নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা0%

নাহজ আল-বালাঘা লেখক:
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: হযরত আলী (আ.)

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক: আশ-শরীফ আর-রাজী
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ:

ভিজিট: 126214
ডাউনলোড: 8027

নাহজ আল-বালাঘা
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 48 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 126214 / ডাউনলোড: 8027
সাইজ সাইজ সাইজ
নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

রাসূলের (সা.) ‘জ্ঞান নগরীর দ্বার’ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী, দার্শনিক, সুলেখক ও বাগ্মী। আলঙ্কারিক শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য ও নৈপুন্য অসাধারণ। তিনি নবুওয়াতী জ্ঞান ভান্ডার হতে সরাসরি জ্ঞান আহরণ করেন এবং সাহাবাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পন্ডিত ছিলেন। এতে কারো দ্বিমত নেই। আরবী কাব্যে ও সাহিত্যে তার অনন্যসাধারণ অবদান ছিল। খেলাফত পরিচালনা কালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ (খোৎবা) দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকগণকে প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে পত্র লিখেছিলেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মানুষের অনেক প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তার এসব বাণী কেউকেউ লিখে রেখেছিল, কেউ কেউ মনে রেখেছিল, আবার কেউ কেউ তাদের লিখিত পুস্তকে উদ্ধৃত করেছিল। মোটকথা তার অমূল্য বাণীসমূহ মানুষের কাছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিল।

আশ-শরীফ আর-রাজী আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের ভাষণসমূহ (খোৎবা), পত্রাবলী, নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ সংগ্রহ করে “নাহজ আল-বালঘা” নামক গ্রন্থটি সঙ্কলন করেন।

খোৎবা - ২০০

الحق و الطريق الواضح

أَيُّهَا اَلنَّاسُ لاَ تَسْتَوْحِشُوا فِي طَرِيقِ اَلْهُدَى لِقِلَّةِ أَهْلِهِ، فَإِنَّ اَلنَّاسَ قَدِ اِجْتَمَعُوا عَلَى مَائِدَةٍ شِبَعُهَا قَصِيرٌ، وَ جُوعُهَا طَوِيلٌ. أَيُّهَا اَلنَّاسُ، إِنَّمَا يَجْمَعُ اَلنَّاسَ اَلرِّضَا وَ اَلسُّخْطُ. وَ إِنَّمَا عَقَرَ نَاقَةَ ثَمُودَ رَجُلٌ وَاحِدٌ فَعَمَّهُمُ اَللَّهُ بِالْعَذَابِ لَمَّا عَمُّوهُ بِالرِّضَی، فَقَالَسُبْحَانَهُ :( فَعَقَرُوها فَأَصْبَحُوا نادِمِينَ ) ، فَمَا كَانَ إِلاَّ أَنْ خَارَتْ أَرْضُهُمْ بِالْخَسْفَةِ خُوَارَ اَلسِّكَّةِ اَلْمُحْمَاةِ فِي اَلْأَرْضِ اَلْخَوَّارَةِ. أَيُّهَا اَلنَّاسُ، مَنْ سَلَكَ اَلطَّرِيقَ اَلْوَاضِحَ وَرَدَ اَلْمَاءَ، وَ مَنْ خَالَفَ وَقَعَ فِي اَلتِّيهِ!.

সত্য ও ন্যায়পথ সম্পর্কে

হে জনমণ্ডলী ,ন্যায় পথের অনুসারীর সংখ্যাল্পতায় তোমরা বিস্মিত হয়ো না। কারণ (এ দুনিয়াতে) মানুষ। শুধু সেই টেবিলের পাশে ভিড় জমায় যাতে অনেক কিছুর মধ্যে ভক্ষণীয় জিনিস অল্প কিন্তু ক্ষুধা চির অতৃপ্ত।

হে জনমণ্ডলী ,নিশ্চয়ই ,যে বিষয় মানুষকে একত্রিত করে তা হলো ভালো অথবা খারাপের জন্য তাদের ঐকমত্য অথবা অনৈকমত্য। ছামুদ জাতির এক ব্যক্তি উষ্ট্রিহত্যা করেছিল ;কিন্তু আল্লাহ তাদের সকলকে শান্তি দিয়েছিলেন। কারণ তারা সকলেই লোকটির গর্হিত কাজের প্রতি মৌন সম্মতি প্রদর্শন করেছিল। তাই মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন , অতঃপর তারা ওটার পায়ের শিরা কেটে দিয়েছিল এবং পরিণামে তারা অনুতপ্ত হলো । ” (কুরআন - ২৬ : ১৫৭) ।

এরপর তাদের ভূমি তলিয়ে গিয়ে কমে গিয়েছিল। যেমন করে লাঙ্গলের ফলা আকর্ষিত ভূমিকে ভেদ করে। হে জনমণ্ডলী ,যে ব্যক্তি হেদায়েতের সুস্পষ্ট পথে চলে সে পানির ঝরনার ধারে পৌছতে পারে এবং যে তা পরিত্যাগ করে সে পানিবিহীন মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায়।

____________________

১। প্রাচীন আরবে খৃষ্টপূর্ব ৪র্থ হতে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে ছামুদ নামক একটা গোত্র বা গোত্রসমষ্টি বাস করতো। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী আল - কুরা উপত্যকায় এ জাতি বসবাস করতো। সালিহ নামক একজন নবীকে আল্লাহ তাদের হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। আল্লাহ বলেনঃ

ছামুদ জাতির কাছে তাদের ভ্রাতা সালিহ - কে পাঠিয়েছিলাম । তিনি বলেছিলেন , হে আমার কওম ,তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর । তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই । তোমাদের জন্য তোমাদের রবের কাছ থেকে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে । আল্লাহর এ উষ্ট্রী তোমাদের জন্য একটা নিদর্শন । একে আল্লাহর জমিতে চরে খেতে দাও ,একে কোন ক্লেশ দিও না ,দিলে মর্মন্তুত শাস্তি তোমাদের ওপর আপতিত হবে এবং স্মরণ কর ,আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন । তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে ,তোমরা সমতল ভূমিতে প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছো । সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টি করো না । তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানেরা ইমানদারগণকে দুর্বল মনে করে বললো , তোমরা কি জানো যে ,সালিহ্ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ? তারা বললো ,তার প্রতি যে বাণী প্রেরিত হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাসী । * দাম্ভিকেরা বললো ,তোমরা যা বিশ্বাস কর আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। ” । অতঃপর তারা সেই উষ্ট্রী বধ করে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। এবং বলে , হে সালিহ! তুমি রাসূল হলে আমাদেরকে যে ভয় দেখিয়েছো তা আনয়ন কর । ” অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো ,ফলে তাদের প্রভাত হলো নিজগৃহে মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় । তারপর তিনি তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন , আমি তো আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌছে দিয়েছিলাম ,কিন্তু তোমরা তো হিতাকাঙ্খীদেরকে পছন্দ করনা ’ (কুরআন ৭:৭৩ - ৭৯)

ছামুদ সম্প্রদায় সতর্ককারীকে মিথ্যাবাদী বলেছিল । তারা বলেছিলো আমরা কি আমাদের মধ্য থেকেই এক ব্যক্তিকে অনুসরণ করবো ? তা হলে তো আমরা বিপথগামী ও উন্মাদ বলে গণ্য হবো । আমাদের মধ্যে কি তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে ? না ,সে তো একজন মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক ” । আগামীকাল তারা জানবে ,কে মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক । আমি তাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। এক উষ্ট্রী ;অতএব ,তুমি তাদের আচরণ লক্ষ্য কর এবং ধৈর্যশীল হও এবং তাদেরকে জানিয়ে দাও যে ,তাদের মধ্যে পানি বন্টন নির্ধারিত এবং পানির অংশের জন্য প্রত্যেকে উপস্থিত হবে পালাক্রমে । এরপর তারা তাদের এক সঙ্গীকে আহ্বান করলো ,সে উটটিকে হত্যা করলো। কী কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী । আমি তাদের ওপর আঘাত হেনেছিলাম এক মহানাদ দ্বারা ;ফলে তারা হয়ে গেল খোয়াড় নির্মাণকারীর বিখণ্ডিত শুষ্ক শাখা - প্রশাখার মতো। (৫৪:২৩ - ৩১) ।

খোৎবা - ২০১

رُوِيَ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَهُ عِنْدَ دَفْنِ سَيِّدَةِ اَلنِّسَاءِ فَاطِمَةَعليه‌السلام كَالْمُنَاجِي بِهِ رَسُولَ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم عِنْدَ قَبْرِهِ

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اَللَّهِ عَنِّي، وَ عَنِ اِبْنَتِكَ اَلنَّازِلَةِ فِي جِوَارِكَ، وَ اَلسَّرِيعَةِ اَللَّحَاقِ بِكَ! قَلَّ، يَا رَسُولَ اَللَّهِ، عَنْ صَفِيَّتِكَ صَبْرِي، وَ رَقَّ عَنْهَا تَجَلُّدِي، إِلاَّ أَنَّ فِي اَلتَّأَسِّي لِي بِعَظِيمِ فُرْقَتِكَ، وَ فَادِحِ مُصِيبَتِكَ، مَوْضِعَ تَعَزٍّ، فَلَقَدْ وَسَّدْتُكَ فِي مَلْحُودَةِ قَبْرِكَ، وَ فَاضَتْ بَيْنَ نَحْرِي وَ صَدْرِينَفْسُكَ.

«فَإِنَّا لِلَّهِ وَ إِنَّا إِلَيْهِ راجِعُونَ» . فَلَقَدِ اُسْتُرْجِعَتِ اَلْوَدِيعَةُ، وَ أُخِذَتِ اَلرَّهِينَةُ! أَمَّا حُزْنِي فَسَرْمَدٌ، وَ أَمَّا لَيْلِي فَمُسَهَّدٌ، إِلَى أَنْ يَخْتَارَ اَللَّهُ لِي دَارَكَ اَلَّتِي أَنْتَ بِهَا مُقِيمٌ. وَ سَتُنَبِّئُكَ اِبْنَتُكَ بِتَضَافُرِ أُمَّتِكَ عَلَى هَضْمِهَا، فَأَحْفِهَا اَلسُّؤَالَ، وَ اِسْتَخْبِرْهَا اَلْحَالَ؛ هَذَا وَ لَمْ يَطُلِ اَلْعَهْدُ، وَ لَمْ يَخْلُ مِنْكَ اَلذِّكْرُ، وَ اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمَا سَلاَمَ مُوَدِّعٍ، لاَ قَالٍ وَ لاَ سَئِمٍ، فَإِنْ أَنْصَرِفْ فَلاَ عَنْ مَلاَلَةٍ، وَ إِنْ أُقِمْ فَلاَ عَنْ سُوءِ ظَنٍّ بِمَا وَعَدَ اَللَّهُ اَلصَّابِرِينَ.

