করছে । পর্দার আড়ালের ঐশী আকর্ষণই আধ্যাত্মিকতার পথিককে সর্বক্ষণ আকৃষ্ট করে রেখেছে এবং এই আকর্ষণই এই জগতে শোক-দুঃখ ও অশ্রুর আকৃতিতে প্রকাশিত হয় । একদিকে মনের দুঃখ ,পেরেশানি ও অশ্রু বিসর্জন অন্যদিকে মনের আনন্দ ,পবিত্র পানীয়ের স্বাদ আস্বাদন এবং তাঁর দর্শনের আনন্দ উপভোগ । যদি কারো এপার ওপার দু পারে কী ঘটছে দেখার সুযোগ থাকে অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছান ,তখন এপারে ও ওপারে উভয় জগতের আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পারবেন । তিনি এক ব্যক্তিকে একই সময়ে পরস্পর বিপরীত দুই অবস্থায় দেখতে পাবেন ।

এই দিকে (দুনিয়ায়) তাকে শোকাহত ,অশ্রু বিসর্জনকারী ও আবেদন-নিবেদনকারী রূপে দেখতে পাবে । অন্যদিকে (আখেরাতে) পবিত্র পানীয় পানের আনন্দ ,ঐশী দর্শনের স্বাদ আস্বাদনরত অবস্থায় দেখবে । এরূপ মর্যাদা আসলেই বিস্ময়কর যে ,দুঃখের মাঝে আনন্দ ,আনন্দের মাঝে দুঃখ ,কান্নার মাঝে হাসি এবং হাসির মাঝে কান্না ।

এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক যে ,আমরা ধারণা করি এ বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপ ,গভীর রহস্য এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি । কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনই এরূপ নয় । কারণ ,সত্যের রূপকে যে দেখবে তার অবস্থা ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের মতো হবে ,যাঁরা আশুরার রাতে ক্রন্দনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছেন । আর এজন্যই নিজেদের সমগ্র সত্তাকে তাঁর পথে এভাবে বিসর্জন দিতে পেরেছেন ।

শোককান্না এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ

ইমাম সাদিক (আ.) এক রেওয়ায়াতে আবি বাছিরকে দোয়া এবং কান্না সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন যেখানে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থা হচ্ছে সিজদায় ক্রন্দনরত অবস্থা । 500

এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,এ কর্মের বাহ্যিক দিক হলো ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়া ,কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ দিক হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আনন্দে আপ্লুত হওয়া ।

কারবালার আন্দোলন আবেগতাড়িত নাকি বিজ্ঞতাপূর্ণ পদক্ষেপ

প্রশ্ন নং 60 : অনেকে বলেন : আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাজগুলো নিতান্তই প্রেমপ্রসূত ছিল-বিজ্ঞতাপ্রসূত ছিল না । একথার অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে ,ইমামের কাজগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধী ?

উত্তর : মানুষের মধ্যে সবসময়ই ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্ব লেগে আছে ,সাধারণত তাকে জিহাদে আকবার (বড় জিহাদ) বলা হয়ে থাকে । অথচ এটা জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) ।

মানুষ যখন তার জ্ঞান ,বিবেক দিয়ে মনের কু-প্রবৃত্তি ও গুনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে তা হচ্ছে জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) । কেননা ,সে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে চায় । এর পরের পর্যায় হচ্ছে জিহাদে আকবার-যা হচ্ছে ভালোবাসা ও বিবেক ,প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা এবং বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ দর্শনের যুদ্ধ ।

এই পর্যায়ে যদিও সে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে কোন সত্যের তাৎপর্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রমাণসমূহের দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে একটি সমাধানে পৌঁছে ,কিন্তু তার অন্তর-যা প্রেম-ভালোবাসার কেন্দ্র তা কখনোই বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্যকে (অর্জিত জ্ঞানকে) যথেষ্ট মনে করে না ;বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবতাকে অনুভব করতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান কামনা করে । অর্থাৎ যা কিছু বুঝতে পেরেছে তা আত্মা দিয়ে অবলোকন করতে চায় ।

এই কারণে এর পর থেকেই প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং জিহাদে আকবার শুরু হয় । অবশ্য এতে কোন দোষ নেই । কেননা ,দু টিই সত্যের সন্ধান পেয়েছে ,কিন্তু একটি সত্যকে বুঝেছে অপরটি সত্যে পৌঁছেছে । প্রকৃত অর্থে একটি সত্য ,আরেকটি চূড়ান্ত সত্য । একটি ভালো আর অপরটি খুব ভালো । একটি পূর্ণতার নিম্নতর স্তর আরেকটি পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায় । এই কারণে আল্লাহর ওলী ও প্রেমিকদের কাজগুলো প্রেম-ভালোবাসার ভিত্তিতে হয়ে থাকে । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : সর্বোত্তম মানুষ তিনিই যিনি প্রেমের মাধ্যমে ইবাদত করেন । 501 সেই ব্যক্তিই ইবাদতের স্বাদ পায় এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকৃত রূপ দেখতে পায় ।

বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান মূলত দলিল-প্রমাণ দিয়ে দোযখ এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব প্রমাণ করে । কিন্তু প্রেম ও মন বলে যে ,আমি (এ পৃথিবীতেই) দোযখ ও বেহেশত্ দেখতে চাই । যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে কিয়ামত ,বেহেশত ,জান্নাত ইত্যাদিকে সত্য হিসেবে গণ্য করে সে হচ্ছে জ্ঞানী । কিন্তু যে ব্যক্তি বেহেশত ও দোজখ দেখতে চায় সে হচ্ছে প্রেমিক পুরুষ ।

সাইয়্যেদুশ শুহাদার (ইমাম হোসাইন) কাজগুলো প্রেমপূর্ণ ছিল ,আর সে প্রেম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে-জ্ঞানহীনতা নয় । এক সময় বলা হয়ে থাকে ,অমুক কাজ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । অর্থাৎ যে কাজ কেবল ধারণা এবং কল্পনার ভিত্তিতে হয়েছে । কিন্তু কখনো কখনো কাজ এমন হয়ে থাকে যে ,শুধু বিজ্ঞতাপূর্ণই নয় ;বরং তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রেমপূর্ণ । অর্থাৎ যা কিছু বুঝেছে নিজের মধ্যে তা পেয়েছে ও অর্জন করেছে ।

যখন মানুষ বাস্তবতার মর্মে পৌঁছে তখন সে প্রেমসুলভ আচরণ করে । তখন তার ক্ষেত্রে জ্ঞানের কোন ভূমিকাই নেই । এই ভূমিকা না থাকার অর্থ এই যে ,জ্ঞানের আলো তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র এক আলোক রশ্মির নিচে ঢাকা পড়েছে । এই কারণে নয় যে ,জ্ঞানের আলো নিভে গেছে এবং আলো নেই । দু টি অবস্থায় জ্ঞান অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং মানুষের কাজ-কর্ম জ্ঞান অনুযায়ী হয় না :

1. যখন মানুষ ক্রোধ এবং কুপ্রবৃত্তির বশে পাপ কাজে লিপ্ত হয় তখন তা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;বরং বোকামিপূর্ণ । এর উদাহরণ হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণের সম্মুখীন চাঁদের মতো যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । এই রূপ অবস্থায় জ্ঞানের আলো নেই । পাপীর জ্ঞান চন্দ্রগ্রহণ হওয়া চন্দ্রের মতো । হযরত আলী (আ.) এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন : এমন অনেক বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেক রয়েছে যা প্রবৃত্তির কর্তৃত্বের হাতে বন্দি (অর্থাৎ তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কুপ্রবৃত্তির নির্দেশের দাস হয়ে পড়েছে) ।

2. এক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো আছে ,কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই । এটা ঐ সময়ে যখন জ্ঞানের আলো তার চেয়ে শক্তিশালী আলোক রশ্মির নিচে থাকে । যেমন দিনের বেলায় তারার কোন কার্যকারিতা (কোন আলো) নেই । এই কার্যকারিতা না থাকা এই কারণে যে ,সূর্যের আলো আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে ,তার আলোক রশ্মির নিচে তারার আলো রঙ হারিয়ে ফেলেছে । তারার আলো না থাকা বা তা নিষ্প্রভ হওয়ার কারণে এমন হয়নি ;বরং সে সূর্যের বিপরীতে ম্রীয়মাণ হয়ে পড়েছে । যে প্রেমাসক্ত হয়েছে তার জ্ঞান আছে এবং আলোও আছে ,কিন্তু জ্ঞানের আলো প্রেমের আলোক রশ্মির নিচে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে ।

কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি এই রকমই ছিল অর্থাৎ তাঁর কাজ শুধু বুদ্ধিমানের মতোই ছিল না ;বরং তার চেয়েও উচ্চতর ছিল । কেননা ,তা প্রেমপূর্ণও ছিল ।

আশুরার সৌন্দর্য

প্রশ্ন নং 61 : কীভাবে আশুরার সৌন্দর্য এবং যায়নাব (আ.)-এর এই উক্তি ما رایت الا جمیلا - আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি -কে উপলব্ধি করা সম্ভব ?

উত্তর : কখনও কখনও মহত্ত্ব কোন বিষয়কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকে ,ঐ জিনিসে নয়-যাকে দেখা হয় । যেমন কেউ কেউ বলেছেন ,কখনও কখনও সৌন্দর্য থাকে মানুষের চোখে এবং দৃষ্টিতে ,ঐ বস্তুতে নয়-যাকে দেখা হয় । আল্লাহর সৃষ্ট এ জগৎ হলো সর্বোত্তম সৃষ্টিব্যবস্থা -যদি কেউ এই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল অস্তিত্বের দিকে তাকায় তবে অনেক অদৃশ্য বিষয়কে সে দেখতে পাবে এবং তাকে সুন্দরও দেখবে । এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে অস্তিত্ব বা ঘটনাটিকে দেখছি ।

সুন্দর দৃষ্টিতে অস্তিত্ব জগৎ ও জীবনকে দেখলে একদিকে আত্মা ও বিবেক প্রশান্তি লাভ করে অন্যদিকে তা মনে এমন অবিচলতা ,দৃঢ়তা এবং পৌরুষের সৃষ্টি করে যা অপ্রিয় জিনিসসমূহকে সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । এই দৃষ্টিতেই আশুরা হযরত যায়নাব কুবরা (সা.আ.)-এর কাছে সুন্দর ব্যতীত কিছুই ছিল না । যখন শত্রুরা এ ঘটনাকে আহলে বাইতের জন্য অবমাননাকর গণ্য করে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করছিল তখন বীরঙ্গনা নারী যায়নাবما رایت الا جمیلا (আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি) বলে তাদেরকে জবাব দিয়েছেন ।502

ইমাম হোসাইন (আ.) এই সফরের শুরুতেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ,যা কিছু ঘটবে আল্লাহর ইচ্ছায় তা যেন তাঁর এবং তাঁর সাথিদের জন্য মঙ্গলকর হয় । আর তা বিজয়ের দ্বারাই হোক আর শাহাদাতের মাধ্যমেই হোক ।

ارجو ان یکون خیرا ما اراد الله بنا قتلنا ام ظفرنا অর্থাৎ আমি আশা করছি আল্লাহর ইচ্ছায় যা-ই সংঘটিত হোক তা আমাদের জন্য মঙ্গলই হবে ,শহীদ হই অথবা বিজয়ী হই ।503

বোনের দৃষ্টিতে ঘটনাটি সৌন্দর্যময় হওয়া এবং ভাইয়ের দৃষ্টিতে তা মঙ্গলজনক হওয়া এ দু টি একে অপরের পরিপূরক । কারবালার দর্পণের অনেক সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে । তার থেকে আমরা এখানে কিছু দিকের উল্লেখ করব ।

1. মানুষের পূর্ণতার দ্যুতি : মানুষ যে কত ঊর্ধ্বে আরোহণ এবং কতটা খোদায়ী রঙ ধারণ করতে পারে যে ,তাঁর (তাজাল্লির) মধ্যে বিলীন হতে পারে তা কর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় । কারবালা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের আত্মার মর্যাদা কত বেশি এবং এর ঊর্ধ্বগামিতা ও পূর্ণতার সীমা কতদূর পর্যন্ত হতে পারে! এই মহান ঘটনা প্রমাণ করেছে যে ,মানুষের মর্যাদা সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে । মূল্যবোধের অনুসন্ধানকারীদের কাছে এ দিকটি অনেক মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত ।

2. আল্লাহর সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশ : আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হওয়ার মর্যাদায় পৌঁছানো অনেক কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার । যদি হযরত যায়নাব (আ.) কারবালার ঘটনাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে করেন তা আল্লাহর ওলী সাইয়্যেদুশ শুহাদা ,তাঁর সঙ্গী সাথি এবং পরিবার-পরিজনের কর্মে যে মহান বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশিত হয়েছে তার কারণে ।

সত্যিই হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ব্যথা অথবা নিরাময় এবং মিলন অথবা বিরহের মধ্যে কোন্টাকে বেছে নেবেন তা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন । অতঃপর যা কিছু মহান প্রেমময় সত্তা আল্লাহ পছন্দ করেন তা-ই পছন্দ করেছিলেন ।

কারবালা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষের সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশস্থল । ইমাম হোসাইন (আ.) জীবনের শেষ মুহূর্তে শহীদ হওয়ার স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করছিলেন-

الهی رضی بقضائک

( হে আল্লাহ! আমরা তোমার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট )। নিজের বোনকেও তিনি এই উপদেশ দিচ্ছিলেন-ارضی بقضائ الله ( আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাক )। এটা আধ্যাত্মিকতার উচ্চ পর্যায় । অর্থাৎ নিজেকে মোটেই না দেখা এবং কেবল আল্লাহকেই দেখা । আল্লাহর পছন্দের মোকাবিলায় নিজের কোন পছন্দ না থাকা । তিনি মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেও তাঁর বক্তৃতায় বলেন :رضا الله رضانا اهل البیت ( আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতের সন্তুষ্টি )।504

এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভালোবাসা এবং আত্মোৎসর্গের ভিত্তি । আর যায়নাব (আ.) এটাকেই সুন্দর বলেছেন এবং এই চিন্তাধারা ও জীবনধারাকেই প্রশংসা করেছেন ।

সত্যমিথ্যার সীমারেখা : আশুরার অন্যান্য সৌন্দর্যের মধ্যে একটি হলো সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এবং হিংস্র স্বভাবের মানুষ ও ফেরেশতার মতো মানুষের অবস্থান ও কর্মের সীমা পরিষ্কার করে দেওয়া । যখন ভালো-মন্দ ,সত্যমিথ্যা মিশ্রিত হয়ে পড়ে ,মিথ্যার অন্ধকাররাশি সত্যকে অস্পষ্ট ও আচ্ছাদিত করে দেয় ,সেই অন্ধকারময় অবস্থায় মানুষের চিন্তাধারায় বিকৃতি ঘটা ও মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার । আর তখন অস্পষ্ট মুখোশধারী কুফর ইসলামের বেশ ধরে সহজ-সরল মুসলমান এবং অগভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের সত্য সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেয় । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কর্মের সৌন্দর্য হচ্ছে যে ,তিনি এমন এক মশাল জ্বালিয়েছেন যেন সত্যপথ পরিষ্কার হয় এবং অন্ধকার দূরীভূত হয় । মেষের পোশাকে আসা নেকড়েস্বরূপ ফিতনা ও মিথ্যার চেহারা প্রকাশিত ও চিহ্নিত হয় এবং তাদের প্রতারণা বা ধোঁকা যেন আর কার্যকর না হয় । এটা কি সুন্দর নয় ?

