আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর8%

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বিভাগ: ইমাম হোসাইন (আ.)

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 30 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 49434 / ডাউনলোড: 5637
সাইজ সাইজ সাইজ
আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক প্রশ্নোত্তর

লেখক:
প্রকাশক: বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক পরিষদ,ইরান।
বাংলা

আশুরা ও কারবালা বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত এ গ্রন্থটিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এর আশুরা বিপ্লব সম্পর্কিত বিভিন্ন  প্রশ্নের উত্তর দেয়া হযেছে

কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা

৭ নং প্রশ্ন : যে কুফাবাসী যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে দাওয়াত দিল তারাই কেন পরবর্তীকালে ইমামকে সাহায্য না করে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল ?

উত্তর : এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে অন্য দু টি প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দিতে হবে ।

এক. কুফাবাসীর চিঠি লেখা এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-কে দাওয়াত করার কারণ কী ছিল ?

দুই. উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ কুফার আন্দোলন দমন করার জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছিল ?

এক. প্রথমে এ বিষয়টা খেয়াল রাখতে হবে যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মক্কায় অবস্থানকালে কুফাবাসীরা তাঁকে পত্র প্রেরণ শুরু করে ।৮২ তাদের পক্ষ থেকে প্রেরিত পত্রের পরিমাণ এত বেশি ছিল যে ,ঐ অবস্থাকে পত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদ আন্দোলন বলা যেতে পারে । কয়েক দিনের মধ্যে এত ব্যাপকভাবে পত্র আসা শুরু হয় যে ,প্রতিদিন গড়ে ৬০০ চিঠি ইমামের কাছে আসত । পরিশেষে চিঠির পরিমাণ প্রায় ১২ হাজারে পৌঁছে ।৮৩ ঐ চিঠিসমূহের যেগুলো পাওয়া গেছে তার কতিপয় চিঠিতে উল্লিখিত নাম ও স্বাক্ষরসমূহের ব্যাপারে সার্বিক গবেষণা করে দেখা গেছে ,চিঠি লেখকগণ নির্দিষ্ট কোন দল বা গোত্রের ছিল না ;বরং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বিভিন্ন দল চিঠি লেখকদের মধ্যে ছিল । আর তাদের মধ্যে বিশিষ্ট শিয়া ব্যক্তিবর্গ ,যেমন ,সুলাইমান বিন সুরাদ খূজায়ী ,মুসাইয়্যাব বিন নাহবা খাজারী ,রোফাআ বিন শাদ্দাদ ও হাবীব বিন মাজাহের প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও ছিলেন ।৮৪

অপরদিকে ,কুফায় বসবাসকারী উমাইয়া গোষ্ঠীর কতিপয় ব্যক্তি ,যেমন শাবাস বিন রিবয়ী (যে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের পর খুশি হয়ে মসজিদ নির্মাণ করেছিল)৮৫ ,হাজ্জার বিন আবজার (যে আশুরার দিন উমর বিন সাদের দলে ছিল এবং ইমামের কাছে প্রেরিত চিঠির কথা অস্বীকার করেছিল)৮৬ ,ইয়াযীদ বিন হারেস বিন ইয়াযীদ (সেও আশুরার দিন ইমামকে দেয়া চিঠির কথা অস্বীকার করেছিল)৮৭ ,আজরা বিন কায়েস (উমর বিন সাদের অশ্ববাহিনীর সেনাপতি)৮৮ এবং আমর বিন হাজ্জাজ জাবিদী (যে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে ফোরাত নদীর পানি নেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য ৫০০ সৈন্য দ্বারা গঠিত একটি দলের সদস্য ছিল)৮৯ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গও ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি দিয়েছিল । ঘটনাক্রমে উৎসাহ-উদ্দীপনামূলক পত্রগুলো এরাই দিয়েছিল এবং ইমামকে বলেছিল- কুফার সেনাবাহিনী আপনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত । ৯০

কিন্তু মনে হয় ,অধিকাংশ পত্র লেখক সাধারণ মানুষ ছিল যাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয়নি এবং তারা দুনিয়াবি স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই পত্র লিখেছিল । আর তারা যেদিকে বাতাস প্রবাহিত হয় সেদিকে চলত । যদিও দুর্যোগকালে তা প্রবাহিত করার ক্ষমতা এদের নেই তবুও এদের সংখ্যা এত অধিক ছিল যে ,প্রচণ্ড এক শক্তি বলে বিবেচিত হতো-যাদেরকে ব্যবহার করে এক অভিজ্ঞ ও সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ফায়দা লুটতে এবং নিজ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে ।

সম্ভবত মুসলিমের কাছে বাইআতকারী ১৮ হাজার লোকের মধ্যে অধিকাংশই এরা ছিল । এরা যখন (উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কুটচক্রের কারণে) নিজেদের পার্থিব স্বার্থ হুমকির মুখে দেখে তখন মুসলিমের দল থেকে বের হয়ে যায় এবং তাঁকে কুফায় অসহায় অবস্থায় ত্যাগ করে ।

অতএব ,এটা স্বাভাবিক যে ,এদেরকে কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর অল্প সংখ্যক সৈন্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখা যাবে । কারণ ,উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ তাদের দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে বহু ওয়াদা দিয়েছিল । এছাড়া ,তারা মনে করত ইমামের সঙ্গী-সাথি কম থাকায় উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের বিজয়ের সম্ভবনা বেশি । এ সম্ভাবনা তাদের মনে যথেষ্ট আশার উদ্রেক করেছিল । আবার এরা এমন লোক ছিল যাদের অন্তরে নবীর দৌহিত্র এবং ইমাম আলী (আ.)-এর সন্তান হিসেবে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল । এদের সম্পর্কে মাজমা বিন আবদুল্লাহ আয়েজী ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেন : অধিকাংশ মানুষের অন্তর তোমার দিকে ,কিন্তু আগামীকাল তাদের তরবারি তোমার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে । ৯১

এদেরই একটি দল কারবালার ময়দানে এক কোনায় দাঁড়িয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের দৃশ্য দেখছিল ,চেখের পানি ঝরাচ্ছিল এবং দোয়া করছিল এ বলে যে , হে আল্লাহ! ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সাহায্য করুন । ৯২

উপরিউক্ত ভূমিকার পর এ ফলাফলে পৌঁছি যে ,পত্র লেখকদের মধ্যে বিভিন্ন দল থাকায় কোন ক্রমেই তাদের উদ্দেশ্য এক ছিল বলে মনে করা যায় না ;বরং বিভিন্ন দলের বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল । যেমন-

১. হাবীব বিন মাজাহের এবং মুসলিম বিন আওসাজার মতো খাঁটি শিয়ারা খেলাফতকে আহলে বাইতের ন্যায্য অধিকার এবং উমাইয়াদের যুলুম-অত্যাচারের রাজত্বকে অবৈধ মনে করতেন । তাঁরা খেলাফতের পুনরুদ্ধার এবং উপযুক্ত জায়গায় তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য চিঠি লিখেছিলেন । তবে তাঁরা সংখ্যায় খুবই কম ছিলেন ।

২. কুফার অনেক লোক বিশেষ করে মধ্যবয়স্ক ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরা ,যারা কুফায় হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা মনে রেখেছিল এবং মুয়াবিয়ার বিশ বছরের শাসনামলে উমাইয়া গোষ্ঠীর যুলুম-অত্যাচার দেখেছিল তারা এ অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ইমাম আলী (আ.)-এর সন্তানের প্রতি মুখ চেয়ে ছিল যাতে তাঁর মাধ্যমে উমাইয়া শাসনের যাঁতাকল থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে ।

