নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা4%

নাহজ আল-বালাঘা লেখক:
: জেহাদুল ইসলাম
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বিভাগ: হযরত আলী (আ.)

নাহজ আল-বালাঘা
  • শুরু
  • পূর্বের
  • 48 /
  • পরের
  • শেষ
  •  
  • ডাউনলোড HTML
  • ডাউনলোড Word
  • ডাউনলোড PDF
  • ভিজিট: 128642 / ডাউনলোড: 8471
সাইজ সাইজ সাইজ
নাহজ আল-বালাঘা

নাহজ আল-বালাঘা

লেখক:
প্রকাশক: র‌্যামন পাবলিশার্স
বাংলা

রাসূলের (সা.) ‘জ্ঞান নগরীর দ্বার’ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী, দার্শনিক, সুলেখক ও বাগ্মী। আলঙ্কারিক শাস্ত্রে তার পান্ডিত্য ও নৈপুন্য অসাধারণ। তিনি নবুওয়াতী জ্ঞান ভান্ডার হতে সরাসরি জ্ঞান আহরণ করেন এবং সাহাবাদের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী পন্ডিত ছিলেন। এতে কারো দ্বিমত নেই। আরবী কাব্যে ও সাহিত্যে তার অনন্যসাধারণ অবদান ছিল। খেলাফত পরিচালনা কালে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ (খোৎবা) দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকগণকে প্রশাসনিক বিষয়ে উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে পত্র লিখেছিলেন। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মানুষের অনেক প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিলেন। তার এসব বাণী কেউকেউ লিখে রেখেছিল, কেউ কেউ মনে রেখেছিল, আবার কেউ কেউ তাদের লিখিত পুস্তকে উদ্ধৃত করেছিল। মোটকথা তার অমূল্য বাণীসমূহ মানুষের কাছে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় ছিল।

আশ-শরীফ আর-রাজী আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিবের ভাষণসমূহ (খোৎবা), পত্রাবলী, নির্দেশাবলী ও উক্তিসমূহ সংগ্রহ করে “নাহজ আল-বালঘা” নামক গ্রন্থটি সঙ্কলন করেন।

খোৎবা- ৩৩

قَالَ عَبْدُ اللَّه بْنُ عَبَّاسِرضي‌الله‌عنه - دَخَلْتُ عَلَى أَمِيرِ الْمُؤْمِنِينَعليه‌السلام بِذِي قَارٍ وهُوَ يَخْصِفُ نَعْلَه فَقَالَ لِي مَا قِيمَةُ هَذَا النَّعْلِ - فَقُلْتُ لَا قِيمَةَ لَهَا - فَقَالَعليه‌السلام واللَّه لَهِيَ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ إِمْرَتِكُمْ - إِلَّا أَنْ أُقِيمَ حَقّاً أَوْ أَدْفَعَ بَاطِلًا - ثُمَّ خَرَجَ فَخَطَبَ النَّاسَ فَقَالَ:

إِنَّ اللَّه بَعَثَ مُحَمَّداًصلى‌الله‌عليه‌وآله - ولَيْسَ أَحَدٌ مِنَ الْعَرَبِ يَقْرَأُ كِتَاباً ولَا يَدَّعِي نُبُوَّةً - فَسَاقَ النَّاسَ حَتَّى بَوَّأَهُمْ مَحَلَّتَهُمْ وبَلَّغَهُمْ مَنْجَاتَهُمْ - فَاسْتَقَامَتْ قَنَاتُهُمْ واطْمَأَنَّتْ صَفَاتُهُمْ

أَمَا واللَّه إِنْ كُنْتُ لَفِي سَاقَتِهَاحَتَّى تَوَلَّتْ بِحَذَافِيرِهَا مَا عَجَزْتُ ولَا جَبُنْتُ وإِنَّ مَسِيرِي هَذَا لِمِثْلِهَا - فَلأَنْقُبَنَّ الْبَاطِلَ حَتَّى يَخْرُجَ الْحَقُّ مِنْ جَنْبِه.

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন যে ,আমিরুল মোমেনিন যখন বসরার লোকদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য বেরিয়ে এলেন তখন তিনি (আবদুল্লাহ) যিকার নামক স্থানে আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য শুনতে এসে দেখলেন আমিরুল মোমেনিন তার জুতা সেলাই করছেন। তিনি আমাকে (আবদুল্লাহকে) বললেন , এ জুতার দাম কত ” ? আমি বললাম , এটার এখন কোন মূল্য নেই ” । তিনি বললেন , আল্লাহর কসম ,আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং ভ্রান্তি প্রতিহত করেছি ; শুধুমাত্র এ বিষয়টি ব্যতীত তোমাদের শাসনকার্য চালনা অপেক্ষা এ জুতা আমার কাছে অনেক বেশি প্রিয়। ” এরপর তিনি মানুষের সম্মুখে বেরিয়ে এসে বললেনঃ

নিশ্চয়ই ,আল্লাহ মুহাম্মদকে (সা.) যখন পাঠিয়েছিলেন তখন আরবদের মধ্যে কেউ বই পড়তে পারতো না অথবা কেউ নবুয়ত দাবি করেনি। তিনি মানুষকে পথ প্রদর্শন করেছিলেন যে পর্যন্ত না তারা সঠিক পথে এসে মুক্তির সন্ধান পেয়েছে। ফলে ,তাদের নেতাগণ সোজা হয়ে গেল এবং তাদের অবস্থা নিরাপদ হলো ।

আল্লাহর কসম ,আমি তাদের নেতৃত্বে ছিলাম। যতক্ষণ পর্যন্ত না দেওয়ালসহ (ঘরটি) সুন্দর আকৃতি সম্পন্ন হয়েছিল। আমি কখনো কোন প্রকার দুর্বলতা বা ভীরুতা প্রদর্শন করিনি। আমার বর্তমান পদচারণাও পূর্ববৎ রয়েছে। আমি ভ্রান্তি আর অন্যায়কে ততক্ষণ পর্যন্ত ভেদ করতে থাকবো যতক্ষণ পর্যন্ত না উহার পার্শ্বদেশ হতে ন্যায় বেরিয়ে আসে।

কুরাইশদের সাথে আমার বিবাদের কারণ কী ? আল্লাহর কসম ,যখন ওরা ইমানহারা ছিল তখন আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এবং যদি তারা এখনো ভ্রান্ত পথ অনুসরণ করে তবে আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। তাদের জন্য বিগত দিনে আমি যেমন ছিলাম আজো তেমনই থাকবো।

আল্লাহর কসম ,আমাদের প্রতি কুরাইশগণের বিদ্বেষপরায়ণতার কারণ হলো আল্লাহ আমাদেরকে (রাসূল ও তার আহলুল বাইত দ্বারা) তাদের ওপর প্রাধান্য ও মর্যাদা প্রদান করেছেন। সুতরাং আমরা তাদেরকে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছিলাম এবং তাতে তাদের অবস্থা এমন হলো যেমন এক কবি বলেছেনঃ

আমার জীবনের কসম ,তুমি প্রতিভোরে তাজা দুধ পান করতে থাকো ,এবং মাখন দিয়ে উত্তম মানের খেজুর খেতে থাকো ; আমরা তোমাকে মহত্ত্ব দিয়েছি যা তোমার কোনদিন ছিল না ,এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়া আর শক্ত তীর দ্বারা তুমি এখন প্ররক্ষিত

____________________

১। আমিরুল মোমেনিনের এ খোৎবাটি ফাদাক রাষ্ট্রায়ত্ব করায় রাসূলের (সা.) পবিত্র কন্যা ফাতিমা যে ভাষণ দিয়েছিলেন তার মতই। ফাতিমা বলেছিলেনঃ

হে লোক সকল ,তোমরা দোষাখের অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে (কুরআন ,৩:১০৩) । তোমরা এক ঢোক পানির মতো নগণ্য ছিলে । তোমরা ছিলে মুষ্টিমেয় লোভী এবং দ্রুতগামীর ঝলকের মত সংখ্যালঘিষ্ট। তোমরা ছিলো পায়ের নিচের ধূলিকণার মতো পদদলিত। তোমরা নোংরা পানি পান করতে। তোমরা টেনিং না করা চামড়া খেতে । তোমরা ছিলে হীনমনা ও ঘৃণিত । আল্লাহ তোমাদেরকে আমার পিতা মুহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে উদ্ধার করেছেন ।

খোৎবা- ৩৪

أُفٍّ لَكُمْ لَقَدْ سَئِمْتُ عِتَابَكُمْ -( أَرَضِيتُمْ بِالْحَياةِ الدُّنْيا مِنَ الآخِرَةِ ) عِوَضاً - وبِالذُّلِّ مِنَ الْعِزِّ خَلَفاً - إِذَا دَعَوْتُكُمْ إِلَى جِهَادِ عَدُوِّكُمْ دَارَتْ أَعْيُنُكُمْ كَأَنَّكُمْ مِنَ الْمَوْتِ فِي غَمْرَةٍ ومِنَ الذُّهُولِ فِي سَكْرَةٍ - يُرْتَجُ عَلَيْكُمْ حَوَارِي فَتَعْمَهُونَ وكَأَنَّ قُلُوبَكُمْ مَأْلُوسَةٌ فَأَنْتُمْ لَا تَعْقِلُونَ - مَا أَنْتُمْ لِي بِثِقَةٍ سَجِيسَ اللَّيَالِي ومَا أَنْتُمْ بِرُكْنٍ يُمَالُ بِكُمْ - ولَا زَوَافِرُ عِزٍّ يُفْتَقَرُ إِلَيْكُمْ - مَا أَنْتُمْ إِلَّا كَإِبِلٍ ضَلَّ رُعَاتُهَا - فَكُلَّمَا جُمِعَتْ مِنْ جَانِبٍ انْتَشَرَتْ مِنْ آخَرَ.

لَبِئْسَ لَعَمْرُ اللَّه سُعْرُ نَارِ الْحَرْبِ أَنْتُمْ - تُكَادُونَ ولَا تَكِيدُونَ - وتُنْتَقَصُ أَطْرَافُكُمْ فَلَا تَمْتَعِضُونَ لَا يُنَامُ عَنْكُمْ وأَنْتُمْ فِي غَفْلَةٍ سَاهُونَ - غُلِبَ واللَّه الْمُتَخَاذِلُونَ - وايْمُ اللَّه - إِنِّي لأَظُنُّ بِكُمْ أَنْ لَوْ حَمِسَ الْوَغَى واسْتَحَرَّ الْمَوْتُ قَدِ انْفَرَجْتُمْ عَنِ ابْنِ أَبِي طَالِبٍ انْفِرَاجَ الرَّأْسِ واللَّه إِنَّ امْرَأً يُمَكِّنُ عَدُوَّه مِنْ نَفْسِه - يَعْرُقُ لَحْمَه ويَهْشِمُ عَظْمَه - ويَفْرِي جِلْدَه لَعَظِيمٌ عَجْزُه - ضَعِيفٌ مَا ضُمَّتْ عَلَيْه جَوَانِحُ صَدْرِه أَنْتَ فَكُنْ ذَاكَ إِنْ شِئْتَ - فَأَمَّا أَنَا فَوَاللَّه دُونَ أَنْ أُعْطِيَ ذَلِكَ ضَرْبٌ بِالْمَشْرَفِيَّةِ تَطِيرُ مِنْه فَرَاشُ الْهَامِ وتَطِيحُ السَّوَاعِدُ والأَقْدَامُ -( ويَفْعَلُ الله ) بَعْدَ ذَلِكَ( مِمَّا يَشاءُ ) -

أَيُّهَا النَّاسُ - إِنَّ لِي عَلَيْكُمْ حَقّاً ولَكُمْ عَلَيَّ حَقٌّ - فَأَمَّا حَقُّكُمْ عَلَيَّ فَالنَّصِيحَةُ لَكُمْ - وتَوْفِيرُ فَيْئِكُمْ عَلَيْكُمْ - وتَعْلِيمُكُمْ كَيْلَا تَجْهَلُوا وتَأْدِيبُكُمْ كَيْمَا تَعْلَمُوا - وأَمَّا حَقِّي عَلَيْكُمْ فَالْوَفَاءُ بِالْبَيْعَةِ - والنَّصِيحَةُ فِي الْمَشْهَدِ والْمَغِيبِ - والإِجَابَةُ حِينَ أَدْعُوكُمْ والطَّاعَةُ حِينَ آمُرُكُمْ.

