নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা7%

নাহজ আল-বালাঘা লেখক:
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: হযরত আলী (আ.)

নাহজ আল-বালাঘা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 48 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 128679 / ডাউনলোড: 8473
সাইজ সাইজ সাইজ
নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

রাসূলের (সা.) ‘জ্ঞান নগরীর দ্বার’ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী, দার্শনিক, সুলেখক ও বাগ্মী। আলঙ্কারিক শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য ও নৈপুন্য অসাধারণ। তিনি নবুওয়াতী জ্ঞান ভান্ডার হতে সরাসরি জ্ঞান আহরণ করেন এবং সাহাবাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পন্ডিত ছিলেন। এতে কারো দ্বিমত নেই। আরবী কাব্যে ও সাহিত্যে তার অনন্যসাধারণ অবদান ছিল। খেলাফত পরিচালনা কালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ (খোৎবা) দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকগণকে প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে পত্র লিখেছিলেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মানুষের অনেক প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তার এসব বাণী কেউকেউ লিখে রেখেছিল, কেউ কেউ মনে রেখেছিল, আবার কেউ কেউ তাদের লিখিত পুস্তকে উদ্ধৃত করেছিল। মোটকথা তার অমূল্য বাণীসমূহ মানুষের কাছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিল।

আশ-শরীফ আর-রাজী আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের ভাষণসমূহ (খোৎবা), পত্রাবলী, নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ সংগ্রহ করে “নাহজ আল-বালঘা” নামক গ্রন্থটি সঙ্কলন করেন।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

খোৎবা - ১৫০

وَ أَسْتَعِينُهُ عَلَى مَداحِرِ الشَّيْطانِ وَ مَزاجِرِهِ، وَالاعْتِصامِ مِنْ حَبائِلِهِ وَ مَخاتِلِهِ، وَ أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدا عَبْدُهُ وَ رَسُولُهُ وَ نَجِيبُهُ وَ صَفْوَتُهُ، لا يُؤ ازى فَضْلُهُ، وَ لا يُجْبَرُ فَقْدُهُ، أَضأَتْ بِهِ الْبِلادُ بَعْدَ الضَّلالَةِ الْمُظْلِمَةِ، وَالْجَهالَةِ الْغالِبَةِ، وَالْجَفْوَةِ الْجافِيَةِ، وَالنَّاسُ يَسْتَحِلُّونَ الْحَرِيمَ، وَ يَسْتَذِلُّونَ الْحَكِيمَ؛ يَحْيَوْنَ عَلى فَتْرَةٍ، وَ يَمُوتُونَ عَلَى كَفْرَةٍ!

ثُمَّ إِنَّكُمْ مَعْشَرَ الْعَرَبِ أَغْرَاضُ بَلايا قَدِ اقْتَرَبَتْ. فَاتَّقُوا سَكَراتِ النِّعْمَةِ، وَاحْذَرُوا بَوائِقَ النِّقْمَةِ، وَ تَثَبَّتُوا فِى قَتامِ الْعِشْوَةِ، وَاعْوِجاجِ الْفِتْنَةِ، عِنْدَ طُلُوعِ جَنِينِها، وَ ظُهُورِ كَمِينِها، وَانْتِصابِ قُطْبِها، وَ مَدارِ رَحاها. تَبْدَأُ فِى مَدارِجَ خَفِيَّةٍ، وَ تَؤُولُ إِلى فَظاعَةٍ جَلِيَّةٍ. شِبابُها كَشِبابِ الْغُلامِ، وَ آثارُها كَآثارِ السِّلامِ، تَتَوَارَثُهَا الظَّلَمَةُ بِالْعُهُودِ! أَوَّلُهُمْ قائِدٌ لِآخِرِهِمْ، وَآخِرُهُم مُقْتَدٍ بِأَوَّلِهِمْ، يَتَنافَسُونَ فِى دُنْيا دَنِيَّةٍ، وَ يَتَكالَبُونَ عَلى جِيفَةٍ مُرِيحَةٍ. وَ عَنْ قَلِيلٍ يَتَبَرَّأُ التَّابِعُ مِنَ اظلْمَتْبُوعِ، وَالْقائِدُ مِنَالْمَقُودِ، فَيَتَزايَلُونَ بِالْبَغْضأِ، وَ يَتَلاعَنُونَ عِنْدَ اللِّقأِ.

ثُمَّ يَأْتِى بَعْدَ ذلِكَ طالِعُ الْفِتْنَةِ الرَّجُوفِ، وَالْقاصِمَةِ الزَّحُوفِ، فَتَزِيغُ قُلُوبٌ بَعْدَ اسْتِقامَةٍ، وَ تَضِلُّ رِجالٌ بَعْدَ سَلامَةٍ؛ وَ تَخْتَلِفُ الْأَهْوأُ عِنْدَ هُجُومِها، وَ تَلْتَبِسُ الْآرأُ عِنْدَ نُجُومِها. مَنْ أَشْرَفَ لَها قَصَمَتْهُ، وَ مَنْ سَعى فِيها حَطَمَتْهُ. يَتَكادَمُونَ فِيها تَكادُمَ الْحُمُرِ فِى الْعانَةِ! قَدِ اضْطَرَبَ مَعْقُودُ الْحَبْلِ. وَ عَمِىَ وَجْهُ الْأَمْرِ. تَغِيضُ فِيهَا الْحِكْمَةُ، وَ تَنْطِقُ فِيهَا الظَّلَمَةُ، وَ تَدُقُّ أَهْلَ الْبَدْوِ بِمِسْحَلِها، وَ تَرُضُّهُمْ بِكَلْكَلِها! يَضِيعُ فِى غُبارِهَا الْوُحْدانُ، وَ يَهْلِكُ فِى طَرِيقِهَا الرُّكْبَانُ. تَرِدُ بِمُرّ الْقَضاءِ، وَ تَحْلُبُ عَبِيطَ الدِّماءِ، وَ تَثْلِمُ مَنارَ الدِّينِ، وَ تَنْقُضُ عَقْدَ الْيَقِينِ. يَهْرُبُ مِنْهَا الْأَكْياسُ، وَ يُدَبِّرُهَا الْأَرْجاسُ. مِرْعادٌ مِبْراقٌ، كاشِفَةٌ عَنْ ساقٍ! تُقْطَعُ فِيهَا الْأَرْحامُ، وَ يُفارَقُ عَلَيْهَا الْإِسْلامُ! بَرِيُّها سَقِيمٌ، وَ ظاعِنُها مُقِيمٌ!مِنْهَا: بَيْنَ قَتِيلٍ مَطْلُولٍ، وَ خائِفٍ مُسْتَجِيرٍ، يَخْتَلُونَ بِعَقْدِ الْأَيْمانِ وَ بِغُرُورِ الْإِيمانِ.

فَلا تَكُونُوا أَنْصابَ الْفِتَنِ، وَ أَعْلامَ الْبِدَعِ؛ وَالْزَمُوا ما عُقِدَ عَلَيْهِ حَبْلُ الْجَماعَةِ، وَ بُنِيَتْ عَلَيْهِ أَرْكانُ الطَّاعَةِ؛ وَاقْدَمُوا عَلَى اللَّهِ مَظْلُومِينَ، وَ لا تَقْدَمُوا عَلَيْهِ ظالِمِينَ؛ وَاتَّقُوا مَدارِجَ الشَّيْطانِ، وَ مَهابِطَ الْعُدْوانِ؛ وَ لا تُدْخِلُوا بُطُونَكُمْ لُعَقَ الْحَرامِ، فَإِنَّكُمْ بِعَيْنِ مَنْ حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَعْصِيَةَ، وَ سَهَّلَ لَكُمْ سَبِيلَ الطَّاعَةِ.

আমি আল্লাহর প্রশংসা করি এবং শয়তানের প্রতারণামূলক কর্মকান্ডের শাস্তি থেকে তাঁর সাহায্য এবং শয়তানের দুরভিসন্ধি (ফাঁদ) ও ওৎপাতা থেকে তাঁর আশ্রয় প্রার্থনা করি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে ,আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল। মুহাম্মদের বৈশিষ্ট্য কারো সাথে তুলনীয় নয় এবং তাঁকে হারানোর ক্ষতি কখনো পূরণীয় নয়। জনবসতিপূর্ণ স্থানসমূহ তাঁর মাধ্যমে আলোকিত হয়েছিল। সেসব স্থান পূর্বে গোমরাহির অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। সেসব স্থানে ছিলো সর্বগ্রাসী অজ্ঞতা ও রূঢ় আচরণ এবং মানুষ হারামকে হালাল মনে করতো ,জ্ঞানীদেরকে অপমানিত করতো ,পথ প্রদর্শকবিহীন অবস্থায় জীবন যাপন করতো ও অবিশ্বাসী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতো।

হে আরবের জনগণ ,তোমরা বিপর্যয়ের শিকার হবে যা সন্নিকটে রয়েছে। তোমরা সম্পদের নেশা পরিহার কর ,খোশগল্পের আডডায় সময় নষ্ট করার বিপদকে ভয় কর ,ফেতনা - ফ্যাসাদের অন্ধকার ও বক্রতায় নিজেদেরকে সুদৃঢ় ও শক্ত রাখো। যখন ফেতনার গুপ্ত প্রকৃতি তার স্বরূপ প্রকাশ করে দেয় ,তখন গোপনীয় বিষয় সর্বসমক্ষে প্রকাশিত হয় এবং এর ঘুর্ণনের অক্ষরেখা ও কিলক শক্তি সঞ্চার করে। এটা নগণ্য অবস্থা থেকে শুরু হয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থায় উন্নিত হয়। প্রারম্ভে এটা কিশোরের মত হলেও এর আঘাত প্রস্তরাঘাতের মতো বেদনাদায়ক । অত্যাচারীগণ (পরস্পর) চুক্তির ভিত্তিতে এর উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করে। তাদের প্রথম জন পরবর্তীগণের জন্য নেতা হিসাবে কাজ করে এবং পরবর্তীগণ প্রথমজনকে অনুসরণ করে। তারা ঘৃণ্য দুনিয়া নিয়ে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে এবং পুতিগন্ধময় এ শবদেহের (দুনিয়া) ওপর লাফিয়ে পড়ে। সহসাই অনুসারীগণ নেতার সাথে চুক্তি বাতিল ঘোষণা করবে এবং নেতাও অনুসারীর সাথে। পারস্পরিক কারণে তাদের মধ্যে থাকবে অনৈক্য এবং একের সাথে অপরের দেখা হলে অভিশম্পাত দেবে।

এরপর এমন এক ফেতনাবাজের আবির্ভাব ঘটবে যে বিনষ্ট জিনিস ধ্বংস করে দেবে। স্বাভাবিক স্পন্দনপ্রাপ্ত হৃদয় আবার কম্পিত হবে ,নিরাপত্তার পর মানুষ আবার বিপথগামী হবে ,কামনা - বাসনা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বহুমুখী হয়ে পড়বে এবং সঠিক ধ্যান - ধারণা তালগোল পাকিয়ে ফেলবে। এ সময়ের ফেতনার দিকে যে এগিয়ে যাবে সে ধ্বংস প্রাপ্ত হবে এবং যে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে: তাকে খতম করে দেয়া হবে। বন্য গাধা যেভাবে পালের মধ্যে কামড়া - কামড়ি করে তারাও নিজেদের মধ্যে তদ্রপ কামড়া - কামড়ি করবে। রাশির গোলাকার চক্র (সত্য ও ন্যায়) এলোমেলো হয়ে যাবে এবং কর্মকান্ডের বাহ্যিক দিকে সকলেই অন্ধ হয়ে থাকবে। এসময় জ্ঞান ও বোধশক্তিতে ভাটা পড়বে এবং জালেমগণই শুধু কথা বলার সুযোগ পাবে। এ ফেতনা তার হাতুড়ি দিয়ে বেদুইনদেরকে বিচূর্ণ করে ফেলবে এবং তার বক্ষ দ্বারা তাদেরকে পিষে ফেলবে। এর গুড়োর মধ্যে একজন পদব্রজক ডুবে যাবে এবং এর পথে একজন অশ্বারোহী ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নিয়ে এটা আসবে এবং (দুধের পরিবর্তে) তাজা রক্ত দেবে। এটা ইমানের মিনার ভেঙ্গে ফেলবে এবং দৃঢ় বিশ্বাসের বন্ধন চুর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলবে। জ্ঞানীরা এটা থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাবে ,অন্যায়কারীরা এর পৃষ্ঠপোষক হবে। এটা বজের মতো গর্জন করবে এবং বিজলীর মতে চমকাবে। এটা নিদারুণ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে। এতে আত্মীয়ের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে এবং ইসলাম পরিত্যাক্ত হবে। যে ব্যক্তি এ অবস্থা অস্বীকার করবে। সে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং যে ব্যক্তি এটা থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে তাকে এতে থাকতে বাধ্য করা হবে। তাদের মধ্যে কতেক প্রতিশোধবিহীন অবস্থায় শহীদ হবে এবং কতেক ভয়ে আতঙ্কিত হবে ও আশ্রয় প্রার্থনা করবে। তারা প্রতিশ্রুতি ও ইমানের ভান দ্বারা প্রতারিত হবে।

তোমরা ফেতনা ও বিদআতের নিশান বরদার হয়ো না। তোমরা সেপথ মেনে চলো যার ওপর উম্মাহর বন্ধন ও আনুগত্যের স্তম্ভ প্রতিষ্ঠিত। মজলুম হিসাবে তোমরা আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়ো এবং জালেম হিসাবে তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে না। শয়তানের পথ আর বিদ্রোহের স্থান এড়িয়ে চলো। তোমাদের পেটে হারাম খাদ্যকণা ঢুকিয়ো না ,কারণ তোমরা তাঁর সম্মুখীন হচ্ছে ,যিনি অবাধ্যতাকে হারাম করেছেন এবং আনুগত্যের পথকে তোমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন।

খোৎবা - ১৫১

الْحَمْدُ لِلَّهِ الدَّالِّ عَلى وُجُودِهِ بِخَلْقِهِ، وَ بِمُحْدَثِ خَلْقِهِ عَلى أَزَلِيَّتِهِ؛ وَ بِاِشْتِباهِهِمْ عَلى أَنْ لا شَبَهَ لَهُ. لا تَسْتَلِمُهُ الْمَشاعِرُ، وَ لا تَحْجُبُهُ السَّواتِرُ، لافْتِراقِ الصَّانِعِ وَالْمَصْنُوعِ، وَالْحَادِّ وَالْمَحْدُودِ، وَالرَّبِّ وَالْمَرْبُوبِ. الْأَحَدِ لا بِتَأْوِيلِ عَدَدٍ، وَالْخالِقِ لا بِمَعْنى حَرَكَةٍ وَ نَصَبٍ، وَالسَّمِيعِ لا بِأَدَاةٍ، وَالْبَصِيرِ لا بِتَفْرِيقِ آلَةٍ، وَالشَّاهِدِ لا بِمُماسَّةٍ، وَالْبائِنِ لا بِتَراخِى مَسافَةٍ، وَالظَّاهِرِ لا بِرُؤْيَةٍ، وَالْباطِنِ لا بِلَطافَةٍ، بانَ مِنَ الْأَشْيأِ بِالْقَهْرِ لَها وَالْقُدْرَةِ عَلَيْها، وَ بانَتِ الْأَشْيأُ مِنْهُ بِالْخُضُوعِ لَهُ وَالرُّجُوعِ إِلَيْهِ، مَنْ وَصَفَهُ فَقَدْ حَدَّهُ، وَ مَنْ حَدَّهُ فَقَدْ عَدَّهُ، وَ مَنْ عَدَّهُ فَقَدْ أَبْطَلَ أَزَلَهُ، وَ مَنْ قالَ:«كَيْفَ» فَقَدِ اسْتَوْصَفَهُ، وَ مَنْ قالَ:«أَيْنَ» فَقَدْ حَيَّزَهُ. عالِمٌ إِذْ لا مَعْلُومٌ، وَرَبُّ إِذْ لا مَرْبُوبٌ، وَ قَادِرٌ إِذْ لا مَقْدُورَ.

فضل العترة فی القرآن

مِنْهَا: قَدْ طَلَعَ طالِعٌ، وَ لَمَعَ لامِعٌ، وَ لاحَ لائِحٌ، وَاعْتَدَلَ مائِلٌ؛ وَاسْتَبْدَلَ اللَّهُ بِقَوْمٍ قَوْماً، وَ بِيَوْمٍ يَوْماً؛ وَانْتَظَرْنَا الْغِيَرَ انْتِظارَ الْمُجْدِبِ الْمَطَرَ. وَ إِنَّمَا الْأَئِمَّةُ قُوّامُ اللَّهِ عَلى خَلْقِهِ، وَ عُرَفاؤُهُ عَلى عِبادِهِ؛ لا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلا مَنْ عَرَفَهُمْ وَ عَرَفُوهُ، وَ لا يَدْخُلُ النَّارَ إِلا مَنْ أَنْكَرَهُمْ وَ أَنْكَرُوهُ. إنَّ اللّهَتَعالَى خَصَّكُمْ بِالْإِسْلاَمِ، وَاسْتَخْلَصَكُمْ لَهُ، وَ ذلِكَ لِأَنَّهُ اسْمُ سَلامَةٍ وَ جِماعُ كَرامَةٍ، اصْطَفَى اللَّهُتَعالى مَنْهَجَهُ.

خصائص القرآن

وَ بَيَّنَ حُجَجَهُ، مِنْ ظاهِرِ عِلْمٍ وَ باطِنِ حُكْمٍ، لا تَفْنَى غَرائِبُهُ، وَ لا تَنْقَضِى عَجائِبُهُ. فِيهِ مَرابِيعُ النِّعَمِ، وَ مَصابِيحُ الظُّلَمِ، لا تُفْتَحُ الْخَيْراتُ إِلا بِمَفاتِحِهِ، وَ لا تُكْشَفُ الظُّلُماتُ إِلا بِمَصابِحِهِ، قَدْ أَحْمى حِماهُ، وَ أَرْعى مَرْعاهُ، فِيهِ شِفأُ الْمُشْتَفِى، وَ كِفايَةُ الْمُكْتَفِى.

আল্লাহর মহত্ত্ব ও ইমাম সম্পর্কে

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর ,তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বের প্রমাণ ,তাঁর সৃষ্টির নতুনত্বের মাধ্যমে তাঁর সত্তার বহিঃপ্রকাশ এবং সৃষ্টি পারস্পরিক সাদৃশ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত যে ,তার সদৃশ কোন কিছুই নেই। বোধি তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না এবং পদ তাঁকে আবৃত করতে পারে না ,শুধুমাত্র স্রষ্টা ও সৃষ্টের ব্যবধানের কারণে সীমাবদ্ধকারী ও সীমিতের কারণে এবং ধারক ও ধারিতের কারণে। তিনি এক কিন্তু গণনায় প্রথম দ্বারা নয় ;তিনি স্রষ্টা কিন্তু কর্ম বা শ্রমের দ্বারা নয় ;তিনি শ্রবণকারী কিন্তু শারীরিক অঙ্গ দ্বারা নয় ;তিনি দর্শনকারী কিন্তু চোখের পাতা প্রসারণ দ্বারা নয় ;তিনি সাক্ষী কিন্তু নৈকট্য দ্বারা নয় ;তিনি নিকটবর্তী কিন্তু দূরত্বের পরিমাপ দ্বারা নয় ;তিনি প্রকাশ্য কিন্তু দৃষ্টিগ্রাহ্যতা দ্বারা নয় ;তিনি গুপ্ত কিন্তু (দেহের) সূক্ষ্ণতা দ্বারা নয়। তিনি বস্তু থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ,কারণ তিনি তাদের পরাভূত করেন এবং তাদের ওপর কুদরত প্রয়োগ করেন। অপরপক্ষে বস্তু তার থেকে আলাদা তাদের পরাজয় ও তার প্রতি প্রত্যাবর্তনের কারণে । যে তার বর্ণনা দেয় সে তাকে সীমায়িত করে। যে তাকে সীমায়িত করে সে তাকে সংখ্যায়িত করে। যে তাকে সংখ্যায়িত করে সে তাঁর অবিনশ্বরতা অগ্রাহ্য করে। যে বলে আল্লাহ কিরূপ ” সে তাঁর বর্ণনার অন্বেষণ করে। যে বলে আল্লাহ কোথায় ” । সে তাকে সীমাবদ্ধতায় আনতে চায়। তিনি তখনো জ্ঞাতা যখন জানার মতো কিছুই ছিল না। তিনি তখনো ধারক যখন ধারণ করার মতো কিছুই ছিল না। তিনি তখনো সর্বশক্তিমান যখন পরাভূত করার মতো কিছুই ছিল না।

ইমাম (আধ্যাত্মিক নেতা) সম্পর্কে

যে জেগে ওঠার - ওঠেছে ,যে আলোক উদ্দীপ্ত হবার - হয়েছে ,যে হাজির হবার - হয়েছে এবং বক্রতা সোজা করা হয়েছে। আল্লাহ একটা জনগোষ্ঠী দ্বারা অন্য একটা জনগোষ্ঠী এবং একটা দিন দ্বারা অন্য একটা দিন প্রতিস্থাপিত করেছেন। এ পরিবর্তনের জন্য আমরা অপেক্ষা করেছিলাম। যেমন করে খরা পীড়িতরা বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। নিশ্চয়ই ,ইমামগণ আল্লাহর বান্দাদের কাছে তাঁর প্রতিনিধি এবং তারা আল্লাহকে চিনিয়ে দেন। আল্লাহ ও ইমামগণকে না চেনা ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং ইমামগণ ও আল্লাহকে অস্বীকারকারী ব্যতীত কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।

কোরআন সম্পর্কে

মহিমান্বিত আল্লাহ ইসলাম দ্বারা তোমাদেরকে বিশিষ্ট করেছেন এবং তোমাদেরকে ইসলামের জন্য পছন্দ করেছেন। কারণ নিরাপত্তা ও সম্মানের নাম ইসলাম।

মহিমান্বিত আল্লাহ ইসলামের পথকে পছন্দ করেছেন এবং প্রকাশ্য জ্ঞান ও গোপন প্রবচন দ্বারা এর ওজরসমূহ উন্মুক্ত করেছেন। এর বিস্ময় (কুরআন) কখনো ফুরিয়ে যাবে না এবং এর তাৎপর্য কখনো শেষ হবে না। এতে রয়েছে অগণিত নেয়ামত ও অন্ধকারের প্রদীপ। ন্যায় ও সত্যের দরজা কুরআন - চাবি ব্যতীত খোলা যায় না এবং অন্ধকারের গ্লানি কুরআন - প্রদীপ ব্যতীত দূর করা যায় না। আল্লাহ এর অপ্রবেশ্য বিষয় (শক্র হতে) সংরক্ষণ করেছেন এবং এর চারণভূমিতে (অনুসারীগণকে) বিচরণ করার অনুমতি দিয়েছেন। এতে রয়েছে (গোমরাহি রোগাক্রান্ত) রোগীর চিকিৎসা এবং মুক্তি সন্ধানীর জন্য মুক্তি।

খোৎবা - ১৫২

اهل الضلاّل

وَ هُوَ فِي مُهْلَةٍ مِنَ اللَّهِ يَهْوِى مَعَ الْغافِلِينَ، وَ يَغْدُو مَعَ الْمُذْنِبِينَ، بِلا سَبِيلٍ قاصِدٍ، وَ لا إِمامٍ قائِدٍ. حَتَّى إِذَا كَشَفَ لَهُمْ عَنْ جَزأِ مَعْصِيَتِهِمْ، وَاسْتَخْرَجَهُمْ مِنْ جَلابِيبِ غَفْلَتِهِمُ، اسْتَقْبَلُوا مُدْبِراً، وَ اسْتَدْبَرُوا مُقْبِلاً، فَلَمْ يَنْتَفِعُوا بِما أَدْرَكُوا مِنْ طَلِبَتِهِمْ، وَ لا بِما قَضَوْا مِنْ وَطَرِهِمْ. وَ إِنِّى أُحَذِّرُكُمْ وَ نَفْسِى هَذِهِ الْمَنْزِلَةَ. فَلْيَنْتَفِعِ امْرُؤٌ بِنَفْسِهِ.

