মুক্তির পথে

মুক্তির পথে30%

মুক্তির পথে লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

মুক্তির পথে
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 34 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 17332 / ডাউনলোড: 3761
সাইজ সাইজ সাইজ
মুক্তির পথে

মুক্তির পথে

লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বাংলা

এ বইটিতে অত্যন্ত শক্তিশালী তাত্ত্বিক আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। কোন অন্ধ অনুকরণ এবং বিশ্বাস সম্পর্কিত উদ্দীপনাময়ী ও চলমান গতানুগতিক আলোচনা এতে স্থান পায়নি বরং গ্রন্থটির সকল আলোচনাই হয়েছে সম্পূর্ণ সত্য এবং সুপ্রমানিত তথ্যসমূহের উপর ভিত্তি করে। আমরা সুস্থ বুদ্ধি ও বিবেককে কখনো বিতাড়িত করি না বরং একই সঙ্গে রাসূল (সঃ) কর্তৃক বর্ণিত দলীলের উপর স্থবির বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানব বুদ্ধিবৃত্তির সমান ব্যবহারের পক্ষপাতি। কেননা তালাবদ্ধ চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্তির চাবি কাঠি হচ্ছে এ বুদ্ধিবৃত্তি। ফলে এরই মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঠিক দিক নির্দেশনা পেতে পারি। সাথে সাথে এ বুদ্ধিবৃত্তি আমাদেরকে এও বলে দেয় যে কোন্ বিষয়টি বিবেক প্রসূত আর কোনটি বিবেক-বহির্ভূত। এ গ্রন্থে বিভিন্ন সহজ বোধগম্য উদাহরণের মাধ্যমে চিন্তার বিকাশ সাধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে যথার্থভাবে ,যেন পরবর্তীতে অন্যান্য চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিবর্গ এ পথে নিজেদের পরিশ্রম ব্যয় করতে এগিয়ে আসেন।

কার্যকারণ

নিঃসন্দেহে বিশ্বজগতের প্রতিটি বস্তুই অপর কোন সত্তার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কথায় প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ রয়েছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ ,আমরা যদি আমাদের বাড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে প্রত্যক্ষ করবো সুপরিকল্পিত সুন্দর একটি গৃহ। তখন যদি বলি এত সুন্দর একটি গৃহ নির্মাণের পেছনে কেউ কাজ করেনি ,এমনিতেই আপন সত্তার বলে নির্মিত হয়েছে তা হলে আমাদের বিবেক-বুদ্ধির ব্যাপারে কেউ সন্দেহ করলে কি অমুলক কিছু হবে ? আমাদের গৃহের যে কোন আসবাপত্রের কথাই ধরুন। গৃহাভ্যন্তরে সজ্জিত সুন্দর একখানা দেয়াল ঘড়ি ,আধুনিক পদ্ধতিতে তৈরী সোফা ইত্যাদির ব্যাপারে যদি কেউ বলে এত সব সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র স্বীয় সত্তা বলে ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রস্তুত হয়েছে তাহলে আপনি তাকে নির্বোধ ,বোকা ও বুদ্ধিহীন বললে কি কোন অন্যায় করবেন ? সব বুদ্ধিমান ব্যক্তিই স্বীকার করবেন যে এ সব প্রতিটি বস্তুর জন্যে নিশ্চয়ই একজন প্রস্তুতকারক রয়েছেন। কেননা কোন কিছুই স্বীয় সত্তায় সৃষ্টি হয়নি। এ সৃষ্টিজগতের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে নিঃসন্দেহে স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হবো যে ,এতসব সুন্দর ,মনোরম ,নিখুত ও শৈল্পিক সৃষ্টি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সৃষ্টি হয়ে যায় নি বরং এ সকল সৃষ্টির পেছনে নিশ্চয়ই কোন কার্যকারণ রয়েছে। এ জগতের পরমাণু থেকে বৃহৎ সৃষ্টি পর্যন্ত প্রতিটি সৃষ্টিই নিখুত এবং চমকপ্রদ। যদি কোথাও আমরা একটা সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর ছবি প্রত্যক্ষ করি তা হলে আমাদের বিবেক ,জ্ঞান ও অবচেতন মন নিঃসন্দেহে একজন ছবি অংকনকারীর কথা ব্যক্ত করতে বাধ্য হবে। আর সে ছবি ও চিত্র যদি আপনার নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয় ও মনোহরিণী আকার ধারণ করে তা হলে নিশ্চয়ই আপনি বলবেন এর স্রষ্টাও একজন সূরুচিসম্পন্ন ও অভিজ্ঞ শিল্পী না হয়ে পারেন না। আপনি যখন একটা সুন্দর গ্রন্থ অবলোকন করেন তখন কি এ পুস্তকের কোন গ্রন্থকার নেই কথাটি ব্যক্ত করেন ? নিশ্চয়ই না। কেননা কোন অস্তিত্বশীল সত্তার জন্যে প্রস্তুতকারকের অস্তিত্বহীনতার ধারণা পাগলের প্রলাপ মাত্র।

এ বিশ্বজগতে প্রতিটি সৃষ্টিই সুন্দর ও আকর্ষণীয়। বিস্তীর্ণ মহাকাশ সুপ্রশস্ত ভূ-পৃষ্ঠ ,সুবিশাল নদ-নদী ,পাহাড়-পর্বত ,বিশাল গ্রহরাজী ও নক্ষত্র মন্ডলী ,বিষ্ময়কর জীব-জন্তু ,মনোরম বৃক্ষরাজী-বনভূমী ও সুন্দর তরুলতা সব কিছুই একটা নির্দিষ্ট কার্যকারণের মাধ্যমে সত্তাশীল হয়েছে। এ প্রসঙ্গে শহীদ ডঃ জাভেদ বাহোনারের বক্তব্য প্রানিধান যোগ্য। তিনি বলেছেন ,কার্যকারণ সন্বন্ধীয় বিধি-বিধান আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে ,প্রত্যেক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পিছনে একটা কারণ থাকে এবং কারণ ছাড়া কোন ঘটনাই ঘটতে পারে না। ...এবং বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার বিশাল অংশ এই দার্শনিক নীতির উপর ভিত্তিশীল। অধিকন্তু কারণ অনুসন্ধান মানুষের সহজাত প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। সে কারণে কোন চিত্রকর্ম ,ভবন অথবা কারো পদচিহ্ন দেখেন কিংবা কোন আওয়াজ শুনতে পেলেই মানুষ তার বোধগম্যতার স্তর যাই হোক না কেন ,ঐ সব ঘটনা সংঘঠনকারী কারণ বা মাধ্যমের অনুসন্ধান করে ,যেন প্রতিটি ঘটনা সংঘটনের কারণ অনুসন্ধান তার পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য লিপি। এ জন্যেই মানুষ এই বিশ্ব জগতে সৃষ্টি ও এর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে যায়।

আল্লাহ্ পাক আল্ কোরআনে বলছেন :

( سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ)

অর্থাৎ : আমি (আল্লাহ্) অচিরেই তাদেরকে প্রান্ত স্থানসমূহে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আমার নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করাবো যেন তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে সেটা সুনিশ্চিত সত্য। (সূরা ফুসসিলাত ,আঃ ৫৩ )

শৃঙ্খলীয় প্রমাণ

সৃষ্টিজগতের সকল ক্ষেত্রে একটি সুষম বিন্যাস ,শৃঙ্খলা ,সমন্বয় ,সামঞ্জস্যতা এবং ভারসাম্য বিদ্যমান। দিন-রাতের পালাবদল ,সপ্তাহ মাস ,ও বৎসরের সুপরিকল্পিত ও সুবিন্যস্থ ব্যবস্থা ,ঋতুসমুহের সঠিক নিয়ম ও পরিচালনা ,সবকিছুই একটি নিশ্চিত ব্যপারে বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করে যে ,এ বিশ্বজগত শৃঙ্খলাবব্ধ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্রিয়াশীল।

সিসিল বাইক হাইম্যান (Cecil Boyce Hamann ) নামক একজন বিজ্ঞানী তারকারাজীর ব্যপারে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন এভাবে : যদি আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তাহলে তারকারজীর শৃঙ্খলার বিস্ময়কর কার্যাদি পরিদর্শনে অবাক কণ্ঠে চিৎকার ধ্বনি বেরিয়ে আসবে । দিবা -রাত্রি ,ঋতুর পালাবদল ,শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে অস্তিত্বমান আসমানের রশ্মিগুলোসহ সবকিছু এক নির্দিষ্ট পথে ঘূর্ণায়মান। এরা এতই সুশৃঙ্খলাবদ্ধভাবে তাদের নিজ নিজ কক্ষে আবর্তিত হচ্ছে যে কয়েক শতাব্দি পূর্বে বর্তমান সময়ের সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের সময় নির্ধারণ করা সম্ভব।

