আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর12%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48500 / ডাউনলোড: 5357
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

কালো পোশাক পরিধান

৩৯ নং প্রশ্ন : শোক প্রকাশের দিনে কালো পোশাক পরিধানের দর্শন কী ?

কালো রং বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন প্রভাব এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । এর বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে কিছু বা বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহার করে থাকে । কালো রং একদিকে বস্তুকে অন্ধকারে গোপন ও ঢেকে রাখে তাই কখনও কখনও এ রঙ কোন কিছুকে ঢেকে রাখা বা গোপন রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় ।৩৫৭ আবার অন্যদিকে তা ব্যক্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত । এ কারণেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের আনুষ্ঠানিক পোশাক (বিশেষত বহিরাবরণ ,যেমন কোট ,ব্লেজার ইত্যাদি) সাধারণত কালো বা গাঢ় সুরমা রঙের হয় । ইতিহাসে এরূপ অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় যে ,বিশেষ ব্যক্তি ,গোষ্ঠী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য এ ধরনের রঙ ব্যবহার করতেন ।৩৫৮

কালো রঙের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব হলো ,এ রঙটি প্রকৃতিগতভাবে দুঃখ ,বিষাদ ও বিষণ্ণতার পরিচায়ক যা শোক প্রকাশের উপযোগী । এ কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ এ রঙকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর দুঃখ ,শোক ও বিষণ্ণতা প্রকাশে ব্যবহার করে থাকে ।

এ বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো রঙ নির্বাচনের মধ্যে উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো ছাড়াও আবেগ-অনুভূতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে । যে ব্যক্তি তার প্রিয় মানুষের শোকে নিজে কালো পোশাক পরিধান করে এবং দেওয়ালগুলোকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় প্রকৃতপক্ষে সে এ কাজ দ্বারা বলতে ও বুঝাতে চায়- (হে বিদায়ী) তুমি আমার চোখের জ্যোতি ও মণি ছিলে ,তোমার মরদেহ মাটিতে দাফন হওয়া আমার কাছে পশ্চিম আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অস্তমিত হওয়ার মতো ;(তোমার বিদায়) জীবনকে আমার চোখে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ;সময় ও স্থানকে গ্রাস করে ফেলেছে ।

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর অষ্টম দিনে পিতার কবরের নিকট গিয়ে ক্রন্দন করে নিম্নলিখিত কবিতাটি পাঠ করেছিলেন

یا ابتاه انقطعت بك الدنیا بانوارها و زوت زهرتها کانت ببهجتك زاهرة فقد اسود نهارها فصار يحکی حنادسها رطبها و یا بسها...والْسی... لازمنا

হে পিতা! তুমি চলে গেছ ,তোমার চলে যাওয়ার কারণে দুনিয়া এর আলো আমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ,এর নেয়ামতসমূহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে ,বিশ্বজগৎ তোমার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ও আলোকিত ছিল ,(কিন্তু তোমার বিদায়ের পর) এর দিনের আলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে ,এর (দুনিয়ার) সিক্ততা ও শুষ্কতা ,এর অন্ধকার রাতের নির্দেশ করে... এবং দুঃখ ও মর্মবেদনা আমাদের সবসময়ের সঙ্গী... । ৩৫৯

এ কারণেই কালো পোশাক পরিধান করার কারণ কালো রঙে লুক্কায়িত থাকা গোপন রহস্যের মধ্যে নিহিত এবং এর প্রকৃতিগত (দুঃখ ও শোকবাহী) রূপটিই একে যুক্তিসঙ্গত একটি প্রথায় পরিণত করেছে । আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীরা শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করে । কারণ ,এ পোশাক তাঁদের প্রতি প্রেম ও বন্ধুত্বের নিদর্শন বহন করে ,স্বাধীনচেতাদের মহান নেতা ও আদর্শপুরুষ ইমাম হোসাইনের প্রতি নিবেদিত থাকার প্রতিশ্রুতি দান করে । এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার রণাঙ্গনে তাঁকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয় ও নৈতিকভাবে তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ।৩৬০ ইমামদের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে বাহ্যিক কালোর অবয়বে তাঁর সাথে সহমর্মিতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের অন্তরকে আলোকিত করা হয় ;যদিও বাহ্যিকভাবে তা কালো ,কিন্তু ভেতরে উজ্জ্বল ও তাঁর আদর্শে আলোকিত ।

৪০ নং প্রশ্ন : অন্যান্য জাতির মধ্যে কালো পোশাক পরিধান করার প্রচলন রয়েছে কি ? কালো পোশাক পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আগমনের পর আব্বাসী খলিফা অথবা আরব জাতি থেকে ইরানে প্রবেশ করেছে ,ইরানী সভ্যতায় এ ধরনের সংস্কৃতি ছিল না ।

উত্তর : প্রথমত ,শোকের সময় কালো পোশাক পরিধানের রীতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে গ্রহণযোগ্য এক প্রথা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ইরান থেকে শুরু করে গ্রীক সভ্যতা ,এমনকি আরবের জাহেলী সংস্কৃতিতেও এর প্রচলন ছিল ।

দ্বিতীয়ত ,কালো পোশাক পরিধান আব্বাসী খলিফাদের সময় অথবা ইসলাম আগমনের পর আরবদের নিকট থেকে ইরানে প্রবেশ করেনি ;বরং এর মূল প্রাচীনকাল থেকেই ইরানী সংস্কৃতিতে নিহিত ছিল এবং বাহ্যিকভাবে তাদের ব্যবহারিক জীবনে এর প্রচলন ছিল । নিচের বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে :

১. অনেক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বর্ণনা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে ,পৃথিবীর অনেক জাতি ও গোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে শোকের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করত । উদাহরণস্বরূপ ইরান ,গ্রীক ও আরব সংস্কৃতির কিছু নমুনা তুলে ধরলাম :

ক. প্রাচীন ইরানের কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : প্রাচীন ইরানের পাণ্ডুলিপিগুলোতে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে ,কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো । ইরানী বিখ্যাত সাহিত্যিক ফেরদৌসী শাহনামা তে ইরানী প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘটনাতে কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন ।

বিশেষ করে যখন রুস্তমের ভাই শুগাদ তাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছিল ,ফেরদৌসী তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :

এক বছর সিস্তানে শোক ছিল ,তাদের জামাসমূহ কালো ছিল ।

সাসানীদের যুগে যখন বাহরাম গুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল ,তার উত্তরাধিকারী ইয়াজ্দর্গাদ শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ।

পথে চল্লিশ দিন পিতার শোক পালন করেছিল ,

সৈন্যরা কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

ফেরেইদুন যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল তার উত্তরাধিকারী ও সন্তানরা এ কাজ করেছিল :

মানুচেহর এক সপ্তাহ যন্ত্রণায় ছিল ,দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ ও চেহারা হলুদ ছিল ;সকলে পরেছিল কালো পোশাক ,রাজা পেলেন মনোবল সৈন্যদের সম্মিলিত সমবেদনা প্রকাশে ।

এ কালো পোশাক পরার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত ইরানে চালু রয়েছে ।৩৬১

খ. গ্রীক সভ্যতায় কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : গ্রীসের প্রাচীন কল্পকাহিনীতে এসেছে : হেক্টরের হাতে প্রটিসিলাস নিহত হওয়ার ঘটনায় টাইটাস অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে শোকের চিহ্ন হিসেবে সবচেয়ে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

এ বিষয়টি গ্রীক সভ্যতায় কবি হোমারের যুগে কালো পোশাক পরিধান করার প্রথার প্রমাণ বহন করে । ইহুদিদের মধ্যে প্রাচীনকালে আত্মীয়-স্বজনের শোকে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে ,সকলে মাথা কামিয়ে ছাই মাখত এবং তাদের পোশাক কালো অথবা কালোর কাছাকাছি কোন রংয়ের ছিল ।৩৬২

বুসতানী তাঁর বিশ্বকোষ -এ কালো রঙ ইউরোপীয় সভ্যতার সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে শোক পালনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রং হিসেবে গণ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন : শোক পালনের সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তার নৈকট্যের শ্রেণিভেদে তারা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করে । বিশেষ করে বিধবা নারীরা কমপক্ষে এক বছর শোক পালন করে এবং এই সময়ে তাদের পোশাক থাকে কোন ধরনের নকশা ও অলংকার ছাড়া কালো রংয়ের ।৩৬৩

আরব জাতির কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : আরবদের ইতিহাস ,কবিতা ও ভাষা সাক্ষ্য দেয় যে ,মিশর হতে সিরিয়া ,ইরাক ও সৌদি আরবসহ সব জায়গায় কালো রঙ শোকের রঙ হিসেবে পরিচিত ছিল ।

ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব সাহিত্যিক ও কোরআনের মুফাস্সির যামাখশারী লিখেছেন : একজন সাহিত্যিক বলেছেন : কালো পোশাক পরিধানকারী সন্যাসীকে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম : কেন কালো পোশাক পরিধান করেছ ? বলল : আরবরা যখন তাদের মধ্য হতে কেউ মারা যায় তখন কোন্ ধরনের পোশাক পরিধান করে ? সন্যাসী বলল : আমিও আমার গুনাহের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছি । ৩৬৪

ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে ,আরব জাতি তাদের মুসিবতের সময় নিজেদের পোশাককে কালো করত ।৩৬৫

রাসূল (সা.)-এর যুগে বদরের যুদ্ধের শেষে যখন ৭০ জন মুশরিক ও কুরাইশ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল তখন মক্কার নারীরা তাদের নিহতদের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।৩৬৬

এসকল ঐতিহাসিক বর্ণনা এবং সাহিত্যিক রচনা ও কবিতা প্রমাণ করে যে ,কালো রং প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে শোকের চিহ্ন হিসেবে প্রচলিত ছিল । এ বিষয়টি ইরান বা ইসলামী যুগের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পৃক্ত নয় ;বরং ইসলামের পূর্বে ইরানীরা ও প্রাচীন গ্রীসের আধিবাসীরাও শোক প্রকাশের প্রথা হিসেবে কালো অথবা গাঢ় নীল রংয়ের পোশাক পরিধান করত ।৩৬৭

২. আহলে বাইত (আ.)-এর মাঝে কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : তথ্যভিত্তিক সংবাদ এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা করে যে ,রাসূল (সা.) এবং পবিত্র ইমামগণও এই যৌক্তিক প্রকৃতিগত পথকে সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় ব্যক্তির শোকে তাঁরা নিজেরাও কালো পোশাক পরিধান করেছেন ।

নাহজুল বালাগার শারহ (ব্যাখ্যা গ্রন্থ)-এ ইবনে আবিল হাদীদ বর্ণনা করেছেন : ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতা আলী (আ.)-এর শাহাদাতের শোকে কালো পোশাক পরিধান করে মানুষের মাঝে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ।৩৬৮

এ কারণে যে হাদীসটি সকল হাদীসবিদ বর্ণনা করেছেন যে ,ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : বনি হাশিমের নারীরা আবা-আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর শোকে কালো পোশাক পরিধান করতেন ।