فَإِنَّمَا الْبَصِيرُ مَنْ سَمِعَ فَتَفَكَّرَ، وَ نَظَرَ فَأَبْصَرَ، وَانْتَفَعَ بِالْعِبَرِ ثُمَّ سَلَكَ جَدَداً واضِحاً يَتَجَنَّبُ فِيهِ الصَّرْعَةَ فِى الْمَهاوِى، وَالضَّلالَ فِى الْمَغاوِى، وَ لا يُعِينُ عَلَى نَفْسِهِ الْغُواةَ، بِتَعَسُّفٍ فِى حَقِّ، أَوْ تَحْرِيفٍ فِى نُطْقٍ، أَوْ تَخَوُّفٍ مِنْ صِدْقٍ.

فَأَفِقْ أَيُّهَا السَّامِعُ مِنْ سَكْرَتِكَ. وَاسْتَيْقِظْ مِنْ غَفْلَتِكَ، وَاخْتَصِرْ مِنْ عَجَلَتِكَ، وَ أَنْعِمِ الْفِكْرَ فِيما جاءَكَ عَلى لِسانِ النَّبِىِّ الْأُمِّىِّصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مِمَّا لابُدَّ مِنْهُ، وَ لا مَحِيصَ عَنْهُ، وَ خالِفْ مَنْ خالَفَ ذلِكَ إِلى غَيْرِهِ، وَدَعْهُ وَ ما رَضِىَ لِنَفْسِهِ، وَضَعْ فَخْرَكَ، وَاحْطُطْ كِبْرَكَ، وَاذْكُرْ قَبْرَكَ فَإِنَّ عَلَيْهِ مَمَرَّكَ، وَ كَما تَدِينُ تُدانُ، وَ كَما تَزْرَعُ تَحْصُدُ، وَ ما قَدَّمْتَ الْيَوْمَ تَقْدَمُ عَلَيْهِ غَداً، فَامْهَدْ لِقَدَمِكَ، وَقَدِّمْ لِيَوْمِكَ. فَالْحَذَرَ الْحَذَرَ أَيُّهَا الْمُسْتَمِعُ! وَالْجِدَّ الْجِدَّ أَيُّهَا الْغافِلُ! وَ لا يُنَبِّئُكَ مِثْلُ خَبِيرٍ.

إِنَّ مِنْ عَزائِمِ اللَّهِ فِى الذِّكْرِ الْحَكِيمِ، الَّتِى عَلَيْها يُثِيبُ وَ يُعاقِبُ، وَ لَها يَرْضى وَ يَسْخَطُ، أَنَّهُ لا يَنْفَعُ عَبْداً -وَ إِنْ أَجْهَدَ نَفْسَهُ وَأَخْلَصَ فِعْلَهُ - أَنْ يَخْرُجَ مِنَ الدُّنْيا، لاقِياً رَبَّهُ بِخَصْلَةٍ مِنْ هَذِهِ الْخِصالِ لَمْ يَتُبْ مِنْهَا: أَنْ يُشْرِكَ بِاللَّهِ فِيمَا افْتَرَضَ عَلَيْهِ مِنْ عِبادَتِهِ، أَوْ يَشْفِى غَيْظَهُ بِهَلاكِ نَفْسٍ، أَوْ يَعُرَّ بِأَمْرٍ فَعَلَهُ غَيْرُهُ، أَوْ يَسْتَنْجِحَ حاجَةً إِلَى النَّاسِ بِإِظْهارِ بِدْعَةٍ فِى دِينِهِ، أَوْ يَلْقَى النَّاسَ بِوَجْهَيْنِ، أَوْ يَمْشِىَ فِيهِمْ بِلِسانَيْنِ. اعْقِلْ ذلِكَ فَإِنَّ الْمِثْلَ دَلِيلٌ عَلَى شِبْهِهِ.

إِنَّ الْبَهائِمَ هَمُّها بُطُونُها؛ وَ إِنَّ السِّباعَ هَمُّهَا الْعُدْوانُ عَلَى غَيْرِهَا؛ وَ إِنَّ النِّسأَ هَمُّهُنَّ زِينَةُ الْحَياةِ الدُّنْيا وَالْفَسادُ فِيها؛ إِنَّ الْمُؤْمِنِينَ مُسْتَكِينُونَ. إِنَّ الْمُؤْمِنِينَ مُشْفِقُونَ. إِنَّ الْمُؤْمِنِينَ خَائِفُونَ.

পথ ভ্রষ্টদের সম্পর্কে

আল্লাহ তাদের সময় মঞ্জুর করেছেন। তারা অবহেলাকারী ব্যক্তিদের সাথে এসে ভ্রমে পতিত হচ্ছিলো এবং চলার কোন রাস্তা বা পথ দেখানোর ইমাম ছাড়া পাপীদের সাথে প্রত্যুষে চলে যায়। অবশেষে আল্লাহ যখন তাদের পাপের পরিণাম তাদের কাছে স্পষ্ট করবেন এবং তাদের অমনোযোগিতার পর্দা থেকে তাদেরকে বের করে আনবেন তখন তারা সেদিকে এগিয়ে যাবে যেদিক থেকে পালিয়ে এসেছিল এবং যে দিকে তারা যাচ্ছিলো সেদিক থেকে পালিয়ে যাবে। যে অভাব তারা মিটিয়েছিল বা যে কামনা তারা পূর্ণ করেছিল তা থেকে তারা উপকৃত হবে না। এ অবস্থা থেকে আমি তোমাদেরকে ও আমার নিজেকে সতর্ক করি। মানুষ তার নিজের থেকেই উপকৃত হতে পারে।

নিশ্চয়ই ,সে ব্যক্তি বুদ্ধিমান যে শোনে ও তা নিয়ে চিন্তা করে ;যে দেখে ও পর্যবেক্ষণ করে ;যে শিক্ষামূলক বিষয়বস্তু থেকে লাভবান হয় এবং পরে সুস্পষ্ট পথে চলে। সেপথে চললে সে খাদ - খন্দকে পতিত হওয়া থেকে বেঁচে যায় ও পথভ্রষ্ট হয়ে চোরাগর্তে আপতন থেকে রক্ষা পায়। সত্যবাদিতার দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যারা তাকে গোমরাহির দিকে নিয়ে যেতে চায় সে তার কথা পরিবর্তন করে অথবা সত্যের ভয়ে তাদেরকে সহায়তা করে না ।

হে শ্রোতামণ্ডলী ,তোমরা নেশাগ্রস্থতা থেকে মুক্ত হও ,তন্দ্রা থেকে জেগে ওঠো ,তোমাদের দুনিয়ামুখি তৎপরতা কমিয়ে ফেলো ,উম্মি নবীর মাধ্যমে যেসব অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক বিষয়াদি তোমাদের কাছে এসেছে তা ভালোভাবে ভেবে দেখ। তোমরা সেসব লোক থেকে দূরে থেকো যারা তাঁর বিরোধিতা করে এবং যা তারা নিজেদের মনমত গ্রহণ করেছে তা ত্যাগ কর। আত্মশ্লাঘা পরিহার কর ,উদ্ধত স্বভাব ত্যাগ কর এবং কবরকে স্মরণ কর ,কারণ সময় তোমাদের সেদিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তোমরা অন্যের সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করবে সেরূপ ব্যবহার পাবে ,তোমাদের যেমন কর্ম তেমন ফল হবে এবং আজ যা প্রেরণ করবে কাল তাই ফেরত পাবে। সুতরাং তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় কর এবং হিসাব - নিকাশের দিনের জন্য কিছু সৎ আমল আগেই প্রেরণ করা। ভয় কর ,ভয় কর ,হে শ্রোতামণ্ডলী! আমল কর ,আমল কর ,হে বেখবর! কেউ তোমাদেরকে আমার মতো সতর্ক করবে না।

প্রাজ্ঞ - স্মারকে (কুরআন) আল্লাহর দৃঢ় সিদ্ধান্ত রয়েছে যে ,যদি কেউ ইবাদতের সময় আল্লাহর অংশীদারে বিশ্বাস করে ,অথবা কাউকে হত্যা করে নিজের ক্রোধ প্রশমিত করে ,অথবা অন্যের আমলের সমালোচনা করে ,অথবা আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিজের দ্বীনে বেদা ’ তের প্রক্ষেপ ঘটায় ,অথবা দ্বীমুখী স্বভাব নিয়ে মানুষের সঙ্গে চলে ,অথবা দ্বীমুখী কথা বলে মানুষের সাথে মেলামেশা করে ,তবে সে যতই সচেষ্ট হোক আর আন্তরিকভাবে আমল করুক না কেন তওবা করা ব্যতীত এ দুনিয়া ত্যাগ করে আল্লাহর কাছে চলে গেলে তার আমল কোন উপকারে আসবে না। কুরআনের এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আল্লাহ পুরস্কার অথবা শাস্তি প্রদান করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি পছন্দ অথবা অপছন্দ করে থাকেন। এটা বুঝে নাও কারণ উদাহরণ এর সাদৃশ্যের জন্য উত্তম দেশনা।

পশু তার পেট নিয়েই উদ্বীগ্ন। হিংস্র প্রাণী অন্যকে আক্রমণ করায় উদ্বীগ্ন। নারী অমর্যাদাকর জীবনের আভরণ ও ফেতনা সৃষ্টিতে উদ্বীগ্ন। অপরপক্ষে ইমানদারগণ বিনয়ী ,আল্লাহর প্রশংসাকারী ও আল্লাহর ভয়ে ভীত ।

____________________

১। রাসূল (সা.) সম্বন্ধে উম্মি ” শব্দটি কুরআনের সূরা আরাফের ১৫৭ - ১৫৮ আয়াতে (৭ : ১৫৭ - ১৫৮) ব্যবহৃত হয়েছে। এর বিশদ ব্যাখ্যা জানার জন্য কুরআনের তফসির দ্রষ্টব্য।

২। ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন যে ,জামালের যুদ্ধে বসরা অভিমুখে যাত্রাকালে এ খোৎবা প্রদান করেন। বসরার গোলযোগের মূল কারণ ছিল একজন নারীর (আয়শা) ইন্ধন। সে কারণে পশু ও হিংস্র প্রাণীর স্বভাব উল্লেখ করে নারীর মধ্যে তা বিদ্যমান আছে বলে আমিরুল মোমেনিন অভিমত ব্যক্ত করেন এবং তার ফলশ্রুতিই জামালের যুদ্ধ ,যাতে হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছিল।

খোৎবা - ১৫৩

وَ ناظِرُ قَلْبِ اللَّبِيبِ بِهِ يُبْصِرُ أَمَدَهُ، وَ يَعْرِفُ غَوْرَهُ وَ نَجْدَهُ. داعٍ دَعا، وَ راعٍ رَعى، فَاسْتَجِيبُوا لِلدَّاعِى، وَاتَّبِعُوا الرَّاعِي. قَدْ خاضُوا بِحارَ الْفِتَنِ، وَأَخَذُوا بِالْبِدَع دُونَ السُّنَنِ. وَ أَرَزَ الْمُؤْمِنُونَ، وَ نَطَقَ الضَّالُّونَ الْمُكَذِّبُونَ. نَحْنُ الشِّعارُ وَالْأَصْحابُ، وَالْخَزَنَةُ وَالْأَبْوابُ؛ وَ لا تُؤ تَى الْبُيُوتُ إِلا مِنْ أَبْوابِها، فَمَنْ أَتاها مِنْ غَيْرِ أَبْوابِها، سُمِّيَ سارِقاً.مِنْها: فِيهِمْ كَرائِمُ الايمانِ، وَ هُمْ كُنُوزُ الرَّحْمَنِ، إِنْ نَطَقُوا صَدَقُوا، وَ إِنْ صَمَتُوا لَمْ يُسْبَقُوا.

شروط الامامة

فَلْيَصْدُقْ رائِدٌ أَهْلَهُ، وَ لْيُحْضِرْ عَقْلَهُ، وَلْيَكُنْ مِنْ أَبْنأِ الْآخِرَةِ، فَإِنَّهُ مِنْها قَدِمَ وَ إِلَيْها يَنْقَلِبُ، فَالنَّاظِرُ بِالْقَلْبِ الْعامِلُ بِالْبَصَرِ يَكُونُ مُبْتَدَأُ عَمَلِهِ أَنْ يَعْلَمَ: أَعَمَلُهُ عَلَيْهِ أَمْ لَهُ! فَإِنْ كانَ لَهُ مَضى فِيهِ، وَ إِنْ كانَ عَلَيْهِ وَقَفَ عَنْهُ. فَإِنَّ الْعامِلَ بِغَيْرِ عِلْمٍ كَالسَّائِرِ عَلَى غَيْرِ طَرِيقٍ. فَلا يَزِيدُهُ بُعْدُهُ عَنِ الطَّرِيقِ الْوَاضِحِ إِلا بُعْدا مِنْ حاجَتِهِ. وَالْعامِلُ بِالْعِلْمِ كَالسَّائِرِ عَلَى الطَّرِيقِ الْواضِحِ. فَلْيَنْظُرْ ناظِرٌ: أَسائِرٌ هُوَ أَمْ راجِعٌ!.

تقابل الروح و الجسد

وَاعْلَمْ أَنَّ لِكُلِّ ظاهِرٍ باطِناً عَلَى مِثالِهِ، فَما طابَ ظاهِرُهُ طابَ باطِنُهُ، وَ ما خَبُثَ ظاهِرُهُ خَبُثَ باطِنُهُ، وَ قَدْ قالَ الرَّسُولُ الصَّادِقُصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم : «إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ وَ يُبْغِضُ عَمَلَهُ، وَ يُحِبُّ الْعَمَلَ وَ يُبْغِضُ بَدَنَهُ». وَاعْلَمْ أَنَّ لِكُلِّ عَمَلٍ نَباتاً، وَ كُلُّ نَباتٍ لا غِنَى بِهِ عَنِ الْماءِ، وَالْمِياهُ مُخْتَلِفَةٌ؛ فَما طابَ سَقْيُهُ طابَ غَرْسُهُ وَ حَلَتْ ثَمَرَتُهُ، وَ ما خَبُثَ سَقْيُهُ خَبُثَ غَرْسُهُ وَ أَمَرَّتْ ثَمَرَتُهُ.

আহলে বাইত (আ.) অনুসরনের প্রয়োজনীয়তা

যে বুদ্ধিমান সে তার লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি রাখে। সে জানে তার রাস্তার কোনটি উচু আর কোনটি নিচু। আহ্বানকারী আহবান করছে মেষপালক তার মেষের পালকে ডাকছে। সুতরাং আহবানকারীর ডাকে সাড়া দাও এবং রাখালকে অনুসরণ করা। বিরোধীগণ বিভ্রান্তি ও গোলযোগের সমুদ্রে প্রবেশ করেছে এবং রাসূলের (সা.) সুন্নাহর পরিবর্তে বেদআত মেনে চলে। ইমানদারগণ দমে পড়েছে এবং গোমরাহ ও মিথ্যাবাদীরা বুক ফুলিয়ে কথা বলছে। আমরা রাসূলের (সা.) আপনজন ,তার সাহাবি ,তার সম্পদ - ভাণ্ডার এবং তাঁর সুন্নাহর দরজা। দরজা ছাড়া কোন ঘরে প্রবেশ করা যায় না। যে ব্যক্তি দরজা ছাড়া অন্য পথে প্রবেশ করে সে চোর বলেই অভিহিত । আহলে বাইত কুরআনের সূক্ষ্মতা এবং তারাই আল্লাহর ধন - ভাণ্ডার। তারা যখন কথা বলে - সত্য কথা বলে ;কিন্তু যখন তাঁরা নিশ্চুপ থাকে তখন কেউ কথা বলতে পারে না ,যে পর্যন্ত না তারা কথা বলে।

ইমামত বা নেতৃত্বের শর্তাবলী

অগ্রদূত (যে ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির আগমন সূচিত করেন) তাঁর লোকজনের কাছে সঠিক প্রতিবেদন পেশ করবে ,তার মানসিক ক্ষিপ্রতা রেখে যাবে এবং তাঁকে পরকালের সুযোগ্য সন্তান হতে হবে ,কারণ তিনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই প্রত্যাবর্তন করবেন। যে ব্যক্তি হৃদয় দিয়ে দেখে ও চোখ দিয়ে আমল করে ,তার আমল শুরু হয় এটা মূল্যায়নের মধ্যে যে ,সে আমলটি তার পক্ষে যাবে নাকি তার বিরুদ্ধে যাবে। যদি তা তার অনুকূলে যায় তবে সে তা করবে। আর যদি তার প্রতিকূলে যায়। তবে সে তা থেকে দূরে থাকবে। কারণ কোন কিছু না জেনে আমল করা মানেই হলো পথ ছাড়া চলা। কাজেই পথ ছেড়ে চললে লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যায় - লক্ষ্য অর্জিত হয় না এবং যে ব্যক্তি জ্ঞানানুসারে আমল করে সে ওই ব্যক্তির মতো যে সুস্পষ্ট পথে চলে। কাজেই ,যে দেখতে পারে তার দেখা উচিত ;সে সামনে এগিয়ে যাবে নাকি ফিরে আসবে।

দেহ এবং আত্মার প্রভাব

জেনে রাখো ,যেকোন জিনিসের জাহের যেমন বাতেনও তেমন। যে জিনিসের জাহের ভালো তার বাতেনও ভালো এবং যে জিনিসের জাহের মন্দ তার বাতেনও মন্দ। রাসূল (সা.) বলেছেন , আল্লাহ কোন লোককে ভালোবাসলেও তাঁর আমলকে ঘৃণা করতে পারেন ,আবার কোন আমলকে ভালোবাসলেও লোকটিকে ঘৃণা করতে পারেন। ” জেনে রাখো ,প্রতিটি আমল অঙ্কুর উদগমের মতো। অঙ্কুর যেমন পানি ছাড়া উদগম হতে পারে না ;পানি আবার নানা রকম হয়ে থাকে। সুতরাং পানি যেখানে ভালো হয় চারাও সেখানে ভালো হয় এবং এর ফলও মিষ্ট হয় ;যেখানে পানি খারাপ হয়। সেখানে চারাও খারাপ হবে এবং এর ফলও তিক্ত হবে।

খোৎবা - ১৫৪

يَذْكُرُ فِيها بَدِيعَ خِلْقَةِ الْخُفَاشِ

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى انْحَسَرَتِ الْأَوْصافُ عَنْ كُنْهِ مَعْرِفَتِهِ، وَرَدَعَتْ عَظَمَتُهُ الْعُقُولَ فَلَمْ تَجِدْ مَساغا إِلى بُلُوغِ غايَةِ مَلَكُوتِهِ! هُوَاللَّهُ الْحَقُّ الْمُبِينُ، أَحَقُّ وَ أَبْيَنُ مِمَّا تَرَى الْعُيُونُ، لَمْ تَبْلُغْهُ الْعُقُولُ بِتَحْدِيدٍ فَيَكُونَ مُشَبَّهاً، وَ لَمْ تَقَعْ عَلَيْهِ الْأَوْهامُ بِتَقْدِيرٍ فَيَكُونَ مُمَثَّلاً. خَلَقَ الْخَلْقَ عَلى غَيْرِ تَمْثِيلٍ وَ لا مَشُورَةِ مُشِيرٍ وَ لا مَعُونَةِ مُعِينٍ، فَتَمَّ خَلْقُهُ بِأَمْرِهِ، وَ أَذْعَنَ لِطاعَتِهِ، فَأَجابَ وَ لَمْ يُدافِعْ، وَانْقَادَ وَ لَمْ يُنازِعْ.