সাইয়্যেদুন্নিসা খাতুনে জান্নাত ফাতিমার দাফনের সময় প্রদত্ত খোৎবা

সাইয়্যেদুন্নিছা খাতুনে জান্নাতের দাফনের সময় আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল ,আমার সালাম ও আপনার কন্যার সালাম গ্রহণ করুন। আপনার কন্যা আপনার কাছে আসছেন এবং তিনি আপনার সাক্ষাত লাভের জন্য তাড়াহুড়া করেছিলেন। হে আল্লাহর রাসূল ,আপনার প্রাণপ্রিয় কন্যার মৃত্যু আমাকে ধৈর্যহারা করে দিয়েছে এবং আমার সহ্যশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমার সান্তুনার ক্ষেত্র এটুকু যে ,আপনার দুঃখজনক ও হৃদয় বিদারক বিচ্ছেদ - বেদনা আমি ধৈর্য সহকারে সহ্য করেছি। আপনাকে আমি নিজ হাতে কবরে শায়িত করেছি। আমার গ্রীবা ও বুকের মাঝখানে আপনার পবিত্র মস্তক থাকাবস্থায় আপনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী । ( কুরআন - ২ : ১৫৬ )

এক্ষণে ,আপনার আমানত ফেরত নেয়া হয়েছে এবং যা দেয়া হয়েছিল তা আবার ফিরিয়ে নেয়া হলো। আমার শোকের আর কোন সীমা রইলো না এবং আমার রাত্রি নিদ্রাবিহীন হয়ে গেল যে পর্যন্ত না আপনি এখন যে ঘরে আছেন আল্লাহ আমার জন্য সে ঘর মঞ্জুর করেন।

নিশ্চয়ই ,আপনার কন্যা আপনার সাক্ষাত লাভ করেই আপনাকে বিস্তারিত বলেছেন যে ,আপনার উম্মাহ তার প্রতি কতই না অত্যাচার করেছে। আপনি দয়া করে তাকে জিজ্ঞেস করে বিস্তারিত খবর জেনে নেবেন। এসব ঘটনা এত অল্পকালের মধ্যে ঘটেছে যে ,লোকেরা এখনো আপনাকে স্মরণ করে এবং আপনার কথা বলাবলি করে । আপনাদের উভয়ের প্রতি আমার সালাম । এ সালাম ,একজন শোকাহতের- কোন বিরক্ত বা সঘৃণ ব্যক্তির নয়। আমার এখান থেকে চলে যাওয়ার কারণ এ নয় যে ,আমি শ্রান্ত হয়ে পড়েছি এবং যদি আমি এখানে থাকি তার কারণ এ নয় যে ,আল্লাহ্ সবুরকারীদের জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি তাতে বিশ্বাস হারিয়েছি।

___________________

১। রাসূলের (সা.) ইন্তিকালের পর তার প্রাণপ্রিয় কন্যার প্রতি যে পরিমাণ জুলুম ও দুর্ব্যবহার করা হয়েছিল তা অত্যন্ত দুঃখজনক ,দুর্ভাগ্যজনক ও হৃদয় - বিদারক। যদিও রাসূলের ইন্তিকালের পর সাইয়্যেদুন্নিছা ফাতিমা মাত্র কয়েক মাস বেঁচে ছিলেন তবুও এ অল্প সময়ের শোক ও দুঃখ - দুর্দশা বর্ণনাতীত। এ বিষয়ে প্রথমে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তা হলো রাসূলের কাফন - দাফনের কথা চিন্তা না করে তাঁর পবিত্র মরদেহ ফেলে রেখে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য তারা সকলেই সকিফা - ই - সাইদায় চলে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এহেন আচরণ খাতুনে জান্নাতকে আহত করেছিল। যখন তিনি দেখলেন যে ,রাসূলের জীবদ্দশায় যারা তার প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা বলতো তারা ক্ষমতা দখলের জন্য এমনভাবে পাগলপারা হয়ে পড়েছিলো যে ,রাসূলের একমাত্র শোকাহত কন্যাকে একটু সান্তুনা দিতেও এলো না ,তখন তার হৃদয় ব্যথাতুর হওয়া স্বাভাবিক। এমন কি কখন রাসূলকে শেষ গোসল দেয়া হয়েছিল এবং কখন তাকে দাফন করা হয়েছিল - এসবের কিছুই তারা জানলো না। যেভাবে তারা রাসূল - কন্যার কাছে এসেছিল তা হলো - তারা আগুন জ্বালাবার উপকরণসহ দল বেঁধে তাঁর ঘরের সামনে জড়ো হয়ে জোরপূর্বক বায়াত গ্রহণের জন্য অত্যাচার ও বিশৃঙ্খলা প্রদর্শন করেছিল। এসব বাড়াবাড়ির মূল উদ্দেশ্য ছিল খাতুনে জান্নাতের ঘরের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তারা এমনভাবে মুছে ফেলতে চেয়েছিল যেন ভবিষ্যতে আর সেই মর্যাদা ফিরে না পায়। এসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়ার মানসে ফাদাক ” - এর দাবি মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে খাতুনে জান্নাত মৃত্যুকালে আছিয়াত করেছিলেন যে ,তারা কেউ যেন তাঁর দাফনে উপস্থিত না থাকে।

খোৎবা - ২০২

طلب الآخرة

أَيُّهَا اَلنَّاسُ، إِنَّمَا اَلدُّنْيَا دَارُ مَجَازٍ، وَ اَلْآخِرَةُ دَارُ قَرَارٍ، فَخُذُوا مِنْ مَمَرِّكُمْ لِمَقَرِّكُمْ، وَ لاَ تَهْتِكُوا أَسْتَارَكُمْ عِنْدَ مَنْ يَعْلَمُ أَسْرَارَكُمْ، وَ أَخْرِجُوا مِنَ اَلدُّنْيَا قُلُوبَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَخْرُجَ مِنْهَا أَبْدَانُكُمْ، فَفِيهَا اُخْتُبِرْتُمْ وَ لِغَيْرِهَا خُلِقْتُمْ. إِنَّ اَلْمَرْءَ إِذَا هَلَكَ قَالَ اَلنَّاسُ: مَا تَرَكَ؟ وَ قَالَتِ اَلْمَلاَئِكَةُ: مَا قَدَّمَ؟ لِلَّهِ آبَاؤُكُمْ! فَقَدِّمُوا بَعْضاً يَكُنْ لَكُمْ قَرْضاً، وَ لاَ تُخْلِفُوا كُلاًّ فَيَكُونَ فَرْضاً عَلَيْكُمْ.

পরকালের রসদ সংগ্রহের উপদেশ

হে জনমণ্ডলী ,নিশ্চয়ই এ পৃথিবী একটা যাত্রাপথ আর পরকাল হলো স্থায়ী আবাসস্থল। সুতরাং যাত্রাপথ থেকে স্থায়ী আবাসস্থলের রসদ সংগ্রহ কর । যিনি তোমাদের সকল গুপ্ত বিষয় অবগত আছেন। তাঁর সম্মুখে তোমাদের পর্দা ছিড়ে ফেলো না। এ পৃথিবী থেকে তোমাদের দেহ চলে যাবার আগে তোমাদের হৃদয়কে পাঠিয়ে দাও। কারণ পরীক্ষার জন্য তোমাদেরকে এখানে রাখা হয়েছে এবং পরকালের জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন কোন মানুষ মারা যায় তখন অন্যরা জিজ্ঞেস করে কী কী সম্পদ সে রেখে গেছে ,আর ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করে কী সৎ আমল সে অগ্রে প্রেরণ করেছে। আল্লাহ তোমাদেরকে আশীর্বাদ করুন ,তোমরা অগ্রে কিছু প্রেরণ কর ;এটা তোমাদের জন্য সঞ্চয় হিসাবে বিবেচিত হবে এবং সবকিছু পিছনে ফেলে যেয়ো না ;কারণ এটা তোমাদের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।

খোৎবা - ২০৩

الاستعداد للآخرة

تَجَهَّزُوا رَحِمَكُمُ اَللَّهُ! فَقَدْ نُودِيَ فِيكُمْ بِالرَّحِيلِ، وَ أَقِلُّوا اَلْعُرْجَةَ عَلَى اَلدُّنْيَا، وَ اِنْقَلِبُوا بِصَالِحِ مَا بِحَضْرَتِكُمْ مِنَ اَلزَّادِ، فَإِنَّ أَمَامَكُمْ عَقَبَةً كَؤُوداً، وَ مَنَازِلَ مَخُوفَةً مَهُولَةً، لاَ بُدَّ مِنَ اَلْوُرُودِ عَلَيْهَا، وَ اَلْوُقُوفِ عِنْدَهَا. وَ اِعْلَمُوا أَنَّ مَلاَحِظَ اَلْمَنِيَّةِ نَحْوَكُمْ دَانِيَةٌ(دائیه) ، وَ كَأَنَّكُمْ بِمَخَالِبِهَا وَ قَدْ نَشِبَتْ فِيكُمْ، وَ قَدْ دَهَمَتْكُمْ فِيهَا مُفْظِعَاتُ اَلْأُمُورِ، وَ مُعْضِلاَتُ(مضلعات) اَلْمَحْذُورِ. فَقَطِّعُوا عَلاَئِقَ اَلدُّنْيَا وَ اِسْتَظْهِرُوا بِزَادِ اَلتَّقْوَى(الآخرة).

বিচার দিনের বিপদ সম্বন্ধে সতর্কাদেশ

তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। পরপারে যাত্রার সামগ্রী সংগ্রহ করো ;কারণ প্রস্থানের আহবান ঘোষিত হয়ে গেছে। এ পৃথিবীতে তোমাদের অবস্থান ক্ষণকালের এবং উত্তম কিছু নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কারণ সম্মুখের উপত্যকায় আরোহণ বড়ই কষ্টসাধ্য এবং বাসস্থান বড়ই ভয়াবহ ও বিপদসঙ্কুল। তোমাদেরকে সেখানে পৌছতে হবে এবং থাকতে হবে। জেনে রাখো ,মৃত্যুর চোখ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় যেন তোমরা মৃত্যুর থাবার মধ্যেই রয়েছে। তোমাদের উচিত এ দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং আল্লাহর ভয়ের রসদ দ্বারা তোমাদের নিজেদেরকে সহায়তা করা ।

খোৎবা - ২০৪

كلم به طلحة و الزبير بعد بيعته بالخلافة و قد عتبا عليه من ترك مشورتهما و الاستعانة في الأمور بهما

لَقَدْ نَقَمْتُمَا يَسِيراً، وَ أَرْجَأْتُمَا كَثِيراً. أَ لاَ تُخْبِرَانِي، أَيُّ شَيْ‏ءٍ كَانَ لَكُمَا فِيهِ حَقٌّ دَفَعْتُكُمَا عَنْهُ؟ أَمْ أَيُّ قَسْمٍ اِسْتَأْثَرْتُ عَلَيْكُمَا بِهِ؟ أَمْ أَيُّ حَقٍّ رَفَعَهُ إِلَيَّ أَحَدٌ مِنَ اَلْمُسْلِمِينَ ضَعُفْتُ عَنْهُ، أَمْ جَهِلْتُهُ، أَمْ أَخْطَأْتُ بَابَهُ! وَ اَللَّهِ مَا كَانَتْ لِي فِي اَلْخِلاَفَةِ رَغْبَةٌ، وَ لاَ فِي اَلْوِلاَيَةِ إِرْبَةٌ، وَ لَكِنَّكُمْ دَعَوْتُمُونِي إِلَيْهَا، وَ حَمَلْتُمُونِي عَلَيْهَا، فَلَمَّا أَفْضَتْ إِلَيَّ نَظَرْتُ إِلَى كِتَابِ اَللَّهِ وَ مَا وَضَعَ لَنَا، وَ أَمَرَنَا بِالْحُكْمِ بِهِ فَاتَّبَعْتُهُ، وَ مَا اِسْتَنَّ اَلنَّبِيُّصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم فَاقْتَدَيْتُهُ، فَلَمْ أَحْتَجْ فِي ذَلِكَ إِلَى رَأْيِكُمَا، وَ لاَ رَأْيِ غَيْرِكُمَا، وَ لاَ وَقَعَ حُكْمٌ جَهِلْتُهُ، فَأَسْتَشِيرَكُمَا وَ إِخْوَانِي مِنَ اَلْمُسْلِمِينَ: وَ لَوْ كَانَ ذَلِكَ لَمْ أَرْغَبْ عَنْكُمَا، وَ لاَ عَنْ غَيْرِكُمَا. وَ أَمَّا مَا ذَكَرْتُمَا مِنْ أَمْرِ اَلْأُسْوَةِ، فَإِنَّ ذَلِكَ أَمْرٌ لَمْ أَحْكُمْ أَنَا فِيهِ بِرَأْيِي وَ لاَ وَلِيتُهُ هَوًى مِنِّي، بَلْ وَجَدْتُ أَنَا وَ أَنْتُمَا مَا جَاءَ بِهِ رَسُولُ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم قَدْ فُرِغَ مِنْهُ، فَلَمْ أَحْتَجْ إِلَيْكُمَا فِيمَا قَدْ فَرَغَ اَللَّهُ مِنْ قَسْمِهِ، وَ أَمْضَى فِيهِ حُكْمَهُ، فَلَيْسَ لَكُمَا، وَ اَللَّهِ عِنْدِي وَ لاَ لِغَيْرِكُمَا فِي هَذَا عُتْبَى. أَخَذَ اَللَّهُ بِقُلُوبِنَا وَ قُلُوبِكُمْ إِلَى اَلْحَقِّ، وَ أَلْهَمَنَا وَ إِيَّاكُمُ اَلصَّبْرَ. ثم قالعليه‌السلام : رَحِمَ اَللَّهُ رَجُلاً رَأَى حَقّاً فَأَعَانَ عَلَيْهِ، أَوْ رَأَى جَوْراً فَرَدَّهُ، وَ كَانَ عَوْناً بِالْحَقِّ عَلَى صَاحِبِهِ.