لما قتل الحسین بن علی)ع ( لیس نساء بنی هاشم السواد و المسوح و کن لاتشتکین من حر ولابرد و کان علی بن الحسین)ع ( یعمل لهن الطعام للمأتم

যখন ইমাম হোসাইন (আ.) শহীদ হলেন তখন বনি হাশিমের নারীরা কালো ও রুক্ষ-পশমের পোশাক পরিধান করেছিলেন ,গরম বা ঠাণ্ডার বিষয়ে তাঁদের কোন অভিযোগ ছিল না ,তাঁরা শোক পালনে রত থাকার কারণে (আমার পিতা) আলী ইবনে হোসাইন (আ.) তাঁদের জন্য খাবার তৈরি করতেন ।

আব্বাসীদের কালো পোশাক পরিধান করার কারণ

আব্বাসী খলিফারা উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সময় থেকে বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে আহলে বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী হিসেবে দাবি করেছিল । এ কারণে যখন তারা ক্ষমতা অর্জন করেছিল তখন তাদের শাসনকে আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর শাসন হিসেবে অভিহিত করত এবং বলত যে ,এই খেলাফত হচ্ছে আলী (আ.)-এর খেলাফতেরই ধারাবাহিকতা । তাদের প্রধানমন্ত্রী আবু সালামা খাল্লালকে আলে মুহাম্মাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সামরিক বাহিনীর প্রধান আবু মুসলিম খোরাসানিকে আলে মুহাম্মাদের আমিন (বিশ্বস্ত ব্যক্তি) বা নেতা হিসেবে নামকরণ করেছিল ।

কালো পোশাক রাসূল (সা.)-এর অবমাননা ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার শোকের প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ।৩৬৯ আব্বাসী খলিফারা কালো পোশাক পরিধানের প্রথা ইরানে এবং অন্যান্য ইসলামী শহরে প্রবর্তন করে নি ;কেননা ,মৃত ব্যক্তির শোকে কালো পোশাক পরিধানের প্রথা সামাজিকভাবে এবং বিশেষভাবে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল ।

কারবালার মযলুম শহীদ ইমাম হোসাইন এবং বনি উমাইয়ার হাতে নিহত তাঁর নাতি যাইদ ইবনে আলী ও ইয়াহিয়া ইবনে যাইদের রক্তের প্রতিশোধের অজুহাতে আব্বাসী খলিফারা কালো পতাকা ও কালো পোশাক পরিধান করাকে আহলে বাইতের শহীদদের শোক প্রকাশের উপকরণরূপে ব্যবহার করেছে । এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করে তারা আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রতারিত করে নিজেদের দলে আনার চেষ্টা করেছে এবং এ ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের মনে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছে । তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও কালো পতাকা ও পোশাককে সবসময়ের জন্য নিজেদের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল ।৩৭০

এই প্রতারণার কারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং অন্যান্য ইমাম কালো রঙের পোশাকের বিরুদ্ধে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতেন । আব্বাসী খলিফারা আনুষ্ঠানিকভাবে কালো পোশাককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ইমামরা এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা করেছেন । তাদের সাথে এ বিষয়ে (কালো পোশাক ব্যবহার) একাত্মতা প্রকাশ করা অত্যাচারী শাসককে স্বীকৃতি দান বলে মনে করা হতো । কিন্তু তাঁরা সার্বিকভাবে আহলে বাইতের শহীদদের শোকে শোকাহত হয়ে কালো পোশাকের সংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন না ।৩৭১

শোক প্রকাশের পদ্ধতি

৪১ নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য কী পরিমাণ শোক প্রকাশ করা বৈধ ?

ইসলামী শরিয়তের বিধান শোক প্রকাশের পেছনে নিহিত দর্শন ও বুদ্ধিমান সমাজের কাছে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিই আহলে বাইত বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করবে । যদি শোকের আবেগ-উদ্দীপনার মাত্রা তার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর এমনভাবে প্রাধ্যান্য লাভ করে যে ,এর দর্শন থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তা শরিয়ত ও বৃদ্ধিবৃত্তির সীমানা থেকে দূরে সরে যাবে । যদি এর ধরন এমন হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সমাজ অপছন্দ ও ঘৃণা করে ,তা শিয়া মাযহাব ও এর প্রকৃত শিক্ষার সাথে অবমাননাকর মনে হয় তাহলে অবশ্যই এ ধরনের শোক প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত ও বর্জিত হবে ।

বলা বাহুল্য ,শোক প্রকাশের ধরন এমন হওয়া উচিত যাতে এর শিক্ষার প্রকৃত বিষয়বস্তুকে মানুষের মাঝে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে এবং ইমামদের সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে । যদি এ শোক প্রকাশের বাহ্যিক রূপ এমন হয় যে ,অভ্যন্তরীণ রূপের আদৌ প্রকাশ না ঘটায় ;বরং মূল বিষয়বস্তুকেই বিতর্কিত করে তোলে তাহলে এ বিষয়টি সঠিক রূপে প্রকাশ লাভ করবে না ;আ তা আশুরার রূপকেই বেমানান করে তুলবে । উদাহরণস্বরূপ ,কিছুসংখ্যক লোক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীরে আঘাত করার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে থাকে । এ ধরনের ব্যক্তিরা শুধু আশুরার প্রকৃত আদর্শকে বিকৃতরূপে প্রচার করল না ;বরং যেমনভাবে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আলী খামেনেয়ী বলেছেন ,তারা আশুরার শিক্ষার প্রতি অবমাননা করল এবং এ অবমাননার কারণে এ ধরনের কাজ বৈধ হবে না ।৩৭২

৪২ নং প্রশ্ন : যদিও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয় তবুও কেন কিছু শোকানুষ্ঠানে তাঁর কেবল হীন ও মযলুম অবস্থা প্রর্দশন করা হয় । কিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ?

উত্তর : عزت শব্দটির অর্থ কঠিন ,শক্তিশালী ,দৃঢ় হওয়া । শব্দটি কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্যকে আল্লাহ ,রাসূল (সা.) এবং মুমিনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছে ।

ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা কোরআনের এই শিক্ষার অনুসরণের ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রগামী ছিলেন । কখনই অপমান ও লাঞ্ছনাকে সহ্য করেননি । ফলে এই বিষয়টিهیهات م نّا الذلة অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে অনেক দূরে -আশুরার আন্দোলনের অন্যতম স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে ।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ,কিছু সূত্র ও লেখনিতে এমন বিষয় উল্লিখিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামে আয়োজিত কিছু শোকানুষ্ঠানে এমন কথা বলা হয়ে থাকে যেগুলোতে তাঁর আন্দোলনে বিদ্যমান সম্মান ও মর্যাদার উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয় ।

এ পদ্ধতির পেছনে নিহিত মনস্তাত্ত্বিক মূল কারণ হলো হোসাইনী আন্দোলনের প্রচারকারী কতিপয় ব্যক্তি ইমামের আন্দোলনের শিক্ষামূলক বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পরিবর্তে শুধু তাদের কান্নার অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্য চেষ্টা করে । এ কারণে অগ্রহণযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে শোকের বিষয়বস্তু বর্ণনা করে এবং হোসাইনী আন্দোলনের অপমানজনক ও লাঞ্ছনাময় চেহারা মানুষের সামনে চিত্রায়িত করে ।

যে সকল বিষয়বস্তু বর্ণনার ফলে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদার হানি ঘটে এবং যার বর্ণনা ইসলাম ,রাসূল (সা.) ,আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত ;এ ধরনের বিষয়বস্তুকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে ।

তবে দলিল সহকারে ও সঠিক সূত্র থেকে হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীরা যে সকল অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন তা বর্ণনা ও বিশ্লেষণের অর্থ তাঁদের মর্যাদার হানি ঘটা নয় ;বরং এর মাধ্যমে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মানুষের নিকট আরো সুস্পষ্ট করা হয় । কেননা ,শত্রুদের অত্যাচারের ঘটনার বর্ণনা এবং তাদের মোকাবেলায় ইমাম হোসাইনের সাহসী ও ও সংগ্রামী ভূমিকার বিশ্লেষণ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে যে ,কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব ।

৪৪ নং প্রশ্ন : আশুরার মহত্ত্ব প্রকাশ ও এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য কেন আলোচনা-সংলাপকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় না ? কেন এ ধারণা করা হয় যে ,আশুরার ঘটনাকে জীবন্ত রাখার একমাত্র পদ্ধতি হলো মানুষকে অবশ্যই বুক চাপড়িয়ে ক্রন্দন করতে হবে ,শহরকে কালো রঙে ঢেকে দিতে হবে ,অর্ধরাত্রি পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে ;এমনকি দিনের কিছু সময়ে বা আশুরার পুরো দিন কাজ-কর্ম পরিহার করে রাস্তায় বের হয়ে

সমবেতভাবে মাতম করতে করতে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে ? বিশেষ করে যখন এ ধরনের কাজ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয় ;অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন ছাড়া এ অনুষ্ঠান পালন করা সম্ভব নয় কি ? এমন কোন পদ্ধতি কি অবলম্বন করা যায় না যাতে এ ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম হবে ? উদাহরণস্বরূপ টক শো ,বৈঠক অথবা সেমিনারের ব্যবস্থা করা যেখানে শ্রোতারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আশুরার স্মৃতিকে জাগ্রত করবে ?