وَ مِنْ لَطائِفِ صَنْعَتِهِ، وَ عَجائِبِ خِلْقَتِهِ، ما أَرانا مِنْ غَوامِضِ الْحِكْمَةِ فِى هَذِهِ الْخَفافِيش الَّتِى يَقْبِضُهَا الضِّيأُ الْباسِطُ لِكُلِّ شَىْءٍ، وَ يَبْسُطُهَا الظَّلامُ الْقابِضُ لِكُلِّ حَي، وَ كَيْفَ عَشِيَتْ أَعْيُنُها عَنْ أَنْ تَسْتَمِدَّ مِنَ الشَّمْسِ الْمُضِيئَةِ نُورا تَهْتَدِى بِهِ فِى مَذاهِبِها، وَ تَتَّصِلُ بِعَلانِيَةِ بُرْهانِ الشَّمْسِ إِلى مَعارِفِها. وَرَدَعَها بِتَلَأْلُؤِ ضِيائِها عَنِ الْمُضِىِّ فِى سُبُحاتِ إِشْراقِها، وَ أَكَنَّها فِى مَكامِنِها عَنِ الذَّهابِ فِى بُلَجِ ائْتِلاقِها، فَهِىَ مُسْدَلَةُ الْجُفُونِ بِالنَّهارِ عَلى أَحْداقِها، وَ جاعِلَةُ اللَّيْلِ سِراجا تَسْتَدِلُّ بِهِ فِى الْتِمَاسِ أَرْزاقِها، فَلا يَرُدُّ أَبْصارَها إِسْدافُ ظُلْمَتِهِ، وَ لا تَمْتَنِعُ مِنَ الْمُضِىِّ فِيهِ لِغَسَقِ دُجْنَتِهِ، فَإِذا أَلْقَتِ الشَّمْسُ قِناعَها، وَبَدَتْ أَوْضاحُ نَهارِها، وَ دَخَلَ مِنْ إِشْراقِ نُورِها عَلَى الضِّبابِ فِى وِجارِها، أَطْبَقَتِ الْأَجْفانَ عَلَى مَآقِيها، وَ تَبَلَّغَتْ بِما اكْتَسَبَتْهُ مِنَ الْمَعاشِ فِى ظُلَمِ لَيالِيها. فَسُبْحانَ مَنْ جَعَلَ اللَّيْلَ لَها نَهارا وَ مَعاشا، وَالنَّهارَ سَكَنا وَ قَرارا، وَ جَعَلَ لَها أَجْنِحَةً مِنْ لَحْمِها تَعْرُجُ بِها عِنْدَ الْحاجَةِ إِلى الطَّيَرانِ كَأَنَّها شَظايَا الْآذانِ، غَيْرَ ذَواتِ رِيشٍ وَ لا قَصَبٍ، إِلا أَنَّكَ تَرى مَواضِعَ الْعُرُوقِ بَيِّنَةً أَعْلاماً. لَها جَناحانِ لَمْ يَرِقّا فَيَنْشَقّا، وَ لَمْ يَغْلُظا فَيَثْقُلا. تَطِيرُ وَ وَلَدُها لاصِقٌ بِها، لاجِئٌ إِلَيْها، يَقَعُ إِذا وَقَعَتْ، وَ يَرْتَفِعُ إِذا ارْتَفَعَتْ، لا يُفارِقُها حَتّى تَشْتَدَّ أَرْكانُهُ، وَ يَحْمِلَهُ لِلنُّهُوضِ جَناحُهُ، وَيَعْرِفَ مَذاهِبَ عَيْشِهِ، وَ مَصالِحَ نَفْسِهِ. فَسُبْحانَ الْبارِئُ لِكُلِّ شَىْءٍ، عَلى غَيْرِ مِثالٍ خَلا مِنْ غَيْرِهِ!.

বাদুরের আশ্চর্যজনক সৃষ্টি সম্পর্কে

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি এমন যে ,তার সম্বন্ধে জ্ঞানের বাস্তবতা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তার মহত্ত্ব বর্ণনা করতে গেলে মানুষের বুদ্ধি - জ্ঞান স্থবির হয়ে পড়ে। সুতরাং মানুষ তার রাজ্যের সীমাপরিসীমা নির্ধারণ করতে পারে না। তিনিই আল্লাহ - মহাসত্য - সত্যের মহাপ্রকাশ। চোখ যা দেখে তা অপেক্ষা তিনি অধিক সত্য - অধিক স্ব - প্রকাশ। বুদ্ধি দ্বারা তাকে উপলব্ধি করা যায় না ,কারণ তাতে সীমা নির্ধারণের প্রশ্ন আসে এবং সীমা নির্ধারণ করলেই তাকে গুণের আকারে আবদ্ধ করা হবে। ধারণা দিয়ে তাঁকে বুঝা যায় না ,কারণ তাতে তাঁর গুণাগুণ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সেক্ষেত্রে তার প্রতি গুণসম্পন্ন দৈহিক অবস্থা আরোপ করা হয়। তিনি সৃষ্টিকে অস্তিত্ত্বে এনেছেন কিন্তু সেজন্য কোন নমুনার প্রয়োজন হয়নি ,কোন উপদেষ্টার পরামর্শের প্রয়োজন হয়নি এবং কোন সাহায্যকারীর সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। তাঁর নির্দেশেই সৃষ্টি সম্পন্ন হয়েছে এবং আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ আনত হয়েছে। সৃষ্টি তাঁর প্রতি সাড়া দিয়েছে এবং তাঁকে অস্বীকার করেনি। সৃষ্টি তাঁর আদেশ মান্য করেছে এবং তাতে দ্বীরুক্তি করেনি ।

তাঁর মাহাত্ম্যপূর্ণ ও আশ্চর্যজনক সৃষ্টির গভীর তাৎপর্যের একটা উদাহরণ (যা তিনি আমাদেরকে দেখিয়েছেন) হলো বাদুর যারা দিবালোকে নিজেদেরকে গোপন করে রাখে। অথচ দিবালোক অন্যসব কিছুকে দৃশ্যমান করে ,যারা রাত্রিকালে বের হয়। অথচ রাত জীবন্ত সব কিছুকে গোপন করে। কিরূপে সূর্যের আলো এদের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয় এবং পথ চলার জন্য ও গন্তব্যস্থলে পৌছার জন্য এদের সূর্যের আলোর প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ বাদুরকে সূর্যের উজ্জ্বল আলোতে চলাফেরা থেকে বিরত করেছেন এবং দিনের বেলায় বাইরে যাবার পরিবর্তে গোপন স্থানে থাকতে বাধ্য করেছেন। ফলে দিনে এরা চোখের পাতা বন্ধ করে রাখে এবং রাতকে প্রদীপ হিসাবে কাজে লাগিয়ে জীবিকার অন্বেষণে বেরিয়ে পড়ে। রাতের অন্ধকার তাদের দৃষ্টিশক্তিতে কোন বাধার সৃষ্টি করতে পারে না এবং অন্ধকারের গাঢ়ত্ব এদের চলাফেরা বন্ধ করতে পারে না। যখনই সূর্য তার ঘোমটা খোলে ও ভোরের রশ্মি দেখা দেয় অমনি গিরগিটি গর্তে ঢোকে। আর বাদুর চোখের ওপরে চোখের পাতা টেনে দেয় এবং রাতের অন্ধকারে যা সংগ্রহ করেছে তা দিয়ে জীবন ধারণ করে। তিনিই মহিমান্বিত যিনি রাতকে তাদের জীবিকা সংগ্রহের জন্য দিন করেছেন এবং দিনকে তাদের বিশ্রামের জন্য রাত করেছেন। তিনি বাদুরকে মাংশল পাখা দিয়েছেন যাতে তারা প্রয়োজনে উড়ে ওপরে ওঠতে পারে। পাখাগুলো কানের অগ্রভাগের মতো দেখায় যাতে কোন পালক ও হাড় নেই। অবশ্য পাখার শিরাগুলো পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। তাদের দুটি পাখা আছে যা এমন পাতলা নয় যাতে উড়তে উল্টে যাবে। আবার এমন পুরুও নয় যাতে ভারী অনুভূত হবে। যখন তারা উড়ে তখন তাদের বাচ্চা তাদেরকে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং তাদের সাথে আশ্রয় নেয় ,যখন তারা নিচে নেমে আসে তখন নিচে নামে ও যখন তারা ওপরে ওঠে তখন ওপরে ওঠে। বাচ্চাগুলোর অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ শক্ত হয়ে নিজে নিজে উড়ে ওপরে ওঠার ও নিজের বাসস্থান চেনার পূর্ব পর্যন্ত বাদুর তাদের বাচ্চাকে ত্যাগ করে না। তিনিই মহিমান্বিত যিনি কারো দ্বারা পূর্বে প্রস্তুতকৃত কোন নমুনা ছাড়াই সব কিছু সৃষ্টি করেছেন।

খোৎবা - ১৫৫

خاطَبَ بِهِ أَهْلَ الْبَصرَةِ

فَمَنِ اسْتَطاعَ عِنْدَ ذلِكَ أَنْ يَعْتَقِلَ نَفْسَهُ، عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ، فَلْيَفْعَلْ. فَإِنْ أَعْتُمُونِى فَإِنِّى حامِلُكُمْ - إِنْ شأَ اللَّهُ - عَلَى سَبِيلِ الْجَنَّةِ، وَ إِنْ كانَ ذا مَشَقَّةٍ شَدِيدَةٍ، وَ مَذاقَةٍ مَرِيرَةٍ. وَ أَمّا فُلانَةُ فَأَدْرَكَها رَأْىُ النِّسأِ، وَ ضِغْنٌ غَلا فِى صَدْرِها كَمِرْجَلِ الْقَيْنِ، وَ لَوْ دُعِيَتْ لِتَنالَ مِنْ غَيْرِى مَا أَتَتْ إِلَىَّ لَمْ تَفْعَلْ. وَ لَها بَعْدُ حُرْمَتُها الْأُولى، وَ الْحِسابُ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى.

سَبِيلٌ أَبْلَجُ الْمِنْهاجِ، أَنْوَرُ السِّراجِ، فَبِالْإِيمانِ يُسْتَدَلُّ عَلَى الصّالِحاتِ، وَ بِالصّالِحاتِ يُسْتَدَلُّ عَلَى الْإِيمانِ، وَ بِالْإِيمَانِ يُعْمَرُ الْعِلْمُ، وَ بِالْعِلْمِ يُرْهَبُ الْمَوْتُ، وَ بِالْمَوْتِ تُخْتَمُ الدُّنْيا، وَ بِالدُّنْيا تُحْرَزُ الْآخِرَةُ، وَ بِالْقِيامَةِ تُزْلَفُ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِينَ،«وَ تُبَرَّزُ الْجَحِيمُ لِلْغاوِينَ» . وَ إِنَّ الْخَلْقَ لا مَقْصَرَ لَهُمْ عَنِ الْقِيامَةِ، مُرْقِلِينَ فِى مِضْمارِها إِلَى الْغايَةِ الْقُصْوى.

قَدْ شَخَصُوا مِنْ مُسْتَقَرِّ الْأَجْداثِ، وَ صارُوا إِلى مَصائرِ الْغاياتِ. لِكُلِّ دارٍ أَهْلُها، لا يَسْتَبْدِلُونَ بِها وَ لا يُنْقَلُونَ عَنْها. وَ إِنَّ الْأَمْرَ بِالْمَعْرُوفِ، وَ النَّهْيَ عَنِ الْمُنْكَرِ لَخُلُقانِ مِنْ خُلُقِ اللَّهِسُبْحانَهُ ، وَ إِنَّهُما لا يُقَرِّبانِ مِنْ أَجَلٍ، وَ لا يَنْقُصانِ مِنْ رِزْقٍ. وَ عَلَيْكُمْ بِكِتابِ اللَّهِ،«فَإِنَّهُ الْحَبْلُ الْمَتِينُ، وَ النُّورُ الْمُبِينُ »، وَ الشِّفأُ النّافِعُ، وَ الرِّىُّ النّاقِعُ، وَ الْعِصْمَةُ لِلْمُتَمَسِّكِ، وَ النَّجاةُ لِلْمُتَعَلِّقِ. لا يَعْوَجُّ فَيُقامَ، وَ لا يَزِيغُ فَيُسْتَعْتَبَ،«وَ لا يُخْلِقُهُ كَثْرَةُ الرَّدِّ» ، وَ وُلُوجُ السَّمْعِ.«مَنْ قالَ بِهِ صَدَقَ، وَ مَنْ عَمِلَ بِهِ سَبَقَ» .

وَ قامَ إلَيهِ رَجُلْ وَ قالَ: یا أمیر المؤمنین، أخْبِرْنا عَنِ الْفِتْنَةِ، وَ هَلْ سَأَلْتَ رَسُولَ اللّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم ؟ فَقالَعليه‌السلام :

إِنَّهُ لَمَّا أَنْزَلَ اللَّهُسُبْحانَهُ قَوْلَهُ:( الم ( ) أَحَسِبَ النّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنّا وَ هُمْ لا يُفْتَنُونَ ) عَلِمْتُ أَنَّ الْفِتْنَةَ لا تَنْزِلُ بِنا وَ رَسُولُ اللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم بَيْنَ أَظْهُرِنا. فَقُلْتُ: يا رَسُولَ اللَّهِ، ما هَذِهِ الْفِتْنَةُ الَّتِى أَخْبَرَكَ اللَّهُ تعالی بِها؟ فَقالَ:«يا عَلِىُّ، إِنَّ أُمَّتِى سَيُفْتَنُونَ مِنْ بَعْدِى» فَقُلْتُ: يا رَسُولُ اللَّهِ أَوَ لَيْسَ قَدْ قُلْتَ لِى يَوْمَ أُحُدٍ حَيْثُ اسْتُشْهِدَ مَنِ اسْتُشْهِدَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ وَ حِيزَتْ عَنِّى الشَّهادَةُ، فَشَقَّ ذلِكَ عَلَىَّ، فَقُلْتَ لِى:«أَبْشِرْ فَإِنَّ الشَّهادَةَ مِنْ وَرائِكَ؟» فَقالَ لِى:«إِنَّ ذلِكَ لَكَذلِكَ فَكَيْفَ صَبْرُكَ إِذن؟ » فَقُلْتُ: يا رَسُولَ اللَّهِ، لَيْسَ هَذا مِنْ مَواطِنِ الصَّبْرِ، وَ لكِنْ مِنْ مَواطِنِ الْبُشْرى وَ الشُّكْرِ، وَ قالَ:«يا عَلِىُّ إِنَّ الْقَوْمَ سَيُفْتَنُونَ بَعْدِى بِأَمْوالِهِمْ، وَ يَمُنُّونَ بِدِينِهِمْ عَلَى رَبِّهِمْ، وَ يَتَمَنَّوْنَ رَحْمَتَهُ، وَ يَأْمَنُونَ سَطْوَتَهُ، وَ قيَسْتَحِلُّونَ حَرامَهُ بِالشُّبُهاتِ الْكاذِبَةِ وَ الْأَهْوأِ السّاهِيَةِ، فَيَسْتَحِلُّونَ الْخَمْرَ بِالنَّبِيذِ، وَ السُّحْتَ بِالْهَدِيَّةِ، وَ الرِّبا بِالْبَيْعِ» قُلْتُ: يا رَسُولَ اللَّهِ، فَبِأَىِّ الْمَنازِلِ أُنْزِلُهُمْ عِنْدَ ذَلِكَ؟ أَبِمَنْزِلَةِ رِدَّةٍ أَمْ بِمَنْزِلَةِ فِتْنَةٍ؟ فَقالَ«بِمَنْزِلَةِ فِتْنَةٍ» .

আয়শার বিদ্বেষ ও বসরার জনগণের প্রতি সতর্কবাণী

বর্তমান সময়ে যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি দৃঢ়ভাবে আসক্ত থাকতে পারে তার তা করা উচিত। যদি তোমরা আমাকে অনুসরণ কর তবে ,ইনশাল্লাহ ,নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করবো যদিও সে পথ দুঃখ - কষ্ট ও তিক্ততায় পরিপূর্ণ। একজন বিশেষ মহিলা সম্পর্কে বলছি ,সে তার নারীসুলভ অভিমতের আওতাধীন এবং কামারের চুল্লির মতো তার বুকে বিদ্বেষের আগুন জ্বলছে। সে আমার প্রতি যেরূপ ব্যবহার করছে ,অন্যদের প্রতি সেরূপ ব্যবহার করতে বলা হলে কখনো তা করবে না । আমার দিক থেকে এরপরও সে যথার্থ সম্মান পাবে ,তবে তার কুকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তাকে জবাবদিহি হতে হবে।

এ পথ আলোক বিশিষ্ট এবং উজ্জ্বলতম বাতি। আমলে সালেহার দিকে হেদায়েত ইমানের মাধ্যমে অনুসন্ধান করতে হয় ;অপরপক্ষে ইমানের দিকে হেদায়েত আমলে সালেহার মাধ্যমে লাভ করতে হয়। ইমানের মাধ্যমে জ্ঞানের উন্নতি সাধন হয় এবং জ্ঞানের কারণেই মৃত্যুকে ভয় করা হয়। মৃত্যুর সাথে এ দুনিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে ,অপরপক্ষে এ দুনিয়ায় আমলে সালেহার দ্বারা পরকাল নিরাপদ হয়। কেয়ামত থেকে মানুষের কোন নিস্কৃতি নেই। তারা এই শেষ পরিণতির দিকে নির্ধারিত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।

তারা তাদের কবরের বিশ্রামস্থল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাত্রা করেছে। প্রত্যেক ঘরেরই নিজস্ব লোক আছে। সেখানে তাদের কোন পরিবর্তন হয় না এবং সেখান থেকে তারা স্থানান্তরিত হয় না। ন্যায়ের প্রতিপালন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার জন্য আদেশ দান মহিমান্বিত আল্লাহর দুটি বৈশিষ্ট্য। তারা মৃত্যুকে নিকটবর্তী করে আনতে পারে না এবং জীবনোপকরণও কমাতে পারে না । আল্লাহর কিতাবকে মান্য করা তোমাদের উচিত কারণ এটা একটা অতি শক্ত রশি ,সুস্পষ্ট আলো ,উপকারী চিকিৎসা ,তৃষ্ণা নিবারক ,মান্যকারীদের জন্য রক্ষাবর্ম এবং আসক্তগণের জন্য মুক্তি। এটা কাউকে বক্র করে না যাকে সোজা করার প্রয়োজন হতে পারে এবং কাউকে দূষিত করে না যাকে পরিশুদ্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। এর পুনরাবৃত্তি ও কানে প্রবেশ করার পৌনঃপুনিকতা একে পুরাতন করে না। যে কেউ কিতাব অনুযায়ী কথা বলে সে সত্য বলে এবং যে কেউ কিতাব অনুযায়ী আমল করে সো (আমলে) অগ্রণী।

একজন লোক দাঁড়িয়ে বললো , হে আমিরুল মোমেনিন ,এ গোলযোগ সম্পর্কে আমাদেরকে বলুন এবং আপনি এ বিষয়ে রাসূলকে (সা.) কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন কিনা। ” আমিরুল মোমেনিন বললেন ,যখন মহিমান্বিত আল্লাহ এ আয়াত নাজেল করলেনঃ

আলিফ - লাম - মীম মানুষ কি মনে করে যে , আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম ” এ কথা বলার ওপরে (তাদেরকে) ছেড়ে দেয়া হবে এবং তারা পরীক্ষিত হবে না ? (কুরআন - ২৯:১ - ২)

তখন আমি জানতে পেরেছিলাম যে ,যতদিন রাসূল (সা.) আমাদের মাঝে থাকবেন ততদিন আমাদের ওপর কোন ফেতনা ,আপতিত হবে না । সুতরাং আমি জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রাসূল ,সেই ফেতনাটা কী যা মহামহিম আল্লাহ আপনাকে জানিয়েছেন ? উত্তরে তিনি বললেন , ওহে আলী ,আমার লোকেরা আমার পরে ফেতনা সৃষ্টি করবে ” । আমি বললাম , হে আল্লাহর রাসূল ,ওহুদের দিনে অনেক লোক শহীদ হয়েছিল। আমি শহীদ হইনি বলে বড় অস্বস্তি অনুভূত হয়েছিল। তখন কি আপনি আমাকে বলেন নি খুশি হও ,এরপর তুমিও শাহাদত বরণ করবে ? রাসূল (সা.) প্রত্যুত্তরে বললেন , হ্যাঁ ,বলেছি ,কিন্তু বর্তমানে তোমার সহ্য শক্তির কী হয়েছে। ” আমি বললাম , হে আল্লাহর রাসূল ,এটা ধৈর্যের উপলক্ষ নয় ,এখন আনন্দ করা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপলক্ষ। ”