সিরিয়ার (শ্যাম) জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতির জন্য নিজের লোকদেরকে আমিরুল মোমেনিন বলেনঃ

দুর্ভাগ্য তোমাদের । তোমাদেরকে তিরস্কার করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তোমরা কি পরকালের পরিবর্তে ইহকালের জীবনকেই অধিক পছন্দ করে বসেছো ? তোমরা কি মর্যাদাকর অবস্থার স্থলে অমর্যাদাকর অবস্থাকে অধিক ভালোবেসেছে ? শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যখন আমি তোমাদের আহ্বান করি তখন তোমরা এমনভাবে চোখ ছানাবড়া কর মনে হয় যমদূতকে দেখেছো এবং মুমূর্ষ লোকের মতো সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়। আমি যতই তোমাদেরকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝাই তা তোমাদের বোধগম্য হয় না ; তোমরা হতবুদ্ধি অবস্থাতেই থাকো। তোমাদের হৃদয় যেন মত্ততায় আচ্ছন্ন ,তাই তোমারা কিছুই বোঝ না। তোমরা চিরতরে আমার আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। না তোমরা এমন অবলম্বন যাতে নির্ভর করা যায় ,আর না তোমরা এমন উপায় যার দ্বারা সম্মান ও বিজয় অর্জন করা যায়। তোমাদের উপমা হচ্ছে সেই উটের পালের মতো যার রাখাল পালিয়ে গেছে ,ফলে একদিকে কতগুলোকে একত্রিত করলে বাকিরা অন্যদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

আল্লাহর কসম ,যুদ্ধানল প্রজ্জ্বলনের জন্য তোমরা বড়ই মন্দ লোক। তোমরা গুপ্ত চক্রান্তের শিকার হচ্ছো কিন্তু শক্রকে তোমাদের চক্রান্তের শিকার করতে পারছো না। তোমাদের এলাকার সীমানা ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে আসছে অথচ তোমরা তাতে ক্রুদ্ধ হচ্ছো না। তোমাদের বিরুদ্ধ পক্ষের চোখে ঘুম নেই অথচ তোমরা অমনোযোগী। আল্লাহর কসম ,অন্যলোকে করবে বলে যারা কর্মসাধনে লিপ্ত হয় না তাদের জন্য পরাজয় অবধারিত। আল্লাহর কসম ,তোমাদের হাবভাব দেখে আমার এ বিশ্বাস জন্মেছে যে ,যদি যুদ্ধ বাঁধে এবং তোমরা তোমাদের চারদিকে মৃত লাশ দেখো তবে তোমরা আবি তালিবের পুত্রকে ধড় থেকে দ্বীখণ্ডিত মস্তকের মতো পরিত্যাগ করে কেটে পড়বে।

আল্লাহর কসম ,যে ব্যক্তি প্রতিপক্ষের জন্য এমন সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় যাতে শত্রু তাকে পরাভূত করে ,মাংশ হাড় থেকে আলাদা করে ফেলে ,হাড়গোড় বিচূর্ণ করে দেয় ও চামড়া তুলে নেয় ,তার মতো নিঃসহায় আর কেউ নেই এবং বক্ষস্থলের অতি দুর্বল দিকে তার হৃদয় স্থাপিত। তোমরা ইচ্ছা করলে সেরকম দুর্বল ও নিঃসহায় হতে পার। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আমি আল - মাশরাফিয়ার ধারালো তরবারির সদ্ব্যবহার করবো যা মাথার খুলি উড়িয়ে দেবে এবং হস্ত - পদ ব্যবচ্ছেদ করবে। তারপর আল্লাহ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যা করার তাই করবেন।

হে লোকসকল ,তোমাদের ওপর আমার অধিকার আছে আর আমার ওপরও তোমাদের অধিকার আছে। আমার ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে তোমাদেরকে সৎপরামর্শ প্রদান ,তোমাদের ন্যায্য পাওনা সম্পূর্ণ পরিশোধ করা ,তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া যেন তোমরা অজ্ঞ না থাকো এবং আচরণের কার্যকারণনীতি বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া যাতে তোমরা আমল করতে পার। তোমাদের ওপর আমার অধিকার হচ্ছে তোমরা আনুগত্যে অটল থাকবে ,আমার সামনে অথবা পিছনে আমার শুভাকাঙ্খী হয়ে থাকবে ,আমার আহবানে সাড়া দেবে এবং আমার আদেশ মান্য করবে।

খোৎবা- ৩৫

الْحَمْدُ لِلَّه وإِنْ أَتَى الدَّهْرُ بِالْخَطْبِ الْفَادِحِ والْحَدَثِ الْجَلِيلِ وأَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَه إِلَّا اللَّه لَا شَرِيكَ لَه - لَيْسَ مَعَه إِلَه غَيْرُه - وأَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُه ورَسُولُهصلى‌الله‌عليه‌وآله -

أَمَّا بَعْدُ فَإِنَّ مَعْصِيَةَ النَّاصِحِ الشَّفِيقِ الْعَالِمِ الْمُجَرِّبِ - تُورِثُ الْحَسْرَةَ وتُعْقِبُ النَّدَامَةَ - وقَدْ كُنْتُ أَمَرْتُكُمْ فِي هَذِه الْحُكُومَةِ أَمْرِي، ونَخَلْتُ لَكُمْ مَخْزُونَ رَأْيِي لَوْ كَانَ يُطَاعُ لِقَصِيرٍ أَمْرٌ - فَأَبَيْتُمْ عَلَيَّ إِبَاءَ الْمُخَالِفِينَ الْجُفَاةِ والْمُنَابِذِينَ الْعُصَاةِ - حَتَّى ارْتَابَ النَّاصِحُ بِنُصْحِه وضَنَّ الزَّنْدُ بِقَدْحِه فَكُنْتُ أَنَا وإِيَّاكُمْ كَمَا قَالَ أَخُو هَوَازِنَ

أَمَرْتُكُمْ أَمْرِي بِمُنْعَرَجِ اللِّوَى

فَلَمْ تَسْتَبِينُوا النُّصْحَ إِلَّا ضُحَى الْغَدِ

সালিশীর পর আমিরুল মোমেনিন এ ভাষণ দিয়েছিলেন

প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর ,যদিও সময় আমাদের জন্য চরম দুর্যোগ ও অপ্রত্যাশিত ঘটনা বয়ে এনেছে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মারুদ নেই ,তার কোন অংশীদার নেই ,তার সাথে আর কারো তুলনা হয় না এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল ।

সমবেদী উপদেষ্টার জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও তার অবাধ্যতা আমাদের জন্য নৈরাশ্য ও দুঃখজনক ফলাফল ডেকে আনলো। এ সালিশী সম্পর্কে আমি পূর্বাহ্নেই তোমাদের নির্দেশ দিয়েছিলাম এবং আমার গোপন মনোভাব তোমাদের কাছে ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু তোমরা রূঢ় প্রতিপক্ষ ও জঘন্য অবাধ্যের মতো আমার আদেশ প্রত্যাখ্যান করেছো । আহা ! যদি কাসিরের আদেশ প্রতিপালিত হতো !! উপদেষ্টা নিজেই তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সন্দেহে পতিত হয়েছিল এবং তার বুদ্ধিমত্তা নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। ফলে আমার ও তোমাদের অবস্থা যা কবি হাওয়াজিন বলেনঃ

মুনারাজিল লিওয়াদে আমি তোমাদেরকে আমার আদেশ দিয়েছিলাম ,কিন্তু তোমরা পরদিন দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত আমার উপদেশের কল্যাণ দেখতে পাও নি ।

____________________

১। সিফফিনের যুদ্ধে ইরাকদের রক্ত - পিপাসু। তরবারি যখন সিরিয়দের উদ্দীপনা ও মনোবল ভেঙ্গে দিয়েছিল এবং আল - হারিরের রাতের অবিরাম আক্রমণে তাদের উচ্চাকাঙ্খা গুড়িয়ে দিল ,তখন আমর ইবনে আস মুয়াবিয়াকে একটা কুটাচালের পরামর্শ দিয়ে বললো , বর্শার আগায় পবিত্র কুরআন তুলে ধরে ইরাকিদের কাছে দাবি করতে হবে - এ কুরআনকেই সালিস মেনে নাও - কুরআনই তোমাদের ও আমাদের মধ্যে ফয়সালা। এতে কিছু লোক যুদ্ধ বন্ধ করতে চেষ্টা করবে এবং কিছু লোক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইবে। ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়ে যুদ্ধ স্থগিত হয়ে যাবে।"

আমরের পরামর্শ অনুযায়ী বর্শার অগ্রভাগে কুরআন বেঁধে উর্দ্ধে তুলে ধরা হলো। ফলে কিছু সংখ্যক জ্ঞানহীন লোক হৈ চৈ শুরু করে বিভেদ সৃষ্টি করে ফেললো এবং প্রায় জয়ের মুখে আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যদের ক্ষিপ্রতা শ্লথ হয়ে গেল। তারা কিছুই না বুঝে চিৎকার করে বলতে লাগলো , যুদ্ধাপেক্ষা আমরা কুরআনের ফয়সালা অধিক ভালো বলে মনে করি। আমিরুল মোমেনিন যখন দেখলেন কুরআনকে চালাকির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তখন তিনি বললেনঃ

হে সৈন্যগণ ,এ প্রতারণা ও চাতুরির ফাঁদে পড়ো না । পরাজয়ের গ্লানি থেকে রক্ষা পাবার জন্য তারা এ কৌশল অবলম্বন করেছে । তাদের প্রত্যেকের চরিত্র আমার জানা আছে । তারা প্রকৃতপক্ষে কুরআনের অনুগামী নয় ; দ্বিনি বা ইমানের সাথে তাদের কোন সংশ্রব নেই । আমাদের জিহাদের মূল কারণই হলো - তাদেরকে কুরআন মেনে চলতে এবং কুরআনের আদেশ - নিষেধ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা । আল্লাহর দোহাই ,তোমরা তাদের প্রতারণামূলক কৌশলের শিকার হয়ো না । তোমরা এগিয়ে চলো - তোমাদের উদম ,সংকল্প ও সাহস নিয়ে । তোমাদের শত্রুর অবস্থা মুমূর্ষ প্রায় - তাদের নিশ্চিহ্ন করা পর্যন্ত থেমে যেয়ো না । এতদসত্ত্বেও প্রতারণামূলক ও বিভ্রান্তিকর এ হাতিয়ার কার্যকর হলো । কিছু লোক অবাধ্য হয়ে বিদ্রোহের পথ বেছে নিল । এদের মধ্যে মিসার ইবনে ফাদকী। আত - তামিমী ও জায়েদ ইবনে হুসাইন আত - তাঈ বিশ হাজার সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এসে আমিরুল মোমেনিনকে । বললো , হে আলী ,আপনি যদি কুরআনের ডাকে সাড়া না দেন। তবে আমরা উসমানের সাথে যেমন ব্যবহার করেছি আপনার সাথেও তেমন ব্যবহার করবো আপনি এখনি যুদ্ধ বন্ধ করুন এবং কুরআনের ফয়সালা মেনে নিন। আমিরুল মোমেনিন তাদেরকে বুঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু শয়তান তাদেরকে বুঝতে দেয়নি । মালিক ইবনে হারিছ আশাতীর বিপুল বিক্রমে তখন শত্রু নিধন করে এগিয়ে যাচ্ছিলো। মালিককে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরত আনার জন্য কাউকে পাঠাতে তারা আমিরুল মোমেনিনকে বাধ্য করলো ফলে ইয়াজিদ ইবনে হানিকে দিয়ে মালিককে ডেকে পাঠানো হলো মালিক এ আদেশ শোনা মাত্র হতভম্ব হয়ে বললেন , তাঁকে (আমিরুল মোমেনিনকে) আমার সালাম জানিয়ে বলো এখন অবস্থান ত্যাগ করার সময় নয় । তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলো । আল্লক্ষণের মধ্যেই বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আমি তাঁর কাছে হাজির হবো । ইবনে হানি এ বার্তা নিয়ে আমিরুল মোমেনিনের নিকট পৌছলে লোকেরা চিৎকার করতে লাগলো যে ,যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য তিনি গোপনে খবর দিয়েছেন । অথচ তিনি যা বলেছিলেন তাদের সামনেই বলেছেন লোকেরা তখন বললো ,যদি মালিক ফিরে আসতে বিলম্ব করে তবে আমিরুল মোমেনিন তাঁর জীবনের আশা ত্যাগ করতে পারেন । এরপর ইবনে হানিকে আবার পাঠানো হলো । তিনি মালিককে বললেন , তোমার কাছে কি আমিরুল মোমেনিনের জীবন অপেক্ষা বিজয় বেশি প্রিয় ? যদি তাঁর জীবন বেশি প্রিয় হয়ে থাকে। তবে যুদ্ধ ছেড়ে তাঁর কাছে চলে যাও। বিজয়ের সুযোগ ছেড়ে দিয়ে হতাশা আর দুঃখ ভারাক্রাক্ত মন নিয়ে মালিক আমিরুল মোমেনিনের সম্মুখে উপস্থিত হলেন । তিনি দেখলেন সেখানে গোলযোগ চলছে । তিনি সেখানে উপস্থিত। লোকদেরকে অনেক তিরস্কার করলেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমনভাবে মোড় নিয়েছিল যা আর ঠিক করা সম্ভব হয়নি।