এর পরও কি কেউ বলতে পারে যে ,গ্রহ-নক্ষত্র কোন একটি দূর্ঘটনার ফলাফল ,আর তারা নিজ কক্ষপথ ভুলে দিকবিদিক ছোটাছুটি করছে ? যদি নক্ষত্ররাজীর কক্ষপথ অনির্দিষ্ট এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা বহির্ভূত হতো তা হলে কিভাবে মানুষ মহাসমুদ্র ,শুস্কমরুভূমি ও নাম-নিশান বিহীন পথঘাটগুলোতে তারকার ঘূর্ণাবর্তের মাধ্যমে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হতো ? যারা মহাপরাক্রমশালী বিধাতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন তারাও এ ব্যপারে একমত যে ,মহাকাশের রশ্মিসমূহের আবর্তন এক নির্দিষ্ট শক্তির অনুসরণ করে চলছে । তাই নক্ষত্রমণ্ডলী কখনও দূর্ঘটনাক্রমে আপন কক্ষপথ থেকে বেরিয়ে শ ূন্যাকাশে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘূর্ণন করতে পারে না। এতসব শৃঙ্খলা ও বিন্যাস ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগ্রত হয় ,কে এ সব কিছুর পরিচালক ,নির্মাতা ও শৃঙ্খলাদানকারী ? আমরা যদি কোন স্কুলের ব্যাপারে শুনি যে ,ঐ স্কুলের ছেলে-মেয়েরা একটি নির্দিষ্ট রংয়ের পোশাক পরিধান করে স্কুলে আগমন করে এবং সঠিক নিয়ম-নীতি মেনে চলে আর সকলে খুব সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ ,তারা সবাই শিক্ষকের নির্দেশ মোতাবেক স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকে তা হলে এটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হবে না যে ঐ স্কুলে নিশ্চয়ই একজন নীতিবান ও বিজ্ঞ শিক্ষক ও পরিচালক রয়েছেন।

বিশ্বব্যবস্থার সকল দিকগুলো বিবেচনা করলে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবো যে ,এ বিশ্বের সকল কিছু শৃঙ্খলাধীন সুনিয়ন্ত্রিত। এর মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি প্রত্যক্ষ করবে না কেউ। সবাই আপন দায়িত্ব পালনে ক্রটিহীন। স্বভাবতঃ-ই মনে প্রশ্ন জাগ্রত হয় ,এতসব কিছুর একজন ব্যবস্থাপক ছাড়াই কি পরিচালিত হচ্ছে ?

সৌরজগতের সর্ববৃহৎ গ্রহ হচ্ছে সূর্য। সূর্যের আয়তন পৃথিবীর চেয়ে ৩ ,৩০ ,০০০ গুণ বড়। সৌরজগত হচ্ছে ছায়া পথের একটি অংশ। এতে অন্তঃত এক বিলিয়ন সূর্য আছে যার অধিকাংশই আমাদের সূর্যের ওজনের চেয়ে অনেক বেশী। জ্যোর্তিষবিদগণ বলেন ,আমাদের ছায়াপথের ন্যায় একলক্ষ ছায়াপথ বিশ্বজগতে বিদ্যমান।

আবার ভূ-মণ্ডল বিশ্বজগতের এমন একটি গ্রহ যেখানে সর্বত্র ভারসাম্য বিরাজমান এবং এর নিজের চতূর্দিকে প্রতিনিয়ত ঘূর্ণায়নমান। যার ফলে দিবা-রাত্রির উদ্ভব হয়েছে। তারপরও সূর্যের চতূদির্কে বাৎসরিক অবস্থান পরিবর্তন অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থান পরিবর্তনের কারণেই ভারসাম্য ও ভূমণ্ডলের কেন্দ্রীয় অবস্থান সর্বদা সংরক্ষিত রয়েছে। এ ধরনের সুবৃহৎ ও সুশৃঙ্খল সৃষ্টি ব্যবস্থা কি কোন মহাক্ষমতাবান প্রস্তুতকারকের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে না ? হ্যাঁ তিনিই সর্বশক্তিমান মহাপরিচালক। তার সার্বভৌমতা ও শাসন ক্ষমতার পরিধির কোন সীমারেখা অংকন করা সম্ভব নয়। ইসলাম ধর্মে তিনিই আল্লাহ নামে অভিহিত।

মানব-প্রকৃতি ও সত্যান্বেষী স্বভাব

এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের বিভিন্ন পথ রয়েছ। দার্শনিকগণ তাদের দর্শনের প্রমাণ করে থাকেন। আরেফ ও আধ্যাত্মি ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ প্রমাণাদিও আমাদের সমক্ষে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু এ সকল পথের মধ্যে সবচেয়ে সহজ ও সরল পথ-যা অতিক্রম করলে সহজে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব ,তা হলো আমাদের সহজাত প্রবৃত্তির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ। আমাদের প্রকৃতগত স্বভাব এমন একটি বিষয় যা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। আরাবীতে এই স্বভাবজাত শব্দটি ফিত্রাত (فطرة ) নামে পরিচিত এবং এর ইংরাজী প্রতিশব্দ হচ্ছেNature যা সর্বকালে ,সর্বস্থানে ও সব মানুষের মাঝে সমানভাবে বিরাজমান। মা তার সন্তানকে ভালবাসেন। নবজাত শিশুকে শিখিয়ে দিতে হয় না যে ,এটি তোমার মা। তাই মায়ের প্রতি সন্তানের আকর্ষণ মানবীয় স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম। তদ্রূপ স্রষ্টা অন্বেষণের মনোভাব প্রতিটি মানুষের একটি প্রকৃতিগত ব্যাপার। প্রতিটি মানুষের অন্তঃকরন খোদা অন্বেষী। মানুষ কৌতুহলী মনোভাব নিয়ে ছুটে চলে এ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তার সন্ধানে। এ কাজটি কাউকে শিখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। মানুষ স্বতঃষ্ফুর্তভাবে নিজেকে যে কোন এক মহাশক্তির অধীনে অবনত রাখতে ইচ্ছুক। আর স্বভাবতঃই এ ধরনেরই এক খোদা অন্বেষণী ঝংকার মনের একান্ত নিবিড়ে প্রতিটি স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষের অন্তকরণ থেকে বেজে উঠে।

সত্যান্বেষী আকাঙ্খা মানুষের সহজাত প্রকৃতিরই অন্তর্ভূক্ত। সাধারণভাবে কোন মানব হৃদয়ই এ অনুভূতি শূন্য নয়। প্রতিটি মানব মনই সর্বদা সকল বিষয়ের মূল উৎস উদঘাটন করতে বদ্ধপরিকর। জ্ঞান অন্বেষনের ব্যাপারে সে স্বভাবতঃই কৌতুহলী। প্রয়োজনে জ্ঞান পিপাসা মিটানোর জন্যে মানুষ যে কোন কষ্ট স্বীকার করে নিতেও কুন্ঠাবোধ করে না। আর এ কারনেই মানুষ তার আত্মপরিচিতির ব্যাপারে স্বীয় বিবেক প্রসূত যে সকল প্রশ্ন থাকে তাহলো ,আমরা কোথা থেকে এসেছি ? কি আমাদের দায়িত্ব ? মানুষের মৌলিক ও স্বভাবজাত প্রসূত জিজ্ঞাসা। কেননা উপরোক্ত প্রশ্নগুলো তার স্বভাবজাত কৌতুহলী মনোভাব থেকেই জন্ম নিয়েছে। মনীষীগণ বলেন : বর্ণ ,গোত্র ,ধর্ম নির্বিশেষে মানুষকে যদি তার স্বীয় অবস্থার উপর ছেড়ে দেয়া হয় আর যদি বিশেষ কোন মতবাদের শিক্ষা-দীক্ষা না পায় এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অভিপ্রায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে তাহলে সে আভ্যন্তরীন তাড়না থেকেই নিঃসন্দেহে কোন মহাশক্তিশালী সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন অনুভব করবে। এ ধরনের ব্যক্তি তার বিবেকের গভীরে এমন এক ধরনের সুপ্ত আওয়াজ অনুভব করে ,যা তাকে এ বিশ্বজগতের সূচনাকারী মহান স্রষ্টার প্রতি অণুরাগী করে তোলে। ইসলামে এ ধরনের মহাশক্তির নাম হচ্ছে আল্লাহ্ । মনোবিজ্ঞানীরা বিশ ্বাস করেন যে ,প্রধানতঃ আল্লাহর উপাসনা স্বাধীনভাবে মানুষের সহজাত প্রকৃতি থেকেই উদ্ভব হয়েছে। এটা মানব প্রকৃতিরই দাবী। তাই ,মানব সভ্যতার ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা দেখতে পাই মানুষ সর্বদা কোন না কোন শক্তির প্রতি নিজেকে সমর্পন করেছে এবং তাকে সৃষ্টিকর্তা বলে পূজা-অর্চনা করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে লক্ষ্য করা যায় ,আল্লাহর উপাসনা-ইবাদত সর্বকালে ,সর্বস্থানে বিভিন্ন রূপে মানুষের মাঝে বিরাজমান ছিল। আর মানুষের মাঝে এ একই ধরনের অনুভূতি ও মনোভাব যা তাকে সর্বদা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী করে রাখে তা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে এ বিষয়টা মানুষের স্বভাবপ্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত। এ জন্যে অন্য কোন দার্শনিক প্রমানের প্রয়োজন হয় না মোটেও। প্রশ্ন হতে পারে খোদা অন্বেষণ মানব প্রকৃতির অংশ হলে পৃথিবীতে নাস্তিকতার অবস্থান বিদ্যমান কেন ? হ্যাঁ ,খোদা অন্বেষী মনোভাব মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। যদিও তা সবার মধ্যে সমপরিমাণ বিরাজমান নয়। কেননা ,যারা বিভিন্ন রকমের শিক্ষা ,প্রচার ও পরিবেশের শিকার তারা এ শিক্ষা ,অপপ্রচার ও দূষিত পরিবেশের মাঝে বৃদ্ধিলাভ করেছে। তাই তাদের ফিত্রাত সে সব শিক্ষা ও প্রচারের মোটা কালো আবরণে ঢেকে গেছে। তাদের অন্তরচক্ষু থাকলেও বুদ্ধিবৃত্তির সাথে এমন একটি বাল্বের তুলনা করা যায় যা একটি মোটা কালো কাপড় দিয়ে পেচিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর সুইচ অন্ থাকার পরও সে বাল্ব আলো বিতরণ করতে পারছে না। কিন্তু যখনই এই অপপ্রচার ও অপসংস্কৃতির কালো পর্দা তাদের মন ও হৃদয় থেকে সরিয়ে নেয়া হবে তখনই তা একটি শক্তিশালী বাল্বের ন্যায় আলো বিকিরণ করতে সক্ষম হবে। তাদের বিবেকই তখন ব্যক্ত করবে -নিশ্চয়ই এ বিশ্ব জগতের কোন সৃষ্টিকর্তা আছেন যিনি সর্বশক্তিমান ,সর্বজ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ।