তখন তিনি বললেন , ওহে আলী ,মানুষ তাদের সম্পদের মাধ্যমে ফেতনায় পতিত হবে ,বিশ্বাসের কারণে আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব প্রদর্শন করবে ,তার দয়া প্রত্যাশা করবে ,তার রোষ থেকে নিরাপদ মনে করবে এবং মিথ্যা সংশয় উত্থাপন করে ও গোমরাহ কামনা - বাসনা দ্বারা হারাম বিষয়কে হালাল মনে করবে। তারা মদকে যবের পানি বলে হালাল করে নেবে ,ঘুষকে দান বলে হালাল করে নেবে ,সুদকে বিক্রয় বলে হালাল করে নেবে। ” আমি বললাম , হে আল্লাহর রাসূল ,সে সময়ে তাদের সাথে আমার কেমন ব্যবহার করা উচিত হবে। - আমি তাদের উৎপথগামিতার দিকে ফিরে যেতে দেব - নাকি রুখে দাঁড়াবো ? তিনি বললেন , রুখে দাড়াবে। ”

____________________

১ । একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে ,আমিরুল মোমেনিনের প্রতি আয়শার আচরণ সর্বদা শত্রুভাবাপন্ন ছিল। প্রায়শই তার মনের এ কালিমা তার মুখে প্রকাশ হয়ে পড়তো এবং তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ স্পষ্ট হয়ে ওঠতো। কোন কারণে তার সামনে কেউ আমিরুল মোমেনিনের নাম নিলে তিনি কপাল কুঞ্চিত করতেন এবং আমিরুল মোমেনিনের নাম নেয়ার স্বাদ তার জিহবা কখনো গ্রহণ করেনি। উদাহরণ স্বরূপ ,উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে উতবাহ আয়শার বরাত সূত্র উল্লেখপূর্বক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বলেছেন , রাসূল (সা.) মৃত্যুশয্যায় থাকাকালে আল - ফজল ইবনে আব্বাস ও অন্য এক ব্যক্তির কাধে ভর দিয়ে তার (আয়শার) ঘরে গিয়েছিলেন। ” আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বললেন , অন্য লোকটি কে তা কি আপনি জানেন ? জবাবে উবায়দুল্লাহ বললেন হ্যাঁ ,আলী ইবনে আবি তালিব। কিন্তু আয়েশা কোন ভাল বিষয়ে আলীর নাম নেয়ার বিরোধিতা করে।" (হাম্বল ,৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ৩৪ ও ২২৮ ;সাদ ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ২৯ ;তাবারী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৮০০ - ১৮০১ ;বালাজুরী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৫৪৪ - ৫৪৫ ;শ্যাফেয়ী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৯৬)

আমিরুল মোমেনিনের প্রতি আয়শার এমন ঘৃণা ও বিদ্বেষের একটা কারণ হলো হজরত ফাতিমার মর্যাদা ও সুনাম আয়শার হৃদয়ে কাটার মতো বিধতো। রাসূলের (সা.) অন্যান্য স্ত্রীদের প্রতি চরম ঈর্ষার ফলে অন্য একজন স্ত্রীর কন্যাকে রাসূল (সা.) ভালোবাসেন এটা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তদুপরি ফাতিমার প্রতি রাসূলের (সা.) ভালোবাসা এত অধিক মাত্রায় ছিল যে ,তার আগমনের জন্য রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে থাকতেন ,নিজের বসার স্থানে তাকে বসাতেন। নারী জাতির মধ্যে তাকে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাশালিনী ঘোষণা করেছেন এবং তার সন্তানদের সর্বাপেক্ষা বেশি ভালোবাসতেন। এসব কিছু আয়শার মর্মপীড়ার কারণ ছিল এবং স্বভাবতই তার মনে হতো যদি তার সন্তান থাকতো তবে তারা রাসূলের (সা.) পুত্র হতো এবং ইমাম হাসান ও হুসাইনের পরিবর্তে তারা রাসূলের (সা.) ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু হতো । কিন্তু তার কোন সন্তান ছিল না এবং তাই তিনি তার মা হবার বাসনা চরিতার্থ করার জন্য তার বোনের ছেলের নামানুসারে উন্মে আবদিল্লাহ ডাকনাম গ্রহণ করেছিলেন। মোট কথা এ সবকিছু মিলিয়ে তার হৃদয়ে একটা ঈর্ষাগ্নি প্রজ্বলিত ছিল যার ফলশ্রুতিতে তিনি যখন তখন ফাতিমার বিরুদ্ধে রাসূলের (সা.) কাছে অভিযোগ করতেন। কিন্তু ফাতিমার প্রতি রাসূলের (সা.) সুনজর এতটুকুও কমাতে পারেন নি। তার এ মর্মাঘাত ও বিচ্ছেদের খবর আবু বকরের কানেও পৌছেছিল। এতে কন্যার প্রতি মৌখিক সান্তুনা ছাড়া আবু বকরের করণীয় কিছু ছিল না বলে তিনি এ বিষয়ে নিজেই উত্তেজিত ছিলেন। অবশেষে রাসূলের (সা.) ওফাতের পর সরকারের ক্ষমতা তার হাতে গেল। ফলে তার মনের ঝাল মিটিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ হয়ে গেল। প্রথমেই তিনি ফাতিমাকে উত্তরাধিকারিত্ব থেকে বঞ্চিত করার জন্য ঘোষণা করলেন যে ,নবীদের কোন ওয়ারিশ থাকে না এবং তারাও কারো ওয়ারিশ নন। এই ঘোষণা বলে তিনি রাসূলের (সা.) পরিত্যক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ব করলেন। এতে ফাতিমা নিদারুণ দুঃখ - কষ্টে নিপতিত হলেন। এ দুঃখে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কোনদিন আবু বকরের সাথে কথা বলেন নি। ফাতিমার মর্মান্তিক মৃত্যুতে আয়শা কোনদিন একটুখানি দুঃখও প্রকাশ করেননি। এমন কি তিনি কোনদিন একটু দেখতেও যান নি। হাদীদ(৯ম খণ্ড ,পৃঃ ১৯৮) লিখেছেঃ

যখন ফাতিমার মৃত্যু হলো তখন আয়শা ব্যতীত রাসূলের (সা.) সকল স্ত্রী বানি হাশিমকে সাত্ত্বিনা দেয়ার জন্য এসেছিল । তিনি নিজেকে অসুস্থ বলে দেখিয়েছিলেন । কিন্তু তার কথাবার্তা আলীর কানো পৌছেছিল যাতে বুঝা গিয়েছিল যে তিনি আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন ।

যেখানে ফাতিমার প্রতি আয়শা এহেন বিদ্বেষ পোষণ করতেন ,সেখানে তিনি ফাতিমার স্বামীর প্রতি একই বিদ্বেষ ও শক্রতা পোষণ করবেন। এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে ইফক ” *- এর ঘটনায় আমিরুল মোমেনিন নাকি রাসূলকে (সা.) বলেছিলেন , সে আপনার জুতার ফিতা অপেক্ষা অধিক কিছু নয় ,তাকে তালাক দিয়ে বিদায় করুন। ” একথা শুনার পর থেকে আমিরুল মোমেনিনের প্রতি আয়শার ঘৃণা ও বিদ্বেষ চরম রূপ লাভ করেছিলো। এ ছাড়াও অনেক সময় আবু বকরের উর্দ্ধে আমিরুল মোমেনিনকে মর্যাদা দেয়া হয়েছিল এবং আবু বকরের উপস্থিতিতেই আমিরুল মোমেনিনের প্রসংশাসূচক উক্তি করা হয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ ,সুরা বারা আহ (তওবা)** নাজিল হওয়ার পর আবু বকরকে হজ্জযাত্রীদের নেতৃত্ব থেকে ফিরিয়ে এনে তার স্থলে আমিরুল মোমেনিনকে প্রেরণ করা হয়েছিল। আবু বকরকে বলে দিয়েছেন যে ,হয় রাসূল (সা.) নিজে না হয় তার পরিবারের কাউকে দিয়ে তা প্রেরণ করার জন্য রাসূল (সা.) আল্লাহ্ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছেন। নেতৃত্ব থেকে বাদ দেয়ার কারণে তিনি আলীর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। একইভাবে আবু বকরসহ সকলের ঘরের যে দরজা মসজিদের দিকে ছিল তা রাসূল (সা.) বন্ধ করিয়ে ছিলেন কিন্তু আলীর সেই দরজা খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন।

আয়শা তার পিতার ওপরে আলীকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করা সহ্য করতে পারতেন না। তাই কখনো এমন বিশেষ উপলক্ষ হলেই তিনি তা পণ্ড করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। জীবন সায়াহ্নে রাসূল (সা.) উসামাহ ইবনে জায়েদের নেতৃত্বে (সিরিয়া অঞ্চলের উপদ্রব প্রশমনের জন্য) সৈন্য বাহিনীকে অগ্রবর্তী হতে আদেশ দিয়েছিলেন এবং আবু বকর ও উমরকে উসামাহর নেতৃত্বাধীনে অভিযানে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তারা রাসূলের (সা.) স্ত্রীদের কাছ থেকে খবর পেয়েছিল যে ,তাঁর অবস্থা বিশেষ ভালো নয় - আর অগ্রবর্তী না হয়ে তারা যেন ফিরে আসে। উসামাহর অধিনস্থ বাহিনী এ সংবাদ পাওয়া মাত্র ফেরত এসেছিল। রাসূল (সা.) এ কথা জানতে পেরে পুনরায় যাত্রা করার জন্য উসামাহকে নির্দেশ দিলেন এবং একথাও বললেন , যে ব্যক্তি বাহিনী থেকে সরে যাবে তার ওপর আল্লাহর লানত। ” ফলে তারা আবার যাত্রা করলো কিন্তু রাসূলের অসুস্থতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে খবর দিয়ে আবার তাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। উসামাহর বাহিনী মদিনার বাইরে যায়নি। কারণ তারা যেতে চায়নি। তাদের দূরদর্শিতায় তারা মনে করেছিল যে ,আনসার ও মুহাজিরগণকে মদিনার বাইরে এ কারণে প্রেরণ করা হচ্ছে যাতে রাসূলের পরে আলীর খেলাফত লাভে কোন প্রকার বেগ পেতে না হয়। এরপর বিলালের মাধ্যমে সালাতে ইমামতি করার জন্য আবু বকরকে বলা হয়েছিল। তিনি ইমামতিকে খেলাফত পাওয়ার দাবি হিসাবে দাঁড় করেছিলেন। এরপর বিষয়গুলো এমন ঘুরপাক খেয়েছিলো যে ,আমিরুল মোমেনিন খেলাফত থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন।

তৃতীয় খলিফার রাজত্বের পর অবস্থা এমনভাবে মোড় নিয়েছিল যে ,মানুষ আমিরুল মোমেনিনের হাতে বায়াত গ্রহণের জন্য পাগল হয়ে পড়লো। এ সময় আয়শা মক্কায় ছিলেন। যখন তিনি আলীর খেলাফতের কথা জানতে পারলেন তখন তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়তে লাগলো। ঈর্ষা ও ক্রোধ তাকে এমনভাবে অস্থির করে তুললো যে ,উসমানের রক্তের বদলার ছুতায় তিনি আলীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সশরীরে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পর্যন্ত সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন। অথচ উসমান নিহত হবার কিছু দিন আগেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ,উসমান কতল হবার উপযুক্ত। যা হোক ,আয়শার বিদ্রোহের ফলে এত রক্তপাত হয়েছিল যে ,সমগ্র বসরা রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল এবং অনৈক্য ও ফেতনার দরজা চিরতরে খুলে গেল।

* ইফাকের ঘটনা আলীর বিরুদ্ধবাদীরা আয়শাকে যেভাবে শুনিয়েছিল। এখানে সেভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম থেকেই যারা আলীর বিরোধিতা করতো তারা আয়শাকে অসত্য ও বিভ্রান্তকর কথা শুনিয়ে তার মন বিষিয়ে তুলেছিল এবং আলীর প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষের মূল কারণ এসব মিথ্যা প্রচারণা। এ কথার অর্থ এ নয় যে ,এসব মিথ্যা প্রচারণা না করলে তিনি আলীকে ভালোবাসতেন বা তার বায়াত গ্রহণ করতেন। আলীকে অপছন্দ করার শত কারণ রয়েছে - কিছু নারীসুলভ ,কিছু পৈতৃক ও কিছু গোত্রীয়। তবু একুটু বলা যায় আলী বিরোধীদের মিথ্যা প্রচারণা ও প্ররোচনা না থাকলে আয়শা জঙ্গে জামালের মতো অন্যায়কাজে অবতীর্ণ হতেন না ;আলীর প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ ব্যক্তি পর্যায়ে থাকতো। যা হোক ,ইফাকের প্রকৃত ঘটনা হলো - রাসূলের (সা.) নিকট যখন সংবাদ পৌছে যে ,মক্কার নিকটবর্তী বনি - মুস্তালিক গোত্র কুরাইশদের সহায়তায় হারেস ইবনে সিরাবের নেতৃত্বে মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন রাসূল (সা.) তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করলেন। এ যুদ্ধে রাসূলের (সা.) স্ত্রী আয়শা তাঁর সফরসঙ্গিনী ছিলেন। আয়শা একটা পৃথক উটে চড়ে গিয়েছিলেন। পঞ্চম হিজরি সনের ২ শাবান (মতান্তরে ৬ষ্ঠ হিজরি সনের শাবান মাস মোতাবেক ৬২৭ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাস) বনি - মুস্তালিকে যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং এ যুদ্ধে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। যুদ্ধ শেষে রাসূল (সা.) মদীনা অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সৈন্যবাহিনীসহ রাত্রি যাপন করেন। ভোরবেলায় কাফেলা তাড়াহুড়া করে পুনঃযাত্রার ব্যবস্থা করে। এদিকে আয়শা তার শিবিকা থেকে বের হয়ে প্রাকৃতিক ডাকে একটু দূরে গিয়েছিলেন। কাজ শেষ করে শিবিকার কাছাকাছি এসেই দেখতে পেলেন যে ,তার গলার হারটি খোয়া গেছে। তিনি পুনরায় হার খুঁজতে চলে যান। কাফেলার লোকজন মনে করেছে যে ,তিনি শিবিকার মধ্যেই বসে আছেন এবং তারা শিবিকা উটের পিঠে বসিয়ে দিল। কাফেলা যাত্রা শুরু করে সে স্থান থেকে চলে গেল। হার খুঁজতে গিয়ে আয়শা তা পেয়ে গেলেন। তিনি তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দেখেন যে ,কাফেলা সে স্থান ত্যাগ করে চলে গেছে। ভয়ে তিনি জড়সড় হয়ে গেলেন। তিনি ভাবলেন পথিমধ্যে কোথাও শিবিকা শূন্য ধরা পড়লে তাকে খুঁজতে লোকেরা সেখানেই আসবে। তাই তিনি চাদরাবৃত হয়ে সেখানে শুয়ে রইলেন। রাসূলের (সা.) নিয়ম ছিল যে ,কোথাও কাফেলা অবস্থান করলে সেই স্থান ত্যাগের পর একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক তল্লাশি করে দেখতো কেউ কোন কিছু ফেলে গেল কিনা এবং তল্লাশি শেষ করে সে কাফেলাকে অনুসরণ করতো। এই কাফেলার তল্লাশি কাজে নিয়োজিত ছিল সাহাবি সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল আস - সুলামী। তিনি তার দায়িত্ব অনুযায়ী তল্লাশি করতে গিয়ে আয়শাকে দেখে চমকে উঠলেন এবং ঘটনা অবগত হয়ে তার উটে আয়শাকে বসিয়ে নিজে উটের দড়ি ধরে হেঁটে যাত্রা করলেন। রাসূলের (সা.) কাফেলা মদিনা পৌছার চার দিন পর আয়শাকে নিয়ে সাফওয়ান মদিনা পৌছেন।

এ দুর্ঘটনার পর মদিনার মোনাফেকগণ সাফওয়ানকে কেন্দ্র করে আয়শার চরিত্রে কালিমা লেপন করে নানা কুকথা প্রচার করতে থাকে। এদের মধ্যে মূখ্য ভূমিকায় ছিল মোনাফেক। সর্দার আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই ,আবু বকরের অনুগ্রহে লালিত ভাগিনা মেসতাহ ইবনে উছাছাহ ,রাসূলের (সা.) স্ত্রী জয়নবের ভগিনী হাসনা বিনতে জাহাশ ও রাসূলের (সা.) কবি হাসান বিন সাবেত। এদের কানাকানি ও কুৎসা - রটনা রাসূলের (সা.) কানে গেলে। তিনি খুবই মর্মাহত হলেন। এক পর্যায়ে আয়শাও বিষয়টি জেনেছেন। তিনি লজ্জায় ও ক্ষোভে - দুঃখে ম্রিয়মান হয়ে একেবারে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমনকি একদিন কুপে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছিলেন। অবশেষে পিতা আবু বকরের বাড়িতে চলে গেলেন। রাসূল (সা.) আয়শাকে যেমন বিশ্বাস করতেন সাফওয়ানের প্রতিও তাঁর তেমনি আস্থা ছিল। কিন্তু কোন কিছুতেই মোনাফেকগণের কানাঘুষা বন্ধ হচ্ছিলো না দেখে রাসূল (সা.) উমর ,উসমান ও আলীকে ডেকে এ বিষয়ে তাদের মতামত চাইলেন। উমর ও উসমান একবাক্যে বলে দিলেন ইহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। ” আলীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি শুধু মিথ্যা ” বলেননি। তিনি তাঁর স্বাভাবিক প্রজ্ঞা ও বিচারবুদ্ধি দ্বারা বিষয়টির ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ তার মতামত প্রদান করেন। এ বিষয়ে তার মতামত বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে লিখেছেন। সেগুলো মোটামুটি নিম্নরূপ :

(ক) আলী বললেন , এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা রটনা। হে আল্লাহর রাসূল (সা.) ,আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে একদিন সালাত আদায়কালে আপনি এক পায়ের জুতা খুলে ফেলেছিলেন। সালাত শেষে এ বিষয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলে আপনি বলেছিলেন ওই জুতায় কিছু নোংরা জিনিস লেগেছিল বলে তা খুলে ফেলার জন্য জিব্রাইল মারফত খবর দেয়া হয়েছিল। সামান্য একটু নোংরা বস্তু থেকে আপনাকে পবিত্র রাখার ব্যাপারে। যেখানে আল্লাহ এতটা সজাগ সেখানে এতবড় একটা বিষয় সত্য হলে আল্লাহ চুপ করে থাকবেন এটা কিছুতেই হতে পারে না। ”

(খ) আলী বললেন , হে আল্লাহর রাসূল ,ব্যাপারটা আমার বিশ্বাস হয় না। তবুও আপনি আয়শার বাদিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখতে পারেন। সে হয়ত সঠিক তথ্য বলে দেবে । ”

(গ) আলী মন্তব্য করলেন , হে আল্লাহর রাসূল ,আয়শা ব্যতীত কি আর কোন নারী নেই ? আপনি এত উদ্বীগ্ন হয়েছেন কেন ? আয়শাকে পরিবর্তন করতে তো আপনি সক্ষম। ”

আমিরুল মোমেনিন সম্পর্কে যাদের সামান্যতম জ্ঞান আছে তারা কখনো তৃতীয় মন্তব্যটি মেনে নেবেন না। আলীর মতো মহান চরিত্রের অধিকারী একজন প্রাজ্ঞ মোনাফেকগণের কুৎসা - রটনার বিষয়ে এমন কুৎসিত মন্তব্য করতে পারেন না। অথচ আলী - বিদ্বেষীগণ আয়শাকে এই কুৎসিত মন্ত্যব্যটি শুনিয়েছিলেন যা তিনি যাচাই - বাছাই না করে বিশ্বাস করেছিলেন এবং আলীর বিরুদ্ধে সারাজীবন বিদ্বেষ পোষণ করেছিলেন। উসমানের রক্তের বদলার ছদ্মাবরণে জঙ্গে জামালে আয়শার অবতীর্ণ হবার এটা অন্যতম কারণও বটে।

যাহোক ,একমাস পর্যন্ত আয়শা এহেন কুৎসা রটনার জন্য নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় কাতর হবার পর আল্লাহ সুরা নূরে বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলে রাসূল (সা.) আয়শাকে তার পিতৃগৃহ থেকে নিয়ে আসেন এবং তিনি মানসিক শান্তি লাভ করেন। এই বিষয়ে আরো অধিক জানার জন্য গোলাম মোস্তফার বিশ্ব নবী (পৃঃ ২৪৭ - ২৫৯) ,আবদুল হামীদ আল খতিবের মহানবী (পৃঃ ১৬৯ - ১৭৫) ,সাদেক শিবলী জামানের হজরত আলী (পৃঃ ১০৪১১১) এবং যে কোন তফসির গ্রন্থের সুরা নূরের শানে নাজুল দ্রষ্টব্য - বাংলা অনুবাদক