৩. একদল লোক কুফায় রাজধানী ফিরিয়ে আনার জন্য একজন যোগ্য নেতা খুঁজছিল ,যিনি এ কাজ সম্পাদন করতে পারেন । কারণ ,কুফার সাথে সিরিয়ার প্রতিযোগিতা ছিল এবং মুয়াবিয়ার বিশ বছরের শাসনামলে রাজধানী কুফা থেকে সিরিয়ায় স্থানান্তরিত হয়েছিল । এদের দৃষ্টিতে এ সময়ে ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন একজন উপযুক্ত ব্যক্তি যিনি একদিকে কুফাবাসীকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ,অপরদিকে উমাইয়াদের শাসনকে অবৈধ মনে করেন । এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এ দল ইমাম হোসাইন (আ.)-কে কুফায় আসার জন্য দাওয়াত করেন ।

৪. শাবাস বিন রাব্য়ী ও হাজ্জার বিন আবজারের মতো গোত্রপতিরা একদিকে নিজের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখার চিন্তায় ছিল ,অপরদিকে নবী-বংশের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই ছিল না । যখন তারা দেখল ,কুফাবাসী ইমাম হোসাইন (আ.)-কে সাহায্যের জন্য প্রস্তুত ,তখন তারা ধারণা করল ভবিষ্যতে অবশ্যই কুফায় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে । ঐ সময় তারা যেন কাফেলা থেকে পেছনে পড়ে না থাকে

এবং ইমামের খেলাফতকালে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী হয় এজন্য পত্র লেখকদের অন্তর্ভুক্ত হয় ।৯৩

৫. সাধারণ মানুষ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে চিঠি লিখতে আগ্রহী হয় এবং বিদ্রোহের আগুনকে উস্কে দেয় ।

দুই. উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কুফায় প্রবেশের ফলে গোত্রপতিরা ও উমাইয়া গোষ্ঠীর অনুসারীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে । খুব দ্রুত তার চারিদিকে সমবেত হয় এবং কুফার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ঘটনা তার সামনে বর্ণনা করে । উবায়দুল্লাহ কুফায় প্রবেশের সাথে সাথে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর প্রতি কুফাবাসীর ভালোবাসা এবং আন্দোলনের পরিধি সম্পর্কে উত্তমরূপে অবগত হয় ;কারণ ,সে মাথায় কাল পাগড়ি ও নেকাব পরিহিত অবস্থায় কুফায় প্রবেশ করে । আর এদিকে ,ইমামের জন্য প্রতীক্ষারত কুফাবাসী তাকে ইমাম হোসাইন (আ.) মনে করে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় ।৯৪ আর এভাবে উবায়দুল্লাহ খুব ভালোভাবে বিপদের গভীরতা আঁচ করে এবং বসরায় স্বীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক যে দক্ষতা ছিল তার ওপর ভিত্তি করে ও স্বীয় অনুসারীদের সহযোগিতায় কুফাবাসীর আন্দোলন দমন করার জন্য খুব দ্রুত প্রভাব বিস্তারকারী রাজনৈতিক কৌশলের আশ্রয় নেয় । তার এ রাজনীতিকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে । যথা:-মনস্তাত্ত্বিক কৌশল ,সামাজিক কৌশল ও অর্থনৈতিক কৌশল । নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরা হলো:

১. মনস্তাত্ত্বিক কৌশল : ইবনে যিয়াদ কুফায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভীতি প্রদর্শন ও প্রলোভনের অপকৌশল হাতে নেয় । কুফার জামে মসজিদে সে তার প্রথম বক্তৃতায় নিজেকে অনুগতদের জন্য দয়ালু পিতা হিসেবে উল্লেখ করে ,আর অবাধ্য ব্যক্তিদের জন্য তরবারি ও চাবুকের কথা বলে ।৯৫

সে আরেকটি কৌশল কাজে লাগায় । আর তা হলো ,সে কুফাবাসীকে জানায় যে ,সিরিয়ার বিশাল বাহিনী বিদ্রোহীদেরকে দমন করার জন্য কুফার দিকে আসছে । তার এ ঘোষণার পর কুফার বিদ্রোহ ,বিশেষ করে যারা মুসলিমের সাথে দারুল ইমারাহ অবরোধ করে রেখেছিল তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিস্তেজ হয়ে পড়ে ।৯৬ কুফাবাসী সিরিয়ার বাহিনীর সাথে তাদের সর্বশেষ সংঘর্ষের-অর্থাৎ ইমাম হাসান (আ.) যখন সন্ধি করেছিলেন-পর থেকে সিরিয়ার বাহিনীকে প্রচণ্ড ভয় পেত এবং সমসময় মনে করত ঐ বাহিনীর সাথে মোকাবিলা করার কোন শক্তি তাদের নেই । কুফার মহিলারাও এ রকম মনোভাব পোষণ করত । এজন্য ইবনে যিয়াদের ঘোষণার পর পরই মহিলারা তাদের স্বামী ,ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন যারা মুসলিমের সাথে ছিল তাদের কাছে যায় এবং তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।৯৭

পরিশেষে এ ধরনের কৌশলের ফলেই যে মুসলিম দুপুরে চার হাজার কুফাবাসীকে সাথে নিয়ে দারুল ইমারাহ অবরোধ করে রেখেছিল এবং উবায়দুল্লাহকে পতনের সম্মুখীন করে তুলেছিল সেই মুসলিম রাতের প্রথম প্রহরে কুফার গলিতে একাকী ঘুবতে থাকেন ।৯৮

২. সামাজিক কৌশল : যেহেতু তখন পর্যন্ত গোত্রীয় ঐক্য ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল সেহেতু গোত্রপতিরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামাজিক দিক থেকে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারকারী ছিল । এজন্য তাদের অনেকেই (যেমন : শাবাস বিন রাবয়ী ,আমর বিন হাজ্জাজ ও হাজ্জার বিন আবজার) পত্র প্রেরণের আন্দোলনে কার্যকর ভাবে যোগ দিয়েছিল এবং স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিমের কুফায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাথে মিলিত হয়েছিল । কিন্তু অধিকাংশই যেহেতু নিজের পদ ও দুনিয়ার স্বার্থ রক্ষার চিন্তায় ছিল সেহেতু উবায়দুল্লাহ্ কুফায় প্রবেশের পর তারাও তার হুমকির মুখে পড়ে মুসলিমের কাছ থেকে সরে গিয়ে উবায়দুল্লাহর বাহিনীতে যোগ দেওয়াটাকেই তাদের দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিলের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করে । এ জন্য তারা খুব দ্রুত বিদ্রোহ করা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় । কারণ ,উবায়দুল্লাহ খুব ভালোভাবে জানত যে ,তাদেরকে কিভাবে নিজের পাশে একত্র করা যায় । সে হুমকি ও মোটা অংকের ঘুষের রাজনীতিকে কাজে লাগিয়ে গোত্রপতি ও বিভিন্ন অঞ্চলের সম্মানী ব্যক্তিদেরকে নিজের পাশে জড়ো করতে সক্ষম হয় । মুজতামা বিন আবদুল্লাহ আয়েজী ,যে কুফার অবস্থা ভালোভাবে জানত এবং সবেমাত্র কুফা থেকে বের হয়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ,সে ইমামের নিকট কুফার গোত্রপতিদের সম্পর্কে বলে : কুফার গোত্রপতি ও সম্মানী ব্যক্তিদেরকে মোটা অংকের ঘুষ দেয়া হয়েছে ,তাদের গোডাউনগুলোকে গম আর যব দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে ,তাদের ভালোবাসাকে টাকা-পয়সা দিয়ে কিনে নেয়া হয়েছে ,তারা শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা করছে এবং আপনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে... । ৯৯

সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী দ্বিতীয় যে দলটিকে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ ব্যবহার করে সেটি হলো অভিভাবক দল । পরিভাষায় অভিভাবক সেই ব্যক্তিকে বলা হতো যার ওপর কয়েক ব্যক্তিকে দেখাশুনা করার ভার ন্যস্ত ছিল । তাদের অনেকেই সরকার থেকে বাৎসরিক এক লক্ষ দিরহাম লাভ করত ।১০০ তবে বিভিন্ন অভিভাবকের আয়ের পরিমাণ ছিল বিভিন্ন রকম । আর তাদের অধীনে বসবাসরত লোকদের সংখ্যা বিশ থেকে একশ র ওপর ছিল ।১০১

যখন কুফায় গোত্রবাসীরা শহরে বাস করা শুরু করে তখন এ পদ একটি সরকারি পদে রূপান্তরিত হয় এবং এ পদের অধিকারীদেরকে কুফার ওয়ালী ও আমীরের কাছে জবাবদিহি করতে হতো ।১০২ আর তাদের নিয়োগ এবং অপসারণও গোত্রপতির মাধ্যমে না হয়ে ওয়ালীর (গভর্নর) মাধ্যমে হতো । এ পদ সরকার এবং জনগণের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষা করত । আর এ পদের অধিকারীদের অধীনে বসবাসরত লোকদের সংখ্যা যেহেতু গোত্রপতির অধীনে বসবাসরত লোকদের সংখ্যার থেকে অনেক কম ছিল সেহেতু তারা খুব সহজেই স্বীয় অধীনস্থ লোকদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত ।

অভিভাবকদের প্রধান দায়িত্ব ছিল রেজিস্ট্রি খাতায় স্বীয় অধীনস্থ লোকদের স্ত্রী ও সন্তানসহ নামের তালিকা তৈরি করা । যখনই কেউ জন্মগ্রহণ করত তখনই তার নাম এ খাতায় লিপিবদ্ধ হতো ,অপরদিকে কেউ মারা গেলে তার নাম মুছে ফেলা হতো । এভাবে তারা স্বীয় অধীনস্থ লোকদের অবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল থাকত । কিন্তু দুর্যোগময় মুহূর্তে অভিভাবকদের কাজ কয়েক গুণ বেড়ে যেত । কারণ ,স্বীয় অধীন এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব-যেটাকে অভিভাবকত্ব বলা হতো-তাদের ওপর ন্যস্ত ছিল । আর সরকার নির্দেশ দেয়া মাত্রই বিদ্রোহী দলকে খুব দ্রুত শাসকদের কাছে পরিচিত করাতে হতো ।১০৩

উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ কুফায় প্রবেশ করার পরই চতুরতার সাথে সামাজিক দিক থেকে শক্তিশালী এ দলটিকে ব্যবহার করা শুরু করে । সম্ভবত উবায়দুল্লাহ্ এ কাজের অভিজ্ঞতা স্বীয় পিতা যিয়াদের কাছে তার কুফায় শাসনকালে শিখেছিল । সে কুফার জামে মসজিদে প্রথম বক্তৃতা করার পর রাজপ্রাসাদে আসে এবং অভিভাবকদেরকে একত্রিত করে তাদের উদ্দেশে বলে : তোমরা অবশ্যই তোমাদের অধীনস্থ এলাকায় বসবাসরত অস্থানীয় এবং আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদের বিরোধী লোকদের তালিকা তৈরি করে আমাকে দেবে । তেমনি খারেজী সম্প্রদায় এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তি যারা বিরোধ সৃষ্টি করতে চায় তাদের ব্যাপারেও আমার কাছে প্রতিবেদন দেবে । যে ব্যক্তি আমার এ নির্দেশ পালন করবে তার সাথে আমার কোন বিরোধ নেই ,কিন্তু যে ব্যক্তি তালিকা তৈরি করবে না সেও যেন স্বীয় এলাকার ব্যাপারে এ দায়িত্ব গ্রহণ করে যে ,তার এলাকার কোন বিদ্রোহী বা বিরোধী ব্যক্তি আমাদের সাথে বিরোধিতা না করে । আর যদি এ রকম না করে তাহলে আমাদের নিরাপত্তা তার ওপর থেকে তুলে নেয়া হবে এবং তার জান ও মালের কোন নিরাপত্তা থাকবে না । আর যে অভিভাবকের এলাকায় আমীরুল মুমিনীন ইয়াযীদের কোন বিরোধীকে পাওয়া যাবে সে অভিভাবককে তার বাড়ির দরজার ওপর ফাঁসিতে ঝুলানো হবে এবং ঐ এলাকায় কোন বাৎসরিক বাজেট প্রদান করা হবে না ।১০৪

অতএব ,বলা যেতে পারে যে ,কুফায় মুসলিমের আন্দোলন নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল উবায়দুল্লাহর এ ধরনের নীতি অবলম্বন এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও মাধ্যমসমূহের ব্যবহার । কারণ ,অভিভাবকগণ ইবনে যিয়াদের হুমকিকে সত্য বলে মনে করেছিল এবং খুব দ্রুত তার চাওয়া-পাওয়াগুলো পূরণ করেছিল আর কঠিনভাবে স্বীয় এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছিল ।

৩. অর্থনৈতিক কৌশল : ঐ সময় জনগণের গুরুত্বপূর্ণ আয়ের উৎস ছিল সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য গ্রহণ । তারা ইরানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের শর্ত হিসেবে যুদ্ধের শুরুতে এ সাহায্য গ্রহণ করত । তাদের শহুরে জীবন শুরু হওয়ার পর এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও আগের রীতি মোতাবেক তাদেরকে সেই সাহায্য প্রদান করা হতো । এ কারণে আরব জনগণ শিল্প ,কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে খুব কম মনোযোগ দিত । সাধারণত এ কাজগলো মাওয়ালীরা (যেসব অনারব আরবদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল) করত । এ অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ,মূলত ঐ সময়ে আরবগণ শিল্প ও যে কোন পেশায় রত হওয়াটাকে নিজের পদ-মর্যাদার পরিপন্থী বলে মনে করত ।১০৫

সরকারি সাহায্য নগদ পরিশোধযোগ্য একটি পরিমাণ ছিল যা কুফার শাসকদের পক্ষ থেকে এককালীন অথবা কয়েক কিস্তিতে জনগণকে প্রদান করা হতো । এছাড়া খেজুর ,গম ,যব ও তেলসহ বিভিন্ন জিনিস রেশন হিসেবে প্রতি মাসে তাদেরকে দেয়া হতো । বলার অপেক্ষা রাখে না যে ,এ রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অধিকাংশ আরবকে প্রচণ্ডভাবে সরকারের প্রতি নির্ভরশীল করে রাখত এবং স্বৈরাচারী শাসকগণও এ দুর্বল দিকটি ভালো করে জানত ;ফলে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত ।

উবায়দুল্লাহ্ বিন যিয়াদ অভিভাবকদেরকে ভয়-ভীতি দেখানোর সময় এ হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করে এবং কোন অভিভাবকের এলাকায় বিদ্রোহী ব্যক্তিকে পাওয়া গেলে ঐ এলাকার সকল লোকের সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার মতো কঠিন পরিণিতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকগণ ছাড়াও দুনিয়াকামী অন্য ব্যক্তিরাও বিদ্রোহ দমনে মাঠে নেমেছিল ।

যখন মুসলিম এবং তাঁর সাথিরা উবায়দুল্লাহর প্রাসাদ অবরুদ্ধ করে রেখেছিল তখন তার এক সফল অনুচর মুসলিমের সাথিদেরকে বিচ্ছিন্ন করার কাজে ব্যস্ত ছিল এবং তাদেরকে এ বলে লোভ দেখাচ্ছিল যে ,যদি তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে তাদের রেশন ও অন্যান্য সাহায্য বাড়িয়ে দেয়া হবে । পক্ষান্তরে ,যদি বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে তাহলে তাদের রেশন বন্ধ করে দেয়া হবে ।১০৬