রাষ্ট্রীয় কার্যে তালহা ও জুবায়েরের পরামর্শ গ্রহণ না করার অভিযোগের জবাবে প্রদত্ত খোৎবা

আমিরুল মোমেনিনের বায়াত গ্রহণের পর তালহা ও জুবায়ের অভিযোগ উত্থাপন করলো যে ,তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যে তাদের সাথে পরামর্শ করেন না বা তাদের সহায়তা গ্রহণ করতে চান না। প্রত্যুত্তরে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ

তোমরা উভয়ে ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমাদের বিরাগ প্রকাশ করে থাক এবং বৃহৎ বিষয় পরিহার করে চলো । তোমরা কি বলতে পার আমি তোমাদেরকে তোমাদের কোন অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি অথবা কোন কিছুতে তোমাদের প্রাপ্য অংশ তোমাদেরকে দেইনি ? কোন মুসলিমের দাবির (যা আমার কাছে আনা হয়েছে) বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে কি আমি কখনো অপারগ হয়েছি ? আমি কি কোন বিষয়ে অজ্ঞ ছিলাম ? আমি কি কোন বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি ?

আল্লাহর কসম ,খেলাফতের প্রতি আমার কোন লোভ ছিল না বা সরকার পরিচালনার প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। কিন্তু তোমরা নিজেরাই আমাকে আমন্ত্রণ করে এ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছ। যখন খেলাফতের দায়িত্ব আমার কাছে এলো আমি আল্লাহর কিতাবকে সকল কাজে আমার সামনে রাখলাম। আল্লাহ এতে আমাদের জন্য যা কিছু রেখেছেন এবং যেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবেই আমি কুরআনকে অনুসরণ করতে লাগলাম। কুরআনের বিষয়ে আমাকে উপদেশ দেয়ার মতো তোমাদের কোন কিছু নেই বা কুরআন সংক্রান্ত বিষয়ে অন্য কারো উপদেশ আমার প্রয়োজন নেই। আমার অজানা এমন কোন আদেশ কুরআনে নেই যে বিষয়ে তোমাদের বা অন্য কোন মুসলিমের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন হতে পারে। যদি এমন হতো যে ,কোন কিছু আমার অজানা রয়েছে তাহলে অবশ্যই আমি তা তোমাদের সাথে বা অন্য কারো সাথে পরামর্শ করতাম ।

বায়তুল মালের সমবন্টন সম্পর্কে তোমরা যে প্রশ্ন তুলেছ সে বিষয়ে আমি নিজের খেয়ালখুশি মতো কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। আমি দেখেছি এবং তোমরাও দেখেছে যে ,রাসূল (সা.) যা কিছু আনতেন তা নিঃশেষ করে দিতেন। সুতরাং এ বিষয়ে তোমাদের প্রতি নজর রাখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ সে বিষয় আল্লাহই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহর কসম ,এ বিষয়ে তোমরা দুজন বা অন্য কেউ আমার কাছে কোন প্রকার আনুকূল্য পাবে না। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের হৃদয়কে ন্যায়ের প্রতি ঝুকিয়ে দিন এবং তিনি আমাদেরকে ও তোমাদেরকে সবুর করার তৌফিক দান করুন। সেই ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক যে সত্য দেখলে সমর্থন করে এবং অন্যায় দেখলে তা পরিহার করে। আল্লাহ তার প্রতিও রহমত বর্ষণ করুন যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যেকে সাহায্য করে ।

খোৎবা - ২০৫

الاخلاق فی الحرب

و قد سمع قوما من أصحابه يسبون أهل الشام أيام حربهم بصفين

إِنِّي أَكْرَهُ لَكُمْ أَنْ تَكُونُوا سَبَّابِينَ، وَ لَكِنَّكُمْ لَوْ وَصَفْتُمْ أَعْمَالَهُمْ، وَ ذَكَرْتُمْ حَالَهُمْ، كَانَ أَصْوَبَ فِي اَلْقَوْلِ، وَ أَبْلَغَ فِي اَلْعُذْرِ، وَ قُلْتُمْ مَكَانَ سَبِّكُمْ إِيَّاهُمْ: اَللَّهُمَّ اِحْقِنْ دِمَاءَنَا وَ دِمَاءَهُمْ، وَ أَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا وَ بَيْنِهِمْ، وَ اِهْدِهِمْ مِنْ ضَلاَلَتِهِمْ، حَتَّى يَعْرِفَ اَلْحَقَّ مَنْ جَهِلَهُ، وَ يَرْعَوِيَ عَنِ اَلْغَيِّ وَ اَلْعُدْوَانِ مَنْ لَهِجَ بِهِ.

যুদ্ধের ময়দানে নীতি নৈতিকতা সম্পর্কে

সিফফিনের যুদ্ধে যখন আমিরুল মোমেনিন শুনলেন যে ,তার লোকেরা সিরিয়দের গালি - গালাজ করছে তখন তিনি বললেনঃ

তোমরা তাদেরকে গালি দিচ্ছ - এটা আমি অপছন্দ করি। যদি তোমরা তাদের কর্মকান্ডের বর্ণনা বা সমালোচনা করে থাক তবে তা কথা বলার একটা ভালো প্রক্রিয়া এবং যুক্তি প্রদর্শনের জন্য অধিক গ্রহণীয় উপায় বলে বিবেচিত হবে। তাদেরকে গালি - গালাজ না করে তোমরা বলো , হে আল্লাহ ,আমাদেরকে ও তাদেরকে রক্তক্ষয় থেকে রক্ষা করুন ,আমাদের ও তাদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করুন ;এবং তাদেরকে বিপথ হতে ফিরিয়ে আনুন যেন তাদের মধ্যে যারা সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞাত তারা তা জানতে পারে। তাদের মধ্যে যারা বিদ্রোহের দিকে ঝুকে পড়ে বিদ্রোহী হয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনুন। ”

খোৎবা - ২০৬

ضرورة حفظ الامامة

في بعض أيام صفين و قد رأى الحسن ابنهعليه‌السلام يتسرع إلى الحرب

اِمْلِكُوا عَنِّي هَذَا اَلْغُلاَمَ لاَ يَهُدَّنِي، فَإِنَّنِي أَنْفَسُ بِهَذَيْنِ - يَعْنِي اَلْحَسَنَ وَ اَلْحُسَيْنَعليهما‌السلام - عَلَى اَلْمَوْتِ لِئَلاَّ يَنْقَطِعَ بِهِمَا نَسْلُ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم .

ইমামতের ধারা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম হাসান যুদ্ধ করতে দ্রুত এগিয়ে গেলে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ

এ যুবককে আমার পক্ষ থেকে যুদ্ধে যেতে বারণ করে ধরে রাখো ,পাছে সে আমার ধ্বংসের কারণ হয়ে পড়ে। এ দুজনকে (হাসান ও হুসাইন) মৃত্যুর দিকে পাঠাতে আমি সম্পূর্ণরূপে অনিচ্ছুক: কারণ তাদের মৃত্যুতে রাসূলের (সা.) বংশধারা শেষ হয়ে যাবে।

খোৎবা - ২০৭

قاله لما اضطرب عليه أصحابه في أمر الحكومة

أَيُّهَا اَلنَّاسُ، إِنَّهُ لَمْ يَزَلْ أَمْرِي مَعَكُمْ عَلَى مَا أُحِبُّ، حَتَّى نَهِكَتْكُمُ اَلْحَرْبُ، وَ قَدْ، وَ اَللَّهِ، أَخَذَتْ مِنْكُمْ وَ تَرَكَتْ، وَ هِيَ لِعَدُوِّكُمْ أَنْهَكُ. لَقَدْ كُنْتُ أَمْسِ أَمِيراً، فَأَصْبَحْتُ اَلْيَوْمَ مَأْمُوراً، وَ كُنْتُ أَمْسِ نَاهِياً، فَأَصْبَحْتُ اَلْيَوْمَ مَنْهِيّاً، وَ قَدْ أَحْبَبْتُمُ اَلْبَقَاءَ، وَ لَيْسَ لِي أَنْ أَحْمِلَكُمْ عَلَى مَا تَكْرَهُونَ!.

সালিশী সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনের মনোভাবে তাঁর অনুচরগণ অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি বললেনঃ

হে জনমণ্ডলী ,আমার ও তোমাদের মধ্যে যে ব্যাপার হয়েছে তা হলো আমি চেয়েছিলাম তোমরা নিঃশেষিত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আল্লাহর কসম ,যদিও যুদ্ধ তোমাদের কিছু লোককে নিয়ে গেছে। তবুও তোমাদের শক্র সম্পূর্ণরূপে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত আমি আদেশ দিয়েছিলাম ,আর আজ আমি আদিষ্ট হচ্ছি । গতকাল পর্যন্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আমি মানুষকে উপদেশ দিয়েছিলাম ,আর আজ আমাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তোমরা এ পৃথিবীতে বাস করার প্রবল ইচ্ছা দেখিয়েছো । কাজেই তোমরা যা অপছন্দ কর তার প্রতি তোমাদেরকে টেনে আনা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।

____________________

১। সিফফিনের যুদ্ধে সিরীয় সৈন্যগণ যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান হারিয়ে ফেলে পালিয়ে যাবার জন্য যখন প্রস্তুত হয়েছিল তখন মুয়াবিয়া তার চিরাচরিত ধূর্তামির একটা কৌশল হিসাবে কুরআনকে ব্যবহার করেছিল। এতে ইরাকি সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলো। তারা আমিরুল মোমেনিনের সকল উপদেশ অমান্য করে যুদ্ধে এক পাও এগুতে রাজি হলো না। অধিকন্তু যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তারা জেদ ধরেছিল। এতে আমিরুল মোমেনিন সালিশীতে সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন। এসব লোকের মধ্যে কতেক প্রকৃতপক্ষেই প্রতারিত হয়েছিল এবং তারা মনে করেছিল কুরআনকে মেনে চলার জন্যই বুঝি সত্যি সত্যি বলা হচ্ছিলো। আবার কিছু সংখ্যক লোক দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। তারা এ সুযোগে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। আবার এমন কিছু লোক ছিল যারা খেলাফতের ক্ষমতার কারণে আমিরুল মোমেনিনের সঙ্গী হয়েছিল ,কিন্তু তারা হৃদয় দিয়ে তাকে সমর্থন করতো না বা তার বিজয়ও কামনা করতো না। এমন কতেক লোক ছিল যারা মুয়াবিয়ার কাছ থেকে অনেক কিছুর আশা পেয়েছিল এবং সেই আশা পূরণের জন্য মুয়াবিয়ার স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিল। এ ছাড়াও এমন কতেক লোক ছিল যারা প্রথম থেকেই মুয়াবিয়ার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এমন একটা অবস্থায় এবং এমন প্রকৃতির সৈন্য নিয়ে এত বড় একটা যুদ্ধে জয়ের মুখোমুখি হওয়া শুধুমাত্র আমিরুল মোমেনিনের সৈন্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল ,রাজনৈতিক সক্ষমতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। তার সৈন্যগণ মুয়াবিয়ার ধূর্তামির শিকার না হলে তার জয় ছিল সুনিশ্চিত। কারণ সিরীয়দের শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়েছিল এবং পরাজয় তাদের মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এ ব্যাপারে ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেনঃ

মালিক আশতার মুয়াবিয়ার কাছ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল এবং তার ঘাড় আঁকড়ে ধরার আল্প বাকি ছিল । সিরীয়দের সকল শক্তি চুরমার হয়ে পড়েছিল । একটা মৃতো টিকটিকির লেজ যেভাবে নড়াচড়া করে সিরীয়দের মধ্যে ঠিক তদ্রূপ নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছিলো ।

খোৎবা - ২০৮

بالبصرة و قد دخل على العلاء بن زياد الحارثي - و هو من أصحابه - يعوده فلما رأى سعة داره قال:

مَا كُنْتَ تَصْنَعُ بِسِعَةِ هَذِهِ اَلدَّارِ فِي اَلدُّنْيَا، وَ أَنْتَ إِلَيْهَا فِي اَلْآخِرَةِ كُنْتَ أَحْوَجَ؟ وَ بَلَى إِنْ شِئْتَ بَلَغْتَ بِهَا اَلْآخِرَةَ: تَقْرِي فِيهَا اَلضَّيْفَ، وَ تَصِلُ فِيهَا اَلرَّحِمَ، وَ تُطْلِعُ مِنْهَا اَلْحُقُوقَ مَطَالِعَهَا، فَإِذاً أَنْتَ قَدْ بَلَغْتَ بِهَا اَلْآخِرَةَ.

