মুক্তির পথে

মুক্তির পথে30%

মুক্তির পথে লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বিভাগ: আল্লাহর একত্ববাদ

মুক্তির পথে
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 34 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 17334 / ডাউনলোড: 3761
সাইজ সাইজ সাইজ
মুক্তির পথে

মুক্তির পথে

লেখক:
প্রকাশক: যাহরা একাডেমী ক্বোম, ইরান
বাংলা

এ বইটিতে অত্যন্ত শক্তিশালী তাত্ত্বিক আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। কোন অন্ধ অনুকরণ এবং বিশ্বাস সম্পর্কিত উদ্দীপনাময়ী ও চলমান গতানুগতিক আলোচনা এতে স্থান পায়নি বরং গ্রন্থটির সকল আলোচনাই হয়েছে সম্পূর্ণ সত্য এবং সুপ্রমানিত তথ্যসমূহের উপর ভিত্তি করে। আমরা সুস্থ বুদ্ধি ও বিবেককে কখনো বিতাড়িত করি না বরং একই সঙ্গে রাসূল (সঃ) কর্তৃক বর্ণিত দলীলের উপর স্থবির বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানব বুদ্ধিবৃত্তির সমান ব্যবহারের পক্ষপাতি। কেননা তালাবদ্ধ চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্তির চাবি কাঠি হচ্ছে এ বুদ্ধিবৃত্তি। ফলে এরই মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সঠিক দিক নির্দেশনা পেতে পারি। সাথে সাথে এ বুদ্ধিবৃত্তি আমাদেরকে এও বলে দেয় যে কোন্ বিষয়টি বিবেক প্রসূত আর কোনটি বিবেক-বহির্ভূত। এ গ্রন্থে বিভিন্ন সহজ বোধগম্য উদাহরণের মাধ্যমে চিন্তার বিকাশ সাধনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে যথার্থভাবে ,যেন পরবর্তীতে অন্যান্য চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিবর্গ এ পথে নিজেদের পরিশ্রম ব্যয় করতে এগিয়ে আসেন।

প্রাকৃতিক বিশ্বে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত

এখন আপনাদের সমক্ষে বিশ্ব প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত সুশৃঙ্খল বিধি-বিধানের উপর এক অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনার সুত্রপাত করবো ,যা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিন্তাবিদদের মতামতে সমৃদ্ধ।

উদ্ভিদ জগতে শৃঙ্খলা :

এ বিষয়ে সর্বপ্রথম উদ্ভিদের বপন বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে নিহিত কারণসমূহে ব্যাপারে একজন উদ্ভিদ ও ভূমিবিদের মতামত পেশ করছি।

Lester John Zimmerman নামক একজন উদ্ভিদ ও ভূমিবিদ বলেন : উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্যে প্রয়োজনীয় উপাদান বায়ু ও মাটি থেকে নেয়া হয়ে থাকে। তবে একটা প্রশ্ন এখানে থেকে যায় ,মাটির উৎপত্তি কোত্থকে এবং কেমন করে মৃত্তিকা উদ্ভিদের খাদ্য উপাদান সঞ্চয় করে রাখে ? উর্বর মাটি খনিজ উপাদান থেকে গঠিত এবং সে মাটি যথেষ্ট পরিমাণ কার্বন ধারণ করে রাখতে সক্ষম। যা আদিম বৃক্ষ ও প্রাণীদেহের ধ্বংসাবশেষ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। পানি ,বায়ু ,আলো ও রাসায়নিক উপাদানগুলো যদিওবা উদ্ভিদের বৃদ্ধির সহায়ক তথাপি এগুলোর কোনটাই একাজের জন্যে যথেষ্ট নয়। বরং এক অদৃশ্য শক্তি এসব সূক্ষ্ম ও জটিল কাজে কার্যকর ,যা প্রতিটি বীজের অভ্যন্তরে লুকায়িত। সেই শক্তিই একটি উপযোগী পরিবেশে একটি বৃক্ষের বৃদ্ধিতে সর্বাত্মক সহযোগীতা করে থাকে। এ শক্তির সময়োপযগী পরিবেশে একটি বৃক্ষের বৃদ্ধিতে সর্বাত্তক সহযোগীতা করে থাকে। এ শক্তির সময়োপযগী পদক্ষেপ অত্যন্ত সূক্ষ্মতা ও নিপুণতার সাথে সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রথমে বিভিন্ন কাজে পারদর্শী উপাদানসমূহের সমন্বয়ে গঠিত ডিম্বানুর সূক্ষ্ম দুটি কোষ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ শুরু করে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেগুলো পৃথক পৃথকভাবে বৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতার পথে অগ্রসর হতে থাকে। যে বীজ মাটিতে ফেলা হয়ে থাকে পরবর্তীতে বৃদ্ধি পেয়ে হুবহু সে বৃক্ষেরই রূপ ধারণ করে থাকে। গমের বীজ থেকে গম গাছই উৎপন্ন হয়ে থাকে। যদি ওক বীজ বপন করা হয় তাহলে পরিণতিতে ওক বৃক্ষই পাওয়া যাবে। যদি কেউ স্বচ্ছ ধারণা ও নিরপেক্ষ অন্তঃকরণ নিয়ে এ ধরণের ক্রিয়া-কর্ম এবং বীজের বৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতার বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাহলে নিঃসন্দেহে সে এ বিশ্ব জগতে বিরাজমান সৌন্দর্য ও প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি সাক্ষ্য প্রদান করতে বাধ্য হবে১৩

এটোমের অভ্যন্তরে নিয়ম-শৃঙ্খলা :

জনাব কুরেন বলেন ,নিঃসংকোচে বলা যায় ,বস্তুজগত এক নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আইন-কানুনের জগত ,বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার জগত নয়। এটা এমন এক জগত যেখানে প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের অনুসরণ করা হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার পথ এখানে অবরুদ্ধ।

অতঃপর তিনি এটোমের দেহে এবং সেখানে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপারে এরূপ বলেন ,‘‘ প্রতিটি এটোম তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত।

