আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর12%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 48497 / ডাউনলোড: 5357
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মনঃকষ্ট

আশুরা আন্দোলনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক

প্রশ্ন নং ৬২ : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিপ্লবের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক দিক সম্পর্কে কিছু বলুন

উত্তর : কারবালার আকাশের তারার ন্যায় উজ্জ্বল ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে অন্য কোন আকাশের তারা উজ্জ্বল ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্ভাসিত হয়নি । আশুরার দিনে সূর্য যেরূপ দুঃখভারাক্রান্ত ,বিবর্ণ ও দ্বিধা নিয়ে উদিত হয়েছিল অন্য কোন দিন সেরূপ রঙহীন ও মনোবেদনা নিয়ে উদিত হয়নি । পৃথিবীর কোন স্থানই নেইনাওয়া (কারবালা)-র ন্যায় সুন্দর ও অসুন্দরকে পাশাপাশি এত উত্তমরূপে প্রদর্শন করেনি । ঐতিহাসিক কোন ঘটনাই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের মতো মানবতার মহান বাণী ধারণ করেনি । তাফ -এর মরুভূমিতে সেদিন তাওহীদ দ্বিতীয়বারের মতো জন্মগ্রহণ করেছিল । আশুরার দিন খোদাপ্রেম নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছিল এবং কোরআন (এর শিক্ষা) নবজীবন লাভ করেছিল । কেন ফেরেশতারা হযরত আদম (আ.)-কে সিজদা করেছিল ,দশই মুহররমেই তার রহস্য উন্মোচিত হয়েছিল । বস্তুত আশুরার দিন কারবালায় মহান আল্লাহর সকল সৌন্দর্যময় বৈশিষ্ট্য পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল ।

চরম তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ফোরাতের কূলে আলীর সন্তান আব্বাস যখন ঘোড়াসহ পানিতে নেমে পানি পান না করেই মশক ভর্তি করে পানি থেকে উঠে এলেন ,তাঁর এ কর্মের মাধ্যমে ভালোবাসা ,আত্মসম্মানবোধ ,মনুষ্যত্ব ও আত্মত্যাগের যে মহান শিক্ষার নমুনা পৃথিবীর বুকে রেখে গেলেন তা সত্যপিপাসুদের জন্য চিরন্তন এক সুপেয় পানির ঝরনা প্রবাহিত করেছে । রক্তাক্ত কারবালার এ মহান বীর মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের নিশান উড়িয়েছিলেন । তিনি সুন্দরের চিরন্তনতা ও অসুন্দরের স্থায়িত্বহীনতার মহান সাক্ষী । কারবালায় ইমাম হোসাইন ও তাঁর ভাই আব্বাস এবং তাঁদের সঙ্গী-সাথিরা কারবালাকে খোদাপরিচিতি ,মানবতা ও মানুষ গড়ার মহান এক শিক্ষালয়ে পরিণত করেছিলেন ।

কোন শিক্ষালয়ই কারবালার শিক্ষালয়ের মতো উত্তম ও সফল শিক্ষার্থী তৈরি ও প্রশিক্ষিত করতে পারেনি । কারবালার ন্যায় কোন শিক্ষাকেন্দ্রেই এত বৈচিত্র্যময় শিক্ষাবিভাগ নেই । খোদাপরিচিত ,খোদাপ্রেম ,মর্যাদাকর বৈশিষ্ট্য ,লক্ষ্যের পথে চূড়ান্ত দৃঢ়তা প্রদর্শন ,ধৈর্য ,সাহসিকতা ,একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্বসহ অসংখ্য বিভাগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সফলতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন । এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুগ্ধপোষ্য শিশু ,কিশোর ,তরুণ ,যুবক ,মধ্যবয়সী ,প্রবীণ ,বৃদ্ধ ,পুরুষ-নারী ,স্বাধীন মানুষ ও দাস সকলেই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন । তাঁদের সকলেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষক ইমাম হোসাইন ইবনে আলী থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন । তাঁর ছাত্ররা কঠিনতম পরীক্ষায় সম্মানের সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন যা তাঁদের অতুলনীয় যোগ্যতার প্রমাণ বহন করে । শাহাদাতের ময়দানের এ অকুতোভয় সৈনিকরা খোদাপ্রেমে এতটা নিমজ্জিত ছিলেন যে ,তাঁদের নেতার পাশে তাঁদের নাম চিরন্তনতা লাভ করেছে । কেননা ,যে কেউ মহান আল্লাহর জন্য তার সত্তাকে একনিষ্ঠ করবে অবশ্যই সে স্থায়িত্ব ও অমরতা লাভ করবে । আশুরার ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত জ্ঞান ,উন্নত নৈতিক চরিত্র ও মর্যাদাকর বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ । কারবালার ভূমির প্রতিটি অংশ মহান আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ ও মহান প্রভুর দাসত্বের স্বীকৃতির প্রমাণবাহী ।

কারবালার চিরন্তন বিপ্লবী ইতিহাসের প্রতিটি পাতা আত্মমর্যাদা ,বন্দেগি ,মহত্ত্ব ও আত্মত্যাগের স্বর্ণলিপি খচিত । এ মহান ঘটনার সকল দিক একটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয় । আমরা সংক্ষেপে এ কালজয়ী বিপ্লবের কিছু দিকের উল্লেখ করছি :

১. ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জ্ঞান ,চরিত্র ও মর্যাদার দিক

কথা এবং কাজের মাধ্যমে তাওহীদের দিকে আহ্বান সকল ঐশী ধর্মের মূল এবং নবীদের শিক্ষার ভিত্তি । ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান আন্দোলনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাওহীদের সর্বোজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয় । ইমাম হোসাইন এক মুহূর্তের জন্য মহান আল্লাহর স্মরণ ,প্রশংসা ,মর্যাদা বর্ণনা এবং কৃতজ্ঞতা থেকে উদাসীন হননি । তিনি যখন মক্কা থেকে ইরাকের দিকে রওয়ানা হন তখন প্রথমেই মহান আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করেন :

الحمد لله و ما شاء الله و لا حول ولا قوة الا بالله

মহান আল্লাহর প্রশংসা ,তিনি যা চান তা-ই হবে ,আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন শক্তি ও ক্ষমতা নেই ।

তিনি তাঁর জীবনের শেষলগ্নে শাহাদাতের মুহূর্তে যখন তিনি তৃষ্ণার্ত ও রক্তাক্ত অবস্থায় শত্রুবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন এবং শিমার তাঁর শির বিচ্ছিন্ন করার জন্য তাঁর বুকের ওপর বসেছিল তখন বলেন : হে প্রভু! আমি আপনার সিদ্ধান্তে (সন্তুষ্ট চিত্তে) ধৈর্যধারণ করছি । আপনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই । হে আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় (দাতা)!

২. ঐশী (খোদা অর্পিত) দায়িত্ব পালন ও মানবিক মূল্যবোধকে দৃঢ়ীকরণ

স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন সেনাপতি যখন শত্রুর সামনে দাঁড়ায় এবং সৈন্য সমবেত করে তখন তার উদ্দেশ্য থাকে শত্রুকে পরাভূত করে জয়ী হওয়া । ইমাম হোসাইনও এ সাধারণ নীতি থেকে ব্যতিক্রম নন । কিন্তু জয় ও পরাজয় তাঁর দৃষ্টিতে ছিল ভিন্ন যা অনেকের জন্যই বোঝা বেশ কঠিন ।

ইমাম হোসাইনের দৃষ্টিতে বিজয় হলো আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সর্বোত্তমরূপে সম্পাদন করা এবং মানবিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠা করা । যদিও এ কর্ম সম্পাদন করতে তাঁকে শহীদ হতে হয় ও বাহ্যিকভাবে পরাজিত হতে হয় । বাহ্যিক জয়-পরাজয় তাঁর লক্ষ্য ছিল না ।

এ কারণেই আমরা দেখি ,মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত এবং ইমাম আলী (আ.)-এর বিশেষ ভক্ত ও অনুসারী তেরেম্মাহ ইবনে আদী যখন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে কারবালার পথে সাক্ষাৎ করেন তখন ইমাম তাঁকে কুফার পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন । তেরেম্মাহ বলেন : কুফার বিভিন্ন গোত্রপ্রধান এবং গোত্রপতিরা (গোত্রের বিশেষ ব্যক্তিরা) ইবনে যিয়াদের নিকট থেকে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণ করে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে । আর সাধারণ মানুষের অন্তর আপনার সঙ্গে ,কিন্তু তাদের তরবারিগুলো আপনার দিকে (বিরুদ্ধে) । তেরেম্মাহ ইমাম হোসাইনকে প্রস্তাব করেন : আপনাকে আল্লাহর নামে কসম দিয়ে বলছি যে ,এ সফর থেকে বিরত হয়ে আমার গোত্র যে অঞ্চলে বাস করে আমার সঙ্গে সেখানে আসুন । কারণ ,তা শত্রুর নাগালের বাইরে । এতে আপনি শত্রুর আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবেন । আবু আবদিল্লাহ (আ.) দু টি বিষয়ের দিকে তেরেম্মার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন-যে ঐশী দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছে এবং মানবিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করা । এ দায়িত্বের অংশ হিসেবে তিনি চুক্তি ও প্রতিশ্রুতির কথা বলেছেন যা তাঁর ও কুফার অধিবাসীদের মধ্যে সম্পাদিত হয়েছে । তিনি বলেন : কুফাবাসীর সাথে আমার যে চুক্তি হয়েছে তা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয় । এতে শেষ পরিণতি যা-ই হোক না কেন ? অর্থাৎ আমি তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে ,কুফায় গিয়ে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করব এবং তাদেরকে সত্যের দিকে পথনির্দেশ করব । আর তারা আমার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে যে ,আমাকে সাহায্য করবে ও পৃষ্ঠপোষকতা দেবে । আমার দায়িত্ব হলো আমি আমার প্রতিশ্রুতি পালন করব ,যদিও এ পথে আমাকে বিভিন্ন রূপ বিপদের সম্মুখীন হতে হয় । এখন কুফাবাসী তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুক বা না করুক (অঙ্গীকার ভঙ্গ করুক) আমি আমার দায়িত্ব পালন করব ।

প্রশ্ন নং ৬৩ : শত্রুরা তাঁর কথায় কর্ণপাত করবে না জানা সত্ত্বেও কেন ইমাম হোসাইন (আ.) শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নসিহত করেছেন এবং তাদের প্রতি করুণা দেখিয়েছেন ?

উত্তর : আল্লাহর নবী এবং তাঁর একনিষ্ঠ বান্দাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর সৃষ্টির প্রতি স্নেহ ,মমতা ও ভালোবাসা প্রকাশ এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া । কোরআনের আয়াত এবং ইতিহাস থেকে এটা খুব ভালোভাবে বোঝা যায় যে ,ঐশী পথনির্দেশকরা জনগণের বিপথগামিতায় আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি ব্যথিত হন এবং কষ্ট পেয়ে থাকেন । তাঁরা যখন দেখতে পান যে ,তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি নির্মল স্বচ্ছ ঝরনাধারার পাশে বসে তৃষ্ণায় আর্তনাদ করছে তখন তাঁরা কষ্ট পান ,অশ্রু ঝরান এবং তাদের হেদায়াতের জন্য দোয়া করেন ।

সত্য ও সরল-সঠিক পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত এবং কুফর ও বাতিলের দিকে তাদের পা বাড়ানো দেখে তাঁরা চরম কষ্ট পান এবং দুশ্চিন্তায় পড়েন । নবী (সা.)-এর কোমল ও স্পর্শকাতর হৃদয় এসব মূর্খতা ও বিপথগামিতা দেখে কখনো কখনো এমন ব্যথিত হতো এবং তিনি এমন মানসিক চাপ অনুভব করতেন যে ,কষ্ট এবং দুঃখের তীব্রতায় তাঁর পবিত্র জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ত । আল্লাহ তা আলা তাঁকে এমনই প্রেম-ভালবাসা দিয়েছেন ।

لعلك باخع نفسك الا یكونوا مؤمنین হয়ত তারা ঈমান না আনার কারণে তুমি তোমার জীবন ধ্বংস করে দেবে । ৫০৮

