নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা7%

নাহজ আল-বালাঘা লেখক:
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: হযরত আলী (আ.)

নাহজ আল-বালাঘা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 48 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 128660 / ডাউনলোড: 8473
সাইজ সাইজ সাইজ
নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

রাসূলের (সা.) ‘জ্ঞান নগরীর দ্বার’ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী, দার্শনিক, সুলেখক ও বাগ্মী। আলঙ্কারিক শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য ও নৈপুন্য অসাধারণ। তিনি নবুওয়াতী জ্ঞান ভান্ডার হতে সরাসরি জ্ঞান আহরণ করেন এবং সাহাবাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পন্ডিত ছিলেন। এতে কারো দ্বিমত নেই। আরবী কাব্যে ও সাহিত্যে তার অনন্যসাধারণ অবদান ছিল। খেলাফত পরিচালনা কালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ (খোৎবা) দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকগণকে প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে পত্র লিখেছিলেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মানুষের অনেক প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তার এসব বাণী কেউকেউ লিখে রেখেছিল, কেউ কেউ মনে রেখেছিল, আবার কেউ কেউ তাদের লিখিত পুস্তকে উদ্ধৃত করেছিল। মোটকথা তার অমূল্য বাণীসমূহ মানুষের কাছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিল।

আশ-শরীফ আর-রাজী আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের ভাষণসমূহ (খোৎবা), পত্রাবলী, নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ সংগ্রহ করে “নাহজ আল-বালঘা” নামক গ্রন্থটি সঙ্কলন করেন।


1

2

3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

খোৎবা - ২০০

الحق و الطريق الواضح

أَيُّهَا اَلنَّاسُ لاَ تَسْتَوْحِشُوا فِي طَرِيقِ اَلْهُدَى لِقِلَّةِ أَهْلِهِ، فَإِنَّ اَلنَّاسَ قَدِ اِجْتَمَعُوا عَلَى مَائِدَةٍ شِبَعُهَا قَصِيرٌ، وَ جُوعُهَا طَوِيلٌ. أَيُّهَا اَلنَّاسُ، إِنَّمَا يَجْمَعُ اَلنَّاسَ اَلرِّضَا وَ اَلسُّخْطُ. وَ إِنَّمَا عَقَرَ نَاقَةَ ثَمُودَ رَجُلٌ وَاحِدٌ فَعَمَّهُمُ اَللَّهُ بِالْعَذَابِ لَمَّا عَمُّوهُ بِالرِّضَی، فَقَالَسُبْحَانَهُ :( فَعَقَرُوها فَأَصْبَحُوا نادِمِينَ ) ، فَمَا كَانَ إِلاَّ أَنْ خَارَتْ أَرْضُهُمْ بِالْخَسْفَةِ خُوَارَ اَلسِّكَّةِ اَلْمُحْمَاةِ فِي اَلْأَرْضِ اَلْخَوَّارَةِ. أَيُّهَا اَلنَّاسُ، مَنْ سَلَكَ اَلطَّرِيقَ اَلْوَاضِحَ وَرَدَ اَلْمَاءَ، وَ مَنْ خَالَفَ وَقَعَ فِي اَلتِّيهِ!.

সত্য ও ন্যায়পথ সম্পর্কে

হে জনমণ্ডলী ,ন্যায় পথের অনুসারীর সংখ্যাল্পতায় তোমরা বিস্মিত হয়ো না। কারণ (এ দুনিয়াতে) মানুষ। শুধু সেই টেবিলের পাশে ভিড় জমায় যাতে অনেক কিছুর মধ্যে ভক্ষণীয় জিনিস অল্প কিন্তু ক্ষুধা চির অতৃপ্ত।

হে জনমণ্ডলী ,নিশ্চয়ই ,যে বিষয় মানুষকে একত্রিত করে তা হলো ভালো অথবা খারাপের জন্য তাদের ঐকমত্য অথবা অনৈকমত্য। ছামুদ জাতির এক ব্যক্তি উষ্ট্রিহত্যা করেছিল ;কিন্তু আল্লাহ তাদের সকলকে শান্তি দিয়েছিলেন। কারণ তারা সকলেই লোকটির গর্হিত কাজের প্রতি মৌন সম্মতি প্রদর্শন করেছিল। তাই মহিমান্বিত আল্লাহ বলেন , অতঃপর তারা ওটার পায়ের শিরা কেটে দিয়েছিল এবং পরিণামে তারা অনুতপ্ত হলো । ” (কুরআন - ২৬ : ১৫৭) ।

এরপর তাদের ভূমি তলিয়ে গিয়ে কমে গিয়েছিল। যেমন করে লাঙ্গলের ফলা আকর্ষিত ভূমিকে ভেদ করে। হে জনমণ্ডলী ,যে ব্যক্তি হেদায়েতের সুস্পষ্ট পথে চলে সে পানির ঝরনার ধারে পৌছতে পারে এবং যে তা পরিত্যাগ করে সে পানিবিহীন মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ায়।

____________________

১। প্রাচীন আরবে খৃষ্টপূর্ব ৪র্থ হতে ৭ম শতাব্দীর মধ্যে ছামুদ নামক একটা গোত্র বা গোত্রসমষ্টি বাস করতো। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী আল - কুরা উপত্যকায় এ জাতি বসবাস করতো। সালিহ নামক একজন নবীকে আল্লাহ তাদের হেদায়েতের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। আল্লাহ বলেনঃ

ছামুদ জাতির কাছে তাদের ভ্রাতা সালিহ - কে পাঠিয়েছিলাম । তিনি বলেছিলেন , হে আমার কওম ,তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর । তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই । তোমাদের জন্য তোমাদের রবের কাছ থেকে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে । আল্লাহর এ উষ্ট্রী তোমাদের জন্য একটা নিদর্শন । একে আল্লাহর জমিতে চরে খেতে দাও ,একে কোন ক্লেশ দিও না ,দিলে মর্মন্তুত শাস্তি তোমাদের ওপর আপতিত হবে এবং স্মরণ কর ,আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন । তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে ,তোমরা সমতল ভূমিতে প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছো । সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টি করো না । তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানেরা ইমানদারগণকে দুর্বল মনে করে বললো , তোমরা কি জানো যে ,সালিহ্ আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত ? তারা বললো ,তার প্রতি যে বাণী প্রেরিত হয়েছে আমরা তাতে বিশ্বাসী । * দাম্ভিকেরা বললো ,তোমরা যা বিশ্বাস কর আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। ” । অতঃপর তারা সেই উষ্ট্রী বধ করে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে। এবং বলে , হে সালিহ! তুমি রাসূল হলে আমাদেরকে যে ভয় দেখিয়েছো তা আনয়ন কর । ” অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো ,ফলে তাদের প্রভাত হলো নিজগৃহে মুখ থুবড়ে পড়া অবস্থায় । তারপর তিনি তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন , আমি তো আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌছে দিয়েছিলাম ,কিন্তু তোমরা তো হিতাকাঙ্খীদেরকে পছন্দ করনা ’ (কুরআন ৭:৭৩ - ৭৯)

ছামুদ সম্প্রদায় সতর্ককারীকে মিথ্যাবাদী বলেছিল । তারা বলেছিলো আমরা কি আমাদের মধ্য থেকেই এক ব্যক্তিকে অনুসরণ করবো ? তা হলে তো আমরা বিপথগামী ও উন্মাদ বলে গণ্য হবো । আমাদের মধ্যে কি তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে ? না ,সে তো একজন মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক ” । আগামীকাল তারা জানবে ,কে মিথ্যাবাদী ও দাম্ভিক । আমি তাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছি। এক উষ্ট্রী ;অতএব ,তুমি তাদের আচরণ লক্ষ্য কর এবং ধৈর্যশীল হও এবং তাদেরকে জানিয়ে দাও যে ,তাদের মধ্যে পানি বন্টন নির্ধারিত এবং পানির অংশের জন্য প্রত্যেকে উপস্থিত হবে পালাক্রমে । এরপর তারা তাদের এক সঙ্গীকে আহ্বান করলো ,সে উটটিকে হত্যা করলো। কী কঠোর ছিল আমার শাস্তি ও সতর্কবাণী । আমি তাদের ওপর আঘাত হেনেছিলাম এক মহানাদ দ্বারা ;ফলে তারা হয়ে গেল খোয়াড় নির্মাণকারীর বিখণ্ডিত শুষ্ক শাখা - প্রশাখার মতো। (৫৪:২৩ - ৩১) ।

খোৎবা - ২০১

رُوِيَ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَهُ عِنْدَ دَفْنِ سَيِّدَةِ اَلنِّسَاءِ فَاطِمَةَعليه‌السلام كَالْمُنَاجِي بِهِ رَسُولَ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم عِنْدَ قَبْرِهِ

اَلسَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا رَسُولَ اَللَّهِ عَنِّي، وَ عَنِ اِبْنَتِكَ اَلنَّازِلَةِ فِي جِوَارِكَ، وَ اَلسَّرِيعَةِ اَللَّحَاقِ بِكَ! قَلَّ، يَا رَسُولَ اَللَّهِ، عَنْ صَفِيَّتِكَ صَبْرِي، وَ رَقَّ عَنْهَا تَجَلُّدِي، إِلاَّ أَنَّ فِي اَلتَّأَسِّي لِي بِعَظِيمِ فُرْقَتِكَ، وَ فَادِحِ مُصِيبَتِكَ، مَوْضِعَ تَعَزٍّ، فَلَقَدْ وَسَّدْتُكَ فِي مَلْحُودَةِ قَبْرِكَ، وَ فَاضَتْ بَيْنَ نَحْرِي وَ صَدْرِينَفْسُكَ.

«فَإِنَّا لِلَّهِ وَ إِنَّا إِلَيْهِ راجِعُونَ» . فَلَقَدِ اُسْتُرْجِعَتِ اَلْوَدِيعَةُ، وَ أُخِذَتِ اَلرَّهِينَةُ! أَمَّا حُزْنِي فَسَرْمَدٌ، وَ أَمَّا لَيْلِي فَمُسَهَّدٌ، إِلَى أَنْ يَخْتَارَ اَللَّهُ لِي دَارَكَ اَلَّتِي أَنْتَ بِهَا مُقِيمٌ. وَ سَتُنَبِّئُكَ اِبْنَتُكَ بِتَضَافُرِ أُمَّتِكَ عَلَى هَضْمِهَا، فَأَحْفِهَا اَلسُّؤَالَ، وَ اِسْتَخْبِرْهَا اَلْحَالَ؛ هَذَا وَ لَمْ يَطُلِ اَلْعَهْدُ، وَ لَمْ يَخْلُ مِنْكَ اَلذِّكْرُ، وَ اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمَا سَلاَمَ مُوَدِّعٍ، لاَ قَالٍ وَ لاَ سَئِمٍ، فَإِنْ أَنْصَرِفْ فَلاَ عَنْ مَلاَلَةٍ، وَ إِنْ أُقِمْ فَلاَ عَنْ سُوءِ ظَنٍّ بِمَا وَعَدَ اَللَّهُ اَلصَّابِرِينَ.

সাইয়্যেদুন্নিসা খাতুনে জান্নাত ফাতিমার দাফনের সময় প্রদত্ত খোৎবা

সাইয়্যেদুন্নিছা খাতুনে জান্নাতের দাফনের সময় আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল ,আমার সালাম ও আপনার কন্যার সালাম গ্রহণ করুন। আপনার কন্যা আপনার কাছে আসছেন এবং তিনি আপনার সাক্ষাত লাভের জন্য তাড়াহুড়া করেছিলেন। হে আল্লাহর রাসূল ,আপনার প্রাণপ্রিয় কন্যার মৃত্যু আমাকে ধৈর্যহারা করে দিয়েছে এবং আমার সহ্যশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমার সান্তুনার ক্ষেত্র এটুকু যে ,আপনার দুঃখজনক ও হৃদয় বিদারক বিচ্ছেদ - বেদনা আমি ধৈর্য সহকারে সহ্য করেছি। আপনাকে আমি নিজ হাতে কবরে শায়িত করেছি। আমার গ্রীবা ও বুকের মাঝখানে আপনার পবিত্র মস্তক থাকাবস্থায় আপনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী । ( কুরআন - ২ : ১৫৬ )

এক্ষণে ,আপনার আমানত ফেরত নেয়া হয়েছে এবং যা দেয়া হয়েছিল তা আবার ফিরিয়ে নেয়া হলো। আমার শোকের আর কোন সীমা রইলো না এবং আমার রাত্রি নিদ্রাবিহীন হয়ে গেল যে পর্যন্ত না আপনি এখন যে ঘরে আছেন আল্লাহ আমার জন্য সে ঘর মঞ্জুর করেন।

নিশ্চয়ই ,আপনার কন্যা আপনার সাক্ষাত লাভ করেই আপনাকে বিস্তারিত বলেছেন যে ,আপনার উম্মাহ তার প্রতি কতই না অত্যাচার করেছে। আপনি দয়া করে তাকে জিজ্ঞেস করে বিস্তারিত খবর জেনে নেবেন। এসব ঘটনা এত অল্পকালের মধ্যে ঘটেছে যে ,লোকেরা এখনো আপনাকে স্মরণ করে এবং আপনার কথা বলাবলি করে । আপনাদের উভয়ের প্রতি আমার সালাম । এ সালাম ,একজন শোকাহতের- কোন বিরক্ত বা সঘৃণ ব্যক্তির নয়। আমার এখান থেকে চলে যাওয়ার কারণ এ নয় যে ,আমি শ্রান্ত হয়ে পড়েছি এবং যদি আমি এখানে থাকি তার কারণ এ নয় যে ,আল্লাহ্ সবুরকারীদের জন্য যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমি তাতে বিশ্বাস হারিয়েছি।

___________________

১। রাসূলের (সা.) ইন্তিকালের পর তার প্রাণপ্রিয় কন্যার প্রতি যে পরিমাণ জুলুম ও দুর্ব্যবহার করা হয়েছিল তা অত্যন্ত দুঃখজনক ,দুর্ভাগ্যজনক ও হৃদয় - বিদারক। যদিও রাসূলের ইন্তিকালের পর সাইয়্যেদুন্নিছা ফাতিমা মাত্র কয়েক মাস বেঁচে ছিলেন তবুও এ অল্প সময়ের শোক ও দুঃখ - দুর্দশা বর্ণনাতীত। এ বিষয়ে প্রথমে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তা হলো রাসূলের কাফন - দাফনের কথা চিন্তা না করে তাঁর পবিত্র মরদেহ ফেলে রেখে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য তারা সকলেই সকিফা - ই - সাইদায় চলে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এহেন আচরণ খাতুনে জান্নাতকে আহত করেছিল। যখন তিনি দেখলেন যে ,রাসূলের জীবদ্দশায় যারা তার প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা বলতো তারা ক্ষমতা দখলের জন্য এমনভাবে পাগলপারা হয়ে পড়েছিলো যে ,রাসূলের একমাত্র শোকাহত কন্যাকে একটু সান্তুনা দিতেও এলো না ,তখন তার হৃদয় ব্যথাতুর হওয়া স্বাভাবিক। এমন কি কখন রাসূলকে শেষ গোসল দেয়া হয়েছিল এবং কখন তাকে দাফন করা হয়েছিল - এসবের কিছুই তারা জানলো না। যেভাবে তারা রাসূল - কন্যার কাছে এসেছিল তা হলো - তারা আগুন জ্বালাবার উপকরণসহ দল বেঁধে তাঁর ঘরের সামনে জড়ো হয়ে জোরপূর্বক বায়াত গ্রহণের জন্য অত্যাচার ও বিশৃঙ্খলা প্রদর্শন করেছিল। এসব বাড়াবাড়ির মূল উদ্দেশ্য ছিল খাতুনে জান্নাতের ঘরের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তারা এমনভাবে মুছে ফেলতে চেয়েছিল যেন ভবিষ্যতে আর সেই মর্যাদা ফিরে না পায়। এসব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেয়ার মানসে ফাদাক ” - এর দাবি মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে খাতুনে জান্নাত মৃত্যুকালে আছিয়াত করেছিলেন যে ,তারা কেউ যেন তাঁর দাফনে উপস্থিত না থাকে।

খোৎবা - ২০২

طلب الآخرة

أَيُّهَا اَلنَّاسُ، إِنَّمَا اَلدُّنْيَا دَارُ مَجَازٍ، وَ اَلْآخِرَةُ دَارُ قَرَارٍ، فَخُذُوا مِنْ مَمَرِّكُمْ لِمَقَرِّكُمْ، وَ لاَ تَهْتِكُوا أَسْتَارَكُمْ عِنْدَ مَنْ يَعْلَمُ أَسْرَارَكُمْ، وَ أَخْرِجُوا مِنَ اَلدُّنْيَا قُلُوبَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَخْرُجَ مِنْهَا أَبْدَانُكُمْ، فَفِيهَا اُخْتُبِرْتُمْ وَ لِغَيْرِهَا خُلِقْتُمْ. إِنَّ اَلْمَرْءَ إِذَا هَلَكَ قَالَ اَلنَّاسُ: مَا تَرَكَ؟ وَ قَالَتِ اَلْمَلاَئِكَةُ: مَا قَدَّمَ؟ لِلَّهِ آبَاؤُكُمْ! فَقَدِّمُوا بَعْضاً يَكُنْ لَكُمْ قَرْضاً، وَ لاَ تُخْلِفُوا كُلاًّ فَيَكُونَ فَرْضاً عَلَيْكُمْ.

পরকালের রসদ সংগ্রহের উপদেশ

হে জনমণ্ডলী ,নিশ্চয়ই এ পৃথিবী একটা যাত্রাপথ আর পরকাল হলো স্থায়ী আবাসস্থল। সুতরাং যাত্রাপথ থেকে স্থায়ী আবাসস্থলের রসদ সংগ্রহ কর । যিনি তোমাদের সকল গুপ্ত বিষয় অবগত আছেন। তাঁর সম্মুখে তোমাদের পর্দা ছিড়ে ফেলো না। এ পৃথিবী থেকে তোমাদের দেহ চলে যাবার আগে তোমাদের হৃদয়কে পাঠিয়ে দাও। কারণ পরীক্ষার জন্য তোমাদেরকে এখানে রাখা হয়েছে এবং পরকালের জন্য তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যখন কোন মানুষ মারা যায় তখন অন্যরা জিজ্ঞেস করে কী কী সম্পদ সে রেখে গেছে ,আর ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করে কী সৎ আমল সে অগ্রে প্রেরণ করেছে। আল্লাহ তোমাদেরকে আশীর্বাদ করুন ,তোমরা অগ্রে কিছু প্রেরণ কর ;এটা তোমাদের জন্য সঞ্চয় হিসাবে বিবেচিত হবে এবং সবকিছু পিছনে ফেলে যেয়ো না ;কারণ এটা তোমাদের জন্য বোঝা হয়ে যাবে।

খোৎবা - ২০৩

الاستعداد للآخرة

تَجَهَّزُوا رَحِمَكُمُ اَللَّهُ! فَقَدْ نُودِيَ فِيكُمْ بِالرَّحِيلِ، وَ أَقِلُّوا اَلْعُرْجَةَ عَلَى اَلدُّنْيَا، وَ اِنْقَلِبُوا بِصَالِحِ مَا بِحَضْرَتِكُمْ مِنَ اَلزَّادِ، فَإِنَّ أَمَامَكُمْ عَقَبَةً كَؤُوداً، وَ مَنَازِلَ مَخُوفَةً مَهُولَةً، لاَ بُدَّ مِنَ اَلْوُرُودِ عَلَيْهَا، وَ اَلْوُقُوفِ عِنْدَهَا. وَ اِعْلَمُوا أَنَّ مَلاَحِظَ اَلْمَنِيَّةِ نَحْوَكُمْ دَانِيَةٌ(دائیه) ، وَ كَأَنَّكُمْ بِمَخَالِبِهَا وَ قَدْ نَشِبَتْ فِيكُمْ، وَ قَدْ دَهَمَتْكُمْ فِيهَا مُفْظِعَاتُ اَلْأُمُورِ، وَ مُعْضِلاَتُ(مضلعات) اَلْمَحْذُورِ. فَقَطِّعُوا عَلاَئِقَ اَلدُّنْيَا وَ اِسْتَظْهِرُوا بِزَادِ اَلتَّقْوَى(الآخرة).

বিচার দিনের বিপদ সম্বন্ধে সতর্কাদেশ

তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। পরপারে যাত্রার সামগ্রী সংগ্রহ করো ;কারণ প্রস্থানের আহবান ঘোষিত হয়ে গেছে। এ পৃথিবীতে তোমাদের অবস্থান ক্ষণকালের এবং উত্তম কিছু নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কারণ সম্মুখের উপত্যকায় আরোহণ বড়ই কষ্টসাধ্য এবং বাসস্থান বড়ই ভয়াবহ ও বিপদসঙ্কুল। তোমাদেরকে সেখানে পৌছতে হবে এবং থাকতে হবে। জেনে রাখো ,মৃত্যুর চোখ তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় যেন তোমরা মৃত্যুর থাবার মধ্যেই রয়েছে। তোমাদের উচিত এ দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং আল্লাহর ভয়ের রসদ দ্বারা তোমাদের নিজেদেরকে সহায়তা করা ।

খোৎবা - ২০৪

كلم به طلحة و الزبير بعد بيعته بالخلافة و قد عتبا عليه من ترك مشورتهما و الاستعانة في الأمور بهما

لَقَدْ نَقَمْتُمَا يَسِيراً، وَ أَرْجَأْتُمَا كَثِيراً. أَ لاَ تُخْبِرَانِي، أَيُّ شَيْ‏ءٍ كَانَ لَكُمَا فِيهِ حَقٌّ دَفَعْتُكُمَا عَنْهُ؟ أَمْ أَيُّ قَسْمٍ اِسْتَأْثَرْتُ عَلَيْكُمَا بِهِ؟ أَمْ أَيُّ حَقٍّ رَفَعَهُ إِلَيَّ أَحَدٌ مِنَ اَلْمُسْلِمِينَ ضَعُفْتُ عَنْهُ، أَمْ جَهِلْتُهُ، أَمْ أَخْطَأْتُ بَابَهُ! وَ اَللَّهِ مَا كَانَتْ لِي فِي اَلْخِلاَفَةِ رَغْبَةٌ، وَ لاَ فِي اَلْوِلاَيَةِ إِرْبَةٌ، وَ لَكِنَّكُمْ دَعَوْتُمُونِي إِلَيْهَا، وَ حَمَلْتُمُونِي عَلَيْهَا، فَلَمَّا أَفْضَتْ إِلَيَّ نَظَرْتُ إِلَى كِتَابِ اَللَّهِ وَ مَا وَضَعَ لَنَا، وَ أَمَرَنَا بِالْحُكْمِ بِهِ فَاتَّبَعْتُهُ، وَ مَا اِسْتَنَّ اَلنَّبِيُّصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم فَاقْتَدَيْتُهُ، فَلَمْ أَحْتَجْ فِي ذَلِكَ إِلَى رَأْيِكُمَا، وَ لاَ رَأْيِ غَيْرِكُمَا، وَ لاَ وَقَعَ حُكْمٌ جَهِلْتُهُ، فَأَسْتَشِيرَكُمَا وَ إِخْوَانِي مِنَ اَلْمُسْلِمِينَ: وَ لَوْ كَانَ ذَلِكَ لَمْ أَرْغَبْ عَنْكُمَا، وَ لاَ عَنْ غَيْرِكُمَا. وَ أَمَّا مَا ذَكَرْتُمَا مِنْ أَمْرِ اَلْأُسْوَةِ، فَإِنَّ ذَلِكَ أَمْرٌ لَمْ أَحْكُمْ أَنَا فِيهِ بِرَأْيِي وَ لاَ وَلِيتُهُ هَوًى مِنِّي، بَلْ وَجَدْتُ أَنَا وَ أَنْتُمَا مَا جَاءَ بِهِ رَسُولُ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم قَدْ فُرِغَ مِنْهُ، فَلَمْ أَحْتَجْ إِلَيْكُمَا فِيمَا قَدْ فَرَغَ اَللَّهُ مِنْ قَسْمِهِ، وَ أَمْضَى فِيهِ حُكْمَهُ، فَلَيْسَ لَكُمَا، وَ اَللَّهِ عِنْدِي وَ لاَ لِغَيْرِكُمَا فِي هَذَا عُتْبَى. أَخَذَ اَللَّهُ بِقُلُوبِنَا وَ قُلُوبِكُمْ إِلَى اَلْحَقِّ، وَ أَلْهَمَنَا وَ إِيَّاكُمُ اَلصَّبْرَ. ثم قالعليه‌السلام : رَحِمَ اَللَّهُ رَجُلاً رَأَى حَقّاً فَأَعَانَ عَلَيْهِ، أَوْ رَأَى جَوْراً فَرَدَّهُ، وَ كَانَ عَوْناً بِالْحَقِّ عَلَى صَاحِبِهِ.

রাষ্ট্রীয় কার্যে তালহা ও জুবায়েরের পরামর্শ গ্রহণ না করার অভিযোগের জবাবে প্রদত্ত খোৎবা

আমিরুল মোমেনিনের বায়াত গ্রহণের পর তালহা ও জুবায়ের অভিযোগ উত্থাপন করলো যে ,তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যে তাদের সাথে পরামর্শ করেন না বা তাদের সহায়তা গ্রহণ করতে চান না। প্রত্যুত্তরে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ

তোমরা উভয়ে ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমাদের বিরাগ প্রকাশ করে থাক এবং বৃহৎ বিষয় পরিহার করে চলো । তোমরা কি বলতে পার আমি তোমাদেরকে তোমাদের কোন অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি অথবা কোন কিছুতে তোমাদের প্রাপ্য অংশ তোমাদেরকে দেইনি ? কোন মুসলিমের দাবির (যা আমার কাছে আনা হয়েছে) বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে কি আমি কখনো অপারগ হয়েছি ? আমি কি কোন বিষয়ে অজ্ঞ ছিলাম ? আমি কি কোন বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি ?

আল্লাহর কসম ,খেলাফতের প্রতি আমার কোন লোভ ছিল না বা সরকার পরিচালনার প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। কিন্তু তোমরা নিজেরাই আমাকে আমন্ত্রণ করে এ দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছ। যখন খেলাফতের দায়িত্ব আমার কাছে এলো আমি আল্লাহর কিতাবকে সকল কাজে আমার সামনে রাখলাম। আল্লাহ এতে আমাদের জন্য যা কিছু রেখেছেন এবং যেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন সেভাবেই আমি কুরআনকে অনুসরণ করতে লাগলাম। কুরআনের বিষয়ে আমাকে উপদেশ দেয়ার মতো তোমাদের কোন কিছু নেই বা কুরআন সংক্রান্ত বিষয়ে অন্য কারো উপদেশ আমার প্রয়োজন নেই। আমার অজানা এমন কোন আদেশ কুরআনে নেই যে বিষয়ে তোমাদের বা অন্য কোন মুসলিমের সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন হতে পারে। যদি এমন হতো যে ,কোন কিছু আমার অজানা রয়েছে তাহলে অবশ্যই আমি তা তোমাদের সাথে বা অন্য কারো সাথে পরামর্শ করতাম ।

বায়তুল মালের সমবন্টন সম্পর্কে তোমরা যে প্রশ্ন তুলেছ সে বিষয়ে আমি নিজের খেয়ালখুশি মতো কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিনি। আমি দেখেছি এবং তোমরাও দেখেছে যে ,রাসূল (সা.) যা কিছু আনতেন তা নিঃশেষ করে দিতেন। সুতরাং এ বিষয়ে তোমাদের প্রতি নজর রাখার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। কারণ সে বিষয় আল্লাহই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহর কসম ,এ বিষয়ে তোমরা দুজন বা অন্য কেউ আমার কাছে কোন প্রকার আনুকূল্য পাবে না। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের হৃদয়কে ন্যায়ের প্রতি ঝুকিয়ে দিন এবং তিনি আমাদেরকে ও তোমাদেরকে সবুর করার তৌফিক দান করুন। সেই ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক যে সত্য দেখলে সমর্থন করে এবং অন্যায় দেখলে তা পরিহার করে। আল্লাহ তার প্রতিও রহমত বর্ষণ করুন যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যেকে সাহায্য করে ।

খোৎবা - ২০৫

الاخلاق فی الحرب

و قد سمع قوما من أصحابه يسبون أهل الشام أيام حربهم بصفين

إِنِّي أَكْرَهُ لَكُمْ أَنْ تَكُونُوا سَبَّابِينَ، وَ لَكِنَّكُمْ لَوْ وَصَفْتُمْ أَعْمَالَهُمْ، وَ ذَكَرْتُمْ حَالَهُمْ، كَانَ أَصْوَبَ فِي اَلْقَوْلِ، وَ أَبْلَغَ فِي اَلْعُذْرِ، وَ قُلْتُمْ مَكَانَ سَبِّكُمْ إِيَّاهُمْ: اَللَّهُمَّ اِحْقِنْ دِمَاءَنَا وَ دِمَاءَهُمْ، وَ أَصْلِحْ ذَاتَ بَيْنِنَا وَ بَيْنِهِمْ، وَ اِهْدِهِمْ مِنْ ضَلاَلَتِهِمْ، حَتَّى يَعْرِفَ اَلْحَقَّ مَنْ جَهِلَهُ، وَ يَرْعَوِيَ عَنِ اَلْغَيِّ وَ اَلْعُدْوَانِ مَنْ لَهِجَ بِهِ.

যুদ্ধের ময়দানে নীতি নৈতিকতা সম্পর্কে

সিফফিনের যুদ্ধে যখন আমিরুল মোমেনিন শুনলেন যে ,তার লোকেরা সিরিয়দের গালি - গালাজ করছে তখন তিনি বললেনঃ

তোমরা তাদেরকে গালি দিচ্ছ - এটা আমি অপছন্দ করি। যদি তোমরা তাদের কর্মকান্ডের বর্ণনা বা সমালোচনা করে থাক তবে তা কথা বলার একটা ভালো প্রক্রিয়া এবং যুক্তি প্রদর্শনের জন্য অধিক গ্রহণীয় উপায় বলে বিবেচিত হবে। তাদেরকে গালি - গালাজ না করে তোমরা বলো , হে আল্লাহ ,আমাদেরকে ও তাদেরকে রক্তক্ষয় থেকে রক্ষা করুন ,আমাদের ও তাদের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করুন ;এবং তাদেরকে বিপথ হতে ফিরিয়ে আনুন যেন তাদের মধ্যে যারা সত্য সম্বন্ধে অজ্ঞাত তারা তা জানতে পারে। তাদের মধ্যে যারা বিদ্রোহের দিকে ঝুকে পড়ে বিদ্রোহী হয়েছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনুন। ”

খোৎবা - ২০৬

ضرورة حفظ الامامة

في بعض أيام صفين و قد رأى الحسن ابنهعليه‌السلام يتسرع إلى الحرب

اِمْلِكُوا عَنِّي هَذَا اَلْغُلاَمَ لاَ يَهُدَّنِي، فَإِنَّنِي أَنْفَسُ بِهَذَيْنِ - يَعْنِي اَلْحَسَنَ وَ اَلْحُسَيْنَعليهما‌السلام - عَلَى اَلْمَوْتِ لِئَلاَّ يَنْقَطِعَ بِهِمَا نَسْلُ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم .

ইমামতের ধারা রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

সিফফিনের যুদ্ধে ইমাম হাসান যুদ্ধ করতে দ্রুত এগিয়ে গেলে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ

এ যুবককে আমার পক্ষ থেকে যুদ্ধে যেতে বারণ করে ধরে রাখো ,পাছে সে আমার ধ্বংসের কারণ হয়ে পড়ে। এ দুজনকে (হাসান ও হুসাইন) মৃত্যুর দিকে পাঠাতে আমি সম্পূর্ণরূপে অনিচ্ছুক: কারণ তাদের মৃত্যুতে রাসূলের (সা.) বংশধারা শেষ হয়ে যাবে।

খোৎবা - ২০৭

قاله لما اضطرب عليه أصحابه في أمر الحكومة

أَيُّهَا اَلنَّاسُ، إِنَّهُ لَمْ يَزَلْ أَمْرِي مَعَكُمْ عَلَى مَا أُحِبُّ، حَتَّى نَهِكَتْكُمُ اَلْحَرْبُ، وَ قَدْ، وَ اَللَّهِ، أَخَذَتْ مِنْكُمْ وَ تَرَكَتْ، وَ هِيَ لِعَدُوِّكُمْ أَنْهَكُ. لَقَدْ كُنْتُ أَمْسِ أَمِيراً، فَأَصْبَحْتُ اَلْيَوْمَ مَأْمُوراً، وَ كُنْتُ أَمْسِ نَاهِياً، فَأَصْبَحْتُ اَلْيَوْمَ مَنْهِيّاً، وَ قَدْ أَحْبَبْتُمُ اَلْبَقَاءَ، وَ لَيْسَ لِي أَنْ أَحْمِلَكُمْ عَلَى مَا تَكْرَهُونَ!.