আশুরা ছিল সত্যমিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী একটি সীমানা যা নামধারী মুসলমানদের থেকে প্রকৃত মুসলমানদের চিহ্নিত করেছে । কারবালায় পরম করুণাময়ের অনুসারীরা এবং শয়তানের বাহিনী পৃথক প্লাটফর্মে আবির্ভূত হয়েছে । যেহেতু মিথ্যা কারবালায় মুখোশবিহীন অবস্থায় ময়দানে এসেছিল সেহেতু সত্য নিশ্চিন্তে ও অকুণ্ঠ চিত্তে মিথ্যার মোকাবেলায় নেমেছিল । যদিও তারা প্রতারণামূলকভাবে ইমাম হোসাইনকে হত্যার উদ্দেশে আগতদেরیا خیل الله ارکبی ( হে আল্লাহর সৈন্যরা! যুদ্ধের জন্য আরোহণ কর ) স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল ।

যদি তাদের পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার পথে সামান্য কিছু অস্পষ্টতা থেকেও থাকে তবে সিরিয়া এবং কুফায় যায়নাব (আ.)-এর বক্তৃতার মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়েছিল । এটা রক্তাক্ত আশুরার একটি অতি মূল্যবান সৌন্দর্য ।

4. প্রকৃত বিজয়ের দীপ্তি : আশুরার অপর একটি সৌন্দর্য হচ্ছে বিজয়ের নতুন এক অর্থ ও তাৎপর্য দান । কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ভুলবশত কেবল সামরিক বিজয়কেই বিজয় এবং অত্যাচারিত হওয়া ও শাহাদাত বরণ করাকে পরাজয় বলে মনে করে । আশুরা দেখিয়ে দিয়েছে যে ,চরম অত্যাচারিত হওয়ার মধ্যেও বিজয় থাকতে পারে । নিহত হওয়ার মাধ্যমেও বিজয়ের গ্রন্থ রচনা করা এবং রক্ত দিয়েও বিজয়ের চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব । সুতরাং কারবালা সংগ্রামের প্রকৃত বিজয়ী ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং কী চমৎকার এ বিজয়!

এটাই সেই তরবারির ওপর রক্তের বিজয় -যা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তৃতায় বিভিন্ন সময় প্রতিধ্বনিত হয়েছে । তিনি বলেছেন : যে জাতি শাহাদাতকে সৌভাগ্য বলে মনে করে তারাই বিজয়ী । আমরা শহীদ হওয়া এবং হত্যা করা উভয় অবস্থায়ই বিজয়ী ।505 এটাই কোরআনের সেই শিক্ষাاِحدی الحسنین (অর্থ: দুই কল্যাণের একটি অর্জন) যা আল্লাহর পথে সংগ্রামীদের সংস্কৃতি ।

যে আল্লাহর নির্ধারিত ছক ও নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে সে সর্বাবস্থায় বিজয়ী এবং সেটা প্রকৃত বিজয়ও বটে ।

এই দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম হোসাইন ,ইমাম সাজ্জাদ এবং হযরত যায়নাবেরও ছিল ।

যেহেতু ঐসব তিক্ত ঘটনা সত্য এবং ইসলামের জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর ছিল সেহেতু তা সুন্দর এবং আকর্ষণীয় । যখন ইবরাহীম বিন তালহা ইয়াযীদের দরবারে ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তিরস্কার করে বলল : (আজ) কে বিজয়ী হয়েছে ? তিনি বললেন : যখন নামাযের সময় হবে এবং আযান ও ইকামত দেয়া হবে তখন বুঝবে যে ,কে বিজয়ী হয়েছে! 506

নিহত এবং শহীদ হয়েও বিজয় লাভ করা কি সুন্দর নয় ?

5. আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত পথে যাত্রা করা : মানুষ যখন কোন কাজ আল্লাহর ইচ্ছা আল্লাহর চাওয়া অনুযায়ী ই ঘটেছে বলে মনে করে তখন তার সৌন্দর্য উত্তমরূপে প্রতিভাত হয় । যদি শহীদদের নেতা বা তাঁর সঙ্গী-সাথিরা শহীদ হয়ে থাকেন এবং হযরত যায়নাব ও নবীর পরিবার বন্দি হয়ে থাকেন তবে আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়েছে । কেননা ,লওহে মাহফুযে তা লিপিবদ্ধ ছিল । কী চমৎকার যে ,দলবদ্ধ একটি কাজ আল্লাহর চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ!

তাহলে কি হোসাইন বিন আলী (আ.)-কে অদৃশ্য থেকে সম্বোধন করে বলা হয়নি-

ان الله شاء ان یراک قتیلا ان الله شاء ان یراهن سبایا

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে নিহত অবস্থায় দেখতে চান এবং তাদেরকেও (নারী-শিশুদের) বন্দি দেখতে চান । সুতরাং এটাই কি আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না যে ,নবীর আহলে বাইত (নারী-শিশুসহ সকল সদস্য) তাঁর ধর্ম এবং মানুষের মুক্তির জন্য বন্দি হবেন ?

অতএব ,এই শাহাদাত বা বন্দি হওয়াতে দুঃখ বা আফসোস কিসের ?

এ দু টি ছিল আল্লাহর দ্বীন রক্ষা এবং খোদাদ্রোহীদের মুখোশ উন্মোচন করার মূল্য যা অবশ্যই দিতে হবে যা প্রেমপূর্ণভাবে ,ধৈর্যসহকারে এবং সাহসিকতার সাথে সম্পাদিত হয়েছে ।

মহীয়সী নারী যায়নাব ওহীর ক্রোড়ে এবং হযরত আলীর শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন । তাই তাঁর নিকট আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরই পথে এই যাত্রা হচ্ছে অতি মূল্যবান এবং সৌন্দর্যের সর্বোত্তম রূপ । তিনি এই কর্মসূচির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত অবলোকন করেছেন । কারণ ,তিনি একে একে প্রতিটি প্রাঙ্গন ও ক্ষেত্রকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করেন । এই ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরার ঘটনাটি কি সৌন্দর্যময় নয় ?

6. আশুরা ভাগ্যনির্ধারণের রাত্রি : এই ক্ষেত্রটিতে আশুরার সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতম প্রকাশ ঘটেছে । কারণ ,হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গীরা প্রস্থান এবং অবস্থান এই দুয়ের মধ্যে অবস্থান করাকে বেছে নিয়েছিলেন ,যা তাঁদের আত্মত্যাগ ও বিশ্বস্ততার নিদর্শন । তাঁরা হোসাইনবিহীন জীবনকে অপমান ও প্রকৃত মৃত্যু মনে করেছেন ।

আশুরার রাতে ইমামের ঐ ঐতিহাসিক বক্তৃতা ,তাঁর প্রতি সঙ্গী-সাথিদের বিশ্বস্ত থাকার ঘোষণা ,ইমাম হাসানের কিশোর সন্তান কাসেমের সাথে ইমামের কথোপকথন এবং প্রশ্নোত্তরের বিষয়বস্তু ও ধরন ,507 সকাল পর্যন্ত সাহাবীদের ইবাদত ,মৃদুস্বরে কোরআন পাঠ ,তাঁবুগুলো থেকে দোয়া পাঠের ধ্বনি উচ্চারিত হওয়া ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং যায়নাবের সামনে তাঁদের সাথিদের বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করা-এগুলোর প্রতিটি এই সুন্দর বইয়ের সোনালি অধ্যায় । তাই যায়নাব কেন আশুরাকে সৌন্দর্যময় দেখবেন না ?

কারবালার শিক্ষার ভিত্তিতেই ইতিহাসে পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায় যুলুম-অত্যাচারের সাথে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে । এটা কি অপরূপ নয় ?

আশুরার প্রতিটি মুহূর্ত ও ক্ষণ শিক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে যা মানুষকে স্বাধীনতা ,বিশ্বস্ততা ,মহানুভবতা ,ঈমান ,সাহসিকতা ,শাহাদাতকামিতা এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভের শিক্ষা দেয় । এটা কি সুন্দর নয় ?

মরু-প্রান্তরের মাটিতে ঝরে পড়া পবিত্র রক্তের স্রোত যুলুম-অত্যাচারের মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে । এটা কি সুন্দর নয় ?

কুফা এবং সিরিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা ভেবেছিল যে ,সত্যপন্থীদের হত্যার মাধ্যমে নিজেদেরকে চিরস্থায়ী করেছে! কিন্তু যায়নাব (আ.)-এর দৃষ্টিতে তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়েছে এবং আহলে বাইতের নূরানি চেহারাকে আরো উজ্জ্বল এবং তাঁদের নাম চিরস্থায়ী করেছে । আর এভাবে আল্লাহর ধর্মকে পুনর্জীবিত করেছে । ফলে কারবালা হয়েছে এক বিশ্ববিদ্যালয় ।

পরম সাহসী ও মহীয়সী নারী হযরত যায়নাব এ সত্যগুলো জানতেন এবং সময়ের ঊর্ধ্বে এ ঘটনার সুপ্রসারিত প্রভাবকে দেখেছিলেন । এই সম্মানিত বন্দি নারীকে ইবনে যিয়াদ তিরস্কারপূর্ণ ভাবে সম্বোধন করে বলেছিল : তোমার ভাই এবং তার পরিবারের সাথে আল্লাহর আচরণকে কেমন দেখলে ? তিনি বললেন : আমি সুন্দর ছাড়া কিছু দেখিনি । এটাই ছিল কুফার শাসকের বিদ্রূপাত্মক কথার জবাব ।

ثار الله এর অর্থ

প্রশ্ন নং 58 :ثار الله শব্দের অর্থ কী ? ইমাম হোসাইন (আ.)-কে এ নামে অভিহিত করার সপক্ষে কোরআন ও হাদীসের কোন দলিল আছে কি ?

উত্তর :ثار শব্দটিثأر অথবাثؤرة শব্দ মূল থেকে এসেছে । এর অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ ,রক্তের বদলা ,রক্তপণ ;রক্ত অর্থেও তা ব্যবহৃত হয় ।488

1ثارالله শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যার প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে ,যেগুলোর সামগ্রিক অর্থ হলো যে ,আল্লাহ্ তা আলা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তের অভিভাবক এবং তিনি নিজেই শত্রুদের থেকে এই মহান ব্যক্তির রক্তের বদলা নিতে চান । কেননা ,কারবালায় সাইয়্যেদুশ শুহাদার রক্ত ঝরানো মহান আল্লাহর নিষিদ্ধের সীমা লঙ্ঘন ,তাঁর সম্মান বিনষ্ট করা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল । সর্বোপরি আহলে বাইত (আ.) হচ্ছেন আলুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত ও বিশেষজন ;এই ইমামদের রক্ত ঝরানোর অর্থ আল্লাহ তা আলার কাছে সম্মানিত ও তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিদের রক্ত ঝরানো ।489

যদিও এ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়নি ,কিন্তু কোরআনের আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে ,আল্লাহ্ বলেছেন

) وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا(

অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় নিশ্চয় আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি । (সূরা বনি ইসরাঈল : 33)

যদি কেউ (যে কোন ধর্মের অনুসারী হোক) অন্যায় ও মযলুমভাবে নিহত হয় তাহলে তার অভিভাবকরা তার রক্তপণ আদায়ের অধিকার রাখে । যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণ বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.) সত্য ,ন্যায় এবং আল্লাহর পথে অসহায় ও মযলুমভাবে শহীদ হয়েছেন ,সেহেতু আল্লাহ নিজেই তাঁর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী । কেননা ,স্বয়ং আল্লাহ্ই ইমাম হোসাইনের রক্তের উত্তরাধিকারী ।

এই কারণেثأرالله এই অর্থে ব্যবহৃত হয় যে ,ইমাম হোসাইনের রক্ত আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং তিনি নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন । এই শব্দটা আল্লাহর সাথে সাইয়্যেদুশ শুহাদার সুদৃঢ় বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করে যে ,তাঁকে হত্যার মাধ্যমে যেন আল্লাহ তা আলার সাথে সম্পৃক্ত ও তাঁর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত এক ব্যক্তির রক্ত ঝরানো হয়েছে । ফলে তাঁর রক্তের প্রতিশোধ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গ্রহণ করলে হবে না ।490

2. যদিثار শব্দটির অর্থ রক্ত হয় ,তাহলে অবশ্যইثار الله শব্দটি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি ;বরং তা উপমা হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । কেননা ,এ বিষয়টি সুনিশ্চিত যে ,আল্লাহ কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নন যে ,তাঁর শরীর অথবা রক্ত থাকবে । অতএব ,এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপমা দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে বুঝানো হয়েছে ,যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের ভূমিকা অর্থাৎ জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা । আল্লাহর দ্বীনের সাথে ইমাম হোসাইনের সম্পর্কও ঠিক সেরকম । আশুরা বিপ্লবই ইসলামকে পুনরায় জীবনদান করেছে ।

3. সম্ভবত এই ব্যাপারটিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা বিভিন্ন রেওয়ায়াতের দলিলের ভিত্তিতে একটি ভালো ফলাফলে পৌঁছতে পারি । আলী (আ.)-কেও আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) বা ইয়াদুল্লাহ (আল্লাহর হাত) বলা হয়েছে । হাদীসে কুরবে নাওয়াফেল (নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ সংক্রান্ত হাদীস)-এ মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,আল্লাহ্ তা আলা বলেছেন : আমার বান্দা ওয়াজিবসমূহের থেকে অধিক পছন্দনীয় কিছু দ্বারা আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না ,তদ্রূপ নফল দ্বারাও আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে । তখন আমিও তাকে ভালোবাসি আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং আমি তার চোখ হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে দেখে ,আমি তার জিহ্বা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে কথা বলে ,আমি তার হাত হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে ধরে ,আমি তার পা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে পথ চলে ;যদি সে আমার দরবারে দোয়া করে আমি তা পছন্দ করি এবং যদি আমার কাছে কিছু চায় তবে তাকে তা দান করি । 491

এই রেওয়ায়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে ,আল্লাহর ওলীরা হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর স্পষ্ট দলিল হিসেবে তাঁর কর্মের প্রকাশকারী । যেহেতু আল্লাহ নিরাকার সেহেতু তাঁর দেহ নেই ,কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন । তাঁর ওলীদের মাধ্যমেই নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটান এবং যখন তাঁর কোন বান্দাকে সাহায্য করতে চান তখন তাঁদের মাধ্যমেই তা করেন এবং ধর্মকে বাঁচানোর জন্য যে রক্ত তিনি ঝরাতে চান তা তাঁর ওলীদের শাহাদাতের মাধ্যমেই ঝরান । ঠিক যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় তাঁর হাতকে সবার হাতের ওপর আল্লাহর কুদরাতী হাতের (ইয়াদুল্লাহ) নমুনাস্বরূপ রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তখন এ আয়াতيَدُ اللَّـهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ অবতীর্ণ করেন ,তেমনি ইমাম হোসাইনের রক্তও আল্লাহর রক্ত (ثارالله ) হিসেবে গণ্য হয়েছে । যিয়ারতে আশুরায় আমরা পড়ি :