فَقَالَ لَهُ اَلْعَلاَءُ: يَا أَمِيرَ اَلْمُؤْمِنِينَ، أَشْكُو إِلَيْكَ أَخِي عَاصِمَ بْنَ زِيَادٍ. قَالَ: وَ مَا لَهُ؟ قَالَ: لَبِسَ اَلْعَبَاءَةَ وَ تَخَلَّى عَنِ اَلدُّنْيَا. قَالَ: عَلَيَّ بِهِ. فَلَمَّا جَاءَ قَالَ:

يَا عُدَيَّ نَفْسِهِ! لَقَدِ اِسْتَهَامَ بِكَ اَلْخَبِيثُ! أَ مَا رَحِمْتَ أَهْلَكَ وَ وَلَدَكَ؟! أَ تَرَى اَللَّهَ أَحَلَّ لَكَ اَلطَّيِّبَاتِ، وَ هُوَ يَكْرَهُ أَنْ تَأْخُذَهَا؟! أَنْتَ أَهْوَنُ عَلَى اَللَّهِ مِنْ ذَلِكَ!.

قَالَ: يَا أَمِيرَ اَلْمُؤْمِنِينَ، هَذَا أَنْتَ فِي خُشُونَةِ مَلْبَسِكَ وَ جُشُوبَةِ مَأْكَلِكَ!.

قَالَ؛ وَيْحَكَ، إِنِّي لَسْتُ كَأَنْتَ، إِنَّ اَللَّهَتَعَالَى فَرَضَ عَلَى أَئِمَّةِ اَلْعَدْلِ أَنْ يُقَدِّرُوا أَنْفُسَهُمْ بِضَعَفَةِ اَلنَّاسِ، كَيْلاَ يَتَبَيَّغَ بِالْفَقِيرِ فَقْرُهُ!.

পার্থিব জগতের সাথে আচরণ সম্পর্কে

আমিরুল মোমেনিন তার অনুচর আ লা ইবনে জিয়াদ আল - হারিছিকে দেখতে গিয়ে তার বিশাল বাড়ি দেখে বললেনঃ

এ পৃথিবীতে এ রকম বিশাল বাড়ি দিয়ে তুমি কী করবে ? পরকালে তোমার এমন একটা বাড়ির প্রয়োজন রয়েছে। যদি তুমি এ বাড়িটি পরকালে নিয়ে যেতে চাও তবে এতে অতিথিদের আপ্যায়ন করে ;আত্মীয় - স্বজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ো এবং তাদের প্রতি তোমার যতটুকু দায়িত্ব রয়েছে তা পালন করো। এসব কাজ করলে এ বাড়ি তুমি পরকালে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

লা বললোঃ হে আমিরুল মোমেনিন ,আমি আমার ভ্রাতা আসিম ইবনে জিয়াদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে অভিযোগ করতে চাই ।

আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ সে কী করেছে ?

লা বললোঃ সে একটা পশমি কোট পরে থাকে এবং পৃথিবীর সব কিছুর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে।

আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ তাকে আমার সামনে নিয়ে আসি ।

যখন সে সামনে এলো আমিরুল মোমেনিন তাকে বললেনঃ ওহে ,তুমি তো তোমার নিজের শত্রু। নিশ্চয়ই ,শয়তান তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কি তোমার কোন মায়া হয় না ? আল্লাহ তোমার জন্য যা হালাল করেছেন তা পরিধান করলে তিনি তোমাকে অপছন্দ করবেন বলে কি তুমি মনে করা ? আল্লাহর জন্য তুমি অতি গুরুত্বহীন যে তিনি এমনটি করবেন।

আসিম বললোঃ হে আমিরুল মোমেনিন ,আপনিও তো মোটা কাপড় পরিধান করেন এবং সাধারণ খাদ্য গ্রহণ করেন।

আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ তোমার ওপর লানত ,আমি তোমার মতো নই। নিশ্চয়ই ,মহিমান্বিত আল্লাহ প্রকৃত নেতার জন্য এটা বাধ্যতামূলক করেছেন যে ,তারা সমাজের নিচু স্তরের লোকদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করবেন যাতে গরীব - দুঃখীগণ তাদের দারিদ্রের জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে।

____________________

১ । প্রাচীনকাল থেকেই সংসারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাপস জীবন যাপনকে আত্মার পবিত্রতা অর্জন করার ও চরিত্র গঠনের উপায় হিসাবে মনে করা হয়। ফলে যারা ভোগ - বিলাস ও পানাহারে সংযমী জীবন যাপন করা ও ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকার ইচ্ছা করতো তারা শহর ও জনজীবনের বাইরে চলে যেতো এবং বনে - জঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতো। কোন পথচারী বা পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের কেউ কিছু খেতে দিলে তারা তা খেতো। অন্যথায় বন্য ফলমূল ও ঝরনার পানি খেয়ে তারা জীবন কাটাতো। শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়িনের ফলশ্রুতিতে এহেন ইবাদতের সূত্রপাত হয়। শাসকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোন কোন লোক বনে - জঙ্গলে ও পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যান করতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে সূত্রপাত হলেও পরবর্তীতে এ ধরনের ইবাদত মানুষ স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে থাকে। ফলে এটা স্বীকৃত হয়ে গেল যে ,আত্মিক উন্নতির জন্য জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে এহেন জীবন যাপন করতে হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এ পদ্ধতির ইবাদত চলে আসছে। বর্তমানেও বৌদ্ধ এবং খৃষ্টানদের মধ্যে এ পদ্ধতি দেখা যায়।

ইসলাম এহেন সন্ন্যাস জীবন অনুমোদন করে না। কারণ আত্মিক উন্নতি অর্জনের জন্য জাগতিক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগের স্বীকৃতি ইসলামে নেই। কোন মুসলিম তার ঘর - সংসার ও পরিবার - পরিজনদের ত্যাগ করে গোপন স্থানে আনুষ্ঠানিক ইবাদতে নিজেকে মশগুল করে রাখবে - এরূপ ইবাদতের অনুমোদন ইসলামে নেই। ইসলামে ইবাদতের ধারণা শুধুমাত্র কতিপয় নির্ধারিত অনুষ্ঠান নয়। এটা এত ব্যাপক যে ,হালাল উপায়ে জীবিকা অর্জন ,একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা ,অন্যের সাথে সদাচরণ এবং সৎ ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা - এসবও ইসলামে ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। যদি কোন ব্যক্তি জাগতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা করে ,তার সন্তান - সন্ততি ও স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন না করে এবং জীবিকা অর্জনের চেষ্টা না করে সারাক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থাকে। সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এবং সে বাচার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করে না। সব কিছু ত্যাগ করে ইবাদত ও ধ্যানে মগ্ন থাকাই যদি আল্লাহর উদ্দেশ্য হতো। তবে মানুষ সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ এহেন ইবাদতের জন্য তার ফেরেশতাই যথেষ্টা ছিল।

আল্লাহ মানুষকে চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়েছেন যেখানে মধ্য - পথই হেদায়েতের কেন্দ্রবিন্দু। এ মধ্যপথ হতে একটুখানিক এদিক সেদিক হলেই তা নির্ঘাত পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। এ মধ্যপথ হলো কেউ জাগতিক বিষয়ে এমনভাবে ঝুকে পড়তে পারবে না যাতে সে পরকালকে ভুলে সম্পূর্ণরূপে দুনিয়াদারিতে ডুবে থাকবে ;আবার সে জাগতিক সবকিছু পরিত্যাগ করে নির্জনে নিজকে অবরুদ্ধ রেখে ইবাদতও করে কাটাতে পারবে না। যেহেতু আল্লাহ এ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন সেহেতু বেঁচে থাকার জন্য তাকে জীবনের কোড অনুসরণ করতে হবে এবং আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত নেয়ামত ও আরাম - আয়েশ পরিমিতভাবে ভোগ করতে হবে। হালাল জিনিস খেতে ও ব্যবহার করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। কাজেই এটা আল্লাহর ইবাদতের বিরোধী নয়। বরং আল্লাহ এসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন যেন মানুষ এসবের সুযোগ গ্রহণ করে শুকরিয়া আদায় করে। এ জন্যই আল্লাহর নবীগণ পৃথিবীতে অন্যদের সাথে বসবাস করতেন এবং অন্যদের মতোই পানাহার করতেন। তাঁরা বনেজঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় নির্জন স্থানে বাস করার বা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার প্রয়োজনীয়তা কখনো অনুভব করেননি।

অপরপক্ষে তারা আল্লাহর জেকের করেছেন ,জাগতিক কর্মকান্ডেও নিজেদেরকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে রাখেননি এবং আনন্দ ও উপভোগের মাঝেও মৃত্যুকে ভুলে থাকেননি।

তাপস জীবন অনেক সময় এমন মন্দ অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে ইহকাল ও পরকাল উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের প্রাকৃতিক প্রণোদনাসমূহ হালাল উপায়ে মিটানো না হলে মনে কুধারণার সৃষ্টি হয় এবং তাতে শান্তি ও মনোনিবেশ সহকারে ইবাদতের বিঘ্ন ঘটে। কখনো কখনো মানুষের অতৃপ্ত আবেগ ও অনুরাগ তাপসভাবকে পরাভূত করে সকল নৈতিক বেড়ি ছিন্ন করে দেয় এবং এমনভাবে অন্যায়ে লিপ্ত করে দেয় যে ,নফসের খাহেশ মিটাতে গিয়ে সে ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে যায়। এ কারণেই ধর্মীয় বিধানে একজন পরিবারবদ্ধ লোকের ইবাদতকে অপরিবারবদ্ধ লোকের ইবাদতের উর্দ্ধে স্থান দিয়েছে।

যে সব লোক সুফিবাদের আলখিল্লা পরে তাদের আত্মিক বড়ত্বের বাগাড়াম্বর করে তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের পথ হতে সরে গেছে এবং ইসলামের ব্যাপক শিক্ষা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। শয়তান তাদেরকে বিপথগামী করেছে এবং তারা তাদের স্বরচিত ধারণার বশবর্তী হয়ে ভ্রান্ত পথে পদাচারণা করে। তাদের গোমরাহি এতদূর পর্যন্ত গেছে যে ,তারা নেতার কথাকে। আল্লাহর কথা এবং নেতার কাজকে আল্লাহর কাজ বলে মনে করে। কখনো কখনো এরা নিজেদেরকে ধর্মীয় সকল বিধি - বিধান ও সীমার উর্দ্ধে মনে করে এবং সকল পাপ কাজকে তাদের জন্য বৈধ মনে করে। ইমান থেকে এমন স্খলন ও ধর্মহীনতাকে সুফিবাদী ’ (আল্লার প্রতি সম্পূর্ণ আসক্তি) নাম দেয়া হয়েছে। এর অবৈধ নিয়মনীতিকে বলা হয় তরিকা ’ এবং এর অনুসারীকে বলা হয় সুফি ’ । সর্বপ্রথম আবু হাশীম আল - কুফী ও শ্যামী এ নাম ধারণ করেছিল। সে ছিল উমাইয়া বংশোদ্ভূত ও অদৃষ্টবাদী (সে বিশ্বাস করতো মানুষ যা কিছু করে তা আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত) । তাকে সুফি বলার কারণ হলো ,সে দরবেশি ও আল্লাহর ভয় জাহির করার জন্য পশমি আলখিল্লা পরিধান করতো। পরবর্তীতে এ নাম সর্বত্র ব্যবহৃত হতে লাগলো এবং সুফি নামের মূল হিসাবে বহু কারণ বের করা হলো। উদাহরণ স্বরূপ ,সুফি শব্দে আরবি তিনটি বর্ণ রয়েছে - "ছোয়াদ ', ওয়াও" এবং ফে ’ । সুফিরা মনে করে ছোয়াদ ' দ্বারা সবুর (ধৈর্য্য) ,সিদক (সত্যবাদীতা) ও সাফা (পবিত্রতা) ; ওয়াও ' দ্বারা উদ (প্রেম) ,উরদ (আল্লাহর নাম জপ) ও ওয়াফা (আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস) এবং ফে ’ দ্বারা ফরদ (ঐক্য) ,ফকর (দীনহীনভাবে) ও ফানা (ঐশীপ্রেমে আত্ম বিলয়) বুঝায়। সুফি শব্দ সম্পর্কে দ্বিতীয় মত হলো - এটা সুফফা শব্দ হতে আগত। সুফফা হলো মসজিদে নববীর একটা বারান্দা। সেখানে যারা থাকতো তাদের বলা হতো অসাহাবুস সুফফা (বারান্দার অধিবাসী) । সুফি শব্দ সম্পর্কে তৃতীয় মত হলো - আরবের একটা গোত্রের আদিপুরুষের নাম ছিল সুফাহ। এগোত্রের লোকেরা কাবা ও হাজীদের সেবা করার কাজে নিয়োজিত ছিল। সে কারণে পরবর্তীতে এ কাজে নিয়োজিতদেরকে সুফি বলা হতো।