**সুরা বারাআহ (সুরা তওবা) নাজিলের ফলে আবু বকরকে আমিরে হজ্জ থেকে বাদ দেয়ার ঘটনাটি হলো - অষ্টম হিজরির রমজান মাসে মক্কা বিজয়ের পর জেলহজ্জ মাসে মোশরেকদের তত্ত্বাবধানে পূর্বে প্রচলিত তাদের নিয়মানুযায়ী হজ্জের আরকান সমাধা করা হয়েছিল। মুসলিমগণ মক্কার আমীর আত্তাব ইবনে উমাদের সাথে হজ্জ সম্পন্ন করে।

নবম হিজরির দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই এ বছরের হজ্জ সম্পর্কে রাসূল (সা.) চিন্তিত হয়ে পড়েন। পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেলেন। এখন হজ্জের সময় তার সামনেই পৌত্তলিকতার অস্তিত্ব তিনি কিভাবে বরাদাশত করবেন। অপরপক্ষে ,তাদেরকে নিষেধ করাও একটা জটিল সমস্যা । কারণ

(ক) ইতিপূর্বে কাবা জিয়ারতে আগত কাউকে নিষেধ না করার সাধারণ নীতি তাঁর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল ;

(খ) বেশ ক ’ টি আরব গোত্রের সাথে তার চুক্তি বলবৎ ছিল যে ,আশহুরে হারামে (নিষিদ্ধ মাসে) কাউকে ভীতি প্রদর্শন করা হবে না ;

(গ) রাসূলের (সা.) পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করে শরিয়তের নীতিমালা প্রচার করা হয়েছিল।

এসব চিন্তা করে নবম হিজরির হজ্জ সম্পাদন করা রাসূলের (সা.) পক্ষে সম্ভব হবে না বিধায় তিনি জিলকদ মাসের শেষ দিকে আবু বকরকে আমিরুল হজ্জ নিয়োগ করে তিনশত মুসলিমকে হজ্জ সম্পাদনের জন্য প্রেরণ করেন যাতে তারা রাসূল কর্তৃক মনোনীত হজ্জের নিয়ম - কানুন বিবৃত করে। আবু বকর মুসলিমদের নিয়ে মদিনা ত্যাগের পর সুরা বারাআহ (তওবা) এর ১ - ৪০ আয়াত নাজিল হয় এবং এতে কাবাগৃহে পৌত্তলিকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সাহাবীগণের কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল সূরাটি কাউকে দিয়ে আবু বকরের কাছে পাঠিয়ে দিলে তিনি হজ্জের সময় তা জনগণকে জানিয়ে দিতে পারবেন। এতে রাসূল (সা.) বললেন , না ,তা হতে পারে না। এটা আমার পক্ষ থেকে এমন একজন ঘোষণা করতে পারে যার যোগ্যতা ও অধিকার আছে - আর সে হলো আলী ” । তারপর রাসূল (সা.) একটা নির্দেশনামা লেখিয়ে তাঁর নিজের দ্রুতগামী উগ্রী 'আজবা ” (মতান্তরে কুসওয়া) তে আরোহণ করিয়ে আলীকে মক্কা অভিমুখে প্রেরণ করলেন।

আলী মদিনা থেকে মক্কার পথে আজু নামক স্থানে আবু বকরের সাথে মিলিত হলেন। ঠিক প্রত্যুষে আলীকে হঠাৎ সেখানে উপস্থিত দেখে আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন , কী হে আলী ,তোমার এ আগমন কি আমীর হিসাবে নাকি মামুর (অনুসারী) হিসাবে ? প্রত্যুত্তরে আলী বললেন , আমির হিসাবে। রাসূলের (সা.) আপনজনদের মধ্য থেকে যোগ্য ও অধিকার প্রাপ্তকে আমিরের দায়িত্ব অর্পন করতে তিনি আদিষ্ট হয়েছেন। ” এরপর আবু বকর আলীর নেতৃত্বাধীনে হজ্জ সমাপন করেন। (কারো কারো মতে আবু বকর আজু থেকে মদিনায় ফিরে আসেন। আবার কারো কারে মতে উভয়ের যুগ্ম নেতৃত্বে হজ্জ সমাপন হয়েছিল) ।

যাহোক ,হজ্জ শেষে সমবেত জনমণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে আলী সুললিত কণ্ঠে সুরা বারা আহর (তওবার) ১ থেকে ৪০ আয়াত আবৃত্তি করে শুনালেন এবং তারপর বজ্রকণ্ঠে রাসূলের (সা.) নির্দেশনামা ঘোষণা করলেন। নির্দেশগুলো হলো

(১) মুমিন ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না ;

(২) এখন থেকে কোন পৌত্তলিক কাবাগৃহে হজ্জ করতে পারবে না এবং কাবাগৃহে প্রবেশ তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো:

(৩) উলঙ্গাবস্থায় কাবা তাওয়াফ করা চলবে না ;

(৪) মোশরিকগণ চার মাসের মধ্যে আপন আপন স্থানে গমন করবে। এরপর তাদের সাথে মুসলিমদের কোন সম্পর্ক থাকবে না ;

(৫) আল্লাহর রাসূলের (সা.) সাথে যার যে চুক্তি হয়েছে তা নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এ সময় সমবেত মোশরিকগণ ঘোষণা শ্রবণ করলো কিন্তু বাধা দেয়ার সাহস হয়নি। তারপর মুসলিমগণ মদিনা প্রত্যাবর্তন করলেন - বাংলা অনুবাদক

খোৎবা - ১৫৬

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي جَعَلَ الْحَمْدَ مِفْتَاحاً لِذِكْرِهِ، وَ سَبَباً لِلْمَزِيدِ مِنْ فَضْلِهِ، وَ دَلِيلاً عَلَى آلاَئِهِ وَ عَظَمَتِهِ.

عِبَادَ اللَّهِ إِنَّ الدَّهْرَ يَجْرِي بِالْبَاقِينَ كَجَرْيِهِ بِالْمَاضِينَ؛ لاَ يَعُودُ مَا قَدْ وَلَّى مِنْهُ، وَ لاَ يَبْقَى سَرْمَدا مَا فِيهِ، آخِرُ فَعَالِهِ كَأَوَّلِهِ. مُتَشَابِهَةٌ أُمُورُهُ، مُتَظَاهِرَةٌ أَعْلاَمُهُ. فَكَأَنَّكُمْ بِالسَّاعَةِ تَحْدُوكُمْ حَدْوَالزَّاجِرِ بِشَوْلِهِ: فَمَنْ شَغَلَ نَفْسَهُ بِغَيْرِ نَفْسِهِ تَحَيَّرَ فِي الظُّلُمَاتِ وَ ارْتَبَكَ فِي الْهَلَكَاتِ، وَ مَدَّتْ بِهِ شَيَاطِينُهُ فِي طُغْيَانِهِ، وَ زَيَّنَتْ لَهُ سَيِّئَ أَعْمَالِهِ. فَالْجَنَّةُ غَايَةُ السَّابِقِينَ، وَ النَّارُ غَايَةُ الْمُفَرِّطِينَ.

ضرورة التقوی

اعْلَمُوا، عِبَادَ اللَّهِ، أَنَّ التَّقْوَى دَارُ حِصْنٍ عَزِيزٍ، وَ الْفُجُورَ دَارُ حِصْنٍ ذَلِيلٍ، لاَ يَمْنَعُ أَهْلَهُ وَ لاَ يُحْرِزُ مَنْ لَجَأَ إِلَيْهِ. أَلاَ وَ بِالتَّقْوَى تُقْطَعُ حُمَةُ الْخَطَايَا، وَ بِالْيَقِينِ تُدْرَكُ الْغَايَةُ الْقُصْوَى. عِبَادَ اللَّهِ، اللَّهَ اللَّهَ فِي أَعَزِّ الْأَنْفُسِ عَلَيْكُمْ، وَ أَحَبِّهَا إِلَيْكُمْ: فَإِنَّ اللَّهَ قَدْ أَوْضَحَ لَكُمْ سَبِيلَ الْحَقِّ وَ أَنَارَ طُرُقَهُ. فَشِقْوَةٌ لاَزِمَةٌ، أَوْ سَعَادَةٌ دَائِمَةٌ فَتَزَوَّدُوا فِي أَيَّامِ الْفَنَأِ لِأَيَّامِ الْبَقَأِ. قَدْ دُلِلْتُمْ عَلَى الزَّادِ وَ أُمِرْتُمْ بِالظَّعْنِ، وَ حُثِثْتُمْ عَلَى الْمَسِيرِ. فَإِنَّمَا أَنْتُمْ كَرَكْبٍ وُقُوفٍ، لاَ يَدْرُونَ مَتَى يُؤْمَرُونَ بِالسَّيْرِ. أَلاَ فَمَا يَصْنَعُ بِالدُّنْيَا مَنْ خُلِقَ لِلاْخِرَةِ! وَ مَا يَصْنَعُ بِالْمَالِ مَنْ عَمَّا قَلِيلٍ يُسْلَبُهُ، وَ تَبْقَى عَلَيْهِ تَبِعَتُهُ وَ حِسَابُهُ! عِبَادَ اللَّهِ، إِنَّهُ لَيْسَ لِمَا وَعَدَ اللَّهُ مِنَ الْخَيْرِ مَتْرَكٌ، وَ لاَ فِيمَا نَهَى عَنْهُ مِنَ الشَّرِّ مَرْغَبٌ. عِبَادَ اللَّهِ احْذَرُوا يَوْما تُفْحَصُ فِيهِ الْأَعْمَالُ، وَ يَكْثُرُ فِيهِ الزِّلْزَالُ، وَ تَشِيبُ فِيهِ الْأَطْفَالُ. اعْلَمُوا، عِبَادَ اللَّهِ، أَنَّ عَلَيْكُمْ رَصَداً مِنْ أَنْفُسِكُمْ وَ عُيُوناً مِنْ جَوَارِحِكُمْ وَ حُفَّاظَ صِدْقٍ يَحْفَظُونَ أَعْمَالَكُمْ، وَ عَدَدَ أَنْفَاسِكُمْ، لاَ تَسْتُرُكُمْ مِنْهُمْ ظُلْمَةُ لَيْلٍ دَاجٍ وَ لاَ يُكِنُّكُمْ مِنْهُمْ بَابٌ ذُو رِتَاجٍ.

وحشة القبر

وَ إِنَّ غَدا مِنَ الْيَوْمِ قَرِيبٌ. يَذْهَبُ الْيَوْمُ بِمَا فِيهِ، وَ يَجِي ءُ الْغَدُ لاَحِقاً بِهِ، فَكَأَنَّ كُلَّ امْرِئٍ مِنْكُمْ قَدْ بَلَغَ مِنَ الْأَرْضِ مَنْزِلَ وَحْدَتِهِ، وَ مَخَطَّ حُفْرَتِهِ. فَيَا لَهُ مِنْ بَيْتِ وَحْدَةٍ، وَ مَنْزِلِ وَحْشَةٍ وَ مَفْرَدِ غُرْبَةٍ! وَ كَأَنَّ الصَّيْحَةَ قَدْ أَتَتْكُمْ، وَ السَّاعَةَ قَدْ غَشِيَتْكُمْ، وَ بَرَزْتُمْ لِفَصْلِ الْقَضَأِ قَدْ زَاحَتْ عَنْكُمُ الْأَبَاطِيلُ، وَ اضْمَحَلَّتْ عَنْكُمُ الْعِلَلُ، وَ اسْتَحَقَّتْ بِكُمُ الْحَقَائِقُ، وَ صَدَرَتْ بِكُمُ الْأُمُورُ مَصَادِرَهَا، فَاتَّعِظُوا بِالْعِبَرِ وَ اعْتَبِرُوا بِالْغِيَرِ، وَ انْتَفِعُوا بِالنُّذُرِ.

তাকওয়ার প্রতি আহবান

প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর যিনি প্রশংসাকে তাঁর জিকিরের চাবি ,তাঁর নেয়ামত বৃদ্ধির উপায় এবং তার মহিমা ও সিফাতের দেশনা করেছেন।

হে আল্লাহর বান্দাগণ ,যারা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে তাদের প্রতি সময় যেরূপ আচরণ করেছে একইরূপ আচরণ তাদের প্রতিও করা হবে যারা জীবিত আছে। যে সময় চলে গেছে তা আর কোনদিন ফিরে আসবে না এবং আজ দুনিয়াতে যা কিছু আছে তা চিরদিন থাকবে না। এর পূর্ববর্তী কাজ পরবর্তী কাজের অনুরূপ। এর বিপদাপদ ও দুঃখ - কষ্ট একটা অপরটিকে ছাপিয়ে যেতে চায়। এর ঝাণ্ডা একটা অপরটিকে অনুসরণ করে। এটা এ জন্য যে ,তোমরা যেন শেষ দিনের প্রতি অনুরক্ত হও যা তোমাদেরকে এত দ্রুত তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে যেমন করে সাত মাসের অদুগ্ধবতী উষ্ট্রিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি আত্ম উন্নতি ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে অন্ধকারে বিহবল হয়ে পড়ে এবং ধ্বংসে জড়িয়ে পড়ে। তার পাপাত্মা তাকে অধর্মের গভীরে ডুবিয়ে দেয় এবং তার মন্দ আমলসমূহকে সুন্দর করে দেখায়। ভালো কাজে যারা অগ্রণী জান্নাত তাদের জন্য আর যারা সীমালঙ্ঘনকারী জাহান্নাম তাদের জন্য ।

তাকওয়ার প্রয়োজনীতা

হে আল্লাহর বান্দাগণ ,জেনে রাখো ,তাকওয়া একটা সুরক্ষিত ঘর এবং তাকওয়াহীনতা অতি দুর্বল ঘর যা বসবাসকারীকে রক্ষা করতে পারে না এবং এতে যারা আশ্রয় গ্রহণ করে তাদেরকে কোন নিরাপত্তা দিতে পারে না। জেনে রাখো ,তাকওয়া পাপের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা করে এবং ইমানের দৃঢ়তা দ্বারা চূড়ান্ত লক্ষ্য (মুক্তি) অর্জন করা যায়।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! আল্লাহকে ভয় কর ,আল্লাহকে ভয় করা ,তোমাদের নিজস্ব ব্যাপারে যা তোমাদের অতি প্রিয় ও নিকটতম। কারণ ,আল্লাহ তোমাদের কাছে সত্যবাদিতার পথের বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন এবং সেই পথকে আলোকমণ্ডিত করেছেন। সুতরাং চিরকালীন দুর্ভোগ ও অনন্ত আনন্দ এ দুটির যে কোন একটা তোমরা বেছে নিতে পার। এই নশ্বর দিনগুলোতে অনন্ত দিনের রসদ সংগ্রহ করা তোমাদের উচিত। তোমাদেরকে রসদের কথা জানানো হয়েছে ,অগ্রগামী হতে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং যাত্রায় তাড়াহুড়া করতে বলা হয়েছে। তোমরা দণ্ডায়মান অশ্বারোহীর মতো যারা জানে না কখন তাদেরকে কুচকাওয়াজ করার জন্য আদেশ দেয়া হবে। সাবধান ,যারা পরকালের জন্য সৃষ্টি হয়েছে তারা এ দুনিয়া দিয়ে কী করবে ? সম্পদ দিয়ে মানুষ কী করবে যা থেকে সে সহসাই বঞ্চিত হবে ? মানুষ শুধুমাত্র সম্পদের কুফল ও হিসাব - নিকাশ পিছনে ফেলে যায়।

হে আল্লাহর বান্দাগণ ,আল্লাহ যে সব কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কখনো পরিত্যাগ করো না এবং যে সব অকল্যাণ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তাতে কখনো লিপ্ত হয়ে না। হে আল্লাহর বান্দাগণ ,সেদিনকে ভয় কর যেদিন আমলের হিসাব নেয়া হবে । সেদিন তোমরা এমনভাবে ভয়ে কাপতে থাকবে। যে ,শিশুও বৃদ্ধ হয়ে যাবে।

হে আল্লাহর বান্দাগণ ,জেনে রাখো ,তোমাদের বাতেনই (বিবেক) তোমাদের জন্য প্রহরী। তোমাদের অঙ্গ - প্রত্যঙ্গসমূহ পাহারাদার এবং সত্যবাদী প্রহরীগণের কাছে বিশ্বস্ত যারা তোমাদের আমল ও শ্বাস - প্রশ্বাসের হিসাব রাখে। রাতের গাঢ় অন্ধকার বা রুদ্ধদ্বার তাদের কাছ থেকে তোমাদেরকে গোপন করতে পারে না ।

কবরভীতি

নিশ্চয়ই আগামীকাল আজকের অতি নিকটবর্তী । আজকের দিনটি তার সব কিছু নিয়ে প্রস্থান করা মাত্রই আগামীকাল এসে পড়বে। এটা এ জন্য যে ,তোমাদের প্রত্যেকেই যেন পৃথিবীর সে স্থানে পৌছে গেছো যেখানে তোমরা একাকী থাকবে (অর্থাৎ কবর) । সুতরাং সেই নিঃসঙ্গ ঘর ,নির্জন থাকার জায়গা ও নির্জন নির্বাসনের কথা তোমাদেরকে কী আর বলবো! শিঙ্গার আওয়াজ যেন তোমাদের কাছে পৌছে গেছে ,নির্ধারিত সময় যেন তোমাদেরকে নাগাল ধরে ফেলেছে এবং তোমরা যেন বিচারের জন্য বেরিয়ে এসেছো । তোমাদের কাছে থেকে মিথ্যার আবরণ সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং তোমাদের সকল ওজর দুর্বল হয়ে পড়েছে। তোমাদের বিষয়ে যা সত্য তা যেন প্রমাণিত হয়েছে। তোমাদের সকল বিষয় এর পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সুতরাং উপমা ও উদাহরণ থেকে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর ,উত্থান - পতন থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর এবং সতর্ককারীদের সতর্কবাণীর সুযোগ গ্রহণ করা।

খোৎবা - ১৫৭

الرسول الأعظم فی القرآن

أَرْسَلَهُ عَلَى حِينِ فَتْرَةٍ مِنَ الرُّسُلِ، وَ طُولِ هَجْعَةٍ مِنَ الْأُمَمِ، وَ انْتِقَاضٍ مِنَ الْمُبْرَمِ؛ فَجَأَهُمْ بِتَصْدِيقِ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَ النُّورِ الْمُقْتَدَى بِهِ ذَلِكَ الْقُرْآنُ فَاسْتَنْطِقُوهُ، وَ لَنْ يَنْطِقَ، وَ لَكِنْ أُخْبِرُكُمْ عَنْهُ؛ أَلاَ إِنَّ فِيهِ عِلْمَ مَا يَأْتِي، وَ الْحَدِيثَ عَنِ الْمَاضِي، وَ دَوَأَ دَائِكُمْ، وَ نَظْمَ مَا بَيْنَكُمْ

الاخبار عن مستقبل بنی أمیة المظلم

فَعِنْدَ ذَلِكَ لاَ يَبْقَى بَيْتُ مَدَرٍ وَ لاَ وَبَرٍ إِلا وَ أَدْخَلَهُ الظَّلَمَةُ تَرْحَةً، وَ أَوْلَجُوا فِيهِ نِقْمَةً. فَيَوْمَئِذٍ لاَ يَبْقَى لَهُمْ فِي السَّمَأِ عَاذِرٌ وَ لاَ فِي الْأَرْضِ نَاصِرٌ. أَصْفَيْتُمْ بِالْأَمْرِ غَيْرَ أَهْلِهِ، وَ أَوْرَدْتُمُوهُ غَيْرَ مَوْرِدِهِ وَ سَيَنْتَقِمُ اللَّهُ مِمَّنْ ظَلَمَ مَأْكَلاً بِمَأْكَلٍ وَ مَشْرَبا بِمَشْرَبٍ، مِنْ مَطَاعِمِ الْعَلْقَمِ وَ مَشَارِبِ الصَّبِرِ وَ الْمَقِرِ وَ لِبَاسِ شِعَارِ الْخَوْفِ، وَ دِثَارِ السَّيْفِ، وَ إِنَّمَا هُمْ مَطَايَا الْخَطِيئَاتِ وَ زَوَامِلُ الْآثَامِ. فَأُقْسِمُ، ثُمَّ أُقْسِمُ، لَتَنْخَمَنَّهَا أُمَيَّةُ مِنْ بَعْدِي كَمَا تُلْفَظُ النُّخَامَةُ، ثُمَّ لاَ تَذُوقُهَا وَ لاَ تَطْعَمُ بِطَعْمِهَا أَبَدا مَا كَرَّ الْجَدِيدَانِ!.

রাসূল (সা.) ও উমাইয়াদের স্বৈরাচার সম্পর্কে

পবিত্র কুরআনে রাসূল (সা.)

