নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা0%

নাহজ আল-বালাঘা লেখক:
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: হযরত আলী (আ.)

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক: আশ-শরীফ আর-রাজী
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ:

ভিজিট: 126237
ডাউনলোড: 8027

নাহজ আল-বালাঘা
বইয়ের বিভাগ অনুসন্ধান
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 48 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 126237 / ডাউনলোড: 8027
সাইজ সাইজ সাইজ
নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

রাসূলের (সা.) ‘জ্ঞান নগরীর দ্বার’ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী, দার্শনিক, সুলেখক ও বাগ্মী। আলঙ্কারিক শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য ও নৈপুন্য অসাধারণ। তিনি নবুওয়াতী জ্ঞান ভান্ডার হতে সরাসরি জ্ঞান আহরণ করেন এবং সাহাবাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পন্ডিত ছিলেন। এতে কারো দ্বিমত নেই। আরবী কাব্যে ও সাহিত্যে তার অনন্যসাধারণ অবদান ছিল। খেলাফত পরিচালনা কালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ (খোৎবা) দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকগণকে প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে পত্র লিখেছিলেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মানুষের অনেক প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তার এসব বাণী কেউকেউ লিখে রেখেছিল, কেউ কেউ মনে রেখেছিল, আবার কেউ কেউ তাদের লিখিত পুস্তকে উদ্ধৃত করেছিল। মোটকথা তার অমূল্য বাণীসমূহ মানুষের কাছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিল।

আশ-শরীফ আর-রাজী আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের ভাষণসমূহ (খোৎবা), পত্রাবলী, নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ সংগ্রহ করে “নাহজ আল-বালঘা” নামক গ্রন্থটি সঙ্কলন করেন।

খোৎবা - ৩

وَ هِیَ الْمَعْرُوفَهُ بِالشِّقشْقِيَّهِ

أَمَا واللَّه لَقَدْ تَقَمَّصَهَا فُلَانٌ وإِنَّه لَيَعْلَمُ أَنَّ مَحَلِّي مِنْهَا مَحَلُّ الْقُطْبِ مِنَ الرَّحَى، يَنْحَدِرُ عَنِّي السَّيْلُ ولَا يَرْقَى إِلَيَّ الطَّيْرُ، فَسَدَلْتُ دُونَهَا ثَوْباً وطَوَيْتُ عَنْهَا كَشْحاً وطَفِقْتُ أَرْتَئِي بَيْنَ أَنْ أَصُولَ بِيَدٍ جَذَّاءَ أَوْ أَصْبِرَ عَلَى طَخْيَةٍ عَمْيَاءَ ، يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ ويَشِيبُ فِيهَا الصَّغِيرُ، ويَكْدَحُ فِيهَا مُؤْمِنٌ حَتَّى يَلْقَى رَبَّه، فَرَأَيْتُ أَنَّ الصَّبْرَ عَلَى هَاتَا أَحْجَى فَصَبَرْتُ وفِي الْعَيْنِ قَذًى وفِي الْحَلْقِ شَجًا أَرَى تُرَاثِي نَهْباً حَتَّى مَضَى الأَوَّلُ لِسَبِيلِه، فَأَدْلَى بِهَا إِلَى فُلَانٍ بَعْدَه.

فَيَا عَجَباً بَيْنَا هُوَ يَسْتَقِيلُهَا فِي حَيَاتِه، إِذْ عَقَدَهَا لِآخَرَ بَعْدَ وَفَاتِه لَشَدَّ مَا تَشَطَّرَا ضَرْعَيْهَا ، فَصَيَّرَهَا فِي حَوْزَةٍ خَشْنَاءَ يَغْلُظُ كَلْمُهَا ، ويَخْشُنُ مَسُّهَا ويَكْثُرُ الْعِثَارُ فِيهَا والِاعْتِذَارُ مِنْهَا، فَصَاحِبُهَا كَرَاكِبِ الصَّعْبَةِ ، إِنْ أَشْنَقَ لَهَا خَرَمَ وإِنْ أَسْلَسَ لَهَا تَقَحَّمَ ، فَمُنِيَ النَّاسُ لَعَمْرُ اللَّه بِخَبْطٍ وشِمَاسٍ وتَلَوُّنٍ واعْتِرَاضٍ ، فَصَبَرْتُ عَلَى طُولِ الْمُدَّةِ وشِدَّةِ الْمِحْنَةِ حَتَّى إِذَا مَضَى لِسَبِيلِه، جَعَلَهَا فِي جَمَاعَةٍ زَعَمَ أَنِّي أَحَدُهُمْ فَيَا لَلَّه ولِلشُّورَى ، مَتَى اعْتَرَضَ الرَّيْبُ فِيَّ مَعَ الأَوَّلِ مِنْهُمْ، حَتَّى صِرْتُ أُقْرَنُ إِلَى هَذِه النَّظَائِرِ ، لَكِنِّي أَسْفَفْتُ إِذْ أَسَفُّوا وطِرْتُ إِذْ طَارُوا، فَصَغَا رَجُلٌ مِنْهُمْ لِضِغْنِه ، ومَالَ الآخَرُ لِصِهْرِه مَعَ هَنٍ وهَنٍ إِلَى أَنْ قَامَ ثَالِثُ الْقَوْمِ نَافِجاً حِضْنَيْه ، بَيْنَ نَثِيلِه ومُعْتَلَفِه ، وقَامَ مَعَه بَنُو أَبِيه يَخْضَمُونَ مَالَ اللَّه، خِضْمَةَ الإِبِلِ نِبْتَةَ الرَّبِيعِ ، إِلَى أَنِ انْتَكَثَ عَلَيْه فَتْلُه وأَجْهَزَ عَلَيْه عَمَلُه، وكَبَتْ بِه بِطْنَتُه

فَمَا رَاعَنِي إِلَّا والنَّاسُ كَعُرْفِ الضَّبُعِ ، إِلَيَّ يَنْثَالُونَ عَلَيَّ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ، حَتَّى لَقَدْ وُطِئَ الْحَسَنَانِ وشُقَّ عِطْفَايَ مُجْتَمِعِينَ حَوْلِي كَرَبِيضَةِ الْغَنَمِ ، فَلَمَّا نَهَضْتُ بِالأَمْرِ نَكَثَتْ طَائِفَةٌ ومَرَقَتْ أُخْرَى وقَسَطَ آخَرُونَ كَأَنَّهُمْ لَمْ يَسْمَعُوا اللَّه سُبْحَانَه يَقُولُ:( تِلْكَ الدَّارُ الآخِرَةُ نَجْعَلُها لِلَّذِينَ، لا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الأَرْضِ ولا فَساداً، والْعاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ) ،

بَلَى واللَّه لَقَدْ سَمِعُوهَا ووَعَوْهَا، ولَكِنَّهُمْ حَلِيَتِ الدُّنْيَا فِي أَعْيُنِهِمْ ورَاقَهُمْ زِبْرِجُهَا أَمَا والَّذِي فَلَقَ الْحَبَّةَ وبَرَأَ النَّسَمَةَ ، لَوْ لَا حُضُورُ الْحَاضِرِ وقِيَامُ الْحُجَّةِ بِوُجُودِ النَّاصِرِ، ومَا أَخَذَ اللَّه عَلَى الْعُلَمَاءِ، أَلَّا يُقَارُّوا عَلَى كِظَّةِ ظَالِمٍ ولَا سَغَبِ مَظْلُومٍ، لأَلْقَيْتُ حَبْلَهَا عَلَى غَارِبِهَا - ولَسَقَيْتُ آخِرَهَا بِكَأْسِ أَوَّلِهَا - ولأَلْفَيْتُمْ دُنْيَاكُمْ هَذِه أَزْهَدَ عِنْدِي مِنْ عَفْطَةِ عَنْزٍ

قَالُوا وقَامَ إِلَيْه رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ السَّوَادِ - عِنْدَ بُلُوغِه إِلَى هَذَا الْمَوْضِعِ مِنْ خُطْبَتِه - فَنَاوَلَه كِتَاباً قِيلَ إِنَّ فِيه مَسَائِلَ كَانَ يُرِيدُ الإِجَابَةَ عَنْهَا فَأَقْبَلَ يَنْظُرُ فِيه - [فَلَمَّا فَرَغَ مِنْ قِرَاءَتِه] قَالَ لَه ابْنُ عَبَّاسٍ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ - لَوِ اطَّرَدَتْ خُطْبَتُكَ مِنْ حَيْثُ أَفْضَيْتَ! فَقَالَ هَيْهَاتَ يَا ابْنَ عَبَّاسٍ - تِلْكَ شِقْشِقَةٌ هَدَرَتْ ثُمَّ قَرَّتْ قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ فَوَاللَّه مَا أَسَفْتُ عَلَى كَلَامٍ قَطُّ - كَأَسَفِي عَلَى هَذَا الْكَلَامِ - أَلَّا يَكُونَ أَمِيرُ الْمُؤْمِنِينَعليه‌السلام بَلَغَ مِنْه حَيْثُ أَرَادَ.

এটা খোৎবায়ে শিকশিকিয়্যাহ নামে খ্যাত

সাবধান! আল্লাহর কসম ,আবু কুহাফার পুত্র (আবু বকর) নিজে নিজেই উহা (খেলাফত) পরিধান করেনিয়েছিল। সে নিশ্চিতভাবেই জ্ঞাত ছিল যে ,খেলাফতের জন্য আমার অবস্থান এমন যেন যাতার কেন্দ্রিয় শলাকা । বন্যার পানি আমা হতে প্রবাহিত হয় এবং পাখী আমা পর্যন্ত উড়ে আসতে পারে না। আমি খেলাফতের সামনে একটা পর্দা টেনে দিলাম এবং নিজেকে উহা থেকে নির্লিপ্ত রাখলাম ।

অতঃপর আমি প্রবল বেগে আক্রমণ করা অথবা ধৈর্য সহকারে চোখ বন্ধ করে অন্ধকারের সকল দুঃখ - দুর্দশা সহ্য করার বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলাম। এরই মধ্যে বয়স্কগণ দুর্বল হয়ে পড়লো ,যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে গেল এবং মোমেনগণ চাপের মুখে আমরণ কষ্ট করে কাজ করছিলো। আমি দেখলাম এ অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। সুতরাং আমি ধৈর্য ধারণ করলাম। যদিও তাদের কর্মকাণ্ড কাঁটার মতো চোখে বিধতেছিলো এবং সামগ্রিক অবস্থা শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে পড়েছিলো। প্রথম জনের মৃত্যু পর্যন্ত আমার লুষ্ঠিত উত্তরাধিকারের জন্য আমি অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সে তা ইবনে খাত্তাবের হাতে তুলে দিয়ে গেল। এরপর আমার দিন উটের পিঠে (অতি দুঃখ - কষ্টে) কাটতে লাগল। শুধুমাত্র জাবিরের ভ্রাতা হাইয়ানের৫ সহচর্যে ক 'টি দিন ভালো গেল।

এটা এক অদ্ভুত ব্যাপার যে ,জীবদ্দশায় সে খেলাফত থেকে অব্যাহতি পাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মৃত্যুকালে সে তা অন্য একজনের হাতে তুলে দিয়ে গেল। এতে কোন সন্দেহ নেই যে ,এরা দুজনই পরিকল্পিতভাবে একই স্তনের বাঁটগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেনিয়েছিল। এজন্য (উমর) খেলাফতকে একটা শক্ত বেষ্টনীর মধ্যে রাখলো ,যেখানে কথাবার্তা ছিল উদ্ধত এবং স্পর্শ ছিল রূঢ়া ; অনেক ভুল - ভ্রান্তি ও ত্রুটি - বিচূতি ছিল এবং তদ্রুপ ওজরও দেখানো হতো। খেলাফতের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি মাত্রই অবাধ্য উটের সওয়ারের মতো হয়ে যেতো - লাগাম টেনে ধরলে নাসারন্ধ কেটে যায় ,আবার টেনে না ধরলে সওয়ার নিক্ষিপ্ত হয়। আল্লাহর কসম ,ফলতঃ ,মানুষ বলগাহীনতা ,ভিন্নরূপিতা ,অদৃঢ়তা ও পথভ্রষ্টতায় জড়িয়ে পড়েছিল।

এতদসত্ত্বেও কালের দৈর্ঘ্য আর কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে তার (উমর) মৃত্যু পর্যন্ত ধৈর্য ধারণ করে রইলাম। সে খেলাফতের বিষয়টি একটা দলের৬ হাতে ন্যস্ত করলো এবং আমাকেও তাদের একজন মনে করলো। হায় আল্লাহ! এ মনোনয়ন বোর্ড দিয়ে আমি কী করবো ? তাদের প্রথম জনের তুলনায় আমার শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে কি কখনো কোন সংশয় ছিল যে ,এখন আমাকে এসব লোকের সমপর্যায়ের মনে করা হলো ? কিন্তু তারা শান্ত থাকলে আমিও শান্ত থাকতাম এবং তারা উচুতে উড়লে আমিও উচুতে উড়তাম। তাদের একজন আমার প্রতি হিংসাপরায়ণতার কারণে আমার বিরোধী হয়ে গেল এবং অপর একজন তার বৈবাহিক আত্মীয়তা ও এটা - সেটা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে চলে গেল। ফলে এদের তৃতীয় জন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার সাথে তার পিতামহের সন্তানেরা (উমাইয়াগণ) দাঁড়িয়ে গেল এবং এমনভাবে আল্লাহর সম্পদ৭ গলাধঃকরণ করতে লাগলো যেভাবে বসন্তের পত্রপল্লব ক্ষুধার্ত উট গোগ্রাসে গিলতে থাকে। তার ক্রিয়াকলাপ তাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে গেল এবং তার অতিভোজন তাকে অবনত করলো ।

সে সময় আমার দিকে জনতার দ্রুত আগমন ছাড়া আর কোন কিছুই আমাকে বিস্মিত করেনি। চতুর্দিক থেকে হায়নার কেশরের মতো এত অধিক জনতা এগিয়ে আসলো যে ,হাসান ও হুসাইন পদদলিত হবার অবস্থায় পড়েছিল এবং আমার উভয় স্কন্ধের কাপড় ছিড়ে গিয়েছিল। ভেড়া ও ছাগলের পালের মতো তারা আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। যখন আমি শাসনভার গ্রহণ করেছিলাম তখন একদল কেটে পড়লো ,আরেক দল বিদ্রোহী হয়ে গেলো এবং অন্যরা এমন অন্যায়ভাবে ক্রিয়াকলাপ করতে লাগলো যেন তারা কখনো আল্লাহর এ বাণী শুনতে পায়নি -

এটা আখিরাতের সে আবাস যা আমরা তাদের জন্যই অবধারিত করি যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ এবং ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে চায় না এবং উত্তম পরিণাম মুত্তাকিদের জন্যই (কুরআন ২৮ : ৮৩) |

হ্যাঁ ,আল্লাহর কসম ,তারা আল্লাহর বাণী শুনেছিল এবং তার অর্থও বুঝেছিল। কিন্তু দুনিয়ার চাকচিক্য তাদের চোখে অধিক প্রিয় হয়ে পড়েছিল এবং দুনিয়ার জাক - জমক ও বিলাসিত তাদেরকে প্রলুব্ধ করে পথভ্রষ্ট করেছিল। মনে রেখো ,যিনি শস্যকণা ভেঙ্গে চারা গজান ও জীবিত সত্তা সৃষ্টি করেন ,তার কসম করে বলছি ,যদি মানুষ আমার কাছে না। আসতো এবং সমর্থনকারীরা যুক্তি নিঃশেষ না করতো এবং জ্ঞানীদের সাথে এ মর্মে আল্লাহর কোন অঙ্গীকার না থাকতো যে ,জালিমের অতিভোজন আর মজলুমের ক্ষুধায় তারা মৌন সম্মতিও দিতে পারবে না ; তাহলে আমি খেলাফতের রাশি তার নিজের কাধে নিক্ষেপ করতাম এবং শেষ জনকে প্রথম জনের পেয়ালা দ্বারা পানি পান করাতাম । তখন তোমরা দেখতে পেতে যে ,তোমাদের এ দুনিযা আমার মতে ছাগলের হ্যাঁচির চেয়েও নিকৃষ্টতর।

(কথিত আছে যে ,আমিরুল মোমেনিন তার খোৎবায় এ পর্যন্ত বলার পর ইরাকের একজন লোক দাঁড়িয়ে গেল এবং আমিরুল মোমেনিনের হাতে একটা চিরকুট দিলেন। আমিরুল মোমেনিন তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় ইবনে আব্বাস বললেন , হে আমিরুল মোমেনিন ,আপনার খোৎবা যেখানে বন্ধ করেছেন সেখান থেকে আবার আরম্ভ করুন। উত্তরে তিনি বললেন , হে ইবনে আব্বাস ,এটা উটের বুদুদের (শিকশিকিয়্যাহ্) মতে যা প্রচুর পরিমাণে নিঃসৃত হয়। কিন্তু অল্পক্ষণেই মিটে যায়। ইবনে আব্বাস বলেছিলেন যে ,তিনি কোনদিন আমিরুল মোমেনিনের কোন কথায় এত দুঃখ পান নি যা পেয়েছিলেন সেদিন ,কারণ অনুরোধ সত্ত্বেও আমিরুল মোমেনিন তাঁর খোৎবা শেষ করলেন না।)

___________________

১ । এ খোৎবাটি খোৎবায়ে শিকশিকিয়্যাহ নামে অভিহিত এবং এটাকে আমিরুল মোমেনিনের প্রসিদ্ধ খোৎবার অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। এটা আর - রাহবাহ নামক স্থানে প্রদান করা হয়। কোন কোন লোক এ খোৎবাটি আমিরুল মামোমেনিনের নয় বলে মনে করেন। তারা আশ - শরীফ আর - রাজীর স্বীকৃত সততার ওপর দোষারোপ করে এ খোৎবাটি তার বুনন বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু সত্যপ্রিয় পণ্ডিতগণ এরূপ মন্তব্যের সকল প্রকার সত্যতা অস্বীকার করেছেন। কারণ খেলাফতের ব্যাপারে আলী ভিন্নমত পোষণ করতেন। একথা আদৌ গোপনীয় নয়। সুতরাং খোৎবার ইঙ্গিীতসমূহ বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ খোৎবায় যে সমস্ত ঘটনাবলী পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তা বর্ষানুক্রমিক ইতিহাসে লিপিবদ্ধ ছিল যা প্রতিটি কথার সত্যতা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে। যেখানে এসব কথা ইতিহাসে বর্ণিত আছে আবার আমিরুল মোমেনিনও বিশদভাবে বলেছেন। সেখানে এসব কথা অস্বীকার করার মতো ক্ষেত্র থাকতে পারে না। রাসূলের (সা.) ইনতিকালের পরবর্তী দুঃখজনক অবস্থা যদি তার স্মৃতিকে তিক্তভাবে নাড়া দিয়ে থাকে। তবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এতে কোন সন্দেহ নেই যে ,এ খোৎবাটি কতিপয় ব্যক্তিত্বের সম্ভ্রমে আঘাত হেনেছে কিন্তু খোৎবাটি আমিরুল মোমিনের বক্তব্য নয় বললেই সম্ভ্রম রক্ষা করা যাবে না। কারণ এ ধরণের সমালোচনা অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও উল্লেখ করেছেন। আমর ইবনে বাহুর আল - যাহিজ (আবু উসমান) । আমিরুল মামোমেনিনের খোৎবার যে শব্দগুলি রেকর্ড করেছিলেন তা খোৎবায়ে শিকশিকিয়্যার সমালোচনা থেকে কম গুরুত্ব বহন করে না। যাহিজের রেকর্ড করা শব্দগুলি নিম্নরূপ :

ওই দুজন সরে গেল এবং তৃতীয়জন কাকের মতো উঠে দাঁড়ালো যার সাহস ছিল পেটে আবদ্ধ । যদি তার উভয় ডানা কেটে ফেলা হতো এবং তার মাথা দ্বিখণ্ডিত করা হতো। তবে তা উত্তম হতো ।

ফলতঃ এ খোৎবার কথাগুলো আশ - শরীফ আর - রাজী বানিয়েছেন এমন ধারণা সত্যের অপলাপ মাত্র এবং এহেন ধারণা স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। এহেন ধারণা যদি কোন গবেষণালব্ধ হয়ে থাকে। তবে সে গবেষণা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা কি উচিত নয় ? একথা স্বীকার্য যে ,ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সত্যকে গোপন করা যায় না। কোন ব্যক্তি বা দলের অস্বীকৃতি ও অসন্তোষের কারণে এহেন চূড়ান্ত যুক্তিগ্রাহ্য সত্যের মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়া যাবে না। এখন আমরা এমন কতিপয় পণ্ডিত ও হাদিসবেত্তার বক্তব্য তুলে ধরবো যারা এ খোৎবাকে আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের কেউ কেউ শরীফ রাজীর অনেক পূর্বেকার ,কেউ কেউ তার সমসাময়িক আবার কেউ কেউ তার পরবর্তীকালের । তারা হলেনঃ