সালিশী সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনের মনোভাবে তাঁর অনুচরগণ অসন্তোষ প্রকাশ করলে তিনি বললেনঃ

হে জনমণ্ডলী ,আমার ও তোমাদের মধ্যে যে ব্যাপার হয়েছে তা হলো আমি চেয়েছিলাম তোমরা নিঃশেষিত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আল্লাহর কসম ,যদিও যুদ্ধ তোমাদের কিছু লোককে নিয়ে গেছে। তবুও তোমাদের শক্র সম্পূর্ণরূপে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত আমি আদেশ দিয়েছিলাম ,আর আজ আমি আদিষ্ট হচ্ছি । গতকাল পর্যন্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আমি মানুষকে উপদেশ দিয়েছিলাম ,আর আজ আমাকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তোমরা এ পৃথিবীতে বাস করার প্রবল ইচ্ছা দেখিয়েছো । কাজেই তোমরা যা অপছন্দ কর তার প্রতি তোমাদেরকে টেনে আনা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।

____________________

১। সিফফিনের যুদ্ধে সিরীয় সৈন্যগণ যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান হারিয়ে ফেলে পালিয়ে যাবার জন্য যখন প্রস্তুত হয়েছিল তখন মুয়াবিয়া তার চিরাচরিত ধূর্তামির একটা কৌশল হিসাবে কুরআনকে ব্যবহার করেছিল। এতে ইরাকি সৈন্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলো। তারা আমিরুল মোমেনিনের সকল উপদেশ অমান্য করে যুদ্ধে এক পাও এগুতে রাজি হলো না। অধিকন্তু যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তারা জেদ ধরেছিল। এতে আমিরুল মোমেনিন সালিশীতে সম্মতি দিতে বাধ্য হলেন। এসব লোকের মধ্যে কতেক প্রকৃতপক্ষেই প্রতারিত হয়েছিল এবং তারা মনে করেছিল কুরআনকে মেনে চলার জন্যই বুঝি সত্যি সত্যি বলা হচ্ছিলো। আবার কিছু সংখ্যক লোক দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। তারা এ সুযোগে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য চিৎকার শুরু করে দিয়েছিল। আবার এমন কিছু লোক ছিল যারা খেলাফতের ক্ষমতার কারণে আমিরুল মোমেনিনের সঙ্গী হয়েছিল ,কিন্তু তারা হৃদয় দিয়ে তাকে সমর্থন করতো না বা তার বিজয়ও কামনা করতো না। এমন কতেক লোক ছিল যারা মুয়াবিয়ার কাছ থেকে অনেক কিছুর আশা পেয়েছিল এবং সেই আশা পূরণের জন্য মুয়াবিয়ার স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেছিল। এ ছাড়াও এমন কতেক লোক ছিল যারা প্রথম থেকেই মুয়াবিয়ার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। এমন একটা অবস্থায় এবং এমন প্রকৃতির সৈন্য নিয়ে এত বড় একটা যুদ্ধে জয়ের মুখোমুখি হওয়া শুধুমাত্র আমিরুল মোমেনিনের সৈন্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল ,রাজনৈতিক সক্ষমতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। তার সৈন্যগণ মুয়াবিয়ার ধূর্তামির শিকার না হলে তার জয় ছিল সুনিশ্চিত। কারণ সিরীয়দের শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়েছিল এবং পরাজয় তাদের মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিলো। এ ব্যাপারে ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেনঃ

মালিক আশতার মুয়াবিয়ার কাছ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল এবং তার ঘাড় আঁকড়ে ধরার আল্প বাকি ছিল । সিরীয়দের সকল শক্তি চুরমার হয়ে পড়েছিল । একটা মৃতো টিকটিকির লেজ যেভাবে নড়াচড়া করে সিরীয়দের মধ্যে ঠিক তদ্রূপ নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছিলো ।

খোৎবা - ২০৮

بالبصرة و قد دخل على العلاء بن زياد الحارثي - و هو من أصحابه - يعوده فلما رأى سعة داره قال:

مَا كُنْتَ تَصْنَعُ بِسِعَةِ هَذِهِ اَلدَّارِ فِي اَلدُّنْيَا، وَ أَنْتَ إِلَيْهَا فِي اَلْآخِرَةِ كُنْتَ أَحْوَجَ؟ وَ بَلَى إِنْ شِئْتَ بَلَغْتَ بِهَا اَلْآخِرَةَ: تَقْرِي فِيهَا اَلضَّيْفَ، وَ تَصِلُ فِيهَا اَلرَّحِمَ، وَ تُطْلِعُ مِنْهَا اَلْحُقُوقَ مَطَالِعَهَا، فَإِذاً أَنْتَ قَدْ بَلَغْتَ بِهَا اَلْآخِرَةَ.

فَقَالَ لَهُ اَلْعَلاَءُ: يَا أَمِيرَ اَلْمُؤْمِنِينَ، أَشْكُو إِلَيْكَ أَخِي عَاصِمَ بْنَ زِيَادٍ. قَالَ: وَ مَا لَهُ؟ قَالَ: لَبِسَ اَلْعَبَاءَةَ وَ تَخَلَّى عَنِ اَلدُّنْيَا. قَالَ: عَلَيَّ بِهِ. فَلَمَّا جَاءَ قَالَ:

يَا عُدَيَّ نَفْسِهِ! لَقَدِ اِسْتَهَامَ بِكَ اَلْخَبِيثُ! أَ مَا رَحِمْتَ أَهْلَكَ وَ وَلَدَكَ؟! أَ تَرَى اَللَّهَ أَحَلَّ لَكَ اَلطَّيِّبَاتِ، وَ هُوَ يَكْرَهُ أَنْ تَأْخُذَهَا؟! أَنْتَ أَهْوَنُ عَلَى اَللَّهِ مِنْ ذَلِكَ!.

قَالَ: يَا أَمِيرَ اَلْمُؤْمِنِينَ، هَذَا أَنْتَ فِي خُشُونَةِ مَلْبَسِكَ وَ جُشُوبَةِ مَأْكَلِكَ!.

قَالَ؛ وَيْحَكَ، إِنِّي لَسْتُ كَأَنْتَ، إِنَّ اَللَّهَتَعَالَى فَرَضَ عَلَى أَئِمَّةِ اَلْعَدْلِ أَنْ يُقَدِّرُوا أَنْفُسَهُمْ بِضَعَفَةِ اَلنَّاسِ، كَيْلاَ يَتَبَيَّغَ بِالْفَقِيرِ فَقْرُهُ!.

পার্থিব জগতের সাথে আচরণ সম্পর্কে

আমিরুল মোমেনিন তার অনুচর আ লা ইবনে জিয়াদ আল - হারিছিকে দেখতে গিয়ে তার বিশাল বাড়ি দেখে বললেনঃ

এ পৃথিবীতে এ রকম বিশাল বাড়ি দিয়ে তুমি কী করবে ? পরকালে তোমার এমন একটা বাড়ির প্রয়োজন রয়েছে। যদি তুমি এ বাড়িটি পরকালে নিয়ে যেতে চাও তবে এতে অতিথিদের আপ্যায়ন করে ;আত্মীয় - স্বজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ো এবং তাদের প্রতি তোমার যতটুকু দায়িত্ব রয়েছে তা পালন করো। এসব কাজ করলে এ বাড়ি তুমি পরকালে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে।

লা বললোঃ হে আমিরুল মোমেনিন ,আমি আমার ভ্রাতা আসিম ইবনে জিয়াদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে অভিযোগ করতে চাই ।

আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ সে কী করেছে ?

লা বললোঃ সে একটা পশমি কোট পরে থাকে এবং পৃথিবীর সব কিছুর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে।

আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ তাকে আমার সামনে নিয়ে আসি ।

যখন সে সামনে এলো আমিরুল মোমেনিন তাকে বললেনঃ ওহে ,তুমি তো তোমার নিজের শত্রু। নিশ্চয়ই ,শয়তান তোমাকে বিভ্রান্ত করেছে। তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কি তোমার কোন মায়া হয় না ? আল্লাহ তোমার জন্য যা হালাল করেছেন তা পরিধান করলে তিনি তোমাকে অপছন্দ করবেন বলে কি তুমি মনে করা ? আল্লাহর জন্য তুমি অতি গুরুত্বহীন যে তিনি এমনটি করবেন।

আসিম বললোঃ হে আমিরুল মোমেনিন ,আপনিও তো মোটা কাপড় পরিধান করেন এবং সাধারণ খাদ্য গ্রহণ করেন।

আমিরুল মোমেনিন বললেনঃ তোমার ওপর লানত ,আমি তোমার মতো নই। নিশ্চয়ই ,মহিমান্বিত আল্লাহ প্রকৃত নেতার জন্য এটা বাধ্যতামূলক করেছেন যে ,তারা সমাজের নিচু স্তরের লোকদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জীবনযাপন করবেন যাতে গরীব - দুঃখীগণ তাদের দারিদ্রের জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে।

____________________

১ । প্রাচীনকাল থেকেই সংসারের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তাপস জীবন যাপনকে আত্মার পবিত্রতা অর্জন করার ও চরিত্র গঠনের উপায় হিসাবে মনে করা হয়। ফলে যারা ভোগ - বিলাস ও পানাহারে সংযমী জীবন যাপন করা ও ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকার ইচ্ছা করতো তারা শহর ও জনজীবনের বাইরে চলে যেতো এবং বনে - জঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হয়ে থাকতো। কোন পথচারী বা পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের কেউ কিছু খেতে দিলে তারা তা খেতো। অন্যথায় বন্য ফলমূল ও ঝরনার পানি খেয়ে তারা জীবন কাটাতো। শাসকদের অত্যাচার ও নিপীড়িনের ফলশ্রুতিতে এহেন ইবাদতের সূত্রপাত হয়। শাসকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোন কোন লোক বনে - জঙ্গলে ও পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যান করতে বাধ্য হয়েছিল। এভাবে সূত্রপাত হলেও পরবর্তীতে এ ধরনের ইবাদত মানুষ স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে থাকে। ফলে এটা স্বীকৃত হয়ে গেল যে ,আত্মিক উন্নতির জন্য জাগতিক বন্ধন ছিন্ন করে এহেন জীবন যাপন করতে হবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এ পদ্ধতির ইবাদত চলে আসছে। বর্তমানেও বৌদ্ধ এবং খৃষ্টানদের মধ্যে এ পদ্ধতি দেখা যায়।

ইসলাম এহেন সন্ন্যাস জীবন অনুমোদন করে না। কারণ আত্মিক উন্নতি অর্জনের জন্য জাগতিক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগের স্বীকৃতি ইসলামে নেই। কোন মুসলিম তার ঘর - সংসার ও পরিবার - পরিজনদের ত্যাগ করে গোপন স্থানে আনুষ্ঠানিক ইবাদতে নিজেকে মশগুল করে রাখবে - এরূপ ইবাদতের অনুমোদন ইসলামে নেই। ইসলামে ইবাদতের ধারণা শুধুমাত্র কতিপয় নির্ধারিত অনুষ্ঠান নয়। এটা এত ব্যাপক যে ,হালাল উপায়ে জীবিকা অর্জন ,একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা ,অন্যের সাথে সদাচরণ এবং সৎ ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা - এসবও ইসলামে ইবাদতের পর্যায়ভুক্ত। যদি কোন ব্যক্তি জাগতিক দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলা করে ,তার সন্তান - সন্ততি ও স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালন না করে এবং জীবিকা অর্জনের চেষ্টা না করে সারাক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থাকে। সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় এবং সে বাচার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করে না। সব কিছু ত্যাগ করে ইবাদত ও ধ্যানে মগ্ন থাকাই যদি আল্লাহর উদ্দেশ্য হতো। তবে মানুষ সৃষ্টির কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ এহেন ইবাদতের জন্য তার ফেরেশতাই যথেষ্টা ছিল।

আল্লাহ মানুষকে চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়েছেন যেখানে মধ্য - পথই হেদায়েতের কেন্দ্রবিন্দু। এ মধ্যপথ হতে একটুখানিক এদিক সেদিক হলেই তা নির্ঘাত পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। এ মধ্যপথ হলো কেউ জাগতিক বিষয়ে এমনভাবে ঝুকে পড়তে পারবে না যাতে সে পরকালকে ভুলে সম্পূর্ণরূপে দুনিয়াদারিতে ডুবে থাকবে ;আবার সে জাগতিক সবকিছু পরিত্যাগ করে নির্জনে নিজকে অবরুদ্ধ রেখে ইবাদতও করে কাটাতে পারবে না। যেহেতু আল্লাহ এ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন সেহেতু বেঁচে থাকার জন্য তাকে জীবনের কোড অনুসরণ করতে হবে এবং আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত নেয়ামত ও আরাম - আয়েশ পরিমিতভাবে ভোগ করতে হবে। হালাল জিনিস খেতে ও ব্যবহার করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। কাজেই এটা আল্লাহর ইবাদতের বিরোধী নয়। বরং আল্লাহ এসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন যেন মানুষ এসবের সুযোগ গ্রহণ করে শুকরিয়া আদায় করে। এ জন্যই আল্লাহর নবীগণ পৃথিবীতে অন্যদের সাথে বসবাস করতেন এবং অন্যদের মতোই পানাহার করতেন। তাঁরা বনেজঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় নির্জন স্থানে বাস করার বা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার প্রয়োজনীয়তা কখনো অনুভব করেননি।

অপরপক্ষে তারা আল্লাহর জেকের করেছেন ,জাগতিক কর্মকান্ডেও নিজেদেরকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে রাখেননি এবং আনন্দ ও উপভোগের মাঝেও মৃত্যুকে ভুলে থাকেননি।

তাপস জীবন অনেক সময় এমন মন্দ অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে ইহকাল ও পরকাল উভয়ই ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের প্রাকৃতিক প্রণোদনাসমূহ হালাল উপায়ে মিটানো না হলে মনে কুধারণার সৃষ্টি হয় এবং তাতে শান্তি ও মনোনিবেশ সহকারে ইবাদতের বিঘ্ন ঘটে। কখনো কখনো মানুষের অতৃপ্ত আবেগ ও অনুরাগ তাপসভাবকে পরাভূত করে সকল নৈতিক বেড়ি ছিন্ন করে দেয় এবং এমনভাবে অন্যায়ে লিপ্ত করে দেয় যে ,নফসের খাহেশ মিটাতে গিয়ে সে ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে যায়। এ কারণেই ধর্মীয় বিধানে একজন পরিবারবদ্ধ লোকের ইবাদতকে অপরিবারবদ্ধ লোকের ইবাদতের উর্দ্ধে স্থান দিয়েছে।

যে সব লোক সুফিবাদের আলখিল্লা পরে তাদের আত্মিক বড়ত্বের বাগাড়াম্বর করে তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের পথ হতে সরে গেছে এবং ইসলামের ব্যাপক শিক্ষা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। শয়তান তাদেরকে বিপথগামী করেছে এবং তারা তাদের স্বরচিত ধারণার বশবর্তী হয়ে ভ্রান্ত পথে পদাচারণা করে। তাদের গোমরাহি এতদূর পর্যন্ত গেছে যে ,তারা নেতার কথাকে। আল্লাহর কথা এবং নেতার কাজকে আল্লাহর কাজ বলে মনে করে। কখনো কখনো এরা নিজেদেরকে ধর্মীয় সকল বিধি - বিধান ও সীমার উর্দ্ধে মনে করে এবং সকল পাপ কাজকে তাদের জন্য বৈধ মনে করে। ইমান থেকে এমন স্খলন ও ধর্মহীনতাকে সুফিবাদী ’ (আল্লার প্রতি সম্পূর্ণ আসক্তি) নাম দেয়া হয়েছে। এর অবৈধ নিয়মনীতিকে বলা হয় তরিকা ’ এবং এর অনুসারীকে বলা হয় সুফি ’ । সর্বপ্রথম আবু হাশীম আল - কুফী ও শ্যামী এ নাম ধারণ করেছিল। সে ছিল উমাইয়া বংশোদ্ভূত ও অদৃষ্টবাদী (সে বিশ্বাস করতো মানুষ যা কিছু করে তা আল্লাহ্ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত) । তাকে সুফি বলার কারণ হলো ,সে দরবেশি ও আল্লাহর ভয় জাহির করার জন্য পশমি আলখিল্লা পরিধান করতো। পরবর্তীতে এ নাম সর্বত্র ব্যবহৃত হতে লাগলো এবং সুফি নামের মূল হিসাবে বহু কারণ বের করা হলো। উদাহরণ স্বরূপ ,সুফি শব্দে আরবি তিনটি বর্ণ রয়েছে - "ছোয়াদ ', ওয়াও" এবং ফে ’ । সুফিরা মনে করে ছোয়াদ ' দ্বারা সবুর (ধৈর্য্য) ,সিদক (সত্যবাদীতা) ও সাফা (পবিত্রতা) ; ওয়াও ' দ্বারা উদ (প্রেম) ,উরদ (আল্লাহর নাম জপ) ও ওয়াফা (আল্লাহর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস) এবং ফে ’ দ্বারা ফরদ (ঐক্য) ,ফকর (দীনহীনভাবে) ও ফানা (ঐশীপ্রেমে আত্ম বিলয়) বুঝায়। সুফি শব্দ সম্পর্কে দ্বিতীয় মত হলো - এটা সুফফা শব্দ হতে আগত। সুফফা হলো মসজিদে নববীর একটা বারান্দা। সেখানে যারা থাকতো তাদের বলা হতো অসাহাবুস সুফফা (বারান্দার অধিবাসী) । সুফি শব্দ সম্পর্কে তৃতীয় মত হলো - আরবের একটা গোত্রের আদিপুরুষের নাম ছিল সুফাহ। এগোত্রের লোকেরা কাবা ও হাজীদের সেবা করার কাজে নিয়োজিত ছিল। সে কারণে পরবর্তীতে এ কাজে নিয়োজিতদেরকে সুফি বলা হতো।

সুফিগণ বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত। তন্মধ্যে ৭টি উপদল প্রধান।এরা হলোঃ

(১)ওয়াহদাতিয়া (মৌলিক একত্ববাদ): এ উপদল সকল অস্তিত্বের একত্বে বিশ্বাস করে। এরা মনে করে পৃথিবীর কোন কিছু থেকে আল্লাহ ভিন্ন নন - সবকিছুতেই আল্লাহ। এমন কি দূষিত বস্তুসমূহকেও এরা তাই মনে করে। এরা নদী ও নদীর তরঙ্গমালাকে আল্লাহর সঙ্গে তুলনা করে। এরা যুক্তি দেখায় যে ,তরঙ্গ কখনো ফুলে উঠে আবার কখনো পড়ে যায় - তাতে কিন্তু নদীর বাইরে তরঙ্গের কোন অস্তিত্ব নেই। তরঙ্গের অস্তিত্ব নদীর অস্তিত্বের মতোই। কাজেই কোন কিছুকে তার মৌলিক অস্তিত্ব থেকে আলাদা করা যায় না ।

(২)ইত্তিহাদিয়াহ (ঐক্যবাদী): এ উপদল বিশ্বাস করে যে ,তারা আল্লাহতে একীভূত হয়ে আছে এবং আল্লাহও তাদের সাথে একীভূত হয়ে আছে। এরা আল্লাহকে আগুন হিসাবে ধরে নিয়ে নিজেদেরকে আগুনে পড়ে থাকা লোহা এবং আগুনে পোড়া লোহার গুণার্জিত বলে মনে করে। (৩)হুলুলিয়া (স্বরূপবাদী) : এ উপদল বিশ্বাস করে ,যারা আল্লাহকে জানার দাবি করে এবং যারা পূর্ণতা (ইনসানুল কামেল) অর্জন করেছে আল্লাহ্ তাদের স্বরূপ পরিগ্রহ করেন। এরা মনে করে পূর্ণতা প্রাপ্ত মানবদেহ আল্লাহর বাসস্থান। এধরনের পূর্ণমানব দৃশ্যত মানুষ কিন্তু বাস্তবে এরা আল্লাহ।

(৪)ওয়াসিলিয়াহ (মিলনবাদী) : এ উপদল নিজদেরকে আল্লাহর সাথে মিলিত বলে মনে করে। এরা বিশ্বাস করে শরিয়তের বিধি - বিধান মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক উন্নতির একটা উপায় মাত্র। মানব সত্তা যখন আল্লাহর সাথে মিলিত হয়ে যায়। তখন তার আর কোন পূর্ণতা বা উন্নতির প্রয়োজন হয়। না। ফলে ওয়াসিলিন '- এর জন্য ইবাদত ও অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। কারণ তারা মনে করে ,যখন সত্য ও বাস্তব সত্তা অর্জিত হয় তখন শরিয়তের বিধি - বিধান পালন করা অর্থহীন। ফলে তারা যা খুশি করতে পারে এবং সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে না।

(৫)জাররাকিয়াহ (প্রমোদবাদী) : এ উপদল মৌখিক ও বাদ্যযন্ত্রের সুরকে ইবাদত মনে করে। এরা দ্বারে দ্বারে গান গেয়ে ভিক্ষা করে এবং দরবেশি দেখিয়ে দুনিয়ার আনন্দ উপভোগ করে। এরা সর্বদা এদের নেতা সম্পর্কে বানোয়াট কাহিনী ও অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করে যাতে সাধারণ মানুষ বিস্ময়াভিভূত হয় ।

(৬)উশশাকিয়াহ (প্রেমবাদী বা ভাববাদী) : এ উপদলের মতবাদ হলো প্রেমের ব্যাকুলতাই মহাসত্য ও বাস্তব সত্তা অর্জনের একমাত্র উপায়। তারা মনে করে ,ইন্দ্রিয়গত প্রেম আল্লাহর প্রেম অর্জনের উপায়। আল্লাহর প্রেমের পর্যায়ে পৌছার জন্য কোন মানব সত্তার প্রতি প্রেমাসক্ত হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। কিন্তু যে প্রেমকে তারা ঐশীপ্রেম বলে মনে করে তা মানসিক বৈকল্য ছাড়া আর কিছু নয় এবং এসব কথার মূল উদ্দেশ্য হলো প্রিয়াকে ভোগ করা। এ ধরনের প্রেম মানুষকে পাপ ও অন্যায়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আল্লাহর প্রেমের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। একজন পারস্য কবি বলেছেনঃ

সত্যি বলতে কী ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেম জীনের মতো আর জীন থেকে কোন হেদায়েত লাভ করা যায়না।

(৭)তালকিনিয়াহ (অভিজ্ঞতাবাদী) : এ উপদলের মতে ধর্মীয় বিজ্ঞান ও বই - পুস্তক পড়া অবৈধ। বরঞ্চ সুফিদের কাছে আত্মিক উন্নতির জন্য এক ঘন্টা বসে চেষ্টা করলে যা পাওয়া যাবে তা সত্তর বছর বই পড়েও অর্জন করা যাবে না।

শিয়া আলেমদের মতে এ উপদলগুলো ভ্রান্ত পথে চলে গেছে। এরা ইসলামের সীমালঙ্ঘন করেছে। এবিষয়ে ইমামগণের অনেক বাণী রয়েছে। এ খুৎবায় আমিরুল মোমেনিন আসিম ইবনে জিয়াদের দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদকে শয়তানের কর্মকাণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন এবং এপথ থেকে দূরে থাকার জন্য জোর দিয়ে তাকে নির্দেশ দিয়েছেন (এ বিষয়ে অধিক জানতে হলে খুই ,১৩শ খণ্ড ,পৃঃ ১৩২ - ৪১৭ ;১৪শ খণ্ড ,পৃঃ ২ - ২২ পড়া যেতে পারে) ।

(উপর্যুক্ত টীকার সাথে বাংলা অনুবাদক দ্বীমত পোষণ করে। সুফি - দর্শনের মূল বিষয় সম্পর্কে টীকাকারের জ্ঞানের দৈন্যতার কারণে তিনি ধর্মের দর্শনকে ত্যাগ করে অনুষ্ঠানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সে কারণেই তিনি কোন বক ধার্মিকের চাল - চলন ও আচার - আচরণকে সুফি দর্শন বলে আখ্যায়িত করেছেন। শিয়া আলেমগণ ইসলামের দর্শন তথা আমিরুল মোমেনিনের মৌলিক দর্শন থেকে কতটুকু সরে গেছে তা সকলের জানা আছে। কারবালার মূল দর্শনের প্রতি কোনরূপ ভ্রক্ষেপ না করে তাজিয়া নিয়ে রাস্তায় মাতামাতি করে ইসলামের মৌলিক বিষয়ে কোন উন্নতি হচ্ছে কিনা তারাই বলতে পারেন। ইমাম আলী কর্তৃক প্রদর্শিত পথই হলো সুফি দর্শন। আসহাবুস সুফফাগণ রাসূলের (সা.) সময়কার সুফি । ইমাম আলী সুফি দর্শন ও আরবি ভাষার স্ট্যাণ্ডার্ড। তিনি সুফি দর্শনের আদি পুরুষ। কিন্তু টীকাকার বৈষ্ণববাদ ও সুফি দর্শনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। ইমাম আলীর সুফি দর্শন পরবর্তীতে বহু ইসলামি দার্শনিক বিভিন্নভাবে থিওরিবদ্ধ করেছেন ,যেমন - ইবনুল আরাবির সর্বেশ্বরবাদ ,জালালউদ্দিন রুমীর প্রেমবাদ ,মনসুর হাল্লাজের বিনাশনবাদ (আনাল হক) ,খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর প্রত্যক্ষণবাদ ,লালন শাহের ভাববাদ ইত্যাদি দার্শনিক ধারণা ও থিওরি বাদ দিয়ে টীকাকার ইসলামকে অনুষ্ঠান সর্বস্ব করে কুরআনিক দর্শন খর্ব করে দিতে চেয়েছেন। কুরআনের দর্শন ও আনুষ্ঠানিক ইবাদত - এ দুয়ের সামঞ্জস্য বিধানই হলো প্রকৃত ইসলামি জীবন। দর্শন বর্জিত ইবাদত যেমন রূঢ়তা ,ইবাদত বর্জিত দর্শনও তেমনি ফাঁপা চিন্তা মাত্র - বাংলা অনুবাদক) ।

খোৎবা - ২০৯

و قد سأله سائل عن أحاديث البدع و عما في أيدي الناس من اختلاف الخبر فقالعليه‌السلام:

إِنَّ فِي أَيْدِي اَلنَّاسِ حَقّاً وَ بَاطِلاً، وَ صِدْقاً وَ كَذِباً، وَ نَاسِخاً وَ مَنْسُوخاً، وَ عَامّاً وَ خَاصّاً، وَ مُحْكَماً وَ مُتَشَابِهاً، وَ حِفْظاً وَ وَهْماً. وَ لَقَدْ كُذِبَ عَلَى رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم عَلَى عَهْدِهِ، حَتَّى قَامَ خَطِيباً، فَقَالَ: «مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ اَلنَّارِ» . وَ إِنَّمَا أَتَاكَ بِالْحَدِيثِ أَرْبَعَةُ رِجَالٍ لَيْسَ لَهُمْ خَامِسٌ:

الاؤل - المنافقون

رَجُلٌ مُنَافِقٌ مُظْهِرٌ لِلْإِيمَانِ، مُتَصَنِّعٌ بِالْإِسْلاَمِ، لاَ يَتَأَثَّمُ وَ لاَ يَتَحَرَّجُ، يَكْذِبُ عَلَى رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مُتَعَمِّداً، فَلَوْ عَلِمَ اَلنَّاسُ أَنَّهُ مُنَافِقٌ كَاذِبٌ لَمْ يَقْبَلُوا مِنْهُ وَ لَمْ يُصَدِّقُوا قَوْلَهُ وَ لَكِنَّهُمْ قَالُوا: صَاحِبُ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم رَآهُ، وَ سَمِعَ مِنْهُ وَلَقِفَ عَنْهُ، فَيَأْخُذُونَ بِقَوْلِهِ، وَ قَدْ أَخْبَرَكَ اَللَّهُ عَنِ اَلْمُنَافِقِينَ بِمَا أَخْبَرَكَ، وَ وَصَفَهُمْ بِمَا وَصَفَهُمْ بِهِ لَكَ، ثُمَّ بَقُوا بَعْدَهُ، فَتَقَرَّبُوا إِلَى أَئِمَّةِ اَلضَّلاَلَةِ، وَ اَلدُّعَاةِ إِلَى اَلنَّارِ بِالزُّورِ وَ اَلْبُهْتَانِ، فَوَلَّوْهُمُ اَلْأَعْمَالَ، وَ جَعَلُوهُمْ(حملوهم) حُكَّاماً عَلَى رِقَابِ اَلنَّاسِ، فَأَكَلُوا بِهِمُ اَلدُّنْيَا، وَ إِنَّمَا اَلنَّاسُ مَعَ اَلْمُلُوكِ وَ اَلدُّنْيَا، إِلاَّ مَنْ عَصَمَ اَللَّهُ، فَهَذَا أَحَدُ اَلْأَرْبَعَةِ.

الثانی - المخطئون

وَ رَجُلٌ سَمِعَ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِ شَيْئاً لَمْ يَحْفَظْهُ عَلَى وَجْهِهِ، فَوَهِمَ فِيهِ، وَ لَمْ يَتَعَمَّدْ كَذِباً فَهُوَ فِي يَدَيْهِ، وَ يَرْوِيهِ وَ يَعْمَلُ بِهِ، وَ يَقُولُ: أَنَا سَمِعْتُهُ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم فَلَوْ عَلِمَ اَلْمُسْلِمُونَ أَنَّهُ وَهِمَ فِيهِ لَمْ يَقْبَلُوهُ مِنْهُ وَ لَوْ عَلِمَ هُوَ أَنَّهُ كَذَلِكَ لَرَفَضَهُ!

الثالث - الجاهلون بالحدیث

وَ رَجُلٌ ثَالِثٌ، سَمِعَ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم شَيْئاً يَأْمُرُ بِهِ، ثُمَّ إِنَّهُ نَهَى عَنْهُ، وَ هُوَ لاَ يَعْلَمُ، أَوْ سَمِعَهُ يَنْهَى عَنْ شَيْ‏ءٍ، ثُمَّ أَمَرَ بِهِ وَ هُوَ لاَ يَعْلَمُ، فَحَفِظَ اَلْمَنْسُوخَ، وَ لَمْ يَحْفَظِ اَلنَّاسِخَ، فَلَوْ عَلِمَ أَنَّهُ مَنْسُوخٌ لَرَفَضَهُ، وَ لَوْ عَلِمَ اَلْمُسْلِمُونَ إِذْ سَمِعُوهُ مِنْهُ أَنَّهُ مَنْسُوخٌ لَرَفَضُوهُ.

الرابع - الحفّاظ الصادقون

وَ آخَرُ رَابِعٌ، لَمْ يَكْذِبْ عَلَى اَللَّهِ، وَ لاَ عَلَى رَسُولِهِ، مُبْغِضٌ لِلْكَذِبِ خَوْفاً مِنَ اَللَّهِ، وَ تَعْظِيماً لِرَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم وَ لَمْ يَهِمْ، بَلْ حَفِظَ مَا سَمِعَ عَلَى وَجْهِهِ، فَجَاءَ بِهِ عَلَى مَا سَمِعَهُ، لَمْ يَزِدْ فِيهِ وَ لَمْ يَنْقُصْ مِنْهُ، فَهُوَ حَفِظَ اَلنَّاسِخَ فَعَمِلَ بِهِ، وَ حَفِظَ اَلْمَنْسُوخَ فَجَنَّبَ عَنْهُ، وَ عَرَفَ اَلْخَاصَّ وَ اَلْعَامَّ، وَ اَلْمُحْكَمَ وَ اَلْمُتَشَابِهَ، فَوَضَعَ كُلَّ شَيْ‏ءٍ مَوْضِعَهُ.

وَ قَدْ كَانَ يَكُونُ مِنْ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم اَلْكَلاَمُ لَهُ وَ جْهَانِ: فَكَلاَمٌ خَاصٌّ، وَ كَلاَمٌ عَامٌّ فَيَسْمَعُهُ مَنْ لاَ يَعْرِفُ مَا عَنَى اَللَّهُ،سُبْحَانَهُ بِهِ وَ لاَ مَا عَنَى رَسُولُ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم فَيَحْمِلُهُ اَلسَّامِعُ، وَ يُوَجِّهُهُ عَلَى غَيْرِ مَعْرِفَةٍ بِمَعْنَاهُ، وَ مَا قُصِدَ بِهِ، وَ مَا خَرَجَ مِنْ أَجْلِهِ. وَ لَيْسَ كُلُّ أَصْحَابِ رَسُولِ اَللَّهِصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم مَنْ كَانَ يَسْأَلُهُ وَ يَسْتَفْهِمُهُ، حَتَّى إِنْ كَانُوا لَيُحِبُّونَ أَنْ يَجِي‏ءَ اَلْأَعْرَابِيُّ وَ اَلطَّارِئُ، فَيَسْأَلَهُعليه‌السلام حَتَّى يَسْمَعُوا، وَ كَانَ لاَ يَمُرُّ بِي مِنْ ذَلِكَ شَيْ‏ءٌ إِلاَّ سَأَلْتُهُ عَنْهُ وَ حَفِظْتُهُ فَهَذِهِ وُجُوهُ مَا عَلَيْهِ اَلنَّاسُ فِي اِخْتِلاَفِهِمْ، وَ عِلَلِهِمْ فِي رِوَايَاتِهِمْ.