যদি আসমানি পথনির্দেশকের মধ্যে এমন বিশেষত্ব না থাকে তবে তাঁর নেতৃত্ব প্রকৃত তাৎপর্য লাভ করতে পারে না । ইমাম হোসাইন (আ.) রেসালাতের বৃক্ষের ফল । তিনি মহানবী (সা.)-এর সন্তান এবং তাঁর অস্তিত্বের অংশ । তিনি নবী থেকে এবং নবী তাঁর থেকে । যেমনি ভাবে রাসূল (সা.) বলেছেন :حسین منِ و انا من الحسین হোসাইন আমা থেকে এবং আমি হোসাইন থেকে । ৫০৯

তিনি নবী (সা.)-এর সমস্ত পূর্ণতার উওরাধিকারী এবং তাঁর উচ্চ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতিচ্ছবি । নবী (সা.)-এর স্নেহ ও মায়া-মমতার ঝরনাধারা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহত্ত্বের পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়েছে । এই কারণেই আবু আবদিল্লাহ (আ.) তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মানুষকে দিকনির্দেশনা দান এবং নসিহত করেছেন । এমনকি ঐশী নেতা তাঁর রক্তপিপাসু দুশমন ও হীন শত্রুদেরকেও তাঁর বক্তব্য এবং উপদেশ-নসিহত দ্বারা হেদায়াতের চেষ্টা করেছেন যা তাঁর মানবপ্রেম ,উন্নত চরিত্র এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে । বিশ্ববাসীর সামনে তাঁর এ কর্ম অলৌকিক এক নিদর্শনস্বরূপ টিকে আছে ।

ইমাম হোসাইন (আ.) যখন আশুরার দিন শত্রুর বিরাট বাহিনীর মুখোমুখি হন কখনই তাদেরকে নসিহত করা এবং তাদের বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকেননি । অথচ তিনি জানতেন যে ,নিশ্চিত শত্রুরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য সর্ব প্রকারের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ,এমনকি কারবালায় তাঁর অবস্থানস্থলে থাকা শিশুদের কাছে পর্যন্ত পানি পৌঁছানোর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে এবং তাদেরকে দেখছেন তাঁর ওপর হামলার জন্য কেবল নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছে ও তাঁর কথা যেন কেউ না শোনে এজন্য শোরগোল ও চিৎকার করছে । তিনি তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায়-যার প্রতিটি বাক্য গভীর অর্থপূর্ণ এবং বিশ্লেষণের দাবি রাখে ,তাতে শত্রুদের নাফরমানি ,অবাধ্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতার মূল কারণ বর্ণিত হয়েছে । শত্রুদের উদ্দেশেই তিনি তা বর্ণনা করেছেন ।৫১০

আবু আবদিল্লাহ (আ.) এমনকি শত্রুপক্ষের নেতাদের ,যেমন উমর বিন সা দ ও শিমারকেও উপদেশ দেয়া থেকে বিরত থাকেননি । আশুরার দিন দুই বাহিনীর মাঝখানে উমরের সাথে সাক্ষাতের সময় তিনি বলেন : হে সা দের সন্তান! আফসোস তোমার জন্য ,তুমি কি সেই আল্লাহকে ভয় কর না যাঁর দিকে ফিরে যেতে হবে ? আমি কার সন্তান তা জানা সত্ত্বেও কি তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করবে ? এ (বিপথগামী) গোষ্ঠীকে ত্যাগ করে আমার সাথে আস তাহলে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারবে ।

উমর ইবনে সা দ বলল : আমি ভয় পাচ্ছি যে ,আমার বাড়ি-ঘর ধ্বংস করে ফেলা হবে ।

ইমাম বললেন : আমি তোমার জন্য তা তৈরি করে দেব ।

উমর ইবনে সা দ বলল : আমি ভয় পাচ্ছি যে ,আমার ধনসম্পদ ,সহায়-সম্পত্তি ছিনিয়ে নেওয়া হবে ।

ইমাম বললেন : হেজাজে আমার যে সম্পদ (ভূমি) আছে তার চেয়েও ভালো সম্পদ তোমাকে দেব ।

উমর ইবনে সা দ বলল : আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানের জীবন নিয়ে শঙ্কিত ।

ইমাম হোসাইন (আ.) নীরব হয়ে গেলেন এবং কোন উত্তর দিলেন না । ইমামের লক্ষ্য ছিল নিজেকে বিকিয়ে দেয়া এক নীচ ও হীন ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া যে তাঁকে হত্যা করে চিরস্থায়ী জাহান্নামের আগুনকে নিজের জন্য অবধারিত করেছে ।

ইমাম হোসাইনের এসব বক্তৃতা এবং উপদেশ-নসিহতের দু টি লক্ষ্য ছিল :

১. শত্রুদের প্রতি তাঁর হুজ্জাত পূর্ণ (চূড়ান্ত প্রমাণ পেশ) করা এবং তাদের জন্য কোন অজুহাতের পথ খোলা না রাখা ।

২. মুষ্টিমেয় লোককে হলেও জাগ্রত করা ,যেমন হুর ইবনে ইয়াযীদ-যাঁর মনে আহলে বাইতের ভালোবাসা এবং ইমামের আলো জ্বলে উঠেছিল ।

এই দয়ার্দ্র এবং জাগরণমূলক বক্তৃতামালা মুসলমান নামধারীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক সৈন্যের মনে প্রভাব ফেলেছিল এবং কিছুসংখ্যক ইমামের বাহিনীতে যোগ দিয়ে চিরন্তন সৌভাগ্য ও মর্যাদা অর্জন করেছিল । এই ছিল ঐশী নেতার পাপী এবং নির্দয় শত্রুদের মোকাবিলায় ভালোবাসা ,স্নেহ-মমতা এবং মানবপ্রেমের প্রকাশ । এই হচ্ছে হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সন্তানের নীতি ও পদ্ধতি ,যিনি চরম স্পর্শকাতর মুহূর্তেও আল্লাহর নির্ধারিত পথ থেকে বিচ্যুত হননি ।

আশুরার নামায

প্রশ্ন নং ৬৪ : ইমাম হোসাইন (আ.) কেন আশুরার দিন তাঁর কিছুসংখ্যক সাথি শহীদ হবেন জেনেও শত্রুসেনাদের মাঝে যোহরের নামায জামাআতের সাথে আদায় করেন ?

উত্তর : নামায হচ্ছে ধর্মের ভিত্তি ।৫১১ আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে সবচেয়ে দৃঢ় বন্ধন হচ্ছে নামায । নামাযের দ্বারাই মুমিনকে চেনা যায় । এই সিঁড়ি দিয়ে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত (মিরাজে) যাওয়া যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ।৫১২

নামায আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সর্বোত্তম পন্থা এবং রাসূল (সা.)-এর নয়নের আলো ।৫১৩ আর তাই নবী (সা.)-এর প্রথম ও শেষ উপদেশ ছিল নামায প্রতিষ্ঠা করা ।৫১৪ নামায মানুষকে পাপকাজ এবং কলুষতা থেকে মুক্ত রাখে ।৫১৫ এমনকি অপূর্ণাঙ্গ এবং অমনোযোগী নামাযও মানুষ ও পাপ কাজের মধ্যে বাধার সৃষ্টি করে ।৫১৬ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সাথি মুয়াবিয়া বিন ওয়াহহাব ইমামকে জিজ্ঞেস করলেন : কোন্ উত্তম বস্তু বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে এবং আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কী ?

ইমাম বললেন : আমার দৃষ্টিতে আল্লাহর পরিচয় লাভের পর নামাযের থেকে উত্তম কিছু নেই । ৫১৭

হোসাইন বিন আলী (আ.) আল্লাহর ধর্মকে জীবিত রাখা ,সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং কুসংস্কার ও আত্মপূজারি অত্যাচারীদের হাত থেকে তাকে মুক্ত করার জন্য কালজয়ী বিপ্লব করেছেন । আর নামায হচ্ছে আল্লাহর এই ধর্মের ভিত্তি । এই ধর্ম এবং মুহাম্মাদ (সা.)-এর শরীয়তের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসেবে ইমাম হোসাইন (আ.) কেন ধর্মের খুঁটি নামাযকে রক্তাক্ত কারবালা প্রাঙ্গনে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে শত্রুদের কাপুরুষোচিত হামলার সামনে প্রতিষ্ঠা করবেন না আর এর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় ও গভীর করবেন না ?

আবু সুমামাহ ছাইদাবী তাঁর নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ভালোবাসায় নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন । তিনি আশুরার দিন দুপুরে যখন ইমাম শত্রু কর্তৃক সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ হন তখন তাঁর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে যোহরের নামাযের সময় স্মরণ করিয়ে দেন এবং তাঁর পেছনে জামাআতে নামায পড়ে আল্লাহর সাক্ষাতে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন । ইমাম এর উত্তরে বলেন : তুমি আমাকে নামাযের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ । আল্লাহ তোমাকে নামায আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত করুন । ৫১৮

হোসাইন বিন আলী (আ.)-এর সঙ্গী-সাথিরা শত্রুদের থেকে নিক্ষিপ্ত হওয়া তীরের সম্মুখে যোহরের নামায আদায় করলেন এবং তাঁদের কয়েকজন নামাযের সময় রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এবং শাহাদাতের ডানায় ভর করে প্রিয়জনের দর্শনে যাত্রা করলেন ।

আশুরার রাতে ইমাম ,তাঁর পরিবারবর্গ এবং সাথিদের কোরআন তেলাওয়াত ,ইবাদত-বন্দেগি এবং দোয়া ও মোনাজাতের দৃশ্য মহান আল্লাহর দাসত্বের সর্বোত্তম প্রদর্শনী । নামাযের প্রতি প্রেম ,আল্লাহর নিকট নিজের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে গোপনে প্রার্থনা করা এ সবকিছুই আবু আবদিল্লাহ (আ.) তাঁর সম্মানিত পিতার নিকট থেকে শিখেছিলেন । ইবনে আব্বাস সিফফিন যুদ্ধের চরম উত্তেজনাপূর্ণ মুহূর্তে আলী (আ.)-কে দেখলেন যে ,আকাশের দিকে মুখ তুলে যেন কোন কিছুর অপেক্ষা করছেন ।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন : হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি কি কোন কিছুর জন্য চিন্তিত ? তিনি বললেন : হ্যাঁ নামাযের সময় হওয়ার অপেক্ষায় আছি । ইবনে আব্বাস বললেন : এই চরম মুহূর্তে যুদ্ধ বাদ দিয়ে আমরা নামাযে নিমগ্ন হতে পারি না । আমীরুল মুমিনীন (আ.) বললেন : আমরা তো নামাযকে প্রতিষ্ঠার জন্যই তাদের সাথে লড়াই করছি ।

সত্যিই যখন আমাদের নেতা ও পথপ্রদর্শক যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রাঙ্গনেও নামাযের মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি এতটা দৃষ্টি রেখেছেন এবং ঐ কঠিন ও চরম মুহূর্তেও নামায আদায় করেছেন ,তখন আমরা যাঁরা ঐ রূপ যুদ্ধের অবস্থায় নেই ,বরং শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে আছি ,আমাদের জন্য কি নামাযকে অবহেলা করা ও হালকা করে দেখা শোভনীয় ? এটা কি যুক্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য যে ,আমরা ঐসব মহান ও পবিত্র ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা পোষণ করি এবং নিজেদেরকে তাঁদের অনুসারী মনে করি ,অথচ যে নামাযকে টিকিয়ে রাখা এবং প্রতিষ্ঠা করার জন্যই তাঁরা এত কিছু করেছেন আমাদের জীবনে তার কোন গুরুত্ব থাকবে না ?

আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত যে ,কোরআন পাঠ ,দোয়া এবং নামাযে কি গুপ্ত রহস্য ও স্বাদ লুকিয়ে রয়েছে যে কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) মুহররমের নবম দিন আছরের সময় যখন মুনাফিক বাহিনী হামলা করার প্রস্তুতি নিয়ে ইমামের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছিল তখন তিনি তাঁর সাহসী-বীর ভাই আব্বাসকে তাদের নিকট এ বলে পাঠালেন যে ,যদি পার যুদ্ধকে কাল পর্যন্ত পিছিয়ে দাও । অতঃপর বললেন : এটা এজন্য যে ,যেন আজ রাতে পরওয়ার দিগারের জন্য নামায আদায় করতে এবং তাঁর দরবারে দোয়া করতে পারি । আল্লাহ জানেন যে ,আমি তাঁর জন্য নামায আদায় ,তাঁর কিতাব পাঠ এবং তাঁর নিকট ইস্তিগফার করাকে কত ভালোবাসি!৫১৯

এটা কি সেই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কথা নয় যিনি নিশ্চয় অপমান আমাদের থেকে দূরে -এই স্লোগান দিয়ে যুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ইসলাম ও মনুষ্যত্বের পথে চরম আত্মত্যাগের শিক্ষা মানবজাতির জন্য রেখে গিয়েছেন ? অথচ তিনিই অমানুষ পাষ-দলের কাছে কোরআন তেলাওয়াত ,ইবাদত ও নামাযের জন্য সময় চেয়েছেন ।

নামায আদায় এবং আল্লাহর দরবারে মোনাজাত ও গোপন প্রার্থনা করার মধ্যে কী মহান মর্যাদা নিহিত আছে যে ,শহীদদের নেতা সে জন্য শত্রুদের কাছে যুদ্ধ বিলম্বিত করার আবেদন জানান ।

কারবালার অন্যায় অবিচারের মূল কোথায় ?