এক : প্রোটন (পজেটিভ) ,

দুই : ইলেকট্রন (নেগেটিভ) ,

তিন : নিউট্রন (পজেটিভ ও নেগেটিভের সংমিশ্রণ বা নিউট্রাল)

প্রতিটি এটোমের সকল প্রোটন তার কেন্দ্র বিন্দুতে অবস্থিত। ইলেকট্রন সংখ্যার প্রোটনের সমপর্যায়ে অবস্থিত। তারা সকলে কেন্দ্র বিন্দুর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ এবং বিভিন্ন কক্ষপথে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে থাকে। তাদের সাথে কেন্দ্র বিন্দুর দূরত্ব এতই অধিক যে একজন মানুষ এ ধরণের দূরত্ব অবলোকন করে এটোমের সাথে সৌরজগতের তুলনা দিয়ে বসতে পারে। সৌরজগতের ন্যয় এটোমের আকারও অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূন্যাকাশে আবৃত থাকে। উল্লেখ্য যে ,এটোমের একটি উপাদানের সাথে অন্য আরেক উপাদানের পার্থক্য শুধুমাত্র সংখ্যাগত দিক দিয়ে কেন্দ্র বিন্দুতে প্রোটন আর কেন্দ্রবিন্দুর চতুর্দিকে ইলেকট্রন ও নিউট্রনের পার্থক্য এবং অবস্থানের ভিন্নতার সমতুল্য। অতএব ,কোটি কোটি মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ অবশেষে এই তিন প্রকার বৈদ্যুতিক অণু থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যা প্রকৃতপক্ষে একটি বস্তুর তিনটি রূপ। সেই বস্তুটির নাম বৈদ্যুতিক শক্তি বাElectricity আর এটাও এক অদৃশ্য শক্তির বহিঃপ্রকাশ’’১৪

অতি ক্ষুদ্রতম অণু কোষের ভিতর শৃঙ্খলা :

যদি আমরা এক ফোটা পানি পরীক্ষাগারের একটা নির্দিষ্ট কাচের উপর রেখে লক্ষ্য করি তাহলে প্রকৃতির এক অত্যাশ্চর্য প্রাণীর নড়াচড়া প্রত্যক্ষ করতে পারবো। এর ভিতর অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটা প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যাবে যাকেAmibe ধীরে ধীরে হজম করে ফেলে। ফলে শুধুমাত্র ঐ ক্ষুদ্র প্রাণীর মলমূত্র অবশিষ্ট রয়ে যায়। যদি আমরা অধিক সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে প্রত্যক্ষ করবো যেAmibe নিজেকে লম্বা করে দুটি অংশে বিভক্ত করে ফেলেছে। যার ফলে দুটি যুবক ও শিশুAmibe এর উৎপত্তি ঘটে। এ ক্ষেত্রে আমরা একটি কোষকে দেখতে পাব যে বেঁচে থাকার জন্যে সে সব ধরণের গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে। অন্যদিকে এসব ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যে বৃহদাকার প্রাণীরা পর্যন্ত বহু সহস্র কোষের প্রয়োজন অনুভব করে থাকে। শুধু তাই নয় ,কোন কোন ক্ষেত্রে তারা বহু সহস্র মিলিয়ন কোষেরও মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এটা দিবালোকের ন্যয় স্পষ্ট যে এ ধরণের ক্ষুদ্র প্রাণীর জন্মদাতা কোন দুর্ঘটনা নয়। বরং সর্বপ্রকার ঘটনা প্রবাহের ঊর্দ্ধের কোন শক্তিই এ অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও বিষ্ময়কর প্রাণীর সৃষ্টিকর্তা । বিষয়টি বলেছেন ,জীব বিজ্ঞানীCecil Boyce Hamam । তিনি প্রাণীদেহের অভ্যন্তরে ক্রিমি জাতীয় জীবাণুর বিভিন্ন ভাগে বিভক্ততে বিশেষজ্ঞ এবং তারিশিন নামক এক প্রকার জীবাণু থেকে বিভিন্ন রোগের বিষাক্ত গ্যাস নির্ণায়ক।১৫

মৌলিক পদার্থের ছকে যথার্থ হিসেব ও শৃঙ্খলা :

মৌলিক পদার্থের চক্রাকার ছক এবং ব্যবস্থা ,এমন এক বিধি ব্যবস্থার সুন্দরতম চিত্র যা এ বিশ্বের জন্যে বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এ ছকটি এমন পদ্ধতিতে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছে যে ,বিশেষ ও সমগুণসম্পন্ন উপাদানগুলো পর্যায়ক্রমিকভাবে ঐ ছকের চতুর্দিকে সর্বদা ঘূর্ণয়মান থাকে। এ চক্রাকার ছকে সমস্ত উপাদানগুলো ইলেকট্রোন সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রেখে সন্নিবেশিত করা হয়ছে। ইলেকট্রোন সংখ্যা তার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রোটনের সংখ্যার সমতুল্য। এভাবে হাইড্রোজেনের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি প্রোটন ,দু টি হেলয়ুম এবং তিনটি ওয়ালিটিউম ছাড়াও আরো অনেক উপাদান বিদ্যমান। যখন উপাদানসমূহ এটোমের ওজন অনুযায়ী ক্রমানুষারে সন্নিবেশিত থাকে তখন তাদের বিশেষ উপাদানগুলোর পরিবর্তন চক্রাকারে এবং বৈকল্পিকভাবে পূনরাবৃত্তি হতে থাকে। যে সমস্ত উপাদান সমান্তরাল সারীতে অবস্থিত তারা তাদের প্রতিবেশীদের সাথে শুধুমাত্র একটি প্রোটন এবং একটি ইলেকট্রোনের পার্থক্য রাখে। আর যেগুলো দৈর্ঘ্যভাবে সারীতে অবস্থিত তাদের বাইরের কক্ষগুলোতে ইলেকট্রোনের সংখ্যা পরস্পর সমান। ইলেকট্রোনের সংখ্যা সমপরিমাণ হওয়ার কারণে যে সমস্ত উপাদান দৈর্ঘ্যভাবে সারীতে অবস্থিত তারা সমগুণ সম্পন্ন। যেহেতু প্রতিটি লিটুয়্যাম ,সোডিয়াম ,পটাশিয়াম ,রোবিডিয়াম ,কাইযিয়াম ও ফ্রানসিয়ামের বহির্কক্ষে একটি করে ইলেকট্রন বিদ্যমান সেহেতু তারা সমগুণ সম্পন্ন এবং একই পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিগণিত। আর যেহেতু ছয়টি উপাদান যথা হেলিয়াম ,নেউন ,আরগুণ ,কারিপটুন ,যানুন ও রাদুন এর চতুরপার্শ্বে কতগুলো অপরিবর্তনশীল মিশ্রণবেষ্টনী দিয়ে রেখেছে তাই তারা অন্যান্য উপাদানের সাথে মিলিত হওয়ার প্রবণতা প্রদর্শন করে না। এ কারণে সেগুলোকে অকেজো গ্যাস বলা হয়ে থাকে । অনুরূপভাবে অন্যান্য সকল উপাদানগুলোও তাদের সমগুণসম্পন্ন উপাদান এবং ইলেকট্রোনের সংখ্যার অনুপাতে বিভিন্ন পরিবারে বিভক্ত হয়েছে। আমাদের সাধারণ বিবেকই বলে দিবে যে ,এ ধরণের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা এবং বিষ্ময়কর সন্নিবিষ্টতা কখনো কোন দূর্ঘটনার ফসল হতে পারে না।