আল্লাহ্ রাসূলকে (সা.) এমন এক সময় প্রেরণ করেছিলেন যখন পৃথিবীতে বেশ কিছু সময়ের জন্য কোন পয়গম্বর ছিল না। মানুষ দীর্ঘকাল ধরে নিদ্রাচ্ছন্ন ছিল এবং রশির পাক শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। রাসূল (সা.) এমন এক কিতাব নিয়ে এসেছিলেন যাতে রয়েছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে যা ছিল তার সমর্থন ও অনুসরণীয় আলো। এ কিতাব হলো কুরআন ,যদি তোমরা একে কথা বলতে বল তবে তা কথা বলতে পারবে না ;কিন্তু আমি এর সম্পর্কে বলবো ,তোমরা জেনে রাখো যে ,এতে রয়েছে যা কিছু ঘটবে তার জ্ঞান ,অতীতের ঘটনা প্রবাহ ,তোমাদের রোগের নিরাময় ও যা কিছু তোমাদের মুখোমুখি হয় তার নিয়মকানুন।

উমাইয়াদের স্বৈরাচার সম্পর্কে

সে সময় এমন কোন ঘর বা তাবু থাকবে না যেখানে জালেমগণ শোকের ছায়া ঢুকিয়ে দেবে না। এবং নিপীড়ন প্রবেশ করবে না। সেই দিনগুলোতে জনগণের অভিযোগ শুনার জন্য আকাশে কেউ থাকবে না এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার মতো মাটিতে কেউ থাকবে না। তোমরা এমন লোককে প্রশাসনের (খেলাফত) জন্য মনোনীত করেছো যে তার যোগ্য নয় এবং তোমরা তাকে এমন পদমর্যাদায় উঠিয়ে দিয়েছে যা তার জন্য প্রযোজ্য নয়। সহসাই আল্লাহ তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন যারা জুলুম করেছে - সেই প্রতিশোধ হবে খাদ্যের বদলে খাদ্য ও পানীয়ের বদলে পানীয়। তাদেরকে খাবার জন্য কোলেসিনথ (শশার মতো বিষাক্ত ফল) এবং পান করার জন্য গন্ধরস ও ঘৃতকুমারী পাতার রস দেয়া হবে। এ সমস্ত খাদ্য ও পানীয়ের যন্ত্রণায় তাদের ভেতরের দিক জ্বলবে এবং বাইরের খোলস তরবারির ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকবে । তারা ভারবাহী জান্তুর মতো পাপের ভার বয়ে বেড়াবে এবং উটের সওয়ারের মতো কুকর্মের সওয়ার হবে। আমি শপথ করে বলছি - আবার শপথ করে বলছি যে ,উমাইয়াগণ খেলাফতকে মুখের শ্লেষার মতো থু করে ফেলে দেবে এবং তারপর আর কোন দিন এর স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে না। যতদিন দিবারাত্র থাকবে ততদিন তারা আর খেলাফতের গ্নধ গ্রহণ করতে পারবে না।

মাযদাকী ধর্ম

অন্য যে ধর্মটি সাসানী আমলের শেষাংশে উৎপত্তি লাভ করেছিল ও যার বিপুল সংখ্যক অনুসারীও ছিল তা হলো মাযদাকী। মাযদাকী ধর্মকে মনী ধর্ম হতে উদ্ভূত মনে করা হয়। এ ধর্মের প্রবর্তক মাযদাক সাসানী শাসক আনুশিরওয়ানের পিতা কাবাদের শাসনামলে নিজেকে এ ধর্মের প্রবক্তা বলে ঘোষণা করেন। কাবাদ প্রথম দিকে মাযদার প্রতি ভালবাসা অথবা এ ধর্মে বিশ্বাসের কারণে অথবা যারথুষ্ট্র পুরোহিত ও সম্ভ্রান্তদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তাঁকে সমর্থন জানান। এতে মাযদাকের কর্মতৎপরতা অনেক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর পুত্র আনুশিরওয়ানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অথবা আনুশিরওয়ান শাসন ক্ষমতা লাভের পর মাযদাকীদের গণহত্যার নির্দেশ দেন। মাযদাকীদের ওপর গণহত্যা পরিচালনায় এ ধর্মাবলম্বীরা আত্মগোপন করে।

মাযদাকীরা ইসলামী শাসনামলের দু বা তিন শতাব্দী পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল এবং এ সময়ে ইসলাম ও খেলাফতের বিরুদ্ধে যে সকল ইরানী বিদ্রোহ করেছিল মাযদাকীরা তার নেতৃত্বে ছিল। এ কারণেই যারথুষ্ট্রগণ তাদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে মুসলমানদের সহযোগিতা করে।

কথিত আছে মাযদাকী ধর্মের প্রবক্তা মূলত যারদুশ্ত নামের এক ব্যক্তি যিনি ইরানের সিরাজের ফাসার অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রথমে মনী ধর্মের একটি স্বতন্ত্র ফির্কার দিকে মানুষকে আহ্বান জানাতেন। তাঁর এ আহ্বান রোম হতে শুরু হয়। পরে তিনি ইরানে ফিরে এসে তাঁর এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। রোমে তিনি বুন্দেস নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ক্রিস্টেন সেন উপরোক্ত বিষয়টি বর্ণনার পর উল্লেখ করেছেন ,

সুতরাং মাযদাকী ধর্ম বুন্দেসের প্রচারিত সত্য দীন । মনী ধর্মের এ ব্যক্তির নতুন ধর্মমত প্রচারের জন্য ইরানে আগমন হতে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে ,তিনি ইরানী বংশোদ্ভূত ছিলেন। যদিও বুন্দেস শব্দটি ফার্সী ভাষায় নাম হিসেবে নেই তদুপরি এটি তিনি নিজের উপাধি হিসেবে গ্রহণ করেন। ইসলামী গ্রন্থগুলোতে দু টি উৎস হতে মাযদাকী ধর্মের বিষয়ে আলেচনা এসেছে। এর একটি হলো আল ফেহেরেসত যেখানে মাযদাকী ধর্মের প্রবক্তা মাযদাকের কিছু পূর্বের এক ব্যক্তি বলে উল্লিখিত হয়েছে ;ইসলামী গ্রন্থসমূহের অপর উৎস খুযায়ে নমাগ গ্রন্থে তাঁর নামের সঙ্গে যারদুশত শব্দটি জুড়ে দেয়া আছে এবং এখান হতেই যারদুশত ফির্কার সৃষ্টি হয়েছে... সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় বুন্দেস যারদুশত এক ব্যক্তি ছিলেন এবং এ ধর্মের প্রবক্তার প্রকৃত নাম যারদুশত যেটি যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তার সমনাম অর্থাৎ মাযদা ইয়াসনা যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তা ও নবী এবং মাযদাকী ধর্মের প্রবক্তা উভয়ের নামই ছিল যারদুশত । সুতরাং আমাদের আলোচিত ধর্মটি মনী ধর্মেরই একটি ফির্কা যার উৎপত্তি মাযদাকের দু শতাব্দী পূর্বেই রোমে বুন্দেসে র হাতে ঘটেছিল এবং তিনি ইরানের ফাসার অধিবাসী খুরেগনের পুত্র যারদুশত ছিলেন।... আরবী গ্রন্থসমূহ হতে জানা যায় ফাসার যারদুশতের আহ্বান শুধুই তত্ত্বগত ছিল। কিন্তু মাযদাক এ ধর্মের একজন সাধারণ প্রতিনিধি ও প্রচারক হিসেবে (তাবারীর মতে) ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ায় ধীরে ধীরে প্রবক্তার স্থান দখল করেন ও তাঁর জীবদ্দশায়ই এ ধর্মকে মাযদাকী বলে প্রচার চালান। ফলে পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ ধারণা করেছে এ ধর্মের প্রকৃত উদ্গাতা ছিলেন মাযদাক। 61

মাযদাকী ধর্মের স্বরূপ ,ফাসায়ী যারদুশতের আবির্ভাবের কারণ ও মাযদাক সম্পর্কে প্রচুর কথা রয়েছে। মাযদাক নিঃসন্দেহে মনীর ন্যায় দ্বিত্ববাদী ছিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে এ দু য়ের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করব। এ ধর্মের আচার-নীতি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধভাব ও সংসার বিরাগের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ক্রিস্টেন সেন বলেছেন , ...মনী ধর্মের ন্যায় এ ফির্কারও মৌল নীতি হলো মানুষ যেন বস্তুর প্রতি আকর্ষণ কমায় এবং যা কিছুই এ আকর্ষণের সৃষ্টি করে তার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করে ও দূরে থাকে। এ কারণেই পশুর মাংস ভক্ষণ মাযদাকীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল এবং তারা বিশেষ নীতির মধ্যে খাদ্য গ্রহণ করত ও কঠোর সাধনায় রত হত । ...শাহরেস্তানী বর্ণনা করেছেন মাযদাক অন্ধকার হতে মুক্তির জন্য আত্মহত্যার নির্দেশ দিতেন। অবশ্য সম্ভাবনা রয়েছে আত্মহত্যা বলতে প্রবৃত্তিকে হত্যা বুঝানো হয়েছে যা আত্মার মুক্তির পথের অন্তরায় । মাযদাক মানুষকে ঈর্ষা ,প্রতিহিংসা ,দ্বন্দ্ব ও হত্যা হতে নিষেধ করতেন। তাঁর মতে যেহেতু মানুষের মধ্যে হিংসা ও দ্বন্দ্বের মূল কারণ অসাম্য সেহেতু বিশ্ব হতে অসাম্যকে বিনাশ করতে হবে। তবেই মানুষের মধ্যে হিংসা ও দ্বিমূখিতার অবসান ঘটবে। মনী ধর্মের মনোনীত প্রতিনিধিগণ বিবাহ করতে পারবেন না ,একদিনের আহার ও এক বছরের প্রয়োজনীয় পোশাকের অধিক রাখতে পারবেন না। যেহেতু মাযদাকীরাও মনীদের ন্যায় সংসার বিরাগ ও কঠোর সাধনায় বিশ্বাসী ছিল তাই ধারণা করা যায় তাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের জন্যও এরূপ বিধান ছিল। তবে মাযদাকীদের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষ বস্তুগত আনন্দ উপভোগ যেমন সম্পদ ,তার পছন্দনীয় নারী প্রভৃতি হতে বিরত থাকতে পারে না ;বরং তারা স্বাধীনভাবে এগুলো উপভোগ করতে প্রত্যাশী ,তাই ধর্মযাজকগণ তাঁদের বিশ্বাসকে এভাবে বর্ণনা করেন: খোদা জীবন যাপনের সকল উপকরণ পৃথিবীতে দিয়েছেন যাতে করে সকল মানুষ সমভাবে তা হতে ব্যবহার করতে পারে। কেউ যেন অপর হতে অধিক গ্রহণ না করে। অসাম্যের কারণেই মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা জন্ম নিয়েছে যে ,তার ভ্রাতার সম্পদ অপহরণ করে নিজেকে পরিতৃপ্ত করবে। তাই কেউ অন্যের চেয়ে অধিক সম্পদ ও নারীর অধিকারী হতে পারবে না। তাই সম্পদশীলদের নিকট থেকে নিয়ে দরিদ্রদের দিতে হবে যাতে করে পুনরায় পৃথিবীতে সাম্য স্থাপিত হয়। 62

অবশ্য স্বয়ং মাযদাক এবং এ ধর্মের উদ্ভাবনের পেছনে কি বিষয় তাঁকে উদ্দীপিত করেছে সে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু জানা যায় না। মাযদাকের পরিচিতি বিশেষত তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার কারণে । ক্রিস্টেন সেন মাযদাকের এরূপ চিন্তার মূলে মানবপ্রেম ও নৈতিক অনুভূতি বলে মনে করেন।

মাযদাকের এরূপ চিন্তার কারণ ও উদ্দেশ্য যাই হোক যে বিষয়টি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার দাবি রাখে তা হলো তৎকালীন ইরানী সমাজ সাম্যবাদী ধারণা গ্রহণের জন্য কিরূপ উপযোগী ছিল। ক্রিস্টেন সেন তাঁর গ্রন্থের মাযদাকী আন্দোলন অধ্যায়ে তৎকালীন শ্রেণীবিভক্ত ইরান সমাজ কিভাবে মাযদাকী চিন্তাধারার প্রসারের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার আশ্চর্য বিবরণ দিয়েছেন। আমরা ইরানের তৎকালীন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এরূপ চিন্তার প্রসারের কারণ হয়েছিল।

সাঈদ নাফিসী সাসানী আমলের ইরান সমাজে বিবাহ ,তালাক ,উত্তরাধিকার ও নারীর অবস্থানের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন , বিশেষ শ্রেণীর প্রাধান্য ও জনসমষ্টির বিশাল অংশের সম্পদের অধিকারবঞ্চিত হওয়ার কারণে ইরান সমাজে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণেই সাসানী আমলের ইরান সমাজ ঐক্যবদ্ধ ছিল না এবং সাধারণ মানুষদের বিরাট অংশ বঞ্চিত ও অসন্তুষ্ট ছিল। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে দু টি বিপ্লবী ধারার জন্ম হয়। যে দু ধারারই লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে তার খোদাপ্রদত্ত অধিকার দান করা। 240 খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ সাসানী শাসনামলের চৌদ্দতম বছরে সাসানী সম্রাট প্রথম শাপুরের সিংহাসনে আরোহণের দিন মনী বঞ্চিত শ্রেণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে তাঁর ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেন ও ঘোষনা দেন। এর ঠিক পঞ্চাশ বছর পর ফার্সের ফাসার যারদুশত নতুন আরেকটি ধর্মের উদ্ভব ঘটান যদিও তাঁর ধর্মে সাম্যবাদের বিষয়টি কতটা উপস্থাপিত হয়েছিল তা জানা যায় না। কারণ তিনি এ ধর্ম তেমনভাবে প্রচার করতে পারেননি। তবে এর প্রায় দু শ বছর পর বমদাদের পুর মাযদাক তাঁর প্রণীত মৌলনীতিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। অবশেষে সাম্য ও মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলামের আগমন ঘটলে সমাজের অধিকারবঞ্চিত মানুষ তাদের অধিকার অর্জন করে ও সাসানী আমলের বৈষম্যের অবসান ঘটে। 63

মাযদাকী ধর্ম বঞ্চিত শ্রেণীর পক্ষে থাকায় শ্রেণীবিভক্ত সমাজে দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে। ক্রিস্টেন সেন বলেন ,

মাযদাকী ধর্ম সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন শ্রেণীর মাঝে উদ্ভব হয়ে এক রাজনৈতিক বিপ্লবী ধারার জন্ম দেয় ,কিন্তু ধর্মীয় ভিত্তি পাওয়ায় উচ্চ শ্রেণীর মধ্যেও এ ধর্মের অনুসারী ছিল। ধীরে ধীরে মাযদাকীরা শক্তি লাভ করে ধর্মযাজক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটায় এবং একজন ধর্মযাজককে তাদের প্রধান মনোনীত করে। 64

ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে ,মাযদাক ও তাঁর অনুসারীরা কাবাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর অন্যতম পুত্র কাউসকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায় ও কাবাদের ঈপ্সিত উত্তরাধিকারী পুত্র আনুশিরওয়ানকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। এর ফলেই আনুশিরওয়ান তাদের সমূলে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন।

ক্রিস্টেন সেন বলেছেন ,

শাসকশ্রেণী তাদের দীর্ঘ দিনের সফল অভিজ্ঞতাকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। তারা ধর্মযাজকদের বিভিন্ন গ্রুপকে দাওয়াত করে। অন্যান্য ধর্মযাজকদের প্রধানদের সঙ্গে মাযদাকী ধর্মীয় গুরুদেরও আহ্বান করা হয়। মাযদাকী পুরোহিতদের এক বৃহৎ অংশ সরকারীভাবে আয়োজিত এ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত হলেন। স্বয়ং সম্রাট কাবাদ (কাওয়ায) অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। এদিকে সম্রাটপুত্র খসরু আনুশিরওয়ান সম্রাটের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে মাযদাকী ও কাউসের ষড়যন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় রত ছিলেন যাতে করে এ অনুষ্ঠান মাযদাকীদের ওপর ভয়ঙ্কর এক হামলার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে। যা হোক বিতর্ক শুরু হলে বেশ কিছু প্রশিক্ষিত ধর্মযাজক ময়দানে আসলেন...। দু জন প্রতিষ্ঠিত খ্রিষ্টান ধর্মযাজক গুলুনাযেস ও বাযানেস যারথুষ্ট্র পুরোহিতদের সঙ্গী হিসেবে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাযানেস সম্রাট কাবাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কারণ তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বেশ দক্ষ ছিলেন। বিতর্কের শেষ পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই মাযদাকীরা পরাস্ত হলেন। এমতাবস্থায় মাযদাকীদের পেছনে অবস্থানকারী প্রহরীরা অস্ত্র হাতে মাযদাকীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রধান বিতর্ককারী (সম্ভবত স্বয়ং মাযদাক ছিলেন) নিহত হলেন। কতজন মাযদাকী এ আক্রমণে নিহত হন তা সঠিক জানা যায়নি। আরব ও ইরানী ঐতিহাসিকগণ যে সংখ্যাসমূহের উল্লেখ করেছেন তার কোন সঠিক ভিত্তি নেই। তবে মনে হয় মাযদাকীদের প্রধান ধর্মযাজকদের সকলেই এতে নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর মাযদাকীদের সকলকে হত্যার নির্দেশ জারী হলো। মাযদাকীরা যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল ও শত্রুর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হলো। তাদের সম্পদ ও গ্রন্থসমূহ পুড়িয়ে দেয়া হলো... তখন হতে মাযদাকীরা গোপনে কর্মতৎপরতা চালানো শুরু করে এবং সাসানী আমলের পরবর্তীতে ইসলামের আবির্ভাবের পরও তারা অনেকবার আত্মপ্রকাশ করেছে। 65

বাহ্যিকভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতার মাধ্যমে মাযদাকী ধর্ম অবদমিত হয়েছিল ,কিন্তু বাস্তবে তারা ছাইচাপা আগুনের ন্যায় অপ্রকাশ্য ছিল। নিঃসন্দেহে ইসলাম আবির্ভূত না হলে মাযদাকী ধর্ম তার সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে পুনরুত্থিত হতো। কেননা যে সকল কারণে এ ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল ও মানুষ এর প্রতি আশ্চর্যজনকভাবে ঝুঁকে পড়ছিল সে কারণসমূহ বর্তমান ছিল। মাযদাকী ধর্ম দীনের মৌল বিশ্বাস ,বিশ্ব ,মানুষ ও সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণার বিষয়ে যারথুষ্ট্র ধর্ম হতে কোন বিষয়ে কমতি রাখত না ;বরং হয়তো কিছুটা উচ্চ পর্যায়ে ছিল। তাই অন্যান্য ধর্ম হতে তাদের আকর্ষণ কম ছিল না। সামাজিক শিক্ষার বিষয়ে তাদের অবস্থান ছিল যারথুষ্ট্র ধর্মের বিপরীতে। কারণ যারথুষ্ট্রগণ শক্তিমান ও ক্ষমতাশীলদের পক্ষে ছিল। আর মাযদাকীরা সাধারণ নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিল।

শক্তি প্রয়োগ ও দমন-নিপীড়নের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে মাযদাকী ধর্মের বিলুপ্তির মূল কারণ ছিল ইসলাম। ইসলাম একত্ববাদী ধর্ম হিসেবে খোদা ,সৃষ্টি ,মানুষ ও জীবন সম্পর্কে এক বিশেষ মৌলনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হয় ,মাযদাকী ধর্ম কোনক্রমেই তার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। ইসলাম তার সামাজিক প্রশিক্ষণের ধারায় ন্যায়নীতি ,সাম্য ,মানুষ হিসেবে সকল শ্রেণী ,বর্ণ ও জাতির অভিন্নতার ধারণা উপস্থাপন করে যার মধ্যে মাযদাকীদের ন্যায় কোন বাড়াবাড়ি ছিল না। বস্তুত ইসলাম চিন্তাগত ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাযদাকীদের অপেক্ষা অধিকতর আকর্ষণীয় ছিল। তাই ইরানের সাধারণ মানুষ মাযদাকী ধর্মে প্রবেশ না করে তাওহীদ ও ন্যায়নীতির প্রতি আহ্বানকারী ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। উমাইয়্যা ও আব্বাসীয় খলীফাগণ তাঁদের শাসনামলে পারস্য ও রোমের শাসকবর্গের নীতি অবলম্বন করলে ইরানে দ্বিতীয়বারের মত মাযদাকী চিন্তার প্রসারের সুযোগ আসলেও ইরানের মানুষদের সচেতনতা সে সুযোগ দেয়নি। কারণ তারা জানত খলীফাদের আচরণের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই ইসলামকে এই খলীফাদের হাত হতে মুক্তি দিতে হবে।

তাই আমরা লক্ষ্য করি উমাইয়্যা শাসনের শেষ দিকে 129 হিজরীতে মারভের সেফিযানজ হতে কালো পোশাকধারীরা যে আন্দোলন শুরু করে তাতে তারা তাদের পতাকায় কোরআনের যে আয়াতটি খোদিত করে তা নিম্নরূপ :

) أذِنَ للّذين يقاتلون بأنّهم ظلموا و إنَّ الله على نصرهم لقدير(

যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হলো তাদের যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। 66

এ আন্দোলনের প্রথম দিন ছিল ঈদুল ফিতর। এদিন আন্দোলনের প্রধান নেতা আবু মুসলিম খোরাসানীর নির্দেশে অন্যতম নেতা সুলাইমান ইবনে কাসির ঈদের খুতবা পড়েন ও উমাইয়্যা খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তৎকালীন সময়ে ইরানীদের মধ্যে মাযদাকী ধর্মের প্রতি আকর্ষণ থাকলে তা প্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিল এটি। কিন্তু আমরা ইতিহাসে লক্ষ্য করি ইরানীদের ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সব সময় ইসলামের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল ;মাযদাকী বা অন্য কোন চিন্তার ওপর নয়।