(১) ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন - তার শিক্ষক আবুল খায়ের মুসাদ্দিক ইবনে শাবিব আল - ওয়াসিতি (মৃত্যু ৬০৫ হিঃ) তাকে বলেছেন যে ,তিনি এ খোৎবাটি শায়েখ আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ আল - বাগদাদির (মৃত্যু ৫৬৭ হিঃ) কাছে শুনেছেন। আল - ওয়াসিতি আরো বলেছেন যে ,আল - বাগদাদি তাকে বলেছেন যদি তিনি ইবনে আব্বাসের দেখা পেতেন তাহলে জিজ্ঞেস করতেন যে ,তার চাচাত ভাই তো কাউকে ছাড়ে নি - এরপরও এমন কী কথা রয়ে গেল। যাতে ইবনে আব্বাস দুঃখ পেয়েছেন ? আল - ওয়াসিতি যখন জিজ্ঞেস করলেন যে ,খোৎবাটি অন্য কারো বানানো উক্তি কিনা আল - বাগদাদি তখন বললেন , আল্লাহর কসম ,আমি বিশ্বাস করি খোৎবাটি আমিরুল মোমেনিনের উক্তি যেমন আমি বিশ্বাস করি তুমি মুসাদ্দিক ইবনে শাবিব। শরীফ রাজীর জন্মের দুশ বছর পূর্বে লিখিত পুস্তকেও আমি এ খোৎবাটি দেখেছি যা বিখ্যাত পণ্ডিতগণ সংকলন করেছিলেন এবং সে সময় শরীফ রাজীর বাবা আবু আহম্মদ আন - নকীবও জন্মগ্রহণ করেনি । ”

(২) ইবনে আবিল হাদীদ এরপর লিখেছেন - তার শিক্ষক আবুল কাসিম মুতাজিলা ইমাম আল - বলখির (মৃত্যু ৩১৭। হিঃ) সংকলনে এ খোৎবাটি দেখেছেন যখন মুক্তাদির বিল্লাহর রাজত্বকাল ছিল। শরীফ রাজী মুক্তাদির বিল্লাহর রাজত্বকালের অনেক পরে জন্ম গ্রহণ করেছেন।

(৩) তিনি আরো লিখেছেন - আবু জাফর ইবনে কিবাহ বিরচিত আল - ইনসাফ ' গ্রন্থে তিনি এ খোৎবাটি দেখেছেন। ইবনে কিবাহ ছিলেন ,ইমামত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আল বলখির ছাত্র (হাদীদ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২০৫ - ২০৬)

(৪) ইবনে মায়ছাম বাহরানী (মৃত্যু ৬৭৯ হিঃ) লিখেছেন যে মুক্তাদির বিল্লাহর মন্ত্রী আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আল - ফুরাতের (মৃত্যু ৩১২ হিঃ) এক লেখায় তিনি এ খোৎবাটি দেখেছেন (বাহারানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৫২ - ২৫৩) ।

(৫) শায়েখ কুতুবুদ্দিন রাওয়ান্দির সংকলিত মিনহাজ আল বারাআহ ফি শারহ নাহাজ আল - বালাঘা ” গ্রন্থে এ খোৎবার নিম্নরূপ ধারাবাহিকতা উল্লেখ করা হয়েছে যা আল্লামা মুহাম্মদ বাকির মজলিসী তার বিহার আল - আনওয়ার ” - গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেনঃ

শায়েখ আবু নসর হাসান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম খোৎবাটি আমাকে অবহিত করেছেন । তিনি হাজিব। আবুল ওয়াফা মুহাম্মদ ইবনে বাদী ,হুসাইন ইবনে আহমদ ইবনে বাদী ও হুসাইন ইবনে আহমদ ইবনে আবদার রহমানের কাছে থেকে খোৎবাটি পেয়েছেন । তারা হাফিজ আবু বকর ইবনে মরদুইয়্যা ইস্পাহানী (মৃত্যু ৪১৬ হিঃ) থেকে ,তিনি হাফিজ আবুল কাসিম সুলায়মান ইবনে আহমদ তাবারানী (মৃত্যু ৩৬০ হিঃ) থেকে ,তিনি আহমদ ইবনে আলী আল - আব্বার থেকে ,তিনি ইসহাক ইবনে সাঈদ আবু সালামা দামাস্কী থেকে ,তিনি খুলাইদ ইবনে দালাজ থেকে ,তিনি আতা ইবনে আবি রাবাহ থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি পেয়েছেন ” (মজলিসী ,৮ম খণ্ড ,পৃঃ ১৬০)

(৬) আল্লামা মজলিসী আরো উল্লেখ করেন যে ,আবু আলী (মুহাম্মদ ইবনে আবদাল ওহাব) আল - জুব্বাই (মৃত্যু ৩০৩ হিঃ) এর সংকলনে এ খোৎবাটি ছিল।

(৭) আল্লামা মজলিসী এ খোৎবার সত্যতা সম্পর্কে আরো লিখেছেনঃ

কাজি আবদাল জব্বার ইবনে আহম্মদ আল - আসাদ আবাদী (মৃত্যু ৪১৫। হিঃ) তার রচিত গ্রন্থ আল - মুঘানি ’ - তে এ খোৎবার কতিপয় বক্তব্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন এতে আমিরুল মোমেনিন পূর্ববর্তী খলিফাগণকে আঘাত করে কিছু বলেননি । তিনি খোংবাটি আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য বলে অস্বীকার করেন নি । (মজলিসী ,৮ম খণ্ড ,পৃঃ ১৬১ )

(৮) আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে বাবাওয়াহ (মৃত্যু ৩৮১ হিঃ) লিখেছেনঃ

আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবাটি মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম ইবনে ইসহাক তালাকাশী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন । তিনি আবদুল আজিজ ইবনে ইয়াহিয়া জালুদি (মৃত্যু ৩৩২ হিঃ) থেকে ,তিনি আবদিল্লাহ আহমদ ইবনে আম্মার ইবনে খালিদ থেকে ,তিনি ইয়াহিয়া ইবনে আবদাল হামিদ হিন্মানী (মৃত্যু ২২৮ হিঃ।) থেকে ,তিনি ঈসা ইবনে রশিদ থেকে ,তিনি আলী ইবনে হুজায়ফা থেকে ,তিনি ইকরামা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি বর্ণনা করেছেন।(বাবাওয়াহ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ১৪৪ ;বাবাওয়াহ ,পৃঃ ৩৬০ - ৩৬১)

(৯) ইবনে বাবাওয়াহ্ তার উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবার আরো একটি বরাত সূত্র উল্লেখ করেছেন যা নিম্নরূপ :

মুহাম্মদ ইবনে আলী মাজিলাওয়াহ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন । তিনি তার চাচা মুহাম্মদ ইবনে আবিল কাসিম থেকে ,তিনি আহম্মদ ইবনে আবি আবদিল্লাহ আল - বারাকী থেকে ,তিনি তার পিতা থেকে ,তিনি ইবনে আবি উমায়ার থেকে ,তিনি আবান ইবনে উসমান থেকে ,তিনি আবান ইবনে তাঘালিব থেকে ,তিনি ইকরামা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে এ খোৎবা প্রাপ্ত হয়েছেন। (বাবাওয়াহ ’ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৪৬. বাবাওয়াহ ’ ,পৃঃ ৩৬১)

(১০) আবু আহমদ হাসান ইবনে আবদিল্লাহ্ ইবনে সাঈদ আসকারী (মৃত্যু ৩৮২ হিঃ) একজন বিখ্যাত সুন্নি পণ্ডিত ছিলেন। তিনি আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবাটির টীকা ও ব্যাখ্যা লেখেছিলেন যা ইবনে বাবাওয়াহ্ তার উক্ত গ্রন্থদ্বয়ে উদ্ধৃত করেছেন।

(১১) আবু ইসহাক ইব্রাহীম ইবনে মুহাম্মদ আছ - ছাকাকী ’ তার রচিত আল - ঘারাত ” গ্রন্থে এ খোৎবা প্রাপ্তির নিজস্ব ধারাবাহিকতা বিবৃত করেছেন। তিনি ২৮৩ হিঃ সনে মারা যান। ২৫৫ হিঃ সনের ১৩ই শাওয়াল মঙ্গলবার তার গ্রন্থখানা লেখা সমাপ্ত হয়েছিল এবং এ বছরই আশ - শরীফ আর - রাজীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মুরতাজা মুসাবী জন্মগ্রহণ করেছিল (জাজাইরী ’ ,পৃঃ ৩৭)

(১২) সৈয়দ রাজী উদ্দিন আবুল কাসেম আলী ইবনে মূসা ইবনে তাউস আল - হুসাইনী আল - হুল্লি (মৃত্যু ৬৬৪ হিঃ) আল ঘারাত" - গ্রন্থের বরাত দিয়ে এ খোৎবার নিম্নরূপ ধারাবাহিকতা বর্ণনা করেছেনঃ

মুহম্মদ ইবনে ইউছুফ এ খোংবাটি আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন । তিনি আলহাসান ইবনে আলী ইবনে আবদাল করিম আজ - জাফরানী থেকে ,তিনি মুহাম্মদ থেকে ,তিনি তার পিতা থেকে ,তিনি তার নানা থেকে এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি পেয়েছিলেন (তাউস ,পৃঃ ১০)

(১৩) শায়েখ আত - তায়ফা মুহাম্মদ ইবনে আল - হাসান আত - তুসী (মৃত্যু ৪৬০ হিঃ) লিখেছেনঃ

আল - হাফফার (আবুল ফাছ হিলাল ইবনে মুহাম্মদ ইবনে জাফর) আমাদের কাছে এ খোৎবাটি বলেছেন । তিনি আবুল কাসিম (ইসমাঈলী ইবনে আলী ইবনে আলী) আজ - জিবিলী থেকে ,তিনি তার পিতা থেকে ,তিনি তার ভ্রাতা জিবিল (ইবনে আলী আল - কুজাই) থেকে ,তিনি মুহাম্মদ ইবনে সালামাহ আশ - শামী থেকে ,তিনি জুরারাহ ইবনে আয়ান থেকে ,তিনি আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী (আশ - শায়েখ আস - সাদুক) এবং তিনি ইবনে আব্বাস থেকে খোৎবাটি পেয়েছিলেন। (তুসী ’ ,পৃঃ ২৩৭)

(১৪) শরীফ রাজীর শিক্ষক শায়েখ আল - মুফিদ (মৃত্যু ৪১৩ হিঃ) এ খোৎবার সনদ সম্পর্কে লিখেছেনঃ

ইবনে আব্বাস থেকে প্রাপ্ত হয়ে অনেক রাবি বিভিন্ন ধারা পরম্পরায় এ খোৎবাটি বিবৃত করেছেন (মুফিদ ,পৃঃ ১৩৫) ।

(১৫) শরীফ রাজীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আলম আল - হুদা আস - সাঈদ আল - মুরতাজা তার গ্রন্থে এ খোৎবাটি রেকর্ড করেছিলেন (মুরতাজা ,পৃঃ ২০৩ - ২০৪) ।

(১৬) আবু মনসুর আত - তাবারসী লিখেছেনঃ

অনেক রাবি ইবনে আব্বাস থেকে বিভিন্ন ধারায় এ খোৎবা বর্ণনা করেছেন । ইবনে আব্বাস বলেছেন তিনি নিজেই রাহবাহ (কুফার একটা স্থান) । আমিরুল মোমেনিনের মুখ নিঃসৃত এ খোৎবা শুনেছেন । তিনি বলেন যে ,খেলাফত ও পূর্ববর্তীর্ণ খলিফাগণ সম্পর্কে আলোচনা উঠলে আমিরুল মোমেনিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খোৎবাটি প্রদান করেন (তাবারসী ,পৃঃ ১০১)

(১৭) আবুল মুজাফফর ইউছুফ ইবনে আবদিল্লাহ্ এবং সিবত ইবনে আল - জাওজী (মৃত্যু ৬৫৪ হিঃ।) লিখেছেনঃ

আমাদের মোর্শেদ আবুর কাসিম আন - নাফিস আল - আনবারী আমাদের কাছে এ খোৎবা বর্ণনা করেছেন । তিনি সহী সনদের মাধ্যমে ইবনে আব্বাস থেকে এ খোৎবা অবহিত হয়েছেন । ইবনে আব্বাস বলেছেন যে ,খলিফা হিসাবে আমিরুল মোমেনিনের বায়াত নেয়ার পর তিনি মিম্বারে উপবিষ্ট হলে এক ব্যক্তি জানতে চাইলো ,তিনি এতদিন নিশ্চুপ ছিলেন কেন । তদুত্তরে আমিরুল মোমেনিন এ খোৎবা প্রদান করেন (জাওজী ,পৃঃ ৭৩) ।

(১৮) শায়েখ আলা - আদৌলা আস - সিমনানী লিখেছেনঃ সাইয়্যোদাল আরেফিন আমিরুল মোমেনিনের খোৎবাগুলোর মধ্যে শিকশিকিয়্যাহ একটা চমৎকার খোৎবা যাতে তাঁর হৃদয়া বেগ বিস্ফোরিত হয়েছে (সিমনানী ,পৃঃ ৩) ।

(১৯) শিকশিকিয়্যাহ ’ শব্দটি সম্পর্কে আবুল ফজল আহমদ ইবনে মুহাম্মদ আল - মায়দানী (মৃত্যু ৫১৮ হিঃ।) লিখেছেনঃ

আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের একটা খোৎবা খোৎবা- আশ শিক্শিকিয়াহ ’ নামে অভিহিত (মায়দানী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৩৬৯) ।

(২০) ইবনে আল - আহীর ” (মৃত্যু ৬০৬ হিঃ) তার নিহায়া গ্রন্থে এ খোৎবার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পনেরো স্থানে বিভিন্ন দলিলাদি দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে ,খোৎবাটি নিঃসন্দেহে আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য।

(২১) শায়েখ মুহাম্মদ তাহির পাটনী তার মাজমা বিহার আল - আনওয়ার ’ গ্রন্থে এ খোৎবার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বহু প্রমাণাদির দ্বারা উপস্থাপন করেছেন যে ,খোৎবাটি আমিরুল মোমেনিনের। প্রতিটি বাক্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আলী বলেন। ” লিখে শুরু করেছেন। (২২) মাজদুদ্দিন আল ফিরুজ আবাদী (মৃত্যু ৮.১৭ হিঃ) তার গ্রন্থে রেকর্ড করেছেনঃ

আলীর এ খোৎবাটির নামকরণ খোৎবা- আশ - শিক্শিকিয়াহ ’ করা হয়েছে এ জন্য যে ,খোৎবার এক পর্যায়ে আমিরুল মোমেনিন নিশ্চুপ হয়ে গেলে ইবনে আব্বাস পুনরায় শুরু করার অনুরোধ করেন । তখন আমিরুল মোমেনিন বলেন , হে ইবনে আব্বাস ,এটা উটের মুখের ফেনার (শিকশিকাহ) মতো বেরিয়ে এসেছে আবার প্রশমিত হয়ে পড়েছে ” (আবাদী ’ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ২৫১)

(২৩) আল - আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা অনুষদের প্রফেসর মুহাম্মদ মুহীউদ্দিন আবদ - আল - হামিদ নাহাজ আল - বালাঘা ” - এর ওপর গবেষণামূলক টীকা লিখেছেন। উক্ত টীকার মুখবন্ধে তিনি মন্তব্য করেছেন যে ,খোৎবাগুলোর প্রতিটি বাক্য আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য। এমনকি মর্যাদাহানিকর উক্তিগুলোও তারই বক্তব্য ।

২। আবু বকরের খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়াকে আমিরুল মোমেনিন চমৎকার রূপকালঙ্করিকভাবে ব্যক্ত করে বলেছেন যে ,তিনি নিজে নিজেই উহা (খেলাফত) পরিধান করেনিয়েছেন। এটা আরবি ভাষায় ব্যবহার্য একটা রূপক । যখন উসমানকে খেলাফত ছেড়ে দিতে বলা হয়েছিল (অবরোধ অবস্থায়) । তখন তিনি বলেছিলেন , যে শার্ট আল্লাহ আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন তা আমি কখনো খুলবো না। ” নিঃসন্দেহে খেলাফত পরিয়ে দেয়ার বিষয়টি আমিরুল মোমেনিন আল্লাহতে আরোপ করেন নি। আবু বকর নিজেই তা পরেছেন কারণ তথাকথিত সর্বসম্মত ঐকমত্য অনুযায়ী আবু বকরের খেলাফত গ্রহণ আল্লাহর মনোনয়ন নয় - এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। সে কারণেই আমিরুল মোমেনিন বলেছেন যে ,আবু বকর খেলাফত পরিধান করেনিয়েছেন। আমিরুল মোমেনিন জানতেন ,এ পোষাক তারই জন্য সেলাই করা হয়েছিল এবং খেলাফতের জন্য তাঁর অবস্থান ছিল যাতার মধ্যশলাকার ন্যায় যা না হলে যাতার পাথর সঠিক অবস্থানে থাকতে পারে না ; ফলে যাতাও কোন কাজে আসে না। তাই আমিরুল মোমেনিন বলেছিলেন – আমি হলাম খেলাফতের কিলক । আমাকে খেলাফত থেকে সরিয়ে রাখার কারণে এর সকল নিয়ম - নীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সকল বিপদাপদ মাথায় নিয়ে আমিই ছিলাম। এসব নিয়ম - নীতির অতন্দ্র প্রহরী। আমিই এসব সংগঠিত করে শৃঙ্খলা বিধান ও সঠিক দিক নির্দেশনায় পরিচালনা করেছিলাম। জ্ঞানের প্রবাহ আমার বক্ষ থেকেই নিঃসরিত হয় এবং আমিই নিয়ম - নীতিকে জল সিঞ্চনে উজীবিত করেছি। আমার অবস্থান কল্পনাতীত উচ্চতর ছিল । কিন্তু দুনিয়াদারদের ক্ষমতা লিন্সা আমার জন্য হয়ে গেল উল্টে পড়া পাথরের সামিল এবং আমি নিঃসঙ্গতায় নিজকে আবদ্ধ করতে বাধ্য হলাম। চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্নতা আর তীব্র হতাশা বিরাজ করছিলো ; যুবকেরা বৃদ্ধ হয়ে গেল এবং বৃদ্ধর কবরে চলে গেল তবুও যেন ধৈর্যধারণকালে শেষ হচ্ছিলো না। আমার উত্তরাধিকার কিভাবে লুটপাট করেনিয়েছে। আমি তা নিজ চোখে দেখছিলাম এবং দেখছিলাম কিভাবে খেলাফত এক হাত থেকে অন্য হাতে বদল হচ্ছিলো। আমি ধৈর্যধারণ করে রইলাম। কারণ তাদের লুটপাট বন্ধ করতে হলে যে উপায় - উপকরণের প্রয়োজন তা আমার ছিল না। ”

খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা ও তার নিয়োগ প্রণালী

রাসূলের (সা.) তিরোধানের পর এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল যিনি ইসলামি উম্মাহর অনৈক্য এবং ইসলামি আইন - কানুনের পরিবর্তন ও প্রক্ষেপ রোধ করতে সমর্থ ছিলেন। কারণ এমন অনেকে ছিল যারা আপন কামনা - বাসনা চরিতার্থ করার জন্য উন্মাহর ঐক্যে ফাটল ধরাতে ও আইন - কানুন পরিবর্তন করে তাতে নিজেদের ধ্যান - ধারণা প্রক্ষেপণে সদা চেষ্টিত ছিল। যদি এহেন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয় ,তাহলে রাসূলের উত্তরাধিকারিত্বের কোন গুরুত্ব থাকে না এবং সেক্ষেত্রে রাসূলের দাফন বাদ দিয়ে সকিফাহ্ - ই - সাঈদার সম্মেলনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ নেহায়েত বাতুলতা মাত্র। আর যদি রাসুলোত্তরকালে একজন খলিফাতুর রাসূলের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হয় ,তাহলে প্রশ্ন এসে পড়ে রাসূল (সা.) কি এমন অবশ্যম্ভাবিতা অনুভব করতে পেরেছিলেন ? যদি ধরা হয় তিনি এদিকে মনোযোগ দেন নি বা এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নি তাহলে এটা একটা বিরাট প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় যে ,স্বধর্ম ত্যাগ ,উন্মাহর খণ্ড - বিখণ্ডতা (বিভক্তি) ও দুষ্ট প্রক্ষেপ রোধ করার উপায় সম্পর্কে রাসূলের মন শূন্য ছিল। অথচ বাস্তবে এমনটি ছিল না। এহেন অবস্থা সম্পর্কে তিনি বারংবার সতর্ক করেছেন। যদি ধরা হয় তিনি এটা অনুভব করতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোন কৌশলী - সুবিধার কারণে তা অমীমাংসিত রেখে গেছেন তাহলে গুপ্ত রাখার পরিবর্তে তিনি ওই সুবিধার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিতেন। কারণ উদ্দেশ্যবিহীন নীরবতা নবুয়তের দায়িত্ব পালনে অবহেলার সামিল। যদি কোন বাধা থাকতো তবে তা প্রকাশ হয়ে পড়তো। যেহেতু রাসূল (সা.) দ্বিনের কোন বিষয় অসম্পূর্ণ রেখে যান নি। সেহেতু তাঁর অবর্তমানে তাঁর প্রাণপ্রিয় ইসলামের এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (খলিফাতুর রাসূল) অসম্পূর্ণ বা অমীমাংসিত রেখে যেতে পারেন না ,এটাই সর্বসম্মত মত। হয়ত তিনি এমন কর্মপন্থা প্রস্তাব করে গেছেন যা কার্যকর হলে অন্যদের হস্তক্ষেপ থেকে দ্বীন নিরাপদ থাকত ।