হাদিসে পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের কারণ ও রাবিদের প্রকারভেদ সম্পর্কে

কেউ একজন বানোয়াট হাদিস ও মানুষের মধ্যে প্রচলিত রাসূলের (সা.) পরস্পর বিরোধী বক্তব্য সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ

নিশ্চয়ই ,আজ মানুষের মাঝে যা প্রচলিত আছে তাতে সত্য ও মিথ্যা এবং শুদ্ধ ও অশুদ্ধের সংমিশ্রণ রয়েছে। এ সবের কিছু কিছু বাতিল যোগ্য এবং কিছু কিছু বাতিলকৃত ;কিছু কিছু সাধারণ ও কিছু কিছু বিশেষ ;কিছু কিছু নির্দিষ্ট ও কিছু কিছু অনির্দিষ্ট ;কিছু কিছু অবিকল ও কিছু কিছু অনুমান আশ্রিত। এমনকি রাসূলের (সা.) জীবৎকালেও তার নামে মিথ্যা বক্তব্য চালানো হয়েছিল। সে জন্য তিনি বলেছিলেন , যে ব্যক্তি আমার নাম দিয়ে কোন মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয় সে নিজের জন্য দোযখে স্থায়ী আবাস তৈরি করে। ” যারা হাদিস বর্ণনা করে তারা চার শ্রেণির বেশি নয়।

প্রথমঃ মিথ্যাবাদী ও মোনাফিক

মোনাফিক সে ব্যক্তি যে ইমানের ভান করে এবং বাহ্যিক আবরণে ও অবয়বে মুসলিমের ভাব দেখায়। এরা পাপে লিপ্ত হতে কোন দ্বিধা করে না এবং পাপ থেকে দূরে সরে থাকার চেষ্টাও করে না। এরা ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহর নবীর নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলে। মানুষ যদি জানতে পারতো যে ,এরা মোনাফিক ও মিথ্যাবাদী তাহলে কখনো তাদের কথা গ্রহণ করতো না এবং এদের কথা বিশ্বাস করতো না। বরং মানুষ মনে করে এরা আল্লাহর নবীর সাহাবি ,তাঁর দেখা পেয়েছে ,তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী শুনেছে এবং তার কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেছে। এ কারণে মানুষ তাদের কথা গ্রহণ করে। মহিমান্বিত আল্লাহ মোনাফিক সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন এবং তাদের সম্পর্কে তোমাদের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। রাসূলের (সা.) পরে তারা তাদের মিথ্যার বেসাতি চালিয়ে যাচ্ছে। গোমরাহির নেতা ও মিথ্যার মাধ্যমে দোযখের দিকে আহবানকারীদের কাছে তারা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে। সুতরাং তারা এদের উচ্চপদে আসীন করেছে ;অফিসার বানিয়ে জনগণের মাথার ওপর বসিয়েছে এবং এদের মাধ্যমে সম্পদ স্তুপীকৃত করেছে। আল্লাহ যাদের রক্ষা করেন তারা ছাড়া সকল মানুষ শাসকদের পিছনে ও দুনিয়ার পিছনে থাকে।

দ্বিতীয়ঃ যারা ভুল করে

কিছু কিছু লোক আছে যারা রাসূলের (সা.) মুখনিঃসৃত বানী শুনেছে কিন্তু তা অবিকল মনে রাখতে পারেনি। এরা রাসূলের (সা.) বাণীকে সংক্ষিপ্তাকারে নিজের থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে অনুমানভিত্তিক কথা বলে। এরা ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলে না। এরা যেভাবে হাদিস বর্ণনা করে সেভাবে আমলও করে এবং দাবি করে , আমি আল্লাহর নবীর মুখে একথা শুনেছি। ” যদি মানুষ জানতে পারতো যে ,এদের বর্ণনায় ভুল রয়েছে তাহলে কেউ তা গ্রহণ করতো না। এমনকি এরা নিজেরাও যদি বুঝতে পারতো যে ,এরা ভুল বর্ণনা করছে। তবে এরা নিজেরা তা পরিত্যাগ করতো।

তৃতীয়ঃ যারা অজ্ঞ

এরা এমন লোক যারা হয়ত শুনেছে রাসূল (সা.) কোন কিছু করতে বলেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে হয়ত রাসূল (সা.) সে কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন - এরা তা শোনে নি। আবার ,হয়ত রাসূল (সা.) কোন কিছু করতে বারণ করেছেন - এরা তা শুনেছে। কিন্তু পরবর্তীতে হয়ত তিনি তা করার অনুমতি দিয়েছেন - এরা তা শোনে নি। এরা যেটুকু আংশিক শুনেছে সেটুকু বর্ণনা করে। এতে প্রকৃত অবস্থার বিপরীত হয়ে যায়। আবার অনেক সময় এরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে রাসূলের বক্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ বা ব্যাখ্যা বুঝতে পারেনি - এমনকি রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞেস করেও অন্তর্নিহিত ভাব জেনে নেয়নি। নিজেরা যেভাবে বুঝেছে সেভাবে বর্ণনা করছে। যদি মুসলিমগণ এদের অজ্ঞতার বিষয় জানতে পারতো। তাহলে তারা এদের বর্ণনা গ্রহণ করতো না ।

চতুর্থঃ যারা সত্যিকারভাবে অবিকল মনে রাখতে পেরেছে

এ ধরনের লোক কখনো আল্লাহ ও রাসূলের বাণী সম্পর্কে কোন মিথ্যা কথা বলে না। আল্লাহর ভয়ে এরা মিথ্যাকে ঘৃণা করে এবং আল্লাহর নবীকে সম্মান করে। এরা ভুল করে না এবং রাসূলের কাছে যা শুনেছে তা অবিকল মনে রাখে। এরা যা শুনেছে তাতে কোন কিছু সংযোজন ও বিয়োজন না করে অবিকল বর্ণনা করে। রাসূল (সা.) যেভাবে বলেছেন। এরা সেভাবেই আমল করে। যখন কিছু করতে বলেছেন তখন সেভাবে করেছে। আবার যখন নিষেধ করেছেন আমনি তা পরিত্যাগ করেছে। এরা রাসূলের কথার সাধারণ ও বিশেষ অর্থ বুঝতে পেরেছে এবং যথোপযুক্ত গুরুত্বসহকারে রাসূলের কথার সুনির্দিষ্ট ও অনির্দিষ্ট ভাবে জানতে পেরেছে।

রাসূলের বাণীর দুভাবে অর্থ করা যায় - একটি হলো বিশেষ বা গুঢ়ার্থবোধক এবং অপরটি হলো সাধারণ বা ভাষার্থবোধক। কখনো কখনো এমন হয়েছে যে ,একজন লোক রাসূলের বাণী শুনেছে কিন্তু এতে মহিমান্বিত আল্লাহ ও তার রাসূল কী বুঝাতে চেয়েছেন সে শ্রোতা তা বুঝতে পারেনি। ফলে এ ধরনের শ্রোতা তাঁর বাণী মনে রেখেছে বটে ,কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ কী বা একথা বলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ও কারণ বুঝতে পারেনি। আল্লাহর নবীর সাহাবাগণের মধ্যে অনেকেই তাকে প্রশ্ন করে বা জিজ্ঞেস করে তাঁর কাছ থেকে কোন কিছুর অর্থ জেনে নেয়ায় অভ্যস্ত ছিলনা। কোন বেদুইন বা আগন্তুক এসে তাকে প্রশ্ন করবে এবং তাতে তারা মনে করতো তারাও শুনে অর্থ জেনে নিতে পারবে। আমি এরূপ বিষয় তাকে জিজ্ঞেস করে প্রকৃত অর্থ জেনে নিতাম এবং তা সংরক্ষণ করতাম। হাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতের কারণই এগুলো ।

____________________

১। এ লোকটির নাম হলো সুলায়েম ইবনে কায়েস আল - হিলালী। ইনি আমিরুল মোমেনিনের মাধ্যমে হাদিস বর্ণনা করতেন ।

২। এ খোৎবায় আমিরুল মোমেনিন হাদিসের রাবিগণকে চার শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেনঃ

প্রথম শ্রেণি হলো - যারা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করে রাসূলের নামে চালিয়ে দিয়েছে। একথা অস্বীকার করার কোন জো নেই যে ,রাসূলের (সা.) সহী হাদিস যখন প্রকাশ পেতে লাগলো তখন বিভিন্ন দল তাদের স্বার্থে মিথ্যা হাদিস রাসূলের নামে চালিয়ে দিয়েছিল। এ কথা কেউ অস্বীকার করলে সে তা জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় - শুধু তর্কের খাতিরে অস্বীকার করবে। একবার আলামুল হুদা সাঈদ মুরতাজা কিছু সংখ্যক সুন্নি উলামার সাথে তর্কে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সাঈদ মুরতাজা ঐতিহাসিক ঘটনাবলী বর্ণনা করে প্রমাণ করলেন যে ,সাহাবাগণের মর্যাদা সম্পর্কে প্রচলিত হাদিসগুলোর সব ক ’ টি বানোয়াট ও মিথ্যা। সুন্নি উলামাগণ যুক্তি দেখালেন যে ,কেউ মিথ্যা হাদিস রচনা করে রাসূলের নামে চালিয়ে দেয়ার সাহস করবে একথা অবিশ্বাস্য ও অসম্ভব। তখন সাঈদ মুরতাজা একটা সহী হাদিসের কথা উল্লেখ করে বলেন যে ,রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

আমার মৃত্যুর পর আমার নামে অসংখ্য মিথ্যা বিষয় প্রচলিত হবে এবং যে কেউ আমার নাম দিয়ে মিথ্যা প্রচার করবে। সে দোষাখে নিজ আবাস তৈরি করবে। (বুখারী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৮ ;২য় খণ্ড ,পৃঃ১০২ ; ৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ২০৭ ,৮ম খণ্ড ,পৃঃ ৫৪ ;নিশাবুরী ,৮ম খণ্ড ,পৃঃ ২২৯ আশাছ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩১৯ - ৩২০ তিরমিয়ী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৫২৪ ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৫ - ৩৬ ,৪০ ,১৯৯ ,৬৩৪ ;মাযাহ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৩ - ১৫) ।

যদি কেউ মনে করে এ হাদিসটি সত্য তা হলে সে অবশ্যই একমত হবে যে ,রাসূলের (সা.) নামে অনেক মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয়া হয়েছে। আবার যদি কেউ মনে করে এ হাদিসটি মিথ্যা তাহলে রাসূলের (সা.) নামে মিথ্যা বিষয় চালিয়ে দেয়ার প্রমাণ এ হাদিসটিই বহন করে। যাহোক ,যাদের হৃদয় ছিল মুনাফেকিতে পরিপূর্ণ ,যারা দ্বীনে ফেতনা ও বিভেদ সৃষ্টি করে দুর্বল ইমান সম্পন্ন মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য দলে ভিড়িয়েছিল তারাই রাসূলের নামে মিথ্যা হাদিস রচনা করেছিল। এ ধরনের লোক রাসূলের জীবদ্দশায়ও ছিল যারা মোমিনগণের সাথেই মিশে থাকতো এবং সারাক্ষণ মুসলিমের অকল্যাণ ও ক্ষতির চিন্তায় ব্যস্ত থাকতো। রাসূলের ইনতিকালের পর এ ধরনের লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে গিয়েছিল এবং অসৎ কর্মতৎপরতায় তারা আরো মনোযোগী হয়ে পড়েছিল। এরা ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শে নানা প্রকার বিকৃতি ও পরিবর্তন করতে দ্বিধা করতো না। কারণ রাসূলের জীবদ্দশায় তারা কিছুটা ভয়ে থাকতো পাছে তিনি তাদের মোনাফেকি ফাঁস করে দিয়ে লজ্জায় ফেলে দেন ;কিন্তু রাসূলের পর তাদের সে ভয় কেটে গেছে। বিভিন্নভাবে এরা ক্ষমতাধর হয়ে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য এ রকম মোনাফেকি করার পরও জনগণ তাদেরকে অবিশ্বাস করতো না। কারণ তারা দাবি করতো যে ,তারা রাসূলের সাহাবা এবং যা বলে তা সত্য ও সঠিক। এরাই নিজেদের জন্য হাদিস বানিয়ে নিল - রাসূলের সাহাবাগণ যে কোন প্রকার সমালোচনা ও প্রশ্নের উর্দ্ধে ;তাদের কোন কাজের আলোচনা - পর্যালোচনা করা যাবে না এবং তাদের কাজের তিরস্কার করা যাবে না। ” আমিরুল মোমেনিন। এহেন উক্তির মুখ থুবড়ে দিয়ে বলেনঃ

এসব লোক গোমরাহির নেতার কাছে মর্যাদা লাভ করেছে এবং এরা মিথ্যা ও অপবাদের মাধ্যমে দোষখের দিকে আহ্বানকারী । সুতরাং এসব নেতারা মোনাফেকদেরকে উচ্চপদে আসীন করে জনগণের মাথার ওপর বসিয়ে দিয়েছিল ।

মোনাফিকগণ ইসলামের ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি সম্পদ স্তুপীকৃত করেছিল। মুসলিমের মুখোশ পরে তারা যথেচ্ছভাবে বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলীতে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করেছিলো। ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেনঃ

যখন তারা যথেচ্ছভাবে চলার সুযোগ পেল তখন তারা ইসলামের অনেক কিছু পরিত্যাগ করেছিলো । যখন মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতো তখন তারাও ইসলাম সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতো । কিন্তু তারা তলে তলে মিথ্যার জাল বুনায় তৎপর থাকতো যা আমিরুল মোমেনিন। পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন । এ সব লোক রাসূলের হাদিসে অনেক মিথ্যার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে - যাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের ইমানে ফাটল ধরিয়ে গোমরাহির দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া । অপরপক্ষে এদের কারো কারো লক্ষ্য ছিল কোন বিশেষ দলের উচ্চ প্রশংসা করা - যাদের সঙ্গে এদের জাগতিক বিষয়াবলীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ছিল ।

এ সময় অতিবাহিত হবার পর যখন মুয়াবিয়া ধর্মের নেতৃত্ব ও ইহকালীন কর্তৃত্বের সিংহাসন দখল করেছিলো তখন সে মিথ্যা হাদিস রচনা করে তাতে জনমত গঠন করার জন্য একটা সরকারি বিভাগ খুলেছিলো। সে তার অফিসারদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল যেন তারা আহলে বাইতের মর্যাদাহানিকর হাদীস রচনা করে তা জনপ্রিয় করে তোলে। একই সাথে সে আদেশ দিয়েছিল যেন তারা (অফিসারগণ) উসমান ও উমাইয়াদের উচ্চকিত প্রশংসা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। এ কাজের জন্য সে পুরস্কার ঘোষণা করে এবং জমি বরাদ্দ দেয়। ফলে হাদিস গ্রন্থগুলোতে অসংখ্য স্বঘোষিত বানোয়াট বক্তব্য স্থান লাভ করে । আবুল হাসান আল মাদায়নীর "কিতাবুল আহদাছ" হতে ইবনে আবিল হাদীদ উদ্ধৃত করেছেনঃ

মুয়াবিয়া তার অফিসারদের কাছে লিখেছিল যে ,তারা যেন সেসব লোকের প্রতি বিশেষ যত্নশীল থাকে যারা উসমানের কথা বলে ,তার শুভাকাঙ্খী ও তাকে ভালোবাসে । যারা উসমানের উচ্চ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করে তাদেরকে যেন বিশেষ পদমর্যাদা ও সন্মান প্রদান করা হয় এবং রাবির নাম ,পিতার নাম ও গোত্র পরিচয়সহ যেন হাদিসটি তার কাছে প্রেরণ করা হয় । মুয়াবিয়া কর্তৃক প্রদত্ত সরকারি মর্যাদা ,জমি ,পোষাক ও নানাবিধি পুরস্কারের ফলে উসমানের প্রশংসাসূচক হাদিস স্তুপীকৃত হয়ে গেল ।

উসমানের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কীয় এসব বানোয়াট হাদিস যখন রাজ্যময় ছড়িয়ে দেয়া হলো তখন পূর্ববর্তী খলিফাদের মর্যাদা যাতে ক্ষুন্ন না হয় সে জন্য মুয়াবিয়া তার অফিসারদের লিখেছিল -

আমার এ আদেশ পাওয়া মাত্র তোমরা জনগণকে বলো যেন তারা সাহাবাগণ ও অন্য খলিফাদের প্রশংসাসূচক হাদিস তৈরি করে এবং সাবধান থেকো ,যদি কোন লোক আবু তুরাব (আলী) সম্পর্কে কোন হাদিস বলে। তবে তোমরাও অন্য সাহাবাগণ সম্বন্ধে অনুরূপ হাদিস রচনা করো । মনে রেখো ,এতে আমি আনন্দিত হবো এবং আমার চক্ষু শীতল হবে । এতে আবু তুরাব ও তার দলের মর্যাদা ক্ষীণ হয়ে পড়বে এবং উসমান বিশেষভাবে মর্যাদাশীল হবে ।

মুয়াবিয়ার এ পত্রের বিষয় জনগণকে জানানোর পর সাহাবাগণের উচ্চসিত প্রশংসাসূচক অসংখ্য বানোয়াট হাদিস লোকেরা বর্ণনা করেছিল ,সত্যের সাথে যেগুলোর কোন সংশ্রব ছিল না (হাদীদ ,১১শ খণ্ড ,পৃঃ৪৩ - ৪৭)

এ বিষয়ে প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আবু আবদুল্লাহ ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আরাফাহ (ডাক নাম নিফতাওয়াহ - হিঃ ২৪৪ - ৩২৩ সন) - এর উক্তি হাদীদ উদ্ধৃত করেছেনঃ

সাহাবাদের মর্যাদা সম্পর্কিত অধিকাংশ মিথ্যা হাদিস মুয়াবিয়ার সময় রচিত হয়েছিল । এসব বানোয়াট হাদিস দ্বারা সে জনগণের কাছে মর্যাদা লাভে কৃতকার্য হয়েছিল । তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বনি হাশিমকে অমর্যাদাকর ও হেয় করে দেখানো (প্রাগুপ্ত)

এরপর মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। দুনিয়াদারগণ রাজাবাদশাহদের কাছে মর্যাদা পাওয়া ও ঐশ্বর্য অর্জনের উপায় হিসাবে হাদিস বর্ণনাকে বেছে নিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ - হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে আব্বাসিয় খলিফা আল - মাহদী ইবনে আল - মনসুরকে খুশি করে মর্যাদা লাভের আশায় গিয়াস ইবনে ইব্রাহীম আন - নাখাই কবুতর উড়িয়ে দেয়া সম্পর্কে একটা বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করেছিল। (বাগদাদী ,১২শ খণ্ড ,পৃঃ ৩২৩ - ৩২৭ ;জাহাবি ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৩৭ - ৩৩৮ ;আসকালানী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৪২২) । আবু সাঈদ মাদায়নী ও অন্যান্যরা বানোয়াট হাদিস বর্ণনাকে জীবিকা উপার্জনের উপায় হিসাবে বেছে নিয়েছিল। এসময় সীমালঙ্ঘনের পর্যায় এতদূর গিয়েছিল যে ,কাররামিয়াহ ও কতিপয় মুতাসাওয়াফাহ ফতোয়া জারি করে বলেছিল - পাপ থেকে বিরত রাখার জন্য অথবা আনুগত্যের প্রতি প্রলুব্ধ করার জন্য মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা জায়েজ | এ ফতোয়ার ফলে প্রকাশ্যে যথেচ্ছভাবে হাদিস বর্ণনা শুরু হয়ে গেল এবং একে নৈতিক ও ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থী মনে করা হতো না। বরং যাদেরকে বাহ্যিক আচার - আচরণে পরহেজগার বলে মনে করা হতো এবং যারা সারাদিন নামাজরত থাকতো তারা সারারাত বিভিন্ন বানোয়াট হাদিস লিখে তাদের খাতা - পত্র ভরে ফেলতো। এধরনের বানোয়াট হাদিসের সংখ্যা বিষয়ে কতিপয় ঘটনা থেকে অনুমান করা যাবে। ছয় লক্ষ হাদিস থেকে বুখারী মাত্র দুই হাজার সাত শত একষট্টিটি হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ৮ ;কস্তালানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৮ ;হাম্বলী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ১৪৩) । মুসলিম তিন লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র চার হাজার হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,১৩শ খণ্ড ,পৃঃ ১০১ ;হাম্বলী ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৩২ ;জাহাবি ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৫১ ,১৫৭ ;খাল্লিকান ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ১৯৪) । আবু দাউদ পাঁচ লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র চার হাজার আট শত হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,৯ম খণ্ড ,পৃঃ ৫৭ ;জাহাবি ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৫৪ ;হাম্বলী ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৯৭ ;খাল্লিকান ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ৪০৪) । আহম্মদ ইবনে হাম্বল প্রায় দশ লক্ষ হাদিস থেকে মাত্র ত্রিশ হাজার হাদিস গ্রহণ করেছিলেন (বাগদাদী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৪১৯ - ৪২০ ;হাম্বলী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৭ ;খাল্লিকান ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৬৪ ;আসকালানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৭৪) । এসব বাছাইকৃত হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু কিছু মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস যে এসে পড়েনি। সে কথা নিশ্চত করে বলা যায় না। এ বিষয়ে আরো অধিক জানতে হলে আল - গাদির (আমিনী) গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২০৮ - ৩৭৮ পৃষ্ঠা পড়ার সুপারিশ করা গেল ।

দ্বিতীয় প্রকার রাবি হলো - যারা বিষয় বা উপলক্ষ বিবেচনা না করে শুদ্ধ - অশুদ্ধ যা কিছু মনে ছিল তাই বর্ণনা করেছে। উদাহরণ স্বরূপ - খলিফা উমর যখন আহত হলেন তখন সুহায়েব তার কাছে এসে কাঁদতে লাগলো। এতে উমর বললেনঃ

হে সুহায়েব ,তুমি আমার জন্য কাঁদছো। অথচ রাসূল (সা.) বলেছেন যে ,মৃত ব্যক্তির লোকেরা তার জন্য কান্নাকাটি করলে তার (মৃতব্যক্তির) শাস্তি হয় (বুখারী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১০০:১০২. নিশাবুরী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৪১ - ৪৫ তিরমিয়ী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩২৭ - ৩২৯ ;নাসাঈ ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ১৮ ;মাযাহ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৫০৮ - ৫০৯: আনাস ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৩৪ ,শাফী ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ২৬৬ আশাছ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১৯৪ ; হাম্বল ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৪১ ও ৪২ ;শাফী ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ৭২ - ৭৪)

খলিফা উমরের মৃত্যুর পর আয়শা ,কাঁদছিলেন। তখন তাকে উমরের বর্ণিত উক্ত হাদিস বলা হলে তিনি বললেনঃ আল্লাহ উমরকে মাফ করুন । আত্নীয় - স্বজন কাঁদলে মৃতের শাস্তি হয় আল্লাহর নবী এমন কথা বলেননি।

এরপর তিনি বলেন যেখানে কুরআন বলেছে একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না সেখানে কী করে জীবিতের কান্নার জন্য মৃত শাস্তি পেতে পারে! এরপর তিনি কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করলেনঃ

কারো পাপের বোঝা অন্য কেউ বহন করবে না। (কুরআন - ৬:১৬৪ ,১৭:১৫ ,৩৫:১৮ ,৩৯:৭ ,৫৩:৩৮)

তারপর আয়শা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন যে ,একদিন রাসূল (সা.) এক ইহুদি মহিলার কবরের পাশ দিয়ে যেতে দেখেন তাঁর আত্মীয় - স্বজন তার জন্য কান্নাকাটি করছে। তখন রাসূল (সা.) বলেছিলেন , তার লোকেরা তার জন্য কাঁদছে। অথচ কবরে তার শাস্তি চলছে। ” রাসূলের (সা.) এ কথার অর্থ এ নয় যে ,আত্মীয়স্বজনের কান্নার জন্য তার শাস্তি হচ্ছে। বরং তিনি বুঝাতে চেয়েছেন কৃতকর্মের শাস্তির জন্য আত্মীয় - স্বজনের কান্না কোন কাজে আসছে না।

তৃতীয় প্রকার রাবি হলো - যারা রাসূলের (সা.) কাছ থেকে এমন কিছু শুনেছে যা হয়ত পরবর্তীকালে রদ হয়ে গেছে। কিন্তু রাসূল (সা.) কর্তৃক এহেন রদ করার বিষয়টি শোনার সৌভাগ্য এদের হয়নি বলে এরা সে বিষয়ে অনবহিত। উদাহরণ স্বরূপ - রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

কবর জেয়ারত করতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু এখন তোমরা তা করতে পার (নিশাবুরী) ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৬৫ ,তিরমিয়ী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৭০ আশাছ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ২১৮ ও ৩৩২: নাসাঈ ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৮৯ ;মাযাহ ,পৃঃ ৫০০ - ৫০১: আনাস ,২য় খণ্ড ,পৃঃ৪৮৫ ;হাম্বল ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৪৫ ,৪৫২ ;৩য় খণ্ড ,পৃঃ৩৮ ,৬৩ ,৬৬ ,২৩৭ ও ৩৫০ ;৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৫০ ,৩৫৫ ,৩৫৬ ,৩৫৭ ,৩৫৯ ও ৩৬১ ;নিশাবুরী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৭৪ - ৩৭৬)

এ হাদিস থেকে বুঝা যায় যে ,রাসূল (সা.) কোন এক সময়ে কবর জেয়ারত করতে নিষেধ করেছিলেন। এ হাদিস দ্বারা সেই নিষেধাজ্ঞা রদ করেছেন। কিন্তু যারা এ হাদিসটি শোনেনি তারা পূর্বের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করেছে এবং সেটাই প্রচার করে বেড়াচ্ছে।

চতুর্থ প্রকার রাবি হলো - যারা ন্যায়নীতি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল এবং যাদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা রয়েছে। তারা হাদিসের উপলক্ষ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত এবং তারা বাতিলকৃত হাদিস ও তারস্থলে প্রতিস্থাপিত হাদিস সম্পর্কে অবহিত। তারা সাধারণ (আম) ও বিশেষ (খাস) ভাবধারা ও হাদিসের স্থান ,কাল ও পাত্র বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। তারা কোন প্রকার বাড়াবাড়ি ,মিথ্যা ,অতিরঞ্জন ও বানোয়াট কথার ধার ধারেনি। তারা যাকিছু শুনেছে তাদের স্মৃতিতে তা অবিকল ধারণ করে রেখেছে এবং সামান্যতম পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ অবিকলতা রক্ষা করে তা মানুষের কাছে বর্ণনা করেছে। এদের বর্ণিত হাদিসই ইসলামের অমূল্য সম্পদ এবং এ ধরনের হাদিস অনুযায়ী আমল করতেই হবে। এ ধরনের হাদিসগুলোর মধ্যে আমিরুল মোমেনিন কর্তৃক বর্ণিত হাদিসগুলো প্রধান। জ্ঞানমার্গে আমিরুল মোমেনিনের অবস্থান রাসূলের (সা.) নিম্নের হাদিসগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়। আমিরুল মোমেনিন ,জাবির ইবনে আবদুল্লাহ ,ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত আছে যে ,রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

আমি জ্ঞানের মহানগরী এবং আলী তার দরজা । যে কেউ আমার জ্ঞান অর্জন করতে চায় তাকে অবশ্যই এ দরজার মধ্য দিয়ে আসতে হবে (নিশাবুরী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১২৬ - ১২৭ ;বার ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১১০২. আছীর ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ২২: বাগদাদী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ৩৭৭ ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৩৪৮ ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ১৭২ ;১১শ খণ্ড ,পৃঃ ৪৮ - ৫০ ;জাহাবি ,৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ২৮ ,শাফী ,৯ম খণ্ড ,পৃঃ ১১৪. আসকালানী ,৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ৩২০ ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৩৭ ;আসকালানী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১২২ - ১২৩ সুয়ুতী ,পৃঃ ১৭০: হিন্দি. ৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ১৫২ ,১৫৬ ও ৪০১. হানাফী ,৭ম খণ্ড ,পৃঃ ৬৩১: জুরকানী ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ১৪৩) |

আমিরুল মোমেনিন ও ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে যে ,রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

আমি প্রজ্ঞার মহাভাণ্ডার এবং আলী তার দরজা । যদি কেউ প্রজ্ঞাবান হতে চায়। তবে তাকে এ দরজা দিয়েই আসতে হবে (ইসফাহানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৬৪. শাফী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ২৭৫ ;বাগদাদী ,১১শ খণ্ড ,পৃঃ ২০৪: হিন্দি ,৬ষ্ঠ খণ্ড ,পৃঃ ৪০১. শাফী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১৯৩)

এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে ,রাসূলের (সা.) জ্ঞান সাগরে পাড়ি দিয়ে তাঁর অনুকম্পা লাভ করার উপায় হচ্ছে আহলে বাইতের মাধ্যমে প্রবাহিত ধারা অনুসরণ করা। আর মানুষ যদি তা করতো। তবে তা কতই না উত্তম হতো। কিন্তু ইতিহাসের এক বিষাদময় অধ্যায় হলো - আহলে বাইতের শক্রগণের বর্ণিত হাদিস ক্ষমতাসীনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে। অথচ রাবিদের নামের তালিকায় যখনই কোন আহলে বাইতের সদস্যের নামোল্লেখ করা হয়েছে আমনি সে হাদিস বাতিল করে দেয়া হয়েছে।

খোৎবা - ২১০

عجائب الخلقة

وَ كَانَ مِنِ اِقْتِدَارِ جَبَرُوتِهِ، وَ بَدِيعِ لَطَائِفِ صَنْعَتِهِ، أَنْ جَعَلَ مِنْ مَاءِ اَلْبَحْرِ اَلزَّاخِرِ اَلْمُتَرَاكِمِ اَلْمُتَقَاصِفِ، يَبَساً جَامِداً، ثُمَّ فَطَرَ مِنْهُ أَطْبَاقاً، فَفَتَقَهَا سَبْعَ سَمَاوَاتٍ بَعْدَ اِرْتِتَاقِهَا، فَاسْتَمْسَكَتْ بِأَمْرِهِ، وَ قَامَتْ عَلَى حَدِّهِ وَ أَرْسَى أَرْضاً يَحْمِلُهَا اَلْأَخْضَرُ اَلْمُثْعَنْجِرُ، وَ اَلْقَمْقَامُ اَلْمُسَخَّرُ(المسجّر) ، قَدْ ذَلَّ لِأَمْرِهِ وَ أَذْعَنَ لِهَيْبَتِهِ، وَ وَقَفَ اَلْجَارِي مِنْهُ لِخَشْيَتِهِ. وَ جَبَلَ جَلاَمِيدَهَا، وَ نُشُوزَ مُتُونِهَا وَ أَطْوَادِهَا، فَأَرْسَاهَا فِي مَرَاسِيهَا، وَ أَلْزَمَهَا قَرَارَاتِهَا، فَمَضَتْ رُؤُوسُهَا فِي اَلْهَوَاءِ، وَ رَسَتْ أُصُولُهَا فِي اَلْمَاءِ، فَأَنْهَدَ جِبَالَهَا عَنْ سُهُولِهَا، وَ أَسَاخَ قَوَاعِدَهَا فِي مُتُونِ أَقْطَارِهَا وَ مَوَاضِعِ أَنْصَابِهَا، فَأَشْهَقَ قِلاَلَهَا، وَ أَطَالَ أَنْشَازَهَا، وَ جَعَلَهَا لِلْأَرْضِ عِمَاداً، وَ أَرَّزَهَا فِيهَا أَوْتَاداً، فَسَكَنَتْ عَلَى حَرَكَتِهَا مِنْ أَنْ تَمِيدَ بِأَهْلِهَا، أَوْ تَسِيخَ بِحِمْلِهَا، أَوْ تَزُولَ عَنْ مَوَاضِعِهَا. فَسُبْحَانَ مَنْ أَمْسَكَهَا بَعْدَ مَوَجَانِ مِيَاهِهَا، وَ أَجْمَدَهَا بَعْدَ رُطُوبَةِ أَكْنَافِهَا، فَجَعَلَهَا لِخَلْقِهِ مِهَاداً، وَ بَسَطَهَا لَهُمْ فِرَاشاً! فَوْقَ بَحْرٍ لُجِّيٍّ رَاكِدٍ لاَ يَجْرِي، وَ قَائِمٍ لاَ يَسْرِي، تُكَرْكِرُهُ اَلرِّيَاحُ اَلْعَوَاصِفُ، وَ تَمْخُضُهُ اَلْغَمَامُ اَلذَّوَارِفُ؛( إِنَّ فِي ذلِكَ لَعِبْرَةً لِمَنْ يَخْشى) .

সৃষ্টি জগতের বিস্ময়

আল্লাহ্ তাঁর মহান কুদরত ও সূক্ষ্ম সৃজনি শক্তি দ্বারা অথৈ ,ঘন ও উচ্চণ্ড পানি থেকে শক্ত শুষ্ক মাটি তৈরি করলেন। তারপর তিনি তার স্তর বিন্যাস করলেন এবং একত্রিত হয়ে জোড়া লাগার পর তাকে সপ্ত আকাশে বিভক্ত করলেন। সুতরাং তাঁর আদেশে তা স্থির হয়ে গেল এবং তাঁর নির্ধারিত সীমায় তা আবদ্ধ হয়ে গেল। তিনি পৃথিবীকে এরূপে তৈরি করলেন যে ,তা গাঢ় নীল ,পরিবেষ্টিত ও আলম্বিত পানি থেকে জন্ম নিল যা তার আদেশের প্রতি অনুগত এবং যখন তাঁর ভয়ে প্রবাহ থেমে গেল তখন তার সম্মানে অবনত হয়ে রইলো ।

তিনি উচু পাহাড় ,শক্ত পাথর ও সুউচ্চ পর্বতমালা সৃষ্টি করেছেন। তিনি এগুলোকে যথাস্থানে স্থাপন করলেন এবং স্থির করে রাখলেন। এদের চূড়া আকাশে উঠে গেল এবং মূল পানিতে রয়ে গেল। এভাবে তিনি পর্বতকে সমতল ভূমির ওপরে তুলে দিলেন এবং এদের ভিত্তি বিশাল বিস্তারে এঁটে দিলেন যেখানে এরা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি এসব পাহাড়ের চূড়াকে সুউচ্চ করেছেন এবং এদের বিস্তৃতি বিশাল করেছেন। তিনি এগুলোকে পৃথিবীর জন্য স্তম্ভ স্বরূপ করেছেন এবং পেরেকের মতো আটকিয়ে দিয়েছেন। ফলে পৃথিবী স্থির হয়েছে ;অন্যথায় পৃথিবী এর অধিবাসীদেরকে নিয়ে বক্র হয়ে যেত অথবা নিজ ভারে নিচের দিকে তলিয়ে যেত অথবা স্বীয় অবস্থান থেকে সরে পড়তো ।

সুতরাং তিনিই মহিমান্বিত যিনি পানির প্রবাহের পর তা বন্ধ করে দিয়েছেন এবং এর পার্শ্বদেশ জলাকীর্ণ অবস্থার পর তাকে শক্ত করে দিয়েছেন। এভাবে তিনি পৃথিবীকে তাঁর বান্দাদের জন্য দোলনা করে দিয়েছেন এবং গভীর সমুদ্রের ওপরে তাকে তাদের জন্য মেঝের মতো বিছিয়ে দিয়েছেন যা স্থির ,অনড় ও নিশ্চল। তীব্র বাতাস পানির প্রবাহকে এদিক সেদিক নাড়াতে পারে এবং মেঘমালা এর থেকে পানি গ্রহণ করে ।

নিশ্চয়ই এতে তাদের জন্য শিক্ষা রয়েছে যারা আল্লাহকে ভয় করে (কুরআন - ৭৯:২৬)

পত্র - ১

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى أَهْلِ اَلْكُوفَةِ، عِنْدَ مَسِيرِهِ مِنَ ألْمَدِينَةٍ إلَى ألْبصْرةِ:

مِنْ عَبْدِ اللَّهِ عَلِيِّ أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَ إِلَى أَهْلِ الْكُوفَةِ جَبْهَةِ الْأَنْصَارِ وَ سَنَامِ الْعَرَبِ.