অবশেষে স্থির হলো যে ,উভয়ে একজন করে সালিস মনোনীত করবে। যারা কুরআন অনুযায়ী খেলাফতের বিষয় নিষ্পত্তি করবে। মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে আমর ইবনে আসকে মনোনয়ন দেয়া হলো। আমিরুল মোমেনিনের পক্ষ থেকে আবু মুসা আশআরীর নাম প্রস্তাব করা হলো। এ ভুল মনোনয়ন দেখে আমিরুল মোমেনিন বললেন , সালিসির ব্যাপারে তোমরা আমার আদেশ অমান্য করেছে। এখন অন্তত আমার এ কথাটি মান্য কর ,আবু মুসাকে সালিস মনোনীত করো না। সে বিশ্বস্ত লোক নয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস অথবা মালিক আশতার - এ দুজনের এক জনকে সালিস মনোনীত কর। কিন্তু তারা তাঁর কথা মানলো না এবং তার দেয়া নাম বাদ দিয়ে দিলো। আমিরুল মোমেনিন বললেন , ঠিক আছে ,তোমরা যা খুশি করো। তবে সেদিন বেশি দূরে নয় যখন তোমরা বুঝতে পারবে যে ,নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছে

সালিস মনোনয়নের পর যখন এতদসংক্রান্ত চুক্তিপত্র লেখা হলো তখন আলী ইবনে আবি তালিবের পর আমিরুল মোমেনিন শব্দগুলো লেখা হয়েছিল। এতে আমর ইবনে আস বললো , আমিরুল মোমেনিন মুছে ফেলো। যদি আমরা তাকে আমিরুল মোমেনিন বলেই স্বীকার করি তবে কেন এ যুদ্ধ লড়ছি ? প্রথমতঃ আমিরুল মোমেনিন আমরের প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানালেন। কিন্তু তারা কোনভাবেই এ শব্দগুলো চুক্তিতে রাখতে রাজি হয় না। দেখে আমিরুল মোমেনিন তা মুছে ফেলে বললেন , এ ঘটনা হুদায়বিয়ার সন্ধির মতোই যখন কাফেরগণ আল্লাহর রাসূল লেখা মানলো না এবং রাসূল (সা.) তা কেটে দিলেন। এ কথায় আমর ইবনে আস রাগান্বিত হয়ে বললো , আপনি কি আমাদেরকে কাফের মনে করেন ? আমিরুল মোমেনিন বললেন ,তুমি কি কোনদিন মোমেনদের সাথে কিছু করেছিলে ? তুমি কি কোনদিন মোমেনদের সমর্থক ছিলে ? যা হোক এ চুক্তির পর জনতা চলে গোল এবং সালিসীদ্বয় পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সাব্যস্ত করলো যে ,আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে খেলাফত থেকে সরিয়ে দিয়ে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করার ক্ষমতা জনগণকে দেয়া হবে। এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী দুমাতুল জান্দাল নামক স্থানে একটা সভা আহবান করা হলো। সালিসদ্বয়ও তাদের রায় ঘোষণার জন্য সেখানে উপস্থিত হলেন। আমর ইবনে আস চাতুর্যের পথ অবলম্বন করে আবু মুসাকে বললো , আপনি বয়ঃজ্যেষ্ঠ ,আপনার আগে কথা বলা আমি বেয়াদবি মনে করি। কাজেই আপনি আগে ঘোষণা করুন। আবু মুসা আমরের তোষামোদে অভিভূত হয়ে জনতার সামনে গর্বভরে দাঁড়িয়ে বললেন , হে মুসলিমগণ ,আমরা উভয়ে যুগ্মভাবে সাব্যস্থ করেছি যে ,আলী ও মুয়াবিয়া খেলাফত থেকে সরে দাঁড়াবে এবং আপনারা আপনাদের পছন্দমত একজন খলিফা নিয়োগ করবেন। একথা বলে আবু মুসা বসে পড়লেন এবং আমর ইবনে আস দাঁড়িয়ে বললো , হে মুসলিমগণ ,আপনারা শুনলেন যে ,আবু মুসা আলী ইবনে আবি তালিবকে অপসারণ করেছেন। আমি তার সাথে একমত পোষণ করি। মুয়াবিয়াকে অপসারণ করার প্রশ্ন উঠে না (কারণ সে খলিফা নয়) । সুতরাং আলীর স্থলে আমি মুয়াবিয়াকে নিয়োগ করলাম। আমর ইবনে আস একথা বলা মাত্র চতুর্দিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। আবু মুসা চিৎকার করে বলতে লাগলেন যে ,এটা চাতুরি ,এটা প্রতারণা। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তিনি ইবনে আসকে বললেন , তুমি চাতুরি করেছে। তোমার উপমা সেই কুকুরের মতো যার কাছে কোন কিছু রাখলে সে আত্মসাৎ করে। আমর ইবনে আস বললো , তোমার উপমা সেই গাধার মতো যার পিঠে পুস্তক বোঝাই করা হয়। আমরের এ চাতুর্যের ফলে মুয়াবিয়ার কম্পিত পা আবার কিছুটা শক্ত হলো ।

সংক্ষিপ্তাকারে সালিসির ফলাফল এটাই যা কুরআনের নামে করা হয়েছে। এহেন প্রতারণা কি কুরআনের শিক্ষা ? ইতিহাসের এ পাতাগুলো ভবিষ্যতের পথ - নির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করা যায় কি ? আমিরুল মোমেনিন সালিসির এ দুঃখদায়ক সংবাদ পেয়ে মিম্বারে উঠে। এ খোৎবা প্রদান করেছিলেন।

২। এটা একটা আরবি প্রবাদ। কোন পরামর্শদাতার উপদেশ অমান্য করে পরে অনুশোচনা করলে এ প্রবাদ প্রয়োগ করা হয়। এ প্রবাদের ঘটনা হলো - হীরা অঞ্চলের শাসনকর্তা যাযিমাহ আল আব্রাশ জামিরাহ অঞ্চলের শাসনকর্তা আমর ইবনে যারিবকে হত্যা করে তার কন্যা যাব্বাহকে জামিরাহর শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। সিংহাসনে আরোহণ করেই যাব্বাহ তার পিতার রক্তের বদলা নেয়ার পরিকল্পনা করে। ফলে সে যাযিমাহর নিকট এ বলে বার্তা প্রেরণ করলো যে ,একাকিনী অবস্থায় শাসনকার্য পরিচালনা করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং যাযিমাহ যদি তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করে শাসনকার্যে তার পৃষ্ঠপোষকতা করে তবে সে কৃতজ্ঞ থাকবে। যাযিমাহ এ প্রস্তাবে উৎফুল্ল হয়ে এক হাজার অশ্বারোহী নিয়ে জাযিরাহ অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো। যাযিমাহর ক্রীতদাস কাসির তাকে উপদেশ দিয়েছিল যে ,এ প্রস্তাব প্রতারণা ও চাতুরি ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই যাযিমাহ এ বিপদে নিজেকে ঠেলে না দেয়াই মঙ্গল। কিন্তু যাযিমাহর বুদ্ধিমত্তা এমনভাবে লোপ পেয়েছিল যে ,সে চিন্তাই করতে পারেনি কেন যাব্বাহ তার পিতার হত্যাকারীকে স্বামী হিসাবে বরণ করবে ? সে জাযিরাহ রাজ্যের সীমান্তে পৌছে দেখলো যাব্বোহর সৈন্য তাকে সম্বর্ধনা দেয়ার অপেক্ষা করছে কিন্তু কোন বিশেষ সম্বর্ধনা বা অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করা হয়নি । এতে কাসিরের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো। সে যাযিমাহকে ফিরে যেতে বললো। যাযিমাহ তার উপদেশ কর্ণপাত করলো না। ফলে শহরে পৌছা মাত্রই যাযিমাহকে হত্যা করা হলো । এতে কাসির বললো , আহা ,যদি কাসিরের উপদেশ মান্য করা হতো। এ থেকেই আরবি ভাষায় এ প্রবাদ প্রচলিত হয়েছে।

৩। হাওয়াজিনের কবি বলতে দুরায়েদ ইবনে সিন্মাহকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ ইবনে সিম্মাহর মৃত্যুতে এ কবিতা লেখেছিল। ঘটনাটি হলো - আব্দুল্লাহ্ ও তার ভাই হাওয়াজিনের বনি জুশাম ও বনি নসর এর নেতৃত্ব দিয়ে একটা আক্রমণ পরিচালনা করে অনেক উট তাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। ফেরার পথে মুন আরাজিল লিওয়া নামক স্থানে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য আবদুল্লাহ মনস্থির করলো। দুরায়েদ তাকে নিষেধ করলো কারণ পিছন থেকে শত্রু আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু আবদুল্লাহ কৰ্ণপাত না করে সেখানে রয়ে গেল। ফলে ভোরবেলা আক্রমণ করে শত্রু আবদুল্লাহকে হত্যা করলো। দুরায়েদ আহত হয়ে প্রাণে বাঁচালো। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুরায়েদ বেশ কয়েকটি কবিতা লেখেছিল। তন্মধ্যে খোৎবায় উল্লেখিত কবিতাটি জনপ্রিয়।

খোৎবা - ৩৬

في تخويف أهل النهروان

فَأَنَا نَذِيرٌ لَكُمْ أَنْ تُصْبِحُوا صَرْعَى بِأَثْنَاءِ هَذَا النَّهَرِ - وبِأَهْضَامِ هَذَا الْغَائِطِ عَلَى غَيْرِ بَيِّنَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ - ولَا سُلْطَانٍ مُبِينٍ مَعَكُمْ - قَدْ طَوَّحَتْ بِكُمُ الدَّارُ واحْتَبَلَكُمُ الْمِقْدَارُ وقَدْ كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ هَذِه الْحُكُومَةِ - فَأَبَيْتُمْ عَلَيَّ إِبَاءَ الْمُنَابِذِينَ - حَتَّى صَرَفْتُ رَأْيِي إِلَى هَوَاكُمْ - وأَنْتُمْ مَعَاشِرُ أَخِفَّاءُ الْهَامِ سُفَهَاءُ الأَحْلَامِ ولَمْ آتِ لَا أَبَا لَكُمْ بُجْراً ولَا أَرَدْتُ لَكُمْ ضُرّاً.