প্রশ্ন নং ৬৫ : অনুগ্রহপূর্বক বলুন ,ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালার সমস্ত অত্যাচার-নির্যাতন এবং পাপাচার ও অনাচারের মূল ভিত্তিকে কিভাবে চিহ্নিত করেছেন ? কেননা ,এই কারণগুলো তাঁর বাণীসমূহ থেকে অধিকতর সুস্পষ্ট ও অনুধাবনযোগ্য ।

উত্তর : নিষ্ঠুর এবং পাষাণহৃদয় থেকেই অন্যায় ,অত্যাচার ,পাপাচার এবং হিংস্রতার সৃষ্টি হয় । নিষ্ঠুর এবং পাষাণ হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে । এর মধ্যে একটি হচ্ছে হারাম খাওয়া । যে কোন প্রকারের হারাম খাওয়ার অকল্পনীয় মন্দ প্রভাব রয়েছে । আত্মার (ক্বালব) মৃত্যু ,ঐশী সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাত) পর্দাচ্ছাদিত হওয়া ,সত্য ও ন্যায়ের দিকে ঝোঁক না থাকা ,আল্লাহর অবাধ্যতা এবং তাঁর ওলীদের সাথে শত্রুতা করা ইত্যাদি হারাম খাওয়ারই ফল । ইসলাম ধর্মে ইবাদতের ব্যাপক অর্থ রয়েছে । হারাম মাল না খাওয়া এবং সৎ চরিত্রকে সবচেয়ে বড় ইবাদত বলে গণ্য করা হয়েছে । অন্যদিকে হারাম মাল খাওয়া অনেক বড় গোনাহের কাজ এবং তা ধ্বংসকারীও বটে । ইমাম বাকের (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে : আল্লাহর নিকট পেট এবং গুপ্তাঙ্গকে হারাম থেকে রক্ষা করা থেকে উত্তম কোন ইবাদত নেই । ৫২০

হারাম (মাল) খাওয়ার অন্যান্য প্রভাব হচ্ছে বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলা ,জ্ঞানান্ধ হয়ে পড়া এবং সত্যকে উপলব্ধি করতে না পারা । পবিত্র কোরআন এবং নিষ্পাপ ইমামরা এ অবস্থাকে হৃদয় মোহরাঙ্কিত হওয়া বলে অভিহিত করেছেন । সত্যের বিপরীতে ঔদ্ধত্য দেখানো ,বাতিলের পথে একগুঁয়েমি করা এবং অন্যায়-অবিচার ,কুফর ও যুলুমের অনুসরণ করা ,এসবই হারাম খাওয়ার পরিণতি ।

আশুরার দিন যখন শত্রুবাহিনী ইমাম হোসাইনকে মূল্যবান পাথরের ন্যায় চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল তখন তিনি তাঁর বক্তৃতার মধ্যে এ দু টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে নির্দেশ করে বলেন : যে আমাকে অনুসরণ করবে সে হেদায়াত পাবে ,যে আমার বিরোধিতা করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে । কিন্তু তোমরা সবাই আমার বিরোধিতা করছ ,আমার কথায় কর্ণপাত করছ না! কেননা ,তোমাদের পেট হারাম মালে পূর্ণ হয়ে আছে এবং তোমাদের অন্তরে মোহর মারা হয়েছে ,আফসোস তোমাদের জন্য! তোমরা কেন আমার কথা শোনার জন্য নীরব হচ্ছ না ? ৫২১

তৃতীয় কারণ যা প্রকৃতপক্ষে মানুষের বিচ্যুত হওয়ার মূল তা হলো আল্লাহকে ভুলে যাওয়া এবং আল্লাহ্ সম্পর্কে উদাসীনতা । আল্লাহর স্মরণ সকল সুখশান্তি ,পূর্ণতা এবং বরকতের উৎস । মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে তা যেন এক ফোঁটা পানি-যা অসীম ,পূর্ণ এবং সৌন্দর্যময় এক মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে । এ অবস্থায় সে সংকীর্ণ বন্দিশালা থেকে নিজেকে বের করে নির্মল ,স্বচ্ছ ,আলোকিত ও অসীম মহাশূন্যে ডানা মেলতে সক্ষম হয়েছে । এর বিপরীতে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন মানুষের অবস্থা স্থবির এক পুকুরের ন্যায় যা জীবনের স্বচ্ছ ঝরনাধারা থেকে আলাদা হয়ে পচা ও দুর্গন্ধময় হওয়ার মুখে পড়েছে ।

আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ আত্মা শয়তানের বিচরণের উত্তম ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে । শয়তান তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাকে নিজের বন্ধু ও সহযোগীদের অন্তর্ভুক্ত করেছে । এমন আত্মায় গুনাহ এবং অবাধ্যতার বীজ খুব সহজে এবং দ্রুত অঙ্কুরিত হয় এবং অল্পতেই শয়তানের ফাঁদে পড়ে তার অনুসারী হয়ে যায় । ইমাম হোসাইন (আ.) বিপুল সংখ্যক শত্রুর সম্মুখে দেয়া খুতবায় তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন : নিঃসন্দেহে শয়তান তোমাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে ভুলিয়ে দিয়েছে । ৫২২ ইমামের এই বক্তব্য আল্লাহর কালামেরই ভাবার্থ । পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : শয়তান এদের ওপর পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে । অতঃপর তাদের আল্লাহর স্মরণ ভুলিয়ে দিয়েছে ,এরা হচ্ছে শয়তানের দল ,তুমি জেনে রাখ ,শয়তানের দলের ধ্বংস অনিবার্য । ৫২৩ ইমাম হোসাইনের বাণী যুগ-যুগান্তরের সকল মানুষের জন্য বার্তাস্বরূপ যা প্রকৃত সৌভাগ্যের চাবি এবং সর্বপ্রকার বিপথগামিতা ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ধারালো তরবারি ,আর তা ঐসব গুনাহ যা অপরাধ এবং বিশৃঙ্খলার ক্ষেত্র তৈরি করে সেগুলোর মোকাবেলায় ঢালস্বরূপ । সব সময় আল্লাহর স্মরণে লিপ্ত থাকা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি মনোযোগই কেবল মানুষকে সত্যের পথে অবিচল রাখে ।

কালো পোশাক পরিধান

39 নং প্রশ্ন : শোক প্রকাশের দিনে কালো পোশাক পরিধানের দর্শন কী ?

কালো রং বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন প্রভাব এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । এর বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে কিছু বা বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহার করে থাকে । কালো রং একদিকে বস্তুকে অন্ধকারে গোপন ও ঢেকে রাখে তাই কখনও কখনও এ রঙ কোন কিছুকে ঢেকে রাখা বা গোপন রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় ।357 আবার অন্যদিকে তা ব্যক্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত । এ কারণেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের আনুষ্ঠানিক পোশাক (বিশেষত বহিরাবরণ ,যেমন কোট ,ব্লেজার ইত্যাদি) সাধারণত কালো বা গাঢ় সুরমা রঙের হয় । ইতিহাসে এরূপ অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় যে ,বিশেষ ব্যক্তি ,গোষ্ঠী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য এ ধরনের রঙ ব্যবহার করতেন ।358

কালো রঙের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব হলো ,এ রঙটি প্রকৃতিগতভাবে দুঃখ ,বিষাদ ও বিষণ্ণতার পরিচায়ক যা শোক প্রকাশের উপযোগী । এ কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ এ রঙকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর দুঃখ ,শোক ও বিষণ্ণতা প্রকাশে ব্যবহার করে থাকে ।

এ বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো রঙ নির্বাচনের মধ্যে উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো ছাড়াও আবেগ-অনুভূতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে । যে ব্যক্তি তার প্রিয় মানুষের শোকে নিজে কালো পোশাক পরিধান করে এবং দেওয়ালগুলোকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় প্রকৃতপক্ষে সে এ কাজ দ্বারা বলতে ও বুঝাতে চায়- (হে বিদায়ী) তুমি আমার চোখের জ্যোতি ও মণি ছিলে ,তোমার মরদেহ মাটিতে দাফন হওয়া আমার কাছে পশ্চিম আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অস্তমিত হওয়ার মতো ;(তোমার বিদায়) জীবনকে আমার চোখে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ;সময় ও স্থানকে গ্রাস করে ফেলেছে ।

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর অষ্টম দিনে পিতার কবরের নিকট গিয়ে ক্রন্দন করে নিম্নলিখিত কবিতাটি পাঠ করেছিলেন

یا ابتاه انقطعت بك الدنیا بانوارها و زوت زهرتها کانت ببهجتك زاهرة فقد اسود نهارها فصار يحکی حنادسها رطبها و یا بسها...والْسی... لازمنا

হে পিতা! তুমি চলে গেছ ,তোমার চলে যাওয়ার কারণে দুনিয়া এর আলো আমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ,এর নেয়ামতসমূহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে ,বিশ্বজগৎ তোমার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ও আলোকিত ছিল ,(কিন্তু তোমার বিদায়ের পর) এর দিনের আলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে ,এর (দুনিয়ার) সিক্ততা ও শুষ্কতা ,এর অন্ধকার রাতের নির্দেশ করে... এবং দুঃখ ও মর্মবেদনা আমাদের সবসময়ের সঙ্গী... । 359

এ কারণেই কালো পোশাক পরিধান করার কারণ কালো রঙে লুক্কায়িত থাকা গোপন রহস্যের মধ্যে নিহিত এবং এর প্রকৃতিগত (দুঃখ ও শোকবাহী) রূপটিই একে যুক্তিসঙ্গত একটি প্রথায় পরিণত করেছে । আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীরা শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করে । কারণ ,এ পোশাক তাঁদের প্রতি প্রেম ও বন্ধুত্বের নিদর্শন বহন করে ,স্বাধীনচেতাদের মহান নেতা ও আদর্শপুরুষ ইমাম হোসাইনের প্রতি নিবেদিত থাকার প্রতিশ্রুতি দান করে । এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার রণাঙ্গনে তাঁকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয় ও নৈতিকভাবে তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ।360 ইমামদের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে বাহ্যিক কালোর অবয়বে তাঁর সাথে সহমর্মিতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের অন্তরকে আলোকিত করা হয় ;যদিও বাহ্যিকভাবে তা কালো ,কিন্তু ভেতরে উজ্জ্বল ও তাঁর আদর্শে আলোকিত ।

40 নং প্রশ্ন : অন্যান্য জাতির মধ্যে কালো পোশাক পরিধান করার প্রচলন রয়েছে কি ? কালো পোশাক পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আগমনের পর আব্বাসী খলিফা অথবা আরব জাতি থেকে ইরানে প্রবেশ করেছে ,ইরানী সভ্যতায় এ ধরনের সংস্কৃতি ছিল না ।

উত্তর : প্রথমত ,শোকের সময় কালো পোশাক পরিধানের রীতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে গ্রহণযোগ্য এক প্রথা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ইরান থেকে শুরু করে গ্রীক সভ্যতা ,এমনকি আরবের জাহেলী সংস্কৃতিতেও এর প্রচলন ছিল ।

দ্বিতীয়ত ,কালো পোশাক পরিধান আব্বাসী খলিফাদের সময় অথবা ইসলাম আগমনের পর আরবদের নিকট থেকে ইরানে প্রবেশ করেনি ;বরং এর মূল প্রাচীনকাল থেকেই ইরানী সংস্কৃতিতে নিহিত ছিল এবং বাহ্যিকভাবে তাদের ব্যবহারিক জীবনে এর প্রচলন ছিল । নিচের বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে :

1. অনেক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বর্ণনা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে ,পৃথিবীর অনেক জাতি ও গোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে শোকের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করত । উদাহরণস্বরূপ ইরান ,গ্রীক ও আরব সংস্কৃতির কিছু নমুনা তুলে ধরলাম :