সুফিগণ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। তন্মধ্যে ৭টি উপদল প্রধান।এরা হলোঃ

(১)ওয়াহদাতিয়া (মৌলিক একত্ববাদ): এ উপদল সকল অস্তিত্বের একত্বে বিশ্বাস করে। এরা মনে করে পৃথিবীর কোন কিছু থেকে আল্লাহ ভিন্ন নন - সবকিছুতেই আল্লাহ। এমন কি দূষিত বস্তুসমূহকেও এরা তাই মনে করে। এরা নদী ও নদীর তরঙ্গমালাকে আল্লাহর সঙ্গে তুলনা করে। এরা যুক্তি দেখায় যে ,তরঙ্গ কখনো ফুলে উঠে আবার কখনো পড়ে যায় - তাতে কিন্তু নদীর বাইরে তরঙ্গের কোন অস্তিত্ব নেই। তরঙ্গের অস্তিত্ব নদীর অস্তিত্বের মতোই। কাজেই কোন কিছুকে তার মৌলিক অস্তিত্ব থেকে আলাদা করা যায় না ।

(২)ইত্তিহাদিয়াহ (ঐক্যবাদী): এ উপদল বিশ্বাস করে যে ,তারা আল্লাহতে একীভূত হয়ে আছে এবং আল্লাহও তাদের সাথে একীভূত হয়ে আছে। এরা আল্লাহকে আগুন হিসাবে ধরে নিয়ে নিজেদেরকে আগুনে পড়ে থাকা লোহা এবং আগুনে পোড়া লোহার গুণার্জিত বলে মনে করে। (৩)হুলুলিয়া (স্বরূপবাদী) : এ উপদল বিশ্বাস করে ,যারা আল্লাহকে জানার দাবি করে এবং যারা পূর্ণতা (ইনসানুল কামেল) অর্জন করেছে আল্লাহ্ তাদের স্বরূপ পরিগ্রহ করেন। এরা মনে করে পূর্ণতা প্রাপ্ত মানবদেহ আল্লাহর বাসস্থান। এধরনের পূর্ণমানব দৃশ্যত মানুষ কিন্তু বাস্তবে এরা আল্লাহ।

(৪)ওয়াসিলিয়াহ (মিলনবাদী) : এ উপদল নিজদেরকে আল্লাহর সাথে মিলিত বলে মনে করে। এরা বিশ্বাস করে শরিয়তের বিধি - বিধান মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক উন্নতির একটা উপায় মাত্র। মানব সত্তা যখন আল্লাহর সাথে মিলিত হয়ে যায়। তখন তার আর কোন পূর্ণতা বা উন্নতির প্রয়োজন হয়। না। ফলে ওয়াসিলিন '- এর জন্য ইবাদত ও অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কারণ তারা মনে করে ,যখন সত্য ও বাস্তব সত্তা অর্জিত হয় তখন শরিয়তের বিধি - বিধান পালন করা অর্থহীন। ফলে তারা যা খুশি করতে পারে এবং সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে না।

(৫)জাররাকিয়াহ (প্রমোদবাদী) : এ উপদল মৌখিক ও বাদ্যযন্ত্রের সুরকে ইবাদত মনে করে। এরা দ্বারে দ্বারে গান গেয়ে ভিক্ষা করে এবং দরবেশি দেখিয়ে দুনিয়ার আনন্দ উপভোগ করে। এরা সর্বদা এদের নেতা সম্পর্কে বানোয়াট কাহিনী ও অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করে যাতে সাধারণ মানুষ বিস্ময়াভিভূত হয় ।

(৬)উশশাকিয়াহ (প্রেমবাদী বা ভাববাদী) : এ উপদলের মতবাদ হলো প্রেমের ব্যাকুলতাই মহাসত্য ও বাস্তব সত্তা অর্জনের একমাত্র উপায়। তারা মনে করে ,ইন্দ্রিয়গত প্রেম আল্লাহর প্রেম অর্জনের উপায়। আল্লাহর প্রেমের পর্যায়ে পৌছার জন্য কোন মানব সত্তার প্রতি প্রেমাসক্ত হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। কিন্তু যে প্রেমকে তারা ঐশীপ্রেম বলে মনে করে তা মানসিক বৈকল্য ছাড়া আর কিছু নয় এবং এসব কথার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রিয়াকে ভোগ করা। এ ধরনের প্রেম মানুষকে পাপ ও অন্যায়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আল্লাহর প্রেমের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। একজন পারস্য কবি বলেছেনঃ

সত্যি বলতে কী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেম জীনের মতো আর জীন থেকে কোন হেদায়েত লাভ করা যায়না।

(৭)তালকিনিয়াহ (অভিজ্ঞতাবাদী) : এ উপদলের মতে ধর্মীয় বিজ্ঞান ও বই - পুস্তক পড়া অবৈধ। বরঞ্চ সুফিদের কাছে আত্মিক উন্নতির জন্য এক ঘন্টা বসে চেষ্টা করলে যা পাওয়া যাবে তা সত্তর বছর বই পড়েও অর্জন করা যাবে না।

শিয়া আলেমদের মতে এ উপদলগুলো ভ্রান্ত পথে চলে গেছে। এরা ইসলামের সীমালঙ্ঘন করেছে। এবিষয়ে ইমামগণের অনেক বাণী রয়েছে। এ খুৎবায় আমিরুল মোমেনিন আসিম ইবনে জিয়াদের দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদকে শয়তানের কর্মকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন এবং এপথ থেকে দূরে থাকার জন্য জোর দিয়ে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন (এ বিষয়ে অধিক জানতে হলে খুই ,১৩শ খণ্ড ,পৃঃ ১৩২ - ৪১৭ ;১৪শ খণ্ড ,পৃঃ ২ - ২২ পড়া যেতে পারে) ।

(উপর্যুক্ত টীকার সাথে বাংলা অনুবাদক দ্বীমত পোষণ করে। সুফি - দর্শনের মূল বিষয় সম্পর্কে টীকাকারের জ্ঞানের দৈন্যতার কারণে তিনি ধর্মের দর্শনকে ত্যাগ করে অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সে কারণেই তিনি কোন বক ধার্মিকের চাল - চলন ও আচার - আচরণকে সুফি দর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন। শিয়া আলেমগণ ইসলামের দর্শন তথা আমিরুল মোমেনিনের মৌলিক দর্শন থেকে কতটুকু সরে গেছে তা সকলের জানা আছে। কারবালার মূল দর্শনের প্রতি কোনরূপ ভ্রক্ষেপ না করে তাজিয়া নিয়ে রাস্তায় মাতামাতি করে ইসলামের মৌলিক বিষয়ে কোন উন্নতি হচ্ছে কিনা তারাই বলতে পারেন। ইমাম আলী কর্তৃক প্রদর্শিত পথই হলো সুফি দর্শন। আসহাবুস সুফফাগণ রাসূলের (সা.) সময়কার সুফি । ইমাম আলী সুফি দর্শন ও আরবি ভাষার স্ট্যাণ্ডার্ড। তিনি সুফি দর্শনের আদি পুরুষ। কিন্তু টীকাকার বৈষ্ণববাদ ও সুফি দর্শনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। ইমাম আলীর সুফি দর্শন পরবর্তীতে বহু ইসলামি দার্শনিক বিভিন্নভাবে থিওরিবদ্ধ করেছেন ,যেমন - ইবনুল আরাবির সর্বেশ্বরবাদ ,জালালউদ্দিন রুমীর প্রেমবাদ ,মনসুর হাল্লাজের বিনাশনবাদ (আনাল হক) ,খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর প্রত্যক্ষণবাদ ,লালন শাহের ভাববাদ ইত্যাদি দার্শনিক ধারণা ও থিওরি বাদ দিয়ে টীকাকার ইসলামকে অনুষ্ঠান সর্বস্ব করে কুরআনিক দর্শন খর্ব করে দিতে চেয়েছেন। কুরআনের দর্শন ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত - এ দুয়ের সামঞ্জস্য বিধানই হলো প্রকৃত ইসলামি জীবন। দর্শন বর্জিত ইবাদত যেমন রূঢ়তা ,ইবাদত বর্জিত দর্শনও তেমনি ফাঁপা চিন্তা মাত্র - বাংলা অনুবাদক) ।

খোৎবা - ২০৯

و قد سأله سائل عن أحاديث البدع و عما في أيدي الناس من اختلاف الخبر فقالعليه‌السلام:

إِنَّ فِي أَيْدِي اَلنَّاسِ حَقّاً وَ بَاطِلاً، وَ صِدْقاً وَ كَذِباً، وَ نَاسِخاً وَ مَنْسُوخاً، وَ عَامّاً وَ خَاصّاً، وَ مُحْكَماً وَ مُتَشَابِهاً، وَ حِفْظاً وَ وَهْماً. وَ لَقَدْ كُذِبَ عَلَى رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم عَلَى عَهْدِهِ، حَتَّى قَامَ خَطِيباً، فَقَالَ: «مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ اَلنَّارِ» . وَ إِنَّمَا أَتَاكَ بِالْحَدِيثِ أَرْبَعَةُ رِجَالٍ لَيْسَ لَهُمْ خَامِسٌ:

الاؤل - المنافقون

رَجُلٌ مُنَافِقٌ مُظْهِرٌ لِلْإِيمَانِ، مُتَصَنِّعٌ بِالْإِسْلاَمِ، لاَ يَتَأَثَّمُ وَ لاَ يَتَحَرَّجُ، يَكْذِبُ عَلَى رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مُتَعَمِّداً، فَلَوْ عَلِمَ اَلنَّاسُ أَنَّهُ مُنَافِقٌ كَاذِبٌ لَمْ يَقْبَلُوا مِنْهُ وَ لَمْ يُصَدِّقُوا قَوْلَهُ وَ لَكِنَّهُمْ قَالُوا: صَاحِبُ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم رَآهُ، وَ سَمِعَ مِنْهُ وَلَقِفَ عَنْهُ، فَيَأْخُذُونَ بِقَوْلِهِ، وَ قَدْ أَخْبَرَكَ اَللَّهُ عَنِ اَلْمُنَافِقِينَ بِمَا أَخْبَرَكَ، وَ وَصَفَهُمْ بِمَا وَصَفَهُمْ بِهِ لَكَ، ثُمَّ بَقُوا بَعْدَهُ، فَتَقَرَّبُوا إِلَى أَئِمَّةِ اَلضَّلاَلَةِ، وَ اَلدُّعَاةِ إِلَى اَلنَّارِ بِالزُّورِ وَ اَلْبُهْتَانِ، فَوَلَّوْهُمُ اَلْأَعْمَالَ، وَ جَعَلُوهُمْ(حملوهم) حُكَّاماً عَلَى رِقَابِ اَلنَّاسِ، فَأَكَلُوا بِهِمُ اَلدُّنْيَا، وَ إِنَّمَا اَلنَّاسُ مَعَ اَلْمُلُوكِ وَ اَلدُّنْيَا، إِلاَّ مَنْ عَصَمَ اَللَّهُ، فَهَذَا أَحَدُ اَلْأَرْبَعَةِ.

الثانی - المخطئون

وَ رَجُلٌ سَمِعَ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِ شَيْئاً لَمْ يَحْفَظْهُ عَلَى وَجْهِهِ، فَوَهِمَ فِيهِ، وَ لَمْ يَتَعَمَّدْ كَذِباً فَهُوَ فِي يَدَيْهِ، وَ يَرْوِيهِ وَ يَعْمَلُ بِهِ، وَ يَقُولُ: أَنَا سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم فَلَوْ عَلِمَ اَلْمُسْلِمُونَ أَنَّهُ وَهِمَ فِيهِ لَمْ يَقْبَلُوهُ مِنْهُ وَ لَوْ عَلِمَ هُوَ أَنَّهُ كَذَلِكَ لَرَفَضَهُ!

الثالث - الجاهلون بالحدیث

وَ رَجُلٌ ثَالِثٌ، سَمِعَ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم شَيْئاً يَأْمُرُ بِهِ، ثُمَّ إِنَّهُ نَهَى عَنْهُ، وَ هُوَ لاَ يَعْلَمُ، أَوْ سَمِعَهُ يَنْهَى عَنْ شَيْ‏ءٍ، ثُمَّ أَمَرَ بِهِ وَ هُوَ لاَ يَعْلَمُ، فَحَفِظَ اَلْمَنْسُوخَ، وَ لَمْ يَحْفَظِ اَلنَّاسِخَ، فَلَوْ عَلِمَ أَنَّهُ مَنْسُوخٌ لَرَفَضَهُ، وَ لَوْ عَلِمَ اَلْمُسْلِمُونَ إِذْ سَمِعُوهُ مِنْهُ أَنَّهُ مَنْسُوخٌ لَرَفَضُوهُ.