أَمَّا بَعْدُ، فَإِنِّي أُخْبِرُكُمْ عَنْ أَمْرِ عُثْمَانَ حَتَّى يَكُونَ سَمْعُهُ كَعِيَانِهِ إِنَّ النَّاسَ طَعَنُوا عَلَيْهِ، فَكُنْتُ رَجُلاً مِنَ الْمُهَاجِرِينَ أُكْثِرُ اسْتِعْتَابَهُ، وَ أُقِلُّ عِتَابَهُ وَ كَانَ طَلْحَةُ وَ الزُّبَيْرُ أَهْوَنُ سَيْرِهِمَا فِيهِ الْوَجِيفُ، وَ أَرْفَقُ حِدَائِهِمَا الْعَنِيفُ. وَ كَانَ مِنْ عَائِشَةَ فِيهِ فَلْتَةُ غَضَبٍ، فَأُتِيحَ لَهُ قَوْمٌ قَتَلُوهُ وَ بَايَعَنِي النَّاسُ غَيْرَ مُسْتَكْرَهِينَ وَ لاَ مُجْبَرِينَ، بَلْ طَائِعِينَ مُخَيَّرِينَ.

وَ اعْلَمُوا أَنَّ دَارَ الْهِجْرَةِ قَدْ قَلَعَتْ بِأَهْلِهَا وَ قَلَعُوا بِهَا، وَ جَاشَتْ جَيْشَ الْمِرْجَلِ، وَ قَامَتِ الْفِتْنَةُ عَلَى الْقُطْبِ، فَأَسْرِعُوا إِلَى أَمِيرِكُمْ وَ بَادِرُوا جِهَادَ عَدُوِّكُمْ، إِنْ شَأَ اللَّهُ عَزَّ وَ جَلَّ.

মদিনা থেকে বসরাভিমুখে যাত্রাকালে কুফার জনগণকে লিখেছিলেন

আল্লাহর বান্দা ও মোমিনগণের কমাণ্ডার আলীর নিকট হতে কুফার জনগণের প্রতি যারা সহায়তা দানে অগ্রণী ও আরবদের প্রধান ।

উসমানের ওপর যা আপতিত হয়েছিল এখন আমি তা এমন সঠিকভাবে তোমাদের কাছে বর্ণনা করছি। যাতে তোমরা স্বচক্ষে দেখার মতো বুঝতে পার। জনগণ তার সমালোচনা করেছিল। মুহাজিরদের মধ্যে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে মুসলিমদের সন্তুষ্ট রাখার এবং ক্ষেপিয়ে না তোলার জন্য তাকে উপদেশ দিয়েছিল। তালহা ও জুবায়ের তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং তারা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। আয়শাও তার ওপর খুব ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে একটা দল তাকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল। তারপর জনগণ আমার কাছে বায়াত গ্রহণ করে। এ বায়াতে কোন প্রকার জোর - জবরদস্তি ছিল না বা কাউকে বায়াত গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে তারা বায়াত গ্রহণ করেছে।

তোমরা জেনে নাও ,মদিনা আজ জনশূন্য হয়ে পড়েছে। বিদ্রোহ দমনের জন্য মদিনা আজ বিশাল পাত্রের ফুটন্ত পানির ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে আছে। অপরদিকে বিদ্রোহীরাও পূর্ণ শক্তি নিয়ে তাদের অক্ষরেখায় আবর্তিত হচ্ছে। সুতরাং তোমরা তোমাদের আমিরের (কমাণ্ডার) দিকে দ্রুত এগিয়ে এসো - এগিয়ে এসো তোমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে। যদি তোমরা তা কর তবে সর্বশক্তির আধার আল্লাহ তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন।

__________________

১। বাহারানী (৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৩৩৩) লিখেছেন যে ,তালহা ও জুবায়ের কর্তৃক ফেতনা সংঘটনের সংবাদ শুনেই আমিরুল মোমেনিন বসরা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। পথিমধ্যে মা ’ আল আযাব নামক স্থান থেকে তিনি স্বীয় পুত্র ইমাম হাসান ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মারফত কুফাবাসীদের নিকট এ পত্র প্রেরণ করেন।

হাদীদ (১৪শ খণ্ড ,পৃঃ ৮ - ১৬) ,আছীর ,(৩য় খণ্ড ,পৃঃ ২২৩) ও তাবারী (১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩১৩৯) লিখেছেন যে ,বসরার বিদ্রোহ দমনের জন্য যাত্রা করে আমিরুল মোমেনিন পথিমধ্যে আর - রাবাযাহ নামক স্থানে ক্যাম্প করেছিলেন। সে ক্যাম্প থেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র মুহাম্মদ ইবনে জাফর ও মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মারফত এ পত্র প্রেরণ করেছিলেন। এ পত্রে আমিরুল মোমেনিন প্রকাশ্যে বলেছেন যে ,উসমানের হত্যা মূলত আয়শা ,তালহা ও জুবায়েরের প্রচেষ্টার ফল এবং তারাই এ হত্যাকান্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুতঃপক্ষে আয়শা এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে ,তিনি প্রকাশ্য জনসভায় উসমানের দোষত্রুটি প্রকাশ করে তাকে হত্যা করা জায়েজ বলে ঘোষণা করেছিলেন ।

আবদুহ (২য় খণ্ড ,পৃঃ ৩) ,ফিদা (১ খণ্ড ,পৃঃ ১৭২) ও বালাজুরী (৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৮৮) লিখেছেনঃ

একদিন উসমান মিম্বারের ওপর ছিলেন । এমন সময় উন্মুল মোমেনিন আয়শা তার বোরখার ভেতর থেকে রাসূলের (সা.) জুতা ও কামিজ বের করে বললেন , এ জুতা ও কামিজ আল্লাহর রাসূলের যা এখনো বিনষ্ট হয়নি । এরই মধ্যে তোমরা তাঁর দ্বীনি ও সুন্নাহ পরিবর্তন করে ফেলেছো । ” আয়শার কথায় উসমান ক্ষেপে গিয়ে তার সাথে উচ্চবাচ্য শুরু করেছিল কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আয়শা বললেন , এ নাছালিকে হত্যা করা জায়েজ ” (নাছালি অর্থ হলো - লম্বা দাড়িওয়ালা ইহুদী) ||

এমনিতেই জনগণ উসমানের ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত ছিল। এ ঘটনা তাদের সাহস আরো বাড়িয়ে দিল এবং তারা তাকে ঘেরাও করে দুটি দাবী পেশ করেছিল। দাবী গুলো হলো - উসমান তার ভুল - ভ্রান্তি সংশোধন করবে ,না হয় খেলাফত হতে সরে যাবে। ঘেরাওকারীগণ এত বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে ,তাদের দুটো দাবীর যে কোন একটা মেনে না নিলে উসমান নিহত হবার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছিল। আয়শা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন কিন্তু তিনি কোন কথা বলেন নি। বরং উসমানকে অবরোধে ফেলে তিনি মক্কা চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সময় মারওয়ান ইবনে হাকাম ও আত্তাব ইবনে আসিদ আয়শার কাছে এসে তাকে বললো , আপনি এখন মক্কা যাওয়া স্থগিত করলে উসমানের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং জনতা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ” তাদের কথায় আয়শা বললেন যে ,তিনি হজ্জ করার নিয়্যত করেছেন। কাজেই তা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এতে মারওয়ান একটা প্রবাদ বাক্য বললো ,যার অর্থ হলোঃ

কায়েস আমার নগরে আগুন লাগিয়ে দিলো ,

এবং যখন অগ্নিশিখা জ্বলে উঠলো ,

সে নিজকে রক্ষা করে কেটে পড়লো।

একইভাবে তালহা ও জুবায়ের উসমানের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এবং তারাই উসমানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ঘনীভূত করা ও বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারাই উসমানের হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী এবং তারাই তাতে অংশগ্রহণকারী। অধিকাংশ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অবহিত ছিল এবং তাদেরকেই উসমানের খুনি বলে মনে করতো। তাদের সমর্থকগণও তাদের এ অপরাধ খণ্ডন করে কোন ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কুতায়বাহ (১ম খণ্ড ,পৃঃ ৬০) লিখেছেনঃ

বসরার পথে আওতাম নামক স্থানে আয়শার সাথে মুঘিরা ইবনে শুবাহর সাক্ষাত হলে মুঘিরা জিজ্ঞেস করেছিল , হে উন্মুল মোমেনিন ,আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? উত্তরে আয়শা বললেন , আমি বসরা যাচ্ছি। ” মুঘিরা ,বসরা যাবার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে আয়শা বললেন , উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য যাচ্ছি। ” মুঘিরা স্তম্ভিত হয়ে বললেন , সে কী ,উসমানের হত্যাকারীগণ তো আপনার সাথেই আছে। ” তারপর মুঘিরা মারওয়ানের দিকে ফিরে তার গন্তব্যস্থল জানতে চাইলেন । উত্তরে মারওয়ান বললো , উসমানের রক্তের বদলা নিতে আমিও বসরা যাচ্ছি। ” মুঘিরা বললেন , উসমানের খুনিরা তো তোমার সাথেই রয়েছে - এ তালহা ও জুবায়ের তাকে হত্যা করেছে। ”

প্রকৃতপক্ষে যে দলটি উসমানকে হত্যা করেছিল এবং হত্যার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিল তারা উসমান হত্যার দোষ আমিরুল মোমেনিনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বসরা চলে গিয়েছিল এবং সেখানে ফেতনা সৃষ্টি করেছিল। আমিরুল মোমেনিনও বিদ্রোহ দমনের জন্য বসরা পৌছলেন। পথিমধ্যে উক্ত পত্রে কুফাবাসীদের সমর্থন চাইলেন। পত্র পাওয়া মাত্র কুফার যোদ্ধাগণ আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এ যুদ্ধ জামালের যুদ্ধ ’ নামে খ্যাত।

পত্র - ২

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلَيهِمْ بَعْدَ فَتْحِ ألْبَصْرةِ

وَ جَزَاكُمُ اللَّهُ مِنْ أَهْلِ مِصْرٍ عَنْ أَهْلِ بَيْتِ نَبِيِّكُمْ أَحْسَنَ مَا يَجْزِي الْعَامِلِينَ بِطَاعَتِهِ، وَ الشَّاكِرِينَ لِنِعْمَتِهِ، فَقَدْ سَمِعْتُمْ وَ أَطَعْتُمْ، وَ دُعِيتُمْ فَأَجَبْتُمْ.

বসরায় জামালের যুদ্ধে জয়লাভের পর কুফাবাসীদেরকে লিখেছিলেন

হে কুফার শহরবাসীগণ ,রাসূলের (সা.) আহলুল বাইতের পক্ষ থেকে আল্লাহ্ তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার দ্বারা তোমাদেরকে পুরস্কৃত করুন। যারা আল্লাহর আনুগত্যের জন্য কাজ করে তাদেরকে যে পুরস্কার দেয়া হয় ,সে পুরস্কার তোমাদেরকে প্রদান করুন। যারা আল্লাহর নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে তাদের পুরস্কারে তিনি তোমাদেরকে পুরস্কৃত করুন। নিশ্চয়ই ,তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং আমাকে মান্য করেছো। আমার আহবানের সাথে সাথে তোমরা সাড়া দিয়েছে।

পত্র - ৩

من كتاب لهعليه‌السلام

( لِشُرَيْحِ بْنِ ألْحارِثِ )

رُوِيَ أَنَّ شُرَيْحَ بْنَ الْحَارِثِ قَاضِيَ أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَعليه‌السلام ، اشْتَرَى عَلَى عَهْدِهِ دَاراً بِثَمَانِينَ دِينَار، فَبَلَغَهُ ذَلِكَ فَاسْتَدْعَى شُرَيْحاً، فَاسْتَدْعَاهُ وَ قَالَ لَهُ:

بَلَغَنِي أَنَّكَ ابْتَعْتَ دَاراً بِثَمَانِينَ دِينَاراً، وَ كَتَبْتَ لَهَا كِتَاباً، وَ أَشْهَدْتَ فِيهِ شُهُوداً.

فَقَالَ لَهُ: شُرَيْحٌ قَدْ كَانَ ذَلِكَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، قَالَ فَنَظَرَ إِلَيْهِ نَظَرَ الْمُغْضَبِ ثُمَّ قَالَ لَهُ: يَا شُرَيْحُ، أَمَا إِنَّهُ سَيَأْتِيكَ مَنْ لاَ يَنْظُرُ فِي كِتَابِكَ وَ لاَ يَسْأَلُكَ عَنْ بَيِّنَتِكَ حَتَّى يُخْرِجَكَ مِنْهَا شَاخِصاً، وَ يُسْلِمَكَ إِلَى قَبْرِكَ خَالِصاً. فَانْظُرْ يَا شُرَيْحُ لاَ تَكُونُ ابْتَعْتَ هَذِهِ الدَّارَ مِنْ غَيْرِ مَالِكَ، أَوْ نَقَدْتَ الثَّمَنَ مِنْ غَيْرِ حَلاَلِكَ! فَإِذَا أَنْتَ قَدْ خَسِرْتَ دَارَ الدُّنْيَا وَ دَارَ الْآخِرَةِ! أَمَا إِنَّكَ لَوْ كُنْتَ أَتَيْتَنِي عِنْدَ شِرَائِكَ مَا اشْتَرَيْتَ لَكَتَبْتُ لَكَ كِتَابا عَلَى هَذِهِ النُّسْخَةِ، فَلَمْ تَرْغَبْ فِي شِرَأِ هَذِهِ الدَّارِ بِدِرْهَمٍ فَمَا فَوْقَهُ.

وَانُّسْخَةُ هَذِهِ: هَذَا مَا اشْتَرَى عَبْدٌ ذَلِيلٌ مِنْ مَيِّتٍ قَدْ أُزْعِجَ لِلرَّحِيلِ، اشْتَرَى مِنْهُ دَارا مِنْ دَارِ الْغُرُورِ مِنْ جَانِبِ الْفَانِينَ، وَ خِطَّةِ الْهَالِكِينَ وَ تَجْمَعُ هَذِهِ الدَّارَ حُدُودٌ أَرْبَعَةٌ: الْحَدُّ الْأَوَّلُ -يَنْتَهِي إِلَى دَوَاعِي الْآفَاتِ، وَ الْحَدُّ الثَّانِي- يَنْتَهِي إِلَى دَوَاعِي الْمُصِيبَاتِ، وَ الْحَدُّ الثَّالِثُ -يَنْتَهِي إِلَى الْهَوَى الْمُرْدِي وَ الْحَدُّ الرَّابِعُ- يَنْتَهِي إِلَى الشَّيْطَانِ الْمُغْوِي، وَ فِيهِ يُشْرَعُ بَابُ هَذِهِ الدَّارِ. اشْتَرَى هَذَا الْمُغْتَرُّ بِالْأَمَلِ، مِنْ هَذَا الْمُزْعَجِ بِالْأَجَلِ، هَذِهِ الدَّارَ بِالْخُرُوجِ مِنْ عِزِّ الْقَنَاعَةِ، وَ الدُّخُولِ فِي ذُلِّ الطَّلَبِ وَ الضَّرَاعَةِ. فَمَا أَدْرَكَ هَذَا الْمُشْتَرِي فِيمَا اشْتَرَى مِنْهُ مِنْ دَرَكٍ، فَعَلَى مُبَلْبِلِ أَجْسَامِ الْمُلُوكِ، وَ سَالِبِ نُفُوسِ الْجَبَابِرَةِ، وَ مُزِيلِ مُلْكِ الْفَرَاعِنَةِ، مِثْلِ كِسْرَى وَ قَيْصَرَ، وَ تُبَّعٍ وَ حِمْيَرَ.

وَ مَنْ جَمَعَ الْمَالَ عَلَى الْمَالِ فَأَكْثَرَ، وَ مَنْ بَنَى وَ شَيَّدَ، وَ زَخْرَفَ وَ نَجَّدَ، وَ ادَّخَرَ وَ اعْتَقَدَ وَ نَظَرَ بِزَعْمِهِ لِلْوَلَدِ، إِشْخَاصُهُمْ جَمِيعا إِلَى مَوْقِفِ الْعَرْضِ وَ الْحِسَابِ، وَ مَوْضِعِ الثَّوَابِ وَ الْعِقَابِ، إِذَا وَقَعَ الْأَمْرُ بِفَصْلِ الْقَضَأِ( وَ خَسِرَ هُنالِكَ الْمُبْطِلُونَ ) . شَهِدَ عَلَى ذَلِكَ الْعَقْلُ إِذَا خَرَجَ مِنْ أَسْرِ الْهَوَى، وَ سَلِمَ مِنْ عَلاَئِقِ الدُّنْيَا.

কুফার কাজি শুরাইয়াহ ইবনে হারিছের (আল - কিন্দি) জন্য লিখেছিলেন

বর্ণিত আছে যে ,আমিরুল মোমেনিন কর্তৃক নিয়োজিত কুফার কাজী শুরাইয়াহ ইবনে হারিছ (আল - কিন্দি) আশি দিনার মূল্য দিয়ে একটা বাড়ি ক্রয় করেছিল । আমিরুল মোমেনিন এ সংবাদ অবগত হয়ে কাজীকে ডেকে এনে বললেন ,

“ আমি জানতে পেরেছি তুমি নাকি আশি দিনার মূল্যে একটা বাড়ি ক্রয় করেছে এবং সেজন্য একটা দলিল করে তাতেও স্বাক্ষার করেছো ৷ ”

শুরাইয়াহ বললেন , হ্যাঁ ;আমিরুল মোমেনিন ,আপনি যা শুনেছেন তা সত্য । ” আমিরুল মোমেনিন রাগত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

হে শুরাইয়াহ ,সাবধান হও ,সহসাই আজরাইল তোমার কাছে আসবে। সে তোমার দলিলের দিকে ফিরেও তাকাবে না বা তোমার স্বাক্ষর প্রদান বিষয়ে তোমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। কিন্তু সে তোমাকে তোমার ক্রয়কৃত বাড়ি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে এবং তোমাকে নির্জন করবে: একাকী অবস্থায় রেখে দেবে। দেখ ,হে শুরাইয়াহ ,যদি তুমি তোমার হালাল উপার্জন ব্যতীত কোন অবৈধ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা বাড়ির মূল্য দিয়ে থাক তবে তোমার ইহকাল ও পরকাল বিনষ্ট করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছো। যদি তুমি বাড়ি ক্রয় করার আগে আমার কাছে আসতে তা হলে আমি তোমার জন্য একখানা দলিল লিখে দিতাম যা দেখলে তুমি ওই বাড়িটি এক দিনার মূল্যেও ক্রয় করতে না। এ কথা বলে আমিরুল মোমেনিনা একখানা দলিল শুরাইয়াকে দিলেন যাতে লেখা ছিলঃ

এটা একটা ক্রয় দলিল যাতে আল্লাহর একজন দীনহীন বান্দা ক্রেতা এবং পরকালে প্রস্থানোদ্যত অন্য বান্দা বিক্রেতা । ক্রেতা ধ্বংসশীল স্থানের মরণশীলগণের এলাকার প্রবঞ্চনার বাড়িগুলোর মধ্য থেকে একটা বাড়ি খরিদ করেছে । এ বাড়িটির চারদিকের ঘোর - চৌহুদি নিম্নরূপ : প্রথম দিকের সীমানা - দুর্যোগের উৎসস্থলের অতি নিকটবর্তী ; দ্বিতীয় দিকের সীমানা - দুঃখ - দুর্দশার উৎসের সাথে যুক্ত ;তৃতীয় দিকের সীমানা - ধ্বংসাত্মক কামনা - বাসনার সাথে যুক্ত ;চতুর্থ দিকের সীমানা - প্রবঞ্চক শয়তানের সাথে যুক্ত এবং এদিকেই বাড়িটির দরজা খোলার পথ । এ বাড়িটি এমন এক ব্যক্তি ক্রয় করেছে যাকে কামনা - বাসনা আক্রমণ করে সর্বত্ব অপহরণ করে নিয়েছে এবং এমন এক ব্যক্তি বিক্রয় করেছে যাকে মৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে । বাড়িটির মূল্য হলো - পরিতৃপ্তির মর্যাদা পরিত্যাগ পূর্বক হতমান ও দুঃখ দুর্দশায় প্রবেশ । যদি ক্রেতা এ লেনদেনের কুফলের সম্মুখীন হয় তবে তা হবে সেব্যক্তির জন্য যে ( আজরাইল) রাজা - বাদশাদের সযত্নে লালিত দেহ গলিয়ে বিনষ্ট করে দিয়েছে ,স্বৈরশাসকদের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং ফেরাউন ,কিসরাস ,সিজার ,তুব্বা ও হিমায়ারদের বিশাল সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছে ।

তারা সকলেই সম্পদের পর সম্পদ স্তুপীকৃত করেছিল এবং সম্পদ বাড়িয়েই যাচ্ছিলো । তারা সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ করেছিল এবং চোখ বালসানো সাজে তা সুসজ্জিত করেছিল । তারা ধন - রত্ব সংগ্রহ করেছিল এবং তাদের ধ্যান - ধারণা অনুযায়ী তারা দাবী করেছিল যে ,তাদের সন্তান - সন্ততিদের জন্য ওগুলো সঞ্চিত করেছিল যারা তাদেরকে হিসাব নিকাশ ও বিচারস্থলে পুরস্কার ও শাস্তির সময় সহায়তা করবে । তখন নির্দেশ হবে , যারা মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তারা আজ ক্ষতিগ্রস্তু (কুরআন - ৪:৭৮) ।

এ দলিল প্রজ্ঞা দ্বারা স্বাক্ষরিত ,এটা কামনা - বাসনার শিকলমুক্ত এবং দুনিয়ার চাকচিক্য থেকে দূরে সরানো |

___________________

১। কিসরাসঃ এটা খুসরাও ’ শব্দের আরবি রূপান্তর ,যার অর্থ হলো - বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী রাজা। ইরানের শাসনকর্তাদের উপাধি ছিল খুসরাও ” ।

২। সিজারঃ রোমের শাসকদের উপাধি সিজার ’ । ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ হলো - যে শিশুর মাতা প্রসবের পূর্বে মারা গেছে এবং মাতার পেট কেটে তাকে বের করে আনা হয়েছে। রোমের শাসকদের মধ্যে অগাস্টাস এভাবে জন্মেছিল বলে তাকে সিজার ’ বলা হতো এবং পরবর্তীতে রোমের শাসকগণ এটাকে উপাধি হিসাবে গ্রহণ করে ।

৩। তুব্বাঃ ইয়েমেনের রাজাদের উপাধি ছিল তুব্বা ’ । তারা হিমায়ের ও হাদ্রামাউত দখল করেছিল। তাদের নাম পবিত্র কুরআনের ৪৪: ৩৭ ও ৫০:১৪ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।

৪ । হিমায়েরঃ দক্ষিণ - পশ্চিম আরবের প্রাচীন সাবাইন রাজ্যের একটি প্রসিদ্ধ গোত্রের নাম। খৃষ্টপূর্ব ১১৫ সান থেকে ৫২৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তারা দক্ষিণ আরবের শক্তিশালী শাসক ছিল। হিমায়রগণ আজকের ইয়েমেনের উপকূলীয় অঞ্চল জুরায়দান (পরবর্তীতে কাতায়বান) নামক এলাকায় ঘনবসতি স্থাপন করেছিল। তারা সম্ভবত তাদের জ্ঞাতি সাবাইনদের ডিঙ্গিয়ে মিশর থেকে ভারত পর্যন্ত সমুদ্র পথে ব্যবসায় - বাণিজ্যের একটা পথ বের করেছিল। হিমায়রদের ভাষা ও কৃষ্টি ছিল সবাইনদের মতোই এবং তাদের রাজধানী ছিল জাফর। তাদের রাজ্য পূর্ব দিকে পারস্য উপসাগর ও উত্তর দিকে আরব মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে হিমায়রদের রাজধানী উত্তর দিকে সরিয়ে সানায় স্থানান্তরিত করা হয় এবং এ শতাব্দীর শেষভাগে ইহুদি ও খৃষ্টানগণ এ এলাকায় শক্ত সিড়ি গেড়ে বসেছিল। অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগে ৫২৫ খৃষ্টাব্দে আবিসিনিয়ানগণ হিমায়রদেরকে ধ্বংস করে দেয় (নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৪৯) ।

পত্র - ৪

و من كتاب لهعليه‌السلام

(إلى بعض أمرأ جيشه)

فَإِنْ عَادُوا إِلَى ظِلِّ الطَّاعَةِ فَذَاكَ الَّذِي نُحِبُّ، وَ إِنْ تَوَافَتِ الْأُمُورُ بِالْقَوْمِ إِلَى الشِّقَاقِ وَ الْعِصْيَانِ فَانْهَدْ بِمَنْ أَطَاعَكَ إِلَى مَنْ عَصَاكَ، وَ اسْتَغْنِ بِمَنِ انْقَادَ مَعَكَ عَمَّنْ تَقَاعَسَ عَنْكَ، فَإِنَّ الْمُتَكَارِهَ مَغِيبُهُ خَيْرٌ مِنْ مَشْهَدِهِ، وَ قُعُودُهُ أَغْنَى مِنْ نُهُوضِهِ.

সেনাবাহিনীর একজন অফিসারকে লিখেছিলেন

যদি তারা ,আনুগত্যের ছাতার নিচে ফিরে আসে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করো না ;কারণ আমরা তো শুধু এটাই চাই যে ,তারা আনুগত্য ভঙ্গ না করুক। কিন্তু যদি এসব লোকের আচরণ গোলযোগ সৃষ্টি ও অনানুগত্যসূচক হয় তবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। এদের মোকাবেলা করতে শুধু তাদের সঙ্গে রেখো ,যারা তোমাকে মান্য করে এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যারা তোমার সাথে যাবে তারাই তোমার প্রকৃত অনুসারী। যারা তোমার সাথে যাওয়া থেকে পিছিয়ে থাকবে তাদের সম্বন্ধে উদ্বীগ্ন হয়ো না। কারণ স্বতঃস্ফুর্ত উদ্যমহীন লোকের উপস্থিতি অপেক্ষা অনুপস্থিতি অধিকতর ভালো। নিরুদ্যম লোকের বাগাড়ম্বর অপেক্ষা চুপচাপ বসে থাকা অনেক ভালো।

___________________

১। বসরার গভর্ণর উসমান ইবনে হুনায়ফ যখন তালহা ও জুবায়েরের উপস্থিতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনকে জানালেন তখন তিনি তাকে এ পত্র লিখেছিলেন। এ পত্রে আমিরুল মোমেনিন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে শক্র যদি একান্তই যুদ্ধের দিকে ঝুকে পড়ে তবে তা যেন মোকাবেলা করা হয় এবং এতে উসমানের সৈন্য তালিকায় তাদের যেন না নেয়া হয় যারা একদিকে তালহা ,জুবায়ের ও আয়শার ব্যক্তিত্বের প্রতি গুরুত্ব দেয়। অপর দিকে শুধুমাত্র যুক্তির খাতিরে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি হয়েছে। এ ধরনের লোক দৃঢ়পদে অবিচলিতভাবে যুদ্ধ করবে না এবং যুদ্ধের জন্য এ ধরনের লোক নির্ভরযোগ্যও নয়। বরং এ ধরনের লোক দলের অন্যদেরকে নিরুদ্যম করে ফেলে। সুতরাং এসব লোককে দল থেকে সরিয়ে রাখাই উত্তম।

পত্র - ৫

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى أشعث بن قيس و هو عامل أذربيجان

وَ إِنَّ عَمَلَكَ لَيْسَ لَكَ بِطُعْمَةٍ، وَ لَكِنَّهُ فِي عُنُقِكَ أَمَانَةٌ، وَ أَنْتَ مُسْتَرْعىً لِمَنْ فَوْقَكَ. لَيْسَ لَكَ أَنْ تَفْتَاتَ فِي رَعِيَّةٍ، وَ لاَ تُخَاطِرَ إِلا بِوَثِيقَةٍ وَ فِي يَدَيْكَ مَالٌ مِنْ مَالِ اللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ، وَ أَنْتَ مِنْ خُزَّانِهِ حَتَّى تُسَلِّمَهُ إِلَيَّ وَ لَعَلِّي أنْ لا أَكُونَ شَرَّ وُلاَتِكَ لَكَ، وَ السَّلاَمُ.

আজারবাইজানের গভর্ণর আশআছ ইবনে কায়েসকে (আল - কিন্দি) লিখেছিলেন

নিশ্চয়ই ,তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এক গ্রাস খাদ্য নয়। এটা এমন এক বিষয় যা তোমার গ্রীবা জড়িয়ে রয়েছে এবং জনগণের নিরাপত্তার জন্য তোমার উপরস্থদের পক্ষে তোমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। জনগণের প্রতি অত্যাচারী হওয়া তোমার সাজে না ,আবার যথাযথ ক্ষেত্র ব্যতীত নিজকে বিপদাপন্ন করাও তোমার উচিত হবে না। তোমার হাতে যে পরিমাণ অর্থ - সম্পদের তহবিল আছে তা সর্বশক্তিমান ও ক্ষমতাশালী আল্লাহর সম্পদ। যে পর্যন্ত তুমি তা আমার কাছে পাঠিয়ে না দেবে সে পর্যন্ত তার দায় - দায়িত্ব তোমার। আমি কোনমতেই তোমার জন্য কুশাসকদের একজন হতে পারবো না এবং বিষয়টি এখানেই শেষ করলাম ।

___________________

১। জামালের যুদ্ধ শেষ হবার পর আজারবাইজানের গভর্ণর আশআছ ইবনে কায়েসকে (আল - কিন্দি) আমিরুল মোমেনিন এ পত্র লিখেছিলেন। আশাআছ উসমানের সময়কাল হতে আজারবাইজান এলাকার গভর্ণর ছিল। এ প্রদেশের রাজস্ব আয় প্রেরণ করার জন্য এ পত্রে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উসমান হত্যার পর হতে আশআছ নিজের অবস্থা সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়ে। ফলে উসমানের সময়কার অন্যান্য অফিসারের মতো সেও প্রাপ্ত রাজস্ব আত্মসাৎ করার ফন্দি এঁটেছিলো। এ পত্র পাওয়ার পর সে তার প্রধান আমাত্যগণকে ডেকে বললো , আমার ভয় হয় ,এ অর্থ আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। কাজেই মুয়াবিয়ার সাথে যোগদান করাই বাঞ্ছণীয়। ” উপস্থিত সকলেই বললে , আমরা তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠী। আমাদেরকে ফেলে তুমি মুয়াবিয়ার আশ্রয়ে চলে যেতে চাচ্ছে - এটা বড়ই লজ্জার বিষয়। ” তাদের কথা শুনে আশআছ পালিয়ে যাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করলো। কিন্তু সে রাজস্ব প্রেরণ করতে রাজি হলো না। ইতোমধ্যে সংবাদ পেয়ে আমিরুল মোমেনিন তাকে কুফায় নিয়ে যাবার জন্য হুজর ইবনে আদি আল - কিন্দিকে প্রেরণ করলেন। হুজর তাকে বুঝিয়ে - শুজিয়ে কুফায় নিয়ে এলো। কুফায় এসে সে চার লক্ষ দিরহাম জমা দিলে আমিরুল মোমেনিন তাকে ত্রিশ হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন এবং অবশিষ্ট অর্থ সরকারি তহবিলে জমা দিয়েছিলেন।

পত্র - ৬

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى معاوية

إِنَّهُ بايَعَنِي الْقَوْمُ الَّذِينَ بايَعُوا أَبابَكْرٍ وَ عُمَرَ وَ عُثْمانَ عَلى ما بايَعُوهُمْ عَلَيْهِ، فَلَمْ يَكُنْ لِلشَّاهِدِ أَنْ يَخْتارَ، وَ لا لِلْغائِبِ أَنْ يَرُدَّ، وَ إِنَّمَا الشُّورى لِلْمُهاجِرِينَ وَ الْأَنْصارِ، فَإِنِ اجْتَمَعُوا عَلى رَجُلٍ وَ سَمَّوهُ إِماما كانَ ذلِكَ لِلَّهِ رِضىً، فَإِنْ خَرَجَ عَنْ أَمْرِهِمْ خارِجٌ بِطَعْنٍ أَوْ بِدْعَةٍ رَدُّوهُ إ لى ما خَرَجَ مِنْهُ، فَإِنْ أَبى قاتَلُوهُ عَلَى اتَّباعِهِ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ، وَ وَلاّهُ اللَّهُ ما تَوَلّى. وَ لَعَمْرِي - يا مُعاوِيَةُ - لَئِنْ نَظَرْتَ بِعَقْلِكَ دُونَ هَواكَ لَتَجِدَنِّي أَبْرَأَ النَّاسِ مِنْ دَمِ عُثْمانَ، وَ لَتَعْلَمَنَّ أَنِّي كُنْتُ فِي عُزْلَةٍ عَنْهُ إِلاّ أَنْ تَتَجَنَّى، فَتَجَنَّ ما بَدا لَكَ! وَ السَّلاَمُ

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানকে লিখেছিলেন

নিশ্চয়ই ,যারা আবু বকর ,উমর ও উসমানের বায়াত গ্রহণ করেছিল তারা একই ভিত্তিতে আমার বায়াত গ্রহণ করেছে। (সে ভিত্তিতে) যারা উপস্থিত ছিল তাদের বিকল্প চিন্তা ছিল না এবং যারা অনুপস্থিত ছিল তাদের প্রত্যাখ্যান করার কোন অধিকার নেই এবং এ বিষয়ে আলাপ - আলোচনা মুহাজিরগণ ও আনসারগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদি তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাউকে খলিফা হিসাবে গ্রহণ করে তবে তা আল্লাহর সন্তুষ্টি বলেই মনে করতে হবে। যদি কেউ আপত্তি প্রদর্শনের জন্য দূরে সরে থাকে তাহলে তারা তাকে সে অবস্থা থেকে ফিরিয়ে দেবে যেখান থেকে সে দূরে সরে ছিলো। সে অস্বীকার করলে তারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এ জন্য যে ,সে মোমিনের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসরণ করেছে এবং আল্লাহ তাকে সেখানে ফিরিয়ে আনবেন যেখান থেকে সে পালিয়ে গেছে। আমার জীবনের শপথ ,হে মুয়াবিয়া ,যদি তুমি তোমার মস্তিস্ক থেকে সকল আবেগ ও রোষ বিদূরিত করে নিরপেক্ষভাবে দেখ ,তাহলে তুমি দেখতে পাবে যে ,উসমানের হত্যার জন্য আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। যা তোমার কাছে দিবালোকের মতো সত্য ,তা যদি তুমি গোপন না কর তাহলে নিশ্চয়ই ,তুমি জান আমি উসমানের সাথে সব কিছুতেই অসম্পৃক্ত ছিলাম এবং তার কাছ থেকে আমি দূরে সরে থাকতাম। এরপরও যদি তুমি ভালো মনে কর আমার ওপর আঘাত হানতে পার এবং এখানেই বিষয়টি শেষ করলাম ।

____________________

১। মদিনার সকল লোক যখন ঐকমত্যে আমিরুল মোমেনিনের বায়াত গ্রহণ করেছিলো তখন মুয়াবিয়া তার ক্ষমতা বিপদাপন্ন মনে করে চারদিকে ছড়াতে লাগলো যে ,আমিরুল মোমেনিন ঐকমত্যের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচিত হননি। এ ধুয়া তুলে সে পুনরায় সাধারণ নির্বাচন দাবী করতে লাগলো। আবু বকরের সময় থেকেই একটা রীতি প্রচলিত হয়ে এসেছিল যে ,মদীনাবাসীগণ যাকে খলিফা নির্বাচিত করবে। সে সমগ্র মুসলিম জাহানের খলিফা বলেই গণ্য হবে। এতে কারো কোন প্রশ্ন করার অধিকার থাকবে না। এ নীতি অনুযায়ী আমিরুল মোমেনিনের ক্ষেত্রে পুনঃনির্বাচন দাবী করার কোন অধিকার মুয়াবিয়ার নেই এবং মদিনাবাসীদের বায়াত অস্বীকার করার অধিকারও তার নেই। আমিরুল মোমেনিন এ পত্রে তাকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার প্রচারণার প্রেক্ষিতে তাকে প্রদমিত করার জন্য আমিরুল মোমেনিন এ যুক্তি দেখিয়েছেন। মূলত তিনি কখনো গোত্র প্রধানদের আলোচনা বা সাধারণ লোকের ভোটের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচনের নীতি মেনে নিতেন না । সে কারণেই মুহাজির ও আনসারদের ঐকমত্যে মনোনীত খলিফার হাতে তিনি বায়াত গ্রহণ করেনি। তিনি খেলাফতের এ স্বরচিত নীতি - পদ্ধতি বৈধ মনে করতেন না। সে কারণেই তিনি সর্বদা খেলাফতে তার অধিকারের কথা বলতেন যা তাকে রাসূল (সা.) মুখে ও দলিলে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাস মতে তার মুখ বন্ধ করার জন্যই ঐকমত্যের যুক্তি দেখিয়েছেন। বস্তুত মুয়াবিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নানা প্রকার ছুতানাতা ধরে কালক্ষেপণ করা এবং তার অনুকূলে জনসমর্থন নেয়া।

পত্র - ৭

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلَيْهِ( معاویه) أَيْضا

أَمّا بَعْدُ، فَقَدْ أَتَتْنِي مِنْكَ مَوْعِظَةٌ مُوَصَّلَةٌ، وَ رِسالَةٌ مُحَبَّرَةٌ، نَمَّقْتَها بِضَلالِكَ، وَ أَمْضَيْتَها بِسُوءِ رَأْيِكَ، وَ كِتابُ امْرِئٍ لَيْسَ لَهُ بَصَرٌ يَهْدِيهِ، وَ لا قائِدٌ يُرْشِدُهُ، قَدْ دَعاهُ الْهَوى فَأَجابَهُ، وَ قادَهُ الضَّلالُ فَاتَّبَعَهُ، فَهَجَرَ لاغِطا وَ ضَلَّ خابِطاً.