নভোপুঞ্জ এবং পৃথিবীর কল্পনাতীত বিশালতা :

কোন সুস্থ মস্তিস্ক ব্যক্তির পক্ষে ভূ-মন্ডলের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জো নেই। তেমনি নভোপুঞ্জও কেউ অস্বীকার করতে পারে না। ভূ-মন্ডলের ওজন ও আয়তনের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশী। পৃথিবীর ওজন আনুমানিক ৬৬০০ বর্গ বিলিয়ন টন। যেখানে এক মিলিয়ন টনের প্রকৃত অনুমাপ মানুষের জন্যে এক দুস্কর ব্যাপার সেখানে এক বিলিয়ন অথবা বর্গ বিলিয়ন তো অনেক দুরের কথা। এত বৃহৎ এ ভূ-মন্ডলের ব্যাপারে স্বভাবতঃ-ই প্রশ্ন জাগ্রত হয় , এ বৃহৎ গ্রহ যার নাম ভূ-মন্ডল ,তা কোত্থকে এসেছে ?

বিশিষ্ট জ্যোতিষবিদগণ বলেন ,আমাদের ছায়াপথের ন্যায় একলক্ষ ছায়াপথ বিশ্ব-প্রকৃতিতে বিদ্যমান। প্রশ্ন হতে পারে ,এ আকাশপুঞ্জের সর্বমোট ওজন কত হবে ? শুধুমাত্র এ বিষয়ে সামান্য একটু চিন্তা একজন মানুষকে বিষ্মিত করে তুলতে যথেষ্ট। তাই এ বৃহৎপুঞ্জের চির বিদ্যমানতার ধারণা একটি অর্থহীন বিশ্বাসের শিকার। কেননা ,সকল বস্তু পরিবর্তনশীল অর্থাৎ বৃদ্ধি পায় এবং পর্যায়ক্রমে প্রসার লাভ করে। এমনকি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান যথেষ্ট মনোযোগের মাধ্যমে প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টি-সূচনা নির্ণয় করে দিতে সক্ষম। সুতরাং সঠিক ও বিবেক সমর্থিত ধারণাটি হচ্ছে যে ,এগুলো সৃষ্ট বস্তু বৈ অন্য কিছু নয়। এ ধরনের বৃহৎ ও সুশৃঙ্খল সৃষ্টি ব্যবস্থা কি কোন প্রস্তুতকারক বা শক্তিশালী স্রষ্টার প্রয়োজন অনুভব করে না ?

কয়েকটি আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত :

প্রাণীদেহের বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্যে ভূ-মন্ডলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন কার্যক্রম সংঘটিত হয়ে থাকে। তন্মোধ্যে নিম্নে কয়েকটি কার্যক্রম উল্লেখ করা হলো :

এক : ভূমির উপরিপৃষ্ঠে জীবন রক্ষী গ্যাস থেকে যে বায়ুমন্ডল গঠিত হয়ে থাকে তার ঘনত্ব ও বেধ প্রায় আটশত কিলোমিটার। এত অধিক ঘনত্ব থাকার কারনেই তা ভূ-পৃষ্ঠকে ঢাল স্বরূপ ,শূন্যাকাশ থেকে নিক্ষিপ্ত প্রতিদিন বিশ মিলিয়ন প্রাণহরণকারী প্রস্তর থেকে প্রতিরক্ষা করতে পারে। এসমস্ত পাথর প্রতি সেকেন্ড প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ভূ-পৃষ্ঠে আঘাত হেনে থাকে।

দুই : বায়ুমন্ডল ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাকে জীবন ধারণের উপযোগী করে গড়ে তোলে এবং মহাসাগর থেকে বাস্প ও প্রয়োজনীয় পানি শুস্ক এলাকায় স্থানান্তরিত করে থাকে। আর এরূপ কার্য সম্পন্ন না হলে মহাদেশগুলো বসবাসের অনুপযুক্ত এক একটি বৃহৎ শুস্ক মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যেত।

তিন : পানির দৃষ্টি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ,দীর্ঘ শীত মৌসুমে মহাসাগর ,সাগর ও নদীগুলোতে জীবন যাত্রা অব্যাহত রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তন্মোধ্যে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষন এবং স্বীয় ওজন বরফে রূপান্তরিত হওয়ার তাপমাত্রার চেয়ে চার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে ধারণ অন্যতম। এ কারণেই নদী ও সাগরের তলদেশে পানি জমাট হতে বাধাগ্রস্থ হয়। অন্য আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্য হচ্ছে ,পানির ওজন বরফের ওজনের চেয়ে বেশী করে সংরক্ষিত রাখা। সেজন্যে বরফ পানির উপর ভেসে থাকতে সমর্থ হয়। আবার যখন পানি বরফে পরিণত হতে থাকে তখন প্রচুর পরিমাণ তাপ পানির নিম্নভাগ থেকে নিঃসৃত হয়ে বরফ গলানোর কাজে সহায়তা করে থাকে।