মাযদাকীরাও মনুয়ীদের ন্যায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে ,যারথুষ্ট্রদের ন্যায় সংখ্যালঘু হিসেবেও টিকে থাকতে পারে নি। এর কারণ মনী ধর্মের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি ,মুসলমানরা মাযদাকীদের ঐশী ধর্ম বা আহলে কিতাব মনে করত না ;বরং মনীদের ন্যায় তাদেরও ধর্মহীন মনে করত। এ কারণেই তারা যারথুষ্ট্রদের ন্যায় সংখ্যালঘু হিসেবেও অবশিষ্ট থাকে নি। অবশ্য একদিকে মাযদাকীদের কঠোর নৈতিক সাধনা ও প্রচেষ্টার বাড়াবাড়ি ,অন্যদিকে সামাজিক ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সাম্যবাদী ধারণা এ দু টি বিষয়ও তাদের নিশ্চি হ্ন হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল।

বৌদ্ধধর্ম

প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষের হিমালয় পর্বতের পাদদেশে বসবাসকারী শৈক্য নামে প্রসিদ্ধ একদল মানুষের মাঝে তাদের সম্রাটের এক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। ত্রিশ বছর তিনি তাদের মধ্যে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেন ও তৎকালীন সময়ের সকল জ্ঞান অর্জন করেন বিশেষত হিন্দু ধর্মের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বেদ সমূহ অধ্যয়ন ও শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তাঁর মনের মধ্যে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং তিনি সাত বছরের জন্য রাজকীয় সব আড়ম্বর ত্যাগ করে নির্জনে চিন্তা ও যোগ সাধনার কাজে লিপ্ত হন। তাঁর মূল ভাবনা ছিল মানব সন্তানের

দুঃখ-কষ্টের কারণ নির্ণয় ও এ হতে মুক্তিদানের মাধ্যমে তাদের সৌভাগ্য ও সাফল্যমণ্ডিত জীবন দান। দীর্ঘকালের চিন্তা ,সাধনা ,একাকী জীবন যাপন ও আত্মিক অনুশীলনের পর এক তমুর (বোধি) বৃক্ষের নীচে তাঁর মনে এক নতুন চিন্তার উদ্ভব হয়। এ চিন্তা ও বিশ্বাসই মানব সন্তানের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে বলে তিনি অনুভব করেন। তখন তিনি মানব সমাজে ফিরে এসে এ শিক্ষা হতে দিক-নির্দেশনা দেয়া শুরু করেন। তিনি যা উদ্ঘাটন করেন তা প্রকৃতির এক স্বাভাবিক রীতি। আর তা হলো এ বিশ্বজগতে পুরস্কার ও শাস্তির নীতি রয়েছে এবং সৎ কর্মের প্রতিদান হলো সৎ এবং অসৎ কর্মের প্রতিদান হলো মন্দ ও অসৎ।

এ সম্রাটপুত্রের নাম ছিল সিদ্ধার্থ। তিনি পরবর্তীতে বুদ্ধ নাম ধারণ করেন। তিনি তাঁর সাধনা অর্জিত শিক্ষার অনুবর্তী হয়ে জীবহত্যা ,উপাস্যদের উপাসনা ও প্রার্থনা হতে নিষেধ করেন। তিনি স্রষ্টা ও উপাস্যদের অস্বীকার করে বিশ্বজগতের চিরস্থায়ীত্বে বিশ্বাস করতে বলেন। ধর্মগ্রন্থ বেদ প্রার্থনা ও কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছে এবং জন্মগতভাবে মানুষদের শ্রেণী বিন্যাস করেছে। বুদ্ধ এগুলোকে সমালোচনা ও অস্বীকার করেছেন।

বুদ্ধের চিন্তাকে ধর্ম সদৃশ না বলে দর্শন সদৃশ বলা যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে বৌদ্ধের অনুসারীরা একে এক ধর্মের রূপ দান করে এবং প্রার্থনা ও উপাসনাকে অস্বীকারকারী বৌদ্ধকে উপাস্যের স্থানে স্থান দেয়। তারা বৌদ্ধের মূর্তি তৈরি করে ও তাঁর উপাসনার জন্য মন্দির প্রস্তুত করে। তাঁর বক্তব্য ও উপদেশ বাণীসমূহকে গ্রন্থাকারে ত্রিপিটক বা জ্ঞানের ত্রিঝুড়ি নামে সংকলন করে ।

বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য অনুসারী পান। পিতার সম্রাজ্য ছাড়াও ভারতের অন্য একটি প্রদেশের অধিবাসীরা তাঁর অনুসারী হয় এবং ধীরে ধীরে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টপূর্ব তিনশ সালে ভারতবর্ষের এক প্রসিদ্ধ সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং তাঁর নির্দেশে অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির নির্মিত হয়। ফলে বৌদ্ধধর্ম সারা ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করে ও অগণিত অনুসারীর সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাজকীয়ভাবে হিন্দুধর্মের প্রচারণা এবং বিশেষত ইসলামের আগমনের পর এ ধর্ম এর জন্মভূমি হতে পাততাড়ি গুটিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। এখনও বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ধর্ম। এ ধর্মের অনুসারীরা এখন শ্রীলঙ্কা ,বার্মা ,থাইল্যান্ড ,ভিয়েতনাম ,তাইওয়ান ,জাপান ,কোরিয়া ,মঙ্গোলিয়া ,তিব্বত ও চীনে বসবাস করে। বৌদ্ধধর্ম ভারত হতেই ইরানে আগমন করে। এ সম্পর্কে ক্রিস্টেন সেন বলেন ,

আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর গ্রীকদের আধিপত্যের সময় বৌদ্ধধর্ম ইরানের পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে। ভারতীয় সম্রাট অশোক যিনি খ্রিষ্টপূর্ব 260 সালে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি গান্ধারের পশ্চিমাঞ্চলে ও কাবুল উপত্যকায় অভিযান চালান। ...বৌদ্ধরা প্রথম খ্রিষ্ট শতাব্দীতে গান্ধারে বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরসমূহ তৈরি করে যার চি হ্ন এখনও ধ্বংসাবশেষ হিসেবে রয়েছে এবং সেগুলোতে হিন্দী (সংস্কৃত অথবা পালি) ও গ্রীক ভাষার মিশ্রণে পাথরে খোদিত লেখাসমূহ রয়েছে... কাবুলের পশ্চিমাঞ্চলের বামিয়ানে পাহাড়ে খোদিত বৌদ্ধের একটি বৃহৎ মূর্তি রয়েছে...67

চীনা পর্যটক হিউয়ান সাং-এর বর্ণনা মতে সপ্তম খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত ইরানে বৌদ্ধমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল এবং ইরানের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে ভারতীয় অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও বর্তমান ছিল।

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ,

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ ভাগে ও প্রথম শতাব্দীর প্রথম ভাগে কাবুল উপত্যকার সম্রাট মানান্দার ভারতবর্ষেও ক্ষমতা লাভ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন ও এর অনুসারীদের মধ্যে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।

তাঁর বর্ণনা মতে 125 খ্রিষ্টাব্দে কান্দাহারে ও পাঞ্জাবে কানিস্কা নামে এক বৌদ্ধ সম্রাট প্রসিদ্ধি লাভ করেন যিনি বৌদ্ধধর্মের একজন বড় প্রচারক ছিলেন।68

বৌদ্ধ ধর্মও এ অঞ্চল হতে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি বৌদ্ধ ও মনীরা ইরানের সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী ছিল। তদুপরি তারা যারথুষ্ট্র অনুসারীদের অপেক্ষা স্বীয় ধর্মকে রক্ষার জন্য অধিকতর সক্রিয় ছিল। তবে বালখের বৌদ্ধবিহারের সেবক বার্মাকী গোষ্ঠী পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল (এবং তাদের অনেকেই ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল) ।

ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে বৌদ্ধধর্ম টিকে থাকতে পারেনি ;বরং তাদের জন্মভূমি ভারতবর্ষের ন্যায় এখানেও আস্তে আস্তে অবক্ষয় ও বিলুপ্তির পথে পা বাড়ায়। তামাদ্দুনে ইরানী গ্রন্থে বলা হয়েছে :

আফগানিস্তানের কাবুলের নিকটবর্তী বামিয়ানের ধর্মীয় গুরুত্ব ও সপ্তম খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত সেখানে বৌদ্ধমন্দিরসমূহের উপস্থিতির বিষয়টি হিউয়ান সাং হতে বর্ণিত হয়েছে। এক কোরীয় পর্যটক পরবর্তী শতাব্দীতে সেখানে একজন ইরানী বৌদ্ধ শাসকের উপস্থিতির উল্লেখ করেছেন। তিনি এই শাসকের অধীন এক শক্তিশালী সেনাদলের অস্তিত্বের কথাও বলেছেন। কিন্তু এর পরের শতাব্দীতেই ইয়াকুব লাইস সাফারী এ এলাকা দখল করেন। 69

সুতরাং বোঝা যায় ইরানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ভারত হতে আগত বৌদ্ধধর্ম ইরানে ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছিল। যেমনটি ইরানের পশ্চিমাঞ্চল ও দজলা-ফোরাতের মধ্যবর্তী অঞ্চল হতে আসা খ্রিষ্টধর্ম ইরানে বিস্তৃতি লাভ করছিল। বৌদ্ধধর্ম পশ্চিম দিকে এবং খ্রিষ্টধর্ম পূর্ব দিকে অগ্রসরমান ছিল। যদিও শাসনকর্তাদের পক্ষ হতে যারথুষ্ট্র ধর্ম রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় এর পুরোহিতগণ এ দু অগ্রসরমান ধর্মের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। পূর্বে যারথুষ্ট্র পুরোহিত কিরিতারের শিলালিপির উদ্ধৃতি আমরা উল্লেখ করেছি যিনি বলেছেন ,বিদেশী ধর্মসমূহের কিছু প্রচারক যাঁদের ইরানে অবস্থান কল্যাণকর ছিল না তাঁদের ইরান হতে বহিষ্কার করা হয়। যেমন ইহুদী ,বৌদ্ধ ধর্মযাজক ,ব্রা হ্ম ,খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ,সামানিগণ...।

কিন্তু যে ধর্মটি বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারতার পথ রুদ্ধ করে বৌদ্ধ ধর্মের কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটায় ও খ্রিষ্টধর্মকে নগণ্য সংখ্যালঘুতে পরিণত করে তা হলো ইসলাম যার অনুশোচনা ও কষ্ট আজও খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ এবং তাঁদের অনুসারী প্রাচ্যবিদদের লেখনী হতে স্পষ্ট বোঝা যায়।

যা হোক বৌদ্ধধর্ম তৎকালীন ইরানের অন্যতম ধর্ম ছিল এবং খ্রিষ্টান ,মনী ও মাযদাকীদের ন্যায় তাদের কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। তাই তারা তেমনভাবে উপস্থাপিতও হয় নি।

মাযদাকী ধর্ম

অন্য যে ধর্মটি সাসানী আমলের শেষাংশে উৎপত্তি লাভ করেছিল ও যার বিপুল সংখ্যক অনুসারীও ছিল তা হলো মাযদাকী। মাযদাকী ধর্মকে মনী ধর্ম হতে উদ্ভূত মনে করা হয়। এ ধর্মের প্রবর্তক মাযদাক সাসানী শাসক আনুশিরওয়ানের পিতা কাবাদের শাসনামলে নিজেকে এ ধর্মের প্রবক্তা বলে ঘোষণা করেন। কাবাদ প্রথম দিকে মাযদার প্রতি ভালবাসা অথবা এ ধর্মে বিশ্বাসের কারণে অথবা যারথুষ্ট্র পুরোহিত ও সম্ভ্রান্তদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে তাঁকে সমর্থন জানান। এতে মাযদাকের কর্মতৎপরতা অনেক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর পুত্র আনুশিরওয়ানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অথবা আনুশিরওয়ান শাসন ক্ষমতা লাভের পর মাযদাকীদের গণহত্যার নির্দেশ দেন। মাযদাকীদের ওপর গণহত্যা পরিচালনায় এ ধর্মাবলম্বীরা আত্মগোপন করে।

মাযদাকীরা ইসলামী শাসনামলের দু বা তিন শতাব্দী পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল এবং এ সময়ে ইসলাম ও খেলাফতের বিরুদ্ধে যে সকল ইরানী বিদ্রোহ করেছিল মাযদাকীরা তার নেতৃত্বে ছিল। এ কারণেই যারথুষ্ট্রগণ তাদের সঙ্গে সহযোগিতা না করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে মুসলমানদের সহযোগিতা করে।

কথিত আছে মাযদাকী ধর্মের প্রবক্তা মূলত যারদুশ্ত নামের এক ব্যক্তি যিনি ইরানের সিরাজের ফাসার অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রথমে মনী ধর্মের একটি স্বতন্ত্র ফির্কার দিকে মানুষকে আহ্বান জানাতেন। তাঁর এ আহ্বান রোম হতে শুরু হয়। পরে তিনি ইরানে ফিরে এসে তাঁর এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। রোমে তিনি বুন্দেস নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। ক্রিস্টেন সেন উপরোক্ত বিষয়টি বর্ণনার পর উল্লেখ করেছেন ,

সুতরাং মাযদাকী ধর্ম বুন্দেসের প্রচারিত সত্য দীন । মনী ধর্মের এ ব্যক্তির নতুন ধর্মমত প্রচারের জন্য ইরানে আগমন হতে স্পষ্ট ধারণা করা যায় যে ,তিনি ইরানী বংশোদ্ভূত ছিলেন। যদিও বুন্দেস শব্দটি ফার্সী ভাষায় নাম হিসেবে নেই তদুপরি এটি তিনি নিজের উপাধি হিসেবে গ্রহণ করেন। ইসলামী গ্রন্থগুলোতে দু টি উৎস হতে মাযদাকী ধর্মের বিষয়ে আলেচনা এসেছে। এর একটি হলো আল ফেহেরেসত যেখানে মাযদাকী ধর্মের প্রবক্তা মাযদাকের কিছু পূর্বের এক ব্যক্তি বলে উল্লিখিত হয়েছে ;ইসলামী গ্রন্থসমূহের অপর উৎস খুযায়ে নমাগ গ্রন্থে তাঁর নামের সঙ্গে যারদুশত শব্দটি জুড়ে দেয়া আছে এবং এখান হতেই যারদুশত ফির্কার সৃষ্টি হয়েছে... সুতরাং নিশ্চিতভাবে বলা যায় বুন্দেস যারদুশত এক ব্যক্তি ছিলেন এবং এ ধর্মের প্রবক্তার প্রকৃত নাম যারদুশত যেটি যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তার সমনাম অর্থাৎ মাযদা ইয়াসনা যারথুষ্ট্র ধর্মের প্রবক্তা ও নবী এবং মাযদাকী ধর্মের প্রবক্তা উভয়ের নামই ছিল যারদুশত । সুতরাং আমাদের আলোচিত ধর্মটি মনী ধর্মেরই একটি ফির্কা যার উৎপত্তি মাযদাকের দু শতাব্দী পূর্বেই রোমে বুন্দেসে র হাতে ঘটেছিল এবং তিনি ইরানের ফাসার অধিবাসী খুরেগনের পুত্র যারদুশত ছিলেন।... আরবী গ্রন্থসমূহ হতে জানা যায় ফাসার যারদুশতের আহ্বান শুধুই তত্ত্বগত ছিল। কিন্তু মাযদাক এ ধর্মের একজন সাধারণ প্রতিনিধি ও প্রচারক হিসেবে (তাবারীর মতে) ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়ায় ধীরে ধীরে প্রবক্তার স্থান দখল করেন ও তাঁর জীবদ্দশায়ই এ ধর্মকে মাযদাকী বলে প্রচার চালান। ফলে পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ ধারণা করেছে এ ধর্মের প্রকৃত উদ্গাতা ছিলেন মাযদাক। 61

মাযদাকী ধর্মের স্বরূপ ,ফাসায়ী যারদুশতের আবির্ভাবের কারণ ও মাযদাক সম্পর্কে প্রচুর কথা রয়েছে। মাযদাক নিঃসন্দেহে মনীর ন্যায় দ্বিত্ববাদী ছিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে এ দু য়ের মধ্যে পার্থক্য বর্ণনা করব। এ ধর্মের আচার-নীতি জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধভাব ও সংসার বিরাগের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ক্রিস্টেন সেন বলেছেন , ...মনী ধর্মের ন্যায় এ ফির্কারও মৌল নীতি হলো মানুষ যেন বস্তুর প্রতি আকর্ষণ কমায় এবং যা কিছুই এ আকর্ষণের সৃষ্টি করে তার সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করে ও দূরে থাকে। এ কারণেই পশুর মাংস ভক্ষণ মাযদাকীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল এবং তারা বিশেষ নীতির মধ্যে খাদ্য গ্রহণ করত ও কঠোর সাধনায় রত হত । ...শাহরেস্তানী বর্ণনা করেছেন মাযদাক অন্ধকার হতে মুক্তির জন্য আত্মহত্যার নির্দেশ দিতেন। অবশ্য সম্ভাবনা রয়েছে আত্মহত্যা বলতে প্রবৃত্তিকে হত্যা বুঝানো হয়েছে যা আত্মার মুক্তির পথের অন্তরায় । মাযদাক মানুষকে ঈর্ষা ,প্রতিহিংসা ,দ্বন্দ্ব ও হত্যা হতে নিষেধ করতেন। তাঁর মতে যেহেতু মানুষের মধ্যে হিংসা ও দ্বন্দ্বের মূল কারণ অসাম্য সেহেতু বিশ্ব হতে অসাম্যকে বিনাশ করতে হবে। তবেই মানুষের মধ্যে হিংসা ও দ্বিমূখিতার অবসান ঘটবে। মনী ধর্মের মনোনীত প্রতিনিধিগণ বিবাহ করতে পারবেন না ,একদিনের আহার ও এক বছরের প্রয়োজনীয় পোশাকের অধিক রাখতে পারবেন না। যেহেতু মাযদাকীরাও মনীদের ন্যায় সংসার বিরাগ ও কঠোর সাধনায় বিশ্বাসী ছিল তাই ধারণা করা যায় তাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের জন্যও এরূপ বিধান ছিল। তবে মাযদাকীদের নেতৃবর্গ বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ মানুষ বস্তুগত আনন্দ উপভোগ যেমন সম্পদ ,তার পছন্দনীয় নারী প্রভৃতি হতে বিরত থাকতে পারে না ;বরং তারা স্বাধীনভাবে এগুলো উপভোগ করতে প্রত্যাশী ,তাই ধর্মযাজকগণ তাঁদের বিশ্বাসকে এভাবে বর্ণনা করেন: খোদা জীবন যাপনের সকল উপকরণ পৃথিবীতে দিয়েছেন যাতে করে সকল মানুষ সমভাবে তা হতে ব্যবহার করতে পারে। কেউ যেন অপর হতে অধিক গ্রহণ না করে। অসাম্যের কারণেই মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা জন্ম নিয়েছে যে ,তার ভ্রাতার সম্পদ অপহরণ করে নিজেকে পরিতৃপ্ত করবে। তাই কেউ অন্যের চেয়ে অধিক সম্পদ ও নারীর অধিকারী হতে পারবে না। তাই সম্পদশীলদের নিকট থেকে নিয়ে দরিদ্রদের দিতে হবে যাতে করে পুনরায় পৃথিবীতে সাম্য স্থাপিত হয়। 62

অবশ্য স্বয়ং মাযদাক এবং এ ধর্মের উদ্ভাবনের পেছনে কি বিষয় তাঁকে উদ্দীপিত করেছে সে বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কিছু জানা যায় না। মাযদাকের পরিচিতি বিশেষত তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার কারণে । ক্রিস্টেন সেন মাযদাকের এরূপ চিন্তার মূলে মানবপ্রেম ও নৈতিক অনুভূতি বলে মনে করেন।

মাযদাকের এরূপ চিন্তার কারণ ও উদ্দেশ্য যাই হোক যে বিষয়টি ঐতিহাসিক পর্যালোচনার দাবি রাখে তা হলো তৎকালীন ইরানী সমাজ সাম্যবাদী ধারণা গ্রহণের জন্য কিরূপ উপযোগী ছিল। ক্রিস্টেন সেন তাঁর গ্রন্থের মাযদাকী আন্দোলন অধ্যায়ে তৎকালীন শ্রেণীবিভক্ত ইরান সমাজ কিভাবে মাযদাকী চিন্তাধারার প্রসারের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার আশ্চর্য বিবরণ দিয়েছেন। আমরা ইরানের তৎকালীন শ্রেণীবিভক্ত সমাজ নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করব। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এরূপ চিন্তার প্রসারের কারণ হয়েছিল।