ইবনে যিয়াদ এ অর্থনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে এবং রেশন বৃদ্ধির ওয়াদা দিয়ে কুফার জনগণের মধ্য থেকে ৩০ হাজার১০৭ সৈন্য সম্বলিত এক বিশাল বাহিনী তৈরি করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠাতে সক্ষম হয় ;যে বাহিনীর অনেকের হৃদয় ছিল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দিকে ।১০৮

ইমাম হোসাইনও এ হাতিয়ারের প্রভাব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন । আর এজন্য তিনি আশুরার দিন স্বীয় বক্তৃতায় তাঁর বিরুদ্ধে কুফাবাসীর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি কারণ হিসেবে সেটিকে উল্লেখ করেছিলেন : তোমরা সবাই আমার বিরোধিতা করছ এবং আমার বক্তব্য শুনছ না ;কারণ ,হারাম মাল থেকে তোমাদেরকে সাহায্য দেয়া হয়েছে এবং তোমাদের পেট হারামে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে । আর এটা তোমাদের অন্তরের ওপর মোহর পড়ে যওয়ার কারণ হয়েছে । ১০৯

কারবালায় পিপাসা

৮ প্রশ্ন নং : কারবালায় কী রকম পিপাসা ছিল ?

উত্তর : নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে যা পাওয়া যায় তা হলো ,ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের তিন দিন পূর্বে অর্থাৎ সাতই মুহররম উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ সেনাপতি উমর বিন সাদকে নির্দেশ দিয়েছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে পানি নেয়া থেকে বিরত রাখ এবং তাঁকে এক ফোঁটা পানি পান করার সুযোগ দিও না । আর সে উসমানের ওপর পানি বন্ধ করার প্রতিশোধ নেয়ার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে এ কাজ করে!১১০

উমর বিন সাদ এ নির্দেশ পাওয়া মাত্র আমর বিন হাজ্জাজকে ৫০০ অশ্বারোহী সাথে দিয়ে ফোরাত নদীর তীর বন্ধ করার হুকুম দেয় যাতে ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিরা পানি নিতে না পারে ।১১১ এ দুই তিন দিন ইমাম এবং তাঁর সাথিরা বিভিন্ন পন্থায় পানি আনার চেষ্টা করছিলেন ;কারণ ,ঐ উত্তপ্ত মরুভূমিতে পিপাসার কষ্ট সহ্য করা বিশেষ করে শিশু ও নারীদের সাধ্যের বাইরে ছিল ।

কোন কোন গ্রন্থে এ রকম এসেছে : ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর শিবিরে পানির জন্য কূপ খনন করা শুরু করেছিলেন ;কিন্তু ইবনে যিয়াদের কাছে যখন এ খবর পৌঁছল তখন সে উমর বিন সাদকে নির্দেশ দিল ,অবরোধ যেন কঠোর করা হয় এবং কূপ খনন করতে বাধা দেয়া হয় ।১১২

আবার কোন কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে এসেছে ,হযরত আব্বাস (আ.) ৩০ জন অশ্বারোহী এবং ২০ জন পদাতিক সৈন্য নিয়ে পতাকাবাহী নাফে বিন হেলালের সাথে রাতের বেলায় ফোরাতের তীরে হামলা করেন । তারা আমর বিন হাজ্জাজের বাহিনীর সাথে লড়াই করার পর ২০ মশক পানি নিয়ে আসতে সক্ষম হন ।১১৩

উপরিউক্ত ঘটনার সুনির্দিষ্ট কোন সময় উল্লেখ করা হয়নি । তবে এ বাক্যটি বর্ণিত হয়েছে : যখন ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের পিপাসার কষ্ট চরম আকার ধারণ করেছিল ।

কোন কোন জায়গায় বলা হয়েছে : ইমাম হোসাইন (আ.) আশুরার দিনে তাঁর বোন যায়নাবের চেহারার ওপর পানি ছিটিয়ে দিয়েছিলেন ;কারণ ,তিনি যখন শাহাদাত নিকটবর্তী হওয়া সম্পর্কিত ইমামের কবিতা শ্রবণ করেন তখন বেহুশ হয়ে যান ।১১৪

উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,আশুরার রাতে ইমামের শিবিরে পানি ছিল । আল্লামা মাজলিসী (র.) বিহারুল আনওয়ার গ্রন্থে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন যে ,আশুরার দিন সকাল বেলাতেও খাওয়ার পানির কোন সমস্যা ছিল না ।

এ সম্পর্কে এভাবে বলা হয়েছে : অতঃপর ইমাম হোসাইন (আ.) স্বীয় সাথিদেরকে বললেন : ওঠ ,পানি পান কর ;কারণ ,এটা হচ্ছে তোমাদের সর্বশেষ খাদ্য । ওজু কর এবং গোসল কর । আর নিজেদের কাপড়গুলোকে পানি দিয়ে ধৌত কর যাতে ঐগুলো তোমাদের কাফন হতে পারে । ঐ সময় ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁদের সাথে ফজরের নামায জামাতে আদায় করেন । ১১৫

এটা তোমাদের সর্বশেষ খাদ্য এই বাক্য এবং আশুরার দিবস সম্পর্কিত অন্যান্য বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ,সঞ্চিত পানি শেষ হওয়ার পর পুনরায় পানি সংগ্রহ সম্ভব হয়নি । আর ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদেরকে নিয়ে কারবালার ঐ উত্তপ্ত মরুভূমিতে শাহাদাতের মুহূর্ত পর্যন্ত একদিকে দুশমনদের সাথে কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন ,অপরদিকে কঠিন পিপাসায় কাতর ছিলেন ।

আল্লামা মাজলিসী (র.) স্বীয় বর্ণনায় তামীম বিন হাসীন খাজারী নামে উমর বিন সাদের এক সৈন্যের উপহাসের কথা উল্লেখ করেন । সে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে লক্ষ্য করে বলছিল : হে হোসাইন! হে হোসাইনের সাথিরা! ফোরাত নদীর পানি দেখতে পাচ্ছ ,কিভাবে সাপের পেটের মতো জ্বলজ্বল করছে ;খোদার শপথ! মৃত্যুর আগে এক ফোঁটা পানি সেখান থেকে পান করতে পারবে না । ১১৬

হুর ইবনে ইয়াযীদ আশুরার দিন কুফাবাসীকে নসীহত করার সময় ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের ওপর ফোরাত নদীর পানি বন্ধ রাখার জন্য তাদেরকে খুব তিরস্কার করেন ।১১৭

কোন কোন গ্রন্থে এসেছে ,ইমাম (আ.) পানি নিয়ে আসার জন্য খুব চেষ্টা করছিলেন ;কিন্তু শিমার বাধা দিয়েছিল এবং ইমামকে উপহাস করেছিল । এ কারণে ইমাম তাকে অভিসম্পাত করেন ।১১৮

আল্লামা মাজলিসী (র.) একটি হাদীস বর্ণনা করেন যার মধ্যে বর্ণিত হয়েছে যে ,হযরত আব্বাস যুদ্ধ করার জন্য অনুমতি চেয়েছিলেন আর ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁকে শিশুদের খাওয়ার পানি নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন । প্রসিদ্ধ মতে ,হযরত আব্বাস (আ.) পানি নিয়ে আনতে সক্ষম হননি ;বরং ফেরার পথে শাহাদাত বরণ করেন ।১১৯

পানির জন্য আবেদন

৯ নং প্রশ্ন : ইমাম হোসাইন (আ.) কি শত্রুদের কাছে নিজের জন্য পানির আবেদন করেছিলেন ?