চার : মৃত্তিকা তার স্বগর্ভে এমন সব খনিজ পদার্থ ধারণ করে রাখে যেগুলোকে উদ্ভিদ সংগ্রহণ করে প্রাণী জগতের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যরূপে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।

পাঁচ : ভূ-মন্ডলের আয়তম যদি চন্দ্রের ন্যয় ক্ষুদ্র অথবা বর্তমান আয়তনের এক চর্তুাংশ হতো তা হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পানি ও বায়ু ধারণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতো আর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতো যেখানে প্রাণীর জীবনাবসান নিশ্চিত হয়ে পড়তো। অপরদিকে যদি পৃথিবী স্বীয় ওজন অপরিবর্তীত রেখে সূর্যের ন্যয় বৃহৎ আকার ধারণ করতো তা হলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একশত পঞ্চাশ গুণ অধিক বেড়ে যেতো আর বায়ুমন্ডলের উচ্চতা প্রায় দশ কিলোমিটার নিচে নেমে আস্তো। পরিণতিতে পানির বাষ্প হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়তো আর বায়ুর চাপ প্রায় ১৫০ বর্গকিলোগ্রামে উপনীত হতো। তদর্থে এক কিলোগ্রাম ওজনের প্রাণী একশত পঞ্চাশ কিলোগ্রামে পরিণত হয়ে যেতো আর তখন মানুষের উচ্চতা কমে কাঠবিড়ালীর ন্যায় ক্ষুদ্রাকৃতিতে পরিণত হতো।

ছয় : যদি ভূ-মন্ডল থেকে সূর্যের দূরত্ব বর্তমান দূরত্বের দ্বিগুণ হতো তা হলে সূর্য থেকে গৃহীত তাপমাত্রা বর্তমান তাপমাত্রার এক চর্তুাংশে অবতরণ করতো আর সূর্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিনরত পৃথিবীর গতিবেগ বর্তমান গতিবেগের অর্ধেকে নেমে আসতো। ফলে বিশ্বের সকল প্রাণী ঠান্ডায় জমাট বেধে যেতো। আর যদি পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব বর্তমান দূরত্বের অর্ধেক হতো তা হলে উষ্ণতা চারগুন ,সূর্যের চতুর্দিকে প্রদক্ষিনের গতিবেগ দ্বিগুন ,ঋতুর সময়কাল অর্ধেক (ঋতুর সময়কাল পরিবর্তন সাপেক্ষে) হয়ে যেতো এবং ভূ-পৃষ্ঠে এতবেশী উত্তপ্ত হয়ে উঠতো যে সেখানে জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে পড়তো।

এগুলো ছিল বিশ্ব প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত অত্যন্ত সুষ্ঠ ও সূক্ষ্ম আইন-কানুন ,বিধি-বিধান এবং অত্যাশ্চর্য সু-শৃঙ্খলার তাক লাগানো প্রকান্ডতার কয়েকটি দৃষ্টান্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ শীর্ষক গ্রন্থে আরো অধিক দৃষ্টান্তের অবতারণা করা হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থে উল্লেখিত একটি উদাহরণ-ই একজন বুদ্ধিমান ন্যয়বিচারকের সমক্ষে সৃষ্টি সূচনার পরিচয়ের এক মহাগ্রন্থ উন্মোচন করে দিতে সক্ষম।

তাই জনৈক পারস্য কবি যথার্থই বলেছেন :

সচেতন ব্যক্তির দৃষ্টিতে সবুজ পাতা বৃক্ষলতার

প্রতিটি পাতা-ই এক একটি গ্রন্থ আল্লাহকে চেনার।

দুর্ঘটনা নাকি কোন মহাশক্তির পরিচালনা ?

সৃষ্টিজগতের বিশালতা ও তার বিষ্ময়কর শৃঙ্খলা ব্যবস্থা এবং সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান প্রাথমিক নিম্নের দুটি সম্ভাবনার ফলাফল ধরে নেয়া যেতে পারে।

এক : সব কিছুই কোন একটি সংঘর্ষ এবং পারস্পরিক মিশ্রনের ফল অর্থাৎ দর্শনের পরিভাষায় সৃষ্টির অস্তিত্ব ও তার বিষ্ময়কর নিয়মশৃঙ্খলার জন্যে কোন বস্তুগত কার্যকারণ-ই যথেষ্ট ,অন্য কোন ক্রিয়াশীল কার্যকারণের প্রয়োজন নেই।

দুই : বিশ্ব সৃষ্টি ও তার সূক্ষ্ম নিপুণতার যথাযথ ও অপরিবর্তনীয় বিধি-বিধান ,সুউচ্চ কোন বিবেক-শক্তি ও প্রজ্ঞার পরিচালনার-ই কারণ আর তিনিই হচ্ছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্রিয়াশীল সূচনাশক্তি ।

এখন আমাদের বিবেককে উপরোক্ত দু টি মতামতের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্যে আহ্বান জানানো উচিত। এক্ষেত্রে তো আর পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও অনুসন্ধান চলে না। একটি মাত্র উপায়ে অন্বেষণ ও গবেষণা চালানো যেতে পারে ,আর তা হলো সুস্থ বুদ্ধি-বিবেকের প্রয়োগ যা অকলুষিত প্রকৃতি এবং গোড়ামী ও একগুয়েমী বিবর্জিত অন্তর আত্মার সমন্বয়ে গঠিত। এ পর্যায়ে আমরা দু জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর মতামত উপস্থাপন করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করছি।