ক. প্রাচীন ইরানের কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : প্রাচীন ইরানের পাণ্ডুলিপিগুলোতে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে ,কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো । ইরানী বিখ্যাত সাহিত্যিক ফেরদৌসী শাহনামা তে ইরানী প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘটনাতে কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন ।

বিশেষ করে যখন রুস্তমের ভাই শুগাদ তাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছিল ,ফেরদৌসী তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :

এক বছর সিস্তানে শোক ছিল ,তাদের জামাসমূহ কালো ছিল ।

সাসানীদের যুগে যখন বাহরাম গুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল ,তার উত্তরাধিকারী ইয়াজ্দর্গাদ শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ।

পথে চল্লিশ দিন পিতার শোক পালন করেছিল ,

সৈন্যরা কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

ফেরেইদুন যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল তার উত্তরাধিকারী ও সন্তানরা এ কাজ করেছিল :

মানুচেহর এক সপ্তাহ যন্ত্রণায় ছিল ,দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ ও চেহারা হলুদ ছিল ;সকলে পরেছিল কালো পোশাক ,রাজা পেলেন মনোবল সৈন্যদের সম্মিলিত সমবেদনা প্রকাশে ।

এ কালো পোশাক পরার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত ইরানে চালু রয়েছে ।361

খ. গ্রীক সভ্যতায় কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : গ্রীসের প্রাচীন কল্পকাহিনীতে এসেছে : হেক্টরের হাতে প্রটিসিলাস নিহত হওয়ার ঘটনায় টাইটাস অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে শোকের চিহ্ন হিসেবে সবচেয়ে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

এ বিষয়টি গ্রীক সভ্যতায় কবি হোমারের যুগে কালো পোশাক পরিধান করার প্রথার প্রমাণ বহন করে । ইহুদিদের মধ্যে প্রাচীনকালে আত্মীয়-স্বজনের শোকে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে ,সকলে মাথা কামিয়ে ছাই মাখত এবং তাদের পোশাক কালো অথবা কালোর কাছাকাছি কোন রংয়ের ছিল ।362

বুসতানী তাঁর বিশ্বকোষ -এ কালো রঙ ইউরোপীয় সভ্যতার সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে শোক পালনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রং হিসেবে গণ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন : শোক পালনের সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তার নৈকট্যের শ্রেণিভেদে তারা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করে । বিশেষ করে বিধবা নারীরা কমপক্ষে এক বছর শোক পালন করে এবং এই সময়ে তাদের পোশাক থাকে কোন ধরনের নকশা ও অলংকার ছাড়া কালো রংয়ের ।363

আরব জাতির কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : আরবদের ইতিহাস ,কবিতা ও ভাষা সাক্ষ্য দেয় যে ,মিশর হতে সিরিয়া ,ইরাক ও সৌদি আরবসহ সব জায়গায় কালো রঙ শোকের রঙ হিসেবে পরিচিত ছিল ।

ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব সাহিত্যিক ও কোরআনের মুফাস্সির যামাখশারী লিখেছেন : একজন সাহিত্যিক বলেছেন : কালো পোশাক পরিধানকারী সন্যাসীকে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম : কেন কালো পোশাক পরিধান করেছ ? বলল : আরবরা যখন তাদের মধ্য হতে কেউ মারা যায় তখন কোন্ ধরনের পোশাক পরিধান করে ? সন্যাসী বলল : আমিও আমার গুনাহের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছি । 364

ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে ,আরব জাতি তাদের মুসিবতের সময় নিজেদের পোশাককে কালো করত ।365

রাসূল (সা.)-এর যুগে বদরের যুদ্ধের শেষে যখন 70 জন মুশরিক ও কুরাইশ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল তখন মক্কার নারীরা তাদের নিহতদের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।366

এসকল ঐতিহাসিক বর্ণনা এবং সাহিত্যিক রচনা ও কবিতা প্রমাণ করে যে ,কালো রং প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে শোকের চিহ্ন হিসেবে প্রচলিত ছিল । এ বিষয়টি ইরান বা ইসলামী যুগের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পৃক্ত নয় ;বরং ইসলামের পূর্বে ইরানীরা ও প্রাচীন গ্রীসের আধিবাসীরাও শোক প্রকাশের প্রথা হিসেবে কালো অথবা গাঢ় নীল রংয়ের পোশাক পরিধান করত ।367

2. আহলে বাইত (আ.)-এর মাঝে কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : তথ্যভিত্তিক সংবাদ এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা করে যে ,রাসূল (সা.) এবং পবিত্র ইমামগণও এই যৌক্তিক প্রকৃতিগত পথকে সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় ব্যক্তির শোকে তাঁরা নিজেরাও কালো পোশাক পরিধান করেছেন ।

নাহজুল বালাগার শারহ (ব্যাখ্যা গ্রন্থ)-এ ইবনে আবিল হাদীদ বর্ণনা করেছেন : ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতা আলী (আ.)-এর শাহাদাতের শোকে কালো পোশাক পরিধান করে মানুষের মাঝে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ।368

এ কারণে যে হাদীসটি সকল হাদীসবিদ বর্ণনা করেছেন যে ,ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : বনি হাশিমের নারীরা আবা-আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর শোকে কালো পোশাক পরিধান করতেন ।

لما قتل الحسین بن علی)ع ( لیس نساء بنی هاشم السواد و المسوح و کن لاتشتکین من حر ولابرد و کان علی بن الحسین)ع ( یعمل لهن الطعام للمأتم

যখন ইমাম হোসাইন (আ.) শহীদ হলেন তখন বনি হাশিমের নারীরা কালো ও রুক্ষ-পশমের পোশাক পরিধান করেছিলেন ,গরম বা ঠাণ্ডার বিষয়ে তাঁদের কোন অভিযোগ ছিল না ,তাঁরা শোক পালনে রত থাকার কারণে (আমার পিতা) আলী ইবনে হোসাইন (আ.) তাঁদের জন্য খাবার তৈরি করতেন ।

আব্বাসীদের কালো পোশাক পরিধান করার কারণ

আব্বাসী খলিফারা উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সময় থেকে বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে আহলে বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী হিসেবে দাবি করেছিল । এ কারণে যখন তারা ক্ষমতা অর্জন করেছিল তখন তাদের শাসনকে আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর শাসন হিসেবে অভিহিত করত এবং বলত যে ,এই খেলাফত হচ্ছে আলী (আ.)-এর খেলাফতেরই ধারাবাহিকতা । তাদের প্রধানমন্ত্রী আবু সালামা খাল্লালকে আলে মুহাম্মাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সামরিক বাহিনীর প্রধান আবু মুসলিম খোরাসানিকে আলে মুহাম্মাদের আমিন (বিশ্বস্ত ব্যক্তি) বা নেতা হিসেবে নামকরণ করেছিল ।

কালো পোশাক রাসূল (সা.)-এর অবমাননা ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার শোকের প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ।369 আব্বাসী খলিফারা কালো পোশাক পরিধানের প্রথা ইরানে এবং অন্যান্য ইসলামী শহরে প্রবর্তন করে নি ;কেননা ,মৃত ব্যক্তির শোকে কালো পোশাক পরিধানের প্রথা সামাজিকভাবে এবং বিশেষভাবে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল ।

কারবালার মযলুম শহীদ ইমাম হোসাইন এবং বনি উমাইয়ার হাতে নিহত তাঁর নাতি যাইদ ইবনে আলী ও ইয়াহিয়া ইবনে যাইদের রক্তের প্রতিশোধের অজুহাতে আব্বাসী খলিফারা কালো পতাকা ও কালো পোশাক পরিধান করাকে আহলে বাইতের শহীদদের শোক প্রকাশের উপকরণরূপে ব্যবহার করেছে । এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করে তারা আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রতারিত করে নিজেদের দলে আনার চেষ্টা করেছে এবং এ ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের মনে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছে । তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও কালো পতাকা ও পোশাককে সবসময়ের জন্য নিজেদের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল ।370

এই প্রতারণার কারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং অন্যান্য ইমাম কালো রঙের পোশাকের বিরুদ্ধে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতেন । আব্বাসী খলিফারা আনুষ্ঠানিকভাবে কালো পোশাককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ইমামরা এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা করেছেন । তাদের সাথে এ বিষয়ে (কালো পোশাক ব্যবহার) একাত্মতা প্রকাশ করা অত্যাচারী শাসককে স্বীকৃতি দান বলে মনে করা হতো । কিন্তু তাঁরা সার্বিকভাবে আহলে বাইতের শহীদদের শোকে শোকাহত হয়ে কালো পোশাকের সংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন না ।371

শোক প্রকাশের পদ্ধতি

41 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য কী পরিমাণ শোক প্রকাশ করা বৈধ ?

ইসলামী শরিয়তের বিধান শোক প্রকাশের পেছনে নিহিত দর্শন ও বুদ্ধিমান সমাজের কাছে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিই আহলে বাইত বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করবে । যদি শোকের আবেগ-উদ্দীপনার মাত্রা তার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর এমনভাবে প্রাধ্যান্য লাভ করে যে ,এর দর্শন থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তা শরিয়ত ও বৃদ্ধিবৃত্তির সীমানা থেকে দূরে সরে যাবে । যদি এর ধরন এমন হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সমাজ অপছন্দ ও ঘৃণা করে ,তা শিয়া মাযহাব ও এর প্রকৃত শিক্ষার সাথে অবমাননাকর মনে হয় তাহলে অবশ্যই এ ধরনের শোক প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত ও বর্জিত হবে ।

বলা বাহুল্য ,শোক প্রকাশের ধরন এমন হওয়া উচিত যাতে এর শিক্ষার প্রকৃত বিষয়বস্তুকে মানুষের মাঝে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে এবং ইমামদের সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে । যদি এ শোক প্রকাশের বাহ্যিক রূপ এমন হয় যে ,অভ্যন্তরীণ রূপের আদৌ প্রকাশ না ঘটায় ;বরং মূল বিষয়বস্তুকেই বিতর্কিত করে তোলে তাহলে এ বিষয়টি সঠিক রূপে প্রকাশ লাভ করবে না ;আ তা আশুরার রূপকেই বেমানান করে তুলবে । উদাহরণস্বরূপ ,কিছুসংখ্যক লোক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীরে আঘাত করার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে থাকে । এ ধরনের ব্যক্তিরা শুধু আশুরার প্রকৃত আদর্শকে বিকৃতরূপে প্রচার করল না ;বরং যেমনভাবে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আলী খামেনেয়ী বলেছেন ,তারা আশুরার শিক্ষার প্রতি অবমাননা করল এবং এ অবমাননার কারণে এ ধরনের কাজ বৈধ হবে না ।372

42 নং প্রশ্ন : যদিও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয় তবুও কেন কিছু শোকানুষ্ঠানে তাঁর কেবল হীন ও মযলুম অবস্থা প্রর্দশন করা হয় । কিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ?