উত্তর : আশুরার দিন সকাল বেলায় যদিও ইমাম হোসাইন (আ.) ,তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথিরা কঠিন পিপাসায় কাতর হয়ে গিয়েছিলেন ,তবুও কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে আসেনি যে ,তিনি শত্রুদের কাছে পানির আবেদন করেছিলেন ।

মূলত কোন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থেই পিপাসার বিষয়টি এতটা গুরুত্বের সাথে বর্ণিত হয়নি ,তবে সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোর কোন কোন কিতাবে এবং বক্তাদের মাঝে এ বিষয়টি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে । আশ্চর্যের বিষয় হলো ,যুদ্ধের ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর সাথিদের বীরত্বপূর্ণ কবিতায় পিপাসার প্রতি কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না ।

এর বিপরীতে আশুরার দিন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কবিতা ও বক্তব্যে যা দেখতে পাওয়া যায় তা আত্মসম্মান ,মর্যাদা এবং বীরত্বগাথায় পরিপূর্ণ । উদাহরণস্বরূপ ঐ বিখ্যাত বাক্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে যা আশুরার দিনে ঘোরতর যুদ্ধের সময় ইমাম হোসাইন (আ.) পাঠ করেছিলেন : জেনে রাখ ,জারজের সন্তান জারজ ইবনে যিয়াদ আমাকে দু টি বিষয়ের যে কোন একটি মানতে বলেছে: হয় তরবারি নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে ,আর না হয় অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে ইয়াযীদের হাতে বাইআত করতে হবে । কিন্তু অপমান ও লাঞ্ছনা আমাদের থেকে দূরে । আর আল্লাহ ,আল্লাহর রাসূল ,ঈমানদারগণ ,পবিত্র ক্রোড়ে লালিত ব্যক্তিগণ ,পৌরুষের অধিকারী এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমাদের জন্য বৈধ মনে করেন না যে ,নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্যের লাঞ্ছনাকে সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণ করার ওপর প্রাধান্য দেই । ১২০

কোন কোন আলোচনা সভা ও শোকানুষ্ঠানে ইমাম হোসাইনের আন্দোলনের সম্মান-মর্যাদা ও বীরত্বপূর্ণ দিকটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা হয় না ,বরং ইমামের ওপর দয়া ও অনুকম্পার বিষয়টি আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে পরিগণিত হয় । একদল কারবালার ঘটনাকে বেশি করুণ করে তোলার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কিস্সা-কাহিনীর আশ্রয় নেয় এবং কোন কোন সময় ইমামের চেহারাকে কলঙ্কিত করে তুলে ধরে ।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ,এসব মিথ্যা কিসসা-কাহিনীর একটিতে এসেছে ,ইমাম হোসাইন (আ.) উমর বিন সাদের কাছে গিয়ে তিনটি আবেদন করেন যার দ্বিতীয়টি ছিল , আমাকে একটু পানি পান করাও ,কারণ ,তৃষ্ণায় আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে ,১২১ কিন্তু উমর বিন সাদ বেহায়ার মতো এ আবেদন নাকচ করে ।

যদিও এ ঘটনাগুলো পাথরের চোখেও পানি প্রবাহিত করতে সক্ষম ,কিন্তু অন্যদিকে আশুরা এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সম্মানিত চেহারার ওপর কালিমা লেপন করে । আর চিন্তাশীল শিয়াদেরকে বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মৌলিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করে । পরিশেষে ,দুশমনদের হাতে বাহানা তুলে দিয়ে শিয়াদের সম্মান ও মর্যাদার ওপর বড় ধরনের আঘাত হানে ।১২২

এক নজরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন1

মদীনার শাসক ওয়ালীদের পক্ষ থেকে এজীদের জন্য বাইআতের আহবানঃ

শুক্রবার , 27 রজব , 60 হিজরি।

ওয়ালীদের সাথে ইমাম হোসাইন (আ:)-এর দ্বিতীয় সাক্ষাতঃ

শনিবার 28 রজব , 60 হিজরী।

মদীনা থেকে ইমাম হোসাইন (আ:)-এর বহির্গমনঃ

শনিবার 28 রজব , 60 হিজরী (রাতে)।

ইমামের মক্কায় প্রবেশঃ

বৃহস্পতিবার (রাতে) , 3শাবন , 60 হিজরী।

মক্কায় অবস্থান :

4 মাস , 5 দিন।

মুসলিমের মক্কা থেকে যাত্রা:

সোমবার , 15 রমজান , 60 হিজরী।

মুসলিমের শাহাদাত :

মঙ্গলবার , 8 জিলহজ্ব , 60 হিজরী।

মক্কা থেকে ইমামের বহির্গমন :

মঙ্গলবার , 8 জিলহজ্ব , 60 হিজরী।

কারবালায় ইমামের প্রবেশ :

শুক্রবার , 3 মুহাররাম , 61 হিজরী।

করবালায় উমর-বিন-সাদের প্রবেশ

শুক্রবার , 3 মুহাররাম , 61 হিজরী।

উমর-বিন-সাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ও ইমামের সাথে কথোপকথন:

3-6 মুহাররাম , 61 হিজরী।

ইমামের সঙ্গীদের জন্য পানি সরবরাহ বন্ধ :

মঙ্গলবার 7 মুহাররাম , 61 হিজরী।

ইমামের বাহিনীর উপর প্রথম হামলা :

বৃহস্পতিবার , 9 মুহাররাম , 61 হিজরী।

কারবালার ঘটনা :

শুক্রবার , 10 মুহাররাম , 61 হিজরী।

কারবালা থেকে আহরে বাইতের (আ.) বন্দীদের বহির্গমন :

শনিবার , 11 মুহাররাম , 61 হিজরী , জোহর নামাজের পর।

মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন না করার কারণ

1 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি ?

উত্তর : ইমাম হোসাইন (আ.) 50 হিজরি থেকে 61 হিজরি পর্যন্ত 11 বছর ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এর মধ্যে 10 বছর মুয়াবিয়ার শাসনামলে অতিবাহিত হয় । ঐ সময় ধরে তার সঙ্গে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল । এ দ্বন্দ্বের কতগুলো নমুনা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিভিন্ন চিঠিতে লক্ষ্য করা যায় । ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর চিঠিতে মুয়াবিয়ার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডগুলো (যেমন আল্লাহর রাসূলের সাহাবী আমর ইবনে হামেক ও হুজর ইবনে আদীকে হত্যা) তুলে ধরে মুসলমানদের ওপর মুয়াবিয়ার শাসনকে বড় ফিতনা হিসেবে উল্লেখ করেন ।2 আর এভাবে ইমাম হোসাইন (আ.) ,মুয়াবিয়ার খেলাফতের বৈধতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলেন । ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে জিহাদ করাকে সর্বশ্রেষ্ঠ আমল মনে করতেন । এছাড়া তিনি মনে করতেন ,যদি কেউ তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়ে জিহাদ করা থেকে বিরত থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই ইস্তিগফার করতে (আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে) হবে ।3 কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন (আ.) কেন মুয়াবিয়ার শাসনামলে আন্দোলন করেননি তার কতগুলো কারণ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্যে পাওয়া যায় । যদি আমরা ঐ কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই ,তাহলে আমাদেরকে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা করতে হবে ।

এক : মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধিচুক্তি

ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল ,ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার কাছে দেয়া চিঠিতে সেই সন্ধিচুক্তির প্রতি তাঁর নিবেদিত থাকার কথা বলে তাঁর বিরুদ্ধে তা লঙ্ঘন করার যে অভিযোগ মুয়াবিয়া তুলেছিল তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ।4 কিন্তু প্রশ্ন হলো ,মুয়াবিয়া যেখানে কুফায় প্রবেশ করার পর সন্ধিচুক্তির কালি শুকানোর আগেই তা লঙ্ঘন করেছিল এবং তার প্রতি নিবেদিত থাকা তার জন্য আবশ্যক নয় বলে ঘোষণা দিয়েছিল5 সেখানে কেন ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি মেনে চললেন ?