الرابع - الحفّاظ الصادقون

وَ آخَرُ رَابِعٌ، لَمْ يَكْذِبْ عَلَى اَللَّهِ، وَ لاَ عَلَى رَسُولِهِ، مُبْغِضٌ لِلْكَذِبِ خَوْفاً مِنَ اَللَّهِ، وَ تَعْظِيماً لِرَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم وَ لَمْ يَهِمْ، بَلْ حَفِظَ مَا سَمِعَ عَلَى وَجْهِهِ، فَجَاءَ بِهِ عَلَى مَا سَمِعَهُ، لَمْ يَزِدْ فِيهِ وَ لَمْ يَنْقُصْ مِنْهُ، فَهُوَ حَفِظَ اَلنَّاسِخَ فَعَمِلَ بِهِ، وَ حَفِظَ اَلْمَنْسُوخَ فَجَنَّبَ عَنْهُ، وَ عَرَفَ اَلْخَاصَّ وَ اَلْعَامَّ، وَ اَلْمُحْكَمَ وَ اَلْمُتَشَابِهَ، فَوَضَعَ كُلَّ شَيْ‏ءٍ مَوْضِعَهُ.

وَ قَدْ كَانَ يَكُونُ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم اَلْكَلاَمُ لَهُ وَ جْهَانِ: فَكَلاَمٌ خَاصٌّ، وَ كَلاَمٌ عَامٌّ فَيَسْمَعُهُ مَنْ لاَ يَعْرِفُ مَا عَنَى اَللَّهُ،سُبْحَانَهُ بِهِ وَ لاَ مَا عَنَى رَسُولُ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم فَيَحْمِلُهُ اَلسَّامِعُ، وَ يُوَجِّهُهُ عَلَى غَيْرِ مَعْرِفَةٍ بِمَعْنَاهُ، وَ مَا قُصِدَ بِهِ، وَ مَا خَرَجَ مِنْ أَجْلِهِ. وَ لَيْسَ كُلُّ أَصْحَابِ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مَنْ كَانَ يَسْأَلُهُ وَ يَسْتَفْهِمُهُ، حَتَّى إِنْ كَانُوا لَيُحِبُّونَ أَنْ يَجِي‏ءَ اَلْأَعْرَابِيُّ وَ اَلطَّارِئُ، فَيَسْأَلَهُعليه‌السلام حَتَّى يَسْمَعُوا، وَ كَانَ لاَ يَمُرُّ بِي مِنْ ذَلِكَ شَيْ‏ءٌ إِلاَّ سَأَلْتُهُ عَنْهُ وَ حَفِظْتُهُ فَهَذِهِ وُجُوهُ مَا عَلَيْهِ اَلنَّاسُ فِي اِخْتِلاَفِهِمْ، وَ عِلَلِهِمْ فِي رِوَايَاتِهِمْ.

হাদিসে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের কারণ ও রাবিদের প্রকারভেদ সম্পর্কে

কেউ একজন বানোয়াট হাদিস ও মানুষের মধ্যে প্রচলিত রাসূলের (সা.) পরস্পর বিরোধী বক্তব্য সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ

নিশ্চয়ই ,আজ মানুষের মাঝে যা প্রচলিত আছে তাতে সত্য ও মিথ্যা এবং শুদ্ধ ও অশুদ্ধের সংমিশ্রণ রয়েছে। এ সবের কিছু কিছু বাতিল যোগ্য এবং কিছু কিছু বাতিলকৃত ;কিছু কিছু সাধারণ ও কিছু কিছু বিশেষ ;কিছু কিছু নির্দিষ্ট ও কিছু কিছু অনির্দিষ্ট ;কিছু কিছু অবিকল ও কিছু কিছু অনুমান আশ্রিত। এমনকি রাসূলের (সা.) জীবৎকালেও তার নামে মিথ্যা বক্তব্য চালানো হয়েছিল। সে জন্য তিনি বলেছিলেন , যে ব্যক্তি আমার নাম দিয়ে কোন মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয় সে নিজের জন্য দোযখে স্থায়ী আবাস তৈরি করে। ” যারা হাদিস বর্ণনা করে তারা চার শ্রেণির বেশি নয়।

প্রথমঃ মিথ্যাবাদী ও মোনাফিক

মোনাফিক সে ব্যক্তি যে ইমানের ভান করে এবং বাহ্যিক আবরণে ও অবয়বে মুসলিমের ভাব দেখায়। এরা পাপে লিপ্ত হতে কোন দ্বিধা করে না এবং পাপ থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টাও করে না। এরা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নবীর নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলে। মানুষ যদি জানতে পারতো যে ,এরা মোনাফিক ও মিথ্যাবাদী তাহলে কখনো তাদের কথা গ্রহণ করতো না এবং এদের কথা বিশ্বাস করতো না। বরং মানুষ মনে করে এরা আল্লাহর নবীর সাহাবি ,তাঁর দেখা পেয়েছে ,তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী শুনেছে এবং তার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছে। এ কারণে মানুষ তাদের কথা গ্রহণ করে। মহিমান্বিত আল্লাহ মোনাফিক সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন এবং তাদের সম্পর্কে তোমাদের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। রাসূলের (সা.) পরে তারা তাদের মিথ্যার বেসাতি চালিয়ে যাচ্ছে। গোমরাহির নেতা ও মিথ্যার মাধ্যমে দোযখের দিকে আহবানকারীদের কাছে তারা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। সুতরাং তারা এদের উচ্চপদে আসীন করেছে ;অফিসার বানিয়ে জনগণের মাথার ওপর বসিয়েছে এবং এদের মাধ্যমে সম্পদ স্তুপীকৃত করেছে। আল্লাহ যাদের রক্ষা করেন তারা ছাড়া সকল মানুষ শাসকদের পিছনে ও দুনিয়ার পিছনে থাকে।

দ্বিতীয়ঃ যারা ভুল করে

কিছু কিছু লোক আছে যারা রাসূলের (সা.) মুখনিঃসৃত বানী শুনেছে কিন্তু তা অবিকল মনে রাখতে পারেনি। এরা রাসূলের (সা.) বাণীকে সংক্ষিপ্তাকারে নিজের থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে অনুমানভিত্তিক কথা বলে। এরা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলে না। এরা যেভাবে হাদিস বর্ণনা করে সেভাবে আমলও করে এবং দাবি করে , আমি আল্লাহর নবীর মুখে একথা শুনেছি। ” যদি মানুষ জানতে পারতো যে ,এদের বর্ণনায় ভুল রয়েছে তাহলে কেউ তা গ্রহণ করতো না। এমনকি এরা নিজেরাও যদি বুঝতে পারতো যে ,এরা ভুল বর্ণনা করছে। তবে এরা নিজেরা তা পরিত্যাগ করতো।

তৃতীয়ঃ যারা অজ্ঞ

এরা এমন লোক যারা হয়ত শুনেছে রাসূল (সা.) কোন কিছু করতে বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে হয়ত রাসূল (সা.) সে কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন - এরা তা শোনে নি। আবার ,হয়ত রাসূল (সা.) কোন কিছু করতে বারণ করেছেন - এরা তা শুনেছে। কিন্তু পরবর্তীতে হয়ত তিনি তা করার অনুমতি দিয়েছেন - এরা তা শোনে নি। এরা যেটুকু আংশিক শুনেছে সেটুকু বর্ণনা করে। এতে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত হয়ে যায়। আবার অনেক সময় এরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে রাসূলের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ বা ব্যাখ্যা বুঝতে পারেনি - এমনকি রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞেস করেও অন্তর্নিহিত ভাব জেনে নেয়নি। নিজেরা যেভাবে বুঝেছে সেভাবে বর্ণনা করছে। যদি মুসলিমগণ এদের অজ্ঞতার বিষয় জানতে পারতো। তাহলে তারা এদের বর্ণনা গ্রহণ করতো না ।

চতুর্থঃ যারা সত্যিকারভাবে অবিকল মনে রাখতে পেরেছে

এ ধরনের লোক কখনো আল্লাহ ও রাসূলের বাণী সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলে না। আল্লাহর ভয়ে এরা মিথ্যাকে ঘৃণা করে এবং আল্লাহর নবীকে সম্মান করে। এরা ভুল করে না এবং রাসূলের কাছে যা শুনেছে তা অবিকল মনে রাখে। এরা যা শুনেছে তাতে কোন কিছু সংযোজন ও বিয়োজন না করে অবিকল বর্ণনা করে। রাসূল (সা.) যেভাবে বলেছেন। এরা সেভাবেই আমল করে। যখন কিছু করতে বলেছেন তখন সেভাবে করেছে। আবার যখন নিষেধ করেছেন আমনি তা পরিত্যাগ করেছে। এরা রাসূলের কথার সাধারণ ও বিশেষ অর্থ বুঝতে পেরেছে এবং যথোপযুক্ত গুরুত্বসহকারে রাসূলের কথার সুনির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট ভাবে জানতে পেরেছে।

রাসূলের বাণীর দুভাবে অর্থ করা যায় - একটি হলো বিশেষ বা গুঢ়ার্থবোধক এবং অপরটি হলো সাধারণ বা ভাষার্থবোধক। কখনো কখনো এমন হয়েছে যে ,একজন লোক রাসূলের বাণী শুনেছে কিন্তু এতে মহিমান্বিত আল্লাহ ও তার রাসূল কী বুঝাতে চেয়েছেন সে শ্রোতা তা বুঝতে পারেনি। ফলে এ ধরনের শ্রোতা তাঁর বাণী মনে রেখেছে বটে ,কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কী বা একথা বলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কারণ বুঝতে পারেনি। আল্লাহর নবীর সাহাবাগণের মধ্যে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করে বা জিজ্ঞেস করে তাঁর কাছ থেকে কোন কিছুর অর্থ জেনে নেয়ায় অভ্যস্ত ছিলনা। কোন বেদুইন বা আগন্তুক এসে তাকে প্রশ্ন করবে এবং তাতে তারা মনে করতো তারাও শুনে অর্থ জেনে নিতে পারবে। আমি এরূপ বিষয় তাকে জিজ্ঞেস করে প্রকৃত অর্থ জেনে নিতাম এবং তা সংরক্ষণ করতাম। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতের কারণই এগুলো ।

____________________

১। এ লোকটির নাম হলো সুলায়েম ইবনে কায়েস আল - হিলালী। ইনি আমিরুল মোমেনিনের মাধ্যমে হাদিস বর্ণনা করতেন ।

২। এ খোৎবায় আমিরুল মোমেনিন হাদিসের রাবিগণকে চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেনঃ

প্রথম শ্রেণি হলো - যারা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করে রাসূলের নামে চালিয়ে দিয়েছে। একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে ,রাসূলের (সা.) সহী হাদিস যখন প্রকাশ পেতে লাগলো তখন বিভিন্ন দল তাদের স্বার্থে মিথ্যা হাদিস রাসূলের নামে চালিয়ে দিয়েছিল। এ কথা কেউ অস্বীকার করলে সে তা জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় - শুধু তর্কের খাতিরে অস্বীকার করবে। একবার আলামুল হুদা সাঈদ মুরতাজা কিছু সংখ্যক সুন্নি উলামার সাথে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সাঈদ মুরতাজা ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করে প্রমাণ করলেন যে ,সাহাবাগণের মর্যাদা সম্পর্কে প্রচলিত হাদিসগুলোর সব ক ’ টি বানোয়াট ও মিথ্যা। সুন্নি উলামাগণ যুক্তি দেখালেন যে ,কেউ মিথ্যা হাদিস রচনা করে রাসূলের নামে চালিয়ে দেয়ার সাহস করবে একথা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। তখন সাঈদ মুরতাজা একটা সহী হাদিসের কথা উল্লেখ করে বলেন যে ,রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

আমার মৃত্যুর পর আমার নামে অসংখ্য মিথ্যা বিষয় প্রচলিত হবে এবং যে কেউ আমার নাম দিয়ে মিথ্যা প্রচার করবে। সে দোষাখে নিজ আবাস তৈরি করবে। (বুখারী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৮ ;২য় খণ্ড ,পৃঃ১০২ ; ৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ২০৭ ,৮ম খণ্ড ,পৃঃ ৫৪ ;নিশাবুরী ,৮ম খণ্ড ,পৃঃ ২২৯ আশাছ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩১৯ - ৩২০ তিরমিয়ী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৫২৪ ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৫ - ৩৬ ,৪০ ,১৯৯ ,৬৩৪ ;মাযাহ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৩ - ১৫) ।