উত্তর : শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের ওপর এ ধরনের বৈঠক ,সেমিনার ,আলোচনার অনুষ্ঠান ,প্রবন্ধ লিখন ,সাংস্কৃতিক ,তাত্ত্বিক ,গবেষণামূলক কাজ অত্যন্ত কার্যকরী ও জরুরি ;তবে ইমামের নাম এবং শোকানুষ্ঠানের বরকতে আমাদের সমাজে এ ধরনের কাজ অনেক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ;সাধারণ মানুষরাও এ থেকে জ্ঞান লাভ করে ।

এ ধরনের কর্মতৎপরতার স্বস্থানে প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু আশুরার শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট কি ? নাকি অন্যান্য প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ,যেমন শোকানুষ্ঠান-যার সঙ্গে মানুষ আগে থেকেই পরিচিত ,তারও প্রয়োজন আছে ?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের মনোবিদ্যার দৃষ্টিতে মানুষের দিকে দৃষ্টি আরোপ করতে হবে এবং দেখতে হবে আমাদের সচেতনমূলক আচরণের পেছনে কোন্ ধরনের উপাদান অধিক কার্যকর । শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই কি আমাদের সামাজিক আচরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে ,নাকি এর সাথে অন্য কোন উপাদান রয়েছে ।

আমাদের আচরণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাব যে ,আমাদের আচরণের মধ্যে কমপক্ষে দু টি উপাদান মূল ভূমিকা পালন করে । একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিচিতিমূলক উপাদান অপরটি অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান । এক ধরনের পরিচিতিমূলক উপাদান রয়েছে যার কারণে মানুষ কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ও একে গ্রহণ করে । স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে তার উপযোগী বৃদ্ধিবৃত্তিক বা অভিজ্ঞতামূলক অথবা অন্য যে কোন দলিল ব্যবহার করা হয় ।

নিশ্চিতভাবে কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের আচরণের ওপর অনেক প্রভাব রাখে ,কিন্তু তা একমাত্র কার্যকরী উপাদান নয় । আরো অনেক

ধরনের উপাদান রয়েছে ,হয়তো আমাদের আচরণের ওপর সেগুলোর প্রভাব পরিচিতিমূলক উপাদানের চেয়েও অধিক । এ ধরনের উপাদানকে সার্বিকভাবে আবেগ ,অনুভূতি ও প্রবণতা নামকরণ করা হয় । এগুলো অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান হিসেবে আমাদের আচরণের ওপর কার্যকর ভূমিকা রাখে ।

যখনই আপনি আপনার আচরণকে-হোক তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অথবা সামাজিক বা রাজনৈতিক-পর্যালোচনা করবেন ,লক্ষ্য করবেন যে ,যে মূল উপাদানটি আপনাকে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য করেছে তা হলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোন উপাদান ।

শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারী এ বিষয়ে বলেন : আমাদের অভ্যন্তরে কোন উপাদান থাকতে হবে যা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করবে । কোন কাজের জন্য আমাদের আগ্রহ থাকতে হবে ,তবেই আমরা কাজটি সম্পাদন করতে উদ্যোগী হব । শুধু কোন কাজ সম্পর্কে জ্ঞান ঐ কাজ করতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে না ,এর সাথে মনোগত কারণও রয়েছে যা ঐ কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে । এ ধরনের উপাদানকে অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান বলা হয় । এ উপাদানই সার্বিকভাবে কোন কাজে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ ,ভালোবাসা ও উদ্দীপনা তৈরি করে । এ উপাদান না থাকলে কোন কাজ সম্পন্ন হয় না । এমনকি যদি মানুষ কোন খাদ্যের বিষয়ে এ জ্ঞান রাখে যে ,তা শরীরের জন্য উপকারী ,কিন্তু ঐ খাদ্য খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ না থাকে তাহলে সে ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে না । যদি কোন ব্যক্তির খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায় ,খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ,যতই তাকে বলা হোক যে ,খাদ্যটি শরীরের জন্য উপকারী ,তবু সে খাদ্যটি খাওয়ার ব্যপারে কোন আগ্রহ খুঁজে পাবে না । অতএব ,কোন কাজের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়াও মানুষের মনের আগ্রহ-উদ্দীপনারও প্রয়োজন রয়েছে । সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ও ঠিক একই রকম । কোন ব্যক্তি কোন আন্দোলনকে ভালো ও উপকারী মনে করলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খুঁজে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না ।

এখন এ বিষয়টিকে আমরা গ্রহণ করেছি যে ,মানুষের সচেতনমূলক যে কোন পদক্ষেপ বা আচরণের পেছনে দুই ধরনের উপাদান থাকা অত্যন্ত জরুরি । প্রথম ,ঐ বিষয় সম্পর্কে পরিচিতিমূলক জ্ঞান । দ্বিতীয় ,ঐ কাজের

জন্য অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান অর্থাৎ উৎসাহ-উদ্দীপনা । আমরা শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন মানবজাতির সৌভাগ্যের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা জানার পরও বুঝতে পারি যে ,শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান আমাদেরকে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী করে তোলে না ;বরং যখন ঐ বিষয়ের প্রতি আমাদের মনে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে তখনই কেবল ঐ আন্দোলনকে স্মরণ করে ইমাম হোসাইনের মতো নিজেকে উৎসর্গ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব ।

শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ও পরিচিতি ঐ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করে না ;বরং অভ্যন্তরীণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে হয় যা আমাদেরকে ঐ কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ।

সভা-সমাবেশ ,আলোচনা-পর্যালোচনা ,বক্তব্য প্রথম উপাদানের অর্থাৎ পরিচিতি ,তথ্য ও জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করে ,কিন্তু আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য অন্য উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে । কোন ঘটনার পরিচিতি ,স্মরণ ও পর্যালোচনা ঐ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে ,তবে যে উপাদানটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল ভূমিকা পালন করে তা হলো মনের দিক-যা সরাসরি মানুষের আবেগ-অনুভূতির সাথে জড়িত ।

যখন কোন মর্মান্তিক ঘটনাকে মঞ্চায়িত করা হয় এবং মানুষ এ ঘটনাকে খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করে তখন সেটার সাথে বই পড়ে অথবা অন্য কারো নিকট থেকে ঐ ঘটনা জানতে পারার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে ।

এ রকম অভিজ্ঞতা আপনারা নিজেরা অনেকবার অর্জন করেছেন । অনেকবার আশুরার ঘটনা শুনেছেন একং জেনেছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কীভাবে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন । কিন্তু শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান কি আপনাদের চোখের অশ্রু প্রবাহিত করে ? অবশ্যই ,না । অথচ যখন আপনি কোন শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং শোকগাথা পাঠকারী কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা আকর্ষণীয় কণ্ঠে বর্ণনা করেন ,বিশেষ করে যদি তাঁর সুর ভালো হয় ,তাহলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আপনার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়বে ।

এ পদ্ধতি আপনার অনুভূতির ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে যা শুধু অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সম্ভব নয় । এ কারণেই যা প্রত্যক্ষ করা হয় তা শোনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব রাখে । এ বিষয়গুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়টি বোঝানো যে ,আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কেন আবু আবদিল্লাহ (আ.) বিদ্রোহ করেছেন ,মযলুম অবস্থায় শহীদ হয়েছেন । কিন্তু এর পাশাপাশি আশুরার ঘটনাকে আমাদের সামনে বর্ণনা বা মঞ্চায়নের মাধ্যমে এমনভাবে সাজাতে ও চিত্রায়িত করতে হবে যাতে তা বেশি পরিমাণে আমাদের হৃদয় ও অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয় । যত বেশি এ আবেগ সৃষ্টি হবে তত বেশি আমাদের জীবনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে ।

এ কারণেই আশুরার ঘটনার ওপর শুধু তত্ত্বগত আলোচনা প্রকৃত ভূমিকা পালনে অক্ষম । বরং সামাজিকভাবে এমনভাবে শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে যা মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করবে । যখন কেউ সকালে ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে দেখতে পায় সম্পূর্ণ শহরকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এবং সর্বত্র কালো পতাকা স্থাপন করা হয়েছে ,এ পরিবর্তনটি মানুষের অন্তরকে অধিক নাড়া দেয় ।

যদিও মানুষ জানে আগামীকাল মুহররমের প্রথম দিন ,কিন্তু এ তথ্য তাদের অন্তরকে ঐ রকম প্রভাবিত করতে পারে না যতটা সকল স্থানে কালো পতাকা ও সকলকে কালো পোশাক পরিহিত দেখা তাকে প্রভাবিত করবে । তাই সামষ্টিক ভাবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে মর্সিয়া পাঠ ও বুক চাপড়ানোর অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে যতটা প্রভাব ফেলা সম্ভব ,অন্য কোন কিছুতে তা সম্ভব নয় ।

এখান থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বক্তব্যগুলো অসংখ্য বার পুনরাবৃত্তি করতেন সেগুলোর কারণ অনুধাবন করা সম্ভব । তিনি বলতেন : আমাদের যা কিছু (মূল্যবোধ) রয়েছে তা মুহররম ও সফর থেকে । তিনি শোকানুষ্ঠানকে ঐত্যিহ্যবাহী প্রচলিত পদ্ধতিতে পালন করার ওপর গুরুত্ব দিতেন । কেননা ,গত তের শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হয়েছিল যে ,আবেগময় পদ্ধতিতে শোক পালনের বিষয়টি মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আত্মত্যাগী অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে কত বেশি ভূমিকা রাখে এবং কীরূপ অলৌকিক পরিবর্তন ঘটায়!

অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে ,ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যে সকল বিজয় অর্জিত হয়েছে তার সবই আশুরার শিক্ষা এবং শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামের বরকতে অর্জিত হয়েছে । এই প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও অচিন্তনীয় ছিল । কোন বস্তুর বিনিময়ে এ ধরনের মহামূল্যবান অনুভূতি সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব ? এরূপ শোকানুষ্ঠানগুলো কি ধরনের পবিত্র প্রেমের সৃষ্টি করে যা মানুষকে শাহাদাত বরণ করার জন্য প্রস্তুত করে ? যদি বলি যে ,প্রকৃত ইসলাম ছাড়া অন্য কোন সমাজ ও মতাদর্শেই এ ধরনের উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না ,তাহলে অর্থহীন কোন কথা বলি নি ।

শোকানুষ্ঠান পালন করার সময়

৪৪ নং প্রশ্ন : কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে তাঁর শাহাদাতের দিন আসার পূর্বেই (আশুরার দিনের পূর্বে) শোক পালন শুরু করি ?

উত্তর : আশুরার পূর্বে শোকানুষ্ঠান পালন হচ্ছে আশুরার শোকানুষ্ঠানের ভূমিকাস্বরূপ । আবু আবদিল্লাহ (আ.)-এর জন্য শোক পালনের মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু এ অনুষ্ঠানের ধরন ও সময় বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে প্রচলিত প্রথা ও রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় । যেমন কিছু অঞ্চলে ইমাম হোসাইনের শোকানুষ্ঠান ৭ মুহররম থেকে শুরু হয়ে ৩রা সফর পর্যন্ত চলতে থাকে ,কিছু অঞ্চলে ১লা মুহররম থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলে ;কিছু অঞ্চলে সারা বছর বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে শোকগাথার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ;কিছু অঞ্চলে মুহররম মাসের শুরু থেকে সফর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান চলে ।

এ সকল ধরন আসলে কোন সমস্যা নয় । কারণ ,শোকানুষ্ঠান এবং মৃত্যুবার্ষিকী পালন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত । সাধারণত মৃত্যুবার্ষিকী পরবর্তী বছরগুলোতে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর রাতে পালন করা হয় । যেহেতু শাহাদাত অনেক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সেহেতু শোকানুষ্ঠানগুলো বছরের যে কোন সময়ে পালন করা হোক না কেন ,এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে ঘটেছে ।

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

সর্বজনীনভাবে মানবপ্রজাতির অনুভূতি মৃত ব্যক্তিদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার সচেতন উপস্থিতির সপক্ষে রায় দেয় , অচেতন বা ঘুমন্ত অবস্থার সপক্ষে রায় দেয় না। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই সদ্যমৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুভব করে যে , যেন সে আশেপাশেই আছে , যেন সব কিছু দেখছে ও শুনছে , কিন্তু কথা বলতে পারছে না অর্থাৎ জীবিতদের শোনার মতো করে কথা বলতে পারছে না।