অস্তিত্ব বিভক্তির প্রমাণ

বুদ্ধিভিত্তিক দৃষ্টিকোন থেকে আমরা অস্তিত্বসমূহকে তিন ভাগে বিভক্ত করতে পারি। কেননা আমরা যখনই অস্তিত্বের প্রকারভেদ নিয়ে চিন্তা করি তখন সেটা হয় তার জাত সত্তার সাথে সম্পৃক্ত হবে নতুবা অসম্পৃক্ত।

সুতরাং : যদি কোন অস্তিত্বের ধারণা করে তাকে তার জাতসত্তার সাথে সংযোগ করানো না যায় তাহলে এ ধরণের কোন সত্তা কখনো সত্তাশীল হতে পারে না। দর্শনের পরিভাষায় এটাকেই বলা হয় :

১. অসম্ভাব্য অস্তিত্ব (মুমতানেউল উজুদ) অপরদিকে যে অস্তিত্বকে তার জাতসত্তার সাথে সম্পৃক্ত করা যায় সেটা আবার দু ভাগে বিভক্ত।

যে অস্তিত্ব কখনো তার জাতসত্তা থেকে পৃথক হয়ে অনস্তিত্বে পরিণত হয়ে যেতে পারে সে সত্তার নাম দর্শনের পরিভাষায় বলা হয় :

২. নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা (মুমকিনুল উজুদ) এবং যে সত্তা কখনো তার জাত থেকে পৃথক হতে পারে না দর্শনের ভাষায় বলা হয় :

৩. স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী সত্তা (ওয়াজিবুল উজুদ) অতএব সত্তাশীল সকল অস্তিত্বকে দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

(১) নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা

(২) স্বাধীন অবশ্যম্ভাবী সত্তা

বস্তজগতের সকল সত্তাই বস্তুগত নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তা। নিম্নে বস্তুগত নির্ভরশীল সম্ভাব্য সত্তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা গেল :

(ক) পরিবর্তন ,পরিবর্ধন ,সংযোগ ,বিয়োগ ইত্যাদি।

(খ) অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্ব আসা আবার অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে ফিরে যাওয়া।

(গ) এ ধরনের অস্তিত্বের জন্যে অস্তিত্বশীলতা ও অস্তিত্বহীনতা উভয়ই সমান। একটি অপরটির উপর কোন প্রকার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বরং এ দু টির সম্ভাবনা সর্বদা সমানভাবে বিরাজমান।

(ঘ) অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব ,অবশ্যই কোন নির্দিষ্ট কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল। কোন কারণ ছাড়া এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে না। আর স্বাধীন অবশ্যাম্ভাবী সত্তার বৈশিষ্ট্যাবলী যেমন : আদি অন্তহীনতা ,সর্বদা বিরাজমান ,সকল কারণের মূল কারণ ,আদিসত্তা ইত্যাদি।

প্রাকৃতিক জগতের সবকিছুই কোন এক সময় সৃষ্টি হয় পরিশেষ আবার তা ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ সকল বস্তুগত সত্তা-ই কোন এক সময়ে অস্তিত্ব লাভ করেছে আবার একটা নির্দিষ্ট সময়ে তা অনস্তিত্বে প্রত্যাবর্তীত হয়ে যায়। মোট কথা সর্বদা পরিবর্তন ও রূপান্তরের আবরণে আবৃত থাকে বস্তুগত সত্তা। তাই এ সকল অস্তিত্ব হচ্ছে সম্ভাব্য নির্ভরশীল মুখাপেক্ষী সত্তা। সবটুকুই কোন নির্দিষ্ট কার্যকারণের উপর নির্ভরশীল ,স্ব-প্রচেষ্টায় বস্তুসত্তা অস্তিত্ব লাভ করতে পারে না কখনো।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে তাহলে সৃষ্টিজগতের মূল কারণ কে ? এর উত্তরে যদি বলা হয় এ সকল সৃষ্টির পেছনে কোন কার্যকারণ ছিল না তা হলে উত্তরদাতা দর্শনশাস্ত্রের সে সুপ্রমাণিত নীতিরই বিরুদ্ধাচারণ করলেন ,যেখানে বলা হয়েছে সব ফলাফলের পেছনে একটি নির্দিষ্ট কার্যকারণ বিদ্যমান। আবার যদি বলা হয় বস্তুনিচয়ের সৃষ্টির কারণ তারা নিজেরাই অর্থাৎ প্রকৃতি নিজেই তার সৃষ্টিকারক ,তাহলে নিদারুণ সত্যেরই অবমাননা করা হবে। কেননা ,বস্তু নিজের সৃষ্টির পূর্বে স্রষ্টার রূপ ধারণ করতে পারে না কিছুতেই। এ ধরনের উত্তর আমাদের নিরেট বুদ্ধিবৃত্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না মোটেও । কি করে অনস্তিত্ব ,অস্তিত্বের প্রবর্তক হতে পারে ? আবার যদি বলা হয় সৃষ্টি বস্তুর স্রষ্টা অপর কোন বস্তুগত সত্তা তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় ,তার সৃষ্টিকর্তা কে ? কেননা সকল বস্তুগত সত্তাই অন্য কোন সত্তার বলে সৃষ্টি হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যদি অপর কোন সম্ভাব্য নির্ভরশীল বস্তুগতসত্তার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করা হয় তাহলে এ ধরনের প্রশ্ন অবিরাম চলতেই থাকেব। আর কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি এ অসমাপ্ত চেইনটির এরূপ অবস্থান মেনে নিতে পারেন না। কারণ ,যদি কোথাও গিয়ে এর প্রশ্ন শেষ না হয় তা হলে বস্তুজগতের অস্তিত্ব ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।

অতএব ,নিঃসংকোচে আমাদের এমন এক সত্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যিনি সকল সৃষ্টির পূবেই অস্তিত্বমান ,যার মাধ্যমে কার্যকারণের অসমাপ্ত চেইনের হবে পূর্ণতা লাভ। যিনি সর্বপ্রথম ,আদিসত্তা ,শাশ্বত। তিনি হলেন অপরিহার্য সত্তা । তিনি আপন থেকেই অস্তিত্বমান ও আবির্ভূত যার কোন সূচনা নেই ,সূচনা তারই সৃষ্টি।

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার পরিচয়

বিজ্ঞান ঈমানের অগ্রদুত।

মানুষের জ্ঞান স্বল্প ও সীমিত।

আল্লাহর অস্তিত্ব বিজ্ঞানের পথধারার ঊর্দ্ধে।

বিশ্ব-প্রকৃতির সূচনাকাল বিদ্যমান।

প্রাকৃতিক বিশ্বে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত।

উদ্ভিদ জগতে শৃঙ্খলা।

এটোমের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা।

অতি ক্ষুদ্রতম অণু কোষের ভিতর শৃঙ্খলা।

মৌলিক পদার্থের ছকে যথার্থ হিসেব ও শৃঙ্খলা।

নভোপুঞ্জ এবং পৃথিবীর কল্পনাতীত বিশালতা।

কয়েকটি আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত।

দুর্ঘটনা নাকি কোন মহাশক্তির পরিচালনা ?

কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রবেশ

হুর বিন ইয়াযীদ ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কুফায় যাওয়ার পথে বাধা দিলে তিনি থেমে যান। এরপর তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন , হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা [মদীনা] থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং 61 হিজরির 2রা মহররমের দিন বুধবার অথবা মঙ্গলবার কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,

লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ পর্যন্ততা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটি-কয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন , এটি কি কারবালা ?

লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন , এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামের স্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের চিঠি

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর ইমাম হোসেইন (আ.)-কে একটি চিঠি প্রদান করে যা নিম্নরূপ: আম্মা বা আদ , হে হোসেইন , আমাকে জানানো হয়েছে যে , তুমি কারবালায় থেমেছো। ইয়াযীদ আমাকে লিখেছে , আমি যেন বিছানায় মাথা না রাখি এবং সন্তুষ্ট না হই যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে পাঠাচ্ছি , অথবা তুমি আমার কাছে এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সালাম।

যখন এ চিঠি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলো , তিনি তা পড়লেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন , যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজে সে কখনোই সফলতা লাভ করে না। দূত তাকে চিঠির উত্তর দিতে বললে ইমাম বললেন , তার জন্য কোন উত্তর নেই , আছে গযব [আল্লাহর]।

আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী

[ ইরশাদ গ্রন্থে আছে ] ইমাম হোসেইন ( আ .) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ( আ .) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আম্মা বা আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি ( যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে ) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।

এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন , আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন। হযরত আব্বাস বিন আলী ( আ .) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসর ণ করলেন।

ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য। তারা বললেন , সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা ( এ অভিযোগের মুখে ) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক ( যদি বেঁচে থাকি ) ।

হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে নবণার্ করেছেন যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম আলী আল-যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন , হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো। এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়-স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো , আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ , আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ পর্যন্তনা আমরা আপনার জন্য কোরবান হই। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তারা বললেন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে [বেহেশতে] থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ? ইমাম বললেন , আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন। এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন।

তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন , আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ? তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখো ?

ক্বাসিম বললেন , মধুর চেয়ে মিষ্টি।

ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার [শিশু] সন্তান আব্দুল্লাহকেও [আলী আসগার] শহীদ করা হবে।

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর খোতবা

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) একটি খোতবায় বলেন: আম্মা বা আদ , বিবেচনা করো আমার পরিবার সম্পর্কে এবং গভীরভাবে ভাবো আমি কে , এরপর নিজেরদের তিরস্কার করো। তোমরা কি মনে করো যে আমাকে হত্যা করা এবং আমার পবিত্রতা ও সম্মান লুট করা তোমাদের জন্য বৈধ ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি , তার ওয়াসী ও তার চাচাতো ভাইয়ের সন্তান নই , যিনি ছিলেন বিশ্বাস গ্রহণে সবার আগে এবং সাক্ষী ছিলেন সে সবকিছুর ওপরে যা মহানবী আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন ? শহীদদের সর্দার হামযা কি আমার পিতার চাচা ছিলেন না ? জাফর , যিনি বেহেশতে দুপাখা নিয়ে উড়েন , তিনি কি আমার চাচা নন ? নবীর হাদীস কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি যেখানে তিনি আমার সম্পর্কে ও আমার ভাই সম্পর্কে বলেছেন : আমরা দুজন জান্নাতের যুবকদের সর্দার ? তাই যদি আমি যা বলছি তার সাথে একমত হও , এবং নিশ্চয়ই আমি যা বলেছি তা সত্য ছাড়া কিছু নয় , তাহলে তা উত্তম , কারণ আল্লাহর শপথ , যে সময় থেকে আমি বুঝেছি আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপছন্দ করেন তখন থেকে আমি কখনোই কোন মিথ্যা বলি নি। আর যদি তোমরা আমি যা বলছি তা বিশ্বাস না কর , তাহলে তোমাদের মাঝে নবীর জীবিত সাহাবীগণ আছে , তাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস কর এবং তারা আমার বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারি , আবু সাঈদ খুদরি , সাহল বিন সাদ সা য়েদি , যায়েদ বিন আরক্বাম এবং আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস কর , তারা তোমাদের বলবে যে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এ হাদীসটি শুনেছে। এটি কি তোমাদের জন্য আমার রক্ত ঝরানোর চাইতে যথেষ্ট নয় ?

তখন অভিশপ্ত শিমর বিন যিলজাওশান বললো , আমি আল্লাহর ইবাদত করি ঠোঁট দিয়ে এবং তুমি যা বলছো তা আমি বুঝি না। এ কথা শুনে হাবীব বিন মুযাহির [ইমামের সাথী] বললেন , আমি দেখছি তুমি আল্লাহর ইবাদত করো সত্তুর ধরনের সন্দেহ নিয়ে এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি সত্য কথা বলেছো এবং তুমি বুঝতে পারো না ইমাম যা বলেন , কারণ আল্লাহ তোমার হৃদয়ের ওপরে একটি [মূর্খতার] মোহর মেরে দিয়েছেন।

ইমাম বললেন , যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর , তোমরা কি এতেও সন্দেহ কর যে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি ? আল্লাহর শপথ , পূর্বে ও পশ্চিমে , আমি ছাড়া নবীর কোন নাতি নেই তোমাদের মধ্যে অথবা অন্যদের মধ্যে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য , আমি কি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করেছি যে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও ? অথবা আমি কি কারো সম্পদ বেদখল করেছি , অথবা কাউকে আহত করেছি যার প্রতিশোধ তোমরা আমার ওপর নিতে চাও ?

যখন কেউ তাকে উত্তর দিলো না , তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে শাবাস বিন রাব ঈ , হে হাজ্জার বিন আবজার , হে ক্বায়েস বিন আল-আশআস , হে ইয়াযীদ বিন হুরেইস , তোমরা কি আমার কাছে চিঠি লিখোনি যে , ফল পেকেছে এবং আশপাশের ভূমিতে ফুল ফুটেছে এবং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে আসুন , যা আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ?

তারা উত্তর দিলো যে তারা এ ধরনের কোন চিঠি লিখেনি। ইমাম বললেন , সুবহানাল্লাহ , আল্লাহর শপথ অবশ্যই তোমরা তা লিখেছিলে।

এরপর তিনি বললেন , হে জনতা , এখন যদি তোমরা আমার আগমনকে পছন্দ না কর , তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও যেন আমি কোন আশ্রয়ের জায়গায় চলে যেতে পারি।

ক্বায়েস বিন আল-আশআস বললো , তুমি যা বলছো তা আমরা জানি না , আমার চাচাতো ভাইদের [বনি উমাইয়ার] কাছে আত্মসমর্পণ কর , তারা তোমার সাথে সেভাবে আচরণ করবে যেভাবে তুমি চাও। ইমাম বললেন , আল্লাহর শপথ , নিকৃষ্ট মানুষের মতো আমি তোমাদের হাতে হাত দিবোনা , না আমি পালিয়ে যাবো কোন দাসের মতো।

এরপর তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর দাসেরা ,

) و َإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَن تَرْجُمُونِ(

নিশ্চয়ই আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় নিচ্ছি ,পাছে তোমরা আমাকে পাথর মারো [হত্যা করো]। [সূরা দুখান: 20]

) إ ِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَّا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ(

আমি আশ্রয় নিই আমার ও তোমাদের রবের কাছে , প্রত্যেক দাম্ভিক থেকে , যে হিসাব দিনে বিশ্বাস করে না। [সূরা মু মিন: 27]

ইমাম আরো অগ্রসর হলেন এবং তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং তাদের সারিগুলোর দিকে তাকালেন শান্তবৃষ্টির মতো। তিনি উমর বিন সা আদকে কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন এবং বললেন , ধন্যবাদ আল্লাহর প্রাপ্য , যিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে মৃত্যু ও ক্ষয়ের বাড়ি বানিয়েছেন এবং যিনি এর মানুষদেরকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করেন। সে ব্যক্তি ধোঁকা খেয়েছে যে এ পৃথিবীর প্রতারণার শিকার হয়েছে , কারণ যে এর ওপর নির্ভর করে সে তাকে হতাশ করে। যে এখানে আকাঙ্ক্ষা করে সে তাকে রিক্তহস্ত করে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা জড়ো হয়েছো এমন একটি কাজের জন্য যা তোমাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ আনবে। তিনি তোমাদের দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তার ক্রোধে ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমাদের কাছ থেকে তার রহমত সরিয়ে নিয়েছেন। তাই আমাদের রব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর তোমরা হচ্ছো নিকৃষ্টতম দাস। তোমরা আল্লাহকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছো এবং তার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিশ্বাস করেছো। এরপরও তোমরা তার পরিবারকে এবং বংশধরকে আক্রমণ করেছো এবং তাদেরকে হত্যা করতে চাও। [ইরশাদ] শয়তান তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য তোমাদের পথ ও লক্ষ্যের ওপর। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফেরত যাবো। এ এক জাতি যারা বিশ্বাস গ্রহণের পর কুফুরী গ্রহণ করেছে , তাই বিদায় হে অত্যাচারী জাতি।

তখন উমর বিন সা আদ বললো , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তাকে উত্তর দাও , কারণ সে আলীর সন্তান। সে যদি সারা দিন তোমাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য শেষ হবে না , না সে ক্লান্তহবে। তখন শিমর এগিয়ে এলো এবং বললো , হে হোসেইন , তুমি কী বলছো ব্যাখ্যা কর যেন আমরা বুঝতে পারি। ইমাম বললেন , আমার বক্তব্যের মূল কথা হলো যে আমি তোমাদের বলছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং আমাকে হত্যা করো না। কারণ আমাকে হত্যা ও আমার পবিত্রতা ধ্বংস করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কারণ আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর কন্যার সন্তান এবং আমার নানী খাদিজা ( আ .) তোমাদের নবীর স্ত্রী। তোমরা হয়তো আমার নানাকে বলতে শুনে থাকবে যে , হাসান এবং হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।

এরপর তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সবদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলেন , কিন্তু তারা তা শুনতে অস্বীকার করলো। তখন ইমাম বললেন , তোমাদের জন্য দুর্ভোগ , তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা চুপ করছো না এবং আমি যা বলছি তা শুনছো না ? আমি তোমাদেরকে ধার্মিকতার পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে আমাকে মান্য করবে সে প্রজ্ঞাবান হবে। আর যে আমাকে মান্য করবে না সে ধ্বংস হবে। তোমরা সবাই আমার অবাধ্য হচ্ছো এবং আমার কথায় কান দিচ্ছো না। এর কারণ হলো তোমরা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ করেছো এবং তোমাদের হৃদয়গুলোতে মোহর মারা হয়েছে। আক্ষেপ তোমাদের জন্য। তোমরা কি ন্যায়পরায়ণ নও এবং শুনতে অক্ষম ?

কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বক্তব্য

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার উটে চড়লেন [অন্যরা বলেন তার ঘোড়ায়] এবং তাদের ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ ও মর্যাদা বর্ণনা করলেন যা তার প্রাপ্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সালাম পাঠালেন ফেরেশতা , নবী ও রাসূলদের ওপর। তারপর বললেন , হে জনতা , তোমরা যেন ধ্বংস হও , দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো , যদিও তারা তোমাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করে নি , না তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন দয়া ও সদয় আচরণ আশা কর। তোমাদের ওপর শত দুর্ভোগ আসুক। তোমরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো যখন তরবারিগুলো এখনও তাদের খাপে রয়েছে , হৃদয়গুলো শান্তিতে আছে , মতামতগুলো যথাযথভাবে স্পষ্ট এবং ভুল থেকে মুক্ত। কিন্তু তোমরা পঙ্গপালের মতো , যারা যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে এবং মথের [প্রজাপতি] মতো , একজনের ওপর আরেকজন যেমন পড়ে। তোমরা ধ্বংস হও , হে যারা দাসীদের প্রেমিক , যারা দলত্যাগ করেছো , যারা কোরআন পরিত্যাগ করেছো , যারা সঠিক বক্তব্যকে বদলে নিয়েছো , যারা খারাপের স্তম্ভ , হে যারা শয়তানদের দ্বারা উস্কানি পাচ্ছো এবং যারা আসমানী আদেশ ছিন্নকারী , তোমরা তাদের পক্ষ নিচ্ছো এবং আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা তোমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য , যা তোমাদের পিতৃপুরুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা থেকে শাখা বেরিয়েছে। তোমরা নোংরা এবং এর বিস্বাদ ফল যা এর বপনকারীর গলায় আটকে যায় এবং তা অত্যাচারীদের কাছে আনন্দের। সাবধান , এখন অবৈধ পিতার অবৈধ সন্তান [উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ] আমাকে তরবারি কোষমুক্ত করা ও অপমান সহ্য করার মাঝে স্থাপন করেছে এবং আমরা অপমান গ্রহণ করবো তা কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল এবং পবিত্র কোলগুলো যা আমাদের দুধ খাইয়েছে , যারা ভদ্র ও যারা অপমান ঘৃণা করে তারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে , আমরা ঘৃণ্য মানুষদের কাছে মাথা নোয়াবো এবং তারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌরুষের সাথে নিহত হতে। জেনে রাখো , আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যদিও আমার সাথে রয়েছে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং যদিও কিছু ব্যক্তি আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করি , আমার রব এবং তোমাদের রব , কোন জীবিত প্রাণী নেই , যার কপালের চুল তার হাতে নেই। নিশ্চয়ই আমার রব সঠিক পথের ওপরে আছেন। [সূরা হুদ: 56]

হে আল্লাহ , তাদের কাছ থেকে আকাশের বৃষ্টি তুলে নিন এবং তাদেরকে অনাবৃষ্টিতে জড়িয়ে যেতে দিন ইউসুফ (আ.)-এর সময়ের মতো এবং বনি সাকীহর এক ব্যক্তিকে [মুখতার বিন আবু উবায়দা সাক্বাফীকে] তাদের ওপর নিয়োগ দিন , যে তাদের গলায় তিক্ত পেয়ালা ঢেলে দিবে। কারণ তারা মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আপনি আমাদের রব , আপনার ওপরে আমরা নির্ভর করি এবং আপনার দিকেই আমরা ফিরি এবং আপনার সামনেই (সবকিছুর) শেষ।

এরপর তিনি তার উট থেকে নামলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ঘোড়ায় চড়লেন , যার নাম ছিলো মুরতাজায এবং তার সাথীদেরকে সাজাতে শুরু করলেন।

[ মালহুফ গ্রন্থে আছে] উমর বিন সা আদ সামনে এগিয়ে এলো এবং ইমামের সেনাদলের দিকে একটি তীর ছুঁড়লো এবং বললো , সেনাপতির সামনে সাক্ষী থেকো যে আমিই ছিলাম যে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।’’ তখন তার অধীনে যারা ছিলো তারা বিরাট সংখ্যায় তীর ছুঁড়তে লাগলো যা পাখির মত দেখাতে লাগলো। ইমাম তার সাথীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,

আল্লাহ তাঁর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষণ করুন , জাগো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং এ তীরগুলো সেনাবাহিনীর দূত যা আমাদের দিকে আসছে।’’

এরপর তারা আক্রমণ করে এবং ইমামের একদল বিশ্বস্তও পরহেজগার সাথী নিহত হন।

বর্ণনাকারী বলেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) নিজের দাড়ি ধরে বললেন ,

আল্লাহর ক্রোধ চরম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদীদের ওপর যখন তারা বলেছিল তাঁর একটি ছেলে আছে এবং তাঁর রাগ খ্রিষ্টানদের ওপর পড়ে যখন তারা তাঁকে তিন জনের একজন বানিয়েছিল এবং তাঁর ক্রোধ গিয়ে অগ্নি উপাসকদের [মাজুসদের] ওপর পড়েছিল যখন তারা তাঁর পরিবর্তে সূর্য ও চাঁদের ইবাদত করতে শুরু করেছিল এবং এখন আল্লাহর ক্রোধ পড়বে এ সম্প্রদায়ের ওপর যারা একত্রিত হয়েছে নবীর নাতিকে হত্যার জন্য। সাবধান , আল্লাহর শপথ , আমি তাদের আশার সাথে একমত হবো না , যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি আমার রবের সাথে মিলিত হই আমার রক্তে ভিজে।’’

বর্ণিত আছে আমর বিন হাজ্জাজ ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথীদের দিকে অগ্রসর হলো এবং বললো ,‘‘ হে কুফাবাসী , তাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো যারা তোমাদের এবং তোমাদের সম্প্রদায়ের কথা শোনে এবং তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করো না যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং ইমামকে অমান্য করেছে।’’ ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,‘‘ হে আমর বিন হাজ্জাজ , তুমি কি লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো ? আমরা কি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছি , আর তোমরা তার ওপর দৃঢ় আছো ? আল্লাহর শপথ , যখন তুমি তোমার এ খারাপ কাজগুলো নিয়ে মরবে তখন তুমি জানতে পারবে যে , কে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং কে জাহান্নামের [আগুনের] জন্য যোগ্য।’’

কারবালায় ইমাম হোসেইন (আ.)-এর প্রবেশ

হুর বিন ইয়াযীদ ইমাম হোসেইন (আ.)-কে কুফায় যাওয়ার পথে বাধা দিলে তিনি থেমে যান। এরপর তার সন্তানদের , ভাইদের ও আত্মীয়দেরকে নিজের চারদিকে জড়ো করলেন এবং কিছু সময়ের জন্য কাঁদলেন ও বললেন , হে আল্লাহ , আমরা আপনার রাসূলের বংশধর। লোকজন আমাদেরকে আমাদের বাড়িঘর থেকে টেনে বের করেছে এবং আমাদেরকে তাড়া করেছে এবং আমাদেরকে আমাদের নানার জায়গা [মদীনা] থেকে চাপ প্রয়োগ করে বের করে দিয়েছে। বনি উমাইয়া আমাদের উপর অত্যাচার করেছে। হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং এ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।

এরপর তিনি সেখান থেকে অগ্রসর হলেন এবং 61 হিজরির 2রা মহররমের দিন বুধবার অথবা মঙ্গলবার কারবালায় প্রবেশ করলেন। এরপর তিনি তার সাথীদের দিকে ফিরে বললেন ,

লোকজন পৃথিবীর দাস এবং ধর্ম শুধু তাদের মুখের কথা এবং তারা এর যত্ন নিবে যতক্ষণ পর্যন্ততা তাদের জন্য আনন্দদায়ক এবং যখন পরীক্ষার উত্তপ্ত পাত্র এসে যায় তখন থাকে শুধু গুটি-কয়েক ধার্মিক ব্যক্তি।

এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন , এটি কি কারবালা ?