এ প্রশ্নের উত্তর কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া যেতে পারে :

. যদি আমরা মুয়াবিয়ার বক্তব্যের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারব যে ,সে সুস্পষ্টভাবে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘনের কথা বলেনি । কারণ ,সে বলেছিল : আমি হাসানকে কতগুলো বিষয়ের ওয়াদা দিয়েছি । আর হতে পারে সে যে ওয়াদার কথা বলেছে তা সন্ধিচুক্তির বহির্ভূত কোন বিষয় ছিল যার প্রতি নিবেদিত থাকা মুয়াবিয়ার মতে আবশ্যক ছিল না । আর অন্তত এর ভিত্তিতে সে অজুহাত দেখাত যে ,তার পক্ষ থেকে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘিত হয়নি ।

. রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ইমাম হোসাইন (আ.) এবং মুয়াবিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ ছিল ,ঠিক যে রকম তফাৎ ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে মুয়াবিয়ার ছিল ।

আসলে মুয়াবিয়া এমন একজন রাজনীতিবিদ ছিল ,যে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে কোন অন্যায়-অবিচার ,6 প্রতারণা ও ছল-চাতুরির

আশ্রয় নিত । এসব প্রতারণার কতক নমুনা ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়েও দেখা যায় । যেমন উসমানের রক্তকে বাহানা হিসেবে তুলে ধরা ,তালহা এবং যুবায়েরকে ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা ,সিফফিনের যুদ্ধে বর্শার মাথায় কুরআন শরীফ তুলে ধরা এবং ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন শহরে অতর্কিত হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ।

অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক পবিত্র ব্যক্তিত্ব ছিলেন ,যিনি স্বীয় লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সত্যের পরিপন্থী কোন পথে অগ্রসর হতেন না । যেভাবে ইমাম আলী (আ.) বলেছিলেন : আমি জোর-জবরদস্তি করে বিজয়ী হতে চাই না । 7

অতএব ,এটা স্বাভাবিক যে ,ইমাম হাসান (আ.) মুয়াবিয়ার সাথে যে চুক্তি করেছিলেন ইমাম হোসাইন (আ.) কোনক্রমেই তা লঙ্ঘন করতে পারেন না । এমনকি মুয়াবিয়া তা লঙ্ঘন করলেও ইমামের পক্ষে সেটা সম্ভব নয় ।

. অবশ্যই আমাদেরকে ঐ সময়ের অবস্থা বিবেচনা করে দেখতে হবে । আর এটাও দেখতে হবে যে ,ইমাম যদি সন্ধির খেলাফ কাজ করতেন তাহলে কী ঘটত ? কারণ ,ঐ সময় মুয়াবিয়া মুসলমানদের একচ্ছত্র খলীফা ছিল । আর তার শাসনব্যবস্থা সিরিয়া থেকে শুরু করে মিশর ,ইরাক ,আরব উপদ্বীপ ও ইয়েমেন তথা গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল । প্রতিটি এলাকাতে তার অনুচর ও দালালরা তার খেলাফতের বৈধতার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতো । এহেন পরিস্থিতিতে ইমামের পক্ষে সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করা কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না ।

মুয়াবিয়া ,হযরত আলী (আ.)-এর সাথে দ্বন্দ্বের সময় সিরিয়াবাসীদের কাছে নিজেকে উসমান দরদী এবং তাঁর খুনের একমাত্র দাবিদার (প্রতিশোধ গ্রহণকারী) হিসেবে তুলে ধরেছিল । যদিও উসমান হত্যার ঘটনায় সে ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাকে কোন সাহায্যই করেনি ।8 অতএব ,এটা সুস্পষ্ট যে ,ঐ সময় কেউ তার সঙ্গে মোকাবিলা করার সাহস করত না । এ পরিস্থিতিতে যদি ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধিচুক্তি লঙ্ঘন করতেন ,তাহলে মুয়াবিয়া তাঁকে মুসলিম সমাজে চুক্তি লঙ্ঘনকারী ও বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত করাতো এবং উম্মাহর চিন্তাধারাকে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করাতো । আর ঐ পরিস্থিতিতে ইমামের আহ্বান মুসলিম জাতির কাছে পৌঁছত না । ইমাম এবং তাঁর সাথিরা এ সময় মুয়াবিয়াকে প্রথম সন্ধি লঙ্ঘনকারী হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টা করেছিলেন ,কিন্তু তাঁরা এতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ।

দুই. মুয়াবিয়ার শক্তিশালী অবস্থান

ঐ সময় মুয়াবিয়ার ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিশেষ করে সিরিয়াবাসীদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করাটাকে কঠিন করে তুলেছিল । কারণ ,সিরিয়াবাসী তাকে নবীর সাহাবা ,ওহী লেখক এবং মুসলমানদের মামা মনে করত । তাদের দৃষ্টিতে ,সিরিয়া ও দামেশকে ইসলাম প্রচারে মুয়াবিয়ার ভূমিকাই ছিল মূখ্য ।

এছাড়া মুয়াবিয়া একজন ধূর্ত রাজনীতিবিদ ছিল । আর তার বয়সও ইমাম হাসান ও হোসাইন (আ.) থেকে বেশি ছিল । এজন্য সে সবসময় ইমামদের কাছে দেয়া চিঠিতে এ দুটি বিষয় উল্লেখ করত এবং নিজেকে খেলাফতের জন্য বেশি উপযুক্ত মনে করত ।9 অতএব ,এটা স্বাভাবিক যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) সন্ধি লঙ্ঘন করলে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগত ।

তিন. মুয়বিয়ার রাজনৈতিক কূটচাল ও ধূর্ততা

সন্ধির পর যদিও মুয়াবিয়া বনি হাশেম ,বিশেষ করে ইমাম আলী (আ.)-এর পরিবারকে কোণঠাসা করার জন্য সকল প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল ,এমনকি বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আ.)-কে শহীদ করেছিল ,10 কিন্তু সে বাহ্যত মানুষদের দেখাত যে ,নবী-বংশের বিশেষ করে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে ,মুয়াবিয়া প্রতি বছর এবং প্রতি মাসে ইমাম হাসান (আ.) ,ইমাম হোসাইন (আ.) এবং আবদুল্লাহ বিন জাফরের জন্য প্রচুর পরিমাণে উপঢৌকন পাঠাত । আর তারাও যেহেতু নিজেদেরকে বায়তুল মালের হকদার মনে করতেন তাই ঐসব উপঢৌকন গ্রহণ করতেন এবং উপযুক্ত জায়গায় সেগুলো খরচ করতেন ।11

মুয়াবিয়া নিজেকে নবীর পরিবারের ভক্ত হিসেবে দেখানোর জন্য মৃত্যুর সময়ে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপারে অসিয়ত করেছিল যে ,যদি ইমাম আন্দোলন করেন তাহলে যেন তাঁকে হত্যা করা না হয় ।12

মুয়াবিয়ার এ রকম রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট । কারণ ,সে ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে সন্ধি করে নিজের খেলাফতকে বৈধতা না থাকার সংকট থেকে মুক্তি দান করে এবং মানুষের মাঝে নিজেকে বৈধ খলীফা হিসেবে পরিচিত করায় । আর সে চাইত না যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করার মাধ্যমে সে মুসলিম সমাজে ঘৃণিত হোক । এর বিপরীতে সে চেষ্টা করত যে ,নবীপরিবারের প্রতি লোকদেখানো ভালোবাসা প্রদর্শন করার মাধ্যমে মুসলমানদের কাছে নিজের সুনাম বজায় রাখা ।