নাহরাওয়ানের জনগণকে তাদের ভাগ্য সম্পর্কে সতর্কীকরণ

আমি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি যে ,আল্লাহর কাছে যখন তোমাদের কোন স্পষ্ট ওজর থাকবে না এবং যখন তোমরা কোন প্রকাশ্য প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপন করতে পারবে না (যা বল সে সম্পর্কে) তখন তোমরা এ খালের বাকের নিচু এলাকার বাকের ধারে নিহত হবে। তোমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছো (মিথ্যামিথ্যি বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য) এবং তাতে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদেরকে ঘিরে ধরেছে। আমি এ সালিশীর বিপক্ষে তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমরা অঙ্গীকার ভঙ্গকারী বিরুদ্ধবাদীর মতো আমার উপদেশ প্রত্যাখ্যান করেছো । তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছো যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার মতামত তোমাদের ইচ্ছার অনুকূলে এনেছি। তোমরা এমন একটা দল যাদের মাথা বোধশক্তি ও বুদ্ধিবিহীন। তোমাদের পিতা না থাকুক! (আল্লাহর অভিশাপ তোমাদের ওপর!!) । আমি তোমাদেরকে কোন বিপর্যয়ে ফেলিনি বা তোমাদের কোন ক্ষতি কামনা করি নি।

____________________

১। নাহরাওয়ানের যুদ্ধের কারণ হলো - সিফফিনের সালিশীর পর আমিরুল মোমেনিন যখন দুঃখভারাক্রান্ত মনে কুফায় ফিরে যাচ্ছিলেন তখন যারা সালিশ মান্য করার জন্য আমিরুল মোমেনিনের ওপর চাপ প্রয়োগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল তারা বলাবলি করতে লাগলো যে ,আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কাউকে সালিশ মান্য করা ইমান হারানোর সামিল। আল্লাহ মাফ করুন ,সালিশ মান্য করে আমিরুল মোমেনিন ইমানহারা হয়ে গেছেন। ফলে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন কর্তৃত্ব নেই ” এ আয়াতের অর্থ বিকৃত করে তারা সাধারণ মুসলিমগণকে তাদের মতাবলম্বী করে হানিরা নামক স্থানে অবস্থিত আমিরুল মোমেনিনের ক্যাম্প থেকে বের করেনিয়ে যায়। আমিরুল মোমেনিন তাদের এহেন দুরভিসন্ধির কথা জানতে পেরে সা ’ সাআহ ইবনে সুহান আল - আবদি এবং যিয়াদ ইবনে নাদার আল - হারিছীকে ইবনে আব্বাসের সাথে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং পরবর্তীতে নিজেই তাদের অবস্থান স্থলে গিয়ে আলাপ - আলোচনা করে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন।

এসব লোক কুফায় পৌছে ছড়াতে লাগলো যে ,আমিরুল মোমেনিন সালিশীর চুক্তি ভঙ্গ করে সিরিয়দের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমিরুল মোমেনিন তাদের এসব প্রচারণার প্রতিবাদ করলে তারা বিদ্রোহ করলো এবং বাগদাদ থেকে বার মাইল দূরবর্তী নাহরাওয়ান নামক খালের নিচু এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল ।

অপরপক্ষে আমিরুল মোমেনিন সালিশীর রোয়েদাদ শুনে সিরিয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মনস্থির করলেন। তিনি খারিজিদের পত্র দিয়ে জানালেন যে ,সালিশদ্বয় কুরআন ও সুন্নাহর পরিবর্তে তাদের ইচ্ছা মাফিক যে রোয়েদাদ দিয়েছে তা তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সুতরাং শক্রকে নির্মূল করার জন্য তাকে সমর্থন করতে তিনি তাদেরকে অনুরোধ করেন। প্রত্যুত্তরে খারিজিগণ বললো , আমাদের মতে ,সালিশ মান্য করে আপনি ইমানহারা হয়ে গেছেন। এখন যদি আপনি ইমান হারানোর কথা স্বীকার করে তওবা করেন তবেই আমরা চিন্তা করে দেখবো কী করা যায়। ” তাদের এহেন উত্তর থেকে আমিরুল মোমেনিন বুঝতে পারলেন যে ,তাদের অবাধ্যতা ও বিপথগামিতা চরমে উঠেছে। এ অবস্থায় তাদের কোন প্রকার সহায়তা গ্রহণ করা বিপদের কারণ হবে বলে তিনি বিবেচনা করলেন। ফলে তাদেরকে উপেক্ষা করে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রার উদ্দেশ্যে তিনি নুখায়লাহ উপত্যকায় ক্যাম্প স্থাপন করলেন। সৈন্যবাহিনী সজ্জিত করার পর আমিরুল মোমেনিন জানতে পারলেন যে ,তারা চায় প্রথমে নাহরাওয়ানের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার পর সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা করতে। আমিরুল মোমেনিন বললেন , নাহরাওয়ানের লোকেরা যেভাবে আছে সেভাবেই থাক। তোমরা প্রথমে সিরিয়া অভিমুখে যাত্রা কর এবং পরে নাহরাওয়ানের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করো। ” লোকেরা বলল যে ,তারা আমিরুল মোমেনিনের প্রতিটি আদেশ তাদের সর্বশক্তি দিয়ে পালন করার জন্য ওয়াদাবদ্ধ ; কাজেই তিনি যেদিকে বলবেন সেদিকেই তারা চলবে। এরই মধ্যে সংবাদ এলো যে ,খারিজি বিদ্রোহীগণ নাহরাওয়ানের গভর্ণর আবদুল্লাহ্ ইবনে খাব্বাহ ইবনে আরাত ও তার গর্ভবতী কৃতদাসীকে হত্যা করেছে এবং বনি তাঈ ও উন্মে সিনান আস - সাইদাইয়াহ গোত্রের অপর তিনজন মহিলাকে হত্যা করেছে। এ সংবাদে আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যগণ আর সিরিয়া অভিমুখে নড়াচড়া করেনি। তিনি বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য হারিছ ইবনে মুররাহ আল - আবদিকে প্রেরণ করলেন। কিন্তু খারিজিগণ হারিছকেও হত্যা করেছে। ফলে আমিরুল মোমেনিন কাল বিলম্ব না করে সসৈন্যে নাহরাওয়ান পৌছলেন এবং তাদের কাছে বার্তা প্রেরণ করলেন যে ,যারা আবদুল্লাহ ইবনে খাব্বাহ ও নির্দোষ মহিলাদের হত্যা করেছে কিসাসের জন্য তাদেরকে আমিরুল মোমেনিনের হাতে তুলে দিতে হবে। উত্তরে খারিজিগণ জানালো যে ,তারা সকলেই একযোগে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং তারা মনে করে যে ,আমিরুল মোমেনিনের পক্ষের সকল লোককে হত্যা করা জায়েজ। এতেও আমিরুল মোমেনিন যুদ্ধের পদক্ষেপ না নিয়ে আবু আইউব আল - আনসারীকে শান্তির প্রস্তাব দিয়ে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন। আবু আইউব তাদের কাছাকাছি গিয়ে উচ্চঃস্বরে বললেন , যে কেউ সেপক্ষ ত্যাগ করে এ পতাকা তলে আসবে এবং কুফা অথবা মাদায়েন যাবে তাকেই সাধারণ ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং কোন কিছুই জিজ্ঞেস করা হবে না। ” এতে ফরওয়া ইবেন নাওফাল আল - আশজাঈ বললো , তবে কেন আর আমিরুল মোমেনিনের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হবো। ” এ বলে সে তার পাঁচশত লোকসহ বেরিয়ে এলো। এরপর কয়েকটি দল বেরিয়ে এসেছে এবং তাদের কেউ কেউ আমিরুল মোমেনিনের দলে যোগ দিয়েছে। কিন্তু চার হাজার লোক (তাবারীর মতে দুই হাজার আট শত) বিদ্রোহী রয়ে গেল। এরা কোনমতেই বেরিয়ে আসতে রাজি হলো না। তারা প্রতিজ্ঞা করে বসলো , হয় মারবো ,না হয় মরবো। ” আমিরুল মোমেনিন এসব বিদ্রোহীকে বুঝিয়ে - শুনিয়ে বের করে আনার কথা চিন্তা করেনিজের সৈন্যদের প্রদমিত করে রাখলেন। কিন্তু খারিজিগণ ধনুকে শর যোজনা করে এবং বর্শা ও তরবারি উন্মুক্ত করে প্রস্তুত হয়ে রইলো। এ সংকট মুহুর্তেও আমিরুল মোমেনিন এ ভাষণে তাদেরকে সতর্ক করে দেন। কোন উপদেশ কার্যকর হয়নি ; তারা আচমকা আমিরুল মোমেনিনের সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাদের আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে ,আমিরুল মোমেনিনের পদাতিক বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ধকল সামলে তারা পাল্টা আক্রমণ করলে মাত্র নয় জন পলাতক ব্যতীত সকলেই নিহত হলো। এ যুদ্ধে আমিরুল মোমেনিনের আট জন সৈন্য শহিদ হয়েছে। ৩৮ হিজরি সনের ৯ সফর এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

খোৎবা- ৩৭

فَقُمْتُ بِالأَمْرِ حِينَ فَشِلُوا وتَطَلَّعْتُ حِينَ تَقَبَّعُوا ونَطَقْتُ حِينَ تَعْتَعُوا ومَضَيْتُ بِنُورِ اللَّه حِينَ وَقَفُوا - وكُنْتُ أَخْفَضَهُمْ صَوْتاً وأَعْلَاهُمْ فَوْتاً فَطِرْتُ بِعِنَانِهَا واسْتَبْدَدْتُ بِرِهَانِهَا كَالْجَبَلِ لَا تُحَرِّكُه الْقَوَاصِفُ - ولَا تُزِيلُه الْعَوَاصِفُ - لَمْ يَكُنْ لأَحَدٍ فِيَّ مَهْمَزٌ ولَا لِقَائِلٍ فِيَّ مَغْمَزٌ الذَّلِيلُ عِنْدِي عَزِيزٌ حَتَّى آخُذَ الْحَقَّ لَه - والْقَوِيُّ عِنْدِي ضَعِيفٌ حَتَّى آخُذَ الْحَقَّ مِنْه.

رَضِينَا عَنِ اللَّه قَضَاءَه وسَلَّمْنَا لِلَّه أَمْرَه - أَتَرَانِي أَكْذِبُ عَلَى رَسُولِ اللَّهصلى‌الله‌عليه‌وآله - واللَّه لأَنَا أَوَّلُ مَنْ صَدَّقَه - فَلَا أَكُونُ أَوَّلَ مَنْ كَذَبَ عَلَيْه - فَنَظَرْتُ فِي أَمْرِي - فَإِذَا طَاعَتِي قَدْ سَبَقَتْ بَيْعَتِي - وإِذَا الْمِيثَاقُ فِي عُنُقِي لِغَيْرِي.