লোকজন উত্তর দিলো , হ্যাঁ। তিনি বললেন , এ জায়গা হলো দুঃখ ও মুসিবতের জায়গা এবং এ জায়গা আমাদের উটগুলোর বিশ্রামের স্থান , আমাদের থামার জায়গা , আমাদের শাহাদাতের জায়গা যেখানে আমাদের রক্ত ঝরানো হবে।

ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের চিঠি

ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া কর্তৃক নিয়োজিত কুফার গভর্নর ইমাম হোসেইন (আ.)-কে একটি চিঠি প্রদান করে যা নিম্নরূপ: আম্মা বা আদ , হে হোসেইন , আমাকে জানানো হয়েছে যে , তুমি কারবালায় থেমেছো। ইয়াযীদ আমাকে লিখেছে , আমি যেন বিছানায় মাথা না রাখি এবং সন্তুষ্ট না হই যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি তোমাকে আল্লাহর কাছে পাঠাচ্ছি , অথবা তুমি আমার কাছে এবং ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ কর। সালাম।

যখন এ চিঠি ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কাছে পৌঁছলো , তিনি তা পড়লেন এবং তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন , যে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি খোঁজে সে কখনোই সফলতা লাভ করে না। দূত তাকে চিঠির উত্তর দিতে বললে ইমাম বললেন , তার জন্য কোন উত্তর নেই , আছে গযব [আল্লাহর]।

আশুরার (দশ মহররম) রাতের ঘটনাবলী

[ ইরশাদ গ্রন্থে আছে ] ইমাম হোসেইন ( আ .) তার সাথীদের রাতের বেলা জড়ো করলেন , ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ( আ .) বলেন যে , আমি তাদের কছে গেলাম শোনার জন্য তারা কী বলেন এবং সে সময় আমি অসুস্থ ছিলাম। আমি শুনলাম ইমাম তার সাথীদের বলছেন ,

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি সর্বোত্তম প্রশংসার মাধ্যমে এবং তাঁর প্রশংসা করি সমৃদ্ধির সময়ে এবং দুঃখ দুর্দশার মাঝেও। হে আল্লাহ , আমি আপনার প্রশংসা করি এ জন্য যে , আপনি আমাদের পরিবারে নবুয়াত দান করতে পছন্দ করেছেন। আপনি আমাদের কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন এবং ধর্মে আমাদেরকে বিজ্ঞজন করেছেন এবং আমাদেরকে দান করেছেন শ্রবণ শক্তি ও দূরদৃষ্টি এবং আলোকিত অন্তর। তাই আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

আম্মা বা আদ , আমি তোমাদের চেয়ে বিশস্ত এবং ধার্মিক কোন সাথীকে পাই নি , না আমি আমার পরিবারের চাইতে বেশী বিবেচক , স্নেহশীল , সহযোগিতাকারী ও সদয় কোন পরিবারকে দেখেছি। তাই আল্লাহ আমার পক্ষ থেকে তোমাদেরকে উত্তমভাবে পুরস্কৃত করুন এবং আমি মনে করি শত্রুরা একদিনও অপেক্ষা করবে না এবং আমি তোমাদের সবাইকে অনুমতি দিচ্ছি স্বাধীনভাবে চলে যাওয়ার জন্য এবং আমি তা তোমাদের জন্য বৈধ করছি। আমি তোমাদের উপর থেকে আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিচ্ছি ( যা তোমরা আমার হাতে হাত দিয়ে শপথ করেছিলে ) । রাতের অন্ধকার তোমাদের ঢেকে দিয়েছে , তাই নিজেদের মুক্ত করো ঘূর্ণিপাক থেকে অন্ধকারের ঢেউয়ের ভেতরে। আর তোমাদের প্রত্যেকে আমার পরিবারের একজনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ো গ্রাম ও শহরগুলোতে , যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের মুক্তি দান করেন। কারণ এ লোকগুলো শুধু আমাকে চায় এবং আমার গায়ে হাত দেয়ার পরে তারা আর কারো পেছনে ধাওয়া করবে না।

এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , সন্তানরা , ও ভাতিজারা এবং আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানরা বললেন , আামরা তা কখনোই করবো না আপনার পরে বেঁচে থাকার জন্য। আল্লাহ যেন কখনো তা না করেন। হযরত আব্বাস বিন আলী ( আ .) সর্বপ্রথম এ ঘোষণা দিলেন এবং অন্যরা তাকে অনুসর ণ করলেন।

ইমাম তখন আক্বীল বিন আবি তালিবের সন্তানদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন , মুসলিমের আত্মত্যাগ তোমাদের জন্য যথেষ্ট হয়েছে , তাই আমি তোমাদের অনমতি দিচ্ছি চলে যাওয়ার জন্য। তারা বললেন , সুবহানাল্লাহ , লোকেরা কী বলবে ? তারা বলবে আমরা আমাদের প্রধানকে , অভিভাবককে এবং চাচাতো ভাইকে , যে শ্রেষ্ঠ চাচাতো ভাই , পরিত্যাগ করেছি এবং আমরা তার সাথে থেকে তীর ছুড়িনি , বর্শা দিয়ে আঘাত করি নি এবং তার সাথে থেকে তরবারি চালাই নি এবং তখন আমরা ( এ অভিযোগের মুখে ) বুঝতে পারবো না কী করবো ; আল্লাহর শপথ , আমরা তা কখনোই করবো না। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের জীবন , সম্পদ ও পরিবার আপনার জন্য কোরবানী করবো। আমরা আপনার পাশে থেকে যুদ্ধ করবো এবং আপনার পাশে থেকে পরিণতিতে পৌঁছে যাবো। আপনার পরে জীবন কুৎসিত হয়ে যাক ( যদি বেঁচে থাকি ) ।

হোসেইন বিন হামদান হাযীনি তার বর্ণনা ধারা বজায় রেখে আবু হামযা সূমালি থেকে বর্ণনা করেন এবং সাইয়েদ বাহরানি বর্ণনার ক্রমধারা উল্লেখ না করেই তার কাছ থেকে নবণার্ করেছেন যে , তিনি বলেছেন: আমি ইমাম আলী আল-যায়নুল আবেদীনকে বলতে শুনেছি , শাহাদাতের আগের রাতে আমার বাবা তার পরিবার এবং সাথীদের জড়ো করলেন এবং বললেন , হে আমার পরিবারের সদস্যরা এবং আমার শিয়ারা [অনুসারীরা] , এ রাতকে ভেবে দেখো যা তোমাদের কাছে বহনকারী উট হয়ে এসেছে এবং নিজেদেরকে রক্ষা করো , কারণ লোকেরা আমাকে ছাড়া কাউকে চায় না। আমাকে হত্যা করার পর তারা তোমাদেরকে তাড়া করবে না। আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত করুন। নিজেদেরকে রক্ষা করো। নিশ্চয়ই আমি আনুগত্য ও শপথের দায়ভার তুলে নিলাম যা তোমরা আমার হাতে করেছো। এ কথা শুনে তার ভাইয়েরা , আত্মীয়-স্বজন ও সাথীরা একত্রে বলে উঠলো , আল্লাহর শপথ হে আমাদের অভিভাবক , হে আবা আবদিল্লাহ , আমরা আপনার সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবো না , তাতে লোকেরা বলতে পারে যে আমরা আমাদের ইমামকে , প্রধানকে এবং অভিভাবককে পরিত্যাগ করেছি এবং তাকে শহীদ করা হয়েছে। তখন আমরা আমাদের ও আল্লাহর মাঝে ওজর খুঁজবো। আমরা আপনাকে কখনোই পরিত্যাগ করবো না যতক্ষণ পর্যন্তনা আমরা আপনার জন্য কোরবান হই। ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই আগামীকাল আমাকে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের সবাইকে আমার সাথে হত্যা করা হবে এবং তোমাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তারা বললেন , সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি আমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন আপনাকে সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন আপনার সাথে শহীদ হওয়ার জন্য। তাহলে কি আমরা পছন্দ করবো না যে আমরা আপনার সাথে উচ্চ মাক্বামে [বেহেশতে] থাকবো , হে রাসূলুল্লাহর সন্তান ? ইমাম বললেন , আল্লাহ তোমাদের উদারভাবে পুরস্কৃত করুন। এরপর তিনি তাদের জন্য দোআ করলেন।

তখন ক্বাসিম বিন হাসান (আ.) জিজ্ঞেস করলেন , আমি কি শহীদদের তালিকায় আছি ? তা শুনে ইমাম আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং বললেন , হে আমার প্রিয় সন্তান , তুমি মৃত্যুকে কিভাবে দেখো ?