আর সে ভাবত যে ,এভাবে সে নবীর বংশধরদের নিজের প্রতি ঋণী করছে । ফলে তারা তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে তার অনুগত হয়ে যাবে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা থেকে বিরত থাকবে । একবার সে ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে বিপুল পরিমাণে উপঢৌকন পাঠিয়ে খোঁটা দিয়ে বলেছিল , এ উপহারগুলো গ্রহণ কর ,আর জেনে রাখ যে ,আমি হিন্দার ছেলে । খোদার শপথ ,এর আগে কেউ তোমাদেরকে এ রকমভাবে দান করেনি । আর আমার পরেও কেউ তোমাদেরকে এভাবে দান করবে না ।

ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়াকে দেয়া চিঠিতে তার উপঢৌকনগুলো যে করুণা প্রদর্শনের যোগ্যতা রাখে না তা উল্লেখ করে বলেছেন : খোদার শপথ ,তোমার আগের এবং পরের কোন লোকের পক্ষে আমাদের থেকে

শ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত কোন ব্যক্তির কাছে উপহার পাঠানো সম্ভব নয় (কেননা ,নবুওয়াতের গৃহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কোন গৃহ নেই) । 13

মুয়াবিয়া জানত যে ,সে যদি কঠোর নীতি গ্রহণ করে ,তাহলে পরিস্থিতি তার প্রতিকূলে চলে যাবে । পরিশেষে মানুষ মুয়াবিয়ার শাসনের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠবে । আর স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম সমাজ আহলে বাইতের পাশে একত্র হবে ।

ঐ সময়ে মুয়াবিয়া ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পক্ষ থেকে বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করত না । কিন্তু ভবিষ্যতে যেহেতু নবী-পরিবারের পক্ষ থেকে কোন বিপদ না আসতে পারে এজন্য এ রকম কলা-কৌশল অবলম্বন করে চলত যাতে অঙ্কুরেই বিপদের বীজ বিনাশ হয়ে যায় ।

অপর দিকে ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার খেলাফতকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে তোলার জন্য প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতেন । এর সুস্পষ্ট নমুনা হলো মুয়াবিয়াকে লেখা চিঠিতে মুয়াবিয়ার সৃষ্ট বেদআত ও তার কৃত অপরাধের বিবরণ তুলে ধরা14 এবং যুবরাজ হিসেবে ইয়াযীদের মনোনয়নের বিরোধিতা করা ।15 অবশ্য ইমাম হোসাইন (আ.) ভালো করেই জানতেন যে ,যদি তিনি মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন ,তাহলে সাধারণ মানুষ মুয়াবিয়ার রাজনৈতিক কলা-কৌশলের কারণে তাঁর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিবে না । উপরন্তু সরকারি অপপ্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুয়াবিয়াকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করবে ।

চার. তৎকালীন সময়ের মুসলমানদের চিন্তাগত ও সামাজিক অবস্থা

যদিও একদল কুফাবাসী ইমাম হাসান (আ.) শহীদ হওয়ার পর সমবেদনা জ্ঞাপন করে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে চিঠি লিখেছিল এবং নিজেদেরকে ইমামের নির্দেশের অপেক্ষাকারী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল16 ,কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ভালোভাবেই জানতেন যে ,সিরিয়ায় মুয়াবিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং কুফা শহরও উমাইয়া গোষ্ঠীর হাতে চলে গিয়েছে । এছাড়া কুফাবাসী ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে অনেকবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । যখন সমগ্র ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর মুয়াবিয়ার প্রভাব-প্রতিপত্তি বহাল হয়েছে তখন যদি তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাহলে পরাজয় ছাড়া অন্য কিছু ঘটবে না । আর যে স্বল্প সংখ্যক সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে তারাও অযথা নিহত হবে এবং তিনি বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত হবেন । পরিশেষে তিনি কোন ফলাফল ছাড়াই শহীদ হবেন এবং তাঁর রক্ত বৃথা যাবে । কিন্তু ইয়াযীদের শাসনামলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ এর বিপরীত ছিল ।

মদীনায় বিদ্রোহ না করার কারণ

2 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনায় তাঁর আন্দোলন শুরু করেননি ?

উত্তর : এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদেরকে ঐ সময়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে । কারণ ,ইমাম হোসাইন (আ.) যখন মদীনায় ছিলেন ,তখনও মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর চারিদিকে ছড়ায়নি । এছাড়া মানুষ তখন পর্যন্ত মুয়াবিয়া এবং ইয়াযীদের খেলাফতের মধ্যে খুব একটা তফাৎ বুঝতে পারেনি । কারণ ,যদিও বিশেষ কিছু ব্যক্তি ,যেমন ইমাম হোসাইন (আ.) ,আবদুল্লাহ ইবনে যোবায়ের ,আবদুল্লাহ ইবনে উমর ও আবদুর রহমান বিন আবু বকর ইয়াযীদকে শরাবখোর এবং কুকুর ও বানর নিয়ে খেলাকারী হিসেবে জানতেন17 ,তথাপি অধিকাংশ মানুষ মুয়াবিয়ার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অথবা উমাইয়া গোষ্ঠীর প্রলোভন ও হুমকির মুখে মুয়াবিয়ার জীবদ্দশায়ই তার ছেলে ইয়াযীদের হাতে বাইআত করেছিল ।18

এছাড়া সমর্থকের দৃষ্টিতেও স্থান হিসেবে মদীনা আন্দোলন করার জন্য খুব একটা উপযুক্ত ছিল না । কারণ :

এক যদিও মদীনায় অধিকাংশ মানুষ আহলে বাইতকে ভালোবাসত ,তথাপি তাদের ভালোবাসা এ পর্যায়ে ছিল না যে ,আহলে বাইতের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে কিংবা কোন ক্ষতি স্বীকার করবে । আর তারা এর নমুনা খুব ভালোভাবে সকীফা এবং পরবর্তী ঘটনায় দেখিয়েছিল । আশ্চর্যের বিষয় হলো হযরত আলী (আ.) যখন বাইআত ভঙ্গকারীদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য মদীনাবাসীদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন ,তখন তাদের অধিকাংশই হযরত আলী (আ.)-এর ডাকে সাড়া দেয়নি । ফলে হযরত আলী (আ.) চারশ 19 অথবা সাতশ 20 সৈন্য নিয়ে বিরোধী দলের কয়েক হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলেন ।

দুই . মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মদীনাবাসীরা তৎকালীন খলীফার অনুগত ছিল । তারা খলীফা আবু বকর ও উমরের এতই ভক্ত ছিল যে ,নবীর সুন্নাতের পাশাপাশি উক্ত দুই খলীফার সুন্নাতের প্রতি খুবই স্পর্শকাতরতা দেখাতো । যেমন এ দলের প্রতিনিধি আবদুর রহমান বিন আউফ ,উমরের গঠিত শুরা য় (খলিফা মনোনয়ন পরিষদ) উক্ত দুই খলিফার সুন্নাত অনুসরণ করাকে হযরত আলী (আ.)-এর খলীফা হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন । কিন্তু আলী (আ.) এ শর্ত মেনে নেননি ।21 হযরত আলী (আ.) যখন খলীফা হন তখন তাঁর খলীফা হওয়ার পেছনেও মদীনাবাসীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না ;বরং বিভিন্ন শহর থেকে আগত মুসলমানরাই প্রথম হযরত আলী (আ.)-কে খলীফা করার জন্য চাপ দিয়েছিল ।

তিন . ঐ সময়ে মদীনায় কুরাইশ বংশের বিভিন্ন শাখার বিশেষ করে উমাইয়া শাখার মারওয়ান ও তার অনুগতদের প্রভাব ছিল খুব বেশি । আর এটা সুস্পষ্ট ছিল যে ,ইমাম হোসাইন (আ.) যদি আন্দোলন শুরু করতেন ,তাহলে তারা দ্রুত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত ।