এখন প্রশ্ন হলো সেই কর্মপন্থাটি কী ? যদি মনে করা হয় তা উন্মাহর ঐকমত্য ,তাহলে তা সত্যিকারভাবে প্রতিফলিত হতে পারে না ,কারণ এতে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু মানব প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই অনুমিত হবে যে ,কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে সকল মানুষের সম্মতি সম্পূর্ণ অসম্ভব। এমন একটা বিষয়ের উদাহরণ দেয়া যাবে না যাতে কোন না কোন ব্যক্তি ভিন্নমত পোষণ করেনি । খেলাফতের মতো একটা মৌলিক বিষয় কিভাবে উম্মাহর সর্বসম্মত ঐক্য নামক অসম্ভব কর্মপন্থার উপর নির্ভর করতে পারে ? অথচ ইসলামের ভবিষ্যত আর মুসলিমের কল্যাণ এ মৌলিক বিষয়টির মুখাপেক্ষী। সুতরাং মৌলিক বিষয়ের জন্য একটা অসম্ভব প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে বিবেক সাড়া দেয় না। এ প্রক্রিয়ার পক্ষে রাসূলের (সা.) কোন হাদিস কেউ দেখাতে পারবে না। ইজি যথার্থই লিখেছেনঃ

জেনে রাখো ,খেলাফত নির্বাচনের মাধ্যমে ঐকমত্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না । কারণ এর স্বপক্ষে কোন ন্যায়সঙ্গত যুক্তি অথবা হাদিস দেখাতে পারবে না ।

বস্তুতঃ সর্বসম্মত ঐকমত্যের সমর্থকগণ যখন দেখলো নির্বাচনে সকলের সম্মতি একটা দুরূহ ব্যাপার তখন তারা সর্বঐকমত্যের বিকল্প হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐকমত্য গ্রহণ করলো এবং তাতে সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামত দারুণভাবে উপেক্ষিত হলো ।

এসবক্ষেত্রে অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত এমন গতি পরিগ্রহ করে যাতে ন্যায় - অন্যায় ,শুদ্ধ - অশুদ্ধ ,ব্যক্তির গুণাগুণ ও উপযুক্ততা বিচার করার কোন সুযোগ থাকে না। এতে প্রকৃত উপযুক্ত ব্যক্তি অগোচরে থেকে যায় এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেখানে মানুষের যোগ্যতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠের অযৌক্তিক প্রবাহ দ্বারা প্রদমিত করা হয় এবং প্রভাবশালীদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য ন্যায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সেখানে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করা দুরাশা মাত্র। যদি ধরাও হয় যে ,ভোটারগণ পক্ষপাতবিহীন দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচন বিবেচনা করেছে এবং তাদের কারো কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল না। তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সঠিক বা তা বিপথে যেতে পারে না এমন মনে করার কোন কারণ নেই। বাস্তবে দেখা গেছে ,পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সংখ্যাগরিষ্ঠগণ নিজেদের মতামত ভুল হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠগণের প্রতিটি সিদ্ধান্ত যদি সঠিক বলে মনে করা হয় তবে শেষোক্ত সিদ্ধান্ত যার দ্বারা অন্য একটি সিদ্ধান্তকে ভুল বলে স্বীকার করা হয়েছে - তা নিশ্চয়ই ভুল। এ অবস্থায় ইসলামের খলিফা নির্বাচন যদি ভুল হয়ে থাকে তবে সে ভুলের জন্য দায়ী কে ? এবং ইসলামি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য কাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে ? একইভাবে খলিফা নির্বাচনোত্তর বিক্ষোভ ও সন্ত্রাসে যে রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার দায় - দায়িত্ব কার ? যে সমস্ত লোক সর্বদা রাসূলের (সা.) সম্মুখে বসে থাকতো তারা যেখানে পরস্পর বাগড়া - বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়েছে ,সেখানে অন্য লোক বাদ পড়ার কথা চিন্তা করা যায় কিভাবে ?

যদি ধরা হয় যে ,ভবিষ্যত অমঙ্গল এড়ানোর জন্য রাসূল (সা.) খলিফা নির্বাচন দায়িত্ববান লোকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন যেন তারা তাদের পছন্দ মতো একজনকে নির্বাচিত করে নেয় ,তা হলেও একই দ্বন্দ্ব ও সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজমান থেকে যায়। কারণ সব লোক ব্যক্তিগত স্বার্থ ও লক্ষ্যের উর্দ্ধে ওঠে একই বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে কোন কিছু মেনে নিতে পারে না। বস্তুত এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা বেশি ছিল ,কারণ সকলে না হলেও অধিকাংশ লোক খলিফা পদে প্রার্থী হয়ে বিপক্ষকে পরাজিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতো। এ চেষ্টার অবশ্যম্ভাবী ফল হতো পারস্পরিক হানাহানি ও সার্বিক অমঙ্গল । সর্বঐকমত্য প্রক্রিয়ায় বিশেষ ব্যক্তির স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ” পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল। এতে একজন যোগ্য ব্যক্তি বেছে নেয়ার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠগণ তাদের মধ্যকার কারো ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জনে যন্ত্রের মতে কাজ করেছিল। আবার ,এসব কর্তৃত্বকারী লোকদের যোগ্যতার মাপকাঠি কী ছিল ? তাদের যোগ্যতা তা - ই ছিল যা সচরাচর প্রচলিত অর্থাৎ ক ’ জন অন্ধ সমর্থক জোগাড় করে জোরালো বক্তব্য দ্বারা সভায় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারলেই কর্তৃত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বলে সবাই গণ্য করে। কিন্তু প্রথম খলিফা নির্বাচনের রীতিটি দ্বিতীয় খলিফা উমরের বেলায় নজির হিসাবে গ্রহণ করা হয়নি। অথচ সর্বসম্মতভাবে কোন নীতি গৃহীত হলে তা স্থায়ী নীতি হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য পালনীয় হয়ে থাকে।

সকিফাহ - ই - সাঈদাহর তথাকথিত সর্বসম্মত নির্বাচনের অবস্থা এরূপ ছিল যে ,এক ব্যক্তির (উমর) কর্মতৎপরতাকে সর্বসম্মত নির্বাচন এবং এক ব্যক্তির কার্যাবলীকে আলোচনা সভা নামে চালিযে দেয়া হয়েছে। আবু বকর ভালভাবেই জানতেন যে ,নির্বাচন মানে দু একজন লোকের ভোট নয় - সাধারণ জনগণের ভোট । তাই তিনি সুকৌশলে সর্বসম্মত নির্বাচন বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট বা নির্বাচনী সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে উপেক্ষা করে উমরকে মনোনয়ন করেছিলেন । আয়শাও মনে করতেন জনগণের ভোটের উপর খেলাফতের বিষয়টি ছেড়ে দিলে অকল্যাণ ও সমস্যার সৃষ্টি হবে। তাই উমরের মৃত্যুকালে তিনি বাণী পাঠালেন -

ইসলামি উম্মাহকে নেতাবিহীন অবস্থায় রেখে যাবেন না । একজন খলিফা মনোনয়ন করুন অন্যথায় আমি অমঙ্গল ও সমস্যার আশঙ্কা করছি ।

নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের দ্বারা যখন নির্বাচন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো তখন জোর যার মুলুক তার ” নিয়মনীতিতে পরিণত হলো। যে কেউ অন্যদেরকে বশে আনতে পেরেছে ,তাদের আনুগত্য আদায় করে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণাধীন করতে পেরেছে ,সে - ই রাসূলের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ও খলিফারূপে গৃহীত হয়েছে। এসব রীতি প্রভাবশালীদের স্ব - রচিত। এসব রীতি - নীতি রাসূলের (সা.) বাণীর বিপরীত যা তিনি তাবুকের যুদ্ধে হিজরাহর রাতে পারিবারিক ভোজে সুরা আল - বারায়াহ্ (সুরা তওবা) জ্ঞাত করতে গিয়ে এবং গাদির - ই - খুমের ভাষণে বলেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো ,যেখানে প্রথম তিন জন খলিফার প্রত্যেকেই একে অপরের পছন্দ দ্বারা মনোনীত হয়েছেন ,সেখানে রাসূলের এহেন পছন্দের কথা স্বীকার করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না। বিশেষত মতবিরোধ রোধ করার জন্য এটাই ছিল একমাত্র উপায়। রাসূল (সা.) বিষয়টি কারো হাতে ছেড়ে না দিয়ে নিজেই সমাধান করে গেছেন। এটা অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য সঠিক প্রক্রিয়া এবং রাসূলের (সা.) সুনির্দিষ্ট বাণী দ্বারা সমর্থনপুষ্টও বটে।

৩ । ইয়ামামাহর হাইয়্যান ইবনে সামিন আল - হানাফি ছিলেন হানিফা গোত্রের প্রধান। তিনি দুর্গাধিপতি এবং সেনাবাহিনীর প্রধানও ছিলেন। জাবির ছিলেন তার অনুজ এবং আল - আ ’ শা (প্রকৃত নাম সাইমুন ইবনে কায়েস ইবনে জন্দল) তার অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। হাইয়্যানের বদান্যতায় আমিরুল মোমেনিন সুখে - স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। এ খোৎবায় তিনি তার বর্তমান জীবন যাপনকে পূর্ববতী অবস্থার সাথে তুলনা করেছেন। বস্তুত আমিরুল মোমেনিন বর্তমান সমস্যা সংকুল অবস্থার সাথে রাসূলের (সা.) তত্ত্বাবধানে শান্তিময় অবস্থার তুলনা করেছেন। বর্তমানে যারা ক্ষমতা দখল করে আছে রাসূলের জীবদ্দশায় তাদের কোন গুরুত্বই ছিল না। তখন আলীর ব্যক্তিত্বের কারণে তাদের প্রতি কারো তেমন মনোযোগ ছিল না। রাসূলের (সা.) তিরোধানের পর সময় বদলে গেছে। তাই এক সময়ের অগুরুত্বপূর্ণ লোকগুলোই মুসলিম বিশ্বের প্রভু হয়ে বসেছে।

৪। আবু লুলুআহ কর্তৃক আহত হবার পর উমর যখন বুঝতে পারলেন যে ,তিনি আর বাঁচবেন না তখন তিনি খেলাফত বিষয়ে একটা পরামর্শক কমিটি গঠন করলেন। এ কমিটিতে তিনি আলী ইবনে আবি তালিব ,উসমান ইবনে আফফান ,আবদুর রহমান ইবনে আউফ ,জুবায়ের ইবনে আওয়ান ,সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে ওবায়দুল্লাহকে সদস্য মনোনীত করলেন। তিনি পরামর্শক কমিটিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করলেন যেন তার মৃত্যুর তিন দিন পর তাদের মধ্য থেকে একজনকে খলিফা হিসাবে নিয়োগে করেন এবং এ তিন দিন সুহাইব যেন খলিফার কাজ চালিয়ে নেবে। এসব নির্দেশাবলী পাওয়ার পর কমিটির কয়েকজন সদস্য তাকে অনুরোধ করেছিল যেন তিনি প্রত্যেক সদস্য সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করেন যাতে তারা খলিফা নির্বাচনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। উমর প্রত্যেক সদস্য সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করে বললেন , সাদ রূঢ় মেজাজের ও উগ্র মস্তিস্কের লোক ; আবদুর রহমান উম্মাহর ফেরাউন ; জুবায়ের স্বার্থে তুষ্ট হলে সত্যিকার ইমানদার কিন্তু স্বার্থ সিদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটলে কট্টর বেইমান হয়ে পড়ে ; তালহা অহংকারী ও উদ্ধত প্রকৃতির - তাকে খলিফা নিয়োগে করলে সে খেলাফতের আংটি তার স্ত্রীর আঙ্গুলো পরিয়ে দেবে ; উসমান তার জ্ঞাতি গোষ্ঠির বাইরে আর কিছুই দেখতে পায় না এবং আলী যদিও খেলাফতের প্রতি বেশি অনুরক্ত তবুও (আমার মতে) শুধুমাত্র তিনিই খেলাফতকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারবেন। ” আলীর যোগ্যতা সম্পর্কে এরূপ স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও উমর পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল খেলাফত যেন তার ইচ্ছার অনুকূলে যেতে পারে (অর্থাৎ আলীকে বঞ্চিত করা) এবং সেভাবেই তিনি পরামর্শক কমিটির সদস্য মনোনয়ন ও কমিটির কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করেছেন। একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকেরও এ কথা বুঝতে কষ্ট হবে না যে ,পরামর্শক কমিটির গঠন ও তার কার্যপ্রণালীর মধ্যেই উসমানের জয়ের সকল উপাদান নিহিত আছে। কমিটির সদস্যদের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে ,আবদুর রহমান ইবনে আউফ উসমানের ভগ্নীপতি ; সাদ ইবনে ওয়াক্কাস আবদুর রহমানের আত্মীয় ও জ্ঞাতি এবং সে সর্বদা আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ উসমানের প্রতি অনুরক্ত ছিল এবং সে আলীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতো। কারণ তালহা ছিল তায়মি গোত্রের। আবু বকরের খেলাফত দখলের ফলে তায়মি ও হাশেমি গোত্রের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল না। এমতাবস্থায় জুবায়ের আলীর পক্ষে ভোট দিলেও উসমানের জয়ের জন্য তার একটা ভোট কোন বাধা হয়ে দাড়ায় না। কেউ কেউ লিখেছেন। পরামর্শক কমিটির বৈঠকের দিন তালহা মদিনায় উপস্থিত ছিল না। তার অনুপস্থিতি এমনকি তাকে যদি আলীর পক্ষেও ধরা হয় তবুও উসমানের জয় অনিবার্য। কারণ উমর তার বিচক্ষণতা দিয়ে যে কার্যপ্রণালী করে দিয়েছেন তা উসমানের জয় সুনিশ্চিত করে দিয়েছে। কার্যপ্রণালীটি নিম্নরূপঃ

যদি দুজন সদস্য একজন প্রার্থীর পক্ষে যায় এবং অপর দুজন সদস্য অন্য প্রার্থীর পক্ষে যায়। তবে আবদুল্লাহ ইবনে উমর মধ্যস্থতা করবে। আবদুল্লাহ যে পক্ষকে নির্দেশ দেবে সে পক্ষ খলিফা নিয়োগ করবে। আবদুল্লাহ ইবনে উমরের রায় যদি তারা মেনে না নেয়। তবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ ,যার পক্ষে থাকবে। আবদুল্লাহ সে পক্ষ সমর্থনা করবে ; অপরপক্ষ এ রায় অমান্য করলে তাদের মাথা কেটে হত্যা করা হবে । (তাবারী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৭৭৯ - ২৭৮০ ; আছীর ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৬৭)

এখানে আবদুল্লাহ্ ইবনে উমরের রায়ে অসম্মতির কোন অর্থ হয় না। কারণ আবদুর রহমান ইবনে আউফ যার পক্ষে থাকবে তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য আবদুল্লাহকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। উমর তার পুত্র আবদুল্লাহ ও সুহাইবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে -

যদি মানুষ মতভেদ করে তোমরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষাবলম্বন করো ,কিন্তু যদি তিনজন একদিকে এবং অপর তিনজন অপরদিকে থাকে তবে আবদুর রহমান ইবনে আউফ যে দিকে থাকবে তোমরা সেদিকে থেকো । (তাবারী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ২৭২৫ ; আছীর ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ৫১)

এ নির্দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলতে আবদুর রহমান ইবনে আউফকেই বুঝানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্য কারো পক্ষে হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ আবদুর রহমানের আদেশের অপেক্ষায় পঞ্চাশটি রক্ত - পিপাসু তরবারি বিরোধী পক্ষের জন্য প্রস্তুত ছিল। অবস্থাদৃষ্ট আমিরুল মোমেনিন আগেই তার চাচা আব্বাসকে বলেছিলেন যে ,উসমান খলিফা হতে যাচ্ছে ,কারণ উমর সে পথই পরিস্কার করে দিয়ে গেছে।

যাহোক উমরের মৃত্যুর পর আয়শার ঘরে নির্বাচনী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সভা চলাকালে আবু তালহা আল - আনসারীর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন লোক উন্মুক্ত তরবারি হাতে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। তালহা সভার কার্য শুরু করলেন এবং উপস্থিত সকলকে সাক্ষী রেখে নিজের ভোট উসমানের পক্ষে প্রদান করলেন । এতে জুবায়রের আত্মসম্মানবোধে আঘাত লেগেছে। কারণ তার মা সাফিয়াহ ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের কন্যা ও আমিরুল মোমেনিনের ফুফু। সুতরাং তিনি আলীর পক্ষে ভোট দিলেন। এরপর সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস তার ভোট আবদুর রহমানের পক্ষে প্রদান করলো। এতে তিনজনের প্রত্যেকেই এক ভোট করে পেয়ে সমান হলো। সুচতুর আবদুর রহমান এ অবস্থায় একটি ফাঁদ পেতে বললো , আলী ও উসমান তাদের দুজন থেকে একজনকে খলিফা মনোনয়ন করার ক্ষমতা যদি আমাকে অর্পন করে তবে আমি আমার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেব । অথবা তাদের দুজনের একজন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে খলিফা মনোনয়নের ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। ” আবদুর রহমানের এ ফাদ আলীকে সব দিক থেকে জড়িয়ে ফেললো। কারণ এ প্রস্তাবে হয় তাকে নিজের অধিকার ছেড়ে দিয়ে খলিফা মনোনীত করতে হবে ,না হয় আবদুর রহমান ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তার ইচ্ছামতো যা করে তা - ই মেনে নিতে হবে। নিজের ন্যায্য অধিকার ছেড়ে দিয়ে উসমান অথবা আবদুর রহমানকে খলিফা মনোনীত করা আলীর পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। প্রথম থেকেই তিনি বঞ্চিত হয়েও তার অধিকারের দাবি কখনো ছেড়ে দেন নি। কাজেই এবারও তিনি নিজের অধিকার আঁকড়ে ধরে রাখলেন। তা না হলে তার মনোনীত খলিফা কর্তৃক ইসলামি উম্মাহর ক্ষতির জন্য তিনিই দায়ী হতেন। সুতরাং আবদুর রহমান নিজেই তার প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে মনোনয়নের ক্ষমতা গ্রহণ করলো এবং আমিরুল মোমেনিনকে বললো , আপনি যদি কুরআন ,সুন্নাহ ও পূর্ববতী দু খলিফার রীতি - নীতি ও কর্মকাণ্ড মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে আমি আপনার বায়াত নেব। ” প্রত্যুত্তরে আলী বললেন , আমি কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আমার বিচার বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবো। ” তিনি তিনবার জিজ্ঞাসিত হলেন এবং তিনবারই একই উত্তর দিলেন। এরপর আবদুর রহমান উসমানের দিকে ফিরে বললো , আপনি কি শর্তগুলো মেনে চলতে পারবেন ? উসমান সন্তুষ্ট চিত্তে তা মেনে নিলেন এবং আবদুর রহমান তার বায়াত গ্রহণ করলো। এভাবে আমিরুল মোমেনিনের অধিকার ও দাবি পদদলিত হলে তিনি বললেনঃ

এটা প্রথম দিন নয় যে ,তোমরা আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছো। আমাকে শুধু ধৈর্য ধারণই করতে হবে ; তোমরা যা কিছু বল আল্লাহ তার বিরুদ্ধে সাহায্যকারী। আল্লাহর কসম ,তুমি এ আশা ব্যতীত উসমানকে খলিফা বানাও নিজে সে তোমাকে খেলাফত ফিরিয়ে দেবে।

ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন যে ,উসমানকে খলিফা নিয়োগ করে সভার কার্য সমাপ্ত করার পর আলী উসমান ও আবদুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন , আল্লাহ্ তোমাদের দুজনের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করুন। ” আলীর একথা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছিল। উসমান ও আবদুর রহমান একে অপরের এরূপ শক্রতে পরিণত হয়েছিল যে ,জীবদ্দশায় তারা একে অপরের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি। এমনকি উসমানের মৃত্যুশয্যায় আবদুর রহমান তাকে দেখতেও যায় নি।

ঘটনা প্রবাহ থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে শূরা (পরামর্শক কমিটি) বলতে বিষয়টি প্রথমত ছয় জন ,তারপর তিনজন এবং সর্বশেষে একজনের হাতে ন্যস্ত করাকে বুঝিয়েছে কি ? তদুপরি পূর্বের দু খলিফার কর্মকাণ্ড অনুসরণ করার শর্ত কি উমর আরোপ করেছিল ? নাকি আলী ও খেলাফতের মধ্যে একটা অন্তরায় সৃষ্টি করার জন্য আবদুর রহমান এ শর্ত জুড়ে দিয়েছিল ? আবু বকর তার স্থলে উমরকে মনোনীত করার সময় তো তার পদাঙ্ক অনুসরণের শর্ত উমরকে দেয়নি ? তাহলে আলীর ক্ষেত্রে এহেন শর্ত আরোপের উদ্দেশ্য কী ?