لِأَنَّها بَيْعَةٌ واحِدَةٌ لا يُثَنَّى فِيهَا النَّظَرُ، وَ لا يُسْتَأنَفُ فِيهَا الْخِيارُ. الْخارِجُ مِنْها طاعِنٌ، وَ الْمُرَوِّي فِيها مُداهِنٌ.

মুয়াবিয়ার প্রতি

আমি তোমার প্রেরিত অলঙ্কারপূর্ণ পত্রে বর্ণিত অসংলগ্ন উপদেশের প্যাকেট পেয়েছি। তুমি তোমার গোমরাহির কারণে এসব লিখেছো এবং অজ্ঞতার কারণে তা আমার কাছে প্রেরণ করেছো। এ পত্রখানা এমন ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছে অন্যকে পথ দেখাবার মতো আলো যার নেই এবং অন্যকে ন্যায় পথে পরিচালিত করার মতো নেতৃত্ব যার নেই। কামন - বাসনা - লালসা তোমাকে চেপে বসেছে ,আর তার তাড়নায় তুমি এ পত্র লিখেছো। গোমরাহি তোমাকে পেয়ে বসেছে ,তাই তুমি গোমরাহ হয়ে গেছে। সে কারণেই তুমি আবোল - তাবোল কথা বলেছো এবং বলগাহীনভাবে বিপথগামী হয়ে পড়েছো।

তোমার জানা উচিত ,বায়াত একবারই হয়ে থাকে। এটা পুনর্বিবেচনা করার কোন অবকাশ নেই এবং পুনঃ নির্বাচন করার কোন জো নেই। যে ব্যক্তি বায়াত থেকে সরে থাকে সে ইসলামের ক্ষতিকারক এবং যে ব্যক্তি কৌশলে সত্যকে এড়িয়ে যায় সে মোনাফিক ।

পত্র - ৮

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللّهِ البَجَلِىّ لَمَا أَرْسَلَهُ إلى مُعاوِيَةَ

أَمّا بَعْدُ، فَإِذا أَتاكَ كِتابِي فَاحْمِلْ مُعاوِيَةَ عَلَى الْفَصْلِ، وَخُذْهُ بِالْأَمْرِ الْجَزْمِ، ثُمَّ خَيِّرْهُ بَيْنَ حَرْبٍ مُجْلِيَةٍ، أَوْ سِلْمٍ مُخْزِيَةٍ، فَإِنِ اخْتارَ الْحَرْبَ فَانْبِذْ إِلَيْهِ، وَ إِنِ اخْتارَ السِّلْمَ فَخُذْ بَيْعَتَهُ، وَالسَّلامُ.

জারির ইবনে আবদিল্লাহ আল - বাজালীকে মুয়াবিয়ার কাছে প্রেরণ করলে তার ফিরে আসতে বিলম্ব দেখে আমিরুল মোমেনিন তাকে এ পত্র লিখেছেন

আমার এ পত্র পাওয়া মাত্র মুয়াবিয়াকে বলো যেন সে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সে যেন একটা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে। তাকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করো - যে যুদ্ধের নেশা তাকে ঘরছাড়া করেছে সে কি তা চায় নাকি শান্তি (তার দৃষ্টিতে যা অপমানকর) চায়। যদি সে যুদ্ধ চায় তবে তাকে ত্যাগ করে চলে এসো ;আর যদি সে শান্তি চায়। তবে তার বায়াত গ্রহণ করো। বিষয়টি এখানে শেষ করলাম ।

পত্র - ৯

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى مُعاوِيَة

فَأَرادَ قَوْمُنا قَتْلَ نَبِيِّنا، وَاجْتِياحَ أَصْلِنا، وَهَمُّوا بِنَا الْهُمُومَ، وَ فَعَلُوا بِنَا الْأَفاعِيلَ، وَ مَنَعُونَا الْعَذْبَ، وَ أَحْلَسُونَا الْخَوْفَ، وَاضْطَرُّونا إِلى جَبَلٍ وَعْرٍ، وَ أَوْ قَدُوا لَنا نارَ الْحَرْبِ،

فَعَزَمَ اللَّهُ لَنا عَلَى الذَّبِّ عَنْ حَوْزَتِهِ، وَالرَّمْي مِنْ وَرأِ حُرْمَتِهِ، مُؤْمِنُنا يَبْغِي بِذلِكَ الْأَجْرَ، وَ كافِرُنا يُحامِي عَنِ الْأَصْلِ، وَ مَنْ أَسْلَمَ مِنْ قُرَيْشٍ خِلْوٌ مِمّا نَحْنُ فِيهِ بِحِلْفٍ يَمْنَعُهُ، أَوْ عَشِيرَةٍ تَقُومُ دُونَهُ، فَهُوَ مِنَ الْقَتْلِ بِمَكانِ أَمْنٍ. وَ كانَ رَسُولُ اللَّهِ،صلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم إِذا احْمَرَّ الْبَأْسُ، وَ أَحْجَمَ النّاسُ قَدَّمَ أَهْلَ بَيْتِهِ فَوَقَى بِهِمْ أَصْحابَهُ حَرَّ السُّيُوفِ وَالْأَسِنَّةِ، فَقُتِلَ عُبَيْدَةُ بْنُ الْحارِثِ يَوْمَ بَدْرٍ، وَ قُتِلَ حَمْزَةُ يَوْمَ أُحُدٍ، وَ قُتِلَ جَعْفَرٌ يَوْمَ مُؤْتَةَ، وَ أَرادَ مَنْ لَوْ شِئْتُ ذَكَرْتُ اسْمَهُ مِثْلَ الَّذِي أَرادُوا مِنَ الشَّهادَةِ، وَ لَكِنَّ آجالُهُمْ عُجِّلَتْ، وَ مَنِيَّتَهُ أُجِّرَتْ.

فَيا عَجَبا لِلدَّهْرِ! إِذْ صِرْتُ يُقْرَنُ بِي مَنْ لَمْ يَسْعَ بِقَدَمِي، وَ لَمْ تَكُنْ لَهُ كَسابِقَتِي، الَّتِي لا يُدْلِي أَحَدٌ بِمِثْلِها، إِلاّ أَنْ يَدَّعِيَ مُدَّعٍ مَا لا أَعْرِفُهُ، وَ لا أَظُنُّ اللَّهَ يَعْرِفُهُ. وَالْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حالٍ.

وَ أَمَّا ما سَأَلْتَ مِنْ دَفْعِ قَتَلَةِ عُثْمانَ إِلَيْكَ، فَإِنِّي نَظَرْتُ فِي هَذا الْأَمْرِ، فَلَمْ أَرَهُ يَسَعُنِي دَفْعُهُمْ إِلَيْكَ وَ لا إِلى غَيْرِكَ، وَ لَعَمْرِي لَئِنْ لَمْ تَنْزِعْ عَنْ غَيِّكَ وَ شِقاقِكَ لَتَعْرِفَنَّهُمْ عَنْ قَلِيلٍ يَطْلُبُونَكَ، لا يُكَلِّفُونَكَ طَلَبَهُمْ فِي بَرِّ وَ لا بَحْرٍ وَ لا جَبَلٍ وَ لا سَهْلٍ إِلاّ أَنَّهُ طَلَبٌ يَسُوْءُكَ وِجْدانُهُ، وَ زَوْرٌ لا يَسُرُّكَ لُقْيانُهُ، وَالسَّلامُ لِأَهْلِهِ.

মুয়াবিয়ার প্রতি

কুরাইশগণ আমাদের রাসূলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল এবং আমাদের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছিল। তারা আমাদেরকে সর্বদা উদ্বীগ্ন অবস্থায় রাখতো ,আমাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করতো ,আমাদের জীবনের আরাম - আয়েশ দূর করে দিয়েছিলো ,আমাদেরকে সর্বদা - আতঙ্কিত রাখতো ,পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে আমাদেরকে বাধ্য করেছিলো এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধানল প্রজ্জ্বলিত করেছিলো ।

এ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে রক্ষা করা ও তাঁর সম্মানকে সমর্থন করার জন্য আমাদেরকে দৃঢ় - সংকল্প - চিত্ত করে দিলেন। আমাদের মধ্যকার ইমানদারগণ ঐশী পুরস্কারের আশায় এবং অবিশ্বাসীগণ জ্ঞাতিত্বের টানে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছিল। কুরাইশদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা আমাদের চেয়ে অনেক কম দুঃখ - দুর্দশা ভোগ করেছিল। এর কারণ হলো - হয় তারা প্রতিরক্ষামূলক প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত ছিল ,না হয় তাদের গোত্রগত অবস্থান (অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করলে গোটা গোত্র তার সমর্থনে চলে যাবে) । সেজন্য তারা হত্যা থেকে নিরাপদ ছিল। রাসূলের (সা.) হাতে যে একটা পথ ছিল তা হলো যুদ্ধ যখন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতো এবং তার যোদ্ধাদের যখন অবস্থান হারানোর উপক্রম হতো তখন তিনি স্বজনদেরকে অগ্রগামী করে পাঠাতেন এবং তাদের মাধ্যমে নিজের অনুচরদেরকে তরবারি ও বর্শা থেকে রক্ষা করতেন। এভাবেই বদরের যুদ্ধে উবাদাহ ইবনে আল - হারিছ ,ওহুদের যুদ্ধে হামজাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং মুতা যুদ্ধে জাফর ইবনে আবি তালিব শহীদ হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) তাঁর আপনজনদের মধ্যে আরেকজনকেও (যার নাম তুমি ভালোভাবে জান অর্থাৎ আলী) বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগামী করে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু শাহাদত বরণ করার জন্য তার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু নির্ধারিত ছিল না বলে সে এখনো বেঁচে আছে।

এটা বড়ই আশ্চর্যের - বিষয় যে ,আমি কিরূপে এমন একজনের দলভুক্ত হতে পারি যে ধর্ম বিষয়ে আমার মতো কর্মচঞ্চল পদক্ষেপ কখনো দেখে নি অথবা এ বিষয়ে আমার মতো কোন অবস্থান যার নেই এবং সে এমন কিছু অবদান দাবী করে যা আমার জানা নেই এবং আমি মনে করি তাঁর এসব দাবী সম্পর্কে আল্লাহও অবহিত নন। যা হোক ,সকল প্রশংসা মহিমান্বিত আল্লাহর ।

উসমানের হত্যাকারীদেরকে তোমার হাতে তুলে দেয়ার জন্য তোমার অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই যে ,আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে দেখেছি এবং তাদেরকে তোমার হাতে বা অন্য কারো হাতে তুলে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার জীবনের শপথ ,যদি তুমি তোমার ভ্রান্ত পথ ও ফেতনামূলক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ না কর তবে নিশ্চয়ই তুমি তাদেরকে চেন। তারা সহসাই তোমাকে খোজ করে নেবে। তাদেরকে জলে - স্থলে - পর্বতে - সমতলে খোঁজার কষ্ট তারা তোমাকে দেবে না। কিন্তু তাদের এ অনুসন্ধান তোমার জন্য বেদনাদায়ক হবে এবং তাদের সাক্ষাত তোমাকে আনন্দ দেবে না। যারা শান্তি চায় তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক ।

____________________

১। আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসূল যখন আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মানুষকে আহবান করেছিলেন তখন কাফের কুরাইশ গোত্র এ সত্যের বাণী স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে রুখে দাড়িয়েছিল। এ প্রতিমা পূজারী দলের হৃদয়ে প্রতিমা - প্রীতি এত প্রকট ছিল যে ,তারা তাদের প্রতিমার বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে রাজি ছিল না। এক আল্লাহর ধারণা তাদের সকল ধৈর্যচ্যুতির জন্য যথেষ্ট ছিল। এ অবস্থায় তারা শুনতে পেল তাদের দেবতাগুলো সামান্য নির্জীব ,নিশ্চল ও জড় পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন তারা দেখলো তাদের বিশ্বাস ও নীতি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে তখন তারা রাসূলকে (সা.) বিপদগ্রস্থ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ ও সকল উপায় অবলম্বন করতে লাগলো। তারা এমন সব ক্লেশদায়ক উপায় অবলম্বন করলো যে ,ঘরের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত রাসূলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লো। এ সময় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের ওপর অবারিত অত্যাচার তারা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এ সময় নওমুসলিমগণ সিজদা করলে তাদেরকে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাত করা হতো। কুরাইশদের এরূপ নিষ্ঠুর অত্যাচার দেখে রেসালতের পঞ্চম বছরে রাসূল (সা.) তাঁর অনুসারীগণকে আবিসিনিয়া হিজরত করার অনুমতি দিয়েছিলেন। নিষ্ঠুর কুরাইশগণ তাদের পিছু নিয়ে আবিসিনিয়াও গিয়েছিল ,কিন্তু আবিসিনিয়ার শাসক রাসূলের অনুসারীদেরকে কুরাইশদের হাতে তুলে দেননি এবং তার মহত্ত্বের ফলে তারা সেখানে কোন বিপদে পড়েনি।

এদিকে রাসূলের বাণী ক্রমাগত বেড়েই চলছে এবং সত্যের আকর্ষণ মানুষের মনে দোলা দিতে লাগলো। তাঁর বাণী ও ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে মানুষ দলে দলে তাঁর ছাতার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে দেখে কুরাইশগণ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো এবং তাদের অবলম্বিত সকল উপায় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে দেখে বনি হাশিমের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো। তারা আশা করেছিল। সকল প্রকার সামাজিক সম্পর্ক ও লেনদেন বন্ধ করে দিলে বনি হাশিম ও বনি আবদ - আল মুত্তালিব রাসূলকে (সা.) সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেবে এবং তাতে স্বাভাবিকভাবেই রাসূল (সা.) দমে যাবেন। কুরাইশগণ নিজেদের মধ্যে এ বয়কট বাস্তবায়নের জন্য পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হলো। এ চুক্তির ফলে বনি হাশিম একঘরে হয়ে পড়লো। কেউ তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে না - তাদের দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমনকি তাদের সঙ্গে মালপত্র বেচাকেনা করাও বন্ধ করে দেয়। এ সময় বনি হাশিমের জন্য একটা দুশ্চিন্তা প্রকট হয়ে উঠেছিলো ;তা হলো শহরের বাইরের উপত্যকায় যে কোন সময় রাসূলের (সা.) আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সবকিছু বিবেচনা করে বনি হাশিম আবি তালিবের শিব (বাসা) নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বনি হাশিমের যে সকল সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা সকলেই শিব - ই - আবি তালিব ” - এ আশ্রয় নিয়েছিল। আর যারা তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। তারা জ্ঞাতিত্ব ও গোত্র টানে তাদের প্রতিরক্ষা বিধান করেছিল। এ সময় হামজা ও আবি তালিব নিজেদের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে রাসূলের (সা.) প্রতিরক্ষা বিধান করেছিল এবং তারা সারাক্ষণ রাসূলকে (সা.) সান্তুনা দিতেন। শত্রুর আক্রমণের ভয়ে প্রতিরাতে রাসূলকে কয়েকবার বিছানা বদল করে ঘুমাতে দিতেন। রাসূলকে একটা বিছানা থেকে সরিয়ে তাঁর স্থলে আলীকে শুইয়ে রাখতেন।

বয়কটের এ দিনগুলো বনি হাশিমের জন্য বড়ই কষ্টদায়ক ছিল। তারা দিনের পর দিন উপোস করে কাটিয়েছে - এমন কি গাছের পাতা খেয়েও দিনাতিপাত করেছে। তিন বছর এভাবে নিদারুণ কষ্টে কাটানোর পর জুহায়র ইবনে আবি উমাইয়া (যার মাতা ছিল আতিকা বিনতে আবদ আল মুত্তলিব) ,হিশাম ইবনে আমর ইবনে রাবিয়াহ (যে তার মায়ের দিক থেকে বনি হাশিমের আত্মীয়) ,আল মুতিম ইবনে আদি ইবনে নওফল ইবনে আবদ মনাফ ,আবুল বখতারী আল - আস ইবনে হিশাম ইবনে আল - মুঘিরাহ এবং জামাআহ ইবনে আল - আসওয়াদ ইবনে আল - মুত্তালিব বয়কট চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব করলে কুরাইশ নেতাগণ কাবায় একটা আলোচনা বৈঠক করে। আবু তালিব উপত্যকার নির্বাসন স্থান থেকে এসে এ বৈঠকে হাজির হয়ে বললেন , আমার ভ্রাতুষ্পপুত্র মুহাম্মদ বলেছে তোমাদের চুক্তির সমুদয় লেখা সাদা - পিপীলিকায় খেয়ে ফেলেছে ;শুধুমাত্র আল্লাহর নামটুকু অবশিষ্ট আছে। তোমরা চুক্তিপত্রটি আনা। যদি তার কথা সত্য হয় তবে তোমরা তার শক্রতা পরিহার কর। আর যদি তার কথা সত্য না হয় তবে আমি তাকে তোমাদের হাতে তুলে দেব। ” এতে তারা রাজি হয়ে চুক্তিপত্র এনে দেখতে পেলো যে ,আল্লাহর নাম ব্যতীত অপর সকল লেখা সাদা - পিপড়ায় খেয়ে ফেলেছে। এ অবস্থা দেখে আল - মুতিম ইবনে আদি চুক্তি পত্রটি ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলো। এভাবে বয়কট চুক্তির অবসান ঘটে এবং বনি হাশিম নিদারুণ দুঃখ কষ্ট হতে নিস্কৃতি পায়। এরপরও রাসূলের (সা.) প্রতি কাফেরদের আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি ;বরং তারা রাসূলের (সা.) প্রাণনাশের ফন্দি এটেছিল ,যে কারণে তাকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছিল। অবশ্য এ সময় আবু তালিব জীবিত ছিলেন না। হিজরতের সময়ও আলী রাসূলের (সা.) বিছানায় শুয়ে থেকে রাসূলকে রক্ষা করার শেখানো পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

এসব ঘটনা মুয়াবিয়ার অজানা ছিল না। তবুও আমিরুল মোমেনিন তার পূর্ব পুরুষদের আচরণ তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে সে সত্যের অনুসারী ও মিথ্যার অনুসারীদের আচরণ বুঝতে পেরে ন্যায় ,সত্য ও হেদায়েতের পথে আসতে পারে।

পত্র - ১০

و من كتاب لهعليه‌السلام

إليْهِ أَيْضَا

الکشف عن نفاق معاویة

وَ كَيْفَ أَنْتَ صانِعٌ إِذا تَكَشَّفَتْ عَنْكَ جَلابِيبُ ما أَنْتَ فِيهِ مِنْ دُنْيا قَدْ تَبَهَّجَتْ بِزِينَتِها، وَ خَدَعَتْ بِلَذَّتِها. دَعَتْكَ فَأَجَبْتَها، وَ قادَتْكَ فَاتَّبَعْتَها، وَ أَمَرَتْكَ فَأَطَعْتَها. وَ إِنَّهُ يُوشِكُ أَنْ يَقِفَكَ واقِفٌ عَلى ما لا يُنْجِيكَ مِنْهُ مُنْجٍ، فَاقْعَسْ عَنْ هَذا الْأَمْرِ، وَخُذْ أُهْبَةَ الْحِسابِ، وَ شَمِّرْ لِما قَدْ نَزَلَ بِكَ، وَ لا تُمَكِّنِ الْغُواةَ مِنْ سَمْعِكَ، وَ إِلاّ تَفْعَلْ أُعْلِمْكَ ما أَغْفَلْتَ مِنْ نَفْسِكَ فَإِنَّكَ مُتْرَفٌ قَدْ أَخَذَ الشَّيْطانُ مِنْكَ مَأْخَذَهُ، وَ بَلَغَ فِيكَ أَمَلَهُ، وَ جَرى مِنْكَ مَجْرَى الرُّوحِ وَالدَّمِ. وَ مَتى كُنْتُمْ يا مُعاوِيَةُ ساسَةَ الرَّعِيَّةِ، وَ وُلاةَ أَمْرِ الْأُمَّةِ، بِغَيْرِ قَدَمٍ سابِقٍ، وَ لا شَرَفٍ باسِقٍ، وَ نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ لُزُومِ سَوابِقِ الشَّقأِ! وَ أُحَذِّرُكَ أَنْ تَكونَ مُتَمادِيا فِي غِرَّةِ الْأُمْنِيِّةِ، مُخْتَلِفَ الْعَلانِيَةِ وَالسَّرِيرَةِ.

وَ قَدْ دَعَوْتَ إِلَى الْحَرْبِ، فَدَعِ النّاسَ جانِبا وَاخْرُجْ إِلَيَّ، وَ أَعْفِ الْفَرِيقَيْنِ مِنَ الْقِتالِ لِيُعْلَمَ أَيُّنَا الْمَرِينُ عَلى قَلْبِهِ وَالْمُغَطّى عَلَى بَصَرِهِ! فَأَنَا أَبُو حَسَنٍ قاتِلُ جَدِّكَ وَ خالِكَ وَ أَخِيكَ شَدْخا يَوْمَ بَدْرٍ، وَ ذلِكَ السَّيْفُ مَعِي، وَ بِذلِكَ الْقَلْبِ أَلْقى عَدُوِّي، مَا اسْتَبْدَلْتُ دِينا، وَ لا اسْتَحْدَثْتُ نَبِيّا، وَ إِنِّي لَعَلَى الْمِنْهاجِ الَّذِي تَرَكْتُمُوهُ طائِعِينَ، وَ دَخَلْتُمْ فِيهِ مُكْرَهِينَ.

وَ زَعَمْتَ أَنَّكَ جِئتَ ثائِرا بدَمِ عُثْمانَ. وَ لَقَدْ عَلِمْتَ حَيْثُ وَقَعَ دَمُ عُثْمانَ فَاطْلُبْهُ مِنْ هُناكَ إِنْ كُنْتَ طالِباً، فَكَأَنِّي قَدْ رَأَيْتُكَ تَضِجُّ مِنَ الْحَرْبِ إِذا عَضَّتْكَ ضَجِيجَ الْجِمالِ بِالْأَثْقالِ، وَ كَأَنِّي بِجَماعَتِكَ تَدْعُونِي - جَزَعا مِنَ الضَّرْبِ الْمُتَتابِعِ، وَالْقَضأِ الْواقِعِ، وَ مَصارِعَ بَعْدَ مَصارِعَ - إِلى كِتابِ اللَّهِ وَ هِيَ كافِرَةٌ جاحِدَةٌ، أَوْ مُبايِعَةٌ حائِدَةٌ.

মুয়াবিয়ার প্রতি

মুয়াবিয়ার কপটতা উম্মোচন

এ দুনিয়ার যা কিছু তোমাকে ঘিরে রেখেছে তা থেকে যখন তোমাকে সরিয়ে নেয়া হবে তখন তুমি কী করবে ? দুনিয়া তার চাকচিক্য দিয়ে তোমাকে আকৃষ্ট করেছে এবং ভোগ - বিলাস ও আনন্দ - উল্লাস দিয়ে তোমাকে প্রতারিত করছে। দুনিয়া তোমাকে আহবান করেছে আর তুমি সে আহবানে উৎফুল্ল চিত্তে সাড়া দিয়েছো। দুনিয়া তোমাকে পরিচালিত করছে ,আর তুমি দুনিয়াকে অনুসরণ করে চলছো। দুনিয়া তোমাকে আদেশ দিচ্ছে ,আর তুমি সে আদেশ অবনত মস্তকে মেনে চলছো। সহসাই এক নকিব তোমাকে সব কিছু অবহিত করাবে যার হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করার মতো কোন বর্ম নেই। সুতরাং দুনিয়ার ধান্দাবাজি থেকে দূরে সরে থাক ,শেষ - বিচারের হিসাব - নিকাশের প্রতি খেয়ালি হও ,মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাক যা তোমাকে যে কোন মুহুর্তে পরাভূত করবে এবং যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের কথায় কান দিয়ে না। আমার উপদেশ মেনে চলো ;তোমার আরাম - আয়েশ ও বিলাসবহুল জীবন যাপনের ফলে তুমি যা ভুলে গেছ আমি শুধু তা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। শয়তান তার দৃঢ় মুষ্টিতে তোমাকে এটে ধরেছে ,তোমার মাধ্যমে তার আকাঙ্খা পরিপূর্ণ করছে এবং তোমার আত্মা ও রক্তের যেরূপ নিয়ন্ত্রণ তোমার ওপর রয়েছে শয়তান তোমাকে তদ্রূপ নিয়ন্ত্রণ করছে।

হে মুয়াবিয়া ,কোন প্রকার অগ্রণী ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য ছাড়াই তুমি কখন জনগণের রক্ষাকর্তা ( ?) ও তাদের কর্মকান্ডের অভিভাবক ( ?) বনেছো ? অতীতে দুর্ভাগ্যজনক ধ্বংস থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। আমি তোমাকে সর্তক করছি পাছে তুমি কামনা - বাসনার তাড়নায় আরো অধিক তাড়িত হও এবং তোমার বাতেন ও জাহের যেন ভিন্নধরনের না থাকে।

তুমি আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছো। জনগণকে এক দিকে সরিয়ে রেখে তুমি নিজে আমার মোকাবেলা করলে ভালো হয়। উভয় পক্ষের জনগণকে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমার সম্মুখে চলে আসো। তোমার ও আমার যুদ্ধেই প্রমাণিত হবে কার হৃদয় মরচে পড়া এবং কার চোখ অজ্ঞতায় ঢাকা । মনে রেখো ,আমি আবুল হাসান যে তোমার পিতামহকে (উতবা ইবনে রাবিআহ) ,তোমার ভ্রাতাকে (হানযালাহ ইবনে আবি সুফিয়ান) ,তোমার চাচাকে (অলিদ ইবনে উতবা) বদরের যুদ্ধে খণ্ড বিখণ্ড করে হত্যা করেছিল। সে - ই তরবারিটি এখনো আমার কাছে আছে এবং আমি এখনো সে দিনের মতো একই মনোভাব নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করি। আমি দ্বীনের কোন কিছুই পরিবর্তন করিনি এবং আমি কোন নতুন নবী নির্বাচন করিনি। নিশ্চয়ই ,আমি দ্বীনের রাজপথে চলছি যা তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করেছো এবং জোর জবরদস্তির পথ বেছে নিয়েছো।

তুমি প্রচার কর - তুমি উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য বের হয়েছো। নিশ্চয়ই তুমি জান ,কিভাবে উসমানের রক্তপাত ঘটেছিল। যদি তুমি উসমানের রক্তের বদলা নিতে চাও তবে যেখানে তার রক্তপাত ঘটেছে সেখানে বদলা নাও । আমি দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধ যখন দাঁত কটমটিয়ে তোমার দিকে তাকায় তখন তুমি সেরূপ চিৎকার কর ,বোঝার ভারে উট যেমন চিৎকার করে। আমি আরো দেখতে পাচ্ছি ,তরবারির অবিরাম আঘাতে মৃতদেহ পড়তে দেখে তোমার দল হতবুদ্ধি হয়ে আমাকে কুরআনের আহবান করছে। যদিও এসব লোক হয় অবিশ্বাসী ,না হয় সত্যত্যাগী ,না হয় বায়াত ভঙ্গকারী।

___________________

১। সিফফিনের যুদ্ধ যাত্রার আগে আমিরুল মোমেনিন মুয়াবিয়াকে এ পত্র লিখেছিলেন। এখানে অল্প কথায় তিনি সিফফিনের পূর্ণ দৃশ্য ব্যক্ত করেছেন। ইরাকিদের আক্রমণে সিরিয়া বাহিনী হতবুদ্ধি হয়ে পালিয়ে যাবার চিন্তা করছিলো। তখন রক্ষা পাবার জন্য বর্শার ডগায় কুরআন তুলে শান্তির জন্য চিৎকার করছিলো। হাদীদ লিখেছেনঃ

আমিরুল মোমেনিনের এ ভবিষ্যদ্বানি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝা যায় যে ,তাঁর ইলমুল গায়েব অত্যন্ত প্রখর ছিল। এহেন ভবিষ্যদ্বানি প্রকৃতই একটা অত্যাশ্চার্য বিষয়।

পত্র - ১১

و من وصية لهعليه‌السلام

وصَى بِها جَيْشا بَعَثَهُ إلَى الْعَدُوِّ

فَإِذا نَزَلْتُمْ بِعَدُوِّ أَوْ نَزَلَ بِكُمْ، فَلْيَكُنْ مُعَسْكَرُكُمْ فِي قُبُلِ الْأَشْرافِ، أَوْ سِفاحِ الْجِبالِ، أَوْ أَثْنأِ الْأَنْهارِ، كَيْما يَكُونَ لَكُمْ رِدْءا، وَ دُونَكُمْ مَرَدّا، وَلْتَكُنْ مُقاتَلَتُكُمْ مِنْ وَجْهٍ وَاحِدٍ أَوِاثْنَيْنِ، وَاجْعَلُوا لَكُمْ رُقَبأَ فِي صَياصِي الْجِبالِ، وَ مَناكِبِ الْهِضابِ، لِئَلاّ يَأْتِيَكُمُ الْعَدُوُّ مِنْ مَكانِ مَخافَةٍ أَوْ أَمْنٍ. وَاعْلَمُوا أَنَّ مُقَدِّمَةَ الْقَوْمِ عُيُونُهُمْ، وَ عُيُونَ الْمُقَدِّمَةِ طَلائِعُهُمْ. وَ إِيّاكُمْ وَالتَّفَرُّقَ: فَإِذا نَزَلْتُمْ فَانْزِلُوا جَمِيعاً، وَ إِذا ارْتَحَلْتُمْ فَارْتَحِلُوا جَمِيعاً، وَ إِذا غَشِيَكُمُ الليْلُ فَاجْعَلُوا الرِّماحَ كِفَّةً، وَ لا تَذُوقُوا النَّوْمَ إِلاّ غِرارا أَوْ مَضْمَضَةً.