সাঈদ নাফিসী সাসানী আমলের ইরান সমাজে বিবাহ ,তালাক ,উত্তরাধিকার ও নারীর অবস্থানের বর্ণনা দিয়ে বলেছেন , বিশেষ শ্রেণীর প্রাধান্য ও জনসমষ্টির বিশাল অংশের সম্পদের অধিকারবঞ্চিত হওয়ার কারণে ইরান সমাজে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণেই সাসানী আমলের ইরান সমাজ ঐক্যবদ্ধ ছিল না এবং সাধারণ মানুষদের বিরাট অংশ বঞ্চিত ও অসন্তুষ্ট ছিল। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে দু টি বিপ্লবী ধারার জন্ম হয়। যে দু ধারারই লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে তার খোদাপ্রদত্ত অধিকার দান করা। 240 খ্রিষ্টাব্দে অর্থাৎ সাসানী শাসনামলের চৌদ্দতম বছরে সাসানী সম্রাট প্রথম শাপুরের সিংহাসনে আরোহণের দিন মনী বঞ্চিত শ্রেণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে তাঁর ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করেন ও ঘোষনা দেন। এর ঠিক পঞ্চাশ বছর পর ফার্সের ফাসার যারদুশত নতুন আরেকটি ধর্মের উদ্ভব ঘটান যদিও তাঁর ধর্মে সাম্যবাদের বিষয়টি কতটা উপস্থাপিত হয়েছিল তা জানা যায় না। কারণ তিনি এ ধর্ম তেমনভাবে প্রচার করতে পারেননি। তবে এর প্রায় দু শ বছর পর বমদাদের পুর মাযদাক তাঁর প্রণীত মৌলনীতিকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। অবশেষে সাম্য ও মুক্তির বাণী নিয়ে ইসলামের আগমন ঘটলে সমাজের অধিকারবঞ্চিত মানুষ তাদের অধিকার অর্জন করে ও সাসানী আমলের বৈষম্যের অবসান ঘটে। 63

মাযদাকী ধর্ম বঞ্চিত শ্রেণীর পক্ষে থাকায় শ্রেণীবিভক্ত সমাজে দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে। ক্রিস্টেন সেন বলেন ,

মাযদাকী ধর্ম সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নিম্ন শ্রেণীর মাঝে উদ্ভব হয়ে এক রাজনৈতিক বিপ্লবী ধারার জন্ম দেয় ,কিন্তু ধর্মীয় ভিত্তি পাওয়ায় উচ্চ শ্রেণীর মধ্যেও এ ধর্মের অনুসারী ছিল। ধীরে ধীরে মাযদাকীরা শক্তি লাভ করে ধর্মযাজক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটায় এবং একজন ধর্মযাজককে তাদের প্রধান মনোনীত করে। 64

ইতিহাসে উল্লিখিত হয়েছে ,মাযদাক ও তাঁর অনুসারীরা কাবাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর অন্যতম পুত্র কাউসকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালায় ও কাবাদের ঈপ্সিত উত্তরাধিকারী পুত্র আনুশিরওয়ানকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নেয়। এর ফলেই আনুশিরওয়ান তাদের সমূলে ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন।

ক্রিস্টেন সেন বলেছেন ,

শাসকশ্রেণী তাদের দীর্ঘ দিনের সফল অভিজ্ঞতাকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগায়। তারা ধর্মযাজকদের বিভিন্ন গ্রুপকে দাওয়াত করে। অন্যান্য ধর্মযাজকদের প্রধানদের সঙ্গে মাযদাকী ধর্মীয় গুরুদেরও আহ্বান করা হয়। মাযদাকী পুরোহিতদের এক বৃহৎ অংশ সরকারীভাবে আয়োজিত এ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত হলেন। স্বয়ং সম্রাট কাবাদ (কাওয়ায) অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। এদিকে সম্রাটপুত্র খসরু আনুশিরওয়ান সম্রাটের সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে মাযদাকী ও কাউসের ষড়যন্ত্রের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় রত ছিলেন যাতে করে এ অনুষ্ঠান মাযদাকীদের ওপর ভয়ঙ্কর এক হামলার মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে। যা হোক বিতর্ক শুরু হলে বেশ কিছু প্রশিক্ষিত ধর্মযাজক ময়দানে আসলেন...। দু জন প্রতিষ্ঠিত খ্রিষ্টান ধর্মযাজক গুলুনাযেস ও বাযানেস যারথুষ্ট্র পুরোহিতদের সঙ্গী হিসেবে এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাযানেস সম্রাট কাবাদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কারণ তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে বেশ দক্ষ ছিলেন। বিতর্কের শেষ পর্যায়ে স্বাভাবিকভাবেই মাযদাকীরা পরাস্ত হলেন। এমতাবস্থায় মাযদাকীদের পেছনে অবস্থানকারী প্রহরীরা অস্ত্র হাতে মাযদাকীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রধান বিতর্ককারী (সম্ভবত স্বয়ং মাযদাক ছিলেন) নিহত হলেন। কতজন মাযদাকী এ আক্রমণে নিহত হন তা সঠিক জানা যায়নি। আরব ও ইরানী ঐতিহাসিকগণ যে সংখ্যাসমূহের উল্লেখ করেছেন তার কোন সঠিক ভিত্তি নেই। তবে মনে হয় মাযদাকীদের প্রধান ধর্মযাজকদের সকলেই এতে নিহত হয়েছিলেন। এ ঘটনার পর মাযদাকীদের সকলকে হত্যার নির্দেশ জারী হলো। মাযদাকীরা যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল ও শত্রুর বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ গড়তে ব্যর্থ হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হলো। তাদের সম্পদ ও গ্রন্থসমূহ পুড়িয়ে দেয়া হলো... তখন হতে মাযদাকীরা গোপনে কর্মতৎপরতা চালানো শুরু করে এবং সাসানী আমলের পরবর্তীতে ইসলামের আবির্ভাবের পরও তারা অনেকবার আত্মপ্রকাশ করেছে। 65

বাহ্যিকভাবে সামরিক শক্তি প্রয়োগ ও সহিংসতার মাধ্যমে মাযদাকী ধর্ম অবদমিত হয়েছিল ,কিন্তু বাস্তবে তারা ছাইচাপা আগুনের ন্যায় অপ্রকাশ্য ছিল। নিঃসন্দেহে ইসলাম আবির্ভূত না হলে মাযদাকী ধর্ম তার সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে পুনরুত্থিত হতো। কেননা যে সকল কারণে এ ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল ও মানুষ এর প্রতি আশ্চর্যজনকভাবে ঝুঁকে পড়ছিল সে কারণসমূহ বর্তমান ছিল। মাযদাকী ধর্ম দীনের মৌল বিশ্বাস ,বিশ্ব ,মানুষ ও সৃষ্টি সম্পর্কে ধারণার বিষয়ে যারথুষ্ট্র ধর্ম হতে কোন বিষয়ে কমতি রাখত না ;বরং হয়তো কিছুটা উচ্চ পর্যায়ে ছিল। তাই অন্যান্য ধর্ম হতে তাদের আকর্ষণ কম ছিল না। সামাজিক শিক্ষার বিষয়ে তাদের অবস্থান ছিল যারথুষ্ট্র ধর্মের বিপরীতে। কারণ যারথুষ্ট্রগণ শক্তিমান ও ক্ষমতাশীলদের পক্ষে ছিল। আর মাযদাকীরা সাধারণ নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিল।

শক্তি প্রয়োগ ও দমন-নিপীড়নের প্রভাব ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে মাযদাকী ধর্মের বিলুপ্তির মূল কারণ ছিল ইসলাম। ইসলাম একত্ববাদী ধর্ম হিসেবে খোদা ,সৃষ্টি ,মানুষ ও জীবন সম্পর্কে এক বিশেষ মৌলনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উপস্থিত হয় ,মাযদাকী ধর্ম কোনক্রমেই তার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না। ইসলাম তার সামাজিক প্রশিক্ষণের ধারায় ন্যায়নীতি ,সাম্য ,মানুষ হিসেবে সকল শ্রেণী ,বর্ণ ও জাতির অভিন্নতার ধারণা উপস্থাপন করে যার মধ্যে মাযদাকীদের ন্যায় কোন বাড়াবাড়ি ছিল না। বস্তুত ইসলাম চিন্তাগত ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মাযদাকীদের অপেক্ষা অধিকতর আকর্ষণীয় ছিল। তাই ইরানের সাধারণ মানুষ মাযদাকী ধর্মে প্রবেশ না করে তাওহীদ ও ন্যায়নীতির প্রতি আহ্বানকারী ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। উমাইয়্যা ও আব্বাসীয় খলীফাগণ তাঁদের শাসনামলে পারস্য ও রোমের শাসকবর্গের নীতি অবলম্বন করলে ইরানে দ্বিতীয়বারের মত মাযদাকী চিন্তার প্রসারের সুযোগ আসলেও ইরানের মানুষদের সচেতনতা সে সুযোগ দেয়নি। কারণ তারা জানত খলীফাদের আচরণের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই ইসলামকে এই খলীফাদের হাত হতে মুক্তি দিতে হবে।

তাই আমরা লক্ষ্য করি উমাইয়্যা শাসনের শেষ দিকে 129 হিজরীতে মারভের সেফিযানজ হতে কালো পোশাকধারীরা যে আন্দোলন শুরু করে তাতে তারা তাদের পতাকায় কোরআনের যে আয়াতটি খোদিত করে তা নিম্নরূপ :

) أذِنَ للّذين يقاتلون بأنّهم ظلموا و إنَّ الله على نصرهم لقدير(

যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হলো তাদের যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। 66

এ আন্দোলনের প্রথম দিন ছিল ঈদুল ফিতর। এদিন আন্দোলনের প্রধান নেতা আবু মুসলিম খোরাসানীর নির্দেশে অন্যতম নেতা সুলাইমান ইবনে কাসির ঈদের খুতবা পড়েন ও উমাইয়্যা খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তৎকালীন সময়ে ইরানীদের মধ্যে মাযদাকী ধর্মের প্রতি আকর্ষণ থাকলে তা প্রকাশের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ছিল এটি। কিন্তু আমরা ইতিহাসে লক্ষ্য করি ইরানীদের ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সব সময় ইসলামের ভিত্তির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল ;মাযদাকী বা অন্য কোন চিন্তার ওপর নয়।

মাযদাকীরাও মনুয়ীদের ন্যায় সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়েছে ,যারথুষ্ট্রদের ন্যায় সংখ্যালঘু হিসেবেও টিকে থাকতে পারে নি। এর কারণ মনী ধর্মের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করেছি ,মুসলমানরা মাযদাকীদের ঐশী ধর্ম বা আহলে কিতাব মনে করত না ;বরং মনীদের ন্যায় তাদেরও ধর্মহীন মনে করত। এ কারণেই তারা যারথুষ্ট্রদের ন্যায় সংখ্যালঘু হিসেবেও অবশিষ্ট থাকে নি। অবশ্য একদিকে মাযদাকীদের কঠোর নৈতিক সাধনা ও প্রচেষ্টার বাড়াবাড়ি ,অন্যদিকে সামাজিক ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ সাম্যবাদী ধারণা এ দু টি বিষয়ও তাদের নিশ্চি হ্ন হওয়ার কারণ ঘটিয়েছিল।

বৌদ্ধধর্ম

প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষের হিমালয় পর্বতের পাদদেশে বসবাসকারী শৈক্য নামে প্রসিদ্ধ একদল মানুষের মাঝে তাদের সম্রাটের এক পুত্র সন্তান জন্ম নিল। ত্রিশ বছর তিনি তাদের মধ্যে আড়ম্বরপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেন ও তৎকালীন সময়ের সকল জ্ঞান অর্জন করেন বিশেষত হিন্দু ধর্মের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ বেদ সমূহ অধ্যয়ন ও শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তাঁর মনের মধ্যে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে এবং তিনি সাত বছরের জন্য রাজকীয় সব আড়ম্বর ত্যাগ করে নির্জনে চিন্তা ও যোগ সাধনার কাজে লিপ্ত হন। তাঁর মূল ভাবনা ছিল মানব সন্তানের

দুঃখ-কষ্টের কারণ নির্ণয় ও এ হতে মুক্তিদানের মাধ্যমে তাদের সৌভাগ্য ও সাফল্যমণ্ডিত জীবন দান। দীর্ঘকালের চিন্তা ,সাধনা ,একাকী জীবন যাপন ও আত্মিক অনুশীলনের পর এক তমুর (বোধি) বৃক্ষের নীচে তাঁর মনে এক নতুন চিন্তার উদ্ভব হয়। এ চিন্তা ও বিশ্বাসই মানব সন্তানের জীবনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পারে বলে তিনি অনুভব করেন। তখন তিনি মানব সমাজে ফিরে এসে এ শিক্ষা হতে দিক-নির্দেশনা দেয়া শুরু করেন। তিনি যা উদ্ঘাটন করেন তা প্রকৃতির এক স্বাভাবিক রীতি। আর তা হলো এ বিশ্বজগতে পুরস্কার ও শাস্তির নীতি রয়েছে এবং সৎ কর্মের প্রতিদান হলো সৎ এবং অসৎ কর্মের প্রতিদান হলো মন্দ ও অসৎ।

এ সম্রাটপুত্রের নাম ছিল সিদ্ধার্থ। তিনি পরবর্তীতে বুদ্ধ নাম ধারণ করেন। তিনি তাঁর সাধনা অর্জিত শিক্ষার অনুবর্তী হয়ে জীবহত্যা ,উপাস্যদের উপাসনা ও প্রার্থনা হতে নিষেধ করেন। তিনি স্রষ্টা ও উপাস্যদের অস্বীকার করে বিশ্বজগতের চিরস্থায়ীত্বে বিশ্বাস করতে বলেন। ধর্মগ্রন্থ বেদ প্রার্থনা ও কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছে এবং জন্মগতভাবে মানুষদের শ্রেণী বিন্যাস করেছে। বুদ্ধ এগুলোকে সমালোচনা ও অস্বীকার করেছেন।

বুদ্ধের চিন্তাকে ধর্ম সদৃশ না বলে দর্শন সদৃশ বলা যেতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে বৌদ্ধের অনুসারীরা একে এক ধর্মের রূপ দান করে এবং প্রার্থনা ও উপাসনাকে অস্বীকারকারী বৌদ্ধকে উপাস্যের স্থানে স্থান দেয়। তারা বৌদ্ধের মূর্তি তৈরি করে ও তাঁর উপাসনার জন্য মন্দির প্রস্তুত করে। তাঁর বক্তব্য ও উপদেশ বাণীসমূহকে গ্রন্থাকারে ত্রিপিটক বা জ্ঞানের ত্রিঝুড়ি নামে সংকলন করে ।

বুদ্ধ তাঁর জীবদ্দশায় অসংখ্য অনুসারী পান। পিতার সম্রাজ্য ছাড়াও ভারতের অন্য একটি প্রদেশের অধিবাসীরা তাঁর অনুসারী হয় এবং ধীরে ধীরে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টপূর্ব তিনশ সালে ভারতবর্ষের এক প্রসিদ্ধ সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের শিক্ষাকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং তাঁর নির্দেশে অসংখ্য বৌদ্ধমন্দির নির্মিত হয়। ফলে বৌদ্ধধর্ম সারা ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করে ও অগণিত অনুসারীর সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাজকীয়ভাবে হিন্দুধর্মের প্রচারণা এবং বিশেষত ইসলামের আগমনের পর এ ধর্ম এর জন্মভূমি হতে পাততাড়ি গুটিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। এখনও বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ধর্ম। এ ধর্মের অনুসারীরা এখন শ্রীলঙ্কা ,বার্মা ,থাইল্যান্ড ,ভিয়েতনাম ,তাইওয়ান ,জাপান ,কোরিয়া ,মঙ্গোলিয়া ,তিব্বত ও চীনে বসবাস করে। বৌদ্ধধর্ম ভারত হতেই ইরানে আগমন করে। এ সম্পর্কে ক্রিস্টেন সেন বলেন ,

আলেকজান্ডারের আক্রমণের পর গ্রীকদের আধিপত্যের সময় বৌদ্ধধর্ম ইরানের পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে। ভারতীয় সম্রাট অশোক যিনি খ্রিষ্টপূর্ব 260 সালে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি গান্ধারের পশ্চিমাঞ্চলে ও কাবুল উপত্যকায় অভিযান চালান। ...বৌদ্ধরা প্রথম খ্রিষ্ট শতাব্দীতে গান্ধারে বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরসমূহ তৈরি করে যার চি হ্ন এখনও ধ্বংসাবশেষ হিসেবে রয়েছে এবং সেগুলোতে হিন্দী (সংস্কৃত অথবা পালি) ও গ্রীক ভাষার মিশ্রণে পাথরে খোদিত লেখাসমূহ রয়েছে... কাবুলের পশ্চিমাঞ্চলের বামিয়ানে পাহাড়ে খোদিত বৌদ্ধের একটি বৃহৎ মূর্তি রয়েছে...67

চীনা পর্যটক হিউয়ান সাং-এর বর্ণনা মতে সপ্তম খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত ইরানে বৌদ্ধমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল এবং ইরানের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে ভারতীয় অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরাও বর্তমান ছিল।

তিনি আরো উল্লেখ করেছেন ,

খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ ভাগে ও প্রথম শতাব্দীর প্রথম ভাগে কাবুল উপত্যকার সম্রাট মানান্দার ভারতবর্ষেও ক্ষমতা লাভ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন ও এর অনুসারীদের মধ্যে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।

তাঁর বর্ণনা মতে 125 খ্রিষ্টাব্দে কান্দাহারে ও পাঞ্জাবে কানিস্কা নামে এক বৌদ্ধ সম্রাট প্রসিদ্ধি লাভ করেন যিনি বৌদ্ধধর্মের একজন বড় প্রচারক ছিলেন।68

বৌদ্ধ ধর্মও এ অঞ্চল হতে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি বৌদ্ধ ও মনীরা ইরানের সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী ছিল। তদুপরি তারা যারথুষ্ট্র অনুসারীদের অপেক্ষা স্বীয় ধর্মকে রক্ষার জন্য অধিকতর সক্রিয় ছিল। তবে বালখের বৌদ্ধবিহারের সেবক বার্মাকী গোষ্ঠী পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল (এবং তাদের অনেকেই ইসলামের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল) ।

ইসলামের আবির্ভাবের পর ইরানে বৌদ্ধধর্ম টিকে থাকতে পারেনি ;বরং তাদের জন্মভূমি ভারতবর্ষের ন্যায় এখানেও আস্তে আস্তে অবক্ষয় ও বিলুপ্তির পথে পা বাড়ায়। তামাদ্দুনে ইরানী গ্রন্থে বলা হয়েছে :

আফগানিস্তানের কাবুলের নিকটবর্তী বামিয়ানের ধর্মীয় গুরুত্ব ও সপ্তম খ্রিষ্ট শতাব্দী পর্যন্ত সেখানে বৌদ্ধমন্দিরসমূহের উপস্থিতির বিষয়টি হিউয়ান সাং হতে বর্ণিত হয়েছে। এক কোরীয় পর্যটক পরবর্তী শতাব্দীতে সেখানে একজন ইরানী বৌদ্ধ শাসকের উপস্থিতির উল্লেখ করেছেন। তিনি এই শাসকের অধীন এক শক্তিশালী সেনাদলের অস্তিত্বের কথাও বলেছেন। কিন্তু এর পরের শতাব্দীতেই ইয়াকুব লাইস সাফারী এ এলাকা দখল করেন। 69

সুতরাং বোঝা যায় ইরানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ভারত হতে আগত বৌদ্ধধর্ম ইরানে ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছিল। যেমনটি ইরানের পশ্চিমাঞ্চল ও দজলা-ফোরাতের মধ্যবর্তী অঞ্চল হতে আসা খ্রিষ্টধর্ম ইরানে বিস্তৃতি লাভ করছিল। বৌদ্ধধর্ম পশ্চিম দিকে এবং খ্রিষ্টধর্ম পূর্ব দিকে অগ্রসরমান ছিল। যদিও শাসনকর্তাদের পক্ষ হতে যারথুষ্ট্র ধর্ম রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করায় এর পুরোহিতগণ এ দু অগ্রসরমান ধর্মের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। পূর্বে যারথুষ্ট্র পুরোহিত কিরিতারের শিলালিপির উদ্ধৃতি আমরা উল্লেখ করেছি যিনি বলেছেন ,বিদেশী ধর্মসমূহের কিছু প্রচারক যাঁদের ইরানে অবস্থান কল্যাণকর ছিল না তাঁদের ইরান হতে বহিষ্কার করা হয়। যেমন ইহুদী ,বৌদ্ধ ধর্মযাজক ,ব্রা হ্ম ,খ্রিষ্টান ধর্মযাজক ,সামানিগণ...।

কিন্তু যে ধর্মটি বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টধর্মের পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারতার পথ রুদ্ধ করে বৌদ্ধ ধর্মের কর্মকাণ্ডের পরিসমাপ্তি ঘটায় ও খ্রিষ্টধর্মকে নগণ্য সংখ্যালঘুতে পরিণত করে তা হলো ইসলাম যার অনুশোচনা ও কষ্ট আজও খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ এবং তাঁদের অনুসারী প্রাচ্যবিদদের লেখনী হতে স্পষ্ট বোঝা যায়।

যা হোক বৌদ্ধধর্ম তৎকালীন ইরানের অন্যতম ধর্ম ছিল এবং খ্রিষ্টান ,মনী ও মাযদাকীদের ন্যায় তাদের কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না। তাই তারা তেমনভাবে উপস্থাপিতও হয় নি।


13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41