উত্তর : عزت শব্দটির অর্থ কঠিন ,শক্তিশালী ,দৃঢ় হওয়া । শব্দটি কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্যকে আল্লাহ ,রাসূল (সা.) এবং মুমিনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছে ।

ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা কোরআনের এই শিক্ষার অনুসরণের ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রগামী ছিলেন । কখনই অপমান ও লাঞ্ছনাকে সহ্য করেননি । ফলে এই বিষয়টিهیهات م نّا الذلة অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে অনেক দূরে -আশুরার আন্দোলনের অন্যতম স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে ।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ,কিছু সূত্র ও লেখনিতে এমন বিষয় উল্লিখিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামে আয়োজিত কিছু শোকানুষ্ঠানে এমন কথা বলা হয়ে থাকে যেগুলোতে তাঁর আন্দোলনে বিদ্যমান সম্মান ও মর্যাদার উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয় ।

এ পদ্ধতির পেছনে নিহিত মনস্তাত্ত্বিক মূল কারণ হলো হোসাইনী আন্দোলনের প্রচারকারী কতিপয় ব্যক্তি ইমামের আন্দোলনের শিক্ষামূলক বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পরিবর্তে শুধু তাদের কান্নার অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্য চেষ্টা করে । এ কারণে অগ্রহণযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে শোকের বিষয়বস্তু বর্ণনা করে এবং হোসাইনী আন্দোলনের অপমানজনক ও লাঞ্ছনাময় চেহারা মানুষের সামনে চিত্রায়িত করে ।

যে সকল বিষয়বস্তু বর্ণনার ফলে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদার হানি ঘটে এবং যার বর্ণনা ইসলাম ,রাসূল (সা.) ,আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত ;এ ধরনের বিষয়বস্তুকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে ।

তবে দলিল সহকারে ও সঠিক সূত্র থেকে হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীরা যে সকল অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন তা বর্ণনা ও বিশ্লেষণের অর্থ তাঁদের মর্যাদার হানি ঘটা নয় ;বরং এর মাধ্যমে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মানুষের নিকট আরো সুস্পষ্ট করা হয় । কেননা ,শত্রুদের অত্যাচারের ঘটনার বর্ণনা এবং তাদের মোকাবেলায় ইমাম হোসাইনের সাহসী ও ও সংগ্রামী ভূমিকার বিশ্লেষণ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে যে ,কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব ।

44 নং প্রশ্ন : আশুরার মহত্ত্ব প্রকাশ ও এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য কেন আলোচনা-সংলাপকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় না ? কেন এ ধারণা করা হয় যে ,আশুরার ঘটনাকে জীবন্ত রাখার একমাত্র পদ্ধতি হলো মানুষকে অবশ্যই বুক চাপড়িয়ে ক্রন্দন করতে হবে ,শহরকে কালো রঙে ঢেকে দিতে হবে ,অর্ধরাত্রি পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে ;এমনকি দিনের কিছু সময়ে বা আশুরার পুরো দিন কাজ-কর্ম পরিহার করে রাস্তায় বের হয়ে

সমবেতভাবে মাতম করতে করতে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে ? বিশেষ করে যখন এ ধরনের কাজ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয় ;অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন ছাড়া এ অনুষ্ঠান পালন করা সম্ভব নয় কি ? এমন কোন পদ্ধতি কি অবলম্বন করা যায় না যাতে এ ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম হবে ? উদাহরণস্বরূপ টক শো ,বৈঠক অথবা সেমিনারের ব্যবস্থা করা যেখানে শ্রোতারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আশুরার স্মৃতিকে জাগ্রত করবে ?

উত্তর : শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের ওপর এ ধরনের বৈঠক ,সেমিনার ,আলোচনার অনুষ্ঠান ,প্রবন্ধ লিখন ,সাংস্কৃতিক ,তাত্ত্বিক ,গবেষণামূলক কাজ অত্যন্ত কার্যকরী ও জরুরি ;তবে ইমামের নাম এবং শোকানুষ্ঠানের বরকতে আমাদের সমাজে এ ধরনের কাজ অনেক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ;সাধারণ মানুষরাও এ থেকে জ্ঞান লাভ করে ।

এ ধরনের কর্মতৎপরতার স্বস্থানে প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু আশুরার শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট কি ? নাকি অন্যান্য প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ,যেমন শোকানুষ্ঠান-যার সঙ্গে মানুষ আগে থেকেই পরিচিত ,তারও প্রয়োজন আছে ?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের মনোবিদ্যার দৃষ্টিতে মানুষের দিকে দৃষ্টি আরোপ করতে হবে এবং দেখতে হবে আমাদের সচেতনমূলক আচরণের পেছনে কোন্ ধরনের উপাদান অধিক কার্যকর । শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই কি আমাদের সামাজিক আচরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে ,নাকি এর সাথে অন্য কোন উপাদান রয়েছে ।

আমাদের আচরণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাব যে ,আমাদের আচরণের মধ্যে কমপক্ষে দু টি উপাদান মূল ভূমিকা পালন করে । একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিচিতিমূলক উপাদান অপরটি অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান । এক ধরনের পরিচিতিমূলক উপাদান রয়েছে যার কারণে মানুষ কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ও একে গ্রহণ করে । স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে তার উপযোগী বৃদ্ধিবৃত্তিক বা অভিজ্ঞতামূলক অথবা অন্য যে কোন দলিল ব্যবহার করা হয় ।

নিশ্চিতভাবে কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের আচরণের ওপর অনেক প্রভাব রাখে ,কিন্তু তা একমাত্র কার্যকরী উপাদান নয় । আরো অনেক

ধরনের উপাদান রয়েছে ,হয়তো আমাদের আচরণের ওপর সেগুলোর প্রভাব পরিচিতিমূলক উপাদানের চেয়েও অধিক । এ ধরনের উপাদানকে সার্বিকভাবে আবেগ ,অনুভূতি ও প্রবণতা নামকরণ করা হয় । এগুলো অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান হিসেবে আমাদের আচরণের ওপর কার্যকর ভূমিকা রাখে ।

যখনই আপনি আপনার আচরণকে-হোক তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অথবা সামাজিক বা রাজনৈতিক-পর্যালোচনা করবেন ,লক্ষ্য করবেন যে ,যে মূল উপাদানটি আপনাকে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য করেছে তা হলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোন উপাদান ।

শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারী এ বিষয়ে বলেন : আমাদের অভ্যন্তরে কোন উপাদান থাকতে হবে যা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করবে । কোন কাজের জন্য আমাদের আগ্রহ থাকতে হবে ,তবেই আমরা কাজটি সম্পাদন করতে উদ্যোগী হব । শুধু কোন কাজ সম্পর্কে জ্ঞান ঐ কাজ করতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে না ,এর সাথে মনোগত কারণও রয়েছে যা ঐ কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে । এ ধরনের উপাদানকে অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান বলা হয় । এ উপাদানই সার্বিকভাবে কোন কাজে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ ,ভালোবাসা ও উদ্দীপনা তৈরি করে । এ উপাদান না থাকলে কোন কাজ সম্পন্ন হয় না । এমনকি যদি মানুষ কোন খাদ্যের বিষয়ে এ জ্ঞান রাখে যে ,তা শরীরের জন্য উপকারী ,কিন্তু ঐ খাদ্য খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ না থাকে তাহলে সে ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে না । যদি কোন ব্যক্তির খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায় ,খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ,যতই তাকে বলা হোক যে ,খাদ্যটি শরীরের জন্য উপকারী ,তবু সে খাদ্যটি খাওয়ার ব্যপারে কোন আগ্রহ খুঁজে পাবে না । অতএব ,কোন কাজের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়াও মানুষের মনের আগ্রহ-উদ্দীপনারও প্রয়োজন রয়েছে । সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ও ঠিক একই রকম । কোন ব্যক্তি কোন আন্দোলনকে ভালো ও উপকারী মনে করলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খুঁজে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না ।

এখন এ বিষয়টিকে আমরা গ্রহণ করেছি যে ,মানুষের সচেতনমূলক যে কোন পদক্ষেপ বা আচরণের পেছনে দুই ধরনের উপাদান থাকা অত্যন্ত জরুরি । প্রথম ,ঐ বিষয় সম্পর্কে পরিচিতিমূলক জ্ঞান । দ্বিতীয় ,ঐ কাজের

জন্য অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান অর্থাৎ উৎসাহ-উদ্দীপনা । আমরা শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন মানবজাতির সৌভাগ্যের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা জানার পরও বুঝতে পারি যে ,শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান আমাদেরকে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী করে তোলে না ;বরং যখন ঐ বিষয়ের প্রতি আমাদের মনে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে তখনই কেবল ঐ আন্দোলনকে স্মরণ করে ইমাম হোসাইনের মতো নিজেকে উৎসর্গ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব ।

শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ও পরিচিতি ঐ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করে না ;বরং অভ্যন্তরীণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে হয় যা আমাদেরকে ঐ কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ।

সভা-সমাবেশ ,আলোচনা-পর্যালোচনা ,বক্তব্য প্রথম উপাদানের অর্থাৎ পরিচিতি ,তথ্য ও জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করে ,কিন্তু আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য অন্য উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে । কোন ঘটনার পরিচিতি ,স্মরণ ও পর্যালোচনা ঐ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে ,তবে যে উপাদানটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল ভূমিকা পালন করে তা হলো মনের দিক-যা সরাসরি মানুষের আবেগ-অনুভূতির সাথে জড়িত ।

যখন কোন মর্মান্তিক ঘটনাকে মঞ্চায়িত করা হয় এবং মানুষ এ ঘটনাকে খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করে তখন সেটার সাথে বই পড়ে অথবা অন্য কারো নিকট থেকে ঐ ঘটনা জানতে পারার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে ।

এ রকম অভিজ্ঞতা আপনারা নিজেরা অনেকবার অর্জন করেছেন । অনেকবার আশুরার ঘটনা শুনেছেন একং জেনেছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কীভাবে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন । কিন্তু শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান কি আপনাদের চোখের অশ্রু প্রবাহিত করে ? অবশ্যই ,না । অথচ যখন আপনি কোন শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং শোকগাথা পাঠকারী কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা আকর্ষণীয় কণ্ঠে বর্ণনা করেন ,বিশেষ করে যদি তাঁর সুর ভালো হয় ,তাহলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আপনার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়বে ।

এ পদ্ধতি আপনার অনুভূতির ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে যা শুধু অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সম্ভব নয় । এ কারণেই যা প্রত্যক্ষ করা হয় তা শোনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব রাখে । এ বিষয়গুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়টি বোঝানো যে ,আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কেন আবু আবদিল্লাহ (আ.) বিদ্রোহ করেছেন ,মযলুম অবস্থায় শহীদ হয়েছেন । কিন্তু এর পাশাপাশি আশুরার ঘটনাকে আমাদের সামনে বর্ণনা বা মঞ্চায়নের মাধ্যমে এমনভাবে সাজাতে ও চিত্রায়িত করতে হবে যাতে তা বেশি পরিমাণে আমাদের হৃদয় ও অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয় । যত বেশি এ আবেগ সৃষ্টি হবে তত বেশি আমাদের জীবনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে ।

এ কারণেই আশুরার ঘটনার ওপর শুধু তত্ত্বগত আলোচনা প্রকৃত ভূমিকা পালনে অক্ষম । বরং সামাজিকভাবে এমনভাবে শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে যা মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করবে । যখন কেউ সকালে ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে দেখতে পায় সম্পূর্ণ শহরকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এবং সর্বত্র কালো পতাকা স্থাপন করা হয়েছে ,এ পরিবর্তনটি মানুষের অন্তরকে অধিক নাড়া দেয় ।

যদিও মানুষ জানে আগামীকাল মুহররমের প্রথম দিন ,কিন্তু এ তথ্য তাদের অন্তরকে ঐ রকম প্রভাবিত করতে পারে না যতটা সকল স্থানে কালো পতাকা ও সকলকে কালো পোশাক পরিহিত দেখা তাকে প্রভাবিত করবে । তাই সামষ্টিক ভাবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে মর্সিয়া পাঠ ও বুক চাপড়ানোর অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে যতটা প্রভাব ফেলা সম্ভব ,অন্য কোন কিছুতে তা সম্ভব নয় ।

এখান থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বক্তব্যগুলো অসংখ্য বার পুনরাবৃত্তি করতেন সেগুলোর কারণ অনুধাবন করা সম্ভব । তিনি বলতেন : আমাদের যা কিছু (মূল্যবোধ) রয়েছে তা মুহররম ও সফর থেকে । তিনি শোকানুষ্ঠানকে ঐত্যিহ্যবাহী প্রচলিত পদ্ধতিতে পালন করার ওপর গুরুত্ব দিতেন । কেননা ,গত তের শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হয়েছিল যে ,আবেগময় পদ্ধতিতে শোক পালনের বিষয়টি মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আত্মত্যাগী অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে কত বেশি ভূমিকা রাখে এবং কীরূপ অলৌকিক পরিবর্তন ঘটায়!

অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে ,ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যে সকল বিজয় অর্জিত হয়েছে তার সবই আশুরার শিক্ষা এবং শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামের বরকতে অর্জিত হয়েছে । এই প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও অচিন্তনীয় ছিল । কোন বস্তুর বিনিময়ে এ ধরনের মহামূল্যবান অনুভূতি সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব ? এরূপ শোকানুষ্ঠানগুলো কি ধরনের পবিত্র প্রেমের সৃষ্টি করে যা মানুষকে শাহাদাত বরণ করার জন্য প্রস্তুত করে ? যদি বলি যে ,প্রকৃত ইসলাম ছাড়া অন্য কোন সমাজ ও মতাদর্শেই এ ধরনের উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না ,তাহলে অর্থহীন কোন কথা বলি নি ।

শোকানুষ্ঠান পালন করার সময়

44 নং প্রশ্ন : কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে তাঁর শাহাদাতের দিন আসার পূর্বেই (আশুরার দিনের পূর্বে) শোক পালন শুরু করি ?