শক্রর মোকাবেলায় প্রেরিত সৈন্যবাহিনীর প্রতি

যখন তোমরা শত্রুর দিকে এগিয়ে যাও অথবা শক্র তোমাদের দিকে এগিয়ে আসে তখন তোমরা উচু স্থানের বা পাহাড়ের ঢালে অথবা নদীর বাঁকে এমন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করো যে স্থান তোমাদেরকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে এবং প্রয়োজনে একটু পিছিয়ে যাবার উপায় থাকে। তোমাদের আক্রমণ যেন এক দিক অথবা দুদিক থেকে রচিত হয়। পর্যবেক্ষকগণকে পাহাড়ের চূড়ায় অথবা এলাকার উচু স্থানে উঠে শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে দিয়ো ;তাতে কোন দিক থেকেই তারা তোমাদের নিকটবর্তী হতে পারবে না এবং আচমকা তোমাদেরকে আক্রমণ করতে পারবে না। জেনে রাখো ,কোন সৈন্যবাহিনীর চক্ষু হলো তার অগ্রগামীদল এবং অগ্রগামীদলের চক্ষু হলো গুপ্তচর দল। সাবধান ,কখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকো না। যখন কোথাও থাম সকলে মিলে থেমো ,আবার যখন চলতে শুরু করো সকলে একত্রেই চলো। রাত্রি হলে তোমাদের বর্শাগুলো চক্রাকারে মাটিতে দাড় করে রেখো এবং রাত্রিকালে ঈষৎ তন্দ্রাচ্ছন্নতার বেশি ঘুমিয়ো না।

পত্র - ১২

و من وصية لهعليه‌السلام

وصی بها لِمَعْقلِ بْنِ قَيْسٍ الرَّياحِىِّ حِينَ أَنْفَذَهُ إلَى الشامِ فِي ثَلاثَةِ آلافٍ مُقَدِّمَةً لَهُ:

اتَّقِ اللَّهَ الَّذِي لا بُدَّ لَكَ مِنْ لِقائِهِ، وَ لا مُنْتَهَى لَكَ دُونَهُ. وَ لا تُقاتِلَنَّ إِلا مَنْ قاتَلَكَ، وَ سِرِ الْبَرْدَيْنِ، وَ غَوِّرْ بِالنّاسِ، وَ رَفِّهْ فِي السَّيْرِ، وَ لا تَسِرْ أَوَّلَ اللَّيْلِ، فَإِنَّ اللَّهَ جَعَلَهُ سَكَناً، وَ قَدَّرَهُ مُقاماً لا ظَعْناً، فَأَرِحْ فِيهِ بَدَنَكَ، وَ رَوِّحْ ظَهْرَكَ. فَإِذا وَقَفْتَ حِينَ يَنْبَطِحُ السَّحَرُ، أَوْ حِينَ يَنْفَجِرُ الْفَجْرُ، فَسِرْ عَلَى بَرَكَةِ اللَّهِ، فَإِذا لَقِيتَ الْعَدُوَّ فَقِفْ مِنْ أَصْحابِكَ وَسَطاً، وَ لا تَدْنُ مِنَ الْقَوْمِ دُنُوَّ مَنْ يُرِيدُ أَنْ يُنْشِبَ الْحَرْبَ، وَ لا تَباعَدْ عَنْهُمْ تَباعُدَ مَنْ يَهابُ الْبَأْسَ حَتَّى يَأْتِيَكَ أَمْرِي، وَ لا يَحْمِلَنَّكُمُ شَنَآنُهُمْ عَلَى قِتالِهِمْ، قَبْلَ دُعائِهِمْ وَالْإِعْذارِ إِلَيْهِمْ.

তিন হাজার সৈন্যের একটি অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে সিরিয়া অভিমুখে প্রেরণের প্রাক্কালে মাকিল ইবনে কায়েস আর - রিয়াহিকে বলেছিলেনঃ

আল্লাহকে ভয় কর যার সম্মুখে সকলেরই উপস্থিতি অবধারিত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে সাক্ষাত অবধারিত নয়। যারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে তারা ব্যতীত অন্য কারো সাথে যুদ্ধ করো না। দুটি ঠাণ্ডা সময়ে (সকাল ও বিকাল) পথ চলো। সৈন্যগণকে দিনের মধ্যভাগে একটু ঘুমোতে দিয়ো। সহজভাবে এগিয়ে যেয়ো এবং রাতের প্রথমভাগে পথ চলো না ,কারণ আল্লাহ এ সময়কে বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত করেছেন - ভ্রমণের জন্য নয়। সুতরাং রাতে শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে এবং বাহন পশুগুলোকেও বিশ্রাম করতে দিয়ো । ভোরের আগমন নিশ্চিত হয়ে সুবে সাদেকের সময় আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করো। শত্রুর মুখোমুখি হওয়া মাত্রই সাথীদের মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করো। আমার আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে ব্যক্তির মতো শত্রুর নিকটবর্তী হয়ো না যে এখনই যুদ্ধ শুরু করতে চায় অথবা সে ব্যক্তির মতো শক্রর কাছ থেকে দূরে সরে পড়ো না যে যুদ্ধের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। শত্রুর প্রতি ঘৃণা যেন তোমাকে যুদ্ধের প্রতি তাড়িত না করে। যুদ্ধ শুরু করার আগে বারবার শক্রকে হেদায়েতের দিকে আহবান করো যাতে তাদের কাছে তোমার সকল ওজর নিঃশেষিত হয়।

পত্র - ১৩

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى أَمِيرَيْنِ مِنْ أُمَرأِ جَيْشِهِ

وَ قَدْ أَمَّرْتُ عَلَيْكُما وَ عَلى مَنْ فِي حَيِّزِكُما مالِكَ بْنَ الْحارِثِ الْأَشْتَرَ، فَاسْمَعا لَهُ وَ أَطِيعا، وَاجْعَلاهُ دِرْعاً وَ مِجَنّاً، فَإِنَّهُ مِمَّنْ لا يُخافُ وَهْنُهُ وَ لا سَقْطَتُهُ، وَ لا بُطْؤُهُ عَمَّا الْإِسْراعُ إِلَيْهِ أَحْزَمُ، وَ لا إِسْراعُهُ إِلى مَا الْبُطْءُ عَنْهُ أَمْثَلُ.

সৈন্যবাহিনীর অফিসারের প্রতি প্রেরিত পত্র

আমি মালিক ইবনে হারিছ আল - আশতারকে তোমাদের ও তোমাদের অধীনস্থ সকলের কমাণ্ডার হিসাবে নিয়োগ করেছি। সুতরাং তোমরা সকলেই তার আদেশ পালন করে চলবে এবং তাকে তোমাদের বর্ম ও ঢাল হিসাবে মনে করবে। কারণ সে এমন এক ব্যক্তি যার কাছ থেকে কোন ভীতি বা ভুলের আশঙ্কা নেই। যেখানে দ্রুততার দরকার সেখানে অলসতা অথবা যেখানে শিথিলতার প্রয়োজন সেখানে দ্রুততা তার কাছে পাওয়া যাবে না।

___________________

১। যিয়াদ ইবনে আন - নদীর আল - হারিছি ও শুরাইয়াহ ইবনে হানি আল - হারিছির নেতৃত্বে আমিরুল মোমেনিন বার হাজারের একটা অগ্রগামী সৈন্যবাহিনী সিরিয়া অভিমুখে প্রেরণ করেছিলেন। পথিমধ্যে সুর আর রুম নামক স্থানে তারা আবুল আওয়ার আস - সুলামির মোকাবেলা করলো। আবুল আওয়ার সেখানে একটা সিরিয় বাহিনী নিয়ে ক্যাম্প করেছিল। আমিরুল মোমেনিনকে এ সংবাদ আল - হারিছ ইবনে জুমহান আল - জুফির মাধ্যমে অবহিত করা হলে তিনি মালিক ইবনে আল হারিছ আল - আশতারকে এ পত্রসহ বাহিনী প্রধান করে প্রেরণ করেছিলেন। এ পত্রে অল্প কথায় অতিসুন্দর করে মালিকের বুদ্ধিমত্তা ,ব্যক্তিত্ব ,শৌর্য - বীর্য ,বীরত্ব ও গুরুত্ব ব্যক্তি করেছেন।

পত্র - ১৪

و من وصية لهعليه‌السلام

لِعَسْكَرِهِ قَبْلَ لِقأِ الْعَدُوُّ بِصِفَّينَ

لا تُقاتِلُوهُمْ حَتَّى يَبْدَؤُوكُمْ، فَإِنَّكُمْ بِحَمْدِ اللَّهِ عَلى حُجَّةٍ، وَ تَرْكُكُمْ إِيّاهُمْ حَتَّى يَبْدَؤُوكُمْ حُجَّةٌ أُخْرى لَكُمْ عَلَيْهِمْ. فَإِذا كانَتِ الْهَزِيمَةُ بِإِذْنِ اللّهِ فَلا تَقْتُلُوا مُدْبِراً، وَ لا تُصِيبُوا مُعْوِراً، وَ لا تُجْهِزُوا عَلى جَرِيحٍ. وَ لا تَهِيجُوا النِّسأَ بِأَذىً، وَ إِنْ شَتَمْنَ أَعْراضَكُمْ، وَ سَبَبْنَ أُمَرأَكُمْ، فَإِنَّهُنَّ ضَعِيفاتُ الْقُوى وَالْأَنْفُسِ وَالْعُقُولِ؛ إِنْ كُنّا لَنُؤْمَرُ بِالْكَفِّ عَنْهُنَّ وَ إِنَّهُنَّ لَمُشْرِكاتٌ؛ وَ إِنْ كانَ الرَّجُلُ لَيَتَناوَلُ الْمَرْأَةَ فِي الْجاهِلِيَّةِ بِالْفَهْرِ أَوِ الْهِراوَةِ فَيُعَيَّرُ بِها وَ عَقِبُهُ مِنْ بَعْدِهِ.

সিফফিনে শত্রুর সাথে যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে সেনাবাহিনীকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন

শত্রুপক্ষ আঘাত হানার পূর্ব পর্যন্ত তোমরা আঘাত করো না। কারণ আল্লাহর অসীম রহমতে ,তোমরা ন্যায়ের পথে রয়েছে এবং তারা যুদ্ধ শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিলে তা তোমাদের পক্ষে আরো একটা পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াবে। ইনশাল্লাহ ,যদি শত্রুপক্ষ পরাজিত হয় তবে তাদের মধ্যে যারা পলায়নপর তাদেরকে হত্যা করো না ,অসহায় কোন ব্যক্তিকে আঘাত করো না এবং আহতগণকে একেবারে শেষ করে দিয়ে না। কোন রমণী যদি তোমাদের সম্মান ক্ষুন্ন করে নোংরা কথা বলে বা তোমাদের অফিসারকে গালি দেয়। তবুও তাদেরকে কষ্ট দিয়ে না। কারণ জ্ঞানে ,মনে ও চরিত্রে তারা তোমাদের চেয়ে দুর্বল। (রাসূলের যুগে) তারা অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর আপতিত না হবার জন্য আমাদেরকে আদেশ দেয়া হতো। এমনকি আইয়ামে জাহেলিয়াতেও যদি কোন পুরুষ কোন নারীকে পাথর অথবা ছড়ি দিয়ে আঘাত করতো। তবে তার চৌদ - পুরুষসহ তাকে গালাগালি করা হতো।

___________________

১। সিফফিনের যুদ্ধ আমিরুল মোমেনিন ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধের জন্য মুয়াবিয়া এককভাবে দায়ী। কারণ সে উসমানের হত্যার জন্য আমিরুল মোমেনিনকে মিথ্যা দোষারোপ করে যুদ্ধ সংঘটিত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা এবং কী কারণে হত্যা করেছিল তা মুয়াবিয়ার অজানা ছিল না। সে তার অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার ধুয়া তুলে বিদ্রোহ ও যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু শরিয়তের বিধান মতে মুসলিমদের ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠিত সত্যের অনুসারী ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অবৈধ ,যেমন -

শাসনকার্যে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না । তাদের কোন কার্য ইসলাম বিরোধী ,এটা নিশ্চিত না হয়ে তাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করো না । যদি তোমার দৃষ্টিতে তাদের কোন কাজ মন্দ বলে মনে হয় তবে সে বিষয়ে সত্য কথা বলে দিয়ো ;কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে উত্থান বা যুদ্ধ ঘোষণা মুসলিমদের ইজমায় নিষিদ্ধ (নাওয়াবী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১২৫ ,বাকিলানী ,পৃঃ ১৮৬ তাফতাজনী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ২৭২)

মুসলিমদের ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠিত কোন ইমামের বিরুদ্ধে যে কেউ বিদ্রোহ করে সে সত্যত্যাগী খারিজি বলে পরিচিত হবে । সাহবিদের যুগে এটা প্রচলিত ছিল এবং তাদের পরেও একথা প্রযোজ্য (শাহরাস্তানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১১৪) ।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে ,মুয়াবিয়ার কর্মকাণ্ড ছিল আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে উত্থান ও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। একজন বিদ্রোহীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্রধারণ করা শান্তির পরিপন্থী কিছু নয়। বরং এটা মজলুমের স্বাভাবিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করলে জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিহত করার এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আর কোন পথ খোলা থাকবে না। সে কারণেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার অনুমতি আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। আল্লাহ বলেনঃ

যদি বিশ্বাসীগণের দু দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে তোমরা তাদের উভয় দলের মধ্যে মীমাংসা করে শক্তি স্থাপন করে দেবে ;কিন্তু যদি তাদের একদল অপর দলকে আক্রমণ করে। তবে তোমরা সকলে মিলে আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে না আসে - যদি তারা ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা করে দিয়ো এবং এতে সুবিচার করো । নিশ্চয়ই ,আল্লাহ সুবিচারকারীকে ভালোবাসেন (কুরআন - ৪৯:৯) |

এ কারণেই আমিরুল মোমেনিন - আল্লাহর ফজলে তোমরা ন্যায়ের পথে আছো | - মর্মে দাবী করেছিলেন। তাসত্ত্বেও তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীকে উপদেশ দিয়েছিলেন যেন তাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের সূচনা না হয়। কারণ তিনি শুধু আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু যখন শান্তি - শৃংখলার জন্য তাঁর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো এবং শত্রু কোন কথা না শুনে যুদ্ধের দিকেই এগিয়ে গেল তখন জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিহত করার জন্য তাদের মোকাবিলা করা তার দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল যা মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে অনুমোদন করেছেনঃ

যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ,তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ,কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করো না । আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না (কুরআন - ২:১৯০) |

এ ছাড়াও আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানেই হলো রাসূলের (সা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

হে আলী ,তোমার শক্তিই আমার শক্তি ,তোমার যুদ্ধই আমার যুদ্ধ (হাদীদ ,১৮শ খণ্ড ,পৃঃ২৪)

এ কারণে রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে যে শাস্তি প্রাপ্য আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে একই শাস্তি পাবার যোগ্য। রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবার শাস্তি মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেনঃ

যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হলো। - তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রশ বিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে । ইহকালে এটাই তাদের শাস্তি এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি (কুরআন - ৫:৩৩) |

এরূপ অনুমতি থাকা সত্ত্বেও পলায়নোন্মুখ ও আহত শক্রকে হত্যা না করার জন্য আমিরুল মোমেনিন তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর এহেন নির্দেশ নৈতিক মূল্যবোধ ও জিহাদের একটি মহোত্তম নিদর্শন। এ নির্দেশ তিনি শুধু মুখে বলেননি লিখেও দিয়েছেন। বস্তুতঃপক্ষে যুদ্ধে পলায়নপর ও অসহায় শত্রু এবং নারী হত্যা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। জামালের যুদ্ধে তাঁর শত্রুপক্ষের নেতৃত্বে নারী থাকা সত্ত্বেও তিনি নীতি পরিবর্তন করেননি। পরাজিত হবার পর তিনি আয়শাকে দেহরক্ষী দ্বারা মদিনা প্রেরণ করেন। এ বিষয়ে হাদীদ (১৭শ খণ্ড ,পৃঃ ২৫৪) লিখেছেনঃ

আমিরুল মোমেনিনের সাথে আয়শা যেরূপ আচরণ করেছে উমরের সাথে যদি সেরূপ আচরণ করা হতো তাহলে জয়লাভের পর উমর তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতো ।

পত্র - ১

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى أَهْلِ اَلْكُوفَةِ، عِنْدَ مَسِيرِهِ مِنَ ألْمَدِينَةٍ إلَى ألْبصْرةِ:

مِنْ عَبْدِ اللَّهِ عَلِيِّ أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَ إِلَى أَهْلِ الْكُوفَةِ جَبْهَةِ الْأَنْصَارِ وَ سَنَامِ الْعَرَبِ.

أَمَّا بَعْدُ، فَإِنِّي أُخْبِرُكُمْ عَنْ أَمْرِ عُثْمَانَ حَتَّى يَكُونَ سَمْعُهُ كَعِيَانِهِ إِنَّ النَّاسَ طَعَنُوا عَلَيْهِ، فَكُنْتُ رَجُلاً مِنَ الْمُهَاجِرِينَ أُكْثِرُ اسْتِعْتَابَهُ، وَ أُقِلُّ عِتَابَهُ وَ كَانَ طَلْحَةُ وَ الزُّبَيْرُ أَهْوَنُ سَيْرِهِمَا فِيهِ الْوَجِيفُ، وَ أَرْفَقُ حِدَائِهِمَا الْعَنِيفُ. وَ كَانَ مِنْ عَائِشَةَ فِيهِ فَلْتَةُ غَضَبٍ، فَأُتِيحَ لَهُ قَوْمٌ قَتَلُوهُ وَ بَايَعَنِي النَّاسُ غَيْرَ مُسْتَكْرَهِينَ وَ لاَ مُجْبَرِينَ، بَلْ طَائِعِينَ مُخَيَّرِينَ.

وَ اعْلَمُوا أَنَّ دَارَ الْهِجْرَةِ قَدْ قَلَعَتْ بِأَهْلِهَا وَ قَلَعُوا بِهَا، وَ جَاشَتْ جَيْشَ الْمِرْجَلِ، وَ قَامَتِ الْفِتْنَةُ عَلَى الْقُطْبِ، فَأَسْرِعُوا إِلَى أَمِيرِكُمْ وَ بَادِرُوا جِهَادَ عَدُوِّكُمْ، إِنْ شَأَ اللَّهُ عَزَّ وَ جَلَّ.

মদিনা থেকে বসরাভিমুখে যাত্রাকালে কুফার জনগণকে লিখেছিলেন

আল্লাহর বান্দা ও মোমিনগণের কমাণ্ডার আলীর নিকট হতে কুফার জনগণের প্রতি যারা সহায়তা দানে অগ্রণী ও আরবদের প্রধান ।

উসমানের ওপর যা আপতিত হয়েছিল এখন আমি তা এমন সঠিকভাবে তোমাদের কাছে বর্ণনা করছি। যাতে তোমরা স্বচক্ষে দেখার মতো বুঝতে পার। জনগণ তার সমালোচনা করেছিল। মুহাজিরদের মধ্যে আমিই একমাত্র ব্যক্তি যে মুসলিমদের সন্তুষ্ট রাখার এবং ক্ষেপিয়ে না তোলার জন্য তাকে উপদেশ দিয়েছিল। তালহা ও জুবায়ের তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং তারা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। আয়শাও তার ওপর খুব ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। ফলে একটা দল তাকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল। তারপর জনগণ আমার কাছে বায়াত গ্রহণ করে। এ বায়াতে কোন প্রকার জোর - জবরদস্তি ছিল না বা কাউকে বায়াত গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি। স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে তারা বায়াত গ্রহণ করেছে।

তোমরা জেনে নাও ,মদিনা আজ জনশূন্য হয়ে পড়েছে। বিদ্রোহ দমনের জন্য মদিনা আজ বিশাল পাত্রের ফুটন্ত পানির ন্যায় উত্তপ্ত হয়ে আছে। অপরদিকে বিদ্রোহীরাও পূর্ণ শক্তি নিয়ে তাদের অক্ষরেখায় আবর্তিত হচ্ছে। সুতরাং তোমরা তোমাদের আমিরের (কমাণ্ডার) দিকে দ্রুত এগিয়ে এসো - এগিয়ে এসো তোমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করতে। যদি তোমরা তা কর তবে সর্বশক্তির আধার আল্লাহ তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন।

__________________

১। বাহারানী (৪র্থ খণ্ড ,পৃঃ ৩৩৩) লিখেছেন যে ,তালহা ও জুবায়ের কর্তৃক ফেতনা সংঘটনের সংবাদ শুনেই আমিরুল মোমেনিন বসরা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। পথিমধ্যে মা ’ আল আযাব নামক স্থান থেকে তিনি স্বীয় পুত্র ইমাম হাসান ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মারফত কুফাবাসীদের নিকট এ পত্র প্রেরণ করেন।

হাদীদ (১৪শ খণ্ড ,পৃঃ ৮ - ১৬) ,আছীর ,(৩য় খণ্ড ,পৃঃ ২২৩) ও তাবারী (১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩১৩৯) লিখেছেন যে ,বসরার বিদ্রোহ দমনের জন্য যাত্রা করে আমিরুল মোমেনিন পথিমধ্যে আর - রাবাযাহ নামক স্থানে ক্যাম্প করেছিলেন। সে ক্যাম্প থেকে তাঁর ভ্রাতুষ্পপুত্র মুহাম্মদ ইবনে জাফর ও মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মারফত এ পত্র প্রেরণ করেছিলেন। এ পত্রে আমিরুল মোমেনিন প্রকাশ্যে বলেছেন যে ,উসমানের হত্যা মূলত আয়শা ,তালহা ও জুবায়েরের প্রচেষ্টার ফল এবং তারাই এ হত্যাকান্ডে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুতঃপক্ষে আয়শা এতই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে ,তিনি প্রকাশ্য জনসভায় উসমানের দোষত্রুটি প্রকাশ করে তাকে হত্যা করা জায়েজ বলে ঘোষণা করেছিলেন ।

আবদুহ (২য় খণ্ড ,পৃঃ ৩) ,ফিদা (১ খণ্ড ,পৃঃ ১৭২) ও বালাজুরী (৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৮৮) লিখেছেনঃ

একদিন উসমান মিম্বারের ওপর ছিলেন । এমন সময় উন্মুল মোমেনিন আয়শা তার বোরখার ভেতর থেকে রাসূলের (সা.) জুতা ও কামিজ বের করে বললেন , এ জুতা ও কামিজ আল্লাহর রাসূলের যা এখনো বিনষ্ট হয়নি । এরই মধ্যে তোমরা তাঁর দ্বীনি ও সুন্নাহ পরিবর্তন করে ফেলেছো । ” আয়শার কথায় উসমান ক্ষেপে গিয়ে তার সাথে উচ্চবাচ্য শুরু করেছিল কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে আয়শা বললেন , এ নাছালিকে হত্যা করা জায়েজ ” (নাছালি অর্থ হলো - লম্বা দাড়িওয়ালা ইহুদী) ||

এমনিতেই জনগণ উসমানের ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত ছিল। এ ঘটনা তাদের সাহস আরো বাড়িয়ে দিল এবং তারা তাকে ঘেরাও করে দুটি দাবী পেশ করেছিল। দাবী গুলো হলো - উসমান তার ভুল - ভ্রান্তি সংশোধন করবে ,না হয় খেলাফত হতে সরে যাবে। ঘেরাওকারীগণ এত বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে ,তাদের দুটো দাবীর যে কোন একটা মেনে না নিলে উসমান নিহত হবার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠেছিল। আয়শা অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলেন কিন্তু তিনি কোন কথা বলেন নি। বরং উসমানকে অবরোধে ফেলে তিনি মক্কা চলে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ সময় মারওয়ান ইবনে হাকাম ও আত্তাব ইবনে আসিদ আয়শার কাছে এসে তাকে বললো , আপনি এখন মক্কা যাওয়া স্থগিত করলে উসমানের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং জনতা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ” তাদের কথায় আয়শা বললেন যে ,তিনি হজ্জ করার নিয়্যত করেছেন। কাজেই তা পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। এতে মারওয়ান একটা প্রবাদ বাক্য বললো ,যার অর্থ হলোঃ

কায়েস আমার নগরে আগুন লাগিয়ে দিলো ,

এবং যখন অগ্নিশিখা জ্বলে উঠলো ,

সে নিজকে রক্ষা করে কেটে পড়লো।

একইভাবে তালহা ও জুবায়ের উসমানের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এবং তারাই উসমানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ঘনীভূত করা ও বিদ্রোহের আগুন প্রজ্জ্বলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে তারাই উসমানের হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী এবং তারাই তাতে অংশগ্রহণকারী। অধিকাংশ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে অবহিত ছিল এবং তাদেরকেই উসমানের খুনি বলে মনে করতো। তাদের সমর্থকগণও তাদের এ অপরাধ খণ্ডন করে কোন ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কুতায়বাহ (১ম খণ্ড ,পৃঃ ৬০) লিখেছেনঃ

বসরার পথে আওতাম নামক স্থানে আয়শার সাথে মুঘিরা ইবনে শুবাহর সাক্ষাত হলে মুঘিরা জিজ্ঞেস করেছিল , হে উন্মুল মোমেনিন ,আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? উত্তরে আয়শা বললেন , আমি বসরা যাচ্ছি। ” মুঘিরা ,বসরা যাবার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে আয়শা বললেন , উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য যাচ্ছি। ” মুঘিরা স্তম্ভিত হয়ে বললেন , সে কী ,উসমানের হত্যাকারীগণ তো আপনার সাথেই আছে। ” তারপর মুঘিরা মারওয়ানের দিকে ফিরে তার গন্তব্যস্থল জানতে চাইলেন । উত্তরে মারওয়ান বললো , উসমানের রক্তের বদলা নিতে আমিও বসরা যাচ্ছি। ” মুঘিরা বললেন , উসমানের খুনিরা তো তোমার সাথেই রয়েছে - এ তালহা ও জুবায়ের তাকে হত্যা করেছে। ”

প্রকৃতপক্ষে যে দলটি উসমানকে হত্যা করেছিল এবং হত্যার সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত ছিল তারা উসমান হত্যার দোষ আমিরুল মোমেনিনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বসরা চলে গিয়েছিল এবং সেখানে ফেতনা সৃষ্টি করেছিল। আমিরুল মোমেনিনও বিদ্রোহ দমনের জন্য বসরা পৌছলেন। পথিমধ্যে উক্ত পত্রে কুফাবাসীদের সমর্থন চাইলেন। পত্র পাওয়া মাত্র কুফার যোদ্ধাগণ আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। এ যুদ্ধ জামালের যুদ্ধ ’ নামে খ্যাত।

পত্র - ২

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلَيهِمْ بَعْدَ فَتْحِ ألْبَصْرةِ

وَ جَزَاكُمُ اللَّهُ مِنْ أَهْلِ مِصْرٍ عَنْ أَهْلِ بَيْتِ نَبِيِّكُمْ أَحْسَنَ مَا يَجْزِي الْعَامِلِينَ بِطَاعَتِهِ، وَ الشَّاكِرِينَ لِنِعْمَتِهِ، فَقَدْ سَمِعْتُمْ وَ أَطَعْتُمْ، وَ دُعِيتُمْ فَأَجَبْتُمْ.

বসরায় জামালের যুদ্ধে জয়লাভের পর কুফাবাসীদেরকে লিখেছিলেন

হে কুফার শহরবাসীগণ ,রাসূলের (সা.) আহলুল বাইতের পক্ষ থেকে আল্লাহ্ তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার দ্বারা তোমাদেরকে পুরস্কৃত করুন। যারা আল্লাহর আনুগত্যের জন্য কাজ করে তাদেরকে যে পুরস্কার দেয়া হয় ,সে পুরস্কার তোমাদেরকে প্রদান করুন। যারা আল্লাহর নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে তাদের পুরস্কারে তিনি তোমাদেরকে পুরস্কৃত করুন। নিশ্চয়ই ,তোমরা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং আমাকে মান্য করেছো। আমার আহবানের সাথে সাথে তোমরা সাড়া দিয়েছে।

পত্র - ৩

من كتاب لهعليه‌السلام

( لِشُرَيْحِ بْنِ ألْحارِثِ )

رُوِيَ أَنَّ شُرَيْحَ بْنَ الْحَارِثِ قَاضِيَ أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَعليه‌السلام ، اشْتَرَى عَلَى عَهْدِهِ دَاراً بِثَمَانِينَ دِينَار، فَبَلَغَهُ ذَلِكَ فَاسْتَدْعَى شُرَيْحاً، فَاسْتَدْعَاهُ وَ قَالَ لَهُ:

بَلَغَنِي أَنَّكَ ابْتَعْتَ دَاراً بِثَمَانِينَ دِينَاراً، وَ كَتَبْتَ لَهَا كِتَاباً، وَ أَشْهَدْتَ فِيهِ شُهُوداً.

فَقَالَ لَهُ: شُرَيْحٌ قَدْ كَانَ ذَلِكَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ، قَالَ فَنَظَرَ إِلَيْهِ نَظَرَ الْمُغْضَبِ ثُمَّ قَالَ لَهُ: يَا شُرَيْحُ، أَمَا إِنَّهُ سَيَأْتِيكَ مَنْ لاَ يَنْظُرُ فِي كِتَابِكَ وَ لاَ يَسْأَلُكَ عَنْ بَيِّنَتِكَ حَتَّى يُخْرِجَكَ مِنْهَا شَاخِصاً، وَ يُسْلِمَكَ إِلَى قَبْرِكَ خَالِصاً. فَانْظُرْ يَا شُرَيْحُ لاَ تَكُونُ ابْتَعْتَ هَذِهِ الدَّارَ مِنْ غَيْرِ مَالِكَ، أَوْ نَقَدْتَ الثَّمَنَ مِنْ غَيْرِ حَلاَلِكَ! فَإِذَا أَنْتَ قَدْ خَسِرْتَ دَارَ الدُّنْيَا وَ دَارَ الْآخِرَةِ! أَمَا إِنَّكَ لَوْ كُنْتَ أَتَيْتَنِي عِنْدَ شِرَائِكَ مَا اشْتَرَيْتَ لَكَتَبْتُ لَكَ كِتَابا عَلَى هَذِهِ النُّسْخَةِ، فَلَمْ تَرْغَبْ فِي شِرَأِ هَذِهِ الدَّارِ بِدِرْهَمٍ فَمَا فَوْقَهُ.

وَانُّسْخَةُ هَذِهِ: هَذَا مَا اشْتَرَى عَبْدٌ ذَلِيلٌ مِنْ مَيِّتٍ قَدْ أُزْعِجَ لِلرَّحِيلِ، اشْتَرَى مِنْهُ دَارا مِنْ دَارِ الْغُرُورِ مِنْ جَانِبِ الْفَانِينَ، وَ خِطَّةِ الْهَالِكِينَ وَ تَجْمَعُ هَذِهِ الدَّارَ حُدُودٌ أَرْبَعَةٌ: الْحَدُّ الْأَوَّلُ -يَنْتَهِي إِلَى دَوَاعِي الْآفَاتِ، وَ الْحَدُّ الثَّانِي- يَنْتَهِي إِلَى دَوَاعِي الْمُصِيبَاتِ، وَ الْحَدُّ الثَّالِثُ -يَنْتَهِي إِلَى الْهَوَى الْمُرْدِي وَ الْحَدُّ الرَّابِعُ- يَنْتَهِي إِلَى الشَّيْطَانِ الْمُغْوِي، وَ فِيهِ يُشْرَعُ بَابُ هَذِهِ الدَّارِ. اشْتَرَى هَذَا الْمُغْتَرُّ بِالْأَمَلِ، مِنْ هَذَا الْمُزْعَجِ بِالْأَجَلِ، هَذِهِ الدَّارَ بِالْخُرُوجِ مِنْ عِزِّ الْقَنَاعَةِ، وَ الدُّخُولِ فِي ذُلِّ الطَّلَبِ وَ الضَّرَاعَةِ. فَمَا أَدْرَكَ هَذَا الْمُشْتَرِي فِيمَا اشْتَرَى مِنْهُ مِنْ دَرَكٍ، فَعَلَى مُبَلْبِلِ أَجْسَامِ الْمُلُوكِ، وَ سَالِبِ نُفُوسِ الْجَبَابِرَةِ، وَ مُزِيلِ مُلْكِ الْفَرَاعِنَةِ، مِثْلِ كِسْرَى وَ قَيْصَرَ، وَ تُبَّعٍ وَ حِمْيَرَ.

وَ مَنْ جَمَعَ الْمَالَ عَلَى الْمَالِ فَأَكْثَرَ، وَ مَنْ بَنَى وَ شَيَّدَ، وَ زَخْرَفَ وَ نَجَّدَ، وَ ادَّخَرَ وَ اعْتَقَدَ وَ نَظَرَ بِزَعْمِهِ لِلْوَلَدِ، إِشْخَاصُهُمْ جَمِيعا إِلَى مَوْقِفِ الْعَرْضِ وَ الْحِسَابِ، وَ مَوْضِعِ الثَّوَابِ وَ الْعِقَابِ، إِذَا وَقَعَ الْأَمْرُ بِفَصْلِ الْقَضَأِ( وَ خَسِرَ هُنالِكَ الْمُبْطِلُونَ ) . شَهِدَ عَلَى ذَلِكَ الْعَقْلُ إِذَا خَرَجَ مِنْ أَسْرِ الْهَوَى، وَ سَلِمَ مِنْ عَلاَئِقِ الدُّنْيَا.