এমনকি নাস্তিক লোকেরা পর্যন্ত তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখায় এবং তাদের স্মৃতির প্রতি ঠিক সেভাবেই ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে যেভাবে ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতো তাদের জীবদ্দশায় ; তাদের চেতনার অসম্মান হোক এটা তারা কিছুতেই মানতে পারে না। এ ব্যাপারে তাদের প্রায় সকলেই আন্তরিক। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত থাকাকালে যাদের সাথে তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো তার মৃত্যুর পরেও তারা তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তথা অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা পোষণের তো কোনোই অর্থ হয় না। আসলে তারা অবচেতনভাবে হলেও মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব ও কাছাকাছি উপস্থিতির প্রত্যয় পোষণ করে। অন্যদিকে যারা আস্তিক , ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সকলেই সচেতনভাবেই এ প্রত্যয় পোষণ করে থাকে।

মানুষ সাধারণতঃ এমন কিছু করতে চায় না তার মৃত স্বজন বেঁচে থাকলে যা অপসন্দ করতো। তারা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে পর্যবেক্ষণক্ষমতাসহ উপস্থিত অনুভব করে বলেই এরূপ আচরণ করে থাকে। মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে বিলুপ্ত বা ঘুমন্ত মনে করলে তারা কখনোই এরূপ আচরণ করতো না , কারণ , সে ক্ষেত্রে এরূপ আচরণ হতো অযৌক্তিক ও অর্থহীন। মৃত ব্যক্তিদের দেহভস্ম সসম্মানে সংরক্ষণ অথবা তাদের ক্ববরে বা তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের কাছে বা তাদের মমিকৃত মৃতদেহের সামনে গিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের পিছনেও তাদের একই অনুভূতি কাজ করে থাকে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকতে চায় , প্রয়োজনে দূরে কোথাও গেলেও যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছে ফিরে আসতে চায় এবং নিয়মিত পরস্পরের খোঁজখবর জানতে চায়। তাই মৃত্যুর পরেও প্রিয় স্বজনদের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার চিন্তা তাদের মধ্যে হতাশা ও বিমর্ষতার সৃষ্টি করে। তাই সকলেই সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে এ আশাই পোষণ করে যে , মৃত্যুর পরেও সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকবে। নিজ বাড়ীতে বা বাড়ীর যথাসম্ভব কাছাকাছি প্রিয় স্বজনদের ক্ববরের পাশে ক্ববর দেয়ার জন্য ওয়াছ্বীয়াত্ করে যাবার পিছনেও একই অনুভূতির প্রভাব বিদ্যমান। নয়তো মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত থাকে বলে ধারণা পোষণ করলে মৃত ব্যক্তির বা তার জীবিত প্রিয় স্বজনদের কারো কাছেই এ ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনোই মূল্য হতে পারে না।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে দীর্ঘ ঘুম পসন্দ করে না - না তার নিজের জন্য , না তার প্রিয় স্বজনদের জন্য। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা হাজার হাজার বা কোটি কোটি বছর ঘুমিয়ে থাকবে এটা নিজের বা প্রিয়জনদের জন্য চিন্তা করতেই মানুষ বিষণ্ন ও বিমর্ষ হতে বাধ্য। তাই তারা মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার জাগ্রত অবস্থাই কামনা করে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে তার নিজের ভালো কাজের পুরষ্কার ও তার শত্রুর বা তাকে কষ্টদানকারীর জোর-যুলুম ও মন্দ কাজের শাস্তির ব্যাপারে অতি বিলম্ব পসন্দ করে না। অবশ্য সে নিজের পুরষ্কার ও প্রতিপক্ষের শাস্তির ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা অপরিহার্য লক্ষ্য করলে সে ক্ষেত্রেও যথাসময়ের পূর্বে ভালো ও মন্দ কাজের কিছু না কিছু প্রভাব আশা করে। উদাহরণস্বরূপ , যাকে পুরষ্কার দেয়া হবে তাকে নির্ধারিত অনুষ্ঠানের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে এলে সেখানেই বা তার কাছাকাছি কোনো ভালো ও আরামদায়ক অবস্থানস্থলে সাদরে বিশ্রাম নিতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও আদর-আপ্যায়ন করা হয়। তেমনি বিবাহ বা অন্যবিধ আনন্দ-অনুষ্ঠানেও মেহমানদেরকে মূল ভোজনপর্বের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে বা কাছাকাছি অন্য কোনো উত্তম পরিবেশে বিশ্রাম ও আরাম করতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও , আন্তরিক আদর-আপ্যায়ন করা হয়। বস্তুতঃ সকলে এটাই আশা করে। অন্যদিকে একজন সন্দেহাতীত ফৌজদারী অপরাধীকে গ্রেফতারের পর থেকে বিচার শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত এমন অবস্থায় রাখা ও আনা-নেয়া করা হয় যাকে শাস্তি বলা না গেলেও তা মোটেই আরামদায়ক বা সম্মানজনক নয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় - যা এক ধরনের মানসিক শাস্তি বটে। আর সাধারণভাবে লোকেরা এটাই পসন্দ ও আশা করে।

তাছাড়া শাস্তি ও পুরষ্কার উভয়ই যদি হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর দূরবর্তী হয় ; তার ছিটেফোঁটাও যদি আশুপ্রাপ্তি না ঘটে , বরং হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর যদি ভালো ও মন্দ উভয় ব্যক্তিকে পাশাপাশি অভিন্ন অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় তাহলে মানবমনে তা অন্যায় বলে প্রতিভাত হয় এবং তা মানুষের মনে ও আচরণে হতাশা সহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে বাধ্য। কারণ , অতি বিলম্বিত পুরষ্কারের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পায় এবং অতি বিলম্বিত শাস্তির প্রতি ভীতিও হ্রাস পায়।

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , মানবপ্রকৃতিতে যতো প্রয়োজন ও কামনা-বাসনা নিহিত রাখা হয়েছে তার সবই পূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাই সর্বজনীনভাবে যেহেতু মানবপ্রকৃতি তার ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব এবং সচেতন জাগ্রত অবস্থা , স্বীয় সৎকর্মের পুরো পুরষ্কার প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলেও অবিলম্বে অন্ততঃ কিছুটা সম্মান-আপ্যায়ন এবং অপরাধীর বিচার ও পুরো শাস্তিতে বিলম্ব হলেও তার জন্য অবিলম্বে অন্ততঃ অপসন্দনীয় অবস্থা দাবী করে , তখন এমনটি হওয়াই অপরিহার্য। অন্যথায় সৃষ্টিকর্তা মানবপ্রকৃতিতে এ ধরনের কামনা-বাসনা প্রদান করতেন না।

দেহবিহীন আত্মার অনুভূতিশক্তি

এরপরও প্রশ্ন উঠতে পারে যে , মৃত্যুর পরে দেহবিহীন আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার অনুভূতিশক্তি থাকবে কিনা ? এ প্রশ্নের ভিত্তি হচ্ছে এই যে , দুনিয়ায় আমরা দেহের মাধ্যমে তথা দৈহিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে বাইরের জগত সম্পর্কে তথ্যাদি আহরণ করি এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি অর্জন করি। দুনিয়ার বুকে আনন্দভোগ ও শাস্তিভোগ উভয়ই দেহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অন্যদিকে শেষ বিচারের জন্য দেহসহ পুনরুত্থান সংঘটিত হবে এবং দেহসহই ব্যক্তিকে পুরষ্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। ধর্মীয় সূত্রও এটাই বলে এবং বিচারবুদ্ধিও এটাই দাবী করে। এমতাবস্থায় দেহবিহীন আত্মার সুখ-দুঃখের অনুভূতির সম্ভাবনা কতোখানি ?

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , পার্থিব জীবনেও মানুষ পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই আনন্দ ও বেদনার অনেক অনুভূতি অর্জন করে থাকে। আর ক্ষেত্রবিশেষে তা দৈহিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে অর্জিত অনুভূতির তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে থাকে। একজন মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় অসম্মানজনক কথা বললে বা গালি দিলে ক্ষেত্রবিশেষে তা বেত্রাঘাত বা ছুরিকাঘাতের চেয়েও অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

অবশ্য পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়ে থাকে তা-ও গুরুত্বহীন নয়। এ কারণেই পুনরুত্থান সংঘটিত হবে পার্থিব জীবনের ন্যায় দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে এবং বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী এমনটিই হওয়া উচিত। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা অত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুর জন্য অপরিহার্য নয়।) তবে পার্থিব জীবনে দেহ কেবল ব্যক্তিসত্তাকে অনুভূতি অর্জনে সহায়তাই করে না , বরং অনুভূতিঅর্জনক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতাও আরোপ করে। কারণ , পার্থিব জীবনে ব্যক্তিসত্তার মনোযোগের একটি বিরাট অংশ , বরং সিংহভাগই তার দেহের প্রতি নিবদ্ধ থাকে - যাতে দেহ কোনো ভুল কাজ না করে , ভুলবশতঃ নিজের ক্ষতি না করে এবং বিপদে না পড়ে। ফলে জাগ্রত অবস্থায় অন্যান্য ক্ষেত্রে আত্মার বিচরণ ও অনুভূতি তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনার তুলনায় খুবই সীমাবদ্ধ থাকে।

এছাড়া দেহের দুর্বলতা ও ক্লান্তি-শ্রান্তির কারণে ব্যক্তির জন্য ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা অবস্তুগত বিধায় তার ক্ষয় , দুর্বলতা ও ক্লান্তি-শ্রান্তি থাকতে পারে না , ফলে তার ঘুম বা বিশ্রামের প্রয়োজন থাকতে পারে না। তেমনি জীবিত ও জাগ্রত অবস্থায় দেহের প্রতি আত্মার যে সিংহভাগ মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে মৃত্যুর পরে তার আর প্রয়োজন না থাকায় আত্মার অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর থাকে এবং তার তৎপরতার ক্ষেত্র হয় ব্যাপকবিস্তৃত। এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য মৃত্যুর পর ব্যক্তির আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আাল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক ফেরেশেতাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত একটি জগতে সীমাবদ্ধতার আওতায় আসে। তবে এটা একটি স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়।

মোদ্দা কথা , মৃত্যুর ফলে দেহযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার ভালো-মন্দের অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বা তার সকল প্রকার কর্মতৎপরতা অসম্ভব হয়ে পড়বে - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না।

অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে , দেহযন্ত্র অচল হয়ে পড়ায় আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার কর্মতৎপরতার আওতা সীমিত হয়ে পড়তে বাধ্য। কিন্তু তার অনুভূতি না থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ , জীবদ্দশায় শরীরের যে অনুভূতি তা আসলে শরীরযন্ত্রের মাধ্যমে আত্মার অর্জিত অনুভূতি বৈ নয়। এমতাবস্থায় মৃত্যুর পরেও যদি আত্মা টিকে থাকে (এবং আসলেই টিকে থাকে) তাহলে তার সুখ-দুঃখের উর্ধে ওঠার ধারণার পিছনে কোনোই যৌক্তিকতা নেই।