৫। তৃতীয় খলিফার রাজত্বকাল সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে ,উসমান ক্ষমতায় আসার পর পরই উমাইয়া গোত্র সুবিধা পেয়ে গেল এবং বায়তুল মাল লুটপাট শুরু করে দিল। খরায় শুকিয়ে যাওয়া অঞ্চলের গরুর পাল সবুজ ঘাস দেখলে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে উমাইয়া গোত্রও সেভাবে আল্লাহর সম্পদের (বায়তুল মাল) ওপর পড়লো এবং গোগ্রাসে তা নিঃশেষ করতে লাগল। অবশেষে উসমানের প্রশ্রয় ও স্বজনপ্রীতি এমন এক পর্যায়ে গেল। যখন মানুষ তার ঘর অবরোধ করে তরবারি দ্বারা তাকে আঘাত করলো এবং সে যা গলাধঃকরণ করেছিল তা বমি করায়ে ছাড়লো।

উসমানের সময়ে কু - শাসন এমনভাবে বিরাজ করেছিলো যে ,উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবাগণের অকদর ও দারিদ্র দেখে কোন মুসলিম স্থির থাকতে পারতো না। অথচ সমুদয় বায়তুল মাল উমাইয়া গোত্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল ; সরকারী পদসমূহ তাদের অনভিজ্ঞ যুবক শ্রেণির দখলে ছিল ,মুসলিমদের বিশেষ সম্পদ (রাষ্ট্রয়াত্ব সম্পদ) তাদের মালিকানায় ছিল ; চারণভূমি তাদের পশুপালের জন্য নির্ধারিত ছিল। গৃহ নির্মিত হয়েছিল কিন্তু শুধুমাত্র তাদের দ্বারা এবং ফলের বাগান ছিল। কিন্তু তা শুধু তাদের জন্য। যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি এসব বাড়াবাড়ির কথা বলতো তবে তার পাজর ভেঙ্গে দেয়া হতো। এহেন আত্মসাতের জন্য কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলে তাকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হতো। দরিদ্র ও দুস্থদের জাকাত এবং সর্বসাধারণের বায়তুল মালের কি অবস্থা উসমান করেছিল তার নমুনা নিমের গুটিকতেক উদাহরণ থেকে অনুমান করা যাবেঃ

(১) হাকাম ইবনে আবুল আসকে রাসূল (সা.) মদিনা থেকে বহিস্কার করেছিলেন। রাসূলের সুন্নাহ ও পূর্ববতী খলিফাদ্বয়ের নীতি ভঙ্গ করে উসমান তাকেই মদিনায় এনে বায়তুল মাল থেকে তিন লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (বালাজুরী ,পৃঃ ২৭ ,২৮ ,১২৫) ।

(২) পবিত্র কুরআনে মোনাফেক বলে ঘোষিত অলিদ ইবনে উকবাহকে বায়তুল মাল থেকে এক লক্ষ দিরহাম দেয়া হয়েছে (রাব্বিহ ,৩য় খণ্ড ,পৃঃ ৯৪) ।

(৩) উসমান তার কন্যা উন্মে আবানকে মারওয়ান ইবনে হাকামের নিকট বিয়ে দিয়ে বায়তুল মাল থেকে তাকে এক লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (হাদীদ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৯৮ - ১৯৯) ।

(৪) উসমান তার কন্যা আয়শাকে হারিছ ইবনে হাকামের নিকট বিয়ে দিয়ে তাকে বায়তুল মাল থেকে এক লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (প্রাগুপ্ত) ।

(৫) তিনি আবদুল্লাহ্ ইবনে খালিদকে চার লক্ষ দিরহাম দিয়েছিলেন (কুতায়বাহ্ ,পৃঃ৮৪)

(৬) আফ্রিকা থেকে খুমস হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ থেকে পাঁচ লক্ষ দিরহাম মারওয়ান ইবনে হাকামকে দিয়েছিলেন (প্রাগুপ্ত) ।

(৭) সাধারণ বদ্যান্যতার কারণ দেখিয়ে রাসূলের প্রাণপ্রিয় কন্যার রাষ্ট্রায়ত্ব ফাদাক ’ । মারওয়ান ইবনে হাকামকে দান করেছিলেন (প্রাগুপ্ত) ।

(৮) মদিনার মাহজুব নামক বাণিজ্য এলাকা জনগণের ট্রাস্ট হিসাবে রাসূল (সা.) ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু উসমান তা তার জামাতা হারিছ ইবনে হাকামকে দান করেছিলেন (প্রাগুপ্ত) ।

(৯) মদিনার চারপাশের তৃণভূমিতে উমাইয়া গোত্র ছাড়া অন্য কারো উটকে চরতে দেয়া হতো না (হাদীদ ’ ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ১৯৯) ।

(১০) উসমানের মৃত্যুর পর তার ঘরে পঞ্চাশ হাজার দিনার (স্বর্ণ মুদ্রা) ও দশ লক্ষ দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) পাওয়া গিয়েছিল। তার নাখারাজ জমির কোন সীমা ছিল না। ওয়াদি - আল কুরা ও হুনায়েনে তার মালিকানাধীন ভূ - সম্পত্তির মূল্য ছিল এক লক্ষ দিনার। তার উট ও ঘোড়ার কোন হিসাব ছিল না। (মাসুদী ,১ম খণ্ড ,পৃঃ ৪৩৫) ।

(১১) প্রধান নগরীগুলো উসমানের আত্মীয় - স্বজনদের শাসনাধীন ছিল। কুফার শাসনকর্তা ছিল অলিদ ইবনে উকবা। কিন্তু মদাসক্ত অবস্থায় সে ইমামতি করতে গিয়ে ফজরের সালাত দু রাকাতের পরিবর্তে চার রাকাত পড়ায় জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এতে খলিফা তাকে সরিয়ে অন্যতম চিহ্নিত মোনাফেক সাঈদ ইবনে আসকে কুফার শাসনকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। এভাবে মিশরে আমিরকে শাসনকর্তা নিয়োগ করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রশাসনে অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন(প্রাগুপ্ত) ।

খোৎবা - ৪

وهي من أفصح كلامهعليه‌السلام وفيها يعظ الناس ويهديهم من ضلالتهم

بِنَا اهْتَدَيْتُمْ فِي الظَّلْمَاءِ وتَسَنَّمْتُمْ ذُرْوَةَ - الْعَلْيَاءِ وبِنَا أَفْجَرْتُمْ عَنِ السِّرَارِ - وُقِرَ سَمْعٌ لَمْ يَفْقَه الْوَاعِيَةَ - وكَيْفَ يُرَاعِي النَّبْأَةَ مَنْ أَصَمَّتْه الصَّيْحَةُ - رُبِطَ جَنَانٌ لَمْ يُفَارِقْه الْخَفَقَانُ - مَا زِلْتُ أَنْتَظِرُ بِكُمْ عَوَاقِبَ الْغَدْرِ - وأَتَوَسَّمُكُمْ بِحِلْيَةِ الْمُغْتَرِّينَ - حَتَّى سَتَرَنِي عَنْكُمْ جِلْبَابُ الدِّينِ - وبَصَّرَنِيكُمْ صِدْقُ النِّيَّةِ - أَقَمْتُ لَكُمْ عَلَى سَنَنِ الْحَقِّ فِي جَوَادِّ الْمَضَلَّةِ - حَيْثُ تَلْتَقُونَ ولَا دَلِيلَ - وتَحْتَفِرُونَ ولَا تُمِيهُونَ.

الْيَوْمَ أُنْطِقُ لَكُمُ الْعَجْمَاءَ ذَاتَ الْبَيَانِ - عَزَبَ رَأْيُ امْرِئٍ تَخَلَّفَ عَنِّي - مَا شَكَكْتُ فِي الْحَقِّ مُذْ أُرِيتُه - لَمْ يُوجِسْ مُوسَىعليه‌السلام خِيفَةً عَلَى نَفْسِه - بَلْ أَشْفَقَ مِنْ غَلَبَةِ الْجُهَّالِ ودُوَلِ الضَّلَالِ - الْيَوْمَ تَوَاقَفْنَا عَلَى سَبِيلِ الْحَقِّ والْبَاطِلِ - مَنْ وَثِقَ بِمَاءٍ لَمْ يَظْمَأْ!

আমিরুল মোমেনিনের দূরদর্শিতা এবং তাঁর ইমানের দৃঢ় প্রত্যয় সম্পর্কে

তোমাদের অন্ধকার যুগে আমাদের কাছ থেকে হেদায়েত লাভ করে তোমরা আলোর পথ দেখতে পেয়েছে এবং তোমরা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছো। আমাদের দ্বারাই তোমরা অন্ধকার রাত থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছো। যে কান কান্নার শব্দ শুনতে পায় না তা বধির হয়ে গেছে। কুরআন ও রাসূলের কান্নায় (কুরআন ও সুন্নাহ্ পরিত্যাগের কারণে) যে ব্যক্তি বধির রয়ে গেল সে কী করে আমার ক্ষীণ স্বর শুনতে পাবে ? যে হৃদয় আল্লাহর ভয়ে প্রকম্পিত হয় সে প্রশান্তি প্রাপ্ত হবে।

আমি সর্বদা শঙ্কিত থাকি তোমাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের পরিণতির জন্য এবং আমি তোমাদেরকে ধোকাবাজদের চাকচিক্যে জড়িয়ে পড়তে দেখেছিলাম। দ্বীনের পর্দা তোমাদের কাছ থেকে আমাকে গোপন করে রেখেছিল কিন্তু আমার নিয়্যতের বিশুদ্ধতা তোমাদের সব কিছু আমার কাছে ফাঁস করে দিল । তোমরা বিপথে চলে গেলে অথচ আমি তোমাদের জন্য সত্য পথে দাঁড়িয়েছিলাম। আমা হতে মুখ ফিরিয়ে যখন তোমরা রাস্তার সন্ধান করছিলে তখন কোন পথ প্রদর্শক ছিল না। ফলে তোমরা কূপ খনন করেছো সত্য ,কিন্তু একটুও পানি পাওনি।

আজ আমি যেসব মূক জিনিসকে (অর্থাৎ আমার সুচিন্তিত সুপারিশসমূহ ও গভীর বেদনাগাথা) তোমাদের সাথে কথা বলাচ্ছি তা নিদারুণভাবে উপেক্ষিত হয়েছিল। যে ব্যক্তি আমা হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার মতামত বা অভিমত ধ্বংস হয়ে যায়। যখন থেকে আমাকে সত্য দেখানো হয়েছে তখন থেকে আমি কখনো সত্যের প্রতি সন্দিহান হইনি। মুসা নিজের জন্য ভীত বিহ্বল হননি ; বরং তিনি অজ্ঞদের পথভ্রষ্টতার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। আজ আমরা সত্য ও অসত্যের মিলন স্থলে উপনীত। কেউ পানি পাবার বিষয়ে নিশ্চিত হলে তৃষ্ণা - কাতর হয় না।

____________________

১। আমিরুল মোমেনিন এ খোৎবায় মুসার ভয় পাবার বিষয়টি এজন্য বলেছেন যে ,যখন যাদুকরগণকে মুসার মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করা হয়েছিল তখন তারা দড়ি ও লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করে যাদুবিদ্যা দেখাতে লাগলো। এতে মুসা ভীত হয়ে গেলেন। কুরআন বলেনঃ

মুসার মনে হলো যাদুর প্রভাবে এগুলো (দাড়ি ও লাঠি) ছুটাছুটি করছে । মুসার অন্তরে একটু ভয়ের সঞ্চার হলো । আমরা বললাম ,ভয় করো না | নিশ্চয়ই তুমিই প্রবল (২০:৬৬ - ৬৮)

আমিরুল মোমেনিন বলেন যে ,মুসার ভয়ের কারণ এ ছিল না যে দড়ি ও লাঠির ছুটাছুটিতে তিনি জীবনের আশঙ্কা করেছিলেন ; বরং তার ভয়ের কারণ ছিল পাছে মানুষ যাদুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এ কৌশলে মিথ্যা ও অলীক প্রতিষ্ঠিত হয়ে পড়ে। এ কারণেই কুরআনে মুসার জীবন রক্ষার সান্তুনা বাণী না শুনিয়ে বলা হয়েছে যে ,তিনিই শ্রেষ্ঠ হিসাবে প্রমাণিত হবেন এবং তার দাবিই টিকে থাকবে। মুসার ভয় যেমন ছিল সত্যের পরাজয় ও মিথ্যার বিজয় সম্পর্কে ,তার নিজের জীবনের জন্য নয় ; তেমনি আমিরুল মোমেনিনের ভয় ছিল সেসব লোকের (তালহা ,জুবায়র ,মুয়াবিয়া ইত্যাদি) ফাঁদে আটকা পড়ে মানুষ যেন ইমান হারিয়ে বিপথগামী হয়ে ধ্বংস হয়ে না যায়। অন্যথায় তিনি নিজের জীবনের ভয়ে কখনো ভীত ছিলেন না।

খোৎবা - ৫

لما قبض رسول اللهصلى‌الله‌عليه‌وآله - وخاطبه العباس وأبو سفيان بن حرب - في أن يبايعا له بالخلافة (وذلك بعد أن تمت البيعة لأبي بكر في السقيفة، وفيها ينهى عن الفتنة ويبين عن خلقه وعلمه)

أَيُّهَا النَّاسُ شُقُّوا أَمْوَاجَ الْفِتَنِ بِسُفُنِ النَّجَاةِ - وعَرِّجُوا عَنْ طَرِيقِ الْمُنَافَرَةِ - وضَعُوا تِيجَانَ الْمُفَاخَرَةِ - أَفْلَحَ مَنْ نَهَضَ بِجَنَاحٍ أَوِ اسْتَسْلَمَ فَأَرَاحَ - هَذَا مَاءٌ آجِنٌ ولُقْمَةٌ يَغَصُّ بِهَا آكِلُهَا. ومُجْتَنِي الثَّمَرَةِ لِغَيْرِ وَقْتِ إِينَاعِهَا كَالزَّارِعِ بِغَيْرِ أَرْضِه.

فَإِنْ أَقُلْ يَقُولُوا حَرَصَ عَلَى الْمُلْكِ - وإِنْ أَسْكُتْ يَقُولُوا جَزِعَ مِنَ الْمَوْتِ - هَيْهَاتَ بَعْدَ اللَّتَيَّا والَّتِي واللَّه لَابْنُ أَبِي طَالِبٍ آنَسُ بِالْمَوْتِ - مِنَ الطِّفْلِ بِثَدْيِ أُمِّه - بَلِ انْدَمَجْتُ عَلَى مَكْنُونِ عِلْمٍ لَوْ بُحْتُ بِه لَاضْطَرَبْتُمْ - اضْطِرَابَ الأَرْشِيَةِ فِي الطَّوِيِّ الْبَعِيدَةِ!

আবু বকর কর্তৃক খেলাফত দখলের পর আব্বাস ও আবু সুফিয়ান খেলাফতের জন্য আমিরুল মোমেনিনকে সাহায্য করার প্রস্তাব করায় এ খোৎবা প্রদান করেন।

হে জনমণ্ডলী !

ফেতনার তরঙ্গ মাঝে শক্ত হাতে হাল ধরে মুক্তির নৌকা চালিয়ে যাও ; বিভেদের পথ থেকে ফিরে এসো ; এবং অহংকারের মুকুট নামিয়ে ফেলো। সে ব্যক্তি সফলকাম ,যে ডানার সাহায্যে উড়ে (যখন তার ক্ষমতা থাকে) অথবা সে শান্তিপূর্ণভাবে থাকে এবং তাতে অন্যরা সুখে - শান্তিতে থাকতে পারে। এটা (খেলাফতের লালসা) পঙ্কিল পানি অথবা শক্ত খাদ্য টুকরার মতো - যে কেউ গলাধঃকরণ করলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি পাকার আগেই ফল তোলে সে ওই ব্যক্তির মতো ,যে অন্যের জমিতে চাষাবাদ করেছে।

যদি আমি বলেই ফেলি (খেলাফতের কথা) তবে তারা আমাকে বলবে ক্ষমতালোভী ; আর যদি আমি নিশূপ হয়ে থাকি তবে তারা বলবে আমি মৃত্যুর ভয়ে ভীত। দুঃখের বিষয় এই যে ,সকল উত্থানপতনের মধ্যেও আমি টিকে আছি। আল্লাহর কসম ,আবু তালিবের পুত্র মৃত্যুর সাথে এমনভাবে পরিচিত যেমন একটি শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে । আমি নীরব রয়েছি আমার গুপ্ত জ্ঞানের কারণে যা আমাকে দান করা হয়েছে। যদি আমি তা প্রকাশ করি তবে গভীর কূপ থেকে পানি উত্তোলনরত রশির মতো তোমরা কাপতে থাকবে ।

__________________

১। রাসূলের (সা.) ইনতিকালের সময় আবু সুফিয়ান মদিনায় ছিল না। তার গন্তব্যে যাবার পথিমধ্যে সে রাসূলের (সা.) দেহত্যাগের খবর শুনে মদিনায় ফিরে এসেছিল। মদিনায় আসা মাত্রই সে জানতে চাইল কে নেতা মনোনীত হয়েছে। তাকে বলা হলো যে ,জনগণ আবু বকরের বায়াত গ্রহণ করেছে। এটা শোনামাত্রই আরবের চিহ্নিত কলহ - পসারি এ লোকটি গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলো এবং তৎক্ষণাৎ আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের কাছে গিয়ে বললো , দেখ ,এসব লোকেরা ফন্দি করে বনি তায়েমের হাতে খেলাফত হস্তান্তর করে দিয়েছে এবং বনি হাশিম চিরতরে বঞ্চিত হলো। এ ব্যক্তি (আবু বকর) তার পরে বনি আদির কোন উদ্ধত ব্যক্তিকে আমাদের মাথার ওপর বসিয়ে দেবে। চল ,আমরা আলী ইবনে আবি তালিবের নিকট যাই এবং তার অধিকার আদায়ের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বলি। ” এরপর সে আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে আলীর কাছে এসে বললো , আপনার হাত দিন - আমি বায়াত গ্রহণ করি এবং যদি কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করে তবে পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে আমি মদিনার রাস্তা ভরে দেব। ” এ মুহূর্তটুকু আমিরুল মোমেনিনের জন্য অত্যন্ত নাজুক ছিল। তিনি নিজকে রাসূলের সত্যিকার উত্তরাধিকারী মনে করতেন। তদুপরি ,আবু সুফিয়ানের মতো গোত্র - নেতা তার গোত্রসহ তাকে সমর্থন দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। এ অবস্থায় যুদ্ধের শিখা জ্বলিয়ে দেয়ার জন্য একটা ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আমিরুল মোমেনিনের দূরদর্শিতা ও সঠিক বিচার ক্ষমতা মুসলিমগণকে গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছিল। তাঁর সুতীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ধরা পড়লো যে ,এ ব্যক্তি গোত্রীয় আবেগ ও কৌলন্যের ধুয়া তুলে গৃহযুদ্ধ ঘটাতে চায় যাতে প্রবল আলোড়নে ইসলামের মূলভিত্তি আলোড়িত হয়ে পড়ে। আমিরুল মোমেনিন তাই তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন। মানুষ যেন কলহ সৃষ্টির প্রস্তাব নিয়ে তার কাছে আসতে না পারে সে জন্য তিনি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলেন যে ,তার জন্য শুধুমাত্র দুটি পথই খোলা ছিল - হয় অস্ত্রধারণ করা ,না হয়নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ,যুদ্ধে নামলে তাঁর কোন সমর্থক থাকবে না ; ফলে তিনি বিদ্রোহ দমন করতে পারবেন না। কাজেই নিশ্চুপ থেকে অনুকূল অবস্থা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন।