দ্বীনে ও ইমানে আমিরুল মোমেনিনের নিজের দৃঢ়তা ও অগ্রণী ভূমিকা সম্পর্কে

আমি আমার কর্তব্য পালনে তৎপর ছিলাম। যখন অন্যরা নিজেদের কর্তব্য পালনের সাহস হারিয়ে ফেলেছিল। আমি এগিয়ে এসেছিলাম যখন অন্যরা নিজেদেরকে গোপন করে রেখেছিল। আমি কথা বলেছিলাম যখন অন্যরা নীরবে মুখ বন্ধ করে বসেছিল। যখন আমি আল্লাহর নূর নিয়ে চলেছিলাম তখন অন্যরা বিফল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে কণ্ঠস্বরে আমিই ছিলাম সবচেয়ে নিম্ন ; কিন্তু অগ্রগামীতায় আমি ছিলাম সর্বোর্ধে। একটা পর্বতকে যেমন বাতাস উড়িয়ে নিতে পারেনা বা ঝঞ্জা - বাতাস নাড়াতে পারে না তেমনি আমি অটলভাবে দ্বীনের রজ্জু ধরে রেখেছিলাম এবং নিজকে সম্পূর্ণরূপে দ্বীনের জামানত হিসাবে নিয়োজিত করেছিলাম। আমার কোন দোষ কেউ দেখতে পায় নি এবং কেউ আমার কোন বদনাম করতে পারেনি ।

আমার মতে একজন নিচ ব্যক্তিও সম্মানের যোগ্য যদি আমি তার অধিকার সংরক্ষণ করি ; আবার প্রতাপান্নিত ব্যক্তিও হীন বলে বিবেচিত হয় যদি আমি তার অধিকার তুলে নেই। আমরা আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যেই সন্তুষ্ট এবং তাঁর আদেশের প্রতি বিনয়াবনত। তোমরা কি মনে কর আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলবো ? আল্লাহর কসম ,আমিই সর্বপ্রথম রাসূলকে স্বীকার করেছি। কাজেই তার সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনাকারীদের প্রথম হতে চাই না। আমি আমার কার্যাবলীর প্রতি খেয়াল করে দেখলাম যে ,আমার আনুগত্য ও তার সাথে আমার অঙ্গীকার আমার ঘাড়ে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

খোৎবা- ৩৮

وإِنَّمَا سُمِّيَتِ الشُّبْهَةُ شُبْهَةً لأَنَّهَا تُشْبِه الْحَقَّ - فَأَمَّا أَوْلِيَاءُ اللَّه فَضِيَاؤُهُمْ فِيهَا الْيَقِينُ - ودَلِيلُهُمْ سَمْتُ الْهُدَى وأَمَّا أَعْدَاءُ اللَّه فَدُعَاؤُهُمْ فِيهَا الضَّلَالُ - ودَلِيلُهُمُ الْعَمَى - فَمَا يَنْجُو مِنَ الْمَوْتِ مَنْ خَافَه ولَا يُعْطَى الْبَقَاءَ مَنْ أَحَبَّه

সংশয়ের নামকরণ ও সংশয়াসক্তকে অবজ্ঞা প্রসঙ্গে

সংশয়কে সংশয় বলা হয় এ জন্য যে ,এটা সত্যের সদৃশ বা সমরূপ। যারা অলি - আল্লাহ্ তাদের ইয়াকিন তাদের জন্য আলোর কাজ করে এবং সত্য পথের দিকে তাদের মনোযোগ দেশনা হিসাবে কাজ করে। অপরপক্ষে যারা আল্লাহর শত্রু তাদের সংশয় তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সন্দেহের অন্ধকারে নিয়ে যায় এবং অন্ধত্ব তাদের দেশনা। মৃত্যুকে ভয় করে এড়ানো যায় না ,আবার অনন্ত জীবন আশা করলেও তা পাওয়া যায় না ।

খোৎবা- ৩৯

مُنِيتُ بِمَنْ لَا يُطِيعُ إِذَا أَمَرْتُ ولَا يُجِيبُ إِذَا دَعَوْتُ - لَا أَبَا لَكُمْ مَا تَنْتَظِرُونَ بِنَصْرِكُمْ رَبَّكُمْ - أَمَا دِينٌ يَجْمَعُكُمْ ولَا حَمِيَّةَ تُحْمِشُكُمْ أَقُومُ فِيكُمْ مُسْتَصْرِخاً وأُنَادِيكُمْ مُتَغَوِّثاً فَلَا تَسْمَعُونَ لِي قَوْلًا ولَا تُطِيعُونَ لِي أَمْراً - حَتَّى تَكَشَّفَ الأُمُورُ عَنْ عَوَاقِبِ الْمَسَاءَةِ - فَمَا يُدْرَكُ بِكُمْ ثَارٌ ولَا يُبْلَغُ بِكُمْ مَرَامٌ - دَعَوْتُكُمْ إِلَى نَصْرِ إِخْوَانِكُمْ - فَجَرْجَرْتُمْ جَرْجَرَةَ الْجَمَلِ الأَسَرِّ وتَثَاقَلْتُمْ تَثَاقُلَ النِّضْوِ الأَدْبَرِ ثُمَّ خَرَجَ إِلَيَّ مِنْكُمْ جُنَيْدٌ مُتَذَائِبٌ ضَعِيفٌ –( كَأَنَّما يُساقُونَ إِلَى الْمَوْتِ وهُمْ يَنْظُرُونَ ) .

জিহাদে যাদের অনীহা তাদের প্রতি ভর্ৎসনা সম্পর্কে

আমি এমন সব লোক নিয়ে আছি। যারা আমার আদেশ অমান্য করে এবং আমার ডাকে সাড়া দেয় না। তোমরা পিতৃবিহীন হও (তোমাদের উপর লা 'নত) । আল্লাহর উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়াতে কিসে তোমাদেরকে বিলম্বিত করছে ? তোমাদের দ্বীন কি তোমাদেরকে একত্রিত করবে না ? তোমাদের লজ্জাবোধ কি তোমাদের উত্তোলিত করবে না ? আমি তোমাদের মাঝে দাড়িয়ে চিৎকার করে সাহায্যের আহবান করছি ,কিন্তু তোমরা আমার কথা শোন না এবং অবস্থা বেগতিক না হলে তোমরা আমার আদেশ মান্য কর না। তোমাদের দ্বারা কোন রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণ করা যায় না এবং কোন উদ্দেশ্য সাধন করা যায় না। তোমাদের ভ্রাতাদের সাহায্য করার জন্য আমি আহবান করেছিলাম ; কিন্তু তোমরা পেটের ব্যথায় কাতর উটের মতো গোঙ্গাতে লাগলে এবং পাছ - মরা উটের মতো দুর্বল হয়ে পড়লে । অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে কম্পমান - দুর্বল একদল সৈন্য আমার কাছে এলোঃ যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে তাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে এবং তারা যেন মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছে। ” (কুরআন - ৮: ৬)

____________________

১। আয়নুত - তামর আক্রমণ করার জন্য নুমান ইবনে বশিরের নেতৃত্বে মুয়াবিয়া দু হাজার সৈন্যের একটা বাহিনী প্রেরণ করেছিলো। কুফার নিকটবর্তী এ স্থানটি ছিল আমিরুল মোমেনিনের সামরিক ঘাটি এবং মালিক ইবনে কা ব আল - আরহাবী ছিল এ ঘাটির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। যদিও তার অধীনে এক হাজার যোদ্ধা ছিল তবুও ওই মুহুর্তে একশত লোক সেখানে উপস্থিত ছিল। আক্রমণকারী সৈন্যদের এগিয়ে আসতে দেখে মালিক সাহায্যের জন্য আমিরুল মোমেনিনকে পত্র লেখেছিল। বার্তা পাওয়ামাত্র মালিকের সাহাযার্থে এগিয়ে আসার জন্য আমিরুল মোমেনিন জনগণকে অনুরোধ করলেন। এতে মাত্র তিনশত লোক প্রস্তুতি নিয়েছিল। আমিরুল মোমেনিন বিরক্ত হয়ে এ ভাষণ দেন। ভাষণ শেষে আমিরুল মোমেনিন ঘরে পৌছার পর আদি ইবনে হাতিম তাঈ এসে বললো , হে আমিরুল মোমেনিন ,আমার অধীনে বনি তাঈ - এর এক হাজার লোক আছে। আপনি আদেশ দিলে আমি তাদের প্রেরণ করতে পারি। আমিরুল মোমেনিন বললেন , এটা খারাপ দেখায় যে শুধুমাত্র একটা গোত্রের লোক শত্রুর মোকাবেলা করবে। তুমি নুখায়ালা উপত্যকায় তোমার বাহিনী প্রস্তুত রাখো। সে তার লোকজনকে জিহাদের জন্য ডাক দিয়েছিল। ইতোমধ্যে বনি তাঈ ছাড়া আরো এক হাজার সৈন্য সেখানে প্রস্তুত হলো। এমন সময় মালিক সংবাদ দিল যে ,সে শত্রুকে বিতাড়িত করেছে - সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

এর কারণ হলো - কুফা থেকে সাহায্য পেতে বিলম্ব হতে পারে ভেবে মালিক তৎক্ষণাৎ আবদুল্লাহ ইবনে হাওয়ালা আল - আজদীকে কারাজাহ ইবনে কা 'ব আল - আনসারী ও মিখনাফ ইবনে সুলায়মান আল - আজাদীর কাছে সাহায্যের জন্য প্রেরণ করলেন। কারাজাহ কোন সাহায্য করেনি। মিখনাফ তার পুত্র আবদার রহমানের নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন সৈন্য প্রেরণ করেছিল এবং তারা সন্ধ্যা নাগাদ মালিকের কাছে পৌছলো। সে পর্যন্ত শত্রুর দুহাজার লোক মালিকের একশত সৈন্যকে পরাভূত করতে পারেনি । আবদার রহমানের পঞ্চাশ জন সৈন্য দেখেই নুমান মনে করলো মালিকের বাহিনী আসা আরম্ভ করেছে। ফলে সে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলো। এমনকি পালিয়ে যাবার সময়ও মালিক তাড়া করে তাদের তিন জনকে হত্যা করেছে।

15

ইমাম সাদিক ( আঃ ) ও একদল সুফী

সুফিয়ান সাওরী মদীনার একজন অধিবাসী। একদিন সে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলো। দেখতে পেলো ইমাম একটি খুব নরম ও সাদা পোশাক পরিধান করে আছেন। যেন ডিমের খোসা আর ভেতরের তরল অংশের মধ্যবর্তী পাতলা পর্দাটি। তাই সে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর প্রতি আপত্তি করে বললো , এ পোশাকটি আপনার জন্য উপযোগী নয়। আপনার পক্ষে এটা কখনও সঙ্গত নয় যে , নিজেকে দুনিয়ার আরাম-আয়েশের সাথে জড়িয়ে ফেলবেন। আপনার কাছ থেকে এটাই আশা যে , খোদাভীতি ও পরহযেগারীর পথ অবলম্বন করে নিজেকে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দূরে রাখবেন।16

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন , আমি তোমাকে এমন একটি কথা বলতে চাই যা তোমার জন্য দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতে কল্যাণকর ও উপকারী হবে। তোমার উদ্দেশ্য যদি হয় এ ব্যাপারে ইসলামের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা তাহলে আমার কথা তোমার জন্য অত্যন্ত উপকারী হবে এবং তুমি এ ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করতে পারবে। কিন্তু যদি তোমার উদ্দেশ্য হয় ইসলাম ধর্মে কোন বেদআত প্রবেশ করানো এবং সত্য ইসলাম থেকে সরলপ্রাণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত করা , তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা পথভ্রষ্ট ও বেদাআত সৃষ্টিকারী লোকদের জন্য আমার কথা নিস্ফল হয়ে থাকে। সুতরাং তাতে আমার কথা তোমার কোন উপকারে আসবে না। সম্ভবত তোমার মনে রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তার সাহাবীবৃন্দের সহজ-সরল ও দারিদ্র্যের জীবন যাপনের কথা জেগে উঠেছে। আর তাতে তুমি এ কথা মনে করে নিয়েছো যে , কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের জন্য দারিদ্র্যের জীবন যাপন করা ফরজ করে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপার তা নয়। রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও তাঁর অনুগত সাথীগণ এভাবে দারিদ্র্যের ও কষ্ট-ক্লেশের জীবন যাপন করেছিলেন তখন , যখন সমাজের চারদিকে অভাব-অনটন , দুঃখ-দারিদ্র্য , কষ্ট-ক্লেশ , অনাহার-অর্ধাহার ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিল। আর তখন লোকেরা সে সব মৌলিক বস্তু থেকে বঞ্চিত ছিল যা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরী। তাই রাসূল (সাঃ) ও তাঁর অনুগত সাহাবীদের জীবন যাপনের মান তৎকালের সাধারণ মানুষের অবস্থার সাথে মিল ছিল। কিন্তু যে যুগে জীবন যাপনের যাবতীয় সামগ্রী সহজে পাওয়া যায় এবং আল্লাহর নেয়ামতসমূহ উপভোগের সুযোগ-সুবিধা বর্তমান থাকে তখন তো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ থেকে উপকার লাভ করার সবচেয়ে বেশি অধিকার হচ্ছে তাঁর অনুগত প্রিয় বান্দাদেরই।