যদি কেউ মনে করে এ হাদিসটি সত্য তা হলে সে অবশ্যই একমত হবে যে ,রাসূলের (সা.) নামে অনেক মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার যদি কেউ মনে করে এ হাদিসটি মিথ্যা তাহলে রাসূলের (সা.) নামে মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয়ার প্রমাণ এ হাদিসটিই বহন করে। যাহোক ,যাদের হৃদয় ছিল মুনাফেকিতে পরিপূর্ণ ,যারা দ্বীনে ফেতনা ও বিভেদ সৃষ্টি করে দুর্বল ইমান সম্পন্ন মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য দলে ভিড়িয়েছিল তারাই রাসূলের নামে মিথ্যা হাদিস রচনা করেছিল। এ ধরনের লোক রাসূলের জীবদ্দশায়ও ছিল যারা মোমিনগণের সাথেই মিশে থাকতো এবং সারাক্ষণ মুসলিমের অকল্যাণ ও ক্ষতির চিন্তায় ব্যস্ত থাকতো। রাসূলের ইনতিকালের পর এ ধরনের লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে গিয়েছিল এবং অসৎ কর্মতৎপরতায় তারা আরো মনোযোগী হয়ে পড়েছিল। এরা ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শে নানা প্রকার বিকৃতি ও পরিবর্তন করতে দ্বিধা করতো না। কারণ রাসূলের জীবদ্দশায় তারা কিছুটা ভয়ে থাকতো পাছে তিনি তাদের মোনাফেকি ফাঁস করে দিয়ে লজ্জায় ফেলে দেন ;কিন্তু রাসূলের পর তাদের সে ভয় কেটে গেছে। বিভিন্নভাবে এরা ক্ষমতাধর হয়ে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ রকম মোনাফেকি করার পরও জনগণ তাদেরকে অবিশ্বাস করতো না। কারণ তারা দাবি করতো যে ,তারা রাসূলের সাহাবা এবং যা বলে তা সত্য ও সঠিক। এরাই নিজেদের জন্য হাদিস বানিয়ে নিল - রাসূলের সাহাবাগণ যে কোন প্রকার সমালোচনা ও প্রশ্নের উর্দ্ধে ;তাদের কোন কাজের আলোচনা - পর্যালোচনা করা যাবে না এবং তাদের কাজের তিরস্কার করা যাবে না। ” আমিরুল মোমেনিন। এহেন উক্তির মুখ থুবড়ে দিয়ে বলেনঃ

এসব লোক গোমরাহির নেতার কাছে মর্যাদা লাভ করেছে এবং এরা মিথ্যা ও অপবাদের মাধ্যমে দোষখের দিকে আহ্বানকারী । সুতরাং এসব নেতারা মোনাফেকদেরকে উচ্চপদে আসীন করে জনগণের মাথার ওপর বসিয়ে দিয়েছিল ।

মোনাফিকগণ ইসলামের ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি সম্পদ স্তুপীকৃত করেছিল। মুসলিমের মুখোশ পরে তারা যথেচ্ছভাবে বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলীতে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করেছিলো। ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেনঃ

যখন তারা যথেচ্ছভাবে চলার সুযোগ পেল তখন তারা ইসলামের অনেক কিছু পরিত্যাগ করেছিলো । যখন মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতো তখন তারাও ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতো । কিন্তু তারা তলে তলে মিথ্যার জাল বুনায় তৎপর থাকতো যা আমিরুল মোমেনিন। পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন । এ সব লোক রাসূলের হাদিসে অনেক মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে - যাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের ইমানে ফাটল ধরিয়ে গোমরাহির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া । অপরপক্ষে এদের কারো কারো লক্ষ্য ছিল কোন বিশেষ দলের উচ্চ প্রশংসা করা - যাদের সঙ্গে এদের জাগতিক বিষয়াবলীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল ।

এ সময় অতিবাহিত হবার পর যখন মুয়াবিয়া ধর্মের নেতৃত্ব ও ইহকালীন কর্তৃত্বের সিংহাসন দখল করেছিলো তখন সে মিথ্যা হাদিস রচনা করে তাতে জনমত গঠন করার জন্য একটা সরকারি বিভাগ খুলেছিলো। সে তার অফিসারদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল যেন তারা আহলে বাইতের মর্যাদাহানিকর হাদীস রচনা করে তা জনপ্রিয় করে তোলে। একই সাথে সে আদেশ দিয়েছিল যেন তারা (অফিসারগণ) উসমান ও উমাইয়াদের উচ্চকিত প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। এ কাজের জন্য সে পুরস্কার ঘোষণা করে এবং জমি বরাদ্দ দেয়। ফলে হাদিস গ্রন্থগুলোতে অসংখ্য স্বঘোষিত বানোয়াট বক্তব্য স্থান লাভ করে । আবুল হাসান আল মাদায়নীর "কিতাবুল আহদাছ" হতে ইবনে আবিল হাদীদ উদ্ধৃত করেছেনঃ

মুয়াবিয়া তার অফিসারদের কাছে লিখেছিল যে ,তারা যেন সেসব লোকের প্রতি বিশেষ যত্নশীল থাকে যারা উসমানের কথা বলে ,তার শুভাকাঙ্খী ও তাকে ভালোবাসে । যারা উসমানের উচ্চ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করে তাদেরকে যেন বিশেষ পদমর্যাদা ও সন্মান প্রদান করা হয় এবং রাবির নাম ,পিতার নাম ও গোত্র পরিচয়সহ যেন হাদিসটি তার কাছে প্রেরণ করা হয় । মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রদত্ত সরকারি মর্যাদা ,জমি ,পোষাক ও নানাবিধি পুরস্কারের ফলে উসমানের প্রশংসাসূচক হাদিস স্তুপীকৃত হয়ে গেল ।

উসমানের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কীয় এসব বানোয়াট হাদিস যখন রাজ্যময় ছড়িয়ে দেয়া হলো তখন পূর্ববর্তী খলিফাদের মর্যাদা যাতে ক্ষুন্ন না হয় সে জন্য মুয়াবিয়া তার অফিসারদের লিখেছিল -

আমার এ আদেশ পাওয়া মাত্র তোমরা জনগণকে বলো যেন তারা সাহাবাগণ ও অন্য খলিফাদের প্রশংসাসূচক হাদিস তৈরি করে এবং সাবধান থেকো ,যদি কোন লোক আবু তুরাব (আলী) সম্পর্কে কোন হাদিস বলে। তবে তোমরাও অন্য সাহাবাগণ সম্বন্ধে অনুরূপ হাদিস রচনা করো । মনে রেখো ,এতে আমি আনন্দিত হবো এবং আমার চক্ষু শীতল হবে । এতে আবু তুরাব ও তার দলের মর্যাদা ক্ষীণ হয়ে পড়বে এবং উসমান বিশেষভাবে মর্যাদাশীল হবে ।

মুয়াবিয়ার এ পত্রের বিষয় জনগণকে জানানোর পর সাহাবাগণের উচ্চসিত প্রশংসাসূচক অসংখ্য বানোয়াট হাদিস লোকেরা বর্ণনা করেছিল ,সত্যের সাথে যেগুলোর কোন সংশ্রব ছিল না (হাদীদ ,১১শ খণ্ড ,পৃঃ৪৩ - ৪৭)

এ বিষয়ে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আবু আবদুল্লাহ ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আরাফাহ (ডাক নাম নিফতাওয়াহ - হিঃ ২৪৪ - ৩২৩ সন) - এর উক্তি হাদীদ উদ্ধৃত করেছেনঃ

সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কিত অধিকাংশ মিথ্যা হাদিস মুয়াবিয়ার সময় রচিত হয়েছিল । এসব বানোয়াট হাদিস দ্বারা সে জনগণের কাছে মর্যাদা লাভে কৃতকার্য হয়েছিল । তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বনি হাশিমকে অমর্যাদাকর ও হেয় করে দেখানো (প্রাগুপ্ত)

এরপর মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। দুনিয়াদারগণ রাজাবাদশাহদের কাছে মর্যাদা পাওয়া ও ঐশ্বর্য অর্জনের উপায় হিসাবে হাদিস বর্ণনাকে বেছে নিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ - হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে আব্বাসিয় খলিফা আল - মাহদী ইবনে আল - মনসুরকে খুশি করে মর্যাদা লাভের আশায় গিয়াস ইবনে ইব্রাহীম আন - নাখাই কবুতর উড়িয়ে দেয়া সম্পর্কে একটা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করেছিল। (বাগদাদী ,১২শ খণ্ড ,পৃঃ ৩২৩ - ৩২৭ ;জাহাবি ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৩৭ - ৩৩৮ ;আসকালানী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৪২২) । আবু সাঈদ মাদায়নী ও অন্যান্যরা বানোয়াট হাদিস বর্ণনাকে জীবিকা উপার্জনের উপায় হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এসময় সীমালঙ্ঘনের পর্যায় এতদূর গিয়েছিল যে ,কাররামিয়াহ ও কতিপয় মুতাসাওয়াফাহ ফতোয়া জারি করে বলেছিল - পাপ থেকে বিরত রাখার জন্য অথবা আনুগত্যের প্রতি প্রলুব্ধ করার জন্য মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা জায়েজ | এ ফতোয়ার ফলে প্রকাশ্যে যথেচ্ছভাবে হাদিস বর্ণনা শুরু হয়ে গেল এবং একে নৈতিক ও ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী মনে করা হতো না। বরং যাদেরকে বাহ্যিক আচার - আচরণে পরহেজগার বলে মনে করা হতো এবং যারা সারাদিন নামাজরত থাকতো তারা সারারাত বিভিন্ন বানোয়াট হাদিস লিখে তাদের খাতা - পত্র ভরে ফেলতো। এধরনের বানোয়াট হাদিসের সংখ্যা বিষয়ে কতিপয় ঘটনা থেকে অনুমান করা যাবে। ছয় লক্ষ হাদিস থেকে বুখারী মাত্র দুই হাজার সাত শত একষট্টিটি হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ৮ ;কস্তালানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৮ ;হাম্বলী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ১৪৩) । মুসলিম তিন লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র চার হাজার হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,১৩শ খণ্ড ,পৃঃ ১০১ ;হাম্বলী ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৩২ ;জাহাবি ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৫১ ,১৫৭ ;খাল্লিকান ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ১৯৪) । আবু দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র চার হাজার আট শত হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,৯ম খণ্ড ,পৃঃ ৫৭ ;জাহাবি ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৫৪ ;হাম্বলী ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৯৭ ;খাল্লিকান ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ৪০৪) । আহম্মদ ইবনে হাম্বল প্রায় দশ লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র ত্রিশ হাজার হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৪১৯ - ৪২০ ;হাম্বলী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৭ ;খাল্লিকান ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৬৪ ;আসকালানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৭৪) । এসব বাছাইকৃত হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস যে এসে পড়েনি। সে কথা নিশ্চত করে বলা যায় না। এ বিষয়ে আরো অধিক জানতে হলে আল - গাদির (আমিনী) গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২০৮ - ৩৭৮ পৃষ্ঠা পড়ার সুপারিশ করা গেল ।

দ্বিতীয় প্রকার রাবি হলো - যারা বিষয় বা উপলক্ষ বিবেচনা না করে শুদ্ধ - অশুদ্ধ যা কিছু মনে ছিল তাই বর্ণনা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ - খলিফা উমর যখন আহত হলেন তখন সুহায়েব তার কাছে এসে কাঁদতে লাগলো। এতে উমর বললেনঃ

হে সুহায়েব ,তুমি আমার জন্য কাঁদছো। অথচ রাসূল (সা.) বলেছেন যে ,মৃত ব্যক্তির লোকেরা তার জন্য কান্নাকাটি করলে তার (মৃতব্যক্তির) শাস্তি হয় (বুখারী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১০০:১০২. নিশাবুরী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৪১ - ৪৫ তিরমিয়ী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩২৭ - ৩২৯ ;নাসাঈ ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ১৮ ;মাযাহ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৫০৮ - ৫০৯: আনাস ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৩৪ ,শাফী ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ২৬৬ আশাছ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১৯৪ ; হাম্বল ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৪১ ও ৪২ ;শাফী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ৭২ - ৭৪)

খলিফা উমরের মৃত্যুর পর আয়শা ,কাঁদছিলেন। তখন তাকে উমরের বর্ণিত উক্ত হাদিস বলা হলে তিনি বললেনঃ আল্লাহ উমরকে মাফ করুন । আত্নীয় - স্বজন কাঁদলে মৃতের শাস্তি হয় আল্লাহর নবী এমন কথা বলেননি।