السلام علیك یا ثار الله و ابن ثاره و الوتر الموتور

অর্থাৎ হে আল্লাহর রক্ত ,তাঁর রক্তের সন্তান ,তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক । তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে নিঃসঙ্গ একাকী! তেমনিভাবে মরহুম ইবনে কুলাভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর 17 এবং 23 নং যিয়ারতে এভাবে বর্ণনা করেছেন :

انک ثارالله فی الارض والدم الذی لا یدرک ترته احد من اهل الارض ولا یدرکه الا الله وحده

যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের জীবনসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে এবং রক্ত থাকা বা না থাকার ওপর তার জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে ,ইমাম আলী ও ইমাম হোসাইনের উপস্থিতি আল্লাহর নিকট তাঁর ধর্মের জন্য তেমন ভূমিকা রাখে । যদি হযরত আলী (আ.) না থাকতেন তাহলে বদর ,উহুদ ,খায়বার ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হতো এবং ইসলাম টিকে থাকত না ;আর যদি ইমাম হোসাইন (আ.) না থাকতেন তাহলে ইসলামের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । কেননা ,আল্লাহ তাঁর মনোনীত বান্দাদের-যখন তাঁরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গী ভূমিকা রাখেন-প্রতি তাঁর ঐশী সাহায্য প্রেরণ করার মাধ্যমেই সকল যুগে তাঁর ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন ।

হ্যাঁ ,যতদিন ইমাম হোসাইনের স্মৃতি জগরুক থাকবে ,তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে ,হোসাইনপ্রীতি মানুষের অন্তরে অন্তরে স্পন্দিত হবে ,তাঁর বেলায়াত ও প্রেমের শিখা মানুষের হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবে , ইয়া হোসাইন আহাজারি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে ততদিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর নাম টিকে থাকবে । কেননা ,তিনি তাঁর সর্বস্ব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন ,উৎসর্গ করেছেন । সত্যকে বিচ্যুতকারী মুনাফিকদের কুৎসিত চেহারা থেকে মুখোশ খুলে দিয়েছেন এবং মহানবীর খাঁটি ও প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন । আর তাই তাঁর রক্ত আল্লাহর রক্তের মর্যাদা পেয়েছে ।

আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ক্রন্দনের ভূমিকা

প্রশ্ন নং 59 : এরফান ও অধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম হোসাইনের জন্য শোক প্রকাশ ও ক্রন্দন-আহাজারিকে কিভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণের (আল্লাহর দিকে যাত্রা) সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে ?

উত্তর : মনের দহন এবং ক্রন্দন : একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে ঐকান্তিকতার সাথে ক্রন্দন ও অন্তর্জ্বালা প্রকাশ অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ এবং তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এরূপ অনুভূতি সৃষ্টিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করেন এবং সবসময় তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন । যদি তিনি প্রকৃতই সেটা অর্জনে ব্যর্থ হন অর্থাৎ শোকে মুহ্যমান হয়ে অশ্রু না ঝরাতে পারেন ,তবে অন্ততপক্ষে ঐকান্তিকতার সাথে কান্নার ভাব অর্জনের জন্য একাগ্রচিত্ত হন ।

সর্বোপরি ইবাদতের পথপরিক্রমায় ইস্তিগ্ফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) সময়ই হোক অথবা যে কোন অবস্থায় ,ক্রন্দন ও দগ্ধ হৃদয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে । কখনই এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় এবং এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় । হৃদয়ের দহন এবং ক্রন্দন ভালোবাসার কারণে হোক অথবা ভয়ে ,ইস্তিগফারের অবস্থায় হোক অথবা কোরআন পড়া অথবা শোনার সময় ,সিজদায় অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক ,অবশ্যই তা গভীর অনুধাবন ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপত্তি লাভ করে । যে উপলব্ধি করতে পারে সেই দগ্ধ হয় ও অশ্রু ঝরায় আর যে উপলব্ধি করতে পারে না সে দগ্ধও হয় না এবং অশ্রুও ঝরায় না ।

সূরা বনি ইসরাঈলের 107-109 নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব ,এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ,যারা অনুধাবন করতে পারে তারা পবিত্র কোরআনের আয়াতের সামনে বিনয়ী ও নম্র হয় এবং ক্রন্দন করে :

) قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا (107) وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا (108) وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا(

(হে নবী) তুমি বল ,তোমরা একে (কোরআনকে) বিশ্বাস কর আর না-ই কর ,নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে (আসমানি কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে যখনই তাদের সামনে এটি পড়া হয় তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে । তখন তারা বলে : আমাদের প্রভু পূত-পবিত্র মহান ,অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ হবে । আর তারা ক্রন্দন করতে করতে নত মস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে ;(মূলত এ কোরআন) তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি করে ।

একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মিক সাধককে এই আয়াতগুলোর তাৎপর্য গভীরভাবে বোঝার উপদেশ দিচ্ছি ;কারণ ,এটা আল্লাহর মহা সত্যবাণী ।

যে কোন সুগভীর জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত এবং শোনার সাথে সাথে এর সত্যতা ও যথার্থতা বুঝতে পারবে ও অন্তরে তা বিশ্বাস করবে । প্রভুর অঙ্গীকারসমূহকে সুনিশ্চিতভাবে দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে । ফলশ্রুতিতে তার বিনয় ,নম্রতা ও ঈমান অনেক গুণে বৃদ্ধি পাবে । ঐশী উৎসাহ ,উদ্দীপনা ,আকুলতা এবং আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা তার সমগ্র অস্তিত্বকে ছেয়ে ফেলবে । তখন তার চেষ্টা ও সাধনা আরো গতিশীল ও পূর্ণতা লাভ করবে । দারিদ্র ও দুনিয়াবিমুখতার পথ বেছে নেবে ,আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে ও দগ্ধ হৃদয়ে অশ্রু ঝরাবে । তার অন্তরের দহন ও নয়নের অশ্রু যেন আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের আশায় রয়েছে ।

যে মহাসত্য ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারেনি সে যে নিজের জাহান্নাম নিজেই তৈরি করেছে-এবং তার মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে-তা অনুভব করতে পারেনি । সে তার অন্তরের ওপর যে পর্দা পড়েছে এবং যা পড়ার কারণে সে বিভিন্ন রূপ বিপদে পতিত হচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি ।

বলে রাখা দরকার যে ,উল্লিখিত আয়াতে যে জ্ঞান এবং সূক্ষ্ণ দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে-এবং ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ক্রন্দনকারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে-তা শাস্ত্রীয় বা তাত্ত্বিক জ্ঞান নয় ;বরং অন্য এক জ্ঞান ও দর্শন । তা না হলে কত বিদ্বান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানী আছেন যাঁরা শাস্ত্রীয় এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ,কিন্তু তাঁদের মধ্যে এই বিশেষত্ব নেই ।

সর্বাবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়ের জ্বালা প্রকাশ এবং ক্রন্দন করা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী এবং আল্লাহর জ্ঞানে ধন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদের বিশেষত্ব । পবিত্র কোরআন এটাকে নবিগণের-যাঁরা সকল আধ্যাত্মিক সাধক এবং ঐশী জ্ঞানের অধিকারীর শিক্ষক-বিভিন্ন গুণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে । সূরা মারইয়ামে আল্লাহর মনোনীত কিছুসংখ্যক বান্দা ও নবীকে তাঁদের বৈশিষ্ট্যসহকারে স্মরণ করা হয়েছে । তাঁদের ব্যাপারে বলা হয়েছে :

) أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا(

এরা হচ্ছে আদমের বংশধর সেসব নবী যাদের প্রতি আল্লাহ তা আলা অনুগ্রহ করেছেন এবং যাদের তিনি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছেন এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর ,যাদেরকে আমি পথপ্রদর্শন করেছি এবং মনোনীত করেছি ,যখনই তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহ তা আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তখন এরা ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়ত । (সূরা মারইয়াম : 58)

) إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(

অর্থাৎ যখন তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহর তা আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় আল্লাহকে সিজদা করার জন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ত ।

এই অংশটি (আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াতের সময়) তাঁদের বিনয় ও নম্রতার সাথে সিজদা করা এবং ক্রন্দনের সংবাদ দেয় । তাঁদের এই কান্না আল্লাহর ভালোবাসায় হোক আর তাঁর ভয়েই হোক ।

এই আয়াতে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে রহস্যময় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত । আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহর নির্বাচিত একদল নবীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ব্যাপারে বলা হয়েছে । আল্লাহ বলেছেন ,এরাই হলো তাঁরা যাঁদের সম্পর্কে পূর্বে (এ সূরায় উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে) বলা হয়েছে । এরাই তাঁরা আল্লাহ যাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন-

أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ অতঃপর আয়াতের শেষে

) إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(

এই বাক্যটি দ্বারা তাঁদের বিনয়ের সাথে মাথা নত করে অশ্রু ঝরানোকে আল্লাহর অনুগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এটি এ সূক্ষ্ম ও গূঢ় রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে যে ,মহান আল্লাহ যাঁকেই বিনয় ও নম্রতার সাথে তাঁর সামনে মাথা নত করা এবং মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেন তা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ ,রহমত ও ফযিলত ।

হে ভাই! মনের হাসি ,দুঃখ ও কান্নার

প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা উৎসমূল ,

জেনে রাখ তায়

এও জেনে রাখ ,রয়েছে প্রতিটির স্বতন্ত্র ভাণ্ডার ও চাবি

রয়েছে যা এক মহা উন্মোচকের হাতের মুঠোয়492

হাফেজ বলেন :

ভোর রাতের এত বেদনা ও ক্রন্দন

সবই জানি তোমার থেকে হে পরমজন!

কোরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে-

) وَمَن يُؤْمِن بِاللَّـهِ يَهْدِ قَلْبَهُ(

যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে পথ দেখিয়ে দেন ।

রাসূল (সা.)ও বলেছেন493 :

قلب المؤمن بین اصبعین من اصابع الرحمن

মুমিনের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে অবস্থান করছে ।

ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন494 :

ان القلوب بین اصبعین من اصابع الله,یقلبها كیف یشاء,ساعة كذا,وساعة كذا

নিশ্চয় অন্তরসমূহ আল্লাহর আঙ্গুলগুলোর দু টির মাঝে রয়েছে ;তিনি যেমনভাবে চান তা পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।

এই দুই রেওয়ায়াত থেকে প্রত্যেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী এ বিষয়টি বুঝতে পারে ।

প্রথম রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,ঐ ব্যক্তির অন্তর প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তা তাঁর রহমান নামের পূর্ণ অধীনে রয়েছে এবং এই নামের কিরণ ও তাজাল্লীর ছায়ায় প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত হয়ে থাকে । অর্থাৎ ঈমান আনয়নকারীদের অন্তরসমূহ তাদের যোগ্যতা এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর রহমান নামের বিভিন্ন স্তরের প্রকাশের নিয়ন্ত্রণাধীন ।

দ্বিতীয় রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,অন্তরসমূহ-বিশ্বাসীদের অন্তর হোক বা যে কোন অন্তর- আল্লাহ নামের নিয়ন্ত্রণাধীন । আর এই পবিত্র ও বরকতময় নামের বিভিন্নরূপ প্রকাশ রয়েছে । তিনি তাঁর ইচ্ছামত প্রত্যেক হৃদয়কে এ নামের বিশেষ তাজাল্লি দ্বারা পরিচালিত করেন এবং ব্যক্তির প্রবণতা ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তার অবস্থার পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।

সালেক (আধ্যাত্মিক যাত্রী)-কে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে ক্রন্দন করাটাকে তার বন্দেগির পথে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে নিজের জন্য সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে হবে । বিশেষ করে এই মাকামে (মাকামে ইস্তিগফারে) যা কিছু মনের দহন দ্বারা অর্জিত হয় তার কদর তারা ভালোভাবেই জানে । যখনই এমন তাওফিক লাভ হয় তখন ইস্তিগফারের সাথে আকুতি মিনতি এবং অনুনয় প্রার্থনাকে অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে হাতছাড়া করে না । সে সতর্ক থাকে যে ,শত্রু যেন তাকে ধোঁকা দিতে না পারে এবং তার সম্মুখে যে রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে শয়তান সূক্ষ্ম চক্রান্ত দ্বারা সে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে । সুতরাং অনুনয়-বিনয় ,প্রার্থনা ও ইস্তিগফার কখনই বন্ধ করে না ,নিজের এ অবস্থাকে বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং অন্য সময়ে তা হবে এমন মনে করে অমনোযোগী হয় না । কারণ ,সে জানে যে ,এই সৌভাগ্য এত সহজে অর্জন করা যায় না এবং এই সুযোগ সবসময় আসে না । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :

اذا اقشعر جلدک و دمعت عیناک، فدونک دونک، فقد قصدقصدک

যখন তোমার দেহ আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং তোমার চোখ থেকে অশ্রু বর্ষিত হয় ,তখন জেনো ,তিনি তোমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন বলেই তুমি এমন অনুভূতির অধিকারী হয়েছ । 495

শোক ও কান্নার অন্য দিক : আরেফদের হৃদয়ের শোক এবং প্রেমাসক্ত ও ভীতদের কান্নার পর্দার একদিকে যেমন রয়েছে হৃদয়ের দগ্ধতা অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বস্তি ,আনন্দ ,উপভোগ এবং মর্যাদার অনুভূতি ।

এখন রাসূল (সা.) এবং ইমামদের বাণী থেকে এর অর্থ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব ।

দগ্ধ হৃদয় ,কান্না এবং মানসিক প্রশান্তি

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : কিয়ামতের দিন প্রতিটি চক্ষু থেকেই অশ্রু ঝরবে ,কিন্তু ঐসব চক্ষু ছাড়া যেসব চক্ষু আল্লাহর নিষেধসমূহকে পরিহার করে চলেছে এবং ঐ চক্ষু যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য জাগ্রত থেকেছে এবং ঐ চক্ষু যে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে । 496

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,পর্দার এ পাশে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী মুখটিই পর্দার ওপাশে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন প্রশান্ত এবং নিশ্চিন্ত রূপে প্রকাশিত হবে । কেননা ,কিয়ামতের দিন পর্দার অন্তরালের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ হওয়ার দিন ।497 ঐ দিন পর্দার আড়ালে থাকা সত্যই সামনে হাজির হবে ।

দুঃখ ,কান্না ও আনন্দ উপভোগ

রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ্ তা আলা শোকাহত ও ব্যথিত হৃদয়কে ভালোবাসেন ।498

আল্লাহর ভালোবাসার অর্থ বান্দাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা । যার ফলে হাদীসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে ,বান্দার হৃদয় যখন পর্দার এ পাশে শোক ও কান্নায় বিহ্বল তখন পর্দার অপর দিকে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।

আর এই আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ উপভোগ করা যায় । ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন : আল্লাহর নিকট রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনায় যে অশ্রুবিন্দু ঝরে তার চেয়ে অধিক প্রিয় কোন কিছু নেই । 499