পদার্থবিদ এ্যাডভিন ফ্যাষ্ট বলেন : তিনটি মূল উপাদান যথা হাইড্রোজেন ,অক্সিজেন ও কার্বন হচ্ছে প্রতিটি প্রাণীদেহের সর্ব প্রাথমিক সামগ্রী। আর উক্ত তিনটি উপাদানের সাথে সামান্য নাইট্রোজেন গ্যাস ও অন্যান্য উপাদানের মিশ্রন আছে। এটা কি সম্ভব যে প্রনীদেহে তার উপাদানেরও স্বেচ্ছাকৃত মিশ্রণ কোন এক দুর্ঘটনার ফসল ? কেন আমরা দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে ব্যক্ত করছি না যে ,প্রাণীকুলের সৃষ্টিকর্তাই এরকম ইচ্ছা পোষন করেছেন ? কেন আমরা সৃষ্টি অস্তিত্বের আলোচনায় একটি সহজ শব্দ আল্লাহ্ উচ্চারণ থেকে বিরত রয়েছি ? যদিও এ শব্দটি অত্যন্ত সাধারণ ও সহজ তথাপি এর মর্যাদা ও আড়ম্বরতা গগন চুম্বী।১৬

জন এ্যাডওয়ালক বুহলের নামক একজন রসায়নবিদ বলেন : যদি সম্ভবনাময়ী হিসেবের ভিত্তিতে প্রকৃতির যে কোন একটি কাজের ফলাফল অর্জনের জন্যে দুর্ঘটনাকে আমরা কারণ হিসেবে ধরে নেই তা হলে প্রত্যক্ষ করতে পারবো যে ,এ সময়কাল উক্ত কাজের জন্যে যথেষ্ট নয় ,যদিও ভূ-পৃষ্ঠের বয়স তিন বিলিয়ন বৎসর ধরা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রোটনের আদি উপাদান থেকে তার কণার সৃষ্টি । শুধুমাত্র স্বাধীন ও প্রত্যয়শীল একটি পথ প্রদর্শকের অস্তিত্ব স্বীকারের মাধ্যমেই সুশৃঙ্খল ও সুসামঞ্জস্য ব্যবস্থাপনা থেকে দুর্ঘটনা বা সংঘর্ষের ধারণাকে পৃথক করা যেতে পারে।১৭

চতুর্থ ইমাম

হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.)

তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.) হলেন চতুর্থ ইমাম । তার প্রসিদ্ধ উপাধি হল সাজ্জাদ ও জয়নুল আবেদীন । আর এ দুটো নামেই (উপাধি) তিনি অধিক পরিচিত । তার মা হলেন ইরানের ইয়াযদগের্দের রাজকন্যা । হযরত ইমাম সাজ্জাদই (আ.) ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র । কারণ , ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অন্য তিন ভাই কারবালায় শাহাদৎ বরণ করেন ।৩৪

অবশ্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-ও পিতার সাথে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তিনি সেখানে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন । যার ফলে অস্ত্র বহন বা যুদ্ধ করার মত দৈহিক সামর্থ তখন তার মোটেই ছিল না । তাই তিনি জিহাদে অংশ গ্রহণ বা শাহাদত বরণ করতে পারেননি । যুদ্ধশেষে ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদের সাথে বন্দী অবস্থায় তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় । তারপর সেখানে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটানোর পর গণসন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইয়াযিদের নির্দেশে সসম্মানে তাকে মদীনায় পা ঠানো হয় । পরবর্তীতে আব্দুল মালেক নামক জনৈক উমাইয়া খলিফার নির্দেশে চতুর্থ ইমামকে পুনরায় বন্দী করে শিকল দিয়ে হাত পা বেধে দামেস্কে পাঠানো হয় । অবশ্য দামেস্ক থেকে আবার তাকে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয় ।৩৫

চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.) মদীনায় ফেরার পর ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । অপরিচিতদেরকে সাক্ষাত প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন । তখন থেকেই সর্বক্ষণ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন । হযরত আবু হামজা সামালী (রা.) ও হযরত আবু খালেদ কাবুলীর (রা.) মত বিশিষ্ট শীয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সাথেই তিনি যোগাযোগ করতেন না । ইমামের ঐ বিশিষ্ট সাহাবীরা তার কাছ থেকে যেসব জ্ঞান আরহণ করতেন , তা তারা শীয়াদের মধ্যেই বিতরণ করতেন । এভাবে শীয়া মতাদর্শের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে । আর এর প্রভাব পরবর্তীতে পঞ্চম ইমামের যুগে প্রকাশিত হয় । সাহিফাতুস সাজ্জাদিয়াহ নামক চতুর্থ ইমামের দোয়ার সংকলন তার অবদান সমূহের অন্যতম । এই ঐতিহাসিক দোয়ার গ্রন্থটিতে ৫৭টি দোয়া রয়েছে । যার মধ্যে ইসলামের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে । এই গ্রন্থ কে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের যাবুর (হযরত দাউদের (আ.) কাছে অবতির্ণ ঐশী গন্থ) বলে অভিহিত করা হয় । বেশকিছু শীয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৫ বছর যাবৎ ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর উমাইয়া খলিফা হিশামের প্ররোচণায় ওয়লিদ। ইবনে আব্দুল মালেক নামক জনৈক ব্যক্তি বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-কে হত্যা করে ।৩৬ এভাবে হিজরী ৯৫ সনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শাহাদত বরণ করেন ।

পঞ্চম ইমাম

ইমাম বাকের (আ.)