আল্লাহর সে সব নেয়ামতের উপর অসৎ ও ফাসেক লোকদের চাইতে তাঁর সৎ ও নেক বান্দাদের অধিকার কতোই না বেশি। নেয়ামতসমূহের অধিকার কাফেরদের লত নায়সম লমানদের কতোই না অধিক! তুমি কোন বিষয়টিকে আমার দোষের বিষয় হিসেবে নির্ণয় করেছো ? মহান আল্লাহর শপথ করে বলছি , যেভাবে তুমি দেখতে পাচ্ছো যে , আমি আল্লাহর দেয়া নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করছি , ঠিক তেমনিভাবে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্তআমার জীবনে এমন একটি মুহূর্তও অতিবাহিত হয়নি যে , আমি আমার মাল-সম্পদ থেকে অন্যদের অধিকার পৌঁছে দেইনি। প্রতিটি সকাল-সন্ধ্যা এ চিন্তা-ভাবনায় নিমজ্জিত থাকি যে , আমার মাল-সম্পদে যার যে হক আছে তা যেন যথাসময়ে তার কাছে পৌঁছে দিতে পারি

সুফিয়ান সাওরী ইমামের যুক্তিসংগত কথার জবাব দিতে পারলো না এবং মাথা ঝুঁকিয়ে চলে গেল। তারপর সে তার বন্ধু-বান্ধব ও তার মতবাদে বিশ্বাসীদের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্তঘটনা তাদেরকে শোনালো। তাতে তারা সকলে মিলে ফয়সালা করলো যে , তারা সকলে সম্মিলিতভাবে ইমাম সাদিক (আঃ)-এর সাথে এ বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করবে।

অবশেষে একদিন সুফিয়ান সাওরী ও তার সকল সাথী ইমাম সাদিক (আঃ)-এর খেদমতে হাজির হলো। তারা বললো , আমাদের বন্ধু তার কথাকে হক প্রমাণ করার ব্যাপারে উপযুক্ত দলিল-প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। তাই আমরা এখন সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণের দ্বারা আপনাকে নিরুত্তর করতে এসেছি

ইমাম সাদিক (আঃ) বললেন , বলো! তোমাদের সে সমস্ত প্রমাণ কি যা দিয়ে তোমরা আমাকে নিরুত্তর করতে চাও

তারা বললো , আমরা কোরআনের আয়াত দিয়েই আমাদের দলিল-প্রমাণ পেশ করতে চাই

সাথে সাথেই ইমাম (আঃ) বললেন , কোরআনের চাইতে উত্তম দলিল আর কি হতে পারে ? সুতরাং তোমরা তোমাদের দলিল উপস্থাপন করো। আমি তোমাদের দলিলাদি শোনার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত রয়েছি । তারা বললো , আমরা আমাদের মতবিশ্বাসের সত্যতা প্রমাণের জন্য কোরআনের দুটি আয়াত তুলে ধরবো। আর আমাদের কথা পরিষ্কার করার জন্য এ দুটি আয়াত যথেষ্ট। আল কোরআনের এক স্থানে মহান আল্লাহ রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কোন কোন সাহাবাদের প্রশংসা এভাবে করেছেন :

যদিও তাদের নিজেদের প্রয়োজন মিটতো না এবং অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য অবস্থায় ছিল নিমজ্জিত। তবুও অপর লোকদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়েছে এবং তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। আর যারা নিজেদেরকে কৃপণতা থেকে রক্ষা করেছে তারাই সফলকাম17

আল কোরআনের অন্য এক স্থা্নে বলা হয়েছে :

যদিও তাদের খাদ্য-খাবারের প্রয়োজন ও আগ্রহ ছিল সে অবস্থাতেও তারা নিজেদের খাবার ইয়াতিম , মিসকীন ও কয়েদিকে দান করে দিয়েছে18

তাদের বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথেই সাথেই এ মজলিসে উপস্থিত এক ব্যক্তি যে এতোক্ষণ তাদের কথাবার্তাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল , সে নিজের পক্ষ থেকে বলে উঠলো , তোমাদের এতোক্ষণের আলাপ-আলোচনায় আমি যা বুঝতে পেরেছি তা হলো-তোমাদের কথাবার্তায় তোমাদের নিজেদেরই আত্মবল নেই। আসলে এ সমস্ত দলিল দ্বারা তোমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে যে , লোকেরা যেনো নিজেদের ধন-সম্পদ ও মালিকানার প্রতি কোন প্রকার মায়া-আকর্ষণ না রাখে এবং তার বেশির ভাগ অংশ যেনো তোমাদের মতো ফকির-মিসকিন লোকদেরকে দিয়ে দেয় যাতে তোমরা তাদের পরিবর্তে ভোগ করতে পারো।

এ কারণে বাস্তবে তোমাদেরকে দেখা যায়নি যে , তোমরা উত্তম উত্তম খাবার ত্যাগ করেছো। ইমাম (আঃ) বললেন , আপাতত এসব কথা বাদ দাও কোন ফল নেই । এরপর ইমাম (আঃ) সুফীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন , তোমরা তো কোরআন মজীদ থেকে দলিলাদি পেশ করছো। কিন্তু তার আগে একটা কথা বলো , তোমরা কি আল-কোরআনের মোহকাম-মোতাশাবেহ নাসেখ-মানসুখ আয়াতগুলোর মাঝে পার্থক্য করতে পারো ? এই উম্মতের থেকে যারাই পথভ্রষ্ট হয়েছে তারা এ পথেই পথভ্রষ্ট হয়েছে। কারণ তারা কোরআনের সঠিক খবর না রেখেই তা আঁকড়ে ধরে।

সুফীরা বললো , এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান মোটামটি। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আমাদের নেই । ইমাম বললেন , তোমাদের দুর্ভাগ্য এটাই। কোরআনের আয়াতের মতো রাসূলে পাক (সাঃ)-এর হাদীসও রয়েছে। এগুলোর উপর পূর্ণ অবগতি রাখা দরকার। কিন্তু তোমরা কোরআনের যে আয়াতগুলোকে পাঠ করেছ , তাতে তো আল্লাহর নেয়ামতসমূহ ব্যবহার করা হারাম বলা হয়নি। এ আয়াতগুলো বদান্যতা , দয়া-দান ও ত্যাগের সাথে সম্পৃক্ত। এ আয়াতগুলোতে আল-কোরআন সে সকল লোকের প্রশংস্রা করছে যারা একটা বিশেষ সময়ে অপরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারা নিজেদের হালাল মাল নিজেরা ব্যবহার করার পরিবর্তে অপরকে দান করে দিয়েছেন। যদি তারা এ মাল না দিতেন তাহলেও তাদের কোন গুণাহ হতো না। কেননা মহান আল্লাহ তাদেরকে হুকুম করেননি যে , অবশ্যই এটা করতে হবে। তেমনি আল্লাহ তাদেরকে এ কাজ করতে বাধাও দেননি। সুতরাং তারা নিজেরা দয়া ও সহানুভূতির বশবর্তী হয়ে নিজেরা কষ্ট করেছেন এবং তাদের মাল-সম্পদ অপরকে দিয়ে দিয়েছেন। যার প্রতিদান মহান আল্লাহ তাদেরকে দেবেন। অতএব এ আয়াতগুলো ও তোমাদের দাবির মধ্যে কোন মিল নেই। কেননা তোমরা সে সমস্ত লোকের তিরস্কার ও নিন্দা করছো যারা নিজেদের মাল-সম্পদ ও খোদার দেয়া নেয়ামত ভোগ করে থাকে।

তিনি বললেন , সে সমস্তলোক , [রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর সাহাবাগণ] সেদিন এ ধরনের দান- খয়রাতের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ বিধান এসেছে যেখানে আল্লাহ এ কাজের একটা সীমা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেহেতু এ হুকুমটি পরে এসেছে তাই তাদের (সাহাবাদের) সে আমলকে রহিত করে দিয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে এ হুকুম মেনে চলা উচিত। সে আমলকে নয়।

মহান আল্লাহ মমিন-মসলমানদের অবস্থার সংশোধনের জন্য এবং তার বিশেষ রহমতের দ্বারা এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন যে , কোন লোক নিজের পরিবার-পরিজনকে কষ্টের মধ্যে রেখে তার সমস্ত সহায় অপরকে দান করে দেবে। কেননা তার পরিবারে এমন শিশু , বৃদ্ধ ও দূর্বল লোকজন থাকে যারা এ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। ধরে নাও , আমার কাছে একটি রুটি আছে আর আমি তা অন্যকে দিয়ে দিলাম। তখন তার পরিণতি এই দাঁড়াবে যে , আমার পরিবার-পরিজন যাদের ভরণ-পোষণের দায়

দায়িত্ব আমার উপর রয়েছে তারা না খেয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। এ জন্য রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন , যদি কোন লোকের কাছে কিছু খোরমা অথবা কিছু রুটি কিংবা কিছু দিনার বা টাকা থাকে আর সে দান করতে চায় , তাহলে প্রথমে উচিত তার পিতামাতাকে দান করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নিজের ও তার স্ত্রী-সন্তানের জন্য দান করবে। তৃতীয় পর্যায়ে তার আত্মীয়-স্বজন ও মুমিন ভাইদেরকে দান করবে। আর চতুর্থ পর্যায়ে ভালো ও কল্যাণ কাজে দান করার পালা। এভাবে দান-খয়রাত ইত্যাদির পালা আসে সবার শেষে।

রসূলুলাহ (সাঃ) যখন শুনতে পেলেন যে , এক আনসার মারা গেছে , আর তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বর্তমান রয়েছে , এদিকে মৃত্যুর পূর্বে সে তার সমস্ত সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দিয়েছে। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন , এ সংবাদ যদি তোমরা আমাকে পূর্বেই দিয়ে দিতে তাহলে আমি তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করার অনুমতি দিতাম না। সে তার ছেলে-মেয়েদেরকে অসহায় অবস্থায় রেখে গেছে। এখন তারা অপরের সামনে হাত পাতছে।

আমার পিতা হযরত ইমাম বাকের (আঃ) আমার কাছে বর্ণনা করেন যে , রাসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন , সব সময় দানখয়রাতের ব্যাপারে নিজের সন্তানদের থেকে শুরুকরবে। এরপর আত্মীয়- স্বজনের যে যত নিকটের হবে সে ততো প্রাধান্য পাবে।

এতসব কিছু ছাড়াও আল-কোরআন তোমাদের মতবিশ্বাসের বিপক্ষে রায় প্রদান করে থাকে। আল কোরআনের এক স্থানে এভাবে বলা হয়েছে :

মোত্তাকী , পরহেযগার ও খোদাভীরুলোক তারাই যারা দান করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও করে না। কৃপণতাও করে না , বরং মধ্যম নীতি অবলম্বন করে।19 কোরআন মজীদের অনেক আয়াতেই যেমনিভাবে কৃপণতা করতে নিষেধ করা হয়েছে , ঠিক তেমনিভাবে খরচ ও দান করার ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ও অপাত্রে করতে বাধা দান করেছে। এ ব্যাপারে আল-কোরআন একটি মধ্যম নীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এটা উচিত নয় যে , কোন লোক তার সমস্তসম্পদ অপর লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে নিজে দারিদ্র্য ও অভাবগ্রস্ত হয়ে মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছে , হে পরোয়ারদিগার! আমাকে রিযিক দান করো । মনে রাখবে যে , মহান আল্লাহ এমন লোকদের দোয়া কখনো কবুল করেন না। আল্লাহর নবী (সাঃ) বলেছেন , মহান আল্লাহ কিছু সংখ্যক লোকদের দোয়া কখনো কবুল করেন না। তারা হলো :

(ক) যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকটে নিজের পিতামাতার অকল্যাণ প্রার্থনা করে।

(খ) যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কাউকে ধার দেয়। কিন্তু কোন সাক্ষীও রাখে না আর লিখিত কোন প্রমাণও রেখে দেয় না। এদিকে ঋণগ্রহীতা টাকাগুলো মেরে দেয়। তখন সে হাত তুলে দোয়া করে আল্লাহর কাছ থেকে সমাধান চায়। তাহলে আল্লাহ তার দোয়া কখনো কবুল করেন না। কেননা সে কোন প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ না রেখে অপরকে ঋণ দিয়ে নিজেই সমাধানের পথ বিনষ্ট করে ফেলেছে।