উত্তর : আশুরার পূর্বে শোকানুষ্ঠান পালন হচ্ছে আশুরার শোকানুষ্ঠানের ভূমিকাস্বরূপ । আবু আবদিল্লাহ (আ.)-এর জন্য শোক পালনের মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু এ অনুষ্ঠানের ধরন ও সময় বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে প্রচলিত প্রথা ও রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় । যেমন কিছু অঞ্চলে ইমাম হোসাইনের শোকানুষ্ঠান 7 মুহররম থেকে শুরু হয়ে 3রা সফর পর্যন্ত চলতে থাকে ,কিছু অঞ্চলে 1লা মুহররম থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলে ;কিছু অঞ্চলে সারা বছর বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে শোকগাথার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ;কিছু অঞ্চলে মুহররম মাসের শুরু থেকে সফর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান চলে ।

এ সকল ধরন আসলে কোন সমস্যা নয় । কারণ ,শোকানুষ্ঠান এবং মৃত্যুবার্ষিকী পালন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত । সাধারণত মৃত্যুবার্ষিকী পরবর্তী বছরগুলোতে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর রাতে পালন করা হয় । যেহেতু শাহাদাত অনেক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সেহেতু শোকানুষ্ঠানগুলো বছরের যে কোন সময়ে পালন করা হোক না কেন ,এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে ঘটেছে ।

কালো পোশাক পরিধান

39 নং প্রশ্ন : শোক প্রকাশের দিনে কালো পোশাক পরিধানের দর্শন কী ?

কালো রং বিভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন প্রভাব এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী । এর বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা অনুসারে কিছু বা বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে এর ব্যবহার করে থাকে । কালো রং একদিকে বস্তুকে অন্ধকারে গোপন ও ঢেকে রাখে তাই কখনও কখনও এ রঙ কোন কিছুকে ঢেকে রাখা বা গোপন রাখার জন্য ব্যবহৃত হয় ।357 আবার অন্যদিকে তা ব্যক্তিত্বের নিদর্শন হিসেবে পরিচিত । এ কারণেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের আনুষ্ঠানিক পোশাক (বিশেষত বহিরাবরণ ,যেমন কোট ,ব্লেজার ইত্যাদি) সাধারণত কালো বা গাঢ় সুরমা রঙের হয় । ইতিহাসে এরূপ অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় যে ,বিশেষ ব্যক্তি ,গোষ্ঠী এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য এ ধরনের রঙ ব্যবহার করতেন ।358

কালো রঙের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব হলো ,এ রঙটি প্রকৃতিগতভাবে দুঃখ ,বিষাদ ও বিষণ্ণতার পরিচায়ক যা শোক প্রকাশের উপযোগী । এ কারণে বিশ্বের অনেক মানুষ এ রঙকে তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর দুঃখ ,শোক ও বিষণ্ণতা প্রকাশে ব্যবহার করে থাকে ।

এ বিষয়টি স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে ,শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো রঙ নির্বাচনের মধ্যে উপরোল্লিখিত যুক্তিগুলো ছাড়াও আবেগ-অনুভূতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে । যে ব্যক্তি তার প্রিয় মানুষের শোকে নিজে কালো পোশাক পরিধান করে এবং দেওয়ালগুলোকে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় প্রকৃতপক্ষে সে এ কাজ দ্বারা বলতে ও বুঝাতে চায়- (হে বিদায়ী) তুমি আমার চোখের জ্যোতি ও মণি ছিলে ,তোমার মরদেহ মাটিতে দাফন হওয়া আমার কাছে পশ্চিম আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অস্তমিত হওয়ার মতো ;(তোমার বিদায়) জীবনকে আমার চোখে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছে ;সময় ও স্থানকে গ্রাস করে ফেলেছে ।

হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর অষ্টম দিনে পিতার কবরের নিকট গিয়ে ক্রন্দন করে নিম্নলিখিত কবিতাটি পাঠ করেছিলেন

یا ابتاه انقطعت بك الدنیا بانوارها و زوت زهرتها کانت ببهجتك زاهرة فقد اسود نهارها فصار يحکی حنادسها رطبها و یا بسها...والْسی... لازمنا

হে পিতা! তুমি চলে গেছ ,তোমার চলে যাওয়ার কারণে দুনিয়া এর আলো আমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ,এর নেয়ামতসমূহ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছে ,বিশ্বজগৎ তোমার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল ও আলোকিত ছিল ,(কিন্তু তোমার বিদায়ের পর) এর দিনের আলো অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে ,এর (দুনিয়ার) সিক্ততা ও শুষ্কতা ,এর অন্ধকার রাতের নির্দেশ করে... এবং দুঃখ ও মর্মবেদনা আমাদের সবসময়ের সঙ্গী... । 359

এ কারণেই কালো পোশাক পরিধান করার কারণ কালো রঙে লুক্কায়িত থাকা গোপন রহস্যের মধ্যে নিহিত এবং এর প্রকৃতিগত (দুঃখ ও শোকবাহী) রূপটিই একে যুক্তিসঙ্গত একটি প্রথায় পরিণত করেছে । আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীরা শোক প্রকাশের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করে । কারণ ,এ পোশাক তাঁদের প্রতি প্রেম ও বন্ধুত্বের নিদর্শন বহন করে ,স্বাধীনচেতাদের মহান নেতা ও আদর্শপুরুষ ইমাম হোসাইনের প্রতি নিবেদিত থাকার প্রতিশ্রুতি দান করে । এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার রণাঙ্গনে তাঁকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয় ও নৈতিকভাবে তাঁর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ।360 ইমামদের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকানুষ্ঠানে কালো পোশাক পরে বাহ্যিক কালোর অবয়বে তাঁর সাথে সহমর্মিতা দেখানোর মাধ্যমে নিজের অন্তরকে আলোকিত করা হয় ;যদিও বাহ্যিকভাবে তা কালো ,কিন্তু ভেতরে উজ্জ্বল ও তাঁর আদর্শে আলোকিত ।

40 নং প্রশ্ন : অন্যান্য জাতির মধ্যে কালো পোশাক পরিধান করার প্রচলন রয়েছে কি ? কালো পোশাক পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আগমনের পর আব্বাসী খলিফা অথবা আরব জাতি থেকে ইরানে প্রবেশ করেছে ,ইরানী সভ্যতায় এ ধরনের সংস্কৃতি ছিল না ।

উত্তর : প্রথমত ,শোকের সময় কালো পোশাক পরিধানের রীতি বিভিন্ন জাতির মধ্যে গ্রহণযোগ্য এক প্রথা হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ইরান থেকে শুরু করে গ্রীক সভ্যতা ,এমনকি আরবের জাহেলী সংস্কৃতিতেও এর প্রচলন ছিল ।

দ্বিতীয়ত ,কালো পোশাক পরিধান আব্বাসী খলিফাদের সময় অথবা ইসলাম আগমনের পর আরবদের নিকট থেকে ইরানে প্রবেশ করেনি ;বরং এর মূল প্রাচীনকাল থেকেই ইরানী সংস্কৃতিতে নিহিত ছিল এবং বাহ্যিকভাবে তাদের ব্যবহারিক জীবনে এর প্রচলন ছিল । নিচের বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করলে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে :

1. অনেক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বর্ণনা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে ,পৃথিবীর অনেক জাতি ও গোষ্ঠী প্রাচীনকাল থেকে শোকের দিনগুলোতে কালো পোশাক পরিধান করত । উদাহরণস্বরূপ ইরান ,গ্রীক ও আরব সংস্কৃতির কিছু নমুনা তুলে ধরলাম :

ক. প্রাচীন ইরানের কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : প্রাচীন ইরানের পাণ্ডুলিপিগুলোতে অনেক প্রমাণ রয়েছে যে ,কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হতো । ইরানী বিখ্যাত সাহিত্যিক ফেরদৌসী শাহনামা তে ইরানী প্রাচীন সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘটনাতে কালো পোশাক শোকের চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করেছেন ।

বিশেষ করে যখন রুস্তমের ভাই শুগাদ তাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করেছিল ,ফেরদৌসী তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন :

এক বছর সিস্তানে শোক ছিল ,তাদের জামাসমূহ কালো ছিল ।

সাসানীদের যুগে যখন বাহরাম গুর দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল ,তার উত্তরাধিকারী ইয়াজ্দর্গাদ শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল ।

পথে চল্লিশ দিন পিতার শোক পালন করেছিল ,

সৈন্যরা কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

ফেরেইদুন যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিল তার উত্তরাধিকারী ও সন্তানরা এ কাজ করেছিল :

মানুচেহর এক সপ্তাহ যন্ত্রণায় ছিল ,দুই চোখ অশ্রুপূর্ণ ও চেহারা হলুদ ছিল ;সকলে পরেছিল কালো পোশাক ,রাজা পেলেন মনোবল সৈন্যদের সম্মিলিত সমবেদনা প্রকাশে ।

এ কালো পোশাক পরার সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত ইরানে চালু রয়েছে ।361

খ. গ্রীক সভ্যতায় কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : গ্রীসের প্রাচীন কল্পকাহিনীতে এসেছে : হেক্টরের হাতে প্রটিসিলাস নিহত হওয়ার ঘটনায় টাইটাস অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে শোকের চিহ্ন হিসেবে সবচেয়ে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।

এ বিষয়টি গ্রীক সভ্যতায় কবি হোমারের যুগে কালো পোশাক পরিধান করার প্রথার প্রমাণ বহন করে । ইহুদিদের মধ্যে প্রাচীনকালে আত্মীয়-স্বজনের শোকে এ প্রথা প্রচলিত ছিল যে ,সকলে মাথা কামিয়ে ছাই মাখত এবং তাদের পোশাক কালো অথবা কালোর কাছাকাছি কোন রংয়ের ছিল ।362

বুসতানী তাঁর বিশ্বকোষ -এ কালো রঙ ইউরোপীয় সভ্যতার সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোতে শোক পালনের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত রং হিসেবে গণ্য হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন এবং লিখেছেন : শোক পালনের সময় মৃত ব্যক্তির আত্মীয়তার নৈকট্যের শ্রেণিভেদে তারা এক সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করে । বিশেষ করে বিধবা নারীরা কমপক্ষে এক বছর শোক পালন করে এবং এই সময়ে তাদের পোশাক থাকে কোন ধরনের নকশা ও অলংকার ছাড়া কালো রংয়ের ।363

আরব জাতির কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : আরবদের ইতিহাস ,কবিতা ও ভাষা সাক্ষ্য দেয় যে ,মিশর হতে সিরিয়া ,ইরাক ও সৌদি আরবসহ সব জায়গায় কালো রঙ শোকের রঙ হিসেবে পরিচিত ছিল ।

ষষ্ঠ শতাব্দীর আরব সাহিত্যিক ও কোরআনের মুফাস্সির যামাখশারী লিখেছেন : একজন সাহিত্যিক বলেছেন : কালো পোশাক পরিধানকারী সন্যাসীকে দেখে প্রশ্ন করেছিলাম : কেন কালো পোশাক পরিধান করেছ ? বলল : আরবরা যখন তাদের মধ্য হতে কেউ মারা যায় তখন কোন্ ধরনের পোশাক পরিধান করে ? সন্যাসী বলল : আমিও আমার গুনাহের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছি । 364

ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে যে ,আরব জাতি তাদের মুসিবতের সময় নিজেদের পোশাককে কালো করত ।365

রাসূল (সা.)-এর যুগে বদরের যুদ্ধের শেষে যখন 70 জন মুশরিক ও কুরাইশ মুসলমানদের হাতে নিহত হয়েছিল তখন মক্কার নারীরা তাদের নিহতদের শোকে কালো পোশাক পরিধান করেছিল ।366

এসকল ঐতিহাসিক বর্ণনা এবং সাহিত্যিক রচনা ও কবিতা প্রমাণ করে যে ,কালো রং প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে শোকের চিহ্ন হিসেবে প্রচলিত ছিল । এ বিষয়টি ইরান বা ইসলামী যুগের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পৃক্ত নয় ;বরং ইসলামের পূর্বে ইরানীরা ও প্রাচীন গ্রীসের আধিবাসীরাও শোক প্রকাশের প্রথা হিসেবে কালো অথবা গাঢ় নীল রংয়ের পোশাক পরিধান করত ।367

2. আহলে বাইত (আ.)-এর মাঝে কালো পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি : তথ্যভিত্তিক সংবাদ এই বিষয়টির সুস্পষ্ট বর্ণনা করে যে ,রাসূল (সা.) এবং পবিত্র ইমামগণও এই যৌক্তিক প্রকৃতিগত পথকে সমর্থন করেছেন এবং নিজেদের প্রিয় ব্যক্তির শোকে তাঁরা নিজেরাও কালো পোশাক পরিধান করেছেন ।