কুফার কাজি শুরাইয়াহ ইবনে হারিছের (আল - কিন্দি) জন্য লিখেছিলেন

বর্ণিত আছে যে ,আমিরুল মোমেনিন কর্তৃক নিয়োজিত কুফার কাজী শুরাইয়াহ ইবনে হারিছ (আল - কিন্দি) আশি দিনার মূল্য দিয়ে একটা বাড়ি ক্রয় করেছিল । আমিরুল মোমেনিন এ সংবাদ অবগত হয়ে কাজীকে ডেকে এনে বললেন ,

“ আমি জানতে পেরেছি তুমি নাকি আশি দিনার মূল্যে একটা বাড়ি ক্রয় করেছে এবং সেজন্য একটা দলিল করে তাতেও স্বাক্ষার করেছো ৷ ”

শুরাইয়াহ বললেন , হ্যাঁ ;আমিরুল মোমেনিন ,আপনি যা শুনেছেন তা সত্য । ” আমিরুল মোমেনিন রাগত চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ

হে শুরাইয়াহ ,সাবধান হও ,সহসাই আজরাইল তোমার কাছে আসবে। সে তোমার দলিলের দিকে ফিরেও তাকাবে না বা তোমার স্বাক্ষর প্রদান বিষয়ে তোমাকে কোন কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। কিন্তু সে তোমাকে তোমার ক্রয়কৃত বাড়ি থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে এবং তোমাকে নির্জন করবে: একাকী অবস্থায় রেখে দেবে। দেখ ,হে শুরাইয়াহ ,যদি তুমি তোমার হালাল উপার্জন ব্যতীত কোন অবৈধ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা বাড়ির মূল্য দিয়ে থাক তবে তোমার ইহকাল ও পরকাল বিনষ্ট করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছো। যদি তুমি বাড়ি ক্রয় করার আগে আমার কাছে আসতে তা হলে আমি তোমার জন্য একখানা দলিল লিখে দিতাম যা দেখলে তুমি ওই বাড়িটি এক দিনার মূল্যেও ক্রয় করতে না। এ কথা বলে আমিরুল মোমেনিনা একখানা দলিল শুরাইয়াকে দিলেন যাতে লেখা ছিলঃ

এটা একটা ক্রয় দলিল যাতে আল্লাহর একজন দীনহীন বান্দা ক্রেতা এবং পরকালে প্রস্থানোদ্যত অন্য বান্দা বিক্রেতা । ক্রেতা ধ্বংসশীল স্থানের মরণশীলগণের এলাকার প্রবঞ্চনার বাড়িগুলোর মধ্য থেকে একটা বাড়ি খরিদ করেছে । এ বাড়িটির চারদিকের ঘোর - চৌহুদি নিম্নরূপ : প্রথম দিকের সীমানা - দুর্যোগের উৎসস্থলের অতি নিকটবর্তী ; দ্বিতীয় দিকের সীমানা - দুঃখ - দুর্দশার উৎসের সাথে যুক্ত ;তৃতীয় দিকের সীমানা - ধ্বংসাত্মক কামনা - বাসনার সাথে যুক্ত ;চতুর্থ দিকের সীমানা - প্রবঞ্চক শয়তানের সাথে যুক্ত এবং এদিকেই বাড়িটির দরজা খোলার পথ । এ বাড়িটি এমন এক ব্যক্তি ক্রয় করেছে যাকে কামনা - বাসনা আক্রমণ করে সর্বত্ব অপহরণ করে নিয়েছে এবং এমন এক ব্যক্তি বিক্রয় করেছে যাকে মৃত্যু তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে । বাড়িটির মূল্য হলো - পরিতৃপ্তির মর্যাদা পরিত্যাগ পূর্বক হতমান ও দুঃখ দুর্দশায় প্রবেশ । যদি ক্রেতা এ লেনদেনের কুফলের সম্মুখীন হয় তবে তা হবে সেব্যক্তির জন্য যে ( আজরাইল) রাজা - বাদশাদের সযত্নে লালিত দেহ গলিয়ে বিনষ্ট করে দিয়েছে ,স্বৈরশাসকদের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং ফেরাউন ,কিসরাস ,সিজার ,তুব্বা ও হিমায়ারদের বিশাল সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছে ।

তারা সকলেই সম্পদের পর সম্পদ স্তুপীকৃত করেছিল এবং সম্পদ বাড়িয়েই যাচ্ছিলো । তারা সুউচ্চ ইমারত নির্মাণ করেছিল এবং চোখ বালসানো সাজে তা সুসজ্জিত করেছিল । তারা ধন - রত্ব সংগ্রহ করেছিল এবং তাদের ধ্যান - ধারণা অনুযায়ী তারা দাবী করেছিল যে ,তাদের সন্তান - সন্ততিদের জন্য ওগুলো সঞ্চিত করেছিল যারা তাদেরকে হিসাব নিকাশ ও বিচারস্থলে পুরস্কার ও শাস্তির সময় সহায়তা করবে । তখন নির্দেশ হবে , যারা মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তারা আজ ক্ষতিগ্রস্তু (কুরআন - ৪:৭৮) ।

এ দলিল প্রজ্ঞা দ্বারা স্বাক্ষরিত ,এটা কামনা - বাসনার শিকলমুক্ত এবং দুনিয়ার চাকচিক্য থেকে দূরে সরানো |

___________________

১। কিসরাসঃ এটা খুসরাও ’ শব্দের আরবি রূপান্তর ,যার অর্থ হলো - বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী রাজা। ইরানের শাসনকর্তাদের উপাধি ছিল খুসরাও ” ।

২। সিজারঃ রোমের শাসকদের উপাধি সিজার ’ । ল্যাটিন ভাষায় এর অর্থ হলো - যে শিশুর মাতা প্রসবের পূর্বে মারা গেছে এবং মাতার পেট কেটে তাকে বের করে আনা হয়েছে। রোমের শাসকদের মধ্যে অগাস্টাস এভাবে জন্মেছিল বলে তাকে সিজার ’ বলা হতো এবং পরবর্তীতে রোমের শাসকগণ এটাকে উপাধি হিসাবে গ্রহণ করে ।

৩। তুব্বাঃ ইয়েমেনের রাজাদের উপাধি ছিল তুব্বা ’ । তারা হিমায়ের ও হাদ্রামাউত দখল করেছিল। তাদের নাম পবিত্র কুরআনের ৪৪: ৩৭ ও ৫০:১৪ আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে।

৪ । হিমায়েরঃ দক্ষিণ - পশ্চিম আরবের প্রাচীন সাবাইন রাজ্যের একটি প্রসিদ্ধ গোত্রের নাম। খৃষ্টপূর্ব ১১৫ সান থেকে ৫২৫ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তারা দক্ষিণ আরবের শক্তিশালী শাসক ছিল। হিমায়রগণ আজকের ইয়েমেনের উপকূলীয় অঞ্চল জুরায়দান (পরবর্তীতে কাতায়বান) নামক এলাকায় ঘনবসতি স্থাপন করেছিল। তারা সম্ভবত তাদের জ্ঞাতি সাবাইনদের ডিঙ্গিয়ে মিশর থেকে ভারত পর্যন্ত সমুদ্র পথে ব্যবসায় - বাণিজ্যের একটা পথ বের করেছিল। হিমায়রদের ভাষা ও কৃষ্টি ছিল সবাইনদের মতোই এবং তাদের রাজধানী ছিল জাফর। তাদের রাজ্য পূর্ব দিকে পারস্য উপসাগর ও উত্তর দিকে আরব মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। চতুর্থ শতাব্দীতে হিমায়রদের রাজধানী উত্তর দিকে সরিয়ে সানায় স্থানান্তরিত করা হয় এবং এ শতাব্দীর শেষভাগে ইহুদি ও খৃষ্টানগণ এ এলাকায় শক্ত সিড়ি গেড়ে বসেছিল। অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগে ৫২৫ খৃষ্টাব্দে আবিসিনিয়ানগণ হিমায়রদেরকে ধ্বংস করে দেয় (নিউ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা ,৫ম খণ্ড ,পৃঃ ৪৯) ।

পত্র - ৪

و من كتاب لهعليه‌السلام

(إلى بعض أمرأ جيشه)

فَإِنْ عَادُوا إِلَى ظِلِّ الطَّاعَةِ فَذَاكَ الَّذِي نُحِبُّ، وَ إِنْ تَوَافَتِ الْأُمُورُ بِالْقَوْمِ إِلَى الشِّقَاقِ وَ الْعِصْيَانِ فَانْهَدْ بِمَنْ أَطَاعَكَ إِلَى مَنْ عَصَاكَ، وَ اسْتَغْنِ بِمَنِ انْقَادَ مَعَكَ عَمَّنْ تَقَاعَسَ عَنْكَ، فَإِنَّ الْمُتَكَارِهَ مَغِيبُهُ خَيْرٌ مِنْ مَشْهَدِهِ، وَ قُعُودُهُ أَغْنَى مِنْ نُهُوضِهِ.

সেনাবাহিনীর একজন অফিসারকে লিখেছিলেন

যদি তারা ,আনুগত্যের ছাতার নিচে ফিরে আসে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করো না ;কারণ আমরা তো শুধু এটাই চাই যে ,তারা আনুগত্য ভঙ্গ না করুক। কিন্তু যদি এসব লোকের আচরণ গোলযোগ সৃষ্টি ও অনানুগত্যসূচক হয় তবে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। এদের মোকাবেলা করতে শুধু তাদের সঙ্গে রেখো ,যারা তোমাকে মান্য করে এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যারা তোমার সাথে যাবে তারাই তোমার প্রকৃত অনুসারী। যারা তোমার সাথে যাওয়া থেকে পিছিয়ে থাকবে তাদের সম্বন্ধে উদ্বীগ্ন হয়ো না। কারণ স্বতঃস্ফুর্ত উদ্যমহীন লোকের উপস্থিতি অপেক্ষা অনুপস্থিতি অধিকতর ভালো। নিরুদ্যম লোকের বাগাড়ম্বর অপেক্ষা চুপচাপ বসে থাকা অনেক ভালো।

___________________

১। বসরার গভর্ণর উসমান ইবনে হুনায়ফ যখন তালহা ও জুবায়েরের উপস্থিতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিনকে জানালেন তখন তিনি তাকে এ পত্র লিখেছিলেন। এ পত্রে আমিরুল মোমেনিন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে শক্র যদি একান্তই যুদ্ধের দিকে ঝুকে পড়ে তবে তা যেন মোকাবেলা করা হয় এবং এতে উসমানের সৈন্য তালিকায় তাদের যেন না নেয়া হয় যারা একদিকে তালহা ,জুবায়ের ও আয়শার ব্যক্তিত্বের প্রতি গুরুত্ব দেয়। অপর দিকে শুধুমাত্র যুক্তির খাতিরে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি হয়েছে। এ ধরনের লোক দৃঢ়পদে অবিচলিতভাবে যুদ্ধ করবে না এবং যুদ্ধের জন্য এ ধরনের লোক নির্ভরযোগ্যও নয়। বরং এ ধরনের লোক দলের অন্যদেরকে নিরুদ্যম করে ফেলে। সুতরাং এসব লোককে দল থেকে সরিয়ে রাখাই উত্তম।

পত্র - ৫

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى أشعث بن قيس و هو عامل أذربيجان

وَ إِنَّ عَمَلَكَ لَيْسَ لَكَ بِطُعْمَةٍ، وَ لَكِنَّهُ فِي عُنُقِكَ أَمَانَةٌ، وَ أَنْتَ مُسْتَرْعىً لِمَنْ فَوْقَكَ. لَيْسَ لَكَ أَنْ تَفْتَاتَ فِي رَعِيَّةٍ، وَ لاَ تُخَاطِرَ إِلا بِوَثِيقَةٍ وَ فِي يَدَيْكَ مَالٌ مِنْ مَالِ اللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ، وَ أَنْتَ مِنْ خُزَّانِهِ حَتَّى تُسَلِّمَهُ إِلَيَّ وَ لَعَلِّي أنْ لا أَكُونَ شَرَّ وُلاَتِكَ لَكَ، وَ السَّلاَمُ.

আজারবাইজানের গভর্ণর আশআছ ইবনে কায়েসকে (আল - কিন্দি) লিখেছিলেন

নিশ্চয়ই ,তোমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব এক গ্রাস খাদ্য নয়। এটা এমন এক বিষয় যা তোমার গ্রীবা জড়িয়ে রয়েছে এবং জনগণের নিরাপত্তার জন্য তোমার উপরস্থদের পক্ষে তোমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। জনগণের প্রতি অত্যাচারী হওয়া তোমার সাজে না ,আবার যথাযথ ক্ষেত্র ব্যতীত নিজকে বিপদাপন্ন করাও তোমার উচিত হবে না। তোমার হাতে যে পরিমাণ অর্থ - সম্পদের তহবিল আছে তা সর্বশক্তিমান ও ক্ষমতাশালী আল্লাহর সম্পদ। যে পর্যন্ত তুমি তা আমার কাছে পাঠিয়ে না দেবে সে পর্যন্ত তার দায় - দায়িত্ব তোমার। আমি কোনমতেই তোমার জন্য কুশাসকদের একজন হতে পারবো না এবং বিষয়টি এখানেই শেষ করলাম ।

___________________

১। জামালের যুদ্ধ শেষ হবার পর আজারবাইজানের গভর্ণর আশআছ ইবনে কায়েসকে (আল - কিন্দি) আমিরুল মোমেনিন এ পত্র লিখেছিলেন। আশাআছ উসমানের সময়কাল হতে আজারবাইজান এলাকার গভর্ণর ছিল। এ প্রদেশের রাজস্ব আয় প্রেরণ করার জন্য এ পত্রে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উসমান হত্যার পর হতে আশআছ নিজের অবস্থা সম্পর্কে ভীত হয়ে পড়ে। ফলে উসমানের সময়কার অন্যান্য অফিসারের মতো সেও প্রাপ্ত রাজস্ব আত্মসাৎ করার ফন্দি এঁটেছিলো। এ পত্র পাওয়ার পর সে তার প্রধান আমাত্যগণকে ডেকে বললো , আমার ভয় হয় ,এ অর্থ আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। কাজেই মুয়াবিয়ার সাথে যোগদান করাই বাঞ্ছণীয়। ” উপস্থিত সকলেই বললে , আমরা তোমার জ্ঞাতি গোষ্ঠী। আমাদেরকে ফেলে তুমি মুয়াবিয়ার আশ্রয়ে চলে যেতে চাচ্ছে - এটা বড়ই লজ্জার বিষয়। ” তাদের কথা শুনে আশআছ পালিয়ে যাবার ইচ্ছা পরিত্যাগ করলো। কিন্তু সে রাজস্ব প্রেরণ করতে রাজি হলো না। ইতোমধ্যে সংবাদ পেয়ে আমিরুল মোমেনিন তাকে কুফায় নিয়ে যাবার জন্য হুজর ইবনে আদি আল - কিন্দিকে প্রেরণ করলেন। হুজর তাকে বুঝিয়ে - শুজিয়ে কুফায় নিয়ে এলো। কুফায় এসে সে চার লক্ষ দিরহাম জমা দিলে আমিরুল মোমেনিন তাকে ত্রিশ হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন এবং অবশিষ্ট অর্থ সরকারি তহবিলে জমা দিয়েছিলেন।

পত্র - ৬

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى معاوية

إِنَّهُ بايَعَنِي الْقَوْمُ الَّذِينَ بايَعُوا أَبابَكْرٍ وَ عُمَرَ وَ عُثْمانَ عَلى ما بايَعُوهُمْ عَلَيْهِ، فَلَمْ يَكُنْ لِلشَّاهِدِ أَنْ يَخْتارَ، وَ لا لِلْغائِبِ أَنْ يَرُدَّ، وَ إِنَّمَا الشُّورى لِلْمُهاجِرِينَ وَ الْأَنْصارِ، فَإِنِ اجْتَمَعُوا عَلى رَجُلٍ وَ سَمَّوهُ إِماما كانَ ذلِكَ لِلَّهِ رِضىً، فَإِنْ خَرَجَ عَنْ أَمْرِهِمْ خارِجٌ بِطَعْنٍ أَوْ بِدْعَةٍ رَدُّوهُ إ لى ما خَرَجَ مِنْهُ، فَإِنْ أَبى قاتَلُوهُ عَلَى اتَّباعِهِ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ، وَ وَلاّهُ اللَّهُ ما تَوَلّى. وَ لَعَمْرِي - يا مُعاوِيَةُ - لَئِنْ نَظَرْتَ بِعَقْلِكَ دُونَ هَواكَ لَتَجِدَنِّي أَبْرَأَ النَّاسِ مِنْ دَمِ عُثْمانَ، وَ لَتَعْلَمَنَّ أَنِّي كُنْتُ فِي عُزْلَةٍ عَنْهُ إِلاّ أَنْ تَتَجَنَّى، فَتَجَنَّ ما بَدا لَكَ! وَ السَّلاَمُ

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানকে লিখেছিলেন

নিশ্চয়ই ,যারা আবু বকর ,উমর ও উসমানের বায়াত গ্রহণ করেছিল তারা একই ভিত্তিতে আমার বায়াত গ্রহণ করেছে। (সে ভিত্তিতে) যারা উপস্থিত ছিল তাদের বিকল্প চিন্তা ছিল না এবং যারা অনুপস্থিত ছিল তাদের প্রত্যাখ্যান করার কোন অধিকার নেই এবং এ বিষয়ে আলাপ - আলোচনা মুহাজিরগণ ও আনসারগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যদি তারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাউকে খলিফা হিসাবে গ্রহণ করে তবে তা আল্লাহর সন্তুষ্টি বলেই মনে করতে হবে। যদি কেউ আপত্তি প্রদর্শনের জন্য দূরে সরে থাকে তাহলে তারা তাকে সে অবস্থা থেকে ফিরিয়ে দেবে যেখান থেকে সে দূরে সরে ছিলো। সে অস্বীকার করলে তারা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। এ জন্য যে ,সে মোমিনের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসরণ করেছে এবং আল্লাহ তাকে সেখানে ফিরিয়ে আনবেন যেখান থেকে সে পালিয়ে গেছে। আমার জীবনের শপথ ,হে মুয়াবিয়া ,যদি তুমি তোমার মস্তিস্ক থেকে সকল আবেগ ও রোষ বিদূরিত করে নিরপেক্ষভাবে দেখ ,তাহলে তুমি দেখতে পাবে যে ,উসমানের হত্যার জন্য আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। যা তোমার কাছে দিবালোকের মতো সত্য ,তা যদি তুমি গোপন না কর তাহলে নিশ্চয়ই ,তুমি জান আমি উসমানের সাথে সব কিছুতেই অসম্পৃক্ত ছিলাম এবং তার কাছ থেকে আমি দূরে সরে থাকতাম। এরপরও যদি তুমি ভালো মনে কর আমার ওপর আঘাত হানতে পার এবং এখানেই বিষয়টি শেষ করলাম ।

____________________

১। মদিনার সকল লোক যখন ঐকমত্যে আমিরুল মোমেনিনের বায়াত গ্রহণ করেছিলো তখন মুয়াবিয়া তার ক্ষমতা বিপদাপন্ন মনে করে চারদিকে ছড়াতে লাগলো যে ,আমিরুল মোমেনিন ঐকমত্যের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচিত হননি। এ ধুয়া তুলে সে পুনরায় সাধারণ নির্বাচন দাবী করতে লাগলো। আবু বকরের সময় থেকেই একটা রীতি প্রচলিত হয়ে এসেছিল যে ,মদীনাবাসীগণ যাকে খলিফা নির্বাচিত করবে। সে সমগ্র মুসলিম জাহানের খলিফা বলেই গণ্য হবে। এতে কারো কোন প্রশ্ন করার অধিকার থাকবে না। এ নীতি অনুযায়ী আমিরুল মোমেনিনের ক্ষেত্রে পুনঃনির্বাচন দাবী করার কোন অধিকার মুয়াবিয়ার নেই এবং মদিনাবাসীদের বায়াত অস্বীকার করার অধিকারও তার নেই। আমিরুল মোমেনিন এ পত্রে তাকে সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তার প্রচারণার প্রেক্ষিতে তাকে প্রদমিত করার জন্য আমিরুল মোমেনিন এ যুক্তি দেখিয়েছেন। মূলত তিনি কখনো গোত্র প্রধানদের আলোচনা বা সাধারণ লোকের ভোটের ভিত্তিতে খলিফা নির্বাচনের নীতি মেনে নিতেন না । সে কারণেই মুহাজির ও আনসারদের ঐকমত্যে মনোনীত খলিফার হাতে তিনি বায়াত গ্রহণ করেনি। তিনি খেলাফতের এ স্বরচিত নীতি - পদ্ধতি বৈধ মনে করতেন না। সে কারণেই তিনি সর্বদা খেলাফতে তার অধিকারের কথা বলতেন যা তাকে রাসূল (সা.) মুখে ও দলিলে দিয়েছিলেন। কিন্তু মুয়াবিয়ার প্রতিশ্রুতি ও বিশ্বাস মতে তার মুখ বন্ধ করার জন্যই ঐকমত্যের যুক্তি দেখিয়েছেন। বস্তুত মুয়াবিয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নানা প্রকার ছুতানাতা ধরে কালক্ষেপণ করা এবং তার অনুকূলে জনসমর্থন নেয়া।

পত্র - ৭

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلَيْهِ( معاویه) أَيْضا

أَمّا بَعْدُ، فَقَدْ أَتَتْنِي مِنْكَ مَوْعِظَةٌ مُوَصَّلَةٌ، وَ رِسالَةٌ مُحَبَّرَةٌ، نَمَّقْتَها بِضَلالِكَ، وَ أَمْضَيْتَها بِسُوءِ رَأْيِكَ، وَ كِتابُ امْرِئٍ لَيْسَ لَهُ بَصَرٌ يَهْدِيهِ، وَ لا قائِدٌ يُرْشِدُهُ، قَدْ دَعاهُ الْهَوى فَأَجابَهُ، وَ قادَهُ الضَّلالُ فَاتَّبَعَهُ، فَهَجَرَ لاغِطا وَ ضَلَّ خابِطاً.

لِأَنَّها بَيْعَةٌ واحِدَةٌ لا يُثَنَّى فِيهَا النَّظَرُ، وَ لا يُسْتَأنَفُ فِيهَا الْخِيارُ. الْخارِجُ مِنْها طاعِنٌ، وَ الْمُرَوِّي فِيها مُداهِنٌ.

মুয়াবিয়ার প্রতি

আমি তোমার প্রেরিত অলঙ্কারপূর্ণ পত্রে বর্ণিত অসংলগ্ন উপদেশের প্যাকেট পেয়েছি। তুমি তোমার গোমরাহির কারণে এসব লিখেছো এবং অজ্ঞতার কারণে তা আমার কাছে প্রেরণ করেছো। এ পত্রখানা এমন ব্যক্তির কাছ থেকে এসেছে অন্যকে পথ দেখাবার মতো আলো যার নেই এবং অন্যকে ন্যায় পথে পরিচালিত করার মতো নেতৃত্ব যার নেই। কামন - বাসনা - লালসা তোমাকে চেপে বসেছে ,আর তার তাড়নায় তুমি এ পত্র লিখেছো। গোমরাহি তোমাকে পেয়ে বসেছে ,তাই তুমি গোমরাহ হয়ে গেছে। সে কারণেই তুমি আবোল - তাবোল কথা বলেছো এবং বলগাহীনভাবে বিপথগামী হয়ে পড়েছো।

তোমার জানা উচিত ,বায়াত একবারই হয়ে থাকে। এটা পুনর্বিবেচনা করার কোন অবকাশ নেই এবং পুনঃ নির্বাচন করার কোন জো নেই। যে ব্যক্তি বায়াত থেকে সরে থাকে সে ইসলামের ক্ষতিকারক এবং যে ব্যক্তি কৌশলে সত্যকে এড়িয়ে যায় সে মোনাফিক ।

পত্র - ৮

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللّهِ البَجَلِىّ لَمَا أَرْسَلَهُ إلى مُعاوِيَةَ

أَمّا بَعْدُ، فَإِذا أَتاكَ كِتابِي فَاحْمِلْ مُعاوِيَةَ عَلَى الْفَصْلِ، وَخُذْهُ بِالْأَمْرِ الْجَزْمِ، ثُمَّ خَيِّرْهُ بَيْنَ حَرْبٍ مُجْلِيَةٍ، أَوْ سِلْمٍ مُخْزِيَةٍ، فَإِنِ اخْتارَ الْحَرْبَ فَانْبِذْ إِلَيْهِ، وَ إِنِ اخْتارَ السِّلْمَ فَخُذْ بَيْعَتَهُ، وَالسَّلامُ.

জারির ইবনে আবদিল্লাহ আল - বাজালীকে মুয়াবিয়ার কাছে প্রেরণ করলে তার ফিরে আসতে বিলম্ব দেখে আমিরুল মোমেনিন তাকে এ পত্র লিখেছেন

আমার এ পত্র পাওয়া মাত্র মুয়াবিয়াকে বলো যেন সে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সে যেন একটা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে। তাকে স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করো - যে যুদ্ধের নেশা তাকে ঘরছাড়া করেছে সে কি তা চায় নাকি শান্তি (তার দৃষ্টিতে যা অপমানকর) চায়। যদি সে যুদ্ধ চায় তবে তাকে ত্যাগ করে চলে এসো ;আর যদি সে শান্তি চায়। তবে তার বায়াত গ্রহণ করো। বিষয়টি এখানে শেষ করলাম ।

পত্র - ৯

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى مُعاوِيَة

فَأَرادَ قَوْمُنا قَتْلَ نَبِيِّنا، وَاجْتِياحَ أَصْلِنا، وَهَمُّوا بِنَا الْهُمُومَ، وَ فَعَلُوا بِنَا الْأَفاعِيلَ، وَ مَنَعُونَا الْعَذْبَ، وَ أَحْلَسُونَا الْخَوْفَ، وَاضْطَرُّونا إِلى جَبَلٍ وَعْرٍ، وَ أَوْ قَدُوا لَنا نارَ الْحَرْبِ،

فَعَزَمَ اللَّهُ لَنا عَلَى الذَّبِّ عَنْ حَوْزَتِهِ، وَالرَّمْي مِنْ وَرأِ حُرْمَتِهِ، مُؤْمِنُنا يَبْغِي بِذلِكَ الْأَجْرَ، وَ كافِرُنا يُحامِي عَنِ الْأَصْلِ، وَ مَنْ أَسْلَمَ مِنْ قُرَيْشٍ خِلْوٌ مِمّا نَحْنُ فِيهِ بِحِلْفٍ يَمْنَعُهُ، أَوْ عَشِيرَةٍ تَقُومُ دُونَهُ، فَهُوَ مِنَ الْقَتْلِ بِمَكانِ أَمْنٍ. وَ كانَ رَسُولُ اللَّهِ،صلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم إِذا احْمَرَّ الْبَأْسُ، وَ أَحْجَمَ النّاسُ قَدَّمَ أَهْلَ بَيْتِهِ فَوَقَى بِهِمْ أَصْحابَهُ حَرَّ السُّيُوفِ وَالْأَسِنَّةِ، فَقُتِلَ عُبَيْدَةُ بْنُ الْحارِثِ يَوْمَ بَدْرٍ، وَ قُتِلَ حَمْزَةُ يَوْمَ أُحُدٍ، وَ قُتِلَ جَعْفَرٌ يَوْمَ مُؤْتَةَ، وَ أَرادَ مَنْ لَوْ شِئْتُ ذَكَرْتُ اسْمَهُ مِثْلَ الَّذِي أَرادُوا مِنَ الشَّهادَةِ، وَ لَكِنَّ آجالُهُمْ عُجِّلَتْ، وَ مَنِيَّتَهُ أُجِّرَتْ.

فَيا عَجَبا لِلدَّهْرِ! إِذْ صِرْتُ يُقْرَنُ بِي مَنْ لَمْ يَسْعَ بِقَدَمِي، وَ لَمْ تَكُنْ لَهُ كَسابِقَتِي، الَّتِي لا يُدْلِي أَحَدٌ بِمِثْلِها، إِلاّ أَنْ يَدَّعِيَ مُدَّعٍ مَا لا أَعْرِفُهُ، وَ لا أَظُنُّ اللَّهَ يَعْرِفُهُ. وَالْحَمْدُ لِلَّهِ عَلَى كُلِّ حالٍ.

وَ أَمَّا ما سَأَلْتَ مِنْ دَفْعِ قَتَلَةِ عُثْمانَ إِلَيْكَ، فَإِنِّي نَظَرْتُ فِي هَذا الْأَمْرِ، فَلَمْ أَرَهُ يَسَعُنِي دَفْعُهُمْ إِلَيْكَ وَ لا إِلى غَيْرِكَ، وَ لَعَمْرِي لَئِنْ لَمْ تَنْزِعْ عَنْ غَيِّكَ وَ شِقاقِكَ لَتَعْرِفَنَّهُمْ عَنْ قَلِيلٍ يَطْلُبُونَكَ، لا يُكَلِّفُونَكَ طَلَبَهُمْ فِي بَرِّ وَ لا بَحْرٍ وَ لا جَبَلٍ وَ لا سَهْلٍ إِلاّ أَنَّهُ طَلَبٌ يَسُوْءُكَ وِجْدانُهُ، وَ زَوْرٌ لا يَسُرُّكَ لُقْيانُهُ، وَالسَّلامُ لِأَهْلِهِ.

মুয়াবিয়ার প্রতি

কুরাইশগণ আমাদের রাসূলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল এবং আমাদের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছিল। তারা আমাদেরকে সর্বদা উদ্বীগ্ন অবস্থায় রাখতো ,আমাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করতো ,আমাদের জীবনের আরাম - আয়েশ দূর করে দিয়েছিলো ,আমাদেরকে সর্বদা - আতঙ্কিত রাখতো ,পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করতে আমাদেরকে বাধ্য করেছিলো এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধানল প্রজ্জ্বলিত করেছিলো ।

এ অবস্থায় মহান আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে রক্ষা করা ও তাঁর সম্মানকে সমর্থন করার জন্য আমাদেরকে দৃঢ় - সংকল্প - চিত্ত করে দিলেন। আমাদের মধ্যকার ইমানদারগণ ঐশী পুরস্কারের আশায় এবং অবিশ্বাসীগণ জ্ঞাতিত্বের টানে আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছিল। কুরাইশদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা আমাদের চেয়ে অনেক কম দুঃখ - দুর্দশা ভোগ করেছিল। এর কারণ হলো - হয় তারা প্রতিরক্ষামূলক প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত ছিল ,না হয় তাদের গোত্রগত অবস্থান (অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কিছু করলে গোটা গোত্র তার সমর্থনে চলে যাবে) । সেজন্য তারা হত্যা থেকে নিরাপদ ছিল। রাসূলের (সা.) হাতে যে একটা পথ ছিল তা হলো যুদ্ধ যখন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতো এবং তার যোদ্ধাদের যখন অবস্থান হারানোর উপক্রম হতো তখন তিনি স্বজনদেরকে অগ্রগামী করে পাঠাতেন এবং তাদের মাধ্যমে নিজের অনুচরদেরকে তরবারি ও বর্শা থেকে রক্ষা করতেন। এভাবেই বদরের যুদ্ধে উবাদাহ ইবনে আল - হারিছ ,ওহুদের যুদ্ধে হামজাহ্ ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং মুতা যুদ্ধে জাফর ইবনে আবি তালিব শহীদ হয়েছিলেন। রাসূল (সা.) তাঁর আপনজনদের মধ্যে আরেকজনকেও (যার নাম তুমি ভালোভাবে জান অর্থাৎ আলী) বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগামী করে প্রেরণ করেছিলেন। কিন্তু শাহাদত বরণ করার জন্য তার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মৃত্যু নির্ধারিত ছিল না বলে সে এখনো বেঁচে আছে।

এটা বড়ই আশ্চর্যের - বিষয় যে ,আমি কিরূপে এমন একজনের দলভুক্ত হতে পারি যে ধর্ম বিষয়ে আমার মতো কর্মচঞ্চল পদক্ষেপ কখনো দেখে নি অথবা এ বিষয়ে আমার মতো কোন অবস্থান যার নেই এবং সে এমন কিছু অবদান দাবী করে যা আমার জানা নেই এবং আমি মনে করি তাঁর এসব দাবী সম্পর্কে আল্লাহও অবহিত নন। যা হোক ,সকল প্রশংসা মহিমান্বিত আল্লাহর ।

উসমানের হত্যাকারীদেরকে তোমার হাতে তুলে দেয়ার জন্য তোমার অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি বলতে চাই যে ,আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে দেখেছি এবং তাদেরকে তোমার হাতে বা অন্য কারো হাতে তুলে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার জীবনের শপথ ,যদি তুমি তোমার ভ্রান্ত পথ ও ফেতনামূলক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ না কর তবে নিশ্চয়ই তুমি তাদেরকে চেন। তারা সহসাই তোমাকে খোজ করে নেবে। তাদেরকে জলে - স্থলে - পর্বতে - সমতলে খোঁজার কষ্ট তারা তোমাকে দেবে না। কিন্তু তাদের এ অনুসন্ধান তোমার জন্য বেদনাদায়ক হবে এবং তাদের সাক্ষাত তোমাকে আনন্দ দেবে না। যারা শান্তি চায় তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক ।

____________________

১। আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আল্লাহর রাসূল যখন আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য মানুষকে আহবান করেছিলেন তখন কাফের কুরাইশ গোত্র এ সত্যের বাণী স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য তাদের সমগ্র শক্তি দিয়ে রুখে দাড়িয়েছিল। এ প্রতিমা পূজারী দলের হৃদয়ে প্রতিমা - প্রীতি এত প্রকট ছিল যে ,তারা তাদের প্রতিমার বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে রাজি ছিল না। এক আল্লাহর ধারণা তাদের সকল ধৈর্যচ্যুতির জন্য যথেষ্ট ছিল। এ অবস্থায় তারা শুনতে পেল তাদের দেবতাগুলো সামান্য নির্জীব ,নিশ্চল ও জড় পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়। যখন তারা দেখলো তাদের বিশ্বাস ও নীতি বিপদাপন্ন হয়ে পড়ছে তখন তারা রাসূলকে (সা.) বিপদগ্রস্থ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ ও সকল উপায় অবলম্বন করতে লাগলো। তারা এমন সব ক্লেশদায়ক উপায় অবলম্বন করলো যে ,ঘরের বাইরে যাওয়া পর্যন্ত রাসূলের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লো। এ সময় যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের ওপর অবারিত অত্যাচার তারা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এ সময় নওমুসলিমগণ সিজদা করলে তাদেরকে জ্ঞান হারানো পর্যন্ত বেত্রাঘাত ও প্রস্তরাঘাত করা হতো। কুরাইশদের এরূপ নিষ্ঠুর অত্যাচার দেখে রেসালতের পঞ্চম বছরে রাসূল (সা.) তাঁর অনুসারীগণকে আবিসিনিয়া হিজরত করার অনুমতি দিয়েছিলেন। নিষ্ঠুর কুরাইশগণ তাদের পিছু নিয়ে আবিসিনিয়াও গিয়েছিল ,কিন্তু আবিসিনিয়ার শাসক রাসূলের অনুসারীদেরকে কুরাইশদের হাতে তুলে দেননি এবং তার মহত্ত্বের ফলে তারা সেখানে কোন বিপদে পড়েনি।