এ পর্যায়ে আমিরুল মোমেনিনের নীরবতা তাঁর দূরদর্শিতা ও উচ্চমানের পলিসির ইঙ্গিতবহ । কারণ সে সময় মদিনা যুদ্ধকেন্দ্রে পরিণত হলে এর শিখা ছড়িয়ে পড়ে সারা আরবকে গ্রাস করে ফেলতো। মুহাজের ও আনসারদের মধ্যে যে বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তা চরমে ওঠে যেতো এবং মোনাফেকগণের খেলার ষোলকলা পূর্ণ হতো। এতে ইসলামের তরী এমন এক জলঘূর্ণিতে পড়ে যেতো যার সমতা সাধন করা কষ্টসাধ্য হতো। এসব চিন্তা করে আমিরুল মোমেনিন অভাবনীয় দুঃখ - কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। কিন্তু হস্ত উত্তোলন করেন নি। ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে যে ,মক্কি জীবনে রাসূল (সা.) বিভিন্ন প্রকার দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছিলেন। কিন্তু তিনি ধৈর্য পরিহার করে সংগ্রাম ও বিরোধে লিপ্ত হননি। কারণ তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে ,সে সময় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ইসলামের প্রসার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। অবশ্য ,যখন তাঁর সমর্থক ও সাহায্যকারীর সংখ্যা আল্লাহ দ্রোহীদের দমনে যথেষ্ট বিবেচিত হলো তখন তিনি শত্রুর মুখোমুখি হলেন। অনুরূপভাবে আমিরুল মোমেনিন রাসূলের জীবনকে আলোক বর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করে শক্তি প্রদর্শনে বিরত ছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমর্থক ও সাহায্যকারী ছাড়া শত্রুর মোকাবেলা করলে জয়ের পরিবর্তে পরাজয় অনিবার্য। এ পরিস্থিতিতে আমিরুল মোমেনিন খেলাফতকে পঙ্কিল পানি বা শ্বাসরুদ্ধকর খাদ্য মনে করেছিলেন। অপরদিকে যে সমস্ত লোক এ খাদ্য জোরপূর্বক কেড়ে নিয়েছিল এবং জোরপূর্বক তা গলাধঃকরণ করতে চেয়েছিল ; তা তাদের গলায় আটকে পড়লো। তারা সেটা গিলতেও পারছিলো না ,বমিও করতে পারছিলো না। অর্থাৎ ইসলামি বিধি - নিষেধে তারা যে সব ভুল - ভ্রান্তি করেছিল তা শুধরে নিয়ে খেলাফত চালাতে পারেনি ; আবার তাদের ঘাড় থেকে এ রাশির বাঁধন খুলেও ফেলতে পারেনি ।

একই কথা তিনি অন্যভাবেও ব্যক্ত করেছেনঃ খেলাফতের কাচা ফল যদি আমি পাড়তে চেষ্টা করতাম তবে বাগান উৎসাদিত হতো এবং আমিও কিছুই পেতাম না ; যেমন অন্যের জমি কর্ষণকারী না পারে একে পাহারা দিতে ,না পারে এতে যথাসময়ে পানি দিতে ,না পারে এর ফসল কাটতে। এসব লোকের অবস্থা এমন ছিল যে ,যদি আমি দখল ছেড়ে দিতে বলতাম যাতে মালিক নিজেই চাষ করতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে ,তবে তারা বলবে আমি কতই না লোভী। আবার আমি নিশ্চপ থাকলে তারা ভাবে আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত। তারা বলুক তো জীবনে আমি কখনো ভীতি অনুভব করেছি। কিনা অথবা প্রাণভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছি কিনা ? ছোট বড় যে কেউ যুদ্ধে আমার সম্মুখীন হয়েছে সেই আমার বীরত্ব ,সাহসিকতা ও নির্ভিকতার পরিচয় পেয়েছে। যে ব্যক্তি সারা জীবন তরবারি নিয়ে খেলা - করেছে আর পাহাড়গুলোকে আঘাত করেছে সে মৃত্যুকে ভয় করতে পারে না। আমি মৃত্যুর সাথে ততটুকু পরিচিত যতটুকু একটা শিশু তার মায়ের স্তনের সাথে নয়। শোন!! আমার নীরবতার একমাত্র কারণ হলো আমার জ্ঞান যা রাসূল (সা.) আমার বক্ষে রেখে গেছেন। যদি আমি তা ফাঁস করি তবে তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে। কিছুদিন গেলেই তোমরা আমার নিস্ক্রিয়তার কারণ জানতে পারবে। তখন তোমরা নিজ চোখে দেখতে পাবে যে ,ইসলামের নামে কী ধরনের লোকেরা খেলাফতের মঞ্চে এসেছিল এবং কতটুকু ধ্বংস তারা সংঘটিত করেছিল। এমনটি ঘটবে সেজন্যই আমার নীরবতা। এটা কারণবিহীন নীরবতা নয়। ”

একজন ফারসি কবি বলেছেনঃ

নীরবতা এমন অর্থ বহন করে যা আক্ষর দ্বারা শেখানো যায় না ।

২। মৃত্যু সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে ,মৃত্যুকে তিনি যতটুকু ভালোবাসেন একটা শিশু তার মায়ের কোলে থেকেও তার পুষ্টিকর উৎসকে (মায়ের স্তন) ততটুকু ভালোবাসে না। মায়ের স্তনের সাথে একটা শিশুর সংযোগ হয় প্রাকৃতিক প্রেরণায়। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে এ প্রকৃতিক প্রেরণা পরিবর্তিত হয়। সীমিত শিশুকাল শেষ হলেই তার মানসিকতা বদলে যায় - এত প্রিয় মায়ের স্তনের দিকে সে ফিরেও তাকায় না। কিন্তু নবী ও আউলিয়াগণের প্রেম আল্লাহর সঙ্গে মিলনের জন্য এবং এটা সম্পূর্ণ মানসিক ও আধ্যাত্মিক। মানসিক ও আধ্যাত্মিক অনুভূতি কখনো বদলায় না এবং দুর্বলতা ও ধ্বংস একে স্পর্শ করে না। যেহেতু মৃত্যুই এ মিলনের উপায় সেহেতু মৃত্যুর প্রতি তাদের ভালোবাসা এত বৃদ্ধি পায় যে ,তারা এর ভয়াবহতায় আনন্দ এবং তিক্ততায় সুস্বাদ অনুভব করে। মৃত্যুর প্রতি তাদের ভালোবাসা এমন ,যেমন তৃষ্ণার্তা ব্যক্তির কূপের প্রতি বা পথ হারানো পথিকের গন্তব্যস্থলের প্রতি। তাই আবদুর রহমান ইবনে মুলজামের (তার ওপর আলাহর লা 'নত) মারণাঘাতের পর আমিরুল মোমেনিন বলেছিলেন , আমি সেই পথিকের মতো যে গন্তব্যস্থলে পৌছেছে অথবা সেই অনুসন্ধানকারীর মতো যে উদ্দিষ্ট বস্তু খুঁজে পেয়েছে এবং আল্লাহর সাথে মিলনের জন্য সকল কিছুই উত্তম। ” রাসূলও (সা.) বলেছিলেন , আল্লাহর সাথে মিলন অপেক্ষা অধিক আনন্দদায়ক আর কিছু নেই। ”

খোৎবা - ৬

لما أشير عليه بألا يتبع طلحة والزبير ولا يرصد لهما القتال وفيه يبين عن صفته بأنهعليه‌السلام لا يخدع

واللَّه لَا أَكُونُ كَالضَّبُعِ تَنَامُ عَلَى طُولِ اللَّدْمِ حَتَّى يَصِلَ إِلَيْهَا طَالِبُهَا ويَخْتِلَهَا رَاصِدُهَاولَكِنِّي أَضْرِبُ بِالْمُقْبِلِ إِلَى الْحَقِّ الْمُدْبِرَ عَنْه - وبِالسَّامِعِ الْمُطِيعِ الْعَاصِيَ الْمُرِيبَ أَبَداً - حَتَّى يَأْتِيَ عَلَيَّ يَوْمِي - فَوَاللَّه مَا زِلْتُ مَدْفُوعاً عَنْ حَقِّي - مُسْتَأْثَراً عَلَيَّ مُنْذُ قَبَضَ اللَّه نَبِيَّهصلى‌الله‌عليه‌وسلم حَتَّى يَوْمِ النَّاسِ هَذَا.

তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ ও জুবায়ের ইবনে আওয়ামের পশ্চাদ্ধাবন না করার জন্য কেউ কেউ উপদেশ দিলে আমিরুল মোমেনিন এ খোৎবা প্রদান করেন।

আল্লাহর কসম ,আমি "দাবু ’ (ভোঁদড় জাতীয় নিশাচর প্রাণী) এর মত হবো না ,যা অনবরত পাথর নিক্ষেপের শব্দেও ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না শিকারি তাকে দেখতে পায় এবং আটক করে। বরং সত্যের পথে অগ্রগামীদের সহায়তায় আমি পথভ্রষ্টদেরকে এবং যারা আমার কথা শুনে ও মানে তাদের সহায়তায় পাপী ও সন্দেহ পোষণকারীকে আঘাত করে যাবো ,যে পর্যন্ত না আমার দিন ফুরিয়ে যায়। আল্লাহর কসম ,রাসূলের (সা.) ইনতিকালের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে আমার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে।

খোৎবা - ৭

يذم فيها أتباع الشيطان

اتَّخَذُوا الشَّيْطَانَ لأَمْرِهِمْ مِلَاكاً واتَّخَذَهُمْ لَه أَشْرَاكاً فَبَاضَ وفَرَّخَ فِي صُدُورِهِمْ ودَبَّ ودَرَجَ فِي حُجُورِهِمْ - فَنَظَرَ بِأَعْيُنِهِمْ ونَطَقَ بِأَلْسِنَتِهِمْ - فَرَكِبَ بِهِمُ الزَّلَلَ وزَيَّنَ لَهُمُ الْخَطَلَ فِعْلَ مَنْ قَدْ شَرِكَه الشَّيْطَانُ فِي سُلْطَانِه ونَطَقَ بِالْبَاطِلِ عَلَى لِسَانِه!

শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণকারীদের সম্পর্কে

তারা শয়তানকে তাদের কর্মকান্ডের বিধায়ক হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং শয়তানও তাদেরকে তার অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাদের বক্ষেই শয়তান ডিম পাড়ে ও বাচ্চা ফুটায়। তাদের কোলেই শয়তান হামাগুড়ি দিয়ে চলে। সে তাদের চোখ দিয়েই দেখে এবং তাদের জিহবা দিয়েই কথা বলে। এভাবেই সে তাদেরকে পাপের পথে পরিচালিত করেছে এবং ক্লেদপূর্ণ জিনিস তাদের জন্য সুসজ্জিত করেছে। তাদের কর্মকাণ্ড সেই ব্যক্তির মতো যাকে শয়তান তার রাজ্যে অংশীদার করে এবং যার জবানে সে কথা বলে ।

খোৎবা- ৮

يعني به الزبير في حال اقتضت ذلك ويدعوه للدخول في البيعة ثانية

يَزْعُمُ أَنَّه قَدْ بَايَعَ بِيَدِه ولَمْ يُبَايِعْ بِقَلْبِه - فَقَدْ أَقَرَّ بِالْبَيْعَةِ وادَّعَى الْوَلِيجَةَ - فَلْيَأْتِ عَلَيْهَا بِأَمْرٍ يُعْرَفُ - وإِلَّا فَلْيَدْخُلْ فِيمَا خَرَجَ مِنْه.

জুবায়ের সম্পর্কে

সে বলে বেড়ায় যে ,সে আমার হাতে হাত রেখেই বায়াত গ্রহণ করেছে কিন্তু অন্তর দিয়ে তা করেনি। সুতরাং সে এমন বায়াত স্বীকার করে না। সে বায়াত গ্রহণ করেছে ; এখন যদি দাবি করে যে তার অন্তরে বিপরীত ভাবে লুক্কায়িত ছিল তা হলে সে স্পষ্ট দলিল নিয়ে আসুক। অন্যথায় ,যেখান থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সেখানে ফিরে যাক (অর্থাৎ বায়াত মেনে চলুক) ।

____________________

১। জুবাইর ইবনে আওয়াম আমিরুল মোমেনিনের হাতে হাত রেখে বায়াত গ্রহণ করেছিল। যখন সে বায়াত ভঙ্গ করে আমিরুল মোমেনিনের বিরোধিতা শুরু করলো তখন সে নানা প্রকার ওজর দেখাতে লাগলো। কখনো সে বলতো ,তাকে জবরদস্তি করে বায়াত করা হয়েছে ; আবার কখনো বলতো ,সে লোক দেখানো বায়াত গ্রহণ করেছে ,তার অন্তরে বিপরীত ধারণা ছিল। কাজেই এরকম বায়াত সে স্বীকার করে না। সে নিজের ভাষায় তার বাইরের ও ভেতরের কপটতা স্বীকার করেছে। যদি জুবায়ের সন্দেহ পোষণ করে থাকে যে ,আমিরুল মোমেনিনের জেদের কারণে উসমান নিহত হয়েছে। তবে বায়াত গ্রহণের জন্য হাত বাড়াবার সময় তা তার মনে থাকার কথা। আসলে আমিরুল মোমেনিনের হাতে বায়াত গ্রহণের পিছনে তার অনেক প্রত্যাশা ছিল। উসমানের জ্ঞাতি - গোষ্ঠী জনগণের সম্পদ যে ভাবে লুটপাট করেছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে। আমিরুল মোমেনিনের সময় তা অসম্ভব দেখে জুবায়ের হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে তার আশার প্রভাত (আলো) দেখা দেয়াতে সে অমূলক উসমান হত্যার ধুয়া তুলেছে।

খোৎবা- ৯

في صفته وصفة خصومه ويقال إنها في أصحاب الجمل

وقَدْ أَرْعَدُوا وأَبْرَقُوا ومَعَ هَذَيْنِ الأَمْرَيْنِ الْفَشَلُ ولَسْنَا نُرْعِدُ حَتَّى نُوقِعَ ولَا نُسِيلُ حَتَّى نُمْطِرَ.

জামাল - যুদ্ধে শত্রুদের কাপুরুষতা সম্পর্কে

তারা মেঘের মতো গর্জন করেছিল বিজলীর মতো চমক দিয়েছিল। লম্ফ - ঝম্ফ ছাড়া তাদের সবটুকুই কাপুরুষতা। তীব্রবেগে শত্রুকে আক্রমণ না করা পর্যন্ত আমরা গর্জন করি না এবং কথার ঢল প্রবাহিত করি না যতক্ষণ পর্যন্ত বৃষ্টি বর্ষণ না করি।

___________________

১। জামালের যুদ্ধে যারা আমিরুল মোমেনিনের মোকাবেলা করার জন্য এসেছিল তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন যে ,তারা গর্জন আর হৈচৈ করে বিক্ষিপ্তভাবে ধাবিত হয়েছিল ; কিন্তু যখন মোকাবেলা হলো তখন তারা খড়ের মতো উড়ে গেল। এক সময়ে তারা জোর গলায় দাবি করেছিল যে ,তারা এটা করবে সেটা করবে। কিন্তু এখন তারা এমন কাপুরুষতা দেখালো যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেল। নিজের সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন , আমরা যুদ্ধের পূর্বে শক্রকে ভীতি প্রদর্শন করি না ,দম্ভোক্তি করি না ,অযথা চিৎকার করে শক্রকে আতঙ্কিত করি না ; কারণ হাতের পরিবর্তে জিহ্বা ব্যবহার করা বীরের কাজ নয়। ” এজন্যই তিনি তাঁর সাথীদেরকে বলেছিলেন , সাবধান ,প্রয়োজনাতিরিক্ত কথা বলো না ,কারণ এটা কাপুরুষতা। ”

খোৎবা- ১০

أَلَا وإِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ جَمَعَ حِزْبَه - واسْتَجْلَبَ خَيْلَه ورَجِلَه وإِنَّ مَعِي لَبَصِيرَتِي مَا لَبَّسْتُ عَلَى نَفْسِي ولَا لُبِّسَ عَلَيَّ - وايْمُ اللَّه لأُفْرِطَنَّ لَهُمْ حَوْضاً أَنَا مَاتِحُه لَا يَصْدُرُونَ عَنْه ولَا يَعُودُونَ إِلَيْه.

তালহা ও জুবায়ের সম্পর্কে

সাবধান ! শয়তান তার দল জড়ো করেছে এবং তার অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যদল সমবেত করেছে। নিশ্চয়ই ,আমার সূক্ষ্ম দৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞান আছে। আমি কখনো নিজের সাথে প্রতারণা করি নি বা প্রতারিতও হইনি। আল্লাহর কসম ,আমি তাদের জন্য একটা জলাধার কানায় কানায় ভরে রাখবো যেখান থেকে শুধু আমিই পানি তুলবো। যারা সেই জলাধারে পা রাখবে তারা বের হয়ে আসতে পারবে না। আর যদি বের হযে আসে তাহলে দ্বীতীয়বার তার দিকে ফিরে যেতে পারবে না ।

____________________

১ । যখন তালহা ও জুবায়ের বায়াত ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করলো এবং আয়শার সঙ্গে বসরা গেল তখন আমিরুল মোমেনিন এ কথাগুলো বলেছিলেন যা একটা দীর্ঘ খোৎবার অংশ মাত্র। ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন ,এ খোৎবায় শয়তান বলতে মুয়াবিয়াকে বুঝানো হয়েছে। কারণ মুয়াবিয়া গোপনে তালহা ও জুবায়েরে সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল এবং আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তাদেরকে প্ররোচিত করেছিল।

খোৎবা- ১১

لابنه محمد ابن الحنفية - لما أعطاه الراية يوم الجمل

تَزُولُ الْجِبَالُ ولَا تَزُلْ - عَضَّ عَلَى نَاجِذِكَ أَعِرِ اللَّه جُمْجُمَتَكَ - تِدْ فِي الأَرْضِ قَدَمَكَ ارْمِ بِبَصَرِكَ أَقْصَى الْقَوْمِ وغُضَّ بَصَرَكَ واعْلَمْ أَنَّ النَّصْرَ مِنْ عِنْدِ اللَّه سُبْحَانَه.