এটা এই অর্থে যে ,বান্দা রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রু ঝরায় ও আকুতি প্রকাশ করে তা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় অর্থাৎ এ দুঃখ ও কান্নার আড়ালে তার হৃদয় তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং সে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের আনন্দ উপভোগ করছে । পর্দার আড়ালের ঐশী আকর্ষণই আধ্যাত্মিকতার পথিককে সর্বক্ষণ আকৃষ্ট করে রেখেছে এবং এই আকর্ষণই এই জগতে শোক-দুঃখ ও অশ্রুর আকৃতিতে প্রকাশিত হয় । একদিকে মনের দুঃখ ,পেরেশানি ও অশ্রু বিসর্জন অন্যদিকে মনের আনন্দ ,পবিত্র পানীয়ের স্বাদ আস্বাদন এবং তাঁর দর্শনের আনন্দ উপভোগ । যদি কারো এপার ওপার দু পারে কী ঘটছে দেখার সুযোগ থাকে অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছান ,তখন এপারে ও ওপারে উভয় জগতের আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পারবেন । তিনি এক ব্যক্তিকে একই সময়ে পরস্পর বিপরীত দুই অবস্থায় দেখতে পাবেন ।

এই দিকে (দুনিয়ায়) তাকে শোকাহত ,অশ্রু বিসর্জনকারী ও আবেদন-নিবেদনকারী রূপে দেখতে পাবে । অন্যদিকে (আখেরাতে) পবিত্র পানীয় পানের আনন্দ ,ঐশী দর্শনের স্বাদ আস্বাদনরত অবস্থায় দেখবে । এরূপ মর্যাদা আসলেই বিস্ময়কর যে ,দুঃখের মাঝে আনন্দ ,আনন্দের মাঝে দুঃখ ,কান্নার মাঝে হাসি এবং হাসির মাঝে কান্না ।

এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক যে ,আমরা ধারণা করি এ বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপ ,গভীর রহস্য এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি । কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনই এরূপ নয় । কারণ ,সত্যের রূপকে যে দেখবে তার অবস্থা ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের মতো হবে ,যাঁরা আশুরার রাতে ক্রন্দনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছেন । আর এজন্যই নিজেদের সমগ্র সত্তাকে তাঁর পথে এভাবে বিসর্জন দিতে পেরেছেন ।

শোককান্না এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ

ইমাম সাদিক (আ.) এক রেওয়ায়াতে আবি বাছিরকে দোয়া এবং কান্না সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন যেখানে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থা হচ্ছে সিজদায় ক্রন্দনরত অবস্থা । 500

এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,এ কর্মের বাহ্যিক দিক হলো ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়া ,কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ দিক হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আনন্দে আপ্লুত হওয়া ।

কারবালার আন্দোলন আবেগতাড়িত নাকি বিজ্ঞতাপূর্ণ পদক্ষেপ

প্রশ্ন নং 60 : অনেকে বলেন : আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাজগুলো নিতান্তই প্রেমপ্রসূত ছিল-বিজ্ঞতাপ্রসূত ছিল না । একথার অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে ,ইমামের কাজগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধী ?

উত্তর : মানুষের মধ্যে সবসময়ই ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্ব লেগে আছে ,সাধারণত তাকে জিহাদে আকবার (বড় জিহাদ) বলা হয়ে থাকে । অথচ এটা জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) ।

মানুষ যখন তার জ্ঞান ,বিবেক দিয়ে মনের কু-প্রবৃত্তি ও গুনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে তা হচ্ছে জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) । কেননা ,সে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে চায় । এর পরের পর্যায় হচ্ছে জিহাদে আকবার-যা হচ্ছে ভালোবাসা ও বিবেক ,প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা এবং বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ দর্শনের যুদ্ধ ।

এই পর্যায়ে যদিও সে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে কোন সত্যের তাৎপর্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রমাণসমূহের দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে একটি সমাধানে পৌঁছে ,কিন্তু তার অন্তর-যা প্রেম-ভালোবাসার কেন্দ্র তা কখনোই বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্যকে (অর্জিত জ্ঞানকে) যথেষ্ট মনে করে না ;বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবতাকে অনুভব করতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান কামনা করে । অর্থাৎ যা কিছু বুঝতে পেরেছে তা আত্মা দিয়ে অবলোকন করতে চায় ।

এই কারণে এর পর থেকেই প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং জিহাদে আকবার শুরু হয় । অবশ্য এতে কোন দোষ নেই । কেননা ,দু টিই সত্যের সন্ধান পেয়েছে ,কিন্তু একটি সত্যকে বুঝেছে অপরটি সত্যে পৌঁছেছে । প্রকৃত অর্থে একটি সত্য ,আরেকটি চূড়ান্ত সত্য । একটি ভালো আর অপরটি খুব ভালো । একটি পূর্ণতার নিম্নতর স্তর আরেকটি পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায় । এই কারণে আল্লাহর ওলী ও প্রেমিকদের কাজগুলো প্রেম-ভালোবাসার ভিত্তিতে হয়ে থাকে । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : সর্বোত্তম মানুষ তিনিই যিনি প্রেমের মাধ্যমে ইবাদত করেন । 501 সেই ব্যক্তিই ইবাদতের স্বাদ পায় এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকৃত রূপ দেখতে পায় ।

বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান মূলত দলিল-প্রমাণ দিয়ে দোযখ এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব প্রমাণ করে । কিন্তু প্রেম ও মন বলে যে ,আমি (এ পৃথিবীতেই) দোযখ ও বেহেশত্ দেখতে চাই । যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে কিয়ামত ,বেহেশত ,জান্নাত ইত্যাদিকে সত্য হিসেবে গণ্য করে সে হচ্ছে জ্ঞানী । কিন্তু যে ব্যক্তি বেহেশত ও দোজখ দেখতে চায় সে হচ্ছে প্রেমিক পুরুষ ।

সাইয়্যেদুশ শুহাদার (ইমাম হোসাইন) কাজগুলো প্রেমপূর্ণ ছিল ,আর সে প্রেম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে-জ্ঞানহীনতা নয় । এক সময় বলা হয়ে থাকে ,অমুক কাজ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । অর্থাৎ যে কাজ কেবল ধারণা এবং কল্পনার ভিত্তিতে হয়েছে । কিন্তু কখনো কখনো কাজ এমন হয়ে থাকে যে ,শুধু বিজ্ঞতাপূর্ণই নয় ;বরং তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রেমপূর্ণ । অর্থাৎ যা কিছু বুঝেছে নিজের মধ্যে তা পেয়েছে ও অর্জন করেছে ।

যখন মানুষ বাস্তবতার মর্মে পৌঁছে তখন সে প্রেমসুলভ আচরণ করে । তখন তার ক্ষেত্রে জ্ঞানের কোন ভূমিকাই নেই । এই ভূমিকা না থাকার অর্থ এই যে ,জ্ঞানের আলো তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র এক আলোক রশ্মির নিচে ঢাকা পড়েছে । এই কারণে নয় যে ,জ্ঞানের আলো নিভে গেছে এবং আলো নেই । দু টি অবস্থায় জ্ঞান অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং মানুষের কাজ-কর্ম জ্ঞান অনুযায়ী হয় না :

1. যখন মানুষ ক্রোধ এবং কুপ্রবৃত্তির বশে পাপ কাজে লিপ্ত হয় তখন তা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;বরং বোকামিপূর্ণ । এর উদাহরণ হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণের সম্মুখীন চাঁদের মতো যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । এই রূপ অবস্থায় জ্ঞানের আলো নেই । পাপীর জ্ঞান চন্দ্রগ্রহণ হওয়া চন্দ্রের মতো । হযরত আলী (আ.) এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন : এমন অনেক বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেক রয়েছে যা প্রবৃত্তির কর্তৃত্বের হাতে বন্দি (অর্থাৎ তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কুপ্রবৃত্তির নির্দেশের দাস হয়ে পড়েছে) ।

2. এক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো আছে ,কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই । এটা ঐ সময়ে যখন জ্ঞানের আলো তার চেয়ে শক্তিশালী আলোক রশ্মির নিচে থাকে । যেমন দিনের বেলায় তারার কোন কার্যকারিতা (কোন আলো) নেই । এই কার্যকারিতা না থাকা এই কারণে যে ,সূর্যের আলো আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে ,তার আলোক রশ্মির নিচে তারার আলো রঙ হারিয়ে ফেলেছে । তারার আলো না থাকা বা তা নিষ্প্রভ হওয়ার কারণে এমন হয়নি ;বরং সে সূর্যের বিপরীতে ম্রীয়মাণ হয়ে পড়েছে । যে প্রেমাসক্ত হয়েছে তার জ্ঞান আছে এবং আলোও আছে ,কিন্তু জ্ঞানের আলো প্রেমের আলোক রশ্মির নিচে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে ।

কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি এই রকমই ছিল অর্থাৎ তাঁর কাজ শুধু বুদ্ধিমানের মতোই ছিল না ;বরং তার চেয়েও উচ্চতর ছিল । কেননা ,তা প্রেমপূর্ণও ছিল ।

আশুরার সৌন্দর্য

প্রশ্ন নং 61 : কীভাবে আশুরার সৌন্দর্য এবং যায়নাব (আ.)-এর এই উক্তি ما رایت الا جمیلا - আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি -কে উপলব্ধি করা সম্ভব ?

উত্তর : কখনও কখনও মহত্ত্ব কোন বিষয়কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকে ,ঐ জিনিসে নয়-যাকে দেখা হয় । যেমন কেউ কেউ বলেছেন ,কখনও কখনও সৌন্দর্য থাকে মানুষের চোখে এবং দৃষ্টিতে ,ঐ বস্তুতে নয়-যাকে দেখা হয় । আল্লাহর সৃষ্ট এ জগৎ হলো সর্বোত্তম সৃষ্টিব্যবস্থা -যদি কেউ এই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল অস্তিত্বের দিকে তাকায় তবে অনেক অদৃশ্য বিষয়কে সে দেখতে পাবে এবং তাকে সুন্দরও দেখবে । এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে অস্তিত্ব বা ঘটনাটিকে দেখছি ।

সুন্দর দৃষ্টিতে অস্তিত্ব জগৎ ও জীবনকে দেখলে একদিকে আত্মা ও বিবেক প্রশান্তি লাভ করে অন্যদিকে তা মনে এমন অবিচলতা ,দৃঢ়তা এবং পৌরুষের সৃষ্টি করে যা অপ্রিয় জিনিসসমূহকে সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । এই দৃষ্টিতেই আশুরা হযরত যায়নাব কুবরা (সা.আ.)-এর কাছে সুন্দর ব্যতীত কিছুই ছিল না । যখন শত্রুরা এ ঘটনাকে আহলে বাইতের জন্য অবমাননাকর গণ্য করে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করছিল তখন বীরঙ্গনা নারী যায়নাবما رایت الا جمیلا (আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি) বলে তাদেরকে জবাব দিয়েছেন ।502

ইমাম হোসাইন (আ.) এই সফরের শুরুতেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ,যা কিছু ঘটবে আল্লাহর ইচ্ছায় তা যেন তাঁর এবং তাঁর সাথিদের জন্য মঙ্গলকর হয় । আর তা বিজয়ের দ্বারাই হোক আর শাহাদাতের মাধ্যমেই হোক ।

ارجو ان یکون خیرا ما اراد الله بنا قتلنا ام ظفرنا অর্থাৎ আমি আশা করছি আল্লাহর ইচ্ছায় যা-ই সংঘটিত হোক তা আমাদের জন্য মঙ্গলই হবে ,শহীদ হই অথবা বিজয়ী হই ।503

বোনের দৃষ্টিতে ঘটনাটি সৌন্দর্যময় হওয়া এবং ভাইয়ের দৃষ্টিতে তা মঙ্গলজনক হওয়া এ দু টি একে অপরের পরিপূরক । কারবালার দর্পণের অনেক সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে । তার থেকে আমরা এখানে কিছু দিকের উল্লেখ করব ।

1. মানুষের পূর্ণতার দ্যুতি : মানুষ যে কত ঊর্ধ্বে আরোহণ এবং কতটা খোদায়ী রঙ ধারণ করতে পারে যে ,তাঁর (তাজাল্লির) মধ্যে বিলীন হতে পারে তা কর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় । কারবালা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের আত্মার মর্যাদা কত বেশি এবং এর ঊর্ধ্বগামিতা ও পূর্ণতার সীমা কতদূর পর্যন্ত হতে পারে! এই মহান ঘটনা প্রমাণ করেছে যে ,মানুষের মর্যাদা সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে । মূল্যবোধের অনুসন্ধানকারীদের কাছে এ দিকটি অনেক মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত ।

2. আল্লাহর সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশ : আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হওয়ার মর্যাদায় পৌঁছানো অনেক কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার । যদি হযরত যায়নাব (আ.) কারবালার ঘটনাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে করেন তা আল্লাহর ওলী সাইয়্যেদুশ শুহাদা ,তাঁর সঙ্গী সাথি এবং পরিবার-পরিজনের কর্মে যে মহান বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশিত হয়েছে তার কারণে ।

সত্যিই হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ব্যথা অথবা নিরাময় এবং মিলন অথবা বিরহের মধ্যে কোন্টাকে বেছে নেবেন তা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন । অতঃপর যা কিছু মহান প্রেমময় সত্তা আল্লাহ পছন্দ করেন তা-ই পছন্দ করেছিলেন ।

কারবালা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষের সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশস্থল । ইমাম হোসাইন (আ.) জীবনের শেষ মুহূর্তে শহীদ হওয়ার স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করছিলেন-

الهی رضی بقضائک

( হে আল্লাহ! আমরা তোমার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট )। নিজের বোনকেও তিনি এই উপদেশ দিচ্ছিলেন-ارضی بقضائ الله ( আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাক )। এটা আধ্যাত্মিকতার উচ্চ পর্যায় । অর্থাৎ নিজেকে মোটেই না দেখা এবং কেবল আল্লাহকেই দেখা । আল্লাহর পছন্দের মোকাবিলায় নিজের কোন পছন্দ না থাকা । তিনি মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেও তাঁর বক্তৃতায় বলেন :رضا الله رضانا اهل البیت ( আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতের সন্তুষ্টি )।504

এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভালোবাসা এবং আত্মোৎসর্গের ভিত্তি । আর যায়নাব (আ.) এটাকেই সুন্দর বলেছেন এবং এই চিন্তাধারা ও জীবনধারাকেই প্রশংসা করেছেন ।

সত্যমিথ্যার সীমারেখা : আশুরার অন্যান্য সৌন্দর্যের মধ্যে একটি হলো সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এবং হিংস্র স্বভাবের মানুষ ও ফেরেশতার মতো মানুষের অবস্থান ও কর্মের সীমা পরিষ্কার করে দেওয়া । যখন ভালো-মন্দ ,সত্যমিথ্যা মিশ্রিত হয়ে পড়ে ,মিথ্যার অন্ধকাররাশি সত্যকে অস্পষ্ট ও আচ্ছাদিত করে দেয় ,সেই অন্ধকারময় অবস্থায় মানুষের চিন্তাধারায় বিকৃতি ঘটা ও মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার । আর তখন অস্পষ্ট মুখোশধারী কুফর ইসলামের বেশ ধরে সহজ-সরল মুসলমান এবং অগভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের সত্য সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেয় । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কর্মের সৌন্দর্য হচ্ছে যে ,তিনি এমন এক মশাল জ্বালিয়েছেন যেন সত্যপথ পরিষ্কার হয় এবং অন্ধকার দূরীভূত হয় । মেষের পোশাকে আসা নেকড়েস্বরূপ ফিতনা ও মিথ্যার চেহারা প্রকাশিত ও চিহ্নিত হয় এবং তাদের প্রতারণা বা ধোঁকা যেন আর কার্যকর না হয় । এটা কি সুন্দর নয় ?