ক্বাসিম বললেন , মধুর চেয়ে মিষ্টি।

ইমাম বললেন , নিশ্চয়ই , আল্লাহর শপথ , তোমার চাচা তোমার জন্য কোরবান হোক , তুমি তাদের একজন যাদেরকে শহীদ করা হবে আমার সাথে কঠিন অবস্থার শিকার হওয়ার পর এবং আমার [শিশু] সন্তান আব্দুল্লাহকেও [আলী আসগার] শহীদ করা হবে।

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন ( আ .)- এর খোতবা

আশুরার দিনে ইমাম হোসেইন (আ.) একটি খোতবায় বলেন: আম্মা বা আদ , বিবেচনা করো আমার পরিবার সম্পর্কে এবং গভীরভাবে ভাবো আমি কে , এরপর নিজেরদের তিরস্কার করো। তোমরা কি মনে করো যে আমাকে হত্যা করা এবং আমার পবিত্রতা ও সম্মান লুট করা তোমাদের জন্য বৈধ ? আমি কি তোমাদের নবীর নাতি , তার ওয়াসী ও তার চাচাতো ভাইয়ের সন্তান নই , যিনি ছিলেন বিশ্বাস গ্রহণে সবার আগে এবং সাক্ষী ছিলেন সে সবকিছুর ওপরে যা মহানবী আল্লাহর কাছ থেকে এনেছেন ? শহীদদের সর্দার হামযা কি আমার পিতার চাচা ছিলেন না ? জাফর , যিনি বেহেশতে দুপাখা নিয়ে উড়েন , তিনি কি আমার চাচা নন ? নবীর হাদীস কি তোমাদের কাছে পৌঁছে নি যেখানে তিনি আমার সম্পর্কে ও আমার ভাই সম্পর্কে বলেছেন : আমরা দুজন জান্নাতের যুবকদের সর্দার ? তাই যদি আমি যা বলছি তার সাথে একমত হও , এবং নিশ্চয়ই আমি যা বলেছি তা সত্য ছাড়া কিছু নয় , তাহলে তা উত্তম , কারণ আল্লাহর শপথ , যে সময় থেকে আমি বুঝেছি আল্লাহ মিথ্যাবাদীদের অপছন্দ করেন তখন থেকে আমি কখনোই কোন মিথ্যা বলি নি। আর যদি তোমরা আমি যা বলছি তা বিশ্বাস না কর , তাহলে তোমাদের মাঝে নবীর জীবিত সাহাবীগণ আছে , তাদের কাছে যাও এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস কর এবং তারা আমার বক্তব্যের সত্যতার সাক্ষ্য দিবে। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আনসারি , আবু সাঈদ খুদরি , সাহল বিন সাদ সা য়েদি , যায়েদ বিন আরক্বাম এবং আনাস বিন মালিককে জিজ্ঞেস কর , তারা তোমাদের বলবে যে তারা আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে আমার ও আমার ভাই সম্পর্কে এ হাদীসটি শুনেছে। এটি কি তোমাদের জন্য আমার রক্ত ঝরানোর চাইতে যথেষ্ট নয় ?

তখন অভিশপ্ত শিমর বিন যিলজাওশান বললো , আমি আল্লাহর ইবাদত করি ঠোঁট দিয়ে এবং তুমি যা বলছো তা আমি বুঝি না। এ কথা শুনে হাবীব বিন মুযাহির [ইমামের সাথী] বললেন , আমি দেখছি তুমি আল্লাহর ইবাদত করো সত্তুর ধরনের সন্দেহ নিয়ে এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তুমি সত্য কথা বলেছো এবং তুমি বুঝতে পারো না ইমাম যা বলেন , কারণ আল্লাহ তোমার হৃদয়ের ওপরে একটি [মূর্খতার] মোহর মেরে দিয়েছেন।

ইমাম বললেন , যদি তোমরা এতে সন্দেহ পোষণ কর , তোমরা কি এতেও সন্দেহ কর যে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাতি ? আল্লাহর শপথ , পূর্বে ও পশ্চিমে , আমি ছাড়া নবীর কোন নাতি নেই তোমাদের মধ্যে অথবা অন্যদের মধ্যে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য , আমি কি তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে হত্যা করেছি যে তোমরা তার প্রতিশোধ নিতে চাও ? অথবা আমি কি কারো সম্পদ বেদখল করেছি , অথবা কাউকে আহত করেছি যার প্রতিশোধ তোমরা আমার ওপর নিতে চাও ?

যখন কেউ তাকে উত্তর দিলো না , তিনি উচ্চ কণ্ঠে বললেন , হে শাবাস বিন রাব ঈ , হে হাজ্জার বিন আবজার , হে ক্বায়েস বিন আল-আশআস , হে ইয়াযীদ বিন হুরেইস , তোমরা কি আমার কাছে চিঠি লিখোনি যে , ফল পেকেছে এবং আশপাশের ভূমিতে ফুল ফুটেছে এবং একটি বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে আসুন , যা আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ?

তারা উত্তর দিলো যে তারা এ ধরনের কোন চিঠি লিখেনি। ইমাম বললেন , সুবহানাল্লাহ , আল্লাহর শপথ অবশ্যই তোমরা তা লিখেছিলে।

এরপর তিনি বললেন , হে জনতা , এখন যদি তোমরা আমার আগমনকে পছন্দ না কর , তাহলে আমাকে ছেড়ে দাও যেন আমি কোন আশ্রয়ের জায়গায় চলে যেতে পারি।

ক্বায়েস বিন আল-আশআস বললো , তুমি যা বলছো তা আমরা জানি না , আমার চাচাতো ভাইদের [বনি উমাইয়ার] কাছে আত্মসমর্পণ কর , তারা তোমার সাথে সেভাবে আচরণ করবে যেভাবে তুমি চাও। ইমাম বললেন , আল্লাহর শপথ , নিকৃষ্ট মানুষের মতো আমি তোমাদের হাতে হাত দিবোনা , না আমি পালিয়ে যাবো কোন দাসের মতো।

এরপর তিনি উচ্চকণ্ঠে বললেন , হে আল্লাহর দাসেরা ,

) و َإِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ أَن تَرْجُمُونِ(

নিশ্চয়ই আমি আমার ও তোমাদের রবের কাছে আশ্রয় নিচ্ছি ,পাছে তোমরা আমাকে পাথর মারো [হত্যা করো]। [সূরা দুখান: 20]

) إ ِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُم مِّن كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَّا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ(

আমি আশ্রয় নিই আমার ও তোমাদের রবের কাছে , প্রত্যেক দাম্ভিক থেকে , যে হিসাব দিনে বিশ্বাস করে না। [সূরা মু মিন: 27]

ইমাম আরো অগ্রসর হলেন এবং তাদের সামনে দাঁড়ালেন এবং তাদের সারিগুলোর দিকে তাকালেন শান্তবৃষ্টির মতো। তিনি উমর বিন সা আদকে কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন এবং বললেন , ধন্যবাদ আল্লাহর প্রাপ্য , যিনি এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং একে মৃত্যু ও ক্ষয়ের বাড়ি বানিয়েছেন এবং যিনি এর মানুষদেরকে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তন করেন। সে ব্যক্তি ধোঁকা খেয়েছে যে এ পৃথিবীর প্রতারণার শিকার হয়েছে , কারণ যে এর ওপর নির্ভর করে সে তাকে হতাশ করে। যে এখানে আকাঙ্ক্ষা করে সে তাকে রিক্তহস্ত করে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরা জড়ো হয়েছো এমন একটি কাজের জন্য যা তোমাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ আনবে। তিনি তোমাদের দিক থেকে তার চেহারা ঘুরিয়ে নিয়েছেন এবং তোমাদেরকে তার ক্রোধে ঢেকে দিয়েছেন এবং তোমাদের কাছ থেকে তার রহমত সরিয়ে নিয়েছেন। তাই আমাদের রব হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ , আর তোমরা হচ্ছো নিকৃষ্টতম দাস। তোমরা আল্লাহকে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছো এবং তার রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে বিশ্বাস করেছো। এরপরও তোমরা তার পরিবারকে এবং বংশধরকে আক্রমণ করেছো এবং তাদেরকে হত্যা করতে চাও। [ইরশাদ] শয়তান তোমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং তোমাদেরকে সর্বশক্তিমান আল্লাহকে ভুলিয়ে দিয়েছে। দুর্ভোগ তোমাদের জন্য তোমাদের পথ ও লক্ষ্যের ওপর। নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয়ই আমরা তার কাছে ফেরত যাবো। এ এক জাতি যারা বিশ্বাস গ্রহণের পর কুফুরী গ্রহণ করেছে , তাই বিদায় হে অত্যাচারী জাতি।

তখন উমর বিন সা আদ বললো , তোমাদের জন্য আক্ষেপ , তাকে উত্তর দাও , কারণ সে আলীর সন্তান। সে যদি সারা দিন তোমাদের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকে তার বক্তব্য শেষ হবে না , না সে ক্লান্তহবে। তখন শিমর এগিয়ে এলো এবং বললো , হে হোসেইন , তুমি কী বলছো ব্যাখ্যা কর যেন আমরা বুঝতে পারি। ইমাম বললেন , আমার বক্তব্যের মূল কথা হলো যে আমি তোমাদের বলছি আল্লাহকে ভয় করার জন্য এবং আমাকে হত্যা করো না। কারণ আমাকে হত্যা ও আমার পবিত্রতা ধ্বংস করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। কারণ আমি তোমাদের নবী (সা.)-এর কন্যার সন্তান এবং আমার নানী খাদিজা ( আ .) তোমাদের নবীর স্ত্রী। তোমরা হয়তো আমার নানাকে বলতে শুনে থাকবে যে , হাসান এবং হোসেইন বেহেশতের যুবকদের সর্দার।

এরপর তারা ইমাম হোসেইন (আ.)-কে সবদিক থেকে ঘেরাও করে ফেললো। তিনি তাদের কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করলেন , কিন্তু তারা তা শুনতে অস্বীকার করলো। তখন ইমাম বললেন , তোমাদের জন্য দুর্ভোগ , তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা চুপ করছো না এবং আমি যা বলছি তা শুনছো না ? আমি তোমাদেরকে ধার্মিকতার পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। যে আমাকে মান্য করবে সে প্রজ্ঞাবান হবে। আর যে আমাকে মান্য করবে না সে ধ্বংস হবে। তোমরা সবাই আমার অবাধ্য হচ্ছো এবং আমার কথায় কান দিচ্ছো না। এর কারণ হলো তোমরা তোমাদের পেট হারামে পূর্ণ করেছো এবং তোমাদের হৃদয়গুলোতে মোহর মারা হয়েছে। আক্ষেপ তোমাদের জন্য। তোমরা কি ন্যায়পরায়ণ নও এবং শুনতে অক্ষম ?