জামাল যুদ্ধে আমিরুল মোমেনিন তার পুত্র মুহাম্মাদ ইবনে হানাফিয়া এর হাতে পতাকা অর্পণকালে এ খোৎবা প্রদান করেন।

পর্বতমালা তার স্থান থেকে সরে পড়তে পারে। কিন্তু তুমি তোমার অবস্থান থেকে নড়তে পারবে না। দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরো। তোমার মাথা আল্লাহকে ধার দাও (আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে নিজকে উৎসর্গ করো) । তোমার পদদ্বয় শক্তভাবে জমিনে স্থাপন করো। বহুদূরবর্তী শত্রুর প্রতিও দৃষ্টি রেখো। শত্রুর সংখ্যাধিক্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করো না। নিশ্চিত মনে রেখো ,সাহায্য ও বিজয় মহিমান্বিত আল্লাহ থেকেই হয়ে আসে ।

____________________

১। মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া আমিরুল মোমেনিনের পুত্র , কিন্তু মায়ের নামানুসারে তাকে ইবনে হানাফিয়া বলা হতো। তার মায়ের নাম খাওলা বিনতে জাফর। বনি হানিফা গোত্রভূত বলে তাকে হানাফিয়া বলা হতো। যখন ইয়ামামার জনগণ ধর্মত্যাগ করে জাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানালো এবং মুসলিম বাহিনীর হাতে পর্যুদস্ত ও নিহত হলো তখন তাদের নারীগণকে কৃতদাসী হিসেবে মদিনায় আনা হয়েছিল। খাওলা বিনতে জাফরও তাদের সাথে মদিনায় নীত হয়েছিল। বনি হানিফার লোকেরা একথা জানতে পেরে আমিরুল মোমিনের নিকট আবেদন করলো যেন খাওলার পারিবারিক ইজ্জতের খাতিরে তাকে কৃতদাসী হওয়ার কলঙ্ক থেকে রক্ষা করা হয়। ফলে আমিরুল মোমেনিন তাকে ক্রয় করে মুক্ত করে দিলেন এবং তাকে বিয়ে করলেন। এরপর তার গর্ভে মুহাম্মদ জন্মগ্রহণ করলেন।

অধিকাংশ ঐতিহাসিক লিখেছেন তাঁর লকব ছিল আবুল কাসিম । বার (৩য় খণ্ড , পৃঃ ১৩৬৬ - ১৩৭২) লিখেছেন যে , রাসূলের (সা.) সাহাবাদের মধ্যে চার জনের পুত্রের নাম ছিল মুহাম্মদ এবং তাদের সকলের লকব ছিল আবুল কাসিম । তারা হলো - (১) মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া (২) মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর ,( ৩) মুহাম্মদ ইবনে তালহা ও (৪) মুহাম্মদ ইবনে সা দ । অতঃপর তিনি লিখেছেন যে , মুহাম্মদ ইবনে তালহার নাম ও লকব রাসূল (সা.) রেখেছিলেন। ওয়াকিদী ’ লিখেছেন যে , মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের নাম ও লকব আয়শা রেখেছিলেন। মূলত রাসূল (সা.) কর্তৃক মুহাম্মদ ইবনে তালহার নাম রাখার বিষয়টি সঠিক হতে পারে না। কয়েকটি হাদিস থেকে জানা যায় যে , আমিরুল মোমেনিনের একটা পুত্রের জন্য রাসূল (সা.) এ নামটি নির্ধারণ করে গিয়েছিলেন। এবং তিনিই হলেন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া। রাসূল (সা.) বলেছিলেন

“ আলী , আমার পরে তোমার ঔরসে এক পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করবে। তাকে আমার নাম ও লকব প্রদান করলাম এবং এখন থেকে কারো জন্য একত্রে আমার নাম ও লকব ব্যবহারের অনুমতি রইলো না । ”

রাসূলের (সা.) উপরোক্ত বাণী সামনে রেখে তালহার পুত্রের নাম রাসূল (সা.) রেখেছিলেন এ কথা সঠিক হতে পারে না। এ ছাড়া কোন কোন ঐতিহাসিক ইবনে তালহার লকব আবু সুলায়মান (আবুল কাসেম নয়) লিখেছেন। একইভাবে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের লকব আবুল কাসিম যদি এজন্য হয়ে থাকে যে , তার পুত্রের নাম ছিল কাসিম (যিনি মদিনার আল্লাহতত্ত্ববিদদের অন্যতম ছিলেন) তা হলে আয়শা কিভাবে তার লকব দিয়েছিলেন ? মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর আমিরুল মোমেনিনের যত্নে লালিত পালিত হয়েছেন। তার কাছে রাসূলের (সা.) বাণী আমিরুল মোমেনিনের গোপন রাখার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে আয়শা কর্তৃক প্রদত্ত নাম ও লকব একত্রে তিনি নিজেই সহ্য করতেন না। তাছাড়া অনেক ঐতিহাসিক তার লকব লিখেছেন আবু আবদার রহমান। খাল্লিকান (৪র্থ খণ্ড , পৃঃ ১৭০) লিখেছেন যে , আমিরুল মোমেনিনের পুত্র মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার জন্য রাসূল (সা.) আবুল কাসিমা ” লকব নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আশরাফ (৩য় খণ্ড , পৃঃ ১১২) লিখেছেনঃ

মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়ার প্রতি এ লকব প্রয়োগ করতে গিয়ে খাল্লিকান বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন । কারণ আমিরুল মোমেনিনের যে পুত্রকে রাসূল (সা.) তাঁর নাম ও লকব একত্রে দান করেছেন এবং যা অন্য আর কারো জন্য অনুমোদিত নয় , তিনি হলেন প্রতিক্ষীত শেষ ইমাম - মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া নয়। হানাফিয়ার আবুল কাসেম লকব প্রতিষ্ঠিত হয় না । কতেক লোক অজ্ঞতা বশতঃ রাসূলের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ইবনে হানাফিয়াকে বুঝেছে ।

যা হোক , মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া ন্যায়পরায়ণতা , দয়া , আত্মত্যাগ , ইবাদতে শ্রেষ্ঠত্ব , জ্ঞান ও কীর্তিতে অতি উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন এবং তিনি তার পিতার বীরত্বের উত্তরাধিকারী ছিলেন। জামাল ও সিফফিনের যুদ্ধে তার কৃতিত্ব এমন প্রভাব ফেলেছিল যে , বড় বড় যোদ্ধাগণও তার নাম শুনলে কেঁপে উঠতো। আমিরুল মোমেনিন তার সাহস ও শৌর্যে গর্বিত ছিলেন এবং সর্বদা যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে সন্মুখভাগে দিতেন। আমিলী লিখেছেন যে , আলী ইবনে আবি তালিব যুদ্ধক্ষেত্রে মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াকে সন্মুখভাগে রাখতেন। কিন্তু হাসান ও হুসাইনকে সন্মুখে এগিয়ে যেতে দিতেন না এবং প্রায়শই বলতেন , এ হচ্ছে আমার পুত্র আর ওরা দুজন আল্লাহর রাসূলের পুত্র। ” একজন খারিজি ইবনে হানাফিয়াকে বলেছিল যে , আলী তাকে যুদ্ধের দাবানলে ঠেলে দেয়। অথচ হাসান ও হুসাইনকে দূরে সরিয়ে রেখে রক্ষা করতে চায়। তখন হানাফিয়া জবাবে বললেন , আমি তাঁর দক্ষিণ হস্ত এবং তারা তার চক্ষু। সুতরাং তিনি তাঁর চক্ষুকে দক্ষিণ হস্ত দ্বারা রক্ষা করেন। ” আশরাফ লিখেছেন যে , একজন খারিজির প্ররোচনায় ইবনে হানাফিয়া নালিশের স্বরে এ বিষয়টি আমিরুল মোমেনিনকে বললে , প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন , তুমি আমার দক্ষিণ হস্ত অপরপক্ষে হাসান ও হুসাইন আমার চক্ষু এবং চক্ষুকে রক্ষা করা হাতের কর্তব্য। ” এ দুটি মতের মধ্যে কোন অমিল নেই। তবে বাগ্মীতার বিবেচনায় এটা আমিরুল মোমেনিনের উক্তি বলেই অধিক যুক্তিযুক্ত। হয়ত আমিরুল মোমেনিনের কথাই ইবনে হানাফিয়া অন্যের কথার জবাবে বলেছিলেন ।

মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া দ্বিতীয় খলিফার রাজত্বকালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের রাজত্বকালে ৬৫ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক ৮০ হিজরিতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে লিখেছেন , আবার কেউ কেউ লিখেছেন ৮১ হিজরিতে। তার মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন মদিনায় , কেউ বলেন আয়লাতে এবং কেউ বলেন তায়েফে ।

২। জামাল - যুদ্ধে আমিরুল মোমেনিন মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণকালে বলেছিলেন যে , তিনি যেন শত্রুর সন্মুখে পর্বত প্রমাণ স্থির - সংকল্প ও দৃঢ়তা সহকারে অবস্থান করেন যাতে করে শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণও যেন তাকে স্থানচ্যুত করতে না পারে এবং তিনি যেন দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরে শক্রকে আঘাত করতে থাকেন। তারপর তিনি বললেন , বৎস আমার , তোমার মাথা আল্লাহকে ধার দাও। এতে তুমি শাশ্বত জীবন লাভ করবে , কারণ কোন কিছু ধার দিলে তা ফেরত পাবার অধিকার থাকে। তাই তুমি জীবনের দিকে না তাকিয়ে যুদ্ধ করো। যদি তোমার মনে জীবনের মায়া এসে যায়। তবে মৃত্যুর মুখোমুখি হবার জন্য অগ্রবতী হতে তুমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। এতে তোমার বীরত্রে সুনাম ক্ষুন্ন হবে। দেখ , কখনো পশ্চাৎপদ হয়ে না , কারণ পশ্চাৎপদ হলে শক্রির সাহস বেড়ে যায় এবং তাদের পদক্ষেপ দ্রুত হয়। শত্রুর সর্বশেষ সারিকে তোমার লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করো। এতে শত্রু তোমার উচ্চাকাঙ্খা অনুধাবন করে ভীত হয়ে পড়বে। তাতে শত্রু বুঢ়োহ ভেদ করা সহজ হবে এবং তাদের গতিবিধিও তোমার কাছে গোপন থাকবে না। দেখো , শত্রুর সংখ্যাধিক্যের প্রতি নজর দিয়ো না - এতে তোমার সাহস ও শৌর্য অক্ষুন্ন থাকবে। ” তিনি আরো বলেছিলেন , যুদ্ধক্ষেত্রে চোখ এত বেশি খোলা উচিত নয় যাতে শত্রুর অস্ত্রের চাকচিক্যে চোখ ধেধে যায় এবং সে সুযোগে শত্রু আক্রমণ করে বসে। সর্বদা মনে রেখো বিজয় আল্লাহর হাতে। যদি আল্লাহ্ তোমাকে সাহায্য করেন তবে কেউ পরাভূত করতে পারবে না। সুতরাং বস্তু উপকরণাদির ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থন অনুসন্ধান করো।

আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করলে তোমাদের ওপর জয়ী হবার কেউ থাকবে না। (কুরআন - ৩:১৬০)

খোৎবা- ১২

لما أظفره الله بأصحاب الجمل وقَدْ قَالَ لَه بَعْضُ أَصْحَابِه - وَدِدْتُ أَنَّ أَخِي فُلَاناً كَانَ شَاهِدَنَا - لِيَرَى مَا نَصَرَكَ اللَّه بِه عَلَى أَعْدَائِكَ

فَقَالَ لَهعليه‌السلام أَهَوَى أَخِيكَ مَعَنَا فَقَالَ نَعَمْ قَالَ فَقَدْ شَهِدَنَا - ولَقَدْ شَهِدَنَا فِي عَسْكَرِنَا هَذَا أَقْوَامٌ فِي أَصْلَابِ الرِّجَالِ - وأَرْحَامِ النِّسَاءِ - سَيَرْعَفُ بِهِمُ الزَّمَانُ ويَقْوَى بِهِمُ الإِيمَانُ.

জামালের যুদ্ধে যখন আল্লাহ আমিরুল মোমেনিনকে শত্রুপক্ষের ওপর বিজয়ী করলেন তখন তার একজন অনুচর বললেন , হায় ! আমার ভাই অমুক যদি যুদ্ধে উপস্থিত থাকতো তাহলে সেও দেখতে পেতো আল্লাহ আপনাকে কিরূপ সাফল্য ও বিজয় দান করেছেন। একথা শুনে আমিরুল মোমেনিন। জিজ্ঞেস করলেন , তোমার ভাই কি আমাকে বন্ধু বলে জানে ?

সে বললো , জি হ্যাঁ ।

আমিরুল মোমেনিন তখন বললেন , তাহলে সে আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমাদের এ সৈন্যবাহিনীতে তারাও উপস্থিত ছিল যারা এখনো পুরুষের ঔরসে ও নারীর জরায়ুতে রয়েছে। সহসাই সময় তাদেরকে বের করেনিয়ে আসবে এবং তাদের মাধ্যমে ইমান শক্তি লাভ করবে।

____________________

১ । উপায় ও উপকরণ থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ কর্মসাধনে ব্যর্থ হয় তা তার ঐকান্তিকতার অভাব নির্দেশক। কিন্তু কর্মসাধনে যদি কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে অথবা জীবনের সমাপ্তিতে কর্ম অসমাপ্ত থেকে যায়। সেক্ষেত্রে কর্মের জন্য পুরস্কার থেকে আল্লাহ তাকে বঞ্চিত করবেন না। কারণ কর্ম নিয়্যত দ্বারাই বিচার্য হয়। যেহেতু তার নিয়্যত ছিল কর্ম সম্পাদনের জন্যই সেহেতু সে কিছুটা পুরস্কার পাবার যোগ্য।

কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মের পুরস্কার নাও থাকতে পারে কারণ কর্ম লোক দেখানো ( রিয়া ) অথবা ভান হতে পারে। কিন্তু নিয়্যত হৃদয়ের গভীরে লুক্কায়িত থাকে। ফলে এতে এক ফোটাও রিয়া অথবা মোহ থাকতে পারে না। প্রতিবন্ধকতার কারণে কর্মসাধন সম্ভব না হলেও নিয়্যতে সর্বদা একই স্তরের অকপটতা ,সততা ,পরিপূর্ণতা ও সঠিকতা থাকতে হবে। নিয়্যত করার অবস্থা না থাকলেও কর্ম সাধনের জন্য যদি হৃদয়ে আবেগ ও উচ্ছাস থাকে। তবে হৃদয়ের সে অনুভূতির জন্য পুরস্কার পেতে পারে। এ কারণেই আমিরুল মোমেনিন বলেছেন ," যদি তোমার ভাই আমাকে ভালোবেসে থাকে। তবে সে তাদের সঙ্গে পুরস্কারের অংশ পাবে যারা আমাদের সমর্থন করে শহিদ হয়েছে। ”

খোৎবা- ১৩

في ذم أهل البصرة بعد وقعة الجمل

كُنْتُمْ جُنْدَ الْمَرْأَةِ وأَتْبَاعَ الْبَهِيمَةِ رَغَا فَأَجَبْتُمْ وعُقِرَ فَهَرَبْتُمْ أَخْلَاقُكُمْ دِقَاقٌ وعَهْدُكُمْ شِقَاقٌ ودِينُكُمْ نِفَاقٌ ومَاؤُكُمْ زُعَاقٌ والْمُقِيمُ بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ مُرْتَهَنٌ بِذَنْبِه والشَّاخِصُ عَنْكُمْ مُتَدَارَكٌ بِرَحْمَةٍ مِنْ رَبِّه - كَأَنِّي بِمَسْجِدِكُمْ كَجُؤْجُؤِ سَفِينَةٍ قَدْ بَعَثَ اللَّه عَلَيْهَا الْعَذَابَ مِنْ فَوْقِهَا ومِنْ تَحْتِهَا - وغَرِقَ مَنْ فِي ضِمْنِهَا.

وفِي رِوَايَةٍ وايْمُ اللَّه لَتَغْرَقَنَّ بَلْدَتُكُمْ حَتَّى كَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَى مَسْجِدِهَا كَجُؤْجُؤِ سَفِينَةٍ - أَوْ نَعَامَةٍ جَاثِمَةٍ.

وفِي رِوَايَةٍ كَجُؤْجُؤِ طَيْرٍ فِي لُجَّةِ بَحْرٍ.

وفِي رِوَايَةٍ أُخْرَى بِلَادُكُمْ أَنْتَنُ بِلَادِ اللَّه تُرْبَةً - أَقْرَبُهَا مِنَ الْمَاءِ وأَبْعَدُهَا مِنَ السَّمَاءِ - وبِهَا تِسْعَةُ أَعْشَارِ الشَّرِّ - الْمُحْتَبَسُ فِيهَا بِذَنْبِه والْخَارِجُ بِعَفْوِ اللَّه - كَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَى قَرْيَتِكُمْ هَذِه قَدْ طَبَّقَهَا الْمَاءُ - حَتَّى مَا يُرَى مِنْهَا إِلَّا شُرَفُ الْمَسْجِدِ كَأَنَّه جُؤْجُؤُ طَيْرٍ فِي لُجَّةِ بَحْرٍ!

বসরার জনগণকে তিরস্কার

তোমরা ছিলে একজন রমণীর সৈন্য এবং একটা চতুষ্পদ জন্তুর নিয়ন্ত্রণাধীন। যখন জন্তুটি রোষে গর্জে উঠলো ,তোমরাও তার সঙ্গে সাড়া দিলে। আবার যখন জন্তুটির পায়ের শিরা কেটে দেয়া হয়েছিল ,তোমরা তখন পালিয়ে গেলে । তোমাদের চরিত্র নিম্নমানের এবং তোমরা অঙ্গীকার ভঙ্গকারী। তোমাদের হৃদয় হচ্ছে মোনাফেকিপূর্ণ। তোমাদের পানি হচ্ছে লবনাক্ত। যারা তোমাদের সঙ্গে থাকে তারা পাপে ডুবে থাকে এবং যারা তোমাদের পরিত্যাগ করে তারা আল্লাহর রহমতের অধিকারী হয়। যদিও আমি তোমাদের মসজিদকে নৌকার উপরিভাগের মতো দীপ্যমান দেখছি। তবুও আল্লাহ তার ওপর ও নিচের দিক হতে শাস্তি প্রেরণ করলে তোমরা যারা এতে রয়েছে। প্রত্যেকেই অতলে তলিয়ে যাবে। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ

আল্লাহর কসম ,তোমাদের শহর নিশ্চয়ই ,এতখানি ডুবে যাবে যে ,এর মসজিদকে আমি নৌকার উপরিভাগ অথবা বসে থাকা উটপাখীর মতো দেখতে পাচ্ছি। অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ

তোমাদের মসজিদকে গভীর সমুদ্রে একটা পাখীর বক্ষের মতো দেখতে পাচ্ছি।

অন্য এক বর্ণনানুযায়ীঃ

তোমাদের শহর অতীব পুতিগন্ধময়। শহরটি পানির অত্যন্ত নিকটবর্তী এবং আকাশ থেকে অনেক দূরে। এ শহরের দশ ভাগের নয় ভাগই পাপে পঙ্কিল। যে কেউ এতে প্রবেশ করে সে পাপের মধ্যে প্রবেশ করে এবং যে এ শহর থেকে বেরিয়ে যায়। সে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করে । তোমাদের এ জনপদের দিকে তাকালে দেখা যায় যে ,পানি এমনভাবে এটাকে গ্রাস করেছে কেবলমাত্র মসজিদের চূড়া গভীর সমুদ্রে ভাসমান পাখীর বক্ষের মতো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না ।

____________________

১। বাহরানী লিখেছেন যে , জামালের যুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর তৃতীয় দিনে আমিরুল মোমেনিন বসরার কেন্দ্রীয় মসজিদে ফজর সালাত সমাপ্ত করে সালাত স্থানের ডান দিকের দেয়ালে হেলান দিয়ে এ খোৎবা প্রদান করেন। এতে তিনি বসরার জনগণের চরিত্রের নিচতা ও ধূর্ততা বর্ণনা করেন। তারা নিজেদের বিচার বিবেচনা বাদ দিয়ে অন্যের প্ররোচনায় ধূমায়িত হয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণভার উটের পিঠে বসে থাকা একজন রমণীর হাতে তুলে দিয়েছিল। তারা তাদের বায়াত ভঙ্গ করেছিল এবং দ্বিমুখী কর্ম দ্বারা তাদের চরিত্রের নিচতা ও বদস্বভাব প্রকাশ করেছিল। এ খোৎবায় রমণী ’ বলতে আয়শাকে এবং চতুষ্পদ জন্তু বলতে আয়শার উটকে বুঝানো হয়েছে। সেজন্যই এ যুদ্ধের নামকরণ করা হয়েছে জামালের (উটের) যুদ্ধ। ”

এ যুদ্ধের সূত্রপাত এভাবে হয়েছিল - যদিও উসমানের জীবদ্দশায় আয়শা তার ঘোর বিরোধিতা করতেন এবং তাকে অবরোধের মধ্যে ফেলেই মক্কায় চলে গিয়েছিলেন তবুও মক্কা থেকে মদিনায় ফেরার পথে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে সালামার কাছে জানতে পারলেন যে , উসমানের পর খলিফা হিসেবে সকলেই আলীর হাতে বায়াত গ্রহণ করেছে। একথা শোনামাত্রই আয়শা দুঃখ সহকারে বললেন , আলীর বায়াত গ্রহণের পূর্বে পৃথিবীর ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়া ভাল ছিল। আমি মক্কায় ফিরে চলে যাব। ” তিনি মক্কায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং বললেন , আল্লাহর কসম , উসমান অসহায়ভাবে নিহত হয়েছে। নিশ্চয়ই আমি তার রক্তের বদলা নেব। ” আয়শার এহেন পরিবর্তন দেখে ইবনে সালামা তাজ্জব হয়ে বললেন , আপনি এসব কী বলছেন , আপনি নিজেই তো বলতেন এ নাছাল ’ টিকে হত্যা করে ফেল ; সে বেইমান হয়ে গেছে। ” প্রত্যুত্তরে আয়শা বললেন , শুধু আমি একা নই , সকলেই এ কথা বলতো। সে সব কথা বাদ দাও। এখন আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে শ্রবন করা। এটা অতীব দুঃখজনক যে উসমানকে তওবা করে শোধরানোর কোন সুযোগ না দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ” এ কথা শোনা মাত্রই ইবনে সালামা আয়শাকে উদ্দেশ্য করেনিম্নের পংক্তি ক ' টি আবৃত্তি করতে লাগলেনঃ