আশুরা ছিল সত্যমিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী একটি সীমানা যা নামধারী মুসলমানদের থেকে প্রকৃত মুসলমানদের চিহ্নিত করেছে । কারবালায় পরম করুণাময়ের অনুসারীরা এবং শয়তানের বাহিনী পৃথক প্লাটফর্মে আবির্ভূত হয়েছে । যেহেতু মিথ্যা কারবালায় মুখোশবিহীন অবস্থায় ময়দানে এসেছিল সেহেতু সত্য নিশ্চিন্তে ও অকুণ্ঠ চিত্তে মিথ্যার মোকাবেলায় নেমেছিল । যদিও তারা প্রতারণামূলকভাবে ইমাম হোসাইনকে হত্যার উদ্দেশে আগতদেরیا خیل الله ارکبی ( হে আল্লাহর সৈন্যরা! যুদ্ধের জন্য আরোহণ কর ) স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল ।

যদি তাদের পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার পথে সামান্য কিছু অস্পষ্টতা থেকেও থাকে তবে সিরিয়া এবং কুফায় যায়নাব (আ.)-এর বক্তৃতার মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়েছিল । এটা রক্তাক্ত আশুরার একটি অতি মূল্যবান সৌন্দর্য ।

4. প্রকৃত বিজয়ের দীপ্তি : আশুরার অপর একটি সৌন্দর্য হচ্ছে বিজয়ের নতুন এক অর্থ ও তাৎপর্য দান । কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ভুলবশত কেবল সামরিক বিজয়কেই বিজয় এবং অত্যাচারিত হওয়া ও শাহাদাত বরণ করাকে পরাজয় বলে মনে করে । আশুরা দেখিয়ে দিয়েছে যে ,চরম অত্যাচারিত হওয়ার মধ্যেও বিজয় থাকতে পারে । নিহত হওয়ার মাধ্যমেও বিজয়ের গ্রন্থ রচনা করা এবং রক্ত দিয়েও বিজয়ের চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব । সুতরাং কারবালা সংগ্রামের প্রকৃত বিজয়ী ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং কী চমৎকার এ বিজয়!

এটাই সেই তরবারির ওপর রক্তের বিজয় -যা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তৃতায় বিভিন্ন সময় প্রতিধ্বনিত হয়েছে । তিনি বলেছেন : যে জাতি শাহাদাতকে সৌভাগ্য বলে মনে করে তারাই বিজয়ী । আমরা শহীদ হওয়া এবং হত্যা করা উভয় অবস্থায়ই বিজয়ী ।505 এটাই কোরআনের সেই শিক্ষাاِحدی الحسنین (অর্থ: দুই কল্যাণের একটি অর্জন) যা আল্লাহর পথে সংগ্রামীদের সংস্কৃতি ।

যে আল্লাহর নির্ধারিত ছক ও নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে সে সর্বাবস্থায় বিজয়ী এবং সেটা প্রকৃত বিজয়ও বটে ।

এই দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম হোসাইন ,ইমাম সাজ্জাদ এবং হযরত যায়নাবেরও ছিল ।

যেহেতু ঐসব তিক্ত ঘটনা সত্য এবং ইসলামের জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর ছিল সেহেতু তা সুন্দর এবং আকর্ষণীয় । যখন ইবরাহীম বিন তালহা ইয়াযীদের দরবারে ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তিরস্কার করে বলল : (আজ) কে বিজয়ী হয়েছে ? তিনি বললেন : যখন নামাযের সময় হবে এবং আযান ও ইকামত দেয়া হবে তখন বুঝবে যে ,কে বিজয়ী হয়েছে! 506

নিহত এবং শহীদ হয়েও বিজয় লাভ করা কি সুন্দর নয় ?

5. আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত পথে যাত্রা করা : মানুষ যখন কোন কাজ আল্লাহর ইচ্ছা আল্লাহর চাওয়া অনুযায়ী ই ঘটেছে বলে মনে করে তখন তার সৌন্দর্য উত্তমরূপে প্রতিভাত হয় । যদি শহীদদের নেতা বা তাঁর সঙ্গী-সাথিরা শহীদ হয়ে থাকেন এবং হযরত যায়নাব ও নবীর পরিবার বন্দি হয়ে থাকেন তবে আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়েছে । কেননা ,লওহে মাহফুযে তা লিপিবদ্ধ ছিল । কী চমৎকার যে ,দলবদ্ধ একটি কাজ আল্লাহর চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ!

তাহলে কি হোসাইন বিন আলী (আ.)-কে অদৃশ্য থেকে সম্বোধন করে বলা হয়নি-

ان الله شاء ان یراک قتیلا ان الله شاء ان یراهن سبایا

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে নিহত অবস্থায় দেখতে চান এবং তাদেরকেও (নারী-শিশুদের) বন্দি দেখতে চান । সুতরাং এটাই কি আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না যে ,নবীর আহলে বাইত (নারী-শিশুসহ সকল সদস্য) তাঁর ধর্ম এবং মানুষের মুক্তির জন্য বন্দি হবেন ?

অতএব ,এই শাহাদাত বা বন্দি হওয়াতে দুঃখ বা আফসোস কিসের ?

এ দু টি ছিল আল্লাহর দ্বীন রক্ষা এবং খোদাদ্রোহীদের মুখোশ উন্মোচন করার মূল্য যা অবশ্যই দিতে হবে যা প্রেমপূর্ণভাবে ,ধৈর্যসহকারে এবং সাহসিকতার সাথে সম্পাদিত হয়েছে ।

মহীয়সী নারী যায়নাব ওহীর ক্রোড়ে এবং হযরত আলীর শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন । তাই তাঁর নিকট আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরই পথে এই যাত্রা হচ্ছে অতি মূল্যবান এবং সৌন্দর্যের সর্বোত্তম রূপ । তিনি এই কর্মসূচির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত অবলোকন করেছেন । কারণ ,তিনি একে একে প্রতিটি প্রাঙ্গন ও ক্ষেত্রকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করেন । এই ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরার ঘটনাটি কি সৌন্দর্যময় নয় ?

6. আশুরা ভাগ্যনির্ধারণের রাত্রি : এই ক্ষেত্রটিতে আশুরার সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতম প্রকাশ ঘটেছে । কারণ ,হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গীরা প্রস্থান এবং অবস্থান এই দুয়ের মধ্যে অবস্থান করাকে বেছে নিয়েছিলেন ,যা তাঁদের আত্মত্যাগ ও বিশ্বস্ততার নিদর্শন । তাঁরা হোসাইনবিহীন জীবনকে অপমান ও প্রকৃত মৃত্যু মনে করেছেন ।

আশুরার রাতে ইমামের ঐ ঐতিহাসিক বক্তৃতা ,তাঁর প্রতি সঙ্গী-সাথিদের বিশ্বস্ত থাকার ঘোষণা ,ইমাম হাসানের কিশোর সন্তান কাসেমের সাথে ইমামের কথোপকথন এবং প্রশ্নোত্তরের বিষয়বস্তু ও ধরন ,507 সকাল পর্যন্ত সাহাবীদের ইবাদত ,মৃদুস্বরে কোরআন পাঠ ,তাঁবুগুলো থেকে দোয়া পাঠের ধ্বনি উচ্চারিত হওয়া ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং যায়নাবের সামনে তাঁদের সাথিদের বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করা-এগুলোর প্রতিটি এই সুন্দর বইয়ের সোনালি অধ্যায় । তাই যায়নাব কেন আশুরাকে সৌন্দর্যময় দেখবেন না ?

কারবালার শিক্ষার ভিত্তিতেই ইতিহাসে পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায় যুলুম-অত্যাচারের সাথে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে । এটা কি অপরূপ নয় ?

আশুরার প্রতিটি মুহূর্ত ও ক্ষণ শিক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে যা মানুষকে স্বাধীনতা ,বিশ্বস্ততা ,মহানুভবতা ,ঈমান ,সাহসিকতা ,শাহাদাতকামিতা এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভের শিক্ষা দেয় । এটা কি সুন্দর নয় ?

মরু-প্রান্তরের মাটিতে ঝরে পড়া পবিত্র রক্তের স্রোত যুলুম-অত্যাচারের মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে । এটা কি সুন্দর নয় ?

কুফা এবং সিরিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা ভেবেছিল যে ,সত্যপন্থীদের হত্যার মাধ্যমে নিজেদেরকে চিরস্থায়ী করেছে! কিন্তু যায়নাব (আ.)-এর দৃষ্টিতে তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়েছে এবং আহলে বাইতের নূরানি চেহারাকে আরো উজ্জ্বল এবং তাঁদের নাম চিরস্থায়ী করেছে । আর এভাবে আল্লাহর ধর্মকে পুনর্জীবিত করেছে । ফলে কারবালা হয়েছে এক বিশ্ববিদ্যালয় ।

পরম সাহসী ও মহীয়সী নারী হযরত যায়নাব এ সত্যগুলো জানতেন এবং সময়ের ঊর্ধ্বে এ ঘটনার সুপ্রসারিত প্রভাবকে দেখেছিলেন । এই সম্মানিত বন্দি নারীকে ইবনে যিয়াদ তিরস্কারপূর্ণ ভাবে সম্বোধন করে বলেছিল : তোমার ভাই এবং তার পরিবারের সাথে আল্লাহর আচরণকে কেমন দেখলে ? তিনি বললেন : আমি সুন্দর ছাড়া কিছু দেখিনি । এটাই ছিল কুফার শাসকের বিদ্রূপাত্মক কথার জবাব ।

ثار الله এর অর্থ

প্রশ্ন নং 58 :ثار الله শব্দের অর্থ কী ? ইমাম হোসাইন (আ.)-কে এ নামে অভিহিত করার সপক্ষে কোরআন ও হাদীসের কোন দলিল আছে কি ?

উত্তর :ثار শব্দটিثأر অথবাثؤرة শব্দ মূল থেকে এসেছে । এর অর্থ হচ্ছে প্রতিশোধ ,রক্তের বদলা ,রক্তপণ ;রক্ত অর্থেও তা ব্যবহৃত হয় ।488

1ثارالله শব্দটির বিভিন্ন অর্থ রয়েছে যার প্রতিটিরই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে ,যেগুলোর সামগ্রিক অর্থ হলো যে ,আল্লাহ্ তা আলা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তের অভিভাবক এবং তিনি নিজেই শত্রুদের থেকে এই মহান ব্যক্তির রক্তের বদলা নিতে চান । কেননা ,কারবালায় সাইয়্যেদুশ শুহাদার রক্ত ঝরানো মহান আল্লাহর নিষিদ্ধের সীমা লঙ্ঘন ,তাঁর সম্মান বিনষ্ট করা এবং তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করার শামিল । সর্বোপরি আহলে বাইত (আ.) হচ্ছেন আলুল্লাহ্ অর্থাৎ আল্লাহর মনোনীত ও বিশেষজন ;এই ইমামদের রক্ত ঝরানোর অর্থ আল্লাহ তা আলার কাছে সম্মানিত ও তাঁর প্রিয়তম ব্যক্তিদের রক্ত ঝরানো ।489

যদিও এ শব্দটি পবিত্র কোরআনে ব্যবহৃত হয়নি ,কিন্তু কোরআনের আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে ,আল্লাহ্ বলেছেন

) وَمَنْ قُتِلَ مَظْلُومًا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِ سُلْطَانًا(

অর্থাৎ যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় নিশ্চয় আমরা তার উত্তরাধিকারীকে (প্রতিশোধ গ্রহণের) অধিকার দান করেছি । (সূরা বনি ইসরাঈল : 33)

যদি কেউ (যে কোন ধর্মের অনুসারী হোক) অন্যায় ও মযলুমভাবে নিহত হয় তাহলে তার অভিভাবকরা তার রক্তপণ আদায়ের অধিকার রাখে । যেহেতু আহলে বাইতের ইমামগণ বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.) সত্য ,ন্যায় এবং আল্লাহর পথে অসহায় ও মযলুমভাবে শহীদ হয়েছেন ,সেহেতু আল্লাহ নিজেই তাঁর রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী । কেননা ,স্বয়ং আল্লাহ্ই ইমাম হোসাইনের রক্তের উত্তরাধিকারী ।

এই কারণেثأرالله এই অর্থে ব্যবহৃত হয় যে ,ইমাম হোসাইনের রক্ত আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত এবং তিনি নিজেই ইমাম হোসাইনের রক্তের বদলা নেবেন । এই শব্দটা আল্লাহর সাথে সাইয়্যেদুশ শুহাদার সুদৃঢ় বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করে যে ,তাঁকে হত্যার মাধ্যমে যেন আল্লাহ তা আলার সাথে সম্পৃক্ত ও তাঁর সবচেয়ে নৈকট্যপ্রাপ্ত এক ব্যক্তির রক্ত ঝরানো হয়েছে । ফলে তাঁর রক্তের প্রতিশোধ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ গ্রহণ করলে হবে না ।490

2. যদিثار শব্দটির অর্থ রক্ত হয় ,তাহলে অবশ্যইثار الله শব্দটি প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি ;বরং তা উপমা হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । কেননা ,এ বিষয়টি সুনিশ্চিত যে ,আল্লাহ কোন বস্তুগত অস্তিত্ব নন যে ,তাঁর শরীর অথবা রক্ত থাকবে । অতএব ,এ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর উপমা দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে বুঝানো হয়েছে ,যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের ভূমিকা অর্থাৎ জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা । আল্লাহর দ্বীনের সাথে ইমাম হোসাইনের সম্পর্কও ঠিক সেরকম । আশুরা বিপ্লবই ইসলামকে পুনরায় জীবনদান করেছে ।

3. সম্ভবত এই ব্যাপারটিকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমরা বিভিন্ন রেওয়ায়াতের দলিলের ভিত্তিতে একটি ভালো ফলাফলে পৌঁছতে পারি । আলী (আ.)-কেও আসাদুল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) বা ইয়াদুল্লাহ (আল্লাহর হাত) বলা হয়েছে । হাদীসে কুরবে নাওয়াফেল (নফল ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ সংক্রান্ত হাদীস)-এ মহানবী (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে ,আল্লাহ্ তা আলা বলেছেন : আমার বান্দা ওয়াজিবসমূহের থেকে অধিক পছন্দনীয় কিছু দ্বারা আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না ,তদ্রূপ নফল দ্বারাও আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে । তখন আমিও তাকে ভালোবাসি আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কান হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং আমি তার চোখ হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে দেখে ,আমি তার জিহ্বা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে কথা বলে ,আমি তার হাত হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে ধরে ,আমি তার পা হয়ে যাই ,যা দ্বারা সে পথ চলে ;যদি সে আমার দরবারে দোয়া করে আমি তা পছন্দ করি এবং যদি আমার কাছে কিছু চায় তবে তাকে তা দান করি । 491