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী ওরফে বাকের (আ.) হলেন পঞ্চম ইমাম । বাকের অর্থ পরিস্ফুটনকারী । মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন ।৩৭ তিনি ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র । তিনি হিজরী ৫৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর । কারবালায় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ব পুরুষদের ওসিয়তের মাধ্যমে তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন ।

হিজরী ১১৪ অথবা ১১৭ সনে (কিছু শীয় বর্ণনা অনুযায়ী) উমাইয়া খলিফা হিশামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহীম বিন ওয়লিদ বিন আব্দুল মালেকের দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৩৮

পঞ্চম ইমামের যুগে ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন গণঅভ্যুত্থান ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এমনকি স্বয়ং উমাইয়া পরিবারের মধ্যেও মতভেদ শুরু হয় । এ সব সমস্যা উমাইয়া প্রশাসনকে এতই ব্যস্ত রাখে যে , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা হয়ে উঠতো না । যার ফলে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি তাদের অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা কমে যায় । এছাড়া কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এবং পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্যাতিত অবস্থা জনগণের হৃদয়ের আবেগ অনুভুতিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল । আর চতুর্থ ইমাম ছিলেন কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী । এর ফলে ক্রমেই মুসলমানরা পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন । এ সব কারণে , পঞ্চম ইমামের দর্শন লাভের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে মদীনায় জনগণ এবং বিশেষ করে শীয়াদের গণস্রোতের ঢল নামে । যার ফলে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপক সুযোগ ইমাম বাকের (আ.)-এর জন্যে সৃষ্টি হয় । এমনকি তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) জীবনেও এমন সুবর্ণ সুযোগ কখনও আসেনি । এ যাবৎ প্রাপ্ত অসংখ্য হাদীসই এ বক্তব্যের উত্তম সাক্ষী । শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী , পণ্ডিত ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ অসংখ্য বিখ্যাত আলেমই হযরত ইমাম বাকেরর (আ.) পবিত্র জ্ঞান নিকেতনে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হয়েছেন । ঐসব বিশ্ববিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিতগণের পূর্ণ পরিচিতি রিজাল (ইসলামী ঐতিহাসিক জ্ঞানী গুণীদের পরিচিতি শাস্ত্র) শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত আছে ।৩৯

ষষ্ঠ ইমাম

ইমাম জাফর আস্ সাদেক (আ.)

পঞ্চম ইমামের পুত্র হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক (আ.) ছিলেন ষষ্ঠ ইমাম । তিনি হিজরী ৮৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে (শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে) আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪০ ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল । ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে মুসাওয়াদাহু বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কেননা , ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয় । এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল । পঞ্চম ইমাম তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামতের যুগে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন । এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন । এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান । ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণপ প্রাপ্ত হয়েছেন । যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ , মুহাম্মদ বিন মুসলিম , মুমিন তাক , হিশাম বিন হাকাম , আবান বিন তাগলুব , হিশাম বিন সালিম , হারিয , হিশাম কালবী নাসাবাহ , জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী , কাযী সাকুনী , কাযী আব্দুল বাখতারী , প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য , যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য ।৪১ হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ , মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী ।

কিন্তু হযরত জাফর সাদেক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন । খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা , নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন । আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন । তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয় । খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত । অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত । তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে । তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত । তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত ।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে । অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন । এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল । খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন । খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল । সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল । অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । ইমাম মদীনায় ফিরে যান । ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন তাকীয়ার মাঝে অতিবাহিত করেন । তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয় ।৪২

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো । ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে , মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায় । অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা (উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে । ইমামের ওসিয়ত নামায় যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে , তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় । এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া । কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে । খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার ওসিয়ত নামা চেয়ে নেয় । কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । কারণ , ঐ ওসিয়ত নামায় ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন । ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর , মদীনার প্রশাসক , ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্ , ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ । এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল ।৪৩

চতুর্থ ইমাম

হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.)

তৃতীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র হযরত আলী বিন হুসাইন (আ.) হলেন চতুর্থ ইমাম । তার প্রসিদ্ধ উপাধি হল সাজ্জাদ ও জয়নুল আবেদীন । আর এ দুটো নামেই (উপাধি) তিনি অধিক পরিচিত । তার মা হলেন ইরানের ইয়াযদগের্দের রাজকন্যা । হযরত ইমাম সাজ্জাদই (আ.) ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একমাত্র জীবিত পুত্র । কারণ , ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর অন্য তিন ভাই কারবালায় শাহাদৎ বরণ করেন ।৩৪

অবশ্য হযরত ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-ও পিতার সাথে কারবালায় উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু তিনি সেখানে ভীষণভাবে অসুস্থ ছিলেন । যার ফলে অস্ত্র বহন বা যুদ্ধ করার মত দৈহিক সামর্থ তখন তার মোটেই ছিল না । তাই তিনি জিহাদে অংশ গ্রহণ বা শাহাদত বরণ করতে পারেননি । যুদ্ধশেষে ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদের সাথে বন্দী অবস্থায় তাকে দামেস্কে পাঠানো হয় । তারপর সেখানে কিছুদিন বন্দী জীবন কাটানোর পর গণসন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইয়াযিদের নির্দেশে সসম্মানে তাকে মদীনায় পা ঠানো হয় । পরবর্তীতে আব্দুল মালেক নামক জনৈক উমাইয়া খলিফার নির্দেশে চতুর্থ ইমামকে পুনরায় বন্দী করে শিকল দিয়ে হাত পা বেধে দামেস্কে পাঠানো হয় । অবশ্য দামেস্ক থেকে আবার তাকে মদীনায় ফেরৎ পাঠানো হয় ।৩৫

চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.) মদীনায় ফেরার পর ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । অপরিচিতদেরকে সাক্ষাত প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন । তখন থেকেই সর্বক্ষণ তিনি নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে ব্যস্ত রাখেন । হযরত আবু হামজা সামালী (রা.) ও হযরত আবু খালেদ কাবুলীর (রা.) মত বিশিষ্ট শীয়া ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সাথেই তিনি যোগাযোগ করতেন না । ইমামের ঐ বিশিষ্ট সাহাবীরা তার কাছ থেকে যেসব জ্ঞান আরহণ করতেন , তা তারা শীয়াদের মধ্যেই বিতরণ করতেন । এভাবে শীয়া মতাদর্শের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে । আর এর প্রভাব পরবর্তীতে পঞ্চম ইমামের যুগে প্রকাশিত হয় । সাহিফাতুস সাজ্জাদিয়াহ নামক চতুর্থ ইমামের দোয়ার সংকলন তার অবদান সমূহের অন্যতম । এই ঐতিহাসিক দোয়ার গ্রন্থটিতে ৫৭টি দোয়া রয়েছে । যার মধ্যে ইসলামের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ জ্ঞান রয়েছে । এই গ্রন্থ কে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের যাবুর (হযরত দাউদের (আ.) কাছে অবতির্ণ ঐশী গন্থ) বলে অভিহিত করা হয় । বেশকিছু শীয়া সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৫ বছর যাবৎ ইমামতের দায়িত্ব পালন করেন । এরপর উমাইয়া খলিফা হিশামের প্ররোচণায় ওয়লিদ। ইবনে আব্দুল মালেক নামক জনৈক ব্যক্তি বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমাম (আ.)-কে হত্যা করে ।৩৬ এভাবে হিজরী ৯৫ সনে ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) শাহাদত বরণ করেন ।

পঞ্চম ইমাম

ইমাম বাকের (আ.)

হযরত মুহাম্মদ বিন আলী ওরফে বাকের (আ.) হলেন পঞ্চম ইমাম । বাকের অর্থ পরিস্ফুটনকারী । মহানবী (সা.) স্বয়ং তাকে এই উপাধিতে ভূষিত করেন ।৩৭ তিনি ছিলেন চতুর্থ ইমাম হযরত জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর পুত্র । তিনি হিজরী ৫৭ সনে জন্মগ্রহণ করেন । ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চার বছর । কারবালায় তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন । পিতার মৃত্যুর পর মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং পূর্ব পুরুষদের ওসিয়তের মাধ্যমে তিনি ইমামতের আসনে সমাসীন হন ।

হিজরী ১১৪ অথবা ১১৭ সনে (কিছু শীয় বর্ণনা অনুযায়ী) উমাইয়া খলিফা হিশামের ভ্রাতুষ্পুত্র ইব্রাহীম বিন ওয়লিদ বিন আব্দুল মালেকের দ্বারা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি শাহাদত বরণ করেন ।৩৮

পঞ্চম ইমামের যুগে ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন গণঅভ্যুত্থান ও যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে । এমনকি স্বয়ং উমাইয়া পরিবারের মধ্যেও মতভেদ শুরু হয় । এ সব সমস্যা উমাইয়া প্রশাসনকে এতই ব্যস্ত রাখে যে , পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ তাদের তেমন একটা হয়ে উঠতো না । যার ফলে পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি তাদের অত্যাচারের মাত্রা অনেকটা কমে যায় । এছাড়া কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা এবং পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) নির্যাতিত অবস্থা জনগণের হৃদয়ের আবেগ অনুভুতিকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল । আর চতুর্থ ইমাম ছিলেন কারবালার সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী । এর ফলে ক্রমেই মুসলমানরা পবিত্র আহলে বাইতগণের প্রতি আকৃষ্ট ও অনুরক্ত হয়ে পড়েন । এ সব কারণে , পঞ্চম ইমামের দর্শন লাভের সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে মদীনায় জনগণ এবং বিশেষ করে শীয়াদের গণস্রোতের ঢল নামে । যার ফলে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের ব্যাপক সুযোগ ইমাম বাকের (আ.)-এর জন্যে সৃষ্টি হয় । এমনকি তার পূর্ববতী ইমামগণের (আ.) জীবনেও এমন সুবর্ণ সুযোগ কখনও আসেনি । এ যাবৎ প্রাপ্ত অসংখ্য হাদীসই এ বক্তব্যের উত্তম সাক্ষী । শীয়া সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট জ্ঞানী গুণী , পণ্ডিত ও ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ অসংখ্য বিখ্যাত আলেমই হযরত ইমাম বাকেরর (আ.) পবিত্র জ্ঞান নিকেতনে প্রতিপালিত ও শিক্ষিত হয়েছেন । ঐসব বিশ্ববিখ্যাত আলেম ও পণ্ডিতগণের পূর্ণ পরিচিতি রিজাল (ইসলামী ঐতিহাসিক জ্ঞানী গুণীদের পরিচিতি শাস্ত্র) শাস্ত্রের গ্রন্থ সমূহে উল্লেখিত আছে ।৩৯

ষষ্ঠ ইমাম

ইমাম জাফর আস্ সাদেক (আ.)

পঞ্চম ইমামের পুত্র হযরত জাফর বিন মুহাম্মদ আস্ সাদেক (আ.) ছিলেন ষষ্ঠ ইমাম । তিনি হিজরী ৮৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি হিজরী ১৪৮ সনে (শীয়া সূত্রে বর্ণিত হাদীস অনুসারে) আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের চক্রান্তে বিষ প্রয়োগের ফলে শাহাদত বরণ করেন ।৪০ ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগে তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একের পর এক উমাইয়া শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল । ঐসবের মধ্যে উমাইয়া শাসক গোষ্ঠিকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে মুসাওয়াদাহু বিদ্রোহের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । কেননা , ঐ বিদ্রোহের মাধ্যমেই উমাইয়া শাসকগোষ্ঠি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাচ্যুত হয় । এছাড়াও ঐসময়ে সংঘটিত বেশকিছু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও উমাইয়া খেলাফতের পতনের কারণ ঘটিয়েছিল । পঞ্চম ইমাম তার দীর্ঘ বিশ বছরের ইমামতের যুগে উমাইয়া খেলাফতের বিশৃংখল ও অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন । এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মাঝে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান ও পবিত্র আহলে বাইতের পবিত্র শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করেন । এভাবে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া এবং তার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ ইমাম হযরত জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্যে এক চমৎকার ও উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় ।