চার . ঐ সময়ে মদীনার জনসংখ্যা খুব কম ছিল । অপর দিকে কুফা ,বসরা ও সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল খুবই বেশি । এজন্য মদীনায় অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে একটা বড় আন্দোলন শুরু করা সহজ ছিল না ।

পাঁচ . ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ,কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য মদীনা খুব একটা উপযুক্ত জায়গা ছিল না । কারণ যেসব বিদ্রোহ এ শহরে সংঘটিত হয়েছে তার প্রত্যেকটি পরাজয়ের শিকার হয়েছে । যেমন-63 হিজরিতে মদীনাবাসী ইয়াযীদের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহ করেছিল ,তা কঠোর হস্তে দমন করা হয় ।22 একই রকম ভাবে 145 হিজরিতে23 মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহর (নাফ্সে যাকিয়া) আন্দোলন ও 169 হিজরিতে24 হোসাইন বিন আলী (ইবনে হাসান মুসাল্লাস ইবনে হাসান মুসান্না ইবনে হাসান ইবনে আলী-যিনি শহীদে ফাখ বা ফাখের শহীদ নামে প্রসিদ্ধ) আন্দোলনে মদীনার অল্পসংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করার কারণে দুটি আন্দোলনই পরাজয়ের শিকার হয় ।

ছয় . উমাইয়া শাসনামলে মদীনাবাসী দেখিয়েছিল যে ,তারা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে এবং আহলে বাইতের পক্ষে অবস্থান নিতে রাজী নয় । এর প্রমাণ হলো মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে হযরত আলী (আ.)-কে গালি-গালাজ করার যে রীতি চালু হয়েছিল মদীনাবাসী তার কোন প্রতিবাদ করেনি ;বরং এ শহরের প্রত্যেকটা মসজিদে মিম্বারের ওপর বসে হযরত আলী (আ.)-কে গালি-গালাজ করা হতো । আর মদীনাবাসী মুয়াবিয়ার এ অন্যায় কর্মকে চোখ বুঁজে সহ্য করত । শুধু ইমাম হোসাইন (আ.) এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন ,কিন্তু কেউ তাঁকে সহযোগিতা করত না ।25

সাত . মদীনা শহরে উমাইয়া গভর্নর ওয়ালীদ বিন উতবার খুব প্রভাব ছিল । এজন্য একটা ছোট-খাট আন্দোলনের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা তার হাত থেকে কেড়ে নেয়া সম্ভব ছিল না ।

মক্কায় গমন

3 নং প্রশ্ন : কেন ইমাম হোসাইন (আ.) আন্দোলনের শুরুতেই মদীনা থেকে মক্কা গেলেন ?

উত্তর : ইয়াযীদ মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ বিন উতবার কাছে চিঠি লিখে নির্দেশ দিয়েছিল যে ,বিরোধীদের কাছ থেকে যেন বাইআত নেয়া হয় । আর বাইআত ব্যতিরেকে তাদেরকে যেন ছাড়া না হয় ।26

ওয়ালীদ চেয়েছিল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে নরম ব্যবহার করতে এবং তাঁর রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত না করতে ।27 কিন্তু মদীনায় বসবাসকারী উমাইয়া গোষ্ঠী বিশেষ করে মারওয়ান বিন হাকাম ,যে ছিল ওয়ালীদের প্রধান উপদেষ্টা সে ওয়ালীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করলো যে ,ইমাম হোসাইন (আ.)-কে যেন হত্যা করা হয় । প্রথম ওয়ালীদ যখন ইয়াযীদের চিঠি পেল ,তখন সে মারওয়ানের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করলো । মারওয়ান বলল : আমার মত হলো ,এ মুহূর্তে আলোচ্য ব্যক্তিদেরকে যেন হাজির করা হয় এবং ইয়াযীদের পক্ষে আনুগত্যের শপথ নেয়ার জন্য বাধ্য করা হয় । আর যদি তারা বিরোধিতা করে তাহলে মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর জানার আগেই যেন তাদেরকে হত্যা করা হয় । কারণ ,তারা যদি মুয়াবিয়ার মৃত্যুর খবর জানতে পারে ,তাহলে তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের বিরোধিতার কথা প্রকাশ করবে এবং মানুষকে নিজেদের চারপাশে একত্র করবে । 28

অতএব ,ইমাম হোসাইন (আ.) মদীনার পরিস্থিতি ভালো না থাকায় নিজের বিরোধিতার কথা প্রকাশ এবং আন্দোলন শুরু করার জন্য মদীনা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন । আর মদীনায় বিপদের আশঙ্কা থাকায় সেখানে কোন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকেন । আর মদীনা ত্যাগের সময় ইমাম হোসাইন (আ.) যে আয়াত তেলাওয়াত করেছিলেন তা থেকে বোঝা যায় ,তাঁর মদীনা ত্যাগের গুরুত্বপূর্ণ করণ ছিল নিরাপত্তার অভাব ।

আবু মিখনাফের মতে ,ইমাম হোসাইন (আ.) 27 রজব অথবা 28 রজব স্বীয় আত্মীয় স্বজনকে সাথে নিয়ে মদীনা ত্যাগের সময় সেই আয়াতটি তেলাওয়াত করছিলেন যা মূসা (আ.) নিরাপত্তার অভাবে মিশর ত্যাগের সময় তেলাওয়াত করেছিলেন29 :

) فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِين (

তাকে পশ্চাদ্ধাবন করা হবে এ ভীতি ও আশঙ্কা নিয়ে তিনি শহর থেকে বের হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন : হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এ অত্যাচারী জাতির হাত থেকে রক্ষা করুন । 30

ইমাম হোসাইন (আ.) এমন এক অবস্থায় মক্কায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন যখন অধিকাংশ মানুষ মুয়াবিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে ছিল অনবহিত (কেননা ,মুয়াবিয়া 15 অথবা 22 রজব মারা যায় আর ইমাম হোসাইন 27 রজব মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন) । আর তাই ইয়াযীদের বিরুদ্ধে তখনও প্রকাশ্যে বিরোধিতা শুরু হয়নি এবং কোন শহর থেকে ,এমনকি কুফা থেকেও (পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাপেক্ষে) কোন চিঠি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছেনি । এজন্য ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হিজরতের জন্য এমন একটি জায়গা বাছাই করতে হতো যেখানে তিনি প্রথমত কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে এবং নিরাপত্তার মধ্যে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন । আর দ্বিতীয়ত ইসলামী ভূখণ্ডের প্রতিটি অঞ্চলে নিজের চিন্তাধারা পৌঁছে দেয়ার জন্য ঐ জায়গাটি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন ।

উপরিউক্ত দুটি বৈশিষ্ট্যই মক্কা শহরের ছিল ।

কারণ ,তখনও পর্যন্ত মক্কা ছিল তাঁর জন্য আপাত নিরাপদ স্থান । এছাড়া এ শহরে কাবা শরীফ থাকায় এবং হজ ও উমরা পালন করার জন্য ইসলামী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানদের আগমনের কারণে ইমাম হোসাইন (আ.) খুব সহজে বিভিন্ন দলের সাথে দেখা করে তাদেরকে উমাইয়া শাসকদের সাথে নিজের বিরোধিতার কথা জানাতে পারতেন । আর এভাবে ইসলামী শহরসমূহ বিশেষ করে কুফা ও বসরার31 বিভিন্ন দলের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতেন ।

ইমাম হোসাইন (আ.) 60 হিজরির 3 শাবান শুক্রবার রাতে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং 8ই যিলহজ পর্যন্ত এ শহরে স্বীয় কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন ।32


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25