এই রেওয়ায়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে ,আল্লাহর ওলীরা হচ্ছেন পৃথিবীর বুকে তাঁর প্রতিনিধি এবং আল্লাহর স্পষ্ট দলিল হিসেবে তাঁর কর্মের প্রকাশকারী । যেহেতু আল্লাহ নিরাকার সেহেতু তাঁর দেহ নেই ,কিন্তু তিনি যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন । তাঁর ওলীদের মাধ্যমেই নিজের গুণাবলির প্রকাশ ঘটান এবং যখন তাঁর কোন বান্দাকে সাহায্য করতে চান তখন তাঁদের মাধ্যমেই তা করেন এবং ধর্মকে বাঁচানোর জন্য যে রক্ত তিনি ঝরাতে চান তা তাঁর ওলীদের শাহাদাতের মাধ্যমেই ঝরান । ঠিক যেভাবে আল্লাহর রাসূল (সা.) হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় তাঁর হাতকে সবার হাতের ওপর আল্লাহর কুদরাতী হাতের (ইয়াদুল্লাহ) নমুনাস্বরূপ রেখেছিলেন এবং মহান আল্লাহ তখন এ আয়াতيَدُ اللَّـهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ অবতীর্ণ করেন ,তেমনি ইমাম হোসাইনের রক্তও আল্লাহর রক্ত (ثارالله ) হিসেবে গণ্য হয়েছে । যিয়ারতে আশুরায় আমরা পড়ি :

السلام علیك یا ثار الله و ابن ثاره و الوتر الموتور

অর্থাৎ হে আল্লাহর রক্ত ,তাঁর রক্তের সন্তান ,তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক । তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক হে নিঃসঙ্গ একাকী! তেমনিভাবে মরহুম ইবনে কুলাভেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর 17 এবং 23 নং যিয়ারতে এভাবে বর্ণনা করেছেন :

انک ثارالله فی الارض والدم الذی لا یدرک ترته احد من اهل الارض ولا یدرکه الا الله وحده

যেমনভাবে মানুষের শরীরে রক্তের জীবনসঞ্চারী ভূমিকা রয়েছে এবং রক্ত থাকা বা না থাকার ওপর তার জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করে ,ইমাম আলী ও ইমাম হোসাইনের উপস্থিতি আল্লাহর নিকট তাঁর ধর্মের জন্য তেমন ভূমিকা রাখে । যদি হযরত আলী (আ.) না থাকতেন তাহলে বদর ,উহুদ ,খায়বার ও খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানরা পরাজিত হতো এবং ইসলাম টিকে থাকত না ;আর যদি ইমাম হোসাইন (আ.) না থাকতেন তাহলে ইসলামের কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । কেননা ,আল্লাহ তাঁর মনোনীত বান্দাদের-যখন তাঁরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গী ভূমিকা রাখেন-প্রতি তাঁর ঐশী সাহায্য প্রেরণ করার মাধ্যমেই সকল যুগে তাঁর ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছেন ।

হ্যাঁ ,যতদিন ইমাম হোসাইনের স্মৃতি জগরুক থাকবে ,তাঁর নাম মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হবে ,হোসাইনপ্রীতি মানুষের অন্তরে অন্তরে স্পন্দিত হবে ,তাঁর বেলায়াত ও প্রেমের শিখা মানুষের হৃদয়ে প্রজ্বলিত থাকবে , ইয়া হোসাইন আহাজারি আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হবে ততদিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর নাম টিকে থাকবে । কেননা ,তিনি তাঁর সর্বস্ব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়েছেন ,উৎসর্গ করেছেন । সত্যকে বিচ্যুতকারী মুনাফিকদের কুৎসিত চেহারা থেকে মুখোশ খুলে দিয়েছেন এবং মহানবীর খাঁটি ও প্রকৃত ইসলামকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন । আর তাই তাঁর রক্ত আল্লাহর রক্তের মর্যাদা পেয়েছে ।

আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমায় ক্রন্দনের ভূমিকা

প্রশ্ন নং 59 : এরফান ও অধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম হোসাইনের জন্য শোক প্রকাশ ও ক্রন্দন-আহাজারিকে কিভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণের (আল্লাহর দিকে যাত্রা) সাথে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে ?

উত্তর : মনের দহন এবং ক্রন্দন : একজন আধ্যাত্মিক সাধকের কাছে ঐকান্তিকতার সাথে ক্রন্দন ও অন্তর্জ্বালা প্রকাশ অত্যন্ত প্রিয় একটি কাজ এবং তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এরূপ অনুভূতি সৃষ্টিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করেন এবং সবসময় তা অর্জনের জন্য চেষ্টা করেন । যদি তিনি প্রকৃতই সেটা অর্জনে ব্যর্থ হন অর্থাৎ শোকে মুহ্যমান হয়ে অশ্রু না ঝরাতে পারেন ,তবে অন্ততপক্ষে ঐকান্তিকতার সাথে কান্নার ভাব অর্জনের জন্য একাগ্রচিত্ত হন ।

সর্বোপরি ইবাদতের পথপরিক্রমায় ইস্তিগ্ফারের (ক্ষমা প্রার্থনা) সময়ই হোক অথবা যে কোন অবস্থায় ,ক্রন্দন ও দগ্ধ হৃদয়ে অনুভূতি ব্যক্ত করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে । কখনই এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয় এবং এর স্বরূপ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় । হৃদয়ের দহন এবং ক্রন্দন ভালোবাসার কারণে হোক অথবা ভয়ে ,ইস্তিগফারের অবস্থায় হোক অথবা কোরআন পড়া অথবা শোনার সময় ,সিজদায় অথবা অন্য যে কোন অবস্থায় হোক ,অবশ্যই তা গভীর অনুধাবন ও অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপত্তি লাভ করে । যে উপলব্ধি করতে পারে সেই দগ্ধ হয় ও অশ্রু ঝরায় আর যে উপলব্ধি করতে পারে না সে দগ্ধও হয় না এবং অশ্রুও ঝরায় না ।

সূরা বনি ইসরাঈলের 107-109 নং আয়াতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাব ,এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ,যারা অনুধাবন করতে পারে তারা পবিত্র কোরআনের আয়াতের সামনে বিনয়ী ও নম্র হয় এবং ক্রন্দন করে :

) قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا (107) وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا (108) وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا(

(হে নবী) তুমি বল ,তোমরা একে (কোরআনকে) বিশ্বাস কর আর না-ই কর ,নিশ্চয় যাদেরকে এর আগে (আসমানি কিতাবের) জ্ঞান দেয়া হয়েছে যখনই তাদের সামনে এটি পড়া হয় তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে । তখন তারা বলে : আমাদের প্রভু পূত-পবিত্র মহান ,অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা পূর্ণ হবে । আর তারা ক্রন্দন করতে করতে নত মস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে ;(মূলত এ কোরআন) তাদের বিনয়ভাব আরো বৃদ্ধি করে ।

একজন নিষ্ঠাবান আধ্যাত্মিক সাধককে এই আয়াতগুলোর তাৎপর্য গভীরভাবে বোঝার উপদেশ দিচ্ছি ;কারণ ,এটা আল্লাহর মহা সত্যবাণী ।

যে কোন সুগভীর জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি কোরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত এবং শোনার সাথে সাথে এর সত্যতা ও যথার্থতা বুঝতে পারবে ও অন্তরে তা বিশ্বাস করবে । প্রভুর অঙ্গীকারসমূহকে সুনিশ্চিতভাবে দেখতে এবং উপলব্ধি করতে পারবে । ফলশ্রুতিতে তার বিনয় ,নম্রতা ও ঈমান অনেক গুণে বৃদ্ধি পাবে । ঐশী উৎসাহ ,উদ্দীপনা ,আকুলতা এবং আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা তার সমগ্র অস্তিত্বকে ছেয়ে ফেলবে । তখন তার চেষ্টা ও সাধনা আরো গতিশীল ও পূর্ণতা লাভ করবে । দারিদ্র ও দুনিয়াবিমুখতার পথ বেছে নেবে ,আল্লাহর সম্মুখে সিজদায় লুটিয়ে পড়বে ও দগ্ধ হৃদয়ে অশ্রু ঝরাবে । তার অন্তরের দহন ও নয়নের অশ্রু যেন আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাঁর অনুগ্রহ লাভের আশায় রয়েছে ।

যে মহাসত্য ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারেনি সে যে নিজের জাহান্নাম নিজেই তৈরি করেছে-এবং তার মধ্যে হাত-পা ছুঁড়ছে-তা অনুভব করতে পারেনি । সে তার অন্তরের ওপর যে পর্দা পড়েছে এবং যা পড়ার কারণে সে বিভিন্ন রূপ বিপদে পতিত হচ্ছে তা বুঝতেই পারেনি ।

বলে রাখা দরকার যে ,উল্লিখিত আয়াতে যে জ্ঞান এবং সূক্ষ্ণ দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে-এবং ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের ক্রন্দনকারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে-তা শাস্ত্রীয় বা তাত্ত্বিক জ্ঞান নয় ;বরং অন্য এক জ্ঞান ও দর্শন । তা না হলে কত বিদ্বান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানী আছেন যাঁরা শাস্ত্রীয় এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের অধিকারী ,কিন্তু তাঁদের মধ্যে এই বিশেষত্ব নেই ।

সর্বাবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়ের জ্বালা প্রকাশ এবং ক্রন্দন করা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী এবং আল্লাহর জ্ঞানে ধন্য আধ্যাত্মিক জ্ঞানীদের বিশেষত্ব । পবিত্র কোরআন এটাকে নবিগণের-যাঁরা সকল আধ্যাত্মিক সাধক এবং ঐশী জ্ঞানের অধিকারীর শিক্ষক-বিভিন্ন গুণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গুণ হিসেবে উল্লেখ করেছে । সূরা মারইয়ামে আল্লাহর মনোনীত কিছুসংখ্যক বান্দা ও নবীকে তাঁদের বৈশিষ্ট্যসহকারে স্মরণ করা হয়েছে । তাঁদের ব্যাপারে বলা হয়েছে :

) أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا(

এরা হচ্ছে আদমের বংশধর সেসব নবী যাদের প্রতি আল্লাহ তা আলা অনুগ্রহ করেছেন এবং যাদের তিনি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছেন এবং ইবরাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর ,যাদেরকে আমি পথপ্রদর্শন করেছি এবং মনোনীত করেছি ,যখনই তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহ তা আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তখন এরা ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়ত । (সূরা মারইয়াম : 58)

) إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(

অর্থাৎ যখন তাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহর তা আলার আয়াতসমূহ পাঠ করা হতো তারা ক্রন্দনরত অবস্থায় আল্লাহকে সিজদা করার জন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ত ।

এই অংশটি (আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াতের সময়) তাঁদের বিনয় ও নম্রতার সাথে সিজদা করা এবং ক্রন্দনের সংবাদ দেয় । তাঁদের এই কান্না আল্লাহর ভালোবাসায় হোক আর তাঁর ভয়েই হোক ।

এই আয়াতে আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসীদের জন্য রয়েছে রহস্যময় সূক্ষ্ম ইঙ্গিত । আয়াতের প্রথমাংশে আল্লাহর নির্বাচিত একদল নবীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ব্যাপারে বলা হয়েছে । আল্লাহ বলেছেন ,এরাই হলো তাঁরা যাঁদের সম্পর্কে পূর্বে (এ সূরায় উক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে) বলা হয়েছে । এরাই তাঁরা আল্লাহ যাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন-

أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ অতঃপর আয়াতের শেষে

) إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا و بُكِیًّا(

এই বাক্যটি দ্বারা তাঁদের বিনয়ের সাথে মাথা নত করে অশ্রু ঝরানোকে আল্লাহর অনুগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । এটি এ সূক্ষ্ম ও গূঢ় রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করছে যে ,মহান আল্লাহ যাঁকেই বিনয় ও নম্রতার সাথে তাঁর সামনে মাথা নত করা এবং মনের সুখ-দুঃখ প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেন তা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহ ,রহমত ও ফযিলত ।

হে ভাই! মনের হাসি ,দুঃখ ও কান্নার

প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা উৎসমূল ,

জেনে রাখ তায়

এও জেনে রাখ ,রয়েছে প্রতিটির স্বতন্ত্র ভাণ্ডার ও চাবি

রয়েছে যা এক মহা উন্মোচকের হাতের মুঠোয়492

হাফেজ বলেন :

ভোর রাতের এত বেদনা ও ক্রন্দন

সবই জানি তোমার থেকে হে পরমজন!

কোরআনের অন্য এক জায়গায় বলা হয়েছে-

) وَمَن يُؤْمِن بِاللَّـهِ يَهْدِ قَلْبَهُ(

যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে আল্লাহ তার অন্তরকে পথ দেখিয়ে দেন ।

রাসূল (সা.)ও বলেছেন493 :

قلب المؤمن بین اصبعین من اصابع الرحمن

মুমিনের অন্তর আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে অবস্থান করছে ।

ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন494 :

ان القلوب بین اصبعین من اصابع الله,یقلبها كیف یشاء,ساعة كذا,وساعة كذا

নিশ্চয় অন্তরসমূহ আল্লাহর আঙ্গুলগুলোর দু টির মাঝে রয়েছে ;তিনি যেমনভাবে চান তা পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।

এই দুই রেওয়ায়াত থেকে প্রত্যেকে তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী এ বিষয়টি বুঝতে পারে ।

প্রথম রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,ঐ ব্যক্তির অন্তর প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে এবং তা তাঁর রহমান নামের পূর্ণ অধীনে রয়েছে এবং এই নামের কিরণ ও তাজাল্লীর ছায়ায় প্রতিপালিত ও প্রশিক্ষিত হয়ে থাকে । অর্থাৎ ঈমান আনয়নকারীদের অন্তরসমূহ তাদের যোগ্যতা এবং ধারণক্ষমতা অনুযায়ী আল্লাহর রহমান নামের বিভিন্ন স্তরের প্রকাশের নিয়ন্ত্রণাধীন ।

দ্বিতীয় রেওয়ায়াত থেকে বোঝা যায় যে ,অন্তরসমূহ-বিশ্বাসীদের অন্তর হোক বা যে কোন অন্তর- আল্লাহ নামের নিয়ন্ত্রণাধীন । আর এই পবিত্র ও বরকতময় নামের বিভিন্নরূপ প্রকাশ রয়েছে । তিনি তাঁর ইচ্ছামত প্রত্যেক হৃদয়কে এ নামের বিশেষ তাজাল্লি দ্বারা পরিচালিত করেন এবং ব্যক্তির প্রবণতা ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তার অবস্থার পরিবর্তন করেন ,একেক সময় একেক রকম ।

সালেক (আধ্যাত্মিক যাত্রী)-কে অবশ্যই আন্তরিকতার সাথে ক্রন্দন করাটাকে তার বন্দেগির পথে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে নিজের জন্য সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে হবে । বিশেষ করে এই মাকামে (মাকামে ইস্তিগফারে) যা কিছু মনের দহন দ্বারা অর্জিত হয় তার কদর তারা ভালোভাবেই জানে । যখনই এমন তাওফিক লাভ হয় তখন ইস্তিগফারের সাথে আকুতি মিনতি এবং অনুনয় প্রার্থনাকে অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে হাতছাড়া করে না । সে সতর্ক থাকে যে ,শত্রু যেন তাকে ধোঁকা দিতে না পারে এবং তার সম্মুখে যে রাস্তা উন্মুক্ত হয়েছে শয়তান সূক্ষ্ম চক্রান্ত দ্বারা সে পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে না পারে । সুতরাং অনুনয়-বিনয় ,প্রার্থনা ও ইস্তিগফার কখনই বন্ধ করে না ,নিজের এ অবস্থাকে বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং অন্য সময়ে তা হবে এমন মনে করে অমনোযোগী হয় না । কারণ ,সে জানে যে ,এই সৌভাগ্য এত সহজে অর্জন করা যায় না এবং এই সুযোগ সবসময় আসে না । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন :

اذا اقشعر جلدک و دمعت عیناک، فدونک دونک، فقد قصدقصدک

যখন তোমার দেহ আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয় এবং তোমার চোখ থেকে অশ্রু বর্ষিত হয় ,তখন জেনো ,তিনি তোমার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন বলেই তুমি এমন অনুভূতির অধিকারী হয়েছ । 495

শোক ও কান্নার অন্য দিক : আরেফদের হৃদয়ের শোক এবং প্রেমাসক্ত ও ভীতদের কান্নার পর্দার একদিকে যেমন রয়েছে হৃদয়ের দগ্ধতা অন্যদিকে তেমনি রয়েছে স্বস্তি ,আনন্দ ,উপভোগ এবং মর্যাদার অনুভূতি ।

এখন রাসূল (সা.) এবং ইমামদের বাণী থেকে এর অর্থ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব ।

দগ্ধ হৃদয় ,কান্না এবং মানসিক প্রশান্তি

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : কিয়ামতের দিন প্রতিটি চক্ষু থেকেই অশ্রু ঝরবে ,কিন্তু ঐসব চক্ষু ছাড়া যেসব চক্ষু আল্লাহর নিষেধসমূহকে পরিহার করে চলেছে এবং ঐ চক্ষু যে আল্লাহর আনুগত্যের জন্য জাগ্রত থেকেছে এবং ঐ চক্ষু যে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে । 496

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,পর্দার এ পাশে গভীর রাতে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী মুখটিই পর্দার ওপাশে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন প্রশান্ত এবং নিশ্চিন্ত রূপে প্রকাশিত হবে । কেননা ,কিয়ামতের দিন পর্দার অন্তরালের গোপন বিষয়গুলো প্রকাশ হওয়ার দিন ।497 ঐ দিন পর্দার আড়ালে থাকা সত্যই সামনে হাজির হবে ।

দুঃখ ,কান্না ও আনন্দ উপভোগ

রাসূল (সা.) বলেছেন : আল্লাহ্ তা আলা শোকাহত ও ব্যথিত হৃদয়কে ভালোবাসেন ।498

আল্লাহর ভালোবাসার অর্থ বান্দাদেরকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা । যার ফলে হাদীসের অর্থ এই দাঁড়ায় যে ,বান্দার হৃদয় যখন পর্দার এ পাশে শোক ও কান্নায় বিহ্বল তখন পর্দার অপর দিকে আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় ।

আর এই আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অন্য রকম আনন্দ উপভোগ করা যায় । ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন : আল্লাহর নিকট রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে এবং কেবল তাঁরই সন্তুষ্টি কামনায় যে অশ্রুবিন্দু ঝরে তার চেয়ে অধিক প্রিয় কোন কিছু নেই । 499

এটা এই অর্থে যে ,বান্দা রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ভয়ে যে অশ্রু ঝরায় ও আকুতি প্রকাশ করে তা তাঁর নিকট খুবই প্রিয় অর্থাৎ এ দুঃখ ও কান্নার আড়ালে তার হৃদয় তাঁর দিকে আকৃষ্ট হয়েছে এবং সে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের আনন্দ উপভোগ করছে । পর্দার আড়ালের ঐশী আকর্ষণই আধ্যাত্মিকতার পথিককে সর্বক্ষণ আকৃষ্ট করে রেখেছে এবং এই আকর্ষণই এই জগতে শোক-দুঃখ ও অশ্রুর আকৃতিতে প্রকাশিত হয় । একদিকে মনের দুঃখ ,পেরেশানি ও অশ্রু বিসর্জন অন্যদিকে মনের আনন্দ ,পবিত্র পানীয়ের স্বাদ আস্বাদন এবং তাঁর দর্শনের আনন্দ উপভোগ । যদি কারো এপার ওপার দু পারে কী ঘটছে দেখার সুযোগ থাকে অর্থাৎ তিনি আধ্যাত্মিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছান ,তখন এপারে ও ওপারে উভয় জগতের আশ্চর্যজনক জিনিস দেখতে পারবেন । তিনি এক ব্যক্তিকে একই সময়ে পরস্পর বিপরীত দুই অবস্থায় দেখতে পাবেন ।

এই দিকে (দুনিয়ায়) তাকে শোকাহত ,অশ্রু বিসর্জনকারী ও আবেদন-নিবেদনকারী রূপে দেখতে পাবে । অন্যদিকে (আখেরাতে) পবিত্র পানীয় পানের আনন্দ ,ঐশী দর্শনের স্বাদ আস্বাদনরত অবস্থায় দেখবে । এরূপ মর্যাদা আসলেই বিস্ময়কর যে ,দুঃখের মাঝে আনন্দ ,আনন্দের মাঝে দুঃখ ,কান্নার মাঝে হাসি এবং হাসির মাঝে কান্না ।

এর চেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক যে ,আমরা ধারণা করি এ বিশ্বজগতের প্রকৃত স্বরূপ ,গভীর রহস্য এবং গোপনীয়তা সম্পর্কে আমরা কিছুটা হলেও বুঝেছি । কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি কখনই এরূপ নয় । কারণ ,সত্যের রূপকে যে দেখবে তার অবস্থা ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের মতো হবে ,যাঁরা আশুরার রাতে ক্রন্দনের মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছেন । আর এজন্যই নিজেদের সমগ্র সত্তাকে তাঁর পথে এভাবে বিসর্জন দিতে পেরেছেন ।

শোককান্না এবং মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ

ইমাম সাদিক (আ.) এক রেওয়ায়াতে আবি বাছিরকে দোয়া এবং কান্না সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন যেখানে তিনি তাঁর সম্মানিত পিতা ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণনা করেছেন : মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর বান্দার মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অবস্থা হচ্ছে সিজদায় ক্রন্দনরত অবস্থা । 500

এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,এ কর্মের বাহ্যিক দিক হলো ক্রন্দনরত অবস্থায় সিজদায় লুটিয়ে পড়া ,কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ দিক হলো মহান আল্লাহর নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের আনন্দে আপ্লুত হওয়া ।

কারবালার আন্দোলন আবেগতাড়িত নাকি বিজ্ঞতাপূর্ণ পদক্ষেপ

প্রশ্ন নং 60 : অনেকে বলেন : আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাজগুলো নিতান্তই প্রেমপ্রসূত ছিল-বিজ্ঞতাপ্রসূত ছিল না । একথার অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় না যে ,ইমামের কাজগুলো ছিল বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধী ?

উত্তর : মানুষের মধ্যে সবসময়ই ভালো এবং মন্দের দ্বন্দ্ব লেগে আছে ,সাধারণত তাকে জিহাদে আকবার (বড় জিহাদ) বলা হয়ে থাকে । অথচ এটা জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) ।

মানুষ যখন তার জ্ঞান ,বিবেক দিয়ে মনের কু-প্রবৃত্তি ও গুনাহ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে তা হচ্ছে জিহাদে আওসাত (মধ্যম জিহাদ) । কেননা ,সে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান হতে চায় । এর পরের পর্যায় হচ্ছে জিহাদে আকবার-যা হচ্ছে ভালোবাসা ও বিবেক ,প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিকতা এবং বুদ্ধিলব্ধ জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ দর্শনের যুদ্ধ ।

এই পর্যায়ে যদিও সে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের ভিত্তিতে কোন সত্যের তাৎপর্যকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং প্রমাণসমূহের দ্বারা তাকে প্রতিষ্ঠিত করে একটি সমাধানে পৌঁছে ,কিন্তু তার অন্তর-যা প্রেম-ভালোবাসার কেন্দ্র তা কখনোই বুদ্ধিবৃত্তিক তাৎপর্যকে (অর্জিত জ্ঞানকে) যথেষ্ট মনে করে না ;বরং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বাস্তবতাকে অনুভব করতে প্রত্যক্ষ জ্ঞান কামনা করে । অর্থাৎ যা কিছু বুঝতে পেরেছে তা আত্মা দিয়ে অবলোকন করতে চায় ।

এই কারণে এর পর থেকেই প্রেম এবং বুদ্ধিবৃত্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং জিহাদে আকবার শুরু হয় । অবশ্য এতে কোন দোষ নেই । কেননা ,দু টিই সত্যের সন্ধান পেয়েছে ,কিন্তু একটি সত্যকে বুঝেছে অপরটি সত্যে পৌঁছেছে । প্রকৃত অর্থে একটি সত্য ,আরেকটি চূড়ান্ত সত্য । একটি ভালো আর অপরটি খুব ভালো । একটি পূর্ণতার নিম্নতর স্তর আরেকটি পূর্ণতার উচ্চতর পর্যায় । এই কারণে আল্লাহর ওলী ও প্রেমিকদের কাজগুলো প্রেম-ভালোবাসার ভিত্তিতে হয়ে থাকে । ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন : সর্বোত্তম মানুষ তিনিই যিনি প্রেমের মাধ্যমে ইবাদত করেন । 501 সেই ব্যক্তিই ইবাদতের স্বাদ পায় এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকৃত রূপ দেখতে পায় ।

বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান মূলত দলিল-প্রমাণ দিয়ে দোযখ এবং জাহান্নামের অস্তিত্ব প্রমাণ করে । কিন্তু প্রেম ও মন বলে যে ,আমি (এ পৃথিবীতেই) দোযখ ও বেহেশত্ দেখতে চাই । যে ব্যক্তি দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে কিয়ামত ,বেহেশত ,জান্নাত ইত্যাদিকে সত্য হিসেবে গণ্য করে সে হচ্ছে জ্ঞানী । কিন্তু যে ব্যক্তি বেহেশত ও দোজখ দেখতে চায় সে হচ্ছে প্রেমিক পুরুষ ।

সাইয়্যেদুশ শুহাদার (ইমাম হোসাইন) কাজগুলো প্রেমপূর্ণ ছিল ,আর সে প্রেম জ্ঞানের ঊর্ধ্বে-জ্ঞানহীনতা নয় । এক সময় বলা হয়ে থাকে ,অমুক কাজ বুদ্ধিমানের কাজ নয় । অর্থাৎ যে কাজ কেবল ধারণা এবং কল্পনার ভিত্তিতে হয়েছে । কিন্তু কখনো কখনো কাজ এমন হয়ে থাকে যে ,শুধু বিজ্ঞতাপূর্ণই নয় ;বরং তার চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রেমপূর্ণ । অর্থাৎ যা কিছু বুঝেছে নিজের মধ্যে তা পেয়েছে ও অর্জন করেছে ।

যখন মানুষ বাস্তবতার মর্মে পৌঁছে তখন সে প্রেমসুলভ আচরণ করে । তখন তার ক্ষেত্রে জ্ঞানের কোন ভূমিকাই নেই । এই ভূমিকা না থাকার অর্থ এই যে ,জ্ঞানের আলো তার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র এক আলোক রশ্মির নিচে ঢাকা পড়েছে । এই কারণে নয় যে ,জ্ঞানের আলো নিভে গেছে এবং আলো নেই । দু টি অবস্থায় জ্ঞান অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং মানুষের কাজ-কর্ম জ্ঞান অনুযায়ী হয় না :

1. যখন মানুষ ক্রোধ এবং কুপ্রবৃত্তির বশে পাপ কাজে লিপ্ত হয় তখন তা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ;বরং বোকামিপূর্ণ । এর উদাহরণ হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণের সম্মুখীন চাঁদের মতো যখন তা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে । এই রূপ অবস্থায় জ্ঞানের আলো নেই । পাপীর জ্ঞান চন্দ্রগ্রহণ হওয়া চন্দ্রের মতো । হযরত আলী (আ.) এই বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন : এমন অনেক বুদ্ধিবৃত্তি ও বিবেক রয়েছে যা প্রবৃত্তির কর্তৃত্বের হাতে বন্দি (অর্থাৎ তার বুদ্ধিবৃত্তি তার কুপ্রবৃত্তির নির্দেশের দাস হয়ে পড়েছে) ।

2. এক্ষেত্রে জ্ঞানের আলো আছে ,কিন্তু এর কার্যকারিতা নেই । এটা ঐ সময়ে যখন জ্ঞানের আলো তার চেয়ে শক্তিশালী আলোক রশ্মির নিচে থাকে । যেমন দিনের বেলায় তারার কোন কার্যকারিতা (কোন আলো) নেই । এই কার্যকারিতা না থাকা এই কারণে যে ,সূর্যের আলো আকাশকে আলোকিত করে রেখেছে ,তার আলোক রশ্মির নিচে তারার আলো রঙ হারিয়ে ফেলেছে । তারার আলো না থাকা বা তা নিষ্প্রভ হওয়ার কারণে এমন হয়নি ;বরং সে সূর্যের বিপরীতে ম্রীয়মাণ হয়ে পড়েছে । যে প্রেমাসক্ত হয়েছে তার জ্ঞান আছে এবং আলোও আছে ,কিন্তু জ্ঞানের আলো প্রেমের আলোক রশ্মির নিচে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে ।

কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি এই রকমই ছিল অর্থাৎ তাঁর কাজ শুধু বুদ্ধিমানের মতোই ছিল না ;বরং তার চেয়েও উচ্চতর ছিল । কেননা ,তা প্রেমপূর্ণও ছিল ।

আশুরার সৌন্দর্য

প্রশ্ন নং 61 : কীভাবে আশুরার সৌন্দর্য এবং যায়নাব (আ.)-এর এই উক্তি ما رایت الا جمیلا - আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি -কে উপলব্ধি করা সম্ভব ?