আপনি এটা শুরু করেছিলেন , এখন হঠাৎ বদলে গিয়ে

গোলযোগের ঝড় - তুফান তুলছেন ,

আপনি তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন

সে বেইমান হয়ে গেছে বলে আমাদেরকে বলেছেন।

সে হত্যা কিন্তু আপনার নির্দেশেই হয়েছে

এবং প্রকৃত খুনি সে , যে আদেশ করেছে।

এতদসত্ত্বেও আমাদের ওপর আকাশ ভেঙ্গে পড়ে নি।

অথবা চন্দ্র - সূর্যেও গ্রহণ লাগেনি।

নিশ্চয়ই , মানুষ এমন একজনের বায়াত গ্রহণ করেছে।

যিনি শক্তিমত্তা ও মহানুভবতা দিয়ে শক্রকে

যিনি কখনো সোরা গণকে কাছে

ভিড়তে দেবেন না ,

যিনি কখনো রশির পাক খুলবেন না

শত্রুগণও তাতে দম্ভিত থাকবে।

তিনি সর্বদা যুদ্ধের জন্য অস্ত্রধারণ করে আছেন

ইমানদার কখনো বিশ্বাসঘাতকের মতো নয়।

যা হোক , প্রতিশোধের একটা উন্মত্ততা নিয়ে আয়শা মক্কায় ফিরে গিয়ে উসমানের হত্যার বদলা নেয়ার জন্য তার হত্যা সম্পর্কে নানা প্রকার কল্পকাহিনী ছড়িয়ে জনমত গঠন করতে লাগলো। তার ডাকে প্রথমেই সাড়া দিল উসমানের সময়কার মক্কার গভর্ণর আবদুল্লাহ্ ইবনে আমির আল - হাদরামী। সে সাথে মারওয়ান ইবনে হাকাম , সা দ ইবনে আ ' স এবং উমাইয়া গোত্রের আরো অনেকে। ইতোমধ্যে তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ ও জুবায়ের ইবনে আওয়াম মদিনা থেকে মক্কায় পৌঁছে গিয়েছিল। অপর দিকে উসমানের রাজত্বকালে ইয়েমেনের গভর্ণর ইয়ালা ইবনে মুনব্বিহ ও বসরার গভর্ণর আবদুল্লাহ ইবনে আমির ইবনে কুরায়েজ মক্কায় পৌছে গিয়েছিল। তারা সকলে মিলিতভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে লাগলো। তারা আমিরুল মোমেনিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র নির্ধারণে আলোচনা অব্যাহত রাখলো। মদিনাকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে নির্ধারণ করার জন্য আয়শা অভিমত ব্যক্ত করলেও কতিপয় লোক তাতে অমত প্রকাশ করেছিল। তারা বললো যে , মদিনাবাসীদের বাগে আনা বড়ই কঠিন ব্যাপার। কাজেই অন্য কোথাও যুদ্ধক্ষেত্র নির্ধারণ করার জন্য তারা বললো। অবশেষে অনেক শলা - পরামর্শের পর বসরার দিকে মার্চ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। কারণ যুদ্ধের কারণের প্রতি সমর্থন দেয়ার মতো লোকের অভাব বসরায় হবে না বলে তাদের বিশ্বাস ছিল। ফলে আবদুল্লাহ ইবনে আমিরের অগণিত সম্পদ আর ইয়ালা ইবনে মুনব্বির ছয় লক্ষ দিরহাম ও ছয় শত উট অনুদান দ্বারা তারা তিন হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী গঠন করে বসরা অভিমুখে প্রেরণ করলো। পথিমধ্যে একটা ছোট্ট ঘটনার কারণে আয়শা অগ্রসর হতে চাইলেন না। ঘটনাটি হলো - একটা জায়গায় উপনীত হলে আয়শা , কুকুরের ঘেউঘেউ শোনতে পেলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি তার উট চালকের কাছে সে জায়গার নাম জানতে চাইলেন। চালক বললো যে , এ জায়গার নাম হাওয়াব। জায়গাটির নাম শোনামাত্রই আয়শা আঁতকে উঠলেন। কারণ তার মনে পড়ে গেল রাসূলের (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী। একদিন রাসূল (সা.) তাঁর স্ত্রীদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন , আমি জানি না , তোমাদের কাকে দেখে হাওয়াবের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠবে। ” আয়শা বুঝতে পারলেন যে , তিনিই সেই স্ত্রী ; তখন তিনি অগ্রযাত্রা বন্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কিন্তু জুবায়ের শপথ করে তাকে বললো সে জায়গা হাওয়াব নয়। তালহা জুবায়েরের কথা সমর্থন করলো। তারা উভয়ে আরো পঞ্চাশজন লোক নিয়ে এলো যারা জুবায়েরের কথার সত্যতার সাক্ষ্য দিল। ফলে আয়শা পুনরায় অগ্রযাত্রা শুরু করলেন।

এ সৈন্যবাহিনী যখন বসরায় পৌছলো , লোকেরা আয়শাকে বহনকারী প্রাণীটি দেখে বিস্ময়েবিহ্বল হয়ে পড়লো। জারিয়া ইবনে কুদাসা বললো , ওগো , উন্মুল মোমেনিন , উসমানের হত্যা একটা হৃদয় বিদারক ঘটনা। কিন্তু তার চেয়েও হৃদয় বিদারক হলো আপনি এ অভিশপ্ত উটে চড়ে বেরিয়ে এসেছেন এবং আপনার সম্মান ও মর্যাদা ধ্বংস করেছেন। এখান থেকে ফিরে যাওয়াই আপনার পক্ষে অধিকতর ভাল। ” হাওয়াবের ঘটনা , কুরআনের নিষেধাজ্ঞা (তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে - ৩৩ : ৩৩) কোন কিছুই যখন তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি , তখন জারিয়ার কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে কেন ?

আয়শার সৈন্যবাহিনী যখন বসরা নগরীতে প্রবেশ করার চেষ্টা করলো তখন বসরার গভর্ণর উসমান ইবনে হুনায়ফ বাধা প্রদান করলো। উভয় পক্ষই অসি কোষমুক্ত করে একে অপরের ওপর আঘাত হানতে শুরু করলো - উভয় পক্ষেই বেশ কিছু সংখ্যক লোক হতাহত হলো। তারপর আয়শা তার প্রভাবের সুযোগ গ্রহণ করে হস্তক্ষেপ করলেন। তাতে উভয় পক্ষ এ মর্মে সম্মত হলো যে , আমিরুল মোমেনিন বসরায় আসা অবধি উসমান ইবনে হুনায়ফ গভর্ণর থাকবে এবং বর্তমান প্রশাসন কাজ চালিয়ে যাবে। কিন্তু দুদিন পরেই এক গভীর রাতে আয়শার বাহিনী উসমান ইবনে হুনায়ফকে আক্রমণ করে চল্লিশ জন নিরপরাধ লোককে হত্যা করেছিল এবং উসমান ইবনে হুনায়ফকে বন্দী করে বেদম প্রহারে আহত করেছিল। এমনকি তার প্রতিটি দাড়ি টেনে তুলে ফেলেছিল। এরপর তারা বায়তুল মালের গুদাম আক্রমণ করলো। বায়তুল মাল লুটের সময় বিশজন লোক হত্যা করেছিল এবং পঞ্চাশজনকে গ্রেফতার করে শিরোচ্ছেদ করেছিল। তারপর তারা বসরার শস্যভান্ডার আক্রমণ করেছিল। এতে বসরার বয়োঃবৃদ্ধ গণ্যমান্য ব্যক্তি হুকায়াম ইবনে জাবালা তার লোকজনসহ জুবায়েরের কাছে এসে বললো , নগরবাসীদের জন্য কিছু খাদ্যশস্য রেখে দিন। অত্যাচারেরও তো একটা সীমা আছে। সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ্ পছন্দ করেন না। আল্লাহর দোহাই , এ ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করুন এবং উসমান ইবনে হুনায়ফকে ছেড়ে দিন। আপনার হৃদয়ে কি আল্লাহর ভয় নেই ? জুবায়ের বললো , এটা উসমান হত্যার প্রতিশোধ। ” ইবনে জাবালা প্রত্যুত্তরে বললো , আপনারা এখানে যাদের হত্যা করেছেন তাদের কেউ কি উসমানের হত্যার সাথে জড়িত ছিল ? আল্লাহর কসম , যদি আমার সমর্থক ও অনুচর থাকতো তবে যেসব মুসলিমকে বিনা অপরাধে আপনারা হত্যা করেছেন তাদের রক্তের বদলা নিতাম। ” জুবায়ের বললো , আমরা এক কণা শস্যও ফেরত দেব না এবং উসমান ইবনে হুনায়াফকেও ছাড়বো না। ” অবশেষে দুপক্ষে যুদ্ধ বেধে গেল। কিন্তু এত বড় বাহিনীর সম্মুখে মুষ্টিমেয় কজন লোক কতক্ষণ টিকতে পারে ? ফলে হুকায়ম ইবনে জাবালা , তার পুত্র আশরাফ ইবনে হুকায়ম ও ভ্রাতা রিল ইবনে জাবালাসহ এ গোত্রের সত্তরজন নিহত হয়েছিল। মোটকথা , আয়শার বাহিনী হত্যা আর লুটপাট করে বসরায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সেখানে না ছিল কারো জীবনের নিরাপত্তা , না ছিল কারো ইজ্জত আর সম্পদ রক্ষার উপায়। আমিরুল মোমেনিন এ সব অত্যাচারের সংবাদ পেয়ে সত্তরজন বদরি (বদর যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিল) ও চার শত রিদওয়ানি (যারা রিদওয়ানের বায়াতের সময় উপস্থিত ছিল) সমন্বয়ে একটা বাহিনী গঠন করে বসরা অভিমুখে যাত্রা করলেন। যখন তিনি যিকর নামক স্থানে পৌছলেন তখন তাঁর পুত্র হাসান ও আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে কুফায় পাঠালেন যেন কুফাবাসীগণ তাঁর সহায়তায় এগিয়ে আসে। আবু মুসা আশারীর বিরোধিতা সত্ত্বেও এ আমন্ত্রণে সাত হাজার কুফি যোদ্ধা আমিরুল মোমেনিনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। সৈন্যগণকে বিভিন্ন কমান্ডারের অধীনে ভাগ করে দিয়ে তিনি সে স্থান ত্যাগ করলেন। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে , আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যবাহিনী বসরার নিকটবর্তী হলে সর্বপ্রথমেই আনসারদের একটা দল নজরে পড়েছিল। আবু আইয়ুব আনসারী ছিলেন এ দলের পতাকা বাহক। এরপর এক হাজার সৈন্যের আরেকটা বাহিনী নজরে পড়েছিল যাদের কমান্ডার ছিলেন খুজায়মা ইবনে ছাবিত আনসারী। তারপর আরেকটা বাহিনী দৃষ্টিগোচর হয়েছিল যাদের পতাকা বহন করছিলেন আবু কাতাদাহ ইবনে রাবি। এরপর এক হাজার বৃদ্ধ ও যুবকের একটা বাহিনী নজরে পড়েছিল যাদের প্রত্যেকের কপালে সেজদার চিহ্ন এবং মুখমণ্ডলে আল্লাহর ভয়ের ছাপ ছিল। তাদের দেখে মনে হয়েছিল যেন তারা শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর মহত্ত্বের সামনে দন্ডায়মান। তাদের কমান্ডার সাদা পোষাক ও মাথায় কালো পাগড়ি পরে একটা কালো ঘোড়ায় চড়ে উচ্চস্বরে কুরআন তেলওয়াত করছিলেন। ইনিই হলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির। এরপর আরেকটি বাহিনী নজরে এলো। এদের পতাকা কায়েস ইবনে সাদ ইবনে উবাদার হাতে ছিল। এরপর এক বাহিনী নজরে এলো । এদের কমান্ডার সাদা পোষাক ও মাথায় কালো পাগড়ি পরিহিত ছিল। তিনি এত সুদর্শন ছিলেন যে সকলের দৃষ্টি তাঁর প্রতি নিপতিত হয়েছিল। ইনি হলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস। তারপর রাসূলের সাহাবাগণের বাহিনী এগিয়ে এলো। এদের পতাকা কুছাম ইবনে আব্বাসের হাতে ছিল । এভাবে কয়েকটি বাহিনী অতিক্রম করার পর একটা বিশাল বাহিনী দেখা গেল। তাদের অধিকাংশের হাতে ছিল বর্শা। তাদের সঙ্গে ছিল বিভিন্ন রঙের অনেক পতাকা । তারমধ্যে একটা বিরাট পতাকা বিশেষ বৈশিষ্ট্য সহকারে দেখা গেল। এ পতাকার পিছনে একজন ঘোড় - সওয়ারকে দেখা গেল। যার মধ্যে মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ রয়েছে। তাঁর পেশি ছিল সুউন্নত এবং দৃষ্টি ছিল নিচের দিকে। তাঁর সন্ত্রম ও মর্যাদা এত প্রখর ছিল যে , কেউ তাঁর দিকে তাকাতে পারছিলো না। ইনিই হলেন চির বিজয়ী বীর শেরে খোদা আলী ইবনে আবি তালিব। তাঁর ডানে হাসান , বামে হুসাইন , সম্মুখে মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া এবং পেছনে বদরিগণ , হাশেম বংশের যুবকগণ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে জাফর ইবনে আবি তালিব। মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া বিজয় ও মর্যাদার পতাকা হাতে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এ বাহিনী যাওয়াইয়াহ নামক স্থানে পৌছলে আমিরুল মোমেনিন ঘোড়া থেকে অবতরণ করে চার রাকাত সালাত আদায় করলেন এবং দীর্ঘক্ষণ সেজদায় পড়ে রইলেন। যখন তিনি মাথা তুললেন তখন দেখা গেল তাঁর অশ্রুতে মাটি ভিজে গিয়েছিল এবং তিনি মুখে বলছিলেনঃ

হে আকাশ , পৃথিবী ও মহাশূন্যের ধারক , এটা বসরা । এর কল্যাণ দ্বারা আমাদের বুক ভরে দাও এবং মন্দ থেকে তোমাদের রক্ষা কর।

অতঃপর তিনি সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জামালের যুদ্ধক্ষেত্রের যে স্থানে শত্রুপক্ষ পূর্ব হতেই ক্যাম্প করেছিল সেখানে নেমে পড়লেন। সর্বপ্রথম আমিরুল মোমেনিন নিজের সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন , কেউ অন্যকে আক্রমণ করবে না বা আক্রমণের ইন্ধনও যোগাবে না। ” তারপর তিনি সোজাসুজি শত্রু সৈন্যের সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে তালহা ও জুবায়েরকে ডেকে বললেন , তোমরা আল্লাহ্ ও তার রাসূলের নামে শপথ করে আয়শাকে বল আমি কি উসমানের হত্যার দোষ থেকে মুক্ত নই ? উসমান সম্পর্কে তোমরা যা বলতে আমি কি তা বলি নি ? বায়াতের জন্য আমি কি তোমাদের ওপর কোন চাপ দিয়েছিলাম নাকি তোমরা স্বেচ্ছায় আমার বায়াত গ্রহণ করেছিলে ? আমিরুল মোমেনিনের এসব কথা শুনে তালহা ক্ষুদ্ধ হয়ে গেল এবং জুবায়ের কিছুটা কোমল হয়েছিল। তারপর আমিরুল মোমেনিন ফিরে এসে মুসলিম নামক আবদ কায়েস গোত্রের একজন যুবকের হাতে কুরআন দিয়ে পাঠালেন যেন তিনি শত্রুপক্ষকে কুরআনের নির্দেশ শুনিয়ে দেন। কিন্তু শত্রুপক্ষ এ পূত - পবিত্র লোকটিকে অজস্র তীর দ্বারা ঢেকে ফেললো। তারপর আম্মার ইবনে ইয়াসির এগিয়ে এসে যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদেরকে বুঝিয়ে বলতে লাগলেন। কিন্তু তাকেও তীর দ্বারা জবাব দেয়া হলো। এ পর্যন্ত আমিরুল মোমেনিন কোন আক্রমণের অনুমতি দেন নি। তাই শত্রুপক্ষ তীরবৃষ্টি ঝরাতে উৎসাহ বোধ করছিলো। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন সাহসী যোদ্ধার মুমূর্ষ অবস্থা আমিরুল মোমেনিনের বাহিনীতে আতঙ্কের সৃষ্টি করলো এবং তারা তাকে বললো , হে , মাওলাল মোমেনিন , আপনি আমাদেরকে আক্রমণ করতে দিচ্ছেন না। অথচ তারা আমাদেরকে তীর দিয়ে ঢেকে ফেলছে। আর কতক্ষণ আমরা আমাদের বক্ষকে তাদের তীরের লক্ষ্যস্থল হিসেবে রাখবো এবং তাদের হঠকারিতায় হাত গুটিয়ে থাকবো। ” এসব কথায় আমিরুল মোমেনিন রাগান্বিত হলেও সংযম আর ধৈর্য ধারণ করে কোন প্রকার যুদ্ধের পোষাক না পরে খালি হাতে শত্রুর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে চিৎকার করে বললেন , জুবায়ের কোথায় ? প্রথমতঃ জুবায়ের এগিয়ে আসতে ইতস্তত করছিলো কিন্তু যখন দেখলো যে , আমিরুল মোমেনিনের হাতে কোন অস্ত্র নেই তখন সে বেরিয়ে এসেছিল। আমিরুল মোমেনিন বললেন , ওহে জুবায়ের , তোমার কি মনে পড়ে একদিন রাসূলে খোদা তোমাকে বলেছিলেন যে , তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করবে এবং তাতে অন্যায় ও বাড়াবাড়ি তোমার দিক থেকেই হবে। ” প্রত্যুত্তরে জুবায়ের বললো তিনি এরূপই বলেছিলেন। তখন আমিরুল মোমেনিন জিজ্ঞেস করলেন , তাহলে কেন আমার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছো ? উত্তরে জুবায়ের বললো যে , তার স্মৃতিতে রাসূলের কথা হারিয়ে গিয়েছিল ; আগে স্মরণ থাকলে সে বসরায় আসতো না। আমিরুল মোমেনিন বললেন , ভাল কথা , এখন তো তুমি স্মরণ করতে পেরেছো ? জুবায়ের। হ্যাঁ বলেই আয়শার কাছে গিয়ে বললো , আমি ফিরে যাচ্ছি , কারণ আলী আমাকে রাসূলের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। আমি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলাম। এখন সঠিক পথ পেয়েছি। আমি আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো না। ” আয়শা বললেন , তোমাকে আবদুল মুত্তালিবের পুত্রগণের তরবারির ভয়ে ধরেছে। ” জুবায়ের না ” বলেই তার ঘোড়া ফিরিয়ে যুদ্ধের জন্য রুখে দাঁড়ালো।

এদিকে আমিরুল মোমেনিন জুবায়েরের সাথে কথোপকথন শেষে ফিরে এসেই দেখলেন শত্রুপক্ষ তার বাহিনীর ডান ও বাম বাহু আক্রমণ করে ফেলেছে। এ অবস্থা লক্ষ্য করে তিনি বললেন , সকল ওজর শেষ হয়ে গেল। আমার পুত্র মুহাম্মদকে ডাক। ” মুহাম্মদ এলে তিনি বললেন , পুত্র আমার , এখন শক্রকে আক্রমণ কর। ” মুহাম্মদ মস্তক অবনত করলেন এবং পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ তীর নিক্ষিপ্ত হচ্ছিলো যে , তাকে থেমে যেতে হলো। এ অবস্থা দেখে আমিরুল মোমেনিন। চিৎকার করে বললেন , মুহাম্মদ , এগিয়ে যাচ্ছে না কেন ? তিনি বললেন , পিতা , এহেন তীরবৃষ্টিতে এগিয়ে যাবার উপায় নেই। তীরবৃষ্টি একটু থেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ” আমিরুল মোমেনিন বললেন , না , তীর আর বর্শা ঠেলেই প্রবল বেগে এগিয়ে যাও এবং শক্রকে আক্রমণ কর। ” এতে মুহাম্মদ ইবনে হানাফিয়া একটুখানি অগ্রসর হলেন। কিন্তু তীরন্দাজগণ এমনভাবে তাকে ঘিরে ফেললো যে , তার পদচারণা বন্ধ করতে হলো। এ অবস্থা লক্ষ্য করে আমিরুল মোমেনিনের কপালে কুঞ্চন দেখা দিল এবং তিনি সজোরে এগিয়ে গিয়ে মুহাম্মদের তরবারির বাটে আঘাত করে বললেন , তোমার এ ভীরুতা তোমার মায়ের রক্তের ফল। ” একথা বলেই মুহাম্মদের হাত থেকে পতাকা নিজের হাতে নিলেন এবং আস্তিন গুটিয়ে এভাবে আক্রমণ করলেন যে , শত্রুব্যূহের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত কোলাহল শুরু হয়ে গেল। যে সারির দিকে তিনি যেতেন তা পরিস্কার হয়ে যেত এবং যে দিকেই যেতেন দেহের পর দেহ পড়ে যেতো এবং মাথাগুলো ঘোড়ার খুরের আঘাতে গড়াগড়ি যেতো। শত্রুর সারিকে প্রবলভাবে প্রকম্পিত করে স্বস্থানে ফিরে এসে মুহাম্মদকে বললেন , দেখ পুত্র , যুদ্ধ এভাবে করতে হয়। ” এ বলে তিনি তার হাতে পতাকা দিয়ে এগিয়ে যেতে বললেন। মুহাম্মদ একটা আনসার বাহিনী নিয়ে শত্রুর দিকে এগিয়ে গেলেন। শত্রুপক্ষও বর্শা তাক করে তার দিকে এগিয়ে এলো। কিন্তু শৌর্যবান পিতার সাহসী পুত্র শত্রুর সারির পর সারি ছত্রভঙ্গ করে দিল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে মৃতদেহ স্তুপাকার হয়ে উঠলো।