দুনিয়ার জীবনে মানুষের আত্মা অতীতের ভালো ও সুখকর স্মৃতির কথা স্মরণ করে আনন্দিত হয় , ভবিষ্যতের শুভ সম্ভাবনার কথা ভেবে আশান্বিত হয়ে ওঠে , অতীতের তিক্ত স্মৃতি বা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য খারাপ পরিণতি আনয়নকারী অতীত ভুলভ্রান্তি এবং ভবিষ্যতের অনিবার্য দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে হতাশ , ব্যথিত ও যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের আনন্দের অনুভূতি এমন চরমে উপনীত হতে পারে যে , এর আতিশয্যে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। তেমনি ভবিষ্যত বিপদাশঙ্কাও এমন হতে পারে যে , তা তার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। অন্যদিকে ভবিষ্যত দুঃখকষ্টের দুঃসহতার কথা চিন্তা করে তার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক সময় আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে দেখা যায়। যুদ্ধে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে নির্যাতিত হবার ভয়ে আহত সৈনিকের আত্মহত্যার ঘটনার কথাও অনেক শোনা যায়।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , আত্মা কেবল অতীত ও ভবিষ্যতের ভালো-মন্দের কারণেও বর্তমানে সুখ বা দুঃখ অনুভব করতে পারে। আর বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের সুখ ও দুঃখ বস্তুগত বা দৈহিক নয় , বরং পুরোপুরি আত্মিক ব্যাপার। এমতাবস্থায় মৃত্যুর তথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর ব্যক্তির আত্মা অতীতের ভালো-মন্দ আমল এবং ভবিষ্যতের পুরষ্কার ও শাস্তির কথা চিন্তা করে আনন্দিত বা যন্ত্রণাকাতর ও অনুতপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার আত্মা বস্তুগত দেহের অধিকারী না থাকায় শারীরিক তৎপরতা চালাতে সক্ষম হয় না। তেমনি সুচিন্তা ও অনুতাপ সহ যে সব আত্মিক কর্ম দুনিয়ার বুকে আঞ্জাম দিলে তা থেকে শেষ বিচারে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতো মৃত্যুর পরে সে সব কাজ আঞ্জাম দিলে শেষ বিচারে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুপরবর্তী জগতে ব্যক্তির আত্মিক তৎপরতা ও আত্মিক অনুভূতি বন্ধ হয়ে যাবে - তার কোনোই কারণ নেই। তবে আত্মা দুনিয়ার বুকে যে সব আত্মিক তৎপরতা চালায় মৃত্যুর পরে তার কতোখানি চালাতে পারে বা কতোখানি চালাবার স্বাধীনতা লাভ করে এবং কোন্ ধরনের ব্যক্তিদের আত্মা স্বাধীনতা লাভ করে এবং যারা তা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে কে কতোখানি স্বাধীনতা লাভ করেন তা এক ভিন্ন বিষয়। এ সম্পর্কে বিচারবুদ্ধি কিছুটা ধারণায় উপনীত হতে পারলেও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভে সক্ষম নয়। কিন্তু ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার আত্মার সুখ-দুঃখের অনুভূতি এবং অতীত ও ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এক অনস্বীকার্য ব্যাপার।

বিষয়টি একটি পার্থিব দৃষ্টান্তের সাহায্যে বোঝার জন্য চেষ্টা করলে বুঝতে পারা সহজ হতে পারে। যেমন : ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেয়ার পর যখন ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তখন যারা খারাপ পরীক্ষা দিয়েছে তারা তাদের অতীতের ভুলের জন্য মনস্তাপে ভুগতে থাকে এবং ফলাফল ঘোষণার পরে সম্ভাব্য অকৃতকার্যতা তার জন্য যে নিন্দা ও ধিক্কার ডেকে আনবে এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা তার মধ্যে চরম যন্ত্রণার সৃষ্টি করতে থাকে। অন্যদিকে যে ছাত্র ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সে তার এ পরীক্ষার কারণে মানসিক প্রশান্তির অধিকারী থাকে এবং ভবিষ্যত শুভ ফলাফলের চিন্তা তার মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয় , ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হওয়া সত্ত্বেও যারা এ দু জন ছাত্রের পড়াশুনা ও পরীক্ষার অবস্থা সম্পর্কে অবগত তারা খারাপ ছাত্রটির প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে সমাদর করে না , অন্যদিকে সকলেই ভালো ছাত্রটির প্রতি স্নেহ-মমতার দৃষ্টিতে তাকায় ও তাকে খাতির করে , সমাদর করে। এ দুই বিপরীত আচরণও দুই ছাত্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে। মৃত্যুর পরমুহূর্ত থেকে শুরু করে পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে আত্মার অবস্থা এ অবস্থার সাথে তুলনীয়।

মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধি মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী সময়ে আত্মার অনুভূতি , সুখ-দুঃখ এবং তার ওপরে অতীত-ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়াকে একটি অপরিহার্য বিষয় বলে গণ্য করে।

আালামে বারযাখ্ কোথায় ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্ বা মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগত সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে : এ জগত কোথায় অবস্থিত ?

নিঃসন্দেহে এ জগতের বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে অকাট্যভাবে জানা বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। তেমনি এর অবস্থান সম্পর্কে যেমন বিচারবুদ্ধির দাবী থাকতে পারে , তেমনি বিচারবুদ্ধি এ সংক্রান্ত কোনো কোনো সমস্যা উপস্থাপন করতে ও তার সম্ভাব্য জবাব প্রদান করতে পারে।

আমরা ইতিপূর্বে যেমন আলোচনা করেছি , বিচারবুদ্ধি মৃত প্রিয়জনদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা ও জীবিত প্রিয়জনদের মধ্যে নৈকট্য কামনা করে এবং এ কারণেই মৃতদের ব্যক্তিসত্তার ঘুমন্ত অবস্থা পসন্দ করে না , বরং জাগ্রত অবস্থা পসন্দ করে। অতএব , এ নৈকট্যের দাবী অনুযায়ী মৃতদের ব্যক্তিসত্তার জীবিতদের কাছাকাছি অবস্থানই কাম্য। অবশ্য কোনো মৃত ব্যক্তির আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আালামে বারযাখে কতোখানি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে ও জীবিত প্রিয়জনদের কাছাকাছি আসতে পারবে অথবা আদৌ সে সুযোগ পাবে কিনা তা স্বতন্ত্র বিষয় ; বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিতভাবে মতামত ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে , বিচারবুদ্ধি মৃতদের ব্যক্তিসত্তার জীবিতদের কাছাকাছি অবস্থান কামনা করে। অতএব , বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী , আালামে বারযাখ্ এই পৃথিবীর বুকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর পরিবর্তে দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রলোকে বা অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে আালামে বারযাখের অবস্থান হলে মানবমন প্রিয়জনদের ব্যক্তিসত্তার সুদূর লোকে অবস্থানজনিত বিষাদ অনুভব করতে বাধ্য। তাই এটা কাম্য নয়। বিশেষ করে আালামে বারযাখের অবস্থান এ পৃথিবীর বুকে হতে যখন কোনো বাধা নেই এমতাবস্থায় তা দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রলোকে বা গ্যালাক্সিতে তা হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে বিচারবুদ্ধি আালামে বারযাখের অনিবার্যভাবে মাটির নীচে হওয়াকেও মানতে পারে না। কারণ , এমন অনেক মানুষ আছে যাদের মৃতদেহকে মাটির নীচে ক্ববর দেয়া হয় না , বরং পুড়িয়ে ফেলা হয় , বা শীতল গৃহে সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া অনেক লোক বন্যজন্তুর বা সামুদ্রিক প্রাণীর পেটে গিয়েছে এবং অনেকের শরীর পচেগলে পানিতে মিশে গিয়েছে ; তাদের জন্য মাটির ক্ববরের প্রশ্ন আসে না। তাই শরীরবিহীন ব্যক্তিসত্তার জন্য আালামে বারযাখ্ কোথায় হবে তার সাথে তার মৃতদেহ কোথায় আছে তার সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য নয়। সুতরাং আালামে বারযাখ্ যেমন এ পৃথিবীর বুকে হওয়া কাম্য তেমনি তা মাটির নীচে না হয়ে মাটির ওপরে হওয়াও কাম্য। আর আল্লাহ্ তা আলার পক্ষে তা খুবই সহজসাধ্য। অবশ্য অধিকতর সঠিকভাবে বললে বলতে হয় , যেহেতু আালামে বারযাখ্ একটি ভিন্ন মাত্রার অবস্তুগত জগত সেহেতু তার জন্য মাটির ওপর-নীচ ও এতদুভয়ের কোনো কিছুই বাধা নয় , বরং তার ক্ষেত্রে মাটির ওপর-নীচ কথাটা আদৌ প্রযোজ্য নয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে , আালামে বারযাখ্ যদি এ পৃথিবীর বুকেই থেকে থাকে তাহলে আমরা কেন মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে ও সে জগতের নিদর্শনাদি দেখতে পাই না ? তাছাড়া যে সব জনাকীর্ণ জনপদে মানুষ ব্যাপকভাবে বিচরণশীল ও কর্মতৎপর সে সব জায়গায় আরেকটি জগতের অস্তিত্ব কীভাবে সম্ভব ?

এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে , আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার জগত। তাই তা এক ভিন্ন মাত্রার (Dimension ) জগত। এ কারণে একদিকে যেমন সে জগত আমাদের ইন্দ্রিয়নিচয়ের ধারণক্ষমতার বাইরে অন্যদিকে একই কারণে বস্তুজগতের সাথে সে জগতের সাংঘর্ষিকতার প্রশ্ন আসে না।

এমনকি আমাদের পার্থিব জগতেও অভিন্ন স্থান-কালে কোনোরূপ সাংঘর্ষিকতা ব্যতীতই একাধিক অস্তিত্বের অবস্থানের দৃষ্টান্ত আছে। উদাহরণস্বরূপ , কাঁচ , বায়ু ও পানির মধ্য দিয়ে আলো অবাধে যাতায়াত করে এবং যাতায়াতকালে খুবই অল্প সময়ের জন্য হলেও (সেকেণ্ডের ক্ষুদ্রাংশের জন্য হলেও) এ সবের মধ্যে অবস্থান করে (যদিও স্থির অবস্থান নয় , বরং গতিশীল অবস্থায় অবস্থান , তবে অবস্থান করে অবশ্যই) । কিন্তু ঐ সব বস্তুর ভিতরে আলোর অবস্থান বা ওগুলোর ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার জন্য ওগুলোকে অপসারণ করার প্রয়োজন হয় না।