ষষ্ঠ ইমামের ইমামতের যুগটি ছিল উমাইয়া খেলাফতের শেষ ও আব্বাসীয় খেলাফতের শুরুর সন্ধিক্ষণ । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ঐ সুবর্ণ সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন এবং ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস পান । ইসলামী ইতিহাসের অসংখ্য বিখ্যাত পণ্ডিত ও ইসলামের বিভিন্ন শাখায় বিশেষজ্ঞ আলেমগণ তার কাছেই প্রশিক্ষণপ প্রাপ্ত হয়েছেন । যাদের মধ্যে জনাব যরারাহ , মুহাম্মদ বিন মুসলিম , মুমিন তাক , হিশাম বিন হাকাম , আবান বিন তাগলুব , হিশাম বিন সালিম , হারিয , হিশাম কালবী নাসাবাহ , জাবের বিন হাইয়্যান সুফীর (রসায়নবিদ) নাম উল্লেখযোগ্য । এ ছাড়াও আহলে সুন্নাতের অসংখ্য বিখ্যাত আলেমগণও তার শিষ্যত্ব বরণের মাধ্যমে ইসলামী পাণ্ডিত্য অর্জন করেন । যাদের মধ্যে হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবু হানিফা , সুফিয়ান সাওরী , কাযী সাকুনী , কাযী আব্দুল বাখতারী , প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য , যারা ষষ্ঠ ইমামের শিষ্যত্ব বরণের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন । হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত শিষ্যদের মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত প্রায় ১৪ হাজার মুহাদ্দিস (হাদীস বিশারদ) ও ইসলামী পন্ডিতের নাম উল্লেখযোগ্য ।৪১ হযরত ইমাম বাকের (আ.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত হাদীস সমূহের পরিমাণ , মহানবী এবং অন্য দশ ইমামের বর্ণিত হাদীসসমূহের চেয়ে অনেক বেশী ।

কিন্তু হযরত জাফর সাদেক (আ.) তাঁর ইমামতের শেষ পর্বে এসে আব্বাসীয় খলিফা মানসুরের কু-দৃষ্টির শিকার হন । খলিফা মানসুর তাকে সদা কড়া পাহারা , নিয়ন্ত্রণ ও সীমাবদ্ধতার মাঝে বসবাস করতে বাধ্য করেন । আব্বাসীয় খলিফা মানসুর নবীবংশের সাইয়্যেদ বা আলাভীদের উপর অসহ্য নির্যাতন চালাতে শুরু করেন । তার ঐ নির্যাতনের মাত্রা উমাইয়া খলিফাদের নিষ্ঠুরতা ও বিবেকহীন স্পর্ধাকেও হার মানিয়ে দেয় । খলিফা মানসুরের নির্দেশে নবীবংশের লোকদের দলে দলে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরা হত । অন্ধকারাচ্ছান্ন জেলের মধ্যে তাদের উপর সম্পূর্ণ অমানবিকভাবে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের মাধ্যমে তিলেতিলে তাদের হত্যা করা হত । তাদের অনেকের শিরোচ্ছেদও করা হয়েছে । তাদের বহুজনকে আবার জীবন্ত কবর দেয়া হত । তাদের অনেকের দেহের উপর দেয়াল ও অট্রালিকা নির্মাণ করা হত ।

খলিফা মানসুর হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-কে মদীনা ত্যাগ করে তার কাছে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ জারী করে । অবশ্য হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) ইতিপূর্বে একবার আব্বাসীয় খলিফা সাফ্ফাহ-র নির্দেশে তার দরবারের উপস্থিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন । এছাড়াও তার পিতার (পঞ্চম ইমাম) সাথে একবার উমাইয়া খলিফা হিশামের দরবারের তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল । খলিফা মানসুর বেশ কিছুকাল যাবৎ ষষ্ঠ ইমামকে কড়া পাহারার মাঝে নজরবন্দী করে রাখেন । খলিফা মানসুর বহুবার ইমামকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল । সে ইমামকে বহুবারই অপদস্থ করেছিল । অবশেষে সে ইমামকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয় । ইমাম মদীনায় ফিরে যান । ইমাম তার জীবনের বাকী সময়টুকু অত্যন্ত কঠিন তাকীয়ার মাঝে অতিবাহিত করেন । তখন থেকে তিনি স্বেচ্ছায় গণসংযোগবিহীন ঘরকুণো জীবন যাপন করতে শুরু করেন । এরপর এক সময় খলিফা মানসুরের ষড়যন্ত্রে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইমামকে শহীদ করা হয় ।৪২

মানসুর ষষ্ঠ ইমামের শাহাদতের সংবাদ পেয়ে মদীনার প্রশাসককে চিঠি মারফৎ একটি নির্দেশ পাঠালো । ঐ লিখিত নির্দেশে বলা হয়েছে , মদীনার প্রশাসক ষষ্ঠ ইমামের শোকার্ত পরিবারের প্রতি সান্তনা জ্ঞাপনের জন্যে যেন তাঁর বাড়িতে যায় । অতঃপর সে যেন ইমামের ওসিয়ত নামা (উইল) তার পরিবারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তা পড়ে দেখে । ইমামের ওসিয়ত নামায় যাকে তার পরবর্তী ইমাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে , তাকে (পরবর্তী ইমাম) যেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় । এই নির্দেশ জারীর ব্যাপারে মানসুরের মূল উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে ইমামতের বিষয়টি চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া । কেননা এর ফলে শীয়াদের প্রাণ প্রদীপ চিরতরে নিভে যাবে । খলিফার নির্দেশ অনুসারে মদীনার প্রশাসক ইমামের বাড়িতে গিয়ে তার ওসিয়ত নামা চেয়ে নেয় । কিন্তু তা পড়ার পর সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে । কারণ , ঐ ওসিয়ত নামায় ইমাম পাঁচ ব্যক্তিকে তার উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত ও ঘোষণা করেছেন । ঐ পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন : স্বয়ং মানসুর , মদীনার প্রশাসক , ইমামের সন্তান আব্দুল্লাহ আফতাহ্ , ইমামের ছোট ছেলে মুসা কাজেম এবং হামিদাহ । এ ধরণের অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে খলিফার সকল ষড়যন্ত্র ধুলিষ্যাৎ হয়ে গেল ।৪৩


4

5

6

7

8

9

10