এরপর তিনি বলেন যেখানে কুরআন বলেছে একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না সেখানে কী করে জীবিতের কান্নার জন্য মৃত শাস্তি পেতে পারে! এরপর তিনি কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করলেনঃ

কারো পাপের বোঝা অন্য কেউ বহন করবে না। (কুরআন - ৬:১৬৪ ,১৭:১৫ ,৩৫:১৮ ,৩৯:৭ ,৫৩:৩৮)

তারপর আয়শা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন যে ,একদিন রাসূল (সা.) এক ইহুদি মহিলার কবরের পাশ দিয়ে যেতে দেখেন তাঁর আত্মীয় - স্বজন তার জন্য কান্নাকাটি করছে। তখন রাসূল (সা.) বলেছিলেন , তার লোকেরা তার জন্য কাঁদছে। অথচ কবরে তার শাস্তি চলছে। ” রাসূলের (সা.) এ কথার অর্থ এ নয় যে ,আত্মীয়স্বজনের কান্নার জন্য তার শাস্তি হচ্ছে। বরং তিনি বুঝাতে চেয়েছেন কৃতকর্মের শাস্তির জন্য আত্মীয় - স্বজনের কান্না কোন কাজে আসছে না।

তৃতীয় প্রকার রাবি হলো - যারা রাসূলের (সা.) কাছ থেকে এমন কিছু শুনেছে যা হয়ত পরবর্তীকালে রদ হয়ে গেছে। কিন্তু রাসূল (সা.) কর্তৃক এহেন রদ করার বিষয়টি শোনার সৌভাগ্য এদের হয়নি বলে এরা সে বিষয়ে অনবহিত। উদাহরণ স্বরূপ - রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

কবর জেয়ারত করতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু এখন তোমরা তা করতে পার (নিশাবুরী) ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৬৫ ,তিরমিয়ী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৭০ আশাছ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ২১৮ ও ৩৩২: নাসাঈ ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৮৯ ;মাযাহ ,পৃঃ ৫০০ - ৫০১: আনাস ,২য় খণ্ড ,পৃঃ৪৮৫ ;হাম্বল ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৪৫ ,৪৫২ ;৩য় খণ্ড ,পৃঃ৩৮ ,৬৩ ,৬৬ ,২৩৭ ও ৩৫০ ;৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৫০ ,৩৫৫ ,৩৫৬ ,৩৫৭ ,৩৫৯ ও ৩৬১ ;নিশাবুরী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৭৪ - ৩৭৬)

এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে ,রাসূল (সা.) কোন এক সময়ে কবর জেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলেন। এ হাদিস দ্বারা সেই নিষেধাজ্ঞা রদ করেছেন। কিন্তু যারা এ হাদিসটি শোনেনি তারা পূর্বের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করেছে এবং সেটাই প্রচার করে বেড়াচ্ছে।

চতুর্থ প্রকার রাবি হলো - যারা ন্যায়নীতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল এবং যাদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা রয়েছে। তারা হাদিসের উপলক্ষ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত এবং তারা বাতিলকৃত হাদিস ও তারস্থলে প্রতিস্থাপিত হাদিস সম্পর্কে অবহিত। তারা সাধারণ (আম) ও বিশেষ (খাস) ভাবধারা ও হাদিসের স্থান ,কাল ও পাত্র বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। তারা কোন প্রকার বাড়াবাড়ি ,মিথ্যা ,অতিরঞ্জন ও বানোয়াট কথার ধার ধারেনি। তারা যাকিছু শুনেছে তাদের স্মৃতিতে তা অবিকল ধারণ করে রেখেছে এবং সামান্যতম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ অবিকলতা রক্ষা করে তা মানুষের কাছে বর্ণনা করেছে। এদের বর্ণিত হাদিসই ইসলামের অমূল্য সম্পদ এবং এ ধরনের হাদিস অনুযায়ী আমল করতেই হবে। এ ধরনের হাদিসগুলোর মধ্যে আমিরুল মোমেনিন কর্তৃক বর্ণিত হাদিসগুলো প্রধান। জ্ঞানমার্গে আমিরুল মোমেনিনের অবস্থান রাসূলের (সা.) নিম্নের হাদিসগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়। আমিরুল মোমেনিন ,জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ,ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত আছে যে ,রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

আমি জ্ঞানের মহানগরী এবং আলী তার দরজা । যে কেউ আমার জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই এ দরজার মধ্য দিয়ে আসতে হবে (নিশাবুরী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১২৬ - ১২৭ ;বার ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১১০২. আছীর ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ২২: বাগদাদী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৭৭ ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৩৪৮ ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ১৭২ ;১১শ খণ্ড ,পৃঃ ৪৮ - ৫০ ;জাহাবি ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ২৮ ,শাফী ,৯ম খণ্ড ,পৃঃ ১১৪. আসকালানী ,৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ৩২০ ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৩৭ ;আসকালানী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১২২ - ১২৩ সুয়ুতী ,পৃঃ ১৭০: হিন্দি. ৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ১৫২ ,১৫৬ ও ৪০১. হানাফী ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ৬৩১: জুরকানী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১৪৩) |

আমিরুল মোমেনিন ও ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে ,রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

আমি প্রজ্ঞার মহাভাণ্ডার এবং আলী তার দরজা । যদি কেউ প্রজ্ঞাবান হতে চায়। তবে তাকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে (ইসফাহানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৬৪. শাফী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ২৭৫ ;বাগদাদী ,১১শ খণ্ড ,পৃঃ ২০৪: হিন্দি ,৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ৪০১. শাফী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৯৩)

এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে ,রাসূলের (সা.) জ্ঞান সাগরে পাড়ি দিয়ে তাঁর অনুকম্পা লাভ করার উপায় হচ্ছে আহলে বাইতের মাধ্যমে প্রবাহিত ধারা অনুসরণ করা। আর মানুষ যদি তা করতো। তবে তা কতই না উত্তম হতো। কিন্তু ইতিহাসের এক বিষাদময় অধ্যায় হলো - আহলে বাইতের শক্রগণের বর্ণিত হাদিস ক্ষমতাসীনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে। অথচ রাবিদের নামের তালিকায় যখনই কোন আহলে বাইতের সদস্যের নামোল্লেখ করা হয়েছে আমনি সে হাদিস বাতিল করে দেয়া হয়েছে।

খোৎবা - ২১০

عجائب الخلقة

وَ كَانَ مِنِ اِقْتِدَارِ جَبَرُوتِهِ، وَ بَدِيعِ لَطَائِفِ صَنْعَتِهِ، أَنْ جَعَلَ مِنْ مَاءِ اَلْبَحْرِ اَلزَّاخِرِ اَلْمُتَرَاكِمِ اَلْمُتَقَاصِفِ، يَبَساً جَامِداً، ثُمَّ فَطَرَ مِنْهُ أَطْبَاقاً، فَفَتَقَهَا سَبْعَ سَمَاوَاتٍ بَعْدَ اِرْتِتَاقِهَا، فَاسْتَمْسَكَتْ بِأَمْرِهِ، وَ قَامَتْ عَلَى حَدِّهِ وَ أَرْسَى أَرْضاً يَحْمِلُهَا اَلْأَخْضَرُ اَلْمُثْعَنْجِرُ، وَ اَلْقَمْقَامُ اَلْمُسَخَّرُ(المسجّر) ، قَدْ ذَلَّ لِأَمْرِهِ وَ أَذْعَنَ لِهَيْبَتِهِ، وَ وَقَفَ اَلْجَارِي مِنْهُ لِخَشْيَتِهِ. وَ جَبَلَ جَلاَمِيدَهَا، وَ نُشُوزَ مُتُونِهَا وَ أَطْوَادِهَا، فَأَرْسَاهَا فِي مَرَاسِيهَا، وَ أَلْزَمَهَا قَرَارَاتِهَا، فَمَضَتْ رُؤُوسُهَا فِي اَلْهَوَاءِ، وَ رَسَتْ أُصُولُهَا فِي اَلْمَاءِ، فَأَنْهَدَ جِبَالَهَا عَنْ سُهُولِهَا، وَ أَسَاخَ قَوَاعِدَهَا فِي مُتُونِ أَقْطَارِهَا وَ مَوَاضِعِ أَنْصَابِهَا، فَأَشْهَقَ قِلاَلَهَا، وَ أَطَالَ أَنْشَازَهَا، وَ جَعَلَهَا لِلْأَرْضِ عِمَاداً، وَ أَرَّزَهَا فِيهَا أَوْتَاداً، فَسَكَنَتْ عَلَى حَرَكَتِهَا مِنْ أَنْ تَمِيدَ بِأَهْلِهَا، أَوْ تَسِيخَ بِحِمْلِهَا، أَوْ تَزُولَ عَنْ مَوَاضِعِهَا. فَسُبْحَانَ مَنْ أَمْسَكَهَا بَعْدَ مَوَجَانِ مِيَاهِهَا، وَ أَجْمَدَهَا بَعْدَ رُطُوبَةِ أَكْنَافِهَا، فَجَعَلَهَا لِخَلْقِهِ مِهَاداً، وَ بَسَطَهَا لَهُمْ فِرَاشاً! فَوْقَ بَحْرٍ لُجِّيٍّ رَاكِدٍ لاَ يَجْرِي، وَ قَائِمٍ لاَ يَسْرِي، تُكَرْكِرُهُ اَلرِّيَاحُ اَلْعَوَاصِفُ، وَ تَمْخُضُهُ اَلْغَمَامُ اَلذَّوَارِفُ؛( إِنَّ فِي ذلِكَ لَعِبْرَةً لِمَنْ يَخْشى) .

সৃষ্টি জগতের বিস্ময়

আল্লাহ্ তাঁর মহান কুদরত ও সূক্ষ্ম সৃজনি শক্তি দ্বারা অথৈ ,ঘন ও উচ্চণ্ড পানি থেকে শক্ত শুষ্ক মাটি তৈরি করলেন। তারপর তিনি তার স্তর বিন্যাস করলেন এবং একত্রিত হয়ে জোড়া লাগার পর তাকে সপ্ত আকাশে বিভক্ত করলেন। সুতরাং তাঁর আদেশে তা স্থির হয়ে গেল এবং তাঁর নির্ধারিত সীমায় তা আবদ্ধ হয়ে গেল। তিনি পৃথিবীকে এরূপে তৈরি করলেন যে ,তা গাঢ় নীল ,পরিবেষ্টিত ও আলম্বিত পানি থেকে জন্ম নিল যা তার আদেশের প্রতি অনুগত এবং যখন তাঁর ভয়ে প্রবাহ থেমে গেল তখন তার সম্মানে অবনত হয়ে রইলো ।

তিনি উচু পাহাড় ,শক্ত পাথর ও সুউচ্চ পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন। তিনি এগুলোকে যথাস্থানে স্থাপন করলেন এবং স্থির করে রাখলেন। এদের চূড়া আকাশে উঠে গেল এবং মূল পানিতে রয়ে গেল। এভাবে তিনি পর্বতকে সমতল ভূমির ওপরে তুলে দিলেন এবং এদের ভিত্তি বিশাল বিস্তারে এঁটে দিলেন যেখানে এরা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এসব পাহাড়ের চূড়াকে সুউচ্চ করেছেন এবং এদের বিস্তৃতি বিশাল করেছেন। তিনি এগুলোকে পৃথিবীর জন্য স্তম্ভ স্বরূপ করেছেন এবং পেরেকের মতো আটকিয়ে দিয়েছেন। ফলে পৃথিবী স্থির হয়েছে ;অন্যথায় পৃথিবী এর অধিবাসীদেরকে নিয়ে বক্র হয়ে যেত অথবা নিজ ভারে নিচের দিকে তলিয়ে যেত অথবা স্বীয় অবস্থান থেকে সরে পড়তো ।

সুতরাং তিনিই মহিমান্বিত যিনি পানির প্রবাহের পর তা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং এর পার্শ্বদেশ জলাকীর্ণ অবস্থার পর তাকে শক্ত করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি পৃথিবীকে তাঁর বান্দাদের জন্য দোলনা করে দিয়েছেন এবং গভীর সমুদ্রের ওপরে তাকে তাদের জন্য মেঝের মতো বিছিয়ে দিয়েছেন যা স্থির ,অনড় ও নিশ্চল। তীব্র বাতাস পানির প্রবাহকে এদিক সেদিক নাড়াতে পারে এবং মেঘমালা এর থেকে পানি গ্রহণ করে ।

নিশ্চয়ই এতে তাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে যারা আল্লাহকে ভয় করে (কুরআন - ৭৯:২৬)