একইভাবে , বিদ্যুত ধাতব পদার্থ , মাটি ও পানির মধ্য দিয়ে চলাচল করে এবং বিদ্যুততরঙ্গ এতদসহ সব কিছুর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে ; এ জন্য কোনো কিছুকে অপসারণ করতে হয় না। চৌম্বক ক্ষেত্রও কোনো কিছু অপসারণ না করে অবস্থান করে। সর্বোপরি আমাদের দেহ জুড়ে যে আত্মার অবস্থান তা-ও বস্তুদেহের কোনো অংশকে অপসারণ না করেই অবস্থান করে। অতএব , এতে সন্দেহের কোনোই কারণ নেই যে , আালামে বারযাখ্ ভিন্ন মাত্রার জগত হবার কারণে এ বস্তুজগতের কোনো কিছুর অবস্থানকে বাধাগ্রস্ত না করেই এখানে অবস্থিত হতে পারে। আর ভিন্ন মাত্রার জগত হবার কারণেই আমরা আমাদের বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা আালামে বারযাখের অস্তিত্ব ও সে জগতের ঘটনাবলী অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছি না।

আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার জগতেও অনেক কিছু বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করতে ব্যর্থ হই। বায়ু পুরোপুরি অদৃশ্য এবং পূর্ণ স্বচ্ছ কাঁচ ও পানি প্রায় অদৃশ্য। অবশ্য এগুলোকে আমরা আমাদের স্পর্শেন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমরা আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোনোটি দ্বারাই আলো-কে সরাসরি অনুভব করতে পারি না ; কেবল কোনো বস্তুতে আলো পতিত হলে তা দেখা যাওয়ার কারণে আমরা আলোর অস্তিত্ব বুঝতে পারি। বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাপারটিও অনুরূপ ; আমরা এতদুভয়ের অস্তিত্ব কেবল উভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝতে পারি। অন্যদিকে রঞ্জন রশ্মি ও অতি লাল রশ্মি সহ এমন কতক রশ্মি আছে যা বায়ু , কাঁচ ও পানি ছাড়াও অন্যান্য স্থূল বস্তুকে - আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার সাধারণ অলোকরশ্মি যেগুলোকে ভেদ করতে পারে না - ভেদ করে চলে যায় বিধায় সাধারণ আলোকরশ্মির মতো তা বস্তুতে পতিত হবার পর প্রতিফলিত হয় না , ফলে সাধাণভাবে আমরা ঐ সব রশ্মির অস্তিত্ব সরাসরি ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা পরোক্ষভাবেও অনুভব করি না ; কেবল বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যেই এ ধরনের আলোর প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে। অথচ সংশ্লিষ্ট যন্ত্র আবিষ্কৃত হবার আগেও এ ধরনের রশ্মির অস্তিত্ব ছিলো এবং তা বস্তুর ওপরে পতিত হয়ে তা ভেদ করে চলে যেতো , কিন্তু আমরা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা না এ সব রশ্মির অস্তিত্ব বুঝতে পারতাম , না এ সবের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারতাম।

অতএব , আালামে বারযাখের অস্তিত্ব এ পৃথিবীর বুকে হওয়ার বিষয়টিকে অসম্ভব মনে করার কারণ নেই। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , আালামে বারযাখ্ আমাদের এ পৃথিবীতে হওয়ার মানে এ নয় যে , এ জগতের অস্তিত্ব এবং মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার অবস্থান ও বিচরণ কেবল মাটির ওপরে মানুষের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হবে। বরং আসমান-যমীনের সর্বত্রই এ জগতের আওতাভুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ , বস্তুদেহের যে সীমাবদ্ধতা আছে আত্মার জন্য সে ধরনের বস্তুগত সীমাবদ্ধতা থাকার প্রশ্ন আসে না যদি না সে জগতের পরিচালনাব্যবস্থার আওতায় বিশেষভাবে কারো ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। অন্যদিকে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে যেমন রঞ্জন রশ্মি ও অতি লাল রশ্মির প্রতিক্রিয়া ধরা সম্ভব হচ্ছে তেমনি শক্তিশালী ব্যক্তিসত্তার অধিকারী জীবিত মানুষের পক্ষে আালামে বারযাখের অবস্থা অবহিত হওয়া সম্ভব হতে পারে। এটাই বিচারবুদ্ধির রায়।

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্

সর্বজনীনভাবে মানবপ্রজাতির অনুভূতি মৃত ব্যক্তিদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার সচেতন উপস্থিতির সপক্ষে রায় দেয় , অচেতন বা ঘুমন্ত অবস্থার সপক্ষে রায় দেয় না। আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকলেই সদ্যমৃত ব্যক্তি সম্পর্কে অনুভব করে যে , যেন সে আশেপাশেই আছে , যেন সব কিছু দেখছে ও শুনছে , কিন্তু কথা বলতে পারছে না অর্থাৎ জীবিতদের শোনার মতো করে কথা বলতে পারছে না।

এমনকি নাস্তিক লোকেরা পর্যন্ত তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখায় এবং তাদের স্মৃতির প্রতি ঠিক সেভাবেই ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে যেভাবে ভক্তি , শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতো তাদের জীবদ্দশায় ; তাদের চেতনার অসম্মান হোক এটা তারা কিছুতেই মানতে পারে না। এ ব্যাপারে তাদের প্রায় সকলেই আন্তরিক। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত থাকাকালে যাদের সাথে তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার সম্পর্ক ছিলো তার মৃত্যুর পরেও তারা তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু যে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তথা অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা , স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা পোষণের তো কোনোই অর্থ হয় না। আসলে তারা অবচেতনভাবে হলেও মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব ও কাছাকাছি উপস্থিতির প্রত্যয় পোষণ করে। অন্যদিকে যারা আস্তিক , ধর্ম নির্বিশেষে তাদের সকলেই সচেতনভাবেই এ প্রত্যয় পোষণ করে থাকে।

মানুষ সাধারণতঃ এমন কিছু করতে চায় না তার মৃত স্বজন বেঁচে থাকলে যা অপসন্দ করতো। তারা মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তাকে পর্যবেক্ষণক্ষমতাসহ উপস্থিত অনুভব করে বলেই এরূপ আচরণ করে থাকে। মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে বিলুপ্ত বা ঘুমন্ত মনে করলে তারা কখনোই এরূপ আচরণ করতো না , কারণ , সে ক্ষেত্রে এরূপ আচরণ হতো অযৌক্তিক ও অর্থহীন। মৃত ব্যক্তিদের দেহভস্ম সসম্মানে সংরক্ষণ অথবা তাদের ক্ববরে বা তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের কাছে বা তাদের মমিকৃত মৃতদেহের সামনে গিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা , ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শনের পিছনেও তাদের একই অনুভূতি কাজ করে থাকে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকতে চায় , প্রয়োজনে দূরে কোথাও গেলেও যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব কাছে ফিরে আসতে চায় এবং নিয়মিত পরস্পরের খোঁজখবর জানতে চায়। তাই মৃত্যুর পরেও প্রিয় স্বজনদের কাছ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকার চিন্তা তাদের মধ্যে হতাশা ও বিমর্ষতার সৃষ্টি করে। তাই সকলেই সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে এ আশাই পোষণ করে যে , মৃত্যুর পরেও সে প্রিয় স্বজনদের কাছাকাছি থাকবে। নিজ বাড়ীতে বা বাড়ীর যথাসম্ভব কাছাকাছি প্রিয় স্বজনদের ক্ববরের পাশে ক্ববর দেয়ার জন্য ওয়াছ্বীয়াত্ করে যাবার পিছনেও একই অনুভূতির প্রভাব বিদ্যমান। নয়তো মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা অনন্ত নিদ্রায় নিদ্রিত থাকে বলে ধারণা পোষণ করলে মৃত ব্যক্তির বা তার জীবিত প্রিয় স্বজনদের কারো কাছেই এ ধরনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনোই মূল্য হতে পারে না।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে দীর্ঘ ঘুম পসন্দ করে না - না তার নিজের জন্য , না তার প্রিয় স্বজনদের জন্য। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিসত্তা হাজার হাজার বা কোটি কোটি বছর ঘুমিয়ে থাকবে এটা নিজের বা প্রিয়জনদের জন্য চিন্তা করতেই মানুষ বিষণ্ন ও বিমর্ষ হতে বাধ্য। তাই তারা মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার জাগ্রত অবস্থাই কামনা করে।

মানবপ্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে , সে তার নিজের ভালো কাজের পুরষ্কার ও তার শত্রুর বা তাকে কষ্টদানকারীর জোর-যুলুম ও মন্দ কাজের শাস্তির ব্যাপারে অতি বিলম্ব পসন্দ করে না। অবশ্য সে নিজের পুরষ্কার ও প্রতিপক্ষের শাস্তির ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা অপরিহার্য লক্ষ্য করলে সে ক্ষেত্রেও যথাসময়ের পূর্বে ভালো ও মন্দ কাজের কিছু না কিছু প্রভাব আশা করে। উদাহরণস্বরূপ , যাকে পুরষ্কার দেয়া হবে তাকে নির্ধারিত অনুষ্ঠানের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে এলে সেখানেই বা তার কাছাকাছি কোনো ভালো ও আরামদায়ক অবস্থানস্থলে সাদরে বিশ্রাম নিতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও আদর-আপ্যায়ন করা হয়। তেমনি বিবাহ বা অন্যবিধ আনন্দ-অনুষ্ঠানেও মেহমানদেরকে মূল ভোজনপর্বের আগেই অনুষ্ঠানস্থলে বা কাছাকাছি অন্য কোনো উত্তম পরিবেশে বিশ্রাম ও আরাম করতে দেয়া হয় এবং হাল্কাভাবে হলেও , আন্তরিক আদর-আপ্যায়ন করা হয়। বস্তুতঃ সকলে এটাই আশা করে। অন্যদিকে একজন সন্দেহাতীত ফৌজদারী অপরাধীকে গ্রেফতারের পর থেকে বিচার শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত এমন অবস্থায় রাখা ও আনা-নেয়া করা হয় যাকে শাস্তি বলা না গেলেও তা মোটেই আরামদায়ক বা সম্মানজনক নয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় - যা এক ধরনের মানসিক শাস্তি বটে। আর সাধারণভাবে লোকেরা এটাই পসন্দ ও আশা করে।

তাছাড়া শাস্তি ও পুরষ্কার উভয়ই যদি হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর দূরবর্তী হয় ; তার ছিটেফোঁটাও যদি আশুপ্রাপ্তি না ঘটে , বরং হাজার হাজার বছর , এমনকি কোটি কোটি বছর যদি ভালো ও মন্দ উভয় ব্যক্তিকে পাশাপাশি অভিন্ন অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় তাহলে মানবমনে তা অন্যায় বলে প্রতিভাত হয় এবং তা মানুষের মনে ও আচরণে হতাশা সহ বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে বাধ্য। কারণ , অতি বিলম্বিত পুরষ্কারের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পায় এবং অতি বিলম্বিত শাস্তির প্রতি ভীতিও হ্রাস পায়।