কুফাবাসীদের লক্ষ্য করে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর বক্তব্য

সাইয়্যেদ ইবনে তাউস বর্ণনা করেছেন যে , ইমাম হোসেইন (আ.) তার উটে চড়লেন [অন্যরা বলেন তার ঘোড়ায়] এবং তাদের ইশারা করলেন চুপ করার জন্য। এরপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ ও মর্যাদা বর্ণনা করলেন যা তার প্রাপ্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় সালাম পাঠালেন ফেরেশতা , নবী ও রাসূলদের ওপর। তারপর বললেন , হে জনতা , তোমরা যেন ধ্বংস হও , দুর্দশাগ্রস্ত হও। তোমরা উৎসাহের সাথে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলে তোমাদের সাহায্য করার জন্য এবং আমরা তা করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হয়েছি। কিন্তু তোমরা এখন সে তরবারিগুলো কোষমুক্ত করেছো যা আমরা তোমাদের দিয়েছি এবং তোমরা আমাদের জন্য আগুন জ্বালিয়েছো যা আমরা তোমাদের ও আমাদের শত্রুদের জন্য জ্বালিয়েছিলাম। তোমরা তোমাদের শত্রুদের পক্ষ নিয়েছো এবং তাদের সাথে থেকে তোমাদের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হয়েছো , যদিও তারা তোমাদের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করে নি , না তোমরা তাদের কাছ থেকে কোন দয়া ও সদয় আচরণ আশা কর। তোমাদের ওপর শত দুর্ভোগ আসুক। তোমরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো যখন তরবারিগুলো এখনও তাদের খাপে রয়েছে , হৃদয়গুলো শান্তিতে আছে , মতামতগুলো যথাযথভাবে স্পষ্ট এবং ভুল থেকে মুক্ত। কিন্তু তোমরা পঙ্গপালের মতো , যারা যুদ্ধের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়েছে এবং মথের [প্রজাপতি] মতো , একজনের ওপর আরেকজন যেমন পড়ে। তোমরা ধ্বংস হও , হে যারা দাসীদের প্রেমিক , যারা দলত্যাগ করেছো , যারা কোরআন পরিত্যাগ করেছো , যারা সঠিক বক্তব্যকে বদলে নিয়েছো , যারা খারাপের স্তম্ভ , হে যারা শয়তানদের দ্বারা উস্কানি পাচ্ছো এবং যারা আসমানী আদেশ ছিন্নকারী , তোমরা তাদের পক্ষ নিচ্ছো এবং আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো ? হ্যাঁ , নিশ্চয়ই প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করা তোমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য , যা তোমাদের পিতৃপুরুষেরা প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তা থেকে শাখা বেরিয়েছে। তোমরা নোংরা এবং এর বিস্বাদ ফল যা এর বপনকারীর গলায় আটকে যায় এবং তা অত্যাচারীদের কাছে আনন্দের। সাবধান , এখন অবৈধ পিতার অবৈধ সন্তান [উবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ] আমাকে তরবারি কোষমুক্ত করা ও অপমান সহ্য করার মাঝে স্থাপন করেছে এবং আমরা অপমান গ্রহণ করবো তা কখনোই হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তার রাসূল এবং পবিত্র কোলগুলো যা আমাদের দুধ খাইয়েছে , যারা ভদ্র ও যারা অপমান ঘৃণা করে তারা এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে যে , আমরা ঘৃণ্য মানুষদের কাছে মাথা নোয়াবো এবং তারা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে যুদ্ধের ময়দানে পৌরুষের সাথে নিহত হতে। জেনে রাখো , আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো যদিও আমার সাথে রয়েছে অল্প কয়েকজন মানুষ এবং যদিও কিছু ব্যক্তি আমাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে।

নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর ওপর নির্ভর করি , আমার রব এবং তোমাদের রব , কোন জীবিত প্রাণী নেই , যার কপালের চুল তার হাতে নেই। নিশ্চয়ই আমার রব সঠিক পথের ওপরে আছেন। [সূরা হুদ: 56]

হে আল্লাহ , তাদের কাছ থেকে আকাশের বৃষ্টি তুলে নিন এবং তাদেরকে অনাবৃষ্টিতে জড়িয়ে যেতে দিন ইউসুফ (আ.)-এর সময়ের মতো এবং বনি সাকীহর এক ব্যক্তিকে [মুখতার বিন আবু উবায়দা সাক্বাফীকে] তাদের ওপর নিয়োগ দিন , যে তাদের গলায় তিক্ত পেয়ালা ঢেলে দিবে। কারণ তারা মিথ্যা বলেছে এবং আমাদের পরিত্যাগ করেছে। আপনি আমাদের রব , আপনার ওপরে আমরা নির্ভর করি এবং আপনার দিকেই আমরা ফিরি এবং আপনার সামনেই (সবকিছুর) শেষ।

এরপর তিনি তার উট থেকে নামলেন এবং রাসূল (সা.)-এর ঘোড়ায় চড়লেন , যার নাম ছিলো মুরতাজায এবং তার সাথীদেরকে সাজাতে শুরু করলেন।

[ মালহুফ গ্রন্থে আছে] উমর বিন সা আদ সামনে এগিয়ে এলো এবং ইমামের সেনাদলের দিকে একটি তীর ছুঁড়লো এবং বললো , সেনাপতির সামনে সাক্ষী থেকো যে আমিই ছিলাম যে প্রথম তীর ছুঁড়েছিল।’’ তখন তার অধীনে যারা ছিলো তারা বিরাট সংখ্যায় তীর ছুঁড়তে লাগলো যা পাখির মত দেখাতে লাগলো। ইমাম তার সাথীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন ,

আল্লাহ তাঁর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষণ করুন , জাগো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর মুখোমুখি হতে এবং এ তীরগুলো সেনাবাহিনীর দূত যা আমাদের দিকে আসছে।’’

এরপর তারা আক্রমণ করে এবং ইমামের একদল বিশ্বস্তও পরহেজগার সাথী নিহত হন।

বর্ণনাকারী বলেন যে ইমাম হোসেইন (আ.) নিজের দাড়ি ধরে বললেন ,

আল্লাহর ক্রোধ চরম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইহুদীদের ওপর যখন তারা বলেছিল তাঁর একটি ছেলে আছে এবং তাঁর রাগ খ্রিষ্টানদের ওপর পড়ে যখন তারা তাঁকে তিন জনের একজন বানিয়েছিল এবং তাঁর ক্রোধ গিয়ে অগ্নি উপাসকদের [মাজুসদের] ওপর পড়েছিল যখন তারা তাঁর পরিবর্তে সূর্য ও চাঁদের ইবাদত করতে শুরু করেছিল এবং এখন আল্লাহর ক্রোধ পড়বে এ সম্প্রদায়ের ওপর যারা একত্রিত হয়েছে নবীর নাতিকে হত্যার জন্য। সাবধান , আল্লাহর শপথ , আমি তাদের আশার সাথে একমত হবো না , যতক্ষণ পর্যন্তনা আমি আমার রবের সাথে মিলিত হই আমার রক্তে ভিজে।’’

বর্ণিত আছে আমর বিন হাজ্জাজ ইমাম হোসেইন (আ.)-এর সাথীদের দিকে অগ্রসর হলো এবং বললো ,‘‘ হে কুফাবাসী , তাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো যারা তোমাদের এবং তোমাদের সম্প্রদায়ের কথা শোনে এবং তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করো না যে ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে এবং ইমামকে অমান্য করেছে।’’ ইমাম হোসেইন (আ.) বললেন ,‘‘ হে আমর বিন হাজ্জাজ , তুমি কি লোকজনকে আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছো ? আমরা কি ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছি , আর তোমরা তার ওপর দৃঢ় আছো ? আল্লাহর শপথ , যখন তুমি তোমার এ খারাপ কাজগুলো নিয়ে মরবে তখন তুমি জানতে পারবে যে , কে ধর্ম থেকে বেরিয়ে গেছে এবং কে জাহান্নামের [আগুনের] জন্য যোগ্য।’’


4

5

6

7

8

9

10