(গ) যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে এ দোয়া করে যে , তাকে যেনো তার স্ত্রীর অনিষ্টতা হতে মুক্তি দান করেন , তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া মহান আল্লাহ মোটেও শোনেন না। এ জন্য যে , স্ত্রীর অনিষ্টতা থেকে মুক্তি লাভের পন্থা ও পদ্ধতি তার নিজের হাতেই রয়েছে। যদি সত্য সত্যই সে স্ত্রীর ব্যাপারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে তাহলে তার অধিকার রয়েছে যে , এমন স্ত্রীকে তালাক দিয়ে নিজের মুক্তির পথ বেছে নেবে।

(ঘ) যে ব্যক্তি নিজের ঘরে হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকে আর রিযিকের জন্য দোয়া করে আল্লাহর কাছে তখন এমন লোকের দোয়ার জবাবে আল্লাহ বলেন :

হে আমার বান্দা! আমি কি তোমার জন্যে নড়াচড়া ও চলাফেলার রাস্তা খোলা রাখিনি ? আমি কি তোমাকে নিখুঁত ও মজবুত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করিনি ? আমি তোমাকে হাত-পা , কান-নাক ও আকল- বুদ্ধি দান করেছি যাতে করে তুমি এগুলো দিয়ে দেখে-শুনে ও চিন্তা-ভাবনা করে হাত-পা ইত্যাদি ব্যবহার করে রিযিকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে পারো। এ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য আছে। এ নেয়ামতগুলোর কৃতজ্ঞতা হচ্ছে যে , তুমি এগুলোর সদ্ব্যবহার করবে। এভাবে আমি আমার ও তোমার মাঝে উসিলা নির্ধারণ করেছি যাতে করে তুমি প্রতিটি জিনিস হাসিল করার জন্য তোমার মেহনতের দ্বারা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারো। আর শ্রম-সাধনার সাথে সম্পৃক্ত কাজগুলো পালন করতে পারো এবং অন্যের কাঁধের বোঝা যেনো তোমাকে হতে না হয়। তোমার চেষ্টা যদি আমার ইচ্ছা মোতাবেক হয় তাহলে আমি তোমাকে যথেষ্ট পরিমাণে রিযিক দান করবো । আর যদি সংগত কোন কারণে তোমার উন্নতি না হয় তাহলেও তুমি অন্তত এ প্রশান্তিলাভ করতে পারবে যে , তোমাকে চেষ্টা করতে বলা হয়েছিল , তুমিও চেষ্টা করেছো। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।

(ঙ) সে ব্যক্তি যাকে মহান আল্লাহ অনেক ধন-সম্পদ দিয়েছেন। আর সে দান করতে গিয়ে তার সমস্তসম্পদ শেষ করে দিয়েছে। এর পরে সে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করে : হে আমার প্রভু! আমাকে রিযিক দান করো। তখন আল্লাহ এমন লোকের জবাবে বলেন :

আমি কি তোমাকে অনেক অনেক রিযিক দান করিনি ? তুমি কেন মধ্যম নীতি অবলম্বন করোনি ? আমি কি এ হুকুম দেইনি যে , দান করার ব্যাপারে মধ্যম নীতি অবলম্বন করো ? আমি কি দান-খয়রাতের বেলায় বেহিসাবে খরচ করার ব্যাপারে তোমাদেরকে নিষেধ করিনি ? (চ) সে ব্যক্তির দোয়াও কবুল হয় না , যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর দরবারে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে দোয়া করে। আর যে আল্লাহর কাছে এমন জিনিস প্রার্থনা করে যা দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়াটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

মহান আল্লাহ কোরআন পাকে বিশেষভাবে তাঁর রাসূলকে দান করার পদ্ধতি শিখিয়েছেন। একটি ঘটনা এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে , আল্লাহর নবী (সাঃ)-এর নিকট কিছু স্বর্ণমূদ্রা ছিল। তিনি তা দরিদ্র লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিতে চাচ্ছিলেন। তিনি চাননি যে , এক রাতের জন্যও সে স্বর্ণমুদ্রাগুলো তার ঘরে পড়ে থাকুক। তাই তিনি সারাদিন ধরে সে মুদ্রাগুলো লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। পরদিন সকালে একজন ভিক্ষুক তাঁর বাড়িতে আসলো এবং সাহায্য প্রার্থনা করলো। সে ভিক্ষুকটি তার প্রয়োজনের তাগিদে বার বার সাহায্যের প্রার্থনা করলো। সে ভিক্ষুকটি তার প্রয়োজনের তাগিদে বার বার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছিল। কিন্তু নবী (সাঃ)-এর কাছে তাকে দেবার মতো কিছুই ছিল না। এতে তিনি খুবই দুঃখিত হলেন। তখন কোরআন মজীদের এ আয়াত অবতীর্ণ হলো যেখানে মহান আল্লাহ দান করার ব্যাপারে তাঁর বিধান জারি করেছেন :

নিজের হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করো না। আর না এতোখানি খুলে রেখো , যাতে করে পরে খালি হাত হয়ে যেতে হয় এবং ভিক্ষুকের সাহায্য প্রার্থনার সময় লজ্জিত ও দুঃখিত হতে হয়।20

এগুলো সে সমস্ত হাদীস যা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর আল- কোরআনের আয়াতসমূহ এ হাদীসগুলোতে বর্ণিত বিষয়াদিকে সমর্থন করে। তাহলে আল-কোরআনে বিশ্বাসী ঈমানদার লোক যারা , তারা কোরআনে বর্ণিত বিষয়াদির প্রতি ও ঈমান রাখে।

মৃত্যুর সময়ে হযরত আবু বকরকে বলা হয়েছিল : আপনার ধন-সম্পদ সম্পর্কে অসিয়ত (অন্তিম উপদেশ) করুন। তিনি বললেন , আমার সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ দান করে দিও। আর অবশিষ্টাংশ উত্তরাধিকারীদের জন্য রইলো। এক-পঞ্চমাংশ সম্পদ কম নয়। বস্তুত হযরত আব বকর স্বীয় সম্পদের এক-পঞ্চমাংশের ব্যাপারে অসিয়ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে একজন রোগীর অধিকার হচ্ছে মৃত্যু রোগের সময়ও সে তার সম্পদের এক-তৃতীয়াংশেরই অসিয়ত করবে। যদি জানতেন যে তার সমুদয় অধিকারকে কাজে লাগানো উত্তম হবে তাহলে এক-তৃতীয়াংশেরই ওসীয়ত করে যেতেন।

হযরত সালমান ফারসী ও হযরত আবু যার গিফারীর খোদাভীতি-পরহেযগারী ও অন্যান্য ফজিলত ও মর্যাদার কারণে সবাই তাদেরকে খবু ভালোভাবে চেনে। তাদের জীবন যাপনের পদ্ধতি ও চরিত্র- আখলাকও ছিল এরূপ।

হযরত সালমান ফারসী যখন বাইতুলমাল থেকে নিজের বাৎসরিক ভাতা গ্রহণ করতেন তখন সেখান থেকে এক বছরের খরচাদিকে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখতেন যাতে করে পরবর্তী বছরের ভাতা পাওয়া পর্যন্তকোন অসুবিধায় পড়তে না হয়। লোকেরা সালমানকে জিজ্ঞাসা করলো :

আপনি এতো বড় একজন মোত্তাকী পরহেযগার লোক হয়েও এক বছরের পুঁজি জমা করে রাখার চিন্তা-ভাবনা করছেন! ধরুন আজকালের মধ্যেই আপনার মৃত্যু হয়ে গেল এবং বছরের শেষ পর্যন্তজীবিত থাকতে পারলেন না তাহলে এক বছরের পুঁজি জমা করে রাখার পেছনে ফায়দা কি ? তাদের প্রশ্নের জবাবে হযরত সালমান ফারসী বললেন , হতে পারে আমি মরবো না। তোমরা কেন এ কথা ধরে নিয়েছো যে , আমি মরেই যাবো। এর বদলে তোমরা এটাও ধরে নিতে পারো যে , আমি আগামী বছর পর্যন্তবেঁচে থাকবো। আর যদি আমি জীবিত থেকে যাই তাহলে আমার জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় খরচাদির সর্বাবস্থায় দরকার হবে। হে অজ্ঞ লোকেরা! তোমরা এ বাস্তব সত্য সম্পর্কে মোটেও ধারণা রাখো না যে , মানুষের কাছে যদি জীবন যাপনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বর্তমান না থাকে তাহলে তার মন আল্লাহর আনুগত্য করার ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যায় এবং আলার আনুগত্য করার জন্য অন্তরের যে স্বস্তিও প্রশান্তিদরকার তার মধ্যে সেটার অভাব দেখা দেয়। আর যদি জীবনযাপন সামগ্রী তার কাছে পুরোপুরি বর্তমান থাকে তাহলে সে আল্লাহর আনুগত্য করার ক্ষেত্রে মোটেও অবহেলা করে না।

কিন্তু হযরত আবু যার গিফারীর নিকট কিছু উট ও ভেড়া-বকরী ছিল , যেগুলোর দুধ পান করে তিনি জীবন যাপন করতেন। কখনো যদি তার গোশত খাবার ইচ্ছা হতো কিংবা বাড়িতে যদি কোন মেহমান আসতো অথবা কোন দরিদ্র-গরিব মানুষের অভাব-অনুভব করতেন তাহলে সে জন্তুগুলো দ্বারা প্রয়োজন মেটাতেন। অন্য লোকদের মাঝে গোশত বন্টন করার সময় নিজের অংশটুকুনও রেখে নিতেন।

তাদের চাইতে বড় মোত্তাকী ও পরহেযগার লোক আর কে ছিলেন ? মহানবী (সাঃ) তাদের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন তা তোমরা ভালো করে জানো। তারা তাকওয়া-পরহেযগারীর নামে নিজেদের সব কিছু বিলিয়ে দেননি। আজ তোমরা জীবন যাপনের যে পন্থা ও মতবাদ উদ্ভাবন করেছো এবং প্রচার করে বেড়াচ্ছো যে , লোকেরা যেন নিজেদের পরিবার-পরিজনের চিন্তা-ভাবনা না করে নিজেদের সমস্ত অর্থ সম্পদ থেকে হাত গুটিয়ে নেয় এবং দুনিয়া ত্যাগ করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে রাসূলে পাকের সাহাবাগণ কখনো এ পন্থা অবলম্বন করেননি।

আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এ হাদীসটি বর্ণনা করছি , যা আমার পিতা ও তার পিতৃ পুরুষগণ রসুলুল্লাহর মাকবুল (সাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন। আমি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছি। রাসূলে আকরাম (সাঃ) বলেছেন :

ঈমানদার লোকেরা আশ্চর্যজনক গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। যদি তার দেহকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয় তাতেও তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আর যদি তাকে পৃ থিবীর পূর্ব ও পশ্চিমের সমস্তদেশগুলোর রাজত্ব দান করা হয় তাহলে সেটাও তার জন্য মঙ্গল ও কল্যাণের ব্যাপারই হবে।

ঈমানদার লোকদের কল্যাণ ও মঙ্গল কি এতেই নিহিত যে , সে অবশ্যই দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তহবে ? মুমিনদের উচ্চ মর্যাদা নিভর্র করে ঈমান ও আকীদা বিশ্বাসের উপর। তাই সে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত অবস্থায় থাকুক অথবা সম্পদের প্রাচুর্যে ডুবে থাকুক , কর্তব্যগুলো যথারীতি আঞ্জাম দিয়ে থাকে। এটাই সে বিশেষ ও ব্যতিক্রম গুণ-বৈশিষ্ট্য যা একজন মর্দে মুমিনের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যায়। আর এ কারণেই যে কোন প্রকারের কষ্ট ও অভাব-অনটন এবং আরাম ও সুবিধা তার জন্য কল্যাণ ও মঙ্গল হয়ে যায়।