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে , মানবপ্রকৃতিতে যতো প্রয়োজন ও কামনা-বাসনা নিহিত রাখা হয়েছে তার সবই পূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাই সর্বজনীনভাবে যেহেতু মানবপ্রকৃতি তার ব্যক্তিসত্তার অমরত্ব এবং সচেতন জাগ্রত অবস্থা , স্বীয় সৎকর্মের পুরো পুরষ্কার প্রাপ্তিতে বিলম্ব হলেও অবিলম্বে অন্ততঃ কিছুটা সম্মান-আপ্যায়ন এবং অপরাধীর বিচার ও পুরো শাস্তিতে বিলম্ব হলেও তার জন্য অবিলম্বে অন্ততঃ অপসন্দনীয় অবস্থা দাবী করে , তখন এমনটি হওয়াই অপরিহার্য। অন্যথায় সৃষ্টিকর্তা মানবপ্রকৃতিতে এ ধরনের কামনা-বাসনা প্রদান করতেন না।

দেহবিহীন আত্মার অনুভূতিশক্তি

এরপরও প্রশ্ন উঠতে পারে যে , মৃত্যুর পরে দেহবিহীন আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার অনুভূতিশক্তি থাকবে কিনা ? এ প্রশ্নের ভিত্তি হচ্ছে এই যে , দুনিয়ায় আমরা দেহের মাধ্যমে তথা দৈহিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে বাইরের জগত সম্পর্কে তথ্যাদি আহরণ করি এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি অর্জন করি। দুনিয়ার বুকে আনন্দভোগ ও শাস্তিভোগ উভয়ই দেহের মাধ্যমে হয়ে থাকে। অন্যদিকে শেষ বিচারের জন্য দেহসহ পুনরুত্থান সংঘটিত হবে এবং দেহসহই ব্যক্তিকে পুরষ্কার বা শাস্তি দেয়া হবে। ধর্মীয় সূত্রও এটাই বলে এবং বিচারবুদ্ধিও এটাই দাবী করে। এমতাবস্থায় দেহবিহীন আত্মার সুখ-দুঃখের অনুভূতির সম্ভাবনা কতোখানি ?

এ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে , পার্থিব জীবনেও মানুষ পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্য ছাড়াই আনন্দ ও বেদনার অনেক অনুভূতি অর্জন করে থাকে। আর ক্ষেত্রবিশেষে তা দৈহিক ইন্দ্রিয়নিচয়ের মাধ্যমে অর্জিত অনুভূতির তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে থাকে। একজন মানুষকে প্রকাশ্য রাস্তায় অসম্মানজনক কথা বললে বা গালি দিলে ক্ষেত্রবিশেষে তা বেত্রাঘাত বা ছুরিকাঘাতের চেয়েও অনেক বেশী যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে।

অবশ্য পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে সুখ-দুঃখের অনুভূতি হয়ে থাকে তা-ও গুরুত্বহীন নয়। এ কারণেই পুনরুত্থান সংঘটিত হবে পার্থিব জীবনের ন্যায় দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে এবং বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী এমনটিই হওয়া উচিত। (এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা অত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুর জন্য অপরিহার্য নয়।) তবে পার্থিব জীবনে দেহ কেবল ব্যক্তিসত্তাকে অনুভূতি অর্জনে সহায়তাই করে না , বরং অনুভূতিঅর্জনক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতাও আরোপ করে। কারণ , পার্থিব জীবনে ব্যক্তিসত্তার মনোযোগের একটি বিরাট অংশ , বরং সিংহভাগই তার দেহের প্রতি নিবদ্ধ থাকে - যাতে দেহ কোনো ভুল কাজ না করে , ভুলবশতঃ নিজের ক্ষতি না করে এবং বিপদে না পড়ে। ফলে জাগ্রত অবস্থায় অন্যান্য ক্ষেত্রে আত্মার বিচরণ ও অনুভূতি তার মধ্যে নিহিত সম্ভাবনার তুলনায় খুবই সীমাবদ্ধ থাকে।

এছাড়া দেহের দুর্বলতা ও ক্লান্তি-শ্রান্তির কারণে ব্যক্তির জন্য ঘুম ও বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা অবস্তুগত বিধায় তার ক্ষয় , দুর্বলতা ও ক্লান্তি-শ্রান্তি থাকতে পারে না , ফলে তার ঘুম বা বিশ্রামের প্রয়োজন থাকতে পারে না। তেমনি জীবিত ও জাগ্রত অবস্থায় দেহের প্রতি আত্মার যে সিংহভাগ মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে মৃত্যুর পরে তার আর প্রয়োজন না থাকায় আত্মার অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর থাকে এবং তার তৎপরতার ক্ষেত্র হয় ব্যাপকবিস্তৃত। এটাই স্বাভাবিক। অবশ্য মৃত্যুর পর ব্যক্তির আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আাল্লাহ্ তা আলা কর্তৃক ফেরেশেতাদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত একটি জগতে সীমাবদ্ধতার আওতায় আসে। তবে এটা একটি স্বতন্ত্র আলোচ্য বিষয়।

মোদ্দা কথা , মৃত্যুর ফলে দেহযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার ভালো-মন্দের অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বা তার সকল প্রকার কর্মতৎপরতা অসম্ভব হয়ে পড়বে - বিচারবুদ্ধি এটা মানতে পারে না।

অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে , দেহযন্ত্র অচল হয়ে পড়ায় আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার কর্মতৎপরতার আওতা সীমিত হয়ে পড়তে বাধ্য। কিন্তু তার অনুভূতি না থাকার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ , জীবদ্দশায় শরীরের যে অনুভূতি তা আসলে শরীরযন্ত্রের মাধ্যমে আত্মার অর্জিত অনুভূতি বৈ নয়। এমতাবস্থায় মৃত্যুর পরেও যদি আত্মা টিকে থাকে (এবং আসলেই টিকে থাকে) তাহলে তার সুখ-দুঃখের উর্ধে ওঠার ধারণার পিছনে কোনোই যৌক্তিকতা নেই।

দুনিয়ার জীবনে মানুষের আত্মা অতীতের ভালো ও সুখকর স্মৃতির কথা স্মরণ করে আনন্দিত হয় , ভবিষ্যতের শুভ সম্ভাবনার কথা ভেবে আশান্বিত হয়ে ওঠে , অতীতের তিক্ত স্মৃতি বা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য খারাপ পরিণতি আনয়নকারী অতীত ভুলভ্রান্তি এবং ভবিষ্যতের অনিবার্য দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে হতাশ , ব্যথিত ও যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ে। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের আনন্দের অনুভূতি এমন চরমে উপনীত হতে পারে যে , এর আতিশয্যে তার মৃত্যু ঘটতে পারে। তেমনি ভবিষ্যত বিপদাশঙ্কাও এমন হতে পারে যে , তা তার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। অন্যদিকে ভবিষ্যত দুঃখকষ্টের দুঃসহতার কথা চিন্তা করে তার হাত থেকে বাঁচার জন্য অনেক সময় আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে দেখা যায়। যুদ্ধে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে নির্যাতিত হবার ভয়ে আহত সৈনিকের আত্মহত্যার ঘটনার কথাও অনেক শোনা যায়।

এ থেকে সুস্পষ্ট যে , আত্মা কেবল অতীত ও ভবিষ্যতের ভালো-মন্দের কারণেও বর্তমানে সুখ বা দুঃখ অনুভব করতে পারে। আর বলা বাহুল্য যে , এ ধরনের সুখ ও দুঃখ বস্তুগত বা দৈহিক নয় , বরং পুরোপুরি আত্মিক ব্যাপার। এমতাবস্থায় মৃত্যুর তথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর ব্যক্তির আত্মা অতীতের ভালো-মন্দ আমল এবং ভবিষ্যতের পুরষ্কার ও শাস্তির কথা চিন্তা করে আনন্দিত বা যন্ত্রণাকাতর ও অনুতপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার আত্মা বস্তুগত দেহের অধিকারী না থাকায় শারীরিক তৎপরতা চালাতে সক্ষম হয় না। তেমনি সুচিন্তা ও অনুতাপ সহ যে সব আত্মিক কর্ম দুনিয়ার বুকে আঞ্জাম দিলে তা থেকে শেষ বিচারে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতো মৃত্যুর পরে সে সব কাজ আঞ্জাম দিলে শেষ বিচারে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুপরবর্তী জগতে ব্যক্তির আত্মিক তৎপরতা ও আত্মিক অনুভূতি বন্ধ হয়ে যাবে - তার কোনোই কারণ নেই। তবে আত্মা দুনিয়ার বুকে যে সব আত্মিক তৎপরতা চালায় মৃত্যুর পরে তার কতোখানি চালাতে পারে বা কতোখানি চালাবার স্বাধীনতা লাভ করে এবং কোন্ ধরনের ব্যক্তিদের আত্মা স্বাধীনতা লাভ করে এবং যারা তা লাভ করেন তাঁদের মধ্যে কে কতোখানি স্বাধীনতা লাভ করেন তা এক ভিন্ন বিষয়। এ সম্পর্কে বিচারবুদ্ধি কিছুটা ধারণায় উপনীত হতে পারলেও বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভে সক্ষম নয়। কিন্তু ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার আত্মার সুখ-দুঃখের অনুভূতি এবং অতীত ও ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়া গ্রহণ বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে এক অনস্বীকার্য ব্যাপার।

বিষয়টি একটি পার্থিব দৃষ্টান্তের সাহায্যে বোঝার জন্য চেষ্টা করলে বুঝতে পারা সহজ হতে পারে। যেমন : ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দেয়ার পর যখন ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে তখন যারা খারাপ পরীক্ষা দিয়েছে তারা তাদের অতীতের ভুলের জন্য মনস্তাপে ভুগতে থাকে এবং ফলাফল ঘোষণার পরে সম্ভাব্য অকৃতকার্যতা তার জন্য যে নিন্দা ও ধিক্কার ডেকে আনবে এ ব্যাপারে দুশ্চিন্তা তার মধ্যে চরম যন্ত্রণার সৃষ্টি করতে থাকে। অন্যদিকে যে ছাত্র ভালো পরীক্ষা দিয়েছে সে তার এ পরীক্ষার কারণে মানসিক প্রশান্তির অধিকারী থাকে এবং ভবিষ্যত শুভ ফলাফলের চিন্তা তার মধ্যে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। শুধু তা-ই নয় , ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হওয়া সত্ত্বেও যারা এ দু জন ছাত্রের পড়াশুনা ও পরীক্ষার অবস্থা সম্পর্কে অবগত তারা খারাপ ছাত্রটির প্রতি অবজ্ঞা বা ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায় এবং আত্মীয়-স্বজন তাকে সমাদর করে না , অন্যদিকে সকলেই ভালো ছাত্রটির প্রতি স্নেহ-মমতার দৃষ্টিতে তাকায় ও তাকে খাতির করে , সমাদর করে। এ দুই বিপরীত আচরণও দুই ছাত্রের মধ্যে পরস্পরবিরোধী অনুভূতির সৃষ্টি করে থাকে। মৃত্যুর পরমুহূর্ত থেকে শুরু করে পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে আত্মার অবস্থা এ অবস্থার সাথে তুলনীয়।

মোদ্দা কথা , বিচারবুদ্ধি মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী সময়ে আত্মার অনুভূতি , সুখ-দুঃখ এবং তার ওপরে অতীত-ভবিষ্যতের প্রতিক্রিয়াকে একটি অপরিহার্য বিষয় বলে গণ্য করে।

আালামে বারযাখ্ কোথায় ?