অপরদিকে শত্রুপক্ষও তাদের সৈন্যগণকে ত্যাগের মহিমা শোনাচ্ছিল। একটার ওপর আরেকটা মৃতদেহ গড়িয়ে পড়ছিলো , তবুও উটটিকে ঘিরে তারা জীবন বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছিলো। বিশেষ করে বনি দাব্বার লোকদের অবস্থা এমন ছিল যে , উটটির লাগাম ধরে রাখার কারণে কনুই পর্যন্ত তাদের হাত কেটে ফেলা হয়েছিল , তাদের বক্ষ বিদীর্ণ করা হয়েছিল , তবুও তাদের মুখে নিম্নের যুদ্ধের গান শোনা যাচ্ছিলঃ

মৃত্যু আমাদের কাছে মধুর চেয়ে মিষ্টি ,

আমরা বনু দাব্বিাহ - উটের রাখাল ,

আমরা মৃত্যুর পুত্র যখন মৃত্যু আসে ,

আমরা বর্শার ফলায় উসমানের মৃত্যু ঘোষণা করি ,

আমাদের নেতাকে ফিরিয়ে দাও , তবেই এ যুদ্ধ শেষ হবে।

বনি দাব্বার লোকদের অজ্ঞতা ও হীন চরিত্র সম্বন্ধে একটা ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায় যা আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মদ মাদায়নী বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন বসরায় একজন কানকাটা লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। তিনি তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বললো , জামালের যুদ্ধে আমি মৃতদেহের দৃশ্য দেখছিলাম , হঠাৎ এক মুমূর্ষ ব্যক্তিকে দেখলাম সে তার মাথা মাটিতে আচড়াচ্ছে। আমি তার কাছে গিয়ে শুনলাম সে নিম্নের পদ ক ’ টি বলছেঃ

আমাদের মাতা আমাদেরকে মৃত্যুর গভীর জলে ঠেলে দিল

আমরা পুরোপুরি ডুবেছি , তিনি ফিরে এলেন না।

ভাগ্যের হেরফেরে আমরা বনু তায়ামকে মেনেছি

আসলে তারা ক্রীতদাস আর ক্রীতদাসী ছাড়া কিছুই নয়।

আমি তাকে বললাম এটা কবিতা বলার সময় নয় ; বরং তুমি আল্লাহকে স্মরণ কর ও কালিমা শাহাদাত পড়। সে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে গালিগালাজ শুরু করে দিল। সে বললো কালিমা শাহাদাত পড়ে জীবনের শেষ মুহুর্তে তুমি আমাকে ভীত আর অধৈর্য হতে বলছো। আমি তার কথায় স্তম্ভিত হয়ে ফিরে চললাম। সে আমাকে ডাক দিয়ে বললো দোহাই তোমার আমাকে কালিমা শিখিয়ে দাও । আমি তাকে কালিমা শেখানোর জন্য কাছে গেলাম। সে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে কালিমা বলতে অনুরোধ করলো। আমি মাথা নামাতেই সে আমার কান কামড়ে ধরলো এবং দাঁত দিয়ে আমূল কেটে ফেললো। একজন মুমূর্ষ লোক থেকে প্রতিশোধ নেয়া আমি সমীচীন মনে করলাম না। তাই তাকে অভিশাপ দিয়ে চলে যেতে উঠে দাঁড়ালাম ; সে বললো , যদি তোমার মা জিজ্ঞেস করে কে তোমার কান কেটেছে। তবে বলে উমায়ের ইবনে আহলাব দাব্বি , যে একজন মহিলা কর্তৃক প্রতারিত হয়েছে এবং সে মহিলা তাকে ইমানদারগণের কমান্ডার বানানোর আশা দিয়েছিল। ”

যা হোক , এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে যখন হাজার হাজার প্রাণ বিনষ্ট হলো এবং বনি আযাদ ও বনি দাব্বার শত শত লোক উটটির লাগাম ধরে রাখার কারণে নিহত হলো। তখন আমিরুল মোমেনিন আদেশ করলেন , উটটিকে হত্যা কর । কারণ এটা শয়তান। ” একথা বলেই তিনি এমন ভীমবেগে আক্রমণ রচনা করলেন যে , শান্তি! শান্তি!”“ বাঁচাও! বাচাও! বলে চারিদিক থেকে চিৎকার ওঠেছিল। উটটির নিকটবর্তী হয়ে তাকে হত্যা করার জন্য তিনি বুজায়ার ইবনে দুলজাকে নির্দেশ দিলেন। বুজায়র তৎক্ষণাৎ এমন জোরে আঘাত করলো যে , উটটির বুক মাটিতে লেগে গেল। উটটি পড়ে যাওয়া মাত্রই শত্রুপক্ষ আয়শাকে একাকী ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ফেলে পলায়ন করলো। সঙ্গে সঙ্গে আমিরুল মোমেনিনের অনুচরগণ আয়শাকে বহনকারী হাওদা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেল। আমিরুল মোমেনিনের নির্দেশে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর (আয়শার ভ্রাতা) আয়শাকে মাফিয়া বিনতে হারিসের ঘরে নিয়ে গেল ।

৩৬ হিজরি সনের ১০ই জমাদি - উস - সানী দ্বিপ্রহরে জামালের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং একই দিন সন্ধ্যায় সমাপ্ত হয়েছিল। এ যুদ্ধে আমিরুল মোমেনিনের বাইশ হাজার সৈন্যের মধ্যে এক হাজার সত্তর জন (মতান্তরে পাঁচ শতজন) । শহিদ হয়েছিল এবং আয়শার ত্রিশ হাজার সৈন্যের মধ্যে সতের হাজার নিহত হয়েছিল। (কুতায়বাহ , তাবারী , মাসুদী , রাব্বিহ) ।

২। হাদীদ লিখেছেন , আমিরুল মোমেনিনের ভবিষদ্বাণী অনুযায়ী বসরায় দুবার বন্যা হয়েছিল - একবার কাদির বিল্লাহর রাজত্বকালে এবং আরেকবার আল - কাইম বি আমরিল্লাহর রাজত্বকালে। উভয় বন্যায় বসরা নগরী এমনভাবে পানিতে ডুবে গিয়েছিল যে , শুধুমাত্র মসজিদের মিনার ভাসমান পাখীর মতো দেখা গিয়েছিল।

খোৎবা- ১৪

أَرْضُكُمْ قَرِيبَةٌ مِنَ الْمَاءِ بَعِيدَةٌ مِنَ السَّمَاءِ - خَفَّتْ عُقُولُكُمْ وسَفِهَتْ حُلُومُكُمْ فَأَنْتُمْ غَرَضٌ لِنَابِلٍ وأُكْلَةٌ لِآكِلٍ وفَرِيسَةٌ لِصَائِلٍ.

বসরাবাসীদের প্রতি ভর্ৎসনা

তোমাদের মাটি সমুদ্রের নিকটবর্তী এবং আকাশ হতে অনেক দূরে ৷ তোমাদের বোধশক্তি খুবই ক্ষীণ ,ধৈর্য মূর্খতাপূর্ণ এবং তোমাদের মন পাপে পূর্ণ। তোমরা তীরন্দাজের লক্ষ্যবস্তু ,খাদকের গ্রাস এবং শিকারির সহজলভ্য শিকার।

খোৎবা- ১৫

فيما رده على المسلمين من قطائع عثمان -رضي‌الله‌عنه

واللَّه لَوْ وَجَدْتُه قَدْ تُزُوِّجَ بِه النِّسَاءُ ومُلِكَ بِه الإِمَاءُ - لَرَدَدْتُه - فَإِنَّ فِي الْعَدْلِ سَعَةً - ومَنْ ضَاقَ عَلَيْه الْعَدْلُ فَالْجَوْرُ عَلَيْه أَضْيَقُ!

উসমান ইবনে আফফান কর্তৃক অনুদানকৃত ভূমি পুনঃগ্রহণ করার পর বলেন

আল্লাহর কসম ,যদিও আমি দেখেছিলাম এ অর্থ দ্বারা নারী বিয়ে করা যায় অথবা ক্রীতদাসী ক্রয় করা যায়। তবুও আমি তা ফেরত প্রদান করতাম। আমি এ কারণে তা গ্রহণ করেছিলাম যে ,এতে ন্যায় বিচার বিধান করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যদি কেউ ন্যায় কাজ করাকে কঠিন মনে করে তবে অন্যায় কাজ করাকে অধিকতর কঠিন মনে করা উচিত।

খোৎবা- ১৬

لما بويع في المدينة وفيها يخبر الناس بعلمه بما تئول إليه أحوالهم وفيها يقسمهم إلى أقسام

ذِمَّتِي بِمَا أَقُولُ رَهِينَةٌ، وَ أَنَا بِهِ زَعِيمٌ. إِنَّ مَنْ صَرَّحَتْ لَهُ الْعِبَرُ عَمَّا بَيْنَ يَدَيْهِ مِنَ الْمَثُلاَتِ حَجَزَتْهُ التَّقْوى عَنْ تَقَحُّمِ الشُّبُهاتِ.

أَلاَ وَ إِنَّ بَلِيَّتَكُمْ قَدْ عَادَتْ كَهَيْئَتِهَا يَوْمَ بَعَثَ اللَّهُ نَبِيَّكُمْصلى‌الله‌عليه‌وآله‌وسلم ، وَ الَّذِي بَعَثَهُ بِالْحَقِّ لَتُبَلْبَلُنَّ بَلْبَلَةً، وَ لَتُغَرْبَلُنَّ غَرْبَلَةً، وَ لَتُسَاطُنَّ سَوْطَ الْقِدْرِ، حَتَّى يَعُودَ أَسْفَلُكُمْ أَعْلاَكُمْ وَ أَعْلاَكُمْ أَسْفَلَكُمْ، وَ لَيَسْبِقَنَّ سَابِقُونَ كَانُوا قَصَّرُوا، وَ لَيُقَصِّرَنَّ سَبَّاقُونَ كَانُوا سَبَقُوا. وَ اللَّهِ مَا كَتَمْتُ وَشْمَةً، وَ لاَ كَذَبْتُ كِذْبَةً، وَ لَقَدْ نُبِّئْتُ بِهَذَا الْمَقَامِ وَ هَذَا الْيَوْمِ.

أَلاَ وَ إِنَّ الْخَطَايَا خَيْلٌ شُمُسٌ حُمِلَ عَلَيْهَا أَهْلُهَا، وَ خُلِعَتْ لُجُمُها فَتَقَحَّمَتْ بِهِمْ فِي النَّارِ. أَلا وَ إِنَّ التَّقْوَى مَطايا ذُلُلٌ حُمِلَ عَلَيْها أَهْلُها وَ أُعْطُوا أَزِمَّتَهَا فَأَوْرَدَتْهُمُ الْجَنَّةَ، حَقُّ وَ بَاطِلٌ، وَ لِكُلِّ أَهْلٌ، فَلَئِن أَمِرَ الْبَاطِلُ لَقَدِيما فَعَلَ، وَ لَئِنْ قَلَّ الْحَقُّ فَلَرُبَّما وَ لَعَلَّ، وَ لَقَلَّمَا أَدْبَرَ شَي ءٌ فَأَقْبَلَ.

شُغِلَ مَنِ الْجَنَّةُ والنَّارُ أَمَامَه - سَاعٍ سَرِيعٌ نَجَا وطَالِبٌ بَطِيءٌ رَجَا - ومُقَصِّرٌ فِي النَّارِ هَوَى - الْيَمِينُ والشِّمَالُ مَضَلَّةٌ والطَّرِيقُ الْوُسْطَى هِيَ الْجَادَّةُ عَلَيْهَا بَاقِي الْكِتَابِ وآثَارُ النُّبُوَّةِ - ومِنْهَا مَنْفَذُ السُّنَّةِ وإِلَيْهَا مَصِيرُ الْعَاقِبَةِ - هَلَكَ مَنِ ادَّعَى و( خابَ مَنِ افْتَرى ) - مَنْ أَبْدَى صَفْحَتَه لِلْحَقِّ هَلَكَ - وكَفَى بِالْمَرْءِ جَهْلًا أَلَّا يَعْرِفَ قَدْرَه - لَا يَهْلِكُ عَلَى التَّقْوَى سِنْخُ أَصْلٍ - ولَا يَظْمَأُ عَلَيْهَا زَرْعُ قَوْمٍ - فَاسْتَتِرُوا فِي بُيُوتِكُمْ( وأَصْلِحُوا ذاتَ بَيْنِكُمْ ) - والتَّوْبَةُ مِنْ وَرَائِكُمْ - ولَا يَحْمَدْ حَامِدٌ إِلَّا رَبَّه ولَا يَلُمْ لَائِمٌ إِلَّا نَفْسَه.

মদিনায় তার হাতে বায়াত গ্রহণের পর এ ভাষণ দেন

আমি যা বলি তার দায় দায়িত্বের নিশ্চয়তা আমার এবং সে জন্য আমিই জবাবদিহি করবো। যার নিকট অতীতের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির (আল্লাহ্ কর্তৃক প্রদত্ত) অভিজ্ঞতা পরিস্কারভাবে প্রকাশ করা হয়ে থাকে ,সন্দেহে পতিত হওয়া থেকে তাকওয়া তাকে বিরত রাখে। জেনে রাখো ,রাসূলের (সা.) আগমন কালে যেসব বিপদাপদ বিরাজমান ছিল সেসব আবার ফিরে এসেছে।

সেই আল্লাহর কসম ,যিনি সত্যের সাথে রাসূলকে পাঠিয়েছেন ,তোমরা মারাত্মকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে ,চালনি দিয়ে চালার মত আলোড়িত হবে এবং রান্না করার পাত্রে চামচ দিয়ে মিশানোর মতো সম্পূর্ণরূপে মিশ্রিত হয়ে যাবে। কারণ তোমাদের নিচু শ্রেণির লোকেরা উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছে এবং উচ্চ শ্রেণির লোকেরা হতমান হয়ে পড়েছে ,তোমাদের পিছনে - পড়া লোকেরা অগ্রগামী হয়েছে এবং অগ্রগামীকে পিছনে ফেলে রাখা হয়েছে। আল্লাহর কসম ,আমি একটা শব্দও গোপন করিনি বা কোন মিথ্যা কথা বলিনি । এ ঘটনা এবং এ সময় সম্পর্কে আমাকে অবহিত করা হয়েছে।

সাবধান ,পাপ হলো অবাধ্য ঘোড়ার মতো। সেই ঘোড়ার ওপর ওদের আরোহীকে সওয়ার করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ওদের লাগামও ঢিলা করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং সেই ঘোড়া আরোহীসহ দোযখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনে রেখো ,তাকওয়া হলো অনুগত ঘোড়ার মতো। ওটার ওপর আরোহীকে সওয়ার করিয়ে দিয়ে লাগাম হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় যাতে আরোহীকে বেহেশতে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীতে ন্যায় আছে ,অন্যায়ও আছে এবং উভয়ের অনুসারীও আছে। যদি অন্যায় প্রাধান্য বিস্তার করে (অতীতে এমনই ছিল) এবং সত্য লাঞ্চিত হয় (যা প্রায়শই ঘটেছে) তাহলে মানুষ যথাযথ পথে অগ্রসর হতে পারে না। একবার পিছনে পড়ে গেলে ,সামনে এগিয়ে আসতে পেরেছে এমন ঘটনা বিরল।

যাদের চিন্তা - চেতনায় বেহেশত ও দোযখ দৃশ্যমান তাদের অন্য কোন লক্ষ্য থাকে না। যে ব্যক্তি প্রচেষ্টা চালিয়ে যায় ও দ্রুত কর্মসাধন করে সে নাজাত পায় এবং যে ব্যক্তি সত্যের অনুসন্ধানকারী সে ধীর হলেও আল্লাহর অনুগ্রহের আশা পোষণ করতে পারে। আর যে ব্যক্তি কর্মসাধন করে না সে দোযখে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ডানে ও বামে বিভ্রান্তিকর পথ রয়েছে। শুধুমাত্র মধ্যবর্তী পথই যথার্থ যা রয়েছে চিরস্থায়ী গ্রন্থে ও রাসূলের তরিকায়। সে পথ থেকেই সুন্নাহ প্রসার লাভ করেছে এবং পরিণামে সে দিকেই প্রত্যাবর্তন।

যে ব্যক্তি অন্য পথ অবলম্বন করে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং যে মিথ্যা আরোপ করে সে হাতাশাগ্রস্থ । যে ব্যক্তি মুখে ন্যায়ের বিরোধিতা করে সে ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেকে না জানাই একজন লোকের যথেষ্ট অজ্ঞতা। যার তাকওয়ার ভিত্তি শক্তিশালী সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না এবং তাকওয়ার ভিত্তিতে করা চাষাবাদ কখনো পানিবিহীন থাকে না । তোমরা নিজেদেরকে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ফেল এবং সংস্কার করা। অতীতের জন্য তওবা কর। নিজেকে তিরস্কার করে কেবলমাত্র আল্লাহর প্রশংসা কর।

____________________

১। তাকওয়া মানে হৃদয় ও মন আল্লাহর মহিমা ও মহত্ত্বে আপ্লুত হওয়া , যার ফলে আল্লাহর ভয়ে মানুষের হৃদয় পরিপূর্ণ থাকে এবং এ অবস্থার অনিবার্য ফল হলো ইবাদতে নিমগ্নতা বৃদ্ধি পাওয়া। আল্লাহর ভয়ে হৃদয় পরিপূর্ণ থাকবে অথচ কাজে কর্মে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না , এটা একেবারেই অসম্ভব। যেহেতু ইবাদত ও আনুগত্য হৃদয়কে সংস্কার করে ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে সেহেতু ইবাদত বৃদ্ধি পেলে হৃদয়ের পবিত্রতাও বৃদ্ধি পায়। সে জন্যই পবিত্র কুরআনে তাকওয়া ’ দ্বারা কখনো ভয় , কখনো ইবাদত ও ধ্যান এবং কখনো হৃদয় ও চেতনার পবিত্রতা বুঝানো হয়েছে। যেমন

( ১) আনা ফাত্তাকুন (সুতরাং আমাকে ভয় কর - ১৬: ২ - এখানে তাকওয়া অর্থ ভয় করা) ।

( ২) ইত্তাকুল্লাহা হাক্কা তুকাতিহি (আল্লাহর ইবাদত কর কারণ তিনিই ইবাদতের যোগ্য - ৩ : ১০২ -- এখানে তাকওয়া অর্থ ইবাদত ও আরাধনা) ।

( ৩) ওয়া ইয়াখশাল্লাহা ওয়া ইত্তাকহি ফাউলায়েকা হুমুল ফায়েজুন (২৪ : ৫২ - এখানে তাকওয়া দ্বারা চেতনার পবিত্রতা ও হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতা বুঝানো হয়েছে) ।

হাদিস অনুযায়ী তাকওয়ার তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমতঃ আদেশ পালন করতে হবে এবং নিষেধাজ্ঞা থেকে নিজকে দূরে রাখতে হবে। দ্বিতীয়তঃ সুপারিশকৃত বিষয় অনুসরণ করতে হবে এবং অপছন্দকৃত বিষয় বাদ দিতে হবে। তৃতীয়তঃ সন্দেহযুক্ত বিষয় অনুমোদিত হলেও বাদ দিতে হবে। প্রথম স্তর সাধারণ মানুষের , দ্বিতীয় স্তর মহৎ ব্যক্তির এবং তৃতীয় স্তর উচ্চ - মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য।

আমিরুল মোমেনিন বলেন যে , তাকওয়া ভিত্তিক কর্ম স্থায়ী হয়। যে কর্মে তাকওয়ার জল সিঞ্চন করা হয় তা ফুলে ফলে সুশোভিত হয় , কারণ কেবলমাত্র আনুগত্যের অনুভূতি থাকলেই প্রকৃত ইবাদত হয়। অনুরূপভাবে জ্ঞানও দৃঢ় প্রত্যয় ভিত্তিক না হলে ইমান ভিতবিহীন ইমারতের মতে যার কোন স্থায়িত্ব নেই।