এদিকে রাসূলের বাণী ক্রমাগত বেড়েই চলছে এবং সত্যের আকর্ষণ মানুষের মনে দোলা দিতে লাগলো। তাঁর বাণী ও ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে মানুষ দলে দলে তাঁর ছাতার নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে দেখে কুরাইশগণ জ্বলে পুড়ে যাচ্ছিলো এবং তাদের অবলম্বিত সকল উপায় ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে দেখে বনি হাশিমের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো। তারা আশা করেছিল। সকল প্রকার সামাজিক সম্পর্ক ও লেনদেন বন্ধ করে দিলে বনি হাশিম ও বনি আবদ - আল মুত্তালিব রাসূলকে (সা.) সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেবে এবং তাতে স্বাভাবিকভাবেই রাসূল (সা.) দমে যাবেন। কুরাইশগণ নিজেদের মধ্যে এ বয়কট বাস্তবায়নের জন্য পরস্পর চুক্তিবদ্ধ হলো। এ চুক্তির ফলে বনি হাশিম একঘরে হয়ে পড়লো। কেউ তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে না - তাদের দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমনকি তাদের সঙ্গে মালপত্র বেচাকেনা করাও বন্ধ করে দেয়। এ সময় বনি হাশিমের জন্য একটা দুশ্চিন্তা প্রকট হয়ে উঠেছিলো ;তা হলো শহরের বাইরের উপত্যকায় যে কোন সময় রাসূলের (সা.) আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সবকিছু বিবেচনা করে বনি হাশিম আবি তালিবের শিব (বাসা) নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বনি হাশিমের যে সকল সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেছিল তারা সকলেই শিব - ই - আবি তালিব ” - এ আশ্রয় নিয়েছিল। আর যারা তখনো ইসলাম গ্রহণ করেনি। তারা জ্ঞাতিত্ব ও গোত্র টানে তাদের প্রতিরক্ষা বিধান করেছিল। এ সময় হামজা ও আবি তালিব নিজেদের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে রাসূলের (সা.) প্রতিরক্ষা বিধান করেছিল এবং তারা সারাক্ষণ রাসূলকে (সা.) সান্তুনা দিতেন। শত্রুর আক্রমণের ভয়ে প্রতিরাতে রাসূলকে কয়েকবার বিছানা বদল করে ঘুমাতে দিতেন। রাসূলকে একটা বিছানা থেকে সরিয়ে তাঁর স্থলে আলীকে শুইয়ে রাখতেন।

বয়কটের এ দিনগুলো বনি হাশিমের জন্য বড়ই কষ্টদায়ক ছিল। তারা দিনের পর দিন উপোস করে কাটিয়েছে - এমন কি গাছের পাতা খেয়েও দিনাতিপাত করেছে। তিন বছর এভাবে নিদারুণ কষ্টে কাটানোর পর জুহায়র ইবনে আবি উমাইয়া (যার মাতা ছিল আতিকা বিনতে আবদ আল মুত্তলিব) ,হিশাম ইবনে আমর ইবনে রাবিয়াহ (যে তার মায়ের দিক থেকে বনি হাশিমের আত্মীয়) ,আল মুতিম ইবনে আদি ইবনে নওফল ইবনে আবদ মনাফ ,আবুল বখতারী আল - আস ইবনে হিশাম ইবনে আল - মুঘিরাহ এবং জামাআহ ইবনে আল - আসওয়াদ ইবনে আল - মুত্তালিব বয়কট চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব করলে কুরাইশ নেতাগণ কাবায় একটা আলোচনা বৈঠক করে। আবু তালিব উপত্যকার নির্বাসন স্থান থেকে এসে এ বৈঠকে হাজির হয়ে বললেন , আমার ভ্রাতুষ্পপুত্র মুহাম্মদ বলেছে তোমাদের চুক্তির সমুদয় লেখা সাদা - পিপীলিকায় খেয়ে ফেলেছে ;শুধুমাত্র আল্লাহর নামটুকু অবশিষ্ট আছে। তোমরা চুক্তিপত্রটি আনা। যদি তার কথা সত্য হয় তবে তোমরা তার শক্রতা পরিহার কর। আর যদি তার কথা সত্য না হয় তবে আমি তাকে তোমাদের হাতে তুলে দেব। ” এতে তারা রাজি হয়ে চুক্তিপত্র এনে দেখতে পেলো যে ,আল্লাহর নাম ব্যতীত অপর সকল লেখা সাদা - পিপড়ায় খেয়ে ফেলেছে। এ অবস্থা দেখে আল - মুতিম ইবনে আদি চুক্তি পত্রটি ছিড়ে ফেলে দিয়েছিলো। এভাবে বয়কট চুক্তির অবসান ঘটে এবং বনি হাশিম নিদারুণ দুঃখ কষ্ট হতে নিস্কৃতি পায়। এরপরও রাসূলের (সা.) প্রতি কাফেরদের আচরণে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি ;বরং তারা রাসূলের (সা.) প্রাণনাশের ফন্দি এটেছিল ,যে কারণে তাকে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছিল। অবশ্য এ সময় আবু তালিব জীবিত ছিলেন না। হিজরতের সময়ও আলী রাসূলের (সা.) বিছানায় শুয়ে থেকে রাসূলকে রক্ষা করার শেখানো পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন।

এসব ঘটনা মুয়াবিয়ার অজানা ছিল না। তবুও আমিরুল মোমেনিন তার পূর্ব পুরুষদের আচরণ তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে সে সত্যের অনুসারী ও মিথ্যার অনুসারীদের আচরণ বুঝতে পেরে ন্যায় ,সত্য ও হেদায়েতের পথে আসতে পারে।

পত্র - ১০

و من كتاب لهعليه‌السلام

إليْهِ أَيْضَا

الکشف عن نفاق معاویة

وَ كَيْفَ أَنْتَ صانِعٌ إِذا تَكَشَّفَتْ عَنْكَ جَلابِيبُ ما أَنْتَ فِيهِ مِنْ دُنْيا قَدْ تَبَهَّجَتْ بِزِينَتِها، وَ خَدَعَتْ بِلَذَّتِها. دَعَتْكَ فَأَجَبْتَها، وَ قادَتْكَ فَاتَّبَعْتَها، وَ أَمَرَتْكَ فَأَطَعْتَها. وَ إِنَّهُ يُوشِكُ أَنْ يَقِفَكَ واقِفٌ عَلى ما لا يُنْجِيكَ مِنْهُ مُنْجٍ، فَاقْعَسْ عَنْ هَذا الْأَمْرِ، وَخُذْ أُهْبَةَ الْحِسابِ، وَ شَمِّرْ لِما قَدْ نَزَلَ بِكَ، وَ لا تُمَكِّنِ الْغُواةَ مِنْ سَمْعِكَ، وَ إِلاّ تَفْعَلْ أُعْلِمْكَ ما أَغْفَلْتَ مِنْ نَفْسِكَ فَإِنَّكَ مُتْرَفٌ قَدْ أَخَذَ الشَّيْطانُ مِنْكَ مَأْخَذَهُ، وَ بَلَغَ فِيكَ أَمَلَهُ، وَ جَرى مِنْكَ مَجْرَى الرُّوحِ وَالدَّمِ. وَ مَتى كُنْتُمْ يا مُعاوِيَةُ ساسَةَ الرَّعِيَّةِ، وَ وُلاةَ أَمْرِ الْأُمَّةِ، بِغَيْرِ قَدَمٍ سابِقٍ، وَ لا شَرَفٍ باسِقٍ، وَ نَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ لُزُومِ سَوابِقِ الشَّقأِ! وَ أُحَذِّرُكَ أَنْ تَكونَ مُتَمادِيا فِي غِرَّةِ الْأُمْنِيِّةِ، مُخْتَلِفَ الْعَلانِيَةِ وَالسَّرِيرَةِ.

وَ قَدْ دَعَوْتَ إِلَى الْحَرْبِ، فَدَعِ النّاسَ جانِبا وَاخْرُجْ إِلَيَّ، وَ أَعْفِ الْفَرِيقَيْنِ مِنَ الْقِتالِ لِيُعْلَمَ أَيُّنَا الْمَرِينُ عَلى قَلْبِهِ وَالْمُغَطّى عَلَى بَصَرِهِ! فَأَنَا أَبُو حَسَنٍ قاتِلُ جَدِّكَ وَ خالِكَ وَ أَخِيكَ شَدْخا يَوْمَ بَدْرٍ، وَ ذلِكَ السَّيْفُ مَعِي، وَ بِذلِكَ الْقَلْبِ أَلْقى عَدُوِّي، مَا اسْتَبْدَلْتُ دِينا، وَ لا اسْتَحْدَثْتُ نَبِيّا، وَ إِنِّي لَعَلَى الْمِنْهاجِ الَّذِي تَرَكْتُمُوهُ طائِعِينَ، وَ دَخَلْتُمْ فِيهِ مُكْرَهِينَ.

وَ زَعَمْتَ أَنَّكَ جِئتَ ثائِرا بدَمِ عُثْمانَ. وَ لَقَدْ عَلِمْتَ حَيْثُ وَقَعَ دَمُ عُثْمانَ فَاطْلُبْهُ مِنْ هُناكَ إِنْ كُنْتَ طالِباً، فَكَأَنِّي قَدْ رَأَيْتُكَ تَضِجُّ مِنَ الْحَرْبِ إِذا عَضَّتْكَ ضَجِيجَ الْجِمالِ بِالْأَثْقالِ، وَ كَأَنِّي بِجَماعَتِكَ تَدْعُونِي - جَزَعا مِنَ الضَّرْبِ الْمُتَتابِعِ، وَالْقَضأِ الْواقِعِ، وَ مَصارِعَ بَعْدَ مَصارِعَ - إِلى كِتابِ اللَّهِ وَ هِيَ كافِرَةٌ جاحِدَةٌ، أَوْ مُبايِعَةٌ حائِدَةٌ.

মুয়াবিয়ার প্রতি

মুয়াবিয়ার কপটতা উম্মোচন

এ দুনিয়ার যা কিছু তোমাকে ঘিরে রেখেছে তা থেকে যখন তোমাকে সরিয়ে নেয়া হবে তখন তুমি কী করবে ? দুনিয়া তার চাকচিক্য দিয়ে তোমাকে আকৃষ্ট করেছে এবং ভোগ - বিলাস ও আনন্দ - উল্লাস দিয়ে তোমাকে প্রতারিত করছে। দুনিয়া তোমাকে আহবান করেছে আর তুমি সে আহবানে উৎফুল্ল চিত্তে সাড়া দিয়েছো। দুনিয়া তোমাকে পরিচালিত করছে ,আর তুমি দুনিয়াকে অনুসরণ করে চলছো। দুনিয়া তোমাকে আদেশ দিচ্ছে ,আর তুমি সে আদেশ অবনত মস্তকে মেনে চলছো। সহসাই এক নকিব তোমাকে সব কিছু অবহিত করাবে যার হাত থেকে তোমাকে রক্ষা করার মতো কোন বর্ম নেই। সুতরাং দুনিয়ার ধান্দাবাজি থেকে দূরে সরে থাক ,শেষ - বিচারের হিসাব - নিকাশের প্রতি খেয়ালি হও ,মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাক যা তোমাকে যে কোন মুহুর্তে পরাভূত করবে এবং যারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের কথায় কান দিয়ে না। আমার উপদেশ মেনে চলো ;তোমার আরাম - আয়েশ ও বিলাসবহুল জীবন যাপনের ফলে তুমি যা ভুলে গেছ আমি শুধু তা তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। শয়তান তার দৃঢ় মুষ্টিতে তোমাকে এটে ধরেছে ,তোমার মাধ্যমে তার আকাঙ্খা পরিপূর্ণ করছে এবং তোমার আত্মা ও রক্তের যেরূপ নিয়ন্ত্রণ তোমার ওপর রয়েছে শয়তান তোমাকে তদ্রূপ নিয়ন্ত্রণ করছে।

হে মুয়াবিয়া ,কোন প্রকার অগ্রণী ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য ছাড়াই তুমি কখন জনগণের রক্ষাকর্তা ( ?) ও তাদের কর্মকান্ডের অভিভাবক ( ?) বনেছো ? অতীতে দুর্ভাগ্যজনক ধ্বংস থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করি। আমি তোমাকে সর্তক করছি পাছে তুমি কামনা - বাসনার তাড়নায় আরো অধিক তাড়িত হও এবং তোমার বাতেন ও জাহের যেন ভিন্নধরনের না থাকে।

তুমি আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছো। জনগণকে এক দিকে সরিয়ে রেখে তুমি নিজে আমার মোকাবেলা করলে ভালো হয়। উভয় পক্ষের জনগণকে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আমার সম্মুখে চলে আসো। তোমার ও আমার যুদ্ধেই প্রমাণিত হবে কার হৃদয় মরচে পড়া এবং কার চোখ অজ্ঞতায় ঢাকা । মনে রেখো ,আমি আবুল হাসান যে তোমার পিতামহকে (উতবা ইবনে রাবিআহ) ,তোমার ভ্রাতাকে (হানযালাহ ইবনে আবি সুফিয়ান) ,তোমার চাচাকে (অলিদ ইবনে উতবা) বদরের যুদ্ধে খণ্ড বিখণ্ড করে হত্যা করেছিল। সে - ই তরবারিটি এখনো আমার কাছে আছে এবং আমি এখনো সে দিনের মতো একই মনোভাব নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করি। আমি দ্বীনের কোন কিছুই পরিবর্তন করিনি এবং আমি কোন নতুন নবী নির্বাচন করিনি। নিশ্চয়ই ,আমি দ্বীনের রাজপথে চলছি যা তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিত্যাগ করেছো এবং জোর জবরদস্তির পথ বেছে নিয়েছো।

তুমি প্রচার কর - তুমি উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্য বের হয়েছো। নিশ্চয়ই তুমি জান ,কিভাবে উসমানের রক্তপাত ঘটেছিল। যদি তুমি উসমানের রক্তের বদলা নিতে চাও তবে যেখানে তার রক্তপাত ঘটেছে সেখানে বদলা নাও । আমি দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধ যখন দাঁত কটমটিয়ে তোমার দিকে তাকায় তখন তুমি সেরূপ চিৎকার কর ,বোঝার ভারে উট যেমন চিৎকার করে। আমি আরো দেখতে পাচ্ছি ,তরবারির অবিরাম আঘাতে মৃতদেহ পড়তে দেখে তোমার দল হতবুদ্ধি হয়ে আমাকে কুরআনের আহবান করছে। যদিও এসব লোক হয় অবিশ্বাসী ,না হয় সত্যত্যাগী ,না হয় বায়াত ভঙ্গকারী।

___________________

১। সিফফিনের যুদ্ধ যাত্রার আগে আমিরুল মোমেনিন মুয়াবিয়াকে এ পত্র লিখেছিলেন। এখানে অল্প কথায় তিনি সিফফিনের পূর্ণ দৃশ্য ব্যক্ত করেছেন। ইরাকিদের আক্রমণে সিরিয়া বাহিনী হতবুদ্ধি হয়ে পালিয়ে যাবার চিন্তা করছিলো। তখন রক্ষা পাবার জন্য বর্শার ডগায় কুরআন তুলে শান্তির জন্য চিৎকার করছিলো। হাদীদ লিখেছেনঃ

আমিরুল মোমেনিনের এ ভবিষ্যদ্বানি থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝা যায় যে ,তাঁর ইলমুল গায়েব অত্যন্ত প্রখর ছিল। এহেন ভবিষ্যদ্বানি প্রকৃতই একটা অত্যাশ্চার্য বিষয়।

পত্র - ১১

و من وصية لهعليه‌السلام

وصَى بِها جَيْشا بَعَثَهُ إلَى الْعَدُوِّ

فَإِذا نَزَلْتُمْ بِعَدُوِّ أَوْ نَزَلَ بِكُمْ، فَلْيَكُنْ مُعَسْكَرُكُمْ فِي قُبُلِ الْأَشْرافِ، أَوْ سِفاحِ الْجِبالِ، أَوْ أَثْنأِ الْأَنْهارِ، كَيْما يَكُونَ لَكُمْ رِدْءا، وَ دُونَكُمْ مَرَدّا، وَلْتَكُنْ مُقاتَلَتُكُمْ مِنْ وَجْهٍ وَاحِدٍ أَوِاثْنَيْنِ، وَاجْعَلُوا لَكُمْ رُقَبأَ فِي صَياصِي الْجِبالِ، وَ مَناكِبِ الْهِضابِ، لِئَلاّ يَأْتِيَكُمُ الْعَدُوُّ مِنْ مَكانِ مَخافَةٍ أَوْ أَمْنٍ. وَاعْلَمُوا أَنَّ مُقَدِّمَةَ الْقَوْمِ عُيُونُهُمْ، وَ عُيُونَ الْمُقَدِّمَةِ طَلائِعُهُمْ. وَ إِيّاكُمْ وَالتَّفَرُّقَ: فَإِذا نَزَلْتُمْ فَانْزِلُوا جَمِيعاً، وَ إِذا ارْتَحَلْتُمْ فَارْتَحِلُوا جَمِيعاً، وَ إِذا غَشِيَكُمُ الليْلُ فَاجْعَلُوا الرِّماحَ كِفَّةً، وَ لا تَذُوقُوا النَّوْمَ إِلاّ غِرارا أَوْ مَضْمَضَةً.

শক্রর মোকাবেলায় প্রেরিত সৈন্যবাহিনীর প্রতি

যখন তোমরা শত্রুর দিকে এগিয়ে যাও অথবা শক্র তোমাদের দিকে এগিয়ে আসে তখন তোমরা উচু স্থানের বা পাহাড়ের ঢালে অথবা নদীর বাঁকে এমন স্থানে অবস্থান গ্রহণ করো যে স্থান তোমাদেরকে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে এবং প্রয়োজনে একটু পিছিয়ে যাবার উপায় থাকে। তোমাদের আক্রমণ যেন এক দিক অথবা দুদিক থেকে রচিত হয়। পর্যবেক্ষকগণকে পাহাড়ের চূড়ায় অথবা এলাকার উচু স্থানে উঠে শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে দিয়ো ;তাতে কোন দিক থেকেই তারা তোমাদের নিকটবর্তী হতে পারবে না এবং আচমকা তোমাদেরকে আক্রমণ করতে পারবে না। জেনে রাখো ,কোন সৈন্যবাহিনীর চক্ষু হলো তার অগ্রগামীদল এবং অগ্রগামীদলের চক্ষু হলো গুপ্তচর দল। সাবধান ,কখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থেকো না। যখন কোথাও থাম সকলে মিলে থেমো ,আবার যখন চলতে শুরু করো সকলে একত্রেই চলো। রাত্রি হলে তোমাদের বর্শাগুলো চক্রাকারে মাটিতে দাড় করে রেখো এবং রাত্রিকালে ঈষৎ তন্দ্রাচ্ছন্নতার বেশি ঘুমিয়ো না।

পত্র - ১২

و من وصية لهعليه‌السلام

وصی بها لِمَعْقلِ بْنِ قَيْسٍ الرَّياحِىِّ حِينَ أَنْفَذَهُ إلَى الشامِ فِي ثَلاثَةِ آلافٍ مُقَدِّمَةً لَهُ:

اتَّقِ اللَّهَ الَّذِي لا بُدَّ لَكَ مِنْ لِقائِهِ، وَ لا مُنْتَهَى لَكَ دُونَهُ. وَ لا تُقاتِلَنَّ إِلا مَنْ قاتَلَكَ، وَ سِرِ الْبَرْدَيْنِ، وَ غَوِّرْ بِالنّاسِ، وَ رَفِّهْ فِي السَّيْرِ، وَ لا تَسِرْ أَوَّلَ اللَّيْلِ، فَإِنَّ اللَّهَ جَعَلَهُ سَكَناً، وَ قَدَّرَهُ مُقاماً لا ظَعْناً، فَأَرِحْ فِيهِ بَدَنَكَ، وَ رَوِّحْ ظَهْرَكَ. فَإِذا وَقَفْتَ حِينَ يَنْبَطِحُ السَّحَرُ، أَوْ حِينَ يَنْفَجِرُ الْفَجْرُ، فَسِرْ عَلَى بَرَكَةِ اللَّهِ، فَإِذا لَقِيتَ الْعَدُوَّ فَقِفْ مِنْ أَصْحابِكَ وَسَطاً، وَ لا تَدْنُ مِنَ الْقَوْمِ دُنُوَّ مَنْ يُرِيدُ أَنْ يُنْشِبَ الْحَرْبَ، وَ لا تَباعَدْ عَنْهُمْ تَباعُدَ مَنْ يَهابُ الْبَأْسَ حَتَّى يَأْتِيَكَ أَمْرِي، وَ لا يَحْمِلَنَّكُمُ شَنَآنُهُمْ عَلَى قِتالِهِمْ، قَبْلَ دُعائِهِمْ وَالْإِعْذارِ إِلَيْهِمْ.

তিন হাজার সৈন্যের একটি অগ্রগামী বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে সিরিয়া অভিমুখে প্রেরণের প্রাক্কালে মাকিল ইবনে কায়েস আর - রিয়াহিকে বলেছিলেনঃ

আল্লাহকে ভয় কর যার সম্মুখে সকলেরই উপস্থিতি অবধারিত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে সাক্ষাত অবধারিত নয়। যারা তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে তারা ব্যতীত অন্য কারো সাথে যুদ্ধ করো না। দুটি ঠাণ্ডা সময়ে (সকাল ও বিকাল) পথ চলো। সৈন্যগণকে দিনের মধ্যভাগে একটু ঘুমোতে দিয়ো। সহজভাবে এগিয়ে যেয়ো এবং রাতের প্রথমভাগে পথ চলো না ,কারণ আল্লাহ এ সময়কে বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত করেছেন - ভ্রমণের জন্য নয়। সুতরাং রাতে শরীরকে বিশ্রাম দিয়ে এবং বাহন পশুগুলোকেও বিশ্রাম করতে দিয়ো । ভোরের আগমন নিশ্চিত হয়ে সুবে সাদেকের সময় আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু করো। শত্রুর মুখোমুখি হওয়া মাত্রই সাথীদের মাঝখানে অবস্থান গ্রহণ করো। আমার আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে ব্যক্তির মতো শত্রুর নিকটবর্তী হয়ো না যে এখনই যুদ্ধ শুরু করতে চায় অথবা সে ব্যক্তির মতো শক্রর কাছ থেকে দূরে সরে পড়ো না যে যুদ্ধের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। শত্রুর প্রতি ঘৃণা যেন তোমাকে যুদ্ধের প্রতি তাড়িত না করে। যুদ্ধ শুরু করার আগে বারবার শক্রকে হেদায়েতের দিকে আহবান করো যাতে তাদের কাছে তোমার সকল ওজর নিঃশেষিত হয়।

পত্র - ১৩

و من كتاب لهعليه‌السلام

إلى أَمِيرَيْنِ مِنْ أُمَرأِ جَيْشِهِ

وَ قَدْ أَمَّرْتُ عَلَيْكُما وَ عَلى مَنْ فِي حَيِّزِكُما مالِكَ بْنَ الْحارِثِ الْأَشْتَرَ، فَاسْمَعا لَهُ وَ أَطِيعا، وَاجْعَلاهُ دِرْعاً وَ مِجَنّاً، فَإِنَّهُ مِمَّنْ لا يُخافُ وَهْنُهُ وَ لا سَقْطَتُهُ، وَ لا بُطْؤُهُ عَمَّا الْإِسْراعُ إِلَيْهِ أَحْزَمُ، وَ لا إِسْراعُهُ إِلى مَا الْبُطْءُ عَنْهُ أَمْثَلُ.

সৈন্যবাহিনীর অফিসারের প্রতি প্রেরিত পত্র

আমি মালিক ইবনে হারিছ আল - আশতারকে তোমাদের ও তোমাদের অধীনস্থ সকলের কমাণ্ডার হিসাবে নিয়োগ করেছি। সুতরাং তোমরা সকলেই তার আদেশ পালন করে চলবে এবং তাকে তোমাদের বর্ম ও ঢাল হিসাবে মনে করবে। কারণ সে এমন এক ব্যক্তি যার কাছ থেকে কোন ভীতি বা ভুলের আশঙ্কা নেই। যেখানে দ্রুততার দরকার সেখানে অলসতা অথবা যেখানে শিথিলতার প্রয়োজন সেখানে দ্রুততা তার কাছে পাওয়া যাবে না।

___________________

১। যিয়াদ ইবনে আন - নদীর আল - হারিছি ও শুরাইয়াহ ইবনে হানি আল - হারিছির নেতৃত্বে আমিরুল মোমেনিন বার হাজারের একটা অগ্রগামী সৈন্যবাহিনী সিরিয়া অভিমুখে প্রেরণ করেছিলেন। পথিমধ্যে সুর আর রুম নামক স্থানে তারা আবুল আওয়ার আস - সুলামির মোকাবেলা করলো। আবুল আওয়ার সেখানে একটা সিরিয় বাহিনী নিয়ে ক্যাম্প করেছিল। আমিরুল মোমেনিনকে এ সংবাদ আল - হারিছ ইবনে জুমহান আল - জুফির মাধ্যমে অবহিত করা হলে তিনি মালিক ইবনে আল হারিছ আল - আশতারকে এ পত্রসহ বাহিনী প্রধান করে প্রেরণ করেছিলেন। এ পত্রে অল্প কথায় অতিসুন্দর করে মালিকের বুদ্ধিমত্তা ,ব্যক্তিত্ব ,শৌর্য - বীর্য ,বীরত্ব ও গুরুত্ব ব্যক্তি করেছেন।

পত্র - ১৪

و من وصية لهعليه‌السلام

لِعَسْكَرِهِ قَبْلَ لِقأِ الْعَدُوُّ بِصِفَّينَ

لا تُقاتِلُوهُمْ حَتَّى يَبْدَؤُوكُمْ، فَإِنَّكُمْ بِحَمْدِ اللَّهِ عَلى حُجَّةٍ، وَ تَرْكُكُمْ إِيّاهُمْ حَتَّى يَبْدَؤُوكُمْ حُجَّةٌ أُخْرى لَكُمْ عَلَيْهِمْ. فَإِذا كانَتِ الْهَزِيمَةُ بِإِذْنِ اللّهِ فَلا تَقْتُلُوا مُدْبِراً، وَ لا تُصِيبُوا مُعْوِراً، وَ لا تُجْهِزُوا عَلى جَرِيحٍ. وَ لا تَهِيجُوا النِّسأَ بِأَذىً، وَ إِنْ شَتَمْنَ أَعْراضَكُمْ، وَ سَبَبْنَ أُمَرأَكُمْ، فَإِنَّهُنَّ ضَعِيفاتُ الْقُوى وَالْأَنْفُسِ وَالْعُقُولِ؛ إِنْ كُنّا لَنُؤْمَرُ بِالْكَفِّ عَنْهُنَّ وَ إِنَّهُنَّ لَمُشْرِكاتٌ؛ وَ إِنْ كانَ الرَّجُلُ لَيَتَناوَلُ الْمَرْأَةَ فِي الْجاهِلِيَّةِ بِالْفَهْرِ أَوِ الْهِراوَةِ فَيُعَيَّرُ بِها وَ عَقِبُهُ مِنْ بَعْدِهِ.

সিফফিনে শত্রুর সাথে যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে সেনাবাহিনীকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন

শত্রুপক্ষ আঘাত হানার পূর্ব পর্যন্ত তোমরা আঘাত করো না। কারণ আল্লাহর অসীম রহমতে ,তোমরা ন্যায়ের পথে রয়েছে এবং তারা যুদ্ধ শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিলে তা তোমাদের পক্ষে আরো একটা পয়েন্ট হয়ে দাঁড়াবে। ইনশাল্লাহ ,যদি শত্রুপক্ষ পরাজিত হয় তবে তাদের মধ্যে যারা পলায়নপর তাদেরকে হত্যা করো না ,অসহায় কোন ব্যক্তিকে আঘাত করো না এবং আহতগণকে একেবারে শেষ করে দিয়ে না। কোন রমণী যদি তোমাদের সম্মান ক্ষুন্ন করে নোংরা কথা বলে বা তোমাদের অফিসারকে গালি দেয়। তবুও তাদেরকে কষ্ট দিয়ে না। কারণ জ্ঞানে ,মনে ও চরিত্রে তারা তোমাদের চেয়ে দুর্বল। (রাসূলের যুগে) তারা অবিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর আপতিত না হবার জন্য আমাদেরকে আদেশ দেয়া হতো। এমনকি আইয়ামে জাহেলিয়াতেও যদি কোন পুরুষ কোন নারীকে পাথর অথবা ছড়ি দিয়ে আঘাত করতো। তবে তার চৌদ - পুরুষসহ তাকে গালাগালি করা হতো।

___________________

১। সিফফিনের যুদ্ধ আমিরুল মোমেনিন ও মুয়াবিয়ার মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধের জন্য মুয়াবিয়া এককভাবে দায়ী। কারণ সে উসমানের হত্যার জন্য আমিরুল মোমেনিনকে মিথ্যা দোষারোপ করে যুদ্ধ সংঘটিত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা এবং কী কারণে হত্যা করেছিল তা মুয়াবিয়ার অজানা ছিল না। সে তার অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য উসমানের রক্তের বদলা নেয়ার ধুয়া তুলে বিদ্রোহ ও যুদ্ধের পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু শরিয়তের বিধান মতে মুসলিমদের ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠিত সত্যের অনুসারী ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা অবৈধ ,যেমন -

শাসনকার্যে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো না । তাদের কোন কার্য ইসলাম বিরোধী ,এটা নিশ্চিত না হয়ে তাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করো না । যদি তোমার দৃষ্টিতে তাদের কোন কাজ মন্দ বলে মনে হয় তবে সে বিষয়ে সত্য কথা বলে দিয়ো ;কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে উত্থান বা যুদ্ধ ঘোষণা মুসলিমদের ইজমায় নিষিদ্ধ (নাওয়াবী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ ১২৫ ,বাকিলানী ,পৃঃ ১৮৬ তাফতাজনী ,২য় খণ্ড ,পৃঃ২৭২)

মুসলিমদের ঐকমত্যে প্রতিষ্ঠিত কোন ইমামের বিরুদ্ধে যে কেউ বিদ্রোহ করে সে সত্যত্যাগী খারিজি বলে পরিচিত হবে । সাহবিদের যুগে এটা প্রচলিত ছিল এবং তাদের পরেও একথা প্রযোজ্য (শাহরাস্তানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১১৪) ।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে ,মুয়াবিয়ার কর্মকাণ্ড ছিল আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে উত্থান ও তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। একজন বিদ্রোহীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্রধারণ করা শান্তির পরিপন্থী কিছু নয়। বরং এটা মজলুমের স্বাভাবিক অধিকার। এ অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করলে জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিহত করার এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আর কোন পথ খোলা থাকবে না। সে কারণেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করার অনুমতি আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন। আল্লাহ বলেনঃ

যদি বিশ্বাসীগণের দু দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে তোমরা তাদের উভয় দলের মধ্যে মীমাংসা করে শক্তি স্থাপন করে দেবে ;কিন্তু যদি তাদের একদল অপর দলকে আক্রমণ করে। তবে তোমরা সকলে মিলে আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে না আসে - যদি তারা ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা করে দিয়ো এবং এতে সুবিচার করো । নিশ্চয়ই ,আল্লাহ সুবিচারকারীকে ভালোবাসেন (কুরআন - ৪৯:৯) |

এ কারণেই আমিরুল মোমেনিন - আল্লাহর ফজলে তোমরা ন্যায়ের পথে আছো | - মর্মে দাবী করেছিলেন। তাসত্ত্বেও তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনীকে উপদেশ দিয়েছিলেন যেন তাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের সূচনা না হয়। কারণ তিনি শুধু আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। কিন্তু যখন শান্তি - শৃংখলার জন্য তাঁর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো এবং শত্রু কোন কথা না শুনে যুদ্ধের দিকেই এগিয়ে গেল তখন জুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিহত করার জন্য তাদের মোকাবিলা করা তার দায়িত্ব হয়ে পড়েছিল যা মহান আল্লাহ স্পষ্টভাবে অনুমোদন করেছেনঃ

যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ,তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর ,কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করো না । আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না (কুরআন - ২:১৯০) |

এ ছাড়াও আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানেই হলো রাসূলের (সা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। রাসূল (সা.) বলেছেনঃ

হে আলী ,তোমার শক্তিই আমার শক্তি ,তোমার যুদ্ধই আমার যুদ্ধ (হাদীদ ,১৮শ খণ্ড ,পৃঃ২৪)

এ কারণে রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অপরাধে যে শাস্তি প্রাপ্য আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে একই শাস্তি পাবার যোগ্য। রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবার শাস্তি মহান আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেনঃ

যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের শাস্তি হলো। - তাদের হত্যা করা হবে অথবা ক্রশ বিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে । ইহকালে এটাই তাদের শাস্তি এবং পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি (কুরআন - ৫:৩৩) |

এরূপ অনুমতি থাকা সত্ত্বেও পলায়নোন্মুখ ও আহত শক্রকে হত্যা না করার জন্য আমিরুল মোমেনিন তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর এহেন নির্দেশ নৈতিক মূল্যবোধ ও জিহাদের একটি মহোত্তম নিদর্শন। এ নির্দেশ তিনি শুধু মুখে বলেননি লিখেও দিয়েছেন। বস্তুতঃপক্ষে যুদ্ধে পলায়নপর ও অসহায় শত্রু এবং নারী হত্যা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। জামালের যুদ্ধে তাঁর শত্রুপক্ষের নেতৃত্বে নারী থাকা সত্ত্বেও তিনি নীতি পরিবর্তন করেননি। পরাজিত হবার পর তিনি আয়শাকে দেহরক্ষী দ্বারা মদিনা প্রেরণ করেন। এ বিষয়ে হাদীদ (১৭শ খণ্ড ,পৃঃ ২৫৪) লিখেছেনঃ

আমিরুল মোমেনিনের সাথে আয়শা যেরূপ আচরণ করেছে উমরের সাথে যদি সেরূপ আচরণ করা হতো তাহলে জয়লাভের পর উমর তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলতো ।


19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41