বিচারবুদ্ধির দৃষ্টিতে আালামে বারযাখ্ বা মৃত্যুর পরবর্তী ও পুনরুত্থানের পূর্ববর্তী জগত সংক্রান্ত সর্বশেষ প্রশ্ন হচ্ছে : এ জগত কোথায় অবস্থিত ?

নিঃসন্দেহে এ জগতের বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে অকাট্যভাবে জানা বিচারবুদ্ধির পক্ষে সম্ভব নয়। তেমনি এর অবস্থান সম্পর্কে যেমন বিচারবুদ্ধির দাবী থাকতে পারে , তেমনি বিচারবুদ্ধি এ সংক্রান্ত কোনো কোনো সমস্যা উপস্থাপন করতে ও তার সম্ভাব্য জবাব প্রদান করতে পারে।

আমরা ইতিপূর্বে যেমন আলোচনা করেছি , বিচারবুদ্ধি মৃত প্রিয়জনদের আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা ও জীবিত প্রিয়জনদের মধ্যে নৈকট্য কামনা করে এবং এ কারণেই মৃতদের ব্যক্তিসত্তার ঘুমন্ত অবস্থা পসন্দ করে না , বরং জাগ্রত অবস্থা পসন্দ করে। অতএব , এ নৈকট্যের দাবী অনুযায়ী মৃতদের ব্যক্তিসত্তার জীবিতদের কাছাকাছি অবস্থানই কাম্য। অবশ্য কোনো মৃত ব্যক্তির আত্মা বা ব্যক্তিসত্তা আালামে বারযাখে কতোখানি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে ও জীবিত প্রিয়জনদের কাছাকাছি আসতে পারবে অথবা আদৌ সে সুযোগ পাবে কিনা তা স্বতন্ত্র বিষয় ; বিচারবুদ্ধি এ ব্যাপারে স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিতভাবে মতামত ব্যক্ত করতে সক্ষম নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে , বিচারবুদ্ধি মৃতদের ব্যক্তিসত্তার জীবিতদের কাছাকাছি অবস্থান কামনা করে। অতএব , বিচারবুদ্ধির দাবী অনুযায়ী , আালামে বারযাখ্ এই পৃথিবীর বুকে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। পৃথিবীর পরিবর্তে দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রলোকে বা অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে আালামে বারযাখের অবস্থান হলে মানবমন প্রিয়জনদের ব্যক্তিসত্তার সুদূর লোকে অবস্থানজনিত বিষাদ অনুভব করতে বাধ্য। তাই এটা কাম্য নয়। বিশেষ করে আালামে বারযাখের অবস্থান এ পৃথিবীর বুকে হতে যখন কোনো বাধা নেই এমতাবস্থায় তা দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রলোকে বা গ্যালাক্সিতে তা হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তবে বিচারবুদ্ধি আালামে বারযাখের অনিবার্যভাবে মাটির নীচে হওয়াকেও মানতে পারে না। কারণ , এমন অনেক মানুষ আছে যাদের মৃতদেহকে মাটির নীচে ক্ববর দেয়া হয় না , বরং পুড়িয়ে ফেলা হয় , বা শীতল গৃহে সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া অনেক লোক বন্যজন্তুর বা সামুদ্রিক প্রাণীর পেটে গিয়েছে এবং অনেকের শরীর পচেগলে পানিতে মিশে গিয়েছে ; তাদের জন্য মাটির ক্ববরের প্রশ্ন আসে না। তাই শরীরবিহীন ব্যক্তিসত্তার জন্য আালামে বারযাখ্ কোথায় হবে তার সাথে তার মৃতদেহ কোথায় আছে তার সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য নয়। সুতরাং আালামে বারযাখ্ যেমন এ পৃথিবীর বুকে হওয়া কাম্য তেমনি তা মাটির নীচে না হয়ে মাটির ওপরে হওয়াও কাম্য। আর আল্লাহ্ তা আলার পক্ষে তা খুবই সহজসাধ্য। অবশ্য অধিকতর সঠিকভাবে বললে বলতে হয় , যেহেতু আালামে বারযাখ্ একটি ভিন্ন মাত্রার অবস্তুগত জগত সেহেতু তার জন্য মাটির ওপর-নীচ ও এতদুভয়ের কোনো কিছুই বাধা নয় , বরং তার ক্ষেত্রে মাটির ওপর-নীচ কথাটা আদৌ প্রযোজ্য নয়।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে , আালামে বারযাখ্ যদি এ পৃথিবীর বুকেই থেকে থাকে তাহলে আমরা কেন মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তাকে ও সে জগতের নিদর্শনাদি দেখতে পাই না ? তাছাড়া যে সব জনাকীর্ণ জনপদে মানুষ ব্যাপকভাবে বিচরণশীল ও কর্মতৎপর সে সব জায়গায় আরেকটি জগতের অস্তিত্ব কীভাবে সম্ভব ?

এ প্রশ্নের জবাবে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন যে , আালামে বারযাখ্ হচ্ছে আত্মা বা ব্যক্তিসত্তার জগত। তাই তা এক ভিন্ন মাত্রার (Dimension ) জগত। এ কারণে একদিকে যেমন সে জগত আমাদের ইন্দ্রিয়নিচয়ের ধারণক্ষমতার বাইরে অন্যদিকে একই কারণে বস্তুজগতের সাথে সে জগতের সাংঘর্ষিকতার প্রশ্ন আসে না।

এমনকি আমাদের পার্থিব জগতেও অভিন্ন স্থান-কালে কোনোরূপ সাংঘর্ষিকতা ব্যতীতই একাধিক অস্তিত্বের অবস্থানের দৃষ্টান্ত আছে। উদাহরণস্বরূপ , কাঁচ , বায়ু ও পানির মধ্য দিয়ে আলো অবাধে যাতায়াত করে এবং যাতায়াতকালে খুবই অল্প সময়ের জন্য হলেও (সেকেণ্ডের ক্ষুদ্রাংশের জন্য হলেও) এ সবের মধ্যে অবস্থান করে (যদিও স্থির অবস্থান নয় , বরং গতিশীল অবস্থায় অবস্থান , তবে অবস্থান করে অবশ্যই) । কিন্তু ঐ সব বস্তুর ভিতরে আলোর অবস্থান বা ওগুলোর ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার জন্য ওগুলোকে অপসারণ করার প্রয়োজন হয় না।

একইভাবে , বিদ্যুত ধাতব পদার্থ , মাটি ও পানির মধ্য দিয়ে চলাচল করে এবং বিদ্যুততরঙ্গ এতদসহ সব কিছুর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে ; এ জন্য কোনো কিছুকে অপসারণ করতে হয় না। চৌম্বক ক্ষেত্রও কোনো কিছু অপসারণ না করে অবস্থান করে। সর্বোপরি আমাদের দেহ জুড়ে যে আত্মার অবস্থান তা-ও বস্তুদেহের কোনো অংশকে অপসারণ না করেই অবস্থান করে। অতএব , এতে সন্দেহের কোনোই কারণ নেই যে , আালামে বারযাখ্ ভিন্ন মাত্রার জগত হবার কারণে এ বস্তুজগতের কোনো কিছুর অবস্থানকে বাধাগ্রস্ত না করেই এখানে অবস্থিত হতে পারে। আর ভিন্ন মাত্রার জগত হবার কারণেই আমরা আমাদের বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয়ের দ্বারা আালামে বারযাখের অস্তিত্ব ও সে জগতের ঘটনাবলী অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছি না।

আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার জগতেও অনেক কিছু বস্তুদেহের পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করতে ব্যর্থ হই। বায়ু পুরোপুরি অদৃশ্য এবং পূর্ণ স্বচ্ছ কাঁচ ও পানি প্রায় অদৃশ্য। অবশ্য এগুলোকে আমরা আমাদের স্পর্শেন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমরা আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের কোনোটি দ্বারাই আলো-কে সরাসরি অনুভব করতে পারি না ; কেবল কোনো বস্তুতে আলো পতিত হলে তা দেখা যাওয়ার কারণে আমরা আলোর অস্তিত্ব বুঝতে পারি। বিদ্যুত ও চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাপারটিও অনুরূপ ; আমরা এতদুভয়ের অস্তিত্ব কেবল উভয়ের প্রতিক্রিয়া থেকেই বুঝতে পারি। অন্যদিকে রঞ্জন রশ্মি ও অতি লাল রশ্মি সহ এমন কতক রশ্মি আছে যা বায়ু , কাঁচ ও পানি ছাড়াও অন্যান্য স্থূল বস্তুকে - আমাদের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতার সাধারণ অলোকরশ্মি যেগুলোকে ভেদ করতে পারে না - ভেদ করে চলে যায় বিধায় সাধারণ আলোকরশ্মির মতো তা বস্তুতে পতিত হবার পর প্রতিফলিত হয় না , ফলে সাধাণভাবে আমরা ঐ সব রশ্মির অস্তিত্ব সরাসরি ইন্দ্রিয়নিচয়ের দ্বারা পরোক্ষভাবেও অনুভব করি না ; কেবল বিশেষ ধরনের যন্ত্রের সাহায্যেই এ ধরনের আলোর প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ে। অথচ সংশ্লিষ্ট যন্ত্র আবিষ্কৃত হবার আগেও এ ধরনের রশ্মির অস্তিত্ব ছিলো এবং তা বস্তুর ওপরে পতিত হয়ে তা ভেদ করে চলে যেতো , কিন্তু আমরা পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা না এ সব রশ্মির অস্তিত্ব বুঝতে পারতাম , না এ সবের প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারতাম।

অতএব , আালামে বারযাখের অস্তিত্ব এ পৃথিবীর বুকে হওয়ার বিষয়টিকে অসম্ভব মনে করার কারণ নেই। তবে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , আালামে বারযাখ্ আমাদের এ পৃথিবীতে হওয়ার মানে এ নয় যে , এ জগতের অস্তিত্ব এবং মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিসত্তার অবস্থান ও বিচরণ কেবল মাটির ওপরে মানুষের স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হবে। বরং আসমান-যমীনের সর্বত্রই এ জগতের আওতাভুক্ত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ , বস্তুদেহের যে সীমাবদ্ধতা আছে আত্মার জন্য সে ধরনের বস্তুগত সীমাবদ্ধতা থাকার প্রশ্ন আসে না যদি না সে জগতের পরিচালনাব্যবস্থার আওতায় বিশেষভাবে কারো ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়। অন্যদিকে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে যেমন রঞ্জন রশ্মি ও অতি লাল রশ্মির প্রতিক্রিয়া ধরা সম্ভব হচ্ছে তেমনি শক্তিশালী ব্যক্তিসত্তার অধিকারী জীবিত মানুষের পক্ষে আালামে বারযাখের অবস্থা অবহিত হওয়া সম্ভব হতে পারে। এটাই বিচারবুদ্ধির রায়।


14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25