উত্তর : কখনও কখনও মহত্ত্ব কোন বিষয়কে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে থাকে ,ঐ জিনিসে নয়-যাকে দেখা হয় । যেমন কেউ কেউ বলেছেন ,কখনও কখনও সৌন্দর্য থাকে মানুষের চোখে এবং দৃষ্টিতে ,ঐ বস্তুতে নয়-যাকে দেখা হয় । আল্লাহর সৃষ্ট এ জগৎ হলো সর্বোত্তম সৃষ্টিব্যবস্থা -যদি কেউ এই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল অস্তিত্বের দিকে তাকায় তবে অনেক অদৃশ্য বিষয়কে সে দেখতে পাবে এবং তাকে সুন্দরও দেখবে । এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমরা কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে অস্তিত্ব বা ঘটনাটিকে দেখছি ।

সুন্দর দৃষ্টিতে অস্তিত্ব জগৎ ও জীবনকে দেখলে একদিকে আত্মা ও বিবেক প্রশান্তি লাভ করে অন্যদিকে তা মনে এমন অবিচলতা ,দৃঢ়তা এবং পৌরুষের সৃষ্টি করে যা অপ্রিয় জিনিসসমূহকে সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে । এই দৃষ্টিতেই আশুরা হযরত যায়নাব কুবরা (সা.আ.)-এর কাছে সুন্দর ব্যতীত কিছুই ছিল না । যখন শত্রুরা এ ঘটনাকে আহলে বাইতের জন্য অবমাননাকর গণ্য করে কটাক্ষ ও বিদ্রূপ করছিল তখন বীরঙ্গনা নারী যায়নাবما رایت الا جمیلا (আমি সুন্দর ছাড়া কিছুই দেখিনি) বলে তাদেরকে জবাব দিয়েছেন ।502

ইমাম হোসাইন (আ.) এই সফরের শুরুতেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে ,যা কিছু ঘটবে আল্লাহর ইচ্ছায় তা যেন তাঁর এবং তাঁর সাথিদের জন্য মঙ্গলকর হয় । আর তা বিজয়ের দ্বারাই হোক আর শাহাদাতের মাধ্যমেই হোক ।

ارجو ان یکون خیرا ما اراد الله بنا قتلنا ام ظفرنا অর্থাৎ আমি আশা করছি আল্লাহর ইচ্ছায় যা-ই সংঘটিত হোক তা আমাদের জন্য মঙ্গলই হবে ,শহীদ হই অথবা বিজয়ী হই ।503

বোনের দৃষ্টিতে ঘটনাটি সৌন্দর্যময় হওয়া এবং ভাইয়ের দৃষ্টিতে তা মঙ্গলজনক হওয়া এ দু টি একে অপরের পরিপূরক । কারবালার দর্পণের অনেক সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে আছে । তার থেকে আমরা এখানে কিছু দিকের উল্লেখ করব ।

1. মানুষের পূর্ণতার দ্যুতি : মানুষ যে কত ঊর্ধ্বে আরোহণ এবং কতটা খোদায়ী রঙ ধারণ করতে পারে যে ,তাঁর (তাজাল্লির) মধ্যে বিলীন হতে পারে তা কর্মের মধ্যেই প্রতিফলিত হয় । কারবালা দেখিয়ে দিয়েছে মানুষের আত্মার মর্যাদা কত বেশি এবং এর ঊর্ধ্বগামিতা ও পূর্ণতার সীমা কতদূর পর্যন্ত হতে পারে! এই মহান ঘটনা প্রমাণ করেছে যে ,মানুষের মর্যাদা সকল সৃষ্টির ঊর্ধ্বে । মূল্যবোধের অনুসন্ধানকারীদের কাছে এ দিকটি অনেক মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত ।

2. আল্লাহর সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশ : আধ্যাত্মিকতার বিভিন্ন পর্যায়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হওয়ার মর্যাদায় পৌঁছানো অনেক কঠিন ও দুঃসাধ্য ব্যাপার । যদি হযরত যায়নাব (আ.) কারবালার ঘটনাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত মনে করেন তা আল্লাহর ওলী সাইয়্যেদুশ শুহাদা ,তাঁর সঙ্গী সাথি এবং পরিবার-পরিজনের কর্মে যে মহান বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশিত হয়েছে তার কারণে ।

সত্যিই হোসাইন ইবনে আলী (আ.) ব্যথা অথবা নিরাময় এবং মিলন অথবা বিরহের মধ্যে কোন্টাকে বেছে নেবেন তা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন । অতঃপর যা কিছু মহান প্রেমময় সত্তা আল্লাহ পছন্দ করেন তা-ই পছন্দ করেছিলেন ।

কারবালা আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি মানুষের সন্তুষ্টির উজ্জ্বলতম প্রকাশস্থল । ইমাম হোসাইন (আ.) জীবনের শেষ মুহূর্তে শহীদ হওয়ার স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত এ কথাটির পুনরাবৃত্তি করছিলেন-

الهی رضی بقضائک

( হে আল্লাহ! আমরা তোমার সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট )। নিজের বোনকেও তিনি এই উপদেশ দিচ্ছিলেন-ارضی بقضائ الله ( আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাক )। এটা আধ্যাত্মিকতার উচ্চ পর্যায় । অর্থাৎ নিজেকে মোটেই না দেখা এবং কেবল আল্লাহকেই দেখা । আল্লাহর পছন্দের মোকাবিলায় নিজের কোন পছন্দ না থাকা । তিনি মক্কা থেকে কুফার দিকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেও তাঁর বক্তৃতায় বলেন :رضا الله رضانا اهل البیت ( আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের অর্থাৎ আহলে বাইতের সন্তুষ্টি )।504

এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভালোবাসা এবং আত্মোৎসর্গের ভিত্তি । আর যায়নাব (আ.) এটাকেই সুন্দর বলেছেন এবং এই চিন্তাধারা ও জীবনধারাকেই প্রশংসা করেছেন ।

সত্যমিথ্যার সীমারেখা : আশুরার অন্যান্য সৌন্দর্যের মধ্যে একটি হলো সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য এবং হিংস্র স্বভাবের মানুষ ও ফেরেশতার মতো মানুষের অবস্থান ও কর্মের সীমা পরিষ্কার করে দেওয়া । যখন ভালো-মন্দ ,সত্যমিথ্যা মিশ্রিত হয়ে পড়ে ,মিথ্যার অন্ধকাররাশি সত্যকে অস্পষ্ট ও আচ্ছাদিত করে দেয় ,সেই অন্ধকারময় অবস্থায় মানুষের চিন্তাধারায় বিকৃতি ঘটা ও মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার । আর তখন অস্পষ্ট মুখোশধারী কুফর ইসলামের বেশ ধরে সহজ-সরল মুসলমান এবং অগভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের সত্য সম্পর্কে সন্দেহে ফেলে দেয় । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কর্মের সৌন্দর্য হচ্ছে যে ,তিনি এমন এক মশাল জ্বালিয়েছেন যেন সত্যপথ পরিষ্কার হয় এবং অন্ধকার দূরীভূত হয় । মেষের পোশাকে আসা নেকড়েস্বরূপ ফিতনা ও মিথ্যার চেহারা প্রকাশিত ও চিহ্নিত হয় এবং তাদের প্রতারণা বা ধোঁকা যেন আর কার্যকর না হয় । এটা কি সুন্দর নয় ?

আশুরা ছিল সত্যমিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারী একটি সীমানা যা নামধারী মুসলমানদের থেকে প্রকৃত মুসলমানদের চিহ্নিত করেছে । কারবালায় পরম করুণাময়ের অনুসারীরা এবং শয়তানের বাহিনী পৃথক প্লাটফর্মে আবির্ভূত হয়েছে । যেহেতু মিথ্যা কারবালায় মুখোশবিহীন অবস্থায় ময়দানে এসেছিল সেহেতু সত্য নিশ্চিন্তে ও অকুণ্ঠ চিত্তে মিথ্যার মোকাবেলায় নেমেছিল । যদিও তারা প্রতারণামূলকভাবে ইমাম হোসাইনকে হত্যার উদ্দেশে আগতদেরیا خیل الله ارکبی ( হে আল্লাহর সৈন্যরা! যুদ্ধের জন্য আরোহণ কর ) স্লোগান দিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল ।

যদি তাদের পরিচয় স্পষ্ট হওয়ার পথে সামান্য কিছু অস্পষ্টতা থেকেও থাকে তবে সিরিয়া এবং কুফায় যায়নাব (আ.)-এর বক্তৃতার মাধ্যমে তা দূরীভূত হয়েছিল । এটা রক্তাক্ত আশুরার একটি অতি মূল্যবান সৌন্দর্য ।

4. প্রকৃত বিজয়ের দীপ্তি : আশুরার অপর একটি সৌন্দর্য হচ্ছে বিজয়ের নতুন এক অর্থ ও তাৎপর্য দান । কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ভুলবশত কেবল সামরিক বিজয়কেই বিজয় এবং অত্যাচারিত হওয়া ও শাহাদাত বরণ করাকে পরাজয় বলে মনে করে । আশুরা দেখিয়ে দিয়েছে যে ,চরম অত্যাচারিত হওয়ার মধ্যেও বিজয় থাকতে পারে । নিহত হওয়ার মাধ্যমেও বিজয়ের গ্রন্থ রচনা করা এবং রক্ত দিয়েও বিজয়ের চিত্র অঙ্কন করা সম্ভব । সুতরাং কারবালা সংগ্রামের প্রকৃত বিজয়ী ছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং কী চমৎকার এ বিজয়!

এটাই সেই তরবারির ওপর রক্তের বিজয় -যা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তৃতায় বিভিন্ন সময় প্রতিধ্বনিত হয়েছে । তিনি বলেছেন : যে জাতি শাহাদাতকে সৌভাগ্য বলে মনে করে তারাই বিজয়ী । আমরা শহীদ হওয়া এবং হত্যা করা উভয় অবস্থায়ই বিজয়ী ।505 এটাই কোরআনের সেই শিক্ষাاِحدی الحسنین (অর্থ: দুই কল্যাণের একটি অর্জন) যা আল্লাহর পথে সংগ্রামীদের সংস্কৃতি ।

যে আল্লাহর নির্ধারিত ছক ও নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে সে সর্বাবস্থায় বিজয়ী এবং সেটা প্রকৃত বিজয়ও বটে ।

এই দৃষ্টিভঙ্গি ইমাম হোসাইন ,ইমাম সাজ্জাদ এবং হযরত যায়নাবেরও ছিল ।

যেহেতু ঐসব তিক্ত ঘটনা সত্য এবং ইসলামের জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর ছিল সেহেতু তা সুন্দর এবং আকর্ষণীয় । যখন ইবরাহীম বিন তালহা ইয়াযীদের দরবারে ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তিরস্কার করে বলল : (আজ) কে বিজয়ী হয়েছে ? তিনি বললেন : যখন নামাযের সময় হবে এবং আযান ও ইকামত দেয়া হবে তখন বুঝবে যে ,কে বিজয়ী হয়েছে! 506

নিহত এবং শহীদ হয়েও বিজয় লাভ করা কি সুন্দর নয় ?

5. আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত পথে যাত্রা করা : মানুষ যখন কোন কাজ আল্লাহর ইচ্ছা আল্লাহর চাওয়া অনুযায়ী ই ঘটেছে বলে মনে করে তখন তার সৌন্দর্য উত্তমরূপে প্রতিভাত হয় । যদি শহীদদের নেতা বা তাঁর সঙ্গী-সাথিরা শহীদ হয়ে থাকেন এবং হযরত যায়নাব ও নবীর পরিবার বন্দি হয়ে থাকেন তবে আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়েছে । কেননা ,লওহে মাহফুযে তা লিপিবদ্ধ ছিল । কী চমৎকার যে ,দলবদ্ধ একটি কাজ আল্লাহর চাওয়ার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ!

তাহলে কি হোসাইন বিন আলী (আ.)-কে অদৃশ্য থেকে সম্বোধন করে বলা হয়নি-

ان الله شاء ان یراک قتیلا ان الله شاء ان یراهن سبایا

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাকে নিহত অবস্থায় দেখতে চান এবং তাদেরকেও (নারী-শিশুদের) বন্দি দেখতে চান । সুতরাং এটাই কি আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না যে ,নবীর আহলে বাইত (নারী-শিশুসহ সকল সদস্য) তাঁর ধর্ম এবং মানুষের মুক্তির জন্য বন্দি হবেন ?

অতএব ,এই শাহাদাত বা বন্দি হওয়াতে দুঃখ বা আফসোস কিসের ?

এ দু টি ছিল আল্লাহর দ্বীন রক্ষা এবং খোদাদ্রোহীদের মুখোশ উন্মোচন করার মূল্য যা অবশ্যই দিতে হবে যা প্রেমপূর্ণভাবে ,ধৈর্যসহকারে এবং সাহসিকতার সাথে সম্পাদিত হয়েছে ।

মহীয়সী নারী যায়নাব ওহীর ক্রোড়ে এবং হযরত আলীর শিক্ষায় প্রশিক্ষিত হয়েছেন । তাই তাঁর নিকট আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁরই পথে এই যাত্রা হচ্ছে অতি মূল্যবান এবং সৌন্দর্যের সর্বোত্তম রূপ । তিনি এই কর্মসূচির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুকেই সৌন্দর্যমণ্ডিত অবলোকন করেছেন । কারণ ,তিনি একে একে প্রতিটি প্রাঙ্গন ও ক্ষেত্রকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করেন । এই ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরার ঘটনাটি কি সৌন্দর্যময় নয় ?

6. আশুরা ভাগ্যনির্ধারণের রাত্রি : এই ক্ষেত্রটিতে আশুরার সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতম প্রকাশ ঘটেছে । কারণ ,হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গীরা প্রস্থান এবং অবস্থান এই দুয়ের মধ্যে অবস্থান করাকে বেছে নিয়েছিলেন ,যা তাঁদের আত্মত্যাগ ও বিশ্বস্ততার নিদর্শন । তাঁরা হোসাইনবিহীন জীবনকে অপমান ও প্রকৃত মৃত্যু মনে করেছেন ।

আশুরার রাতে ইমামের ঐ ঐতিহাসিক বক্তৃতা ,তাঁর প্রতি সঙ্গী-সাথিদের বিশ্বস্ত থাকার ঘোষণা ,ইমাম হাসানের কিশোর সন্তান কাসেমের সাথে ইমামের কথোপকথন এবং প্রশ্নোত্তরের বিষয়বস্তু ও ধরন ,507 সকাল পর্যন্ত সাহাবীদের ইবাদত ,মৃদুস্বরে কোরআন পাঠ ,তাঁবুগুলো থেকে দোয়া পাঠের ধ্বনি উচ্চারিত হওয়া ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং যায়নাবের সামনে তাঁদের সাথিদের বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করা-এগুলোর প্রতিটি এই সুন্দর বইয়ের সোনালি অধ্যায় । তাই যায়নাব কেন আশুরাকে সৌন্দর্যময় দেখবেন না ?

কারবালার শিক্ষার ভিত্তিতেই ইতিহাসে পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায় যুলুম-অত্যাচারের সাথে সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে । এটা কি অপরূপ নয় ?

আশুরার প্রতিটি মুহূর্ত ও ক্ষণ শিক্ষালয়ে পরিণত হয়েছে যা মানুষকে স্বাধীনতা ,বিশ্বস্ততা ,মহানুভবতা ,ঈমান ,সাহসিকতা ,শাহাদাতকামিতা এবং অন্তর্দৃষ্টি লাভের শিক্ষা দেয় । এটা কি সুন্দর নয় ?

মরু-প্রান্তরের মাটিতে ঝরে পড়া পবিত্র রক্তের স্রোত যুলুম-অত্যাচারের মূল ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে । এটা কি সুন্দর নয় ?

কুফা এবং সিরিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টিকারীরা ভেবেছিল যে ,সত্যপন্থীদের হত্যার মাধ্যমে নিজেদেরকে চিরস্থায়ী করেছে! কিন্তু যায়নাব (আ.)-এর দৃষ্টিতে তারা নিজেরাই নিজেদের কবর খুঁড়েছে এবং আহলে বাইতের নূরানি চেহারাকে আরো উজ্জ্বল এবং তাঁদের নাম চিরস্থায়ী করেছে । আর এভাবে আল্লাহর ধর্মকে পুনর্জীবিত করেছে । ফলে কারবালা হয়েছে এক বিশ্ববিদ্যালয় ।

পরম সাহসী ও মহীয়সী নারী হযরত যায়নাব এ সত্যগুলো জানতেন এবং সময়ের ঊর্ধ্বে এ ঘটনার সুপ্রসারিত প্রভাবকে দেখেছিলেন । এই সম্মানিত বন্দি নারীকে ইবনে যিয়াদ তিরস্কারপূর্ণ ভাবে সম্বোধন করে বলেছিল : তোমার ভাই এবং তার পরিবারের সাথে আল্লাহর আচরণকে কেমন দেখলে ? তিনি বললেন : আমি সুন্দর ছাড়া কিছু দেখিনি । এটাই ছিল কুফার শাসকের বিদ্রূপাত্মক কথার জবাব ।


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25