আমি জানি না এ বিষয়ে এতোক্ষণ পর্যন্ত আমি যে বক্তব্য রেখেছি , তা তোমাদের জন্য যথেষ্ট কিনা ? নাকি এ বিষয়ে আমাকে আরো কিছু বলতে হবে ? তোমরা জানো যে , ইসলামের প্রথম দিকে মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। তখন জিহাদের বিধান ছিল এই যে , একজন মুসলমান দশজন কাফেরের মোকাবিলায় লড়াই করবে। আর যে এমনটা না করতো সে গুণাহগার , নাফরমান ও অপরাধী বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু যখন মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেল এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অস্ত্র-সরঞ্জাম ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি লাভ করলো তখন মহান আল্লাহ তাঁর দয়া ও মেহেরবানী দ্বারা সে বিধানের পরিবর্তন করে দিলেন। তখন প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হলো সে দুইজন কাফেরের সাথে মোকাবিলা করবে। এর চেয়ে বেশির সাথে লড়াই করা তার কর্তব্য নয়।

আমি তোমাদেরকে ইসলামের বিচার আদালত এবং বিচার আইন বিষয়ে প্রশ্ন করবো। ইসলামে মজলুমের প্রতি ন্যায়-ইনসাফ করার এবং অপরাধীর শাস্তি প্রদার্নের ব্যাপারে কি বিধানের ব্যবস্থা্ রয়েছে ? ধরো তোমাদের মধ্যে থেকে কারো বিরুদ্ধে ইসলামী আদালতে তার স্ত্রীর খোরপোষের বিষয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর বিচারক তার বিরুদ্ধে এ রায় প্রদান করলো যে , তাকে তার স্ত্রীর খোরপোষ দিতে হবে। তখন সে কি ওযর-আপত্তি পেশ করবে এবং নিজের স্ত্রীর খোরপোষের ব্যবস্থা কিভাবে করবে ? তখন কি সে এ ওযর-আপত্তি পেশ করবে যে , আমি একজন মোত্তাকী- পরহেযগার মানুষ এবং আমি দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ পরিত্যাগ করার নীতি অবলম্বন করেছি ? তখন কি তার এ আপত্তি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে ? আর এটা কি সঙ্গত হবে ? তোমাদের আকীদা বিশ্বাস মতে কি বিচারকের এ নির্দেশ ন্যায়-ইনসাফ ভিত্তিক নয় ? নাকি সেটা অন্যায়-অবিচার ভিত্তিক ? যদি তোমরা বলো যে , বিচারকের এ হুকুম অন্যায় ও অবিচার ভিত্তিক তাহলে তার অর্থ এ দাঁড়াবে যে , তোমরা পরিষ্কার মিথ্যা বলছো। শুধু তাই নয় , বরং তোমাদের এ মিথ্যা দ্বারা তোমরা সমস্ত মুসলমানের সাথে অন্যায় ও বেইনসাফীর কাজ করছো। আর যদি বলো যে , বিচারকের এ বিচার সঠিক তাহলে তার অর্থ হবে যে , তোমাদের ওযর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা বাতিল। সুতরাং তোমরা এ কথা স্বীকার করে নাও যে , তোমাদের জীবন পদ্ধতি ও মতবাদ ভ্রান্তও বাতিল।

এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে যে , মানুষের জীবনে এমন অনেকগুলো অবস্থা আছে যেখানে মুসলমানরা অনেক জরুরি ও অজরুরি খরচ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। যেমন কখনো যাকাত দিতে হয়। আবার কখনো কাফফারা (অপরাধের শরীয়তী মাশুল) দিতে হয় , তাহলে যদি তোমাদের মনগড়া সংশোধন মেনে নেয়া হয় এবং সমস্তলোক (তোমাদের মতের) মোত্তাকী পরহেযগার হয়ে যায় আর সকল লোকই যদি জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় , তখন এমন অবস্থায় এ সমস্ত ফরজ সদকা ও কাফফারার কি হবে ? সোনা-রূপা , ভেড়া-বকরী , গরু-মহিষ , উট- দুম্বা ও অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার , খোরমা , কিশমিশ ইত্যাদির যাকাত দেয়া ফরজ। তাহলে এসব জিনিসের ফরজ যাকাতের কি হবে ? যাকাত কি এ জন্য ফরজ করা হয়নি যে , এর দ্বারা গরিব ও অসহায় লোকদের জীবনকে সুন্দর করে গড়া যায় ? আর গরিব লোকও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন যাপন করতে পারে ? দান-উপহারের দ্বারা সৌভাগ্যবান হতে পারে ? ইসলামের এ বিধানটি নিজেই এ কথার সাক্ষ্য-প্রমাণ বহন করে যে , ইসলামের সমস্ত আইন-কানুনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রাকে সুখ-সমৃদ্ধির পান্তে পৌঁছে দেয়া এবং তার সুখ নিশ্চিত করা। আর যদি দ্বীনের উদ্দেশ্য হতো দারিদ্র্য ও দুনিয়া ত্যাগ এবং দ্বীনের শিক্ষা-দীক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি এটা হতো যে , মানুষ এ দুনিয়া ও তার ধন-সম্পদ থেকে দূরে থাকবে এবং ফকির ও দরিদ্রের জীবন বেছে নেবে , তাহলে তো তার অর্থ এ দাঁড়াবে যে , যারা গরিব-মিসকিন তারা জীবনের আসল ও উচ্চ লক্ষ্য হাসিল করে ফেলেছে। কাজেই তাদেরকে আর কোন কিছু দেয়া উচিত হবে না যাতে করে তাদের এ মঙ্গল ও কল্যাণকর অবস্থা থেকে সরে যেতে না পারে। এর সাথে সাথে গরিব-মিসকীনদের উচিত হবে যে , তারা কারো কাছ থেকে কোন দান ইত্যাদি কখনোই গ্রহণ করবে না যাতে করে তাদের কল্যাণ ও মঙ্গলকর অবস্থা স্থায়ী থেকে যায় ।

মূল কথা হলো যে , যদি তোমাদের কথা সত্য হিসাবে মেনে নেয়া হয় তাহলে তো কোন লোককেই তার ধন-সম্পদ তার কাছে রেখে দেয়া উচিত নয় , বরং তার সমস্ত সম্পদ অন্যদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া উচিত। ফলে যাকাতের কোন অবকাশই বাকি থাকে না।

তাহলে এখন এ কথা পরিষ্কারভাবে জানা গেল যে , তোমরা একটা মারাত্মক ও খারাপ রাস্তা অবলম্বন করেছো এবং একটা মন্দ পথে লোকদেরকে আহবান করছো। তোমরা যে মতবাদে বিশ্বাস করছো এবং অপরাপর লোকদেরকেও সে পথের দিকে আহবান করছো তার ভিত্তি হলো মুর্খতা , কোরআনী শিক্ষা সম্পর্কে এবং রাসূল (সাঃ)-এর হাদীস ও সুন্নত সম্পর্কে অজ্ঞতা। এ হাদীসগুলো সে হাদীস নয় যা সন্দেহের চোখে দেখা যেতে পারে , বরং এগুলো সে হাদীস যার সত্যতা ও বিশুদ্ধতার সাক্ষী স্বয়ং আল-কোরআন। কিন্তু তোমরা সে নির্ভরযোগ্য ও সনদ যুক্ত হাদীসগুলো গ্রহণ করতে অস্বীকার করছো কারণ সেগুলো তোমাদের মনগড়া মতাদর্শের মোতাবেক নয়। আর এটাও তোমাদের আরেকটা মুর্খতা। তোমরা আল-কোরআনের আয়াতের মধ্যে নিহিত উত্তম ও আশ্চর্যজনক ভেদগুলোর প্রতি চিন্তা-ভাবনা করো না। নাসেখ-মানসখ ও মোহকাম-মোতাশাবেহ আয়াতগুলোর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করতেও তোমরা অনভিজ্ঞ। আর আদেশ ও নিষেধগুলোও তোমরা নির্ণয় করতে পার না।

তোমরা আমাকে হযরত সুলাইমান ইবনে দাউদ (আঃ)-এর কাহিনীর ব্যাপারে জবাব দাও- যিনি মহান আল্লাহর দরবারে এমন একটি রাজত্ব চেয়েছিলেন যার চাইতে বৃহৎ আর কোন রাজ্য কেউ পেতে না পারে।21 আর মহান আল্লাহ তাকে ঠিক তেমনি একটি রাজত্ব দানও করেছিলেন। আর এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে , আল্লাহর নবী সুলাইমান (অঃ) তার প্রাপ্য অধিকার ব্যতীত প্রার্থনা করতে পারবে না। মহান আল্লাহ কোরআন মজীদে এটাকে সুলাইমানের দোষের বিষয় বলে সাব্যস্ত করেননি আর কোন মুমিন দোষের বিষয় বলে সাব্যস্ত করেননি। আজ পর্যন্ত কাউকে এ কথা বলতে দেখা যায়নি যে , হযরত সুলাইমান (আঃ) এ পৃথিবীতে এতো বিস্তৃত ও নজিরবিহীন রাজত্ব কেন প্রত্যাশা করলেন ? এমনিভাবে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর পূর্বে (তার পিতা) হযরত দাউদ (আঃ) এর ঘটনা স্মরণযোগ্য। অনুরূপভাবে হযরত ইউসফু (আঃ)-এর ঘটনাতেও দেখা যায় হযরত ইউসুফ (আঃ) তৎকালীন বাদশার নিকট সরকারিভাবে একথা বলছেন : রাজ্যের কোষাগারের তথা অর্থনৈতিক বিষয়াদির দায়-দায়িত্বের কাজটি আমার উপরে ছেড়ে দিন। কেননা আমি নির্ভরযোগ্য , বিশ্বস্তও অভিজ্ঞ।22

অতঃপর অবস্থা এই দাঁড়ালো যে , মিশর থেকে ইয়ামেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট সাম্রাজ্যের সমস্তদায়- দায়িত্বই তার উপর ন্যস্ত হলো। তিনি হলেন সাম্রাজ্যের বাদশাহ। এ সময় আশপাশের দেশগুলোতে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। সে সব দেশের লোকেরা তার রাজ্য থেকে শাক-সবজি , খাদ্য-খাবার ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেতো। কিন্তু না , হযরত ইউসুফ (অঃ) কোনদিন কারো সাথে বেইনসাফী ও অন্যায় কাজ করেছেন। আর না তার থেকে কোন দোষের কথা আল্লাহ কোরআনে বলেছেন। ঠিক তেমনিভাবে জনাব যুলকারনাইনের কাহিনীও কারো অজানা নয়। তিনি খোদার এমন এক বান্দা ছিলেন যে , মহান আল্লাহকে ভালোবাসতেন। আর আল্লাহও তাকে ভালোবাসতেন। তাই তো জাগতিক কারণসমূহ তার অধিকারে চলে আসে। তিনি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত জগতের অধিপতি হন।

শোনো হে সুফীদল! এ ভ্রান্তপথ পরিত্যাগ করো এবং ইসলামের প্রকৃত ভিত্তিগুলো আঁকড়ে ধরো। মহান আল্লাহ যে সব বিষয়ে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন তার সীমা লংঘন করো না। আর নিজেদের মনগড়া কোন কিছু আবিষ্কার করো না। যে সব বিষয়ে তোমাদের জ্ঞান নেই সেখানে হস্ত ক্ষেপ করো না। সে সব বিষয়ের জ্ঞান জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে অর্জন করো। নাসেখ ,মানসুখ ,মোহকাম , মোতাশাবেহ ও হালাল-হারামের জ্ঞান হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত থাকো। এতে কেবল তোমাদের জ্ঞান অর্জনের কল্যাণই নয় , বরং তোমাদেরকে অজ্ঞতা ও মুর্খতার অভিশাপ থেকে মুক্তি দেবে। অজ্ঞতা থেকে দূরে থাকো। কেননা অজ্ঞতার পক্ষপাতিত্বকারীদের সংখ্যা অনেক। তার বিপরীতে জ্ঞানের সমর্থক বড়ই কম। মহান আল্লাহ বলেন , জ্ঞান গরিমা ও বদ্ধিমত্তা , জ্ঞানী বুদ্ধিমানদের চাইতেও বড়।23


3

4

5

6

7

8

9

10

11

12

13

14

15

16

17

18

19

20

21

22

23

24

25

26

27

28

29

30

31

32

33

34

35

36

37

38

39

40

41