নাহজুল বালাগার শারহ (ব্যাখ্যা গ্রন্থ)-এ ইবনে আবিল হাদীদ বর্ণনা করেছেন : ইমাম হাসান (আ.) তাঁর পিতা আলী (আ.)-এর শাহাদাতের শোকে কালো পোশাক পরিধান করে মানুষের মাঝে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন ।368

এ কারণে যে হাদীসটি সকল হাদীসবিদ বর্ণনা করেছেন যে ,ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন : বনি হাশিমের নারীরা আবা-আবদিল্লাহ হোসাইন (আ.)-এর শোকে কালো পোশাক পরিধান করতেন ।

لما قتل الحسین بن علی)ع ( لیس نساء بنی هاشم السواد و المسوح و کن لاتشتکین من حر ولابرد و کان علی بن الحسین)ع ( یعمل لهن الطعام للمأتم

যখন ইমাম হোসাইন (আ.) শহীদ হলেন তখন বনি হাশিমের নারীরা কালো ও রুক্ষ-পশমের পোশাক পরিধান করেছিলেন ,গরম বা ঠাণ্ডার বিষয়ে তাঁদের কোন অভিযোগ ছিল না ,তাঁরা শোক পালনে রত থাকার কারণে (আমার পিতা) আলী ইবনে হোসাইন (আ.) তাঁদের জন্য খাবার তৈরি করতেন ।

আব্বাসীদের কালো পোশাক পরিধান করার কারণ

আব্বাসী খলিফারা উমাইয়া খলিফাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর সময় থেকে বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে আহলে বাইতের শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণকারী হিসেবে দাবি করেছিল । এ কারণে যখন তারা ক্ষমতা অর্জন করেছিল তখন তাদের শাসনকে আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর শাসন হিসেবে অভিহিত করত এবং বলত যে ,এই খেলাফত হচ্ছে আলী (আ.)-এর খেলাফতেরই ধারাবাহিকতা । তাদের প্রধানমন্ত্রী আবু সালামা খাল্লালকে আলে মুহাম্মাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সামরিক বাহিনীর প্রধান আবু মুসলিম খোরাসানিকে আলে মুহাম্মাদের আমিন (বিশ্বস্ত ব্যক্তি) বা নেতা হিসেবে নামকরণ করেছিল ।

কালো পোশাক রাসূল (সা.)-এর অবমাননা ও তাঁর আহলে বাইতের ওপর ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনার শোকের প্রতীক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ।369 আব্বাসী খলিফারা কালো পোশাক পরিধানের প্রথা ইরানে এবং অন্যান্য ইসলামী শহরে প্রবর্তন করে নি ;কেননা ,মৃত ব্যক্তির শোকে কালো পোশাক পরিধানের প্রথা সামাজিকভাবে এবং বিশেষভাবে শহীদদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে প্রথম থেকেই প্রচলিত ছিল ।

কারবালার মযলুম শহীদ ইমাম হোসাইন এবং বনি উমাইয়ার হাতে নিহত তাঁর নাতি যাইদ ইবনে আলী ও ইয়াহিয়া ইবনে যাইদের রক্তের প্রতিশোধের অজুহাতে আব্বাসী খলিফারা কালো পতাকা ও কালো পোশাক পরিধান করাকে আহলে বাইতের শহীদদের শোক প্রকাশের উপকরণরূপে ব্যবহার করেছে । এই ধরনের কৌশল ব্যবহার করে তারা আহলে বাইতের অনুসারীদের প্রতারিত করে নিজেদের দলে আনার চেষ্টা করেছে এবং এ ধরনের প্রচার-প্রপাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের মনে নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছে । তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও কালো পতাকা ও পোশাককে সবসময়ের জন্য নিজেদের নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল ।370

এই প্রতারণার কারণেই ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এবং অন্যান্য ইমাম কালো রঙের পোশাকের বিরুদ্ধে ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলতেন । আব্বাসী খলিফারা আনুষ্ঠানিকভাবে কালো পোশাককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ইমামরা এই বিষয়ে তাদের বিরোধিতা করেছেন । তাদের সাথে এ বিষয়ে (কালো পোশাক ব্যবহার) একাত্মতা প্রকাশ করা অত্যাচারী শাসককে স্বীকৃতি দান বলে মনে করা হতো । কিন্তু তাঁরা সার্বিকভাবে আহলে বাইতের শহীদদের শোকে শোকাহত হয়ে কালো পোশাকের সংস্কৃতির বিরোধী ছিলেন না ।371

শোক প্রকাশের পদ্ধতি

41 নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য কী পরিমাণ শোক প্রকাশ করা বৈধ ?

ইসলামী শরিয়তের বিধান শোক প্রকাশের পেছনে নিহিত দর্শন ও বুদ্ধিমান সমাজের কাছে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিই আহলে বাইত বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করবে । যদি শোকের আবেগ-উদ্দীপনার মাত্রা তার বুদ্ধিবৃত্তির ওপর এমনভাবে প্রাধ্যান্য লাভ করে যে ,এর দর্শন থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তা শরিয়ত ও বৃদ্ধিবৃত্তির সীমানা থেকে দূরে সরে যাবে । যদি এর ধরন এমন হয় যা বুদ্ধিবৃত্তিগতভাবে সমাজ অপছন্দ ও ঘৃণা করে ,তা শিয়া মাযহাব ও এর প্রকৃত শিক্ষার সাথে অবমাননাকর মনে হয় তাহলে অবশ্যই এ ধরনের শোক প্রকাশ অনাকাঙ্ক্ষিত ও বর্জিত হবে ।

বলা বাহুল্য ,শোক প্রকাশের ধরন এমন হওয়া উচিত যাতে এর শিক্ষার প্রকৃত বিষয়বস্তুকে মানুষের মাঝে সঠিকভাবে প্রচার করতে পারে এবং ইমামদের সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে । যদি এ শোক প্রকাশের বাহ্যিক রূপ এমন হয় যে ,অভ্যন্তরীণ রূপের আদৌ প্রকাশ না ঘটায় ;বরং মূল বিষয়বস্তুকেই বিতর্কিত করে তোলে তাহলে এ বিষয়টি সঠিক রূপে প্রকাশ লাভ করবে না ;আ তা আশুরার রূপকেই বেমানান করে তুলবে । উদাহরণস্বরূপ ,কিছুসংখ্যক লোক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজেদের শরীরে আঘাত করার মাধ্যমে শোক প্রকাশ করে থাকে । এ ধরনের ব্যক্তিরা শুধু আশুরার প্রকৃত আদর্শকে বিকৃতরূপে প্রচার করল না ;বরং যেমনভাবে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আলী খামেনেয়ী বলেছেন ,তারা আশুরার শিক্ষার প্রতি অবমাননা করল এবং এ অবমাননার কারণে এ ধরনের কাজ বৈধ হবে না ।372

42 নং প্রশ্ন : যদিও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব অতুলনীয় তবুও কেন কিছু শোকানুষ্ঠানে তাঁর কেবল হীন ও মযলুম অবস্থা প্রর্দশন করা হয় । কিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব ?

উত্তর : عزت শব্দটির অর্থ কঠিন ,শক্তিশালী ,দৃঢ় হওয়া । শব্দটি কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্যকে আল্লাহ ,রাসূল (সা.) এবং মুমিনদের অনন্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছে ।

ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারীরা কোরআনের এই শিক্ষার অনুসরণের ক্ষেত্রে সবসময় অগ্রগামী ছিলেন । কখনই অপমান ও লাঞ্ছনাকে সহ্য করেননি । ফলে এই বিষয়টিهیهات م نّا الذلة অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে অনেক দূরে -আশুরার আন্দোলনের অন্যতম স্লোগানে রূপান্তরিত হয়েছে ।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ,কিছু সূত্র ও লেখনিতে এমন বিষয় উল্লিখিত হয়েছে যার ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামে আয়োজিত কিছু শোকানুষ্ঠানে এমন কথা বলা হয়ে থাকে যেগুলোতে তাঁর আন্দোলনে বিদ্যমান সম্মান ও মর্যাদার উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয় ।

এ পদ্ধতির পেছনে নিহিত মনস্তাত্ত্বিক মূল কারণ হলো হোসাইনী আন্দোলনের প্রচারকারী কতিপয় ব্যক্তি ইমামের আন্দোলনের শিক্ষামূলক বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পরিবর্তে শুধু তাদের কান্নার অনুভূতিকে জাগ্রত করার জন্য চেষ্টা করে । এ কারণে অগ্রহণযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে শোকের বিষয়বস্তু বর্ণনা করে এবং হোসাইনী আন্দোলনের অপমানজনক ও লাঞ্ছনাময় চেহারা মানুষের সামনে চিত্রায়িত করে ।

যে সকল বিষয়বস্তু বর্ণনার ফলে ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীদের সম্মান ও মর্যাদার হানি ঘটে এবং যার বর্ণনা ইসলাম ,রাসূল (সা.) ,আলী (আ.) এবং আহলে বাইতের সুন্নাতের সাথে সাংঘর্ষিক হয় তা অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত ;এ ধরনের বিষয়বস্তুকে অবশ্যই বর্জন করতে হবে ।

তবে দলিল সহকারে ও সঠিক সূত্র থেকে হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহাবীরা যে সকল অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছেন তা বর্ণনা ও বিশ্লেষণের অর্থ তাঁদের মর্যাদার হানি ঘটা নয় ;বরং এর মাধ্যমে তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা মানুষের নিকট আরো সুস্পষ্ট করা হয় । কেননা ,শত্রুদের অত্যাচারের ঘটনার বর্ণনা এবং তাদের মোকাবেলায় ইমাম হোসাইনের সাহসী ও ও সংগ্রামী ভূমিকার বিশ্লেষণ এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে যে ,কিভাবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সম্ভব ।

44 নং প্রশ্ন : আশুরার মহত্ত্ব প্রকাশ ও এর গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য কেন আলোচনা-সংলাপকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় না ? কেন এ ধারণা করা হয় যে ,আশুরার ঘটনাকে জীবন্ত রাখার একমাত্র পদ্ধতি হলো মানুষকে অবশ্যই বুক চাপড়িয়ে ক্রন্দন করতে হবে ,শহরকে কালো রঙে ঢেকে দিতে হবে ,অর্ধরাত্রি পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে ;এমনকি দিনের কিছু সময়ে বা আশুরার পুরো দিন কাজ-কর্ম পরিহার করে রাস্তায় বের হয়ে

সমবেতভাবে মাতম করতে করতে দীর্ঘ পথ হেঁটে যেতে হবে ? বিশেষ করে যখন এ ধরনের কাজ অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয় ;অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন ছাড়া এ অনুষ্ঠান পালন করা সম্ভব নয় কি ? এমন কোন পদ্ধতি কি অবলম্বন করা যায় না যাতে এ ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম হবে ? উদাহরণস্বরূপ টক শো ,বৈঠক অথবা সেমিনারের ব্যবস্থা করা যেখানে শ্রোতারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আশুরার স্মৃতিকে জাগ্রত করবে ?

উত্তর : শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের ওপর এ ধরনের বৈঠক ,সেমিনার ,আলোচনার অনুষ্ঠান ,প্রবন্ধ লিখন ,সাংস্কৃতিক ,তাত্ত্বিক ,গবেষণামূলক কাজ অত্যন্ত কার্যকরী ও জরুরি ;তবে ইমামের নাম এবং শোকানুষ্ঠানের বরকতে আমাদের সমাজে এ ধরনের কাজ অনেক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ;সাধারণ মানুষরাও এ থেকে জ্ঞান লাভ করে ।

এ ধরনের কর্মতৎপরতার স্বস্থানে প্রয়োজন রয়েছে । কিন্তু আশুরার শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণরূপে উপকৃত হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট কি ? নাকি অন্যান্য প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ,যেমন শোকানুষ্ঠান-যার সঙ্গে মানুষ আগে থেকেই পরিচিত ,তারও প্রয়োজন আছে ?

এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের মনোবিদ্যার দৃষ্টিতে মানুষের দিকে দৃষ্টি আরোপ করতে হবে এবং দেখতে হবে আমাদের সচেতনমূলক আচরণের পেছনে কোন্ ধরনের উপাদান অধিক কার্যকর । শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই কি আমাদের সামাজিক আচরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে ,নাকি এর সাথে অন্য কোন উপাদান রয়েছে ।

আমাদের আচরণগুলোর দিকে মনোনিবেশ করলে দেখতে পাব যে ,আমাদের আচরণের মধ্যে কমপক্ষে দু টি উপাদান মূল ভূমিকা পালন করে । একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও পরিচিতিমূলক উপাদান অপরটি অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান । এক ধরনের পরিচিতিমূলক উপাদান রয়েছে যার কারণে মানুষ কোন বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভ করে ও একে গ্রহণ করে । স্বাভাবিক ভাবেই যে কোন বিষয় সম্পর্কে জানতে তার উপযোগী বৃদ্ধিবৃত্তিক বা অভিজ্ঞতামূলক অথবা অন্য যে কোন দলিল ব্যবহার করা হয় ।

নিশ্চিতভাবে কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান আমাদের আচরণের ওপর অনেক প্রভাব রাখে ,কিন্তু তা একমাত্র কার্যকরী উপাদান নয় । আরো অনেক

ধরনের উপাদান রয়েছে ,হয়তো আমাদের আচরণের ওপর সেগুলোর প্রভাব পরিচিতিমূলক উপাদানের চেয়েও অধিক । এ ধরনের উপাদানকে সার্বিকভাবে আবেগ ,অনুভূতি ও প্রবণতা নামকরণ করা হয় । এগুলো অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান হিসেবে আমাদের আচরণের ওপর কার্যকর ভূমিকা রাখে ।

যখনই আপনি আপনার আচরণকে-হোক তা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অথবা সামাজিক বা রাজনৈতিক-পর্যালোচনা করবেন ,লক্ষ্য করবেন যে ,যে মূল উপাদানটি আপনাকে এ ধরনের আচরণ করতে বাধ্য করেছে তা হলো উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী কোন উপাদান ।

শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মুতাহ্হারী এ বিষয়ে বলেন : আমাদের অভ্যন্তরে কোন উপাদান থাকতে হবে যা আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করবে । কোন কাজের জন্য আমাদের আগ্রহ থাকতে হবে ,তবেই আমরা কাজটি সম্পাদন করতে উদ্যোগী হব । শুধু কোন কাজ সম্পর্কে জ্ঞান ঐ কাজ করতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে না ,এর সাথে মনোগত কারণও রয়েছে যা ঐ কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে । এ ধরনের উপাদানকে অভ্যন্তরীণ ও মনোগত উপাদান বলা হয় । এ উপাদানই সার্বিকভাবে কোন কাজে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আগ্রহ ,ভালোবাসা ও উদ্দীপনা তৈরি করে । এ উপাদান না থাকলে কোন কাজ সম্পন্ন হয় না । এমনকি যদি মানুষ কোন খাদ্যের বিষয়ে এ জ্ঞান রাখে যে ,তা শরীরের জন্য উপকারী ,কিন্তু ঐ খাদ্য খাওয়ার প্রতি তার আগ্রহ না থাকে তাহলে সে ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে না । যদি কোন ব্যক্তির খাওয়ার রুচি নষ্ট হয়ে যায় ,খাওয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ,যতই তাকে বলা হোক যে ,খাদ্যটি শরীরের জন্য উপকারী ,তবু সে খাদ্যটি খাওয়ার ব্যপারে কোন আগ্রহ খুঁজে পাবে না । অতএব ,কোন কাজের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও পরিচিতি ছাড়াও মানুষের মনের আগ্রহ-উদ্দীপনারও প্রয়োজন রয়েছে । সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ও ঠিক একই রকম । কোন ব্যক্তি কোন আন্দোলনকে ভালো ও উপকারী মনে করলেও যতক্ষণ পর্যন্ত না ঐ আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা খুঁজে পায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে না ।

এখন এ বিষয়টিকে আমরা গ্রহণ করেছি যে ,মানুষের সচেতনমূলক যে কোন পদক্ষেপ বা আচরণের পেছনে দুই ধরনের উপাদান থাকা অত্যন্ত জরুরি । প্রথম ,ঐ বিষয় সম্পর্কে পরিচিতিমূলক জ্ঞান । দ্বিতীয় ,ঐ কাজের

জন্য অভ্যন্তরীণ মনোগত উপাদান অর্থাৎ উৎসাহ-উদ্দীপনা । আমরা শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন মানবজাতির সৌভাগ্যের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তা জানার পরও বুঝতে পারি যে ,শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে তথ্য ও জ্ঞান আমাদেরকে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী করে তোলে না ;বরং যখন ঐ বিষয়ের প্রতি আমাদের মনে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টি হবে তখনই কেবল ঐ আন্দোলনকে স্মরণ করে ইমাম হোসাইনের মতো নিজেকে উৎসর্গ করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করব ।

শুধু কোন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান ও পরিচিতি ঐ বিষয়ে আগ্রহ সৃষ্টি করে না ;বরং অভ্যন্তরীণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হতে হয় যা আমাদেরকে ঐ কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে ।

সভা-সমাবেশ ,আলোচনা-পর্যালোচনা ,বক্তব্য প্রথম উপাদানের অর্থাৎ পরিচিতি ,তথ্য ও জ্ঞানের চাহিদা পূরণ করে ,কিন্তু আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য অন্য উপাদানের প্রয়োজন রয়েছে । কোন ঘটনার পরিচিতি ,স্মরণ ও পর্যালোচনা ঐ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে ,তবে যে উপাদানটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল ভূমিকা পালন করে তা হলো মনের দিক-যা সরাসরি মানুষের আবেগ-অনুভূতির সাথে জড়িত ।

যখন কোন মর্মান্তিক ঘটনাকে মঞ্চায়িত করা হয় এবং মানুষ এ ঘটনাকে খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করে তখন সেটার সাথে বই পড়ে অথবা অন্য কারো নিকট থেকে ঐ ঘটনা জানতে পারার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে ।

এ রকম অভিজ্ঞতা আপনারা নিজেরা অনেকবার অর্জন করেছেন । অনেকবার আশুরার ঘটনা শুনেছেন একং জেনেছেন যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) কীভাবে কারবালার প্রান্তরে শহীদ হয়েছেন । কিন্তু শুধু এ ঘটনা সম্পর্কে জ্ঞান কি আপনাদের চোখের অশ্রু প্রবাহিত করে ? অবশ্যই ,না । অথচ যখন আপনি কোন শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন এবং শোকগাথা পাঠকারী কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা আকর্ষণীয় কণ্ঠে বর্ণনা করেন ,বিশেষ করে যদি তাঁর সুর ভালো হয় ,তাহলে অনিচ্ছাকৃতভাবেই আপনার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়বে ।

এ পদ্ধতি আপনার অনুভূতির ওপর অধিক প্রভাব বিস্তার করতে পারে যা শুধু অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে সম্ভব নয় । এ কারণেই যা প্রত্যক্ষ করা হয় তা শোনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি প্রভাব রাখে । এ বিষয়গুলো বর্ণনা করার উদ্দেশ্য ছিল এ বিষয়টি বোঝানো যে ,আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কেন আবু আবদিল্লাহ (আ.) বিদ্রোহ করেছেন ,মযলুম অবস্থায় শহীদ হয়েছেন । কিন্তু এর পাশাপাশি আশুরার ঘটনাকে আমাদের সামনে বর্ণনা বা মঞ্চায়নের মাধ্যমে এমনভাবে সাজাতে ও চিত্রায়িত করতে হবে যাতে তা বেশি পরিমাণে আমাদের হৃদয় ও অনুভূতিকে নাড়া দেয় এবং আমাদের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি হয় । যত বেশি এ আবেগ সৃষ্টি হবে তত বেশি আমাদের জীবনে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে ।

এ কারণেই আশুরার ঘটনার ওপর শুধু তত্ত্বগত আলোচনা প্রকৃত ভূমিকা পালনে অক্ষম । বরং সামাজিকভাবে এমনভাবে শোকানুষ্ঠান পালন করতে হবে যা মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করবে । যখন কেউ সকালে ঘর থেকে বাহিরে বের হয়ে দেখতে পায় সম্পূর্ণ শহরকে কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এবং সর্বত্র কালো পতাকা স্থাপন করা হয়েছে ,এ পরিবর্তনটি মানুষের অন্তরকে অধিক নাড়া দেয় ।

যদিও মানুষ জানে আগামীকাল মুহররমের প্রথম দিন ,কিন্তু এ তথ্য তাদের অন্তরকে ঐ রকম প্রভাবিত করতে পারে না যতটা সকল স্থানে কালো পতাকা ও সকলকে কালো পোশাক পরিহিত দেখা তাকে প্রভাবিত করবে । তাই সামষ্টিক ভাবে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে মর্সিয়া পাঠ ও বুক চাপড়ানোর অনুষ্ঠান পালন করার মাধ্যমে যতটা প্রভাব ফেলা সম্ভব ,অন্য কোন কিছুতে তা সম্ভব নয় ।

এখান থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বক্তব্যগুলো অসংখ্য বার পুনরাবৃত্তি করতেন সেগুলোর কারণ অনুধাবন করা সম্ভব । তিনি বলতেন : আমাদের যা কিছু (মূল্যবোধ) রয়েছে তা মুহররম ও সফর থেকে । তিনি শোকানুষ্ঠানকে ঐত্যিহ্যবাহী প্রচলিত পদ্ধতিতে পালন করার ওপর গুরুত্ব দিতেন । কেননা ,গত তের শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় প্রমাণ হয়েছিল যে ,আবেগময় পদ্ধতিতে শোক পালনের বিষয়টি মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আত্মত্যাগী অনুভূতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে কত বেশি ভূমিকা রাখে এবং কীরূপ অলৌকিক পরিবর্তন ঘটায়!

অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে ,ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যে সকল বিজয় অর্জিত হয়েছে তার সবই আশুরার শিক্ষা এবং শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নামের বরকতে অর্জিত হয়েছে । এই প্রভাব অত্যন্ত গভীর ও অচিন্তনীয় ছিল । কোন বস্তুর বিনিময়ে এ ধরনের মহামূল্যবান অনুভূতি সমাজের মধ্যে সৃষ্টি করা সম্ভব ? এরূপ শোকানুষ্ঠানগুলো কি ধরনের পবিত্র প্রেমের সৃষ্টি করে যা মানুষকে শাহাদাত বরণ করার জন্য প্রস্তুত করে ? যদি বলি যে ,প্রকৃত ইসলাম ছাড়া অন্য কোন সমাজ ও মতাদর্শেই এ ধরনের উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না ,তাহলে অর্থহীন কোন কথা বলি নি ।

শোকানুষ্ঠান পালন করার সময়

44 নং প্রশ্ন : কেন আমরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ক্ষেত্রে তাঁর শাহাদাতের দিন আসার পূর্বেই (আশুরার দিনের পূর্বে) শোক পালন শুরু করি ?

উত্তর : আশুরার পূর্বে শোকানুষ্ঠান পালন হচ্ছে আশুরার শোকানুষ্ঠানের ভূমিকাস্বরূপ । আবু আবদিল্লাহ (আ.)-এর জন্য শোক পালনের মূলনীতি ইসলামী শরিয়তের গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাবের অন্তর্ভুক্ত । কিন্তু এ অনুষ্ঠানের ধরন ও সময় বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে প্রচলিত প্রথা ও রীতি দ্বারা প্রভাবিত হয় । যেমন কিছু অঞ্চলে ইমাম হোসাইনের শোকানুষ্ঠান 7 মুহররম থেকে শুরু হয়ে 3রা সফর পর্যন্ত চলতে থাকে ,কিছু অঞ্চলে 1লা মুহররম থেকে আশুরার দিন পর্যন্ত চলে ;কিছু অঞ্চলে সারা বছর বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে শোকগাথার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় ;কিছু অঞ্চলে মুহররম মাসের শুরু থেকে সফর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত শোকানুষ্ঠান চলে ।

এ সকল ধরন আসলে কোন সমস্যা নয় । কারণ ,শোকানুষ্ঠান এবং মৃত্যুবার্ষিকী পালন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি ও রীতিনীতির সাথে সম্পর্কিত । সাধারণত মৃত্যুবার্ষিকী পরবর্তী বছরগুলোতে মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর রাতে পালন করা হয় । যেহেতু শাহাদাত অনেক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সেহেতু শোকানুষ্ঠানগুলো বছরের যে কোন সময়ে পালন করা হোক না কেন ,এ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে ঘটেছে ।


18

19

20

21

22

23

24

25